Monday, May 6, 2024
Homeকিশোর গল্পউপহার - রূপা মণ্ডল

উপহার – রূপা মণ্ডল

উপহার - রূপা মণ্ডল

সত্যিই টিফিনের সময় রজতের বড্ড কষ্ট হয়। কোনদিনও টিফিন আনতে পারে না, পাছে বন্ধুরা বলে “আমাদের খাবারে লোভ দিচ্ছে!” তাই ও ওইসময়ে স্কুলের খেলার মাঠে কোন একটা গাছের নিচে বসে থাকে। ফেরার সময় টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে জল খেয়ে নেয়। একদিন সেটা নজরে আসে ক্লাসের একটি ছেলের।
–তুই এখানে বসে আছিস কেন? তোর খাবার নেই?

রজত দু’দিকে মাথা নাড়ে।

সঞ্জয় ঠিক করে কাল থেকে সে একটা করে রুটি বেশি আনবে।

ক্রমশ ওদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়ে উঠে। সঞ্জয় জানতে পারে রজতের বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। বাবা সামান্য আয়ের চাকরি করেন; পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রজতই বড়। এছাড়া আছেন রজতের মা, ঠাকুমা, ঠাকুরদা ও ওর বাবার একজন বয়স্ক পিসিমা। ওই সামান্য আয়ে সবার মুখের খাবার জোটাতে ওর বাবার হিমসিম অবস্থা। তাই টিফিনের কথা ভাবতে পারে না রজত।

কিন্তু সে পড়াশোনা করে মন দিয়েই। সেখানে কোন ফাঁকিবাজি নেই তার। শুধু অঙ্কে সে দুর্বল। গৃহশিক্ষককে দেওয়ার মতো টাকা নেই ওদের। তাই মাঝে মাঝে স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই গৌরাঙ্গবাবু সময় পেলে ওকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেন। বলেন– আজ ছুটির সময় টিচার্সরুমে একটু আসিস তো?

ছুটির পর গুটি গুটি পায়ে টিচার্সরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রজত। গৌরাঙ্গবাবু একটা ঠোঙা হাতে মুড়ি খাচ্ছিলেন। রজতের দিকে আর একটা ঠোঙা বাড়িয়ে দেন।

–নে, খা।

রজত দেখে ঠোঙাতে চানাচুর-মুড়ি রয়েছে। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল তার। মাস্টারমশাই কেমন করে যে জানলেন! মুড়ি খেতে খেতে অঙ্কের পাঠ চলে।

সঞ্জয়ের কাছে রজতের আর্থিক দুরবস্থার কথা জানতে পেরে অন্য কয়েকজন বন্ধুও তাদের থেকে ওকে টিফিনের ভাগ দিতে শুরু করে।

অবশেষে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে পড়ে। সবাই দইয়ের ফোঁটা কপালে লাগিয়ে পরীক্ষা দিতে আসে। আবার পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে ডাবের জল খায়। রজতের সে সৌভাগ্য হয়নি কোনদিন।

অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পর গৌরাঙ্গবাবু নিজে চলে এসেছিলেন রজতদের বাড়িতে। কোথায় তাঁকে বসতে দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না রজত। তক্তাপোষের উপর পাতা মলিন চাদরটা একটু ঝেড়ে দেয়। মাস্টারমশাইয়ের লক্ষ্য নেই সেদিকে। জিজ্ঞেস করেন–সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিস তো? কোশ্চেন বেশ ভালো এসেছিল। ওই যে সম্পাদ্যটা আগে তুই করেছিলি আমার কাছে, করেছিস তো ওটা? আর ওই এক্সট্রা জ্যামিতিটা?

রজতের মা এক পেয়ালা চা এনেছেন দেখে তিনি লজ্জিত হয়ে উঠেন।

–এর আবার কী দরকার ছিল দিদি?

কিন্তু খুব তৃপ্তি করে পান করেন চা-টা।

রেজাল্ট বের হলে দেখা যায় রজত খুব অল্পের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। কিন্তু অঙ্কে সে একশোয় একশো পেয়েছে। গৌরাঙ্গবাবুর পরামর্শে সে উচ্চ মাধ্যমিকে কমার্স নিয়ে ভর্তি হয়।

কমার্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই সে একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকে। একজন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেটের সঙ্গী হিসেবে কাজ জুটে যায় তার। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রজত সেই ভদ্রলোকের অধীনে কাজ করতে করতে নাইট কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সেই ভদ্রলোক তাকে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সেই কোম্পানিতে খুব দায়িত্ব সহকারে কাজ করতে করতে সে একজন ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে এসে নিজে তার সঙ্গে পার্টনারশিপ বিজনেস শুরু করে অবশেষে নিজে একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

একদিন সে ফেসবুকে খবর পায় তাদের স্কুলে রিইউনিয়ন হবে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠে। বিশেষ করে গৌরাঙ্গবাবুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা সবচেয়ে বেশি।

স্কুলের উঠানে অনেক মানুষের ভিড়ে সে খুঁজতে থাকে তার পরিচিত মুখগুলোকে।

–দাদা, সরুন সরুন।

ক্যাটারিং-এর দু’জন লোক একটা বড় ডেকচি নিয়ে যেন ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। আর ছিটকে সরে যেতে যেতে উল্টো দিকে যার সঙ্গে রজত ধাক্কা খেল সে তার সেই প্রিয় বন্ধু সঞ্জয়। সঞ্জয় দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল রজতকে। আনন্দের আতিশয্যে দুই বন্ধুর গলা বুঁজে আসে। কথা সরে না। ঠিক তখনই আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়–অভিজিৎ আর নিমাই। এরপর আরও অনেক পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হতে থাকে। স্কুলের তৎকালীন পিওন রামুদার গালভরা হাসি এখনও তেমনি আছে।

গেম-টিচার মন্মথবাবুর এখন সব চুল সাদা। তবু পুরোনো ছাত্রদের দেখে দু’ হাত বাড়িয়ে ছুটে এলেন।

রজতের দু’চোখ খুঁজতে থাকে গৌরাঙ্গবাবুকে। কিন্তু খুঁজে পায় না। সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করতে তার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বলল–চল, খেলার মাঠে চল।

খেলার মাঠ এখনও ঠিক আগের মতই আছে। শুধু একটা মস্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়েছে মাঠটাকে। ফলে প্রশস্ত জায়গাটা যেন অনেকটা ছোট হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কয়েকটা গাছতলা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। সেখানে বসে সঞ্জয় একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল রজতের দিকে।

–আমি খাই না রে।

–সেকি, সিগারেট খাস না?

–না। ডাক্তারবাবুর বারণ।

–তবে আমিও খাব না, থাক।

সিগারেটটা আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখল সঞ্জয়। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–গৌরাঙ্গবাবুকে তাঁর দুই কৃতী পুত্র দেখে না। বছর দুয়েক আগে দেখা করতে গিয়ে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বাড়িটার বহুকাল সংস্কার হয়নি। নিজে একটা ছোট্ট ঘরে কোনমতে আছেন। স্ত্রী বেঁচে নেই। টিউশন পড়িয়ে কোনক্রমে একার সংসার চালান। নিজেই রান্না করেন। ওষুধের খরচ বা ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই। আমি কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম। নিতে চাননি।

রজতের চোখে জল আসে। তার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের এমন অবস্থা শুনে তার মনের সব আনন্দ মুছে যায়।

তবু বন্ধুদের মাঝে একটু মুখে হাসি টেনে আনতে হয় তাকে। টুকরো টুকরো কথা, স্মৃতি, ভাববিনিময় চলতে থাকে। খাওয়ার পর রজত সঞ্জয়কে অনুরোধ করে গৌরাঙ্গবাবুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। সঞ্জয় সে অনুরোধ রাখে। রজতের গাড়ি চড়ে ওরা গৌরাঙ্গবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

গৌরাঙ্গবাবুকে দেখে রজতের কান্না পেতে লাগল। কী চেহারা হয়েছে মানুষটার! আর প্রিয় ছাত্রকে দেখে চোখের জল বাঁধ মানছে না গৌরাঙ্গবাবুরও। রজত গৌরাঙ্গবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

–এখন তুমি কী করছ বাবা?

সঞ্জয় উত্তর দিল–ও এখন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল একজন মাস্টারমশাই। রজত এখন মস্তবড় ব্যবসায়ী।

–খুব ভালো কথা। তোমাদের মঙ্গল হোক বাবা! আরও বড় হ’ও।

–মাস্টারমশাই, আমি যে আপনার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম।

রজতের কথা শুনে একটু অবাক হলেন গৌরাঙ্গবাবু।

–আমার কাছে? কী আশা বাবা?

–আমি ঝাড়গ্রামে একটা প্রাইভেট স্কুল খুলেছি। আপনাকে সেই স্কুলের দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি হবেন প্রধান শিক্ষক।

–আ-আমি?

বিস্ময় ও আনন্দে গলা দিয়ে স্বর বের হতে চায় না গৌরাঙ্গবাবুর।

–কিন্তু এই বয়সে আমি কি পারব?

–আপনি না করলে চলবে না মাস্টারমশাই। আপনাকে এই গুরুদায়িত্ব নিতেই হবে। মানুষ গড়ার দায়িত্ব। আপনিই পারবেন। আপনাকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। বলুন কবে যাবেন?

–কিন্তু আমার এই কুঁড়েঘর আর ছাত্রছাত্রীদের কী হবে?

–তার একটা কোন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। আমাকে আপনি কথা দিন আমার সঙ্গে যাবেন আমাদের সেই নতুন স্কুলে? সেখানেই বাংলোতে আপনি থাকবেন।

–যাব বাবা, যাব। যার নিজের কেউ নেই সে তোমাদের মতো ছাত্র পেয়েছে এটাই অনেক। ভগবানের এ এক অদ্ভুত বিচার। এক কুল ভেঙে দিয়ে তিনি আর এক কুল গড়েন। মানুষ গড়ার কারিগর–বেশ বলেছ! আমাকে আবার পারতেই হবে।

এর কিছুদিন পর একদিন বিকেলে এক সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখা গেল রজতের সঙ্গে ঝাড়গ্রামে একটা স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নামতে। তিনিই প্রধান শিক্ষক। অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা তখন হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের গেটের সামনে। বৃদ্ধ মাস্টারমশাই মোটা চশমা চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন –

‘গৌরাঙ্গ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। মাস্টারমশাইয়ের চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments