Monday, April 29, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পস্বর্ণমুদ্রা-রহস্য - জাহীদ রেজা নূর

স্বর্ণমুদ্রা-রহস্য – জাহীদ রেজা নূর

স্বর্ণমুদ্রা-রহস্য - জাহীদ রেজা নূর

অঘটনটা যে এভাবে ঘটবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। গোলটেবিল ঘিরে বসেছে ছয় বন্ধু। ছোট্ট কাপড়ের থলি থেকে সজল যেইমাত্র স্বর্ণমুদ্রাগুলো টেবিলে বিছিয়ে দিয়েছে, ঠিক তক্ষুনি দারোয়ান রাজিব মিয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ‘সর্বনাশ হইয়া গেছে! লাইকাকে জোর কইরা নিয়া যাইতাছে!’

রাজিব মিয়া বলে কী! শুক্রবার বেলা এগারোটার ফকফকে আলোয় এই বাড়ির অতন্দ্রপ্রহরী লাইকাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ! তড়াক করে টেবিল থেকে উঠে পড়ল ওরা ছয়জন। এক দৌড়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়। তাকাল লাইকার ঘরের দিকে। শূন্য। তাকাল এদিক-ওদিক। না, লাইকা কোথাও নেই। সজল চিৎকার করে জানতে চাইল, কে কীভাবে লাইকাকে নিয়ে গেছে? রাজিব মিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাউমাউ করে যা বলল, তা থেকে ওরা পাঠোদ্ধার করল এই: দুজন লোক এসে জানতে চেয়েছিল, এই বাড়িতে বিদ্যুিমস্ত্রি ডাকা হয়েছে কি না। রাজিব মিয়া ফোন হাতে নিতেই একজন রাজিবের নাকে বসিয়ে দিয়েছে ঘুষি, অন্যজন লাইকাকে পাঁজাকোলা করে তুলে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে। ঘুষিমারা লোকটি একটা ছুরি বের করে বলেছে, পিছে পিছে এলে খুন করে ফেলব।

ওরা বের হতেই রাজিব মিয়া এক ছুটে চলে এসেছে সজলদের কাছে। রাজিব মিয়ার নাকের পাশে একটা আংটির দাগ গাঢ় হয়ে বসেছে। আহা, বেচারা!

নিপু, তপু, চঞ্চল, সমিত আর বাবুও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সজলের সঙ্গে। লাইকা এক দারুণ কুকুর। একেবারে মহাশূন্য ঘুরে আসা লাইকার মতোই দেখতে। তাই কেনার সময়ই ওর নাম রাখা হয়েছে লাইকা। ছুটির দিনে পাঁচ বন্ধু যখন সজলদের বাড়িতে বেড়াতে আসত, তখন সব সময় ওদের চারপাশে ঘুরঘুর করত লাইকা। অচেনা কেউ এলে ঘেউ ঘেউ করে পাড়া মাথায় তুলত। সেই লাইকাকে কেউ নিয়ে গেল!

এখনই বাড়ির বড়দের জানাতে হবে। তার আগে পুরো বাড়িটা একবার খুঁজে দেখা দরকার। সবাই শার্টের হাতা গুটিয়ে, প্যান্ট গুটিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল বাড়ি। মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো লাইকাকে রেখেই গেছে ওরা।

কিন্তু ১৫ মিনিট খুঁজেও লাইকাকে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে সজল একবার বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলে এসেছে লাইকার কথা। বাবা ফোন করে দিয়েছেন পুলিশে। যে করেই হোক, লাইকাকে উদ্ধার করতে হবে।

ক্লান্ত বন্ধুরা ফিরে এল ঘরে। বসল গোলটেবিলটার চারপাশে। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা স্বর্ণমুদ্রাগুলো এখন কারও নজরে পড়ছে না। সবাই যেন লাইকার অন্তর্ধানে মূক ও বধির হয়ে গেছে।

২.

বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় সজল বলেছিল, ‘তোদের জন্য একটা চমক আছে।’

‘কী রে?’ তপু জানতে চায়।

‘মিসরের পিরামিডে মমির কফিনে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা দেখাব তোদের!’

‘চাপাবাজি কম করিস। এখনই বলতে শুরু করবি, গতবার যখন মিসরে গিয়েছিলি, তখন পিরামিডের ভেতর থেকে একটা মমি বের হয়ে এসে বলেছিল, এই নে, তোকে আমি কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা দিলাম।’ সমিত বলল হাসতে হাসতে।

সজল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিছু না শুনেই যে যার মতো কথা বলছিস কেন? আগে শোন পুরোটা। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব পড়ান আমার ছোট চাচা। তিনিই প্যারিসের এক নিলাম থেকে বারোটা স্বর্ণমুদ্রা কিনেছেন। কে জানে, হয়তো তুতেন খামেনের মমির পাশেই এগুলো রাখা ছিল।’

‘তা তোর চাচা হঠাৎ বোস্টন থেকে ঢাকায় এসেছেন কি তোকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখাতে? তিনি কি জানেন না, ঢাকা শহরে যেকোনো সময় তা চুরি হয়ে যেতে পারে!’ বলল চঞ্চল।

‘ওগুলোর নামে বিমা করা আছে। তা ছাড়া আমাদের বাড়ি থেকে কে চুরি করবে?’

‘তা ঠিক। তোদের বাড়িতে ঢুকে চুরি করা সহজ কাজ না।’ বলল নিপু।

ঠিক হলো, সকালের দিকে সবাই যাবে সজলের বাড়িতে। একটু সাজুগুজু করেই যাবে। দুপুরে টেকআউটে খাওয়া হবে সজলের ছোট চাচার টাকায়। শুক্রবার দুপুর বা রাতে অনেকেই বেরিয়ে পড়ে রেস্তোরাঁয় খাবে বলে। ক্লাস এইটের একদল ছেলে যাচ্ছে খেতে, তাদের মনে একটু রং লাগতেই পারে। তাই পোশাকে-আশাকে ফিটফাট হয়ে এসেছে ওরা।

সবচেয়ে মজার পোশাক পরেছে নিপু। গ্রীষ্মের এই গরমেও ফুলহাতা শার্টের ওপর পরে এসেছে কটি। সাদা শার্টের ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের কটিতে নাকি অন্যের মনোযোগ পাওয়া যায়। এই ‘অন্য’টা কে, সে ব্যাপারটা অবশ্য নিপু পরিষ্কার করে বলেনি। তবে অন্য বন্ধুরা বুঝে নিয়েছে, এই ‘অন্য’টা ওরা কেউ নয়। সত্যিই ‘অন্য’ কেউ। বাবু পরেছে সবুজ শার্ট। ফুলহাতা শার্টের হাতায় সুন্দর সোনালি কাফলিঙ্ক। তবে ও কোট বা কটি—কোনোটাই পরেনি। তপু অন্য সময়ের মতোই পাঞ্জাবি পরেছে, তবে আজকের পাঞ্জাবিটার রং খয়েরি। খুব মানিয়েছে ওকে। এই পাঞ্জাবি ওকে উপহার দিয়েছেন ওর নীতু খালা। পছন্দ করে দিয়েছে নীতু খালার ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ে মিতুল। চঞ্চল বরাবরের মতো টি-শার্টে এসেছে। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে এই টি-শার্টটিও ফুলহাতা। চঞ্চল বেশ রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘সেদিন সীমান্ত স্কয়ারে এই টি-শার্ট দেখে একজন অনেকবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখা যাক না, আজও যদি সে রকম কিছু ঘটে!’ সমিতই কেবল গ্রীষ্মের গরম মাথায় রেখে পরেছে সাদা হাফহাতা টি-শার্ট আর খয়েরি প্যান্ট।

৩.

এভাবে মুখ বন্ধ করে বসে থাকা মুশকিল। কিন্তু কী নিয়ে কথা হবে, তা তো জানা থাকতে হবে। সজল মুখ কালো করে থলের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রাগুলো ভরতে থাকল। আর তখনই চোখে পড়ল, একটা স্বর্ণমুদ্রা নেই!

‘এই দেখেছিস, এগারোটা স্বর্ণমুদ্রা এখানে! আরেকটা গেল কই?’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল সজল।

‘বলিস কী! আবার গুনে দ্যাখ!’ তপু বিস্মিত কণ্ঠে বলল।

সজল সবগুলো স্বর্ণমুদ্রা বের করে আবার গুনল। এগারোটা!

ওরা সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

বাবু শার্লক হোমসের এরকুল পোয়ারো পড়া ছেলে। সে বলল, ‘এখানে একটা রহস্য আছে! কোনো ঘটনাই কাকতালীয় নয়। লাইকার চুরির সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রা চুরির একটা যোগসূত্র আছে।’

ধমকে উঠল সমিত, ‘এখানে গোয়েন্দাগিরি ফলাতে হবে না! সবখানেই তুই রহস্যের গন্ধ খুঁজে বেড়াস।’

সমিতের কথা বাবু গায়েই মাখল না। বলল, ‘এটা একটা পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। কেউ একজন স্বর্ণমুদ্রা চুরি করার জন্যই গল্পগুলো সাজিয়েছে। খেয়াল করে দ্যাখ, আমরা যখন স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখব বলে বের করলাম, ঠিক তখনই রাজিব মিয়া এসে লাইকার চুরি হওয়ার কথা জানাল। আমরা সাত-পাঁচ না ভেবেই স্বর্ণমুদ্রাগুলো টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেলাম। ঠিক এই ফাঁকে কেউ একজন একটা স্বর্ণমুদ্রা চুরি করে নিয়েছে।’

‘কীভাবে তা সম্ভব? আমরা সবাই তো একসঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলাম!’ চঞ্চল বলল।

‘সেটাই তো প্রশ্ন।’ বেশ গোয়েন্দার মতো বলল বাবু, ‘সে সময় কেউ একজন কাজটা করেছে। বাড়িতে আর কে কে আছে, তা জানতে হবে।’

‘বাবা ছিলেন দোতলায়। বাবুর্চি ছিল রান্নাঘরে। আর কেউ এখন বাড়িতে নেই।’ বলল সজল।

‘বাবুর্চি বিশ্বাসী?’

‘আমার জন্মের আগে থেকে এখানে কাজ করে।’

‘তার পরিবারের লোকজনও কি এখানে থাকে?’

‘না, তারা দেশের বাড়িতে থাকে। বছরে চারবার রহিমুদ্দীন চাচা দেশের বাড়িতে যান।’

‘এর মধ্যে তাঁর পরিবারে কোনো সমস্যা হয়েছে?’

‘সমস্যা মানে?’

‘এই ধর, কারও অসুখ-বিসুখ।’

‘হ্যাঁ, চাচার ছেলেটার কিডনির অসুখ হয়েছে। কয়েকবার ঢাকায় এনে চিকিৎসা করানো হয়েছে।’

‘সেরেছে?’

‘তা তো আমি জানি না। তবে চাচা চিন্তা করেন ছেলেকে নিয়ে।’

যেন বুঝতে পেরেছে, এমন একটা ভাব নিয়ে বাবু বলল, ‘একেকটা স্বর্ণমুদ্রার দাম কত হতে পারে?’

‘ছোট চাচা বলেছেন, পাঁচ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’

চকচক করে ওঠে বাবুর চোখ। ‘তাহলে খোঁজ নে, অসুখ সারাতে কত টাকা খরচ হবে। রহিমুদ্দীন চাচা হয়তো তক্কে তক্কে ছিলেন। তিনিই লাইকাকে চুরি করিয়েছেন। তারপর সুযোগ বুঝে একটা স্বর্ণমুদ্রা গাপ করেছেন।’

‘কী যা-তা বলছিস!’ রাগে রি রি করে ওঠে সজল। ‘রহিমুদ্দীন চাচার টাকার দরকার হলে সব সময় দেওয়া হয়েছে। তিনি খারাপ মানুষ নন। আজ তোদের এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো দেখাব, সে কথা তিনি জানবেনই বা কী করে?’

‘তারপরও তার ওপর নজর রাখতে হবে।’ বেশ গম্ভীর হয়ে বলল বাবু।

৪.

সজল স্বর্ণমুদ্রাগুলো আরেকবার বের করে গুনে দেখল। নাহ্! এগারোটাই। সত্যিই একটা স্বর্ণমুদ্রা চুরি হয়েছে।

নিপু স্বর্ণমুদ্রাগুলো হাতে নিল। সেই কয়েক হাজার বছর আগের স্বর্ণমুদ্রা! ফারাও রাজার মৃত্যুর পর বুঝি তার কফিনে এগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই লুকিয়ে থাকতে পারত এরা। কিন্তু মানুষের অভিযানের হাত থেকে এরাও রেহাই পায়নি। তাই আবার ফিরে এসেছে। নিলামে উঠেছে। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরে।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। একটু পরই টেকআউটে গিয়ে বার্গার খাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে যাওয়া হবে কি না, তা কেউ জানে না। এত সাজগোজ করে এল সবাই, কিন্তু এখন খাওয়ার খুব ইচ্ছে নেই।

হঠাৎ বাবু চিৎকার করে বলল, ‘পেয়েছি!’

‘কী পেলি?’ অবাক হয়ে বলল চঞ্চল।

‘লাইকা নাকি স্বর্ণমুদ্রা?’ জিজ্ঞেস করল সমিত।

‘চোর!’

‘কে চোর?’

‘ওই রাজিব মিয়া!’

‘মানে?’

‘মানে খুব সোজা। ওই রাজিব মিয়াই চুরি করেছে স্বর্ণমুদ্রা। ওর কোনো সাঙাতকে দিয়ে লাইকাকে চুরি করিয়েছে, তারপর নিজে এসে আমাদের সেই খবর দিয়েছে। আমরা সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পরও রাজিব মিয়া এ ঘর থেকে বের হয়নি। সজল ডাকার পরই কেবল বেরিয়েছিল। মনে পড়ছে তোদের?’

‘ঠিক। মনে পড়ছে।’ বলল সজল।

‘তাহলে চল, ওর কাছ থেকে কথা বের করি।’

দারোয়ানের ঘরে বসে ছিল রাজিব মিয়া। ওদের দেখে উঠে দাঁড়াল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘লাইকাকে পাইছেন?’

সজল বলল, ‘ঘরে বসে লাইকাকে পাব কী করে? লাইকাকে তো ধরে নিয়ে গেছে।’

ওদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল রাজিব মিয়া।

বাবু রাজিব মিয়ার খুব কাছে এসে ওর নাকের পাশের রক্ত জমে যাওয়া আঘাতটা দেখল। একটা আংটির ছাপ রয়ে গেছে সেই আঘাতে। যে লোক রাজিব মিয়ার নাকে ঘুষি মেরেছে, তার হাতে একটা আংটি ছিল। নিশ্চয়ই সেই লোকটা রাজিব মিয়ার বন্ধু। আটঘাট বেঁধেই নেমেছে পথে।

বাবু রাজিব মিয়াকে জিগ্যেস করল, ‘রাজিব মিয়া, তোমাকে যে লোকটা ঘুষি মেরেছিল, সে কেমন দেখতে?’

কিছুক্ষণ ভাবল রাজিব মিয়া। তারপর বলল, ‘আমার মতো।’

‘তোমার মতো মানে?’

‘মানে, আমার মতো। দেখতে আমারই মতো।’

‘তোমার যমজ ভাই আছে নাকি?’

‘না।’

বাবু চুপ করল। নিপু এগিয়ে এল এবার। রাজিব মিয়ার হাত দুটি ধরল। তারপর ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘এই আঙুলে তো একটা আংটি ছিল!’

সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাজিব মিয়ার আঙুলের ওপর। সত্যিই, তর্জনীতে আংটির গাঢ় দাগ। এই আঙুলে যে বছরের পর বছর একটা আংটি ছিল এবং তা আজ-কালের মধ্যেই খোলা হয়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না কারও।

‘রাজিব মিয়া, আংটি কই?’ সজল প্রশ্ন করল।

‘আ আ আংটি খুইল্যা রাখছি।’ বিড়বিড় করে বলল রাজিব মিয়া।

‘কেন খুলে রেখেছ?’ চোর বাগে পেয়েছে বাবু। তাই এবার সে-ই প্রশ্ন করা শুরু করল।

‘টাইট হইয়া গেছিল।’

‘মিথ্যে কথা!’ হুংকার দিয়ে উঠল বাবু। ‘তুমি আসলে নিজের মুখে নিজেই ঘুষি মেরেছিলে। তুমি বুঝে উঠতে পারোনি যে আংটির ছাপ নাকের পাশে লেগে থাকবে। ওই ছাপ আর তোমার হাতে আংটি দেখেই সবাই বুঝে যেত যে তুমিই তোমার নাকে ঘুষি মেরেছ।’ বাবু বলল।

ইতস্তত করে রাজিব মিয়া বলল, ‘হ, আমার নাকে আমিই ঘুষি মারছি।’

‘এবার বলে ফেলো তো, লাইকাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ। স্বর্ণমুদ্রাটা কোথায় রেখেছ?’ বাবু বলল।

‘লাইকা কই আছে, আমি জানি না। স্বর্ণমুদ্রা আমি পামু কই?’ বিস্মিত রাজিব মিয়ার উত্তর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবু বলে, ‘তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই। পুলিশ ডাকা হয়েছে, তারাই তদন্ত করে দেখবে!’

পুলিশের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রাজিব মিয়া, ‘আমারে বাঁচান। আমার চাকরিটা খাইয়েন না। বাড়িতে মা আর বোন আছে। চাকরি চইল্যা গেলে ওরা না খাইয়া মরব।’

বাবু বলল, ‘চুরি করার আগে এসব ভাবনা কোথায় ছিল?’

‘আমি চুরি করি নাই!’

‘তাহলে নিজের নাকে এই ঘুষির মানে কী? লাইকা নেই কেন? কোথায় গেল স্বর্ণমুদ্রা?’

‘আমার তো ডিউটি দেওয়াই কাম। কাইল রাইতে অনেকক্ষণ জাইগ্যা ছিলাম। তাই সকালে ঘুম পাইছে। হঠাৎ ঘুম ভাইঙ্গা গেছে। দেহি, লাইকা নাই! আমি খুব ভয় পাইয়া গেছি। আমার তো ঘুমানোর কথা আছিল না। এইবার তো আমার চাকরি চইলা যাইব। তাই নিজেই নিজেরে ঘুষি মাইরা এই গল্পটা বানাইছিলাম!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল রাজিব মিয়া।

‘তাহলে লাইকাকে কেউ চুরি করেনি?’

‘হেইডা আমি জানি না। আমি তো ঘুম থাইকা উইঠা আর লাইকারে দেহি নাই।’

‘একদম বাজে কথা!’ আবার হুংকার দিয়ে উঠল বাবু, ‘তুমি লাইকাকে চুরি করিয়েছ, স্বর্ণমুদ্রা চুরি করেছ। কোথায় রেখেছ, সেটা বলো!’

রাজিব মিয়া নতুন করে কান্না শুরু করার আগেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দূর থেকে দেখা গেল, ছোট চাচা আসছেন। তাঁর সামনে বেশ হাসিখুশি লাইকাও দৌড়ে দৌড়ে আসছে!

বাবু হতভম্ব হয়ে গেল। রাজিব মিয়ার চোখে আলোর ঝিলিক, ‘লাইকা আইয়া পড়ছে! লাইকা আইয়া পড়ছে!’

৫.

সমিত মুচকি হেসে বলল, ‘কি রে বাবু! রহস্যের সমাধান হয়েছে?’

বাবু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ছোট চাচা না হয় লাইকাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্বর্ণমুদ্রা?’

এই রহস্যের সমাধান করতে পারল না কেউ। রাজিব মিয়া তো জানতই না স্বর্ণমুদ্রার কথা। ও ঘুমিয়ে পড়ার ভয়েই তো আধমরা হয়ে ছিল। ওর পক্ষে স্বর্ণমুদ্রা চুরি করা সম্ভব নয়। বাবুর্চি ছিলেন রান্নাঘরে। রাজিবের চিৎকারে তিনি টেবিলের কাছে আসতেও পারেন। কিন্তু তিনি তো এই বাড়ি থেকে সব ধরনের সাহায্য পান, শুধু শুধু চুরি করতে যাবেন কেন?’

‘সেটাই তো বলছি!’ হাসল সমিত। ‘চোর তাহলে বাইরের কেউ নয়। আমাদের ছয়জনের মধ্যে কেউ একজন চুরি করেছে।’

‘কে?’ চঞ্চল মুখে চঞ্চল প্রশ্ন করল।

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’ সমিত বলল, ‘আয়, আমরা নিজেরাই নিজেদের পকেটগুলো খুঁজে দেখি। অসাবধানে কারও পকেটে একটা স্বর্ণমুদ্রা ঢুকে গেল কি না।’

সবাই প্যান্ট-শার্ট-টি-শার্টের পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজল, কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার দেখা মিলল না।

এ অবস্থায় বার্গার খেতে যাওয়া যায় কি না, সেটা ভেবে বের করতে পারল না কেউ। আসলে পেটে ইঁদুর দৌড়ালেও কেউ তা প্রকাশ করতে পারছে না—পরিস্থিতিটাই এ রকম।

হঠাৎ বাবু চিৎকার করে ওঠে, ‘ইউরেকা! ইউরেকা! স্বর্ণমুদ্রার খোঁজ মিলেছে!’

‘কোথায়?’ সমস্বরে চিৎকারের প্রতিধ্বনি করে উঠল বাকি পাঁচজন।

‘এমন এক জায়গায় স্বর্ণমুদ্রা আছে, যা কেউ কল্পনাই করতে পারবে না।’

‘বল শিগগির কোথায় আছে!’ কারও যেন তর সইছে না।

‘সেটা বলার আগে আমি একটা কথা বলে নিই। বাইরে খেতে যাব বলে এই গরমের মধ্যেও আমি সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছি। এটা নিশ্চয়ই তোদের নজর এড়ায়নি।’

‘হ্যাঁ, আমরা তা খেয়াল করেছি।’ বলল সজল।

‘শার্টের হাতায় কাফলিঙ্ক লাগাব বলেই এই শার্ট পরেছি। কাফলিঙ্কে নাকি আমাকে মানায়।’ বাবু বলল।

‘হ্যাঁ, তোকে আসলেই খুব বাবু বাবু লাগছে।’

‘কাফলিঙ্কটা আসলে আমার মামার।’ বাবু অপরাধীর মতো বলল।

নিপুর তর সইছিল না। বলল, ‘তোর কাফলিঙ্ক তোর মামার না চাচার, তার সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রার সম্পর্ক কী?’

‘আছে, সম্পর্ক আছে।’ বলে হাসল বাবু, ‘মামার এই কাফলিঙ্ক পরে এসেছি আমি। রাজিব মিয়া যখন লাইকা হারিয়ে গেছে বলে চিৎকার করেছে, তখন সজল স্বর্ণমুদ্রাগুলো কেবল থলে থেকে বের করেছিল। সম্ভবত তখন একটা স্বর্ণমুদ্রা গড়িয়ে আমার হাতের কাছে এসেছিল। তারপর সেই কাফলিঙ্কের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। সেটা হয়তো পড়েই যেত, কিন্তু আমরা যখন লাইকাকে খুঁজতে লাগলাম, তখন সবাই শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়েছিলাম। তাই কাফলিঙ্কের সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল স্বর্ণমুদ্রাটা।’

তারপর বাবু হাত উল্টে কাফলিঙ্কটা দেখাল ওদের। কাফলিঙ্ক আর বোতামের ঘরের মধ্যে এমনভাবে স্বর্ণমুদ্রাটা আটকে রয়েছে যে বোঝার কোনো উপায় নেই সেখানে ওটা আছে কি নেই। রং তো একই—সোনালি!

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ওদের। আর তক্ষুনি ওরা বুঝতে পারল বার্গার খাওয়ার জন্য এখনই উঠতে হবে। আর হ্যাঁ, যে জন্য সাজুগুজু করে আসা, সেই মহৎ উদ্দেশ্যও পূরণ হবে বলে আশা করছে ওরা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments