Tuesday, August 19, 2025
Homeবাণী ও কথাস্লাইড রুল - হুমায়ূন আহমেদ

স্লাইড রুল – হুমায়ূন আহমেদ

স্লাইড রুল – হুমায়ূন আহমেদ

আজকালকার ছেলেমেয়েরা স্লাইড রুলের নাম শোনে নি। স্লাইড রুল হলো গুণভাগ করার স্কেল। একটা স্কেলের ভেতর ছোট্ট একটা স্কেল। ছোট স্কেলটা slide করতে পারে বলে স্লাইড রুল নাম। রুল এসেছে রুলার থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাজ ছিল ফার্স্ট ইয়ারের কেমিস্ট্রি ছাত্রছাত্রীদের স্লাইড রুলের ব্যবহার শেখানো। বড় বড় অংক কত সহজে রুলার নাড়াচাড়া করেই সমাধান করা যায় তা দেখে সবাই মুগ্ধ হতো। চোখ বড় বড় করে বলত—বাহ! তাদের এই বিস্ময় ধ্বনি শোনার জন্যেই আমি আগ্রহ করে স্লাইড রুল বিষয়ক ক্লাসগুলি নিতাম।

এখন অনেক জটিল অংক নিমিষেই ক্যালকুলেটারের বোতাম টিপে করা যায়। যারা অংকগুলি করে তারা কেউ বিস্ময়সূচক বাহ ধ্বনি করে না। ক্যালকুলেটর জটিল অংক করবে এটা নিপাতনে সিদ্ধ। এই নিয়ে বিস্মিত হবার কিছু নেই।

আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের হাত থেকে স্লাইড রুল কেড়ে নিয়েছে। বিস্মিত হবার বিষয়গুলি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

চলে গেছে টেলিগ্রাম। মোর্স সাহেবের টরে টক্কা। ট্রেনে যাবার সময় রেল লাইন ধরে টেলিগ্রাফের খুঁটি। তারের ওপর পাখিদের বসে থাকার দৃশ্য দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ আর কোনো যুবা পুরুষের কাছে টেলিগ্রাম আসে না– Mother serious. Come sharp.

এই টেলিগ্রামের অর্থ যে মা অসুস্থ তা কিন্তু না। এর গূঢ় অর্থ, তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। চলে এসো। মায়ের অসুখের খবর জানিয়ে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া।

টেলিগ্রামের আলাদা ভাষাই ছিল। মাত্র সাতটা শব্দের মধ্যে যা বলার বলতে হতো। শব্দ বেশি ব্যবহার করার অর্থ বেশি চর্জি। অল্প শব্দে টেলিগ্রাম করার জন্যে বিচিত্র ভাষা তৈরি হয়ে গেল।

উদাহরণ দেই। ছেলেকে জানানো হবে–বাবা এখন অনেক সুস্থ। সবাইকে চিনতে পারছেন। তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন। আঙুর খেতে চাচ্ছেন। কিছু আঙুর নিয়ে চলে এসো। দেরি করবে না।

BABA BETTER RECOGNIZING SEE YOU COME GRAPE.

অন্যরা এই টেলিগ্রামের মর্মার্থ বুঝবে না। যার কাছে পাঠানো হয়েছে সে ঠিকই বুঝবে।

হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি। আজকাল কেউ আর চিঠি লিখে না। SMS চালাচালি করে। SMS-এর কী বিচিত্র ভাষা–KFC CHICKEN KHABE? Love U

অর্থ–KFCর চিকেন খাবে? তোমাকে ভালোবাসি।

ফাউনটেন পেন চলে গেল।

এখন বলপয়েন্ট। কালি শেষ কলম ফেলে দাও। আমাদের সময় চালু ঝর্ণা কলমের নাম ছিল রাইটার আর পাইলট। সবার বুকপকেটে কলম শোভা পেত। জামাইদের উপহার ছিল শেফার্স কলম। তারো আগে নিবের কলম। আমার শৈশবের কলম হলো নিবের কলম। আমাদের সময়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত দোয়াত থাকত। একটা দোয়াত ছিল, উল্টে গেলেও কালি পড়ত না। দোয়াতের কালি আমরা নিজেরা বানাতাম। এক আনা দামের কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত। এক দোয়াল কালি বানাতে একটা টেবলেটই যথেষ্ট ছিল। যে সব ছেলেমেয়ের বাবার টাকাপয়সা আছে, তারা দুটা ট্যাবলেট দিত। তাদের কালির রঙ ছিল দর্শনীয়।

হাতঘড়ি উঠে যাব উঠে যাব করছে। তাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজছে। সময় দেখার জন্যে এখন আর হাতঘড়ির প্রয়োজন নেই। হাতে মোবাইল আছে। সেখানে সময় দেখা যায়। শুধু সময় না, কী বার, কত তারিখ কোন শতাব্দী সব।

একসময় হাত ঘড়ির কী বাবুয়ানিই না ছিল! রেডিওর সঙ্গে সেই ঘড়ির টাইম মিলানো হতো। হাতঘড়ির টাইম রেডিও টাইম কি না তা জানা আবশ্যক ছিল। জামাইদের উপহার সামগ্রীর মধ্যে অবশ্যই হাতঘড়ি থাকতে হতো।

মৃত্যুঘণ্টা বাজছে এমন কিছু জিনিসপত্রের তালিকা আমি তৈরি করেছি। পাঠকরা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

১. শিলপাটা
গুঁড়া মসলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আদা বাটা, রসুন বাটা পাওয়া যাচ্ছে। মসলা গুঁড়া করার মেশিন সস্তায় কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে, শিলপাটার কী দরকার? এই বস্তু যেহেতু চলে যাচ্ছে–চলে যাবে শিলপাটা ধার করাবার কর্মীরা। ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাকের মতো তাদের গলা শোনা যাবে না। জানালার কাছে এসে কেউ বলবে না, শিলপাটা ধার করাইবেন?

২. বই
বাসস্থান ছোট হয়ে আসছে। বই রাখার জায়গা নেই। বইয়ের প্রয়োজনও তেমন নেই। ইন্টারনেট চলে এসেছে। যে-কোনো প্রয়োজনীয় বই ইন্টারনেটে পড়া যাবে। একটা সময় ছিল যখন মধ্যবিত্তের স্বপ্নে সবসময় ছোট্ট একটা লাইব্রেরি থাকত। সেই লাইব্রেরির দর্শনীয় সংগ্রহ–এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা। অতি যত্নে ঝাড়পোছ করে রাখা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা ছিল রুচি এবং বিদ্যানুরাগের শ্রেষ্ঠ নির্দশন। (যাদের সংগ্রহে এই জিনিস আছে, তাদের কেউ তার পাতা উল্টে কখনো দেখেছেন এমন অপবাদ দেওয়া ঠিক হবে না।)

বিত্তবানদের বাড়িতে জায়গার অভাব নেই। তবে তাঁদের বইয়ের লাইব্রেরির জায়গা দখল করে নিয়েছে হোম থিয়েটার নামক এক বস্তু।

.

হারিয়ে যাওয়া জিনিসের তালিকা বড় করতে ইচ্ছা করছে না। যা হারিয়ে যাবার তা হারিয়ে যাবে। এদের জন্যে শোকগাথার কোনো প্রয়োজন নেই। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! বলে বিলাপ সঙ্গীত অর্থহীন।

পৃথিবী বদলাবে এটাই তো স্বাভাবিক। হারিয়ে যাওয়া সময় নিয়ে আমরা হা হুতাশ করব এটাও স্বাভাবিক।

তাহলে স্লাইড রুল নিয়ে লেখাটা কেন লিখলাম? সেদিন পুরনো ট্রাংক ঘাটতে গিয়ে আমার স্লাইড রুলটা খুঁজে পেলাম। একচল্লিশ বছর আগে আশি টাকা দিয়ে এটা কিনে ভেবেছিলাম বিজ্ঞানের কী অপূর্ব একটা আবিষ্কার এখন আমার হাতে। আমি কত না ভাগ্যবান!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments