Thursday, August 28, 2025
Homeবাণী ও কথাজগদলের দিন - হুমায়ূন আহমেদ

জগদলের দিন – হুমায়ূন আহমেদ

আমার শৈশবের অদ্ভুত স্বপ্নময় কিছুদিন কেটেছে জগদলে। জগদলের দিন আনন্দময় হবার অনেকগুলি কারণের প্রধান কারণ স্কুলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। সেখানে কোনো স্কুল নেই। কাজেই পড়াশোনার যন্ত্রণা নেই। মুক্তির মহানন্দ।

আমরা থাকি এক মহারাজার বসতবাড়িতে, যে-বাড়ির মালিক অল্প কিছুদিন আগেই দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন। বাড়ি চলে এসেছে পাকিস্তান সরকারের হাতে। মহারাজার বিশাল এবং প্রাচীন বাড়ির এক তার বাবা। দুতলাটা তালাবদ্ধ। শুধু দুতলা নয়, কয়েকটা ঘর ছাড়া বাকি সবটা তালাবদ্ধ। কারণ মহারাজা জিনিসপত্র কিছুই নিয়ে যাননি। ঐসব ঘরে তার জিনিসপত্র রাখা।

ঐ মহারাজার নাম আমার জানা নেই। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিও বলতে পারলেন না। তবে তিনি যে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিলেন তার অসংখ্য প্রমাণ এই বাড়িতে ছড়ানো। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। সেই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর ছিল নিজস্ব জেনারেটর। দাওয়াতের চিঠি ছেপে পাঠানোর জন্যে মিনি সাইজের একটা ছাপাখানা।

বাবাকে অসংখ্যবার বলতে শুনেছি-মহারাজার রুচি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আহা, কত বই! কত বিচিত্র ধরনের বই।

বাবা অনেক লেখালেখি করলেন, যাতে বইগুলি অন্তত সরকারি পর্যায়ে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। তাঁর লেখালেখিতে কোনো কাজ হল না। বাবা কতবার যে গভীর বেদনায় বললেন-আহা, চোখের সামনে বইগুলো নষ্ট হচ্ছে, কিছু করতে পারছি না! তিনি ইচ্ছা করলেই সমস্ত বই নিজের সংগ্রহে যুক্ত করতে পারতেন। তাতে বইগুলি রক্ষা পেত। তিনি তা করলেন না। পরের জিনিস নিজের মনে করার প্রশ্নই আসে না। তিনি হাহুতাশ করতে লাগলেন। চোখের সামনে বই নষ্ট হতে লাগল। হোক নষ্ট, তাতে আমাদের অর্থাৎ ছোটদের তেমন কিছুই যায় আসে না। কারণ আমাদের সামনে অন্য একটি জগৎ খুলে গেছে।

বাড়ির সামনে বিশাল বন। একটু দূরেই নদী, যে-নদীর পানি কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ। নদীর তীরে বালি ঝিকমিক করে জ্বলে। নদীটিই পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়ার সীমানা। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম কখন দুপুর হবে-নদীতে যাব গোসল করতে। একবার নদীতে নামলে ওঠার নাম নেই। তিন ভাইবোন নদীতে ঝাপাঝাঁপি করছি, বড়রা হয়তো একজনকে জোর করে ধরে পাড়ে নিয়ে রাখল। আনতে গেল অন্যজনকে। এই ফাঁকে পাড়ে যে আছে সে লাফিয়ে নামল।

বিকেলগুলিও কম রোমাঞ্চকর ছিল না। প্রতিদিনই বাবা কাঁধে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে বলতেন—চল বনে বেড়াতে যাই। কাধে বন্দুক নেয়ার কারণ হচ্ছে প্রায়ই বাঘ বের হয়। বিশেষ করে চিতাবাঘ।

বাবার সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত বনে ঘুরতাম। ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম রাতে। ভাত খাওয়ার আগেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত। কত বিচিত্র শব্দ আসত বন থেকে। আনন্দে এবং আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠতাম।

সবাই ঘুমুতাম একটা ঘরে। বিশাল তিনটা খাট একত্র করে ফুটবলের মাঠের আকৃতির একটা বিছানা তৈরি করা হত। বিছানার উপরে সেই ম্যাপ তৈরি এক মশারি। রাতে বাথরুম পেলে মশারির ভেতর থেকে নামা নিষিদ্ধ ছিল কারণ খুব কাঁকড়াবিছা এবং সাপের উপদ্রপ।

কাঁকড়াবিছাগুলি সাপের মতোই মারাত্মক। একবার কামড়ালে বাচ্চার মা। নেই, এমনি তার বিষ। মৃত্যু সঙ্গে নিয়ে কাড়াবিছা মেঝেতে হেঁটে হেঁটে যাচ্চে আমি বিছানায় বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছি-এই ছবি এখনও চোখে ভাসে।।

আমাদের আশেপাশে কোনো জনমানব ছিল না। অনেক দূরে বনের ভেs একজন কম্পাউন্ডার থাকতেন। সভ্য মানুষ বলতে তিনিই। তার বড় মেয়েটির নাম আরতি। আমার বয়সী, বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে। দেবী প্রতিমার মতো শান্ত মুখশ্রী, কিন্তু সেই শ্রীময়ী চেহারার সঙ্গে স্বভাবের কোনো মিল নেই। একদিন সকালে আমাদের বাসার সামনে এস মিহি সুরে ডাকতে লাগল-কাজল, এই কাজল!

আমি বের হয়ে এলাম। যেন কত দীর্ঘদিনের চেনা সেই ভঙ্গিতে বলল, বনে বেড়াতে যাবে। উচ্চরণ বিশুদ্ধ শান্তিপুরী। গলার স্বরটিও ভারি মিষ্টি। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ।

সে আমাকে নিয়ে বনে ঢুকে গেল। ক্রমেই সে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। আমি একসময় শঙ্কিত হয়ে বললাম, ফেরার পথ মনে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল যে এরকম অদ্ভুত কথা কখনো শোনেনি। তার পরই হঠাৎ একটা দৌড় দিয়ে উধাও হয়ে গেল।

আমি ভাবলাম, নিশ্চয় লুকোচুরি জাতীয় কোনো খেলা। আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে কাতর গলায় ডাকতে লাগলাম-আরতি, এই আরতি।

তার কোনো খোঁজ নেই। এই অদ্ভুত মেয়ে আমাকে বনে রেখে বাসায় চলে গেছে।

আমি পথ খুঁজে বের করতে গিয়ে আরও গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। একসময় দিশাহারা হয়ে কাদতে বসলাম। জনৈক কাঠকুড়ানো সাঁওতাল যুবক এই অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে বাসায় দিয়ে আসে।

এর দিন পাঁচেক পর আরতি আবার এসে ডাকতে লাগল—এই কাজল, এই- আমি বের হওয়ামাত্র বলল, বনে যাবে?

আমি খুব ভালো করে জানি, এই মেয়ে আমাকে আবার আগের দিনের মতো গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে আসবে। তবু তার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলাম না। পরে যা হবার হবে। আপাতত খানিকক্ষণ এই রূপবতী পাগলি মেয়ের সঙ্গে থাকা যাক। সেদিনও সে তা-ই করল। এর জন্যে তার উপর আমার কোনোরকম রাগ হল না। বরং মনে হল এই মেয়েটির পাশাপাশি থাকার নিয়য়ে আমি আমার সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। এই মোহকে কী বলা যায়? প্রেম? প্রেম সম্পর্কে ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা তো এখানে খাটে না। তা হলে এই প্রচণ্ড মোহের জন্ম কোথায়? আমি জানি না। শুধু জানি, মেয়েটির বাবা একদিন তার পরিবার-পরিজন নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে ইন্ডিয়া চলে যান। এই খবর পেয়ে গভীর শোকে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? আমি বললাম, পেটে ব্যথা। বলে আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম। পেটব্যথার অষুধ হিসেবে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে আমাকে সারাদিন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হল। বাবা আমাকে দুফোটা বায়োকেমিক অষুধ দিলেন। তখন তিনি বায়োকেমিক অষুধ নিয়ে খুব মেতেছেন। চমৎকার একটা ব্যাগে তার অষুধ থাকে। বারোটা শিশির বারো রকমের অষুধ। পৃথিবীর সব রোগব্যাধি এই শিশির ঔষধে আরোগ্য হয়। অনেকটা হোমিওপ্যাথির মতো। তবে হোমিওপ্যাথিতে যেমন অষুধের সংখ্যা অনেক, এখানে মাত্র বারোটা।

বাবার বায়োকেমিক চিকিৎসায় আমার বিরহব্যথা অনেকটা দূর হল। এই পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়-এমন মনোভাব নিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের ভেতরই আবার বিছানায় উঠতে হল। কারণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। বাবা-মা দুজনেরই মুখ শুকিয়ে গেল-লক্ষণ ভালো নয়। নিশ্চয় ম্যালেরিয়া। সেই সময়ে এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়া কুখ্যাত ছিল। একবার কাউকে ধরলে তার জীবনীশক্তি পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিত। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা প্রতিষেধক হিসেবে বায়োকেমিক ওষুধ ছাড়াও প্রতি ররিবারে পাঁচ গ্রেন করে কুইনাইন খাচ্ছি। তার পরও ম্যালেরিয়া ধরবে কেন?

বাবা এই ভয়ংকর জায়গা থেকে বদলির জন্য চেষ্টা-তদবির করতে লাগলেন। শুনে আমার মন ভেঙে গেল। এত সুন্দর জায়গা, এমন চমৎকার জীবন-এসব ছেড়ে কোথায় যাব? ম্যালেরিয়ায় মরতে হলেও এখানেই মরব। তা ছাড়া ম্যালেরিয়া অসুখটা আমার বেশ পছন্দ হল। যখন জ্বর আসে তখন কী প্রচণ্ড শীতই-না লাগে! শীতের জন্যেই বোধহয় শরীরে একধরনের আবেশ সৃষ্টি হয়। জুর যখন বাড়তে থাকে তখন চোখের সামনের প্রতিটি জিনিস আকৃতিতে ছোট হতে থাকে। দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। একসময় নিজেকে বিশাল দৈত্যের মতো মনে হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি।

শুধু আমি একা নই, পালা করে আমরা সব ভাইবোন জ্বরে পড়তে লাগলাম। একজন জ্বর থেকে উঠতেই অন্যজন জ্বরে পড়ে। জ্বর আসেও খুব নিয়মিত। আমরা সবাই জানি কখন জ্বর আসবে। সেই সময়ে লেপ-কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আগেভাগেই বিছানায় শুয়ে পড়ি।

প্রতিদিন ভোরে তিন ভাইবোন রাজবাড়ির মন্দিরের চাতালে বসে রোদ গায়ে মাখি। এই সময় আমাদের সঙ্গ দেয় বেঙ্গল টাইগার। বেঙ্গল টাইগার হচ্ছে আমাদের কুকুরের নাম। না, আমাদের কুকুর নয়, মহারাজার কুকুর। তার নাকি অনেকগুলি কুকুর ছিল। তিনি সবকটাকে নিয়ে যান, কিন্তু এই কুকুরটিকে নিতে পারেননি। সে কিছুতেই রাজবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি।

মা তাকে দুবেলা খাবার দেন। মাটিতে খাবার ঢেলে দিলে সে খায় না। থালায় করে দিতে হয়। শুধু তাই না, খাবার দেবার পর তাকে মুখে বলতে হয়–খাও।

খানদানি কুকুর। আদব-কায়দা খুব ভালো। তবে বয়সের ভারে সে কাবু। সারাদিন বাড়ির সামনে শুয়ে থাকে। হাই তোলে, ঝিমুতে ঝিমুতে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে।

এক ভোরবেলার কথা। আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। আমি কম্বল গায়ে দিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে আছি। আমার সঙ্গে শেফু এবং ইকবাল। মা এসে আমাদের মাঝখানে শাহীনকে আমার ছোট ভাই বসিয়ে দিয়ে গেলেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তার দিকে নজর রাখা, সে যেন হামাগুড়ি দিয়ে চাতাল থেকে পড়ে না যায়।

মা চলে যাবার পরপরই হিসহিস শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম। যে-দৃশ্য দেখলাম সে-দৃশ্য দেখার জন্য মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। মন্দিরের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে প্রকাণ্ড একট কেউটে সাপ বের হয়ে আসছে। মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে। ফণা তুলে এদিক-ওদিক দেখছে, আবার মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছে, আবার ফণা তোলে। আমরা তিন ভাইবোন ছিটকে সরে গেলাম। শাহীন একা বসে রইল, সাপ দেখে তার আনন্দের সীমা নেই। সে চেষ্টা করছে সাপটির দিকে এগিয়ে যেতে। আর তখনই বেঙ্গল টাইগার ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপটির উপর। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে আমরা কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারলাম না কী হচ্ছে। একসময় শুধু দেখলাম কুকুরটা সাপের ফণা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। বেঙ্গল টাইগার ফিরে যাচ্ছে নিজের জায়গার। যেন কিছুই হয়নি। নিজের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড সে শেষ করল।

সাপ কুকুরটিকে কামড়াবার সুযোগ পেয়েছিল কি না জানি না। সম্ভবত কামড়ায়নি। কারণ কুকুরটি বেঁচে রইল, তবে নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল।

দ্বিতীয় দিনে তার চামড়া খসে পড়ল এর দগদগে ঘা দেখা দিল। এই থেকে মনে হয় সাপ সম্ভবত কামড়েছে। সাপের বিষ কুকুরের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন ভয়াবহ নয়।

আরও দুদিন কাটল। কুকুরটি চোখের সামনে পচেগলে যা।চ্ছে। তার কাতরধ্বনি সহ্য করা মুশকিল। গা থেকে গলিত মাংসের দুর্গন্ধ আসছে।

বাবা মাকে ডেকে বললেন, আমি এর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। তুমি বন্দুক বের করে আমাকে দাও।।

বাবা আমাদের চোখের সামনে পরপর দুটি গুলি করে কুকুরটিকে মারলেন। শান্ত গলায় বললেন, যে আমার কাজলের জীবন রক্ষা করেছে তাকে আমি গুলি করে মারলাম। একে বলে নিয়তি

আমার কাছে বাবাকে পৃথিবীর নিরতম মানুষদের একজন বলে মনে হল। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না এমন একটি কাজ তিনি কী করে করতে পারলেন। রাগে দুঃখে ও অভিমানে রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়েছি। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় বসালেন।

দুজন চুপচাপ বসে আছি। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তক্ষক ডাকছে। বাড়ির চারপাশের আমের বনে হাওয়া লেগে বিচিত্র শব্দ উঠছে।

বাবা কিছুই বললেন না। হয়তো অনেক কিছুই তার মনে ছিল। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেন না। একসময় বললেন, যাও ঘুমিয়ে পড়ো।

কুকুরটি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

আমার মনে আছে–এই নিয়ে আমি কিছু-একটা লিখতে চেষ্টাও করেছিলাম। রচনাটির নাম দিয়েছিলাম বেঙ্গল টাইগার কিংবা আমাদের বেঙ্গল টাইগার। সম্ভবত এই রচনাই আমার প্রথম সাহিত্য। বলাই বাহুল্য, অতি তুচ্ছ রচনা। কিন্তু হৃদয়ের গভীর যাতনায় যার জন্ম তাকে তুচ্ছই-বা করি কী করে?

জগদলে বেশিদিন থাকা হল না। বাবা বদলি হলেন দিনাপুরের পচাগড়ে [পঞ্চগড়]। এই জায়গা সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে ভোরবেলা বাসার সামনে এসে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবল চুড়া দেখা যেত। মনে হত পাহাড়টা রূপার পাতে মোড়া। সূর্যের আলো পড়ে সেই রূপা চকচক করছে। বাবা আমাদের মধ্যে সাহিত্যবোধ জাগ্রত করবার জন্যেই হয়তো এক ভোরবেলায় ঘোষণা করলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নিয়ে যে একটা কবিতা লিখতে পারবে সে চার আনা পয়সা পাবে। অনেক চেষ্টা করেও কোনো কবিতা দাঁড় করাতে পারলাম না। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আরও মন-খারাপ হল যখন আমাদের তিন ভাইবোনকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হল।

স্কুলে ভরতি করতে নিয়ে গেলেন বড়মামা। তিনজনই কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছি। এই পৃথিবীর হৃদয়হীনতা কেউই সহ্য করতে পারছি না। বড়মামা উপদেশ দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছেন–বিদ্যা অমূল্য ধন, পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে-এইসব।

অমূল্য ধন বা গাড়ি-ঘোড়া কোনোকিছুরই প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি না।

বড়মামা আমাদের চোখের জল অগ্রাহ্য করে স্কুলে ভরতি করিয়ে দিলেন। শুধু তা-ই নয়, হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে আমি বিনা বেতনে আপনাদের স্কুলে পড়াব। আপাতত আমার কিছু করার নেই, হাতে প্রচুর অবসর।

হেডমাস্টার রাজি হলেন। আমি খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলাম। যা-ই হোক, একজন স্যার হলেন আমাদের নিজেদের লোক এবং অতি প্রিয় মানুষ। স্কুলের দিনগুলি হয়তো খারাপ যাবে না। দ্বিতীয় দিনেই বড়মামা আমাদের ক্লাসে অঙ্ক করাতে এলেন। আমি হাসিমুখে চেঁচিয়ে উঠলাম-বড়মামা?

মামার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। হুংকার দিয়ে বললেন-মমা? মামা মানে? চড় দিয়ে সব দাঁত খুলে ফেলব। স্কুলে আমি তোমাকে চিনি না। তুমিও আমাকে চেন না। বলো, ৬-এর ঘরের নামতা বলো। পাঁচ ছয় কত?

আমি হতভম্ব।

একি বিপদ! ছয়ের ঘরের নামতা যে জানি না এটা বড়মামা খুব ভালো করেই জানেন। কারণ তিনি আমাদের পড়ান।

তিনি দুনিয়া-কাঁপানো হুংকার দিলেন, কী, পারবে না?

আবার কী? বলো, জি না।

জি না।

বলো, জি না স্যার।

জি না স্যার।

না পারার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। আত্মীয় বলে আমার কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে না। আমার চোখে সব সমান। সবাই ছাত্র। ক্লাস-ক্যাপ্টেন কোথায়? যাও, বেত নিয়ে আসো।

বেত আনা হল। এবং সত্যি সত্যি বড়মামা ছয়টি বেতের বাড়ি দিলেন–যেহেতু ছয়ের ঘরের নামতা।

স্কুলে মোটামুটি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে গেল। ছাত্রমহলে রটে গেল ভয়ংকর  রারী একজন স্যার এসেছেন। অতি কড়া, তার ক্লাসে নিশ্বাস ফেলা যায় না

বড়মামার চাকরি দীর্ঘস্থায়ী হল না। স্থানীয় এস.ডি.ও. সাহেবের ছোট ভাইকে কানে ধরে উঠবস করার কারণে তার চাকরি চলে গেল। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বড়মামা আবার আগের মূর্তিতে ফিরে এসেছেন। গল্প করছেন, আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথায় গেলে নাকি রাতের বেলা দার্জিলিং শহরের বাতি দেখা যায়, নিয়ে গেলেন।

গভীর রাত পর্যন্ত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। দার্জিলিং শহরের বাতি আর দেখছি না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। কিছুই দেখা গেল না। বড়মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ওদের আজ বোধহয় ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে। আরেকদিন আসতে হবে। অসাধারণ দৃশ্য! না দেখলে জীবন বৃথা।

একদিন সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ি নদী দেখাতে। প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে নালার মতো একটা জলধারা পাওয়া গেল। মামা বললেন, তুমি ঘুরে বেড়াও। আমি এই ফাঁকে একটা কবিতা লিখে ফেলি। মামা নদীর পাড়ে বসে কুলটানা খাতায় কবিতা লিখতে বসলেন। দীর্ঘ কবিতা লেখা হল। কবিতার নামটা মনে আছে।

হে পাহাড়ী নদী।

বড়মামার এই কবিতা স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপাও হল। পচাগড়ের দিনগুলি আমাদের কাছে একসময় সহনীয় হয়ে উঠল এবং ভালো লাগতে লাগল। আমার একজন বন্ধু জুটে গেল যে নর্দমার পানিতে মাছ মারার ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। দুজনেই বড়শি-হাতে নর্দমায় নর্দমায় ঘুরে বেড়াই। নর্দমায় ট্যাংরা, লাটি এবং পুঁটিমাছ পাওয়া যায়। আমার বন্ধুর পকেটে নারিকেলের মালায় থাকে কেঁচো। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক টুকরা কেঁচো নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বড়শিতে গেঁথে পানিতে ফেলে দেয়। দেখতে বড় ভালো লাগে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments