Wednesday, August 20, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পআতঙ্ক - মানবেন্দ্র পাল

আতঙ্ক – মানবেন্দ্র পাল

হঠাৎ কলিংবেল বাজল। খুব আস্তে। বেল বাজানোর ধরন শুনেই বোঝা গেল অপরিচিত কেউ। নিশ্চয়ই ভদ্র, বিনীত। তবু অনাদিবাবু অবাক হলেন। এই অসময়ে কে আসতে পারে?

জায়গাটা কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকার কুঁদঘাট। একসময়ে পরিত্যক্ত ছিল। এখন দিন যত যাচ্ছে ততই লোকবসতি বাড়ছে। তবু এখনো এখানে-ওখানে বাঁশঝাড়, জলা-জঙ্গল। বাইরে থেকে এসে সে সময়ে অনাদিবাবু বুদ্ধিমানের মতো সামান্য টাকায় বাড়িটা করে ফেলেছিলেন। পাড়ার সকলেই পরিচিত।

এখন বেলা দুটো। অনাদিবাবু খেয়েদেয়ে কাগজ পড়ছিলেন। এমনি সময়ে কলিংবেল বাজল কি-রিং।

অনাদিবাবু উঠে দরজা খুলে দিয়ে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। তারপরেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন–আসুন।

সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীকে ডাকলেন, শুনছ? দেখে যাও কে এসেছেন।

ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ দেখলে ভয় পেতে হয়। কুচকুচে কালো রঙ, মাথার চুল জট পাকিয়ে গিয়েছে। নাকটা থ্যাবড়া। চোখ দুটো গোল। একটু লালচেও। পরনে গেরুয়া কাপড়। কাছা দিয়ে পরা। হাতের ক্যাম্বিসের ব্যাগটা মাটিতে রেখে হাতজোড় করে অনাদিবাবুদের নমস্কার করে ইংরিজিতে বললেন, দেখা করতে এলাম।

অনাদিবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই নমস্কার করে বললেন, আমাদের সৌভাগ্য। মাদ্রাজী এই মহিলাটির সঙ্গে অনাদিবাবু আর তাঁর স্ত্রীর পরিচয় হয়েছিল বছর তিনেক আগে দক্ষিণ ভারতে তিরুপতির পাহাড়ে। ভদ্রমহিলা দীর্ঘদিন ধরে প্রেতচর্চা করেন। শুধু প্রেতচর্চাই নয়, মনোবিকারগ্রস্ত লোকেদের ওপর

প্রচণ্ড শক্তিতে প্রভাব বিস্তার করতেও পারেন।

এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে অনাদিবাবুরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে আসবার সময়ে অনাদিবাবু বলেছিলেন, মাতাজি, কলকাতায় যখনই আসবেন, আমার বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দেবেন।

মাতাজি কথা দিয়েছিলেন। গতবার দার্জিলিং যাবার পথে কলকাতায় এসে দেখা করেছিলেন। এবার যাচ্ছেন কাশ্মীর-পহেলগাঁও। যাবার পথে তাই দেখা করতে এসেছেন।

দুপুরবেলায় বিশ্রামের পর বিকেলে ওঁরা তিনজন বসে গল্প করছেন, শুভা কলেজ থেকে ফিরল। তাকে দূর থেকে দেখেই মাতাজি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। অনাদিবাবু বললেন, আমাদের মেয়ে শুভা, একটিমাত্র মেয়ে।

শুভা ভুরু কুঁচকে মাতাজিকে একবার দেখেই চলে যাচ্ছিল, শুভার মা ডাকলেন, ও কি! চলে যাচ্ছ কেন? প্রণাম করো। সেবার সাউথে গিয়ে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।

শুভা কোনোরকমে প্রণাম করে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মাতাজি যেন কেমন একরকমভাবে শুভকে দেখছিলেন।

–আপনাদের মেয়ে? তিরুপতিতে তো দেখিনি। আগের বার এসেও দেখিনি।

অনাদিবাবু বললেন, তিরুপতিতে ও যায়নি। আর যেবার আপনি এখানে এসেছিলেন তখন ও ছিল ওর মামার বাড়িতে।

মাতাজি শুভকে দেখতেই লাগলেন। শুভার মা বললেন, শরীরটা ওর মোটেই ভালো যাচ্ছে না। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া একরকম বন্ধ। সব সময়ে কী ভাবে। আর মেজাজ

মায়ের কথার মাঝখানেই শুভা বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল, মাতাজি সস্নেহে ওর হাতটা চেপে ধরে ইংরিজিতে বললেন, রাতে তোমার বোধহয় ভালো ঘুম হয় না। তাই না?

শুভা এক মুহূর্তের জন্যে অবাক হয়ে মাতাজির দিকে তাকাল। তারপর জানি না বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।

শুভার মা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখলেন তো কিরকম অভদ্র! কিন্তু এরকম ও ছিল না। বছর চারেক থেকে ও যেন কেমন হয়ে উঠছে।

বছর চারেক? এখন তো ও কলেজে পড়ছে। তাহলে তখন

–তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। পড়াশোনায় খুব ভালো। ধীর, শান্ত

বাধা দিয়ে মাতাজি বললেন, ইস্কুলে কি ওর কোনো অশান্তি ছিল?

শুভার বাবা বললেন, না, অশান্তি আর কি। পড়াশোনা নিয়েই থাকত। তবে–

এই পর্যন্ত বলে তিনি শুভার মায়ের দিকে তাকালেন।

শুভার মা বললেন, তবে অশান্তি বাধাত একটি মেয়ে–শিখা। গাজিয়াবাদ না কোথা থেকে নতুন এসেছিল। যেমনি রূপ, তেমনি দেমাক। সে শুভাকে একেবারে সহ্য করতে পারত না। ও পড়াশোনায় ভালো, দেখতে খারাপ নয়, সবাই ওকে ভালোবাসত। আর শিখা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরত। আশ্চর্য!

মাতাজি হেসে বললেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এক ধরনের মানুষ থাকে যারা স্বভাবতই ঈর্ষাপরায়ণ। তারা কাউকে সুখী হতে দেয় না, নিজেও সুখী হতে পারে না।

একটু থেমে বললেন, মেয়েটিকে কি আপনি কখনো দেখেছিলেন?

-হ্যাঁ, একবারই।

মেয়েটি কি খুব বেপরোয়া?

খুবই। টিচারদেরও নাকি মানত না।

মাতাজি টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, হাতে ছড়ি জাতীয় কিছু নিয়ে বেড়াতে ভালোবাসত? পায়ের কাছে ঢিল পেলে কুড়িয়ে নিয়ে অকারণে কুকুর, ছাগল মারত?

শুভার মা হেসে বললেন, অত বলতে পারব না। তবে বিরাট একটা কুকুর নিয়ে ঘুরত। একদিন শুতাকে রাস্তায় একা পেয়ে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যি ঠিক সেই সময়ে মেয়েটার দাদা এসে পড়েছিল। তাই শুভা বেঁচে গিয়েছিল।

– যাক, একটা বড়ো রকমের অ্যাকসিডেন্ট থেকে আপনার মেয়ে বেঁচে গিয়েছে। আচ্ছা, সে কি আপনার মেয়েকে কোনোভাবে টিজ করত?

–নিশ্চয়। তার টিজ করার জ্বালায় তো শুভকে ইস্কুল ছাড়তে হতো।

–কিরকম টিজ করত একটু বলুন।

–সে আর কত বলব। দল পাকিয়ে ওর বিরুদ্ধে নানা কথা রটাত, অঙ্গভঙ্গি করে ভ্যাঙাত। সিঁড়ি দিয়ে হয়তো নামছে–শিখা ওপর থেকে এসে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে চলে যেত। এমনি কত। শুভা তো সব বলত না।

মাতাজি মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন–মেয়েটি এখন কোথায়? নিশ্চয়ই এখানে নেই?

শুভার মা বললেন, ঠিকই বলেছেন। ওরা এখন আর এখানে নেই। ইস্কুল ছেড়ে দেবার পরই চলে যায়।

–ইস্কুল ছেড়ে দিল কেন?

–সেও এক কাণ্ড। একদিন শিখা টিফিনের সময়ে আর একটা মেয়ের বই চুপি চুপি নিয়ে শুভার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে চোর সাজাবার চেষ্টা করে। মেয়ে তো কেঁদেকেটে অস্থির। এই নিয়ে তুলকালাম। একটি মেয়ে বুঝি শিখার কাণ্ডকারখানা দেখে ফেলেছিল। সেই সব ফাঁস করে দেয়। শিখা ছুটে গিয়ে সেই মেয়েটার গলা টিপে ধরে। মেরেই ফেলত। ভাগ্যজোরে বেঁচে যায়। হেডমিস্ট্রেস শিখার গার্জেনের কাছে কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেন। ব্যস! তারপরই শিখা ইস্কুল ছেড়ে দিল।

মাতাজি বললেন, কিন্তু তাতেও অশান্তি ঘুচল না, কি বলুন?

–ওরে বাবা! অশান্তি ঘুচবে কি, আরো বেড়ে গেল। উড়ো চিঠি আসতে লাগল–পড়াশোনা না ছাড়লে শুভকে মরতে হবে। কী সাংঘাতিক কথা ভাবুন তো!

মাতাজি বললেন, শুভা নিশ্চয়ই ইস্কুল ছাড়েনি?

–সে মেয়েই নয়।

উড়ো চিঠির কথা পুলিশে জানিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ। কিন্তু ওরা তখন এ তল্লাট থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়েছে।

মাতাজি চুপ করে ভাবতে লাগলেন।

শুভার মা বললেন, মেয়ের যে তারপর কী হলো–হাসি নেই–আনন্দ নেই–দিন দিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।

মাতাজি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি একবার আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলব। আমি নিজেই যাচ্ছি ওর কাছে। আপনারা এখানেই থাকুন।

টেবিলের ওপর দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিল শুভা। মাতাজি ঢুকেই বললেন, রাত্তিরে তোমার ঘুম হয় না। নিশ্চয় তুমি ভয় পাও?

শুভা বিরক্ত হয়ে মুখ তুলে তাকাল। মাতাজি বলতে লাগলেন, আমি জানি যখনই তুমি একা থাক তখনই কিছু দেখতে পাও। ঠিক কিনা?

শুভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

–উত্তর দাও?

এবার শুভা নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়াল। কোনোরকমে বলল, হ্যাঁ।

–কি দ্যাখ, পরিষ্কার করে বলো।

শুভা একটু চুপ থেকে বলল, তেমন কিছু নয়, ঘরে হয়তো একা পড়ছি, বাড়িতে কেউ নেই, মনে হলো কেউ যেন চট্ করে সরে গেল। কখনো মনে হয় পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাতে প্রায় কিরকম একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি ঘরের মধ্যে কি যেন নড়ে বেড়াচ্ছে। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে যাই। বুকের মধ্যে কিরকম করে।

–মা-বাবাকে এ কথা বলেছিলে?

না।

–কেন?

–কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টে ঠাট্টা করবে। নইলে বলবে মানসিক ব্যাধি। আমি সায়েন্স-পড়া মেয়ে। আমি নিজেকে বুঝি। জানি এ আমার ব্যাধি নয়। কেউ একজন আমাকে মারবার চেষ্টা করছে।

মাতাজি শান্ত গলায় বললেন, কে মারবে তোমায়?

শুভার মুখটা হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, তা জানি না। তবে যে আমাকে রোজ ভয় দেখাচ্ছে সেই-ই আমায় মারবে।

মাতাজি চুপ করে তাঁর নিজের আঙটির মস্তবড়ো পাথরটা অকারণ নাড়তে লাগলেন। তারপর বললেন, আমি শুধু আর একটা কথা জিগ্যেস করব। তুমি কি এর মধ্যে কোনোদিন তোমার ইস্কুলের সেই মেয়েটিকে শিখা যার নাম–স্বপ্নে কিংবা অন্য কোনোভাবে দেখেছ?

শুভা অবাক হয়ে বলল, তা কি করে দেখব! ও তো আর এখানে নেই। কোথায় আছে তাও জানি না।

মাতাজি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, তাও হয়তো শীগগির জানতে পারবে। তবে আমার একটা কথা কিছুতেই ভয় পেও না। মনে রেখো দুষ্ট আত্মা ভয় দেখাতেই পারে, সজীব মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না, যদি না জীবিত মানুষ নার্ভাস হয়ে পড়ে।

কি-ন্তু- দুষ্টু আত্মার কথা বলছেন কেন? শুভার গলা কেঁপে উঠল। শিখা কি তবে–

–ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি আজ যাচ্ছি। পরে আবার দেখা হবে। বলে শুভার মাথায় হাত রাখলেন।

সঙ্গে সঙ্গে শুভার শরীরটা কেমন করে উঠল। যেন ইলেকট্রিকের শখ খেল।

.

তারপর একদিন।

গভীর রাত। আকাশে মেঘ থমথম করছে। শুভার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কেবলই এপাশ-ওপাশ করছে। পাশের ঘরেই বাবা ঘুমোচ্ছন। এখান থেকেই নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শুভার মনে হলো সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষই বুঝি ঘুমোচ্ছে। জেগে শুধু সে একা।

ভাবতে ভাবতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল কতকগুলো কুকুরের ডাকে। কুকুর তো ডাকতেই পারে। অমন কত দিন কত রাত্রে কত কুকুর ডেকে গেছে। কিন্তু আজকের ডাকটা যেন কেমন। যেন প্রচণ্ড ভয়ে কুকুরগুলোর গলা কাঁপছে। কুকুরের ডাকটা ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল। আর তারপরেই শুভার ঠিক মাথার জানলাটায় শব্দ হলো খট-খট-খ। সেই সঙ্গে ঝড়ের গোঙানি।

ঝড়েই কি জানলা খটখট করছে?

শুভা ধড়মড় করে হাতের ওপর ভর দিয়ে মাথা তুলে জানলার দিকে তাকাল। কি যেন দেখল। সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত দেহটা অবশ হয়ে গেল। একটা ছায়ামূর্তি। ঠিক যেন–ঠিক যেন–

কিরে চিনতে পারছিস? জানলার গ্রিলটা ধরে বাইরে ঝুলছে শিখা। ঝোড়ো হাওয়ায় তার লম্বা চুলগুলো উড়ছে। মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু গলার স্বর পরিষ্কার। চিনতে না পারিস তো মনে করিয়ে দিই। আমি তোদর সেই শিখা। তোর জন্যেই আমাকে ইস্কুল ছাড়তে হয়েছিল। তোর জন্যেই অনেক অপমান। প্রতিশোধ তখন নিতে পারিনি। এখন নেব। আজ আমার মৃত্যুদিন। তাই দেখা করে গেলাম।

শিখা একটু থামল। জানলার গ্রিলে মাথাটা রেখে কেমন একরকম চোখ বের করে তাকাল। তারপর বলল, আজ থেকে সাত দিনের মধ্যে তোকে মারবই। কথাটা জানিয়ে গেলাম।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। সেইটুকু আলোয় শুভা দেখল কী যেন একটা হাওয়ায় সাঁতার কেটে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শুভা চিৎকার করে উঠল।

ব্যাপারটা সবাই শুনল। এটা যে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না সে বিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। তবু সাতটা দিন সবাই শুভকে সাবধানে থাকতে বলল। শুভা বিমর্ষ গলায় বলল, কী আর সাবধান হব?

ছটা দিন কেটে গেল। এতটুকু অশুভ ছায়া নেই। রাত্তিরে সেই যে কুকুরের ডাক শুনেছিল, সে ডাকও আর শোনা যায়নি। এমন কি ঘুমেরও ব্যাঘাত হয়নি। কিন্তু পরের দিন–

দিনের বেলা। ঘড়িতে তিনটে বাজল। রোজকার মতো শুভা দোতলার ছাদে উঠল শুকনো কাপড় তুলতে। একমনে কাপড় তুলে যাচ্ছিল। লক্ষ্য পড়ল, কয়েকটা বাড়ির পরে যে বাড়িটা, তার ছাদে দাঁড়িয়ে তারই বয়সী একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেয়েটিকে শুভা চিনতে পারল না। কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে হলো না। সে একটা একটা করে শাড়ি, ব্লাউজ, ধুতি আলসে থেকে তুলতে লাগল। কিন্তু মুশকিল হলো বাবার গেঞ্জিটা নিয়ে। গেঞ্জিটা উড়ে পড়েছে কার্নিসের ওপর। একটু জোর বাতাস পেলেই পড়বে রাস্তার নর্দমায়। অথচ আলসে থেকে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ালেও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। শুভা একটা লাঠি বা লম্বা কাঠি খুঁজল। কিন্তু তেমন কিছু পেল না। নিচে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে এলেই হয়, কিন্তু শুভার আর নিচে নামতে ইচ্ছে করল না। ঠিক করল গেঞ্জিটা নিয়ে অবে যাবে।

কিন্তু নেবে কি করে? ওটা যে নাগালের বাইরে। নিতে গেলে তাকে আলসে টপকে ঐ সরু কার্নিসের ওপর নামতে হয়। আর ওখানে নামা মানেই হয় কার্নিস ভেঙে, না হয় মাথা ঘুরে একেবারে রাস্তায় পড়ে যাওয়া। পড়লে আর রক্ষে নেই।

শুভা আলসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। তার মনে হলো পড়ে যাওয়া কি এতই সোজা? সার্কাসে সে শূন্যে দোল খাওয়ার কত খেলা দেখেছে। তারাও তো তারই মতো মেয়ে। তারা কি পড়ে যায়? তারা যদি অমন মারাত্মক খেলা খেলতে পারে তাহলে সে কেন কার্নিসে নেমে সামান্য একটা গেঞ্জি তুলে আনতে পারবে না?

কী করবে ভাবছে হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল সেই মেয়েটার দিকে। সে হাসছে। আর আশ্চর্য হাত দিয়ে ক্রমাগত ইশারা করছে কার্নিসে নামার জন্যে। এবার শুভা আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। লোকে যেমন করে ঘোড়ায় চাপে তেমনি করে পরনের শাড়িটা গুটিয়ে আলসের ওপর চেপে বসল। সে যে কী অদ্ভুত দৃশ্য! তারপর যেই ডান পা-টা বাড়িয়ে দিয়েছে মরণ-ফঁদের দিকে অমনি কে যেন কঠিন স্বরে ডাকল, শুভা! নেমে এসো শীগগির!

শুভা চমকে উঠে দেখল ছাদে কখন বাবা উঠে এসেছেন। বাবাকে দেখে তার যেমন আনন্দ হলো তেমনি ভয় হলো। তার মনে হলো সে যেন ইচ্ছে করে কত বড়ো অপরাধ করতে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি আলসে থেকে নেমে মাথা নিচু করে নিচে নেমে গেল।

.

কদিন মোটামুটিভাবে কাটল। শুভার মানসিক অবস্থার কিন্তু উন্নতি নেই। বরং আরো একটু খারাপ হয়েছে। যখন-তখন ছাদে যাচ্ছে। সেই মেয়েটাকে আর একবার দেখতে চায়। অনাদিবাবু শেষে বাধ্য হয়ে ছাদের সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন।

সেদিন গভীর রাতে আবার সেই কুকুরের ডাক। শুভার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘর। তার কিরকম ভয় করল। পাশেই মা শুয়েছিলেন। শুভা অন্ধকারে মাকে একবার ছুঁলো। একটু পরে মাথার কাছে জানলায় চুক চুক শব্দ। কে যেন বন্ধ জানলাটা খুলতে বলছে। শুভার দেহ হিম হয়ে গেল। মাকে। ডাকতে গেল। স্বর বেরোল না।

–খুব বেঁচে গেলি সেদিন।

শুভা চমকে উঠল। শিখার গলা।–একেবারে ঘরের মধ্যে।

ভাগ্যি তোর বাবা এসে পড়েছিল। কিন্তু এবার আর কারো সাধ্য নেই বাঁচায়। কালই তোকে মারব। বলতে বলতে স্বরটা যেন ফ্যানের হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

পরের দিন। সকাল থেকেই শুভা মা-বাবার কড়া পাহারায়। শুধু মা-বাবাই নন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও বারে বারে আসছে-যাচ্ছে। কেবলই লক্ষ্য রাখছে শুভার ওপর। এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! অথচ উড়িয়ে দিতেও পারছে না। শুভা কিন্তু বিরক্ত হচ্ছে। সে কী চিড়িয়াখানার নতুন কোনো জন্তু যে সবাই তাকে দেখে যাচ্ছে? রাগ করে সে ঘরে খিল দিল।

বেলা তখন প্রায় একটা। অনাদিবাবু পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করছিলেন বাইরের ঘরে বসে। শুভার মা বাথরুমে। হঠাৎ অনাদিবাবু শুনলেন রাস্তায় একটা হৈচৈ গেল গেল–গেল

তিনি একলাফে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন দুটো ট্যাক্সি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আর সেখানে লোকের ভিড়। একটু পরেই কারা একটি মেয়েকে ধরাধরি করে নিয়ে এল।

শীগগির একটু জল!

না, শুভা মরেনি। দুটো ট্যাক্সির মুখে পড়েও আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছে।

জ্ঞান ফিরে আসার পর শুভা অল্প দু-একটা কথা যা বলল তা এই

খিল বন্ধ করে জানলায় দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখল সেদিনের সেই মেয়েটা খুব সেজে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হি-হি করে হাসছে। কে এই মেয়েটা, কোথায় তার বাড়ি, কেনই বা তাকে দেখলেই হাসে জানার জন্যে সে তখনি খিড়কির দরজা দিয়ে ছুটে গিয়েছিল। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

.

কয়েকটা মাস বেশ ভালোভাবেই কাটল। আর কোনো উপদ্রব নেই। শুভা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আজকাল সবার সঙ্গে গল্প করে, হাসে। ওকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে ওর মা এখন ওকে সংসারের টুকিটাকি কাজ দেন।

সেদিন বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। অনাদিবাবু বললেন, শুভা, একটু চা করো তো। বলে নিচে নেমে গেলেন। শুভার মা গেলেন ঠাকুরঘরে। দোতলাটা একেবারে ফাঁকা। নিস্তব্ধ। শুভা রান্নাঘরে এসে স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। একটু পরে তার শরীরটা কেমন করে উঠল। মনে হলো যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাথাটা ঝিঁঝিম্ করছে। শুভা উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরের সামনের বারান্দাটার দিকে তাকাল-খাঁ খাঁ করছে। সামনের ঘরগুলোও ফাঁকা। এরকম তো রোজই ফাঁকা থাকে। কিন্তু আজ কেন এত ভয় করছে? মনে হচ্ছে যেন বাড়িতে কেউ নেই। সবাই তাকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে এটা যেন কোনো ভুতুড়ে বাড়ি।

শুভা কেমন যেন ভয় পেয়ে গোঙাতে লাগল। মনে হতে লাগল এখুনি সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে।

আর ঠিক সেই সময়ে সে স্পষ্ট দেখল তার সামনে শিখা দাঁড়িয়ে। রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। দুচোখে আগুন-ঝরা দৃষ্টি। একরাশ কালো চুল বাতাসে উড়ছে।

–দুবার বেঁচে গেছ। এবার রেহাই নেই। বলে শিখা দুহাত বাড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। আর শুভা পিছোতে লাগল জ্বলন্ত স্টোভের দিকে। ক্রমশ আগুনের তাত তার গায়ে লাগল। তবু পিছোচ্ছে শুভা। না পিছিয়ে উপায় নেই। শিখা রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে।

চিৎকার করতে গেল শুভা, পারল না। ঠিক এই মুহূর্তে বাইরের ঘরের দরজায় কলিংবেল বাজল–কি-রিং-কি-রিং–

শুভা শুনতে পেল বাবা দরজা খুলে দিলেন। শুনতে পেল, কাকে যেন সাদর অভ্যর্থনা করছেন–আসুন–আসুন।

সেই সঙ্গে আরো শুনতে পেল কোনো মহিলার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, শীগগির আমায় ওপরে নিয়ে চলুন।

সিঁড়িতে দ্রুত পায়ের শব্দ। কে যেন হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে। শুভা যেন জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে। দেওয়াল ধরে সামলে নিল কোনোরকমে। না, শিখা নেই। শুভা তবু ভয়ে ভয়ে তাকাল। দেখল সামনে ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে মাতাজি দাঁড়িয়ে।

মাতাজি হেসে বললেন, ভয় নেই। ও আর কোনোদিন আসবে না। আজ ওর আত্মা মুক্তি পেয়ে গেল।

ততক্ষণে শুভার মা-বাবাও এসে পড়েছেন। তাঁরা অবাক হলেন, রান্নাঘরের কাছ থেকে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করে আসছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments