Wednesday, August 27, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পটমাটো সস - তারাপদ রায়

টমাটো সস – তারাপদ রায়

টমাটো সস – তারাপদ রায়

অনেকে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু কথাটা রীতিমতো সত্যি।

আমি প্রথম টমাটো সস দেখি কলকাতা আসার ঢের আগে, কলকাতা থেকে অনেক দূরে এক নিতান্ত পাড়াগেঁয়ে মফসসল শহরে। সে বহুকাল আগে।

ঠিক শহর নয়, বলা উচিত গণ্ডগ্রাম। স্থানীয় লোকেরা মুখে বলত টাউন। তখন সবে যুদ্ধের শেষ হয়েছে, ডামাডোলের বাজার। আমাদের শহরে তখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি, রেললাইন নদীর ওপারে। তিরিশ মাইল দূরে, কয়েকটা টিনের লম্বা চারচালার নীচে একটা সিনেমা হল রয়েছে, সেখানে ছবির প্রত্যেক রিলের শেষে একবার ইন্টারভ্যাল, প্রোজেকটরে রিল বদলিয়ে তারপর পরের কিস্তি। একালের দূরদর্শনের ধারাবাহিক তেরো ভাগের বহু আগে সেখানে অনিবার্য কারণে শুরু হয়েছিল সেই কিস্তিমালা।

সেই ১৯৪৫-৪৬, যুদ্ধ শেষ, দুর্ভিক্ষ শেষ। তখনও পার্টিশানের ধাক্কা এসে লাগেনি আমাদের সেই ভাঙা দালানে আর পুরনো আটচালা ঘরে। সেই দালান আর টিনের ঘর দুটো মহাযুদ্ধ, কয়েকটা ঘূর্ণিবাত্যা আর কিছু বন্যা আর খরা আর দুর্ভিক্ষ কোনও রকমে পার হয়ে তখনও টিকে ছিল।

সেই সময়ে আমাদের রাঙামামা ফিরলেন বিলেত থেকে। রাঙামামা আমাদের নিজের মামা নন, আমাদের নিজেদের কোনও মামা ছিল না কস্মিনকালে, অর্থাৎ আমার মার কোনও ভাই ছিল না। আমার বাবা প্রকৃত শালা বলতে কী বোঝায় তা জানতেন না।

রাঙামামা ছিলেন আমার সোনা কাকিমার আপন দাদা, সোনা কাকিমা বলতেন ফুলদা। সেই সোনা আর ফুল দুইয়ে মিলেমিশে কী করে রাঙা হয়েছিল, সে এক কঠিন সমস্যা, এখন আর। সমাধান করা সম্ভব নয়, কিন্তু সেকালে এমন হত।

পৃথিবী থেকে রাঙাদা আর সোনাদা কিংবা ফুলদা-রা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, হাম দো। হামারা দো সভ্যতার এই মর্মান্তিক সংকটে গল্পের দরজায় দাঁড়িয়ে সোনা, ফুল আর রাঙাদের কথা কিঞ্চিৎ উল্লেখ করে রাখি।

সবচেয়ে যে বড়, সে বড়দা বা বড়কাকা বা বড় মাসিমা। বড়-র পর মেজো, তারপর সেজো, তারপরে বা কোথাও কোথাও প্রয়োজনমতো রাঙা, সোনা, নোয়া, ফুল এবং সর্বশেষ ছোড়দি বা ছোটপিসি। এর পরেও যদি কেউ থাকে তাকে নাম ধরে সঙ্গে দাদা বা পিসি যোগ করে সম্বোধন। করা ছাড়া গতি নেই।

অবশ্য এসব ঝামেলা থেকে এখন আমরা প্রায় মুক্ত হতে চলেছি। রাঙাদা, সোনাদা বহু দিন গেছে, ছোড়দা বড়দাও যায়-যায়। এর পরে মামা কাকা, মাসি-পিসি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে।

এসব অবান্তর কথা থাক। আমরা আমাদের মূল গল্পে ফিরে যাই। রাঙামামার গল্প।

আমি রাঙামামাকে আগে দেখিনি। আমার খুব ছোটবেলায় তিনি বিলেত গিয়েছিলেন। সেটা সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটু আগে। তাকে আমি সেই সময় দেখে থাকলেও, অত অল্প বয়েসের। কিছু মনে নেই আমার।

খনিবিদ্যার অর্থাৎ মাইনিংয়ের কী একটা উচ্চমানের অধ্যয়নের জন্যে রাঙামামার বিলেতযাত্রা, তিনি গিয়েছিলেন নিউ ক্যাসেলে।

বাংলা কথায় আছে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া, তেমনই ইংরেজিতে বলা হয় নিউ ক্যাসেলে কয়লা নিয়ে যাওয়া। ওই নিউ ক্যাসেলেই রাঙামামা গিয়েছিলেন।

পরে শুনেছি, রাঙামামা যখন বিলেত যাওয়ার পূর্বাহ্নে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসেন, তখন তার নিজের জামাইবাবু ফুলকাকা একটা খুব ছোট বাক্সে খুব ভাল করে বাঁশ কাগজ দিয়ে প্যাকিং করে মানে রাঙামামাকে কী একটা জিনিস উপহার দেন। ফুলকাকা তার শালাকে বলেছিলেন, নিউ ক্যাসেলে গিয়ে খুলে দেখবে, খুব ভাল লাগবে।

সেই প্যাকেটের মধ্যে নাকি কয়েক টুকরো কয়লা পোরা ছিল। জানি না, নিউ ক্যাসেল পর্যন্ত সেই কয়লা বহন করে নিয়ে রাঙামামা কতটা কৌতুকান্বিত বোধ করেছিলেন সেই মোক্ষম বিদেশে, কিন্তু এই ঘটনাটা আজ এই প্রায় অর্ধেক শতাব্দী পরেও আমাদের বাড়িতে অনেকেরই মনে আছে। এই নিয়ে সেই আমলের আমরা যারা দু-চারজন এখনও আছি, দেখা হলে হাসাহাসি হয়।

মাত্র দু বছরের জন্যে বিলেত গিয়েছিলেন রাঙামামা। সেখানে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আটকে পড়েন। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরলেন, সে প্রায় সাত বছর পরে।

সে ফেরাও খুব সহজ হয়নি। অনেক অপেক্ষা করে তারপর ঘুরপথে দেশে এসেছিলেন। এডেনে এসে জাহাজ বদলিয়ে এবং আরও মাসখানেক আটকিয়ে থেকে তিনি যে জাহাজে উঠলেন, সেটা যখন বোম্বে পৌঁছাল, তখন সেখানে ধর্মঘট চলছে কিংবা অন্য কী একটা গোলমাল।

রাঙামামার বহুবিধ দুর্দশার বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে বলি, অবশেষে তিনি দেশে মানে তার নিজের গ্রামে, এসে পৌঁছালেন যাত্রা শুরু করার প্রায় ছয় সাত মাস পরে।

আমাদের টাউন আর রাঙামামাদের গ্রাম খুব কাছাকাছি ছিল, মধ্যে মাত্র একটা ছোট নদী। নদীর ওপারের ঘাটে স্নান করতে দেখে আমার ঠাকুমা নিজে পছন্দ করে রাঙামামার বোন সোনাকাকিমাকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়ির বউ করে।

সে যা হোক, রাঙামামা যখন গ্রামে ফিরে এলেন তখন তার ঘাড় পর্যন্ত ছড়ানো রুক্ষ আ-তেলা চুল, পরিধানে গরম কোট-প্যান্ট, পোড়ামাটির পুতুলের মতো গায়ের কালচে রং। বাড়ির লোকেরা কিন্তু এ সমস্ত দেখেও মোটেই বিচলিত বোধ করেনি। তারা সবাই আশঙ্কা করেছিল, এতদিন পরে রাঙামামা নিশ্চয় মেমসাহেব বউ নিয়ে ফিরবে।

তখনও মেমসাহেব বউ ব্যাপারটার খুব চল হয়নি দেশে, বিশেষ করে সেই অজ মফস্সলে। মেমসাহেব সম্পর্কে এর কিছুদিন আগেই একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল আমাদের টাউনেই।

চক্রবর্তীদের বাড়ির বড় ছেলে, শহরের মধ্যে ডাকনামে তাঁর পরিচয় ছিল বোঁচা ডাক্তার। তিনি ডাক্তারি পাশ করে বাজারের পাশে একটা ফার্মেসিতে এসে বসেন এবং ভালই প্র্যাকটিস করছিলেন। এই সময় যুদ্ধ। যুদ্ধে নাম লিখিয়ে তিনি আর্মির ডাক্তার হয়ে চলে যান। তারপর যুদ্ধ শেষ হলে নামের পাশে অবসরপ্রাপ্ত মেজর উপাধি অর্জন করে আবার শহরে ফিরে এলেন।

কিন্তু তিনি একা এলেন না। সঙ্গে নিয়ে এলেন বিবাহিতা স্ত্রী, এক ইঙ্গ-ভারতীয় মেমসাহেব। যুদ্ধের সময় একই হাসপাতালে মহিলা নাকি নার্স ছিলেন, সেখানেই কাজ করতে করতে আলাপ, পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয়।

বাড়ির লোক এসব কথা আগে জানতে পারেনি। সবাই মেমবউ দেখে হতচকিত হয়ে পড়ল। কৌতূহল, উৎকণ্ঠা সব কিছু মিলিয়ে ওই মফসলের শহরে সেই মেমকে নিয়ে হাটে-বাজারে, পুকুরঘাটে, বার লাইব্ররিতে হঠাৎ নানাবিধ গুঞ্জন শুরু হল।

কিন্তু মেম যখন লালপাড় শাড়ি পরতে আরম্ভ করল, তারপর অল্প অল্প করে পান-দোকতা খেতে শুরু করল, অবশেষে একদিন পুকুরের ঘাটে রীতিমতো ডুব দিয়ে স্নান করল, এমনকী বোঁচা ডাক্তারের গোরু পর্যন্ত মেম নিজেই দুইতে লাগল–সকলেই স্বীকার করল যে, বোঁচা ডাক্তারের স্ত্রীভাগ্য ভাল। মেম সন্ধ্যাবেলা ঘোমটা টেনে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে এরপর যেদিন কালীবাড়িতে প্রণাম করতে গেল, সেদিন অতি বড় নিন্দুকেরাও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এর পরেই ঘটল ভয়াবহ মারাত্মক এক ঘটনা এবং সেই সঙ্গে যবনিকাপতন। কী যে সঠিক হয়েছিল কেউ ভাল করে জানে না, বোঁচা ডাক্তার এবং তার বাড়ির লোকেরাও কখনও কাউকে বলেনি। একদিন শেষরাত্রে বোঁচা ডাক্তারের বাড়ির দিক থেকে প্রচণ্ড হইচই, চিৎকার, চেঁচামেচি শোনা গেল। বামা কণ্ঠে ইংরেজি গালাগাল রাস্কেল, স্টুপিড, বাস্টার্ড, বিচ, সান অফ এ বিচ… বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে মেম তার ভাষায় অকল্পনীয় অকথ্য শব্দগুলি চেঁচিয়ে বলে আর থুথু ফেলে। ডাক্তারবাড়ির উঠোনটা থুথুতে ভিজিয়ে হাতে হান্টার কাঁধে সুটকেস, ব্রিচেস জাতীয় প্যান্ট পরা রণরঙ্গিনী মূর্তিতে মহিলা পতিগৃহ থেকে বেরিয়ে গট গট করে বাজারের রাস্তায় গিয়ে একটা টমটম গাড়ি ভাড়া করে স্টিমারঘাটের দিকে চলে গেল। পড়ে রইল তার শাখাসিঁদুর, লালপাড় শাড়ি, পান-দোকতা। সে আর ফেরেনি।

পুরো শহরটা থমকে গিয়েছিল সেদিন। ওই ছোট শহরের ইতিহাসে অনুরূপ উত্তেজনাময় প্রভাতকাল এর আগে আর কখনও আসেনি।

সুতরাং রাঙামামা বিলেত থেকে যদি মেমবউ নিয়ে আসে, তবে কী হবে এই আশঙ্কা স্বভাবতই ছিল। সবাই বলাবলি করত, যুদ্ধে সব সাহেব তো মরে ভূত হয়ে গিয়েছে, মেম সাহেবেরা বর পাবে কোথায়, তারা কি সুপাত্র পেলে ছেড়ে দেবে, ঝুলে পড়বে না!

কিন্তু যে কারণেই হোক মেমসাহেবরা রাঙামামাকে রেহাই দিয়েছিল। তার ঘাড়ে ঝুলে পড়েনি। রাঙামামা বিলেত থেকে একাই ফিরেছিলেন। মেম জুটিয়ে আনেননি। ফলে নিঃসঙ্গ রাঙামামা ফিরে আসায় হিতৈষীরা বেশ একটু স্বস্তিই পেলেন।

বিলেত থেকে মেম আনেননি বটে, তবে একটা খারাপ অভ্যেস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, বাথরুম সংক্রান্ত।

ব্যাপারটা সত্যি গোলমেলে। সাত বছরে রাঙামামার অভ্যেস সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। তাদের নিজেদের বাড়িতে বাথরুম ইত্যাদির যা বন্দোবস্ত ছিল তা প্রাগৈতিহাসিক, কোনও রকমে আবরু রক্ষা।

ফিরে এসে এই দিশি ব্যবস্থায় রাঙামামার খুবই অসুবিধে হচ্ছিল। খবরটা তাঁর দিদি অর্থাৎ আমাদের সোনাকাকিমার কানে ওঠে দু-একদিনের মধ্যেই।

আমাদের বাড়িতে আমাদের ঠাকুরদার ঘরের সঙ্গে লাগানো একটু চলনসই গোছের বাথরুম ছিল, সেটায় আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। শুধু ঠাকুরদা ব্যবহার করতেন সেটা, আর যদি কখনও কোনও অভিজাত অভ্যাগত থাকতেন, তাঁকে ওই বাথরুমটা ব্যবহার করতে দেওয়া হত।

ওই বাথরুমে অবশ্য জলের কল ছিল না। শুধু ওই বাথরুমে কেন, আশেপাশে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোথাও জলের কল ছিল না। সিমেন্ট বাঁধানো টব ছিল বাথরুমের একপাশে, ইদারা থেকে বালতি বালতি জল তুলে সেটা কাজের লোকেরা ভরে রাখত।

সোনাকাকিমা ঠাকুরদাকে বলে তার বিলেত-ফেরত ভাইয়ের জন্যে বাথরুমটার বন্দোবস্ত করলেন।

প্রতিদিন সকালবেলা খেয়া নদী পার হয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে রাঙামামা দেড় মাইল হেঁটে আমাদের গাঁয়ে স্নান-প্রাতঃকৃত্যাদি করতে আসতেন। তখনও কাঁধের ঝোলা ব্যাগ চালু হয়নি, একটা বিলিতি পোর্টফোলিয়ে ব্যাগে তোয়ালে, পাজামা ইত্যাদি ভরে সঙ্গে নিয়ে আসতেন তিনি।

ক্রমে রাস্তাঘাটে, পাড়ায় লোকজন সবাই জেনে গিয়েছিল রাঙামামার এই প্রাত্যহিক আগমনের কারণ। কোনও কোনও দিন হয়তো অন্য কাজেই রাঙামামা বিকেল বা সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছেন। কিন্তু আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, ইনি বাথরুমে যাবেন বলে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে যেত, এই, কে আছিস! বিশ্বম্ভর এসেছে, তাড়াতাড়ি দ্যাখ, বাথরুমে জল আছে। নাকি?

বিশ্বম্ভর বলা বাহুল্য, রাঙামামার প্রকৃত নাম। কখনও কাজের লোকের সাড়া না পেলে ঠাকুমা রাঙামামাকে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করতেন, বাবা বিশ্বম্ভর, তোমার তাড়াতাড়ি নেই তো?

ব্যাপারটা ক্রমশ অতিশয় হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাঙামামাকে আমাদের বাড়ির দিকে আসতে দেখলেই রাস্তার লোকেরা হাসাহাসি করত, বলত, বিলেত-ফেরত কাজে যাচ্ছে।

শুধু রাস্তার লোক কেন, আমাদের বাড়ির লোকেরা, এমনকী গুরুগম্ভীর মুহুরিবাবুরা পর্যন্ত মুখ টিপে হাসতেন। আমাদের রান্নার ঠাকুর ছিল তেওয়ারি। সে একদিন বলেছিল, শালাবাবুর একদম শরম নাহি আছে। সেকথা শুনে সোনাকাকিমার সে কী রাগ। তেওয়ারি কিন্তু কাউকে পরোয়া করত না, বিশেষ করে সোনাকাকিমা জাতীয় নতুন বউদের যারা মাত্র দু-দশ বছর এ বাড়িতে এসেছে তাদের ধর্তব্যের মধ্যে আনত না তেওয়ারি ঠাকুর, তার তখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে আমাদের বাসায়।

এসব যা হোক, রাঙামামার এই হাস্যকর পর্যায় খুব বেশিদিন চলেনি। সপ্তাহ তিন-চারেকের মধ্যেই তিনি ধানবাদ না আসানসোলে কোথায় যেন কয়লাখনিতে কাজ নিয়ে চলে গেলেন। তখন কয়লাখনিগুলোর অধিকাংশ ম্যানেজারই সাহেব। সেই ম্যানেজার সাহেবদের বাংলোতে আর যাই হোক, বিলিতি প্রিভিওয়ালা বাথরুম অবশ্যই ছিল। ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল বিশাল সেই সব বাথরুমের বর্ণনা দিয়ে রাঙামামা চাকরিতে জয়েন করে সোনাকাকিমাকে বিশদ চিঠি দিয়েছিলেন।

বাথরুমের ব্যাপারটা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেকটা গড়িয়ে গেল।

কিন্তু এ গল্প বাথরুমেব নয়। এ গল্প টমাটো সসের। এতক্ষণ শুধুই ভণিতা হল, এবার আসল বিষয়ে যেতে হচ্ছে।

টমাটো নামক তরকারি কিংবা ফলটি তখনও জলচল হয়নি, অন্তত আমাদের ওই অঞ্চলে। পুজোপার্বণে টমাটোর চাটনি চলত না, ঠাকুরদালানে টমাটো ছিল নিষিদ্ধ। লোকে কাঁচা টমাটো বিশেষ খেত না, তরকারিতে মাছ-মাংসে টমাটো দেওয়ার রীতিও প্রচলিত হয়নি।

বাজারে সামান্যই উঠত টমাটো, চাষও হত কম। যেটুকু টমাটো বাজারে উঠত, তার প্রায় সমস্তটাই পাটের সাহেবরা কিনে নিয়ে যেত। বাকি অল্প কিছু কারা কিনত কে জানে, আমরা তো কখনও কিনিনি। সত্যি কথা বলতে কী, জিনিসটাকে আমরা টমাটো বলতাম না। আমরা বলতাম বিলিতি বেগুন। রং এবং আকারের পার্থক্য বাদ দিলে, টমাটো গাছের পাতার এবং ফুলের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে বেগুনের সঙ্গে, তাই হয়তো এই নাম। যেভাবে একদা বিলিতি কুমড়ো কিংবা বিলিতি আমড়ার নামকরণ হয়েছিল।

এই সামান্য আখ্যানে টমাটো সম্পর্কে এত কথা বলার প্রয়োজনই পড়ত না, যদি না রাঙামামা চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আমাদের আধ-বোতল টমাটো সস দিয়ে যেতেন।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিলেত থেকে রাঙামামা ফেরার সময় প্রায় কিছুই কারও জন্যে আনতে পারেননি। কোনও রকমে নিজের পৈতৃক প্রাণটি নিয়ে ফিরেছিলেন। তাঁর নিজের দিদি অর্থাৎ আমাদের সোনাকাকিমাকে একটা মাফলার দিয়েছিলেন, আর আমার সাহেবি-ভাবাপন্ন ঠাকুরদাকে দিয়েছিলেন। একজোড়া জার্মান সিলভারের কাটা-চামচ।

আমাদের সকলেরই ধারণা ছিল যে, এই দুটো উপহারের জিনিসই পুরনো, আগে ব্যবহার করা। বিশেষ করে জার্মান সিলভারের ব্যাপারটায় সবাই ধরে নিয়েছিল, এ নিশ্চয় যুদ্ধের আগে কেনা। কারণ যুদ্ধের পরে আর জার্মান সিলভার আসবে কোথা থেকে? সোনাকাকিমার আশকারাতে এসব নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ গুজগাজ, ফিসফিস হয়েছিল, কিন্তু সোনাকাকিমা মনে আঘাত পেতে পারে এই ভেবে তার সামনে এ নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য কেউ করেনি।

যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা রাঙামামা এলেন। তাকে দেখেই আমার ঠাকুমা যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, এই বিশ্বম্ভর এসেছে, তাড়াতাড়ি বাথরুমে জল দে, আলো দে! জনৈক পরিচারিকা নির্দেশ শুনে সঙ্গে সঙ্গে একটা লম্ফ নিয়ে বাথরুমে রাখতে গেল।

একটু বিব্রত হয়ে রাঙামামা বললেন, না, বাথরুমে যাব না। কাল তো চলে যাচ্ছি নতুন কাজে, তাই একটু দেখা করতে এলাম।

সোনাকাকিমা পাশের বাড়িতে আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ভাইয়ের গলা শুনে ছুটে এলেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রাঙামামা উঠবার সময় তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা আধভরতি বোতল–যার মধ্যে একটা লাল রঙের ঘন তরল জিনিস রয়েছে, সেই বোতলটা সোনাকাকিমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, এটা জামাইবাবুকে দিস, মাছভাজার সঙ্গে খাবে, খুব ভাল জিনিস। আমারটা থেকে অর্ধেক দিয়ে গেলাম।

আমরা কাছেই এসে বসেছিলাম। রাঙামামা উঠে যাওয়ার আগেই লণ্ঠনের আলোয় আমরা বোতলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম, ভেতরে লঙ্কাবাটার মতো ঘন লাল কী একটা জিনিস, আর বোতলটার গায়ে ইংরেজিতে কী সব লেখা, সুপক্ক দ্রাক্ষাগুচ্ছের ছবি আঁকা বোতলের গায়ে লাগানো রয়েছে। দেখলেই কেমন লোভ হয়, বোঝা যায় মহার্ঘ্য সুস্বাদু পানীয়।

আসলে একটা খালি বিলিতি ব্র্যান্ডির বোতলে কৃপণ রাঙামামা নিজের টমাটো সসের বোতল থেকে কিছুটা উপহার দিয়েছিলেন।

টমাটো সস সম্পর্কে আমাদের তখন কোনও রকম ধারণাই ছিল না। আমরা শিশুরা কেন, বড়রাও ধরতে পারল না জিনিসটা কী?

সন্ধ্যার পরে বাজারের চায়ের স্টল থেকে আড্ডা দিয়ে সোনাকাকা ফিরলেন, বোতলটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, তারপর লেবেলটা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন, বললেন, শালা তো খাঁটি বিলিতি জিনিস দিয়ে গেছে। যাই জিনিসটা দাদাকে দেখিয়ে আনি।

তখনও পর্যন্ত মদ জিনিসটা আমাদের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায়নি। মদ ব্যাপারটা খুব চালু ছিল না। শহরে সিনেমা হলের সামনে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা চক্রবর্তী বাড়ির বোঁচা ডাক্তারের এক কাকা শূন্য বোতল হাতে লাফালাফি দাপাদাপি করে খুব মাতলামি করতেন। এতদিন পরে মনে হয়, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মদমত্ততা ছিল না, ওর মধ্যে অনেকটা অভিনয় ছিল।

এ ছাড়া আগের বছর লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে দুজন পাটের সাহেব মাতাল অবস্থায় পাটগুদামের মাঠে মল্লযুদ্ধ করেছিল। শহরসুদ্ধ নোক পরিষ্কার ঝকঝকে জ্যোৎস্নার আলোয় সে লড়াই উপভোগ করেছে।

আমার বাবাকে বোতলটা নিয়ে সোনাকাকা দেখালেন। আদালত থেকে ফিরে একটু বেড়িয়ে এসে তখন বাবা বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন। বোতলটা দেখে বাবা খুশিই হলেন, হ্যারিকেনের ফিতেটা একটু উসকিয়ে দিয়ে ভাল করে বোতলটা দেখলেন, তারপর বললেন, কলকাতার হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে আমার পাশের ঘরে রংপুরের একটা ছেলে, কী রায়চৌধুরী যেন নাম ছিল, সে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা সোড়া আর বরফ কিনে এনে সেগুলো মিশিয়ে এই সব জিনিস খেত। আমাকে বেশ কয়েকবার খাওয়ার জন্যে সেধেছে। সাহস পাইনি। এর পরে বোতলটা খুব যত্ন নিয়ে দেখে বললেন, তবে রায়চৌধুরী যে জিনিসটা খেত, সেটা লাল ছিল না আর এত ঘনও ছিল না।

সোনাকাকা বললেন, তোমার বন্ধু সস্তার জিনিস খেত, তাই অত হালকা। এটা হল আসল জিনিস, সলিড অ্যালকোহল। বিশ্বম্ভর সোজা বিলেত থেকে নিয়ে এসেছে, কম কথা নাকি!

বিশ্বম্ভরের কথা শুনে বাবা একটু উদাস হলেন, বললেন, বিশ্বম্ভর এই সব অভ্যেস করেছে? বিলেত গেলে লোকের এই একটা ক্ষতি হয়।

এমন সময় কাছারিঘর থেকে দুজন মক্কেলকে সঙ্গে করে কিছু নথিপত্র নিয়ে আমাদের নতুন মুহুরিবাবু বারান্দায় বাবার কাছে এলেন। বাবা সাধারণত সন্ধ্যার পরে কাছারিঘরে বসেন না। দু-চারজন মক্কেল এলে বা জরুরি কোনও ব্যাপার থাকলে বাইরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়েই সেটা করেন।

আমাদের এই নতুন মুহুরিবাবু সেকালের তুলনায় বেশ স্মার্ট। হাইকোর্টে মক্কেলদের মামলার তদ্বির-তদারক থাকলে তিনিই সেরেস্তার তরফ থেকে কলকাতায় যান। কলকাতায় গিয়ে তিনি এদিক সেদিক যাতায়াত করেন, মক্কেলের পয়সায় এটা-সেটা চাখেন। এসব খবরও মক্কেলদের মারফতই বাবার কানে আসে। বাবা অবশ্য কিছু বলেন না। এই তো কয়েকমাস আগে চৌরঙ্গির একটা মদ খাওয়ার দোকান থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটা গোরা মাতাল নতুন মুহুরিবাবু অর্থাৎ রামকমলবাবুকে হঠাৎ পেছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। ফলে রামকমলবাবুর সামনের একটা দাঁত ভেঙে যায়। তা নিয়েও প্রকাশ্যে তাকে কেউ কিছু বলেনি, সব কথাই যদিও কানে এসেছে।

আজ কিন্তু রামকমলবাবুর আসবীয় অভিজ্ঞতার সাহায্য চাইলেন বাবা। মক্কেলদের ব্যাপারটা মিটে গেলে তারা চলে গেল, রামকমলবাবুও কাগজপত্র গুছিয়ে উঠছিলেন, বাবা ইজিচেয়ারের ওপাশে মেঝে থেকে তুলে বোতলটা রামকমলবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, রামকমল, দ্যাখো তো এটা কী জিনিস? কী রকম জিনিস?

রামকমলবাবু সন্তর্পণে বোতলটা একটু কাত করে এক ফোঁটা তর্জনীতে ছুঁইয়ে সেটা বাঁ হাতের কবজির উপরে খুব ঘষলেন এবং যেভাবে লোকে বাজারে ঘি কেনার সময় ঘিয়ের খাঁটিত্ব শুকে এঁকে যাচাই করে, তিনি ঠিক সেই রকম ভাবে ঘন ঘন শুকতে লাগলেন। তারপর বোতলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে খুব গম্ভীর হয়ে রামকমলবাবু বললেন, এ তো একেবারে খাঁটি। খুব দামি। বিলিতি মদ। পাকা আঙুর জমিয়ে তৈরি।

লোভাতুর দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ বোতলটার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর সেটা বাবার হাতে দিয়ে কেমন একটু দুঃখিতভাবে রামকমলবাবু কাছারিঘরে ফিরে গেলেন। তার জানা ছিল যে, মদ ব্যাপারটা আমাদের বাড়িতে চলে না। তিনি বোধহয় আশা করেছিলেন যে, এই দুর্লভ সাহেবভোগ্য পানীয় তারই প্রাপ্য হবে।

বাবা কিন্তু ইতিমধ্যে মনে মনে অন্য মতলব এঁটেছেন। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ দুই ভ্রাতা, আমাদের সোনাকাকা এবং ছোটকাকাকে ডেকে পাঠালেন। বিনা ভনিতায় তিনি বললেন, বিশ্বম্ভর এত ভাল জিনিসটা দিয়ে গেছে, সেটা নষ্ট করা উচিত হবে না।

ছোটকাকা কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির মধ্যে এসে জিনিসটার কথা জানতে পেরেছেন। তার তখন বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, সব বিষয়েই যথেষ্ট উৎসাহ, রীতিমতো আধুনিক। তিনি সোৎসাহে তাল দিলেন, সব জিনিসই টেস্ট করে দেখা উচিত, আর এক দিন খেলে তো নেশা হবে না!

সোনাকাকা বাবাকে বললেন, বিশ্বম্ভর বলেছে তোমার বউমাকে মাছভাজার সঙ্গে খেতে।

বাবা বললেন, আজ তো বাজার থেকে অনেক চাদা মাছ এনেছিলাম। তার কয়েকটা রান্নাঘর থেকে ভাজিয়ে আনতে হবে। বলবি ঝোলে খাব না, কেউ আপত্তি করলে আমাকে বলবি।

আপত্তি আর কে করবে? ঠাকুমা আপত্তি করবেন না, একমাত্র আমার মা আপত্তি করতে পারেন, সেই জন্যে বাবা এই কথা বললেন, তারপর ছোটকাকাকে নির্দেশ দিলেন, তুই নদীর ধারে পাটের গুদামের সাহেববাংলোয় গিয়ে বাবুর্চিকে একটা টাকা দিয়ে কিছু বরফ নিয়ে আয়। ওদের বরফের মেশিন আছে। আর ফেরার পথে লুকিয়ে সিনেমা হলের সামনে থেকে কয়েক বোতল সোডা নিয়ে আসবি। কেউ দেখতে পেলে বলবি, হজমের গোলমাল হয়েছে দাদার, ডাক্তার খেতে বলেছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বললেন, কোনও তাড়াতাড়ি করিস নে। বাবা সাড়ে সাতটা আটটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়বেন, তারপরে আমরা বসব।

সেদিন ঠাকুরদা সাড়ে সাতটার মধ্যে শুয়ে পড়েছিলেন। তার আগে ছোটকাকা বাজার থেকে ফিরে এসেছিলেন, বরফ সংগ্রহ করতে পারেননি। সাহেবদের কী পার্টি আছে, সব বরফ লাগবে, বাবুর্চি দিতে সাহস পায়নি। তবে চার বোতল সোডা এনেছেন।

রাত আটটা নাগাদ বাইরের বারান্দায় লণ্ঠনের ফিতে খুব কমিয়ে শীতলপাটিতে আসর বসল। সারা বাড়িতে একটা চাপা উত্তেজনা। সেই আমাদের পরিবারে প্রথম মদের আসর। বাবা নিজেই উদ্যোগ করে এনেছেন, তাই কেউ কিছু বলতে পারছে না।

আমরা ভেতরের একটা ঘরে বসে জানলা দিয়ে সব দেখছিলাম। একবার ঠাকুমা এসে উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন, তার সোনার টুকরো তিন ছেলে একত্রে মদ খেতে বসেছে। সবচেয়ে দুঃসাহস সোনাকাকিমার, এর মধ্যে আলগোছে এসে একথালা মাছভাজা দিয়ে গেলেন।

ছোটকাকা তিনটে গেলাসে অল্প অল্প করে জমাট রঙিন পানীয় ঢেলে তার সঙ্গে এক বোতল সোডা সমানভাবে মেশালেন। বাবা বোধহয় ক্রমশ একটু ভয় পাচ্ছিলেন, সম্ভবত ভাবছিলেন যে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, তিনি বললেন, দেখিস আমাকে যেন বেশি দিস না!

চল্লিশ বছর আগের গহন মফস্সলের রাত আটটা। বোধহয় ফাল্গুন মাস সেটা। কাঠচাপা ফুল আর সজনে ফুলের মেলানো-মেশানো গন্ধের মদিরতা বাতাসে। দূরে মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা দিয়ে দু-একটা লণ্ঠন দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে পুকুরের জলে আর জলের উপরে জোনাকির আলো আর জোনাকির ছায়া একাকার হয়ে গেছে। একটা লোক পুকুরের ওপারে চাতালের ওপরে দাঁড়িয়ে বোঁ বোঁ করে একটা বাঁশের লাঠি ঘোরাচ্ছে, তার মানে বাজার বন্ধ হয়েছে, রাধু পাগলা বাজার থেকে ফিরেছে। আবছা আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে না পড়া পর্যন্ত সে একা একা লাঠি ঘুরিয়ে যাবে, এটা তার দিনের শেষ কাজ।

একটু আগে শেয়াল ডাকছিল, এখন আর ঘণ্টাতিনেক ডাকবে না। এখন শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। দূরে ইটখোলার এদিকটায় একটা তক্ষক সারা সন্ধ্যা ডাকছিল, সেটাও আর ডাকছে না।

ঠিক এই মুহূর্তে মাত্র দেড় গেলাসের মাথায় ছোটকাকা মাতাল হয়ে গেলেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পুকুরের ওপারে রাধু পাগলার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, আজ রাধুকে আমি ঠান্ডা করব, ওর অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না।

বাবা এবং সোনাকাকা বাধা দিলেন, রাধু তো প্রত্যেকদিনই এ রকম করে। তোর কী? মাতলামি করিস না। চুপ করে বোস।

ঠাকুমা অল্প দূরে অন্ধকারে ঘরের মধ্যে বসে তার ছেলেদের অধঃপতনের দৃশ্য অভিনিবেশ সহকারে অবলোকন করছিলেন। মাতলামি শব্দটা শুনে কিংবা ছোটকাকার এই মারমূর্তি দেখে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ওরে বিশ্বম্ভর, তুই আমার এত বড় সর্বনাশ করে গেলি! ছাব্বিশ দিন বাথরুম ব্যবহার করার এই তোর প্রতিদান।

ঠাকুমার এই আর্ত চিৎকারে চারদিকে সোরগোল পড়ে গেল। লম্ফ, হ্যারিকেন হাতে আশেপাশের বাড়ি থেকে পাড়া-প্রতিবেশী ছুটে এল। এমনকী পুকুরের ওপার থেকে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে রাধু পাগলাও আজ তোর একদিন কি আমার একদিন বলতে বলতে দৌড়ে এল।

হই-হট্টগোলে ঠাকুরদা আচমকা কঁচা ঘুম ভেঙে ভাবলেন যে, বুনো শুয়োর কিংবা পাগল শেয়াল বাড়িতে ঢুকেছে। তিনি বার বার চেঁচাতে লাগলেন, ওটার মুখে টর্চ ফোকাস কর, তা হলেই পালিয়ে যাবে।

সেদিন সেই পারিবারিক কেলেঙ্কারির তুঙ্গ মুহূর্তে দুজন মাত্র ঠান্ডা মাথার পরিচয় দিয়েছিলেন। একজন আমার মা, তিনি কেউ কিছু দেখবার বা বুঝবার আগে নিষিদ্ধ বোতলটি বারান্দা থেকে সরিয়ে ফেলেছিলেন। আর দ্বিতীয় জন আমার সোনাকাকিমা, তিনি তেওয়ারি ঠাকুরকে চার আনা পয়সা বখশিশ দিয়ে রাঙামামাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

পাড়ার সবাই সন্দেহজনক মুখ করে কিছুক্ষণ পরে চলে গেল। মা আসল বোতলটা লুকিয়েছিলেন, কিন্তু সোডার বোতল আর গেলাসগুলো তখনও শীতলপাটির ওপরে ছিল। তা ছাড়া ঠাকুমা যে হঠাৎ বাতের ব্যথায় ওরকম ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন, সেকথা কেউ বিশ্বাস করেনি।

সমস্ত লোকজন চলে যাওয়ার পরে রাঙামামা এলেন। সব শুনে তিনি তো স্তম্ভিত। তিনি যত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যে, তাঁর মনে কোনও রকম কুমতলব ছিল না, ঠাকুমা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, বিশ্বম্ভর, শেষ পর্যন্ত এই তোমার মনে ছিল!

পরের দিন সকাল সাতটায় স্টিমার, বাড়ি থেকে রাঙামামাকে অন্তত পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় বেরোতে হবে ঘোড়ার গাড়িতে স্টিমারঘাটে পৌঁছনোর জন্যে। নতুন কাজে যাবেন, জিনিসপত্র কিছু গোছানো হয়নি তখনও। কিন্তু সেদিন রাঙামামা রাত বারোটার আগে আমাদের বাসা থেকে পরিত্রাণ পেলেন না।

টমাটো সস জিনিসটা কী? মদের সঙ্গে তার তফাত কী? এসব দুরূহ প্রশ্নের উত্তর, সেই সঙ্গে টমাটো সসের ব্যবহার কী, এটা যে সোডা দিয়ে খেতে নেই, এটা যে কাসুন্দির মতো ভাজা জাতীয় খাবারের সঙ্গে মাখিয়ে খেতে হয়–সব কথা রাঙামামা গুছিয়ে বললেন। তিনি একথাও বললেন যে, ওই ব্র্যান্ডির খালি বোতলটা টমাটো সস ভাগ করে দেওয়ার জন্যে আজ সকালেই সাহেবদের বাবুর্চির কাছ থেকে নগদ এক আনা দিয়ে কিনেছেন। তিনি নিজে ব্র্যান্ডি-ট্যান্ডি কিছুই খান না, বোতল পাবেন কোথায়! রাঙামামার কথা কে কী বুঝল, কে জানে? পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মা প্রথমেই বোতলটা উপুড় করে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল রান্নাঘরের সিঁড়ির পাশে ফেলে দিলেন। ওই সিঁড়ির পাশে আমরা প্রতিদিন ভাত খেয়ে মুখ ধুয়ে আঁচাতাম।

সেই রান্নাঘরের পাশে আঁচানোর জায়গায় কিছুদিন পরে একটা চনমনে পেঁপেগাছ একা একাই জন্মাল। সেই গাছে কী চমৎকার বড় বড় পেঁপে হল, সংখ্যায় রাশি রাশি। সেগুলো গাছেই পাকল, গাছেই পাখিরা ঠুকরিয়ে খেয়ে নিল, আমাদের ঠাকুমা কোনওদিন বাড়ির কাউকে ওই মদ্যপ গাছের একটি পেঁপেও খেতে দেননি। কিছুদিন পরে লোক দিয়ে কাটিয়ে ফেলে দিলেন গাছটা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments