Wednesday, May 1, 2024
Homeলেখক-রচনারচনা সমগ্রসোনার হরিণ নেই – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

সোনার হরিণ নেই – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

Table of contents

সোনার হরিণ নেই – ১

বেশ মজার স্বপ্ন দেখছিল বাপী তরফদার। শহরটা যেন পাঁচ মাসের দেখা কলকাতার শহর নয়। জঙ্গলটাও বানারজুলির চেনা জঙ্গল নয়। কলকাতার মতোই আর একটা শহর। বানারজুলির মতোই আর একটা জঙ্গল। সেই শহর আর জঙ্গল পাশাপাশি নয়। একটার মধ্যে আর একটা। জঙ্গলের মধ্যে শহর, আবার শহরের মধ্যেই জঙ্গল। হাতি বাঘ ভালুক হায়না চিতা হরিণ মানুষ মেয়েমানুষ সব যে-যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। কারো প্রতি কারো ভূক্ষেপ নেই।

ঘোরের মধ্যেই ঘুমটা ভেঙেছে। বাপী তরফদার হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারছিল না কোথায় শুয়ে সে। উদ্ভট স্বপ্নের রেশ মগজে লেগে আছে। সামান্য নড়াচড়ার ফলে দড়ির খাটিয়া ক্যাচ-ক্যাঁচ করে উঠতে সজাগ হল। সবে সকাল। মাথাটা ভার-ভার।

দেড় মাস হল খুপরি ঘরের এই দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে রাত কাটছে। তার আগে যেখানে ছিল সেটা ভদ্রলোকের আশ্রয়। সেখানে সুখ ছিল। ভোগ ছিল। মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখের তারায় আগুন ছিল। সে আগুনে ব্যভিচারের প্রশ্রয় ছিল। রমণীর অকরুণ ইশারায় মণিদার পুরুষকার বাপী তরফদারের পিঠে চাবুক হয়ে নেমে আসে নি। ভালো মানুষ মণিদা সাদামাটা দু’চার কথায় তাকে বিদায় দিয়েছিল।

তারপর থেকে এই দেড় মাস এখানে।

ভদ্রলোকের সেই সুখের ঘরের আশ্রয় থেকে ঢের ভালো। তবু সকালে ঘুম ভাঙলে মাথাটা রোজই ওই রকম ভার-ভার লাগে। সেটা দড়ির খাটিয়ার দোষ নয়। নিজের দোষ। মাথার দোষ। অমন পাগলের স্বপ্ন ক’টা লোক দেখে? স্বপ্ন দেখুক বা না দেখুক, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে খাপছাড়া ভাবনাগুলো আর ইচ্ছেগুলো মাথার মধ্যে ঠিকি দিয়ে জমতে থাকে, সেগুলো তরল হবার মতো গাঢ় ঘুমের প্রলেপই বা কতটুকু পড়ে? নইলে এই রকম দড়ির খাটিয়ায় চেপেই তাদের মতো লোকেরা নিমতলা-কেওড়াতলায় চলে যায়। আবার ওতেই শুয়ে ঘুমোয়ও দিব্যি।

টালি-ছাওয়া পঁচিশ ঘর বাসিন্দার মধ্যে ক’টা ঘরেই বা খাট-চৌকি আছে। ভালো ঘুম না হওয়াটা নিজের স্বভাবের দোষ বাপী তরফদারের। তার বুকের তলায় অসহিষ্ণু বাষ্প ছড়ানোর একটা মেসিন বসানো আছে। মুখ দেখলে কিছু বোঝা যায় না, সেটা তার নিজের কৃতিত্ব। কিন্তু ওই মেসিনটার ওপর তার কোনো হাত নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওটা কাজ করে চলেছে। বাষ্পগুলো ঠেলেঠেলে মাথায় নিয়ে গিয়ে ঠাসছে। ওই নিয়ে ঘুম, ওই নিয়ে জাগা।

গোল চাপ-বাঁধা এই পঁচিশটা টালিঘরের শতেক বাসিন্দাদের একজন ভাবতে চেষ্টা করে নিজেকে। কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় কেউই তা ভাবে না। এমন কি, যার আশ্রয়ে ওই আধখানা ঘরে সে আছে, সেই রতন বনিকও ভাবে না। তার বউটার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। কিন্তু বাকি সকলে তাকে ভদ্রলোক ভাবে। ভদ্রলোকের ছেলে ভাবে। ভদ্রলোকের মস্ত পাশ-টাশ করা ছেলে ভাবে। তাদের চোখে এখানে সে রতন বনিকের সমাদরের অতিথি। নেহাৎ বিপাকে পড়ে দিন কতকের জন্য এসে ঠাঁই নিয়েছে। দিন ফিরলেই চলে যাবে। নইলে বিপুলবাবুও ওদের মতো ওই আধখানা টালি-ঘরে পাকা বসবাসের ভাঙা কপাল নিয়ে এসেছে নাকি! রতন বনিক কপাল চেনে। বিপুলবাবুর কপাল এরই মধ্যে সকলকে সে ঢাক পিটিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে।

…বিপুল তারই নাম। শুধু বিপুল নয় বিপুলনারায়ণ তরফদার। গরিব বাবা-মা কোন্ বিপুল আশার খুঁটি ধরে এরকম একটা নাম রেখেছিল জানে না। গোটা নামটা মনে হলে নিজেরই হাসি পায়। তবে এই পোশাকি নাম ভালো পোশাকের মতো তোলাই থাকে বেশির ভাগ সময়। বাবা মা আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছেই সে বাপী। বাপী তরফদার। জ্ঞান বয়সের আগে থেকে ওই নাম শুনে তার কান পেকেছে। কিন্তু খিদিরপুর ব্রুকলিন গোডাউনের বাবুদের পিয়ারের পিওন ‘আট-কেলাস’ পড়া রতন বনিকের সঙ্গে কার্য-কারণ সুবাদে এখানে তার ওই পোশাকি নামটাই চালু।

অন্য সব দিনের সঙ্গে এই দিনটার সকাল দুপুর বা বিকেলের রঙে তফাৎ ছিল না একটুও। টালি এলাকার সক্কলের আগে রোজ যেমন ঘুম ভাঙে আজও তাই ভেঙেছিল। তফাৎ শুধু উদ্ভট স্বপ্নটা। তার রেশ ছিঁড়তে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একবার চোখ তাকিয়ে খুপরি জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলোর আভাস দেখেছিল। নড়বড়ে জানলা দুটো বন্ধ করলেও খানিকটা ফাঁক থেকেই যায়। সেই ফাঁক দিয়ে আলো ঢোকে। মাথার ওপরের টালির ছাদের ফাঁক দিয়েও আলোর রেখা হামলা করে। আলোর এরকম বেয়াড়া স্বভাব বরদাস্ত করতে ইচ্ছে করে না বাপী তরফদারের। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শতেক ফুটোর কম্বলটা মাথার ওপর টেনে দিয়ে অন্য দিনের মতোই সে আবার অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেছল।

উনিশ-শ আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারির একেবারে গোড়ার দিক এটা। চার কি পাঁচ তারিখ হবে। সকালের শীতের কামড়ের হাত থেকে বাঁচার তাগিদেও আপাদ—মস্তক কম্বলে ঢাকা দিতে হয়। কিন্তু শেষ রাতে হোক বা প্রথম সকালে হোক, চোখ একবার দু’ ফাক হলে ঘুমের দফা শেষ। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলেও সবার আগে কলতলার কলরব কানে কটকট করে লাগবে। এই শীতের সকালেও জল নিয়ে কাড়াকাড়ি। কম্বলের তলায় ঢুকে বাপী তরফদারের ইচ্ছে করে ওদের সক্কলের মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে দিয়ে আসতে।

সকালের আলো গরম হতে না হতে একটু আগে পরে গাঁ-গাঁ করে রেডিও বেজে উঠবে দু’ ঘর থেকে। পঁচিশ ঘর বাসিন্দার মধ্যে মাত্র দু’ ঘরেই এই সম্পদ আছে। তারা সক্কলকে জানান দিয়ে বাজায়। প্রথমেই শোকের প্রসঙ্গ শুরু হবে। সমস্ত দেশ জুড়ে শোকের কাল, শোক-পক্ষ চলেছে এখন। আজ ফেব্রুয়ারির চার তারিখ কি পাঁচ তারিখ বাপী তরফদার ঠিক করে উঠতে পারছিল না। যাই হোক, পাঁচ-ছ’দিন আগে নীল আকাশ থেকে আচমকা একটা বাজ পড়ার মতো সেই শোকসংবাদ সমস্ত পৃথিবীর বুকের ওপর ফেটে পড়েছিল। গান্ধীজী দিল্লীর প্রার্থনা সভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘হা-রাম’ বলে চিরকালের মতো মাটিতে লুটিয়েছেন।

খবরটা শুনে পৃথিবীর শত-সহস্র-কোটি মানুষের মতো বাপী তরফদারও প্রথমে সচকিত আর পরে স্তব্ধ হয়েছিল। কলকাতায় এসেছে মাত্র পাঁচ মাস আগে। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার এক মাসের মধ্যে। দূরে বসে দাসত্বের শেকল ভাঙার ঝনঝনানি কানে যত মিষ্টি লেগেছিল, এই পাঁচ মাস যাবৎ আবেগশূন্য বাস্তব-ভূমির ওপর বিচরণের ফলে তার রেশ প্রায় মিলিয়েই গেছে। তার চোখে মহাত্মার হত্যা সেই আবেগ-শূন্যতার শেষ নজির। এই নজির দেখে সেদিন সে স্তব্ধ বোবা হয়ে বসেছিল। সকলেরই তাই হবার কথা। কিন্তু তারপর থেকে দেখছে শোকের আনুষ্ঠানিক দিকটাও কম ব্যাপার নয়। যত বড় শোক, ততো বড় অনুষ্ঠান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রেডিওয় শোকের গান আর শোকের বক্তৃতা, পথে ঘাটে শোকের মিছিল আর শোকের মিটিং। বাপী তরফদারের এক-একসময় মনে হয়েছে দেশটা সত্যি শোকে ডুবে গেল নাকি শোকের উচ্ছ্বাসে। বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে নিজে তো কখনো সরবে শোক করেনি।

…যে মহারানীর ঘুম ভাঙলে বাপী তরফদারের শরীর খানিক চাঙা হতে পারে আর মাথার ভার একটু কমতে পারে, তাঁর সকাল হতে কম করে এখনো ঘণ্টা দুই দেরি। রতন বনিকের বউ কমলা বনিক। আজ দেড়মাস হয়ে গেল ওরাই তার আশ্রয়দাতা এবং আশ্রয়দাত্রী। রতন বনিকের কড়া হাতের ধাক্কা না খেলে রেডিও বাজুক বা কলতলা সরগরম হোক বেলা আটটার আগে সেই দেমাকীর ঘুম ভাঙতে চায় না। ঠেলা মেরে ঘুম ভাঙানোর পরে রতনকে আবার মিষ্টি সোহাগের সুরে দু’চার কথা বলতে হয়। তা না হলে সাত-সকালে বউয়ের বচনের তোড়ে অনেক সময় তাকে ছিটকে এই খুপরি ঘরে চলে আসতে হয়। সপ্তাহে একদিন করে নাইট ডিউটি পড়ে রতন বনিকের। ফেরে পরদিন সকাল দশটায়। সেদিন বেলা আটটা সাড়ে-আটটার আগে কেউ আর বাপী তরফদারের এই খুপরি ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে না।

গত রাতে রতনের নাইট ডিউটি ছিল না অবশ্য। তাই সোয়া সাতটা থেকে সাড়ে-সাতটার মধ্যে চায়ের আশা আছে। খুপরি ঘরের দরজা আছে কিন্তু হুড়কো নেই। অন্য দিনের মতোই কমলা দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিল। কম্বলের তলা থেকে বাপী তরফদার সেটা টের পেয়েছে। কারণ, ভেজানো দরজা দুটো শব্দ করেই খোলা হয় আর এই কমলার চলনও লঘু নয়। ঘরে ঢুকে রোজ সে আপাদমস্তক কম্বলে মোড়া একই দৃশ্য দেখে, আর বাপী তরফদারও একই সম্ভাষণ শোনে।

—কই গো, বড়বাবুর ঘুম ভেঙেছে—নাকি ফিরে যাব?

এক ডাকে সাড়া না দিলে সত্যি ফিরে যাবে। দ্বিতীয়বার আর ডাকবে না। সাড়া না পেয়ে এরকম ফিরে গেছে দুই-একদিন। কমলার নিজের ঘুমের ওপর মমতা আছে বলেই বেশি হাঁকডাক করে কারো পাকা ঘুম ভাঙাতে চায় না। ডাক শোনা মাত্র বাপীকে কম্বল ফেলে তড়াক করে দড়ির খাটিয়ার শয্যায় উঠে বসতে হয়।

সকালের এই একটা সময় রতন বনিকের বউটাকে ভালোই লাগে। ঘুমের দাগ লাগা ফোলা-ফোলা মুখ। কালো চোখের তারায় ঘুম-ছোঁয়া ঢুলু ঢুলু ভাব একটু। তার এক হাতে শাড়ির আঁচলে জড়ানো গরম চায়ের গেলাস, অন্য হাতে শস্তা দামের খানচারেক বিস্কুট, নয়তো হাতে-গড়া দু’খানা রুটি আর গুড়। বিস্কুট বা রুটি পছন্দ নয়, ওই চায়ের গেলাসটাই লোভনীয়। কিন্তু কমলার শাসনে পড়ে বিস্কুট বা রুটি-গুড়ও নিতে হয়। না নিলে কমলা ধমকে উঠবে, খালি পেটে চা গিললে কারো ‘নিভার’ আস্ত থাকে!

‘আট-কেলাস’ পড়া রতন বনিকের ‘ছ-কেলাস’ পড়া বউয়ের ভুলটা বাপী তরফদার একদিন শোধরাতে চেষ্টা করেছিল। কথাটা নিভার নয়, লিভার।

পলকা ঝাঁঝের মুখঝামটা দিয়ে উঠেছিল কমলা বনিক।—থাক, নিজের বিদ্যে নিজের মাথায় ঠেসে রাখো, আমাকে আর বিদ্যে দান করতে হবে না!

এরপর আর ভুল সংশোধনের চেষ্টা করেনি। কিন্তু রোজ সকালে ওই শামলা মুখের ধমক একটু খেতেই হয়। কারণ, কম্বল ফেলে ধড়মড় করে উঠে বসেই চায়ের গেলাসের জন্য হাত বাড়ায় সে। ফল কি হবে জেনেও। শাড়ির আঁচল তেমনি গেলাসে ধরে রেখেই কমলা চোখ পাকাবে। —মুখ ধোয়া হয়েছে?

এটুকু ভালো লাগে বলেই বাপী তরফদার মিথ্যে বলে না। বিব্রত মুখে মাথা নেড়ে জানান দেয়, ধোয়া হয়নি।

ঘেন্নাও করে না বাসি মুখে কিছু গিলতে—যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো!

এই নিয়মিত অধ্যায় চটপট সারা হলে তবে চায়ের গেলাস আর বিস্কুট বা রুটি তার হাতে আসে।

আজও এর খুব ব্যতিক্রম হল না। তবে একটু হল চায়ের গেলাস আর বিস্কুট হাতে নিয়ে বসার পর। গজেন্দ্রগমনে কমলা বনিক দরজার কাছাকাছি এগিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। এটুকু অপ্রত্যাশিত। চা দিয়ে চলে যাবার সময় বিপুল তরফদারের দু’চোখ নিজের অগোচরে দরজা পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করেই। আজ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে চাউনিটা তার মুখের ওপর হোঁচট খেল। আর এটুকুও কমলার চোখে ধরা পড়ল। হাসির ঝিলিক ঢাকা দেবার জন্যেই সে ছোট করে হাই তুলল একটা। —বুড়ো বলছিল বিপুলবাবু দুই-একদিনের মধ্যেই চলে যাবে।… ঠিক? আ হা, ষাট ষাট, জিভে গরম চায়ের ছেঁকা লাগল বুঝি?

চায়ের গেলাস কোলের কাছে নামিয়ে বাপী তরফদার গম্ভীর মুখে জবাব দিল, দেড় মাস হয়ে গেল আর কত অসুবিধে করব তোমাদের…

কমলাও গম্ভীর মুখেই সায় দিল, আমাদেরই বা সকালে এক গেলাস চা আর দু’খানা বিস্কুট দিয়ে কতকাল কেষ্ট ঠাকুরকে ধরে রাখার ক্ষ্যামোতা বলো। …তা এবার কোন্ মহলে ঘর ঠিক হল?

—কোথাও না। দেশেই চলে যাব ভাবছি। এখানে আর কিছু হবে-টবে না— কমলার কালো চোখের তারায় চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল একটু। বলল, কোথায় যে তোমার হবে ভগবানই জানে। বুড়ো অবিশ্যি বলে, হবে যখন দেখে নিস, বিপুলবাবুর ভাগ্যিখানা কালবোশেখীর ঝড়ের মতোই সবদিক তোলপাড় করে নেমে আসবে একদিন—তা দেখো, যেখানে গেলে হবে সেখানেই যাবে, তার আর কথা কি।

হেলেদুলে চলে গেল।

…আর এই সকালেই ইদানীংকালের সেই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধটা তার মধ্যে ছড়িয়ে রেখে গেল। বাপী তরফদারের ওই কমলার ওপরেই রাগ হতে থাকল। ভদ্রলোকের সংস্রব এড়িয়ে রাতের এই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু তার নিশ্চিত আশ্রয় হয়ে উঠতে পারত। রতনের সঙ্গে কথা বলে সামান্য কিছু ভাড়াও ঠিক করে নেওয়া যেত। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার কথা ইদানীং রতনকে বলতে হচ্ছে নিজের ভিতরের অস্বস্তি দিনে দিনে বাড়ছে বলে। যাবার কথা রতনকে কাল রাতেও বলেছে।

অস্বস্তি শুরু হয়েছিল এখানে আসার দিনকতকের মধ্যেই. বয়স্ক রতন বনিকের ওই তরতাজা বউটা ঠারেঠোরে তাকাতে জানে। চোখের কোণে আর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ঝিলিক ফোটাতে জানে। প্রথম কটা দিনই শুধু ধারেকাছে ঘেঁষেনি, আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছে। সমস্ত দিন ঘোরাঘুরি করে বাপী তরফদার তখন বিকেলের দিকে ঘরে ফিরত। ঘণ্টা দুই-তিন দড়ির খাটিয়ায় চিৎপাত শুয়ে থেকে আবার বেরুতো। বাইরে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ফিরত।

একদিন সন্ধ্যার ঠিক পরে ব্যস্তসমস্ত মুখে ঘরে ঢুকে রতন বনিক বলেছিল, আজ নাকি সমস্ত দিন খাওয়াই হয়নি আপনার?

বাপী তরফদার সচকিত।—কে বলল?

—বউ বলছিল, আজ সমস্ত দিন উপোস গেছে কেষ্ট ঠাকুরের—

বলে ফেলেই লজ্জা পেয়ে জিভ কামড়েছে সে। তারপর সে বলেছে, কিছু মনে করবেন না বাবু, বউটার লঘু-গুরু জ্ঞান নেই—ওই রকমই কথা। বলে, কেষ্ট ঠাকুরপানা মুখখানা—। আজ ঘরে ফিরতেই বলল, কেষ্ট ঠাকুর সমস্ত দিন উপোস দিয়েছে। এরই মধ্যে ভাত তরকারি রেঁধে ফেলেছে, সকালের একটু মাছও আছে—আপনাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঠেলে পাঠালো আমাকে। চলুন —

বাপী তরফদার বাধা দিয়েছিল, না না, তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না, আমি একটু বাদেই বাইরে থেকে খেয়ে আসছি—

মাথা নেড়ে রতন বনিক বলেছিল, আজ আর সেটি হচ্ছে না বিপুলবাবু, রাঁধা ভাত-তরকারি সব তাহলে ড্রেনে ঢেলে দেবে, আমাকেও খেতে দেবে না। চলুন শিগগীর—

অগত্যা উঠে আসতে হয়েছে। সকালের চা-রুটির পর সেদিন সত্যিই চার পয়সার মুড়ি আর চার পয়সার চিনেবাদাম ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। সেটা যে নিছক অভাবের দরুন তা নয়। তিন মাসের চাকরির কিছু পুঁজি হাতে আছে এখনো। অবশ্য হিসেবের বাইরে একটিও বাড়তি পয়সা খরচ করে না সে। কিন্তু একেবারে না খাওয়াটা পয়সা বাঁচানোর তাগিদে নয়। মেজাজ না থাকলে এক—আধ বেলা ওরকম উপোস দিতে অভ্যস্ত।

খেতে খেতে একটু সহজ হবার জন্যেই রতন বনিকের বউয়ের দিকে একবার মুখ তুলে তাকিয়েছিল। আর তার পরেই কি-রকম ধাক্কা খেয়েছিল একটু। এ—কদিনে দুই-একবার আভাসে দেখলেও মুখখানা চোখে পড়েনি। আধবয়সী রতন বনিকের ঘরে এরকম বউ থাকা সম্ভব সে ভাবেনি। গায়ের রং তারই মতো কালো ঘেঁষা, কিন্তু অল্প বয়েস, সুঠাম স্বাস্থ্য। কালো চোখে সরমের বালাই নেই। উল্টে সে নিজেই রমণীটির চোখে একটি দর্শনীয় বস্তু।

চোখাচোখি হতে বাপী তরফদার হেসেই বলেছিল, সমস্ত দিন সত্যিই আজ ভালো করে খাওয়ার ফুরসত হয়নি, কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে?

তক্ষুণি জবাব এলো, মাটির কেষ্ট হলে বোঝা যেতনি, ওই বুড়োর চোখ থাকলে সে-ও বুঝত

বউয়ের কথা শুনে রতন বনিক হেসে উঠেছিল, তোর মতো চোখ আর কার আছে বল্। পরে বলেছিল, তোর স্বভাব জানি, বিপুলবাবুর সামনে কক্ষনো ঠাট্টা-—ঠিসারা করে বসিসনি যেন—আমাদের কত ভাগ্যির জোরে উনি এখানে এয়েছেন—একদিন ওঁর দিন কেমন ফেরে দেখে নিস—

নিরীহ বিস্ময়ে কমলা বলেছিল, দিন ফিরলে আমি দেখে নেব কি করে গো!

তুষ্ট মুখে হার মেনে রতন বলেছিল, সবেতে কেবল ফষ্টিনষ্টি কথা তোর—দিন ফিরলেই বিপুলবাবু কি আমাদের ভুলে যাবেন!

সেই দিন থেকে ভিতরে ভিতরে কেমন অস্বস্তি বোধ করেছিল বিপুল তরফদার। দীর্ঘকাল জঙ্গলে বাসের ফলে বুনো জন্তু-জানোয়ার ছেড়ে মানুষেরও প্রবৃত্তির দিকটা অনেকখানি চেনা তার। সেই সঙ্গে নিজের খোলস-ঢাকা চরিত্রও ভালোই জানা। মনের তলায় সেই রাতেই একটা বিপদের আভাস উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে।

পরদিন থেকেই সকালে চা-বিস্কুট বা চা-রুটি-গুড় নিয়ে রতন বনিকের বদলে কমলা নিজেই দরজা ঠেলে অনায়াসে ঘরে ঢুকেছে। আর তখন অতিথির অস্বস্তি—টুকুও তার কাছে উপভোগ্য কৌতুকের মতো। তারপরে আবারও এক-আধদিন দুপুরের খাওয়া বাদ পড়লে এই বউটার চোখে ধরা পড়বেই। আর তখন জুলুম করে ধরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসাবে তাকে। ঠিসারার সুরে রতনকে বলবে অসময়ে তোমার ভাগ্যিমন্ত অতিথির একটু সেবা-যত্ন করে রাখলে আখেরে কাজ দেবে—কি বলো?

রতন বনিকেরও তুষ্ট মুখ—এখন ঠাট্টা করছিস কর, পরে দেখে নিস।

বাপী তরফদার এরপর বিকেলে ঘরে ফেরাই ছেড়ে দিল। একেবারে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ঢুকত।

কমলা সেই সময় থেকে তাকে বড়বাবু বলে ডাকতে শুরু করেছে। শুনে কান করকর করেছে বাপী তরফদারের। কিন্তু এ নিয়ে তাকে কিছু বলেনি। বলতে গেলেই কমলা দুটো রসের কথা বলে বসবে। সেটা নিজেকে প্রশ্রয় দেওয়ার সামিল হবে বাপী তরফদারের। সব থেকে বেশি ভয় নিজেকে। বনে-জঙ্গলে বাসের কালে বিষাক্ত সাপের আচমকা ছোবলে এক একটা বড় বড় জীবকে ধরাশায়ী হতে দেখেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে ওই রকম একটা হিংস্ৰ প্ৰবৃত্তি তার মধ্যেও লুকনো আছে। এই কারণেই নিজেকে সব থেকে বেশি ভয়।

…দেড় মাস আগে প্রবৃত্তির এই দিকটা আচমকা অনাবৃত হয়ে গেল। গৌরী বউদি দেখেছিল। চিনেছিল। গৌরী বউদি কম করে ছ’ বছরের বড় তার থেকে। কিন্তু জানোয়ার বয়েস দেখে না। গৌরী বউদিও চোখের সামনে সেদিন তাজা জ্যান্ত পুরুষ দেখেছিল একটা। তার চোখের আগুনে পতঙ্গ পোড়ে না। পতঙ্গ করুণার পাত্র। মণিদা করুণার পাত্র। গৌরী বউদির চোখের আগুনে ব্যভিচারের প্রশ্রয়।

…কিন্তু জানোয়ারটা ততক্ষণে খোলসে সেঁধিয়েছিল আবার। গৌরী বউদি তাকে ক্ষমা করেনি। তাকে আশ্রয়-ছাড়া করেছে।

…এই কমলার মতোই গায়ের মাজা রং গৌরী বউদির। সুপটু প্রসাধনে আর একটু উজ্জ্বল হয়তো। মাথায়ও কমলার থেকে কিছু লম্বা। কিন্তু গৌরী বউদির মতো নয় কমলা। তার মতো তীক্ষ্ণ নয়। নির্লিপ্ত নয়। অকরুণ নয়। মায়া-মমতা আছে। বুড়ো স্বামীর যত্ন-আত্তি করে। মেজাজ ভালো থাকলে সহজ কৌতুকে আর উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর। সে ঠারেঠোরে তাকাতে জানলেও তাকে দেখে গৌরী বউদির মুখ মনে পড়ত না বাপী তরফদারের।

কিন্তু ইদানীং মনে পড়ে। পড়ছে। হঠাৎ-হঠাৎ মনে হয়, সে-রকম পরিস্থিতি—বিপর্যয়ে এই কমলাও গৌরী বউদির মতো হয়ে উঠতে পারে। মণিদার মতো রতন বনিকও হয়তো তখন নিরীহ মুখে ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলবে। সেই ভয়েই মাঝে মাঝে এই আশ্রয় ছেড়ে পালানোর কথা ভাবছে সে। যাবার কথা রতন বনিককে বলেছেও।

.

কমলা নিজের স্বামীকেই বলে বুড়ো। রতনের সামনেই বলে। কিন্তু রতন তাতে রাগ করে না। এই বউয়ের পাশে একগাল কাঁচা-পাকা দাড়ির জন্য একটু বেখাপ্পাই দেখায় তাকে। দ্বিতীয় পক্ষের এই বউকে খুশি করার জন্যও রতন বনিক কেন দাড়ির মায়া ছাড়তে পারে না বাপী তরফদার সেটা ভালোই অনুমান করতে পারে।

ব্রুকলিনের বাবু এমন কি বড়বাবুদের কাছেও কোনো কারণে রতনের একটু বিশেষ সমাদর আছে। এই দাড়ির বোঝা সাফ করে ফেললে সেই বিশেষ কদরে ঘাটতি পড়ার আশংকা। কিন্তু দাড়ির কারণে এই স্বামী-সম্ভাষণ কি অন্য কোনো চাপা ক্ষোভের ফলে সেটা একমাত্র কমলাই জানে। রতনের বয়েস এখন উনচল্লিশ আর কমলা খুব বেশি হলে কুড়ি ছাড়িয়েছে। কমলা বাপীর থেকে দেড়-দু’ বছরের ছোট হতে পারে।

সন্ধ্যায় পর মাত্রা রেখে একটু-আধটু নেশা করার অভ্যাস আছে রতন বনিকের। এই খুপরিটা তার নেশার ঘর। বোতল থেকে সাদা জলের মতো খানিকটা দিশি মাল খায় আর সেই সঙ্গে নুন মেশানো কিছু আদার কুচি। আগে হয়তো ওই পর্বের পর এই দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে খোয়াব দেখত। এখন মেঝেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে অল্প অল্প দোলে। কেউ সামনে থাকলে মন খুলে গল্প করে তার সঙ্গে। সামনে গোড়ার দিকে বাপী তরফদারই থাকত। রতনের সংকোচ সে-ই কাটিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমি তোমার আশ্রিত, কিন্তু তোমার কোনরকম অসুবিধে হচ্ছে দেখলে আমি সরে পড়ব।

রতনের অসুবিধের ব্যাপারটা প্রথম সন্ধ্যাতেই টের পেয়ে গেছল। অন্য কারো ঘরে গিয়ে নেশা সেরে এসে রতন এই খুপরিতে এসে বসেছিল। মেঝেতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকে একটু একটু দুলতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর ওর জিভ আলগা হতে সমস্যা বুঝেছে। বউটার বিবেচনার অভাবের কথাই বলছিল রতন। মাতাল তো আর হয় না, সমস্ত দিন খাটা-খাটনির পর সামান্য মৌজের লোভে যা একটু খায়। শরীর মন ভালো থাকে রাতে ভালো ঘুম হয়। এই খুপরি ঘরে অতিথি আছেন জেনেও বোতল সুদ্ধু বউ তাকে নিজের ঘর থেকে বার করে ছাড়ল। বোতল হাতে দেখলে রতনকে সাদরে ডেকে নেবার মতো ঘর এখানে আরো দু-পাঁচটা আছে। কিন্তু যে ডেকে নেবে তাকে ভাগ তো দিতেই হয়। সেদিনই খামোখা একটা ছোট বোতল একেবারে ফাঁক হয়ে গেল। রোজ রোজ লোককে এ-রকম ভাগ দিতে হলে সে যে ফতুর হয়ে যাবে বউয়ের এই সামান্য বিবেচনাও নেই।

বাপী তরফদার তারপর ওই কথা বলে তাকে নিশ্চিন্ত করেছিল। ঢুলু ঢুলু দু’ চোখ টান করে রতন বলেছিল, বিপুলবাবুর মতো এমন দরাজ মনের মানুষ সমস্ত ব্রুকলিনেও আর দুটি নেই, অথচ বরাত এমন যে তারই চাকরিটা সকলের আগে খোয়া গেল। কিন্তু সে নিশ্চিন্ত, বিপুলবাবু ঢের ঢের বড় হবেন বলেই এই ধাক্কাটা খেতে হল।

ওর বড় হওয়ার ভবিতব্যের কথা শুনে কমলা তাকে ঠাট্টা করে বড়বাবু বলা শুরু করেছে।

অতিথির কাছ থেকে রতন বনিক ঘর ভাড়া নেবেই না যখন, অন্যভাবে বাপী তরফদারকে তার দরাজ মনের পরিচয় দিতে হয়েছে। বার দুই নিজে ছোট বোতল কিনে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছে। রতন বনিক খুশিতে আটখানা। এ-সময় একটুআধটু চেখে দেখলে বাবুরও মন ভালো হত এ-কথা অনেকবার বলেছে। কিন্তু জঙ্গলের মানুষদের এ জিনিস হামেশাই খেতে দেখেছে বাপী। অনেক বেলেল্লাপনাও দেখেছে। ফলে এই লোভ সে বাতিল করেছে। রতনের কথায় ও বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয়নি। উল্টে বউয়ের ওকে ঘরে বসে এ জিনিস খেতে না দেওয়ার তেজটুকু ভালো লেগেছে।

এ-সময় ওই দ্বিতীয় পক্ষটির গল্প রতন বনিকের মুখেই শুনেছিল সে।… কমলা রতনের নিজের শালী। প্রথম পক্ষ দুর্গার থেকে ঢের ছোট অবশ্য। শ্বশুর-শাশুড়ীর বুড়ো বয়সের মেয়ে। …দুর্গার সর্বাঙ্গ মায়ের দয়ায় ছেয়ে গেছল। সেটা জানাজানি হতে সরকারী গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে রেখে এসেছিল। আর ঘরের মুখ দেখতে পায়নি, সেখানেই সব শেষ। পাঁচ বছর আগের কথা। দুর্গাকে হারিয়ে রতন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেছিল। কমলার তখন বছর পনের কি ষোল বয়েস। মফঃস্বলে বিধবা মায়ের কাছে থাকে। শাশুড়ী তাকে চিঠি লিখত, একটা তো গেছেই, যেটা আছে তার ভয়ে বুকের ভিতরটা সর্বদা হিম হয়ে থাকে। মেয়েটা দিনকে দিন দজ্জাল হয়ে উঠছে।

রতনের তখন শোকের সময়। অতশত কান দেয়নি। বছর ঘুরতে শাশুড়ীর জোর তাগিদ এলো, জামাইয়ের শিগগীর একবার আসা দরকার—এখানকার ঘর বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ইচ্ছে তার। ততদিনে রতন বনিকের শোক হালকা হয়েছে। কিন্তু বোতলের অভ্যাসটাও তখন থেকেই।

ছুটি নিয়ে শাশুড়ীর কাছে গিয়ে তার সমস্যা স্পষ্ট করে বুঝল। সমস্যা ছোট মেয়ে। কমলার তখন বছর সতেরো বয়েস। বাড়ন্ত গড়ন। তাকে দেখে চোখে পলক পড়ে না রতনের। অনেক ছোট শালী, কাছে ডেকে আগের মতোই গায়ে পিঠে হাত বোলাবার লোভ ছাড়তে পারেনি। কিন্তু সতের বছরের ওই কমলা পাকা ঝানু মেয়ে তখন। তার হাত একটু বেসামাল হতেই ফোঁস করে উঠেছে। আর তাই দেখে ভিতরে ভিতরে রতন বনিকও পাগল হয়েছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি।

গম্ভীর মুখে সামনে বসে শাশুড়ীর নালিশ শুনেছে সে। সমস্যা আর দুর্ভাবনার কথা শুনেছে। এই মেয়েকে আর সামলাতে পারছে না শাশুড়ী। তার ফষ্টিনষ্টি বেড়েই চলেছে। আগে আশপাশের সমান পর্যায়ের ছেলে-ছোকরাগুলো উৎপাত করত। ওই পাজী মেয়েও তাদের আসকারা দিত। যার সঙ্গে খুশি বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। কোথাও যাত্রা হচ্ছে শুনলে মায়ের শাপমনিতে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যেত। এখন ভদ্দরঘরের ছেলেদের উৎপাত শুরু হয়েছে। দিনেদুপুরে জানলা দিয়ে ঢেলার মতো চিঠির মোড়ক ঘরে এসে পড়ে। শাশুড়ী লেখাপড়া জানে না, আর কমলাও চোখ-কান বুজে মায়ের কাছে মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু ফাঁক পেলেই চুপিচুপি বেরিয়ে যায়। একা শহরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসে। ওই সব পাজী ছেলেগুলোই নিশ্চয় পয়সা যোগায়। চৌদ্দ-পনের বছর বয়েস পর্যন্ত বাখারিপেটা করে মেয়েকে মাটিতে শুইয়ে ফেলা গেছে, কিন্তু এখন মেয়েটা মায়ের সমস্ত শাসনের বাইরে।

…হ্যাঁ, বুদ্ধির চালে সেই একবার শাশুড়ী আর তার মেয়ে দুজনকেই ঘায়েল করতে পেরেছিল রতন বনিক। ভেবে-চিন্তে শাশুড়ীকে বলেছে, কমলাকে এখান থেকে সরানো দরকার। কলকাতা দেখাবার নাম করে শাশুড়ী আর শালী দুজনকেই তার ওখানে নিয়ে যাবে সে। আর তারপর কমলার মতো মেয়ের ভালো বিয়ে হতে কতক্ষণ? কমলার যে ভালো বিয়ে হবে নিঃসংশয়ে সেই ভবিষ্যৎবাণীও করেছে। জামাইয়ের এই ঘোষণার ওপর শাশুড়ীর ভারী আস্থা। তার ওপর শুনেছে খরচাপত্রের জন্যেও ভাবনা নেই—যা করার জামাই-ই করবে। কলকাতার এই চাকুরে জামাই শাশুড়ীর মস্ত গর্ব।

কমলাও সানন্দে এসেছে। কলকাতা দেখার লোভ, তার ওপর দিনে একটা করে সিনেমা দেখার লোভ। এত লোভের টোপ না গিলে থাকতে পারবে এমন মেয়ে কমলা নয়। সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে বিয়ের আগের দিন মতলবটা শাশুড়ীকে জানিয়েছে রতন বনিক। প্রথম শোনার পর শাশুড়ী ঘণ্টা-কতক গুম হয়ে ছিল অবশ্য। কিন্তু আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে মেয়ের হাল কি হতে পারে সেই ভবিষ্যৎবাণী শোনার পর শাশুড়ী আর আপত্তি করেনি। উল্টে ভেবেছে এ বরং ভালোই হল, মেয়েটা তোয়াজে থাকবে।

কমলা জেনেছে একেবারে বিয়ের দিন সকালে। কিন্তু সেদিন আর রতন বনিক এই টালি এলাকা থেকে তার পালাবার মতো কোনো ফাঁক রাখেনি। শেষে মুখ বুজেই বিয়েটা করতে হয়েছে তাকে। তবে ওই দজ্জাল বউকে বাগে আনতে বেশ সময় লেগেছিল রতন বনিকের। কখন কোন্ ফাঁক দিয়ে পালায় সেই ভয়ে আস্ত একটা মাস আপিসে ছুটি নিতে হয়েছিল। আর রোজ একটা করে সিনেমা দেখাতে হয়েছিল।

কথায় কথায় একদিন বউয়ের আর একটা খেদের কথা জেনেছিল রতন বনিক। এখানে কারো ঘরে কোনো শুভ কাজ হলে বউ নাকি অপমান বোধ করে। কুড়ি পার হতেও ছেলেপুলে হল না বলে এখানকার এয়োরা কোনো শুভ কাজে প্রথমে তার মুখ দেখতে চায় না। রতন বনিক অবশ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছে কমলা ছেলের মা হবে, ব্যস্ত হবার কি আছে, সবে তো কুড়ি গড়ালো বয়েস। কিন্তু বউ তক্ষুনি গলা উঁচিয়ে তর্ক করবে, তাহলে দিদির কেন তিরিশ বছরেও ছেলেপুলে হল না! এ-সব কথা শুনলে রতন বিরক্ত হয়। —দিদির বরাতে ছিল না তাই হয়নি—তা নিয়ে তোর এত বড় ভাবনা কেন, তোর হলেই তো হল! কপালের ব্যাপারে এত লোকের এত বিশ্বাস রতন বনিকের ওপর, এতটুকু বিশ্বাস নেই শুধু ঘরের বউয়ের। আর বিশ্বাস না থাকলে কারো কোনোদিন কিছু হয়!

…আপিসের সহকর্মীদের কাছে তো বটেই, বাবুদের আর বড় দরের বাবুদের কাছেও পিওন রতন বনিকের ওই কপাল গোনার গুণেই বাড়তি খাতির। মাস দুই আগে পর্যন্ত বাপী তরফদার নিজেও ওই ব্রুকলিনেরই সাধারণ কেরানীবাবুদের একজন ছিল। রতন বনিক সেই বিভাগেরই পিওন। কিন্তু পিওনের কাজ খুব একটা করতে হয় না তাকে। কারণ, দশটা-পাঁচটা অফিসের মধ্যে নিজের বা অন্য বিভাগের কোনো না কোনো বাবু ডিউটির অর্ধেক সময় তাকে ডেকে নিয়ে পাশে টুল পেতে বসিয়ে ভবিষ্যতের জট ছাড়াতে চায়।

নিজস্ব পদ্ধতিতে ভবিষ্যৎ গণনার সুনাম দিনে দিনে বাড়ছিল রতনের। হাত দেখা বা ঠিকুজি দেখার সঙ্গে এই গণনার কোনো সম্পর্ক নেই। তার কোন্ এক গুরুর আশীর্বাদে এক ভিন্ন পদ্ধতিতে সে ভবিষ্যৎবক্তা আর ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়ে বসেছে। একমাথা চুল, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, আর চওড়া কপালে তেমনি মোটা করে মেটে সিঁদুর ঘষা। অনেকেরই বিশ্বাস লোকটার তন্ত্রমন্ত্র জানা আছে কিছু। ছোট বড় বাবুদের কাছ থেকে দু’দশ টাকা রোজগার হয় রতন বনিকের।

সে তার খদ্দেরের মাথার শেপ দেখে, ভুরু কান নাক চোখ দেখে, ঠোটের বক্রাভাস দেখে—আর সব থেকে বেশি মুখ আর কপালের রং। শুধু তার চোখেই যে কোনো লোকের সুসময়ে অথবা দুঃসময়ে কপাল আর মুখের রং—বদল ধরা পড়ে। খুব নিবিষ্ট মনে এইসব দেখে নিয়ে চোখ বুজে সে ভবিষ্যৎ বলা শুরু করে। যা বলে তার কিছু সত্য হতে পারে, বেশির ভাগই হয়তো সত্য হয় না। বাপী তরফদারের তাই ধারণা। একশটা ঢিল ছুঁড়লে দুদশটা লেগে যায়ই। কিন্তু মানুষের মন এমনি দুর্বল, যেটা লাগল সেটারই দাগ থেকে গেল। অনেককে বলতে শুনেছে, ব্যাটা ভাঁওতাবাজ, কিসসু জানে না। কিন্তু বিপাকে পড়লে অথবা কোনো আশার সম্ভাবনা দেখলে তাদেরও ওকে খাতির করে কাছে ডেকে বসাতে দেখেছে।

শাশুড়ীর কাছে চিঠি লিখতে হলে বা টাকা পাঠাতে হলে নতুন বাবু অর্থাৎ বাপী তরফদার তার সেই চিঠি অথবা মানিঅর্ডার ফর্ম লিখে দিত। আর রোজ ওকে দিয়ে চা আনানোর সময় ওকেও চা খাওয়ার পয়সা দিত। সেই কারণে হোক বা সমস্ত বিভাগের মধ্যে এমন কি আপিসের মধ্যে একমাত্র বিপুল তরফদারই ভাগ্য যাচাইয়ের ব্যাপারে কখনো শরণাপন্ন হয়নি বলে হোক— রতন বনিকের তার ওপর একটু বেশি টান ছিল। তার আগ্রহ না থাকলেও নিঃসংশয়ে সে তার সম্পর্কে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যা শুনে সহকর্মীদের চোখ ট্যারা আর বাপী তরফদারের মেজাজ গরম। তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সে গোটা ব্রুকলিন ডিপোর মালিক হয়ে বসলেও অবাক হবার কিছু নেই।

…ভবিতব্যের কথা শুনে অপরের হাসি দেখে সাধারণ েেকরানীবাবু বিপুলনারায়ণ তরফদারের মেজাজ গরম হবার আরো কারণ আছে। খুব ছেলেবেলা থেকে সে আকাশ-ছোঁয়া রকমের বড় হওয়ার স্বপ্নই দেখে এসেছে। সেই স্বপ্ন এত প্রত্যক্ষ যে এর প্রতিকূল কোনো বাস্তব সম্ভাবনার সঙ্গে এতটুকু আপোস নেই। মনের তলায় এক বিশাল সাম্রাজ্যই গড়ে বসে আছে। বড় হওয়ার এই তাড়নাটা বাসা বেঁধে আছে অনেক দিনের এক অসহ্য তাচ্ছিল্যের আঘাত থেকে। আর, নিজের সেদিনের ছোট শরীরটার তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ থেকে।

…মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে দুঃসহ অপমানের বিকৃত প্রতিশোধের প্ররোচনায় কোনরকম জ্ঞানবুদ্ধি বিবেচনার অবকাশ ছিল না। তারপর শাসনের চাবুকে অপরিণত বয়সের সেই দেহ ঝাঁঝরা হয়েছে। দুই কশ-ঝরা নিজের সেই তাজা রক্তের স্বাদ বাপী তরফদার এ জীবনে ভুলবে না।

সেই থেকেই বড় হওয়ার একটা অফুরন্ত তাগিদ ধমনীর রক্তে টগবগ করে ফুটত সর্বদা। এখনো ফোটে। কত বড় হলে মন ভরে সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। কোনো গণ্ডী বা কোনো সীমানার মধ্যে কুলোয় না সেটা।

.

বাপী তরফদারের সমূহ সমস্যা রতন বনিকের বউ কমলাকে নিয়ে। তার হাবভাব রকম-সকম দ্রুত বদলাচ্ছে। ওকে দেখলেই মনের তলায় অঘটনের ছায়া পড়ে। বাপী তরফদার সরোষে ওটা ছিঁড়েখুঁড়ে মন থেকে সরায়

মাত্র দিন পাঁচ-ছয় আগের কথা। বিকেলের আগেই রেডিও মারফৎ খবরটা আগুনের গোলার মতো ছড়িয়ে পড়তে স্তব্ধ বাপী তরফদার আর বাইরে টহল না দিয়ে এই খুপরি ঘরে এসে বসেছিল। ও-পাশ থেকে কমলা দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে। একপিঠ খোলা চুল, ঢিলে-ঢালা বেশ-বাস, উত্তেজনায় দুচোখ কপালে।—তুমিও খবর শুনেছ তাহলে? তোমাদের ভদ্দরলোকদের হল কি গো বড়বাবু, দেশসুদ্ধ মানুষ জানে উনি মানুষ নন্—দেবতা—তাঁকেই গুলি করে মেরে দিলে?

এর কি জবাব দেবে বাপী তরফদার। তার নিজের মাথার মধ্যেই সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।

আগ্রহে আর উত্তেজনায় কমলা খাটিয়ার সামনেই মেঝের ওপর বসে পড়েছিল। তার শোনার ইচ্ছে, জানার ইচ্ছে, বোঝার ইচ্ছে। এ-রকমও কেন হয়, দেবতার আবার শত্রু থাকে কি করে?

বাপী তরফদার টুকটাক দুই-এক কথায় জবাব দিচ্ছিল। জানতে বুঝতে এসে কমলা নিজেই বেশি কথা বলছিল। গেল বছর বেলেঘাটায় গিয়ে কমলা নিজের চোখে গান্ধীজীকে দেখে এসেছিল। এখানকার আরো অনেকে গেছিল। নিজের কানে তাঁর কথা শুনেছে, নিজের চোখে তাঁর হাসি দেখেছে—জন্ম সার্থক। আর আজ কিনা এই!

বলতে বলতে কমলা থমকে মুখের দিকে তাকিয়েছে। নিজের অগোচরে বাপী তরফদারের দু’চোখ তার মুখে বুকে ওঠা-নামা করেছে হয়তো দুই একবার! কিন্তু আসলে সে নিজের প্রতি বা কারো প্রতি সচেতন ছিল না একটুও।

গা-ঝাড়া দিয়ে কমলা বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়িয়েছিল আর সঙ্গে সঙ্গে খসা আঁচলটা সজোরে বুকের ওপর দিয়ে পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। তার পর ছদ্ম ঝাঁঝে বলে উঠেছিল, খুব যে পরের বউকে সামনে বসিয়ে চোখের সাধ মেটানো হচ্ছে—অ্যাঁ?

বলতে বলতে ঘর ছেড়ে চলে গেছল সে। বাপী তরফদার কাঠ।

পরের চার-পাঁচ দিনের মধ্যে কমলার হাবভাব আরো অন্যরকম দেখছে। বাইরে গম্ভীর, কিন্তু চোখে চোখ পড়লে অঘটনের অস্বস্তিকর ছায়াটা আরো ঘন হয়ে উঠেছে। বাপী তরফদার বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে দুবেলার খাওয়া সেরে একেবারে রাতে ফেরে। গতকাল বেরুনোর আগে কমলা এই খুপরিতে এসে হাজির। কালো মুখ পলকা-গম্ভীর, চোখের কোণে কৌতুক চিকচিক

—আজকাল তোমার কোন্ পার্কে ডিউটি চলছে গো?

—তার মানে? না বুঝেও বিরক্ত।

—মানে আবার কি, রোজ সাড়ে এগারোটা বারোটায় বেরিয়ে রাত নটা পর্যন্ত হন্যে হয়ে তুমি চাকরি খুঁজে বেড়াও সেটা ওই হাঁদা বুড়ো বিশ্বাস করলেও আমি করি না। চাপা হাসি উছলে উঠতে চাইল কিন্তু উঠতে দিল না।—মরুকগে, এদিকে একটা ভালো ছবি হচ্ছে, এখানকার অনেকে দেখেছে; দুকুরের শোয়ের দু’খানা টিকিট কাটতে পারবে? আমি পয়সা দিচ্ছি—

কমলার চোখ এড়িয়ে মাথা নেড়ে বাপী তরফদার বিড়বিড় করে জবাব দিল, আমার সময় হবে না।

এ জবাবের জন্য প্রস্তুতই ছিল কমলা।—ঠিক আছে, টিকিট আমিই কেটে রাখব না হয়…তোমার দেখার সময় হবে?

এবারে ওর চোখের দিকে তাকালো বাপী তরফদার। কমলা ফিক করে হেসে ফেলল।—তোমার অত ভয় কিসের, কেউ টের পাবে না। ছবি দেখার পর বেরিয়ে এসে আমি তোমাকে চিনতেও পারব না—সোজা ঘরে চলে আসব—কমলার দুচোখের কৌতুক সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। জবাব না দিয়ে বাপী তরফদার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

তারপর কাল রাতেই রতন বনিককে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলেছে। আর তাই শুনেই কমলার সকালের এই ঠেস।

.

কিন্তু সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত আজকের দিনটায় আর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। অভ্যাসমতো বাপী ঘণ্টাকয়েক আপিসপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেছে; সেখানে লালদীঘির মাছ দেখে ঘণ্টা দুই কেটেছে। বিকেলে ময়দানের মাঝখান দিয়ে অন্য দিনের মতোই দক্ষিণে হাঁটা দিয়েছে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের পয়সা কটাও বাঁচে আবার লম্বা হাঁটাও হয়। এই হাঁটারও কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। পা যখন আর চলতে চায় না, ধারেকাছের কোনো একটা পার্ক-টার্ক-এ বেঞ্চিতে নয়তো ঘাসের ওপরে বসে পড়ে। ততক্ষণে শীতের ছোট বেলার শেষ আলোটুকু অন্ধকারের জঠরে চলে যায়।

আজ ক্লান্ত লাগছিল না। বেলা তিনটে নাগাদ ছেলেবেলার বন্ধু নিশীথ সেন—এর আপিসে গেছল। সে ভর-পেট জলখাবার খাইয়ে দিয়েছে। লোকালয়ের ফুটপাথ ধরে চলতে চলতে নিজের বাসের এলাকা ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে চলেছে। হাজরা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে গেল একটু। লাইট জ্বালিয়ে প্যান্ডেল খাটিয়ে এখানেও গান্ধীজীর শোকসভা চলেছে।

এর পাশেই আর এক দৃশ্য দেখে হাসি পেয়ে গেল বাপী তরফদারের। রেলিং—ঘেঁষা ফুটপাথে গজ দশেক দূরে দূরে কুপী জ্বালিয়ে দু’জন শীর্ণকায় গণৎকার বসে। সামনে ফুটপাথের ওপরেই খড়ির ছক-কাটা। তাদের সামনে একজন করে খদ্দের হাত বাড়িয়ে বসে আছে। এখানেও ভাগ্য গণনা চলছে। এক-আধজন আবার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। বসে পড়বে কি পড়বে না—দোনামনা ভাব।

বাপী তরফদার এগিয়ে চলল। মানুষ কত দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে নিশ্চিন্ত হতে পারে? আসলে এ একটা রোগ। রোগের মতো কিছু। এই রোগে বাপী নিজেও জর্জর। কিন্তু কোনো লোককে সে হাত দেখায় না। ঠিকুজি দেখায় না। সে জানে, দেখালে একটা রূঢ় বাস্তব তাকে হাঁ করে গিলতে আসবে। কল্পনায় যে সাম্রাজ্যের সে অধীশ্বর, সেটা কোনদিন সত্যের ধারেকাছে ঘেঁষবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কোনো গণৎকার করবে না। বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, রতন বনিকের ভবিষ্যৎ-বচন বরং শুনতে ঢের ভালো লাগে তার।

কিন্তু ঠিক এই এক ব্যাপার থেকেই যে এই দিনটা অন্য সবগুলো গতানুগতিক দিন থেকে এত তফাৎ হয়ে যাবে, তখন পর্যন্ত এ-রকম সম্ভাবনা তার কল্পনা মধ্যেও নেই।

…বড় রাস্তা ছেড়ে ভিতরের একটা মাঝারি রাস্তা ধরে আরো আধ মাইলটাক দক্ষিণে হেঁটে এসেছিল। সামনের মোড়ের মাথায় একটা তিনতলা বাড়ির রাস্তাঘেঁষা একতলার ঘরটার দিকে চোখ গেল। বাপী আবারও হেসে উঠল। ওই . ঘরেই একজন জ্যোতিষী বসে সে জানে। এই রাস্তায় আরো এসেছে-গেছে। এই একজন বড়লোকের জ্যোতিষী। বড়লোকের ভাগ্য দেখে, ভাগ্য ফেরায়। ঘরের সামনে দু’টো তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে অভিজাত মেয়ে-পুরুষেরা অপেক্ষা করে। ভিতরের খদ্দের বেরিয়ে এলে তবে আর একজনের পালা।

আজও দূর থেকে সেই একই দৃশ্য দেখল। দু’খানা গাড়ি দরজায় দাঁড়িয়ে। বাইরে দু’জন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। বাপী তরফদার হাসছে মৃদু মৃদু, এগিয়ে আসছে। সামনের দরজা দিয়ে ফরাস-ঢাকা চৌকিতে বসা জ্যোতিষীকে দেখা গেল। তার সামনে দুটি অভিজাত মহিলা বসে। পিছন থেকে তাদের পিঠ দেখা যাচ্ছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। জ্যোতিষীর মুখে হুঁকো-গড়গড়ার নল। নলের তামাক টানছে আর নিবিষ্ট মনে দেখছে কিছু।

দরজা ছাড়িয়ে এসে পাশের জানলা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই বাপী তরফদার স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ডটা লাফালাফি করে বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। এ কাকে দেখছে বাপী তরফদার? কাদের দেখছে? সত্যি দেখছে না স্বপ্ন কিছু।

সত্যি না হলে গত আটটা বছরের এতগুলো দিন থেকে এই দিনটা—এই রাতটা মুহূর্তের মধ্যে এত তফাৎ হয়ে গেল কি করে? সত্যিই এখানে এত বড় একটা চমক তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে!

জানালার গরাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত দুই চক্ষু মেলে দেখছে। ওই দু’জনই এত বেশি চেনা তার যে দেখামাত্র সর্বাঙ্গের স্নায়ুগুলো একসঙ্গে টানটান হয়ে গেল। বয়স্কা মহিলার জমকালো বেশবাস, গলায় কানে হাতে ঝকমক এক রাশ গয়না। …মনোরমা নন্দী। জ্যোতিষীর সামনে কচি পদ্মের মতো দু’হাত মেলে বসে আছে তার মেয়ে মিষ্টি…মালবিকা। ছেড়ে আসা এক জায়গায় সে যেমন বিপুল নয়—বাপী, সেখানে এই মেয়েও তেমনি মালবিকা নয়—মিষ্টি। মিষ্টি মিষ্টি! বাপী, অপলক চেয়ে আছে। দশ আর আটে আঠেরো হবে এখন বয়স। দশ বছরের সেই গরবিনী মেয়েটা আঠেরোয় এই হয়েছে!

বাপী তরফদার তাদেরই দেখছে আর তার মা-কে দেখছে এ কি বিশ্বাস করবে?

ভিতরে জোরালো আলো। বাইরেটা সে তুলনায় অন্ধকার। ভিতর থেকে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

কতক্ষণ কেটেছে জানে না। উঠতে দেখল তাদের। মনোরমা নন্দী হাসছেন। মিষ্টি নন্দীও হাসছে। মনোরমা নন্দী সুন্দর হাতে ব্যাগ খুলে দুটো দশ টাকার নোট জ্যোতিষীর সামনে রাখলেন। ভিতরের কথাবার্তা আসছে না।

নিজের ওপর আর এতটুকু দখল নেই বাপী তরফদারের। তারা বেরিয়ে আসতে সে দু’হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল।

মনোরমা বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন। পা-জামা পরা খয়ের রঙের গরম আলোয়ান জড়ানো একটা ছেলে হাঁ করে তাঁর মেয়েকে দেখছে। দেখছে না, দুই চোখ দিয়ে গিলছে।

—স্টুপিড! খুব অস্পষ্ট ঝাঁঝে কথাটা বলে মেয়ের হাত ধরে তিনি গাড়িতে উঠলেন। মেয়েটারও বিরক্তি-মাখা লালচে মুখ।

সাদাটে রঙের গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে আরো দক্ষিণে চলল।

পিছন থেকে গাড়িটার নম্বর চোখে পড়ল বাপী তরফদারের। তখনো স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে সে। গাড়ির রক্তবর্ণ সাইডলাইট দুটোও মিলিয়ে গেল।

হঠাৎ জিভে করে নিজের শুকনো ঠোঁট বার দুই ঘষে নিল বাপী তরফদার। আট বছর আগের সেই অকরুণ আঘাতের চিহ্ন আট দিনেই মিলিয়েছে। কিন্তু নিজের দেহের সেই তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে।

সোনার হরিণ নেই – ২

…অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি।

শুধু কথা নয়, এক বুড়োর ফ্যাসফেসে গলার টানা স্বরসুদ্ধু হুবহু মনে পড়ে গেলে বাপী তরফদারের।

ছেলেবেলা থেকে এ-পর্যন্ত একটিমাত্র গুণের ওপর মস্ত নির্ভর তার। প্রখর স্মরণ শক্তি। এই গুণটুকুও না থাকলে হাতের মুঠোয় বি-এস-সি’র ডিগ্রি ধরা দুরে থাক, স্কুলের গণ্ডী পার হতে পারত কিনা সন্দেহ। যা একবার দেখে নেয় তার ছাপ মগজ থেকে আর সরে না। যা একবার শোনে কানে লেগেই থাকে। কিন্তু এই গুণটাকে সে যদি কোনো উপায়ে বিস্মরণের রসানলে ঠেলে দিতে পারত, দিতই। একটুও দ্বিধা করত না। …অনেক দাহ অনেক যন্ত্রণার শেষ হত তাহলে

এক ধাক্কায় নটা বছর হুড়হুড় করে পিছনে সরে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে হাফপ্যান্ট আর মোটা ছিট কাপড়ের ফতুয়া পরা তেরো বছরের এক ছেলে, নাম যার বাপী—সে সেই বনাঞ্চলের সব থেকে শৌখিন রংচঙা কাঠের বাংলোর বাইরের সাজানো ঘরের দরজার পাশে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে। ভিতরের গদিআঁটা ঝকঝকে বেতের সোফায় বসে মুগা রঙের চোগাচাপকান পরা একজন সাদা দাড়িঅলা মুসলমান ফকির। সাদা দাড়ি নেড়ে নেড়ে অন্ন দেখে ঘি আর পাত্র দেখে ঝি দেবার কথা সে-ই বলছিল।

তার হাঁটুর এক হাতের মধ্যে চামড়া-ঢাকা চেকনাই মোড়ার ওপর মেমসাহেব বসে। অদূরের আর একটা সেটিতে সাহেব —যাঁকে সামনে দেখলে ভয়ে আর সম্ভ্রমে বাপীর বাবা আর বন-এলাকার সমস্ত মানুষের মাথা বুকের দিকে নুয়ে পড়ে। সাদা দাড়ি আর মাথায় সাদা ফেজ টুপী দেখেই অপরিচিত মানুষটাকে মনে মনে ফকির আখ্যা দেয়নি বাপী। সে যখন এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছে, ওই সাদা দাড়ি তখন সবে মেমসাহেবের হাত ছেড়ে তার ন বছরের মেয়ে মিষ্টিকে কাছে টেনে নিয়েছে। সোফার হাতলের পাশে এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মিষ্টির পরনে জেল্লা ঠিকরনো বেগনে রঙের ফ্রক। ওই ফ্রকটাতে এত সুন্দর লাগছে মিষ্টিকে যে এক হাতে ওকে ওইভাবে জড়িয়ে ধরে থাকার জন্য বুড়োর ওপর রাগই হচ্ছিল বাপীর। আরো একটু গলা বাড়িয়েছে সে। ওদের পিছনে একটু দূরে আর একটা সোফায় আবার ভারিক্কি মুখে দীপুদা বসে। ওকে দেখতে পেলেই উঠে এসে মাথায় খট খট করে গাঁট্টা বসাবে। তবু সাবধানে মিষ্টিকে দেখার লোভ সামলে উঠতে পারছিল না বাপী।

…মিষ্টির ডান হাতটা বুড়োর সোফার হাতলে চিৎ করে পাতা। বাঁ হাতটা সামনে মেলে ধরা। ফুটফুটে হাতের ছোট চেটো দুটোতে যেন হালকা গোলাপী রং বোলানো। সেই দুটো হাতের ওপর বুড়ো তার এক হাতের পুরু কাঁচের চাকতিটা ফেলে একমনে দেখা শুরু করতেই বাপী বুঝে নিল লোকটা গণৎকার। ওই কাঁচের জিনিসটা সে চেনে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস না কি বলে ওটাকে। গণৎকার যদি মুসলমান হয় তাকে ফকির ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে বাপী জানে না।

হাতের রেখার ওপর চোখ রেখে বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, বেটীর নাম কি?

লজ্জা-লজ্জা মুখ করে মিষ্টি বলল, মালবিকা নন্দী। জবাব দিয়ে সকৌতুকে ও একবার বুড়োর মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার নিজের হাতের দিকে।

এরপর ভবিষ্যৎ বলা শুরু হল। খাসা মেয়ে। যত বড় হবে আরো খাসা হবে। উদ্‌গ্রীব মুখে তার মা আরো সামনে ঝুঁকল। আর বাবা সিগারেট ধরালো।

—খুব বুদ্ধিমতী মাইয়া। অনেক লেখা-পড়া অইব। বি.এ. এম.এ. পাস করবো। না, কোন রকম বড় অসুখবিসুখ দেখা যায় না, মায়ের কোনো ভাবনা নাই, বেটীর শরীর স্বাস্থ্য ভালো যাইবো।

মেমসাহেবের প্রশ্ন, আর বিয়ে? বিয়ে কেমন হবে দেখুন—

বাইরে থেকে বাপীরও মনে হল মিষ্টির সম্পর্কে এইটেই শুধু জানার মতো কথা, আর সব বাজে।

ওর দুটো হাতের ওপরেই কাচ ফেলে-ফেলে দেখছে বুড়ো। বেশ করে দেখে নিয়ে শেষে শ্লোকের মতো করেই কথা কটা বলল। ‘অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি’—

বাইরে থেকে স্পষ্টই শুনল বাপী কিন্তু অর্থ বুঝল না। মেয়ের বিয়ের মধ্যে অন্ন ঘি ঝি আবার কি ব্যাপার! মাথাটা আবার একটু বাড়িয়ে দিতে হল। মিষ্টি ও বড় বড় চোখ করে বুড়োর দিকে চেয়ে আছে।

মিষ্টির মা উদ্বিগ্ন একটু।—তার মানে গণ্ডগোল দেখছেন নাকি? প্রশ্নটা করেই কিছু খেয়াল হল। মেয়েকে বলল, এই মিষ্টি তোর হয়েছে, তুই যা এখন।

মিষ্টি মাথা ঝাঁকালো, দাদা থাকলে আমি থাকব না কেন!

ফলে দাদার প্রতিও মায়ের নির্দেশ, দীপু, তুইও বাইরে যা তো একটু—

শোনামাত্র এদিক থেকে বাপীর ছুট লাগানোর কথা। কিন্তু প্রস্তুত হবার আগেই ছেলের প্রতিবাদ কানে এলো, বা রে, আমারটা তো দেখাই হয়নি এখনো,’ আমি তাহলে বাড়ি থেকেই চলে যাচ্ছি—

বাপী জানে, মেমসাহেব ছেলের কাছে নরম মেয়ের কাছে গরম। ওমনি ছেলেকে অনুমতি দিল, আচ্ছা তুই থাক। সুর পাল্টে মেয়েকে বলল, মিষ্টি! কতদিন বলেছি না দাদা তোমার থেকে ঢের বড়–যাও, ও-ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বোসো—

বাপী এদের সমস্ত খবর রাখে। বাইরের শাসন সাহেবের আর ভিতরের শাসন মেমসাহেবের। বিরস মুখে মিষ্টি দরজার দিকে পা বাড়ালো। এবারে বিপদ হতে পারে বাপী জানে, তবু দরজার আড়াল থেকে সে নড়ল না।

বাইরে পা দিয়ে ওকে দেখেই মিষ্টি থমকালো এক দফা। পরের মুহূর্তে ঘরের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মা—বাপী পাজিটা এখানে দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছে সব!

এক লাফে জাহাজ মার্কা কাঠের বাংলো থেকে বাপী মাটিতে এসে পড়ল। খানিকটা নিরাপদ ব্যবধানে ছুটে এসে ঘুরে দাঁড়াল। না, ওর চিৎকার শুনে সাহেব বা মেমসাহেব কেউ বেরিয়ে আসেনি। এসেছে দীপুদা। চোখোচোখি হতে সে হাত তুলে মার দেখালো, তারপর আবার ভিতরে চলে গেল।

বয়সে দীপুদা তিন বছরের বড় হলেও আর সেবারে সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেও ওই ননীর শরীরে জোর কত বাপীর তাতে সন্দেহ আছে। কিন্তু সাহেবের ছেলের জোর যাচাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। তাই হাতের নাগালে পড়লে বাপীকে গুঁতো খেতে হয়। সাহেবের ছেলে না হলে ও উল্টে লড়ে দেখতে পারত। ছুটে দীপুদা তার নাগাল পায় না কখনো, সে-চেষ্টা করলে জিভ বার-করা কুকুরের হাল হয়।

দীপুদা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পরেও ফ্রক পরা মিষ্টি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আর ওকেই দেখছে। এ-রকম একটা সুযোগ বাপী ছাড়তে পারে না। যতটা সম্ভব দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াল। তারপর হাত দুটোও দুপাশে টান করে দিল। শেষে মুখটা বিকৃত-কুৎসিত করে আর ছ’আঙুল জিভ বার করে ভেঙচি কেটে দাঁড়িয়ে রইল।

ফল যেমন আশা করেছিল তেমনি। রাগের মাথায় ও-দিকের কাঠের বারান্দা থেকে মিষ্টিও চোখের পলকে ঠিক ওই রকম পা ফাঁক করে হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আর জিভ বার করে ভেঙচি কেটে পাল্টা জবাব দিল। তারপরেই তারস্বরে আবার চিৎকার, ও মা! দেখে যাও বাপী পাজিটা আমাকে কি বিছুছিরি করে ভেঙাচ্ছে।

আর দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। মেয়ের ডাকে ওই মেমসাহেব বাইরে এসে আঙুল তুলে ডাকলেই বাপীকে কাচপোকার মতো কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়িয়ে কানমলা বা চড় খেয়ে আসতে হবে। চড় অবশ্য এখন পর্যন্ত খেতে হয়নি, কিন্তু কানে দুই-একবার হাত পড়েছে। আর চড়িয়ে গাল লাল করে দেবার শাসানি শুনতে হয়েছে। এ-সব নির্যাতন ওই সোহাগী মেয়ের নালিশের ফল। নইলে দরকার পড়লে মেমসাহেব ওকে ডেকে ফাইফরমাস তো বেশ করে। আর, একটু সুনজরের আশায় বাপীও তার কোনো কাজ করতে পেলে বর্তে যায়।

সোহাগী মেয়ের চিৎকার শেষ হবার আগেই বাপী রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। তারপর জঙ্গলের ভিতর দিয়েই হাসতে হাসতে ঘরমুখো হয়েছে।

মাথায় ফকিরের কথাগুলো ঘুর-পাক খেতে লাগল। যা বলল তার অর্থ কি হতে পারে? ঘরে গিয়ে পিসীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। পিসীর কথাবার্তার মধ্যে ও বাঙালের টান আছে, বিশেষ করে বাবার সঙ্গে যখন কথা বলে। আর ওই ফকিরের মতো অনেক রকমের ছড়া-পাঁচালি কাটে পিসী।

বাপীর যা-কিছু আদর আব্দার সব পিসীর কাছে। ঘরে মা নেই। মা-কে সে—রকম মনেও পড়ে না। চিন্তা করলে মায়ের একটা কাঠামো শুধু মনে আসে। আরো সাত বছর আগে অর্থাৎ বাপীর ছ’বছর বয়সের সময় এখনকার হাসপাতাল থেকে মা-কে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে মা আর এই বানারজুলিতে ফিরে আসেনি। পিসী তার আগে থেকে এখানে ছিল। একদিন বিকেলের দিকে তাকে মেঝেতে আছড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেছিল। আর বাবাকে মুখ কালি করে ঘরের কোণে বসে থাকতে দেখেছিল। তারপর জেনেছে মা বড় হাসপাতাল থেকেই সগে চলে গেছে। এই তেরো বছরের জীবনে তারপর মায়ের জন্য হাহুতাশ করার সময় খুব একটা মেলেনি।

ঘরে ঢুকে পিসীকে বলল, সাহেব বাংলোয় মস্ত এক ফকির এসেছে কোথা থেকে, সকলের হাত দেখছে—

হাত দেখা ফকিরের কথা শুনে পিসীর জিভে জল গড়ালো।—বলিস কি রে! কে ফকির? কোথাকার ফকির? তুই নিজের হাতটা একবার দেখিয়ে এলি না কেন?

বিরক্তিভরে শেষের প্রশ্নটারই জবাব দিল, কি যে বলো ঠিক নেই, সাহেব মেমসাহেব তাদের ঘরে বসে হাত দেখাচ্ছে সেখানে নিজের হাত বাড়াতে গেলে আস্ত থাকত—দুমড়ে ভেঙে দিত না!

এ-রকম কথা শুনলে পিসীর রাগ হয়ে যায়। কেন, ভেঙে দেবে কেন শুনি? ওদের ভবিষ্যৎ আছে তোর নেই—তুই কি বানের জলে ভেসে এসেছিস নাকি!

পিসী আবার বাবার ঠিক উল্টো। বাবা সাহেব মেমসাহেবের নাম শুনলে কাঁপে। পিসী জ্বলে। পিসীর রাগের কারণও বাপী নিজেই। তার কাছে ও দুধের ছেলে। সাহেবের ছেলে ভাইপোর গায়ে যখন-তখন হাত তোলে, আর মা-ও ভালো ব্যবহার করে না, ধমক-ধামক করে, কানে হাত দেয় পর্যন্ত—এ পিসী বরদাস্ত করতে পারে না। দাঁত কড়মড় করে, বাপীকেই ঠেঙাতে আসে, তুই নোলা বার করে যাস কেন ও-দিকে বেহায়ার মতো—এত হেনস্তার পর লজ্জা করে না ও-মুখো হতে?

বাপীর লজ্জা করে না। দীপুদা তার বাবা-মা, এমন কি ওই মিষ্টিটার ওপরে পর্যন্ত কি-রকম একটা আক্রোশ তারও বুকের তলায় জমাট বেঁধে আছে। তবু যায়। না গিয়ে পারে না। বিকেলে বা ছুটির দিনে একটা অদৃশ্য কিছু তাকে ওই বাংলোর দিকে টেনে নিয়ে যায়। ওই বাংলোটা তার চোখে রূপকথার নিষেধের এলাকার মতো। নিষেধ বলেই ওদিকে হানা দেবার লোভ।

পিসীর সামনে গ্যাঁট হয়ে বসল বাপী।—বাজে কথা ছাড়ো—অন্ন দেইখা দিবা ঘি পাত্র দেইখা দিবা ঝি—মানেটা কি চটপট বলে দাও দেখি?

হঠাৎ এই বচন শুনে পিসী হাঁ প্ৰথম।—কে বলেছে?

—ওই ফকির।

—কাকে বলেছে?

—মিষ্টির হাত দেখে তার মা-কে বলেছে।

পিসী মিষ্টিকে চেনে। মেমসাহেবকে লুকিয়ে ও বাপীর সঙ্গেই দু’দিন এখানে এসেছে। পিসী ওকে আদর করে নারকেলের নাড়ু আর মুড়ির মোয়া খাইয়েছে।

হাসিমুখে পিসী ভাইপোকে ছড়ার অর্থ বুঝিয়ে দিল। শুনে বাপী চিন্তিত হওয়া দুরে থাক উল্টে খুশি হল। ঢাক-ঢোল-শানাই বাজিয়ে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেই হল? হোক গণ্ডগোল —গণ্ডগোলটা যত বেশি হয় বাপী ততো খুশি হবে। ওই হাবা মেয়ে কি বোঝেনি। বুঝবে কি করে, তাকে তো ঘর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পিসীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলে নিজের মা ওকে ঘর থেকে সরাবে কেন! মিষ্টিটাকে এবার হাতের নাগালে পেলে হয়—

ডাকলে মিষ্টি যে ওর ধারেকাছে আসতে চায় না সেই দোষটা বাপীর নিজেরই। মেয়েটাকে দেখলেই মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপে। অবস্থার ফারাকটা ওরা যদি এত বড় করে না দেখত তাহলে বোধ হয় এতটা হত না। মেয়েটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা অজ্ঞাত লোভ মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দেয়। ঝাঁকড়া আধা—কোঁকড়ানো চুলের সামনে ফর্সা টুলটুলে মুখখানা দেখে মনে হয় ছোট্ট মিশকালো একটা ঝোপের মধ্যে সুন্দর একখানা বড়ো ফুল বসানো।

একা পেলেই ডেকে বসত, এই মিষ্টি, শোন্—

মিষ্টি কাছে আসত। — কেন?

—-তোকে আমি খেয়ে ফেলব। তারপর আরাম করে এক গেলাস জল খাব।

এরপর আর রাগ না করে থাকতে পারে কোন্ মেয়ে। কাছে আসুক না আসুক, দেখা পেলেই বাপীর ওই কথা।—মিষ্টি, তোকে আমি খেয়ে নেব-দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাছে এলে খেয়ে নেব বলে?

মিষ্টি এই নিয়ে তার দাদার কাছে আর মায়ের কাছে নালিশ করেছে। দীপুদা এই অপরাধে ওর মাথায় কম গাঁট্টা মারেনি। আর এই অপরাধেই মেমসাহেবের হাতে কানমলা খেয়েছে। তার ফলে দেখা হলে দূর থেকে আরো বেশি করে এই কথা বলে ছুটে পালিয়েছে। এরপর বাবার কাছে সাহেব বা মেমসাহেব কে তড়পেছে বাপী আজও জানে না। বাবা একদিন আপিস থেকে ঘরে ফিরেই ওকে ধরে বেদম ঠেঙানি। কি দোষে মার খাচ্ছে, পিসীর বা ওর তাও বুঝতে সময় লেগেছে। এই মারের ফলেই পিসীর সঙ্গে বাবার ঝগড়া বেধে গেছে। দোষটা তখন বোঝা গেছে। বাবা বলেছে, সাহেবের মেয়েটাকে দেখলেই মিষ্টি খাবে, মিষ্টি খাবে বলে চেঁচায়—আজ ওকে আমি শেষ মিষ্টি খাওয়াচ্ছি।

বাবার ওপরে রাগ করেই পিসী গুমগুম করে ওর পিঠে আরো কটা কিল বসিয়ে দিয়েছে—সাহেবের গরিব কেরানীর ছেলে হয়ে তোর এত লোভ—পা চাটতে পারিস না?

একরকম বিপাকে পড়ার ফলেই মিষ্টিকে দেখলে বাপী এখন আর গলার আওয়াজে জানান দিয়ে একথা বলে না। কিন্তু মনে মনে ঠিক বলে। আগের থেকে আরো বেশি বলে। আর সেটা ওই মেয়ে ঠিক বুঝতে পারে। কিন্তু কানে না শুনলে নালিশ করতে পারে না বলেই বাপীর ওপর আরো বেশি রাগ তার। দাদাকে বলেওছে ক’দিন, ও মনে মনে ঠিক আমাকে খাবার কথা বলছে, ঠোঁট নড়ছে দেখছ না—ধরে দাও না দু’ঘা!

কিন্তু দীপুদা যখন দেখে তখন আর বাপীর ঠোঁট নড়ে না। বোনের রাগের কথায় সে অতটা অবুঝ হতে পারে না। তবু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে নেয়, মনে মনে বলছিস?

যতটা সম্ভব মুখখানা নিরীহ করে তুলে বাপী মাথা নাড়ে। বলছে না।

দুপুরটা কোনরকমে কাটিয়ে জংলা পথ ধরে আবার সোজা বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। বিকেলে মিষ্টি বাংলো ছেড়ে বেরুবেই জানা কথা। নিজেদের বাগানে ছোটাছুটি করে আবার সামনের পাকা রাস্তা ধরে বেড়ায়ও। ফাঁক পেলে মেয়েটার জঙ্গলে ঢুকে পড়ারও লোভ খুব। কিন্তু একলা ঢুকতে সাহস পায় না। বাপীর তোয়াজ তোষামোদে মেজাজ ভালো থাকলে মা-কে লুকিয়ে তার সঙ্গেই মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে। ইদানীং বাপীরও তোষামোদের মেজাজ নয় বলে সেটা বন্ধ আছে। এমন কি মিষ্টি ওকে দেখলে বাগান ছেড়ে বাইরেই আসতে চায় না।

চুলবুলে মেয়ে ঘরে কতক্ষণ আর থাকবে। একটু বাদেই কাঠের বাংলোর বারান্দায় দেখা গেল ওকে। তারপর থমকেও দাঁড়াল; অর্থাৎ ওরও চোখ এই দিকে।

একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল বাপী। কেউ নেই। গেট-এর সামনে এসে হাত তুলে ইশারায় কাছে ডাকল।

মিষ্টি দাঁড়িয়ে রইল। অপলক চোখ। রাগ-রাগ মুখ। বাপী বুঝে নিল সকালে যেভাবে ওকে ভেংচি কাটা হয়েছে, সহজে আসতে চাইবে না। খুব মোলায়েম গলায় ডাকল, মালবিকা, একটা কথা শুনে যা, খুব মজার কথা

মালবিকা বলে ডাকার মানে ওকে বোঝাতে চায় মনে মনেও সে এখন মিষ্টিকে খেয়ে ফেলার কথা ভাবছে না। কিন্তু মেয়েও ত্যাদড় কম নয়।—ফের তুই-তুকারি করে কথা! মা-কে ডাকব?

বাপীর ইচ্ছে হল দুই চড়ে ফোলা ফোলা লালচে গালে দশ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেয়। তার বদলে দু হাত জোড় করে ফেলে বলল, ঠিক আছে আর তুই—তুকারি করব না, কিন্তু একবার এলে খুব মজার কথা বলতাম, সকালের সেই গণৎকারের কথা—পিসীমার কাছে চুপিচুপি জিগগেস করে জেনে নিয়েছি!

বাংলো ছেড়ে বাইরে আসার লোভ একটু একটু হচ্ছে বোঝা যায়। তবু মাথা নাড়ল, মা তোমাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিয়েছে।

এ-কথা মিষ্টি আগেও বলেছে। শুনলেই রাগে ভিতরে ভিতরে গজরাতে থাকে বাপী। কিন্তু এত শুনেছে বলেই কানে তোলার মতো নয়। সাদা-মাটা মুখ করে বলল, ঠিক আছে, শুনতে হবে না তাহলে…জঙ্গলের মধ্যে মস্ত একটা মৌচাকও দেখাব ভাবছিলাম। আবু বলছিল, শিগগীরই মওকা বুঝে এক রাত্তিরে ওটা পেড়ে ফেলবে—অনেক মধু হবে। তুই তোর মায়ের আঁচলের তলায় বসে থাকগে যা।

গেট ছেড়ে রাস্তার এ-ধারে চলে এলো বাপী।

লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে মিষ্টির। এই পাজীটার সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে ওর ভালই লাগে। বাবার সঙ্গে বা বাবার লোকের সঙ্গে ও আর দাদা জঙ্গলে ঘুরেছে। হাতীর পিঠে চেপেও ঘুরেছে। কিন্তু সে আর এক রকমের ঘোরা। বাপীর সঙ্গে ঘুরতে অন্য রকমের মজা। বাপী হাত ধরে টানাটানি করলেও মিষ্টি ঘন জঙ্গলে ঢোকে না অবশ্য। এমনিতেই গা ছমছম করে। দাদাও ভীতু, একলা বেশি দূর যায় না। কিন্তু বাপীর ভয়ডরের লেশমাত্র নেই। যেখানে বাঘ, ভালুক, চিতা থাকে, আবুর সঙ্গে ও নাকি সে-সব জায়গাও চষে বেড়িয়েছে। আর ঢিল নিয়ে বুনো মোরগ খরগোস বেঁজী সজারু তাড়া করতে মিষ্টি নিজের চোখেই দেখেছে। ছমছমানি ভাব কেটে গিয়ে তখন সত্যিকারের মজা।

রাস্তার ওদিকে চলে গেল দেখে মিষ্টির আর বাংলোয় দাঁড়িয়ে থাকা হল না। পায়ে পায়ে নেমে গেট-এর কাছে এসে চোখ বেঁকিয়ে দেখে নিল সত্যি চলে যাচ্ছে কিনা। তারপর অনেকটা নিজের মনেই কথা ছুঁড়ে দিল, হুঁ, মৌচাক দেখতে যাই আর বোলতা এসে কামড়ে দিক্।

বোলতার বদলে বাপীর নিজেরই ওই ফোলা গালে কামড় বসাতে ইচ্ছে করছিল। বলল, বোলতা আর মৌমাছির তফাৎ জানিস না—তোকে দেখতে হবে না। ঢিল না ছুঁড়লে মৌমাছি চাক ছেড়ে নড়ে?

—আবু চাক ভাঙবে কি করে, তখন কামড়াবে না?

—রাতে ধোঁয়া দিয়ে ভাঙবে। জঙ্গল-সাহেবের মেয়ের কত সাহস আবুকে বলে আসিগে যাই।

ওই একজনকে জঙ্গলের দেবতা বা অপদেবতা ভাবে মিষ্টি। আবু রব্বানীকে এ তল্লাটের মানুষ ছেড়ে জঙ্গলের সমস্ত জীব-জন্তুগুলোও চেনে বোধ হয়। জঙ্গলের খবর ওর থেকে বেশি কেউ রাখে কিনা সন্দেহ। এই জন্যে মিষ্টির বাবাও ওকে পছন্দ করে। আবুর বাবা এ জঙ্গলের হেড-বীটম্যান। ওর ছেলে আবুকে বাবা শিগগীরই বীটম্যান করে দেবে শুনেছে মিষ্টি। ওই আবু একসময় দাদার দু ক্লাস ওপরে পড়ত নাকি। বছর-বছর ফেল করার ফলে পাঁচ বছরের ছোট বাপী ওকে ধরেছিল। আর সেই বছরেই আবু ঘেন্নায় ইস্কুল ছেড়েছে। বয়সে দাদার থেকে মাত্র দু’বছরের বড়। বেশি হলে উনিশ। এরই মধ্যে শুধু পাথর ছুঁড়ে আর লাঠি পেটা করে কত রকমের জীব মেরেছে ঠিক নেই। এই সেদিনও পেল্লায় এক বিষধর সাপ মেরে মিষ্টির বাবাকে দেখাতে এনে খুব বকুনি খেয়েছিল। সাপ ইঁদুর খায়। ইঁদুর বনের ক্ষতি করে। তাই বেশি সাপ মারলে বনের ক্ষতি। বাবা বকুক আর যা-ই করুক, ওর বুকের পাটা আছে অস্বীকার করতে পারে নি। কেউ পারে না। জঙ্গলের ব্যাপারে তার আলাদা মর্যাদা।

বাপীকে নিয়ে আবুর সঙ্গেও মিষ্টি চুপি চুপি জঙ্গলে কম বেড়ায়নি। ছুটির দিনের দুপুরে বাবা-মা ঘুমোয়, দাদা শহরে যায়। ফাঁক বুঝে বাপীও এসে মিষ্টিকে ডেকে নিয়ে যায়। বাবা-মা ওকে না দেখতে পেলেও ভাবে কাছাকাছি আছে কোথাও। আবু সঙ্গে থাকলে আর হাতে সময় থাকলে মিষ্টি ওদের সঙ্গে একটু ঘন জঙ্গলে ঢুকতেও ডরায় না। এই আবুর কাছে মিষ্টির ভীরু অপবাদ কাম্য নয়।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেট খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে হল। মেয়ে ভাঙবে তবু মচকাবে না। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, আবুকে বললে বয়েই গেল। বাবাকে বলে দেব আবু জঙ্গলের ক্ষতি করছে, ওকে যেন বীটম্যান না করে।

বাপীর ধৈর্য কমছে, তাই রাগ বাড়ছে।—কি? আবুর নামে নালিশ করবি তুই?

—ফের তুই?…তুমিই বা আমার নামে ওকে বলতে যাবে কেন? বোল্লার চাক কত দূর?

একবার শুধরে দেবার পরেও ফের আবার বোলতাই বলল। বাপীর মনে ওকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার তাড়না।—খুব কাছে।…আচ্ছা, আবুকে কিছু বলব না। মিষ্টি অত সহজে ভোলবার পাত্রী নয়।—মজার কথা কি বলবে বলছিলে? টোপটা আরো একটু রহস্যজনক করে তোলার সুযোগ পেল বাপী। মুখে হাসি টেনে বলল, সকালে গণৎকারের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা বলার সময় তোর মা তোকে ঘর থেকে সরিয়ে দিল কেন সে তো বুঝতেও পারিসনি বোকা মেয়ে! আয়, বলছি—

এবারে আর ‘তুই’ বলার জন্য ফোঁস-ফোঁস করে সময় নষ্ট করতে চাইল না মিষ্টি। আসলে মা বলেছিল বলেই, নইলে তুই-তুমির তফাৎ খুব একটা কানে লাগে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলোর দিকটা দেখে নিল একবার। কেউ নেই। রাস্তা পেরিয়ে কাছে এলো।…বিয়ের কথা মানেই মজার কথা আর ভালো কথা, কিন্তু মা হুট্ করে ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিল কেন সত্যিই মাথায় ঢোকে নি।

—বলো।

—আগে এদিকে আয়। কাছে পাওয়া মাত্র ওর একখানা হাতের ওপর দখল নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। তারপরেও হাত ছেড়ে দিল না। মিষ্টির সুন্দর ছোট হাত নিজের হাতে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে বা চাপাচাপি করতে ভালো লাগে।

—সকালের ওই গণৎকার কোত্থেকে এলো রে?

—বাবা শিলিগুড়ি থেকে আনিয়েছে। অনেক জানে।

—কি নাম?

—পীর বস্।

—তার মানে এক বাক্স পীর!

না বুঝে মিষ্টি বোকার মতো তাকালো তার দিকে।

বাপী বলল, বি-ও-এক্স বক্স মানে বাক্স না?

—তোমার মুণ্ডু, তুমি এই-সব বজ্জাতি করার জন্য আমাকে ডেকে এনেছ! হাত ছাড়াবার চেষ্টা।

—না রে না—তোর বিয়ের কথায় বুড়ো সেই ছড়াখানা কি বলেছিল মনে আছে?

একটা কি বলেছিল মিষ্টির মনে পড়ছে। চেষ্টা সত্ত্বেও কথাগুলো মনে পড়ল না। মাথা নাড়ল, মনে নেই।

‘অন্ন দেইখা দিবা ঘি, পাত্র দেইখা দিবা ঝি’! বাপী হেসে উঠল।

মনে পড়ল। বুড়ো গণৎকার এই কথাগুলোই বলেছিল বটে। বড় বড় চোখ করে মিষ্টি ওর দিকে মাথা বেঁকিয়ে তাকালো। তার মানে কি?

—’অ’ আর ‘নয়-নয়’ অন্ন মানে ভাত তো?

মিষ্টি মাথা নাড়ল। তাই।

—পচা গন্ধ-অলা চালের ভাতে ভালো ঘি ঢাললেও খেতে স্বাদ ভালো হয়? এবারে একটু ভেবে-চিন্তে মাথা নাড়ল মিষ্টি। হয় না বটে।

—আর পাত্র মানে হল ছেলে, যে-ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। আর ঝি মানে হল মেয়ে—যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে।

মিষ্টি ফোঁস করে উঠল, ঝি মানে কখনো মেয়ে নয়।

বাপী তেমনি জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ মেয়ে। পিসীর কাছে শুনে আমি ডিকশনারী দেখে নিয়েছি, বিশ্বাস না হয় তুইও দেখে নিস। ঝি মানে ঝিও হয় আবার মেয়েও হয়।

এ-কথা শুনে মিষ্টি দমে গেল একটু। বলল, ঝি মানে মেয়ে হলেই বা মা আমাকে ঘর থেকে যেতে বলবে কেন?

—তোর বিয়ে নিয়ে হ্যাঙ্গামা আছে বলে। বাপী-গম্ভীর!—পচা চালের মতো একটা বাজে ছেলের হাতে পড়বি তুই।

—কখনো না। পীর সাহেব তো বলেছে, আমার অনেক লেখা-পড়া হবে চেহারা আরো ঢের সুন্দর হবে, অসুখ করবে না, শরীর ভালো থাকবে—তাহলে খারাপ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে কেন?

অনেক-জানার মতো মুখ করে বাপী হাসতে লাগল। বলল, ওই জন্যেই তো এই শোলকটারে! তোর পীরসাহেব বলেছে, যত ভালো মেয়েই হোক, সে-রকম ভালো ছেলের সঙ্গে যদি বিয়ে দিতে না পারো তাহলে পচা চালে ভালো ঘি ঢালার মতো হবে সেটা। বুঝলি?

বুঝেও গোঁ-ভরে মিষ্টি বলল, বাবা ঠিক দেখেশুনে ভালো ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেবে আমার—

বাপীর মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হল।—তুই আচ্ছা বোকা, তোর বাবাও কি গণৎকার নাকি যে আগে থেকেই ছেলের সব জেনে ফেলবে। ভয় না থাকলে পীরসাহেবের মতো এত বড় গণৎকার এ-কথা বলবে কেন, আর তোর মা-ই বা তোকে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে সরিয়ে দিতে চাইবে কেন! পরিতুষ্ট বাপী ওর হাতে বড়সড় চাপ দিল একটা। অকাট্য যুক্তির মুখে পড়ে মিষ্টি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বেশ রাগ হচ্ছে। একে হাসছে তায় হাতের ওপর হামলা।

—বোলতার চাক কই?

বাপী থতমত খেল একটু। চারদিকে তাকালো একবার।—কোন্ গাছটায় দেখেছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না…একটু খুঁজলেই পেয়ে যাব।

এক ঝটকায় মিষ্টি নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।—মিথ্যেবাদী, মিথ্যেবাদী! সঙ্গে সঙ্গে যে-দিক থেকে এসেছে সেইদিকে ছুট্‌।

মৌচাক জঙ্গলের কোথাও না কোথাও আছেই। একটা ছেড়ে অনেক আছে। কিন্তু একটাও দেখে রাখা হয়নি বলে বাপী মনে মনে পস্তালো একটু। ছুটে গিয়ে আবার ওকে চেপেচুপে ধরার লোভ। কিন্তু ধরতে পারলেও আজ আর ফেরানো যাবে না।…ওর ফুটফুটে নরম-গরম হাতটা এতক্ষণ নিজের হাতের মধ্যে ছিল, বেশ লাগছিল।

হৃষ্ট মুখেই বাপী এবার আর একজনের সন্ধানে চলল। বয়সে ছ বছরের তফাৎ হলেও এখানে প্রাণের দোসর একজনই।

আবু রব্বানী।

ওই রব্বানীর সে একনিষ্ঠ ভক্ত বললেও বেশী বলা হবে না। তার একান্ত কাছে থাকার ফলে বাপীর ইদানীং কত দিকে জ্ঞান বাড়ছে তা নিজেই অনুভব করতে পারে। বাপীর বিবেচনায় আবুর মতো মরদ তামাম বানারজুলিতে আর দুটি নেই। আবুরও ওর ওপর অকৃত্রিম স্নেহ। তার কারণ আছে। বীটম্যান হবার আশায় বানারজুলির এত বড় রিজার্ভ ফরেস্টের স্থানীয় সর্বেসর্বা রেঞ্জ অফিসারের মেমসাহেবটিকে আবু নানানভাবে তোয়াজ তোষামোদ করে চলেছে বটে। ঝুড়ি ভরতি ফিকে পীত রঙা শাল ফুল অথবা টকটকে লাল পলাশ দিয়ে আসে, আম জাম জামরুল পেয়ারা খেজুর নিয়ে যায়, বুনো মুরগী বা খরগোশ মারতে পারলে মেমসাহেবকে ভেট দিতে ছোটে। কিন্তু চাকরিটা একবার হয়ে গেলে ওর সমূহ মনিব কেরানীবাবু অর্থাৎ বাপীর বাবা হরিবাবু। তাই বাপীর সঙ্গে খাতির রাখাটা তার দরকারও বটে। কিন্তু আবুর অকৃত্রিম স্নেহটাই বড় করে দেখে বাপী।

—আরে থো থো—আল্লার খবর মোল্লায় রাখে!

বাপীর মুখে গণৎকার পীর বস্-এর সমাচার শুনে বাঙাল টান দিয়ে ওই মন্তব্য করেছিল আবু রব্বানী। বিশেষ করে মিষ্টির বি-এ এম-এ পাশ করে মস্ত বিদুষী হওয়ার সম্ভাবনাটা এক ফুঁয়ে বাতিল করে দিয়েছিল সে। বলেছে, বি-এ এম-এ দূরে থাক, ওই মেয়েকে ম্যাট্রিকও পাশ করতে হচ্ছে না বলে দিলাম।

আবু নিজে অনেক বছরের চেষ্টায় ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে প্রমোশন না পেয়ে পড়া ছেড়েছে একথা একবারও মনে হয় না বাপীর। সত্যিকারের বিস্ময় নিয়ে শুধিয়েছে, কেন বলো তো—মেয়েটা তো ওদের ক্লাসে ফার্স্ট হয়।

—ফার্স্ট হোক আর লাস্ট হোক, এই পীর যা বলে শুনে রাখ্

শুনে রাখার মতোই কথা বটে। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু বেশি পড়াশুনা কেন হবে না বলো না?

আবুর মুখে সবজান্তা হাসি। তোর কোনো বুদ্ধি যদি থাকত! এই বয়সেই চেহারাখানা দেখছিস না মেয়েটার, ষোল-সতের বছরের ডবকা বয়সে এই মেয়ের চেহারাখানা কি রকম হতে পারে চোখ বুজে ভেবে দেখ দিকি? ভেবেছিস? ভালো করে ভাব—

বাপী সঠিক ভেবে উঠতে পারল না। তবে একটা সম্ভাব্য আদল চোখে ভাসল বটে। কিন্তু কি বলতে চায় বোঝেনি তখনো। মাথা নাড়ল। ভেবেছে।

আবু এবার ব্যাখ্যা শোনালো। সেই বয়সে কোনো কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর। বিয়ে করে ঘরে এনে পুরবে, তারপর লুটেপুটে শেষ করবে। বি-এ এম-এ পাস করার ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?

হ্যাঁ করে বাপী আবুর মুখখানাই দেখছিল। মগজে এত বুদ্ধিও ধরে ও! রাস্তার পাশে জ্যোতিষীর জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওই মা মেয়েকে অপলক চোখেই দেখে নিয়েছিল বাপী তরফদার। তারপর শুধু মেয়েকেই চেয়ে চেয়ে দেখেছে। ওই মা পাশে না থাকলে হঠাৎ দেখে চিনতে পারত কিনা সন্দেহ। জ্যোতিষীর সামনে মিষ্টি টান হয়ে বসে ছিল। ডান পা-টা পিছনে মোড়া। জ্যোতিষীর দিকেই চেয়ে ছিল সে।

জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে স্থানকাল ভুলে বাপী তরফদার ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেছে। মাথা…কপাল…নাক কান চোখ মুখ…গলা… কাঁধ বুক।

এক পা পিছনে মুড়ে বসার ভঙ্গী…বুক থেকে কোমরের নীচে পর্যন্ত ঈষৎ স্থির যৌবনরেখা…একটু নড়লে-চড়লে সেই রেখাগুলোও নড়া-চড়া করেছে।

নিজের অগোচরে মনে মনে একটা হিসেব সেরে নিয়েছে বাপী তরফদার। আবু রব্বানীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। ঠিক ন’ বছর আগের কথা …মিষ্টির বয়েস এখন আঠারো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কপালে বা সিঁথিতে সিঁদুরের আঁচড় নেই।

গাল দুটো আগের মতো ফোলা-ফোলা নয়। মেদ-ঝরা টানা মুখ। আগের তুলনায় আরো আয়ত চোখ। গায়ের রঙও আগের থেকে ঢের বদলেছে, অনেক কম ফর্সা মনে হয়। কিন্তু এই রঙের মধ্যে আদুরে ভাব থেকে তাজা ভাব বেশি।

নির্নিমেষে দেখছিল বাপী তরফদার। তার এই দেখাটা বাইরের প্রতীক্ষারত অন্য মেয়ে-পুরুষদের চোখে বিসদৃশ লাগছিল সে হুঁশ নেই। মা-মেয়ে যখন উঠেছে, বাপী তরফদার আত্মস্থ নয় তখনো। অনাবৃত অপলক দু চোখ মিষ্টির সর্বাঙ্গে ওটা-নামা করেছে। তারা বেরিয়ে আসতে বাপী তাদের দু’হাতের মধ্যে এসে মাকে ছেড়ে মেয়েকেই দেখেছে। দেখেনি, দুই চোখের বাঁধনে তাকে আটকে রাখতে চেয়েছে। চিনতে পারার কথা নয়, দুজনের কেউই চিনতে পারেনি। অস্ফুট ঝাঁজে ‘স্টুপিড’ বলে মেয়ের হাত ধরে মা গাড়িতে উঠেছে। মেয়েরও বিরক্তিমাখা লালচে মুখ। মৃদু শব্দ তুলে সাদাটে গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। পিছনের লাল আলোয় গাড়ির নম্বরের ওপর চোখ আটকেছে বাপী তরফদারের।

সেই দিকে চেয়ে ন’ বছর নয়, নিজের অগোচরে আটটা বছর পিছনে পাড়ি দিয়েছে বাপী তরফদার।…ওর বয়েস যখন চৌদ্দ। …মিষ্টির দশ।

হঠাৎ জিভে করে নিজের শুকনো দুই ঠোঁট ঘষে নিল বাপী তরফদার। আট বছর আগের সেই আঘাতের চিহ্ন নেই—কিন্তু জিভে নিজের দেহের সেই তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ!…এক মেয়েকে কেন্দ্র করে আট বছর আগে অপরিণত বয়সের ছেলের সেই প্রবৃত্তির আগুন বাইশ বছরের এই দেহের শিরায় শিরায় হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আবার

আবছা অন্ধকার শূন্য পথের দিকে চেয়ে দু চোখ ধক্‌ধক্ করছে প্রবৃত্তির ক্রূর আদিম অভিলাষ।

সোনার হরিণ নেই – ৩

শীতের রাত বাড়ছে। পথে লোক চলাচল নেই বললেই চলে। বাপী ঠায় দাঁড়িয়ে গায়ে শার্টের ওপর শুধু একটা আলোয়ান। কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু ভিতর থেকে একটা উষ্ণ তাপের ওঠা-নামা চলেছে তখনো। একেবারে বুকের পাতাল থেকে। বাইরের ঠাণ্ডা চামড়ায় বিধলেও টের পাচ্ছে না। বাইরের জানালা দিয়ে দু চোখের এক-একটা উষ্ণ ঝাপটায় জ্যোতিষীর সামনে বসা শেষ লোকটাকে তুলে দিতে চাইছে।

জ্যোতিষীর অপেক্ষায় বাইরে তখন একমাত্র বাপী তরফদার ছাড়া আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। হাতের কবজিতে পুরনো আমলের ঘড়ি বাঁধা আছে একটা। সেটা চলছে। রাত দশটা বেজে দশ।

ভবিতব্য জানার আশ মিটিয়ে শেষ লোকটা উঠল। বাপী তরফদারের স্নায়ুগুলো টান-টান আবার। লোকটা বেরিয়ে আসতে সে ঢোকার জন্য প্রস্তুত। দেখতে না পেলেও নিজের চোখ-মুখের খরখরে ভাবটা অনুমান করতে পারছে। ভিতরে ঢোকার আগে সেটা মোলায়েম করে নেবার তাগিদ।

ঘর ফাঁকা হবার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষী ভদ্রলোক নিজের ভাগ্য যাচাইয়ে মনোনিবেশ করেছে। সামনের এক-হাত প্রমাণ কাঠের বাক্সটা খুলে ভিতর থেকে এক মুঠো নোট বার করে ওটার ওপর রাখতে যাচ্ছিল। মুখ তুলে তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গে নোটগুলো আবার কাঠের বাকসের ভিতরে চালান করল। একই সঙ্গে পাশের গোল পকেট ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল?

বাপী তরফদার মাথা নাড়ল। ছিল না। আর কিছু বলার আগে ভদ্রলোকও মাথা নাড়ল।—অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর হবে না।

প্ল্যানমাফিক বাপী তরফদার সবিনয়ে বলল, আমি শুধু একজনের ঠিকানা জেনে নেবার জন্য অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করছি…মিসেস মনোরমা নন্দী, আজ তাঁর এখানে আসার কথা ছিল…আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, জানা থাকলে ঠিকানাটা দয়া করে যদি বলেন….

ভদ্রলোকের গোল দুচোখ তার মুখের ওপর আটকে থাকল খানিক। তারপর আপাদ-মস্তক ওঠা-নামা করল।—তাঁদের এখানে আসার কথা ছিল আপনি জানলেন কি করে?

সন্দেহ এড়ানোর জন্যেই শুধু মনোরমা নন্দীর নামটা করেছিল। মালবিকা বা মিষ্টির নাম করে নি। তবু ভদ্রলোকের চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে সেটা অনুভব করা গেল। আমতা-আমতা করে জবাব দিল, বিকেলে ফোনে কথা হয়েছিল…তখন বলেছিলেন—

—ফোন নম্বর জানা আছে, বাড়ির ঠিকানা জানা নেই?

বাপী তরফদার মাথা নাড়ল। জানা নেই।

মুখের ওপর সন্দিগ্ধ চাউনিটা কঠিন হয়ে উঠতে লাগল।—কি মতলব?

—আজ্ঞে…..?

—আমি দু ঘণ্টা আগেও তোমাকে ওই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ভদ্রমহিলার ঠিকানা চাই কেন? কি মতলব?

ভিতরের উত্তেজনার ফলে এ-রকম বিপাকে পড়ার কোন সম্ভাবনা অন্তত মাথায় আসে নি। এখন ছুটে পালাতে চাইলেও চেঁচামেচি করে লোক ডাকবে কিনা কে জানে। এই তিনতলা বাড়ীর একতলায় বসে জ্যোতিষী করে। ডাকলে ভিতর থেকে কতজন ছুটে আসবে ঠিক নেই। কোণঠাসা হয়ে জবাবদিহি করল, ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ এখানে দেখে তাঁর স্বামীর কাছে একটা চাকরির তদ্বিরের জন্য ঠিকানা খোঁজ করছিলাম…অনেক কাল আগে উত্তরবঙ্গে থাকতে ওঁরা আমাকে চিনতেন….

আরো রূঢ় স্বরে জ্যোতিষী জিজ্ঞাসা করল, ওঁর স্বামীর নাম কি?

—সন্দীপ নন্দী…উত্তরবঙ্গে বানারজুলি রিজার্ভ ফরেস্টের রেঞ্জ অফিসার ছিলেন এক সময়…বড় দুঃসময় চলছে তাই একটু চেষ্টা করার ইচ্ছা ছিল—

এবারে বিশ্বাসযোগ্য হল বোধ হয়। শীতের রাতের এই বেশবাস বিশ্বাসের অনুকূল। ভদ্রলোকের ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস দেখা গেল। ভাঁওতাবাজী ধরে ফেলার মতই পাকা জ্যোতিষী। বলল, কোন মহিলার ঠিকানা জানার জন্য এভাবে আর কখনো কোথাও ঢুকে পড়ো না—ওঁর স্বামী কলকাতায় থাকেন না। যাও।

বেরিয়ে এল। এর পরেও উত্তেজনার উপশম হল না একটুও। মনে মনে জ্যোতিষীর মুন্ডুপাত করতে করতে ঘরের দিকে পা বাড়াল। ওই মেয়েকে আবারও দেখার তাড়না ভিতরে একটা যন্ত্রণার মত ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকল। সেই যন্ত্রণার তাপ বুকের পাঁজর থেকে মাথার দিকে উঠছে। জ্যোতিষীর জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে মিষ্টিকে, আর বাইরে বেরুনোর পর সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছে। এই দেখার বিশ্লেষণে ফাঁক ছিল না বড়। আগের সঙ্গে মেলে না। মাথায় লম্বা হয়েছে বেশ। স্বাস্থ্যও লোভনীয় রকমের নিটোল ছাঁদ নিয়েছে। ফোলা গাল ভেঙে অন্য ধাঁচের পরিণত আকার নিয়েছে। গায়ের রঙে তাজা তামাটে প্রলেপ পড়েছে। সব মিলিয়ে মিষ্টিকে তীক্ষ্ণ মনে হয় এখন। রূপ নয়, এর থেকে ঢের রূপসী কলকাতায় এ ক’মাসে সে অনেক দেখেছে। সন্ধ্যার দিকে যে কোন অভিজাত বার-রেস্তারাঁর সামনে দাঁড়ালে দু-চারটি অন্তত রূপসী মেয়ে চোখে পড়েই। বড় গোছের যে-কোন সোস্যাল ফাংশান ভাঙলেও চোখে পড়ে। ভিতরের সুপ্ত বাসনা অনেক সময়েই তাকে ওসব জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। পকেটে পয়সার টান। হিসেবী মন বাজে খরচের ঝোঁকে বিক্ষিপ্ত হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক-একদিন শুধু বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে। এই গোপন অশালীন দেখার খবর একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। সে-তুলনায় এই রূপ এমন কিছু নয়। কিন্তু এই রূপের মধ্যে এমন কিছু আছে যা পুরুষের বিশ্লেষণের বস্তু, আবিষ্কারের বস্তু। এই বিশ্লেষণ অথবা আবিষ্কার দীর্ঘকালের জমাট-বাঁধা লোভ আর যন্ত্রণার ফল কিনা জানে না। জানতে চায়ও না। অপ্রত্যাশিতভাবে যার দেখা পেল আজ, তার সমস্ত খুঁটিনাটি দু চোখের তারায় আগলে নিয়ে পথ চলেছে।

মগজে সাদাটে গাড়ির নম্বরটা ঘুরপাক খাচ্ছে।

রাত প্রায় এগারোটা। টালি-এলাকায় শীতের নিঝুম রাত। রাস্তার ধারে লাইটপোস্টের ঝিমুনো আলোয় ভিতরে ঢোকার সরু গলি-পথ দেখা যাচ্ছে। বাপী তরফদার নিঃশব্দে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। অন্ধকার সত্ত্বেও আন্দাজে ঠিক নিজের খুপরির দরজা ঠেলে অন্দরে ঢুকে যেতে পারবে। কিন্তু ভেতরটাও খুব অন্ধকার নয়। ওপর থেকে খানিকটা জ্যোৎস্না এক ধারের টালি বেয়ে উঠোনে লুটোপুটি খাচ্ছে।

কোন দিকে না তাকিয়েই বাপী তরফদার তার খুপরি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। তার পরেই বিষম চমক। পাশের ঘরের দরজা দুটো খোলা। দরজার ওধারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রতন বনিকের ঘুমকাতুরে বউ কমলা। মুখ—চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাহলেও সাদা চাদর জড়ানো ওই মূর্তি ভুল হবার নয়।

চোখের পলকে বাপী তরফদার নিজের খুপরির দরজা ঠেলে ভিতরে চলে এলো। ক্যাঁচ করে শব্দ হল একটু। আবার বন্ধ করার সময়েও সেই শব্দ। জোরে না হলেও ওই শব্দ রাতের এই নিঝুম স্তব্ধতা ভেঙে দেওয়ার মতো বিরক্তিকর। দরজা বন্ধ করে ঘরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে রইল বাপী। এতক্ষণে শীতটা ছেঁকে ধরেছে তাকে। একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি পা বেয়ে বুকের হাড়ের দিকে এগোচ্ছে। মিনিট খানেক বাদে পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করার আর হুড়কো লাগানোর মৃদু শব্দ কানে এলো।

এবারে ঠাণ্ডার ভাবটা কমতির দিকে। অবসন্ন শরীরটা দেয়াল-ঘেঁষা দড়ির খাটিয়ার কাছে টেনে নিয়ে এলো। বসল। গায়ের আলোয়ান খুলে পায়ের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর জামাসুদ্ধই কম্বলের নিচে ঢুকে গেল।

বিকেল থেকে এই রাত পর্যন্ত আজ অনেক মাইল হাঁটা হয়েছে। স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে। রাতে কিছু খেয়ে নেবার কথা মনেও পড়ে নি। কম্বলের তলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল দু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।

বাপী তরফদার জানে এই সন্ধেটা আর এই রাতটা অনেকগুলো বছরের অনেকগুলো সন্ধ্যা থেকে আর রাত থেকে এত তফাৎ হয়ে গেছে যে খানিকক্ষণের মধ্যেই অবসন্ন স্নায়ুগুলো আবার টান-টান হয়ে উঠবে। কিন্তু মনে-প্রাণে এখন সে ঘুমের অতলে ডুবে যেতে চায়। মড়ার মতো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায়।

দরজার পরিচিত শব্দটা কানে এলো যখন, অন্য দিনের মতোই বাপী তরফদারের আপাদমস্তক কম্বলের নিচে। কিন্তু আজ সে রাত থাকতে উঠে মুখহাত ধুয়ে আবার শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।

—বড়বাবু ঘুমিয়ে না জেগে?

কম্বলের তলা থেকে গলার স্বরটা ভারী-ভারী ঠেকল কানে। কম্বল বুকের নিচে নামিয়ে বাপী সোজা কমলার মুখের দিকে তাকালো। ঘুম-ভাঙা ফোলাফোলা মুখ আঁচলের ঘোমটায় কান মাথা গলা বেড়িয়ে আধখানা ঢাকা। ভিতরেও আজ পাতলা ব্লাউস নয়, একটা গরম জামা পরেছে। তার ওপর দিয়ে আঁট করে শাড়ি জড়ানোর ফলে শরীরটাও ফোলা ফোলা লাগছে।

বাপী আস্তে আস্তে উঠে বসল। নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞসা করল, ঠাণ্ডা লাগালে কি করে?

অনেকটা সেই রকমই নির্লিপ্ত ঢংয়ে কমলা ফিরে জিজ্ঞাসা করল, ঠাণ্ডা লেগেছে তুমি বুঝলে কি করে?

—গলার আওয়াজ শুনে, তাছাড়া ঢাকাঢুকি দিয়ে এসেছ—

তার চোখের ওপর কমলার দু চোখ আকারে বড় হতে থাকল। তারপর রাগত সুরে বলল, দেখো, সাতসকালে গোপাল ঠাকুরের রঙ্গও ভাল লাগে না বলে দিলাম…ঢাকাঢুকি না দিয়ে কবে তোমার সামনে এসেছি?

সকালের ঠাণ্ডা সত্ত্বেও ঝাঁ করে দু কান গরম হয়ে উঠল বাপী তরফদারের। তাড়াতাড়ি ওকে বিদায় করার জন্যেই চায়ের গেলাসের দিকে হাত বাড়ালো।

—মুখ ধোয়া হয়েছে?

—হয়েছে।

সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের চোখে একবার দেখে নিল।—কখন হল?

—কারো ওঠার আগেই হয়েছে, দাও।

গেলাস আর নুন-মাখানো গরম রুটি দুটো সামনে এগিয়ে দিয়ে ঠেসের সুরে কমলা বলে উঠল, দরজায় আওয়াজ শুনেও তাহলে কম্বলের তলায় ঢুকে ছিলে কেন?

বাপী তরফদার জবাব দিল না বা তার দিকে তাকালো না। রাতের নির্জলা উপোসের পর গরম চা আর নুন-ছড়ানো গরম রুটি অমৃতের মতো লাগছে। সকালে চায়ের সঙ্গে রুটি হলে সে চিনি-গুড়ের থেকে নুন পছন্দ করে।

কমলা এস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল। কারণ না বুঝলেও বাপী তরফদার স্বস্তি বোধ করল একটু। কিন্তু দু মিনিটের মধ্যেই দ্বিগুণ বিরক্ত। শাড়ির আঁচলে নিজের চায়ের গরম গেলাস ধরে আবার এ-ঘরে হাজির। চোখের কোণে কৌতুকের ছোঁয়ায় শ্যামবর্ণ মুখ সরস দেখাচ্ছে।

দু চুমুক তল করে বলল, বুড়োটা ঘুমোচ্ছে এখনো, ঠাণ্ডার চোটে উঠে পড়ে আজ এক ঘণ্টা আগে চা বানিয়েছি। তুমি চায়ের পিত্যেশে বসে আছ জানলে আরো আগেই করে দিতে পারতাম। বলতে বলতে একটা হাত পিছন দিকে নিয়ে দরজার একটা পাট বন্ধ করে দিল। তারপর সেদিকের দেয়ালে আড়াল নিয়ে ফিক করে হাসল একটু–তোমার ঘরে এসে গল্প করতে করতে চা খেতে দেখলে কার চোখে আবার কাঁটা বেঁধে ঠিক কি।

কাল রাতে নিজের ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভুলতে পারেনি। আজ এই দিনমানেও ওকে দেখে অস্বস্তি। চাপা বিরক্তির সুরে বাপী বলল, আমার ঘরে এসে চা খাওয়ার দরকারটা কি!

চায়ের গেলাস মুখে তুলেছিল। সেটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে রেখেই হাসি আড়াল করল। —গোপাল ঠাকুরের মনে এক মুখে এক—হুঃ। বড় বড় তিন চার ঢোঁক চা গিলে নিল। তারপর টেনে টেনে বলল, বড়বাবুর কি সাঁঝের টাইমে কোনো ডিউটি-টিউটি জুটেছে নাকি?

—না। নিজের গেলাস খাটিয়ার সামনে মেঝেতে নামিয়ে রাখল।

—তবে কাল রাতে ফিরতে এত দেরি হল?

এবার সত্যি সত্যি ধমকে উঠল বাপী তরফদার। —দেরি হল তো হল—কেন দেরি হল সে জবাবদিহি তোমার কাছে করতে হবে?

গেলাসের চা শেষ করে মুখখানা আর একবার ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার বোধ করল কমলা। ঝাঁজালো ব্যঙ্গ ঝরল তার গলাতেও।— সাধে বড়বাবু বলি! নুন রুটি দিয়ে দিন শুরু তবু মেজাজ কতো! রাত-দুকুর পর্যন্ত হাট-করা খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঠাণ্ডা লাগালাম, সকালে তাই নিয়ে উঠে চা করে খাওয়ালাম—লজ্জাও করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে!

বলতে বলতে এক-পাট খোলা দরজা ভুলে যেভাবে কাছে এগিয়ে এলো, মুহূর্তে দিশেহারা অবস্থা বাপী তরফদারের। কিন্তু না, টুপ করে উপুড় হয়ে তার খাওয়া গেলাসটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে দু চোখে এক ঝলক মেকি আগুন ছড়িয়ে প্রস্থান করল।

বাপী তরফদার পঙ্গুর মতো বসে রইল। তারপর আত্মস্থ হল।…হ্যাঁ, মুখ নেড়ে কথা বলতে লজ্জা করে। আগেও করেছে, এখনো করে। তাই কথা বেশি বলে না, বলতে চায় না। কিন্তু এখন অন্যায় থেকে বেশি করে ভয়। ভয় কমলাকে। তার থেকে ঢের বেশি নিজেকে।

…বানারজুলিতে সোমত্ত বয়সের দু-ঘর সাপুড়ে মেয়ে ছিল। ননদ-ভাজ সম্পর্ক। একজনের মরদ দিন-রাত নেশা করে পড়ে থাকত। আর একজনের মরদের দুটো চোখই বসন্তের গুটিতে খেয়ে দিয়েছে। সেই ননদ-ভাজ একসঙ্গে দু’তিনটে ঝাঁপিতে সাপ পুরে নিয়ে গ্রামে শহরে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াতো। গাল ফুলিয়ে পেটমোটা সাপুড়ের বাঁশি বাজিয়ে যেত ঘাগরা-পরা মেয়ে দুটো। কিছু পয়সা মেলার মতো ভিড় দেখলেই সাপের ঝাঁপি খুলে বসত তারা। হরেক রকমের সাপ বের করত। বাঁশি বাজাতো আর সাপের খেলা দেখাতো। কিন্তু অবাক চোখে বাপী ওই মেয়ে দুটোকেই বেশি দেখতো। হাঁটু গেড়ে বা হাঁটু মুড়ে বসে বসে ফণা তোলা সাপের মতোই সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে কোমর-বুক-মাথা দোলাতো তারা। ওই করে সাপকে উত্তেজিত করতে চাইত। শুধু তাই নয়, সাপের ছোবল খাবার জন্য অঙ্গ যেন চিড়-চিড় করত তাদের। ফণা-তোলা সাপের সামনে ভুঁয়ের ওপর হাত পেতে দিত। ছোবল পড়ার আগেই চোখের পলকে হাত সরিয়ে নিত, মাটির উপর ছোবল পড়ত। এই করে যতবার ওরা সাপকে ঠকাতে পারতো ততো ওদেরও উত্তেজনা বাড়ত। কিন্তু ক্রুদ্ধ সাপের ছোবল একবার না একবার হাতের উল্টো পিঠে বা আঙুলের মাথায় পড়তই। সঙ্গে সঙ্গে দরদর করে রক্ত বেরুতো। ওরা তখন থলে থেকে কি পাতা বার করে দাঁতে চিবিয়ে সে-পাতা ক্ষতর ওপর লাগিয়ে দিত। ছোবল খাবার পরে উত্তেজনার শেষ।

…কমলাও অনেকটা সেই সাপুড়ে মেয়ে দুটোর মতোই। সাপকে দখলে রেখে উত্তেজনা বাড়িয়ে ছোবল খাওয়ার লোভ। কিন্তু সাপুড়ে মেয়েদের সাপের মতো নিজেকে নির্বিষ ভাবে না বাপী তরফদার। তাই কমলার থেকেও নিজেকে বেশি ভয়।

কিন্তু গত সন্ধ্যা থেকে তার ভিতরে ভিতরে সাপের মতোই এক বিষ-বাষ্প কুণ্ডলি পাকাচ্ছে, গজরাচ্ছে, ফুঁসে উঠে ছোবল বসাতে চাইছে। এই অকরুণ অব্যর্থ সন্ধানী লক্ষ আর এক মেয়ে। নাম মিষ্টি। মালবিকা…।

বানারজুলির সবজান্তা আবু রব্বানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, ষোল-সতের বছর বয়সে মিষ্টির চেহারাখানা যা হবে, কোনো না কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর—বিয়ে করে ওকে ঘরে এনে পুরবে, তারপর লুটেপুটে শেষ করবে—বি.এ., এম.এ., পাস করার ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?

হিসেবে ভুল হবার নয় বাপী তরফদারের। নিজের বয়েস চৌদ্দ আর আটে বাইশ। মাস দেড়-দুই বেশি হতে পারে। ওই মেয়ের দশ আর আটে আঠের। সেই চৌদ্দ আর সেই দশ থেকে আটটি বছর সামনে পা ফেলেছে তারা। কিন্তু বাপীর একটা সত্তা চৌদ্দর সেই অবুঝ দুরন্ত রক্তাক্ত গণ্ডীর মধ্যে আটকে আছে এখনো। আর এই মেয়ের সবটাই সেই দশের গণ্ডী টপকে ভরভরতি আঠেরোয় পা ফেলে জাঁকিয়ে বসেছে। অতীতের ছিটে-ফোঁটাও তার গায়ে লেগে নেই। আবু রব্বানীর ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয়নি। ভরাট সময়ে যে রূপ রব্বানীর কল্পনায় ছিল সেটা এ-চেহারার সঙ্গে আদৌ মিলবে না এ বাপী হলফ করে বলতে পারে। তার থেকে ঢের ভালো কি ঢের খারাপ জানে না। মোট কথা মেলেনি, মিলবে না। কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়েছে কিনা জানে না, কিন্তু কেউ ঘরে এনে পুরতে পারেনি এখন পর্যন্ত। সাদা সিঁথিই তার প্রমাণ। বাপী তরফদার আরো হিসেব করেছে। এম. এ. পড়ার বয়স এখনো হয়নি, কিন্তু এযাবৎ ফেলটেল যদি না করে থাকে তো এতদিনে বি.এ., পড়া শুরু করা উচিত।

একটা অসহিষ্ণু তাড়নায় বেলা এগারোটার মধ্যে স্নান-টান সেরে বেরিয়ে পড়ল। শুধু মোটর গাড়ির নম্বরটা সম্বল। শহর কলকাতার শত সহস্র গাড়ির মধ্যে সেই নম্বরের সাদাটে গাড়িটাকে খুঁজে বার করার চিন্তাও হাস্যকর পাগলামি। কিন্তু আট বছর পরের এই হঠাৎ-দেখাটা হঠাৎই শেষ একেবারে, এরকম চিন্তা বাপী বরদাস্ত করতেও রাজী নয়।

এক জায়গায় বেশ করে খেয়ে নিল। অনেক দিন বাদে নিজেকে সুস্থ আর তাজা রাখার তাগিদ। খেয়েদেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে একটা বড় কিছুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতি। আজ আর পা দুটো কোনো আপিসপাড়ার দিকে এগোতে রাজি নয়। গত সন্ধ্যার পথ ধরে হাঁটা শুরু করল। জ্যোতিষীর একতলা ঘরের বাইরের দরজা বন্ধ। খোলা থাকলেও সেখানে ওই বাঞ্ছিত মুখ আজও চোখে পড়বে এমন আশা বাতুলে করে।

জ্যোতিষীর ঘর ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল বাপী তরফদার। অপ্রত্যাশিত হদিস মিলবে এরকম আশা করছে না বটে, কিন্তু রাস্তার দুদিকের একটা বাড়িও তার শ্যেন দৃষ্টি থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাটা ফুরিয়ে গেল একসময়। বেঁকে গিয়ে ট্রাম লাইনের বড় রাস্তায় এসে মিশেছে। সামনে ব্রীজ। একটা রাস্তা গেছে তার তলা দিয়ে। আর একটা রাস্তা ট্রাম লাইন পেরিয়ে লেক-এর দিকে।

গলা দিয়ে অস্ফুট একটা গালাগাল বেরিয়ে এলো। বড় রাস্তার বাস স্টপের ‘ কাছে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়ে রইল বাপী তরফদার। মাঝখানের ট্রাম লাইন ধরে ট্রাম আসছে যাচ্ছে। এক-একটা করে মানুষ বোঝাই বাস এসে দাঁড়াচ্ছে আবার চলে যাচ্ছে। মোটর ছুটেছে অবিরাম। সাদাটে রঙের গাড়ি দেখলে দু চোখ সেটার গায়ে আটকাচ্ছে। সব-কিছুই দেখছে বটে, কিন্তু আসলে সে ভেবে চলেছে।

হঠাৎই মাথায় এলো কিছু। চেষ্টার নাম পুরুষকার। দেখা যাক। সামনে যে বাস পেল তাতেই উঠে পড়ল। সব বাসই ডালহৌসি যায় এ-সময়। গাড়ির নম্বর থেকে বাড়ির হদিশ মেলা সম্ভব কিনা বন্ধু নিশীথ সেন সেটা বলতে পারে। নিশীথের বাবা মধ্য কলকাতার মাঝারি নাম-ডাকের কবিরাজ। নিজের আয়ুর্বেদ ফার্মেসি আছে। তাঁর ঝরঝরে গাড়ি আছে একটা। সেই গাড়িরও নম্বর আছে।

কলকাতায় বাপীর মোটামুটি দরদী বন্ধু বলতে ওই একজনই—নিশীথ সেন। ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে, একসঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বানারহাটে নিশীথ তার দাদুর কাছে থেকে স্কুলে পড়াশুনা করত। জলপাইগুড়ি থেকে আই-এসসি পরীক্ষার পর ছাড়াছাড়ি। নিশীথ আই-এসসির পর কলকাতায় বি-এ পাস করেছে। ছেলেকে মেডিক্যাল কলেজে পড়ানোর ইচ্ছে ছিল বাপের। কিন্তু আই-এসসি’র ফল দুই দাঁড়ির নিচের দিকে ঠেকতে সেটা সম্ভব হয় নি। বি—এ পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ও একটা যুদ্ধের আপিসের চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল। এখনো সে চাকরিতে টিকে আছে, কিন্তু মাথার ওপর ছাঁটাইয়ের খড়্গা ঝুলছে। দুদিন আগে হোক পরে হোক ওটা নেমে আসবেই। তা বলে বাপীর মতো বেকার হবে না সে। বি-এ পড়ার সময় থেকে বাপের কাছে কবিরাজি চিকিৎসার তালিম নিচ্ছে। বাবার সঙ্গে বসে নানারকম কবিরাজি ওষুধ তৈরির কাজে হাত পাকাচ্ছে। রোজ সন্ধ্যার পরে আয়ুর্বেদ ফার্মেসিতে বাবার পাশের কাঠের চেয়ার দখল করে গম্ভীর মুখে ছোট কবিরাজ হয়ে বসতে দেখা যায় তাকে। ছুটির দিনে সকাল—বিকেল দু বেলাই বসে সেখানে। বাপের অনুপস্থিতিতে সে এখন দিব্বি ঠেকা দিতে শিখেছে। চাকরিটা নেহাৎ আছে বলেই ছাড়তে পারছে না। চাকরি গেলে আয়ুর্বেদের দুই-একটা দিশী টাইটেল জুড়ে পাকাপোক্ত কবিরাজ হয়ে বসবে।

নিশীথ সেন আপিসেই আসেনি আজ। আবার একটা গালাগাল বেরিয়ে এলো বাপীর ভিতর থেকে। এটা ছেলেবেলার অভ্যাস। অনেক রকমের কুৎসিত গালাগালও নিঃশব্দে ঠেলে বেরিয়ে আসে।

আবার কলেজ স্ট্রীটের বাস ধরল। কপালে আজ কিছু পয়সা গচ্চা লেখা আছে।

কলেজ স্ট্রীট ছাড়িয়ে আরো একটু উত্তরে এগোলে নিশীথের বাড়ি। বাড়ির কাছেই ওদের আয়ুর্বেদ ফার্মেসি। আগে সেখানে হানা দিল। দরজা বন্ধ, কিন্তু বাইরে তালা ঝুলছে না। অর্থাৎ ভিতরে কেউ আছে। বাপ আর ছেলে ভিন্ন আর কেউ এ দপ্তর খোলে না। এই বেলা দেড়টায় বাপের এখানে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার সম্ভাবনা কম।

বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিল। সাড়া না পেয়ে দরজার গায়ে জোরে দু’চারটে চড়চাপড় বসালো। ভিতর থেকে দরজা খোলা হল।

কাঁচা ঘুম-ভাঙা মুখখানা বিরস দেখালো নিশীথের। হাই তুলে বলল, তুই মরতে এখানে এসে জুটলি—

—আপিস কামাই করে এখানে ঘুমুচ্ছিস?

—বাড়িতে থাকলেই বাবা কোনো পাচন বা সালসা বানাবার কাজে বসিয়ে দিত, এখানেও তুই দিলি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। বোস, খাবি কিছু?

এই বেঁটেখাটো ছেলেটার বুকের তলায় একটু নরম জায়গা আছে। এমনিতে বাস্তববুদ্ধি প্রখর। কিন্তু বেকার বন্ধুর প্রতি সদয়। চাকরির প্রথম কটা দিন ওর বাড়িতেই ছিল বাপী তরফদার। কিন্তু বন্ধুর প্রীতি বেশি, কি অনুকম্পা —জানে না।

বিরক্ত মুখ করে জবাব দিল, তুই ভাবিস আমি খালি খেতেই আসি তোর কাছে। এখন অন্য দরকারে এসেছি মন দিয়ে শোন, তোদের তো একটা গাড়ি আছে?

হঠাৎ গাড়ির খোঁজ কেন ভেবে না পেয়ে নিশীথ সেন শুরু থেকেই সতর্ক।—আছে একটা, কিন্তু তার ওপর বাবা ছাড়া আর কারো দখল নেই।

—আরে বাবা আমি তোদের গাড়ি চাইছি না; কোনো গাড়ির নম্বর যদি তোকে দিই তুই তার মালিকের ঠিকানা বার করে দিতে পারিস?

নিশীথ সেন অপ্রস্তুত একটু। —সে আবার কি—!

—আমার খুব দরকার। কাল হঠাৎ ভদ্রলোকের গাড়িটা দেখলাম, চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, নম্বরটা মনে আছে, বাড়ির ঠিকানা বার করতে পারলে একটা চাকরি-বাকরি হতে পারে—

নিশীথ সেন জ্যোতিষী নয়, তাছাড়া পরিস্থিতিও সন্দিগ্ধ হবার মতো নয়। একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রলোকের কোন্ আপিস বা কি চাকরি জানিস না?

জেরা পছন্দ নয়।—সে জানলে আর তোর কাছে আসব কেন, বড় চাকরিই করে নিশ্চয়, এককালে খুব চেনাজানা ছিল, ধরতে পারলে একটা সুরাহা হতে পারে।

—ভদ্রলোকের নাম কি? ফোন-গাইড দেখেছিস?

ভদ্রলোক বাপী তরফদারের চিন্তার মধ্যেও নেই বলেই তল্লাসীর এই প্রাথমিক রাস্তাটা মনে পড়ে নি। —সন্দীপ নন্দী…ফোন-গাইড আছে এখানে?

জবাব না দিয়ে নিশীথ সেন ঢাউস টেলিফোন গাইডটা টেনে নিল। সাগ্রহে খোঁজাখুঁজি চলল খানিকক্ষণ। দুজন সন্দীপ নন্দীর নাম পাওয়া গেল, কিন্তু বাড়ির ঠিকানা দক্ষিণ কলকাতার নয়। তাছাড়া তাদের একজন ডাক্তার আর একজন অ্যাডভোকেট। নন্দী এস-এর মধ্যে একগাদা নম্বর। ফোন-গাইড বন্ধ করে নিশীথ জিজ্ঞাসা করল, গাড়ির নম্বর ঠিক মনে আছে?

বাপী তরফদার গড়গড় করে নম্বর বলে দিতে সে একটু ভেবে মন্তব্য করল, মোটর ভেহিলিস্-এ গেলে বাড়ির ঠিকানা বার করা যায়, অনেক দূর—

—সেটা কি? সেটা কোথায়?

—তোদের ও-দিকেই। সেখানে কলকাতার সমস্ত গাড়ির ঠিকানাপত্তর থাকে। কাল একবার খোঁজ করে দেখ না —

—কাল নয়, আজই। বাপী তরফদার সাগ্রহে উঠে দাঁড়াল।—আমার দ্বারা হবে না, চল আমি তোকে বাস ভাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আবার পৌঁছেও দেব—

তাগিদ বোঝাবার জন্যেই এরকম করে বলা।

মোটর ভেহিকিলস্-এর অপরিচিত চত্বরে পা ফেলতেই জনা-তিনেক হা-ঘরে মূর্তি হেঁকে ধরল। কি চাই? নতুন লাইসেন্স না রিন্যুয়াল? লার্নার্স লাইসেন্স? ট্র্যান্সফার?

এখানে একলা এলে বাপী তরফদার কোনো কিছুর হদিস পেত কিনা সন্দেহ। কিন্তু নিশীথ সেন-এর জানা আছে। দালালদের মধ্য থেকে সব থেকে দুঃস্থ মার্কা লোকটাকে বেছে নিল সে। তারপর বক্তব্য জানালো। গাড়ির নম্বর থেকে বাড়ির ঠিকানা বার করে দিতে হবে।

এরকম ফরমাস পেতে অভ্যস্ত নয় এরা। দুরূহ দায়িত্ব নেবার মতো মুখ করে দালাল পাঁচ টাকা দর হাঁকল। বাপী তরফদার তক্ষুনি পাঁচ টাকাই বার করতে রাজি। কিন্তু নিশীথ সেন আট আনা থেকে শুরু করে এক টাকায় রফা করে ফেলল।

দশ মিনিটেই মধ্যে কাজ হাসিল। কিন্তু ঠিকানা হাতে নিয়ে নিশীথ সেন হাঁ… না সন্দীপ না নন্দী। সেই নম্বরের গাড়ির মালিকের নাম অনিমেষ ঘোষ!

বিব্রত মুখে বাপী তরফদার তার হাত থেকে কাগজটা নিল। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা দেখে আশান্বিত একটু। সেই জ্যোতিষীর ডেরার রাস্তায় বাড়ির নম্বর। একটা টাকা দিয়ে দালাল বিদায় করে বন্ধুকে বলল, কোনো আত্মীয়ের গাড়ি হবে হয়তো ওটা—

নিশীথ সেন প্রস্তাব করল, এতটাই যখন করা গেল ওটুকু আর বাকি থাকে কেন—চল্, ওই ঠিকানাতেই খোঁজ কর দেখি তোর চেনা লোকের হদিস মেলে কিনা।

—না, না, আজ আর ভালো লাগছে না। বাপী তরফদার ব্যস্ত হয়ে উঠল।— মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, নাম মিলছে না, চলতি গাড়িতে কাকে দেখতে কাকে দেখলাম কে জানে। ইয়ে, আমি এ-দিকে একটু কাজ সেরে যেতাম…তোকে পৌঁছে দিতে হবে?

তাকে অব্যাহতি দিয়ে নিশীথ সেন নিজের বাস ধরল। তারপর…। তারপর অপচয় করার মতো হাতে আর এক মুহূর্তও সময় নেই বাপী তরফদারের।

…সেই রাস্তা।

মিথ্যেই অনেকটা আগে থেকে রাস্তার ডান দিকের বাড়িগুলোর দিকে চোখ রেখে দ্রুত হেঁটে চলেছে বাপী তরফদার। রাস্তার বাঁয়ের বাড়িগুলোর জোড় নম্বর। তার বে-জোড় নম্বর চাই। নিজের ওপরেই বিরক্ত। বোকার মতো বেশি হাঁটছে। ওই নম্বরের বাড়ি রাস্তার শেষ মাথায় হবে। বাসে চেপে এসে শেষ দিক থেকে খুঁজতে খুঁজতে এলে সময়ের সাশ্রয় হত। শীতের বেলা পড়ে আসছে, তার হাঁটার গতি বাড়ছে।

কম করে দেড় মাইল লম্বা এই রাস্তা। জ্যোতিষীর বাড়ি সিকি মাইলের মধ্যে। লোকটা বিকেলেই দপ্তর খুলে বসেছে, আর আশ্চর্য, খদ্দেরও জুটেছে! জানলা দিয়ে একটা অসহিষ্ণু দৃষ্টি ছুঁড়ে বাপী তরফদার হনহন করে এগিয়ে চলল।

বাড়ির নম্বর যতো বাড়ছে, উত্তেজনাও বাড়ছে ততো। একটা বাড়ির সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেল শেষে।…নম্বর মিলেছে। সামনে কোলাপসিবল গেট লাগানো শূন্য গ্যারাজ। তার কোণের দিকে দেয়ালের গায়ে বাড়ির নম্বর-প্লেট। ছোটর ওপর ছিমছাম বাড়ি।

বুকের ভিতরটা ধপ-ধপ করছে বাপী তরফদারের। …ওই গাড়িটা হয়তো এই বাড়িরই, কিন্তু মিষ্টি মালবিকা নন্দী নামে কোনো মেয়ে কি সত্যিই এখানে থাকে? পনের বিশ গজ এগিয়ে গিয়ে রাস্তা টপকে উল্টো দিকের ফুটপাথ-এ এসে দাঁড়াল। দোতলার বারান্দাটা ফাঁকা। তার ও-ধারে পর পর তিনটে ঘরে লোক চলাচলের আভাস পাচ্ছে। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

নির্নিমেষে ওই দোতলার দিকেই চেয়ে আছে বাপী তরফদার। হঠাৎ তন্ময়তায় ছেদ পড়ল কেন জানে না। উল্টো দিকের বাড়িটার একতলায় বাঁধানো দাওয়ায় তারই বয়সী জনা-তিনেক ছেলে বসে সিগারেট টানছে। তারা ওকে দেখেই হাসাহাসি করছে বোধ হয়। আবার ঘন ঘন সামনের বাড়িটার দোতলার দিকে তাকাচ্ছে।…এদিকের একটা বাড়ির দোতলায় রেলিংএর সামনে সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একজন সুশ্রী লোক দাঁড়িয়ে। তারও দৃষ্টি ওই বাড়িটার দোতলার বারান্দার দিকে। বাপী তরফদারের হঠাৎ কেমন মনে হল সিগারেট-মুখে ওই ছেলেগুলো বা দোতলার ওই লোকটাও তারই মতো কারো দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। বাপী তরফদারের আশা বাড়ছে।

হঠাৎ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হবার দাখিল তার। ঘর থেকে ওই দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে একজন। খোলা চুল ফোলা-ফোলা মুখ। মনোরমা নন্দী! মিষ্টির মা।

সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস ফেলল বাপী তরফদার। একটা প্রকাণ্ড অনিশ্চয়তার অবসান। অনিমেষ ঘোষ যে-ই হোক, মিষ্টি এ বাড়িতেই থাকে।

ভুরু কুঁচকে মহিলা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দাওয়ার ছেলে তিনটিকে দেখলেন একবার। সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা লোকটাকেও দেখলেন। তারপর বাপীর দিকে চোখ গেল তাঁর। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন আবার।

বাপী তরফদারের মনে হল শেষের বিরক্তিটুকু এক বাড়তি উপদ্রব দেখার দরুন। অর্থাৎ তাকে দেখেই।

এর তিন-চার মিনিটের মধ্যে দাওয়ার ছেলে কটা সচকিত। তিনজনেরই ঘাড় রাস্তার উল্টো দিকে ফিরেছে। …হ্যাঁ, ও-দিক থেকে সাদাটে গাড়ি আসছে একটা। সঙ্গে সঙ্গে তারও ধমনীর রক্তে দাপাদাপি

গাড়িটা এই সাতাশি বাড়ির গায়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। তবু সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সাদাটে গাড়ি। এঞ্জিনের সামনে সেই নম্বরের প্লেট।

গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে হর্নও বেজেছে। মনোরমা নন্দী আবার দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ভিতর থেকে একটা অল্পবয়সী চাকর ছুটে এসে গ্যারাজের তালাবন্ধ কোলাপসিবল গেট খুলতে গেল।

বাপী তরফদারের একাগ্র দু চোখ গাড়িটার গায়ে আটকে আছে। পিছনের দরজা খুলে প্রথমে মিষ্টি নামল। বুকের সঙ্গে একপাঁজা বই ধরা। পরনে হালকা সবুজ শাড়ি, সবুজ ব্লাউস। নেমে দাঁড়াল একটু। পিছনে আর একজন প্যান্ট-কোট পরা বৃদ্ধ লোক নামছেন। তাঁর জন্য কয়েক পলকের প্রতীক্ষার ছলে দাঁড়িয়ে তিন দিকে তিন ঝলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মিষ্টি নন্দী : প্রথমে দাওয়ার ছেলে তিনটের দিকে— তাদের কারো মুখে সিগারেট নেই এখন। তারপর সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-আঁটা সুশ্রী গম্ভীর মূর্তির দিকে।

তারপর বাপী তরফদারের দিকে। তাকে দেখাটা নতুন পতঙ্গ দেখার মতো। পলকা ঝটকায় ঘুরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।

সোনার হরিণ নেই – ৪

আবু রব্বানী বলেছিল, যদি মরদ হোস তো একদিন শোধ নিবি। একটা চোখ ছোট করে অন্য চোখ সটান তাকিয়ে শুধিয়েছিল, কি রকম শোধ বুঝলি?

চৌদ্দ বছরের বাপী মাথা নেড়েছিল, বুঝেছে। আবুর কল্যাণে এর ঢের আগে থেকেই না-বোঝার মতো কত কি জল-ভাত তার কাছে। তাছাড়া না বুঝলে নিজের কপাল নাক মুখ তো অক্ষতই থাকত। শোধ নেওয়ার কোনো কথাই উঠত না। তবু আবু রব্বানীর কথাগুলো নতুন করে মনে পড়েছে বাপীর।

পরের দুদিনও একটা অবুঝ অস্থিরতা সকালে-বিকেলে গলায় শেকল পরিয়ে এ পর্যন্ত টেনে এনেছে তাকে। এই সাতাশি নম্বর বাড়িটার দরজা পর্যন্ত। শুধু অস্থিরতা নয়, এক ধরনের অব্যক্ত উপোসী যন্ত্রণাও। শুকনো দুই ঠোঁট বার বার জিভে ঘষেছে। নিজের একদিনের সেই থ্যাতলানো মুখের রক্তের নোনতা স্বাদ লেগেই আছে। সেই ফয়সালা বাকি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার স্বপ্ন দেখতে অসুবিধে হয়নি। কল্পনার জগতের সোনার সিংহাসনেও চেপে বসা গেছে। তারপর এক মেয়ের সঙ্গে চরম কিছু ফয়সালার মুখোমুখি এসে থেমে গেছে। সেটার ছক কোনো সময় মনের মতো হয়নি।

সেটা আজও বাকি। সেই মেয়ের দেখা মেলার সঙ্গে সঙ্গে নিভৃতের একটা অস্বাভাবিক বিশ্বাস মগজে দাগ কেটে বসেছে। ফয়সালা হবে বলেই এত বড় দুনিয়ায় এত বছর বাদে আবার দেখা তার সঙ্গে।

ভিতরে ভিতরে এমন একটা নাড়াচাড়া না পড়ে গেলে বাপী তরফদার হয়তো আর একটু মাথা খাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে পা ফেলে চলত। গত পরশু আর কাল শুক্রবার আর শনিবার গেছে। এ দুদিনের হাজিরায় কোনরকম ব্যাঘাত ঘটেনি। সকাল সাড়ে নটার আগে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালের নেম-প্লেটের নামটা মুখস্থ হয়ে গেছে। অনিমেষ ঘোষ, অ্যাডভোকেট। মালবিকার মায়ের বাবা হবে হয়তো। মুখ দেখে আর বয়েস আন্দাজ করে সেইরকমই মনে হয়েছে।

…পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রথমে বই বুকে করে বেণী দুলিয়ে ওই মেয়েকে সুতৎপর গাম্ভীর্যে গাড়িতে উঠে বসতে দেখেছে। তিন দিনে তিন রকমের শাড়ি পরতে দেখল। যেদিন যেটা পরেছে সেটাই যেন সব থেকে ভালো মানিয়েছে। গাড়িতে ওঠার ফাঁকে বাপীর দিকে চোখ গেছে। উল্টো দিকের রকে আর দোতলার বারান্দায়ও। দোতলার বারান্দায় সোনালি ফ্রেমের চশমা। রকে দুটো তিনটে বা চারটে ছেলে। বাপীকেও এদের মতোই নতুন একজন ধরে নেওয়া হয়েছে, সন্দেহ নেই। চিনতে না পারাটা বাপীর ক্ষতর ওপর নুন ছড়ানোর মতো লেগেছে।

এক আধ মিনিটের মধ্যে বয়স্ক ভদ্রলোক গাড়িতে এসে ওঠেন। দোতলার বারান্দায় তখন মালবিকার মা মনোরমা নন্দীর অপ্রসন্ন মুখখানাও দেখা যায়। গাড়িটা সকলের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেলে তিনি ভিতরে পা বাড়ান বিকেলেও একই ব্যাপার। পাঁচটা পনের থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে সাদা গাড়ি সাতাশি নম্বরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ওই মেয়ে আগে নেমে ভিতরে চলে যায়। পিছনে বয়স্ক ভদ্রলোক। তাঁর কোনদিকে বা কারো দিকে চোখ নেই। আত্মতৃপ্ত সুখী মানুষ মনে হয়। রকে সেই দুটো তিনটে বা চারটে ছেলে। সামনের দোতলার ।বারান্দায় সেই সোনালি ফ্রেমের চশমা। আর সাতাশি নম্বরের দোতলার বারান্দায় মনোরমা নন্দীর অপ্রসন্ন মুখ।

…গত বিকেলেও বাড়িতে ঢুকে পড়ার ঝোঁক অনেক চেষ্টায় সামলেছে বাপী তরফদার। আজ রবিবার। কলেজ বন্ধ। সকাল সাড়ে আটটা না বাজতে ভিতরের দুর্জয় তাড়না তাকে এখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে। এমনিতে দেখা পাওয়ার আশা কম। আজ বাপী ভিতরে ঢুকেই পড়বে। তারপর যা হয় হবে। এরকম ঝোঁকের ফলেই অন্য কোনো বাস্তব সম্ভাবনা তার হিসেবের মধ্যে ছিল না।

খাবার লোভে বা সঙ্গিনীর লোভে কোনো বেপাড়ার কুকুর সীমানা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়লে পাড়ার সগোত্র-দল সেটা যেমন বরদাস্ত করে না, ঘেউ ঘেউ রব তুলে চারদিক থেকে ছেঁকে ধরে আঁচড়ে কামড়ে ওটাকে পাড়া-ছাড়া করতে চায়—হঠাৎ সেই গোছের দাঁড়াল অবস্থাখানা। রোববারের রকের মজলিশে জন পাঁচেক বসে। পর পর কদিন সকাল-বিকেলে দুবেলা একটা উটকো লোককে ওই সাতাশি নম্বর বাড়ির সামনে টহল দিতে দেখেছে তারা। সামনের দোতলা বাড়ির সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা সুশ্রী লোকটাও দেখেছে। সকলেরই একসঙ্গে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

আগেও এদের হাব-ভাব সদয় মনে হয়নি বাপী তরফদারের। তা বলে এরকম অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সাতাশি নম্বরের সামনে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে রকের ছেলেগুলো উঠে এসে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ওদের এক মুরুব্বির হাত সোজা তার কাঁধের ওপর উঠে এলো।

—কি মতলব ব্রাদার?

বাপী তরফদার জবাব হাতড়ে পেল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

পাশ থেকে একজন সোল্লাসে ফোড়ন কাটল, অসুবিধে দেখে ব্রাদার বোবা হয়ে গেছে, দু’ঘা না বসালে কথা বেরুবে না।

এসব মজার ব্যাপারের চট করে গন্ধ পায় লোকে। অবশ্য একটু চেঁচামেচিও শুরু হয়ে গেছে। এদিক ওদিক থেকে বাচ্চা-কাচ্চারা স-কলরবে দৌড়ে আসছে। রাস্তার দুদিকেরই দোতলার বারান্দায় লোক দেখা যাচ্ছে। ভেবাচাকা খাওয়া মুখ তুলে বাপী তরফদার তাদেরও দেখল একবার। এদিকে মালবিকা… মিষ্টি… রেলিংএ ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। পাশে তার মা। ওদিকে সেই সোনালি ফ্রেমের চশমা। পাশে আরো দুই-একজন। পরিস্থিতি জমে উঠতে যারা তাকে ছেঁকে ধরেছে তাদেরও উল্লাস বেড়েছে। এদিক ওদিক থেকে ধাক্কা মেরে কথা বার করতে চেষ্টা করছে। মুরুব্বিটি কাঁধে একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়ে তর্জন করে উঠল, জিভ টেনে ছিঁড়ব বলে দিলাম। কি মতলবে রোজ দুবেলা এখানে এসে ছোঁক ছোঁক করা হচ্ছে?

নিরুপায় বাপী তরফদার এবারে সাতাশি নম্বরের বাড়িটাই দেখিয়ে দিল। ওখানে ঢোকার জন্যে।

ছেলেগুলো থমকে গেল একটু। সকলেই বাড়িটার দিকে তাকালো। দলের

মুরুব্বি এবারে যথাসম্ভব গলা মিষ্টি করে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা কদিন ধরে এই লোকটা আপনাদের বাড়িতে ঢোকার জন্যে ঘুরঘুর করছে বলছে— একে চেনেন নাকি?

সরোষে মাথা নেড়ে মনোরমা নন্দী ভিতরে চলে গেলেন। মেয়ে দাঁড়িয়েই থাকল।

কাঁধ ছেড়ে মুরুব্বি এবার মুঠো করে বুকের জামা টেনে ধরল তার।—শালা মেরে একেবারে তক্তা বানিয়ে দেব—পাড়ায় ঢুকে এত সাহস তোমার?

সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক থেকে জামা ধরে টানাটানি চলল। জামাটা ফ্যাস—ফ্যাস করে ছিঁড়তে থাকল। কাঁধে কোমরে দুই-একটা গুঁতোও পড়ল। একজন চুলের মুঠি চেপে ধরেছে।

সামনের বাড়ির দোতলা থেকে সোনালি, ফ্রেমের সুশ্রী তরুণ গম্ভীর নির্দেশের সুরে বলল, ঘাড় ধরে পাড়ার বার করে দিয়ে এসো, আর যেন না ঢোকে!

এই নির্দেশ মতোই কাজ করল ছেলেগুলো। মারধরের দিকে না গিয়ে রাস্তা পার করে দেবার জন্যেই সামনের মোড় পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে চলল তাকে। যে লোভে নিজেরা সকাল-বিকেল রকে বসে থাকে সেই লোভেই আর একজন একটু বেশি এগিয়ে এসেছে বলে কত আর হেনস্থা করা চলে। আশা তো কারোরই নেই, চোখে দেখাই সার। মোড়ের এধারে ছেড়ে দিয়ে শুধু শাসালো, আর এদিকে রস করতে এসো না ব্রাদার, ওই অসিতদা না বললে আজ তোমার মিষ্টি মুখখানা একেবারে থেঁতো হয়ে যেত।

তার ওপর দিয়ে বিস্ময়ের পলকা রঙ চড়ালো আর একজন। —কি ব্যাপার বল্ তো মাইরি, ওই অসিতদার সব থেকে বেশি কলজেয় জ্বালা ধরার কথা, আর সে-ই আগেভাগে ক্ষমা করে ফেলল।

মুরুব্বি গম্ভীর মন্তব্য করল, রোমান্টিক গ্রেটনেস। থাম্ এখন—

বাপীকে বলল, যাও বাছা, ঘরের ছেলে ঘরে চলে যাও —

ওরা ফিরে চলল। বাপী তরফদার সেদিকে চেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ফর্সা লোকটাই অসিতদা হবে। একটা মেয়ের জন্য তারও কলজে পুড়ছে আগেই বুঝেছিল। এখন আরো ভালো বোঝা গেল।

হনহন করে হেঁটে চলল বাপী তরফদার। কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সকলেই আস্ত ট্রাউজারের ওপর লণ্ডভণ্ড ছেঁড়া জামাটা দেখছে। আক্রোশের একটা জ্বলন্ত পিণ্ড গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে। সেখান থেকে একটা অসহ্য তাপ চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ছে।

এত বড় হামলাটা যারা করল, রাগ এই মুহূর্তে তাদের ওপর নয়। গুষ্টির পিণ্ডি ওই অসিতদা না কে, তার ওপরেও নয়। আক্রোশ নিজের ওপর। আরো বেশি দোতলার রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়ানো ওই মেয়ের ওপর। যার নাম মালবিকা। মিষ্টি তাকে ঘিরে সেই মেয়ে একপাল পথের কুকুরের খেয়োখেয়ির মজা দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।…আবু রব্বানী বলেছিল, মরদ হোস তো শোধ নিবি। সেই চরম শোধের নিষ্ঠুর অভিলাষ শিরায় শিরায় জ্বলছে এখন।

উঠোনে পা দিতেই রতন বনিকের বউ কমলার সঙ্গে চোখাচোখি। এটাই সব থেকে অবাঞ্ছিত বাপী তরফদারের। উঠোনের একধারের বাঁধানো কলতলায় শুধু কমলা ছাড়া আর কেউ নেই। বেলা দশটার ওধারে এখন কারোরই থাকার কথা নয়। ছুটির দিনে পুরুষেরা ভালো-মন্দ বাজার করে আনে, তারপর ঘরে বসে বা বাইরে কোথাও আড্ডায় মশগুল হয়। মেয়েরা রান্নায় ব্যস্ত থাকে। টিউব—ওয়েলের হাতল চালিয়ে কমলাকে ওখান থেকে জল নিতে কমই দেখা যায়। তার ঘরের জল এমন কি স্নানের জলও রতনই তুলে দেয়। তাদের রান্নাঘরের পিছনে ছোট ঘেরানো স্নানের জায়গা আছে। আব্রু যাদের তাদের অনেক ঘরেই এরকম ব্যবস্থা।

আজ হয়তো কোনো কারণে জল ফুরিয়েছে। রবিবারে বেলা দুটো আড়াইটের আগে রতনের টিকির দেখা মেলে না। বাজার ফেলে দিয়েই সে বেরিয়ে পড়ে। ছুটির দিন মানেই তার কিছু বাড়তি রোজগারের দিন। বেশ খানিকটা আদর-কদর মেলার দিন। অনেক ক্লায়েন্ট জোটে। কোনো কোনো রবিবারে আবার আপিসের বাবুদের বাড়িতেও ভবিষ্যৎ-বচন শোনাতে যেতে হয়।

অন্য দিন হলে টিউবওয়েলের হাতল চালিয়ে কমলার ঘড়ায় জল ভরার দৃশ্যটা দেখতে মন্দ লাগত না বাপীর। আজ ভিতরটা ডবল চিড়চিড় করে উঠল। শুধু ওর হেনস্থা দেখার জন্যেই যেন বউটা এ সময় ওখানে দাঁড়িয়ে।

কমলার এদিকে অর্থাৎ সামনের দিকে মুখ। উঠোনে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি। টিউবওয়েলের হাতল হাতেই থেকে গেল। নামছে উঠছে না। কমলার দু’চোখ কপালে।

ওই দৃষ্টি থেকে সরোষে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে বাপী তরফদার ঘরে ঢুকেই ঠাস করে দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। নড়বড়ে দরজায় ছিটকিনি নেই, ছেড়ে দিতেই চার ছ’ আঙুল ফাঁক আবার।

পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে ক্যাঁচ করে একটা মৃদু শব্দ কানে আসতেই বাপীর ঝাঁজালো দৃষ্টি দরজার দিকে। এক পাট খুলে কমলা ঘরে ঢুকল। শাড়ির আঁচলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে দু পা এগিয়ে এলো। বাপী তার খাটিয়ায় বসে। ছেঁড়া—খোঁড়া জামাটাও গা থেকে খোলার ফুরসৎ পেল না। দু চোখের উগ্র ঝাপটায় ওকে আবার ঘর থেকে বার করে দিতে চায়।

চোখের বিস্ময় মুখে নেমে এলো কমলার। ব্যাপার কি গো বড়বাবু মারামারি-টারামারি করে এলে নাকি কোথাও থেকে?

এই অবস্থা দেখে ঢুকেছে যখন এমনিতে ঘর ছেড়ে যাবার মেয়ে নয় কমলা। বাপী কি করবে এখন? জবাবে উঠে এসে ধাক্কা মেরে বার করে দেবে?

কমলা খুঁটিয়ে দেখছে ওকে। উসকোখুসকো চুল, ক্রুদ্ধ বিবর্ণ মুখ, ছেঁড়া—খোঁড়া ঝলঝলে জামা। চকিতে কাছে এগিয়ে এলো সে। বাপীর হাঁটুর লাগালাগি প্রায়। তারপর ঝুঁকে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে গা দেখতে চেষ্টা করল। আঘাতের দাগ চোখে পড়ে কিনা সভয়ে তাই দেখছে।

বাপীর গলার কাছে একটা গরম নিঃশ্বাসের ছেঁকা লাগল। পরের মুহূর্তে মাথায় ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠে গেল। দুটো চোখের শলাকা কমলার ঝুঁকে পড়া মুখ থেকে নেমে বুকের ওপর বিদ্ধ হল।…বহুদিনের উপোসী ক্রুদ্ধ জানোয়ারটাকে এই মুহূর্তে খোলস ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেবে? স্থান ভুলে কাল ভুলে রসাতলে ডুবে যেতে দেবে? আজকের অত বড় অপমানের জ্বালা জুড়োবে তাহলে?

আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কমলা বিষম থতমত খেল এক প্রস্থ। দু’পা পিছনে সরে গেল। এরকম চাউনির একটাই অব্যর্থ অর্থ হতে পারে বুঝি। কৈফিয়তের সুরে বলল, কোথাও লাগল-টাগল কিনা দেখছিলাম….

ফাঁড়া কাটলো। নিজের কি সামনে যে দাঁড়িয়ে তার, বাপী জানে না। মাত্র কটা মুহূর্তের মধ্যে নিজের সঙ্গে অনেক যুঝে অশান্ত ক্রুদ্ধ জানোয়ারটাকে আবার খোলসের ভিতরে ঠেলে দিতে পেরেছে। কিন্তু তার ধকল চোখেমুখে এখনো এত স্পষ্ট যে কমলাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মনে হল। বাপী তার মুখের ওপর রূঢ় ঝাপটা মেরে বসল একটা।—কেন দেখছিলে? কেন তোমরা এভাবে জ্বালাতন করো আমাকে?

—আমরা! কমলার বিস্ময়-ঝরা দু’চোখ তার মুখের ওপর নড়েচড়ে স্থির হল।…অন্য কোনো মেয়ের জ্বালাতনে আজ এই হাল নাকি তোমার?

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই চলেছে।—তুমি যাবে এখন এখান থেকে?

কমলা মোলায়েম করে বলল, কি হয়েছে শুনি আগে—উঠোনে পা দিতেই ওই মূর্তি দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম—

খাটিয়া ছেড়ে বাপী প্রায় তেড়েই এলো, তুমি এক্ষুণি যাবে কি যাবে না আমি জানতে চাই?

কমলা চেয়ে আছে। রাগ ছাড়া কিছু দেখার আছে যেন। এক পাট খোলা দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। গম্ভীর। শামলা মুখ একটু মচকে বলল, আমার বাড়ি আমার ঘর, তুমি তাড়াবার কে?

—ও। ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি।

অসহিষ্ণু হাতের টানে ছেঁড়া জামাটা ছিঁড়েই গা থেকে খুলে খাটিয়ার ওপর আছড়ে ফেলল। দড়ি থেকে আর একটা আস্ত জামা টেনে নিয়ে সরোষে দরজার দিকে এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। এক পাট খোলা দরজা আগলে কমলা তেমনি দাঁড়িয়ে।

দুজনে সোজা তাকালো দুজনের দিকে। বাপীর লাল চোখ। কমলা প্রায় তেমনি গম্ভীর।

—কি হল, যাও?

বাপী ফুঁসে উঠল, সরো বলছি!

পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে একবার বাইরেটা দেখে নিল কমলা। কেউ নেই। থাকলেও এই দিনমানে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখলে খুব কিছু মনে করবে না কেউ। বুড়োর গণনা আর বোলচালের ফলে বড়বাবুকে এখনো মস্ত বাবুই ভাবে সকলে।

আবার সোজা তাকিয়ে পলকা ঝাঁজে কমলা বলল, এক বস্ত্রে চলে যাচ্ছ— তোমার ওই রাজ-শয্যা, বাড়তি জামাটামা আর ওই ভাঙা টিনের সুটকেস কার জন্যে রেখে যাচ্ছ?

বয়েস মাত্র বাইশ, কিন্তু নিজের ভিতরের বয়েস কতো এগিয়ে আছে বাপীই শুধু জানে। রমণীর এই তেজ আর এই উক্তির বিপরীত রসের আঁচটুকু ভালোই অনুভব করতে পারে। সভয়ে এদিকটাই এড়িয়ে চলেছে এতকাল। কিন্তু আজ হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। এই মেয়ে ভিতর দেখেছে তার। সেই জোরেই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কথা বলছে।…এক মেয়ের চোখের ওপর অপমানের সেই চাবুকের জ্বালা আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে। এখন সামনে এক হাতের মধ্যে যেভাবে আর একজন দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে জ্বালা জুড়োবার সেই ক্রুর লোভ নিজের দুটো চোখের তারায় আবারও চিকিয়ে উঠছে।

এবারে কমলার গলার স্বর মোলায়েম-এ।—ঠাণ্ডা হয়ে বোসোগে যাও। তার পর ইচ্ছে হয় বলবে, ইচ্ছে না হয় বলবে না। আমি কি তোমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছি!

ভিতরের অসহিষ্ণু তাড়না মাড়িয়ে বাপী খাটিয়ায় এসে বসল।

কমলা অনড় তার পরেও। দেখছে। ———এক গেলাস চা করে এনে দেব?

—না!

—বাবা রে বাবা, বাইরে কোথায় কি কাণ্ড করে এসে এখন ঘরের ভালো মানুষদের কাছে যত দাপট আর হম্বি-তম্বি…রান্নাটা সেরে ফেলিগে যাই, তুমিও চানটান করে মাথা ঠাণ্ডা করো।

যেতে যেতে চোখের কোণ দিয়ে খাটিয়ায় বসা মুখখানা আর একবার দেখে নিল।

বাপী সটান শুয়ে পড়ল। স্নায়ুর ওপর দিয়ে আবার এক প্রস্থ ঝড় বয়ে গেছে। অসাড়ের মতো পড়ে থাকল খানিক। নিজের বুকের তলার টিপটিপ শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ নিজের ওপরেই আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগল সে। এই পৃথিবীর মুখ একেবারে না দেখলে কি হত? না জন্মালে কি হত? মানুষের খোলসে ঢাকা ভিতরের এই হিংস্র অবুঝ জানোয়ারটাকে আর কতকাল ধরে পুষবে? মাত্র কটা মুহূর্তের জন্য হলেও খোলস ছিঁড়ে নিঃশব্দ হুংকারে ওটা বেরিয়েই এসেছিল। থাবা উঁচিয়েছিল। কমলা দেখেছে। চিনেছে। অথচ সত্যিই তার দোষ নেই। যে মূর্তিতে ঘরে ফিরতে দেখেছে, আঁতকে ওঠারই কথা। ছুটে আসারই কথা।

চোখের সামনে আর একখানা মুখ ভেসে উঠল। সে-ও রমণীর মুখ। অকরুণ মুখ। কিন্তু সেদিন সেই সময়ে খুব অকরুণ ছিল না। মণিদার বউ গৌরী। বাপীর থেকে ছ’ বছরের বড় গৌরী বউদি। রসভঙ্গের এক মূর্তিমান কৌতূকের মতো বাপী তরফদার অসময়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে দেরি তখনো। সেই প্রকাশ্য নির্জনে পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাট থেকে কোনো পুরুষের বেপরোয়া অভিলাষের আবেদন এবং এ ফ্ল্যাট থেকে সেটা নাকচের নিঃশব্দ প্রহসন চলছিল। বাপী তরফদার স্বচক্ষে দেখেছে। দোতলার বারান্দা থেকে ওকে দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে একটা লঘু ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করেছিল গৌরী বউদি। রস-ভঙ্গের ব্যাপারখানা উপভোগ্য ব্যতিক্রমের মতো।

…সেদিনও মাথায় আগুন জ্বলছিল বাপী তরফদারের। অপমান আর হতাশার যন্ত্রণা ভিতরটা কুরে খাচ্ছিল। সেই মূর্তি দেখে কমলার মতো আঁতকে উঠে গৌরী বউদি বসার ঘরের দরজা খুলে ছুটে না আসুক, কাছেই এসে দাঁড়িয়েছিল।

—কি ব্যাপার? এ সময়ে যে?

জবাব না পেয়ে আর একটু এগিয়ে এসে গৌরী বউদি আরো ভালো করে দেখে নিয়েছিল।—এই মূর্তি কেন? কে তাড়া করল?

…সেদিনও বাপী তরফদার স্থানকাল ভুলেছিল। পুরুষের রোষে বাসনা ঝলসে উঠেছিল। মনে হয়েছিল অপমান আর হতাশার আক্রোশ উজাড় করে জাহান্নমে ডুবিয়ে দেবার মতো এক রমণীয় আধার নাগালের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

…আর, চোখের সামনে হঠাৎ একটা দুর্বিনীত তাজা পুরুষ দেখেছিল গৌরী বউদি।

কি মনে হতে বাপী তরফদার খাটিয়ায় উঠে বসল। তারপর জামাটা টেনে নিয়ে গায়ে পরল। তাকে চান করে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলে কমলা রান্না সারতে গেছে। রান্না শেষ হলেই আবার আসবে। ওকে ঠেলে স্নানে পাঠাবে। তারপর জোর করে ঘরে ধরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসাবে। নয়তো এ-ঘরে ওর খাবারটা নিয়ে আসবে। পরে কি হবে বলা যায় না, কমলা গৌরী বউদির মতো নয় এখনো। তার মতো অকরুণ নয়। মায়া দয়া আছে। আছে বলেই ওই উদ্‌ভ্রান্ত মূর্তি দেখে ছুটে এসেছিল। আর অত ছলা-কলা জানে না বলেই অমন কাছে এসে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে ব্যাকুল চোখে গায়ে আঘাতের চিহ্ন খুঁজেছিল। আজ অন্তত কমলা ওকে বাইরে খেতে যেতে দেবে না। বাপী তরফদারের এটা নির্ভুল অনুমান।

আবার একটা অসহিষ্ণুতা ঘরের বাইরে ঠেলে নিয়ে এলো ওকে। তারপর উঠোনে নামিয়ে দিল।

—ও কি! না খেয়ে এ-সময় আবার চললে কোথায়? বড়বাবু শোনো—শোনো বলছি? উঠোনের চারদিকে ঘর, কত আর গলা উঁচিয়ে ডাকতে পারে কমলা?

বাপী তরফদার ফিরেও তাকালো না। হনহন করে বেরিয়ে গেল।

নিরুদ্দিষ্টের মতো হেঁটে চলল অনেকক্ষণ। অনেক পথ। এই করে নিজেকে ক্ষয় করার তাগিদ। কিন্তু ক্ষয় সত্যিই করা যায় না। ক্লান্তি সার। সামনে পার্ক। বকুল গাছের ছায়ায় একটা খালি বেঞ্চিতে গা ছেড়ে বসল। শীতকাল হলেও এই অবেলায় দ্বিতীয় লোক নেই পার্কে।

ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছু টের পাচ্ছে না। বুকের দিক থেকে একটা চিনচিন যন্ত্রণা শুধু পেটের দিকে নামছে। সেটা সাতাশি নম্বর বাড়ির সামনের সেই অপমানের যন্ত্রণা হতে পারে। নিজের ভিতরের গ্লানির দরুনও হতে পারে। গ্লানি স্বাভাবিক। ওপরঅলার অভিশাপের মতোই প্রবৃত্তির অবুঝপনা হঠাৎ-হঠাৎ দখল দিয়ে বসে তার ওপর। নইলে বরাবর একটাই লক্ষ্য তার। একজনই লক্ষ্য। আট বছর ধরে ভিতরে বাইরে একজনকেই সে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে। আট বছর বাদে তার দেখা মিলেছে।

সব ভুলে বাপী তরফদার দুটো মেয়েকে দেখছে এখন চোখের সামনে। একজনের বয়েস দশ। নাম মিষ্টি। ফুটফুটে রং। ফোলা-ফোলা গাল। মাথায় ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল। বাপী নামে একটা দুরন্ত ছেলে মিষ্টি খেয়ে জল খেতে চায় শুনে সে রাগে ফুঁসছে, জিভ ভেঙাচ্ছে।

…আর একজনের বয়েস আঠের। নাম মালবিকা। গাল দুটো ফোলা নয় একটুও। মেদ-ঝরা সুঠাম দেহ, টানা মুখ। আয়ত চোখ। অনেক কম ফর্সা কিন্তু ঢের বেশি তাজা।…বাপী তরফদারের একটা বয়েস চৌদ্দয় আটকে আছে, আর একটা বয়েস বাইশ ছাড়িয়ে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কেউ কল্পনা করতে পারে না। ওই মেয়েও না। ওই মেয়ে চেনেও না তাকে। চেনার আগ্রহও নেই। বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৃষ্টচিত্তে একটা অপমানের প্রহসন দেখেছে শুধু। নিগ্রহ দেখেছে।

বাপী তরফদার সোজা হয়ে বসল। স্নায়ুগুলো সব টান হয়ে উঠল। নিঃশ্বাসে এক ঝলক তপ্ত বাষ্প ঠেলে বেরুলো। চৌদ্দ বছরের একটা ছেলের ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত মুখ দেখছে। সেটা যদি শেষ কথা না হয়ে থাকে, আজকের এই অপমান আর নিগ্রহও শেষ কথা নয়। বাপী তরফদার তা হতে দেবে না।

বছরগুলো পিছনে সরে যাচ্ছে। আট বছর…ন’ বছর…দশ বছর। চোখের সামনে শান্ত গম্ভীর রহস্যে ছাওয়া বানারজুলি এগিয়ে আসছে।

সোনার হরিণ নেই – ৫

দুপুরেও আকাশ সেদিন মেঘলা ছিল। পিছনের দিকে তাকালে বুক পর্যন্ত কালচে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের সারির মাথাগুলো শুধু দেখা যাচ্ছিল।

বাপী বৃষ্টি ভালবাসে না। কিন্তু মেঘলা আকাশ ভারী পছন্দ। আর ওই মেঘে পেট-ঠাসা হিমালয়ও। ঝমঝম বৃষ্টি এসব জায়গায় লেগেই আছে। তখন ঘরে থাকলে বেরুনো দায়। পিসী চোখে আগলায়। কাঠের ঘরে বসে তখন জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখলেও পিসী থেকে থেকে এসে শাসিয়ে যায়, জল মাথায় করে কেউ এখন বাইরে বেরুলে আর রক্ষা নেই—বাবাকে বলে ঠ্যাং ভাঙার ব্যবস্থা না করে ছাড়বে না।

বাপী পিসীর তম্বির পরোয়া করে না। বারো বছর বয়সে এটুকু অন্তত বুঝেছে পিসী আর যা-ই করুক, বাবার কাছে ওর নামে নালিশ করবে না। আসলে জলে বেরুতে বাপীর নিজেরই ভালো লাগে না। জংলা রাস্তাগুলো সব পিছল আর প্যাচপ্যাচে হয়ে যায়। গাছে পাখি কলকল করে না। বাঁদরগুলো সব মৌনী হয়ে বসে থাকে। খরগোশ আর বনমোরগগুলোর টিকির দেখা মেলে না। যদি বা দুই একটা চোখে পড়ে, পিছল রাস্তায় তাড়া করা যায় না।

তার থেকে মেঘলা আকাশ ভালো। বানারজুলির পেল্লায় জঙ্গলখানার তখন আর এক চেহারা। শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস—এই-সব বড় বড় গাছগুলো তখন বেজায় গম্ভীর। আর তাই দেখে ছোট গাছগুলোও যেন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ মেরে থাকে। আকাশে সূয্যি ঠাকুর যতই জ্বলুক, এমনিতেই জঙ্গলের মধ্যে ছায়া-ছায়া ভাব। উনি মেঘে ঢাকা পড়লেই সেই ছায়া-ভাবটা ঘন থমথমে হয়ে ওঠে। আর তখনই জঙ্গলটাকে বাপীর সব থেকে ভালো লাগে। ওটা তখন অদৃশ্য একটা হাত বাড়িয়ে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসতে চায়। এমন কি পাঁচ মাইল দূরের স্কুলের ক্লাসে বসেও বাইরে মেঘলা আকাশ দেখলে ভিতরটা পাখা মেলে বানারজুলির ওই জঙ্গলে এসে সেঁধোয়, তারপর ইচ্ছাসুখে হুটোপুটি করতে থাকে। এক-একদিন তো এমন হয়, স্থান-কাল মনে থাকে না। মাস্টারমশাই উঠে এসে কান টেনে ধরে। অন্য ছেলেরা হাসাহাসি করে।

আর, তখন ঘরে থাকলে তো কথাই নেই। ছুটির দিনের দুপুর হলে সোনায় সোহাগা। পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে ছোট্ট মজবুত লাঠিখানা হাতে করে ছুটে বেরুবেই। ওই ছোট্ট জুতসই লাঠিটা ওকে দিয়েছিল আবু রব্বানী। তেল খাইয়ে—খাইয়ে ওই লাঠি বাপী এখন প্রাণের জিনিস করে তুলেছে। জঙ্গলে ঢোকার আগে আরো কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে নিতে হয়। শার্টের দু পকেট আর প্যান্টের দু-পকেট বাছাই নুড়ি-পাথরে বোঝাই করে নেয়। ফুরোলে ওই অস্ত্র জঙ্গলেও মেলে। জল পড়লে ওপরের মাটি কাদা হয় বটে, কিন্তু আসলে তো পাথুরে জঙ্গল।

পাথর হাতে নিলেই বাপীর আবুকে মনে পড়ে। টিপ বটে হাতের। টিপের কমপিটিশন বা প্রাইজ থাকলে আবুকে দুনিয়ার কেউ হারাতে পারত না বোধ হয়। ওর মতো টিপ করার জন্য বাপীরও চেষ্টা বা নিষ্ঠায় ফাঁক নেই। ফারাক ঠিক করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গাছের মোটা-সরু ডাল লক্ষ্য করে প্রায়ই টিপের মহড়া দিতে হয়। এই করে করে তারও হাতের টিপ মন্দ নয় এখন। কিন্তু আবু রব্বানীর ধারে কাছে নয় তা বলে।

বাপী কোনো সময়ই বৃষ্টি পছন্দ করে না এমন নয়। লোকে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলে তারপর দুটো কাঁটাই ফেলে দেয়। বাপীরও তেমনি স্কুলে রওনা হবার আগেভাগে বৃষ্টি এলে স্কুল কামাই করার তাড়না। তারপর বৃষ্টি আর স্কুল দুইই চুলোয় যাক। যেমন আজকের এই দিনটায় এই রকমই হবে আশা করেছিল। পড়ার বই সামনে রেখে সকাল থেকে নটা পর্যন্ত জানলা দিয়ে ঘন ঘন আকাশ দেখেছে। সকাল ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত ওই আকাশ মেঘে কালি। কালো কালো মেঘের চাঙড়ে হিমালয়ের পেট-বুক ঢাকা। গলা উঁচিয়ে না পড়লে বাবা আর পিসী ভাবে পড়ায় ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। মেঘের সাজ দেখে আনন্দে বাপীর গলা আপনি চড়ছিল। ওই মেঘ হুড়মুড় করে আজ গোটা বানারজুলির ওপর ভেঙে পড়বেই।

কিন্তু বেলা সাড়ে নটার আগে ভাঙুক এটা চায় না। চান-খাওয়া সেরে ঘড়ি ধরে রোজ পৌনে দশটায় একগাদা বই-খাতার ঝোলা কাঁধে ফেলে স্কুলে রওনা দিতে হয়। স্কুল বসে বেলা এগারোটায়। পাঁচ মাইল দূরে সেই বানারহাটে স্কুল। অত পথ হাঁটার ধকল কিছু নয়, রাস্তায় একে একে আরো অনেক ছেলে জোটে। হৈ-হৈ করে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আসলে স্কুলটুল ভালো লাগে না। ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার চিন্তাতে গায়ে জ্বর আসে। সকালে ঘুম ভাঙলেই স্কুলে না যাওয়ার নানা ফন্দি মাথায় জট পাকাতে থাকে। সকালের জলখাবার খেতে খেতে পিসীকে প্রায়ই শুনিয়ে রাখে, এই এই কারণে আজ স্কুলে যাবে কি যাবে না ঠিক নেই। কিন্তু হাসতে মানা বাবাটি সামনে এসে দাঁড়ালেই সব ফন্দি—ফিকির মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়।

কিন্তু আজকের আকাশ আর পাহাড় দেখে স্কুল ফাঁকির চিন্তা থেকে মাথাটাকে বিশ্রাম দেওয়া গেছে। আজকের দিনের ব্যবস্থা যা হবার ওখান থেকেই হচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতে বাবা যদি ছাতা নিয়ে স্কুলে যেতে বলে, পিসী সে হুকুমও বরবাদ করে দেয়। বৃষ্টিকে বড় ভয় পিসীর। এখানকার ভাষায় ‘মালোরি’ জ্বর ঘরে ঘরে লেগে আছে। তার ওপর ব্ল্যাকওয়াটার ফিভার না কি এক ঘোড়ার ডিমের ব্যামোয় জঙ্গলের আর আশপাশের চা-বাগানের কতগুলি লোক ধপাধপ মরল। পিসীর ধারণা জলে ভেজার থেকেই যত রাজ্যের ব্যামোর উৎপাত।

কিন্তু ঘড়িতে যখন নটা, বারো বছরের বাপীর মেজাজের তখন বারোটা। ওই আকাশ তার সঙ্গে একটা বড় রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মেঘ এখনো গোটা আকাশ জুড়ে আছে বটে, কিন্তু এখন আর তেমন ঘন গভীর নয়। পাহাড়ের বড় গাছগুলোও একটু একটু দেখা যাচ্ছে। মেঘ-বিশারদ না হলেও অনেক লক্ষ্য করার ফলে বাপী মোটামুটি ওদের হালচাল জানে। হলপ করে বলতে পারে ঘণ্টাকতকের মধ্যে এই মেঘ আর বর্ষাবে না।

মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল। হাতের বই চটাস করে টেবিলে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর ঝাঁজে বসার বেতের চেয়ারটা পিছনে ওলটালো। ওটার ওপর আর একটা লাথি ঝেড়ে গটগট করে সোজা হেঁসেলে পিসীর কাছে।—আমি আজ স্কুলে যাচ্ছি না—কক্ষনো যাচ্ছি না।

এরকম শুনে পিসীর দু কান অভ্যস্ত। মুখ না ফিরিয়ে বললেন, আজ আবার কি হল, আজ তো আরো কষ্ট কম হবে, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি

রাগের চোটে ভেংচে উঠল বাপী। —ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি—ঠাণ্ডার জন্যে পাঁচ মাইল রাস্তা কমে দু মাইল হয়ে যাবে? হাঁটতে হাঁটতে পায়ের সুতো ছিঁড়ে যায়, ফেরার সময় জিভ বেরিয়ে পড়ে—তবু একটা সাইকেল কিনে দেবে না—আর ছ’ মাস ধরে ভোলানো হচ্ছে সাইকেল হবে! আজ আমি যাব না, যাবই না! বাবাকে বলে দাও আমার পা দুটো আজ সকাল থেকে টনটন করছে।

এতটুকু ছেলের পাঁচ-পাঁচ দশ মাইল হেঁটে যাওয়া আসা পিসীর চোখেও অত্যাচারের সামিল। চা-বাগানের অনেক বাবুর বাড়িতেই সাইকেল আছে। তাদের ছেলেরা বেশির ভাগ সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে। আবার অনেক সমবয়সী তাদের ক্যারিয়ারে বসে যায়। বাপী ছোট বলে তাদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায় না। তাছাড়া ওর নিজেরও দয়া চাইতে ইচ্ছে করে না। সাইকেল চড়া শেখার আন্তরিক অভিলাষ একমাত্র আবুর কাছে ব্যক্ত করেছিল। আবু বলেছিল, শিখে কি হবে, তোর বাবা কিনে দেবে?

বাপী বলেছে, পিসীর পিছনে লেগে থাকব, তার তাগিদে বাবা একদিন না একদিন কিনে দেবেই।

এরপর আবু চা-বাগানের কোন্ এক পিওনের কাছ থেকে একটা ঝর্ঝরে সাইকেল জোগাড় করে এনেছিল। চালাতে শেখা এক দিনেই হয়ে গেছল। তারপর কিছু দিন ওই নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। ছুটির দিনে ঘণ্টা কতকের জন্য একটা সাইকেল তার চাই-ই। পিসীর কাছ থেকে চার আনা আট আনা আদায় করে আবুর হাতে দিত। আবু কখনো পিওন কখনো আরদালিকে ঘুষ দিয়ে সাইকেল যোগাড় করত। কারো কাছে ভালো সাইকেল দেখলে লোভে দু চোখ চকচক করে ওঠে বাপীর। চুরি করে পার পেলে আপত্তি হত না বোধ হয়। বড় সাধ, ওরও একদিন ঝকঝকে একটা সাইকেল হবে।

কিন্তু এক বছরে আশা অনেক ফিকে হয়ে এসেছে। পিসীর কথা বাবা কানে তোলে না। পিসীর দরদ আছে। দুধের ছেলের অত পথ হাঁটাটা তার বুকে লাগে। নিজের উদ্যোগে ভাইপোর সাইকেল চড়াটা শেখা হয়ে গেছে যখন, সাইকেল একটা ওকে কিনে দেওয়াই উচিত। এই উচিত কথাটা বাবাকে অনেকবার শুনিয়েছে পিসী। গোড়ায় গোড়ায় বাবা কোনো জবাবই দেয়নি। আড়াল থেকে বাপী কখনো তাকে ভুরু কোঁচকাতে দেখেছে, কখনো না শোনার মতো করে পাশ কাটাতে দেখেছে। কিন্তু পিসীর তাগিদে কামাই নেই। কারণ পিসীর ওপর বাপীর না-ছোড় জুলুম। শেষে বাবা একদিন মহা বিরক্ত। তেতে উঠে পিসীকে বলল, প্রথম যেদিন বলেছ সেদিনই তোমার কথা আমার কানে গেছে। আমার কি মাটির তলায় টাকা পোঁতা আছে যে ভাবছ ইচ্ছে করে দিচ্ছি না? শুনে রেখেছি সুযোগ—সুবিধে যদি হয় কখনো— দেব। রোজ তোমার এই এক বায়না নিয়ে আসার দরকার নেই।

বাস, সেই থেকে পিসীরও আর তাগিদ দেওয়ার সাহস নেই।

ডালের কড়া নামিয়ে সুধারাণী ভাইপোর মুখখানা দেখলেন একবার।—সকাল থেকেই বুঝি স্কুলে না যাবার ফন্দি আঁটছিস—তোর বাবা সাইকেল কিনে না দিলে আমি কি করব—আমার টাকা আছে?

বাপীর চোখে পিসীর টাকা না থাকাটাও অপরাধ।—টাকা নেই তো স্কুলে পাঠানোর এত গরজ কেন? আমার কষ্ট হয় না? আজ আমি স্কুলে যাব না—যাবই না।

পিছনে বাবার চটির আওয়াজ কানে আসতে সচকিত। তাঁরও চানে যাবার সময় এটা। খেয়েদেয়ে দশটার মধ্যে হরিনারায়ায়ণবাবু দপ্তরে গিয়ে বসেন। অধস্তনদের কাছে তিনি কেরানীবাবু। অন্যদের কাছে শুধু হরিবাবু। সকালের কাজ সেরে দিদিকে কাঠের আলমারির চাবি দিতে এসেছেন। ওই আলমারিতে দরকারী কাগজপত্র থাকে।

ছেলের কথা কানে যায়নি, চড়া গলা শুনেছেন। মুখ দেখেই কিছু একটা বকাবকির আঁচ পেলেন।—কি হয়েছে?

বাপী পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু বাবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সুধারাণী সামাল দিতে চেষ্টা করলেন, ওর আজ পা কনকন করছে, অত পথ হেঁটে স্কুলে যেতে চাইছে না—

বাপীর মনে হল চোখ দুটো দিয়েই বাবা ওর কান টেনে ধরল। কথাগুলো ঠাস ঠাস করে দু-গালে দুটো চড় পড়ার মতো।—দশ মিনিটের মধ্যে চান সেরে খেতে বোস্—

বাপী পাশ কাটালো। বাবার ওপরেই সব থেকে বীতশ্রদ্ধ। আড়াল থেকে পিসীর গলা কানে আসতে সাগ্রহে কান পাতল।

—তোর সবেতে বেশি বেশি, ওইটুকু ছেলের রোজ অত পথ হাঁটতে কষ্ট তো হয়ই—একটা সাইকেল কিনে দিবি-দিবি করেও তো দিলি না।

বাবার চাঁছাছোলা জবাব।—ওর থেকে ঢের বেশি কষ্ট আমরা করেছি—এখনো করছি। অত বেশি আসকারা দিও না, গরিবের ছেলে গরিবের মতো বাড়তে দাও। একটা সাইকেল কিনতে অনেক টাকা লাগে, বুঝলে?

ঠক করে কাঠের মেজেতে চাবি ছুঁড়ে দেওয়ার শব্দ। তা সত্ত্বেও পিসীর গলা কানে এলো আবার, তুই তো কেবল আসকারা দিতেই দেখিস—কবে পাঁচ-পাঁচ দশ মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে স্কুলে গেছিস এসেছিস—বাড়ির দোরগাড়ায় স্কুল ছিল। নতুন না পারিস, দেখে-শুনে একটা পুরনো কিনে দে না—

আড়ালে বাপীর উৎফুল্ল মুখ। পিসীর সাহস আছে বলতে হবে। বাবার ফটফট চটির আওয়াজেই মেজাজ বোঝা যায়। বাপী আড়াল থেকে হাওয়া।

.

খেয়েদেয়ে সময়মতো কাঁধে বইয়ের থলে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। এই মেঘলা দিনে স্কুলে যেতে হচ্ছে। মুখ ভার। কিন্তু পিসীর ওপর আর রাগ করা সাজে না। বাইরে বেরিয়ে সরোষে আকাশের দিকে তাকাতে মেজাজ আরো বিগড়লো। নীল আকাশের বুক-জোড়া মস্ত একখানা কালচে অথচ হালকা মেঘের চাদর বিছানো। গা-পোড়ানো রোদের ছিটে-ফোঁটা নেই। ঠাণ্ডা, মিষ্টি বাতাস। বাঁধানো রাস্তার পাশ ঘেঁষে জঙ্গল। অদূরের লম্বা-লম্বা গাছগুলো এখন থেকেই গম্ভীর। বাপীকে স্কুলে যেতে হচ্ছে বলে ওরাও যেন মনমরা। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল বাবা বলে কোনো মানুষ যদি দুনিয়ায় না থাকত।

—কি রে, স্কুল চললি? পিছন থেকে কাঁধের কাছে মাঝারি জোরের চাপড় একখানা। আবু রব্বানী। ওর হাতে নিজের মাথার থেকেও এক হাত লম্বা সেই পাকা পোক্ত লাঠি—যেটা দেখলে বাপীর দু চোখ জুড়িয়ে যায়। আবুরও সব থেকে পিয়ারের জিনিস ওইটি। লাঠির এক-দিকে রূপোর মতো ঝকঝকে বড়—সড় একটা ইস্পাতের ফালা গোঁজা। ওটা দিয়ে সাপ-খোপ ছেড়ে মাঝারি সাইজের জন্তু-জানোয়ারকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়। ঘায়েল করার দৃশ্য বাপী নিজের চোখেই কম দেখেনি। কিন্তু বাইরে থেকে ইস্পাতের ধারালো ফালা দেখা যায় না। লোহার প্যাচঅলা ক্যাপে ঢাকা। যেন একদিকে লোহা বাঁধানো পাকাপোক্ত লাঠিই একটা। আবুর হাতে ওই লাঠি দেখেই বাপী বুঝে নিল ও এখন জঙ্গল ছুঁড়তে যাচ্ছে।

—পড় পড়, ভালো করে লেখা-পড়া না শিখলে মানুষ হবি কি করে? লেখা—পড়া শিখে বাবু হবি, এই আবুই তখন আবার তোকেও সেলাম ঠুকবে—

পর পর অনেক বার ফেল করে আবু এ বছরই স্কুল ছেড়েছে। নইলে এবারে বাপীর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তে হত। মুখে বিকার নেই, কথাগুলোও গম্ভীর। বাপীর তবু মনে হল ঠাট্টাই করছে। এই দিনেও স্কুলে যেতে হচ্ছে ঠাট্টা করবে না তো কি। লাঠি হাতে আবুকে দেখেই স্কুলের বিতৃষ্ণা আরো বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে। জিজ্ঞাসা করল, তুমি জঙ্গলে যাচ্ছ বুঝি?

—তা ছাড়া কোন চুলোয় আর যাব। বাপের হুকুম সকাল-বিকেল এখন জাঙল ঠেঙাতে হবে। মতলবখানা বুঝলি না, এরপর তোর বাপকে ধরা-করা করে বীটম্যানের খাতায় আমার নামটা ঢোকাতে চেষ্টা করবে।

বাপীর বিবেচনায় সেটা মস্ত ভাগ্যের কথা। বাবার মতো কেরানীবাবু হওয়ার থেকে বীটম্যান হওয়া ঢের ভালো। একটা বড় নিঃশ্বাস ঠেলে বার করে সখেদে বলল, আমার আজ একটুও স্কুলে যেতে ইচ্ছে কচ্ছিল না—বাবার গুঁতোয় যাচ্ছি।

আবুর সঙ্গে আবুর মতো করেই কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করে বাপী। ঢিমেতালে চলতে চলতে তাচ্ছিল্যভরে আবু জবাব দিল, ইচ্ছে না করলে কোন বাপ আবার ঠেলে পাঠাতে পারে—মন না চায় যাবি না।

লোভ বাড়ছে। আবার ভয়ও।—–বাবা টের পেয়ে গেলে?

—ভোঁতা মাথা হলে টের পাবে আর গায়ের ছাল ছাড়াবে। সময়ে স্কুলে রওনা হয়েছিস, আবার সময়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘরে ফিরবি—টের পাবে কেমন করে?

চাপা উত্তেজনায় বাপীর বুক দুরুদুরু। তার পরেই আবার হতাশা।—অ্যাবসেন্ট হলে কাল যে আবার দরখাস্ত দিতে হবে স্কুলে, তখন টের পাবেই।

দাঁড়িয়ে গিয়ে আবু ঘাড় বেঁকিয়ে ওর বুদ্ধির বহর দেখে নিল। তারপর হাল—ছাড়া গলায় বলল, তুই বরং স্কুলেই চলে যা। কি করে যে পাসটাসগুলো করিস বুঝি না—এক বাবা ছাড়া পিরথীবিতে আর গার্জেন নেই? পাঁচ দিন সাত দিনের জন্য বাপ অন্য জঙ্গলের কাজে গেছে বললে মাস্টাররা কি যাচাই করে দেখতে আসবে নাকি? বাপ না থাকলে তখন পিসী সই করলে চলবে না? পিসীর স‍ই করা মানে বাঁকা-চোরা করে তোর সই করা—

বুকের ভিতরে আবার দুরু দুরু বাপীর।

—শোন্, তোকে ধরার তালেই ইদিক দিয়ে এলাম। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ছি—ইচ্ছে থাকে তো তুইও ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়। মেঘলা দিনে আবার জন্তু-জানোয়ারগুলোর প্রেম বেশি চনমন করে ওঠে—

লোভের শেষ আস্ত রাজভোগখানা ছুঁড়ে দিয়ে আবু হনহন করে খানিক পথ ভেঙে জঙ্গলে ঢুকে গেল। বাপী সেখানে মিনিট খানেক ঠায় দাঁড়িয়ে। এই লোভ সামলানোর সাধ্যি আর নেই। পিছনের জঙ্গলের মধ্যেই আবুদের মেটে-ঘর। ওকে ধরার জন্যেই এই পথ ধরে এসেছে। ওইটুকু সব বাধা আর সব নিষেধ তুচ্ছ করার মতো যথেষ্ট। তার ওপর মেঘলা দিনে জন্তু-জানোয়ারগুলোর প্রেম চনমন করে ওঠার কথা।

পিছনে ঘুরে দেখে নিল। কেউ আসছে না। চোখের পলকে সে-ও ওখান থেকেই জঙ্গলের আড়ালে।

প্রেম বলতে বাপী এতকাল পিসীর মুখে রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমের কথাই শুনে এসেছে। রূপকথার রাজপুত্র মেঘ-বরণ চুল রাজকন্যার খোঁজে পক্ষীরাজ ঘোড়ার চেপে জঙ্গল পাহাড় টপকে সাগর পেরিয়ে রাক্ষসের দেশ থেকে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছে। পাশা খেলে ডাইনী পাশাবতীর দফা রফা করে, নয়তো একডুবে কাজলদীঘির তলা থেকে সোনার কৌটা তুলে তলোয়ারের ঘায়ে ভোমরা-ভোমরি দুখানা করে এক-একটি রাজপুত্র এক-একটি সোনার বরণ রাজকন্যাকে ঘরে এনে ধুমধাম করে বিয়ে করেছে। পিসীর মুখে ওইসব গল্প শুনেও বুকের রক্ত টগবগ করে ফোটে, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়। খানিকক্ষণের মধ্যে বাপী নিজেই সেই সব রাজপুত্র বনে যায়।

কিন্তু জঙ্গলের জীবগুলোর প্রেম একেবারে অন্য ব্যাপার। কোটা ওদের ভালবাসা-বাসি আর কোন্টা মারামারি খেয়োখেয়ি এখনো ভালো বুঝতে পারে না। এই ব্যাপারে আবু ইদানীং ওকে একটু-আধটু পাঠ দিচ্ছে। একটু একটু করে ভারী মজাদার নিষেধের জগতের পর্দা সরাচ্ছে। নইলে আগে চোখে দেখতে পেলেও বাপী কি কিছু বুঝতে পারত! এখনো পারে না, আবু বলে দিলে ঠকে শেখে। ভালবাসা-বাসি করতে হলে জীবগুলোরও একটা মেয়ে, আর একটা পুরুষ দরকার হয়, তা-ই জানত না।

এই পাঠ শুরু মাস দুই আগে। দূরে একটা বন-মোরগকে ছুটে আর একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে বাপী হাতের পাথর তুলেছিল। দুটোকেই একসঙ্গে শেষ করবে। আবু থামালে।—দাঁড়া, প্রেম করছে দেখছিস না, এ সময় মারতে হয়!

বাপী হাঁ। —মারামারি করছে না?

আবু হেসে সারা। তারপর এযাবৎ আশপাশের অনেক জানোয়ারেরই প্রেম করাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ওকে। এমন কি খরগোশ বা কাঠবেড়ালীর প্রেমও বাপী এখন একটু-আধটু আঁচ করতে পারে। তবু গেল রোববারেই তো এক তাজ্জব ব্যাপার দেখে ঠকেছে।

সেদিন জঙ্গলে পাশাপাশি চলতে চলতে আবু কি দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছল। তারপরেই সেই অদ্ভুত দৃশ্যটা বাপীও দেখেছে। দুটো সাপ একটা আর একটাকে জড়িয়ে পাকিয়ে লেজে ভর করে একেবারে ছুঁয়ে পোঁতা লাঠির মতো দাঁড়িয়ে . আছে। দুটোর ফণাও মুখোমুখি, লাগালাগি।

আবুর সঙ্গে আড়ালে সরে গিয়ে তাজ্জব দৃশ্যটা অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে। আবু ফিস্ ফিস্ করে বলেছে, প্রেমে বাগড়া দিলে ক্ষেপে গিয়ে দুটোই একসঙ্গে তাড়া করবে। সাবধান, জোরে নিঃশ্বাসও ফেলবি না!

হাঁ করে বাপী দেখেছে আর বুঝেছে, এ-ও প্রেম। সেই দিনই পরে আবুর মুখে বাঘের প্রেমের গল্প শুনে বাপীর গায়ে কাঁটা! প্রেম করার সময় হলে বাঘিনী নাকি ডেকে ডেকে কাছাকাছির বা দূরের বাঘকে জানান দেয়। সেই প্রেমের ডাক আবু নিজের কানে শুনেছে। ওই ডাক শুনে কখনো আবার একটার বেশি পুরুষ বাঘ এসে হাজির হয়। বাঘিনীকে পাবার জন্য দুই বাঘের মধ্যে তখন যাকে বলে একেবারে খতমের লড়াই। যে জিতবে বাঘিনী তার। আর, বাঘিনীর প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে যদি একটাই বাঘ আসে তো সে ব্যাটাও নিজের বীরত্ব দেখিয়ে বাঘিনীর মন পাবার জন্য একগাদা পশু মারবে—যা খাবে না তার থেকেও ঢের বেশি।

কদিন ওই প্রেমের পাঠ শুনে আর নিজের চোখেও অনেক দেখার পর বারো বছরের বাপীর ধারণা, জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারের ভালোবাসা-বাসিটা রূপকথার রাজপুত্র রাজকন্যার মতো। ঝাঁপাঝাঁপি ঝকাঝকি জড়াজড়ির ব্যাপার। তার চোখে দেখা বানারজুলির মানুষ বা মেয়েমানুষেরা রূপকথার ছেলে—মেয়ের মতো নয়। আবার জঙ্গলের জীবজন্তুর মতোও নয়। অথচ আবু বলে, মেয়ে-পুরুষের ভালো-বাসা-বাসি না হলে কেউ জন্মাতোই না—বাপী না, আবু না, পৃথিবীর কেউ না। অবাক কথা। বাপী যেটুকু বোঝে তার থেকে বেশি অস্পষ্ট থাকে। কেউ বলে দেয়নি, নিজের ভিতর থেকেই কেমন করে জেনেছে এসব দেখাশোনা বা বোঝাটা ভয়ানক গোপনীয় ব্যাপার। আবার এত গোপনীয় বলেই জানার ভীষণ লোভ।

আজকের মতো এমন দিন হয় না। বাবার ভয়-ডর উবে গেছে। এমন ছুটির স্বাদ আলাদা। কেবল একটু আফসোস হাতে নিজের লাঠিটা নেই। জঙ্গল থেকে সরু একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে মনের আনন্দে ছোট গাছ আর ঝোপঝাড় পেটাতে পেটাতে আবুর পাশাপাশি চলেছে। কাঁধের বই-খাতার থলের বোঝাটা একজন বীটম্যানের কুঁড়েতে জিম্মা রেখে নিশ্চিন্ত। ঘরে ফেরার সময় তুলে নিয়ে যাবে।

মেঘলা আকাশের ঠাণ্ডা অথচ ঝিমুনো ছোঁয়াটা জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। এ রকম হয় বলেই বাপীর ভালো লাগে। আজ অনেক দূরে চলে যাবার ইচ্ছে। একেবারে পাহাড়-ঘেঁষা বাঘ বা চিতার ডেরার দিকে না হোক, এক-আধটা ভালুক-টালুকের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে। বিপাকে না পড়লে এখানকার ভালুক মানুষ তাড়া করে না, উল্টে পালায়। আবু অনেক দেখেছে। ও নাকি ভালুকের ভালোবাসা-বাসিও দেখেছে।

কিন্তু কিছুটা যেতে যে জিনিসটা চোখে পড়ল সে অন্য ব্যাপারে। খুব সুন্দরও একটা বড় ময়ূর রং-বেরঙের বিশাল পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘুরেফিরে এক-একবার ঢং করে নাচছে। ওটার সামনে আর একটা পেখমছাড়া ময়ূর পোকামাকড় খুঁটে খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে পেখমমেলা বড় ময়ূরটাকে দেখছে।

আবু মন্তব্য করল, কেমন প্রেম করছে দ্যাখ—

বাপী দাঁড়িয়ে গেল। মেঘলা দিনে পেখম ছড়ানো ময়ূর অনেক দেখেছে। নাচতেও দেখেছে। কিন্তু প্রেমের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি।

—সামনের ওই কুচ্ছিতটা মেয়ে ময়ূর?

—না তো কি। নেচে নেচে রূপের বাহার দেখিয়ে ওকে ভোলাচ্ছে।

বাপীর আরো খানিক দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আবু তাড়া দিল, এসব তো দুধের খোকারা দেখবে—আয়।

ঘণ্টা দুই আড়াই জঙ্গলখানা মন্দ চষা হল না। এরকম তো কতদিন কতবার করেছে, কিন্তু আনন্দটা সব সময় আনকোরা নতুন। বাপীর একটু খেদ বড় জানোয়ার একটাও চোখে পড়েনি। বাপী আর এক দিকের গভীরে খানিক এগোতে চেয়েছিল। আবু বাধা দিয়েছে, ওদিকে নয়, বুনো শুয়োর বেরোতে পারে।

দাঁতাল বুনো শুয়োর কি ভয়ংকর জীব বাপীর শোনা আছে। ভালুকের মতো নয়, দেখলে সোজা তেড়ে আসে। এ জায়গাও নিরাপদ খুব নয়, এসে হাজির হলেই হল। তখন চটপট কোনো গাছে উঠে পড়লে বাঁচোয়া। এদিকে সেরকম গাছের অভাব নেই।

আবু আর ঘুরতে রাজি নয়। তার খিদে পেয়েছে, ঘরে যাবে। বাপীকেও আসতে বলল। যা আছে ভাগ করে খাওয়া যাবে। তারপর ফের জঙ্গলে এসে আড্ডা দাও বা যত খুশি ঘোরো।

কিন্তু দু কদম না এগোতেই ঝমঝম চেনা শব্দ। তারপর যে কাণ্ড দুজনারই খিদে-টিদে সিকেয়। দিব্বি বড়সড় সজারু একটা। ওদের দেখেই পালাচ্ছে। ওটাকে দেখামাত্র চাপা উত্তেজনায় আবুর অন্য মুখ। ফলে বাপীরও। চোখের পলকে ছিটকে গিয়ে আবু ওটার পিঠে ডান্ডার গোটাকতক পেল্লায় ঘা বসিয়ে দিল লোহামোড়া দিকটা দিয়ে। সারা গায়ের এক বিঘৎ মোটা মোটা কাঁটাগুলো মেলে দিয়ে সজারুটা দাঁড়িয়ে লড়ছে, আবার গর্তের দিকে ছুটছে। ওর গর্ত সামনের ওই চারা গাছগুলোর বেড-এর দিকে।

আবু ছুটে গিয়ে সেই গর্তটা বার করে তার মুখ আগলালো। ওকে চেঁচিয়ে হুকুম করল, হাতে পাথর তুলে নে, ওদিকে দিয়ে না পালায় তুই দ্যাখ—একটা সজারু মারার সাধ অনেক দিনের—এ শালাকে আজ মারবই। বলতে বলতে লাঠি থেকে লোহার খাপ খুলে ইস্পাতের ঝকঝকে ধারালো ফলাটা বার করে লাঠি বাগিয়ে ধরল।

কিন্তু অত বড় সজারু মারা সহজ নয়। ওই বড় বড় কাঁটার আড়ালে আসল জীবটিকে পাওয়া ভার। না চলে লাঠি, না পাথর। ওটার যেমন প্রাণপণ বাঁচার লড়াই এদের তেমনি মারার। ইস্পাতের ফলার খোঁচায় কাঁটাগুলো রক্তাক্ত। লাঠি আর পাথরের ঘায়ে ভেঙেছেও অনেকগুলো। শেষে ওটা ঝিমিয়ে পড়তে আবু অনেক কাছে গিয়ে ধারালো ফলার দিকটা মোক্ষমভাবে বসাতে পারল। ওরকম বার কয়েকের চেষ্টায় ওটার ভবলীলা সাঙ্গ।

এই উত্তেজনায় ফাঁকে কম করে ঘণ্টা-সোয়াঘণ্টা পার। বাপীর হাঁপ ধরে গেছে। ধুলোমাখা রক্তাক্ত জীবটাকে দেখে গাও ঘুলোচ্ছে। কিন্তু আবু ফুর্তিতে টইটম্বুর। পকেটে ধারালো ছোরা একটা থাকেই। গাছ থেকে দড়ির মতো একটা লম্বা ঝুরি কেটে এনে তার এক মাথা দিয়ে ওটার গলার দিকটা শক্ত করে বাঁধল। তারপর টেনে নিয়ে চলল। আবুর কথা শুনে বাপীরও গা-ঘুলনো ভাবটা গেছে। অত বড় সজারুটা মারার জন্য আবু নাকি জঙ্গল আপিস থেকে এক টাকা বা দু টাকা প্রাইজ পাবে। সজারু চারাগাছের বেড-এর নরম মাটির তলা দিয়ে লম্বা গর্ত করে চারাগাছের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই সজারু মারলে পুরস্কার। তাছাড়া সজারুর মাংস খেতে চমৎকার। কম করে সাত-আট সের মাংস হবে ওটার। আবুর বাড়িতে আজ ভোজ লাগবে। বাপীর নেমন্তন্ন তো বটেই। আর বড় সজারুর কাঁটাও ফেলনা নয়। ড্রইং করার কলম হয় ওই দিয়ে। আবু হেসে উঠল।—আচ্ছা ওরা প্রেম করে কি করে বল তো, নড়লে চড়লেই তো বড় বড় কাঁটা!

মাথা ঘামিয়ে বাপীও ভেবে পেল না।

আধ ঘণ্টা ধরে পালা করে ওটাকে হিঁচড়ে টেনে জঙ্গলের বাইরে পাকা রাস্তার এনে ফেলল। টানতে সুবিধে, কেরামতিটাও লোক দেখবে। আনন্দে বাপী স্কুল পালানোর বিপদও ভুলেছে। কারণ এত বড় একটা বাহাদুরির পিছনে সেও আছে। রাস্তার লোকেরা জীবটাকে দেখছে আর ওদেরও দেখছে। কেউ কেউ আবার দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করছে—কোথায় পেল, বা কি করে মারল।

লম্বা রাস্তাটা বাঁক নিতে সামনের দিকে চেয়ে দুজনেই অবাক। খোদ বড় সাহেবের ছবির মতো সুন্দর বাংলোর সামনে মালবোঝাই ট্রাক একটা। তার পিছনে জিপ।

সেখানে ছোট সাহেব অর্থাৎ ফরেস্টার, ফরেস্ট গার্ড, কেরানীবাবু অর্থাৎ বাপীর বাবা, আবুর বাবা হেড বীটম্যান কালু, তার সঙ্গে আরো কয়েকজন বীটম্যান পিওন—সকলেই ব্যস্তসমস্ত। নীচের কর্মচারীরা ট্রাকের দড়ি খুলে মাল নামানোর তোড়জোড় করছে।

বানারজুলি জঙ্গলের সর্বময় কর্তা রেঞ্জ অফিসারের বাংলো ওটা। বড় সাহেবের বাংলো। অবাঙালী বড়সাহেব বদলি হবার ফলে প্রায় তিন সপ্তাহ বাংলোটা খালি পড়ে ছিল।

আবু বলল, নতুন বড়সাহেব এলো বোধ হয়। শিগগীর আয়—

বাঁধা সজারুটাকে টানতে টানতে প্রায় ছুট লাগালো আবু। সেখানে আব্বা আছে, কেরানীবাবু আছে, ছোটসাহেব আর বীটম্যানরা আছে—সকলের সামনে খোদ বড়সাহেবকে কেরামতিটা দেখাবার এমন মওকা আর পাবে কোথায়?

পায়ে পায়ে বাপীও এগিয়ে এসেছে। স্কুল পালানোটা আর মনেই নেই। জিপটার দিকে চোখ। ফরেস্টার সাহেব আর বাবা যাকে তোয়াজ করছে ওই ছিপছিপে সুন্দরপানা সাহেবটিই নিশ্চয় নতুন রেঞ্জ অফিসার। তার দু হাত দূরে ঝকমকে শাড়ি পরা মেমসাহেব। বেশ সুন্দর দেখতে। মেমসাহেবের সামনেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটা বড়। পরনে ধপধপে সাদা হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট। আর চকচকে রঙিন ফ্রক পরা মেয়েটার ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, ফুটফুটে ফর্সা রং ফোলা ফোলা লালচে গাল…পুতুল পুতুল মুখ।

বাপী হাঁ করে মেয়েটাকেই দেখছে।

আবুর বরাত খারাপ। লতার দড়ি-বাঁধা ওই পেল্লায় মরা সজারু এনে ফেলতে সকলে যখন সচকিত, খোদ বড়সাহেবের বিরক্ত মুখ। মেমসাহেব আঁতকে ওঠার দরুন হতে পারে। আরদালি পিওন ফরেস্ট গার্ড বীটম্যানরা দুচার মিনিটের জন্য অমনোযোগী হল বলেও হতে পারে। এতে হয়ত দণ্ডমুণ্ডের মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্বে ঘা পড়ল। তার ওপর মেমসাহেবের নাক-মুখ কোঁচকানো বিরক্তি।—মাগো, কি বিচ্ছিরি—সরিয়ে নিতে বলো!

আবুর ভেবাচাকা মুখ। ছেলের কেরামতি দেখে ওর বাবা কালুর দু চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। বড়সাহেবের বাহবা আশা করেছিল। মেমসাহেবের কথা শুনে আর বড়সাহেবের মুখ দেখে রক্ত জল। আগুন চোখে ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর আগেই ত্রস্ত আবু তার সজারু সমেত রাস্তার ওধারে জঙ্গলে নেমে গেল। সব থেকে বেশি ঘাবড়েছে ও-ই

ফুটফুটে মেয়েটা সভয়ে মায়ের তিন পা পিছনে চলে গেছল। দেখার জন্য এবারে রাস্তার এধারে এগিয়ে এলো। তার দাদাকে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের দিকে খানিকটা নেমে দাঁড়াতে দেখে এগিয়েছে। তবু সাহস দেখে বাপীর হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা বলছে, এই দাদা, আর নামিস না—

জঙ্গল থেকে রাস্তা অনেকটা উঁচু। মরা সজারুটাকে টেনেহিঁচড়ে আবু ততক্ষণে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। বাপীর বরাত ভাল, তার ব্যস্তসমস্ত বাবা তখন মাল রাখার তদারকির কাছে বাংলোর ভিতরে। এই অপ্রিয় ব্যাপারটা দেখলে বা জানলে দুর্ভোগ হত। ঘর্মাক্ত কলেবরে এবারে বাইরে আসতে ছেলের দিকে চোখ গেল। বাপী জঙ্গলের দিকে মুখ করে সাহেবের মেয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে।

কাঁধের নীচে বাবার হাতের হ্যাঁচকা টান পড়তে মুহূর্তের জন্য মুখ আমসি। পরের মুহূর্তে অবাক। ঘাম-ঝরা হাসিমাখা মুখ বাবার। স্কুল-ফুল ভুলে গেছে। ওকে বড়সাহেবের সামনে টেনে বলল, প্রণাম কর্—

সাহেবের ধুলোমাখা বুটে প্রণাম ঠুকে ওঠার ফাঁকে আবার বাবার চিনিগলা কথাই কানে এলো।—মা-মরা এই একটাই ছেলে আমার স্যার, আশীর্বাদ করুন—

বড়সাহেব সামান্য মাথা নাড়লেন। বাবার হুকুমে মেমসাহেবকেও স্যান্ডালপরা পা ছুঁয়ে প্রণাম সারতে হল। তাদের মেয়ে এদিকে ঘাড় বেঁকিয়ে ওকে দেখছে। বাবার ভাবনা গেছে। হাল্কা পায়ে বাপী আবার মেয়েটার কাছে এসে দাঁড়াল। আগের আধ-বুড়ো খোট্টা বড়সাহেবের ছেলেমেয়ে ছিল না। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার লোভ খুব। চেষ্টার দরকার হল না, ও-ই কথা বলল।

—ওটা কি মেরে এনেছিলে?

—সজারু।

—লাঠি পাথর আর লাঠির মধ্যে ইস্পাতের ফলা খোঁজা আছে—তাই দিয়ে।

—তুমি মারতে দেখেছ? শুনেই গা শিরশির করছে যেন মেয়েটার।

—আমি আর আব্বুই ত মারলাম ওটা।

এবারে বড় বড় চোখ করে ওকে ভালো করে দেখার দরকার হল যেন।—ভয় করল না?

—নাঃ।

—ওটা তাড়া করল না?

—তাড়া করবে কি, ভয়ের চোটে গর্তে ঢুকতে চাইছিল। আবু গর্তের মুখ আগলে ছিল।

মেয়েটার চোখেমুখে অবিশ্বাস। আর একবার ওকে ভালো করে দেখে নিল।—তুমি এইটুকু ছেলে, তুমি মেরেছ না আরো কিছু—

ওকে বিশ্বাস করানো যেন বাপীর দায়।—আবুকে জিগ্যেস করে দেখো, ও তো আর মিথ্যে কথা বলবে না।

বিশ্বাস করা তবু সহজ নয়।—তোমার নাম কি?

—বাপী।

হেসে উঠল। সার বাঁধা ছোট দাঁতের সারির ঝিলিক।—বাপি তো বাবাকে বলে—ওই তো বাপি। .

হাত তুলে বাবাকে দেখালো।

মজার কথায় বাপীরও মজা লাগল একটু। জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?

—মিষ্টি।

এবারে বাপী হাসল।—মিষ্টি তো লোকে খায়—

মেয়েটা প্রতিবাদ করল, যেমন বুদ্ধি তোমার, আমি মিষ্টি দেখতে বলে দাদু নাম রেখেছিল মিষ্টি—আমার ভালো নাম মালবিকা নন্দী—তোমার ভালো নাম নেই?

মনে মনে বাপী বলল, মেয়ের অহংকার দেখো, নিজেই বললে মিষ্টি দেখতে। কিন্তু মিষ্টি যে সত্যি ভারী মিষ্টি দেখতে অস্বীকার করার উপায় নেই।

—বিপুলনারায়ণ তরফদার

—মা-গো, কি বিচ্ছিরি নাম—তোমাদের জংলা দেশে বুঝি এ-রকম সব বড় বড় নাম হয়?

নাম নিয়ে বাপী কখনো মাথা ঘামায় না। শুনে রাগ হলেও প্রকাশ করার উপায় নেই।—এর আগে তোমরা জঙ্গলে ছিলে না?

—ছিলাম তো, ময়নাগুড়ির জঙ্গলে ছিলাম। সেখান থেকে এখানে বদলি হয়ে এলাম।

বাপীর হাসিই পাচ্ছে, যেন ও-ই রেঞ্জ অফিসার, এক জঙ্গল থেকে আর এক জঙ্গলে বদলি হয়ে এলো। বলল, তাহলে তুমিও তো জংলা দেশের মেয়ে।

তক্ষুণি মুখ-মচকানো জবাব—এঃ, আমার কলকাতায় জন্ম—বুঝলে? সেখানে মায়ের বাবা থাকে, দাদুর কাছে ছ বছর ছিলাম আমরা—তুমি কলকাতা দেখেছ?

দেখেনি যখন বাপীর মাথা নাড়া ছাড়া উপায় কি। মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিল, বাবা-মা বাংলোর ভিতরে চলে গেছে, দাদাও রাস্তায় নেই।

—কলকাতা দেখনি আবার ফটফট করছ—তুমি জংলি ভূত একটা—

খিল খিল করে হাসতে হাসতে বাংলোর দিকে ছুট।

বাপীর রাগ হবার কথা। কিন্তু একটুও রাগ হচ্ছে না। অবাক চোখে বাংলোটাকেই দেখছে। ওই আঙিনায় ঢোকার তাগিদ কখনো বোধ করে নি। আজ করছে। ঢুকলে সাহেব মেমসাহেবের কথা জানে না, বাবা যে তেড়ে আসবে এটুকু বোধ আছে।

রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে নামল। আবুর টিকির দেখা নেই। এতক্ষণে তার ঘরের কাছাকাছি চলে গেছে হয়তো। বেচারা আবুর এমন একখানা সজারু মারার কদর হল না। ওই মেমসাহেবের জন্যেই হল না। একেবারে ননীর শরীর, দেখেই মূর্ছা গেলেন। না, দেখতে ভালো হলেও মেমসাহেবকে ওর একটুও ভালো লাগে নি ওদের ছেলেটারও দেমাক খুব, একটা কথাও বলল না। কিন্তু মিষ্টি মেয়েটা কি মিষ্টি কি মিষ্টি! হাসলে সুন্দর, মুখ মচকালে সুন্দর, আবার সজারু দেখে ভয়—পাওয়া মুখখানাও সুন্দর। কথা শুনে এক-একবার রাগ হচ্ছিল বাপীর। কিন্তু তাও বেশ লাগছিল। চা-বাগানের বাবুদের ছোট-বড় আরো অনেক মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখেছে, কিন্তু মিষ্টির মতো কেউ না। আর তাদের এত দেমাক যে কেরানীবাবুর ছেলের সঙ্গে কথাই বলে না। বড়সাহেবের মেয়ে মিষ্টি সেধে কথা বলেছে। কত কথা আর মিষ্টি মিষ্টি কথা।

জঙ্গলের পথ ছেড়ে আবার রাস্তা ধরল। বাড়ি। বই খাতা সেই বীটম্যানের ঘরেই পড়ে থাকল তাও মনে নেই। ঘরে ঢোকার মুখে মনে পড়ল। পিসী সামনে নেই, জেরায় পড়তে হল না।

—পিসী! মিষ্টি এসে গেছে—!

ভিতরের দাওয়ায় বসে ওর জন্যেই জলখাবারের রুটি বেলছিলেন সুধারাণী। অবাক হবারই কথা, বাইরে থেকে মিষ্টি কখনো কেউ আনে না। কখনো-সখনো তিনিই ঘরে তৈরি করে দেন।

—কোত্থেকে এলো, কে আনল?

বাপীর মুখে দুষ্টু-দুষ্টু হাসি—জঙ্গলের বড়সাহেব এলো আজ, আর তার সঙ্গে মেমসাহেব এলো—তাদের সঙ্গে মিষ্টি এলো।

ভালোমানুষ পিসী প্যাচ বুঝবে কেমন করে।—তোদের জন্যেও দিল বুঝি? কি মিষ্টি?

—বড়সাহেব আর মেমসাহেবের মেয়ে মিষ্টি। পিসীকে ঠকাতে পেরে বাপী হেসে উঠল।—নাম মিষ্টি দেখতে মিষ্টি কথাও মিষ্টি—আমার খেয়েই নিতে ইচ্ছে করছিল গো!

সুধারাণী বুঝলেন এবং ভাইপোর বজ্জাতির কথা শুনে না হেসেও পারলেন না।—শুনলে তোর নোলা ছিঁড়ে দেবে একেবারে—কি পাজী হয়েছিস তুই। যা মুখ হাত ধুয়ে আয়, আমি রুটি কখানা করে দিই চট করে—

পেটের আগুনও জ্বলছে এতক্ষণে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ঘুরে এসে পিসীর সামনে দাওয়ার ওপরেই বসে পড়ল। থালায় খাবার দেখে আর পিঁড়ি পাতার তর সইল না।

জঙ্গলের নতুন মনিবের খবর নেবার কৌতূহল সুধারাণীর। মনিব ভালো মানুষ হলে ভাইয়ের ভাগ্য। নইলে অনেক হেনস্থা। যখন-তখন ডাক পড়ে, কথায়-কথায় শাসায়। কেরানীবাবু-টাবুরা ঘরের কেনা গোলাম।— সাহেব মেমসাহেবকে কেমন দেখলি?

রুটি তল করতে করতে বাপী জবাব দিল, সাহেবের হুমো গম্ভীর মুখ, মেমসাহেব আর তার মেয়ে মরা সজারু দেখে ভিরমি খায়। দৃশ্য মনে পড়তেই হাসি। সোৎসাহে সজারু মারা, আর আবুর সেটা সাহেব মেমসাহেবকে দেখাতে আনার ফলখানা বলে ফেলল।

গালে হাত দিয়ে শুনছিলেন সুধারাণী। শোনার পরে খটকা।—তুই স্কুলে ছিলি তো সজারু মারলি কি করে?

রুটি গলায় ঠেকার দাখিল। ফলে স্বর চড়া এবং বিরক্তি ভরা। —মাঝে মধ্যে স্কুল হাফ-হলিডে হয়ে যেতে নেই–বারো মাসই পুরো স্কুল হয়?

আর কাছে বসে থাকা নিরাপদ নয় বাপীর সে-জ্ঞান টনটনে। পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে বই-খাতার ঝোলাটা নিয়ে আসতে হবে। শেষ আস্ত রুটি আর তরকারিটুকু একেবারে মুখে পুরে উঠে পড়ল।

পরের দশটা দিনের মধ্যে দুটো রবিবার, দুটো শনিবারের হাফ-ডে, আর কি এক পরব উপলক্ষে এক দিন ছুটি গেছে। সেই পাঁচটা দিনের বেশির ভাগ সময় বাপীর রেঞ্জ অফিসারের বাংলোয় সামনে আর আশপাশে ঘুর ঘুর করে কেটেছে। স্কুলের দিনেও বিকেলে একবার করে পা দুটো ওকে এ-দিকে টেনে এনেছে। বাংলোর ভিতরের চত্বরে আর সামনের ওই চেয়ার-টেবিল সাজানো কাঠের বারান্দায়ও পা দিয়েছে। পরবের ছুটির দিনের সমস্ত দুপুরটা মিষ্টির সঙ্গে গল্প করে কেটেছে। ওর বাবা ভিতরে ঘুমুচ্ছিল। দীপুদা চা-বাগানের কোন্ নতুন বন্ধুর বাড়ি টহল দিতে বেরিয়েছে। বাইরের টেবিলে মিষ্টির একটা পাতলা বই, খাতা আর পেনসিল।

দুপুরেও মেয়ের পড়ায় কি মন—রাস্তার ঠিক পরেই ওদের গেটের মুখোমুখি ছোট গাছটার একটা ডালে গ্যাঁট হয়ে বসে বাপী মজা দেখছিল।… মিষ্টি পড়ার টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে কাঠের মেঝেতে বার কয়েক ঝাঁপ খেল। প্রতিটি ঝাঁপের পরে ঘাড় বেঁকিয়ে ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। অর্থাৎ মা-বাবা ভিতর থেকে টের পেল কিনা। শব্দ না করে ঝাঁপ খাওয়ার কেরামতিটাই রপ্ত করছে মনে হল বাপীর। সে-খেলা শেষ হতে হাতের রাবার মেঝেতে ফেলে ফেলে এক পা তুলে টেবিল-চেয়ারের চারদিকে ঘুরে এক্কা-দোক্কা খেলা চলল খানিক। তারপর লালচে মুখে খানিক এগিয়ে এসে গেট বরাবর মুখ করে দাঁড়িয়ে একটু একটু হাঁপাতে লাগল।

বাপী এই মওকায় কোকিলের ডাক ডেকে উঠল একটা। তারপর আরো একটা। কানা মেয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। গাছটাও দেখল। কিন্তু পা ঝুলিয়ে বসে থাকা সত্ত্বেও ওর দিকে চোখ গেল না।

বাপী অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল। অবাধ্য পা দুটো এর পর ওই গেট পেরুতোই, কিন্তু মনের তলায় মেমসাহেবের ভয়। মুখে কিছু না বললেও ওর আসাটা যে পছন্দ নয় সেটুকু বাপী গেল দিনই আঁচ করতে পেরেছিল। বিকেলে মিষ্টির ডাকেই ভিতরে ঢুকেছিল, তারপর সামনের আর পিছনের বাগানে মিষ্টির সঙ্গে ছোটাছুটি করে খেলা করছিল। এই মেয়ে ওর সঙ্গে ছুটে পারবে কেন। দশ গজ এগিয়ে দিয়েও ওকে হারিয়ে আগে গিয়ে বুড়ী ছুঁয়েছে। বারান্দার চেয়ারে বসে আগেও মেমসাহেব ওদের ছোটাছুটি লক্ষ্য করেছে। তার মুখখানা বাপীর অপ্রসন্ন মনে হয়েছে। গেল দিনে সব থেকে বেশি মনে হয়েছে। বার বার হেরে আদুরে মেয়ের মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। এবারে তার অর্ধেকের বেশি এগিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে হারানোর গোঁ। কিন্তু বাপী এমন অন্যায় হারা হারতে রাজি নয়।

এই থেকে কথা কাটাকাটি। মেমসাহেব তখন বারান্দার এ-মাথায় এসে কড়া গলায় মেয়েকে চলে আসতে হুকুম করল। আর ওর দিকে এমন করে তাকালে যে বাপীর পা দুটো আপনা থেকেই গেটের দিকে। ফলে ভিতরের তাড়না সত্ত্বেও এ-দিনের দুপুরে ওই ছোট গেট পেরুনো নিরাপদ হবে কিনা ভাবছিল।

কোকিলের ডাকে কাজ হল না দেখে বাপী একটু জোরেই বার-দুই হাততালি দিল। গাছের ডালে এবারে ওকে আবিষ্কার করতে পেরে মেয়েটা পলকের জন্য হাঁ। তারপর একমুখ হাসি। এমন মজার ব্যাপার আর যেন হয় না। তরতর করে কাঠের সিঁড়ি টপকে ছুটে গেটের কাছে এলো। .

বাপী হাতের ইশারায় ওকে কাছে আসতে বলল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি একবার ওদের ঝিমুনো বাংলোটা দেখে নিল। তারপর আস্তে আস্তে গেটের আটা সরিয়ে তিন-চার লাফে রাস্তার এধারে।

সামান্য গলা চড়িয়ে বাপী বলল, এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি, টেবিল থেকে লাফালি, ধেই ধেই করে নাচলি, আর এদিকে একবার তাকালি না।

এর মধ্যে বাপী অনায়াসে তুমি থেকে তুই-এ চলে এসেছে। মিষ্টির কানে সেটা একটুও লাগে নি। হি-হি করে হেসে উঠল।—গাছের ওপর তোমাকে ঠিক হনুমানের মতো লাগছে।

রাগ হতে পারত, কিন্তু মিষ্টির হাসি দেখতে বেশি মজা। কাঠবেড়ালের মতো তরতর করে গাছ থেকে নেমে এলো। — জঙ্গলের ভেতরে যাবি? চল, খুব ভাল লাগবে—

ভয়ে ভয়ে মিষ্টি জঙ্গলের ভিতর দিকে চোখ চালাল একবার। লোভ একটু হচ্ছে। বাবার লোকজনের সঙ্গে ময়নাগুড়ির জঙ্গলে গেছে। মজা লাগে আবার গা ছমছমও করে।—তুমি একলাই জঙ্গলের ভিতরে চলে যাও?

—হরদম যাই। তোর ভয় করছে?

—ভয় করবে কেন, মা জানতে পারলে বকবে না? তাছাড়া বারোখানা অঙ্ক করে রাখতে বলেছে, না হলে দেবে একেবারে

—কি অঙ্ক?

—কঠিন কঠিন অঙ্ক, দেখবে এসো না?

—তোর মা রাগ করবে না?

—রাগ করবে কেন, আমাকে বাইরে দেখলে বরং রাগ করতে পারে। তাছাড়া মা তো এখন ঘুমুচ্ছে —

অগত্যা বাপী ওর সঙ্গে কাঠের বারান্দায় চলে এলো। মিষ্টির কঠিন কঠিন অঙ্ক দেখে হাসিই পেয়ে গেল। পুচকে পুচকে যোগ-বিয়োগ-গুণ ভাগ।—এই অঙ্ক তোর! বারো মিনিটও লাগবে না, আমি উত্তর বলছি তুই লেখ—

এই প্রস্তাব পছন্দ। চটপট কাজটা সারা হয়ে গেলে গল্প করার সুবিধে। কিন্তু বই থেকে অঙ্কগুলো ঠিক-ঠিক খাতায় তোলার ঝামেলা আছে। চেয়ারে বসলে টেবিল বেশি উঁচু। মিষ্টি দাঁড়িয়েই কাজে মন দিল। বাপীও ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা হাত মিষ্টির ঝুঁকে পড়া পিঠের ওপর দিয়ে টেবিলের ওদিকে। মেয়েটা জানতেও পারছে না ওই হাতটা ওকে আরো কাছে আগলে রাখতে চাইছে। এত কাছাকাছি লাগালাগি হয়ে থাকতে এত ভাল লাগে দু মিনিট আগে বাপীও কি জানত! মিষ্টির গায়ে আর ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুলে ভারী একটা মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ। গন্ধটা আরো ভাল করে নিতে গিয়ে নিজের গালের সঙ্গে ওর মাথাটা ঠেকেই গেল একবার।

—আঃ, সরো না! কাঁধ আর কোমর দিয়ে মিষ্টি ওকে ঠেলে দিল একটু। মন দিয়ে সব কটা অঙ্ক আগে খাতায় তুলে ফেলেছে।

সরতে একটু হল বটে কিন্তু বাপীর অবুঝ একটা ইচ্ছে আরও বেড়ে গেল। ইচ্ছেটা ঠিক যে কি নিজেও জানে না।

অঙ্কগুলো এরপর টকাটক হয়ে গেল বটে। এত তাড়াতাড়ি যে মিষ্টি ভারী অবাক। বাপী চোখ দিয়ে দেখে, আর ওকে লিখতে বলে। মিষ্টির মনে হল বাপীর মত এমন অঙ্ক-বিশারদ আর হয় না। অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করল, সব রাইট?

—রাইটের বাবা।

মিষ্টি খুব খুশি। চুপি চুপি এও এক মজার খেলা সাঙ্গ হল যেন।—তুমি বলে দিয়েছ মা যেন কক্ষনো জানতে না পায়, তাহলে দুজনকেই ধরে দেবে—

মুখোমুখি চেয়ার পেতে গল্প করতে বসল দুজনে। বাপীর গল্প মানে জঙ্গলের গল্প। জঙ্গলে ঘুরতে কেমন লাগে। কাছাকাছির মধ্যে হামেশা কোন্ কোন্ জীবের দেখা মেলে। তাড়া করলে ওরা কিভাবে পালায়। কোনগুলোকে অনায়াসে পাথর ছুঁড়ে মারা যায়। ও কত মেরেছে। মিষ্টি ওর সঙ্গে জঙ্গলে গেলেই দুই-একটা মেরে দেখাবে।

ফাঁক পেলে এর পর মিষ্টিকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাবার মতলব। এই জন্যেই লোভ দেখানো।

—আর ওরা কেমন জোড় বেঁধে খেলা করে জানিস? কক্ষনো দুটো পুরুষ আর দুটো মেয়েতে খেলা করে না। একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে—

মিষ্টি হাঁ করে ওর কথা শুনছে।

—বুঝলি না বোকা মেয়ে! যেমন ধর একটা পুরুষ খরগোশ আর একটা মেয়ে খরগোশ, একটা পুরুষ ময়ূর আর একটা মেয়ে ময়ূর, একটা পুরুষ সাপ আর একটা মেয়ে সাপ—

সাপ শুনেই মিষ্টির গায়ে কাঁটা দিল।—সাপেরাও খেলা করে? তুমি দেখেছ?

—দেখিনি আবার! এই সেদিনই তো দেখলাম দুটো পেল্লায় সাপ একটা আর একটাকে পেঁচিয়ে লেজে ভর করে লাঠির মত দাঁড়িয়ে আছে।…এটা অবশ্য ঠিক খেলা নয়, তুই বুঝবি না…

মিষ্টির দু চোখ বড় বড়।—মারামারি?

—দূর বোকা। না, আমার বলতে লজ্জা করছে…

সাপের কথা বলতে লজ্জা করবে কেন মিষ্টি ভেবে পেল না। লজ্জার কথা শুনে আরও কৌতূহল।—মারামারি না হলে কি বলো না?

—ভালবাসা-বাসি।

শুনেই মিষ্টি হেসে সারা। হাসির চোটে একঝাঁক চুল মুখের ওপর এসে গেল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেগুলো সরাতে সরাতে তেমনি হাসি আর অবিশ্বাসে ভেঙে পড়ে বলল, সাপ আবার ভালবাসে নাকি?

চুল সরানো মুখখানা রসে টইটম্বুর ফলের মত টুপটুপ করছে। গাল দুটো ধরে টিপে দিতে ইচ্ছে করছে বাপীর।

একটুও যদি বুদ্ধি থাকত তোর, পুরুষ সাপ মেয়ে সাপকে ভালবাসবে না কেন—এ কি মানুষ নাকি যে দেখলেই ছুবলে দেবে! আমার সঙ্গে জঙ্গলে এলে কত কি দেখতে পাবি।

—না বাবা, মিষ্টি মাথা দোলাল, আমার সাপ শুনেই ভয় করছে।

—আচ্ছা ভীতু মেয়ে তো, ও-সব সাপ-টাপ বা পাজী জানোয়ার সব বেশি জঙ্গলে থাকে, বুঝলি? তাছাড়া আমি সঙ্গে থাকলে আর ভয় কি!

বাপীর বিশ্বাস ভুলিয়ে-ভালিয়ে দুই একবার জঙ্গলে নিয়ে ঢোকাতে পারলে মিষ্টিও ওই জঙ্গলটাকে ওরমতই ভালবেসে ফেলবে। বানারজুলির জঙ্গল কেউ ভাল না বেসে পারে না।

কিন্তু সব উৎসাহের মুখে বড় রকমের হোঁচট খেতে হল। বেলা যে চারটে গড়াতে চলল, বাপী বা মিষ্টি কারোই খেয়াল ছিল না। দুপুরের ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা মুখে মেমসাহেব ঘর থেকে বেরুল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে কাঁটা বিঁধল। দুটো চেয়ার মুখোমুখি লাগানো। আর তাতে মুখোমুখি আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে দুজনে।

মেমসাহেবের ভ্রুকুটি দেখেই চোরের দায়ে ধরা পড়ল বাপী। নড়-চড়া ভুলে শুকনো মুখে একটা শাস্তির অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ঝাঁঝালো গলায় মেমসাহেব প্রথমে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, অঙ্ক হয়েছে? মেয়েও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। হয়েছে। তার ভয়, কি করে হয়েছে মা না সেটা বুঝে ফেলে।

এবারে বাপীর পালা। মেমসাহেবের ভুরুর ভাঁজ সোজা হয় নি তখনো।— তোর বাড়ি কোথায়?

একটা হাত তুলে বাপী শুধু রাস্তার দিকটাই দেখিয়ে দিল।

আরও ঝাঁঝালো গলায় মেমসাহেব বলে উঠল, মেয়েদের সঙ্গে তোর এত কি খেলা আর গল্প—যা বাড়ি যা—আর কক্ষনো যেন এভাবে না দেখি!

গেটের বাইরে পা দিয়ে বাপী হাঁপ ফেলে বাঁচল বটে, কিন্তু তার পরেই যত রাগ ততো দুঃখ। একটু আড়াল নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলোটাকেই দেখল খানিক। মিষ্টি তার মায়ের সঙ্গে ঘরে চলে গেছে। নিজের দোষেই এমনটা হল। খেয়াল করে ওই মহারাণীর ঘুম ভাঙার আগে সটকান দিলে এই গণ্ডগোল হত না।

পরের দুটো দিন সকালে আর স্কুল-ফেরত বাড়িতে না ঢুকে বাংলোটার সামনের রাস্তায় কতবার ঘোরাঘুরি করেছে, হিসেব নেই। বাইরের ওই কাঠের বারান্দায় সাহেব বা মেমসাহেবকে দেখলে সরে যায়। মিষ্টি ঠাণ্ডা মেয়ে নয় একটুও, যে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকবে। ওর দেখাও অনেক বার করে মেলে। আর বাপীর পা দুটো তখন ওই গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকতে চায়। মেমসাহেব না থাকলে গেটের কাছাকাছি এগিয়েও আসে। মিষ্টি তখন ওকে ঠিক দেখতে পায়। ওর সঙ্গে খেলা করতে বা গল্প করতে যে ভাল লাগে মিষ্টির, বাপী সেটা মুখ দেখলেই বুঝতে পারে। ফাঁক বুঝে হাতের ইশারায় বাপী ওকে গেটের বাইরে চলে আসতে বলেছিল। জবাবে মেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতের ছোট্ট বুড়ো আঙুল নেড়ে যা বোঝাবার বুঝিয়েও দিয়েছে। অর্থাৎ ওর আসাটা বা বাপীর সঙ্গে খেলা করাটা মা বরদাস্ত করবে না। ফিক ফিক করে হেসেওছে আবার। বাপী জ্বলতে জ্বলতে ফিরে গেছে।

একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বড়সাহেব আর মেমসাহেবের ডাঁটের ছেলে দীপুদার মন পেলে আবার ও-বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকা সহজ হতে পারে। সুদীপ নন্দী। বাবা-মায়ের আদরের নাম দীপু। একই স্কুলে ওর থেকে তিন ক্লাস ওপরে অর্থাৎ ক্লাস নাইনে পড়ে দীপুদা। বছরের চার মাস কেটে গেলেও স্কুলে ভর্তি হতে অসুবিধে হয় নি। বাপীর ধারণা বড়লোকের ছেলে বলেই হয় নি। জঙ্গলের জিপে চড়ে স্কুলে যায় জিপে চড়ে ফেরে। মিষ্টি তো কাছের চা-বাগানের মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাপী ভাবে খুব মজা ওর। সকাল আটটায় স্কুল, বারোটায় ছুটি। সমস্তটা দুপুর হাতের মুঠোয়। দীপুকে জিপে চেপে স্কুলে যেতে দেখে বাপীরও জিপে ওঠার লোভ খুব। কিন্তু এত দিন সাহস করে বলতে পারে নি।

তোয়াজ কি করে করতে হয় বাপীর একটু-আধটু জানাই আছে। বাবাকে দেখেছে, আবুর বাবা কালুকে দেখেছে, চা-বাগানের অনেক বাবুদেরও সাহেবকে তোয়াজ তোষামোদ করতে দেখে আসছে।

সেদিন স্কুল-গেটে জিপটা থামতেই বাপী ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করল, তোমার বইখাতাগুলো আমি ক্লাসে দিয়ে আসব দীপুদা?

কেরানীবাবুর ছেলেকে দীপু বেশ চেনে। বাড়িতে বোনের সঙ্গে খেলা করতেও দেখেছে।

—কেন?

—তোমার কষ্ট হবে। তাই…।

তোয়াজটুকু মন্দ লাগল না। কিন্তু ধমকের সুরে মুখে বলল, ভাগ—।

মুখ কাঁচুমাচু করে টিফিনের সময় ফাঁক বুঝে আবার দীপুদার সামনে। —পিসী চমৎকার আমসত্ত্ব বানায় দীপুদা, আজ তোমার কথা বলতে অনেকটা দিয়ে দিয়েছে—আর পাকা কামরাঙাও আছে, খুব মিষ্টি—খাবে?

তার এক হাতে মস্ত একটা লোভনীয় কামরাঙা আর অন্য হাতে সোনা-রঙ আমসত্ত্ব খানিকটা।

ও-দুটো নিয়ে দীপু ওকে কৃতার্থ করল। খেতে খেতে মন্তব্য করল, বেশ তো…। কাল আবার আনিস—

পরদিনও ওই একই ঘুষ। সঙ্গে একটা বাড়তি টোপ।—আমাতে আবুতে জঙ্গল থেকে বন-মোরগ বা খরগোশ মেরে বাড়িতে দিয়ে আসব দীপুদা?

আবুকেও দীপুদার চেনা হয়ে গেছে।—দিস। মাকে বলব’খন আবুকে বখশিশ দেবে। দুই-ই খুব ভালো খেতে…

বাপীর বলার ইচ্ছে, আবু বখশিশ-টখশিশ নেয় না। বলা গেল না।

—তোর কোন্ ক্লাস রে?

—ক্লাস সিকস…!

এই মওকাতেই বুকের দম আটকে বাপী বলে ফেলে, রোজ পাঁচ মাইল করে হেঁটে আসতে-যেতে আমার খুব কষ্ট হয় দীপুদা, তোমাদের জিপে করে যদি আমাকে একটু

কথাটা আর শেষ করে উঠতে পারল না। তার আগেই দীপুদা কট কট করে বলে উঠল, ও…এই মতলবে আমার মন ভেজানো হচ্ছে। সাহস তো কম নয়, তোর সঙ্গে আমি এক জিপে আসব যাব?

বাপী চুপসে গেল। কিন্তু আমসত্ত্ব কামরাঙার লোভে হোক বা বন-মোরগ খরগোশ ভেটের আশায় হোক, দীপুদা একেবারে অনুদার হতে পারল না, বলল, আচ্ছা, এক কাজ করিস, আসার সময় মাইলটাক হেঁটে এসে রাস্তার এক জায়গা দাঁড়িয়ে থাকিস, আমি তুলে নেব—আবার স্কুলের আধ-মাইলটাক আগে নেমে যাবি। ফেরার সময় হেঁটেই যেতে হবে, উঁচু ক্লাসের এত ছেলের সামনে তোকে সঙ্গে নিতে পারব না।

বাপীর পিত্তি জ্বলে গেল। ও যেন চার পয়সা ভিক্ষে চেয়েছে আর বড়লোকের ছেলে দয়া করে একটা পয়সা দিলে। ওই জিপের দিকে বাপী যদি জীবনে আর ফিরেও তাকায়।

সাহেব বাংলোর দিকে মনটা পড়ে থাকার ফলে আবুর সঙ্গে কদিনের মধ্যে দেখাও হয় নি। সেই সজারু-ভোজের সন্ধ্যায় পর থেকে। ওকে দেখেই আবু ঠেস দিয়ে বলল, কি রে, সাহেবের মেয়ের সঙ্গে এত ভাব-সাব যে ইদিক মাড়াতেও ভুলে গেলি?

দোষটা প্রায় স্বীকার করে নিয়েই বাপী জিজ্ঞাসা করল, তুমি জানলে কি করে? —সেদিন ও-দিক দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম বাগানে মেয়েটার সঙ্গে খুব হুটোপুটি করছিস।

বিমর্ষ মুখে বাপী বলল, আর যাই না, বারণ করে দিয়েছে—

মুখ দেখে আর কথা শুনে আবুরও কৌতূহল।—কে বারণ করল?

—মেমসাহেব মহারাণী—আবার কে!

আবু হাসতে লাগল।—তুই হলি গিয়ে ওদের চোখে একটা কাক— পেখম লাগিয়ে দহরম-মহরম করতে যা আরো!

কাকের ময়ূরপুচ্ছ পরার গল্পটা বাপীও জানে। তবু আবুর কথায় মন খারাপ

হয়ে গেল। বলল, আমার ভাল লাগে যে—

—কি ভাল লাগে?

এবারে লজ্জা-লজ্জা মুখ বাপীর।—তুমি কাউকে বলবে না?

আবু মাথা নাড়ল। বলবে না।

আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করে।

—আবুর হাঁ হবার পালা এবার।—কাকে রে?

—ওই মিষ্টিকে

—বলিস কি রে। ওই পুঁচকে মেয়ের যে চোখই ফোটে নি এখনো!

শুনে শুনে আবুর ঠাট্টা এখন বুঝতে পারে বাপী। আর আবুর কাছে লজ্জাশরমেরও ধার ধারে না। বলল, হলই বা ছোট বড় হবে তো?…ওর গায়ে আর চুলে কি মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ, আর হাতটাতগুলো যা নরম না!

—বা বা বা বা! এরই মধ্যে এতটা এগিয়েছিস! হাসতে হাসতে আবু বেশ জোরেই পিট চাপড়ে দিল।—লেগে থাক, লেগে থাক— ও মেয়ে বড় হলে খাসা দেখতে হবে ঠিকই, আর পছন্দ হলে তখন তোকে একটা বেয়ারা-টেয়ারা করে নেবে।

আবুর এই ঠাট্টায় বাপীর যথার্থ রাগ হয়ে গেল। ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে হন—হন করে চলে এলো।

বাংলোর সামনের রাস্তায় পা ফেলতে গিয়েও পিছু হটে সেই গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।…বারান্দায় সাহেব মেমসাহেব আর মিষ্টি। সাহেব মেমসাহেব কথা কইছে। মিষ্টি এক পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে হাত দুটো দু পাশে পাখির ডানার মত ছড়িয়ে বন-বন করে দফায় দফায় পাক খাচ্ছে। আর থেকে থেকে নিজের মনেই হাসছে।

বাপী দেখছে।

…বাংলোটা ওর চোখে রূপকথার দেশের কোন নিষেধের বাড়ির মতো কদিন ধরে সেই রকমই মনে হচ্ছে। মিষ্টিকে কিন্তু কোন রূপকথার রাজকন্যা ভাবা মুশকিল। রূপকথার মেয়েরা কখনো ফ্রক পরেছে শোনে নি, তাই মেলে না। না মিললেও ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। আর সাহেব-মেমসাহেবকে রাক্ষস-রাক্ষসীর মত কেটে কুচি কুচি করে ফেলতে ইচ্ছে করে।

…রাক্ষস-রাক্ষসী কেটে ফেললে রূপকথার মেয়েরা খুশি হয়। হাসে কিন্তু বাবা-মাকে কাটলে মিষ্টি বোকা মেয়ের মতো ভ্যা-ভ্যা করে কাঁদবে।

সেই অবুঝপনার জন্যেই গাছের আড়ালে বাপীর দু চোখ রাগে বোঝাই।

.

হাতির নাম বনমায়া। বানারজুলি জঙ্গলের পোষা হাতি। কাঠ টানে। আর জিপ চলে না এমন জায়গায় যেতে হলে জঙ্গলের বাবুরা ওর পিঠে চাপে। পিঠে তখন হাওদা লাগানো হয়। বনমায়াকে বাপী জন্ম থেকে দেখে আসছে। ওর পিঠে চেপেওছে কত। বনমায়া নামটাও খুব মিষ্টি লাগে। চা-বাগানের সাহেব বাংলোয় একটা নেপালী মেয়ে কাজ করত। তার ওই নাম ছিল। বছর তিনেক অগে ওই মেয়েটাকে নিয়ে কি একটা হুজ্জত হয়েছিল খুব। এখানকার অনেক লোক সাহেবদের ওপর ক্ষেপে গেছল। আর তারপর থেকে সেই মেয়েটা একেবারে হাওয়া। বাপী তখন আরো কত ছোট। ভালো করে কিছু বুঝতেই পারে নি।

কিন্তু বাপীর মাথা এখন আর তত কাঁচা নয়। বনমায়া নাম থেকে নিজেই বুঝে নিয়েছে এটা মেয়ে হাতি। আবু হেসে বলে, বনমায়ার রূপ খুব। ওকে দেখলে চা-বাগানের আর জঙ্গলের কন্ট্রাক্টরদের মর্দা হাতি দুটো নাকি ছোঁক ছোঁক করে কাছে আসতে চায়। কিন্তু বনমায়ার রূপ যেমন দেমাক তেমন। কাউকে পাত্তাও দেয় না। রূপের কথা বনমায়ার মাহুত ভীম বাহাদুরও বলে। ভীম বাহাদুরের সঙ্গেও বাপীর মন্দ খাতির নয়। মাস গেলে মাইনেটা তো বাপীর বাবার হাত থেকেই নিতে হয়। তা বনমায়ার রূপ নিয়ে ভীম বাহাদুরেরও খুব গর্ব। এদিককার সব নেপালী আর অবাঙালী মেয়ে-পুরুষই মোটামুটি পরিষ্কার বাংলা বলে। ভীম বাহাদুরের জন্ম-কৰ্ম্ম সব এখানেই। বনমায়ার মাথা চাপড়ে ভীম বাহাদুরকে বাপী নিজের কানে বলতে শুনেছে, তোর মরদ খুঁজে বার করতে হলে আমাকে আফ্রিকার জঙ্গল ছুঁড়ে আসতে হবে।

আবুও শুনেছিল। সে হেসে সারা। কিন্তু বাপীর মাথায় কিছুই ঢোকে নি। পরে আবু খোলসা করে বলতে কিছু কিছু বুঝেছে।…বনমায়ার বয়েস নাকি মাত্র কুড়ি। আশী-নব্বুই একশ দেড়শ বছর পর্যন্তও বাঁচে হাতিরা। তা এই বয়সেই বনমায়ার সর্ব অঙ্গে রূপ ছুঁয়ে পড়েছে। আর স্বাস্থ্যখানাও তেমনি হয়েছে। প্রায় দশ ফুট উঁচু পাঁচ ফুটের মতো শুঁড়। ওর যুগ্যি বর সে-রকম জাঁদরেল মরদ হাতি এখানে কোথায় জুটবে? বরের খোঁজে তাই আফ্রিকায় যাবার কথা বলছিল ভীম বাহাদুর। এখানকার কোনো পোষা মরদ হাতির হাতে ও নাকি কখনো ওকে ছেড়ে দেবে না।

হাতির বর শুনে বাপীর হাসি পেয়ে গেছল। হাতির রূপ কাকে বলে অতশত বোঝে না। একটা হাতির সঙ্গে আর একটা হাতির তফাতও ভালো করে আঁচ করতে পারে না। তবে অনেক দেখার ফলে ছাড়া অবস্থায় একলা চড়ে বেড়ালেও বনমায়াকে ঠিক চিনতে পারে। আর বনমায়া তো ওকে চেনেই। দেখলেই শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম ঠোকে। কেরানীবাবুর ছেলেকে সেলাম করাটা ভীম বাহাদুর শিখিয়েছে।

রূপ না চিনলেও বনমায়ার মতো সভ্যভব্য ঠাণ্ডা জীব বাপী আর দেখে নি। হাজার দৌরাত্ম্যেও ওর মেজাজ গরম হয় না। শুঁড় ধরে ঝুলে পড়লেও ও মজা পায় আর দোলা দেয়। কলা বেল আখ শুঁড়ের কাছে ধরে বার বার সরিয়ে নিলে পিটপিট করে তাকায়, তারপর ঝাঁ করে ঠিক সময় কেড়ে নেয়। বাপী তখন রাগ দেখিয়ে চড়চাপড় ঘুষি বসিয়ে দেয়। কিন্তু বনমায়া তখন সাত চড়ে রা নেই এমন ঠাণ্ডা।

দেড় মাস আগে, আবুর কথায় যাকে বলে এই বনমায়ার নামেও কলঙ্কের ঢি ঢি পড়ে গেছল একেবারে। সেই বিষম ঘটনার আগের রাতে জঙ্গলের এ-ধারের আর আশপাশের অনেকেই একটা বুনো হাতির ডাক শুনেছিল। সে নাকি সাংঘাতিক ডাক। দল ছাড়া ক্ষ্যাপা বুনো হাতি ভয়ঙ্কর জীব। কাছে ঘেঁষবে কে?

দূরের জঙ্গলে বা পাহাড়ী এলাকায় দল-বাঁধা বুনো হাতির উপদ্রব নতুন কিছু নয়। ছোট পাহাড়ী নদীগুলোর নাম খোল। সেই খোলে ওরা জল খেতে আসে। একসঙ্গে অনেকগুলো পাহাড়ের দিক থেকে নেমে এসে এক-এক সময় জঙ্গল তছনছ করে, চাষের খেত মুড়িয়ে দেয়। ওদিকের লোকেরা তখন দল বেঁধে মশাল জ্বেলে ঢাক ঢোল কানেস্তারা বাজিয়ে হাতি তাড়ায়। ওদিকের ফরেস্ট গার্ডকেও তখন বন্দুক নিয়ে ছুটতে হয়। কিন্তু হাতির দঙ্গল এদিকের জঙ্গলে বা লোকালয়ে আসে না। আবু বলে, বুনো হলেও ওরা বুদ্ধি ধরে। চা-বাগান আর জঙ্গলের সব বাংলোগুলোতেই বন্দুক আছে। এদিকে এলে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে সে ওরা বেশ জানে। ক্ষ্যাপা হাতির কথা আলাদা। ক্ষেপে গেলে কারই বা কাণ্ডজ্ঞান থাকে। সেদিন ওটার হাঁকডাক শুনে জঙ্গলের কুঁড়েতে যারা থাকে তাদের রক্ত জল। ওটা হানা দিয়েছিল চা-বাগানের দিকে। ওটাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য বাগানের সাহেবরা তখন এক ধার থেকে জঙ্গলের দিকে রাইফেল ছুঁড়েছে। হৈ-হৈ কাণ্ড যাকে বলে। দূরে হলেও থমথমে বেশি রাতের সেই গুলির শব্দ আর হাতির ডাক বাপীরও শোনার কথা। কিন্তু বাপী বিছানায় গা দিল কি ঘুমে কাদা।

পরদিন সকালে সকলের চক্ষু ছানাবড়া। বনমায়ার পায়ের শেকল ছেঁড়া। বনমায়া হাওয়া। ভীম বাহাদুরের মাথা খারাপ হওয়ার দাখিল। পাগলের মতো বনমায়ার খোঁজে তামাম জঙ্গল চষে বেড়াল। সব দোষ এসে চাপল ওরই ঘাড়ে। বুনো হাতির ডাক শুনে ও কেন আগে থাকতে বন্দুক-অলা ফরেস্ট গার্ড এনে বনমায়াকে পাহারা দিল না। ভীম বাহাদুর যত বলে, বুনো হাতি এসে বনমায়ার শেকল ছেঁড়ে নি—তাহলে বনমায়াও চেঁচিয়ে একাকার করত, আসলে বনমায়াই নিজে শেকল ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে—আগের বড়সাহেব ততো রেগে যায়। চাকরি তো গেলই তার ওপর ওর বিচার হবে। একটা হাতি খোয়ানো কম ব্যাপার নয়। আবু চোখ টিপে হেসে হেসে বলেছিল, ভীম বাহাদুরের কথাই ঠিক। ওটা ছিল বুনো মস্তির প্রেমের ডাক। বনমায়া সাড়া না দিয়ে পারে নি।

তার আগেই ওর কাছ থেকে বাপীর বুনো জীব-জন্তুর প্রেমের পাঠ নেওয়া শুরু হয়ে গেছল। তখন পর্যন্ত মস্তি কথাটা শোনে নি। মস্তি কি?

আবু বলেছে, মরদ হাতির মাথায় প্রেম জাগলে বিষম ব্যাপার। তখন সঙ্গিনী না পেলে ক্ষেপে যায়। সেই সময় ওদের মাথায় আপনা থেকেই এক রকমের রস গড়ায়। ওই দশার সময় ওদের মস্তি বলে। কিন্তু দলছুট মস্তি সঙ্গিনী পাবে কোথায়? তখন আরো ক্ষ্যাপা দশা। পোষা হাতী দেখলে শিকল ছিঁড়ে দাঁতের ঘা মেরে মেরে ওটাকে টেনে নিয়ে যাবেই। না গেলে মেরে ফেলবে। আবুর মতে বনমায়ার দুর্জয় সাহস। নিজে থেকে নিঃশব্দে শেকল ছিঁড়ে ওই বুনো মস্তির সঙ্গে পালিয়েছে। পোষমানা মেয়ে হাতিরা তো বুনো মস্তিকে সাংঘাতিক ভয় করে।

সব জানা আর শোনার পর বাপীর বনমায়ার জন্য খুব চিন্তা হয়েছিল। বুনো মস্তি শেষ পর্যন্ত ওটাকে মেরেই ফেলে কিনা কে জানে। আর ভীম বাহাদুরের জন্য বেজায় দুঃখ হয়েছিল। পাগলার মতো ও তখনো বনমায়াকে খুঁজেই চলেছে।

তিন সপ্তাহ বাদে আবার এক দারুণ ব্যাপার। আর সেই ব্যাপারের নায়ক কিনা বাপী নিজেই। বনের পশু-পাখির কিছু ভালবাসাবাসি দেখার তাড়নায় ছুটির সেই নির্জন দুপুরে একলাই জঙ্গলে ঢুকেছিল। হঠাৎ দেখে দশ গজের মধ্যেই একটা হাতি! ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ভালো করে দেখবে কি, ভয়ে গায়ের রক্ত জল।

তার পরেই কি কাণ্ড। ও যে বনমায়া! ওই তো শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম করল ওকে! বাপী বিশ্বাস করবে না স্বপ্ন দেখছে?

আনন্দে আর উল্লাসে পাগলের মতো নাচই শুরু করে দিয়েছিল বাপী। আর ওর শুঁড় ধরে টানাটানি করে বলেছিল, চল শিগগীর চল, তোর জন্য এদিকে কত কাণ্ড!

কিন্তু বনমায়া কম বজ্জাত নয়। পাছে একলা গেলে মারধর খেতে হয়, বাপীর ধারণা সেই জন্যেই শুঁড়ে পেঁচিয়ে ওকে মাথায় তুলে বসিয়ে নিয়ে তারপর চলল।

কি মজাই না হল তারপর। যে দেখে সে হাঁ। বনমায়ার মাথায় চড়ে বাপী আসছে! কাতারে কাতারে লোক ছুটে আসতে লাগল। আর ভীম বাহাদুর তো বনমায়াকে দেখে কেঁদেই ফেলল। প্রথমেই রাগের চোটে ওর শুঁড়ে দুমদাম কটা ঘুষি। তারপর কান্না! শেষে সকলের সামনে বাপীকে জড়িয়ে ধরে কি আদর কি আদর!

শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে সেই বনমায়া আসছে জঙ্গল ধরে। ওর পিঠে হাওদা, তাতে মিষ্টি বসে, দীপুদা বসে আর বন্দুক হাতে ফরেস্ট গার্ড দেবকী দাস বসে। মাথার ওপরে ঘাড়ের দিকে ভীম বাহাদুর।

পরের রবিবারে সকালে জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে বড়সাহেবের বাংলোর দিকেই আসছিল বাপী। এই দৃশ্য দেখে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।

বনমায়া গলা দিয়ে ঘোঁৎ করে একটু আনন্দ জানিয়ে শুঁড় উঁচিয়ে বাপীকে সেলাম ঠুকলে। তাই দেখে মিষ্টি আর দীপুদা অবাক। আনন্দে হাততালি দিয়ে মিষ্টি বলে উঠল, কি মজা দাদা, বাপীকে তুলে নে না, ও জঙ্গলের কত কি জানে—ও লোভ দেখিয়েছিল বলেই তো বাবা-মাকে ধরে আজ জঙ্গলে আসা হল—

দাদার হুকুমের পরোয়া না করেই ভীম বাহাদুর সানন্দে ডাকল, জলদি উঠে এসো বাপী ভাই, আজ বহুত মজা হবে।

রক্ত নেচে উঠলেও বাপী নড়ছে না। জিপে করে স্কুলে যেতে চাওয়ার অপমান ভোলে নি। দীপুদার মুখ দেখে মন বোঝার চেষ্টা।

জঙ্গলে ঢুকতে যাচ্ছে বলেই দীপুদার আজ উদার হতে বাধল না। একজন বাড়লে জোরও একটু বাড়ে। বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, উঠে আয়—

না, ওর ওঠার জন্য বনমায়াকে ওয়েট করানোর দরকার নেই। বাপী ওর শুঁড় বেয়ে তরতর করে উঠে এলো। ভীম বাহাদুরকে পেরিয়ে হাওদায় মিষ্টির গা ঘেঁষে বসে পড়ল। ওর বরাত বটে একখানা আজ। আনন্দের চোটে গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, দুর্গা দুর্গা—

মিষ্টির আবার খিল খিল হাসি।—দুর্গা দুর্গা কেন, আমরা কি শিকারে চলেছি?

বাপীর মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল তক্ষুনি। বলল, তা না, নাম নিলে যাত্রা ভালো হয়, গাছ থেকে তো অনেক সময় সাপ-টাপও লাফিয়ে পড়তে পারে—

—অ্যাঁ? শিউরে উঠে বাপীর সঙ্গে একেবারে লাগালাগি হয়ে বসল মিষ্টি। দীপু

এদিকের জঙ্গল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তেমন। অস্বস্তি তারও, চোখ পাকালো—তুই ওকে ভয় দেখাচ্ছিস?

বাপীর মুখ আমসি। এক্ষুনি না ওকে আবার নেমে যেতে বলা হয়। সামাল দিল দেবকীনন্দন, কিছু ডর নাই ছোট হুজুর, তার আগেই আমি গুলি করে খতম করে দেব।

ফাঁড়া কাটল। বনমায়া হেলে দুলে চলেছে। আর তাইতে মিষ্টির ছোট্ট শরীর ওর গায়ে কেবলই ঠোক্কর খাচ্ছে। তাছাড়া লেগেই বসে আছে ওর সঙ্গে। মেয়েটার শরীরের হাড়গোড়সুদ্ধ নরম। চুরি করে বেশ বড় বড় নিঃশ্বাস টানছে বাপী। মিষ্টির গায়ের গন্ধ, আর চুলের গন্ধ।

দেবকীনন্দন কত রকমের জানোয়ার আছে এই জঙ্গলে দীপুদাকে শোনাচ্ছে। নটখট জানোয়ারের মধ্যে চিতাবাঘ, ভালুক, বুনো শুয়োর, বুনো হাতি, বনবেড়াল—ঢাউস সাপ—এই সব।

চকিতে বাপীর মাথায় আবার এক মতলব খেলে গেল—দীপুদা, আবুকে তুলে নিই চলো। তাহলে দারুণ হবে—ভালুক-টালুক এসে গেলে ও কেমন নেমে গিয়ে তাড়া করে দেখবে—কোথায় কোন্ রকমের জানোয়ার থাকে ও সব জানে। সঙ্গে সঙ্গে আরো লোভের টোপ ফেলল, তাহলে আজই খরগোশ বা বন—মোরগও ঠিক পেয়ে যাবে—

আবু ছেলেটা যে ডাকসাইটে দীপুর জানা হয়ে গেছে। এখানকার নতুন বন্ধুদের মুখে শুনেছে। প্রথম দিনের সেই সজারু মেরে আনাটাও ভোলে নি। তাছাড়া ওর বাবা কালু তো ওকে তার বড়সাহেবের কাছে বাংলাতে এনে হাজির করেছিল। সাহেবকে ছেড়ে আবু দীপুকেও বুকে মাথা ঠেকিয়ে . আদাব জানিয়েছিল। একটা দুটো বনমোরগ নিয়ে বাংলোয় ফিরলে বাবা-মাও খুশী হবে। এদিকে বন-মোরগ মারার মজাটাও মন্দ হবে না। তাছাড়া অচেনা জঙ্গলে তার মতো একটা ছেলে থাকলে আরো নিশ্চিন্দি।

তবু ইতস্তত ভাব একটু—তুলে এনে বসাবি কোথায়, এই হাওদার মধ্যে গ্যাজা-গেঁজি হয়ে বসতে পারব না।

বাপী বুঝল আসলে বাবুর মানে লাগছে। ব্যস্ত হয়ে বলল, সে তুমি কিচ্ছু ভেব না দীপুদা, আবু ঠিক ভীম বাহাদুরের পাশে জায়গা করে নেবে।

আবুকে তুলে নেওয়ার কথায় ভীম বাহাদুরও তক্ষুনি সায় দিল। বলল, হাঁ, ঠিক হোয়ে যাবে ছোট সাব, বনমায়া কি ছোট মেয়ে।

নিজের নাম শুনেই হাতিটা কান খাড়া করল। আর ছোট মেয়ে শুনে মিষ্টির খিল-খিল হাসি। হাসলেই ওর ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা বাপীর বুকে ঠেকছে।

দীপুই কর্তাব্যক্তি এখানে। আবেদন মঞ্জুর করল, ডেকে নে তা হলে, কতদূর?

হাতিতে চেপে গেলে কি আর দূর, ভীম বাহাদুর চলো। সোনায় সোহাগা গোছের আনন্দ বাপীর।

আবু কতটা খুশী দেখে বোঝা ভার। সাহেবের ছেলে সঙ্গে আসতে বলেছে শুনে তেরছা চোখে বাপীর দিকে তাকালো। মিষ্টির দিকেও। উল্লাস মাখা চোখ দুটো দিয়েই বাপীর ওকে আনার তাগিদ। ঘর থেকে নিজের লাঠিখানা নিয়ে আবু এসে হাতির শুঁড়ে চেপে বসল। সকলের আনন্দ ষোল কলায় পূর্ণ।

আনন্দের হুল্লোড়ের মধ্যে তিনটে ঘণ্টা কোথায় দিয়ে কেটে গেল। আবুকে নিয়ে বাপীর গর্ব সার্থক। দীপুদা আর মিষ্টি দুজনই ওর তারিফ করেছে। আবুর কথামতো হাতি নিয়ে এক এক দিকে হানা দেবার ফলে ওরা দু’দুটো ভালুক পালাতে দেখেছে। একটা বুনো শুয়োর দেখেছে। বুনো শূয়োরটার-বেজায় রাগ, আবুর দিকে তেড়ে এসেও শেষে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে জঙ্গলে ঢুকে গেল। আবু তখন হাতির শুঁড় ঘেঁষে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। একলা পেলে ওই বুনো শূয়োর ওকে আস্ত রাখত না। হাওদায় বসে থাকলেও মিষ্টির গা ছমছম করছিল, ভালুক আর ওই শূয়োর দেখে এক হাতে বাপীকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল। বরাত-জোরে একটা বাঘ-টাঘ যদি বেরিয়ে পড়ত, নিদেনপক্ষে কাছাকাছির মধ্যে কোথাও বাঘের গর্জন-টর্জনও যদি শোনা যেত, মিষ্টি তাহলে দু’হাতেই ওকে জাপটেমাপটে ধরত বোধ হয়। লাগালাগি হয়ে তো বসেই আছে, তাছাড়া আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টির অজান্তে কতবার যে ওর পায়ে পিঠে কোমরে হাত দিয়েছে বাপী, সে শুধু ও নিজেই জানে।

বুনো শুয়োর দেখার পর দেবকীনন্দন আর ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে রাজি হয় নি। বড়সাহেবের বকুনির ভয় আছে। ফেরার সময় আবুর সঙ্গে বাপীও কিছু কেরামতি দেখাতে পেরেছে। তিন-তিনটে বন-মোরগ মারা হয়েছে, তার মধ্যে হাতির পিঠ থেকে নেমে একটা ও মেরেছে। বাকি দুটো আবু। খরগোস মারা গেল না। দীপুর একটা হরিণ মারার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাহেবের হুকুম ভিন্ন দেবকীনন্দন রাজি হল না। শিকারের ব্যাপারে রিজার্ভ ফরেস্টের আইন-কানুন সে-সময়েও ছিল। কিন্তু শিকারীরা সে-সময় আইনের পরোয়া বড় একটা করত না। কিছু টাকা খসালেই ফরেস্ট গার্ডের মুখ সেলাই। কিন্তু খোদ বড়সাহেবের ছেলের সঙ্গে এসে দেবকীনন্দন আইন অমান্য করে কি করে।

সকলের সঙ্গে এইদিন বাপীও নির্ভয়ে বড়সাহেবের বাংলোয় ঢুকতে পেরেছে। বন-মোরগ নিয়ে দীপুদা যেন দিগ্বিজয় করে ঘরে ফিরেছে। তিন-তিনটে বন-মোরগ দেখে মেমসাহেবও খুশি। তার মধ্যে একটা বাপী মেরেছে মিষ্টি সে-খবরও তার মাকে জানিয়ে দিল। বাপী আশা করেছিল, মেমসাহেব একটা মোরগ অন্তত ওকে আর আবুকে দিয়ে দেবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।

বাপীর তা বলে আফসোস নেই খুব। বাধা নিষেধ ঘুচল ভেবে আনন্দে আটখানা। মিষ্টিকে এক ফাঁকে জানিয়ে দিল, দুপুরে খেয়ে-দেয়ে আবার সে আসছে। বলেই ছুট। আবু আগেই বেরিয়ে এসেছিল। তাকে ধরল।

আবু ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো ওর দিকে। গম্ভীর। কিন্তু ভিতরে হাসছে বোঝা যায়। একটা চোখ ছোট করে বলল, কি করে, খুব মজা লুটলি বুঝি আজ— মেয়েটাকে তো কোলে সাপটে নিয়ে বসেছিলি দেখলাম—

বারো বছরের জীবনে বাপী এত আনন্দ আর পেয়েছে কিনা জানে না। অচেনা গোছের ভারী অদ্ভুত স্বাদ এ আনন্দের। শরীরটার ভেতর পর্যন্ত নরম-নরম একটা স্পর্শ এখনো ছড়িয়ে আছে। আবুর কথা শুনে লজ্জা পেল। এক ও ছাড়া আর সকলের চোখে ধুলো দিতে পেরেছিল। এমন কি ওই বোকা মেয়েটার চোখেও।

আবু এবারে নিজে থেকেই মন্তব্য করল, তোর স্বভাবচরিত্তি আমার থেকে ভালো বলতে হবে—

আবুর কোনো কথাই বাপীর কাছে হেলা-ফেলার নয়। ঠাট্টা হলেও না। মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা।—কেন?

—একটা দুধের মেয়েকে নিয়ে দিব্বি মেতেছিস। তোর মতো বয়সে আমার ষোল-আঠারো বছরের মেয়েগুলোকে ভালো লাগত।

বাপী বিমূঢ় একটু। আবু এখন বড় জোর সতের পেরিয়েছে। বাপীর বয়েসে মানে বারো বছর বয়সে ষোল-আঠারোর মেয়েদের ভালো লাগত! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে এখন?

—এখন কি?

——এখন কোন্ বয়সের মেয়েদের ভালো লাগে?

ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবু।—আর বলিস না, আমার বারোটা বেজে গেছে। বয়েস-টয়েসের ধার ধারি না, ভালো এখন শুধু একটা মেয়েকেই লাগে—কিন্তু ভীম বাহাদুর টের পেলে আমার মুখ থেঁতো করে দেবে—

শুনে বাপী হাঁ একেবারে।—কেন? কোন্ মেয়েকে ভালো লাগে তোমার?

—বনমায়াকে। মানুষের মেয়ে-টেয়ে আর ভালো লাগে না। অমন ডাকাবুকো প্রেম ওই বজ্জাতের মতো আর কোনো মেয়ে জানে না। ডর-ভয়ের মাথা খেয়ে একুশ দিনের মধ্যে একটা বুনো মস্তিকে ঠাণ্ডা করে ঘরের মেয়ে আবার ঘরে ফিরে এলো—চাট্টিখানি কথা!

বাপী এরপর হেসে বাঁচে না। ঘরে ফিরেও আবুর হাতি-মেয়ে প্রেমে পড়ার কথা যতবার মনে এসেছে, কেবল হেসেছে।

কিন্তু আবুর ঠেসের কথায় বাপী একটুও হতাশ হয় নি। মিষ্টিটা ছোটই বটে। কিন্তু যে মিষ্টিকে ওর খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে সে যেন ঠিক অত ছোট নয়। বাপী নিজেও তো সকলের চোখে কত ছোট, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও কি আর তেমন ছোট? মিষ্টিরও দেখতে দেখতে আর একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হবে। আর, আবু তো নিজেই বলেছে বড় হলে ওই মেয়ে খাসা দেখতে হবে।

পিসীর চোখে ধুলো দিয়ে সময় হিসেব করে বাপী দুপুরে আবার মিষ্টিদের বাংলোর সামনে হাজির। কিন্তু সামনের বারান্দা ফাঁকা। এই হিসেবে গরমিল দেখেই বাপীর মেজাজ গরম। দুটো বেজে গেছে, চারটের মধ্যেই তো ওর মা মহারানী দিনের ঘুম সাঙ্গ করে হেলে দুলে ওই বারান্দায় এসে দাঁড়াবেন। গেটটা ধরে বাপী শূন্য কাঠের বারান্দার দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু ঘরের জানলা দিয়ে মিষ্টি ওকে ঠিকই দেখেছে। বাবা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ওদিকে মায়েরও পাকা ঘুমের ঘন নিঃশ্বাস। মিষ্টির ওপরেও মায়ের আজ একটু ঘুমোনোর হুকুম ছিল। দাদা যে ছুটির দিনে আড্ডা দিতে বেরোয় সেটা কিছু নয়। ঘুম-টুম ধারে কাছে নেই মিষ্টির। উপুড় হয়ে শুয়ে মুখ তুলে জানলা দিয়ে গেটের দিকে দেখছিল।

পা টিপে বিছানা থেকে নেমে এলো। তারপর বারান্দায় এসেই ফিক করে হাসি। এই লুকোচুরির দেখাশুনার মধ্যে বেশ মজা আছে।

মজার ছোঁয়া বাপীর মুখেও। হাত তুলে মিষ্টিকে কাছে আসতে ইশারা করল। মিষ্টি দ্বিধায় পড়ল একটু। ওর ইচ্ছে বাপী আসুক। কিন্তু গেল সপ্তাহে ওকে এখানে এনে বসানোর ফলটা ভালো হয় নি মনে আছে। দেড় দু’-ঘণ্টা এখন আনন্দে কাটানোর ইচ্ছে ওরও।

গেটের কাছে আসতে এ-ধার থেকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি কচ্ছিলি?

—মায়ের কাছে শুয়ে ছিলাম, আর তুমি আস কিনা জানলা দিয়ে দেখছিলাম—

—মা কি কচ্ছে?

—মা-বাবা দু’জনেই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে—ভারী খাওয়া হয়েছে তো।

—খুব মুরগির মাংস সাঁটালি বুঝি?

মিষ্টির মুখে এখনো জল গড়ানোর দাখিল। কি সুন্দর খেতে, মা নিজে রান্না করল। দাদা তো নিজে পেট ঠেসে খেয়ে টিফিন বাক্সয় করে তার বন্ধুর জন্যেও নিয়ে গেল—

বাপী এবারে ঠেস দিতে ছাড়ল না। বলে উঠল, আমরা মেরে এনে দিলাম আর নিজেরাই স্বার্থপরের মতো খেলি—আমাদের কথা একবার মনেও পড়ল না?

মিষ্টি বিপাকে পড়ল। বাপী বলার পরে মনে হল ওদেরও দেওয়া উচিত ছিল। বলল, মা না দিলে আমি কি করব…এখনো আছে বোধ হয়, মা ঘুম থেকে উঠলে তোমাকে দিতে বলব?

—আমার খেতে বয়ে গেছে, আমি কি ভিখিরি? শব্দ না করে শেকল সরিয়ে আস্তে আস্তে গেটটা খুলল।—নে, বেরিয়ে আয় চট করে, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে খেলা করিগে চল্।

কিন্তু মিষ্টির অত সাহস নেই।—মা জানতে পারলে রক্ষে রাখবে না।

—তুই আচ্ছা ভীতু। মা জানছে কি করে, তার ঘুম ভাঙার ঢের আগেই তুই চলে আসবি। তোকে নিয়ে কি আমি দূরে যাব নাকি, কাছেই খেলা করব— জঙ্গলের মতো মজা আর কোথাও আছে নাকি, নিজেই তো দেখলি!

মিষ্টি তবু ভয় পাচ্ছে দেখে এবারে রেগেই গেল।—মায়ের পাশে শুয়ে তুইও তাহলে ঢেপসির মতো ঘুমোগে যা—মুরগির মাংস খুব ভালো হজম হবে’খন— স্বার্থপর মেয়ে কোথাকারের, আর কক্ষনো যদি আসি।

গেট ছেড়ে বাপী রাস্তাটার ওপারে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ভাবখানা এক্ষুনি ও একলাই জঙ্গলে নেমে যাবে।

বাপীকে অন্তত না দিয়ে নিজেদের মুরগির মাংস খাওয়াটা যে স্বার্থপরের কাজ হয়েছে মিষ্টি এখন আর সেটা অস্বীকার করে কি করে। তাছাড়া সকালে ওই ছেলের সঙ্গে জঙ্গলে ঘোরার মজাটাও কম হয় নি। ও চলে গেলে সত্যি খারাপ লাগবে। রাগ করে যদি আর না আসে তাহলে আরো খারাপ লাগবে।

একটা হাত তুলে বাপীকে দাঁড়াতে বলল। তারপর হালকা পায়ে ছুটে বাংলোয় উঠে গেল। বাবা মা কেমন ঘুমোচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখে নিল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ছুটে চলে এলো। সন্তর্পণে গেটের শিকলটা তুলে দিয়ে সেও রাস্তার এ—ধারে। উত্তেজনায় বুকের ভিতরে টিপটিপ

মিষ্টির একটা হাত বাপীর দখলে। তরতর করে রাস্তার ঢল বেয়ে নেমে চোখের পলকে দু’জনে জঙ্গলের আড়ালে। মিষ্টির গা ছমছম করছে। এখন তো আর বড় কেউ সঙ্গে নেই। ভিতরে পা দিয়েই মনে হল জঙ্গলটা ভীষণ নিরিবিলি এখন।

বাপীর বুঝতে দেরি হল না। হাতির পিঠে বসেই ভালুক আর বুনো শুয়োর দেখে ওই মেয়ে ওকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরছিল। ওর যেন সুবিধেই হল।

—ভয় করছে বুঝি?

মিষ্টির স্বীকার করতে আপত্তি, আবার একেবারে অস্বীকারও করতে পারছে না।

—দূর বোকা মেয়ে, আমি তো সঙ্গে আছি। হাত ছেড়ে বাপী এবারে ওর কাঁধ ধরে নিজের গায়ের সঙ্গে আগলে নিয়ে পা বাড়ালো।

ভয়-ডর কিছুক্ষণের মধ্যেই মিষ্টিরও উবে গেল। দুটো রঙচঙা প্রজাপতির পিছনে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। পাথর হাতে করে গাছের ডোরা-কাটা কাঠ—বিড়ালিও তাড়া করল দু’জনে। একটা খরগোস ও-দিক ফিরে গাছের কচি পাতা খাচ্ছিল, একেবারে একটুর জন্যে বাপীর ঢিলে থেঁতো হবার হাত থেকে বেঁচে গেল।

এ এক ভিন্ন রোমাঞ্চ। ছোটাছুটির ফলে মিষ্টি অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। বাপীর চোখে তাও মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। ফোলা ফোলা গাল দুটোতে এখন যেন আলগা রং লেগেছে। চুলের গোছা মাঝে মাঝেই মুখে এসে পড়ছে। বাপী লক্ষ্য রাখছে, ফাঁকে পেলে ওর আগে নিজে হাত বাড়িয়ে সেগুলো পিছনে সরিয়ে দিচ্ছে।

এরপর একটা গাছের বুক-সমান নীচু মোটাসোটা ডাল বেছে নিয়ে বাপী দু’হাতে ভর দিয়ে সেটার ওপর লাফিয়ে উঠে বসল। তারপর ঝোলানো পা দুটোকে শক্ত করে একটু ঝুঁকে মিষ্টির হাত দুটো ধরে হুকুম করল, নে, পায়ের ওপর পা দিয়ে উঠে চলে আয়।

মিষ্টির এখন সবেতে আনন্দ। গাছের ডালে কখনো চড়ে নি বা বসে নি। বাপীর হাত ধরে ওর পা বেয়ে উঠতে চেষ্টা। খিল খিল হাসি। ওঠা হল, এখন হাত ছেড়ে বাপীর পাশে গাছের ডালে বসে কি করে?

কি করে বসবে রাপী সেটা ভালোই জানে। একটা হাত ছেড়ে কোমরের কাছটা জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে এলো ওকে। মুখে মুখে ঠেকল, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি। তারপর দু’হাতে একরকম জাপটে ধরেই পাশে ডালের ওপর বসিয়ে দিল।

মিষ্টি আনন্দে আত্মহারা। আর আনন্দের সঙ্গে বাপীর হাড় মাংসের মধ্যে আরো অচেনা কিছুর ঝিলিক। গাছে বসার পরেও এক হাতে নিজের গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে।

কিন্তু মিষ্টির এখন সাহস খুব।—আঃ, সাপটে ধরে আছ কেন, ছাড়ো না! জবাবে একটু ধমকের সুরে বাপী বলল, হ্যাঁঃ, পড়ে গেলে তখন? তোর কি অভ্যেস আছে? পড়ে গিয়ে ওই ননীর শরীর একটু ছড়ে গেলে তোর মা আস্ত রাখবে আমাকে? গাছে একটা বাঁদর-টাদর এসে বসলেই তো তুই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবি।

মিষ্টি সভয়ে গাছের ওপরটা দেখে নিল একবার।—বাঁদর এসে বসবে নাকি?

বাপী যথাসম্ভব গম্ভীর।— আমি থাকলে ভয় নেই, এখানকার বাঁদরেরা আমাকে ওদের হেডমাস্টার ভাবে।…বাড়ির থেকে এখানে তোর ভালো লাগছে কিনা বল—

সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টির অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস।—খু-উ-ব ভালো লাগছে। সকালেও ভালো লেগেছিল। বাড়িতে কিচ্ছু মজা নেই।

সোৎসাহে বাপী বলল, তাও তো এখন পর্যন্ত কিছুই দেখিস নি তুই। জঙ্গলে জীব-জন্তুরা যে কি-কাণ্ড করে না!

ওদের ভাল-বাসাবাসির ব্যাপারটা বলতে গিয়েও বলল না। হাঁদা মেয়ে বাড়ি গিয়ে, যদি আবার কাউকে বলে দেয় তাহলে চিত্তির। জোরে শ্বাস টানল বার কয়েক। মিষ্টির চুলের গন্ধ আর গায়ের গন্ধ। সকালে আবু ঠাট্টা করে বলছিল, হাওদার ওপর ও নাকি মিষ্টিকে কোলে সাপটে নিয়ে বসেছিল। না অতটা পারে নি। ওকে গাছে টেনে তোলার সময় বরং ঢের বেশি চালাকি করা গেছে। সেই চালাকির ঝোঁকটাই মাথায় চেপে বসছে আবার।

—তোর চুলে আর গায়ে সুন্দর গন্ধ…কি করে হল রে? কি মাখিস?

মিষ্টি বলল, চুলে মা গন্ধ তেল মাখিয়ে দেয়, চানের সময় গায়ে সাবান ছাড়া আর তো কিছু মাখি না—

বাপী ওর গলার নীচে নাক ঠেকিয়ে জোরে দু’বার শ্বাস নিল। তারপর মন্তব্য করল, তোর গায়েও সুন্দর গন্ধ।

নিজের বুকে চিবুক ঠেকিয়ে মিষ্টি বুঝতে চেষ্টা করল কি-রকম সুন্দর গন্ধ! তারপর বলল, আমি তো পাচ্ছি না!

বাপী বলল, নিজেরটা নিজে পাওয়া যায় না বোধ হয়, আমার পাস কিনা দেখ্‌ তো।

মিষ্টি ওর বুকে নাক ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস টেনেই মুখটা বিকৃত করে ফেলল।—

এঃ, বিচ্ছিরি ঘামের গন্ধ!

রাগ না করে বাপী হাসতে লাগল। বলল, আমি তো ছেলে, বুঝলি না— ছেলেদের গায়ে কি মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ মানায়!

আনন্দে যত বিভোর হোক, আজ সময়-জ্ঞান ভোলেনি বাপী। ধরা পড়লে আজকের আনন্দ তো মাঠে মারা যাবেই, পরেও আর কোনো আশাই থাকবে না। লাফিয়ে ডাল থেকে মাটিতে নেমে পড়ল। তারপর দু’হাত বাড়িয়ে মিষ্টিকে ডাকল, আয়।

ওর মতো লাফিয়ে নামতে পারে কিনা মিষ্টি একবার দেখে নিল। লোভ হচ্ছে, কিন্তু খুব ভরসা পাচ্ছে না। সেটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর গলায় শাসনের সুর।—হাতে পায়ে লেগে গেলে জঙ্গলে ঘোরার মজা একদিনেই শেষ—চলে আয়।

দু’দিকের পাঁজর ধরে বাপী নিজের বুকের ওপর টেনে নামালে ওকে। তারপর তক্ষুনি মাটিতে না নামিয়ে সেই ভাবেই দশ বারো পা এগিয়ে গেল। বুক ছেড়ে মুখের সঙ্গেও মুখ ঠেকে আছে। এবারে মিষ্টির অস্বস্তি।—মাটিতে নামাচ্ছ না কেন!

—দাঁড়া, পিঁপড়ের ডাঁই-ফাই দেখেছিলাম ও-দিকটায়। দাঁড়িয়ে গেল। মুখে হাসি।—আমার গায়ে কত জোর জানিস, তোকে আমি এমনি করে ওই রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি—যাব?

—না—না। মিষ্টি এবারে হিঁচড়ে নেমে এলো।—আমি কি ছোট, কেউ দেখে ফেললে?

মাটিতে নেমে গেলেও বাপী ওর হাতের ওপর দখল নিতে ছাড়ল না। রাস্তার কাছাকাছি এসে হাতও ছাড়ল।—শোন, বাড়িতে কাউকে কিছু বলবি না কিন্তু খবদ্দার!

ঠোঁট উল্টে মিষ্টি জবাব দিল, কি বুদ্ধি তোমার, বললে তো মা আমাকেই আগে ঠেসে বকুনি লাগাবে।

ছুটে রাস্তায় উঠে গেল। বাপীও এগিয়ে এসে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে। সন্তর্পণে গেট খুলে আবার শেকল লাগিয়ে দিয়ে মিষ্টি চোরের মতোই বাংলোয় উঠে গেল। ঘরের মধ্যে একবার উঁকি দিয়ে একমুখ হেসে আবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। গাছের আড়াল থেকে বাপীও গলা বাড়িয়েছে। হাত নেড়ে মিষ্টি বুঝিয়ে দিল, বাবা-মা এখনো ঘুমোচ্ছে।

বাপী হাওয়ায় ভেসে বাড়ি চলল। আবুটা শুনলে কি বলবে ভাবছে আর হাসছে। সেই সঙ্গে একটা অবুঝ আনন্দ ভিতর থেকে উপচে পড়তে চাইছে। এটা কি রকমের আনন্দ বা এ-রকম কেন হয় বাপীর কাছে এখনো খুব স্পষ্ট নয়।

…তবে আবুর একটা কথা ঠিক, মিষ্টিটা এখনো বড্ড ছোট। আজ এত কাণ্ড হয়ে গেল, ও কিছু বুঝতেই পারল না। তাই ওর এই আনন্দের এক ফোঁটাও ভাগ পেল না।

…বাপীর যদি সে-রকম মন্ত্র-টন্ত্র কিছু জানা থাকত, মিষ্টিটাকে তাহলে রাতা—রাতি আর একটু বড় করে ফেলত।

.

ঠিক এক বছরের মাথায় বনমায়াকে নিয়ে আবার একপ্রস্থ হৈ-চৈ। আর তার এক মাসের মধ্যে ওর মাহুত মন-মরা ভীম বাহাদুরের আশা আর ভবিষ্যদ্বাণী দুই-ই তাক লেগে যাওয়ার মতো সফল।

বনমায়া আবার পালিয়েছে। এক মাস না যেতে ঠিক আগের বারের মতো একা নিজেই আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর এবারের পালানোটা একেবারে অন্যরকম। এবারে আর জঙ্গলের কেউ বা আশপাশের বন্দুক-অলা সাহেবদের কেউ দ্বিতীয় কোনো বুনো হাতির হাঁকডাক শোনে নি। এদিকে প্রথমবার পালানোর ফলে বনমায়ার পায়ের শেকল বদলে ঢের শক্ত-পোক্ত শেকল আনা হয়েছিল। পেল্লায় শাল-গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা সেই শেকল ছেঁড়া একলা বনমায়ার কর্ম নয়। একলা যে ছেঁড়ে নি তারও প্রমাণ মিলেছে। আগের রাতে অল্প অল্প বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার মাটিতে বনমায়া ছাড়া আরো একটা হাতির পায়ের ছাপ দেখা গেছে। আর জঙ্গল থেকে দূরের পাহাড়ের দিকে পাশাপাশি দুটো হাতি চলে যাওয়ার হদিসও মিলেছে।

মোট কথা, এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে, বুনো মরদ হাতিটা এবার নিঃশব্দে এসেছে। দুজনে মিলে শিকল ছিঁড়ে তেমনি নিঃশব্দে একসঙ্গে পালিয়েছে। এই পাহাড়ী জঙ্গল এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই দিব্বি ঠাণ্ডা পড়ে। সাহেব-সুবোরা বিলিতি আর জঙ্গল বা চা-বাগানের নিচের ধাপের জোয়ান-বুড়োরা দিশী মদ টেনে পাকা ঘুম লাগায়। বড় রকমের হাঁক-ডাক না হলে এমনিতে তাদের অসময়ে ঘুম ভাঙার আশা কম।

বড়সাহেব সন্দীপ নন্দী গেল বছরের হাতি পালানোর ফিরিস্তি শুনেছেন। এবারে এমন নিঃশব্দে পালানোয় ব্যাপারটা নিজে চাক্ষুস তদারক করে ভীম বাহাদুরের খুব একটা দোষ খুঁজে পেলেন না। কিন্তু মরা হাতির দাম যেখানে লাখ টাকা, সেখানে পোষা জ্যান্ত হাতি পালালে সরকারী কৈফিয়তে দোষ-ত্রুটি তো কিছু বার করতেই হবে। হাতি তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে অতএব কারো দোষ নেই এ-কথা লিখতে পারেন না। ও-দিকে চোখের জল ফেলে আর দু-হাত জোড় করে ভীম বাহাদুর যা বলছে তাতে তড়িঘড়ি শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, গম্ভীর থাকা দায়। তার আর্জির সার কথা, সাহেব যেন নারাজ না হন, সে নিরপরাধ হলেও দোষ মেনে নেবে যদি না বনমায়া ফিরে আসে। গা জুড়োলেই বনমায়া ফিরে আসবে। আসবেই।

ওর সমব্যথী ফরেস্ট গার্ড আর বীটম্যানদেরও সেই বিশ্বাস। অতএব বড়সাহেব তদন্তসাপেক্ষ রিপোর্ট দিয়ে বিচার স্থগিত রেখেছেন। আর মুখে ভীম বাহাদুরকে বলেছেন, ভালো করে তল্লাসি চালিয়ে যেতে, না পেলে মুশকিল হবে।

ভীম বাহাদুরের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ করে গেলবারের মতোই, এক মাসেরও আগে বনমায়া যেমন নিঃশব্দে গেছিল তেমনি নিঃশব্দে আবার ফিরে এসেছে। আর রাগের চোটে ভীম বাহাদুর পাগলের মতো কাণ্ড করেছে। ঘর থেকে ডাঙশটা এনে ওর মাথায় চেপে বসে এলোপাথারি মার শুরু করেছিল। বনমায়াও তেমনি গাঁ-গাঁ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। ভীম বাহাদুরের একটা পা ধরে টেনে আবু ওকে হিঁচড়ে নামিয়েছে। তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছে, কি বুদ্ধি তোমার, প্রেম মাথায় চড়লে ও পালাবেই, কিন্তু এরকম মার খেলে আর ফিরে আসবে?

ওর যুক্তির কথা শুনে বনমায়াকে ভীম বাহাদুরের এরপর সে কি আদরের ঘটা।

কত কি আছে যা ভাগ না করলে ভোগের আনন্দ বাড়ে না। বাপীরও সেই গোছের খেদ। খেদ কেন, রাগই বলা যেতে পারে। রাগ মিষ্টির ওপর, মিষ্টির মায়ের ওপর, এমনকি কলকাতায় কারা সব ঘোড়ার ডিমের আত্মীয় আছে ওদের, তাদের ওপরেও। এক মাসের ওপর হয়ে গেল ছেলেমেয়ে নিয়ে মিষ্টির মা কলকাতায় গেছে কোন্ আত্মীয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে। মহারাণীর এখনো ফেরার নাম নেই। আসলে ছেলেমেয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, পরীক্ষার ফল বেরুলেও নতুন ক্লাস এখনো শুরু হয় নি, তাই ফেরার তাড়াও কম। কিন্তু বনমায়াকে নিয়ে এ-দিকে এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল আবার, মিষ্টি জানতেও পারল না।

এই একটা বছরে বাপীর বুদ্ধিসুদ্ধি আরো পেকেছে। ওর জন্যেই জঙ্গলে বেড়ানোর নামে মিষ্টির এখন জিভে জল গড়ায়। আগের থেকে ওর সাহসও অনেক বেড়েছে। ছুটির দিনের দুপুরে ও-ই বরং বাপীর অপেক্ষায় ঘর বার করে এখন। খরগোস কাঠবেড়ালি বা বন-মোরগ তাড়া করার ঝোঁকে বাপী যে এক—একদিন ওকে নিয়ে কতটা দূরে চলে যায় মিষ্টি ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না। আবু সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। মিষ্টি তখন নিজের খুশিতেই একটু দূরে পা বাড়াতে চায়। বাপীর বোল-চালের ফলে হোক বা আবুর হাবভাব দেখেই হোক, মিষ্টির এখন বিশ্বাস বাঘ-ভালুক সামনে পড়ে গেলেও আবু ওদের কলজে ফুটো করে দেবে। আবু নিজেই বলে, তোমাদের যেমন দেবতা আছে, জঙ্গলের তেমনি অপ-দেবতা আছে। আমি হলাম গিয়ে সেই অপ-দেবতা, আমি সঙ্গে থাকলে তোমার কোনো ভয় নেই খুকুমণি।

কিন্তু বাপীর নিজের দোষেই মিষ্টি একটা জিনিস ইদানীং বুঝে ফেলেছে। ফাঁক পেলেই ওর এই সুন্দর শরীরটার ওপর ও হামলা করে। চালাকি করে গায়ে পিঠে হাত দেয়, মিথ্যে ভয় দেখিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। নিজে এখন অনায়াসে উঠতে পারলেও বুকের সঙ্গে সাপটে ধরে গাছের ডালে বসায় নয়তো ডাল থেকে নামায়। একদিন তো ডাল থেকে নামার সময় ইচ্ছে করেই ওকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেল। এমনি করল যেন টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে। মিষ্টির অবশ্য লাগে নি, লেগে থাকে তো ওরই একটু-আধটু লেগেছে। কারণ মিষ্টি ওপরে আর ও নীচে। কিছু বুঝুক না বুঝুক, মিষ্টির এরকম হামলা করতে দিতে আপত্তি। আগেও বলেছে—দাদা মারলে মা দাদাকেই বকে, মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে হয় না, বুঝলে? আর তুমি কেবল আমাকে পেলেই ধরে টানাটানি করো। এরকম করলে মাকে আমি বলে দেব।

বাপীর রাগ যেমন ভয়ও তেমনি। হেসেই ওকে ভোলাতে চেষ্টা করেছে, তুই যেমন বোকা, মেয়েদের মারতে নেই বলে গায়ে হাত তুলতে নেই—আমি কি তোকে মারার জন্যে গায়ে হাত দিই?

—তবে কেন দাও?

বাপী ভয়ে ভয়ে খুব মোলায়েম করে বলেছে, আমার ভালো লাগে।

—আমার বিচ্ছিরি লাগে। তুমি ও-রকম করলে আমি আর আসবই না। বাপী কথা দিয়েছিল ও-রকম আর করবে না। কিন্তু তার পরের ছুটির দিনেই ইচ্ছে করে গাছের ডাল থেকে নামানোর সময় ওকে নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে। মিষ্টি আর কিছু না বুঝুক, এটুকু বুঝেছে ওর শরীরের ওপর হামলা করতে ওই পাজী খুব মজা পায়।

এরপর কলকাতায় যাবার আগে মাত্র দুটো ছুটির দিনে জঙ্গলে এসেছিল। দুদিনই মিষ্টি বেঁকে বসেছিল, আসবে না। দাদার বন্ধু দাদাকে বলেছে, চা-বাগানের এক দুষ্টু লোক একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল, সেই জন্য রেগে গিয়ে অন্য লোকেরা ওই লোকটাকে মেরেছে। মিষ্টির মা বলেছে, বেশ করেছে মেরেছে, ও—রকম অসভ্য লোককে মারাই উচিত।—জঙ্গলে গেলে তুমিও অসভ্যের মতো করো, তোমার সঙ্গে যাব না!

নিরুপায় বাপী তখন নিজের কান মলেছে। বলেছে, ও-রকম করাটা যে অসভ্যতা ও ঠিক জানত না—আর কক্ষনো ও-রকম করবে না।

এরপর মিষ্টি এসেছে। বাপী ওর হাত ধরেছে তাতে খুব আপত্তি হয় নি। হাত ধরাটা তো আর গায়ে হাত দেওয়া নয়। পরের বারেও মিষ্টি আগে থাকতে গায়ে হাত না দেবার কড়ার করে তবে জঙ্গলে ঢুকেছে। বাপীর তাতেই প্রচণ্ড রাগ হয়েছে, হাত দুটো আরো বেশি নিশপিশ করেছে। আর অতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলার জন্য মনে মনে নিজেকেই গালাগাল করেছে।

রাগ বাপীর ওই বড়সাহেবের বাংলোর সকলের ওপরেই। মিষ্টির বাবা-মা, দীপুদা সক্কলের ওপর। ও-বাড়িতে ঢুকতে হলে আবুর সঙ্গে খরগোস বা বন—মোরগ নিয়ে, আম-জাম-জামরুল-পেয়ারা-খেজুর নিয়ে, ঝুড়ি ভরতি শাল-পলাশ নিয়ে, বা চাক-ভাঙা মধু নিয়ে যেতে হয়। আবুর আশা মেমসাহেবের নেকনজরে পড়লে সে বীটম্যান হবে। আর বাপীর আশা, মেমসাহেব বা দীপুদার কাছে ওর একটু আদর হবে, যার ফলে যখন-তখন ওই বাংলোয় আসাটাও সহজ হবে। কিন্তু একটা বছরে এটুকু ভালোই বুঝে নিয়েছে, আদরের আশা দূরে থাক, এই বাংলোর মানুষেরা ওদের মানুষই ভাবে না। জিনিস-টিনিস পেলে এমন ভাব দেখায় যেন এসব তাদের পাওনা। এমনিতে মিষ্টির সঙ্গে একটু গল্প করার লোভে বাংলোয় পা দিলেই মেমসাহেবের দুই ভুরুর মধ্যে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। সকালে জিনিস দেবার পর বিকেলে এলেও এমনিই অখুশি মুখ দেখে মেমসাহেবের। আর একদিন আবুর সঙ্গে এক ভাঁড় চাকভাঙা মধু নিয়ে এসে মেমসাহেবের মুখ হাসি দেখে সাহসে ভর করে তার সামনেই মিষ্টিকে ডেকে বলেছিল, মিষ্টি, একটা কথা শুনে যা—

সঙ্গে সঙ্গে মেমসাহেবের ফোঁস-মূর্তি।—এই ছেলে, অসভ্যের মতো তুই—তুকারি করিস কেন? ফের শুনি তো কান ছিঁড়ে দেব—

অপমানে বাপীর মুখ কালি একেবারে। বাইরে এসে আবু আবার তার ওপর হেসে হেসে নুন ছড়িয়েছে।—কি রে, ওই মেয়ের সঙ্গে আর প্রেম করবি না কি এরপর ওর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম ঠুকবি?

রাগের চোখে বাপী জ্বলে উঠেছিল, ওই মিষ্টিকে একদিন আমি একেবারে গিলে খাব দেখে নিও।

পিঠ চাপড়ে দিয়ে আবু বলেছিল, এই তো মরদের মতো কথা।

মেমসাহেব তো তবু মুখে বলেছে কান ছিঁড়ে দেবে। দীপুদা যখন তখন কান টেনেই ধরে, আর মাথায় খট-খট করে গাঁট্টা বসিয়ে দেয়। সব ছুটির দিনেই একলা মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার সুযোগ হয় না। কোনো কোনো ছুটির দিনে ওদের বাংলোয় অতিথি আসে, কোনোদিন বা দীপুদা এমনিই বেরোয় না। তখন একলা মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার আশায় ছাই। বাপী তখন ছুটে গিয়ে আবুকে ধরে নিয়ে আসে। আবুকে দেখলে দীপুদা জঙ্গলে বেড়াতে আপত্তি নেই। বাড়িতে লোকজন দেখে বেরুবার আশায় এই লোভটা মিষ্টিই একদিন দাদাকে দেখিয়েছিল, আর বাপীকে বলেছিল আবুকে ডেকে আনতে। তারপর থেকে ঘরে থাকলে আবুও জঙ্গলে ঘোরার রস কিছু পেয়েছে। এক-একদিন নিজেই ওকে ডেকে বলে দেয়, আবুকে ডেকে নিয়ে আসিস—

এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে ভয়-ডর আপনা থেকেই কমে আসে। মিষ্টি এখন সামনের রাস্তা পেরিয়ে একলা জঙ্গলে নামলে আর খুব কাছাকাছির মধ্যে ঘোরাঘুরি করলেও ওর মা বকা-ঝকা করে না। কেবল বলে দেয়, খবরদার দূরে যাবি না, এখান থেকে ডাকলে যেন শুনতে পাস—

ছেলে আর আবু সঙ্গে থাকলে কিছুই বলে না। তার ধারণা কাছাকাছির মধ্যেই থাকে ওরা। সে-সময় দীপুদার মাতব্বরী আর শাসন দেখে বাপীর গা জ্বলে যায়। জঙ্গলটা যেন ওদের সম্পত্তি। ইচ্ছে মতো বাপী এদিক ওদিক ছুট লাগালে চোখ পাকাবে। পশু-পাখি টিপ করে পাথর ছুঁড়লেও এক-এক সময় আচমকা গাঁট্টা। কি, না আমি মারতে যাচ্ছিলাম, তুই আগে মেরে বসলি কেন? ওর সঙ্গে ছুটতে গিয়ে মিষ্টি হোঁচট খেয়ে ব্যথা পেল কি পেল না, দীপুদার চড়-চাপড়টা এসে পড়ল ওর ওপর। বাপীর সব থেকে বেশি অপমান হয় এসব যখন আবু দেখে আর তেরছা চোখে ওর দিকে তাকায়। যেন বলতে চায়, ভালবাসার আর কি দাম দিবি, এরপর কি জুতোপেটা শুরু হলে আক্কেল হবে?

সেই এক বছর আগে মিষ্টিকে ভালবাসতে ইচ্ছে করার কথাটা বোকার মতো আবুকে যদি না বলে ফেলত, তাহলে এতটা খারাপ লাগত না। মিষ্টির মা বা দীপুদা শাসন করলেও আবু এভাবে তাকিয়ে মজা পেত না, বা ঠাট্টা-ঠিসারা করত না। ওই বাংলোর মহারাণী আর তার ছেলের ওপর কত যে রাগ বাপীর সে শুধু ওই জানে। রাগ বড়সাহেবের ওপরেও। বাপীর বাবার থেকে এত ওপরের একজন না হলে ওকে এত হেলা-ফেলা কেউ করত না। আর রাগ সময় সময় তাদের আদুরে মেয়ের ওপরেও। ওই মিষ্টির থেকে বনমায়া ঢের ভাল। পায়ে শেকল বাঁধো আর যা-ই করো, ভালবাসার পুরুষ হাতি এলে সব ভয়-ডর বিসর্জন দিয়ে ও তার সঙ্গে চলে যাবেই। মিষ্টি যদি বনমায়ার মতো হত।

বনমায়াকে নিয়ে আবুর সঙ্গে অনেক রসের কথা হয়েছে বাপীর। সে-সব কথা মিষ্টিটাকে বলাও যাবে না। এক বছরেই বাপী ভিতরে ভিতরে যেমন ধাঁধাঁ করে বড় হয়ে গেছে, ও তো আর অতটা হয় নি। আর আবুর তো কথাই নেই, আঠেরো বছর পার—জঙ্গলের যাকে বলে বুক-চিতানো মরদ একখানা। ওকে দেখলেও বাপীর চোখ জুড়োয়।

কিন্তু মিষ্টিরা নতুন বছরের ছুটির মধ্যে এখানে না থাকাতে জন্ম থেকে দেখা এই বানারজুলির জঙ্গলটাকেই আরো চেনা আরো জানার সুযোগ হয়েছে বাপীর। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ, ছুটির আগে রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। নতুন ক্লাসের বই—পত্রই কেনা হয় নি এখন পর্যন্ত—বই নিয়ে বসার তাড়াই বা দেয় কে? তার ওপর স্কুল ছুটি।

সকাল দুপুর বাপীর আবুর সঙ্গেই কাটছে। আঠারো পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবুর বীটম্যান হওয়ার দাবী। এতদিন স্কুল ছাড়া সার্টিফিকেটে ওর বয়েসটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাকরির জন্য আবু এখন কোমর বেঁধে তৈরি। ওর বাবা কালুকে নিয়ে বাপীর বাবার সঙ্গে দেখা করে দরখাস্ত পেশ করেছে। বাবা দরখাস্ত রেখেছে, আশাও দিয়েছে। চাকরি দেওয়া না দেওয়ার মালিক বড় সাহেব— মিষ্টির বাবা। সেটা সকলেই জানে। কিন্তু তার কাছে সুপারিশ তো কাউকে করতে হবে। বাপীর বাবা সেই সুপারিশের আশ্বাস দিয়েছে।

আবুকে মুখে কিছু না বললেও এখানেই বাপীর যা একটু সংশয়। বড় সাহেবকে দশ গজের মধ্যে দেখলেই বাবার চোখ-মুখের যা অবস্থা হয় তার দ্বারা ধরা-করার ব্যাপারটা কতদূর হবে কে জানে। তবে আবুকে অন্য দিক থেকে একটু আশার কথা শোনাতে পেরেছে বাপী। বাবা ওর দরখাস্ত বড়সাহেবকে দিলেই ও মিষ্টিকে ধরবে। মিষ্টি বাপের আদুরে মেয়ে, তার ওপর আবুকে ওরও ভারী পছন্দ। তাছাড়া এটা ওটা ভেট দিয়ে দিয়ে আবু মেমসাহেবকেও খুশি রেখেছে। আবুর চাকরি তাহলে হবে না কেন?

কিন্তু আবু কোনো চিন্তা-ভাবনার ধার ধারে না। নিজের কাছে ও পাকাপোক্ত বীটম্যান একজন হয়েই বসেছে। বাপ অর্থাৎ হেড বীটম্যান কালুর চার ভাগের তিন ভাগ কাজ ও-ই করছে এখন। বীটম্যানদের প্রথম কাজ জঙ্গলে টহল দেওয়া। বাপী তার সেই টহলের দোসর এখন।

জঙ্গলের মধ্যেই মাটির ঘরে থাকে ওরা। সব বীটম্যানরাই তাই। অনেকটা দূরে দূরে ওদের ঘর। ভাড়া গুনতে হয় না, এমনিতেই থাকতে পায়।

সকালে মুখে কিছু গুঁজেই বাপী ছোটে আবুর ওখানে। দেরি হলে আবু একলাই বেরিয়ে পড়বে। কারণ কালু তো এখন আর সকালের মুখ দেখে না। পড়ে পড়ে ঘুমোয় বা ঝিমোয়। বাপীর ধারণা ছেলে অনেক কাজ বুঝে নেবার পর থেকে ওর নেশার মাত্রা বেড়েছে। আর নিজে থেকে কিছু বলে না বলে বাপীও মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না।

টহল দেবার সময় বীটম্যানদের হাতে পাকানো বাঁশের লাঠি থাকে। কিন্তু আবু নিজের পিয়ারের সেই লোহার খাপ আঁটা ইস্পাতের ফাল বসানো লাঠিটা সঙ্গে নেয়। বাপীর হাতেও থাকে তার নিজের ছোট লাঠি। শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস গাছগুলোয় ঘা মারতে মারতে এগোয় তারা। ফুর্তি করার জন্য ঘা মারা নয়। কোনো গাছে পোকা ধরল কিনা ঘা মারার শব্দ থেকে সেটা বোঝা যায়। বাপী বুঝতে পারে না, কিন্তু আবু ঠিক বুঝতে পারে। গাছের শত্রু উই, গান্ধীপোকা, গঙ্গাফড়িং, পঙ্গপাল। কোন্ শত্রু নিকেশের জন্য কি ওষুধ দরকার আবু তাও জেনে ফেলেছে। কোনো গাছে পোকা ধরলে বা শত্রুর সন্ধান পেলে বীটম্যানের কাজ ওপরঅলার কাছে রিপোর্ট করা।

ফাঁকি না দিলে বীটম্যানের আরো অনেক কাজ। চারাগাছের বেড নিয়ম করে পরীক্ষা করা একটা বড় দায়িত্ব। জলের নালা দিয়ে ঠিক মতো জল আসছে কিনা, বেশি জল আসছে কিনা, ওর কাছাকাছি সজারু গর্ত খুঁড়ল কিনা, এইসব। বুনো শূয়োরও কত সময় চারাগাছ মুড়িয়ে দিয়ে যায়। সেরকম সম্ভাবনা দেখলে লোকজন ডেকে লাঠি আর টিন কানেস্তারা নিয়ে আশপাশের বড় গাছের ডালে বসে পাহারা দিতে হয়। পাহারা মানে টিনকানেস্তারা পিটে জানোয়ারদের ভয় দেখানো।

কিন্তু আবুর সেরকম পাহারাদার হতে ইচ্ছে করে না। বীটম্যান হলেই ও একটা বন্দুক পেতে চেষ্টা করবে। ওর বাপের যদি সেরকম হিম্মত থাকত তাহলে ঠিক একটা বন্দুক আদায় করতে পারত। কিন্তু রাত হলেই তো নেশায় পেয়ে বসে বাপটাকে। তার হাতে বন্দুক দেবে কে? না, বাপের ওপর খুব একটা শ্রদ্ধাভক্তি নেই আবুর। বাপীর বাবা মানে কেরানীবাবু নেহাত ভালোমানুষ বলে ওর বাপের দোষত্রুটি ধামাচাপা দিয়ে রাখে—এ কথা আবু নিজের মুখে ওকে বলেছে।

জঙ্গলের মধ্যেই একটা ভাটিখানা আছে বাপী এতদিন সেটা জানত না। এক—দিনের অভিজ্ঞতার তাও জানা হয়ে গেল। বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল দুজনে, হঠাৎ কোত্থেকে একটা বড়সড় হরিণ ঝড়ের মতো ওদের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগল। ওটার গায়ে একটা তীর বেঁধা। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।

ব্যাপার ভালো করে বোঝার আগেই বাপী দেখে আবুর দুচোখ ঝলসে উঠেছে, চোয়াল কঠিন। হ্যাঁচকা টানে বাপীকে টেনে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু তীর ধনুক হাতে উল্টোদিকের ছুটন্ত লোক দুটো দেখেই ফেলল ওদের। থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

আবু তারস্বরে একটা বিকট চিৎকার করে লোক দুটোকে তাড়া করল। জঙ্গল—চোর বা অন্য কোনো বিপদ-আপদ দেখলে বীটম্যান অন্য বীটম্যানদের বা ফরেস্ট গার্ডদের এমনি চিৎকার করে জানান দেয়।

লোক-দুটো চোখের পলকে উধাও। আরো কয়েকবার চিৎকার করেও আর অন্য কোনো বীটম্যানের সাড়া পেল না। ওর যতো উত্তেজনা ততো রাগ। মাল বা পলিয়া জঙ্গল-চোরদের এই কাজ। ফাঁক পেলে তীর ধনুক দিয়ে তারা হরিণ মারে, রাতে কাটা গাছের কাঠ সরায়।…হরিণটা নিশ্চয় কোথায় মরে পড়ে থাকবে। তখন প্রথম দোষটা পড়বে ওর বাবার ঘাড়ে। এ-এলাকায় তার নিজের টহল দেবার কথা, অন্য লোকও মোতায়েন রাখার কথা। আর এ-দিকের ফরেস্ট গার্ডের কাছেও জবাবদিহি করতে হবে।

আবু তার বাবার খোঁজে ছুটল। পিছনে বাপী। কিন্তু কালু ঘরে নেই। দাঁত কড়মড় করতে করতে হনহন করে আবু আবার জঙ্গলের আর এক দিকে চলল।

গাছ-গাছড়ার আড়ালে একটা মাটির ঘর। সেখানে আসতেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এলো বাপীর। সামনেই পেল্লায় কড়ার মধ্যে ফুটছে কি। উৎকট গন্ধটা সেদিক থেকে আসছে। এদিকটায় মাটির ওপরেই বসে আছে আবুর বাবা কালু, তার সঙ্গে আরো তিন-চারজন। সকলের হাতেই মাটির ভাঁড়।

আবু ঝাঁঝালো গলায় খবরটা কালুকে দিল। কালু বসে বসে দুলছিল। ঘোলাটে চোখ। জঙ্গল-চোরের উদ্দেশে একটা বিচ্ছিরি গাল দিয়ে উঠল সে। তার সঙ্গীরা আরো কিছু গালাগাল যোগ করল। কালু ছেলেকে হুকুম করল, চোর দুটোকে গাছের সঙ্গে কষে বেঁধে রাখ—আমরা যাচ্ছি। আর বলল, খুঁজে-পেতে মরা হরিণটাকে ঘরে নিয়ে যেতে—রাতে ভোজ হবে।

বাপীর হাত ধরে টেনে আবু রাগে গজগজ করতে করতে ফিরল আবার। অভিসম্পাতও করল, দিনের বেলায়ই বেহেড মাতাল হয়ে আছে—মরুক—ধরা পড়ে মরুক সব!

বাপী সেই প্রথম জানল ওটা ভাটিখানা। চুরি করে মদ চোলাই হয় ওখানে। সকলেই জানে, পাহারাদাররাও জানে। কিন্তু ভাবখানা দেখায় যেন কেউ কিচ্ছু জানে না।

বাপী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, হরিণ মারার ব্যাপারটা ধরা পড়লে তোমার বাবার শাস্তি হবে?

আবু ঝাঁঝালো জবাব দিল, হওয়া তো উচিত। কিন্তু শাস্তি দেয় কে—এখানে ছোট থেকে বড় সব শালা চোর!

বাপী ঘাবড়েই গেল।—আমার বাবাও?

—না, তোর বাবার অত সাহস নেই—তা বলে তোর বাবার বাপ-খুড়োরা কেউ কম যায় না—বুঝলি?

বাপীকে হাঁ করে থাকতে দেখে রাগের মুখেও আবু হেসে ফেলেছিল। তারপর চুরির ব্যাপারটার ব্যাখ্যাও করেছিল। বাপীর বাবার বাপ-খুড়ো বলতে জঙ্গলের বড় মাঝারি ছোট সাহেবরা। এবারের বড়সাহেব অর্থাৎ মিষ্টির বাবা আসার পর থেকে জঙ্গলের চুরি নাকি আগের থেকেও বেড়ে গেছে। কন্ট্রাকটারদের গাছ ইজারা দেওয়ার সময় মোটা ঘুষের টাকা ওই সাহেবসুবোদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। অনেক শিশুগাছ ইচ্ছে করেই চিহ্ন দেওয়া হয় না। চিহ্ন না থাকা মানেই সরকারী হিসেবে সে গাছ নেই। শিশুগাছ খুব দামী। ভালো কাঠ আর তক্তা হয়। টাকা খেয়ে বড় সাহেব মেজ সাহেবরা সেই সব মার্কা ছাড়া গাছ কাটতে দিলে কে আর ধরবে? কার বুকের পাটা আছে যে বলে দেবে? তাছাড়া ঘুষ দিয়ে বেআইনী শিকারও কম হচ্ছে নাকি এখন এখানে?

মিষ্টির বাবা পর্যন্ত এরকম খারাপ কাজের মধ্যে আছে শুনে বাপীর মুখে কথা সরে না। কিন্তু কাউকে বলার জো নেই, এমন কি পিসীকেও না। আবু সাবধান করে দিয়েছে, খবদ্দার কাউকে বলবি না—তোর বাবার কানে গেলে উল্টে তোকেই ধরে পিটবে। আর বড়সাহেব মেজসাহেবদের কানে গেলে তো তোর আমার বাবারই চাকরি নট।

মুখে না বলতে পারুক, এত সব জানার ফলে বাপীর ভিতরে ভিতরে রাগ খুব। জঙ্গলটা একটু আদর-যত্ন আর দেখা-শুনার আশায় মানুষের মুখ চেয়ে আছে, আর মানুষই কিনা সব থেকে বেশি হামলা করছে তার ওপর।

বড়সাহেবের বাংলোয় ওই আদুরে মেয়ের দেখা পাওয়া গেল স্কুল খোলার ঠিক আগের দিনটিতে। এসেছে বাপী তাই জানত না। তবে রোজই একবার করে এদিকটায় টহল দিয়ে যায়।

সকালে মিষ্টিকে বারান্দায় দেখেই আনন্দে বুকের ভিতরটা দাপাদাপি করে উঠল। কিন্তু ডাকবে কি, বড়সাহেব এই বারান্দায় বসেই কাগজ পড়ছে।

ডাকতে হল না, মিষ্টি নিজেই দেখল ওকে। ঘাড় বেঁকিয়ে বাপকে একবার দেখে নিয়ে ও গেটের কাছে চলে এলো।

বাপী গেট-এর ওধারে।

—জানো, আমি ফার্স্ট হয়েছি—বাবা বলল। দাদাও পাশ করেছে—

ফার্স্ট বা পাশের ধার ধারে না বাপী, ওকে দেখেই খুশিতে টইটম্বুর।—কবে ফিরলি?

—কাল বিকেলে। ছুটির মধ্যে তুমি আর আবু খুব জঙ্গল চষলে তো?

খুব। বাপী কথা বলবে কি প্রায় দেড় মাস বাদে মিষ্টিকে দেখে চোখে পলক পড়ে না। মিষ্টির বয়েস এখন মাত্র নয়, কিন্তু এই দেড়টা মাসের মধ্যে ও যেন দিব্বি বড়সড় হয়ে উঠেছে। মাথায় বেড়েছে, মুখ আরো ফর্সা হয়েছে। বলল, এদিকে কত কি কাণ্ড হয়ে গেল তুই জানিসও না—দুপুরে জঙ্গলে আসবি তো? সব বলব—

— মিষ্টি!

পিছনের বারান্দা থেকে ধমকের সুরে মায়ের আচমকা ডাক। তাঁর হাতের কাচের গেলাসে দুধ। অপ্রসন্ন চাউনি।

জবাব দেওয়া হল না। মিষ্টি ঘুরে আবার বারান্দার দিকে ছুট। বাপীরও আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস নেই। মহারাণীর মুণ্ডুপাত করতে করতে বাড়ির দিকে চলল। ফিরে আসা হয়েছে জানলে বাপী ঠিক হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসত। শুধু কর্তা কেন, ঘুষ ছাড়া গিন্নীরও খুশি মুখ দেখা যায় না। এখন কতক্ষণে দুপুর হবে আর কতক্ষণে একলা পাবে মিষ্টিকে ঠিক নেই।

ঠিক সময়েই দুপুর হল। মিষ্টিকেও একলাই পেল। কিন্তু এতদিন বাদে জঙ্গলে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েও মেয়েটার হাব-ভাব অন্য রকম। গেট পর্যন্ত ছুটে চলে আসারও তাড়া নেই। নেহাত গেট-এর কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বলেই আসা। বাপীর সবুর সয় না। আবার ওর মুখ দেখে শংকাও একটু। গলা চেপে জিজ্ঞাসা করল, তোর মা ঘুমোয়নি?

—ঘুমিয়ে কাদা। আর বাবাও বাড়ি নেই।

—তাহলে কি হল, জঙ্গলে যাবি না?

মিষ্টি একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল ওকে। এরকম করে দেখাটাও নতুন ঠেকছে বাপীর।

—আবু কোথায়?

—আবুকে দিয়ে কি হবে? সে জঙ্গলে ঘুরছে কি বাড়িতে ঘুমুচ্ছে কে জানে!

কড়ার করে নেওয়ার সুরে এবারে মিষ্টি বলল, জঙ্গলে ঢুকে তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না?

এতদিন বাদে এসেও সেই পুরনো কথাই আগে বলবে বাপী ভাবেনি। বলার ফলে রাগের সঙ্গে ওই লোভটাই ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল।—তোর কি ননীর শরীর নাকি যে হাত দিলে গলে যাবি? হাত দেব না সে তো সেই কবেই বলেই রেখেছি!

গেট খুলে আর বন্ধ করে মিষ্টি বেরিয়ে এলো। কত দিনের মধ্যে জঙ্গলে পা দেয়নি। বেরুনোর তাগিদ তারও কম নয়। জঙ্গলে ঢুকে বাপী ওর হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিল!

—ফের?

বাপী থতমত খেল একদফা। দেড় মাসের মধ্যে কতটা বড় হয়ে গেছে ঠাওর করে উঠতে পারল না। —হাত ধরতেও দিবি না?

—না। কলকাতার সোনাদি বলেছে তুমি একটা অসভ্য ছেলে, তোমার সঙ্গে একলা জঙ্গলে আসতেই বারণ করেছিল। বলেছিল, তোমার মতলব খারাপ।

বাপী হতভম্ভ।—সোনাদি কে?

—আমার এক দূর-সম্পর্কের মাসির মেয়ে। তারও এখন তোমার মতো তেরো বছর বয়েস।

—সে আমার কথা জানল কি করে?

—সোনাদির কাছে তোমার সঙ্গে চুপিচুপি জঙ্গলে বেড়ানোর গল্প করেছি না? আমাকে একলা পেলে তুমি কত রকমের দুষ্টুমি করো তাও বলেছি। তাই শুনেই তো সোনাদি আমাকে সাবধান করে দিল—আমি কি অত বুঝতাম?

বাপীর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। আবার ভয়ও কম নয়।—আর তোর সোনাদি তোর মাকেও বলে দিল?

ঠোঁট উল্টে মিষ্টি জবাব দিল, হুঁঃ, সোনাদি অত বোকা কিনা। ওদের বাড়ির পাশের এক বজ্জাত ছেলে এক সন্ধ্যায় চুপি চুপি ছাদে উঠে গিয়ে সোনাদিকেই পিছন থেকে জাপটে ধরেছিল—সোনাদি সেকথাই তার মাকে আজ পর্যন্ত বলেনি—তারপর সেই পাজী ছেলে চুমু খেতে চেয়ে সোনাদিকে চিঠি পর্যন্ত লিখেছে—সোনাদি তাও মাসিকে বলেনি, বুঝলে?

বাপীর ভয়ডর উবে গেল। এ কথা শোনার পর একটা অজানা ইচ্ছে মুখের দিকে এগিয়ে আসছে, আর হাত দুটো আগের থেকে আরো বেশি নিশপিশ করছে। বলল, তোর সোনাদির খুব বুদ্ধি, তোর যদি সে-রকম বুদ্ধি থাকত!

সঙ্গে সঙ্গে বনমায়ার গল্পে চলে এলো সে। আগের বার বনমায়ার পালানো আর ফিরে আসার গল্প ঢের আগেই মিষ্টিকে বলেছিল। এবারেও বনমায়া কি কাণ্ড করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে তার ভালবাসার পুরুষ হাতির সঙ্গে চলে গেছল, একমাস ধরে ফুর্তিটুর্তি করে কবে আবার ফিরেছে—ওকে দেখে ভীম বাহাদুর ক্ষেপে গিয়ে কি করেছিল, আর আবু কি বলেছিল—এই সব।

এই গল্প শোনানোর ফাঁকে বাপী কখন ওর একটা হাত নিজের হাতের দখলে নিয়ে নিয়েছে, মিষ্টির খেয়ালও নেই। ও-দিকে মিষ্টিও এবারে সোৎসাহে কলকাতায় টারজানের ছবি দেখে আসার গল্প বলল। জঙ্গলের রাজা টারজান। টারজানের মতো বীর আর কাউকে হতে হয় না—গাছের ঝুরি ধরে অনেক দূরের গাছে দোল খেয়ে চলে যায়, পাহাড় থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে, তার সেই ভীষণ ডাক শুনলে হাতি-বন্ধু, আর শিম্পাঞ্জী চলে আসে, লড়াই করে বাঘ সিংহ কুমির মেরে ফেলে। মনে করতেও গায়ে কাঁটা মিষ্টির।

ভাগ্য বটে মিষ্টিটার। কলকাতায় গিয়ে এমন ছবিও দেখে এলো। শুনেই বাপীর রক্ত নাচছে, আর টারজান হবার সাধ যাচ্ছে। হঠাৎ কি ভেবে জিজ্ঞাসা করল, জঙ্গলে টারজানের সঙ্গে কোনো মেয়ে ছিল না?

—ছিল না কি গো! টুকটুকে মেমসাহেব মেয়ে! তারও পরনে টারজানের মতো এইটুকু চামড়ার মতো কি—আর বুক শুধু একটু ঢাকা—তাতেও কি সুন্দর দেখাচ্ছিল।

বাপীর নিঃশ্বাস বন্ধ—টারজান সেই মেয়ের গায়ে হাত-টাত দিত না? মিষ্টির খিলখিল হাসি। দিত না আবার—দুজনে জড়াজড়ি করে গাছের শিকড় ধরে দোল খেত, টারজান মাটিতে শুয়ে থাকলে মেয়েটা তার বুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ত—

আনন্দে বাপী মিষ্টির দু কাঁধ ধরে বড়সড় দুটো ঝাঁকুনি দিল।—তবে? তোর সোনাদি জঙ্গলের খেলা কিচ্ছু জানে না—বুঝলি? জঙ্গলের সব অন্য রকম।

টারজানের ছবি চোখে লেগে থাকায় মিষ্টি খুব যেন সেটা অস্বীকার করে উঠতে পারল না।

.

নতুন বছরের শুরু থেকেই বাপীর পড়াশুনা শিকেয় উঠেছিল। সেবারের হাফ—ইয়ারলি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ভালোমানুষ হরিবাবুরও মেজাজ গরম। ভালো নম্বর কিছুতে নেই, তার মধ্যে দু’পেপারে ফেল! পড়াশুনার জন্য সেই প্রথম ছেলের গায়ে হাত তুলতে গেছলেন তিনি। এক স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া ঘরের বাইরে পা দিলে আস্ত রাখবেন না বলে শাসিয়েছেন।

বাপী কী করবে? দু’বেলাই বইখাতা নিয়ে সময়মতো পড়তে বসে। কিন্তু ওর চোখের সামনে কেবল জঙ্গল আর আবু আর মিষ্টি আর টারজান। পড়ার ফাঁকে তারা কখন যে এসে হাজির হয় বাপী নিজেও জানে না। তাছাড়া পড়তে বসেই দীপুদার ওপর রাগ, আবুর এই ছ’মাসের মধ্যেও চাকরি না হওয়ার জন্য বড়সাহেবের ওপর রাগ। আর সব থেকে বেশি, চাকর-বাকরের মতো ওকে হেলা-ফেলা করার জন্য মিষ্টির মায়ের ওপর রাগের যত সব কাল্পনিক ফয়সলা মাথায় ভিড় করে আসে।

…এর মধ্যে চালাকি করে একদিন মিষ্টিকে বাড়িতেও আনা গেছল। তারপর আর একদিন মিষ্টি নিজেই এসেছে। পিসী বড়সাহেব-টাহেব পছন্দ করে না। কিন্তু বড়সাহেবের এই মেয়েটাকে পিসীরও ভালো লেগেছিল। দুদিন আদর করে খেতে দিয়েছে। আর বাপীকে বলেছে সুন্দরই তো মেয়েটা, আর বেশ বাড়ন্ত গড়ন।

পড়তে বসলে এ-সবও বাপীর মনে পড়ে। বাড়ন্ত গড়নের মেয়ে আরো একটু চটপট বড় হয় না কেন তাও ভাবে।

পরীক্ষার ফল নিয়ে বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার দিন-কতকের মধ্যে আবার বিপর্যয় নেমে এলো একটা। অথচ এর উল্টো হবার কথা

মাত্র চারদিন আগে বড়সাহেবের কাছেও আবুর একটু খাতির কদর হয়েছে। আবুটা ডাকাতই বটে। সাঁঝের আঁধারের আগে গভীর জঙ্গলে ঢুকেছিল। একা। গাছে একটা বন-বিড়াল দেখে পিছন থেকে বড় পাথর ছুঁড়ে ওটাকে পেড়ে ফেলেছিল। বন-বিড়াল এমনিতেই ভীষণ হিংস্র। পাথরের ঘায়ে ভালো মতো জখম হয়েও মাটিতে পড়ে ওটা তেড়ে এসে আবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবুর লাঠির পেল্লায় ঘায়ে আবার মুখথুবড়ে পড়েছে। তারপর আবু লাঠিপেটা করেই ওটাকে শেষ করেছে।

এই বন-বিড়ালটাই একধার থেকে জঙ্গলের ছাগল ভেড়া আর মুরগি মারছিল। এমন দুঃসাহসের জন্য বড়সাহেব সন্দীপ নন্দী পাঁচ টাকা পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। আর চাকরির আশ্বাসও দিয়েছেন।

বাপীর আনন্দ ধরে না। বাবা যতই শাসন করুক, ছুটির দিনে ঘরে বসে থাকা ওর কুষ্ঠিতে নেই। চারদিন পরের বোরবারে মিষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল। আর মনের আনন্দে বেশ দূরেও চলে গেছল। আবুর এত বড় বীরত্বের পর ওদেরও যেন ভয় সাজে না।

গোঁ-ভরে একটা খরগোসের পিছনে ছুটেছিল বাপী। ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে মিষ্টি দাঁড়িয়ে গেছল।

একটু বাদে বিশহাত দূরের শিশুগাছটার দিকে চোখ পড়তে মিষ্টির ছোট্ট শরীরটা একেবারে নিস্পন্দ কাঠ যেন। সব রক্ত যেন ঠাণ্ডা জল হয়ে যাচ্ছে।

গাছের মোটা গুঁড়িটার পাকে-পাকে জড়িয়ে আছে একটা অতিকায় ময়াল সাপ। সমস্ত গায়ে ঝকঝকে কালো-সাদার ছোপ-ছোপ দাগ। তার লম্বা চ্যাপটা মুখটা সামনের দিকে টান হয়ে এগিয়ে আছে। চোখ দুটো মিষ্টির চোখের সঙ্গে আ কে আছে। একটা সোঁ-সোঁ নিঃশ্বাস যেন মিষ্টির গায়ে এসে লাগছে।

নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। সর্ব অঙ্গ অবশ। গলা দিয়ে একটু শব্দও বার করতে পারছে না।

ওকে দুচোখে আটকে নিয়ে সাপ্টা আস্তে আস্তে গুঁড়ি থেকে শরীরের প্যাঁচ খুলছে!

তারই মধ্যে ফিরে এসে বাপী এই দৃশ্য দেখে ভেবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল প্রথম। তার পরেই মাথার মধ্যে যা খেলে গেল ও-ই জানে। বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে মিষ্টিকে এক ধাক্কা। সেই ধাক্কায় চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ল ও। সঙ্গে সঙ্গে বাপী ওকে টেনে তুলল।—ওঠ! ছোট্‌! নইলে আস্ত গিলে ফেলবে।

পাগলের মতোই ছুটেছে দু’জনে। বাংলোয় এসেও মিষ্টির সমস্ত মুখ নীল—বর্ণ। থরোথরো কাঁপুনি। বাপীর সেই ধাক্কার ফলে হাত-পা কেটে ছড়ে রক্তাক্ত। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে বাইরের লোক পর্যন্ত ছুটে এসেছে। বড়সাহেব বাংলোতেই ছিলেন।

কি হয়েছে না হয়েছে তাঁর জেরায় পড়ে বাপীকে সবই বলতে হয়েছে। কোথায় কত দূরে ঘটেছে এব্যাপার—তাও। আর মায়ের ধমকে ছুটির দিনে জঙ্গলে বেড়ানোটাও মিষ্টি ফাঁস করে দিয়েছে।

তারপর বাপীরও তার বুদ্ধি আর বীরত্বের পুরস্কার মিলেছে।

বড়সাহেবের থমথমে মুখ। তিনি কিছু বলেননি। মেমসাহেব সকলের চোখের সামনে বাপীর একটা কান ছিঁড়েই নিতে চেয়েছে। তারপর গালাগাল করতে করতে ঘাড় ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

সন্ধ্যার পর বাবার সপাসপ গোটাকতক চটির ঘা।

জীবনের সব সাধ-আহ্লাদই বুঝি শেষ বাপীর। নিঝুম রাত। পিসীর দু’হাত তফাতে সরে শুয়ে আছে। ঘুমোতেই চাইছে।…ভাবছে, রাতের ঘুম সকালের মধ্যে আর একেবারে না ভাঙলে কি হয়?

.

‘পাথরে পাঁচ কিল’— রেগে গেলে পিসী বলত কথাটা। বলত, তোকে কিলোলে কি হবে, তার পাঁচগুণ ব্যথা নিজের হাতে ফিরে আসবে। ফাঁক পেলেই অপমানের ব্যথা ও রকম পাঁচগুণ ফিরিয়ে দেবার গোঁ এখন বাপীর। ওকে এরপর বাংলোর গেটের কাছে দেখলেই দীপুদা তেড়ে আসে। মেমসাহেব মহারাণীর সঙ্গে চোখা চোখি হলেই ভ্রুকুটি। যেন বাইরের এই রাস্তাটাও তার খাস দখলের। চাকরির লোভে আবু যখন তখন বাংলোয় যায়, মেমসাহেবকে ভেট দেয়, মিষ্টিকেও এটা সেটা দিয়ে বা জঙ্গলের গল্প বলে তোয়াজ করে। আগের মতো আবুও ওদের অত দোষ ধরে না। উল্টে উপদেশ দেয়, ভালো করে মন দিয়ে পড়াশুনা কর, মানুষ হ’—নইলে ওদের কেন—কারোই কোনোদিন পাত্তা পাবি নে।

বাপীর সব থেকে বেশি রাগ মিষ্টির ওপর। ও না থাকলে তো সাপের পেটেই চলে যেত একেবারে। যে যা-ই বলুক, ওর তো কেনা হয়ে থাকা উচিত বাপীর কাছে। তা না, হাব-ভাব এমন, যেন দোষটা বাপীরই।

এর পরেও ছুটির দিনের দুপুরে আর সুযোগ পেলে, সকালেও বাংলোর দিকে হানা না দিয়ে পারে না। বকা-ঝকা মার-ধরের পরোয়া করে না। কিন্তু মিষ্টি সহজে কাছেই আসতে চায় না, দূর থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দেয় আসবে না। বাপীর মাথায় তখন সব থেকে বেশি আগুন জ্বলে। রাগের চোটে ভেংচি কাটে। ডবল রেগে গিয়ে মিষ্টিও জিভ ভেঙায়, তারপর মায়ের কাছে বা দাদার কাছে নালিশ করতে ছোটে। বাপী ওর রাস্তায় বেরুনোর অপেক্ষায় ওঁত পেতে থাকে। একলা পেলে মিষ্টিকে খেয়ে ফেলার কথা বলে, মিষ্টি খেয়ে জল খাবার কথা বলে, জিভ চকচক করে ওকে শোনায় মিষ্টি খেতে কত আরাম। তার ফলে বাবার কাছে বেদম প্রহার আবার একদিন।

দিন গেলে সব শাসনের কড়াকড়ি আপনা থেকে কমে আসে, সেই হিসেব বাপীরও আছে। ওই মহারাণী কদিন আর মেয়েকে চোখে চোখে আগলে রাখবে? জঙ্গলের স্বাদ একবার পেলে বাতিল করা আর সহজ নয়। বিকেল হলে মহারাণী মেয়ের রাস্তায় আসা ঠেকাতে পারে না। আর ফাঁক পেলে ওই মেয়ে এখনো জঙ্গলে ঢুকে পড়ে—কিন্তু দূরে যায় না, খুব কাছাকাছির মধ্যেই থাকে। বাপীরও সেই সুযোগের অপেক্ষা

ওকে দেখলেই মিষ্টি চোখ পাকায়, মা তোমার সঙ্গে মিশতে বারণ করেছে, কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছে। ফের আমার সঙ্গে দেখলে তোমাকে রক্ষে রাখবে না বলে দিলাম।

বাপীর মাথায় রক্ত ওঠে। আর মিষ্টির মাথাটা আচ্ছা করে কোনো গাছে ঠুকে দিয়ে পালাতে ইচ্ছে করে। অথচ মনের মতো পেয়ারা কুল কামরাঙা আচার—টাচার ঘুষ পেলে মিষ্টি নিজেই স্বীকার করে বাপীর কোনো দোষ নেই—ওর জন্যেই ওকে ময়াল সাপের পেটে ঢুকতে হয় নি। একদিন এ-ও কবুল করেছে যে বাপীর সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে ওর খু-উ-ব ভালো লাগে, কিন্তু মায়ের ভয়ে পারে না।

ওই মায়ের অবাধ্য হবার মতো এতটুকু সাহস নেই বলেই বাপী আরো রেগে যায়। ওকে বেইমান বলে, ভীতু বলে। বলে, ননীর পুতুল—মায়ের আঁচলের তলায় থাক্‌গে। ধরা পড়ার ভয় না থাকলেও মিষ্টি বারান্দা ছেড়ে গেটের দিকে আসতে না চাইলে কিল চড় দেখায়, জিভ ভেঙায়। আদুরে মেয়েও বিষম রাগে ফোঁস করে উঠবেই। নিজেও যা-তা বলবে, পাল্টা কিল চড় দেখাবে, জিভ ভেঙাবে—আর তারপর মায়ের কাছে বা দাদার কাছে নালিশও করবে। এমনি নালিশের ফলে ওর মা মহারাণী আবার একদিন ওকে ডেকে কান মলে দিয়েছিল। দীপুদাও বোনের নালিশ শুনলেই গাঁট্টা মারতে ছুটে আসে।

এমনি করেই আবার একটা বছর শেষ। বাপী নতুন ক্লাসে উঠেছে। বরাত—জোরে কিনা জানে না, মোটামুটি ভালই পাশ করেছে। ফেল করলে ওর নিজের অন্তত অবাক হবার কিছু ছিল না। কারণ পরীক্ষার আগে পর্যন্তও মনের অর্ধেকটা ওই সাহেববাংলোর দিকে পড়ে থাকত। আর পরীক্ষার পরের ছুটির দিনগুলোতে তো মিষ্টিকে ধরে একেবারে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছে করত। ক্লাস পরীক্ষায় এবারও ফার্স্ট হয়েছে সেই দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না মেয়ের। বাড়ির চাকর বা বাগানের মালির সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াবে, তবু ওর সঙ্গে নয়। তিন-চারটে মেয়ে বন্ধু হয়েছে এখন। চা-বাগানের ছোট বা মাঝারি সাহেবদের মেয়ে, সঙ্গে লোক নিয়ে ওর চোখের ওপর দিয়ে হাসতে হাসতে তাদের বাড়ি চলে যায়। ডাকলে মুখের ওপর বলে দেয়, তুমি বজ্জাতি করো, তোমার সঙ্গে মিশব না। কেবল ভালো কিছু লোভের টোপ ফেলতে পারলে একটু আধটু আসে। আর এলেও বাপীরই বেফাঁস রাগের ফলে ঝগড়া বেধে যেতে দশ মিনিটও সময় লাগে না।

এটাই যে জীবনের সব থেকে দুর্বৎসর বাপী জানত না। বছরের মাঝামাঝি সময়ে মন-মেজাজ বরং একটু ভালো হয়েছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরুতে দীপুদা কলকাতায় পড়তে চলে গেছে। বাপী অনেকখানি নিষ্কণ্টক। দাদা না থাকার ফলে ওই মেয়ে এখন অনেকটা একলা হয়ে যাবে। বাপীর আশা, ভুলিয়ে-ভালিয়ে আবার ওকে আগের মতো জঙ্গলে টানা যাবে।

.

…সকলে ধরে নিয়েছিল এ-বছর বনমায়ার চরিত্র ভালো হয়ে গেছে। দেখা গেল তা নয়, এবারে দিনমানে ছাড়া অবস্থাতেই পালিয়েছে। গাছ পাতা খাওয়ানোর জন্য ভীম বাহাদুর ওকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল। ছেড়ে দিয়ে ঘণ্টা দু’ ঘণ্টার জন্য নিজেও কোথায় গেছল। ফিরে এসে দেখে বনমায়া উধাও। ডেরাতেও নেই। পরে বাপীকে আবু হেসে হেসে বলেছে, বনমায়া গেলেই দোষ, ওকে জঙ্গলে ছেড়ে ভীম বাহাদুর নিজে কোথা গেছল?

কোথায় গেছল শুনে বাপীর রক্তেও দোলা লেগেছে। ভীম বাহাদুর চা—বাগানের আড়াই-পাত্তি তোলা এক কামিন মেয়ের প্রেমে পড়েছে ওকে বিয়ে করবে বলে টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় আছে। ফাঁক পেলে সেই মেয়ের সঙ্গে ফষ্টি—নষ্টি করতে যায়।

বরাত ভালো, কর্তাবাবুরা এবারে আর বনমায়ার পালানো নিয়ে ভীম বাহাদুরের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেনি। তারাও বুঝে নিয়েছে, বছরে দেড় বছরে বনমায়া একবার করে পালাবেই আর দিনকতক গেলে নিজে থেকে ফিরেও আসবে।

কিন্তু উধাও হবার সেই রাতেই বনমায়া তার প্রেমিক হাতিকে নিয়ে বেশ একটা রগড়ের কাণ্ড করে গেছে। আসলে ওরা বানারজুলি জঙ্গলের খুব দূরে কোথাও যায়নি তখন পর্যন্ত। বেশি রাতে দুটোতে মিলে জঙ্গলের সেই গোপন ভাঁটিখানায় এসেছে। সেখানে যে দুটো লোক ভাঁটি আগলায় প্রাণের ভয়ে তারা একটা গাছের মগডালে গিয়ে উঠেছে। বনমায়া আর তার সঙ্গী বুনো হাতি হাঁড়ি—ভরতি দারু চোঁ-চো করে মেরে দিয়েছে। তারপর দুটোতে মিলে সে কি আহ্লাদ আর নাচানাচি। সেই আহ্লাদে আর নাচানাচিতে ভাঁটিখানা ভেঙে গুঁড়িয়েছে, সামনের অনেক ছোট গাছপালা মুড়িয়েছে। আবু আর বাপী ছুটে গিয়ে সেখানকার অবস্থাখানা দেখে এসেছে। বাপের আড়ালে হেসেছে শুধু আবু। নইলে ওর বাবা কালু আর অন্য বীটম্যানদের বনমায়ার ওপর সে কি রাগ!

ভালো মেয়ের মতো এবার বনমায়া দু সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে এসেছে। এবারে আর ভীম বাহাদুর রাগ করবে কোন্ মুখে? দৃশ্য দেখে বাপীর বেজায় হাসি পাচ্ছিল। বনমায়া তার খুদে চোখ দুটো বেঁকিয়ে ভীম বাহাদুরকে দেখছিল আর থেকে থেকে মাথা নাড়ছিল আর শুঁড় দোলাচ্ছিল। যেন বলছে, এমন কাজ আর কক্ষনো করব না। ভীম বাহাদুরও যেন আড়ি করে অর্থাৎ মুখখানা হাঁড়ি করে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে।

এই সময় আবুর একটা কথায় সামনে যারা ছিল সকলেই হেসে উঠেছে। এমন কি ভীম বাহাদুরও। বনমায়ার বুকের কাছে পেল্লায় দুটো আদরের চড় বসিয়ে আবু বলল, তিন বছর ধরে পালিয়ে গিয়ে রস করে আসছিস—বাচ্চা—কাচ্চা হবার নাম নেই কেন? তোর মরদটাকে ধরে এনে ডাক্তার দেখা—

.

সকলের সঙ্গে বাপীও হেসেছে বটে, কিন্তু এ-সব কথা শুনলেও ভিতরে ভিতরে কি-রকম হতে থাকে। সকলের অলেক্ষ্য বনমায়ার সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। জন্তু জানোয়ারের প্রেম বা ভালবাসাবাসির কিছুই আর অস্পষ্ট নয় ওর কাছে। বয়েস তো চৌদ্দ গড়াতে চলল, তবু মানুষের ব্যাপারটাই যা একটু আবছা এখন পর্যন্ত। আবু অবশ্য বলে, সব এক ব্যাপার। মানুষ ওদের থেকে আরো পাজী জানোয়ার। ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে বেশির ভাগ জন্তুর সময়ের বাছবিচার আছে, বছরের মধ্যে কোনো একটা সময় ধরে ওরা মেলে। মানুষ সম্বৎসর ভোগের দাস।

এই ভোগটা ভালো করে বোঝার জন্য একটা দুর্বোধ্য তাড়না। ফাঁক পেলেও এক-এক সময় চা-বাগানের দিকে চলে যায়। সেখানকার পাতা-তোলা সোমত্ত বয়সের মেয়েগুলোকে চেয়ে চেয়ে দেখে বিশেষ করে। এদের মধ্যে কোনটা ভীম বাহাদুরের ভালবাসার মেয়ে জানতে ইচ্ছে করে। ওরা গায়ে জামা-টামা পরে না, খাটো কাপড় একদিকের কাঁধ-বুক পেঁচিয়ে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত নেমে আসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওদের ঢলঢলে শরীরের বাঁধুনিতে আর উঁচু বুকে কি-রকম মিষ্টি-মিষ্টি ঢেউ খেলে। চোদ্দ বছরে বাপী এখন মাথায়ও ঢ্যাঙা হয়েছে বেশ। ওর সেই হাঁ করে দেখাটাও কম-বয়সী কতগুলো মেয়ে বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। ওর দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসে এক সময়। কালো মুখে সাদা দাঁতের সারি ঝকঝক করে। একটা দুটো মেয়ে আবার দুষ্টুমি করে হাত তুলে কাছে ডাকেও। বাপী তক্ষুনি ছুটে পালায়। কিন্তু তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাথাটা ঝিম-ঝিম করে।

আজ আবুর ওই রসিকতার কথাগুলোই বাপীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আবু অন্য কাজে চলে না গেলে সঙ্গে নিত। বড়সাহেবের বাংলোর কাছে এলে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।

বারান্দায় দুহাত শূন্যে ঝাঁকিয়ে মিষ্টি তার বাবার কাছে কিছু একটা আব্দার করছে। ওর পরনে একটা লাল ডুরে শাড়ি। গায়ে চকচকে নতুন জামা!

বাপীর চোখে পলক পড়ে না। এই বেশে মিষ্টিকে আর কখনো দেখেনি। জামা আর শাড়ির একটা লালচে আভা মিষ্টির চোখে মুখে ঠিকরোচ্ছে। মিষ্টিরও বয়েস দশের মাঝামাঝি এখন। আগের থেকে মাথায় বেড়েছে আর আরো হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে বাপী সেটা আগেই লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু এখন ওকে দেখেই মনে হল ও হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে মস্ত বড় হয়ে গেছে। রূপকথার সেই রাজকন্যাদের মতো হয়েছে।

বাবার পিছনে মিষ্টি ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল, বাপী জোরে একটা হাততালি দেবার লোভ সামলাতে পারল না। মিষ্টি ঘাড় ফেরালো। অন্য দিন হলে ও হয়তো জিভ ভেঙচে ঘরে সেঁধিয়ে যেত। গত পরশুও তাই করেছে। বাপীকে পাল্টা ভেঙচি কাটার সুযোগ না দিয়ে ঢুকে গেছল। কিন্তু আজ এই নতুন সাজটা দেখানোর তাগিদে পায়ে পায়ে বারান্দা থেকে নেমে গেটের দিকে এগুলো। বাপীর অমন ভেবাচেকা খাওয়া চাউনি দেখে ওর ঠোটে টিপ-টিপ হাসি।

সব রেষারেষি ভুলে বাপী বলেই ফেলল, কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে তোকে— মাইরি বলছি।

মিষ্টিরও একমুখ হাসি।—কলকাতায় দিদিমাকে চিঠি লিখেছিলাম, আমার জন্য সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে পাঠাতে—লোকের সঙ্গে কাল শাড়ি জামা দুইই পাঠিয়েছে। বাবাকে আজ আচ্ছা করে ধরেছি জিপে করে বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, আমি এই শাড়ি পরে যাব—বাবা রাজি হয়ে গেছে।

শুনে সত্যি হিংসে হচ্ছে বাপীর। চাইলেই শাড়ি পায়, বাবার সঙ্গে জিপে করে বেড়াতে পায়। মাথা খুঁড়লেও শাড়ি-পরা মিষ্টির পাশে বসে জিপে করে একটু বেড়ানোর উপায় নেই। সাহেব মেমসাহেব ছেড়ে মিষ্টিকেও এ কথা বললে ও বেয়াদপী ভেবে মুখ মচকাবে। কি, না ওর বাবা কেরানী, কেরানীর ছেলের এত সাহস বরদাস্ত হবার নয়। কেরানীর বোনের হাতের তৈরি আমসত্ত্ব-আচার বা দুধ—কলা-মুড়ি তো বেশ, চেটেপুটে খেতে পারিস।

তবু, এই মিষ্টিকেই আজ দারুণ লাগছে বাপীর। তাই ঠেস-ঠিসারায় ওকে রাগাতে চাইল না। উল্টে খুব মোলায়েম করে বলল, আজ দুপুরে এই শাড়িটা পরে চুপিচুপি জঙ্গলে বেড়াতে আসবি? আয় না, একেবারে জঙ্গলে দেবীর মতো দেখতে লাগবে তোকে—

মিষ্টির মন ভিজল, কিন্তু ভরসা পেল না। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, হুঁ, বাড়িতেই বলে শাড়ি সামলাতে পারি না, এদিক ধরি তো ওদিক খোলে—শাড়ি পরে জঙ্গলে ঢুকে আছাড় খেয়ে মরি আর কি।

—না রে না, আমি তো থাকছি সঙ্গে, আছাড় খাবি কেন?

শোনামাত্র মিষ্টি চোখ পাকালো। ও, এই ফাঁকে আমার গায়ে হাত দেবার মতলব তোমার—কেমন? ফের তুমি আমাকে তুই-মুই করে কথা বলছ?

মুহূর্তের মধ্যে বাপীও আগের সেই বাপী। দু চোখে রাগ জমাট বাঁধছে। সেই সঙ্গলোভও চিকিয়ে উঠছে। অনেক দিনের মধ্যে গায়ে দূরে থাক, হাতে হাত ঠেকাবারও সুযোগ হয়নি। রাগের চোটে হাত দুটো ডবল নিশপিশ করছে, আর ওই ফোলা গাল দুটো ছিঁড়ে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু মিষ্টিও সেয়ানা কম নয় এখন। এই চোখ-মুখ দেখেই গেট ছেড়ে এক ঝটকায় তিন পা পিছিয়ে গেল। তারপর বাপীর মতো করেই পলকা রাগে চোখ পাকাতে চেষ্টা করল। এখানে ও-ছেলের কোনো জারিজুরি খাটবে না জানে বলেই ঠোঁটে মজার ছোঁয়া।

—ডাকব মাকে?

গেট ছেড়ে বাপী হনহন করে হাঁটা দিল। রাগের মাথায় বনমায়ার ফিরে আসার খবরটাই ওকে বলা হল না। কিন্তু রাগটা আজ আর বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেল না!… আবু যদিও বলে ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে মানুষে জানোয়ারে তফাৎ নেই, তবু ওর চোখে মেয়েরা এখনো আবছা রহস্যের মতো। আজ শাড়িপরা মিষ্টিও যেন ওমনি একটু রহস্যের ওধারে চলে গেছে।

এর দিন-কতকের মধ্যে সেই রহস্যের পর্দা ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার। কি কারণে স্কুলের ছুটি চলছে তখন।

কলকাতা থেকে জাঠতুতো ভাই মণিদা এসেছে। সঙ্গে তার নতুন বউ গৌরী। গৌরী বউদি। মাত্র মাসখানেক আগে বিয়ে হয়েছে তাদের। কলকাতা থেকে নেমন্তন্নর চিঠি এসেছিল। বাবা লিখেছে যাওয়া সম্ভব নয়। সুযোগ সুবিধে হলে মণিদা যেন বউ নিয়ে বেড়াতে আসে।

নতুন বউ নিয়ে মণিদা গেছল দার্জিলিং বেড়াতে। ফেরার পথে দিন চার—পাঁচের জন্য এখানে আসা। আগে থেকে জানান দিয়েই এসেছে তারা। শুনে বাপী একমাত্র কারণে খুশী হতে পারে নি। দুখানা মাত্র ঘর। অতিথিরা এলে থাকার ব্যবস্থা কি হবে শুনেই বাপীর মাথা গরম হয়েছিল। বাবার ঘরটা বড় একটু। পিসীর সঙ্গে সেই কটা রাত বাপীকে বাবার ঘরে শুতে হবে। এমন বিড়ম্বনার মধ্যে বাপীকে স্মরণীয়কালের মধ্যে পড়তে হয় নি।

কিন্তু মণিদা আর তার নতুন বউ গৌরী বউদিকে দেখে বাপীর সেই চাপা কৌতূহল নতুন খোরাক পেল। গৌরী বউদির বছর কুড়ি হবে বয়েস আর মণিদার আটাশ। বয়সের তুলনায় মণিদাকে একটু ভারিক্কী গোছের দেখায়। ওদিকে নাম গৌরী হলেও গৌরী বউদি ফর্সা নয় আদৌ। কালোই বলা চলে। কিন্তু মুখখানা বেশ চকচকে, চোখ দুটো হাসি-হাসি।

উঠতে বসতে চলতে ফিরতে পুষ্ট যৌবনের কোনো মেয়েকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল বাপীর। আরো কিছু উষ্ণ অথচ মজার খোরাক পেতে লাগল মণিদার উদ্দেশে গৌরী বউদির হাসি-মাখা চোখের ইশারার ব্যাপার-ট্যাপারগুলো লক্ষ্য করে। মণিদা হয়তো পিসীর সঙ্গে কথা কইছে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর, গৌরী বউদিও সেখানেই। হঠাৎ দেখা গেল, পিসীকে গোপন করে চোখের ইশারা করে আর সামান্য একটু ঘাড় বেঁকিয়ে কি বোঝাতে চেষ্টা করে গৌরী বউদি ঘরে চলে গেল। আর তার একটু বাদেই মণিদাও চলল সেদিকে। বাবার সামনেও দুরাত এই কাণ্ড দেখেছে। খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ গল্পসল্প অনেকক্ষণ ধরে। বাপীকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়, ও ঠিক লক্ষ্য করেছে। গৌরী বউদি উসখুস করছে একটু আর মণিদার দিকেই চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতে গৌরী বউদির সেইরকম ইশারা আর তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে যাওয়া। তার একটু বাদেই মণিদা গোটা দুই হাই তুলে বলল, যাই, শুয়ে পড়িগে।

বাপীর অজানা রহস্যের সব কিছু এখন ওই একটা ঘরের আড়ালে। ভিতরে এক অবুঝ অবাধ্য তাড়না। ওই কাঠের ঘরের কোন্ ফাঁকে বাইরে থেকে চোখ লাগালে ভিতরের সব দেখা যায় তাও ওর জানা। ওটা পিসীর আর ওর ঘর। আচার আমসত্ত্ব এমন কি পয়সা চুরি করার জন্যও নিজের উপস্থিতি গোপন করে পিসী ঘরে আছে কিনা বা কি করছে না করছে—কত সময়ে দেখতে হয়। জলে টলে ভিজে এলে তো দেখতেই হয়—কারণ ওই এক ব্যাপারে পিসীর মাথার ঠিক থাকে না।

…বাবা শুলেই ঘুম। পিসীকে বাইরে যাবার কথা বলে পা টিপে বাইরের সেই ফাটলেও চোখ লাগিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ততক্ষণে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। চোখ নিঃশব্দে দিনের বেলাতেও লাগিয়েছে। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া সারতেই বেলা হচ্ছে ইদানীং। মণিদাকে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতে দেখে, আর গৌরী বউদিকে কলকাতা থেকে আনা গল্পের বই পড়তে দেখে।

মণিদাকে দেখে বাপীর মনে হয়েছে, মোটাসোটা ভাল মানুষ। খেতে আর ঘুমোতে ভালবাসে। যার মধ্যে রহস্যের ছিটে-ফোঁটাও নেই। যা-কিছু সব ওই গৌরী বউদিকে ঘিরে। চোখের ইশারায় বা ভ্রুকুটি বা ঠোটের হাসি দিয়ে মণিদাকে যেন যেমন খুশি চালানোর ক্ষমতা রাখে।

বাপীর একটা সুবিধে, নতুন যে দেখে সে-ই ওকে খুব নিরীহ গো-বেচারা গোছের ছেলে ভাবে। মণিদা আর বিশেষ করে গৌরী বউদি তো ভাবেই। নইলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়ানোর সময় বুকের কাপড় খসে গেলেও পিসীর সামনে যেমন তাড়াতাড়ি তুলে দেয়, ওর সামনে নয়। সকাল সাড়ে নটার মধ্যে সেদিন বাপীর সঙ্গে গৌরী বউদি আর মণিদার জঙ্গল দেখতে বেরুনোর কথা। জঙ্গলের ব্যাপারে ও যেমন ডানপিটে সেটা অবশ্য তারা জেনেছে। পাথর দিয়ে এক দিন দুটো বুনো মুরগী মেরে এনে তাদের খাওয়ানো হয়েছে। তাদের অবাক হতে দেখে পিসী ওর জঙ্গলের দস্যিপনার গল্প করেছে। কিন্তু ওর পড়াশুনার ব্যাপারে বাবা আবার যা বলেছে তাতে সকলেই ওকে হাবাগোবাই ধরে নিয়েছে। তা না হলে জঙ্গলে বেরুনোর আগে গৌরী বউদি এমন কাণ্ড করে সেদিন।

…গৌরী বউদি বলেছিল, একেবারে স্নান সেরে বেরুবে। দেরি দেখে তার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে বাপী ঢুকে থতমত খেল। কিন্তু ওকে দেখে মণিদা বা গৌরী বউদির ভ্রুক্ষেপ নেই। প্যান্ট আর শার্ট পরে তৈরি হয়ে মণিদা চৌকিতে বসে সিগারেট টানছে। গৌরী বউদির হাতে পাট-ভাঙা শাড়ি, তার উল্টো-সোজা দেখে নিচ্ছে। পরনে শুধু ব্লাউস আর সায়া। ওকে দেখে শাড়ির দিকে চোখ রেখেই বলল, দাঁড়া রে বাবা, যাচ্ছি তো জঙ্গলে, অত তাড়া কিসের—এ তো আর সিনেমার টিকিট ফুরিয়ে যাবার মতো কিছু নয়!

স্নানের আগে বাপী গৌরী বউদিকে একবার তাড়া দিয়েছিল বটে। এখন ঘর থেকে সরে না গেলেও কেউ কিছু ভাববে মনে হল না। গৌরী বউদি যত্ন করে শাড়ি পরছে। বাপী আড়চোখে দেখছে দাঁড়িয়ে, আর মণিদা আগে কখনো জঙ্গল টঙ্গল দেখেছে কিনা সে-সম্বন্ধে দুই একটা অবান্তর কথা জিজ্ঞাসা করছে।

ধীরে সুস্থে শাড়ি পরা শেষ হল গৌরী বউদির। ঘাড় বেঁকিয়ে পিছন দিকটা দেখে নিয়ে ওকে বলল, পিছনে পায়ের দিকটা টেনে দে দেখি।

এ-রকম উদ্ভট ফরমাসের জন্য বাপী আদৌ প্রস্তুত ছিল না। পিছনে গিয়ে উপুড় হয়ে বসে শাড়ির ওপর দিয়ে দুহাতে একটা পা ধরল, কিন্তু কি ভাবে টানবে বুঝতে পারছে না।

গৌরী বউদি হেসে বাঁচে না। হাসছে মণিদাও। গৌরী বউদি হাসি সামলে বলল, তুই এ-রকম হাঁদা, অ্যাঁ? পা ধরে টানছিস! শাড়ির তলার দিকটা টান করে দিতে বললাম তোকে আর তুই পা চেপে ধরে শাড়িটা কুঁচকে দিলি?

এবারে বাপীর মাথায় ঢুকেছে। তাই করেছে। আর সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস নিয়েছে। স্নো-পাউডারের গন্ধ…। মিষ্টির গায়ের মতো নয়।

ওদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। গা ছমছম করছে বলে হোক বা পায়ে ঠোক্কর খাবার ভয়ে হোক, গৌরী বউদি বেশির ভাগ সময় বাপীর হাত ধরে থেকেছে। জঙ্গলের গল্প করতে করতে বাপীর মাথায় আরো বেশি হাবা-গোবা সাজার ঝোঁক চেপেছে। ভিতর থেকে কে যেন ইন্ধন যুগিয়েছে। খুব বোকার মতো যে-প্রসঙ্গে আসতে চায় তার সুযোগের অভাব জঙ্গলে নেই। দুটো বন-মোরগ দেখে লোভীর মতো মণিদা বলে উঠল, মার না-পারবি?

বোকা-বোকা গম্ভীর মুখে বাপী মাথা নেড়েছে। ও দুটোর একটা পুরুষ, একটা মেয়ে—ভালবাসাবাসির সময় মারতে নেই।

এই প্রসঙ্গে আসতে চায় বলেই বলা। নইলে আগে-পিছে মুরগি দুটো এমনিই চরছিল। ওদের দেখে জঙ্গলে ঢুকে গেছে। কিন্তু এ-কথা শুনে মণিদা আর গৌরী বউদি দুজনেই হাঁ প্ৰথম। তারপর তাদের দুজনের চোখোচোখি। মণিদা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আর গৌরী বউদি হাসি সামলানোর চেষ্টায় হাত ছেড়ে শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজেছে. তাও কি সহজে হাসি থামে।

তেরছা চোখে চেয়ে গৌরী বউদি জিজ্ঞাসা করল, তুই জানলি কি করে?

আরো সাদা মুখ করে বাপী জবাব দিল; জঙ্গলে বেশিদিন থাকলেই জানা যায়। আমাদের সাড়া পেয়ে ঝোপে ঢুকে গেল বলে, নইলে দেখতে একটা আর একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

আবার ঝলকে ঝলকে হাসি গৌরী বউদির, আর মণিদার সঙ্গে চোখোচোখি। এত হাসির কি হল বাপী যেন বুঝতেই পারছে না।

গৌরী বউদি জিজ্ঞাসা করল, তুই নিজে থেকে জেনেছিস, না কেউ তোকে বলে দিয়েছে?

বাপী সতর্ক। আবার প্রসঙ্গ বিস্তারের ঝোঁকও অদম্য।—গোড়ায় গোড়ায় আবু বুঝিয়ে দিয়েছে। ও তো সব জন্তু-জানোয়ারের নাড়ি-নক্ষত্র জানে, আর চোখেও দেখেছে।…ওর সঙ্গে থেকে আমিও কম দেখি নি।

এমন সাদাসিধে ছেলের মুখ থেকে আরো শোনার লোভ গৌরী বউদির। তক্ষুনি জিজ্ঞাসা করল তুই আর কি দেখেছিস?

বাপী তখন ভালবাসাসির সময় পুরুষ ময়ূর পাখনা মেলে মেয়ে ময়ূরকে কেমন নাচ দেখায় সেকথা বলেছে, সাপের সেই পাকে পাকে জড়ানো মারাত্মক ভালবাসাবাসির কথা বলেছে। একই প্রসঙ্গে তিন বছর ধরে বনমায়ার বজ্জাতির কথাও বলেছে।

আদিম ইশারা কাকে বলে বাপী সঠিক না জানলেও নতুন কিছু দেখছে। গৌরী বউদির কালো মুখে লালের ছোপ লেগেছে। থেকে থেকে মণিদার সঙ্গে চোখে চোখে কিছু কথা হচ্ছে তার। দুজনেরই, বিশেষ করে গৌরী বউদির মুখে চাপা হাসি ঠিকরে পড়ছে।

কি দিন কি দিন আজ! ফেরার পথে একদিকে চোখ পড়তে বাপীর পা দুটো আটকে গেল মাটির সঙ্গে। অদূরে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে ভীম বাহাদুর। তার তিন হাত দূরে বসে একটা উঠতি বয়সের কালো-কালো পাহাড়ী মেয়ে। বাপী দেখামাত্র বুঝে নিয়েছে মেয়েটা কে।

এই দলটিকে দেখে ভীম বাহাদুর বেশ লজ্জা পেয়েছে। কারণ বাপী তো আর ওর অচেনা নয়। ওদের হাব-ভাব দেখে আর বাপীর মুখ দেখে গৌরী বউদি কৌতূহলে টইটম্বুর। খানিক এগিয়ে জিজ্ঞসা করল, তুই চিনিস নাকি এদের?

—চিনব না কেন। লোকটা হল ভীম বাহাদুর, বনমায়ার মাহুত,—মেয়েটা ভীম বাহাদুরের ভালবাসার মেয়ে। কাজে ফাঁকি দিয়ে দুটোতে জঙ্গলে এসে ঢুকেছে—

এর পর বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মণিদার চাউনি দেখে বাপীর মনে হয়েছে তার বেজায় জল-তেষ্টা পেয়েছে। আর জলের অভাবে ঘন ঘন গৌরী বউদির দিকে তাকাচ্ছে। গৌরী বউদি কেবলই হাসি চাপছে, আর সঙ্গের হাবা ছেলেটাকেই গোপন করে ইশারায় মাথা নাড়ছে বা ভ্রূকুটি করে মণিদার কোনো ইচ্ছে নাকচ করে দিচ্ছে।

…নিঝুম দুপুরের বাতাসেও কি যে কানাকানি ছিল বাপী জানে না। বাবা বেরিয়ে গেছে। পিসীও শুয়ে। ও-ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ যেন জোর করে বাপীর পা দুটোকে সেই ঘরের পিছনে টেনে নিয়ে গেল। তারপর একটা চোখ সেই ফাটলে।

তারপরেই বাইরে একেবারে কাঠ ও। ভিতরে প্রবল ঝাঁকুনি। বুকের ধপধপানি ভিতরের কেউ শুনতে পাচ্ছে কিনা সেই ভয়। শরীরের রক্ত শিরশির করে গা বেয়ে নামছে তো নামছেই। আবার একই সঙ্গে মাথার দিকে আগুন ছুটেছে। নদীর ঢেউয়ের মতো পায়ের নীচের মাটি দুলছে।

কতক্ষণ কেটেছে জানে না। হঠাৎই আবার একটা ঝাঁকুনি খেয়ে চমক ভাঙল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাপী ঘরের বাইরে ছুটল। ছুটে একেবারে জঙ্গলে। সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছে। বুকের ভিতরটা আরো বেশি ঢিপ ঢিপ করছে।

জঙ্গলে ঢুকেও হন হন করে হেঁটেই চলেছে বাপী। অথচ এর থেকে বাড়ির কুয়োটাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ভালো হত। গা মাথা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারলে ভালো হত।

.

চোখের সামনে আর রহস্যের পর্দা বলে কিছু নেই। এতদিন সেটা অল্প অল্প নড়ছিল, দুলছিল। তার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু আভাস উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল তার সবটাই যে এমন আজব কল্পনা বাপী ভাবতেও পারে নি। কিন্তু তাই যেন ঢের ভালো ছিল আর মিষ্টি ছিল।

এক হ্যাঁচকা টানে পর্দাটা ছিঁড়ে দিয়েছে কেউ। কেউ কেন, বাপী নিজেই দিয়েছে। আর সেই মুহূর্তে ওর বুকের তলার রূপকথার জগৎটা ভেঙে গুঁড়িয়ে একাকার হয়ে গেছে।

গৌরী বউদিকে নিয়ে মণিদা চলে গেছে। বাপী হাঁপ ফেলে বেঁচেছে। গৌরী বউদির পাশে মণিদাকে একটু বেঁটে দেখায়। বাপী গৌরী বউদির মাথায় মাথায় হবে। যাবার আগে গৌরী বউদি ওকে দু গাল টিপে আদর করে গেছে। কলকাতায় গেলে তাদের ওখানেই উঠতে বলেছে। মাঝের দুটো দিন বাপী আগের মতো কাছে যেতে পারে নি, তাকাতে পারে নি। মনে হয়েছে, ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকালেই চুরি ধরা পড়ে যাবে। একেবারে জল-ভাত ছেলে না ভাবলে গৌরী বউদির সন্দেহ হতে পারত।

যেমন আবুর হয়েছিল।

আগেও বাপীকে তারিফের সুরে অনেক সময় বলেছে, তুই একটা ভিজে বেড়াল, দেখলে মনে হবে কিছু জানিস না, কিছু বুঝিস না—ভাজা মাছখানাও উল্টে খেতে জানিস না। মজা লুটতে চাস তো এই ভাবেই থাকবি আর দরকার হলে ঝোপ বুঝে কোপ মারবি।

মণিদারা চলে যাবার পরেও বাপীর মনে স্বস্তি নেই একটুও। ও যেন কি একটা সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। তার থেকে যত বেরিয়ে আসতে চায়, ওটা ততো টানে। আর ভিতরে একটা অজানা যন্ত্রণা ছড়ায়। নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যেই বিনা তাগিদে পড়ার বই নিয়ে বসে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু যন্ত্রণাটা তখন মাথায় নড়াচড়া করতে থাকে। বই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ছোট লাঠিটা হাতে করে জঙ্গলে চলে আসে। দমাদম পিটে এক-একটা গাছের ছাল তুলে দেয়। নয় তো পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঘা করে দেয়। একটা ময়ূর দেখে পাথর নিয়ে খ্যাপার মতো তাড়া করেছিল। এরকম করলে যন্ত্রণার চাপ-ধরা বাতাসটা হাল্কা হতে থাকে।

কিন্তু সে আর কতক্ষণ। অবাধ্য পা দুটো তারপর ওই বড়সাহেবের বাংলোর দিকে এগোবেই। বরাত এমন, পর পর দুদিনই মিষ্টির বদলে ওর বাবা-মাকে বারান্দায় দেখেছে। মেরে ফার্স্ট হয় ক্লাসে, সকালের দিকে ঘরে বসে তার পড়াশুনা করাই স্বাভাবিক এটা মনে হয় না। অকারণ রাগে একটা খারাপ গালাগাল ভিতর থেকে ঠেলে বেরোয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই সাহেব আর মেমসাহেবকে ঘিরেই একটা কুৎসিত ছবি মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। নিজের ভিতর থেকে সেটা উচ্ছেদ করার তাগিদে বাপী হনহন করে সামনে এগিয়েছে।

সেই সামনে এগনোর শেষ চা-বাগানের আড়াই-পাতি তোলা মেয়েদের কাছাকাছি এসে। যে মেয়েগুলো ওকে দেখলেই মজা পায়। দাঁত বার করে হাসে। ওকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাসা চলে মনে হয়। সেদিনও এক ফুর্তিবাজ মেয়ে হাত তুলে ওকে ডেকে বসল। বাপী সেদিন আর আগের মতো ছুটে পালালো না। কটা দিনের মধ্যে ভিতরটা কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নিজেরও জানা ছিল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।

মেয়েটা কম করে আট-ন বছরের বড় ওর থেকে। ঠোঁট আর কালো কালো চোখ দুটোও হাসিতে ভেজা। বেতের ঝুড়ি বাঁধা কোমর সোজা করে দাঁড়াল। অবাক সুরে জিগ্যেস করল, তুমি ইখেনে কি দেখতি আস গো খোকাবাবু?

বাপী বলল, তোমাদের পাতা তোলা দেখতে ভালো লাগে।

শুনে মেয়েটা শক্ত মাটিতে আছাড় খেল যেন।—পাতি তুলা দেখতি ভালো লাগে—মোদের দেখতি লয়। হায় হায় হায় হায়—

আশপাশের আট-দশটা মেয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠল। বোকা মুখ করে বাপীও হেসেছে একটু একটু। তারপর চলে এসেছে। একটা ছোট ছেলেকে রসে পেয়েছে ভেবেই এমন হাসাহাসি ওদের! বয়েসটা যে বাপীর রাতারাতি কত বেড়ে গেছে ওরা জানবে কি করে। এত বেড়েছে যে নিজের ভিতরে আর কুলিয়ে উঠছে না। মনে হয় এজন্যেই এমন যন্ত্রণা।

ঘরের সামনের জমিতে বসে হাত-দা দিয়ে একটা বাখারি চাঁছিল আবু রব্বানী। বাপী কাছে আসতে মুখ তুলে একবার দেখে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল।

বাপী সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিল মেজাজ-পত্র ভালো নয়। ওর পাশে আরো কটা চাঁচা বাখারির টুকরো পড়ে আছে।

হাত দুই ফারাকে বাপীও মাটির ওপরেই বসল। বলল, দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুরে তোমাকে জঙ্গলে না পেয়ে এখানে এলাম—

বাখারি চাচার ফাঁকে আবু একবার টেরিয়ে দেখে নিল ওকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞসা করল, ছুটির মধ্যে এ কদিন সকাল দুপুর কোথায় ডিউটি দিলি— বড়সাহেবের বাংলোয়?

বাপী ঢোক গিলল।—না, কলকাতা থেকে দাদা-বউদি এসেছিল।

এবার আবু অবাক একটু।—তোর আবার দাদা-বউদি কে?

জ্যাঠতুতো দাদা।…বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল। এখানেও এসে ছ-সাত দিন ছিল—

বাখারি ছেড়ে আবুর ছোট ছোট চোখ দুটো এবার সোজা ওর মুখে এসে আটকালো। এভাবে কি দেখার আছে ভেবে না পেয়ে বাপীর অস্বস্তি।

—দাদার বয়স কত?

—সাতাশ-আটাশ।

—আর বউদির?

—বছর কুড়ি। আবুর চাউনি আর রকম-সকম দেখে বাপী ঘাবড়েই যাচ্ছে।

—দেখতে কেমন?

—কালো।…তবে ভালোই।

আবু এবার কানে গোঁজা একটা বিড়ি টেনে নিয়ে দাঁতে লাগালো। কোমরের লুংগিতে গোঁজা দেশলাই বার করে ধরালো সেটা। বন-বেড়াল মারার পর চাকরিটা হয়েই গেছে ধরে নিয়ে বিড়ি খেতে শুরু করেছিল। ওকে বলেছিল, কোনো একটা নেশা না থাকলে পুরুষমানুষকে মানায় না। কিন্তু বাপের হাল দেখে হাঁড়িয়ার ওপর হাড়ে চটা। তাই বিড়ি ধরেছে।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এবার হাল্কা চালে বলল, তাই বল্, নতুন বউদির সেবাযত্ন করে বেশে রসে-বসে ছিলি কটা দিন—নইলে ছুটির দিনগুলোতেও তোর মতো ছেলে সকাল দুপুর ঘরে কাটায়।

বাপীর ফাঁপরে পড়ার দাখিল। আবু নিজেই বলে জঙ্গলের সব জানোয়ারের মন-মেজাজ বোঝে। এখন মনে হল, ওর দিকেও আর একটু ভালো করে তাকালে ভিতরে যা আছে সব গলগল করে বার করে নেবে।

হেসেই পাশ কাটাতে চেষ্টা করল। —বাবা আপিস নিয়ে এত ব্যস্ত এ কদিন, আমাকে বাজার পর্যন্ত করতে হয়েছে— বুঝলে?

ডাহা মিথ্যে কিছু বলে নি। সত্যি কদিন ধরে বাবার কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। রাতে ছাড়া কলকাতার অতিথিদের সঙ্গে দুদণ্ড বসে গল্প করারও সময় পায় নি। কৈফিয়ত দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ জঙ্গলে যাও নি যে?

বিড়িটা দাঁতে চিবিয়ে আবু অস্ফুট রাগত জবাব দিল, এ শালা জঙ্গলের নিকুচি করি আমি।

জঙ্গল-অন্ত-প্রাণ আবুর মুখে এ কি কথা।—কেন চাকরি হবে না তোমার?

—হবে। তোর শ্বশুরের নাতি-নাতনী হবার পরে হবে।

শ্বশুর কাকে বলছে বাপীর সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। আগেও ঠাট্টা করে বড়সাহেবকে ওর শ্বশুর বলেছে। কিন্তু নাতি-নাতনী হবার কথাটা শোনা মাত্র একটা দৃশ্য ভিতরে থেকে ঠেলে ওঠার উপক্রম, সঙ্গে সেই যন্ত্রণাটাও। আবু নিজের খেয়ালে আছে তাই বাঁচোয়া। বলল, তোর পিসীর কাছ থেকে কিছু ধার যোগাড় করে দিতে পারিস—একটা খাকী ফুল-প্যান্ট আর মোটামুটি একটা ভালো জামা দরকার। শিলিগুড়ি চলে যেতে পারলে একটা কাজ হয়ে যেত— যুদ্ধের চাকরিতে সেখানে অনেক লোক নিচ্ছে শুনলাম।

বাপী হতভম্ব।—যুদ্ধের চাকরি!

আবুর গলায় বিরক্তি।—কি লেখাপড়া করিস, পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে কিনা জানিস না?

সে তো ইংরেজদের সঙ্গে জার্মানির—এখানে কি?

এখানেও হতে পারে, নইলে ঝুড়ি ঝুড়ি লোক নিচ্ছে কেন? আবার পাঠিয়েও দিতে পারে, এই বানারজুলির রাস্তা দিয়েও ট্রাক বোঝাই মিলিটারি যাচ্ছে আসছে, দেখিস না?

বাপী ভয়ানক দমে গেল। বানারজুলি ছেড়ে, এই জঙ্গল ছেড়ে আর ওকে ছেড়ে আবু কোথাও চলে যেতে পারে ভাবলেও বুকের ভেতর টনটন করে। তার ওপর বলে কিনা যুদ্ধের চাকরি নেবে, যুদ্ধে যাবে!

—কি রে, শুনেই ঘাবড়ে গেলি যে। ওর মুষড়ে পড়া মুখ দেখে আবুর একটু ভালো লেগেছে।—আরেএই শর্মা না পারে কি, কোনো শালার একটা চান্স দেবার নাম নেই—এখানে বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজব?

গলায় একটু জোর এনে বাপী বলল, এখানেই ঠিক তোমার কাজ হয়ে যাবে, দেখো।

—আর হয়েছে। আমাদের বড়সাহেবের ছোট বাবা এসে সক্কলের পেছনে হুড়ো দিয়ে গেছে, এখন চাচা যে যার আপনা প্রাণ বাঁচা–কে কাকে দেখে? চোখ-কান বুজে নতুন বউদির সেবা-যত্নই করে গেলি, এদিকের কোনো খবরই রাখিস না বুঝি?

মাথার যে অবস্থা চলেছে সত্যি কোনো খবরই রাখে না বাপী। বাবাকে একটু বেশি ব্যস্ত দেখেছে কদিন এই যা। আর মণিদারা চলে যাবার পর এ দুদিন বাবার সঙ্গে দেখাই হয় নি বলতে গেলে। আগেই বা কতটুকু হত।

আবুর মুখে মোটামুটি খবর শুনে সেও তাজ্জব। বড়সাহেবের ছোট বাবা বলতে উত্তরবঙ্গের সহকারী ডিভিশন্যাল ফরেস্ট অফিসার—দু’কথায় অ্যাসিসট্যান্ট ডি এফ ও। তার ওপরে ডি এফ ও—সে লালমুখো খাঁটি সাহেব। আর ওই এ-ডি-এফ-ও এদেশের মানুষ হলেও বাঙালী নয়। কারো লাগানো—ভাঙানোর জন্যে হোক বা বানারজুলি জঙ্গলের রিপোর্ট দেখে হোক, জানান না দিয়ে সে হুট করে এসে হাজির হয়েছিল। চার-পাঁচ দিন থেকে সব দেখে শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফিরে গেছে।

না বুজেই বাপী জিগ্যেস করল, অত রেগে গেল কেন?

—রেগে যাবে না, যার চোখ আছে সে-ই বুঝবে এ জঙ্গলের বারোটা বাজতে আর বেশি বাকি নেই। আধ্যেক নালা শুকনো, জল চলে না, কত চারা-বেড শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেল, তাও ছাগল-গরুতে মুড়িয়ে যাচ্ছে, দামী দামী শিশু গাছ-গুলোর চার ভাগের এক ভাগ লোপাট, শালজঙ্গল তো আরো বেশি ফাঁকা হচ্ছে—ওদিকে জঙ্গল কূপ-এর ইজারাদাররা সেই একই টাকা দিচ্ছে। সাহেবদের পিয়ারের বা খদ্দের-শিকারীরা এসে একধার থেকে বাঘ ভালুক শুয়োর হরিণ মেরে মেরে জঙ্গল কানা করে দিচ্ছে—জঙ্গল বাঁচবে কি মন্ত্রের জোরে? ছোট থেকে বড় সব শালা চোর—বুঝলি?

সত্যিকারের রাগে বেগনে মুখ আবুর। বাপী কিছু জানত, কিন্তু এতটা জানত না। শেষের কথায় আরো মুখ শুকালো। ভয়ে ভয়ে বলল, আমার বাবাও?

—ধেৎ। এবারে আবু ঠাণ্ডা একটু।—তোর বাবা হল গিয়ে ধার্মিক চুনোপুঁটি মানুষ, তেনার কথা কে বলছে। জঙ্গলটা সায়েব-সুবোদের লুটের মাল, তাদের পেট মোটা হচ্ছে। নড়ুক নডুক— ধৰ্ম্মের কল বাতাসে ভালো করে নড়ুক।

ঝটকা মেরে উঠে ঘরে চলে গেল। হাত-দা টা ওর হাতেই। বাপীর মনে হল, হাতের কাছে তেমন কাউকে পেলে একটা কোপ-টোপ বসিয়ে দিতে পারে।

মিনিট সাত-আটের মধ্যে আবার বেরিয়ে এলো। পরনে হাতে-কাচা পরিষ্কার পাজামা গায়ে ফুলকাটা পাঞ্জাবি। এ-ই ওর বাবু-পোশাক। চাঁছা বাখারিগুলো জড়ো করে হাতে নিল।—চল্।

আবু চল্ বললেই চলে অভ্যস্ত বাপী। ওর হাতের বাখারিগুলো বেশ পুরুষ্ট। ভাবল তেমন ভালো কোনো চারাগাছের জন্য হয়তো ওগুলোর দরকার। কিন্তু আবু জঙ্গলের পায়ে-হাঁটা পিছনের রাস্তা ধরে চলল। ও-দিকে শুধু ঝোপ-ঝাড় আর নীচু-জাতের খেটে-খাওয়া মানুষদের একটা দুটো করে মাটির ঘর ছাড়া আর কিছু আছে বলে জানে না। এদিকে যারা থাকে তারা বেজায় গরিব।

আরো একটু ভিতরের দিকে প্রায় দেড় মাইল হাঁটার পর আবু ওকে নিয়ে এক জায়গায় এসে থামল। একই মাটির ছাদের নিচে পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা সামান্য বড় আর একটা ছোট। ছোট ঘরটার সামনেটা হাঁ করা, অর্থাৎ দরজা নেই। বড় ঘরের সামনে হোগলার ওপর বাখারি লাগিয়ে দরজা বসানো। ঘর দুটোর চারদিকে একটু জায়গা নিয়ে গাছের ডালের বেড়া দেওয়া হয়েছে। ডালগুলো বাঁশের খুঁটির সঙ্গে মোটা তার দিয়ে কষে বাঁধা। সামনেও দুটো বাঁশের খুঁটির সঙ্গে আটকানো গাছের ডালের গেট।

কাছাকাছির মধ্যে আর কোনো মাটির ঘরও নেই।

আবু গলা চড়িয়ে হাঁক দিলে, কই গো, বাদশা-বেগমরা এখনো সব ঘুমিয়ে নাকি?

বাপীর মুখে কথা নেই, ভিতরে বেশ অবাক। আবুর সঙ্গে এতকাল ঘুরছে, কিন্তু এখানে এই প্ৰথম

প্রায় একই সঙ্গে পাশাপাশি ঘর দুটো থেকে দুটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। আর দরজাঅলা ঘরটার ভিতর থেকে পুরুষের গলা ভেসে এলো, আবু ভাই এলে? দুলারি, আবু ভাইকে ভিতরে আসতে বল্ না—

দুজনেরই পরনে আধ-ময়লা জোড়াতাপ্পির শাড়ি। পুরুষের গলা থেকে বোঝা গেল হোগলার দরজার সামনে যে, সে-ই দুলারি। বছর উনিশ-কুড়ি, অর্থাৎ আবুর বয়সী হবে। যেমন ঢ্যাঙ্গা, তেমনি আঁটোসাঁটো শরীর। গায়ের রং কালো ঘেঁষা তামাটে। মাথার এলোমেলো লালচে চুলে কখনো বোধ হয় তেলের ছোঁয়া পড়ে নি। সুন্দরও নয়, কুৎসিতও নয়। রুক্ষ মুখ, ধার-ধার চাউনি

বাপীকে দেখে নিল একবার। তারপর আবুর দিকে চোখ। গলার স্বরও পুরুষালি ধাঁচের, ঘরের লোকের উদ্দেশে জবাব দিল, বলতে হবে না, শুনতে পাচ্ছে।

দরজাশূন্য পাশের ছোট ঘরের সামনের মেয়েটা হয়তো দুলারির থেকে বছর দুই ছোট হবে। অত লম্বাও নয়। বেশ ফর্সা। ঢলঢলে মুখ। নাক চাপা একটু। তেলের অভাবে এরও মাথার চুল রুক্ষ, তবু অন্যজনের মতো নয়। চাউনি দেখে মনে হবে এই মেয়েটার একটু রস-বোধ আছে।

গেট সরিয়ে আবু ভিতরে ঢুকল। এতক্ষণের বিরক্তি-ভরা মুখটা একটু হাসি হাসি দেখাচ্ছে এখন। ঘাড় ফিরিয়ে বাপীকে বলল, আয়—।

বড় মেয়েটার সামনে এসে হাতের বাখারিগুলো বাড়িয়ে দিল, ধরো, কাল’ এসে ও-ঘরের দরজা বানিয়ে দেব।

—তোমার দরজার জন্যে আমরা মরে যাচ্ছিলাম? ওই রেশমাকে দাও, ঘরে কেউ ঢুকতে চাইলে বাখারি-পেটা করবে।

রেশমা কোনো মেয়ের নাম হয় বাপী জানত না। কিন্তু বেশ মিষ্টি লাগল। মেয়েটার চোখে ভ্রুকুটি, ঠোটে হাসি।

হাতের বাখারি আবু মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, ওঃ, সব দায় যেন আমার ওসব দরজা-টরজা নিজেরাই বানিয়ে নিও। যতো ভালো করতে যাই ততো সব পেয়ে বসে—

দুলারিরও ঠাণ্ডা তেরছা জবাব।—অত ভালো করার জন্য কে সাধছে তোমাকে?

—ফের তুই আবু ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাটক্যাট করে কথা বলিস দুলারি? ভিতর থেকে পুরুষের কর্কশ গলা।

যে-মুখ করে দুলারি ঘরের দিকে চোখ ফেরালো একবার, বাপীর মনে হল ভিতরে যে আছে তাকে সে একটুও কেয়ার করে না। আবু এগিয়ে যেতে দরজা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াল। আবু ভিতরে চলে গেল।

বাপী হাঁ করে দাঁড়িয়ে। এরকম বাতাস থেকে ঝগড়া টানার কারণ কিছু বুঝছে না। এবারে দুটো মেয়েরই ওর দিকে চোখ। তারপর দুলারির আবার তেমনি ঠাণ্ডা চাঁছাছোলা কথা।—কি বুদ্ধি, এখেনে বাবু-ঘরের ছেলে এনে হাজির!

ভিতর থেকে আবু ডাকল, বাপী, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন, ভিতরে আয়।

অগত্যা বাপীও পায় পায় ভিতরে এসে ঢুকল। পিছন থেকে এগিয়ে এসে দুলারি গম্ভীর মুখে একটা তেলচিটে ছেঁড়া-খোঁড়া চাটাই মাটিতে পেতে দিল।

চাটাইয়ের ওপর আবু গ্যাঁট হয়ে বসল। হাত ধরে ওকেও বসালো। দড়ির খাটিয়ায় বসা কালো কালো দাড়ি-বোঝাই লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বাপী বিমূঢ় হঠাৎ। এই লোকটাকে তো ও খুব চেনে। কাঁধের পেল্লায় ঝোলায় ছোট-বড় তিন-চারটে ঝুপড়ি নিয়ে সাপুড়ের পেটমোটা বাঁশি বাজিয়ে বানারজুলির রাস্তায় আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে কত রকম সাপের খেলা দেখাতো। বছরখানেক হল একে আর দেখছে না। তার এ কি হাল! দাড়ির জন্য গাল দেখা যাচ্ছে না, সমস্ত কপাল নাক আর চোখের নিচটা বসন্তের শুকনো গর্তে ছেয়ে আছে। চাউনিও কি—রকম ঘোলাটে।

আবু জিজ্ঞসা করল, ছট্টু দাদাকে দেখেছিস কখনো?

বাপীর নাম জানা ছিল না। বলল, সাপের খেলা দেখাতো…

লোকটার বয়েস চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। দাড়ির জন্য দুলারির ডবল বয়েস মন হল। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, নিজে এখন খোদার খেলা দেখছি।

আবু বলল, গেলবারের বসন্তে ছোট্ট দাদার চোখ দুটোও গেছে। এখন আবার বুকের ব্যামোয় ধরেছে। এই হল ছোট্ট দাদার বিবি দুলারি আর ওই রেশমা— ছোট্ট দাদার বোন।

দুলারি খাটিয়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, আর রেশমা দরজার কাছে। ওদের দিকে একবার করে তাকাতে গিয়ে ঘরের এককোণে থাকে থাকে সাজানো কটা সাপের ঝুড়িও চোখে পড়ল। ওগুলোতে এখনো সাপ আছে মনে হল।

বাপীর পরিচয় শুনেই ছোট্ট দাদা বলল, বাপকে ধরে আবুর চাকরিটা জলদি পাইয়ে দাও খোকাভাই—নইলে ও যুদ্ধে চলে যাবে বলছে।

এরপর আবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সে। আবুর মতো ছেলে আর হয় না। আল্লার শেষ মার থেকে ও-ই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। ভাঙা ঘর মেরামত করে দিয়েছে, জঙ্গলে মুরগি খরগোস যা পায় মেরে এনে ওদের দিয়ে যায়, নইলে কাঠ বেচে দুলারি আর কটা টাকা পায়, গোটা মাসের আটা-চালও হয় না তা দিয়ে। ঘরের পিছনে খানিকটা জমি সাফ করে এই আবুই চারদিকে গাছের ডালের বেড়া দিয়েছে। পিছনের জমিতে এখন লাউ কুমড়ো আর শাকটাক বেশ হচ্ছে। সোৎসাহে ছোট্ট মিয়া বলল, তোমার লঙ্কা গাছে এখন খুব লঙ্কা ধরেছে আবু ভাই।

আবু নির্লিপ্ত মুখে নিজের প্রশংসা শুনছিল। ওদিকে দুলারির মুখে কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটা নেই। শুধু রেশমার হাসিমাখা দুচোখ আবুর মুখের ওপর। দেখামাত্র বাপীর স্নায়ুতে সাড়া জাগল একপ্রস্থ। আবু যে খুব ভালো তাতে ওরও কোনো সন্দেহ নেই। তবু আবুর এত দয়া এত উদারতা সব ওই রেশমার জন্য। এ একেবারে অকাট্য সত্য। এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

আবু উঠে পড়ল। ওকেও ডাকল, চল, কেমন লঙ্কা হল দেখে আসি।

এদিক থেকে দুলারি হুকুম করল, রেশমা যা—

আবু ওমনি ঝাঁঝিয়ে উঠল, রেশমা যাবে কেন, আমি চিনি না?

পাল্টা ঝাঁঝে দুলারি বলল, গেলে তোমার গায়ে হলকা লাগবে?

সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, আবু ভাইয়ের সব কথায় তুই জবাব দিস কেন?

পিছনের ছোট সবজি বাগান দেখতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। রেশমা ওদের দশ হাতের মধ্যেই ছিল। আবু ওর দিকে ফিরেও তাকায় নি। বাপীর তবু মজা লাগছিল। আবুর সঙ্গে এতদিন এত মিশেছে, অথচ এত বড় ব্যাপরটা ঘূণাক্ষরে জানতে পারে নি। ওর পেটে পেটে এত!

কিন্তু ফেরার পথে ওই রেশমার কথা শুনে বাপী অবাক আবার। রেশমার বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে মরদও আছে। লোকটা আবার মুসলমান নয়, খ্রীষ্টান।। জঙ্গলে কুলির কাজ করে কাঁদনা—রেশমা তার বউ। দিন-রাত মদ খায় লোকটা, ঘরে এক পয়সাও দেয় না। নেশায় বাগড়া দিতে গেলে বউটাকে ধরে দেদার ঠেঙায়। মেরে শুইয়ে ফেলে একেবারে। যেদিন খুব বেশি মারধর হয়, রেশমা তার ভাজের কাছে পালিয়ে আসে। দুদিন চারদিন বাদে আবার যায়, আবার মার খায়, আবার আসে। ছ’ মাস ধরে এরকমই চলছে।

শুনে বাপীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তাহলে আবুর কি-যে আশা ভেবে পেল না।

.

দু’ সপ্তাহের মধ্যে বানারজুলির জঙ্গলের শান্তি তছনছ হয়ে গেল। নাড়াচাড়া কিছু পড়বে সেটা সহকারী ডি. এফ. ও. চলে যাবার পরে সকলেরই মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই নাড়াচাড়ার ফল যা দাঁড়াল সেটাই নীল আকাশ থেকে আচমকা বাজ পড়ার মতো।

আবু আর বাপীর অন্তত সেই রকমই মনে হল।

মাঝে এখানকার রেঞ্জ অফিসার সন্দীপ নন্দী তিন-চার দিনের জন্য হেডকোয়ার্টার্স চলে গেছলেন। এর দিনকতক বাদে স্বয়ং ডি.এফ.ও. লালমুখো খাঁটি সাহেব এসে হাজির। সক্কলকে অবাক করে এখানকার বড় সাহেব অর্থাৎ নন্দী সাহেবের’ বাংলোয় তিন দিন তিন রাতের অতিথি হলেন তিনি। আগের সহকারী ডি. এফ. ও.-র জন্য চা-বাগানের বাংলো ঠিক করা হয়েছিল। এবারের পরিদর্শনের ফল কি দাঁড়াবে তখনো কেউ জানে না। আবু চুপি চুপি বাপীকে বলেছিল, তোর শ্বশুরের বাংলোয় শহর থেকে বাবুর্চি আর খানসামা এসেছে, আধপেটি বিলিতি বোতলও এসেছে—আর কত রকমের মাংস আছে ঠিক নেই।

বিলিতি সাহেবকে নিয়ে ঘটা করে দুদিন জঙ্গল দেখানো হল। ফাইলপত্রও পরীক্ষা করা হল। জঙ্গলের গলদের প্রধান আসামী আবুর বাবা কালু রব্বানী। লালসাহেব জানলেন, জঙ্গলের ভিতরে ভাঁটিখানা গজিয়ে ওঠার মূলে সে। আসামীর তালিকায় আরো তিনজন বীটম্যান, একজন ফরেস্ট গার্ড, একজন সেচের বাবু। বাপীর বাবা হরিবাবুর ফাইল আর গাছপালার হিসেবনিকেশও বিলিতি সাহেবের কাছে সন্তোষজনক নয়। এদের সকলের যথাযোগ্য দন্ডের নির্দেশ দিয়ে তিনি চলে গেলেন।

এরপর এখানকার বড়সাহেবের সেই দণ্ড বিধানের পালা। হেড বীটম্যান কালু রব্বানী, তিনজন বীটম্যান, একজন ফরেস্ট গার্ড আর সেচবাবুর চাকরি গেল। তদন্তসাপেক্ষে হরিবাবুকে সাসপেন্ড করা হল।

কপাল শুধু আবু রব্বানীর। বড়সাহেব নিজে ডেকে তাকে বীটম্যানের চাকরি দিলেন। চাকরি পেয়ে আবু সাহেবকে সেলাম ঠুকল আর ঘরে এসে নিজের কপাল চাপড়ালো।

বাবার চোখে জল দেখেছে বাপী। পিসীর পায়ে হাত রেখে বাবাকে বলতে শুনেছে, আমি কোনদিন এক পয়সাও কারচুপি করিনি, তুমি তো জানো।

পিসীর চোখেও জল। বাবাকে হাত ধরে টেনে তুলেছে আর বলেছে, এত ভেঙে পড়িসনে, ঠাকুর এত বড় অবিচার কক্ষনো করতে পারেন না।

ঠাকুরের ওপর বাবার ভরসা এখন কতটুকু বাপী জানে না। দিনের মধ্যে পাঁচ বার করে তাকে ঘর থেকে ছুটে বেরুতে দেখছে। কোথায় যায় বাপী তাও আঁচ করতে পারে। বিচার যে করবে তার কাছে। ওই বড়সাহেবের বাংলোয় মেজসাহেবের বাংলোয়। চোখে না দেখলেও বাপী জানে, আবুর মতে আসল চোর যারা, বাবা তাদেরই হাতেপায়ে ধরছে, কান্নাকাটি করছে।

আরো তিন সপ্তাহ বাদে বাবার ছট্‌ফটানি কমল। মুখ থমথমে এখন। তার বিচার হয়ে গেছে। বড়সাহেব দয়া করেছে। চাকরি থাকল। তিন বছরের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ। সঙ্গে ওয়ার্নিং।

এবারেও আবু ওকে চুপিচুপি বলেছে, পাছে মরীয়া হয়ে বাবা হেড কোয়ার্টারস-এ ছোটে আর হাটে হাঁড়ি ভেঙে সব ফাঁস করে দেয় সেই ভয়ে বড়সাহেব আর মেজসাহেব এই দয়া দেখালো। বলেছে, তোর বাবা তো আর আমার বাপের মতো মুখু নয়!

ভেতর-বার সব জ্বলছে বাপীর। সেই কবে থেকে জ্বলছে। দূর থেকে বাংলোটাকে দেখে। চোখের আগুনে ওটা ভস্ম হয় না। বাড়ির মানুষগুলোও ভস্ম হয় না।

…তারপর সেই দিন। যে দিনটা বাপী এ জীবনে আর কোনদিন ভুলবে না। কোনদিন না।

মিষ্টি জঙ্গলে। মিষ্টি একা। ওদের বাংলোর খুব কাছেই। একটা রঙিন প্রজাপতির পিছনে তাড়া করেছে।

সেটা শনিবার। প্রচণ্ড কিছু ঘটবে বলেই বাপীর এই মতি কিনা কে জানে। আকাশ সেদিনও মেঘলা ছিল। বানারজুলি জঙ্গলে ওকে বড্ডোই টানছিল। শনিবার দেড়টায় ছুটি। ক্লাসের মাস্টারমশাইকে পিসীর শরীর খারাপের কথা বলে বারোটায় বেরিয়ে এসেছে। তারপর বাড়ি। তারপর জঙ্গল। নিজের মনে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দূর থেকে দুটো চোখে একবার মিষ্টিকে ভস্ম করার আশা নিয়েই এদিকে এসেছিল। বেলা এখন আড়াইটের কম নয়।

দূর থেকে মিষ্টিকে দেখেই বাপীর পা দুটো থেমে গেল একবার। ওকে দেখে নি। দেখলেই ছুটে পালাবে। সেই পথ আগলানোর জন্যেই আধ মিনিটের মধ্যে পিছন দিকে চলে এলো। মিষ্টি এখনো প্রজাপতির পিছনে। মাঝে কিছুদিন কাছাকাছি না হওয়ার ফলে বেশ ডাগরটি লাগছে। বাপীর দু চোখ লোভে চিকচিক করছে। আগের মতো নয়, এই লোভ বাপীর কাছেও নতুন। চোখের সামনে জোড়া জোড়া মুখ। মণিদা আর গৌরী বউদি…ভীম বাহাদুর আর তার ভালবাসার মেয়ে…আবু আর রেশমা। পিছন থেকে বাপী নিঃশব্দে এগোচ্ছে। তার চোখে শুধু লোভ নয়, দুর্জয় আক্রোশও।

প্রজাপতির পিছনে আর না গিয়ে মিষ্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাপী তখন ওর পাঁচ হাতের মধ্যে। মিষ্টি থমকে তাকিয়ে মতলব বুঝতে চেষ্টা করল। বলল, পিছন থেকে চুপি চুপি আসা হয়েছে—কেমন?

একেবারে কাছে এসে বাপী জবাব দিল, চুপি চুপি আসব কেন। তোকে দেখেই তো এলাম—

একটা হাত ধরল। এক ঝটকায় সেই হাত ছাড়িয়ে মিষ্টি ধমকে উঠল, ফের গায়ে হাত! গিয়ে বলব মাকে?

প্রাণপণ চেষ্টায় বাপীর বাইরেটা মোলায়েম তখনো।—ঠিক আছে, আমাদের বাড়ি চল্, পিসী ক্ষীরের পুলি বানিয়েছে—খেলে আর ভুলতে পারবি না।

মিষ্টি মুখ মুচকে জবাব দিল, হ্যাঁঃ, তোমার বাবা চুরি করে ধরা পড়েছে, আমার বাবা ক্ষমা করে দিল বলে—আর কক্ষনো তোমাদের বাড়ি খেতে যাই—

কথাগুলো মুগুরের ঘায়ের মতো মগজে এসে লেগেছে। তারপর যা ঘটার চোখের পলকে ঘটে গেল। আচমকা দুটো হাতসুদ্ধু বেড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে বাপী ওকে শূন্যে তুলে নিয়ে ভিতরের দিকে ছুটল। মিষ্টি ভালো করে চেঁচাবারও ফুরসৎ পেল না। ওর হাঁ-করা মুখের মধ্যে বাপী নিজের মুখ চেপে ধরেছে।

পঁচিশ-তিরিশ, গজের বেশি এগনো গেল না। ওর ঠোটে মুখে মিষ্টি দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। জুতোসুদ্ধু পা ছুঁড়ছে।

দাঁড়িয়ে গেল। তার পরেই মিষ্টি মাটিতে। বাপী ওর ওপরে। ভিতর থেকে যে শয়তানটা বেরিয়ে এসেছে, বাপী নিজেও তাকে ভালো চেনে না। তার স্থান কাল বোধ নেই, ভালো-মন্দ জ্ঞান নেই, পরিণামের হিসাব নেই। তার শুধু লোভ, শুধু আক্রোশ। মুখে দাঁতে ঠোটে জিভে নরম মাংসের স্পর্শ। মুখে মুখ চেপে গলা দিয়ে ওকে টু শব্দও বার করতে দিচ্ছে না। আর হাত দুটোরও সর্বাঙ্গের মাংস খুবলে তুলে নেবার উল্লাস।

এই উল্লাসের মুখে আবার একটা ধাক্কা খেয়েই শয়তান থমকালো। তারপর পলকে কোথায় সেঁধিয়ে গেল। এবার বাপী দেখছে। দেখছে মিষ্টির সমস্ত মুখ আবির-গোলা লাল। চামড়া ফেটে এক্ষুনি রক্ত বেরিয়ে আসবে বুঝি। বড় হাঁ—এর মধ্যে একটা বিকট কান্না ধরে আছে। ওটা মুক্তি না পেলে দম-বন্ধ হয়ে মরেও যেতে পারে।

নিজের অগোচরেই ওকে ছেড়ে বাপী হাত-দুই সরে গেল। খুব শব্দ না করেই কান্নাটা মুক্তি পেল। তারপরেই এক্তে উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি পনের-বিশ হাত ছুটে গেল। পলকের জন্য ঘুরে দাঁড়াল একবার। মাটি থেকে বড়সড় একটা পাথর তুলে নিয়ে প্রাণপণ জোরে ছুঁড়ে মারল ওকে। লাগলে কি হত বাপী জানে না। লাগল না। বাপী নিজের অজান্তে মাথা নুইয়ে ফেলেছিল। মুখ তুলে দেখে মিষ্টি নেই।

তখনো বিকেল। আবুর ঘরের সামনের উঠোনে বসেছিল বাপী। শরীর অবসন্ন। কিছু একটা ঘটবে জানে। কিন্তু ও কি করবে জানে না। তাই এখানে। আবু এলো। সঙ্গে আরো দুজন বীটম্যান। আবুর থমথমে মুখ। বলল, বাড়িতে না দেখেই বুঝেছি তুই এখানে। চল্ বড়সাহেবের বাংলোয় যেতে হবে, তোকে ধরে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে—

বাপী ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

আবু রেগে গেল।—হাঁ করে দেখছিস কি, আমি বড়সাহেবের গোলাম না এখন? তারপর ঝুঁকে গলা খাটো করে বলল, তোর বাবাও আছে সেখানে, দুষ্টুমি করেছিস, না হয় মারধর খাবি একটু, অত ভয়ের কি আছে, চল্–

কি দুষ্টুমি বা ভয়ের কতটা, আবুও জানত না। বাংলোর বারান্দায় মেমসাহেব, সাহেব আর বাপীর বাবা। দরজার ওধারে মিষ্টি।

আর কাউকে কিছু করতে হল না। যা করার বাবাই করল। চুলের মুঠি ধরে কিল-চড় ঘুষি মেরে মেরে ওকে কাঠের মেঝেতে ফেলল প্রথম। তারপর একজন বীটম্যানের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে পাগলের মতো পিটতে লাগল। চাপা আর্তনাদ করে করে বাপী উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা ওর প্রাণটা বার হওয়ার আগে আর থামবেই না। পিঠ হাত পা কপাল নাক মুখের চামড়া ফেটে চৌচির। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। জিভে ঠোটে গরম তাজা রক্তের নোনা স্বাদ।

এবার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে বাপীর। আরো অন্ধকার। গায়ে মুখে মাথায় লাঠির ঘা পড়ছে এখনো কিন্তু আর যেন অত লাগছে না। ও কি রকম ঘুমপাড়ানি অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।

.

সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন কিনা বাপী ঠাওর করে উঠতে পারল না। নিজের ঘরের চৌকিতে শুয়ে আছে। কোণে ডিম-করা হারিকেন। আলোর থেকে অন্ধকার বেশি। ঘরে কেউ নেই।

পিসী রাত থাকতে ওঠে। তাই উঠে গেছে বোধ হয়। কিন্তু তা হবে কেমন করে। রাতে শোবার পর ঘরে হারিকেন জ্বলে না। তাহলে ও শুয়ে কেন?

মাথা উঁচিয়ে খোলা দরজার দিকে দেখতে গিয়ে টের পেল কেন। ঘাড়ে মাথায় কপালে মুখে আর সমস্ত গায়ে ভীষণ যন্ত্রণা। শুধু ব্যথা নয়, জ্বলেও যাচ্ছে। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে।

স্বপ্ন নয়। মনে পড়ছে। সাহেববাংলোর বারান্দা থেকে কে যেন এক সময় ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারপর একবার দুবার চোখ তাকিয়ে খুব সম্ভব আবুর মুখখানাই দেখেছিল। জিভটা মুখের ভিতর নড়াচড়া করল, তারপর নিজের ঠোঁট দুটোও চেটে দেখল। না, রক্ত লাগছে না। কেবল জ্বালাই করছে। ঠোটে আর তার ওপরে নিচে কোন ওষুধ-টষুধ লাগানো হয়েছে বোধ হয়। জিভটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল। কিন্তু তার থেকে ঢের বিচ্ছিরি নোতা রক্ত। সেটা মনে পড়তে গা-টা কেমন করে উঠল। নিজের শরীরের রক্তের এমন গা-গুলনো গরম নোনতা স্বাদ, জানত না।

—ক’বার তোকে ঘরে যেতে বললাম, বসে বসে বসে রাত করছিস কেন?

বাইরে বাবার বিরক্তি ঝরা ভারী গলা। বাপীর দু কান খাড়া। কিন্তু যাকে বলল তার কোন জবাব শোনা গেল না…কাকে বলল? নিশ্চয় আবুকে। ও হয়ত চলে গেল। কারণ একটু বাদেই পিসীর কথা কানে এলো।

—এটুকু আর বাকি রেখে জ্যান্ত ফিরিয়ে আনলি কেন—একেবারে শেষ করে দিলেই তো হত।

আর এক প্রস্থ চাবুকের মতই বাবার ঝাঁঝালো জবাব।—শেষ করতেই চেয়েছিলাম, আর শেষ করাই উচিত ছিল—বুঝলে? কিন্তু ও শেষ হবার ছেলে নয়, তার আগে আমাকে শেষ করবে।

মুখের মধ্যে বাপীর জিভ নড়ে-চড়ে উঠল আর একবার। ঠোঁট দুটো চেটে নিল। রক্ত নয়। রক্তের থেকেও বিস্বাদ কিছু যেন ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছে। যত রাগ ততো ঘৃণা। বাবার গলা শুনেই এই, মুখ দেখলে হয়তো ফিনকি দিয়ে রক্তই ছুটবে।

কিন্তু মুখ রাতে দেখা গেল না। সকালেও না। সকালে যখন চা-বাগানের ডাক্তার এলো, তখনও না। রাতে বা সকালে পিসীর সঙ্গেও কোন কথা হয়নি বাপীর। রাতটা কি-রকম ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। পিসী ডাক্তারকে বলল, সমস্ত রাত জ্বরে ভাজা ভাজা হয়েছে।

ডাক্তার পরীক্ষা করল। নাক মুখ আর সমস্ত গা হাত পা উল্টে-পাল্টে দেখল। তারপর গম্ভীর মুখে বাইরে চলে গেল। একটু বাদেই বাপীর কানে মধু। পিসীকে ডাক্তার বলছে, চিকিৎসা যা করার করছি, কিন্ত আপনার উচিত পুলিশে খবর দেওয়া—ছেলেকে এ-রকম শাসন করা চলে কিনা সেটা তারা বুঝিয়ে দেবে।

ঘাড় উঁচিয়ে বাপী পিছনের দরজার দিকে তাকালো। বাবা কোথায়? বাবা কি শুনল?

দুপুরে আবু এলো। বাবা তখন আপিসে। পিসী তার পুজোর জায়গায়। আবু ঘরে ঢুকলে পিসীকে গোবরজলের ছড়া দিতে হয় বলে ভিতরে কমই ঢোকে। আজ ও ঘরে বা দিতেই একটা উদ্‌গত অভিমানে বাপী অন্য দিকে মুখ ফেরাল। পিসী শোয় বলে আবু চৌকি ছোঁবে না। হাত দুই তফাতে দাঁড়িয়ে ওকে দেখল একটু। বলল, রাগ তো হবেই তোর, আমি শালা কেমন গোলাম ভাল করে দেখে রাখ—

বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা বাপীও বুঝল। আস্তে আস্তে ওর দিকে ফিরল আবার। আর মনে মনে ভাবল, চোখে যদি জল আসে তো নিজের চোখ দুটো উপড়ে ফেলবে।

আবু বলল, কাল রাতেও খবর নিতে এসেছিলাম। পিসী বলল খুব জ্বর তোর। তোর বাবার মুখের দিকে চেয়ে আর ঘরে ঢোকার সাহস হল না। এখন আপিসে কাজ করছে দেখে ঝট করে চলে এলাম।

বাপী বলল, একটা কিছু টেনে নিয়ে বোসো না—

—আর বসে না, এক্ষুনি তো জঙ্গল ঠাঙাতে বেরুতে হবে। তারপর গলা খাটো করে বলল, এত বড় কাণ্ড হবে জানলে আমি তোকে বানারজুলি থেকেই পাচার করে দিতাম। সামনে ঝুঁকল একটু, কি করেছিলি রে তুই—মেয়েটার একেবারে সব্বোনাশ টব্বোনাশ করে বসে আছিস নাকি? কুকুর বেড়ালকেও তো কেউ এভাবে মারে না—

সর্বনাশ কাকে বলে বাপী তাও এখন বেশ বুঝতে পারে। একটা মেয়ের নরম মাংসের ওপর পাগলের মতো সেই হামলার পর ভিতরের শয়তান আরো বেপরোয়া কিছুর দিকে ঝুঁকতে চাইছিল। কিন্তু মিষ্টির হাঁ-করা মুখের দম—আটকানো কান্না দেখে সেই শয়তান উধাও হয়েছিল। এখন খেদ। আবু যা বলছে তাই হলে কি হত? না-হয় একেবারে মেরে ফেলা হত ওকে। তার বেশি কি হত?

আবু চেয়ে আছে। কিন্তু বাপী কি করেছে না করেছে মুখে কি বলবে? মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, অতটা না।

দাঁতে দাঁতে ঘষে আবু বলল, যদি মরদ হোস তো একদিন শোধ নিবি। তারপর একটা চোখ ছোট করে অন্য চোখে সটান তাকিয়ে শুধলো, কি-রকম শোধ বুঝলি?

কেন যেন বাপীর জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োচ্ছে একটু। মাথা নাড়ল। বুঝেছে।

কিন্তু দু-মাস না যেতে রাগে আর পরিতাপে নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করেছে বাপীর। জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারের মতোই একটা চলন্ত জিপে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে। রেঞ্জ অফিসার সন্দীপ নন্দী দিনাজপুর না কোথাকার জঙ্গলে বদলি হয়ে গেল এ-খবর প্রথম আবুই দিয়েছিল ওকে। বলেছিল, অনেক দুর্নাম রটেছে বড়সাহেবের নামে, কত আর চাপা দেবে? তাই মানে মানে নিজেই তদবির করে সরে পড়ছে।

আগে কায়মনে কিছু চাইলে বাপী সেই প্রার্থনা ভগবান নামে অদৃশ্য কারো কাছে পেশ করত। সেই মারের পর ভগবানের নাম আর মুখেও উচ্চারণ করে নি। তবু নিজের বুক চিরে কাউকে রক্ত দিলে যদি এই বদলি বন্ধ হত, তাও দিত। কিন্তু কিচ্ছু করা গেল না। ওরা চললই।

এত দিনের মধ্যে বাপী আর বাংলোর কাছে আসেনি। আজও দূরেই দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে ব্যস্তসমস্ত বাবাকে দেখেছে। মেজসাহেব ছোট সাহেব, ফরেস্ট গার্ড, বীটম্যানদের দেখেছে।…মেয়ের হাত ধরে মেমসাহেব জিপে উঠল। সাহেব সামনে। জিপটা আসছে। বাপী রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েছিল, ধারে সরে গেল। মিষ্টি দেখেছে ওকে। মাকেও দেখিয়েছে। জিপটা বেরিয়ে গেল। বাপী মিষ্টির দিকেই চেয়ে আছে। মিষ্টিও। সামনে বাবা, পাশে মা, তবু ওর ভয়-ভয় মুখ।

জিপ দূরে বাঁকের আড়ালে মিলিয়ে গেল। শিরায় শিরায় রক্ত ফুটছে বাপীর। মুখে বলছে না কিছু। মনে বলছে। কদ্দূর পালাবি? তোকে আর পাব না ভেবেছিস?

পরের দু বছরে বাপীর ভেতর-বার বদলেছে। পড়াশুনাটা মোটামুটি ভাবে করে গেছে। সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। পৃথিবীর যুদ্ধ তখন ঘরের কোণে এসে গেছে। চা-বাগানের ক্লাবে খবরের কাগজ আসে। রোজ সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়ে বাইরের বেঞ্চিতে বসে বাপী কাগজ পড়ে। কিন্তু যুদ্ধের এত খবর মনে খুব একটা দাগ কাটে না। ওরও ভিতরে অবিরাম যে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে সেটা কম কিছু নয়। মিষ্টি নামে একটা মেয়ে কোথাও না কোথাও আছেই। বাপী হিসেব ভোলেনি। ওই মেয়ে বারো পেরিয়েছে এখন। কল্পনায় আর একটু বড় দেখেছে ওকে। আরো সুন্দর দেখেছে। আরো বড় হোক। আরো সুন্দর হোক। দেখা হবে। হবেই হবে।

বানারজুলির জঙ্গল তেমনিই টানে ওকে। আবু ভীষণ ব্যস্ত। তার দেখা কম মেলে। কাজে গাফিলতি নেই। তার ওপর রোজ চা-বাগানের বস্তি এলাকায় গিয়ে বাপের জন্য হাঁড়িয়া জোগাড় করে নিয়ে আসতে হয়। চাকরি খোয়ানোর ফলে কোন সন্ধ্যাতেই এই জিনিস থেকে ও বাপকে বঞ্চিত করে নি। জঙ্গলে বেশি ভাগ সময় একলাই ঘুরে বেড়ায় বাপী। কিন্তু এ ঘোরাটা অন্য রকম। জীবজন্তুর ভালবাসাবাসির দিকে আর চোখ নেই। এ দু’ বছরেও বনমায়া তার হিসেবমতো নিখোঁজ হয়েছে আর সকলের প্রত্যাশিত সময় মতোই ফিরেছে। কিন্তু এ নিয়েও বাপী আর আগের মতো অত উত্তেজনা বোধ করে না। এমন কি চা-বাগানের আড়াই-পাতি তোলা হাসি উছলানো মেয়েদের দিকেও আর বেশি ঘেঁষে না। নিজের মনে জঙ্গলে ঘোরে। এখানকার নিস্তব্ধতা ভালো লাগে। গাছ-পালার সরসর শব্দও ভালো লাগে।

যা একটু কৌতূহল কেবল বসন্তের কোপে অন্ধ সাপুড়ে ছটু মিঞার বউ দুলারি আর তার ননদ মাতাল কাঁদনার বউ রেশমাকে নিয়ে। দুলারি এক রকমই আছে। পুরুষালি ছাঁদ, মুখে কম কথা, আর আবুকেও চোখ রাঙানোর সাহস। কিন্তু মাতাল স্বামীর হাতে মার খাওয়া রেশমার মুখখানা আরো ঢলঢলে হয়েছে। বছর উনিশ এখন ওর বয়েস। আবু বলেছে মাসের মধ্যে কম করে বিশ-বাইশ দিন রেশমা এখন তার ভাজের কাছেই থাকে। কাঁদনা এসে হাতেপায়ে ধরে খুব কাকুতি-মিনতি করলে তবে যায়। কিন্তু দুদিন বাদে আবার দাগড়া-দাগড়া মারের দাগ নিয়ে পালিয়ে আসে। মদ খেলেই ইদানীং ওর নাকি বউয়ের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে মাথায় সন্দেহ গজাতে থাকে। তারপর মেরে শুইয়ে না ফেলা পর্যন্ত সন্দেহের পোকাগুলো মাথা থেকে সরে না। রেশমা আর নাকি তার মরদের ঘরে যাবেই না পণ করেছে।

এত কথা বাপী আবুর মুখ থেকে শুনেছে। আর কাঁদনার সন্দেহ কতটা সত্যি আবুর মুখের দিকে চেয়ে তাই আঁচ করতে চেষ্টা করেছে। ওদের নিয়ে কৌতূহলের আরো কারণ, দুলারি আর রেশমা দুজনেই এখন রোজগারের রাস্তায় নেমে পড়েছে। সাপের ঝুড়ি আর বাঁশি নিয়ে দুজনে একসঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাপ-খেলা দেখাতে বেরোয়। দু বছরে অন্ধ ছুটু মিয়ার কাছে বিদ্যেটা রপ্ত করে নিয়েছে। সকালে ঘরের কাজ থাকে, রান্নাবান্না থাকে, খুব বেশি ঘুরতে পারে না। কিন্তু দুপুর পেরুনোর আগে অনেক দূরে দূরে চলে যায় ওরা। ভয়-ডর নেই। দুলারির তো একেবারে নেই।

ওরা কোথাও সাপ খেলা দেখাচ্ছে দেখলে বাপী গুটিগুটি না এগিয়ে পারে না। শুধু বাপী কেন জোয়ান বয়সের অনেকেই এগোয়। দুলারি আর রেশমা দুজনেই ঘাগরা পরে বেরোয়। সেই ঘাগরা ওদের হাঁটু ছাড়িয়ে এক বিঘতও নামে না। গায়ে রংবেরংয়ের আঁট কোর্তা। ছটু মিয়ার খেলা অনেক দেখেছে বাপী। সেই একই খেলা এদের হাতে যেন অন্যরকম। গাল ফুলিয়ে সাপুড়ের বাঁশি বাজিয়ে পালা করে খেলা দেখায়। সাপ ডাইনে বাঁয়ে দোলে। হাঁটু মুড়ে বসে ওরাও তেমনি দোলে। ছোবল মারার মতলবে সাপ সামনে পিছনে দোলে। ওদের তখন উত্তেজনা বাড়ে। ওরাও সামনে পিছনে দোলে। ছোবল খাবার জন্য মাটিতে উল্টো করে হাত পাতে, আবার ছোবল পড়ার আগে পলকে হাত সরায়। এই করে সাপের উত্তেজনা বাড়ায়। নিজেদের আর যারা গোল হয়ে দাঁড়ায়—তাদেরও। সাপের ছোবল একবার না একবার লেগেই যায়। ঝর ঝর করে রক্ত পড়ে। তখন ঠাণ্ডা হয়ে পাতা আর শেকড়বাকড় চিবিয়ে চটপট লাগিয়ে দেয়।

বাপী লক্ষ্য করেছে ছোবল খাবার লোভ রেশমার থেকেও দুলারির বেশি। অন্ধ ছোট্ট দাদাকে যত বুড়োই দেখাক, দুলারির বয়েস এখন বড় জোর বাইশ। কিন্তু সাপ খেলা দেখানোর সময়েও মুখখানা করে রাখে বত্রিশের মতো। রেশমার মতো হাসে না। কিন্তু ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে দোলে ওর থেকেও বেশি। খপ করে একসময় দু-হাতে সাপের গলা চেপে ধরে বুকের কাছে নিয়ে আসে। সাপের মুখ নিজের মুখের কাছে। সাপের চেরা-জিভ চিড়বিড় করে। দুলারিও তখন ঘন ঘন জিভ বার করে আর টেনে নেয়। যেন জিভেই ছোবল নেবার বাসনা। বাপীর কেমন যেন তখন সাপের চেয়েও ওই দুলারিকেই বেশি ভয় করে।

পরীক্ষা এসেই গেল। পড়াশুনায় আপনা থেকেই একটু মন বসেছে। তারই মধ্যে আচমকা দুর্যোগ। যে ‘ম্যালোরি’ জ্বরের ভয় পিসীর, তাই তাকে খেয়ে বসল। পাঁচদিনের মাথায় ধুপ করে মরে যেতে বোঝা গেল ওটা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ডাক্তারের মুখে ওই নাম বাপী পরে শুনেছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাত্র আট দিন বাকি তখন

বাবা কাঁদল না। পাথর হয়ে থাকল। বাপীও কাঁদল না। বুকের একখানা হাড় খসে গেল। তবু না। আছড়ে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তবু না। কেবল আবুর চোখে জল দেখেছিল।

পরীক্ষায় ছেদ পড়ল না। পরীক্ষা শুরু হল, শেষও হল। গত দু বছরের মধ্যে বাবার সঙ্গে বাপীর কদিন মুখ-দেখাদেখি হয়েছে হাতে গোনা যায়। পিসী চোখ বোজার পর মুখ-দেখাদেখি দু বেলাই হচ্ছে এখন। বাবা মোটামুটি রাঁধতে জানে। বাপীর হাতে ছেড়ে দিলে রান্না একরকম সে-ও করতে পারে। কিন্তু বাবা মুখ বুজে নিজেই রান্না করে। বাপী দেখে। কিছু বলে না। পরীক্ষা হয়ে যাবার পর বাবা সকালের বাজারটা ওকে মাঝে মাঝে করতে দেয়।

একই বাড়িতে দুটি প্রায় অচেনা বাসিন্দা দুজন। সকালে বাবার আপিস থাকে। আগে খেয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু রাতে বা ছুটির দিনেও খাবার সময় বাপী দূরে সরে থাকে। বাবা বুঝে নিয়েছে ও তার সঙ্গে বসে খাবে না। তাকে সামনে দেখলে আজও বুকের একেবারে তলা থেকে একটা বিতৃষ্ণা ঠেলে ওঠে বাপীর। বাবা তাও বুঝতে পারে কিনা বাপী জানে না। বাবা ডাকে না। ওরটা সাজিয়ে রেখে নিজে খেয়ে চলে যায়।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরোল। বাবা এতটা আশা করে নি নিশ্চয়। আর বাপী ফল নিয়ে মাথাই ঘামায় নি। পাশ করবে জানত।

…ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। খবর আসার পরদিনই বাবার মুখ দেখল। এ-ঘরে এসে বলল, বড়সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে, কাল বিকেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। আমি নিয়ে যাব।

কে এখন বড়সাহেব বাপী সে-খোঁজও রাখে না। কি কথা হয়েছে বা কেন দেখা করতে হবে না বুঝে মুখের দিকে চুপচাপ চেয়ে রইল।

বাবা বলল, এ জঙ্গলে আর একজন ক্লার্ক নেওয়া হবে সেটা আগেই ঠিক হয়ে ছিল। বড়সাহেবকে তোর কথা বলে আমি আটকে রেখেছিলাম। ম্যাট্রিক পাশ চাই। আজ রেজাল্টের কথা বলতে সাহেব কালই দেখা করতে বললেন।

কথা শেষ করে বাবা চলে যাচ্ছিল, বাপী বলল, আমি কলেজে পড়ব।

হরিবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন. ছেলের মুখ এবারে ভালো করে দেখে নিলেন। সেই পুরনো বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা নিজের মুখে আরও কত এঁটে বসেছিল বাপী জানে না। গলার স্বরেও কিছু প্রকাশ পেয়েছে কিনা বলতে পারে না।

হরিবাবুর মুখে কঠিন আঁচড় পড়তে লাগল। গলাও অসহিষ্ণু ভারী।—কলেজ মানে তো সেই জলপাইগুড়ি, সেখানে হস্টেলে থেকে পড়ার ইচ্ছে?

বাপী চুপ।

—আমার সে ক্ষমতা নেই।

বাপীর জবাবও এবারে স্পষ্ট।অর্থাৎ একবার সেখানে গিয়ে দেখব কোন ব্যবস্থা হয় কিনা।

হরিবাবু থমকালেন। মুখের ওপর এতকাল কোন কথা শুনে অভ্যস্ত নয়। তাঁর চোখে এটা অবাধ্যতা। কিন্তু সামনে যে দাঁড়িয়ে সে এখন তাঁর চেয়েও তিন আঙুল ঢ্যাঙা। দু বছর আগের সেই মারের পর থেকে ছেলে বদলেছে এ তিনি লক্ষ্য করেছেন। শাসন নিষ্ফল হয় নি ভেবেছেন। দিদি মাঝে না থাকাতে বাপ—ছেলের ফারাকটা এখন আরও বেশি স্পষ্ট। কিন্তু ছেলের এই মুখে আর এই স্পষ্ট জবাবে যেন আরও কিছু লেখা আছে।

অসহিষ্ণুতা চাপতে পারলেন না।—সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা হয় কিনা দেখার জন্য এখানকার চাকরি বসে থাকবে?

বাপী নিরুত্তর।

এই নীরবতার মধ্যেও ধৃষ্টতা দেখলেন হরিবাবু।—ম্যাট্রিক পাশ করে খুব লায়েক ভাবছিস নিজেকে, কেমন? স্টুপিড! এখানে আমার ব্যবস্থাই ব্যবস্থা এ যেন মনে থাকে!

থমথমে মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

পরদিন খেয়ে-দেয়ে সকাল দশটা নাগাদ আপিসে বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন, চারটে বাজার মিনিট পনের আগে আপিসে আসতে হবে, সেখান থেকে আমি সঙ্গে করে বড়সাহেবের বাংলোয় নিয়ে যাব।

বাপী চুপচাপ অন্য দিকে চেয়ে রইল।

আপিসে বেরুনোর সময় মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে চান হরিবাবু। আজ রাখা গেল না। চাপা গর্জন করে উঠলেন, আমার কথা কানে যাচ্ছে?

বাপী এবারে সোজা বাবার মুখের দিকে তাকালো। ঠাণ্ডা মুখ। ঠাণ্ডা গলা।— তুমি আর না পড়াতে পার, পড়াবে না। এভাবে জুলুম করছ কেন?

হরিবাবু ঠিক দেখছেন? ঠিক শুনছেন? পায়ে এখন চটি নেই, ফিতে বাঁধা জুতো। তাই খুলে হাতে নেবেন? কিন্তু ছেলের এই মুখের দিকে চেয়ে কটা মুহূর্তের মধ্যেই আবার তাঁর মনে হল, আগের সেই দিন আর নেই। কতটা নেই ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। ছেলের ঠাণ্ডা চাউনির ভিতর থেকে কিছু ঠিকরে পড়ছে মনে হল তাঁর। উদ্‌গত রাগ ঠেলে তল করলেন।

—আচ্ছা, বড়সাহেবের সঙ্গে দেখাশুনা কথাবার্তা হোক। তারপর আর কিছু ভাবার থাকে তো বিকেলে ঘরে এসে ভাবা যাবে।

হরিবাবু হনহন করে চলে গেলেন।

বাপী তার এক ঘণ্টার মধ্যে স্নান সারল। খাওয়া সারল। অন্য দিন দেরি হয়। আজ তাড়া।

এরই মধ্যে আবু এসে হাজির। খুশি উপছানো মুখ।— তোর পেটে পেটে এত যে আমাকে খবর পর্যন্ত দিলি না—অ্যাঁ?

—কি খবর?

—আজ বড়সাহেবের সঙ্গে তোর মোলাকাত হবে, কাল পরশু থেকে তুই আমাদের ছোট কেরানীবাবু। শুনেই ছুটে চলে এলাম আমি——

বাপীও হাসছে অল্প অল্প।—কার কাছে শুনলে?

—একবার আপিসে গেছলাম, তোর বাবাই ডেকে খবরটা দিলেন। আমি তোকে এর পর কি বলে ডাকব রে—হ্যাঁ? লোকের সামনে না হয় আপনি-টাপনি করে বলব—কি বলিস?

——আগে কাজ হোক, তারপর ভেবো। চকিতে ভেবে নিল কি।—বাবা নিজে ডেকে তোমাকে শুধু এই খবরটা দিল, না আর কিছু বলল?

—খবরটা জানিয়ে আমাকে বললেন, সাড়ে তিনটের সময় ঘরে গিয়ে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসিস। চারটেয় বাংলোয় বড়সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা।

বাপী হাসছে মনে মনে। বাবার তাহলে নিজের হুকুমের ওপর ভরসা একটু কমেছে। মনে মনে নয়, বাইরেও হাসল বাপী। বলল, ওই বাংলোর বারান্দাতেই বাবা আমাকে মেরে মেরে একেবারে শুইয়ে ফেলেছিল—নিজের রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আমি।

আবু থতমত খেল একটু।—দূর, দু বছর আগের সেই মার তোর গায়ে লেগে আছে, না সেই বড়সাহেব আছে। এই লোকের কাছে কাজের কদর আছে বলেই তো তোর বাবার সুবিধে হয়েছে।

বাপীর মজাই লাগছে। আবার বলল, আর পরদিন দুপুরে এসে তুমি বলেছিলে, যদি মরদ হোস্ একদিন শোধ নিবি—আর আজ ছোট কেরানী হয়ে বসছি দেখেই এত খুশি তুমি?

এবারে আবুকে ঢোঁক গিলতে হল।—আচ্ছা ছেলে তো তুই, সেসব কথা এখনও মনে করে বসে আছিস! তারা এখন পৃথিবীর কোন্ রাজ্যে আছে তার কিছু ঠিক আছে? তাছাড়া খোদার মর্জি হলে ছোট কেরানী হলেও শোধ নেবার দিন আসতে পারে। খুশির দিনে ও-সব মাথায় রাখিস না, অনেক কাজ এখন, যাই—ঠিক সাড়ে তিনটেয় এসে যাব, রেডি থাকিস—

চলে গেল।…না ওকেও কিছু বলা গেল না। বলা নিরাপদ ভাবল না। সমূহ সমস্যার সমাধান পিসীই করে রেখে গেছে। নইলে আবুকেই বলতে হত। তার কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হত। তার দরকার হল না, বাঁচোয়া। আবু যে ওকে ভালবাসে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাপীর মতলব জানলে ওকে আগলাবার জন্য কি কাণ্ড করে বসত, কে জানে। হয়ত বাবার কাছেই ছুটত আবার। চাকরি ওর কাছে মস্ত জিনিস এখন।

…কি করবে না করবে বাপী গত রাতেই ঠিক করে ফেলেছিল। দরকার শুধু নগদ কিছু টাকার। বানারহাট পৌছুতে পারলে সেখান থেকে জলপাইগুড়ি পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মাইলের বেশি নয়। ভাড়া সেই দিনে বড়জোর এক টাকা। খুব কম হলেও আরও তিন-চার টাকা বাপীর হাতে থাকা দরকার। সপ্তাহের বাজার আর টুকিটাকি কেনার জন্য বাবা ওর হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাপী বরং ওই পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল হেঁটে যাবে, তবু ও-টাকার এক পয়সাও ছোঁবে না। আবুকে বলে দেখবে ভেবেছিল পাঁচটা টাকা ধার দিতে পারে কিনা।

কিন্তু গত রাতের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। চৌকির নিচে পিসীর ছোট বাক্সটার কথা মনে পড়ল। চাবি বাপীর কাছেই। পিসী মারা যাবার পরে এ পর্যন্ত আর খুলে দেখা হয় নি ওতে কি আছে না আছে। যদি কিছু থাকে তা বাপীর ছাড়া আর কার?

জামাকাপড়ের তলা থেকে হাতে তৈরি ছোট্ট থলে বেরুলো একটা। বেশি শব্দ না করে বিছানায় উপুড় করে ফেলল। সবই কাঁচা টাকা, আর একটা আধুলি। মোট সাড়ে সতের টাকা। বাপীর কাছে ঐশ্বর্য। টাকা থলেয় পুরে ওটা কপালে ঠেকাল। ভগবান-টগবান নয়, পিসীকে প্রণাম করল। তারপর সমস্ত রাত আর সকাল কাটল এই দুপুরের প্রতীক্ষায়।

সঙ্গে যা নেবার চটপট গুছিয়ে নিল। টিনের ছোট সুটকেসে ধুতি, শার্ট, গেঞ্জি একটা গরম সোয়েটার। শতরঞ্জী মোড়ানো পুঁটলিতে শুধু নিজের পুরনো কম্বল, রঙিন চাদর একটা, আর গায়ের আলোয়ান। বিছানা-বালিশের বিলাসিতা মন থেকে ছেঁটে দিয়েছে। ওই টিনের সুটকেসই দিব্বি মাথায় দিয়ে শোয়া যাবে।

বারোটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। বাবার বাজারের টাকা তার বিছানায় বালিশ চাপা দিয়ে রেখে এসেছে।…আবু আসবে সাড়ে তিনটেয়। ঘরে শেকলতোলা দেখে ভাববে ও আগেই বাবার আপিসের দিকে চলে গেছে। আপিসে না পেয়ে আবার ঘরের দিকে ছুটবেই। মোট কথা, ও নেই জানাজানি হতে বিকেলে চারটে গড়াবে। ততক্ষণে ও অনেক দূরে।

জঙ্গল দিয়ে নয়, সোজা রাস্তা দিয়েই চলল। জঙ্গলে আবুর সঙ্গে ফের দেখা হয়ে গেলে মুশকিল। ভয় শুধু ওকে। রাস্তায় আর কোন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই বা। কে কি বুঝবে? বেরিয়ে যখন পড়েছে, আর ওকে ফেরাবার সাধ্য কারও নেই।

বরাত ভাল। আধ মাইল না যেতে এক ঠেলা-অলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুটো লোক ঠেলায় লোহালক্কর চাপিয়ে বানারহাট যাচ্ছে। বাপীর কাছে প্রত্যেকটা পয়সা দামী এখন। তবু দু আনায় রফা করে টিনের সুটকেস আর শতরঞ্জীর পুঁটলি ঠেলায় তুলে দিল। ঝাড়া হাতে-পায়ে ওকে দেখলেও এখন আর কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।

আরও মাইলখানেক এগিয়ে বাপী মনে মনে নিজের বিবেচনার তারিফ করল। সামনের দিক থেকে আসছে সাপুড়ে ননদ-ভাজ। দুলারি আর রেশমা। পরনে খাটো ঘাগরা, মাথায় ছোট বড় সাপের ঝুড়ি। ও-দিক থেকে খেলা দেখিয়ে ফিরছে। রোদের তাতে দুজনারই লালচে মুখ

ওকে দেখে রেশমা দাঁড়িয়ে গেল। তাই দুলারিও। মরদের হাতে ঠেঙানি খেয়ে রেশমা কাঁদে কেমন বাপী জানে না। কিন্তু হাসে বেশ।

—ভরদুপুরে কোথায় গো বাপী-ভাই?

আবুর সঙ্গে এত খাতির, বয়েসও বছর দুই বড় হবে, রেশমা ওকে তাই বাপী—ভাই বলে ডাকে। দুলারির মুখে এযাবৎ কোন ডাক শোনে নি।

—এই সামনে। তোমাদের আজ এত বেলা, দুরে গেছলে বুঝি?

—হ্যাঁ গো, আজ ভাল রোজগার হল। কদিনের মধ্যে তোমার বীটম্যান সাহেবের দেখা নেই কেন?—বলো, দাদা খোঁজ করছিল।

দুলারির কপালে ভ্রুকুটি।—বলো রেশমা খোঁজ করছিল।

নিরীহ মুখে বাপীও একটু মজাই করল। বলল, খানিক আগে আমার ওখানেই ছিল, এতক্ষণে বোধ হয় তোমাদের ঘরেই বসে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে রেশমা বলল, চল ভাবী, পা চালিয়ে চল—বেলা বাড়ছে।

গম্ভীর চোখে রেশমার মুখে ঝপ করে একটা ছোবল বসাবার মত চাউনি দুলারির।

ওরা এগুলো। বাপী দাঁড়িয়ে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জাও পেল। এক সঙ্গে দুজনেই ওরা পিছন ফিরে তাকালো। বাপী ঘুরে তাড়াতাড়ি পা চালাল।

…মাতাল ঠেঙাড়ে সোয়ামীর সঙ্গে রেশমার ছাড়াছাড়ি এক-রকম হয়েই গেছে যখন, আবুটা ওকে নিকে করে ফেলছে না কেন বাপী ভেবে পায় না। ওদের সমাজে এটা কঠিন ব্যাপার মনে হয় না।…তবে যত সেয়ানাই হোক, আবুর ভেতরটা নরম। হয়তো ওই মাতাল কাঁদনার জন্যও একটু দরদ আছে। কিংবা দুজনাই এখন ওরা জঙ্গলের চাকুরে বলে হয়তো চক্ষুলজ্জায় পেরে উঠছে না।

বানারহাটে পৌঁছে প্রথমেই নিশীথের মামা-বাড়িতে এলো বাপী। নিশীথ সেন। ক্লাসে ওর সঙ্গেই সব থেকে বেশি খাতির। নিশীথ সেন জন্ম থেকেই বলতে গেলে দিদিমার কাছে মানুষ। বাবা-মা কলকাতায়। বাবা সেখানে কবিরাজ। অন্য ভাই-বোনেরা তাদের কাছেই থাকে।

এ-বাড়িতে বাপীর আগেও যাতায়াত ছিল। শুনল, নিশীথ আগের দিনই জলপাইগুড়ি চলে গেছে। সেখানে ওর আর এক মামা থাকে। কাঠের কারবারী। ভাল অবস্থা। এখন সেখানেই উঠেছে। তারপর হস্টেলে থেকে কলেজে পড়বে। জলপাইগুড়ির মামার অনেকগুলি ছেলেপুলে। সেখানে থাকলে ওর পড়াশুনার ব্যাঘাত হবে।

ঠিকানা নিয়ে বাপী আবার বেরিয়ে পড়ল।

সমস্যার সমাধান এত সহজে হয়ে যাবে কল্পনাও করে নি। কলেজে পড়ার জন্য ও কিভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে শুনে নিশীথও প্রথমে বেশ ঘাবড়েছিল। বাপীও আই. এস. সি.-ই পড়বে। সায়েন্সের মাইনে সাত টাকা। ভর্তির ফী ছাড়াও অ্যাপারেটাসের জন্য কশান মানি পনের টাকা জমা রাখতে হয়। হস্টেলে থাকা-খাওয়া বাবদ এ-সবের ওপর মাসে আরও চল্লিশ টাকার ধাক্কা

মুশকিল আসান এক দিনের মধ্যে ওই নিশীথই করে ফেলল। এখানকার মামাও নিশীথকে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করার জন্য বকাঝকি করেছিল। ও রাজী হয় নি। মামা-মামীর সঙ্গে কথা বলে তাদের একচৌকি ছেলেমেয়ে অর্থাৎ দুটি ছেলে আর দুটি মেয়েকে পড়ানোর ভার বাপীর ওপর চাপিয়ে দিল। মামা—মামীকে বোঝালো ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করা বন্ধু অল্পের জন্য স্কলারশিপ মিস করেছে। এমন মাস্টার পাওয়া ভাগ্যের কথা। বিনিময়ে বাপী এখানেই থাকবে খাবে আর দশ টাকা মাইনে পাবে।

মামার কাছে ছ মাসের মাইনে আগাম পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। পনের টাকা বাপীর কাছে আছে, বাকি যা লাগে নিশীথ ধার দিল। কলেজে ভর্তি হওয়ার সমস্যা মিটল।

কিন্তু কদিনের মধ্যে বাপীর ক্লান্তি এসে গেল। ওর কল্পনা যে সাম্রাজ্যের সিংহাসনের দিকে ছোটে, বাস্তবটা সে তুলনায় একটা কুৎসিত ঘায়ের মতো। নিশীথের মামার ছেলে-মেয়েদের প্রতিও ভিতরটা বিরূপ। যুদ্ধের চাকরিতে লোক নেওয়া হচ্ছে। ভাবে সব ছেড়েছুড়ে ওতেই ঢুকে পড়ে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কেমন হয়। আবার নিজেই জানে, সব সম্ভাবনা তাহলে ভরাডুবি হয়।

দিন-কুড়ির মধ্যে কলেজের আপিসে ডাক পড়ল। কেন, বাপী কল্পনা করতে পারে নি। বানারজুলি থেকে বাবা আপিসে চিঠি দিয়েছে তার ছেলে ওখানে ভর্তি হয়েছে কিনা। হয়ে থাকলে কোন্ ঠিকানায় আছে। জবাবে আপিসের কেরানীবাবু ওর ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে, আর ওকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা ছেলের ঠিকানা জানে না, এ কেমন কথা?

বাপী যা-হোক জবাবদিহি করে চলেছে।

মাসের শেষে ওর নামে বাবার কাছ থেকে তিরিশ টাকা মনিঅর্ডার। কুপনে শুধু লেখা মাসে-মাসে তিরিশ টাকার বেশি পাঠানো সম্ভব নয়।

মাসে তিরিশ টাকা পাঠানোই বাবার পক্ষে কতখানি বাপী তা জানে। টাকার জন্য নয়—সেই ঘৃণা, সেই বিদ্বেষ। টাকা নিয়ে তক্ষুনি পোস্ট অফিসে ছুটল। গাঁটের পয়সা খরচ করে তিরিশ টাকাই ফেরত পাঠাল। কুপনে লিখল, টাকার দরকার নেই। কারও কাছ থেকে কোন আশা নিয়ে সে ঘর ছেড়ে আসে নি।

পরের মাসের মাঝামাঝি টেলিগ্রাম। কাউকে দিয়ে আবু তার পাঠিয়েছে। হরিবাবুর অবস্থা সংকটাপন্ন। চলে এস।

এবারে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছে বাপীর। কিন্তু তবু অভিমান। তবু বিদ্বেষ। যাবে? যাবে না।…যাবে?

…সেই দিনই বানারজুলি পৌঁছেছে। তার পরদিন বেশি রাতে বাবা চোখ বুজল। হঠাৎ বুকের বাঁ দিকে প্রচণ্ড ব্যথায় শয্যা নিয়েছিল। তার পরেই এমন অবস্থা যে স্থানীয় ডাক্তার হাসপাতালে সরাতেও সাহস করে নি। আগের সমস্ত রাত এমন কি পরদিন বিকেল পর্যন্ত বাবার পুরো জ্ঞান ছিল। বাপী এসে দাঁড়াতেই বাবা বড় বড় চোখে ওকে দেখেছে। সেই বড় বড় চোখের জল দুই গালে গড়িয়েছে। বাবা যেন অব্যক্ত আকৃতিতে ওকে সব ভুলে যেতে বলছে।

বাপীর ভিতরটা দুমড়ে ভেঙেছে। সমস্ত রাত বসে তার বুকে হাত বুলিয়েছে। বাবা তারপর পরম তৃপ্তিভরে থেকে থেকে ওকে দেখেছে।

পরদিন ভোররাতে সব শেষ। পিসী যেতেও বাপী কাঁদতে পারে নি। এখনও পারল না। পিসীর বুকে আছড়ে পড়ে যেমন কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, বাবার দিকে চেয়েও তেমনিই একটা ইচ্ছে ভিতর থেকে ডুকরে উঠছে। এত দিনের সব ঘৃণা আর বিদ্বেষ ফিরে ওকেই চাবুক হেনেছে।

বাবার কাজ মেটার পরেও কিছুদিন থেকে যেতে হল। এবারের বড় সাহেব সত্যি ভাল লোক। বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ডের বারোশো কত টাকা ওর হাতে তুলে দিলেন। মালপত্রসহ ওকে বানারহাট পৌঁছে দেবার জন্য জীপও দিলেন।

সঙ্গে আবু। বানারহাট পর্যন্ত ওর সঙ্গে যাবে। কিন্তু মুখে কথা নেই।

যেতে যেতে বাপী এবারে লোভীর মতই বানারজুলির জঙ্গল দেখছে। আবার সামনে তাকিয়েই জীপটাকে দাঁড়াতে বলল। পথের ধারে গাছের গুঁড়িতে বনমায়া বাঁধা। ও সামনে যেতেই গলা দিয়ে শব্দ বার করে শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম জানালো। বাপী ওর কপালে আর শুঁড়ে বারকয়েক হাত বুলিয়ে আবার ফিরে এলো। চোখের কোণ দুটো বড় বেশি শিরশির করছে। গেল বারে বানারজুলি ছাড়ার সময়ে এমন হয় নি।

একটু সহজ হবার জন্যেই আবুকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বিয়েটা হচ্ছে কবে?

বিকৃত মুখ করে আবু জবাব দিল, বিয়ের নিকুচি করেছে। শালার মরদ ঘরে থাকতে তার বিবিকে বিয়ে করা অত সোজা!

বাপী হেসে ফেলল। কিন্তু ভেতর হাল্কা হল না। আবুর সঙ্গে, এই বানারজুলির সঙ্গে, বানারজুলির জঙ্গলের সঙ্গে, বানারজুলির আকাশ-বাতাসের সঙ্গে কি-যে নাড়ির যোগ এ আগে জানত?

সেই যোগ ছিঁড়ে আজ ও ভেসে চলল। একেবারে একা।

.

জলপাইগুড়ি ফিরে বাপীর প্রথম কাজ ঠাঁইবদল। নিশীথের মামা বাড়িতে ওই দুই মাসের মধ্যেই হাঁপ ধরে গেছল। পড়ার সময় ছাড়াও ছোট চারটে ছেলেমেয়ে ছেঁকে ধরে থাকে ওকে। ওদের সঙ্গে খেলতে হবে, গল্প শোনাতে হবে। তাছাড়া নিশীথের মামা-মামীরও বাড়তি ফাইফরমাসের কামাই নেই।

নিশীথের সঙ্গে হস্টেলে থাকার বায়না ছিল বাপীর। হাতে সাড়ে বারোশ’র ওপরে টাকা তখন অনেক টাকা। কিন্তু মাসে সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশ টাকা খরচ ধরলে দু’ বছরের মধ্যে ও-টাকা ফুরোবে বাপীর সে-হিসেব আছে। তাই নিশীথকে বলল, খাব-দাব না, তোর মামাতো ভাইবোনদের পড়ানোর টাকা কতটা বাড়াতে পারিস দেখ্‌, নইলে আই. এস. সি. পাশ করতেই জমা টাকা শেষ হবে।

নিশীথের কানে কিছু ঢোকালে ভালই ঢোকে। কোমর বেঁধে মামা-মামীর সঙ্গে ফয়সলা করে এলো। বন্ধুর জন্য মাসে পঁচিশ টাকাই দাবী ছিল তার—একটা জোয়ান ছেলের দু’বেলার ভাত আর জলখাবার দিতে মাসে পনের টাকাও খরচ হত না নাকি মামার? যুদ্ধের বাজারে খাওয়া-পরার খরচ বাড়ছে না?

মামা-মামী মাসে কুড়ি টাকায় ফয়সলা করল। সেই সঙ্গে বিকেলের জল—খাবার যোগান দিতেও রাজি হল। ছেলেমেয়ের রেজাল্ট ভালো হলে পরের বছরে আরো মাইনে বাড়ানোর কড়ার করে নিশীথ হস্টেলে ফিরল। এবারে আর এক প্ল্যান মাথায় ঘুরছে তার। এখন পুঁজি থেকে মাসে তিরিশ টাকা খরচ হলেও দু’ বছরে আই. এস. সি. শেষ করার পর বি. এস. সি. পড়ার পুরো টাকা হাতে থাকে না। তাই বাপীকে পরামর্শ দিল, তোর ওই কামানো টাকা নিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা কর, কলেজের মাইনে সাত টাকা আর হস্টেলের সীট-রেন্ট ছ’ টাকা যদি মাপ হয়ে যায়, তাহলে বি. এস. সি. পাশ করা পর্যন্ত আর ভাবনা থাকবে না। কিন্তু বাপী রাজি হল না। এক পিসীর কাছে ভিন্ন এযাবৎ আর কারো কাছে মুখ ফুটে কিছু চায় নি। এ-প্রস্তাব সরাসরি ভিক্ষে চাওয়ার মতো। কিন্তু নিশীথ নাছোড়বান্দা। হস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টকে ধরে ওর সীট-রেন্টের ছ’টা টাকা বাঁচিয়ে ছাড়ল।

বাপীর এতেও খারাপ লাগল খুব। তবে এবারে অনেকটা নিশ্চিন্ত বটে। আবু রব্বানী বানারজুলির বাড়িটা কি করবে কে জানে। বাপী ওটা ওকে বিক্রী করে দিতে বলেছিল। শুনে রাগ-রাগ মুখ করে আবু বলেছে, তুই কি একেবারে বিবাগী হতে যাচ্ছিস নাকি—ছোট-বড় দেড়খানা কাঠের ঘর বিক্রী করে কি ঐশ্বর্য পাবি শুনি? তার থেকে বাপ আর পিসীর স্মৃতি থাক না—

বলেছে ঠিকই। তবে দেড় ঘরের সামনে পিছনে আর পাশে জমি খানিকটা আছে। কিন্তু তারও কি-বা দাম তখন। পিসীর মুখে গল্প শুনেছিল, বাবা যখন ওখানে ঘর তুলেছে, সর্বসাকুল্যে খরচ পড়েছিল নব্বুই টাকা। জমির দাম ধরে। কাঠ জঙ্গল থেকে ওমনি পেয়েছিল বাবা। শুধু ঘরামি আর মিস্ত্রীর খরচ। তারাও আবার জঙ্গলের খাতিরের কন্ট্রাকটারের লোক।

আবুর মন বুঝে বাপী ওকে ভাড়াটে পাওয়া যায় কিনা দেখতে বলে এসেছে। মাসে পাঁচ-সাত টাকা যা মেলে। ও-সব জায়গায় তাও পাওয়া সহজ নয় জানে। যতদিন না ভাড়াটে জোটে আবুকে বাড়িটা দেখাশুনা করতে বলেছে; আর সম্ভব হলে রাতে ওখানে ওকে থাকতে বলেছে।

খুব একটা বড় ভাবনা বাপীর মাথার ওপর কিছু নেই এখন। তবু ভালো লাগে না। বাপীর কিছুই ভালো লাগে না। না নিজে পড়তে, না নিশীথের মামাতো ভাইবোনগুলোকে পড়াতে। বয়েস সবে সতের এখন। কলেজে ওর বয়সী বা ওর থেকে বড় ছেলেরা কত রকম হৈ-চৈ ফুৰ্তিতে দিন কাটায়। কিন্তু বাপীর ভিতরের বয়েসটা ওদের সক্কলকে ছাড়িয়ে ঢের এগিয়ে গেছে। ও-সব খেলাধুলো হৈ-চৈ ওর জন্য নয়। তার থেকে নিরিবিলি ভালো লাগে। ভাবতে

ভাল লাগে। ভাবনার মধ্যে অনেক বড় হতে ভাল লাগে। বয়সে নয়, ক্ষমতায়। এমন ক্ষমতা, যার কোনো শেষ নেই। তল-কূল নেই। কেরানীর ছেলে বলে যারা নাক সিঁটকেছে, যারা চোখ তাকিয়ে দেখে নি, তাদের চোখ ঠিকরে যায় এমন বড়।

ছুটির দিনে বা অন্য দিনেও ফাঁক পেলেই বিকেলের দিকে একলা দু’ আড়াই মাইল পথ হেঁটে করলা নদী বা তিস্তার ধারে এসে বসে থাকে। করলার থেকে তিস্তার দিকটা বেশি নিরিবিলি। সামনে সরু খালের মতো তিরতিরে জল। হাঁটুর ও আধখানা ডোবে না। তার ওধারে ধু-ধু বালুর চর। তার শেষে ডুয়ার্স-এর জঙ্গলের রেখা। সতৃষ্ণ চোখে বাপী সেই সবুজ রেখার দিকে চেয়ে থাকে। তখন বানারজুলি ওকে ভয়ানক টানে। খাল পেরিয়ে কতদিন সেই চড়ার ওপর দিয়ে ওই জঙ্গলের রেখা লক্ষ্য করে কতদূর হেঁটে চলে গেছে ঠিক নেই। কিন্তু ওই সবুজ রেখা ঠিক তেমনি দূরে

মাথার ওপর দিয়ে আজকাল ঘন ঘন এরোপ্লেন উড়ে চলে যায়। বাপী কাগজ পড়ে রোজ। পৃথিবীর যুদ্ধ এখন ঘরের কোণে। কিন্তু মাথার ওপর এরোপ্লেন দেখলে ওর যুদ্ধটুদ্ধ মনে থাকে না। মনটা ঢের ওপর দিয়ে উড়ে চলতে থাকে।

…বিষম চমকের দিনের সেই শীতের বিকেলেও বাপী তিস্তার পারে একলা বসে। যুদ্ধের বোমা কলকাতায় পড়েছে। রেডিও মারফৎ সর্বত্র সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া খবর এসে গেছে। অনেকে বলাবলি করছে জাপানীদের দলে ভিড়ে সুভাষ বোসের এই কীর্তি। তার আজাদ হিন্দ ফৌজ নাকি ভারতের কোন কোন জায়গা দখল করেছে। এবার বার্মা থেকে কলকাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা তারই সূচনা।

দিকে দিকে আতঙ্ক। এমন কি এই জলপাইগুড়িতেও। কিন্তু বাপীর ভিতরে আতঙ্কের বদলে অন্য রকম উত্তেজনা। আর মাথার ওপরের ওই এরোপ্লেনের মতো তার উদ্ভট কল্পনা পাখা মেলে দিয়েছে। সুভাষ বোস আর যা-ই করুক দেশের ক্ষতি কক্ষনো করতে পারে না। বোমা ফেললেও না। গত বছরের জানুয়ারিতে ওই লোকের ইংরেজের তাঁবেদার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হবার খবর ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাপীর বুকের তলায় যে আনন্দের বান ডেকেছিল, আজও মনে আছে। তখন ও বানারজুলি চা-বাগানের ক্লাবের বারান্দায় বসে রোজ সন্ধ্যায় খবরের কাগজ পড়ত। এ খবর পড়ে আবুর সঙ্গে পরামর্শ করেছিল, সুভাষ বোস যদি পালিয়ে এই বানারজুলির জঙ্গলেই এসে উপস্থিত হয়, তাহলে কেমন করে ও আর আবু তাকে এই জঙ্গলের মধ্যেই সকলের চোখের আড়ালে রাখবে। বাপীর তখনো ধারণা, পালানোর সব থেকে ভালো জায়গা একমাত্র জঙ্গল।

এই সুভাষ বোস নাকি ভারতের কোনো কোনো মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা তুলেছে—ফিসফিস করে এ কথাও কেউ কেউ বলে। বাড়িতে রেডিও আছে এমন বড়লোকের ছেলেও কলেজে আছে। তাছাড়া সৈন্য বিভাগের দুই একজন হোমরাচোমরার আত্মীয়ও দু’পাঁচ জন আছে। এরাই বলাবলি করে।

বাপীর বদ্ধ বিশ্বাস, কলকাতায় বোমা পড়েছে এবং আরো পড়তে পারে— সে শুধু শত্রু নিপাতের জন্য। যারা দেশের শত্রু তাদের ছাড়া আর কারো কোনো ক্ষতি হবে না বা হতে পারে না। কলকাতা কেমন, কলকাতা কি তাও বাপী জানে না। কিন্তু কলকাতা শুনলেই কতগুলো মুখ সামনে ভেসে ওঠে। কলকাতায় থাকুক না থাকুক, ওটা যেন তাদেরই খাস বাসের জায়গা। তা ছাড়াও বাপীর বিশ্বাস তারা কলকাতাতেই আছে। অতএব বোমায় যে শত্রুরা নিপাত হয়েছে বা হবে তাদের মধ্যে ওই চেনা মুখ কটা আছে। …সন্দীপ নন্দী তার মেমসাহেব মনোরমা নন্দী আর তাদের ছেলে সুদীপ নন্দী। বাপীর এই কল্পনায় ওরা দেশেরও শত্রু। কলকাতার এই বোমায় বা পরের বোমায় তারা সব শেষ হয়ে গেলে থাকল শুধু একজন। মিষ্টি।

কল্পনায় সেই অবস্থায় মিষ্টিকে মুখোমুখি দেখছে বাপী আর হেসেছে। মিষ্টি ও দেখছে ওকে। এখন এক বাপী ছাড়া ওর কোনোদিকের কেউ নেই। এবারে বাপীর কি দণ্ড দেবে ভেবে না পেয়ে ওর চোখেমুখে এত ভয়!

বাপীর তাই আরো বেশি হাসি পাচ্ছে। ও-যে কত উদার হয়ে একলার জগৎ থেকে মিষ্টিকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছে তা জানবেই বা কেমন করে, বিশ্বাসই বা করবে কি করে।

মাথার ওপর গোঁ-গোঁ শব্দে আবার একটা এরোপ্লেন উড়ে গেলে বাপীর চমক ভাঙল। সামনে তিস্তার খাল। তারপর ধূ-ধূ বালুচর। তার ওধারে ডুয়ার্সের বনের রেখা।

বাপী হাসছে আবারও। একটা বয়েস ওর অন্য ছেলেদের থেকে ঢের এগিয়ে গেছে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে আর একটা বয়েস কল্পনার জগতের মধ্যে আটকে আছে। নইলে কোথায় বোমা আর কোথায় মিষ্টি।

জলপাইগুড়ি এসে বানারহাটের একজন অসম বয়সী সঙ্গী পেয়েছে বাপী। এখন সঙ্গী, আগে ছিলেন সেখানকার স্কুলের ড্রইং মাস্টার। নাম ললিত ভড়। বছর চল্লিশ বয়েস। ম্যাট্রিক পাশ। আর্ট স্কুল বা কলেজের ডিপ্লোমা ডিগ্রি কিছু নেই। নিজগুণে আর্টিস্ট। তাই কোনো সরকারী স্কুলে চাকরি জোটেনি। বেশ বড়সড় মোটা মানুষ। পান-খাওয়া কালো ছোপ ধরা দাঁত। একমাথা চুল আর একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তিন মাসে একবার চুলে কাঁচি পড়ে, আর মাসে দুবার গালে ক্ষুর। আঁকার থেকেও ললিত ভড়ের শাস্ত্রজ্ঞান বেশি। চুল-দাড়ি কাটা না কাটা নিয়েও দু’পাঁচটা সংস্কৃত শ্লোক ঝেড়ে দিতে পারেন। বানারহাটের স্কুলের সব ক্লাসেই একটা বেত নিয়ে ঢুকতেন। কিন্তু সেই বেতের ঘা একমাত্র টেবিলের ওপর ছাড়া কখনো হয়তো কারো গায়ে পড়েনি। বেত হাতে ক্লাসে ঢোকেন কেন জিজ্ঞাসা করলে নিজেই বলতেন, ওটা পারসোনালিটি কমপ্লেক্স। বুঝলি কিছু?

বুঝুক না বুঝুক, ছেলেরা মাথা নাড়ত, বোঝেনি। ললিত ভড় তখন কালো ছোপ-ধরা দাঁত বার করে ধমকের সুরে বলতেন, সব তো বুঝে ফেলেছিস এখন এটা বাকি—বড় হ’, বুঝবি।

জলপাইগুড়িতে তাঁর পৈতৃক ভিটে। বাড়ি বলতে দু’খানা খুপরি কাঠের ঘর। এককালে .এই জলপাইগুড়ির কোথায় নাকি তাঁদের ঘর-বাড়ি আর অনেকটা জমিজমা ছিল। বন্যায় সব খেয়ে দিয়েছে। বানারহাটে থাকতেই ভদ্রলোক এখানকার কোনো বে-সরকারী স্কুলে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই চাকরি এতদিনে হয়েছে।

বানারহাটের স্কুলের ছেলেরা ললিত ভড়কে বলত পেটুক ভড়। না, কেউ তাঁকে পেটুকের মতো খেতে দেখেনি কোনদিন। তবু তাঁকে পেটুক বলার পিছনে একটা মজার ব্যাপার আছে। আঁকার হাত পরিষ্কার। বোর্ডে যা এঁকে দেন ছেলেদের তাই আঁকতে হয়। কিন্তু কোনদিন কেউ তাঁকে ফুল লতা পাতা গাছগাছড়া নদী পাহাড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিষয়ে কিছু আঁকতে দেখে নি। তাঁর আঁকার মধ্যে খাবার বিষয় থাকবেই। আম, আতা, কলা, পেঁপে, আঙুর, বেদানা, পেয়ারা, জাম-জামরুলের থোকা—লাউ, কুমড়ো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলুর ঝুড়ি, বড় বড় টোমাটো, ফলন্ত সিম গাছ, বেগুন গাছ—হাঁড়িভরতি রসোগোল্লা বা দই, ডিশভরতি সিঙ্গাড়া বা তালশাঁস সন্দেশ—দশ বিশ সের ওজনের রুইকাতলা, পোলাউ কালিয়া পঞ্চব্যঞ্জনের সামনে বসা তৃপ্তমুখ ভোজনবিলাসী— কথামালার সেই লোলুপ নেকড়ের সামনে নধর মেষশাবক, নাগালের বাইরে থোকা-থোকা আঙুর ডালের নিচে শেয়াল, কাকের মুখে মাংসের টুকরো দেখে ধূর্ত শেয়ালের চাটু কথা—এইসব তাঁর আঁকার বিষয়। সর্ব ব্যাপারে কিছু না কিছু খাওয়ার যোগ থাকবেই।

মাস দেড়েক আগে রাস্তায় একদিন হঠাৎ দেখা তাঁর সঙ্গে। বাপীকে দেখে আনন্দে আটখানা। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই কাঁধ জড়িয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। বানারজুলিতে গরিবদের কুঁড়েঘর তো কতই দেখেছে বাপী। নিজেদের অবস্থাও সেই রকমই ছিল। কিন্তু ঘুণধরা এই কাঠের খুপরি ঘর দুটোয় এসেই বাপীর মনে হয়েছিল, দারিদ্র্য এখানে একেবারে হাঁ করে আছে।

হাঁক দিয়ে স্ত্রীকে ডাকলেন। দুটো ছেলে ঘরে এলো। পরনে হাফপ্যান্ট, আদুড় গা। আট আর বারোর মধ্যে বয়েস। দরজার কাছে ময়লা শাড়ি জড়ানো বছর চোদ্দর একটা মেয়ে। এই ছেলে দুটো আর মেয়েটা বেশ লম্বা আর ফর্সাও— কিন্তু গায়ে কারো মাংস নেই। শুধু হাড়গুলো চামড়ায় মোড়া। এত রোগা ছেলেমেয়ে বাপী আর দেখেইনি বোধ হয়।

মাস্টারমশাইর বউ এলেন। উনিও হাড়-চামড়া-মোড়া লম্বা ফর্সা কাঠি একখানা। ললিত ভড় বললেন, আমার বানারহাট স্কুলের ছাত্র বিপুল, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে কলেজে পড়তে এসেছে—দেখ তো ওকে দেবার মতো ঘরে কিছু আছে কিনা।

মুখে হাসিও না রাগও না, একবার ওর দিকে তাকিয়ে ভড়-গিন্নী কলের পুতুলের মতো চলে গেলেন। বাপীর মুখের দিকে চেয়েই ললিত ভড় বললেন, থাক, তোকে আর লজ্জা পেতে হবে না, স্কুলে তোরা আমাকে পেটুক-ভড় বলতিস আমি জানি না নাকি! কিছু খেতে না দিলে মনে মনে ঠিক নিন্দে করবি—

লাল-কালো দাঁত শুধু না, খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁক দিয়েও খুশি ঠিকরে পড়ছিল। এর পরেই সোৎসাহে ওকে শোনাতে লাগলেন, হাতে কিছু টাকা এলেই পিছনের জমিটুকুতে কি-কি আনাজ লাগাবেন—ভালো মাটি, খাসা তরিতরকারি হবে।

চকিতে রেশমা আর দুলারির কথা মনে পড়ে গেছল বাপীর। অন্ধ হুটু মিয়ার ঘরের পিছনে তারাও তরকারির বাগান করেছিল। কিন্তু তাতে অভাব মেটেনি। তারা এখন সাপের খেলা দেখায়।

একটা মাঝারি সাইজের ডালায় নুন আর গোলমরিচ ছড়ানো তেলে ভাজা চিঁড়ে এনে সামনে রাখল সেই রোগা মেয়েটা। কিছু সেদ্ধ মটরশুঁটিও আছে ওতে।

—খা-খা—খাসা জিনিস। ললিত ভড় নিজেও ডালা থেকে একমুঠো তুলে নিলেন।

সত্যি মুখরোচক। রোগা ছেলে দুটো হাঁ করে দেখছে। বাপী কাছে ডাকতে ওরাও এসে খেতে বসে গেল। মেয়েটা আবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। বাপী বলল, তুমিও চারটে নাও না, আছে তো—

ললিত ভড় ডাকলেন, লজ্জা কি রে, আয় আয়। বাপীকে বললেন, আমার মেয়ে কুমকুম, ও-ই বড়, ক্লাস এইট-এ পড়ে—খুব ভালো মেয়ে।

কিন্তু ভালো মেয়ে এলো না। অন্য ঘরে চলে গেল। বাপী বিমনা একটু। …মিষ্টির থেকে বছরখানেকের বড় হতে পারে মেয়েটা। কিন্তু কৌতূহল হওয়া দূরে থাক, মেয়ে বলেই মনে হয় না।

চিঁড়ের ডালার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল, আবার বুকের ভিতরে কেমন করছিলও। কথা বলতে বলতে ললিত ভড় চিঁড়েভাজা তুলে নিচ্ছেন। ছেলে দুটো চটপট খাওয়া সারছে। ওই চিঁড়ের ডালায় বাপী আর একটিবার মাত্র হাত দিয়েছে। তার মধ্যে ডালা খালি।

ললিত ভড়ের শিল্প-কলায় সর্বদা ভালো ভালো খাবার জিনিস থাকে কেন বাপী তা এতদিনে বুঝতে পারছে।

মনের মতো শ্রোতা পেলে ড্রইং মাস্টার ললিত ভড় সব থেকে খুশি। ভালো খাবার পাওয়ার থেকেও কিনা তা অবশ্য বাপীর যাচাই করার সুযোগ হয় নি। এই তিস্তার পারেই মাঝে মাঝে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। লম্বা হাঁটার ঝোঁকে অনেক দিনই এদিকে চলে আসেন। ছেলেমেয়ে বউ যত হাড়-চামড়া-সার হোক, তাঁর দেহখানা লম্বার ওপর নাদুসনুদুস।

দেখা হলে এ-সময় যুদ্ধের কথা ছাড়া আর কি কথা হবে। তখন যুদ্ধ নিয়েই অনর্গল বলে যান ললিত ভড়। মেজাজ তিরিক্ষি হতেও সময় লাগে না। —ওসব যুদ্ধ-টুদ্ধ হল রাজরাজড়ার ব্যাপার, বুঝলি? ও আমাদের কিছু নয়। আমাদের শুধু পেটের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ লেগেই আছে। আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখে ইংরেজ এই যুদ্ধটাই বেশ করে শিখিয়েছে। ইচ্ছে করলেই ওরা বেশি দিতে পারে, কিন্তু দেবে কেন? ভরা পেটে আর গোলাম হতে চাইবে কেউ? ইস্কুল-কলেজের বড় বড় ছেলেগুলোকেও এটা বোঝাতে গেলে ওরা আবার বোকার মতো হাসে। ওদের কাছে আমি সদৃশপ্রাজ্ঞ, মানে যেমন চেহারা, তেমনি বুদ্ধি।

এই প্রসঙ্গে লাল-কালো দাঁত আর দাড়িবোঝাই মুখ খিঁচিয়ে একদিন বলেছিলেন, শ্লোক আছে, স্বদেশের ঠাকুর, বিদেশের কুকুর—মানে জানিস? স্বদেশে যার সম্মান, বিদেশে তার অনাদর। আমাদের ঠিক উল্টো। ইংরেজ বিদেশে এসে ঠাকুর আর আমরা স্বদেশে থেকে কুকুর। আমাদের মরণ ভাগাড়ে, অপরং বা কিং ভবিষ্যতি—যুদ্ধ লাগুক, থামুক, আমাদের আবার ভবিষ্যৎ কি?

পরের বছরেও ড্রইং মাস্টার পেটুক-ভড়ের মুখে হা-হা হাসি দেখেছে বাপী। কিন্তু তাঁর কথাবার্তা আর শ্লোকের ধার আরো ঝাঁঝালো। কলকাতার কাগজগুলোতে তখন সমস্ত চব্বিশ পরগণা আর বাংলার বহু জায়গা জুড়ে দুর্ভিক্ষের বার্তা। চালের বস্তা সব নাকি পাখা মেলে উবে যাচ্ছে। ডাল তেল নুন মশলাও উধাও। ভাত ছেড়ে ভাতের একটু ফ্যানের জন্য দিকে দিকে আর্তনাদের খবর। দুর্ভিক্ষ শব্দটাই শুধু শোনা ছিল, ব্যাপারখানা কি বাপীর জানা ছিল না। এখনো খুব স্পষ্ট নয়। কারণ উত্তর বাংলা মোটামুটি ধান-চালের দেশ। কিন্তু অন্য প্রান্তের দুর্ভিক্ষের বাতাসে এখানেও অনেক কিছুর দর চড়া। ত্রাসে যে যতটা পারছে ঘরে এনে মজুত করছে। পড়াতে গিয়ে নিশীথের মামা বাড়িতেই তো কত চালের বস্তার ঠিকি দেখেছে বাপী।

এই প্রসঙ্গে পেটুক-ভড়ের রুদ্রমূর্তি এক এক সময়।—রাশি রাশি লোক মরছে বুঝলি? খিদের জ্বালায় মানুষগুলো পিঁপড়ের মতো পটাপট মরে যাচ্ছে। ওরা হিসেব দিচ্ছে পনের লক্ষ, কিন্তু কম করে পঁয়ত্রিশ লক্ষ হবে, শুনে রাখ আমার কাছে। সরকারী ফিগার চ্যালেঞ্জ করে কাগজে ওই খবর বেরিয়েছে। দুর্ভিক্ষ অল্পকাল, স্মরণ থাকে চিরকাল—সেই চন্দ্রগুপ্তর আমল থেকে এ পর্যন্ত কত কোটি লোক দুর্ভিক্ষে মরেছে এই দেশে তাও আমি হিসেব করে বলে দিতে পারি। কিন্তু আগের কালে পথঘাট ছিল না, গাড়িঘোড়া ছিল না—যেখানে দুর্ভিক্ষ হত পটাপট লোক মরত। কিন্তু এখন হয় কেন? এখন মরে কেন? আগের কালে দুর্ভিক্ষ তাড়ানো ছিল রাজধর্ম—রাজরাজড়ারা সুফলার ধান আগেকার জন্য মজুত রাখত আর বিলোতো। এখন কে মজুত করেছে? কারা বিলোচ্ছে? আমি ছবির মধ্যেও খাবার যোগান দিই, কিন্তু এই রাজরাজড়ারা কি করে?

আর একদিন শুকনো মুখ দেখেই বাপীর মনে হচ্ছিল ভদ্রলোকের কিছু খাওয়া হয় নি। সকাল থেকেই খাওয়া হয় নি কিনা কে জানে। কথার ফাঁকে দু’বার উঠে তিস্তার ওই তিরতিরে জলেই কুলকুচি করে এসেছেন।

—শাস্ত্রমতে দুর্ভিক্ষ কেন হয় জানিস? ঈতির দোষে। ‘ঈতি’ কি জানিস? ঈতি হল অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি পঙ্গপাল মুষিক আর যুদ্ধ। এই দুর্ভিক্ষে ঈতির প্রথম চারটেই বাদ। কেবল যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে কি? মানুষের উপদ্রব আর মানুষের লোভ। বুঝলি? কিন্তু আমার কথা কে শোনে—আমার হল গিয়ে ‘দারিদ্র্যদোষো—গুণরাশিনাশী’–অভাবের আগুনে সব গুণ পুড়ে ছাই। স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলেদের সেদিন এই দুর্ভিক্ষটা কি আর কেন তাই বলছিলাম—পাশ দিয়ে যেতে পণ্ডিতমশায় এই টিপ্পনী কেটে গেল।

ফেনা-ওঠা শুকনো মুখ আবার তিস্তার জলে ধুতে গেলেন। বাপী পকেটে হাত দিল। একটা আধুলি আছে জানে। পারতপক্ষে খরচ করে না।

মুখ ধুয়ে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।—চলুন।

খেয়াল না করেই ললিত ভড় ওর সঙ্গে চললেন। মুখেরও কামাই নেই— আসল কথা হল টাকা, বুঝলি? টাকা থাকলেই জ্ঞান বুদ্ধি মান সম্মান প্রতিপত্তি সব থাকল তোর। আর টাকা না থাকলে নিজের জনেরাও চিবুনো ছিবড়ের মতো ছুড়ে ফেলে দেবে। তোর এখনো কেউ নেই বলেই বলছি এটা মনে রাখিস— নইলে ঠকতে হবে।

লোকালয়ে এসে বাপী একটা জিলিপি ভাজা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার মধ্যে ফুরফুরে টাটকা মুড়ি।—গরম জিলিপি আর মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে মাস্টারমশাই।

এবারে বাস্তবে ফিরলেন ললিত ভড়। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ওর সঙ্গে। জিলিপি-ভাজা বড় কড়ার দিকে চেয়ে চোখ দুটো একটু চকচক করে উঠল কিনা বাপী জানে না।

—আজ থাক, তোকে আর একদিন খাওয়াব’খন।

বাপী জোর দিয়ে বলল, আজ আমি। একদিন আমি আপনাকে খাওয়াতে পারি না। পকেট থেকে আধুলিটা বার করে দেখালো, এই দেখুন পয়সাও এনেছি—

দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ললিত ভড় পিছনে। আমতা আমতা করে বললেন, তোর যখন এত ইচ্ছে, একটা কাজ কর তাহলে…কিছু বেশিই নে, বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়া যাবে…ওরাও মুড়ি আর গরম জিলিপি খুব ভালবাসে। আর, আমার জন্যে এক পয়সার পান কেন, মুখটা কেমন হয়ে আছে।

চার আনায় মস্ত এক ঠোঙা মুড়ি, পনের পয়সার তিরিশটা গরম জিলিপি আর দু’হাত দূরের দোকান থেকে এক পয়সায় দুটো পান কেনা হল। একটা পান ললিত ভড় তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন।

কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসে কি যে আবার দরকারী কাজ পড়ে গেল তাঁর বাপী বুঝল না। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা তুই যা, আমি একটা কাজ সেরে এখনই আসছি—আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, তোরা শুরু করে দে—

বাপী কিছু বলার অবকাশ পেল না, তার আগেই হন হন করে উনি আর একদিকে চলে গেলেন।

ওঁর বাড়িতে পা দেবার পর ব্যাপারখানা বোঝা গেল। প্রথম দিনের পর বাপী এযাবৎ আরো চার-পাঁচ দিন এখানে এসেছে। ভড়-গিন্নী কাছে আসেন না, মেয়ে আর ছেলে দুটোর সঙ্গে কথাবার্তা হয়।

ওকে দেখে রোগা পাংশুমূর্তি কুমকুম এগিয়ে এলো। পিছনে ভাই দুটো। হাতে মুড়ির ঠোঙা আর জিলিপির ঝুড়ি দেখে ছেলে দুটোর চোখে মুখে চাপা উল্লাস। পারলে ছিনিয়ে নেয়।

কুমকুম জিজ্ঞাসা করল, এ-সব কেন?

আমতা আমতা করে বাপী বলল, মাস্টারমশাই পাঠালেন, কোথায় একটু কাজে গেলেন, এখুনি আসবেন—

হাত বাড়িয়ে কুমকুম জিলিপি আর মুড়ির ঠোঙা নিলে আর সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে বলে উঠল, সমস্ত দিন বাড়িসুদ্ধ সকলকে উপোস করিয়ে এখন জিলিপি পাঠালেন—

থতমতো খেয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাড়িসুদ্ধ সকলে উপোস কেন?

—মাসের শেষে মায়ের বাক্স থেকে বাবা দশ টাকা চুরি করে ধরা পড়েছে তা তোমাকে বলেনি বুঝি! মায়ের জেরার চোটে ধরা পড়েছে। দশ-দশটা টাকা কলকাতায় কোন্ দুর্ভিক্ষের ফান্ডে মণি-অর্ডার করে পাঠানো হয়েছে। রাগ করে মা আজ সমস্ত দিন নিজেও রাঁধেনি, আমাকেও রাঁধতে দেয়নি—দুপুর থেকে সব্বার উপোস চলছে।

বাপী পালিয়ে এসেছে।

আবার একটা অদম্য ইচ্ছা মাথায় নতুন করে চেপে বসেছে। অনেক অনেক বড় না হলেই নয়। অনেক—অনেক টাকা রোজগার না করলেই নয়।…অপমানের শোধ নেবার জন্য অনেক বড় হওয়া দরকার, আর অনেক টাকা দরকার। আবার ললিত ভড়ের মতো মানুষের জন্যেও দরকার।

পড়াশুনা ভালো লাগুক না লাগুক, পরীক্ষায় পাশ না করলে চলবে না, এটা ভালোই জানে। নিশীথের সঙ্গে একঘরে থাকে তাই বই-এর সমস্যা নেই। ফাইনাল পরীক্ষার চার-পাঁচ মাস মাত্র বাকি আর। নিশীথের ঘুম ভাঙার আগেই ও পড়াশুনো কিছুটা সেরে রাখে।

বিষম হাঁপাতে হাঁপাতে ললিত ভড়ের বারো বছরের বড় ছেলেটা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো। সমস্ত রাস্তা ছুটেই এসেছে বোধ হয়। দু’ চোখ কপালে।— বাপীদা শিগগীর দিদি তোমাকে যেতে বলল, একপাল পুলিশ এসে আমাদের ঘর তছনছ করছে, বাবাকে তারা ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।

বাপী হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত। তারপর বুকের মধ্যে কাঁপুনি। প্রথমেই ক’মাস আগে গিন্নীর বাক্স থেকে মাস্টারমশাইর দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠানোর ব্যাপারটা মনে পড়ল। এবারে কি বাড়ির বাইরে কোথাও কিছু করে বসল নাকি ভদ্রলোক!

কিন্তু এই বাচ্চা ছেলে কি আর বলতে পারবে; জামা গায়ে চড়িয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। নিশীথ তখনো ঘুমুচ্ছে।

…বাড়িতে অনেক পুলিশই বটে। পাড়ার মানুষেরা সব দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। ছেলেটার হাত ধরে বাপী পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। ললিত ভড়কে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। এবারে পুলিশ ভ্যানে তোলা হবে।

বাপীকে দেখে লাল-কালো দাঁত বের করে অদ্ভুত বোকার মতো হাসলেন ললিত ভড়। সমস্ত ব্যাপারখানা যেন তাঁর কাছেও দুর্বোধ্য। বিড়বিড় করে বললেন, কি ব্যাপার কিছু বুঝছি না, তুই এদের একটু দেখিস—

একজন পুলিশের ভদ্রলোক বাপীর দিকে এগিয়ে এলো হঠাৎ। গম্ভীর কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, হু আর ইউ?

—বিপুল তরফদার।

—ইনি কে হন? আঙুল তুলে ললিত ভড়কে দেখালেন।

-–আমাদের মাস্টারমশায় ছিলেন।

—কি করা হয়?

—আমি? কলেজে পড়ি…।

—কোথায় থাকা হয়?

—কলেজের হস্টেলে।

লোকটা ফিরে গেল। তার দু’মিনিটের মধ্যে ললিত ভড়কে ভ্যানে তুলে নিয়ে ওরা চলে গেল। আশপাশের সকলে ছুটে এলো। সকলের মুখে এক কথা, হাটে বাজারে লেকচার দিয়ে বেড়ানোর ফল। চেঁচামেচি করে ছেলেগুলোর কান বিষানোর খবর কি ওরা রাখে না—আগে ধরে নি সেটাই আশ্চর্য।

ললিত ভড়ের ঘরে এলো বাপী। দুটো ঘরই লণ্ডভণ্ড করে রেখে গেছে ওরা। কাগজপত্র ছড়ানো। বিছানা-টিছানাগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাক্স-প্যাঁটরা হাঁ-করা খোলা। রোগা মেয়ে কুমকুম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে। হাড় বার করা ছেলে দুটোর চোখে ভয় আর বিস্ময়। ভড়-গিন্নীরই শুধু তেমনি কলের পুতুলের মতো মুখ

পুলিশের এক অফিসারের ছেলে কলেজে পড়ে। নিশীথের সঙ্গে তার বেশি ভাব। নিশীথকে বলে সেই ছেলের মারফৎ খোঁজ নেবার পর জানা গেল, পুলিশের চোখে ‘বিপজ্জনক’ মানুষের লিস্ট-এ নাকি ললিত ভড়ের নাম উঠেছে। পোলিটিকাল প্রিজনারদের এখন আর শিগগীর ছাড়া পাবার কোনো আশা নেই।

পরের দশ-পনের দিনের মধ্যে বাপী অনেকবার ললিত ভড়ের বাড়ি এসেছে। কিন্তু ভড়-গিন্নীর কলের মুখখানা মনের পড়লে আসতে ইচ্ছে করে না। ললিত ভড়ের খবর নেবার চেষ্টাও তলায় তলায় করেছে। একদিন শুনল, তাঁকে জলপাইগুড়ি থেকে বাইরে কোথায় চালান করে দেওয়া হয়েছে।

সেদিনই তাঁর বাড়ি এসে দেখে বাইরে থেকে ঘর তালাবন্ধ। পাশের বাড়িতে খবর নিয়ে জানল, ছেলেমেয়ে নিয়ে ভড়-গিন্নী বাড়ি তালাবন্ধ করে দিনাজপুরে চলে গেছেন। সেখানে তাঁর ভাইয়ের বাড়ি।

এ-খবর জানার পর বাপী হালকা বোধ করেছে একটু। ছেলে দুটো, মেয়ে আর কলের মুখ ভড়-গিন্নীর ভাবনায় ওর গলার কাছে কি দলা পাকিয়ে থাকত।

সেই থেকে বাপীর উপচে-ওঠা গলগলে ঘৃণা আর বিদ্বেষের পাকে আর একটা নাম জড়িয়েছে।

সে-নাম পুলিশ।

আই. এস. সি. পাশ করল। তারপর আরো নিঃসঙ্গতার মধ্যে পরের দুটো বছরও কেটে গেল। আই. এস. সি. পাশ করে নিশীথ কলকাতায পড়তে চলে গেছল। মেডিকেল কলেজে জায়গা না পেয়ে সে কলকাতায় বি. এ. পড়া শেষ করেছে। মাঝেসাঝে চিঠি লেখে। বি. এ. পাশ করার খবর দিয়েছে। এদিকে বাপী বি. এস. সি পাশ করেছে।

নিশীথের মামা-বাড়িতে চার ছেলেমেয়ে পড়ানোয় ছেদ পড়েনি। মাইনে পঁয়তিরিশ টাকায় উঠেছে। এক মাস দেড় মাসের ছুটিছাটায় হস্টেল বন্ধ থাকলে নিশীথের এই মামা-বাড়িতেই এসে থাকতে হয়, খেতে হয়। তখন মাইনে আবার কুড়ি টাকায় নেমে আসে। ফোর্থ ইয়ারের শুরু থেকে বাপী স্কুলের উঁচু ক্লাসের তিনটে ছেলেকে একসঙ্গে পড়ানোর কাজ জোটাতে পেরেছিল। বিকেলে হস্টেলে এসে ঘড়ি ধরে দেড় ঘণ্টা পড়ে যেত। অঙ্ক, অ্যাডিশনাল অঙ্ক আর মেকানিকস—এই তিন বিষয়। এখনো পড়ে। দশ টাকা করে দেয়। তিনজনে তিরিশ টাকা। ফোর্থ ইয়ারে উঠে বাপীর ব্যাংকের বাকী শ’ আড়াই টাকা আর খরচ হয় নি। মুশকিল দাঁড়িয়েছে বি. এস. সি. পরীক্ষার পর। সেই তিন ছেলের একজনের বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে আসতে হয়—বাকি দু’জনও সেখানেই আসে। আবার বাপীকে নিশীথের এই মামা-বাড়িতে ঠাঁই নিতে হয়েছে। তবে মাইনে এবার কুড়ির বদলে পঁচিশে এসেছে। মোট রোজগার তিরিশ আর পঁচিশ পঞ্চান্ন। খরচ নেই বললেই হয়।

বি. এস. সি.’র ফল বেরিয়েছে জুনের শেষে। বাপী পোস্ট অফিসে এসেছিল। একটা খাম কিনে সেখানে দাঁড়িয়েই কলকাতায় নিশীথকে চিঠি লিখেছে। ওর বি. এ. পাশের রেজাল্ট কিছুদিন আগেই জেনেছিল। নিশীথ বাপের কাছে কবিরাজি শিখবে আর চাকরির চেষ্টাও করবে লিখেছিল। বাপী তাকে লিখল, সুযোগ-সুবিধে হলে ওর জন্যেও একটা চাকরির চেষ্টা যেন অবশ্য করে। চাকরির সুবিধে হতে পারে কলকাতায় নিশীথের বাবার সঙ্গে এমন অনেকের চেনা-জানা থাকা সম্ভব।

খাম পোস্ট করে ফেরার সময় অবিশ্বাস্য চমক। উল্টো দিক থেকে যে মানুষটি আসছেন তাঁকে দেখে বাপী হাঁ—

ড্রইং মাস্টার ললিত ভড়।

চুলদাড়ি বোঝাই সেই মুখ। তবে চুল আর দাড়ি দুই-ই এখন কাঁচা-পাকা সেই রকম কালো ছোপ-ধরা লাল দাঁত। আড়াই বছরে ভদ্রলোক শীর্ণ হয়েছেন একটু। বাপীকে দেখে খুশীতে উপচে উঠলেন।—কদিন ধরে তোর কথাই ভাবছি, কলেজ বন্ধ হস্টেল বন্ধ— কে খবর দেয়? আমি ভাবলাম কোথাও চলেই গেছিস।

খুশী বাপীও কম নয়।—আপনি কবে ছাড়া পেলেন? কবে এলেন?

—বারো-চৌদ্দ দিন হবে। এখান থেকে রাজসাহীতে চালান করে দিয়েছিল, সেখানেই ছিলাম।

—কেমন ছিলেন?

—খারাপ আর কি। গোড়ার কিছুদিন গুঁতোর চোটে চোখে অন্ধকার দেখতে হত, কিন্তু আমি কার নাম আর কি চক্রান্তের কথা বলি বল? ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না। তারপর অবশ্য ভালই ছিলাম, ওরা আমাকে নিয়ে মজা করত, ভালোভালো খাবারের ছবি এঁকে দিলে আমাকে একটু ভালো খেতে দিত। হা হা হাসি।

কিন্তু বাপীর দু’ চোখ জ্বলছে পুলিশ মারধর করেছে, অকারণে আড়াইটে বছর আটকে রেখেছে, সামান্য সম্বল চাকরিটাও গেছে। জিগ্যেস করল, আপনি ফিরেছেন আপনার ছেলেমেয়ে জানে? তারা তো সব দিনাজপুর চলে গেছল…

—হ্যাঁ, বউয়ের ভাই সেখানে কোর্টের মুহুরি। নিজের জায়গা-জমি আছে, গোরু আছে দুটো, পুকুরে মাছ আছে—ভালই আছে নিশ্চয়।

—আপনি ফিরে এসে সেখানে যান নি?

—যাব রে, সবে তো এলাম। হাসছেন—চাকরিটা আবার হল কিনা বোঝার জন্য স্কুলের হেড-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম। দেখেই আঁতকে উঠল ভদ্রলোক, চাকরির কথা বলব কি। আরো হাসছেন।—তার আর দোষ কি বল, ছাপোষা মানুষ, জেল-খাটা লোককে টানাবে কোন্ ভরসায়?

জেল-খাটা লোককে বাপী একটা মিষ্টির দোকানের দিকে টেনে নিয়ে গেল। খুশি-খুশি বিব্রত মুখে ললিত ভড় বললেন, আবার এখানে কেন রে?

বাপী বলল, আপনার খাওয়া পাওনা আছে মাস্টারমশাই—আমি বি. এস. সি. পাশ করেছি, ডিসটিংশনও পেয়েছি।

শুনেই সানন্দে খেতে বসে গেলেন ললিত ভড়। কাউকে খাইয়ে এত তৃপ্তি আর কি পেয়েছে বাপী? প্রচুর খাওয়ার পর খুশির ঢেকুর তুলে ললিত ভড় মন্তব্য করলেন, তুই বড় ভালো ছেলে, আর বড় নরম মন—তোর কি হবে না।

অর্থাৎ ভালো ছেলে আর নরম হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাপী হেসেই ফেলেছিল।

আবার ঠাঁই বদল। নিশীথের মামার বাড়ি ছেড়ে বাপী ললিত ভড়ের দু ঘরের একটাতে উঠে এসেছে। কেন তাঁকে বুঝতে দেয় নি। উল্টে বলেছে, ও-ই একটু মাথা গোঁজবার জায়গা পেল। ললিত ভড় কেন স্ত্রী বা ছেলেমেয়েকে দেখতে একবার দিনাজপুর যান নি, কেন জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার খবরটা পর্যন্ত তাদের দেন নি সেটা বাপীর থেকে ভালো আর কে আঁচ করতে পারে? বাপী এখানে চলে না এলে মানুষটার উপোস বরাদ্দ। হাতে অঢেল সময় এখন, আর একটা টিউশন যোগাড় করে নেওয়া বাপীর পক্ষে খুব অসুবিধে হবে না। যাদের পড়ায় তাদের বললেই হতে পারে। তাদের কাছে ওর অঙ্ক শেখানোর সুনাম খুব।

ললিত ভড়ের কাছে উঠে আসার ফলে বাপীর লাভও কিছু হয়েছে। এক তো মানুষটার সঙ্গ ভালো লাগে। ভদ্রলোক নিজে রান্নাবান্নায়ও পটু বেশ। দেড় মাস তাঁর কাছে থেকে বাপীর মোটামুটি রান্নাও শেখা হয়ে গেল। আর তাঁর কাছ থেকে কিছু যোগব্যায়ামও শেখা হয়েছে। বেশি খিদে হয় বলে নাকি ও-পাট ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু জানেন অনেক কিছু।

মাত্র দেড় মাস। ছেচল্লিশ সালে ষোলই আগস্ট থেকে তামাম ভারতে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠল। গোটা দেশ রক্তে ভেসে যেতে লাগল। সে এক বীভৎস সময় এখানেও। মানুষের বিশ্বাস গেছে, বুকের ভেতরটা দুভাগ হয়ে গেছে। দুদিন আগের গলাগলি ভাব গলা-কাটাকাটির দিকে গড়ালো। কেবল ভয় আর কেবল সন্দেহ সম্বল। বাপীর থেকে-থেকে তখন বানারজুলির আবু রব্বানীর কথা মনে হয়েছে। দুলারি আর রেশমার কথা মনে হয়েছে। বাপীকে কাছে পেলে তারা এখন কি করবে?

গোলযোগের প্রথম ঝাপটার পরেই ললিত ভড় বাপীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিনাজপুরে ছুটে গেছেন। তারপর একটা বছরের মধ্যে একটা চিঠি না, একটা খবর না। কেউ বেঁচে আছে কি নেই তাও বাপী জানে না।

এক বছর বাদে, সাতচল্লিশের পনেরই আগস্ট জলপাইগুড়ির মানুষ অন্তত হেসেছে আর হাঁপ ফেলে বেঁচেছে। একদিন আগেও বুক ধুকপুক সকলের। দেশ স্বাধীন হবে, দুশ’ বছরের দাসত্বের শেকল ভাঙবে—কিন্তু এ-জায়গার মানুষদের ভাগ্যে কি আছে?

পরদিনই বিপরীত উল্লাস। জলপাইগুড়ির বলতে গেলে সবটাই ভারতের এলাকায় পড়েছে। কিন্তু দিনাজপুরের অনেকটা পাকিস্তানের দিকে চলে গেছে। দিনাজপুরের মানুষ কি করছে বাপী জানে না। বিপুল উল্লাসের জয়ধ্বনি দিয়ে জলপাইগুড়ির মানুষ ট্রেজারিতে স্বাধীন ভারতের তিন-রঙা পতাকা তুলেছে।

কলকাতায় নিশীথের সঙ্গে বাপীর চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। পরের মাসেই নিশীথের টেলিগ্রাম। চাকরির একটা ব্যবস্থা হয়েছে। পত্রপাঠ চলে এসো।

টেলিগ্রাম হাতে বাপী বিহ্বল খানিকক্ষণ।

…কলকাতা!

…চাকরি করতে বাপী সত্যি কলকাতা যাবে?

…এই বাইশ বছরের জীবনের বুকের তলার সব থেকে বড় সাধ সফল হবে এবার?

…দশ বছর আগে বানারজুলির বড়সাহেবের আট বছরের এক মেয়ে প্রথম দিনের আলাপে ওকে বলেছিল,, কলকাতা দেখনি আবার ফটফট করছ—তুমি জংলি ভূত একটা। সেই কলকাতা!

.

কলকাতা।

হাওয়ায় ভেসে কলকাতা এসেছে বাপী। ওকে নেবার জন্য নিশীথ স্টেশনে হাজির ছিল। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। বাপী ওকে চিঠিতে লিখেছিল দুদিন ওর বাড়ীতে থেকে জ্যাঠাতুতো দাদার অর্থাৎ মণিদার বাড়িটা খুঁজে নেবে। আপাতত সেখান থেকেই চাকরি করবে।

মণিদার বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে তাকেও চিঠি লিখত। জানে না। ঠিকানা বানারজুলির বাড়িতে কোথাও পড়ে থাকতেও পারে। বাপীর স্মরণশক্তি প্রখর। মণিদা কাস্টমস-এ চাকরি করে এটুকু আজও মনে আছে। কারণ বাবা এক রাতে ঠাট্টা করে তাকে বলেছিল, কাস্টমসের চাকরির তো মাইনে থেকে উপরি বেশি শুনেছি।

বাবার কথায় মণিদা খুব হেসেছিল।

কিন্তু মণিদার আপিসের ঠিকানাই বা পাবে কোথায় যে একটা চিঠি লিখে জানাবে, ও আসছে।

শনিবার সকালে এসে পৌঁছেছিল। নিশীথ সেদিন ছুটি নিয়েছে। ও প্রায় বছরখানেক আগেই চাকরিতে ঢুকে গেছে। ওর আপিস ডালহৌসিতে। কেরানী হলেও আপার ডিভিশন।

শনি-রবি দুটো দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে নিশীথ কলকাতা দেখালো ওকে। চিড়িয়াখানা মিউজিয়াম বোটানিক্যাল গার্ডেনও বাকি থাকল না। ঠাট্টা করে বলল, সব দেখে রাখ, এই প্রথম কলকাতায় এসেছিস বুঝতে পারলে লোকে বাঙাল বলবে।

দেখে শুনে গোড়ায় বাপী হাঁ হয়ে গেছল সত্যি কথা। বই-এ পড়েছিল, আজব শহর কলকাতা। এমন তাজ্জব রকমের আজব কে জানত! ট্রাম বাস লরি ট্যাক্সি মোটর ঠেলা রিকশার মিছিল দেখে দুদিনেই মাথা ঝিম-ঝিম করেছে। গোটা কলকাতা শহরটা যেন সদা ব্যস্ত, ছুটছে আর ছুটছে। আসার সময় ট্রেনে বাসে ঘুরে ফিরে মিষ্টির কথাই বেশি মনে এসেছিল। কোথায় আছে ওরা এখন জানে না। কিন্তু বাপীর বদ্ধ ধারণা, কলকাতায় আছে। মিষ্টি কথায় কথায় একদিন বলেছিল, একটু উঁচু ক্লাসে উঠলেই ও কলকাতায় দাদুর কাছে থেকে পড়াশুনা করবে। ওর মা-তে বাবা-তে সেই রকমই নাকি কথা হয়ে আছে।

ট্রেনে আরো কিছু মনে পড়াতে বাপীর হাসি পেয়ে গেছল। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দু-দুবার সেই বিশাল ছাপা সরকারী গেজেট এনে পড়া। কেন সে শুধু ও-ই জানে।

সেই থেকে বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল, আর কেউ থাকুক না থাকুক, মিষ্টি অন্তত কলকাতাতেই আছে। একদিন না একদিন দেখা হয়ে যাবেই। একটা ক্রুর অভিলাষ ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে চেয়েছে। কলকাতায় চাকরি হওয়াটা সেই অনেক অনেক বড় হওয়া আর শোধ নেওয়ার প্রথম ধাপ। কিন্তু এই কলকাতা দেখে বাপী হকচকিয়ে গেছে। ওদের হদিস মেলা দূরে থাক, এই ব্যস্তসমস্ত শহর থেকে মণিদাকে খুঁজে বার করবে কি করে ভেবে পেল না।

মণিদাকে না পেলেও অবশ্য ঘাবড়াবার খুব কিছু নেই। হাতে চারশ টাকার মতো মজুত আছে। চাকরির মাইনেয় কোনো মেসে থাকার খরচা চলেই যাবে। তবু নতুন জায়গায় একটু অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মণিদাকে পেলে ভালো হয়।

যে জন্যে কলকাতায় আসা সেটা আর যাই হোক, লোয়ার ডিভিশন কেরানীর চাকরি নয়। এ রকম চাকরি বাপী চার বছর আগে ঘরে বসেই করতে পারত। করবে না বলেই ঘর ছেড়েছিল, বাবাকে ছেড়েছিল। চার বছর বাদে বি. এসসি. পাশ করার পর সেই লোয়ার ডিভিশন চাকরি মনে ধরার কথা নয়। আকর্ষণ একটাই। কলকাতা। বড় হতে চাও তো বড় গণ্ডিতে এসে বোসো। কলকাতা সেই বড় গণ্ডি। ভাগ্যের জোর থাকলে এখান থেকেই ফকির উজির হয়, ছেঁড়া কাঁথার মানুষ হাত বাড়িয়ে স্বপ্নে লাখ টাকা মুঠোয় ধরে। বাপী তাই কলকাতার এই বড় গণ্ডিতে এসে একটু বসার জায়গা পেয়েই খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল। আপার ডিভিশন লোয়ার ডিভিশন নিয়ে মাথা ঘামায় নি। নইলে ওর থেকে অনেক খারাপ ছাত্র নিশীথ সেন আপার ডিভিশন। যত ছোটই হোক, বাপীর কাছে কলকাতায় এসে স্থিতি হতে পারাটাই ভাগ্যের পাশার একটা বড় দান।

কিন্তু বাস্তবের মুখোমুখি হতে না হতে ভিতরে ধাক্কা খেল। কবিরাজ বাবার একজন অন্তরঙ্গ ভক্তকে নিশীথ রামকাকা বলে ডাকে। নাম রামচরণ গাঙ্গুলী। ব্রুকলিনের কোনো বিভাগের তিনি মেজবাবু। বড়বাবু মন্মথ সোমের সঙ্গে তাঁর বেজায় খাতির। রেসের মাঠে হরিহর আত্মা দুজনে। এই খাতিরের সুতো ধরে বাপীর চাকরি। বড়বাবু মন্মথ সোমকে অজীর্ণ রোগে ধরেছিল। রামকাকার অনুরোধে নিশীথের বাবা দু’মাস বিনে পয়সায় চিকিৎসা করে তাঁকে সারিয়ে তুলেছেন। সেই মওকায় নিশীথ রামকাকাকে বন্ধুর চাকরির জন্যে ধরে পড়েছিল।

কিন্তু প্রথম দিন খিদিরপুর ব্রুকলিন ডিপোয় হাজিরা দিয়ে বাপী ভিতরে ভিতরে হতাশ। যদিও সেই দিনই কাজে জয়েন করার ব্যাপারে কোনরকম অসুবিধে হয় নি। রামকাকা বাপীকে বড়বাবু মন্মথ সোমের কাছে নিয়ে এসেছেন। বিশাল হলের এক কোণে তিন দিক ঘেরা একটু ছোট জায়গায় তিনি বসেন। সামনে তাকালে সমস্ত দপ্তরটি তাঁর চোখের সামনে।

বাপীর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। যুদ্ধোত্তর হওয়ায় কলকাতার কেরানীবাবুরাও বেশির ভাগ তখন ধুতি ছেড়ে ট্রাউজার আর শার্ট ধরেছে। ধুতি পাঞ্জাবি পরে প্রথম দিন আপিসে উপস্থিত হওয়াটা নিশীথের পছন্দ ছিল না। কিন্তু উপায় কি। বিকৃত মুখ করে বলেছিল, একটু কম ঢ্যাঙা হলেও তো আমারটা দিয়ে দিন-কতক চালিয়ে দিতে পারতিস।

বড়বাবুকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে দিয়েছিলেন রাম গাঙ্গুলি। কিন্তু তার সুযোগ কম দেখে বাপী স্বস্তি বোধ করল। চার দিকের চেয়ার ঠেলে টেবিলের তলায় পায়ের নাগাল পাওয়া সহজ নয়। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালো।

বাপী জানে আগে থাকতে বলা কওয়া আছে। তবু রাম গাঙ্গুলি পরিচয় দিতে মুখ তুলে চুপচাপ খানিক দেখলেন ওকে। ছোটখাটো রোগা মানুষ, ফ্যাকাশে মুখ গম্ভীর। যাচাই করে দেখার মতো হিসেবী চাউনি। বসতে বললেন না।

—এ বছর বি. এসসি. পাশ করেছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। দ্বিতীয় প্রশ্নের আগে বাপী এবারে বুদ্ধিমানের মতো বলল, আমার নাম বিপুল, আপনি তুমি করে বলুন।

—ডিসটিংশনে পাশ করেছ?

—হ্যাঁ স্যার।

—অনার্স পড়লে না কেন?

বাপী এর কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। চুপ করে রইল।

—কোন্ কলেজ থেকে পাশ করেছে?

বলল।

—বাড়ি কোথায়?

বলল।

—দেশ?

এবারে একটু মাথা খাটাল বাপী। দেশ ভাগ হয়েছে যখন কাজে লাগতেও পারে। বলল, দেশ কখনো দেখিনি স্যার, শুনেছি পূর্ববঙ্গে।

বাপী কেন, বাপীর বাবাও দেশ দেখেনি। বড়বাবুর দু চোখ আবার ওর মুখের ওপর আটকে রইল খানিক। তারপর যে মন্তব্যটা করলেন সেটাই অপ্রত্যাশিত এবং হতাশার কারণ—একেবারে ভাঙা হাটে এসেছ, চাকরি আজ আছে কাল নেই, কি লাভ।

নিশীথ অবশ্য কলকাতায় আসার পর পর বলেছিল, টেম্পোরারি চাকরি। বাপী জানে গোড়ায় সব চাকরিই টেম্পোরারি। তাছাড়া কেরানীর পাকা চাকরি করছেই বা কে। কিন্তু ভাঙা হাটের চাকরি, আর, আজ আছে কাল নেই শুনে ঘাবড়ালো একটু।

বড়বাবু চেয়ার ঠেলে উঠলেন। ওকে আসতে ইশারা করে সামনে এগোলেন। হল পেরিয়ে বারান্দার ওদিকে আর একটা ঘর। দরজার বাইরে চাপরাসী টুলে বসে। বড়বাবুকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।

বাপীকে অপেক্ষা করতে বলে বড়বাবু সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন।

এবং দু মিনিটের মধ্যে ওরও ডাক পড়ল।

মস্ত টেবিলের ওধারে যিনি বসে তিনি বড়বাবুরও ওপরওয়ালা বোঝা গেল। বাঙালী। বড়বাবু অবশ্য তাঁর সামনের চেয়ারে বসে। সাহেব তাঁর সমবয়সী হবেন।

বাপী এবারেও দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার সারল। বাঙালী সাহেব মাথা নাড়ালেন কি নাড়লেন না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার শুধু দেখলেন ওকে। তারপর বড়বাবুকে বললেন, ঠিক আছে।

বড়বাবুর ঠোটের ফাঁকে এবারে সামান্য হাসির রেখা লক্ষ্য করল বাপী।

ওকে সঙ্গে করে নিজের জায়গায় ফিরলেন আবার। নিজে বসে এবারে ওকে ও বসতে বললেন। সেই ফাঁকে আবার একটু দেখেও নিলেন।

—বয়েস কত?

—বাইশ।

বয়েস পছন্দ হল না কি আর কিছু, বাপী সঠিক বুঝে উঠল না। বয়েসই হবে বোধ হয়। কারণ, আর একবার মুখ থেকে বুক পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বললেন, ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটের বয়েস যাই থাক, ঠিক ঠিক বয়েস কত? বলতে বলতে একটা ছাপা ফর্ম বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে, বয়েসের জন্য তোমার চাকরি আটকাবে না—আমার তো তেইশ-চব্বিশ মনে হচ্ছে।

চাকরি পাওয়ার আগ্রহটাই বাপীর সব আপাতত। প্রতিবাদ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবল। জবাব দিল, হতে পারে স্যার…সার্টিফিকেটে কমানো আছে কিনা বাবা জানতেন।

হতে পারে শুনে অখুশি নন। ভদ্রলোকের ঠোটের হাসিটুকু চেষ্টা করে হাসার মতো। তেমনি একটু হেসে মন্তব্য করলেন, নানা আশায় ছেলের দুই-এক বছর বয়েস সব বাবাই কমিয়ে লেখান। ওই ফর্মটা ফিল-আপ করো, সার্টিফিকেটের বয়সই লিখবে।

অর্থাৎ উনি ধরেই নিলেন বাপীর বয়েস তেইশ-চব্বিশের কম নয়।

পৃথক দরখাস্ত করারও দরকার হল না। ফর্ম ফিল-আপ করা হতে ওতেই তিনি খসখস করে লিখলেন কি, নিজের নাম সই করলেন, তারপর সেটা নিয়ে আবার চলে গেলেন।

মিনিট পাঁচ-সাত বাদে খালি হাতে ফিরলেন। চেয়ারে বসে আবার একটু চেয়ে রইলেন। ভদ্রলোকের এই দেখাটাই কেন যেন অস্বস্তিকর বাপীর কাছে।

—রামবাবুর মুখে তোমার কথা সব শুনেছি, বাবা-মা তো নেই, ভাই-বোন বা অন্য কোনো আত্মীয়-পরিজনও নেই?

রামবাবুর মুখে শোনা মানে নিশীথের মুখে শোনা। সে কি বলেছে না বলেছে কে জানে। তাই জ্যাঠতুতো দাদার কথাও বলা গেল না। জবাব দিল, না স্যার…

খুব সদয় মুখ করে বললেন, ভেরি আনফরচুনেট। যাক, কাজটা কিছুই নয়, তার ওপর পিওরলি টেম্পোরারি, স্টিল ক্যারি অন।

সেইদিনই কাজে বহাল হয়ে গেল। তিন-চার দিনের মধ্যেই চাকরির ব্যাপারটা বুঝে নিল। ব্রুকলিন ডিপো যুদ্ধের বহু রকমের মাল স্টকের অফিস। এই আপিস এখন অনেকটাই গুটনো হয়ে গেছে। তবু সময় সময় কাজ জমে গেলে ছাঁটাই কর্মচারীদেরই কিছু কিছু আবার অস্থায়ীভাবে ডেকে নেওয়া হয়। বাপী ছাঁটাই মার্কা না হলেও বড়বাবুর কল্যাণে ঢুকে গেছে।

নিশীথের ওপর গোড়ায় একটু অভিমানই হয়েছিল বাপীর। এরকম চাকরির জন্য এভাবে ছুটে আসত কিনা সন্দেহ। মাইনে ষাট টাকা ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স আঠারো—সর্বসাকুল্যে মাস গেলে আটাত্তর টাকা।

মেজাজ খারাপ করে নিশীথকে বলেই ফেলেছিল কথাটা। নিশীথ কানে তোলেনি, বলেছে, ওই বড়বাবুটির ক্ষমতা কত জানিস না, লেগে থাক আর ভদ্রলোকের মন রেখে চল—

ঊনিশ-বিশ একই কথা রাম গাঙ্গুলি বলেছেন।—বড়বাবু কাউকে রাখবেন বলে ধরে থাকলে তাকে হটানো সহজ নয়, বুঝলে? বাজে ভাবনা না ভেবে তাঁর মন রেখে চলো।

মন রেখে কি করে চলতে হয় বাপীর সেটাই ভালো জানা নেই। চাকরির মাসখানেকের মধ্যে কপাল দেখা রতন বনিক ওর বশংবদ হয়ে ওঠার পর সেও বলেছে, আপনি হলেন গিয়ে বড়বাবুর লোক, আপনার ‘রিট্রেঞ্চ’-এর ভাবনা কি! বড়বাবুর ইয়েস তো বড়সাহেবের ‘ইয়েস’, এনার ‘নো’ তো ওনারও ‘নো’।

বড়বাবুর লোক ভেবেই রতন বনিক ওরও অনুগত হয়ে উঠছে কিনা, বাপীর সেই সংশয়। বড়বাবুর মন পাওয়ার আশায় বাপী শুরু থেকেই যতটা সম্ভব মন দিয়ে কাজ করছে। ছুটির পরেও এক ঘণ্টা তিনি আপিসে থাকেন বেশির ভাগ চাকুরেরা ছুটির সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু বাপী তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে। বাপীর ধারণা মুখে কিছু না বললেও ভদ্রলোক ভিতরে ভিতরে খুশিই হন একটু।

.

মণিদার বাড়ির হদিস মিলেছে চাকরিতে ঢোকার চার দিন বাদে।

আফিস পালিয়ে নিশীথ তার স্ট্র্যান্ড রোডের হেড অফিসে ঠিকানার খোঁজে গেছল। বরাতক্রমে যে ঘরে ঢুকে নিশীথ মণিলাল তরফদারের খোঁজ করছিল, ভদ্রলোক সে ঘরেই দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা কইছিল। নিজের নাম কানে যেতে এগিয়ে এসেছে। মণিদা নিজেই বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে আর বাপীকে চলে আসার কথা বলেছে। পার্ক সার্কাসের দিকে ঠিকানা। নিশীথ তাকে বলে এসেছে বাপী রোববার যাবে। খবরটা দিয়ে নিশীথ মন্তব্য করেছে, তোর মণিদাকে দেখে সেরকম বড় চাকরে-টাকরে মনে হল না রে। বলেছিলি কাস্টমস-এ ভালো চাকরি করে…পরনে দেখলাম ঢলঢলে ট্রাউজার আর গায়ে টুইলের শার্ট—তাও সে রকম পাটভাঙা পরিষ্কার নয়।

বাপীর ধারণা ছিল মণিদা ভালো চাকরিই করে। তাই বলেছিল। একথা শোনার পর সেখানে থেকে চাকরি করার কতটা সুবিধে হবে সেই ভাবনা। মণিদার বাড়ির হদিস মিলতে এ ছাড়াও একটু অস্বস্তি। আট বছর আগে বানারজুলির একটা সকাল আর দুপুর ভিতরের কোনো গোপন সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের ছেলেবেলাটাকে এক এক সময় একেবারে শেকড়সুদ্ধু টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে বাপীর।

রবিবার সকালে নিশীথ ওকে বাড়ির সেকেলে গাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে গেল। নিজে ঢুকল না কারণ বাবা তাড়া দিয়ে রেখেছে। রবিবার সকালে বাবার কাছে হাতে-কলমে কাজ শিখতে হয়, কবিরাজি ওষুধপত্র বানাতে হয়। কিন্তু বাইরে থেকে মণিদার ফ্ল্যাট দেখেই ও হয়তো অপ্রস্তুত একটু। বেশ ভালো চাকরি না করলে এ জায়গায় এরকম ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব নয়।

রাস্তার ওপর শেষ বাড়িটা মণিদার। সামনে ছোট একটু পার্কের মতো। খোলামেলা জায়গা। নিচের দরজার সামনে দো-ভাঁজ লুঙ্গি করে কাপড় পরা একটি লোক দাঁড়িয়ে। নিশীথ তাকে জিজ্ঞেস করতে সে দোতলাটা দেখিয়ে দিল।

ওকে ছেড়ে নিশীথ নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল।

একতলায় মাদ্রাজী পরিবারের বাস মনে হল। বাপী পায়ে পায়ে দোতলায় উঠে এলো। হাতে রংচটা টিনের সুটকেস আর ময়লা শতরঞ্জী মোড়া দড়িবাঁধা শীর্ণ শয্যা। সিঁড়ির মুখের দরজা পেরিয়ে ভিতরে পা দিতেই হাতের জিনিস দুটো বেমানান লাগল। এও বেশ বড়সড় একখানা ঘরের মতোই। বিস্কুট রঙের তকতকে মেঝে, মাঝামাঝি ডাইনিং টেবিলের চারদিকে চেয়ার। বাপী কখনো টেবিল-চেয়ারে ভাত খায়নি, তবু সস্তার জিনিস যে নয় ওগুলো আঁচ করতে পারে। টেবিলে শৌখিন পেয়ালা আর ছোট বড় ডিশ পড়ে আছে। একটু আগেই বাড়ির লোকেরা প্রাতরাশ সেরে উঠে গেছে বোঝা যায় ওদিকের দেয়াল আলমারির কাঁচের পাল্লা দিয়ে ঝকঝকে ক্রকারি সেট দেখা যাচ্ছে।

সামনে পর পর তিনটে ঘর। পুরু পর্দা ঝুলছে। শেষের ঘর থেকে রেডিওর গান কানে আসছে।

হাতের টিনের সুটকেস আর বিছানার পুঁটলি চট করে চোখে পড়বে না এমন এক কোণে রাখল বাপী। তারপর প্রথম ঘরের পর্দাটা সরিয়ে দেখল।

এটা বসার ঘর। গদির সোফা সেট ডিভান সাজানো। বাপীর হকচকিয়ে যাওয়ার দাখিল। পর্দা সরানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি যার সঙ্গে সে বছর ছ-সাতেকের একটি ছেলে। আধশোয়া হয়ে একটা পাতলা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল, তার একখানা পা হাতলের ওপর। পাশের সোফায় মণিদার চোখের সামনে খবরের কাগজ। মুখে আধখানা চুরুট. পরনে চকচকে লুঙ্গি, গায়ে জালি গেঞ্জি।

—বাবা!

দরজায় অপরিচিত লোক দেখে ছেলেটা মণিদাকে ডাকল।

মণিদার মুখের কাজ থেকে কাগজ সরল। চুরুটটা হাতে নিয়ে এক গাল হাসি। কাগজ ফেলে সোফা ছেড়ে উঠল—কত বড় হয়ে গেছিস রে বাপী! আয় আয়—বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি তো?

বাপী হাসিমুখে মাথা নাড়ল। অসুবিধে হয়নি। তারপর এগিয়ে এসে মণিদাকে একটা প্রণাম ঠুকল।

তিনটে ঘরেরই মাঝখানে একটা করে ভিতরের দরজা। বাইরের বারান্দার দিকেও একটা করে দরজা। ভিতরের দরজার পর্দাগুলো তোলা এখন।

মণিদা হাঁক দিলেন, কই গো কে এসেছে, দেখে যাও—

হাঁক শোনার আগেই ওই শেষের ঘর থেকে গৌরী বউদি ওকে দেখে এগিয়ে আসছিল। ও-ঘর থেকেই রেডিওর গান শোনা যাচ্ছিল। সেটা এখনো চলছে। কে এলো বা কে আসবে জানাই ছিল নিশ্চয়। কিন্তু এগিয়ে আসতে আসতে গৌরী বউদি যেন খুব পরিচিত মানুষ দেখছে না। এ ঘরে পা ফেলার আগেই বাপী যেটুকু দেখার দেখে নিয়েছে। সামান্য মোটার দিক ঘেঁষেছে গৌরী বউদি, নইলে আট বছর আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। তখন কুড়ি ছিল বয়েস, এখন আঠাশ হবে! এই আট বছরে মণিদা ফুলে আরো গোলগাল হয়েছে। ফলে তাকে আরো বেঁটে দেখায়। কিন্তু সামান্য মোটা হবার ফলে গৌরী বউদিকে আগের থেকে একটু লম্বা মনে হয়।

মণিদা জিজ্ঞসা করলেন, ওকে চিনতে পারো?

গৌরী বউদির সেই হাসিমাখা চকচকে চোখ দুটো পরিষ্কার মনে আছে বাপীর। তখন মনে হত, ওই দুটো চোখ দিয়েই গৌরী বউদি অনেক কথা বলতে পারে। এখন কতটা পারে জানে না, এখন সামান্য একটু হাসি শুধু ছুঁয়ে আছে। বাপীর দিকে তাকিয়েই বলল, জানা ছিল বলে পারছি, না থাকলে পারতুম না। খাসা মানিক-মানিক চেহারাখানা হয়েছে তো এখন।

বাপী তাকেও একটা প্রণাম সারতে গেল। তার আগেই গৌরী বউদি দু’পা সরে গিয়ে বলল, প্রণাম-টনাম দরকার নেই, বোস—জোয়ান-মর্দ ছেলে পায়ে হাত দিতে এলে বিচ্ছিরি লাগে।

বাচ্চা ছেলেটা বই হাতে সেইভাবেই শোফায় আধ-শোয়া হয়ে নতুন লোকটাকে দেখছিল আর মা-বাবার কথা শুনছিল। তার দিকে চোখ যেতেই গৌরী বউদির সামান্য মেজাজ চড়ল।—এই ছেলে! নবাবের মতো শুয়ে কি পড়া হচ্ছে তোর?

ছেলে সোজা হয়ে বসল।—কি করব বাবা তো শুধু কাগজই পড়ছিল, স্কুলের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিল না—

এমন সামান্য কারণেও গৌরী বউদির চকচকে চোখে বিতৃষ্ণাই দেখল যেন বাপী। কথাগুলোও রূঢ় একটু।—সমস্ত দিন তো বাইরেই কাটাও, সকালের একটা ঘণ্টাও যদি না দেখতে পারো তো কাল থেকেই ওর জন্যে একজন মাস্টার ঠিক করো। কৈফিয়ত দাখিলের সুরে মণিদা বলল, আজ রোববার, দেব’খন দেখিয়ে—

—তোমার কাছে ওর বারো মাসই রোববার। ছেলের দিকে ফিরল, ওঘরে গিয়ে নিজে যা পারিস পড়গে যা, আমি আসছি—রেডিওটা বন্ধ করে নিস।

বাপী লক্ষ্য করছে মায়ের মতোই মুখ ছেলের। মণিদার আদলের ছিটেফোঁটাও নেই। মনঃপূত হোক না হোক মায়ের হুকুমে উঠে চলে গেল। এদিকের পর্দা ঠেলে দরজার কাছ থেকেই গলা একটু চড়িয়ে গৌরী বউদি বলল, ভিখু, চায়ের জল চড়াও, আর মিটসেফ-এ খাবার কি আছে দেখো—

….বানারজুলিতে নতুন বউ গৌরী বউদির সঙ্গে এই গৌরী বউদির কিছু একটা বড় তফাৎ এর মধ্যে চোখে পড়ছে বাপীর। বানারজুলি থেকে ফেরার আগে বাপীকে গাল টিপে আদর করে এসেছিল মনে আছে। এই গৌরী বউদির আর কিছু না হোক, মেজাজ বেশ বদলেছে বোঝা যায়।

সোফায় বসে মণিদা নেভানো চুরুটটা আবার ধরিয়েছে। দরজা ছেড়ে এদিকে আসতে একটু সহজ হবার তাগিদে বাপী বলল, সকালের চা জলখাবার খেয়েই বেরিয়েছিলাম—

ওর মুখোমুখি সোফাটায় বসল গৌরী বউদি।—কেন, এখানে জুটবে কি জুটবে না ভেবে?

বাপী তাড়াতাড়ি বলল, তা কেন, যতবার দেবে ততোবার খেতে পারি। চট করে অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে গেল, ছেলেটাকে এমন তাড়া দিয়ে পড়তে পাঠালে যে আমি কে জানলও না—কি পড়ে, রোববারেও ওর কি এত পড়া?

চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে মণিদা বলল, ক্লাস ওয়ান। ভাগ্যে বাপী হেসে ফেলেনি। কারণ সঙ্গে সঙ্গে রুষ্ট চোখের একটা ঝাপটা খেল মণিদা। সঙ্গে ঝাঁঝালো কথারও। ক্লাস ওয়ান হোক আর যাই হোক, সঙ্গে নিয়ে না বসলে ওইটুকু ছেলে নিজে থেকে দিগগজ হয়ে যাবে? উইকলির রেজাল্টগুলো চোখ তাকিয়ে দেখেছ একবারও? লজ্জা করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে?

মণিদার মুখখানা একটু চুপসেই যেতে দেখল বাপী। তাড়াতাড়ি ওই আবার সামাল দিতে চেষ্টা করল। তুমি কিছু ভেব না বউদি, এবার থেকে আমিই ওকে নিয়ে বসব—কি নাম ওর?

গৌরী বউদি জবাব দিল না। এবারে মণিদার আগ্রহ দেখা গেল।—তাই তো রে। তোর সেই বন্ধুটি বলছিল ডিস্টিংশনে বি. এসসি. পাশ করে তুই এখানে এসে কি একটা চাকরিতে ঢুকেছিস। আমার সকাল দুপুর বিকেল রাত্তির চাকরির জোয়াল কাঁধে—তুই একটু নিয়ম করে ছেলেটাকে দেখলে তো ভালোই হয়— কি বলো?

শেষের বিনীত জিজ্ঞাসা বউয়ের উদ্দেশে। জবাব না দিয়ে গৌরী বউদি এবারে দু’চোখে বাপীকে যাচাই করে নিচ্ছে। অগত্যা বাপী বলল, ডিস্টিংশনে বি. এসসি. পাস করাটা কিছু-নয়—ছেলে পড়িয়ে অভ্যেস আছে। এই করেই তো নিজের পড়াটা চালিয়েছি।

গৌরী বউদির দু চোখ ওর মুখের ওপর থেকে পাশের খোলা দরজার দিকে ঘুরল।—বাচ্চু!

মায়ের একডাকে ওদিক থেকে ছেলেটা ছুটে এলো। বাপীকে দেখিয়ে গৌরী বউদি বলল, এ তোর একজন কাকু হয়, এখানে থাকবে—কাল থেকে রোজ সকালে আর সন্ধ্যায় এই কাকু তোকে পড়াবে—বুঝলি?

বাপী দেখল, গৌরী বউদির মুখখানা একটু প্রসন্ন এখন। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা দেখে প্রথম সুযোগে পড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে যেটুকু করা যায়। তবু আধঘণ্টা হয় নি এসেছে, মুখের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গৌরী বউদি ছেলেকে ডেকে ওই ফয়সলা করে ফেলার মধ্যে এই বিনিময়ের হিসেবটুকুই যেন বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল। মণিদা বা গৌরী বউদি এ পর্যন্ত পিসী বা বাবার সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেনি।

ছেলেটা সোজা তাকিয়ে কাকুর মুখখানা একবার দেখে নিল। জীবটি বিপজ্জনক কিনা বোঝার চেষ্টা। সে রকম মনে হল না। মায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, মাস্টার কাকু?

মাস্টার ঠিক করার কথা প্রায়ই শোনে, তাই এ প্রশ্ন।

—না, বাপী কাকু। জঙ্গলের কতরকম গল্প বলবে তোকে শুনিস’খন। কিছু মনে পড়তে গম্ভীর মুখে সামান্য হাসির আভা ছড়ালো। কি মনে পড়তে পারে বাপী সেটা সেই মুহূর্তে আঁচ করেছে।

ছেলের গলায় অভিমান ঝরল।—হ্যাঁ জঙ্গলের গল্প শুনবে, আজ পর্যন্ত আমাকে চিড়িয়াখানাই দেখালে না তোমরা

—এবারে কাকু দেখাবে’খন। এখনো এক ঘণ্টা পড়তে হবে, বই নিয়ে বোসগে যা।

দ্বিতীয়বার বলতে হল না, বাচ্চু চলে গেল। ভিখু বাড়ির আধবুড়ো চাকর। তার সামনে ডিশে কিছু খাবার আর এক পেয়ালা চা রাখল। দাদা বউদির সামনেও এক পেয়ালা করে চা রেখে প্রস্থান করল।

পেয়ালা তুলে নিয়ে গৌরী বউদি আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, জঙ্গলে জন্তুজানোয়ারদের আর কি নতুন ভালবাসাবাসি দেখেছিস?

ডিশের খাবার সবে একটু মুখে তুলেছিল। বাপীর বিষম খাবার দাখিল। মাথাটাও ঝিমঝিম করে উঠল। ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গ থেকে এক দুপুরের দৃশ্যটা বেরিয়ে আসার জন্য ডানা ঝটপট করেছে। বানারজুলির জঙ্গলের সেই একটা দিন মণিদাও ভোলেনি হয়তো। বউয়ের রসিকতার কথা শুনে তার ভারী গালের খাঁজে খাঁজে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে।

পলকা ধমকের সুরে গৌরী বউদি আবার বলল, বল না! ইস লজ্জা দেখো ছেলের—

বাপীর মনে হয়, গৌরী বউদি ওকে সেই আট বছর আগের মতোই বোকা ভাবছে। এখনো সেই বোকাবোকা ভাবটাই ধরে রাখার চেষ্টা বাপীর। লোকের চোখে ধুলো দেবার মতো এর থেকে ভালো কৌশল জানা নেই। হাসতে চেষ্টা করে বোকার মতোই বলল, তখন কি কিছু বুঝতাম নাকি!

…বানারজুলিতে এই গৌরী বউদির মুখে অনেক রকমের খুশির ছটা দেখেছিল বাপী, মুখে খিলখিল হাসি দেখেছিল।…জঙ্গলে যাবার আগে পাট-ভাঙা শাড়ি পরার পর ওকে পিছনে পায়ের দিকটা টেনে দিতে বলেছিল, আর উদ্ভট ফরমাসটা না বুঝে বাপী উপুড় হয়ে বসে শাড়ির ওপর দিয়ে দু হাতে তার একটা পা চেপে ধরে কি করে টানবে ভেবে পাচ্ছিল না। গৌরী বউদি তখন ওকে হাঁদা বলেছিল আর হেসে সারা হয়েছিল।…তারপর জঙ্গলে ওর সেই সব কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে হেসেছিল আর ঘন ঘন সেই হাসি মণিদার দিকে ঠিকরে পড়ছিল। এ পরিস্থিতি অতটা হাসির না হলেও বাপীর মনে হয়েছে গৌরী বউদি এখন আর সেরকম হাসে না বা হাসতে পারে না। ধার ধার মুখের এই হাসির মধ্যে যেন কিছু হিসেব লুকনো আছে। অপচয় নেই।

ঠোটের ফাঁকে এমনি একটু হাসি খেলে গেল। ভুরুর মাঝে হাল্কা ভাঁজ পড়ল একটু।—এখন সব বুঝে ফেলেছিস? তার পরেই আত্মস্থ। —যাক জঙ্গলের গল্প করতে গিয়ে ছেলের মাথায় আবার এসব ঢোকাতে যেও না।

বাপী তখুনি মাথা নাড়ল। অমন কাজ সে করবে না। এর ফলেও গৌরী বউদি কয়েক পলক চেয়ে রইল। এই বয়সের ছেলের সরলতা দেখে ভিতরে ভিতরে মজা পাচ্ছে হয়তো।

মণিদা প্রসঙ্গ ঘোরালো। ওর চাকরির খোঁজ নিল। শোনার পর বীতশ্রদ্ধ। — বি. এসসি. ডিস্টিংশনে পাশ করার পর এই চাকরি করতে ছুটে এলি, মাইনে কত?

গৌরী বউদির সামনে এ প্রশ্নটাই যেন কাম্য ছিল। অকপটে বলে দিল, সব মিলিয়ে মাসে আটাত্তর টাকা—

—দেখ কাণ্ড। হালছাড়া চোখে মণিদা একবার তার বউয়ের দিকে তাকালো। তারপর ওকেই বলল, এরকম কেরানীর চাকরি করবি তো আমাকে জানালি না কেন, আমার ওখানে চেষ্টা করে দেখতাম। কাকাও তো লিখতে পারত—

—বাবা চার বছর আগে মারা গেছেন, তোমাকে বললাম না টিউশনি করে নিজের পড়া চালিয়েছি।

গৌরী বউদি নির্লিপ্ত কিন্তু মণিদা অপ্রস্তুত একটু।—জানব কি করে বল, তুইও তো কিছু লিখিসনি। পিসীর মারা যাবার খবর অবশ্য কাকাই জানিয়েছিল।

বাপী তাড়াতাড়ি কাজের কথায় ফিরে এলো।—এ চাকরিও এক্কেবারে টেম্পোরারি, কবে আছে কবে নেই—তোমার ওখানে এখনো একটু চেষ্টা করে দেখো না মণিদা।

মণিদার গলায় এবারে অতটা উৎসাহ নেই। বলল, দেখি—

কিন্তু এটুকু আশার মুখেও গৌরী বউদি ছাই ঢেলে বসল—যাক, তোমাকে আর দেখতে হবে না, যা করছে করুক পরে দেখা যাবে’খন—তোমার ওখানে ঢুকে পরের ছেলে হাতকড়া পড়ুক শেষে

বাপী অবাক। সত্যি মাথায় কিছু ঢুকল না। মণিদা সামাল দিতে চেষ্টা করল, বললেই কি চাকরি হওয়া অত সহজ নাকি—

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাইরে চটির শব্দে ঘাড় ফেরালো।—এসো সন্তু এসো—

মণিদার ওখানে ঢুকলে হাত-কড়া কেন পরতে হবে তখনকার মতো বাপীর সেটা দুর্বোধ্যই থেকে গেল।

দামী চটির আওয়াজ তুলে পর্দা ঠেলে যে ঘরে ঢুকল সে বেশ লম্বা একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ। বয়েস বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে। গায়ের রং ফর্সা, মুখ সুন্দর নয়। পরনে দামী কাপড়ের সাদা পাজামা গায়ে মুগার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির দুটো হাতই পাঁচ-ছ’ আঙুল করে গোটানো। এক হাতের আঙুলে ঝকঝকে সাদা পাথরের আংটি, অন্য হাতে নীল পাথরের। ডান হাতের পুষ্ট কব্জিতে মস্ত একটা সোনার ঘড়ি। পাঞ্জাবির বুক খোলা, তার একদিকে সোনার চেনে সোনার বোতাম আটকানো। সব কটা বোতামের মাঝখানে একটা করে পাথর ঝিকমিক করছে— ওগুলোর নামই হীরে কিনা বাপী জানে না।

ভদ্রলোক নতুন মুখখানা দেখে নিয়ে বলল, রোববারের আড্ডা জমে গেছে দেখছি—

সোফায় মণিদার পাশে বসল। মণিদা নেভা চুরুট অ্যাশপটে গুঁজতে গুঁজতে পরিচয় দিল, আমার খুড়তুতো ভাই বাপী এসেছে উত্তরবঙ্গের সেই বানারজুলির জঙ্গল থেকে এখানে চাকরি করতে—ওর সঙ্গে গল্প করছিলাম।

জলপাইগুড়ির পাঁচটা বছর মণিদার মাথায় নেই। ব্যাকব্রাশ চুলের দরুন ভদ্রলোকের কপালখানা বেশি চওড়া দেখায়। সে তুলনায় চোখদুটো সামান্য ছোট। হাসিমাখা চাউনি বাপীর মুখের ওপর। হালকা মন্তব্য করল, জঙ্গল থেকে এসেছে বলছ, ভায়ার মুখখানা দেখে মনে হয় বৃন্দাবন থেকে আসছে।

মণিদা জোরেই হেসে উঠল। কিন্তু বাপীর চোখ তখন গৌরী বউদির দিকে। মুখের ধার-ধার ভাব মিলিয়ে গেছে। রসিকতা উপভোগ করল, হাসির সঙ্গে আবার একটু ঠেসও ছুঁড়ে দিল।—তোমার কি আর অত ভুল হয়, জঙ্গল থেকে এলেও ওর ভেতরখানা বৃন্দাবন থেকে আসার মতোই।

সাদা কথায় আবার বোকাই বলা হল ওকে। কিন্তু শুধু ওর ভেতর বোঝানোর জন্যে গৌরী বউদি যেন কথাগুলো বলল না। মণিদার এতেও হাসি। তারপর বাপীর সঙ্গে পরিয় করিয়ে দিল, এ হল সনৎ চৌধুরী, মস্ত কন্ট্রাক্টর, পাশের বাড়িটা ওর

বাপীর খুব ইচ্ছে করছিল, উঠে এসে সনৎ চৌধুরীকেও একটা প্রণাম ঠুকে গৌরী বউদিকে বুঝিয়ে দেয়, সত্যি কত জলভাত ছেলে ও। পেরে উঠল না। কোনরকমে দু’হাত জুড়ে নমস্কার সারল।

পকেট থেকে শৌখিন সিগারেট কেস বার করে ভদ্রলোক নিজের ঠোটে একটা সিগারেট ঝুলিয়ে কেসটা মণিদার দিকে বাড়িয়ে দিল।

মণিদা বলল, সিগারেট তো খাই-ই না, তবে তোমার দামী সিগারেট দেখলে লোভ হয়, দাও—

সিগারেট ধরিয়ে সনৎ চৌধুরী হৃষ্টমুখে বাপীর দিকে তাকালো—ভায়ার এখানে থাকা হবে নাকি?

হাঁ বা না কিছুই না বলে বাপী হাসতে চেষ্টা করল একটু। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মণিদা বলল, হ্যাঁ, কলকাতায় আমি ছাড়া ওর আর কেউ কোথাও নেই—

এই প্রশ্ন আর জবাবের মধ্যে গৌরী বউদি মজার কি পেল বাপী জানে না। কিন্তু মজাটুকু শুধু চোখেই ঠিকরলো। মুখে বলল, আমাদের তো মোটে তিনখানা ঘর, সন্তুর ওখানেও পাঠিয়ে দিতে পারো—অতবড় বাড়িতে একলা থাকে— দুজনেরই উপকার হবে।

নাম ধরে ডাকাটা বাপীর কানে ধরা পড়েছে। সনৎ বা সন্তু চৌধুরীর হাসিমাখা ভ্রুকুটি গৌরী বউদির দিকে।—উপকার হবে কিরকম?

—ও একটু চালাক চতুর হবে আর তুমি সৎসঙ্গ পাবে।

বাপী ছাড়া সকলেই হাসছে। কিন্তু শুধু মণিদার হাসিটা বোকা-বোকা লাগছে বাপীর।

মণিদা বলল, যাই বাজারটা সেরে আসি—

সন্তু চৌধুরী তক্ষুনি বলল চলো আমিও যাই।

গৌরী বউদি সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো।—এই! একরাশ বাজার করে এনে আমাকে হেঁসেলে পাঠানোর মতলব?

সন্তু চৌধুরীর সাদামাটা জবাব, ছুটির দিনে আমার শুধু একটু ভালো খাওয়ার মতলব —সেটা তোমার ভিখুর দ্বারা সম্ভব হলে হেঁসেলে যাবে না।

এ কথার ফাঁকে বাচ্চু লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে সোজা সন্তু চৌধুরীর কোলে এসে জাঁকিয়ে বসল।—সন্তুকাকু, মা বলেছে আমি ওই বাপী কাকুর সঙ্গে এবারে চিড়িয়াখানা দেখতে যাব।

—খুব ভালো কথা। কবে?

জবাবের আশায় বাচ্চু তার মায়ের দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যেই কিছু একটু ভেবে নিল গৌরী বউদি। সন্তু চৌধুরীকেই জিজ্ঞাসা করল, দুপুরের দিকে তোমার গাড়িটা ফ্রি থাকবে?

—হুকুম হলেই থাকবে।

মণিদা জামা-কাপড় বদলাতে যাচ্ছিল। বাধা পড়ল।— দুপুরে তোমার কি কাজ? মণিদার বিব্রত মুখ।—খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রামের পর আমার তো একবার বেরুতেই হবে।…গাড়ি থাকলে আর কি, বাপীই নিয়ে যেতে পারবে’খন।

ঘর ছেড়ে চলে গেল। গৌরী বউদি ছেলেকে বলল, ঠিক আছে আজই যাবি।

বাচ্চু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু সেই মুহূর্তে স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটা সাড়া পড়ে গেল বাপীর।…গৌরী বউদির ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি, পলকের তেরছা চাউনি সন্তু চৌধুরীর মুখের ওপর। বাপীর মনে হল, গৌরী বউদি ছেলেকেই শুধু খুশী করল না। পলকের ওই কটাক্ষে সন্তু চৌধুরীর প্রতিও কিছু যেন অযাচিত করুণার আশ্বাস।

…ভদ্রলোকের ছোট ছোট চোখে হাসি চিকচিক করছে।

.

সুখ কাকে বলে?

চেয়ারে বসে টেবিলের ভালো ভালো সাজানো খাবার আয়েস করে গলা দিয়ে নামানো? ভালো ঘরে খাটের উপর গদির বিছানায় শুয়ে আরামে রাত কাটানো?

তা যদি হয় তো দেড়টা মাস বেশ সুখেই কেটে গেল বাপীর। বাইশ বছরের মধ্যে এমন সুখ আর আরামের নাগাল আর কখনো পায় নি। তবু ভোর হতে না হতে ঘুম ভাঙে। এটা বরাবরকার অভ্যাস। কিন্তু এই সুখ যখন ছিল না, ঘুম ভাঙার পরেও তখন ইচ্ছে করলে বিশ-তিরিশ মিনিট আমেজের মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারত। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এখন এই গদির শয্যা পিটে খোঁচা মেরে তুলে দেয়।

খাট-পাতা মাঝের ঘরটা সম্ভবত অতিথি-অভ্যাগতর জন্য। কিন্তু দেড় মাসের মধ্যে বাপী একমাত্র পাশের বাড়ির সন্তু চৌধুরী ভিন্ন এই ফ্ল্যাটে অন্য কোনো নতুন মুখ দেখে নি। শুধু খাট নয়, দেয়াল ঘেঁষে চকচকে ড্রেসিং টেবিলও আছে একটা। জিনিসপত্র রাখার দেয়াল আলমারি আছে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে আলনাও। গৌরী বউদি বাপীর জন্য এই ঘরটাই বরাদ্দ করেছে। খাটে নিজের ছেঁড়া খোঁড়া বিছানা-বালিশেরও ঠাঁই হয় নি। গৌরী বউদি বলেছে তোর ওই রাজ-শয্যা এখানে চলবে না—সরিয়ে রাখ।

নিজেই চাদর বালিশ আর একটা সুন্দর বেড-কভার বার করে দিয়েছে। বলেছে, সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে—আমি নোঙরা দেখতে পারি না।

গোড়ার তিন-চার দিনের মধ্যে নিশীথ ওর খবর নিতে এসেছিল। থাকার ব্যবস্থা দেখে ওরও চমক লেগেছিল।—লোয়ার ডিভিশন হলে কি হবে, রাজার হালে আছিস দেখছি।…তোর মণিদা তাহলে বড় চাকরিই করেন।

এত আরাম সত্ত্বেও ভোর না হতে বাপীর ঘুম ভাঙে। বাথরুম, মুখ-হাত ধোয়া সেরে বসার ঘরের দরজা খুলে পা-টিপে তিনতলার ছাদে উঠে যায়। আধ ঘণ্টার ওপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো মজবুত আর তরতাজা রাখার মহড়া চলে। নিঃশব্দে খানিক হাত ছোঁড়া ছুঁড়ি ঝাঁপাঝাঁপির পর লম্বা ছিপছিপে শরীরটাকে নানাভাবে দুমড়ে বাঁকিয়ে চুরিয়ে হাড়গোড়সুদ্ধু যথেচ্ছ বশে আনার চেষ্টায় দরদর করে ঘাম ছুটতে থাকলে এ-পর্বের শেষ। বানারজুলির দৌড়ঝাঁপ আর জঙ্গল টহল দিয়ে বেড়ানো বন্ধ হবার পর থেকে বাপীর এই অভ্যেস। কোন দিন বাদ পড়লে বিচ্ছিরি লাগে, গা ম্যাজম্যাজ করে। ঘরের বদলে এখানে খোলা ছাদ পেয়ে আরো সুবিধে হয়েছে। দেড় মাস ললিত ভড়ের বাড়িতে একসঙ্গে কাটানোর সময় সেই পেটুক-ভড় ওর এই কসরত করা দেখে খুশি হয়ে দু-তিনটে যোগব্যায়ামও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জানতাম তো অনেক কিছু, এসব করলে রাক্ষুসে খিদে হয়—তাই ছেড়ে দিয়েছি।

ঘাম মারতে সময় লাগে। ততক্ষণে পুবের কোণে লাল সূর্যটা খুব একটু একটু করে আকাশের ডাঙায় উঠে বসে। বাপীর ভিতরে তখন শুচি ভাব-টাব কিছু জাগে না। দেখতে শুধু ভালো লাগে। রোজ দেখে রোজই নতুন মনে হয়।

নিচে নেমে প্রথম কাজ শেভিংয়ের পর নিঃশব্দে স্নান সেরে আসা। আগে তিন দিনে এক দিন শেভ করত। —কিন্তু গৌরী বউদির তাও চোখে লেগেছিল। একবার চারদিন পরের শেভ করা মুখের দিকে চেয়ে চা খেতে খেতে বলেছিল, কালো মুখখানা তো ভালই দেখায়, খোঁচা খোঁচা দাড়ি রেখে ভূতের মতো থাকিস কেন—রোজ কামাতে পারিস না?

গৌরী বউদি মিষ্টি কথার ধার ধারে না। এই বলাটুকুর মধ্যেও বকুনির সুর। শুধু শেভ করা নিয়ে নয়, বাড়িতে আধ-ময়লা ধুতি পরে থাকাটাও তার চক্ষুশূল। সেই গোড়ার তিন-চার দিনের মধ্যে বলেছিল, বাড়িতে পরিষ্কার পাজামা পরবি, টাকা না থাকে তো আমার থেকে ধার নিয়ে কয়েকটা করিয়ে নে—মাস কাবারে দিয়ে দিবি।

পুঁজির টাকায় হাত পড়ে নি। সেই দিনই আপিস ফেরত একসঙ্গে তিনটে পাজামা আর তিনটে সাদা পাঞ্জাবির অর্ডার দিয়ে এসেছিল। আপিসের জন্য পাঞ্জাবি বানানোর কথা আগেই ভেবে রেখেছিল।

….গৌরী বউদির ধারালো মুখে হাসি-ছোঁয়া রসিকতাও ঝরে। প্রথম যেদিন শেভিংয়ের পর স্নান সেরে মাথা আঁচড়ে সেই পাজামা পাঞ্জাবি পরে চায়ের টেবিলে এসে বসেছিল, গৌরী বউদি বড় বড় চোখ করে ওর দিকে চেয়ে ছিল। ঠোঁটে হাসির ফাটলও দেখা গেছল একটু। তারপর বাচ্চু আর মণিদার সামনেই বলেছিল, বাঃ, তোকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে যে রে!

মণিদা ভারী মুখ টিপে হাসছিল। মায়ের কথা শুনে আরো বেশি হেসেছিল সাত বছরের ছেলেটা। আর যতটা সম্ভব বোকার মতো লজ্জা পেতে চেষ্টা করছিল বাপী। কিন্তু ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গ থেকে কারা যেন কিলবিল করে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।

স্নান সারা হবার পর বাপীর একটা বড় কাজ কাতুকুতু দিয়ে আর খুনসুটি করে বাচ্চুর ঘুম ভাঙানো। এখানে আসার চার-পাঁচ দিনের মধ্যে মায়ের কাছে বায়না তুলে বাচ্চু তার শয্যা বদল করেছে। এতদিনে ছেলেটা বাড়িতে প্রায় নিঃসঙ্গ ছিল। কার সঙ্গে কথা বলবে, `কার সঙ্গে খেলা করবে? সন্তু কাকা অবশ্য খুব ভালো, ওকে কত রকমের খেলনা কিনে দেয়, ছবির বই কিনে দেয়, ওর জন্য বড় বড় লজেন্স চকোলেটের বাক্স নিয়ে আসে। কিন্তু এক রবিবার সকালে ছাড়া তাকে আর পাচ্ছে কতটুকু। সন্ধ্যার পরে যখন আসে তখন কেবল মায়ের সঙ্গেই আড্ডা দেয়। বাচ্চুকে তখন পড়ার বই নিয়ে বসতে হয়। বাবা বেশির ভাগ দিন সকাল দশটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না। যেদিন আগে এসে পড়ে সেদিন বাচ্চুর খুব মজা। বাবা ওর সঙ্গে গল্প করে, খেলা করে, নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। মায়ের সঙ্গেই সব থেকে কম ভাব। মা মারে-টারে না, কিন্তু একটু কিছু হলেই এমন করে তাকায় যে তাতেই ওর কান্না পায়। মা কখনো ওর সঙ্গে খেলেটেলে কিনা বা ওকে আদর করে কিনা জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটা পরিষ্কার জবাব দিয়েছিল, মা খেলতেও জানে না, আদর-টাদরও জানে না।

দুদিনের মধ্যেই বাপীকাকুকে খুব ভালো লেগে গেছে বাচ্চুর। ওর ভিতরেও তো কত কথা জমা হয়, কিন্তু সে-সব শোনার বাড়িতে আর দ্বিতীয় লোক নেই। বাপীকাকু শোনে, হাসে, ওর বুদ্ধির তারিফ করে। বিকালে আপিস থেকে ফিরে ওকে নিয়ে বেড়াতে যায়, নয়তো দুজনে ছাদে গিয়ে হুটোপুটি করে। কিন্তু খেলাধুলো বা ছুটোছুটিতে এতবড় মানুষটা কেন যে সব সময় ওর সঙ্গে হেরে যায় বাচ্চু ঠিক বুঝতে পারে না। আর কত রকমের মজার গল্প করে করে পড়ায়। পড়তে একটুও খারাপ লাগে না।

রাতে বাপীকাকুর সঙ্গে শোয়ার হুকুম মিলেছে এই পড়াশুনার ছুতো ধরে। বাবা-মা ঘুম থেকে ওঠে সাড়ে সাতটায়, বাচ্চু তারও পরে। মুখ হাত ধোয়া আর সকালের খাওয়া সেরে পড়তে বসতেই সাড়ে আটটা। ওদিকে ন’টা বাজতে না বাজতে বাপীকাকুর আপিসের তাড়া। সকালে পড়বে কখন। অথচ বাপীকাকু ওকে বলেছে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারলে বাবা-মা ওঠার আগে ওর পড়াই শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সকালে ও ওঠে কি করে?

পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ছেলের পড়াশুনার উৎসাহ তার মা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। আর ফাঁকে ফাঁকে সকাল সন্ধ্যায় বাপীর পড়ানোর ব্যাপারটাও ঠিকই দেখেছে। যত হাঁদাই ভাবুক, গরিবের ছেলের এদিকে যে কিছু পটুতা আছে, সেটা তার মনে হয়েছে। এই জন্যেই শেষে ছেলের বাপীকাকুর সঙ্গে শোয়ার অনুমতি মিলেছে।

বাপী ঠিক ছ’টায় ওকে ঠেলে তোলে। মুখ হাত ধুইয়ে পড়াতে বসতে সাড়ে ছটা। আটটার মধ্যে পড়া শেষ। অত ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতে সহজে চায় না। কিন্তু ওঠার পরে ওইটুকু সকালের মধ্যে স্কুলের সব পড়া সেরে ফেলার মজাটাও জানা ছিল না। আর প্রথম দিনেই ওর পড়া নিয়ে বাপীকাকুর সাহস দেখে তো বাচ্চু অবাক। চায়ের পাট শেষ হতে মা বলেছিল, যা আবার বই নিয়ে বোসগে—

মায়ের হুকুম হলে বাচ্চু প্রতিবাদ জানে না। প্রতিবাদ জানে না। বাচ্চু কেন, কেউ জানে না। কিন্তু বাপীকাকু টক করে বলে দিল, সকালে দেড় ঘণ্টা টানা পড়া হয়ে গেছে, আবার বই নিয়ে বসবে কি? ওকে বলেছে, না রে, এখন আর পড়তে হবে না, তোর খেলার জিনিস কি আছে বার কর, আমি দেখব। তারপর আবার হেসে মাকে বলেছে, আমার হাতে ছেড়েছ, কটা দিন সবুর করে দেখো—

বাচ্চু ভেবেছিল, মা রেগেই গেল। বাপীকাকুর দিকে ভুরু কুঁচকে একটু তাকিয়েও ছিল। তারপর বাবার দিকে ফিরে কি রকম মজার সুরে বলেছিল, আবার দেমাকও একটু আছে দেখি!

বাপীর আপিস সেই খিদিরপুরে। নটার মধ্যে সে একলাই ভাত খেতে বসে যায়। মণিদা সাড়ে নটায় খেতে বসে। তার আগে বাপী খাওয়া শেষ করে বেরিয়েই পড়ে। সকালের খাওয়ার সময় কেউ তদারক করতে আসে না। তবু ভিখুর কল্যাণে সকালের সেই তাড়ার মধ্যেও খাওয়াটা ভালোই জোটে। দশটা—পাঁচটা আপিস। লোয়ার ডিভিশন হলেও সেখানকার আপার ডিভিশনরাও ইদানীং ওর প্রতি তলায় তলায় ঈর্ষান্বিত একটু। তার কারণ বড়বাবু মন্মথ সোমের অহেতুক স্নেহ। সেই স্নেহ যে এখন বাড়তির দিকে সেটা বাপীই সব থেকে ভালো অনুভব করতে পারে।

বড়বাবুকে হাসতে বড় দেখে না কেউ। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলার সময় মন্মথ সোম একটু-আধটু হাসেনও। প্রায়ই ওকে নিজের খুপরিতে ডেকে নিয়ে সামনে বসিয়ে কাজ করান। সকলের চোখে, বাপীর চোখে তো বটেই, এ-ও এক ভাগ্যের লক্ষণ। কাজের ফাঁকে অন্য কথাও দু-চারটে বলেন। বাপী এখন কোথায় আছে তাও জেনে নিয়েছেন। অত দূর থেকে ট্রাম-বাসের ভিড় ঠেলে ঠিক দশটায় হাজিরা দেওয়া ধকলের ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপীর কখনো লেট হয় না— এজন্যেও ভদ্রলোক খুশি। নিজের মুখেই সে-কথা বলেছেন। চাকরি-বাকরির মন্দা বাজার আর অনিশ্চয়তার কথাও মাঝে মাঝে বলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ দেন, লেগে থাকো, আমি তো আছি—দেখা যাক।

দুটোর সময় নিজের একটা খুপরি ঘরে টিফিন করতে যান তিনি। ইদানীং মাঝে মাঝে বেয়ারা মারফৎ সেখানেও ডাক পড়ছে বাপীর। নিজের টিফিন বাক্স থেকে টিফিন বার করে ওকে খেতে দেন। বাপী তখন খুব লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু ভদ্রলোক বলেন, আমি তো তোমার বাবার মতো, লজ্জা কি, খাও।

কেরানী মহলে মন্মথ সোমের সুনাম খুব নেই। কিন্তু বাপী মনে মনে তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারে না। নিশীথের বাবা তাঁর রোগ সারিয়েছেন, সেই কৃতজ্ঞতায় অজানা অচেনা একটা ছেলের প্রতি এত স্নেহ যাঁর, বাপী তাঁকে খারাপ ভাববে কেমন করে। নিশীথের রাম-কাকাও মাঝে মাঝে ওকে বলেন, বড়বাবু তোমার ওপর খুব খুশি—তোমার ভাবনা নেই।

অতঃপর, মাইনে যা-ই হোক, আপিসেও বাপীর সুখের দিনই চলেছে। বিকেলে বাড়ি ফেরার দশ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে ভিখু জলখাবার সাজিয়ে দেয়। পরিপাটী ব্যবস্থা। ভিখুর ওঠা-বসা চলা-ফেরা সবই বাড়ির কর্ত্রীর নির্দেশে। এখানে কর্তা কেউ নেই, একজন শুধু কর্ত্রী। ভালো খাওয়া-দাওয়া বা আরামে থাকার ব্যাপারে গৌরী বউদির এতটুকু কার্পণ্য নেই সেটা স্বীকার করতেই হবে। রাতের খাওয়া সকালের থেকেও ভালো। খাবার টেবিলে সে-সময় বাপীর দোসর শুধু বাচ্চু। মণিদা তো থাকেই না, গৌরী বউদিও সে সময় কমই বাড়ি থাকে। থাকলেও রেডিওর গান বা নাটক শোনে। নয়তো গল্পের বই পড়ে। সন্তু চৌধুরী এলে তার সঙ্গে গল্প করে।

রাতের খাওয়ার পর বাচ্চুর সঙ্গে গল্প করতে করতে আরামের শয্যায় শুয়ে ঘুম।

যা-ই হোক, সুখের এই যদি হিসেব হয়, বাপী সুখে নেই এ সে নিজেও জোর করে বলতে পারবে না। কিন্তু থেকে থেকেই বাপীর কেমন মনে হয়, এরকম সুখের সঙ্গে কোনো শিকড়ের যোগ নেই। একটা আলল্গা সুখের হাওয়ায় ও ভাসছে। হঠাৎ কোনো কারণে হাওয়াটা বন্ধ হতে পারে। হলে ধুপ করে মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে।

ফলে এই দুটো মাস চোখকান সর্বদাই সজাগ তার। সুবিধে এই, মুখ দেখে সেটা কেউ বুঝতে পারে না। এই দেড়টা মাসে বাপী অনেক জেনেছে, অনেক বুঝেছে।

মণিদা তেমন বড় চাকরি কিছু করে না। কাস্টমস-এর ইন্সপেক্টর। আগে ছিল প্রিভেনটিভ অফিসার, তার থেকে ইন্সপেক্টর হয়েছে। মণিদা কথায় কথায় নিজেই গল্প করেছে, এর মধ্যেই বার দুই একটু প্রমোশনের কথা উঠেছিল তার। কিন্তু আর প্রমোশন-টমোশন চায় না। এই বেশ আছে।

কেন বেশ আছে বাপী ভালই আঁচ করতে পারে। সেই আটচল্লিশ সালে ইন্সপেক্টরের মাইনে সর্বসাকুল্যে সাড়ে চারশ-পাঁচশর মধ্যে। বাপীর ধারণা, ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে এই হালে মাস চালাতে কম করে বারোশ টাকা লাগে মণিদার। সেটা কি করে আসে আর কোত্থেকে আসে বোঝা কিছু শক্ত নয়। বাবার সেই ঠাট্টা ভোলে নি। বলেছিল, ওখানে তো মাইনের থেকে উপরি বেশি শুনেছি। প্রমোশন নিলে এই উপরিতে ঘাটতি পড়ে নিশ্চয়। মণিদা কেন সকাল দশটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে ঘরে ফেরে না তাও আঁচ করা সহজ। কাস্টমস-এর ব্যাপারে হানাদারির কাজ লেগেই আছে। এটা যত বেশি হয়, পকেটে কাঁচা টাকার আমদানিও ততো বাড়ে। শুধু টাকা কেন, ভালো ভালো জিনিসও কম আনতে দেখছে না বাপী।

ফাঁকতালে মণিদাকে নিজের ওখানে চাকরির তাগিদ দিতে গিয়ে বাপী আরো কিছু বুঝে নিয়েছে। মণিদা খোলাখুলি বলেছে, কেরানীর চাকরির ভবিষ্যৎ ওখানেও কিছুই নেই। আর প্রিভেনটিভ অফিসারের চাকরি সেরকম ধরা-করার জোর না থাকলে হয়ই না। তার ওপর ঘুষ লাগে এন্তার। এই প্রসঙ্গেও নিজের সম্পর্কে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছিল। প্রিভেনটিভ অফিসার থেকে প্রমোশন পেতে আমারই কালঘাম ছুটে গেছল, বুঝলি? বছরের পর বছর ওই এক জায়গায় ঘষ্টে মরছিলাম। শেষে সন্তুর এক খাতিরের মুরুব্বির জোরে হয়েছে— তাও কি এমনি, করকরে পাঁচটি হাজার টাকা তার পকেটে গুঁজে দিতে হয়েছে।

দুয়ে দুয়ে চারের হিসাবটা বাপী বড় সহজে করে ফেলতে পারে। ওর ধারণা মুরুব্বির পকেটে গোঁজা ওই পাঁচ হাজার টাকাও সন্তু চৌধুরীর পকেট থেকেই খসেছে। কিন্তু মণিদার উন্নতির জন্য তার এত উদার হবার কারণ কি?

সন্তু চৌধুরীর গল্প শুনতেও বাকী নেই। মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। শিবপুরে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিল। মামার কনট্রাক্টরি ব্যবসায় ঢুকে পড়েছিল। সেই মামাটির আবার অনেক রকম বদ দোষ আর নেশাটেশা ছিল। হুট করে মরেই গেল একদিন। ব্যবসার হাল সেই থেকে সন্তু চৌধুরীর হাতে। রোজগারপাতি আগেও ভালই হচ্ছিল। একেবারে লাল হয়ে গেল এক যুদ্ধের বাজারে। ধুলো-মুঠি ধরলে সোনা।

বাপী বোকা-মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ভদ্রলোকের এত টাকাকড়ি, তবু এত বয়েস পর্যন্ত বিয়ে করলেন না যে?

কত আর বয়েস, বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি নয়। করবে হয়তো একদিন। হেসে হেসে মণিদা বলেছিল, মেয়ে জাতটার ওপরেই ওর বিতৃষ্ণা—এখন যারা এগিয়ে আসে তারা কেবল নাকি ওর বাড়ি গাড়ি আর টাকা দেখে এগিয়ে আসে—ওকে দেখে নয়। মামার সঙ্গে যখন ছিল, তখন এক মেয়েকে ওর মনে ধরেছিল, আর স্মার্ট ছেলে দেখে সেই মেয়েও বেশ ঝুঁকেছিল। কিন্তু মামার ফার্ম শুনে বাড়ির লোক ছেড়ে সেই মেয়েও বেঁকে গেল। সেই মামার ফার্মে তখন যে ও চার আনা মালিক হয়ে বসেছে রাগের চোটে সেটা আর বললই না। আর একবার এক জায়গায় বিয়ে প্রায় ঠিক, কিন্তু সেই বাড়ির লোকেরা চুপি চুপি ওর ব্যাংক—ব্যালেন্সের খবর নিচ্ছে দেখে রেগে-মেগে বিয়ে ভণ্ডুল করে দিল

আসলে ও একটু স্নেহের কাঙাল, বুঝলি। তোর বউদির কাছে ওটুকু পায় বলেই কেনা হয়ে আছে।

মণিদার এভাবে বলার আগ্রহটা ওর শোনার আগ্রহ থেকে কম নয়। বউদির স্নেহ আর অন্যজনের কেনা হয়ে থাকার নমুনা বাপী এই দেড় মাস ধরেই দেখছে। অবাকও লাগে। এর মধ্যে রাখা-ঢাকার কোনো ব্যাপার নেই। রোববারের সকালে ভদ্রলোকের বেশি বাজার করা এবং এখানে খাওয়া প্রায় বরাদ্দ। তাছাড়া সপ্তাহের মধ্যে সাত দিনই গৌরী-বউদি সন্ধ্যার পর হয় নিজের শোবার ঘরে বসেই তার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, নয় তার গাড়িতে হাওয়া খেতে বেরুচ্ছে, নয়তো ছটা-নটার শোতে সিনেমা বা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে। মণিদা সাধারণত রাত দশটার আগে ফেরে না, কিন্তু গৌরী বউদি মাঝেসাঝে বাইরে থেকে রাতের খাওয়া সেরে আরো পরে ফেরে। এ নিয়ে মণিদার মুখে কখনো কোনো অভিযোগের লেশমাত্র দেখে নি বাপী। এমন কি ফেরার পর কোথায় গেছল, সে-খবরও নেয় না। গৌরী বউদি নিজের থেকে বলল তো শুনল।

বানারজুলির সেই হাসি-খুশি গৌরী বউদির এত উন্নতি দেখে বাপীর তাক লেগে যায়। দুনিয়ায় কাউকে যেন কেয়ার করার কিছু নেই তার। … স্নেহ পাওয়া আর কেনা হয়ে থাকার নমুনা দেখে এখানকার প্রথম সকালেই বাপীর স্নায়ুগুলো এক-প্রস্থ নাড়াচাড়া খেয়েছিল। …মণিদা কাজে যাবে, সন্তু চৌধুরীর গাড়িতে বাপীর সঙ্গে ছেলেকে চিড়িয়াখানা দেখতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল গৌরী বউদি। তার পলকের কটাক্ষে সন্তু চৌধুরীও যেন কিছু অযাচিত করুণার আশ্বাস পেয়েছিল। …ও-রকম দেখাটা বা ভাবাটা নিজের একটা বিতিকিচ্ছিরি রোগ ভাবতে চেষ্টা করেছিল বাপী।

কিন্তু না। নিজের দুটো চোখ ওকে বড় ঠকায় না।

বাপীর এখন হাসি পায়। মণিদার কথা ভেবে অবাক হয় আবার একটু দুঃখও হয়। মণিদা সত্যি কি কিছু বোঝে না? আর রাগ হয় এই ছোট্ট ছেলেটার দিকে তাকালে। কাকুকে পেয়ে বাচ্চু বর্তে গেছে।

তবে গৌরী বউদিও বাপীর ওপর সদয় এখন। কারণ ছেলে। দেড় মাসের মধ্যে শেষের পর পর চারটে উইকলি রিপোর্টে বাচ্চু ক্লাসে ফার্স্ট। মাথা খাটিয়ে পড়াটা আনন্দের জিনিস করে তুলতে পারলে আর নিয়ম করে দু’বেলা নিয়ে বসলে ওটুকু ছেলের ফার্স্ট না হওয়াটাই আশ্চর্য।

বৈঠকখানায় বসে রবিবারের সেই সকালে বাচ্চুকে পালোয়ানের গল্প শোনাচ্ছিল বাপী। সামনে সেই পালোয়ানের ছবির বই খোলা। গৌরী বউদি এসে দাঁড়াল আর বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞাসা করল, আপিসের চাকরি কেমন চলছে?

তাৎপর্য না বুঝে বাপী বলল, খাঁড়া তো ঝুলছেই, যে-কোনদিন গলায় নেমে এলেই হল।

গৌরী বউদি বলল, তোকে ভাবতে হবে না, সন্তুকে বলে রেখেছি, ও নিয়ে নেবে। আজ এলে কথা বলে নিস—

ছেলের ফার্স্ট হওয়ার পুরস্কার সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। বাপীর ফাঁপরে পড়া মুখ। আমতা আমতা করে জবাব দিল, এ-রকম চাকরিতে একজনের মর্জির ওপর ভালো-মন্দ, তার থেকে ওই কাস্টমসেই কিছু হয় কিনা দেখ না বউদি।…সেই গোড়ার দিনে তুমি মণিদাকে বলেছিলে হাত-কড়া পরতে হবে….লোভটোভের মধ্যে গিয়ে না পড়লে তা কেন হবে।

ভুরু কুঁচকে তাকালো গৌরী বউদি। অখুশি, আবার একটু অবাকও। এ ছেলে এমন কথা বলতে পারে ভাবে নি। বলল, মাথা তো বেশ খেলে দেখছি। কাস্টমস-এর চাকরি কি আমার হাতের মুঠোয় যে চাইলি আর দিয়ে দিলাম।

বাইরে চটির শব্দ। বাপী আর কিছু বলার ফুরসৎ পেল না। সন্তু চৌধুরী ঘরে ঢুকল আর হেসে প্রথমে ছেলেটাকে তোয়াজের সুরে জিজ্ঞাসা করল, বাচ্চু-বাবুর কি করা হচ্ছে?

গল্প আর খেলার মাঝে মায়ের এসে দাঁড়ানোটা বাচ্চুর তেমন পছন্দ হয় নি। সোৎসাহে নিজের জগতে ফেরার ইচ্ছে। বলল, বাপীকাকুর কাছে পালোয়ানের গল্প শুনছিলাম—আমিও পালোয়ান হয়ে গেছি, বাপীকাকুকে একবার পাঞ্জায় হারিয়ে দিয়েছি। আর একবার হারাবো দেখবে?

গল্পের ফাঁকে এই কসরত একবার হয়ে গেছল। সোফায় বসে হাসিমুখে সন্তু চৌধুরী তাল দিল, বেশ, কেমন পালোয়ান দেখা যাক।

—বাপীকাকু চলে এসো।

সামনে ছোট টেবিলে কনুই রেখে আর এক প্রস্থ পাঞ্জা লড়ার মহড়া হল। বাপীকাকুর হাত নড়ছে না দেখে আগের বারের মতো বাচ্চু তার ছোট শরীরটা ওই হাতের ওপর চাপিয়ে দিতে বাপী হাল ছেড়ে হার মানল।

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সন্তু চৌধুরী হাসি মুখেই মন্তব্য করল, ওকে অতটা ঠকানো উচিত নয় ব্রাদার, তোমার ড্র করা উচিত ছিল।

ছোট্ট ছেলেটা কি বুঝল সে-ই জানে। চ্যালেঞ্জের সুরে বলে উঠল, তুমি বাপীকাকুর সঙ্গে জিততে পারবে? লড়ে দেখো দেখি?

সন্তু চৌধুরীর খুশীর মেজাজ। তাকেও ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল। সিগারেট অ্যাশপটে গুঁজে সিল্কের পাঞ্জাবির হাত গোটাতে গোটাতে এগিয়ে এলো। পরিপুষ্ট বাহু। হালকা ব্যঙ্গের সুরে বলল, ওকে জোয়ান বানাচ্ছ, তোমার নিজের কেরামতিটা দেখা যাক।

এই ছেলেমানুষি দেখেই হয়তো গৌরী বউদির ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস একটু। বাচ্চু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। আর বাপী যেন একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল। বলল, লেগে-টেগে যাবে না তো…?

শুনে জোরেই হেসে উঠল সন্তু চৌধুরী। বলল, তোমার পক্ষে ওই বাচ্চুই নিরাপদ তাহলে—

আমতা আমতা করে বাপী বলল, না, আমি আপনার কথা বলছিলাম…. সন্তু চৌধুরী থমকালো এবার। ছোট চোখ গোল হল। নিরীহ গোছের এই শেষের কথা শুনে গৌরী বউদিও কম অবাক নয়।

—আমার লেগে যাবে। এসো এসো, দেখাই যাক একবার

টেবিলের সামনের সোফায় জাঁকিয়ে বসল। এমন কথার পর সমুচিত শিক্ষা না দিলেই নয়।

মাথায় সমান সমানই লম্বা হবে দুজনে। কিন্তু গায়ে-গতরে সন্তু চৌধুরী হৃষ্টপুষ্ট অনেক বেশি। লোকটার গায়ে জোর কেমন বাপীর ধারণা নেই। তবু মনে হয়েছে, এই লোককে জব্দ না করতে পারলে সত্যের জোর বলে কিছু নেই। মনে হয়েছে, শরীরের জোরটাই সব নয়। তাই অমন কথা অতি সহজে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

টেবিলে কনুই রাখল। হাতে হাত মেলালো। ও-ঘর থেকে মণিদাও এসে হাজির তখন। মজা দেখছে। বাচ্চুর উত্তেজনা চরমে। আর গৌরী বউদি যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে চাপ দিয়ে বাপীর হাত নোয়াতে চেষ্টা করছে সন্তু চৌধুরী। কিন্তু হাতটা যেন মাটিতে পোঁতা লোহা একখানা। ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে সন্তু চৌধুরীর। নভেম্বরের গোড়ায় হালকা ঠাণ্ডা সত্ত্বেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম করছে। বাপীর মুখে ছেলেমানুষি কৌতুক। এক-একবার ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। ও যেন তাকে সুযোগ দিচ্ছে সময় দিচ্ছে।

হাত সোজা রেখেই সোজা হয়ে বসল একটু। তারপর জোর বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা বাপীর। ও জিতবে সেটা অবধারিত এখন। সেই চাপ ঠেকানোর চেষ্টায় সন্তু চৌধুরী দরদর করে ঘামছে। তবু ঠেকানো গেল না। কাত হয়ে হাতের পিছনটা টেবিলে শুয়েই পড়ল শেষে।

আনন্দে হাততালি দিয়ে তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে লাগল বাচ্চু। পকেট থেকে রুমাল বার করে সন্তু চৌধুরী ঘাম মুছছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছেও। মণিদা অবাক বেশ। গৌরী বউদি বাপীকেই দেখছে। তার চোখে নতুন বিস্ময়।

পকেটে রুমাল রেখে সন্তু চৌধুরী হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা খুব অকৃত্রিম নয়। বাপীর অন্তত মনে হলো তার পুরুষকার ঘা খেয়েছে। সন্তু চৌধুরী হেসেই বলল, কংগ্রাচ্যুলেশনস।…তোমার চেহারাখানা বেশ ডিসেপটিভ ভায়া, না বুঝে ঠকেছি।

বাপী লজ্জা-লজ্জা করে সোফা ছেড়ে উঠল। বাচ্চুকে নিয়ে ও-ঘরে যাবে। আর তখনি কেন যেন একটু উদার হতে চাইল সন্তু চৌধুরী। বলল, তোমার বউদি আমার ফার্মে নিয়ে নেবার কথা বলছিলেন তোমাকে…একদিন বাড়ি এসো, আলোচনা করা যাবে।

বাপী নিরুত্তর। একটু বিব্রতও। জবাব গৌরী বউদিই দিল। তির্যক সুরে বলল, কোনো একজনের মর্জির চাকরি করার ইচ্ছে নেই ওর, কাস্টমস-এ ঢুকতে চায়— সন্তু চৌধুরী আবারও যেন তেতো গিলল একটু।—তুমি বলেছিলে বলেই বলা, ইন দ্যাট্ কেস আই কান্ট হেল্প।

বাচ্চুর হাত ধরে বাপী তেমনি বিব্রত মুখ করেই বেরিয়ে গেল। পরে সমস্ত দিনের মধ্যে গৌরী বউদি যে অনেকবার লক্ষ্য করেছে ওকে, সোজা না তাকিয়ে বাপী সেটা অনুভব করেছে।…সন্তু চৌধুরী বলেছিল, অ্যাপিয়ারেন্স ডিসেপটিভ। অর্থাৎ বাইরে যেমন দেখায় ভিতরে তেমন নয়। চাকরির কথায় আর পাঞ্জা লড়ার ব্যাপার দেখে গৌরী বউদিরও সেই সংশয়।

দিন পনের বাদে বাপীরই ভুলে সেই সংশয়ের ওপর আবার নতুন আঁচড় পড়ল একটা। রোববার না হলেও কি একটা ছুটির দিন সেটা। মণিদাও বাড়িতে। ফুরসৎ মিললে তার কাগজ পড়ার বাতিক, বসার ঘরে কাগজ পড়ছিল। এ ঘরে বাপী আর বাচ্চু। ছেলেটার এক্ষুনি বেড়াতে যাবার বায়না। সদ্য কেনা একটা সানগ্লাস পরে গৌরী বউদি ঘরে ঢুকল। হালফ্যাশানের মোটা লালচে ফ্রেমের চশমা। মস্ত মস্ত দুটো কালচে লাল কাঁচ। চোখ দুটির ওপর নিচের অনেকটা ঢাকা পড়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিল একটু। তারপর বাপীর দিকে।

—কেমন হল?

বাপীর মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে এলো, বেশ মিস্টিরিয়াস লাগছে। পরক্ষণে আবার সামাল দিল, বেশ ভালো লাগছে…

গৌরী বউদি নতুন চশমা হাতে নেমে এলো। ভুরু দুটো প্রায় স্বভাবে কুঁচকোয় এখন।—মিস্টিরিয়াস লাগছে মানে বেশ ভালো লাগছে?

বাপী আর তার দিকে তাকালও না, কথাও বোধ হয় কানে গেল না। বাচ্চুকে তাড়া দিল, যাবি তো চল—

গৌরী বউদি বসার ঘরে চলে গেল। সেখানে সামনে মণিদা। গৌরী বউদির ধার-ধার কথা কানে এলো, তোমার ওই ভাইকে যত হাঁদা ভাবি আমরা ততো নয়—বুঝলে? সন্তুও সেদিন ওই কথাই বলছিল।

—কি হল আবার…। মণিদার গলা।

গৌরী বউদির কথা আর শোনা গেল না। সিঁড়ি দিয়ে ততক্ষণে সে হয়তো নিচে নামছে। কারণ, নিচে থেকে তাগিদ দেবার মতো করেই গাড়ির হর্ন বেজে উঠেছে।

সরলতার মুখোশ খুলে গেলে সুবিধে হবে না বাপী জানত। কিন্তু পরের মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওটা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেল। বাপী তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমেন ছোট কেরানী বিপুল তরফদারের প্রতি অমন অঢেল স্নেহের কারণটা আকাশ থেকে হঠাৎ একটা গোলার মতো নেমে সোজা ব্রহ্মতালুতে আঘাত করেছে। শনিবার হাফ-ডে। আপিসের কিছু কাজের অছিলায় সেদিন মন্মথ সোম তাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন। থাকেন হাওড়ায়।

ফাইল মেলানো দশ মিনিটে হয়ে গেল। তারপর ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা প্রচুর আপ্যায়ন করলেন। ঘরের তৈরি অনেক কিছু খাওয়ালেন। কিন্তু সেই ভালো ভালো খাবার বাপীর গলা দিয়ে নামে না। কারণ, সেই আপ্যায়নে যোগ দিয়েছে বছর একুশ-বাইশের একটি মেয়ে। সোম কর্তা-গিন্নীর একমাত্র মেয়ে। নাম ঊষা। ফর্সা আর মোটাসোটা, কিন্তু মুখে কোন রকম শ্রীর লেশমাত্র নেই। সেই মুহূর্তে বাপী ব্যাপার বুঝে নিয়েছে। আর সেই প্রথমে ওর বাইশ বছর বয়েস শুনে মন্মথ সোম কেন খুশি হন নি তাও বুঝেছে। এমন কি ছাঁটাইয়ের বাজারে চাকরি কেন পেয়েছিল তাও আর অস্পষ্ট নয়। কর্তা-গিন্নী মেয়ের সামনেই মেয়ের অনেক প্রশংসা করলেন।

পরের সপ্তাহেও এক রকম কাচপোকার মতোই মন্মথ সোম বাড়ি টেনে নিয়ে গেলেন ওকে। আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। এবারে মেয়েকে রেখে কর্তা-গিন্নী মাঝে মাঝে উঠেও গেলেন। মেয়ের মুখ দেখেই বাপীর মনে হল সে স্থির জেনে বসে আছে দুজনের সম্পর্কটা কি দাঁড়াবে। বাপীর পছন্দ অপছন্দের কোনো প্রশ্ন নেই, ওই মেয়ের ওকে পছন্দ হয়েছে সেটা স্পষ্ট।

সরাসরি প্রস্তাব এল মেজবাবু রামনারায়ণ গাঙ্গুলি—নিশীথের রাম কাকার মারফৎ। সঙ্গে লোভের টোপ।—আর কি, বরাত তো ফিরে গেল তোমার, ওই একটিই মেয়ে, বড়বাবুর বাড়ি ঘরদোর যা-কিছু সব তোমারই—আর, মেয়েটারও খুব পছন্দ দেখলাম তোমাকে।

না, তাঁর গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় নি বাপী। বলেছে, মাপ করবেন, বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

রামবাবু আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, ঝাঁঝালো মুখে বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে চলে গেছে।

চাকরি থাকবে না বুঝেছে। আর সেই দুর্ভাবনার কথাটা মণিদাকে না বলেও পারে নি। মণিদা যে সেটা গৌরী বউদিকে বলে দিয়েছে সেটা পরদিনই বোঝা গেছে। কারণ গৌরী বউদির চোখে কৌতুকের ঝিলিক। বিয়ে করতে রাজি নয় বলে চাকরি যাচ্ছে মণিদা তাও বলে দিয়েছে নিশ্চয়।

বড়বাবু—মন্মথ সোমের টেবিলে ডাক পড়েছে। থমথমে মুখ কিন্তু গলার স্বর নরম।—তুমি ভেবে দেখো একটু, লোয়ার ডিভিশন থেকে তোমাকে আপার ডিভিশন করে দিতেও আমার বেশি দিন লাগবে না।

—মাপ করবেন।

নিজের চেয়ারে ফিরে এসেছে।

মাসের সতের তারিখে রামবাবু ছাঁটাইয়ের নোটিস ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, কাল দুটোর মধ্যে এসে এ ক’দিনের মাইনে নিয়ে যেও।

হ্যাঁ, বাপী জ্বলতে জ্বলতেই বাড়ি ফিরছিল। মেয়েরাই ওর জীবনের প্রধান শত্রু। সমস্ত মেয়ে জাতটাকে ছারখার করে দেবার মতোই ভিতরের আক্রোশ আর জ্বলুনি।

দুপুর আড়াইটে তখন। মাথার ওপর শীতের সূর্যটাও আজ বেশি জ্বলছে। বাপী শর্টকাট করে সামনের ছোট পার্কের ভিতর দিয়ে আসছিল। পা দুটো থেমে গেল। সামনের বারান্দায় গৌরী বউদি দাঁড়িয়ে। আর লাগোয়া পাশের বাড়ির বারান্দায় সন্তু চৌধুরী দাঁড়িয়ে। সে যেন চোখের ইশারায় মাথা নেড়ে নেড়ে নিঃশব্দে কিছু আর্জি পেশ করছে। বাপীর মনে হল, গৌরী বউদিকে ডাকছে বা নিজে আসতে চাইছে। গৌরী বউদির ঠোটে হাসি, চোখে হাসি। অল্প অল্প মাথা নেড়ে আর্জি নাকচ করছে।

রাস্তাটা পার হবার পর দু’জনেই দেখল বাপীকে। বাপীর স্নায়ু আর নিজের বশে নেই তখন। ওকে দেখেই সন্তু চৌধুরীর বিমর্ষ মুখ। গৌরী বউদি সচকিত একটু। তারপর সন্তু চৌধুরীর দিকে চেয়ে হাসছে।

বাপীর ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বসার ঘর দিয়ে ঢুকতে হবে। এটাও দুপুরে বন্ধই থাকে। খটাখট শব্দে জোরেই কড়া নাড়ল।

গৌরী বউদি দরজা খুলে দিল। মুখখানা দেখল একটু ভালো করে। একেবারে অন্য রকম লাগছে। জিজ্ঞেস করল, এই মূর্তি কেন, কে তাড়া করল? সঙ্গে সঙ্গে নিজেরই হয়তো মনে পড়ল কিছু।—এ সময়ে যে? চাকরিটা গেল বুঝি?

ভিতরের গোপন সুড়ঙ্গের দরজা খোলা পেয়ে এক মুহূর্তে সেই আদিম হিংস্ৰ পশুটা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। বাপীর আর অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, কাণ্ডজ্ঞান নেই। সামনে খোলা চুল পিঠে ছড়ানো, ঢিলে-ঢালা বেশ-বাসে যে দাঁড়িয়ে—তার মুখ দেখছে, বুক দেখছে—এক উপোসী জানোয়ার বড় লোভনীয় গ্রাসের কিছু দেখছে।

হ্যাঁ, চাকরিটা গেল।…এ সময়ে এসে গেলাম বলে তোমার খুব অসুবিধে হল?

জবাবটা দেবার আগে হঠাৎ ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে গৌরী বউদি তিন-পা পিছনে সরে গেছে। আর, তারপরে বিস্ময়ের অন্ত নেই তার। সে-ও চেয়ে আছে। ..তারপর। গৌরী বউদি পিছন ফিরে ঢিমেতালে এ ঘরের দরজা দিয়ে মাঝের ঘরে। সে-ঘরের খোলা দরজা দিয়ে নিজের ঘরে।

বাপীর বুকের তলার দানবটার তখনো দাপাদাপি থামে নি।

বসার ঘরের দরজা বন্ধ করে মাঝের ঘরে অর্থাৎ নিজের ঘরে এলো। সামনের ঘরের খোলা দরজার দিকে চেয়ে নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে রইল খানিক। স্নায়ুগুলো কাঁপছে। কটা মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটে গেল খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু জানোয়ারটা আবার ভিতরে সেঁধিয়েছে।

আস্তে আস্তে সামনে এগলো। খোলা দরজা দুটো শব্দ না করে বন্ধ করতে গেল। আধখানা বন্ধ করার আগেই নিশ্চল আবার।

ও-ঘর থেকে গৌরী বউদি ডাকল, বাপী শোন্ তো—

গলায় স্বর যেমন সহজ তেমনি নির্লিপ্ত।

আধ-ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে এসে দাঁড়াল। গৌরী বউদি শয্যায় শয়ান। কাঁধের শাড়ি আধখানা খসে বুকের ওপর উঁচিয়ে আছে। ঘাড় ফিরে তাকালো। চোখে হাসি। ঠোটে হাসি।

—এদিকে আয়।

ভিতরের জানোয়ারটাকে আর চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছে না বাপী। কয়েক পা এগিয়ে এলো।

অল্প অল্প হাসছে গৌরী বউদি। সেই হাসিটা ওকে শয্যার আরো কাছে টেনে নিয়ে যাবার মতো।

—তুই এত পাকা হলি কবে থেকে?

—তোমরা বানারজুলি যাবারও অনেক আগে থেকে।

—হুঁ? চোখে বিস্ময় ঝরল। সেই সঙ্গে আরো কিছু।—তাহলে অত বোকার মতো থাকিস কেন?

—তাতে সুবিধে।

—কি সুবিধে?

—লোকে বোকা ভাবে সেই সুবিধে।

তেমনি অল্প অল্প হাসছে গৌরী বউদি। হঠাৎ বানারজুলির সেই ননদভাজ সাপুড়ে মেয়ে দুটোকে মনে পড়ল বাপীর। বিশেষ করে ছট্টুমিয়ার বউ দুলারিকে। সাপের ছোবল খাবার লোভ, ছোবল খাওয়ার নেশা। সাপ যত ফোঁসে সামনে পিছনে সেই মেয়ে তাতে দোলে আর হাত বাড়ায়।

—গৌরী বউদির চোখেও সেই লোভ। না, তার থেকেও বেশি কিছু। তাজা কাঁচা একটা পুরুষ দেখছে গৌরী বউদি।…ব্যভিচার বয়েস জানে না। কিছু মানে না। হাসছে অল্প অল্প। বলল, বসার ঘরে দরজা বন্ধ আছে তো? কেউ ঢুকে পড়লে চেয়ার টেবিলসুদ্ধ যাবে—

শয্যার মাথার দিকের দরজার দিকে তাকালো বাপী। ছিটকিনি তোলা। বসার ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে তিন ঘরের কোনটাতে কারো ঢোকার উপায় নেই বটে।

—দেখছি। বাপী ভিতরের দরজার দিকে পা বাড়ালো।

পিছন থেকে গৌরী বউদি বলল, দেখে আয়—তোর সঙ্গে কথা আছে।

ভিতরের জানোয়ারটার অস্তিত্বসুদ্ধু উবে গেছে। ওর সত্তা বিষাদে ডুবছে, তলিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে বাপীর আর বাচ্চুর নতুন তোলা ফোটো। ছেলেটা দুষ্টু দুষ্টু হাসছে বাপীর দিকে চেয়ে। বাপীর চোখ দুটো শিরশির করছে, বুকের হাড়ে হাড়ে কান্না গুমরে উঠতে চাইছে।

বসার ঘরে এলো। নিঃশব্দে বন্ধ দরজা দুটো খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। দরজা দুটো বাইরে থেকে আবার আস্তে আস্তে টেনে দিয়ে নিচে চলে এলো।

ফিরল রাত দশটার পরে। মণিদা তখনো বসার ঘরে। মাঝের ঘরের বিছানায় বাচ্চু নেই। অর্থাৎ আজ মায়ের কাছে ঘুমুচ্ছে। গৌরী বউদির মুখ দেখা গেল না। কিন্তু বাপী ঠিক জানে সে তার ঘরেই আছে।

…না, পরদিন সকালে মণিদার কোনো শাসন চাবুক হয়ে নেমে আসে নি। উল্টে তারই ভীরু মুখ। আমতা-আমতা করে বলল, হঠাৎ কি যে হল তোর বউদির…তোকে আজই চলে যাবার কথা বলছে।

যেতে হবে বাপী জানত। মাথা নাড়ল। আজই যাবে।

বাচ্চুর চোখে ধুলো দিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল। মাসের ষোল দিনের মাইনে নেবার জন্য দুপুরে ব্রুকলিনে এলো। বেরিয়ে আসার সময় দুঃখ আর সহানুভূতি জানাতে জানাতে রতন বনিক গেট পর্যন্ত এলো। ভালো মানুষ বিপুলবাবুর এত চট করে চাকরিটা চলে যাবে, এ ও ভাবতেই পারে নি।

কি মনে হতে বাপী বলল, যা হবার তো হল। আমাকে দিন কতকের একটু মাথা গোঁজার মতো জায়গা বলে দিতে পারো? তুমি থাকো কোন্ দিকে?

—ভবানীপুরের দিকে। রতন বনিক অবাক একটু।

বাপী হেসেই বলল, আজ থেকে থাকার জায়গাও নেই.:.যেখানে হোক একটু জায়গা পেলে হত, টাকাও কিছু দিতাম।

রতন বনিকের মুখখানা দরদে ছেয়ে গেল। বলল, একটা খুপরি ঘর তো আমারই আছে…কিন্তু সেখানে তো আপনি থাকতে পারবেন না, একেবারে বস্তির মতো।

বাপী আশার মুখ দেখল। লোকটা সত্যি ভালো।…আর ভদ্রলোকের থেকে অনেক ভালো। সাগ্রহে বলল, আমি খুব পারব, তোমার অসুবিধে হবে না?

রতন বনিক এরপর ছুটে গিয়ে বাকি সময়টুকুর জন্য ছুটি নিয়ে এসেছে। তারপর বাপীর সেই সামান্য মাল-পত্র বয়ে তাকে সঙ্গে করে টালি এলাকার খুপরি ঘরে এসে তুলেছে।

…গৌরী বউদি ঘর ছেড়ে বেরোয় নি। বাচ্চু তখন স্কুলে। মণিদা আপিসে।

সোনার হরিণ নেই – ৬

মিষ্টি হাসছে, বাপী তরফদারও।

মিষ্টি বলল, সেই দস্যি তুমি আজও আমার পিছনে লেগে আছ কি করে বুঝব। আর আমি চিনবই বা কি করে, মাঝের আটটা বছর কি কম নাকি!

বাপী বলল, আমি তো গণৎকারের ওখানে তোমাকে দেখেই চিনেছিলাম। মিষ্টি যেমন খুশি তেমনি অবাক।—কি করে চিনলে বলো তো! দশ বছরে যা ছিলাম, এই আঠেরো বছরেও কি তেমনি আছি নাকি আমি!…তখন তো ফ্ৰক পরতাম।

বাপী হাসছে। কিন্তু সত্যি কথাটা বলছে না।…বানারজুলির দশ বছরে সেই ফ্রক—পরা মিষ্টি আর কলকাতার এই আঠেরো বছরের শাড়ি-পরা আর কলেজেপড়া মিষ্টি এক নয়। একরকমও নয়। বানারজুলির ফ্রক-পরা মিষ্টির একমাথা ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, লালচে ফোলা-ফোলা গাল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর বিস্ময়মাখা দুটো কালো চোখ। ধরে চিবুতে ইচ্ছে করত, দুটো ফর্সা কচি কচি হাত আর আঙুল, গায়ে মিষ্টি—মিষ্টি গন্ধ। আটটা বছর জুড়লে সেই মিষ্টি এই মিষ্টি হয়, এ বাপী কল্পনাও করতে পারত না। মাথায় বড় খোঁপা। ফর্সা রঙে মেটে ছোপ ধরেছে। ফোলা গাল আর মুখের আদুরে ভাব গিয়ে অন্য ছাঁদ নিয়েছে। চোখের গোল ভাবটা পর্যন্ত এখন আয়ত-গভীর, তাতে বুদ্ধির ছোপ, কৌতুকেরও।…বেশি লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়, মোটাও নয় আবার রোগাও নয়—পা থেকে মাথা পর্যন্ত ও যেন এখন কারো বেশ হিসেবের তৈরি। হিসেবের বাইরে যেটুকু সেটুকু আরো বেশি লোভনীয় বলেই শাড়ির আড়ালে বেশ করে আগলে রাখার চেষ্টা। তবু সর্ব অঙ্গে তার উঁকি ঝুঁকির কামাই নেই।…না, এই মিষ্টি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বাপী হয়তো দাঁড়িয়ে যেত, দেখত। কিন্তু চিনতে পারত না। জ্যোতিষীর ঘরে ওর মাকে দেখে পলকে চিনেছিল। মাকে চেনার ফলে মেয়েকে চিনেছে।

কিন্তু এখন আর বুকের তলায় এতদিনের সেই ভীষণ যন্ত্রণাটা নেই। সেই ভয়ংকর আক্রোশও নেই। গোপন সুড়ঙ্গপথের সেই জানোয়ারটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অনেক—অনেক যুদ্ধ অনেক ক্লান্তির পরে ও যেন তার লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছে। আর তার কোনো খেদ নেই, কোনো ক্ষোভ নেই। এই মিষ্টি এখন তার মিষ্টি-মিষ্টি হাতখানা যদি মাথা রাখে, যদি একটু হাত বুলিয়ে দেয়, পরম শান্তিতে বাপী তাহলে এখন ঘুমিয়েও পড়তে পারে।

রাগ বা ক্ষোভ না থাকুক, একটু অভিমানের কথা বলতে ইচ্ছে করছে তবু। বলল, এই আট বছরে আমি তোমাকে একটা দিনের জন্যেও ভুলিনি, কিন্তু তুমি দিব্যি ভুলে গেছলে—

মিষ্টির ঠোঁটে দুষ্টু দুষ্টু হাসি, আবার চোখের কোণে প্রতিবাদের হাল্কা কোপও একটু। জবাব দিল, এমনিতে ভুলে গেছলাম বটে, কিন্তু একেবারে ভোলার উপায় ছিল? বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বুঝতে পারতাম, তখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যেত।…মিষ্টি খাব মিষ্টি খাব করে জ্বালিয়ে মারতে আর হাতের নাগালে পেলে কি কাণ্ড করতে। শেষে সেই একদিন…যাঃ। আমি বলব না—

বাপীর কান জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভিতর জুড়িয়ে যাচ্ছে। সেই তাজা রক্তের স্বাদও মুখে আর লেগে নেই। বাপী হাসছে।—সেই একদিন বাবার হাতে শাস্তিখানা কেমন খেলাম তাও তো নিজের চোখেই দেখেছিলে।

মনে পড়তে গা শিউরে উঠল মিষ্টির। বাপীর তাও ভারী মিষ্টি লাগল।

—সে কথা আর বোলো না। আবু যখন তোমাকে ধরে নিয়ে এলো তখনো সবার আগে ছুটে গিয়ে তোমার মাথাটা মনের সাধে মাটিতে ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। তারপর তোমার বাবার সেই পাগলের মতো মার দেখে আর তোমার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে দেখে সারা গা ঘুলোচ্ছিল, আর এত রাগ হচ্ছিল তোমার বাবার ওপর যে ইচ্ছে করছিল, বেঁটে মোটা লাঠিটা কেড়ে নিয়ে তাকেই ঘাকতক বসিয়ে দিই।

….আশ্চর্য! সত্যি একটা মোটা লাঠির খোঁচা লাগছে গায়ে।

চমক ভেঙে বিষম ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসল বাপী তরফদার। না, বাপী স্বপ্ন দেখছিল না। জেগেই ছিল। বসেই ছিল। এখানে বসেই একটা খুব লোভনীয় বাস্তবের খুব কাছাকাছি পৌঁছে লাঠির খোঁচায় আচমকা এখানেই ফিরে এলো আবার। রাতের অন্ধকার ঘুটঘুটি এই পার্কে। বকুলতলার এই বেঞ্চিতে…।

…সেই থেকে বাপী তরফদার জেগেই আছে। বসেই আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে মনে আছে। ছেলেমেয়েরা এসেছে, খেলাধুলো করছে, ছোটাছুটি হুটোপুটি করছে—মনে আছে। দিনের আলোয় টান ধরতে পার্কটা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়েছে, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসতে একেবারে খালি হয়ে গেছে, তাও খেয়াল করেছিল। তারপর এমনি বসে থেকে এমনি চোখ তাকিয়ে কতক্ষণ কিভাবে কেটে গেল তাই শুধু খেয়াল নেই। সমস্ত সত্তাসুদ্ধ কতক্ষণ উধাও হয়েছিল এখনো ঠাওর করতে পারছে না।

লাঠির খোঁচা পুলিশের। এখন সে পিছনে কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।

লোকটা ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে বড় শ্বাস টানল একটা। মদটদ খেয়ে ঝিম মেরে বসে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা। মাথার ওপর বকুল গাছটার জন্য এখানটায় এক চাপ অন্ধকার। লোকটা মাঝবয়সী বাঙালী। কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, এত রাতে এখানে বসে কি হচ্ছে?

বাপী বেঞ্চি ছেড়ে উঠল। সমস্ত দিন পেটে কিছু না পড়ায় মাথাটা ঘুরছে। যে বরাত, সন্দেহ হলে হয়তো টেনে নিয়ে গিয়ে লক্-আপে ঠেলে দেবে। ক্লান্ত সুরে বলল, মনটা ভালো ছিল না সিপাই সাহেব…বসে ছিলাম।

মাতাল-টাতাল নয়, মুখ দেখে চোর-ছেঁচড়ও মনে হল না। তবু পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বলল, রাত বারোটায় মন ভালো করার জায়গা নয় এটা, অন্য পুলিশের খপ্পরে পড়লে আর কিছু না হোক হাতের ওই ঘড়ি খুলে দিতে হত। পা চালিয়ে চটপট ঘরে চলে যান —

পার্কের গেট পেরিয়ে কব্জির পুরনো ঘড়িতে সময় দেখল বাপী। বারোটা নয়, এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট। ঘর এখান থেকে অনেক দূর, কম করে আধ ঘণ্টা লাগবে। শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল। একটা দোকানপাট খোলা নেই যে কিছু কিনে মুখে দেবে। ইচ্ছে করছে না, আবার শরীরও চলছে না।

…বিমনা হবার মতো রসদ পার্কে বকুলতলার বেঞ্চিতে বসেই সংগ্রহ করেছিল। হোক কল্পনা, কিন্তু তারই মধ্যে মিষ্টিকে খুব কাছে পেয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখেছিল। আর এক আশ্চর্য শান্তিতে বাপীর ভিতর-বার ডুবে গেছল। সেই শান্তির ছোঁয়ায় সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল কি না কে জানে! নইলে এত রাত হয়ে গেল কি করে…! এখনো সেই তৃপ্তির স্বাদটুকু ভিতরে লেগে আছে।

মনটা সজাগ হয়ে উঠছে আবার। বেশ জোরও পাচ্ছে।…পার্কে বসে নিজের মন থেকে যে ছবি আঁকছিল সেটা এমন কিছু আজগুবী নয়। সত্যি হতে পারে না এমন কিছু নয়। বরং এর বিপরীত চিন্তাটাই বাপীর মাথায় একটা আশ্বাসের মতো এঁটে বসতে লাগল। আটটা বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আবার কোনো নিভৃতে মুখোমুখি হতে পারলে বাপী যা ভাবছিল তাই হবে। মিষ্টির চোখে ওইরকমই বিস্ময় ঝরবে। তারপর মিষ্টি ওইরকম করেই হাসবে, আর ওই গোছের কথাই কিছু বলবে।

নিজের অজান্তে পা আরো দ্রুত চলছে বাপীর। দুপুরে ওই পার্কটায় বসে প্রথম যা মনে হয়েছিল, ঘুরেফিরে এখন তাই আবার মাথায় আসছে।…সাতাশি নম্বরের ওই বাড়িটার দোতলায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি ঠাণ্ডামুখে আজ ওর নিগ্রহ দেখেছে। ওর ওপর পাড়ার ছেলেগুলোর হামলা দেখেছে। মিষ্টির চোখে সেটা অপরিচিতের নিগ্রহ। অপরিচিতের ওপর হামলা। কিন্তু এ-ই শেষ নয়। শেষ হতে পারে না। চৌদ্দ বছরের একটা ছেলের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মুখ যদি শেষ কথা না হয়ে থাকে, আজকের এই অপমান আর নিগ্রহও শেষ কথা নয়। বাপী তা হতে দেবে না।

সামনে পিছনে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে সেই থেকে। রাতের নির্জনে রাস্তা পাহারা দেওয়াটা ওদের যেন ডিউটি। পাড়া জানান দিতে দিতে খানিক সঙ্গ নেয়। ভয় পেলে তেড়েও আসে। ভয়শূন্য নির্লিপ্ততা দেখলে চেঁচানি থামে। তারপর আবার সামনের রাস্তার কুকুরের পালা। মিষ্টিদের সাতাশি নম্বরের বাড়ির সামনের সেই ছেলেগুলোকে আবার মনে পড়ে গেল বাপীর। আর সোনালী ফ্রেমের চশমা-পরা ফুটফুটে ফর্সা সেই ছেলেটাকে—পাড়ার ছেলেদের অসিতদা। তাদেরও কাউকে পাহারায় মোতায়েন রাখেনি কেউ। তারা নিজে থেকেই পাহারা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা খুশির ছবি চোখে ভাসল বাপীর।…এরপর মিষ্টির সঙ্গেই যদি ওরা ওকে ওই সাতাশি নম্বরের বাড়িতে ঢুকে যেতে দেখে তো কি করবে? কুণ্ডলি পাকিয়ে বসবে আর বার করা জিভ দিয়ে লালা ঝরবে?

পা দুটো থেমে গেল। পৌঁছে গেছে। ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটাই এখন। টালি এলাকার বাইরেটা নিঝুম। ভিতরেও। তবু এত রাতে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে ঠিক নেই। কিন্তু সেটা সমস্যা নয়। লোকগুলো এমনিতে সরল। রতন বনিক ওদের যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছে। বিপুলবাবুকে ওরাও লেখাপড়া-জানা নির্বিবাদী ভালোমানুষ জানে। সমস্যা অন্য। সমস্যা বাপী নিজে। সেই কারণে বিষণ্ণ। আবার সেই কারণে নিজের ওপর অসহিষ্ণু।

…সমস্যা ওর ভিতরের সেই জানোয়ারটা। ওটা খোলস থেকে বেরিয়ে পড়লে নিজের ওপর বাপীর আর এতটুকু দখল থাকে না। মেয়েরা দেখা মাত্র সেই মাংসলোলুপ জানোয়ারটাকে চেনে।…গৌরী বউদি দেখেছিল। দেখেই চিনেছিল। প্রশ্রয় দিতে চেয়েছিল। জানোয়ারটা আবার খোলসে ঢুকে গেছল বলেই মণিদার সেই আরামের ঘর ছেড়ে আজ ও এইখানে।…আজ আবার তেমনি দিনেদুপুরেই ওটা আচমকা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। খুব কাছে এসে ঝুঁকে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে পিঠে আঘাতের দাগ আছে কিনা দেখতে গেছল রতন বনিকের বউ কমলা বনিক। জানোয়ারটা তখন দুটো চোখের ভেতর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে ওর ওপরেও ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কমলা ওটাকে দেখেছে। চিনেছে। বিষম হকচকিয়ে গিয়ে কয়েক পা পিছনে সরে গেছে।

হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে গৌরী বউদিও খানিক পিছনে সরে গেছল। তারপর চোখের সামনে কাঁচা তাজা পুরুষ দেখেছিল। বয়েস ভুলে, সব ভুলে, পতঙ্গ পোড়ানোর নেশায় পেয়েছিল তাকে।

কমলা বনিক কি করবে?

পুলিশ তাড়া না করলে রাতটা ওই পার্কেই কাটিয়ে দিত।

পায়ে পায়ে উঠোনে চলে এলো। নিশ্চিন্ত একটু। কেউ জেগে নেই। কমলার ঘরের দরজা বন্ধ। যত সন্তর্পণে খুপরি ঘরের দরজা খুলুক, ক্যাচ করে শব্দ একটু হবেই। কিন্তু দরজা ঠেলতেই বাপী হাঁ একেবারে।

খাটিয়ার কাছে ছোট্ট একটা হারিকেন ডীম করা। ওটার সামনে ঝাঁপিতে কিছু চাপা দেওয়া। দেখেই বুঝল, ওটার নীচে বাপীর রাতের খাবার। এদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝের ওপর হাত পা ছড়িয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে রতন বনিক।

বাপী নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল খানিক।…

সমস্ত দিন লোকটার মেহনতের মধ্যে কাটে। আপিসের কাজ কিছু আছেই, তার ওপর ভাগ্য গোনার ধকলে জিভের কামাই নেই। সন্ধ্যার পর এই খুপরি ঘরে বসে মৌজ করে একটু নেশা করে। ইচ্ছে করেই বাপী সে সময় ঘরে আর থাকেই না। নেশা বেশ জমে উঠলে রতন নিজের ঘরে যায়, খেয়েদেয়ে রাত সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে অঘোরে ঘুম

…আজ বউয়ের হুকুমে ওর এই বাড়িতে ধকল সম্ভবত।

কাঁধ ধরে জোরে নাড়া দেবার পর রতনের ঘুম ভাঙল। লণ্ঠনটা এত ডীম্‌ করা যে ভালো করে মুখ দেখা যায় না। তবু বাপীর মনে হল, ও এখানে এভাবে পড়ে ঘুমুচ্ছিল কেন নিজেই চট করে ঠাওর করে উঠতে পারছে না। বাপী বলল, ঘরে গিয়ে ঘুমোও গে যাও

বিপুলবাবুর গলা শুনে মাথা পরিষ্কার হচ্ছে। শিথিল শরীরটা মেঝে থেকে টেনে তুলল। ঝুঁকে ছোট লণ্ঠনটা উসকে দিল। তারপর চোখ বড় করে বিপুলবাবুর মুখখানা দেখল। জিজ্ঞেস করল, রাত কত এখন?

—অনেক। বাপী বিব্রত বলেই ভিতরে ভিতরে বিরক্ত। এরকম কষ্ট করার কি দরকার ছিল, শুয়ে পড়োগে যাও।

রতনের দু চোখ ঘুমে বোঝাই। বলল, ওই আপনার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, খেয়ে নিন —

কথা না বাড়িয়ে ও বাইরে গিয়ে দরজা দুটো টেনে দিল। ঘুরে বাপী নির্দয় চোখে ঝাঁপিটার দিকে তাকালো। কারণ ওটার নিচে যা আছে তাই এখন সব থেকে বেশি দরকার ওর। ওটা দেখার পর পেটের তাগিদ এমনি যে গোগ্রাসে এখন গিলতে না বসে উপায় নেই।

খেতে বসল। সামগ্রী বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু থালায় সাজিয়ে রাখার মধ্যে যত্নের ছোঁয়া আছে।…এটুকুর মধ্যেই কমলার সঙ্গে গৌরী বউদির একটা বড় তফাৎ। তবু এই রাতটা না কাটলে, বাপী কাল কি করবে? কাল কেমন করে মুখ দেখাবে? তার খাবার সাজিয়ে রাখা দেখে তলায় তলায় ভরসাও পাচ্ছে একটু।… সেই কটা স্তব্ধ হিংস্র মুহূর্তের মধ্যে কমলা সত্যি কতটা ভিতর দেখেছিল ওর? কতটুকু বুঝেছিল?…গৌরী বউদির মত অতটা নাও হতে পারে। কমলা হয়তো বা চণ্ডাল রাগ ভেবেই অমন হকচকিয়ে গেছল। আর তারপর সামলে নিয়ে নিজের জোর ফলিয়েছিল। বলেছিল, আমার ঘর থেকে আমাকে চলে যেতে বলার তুমি কে?…বাপী নিজেই চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কই যাও?…মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, এক কাপ চা এনে দেবে কিনা। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য ওকে চানে যেতে বলে ধীরেসুস্থে রান্না চড়াতে চলে গেছল। না খেয়ে ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে আকুতি নিয়েই পিছন থেকে ডেকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিল।

খেতে খেতে নিজের দিক টেনেই ভাবছিল বাপী। কিন্তু ভিতরের অস্বস্তিটা থিতিয়েই থাকল।

সমস্ত দিনের এত ধকলের পর খাটিয়ায় গা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু ঘুম চট করে চোখের ধারেকাছে ঘেঁষবে না জানে।

…নিশীথ বলেছিল, তুই একটা রামবোকা। একটা মাত্র মেয়ে, তাও কালো—কোলো নয়, বেশ ফর্সা, স্বাস্থ্য ভালো। কোথায় জামাই হয়ে জাঁকিয়ে বসবি, বাড়ি—ঘরের মালিক হবি, শ্বশুর ওদিকে নিজের দায়ে তোর পাকা চাকরি আর প্রমোশনের জন্য ওপরওয়ালার কাছে হত্যা দেবে—তা না, নিজের গোঁয়ে চাকরিটাই খুইয়ে বসলি। কি লাভ হল?

রতন বনিকের এই খুপরি ঘরে এসে ওঠার পরদিন, অর্থাৎ চাকরিতে জবাব হয়ে যাবার তিন দিনের মধ্যে বাপী বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছিল। কিন্তু কিছু বলার আগেই নিশীথের ওই কথা।

সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটা ওরই ওপর উগ্র হয়ে উঠেছিল বাপীর। তুইও তাহলে সব জেনেশুনেই এই চাকরি নেবার জন্য আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলি।

পাল্টা ঝাঁঝ দেখে নিশীথ ওকে বুঝিয়েছিল, সে সময় ও সত্যি কিছু জানত না। পরে রামকাকা ওকে বলেছিল। তাও চাকরি হবার অনেক পরে, আর বড়বাবু মন্মথ সোমের ছেলে পছন্দ হবার পরে। বন্ধুকে একটু খুশি করার জন্যেও হতে পারে, নিশীথ আরো বলেছিল, তোর গায়ের রং ফর্সা না হলেও মুখের মধ্যে তো বেশ একটু মিঠে ভাব আছে—রামকাকার মুখে শুনেছি, শুধু বড়বাবুর নয়, তার মেয়েরও তোকে ভারী পছন্দ হয়েছিল…আমি কোথায় আশায় দিন গুনছিলাম, এর মধ্যে কাল রামকাকার কথা শুনে বুঝলাম সব চিত্তির। তুই বড়বাবুর আশায় ছাই দিয়েছিস, আর বড়বাবুও তোকে আপিস থেকে ছেঁটে দিয়েছে।…আমারই ভুল হয়েছে, ঘাড়ে চেপে থেকে তোকে রাজি করানো উচিত ছিল।

নিশীথের দোষ নেই বুঝে বাপীর রাগ পড়ে এসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তুই হলে কি করতিস?

—আমি? ওষুধের বড়ির মতো গলায় ফেলে টুক করে গিলে বসে থাকতাম। আরে বাবা, আমার কথা আলাদা, আমার যদি তেমন কোনো মেয়ে চোখে পড়ে বা মনে ধরে, তাতেই বা কি? কবিরাজের ছেলে হবু কোবরেজের সঙ্গে কোনো আধুনিক মেয়ে প্রেমে পড়ে এমন কথা নাটক-নভেলেও কখন পড়েছিস?

…বাপী হেসে ফেলেছিল। নিশীথ আবার বলেছিল, তোর মাথারই ঠিক নেই, নইলে কোন রূপসী আর বিদুষী তোর জন্যে মালা গাঁথছে যে এমন মওকা হেলায় হারালি!

খাটিয়ায় শুয়ে নিশীথের কথাগুলো মনে পড়েছিল। মিষ্টির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা সেদিন কোনো কল্পনার মধ্যেও ছিল না। যত অবাস্তবই হোক, তবুও ওই কথা শোনার পর মনে হয়েছিল, কোথাও কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে। করতে বাধ্য!…ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমের প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল কেন? এই কলকাতায় শিকড় গেঁথে বসতে পারাটাই তো তখন একমাত্র কাম্য ছিল, প্রাণপণে চাকরিটা রক্ষা করতেই তো চেয়েছিল, তবু অমল দিশেহারা দশা কেন সেদিন?

…বাপী ভাবছে কেন। মিষ্টির সঙ্গে অচিরে দেখা হওয়াটা সেদিনও কোনো কল্পনার মধ্যে ছিল না। নিশীথ যা বলেছিল সেই অসম্ভব ব্যাপারটা সত্তার মধ্যে ছিল।…কোথাও কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে। করতে বাধ্য।

…কল্পনার বাইরে ব্যাপারটা ঘটেছে। সেই একজনের দেখা পেয়েছে। বাপীকে চিনতে পারেনি। কিন্তু পারলে কি হত? কি হবে? নিশীথ তবু কবিরাজের ছেলে হবু কবরেজ? বাপী কে? বাপী কি? এখন পেট ঠাণ্ডা, মাথা ঠাণ্ডা। ফলে করকরে বাস্তবটাও বেশি স্পষ্ট। এখন আর জোর দিয়ে ভাবা যাচ্ছে না কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে বা করতে বাধ্য। আধুনিক মেয়ের হবু কবরেজের প্রেমে পড়ার থেকেও এ বেশি হাস্যকর অবাস্তব।

স্নায়ু তেতে উঠছে আবার। যত অবাস্তবই হোক সেটা নস্যাৎ করার চেষ্টা।…হিসেবের বাইরে কত কি ঘটে, কত কি হয়। বানারজুলির বিশালকায়া বনমায়ার চেহারাখানা সামনে এগিয়ে এলো। বুনো হস্তির ডাকে ভয়ে কুঁকড়ে না গিয়ে ওই বজ্জাত সকলের সব হিসেব বানচাল করে শিকল ছিঁড়ে ফি বছর তার সঙ্গেই পালায় কেন? জাতের ভয় আর সমাজের ভয় শিকেয় তুলে ভীমবাহাদুর আর তার ভালবাসার কালো মেয়ে কাছাকাছি আসে কেমন করে? আবু রব্বানী কি এতদিন রেশমাকে নিজের ঘরে এনে তুলতে পেরেছে? এ-ও তো কোনো হিসেবের মধ্যে পড়ে না।

…অন্ধকারে বড় করে চোখ তাকিয়ে আরো কিছু দেখছে বাপী। বানারজুলি বাংলোর বড়সাহেবের সেই মেয়ে মিষ্টি আর সাতাশি নম্বর বাড়ির এই মিষ্টিকে পাশাপাশি দেখছে। কিছু ভেঙে আর অনেকটা জুড়ে সেই মিষ্টি থেকে এই মিষ্টি। বাপীও তাই। কিন্তু বাপী আর কত বদলেছে? আট বছর আগের সব কিছু তো একেবারে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে : তাহলে সেই মিষ্টি বা কতটা বদলাতে পারে? কতটা বদলানো সম্ভব?

পার্কে নিজের কল্পনার ছবিগুলো সামনে এগিয়ে আসছে আবার। বাস্তব অবাস্তব সম্ভব অসম্ভবের দরিয়া পারের ছবি।…মাথায় বড় খোঁপা। আগের ফুটফুটে ফর্সা রঙে এখন মেটে ছোপ। ফোলা গাল আর আদুরে ভাব গিয়ে এই মুখের অন্য ছাঁদ। চোখের সেই গোল ভাব এখন আয়ত গভীর। তাতে বুদ্ধির ছাপ, কৌতুকেরও। …মিষ্টি। পার্কে দেখা মিষ্টির সেই হাসি। সেই সব কথা। মন জুড়নো হাসি, প্রাণ জুড়নো কথা।

মিষ্টি। আমি বড় ক্লান্ত। তোমার একখানা হাত আমার মাথায় রাখো। আমি ঘুমিয়ে পড়ি!

বাপী ঘুমিয়েই পড়ল।

কলতলার কলরব জমে ওঠার আগে বাপী মুখ-হাত ধোয়া সেরে আসে। নইলে মেয়েদের জটলার মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু অনেক দিন বাদে আজই . ঘুম ভাঙতে দেরি। মাথাটাও অন্যদিনের মতো ভার-ভার নয়। উল্টে ঝরঝরে লাগছে। ওদিকে কলতলা জমজমাট।

কলসির জল গড়িয়ে মুখ ধোয়ার কাজটুকু জানলা দিয়ে সারল। তারপর আবার শুয়ে চায়ের অপেক্ষা। এই সকালেও কমলার মুখোমুখি হওয়ার চিন্তা অস্বস্তিকর। সেটুকু চাপা দেবার জন্যই বাপী বেশি গম্ভীর। তার কেন যেন ধারণা, চা দিতে এসে কমলা আজ মুখে কোনো কথা বলবে না। শুধু চেয়ে দেখবে একটু। তারপর চায়ের গেলাস বাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ চলে যাবে। হাসা বা কথা বলার সুযোগ দিতেও চায় না বলে বাপী এমন গম্ভীর।…কিন্তু চা দিতে আজ দেরিই হচ্ছে।

ক্যাঁচ করে দরজা ঠেলার সেই পরিচিত শব্দ। পরের মুহূর্তে বাপী বিমূঢ়। এক হাতে ডিশের ওপর ওর চায়ের গেলাস আর অন্য হাতে নিজের গেলাস নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকছে রতন বনিক। আর সেই কটা মুহূর্তের মধ্যে বাপীর মনে হল, কমলার মুখে রোজ সকালের বড়বাবু ডাকটা বড় মিষ্টি লাগত।

রতন বলল, জেগে আছেন দেখছি—নিন। হাসছে।—পিওনের বউ হলে কি হবে, দেমাক খুব। বলে, আমাকে অপমান করলে আমি যাব কেন, তুমি যাও। ডিশে বিস্কুটসহ গেলাসটা হাতে নিল বাপী। কমলা এলো না, স্বস্তি। রাগই যদি হয়ে থাকে তাহলে আরো স্বস্তি;কিন্তু এখানে অপমান শব্দটা খুব প্রাঞ্জল নয়। হাসতে চেষ্টা করে বলল, অপমান কি করলাম…।

—মেয়েছেলের কথা ছাড়েন। আপনার জন্যে রান্না হচ্ছে জেনেও আর পিছন থেকে ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও আপনি নাকি না খেয়ে চলে গেলেন—সেই অপমান। আর বলে কি, আপনার খাবার-টাবার এবার থেকে আমাকেং দিয়ে যেতে হবে, ও পারবে না।

বাপী বলল, কিছু দরকার নেই, কাউকে দিয়ে যেতে হবে না।

রতন এবার মাথা নাড়ল—সে হবে না। বউ বলছিল, রাতে ছেড়ে দিনেও নাকি সব দিন আপনার খাওয়া হয় না। অতিথি না খেয়ে থাকলে গেরস্তের অকল্যাণ হয় এ সম্বন্ধে বউয়ের সঙ্গে আমি একমত। দিনে আপনিও কাজের ধান্ধায় ঘোরেন, আমিও সকাল সকাল আপিসে চলে যাই—যে ক-দিন না বউয়ের রাগ পড়ে, আপনার রাতের খাবার আমিই দিয়ে যাব। ফের আপনি রাতে উপোস দিচ্ছেন জানলে বউটা সত্যি ক্ষেপে যাবে…যত দেমাকই দেখাক ওর ভেতরটা ভালো, বুঝলেন বিপুলবাবু।

বাপী একটুও খুশি হতে পারছে না। বলল, তোমার বউয়ের কি ধারণা আমি পয়সার অভাবে উপোস দিচ্ছি?

রতন জিভ কাটল।—তা কেন, ছি-ছি-ছি, বউও জানে নিজের খেয়ালে থাকেন, তাই সময়ে খাওয়া হয় না—এই জন্যেই তো আরো বেশি মায়া। আপনার যদি সম্মানে লাগে না-হয় মাসের শেষে ধরে দেবেন কিছু—খাওয়াটা তো হবে।

আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝে বাপী চুপ। রতন বনিক এবারে একটু নিরীক্ষণ করে দেখল ওকে।—আপনার কপালের রঙ এখন অবশ্য আরো একটু কালো হয়েছে…তা ভাল হবার আগে অনেক সময় অমন হয়। আপনার দিন ফিরতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না, দেখে নেবেন।

হাত বাড়িয়ে ডিশ আর গেলাস নিয়ে রতন চলে গেল। বাপী বিমনা একটু। এরকম আশার কথা রতন অনেক বলেছে। বাপী কানে তোলেনি। কখনো বা হেসেছে। আজও ওর কথা বেদবাক্য ভাবছে না। শুধু রতনের এই বিশ্বাসের জোরটুকুই ভিতর থেকে যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে।

মাথার মধ্যে সময়ের একটা হিসেব ঘুর-পাক খাচ্ছিল বাপীর। স্নান সেরে জামাকাপড় বদলে সেই সময় ধরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ট্রাম বা বাস ধরার দরকার নেই, হাতে সময় যথেষ্ট। হাঁটার ব্যাপারে পা দুটো বাধ্যও খুব। ট্রাম-বাসের ভিড়ে হাঁপ ধরে।

…সাতাশি নম্বরের সেই বাড়ির রাস্তা সকলের জন্য খোলা। শুধু বাপীর জন্য নয়। কিন্তু খোলা থাকলেও বাপী আজ ও-পথ মাড়াতো না। পাড়ার ওই ছেলেগুলোর হামলা করার কোনো দরকার ছিল না। ওদের চোখের সাধ মেটানোর ভাগীদার নয় বাপী। পরের ভাবনা তাকে এমনিতেই ভাবতে হত। ভাবা হয়েছে।

সাতাশি নম্বর বাড়ির সাদাটে গাড়ি রাস্তার বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ে। তারপর ডাইনে যায় কি বাঁয়ে, উত্তরে কি দক্ষিণে সেটুকুই আজ দেখা দরকার। আজ আর এর বেশি কিছু নয়।

সাদা গাড়ির নম্বরসুদ্ধু জানা। তাই বড় রাস্তার মুখোমুখি দাঁড়ানোরও দরকার নেই। সেখান থেকে কম করে একশ গজ দূরে একটা গাড়িবারান্দার নিচে এসে দাঁড়াল। সময় ধরে এসেছে, খুব অপেক্ষা করতে হবে না জানে। আট-দশ মিনিটের মধ্যে সেই সাদা গাড়ি বড় রাস্তার মুখে। ভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বাপী জানে না। হর্ন বাজিয়ে গাড়িটা বাঁয়ে অর্থাৎ বাপী যেদিকে দাঁড়িয়ে সেইদিকে ঘুরল। তারপর একশ গজ গড়াতে আর কতটুকু?

মিষ্টি গাড়ির বাঁ দিকে। আপনা থেকেই বাপীর পা দুটো ফুটপাথ ঘেঁষা রাস্তার দিকে এগিয়ে এসেছে। কয়েক পলকের মুখোমুখি, চোখাচোখি। মিষ্টি চিনেছে। চিনেছে বলতে বে-পাড়ার যে ছেলেটাকে বাড়ির সামনে কদিন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে আর গতকাল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাড়ার ছেলেগুলোর হাতে যার দুর্ভোগ দেখছে—তাকে চিনেছে। আজ এইখানে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থটাও ওর কাছে যেন খুব স্পষ্ট। সেই কটা মুহূর্তের মধ্যে বাপীর মনে হয়েছে, মিষ্টি ওকে দেখেছে আর দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকাতেও অরুচি।

গাড়িটা এগিয়ে গেল। বাপীর চোখে আগুন। বুকের তলায় সেই অসহিষ্ণু দাপাদাপি। কাল ওর পাড়ার ছেলেরা যে অপমান করেছিল, আজ এই বিতৃষ্ণা অবজ্ঞার চাউনি ছুঁড়ে ও যেন তার দ্বিগুণ অপমান করে গেল।

গাড়িটা কোন্ দিকে কোন্ রাস্তা ধরে যায় আজ শুধু একটু জানতে বুঝতেই এসেছিল। কিন্তু ওপরঅলার ইচ্ছে অন্য রকম। বাপী শ্যেনদৃষ্টিতে ওই চলন্ত গাড়িটার দিকেই চেয়ে ছিল। সামনেই বড় রাস্তার চার-মুখে দাঁড়িয়ে গেল ওটা। ট্র্যাফিকের লাল আলো জ্বলে উঠেছে। সবুজ হলে আবার চলবে।

সত্যি কেমন বরাত আজ বাপীর কে জানে। পরের যা প্ল্যান সেটা এই মুহূর্তে এভাবে হাতের মুঠোয় পাবে ভাবেনি। গাড়িবারান্দার ও-মাথায় একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। আট-দশ গজের মধ্যে। বাপী ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল। বাঙালী ড্রাইভার ঘাড় ফেরাতে আঙুল তুলে সামনেটা দেখিয়ে দিল।

বাঁ দিকে পাঞ্জাবীর বুক পকেটের ওপর হাত রেখে চাপ দিল একটু। ধপ-ধপ কতটা করছে দেখার জন্যে নয়। খুচরো পয়সা নিচের পকেটে থাকে, আর টাকা পাঞ্জাবির ভিতরের পকেটে। কলকাতার ট্রাম-বাসে চড়তে হলে সব জামার ভিতরে একটা করে পকেট দরকার সেটা নিশীথ ওকে গোড়াতেই বলে দিয়েছিল। যে কটি টাকা খরচ মাসে, ব্যাঙ্ক থেকে একবারেই তুলে ফেলে। খরচ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে-টাকা ওর জামার সঙ্গেই ঘোরে। তবু সাবধানের মার নেই। আজ জামা আর পাজামা বদলেছে। আনতে ভুলেছে কিনা একবার ওপর দিয়ে স্পর্শ করে বুঝে নিল।

সাদা গাড়ির দুটো গাড়ি পিছনে ওর ট্যাক্সি। কলকাতার ট্যাক্সিতে বাপী এই প্রথম। এর আগে বারকয়েক নিশীথের বাবার পুরনো গাড়িতে চাপা হয়েছে।… হলদে আলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই সবুজ আলো। এ-দিকের গাড়ির সারি চলল।

খুব গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে বলল, ওই সাদা গাড়িটার পিছনে চলুন তো…। গাড়ির নম্বরও বলে দিল।—গাড়ির ওই মেয়েটি যে কলেজে পড়ে, আমার আগে সেখানে একবার যাওয়া দরকার, কলেজের নামটা মনে পড়ছে না…।

সাদা গাড়ির পিছনের কাচ দিয়ে ওই মেয়ের শুধু মাথা আর গলা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের উৎকণ্ঠার পর বাপী নিশ্চিন্ত একটু।—মিষ্টিদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করতে গিয়ে জ্যোতিষীর হাতে নাকাল হওয়াটা ভোলেনি। ড্রাইভার ঘাড়ও ফেরালো না। সাদা গাড়ির পিছনে চলল।

হাজরায় সাদা গাড়ি ডাইনে বাঁক নিল। বাপীর ট্যাক্সিও। তারপর বেশ খানিকটা সোজা গিয়ে তারপর কোথা দিয়ে কোথায় চলল ঠাওর করা গেল না। এদিকের সব রাস্তাই বাপীর অচেনা। আরো খানিক বাদে সচকিত। এবারে চেনা লাগছে জায়গাটা। গাড়ি আর পিছনে ট্যাক্সি পার্ক সার্কাসের ময়দানের দিকে চলেছে। মণিদার বাড়ি থেকে মাইল দেড় দুই হাঁটা পথ। ওই ময়দানে বাপী অনেকবার এসেছে। …ট্যাক্সি এখন ছেড়ে দিলেও চলে। বাপী বুঝে নিয়েছে ওই মেয়ের কোন কলেজ। মেয়েদের একটাই নামডাকের কলেজ এখানে।

সামনের সাদা গাড়ি বড় ফটকের সামনে থাকল। মস্ত কাঠের গেটের এক পাট খোলা। বাপী পঁচিশ-তিরিশ গজ পিছনে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালো। সাদা গাড়ি থেকে নেমে মিষ্টিকে ভিতরে ঢুকে যেতে দেখল। গাড়িটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বাপী ট্যাক্সি থেকে নামল। মিটার দেখে ভাড়া মেটানোর সময় ট্যাক্সিঅলা শুধু মুখের দিকে তাকালো একবার। সে হয়তো আশা করেছিল তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ট্যাক্সিতে উঠে বাপী বলেছিল, মেয়েটি যে কলেজে পড়ে আগে একবার সেখানে যাওয়া দরকার। মুখে কিছু বলল না ট্যাক্সিঅলা, কিন্তু একবার চোখ তাকিয়ে যেন বলে গেল তোমার মতো সোয়ার আমার অনেক দেখা আছে।

পায়ে পায়ে ফটকের দিকে এগলো। গাড়িতে বাসে পায়ে হেঁটে দলে দলে মেয়ে আসছে আর ঢুকে যাচ্ছে। কলেজের চারদিক ঘেরা উঁচু পাঁচিল। এক-পাট খোলা ফটকের ভিতর দিয়ে সামনের বিশাল হলদে দালান দেখা যাচ্ছে। দুদিকে বাগান।

…না, এখন নয়। আরো ঘণ্টা কয়েক বাদে। বাপীর আর তাড়া কিছু নেই। ফিরে চলল। ময়দানে ঘোরাঘুরি করে কাটাল খানিক। তারপর আবার রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে একটা বড় রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেল। নিশীথের সঙ্গে ছোট রেস্তরাঁয় খেয়েছে। কিন্তু এইদিন অন্য সব দিনের থেকে তফাৎ কিছু হবেই। ঢুকে পড়ল। মুখ-হাত ধোবার জায়গায় বড় আয়না। নিজেকে দেখে নিল। পা-জামার বদলে পরনে ধুতি থাকলে ভাল হত। তবু পাটভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবিতে খারাপ দেখাচ্ছে না। এ ব্যাপারে গৌরী বউদি ওকে একটু শৌখিন করে দিয়েছিল।

বেশ করে খেয়ে নিল। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। হোক। সব থেকে বড় ফয়সলাই হয়তো আজ হয়ে যাবে। ছোট কিছু ভালো লাগছে না।

বাপী কিছু চিন্তা করছে না। কিচ্ছু ভাবছে না। সব ভাবনা-চিন্তা পরে। এলোমেলো ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাতে লাগল। দুটো যেন আর বাজবেই না।

বাজল একসময়। বাপী তখন কলেজ-ফটকের কাছাকাছি। দারোয়ান বসে আছে একজন। এখান থেকেই বাধা পড়বে কিনা কে জানে। না, কিছু বলল না। বাপী সোজা কলেজের দালানের দিকে চলল। দু-দিকের বাগানে দুটো-চারটে করে মেয়ে বসে।

হলঘরের সামনের কাঠের বেঞ্চিতে জনাতিনেক বেয়ারা বসে। ওদের মধ্যে বুড়ো মতো অবাঙালী লোকটাকে ডাকল। সে উঠে এলো।

—মালবিকা নন্দীকে চেনো? থার্ড ইয়ারে পড়ে।

পুরনো বেয়ারা, পুরনো ছাত্রীদের অনেককেই চেনে।—মালবিকা নন্দী কোন ডিপার্ট, হিস্টরি?

বাপী মাথা নাড়ল।

—কি দোরকার আপনার?

—খুব দরকার—একটু যদি খবর দাও…

আঙুল তুলে সে একটা ঘর দেখিয়ে দিল।—ওই আপিস ঘরে গিয়ে বোসেন—শিলিপ ভেজিয়ে দেন—

বাপী বলল, তুমি একটু সাহায্য করো না ভাই, আমি বাইরে থেকে এসেছি, কিছুই জানি না, একটা খবর দেওয়া খুব দরকার।

বিনয়ে তুষ্ট প্রায় সকলেই। আধবুড়ো বেয়ারা ওকে সঙ্গে করে আপিস ঘরে নিয়ে এলো। কেরানীবাবুকে নিজেই কি বলে একটুকরো সাদা কাগজ ওর হাতে দিল।—আপনার নাম লিখে দেন, আওর ঠিকানা।

পেন্সিলও সে-ই এগিয়ে দিল।

বাপী প্রথমে লিখল, মালবিকা নন্দী। তলায় লিখল, বাপী তরফদার। বানারজুলি ফরেস্ট।

বেয়ারা স্লিপ নিয়ে চলে গেল। বাপী আবার বাইরের বারান্দায়।

ছটা-সাতটা মিনিট নয় যেন একটা যুগ। বেয়ারা ফিরে এসে জানালো, পাঞ্চ মিনিটের মধ্যে কেলাস শেষ হোবে—ওপেক্ষা করুন, আসছেন।

অনেকক্ষণের একটা রুদ্ধশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। বাপী পায়ে পায়ে বারান্দা ছেড়ে নিচে নেমে এলো। তারপর ফটকটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

…মিষ্টি তাহলে আসছে!

সোনার হরিণ নেই – ৭

মিষ্টি এলো। বারান্দায় পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

স্লিপটা পেয়ে আগ্রহ নিয়ে নেমে এসেছিল মনে হয়। কারণ বাপীর পুরো পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। কিন্তু চোখাচোখি হওয়া মাত্র তার দু’চোখে ধাক্কা খেল। বানারজুলির বাপী তরফদার এই লোক সেটা কল্পনার মধ্যেও ছিল না। শুধু অবাক নয়, অপ্রস্তুতও। কারণ এখন হয়তো দেখা মাত্র মনে হয়েছে এই লোক বা এমন লোক বাপী তরফদার ছাড়া আর কে হতে পারে?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে থাকলে বাপী এদিকে সরে আসত না। চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। চেয়ে রইল। দু চোখে হাসি ছুঁয়ে আছে কি নেই। বাকিটুকু প্রতীক্ষা। দেখার পর আর চেনার পর ওই মেয়ে এখন যদি মুখ ঘুরিয়ে আবার ভিতরে চলে যায়, জীবনের পুরনো অধ্যায় পুরোপুরি শেষ করে নিয়ে বাপীও নিজের পা দুটোকে গেটের বাইরে টেনে নিয়ে যাবে।

শেষ নয়। বারান্দা থেকে নামল।

…পরনে গাঢ় খয়েরি রঙের ওপর চকচকে সাদা বুটির শাড়ি। গায়ে ধপধপে সাদা ব্লাউজ। পায়ে হালকা শৌখিন স্যান্ডাল। বাপী ভোলে না কিছু। বানারজুলির সাহেব বাংলোয় লাল ডুরে শাড়ি পরা দশ বছরের মিষ্টিকে দেখে। রূপকথার রাজকন্যার মতো মনে হয়েছিল। ওর সেই ঝলমলে শাড়ি সামলানোর বিড়ম্বনাটুকুও মনে আছে। …এখন এই পাতলা দামী শাড়ি দেহের ভাঁজে ভাঁজে অনায়াসে লেপটে আছে। একটুও বাড়তি নয়।

পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আসার এই নিস্পৃহ ধরনটা বানারজুলির বাংলোর থেকে সেই মিষ্টির নেমে আসার সঙ্গে মেলে কিছুটা। আসার আগ্রহ যদি থাকেও, বুঝতে দিতে আপত্তি। দেড় গজ তফাতে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একটুকরো হাসি ঠোটের ফাঁকে যেন এসেই গেল।

—এত দিনে চিনতে পেরেছ তাহলে?

বাপীর গলায় বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। অভিমানও না।

সোজা মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি দেখছে ওকে। বানারজুলির সেই দুরন্ত দস্যি ছেলেটাই যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাসল। মাথা নাড়ল। চিনতে পেরেছে। হাসিমাখা কালো দুচোখ ওর মুখের ওপর নড়াচড়া করল একটু। জিজ্ঞাসা করল, তুমি চিনলে কি করে?

চোখে এর মধ্যে ওকে অনেকবার দেখেছে। আর মনে মনে তো অবিরাম দেখে চলেছে। আট বছর বাদে গলা এই প্রথম শুনল। কচি ছেলের মতো হাল্কা মিষ্টি

বাপী কি জবাব দেবে? বলবে গত আট বছরের মধ্যে আটটা দিনের জন্যেও তুমি আমার চোখের আড়ালে ছিলে না—আমি চিনব না কেন? গদ্যাকারের সত্যি কথাই বেরুলো মুখ দিয়ে। বলল, তোমাদের বাড়ির রাস্তার এ মাথায় এক জ্যোতিষীর চেম্বারে রাত্রে মায়ের পাশে বসে বসে তুমি হাত দেখাচ্ছিলে…আমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম।

মাত্র দিন কতক আগে মা জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গেছল সেটা মনে না পড়ার কথা নয়। মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প আর দেখছে। একসঙ্গে অনেক দেখার আছে যেন। বলল, মা সঙ্গে ছিল বলে চিনেছ। ডেকে কথা বললে না কেন?

—এভাবে হঠাৎ তোমার দেখা পেয়ে খুব অবাক হয়ে গেছলাম।… তোমাদের বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিলাম।

—তারপর? মিষ্টি উৎসুক।

তোমরা বেরিয়ে এলে। তখনো আমাকে হাঁ করে তোমার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে তোমার মা ঝাঁঝালো গলায় স্টুপিড বলে গাড়িতে উঠলেন। তুমিও খুব বিরক্ত হয়েছিলে—

মিষ্টির মুখে মিষ্টি বিড়ম্বনার খেলা। — কক্ষনো না, আমার কিছু মনে পড়ছে না।

মনে পড়ছে কি পড়ছে না তা নিয়ে বাপীর কোনো মাথাব্যথা নেই। মন বলছে আট বছর বাদে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে ওকে দেখে আর চিনে এই মেয়ে অখুশি নয়। আট বছর আগের সেই বানারজুলির দিনগুলি এই দুটো কালো চোখে এক—সঙ্গে ভিড় করে এসেছে। আসছে।

—তোমার ক্লাস আছে?

—ছিল। হাত উল্টে ঘড়ি দেখে নিল।—ক্লাস বসে গেছে, আর ঢোকা যাবে না।

—খুব ক্ষতি হল?

মিষ্টি হেসেই মাথা নাড়ল—খুব না।

—এ ঘণ্টার পরে ছুটি?

—না, আর একটা ক্লাস আছে।

একদিন এ ক্লাসও কামাই হলে?

হাসি-ছাওয়া দু’চোখ মুখের ওপর থমকালো একটু। নাকচ করার কথা কেন যেন ভাবাও গেল না। জবাব দিল, হলে আর কে কি কচ্ছে।…আচ্ছা একটু দাঁড়াও আসছি—

কয়েক পা এগিয়েই ঘুরে তাকালো।—এই একদিনই তো?

বাপী চেয়ে রইল। জবাব দেবার মতো প্রশ্ন কিছু নয়। কান-মন ভরে দেবার মতো কিছু। হালকা পা ফেলে মিষ্টি চলে গেল।

চারদিকে চেয়ে বাপী দেখছে। এটা গতকালের সেই পার্ক নয়। মিষ্টির এই আসা বা যাওয়া গতকালের মতো দিবাস্বপ্ন নয়। কিন্তু গতকালের সেই আমেজটুকুর সঙ্গে এই বাস্তবের বড় অদ্ভুত মিল। এক আশ্চর্য শান্তিতে সেই রকমই ভিতর-বার ডুবে যাবার মতো। পার্কে পুলিশের লাঠির খোঁচায় ঘোর কাটার পরেও ঘরের দিকে পা চালিয়ে বাপী ভাবছিল, আটটা বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে কোনো নিভৃতে এই মেয়ের মুখোমুখি হতে পারলে পার্কের সেই কল্পনার ছবিটা একেবারে মিথ্যে হয়ে যাবে না। হতে পারে না।

মিথ্যে হয়নি। বিস্ময়ের সেই হাবুডুবু ব্যাপারই দেখেছে। খুশির চাপা তরঙ্গ দেখেছে। হাসিটুকুও সেই রকমই।

মানুষের ভিতরের কোন দিকটা আসল সত্য, অনুভূতির এই জোয়ারে তারও হদিস মেলা ভার। জ্যোতিষীর ঘরে মায়ের পাশে এই মিষ্টিকে দেখা মাত্ৰ অনেক—অনেক দিনের ক্ষুধার্ত স্নায়ুগুলো একসঙ্গে টান-টান হয়ে উঠেছিল। তারা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানশূন্যের মতো এই বাপী তরফদার দু’হাতের মধ্যে এসে মাকে ছেড়ে ওই মেয়েকে ব্যভিচারী দুটো চোখের বাঁধনে আগলে রাখতে চেয়েছিল। পিছনে লাল আলো জ্বেলে সাদা গাড়িটা চলে যাচ্ছিল যখন তখনো চৌদ্দ বছর বয়সের সেই প্রবৃত্তির আগুন বাইশ বছরের দেহের শিরায় শিরায় দাউ দাউ করে জ্বলছিল। পরেও সাতাশি নম্বরের বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে যতবার দেখেছে ওকে, বাসনার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলেছে। আর গতকাল বাড়ির দোতলার বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত মুখে ওর ওপর কতগুলো হায়নার হামলা দেখছিল আর মজা পাচ্ছিল যে মেয়ে—তাকে কোন পাতালে টেনে নিয়ে যেতে পারলে সঠিক জবাব হয়, বুকের তলায় সেই নরক খুঁজে বেড়াচ্ছিল। প্রবৃত্তির সেই নিষ্ঠুর আদিম অভিলাষে সমস্ত মেয়ে জাতটাকেই দগ্ধে নিঃশেষ করতে চেয়েছে। ভিতরের পশুটা থাবা চেটেছে। তারপর একজনকে না পাওয়ার আক্রোশে আর একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে। কমলা বনিক কতটা দেখেছে কতটা বুঝেছে বাপী জানে না।

আজ?

পার্কের গতকালের অনুভূতিটুকুই ঠাণ্ডা প্রলেপের মতো ভিতরের আনাচে—কানাচে ছড়িয়ে আছে। বুকের তলায় দুমড়ানো গুমরানো সেই ভীষণ যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। সেই ভয়ংকর আক্রোশ নেই। সুড়ঙ্গপথের সেই জানোয়ারটাও উধাও। তার পরিত্যক্ত শূন্য গুহা-গহ্বর খুঁজে বাপীর শান্ত দৃষ্টি আবার ওই হলঘরের বারান্দার দিকে।

আর ঘড়ি দেখেনি। তবু আট-ন’ মিনিটের বেশি হবে না বোধ হয়। মিষ্টি আসছে। হাতে দুটো মোটা বই আর একটা বাঁধানো খাতা। লালচে মুখ। চোখে এখনো হাসি চিকচিক করছে। বানারজুলির বাপী ভাবত মিষ্টি কবে বড় হবে। বড় হয়েছে। বড় হবার পর বানারজুলির সেই সব কাণ্ড যদি মনে পড়ে তাহলে কোন মেয়ের মুখে না লালের আভা ছড়াবে?

বাপী হলপ করে বলতে পারে মনে পড়েছে। নইলে আসত না। পাত্তা দিত না।

কাছে এসে হাসি মুখে মিষ্টি বলল, দাদুকে অফিস চেম্বারে একটা ফোন করলাম। গাড়ি নিয়ে আসার দরকার নেই বলে দিলাম।

এই পুরস্কারটুকুও বাপী দুটো চোখ দিয়েই গ্রহণ করল। এখানে আর দাঁড়ানোর ইচ্ছে নেই। বানারজুলির মতো এই মিষ্টি মায়ের খুব পরোয়া করে মনে হয় না। তবু গেটের দিকে পা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, তোমার মা ভাববেন না?

মিষ্টির কথাবার্তায় আগেও ঘোরপ্যাঁচ ছিল না খুব, এখনো অনেকটা তাই, পাশে চলতে চলতে হালকা সুরে বলল, মাকে নিয়েই মুশকিল, সব সময় বেশি ভাবে—

—কি রকম?

—তাঁর ধারণা, দুনিয়ার সব ছেলে তাঁর মেয়েকে গিলে খাবার জন্য হাঁ করে আছে। হেসে ফেলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একবার।—কোথায় যাচ্ছি, এখানে তো বানারজুলির মতো জঙ্গল নেই…

কথাগুলো ডবল হলেও একেবারে সবল ভাবা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে সহজ হবার দায় বাপীরই। সেও তাকালো একবার। স্বীকার করে নিয়েই জবাব দিল।— না, এখানকার জঙ্গল বানারজুলির মতো নয়…।

—এখানকার জঙ্গল মানে? মিষ্টির মুখে পলকা বিস্ময়।

বাপী হাসছে অল্প অল্প। গেটের বাইরে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। হালকা করে একটু ভারী জবাবই দিয়ে বসল।—বানারজুলির জঙ্গলে আর যাই বলো কোনরকম কৃত্রিমতা আর ছলনা নেই। পাঁচ মাস হল এসে দেখছি এখানে সবটাই তাই। শব্দ করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সামাল দেবার চেষ্টা। বলল, কেবল এই খানিকক্ষণ হল অন্য রকম লাগছে—

অর্থাৎ খানিক আগের এই যোগাযোগের পর থেকে কৃত্রিমতা বা ছলনা দূরে সরেছে। মিষ্টির আয়ত দু চোখ ওর মুখের ওপর।

কি দেখছে বাপী অনায়াসে বলে দিতে পারে। নিজের গায়ের রং কোনদিনই ফর্সা নয়। কিন্তু ছাঁদ-ছিরির কিছু প্রশংসা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে। ড্রইং—মাস্টার ললিত ভড় বলতেন, ললিত-ঋজু-দাক্ষিণ্যে পুষ্টু হলে তবে পুরুষ। লক্ষ্য করলে ওর মধ্যেও পুরুষের এই দাক্ষিণ্যটুকুর এখন মেয়েদের চোখে পড়ে। রতন বনিকের বউ কমলা বনিকের চোখে পড়েছে। মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখে পড়েছে। ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমের মেয়ে ঊষার চোখে পড়েছে। মিষ্টির চোখেও পড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ভেতর দেখে নেওয়ার চেষ্টা। বানারজুলি জঙ্গলের চৌদ্দ বছরের বেপরোয়া ছেলের সেই হিংস্র লোলুপ তাড়না কতটা আড়াল নিয়ে আছে বোঝার চেষ্টা।

বাপীর মজা লাগছে। মুখে কিছু না বলে ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। মিষ্টি সচকিত। বাংলো থেকে ওকে বার করে জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাতের ওপর দখল নিত তাও মনে না পড়ার কথা নয়।—কি?

বইখাতা আমাকে দাও।

মিষ্টি হেসে ফেলল। দিয়েও দিল।

বাপী বলল, শহরের রীতি অনুযায়ী এখন কোথাও গিয়ে তোমাকে একটু চা খাওয়ানোর প্রস্তাব করা উচিত বোধ হয় …

তেমন হেসেই মিষ্টি জবাব দিল, শহরের রীতি অনুযায়ী আমারও সায় দেওয়া উচিত।

সামনের দিকে এগলো দুজনে। বইখাতায় নরম হাতের স্পর্শ লেগে আছে। সংগোপনে সেটুকু অনুভব করার লোভ বাপীর।

মিষ্টি এদিকে ফিরল। দু চোখে কৌতূহল ছেয়ে আছে।—জ্যোতিষীর ওখানে দেখে তুমি আমাদের বাড়ি চিনলে কি করে?

বাপী ঘটা করে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা।—সেজন্য অনেক মেহনত করতে হয়েছে। প্রথম সেই জ্যোতিষীর কাছ থেকে মিথ্যে অজুহাতে ঠিকানা আদায় করতে গিয়ে চোরের দায়ে ধরা পড়ার দাখিল হয়েছিল।

চলতে চলতে সকৌতুকে আবার ঘাড় ফেরালো মিষ্টি।—তারপর?

—তার পরের দিন দুপুর থেকে তোমাদের ওই রাস্তা চষেও কোনো হদিস পাওয়া গেল না। শেষে কলেজ স্ট্রীটে এক বন্ধুর বাড়ি এসে টেলিফোন ডাইরেকটরিতে তোমার বাবার নাম খোঁজা হল—

—বাবা তো অল ইণ্ডিয়া সার্ভিসে চলে গেছেন, এখন মধ্যপ্রদেশে পোস্টেড, আমি আর মা দাদুর কাছে থাকি, টেলিফোন দাদুর নামে—পাবে কি করে।

—পাইনি। এরপর তোমাদের গাড়ীর নম্বর সম্বল। সেটা মনে ছিল। বন্ধুর সাহায্যে মোটর ভেহিকিলস-এ এসে একজন দালালকে এক টাকা ঘুষ দিয়ে তবে ঠিকানা হাত করা গেল।

সাদামাটা সত্যি কথার সহজ প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ্য করছে বাপী। মিষ্টি হাসছে। আগের কথা ভোলেনি বলেই অবিশ্বাস করছে না। বলল, ঠিকানা হাতে পেয়েও বাড়িতে না ঢুকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে কেন?

—তোমার মায়ের ভয়ে।

বিব্রত মুখে মিষ্টি বলল, ভিতরে এলে মা কি তোমাকে সেই বানারজুলির মতো তাড়া করে আসত নাকি?

তেমনি সাদাসিদে মুখে বাপী জবাব দিল, না চিনেই স্টুপিড বলেছিলেন, চিনলে তাড়া করার কথা নয়?

মিষ্টি আর যেন তেমন জোর দিয়ে অস্বীকার করতে পারল না। বাপী বলল, তবু গতকাল কপাল ঠুকে ঢুকেই পড়ব ভেবেছিলাম। অদৃষ্টে দুর্ভোগ লেখা ছিল। তোমার পাড়ার ভক্তের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে টানা-ছেঁড়া শুরু করে দিল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তুমি সেই দুর্দশা দেখেছিলে। তোমার ভক্তদের তাইতে আমাকে শায়েস্তা করার উৎসাহ আরো বেড়ে গেছল।

এও সত্যি। মিষ্টির সহজ হবার চেষ্টা।—আজ তাই অন্য রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলে?…আমার এই কলেজ জানলে কি করে?

—গাড়ি থেকে আমাকে দেখে তুমি বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলে। তখন ট্যাক্সিতে ফলো করে তোমাকে এই কলেজে ঢুকতে দেখলাম।

একটুও বাড়িয়ে বলেনি। রং ফলায়নি। আট বছর আগের ছেলেবেলার সেই দুরন্ত দস্যিকে এর সঙ্গে মেলানো সহজ নয়। কিন্তু মিলছেও আবার। জিগ্যেস করল, তারপর এই বেলা দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করে স্লিপ পাঠালে?

বাপী হাসল। বলল, স্লিপ পেয়েও তুমি আসবে কি আসবে না সন্দেহ ছিল। এতবার দেখেও যখন চিনতে পারলে না, ভাবলাম ভুলেই গেছ।

সামান্য ফিরে মিষ্টি তেরছা চোখে আর একবার দেখে নিল ওকে। পাতলা দুই ঠোট কৌতুকে টসটস করছে। তারপর সংকোচের কথাটা বেশ সহজেই বলে ফেলল।—তোমাকে চিনতে না পারলেও বানারজুলির বাপীকে ভোলা শক্ত।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হল আট বছরের ফারাকের অর্ধেকটাই জুড়ে গেছে। তরল সুরে মিষ্টি আবার বলল, তবু কদিন দেখে তোমাকে চেনা আমার উচিত ছিল।

—কেন?

—তুমি ছাড়া এত কাণ্ড আর কে করবে। কাল তো আরো চেনা উচিত ছিল।

—কেন? দু’ কান ভরে কেবল শুনতেই ইচ্ছে করছে বাপীর।

—পাড়ার ওই পাজীগুলো যখন তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তুমি দোতলার দিকে একবার ফিরে তাকিয়েছিলে। এমন তাকানো যেন অতটা দূর থেকেই একেবারে ভস্ম করে ফেলবে আমাকে।…আট বছর আগে বাবা বানারজুলি থেকে দিনাজপুরে বদলি হতে আমরা যখন বাংলো ছেড়ে জিপে করে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন ওই রকম করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে তুমি। আমার ভয়ই করছিল, এই বুঝি চলন্ত জিপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে একেবারে শেষ করে ছাড়বে।

বাপী সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেললে একটা। এ কথার পর এতদিনের ব্যবধান আরো কিছুটা জুড়ে গেল। লঘু সুরে জিজ্ঞাসা করল, কালও ভয় করছিল নাকি?

হাসি মুখে মাথা দোলালো।—তা অবশ্য করছিল না।…এখন আর কোনো ভয়-ডরের ধার ধারি না।

শেষেরটুকু যেন পুরনো দিনের এক দামাল ছেলেকে শোনানোর জন্যেই। বাপী সামনে হাঁটছে, কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। চেয়েই আছে। সেটুকু অনুভব করার ফলে আবার চোখোচোখি। মিষ্টির ভুরুর মাঝে পলকা একটু।—কি দেখছ?

—মিষ্টি।

হেসে উঠল।—জল দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে কচ্ছে?

বাপীর হাসিতে খুশির বিড়ম্বনা। আট বছরের ফারাক এবারে জুড়েই গেল বুঝি। দিনমানের এই কলকাতা না হলে হাত বাড়িয়ে আগের মতো ওর একখানা হাতের ওপর দখল নেওয়াও একেবারে অসম্ভব কিছু হত না।

এবারে মিষ্টি গম্ভীর একটু। কিন্তু হাসির ছোঁয়া লেগেই আছে। বলল, এখানে আমি মালবিকা, এক মা আর দাদু শুধু মিষ্টি বলে ডাকে।

—দীপুদা?

—দাদা বিলেতে!

ভালো খবর। তাকে নিয়ে বাপীর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। বলল, আমি মিষ্টি ছাড়া আর কিছু ডাকতে পারব না—

তার দিকে না ফিরে এবার একটু নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল, তেমন ডাকা—ডাকির চান্স পাচ্ছ কোথায়…।

বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো। এই জবাব আশা করেনি। আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে হাল্কা গলায় জোর দিয়ে বলল, আমি কোনো চান্সের ওপর নির্ভর করি না, গত আট বছর ধরেই ডেকে চলেছি, কোনো একটা দিনও বাদ পড়েনি।

মিষ্টি ঘাড় ফিরিয়ে সোজা তাকালো এবার। মুখ আরো একটু গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটে হাসির আভাস। চোখের কোণেও। তবু বাপীর মনে হল এতক্ষণের সহজ স্পষ্টতা থেকে ওর যেন একটু তফাতে সরার চেষ্টা। মন্তব্যের সুরে মিষ্টি বলল, ভালো কথা নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ-প্রসঙ্গ বাতিল।—কটা দোকান তো পার হয়ে গেল, চা খাওয়াবে কোথায়?

বাপী অপ্রস্তুত।—তাই তো, তোমাকে কাছে পেয়ে কেমন দিশেহারা দেখো…ভুলেই গেছলাম।

কাছে পাওয়ার কথাটা এমন নিঃসংকোচে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে যে মিষ্টি আবারও না তাকিয়ে পারল না। বাপী বুঝল। কিন্তু বুকের ভিতরটা তার ভরাট এখন। মনে মুখে লাগাম নেই। বরং ওই মুখের বিড়ম্বনাটকু রসিয়ে দেখার মতো।

সামনের বড় রেস্তরাঁয় ঢুকে পড়ল। পাশে মিষ্টি। বাপীর বাদশাই মেজাজ। পর্দা ঠেলে একটা ক্যাবিনে বসল। মুখোমুখি মিষ্টি। বেয়ারা হাজির।

—চায়ের সঙ্গে আর কি খাবে বলো।

দু চোখ মুখের ওপর তুলে মিষ্টি কিছু বুঝতে চেষ্টা করল।—সেই সকাল দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করলে, সমস্ত দিনে তোমার খাওয়া হয়েছে কিছু?

কথাগুলো একটু দরদের স্পর্শের মতো কানের ভিতর দিয়ে বুকের দিকে এগোতে থাকল। বাপীর খুব ইচ্ছে হল মাথা নাড়ে, বলে হয়নি। বলা গেল না। এই দিনে কোনো মিথ্যের জায়গা নেই। সরস সত্যি জবাবই দিল।—ভাগ্যটাকে ভালো করার ঝোঁকে অন্য দিনের থেকে আজ বরং ভালো খাওয়া হয়েছে।

—তাহলে শুধু চা-ই হোক।

—তা কখনো হয়। বাপী সাগ্রহে টেবিলের মেনু কার্ড দেখতে লাগল। কিন্তু কি ছেড়ে কি আনতে বলবে ভেবে পেল না। আজ কোনো হিসেবের দিন নয়। মেনু কার্ডে যা আছে সব আনতে বললে কি হয়?

কিন্তু চায়ের সঙ্গে মিষ্টি শুধু একটা মাছের ফ্রাই ছাড়া আর কিছু নিতে রাজি হল না। অগত্যা দুজনেরই তাই। অর্ডার নিয়ে বেয়ারা চলে গেল। মিষ্টি বাপীর দিকেই চেয়ে আছে। ব্যস্ততা দেখে টিপটিপ হাসছে।

—ছেলেবেলায় তুমি কিন্তু বেশ খেতে ভালবাসতে।

—মিষ্টি চট করে জবাব দিল, ছেলেবেলা আর কদিন থাকে।

বাপীর আবারও মনে হল, প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর এই মেয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিচ্ছে। কথা কম বলছে। শুনছে বেশি। দেখছে আরো বেশি। শোনা বা দেখাটা নিরাসক্ত নয় অবশ্য। দেখে শুনে বা বুঝে পা ফেলার মতো শুধু নিজের সম্পর্কেই সতর্ক একটু। অস্বাভাবিক নয়। বাপীর ছেলেবেলাটা এই মেয়ের কাছে এক বিষম স্মৃতি বটেই। তাই ছেলেবেলা নাকচ করে ওকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা।

কিন্তু বাপীর কাছে তার ছেলেবেলার জোরটাই সব। সেই জোরেই এ মেয়ের আজ দু-দুটো ক্লাস কামাই। সেই জোরেই আট বছর বাদে মুখোমুখি হবার সঙ্গে সঙ্গে কালো চোখের গভীরে আগ্রহের বন্যা। নিজেকে নিয়ে ও এখন একটু হিসেবী হয়ে উঠছে মনে হতে বাপীর মজাই লাগছে।

বয় বড় ডিশে দুটো ফ্রাই এনে দুজনের সামনে রাখল। আনুষঙ্গিক টুকি-টাকি আরো কিছু সাজিয়ে দিয়ে গেল। অভ্যস্ত হাতে মিষ্টি কাঁটা-চামচ তুলে নিতে সপ্রতিভ মুখে বাপী বলল, আমি এখনো জংলিই থেকে গেছি—এ দুটো ঠিক চলবে না।

জবাবে অতি-আধুনিকতার বক্রাভাস কিছু দেখা গেল না। বরং শুনে এবং বুঝে যা করল সেটুকু আরো মিষ্টি। নিজের কাঁটা-চামচ ডিশের একপাশে রেখে বেল বাজালো। বয় আসতে বলল, ওয়াটার বোউল—

হাতের চায়ের পট আর পেয়ালা সমতে ট্রে-টা টেবিলে রেখে বয় গেল আর ফিরল। এক ট্রেতে মাঝারি আকারের দুটো সাদা বাটি। তাতে হাত ধোয়ার গরম জল।

আট বছর বাদে দাক্ষিণ্যের ভরা ডালিসুদ্ধ খসে পড়ার মতোই দিন এটা। বাপীর দুচোখে লোভ চিকিয়ে উঠছে কিনা জানে না। উঠলেও এখন আর বাপী একে ঠিক লোভ বলতে রাজি নয়। সামনে যে বসে তাকে আর নিছক লোভের দোসর ভাবতে চায় না। আরো কিছু। ঢের বেশি কিছু।

মিষ্টি টান হয়ে বসে আছে এখন। পরিপুষ্ট দু হাতের কনুই টেবিলের ওপর। দু হাতের দু জোড়া আঙুলের মাথায় ফ্রাইটা ঝুলছে। অল্প অল্প দাঁতে কাটছে আর টুকটাক এটা সেটা জিজ্ঞাসা করছে। বাপী জবাব দেবে, না এই সহজ সুঠাম ভঙ্গীটুকু দেখবে?

মিষ্টি পিসীর কথা জিজ্ঞাসা করল। তারপর বাবার কথা। কেউ নেই শুনে চাউনি উতলা একটু।—তোমার আর কে থাকল তাহলে?

কে থাকল বলায় একটা অদম্য লোভ ঠেলে তল করতে হল। কিন্তু চোখে গোপন থাকল না বোধ হয়। কারণ এই চোখে চোখ পড়তে মিষ্টির দুই হাতের আঙুলে ঝোলানো ফ্রাইয়ে বড় কামড় পড়ল একটা। চকচকে দাঁতের সারি দেখা গেল। দৃষ্টিও প্লেটের দিকে নেমে এলো।

একটু পরেই ঠোঁটের ফাঁকে আবার চাপা হাসি।—তোমাদের সেই বনমায়ার খবর কি?

প্রসঙ্গান্তর সরস বটে।—গত চার-পাঁচ বছরের খবর রাখি না। তার আগে পর্যন্ত বছরে একবার করে সাধ্বী মেয়ের মতো বনমায়া সেই একই পুরুষ-হাতির সঙ্গে শিকল ছিঁড়ে পালিয়েছে আর ওর সময়মতো ফিরেও এসেছে। এখনো সেই রকমই চলছে মনে হয়।

মিষ্টির মুখে লালের ছোপ একপ্রস্থ। সেধে বিড়ম্বনা ডেকে আনা। তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করল, আর তোমার জঙ্গল-গুরু সেই আবু রব্বানী?

বাপী হাসছে মিটিমিটি।…বীটম্যান হবার পর সেও এক বীটম্যানের বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে দেখেছিলাম। সেই লোকটা মদে বেহুঁশ হয়ে থাকে, আর হুঁশ ফিরলে বউ ঠেঙায়। আবু তার লিভার পচে মরার অপেক্ষায় ছিল, এতদিনে বউটাকে নিজের ঘরে এনে তুলতে পেরেছে বোধ হয়।

—কি বিচ্ছিরি। মিষ্টির মুখ আরো লাল। ফ্রাইয়ের শেষের সামান্যটুকু ডিশে ফেলে রুমালে হাত মুছে চায়ের পটসুদ্ধ ট্রে-টা কাছে টেনে নিল।

বাপীর আগেই খাওয়া হাত-মোছা শেষ। টেবিল থেকে মিষ্টির মোটা বইটা হাতে তুলে নিল। খুলে দেখল, ইংরেজি ইতিহাস বই। আর একটু কাছে তুলে সন্তর্পণে নিঃশ্বাস নিল। প্রত্যাশিত একটা সুবাস বইটার মধ্যেও ছড়িয়ে থাকতে পারে।

বইটা আবার যথাস্থানে রেখে জিগ্যেস করল, হিস্ট্রি অনার্স পড়ছ?

চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে মিষ্টি মাথা নেড়ে সায় দিল।

—থার্ড ইয়ার তো?

—তুমি জানলে কি করে?

—আমার হিসেব আছে। ম্যাট্রিকে তুমি ইতিহাস আর সংস্কৃতয় লেটার পেয়েছিলে, আই-এতে শুধু ইতিহাসে। হিংসেয় আমার বুক চড়চড় করেছিল। এখন আনন্দ হচ্ছে।

মিষ্টির দু চোখ এবার যথার্থ বিস্ফারিত।

খুশির মেজাজে রহস্যটা এবারে নিজেই ফাঁস করল বাপী। তোমার পাশের দু বছরের দুটো গাবদা গেজেট আমাকে পড়তে হয়েছে—কলকাতার সব কটা মালবিকা নন্দীর থেকে ঠিক তোমাকে বেছে নিয়েছি।

এই ছেলের অসাধ্য কি, মিষ্টি যেন নতুন করে আবার তাই দেখছে। চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিল। নিজের পেয়ালা কাছে টেনে নিল। এখন গম্ভীর-গম্ভীর। কেন বাপী আঁচ করতে পারে। আজও ও কত আগ্রহ আর কত কৌতূহল নিয়ে বসে আছে সেটা বড় বেশি স্পষ্ট।

—গেজেট পড়ে তোমার হিংসে হত কেন? নিজে ওদিক মাড়াওনি?

আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে বাপীর নিজেরও বলার তাগিদ। জানানোর তাগিদ ছেলেবেলার মতো প্রবৃত্তিসর্বস্ব হয়েই গত আটটা বছর কাটিয়ে দেয়নি। নিজের বিদ্যে-বুদ্ধির বড়াই কখনো করেনি, আজও করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এই একজনেরই যেন ওর সবটুকু জানা দরকার, চেনা দরকার, বোঝা দরকার।

তাই বরাতজোরে নিজের ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করার কথাটা এসেই গেল। পাশের পরে জঙ্গলের ছোট কেরানীর চাকরি না নেওয়ার জন্য বাবার সঙ্গে মন-কষাকষি আর বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি পালানোর কথাও। তারপর চার-চারটে বছর টিউশনের জোরে আর কপালজোরে আই. এসসি. আর ডিস্টিংশনে বি. এসসি. উতরে যাওয়ার বৃত্তান্ত

হালকা চালেই বলেছে। প্রাণান্তকর অনিশ্চয়তা বা অনটনের দিকটাও ফাঁপিয়ে তোলেনি। মিষ্টির অপলক দু চোখ ওর মুখের ওপর। যেটুকু বোঝার বুঝেছে হয়তো।

—তারপর কলকাতায় কি, চাকরি না এম. এসসি.?

বাপী হাসতে লাগল।—চাকরি। এখানকার এক বন্ধুর সাহায্যে একটা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি যোগাড় করে চলে এসেছিলাম। দেড় মাসের ওপর হয়ে গেল সেটাও গেছে—

পরের প্রশ্নটা যাতে করে সেই আশা নিয়েই বাপী ওরকম হাসছিল। —চাকরি গেল কেন?

—যুদ্ধের আপিসের টেম্পোরারি চাকরি…তবে আমার গেল অন্য কারণে। হাসিটুকু এখন শুধু চোখে লেগে আছে বাপীর।— সেখানকার বড়বাবুর এক মাত্র মেয়েকে বিয়ে করে গলায় ঝোলাতে রাজি হলে চাকরিতে প্রমোশন হত আর তাদের বাড়িটাও দখলে আসত। রাজি হলাম না বলে সেই মেয়ে যেমন মনমরা তার বাপের তেমনি রাগ। এই দুইয়ের ধাক্কায় চাকরি খুইয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম।

যেভাবে বলল, মিষ্টিরও হেসে ফেলার কথা। কিন্তু মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। শোনার পর চায়ে মনোযোগ।

মিনিট পনের বাদে পায়ে পায়ে বড় ময়দানের দিকে আসছিল দুজনে। ময়দানের অন্য প্রান্তে সেই সভা। গান্ধী-প্রয়াণের শোকসভা। আটচল্লিশের ফেব্রুয়ারির দশ কি এগারো তারিখ এটা। এরই মধ্যে বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। দুজনের কারো সঙ্গেই গরম কিছু নেই। কিন্তু বাপী অন্তত ঠাণ্ডা গরম কিছুই টের পাচ্ছে না।

এবারে সামনের রাস্তার দিকে এসে মিষ্টি দাঁড়িয়ে গেল। স্বাভাবিক সুরেই বলল, আর দেরি করলে মায়ের বকুনি খেতে হবে।

বাপীও মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ যাবৎ কেন যেন চিনচিন করছে ভিতরটা। সেটা আরো বাড়ল। আবার কবে দেখা হবে?

—অনার্স ক্লাস তো বেশি কামাই করা চলে না, ওদিকে ক্লাস শেষ হবার আগেই দাদুর গাড়ি এসে হাজির হয়—

—আমি জিজ্ঞেস করছি, আবার কবে দেখা হবে?

মিষ্টির দু চোখ এবারে ওর মুখের ওপর থমকে রইল।—তুমি থাকো কোথায়?

শিরায় রক্তের তাপ বাড়ছে বাপীর। গড়গড় করে বলে গেল, ভবানীপুরের টালি কোয়াটারস-এ। আসলে সেটা একটা টালির বস্তি। পঁচিশ ঘর বাসিন্দা থাকে। চাকরি যাবার পর সে অফিসের পিওন রতন বনিক আর তার বউ কমলা বনিক সেখানে তাদের একটা খুপরি ঘরে আমাকে আদর করে রেখেছে।…শুনে আরো ঘাবড়ে গেলে বোধ হয়?

হকচকিয়ে গেল যে তাতে কোনো ভুল নেই। বাপীর দু চোখ তার মুখের ওপর এঁটে বসল আরো।—শোনো মিষ্টি, কেরানীগিরির চাকরির আশায় আমি কলকাতায় ছুটে আসিনি—এসেছি একদিন না একদিন তোমার দেখা পাব বলে! আজই আমি খুব ভালো করে জেনেছি, লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হওয়াটা যেমন

আমার অদৃষ্ট নয়, রতন বনিকের বস্তিতে থাকাটাও তেমনি আর বেশিদিনের সত্যি নয়। সব বদলাবে, একেবারে অন্য রকম হয়ে যাবে—তুমি চাইলেই হবে।

মিষ্টি শুনছে। চেয়েও আছে। ঠোটের ফাঁকে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা।— ভালো কথা তো, আমি চাইব না কেন…

—তাহলে কবে দেখা হবে, কাল বিকেলে তোমাদের বাড়ি যাব?

মিষ্টি যেন নিজের সঙ্গেই যুঝছে।—পাড়ার সেই ছেলের দঙ্গল আছে না? বাড়িতে মা আছে না? মায়ের আজকালকার মেজাজ জানো?

বাপী কানেও নিতে চাইল না। পাড়ার ছেলেদের আমি পরোয়া করি না। মায়ের ভাবনা তোমার। যাব?

মিষ্টির ঠোটের ফাঁকের আয়াসের হাসিটুকু মিলিয়ে যেতে লাগল। আয়ত কালো দু চোখ বাপীর মুখের ওপর স্থির হয়ে বসতে লাগল। দেখছে। দেখছেই। অপলক।

—দেখা করতেই হবে?

—দেখা করতেই হবে।

—তাহলে এসো।…তবে বাড়িতে নয়।

—কোথায়?

—লেক চেনো?

মাথা নাড়ল। চেনে!

একটা নিশানা বলে দিল।——কাল বিকেল সাড়ে চারটেয় এসো। আমি বাসে চলে যাচ্ছি, সঙ্গে আসার দরকার নেই।

উল্টো দিক থেকে বাস আসছে একটা। হনহন করে রাস্তা পার হয়ে গেল। বাস এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে উঠে পড়ল।

বাসটা ছেড়ে যাবার পরেও বাপী নিশ্চল দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণের একটা দমবন্ধ নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে মুক্তি পেয়ে বাঁচছে।

.

রাতের খাবার কে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছল বাপী জানে না। সকালে আজও চা-রুটি নিয়ে রতন বনিক ঢুকল। কমলা নয় অর্থাৎ কমলা বনিকের রাগ হোক বা আর কিছু হোক এই দুদিনেও সেটা তেমনি আছে।

সে না আসায় গতকালের থেকে আজ আরো বেশি স্বস্তি।…কমলা বনিকের সামনে সেদিনের সেই হিংসলোলুপ মুহূর্তের ছায়াসুদ্ধু মুছে দিতে পারলে বাপী তরফদারের আত্মশুদ্ধি হত। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও কমলার পরের আচরণ ভোলেনি। আজকের এই দিনে বাপী সেই স্মৃতি থেকেও নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসতে চায়।

রতন বলল, আজ আবার একটু ফ্যাসাদ হয়েছে বিপুলবাবু, নাইট ডিউটি পড়েছে। ওই দেমাকীকে বুঝিয়ে বললাম, আজকের রাতে অন্তত আপনার খাবারটা যেন দিয়ে যায়। কিছু বলল না… দেবে নিশ্চয়, রাগ করুক আর যাই করুক, আপনার ওপর দরদ তো একটু আছেই—

বাপীর মুখে গরম চায়ের ছেঁকা লেগে গেল। তাড়াতাড়ি বাধা দিল, না-—না, তার কিছু দরকার নেই, রাতে আমি খেয়ে আসব।

—তা কি হয়!

বাপী সত্যি বিরক্ত।—–কথা শোনো, রাতে আমার এক জায়গায় খাবার কথা আছে, আমি নিজেই তোমাকে বলতাম—ওকে বারণ করে দাও আজ খাবার রাখার দরকার নেই।

বাপী মিথ্যে বলেনি খুব। সকালে ঘুম ভাঙতেই ভেবে রেখেছে বিকেলের কথাবার্তার পর সন্ধ্যায় মিষ্টিকে কোনো ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাতের খাওয়া সারবে। মিষ্টির কোনো ওজরআপত্তি শুনবে না।

বেলা বারোটা নাগাদ একেবারে তৈরি হয়ে বেরুলো। আগে ব্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা তুলতে হবে। এ মাসের খরচটা হিসেবের মধ্যে থাকবে না। সঙ্গে কিছু টাকা থাকা ভালো। তারপর দুপুরে কোথাও যা হোক কিছু খেয়ে নেওয়া। তারপরের সময়টুকু কি করে কাটাবে সে দেখা যাবে।

ঘরের বাইরে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ও-ঘরের দাওয়ার সামনে কাঠের থামে ঠেস দিয়ে কমলা দাঁড়িয়ে। একঝাঁক খোলা শুকনো চুল পিঠে ছড়ানো। চান করেনি এখনো।

ওকে দেখে একটুও নড়ল না। চোখ বেঁকিয়ে তাকালো।

বাপী তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে উঠোনে নামল। তারপরেই সহজ হওয়ার তাড়না একটু। না এগিয়ে কমলার দিকে ফিরল।—রাতে খাবার রাখার দরকার নেই, রতন বলেছে তো?

কমলা জবাব দিল না। মাথাও নাড়ল না। সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সেই রকমই চেয়ে রইল।

এবারে বাপীর দ্রুত প্রস্থান। ওই চাউনি নিয়েই কমলা যেন সারা গায়ে জলবিছুটি ছড়িয়ে দিল খানিকটা। আর বলতে চাইল, যত ভালো মুখ করেই থাকো, তোমার ভেতর দেখা চেনা আর বোঝা আমার হয়ে গেছে।

বাইরে এসে বাপী সেই দিনটার জন্য নিজেকেই চাবকাতে চাইল আর এক প্ৰস্থ।

অনেক ধৈর্য আর অনেক প্রতীক্ষার সেই বিকেল। ঘড়িতে চারটা পঁচিশ। দূরে দাঁড়িয়ে বাপী দেখল যেখানে থাকার কথা, মন্থর পায়ে মিষ্টি সেদিকে চলেছে। বাপী আরো বিশ মিনিট আগে থেকে একটু আড়াল নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে।

দু’চোখে খুশি উপচে উঠল। ডাকল না। নিজেও তক্ষুনি এগিয়ে এলো না। এই দেখাটুকু বাড়তি পাওনার মতো। আজ ফিকে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। মিষ্টি তো জানেও না এই রংটা বাপীর কত পছন্দ।

মিষ্টি বেঞ্চিতে বসল না। পায়ে পায়ে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। পিছন ফিরে একবার চারদিক থেকে নিয়ে আবার জল দেখতে লাগল।

বাপী এগিয়ে এলো। হাসিতে খুশিতে উদ্ভাসিত মুখ। মিষ্টি ঘুরে দাঁড়াল।

তার ঠোঁটে বা চোখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। কাল বাসে ওঠার আগে যেমন দেখেছিল তেমনি চাউনি। তারপর সামনের রাস্তাটায় দৃষ্টি ফেরালো একবার।

বাপী অবাক একটু।—কি?

মিষ্টি জবাব দিল না। তেমনি চেয়ে রইল। পরক্ষণে দু’চোখ আবার ওই রাস্তার দিকে। কি ব্যাপার ভেবে না পেয়ে বাপীও সেদিকে ঘাড় ফেরাতেই সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি একটা। মাথার মধ্যিখানে আচমকা একটা মুগুরের ঘা পড়েছে।

…হনহন করে এদিকে আসছে একজন। এসে গেছে। চেনা মুখ। পরনে ট্রাউজার আর সিল্কের শার্ট। ফর্সা রং। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। মিষ্টিদের উল্টো দিকের বাড়ির দোতলার সেই একজন। পাড়ার ছেলেদের অসিতদা।

বিমূঢ় মুখে মিষ্টির দিকে ফিরল বাপী। পরমুহূর্তে শরীরের সমস্ত রক্ত মাথার দিকে ধাওয়া করল। মিষ্টির ঠোটের ফাঁকে এখন একটু হাসির আভাস।

সোনালি চশমা হাজির।—এই যে ব্রাদার, মালবিকার কাছে তোমার ছেলেবেলার কিছু কথা আর কালকের অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনলাম। সেদিন গলাধাক্কা খেয়েও শিক্ষা হল না, আজ যে ভায়া আরো কপাল মন্দ।

মুখের কথা শেষ হবার আগেই কোথা থেকে আরো তিন-তিনটে ছেলে ছুটে এলো। পাড়ার সেই ছেলেরাই। এসেই একজন জামার বুকের কাছটা মুঠো করে ধরল।

—এই যে চাঁদ, আজ তোমাকে কোন বাবা রক্ষা করবে?

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলে উঠল, না অসিতদা, আজ আর তোমার কোনো কথা শুনছি না—চাঁদুকে তুমি আমাদের হাতে ছেড়ে দাও, আমরা ওদিকে নিয়ে গিয়ে যা বোঝাবার বেশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু পলকের মধ্যে যা ঘটে গেল তার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। যে ছেলেটা জামা চেপে ধরেছিল, মিষ্টির দু হাতের আচমকা ধাক্কায় তার হুমড়ি খেয়ে পড়ার দাখিল। মিষ্টির মুখ টকটকে লাল, ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত গলার স্বর।—এ কি? এদের কে আসতে বলেছে। ও যাতে বুঝতে পারে সেইজন্য আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম—তুমি এদের এনেছ কেন?

সোনালি চশমার ভেবাচেকা মুখ। ছেলে তিনটেরও। ওই তিনজনের দিকে ঘুরে মিষ্টি আবার ফুঁসে উঠল, যাও বলছি এখান থেকে—চলে যাও!

ছেলে তিনটে গুটিগুটি সরে দাঁড়াল একটু। রমণীর মতিগতির কুলকিনারা পাচ্ছে না তারা।

কিন্তু বাপীর পৃথিবী উল্টে গেছে। মাথায় সেই পুরনো আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছে। বুকের পাতালের শূন্য গুহায় সেই জানোয়ারের দাপাদাপি। সবার আগে ওই মেয়ের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্রূর অভিলাষ।

বাপী গলার স্বর চড়া নয়, কিন্তু সকলের শোনার মতো। মিষ্টিকে বলল, আর বোঝানোর দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি।…তোমার এই বীরপুরুষেরা যদি মায়ের ছেলে হয়, একে একে আসতে বলো, এই চারজনকেই লেকের জল খাইয়ে আনতে পারি কিনা দাঁড়িয়ে দেখো।

….কি! সোনালি চশমা রুখে এলো।

চকিতে মিষ্টি এগিয়ে এসে বাধা দিল আবার।—থাক্ হয়েছে। বাপীর দিকে ফিরল। গলার স্বর তপ্ত।—বুঝে থাকলে চলে যাও। আর এসো না।

.

রাত অনেক। সেদিনের পুলিশের লাঠির খোঁচা মনে ছিল। এত হেঁটেও পা দুটোকে অবশ করা গেল না। বাপী তরফদার ঘরের দিকে চলেছে এখন। মুখে আবার আট বছর আগের সেই রক্তের স্বাদ। ভিতরের জানোয়ারটা অবিরাম ফুঁসছে। গজরাচ্ছে।

টালি এলাকার নিঝুম উঠোন পেরিয়ে নিঃশব্দে দাওয়ায় উঠে এলো। খুপরি ঘরের দরজা ঠেলতে ক্যাঁচ করে সেই পুরনো শব্দ একটু। আজ খাবার ঢাকা নেই, তাই ডীম-করা হারিকেনও নেই। জামাটা খুলে ঘুটঘুটি অন্ধকারে দড়ির ওপর ফেলল। তারপর শরীরটা খাটিয়ার ওপর আছড়ে পড়তে চাইল।

কিন্তু এ কি! এ কি! এ কি!

মাথায় বিদ্যুত্তরঙ্গ। ভালো করে বোঝার আগেই অন্ধকারে ওই শয্যা থেকে দুটো হাত অমোঘ নিবিড় বেষ্টনে তাকে বুকের ওপর টেনে নিল। রমণীর হাত। রমণীর বুক। সর্বাঙ্গে তপ্ত স্পর্শের তড়িৎপ্রবাহ। শুকনো দুটো ঠোঁট বিস্মৃতির উষ্ণ ঘন অধরের গ্রাসে।

সোনার হরিণ নেই – ৮

রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে ট্রেন ছুটেছে। কামরার বেশির ভাগ লোক ঘুমোচ্ছে। জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ বসেই ঝিমুচ্ছে। বাপীর কারো দিকে চোখ নেই। দু’ চোখ জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে। ভিতরে আরো বেশি দমবন্ধ-করা অন্ধকার।

মা বলে কি কেউ কোথাও আছে? নিজেরই বিষে ভিতর-বার কালি হয়ে গেলেও যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়, যার বুকে মুখ গোঁজা যায়, মুখ লুকনো যায়? বুকের জমাট-বাঁধা কান্নার স্তূপ যার স্পর্শে গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়? বাপী জানে না। মা কাকে বলে জানে না। কিন্তু মায়ের মতো করে কেউ ডাকছে ওকে। বানারজুলি ডাকছে। বানারজুলির জঙ্গল হাতছানি দিচ্ছে। এত বড় পৃথিবীতে শুধু সেখানে একটু আশ্রয়। সেখানে একটু মুখ লুকানোর জায়গা।

বাপী তরফদার সেইখানে চলেছে।

সেই রাতের পর আরো দুটো রাত রতন বনিকের খুপরি ঘরে বিনিদ্র কেটেছে। নাইট ডিউটি দিয়ে রতন বনিক সকাল সাতটার মধ্যে খুশি মেজাজে ঘরে ফিরেছিল। সপ্তাহে একদিনের নাইট ডিউটিটা ওর চক্ষুশূল। বাকি ছ’টা দিন নিশ্চিন্ত। কমলা নয়, ও-ই চায়ের গেলাস হাতে করে ঘরে ঢুকেছে। জিগ্যেস করেছে, রাতে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয়েছিল তো?

নিঃশংক, নিশ্চিন্ত মানুষ। কথাগুলো তাই বিবেকের পিঠে চাবুক হয়ে নেমে এসেছিল। তার থেকে যদি বাপীর মুখের দিকে চেয়ে এই সাদাসিধে ভালোমানুষটার চাউনি ঘোরালো হয়ে উঠত, তাহলেও কিছু সান্ত্বনা থাকত। মুখের দিকে না চেয়ে বাপী বিড়বিড় করে জবাব দিয়েছে, রাতে খাব না বলেই তো রেখেছিলাম—

…সকাল দশটার মধ্যে রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু যাবে কোথায়? দুর্ভর দিন কাটবে কেমন করে? সঙ্গোপনের পশুটা প্রাণভয়ে গুহা ছেড়ে উধাও। তখন তার অস্তিত্বই নেই।

কমলা বনিক কোনদিন তার শিকার ছিল না। সেই রাতেও না। দেহ যারই হোক, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শেকল-ছেঁড়া ক্ষিপ্ত আহত জানোয়ার অপটু উল্লাসে যাকে নিয়ে বিস্মৃতির অতলে ডুবেছিল, সে আর কেউ। আর একজন। তারপর চেতনার কশাঘাতে জেগে ওঠা সেই রূঢ় বাস্তব। বাপী তরফদারের যন্ত্রণা সম্বল।

বিকেলের দিকে কে যেন লেকে টেনে এনেছে তাকে। আগের দিনের সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতর ওপর হিংস্র নখের আঁচড় পড়েছে। ফিকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে। মাথায় আগুন জ্বলেছে।

বাপী তরফদার এরই মধ্যে সচকিত। একটা অস্বস্তির ছায়া পড়ছে।… জানোয়ারটা ওঁত পেতে ছিল কোথায়। সুযোগ আর সময়ের প্রতীক্ষায় ছিল। গুটি গুটি এবারে তার আশ্রয়ের দিকে এগোচ্ছে। বিবেকের কশাঘাতে বাপী তরফদার ওটাকে ধরাশায়ী করতে চেয়েছে, নির্মূল করতে চেয়েছে। কিন্তু ওই শয়তান তার সময় জানে। সুযোগ জানে। পায়ে করে তাকে থেঁতলে থেঁতলে বাপী তরফদার হনহন করে লেক থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবু তার পায়ের শব্দ বাড়ছেই, বাড়ছেই। যত বাড়ছে, নিজের ওপর বাপীর ততো দখল কমছে

…রাত সাড়ে আটটায় কে তাকে ঘরে টেনে এনেছে। হাতের ধাক্কায় নড়বড়ে দরজা দুটো আর্তনাদ করে উঠেছে। এখন ওর কাছে পাশের ঘরের ওই একজন ক্ষমার পাত্রী নয়, দয়ার পাত্রী নয়। কোনো মেয়েই নয়। আগের রাতের তিমির তৃষ্ণার অনুভূতি হাড়ে-পাঁজরে যন্ত্রণার বাষ্প ছড়াচ্ছে।

….ছোট লণ্ঠন হাতে ঢুকেছিল রতন বনিক। খোশ মেজাজ। টেনে টেনে বলেছিল, ক’দিনের মধ্যে আজই একটু তাড়াতাড়ি ফিরলেন দেখছি

সকালে যে মানুষটার কথায় বিবেকের চাবুক পড়েছিল পিঠে, এখন তাকে ঠেলে সরানোর তাগিদ।—খেয়ে এসেছি। খাবার আনার দরকার নেই।

—কেন? আমার বউটার ওপর আপনি রেগেই গেলেন নাকি? অসহিষ্ণু ঝাঁঝে বাপী বলেছে, কি বাজে বকছ!

—ঠিক আছে, আপনার যেমন সুবিধে।

লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ দুলছিল রতন বনিক। মুখের খুশি কাঁচা—পাকা দাড়ি বেয়ে ছুঁয়ে পড়ছিল। মাছের মতো চোখ। চার হাত দূর থেকেও চেনা গন্ধ বাপীর নাকে আসছিল। মাত্রার ঠিক ছিল না। বোঝা যায়। কিন্তু ওর ঢলো—ঢলো কথা শুনে বিরক্তির বদলে বাপীর দু’কান সজাগ।

বউটার মতিগতি আজ বদলেছে বিপুলবাবু—বুঝলেন। বোতল নিয়ে আজ আর এ-ঘরে আসতে হল না, ঘরে বসেই খেতে দিলে। আর তোয়াজ করে সেই সঙ্গে এটা-সেটা ভেজে খাওয়ালে। ফুর্তির চোটে একটা গোটা বোতল সাবড়ে দিলাম দেখেও রাগ করল না। শব্দ করে রতন বিশাল হাই তুলল একটা।— আপনার খাওয়ার পাট নেই যখন, যাই শুয়ে পড়িগে—

দুলতে দুলতে চলে গেল। লণ্ঠনটা রেখে যেতেও ভুলেছে।

দুর্বার লোভের দু’ চোখ কতখানি চকচক করে উঠেছিল, বাপী খবর রাখে না। কিন্তু অনুমান করতে পারে। রতনের কথাগুলো শেষ হতে না হতে বুঝেছিল, এই

রাতেও কমলা আসবে।

…এসেছিল।

তার পরের রাতেও।

একই আধারে ওই অবুঝ লুব্ধ জানোয়ার আর মানুষ পাশাপাশি বাস করে কেমন করে। নগ্ন উল্লাসে জানোয়ারটা যখন নখ-দাঁত বার করে, মানুষটার তখন অস্তিত্ব নেই। আবার লজ্জায় ক্ষোভে নিদারুণ ধিক্কারে মানুষ যখন যন্ত্রণার মাটিতে ঘষে ঘষে নিজেকেই রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, ওই শয়তান তখন নিখোঁজ বাপী তরফদার এমন দুটো দুর্বার সত্তা আর কত বইতে পারে?

রাতে ঘুম হয়নি। সকালের মধ্যে মনস্থির। ভালো করে ভোর হবার আগে সকলের অগোচরে এখান থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্বল ইচ্ছেটা বাতিল করেছে। অন্য সব বাসিন্দাদের মনে খটকা লাগতে পারে, সংশয়ের আঁচড় পড়তে পারে। রতন বনিকের সেটা প্ৰাপ্য নয়।

আজও সকালে রতনই চা-রুটি নিয়ে হাজির। বাপী ওইটুকু ঘরেই পায়চারি করছিল। আসা মাত্র বলল, আমি আজ চলে যাচ্ছি রতন।

শুনে রতন বনিক একেবারে হাঁ। যাবার কথা বিপুলবাবু মাঝেসাঝে বলে বটে, কিন্তু কাজকর্মের সুরাহা হবার আগে সত্যি যাবে ভাবেনি। তাই ধাক্কাই খেল।— আজই যাবেন!…আমাদের ওপর রাগ করেছেন?

সামান্য কথায়ও বুকের তলায় মোচড় পড়ে। বাপী মাথা নাড়ল। বলল, তোমাদের ঋণের কথা ভুলব না, তোমার মতো ভালোমানুষও আমি কম দেখেছি রতন।

রতন বনিক নিশ্চিন্ত, খুশিও।—কি যে বলেন, আপনি ছিলেন, আমাদের কত ভাগ্যি।…আজই যাবেন কেন, কাজটাজের কিছু খবর পেয়েছেন?

—দেশে যাব, সেখানে একটু তদ্বির-তদারক করতে পারলে চা-বাগানের কাজ কিছু পেয়ে যেতে পারি। বাপী ভেবে বলেনি, কিছু বলা দরকার তাই বলেছে। আসলে বাপী কোথায় যাবে সে ফয়সালাও নিজের সঙ্গে তখন পর্যন্ত হয়নি। এখান থেকে নড়বে এটুকুই স্থির।

রতন বনিক চেয়ে রইল একটু। বলল, কাজ পেতে পারেন না—পেয়ে যাবেন। ক’দিন আগে যা দেখেছিলাম, তার থেকে আপনার কপালের রং অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। আমর কথা মিলিয়ে নেবেন, দিন ফিরলে ভুলবেন না যেন। বউটাকে বলি, ভালো কিছু রাঁধুক আজ, আমি না-হয় এ-বেলা হাফ-ডে ছুটি নিয়ে ও-বেলা আপিস যাব।

বাপী ব্যস্ত হয়ে উঠল, না-না, তার কিছু দরকার নেই, আমি ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব, সকালের দিকে গাড়ি। মুখে হাসি টানার চেষ্টা, খাওয়ার জন্য ব্যস্ত কেন, কম খেলাম নাকি এ পর্যন্ত!

—তাহলে ভালো করে একটু জলটল খেয়ে নিন, আমি চট্ করে দোকান থেকে ঘুরে আসছি।

দু’ঘণ্টার আগেই বাপী বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। চলে যাচ্ছে শুনে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকে দেখা করে গেল। রতন তাদের বলেই ফেলেছে, চা-বাগানের মস্ত একটা কাজের খবর পেয়ে বিপুলবাবু চলে যাচ্ছেন। রতন ট্যাক্সি ডাকতে গেল। খুপরি ঘরে বাপী একা নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে। ও-ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার কি বলে আসবে, আমি চলে যাচ্ছি?

কমলা নিজেই এলো। দরজা দুটো খোলা। আজ এক পাটও বন্ধ করল না। বাইরে থেকে সরাসরি চোখে না পড়ে সেই ভাবে দেওয়ালের দিক ঘেঁষে দাঁড়াল।

কিন্তু কমলার এই মুখ দেখবে বাপীর কল্পনারও মধ্যেও ছিল না। গত তিন রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে লোলুপ সান্নিধ্যের উদ্‌ভ্রান্ত মুহূর্তেও তার মুখ দেখতে পায়নি। নিঃশব্দে এসেছে। নিঃশব্দে চলে গেছে। একটি কথাও বলেনি। আজ ওকে দেখে বাপীরই বিস্ময়। কমলার এমন ঢলঢলে প্রশান্ত কমনীয় শামলা মুখ আর কি কখনো দেখেছে? সংকোচের লেশ নেই, অনুতাপের চিহ্ন নেই, বিবেকের তাড়নার এতটুকু ছায়ামাত্র নেই। মুখের দিকে চেয়ে রইল একটু, বলল, তুমি চলে যাবে জানতাম, আজই যাবে ভাবিনি…ভালই হল।

বাপীর খুব ইচ্ছে জিগ্যেস করে, কেন ভালো হল। মুখে কথা সরল না। নির্বাক দু’ চোখ ওর মুখের ওপর।

কমলাও দেখছে। বলল, এর পর তুমি কেবল আমাকে ঘেন্নাই করবে জানি। কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে পুজো করেই যাব, আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব

যেন তোমাকে ভালো রাখে।

ভিতরে ভিতরে বাপী হঠাৎ বড় রকমের নাড়াচাড়া খেল একটা।…ওর জন্যে, ওর ভালোর জন্যে দু’ চোখে এত মায়া বাপী আর কার দেখেছে? মনে পড়ছে কার দেখেছে। বানারজুলির পিসিমার দেখেছে। আর সেই মুহূর্তে সত্তার নাড়িতে টান পড়েছে একটা। পিসিমা নেই। বানারজুলি আছে. মা কাকে বলে বাপী জানে না। মায়ের মতো করে বানারজুলি তাকে ডাকছে। অনেক ডেকেছে। বাপী শোনেনি। এখন আবার ডাকছে।

বাপী চলেছে।

.

জলপাইগুড়িতে এবারে আর দু’ ঘণ্টাও ভালো লাগল না। যাঁর টানে এসেছিল তিনি নেই। ড্রইং-মাস্টার ললিত ভড়। তাঁর ঘরে সেই মরচে-ধরা তালা ঝুলছে এখনো। চারদিক আগাছায় ভরে গেছে, দু’ঘরের পিছনেরটা পড়ো-পড়ো। বুকের তলায় কারো জন্য এখনো যে একটু দরদের জায়গা আছে বাপী জানত না। এখন টের পাচ্ছে। ভিতরটা টনটন করছে। সপরিবারে একটা মানুষ একেবারে হারিয়েই গেল।

জলপাইগুড়ি থেকে বানারহাট পর্যন্ত টানা বাস ছিল। সেখানে এসে শুনল আরো একটু সুব্যবস্থা হয়েছে। বানারহাট থেকে বাস সার্ভিস চালু হয়েছে বানারজুলির চা-বাগানের কল পর্যন্ত।

আসতে আসতে বাপী ভাবছিল, তার ঘরদোরেরই বা কি অবস্থা কে জানে। ভেঙে পড়ার কথা অবশ্য নয়। আবু রব্বানী থাকলে বে-দখল হবার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু যে মেজাজের মানুষ ও, এখনো বীটম্যানের কাজ নিয়ে পড়ে আছে কিনা কে জানে। থাকলেও বাড়ি খালি পড়ে আছে কি ভাড়াটে বসানো হয়েছে জানে না। বাবা মারা যাবার পরে চলে আসার সময় আবুকে বাড়িটা বেচে দিতেই বলে এসেছিল। আবু রাজি না হওয়াতে ভাড়াটে দেখতে বলেছিল। দেড়ঘরের কাঠের বাড়ির পাঁচ-সাত টাকা যা ভাড়া—জোটে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে বাপী নিজে একটা চিঠি লিখেও খবর নেয়নি। এর মধ্যে কত কাণ্ড। যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়েছে। দেশ দু-খণ্ড হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে। এই তোড়ে তার দেড়ঘরের বসতবাড়ির অদৃষ্ট চোখে না দেখা পর্যন্ত ভরসা করার কিছু নেই।

চা-কলের সামনে বাস এসে দাঁড়ানোর আগেই বাপী ভাবনাচিন্তা ভুলে গেল। সেই বানারজুলি। আকাশের গা ঘেঁষা সেই পাহাড়ের সারি। তার গায়ে থাক-থাক পেঁজা তুলোর মতো সাদাটে মেঘ।…ওই বানারজুলির জঙ্গল। দিনটা ঠিক মেঘলা নয় আজ। কিন্তু জঙ্গলের দিকটা মেঘলা দিনের মতোই লাগছে।

…ওই মাথা-উঁচু শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস গাছগুলো যেন সেই আগের মতো বাপী নামে এক দুরন্ত ছেলের পা ফেলার অপেক্ষায় ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের মাথা থেকে টিনের সুটকেস আর বাঁধা বিছানা নামানো হতেই বাপীর ছোটার তাড়া। কিন্তু বাক্সবিছানা নিজে বয়ে নিয়ে যাবার মতো এখন আর অত হাল্কা নয়। জিনিস তো কিছু বেড়েইছে।

পয়সা কবুল করে একটা লোক জোটানো গেল। তারপর জুতোর তলা দিয়েও পায়ে সেই পরিচিত পথের স্পর্শ। এদিকের চা-বাগনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেই পুরনো দৃশ্য চোখে পড়ল। নানা বয়সের নানা রংয়ের মেয়েরা আড়াই-পাতি তুলছে আর কোমরের সঙ্গে বাঁধা বেতের ঝুড়িতে ফেলছে। বাপী একটু না দাঁড়িয়ে পারল না। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কিছুই বদলায়নি, জীবনের স্রোত সেই একভাবেই চলছে।

বদলেছে শুধু বাপী নিজে। আগের মতো ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা আর সেরকম করে হাসবে না, রঙ্গকৌতুক উছলে উঠবে না। ওরা মতলব দেখবে, লোভের ছোবল ভাববে। অথচ সেই চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে যেমন ছিল সেই মুহূর্তে অন্তত সেটুকু লোভেরও ছিটেফোঁটা নেই।

চা-বাগানের সাহেববাংলো কটা পার হবার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর উৎসুক দু চোখ আর একদিকে ছুটল। রাস্তার ঢালের ওধারে শালগুঁড়ির দিকে। তারপর সেই ছেলেবেলার মতোই ছুটে যেতে ইচ্ছে করল।

বনমায়ার একটা পা শালগুঁড়ির সঙ্গে শেকলে বাঁধা। সামনে ডালপালা ছড়ানো। বনমায়ার খাবার তাড়া খুব নেই। বেছে একটা দুটো তুলে মুখে দিচ্ছে। সঙ্গের লোকটাকে দাঁড়াতে বলে বাপী নেমে গেল। শালের ছায়ায় বছর আঠারো—উনিশের একটা ছেলে মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

বাপী আট-দশ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। এবারে হাতিটা দেখল ওকে। পেল্লায় শরীরের ক্ষুদে চোখ দুটো স্থির খানিক। তারপরেই বিশাল দেহে আনন্দে তরঙ্গ তুলে শুঁড়ে উঁচিয়ে মস্ত সেলাম। গলা দিয়ে আনন্দের টানা ঘড়ঘড় শব্দে গাছতলায় ছোকরার ঘুম ভেঙে গেল।

বাপীর গলার কাছে আনন্দের ডেলা আটকেছে একটা। আর চোখের দু কোণ শিরশির করছে। এগিয়ে যেতে বনমায়া ওকে শুঁড়ে দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সোহাগ জানালো। যেন বলতে চায়, এতদিন কোথায় ছিলে, কত খুঁজেছি তোমাকে। ছেড়ে দিতে বাপী ওর শুঁড়ে হাত বুলিয়ে আদর করল খানিকক্ষণ। বলল, ছ বছর বাদে দেখেও তুই আমাকে ঠিক চিনে ফেললি! কি করে চিনলি? একবার চিনে রাখলে তোরা আর ভুলিস না?

গাছতলার ছেলেটা মুখ উঁচিয়ে এই আদরের মাখামাখি দেখছিল। ভূমিশয্যা ছেড়ে অবাক মুখে উঠে এলো। বাপী দেখেনি। বনমায়ার নাকেমুখে এবার ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে ঘুরে তাকালো। মনে হল, এই ছেলেটাকে বনমায়া তেমন পছন্দ করে না।

বাপীর পরনে পরিষ্কার পাজামা-পাঞ্জাবি। এই এখন সর্বদার পোশাক। কিন্তু বনমায়ার হাবভাব দেখে হোক বা যে কারণেই হোক ছেলেটা হয়তো বিশেষ কেউ ভেবে বসল ওকে। ফিরে তাকাতে সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকল।

—তুমি কে?

—জী লছমন…

—ওর মাহুত ভীমবাহাদুর কোথায়?

লছমন সবিনয়ে জানালো, ভীম বাহাদুর চার বছর আগে এ-জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এখন ও-ই বনমায়ার মাহুত।

বাপী তক্ষুনি বুঝে নিলে এই পালানোর সঙ্গে ওর সেই ভালবাসার মেয়ের কিছু যোগ আছে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে বনমায়াকে ছেড়ে একেবারে পালানোর দরকার হল কেন বোঝা গেল না। যতদূর মনে পড়ে, আবুর মুখে শুনেছিল ভীমবাহাদুর পণের টাকা জমাচ্ছে। যে মেয়েকে চায় তাকে পেতে হলে তার বাপকে পণের টাকা গুনে দিতে হরে।

কথার ফাঁকে বাপী বনমায়ার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বনমায়ার হঠাৎ ফোঁস-ফোঁসানি তাইতে থেমেছে ছেলেটা তাও লক্ষ্য করল। একটু আগ্রহ নিয়ে বলল, আপনাকে হুজুর এই গোঁয়ার হাতিটা খুব ভালবাসে দেখছি।

এক প্রেমিকের সঙ্গে পালানো ছাড়া বনমায়া গোঁয়ার এমন অপবাদ বাপীর কানে এই প্রথম। জিজ্ঞেস করল, কেন, তোমাকে ভালবাসে না?

লছমনের মুখখানা বিষ একটু। মাথা নেড়ে জানালো, ভালবাসে না। তারপর ওর কথা থেকে সমস্যা বোঝা গেল। ভীমবাহাদুর চলে যাবার পর চার বছরে একে একে পাঁচজন মাহুত বনমায়ার কাজে লেগেছে। ও ছ নম্বর। গোড়ায় তিন—তিনটে মাহুতকে এই জিদ্দী হাতি কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। কাছে গেলে তেড়ে এসেছে। টানা দুটো বছর ওকে দিয়ে জঙ্গলের কাজ হয়নি। পরের দুটো মাহুতও খুব সুবিধে করতে পারেনি। এখন অবশ্য আগের তুলনায় অনেক ঠাণ্ডা, কিন্তু এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করে, আর মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়! ক’দিন বেশ ঠাণ্ডা ছিল, আজ আবার মতিগতি সুবিধের নয়।

বাপীর ধারণা, ওকে দেখে বনমায়ার ভীমবাহাদুরকে আজ বেশি মনে পড়ছে। তাই রাগ। জিজ্ঞেস কর, ও ফি বছর একবার করে পালাতো—এখনো পালায়? লছমনের হাসি-হাসি মুখ। জবাব দিল, সে-বেলায় ঠিক আছে। কোনো বছর বাদ যায় না। আবার ফিরেও আসে। পালালে সাহেবরা এখন আর রাগটাগ করে না, জানে ফিরে আসবে। কেবল যতদিন না আসে আমার হয়রানি। আমি কাজ নেবার তিন সপ্তাহের মধ্যেই পালিয়েছিল।

বাপী ভেবে পেল না, এই মেজাজ যখন, বনমায়া পালিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে কেন? হয়তো ভীমবাহাদুরের টানে আসে। ভাবে ফিরে এসে ওকে দেখতে পাবে। হয়তো বা সভ্যভব্য হাতি জংলি দোসরের সঙ্গ খুব বেশিদিন বরদাস্ত করতে পারে না। আবুর একটা কথা মনে পড়তে বনমায়াকে আর একবার ভালো করে দেখে নিল।…সেবার ফিরে আসার পর বনমায়াকে একটা বড়সড় আদরের চাপড় মেরে আবু বলেছিল, তিন বছর ধরে পালিয়ে গিয়ে রস করে আসছিস—বাচ্চা-কাচ্চা হবার নাম নেই কেন? তোর মরদটাকে ধরে এনে ডাক্তার দেখা।

বাচ্চা আজও হয়নি বোধ হয়। হলে দেখতেই পেত। লছমনকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আবু রব্বানীকে চেনো?

সঙ্গে সঙ্গে ও ঘাড় হেলিয়ে জানালো, খুব চেনে। আঙুল তুলে জঙ্গলের দূরের দিকটা দেখিয়ে দিল। ওই জঙ্গলে থাকে।

আবু এখানেই আছে জেনে বাপী নিশ্চিন্ত একটু। তারপরেই মনে হল সঙ্গের মাল নিয়ে সোজা নিজের ডেরায় গিয়ে কি লাভ। খালি আছে কিনা ঠিক নেই, আর খালি যদি থাকেও, ও আসবে বলে কি কেউ ঘরদোর খুলে বসে আছে? আবুর সঙ্গেই আগে দেখা হওয়া দরকার।

লছমন এতক্ষণে ভরসা করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে হুজুর?

বাপী হেসেই জবাব দিল, আমি তোমাদের হুজুর-টুজুর কেউ নই। এখানেই জন্মেছি এখানেই বড় হয়েছি। পাঁচ-ছটা বছর এখানে ছিলাম না—

কোনো ভদ্রলোক এভাবে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে সদালাপ করে না হয়তো। খুশি—মুখ দেখল। সেই সঙ্গে হঠাৎ কিছু প্রত্যাশাও যেন।—আমার একটু উপকার করবেন বাবু?

বাপী অবাক!—আমি আবার তোমার কি উপকার করতে পারি?

গলায় আব্দারের জোর ঢেলে লছমন বলল, আপনি একটু চেষ্টা করলেই পারবেন বাবু—ওই জেদী হাতি আপনাকে কত ভালবাসে স্বচক্ষে দেখলাম। এক ভীমবাহাদুরকে এ-রকম ভালবাসত শুনেছি। আপনি একটু চেষ্টা করলে ও আমাকেও ঠিক পছন্দ করবে—ওরা যাকে ভালবাসে তাদের কথা শোনে, বোঝে ওকে দিয়ে এখনো জঙ্গলের কাজ ভালো করে করাতে পারি না, না পারলে সাহেবরা বা ঠিকাদার খুশি থাকে না। এরকম হলে আগের মাহুতদের মতো আমারও কাজ যাবে—

এমন উপকারের বায়না বাপী আর শোনেনি। হড়হড় করে এতগুলো কথা বলার পর ছেলেটার কালো মুখ প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল করছে। বাপীর হাসি পাচ্ছে। বানারজুলিতে পা দিয়েই একটা কাজের মতো কাজ পেল বটে।

—আবু রব্বানীকে বলোনি কেন, ওকেও তো বনমায়া ভালবাসে।

এবারে লছমনের মুখ দেখে মনে হল প্রায় অসম্ভব প্রস্তাব কিছু। বলল, সে তো এখন মস্ত লোক বাবু, অনেককে টপকে জঙ্গলের হেড বীটম্যান হয়েছে, বন্দুক নিয়ে ঘোরে, বড়সাহেব তাকে পছন্দ করে—তার কাছেই তো যেতে সাহস হয় না। কখনো দেখা হয়ে গেলে বনমায়াকে একটু আদর করে, আর আমাকে বলে, ভালো সেবা-যত্ন করে ওকে বশ কর, নইলে তোরও সময় ঘনালো বলে। না বাবু, তাকে দিয়ে হবে না, আপনি চেষ্টা করলেই হবে—আপনাকে ও আবুর থেকেও বেশি ভালবাসে স্বচক্ষে দেখলাম।

…আবু রব্বানী তাহলে এখন হেড বীটম্যান আর মস্ত লোক। একটা বন্দুক বাগাতে পারেনি বলে নিজের বাপকে অকর্মণ্য ভাবত, তাও মনে আছে। কি ভেবে নিয়ে রাস্তার বাক্সবিছানা মাথায় লোকটাকে ডাকল। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লছমনকে বলল, আমার এই জিনিসগুলো তোমার জিম্মায় রাখো, আমি একটু ঘুরে আসছি। আবু রব্বানীর ওখানেই যাব—

সভয়ে লছমন বাবু থেকে আবার হুজুরে উঠে এলো তক্ষুনি।—আমার কথা যেন কিছু বলবেন না হুজুর!

বাপী হেসেই আশ্বাস দিল, তোমার কিছু ভয় নেই, বনমায়া যাতে তোমাকে পছন্দ করে আমি নিজেই সে-চেষ্টা করব। বনমায়ার শুঁড় চাপড়ে দিল, লছমনকে ভোগাচ্ছিস কেন, অ্যাঁ?

লোকটার পয়সা মিটিয়ে আবার রাস্তায় উঠে এলো। যত এগোচ্ছে চোয়াল দুটো এঁটে বসছে। ধমনীতে রক্তের স্রোত বদলাচ্ছে। আর খানিক এগোলেই সেই বাংলো। বানারজুলি জঙ্গলের বড় সাহেবের বাংলো।

এলো। রাস্তা ছেড়ে সেই ধারের গাছটার সামনে দাঁড়াল। যে গাছের নিচু ডালে বসে মিষ্টিকে নানা কৌশলে ওই বাংলো থেকে টেনে আনত। বাইরের কাঠের বারান্দায় মাঝবয়সী একজন আয়া গোছের কেউ বসে।

আট সাড়ে আট বছর আগে ওই বারান্দায় এই শরীরটা বাবার চাবুকে লুটোপুটি খেয়েছিল। গায়ের চামড়া ফেটে ফেটে যাচ্ছিল। ঠোঁট ফেটে কেটে মুখ রক্তে ভরে গেছল।…ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টি দেখছিল। আর এই সেদিন বিকেলে লেকের ধারে ভিতরটা যখন তার থেকেও বেশি ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল…মিষ্টি দেখছিল।

কিন্তু আশ্চর্য! বাপীর চোয়াল দুটো আরো এঁটে বসছে, একটা ক্ষমাশূন্য অভিলাষ ভিতরে দাপাদাপি করছে, অথচ প্রতিশোধের সেই সাদা আগুন এই মুহূর্তে ঠিক তেমন করে জ্বলছে না।…কেন? নিজে ভ্রষ্ট হবার ফল? অপরাধ—চেতনা?

বাপী সামনের ওই বাংলোর দিকে চেয়ে আছে বটে, কিন্তু দেখছে নিজেকে। আরো কিছু দেখার আছে যেন, বোঝার আছে। সব প্রত্যাশার বুকে ছুরি বসানো আচমকা অপমানের আঘাতে আর আত্মঘাতী ক্রোধে আর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে প্রবৃত্তির ক্রূর উল্লাসে সেই আরো-কিছু-দেখা বা বোঝার ব্যাপারটা দূরে সরে গেছল। বাপীর ভেতর-বার এই মুহূর্তে আবার অদ্ভুত ঠাণ্ডা। এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বনের হাতি বনমায়া সেই ঠাণ্ডা প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে।

…পুরনো দিনের অন্তরঙ্গ সঙ্গীকে বনের পশুও ভোলে না। মানুষ ভোলে?…মিষ্টি কি একেবারে ভুলতে পেরেছিল? স্লিপ পাঠানোর তিন-চার মিনিটের মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসেছিল, তার দু’চোখে বিস্ময় আর আগ্রহের বন্যা দেখেছিল—সে কি মিথ্যে।…সেই সন্ধ্যায় চলে যাবার আগে ওর জুলুমে পড়ে অমন করে মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি কি দেখছিল? শুধু দেখছিল, না নিজের সঙ্গে যুঝছিল? তারপর ভব্যভাবে বাপীকে অকরুণ কিছু বুঝিয়ে দেবার জন্যে একই সঙ্গে ওই সোনালী চশমাকেও লেকে ডেকেছিল বটে। আট বছরের ফারাকে কেউ যদি তার মন কেড়েই থাকে, ছেলেবেলার সাথীকে দেখামাত্র তাকে নাকচ করে দেবে এমন আশা বাতুলে করে। ঠাণ্ডাভাবে এটুকুই হয়তো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল। পাড়ার ভক্তের দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে-আঘাত চারগুণ হয়ে বাপীর বুকের ভিতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছিল সত্যি কথাই। কিন্তু মিষ্টি যে মূর্তিতে ওদের ধাওয়া করে তাকে আগলেছিল আর সেই মন কাড়া সোনালি চশমার ওপর যে-রকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল—সেই সত্যটা কি কম কিছু?

…পুরনো লোভ পুরনো আশা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আবার। ওই মাখমের দলা সোনার চশমা মিষ্টির জীবনের দোসর হতে পারে না। মিষ্টি বাপীর জগৎ থেকে একেবারে মুছে যাবে এমন হতে পারে না। দুনিয়া যত বড়ই হোক, আবার যোগাযোগ হবে, আবার কিছু ঘটবে। ঘটতে বাধ্য। যা ঘটেছে সেটা এখনো শেষ নয়, শেষ কথা নয়।

কিন্তু এই উদ্দীপনার পিছনে বিষাদের ছায়া দুলছে। সত্তার দুর্বার জোরের অনেকখানি কলকাতার সেই টালি এলাকায় খুইয়ে এসেছে। দোষ কমলা বনিকের কি নিজের সেটা কোনো সান্ত্বনা নয়।

অসহিষ্ণু তাড়নায় চিন্তাটা বাতিল করার চেষ্টা বাপীর। এখান থেকেই জঙ্গলে ঢুকত মিষ্টিকে নিয়ে। বাপী নেমে এলো। জঙ্গল তেমনি আছে, শুধু অনেকদিন না দেখার ফলেই হয়তো ঘন লাগছে একটু।

…সব যেন সেদিনের কথা, সেদিনের ব্যাপার। এদিকটায় ওরা রঙিন প্রজাপতি আর কাঠবেড়ালি আর খরগোশের পিছনে ছোটাছুটি করত। বাপী তরফদার দেখছে, দাঁড়াচ্ছে, আবার চলছে।…ওই সেই ছোট গাছটা। বাপী এই ছোট ডালটায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল, দু হাতে দুটো হাত ধরে মিষ্টিকে প্রথমে পায়ের ওপর তুলেছিল, তারপর বুকে জাপটে ধরে পাশে বসিয়ে দিয়েছিল। নামার সময় তেমনি বুকে করে নামিয়েছিল—দশ-বারো গজ ওমনি টেনে নিয়ে তবে ছেড়েছিল।

পা দুটো আড়ষ্ট আবার এক জায়গায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।…সামনে সেই শিশুগাছ যার মোটা গুঁড়িতে পাকে পাকে জড়িয়ে ছিল সাদা-কালো ছোপের বিশাল ময়াল সাপ, চ্যাপ্টা মুখটা সামনে টান হয়ে মিষ্টির দিকে। ওটার সোঁ-সোঁ নিঃশ্বাসে মিষ্টির সর্বঅঙ্গ অবশ, নড়াচড়ারও ক্ষমতা ছিল না। ওকে দুচোখে আটকে নিয়ে সাপটা আস্তে আস্তে গাছের গুঁড়ি থেকে নিজের শরীরের প্যাঁচ খুলছিল।…বাপীর আচমকা প্রচণ্ড ধাক্কায় মিষ্টির চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়েছিল। তারপর পাগলের মতোই ছুটেছিল দুজনে।

বাপীর কপালে ঘাম। সংকট যেন সদ্য কেটেছে।…পুরস্কারও পেয়েছিল। মেয়েকে জঙ্গলে টেনে আনার অপরাধে মেমসাহেব সকলের চোখের সামনে বাপীর কান টেনে ছিঁড়তে চেয়েছে, আর গালাগাল করে ঘাড় ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

সেই বাপী আজ এই মুহূর্তেও ভাবছে যে-মেয়েকে ধরা-বাঁধা মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছে, তার ওপর সব দখল কার? শুধু তার ছাড়া আর কার হতে পারে?

পা দুটো আরো এক জায়গায় থেমে গেল। সেখানে সেই শেষ কিছু ঘটেছিল। যার ফলে মুখের গা-ঘুলনো রক্তের স্বাদ জীবনে ভুলবে কিনা জানে না। স্থান—কাল ভাল-মন্দ ভুলে, পরিণামের হিসেব ভুলে উন্মাদ লোভে আর আক্রোশে সেই মেয়েকে এখানে এনে ফেলেছিল আর তার সর্বাঙ্গর নরম মাংস খুবলে নেবার উল্লাসে মেতেছিল। বাপী তরফদারের মুখের রেখা কঠিন। কপালে ভ্রুকুটি। শিরায় শিরায় উষ্ণ তাপ। টালি এলাকার খুপরিঘরে আত্মবিলোপের দাহ বুকে লেগে আছে। কিন্তু এখানকার সেই স্মৃতির কোনো দাহ নেই। অনুতাপ নেই। বরং সেই দখল অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ায় পরিতাপ। ওই একজনের ওপর তার সত্তার অধিকার। কোথা দিয়ে কেমন করে সেই অধিকার এসেছে, চৌদ্দ বছরের বাপী জানত না, আজকের বাপী তরফদারও জানে না। সেই অধিকার নাকচের যন্ত্রণা সেদিনও যেমন, আজও তেমনি।

আবু রব্বানীর ডেরার সামনে এসে বাপীর ধোঁকা লাগল বেশ। খুব ভালো জানা না থাকলে চেনা যেত না এমনি ভোল পাল্টেছে। দুখানা ঘরের পাশে এখন আরো একটা ঘর। সামনে পিছনের অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। চারদিকের সবটা জুড়ে শক্তপোক্ত বাঁশের বেড়া। সামনে বাঁশের মজবুত গেট। এদিকে পাহাড়ী ফুলের বাগান।

বনমায়ার ছোকরা মাহুত লছমন সসম্ভ্রমে বলেছিল, আবু রব্বানী মস্ত মানুষ একজন। এখন তার ভেতর কেমন কে জানে। গেট খুলে পায়ে পায়ে ঘরের দিকে এগলো। ঘর থেকে মোটাসোটা তিন-সাড়ে তিন বছরের কালো-কোলো ন্যাঙটা ছেলে ছুটে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল, তারপর হাঁ করে চেয়ে রইল।

ছেলেটা নয়, ভেবাচাকা খেয়ে গেল বাপীই বেশি। শুধু বিয়ে নয়, আবুর এর মধ্যে ছেলেও হয়ে গেছে! এরপর যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তাকে দেখে বাপী সত্যি হাঁ। ছটু মিঞার বউ দুলারি। তার কোলে আর একটা আট-ন’মাসের বাচ্চা। কিন্তু দুলারি কেন? রেশমা নয় কেন?

বাড়ির আঙিনায় ঢুকে একটা লোককে সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুলারি ছেলে কোলে নিয়েই গম্ভীর মুখে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কাকে চাই বা কি চাই? করা হল না। তামাটে মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়তে লাগল।

—বাপীভাই না?

অবাক চোখে দুলারির দিকে চেয়ে বাপী মাথা নাড়ল। আগে ওকে কখনো বাপীভাই বলে ডেকেছে মনে পড়ে না। তামাটে রঙে এখন আর অতটা কালচে ভাব নেই। ঢ্যাঙা শরীর এখনো প্রায় আগের মতোই আঁটোসাঁটো। মাথার চুল এলোমেলো, লালচে নয় আগের মতো। বেশ সুবিন্যস্ত আর তেল-চকচকে। মুখের সেই রুক্ষভাব আর নেই, চাউনিও তেমন ধার-ধার নয়।

তবে স্বভাব-গম্ভীর মেয়ের আপ্যায়নে উচ্ছ্বাস বেশি ধরা পড়ে না। এত বছর বাদে ওকে দেখে অখুশি নয় এটুকুই বোঝা গেল।

—বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, দাওয়ায় উঠে এসো। কত বড়টি হয়ে গেছ, অনেক লম্বাও হয়েছ—আমি হঠাৎ চিনতেই পারিনি। কবে এলে?

—আজই। বাপী খানিকটা এগিয়ে এলো বটে, কিন্তু মাটি ছেড়ে দাওয়ায় উঠল না। কোলের বাচ্চাটা আঙুল চুষছে আর কুতকুত করে তাকাচ্ছে। বড়টাও দুলারির গা ঘেঁষে ড্যাবডেবে চোখে ওকে নিরীক্ষণ করছে। জিজ্ঞেস করল, আবু কোথায়?

—খানিক আগে তো তোমার ঘরের দিকেই যাচ্ছে বলে গেল, তুমি ও দিক থেকে আসছ না?

—না। ব্যাপারটা এখনো বোঝার চেষ্টা বাপীর।—ছটু মিঞার খবর কি? সামনের আকাশের দিকে একবার একটু মুখ উঁচিয়ে নির্লিপ্ত গলায় দুলারি জবাব দিল, তার খবর তো ওখানে, সেই যেবারে তুমি শেষ এলে সে-বছরই চলে গেল—

বাপী ভাবল, আর কেউ নেই বলে আবু রেশমার সঙ্গে ওকেও ঘরে এনে রেখেছে। তবু কেন যেন বোকার মতোই জিজ্ঞাসা করল, এরা কার ছেলে?

এত অবাক হতে দেখেই হয়তো তামাটে মুখে হাসি ফুটল একটু—যার কাছে এসেছ তার, আবার কার?

—রেশমা কোথায়?

জবাব দেবার আগে দুলারি এবারে ওকে ভালো করে দেখে নিল একটু। তারও অবাক লাগছে বোধ হয়। সাপ নাচাতো যে মেয়ে সে বাঁকা তাকাতে জানে, বাঁকা কথাও বলতে পারে।—এতকাল বাদে এসেই রেশমার খোঁজ কেন—সে তার ঘরেই হবে।

বাপী এখনো কি শুনছে কি বুঝছে ঠিক নেই।…রেশমা তার ঘরে আর দুলারি আবুর ঘরে! হঠাৎই রহস্যের পর্দাটা উঠে গেল। কিন্তু সে-ও তো বিস্ময়ে হাবুডুবু খাবার মতোই ব্যাপার!

বিড়ম্বনার ধকল সামনে বলল, আচ্ছা এখন যাই, আবুকে ধরতে পারি কিনা দেখি। পরে আবার আসব—

তড়িঘড়ি পা চালিয়ে একেবারে আঙিনার বাইরে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিজের ঘরের পথ ধরেও মাথায় এই বিস্ময়টুকুই ঘুরপাক খাচ্ছে। সাপ খেলানোর ব্যাপারে দুলারি রেশমার থেকেও ঢের বেশি চৌকস ছিল বটে। হতেই পারে, ঘরের লোকের কাছ থেকে সরাসরি শিখেছে। রুক্ষ মুখে পেটমোটা বাঁশি লাগিয়ে গাল ফুলিয়ে হেলেদুলে সাপের ফণার সঙ্গে তালে তালে ঝোঁক মিলিয়ে সাপ খেলানোর দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুলারি এ কি খেলা দেখালো!

আরো একটু ধাক্কা বাকি ছিল বাপীর।

নিজের বাড়ির সামনে এসেও হাঁ। এরও ভোল বদলে গেছে। ছোট-বড় দুখানা ঘরের পাশের খালি জমিতে লাগোয়া আর একটা বড় ঘর গজিয়েছে। কাঠের বাড়িতে আগে রঙের বালাই ছিল না, এখন ওটার সর্বাঙ্গে রঙের জেল্লা। হালে সংস্কারও করা হয়েছে সন্দেহ নেই। তকতকে ছোট্ট বাংলোর মতো দেখাচ্ছে। সামনের চিলতে বারান্দায় বেতের চেয়ার বেতের টেবিল। ধপধপে সাদা টেবিল-ক্লথ।

আবু রব্বানী সত্যি কি-রকম মস্ত মানুষ হয়েছে বাপী ভেবে পেল না। সামনের দরজা খোলা দেখে ভাবল আবু ভিতরেই আছে।

পায়ে পায়ে উঠে এলো। তারপর খোলা দরজার ভিতরের দিকে এক পা ফেলে মুখ বাড়াতেই বিষম চমক।

—হু ইজ্ ইট! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

মহিলা কণ্ঠের ঝাপটা খেয়ে দু’ পা পিছনে ছিটকে এলো বাপী। সঙ্গে সঙ্গে উগ্রমূর্তি মহিলাটিও বাইরে। বাঙালীর মতোই শাড়ি পরা, কিন্তু এক নজরেই বোঝা যায় বাঙালী নয়। নেপালী। চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে বয়েস। ফর্সা মুখে লালিত্য কম। এই মুহূর্তে অন্তত উগ্রমূর্তি, রুষ্ট চাউনি। তার পিছনে বছর উনিশের একটি মেয়ে। কমনীয় মুখ, হৃষ্টপুষ্ট সুডৌল চেহারা। পরনে রঙিন ঘাগরা, গায়ে লম্বাটে সাদা ব্লাউস।

বাপীর অমন বিমূঢ় মুখখানা দেখেও মহিলা সদয় নয়। তেমনি রুক্ষ স্বরে আবার জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

বাপীর গলা দিয়ে শুধু বেরুলো, আবু রব্বানী…

ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে নেপালী মহিলা এবারও একটু কড়া গলায় কিন্তু পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, আবু রব্বানীর খোঁজে এসে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন কেন? কি দরকার তাকে?

পিছনের সুদর্শনাটি মহিলার মেয়েই হবে হয়তো। দুর্দশা দেখছে। বাপী নিজেকে অথৈ জল থেকে টেনে তুলল এবার। মোলায়েম করেই বলল, দরকার কিছু না…। এতকাল আমি জানতাম এটা আমারই বাড়ী…বছর কয়েক ছিলুম না এখানে, দরজা খোলা দেখে ভিতরে আবু আছে ভেবে ঢুকতে যাচ্ছিলাম।

এমন জবাব আশা করেনি বোঝা গেল। মহিলার গোল চোখ আর একটু গোল হতে দেখা গেল। মেয়ের চাউনিও বদলেছে।

এর পরেও মচকাবার পাত্রী নয় মহিলা। গলার ঝাঁঝ একটু কমল শুধু। কি নাম আপনার?

—বাপী তরফদার।

ভুরু কুঁচকে কিছু স্মরণ করার চেষ্টা। স্মরণ হল কিনা বোঝা গেল না। তারপর সাফ কথা—আবু রব্বানী খানিক আগে এসেছিল, চলে গেছে। আপনার কিছু জানার বা বোঝার থাকে তো তার সঙ্গে দেখা করুন।

কথা শেষ হবার আগেই ঘরে চলে গেল। বাপী এবারে কয়েক পলক মেয়েটার মুখোমুখি। ভিতর থেকে আবার একটা তাড়া খাওয়ার সম্ভাবনা মনে আসতেই বাপী তাড়াতাড়ি নেমে এলো।

বিশ-বাইশ গজ দূরে এসে সন্তর্পণে ফিরে তাকালো একবার। মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে আর তাকিয়েই আছে। যার ঘর-বাড়ি তারই এমন হেনস্থার প্রহসনটা বেজায় উপভোগ্য যেন।

অগত্যা সামনের সোজা রাস্তা ধরে বাপীর দ্রুত প্রস্থান।

সোনার হরিণ নেই – ৯

হাসি আর থামেই না। হাসির দমকে জঙ্গলের গাছপালাকে সুদ্ধু তাক লাগিয়ে দিচ্ছে আবু রব্বানী। অদুরের নতুন চারা বেড-এ যে তিন-চারটে লোক কাজ করছে তারাও মাঝে মাঝে এদিকে ঘাড় ফেরাচ্ছে। আবু রব্বানী জঙ্গলের অনেকগুলো খেটে খাওয়া লোকের মুরুব্বি এখন। দস্তুরমতো কড়া মানুষ আর দাপটের মানুষ। সেই লোকের এত ফূর্তি আর এমন হাসি ওদের কাছেও নতুন কিছু

একটু সামলে আবু বলল, তুমি বাপীভাই সেই আট বছর আগে থেকে ধরে নিয়ে বসে আছ আমি রেশমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি! এত চৌকস হয়েও তুমি ভাবলে কিনা রেশমার জন্য আমার কলজে পুড়ছে। রোসো, ঘরে ফিরি আগে, দুলারি শুনলেও হেসে গড়াবে।

বোকা বনলেও বাপী হাসছে। নিজের এমন বিতিকিচ্ছিরি ভুলটা স্বীকার করতে আপত্তি নেই। ওর এত হাসি আর এত আনন্দ দেখে স্বস্তিও বোধ করছে। বাইরে যত হোমরাচোমরা হয়ে উঠুক ভিতরের মানুষটা খুব বদলায়নি।

নিজের ঘর-বাড়িতে অমন একখানা ঝাপটা খেয়ে তিক্ত মেজাজে বাপী আবার জঙ্গলে ঢুকেছিল। বাড়তি ঘর তুলে সাজিয়েগুছিয়ে ওই নেপালিনী যে—রকম জাঁকিয়ে বসেছে, তাতে নিজের ডেরায় ঠাঁই মেলার আশায় জলাঞ্জলি। ভরসা আবু রব্বানী।

জিগ্যেস করতে আঙুলের নিশানায় একটা লোক বলে দিল, ওদিকে নয়া চারা বেড হচ্ছে, আবু রব্বানী সেদিকে আছে—

নিশানা ধরে এগোতে এগোতে বাপীর মনে হল জঙ্গলটার কিছু উন্নতি হয়েছে। বড় বড় গাছগুলোর সাদা রং মাখানো গুঁড়ির ওপর কালো কালো নম্বরগুলো বেশ চকচকে লাগছে। পড়ন্ত বেলাতে এদিকে সেদিকে দুই-একটা করে লোক কাজ করছে। রাবারের নল দিয়ে কেউ গাছে জল দিচ্ছে, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছে। কাগজে-কলমে কাজের লোক আগেও ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ সময় তাদের খুঁজেপেতে বার করতে হত। বাপীর মনে হল জঙ্গলটা কিছু যত্নের ছোঁয়া পেয়েছে।

পিছন ফিরে থাকলেও দূর থেকে আবুকে চিনতে অসুবিধে হল না। পরনে খাকি ফুল প্যান্ট। গায়ে চক্রাদার মোটা আঁট গেঞ্জি। চওড়া কাঁধ, আগের থেকেও কিছু লম্বা লাগছে ওকে। কালো সুপুষ্ট দুই বাহু। এক হাতের কব্জিতে ঘড়ি অন্য হাতে ছোট মোটা ছড়ি। ছড়ি দেখে ওর হাতের সেই লম্বা শক্ত পোক্ত লাঠিটার কথা মনে পড়ে গেল, যার একদিকে ইস্পাতের ঝকঝকে ধারালো ফালা গোঁজা আর তার ওপরে লোহার ক্যাপ। ওই লাঠি আবুর চোখের মণি ছিল একদিন। মস্ত মানুষ হয়ে এখন কি সেটা বাতিল করেছে? দেখলে মনে হবে জঙ্গলের কোনো ছোটোখাটো অফিসার লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছে।

—হেঁজিপেঁজি ব্যাপার নয়, এ চন্দ্রার বেড ইয়াদ রেখো সাঙাতরা—বড় সাহেবের স্পেশাল অর্ডারের জিনিস। চারা গজালেই সাপে ছুবলোনো বেজির উৎপাত হবে—খুব হুঁশিয়ার, নষ্ট হলে কারো কাঁধে মাথা থাকবে না।

পিছন থেকে আলতো করে বাপী বলল, কাঁধের ওপর নিজের মাথাটা তো খুব টান দেখছি—এদিকে ফেরাও।

ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়াল। আর তার পরেই খুশিতে আনন্দে দুই চক্ষু বিস্ফারিত একেবারে। ঠিক দেখছে কিনা সেই সন্দেহ।

—বাপী তুই! মা-মানে বাপীভাই তুমি!

দেমাক না বেড়ে থাকলে এই উচ্ছ্বাসই প্রত্যাশিত। বাপী হাসছে।—আবার তুমি কেন!…

লাঠিসুদ্ধু দু হাত বুকের সঙ্গে জাপটে ধরল ওকে। সঙ্গের লোক কটা হাঁ মেরে গেছে দেখে ছেড়ে দিল। কপট গাম্ভীর্যে ইশারায় ওদের কাজে মন দিতে হুকুম করল। তারপর আবার বে-সামাল খুশির উচ্ছ্বাস।—আরে বাপরে বাপ, এখন তুমি কত বড় কত বিদ্বান মানুষ—আর এখানে থাকলে তো কবেই আমার মুরুব্বি হয়ে বসতে—আনন্দে মুখ ফসকে ওরকম বেরিয়ে গেছল—এবার থেকে বাপীভাই-ই বলব। কিন্তু তুমি আজ কোত্থেকে? তোমাকে কত খুঁজেছি, তোমাদের কলেজের ঠিকানায় চিঠি লিখেছি—চার-পাঁচ মাস আগে তোমার খোঁজে জলপাইগুড়িও চলে গেছলাম। শুনলাম প্রায় দেড় বছর আগে গ্র্যাজুয়েট হয়ে তুমি নিপাত্তা—

কাঁধ জড়িয়ে ধরে পনের-বিশ গজ সরে এসে ওকে নিয়ে বসল এক জায়গায়।—পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে একটা চিঠি নেই, একটা খবর নেই—ভাবলাম, বানারজুলির এই জংলিটাকে ভুলেই গেছ। কবে এলে? আজই?

হাসি মুখে মাথা নেড়ে বাপী বলল, এসেই পর পর দুটো রাম-ধাক্কা

—সে আবার কি, কোথায়?

—প্রথমটা তোমার বাড়িতে।

—গেছলে বুঝি? তা ধাক্কা কেন, দুলারিকে দেখে?

বাপী হাসতে লাগল। লজ্জা লজ্জা মুখ করে আবু বলল, ওকে যখন ঘরে আনি তোমার কি কোনো পাত্তা ছিল যে খবর দেব!

—সেজন্যে নয়, আমি বরাবর জানতাম রেশমাকে নিজের ঘরে এনে তোলার জন্য তুমি হাঁ করে আছ।

আবু রব্বানীর এবারে আকাশ থেকে পড়া মুখ।—রেশমাকে! এ আবার তোমার মাথায় গজালো কি করে?

অবাক বাপীও কম নয়। কারণ তখনো ধারণা বিশেষ কোনো ঘটনার ফলেই রেশমার বদলে দুলারি তার ঘরে। কিন্তু আবুর মুখ দেখে আর কথা শুনে মনে হচ্ছে তাও না। কি মনে পড়তে বাপী বলল, বাবা মারা যাবার পর বানারজুলি ছাড়ার আগে তোমার বিয়েটা কবে হবে, জিগ্যেস করতে বিরক্ত মুখ করে তুমি বলেছিলে, শালার মরদ ঘরে থাকতে তার বিবিকে বিয়ে করা অত সোজা!…সে তবে কার কথা বলেছিলে?

—কেন, সেই ছটু মিঞার কথা। তুমি কি ভেবে বসেছিলে রেশমার মরদ কাঁদনা?

বাপী বোকার মতো মাথা নাড়ল। এতদিন সেই ধারণাই বদ্ধমূল ছিল বটে। তাই শুনে আবুর সেই হাসি।—এমন হাসি যে আশপাশের ওই লোকগুলোও সচকিত। তারপর বলল, তোমার দোষ নেই, বলতে গেলে তো ছেলেমানুষই ছিলে তখন। তাছাড়া আধ-মরা মরদের সেবাযত্ন করলেও আমার ভিতরের মতলবখানা দুলারি টের পেয়ে গেছল। তাই কড়া ভাব দেখাতো আর ছুবলোতে আসত। রেশমা আঁচ পেয়েছিল দুলারির কাছ থেকে—ননদ-ভাজে ভারি ভাব তো—তাই রেশমা আমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করত। এই সব দেখেই তুমি উল্টোপাল্টা ভেবে বসে আছ।

চওড়া বুক চিতিয়ে আর এক দফা হাসল।—আরে আমি হলাম গিয়ে জঙ্গলের সেই অপদেবতা আবু রব্বানী—আমার যুগ্যি বিবি তামাম বানারজুলিতে দুলারি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি! ছটু মিঞা মারা যাবার তিন দিনের মধ্যে দুপুরের নিরিবিলিতে ছোঁক ছোঁক করে যখন গিয়ে হাজির হলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল, তারপর বলল, কালকেউটের ঝুপড়িটা এনে খুলে দেব? দুদিন বাদে আবার গিয়ে হাজির হতে বলল, একটা চেলা কাঠ ঠিক করি আগে, তারপর এসো।

বাপী উৎসুক।—তারপর?

—আমিও সেই ছেলে। পরদিন দুটো লোকের মাথায় দেড়-দেড় তিন মণ চেলা কাঠ এনে ওর উঠোনে ফেললাম আর গ্যাঁট হয়ে ওদের দাওয়ায় বসলাম। আবুর প্রাণখোলা হাসি।—দুলারির তখনকার মুখখানা যদি দেখতে!

আবুর এখন সবদিক থেকে সুদিন আর সুখের দিন চলছে বোঝা গেল। বাপী পর পর দুটো রাম-ধাক্কা খাওয়ার কথা বলেছিল মনে পড়তে জিজ্ঞেস করল, একটা ধাক্কা তো দুলারি, আর একটা কি?

—তোমাকে না পেয়ে নিজের ঘরে গেছলাম। সেখান থেকে নেপালী মহিলার তাড়া খেয়ে বেরুতে হয়েছে।

—এই রে! তোমার ঘরবাড়ি তো বেদখল। চার-পাঁচ মাস আগেও যদি একটা খবর পেতাম তাহলে ছাড়ি? তোমার খোঁজে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত গেছলাম—

বাপী শংকিত।—বেচে দিয়েছ নাকি?

আবু এটুকুতেই আহত।—আমি যেমন লোকই হই, তোমার সঙ্গে বেইমানি করব বাপী ভাই? আমাকে জিম্মাদার করে গেছ আর আমিই খেয়ে নেব?

বাপীর তাড়াতাড়ি সামাল দেবার চেষ্টা।—খেয়ে নেবার কথা বলিনি, সুবিধে পেলে বেচে দেবার কথা তো আমি লিখেই দিয়ে গেছলাম তোমাকে।…তাহলে কি ভাড়া দিয়েছ?

—ভাড়াই বলতে পারো, তবে তার মধ্যেও প্যাচ-ঘোঁচ আছে। মওকা পেয়ে আমি তোমার ভালোই করতে গেছলাম, বাড়ির চেহারাখানা কেমন হয়েছে ভালো করে দেখেছ?

বাপী মাথা নাড়ল। দেখেছে।

—গেল মাসে আবার ইলেকট্রিক লাইটও আনা হয়েছে। ও তল্লাটে এখন কেবল তোমার বাড়িতেই বিজলির আলো জ্বলে—অনেক খরচা করে চা—বাগানের কোয়ারটারস থেকে লাইন টানা হয়েছে—তা কে তাড়া করল, নেপালী মেমসাহেব…মানে গায়ত্রী রাই নিশ্চয়?

—নাম কি করে জানব, যার বয়েস বেশি।

—হ্যাঁ, গায়ত্রী রাই। তার মেয়ে ঊর্মিলা রাই। মেয়েকে দেখেছ?

—হুঁ।

একটা চোখ সামান্য ছোট করে আবু হাসল একটু।—বেশ খাসা, না!

আগের দিনের মতো চটুল প্রসঙ্গ বাপীর ভালো লাগল না। তার বুকের তলার ক্ষত আবু জানে না। তাছাড়া স্বাস্থ্য ভালো আর রং ফর্সা হলে বয়েসকালের সব নেপালী মেয়েরাই মোটামুটি সুশ্রী। যে তপ্ত নিঃশ্বাস মুচড়ে বেরিয়ে আসছে সেটা গোপন করার তাগিদ।…ওই মেয়েকে খাসা বলছে, মিষ্টিকে দেখলে কি বলত?

হাল্কা সুরেই জবাব দিল, মায়ের তাড়া খেয়ে আর অত দেখা হয় নি।

আবুর এতেও হাসি।—দেখতে গেলে আরও বেশি তাড়া খেতে—মাটি জাঁদরেল মেয়েমানুষ। সব বলব’খন–তা তোমার সঙ্গে তার কি কথা হয়েছে?

এ প্রসঙ্গও সংক্ষেপে সারল বাপী। তারপর বলল, এখানে থেকে যাব বলেই এসেছিলাম, যা হোক কিছু করে চালিয়ে নিতাম—তাও হবার নয় দেখছি।

আবু প্রায় আগের মতোই তিরিক্ষি।—আমি থাকতে তোমার এখানে থাকার জায়গার অভাব হবে? চলে যেতে হবে? তুমি কিছু ভেবো না, সব আমার ওপর ছেড়ে দাও। এই আবু রব্বানী এখন খোদার দয়ায় অনেক কিছু পারে—বুঝলে?

বোঝা যায় কি যায় না এমন একটু শ্লেষ মাখিয়ে বাপী বলল, এখানে পা দিয়েই শুনেছি তুমি এখন একজন মস্ত লোক এখানকার—

—কোন শালা—। বেফাঁস শব্দটা মুখ দিয়ে বার করেই জিভ কাটল আবু রব্বানী—তুমি এখন অনেক পাশটাশ করা ভদ্রলোক মনে থাকে না, আমি শালা সেই জংলিই আছি—

বাপী বলল, জংলিই ভালো, মনে রাখার দরকার নেই।

আবুর হৃষ্ট মুখ।—আসলে কি জানো বাপীভাই, দাপটে না চললে সকলে ঘাড়ে পা দিতে চায়, তা বলে তুমি মস্ত লোক বলবে?

—আচ্ছা বলব না। কিন্তু আমাকে থাকতে দেবে কোথায়, নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলবে?

নিরীহ মুখে আবু ফিরে জিজ্ঞাসা করল, তুললে অসুবিধে হবে?

—তা হয় না—

আবু হেসে উঠল।—আমি মস্ত লোক হয়েছি, না তুমি ভদ্দর লোক হয়ে গেছ বোঝো তাহলে। কিছু ভেবো না, তোমাকে আমি জঙ্গলের ঘরে রাখব না। উঠে দাঁড়াল।—কিন্তু আমার ঘরে গিয়ে কিছু মুখে দিতে আপত্তি নেই তো?

বাপীও উঠে পড়ল। মনের অবস্থা আবুর বোঝার কথা নয়। জঙ্গলের ঘরে কেন, একেবারে গহন জঙ্গলে সেঁধিয়ে যাবার মতোই ভিতরের তাড়না। একা থাকতে চায়। নিরিবিলিতে থাকতে চায় দিন-কতক। গুলি-বিদ্ধ বাঘও হিংস্র আক্রোশে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, তারপর ক্ষত শুকোনোর তাড়নায় নিরিবিলি আড়াল খোঁজে। সামনে দিয়ে তখন হরিণ নেচে গেলেও মুখ ফিরিয়ে থাকে।

—চলো। খিদের চোটে অন্ধকার দেখছি।

যত খুশিই হোক, আবুর কাজে গাফিলতি নেই। নতুন চারা-বেডটার দিকে এগিয়ে গেল। একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে লোক ক’টাকে বলল, রাতে এরপর দুজন করে পাহারা দিতে হবে মনে থাকে যেন, নইলে বেজিতে শেষ করে দেবে।

যেতে যেতে বাপী বলল, বড়সাহেবের স্পেশাল অর্ডারের চন্দ্রা না কিসের বেড বললে ওটা জঙ্গলে ফুলের চাষ-টাষও হচ্ছে নাকি আজকাল?

আবু মিটি মিটি হাসতে লাগল। দুদিন সবুর করো, সব জানবে। চন্দ্ৰা কোনো বাহারী ফুল নয়, ওর আর এক নাম সর্পগন্ধা—অ্যালোপাথি কবরেজি হোমিওপ্যাথি এই তিনেতেই এর দারুণ কদর। এছাড়া হাতুড়েরাও পাগলদাওয়াই বানাবার জন্যে এর ফুল ফল পাতা শেকড়বাকড় সব কেনে।

সর্বগন্ধা নাম বাপীরও জানা। কিন্তু বীটম্যান আবুর এত-সব জানার কারণ কি, আর ওর মুখেই বা এরকম হাসি কেন? জিজ্ঞেস করল, বড়সাহেবের হুকুমে জঙ্গলে ওষুধের গাছ-গাছড়াও চাষ হচ্ছে এখন?

—হচ্ছে না, আমি হওয়াচ্ছি। আর একটু কায়দা করে বড়সাহেবের হুকুমটা আদায়টা করে নিতে হচ্ছে। খুশিতে টইটুম্বুর মুখ আবুর।—বললাম তো, কটা দিন সবুর করো, সব জানবে সব শুনবে। তুমি এখানেই থেকে যাবে শুনে আমার বুকের ছাতি ডবল হয়ে গেছে—তুমি যা-হোক কিছু করে চালিয়ে নেবার কথা বলছিলে—এখানে পয়সার ছড়াছড়ি, বুঝলে দোস্ত—শুধু মাথা খাটিয়ে তুলে নিতে জানলেই হয়

আবু রব্বানী মাথা খাটাচ্ছে আর পয়সাও তুলছে এটুকু বোঝা গেল। সেটা যে চাকরির পয়সা নয়, বাড়তি কিছু, তাও স্পষ্ট।

আরো একটু এগিয়ে বাপী দাঁড়িয়ে গেল।—বাক্স-বিছানা এদিকে রেখে এসেছি, নিয়ে নিলে হত।

—কোথায় রেখেছ?

বাপী ইচ্ছে করেই লছমনের নাম করল না। হেসে বলল, বনমায়ার জিম্মায়।

—বনমায়া! আমাদের বনমায়া?

সায় দিয়ে বাপী বলল, এখানে এসেই তো সবার আগে ওর সঙ্গে দেখা করলাম।

—তোমাকে চিনল?

—খুব। শুঁড় উঁচিয়ে আগের মতো সেলাম বাজালো, শুঁড় পেঁচিয়ে আদর করল।

শুনে আবুও খুশি। বলল, এক ভীমবাহাদুর ছাড়া বনমায়ার কদর এখানে কেউ বুঝলই না। ভেবে নিল কি একটু।—বাক্স-বিছানা ওখানেই থাক এখন….আপাতত ওদিকেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। লছমন দেখে রেখেছে তো?

সায় পেয়ে ঘরের দিকেই চলল আবার। আবু বলল, ভীমবাহাদুর নেই, বনমায়ার মেজাজেরও ঠিক নেই; তবে ফি বছর মরদের সঙ্গে পালানোটা ঠিক আছে!

—বনমায়াকে ছেড়ে ভীমবাহাদুর পালালো কেন?

শুনল কেন। না পালালে ভীমবাহাদুরকে জেলে পচতে হত। এখনো ওর নামে হুলিয়া বহাল আছে। ভালবাসার মেয়েকে ঘরে আনার আধা-আধি টাকার যোগাড় হয়ে গেছল। সেই টাকা জমানোর নেশায় ভীমবাহাদুর ভালো খেত না পর্যন্ত। চা-বাগানের এক উঠতি বয়সের দাপটের বাবু ওই পাহাড়ী মেয়েকে ছলাকলায় ভুলিয়ে নিজের বাংলোয় নিয়ে এসেছিল। তারপর যা, তাই। মেয়েটা বাবুর গায়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল বলে সে তাকে চাবুক দিয়ে মেরেছে পর্যন্ত। আর দরজায় পাহারা মোতায়েন রেখেছে।

মাঝরাতে ভীমবাহাদুর বাংলোয় ঢুকে তার বুকে ছুরি বসিয়েছে। আধ ঘুমন্ত পাহারা-অলা ওর সেই মূর্তি দেখে পালিয়ে গেল। বাবুটি তখন নেশা করে ঘুমোচ্ছিল। সে ঘুম আর তার ভাঙেনি। সেই রাতেই ভীমবাহাদুর তার ভালবাসার মেয়েকে নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

বাপী মুখ বুজে চলেছে। কিন্তু ভিতরে নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। দক্ষিণ কলকাতার কোনো এলাকার সাতাশি নম্বর বাড়ির উল্টো দিকের দোতলা বারান্দার সোনালি চশমা রাঙামুখো একজনের কলজে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দেবার সুযোগ পেলে তার নিজের হাত একটুও কাঁপত কি? নাকি রাতের অন্ধকারে খুপরি ঘরে ঢুকে রতন বনিক তার বউ কমলা বনিকের আর বাপী নামে এক বেইমানের বুকে ওমনি ছুরি বসিয়ে গেলে খুব অন্যায় হত?

কথায় কথায় আরো কিছু খবর জানালো আবু রব্বানী।…ওর বাবা কালু তিন বছর আগে মারা গেছে। শেষের দিকে ছেলের ওপরেও তার অভিমান, যেন ওকে হটিয়ে ছেলে তার জায়গাটা জুড়ে বসেছে। অথচ শেষ সময় পর্যন্ত আবু তাকে নেশার জিনিস যুগিয়ে এসেছে—শহর থেকে সেরা জিনিস এনেও খাইয়েছে। আর গেল বছর রেশমার মরদ কাঁদনা মাটি নিয়েছে। ওর আর পেট বলে কিছু ছিল না, হেজে পচে গেছল। ও মরে বেঁচেছে, রেশমারও নিষ্কৃতি।

বাপী জিগ্যেস করল, রেশমা একাই সাপ খেলা দেখাচ্ছে এখন?

—ছোঃ! তার থেকে ঢের ঝাঁঝের খেলা দেখাচ্ছে। আবু হাসতে লাগল, রেশমা আর সে রেশমা নেই, বুঝলে? এখন বুকের পাটা কত, বিষাক্ত সাপগুলোর খপাখপ টুটি টিপে ধরা দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে।

বাপী ভেবে নিল সাপ ধরে রেশমা এখন অন্য সাপুড়েদের কাছে বেচে দেয়। আবুর কথায় আর হাব-ভাবে কিছু রসের ছোঁয়া থাকলেও বাপী আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলতে লাগল। রস চুলোয় যাক।

আবু হঠাৎ উৎসুক চোখে ঘাড় বেঁকিয়ে ওকে দেখে নিল।—আগে তোমার কথা শুনি বাপীভাই, অ্যাদ্দিন ছিলে কোথায়?

—কলকাতায়।

—চাকরির চেষ্টায়?

—মাস কয়েক যুদ্ধের আপিসে টেম্পোরারি চাকরি করেছি। —তারপর বেকার বসে ছিলে?

বাপী মাথা নাড়ল। তাই। এ নিয়েও কথা বাড়াতে চায় না। কিন্তু আবু খুশিতে ডগমগ।—খোদার খেল দেখো, তার মরজি না হলে টান পড়ে না—এখানে কাজই উল্টে তোমার জন্যে হাঁ করে আছে! আমি কতদিন তোমার কথা ভেবেছি, দুলারিকেও বলেছি, এ-সময় বাপীভাই এখানে থাকলে জমত ভালো—নেপালী মেমসাহেবকে ওই বাড়িটা দেবার সময় তোমার কথা তো খুব হত—

আবু রব্বানী এ ক’বছরে আরো কত চতুর হয়েছে বাপীর ধারণা নেই। বাড়িটা হাতছাড়া হয়েছে বলে এমন আশার কথা শোনাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বাপী ভিতরে উৎসুক একটু, বাইরে প্রায় নির্লিপ্ত।—কি কাজ, চাকরি-টাকরি?

—চাকরি করলে চাকরি, নয়তো চুক্তিতে রফা হলে চুক্তি—ধৈর্য ধরে সব দেখে-শুনে যা তুমি ভালো বুঝবে। বললাম না পয়সার ছড়াছড়ি এখানে। মাথা খাটাও, দিল লাগাও আর কড়ি তোলো। তোমার মতো ভদ্দরলোকের চামড়া গায়ে থাকলে আর বিদ্যের জোর থাকলে এই আবু রব্বানীকে আজ দেখতে হত! নেপালী মেমসাহেবের ওই প্যাচামুখো লাটসাহেবকেই লাট খাইয়ে দিতাম না! এও দুর্বোধ্য। তবে নেপালী মেমসাহেব যে ওর স্বার্থের কোনো বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে, এটুকু স্পষ্ট।

আবু আর একবার ঘাড় ফেরালো, তারপর বলল, তুমি একটু বদলে গেছ বাপীভাই…

—কেন?

—আগে আমার সব ব্যাপারে তোমার কত আগ্রহ ছিল, উৎসাহ ছিল—প্রায় ছ’বছর বাদে দেখা, আর তুমি যেন আমার কাছ থেকে ছ’হাত দূরে দূরে হাঁটছ।

আবু চালাক বলেই একটু ঘুরিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করল। নইলে সাদাসাপটা বলে বলত, আগে তো আমার চেলাটি ছিলে, আমাকে গুরু ঠাওরাতে। এখন সে—রকম দেখছি না। বাপী হাসল একটু, জবাব দিল, আধ-হাত দূর দিয়েও তো হাঁটছি না!

হঠাৎ আগের মতোই সন্ধানী চাউনি আবুর। কথার ধরনও তেমনি চাঁছাছোলা—সাহেব বাংলোর তোমার সেই মহারাণীর মেয়ের খবর কি, আর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে?

আবুর সঙ্গে দেখা হলে এ-কথা উঠবে জানত। আর যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত মুখে এ-প্রসঙ্গ ধামা-চাপা দেবার চেষ্টাই করবে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে আবুকে আগের মতো সেই কাছের মানুষ মনে হতে বুকের তলায় মোচড় পড়ল। জবাব না দিয়ে একবার তাকালো শুধু।

আবু লক্ষ্য করছে। উৎসুকও।—দেখা হয়েছে তাহলে! কেমন এখন? বহুত খুবসুরৎ?

—ভালোই।

খপ করে শিকার ধরে তোলার মতো চকচক করছে আবুর দু চোখ।—কত দিন আগে দেখা হয়েছে?

বাপী কি হঠাৎ জোর গলায় ওকে ধমক লাগাবে একটা? পারা গেল না। বিড়-বিড় করে বলল, বেশি দিন নয়।

যন্ত্রণার আঁচ আবু কতটা পেল সে-ই জানে। সব ঝেড়ে ফেলার মতো করে বলল, গুলী মেরে দাও বাপীভাই, আমি তো সেই কবেই বলে রেখেছিলাম ও—মেয়ে বেশি দিন বাপ মায়ের সিন্দুকে বসে থাকবে না। যেতে দাও—নিজের দুটো পায়ের ওপর শক্ত করে দাঁড়ালে অমন কত হুরী-পুরী এসে গড়াগড়ি খাবে!

বাপী সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। আবু ধরে নিয়েছে মিষ্টি অন্যের হেপাজতে চলেই গেছে আর সেই মনস্তাপেই কলকাতা ছেড়ে ও আজ বানারজুলিতে। একেবারে সত্যি না হলেও কত আর ভুল…।

ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আবুর আর এক মূর্তি। ঘরে ঢুকল না তো একখানা দুরন্ত খুশির ঢেউ আছড়ে পড়ল যেন। হাতের লাঠি একদিকে ছুঁড়ে ফেলল। সাড়ে তিন বছরের ছেলেটা ছুটে এসে, তার সাধ্যমতো একটা লাফ দিয়ে দু-হাতে বাপের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলতে লাগল। ওদিকে দুলারির কোলের আঁট—ন’মাসের ছেলেটাও দু-হাত তুলে বাপের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ব্যগ্র। হাত বাড়িয়ে আবু আগে ওকে নিয়ে লোফালুফি খেলল খানিক। ছেলেটার ভয়-ডর নেই, খিক-খিক হাসি। তারপর একটু দূর থেকেই ওটাকে মায়ের কোলে ছুঁড়ে দিয়ে আবু বড়টার সঙ্গে ছোটাছুটি আর মেকি মারামারি ঘুষোঘুষি শুরু করে দিল। বাপীকে বলল, কালে দিনে এ দুটো আমার থেকেও কড়া অ্যালসেসিয়ান হয়ে উঠবে দেখে নিও

ছেলেটাকে উসকে দেবার জন্য আবু একটু জোরেই ঘা বসাচ্ছে এক একবার আর ওটা দ্বিগুণ গোঁ-ভরে বাপের ওপর চড়াও হচ্ছে। দুলারির তামাটে মুখ প্রসন্ন, কিন্তু ধমকেই উঠল, আঃ থামবে। বাপীভাই যে কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গেল!

মায়ের ধমকেই ছেলের দৌরাত্ম্য থামল। কি মনে পড়তে আবুর হাসিমুখ বিপরীত গাম্ভীর্যে ঘোরালো করে তোলার চেষ্টা। গলায় কপট শ্লেষ মিশিয়ে বলল, রেশমার বদলে তোমাকে আমার ঘরে দেখে বাপীভাই তার থেকে ঢের বেশি হাঁ হয়েছে—বুঝলে? আমি রেশমার জন্য পাগলা হয়ে গেছলাম দেখে গেছে আর আজ ঘরে এসে দেখে বিবি বদল।

দুলারি হাসছে না ঠিক, তামাটে মুখে হাসির আভা ছড়াচ্ছে। বলল, বাপীভাইয়ের তখন চোখ কানা ছিল বোধ হয়।

আবু হা-হা শব্দে হেসে উঠল। হাসছে বাপীও। আর মনে মনে সায় দিচ্ছে, কানা যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবু বলল, দুজনেরই খিদে পেয়ে গেছে, কি আছে জলদি দাও—বাপীভাইকে নিয়ে এরপর আবার নেপালী মেমসাহেবের কাছে যেতে হবে।

সুপটু গৃহিণীর মতো পাঁচ মিনিটের মধ্যে একরাশ জলখাবার নিয়ে দুলারি হাজির। বাপী আসবে ধরেই নিয়েছিল বোধ হয়। খুশি মুখে আবু টিপ্পনী কাটল, এত সব আজ তোমার খাতিরে, আমার অত জোটে না।

দুলারিরও সমান জবাব।—বেইমানি কথা শুনলে জিভে গরম ছেঁকা লাগাব। আবু সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো।—আমার জিভে ছেঁকা লাগালে আখেরে কে পস্তাবে?

সাপুড়ে মেয়ের তামাটে মুখে শরমের রং। কটাক্ষের চাবুক হেনে চটপট সরে গেল। আবু হাসতে লাগল।

বাপী সুখের ঘর দেখছে।

.

জলখাবারের পাট শেষ হতে আবু আয়েস করে বিড়ি ধরালো একটা। বাপীকে বলল, সিগারেটও আছে—চলে?

বাপী মাথা নাড়ল, চলে না। নিজের বাড়ির খবর জানার তাগিদ। জিগ্যেস করল, নেপালী মেমসাহেবের কাছে যাবে এখন?

—যাব’খন। হাসল।—ওই ঠাকরোনটির কাছে যেতে হলে এমনিতেই বেশ করে দম নিয়ে যেতে হয়—তার ওপর আজ বাড়ির মালিককে দেখে ক্ষেপেই আছে কিনা কে জানে।

—কেন?

—কেন আর, নতুন ঘর তুলে তোমার বাড়ির ও-রকম ভোল পাল্টাতে এককাঁড়ি টাকা খরচ হয়েছে—আমাকে হিসেব দেবে বলছিল।…লাইট-ফাইট জল-কলসুদ্ধু কম করে পাঁচ হাজার হবে—সে বাজার কি আছে!

বাপীর দু’কান খাড়া। বাড়ির দায় ওর ওপরেই ছেড়ে দিয়ে গেছল। ভাড়া আর বিক্রীর দুটো পরোয়ানা ওকেই লিখে দিয়েছিল। বেচে যে দেয় নি সেটা আবু আগেই বলেছে। আবার ভাড়া নিয়েও কি প্যাচ-ঘোঁচের ব্যাপার আছে বলছিল। কি শর্তে নেপালী মেমসাহেব ওই বাড়ির পিছনে অত টাকা ঢেলেছে আবু এখন পর্যন্ত সেটাই বলে নি।

সে বাড়ির মালিক শুনে মহিলা থমকেছিল বেশ, বাপীর মনে আছে। জিজ্ঞেস করল, তা আমাকে দেখে ক্ষেপবে কেন?

হাতের বিড়িটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলল আবু রব্বানী।—মেমসাহেব জানে বাড়ির মালিক বে-পাত্তা! কোন দিন ফিরবে কি ফিরবে না তারও ঠিক নেই। আর জানে, আমি বাড়ির জিম্মাদার, আমি সব্বে-সর্বা—তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘর তুলেছে আর বাড়ি সাজিয়েছে—আমার সঙ্গে এখন পর্যন্ত সইসাবুদটা পর্যন্ত হয়নি, এর মধ্যে খোদ মালিক হাজির দেখলে কি আহ্লাদে আটখানা হবে?

বাপী ভিতরে ভিতরে স্বস্তি বোধ করল একটু। বাড়ির ব্যাপারে এত সব তোমার পারমিশন নিয়ে করা হয়েছে?

—হুঁঃ, সেই মেয়ে! পারমিশন-টারমিশনের ধার ধারে না, তাঁর মর্জি-মাফিক কাজ—ম্যানেজারকে দিয়ে তোমার বাড়ির খোল-নলচে পাল্টানোর পর চুক্তির কথা তুলেছে—আমি মওকা পেয়ে চুপ মেরে ছিলাম—

—নেপালী মেমসাহেবের আবার ম্যানেজারও আছে নাকি?

—নেই আবার—হেঁজিপেঁজি মেয়েমানুষ নাকি! সে শালাই তো তার প্যাচামুখো লাটসায়েব।

জঙ্গল ভেঙে ঘরে ফেরার পথে আবু বলেছিল বটে, বিদ্যেবুদ্ধির জোর থাকলে নেপালী মেমসাহেবের কোন্ প্যাচামুখো লাটসায়েবকে লাট খাইয়ে দিত।

বাড়ি আর চুক্তির ব্যাপারটা বাপী আর একটু বিশদ করে শুনে নিল। গায়ত্রী রাই পাশের জমিসুদ্ধু বাড়িটা কিনে নিতে চেয়েছিল। যুদ্ধের পর জায়গা-জমির দাম এ—দিকেও হু-হু করে বাড়ছে দেখে আবু রাজি হয় নি। তাছাড়া দোস্তের পৈতৃক ভিটের ওপর তারও কম মায়া নয়। গরজের দায়ে গায়ত্রী রাই চড়া দামের লোভ দেখিয়ে চাপাচাপি করছিল। মিনমিন করে আবু তখন একটা মিথ্যে কথাই বলেছে। ও বাড়ির জিম্মাদার ইচ্ছে করলে ভাড়া দিতে পারে, বেচতে-টেচতে পারে না।

গায়ত্রী রাইয়ের দাপটের ম্যানেজারের নাম রণজিৎ চালিহা। আসামের মানুষ। ধরাকে সরা ভাবে। বাড়ির মালিক পাঁচ বছর যাবৎ নিখোঁজ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ওটা জবরদখলের মতলব দিয়েছিল মেমসায়েবকে। বলেছিল, সব নিজের ভেবে তুমি যা-খুশি করে নাও, কেউ দাবি ফলাতে এলে আমি আছি। কিন্তু গায়ত্রী রাই যত জাঁদরেল মেয়েমানুষই হোক, অমন কাঁচা ঠকবাজি পছন্দ করে না। তাছাড়া বেগতিক দেখে মেমসায়েবের কাছে আবু বাপীর মরা বাপকে এই জঙ্গলের অফিসার বানিয়ে দিয়েছিল। বলেছে, এখানকার সরকারী ছোট অফিসার ছিলেন ভদ্রলোক—আর মস্ত ধার্মিক মানুষ ছিলেন, সক্কলে তাঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। তাঁর ছেলের সঙ্গে এ-রকম করাটা ঠিক হবে না, তাছাড়া বাড়ির দলিলপত্র মালিকের কাছে আছে—নিখোঁজ হলেও সে সব তো আর হাতছাড়া হয় নি।

গায়ত্রী রাই হাঁ-না কিছুই বলেনি। কারো উপদেশ বরদাস্ত করার মেয়ে নয়। আবুকে ধমকে যে ওঠেনি তাতেই বোঝা গেছে বড়দরের অন্যায় কিছু করবে না। বাড়ির ভোল বদলানোর পর আবুর ডাক পড়েছে; গায়ত্রী রাই জানিয়েছে সব ঠিক-ঠাক করে নিতে পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে। হিসেব তার ম্যানেজারের কাছে আছে। এ-টাকাটা ভাড়ার টাকা থেকে কাটান যাবে—সব শোধ হলে তবে মাসের ভাড়া হাতে আসবে।

এই মওকা ছাড়ার পাত্র কি আবু রব্বানী? ভিজে বেড়ালের মতো মুখ করে ভাড়ার ফয়সলায় নেমেছে। শুধু বসতবাড়ি তো নয়, বাড়তি ঘরখানা তোলা হয়েছে ব্যবসার কাজে লাগানোর জন্য। তাছাড়া যুদ্ধের সময় থেকে এই বানারজুলিতেও সেলামীর ভূত নেমেছে——ইজেরাদার ঠিকেদারদের কল্যাণে এখন একখানা ঘর পেতে হলে আগে নজরানা গুনে দিতে হয়। আবুর বরাত ভালো ম্যানেজার তখন ট্যুরে। গায়ত্রী রাইয়ের পায়ের কাছে বসে অনেক কথা নিবেদনের সুযোগ পেয়ে গেছল। যেমন বাড়ির মালিক বাপী তরফদার তার প্রাণের দোস্ত—আর তার বাপের দয়াতে ওর এখানকার জঙ্গলের চাকরি, সেই দোস্ত ফিরে এসে যদি ওকে বেইমান ভাবে তাহলে খোদার বজ্র ওর মাথায় নেমে আসবে। তাই বাড়ির ব্যাপারে আবুর মুখ না চেয়ে হকের ফয়সালাই করতে হবে।—কারণ পাঁচ হাজার ভাড়া থেকে কাটানো গেলে এখন যা হয়েছে তার সবটাই তো বাড়ির মালিকের। তাই পাঁচ হাজার থেকে প্রথমেই হাজার টাকা সেলামী বাবদ কাটান যাবে। আর একশ টাকার নিচে এই দিনে এরকম বাড়ির ভাড়া তো হতেই পারে না।

কলে পড়লে নেপালী মেমসাহেবের দরাজ হাত। এ নিয়ে খুব একটা ঝকাঝকি করেনি। সেও আবু রব্বানীকে সেয়ানা জানে কিন্তু বেইমান ভাবে না। ভাববেই বা কেন, আবু তাকে বলেছে, সেলামী বাদ দিয়ে বাকি চার হাজার টাকা থেকে একশ টাকা করে কাটান দেবার চুক্তি সে-ই করবে—তত-দিনে বাড়ির মালিকের দেখা নিশ্চয় মিলবে, আর না যদি মেলে তো মেমসায়েব যেন তার পরের টাকা বানারহাটের সরকারী দপ্তরে বাড়ির মালিকের নামে চেকে জমা করে দেন। ও তো আর হাত পেতে একটি পয়সাও নিচ্ছে না।

হাজার টাকা সেলামী আর একশ টাকা ভাড়া শুনে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা নাকি আবুকে ধরে এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের জবান খসলে পাকা ব্যাপার। তার কথামতো কাগজপত্র তৈরি। কিন্তু হচ্ছে হবে করে এই চার মাসেও সইবাবুদের ফুরসৎ মেলেনি। ম্যানেজার মাসের অর্ধেক সময় বাইরে বাইরে ঘোরে, নেপালী মেমসায়েবও হুট হুট করে তার পাহাড়ের বাড়িতে চলে যায়। আর দুজনেই যখন এখানে তখন এত কাজের চাপ আর এত রকমের প্ল্যান—প্রোগ্রাম হিসেব-নিকেশ যে এই সামান্য ব্যাপারটা হয়তো মনেই থাকে না।

এবারে তিন নম্বর বিড়িটা আবু বাইরে ছুঁড়ে ফেলে হিসেব দাখিল করল, খরচের মোট পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে হাজার টাকা সেলামী বাদ দিলে থাকল চার হাজার। তার থেকে গত চার মাসের চারশ টাকা ভাড়া আর তার আগের চার মাসে পঞ্চাশ টাকা করে ধরে মোট ছ’শ টাকা তোমার শোধ হয়েই গেছে। হেসে উঠল, হাঁ হয়ে গেলে যে—মওকা পেয়ে আবু রব্বানী দোস্তের ভালো করেছে কি খারাপ করেছে?

বাড়ির ব্যাপারে বাপী অন্যরকম ভাবছিল বলে নিজেরই খারাপ লাগছে। বলল, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে—

আবু এতেই খুশি। দুনিয়ার অনেকখানি হাতের মুঠোয় এমন সুরে বলে উঠল, ভালোর এখনো ঢের বাকি, সবে এলে, এখন তোমার আমার দু মাথা এক হলে কি যে হবে দেখো!

ওকে পেয়ে আবুর মাথায় কিছু মতলব গজিয়েছে আগেই সেটা বোঝা গেছে। ঘরে আসার পথে ওর মুখে ফুর্তি উপচে পড়ছিল, কলকাতায় বাপী বেকার বসেছিল শুনে বলেছিল, খোদার মর্জি না হলে টান পড়বে না—এখানে কাজই উল্টে তার জন্যে হাঁ করে আছে। দুলারিকেও নাকি কত সময় বলেছে, এ-সময় বাপীভাই এখানে থাকলে জমত ভালো।…আর বলছিল, পয়সার ছড়াছড়ি এখন এখানে—মাথা খাটাও, দিল্ লাগাও আর কড়ি তোলো। ওকে পেয়ে আবুর মাথা খাটানো দিল্ লাগানোর জোর আর কড়ি তোলার আশা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এদিকটা বাপীর কাছে দুর্বোধ্য এখনো

আবু রব্বানীর জিভের লাগাম আরো ঢিলে এরপর। খুশি-ঝরা দুচোখ বাপীর মুখের ওপর। দেখছে কিছু। তরল গলায় বলল, তোমার মুখখানা এখন আগের থেকে ঢের মিষ্টি লাগছে বাপীভাই—দেখলেই মনে হয় ভেতর-বার সাফ— নেপালী মেমসাহেবের ঠিক পছন্দ হয়ে যাবে।

শোনার পর কান খাড়া, বাপী হাল্কা সুরে ইন্ধন যোগালো, কেন—মেয়ের জন্য পাত্রটাত্র খুঁজছে!

রসের কথায় আবু আর চাঁচাছোলা মানুষ নয় আগের মতো। হেসে উঠে জবাব দিল, মেয়ের জন্য কেন, নিজের জন্যেই খুঁজছে—ঠাকরোন বিধবা জানো তো?

নেপালিনীদের কী দেখে সধবা বিধবা বোঝা যেতে পারে বাপীর ধারণা নেই। পাত্র খোঁজার রহস্যটা আবু আর একটু বিস্তার করল। নিজের কাজের জন্যেই খুব একজন বিশ্বাসী আর লেখাপড়া জানা চৌকস লোক খুঁজছে নাকি গায়ত্রী রাই। ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে চা-বাগান থেকে দুবার দুটো ভদ্রলোক ছেলেকে এনে কাজে বহাল করেছিল। দুজনেই তারা চা-বাগানের কেরানী। চা-বাগানের কর্তাব্যক্তিরা গায়ত্রী রাইকে চোখে বড় দেখে না কিন্তু মানে-গনে খুব। দরকার শুনে তারাই দুবার দুজনকে লম্বা ছুটি দিয়ে আর বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে মহিলার যাচাইয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু একজনও টিকে যেতে পারে নি। গায়ত্রী রাই দুজনকেই ছেঁটে দিয়ে চা-বাগানে ফেরত পাঠিয়েছে। আবুর মতে ওই দুজনের একজন অন্তত বেশ শিক্ষিত আর চালাক-চতুর, আবু ধরে নিয়েছিল সেই লোকটা টিকেই যাবে। রসের ছোঁয়া পেলে আবুর এক চোখ এখনো একটু ছোট হয়ে যায়! মুচকি হেসে বলল, আমার ধারণা ওই লোকটার ঘাড়ে ঠাকরোনের খাঁড়া নেমেছে অন্য কারণে, নইলে কাজকর্ম ভালই করছিল, আর পরে ম্যানেজারও তাকে ভালো চোখেই দেখছিল।

মুখ দেখে বোঝা না গেলেও রস-টস কানে নেবার মন নয় বাপীর। সাদাসিধে ভাবেই জিগ্যেস করল, আমার মুখ দেখে আর ভেতর-বার সাফ ভেবে তোমার নেপালী মেমসাহেব এখন আমাকে সে জায়গায় নিয়ে নেবে ভাবছ?

—নিশ্চয় নেবে। আবুর গলার জোর বাড়ল।—একে তোমার বাড়ির সে ভাড়াটে, তার ওপর ওই বাড়ির ব্যাপারেই তোমার সম্পর্কে আমি একরাশ গুণ গেয়ে রেখেছি না! যেমন লোকই হই, ঠাকরোন আমাকে দারুণ বিশ্বাস করে— লেখাপড়া জানা একজন ভালো অথচ চালাক-চতুর মানুষ তার খুব দরকার এ কথা নিজে আমাকে বলেছে। চাকরি না পোষায় চুক্তিতে কাজ করতে পারো, তবে আটঘাট সব বুঝে নিয়ে মেমসাহেবের গলায় দাঁত বসাতে হলে চাকরিতে লেগে যাওয়াই ভালো। হেসে উঠল, ভেবো না, দাঁত বসানোর মওকা আমিই করে দেব—

বাপীর চোখে বা মুখে উৎসাহের চিহ্ন নেই। ওর মিষ্টি মুখের ছলনার ওপর আবু কিছুটা নির্ভর করছে মনে হতে খারাপই লাগল। বলল, আমার ভেতরবার সাফ ভেবে নেপালী মেমসাহেবের পছন্দ হলে তোমার কি লাভ—ভাঁওতাবাজীর ব্যাপার কিছু?

এবারে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল আবু রব্বানী। মেজাজী পুরুষ! দেখো বাপীভাই, আমি লোক যেমনই হই আর যা-ই করি নিজেকে খোদার গোলাম ভাবি। তুমি লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকের ছেলে, আমার দোস্ত—তোমাকে নোংরামির মধ্যে যেতে বলব কেন, আর তুমিই বা তা বরদাস্ত করবে কেন? তোমাকে মেমসায়েবের সঙ্গে জুড়ে দিতে চাই কেরামতি দেখিয়ে একদিন ওই চালিয়াৎ ম্যানেজারকে ঢিট করার জন্য, আর আমাদের ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা ঠিক—ঠিক পাইয়ে দেবার জন্য। এরই নাম দাঁত বসানো, নইলে তো ওই আধবয়সী মেয়েমানুষের বদলে তার মেয়েকেই দেখিয়ে দিতাম!

উষ্মার মুখেই হেসে ফেলল আবার। —খবরদার, মেয়ের দিকে তাকিয়েছ কি কেস গড়বড়—এ ব্যাপারে মা-টি যাকে বলে বাঘিনী। মেয়ের পিছনে ছোঁকছাক করতে দেখেই চা-বাগানের সেই চৌকস লোকটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছিল।

ঘরে বাতাসের অভাব, না বুকে? দুনিয়ায় কি এমন জায়গা নেই যেখানে মেয়ে নেই? বাপী বিড়বিড় করে বলল, মেয়ের কথায় কাজ নেই, মায়ের কথা বলো। গায়ত্রী রাইয়ের মেজাজ বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বাপীর মিনিট কয়েকের পরিচয়। একটা উটকো মানুষ অন্দরে ঢুকে পড়েছে ভেবে তার ঝাঁঝ দেখে আর ঝাপটা খেয়ে চলে এসেছিল। ওটুকু দিয়ে মহিলার বিচার সম্ভব নয়। তবু বাপীর মনে হয়েছিল তার রমণীসুলভ কোমলতার দিকটায় কিছু ঘাটতি আছে।

কিন্তু আবুর প্রগল্ভ বিস্তারের সার থেকে ওই রমণীর যে ছবিটা পেল তেমনটি হাজার গণ্ডা মেয়েছেলের মধ্যে একজনকেও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ

…বানারজুলির এই জঙ্গল ভারত সীমার মধ্যে। কিন্তু জঙ্গলের পরিধি ভুটান পর্যন্ত জুড়ে আছে। ভুটান স্বাধীন। এখান থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে সেই স্বাধীন ভুটানের বাসিন্দা গায়ত্রী রাই।

সেখানে একটা ছোট্ট পাহাড়ের মাথায় তার নিজস্ব বাড়ি। বাড়িটা করেছিল তার স্বামী বীরেশ্বর রাই। হিমালয়ের নিচের দিকে অমন ছোট ছোট অজস্র পাহাড় আছে। যারা অবস্থাপন্ন তারা নামমাত্র টাকায় সেই সব পাহাড় ইজারা নিয়ে তার ওপর ঘরবাড়ি তোলে। বীরেশ্বর রাই টাকার মুখ দেখার পরেই পাহাড়ের ওই বাড়ি করেছিল, কিন্তু সেই বাড়ির চেহারা এখন যা দাঁড়িয়েছে তার বারো আনা গায়ত্রী রাইয়ের কৃতিত্ব। সে-এলাকার অমন বাড়ি এখন খুব বেশি নেই। পাহাড়ের সেই বাড়িতে আবু বার কয়েক গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের হুকুমে তার কাজ নিয়েই যেতে হয়েছে। গায়ত্রী রাইয়ের নিজের ভ্যান আছে একটা। স্বামীর আমলে জিপ ছিল। সেই জিপ বেচে দেওয়া হয়েছে। এখন ভ্যানেই যাতায়াত চলে।

আবুর যাতায়াত ভ্যানেই। ভ্যানে পাহাড়ের তলা থেকে উঠে একেবারে পাহাড়ের ডগায় বাংলোর কম্পাউন্ডে পৌঁছে যেতে পারে। তলা থেকে লাল কাঁকরের রাস্তা পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের স্বামীর আমলে রাস্তাটা ভাল ছিল না। সেই রাস্তার সংস্কারও গায়ত্রী রাই করিয়েছে আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খোলা দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের দেয়ালের উল্টো দিকে তারের বেড়া লাগিয়েছে।

কারণ তিন বছর আগে কিছুটা স্বামীর দোষে আর কিছুটা বা ওই রাস্তার দোষে গায়ত্রী রাইয়ের কপাল ভেঙেছিল। আবু রব্বানীর অবশ্য ধারণ। সেই থেকে নেপালী মেমসাহেবের কপাল খুলে গেছে।

গায়ত্রী রাইয়ের ওই পাহাড়ের ঘরবাড়ি দেখার জন্য একজন লোক আর একটা মালী আছে। আর সেখানে তার পেশার কাজে সাত-আটজন নানা জাতের পাহাড়ী লোক বহাল আছে। এদের সকলের মাথার ওপর যে তার নাম ঝগডু। দেশ বিহারে। কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে এদিকের জঙ্গলে আর পাহাড়ে বাস। তার বউ বুনো হাতির পায়ের তলায় চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে মরেছে। দু-দুটো জোয়ান ছেলের একটাকে সাপে কেটেছে আর একটাকে ভালুকে মেরেছে। কিন্তু আবু সে-জন্যে লোকটার বড় রকমের শোক-পরিতাপ কিছু দেখে নি। কেবল সাপের গলা টিপে বিষ নিঙড়ে বার করার সময় তার চোখ দুটো সাপের থেকেও বেশি জ্বলতে দেখে, আর ভালুক শিকারের গন্ধ পেলে এই বয়সেও যে অস্ত্র সামনে পায় হাতে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে। এই বয়সে বলতে লোকটার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। এখনো পাথরে কোঁদা মজবুত শরীর। বীরেশ্বর রাইয়ের ব্যবসার শুরু থেকে তার সঙ্গে আছে। এখন তো মেমসায়েব না থাকলে ও-ই পাহাড়ের বাড়ির সর্বেসর্বা।

বয়েসের অনেক ফারাক সত্ত্বেও এই ঝগড়ুর সঙ্গে আবুর গলায় গলায় ভাব এখন। ভাব দু-তিন কারণে। স্বয়ং কর্ত্রীর যে বিশ্বাসের পাত্র ঝগড়ুর কাছে তার কদর বেশি। তা ইদানীং তো কর্ত্রীর অনেক রকমের জরুরী কাজে আবুর ডাক পড়ে। সে হেড বীটম্যান হবার পর মেমসাহেবের আয়-পয় আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ আবুকে সত্যিকারের মরদ ভাবে ঝগড়ু। পাহাড় থেকে নেমে এ—পর্যন্ত তিনটে ভালুক শিকার করেছে ওরা। আবুর বন্দুক আছে এখন, কিন্তু বন্দুক দিয়ে শিকার করাটা কি এমন মরদের কাজ। দুজনে মাথা খাটিয়ে জাঁদরেল ভালুককে নাজেহাল করে হাতের অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করতে পারলে তবে তো কথা। তাই করেছে। আর সে-সময় আবুর সাহস আর বুদ্ধি বিবেচনা দেখে ঝগড়ুর তাক লেগে গেছে।

গলায় গলায় ভাবের তৃতীয় কারণ—কারণ। অর্থাৎ শরাব। ভুটানে এই জিনিসটি অঢেল। বাজারে অনেক রকমের সস্তার মাল মেলে। আবার দামী বিলিতি জিনিসও এন্তার পাচার হয়ে আসে। দামী হলেও অন্য জায়গার তুলনায় ঢের সস্তা। কিন্তু গরীব মানুষ ঝগড়ুকে কম পয়সার দিশী মালই গিলতে হয়। অথচ সে বিলিতি বা দামী শরাবের ভক্ত। গন্ধ পেলে জিভে জল গড়ায়। ভাল জিনিসের স্বাদ জেনেছিল মনিব অর্থাৎ বীরেশ্বর রাই বেঁচে থাকতে। তখন দিশী জিনিসের দিকে ফিরেও তাকাত না ঝগড়ু। মনিবটি একদিকে যেমন দিলদরিয়া মানুষ ছিল, অন্যদিকে তেমনি শরাব-রসিক ছিল। কত রকমের দামী মাল ঘরে মজুত রাখা হত তখন। সাহেব দরাজ হাতে তার ভক্তকে প্রসাদ দিত—সিকি বোতল আধ-বোতল যা অবশিষ্ট থাকত ঝগড়ুর ভোগে আসত। ঝগড়ুর সেই সব সুখের দিন গেছে। ভাল জিনিস আর মেলেই না। কর্ত্রী ঘরে থাকলে এখন কত লুকিয়েচুরিয়ে আর মেহনত করে তাকে একটু-আধটু দিশী মাল খেতে হয়। টের পেলে এত পুরনো খাতিরের লোককেও ওই মনিবানি খাতির করবে না। যা-ই হোক, মেমসায়েবের ফরমাশ মত আবু পাহাড়ে গেলে বেশি দামের ভাল মালই ঝগড়ুকে খাওয়ায়। এরই ফলে দোস্তি জমজমাট। সেই দিলখুস নেশার সময় ঝগড়ুর মুখ থেকে এই পরিবারের নাড়িনক্ষত্র জেনেছে আবু রব্বানী।

ওষুধের বনজ কাঁচা মাল সরবরাহের ব্যবসা ফেঁপে উঠেছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। অ্যালোপ্যাথী, কবিরাজি / আর হোমিওপ্যাথী ওষুধের কারখানায় যেসব শিকড়—বাকড় লতাপাতা বীজ ফলমূল গাছগাছালির বিশেষ চাহিদা। আশপাশের হেকিম ওঝা হাতুড়ে বদ্যিরাও এ-সবের খদ্দের। ভেষজগুণের দামী আর দুষ্প্রাপ্য মাল সংগ্রহের দিকে বেশি ঝোঁক ছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। এ ব্যাপারে দারুণ পরিশ্রমী ছিল নাকি মানুষটা। নিজে পড়াশুনা করত, ওষুধের গাছগাছড়া লতাপাতা চেনে এমন লোকদের খুঁজে বার করত, তাদের নিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। এই করে ওষুধের গাছ যোগাড় করা আর চাষ করার একটা দলই তৈরী করে ফেলেছিল। তারা এখনো আছে, নতুন লোককেও শেখাচ্ছে। পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষেরা বেশির ভাগই ভীষণ গরিব। পয়সার মুখ দেখলে তাদের উৎসাহের অভাব হয় না, জঙ্গলের বাঘ-ভালুকেরও পরোয়া করে না। ওষুধের গাছ, লতাপাতা, বীজ, দানা চেনার ব্যাপারে সব থেকে চৌকস হয়ে উঠেছিল ওই ঝগড়ু। মনিব এ-জন্যে ওকে সব থেকে বেশি ভালবাসত। বয়েস হয়েছে, এখন আর যোগাড়ের কাজে বেরোয় না। পাহাড়ের বাংলোর পিছন দিকে কিছু দামী ওষুধ গাছের চাষের বাগান আছে, সেটা দেখাশুনা করে আর অন্য লোকদের তালিম দেয়।

বীরেশ্বর রাইয়ের এই সব বনজ কাঁচা মালের পসরা ভুটান সিকিম ছেড়ে আসাম আর উত্তর বাংলার দিকেও ছড়িয়ে গেছল। ও-সব দিকে তখনও কবিরাজি চিকিৎসার প্রাধান্য। অশিক্ষিত বা গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষেরা আগে হেকিম বা কবিরাজের কাছে ছুটত। ফলে ছোট-বড় কবিরাজি ওষুধ তৈরির কারখানাও গজিয়ে উঠছিল। তা ছাড়া ছোট-বড় কবিরাজেরা নিজেরা তো ওষুধ তৈরি করেই। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য দফায় দফায় লম্বা টুরে বেরুতো বীরেশ্বর রাই। ফলে সুনাম আর তার কাঁচা মালের কদর দুই-ই বেড়েছে।

এই ব্যবসা সামনে রেখে কাঁচা টাকা রোজগারের আর একটা দিকও হাতের মুঠোয় এসে গেছল বীরেশ্বর রাইয়ের। পাহাড়ী বনজঙ্গলে ওষুধের গাছ-গাছালি ছাড়া নেশার জিনিসও কত রকমের গজায় তার ঠিক নেই। আফিম গাঁজা ভাঙ তো আছেই, আরও অনেক রকমের ছোট-বড় নেশার জিনিসের হদিস মেলে। এ-ব্যাপারেও যেটুকু জ্ঞানগম্যি থাকা দরকার বীরেশ্বর রাইয়ের সেটুকু ছিল। এ ব্যবসা সে বাইরে চালাত না। এই সব নেশার জিনিস ভুটানের রাজধানী থিম্পু আর পারোর মত দুই একটা বড় শহরে চালান দিত। তাইতেই অনেক টাকা ঘরে আসত।

ব্যবসা ফেঁপে উঠতে বীরেশ্বর রাই একা আর পেরে উঠছিল না। রণজিৎ চালিহা তখন চা-বাগানে চাকরি করে। তার বন্ধু আর এক গেলাসের ইয়ার। চালাক-চতুর চৌকস মানুষ। টগবগ করে অসমীয়া বাংলা হিন্দী ভুটানি নেপালী আর ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। রণজিৎ চালিহার ওপর আগে থাকতেই চোখ ছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। আসামের মানুষ, তাকে পেলে আসামের বাজারটা ভাল মত কব্জায় আসতে পারে। তাছাড়া অতগুলো ভাষা জানা একটা চৌকস লোককে হাতে পেলে সব-দিক থেকেই সুবিধে। হাতে পাওয়া ব্যবস্থা ওপরঅলাই করে দিলে। হঠাৎ কি গোলযোগে চা-বাগানের চাকরি নিয়ে টানাটানি রণজিৎ চালিহার। সেই মওকায় বে-ইজ্জত হবার আগেই বীরেশ্বর রাই আরও কিছু বেশি মাইনের টোপ ফেলে ব্যবসায় টেনে নিল। সেই থেকে সে ম্যানেজার।

বন্ধু আর এক গেলাসের ইয়ার হলেও ব্যবসার কাজকর্ম আর টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে কড়া মানুষ ছিল বীরেশ্বর রাই। সব-দিকে তার চোখ ছিল। রাতে গেলাস নিয়ে বসলে বা মেয়ে-বউ নিয়ে তার সঙ্গে কোন ফুর্তির সফরে .. বেরুলে তখন বন্ধু। অন্য দিকে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহাও চতুর কম নয়। মনিব-বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে মন বুঝতো আর চটপট সেই মতো কাজ সেরে ফেলত। ফলে ঝগড়ু দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া ভুল-বোঝাবুঝি কখনও হতে দেখে নি। একসঙ্গে চার বছর কাজ করেছে তারা, ততদিনে ব্যবসা আরও চাঙা হয়ে উঠেছে। মালিক তার ওপর খুশি ছিল, আর ফুর্তিবাজ কাজের মানুষটার ওপর মালকানও অখুশি ছিল না। মালিক বেঁচে থাকতে ম্যানেজার কত মাইনে আর উপরি পেল বা এখন কত মাইনে পায় ঝগড়ু বা আবুর কোন ধারণা নেই। মাইনে এখন আরও বেশি পায় নিশ্চয়, কিন্তু আবুর ধারণা, ইদানীং তার বাড়তি রোজগার মাইনের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। যতই হোক মাইনের টাকায় এত মদ খাওয়া ফুর্তি করা বা এমন চালের ওপর থাকা সম্ভব নয়। আবুর আরও ধারণা, তার বাড়তি রোজগারের ব্যাপারটা গায়ত্রী রাইও জানে কিন্তু কিছু বলে না। বলবে কি করে, ব্যবসায় অনেকখানি তো বলতে গেলে এখনও তারই হাতে।

যতখানি সম্ভব গায়ত্রী রাই নিজেই ব্যবসার হাল ধরেছে আর ধরে আছে। বীরেশ্বর রাই মারা গেছে তিন বছর আগে। আচমকা অঘটন, আচমকা মৃত্যু। পাহাড়ের বাংলোয় ওঠার পথে বেসামাল জিপ নিচে পড়ে যায়। জিপ চালানোর ব্যাপারে মানুষটা বেপরোয়া হলেও পাকা হাত। তখনও বর্ষা শুরু হয়ে যায় নি। বর্ষাকালে পাহাড়ের বাংলোয় থাকাই যায় না। প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। রাস্তা খারাপ হয়ে যায়। ধ্বস নামে। রাস্তা বন্ধও হয়ে যায়। প্রতি বছর বর্ষা নামার আগে সপরিবারে পাহাড় থেকে নেমে আসতে হয়। ওই সময়টা কাছাকাছির কোন শহরে বা চা—বাগানের বাংলো ভাড়া করে থাকে তারা। বর্ষা শুরু না হলেও সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল, আর পাহাড়ী রাস্তাও বেশ খারাপ হয়ে গেছল। তাছাড়া তখনকার সেই রাস্তাও এখনকার মত ছিল না। সেই অঘটনের ফলেই এককাড়ি টাকা খরচ করে এখানকার এই রাস্তা বানিয়েছে গায়ত্রী রাই। যা-ই হোক, বৃষ্টিতে রাস্তা খারাপ থাকলেও বীরেশ্বর রাইয়ের মতো অমন পাকা হাতে এই গোছের অ্যাকসিডেন্ট হবার কথা নয়। আসলে একটা মস্ত কাজ হবার ফলে মনের আনন্দে এন্তার মদ গিলে দুই বন্ধু বাড়ি আসছিল। পোস্ট মরটেম রিপোর্ট থেকে সেটা বোঝা গেছে। রণজিৎ চালিহারও সেই রাতে পাহাড়ের বাংলোতেই খাওয়া আর থাকার কথা। কিন্তু কিছু টুকিটাকি কাজ সারার জন্য সে আগেই নেমে গেছল। কাজ শেষ করে ঘণ্টা দু ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে। এক কথায় আয়ুর জোর ছিল লোকটার। নইলে একসঙ্গে দুজনেই শেষ হয়ে যেত।

সেই থেকে মদ দু চোখের বিষ গায়ত্রী রাইয়ের। তার কাজের লোকদের কারও মদ খাওয়া বরদাস্ত করে না। একমাত্র রণজিৎ চালিহাকেই কিছু বলে না। স্বামী বেঁচে থাকতে ব্যবসার হিসাবপত্র রাখা আর পার্টির কাছে চিঠিপত্র লেখার কাজ গায়ত্রী রাই করত। কিন্তু সে মারা যাবার দু মাসের মধ্যে মহিলা এমন শান্ত হাতে ব্যবসার হাল ধরবে কেউ ভাবে নি। প্রখর বুদ্ধিমতী তো বটেই, এই তিন বছরে ব্যবসা ডবল ফাঁপিয়ে তোলার ব্যাপারে কম সাহস দেখায় নি। অবশ্য এই সাহসও রণজিৎ চালিহাই যুগিয়েছে। একটু বেপরোয়া হতে পারলে কত সহজে আরও কত বেশি টাকা রোজগার করা যায় সে-পথ সে-ই গোড়ায় দেখিয়েছে। না, টাকার গন্ধ পেলে মহিলা পেছু পা হবার মেয়ে নয়। ভুটান সিকিম উত্তরবাংলা আর আসামের নানা জায়গায় বনজ ওষুধের কাঁচা মাল মজুতের পাকাপোক্ত ঘাঁটি করা হয়েছে। সেই সব জায়গায় কাজ চালানোর জন্য লেখাপড়া জানা স্থানীয় এজেন্ট বাছাই করে বহাল করা হয়েছে। তাদের ব্রোকাররা জায়গায় জায়গায় গিয়ে অর্ডার বুক করে। কমিশন পায়। এই নির্ভরযোগ্য চালিহা তার ডান হাত— সে সঙ্গে থাকত। এ-রকম ঘাঁটি করার ফলে কারবারের মাল এখন ওদিককার বড় বড় অনেক শহরেই পৌঁছে যাচ্ছে।

এদিকে নেশার কারবারটি আগের থেকে চারগুণ জমজমাট। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে নেশা করাটা চক্ষুশূল, কিন্তু নেশার জিনিস বিক্রী করে ঘরে টাকা তুলতে আপত্তি নেই। ভুটানের থিম্পু বা পারো ছেড়ে বর্ডারের কাছাকাছি বড় শহর ফুটশোলিঙ, পর্যন্ত নেশার মাল পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সে-সব জায়গা থেকে এখানে আসছে ভাল ভাল মদ! বানারজুলি আর আশপাশের অনেক চা-বাগানের সাহেব-সুবোরা এই মদের এখন বড় খদ্দের। হবে না কেন, ও-সব জিনিসের এখানে অনেক দাম—আর আনাও সহজ ব্যাপার নয়। সুবিধের দামে হাতের কাছে মজুত পেলে তাঁরা ঝুকবে না কেন? সুবিধের দামে দিয়েও রাইয়ের মোটা লাভ থাকে।

ব্যবসার আরও একটা বড় শাখা বিস্তার করেছে গায়ত্রী রাই। সাপের ব্যবসা। এ—দেশ থেকে বহু সাপ বিদেশের নানা জায়গায় চালান যায়। আমেরিকা ইংল্যান্ড পশ্চিম জার্মানি হল্যান্ড জাপান সকলেরই সাপের চাহিদা। বিষাক্ত সাপ তো বটেই, নির্বিষ সাপও চাই তাদের। এখানে এত খবর কে রাখত? সাপুড়ে আর বেদেবেদেনীদের কাছে দালালদের আনোগোনা বাড়তে ব্যাপারটা বোঝা গেছে। তারা তো খবর রাখেই। এই বানারজুলি থেকে শুরু করে বিশাল তরাইয়ের জঙ্গলের সর্বত্র বিষধর আর নির্বিষ সাপ কিলবিল করছে। সাপের কি শেষ আছে এ-সব দিকে! গায়ত্রী রাইয়ের এই ব্যবসা শুরু করার পিছনে আসল কৃতিত্ব আবু রব্বানীর। এদিককার জঙ্গলের সে হেড বীটম্যান। দালালরা তার কাছে আসত, তার পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে অনুরোধ করত লোক লাগিয়ে জ্যান্ত সাপ ধরে দাও। এমনি সাপ হলে কম পয়সা, বিষাক্ত সাপ হলে বেশি। যে ধরে দেবে তাদেরও এক-একটা সাপের জন্য আট আনা থেকে দেড়-দু টাকা পর্যন্ত দিত তারা। পাইথন পেলে দশ-পনের টাকা দিতেও রাজি। তাজ্জব ব্যাপার।

কিন্তু সরকারী চাকুরে আবু দালালদের খুশি করে কি করে? তারা এলে তখন সাপের খোঁজ। সে তো আর সাপ মজুত করে রাখতে পারে না বা আগে থাকতে লোক লাগিয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে সাপ কিনে রাখতে পারে না। কথায় কথায় একদিন দালালদের চাহিদার ব্যাপারটা সে গায়ত্রী রাইকে বলেছিল। মেমসাহেবের একটা মজা আছে, নিজে কথা বেশি বলে না কিন্তু সকলের সব কথা শোনে। শোনার পর ম্যানেজারকে ডেকে বলল কি ব্যাপার খবর নিতে। এ-সব ব্যাপারে রণজিৎ চালিহা তৎপর খুব বলতেই হবে। আট-দশ দিনের মধ্যে সমস্ত খবর তার ঠোটের ডগায়। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ সাপ বিদেশে যাচ্ছে। বাকি পাঁচ ভাগ দেশের গবেষণার কাছে লাগছে। বাইরে সাপ চালানের প্রতিষ্ঠান আছে। এ-দেশে। দালালদের হাত ঘুরে সেই সাপ প্রতিষ্ঠানে পৌঁছয় দালালরা তো লাভ করেই, খোদ কারবারীরাও তার ওপর মোটা লাভ করে সাপ বিদেশে চালান দেয়। প্রতিষ্ঠান বড় দালালদের কাছ থেকে কোন্ জাতের সাপ কি দরে কেনে শুনে মেমসাহেব পর্যন্ত হাঁ একেবারে। বিষাক্ত সাপের দাম ছয় থেকে বিশ টাকা পর্যন্ত ওঠে। তার মধ্যে একটা শঙ্খচূড়ের দাম একশ থেকে তিনশ সাড়ে তিনশ পর্যন্ত হয়। যত বড় হবে ততো দাম চড়বে। আর নির্বিষ সাপের মধ্যে পাইথনের দামও একশ থেকে আড়াইশ-তিনশো হতে পারে।

ব্যস, আবুর হুকুম হয়ে গেল বেদে সাপুড়ে বা জঙ্গলের লোকের কাছ থেকে একটা সাপও যেন দালালরা না পায়। সাপের খোঁজে এলে তাদের গায়ত্রী রাই অথবা ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। আর সকলকে জানিয়ে দিতে হবে জ্যান্ত সাপ ধরে আনলে দালালদের থেকে অনেক ভাল দামে তারা সেগুলো কিনে নেবে। বিয়ের আগে দুলারিরা যে ডেরায় থাকত সেটা এখন নানা জাতের আর নানা রকমের সাপের গুদাম। মাস গেলে দুলারি এখন কুড়ি টাকা করে ডেরার ভাড়া পায়। আর আরও পঞ্চাশ টাকা পায় এই ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্য। দেখাশুনা বলতে সাপ ধরার লোকদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা আর দালালদের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেলে মালকান বা ম্যানেজারের নির্দেশমত তাদের হাতে সাপ জিম্মা করে দেওয়া। দুলারির নামে এই দেখাশুনার ব্যাপারটা সব আবুই করে। দু-দুটো বাচ্চা নিয়ে তার অত সময় কোথায়। দুলারি এখন পাকা সংসারী হয়ে গেছে।

সাপের বিষও যে সোনার দরে বিকোয় তাই বা কে জানত? কিন্তু গায়ত্ৰী রাই ঠিক জেনেছে। সাপের বিষের চাহিদা অবশ্য সামান্যই সে-সময়। কিন্তু যেটুকু আছে তাতেও কম লাভ নয়। বাছাই করা কিছু বিষাক্ত সাপ গায়ত্রী রাইয়ের পাহাড়ের বাংলোয় চলে যায়। সেখানে একটা সাপের ঘরই করে দেওয়া হয়েছে। ওদিকটার ভার ঝগড়ুর। ওর হাতে টিপুনির চাপে সাপগুলো গলগল করে বিষ ঢেলে দেয়। সাপের বিষ পেতে হলে খদ্দেরদের সেই পাহাড়ের বাংলোয় যেতে হয়।

গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে ম্যানেজার রণজিৎ চাহিলার অবনিবনা কেউ কখনও দেখে নি। বরং এই একজনের সঙ্গেই শুধু মেমসাহেব হাসিমুখে কথাবার্তা বলে, আর বেশির ভাগ ব্যাপারে তার সঙ্গেই পরামর্শ-টরামর্শ করে। কিন্তু একবার মেমসাহেবের সঙ্গে তার মনকষাকষি একটু হয়েছিল সে-খবর শুধু ঝগড়ু রাখে। আবুকে এই গোপন কথাও সে-ই বলেছে। সাহেব মারা যাবার বছরখানেকের মধ্যে রণজিৎ চালিহা নাকি গোটা ব্যবসাটা তিনজন পার্টনারের নামে চালাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। একজন গায়ত্রী রাই, একজন তার মেয়ে উর্মিলা রাই আর একজন সে নিজে। সাদা কথা, তিন ভাগের এক ভাগ মালিক হতে চেয়েছিল। মেয়ের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ঝগড়ুর। এ খবর সে-ই চুপি চুপি ফাঁস করেছে। তার কাছে। মেয়ে তখন নাবালিকা। মেমসাহেব সে-প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। ম্যানেজারের তখন নাকি মেজাজ বিগড়েছিল। মেমসাহেব কোন্ কায়দায় তাকে ঠাণ্ডা করেছে, ঝগড়ু জানে না। তবে মাইনে যে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর ঝগড়ু লক্ষ্য করেছে, তারপর থেকে বাড়িতে লোকটার আদর-আপ্যায়নও বেড়েছে।

রণজিৎ চালিহার বউ ছেলে মেয়ে আছে। আগে বছরের বেশির ভাগ সময় তারা আসামেই থাকত, মাস-কতকের জন্য বানারজুলিতে আসত। গত দু বছরের মধ্যে আর আসেই নি তারা। ফলে দেড়-দু মাস অন্তর ম্যানেজারের আসামে টুর প্রোগ্রাম পড়ে। অবশ্য ব্যবসার বাজারও সেখানে ভালই জমে উঠেছে। আগে মেমসাহেবের কাছে লোকটার খাতির কদর দেখে আবুরা ভাবত লটঘটের ব্যাপার কিছু আছে। অমন কড়া মালকান এই লোকের কাছে শুধু নরম নয়, হাসি-খুশিও। প্রেমের আবার বয়েস বলে কিছু আছে নাকি? মেমসাহেব পাহাড়ের বাংলোয় থাকলে ম্যানেজার সেখানে মাঝেসাজে গিয়ে উপস্থিত হয়, খানাপিনা করে, রাতে থাকেও। ওদিকে ম্যানেজারের বউ ছেলে মেয়ে এ-দিক মাড়ায় না। কিন্তু দু-দুটো বছর একভাবে কেটে গেল, নানা কারণে আবুর আর এখন সে-রকম কিছু মনে হয় না। তাছাড়া সে-রকম হলে ঝগড়ু নেশার মুখে ঠিক বলে দিত। ম্যানেজার লোকটাকে ঝগড়ু খুব একটা পছন্দ করে না। পছন্দ কোন কর্মচারীই করে না। লোকটার এমন হাবভাব যেন সে-ই সব-কিছুর হর্তাকর্তা বিধাতা। নিজে কত দিকে কত ভাবে টাকা কামাচ্ছে ঠিক নেই, অন্যকে হকের পয়সা দেবার বেলায় বকাঝকি করে মালিককে খুশি করার চেষ্টা। নেশার মুখে ঝগড়ু বরং বলেছে, তেমন দরকার পড়লে মালকান গাল বাড়িয়ে ব্যাঙের লাথি খেতে পারে, আবার দুশমন ঢিট করতেও জানে। দরকার

হলে যত লায়েকই হোক ওই ম্যানেজারকেও টাইট দিতে ছাড়বে না। কেন বলতে পারবে না, আবু এখন তার মেমসাহেবের এই চরিত্রটাই বেশি বিশ্বাস করে।

আবুর সঙ্গে মেমসাহেবের যোগাযোগ দু বছরেরও বেশি। আর বছর খানেকের ওপর হল ও তার একজন বিশ্বস্ত লোক। বর্ষায় তো পাহাড় থেকে নেমে আসতেই হয়, আবার কড়া শীতেও নেমে আসতে হয়। এই জন্য মেমসাহেব পাকাপোক্ত ডেরার খোঁজে ছিল। ইদানীং বানারজুলির দিকে কাজ বেশি, আবার এখানে থাকলে যোগাযোগের সুবিধেও বেশি। আট মাস আগে আবু বাপীর বাসাটা তার জিম্মায় ছেড়েছে। দুলারিও এই পরামর্শই দিয়েছিল। মেমসাহেবের নেকনজরে পড়ার আরও কারণ আছে। ও কাজের লোক কেমন তা তো দেখেছেই। তার ওপর ও এ-জঙ্গলের হেড বীটম্যান হবার দরুন সুবিধেও কম পাচ্ছে না। যেমন, জঙ্গলে আজ বাপী স্বচক্ষে যে চন্দ্রা বা সর্পগন্ধার বেড দেখে এলো, সেটা ওখানে হচ্ছে কার জন্য? হচ্ছে কি করে? হচ্ছে ওই মেমসাহেবের জন্যে, খরচ একরকম নেই-ই বলতে গেলে। আর হচ্ছে আবুর দৌলতে। মাথা চুলকে বড়সাহেবের কাছে আর্জি পেশ করল, কিছু ভাল ওষুধ-গাছের বীজ তার হাতে এসেছে, জঙ্গলের মধ্যে একটু জায়গা নিয়ে চাষ করতে দিলে অনেক গরীব লোকের উপকার হয়। নি-খরচায় লোকের উপকার করে নাম কিনতে পারলে বড়সাহেবই বা আপত্তি করবে কেন? জঙ্গলে তো আর জায়গার টানাটানি নেই। তাছাড়া আবুর কল্যাণে জঙ্গলের কম জিনিস কি তার বউয়ের হেঁসেলে বা ভাঁড়ারে যায় যে আর্জি নাকচ হবে?

গল্পে গল্পে কখন সন্ধ্যা পার বা কখন দুলারি ঘরে হারিকেন রেখে গেছে দুজনের কেউই তেমন খেয়াল করে নি। এই সমাচার আরও কতক্ষণ চলত কে জানে। বাধা পড়ল।

আবু এ-দিন ফিরে ছিল, ঘরে যে ঢুকল, তাকে দেখে বাপীই প্রথমে সচকিত। দুলারি নয়।

রেশমা।

অন্দরে একজন বাইরের লোক দেখে ভিতরে ঢুকে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই মুখে বিস্ময় ভাঙল।—বাপীভাই মনে হচ্ছে—অ্যাঁ?

আবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তারপর কিছু একটা রসিকতা করতে গিয়েও বাপীর মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। মজা দেখছে।

কারণ বাপীর মুখে কথা নেই। চেয়েই আছে। সেই রেশমাই বটে, অথচ অনেক তফাৎ।…বছর দুই বড় হবে বাপীর থেকে, বছর চব্বিশ-পঁচিশ হবে বয়েস এখন। কিন্তু এত দিনেও মেয়েটার বয়েস বাড়ে নি; শুদু চেকনাই বেড়েছে। আগের থেকে অনেক তাজা আর পুষ্ট লাগছে। পরনের খাটো ঘাগরা আগের মত মলিন নয়। গায়ের আঁট জামাটাও চকচকে। মাথার সেই উস্কো-খুস্কো চুল মিশকালো এখন—পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। সুমা-টুৰ্না কিছু লাগানোর দরুন চোখ দুটো গভীর টানা দেখাচ্ছে।

বাপীর এই গোছের দেখার জালে পড়লে রেশমা আগে খিলখিল করে হেসে উঠত। এখনও হাসছে বটে, কিন্তু এখনই যেন সত্যিকারের সাপের খেলা দেখানো মেয়ের হাসি।

পরের মুহূর্তে মেয়ে গম্ভীর। একটু এগিয়ে এসে আবুর মুখোমুখি দাঁড়াল। দু হাত দু দিকের কোমরে উঠে এলো। চোখে ভ্রুকুটি।

কপট যন্ত্রণায় আবুর মুখ কুঁচকে গেল।—অমন করে চোখ দিয়ে বিঁধিস না মাইরি, বাপীভাই এসেই আমার ঘরে তোর বদলে দুলারি কেন জিগ্যেস করে বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।

খেদ শেষ হবার আগে দুলারিও ঘরে। আবু এখন কোন্ দিক সামলাবে। মেকি ত্রাসে পিছিয়ে বসল একটু।—মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, বাপীভাই বাঁচাও!

রেশমা ফিরে দেখল দুলারিও মুখ টিপে হাসছে। তাকে নিয়ে রসের কথা কিছু হয়েছে বুঝেও তেমন কৌতূহল দেখাল না। আবুর দিকে ফিরে শাসনের সুরে বলল, এই জন্যেই তোমার পাত্তা নেই—বুকে বসানোর জন্য মালকান ওদিকে ছুরি হাতে অপেক্ষা করছে—যাও। ম্যানেজারও আছে—

—শালারা খেলে দেখছি। রস ভুলে আবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।— বাপীভাই চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বাপীর দু চোখ তখনও রেশমার মুখের ওপর। রেশমা কটাক্ষে এ-দিকে তাকালো একবার। ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দিল।—আবু সাহেব তুমি একলাই যাও, বাপীভাই এখন আমাকে দেখতে ব্যস্ত।

পিছন থেকে দুলারি একটা থাপ্পড় বসালো তার পিঠে। আত্মস্থ বাপী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। আবুকে বলল, চলো।

সোনার হরিণ নেই – ১০

চারদিকের আবছা অন্ধকারের মধ্যে শুধু বাপী তরফদারের বাড়িটাই আলোয় ঝলমল করছে। লাইন ধরে কাছে-দূরের আর সব লণ্ঠন কুপী মোমবাতির টিমটিম আলো। ওই বাড়িটা এখন চোখ টানার মতোই ব্যতিক্রম। নেপালী মহিলার রুচির প্রশংসা করতে হয়। দিনের বেলায়ও বাপী বাড়িটার ছিমছাম চেহারা দেখে গেছে।

সামনের বারান্দায় আরো চড়া আলো জ্বলছে। টেবিলের দুদিকের শৌখিন বেতের চেয়ারে গায়ত্রী রাই আর তার ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা বসে। হাসিমুখে কথাবার্তা চলছে। আবু বলছিল, ওই ম্যানেজার ছাড়া মেমসায়েবকে আর কারো সঙ্গে হেসে কথা বলতে দেখে না ওরা। কথা বেশি রণজিৎ চালিহাই বলছে। গায়ত্রী রাই অল্প অল্প হাসছে, এক-একবার মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে বা কিছু বলছে। দূর থেকে এ-দৃশ্য দেখেই আবুর পিত্তি জ্বলে গেল। চাপা ঝাঁঝে বলে উঠল, শালা ঠিক গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, আর মেমসাহেবকে কিছু লাভের রোশনাই দেখাচ্ছে। ও-ব্যাটা এখন ওখানে না থাকলেই ভালো হত, মেমসাহেবের ওপর দিয়ে কথা কইবে।

কি ভেবে মৃদু গলায় বাপী বলল; বাড়ি নিয়ে কথা উঠলে তুমি চুপ করে থেকো, আমি এসে যাবার পরে আর তোমার কোনো দায়িত্ব নেই।

এতেই আবু ঘাবড়ে গেল।—তুমি কি গোলমেলে কথা কিছু বলবে নাকি? মেমসাহেবের মেজাজ খারাপ করে দিও না বাপী ভাই, আর ওই ম্যানেজারও একটুও সাদা মনের লোক নয় মনে রেখো।

বাপী আশ্বস্ত করল তাকে, ঠিক আছে।

বারান্দার জোরালো আলো, বাইরের দিকটা অন্ধকার। তাই একেবারে দাওয়ার কাছে আসার আগে বারান্দার দু’জন ওদের লক্ষ্য করল না। দু’জন নয়, তিনজন। বারান্দা-লাগোয়া ঘরের দরজার কাছে একটা চেয়ারে বসে গায়ত্রী রাইয়ের মেয়ে ঊর্মিলা রাই বই পড়ছে। এদের আড়ালে দূর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না।

ভিতরে ঢুকে পড়তে বারান্দার দু’জনের ওদের দিকে চোখ গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেরই খুশি মুখ গাম্ভীর্যের আড়ালে সেঁধিয়ে গেল। কাছে এগোবার ফাঁকে প্রথম রণজিৎ চালিহাকেই এক নজর দেখে নিল বাপী। পরনে দামী স্যুট, দামী টাই, ধপধপে ফর্সা রং, চওড়া উঁচোনো কপাল, সে-তুলনায় ছোট চোখ। আসামের মানুষ দেখলেই বোঝা যায়। বয়েস বেশি হলে চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ।

ওরা কাছে আসার ফাঁকে গায়ত্রী রাই নেপালী ভাষায় চাপা গলায় রণজিৎ চালিহাকে বলল কিছু। চালিহা অল্প ঘাড় বেঁকিয়ে আবুকে ছেড়ে বাপীকে ভালো করে দেখে নিল। বাপীর ধারণা, ও যে বাড়ির মালিক মেমসাহেব তার ম্যানেজারকে সেটাই জানান দিল। .

এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আবু রব্বানীর অন্য মুখ। বিনয় উপচে পড়ছে। ঝুঁকে মেমসাহেবকে সেলাম জানালো। আবার মুখেও বলল, গুড ইভনিং মেমসায়েব। তারপর ম্যানেজারের উদ্দেশে আরো বিনীত অভিবাদন।—গুড ইভনিং সার!

মনে মনে বাপী আবুকে তারিফ না করে পারল না। ও উন্নতি না করলে কে করবে!

বাপী দু হাত জুড়ে কপালে ঠেকালো, কিন্তু মহিলা ওর দিকে তাকালোই না। ফলে বাপী ম্যানেজারের দিকে আর না ফিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়ে ঊর্মিলা বিকেলে বাড়ির মালিকের হেনস্থা দেখেছে, আবার সে এসে দাঁড়াতে তার বই পড়ার মনোযোগ গেল। এবারে মায়ের সঙ্গে আংকল চালিহা, লোকটার কপালে দুর্ভোগ আছে ভাবছে।

বাড়ির মালিকের অস্তিত্ব স্বীকার করারও দায় নেই যেন গায়ত্রী রাইয়ের। ঈষৎ রুষ্ট স্বরে আবুকে বলল, বিকেল থেকে তোমার খোঁজে লোক পাঠানো হয়েছে—কোথায় ছিলে?

আবু রব্বানীর অপ্রস্তুত মুখ, কিন্তু জবাব সপ্রতিভ। এতকাল বাদে দোস্তকে কাছে পেয়ে ভুলে গেলাম—

আবু রব্বানীর মতো একজনের সঙ্গে এত দোস্তির কারণে কিনা বলা যায় না, বাপীকে এখনো কেউ বসতে বলছে না। আবুর জবাবও গায়ত্রী রাইয়ের কাছে তেমন খুশি হবার মতো নয়। আরো গম্ভীর। বাড়ীর ব্যাপারে কাগজপত্র কবেই সই হবার কথা ছিল, এখনো হয়নি কেন?

আবুর বিনীত জবাব, ম্যানেজার সায়েব জানেন—

রণজিৎ চালিহা বলল, সব রেডি আছে, কালই হতে পারে।

জবাবের আশায় আবু এবার বাপীর দিকে তাকালো। কিন্তু বাপীর এমন মুখ যেন মাথায় ঢুকছেই না কিছু। অগত্যা আবু মেমসাহেবের দিকে ফিরল। বলল, ঘরের মালিক এসে গেছে, এখন যা করার সেই করবে—তাকে বলুন।

গায়ত্রী রাইয়ের এই উক্তিও পছন্দ হল না—আমি মালিক-টালিক জানি না, তোমার সঙ্গে আমার কথা পাকা হয়েছে, তাকে যা বলার তুমি বলো—কনট্রাক্ট কালই সই হওয়া চাই।

নিরুপায় আবুর দু’ চোখ আবার বাপীর দিকে। দোস্ত সব জেনেশুনে ওকে এমন ফ্যাসাদে ফেলছে কেন?

অগত্যা এবারে বাপীর জিভ নড়ল। দু’ চোখ মহিলার মুখের ওপরে।—কোন্ বাড়ির কথা হচ্ছে…এই বাড়ি?

গায়ত্রী রাইয়ের বিরূপ চাউনি।—সেটা এতক্ষণে বুঝলেন?

বাপীর এই মুখে কৃত্রিমতা খুঁজে পাওয়া শক্ত। বলল, আপনাদের কথাবার্তা আমি ঠিক খেয়াল করিনি—বিকেল থেকে এই ক’ঘণ্টার অর্ধেক সময় আবুর মুখে কেবল আপনার প্রশংসা শুনেছি। তাই আমি ভাবছিলাম একজন ভদ্রলোকের ছেলেকে আপনি বসতেও বলছেন না কেন…

ধাক্কাটা শুধু সামনে মহিলা নয়, রণজিৎ চালিহা, দরজার ও-ধারের চেয়ারে বই হাতে ঊর্মিলা, এমন কি আবুর ওপরেও গিয়ে পড়ল।

—সীট্ ডাউন প্লীজ। বলা বাহুল্য, শিষ্টাচারের খোঁচা মেয়ে মহিলার মুখ-ভাব আরো অপ্রসন্ন।

বাপী চেয়ার টেনে বসল। ঊর্মিলা উঠে ঘর থেকে একটা মোড়া এনে আবুর সামনে রেখে আবার নিজের চেয়ারে ফিরে গেল। ইশারায় ওকেও বসতে বলে, গায়ত্রী রাই বাপীর মুখোমুখি।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, বলুন, বাড়ির কি হয়েছে?

—কি হয়েছে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?

কি হয়েছে দেখার জন্যেই বাপীর দু’চোখ বারান্দার চারদিকে আর ঊর্মিলা রাইকে ছাড়িয়ে ভিতরের দিকেও একবার ঘুরে এলো। মেয়েটার চাউনিতে কৌতুকের ছায়া।

এদিকে বাপীর হৃষ্ট পর্যবেক্ষণেও ভেজাল কিছু নেই। অকপট প্রশংসার সুরেই বলল, দিনের বেলা দেখে গেছলাম, রাতে আরো ভালো লাগছে…ঘর বেড়েছে, ইলেকট্রিক লাইট এসেছে…নিজের সেই বাড়ি বলে চেনাই যায় না।

গায়ত্রী রাই তেমনি গম্ভীর, কিন্তু গলার স্বর নরম একটু।–এর জন্য আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে নট্ লেস্ দ্যান…ফাইভ থাউজ্যান্ড। এ-টাকাটা ভাড়া থেকে কিভাবে অ্যাডজাস্ট করা হবে সেটা আবুর সঙ্গে সেল্ড হয়ে আছে। আপনি জেনে নেবেন…এগ্রিমেন্ট রেডি আছে। চালিহার দিকে ফিরল, গেট্ ইট সাইন্ড্ টুমরো—

বাপী পাশের দিকে অর্থাৎ ম্যানেজারের দিকে ফিরেও তাকালো না। তার আবেদন খোদ কর্ত্রীর কাছে। মুখখানা ফাঁপরে পড়ার মতো। বলল, আপনি আমার ভাঙা বাড়ির চেহারা পাল্টে যা করেছেন মিসেস রাই, আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। এরকম করার সামর্থ্য আমার কোনদিন হত না, সই-টইয়ের জন্যেও কিছু আটকাবে না…কিন্তু একটু মুশকিল হল আমি থাকব কোথায়?

মুখের কথা শেষ হতে না হতে চালিহা বলে উঠল, দ্যাটস্ নট্ আওয়ার লুক আউট!

বাপীর ভেবাচাকা খাওয়া মুখ। চালিহাকে একবার দেখে নিয়ে সংকোচ আর সম্ভ্রমের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ইনি?

চালিহা থমকালো। ধৃষ্টতা দেখছে। গায়ত্রী রাই জবাব দিল, ইনি মিস্টার রণজিৎ চালিহা, আমাদের বিজনেসের চিফ একসিকিউটিভ।

আমার বিজনেস বলল না বা ম্যানেজার বলল না বাপীর কানে সেটুকু ধরা পড়েছে। সবিনয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে আবার মহিলার দিকে ফিরল।——বাড়ির এগ্রিমেন্ট আপনার সঙ্গে, না আপনার ফার্মের সঙ্গে?

—আমার সঙ্গে।

—তাহলে কথাবার্তাও আপনার সঙ্গে হোক।…বাড়ি নিয়ে আপনাকে আমি কোনো ট্রাবল দেব না, আবুর সঙ্গে যা সে করেছেন তাই হবে। কিন্তু আমার প্রবলেমটা আপনিও এঁর মতো এক কথায় নাকচ করে দেবেন আমি আশা করছি না।

রণজিৎ চালিহার ফর্সা মুখ লাল। সরাসরি কারো দিকে না তাকালেও বাপীর অগোচর কিছু নেই। মোড়ায় বসা আবুর উতলা মুখ। আর দরজার লাগোয়া চেয়ারে বসা ওই মেয়ের চোখের কোণে কৌতুক আরো বেশি জমাট বেঁধেছে। অর্থাৎ কর্ত্রীর সামনে বসে প্রকারান্তরে তার ম্যানেজারকে তুচ্ছ করাটা নতুন কিছু।

কিন্তু বাপী তরফদারের ষষ্ঠ অনুভূতি ওকে বড় ঠকায় না। আবুর মুখে গায়ত্ৰী রাই আর তার এই ম্যানেজারের সম্পর্কে আদ্যোপান্ত শোনার পর থেকেই একটা সম্ভাবনা মনের তলায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। এখন এই কথার পরে মহিলারও গম্ভীর চাউনিতে যদি পলকের প্রশ্রয়ের আভাস সত্যিই মিলিয়ে যেতে দেখে থাকে, তাহলে তার হিসেবের সঙ্গে মেলে।

মনে হল দেখেছে।

গায়ত্রী রাইয়ের কথায় অবশ্য সেই প্রশ্রয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কথাও বিরক্তি-ছোঁওয়া।—আপনার প্রবলেম শুনে আমি কি করতে পারি?…বড়জোর পুরো ভাড়া একশ’ টাকার জায়গায় মাসে পঞ্চাশ-ষাট টাকা করে কাটা যেতে পারে।

মহিলা চতুর কত বুঝতে একটুও সময় লাগল না বাপীর। টাকা তার কাছে কোন সমস্যা নয়। পঞ্চাশ-ষাট ছেড়ে পঁচিশ-তিরিশ টাকা করে কাটতে বললেও হয়তো রাজি হয়ে যাবে। কারণ তাতে বাড়ির দখলের দাবি অনেক বছর ধরে কায়েম থাকবে। কিন্তু ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা এই কূট চালের ধার দিয়েও গেল না। অসহিষ্ণু ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, তাহলে আবার ফ্রেশ এগ্রিমেন্ট করতে হয়—এমনিতেই ওই আবু রব্বানী যতটা পারে স্কুইজ করছে।

বাপী এবার তার দিকে ফিরল। ঠাণ্ডা-গলায় জবাব দিল, ওই এগ্রিমেন্টের আমি কানাকড়িও দাম দিই না।

রণজিৎ চালিহার ফর্সা মুখ তেতে ওঠার বা সামনের মহিলার দু’চোখ ঘোরালো হয়ে ওঠার আগেই বাপী একই সুরে আবার যা বলল, সেটা কেউ আশা করেনি। চোখে গায়ত্রী রাইকে দেখিয়ে ম্যানেজারকেই বলল, আমার বন্ধু আবু রব্বানী যাঁকে এত শ্রদ্ধা করে আর বিশ্বাস করে, আমারও তাকে তেমনি শ্রদ্ধা করতে আর বিশ্বাস করতে অসুবিধে নেই। ওই এগ্রিমেন্ট আপনি ছিঁড়েও ফেলতে পারেন, ওঁর মুখের কথাই যথেষ্ট। ধীরেসুস্থে গায়ত্রী রাইয়ের দিকে ফিরল।— সত্যিই যদি স্কুইজ করা হয়েছে মনে করেন, তাহলে বলবেন, যা উচিত বিবেচনা করবেন তাই হবে। কিন্তু আমার সমূহ প্রবলেম অন্যরকম—

কথার কলে পড়ে চালিহার মেজাজ আরো তিরিক্ষি। আবারও আগ্ বাড়িয়ে গজগজ করে উঠল, সেটা আমাদের বলে লাভ কি—আপনার প্রবলেম মাথায় রেখে আমরা বাড়ির রিনোভেশনে হাত দিইনি বা এত টাকা ঢালিনি।

বাপীর নিরীহ দু’চোখ প্রথমে মা, পরে দরজার ওধারে মেয়ের মুখের ওপর ঘুরে এলো। অত বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার কথা বলার পর ম্যানেজারের এই মেজাজ তাদের কাছেও সুশোভন লাগছে না। বাপীর স্নায়ুগুলো আরো যেন নিজের বশে এখন। মোড়ায় বসা হতবাক মূর্তি আবুর দিকে ঘুরে তাকালো।—ঘর বাড়ানো বা এত সব করার পরামর্শ তুমি দিয়েছিলে?

আবুর হাঁসফাঁস দশা। কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। পাশ থেকে রণজিৎ চালিহাই খেঁকিয়ে উঠল আবার।—ও পরামর্শ দেবে কি? এই ঘর-বাড়ি ওঁর মতো মহিলার বাসযোগ্য ছিল? যেটুকু দরকার করে নেওয়া হয়েছে।

বাপীর ঠোটের ফাঁকে একটু হাসি যেন আপনা থেকেই এসে গেল। বলল, বাড়ির হাল দেখে ছেলেবেলায় আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগত, আর তখন চা-বাগানের বড় বড় বাংলোগুলো দেখে ভাবতাম বড় হয়ে ওখানে ও-রকম একটা বাংলো তুলব।…তা এই গরীবের কুঁড়েঘর নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে আপনিও চা-বাগানের কোনো জমিতে ওঁর উপযুক্ত একখানা হালফ্যাশানের বাংলো তুলে দিতে পারতেন?

এই বানারজুলির জঙ্গলেই বাপী দেখেছে, তৈরি মৌচাকে ঢিলের যুৎসই ঘা পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি তাড়া করে আসে আবার চাক থেকে টসটস করে মধুও ঝরে। আবুর দিকে বাপী তাকায়নি, তার দিশেহারা অবস্থাটা আঁচ করতে পারে। বাকি তিনজোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি প্রথমে ছেঁকে ধরল তাকে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া আর ততটা গরম মনে হল না। ঊর্মিলা রাইয়ের চোখের সামনে বই। গায়ত্রী রাইয়েরও বাইরে রুষ্ট মুখ কিন্তু ভিতরে তরল কিছু তল করার চেষ্টা।

…খোঁচাটা শেষ পর্যন্ত একজনেরই দম্ভের চাকে গিয়ে লেগেছে। সম্ভাবনার সেই অনুভূতিটা ভিতরে আর এক দফা নড়া-চড়া করে গেল। বাপীর হিসেব মিলছে।

রণজিৎ চালিহা চেয়ার ছেড়ে উঠেই দাঁড়াল এবার। ক্রুদ্ধ দু’চোখ গায়ত্ৰী রাইয়ের দিকে। এই একজনকে এরপর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করা হবে কিনা এই জিজ্ঞাস্য হয়তো।

জবাবে রমণীর পল্কা ভ্রুকুটি। গলার স্বরে হালকা শাসন, ডোন্ট বি ইমপেশেন্ট ম্যান! বোসো। তারপরেই রসকষশূন্য গম্ভীর দু চোখ বাপীর মুখের ওপর চড়াও হল। গলার স্বরে ঠাণ্ডা ঝাপটা।—ওঁকে ও-কথা বলবার অর্থ কি, এ বাড়ি আমরা জবর-দখল করে খুশিমতো রেনোভেট করে নিয়েছি?

বাপীও ঠাণ্ডা মুখেই মাথা নাড়ল।—না। যা করেছেন একটু আগে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছি, আর ভাড়া-টাড়ার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই হবে বলেছি।

ঘরে বসে আবু বলছিল, বাপী ভাইয়ের মুখখানা আগের থেকে ঢের মিষ্টি লাগছে, দেখলে মনে হয় ভেতর বার সাফ—নেপালী মেমসায়েবের ঠিক পছন্দ হয়ে যাবে। আবুর সে-আশায় এখন ছাই পড়েছে কিনা জানে না, কিন্তু মুখের দিকে চেয়ে ওর মেমসায়েবের এখন ভিতর দেখার চোখ।

—ঠিক আছে। থাকার জায়গার প্রবলেমের কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা কি করতে পারি?

এ-প্রশ্নের জন্য বাপী প্রস্তুতই ছিল। জবাব দিল, বাড়ির জন্য আপনি অনেক খরচ করেছেন আরো কিছু খরচ করলে সমস্যা মেটে। পাশের খালি জমিতে সেপারেট আর এক্সক্লুসিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট সুদ্ধু আমার জন্য একখানা ঘর তুলে দিন।

প্রায় কর্কশ স্বরেই গায়ত্রী রাই বলে উঠল, অ্যাবসারড! এখানে আমি থাকি, আমার মেয়ে থাকে—আমাদের অসুবিধে হবে!

দরজার কাছে সেই মেয়ে তেমনি বসেই আছে। বাপীর সহিষ্ণুতায় এবারে চিড় খেল একটু। সব মেয়েই মেয়ে। হয়তো ওকে করুণাপ্রার্থী ভাবছে এবার। সংযত সুরেই বলল, অসুবিধে আমারও খুব হবে মিসেস রাই…নিজের নিরিবিলি শান্তির ঘরে একটু আশ্রয় পাব বলে কলকাতা থেকে চলে এসেছিলাম। যাক, মাঝে যেমন খুশি পার্টিশন দিয়ে নিতে পারেন, আর সব সুদ্ধ যা খরচ হবে তাও ওই ভাড়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারেন।

মায়ের পিছনে মেয়ে উসখুস করে উঠল একটু। অসুবিধে তারও হবে শুনে হয়তো মজার ছোঁয়া লেগে থাকবে। বাপী তাকালো না। সব থেকে বেশি অবিশ্বাস আর ঘৃণা নিজের ওপর।

গায়ত্রী রাই মাথা নাড়ছে। চাউনিও সদয় নয়। বলল, তাই ডোন্ট লাইক দি আইডিয়া।

এবারেও বাপীর নরম মুখ। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট।—টাকা সংগ্রহ করে নিজের জমিতে যদি সেপারেট ঘর তুলি, আপনি আটকাবেন কি করে?

এবারে যথার্থ হালছাড়া ক্রুদ্ধ মুখ মহিলার। এদিকটা ভাবেনি। তার দাপটের ম্যানেজার এতক্ষণে হয়তো ধৈর্যের শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু এ কথার পর সেও আর দাপট দেখালো না। ঘাড় বেঁকিয়ে নেপালী ভাষায় কি দুই-এক কথা বলল তাকে।

কি বলল তক্ষুনি বোঝা গেল। গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর এঁটে বসল। বলল, পাশের জমিসুদ্ধু বাড়িটা যদি আমি কিনে নিতে চাই? আই উইল পে ফেয়ার প্রাইস, পাঁচ হাজার টাকা আমি অলরেডি খরচ করেছি…আরো আট হাজার টাকা দিতে পারি। এগ্রিড?

বলা নেই কওয়া নেই একটা মুখের কথায় আট হাজার টাকার মালিক হয়ে বসতে পারে—ভাবলেও বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে ওঠার কথা। আট হাজার টাকা একসঙ্গে কখনো চোখে দেখেনি। কিন্তু বাপী গরজ দেখছে। গরজ বুঝছে। রয়ে-সয়ে ফিরে জিগ্যেস করল, আপনার বিবেচনায় সব মিলিয়ে এই বাড়ি আর জমির দাম তাহলে তেরো হাজার টাকা?

—টেন থাউজ্যান্ড? ঝাঁঝালো গলায় দর চড়িয়ে গায়ত্রী রাই বলল, কিসের কি দাম আমার জানা আছে, আমার দরকার তাই এই দাম—কিন্তু আর বাড়বে না। এগ্রিড?

ঘাড় ফিরিয়ে একবার আবুর মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করছে বাপীর। কিন্তু বেচারা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার টালি এলাকার ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের কথা মনে পড়ে গেল। আসার দিনও বলেছিল, কপালের রং বদলাচ্ছে, এবারে দিন ফিরল বলে। কয়েকশ’ টাকা পুঁজির বৃত্ত থেকে একেবারে দশ হাজার টাকার বৃত্তের মধ্যে এসে দাঁড়াল? কিন্তু বুকের তলায় যে বৃত্তে পৌঁছনোর তৃষ্ণা এখন, সেটা দশ হাজারের দশ বিশ গুণ হলেও কিছু নয়। আবুর কথা আর উচ্ছ্বাস সত্যি হলে এই একটি রমণীর সঙ্গে তেমন যোগ-নির্বন্ধে ভাগ্যের পাশায় তার থেকে ঢের বড় দান পড়তে পারে। দশ হাজার টাকা হাতের মুঠোয়। যে-কোন সময় হাত বাড়ালেই পাবে, কিন্তু এক্ষুনি হাত বাড়ানো মানেই এই যোগের শেষ। বাপী তরফদার আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, দশ হাজার টাকা কেন, এই জীবনটাকে জুয়ার আসরে নামাতে আপত্তি নেই।

রমণীর অসহিষ্ণু প্রতীক্ষা মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। দু’ চোখের অকরুণ ঝাপটায় ওর মুখের জবাব টেনে বার করার মতো। বাপী বলল, না, আর বাড়াতে হবে না, মন থেকে সায় পেলে ওতেই হবে। পেলে বলব।

মহিলা চেয়েই আছে। দশ হাজার টাকার টোপ গেলার মতো জোরটা কোথায় বোঝার চেষ্টা। এবারে ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, সায় পেতে কতদিন লাগবে?

এত বড় একটা লোভের থাবা থেকে এমন অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পেরে বাপীর ভিতরটা হালকা লাগছে। সেই সঙ্গে নিজের একটা জোরের দিকেরও হদিস মিলছে। মুখে বিপন্ন হাসি।—সায় এক্ষুনি পাচ্ছি না যখন কতদিনের মধ্যে পাব বলি কি করে…কিন্তু আপনার এত তাড়া কিসের, আমি সত্যি বাড়ি নিয়ে আপনার সঙ্গে কোনো রকম বোঝাপড়া করতে আসিনি। আপনাকে দেখতে এসে নিজের সমস্যার কথাটা বলে ফেলাই হয়তো অন্যায় হয়েছে।

গায়ত্রী রাইয়ের ব্যাপারটা দেখে ভেতর বোঝা কারো দ্বারা সম্ভব কিনা বলা যায় না। এ-কথার পরেও মুখে কোনো রকম রেখা দেখা গেল না। তবু বাপীর কেমন মনে হল, বোঝাপড়ার চেষ্টা বাতিল করে মহিলা এবারে শুধুই ওর ভেতর দেখছে।

এ-দিকে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল, তারপর অনেকক্ষণের একটা অসহ্য বিরক্তি ঠেলে উঠে দাঁড়াল।

গায়ত্রী রাইও সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তাকালো। বাড়িতে ঢোকার আগে আছা অন্ধকার থেকে মহিলার হাসিমুখ দেখা গেছল। এখন হাসি নেই মুখে, কিন্তু চাউনিটা অন্তরঙ্গ।—যাচ্ছ?

—হ্যাঁ, সাড়ে আটটায় ক্লাবে সেই পার্টির সঙ্গে মিট্ করার কথা।

—ঠিক আছে। কাল সকালে আসছ?

মাথা নাড়ল, আসছে।

সে পা বাড়াবার আগে গায়ত্রী রাই আবার বলল, ক্লাবেই যাচ্ছ যখন একটা কাজ কোরো তো, সেখানকার ম্যানেজারকে দিন-কতকের জন্য এঁকে ঘর ছেড়ে দিতে বলো…আটিল উই রিচ্ সামহয়্যার।

রণজিৎ চালিহা বাপীর দিকে একটা উষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিল। বাড়ির দর দশ হাজার টাকা তুলে ফেলার জন্যেই হাবভাবে জ্বলতে দেখা গেছে লোকটাকে। এখন এই কথা। জবাব দিল, কোথাও রিচ্ করার জন্য তোমার এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার আছে?

সঙ্গে সঙ্গে এদিক থেকে আবার সেই হাল্কা-গম্ভীর ভ্রুকুটি। যার একটাই অর্থ, যা বলছি করো, এ-রকম জল-ভাত ব্যাপার নিয়ে মেজাজ গরম কোরো না।

রণজিৎ চালিহা বারান্দা থেকে নেমে অন্ধকারে মিশে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হল অনেকক্ষণের একটা কৃত্রিম গুমোট কেটে গেল। সামনের মহিলা এখনো গম্ভীর বটে, কিন্তু মুখের অকরুণ টান-ভাবটা গেছে। ওদিকে তার মেয়েও বেতের চেয়ার তুলে এনে মায়ের পাশে বসল। লালচে ঠোঁটের ফাঁকে টিপ-টিপ হাসি। আরো কিছু মজার খোরাকের প্রত্যাশা।

বাপী তাকাতে চায় না। দেখতে চায় না। সব মেয়েই মেয়ে। ওর জীবনে শনি। শনির দৃষ্টিতে সব জ্বলে, সব পোড়ে। ভিতরের ক্ষতবিক্ষত সত্তা কাউকে যেন চিৎকার করে নালিশ জানাতে চাইছে, এখানেও আবার একটা মেয়ে কেন? কেন?

ঘাড় বেঁকিয়ে একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে আবার এদিক ফিরে গায়ত্রী রাই হঠাৎ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, ইউ রাসকেল, কাম হিয়ার।

বাপী হকচকিয়েই গেছল। কিন্তু না এই আচমকা সম্ভাষণ বা আহ্বান ওকে নয়। আবুকে। কিন্তু আবুও এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল।

ঝাঁঝালো গলায় গায়ত্রী রাই আবার হুকুম করল, মোড়াটা এনে এখানে বোসো।

নিজের বাঁ পাশটা দেখিয়ে দিল। আবু শশব্যস্ত হুকুম তামিল করল। ঘাড়ে কি অজানা কোপ পড়ে ভেবে পাচ্ছে না।

গায়ত্রী রাইয়ের দুই সাদাটে ভুরু কুঁচকে জোড়া লাগার দাখিল।—কমাস আগেও বাড়ির মালিকের সম্পর্কে তুমি আমার কাছে গাদা গাদা প্রশংসা করে গেছ—সে এই মালিক?

এবারেও আবুর হতচকিত মূর্তি। জবাব দিল, জি মেমসায়েব।

সোজা হয়ে বসে নাক দিয়ে ফোঁস করে গরম বাতাস ছড়ালো এক ঝলক। তুমি একটা গাধা, হি ইজ্ এ ডেনজারাস্ ম্যান।

—জি মেমসায়েব—না, মেমসায়েব না। ভুল শুধরে ব্যস্তমুখে আবু উঠে দাঁড়াল একেবারে।—খোদার কসম খেয়ে বলছি বাপীভাই খুব ভালো লোক— আমার থেকে সাচ্চা লোক। ওই ম্যানেজার সায়েব খামোখা গরম হয়ে উঠতে

ওর মেজাজ খারাপ হয়েছিল—বাপীভাই, মেমসায়েবকে তুমি বুঝিয়ে বলো না।

এই আবু ঢিল নিয়ে বা শুধু লাঠি হাতে জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে মোকাবিলা করে ভাবা শক্ত। কিন্তু বাপীর স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাড়া জেগেছে আবার। ভিতরে আবার সেই অনুভূতির আনাগোনা। সে অনুভূতি আগে থাকতে কিছু ইশারা পাঠায়, কিছু বলে দেয়। আবুটা সরলই বটে। সত্যিই ডেনজারাস ভাবলে ওর মেমসাহেব এমন ঘটা করে বলত না—ভাবল না।

ওর হাঁসফাস দশা দেখে মেয়েটা হাসছে। বাপীর চোখে হাসি, মেমসায়েবকেই দেখছে।

আবুর কপালে আবার একটা ধমক।—ইউ শাট্ আপ অ্যান্ড সীট ডাউন! গায়ত্রী রাইয়ের দু চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর আটকালো। ঘনিষ্ঠ আদৌ বলা যাবে না, কিন্তু সেরকম তপ্তও নয়।

—কি নাম বলেছিলে—বাপী তরফদার?

সোজা তুমি করে বলল। এতক্ষণই যেন একটা বাড়তি সৌজন্যের লাগাম ধরে বসেছিল। এ-ও বাপীর হিসেবের সঙ্গে একটু বেশিই মিলছে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আই থিংক ইউ আর নট এ স্ট্রেট ম্যান—আর ইউ?

চোখে চোখ রেখে বাপী হাসল একটু।—খুব স্ট্রেট বলেই তো মিস্টার চালিহা আর সেই সঙ্গে আপনিও একটু রেগে গেছলেন…আমি কি একটাও বাঁকাচোরা কথা বলেছি?

নিজে না চাইলে ওই মুখে নরম দাগ পড়েই না বোধ হয়। কিন্তু জবাব শুনে অখুশি মনে হল না। জিজ্ঞেস করল, পড়াশুনা কতদূর করা হয়েছে?

বলল।

—অনার্স ছিল?

আজ্ঞে না, অনার্সের বই কেনার মতো সঙ্গতি ছিল না। ডিসটিংশন পেয়েছিলাম।

আবু রব্বানীর মুখে একটা বড় আশার বাতি জ্বলে উঠেছে। তড়বড় করে বলল, দারুণ ভালো ছাত্র ছিল মেমসায়েব, আমার সঙ্গে মিশে আর দিনরাত জঙ্গল চষে অল্পের জন্য স্কলারশিপ মিস করেছে। হাই ফার্স্ট ডিভিশনে

মেমসায়েব ওকে ধমকে থামালো, তোমাকে কিছু জিগ্যেস করা হয়নি। বাপীই যেন হাঁপ ফেলে বাঁচল, উৎসাহের ঝোঁকে আবু ওকে আরো কত বেমক্কা ফাঁপিয়ে তুলত ঠিক নেই।

—বয়েস কত?

বাপীর মনে পড়ে ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোম খাঁটি বয়েস জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর মনে কিছু ছিল, এঁর মনে কিছু থাকা অবশ্য সম্ভব নয়। তবু পাশে এই বয়সের একটা মেয়ে বসা বলেই নিজের বয়েস দশটা বছর বাড়িয়ে বলতে পারলে স্বস্তি বোধ করত। কিন্তু পারা গেল না, সত্যি কথাই বেরিয়ে এলো।—এবার তেইশ হবে।

এত কাঁচা বয়েস মহিলারও খুব মনঃপূত হল না যেন। কারণটাও বাপী হয়তো আঁচ করতে পারে। কিন্তু তলিয়ে ভাবার আগেই পরের প্রশ্ন। কলকাতায় কি করা হত?

—যুদ্ধের আপিসের টেম্পোরারি চাকরি।

—গেছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ভিতরে ভিতরে কেন যেন এখন আবার মেয়েটার পাশে বসে থাকা পছন্দ হচ্ছে না বাপীর। এখন কিছু মজার কথা হচ্ছে না, উঠে গেলেই তো পারে।

—এখন এখানে থাকা হবে?

বাপীর মনে হল প্রত্যেক কথার ফাঁকে মহিলা ওকে যাচাই করে নিচ্ছে।

-–সুযোগ সুবিধে হলে সেই রকমই ইচ্ছে।

—কিরকম সুযোগ সুবিধে?

চাকরির কথা ইচ্ছে করেই মুখে আনল না। বলল, ছোটখাটো কোনো ব্যবসা যদি করতে পারি?

এই জঙ্গলে আবার কি ব্যবসা?

বাতাস অনুকূল। বাপী হেসেই জবাব দিল, সে তো আমার থেকে আপনি ভালো জানেন।

এবার চাউনিটা আবার রুক্ষ কয়েক নিমেষের জন্য।—যা জানি সে-চেষ্টা করতে গেলে আমিই তোমাকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেব।…চাকরি করবে?

আবুর আর সবুর সইল না।—কেন করবে না মেমসায়েব, আপনার মুখের কথা খসলে বাপীভাইকে আমি আর ছাড়ি! ওর থেকে সেরা লোক আপনি এই তামাম বানারজুলিতেও পাবেন না—এ আমি হলপ করে বলতে পারি। জঙ্গলের নাড়ি-নক্ষত্র জানে, গাছ-গাছড়াও কম চেনে না—

এরপর তোমাকে আমি এখান থেকে বার করে দেব!

সঙ্গে সঙ্গে আবুর উচ্ছ্বাসের গলায় কুলুপ। কিন্তু মেমসায়েবের এরকম ঠাণ্ডা দাবড়ানি খেয়ে ও অভ্যস্ত বোধ হয়। হেসেই নিজের দু’কানে হাত দিয়ে সামাল দিল।

বাপীর দিকে ফিরল গায়ত্রী রাই। আমি প্রথমে তোমাকে ছ’মাসের জন্য ট্রায়েল দেব—ইট উইল বি এ রিগরাস জব, বাট দেয়ার ইজ ফিউচার—এই ছ’মাস কি পাবে না পাবে সেটা পরে ঠিক করব।

ভাগ্যের পাশায় দান পড়েছে, শুরুতেই সেটা জোরালো করে তোলার মতো জুয়াড়ীর খেলা দেখানোর এই মওকা। বাপীর এখন বদ্ধ ধারণা, আবুর মুখে সব শোনার পর যে অনুভূতিটা মনের তলায় আনাগোনা করে গেছে তাতে কোনো ভুল নেই। ভুল হলে একটা মানুষ এখান থেকে চোখের আড়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস এমন বদলে যেত না।

বাপী চুপ। কিছুটা নির্লিপ্তও।

—ও কে?

—ভেবে আপনাকে জানাব।

জবাব শুনে আবু তড়াক করে মোড়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

না, মহিলাও এই জবাব আশা করেনি। ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়ল।—ভাবার কি আছে?

বিড়ম্বনার ধকল কাটাবার চেষ্টাতেই যেন সময় নিল একটু। বলল, যে-রকম লোক চাইছেন, ছ’মাসের ট্রায়ালে সেটা সম্ভব কিনা আপনিই জানেন।…তাছাড়া মিস্টার চালিহার জন্য আমাকে কিছুটা ফ্রীহ্যান্ড দিতে আপনারই হয়তো অসুবিধে হবে।

এটুকুতেই ঠিক বোধগম্য হবার কথা নয়, হলও না। কিন্তু এতেই চোখকান সজাগ। মনে আরো কিছু আছে তাও যেন আঁচ করতে পারছে। কোনো ব্যাপারে অস্পষ্ট বরদাস্ত করার মেজাজও নয় মহিলার। বলল, কারো যোগ্যতা বুঝতে ছ’মাস যথেষ্ট সময়। ফ্রি-হ্যান্ড দেবার কথা এখনই আসছে কোথা থেকে? আর তোমার জন্যে মিস্টার চালিহাকে নিয়ে আমার কি অসুবিধে হবে? হি উইল বি ইয়োর বিগ বস্…অবশ্য তোমার সম্পর্কে তিনি ভালো ইমপ্রেশন নিয়ে যাননি, তোমাকে গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করবেন বলে মনে হয় না। আই উইল ট্রাই—

বেশ স্পষ্ট অথচ নরম গলায় বাপী বলল, মিস্টার চালিহা আমাকে খুব গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করবেন মনে হলে আপনি কি অনেক আগেই আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতেন না?

নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল গায়ত্রী রাই। এই মুখ আর এই চাউনি দেখে ওদিকে ঊর্মিলা রাই আর এদিকে আবু রব্বানীও চকিত বিমূঢ়।

—হোয়াট ডু ইউ মীন্?

বাপী চুপ। একবারেই জবাব দেবার ইচ্ছে নেই।

ফলে মহিলার আরো ঝাঁঝালো গলা।—কাম স্ট্রেট, হোয়াট ডু ইউ মীন?

বেশ সহজ অথচ শান্ত মুখে বাপী বলে গেল, আপনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বুঝতে পারছি, মনে যা আসে বলে ফেলে আমি অনেক সময় এরকম মুশকিলে পড়ি।…আবুর মুখে আপনার আর আপনার ব্যবসার গল্প শুনে আমার কেমন মনে হয়েছিল; এত বড় অর্গানিজেশনে বাইরের কোনো একজন সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে এটা আপনি চান না। আর এই জন্যেই মিস্টার চালিহার মতোই যোগ্য হয়ে উঠতে পারে এমন একজন নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসী লোক আপনার দিক থেকে আপনি চাইছেন। এ যদি ঠিক না হয়, ছ’মাসের ট্রায়েল দেবার দরকার নেই—নিজেকেই আমি বাতিল করছি।

মাত্র দু’চার মুহূর্তের জন্য বাপী যা দেখে উঠল সে কি ভুল? বুকের তলায় গোপন কিছুর ছবিটা কেউ যদি আচমকা চোখের সামনে তুলে ধরে, সে কি চকিতের জন্য এমনিই ধড়ফড় করে ওঠে না? কিন্তু সে শুধু কটা পলকের জন্য। গায়ত্রী রাইয়ের পালিশ করা সাদাটে মুখে আলগা রক্ত জমাট বাঁধছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হিসহিস স্বরে বলল, ইউ আর রিয়েলি ইমপারটিনেন্ট। আমার সামনে বসে আমারই চিফ একজিকিউটিভ সম্পর্কে তুমি এমন কথা বলো? এত সাহস তোমার? শুধু গলার নয়, চোখেও আগুন ঝরছে।—ইউ মে গো নাও।

বাইরে পা দিয়ে আবুর হতাশা একটা আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।—একেবারে পারে এনে এভাবে খেয়া ডোবালে বাপীভাই?

এদিকটায় রাস্তায়ও আলো নেই। বেশ অন্ধকার। চা-বাগানের কাছাকাছি হলে তবে রাস্তায় আলো। আবুর হাতে টর্চ। সন্ধ্যার পর ঘরের বার হলে এখানে সকলের হাতেই টর্চ বা হ্যারিকেন থাকে।

টর্চের আলোটা পায়ের দিকে রাস্তার ওপর। পাশাপাশি চললেও আবু ভালো করে দোস্ত্-এর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। বাপী হাসছে একটু একটু। নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবনা-চিন্তা আর সত্যি নেই। কারণ খুব বড় কিছু খোয়াবারও নেই আর।

বলল, তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?

আবু যথার্থ বেজার। একটু হয়তো বিরক্তও।—এরপর ওই মেমসাহেব আমাকেও ছাড়বে না। তোমার ওইসব কথা ফাঁস করে দিলে ওই শালা ম্যানেজার ছাড়বে?

নির্লিপ্ত সুরে বাপী বলল, তাহলে তুমি আমাকে ছাড়ো। আমাকে ক্লাবে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গিয়ে তোমার মেমসাহেবকে বলো, পাঁচ বছরে আমি এত বদলে গেছি তুমি জানতে না।

আবুর হাতের টর্চ আস্তে আস্তে বাপীর মুখের ওপর উঠে এলো। ঠোঁটে হাসি দেখে রাগই হল।—তুমি সত্যি বেশ বদলেছো তাহলে? আবু রব্বানী মওকা খোঁজে কিন্তু আসলে কোন্ শালার পরোয়া করে? দশ হাজার টাকা বাড়ির দাম পেলে—নিলে না। সেধে চাকরি দিতে চাইলে—তার জবাবে ওপর-পড়া হয়ে ওই কথা বলে এলে—তোমার মতলবখানা কি?

টর্চ নামাও।…বাড়ির দাম মজুতই আছে। দরকার হলে বেচে দেব, আর তুমি সঙ্গে থাকলে ওই টাকায় নিজেরাই কিছু করতে পারব। কিন্তু তোমার কি মত, মেমসাহেবকে যা বলেছি, সত্যি নয়?

আবু তবু ক্ষুব্ধ।—গায়ে পড়ে অত সত্যি কথা বলার দরকার কি ছিল?

বাপী আর কিছু বলল না। বলার আছেই বা কি। আবু যা ভাবছে তা হতেই পারে। গায়ত্রী রাই বাপীকে হয়তো হেঁটেই দিল।…কিন্তু তা যদি হয়, ভাগ্যের ছকে তেমন কোনো বড় দান পড়েনি বুঝতে হবে। ছেঁটে দিলেও বাপীর খেদ থাকবে না। কিন্তু মন সে-কথা বলছে না। দেখা যাক…।

আর কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। রাজ্যের ক্লান্তি। কাল সমস্ত রাত ঘুম হয়নি। ঘুম ক’রাত ধরেই নেই। আজও সকাল থেকে এ পর্যন্ত ধকলের মধ্যে কাটল। এখন নিরিবিলির তৃষ্ণা। একলার কোটরে সেঁধিয়ে যাবার তাড়না।

জিগ্যেস করল, ক্লাবে আলাদা ঘর-টর একটা পাব তো?

বুক ঠুকে বলার মতো করে আবু জবাব দিল, এজন্যে ওই মানেজারকে বলার কিছু দরকার ছিল না—সে ব্যবস্থা এ-মোল্লাই করতে পারত।

সোনার হরিণ নেই – ১১

এক ঘুমে ভোর।
চোখ তাকিয়ে বাপী নিজেই অবাক। জানলা দিয়ে বানারজুলির নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। তার গায়ে ধূসর পাহাড়ের দেয়াল। বাপীর লোলুপ দু চোখ সেদিকে স্থির খানিক।
দু রাত আগে বুকের তলায় যখন রক্ত ঝরছিল, সেই বানারজুলি তখন মায়ের মতো হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। বানারজুলি সত্যিই আশ্রয় দেবে ওকে? নইলে এমন একটানা শান্তির ঘুম এলো কোত্থেকে?
কিন্তু এই ক্লাবে থাকা পোষাবে না। পাঁচ ছ-বছরে ক্লাবের ভোলও একেবারে বদলে গেছে। একতলা বিশাল লম্বা দালান এখন। ছোট-বড় দুটো হলঘর। বাইরের অতিথি অভ্যাগতদের দুই-এক রাত থাকার মতো মাঝারি ঘরও আছে কয়েকটা। ভাড়া লাগে না, কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের সুপারিশ লাগে। সাজানো—গোছানো ঘর। একদিকে গদির শয্যা, দেয়ালের গায়ে ড্রেসিং টেবল, আলমারি। অ্যাটাচড বাথ। সেখানেও বেসিন, বাথটাব, মাথার ওপর শাওয়ার। গায়ত্ৰী রাইয়ের চিফ একজিকিউটিভ ক্লাবের ম্যানেজারকে ঘরের কথা বলেই রেখেছিল। এখানে তাকে ম্যানেজার কেউ বলে না। ছোট-বড় উঁচু-নিচু সকলেরই সে ডাটাবাবু। বাপী পরে জেনেছে ভদ্রলোকের নাম বাবুলাল দত্ত—সকলের মুখে মুখে ডাটাবাবু হয়ে গেছে।
মুখ দেখে বয়েস আঁচ করা শক্ত। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে যে কোনো বয়েস হতে পারে। ঢ্যাঙা, রোগা, ফর্সা। পরনে ঢিলে-ঢালা ট্রাউজার, গায়ে ঢোলা কোট। হাসি-হাসি মুখ, চটপটে হাব-ভাব।
লোকটা আবুকেও খাতিরই করে বোঝা গেছে। বেয়ারার মারফৎ খবর পেয়ে এসেই অন্তরঙ্গ সুরে বলেছিল, কদিনই ভাবছি আবুসাহেবের একেবারে দেখা নেই কেন।
একটা চোখ একটু ছোট করে ঠাট্টার সুরে আবু জিজ্ঞেস করেছিল, মালে টান পড়েছে।
পাশে অচেনা লোক দেখে ডাটাবাবু সপ্রতিভ সৌজন্যে বাপীকে নমস্কার জানিয়েছে—মিস্টার তরফদার? মিস্টার চালিহা আপনার কথা বলে গেছেন। সব ঘরই খালি—যেটা খুশি নিতে পারেন।
সব শেষের এই নিরিবিলি ঘরটাই বেছে নিয়েছে বাপী। বিকেলে একটু ভারী খাওয়া হয়েছিল, ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ খুব ছিল না। কিন্তু আবুর কাছে পার নেই। আজকের দিনটা অন্তত বাপীভাই তার আদরের অতিথি। ক্লাব ক্যানটিনের খানা ভালো, ওই ক্যানটিন চালিয়েই বাবু ডাটা লাল হয়ে গেল, নইলে ম্যানেজার হিসেবে তার মাইনে-কড়ি কিছু নেই—ক্যানটিনে দুজনে একসঙ্গে ডিনার সারবে, তাকে আবু খাওয়াবে।
ডিনারের আগে ক্লাব দেখিয়েছে আবু, ক্লাবের গল্প করেছে। সব কটা চা—বাগানের মালিক আর কর্তাব্যক্তিরা জোট বেঁধে বাড়তি লাভের কড়ি থেকে এই নতুন ক্লাব করেছে। নইলে এই পেল্লায় দালান তুলতে আর সব ব্যবস্থা করতে খরচ যা হয়েছে তার সবটাই ইনকাম ট্যাক্সের পেটে গিয়ে ঢুকত। ভাগাভাগি করে সব টাকাই কোম্পানীগুলোর খরচের খাতায় উঠেছে।
ক্লাবে সাজ বা সরঞ্জামের ত্রুটি নেই। তকতকে বিলিয়ার্ড টেবল, দু সেট টেবলটেনিস বোর্ড, গোটাতিনেক ক্যারমবোর্ড, মাঝারি হলঘরের একদিকে অনেকগুলো ছোট ছোট টেবল, চারদিকে শৌখিন চেয়ার। এখানে তাস দাবা জুয়ার আড্ডা। অন্যদিকে দুটো বড় বড় টেবলে খবরের কাগজ আর রংচঙা জার্নাল ম্যাগাজিন ছড়ানো।
রাত দশটার কাছাকাছি। তখনো জুয়ার আসর জমজমাট। দু-পাঁচজন আধ—বয়সী মহিলাকেও দেখা গেছে এখানে। খবরের কাগজ বা জার্নালের দিকে কেউ নেই। চার-পাঁচটা টেবিলে তিন তাস রামি পোকার চলেছে। ওদিকে সকলেই গম্ভীর, জোরালো আলোর নীচে সিগারেটের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে। ব্যস্ত শুধু কয়েকটা তকমা পরা বেয়ারা। অর্ডার মাফিক ড্রিঙ্ক সারভ করে যাচ্ছে আর হিসেবের খাতায় সই নিচ্ছে। হিসেবের ফয়সলা হয় প্রত্যেক জুম্মাবার অর্থাৎ শুক্রবারে। শনি রবি দুদিন চা-বাগানের ছুটি। তাই শুক্রবার রাতে হোমরাচোমরাদের নাকি দিল ভালো থাকে। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি ইত্যাদি আছে। বুঝে শুনে রকমারি মদ আমদানির ব্যবস্থা এবং তদারক তারাই করে থাকে। মেম্বাররা কি দরে সেটা এখানে ভোগ করবে তাও তারাই হিসেব কষে ঠিক করে দেয়। এ ব্যাপারে ডাটাবাবু শুধু জিম্মাদার, সার্ভিস চার্জ ছাড়া আর বেশি কিছু লাভ করতে পারে না। তবে আবুর ধারণা বাজারে শুধু খালি বোতল বেচেই লোকটা মন্দ কামায় না। তার আসল লাভ ক্যানটিন থেকে। খানা ভালো। গলা-কাটা দাম। শুক্কুর শনি এই দুটো দিন ডাটাবাবুর লক্ষ্মীবাবুর। চা—বাগানের রইস মানুষেরা সপরিবারে ওই দু রাতে ওখানেই ডিনার সারে।
অল্প আর মাঝারি আয়ের খদ্দেরদের জন্য ডাটাবাবুর ডে-ক্যানটিন খোলা থাকে। তখন কম খরচে লাঞ্চ মেলে। আর যা মেলে সেটা ডাটাবাবুর নিজস্ব কারবার। কম দামে দিশী ভালো মালের যোগানদার ডাটাবাবু। সবাই তো আর হোমরা-চোমরা চাকুরে নয় এখানে। লাঞ্চ খেতে এসে বা এমনিতেও সূয্যি ডোবার আগে এসে তারা আস্ত বোতল কিনে নিয়ে যায়। একটু অসুবিধে, ইচ্ছে করলেও এ জিনিস এখানে বসে খাবার হুকুম নেই। এখানকার বড় সাহেব—সুবোদের সঙ্গে রণজিৎ চালিহার খাতির বাজারের থেকে সস্তায় নামী-দামী মাল যোগানোর দৌলতে, আর ডাটাবাবুর কাছে আবু সায়েবের খাতিরও অনেকটা একই কারণে। আবু বর্ডারের বাইরে গেলেই কম দামের দিশী মাল পাবার আশায় হাঁ করে থাকে ডাটাবাবু। বর্ডারের ওধারে হরেকরকমের দিশী মালেরও ছড়াছড়ি। এই দিশী মাল মানে হাঁড়িয়া পচাই নয়, তার থেকে ভদ্দরলোকের জিনিস।
এহেন জায়গায় কিনা বাপী তরফদার।
এরকম জায়গায় রাতটা অঘোর ঘুমের মধ্যে কেটে গেল সেটাই আশ্চর্য। আরো কদিন ক’রাত থাকতে হবে কে জানে। এখানে বানারজুলির বাতাস নেই, বানারজুলির মাটির গন্ধ নেই। এর থেকে আবুর জঙ্গলের ঘরের একটাতে থাকতে পেলেও বেশি স্বস্তি বোধ করবে।
মুখ হাত ধোয়া হতেই চায়ের তেষ্টা। আর তক্ষুণি বুকের তলায় মোচড়। এই দুটো কান আর দুটো চোখ একটা যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে এলো।…এমনি সকালে খুপরি ঘরের নড়বড়ে দরজা বাইরে থেকে ঠেলে খোলার ক্যাঁচ করে শব্দ।…এক হাতে রুটি বা বিস্কুট, অন্য হাতে গরম চায়ের গেলাস…ঘুমের দাগে ফোলা ফোলা একখানা শামলা মুখ!
দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো বাপী। বারান্দায় একটা বেয়ারার জিম্মায় বনমায়ার নতুন মাহুত লছমন তার বাক্স আর বিছানা রেখে গেছে। আবু বলে গিয়ে থাকবে। এখানে এ দুটোর একটাও মানায় না। ঘরে ঢুকিয়ে দিতে বলে বাপী সোজা ক্যানটিনে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আর এক দিক থেকে ডাটাবাবু সামনে এগিয়ে এলো।—গুড মর্নিং সার, রাতে কোনো অসুবিধে হয়নি?
টাটে গোলাপ কি গাঁদা ডাটাবাবু সেটা দেখে না। বাপী জবাব দিল, কিছু না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হালকা শিস দিতে বেয়ারা ছুটে এলো।—সাবকা ব্রেকফাস্ট।
ডাটাবাবু হাল্কা চালে কিচেনের দিকে চলে গেল। এরপর শুধু চা আর চোস্ট অর্ডার দেয় কি করে? সঙ্গে একটা ডিমের পোচ বলল। কিন্তু এরই বিল দেখে বাপীর দু চোখ কপালে। চায়ের পাট শেষ হতে বিল সামনে রেখে বেয়ারা জিজ্ঞেস করল, দুপুরে লাঞ্চ হবে কি না।
বাপী জানালো, হবে। কিন্তু ভিতরে আবার আর এক চিন্তা। এখানে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার করতে হলে তার পুঁজি ফাঁক হতে কদিন আর। আবু আর তার মেমসায়েব খাসা ব্যবস্থাই করল যা হোক।
এখানে সন্ধের পর কাগজ আসে। বাপী বাইরে বসে আগের দিনের কাগজটা উল্টে-পাল্টে দেখছিল। কত দিন যাবৎ বাইরের জগৎটাকেই ভুলে বসেছিল। খবরের কাগজ হাতে নিয়েও দেখেনি। কিন্তু আজও একটু বাদেই আর ভালো লাগল না।
দূরে বানারজুলির জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ওটা টানছে ওকে। আবু সকালে আসবে বলে গেছল। তার জন্য অপেক্ষা করতে না হলে বেরিয়েই পড়ত।
কিন্তু নটা বেজে গেল আবুর দেখা নেই। থাকা খাওয়ার ফয়সালাই আগে করে নেওয়া দরকার। জলপাইগুড়ির ললিত ভড়ের কল্যাণে রান্নাটাও রপ্ত হয়েছিল। নিজেরটা নিজেই করে নিতে পারে। এই ক্লাবঘরে থাকলে সেটা সম্ভব নয়। একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলে গায়ত্রী’ রাই যদি মাসে একশ টাকা— বাড়িভাড়া থেকে পঞ্চাশ টাকা করেও ওর হাতে দেয় তাহলে খাওয়া-খরচটা অন্তত চলে যেতে পারে। ভালো খেতে ভালো লাগে না এমন নয়, কিন্তু গত পাঁচ বছরে বাপী এ ব্যাপারে অনেকখানি নিরাসক্ত হতে পেরেছে।…যাক বাড়ির দশ হাজার টাকা দাম পাবার পর মাসে মাসে খুদ কুড়নোর কথা আর ওঠেই না। বেচেই দেবে। এমন লোভনীয় দর পেয়েও কাল রাতে অমন নিস্পৃহ থাকতে পারল কি করে সেটাই আশ্চর্য লাগছে এখন।
এই দশ হাজারের অঙ্কটা সামনে রেখে বাপীর নিজেকে একটু চাঙা করে তোলার চেষ্টা। কিন্তু গতরাতে এমন নির্লিপ্ত ভাবখানা দেখিয়ে এসে আজই আবার নিজে থেকে বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে ছুটে যেতে পারে না। পরিস্থিতি বোঝার জন্যেও কটা দিন সবুর করতেই হবে।
আবুর এখনো দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে পাজামা পাঞ্জাবি বদলাবার জন্য ঘরে এলো। সাড়ে নটা বাজে, এবারে বেরিয়ে পড়বে।
মিনিট দশেকের মধ্যে বেরুতে গিয়ে দেখে ডাটাবাবুর কিচেন ঘর থেকে আবু রব্বানী এদিকে পা বাড়িয়েছে। দরজার কাছে ডাটাবাবু দাঁড়িয়ে। অতটা দূরে থেকেও বাপীর মনে হল কাঁচুমাচু মুখ তার। আর বড় বড় পা ফেলে আবুর গম্ভীর চালের এই মুখ দেখলে কেউ বলবে না বানারজুলি জঙ্গলের বীটম্যান ও।
কাছে এসে ধমকের সুরে বলল, সকালে ব্রেকফাস্টের টাকা দিতে গেলে কেন? আর শুধু ডাল ভাত মাছের ঝোলের লাঞ্চ অর্ডার দিয়ে এসেছ কেন?
জবাব না দিয়ে বাপী চেয়ে রইল। এত দেরিতে এসেও প্রথমেই ডাটাবাবুর কাছে এই খোঁজ নিতে গেল, অবাক হবারই কথা।
ঘরে পা দিয়ে আবু আবার বলল, ডাটাবাবুকে বকে এলাম আর তোমার অর্ডার বাতিল করে ফার্স্ট ক্লাস লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে এলাম, আর বলে দিলাম এরপর যে কদিন এখানে থাকবে ব্রেকফ্রাস্ট বা লাঞ্চডিনারের কোনো বিল যেন তোমার কাছে হাজির না করা হয়।
—সে কি! টাকা কে দেবে—তুমি?
—না, মেমসায়েব।
বাপীর স্নায়ু সজাগ। কিছু কি ঘটেছে এর মধ্যে আর সেইজন্য আবুর আসতে দেরি? কিন্তু ওর মূর্তি দেখে কিছু বোঝা দায়।
পিছনের দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে আবু ভুরু কুঁচকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল।—আমার দেরি দেখে সটকান দিচ্ছিলে?
—বসে বসে ভালো লাগছিল না। কিন্তু তোমার ওই—
—বোসো। আগে আমার কথার জবাব দাও। বয়সে আমি কত বড় হব তোমার থেকে?
এই গাম্ভীর্য দেখে বা প্রশ্ন শুনে বাপীর আবারও কেমন মনে হল সমাচার কিছু আছে। জবাব দিল, বছর ছয় হবে…
—তাহলে তুমি গুনে গুনে আমার দুগালে তিন-তিন ছটা থাপ্পড় মারো, আর কান দুটো ছ’বার কষে মুলে দাও।
কপট রাগ আর ধরে রাখতে পারল না। দু’ হাতে বাপীকে বুকে জাপটে ধরল আর দু’গালে নিজের গাল ঘষতে লাগল। এরপর চুমুটুমুও খেয়ে বসতে পারে, বাপীর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা।
—বাপী ভাই আমি একটা পাঁঠা—আমি একটা গরু—আমি একটা গাধা।
এরপর যেটুকু, বাপীর কাছে অন্তত তা আর অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। তবু দু’ কান সজাগ রেখে মন দিয়েই শুনল। রাতে ব্যাজার মন নিয়ে আবু রব্বানী ঘরে ফিরেছে। দুলারিকেও বলেছে, মেমসায়েবের কাছে গিয়ে বাপী ভাই বিসমিল্লায় গলদ বাঁধিয়ে বসেছে, এখন ওর নিজের গলা বাঁচলে হয়।
সকালে জঙ্গলে যাবার আগে বাপী ভাইয়ের কাছে আসার কথা, কিন্তু তার আগেই লোক মারফৎ মেমসায়েবের তলব। জলদি যেতে হবে। আচ্ছা করে ঝাড়বে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছে। মেমসায়েব বারান্দায় তার অপেক্ষাতেই বসেছিল। সামনে গিয়ে মন ভেজানোর মতো সেলাম ঠোকার সময়ও দিলে না। রক্ত জল করে দেবার মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার ওই লোক কাল অমন কথা বলে গেল কেন—তার কাছে তুমি আমাদের সম্বন্ধে কি বলেছ?
নিরুপায় আবু তখন আল্লার দোহাই দিয়ে জানালো, দোস্ত যা বলে গেছে তার সবটাই নিজের মাথায় গজিয়েছে, সে এরকম বলতে পারে মনে হলে এই বিপাকে পড়ার জন্য তাকে মেমসায়েবের কাছে নিয়েই আসত না। রাতে এখান থেকে বেরুনোর পর দোস্তের সঙ্গে তার এ নিয়ে একরকম ঝগড়াই হয়ে গেছে। আবু শুধু তার কাছে মিসিসায়েবের (ঊর্মিলার) এলেমদার বাপজানের জিপ অ্যাকসিডেন্টের গল্প করেছিল। ম্যানেজার চালিহা সাহেবের আয়ুর জোরের কথা বলেছিল, আর মেমসায়েব এই ম্যানেজারকে নিয়ে বুদ্ধি আর সাহসের জোরে কি করে তার খসমের ব্যবসা এমন জমজমাট করে তুললেন সেই সব গল্প করেছিল। দোষের মধ্যে মেমসায়েব এখন আর একজন লেখাপড়া জানা ইমানদার লোক খুঁজছেন আর এ পর্যন্ত দুজন লোককে ট্রায়েল দিয়ে ছাঁটাই করেছেন এ খবরটাও দোস্তকে জানিয়েছিল। ও খুব আশা করেছিল দোস্তকে মেমসায়েবের পছন্দ হবেই। কারণ এমন বিদ্যাবুদ্ধি আর সাহস ও-বয়সে কম ছেলেই ধরে। কিন্তু এখানে এসে আর চালিহা সায়েবকে দেখে দোস্ত কি ভেবে আর কি বুঝে অমন বেমক্কা কথা বলে ফেলল সেটা এখনো ওর মাথায় আসছে না।
বরফ-ঠাণ্ডা মুখ করে মেমসায়েব ওর কথা শুনে গেল। তারপর বলল, তোমার দোস্ত একটা হাড়-পাজী ছেলে— বুঝলে?
মেমসায়েবকে একটু তোষামোদ করার আশায় আবু মাথা নেড়ে প্রায় সায় নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই অবিশ্বাস্য কিছু দেখল। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মতো কি। আর চোখেও একটু খুশির জেল্লা।
আবু বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পেল না।
সঙ্গে সঙ্গে আবার মালকানের কড়া মুখ। ঝাঁঝালো গলায় আবুকে সাবধান করল, দোস্ত কাল রাতে এখানে কি বলেছে না বলেছে এ যেন কাক-পক্ষীতেও জানতে না পারে—জানলে দুজনেরই গর্দান যাবে। তারপর হুকুম করল তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। তারপর নিজেই আবার বলল, এখন থাক, সকালের দিকে চালিহার আসার কথা, বিকেল তিনটে-চারটের সময় যেন দেখা করে।
আবু রব্বানীর বুদ্ধিসুদ্ধি একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে সেঁধিয়েছিল। এবারে খোলসা। আনন্দে সেখানেই একটা ডিগবাজী খেতে সাধ গেছল তার। কিন্তু মেমসায়েবের জেরার শেষ নেই তার পরেও। ছেলেবেলায় কেমন দেখেছে দোস্তকে, একটু বড় হবার পর কেমন দেখেছে, পাঁচবছর দেখেনি এর মধ্যে বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র যে বিগড়োয়নি সে জানল কি করে—এই সব
আবুও তখন লাগাম ছেড়ে বন্ধুর প্রশংসা করেছে। সত্য-মিথ্যে যা মনে এসেছে তাই বলেছে। বলেছে, পাঁচ বছরে স্বভাব বদলে থাকলে কলকাতার মতো আমোদ-আহ্লাদের জায়গা ছেড়ে সে এই জঙ্গলে ফিরে আসবে কেন। এতদিন বাদে দেখে ক’ঘণ্টার মধ্যে আবুর বরং ভয় করেছে বন্ধু বিবাগী-টিবাগী না হয়ে যায়। আর টাকার লোভ যে নেই সে প্রমাণ তো মেমসায়েব নিজেই পেয়েছেন পকেটে দশ টাকা আছে কিনা সন্দেহ কিন্তু বাড়িটার জন্য নাকের ডগায় দশ হাজার টাকা দুলিয়েও তাকে লোভের জালে আটকানো গেল না।
বুকের তলার ক্ষতর ওপর আঁচড় পড়ল কটা। ওর স্বভাব-চরিত্রের খবর জানা থাকলে প্রশংসা করতে গিয়ে এই আবু রব্বানীরও জিভ আটকে যেত। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বাপী তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আমার ক্লাব-ক্যানটিনে খাওয়া—দাওয়ার খরচ চালানোর ভার তাহলে তোমার মেমসায়েবের?
হ্যাঁ। ভালো ঘর পেয়েছ কিনা খোঁজ করল। আমিও তক্ষুনি কাজ হাসিল করে নিলাম। বললাম, ভালো ঘর পেলে কি হবে, ওখানে ডাটাবাবুর খাওয়ার বিল মেটাতে তো এক হাত জিভ বেরিয়ে যাবে। মেমসায়েব তক্ষুণি বলে দিল, বিল সব আমার কাছে পাঠাতে বোলো। আবু হাসছে হি-হি করে।―এমনিতে মেমসায়েবের আঙুলের ফাঁকে জল গলে না, আমার যে এখানে ম্যাজিকের মতো লাগছে গো বাপী ভাই!
এবার বাপীও হাসল।—গায়ে পড়ে অত সত্যি কথা বলার দরকার কি ছিল এখন সেটা বুঝছ তাহলে?
আবু অকপটে মাথা ঝাঁকালো।—হাড়ে হাড়ে বুঝছি। কাল দুলারির কাছে তোমাকে গালই পেড়েছি আর এই ভোজবাজির কথা শুনলে ও আমাকে বোকা পাঁঠা বলবে।
ঘরের মধ্যে আর ভালো লাগছিল না। আবুর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল। ও এখন জঙ্গলের কাজে যাবে। হেড বীটম্যান হিসেবেও দায়িত্ব তো একেবারে কম নয়। ওর সঙ্গে আগের মতোই জঙ্গলে কাটানোর তৃষ্ণা বাপীর।
পাশাপাশি পাকা রাস্তা ধরে চলতে চলতে বাপী জিজ্ঞেস করল, আপাতত আমার এই ক্লাবে থাকাই ঠিক তাহলে?
আবু সানন্দে জবাব দিল, খাবেদাবে তোফা আনন্দে থাকবে—গ্যাটের পয়সা খরচা না হলে এর থেকে ভালো জায়গা আর আছে নাকি? তবে মেমসায়েব পাশের জমিতে তোমার ঘর তুলে দেয়ার কথাটা একেবারে ছেঁটে দেয় নি। আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই খালি জমিটুকু দেখে বলছিল, ঘর একটা-দুটো আরো তোলা যেতে পারে, কিন্তু এটুকুর মধ্যে মাঝখানে দেয়াল বা কাটের পাঁচিল তুললে বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে যাবে। এতে রাজী হবে না বোধ হয়, কিন্তু তোমার থাকার ব্যবস্থা তো কিছু করে দিতেই হবে—বারো মাস ডাটাবাবুর বিল মেটানোর মেয়ে তো নয়।
বাপী জিজ্ঞেস করল, পাঁচিল তুলতেই হবে কেন, মেয়ের জন্য?
—আর কি। মেয়ের চারদিকে অষ্টপ্রহর চোখের পাঁচিল তো দিয়ে রেখেছে। নতুন কিছু রসের খোরাক পেয়ে আবু দাঁড়িয়েই গেল।—ওই মেয়ের কাণ্ডমাণ্ড তোমাকে কিছু বলা হয়নি—না?
বাপী সচকিত। শোনার লোভ নেই। কিন্তু সতর্কতার প্রয়োজন কতটুকু, জেনে রাখা দরকার। মাথা নাড়ল, বলেনি।
গোড়ায় এই কাণ্ডরও সবটাই আবুর সেই ভুটান পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ুর মুখে শোনা। হলে নিজে চোখেও কিছু দেখেছে আর তাই নিয়ে মা-মেয়ের মন—কষাকষির ব্যাপারটা আঁচ করেছে।
মেমসায়েবের এই মেয়ে ঝগড়ুর চোখের মণি। ঊর্মিলার কথায় ঝগড়ুর কড়া নেশার মুখেও স্নেহ গলে গলে পড়তে দেখেছে আবু। ও তাকে আদর করে ঊর্মি বলে ডাকে। মেমসায়েবকে ভয়ও করে ভক্তিও করে, কিন্তু ভালবাসে ওই উর্মিকে। মেয়েটার নাকি তার বাপের মতোই দিলখোলা দরাজ মন। মা-কে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভালো মালের বোতল সময়-সময় ও-ই মেয়ে দিয়ে যেত ঝগড়ুকে। কিন্তু বরাত এমন দেড় বছর হয়ে গেল ওই মেয়ের সক্কলের ওপর রাগ আর অভিমান
ঊর্মিলা দার্জিলিং থেকে পড়াশুনা করত বরাবর। এবারে তার বি.এ. পরীক্ষা দেবার কথা। কিন্তু মায়ের কড়া দাপটে পড়াশুনায় জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে মায়ের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে এখন। মায়ের সাফ কথা বাড়িতে বসে পড়াশুনা করে প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে পারো তো দাও, নইলে দিতে হবে না। মেয়েও রাগ করে ও-পাট বন্ধ করে বসে আছে।
মোদ্দা কথা, দার্জিলিঙের কাছাকাছি এক চা-বাগানের ছোকরা এঞ্জিনিয়ারের প্রেমের হাবুডুবু খাচ্ছে ঊর্মিলা রাই। মেয়ে চালাক যেমন সেয়ানাও তেমনি। অনেক দিন পর্যন্ত ব্যাপারখানা সকলের চোখে গোপন ছিল। কলেজের ছুটি-ছাটা মেয়ে মায়ের কাছে এসে থাকে আবার ছুটি ফুরোলে চলে যায়। ধরা পড়বে কি করে?
কিন্তু, প্রেম পাকতে থাকলে চালাক ছেলে-মেয়েরাও বোকা হয়ে যায়, আবার বেপরোয়াও হয়। এই জন্যেই দুনিয়ার কোনো প্রেমই শেষ পর্যন্ত চাপা থাকে না বোধ হয়। মেয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর লম্বা ছুটির মধ্যেই সব ফাঁস। ঊর্মিলা মাঝে মাঝে সকালে পাহাড়ের বাংলো থেকে নেমে আসে, দুপুরের খাওয়ার সময়ের আগে আর দেখা মেলে না। আবার খেয়ে-দেয়ে দুপুরে নামল তো সন্ধ্যার আগে আর দেখা নেই। মা বকাবকি করলেও চোখ উল্টে থাকে, নয়তো জবাব দেয়, ছুটির মধ্যে বাড়িতে ভালোলাগে না—পাহাড় আর জঙ্গল দেখে বেড়ায়।
মায়ের তাতেও দুর্ভাবনা। এসব জায়গায় একলা পাহাড় জঙ্গল দেখে বেড়ানো নিরাপদ নয়। কিন্তু ঝগড়ুকে সঙ্গে দিতে চাইলে মেয়ে মুখঝামটা দেবে। সে আর কচিটি আছে নাকি এখন?
মায়ের হাতে পড়লে বকুনি খাবে ভেবে ঝগড়ু নিজেই অনেক সময় মেয়ের ফিরতে দেরি দেখে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু কাছে দূরে কোথাও তার দেখা মেলেনি। এদিকে মা তো আর সর্বদা ঘরে বসে থাকে না, দিনরাতের বেশির ভাগ সময় তার মাথায় ব্যবসার চিন্তা। দু’চারদিনের জন্য আবার বানারজুলিতে বা অন্য কোথাও চলে যায়। বড় বড় পার্টির সঙ্গে নিজেরও অনেক সময় যোগাযোগ রাখতে হয় তার। মেয়ের জন্য তখন পর্যন্ত কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। নিজের বাড়ি, ঝগড়ু আছে, চিন্তার কি আছে?
…মেয়ে একদিন সকালে বেরুলো, রাত পর্যন্ত দেখা নেই। তার খানিক আগে মালকান দু’দিনের জন্য বাইরে চলে গেছে। ঊর্মি অবশ্য ঝগড়ুকে বলে গেছল, দুপুরে ফিরবে না। তার চেনাজানা কয়েকজন মেয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে হৈ-চৈ করে কাটাবে আর বাইরে খেয়ে নেবে। কিন্তু সেয়ানা মেয়ে মা থাকতে একটি কথাও বলেনি। তারপর দুপুর গড়ালো, বিকেল আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল, তার দেখা নেই! ভাবনা-চিন্তায় অস্থির হয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলো ঝগড়ু। তাকে আর এ তল্লাটে না চেনে কে? শেষে অনেকটা দূরে সেই পাকা রাস্তার ধারে এক চালা-ঘরের বুড়ো সাঙাতের সঙ্গে দেখা। ঝগড়ুর দুশ্চিন্তার কথা শুনে সে যা খবর দিল, দুই চক্ষু ছানাবড়া। মিসি সায়েবকে নাকি মাঝে মাঝে জিপে করে এক ছেলের সঙ্গে হাওয়া খেতে দেখে তারা। এই রাস্তাতেই যাতায়াত তাদের। সুন্দরপানা অল্প-বয়সী ছেলে, কোন্ দেশী বলতে পারবে না, তবে স্বজাতের নয় এটা ঠিক—অর্থাৎ নেপালী নয়। সাদা চামড়ার সায়েব-সুবো বা ফিরিঙ্গি-টিরিঙ্গিও নয়। পরনে চেকনাই প্যান্ট শার্ট, নিজেই জিপ চালায়। পাশে মিসি সায়েব। সেই সকালেও এই রাস্তায় জিপে দুজনকে দেখেছে। অমন ফুর্তির মুখ কে না চেনে। তাই তারা ভেবেছে ঝগড়ুর মালকান মেয়ের জন্যে ভিনজাতের আদমী ঠিক করে ফেলেছে।
ঝগড়ু ফিরে এসেছে। কিন্তু বাংলোয় ওঠেনি। পাহাড়ে ওঠার রাস্তা আগলে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। ওই জিপের দেখা মিলেছে আরো ঘণ্টাখানেক বাদে। রাত তখন কম করে নটা। আশেপাশে জনমানব নেই।
সামনে এসে হেড লাইটের আলোয় ঝগড়ুকে পাথরখানার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঊর্মিলার প্রেমের চটকা ভাঙল। ওদিকে সেই ছেলেরও মুখ শুকনো। জিপ থেকে নেমে ঊর্মিলা ছুটে এলো। তার প্রথম ত্রাস, মা হঠাৎ ফিরে এসেছে কিনা, নইলে ঝগড়ু এখানে এই মুখ করে দাঁড়িয়ে কেন?
মা আসেনি শুনে মেয়ের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। বলল, ফিরতে দেরি হবে বলেই তো গেছল, অত চিন্তার কি আছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে দেরি হয়ে গেল, তাদের একজনের আত্মীয় পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে।
প্রেমিকটিও জিপ থেকে নেমে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝগড়ু তখন রাগে ফাটছে। তাকে দেখিয়ে ঊর্মিলাকেই বলল, ফের মিথ্যে কথা বলবে তো তোমার সামনেই ওর মাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে আসব। তোমার ওই খেলা কত দিন ধরে চলছে আমার জানতে বাকি নেই—আসুক মালকান
ঝগড়ুর মেজাজ জানে ঊর্মিলা, প্রেমিকটি জিভ নেড়ে কিছু বলতে গেলে হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। ইশারায় চটপট তাকে সরে পড়তে বলল। তারপর বাংলোয় ফিরে ঝগড়ুকে নিয়ে পড়ল। তোয়াজ তোষামোদে কাজ হল না দেখে রাগবিরাগ শুরু হয়ে গেল। মা কিছু জানবে না কথা দিতেই হবে। আর তা না হলে নিজের ওপর এমন শোধ নেবে যে ঝগড়ুকে চিরকাল পস্তাতে হবে। কি করবে রাগের মুখে তাও বলল। শেষে ছোট মেয়ের মতোই ওকে জাপটেমাপটে ধরে সে কি আদরের ঘটা ঝগড়ুর, কথা না দিয়ে উপায় কি? মদ দু’চোখের বিষ মালকানের কিন্তু ম্যানেজার বা ব্যবসার সেরকম মানী অতিথি অভ্যাগতর জন্য ঘরে দামী মাল কিছু মজুত রাখতেই হয়। মেয়ের বুকের এত পাটা, তার থেকে একটা আস্ত বোতল সরিয়ে ওকে দিয়ে দিয়েছিল। আর পরদিন সেই ছেলেকে একেবারে পাহাড়ের বাংলোয় তুলে এনে ঝগড়ুর সঙ্গে মিতালি করিয়ে ছেড়েছে।
ঝগড়ু ভয়ে বাঁচে না। আরো পাঁচজন আছে এখানে। মেয়েটার জন্য তাদের মিথ্যে বোঝাতে হয়েছে, মিথ্যে বলতে হয়েছে। নানা রকম রইস খদ্দেরের আনা—গোনা আছেই বাড়িতে। এ রকম এক দিন না। মায়ের অনুপস্থিতিতে আরো অনেক সময় ওই ছেলেকে এই পাহাড়ের বাংলোয় দেখা গেছে। ঊর্মিকে ঝগড়ু বকা-ঝকা করে, মায়ের কাছে বলে দেবে বলে ভয় দেখায়, নিজের বিপদের কথা বলে—কিন্তু কে কার কথা শোনে!
ছেলেটাকে অবশ্য ভালোই লেগেছিল ঝগড়ুর। মিষ্টি চেহারা। নাম বিজয় মেহেরা। পাঞ্জাবী। কিন্তু দাড়ি-গোঁপের বালাই নেই। কেতাদুরস্ত হালফ্যাশানের ছেলে। এনজিনিয়ারিং পাস করে সবে মিরিকের চা-বাগানে ঢুকেছে। দার্জিলিং আর শিলিগুড়ির মাঝামাঝি জায়গা মিরিক। সুখিয়া পোখরির কাছে দল বেঁধে মেয়েরা পিকনিকে গেছল। সেখানে ওই ছেলের সঙ্গে ঊর্মিলার আলাপ। ঝগড়ু বলেছে প্রথম আলাপেই নাকি বেশ ঘন ব্যাপার। তারপর ফাঁক পেলেই ওই ছেলের দার্জিলিং-এ ছোটা, আর ফাঁক পেলে মেয়েরও তেমনি হস্টেল পালিয়ে মিরিক বেড়াতে আসা। বিজয়ের হেপাজতে কোম্পানীর জিপ আছে একটা। তার ফলে দার্জিলিং থেকে মিরিক বা মিরিক থেকে দার্জিলিং কতটুকু আর পথ? তাছাড়া শনি রবি সপ্তাহে দুদিন তো ছুটি।
সে-ও এক শনিবার। পড়বি তো পড় বাঘিনীর মুখে। অর্থাৎ মায়ের মুখো—মুখি। ঊর্মিলা তখন বি.এ. পড়ে। গায়ত্রী রাই ব্যবসার কাজে নিজের ভ্যানে কার্সিয়াঙে এসেছিল। কাজ শেষ করে ফেরার মুখে বিপত্তি। এক জায়গায় পথ আগলে একটা বাস বিকল হতে কতগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের ভ্যানও এসে থেমেছে। বাঁকা রাস্তার অদূরে একটা জিপ দাঁড়িয়ে। সেই জিপে চালকের পাশে তার মেয়ে বসে। দুজনেই হাসিখুশিতে এত মশগুল যে কোনদিকেই চোখ নেই। নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করবে কিনা গায়ত্রী রাইয়ের সেই বিস্ময়। কোথায় দার্জিলিঙের হস্টেল আর কোথায় কার্সিয়াঙ—কম করে পনের-ষোল মাইল পথ!
ভ্যানে গায়ত্রী রাইয়ের পিছনে যে লোকটা বসে ছিল সেও এইখানে জিপে ওই ফিটফাট ছেলের পাশে মিসিসায়েবকে দেখে হকচকিয়ে গেছে। লোকটা পাহাড়ের বাংলোয় কাজ করে। বাইরে বেরুলেই অনেক সময়ই বাংলোর কেউ না কেউ মেমসায়েবের সঙ্গে থাকে। জিপের ওই ছেলেটাকে সে পাহাড়ের বাংলোয় দেখেছে। ঝগড়ু বলেছিল, মেমসায়েবের খাতিরের খদ্দের। মেমসায়েবের এই মূর্তি দেখে আর তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে লোকটা সে-কথাও না জানিয়ে পারল না। কারণ এখানে ওই ছেলের পাশে মিসিসায়েবকে দেখে তারও দস্তুরমতো খটকা লেগেছে।
তারপর বেড়াল যেমন ইঁদুর ঘরে আনে সেই রকম করে জিপ থেকে মেয়েকে টেনে নামিয়ে নিজের গাড়িতে তুলল মেমসায়েব। মেয়ের তখন হয়ে গেছে। সেখান থেকে সোজা নিজের পাহাড়ের বাংলোয়। ঘরে এনে বারকতক ঝাঁকুনি দিতেই মেয়ে গলগল করে সব স্বীকার করে ফেলল, আর বি.এ. পাশ করার পর ওই ছেলেকে তার বিয়ে করার সংকল্পের কথাও বলল। জবাবে মায়ের ঠাস ঠাস দুই থাপ্পড়ে সোজা বিছানায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হল তাকে।
বাইরে থেকে মেমসায়েবের অলক্ষ্যে ঝগড়ু মেয়ের শাস্তি দেখেছে। তারপর নিজের শাস্তির অপেক্ষা করছে।
ডাক পড়তে ঝগড়ু মেমসায়েবের মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। কিন্তু বলার যা বলেছে।—তাকে যেমন খুশি শাস্তি দিতে পারেন। সব জেনেও ও কিছু জানায় নি বা জানাতে পারে নি কারণ তার মেয়ে দুর্গা মায়ের নাম করে তাকে শাসিয়ে রেখেছিল মা-কে কিছু বললেই পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ খেয়ে নিজেকে শেষ করবে আর শোধ নেবে। বলেছিল, সে ওই ছেলেকে বিয়ে করবে আর সময়ে সে-কথা মা-কে নিজেই জানাবে।
না, মালকান ওকে কোনো শাস্তি দেয় নি বা কিছুই বলে নি।
পরদিন মেয়েকে নিয়ে নিজে দার্জিলিং চলে গেছে। সেখানে কি হয়েছে না হয়েছে তারাই জানে। মোট কথা এটুকু বোঝা গেছে, মেমসায়েব সেখানে বেশ কড়া ব্যবস্থাই কিছু করে এসেছিল।
কিন্তু প্রেমজ্বর ছাড়ানো মুখের কথা নয়। তিন-চার মাসের মধ্যে দার্জিলিং থেকে মেমসায়েবের নামে চিঠি এসেছে। সেটা কি চিঠি ঝগড়ু জানে না, ফলে আবুও জানে না। তবে এটা ঠিক, হস্টেল থেকে মেয়ের নামে কড়া নালিশ কিছু। চিঠি পেয়েই থমথমে মুখে মেমসায়েব দার্জিলিং চলে গেছে আর বইপত্র বাক্স বিছানাসুদ্ধু মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। ব্যস, মেয়ের পড়ার পাট খতম। মা আর মেয়েকে কলেজে পাঠাবে না, মেয়েও প্রাইভেট পরীক্ষা দেবে না।
বিজয় মেহেরাকে আবু স্বচক্ষে এই বানারজুলিতেই দেখেছে। দেখেছে মেমসায়েবও। তাকে প্রাণের ভয় দেখিয়েছে পর্যন্ত। সাত-আট মাস আগে মেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। দু’-দিন দু’-রাত নিখোঁজ। এই আবুকে সঙ্গে করেই মেমসায়েব মিরিকে চলে গেছল। যে চা-বাগানের এঞ্জিনিয়ার সেই ছেলে, তার ম্যানেজারের কাছে নালিশ করেছিল। কিন্তু অপ্রস্তুত হয়ে ফিরতে হয়েছে। কারণ বিজয় মেহেরা সেখানেই তখন কাজে ব্যস্ত। ঊর্মিলা ঘর ছেড়ে পালিয়েছে শুনে সে হাঁ।
দু’-দিন বাদে ঊর্মিলার শিলিগুড়ির এক বান্ধবী এক-রকম জোর করেই তাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছে। দু’-রাত সে ওই বন্ধুর বাড়িতে বন্ধুর কাছে ছিল।
তারপর থেকে এ পর্যন্ত আর গোলযোগ কিছুই দেখা যায় নি। বাইরে মেয়েকে অনেকটা শান্তই দেখা যায়। মা তাকে সারাক্ষণ চোখে আগলে রাখে। যখন যেখানে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায়। কিন্তু আবুর এখনো ধারণা, মেয়েটার ওই ছেলের ওপরেই মন পড়ে আছে। মায়ের চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়, তবু তলায় তলায় কোন রকম যোগসাজশ আছে কিনা কে জানে। এদিকে বাইরের কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে মিশতে দেখে না তাকে। শহর থেকে গাদা গাদা ইংরেজি গল্পের বই আনায় আর পড়ে।
আবুর মুখ চলে তো পা চলে না। এতক্ষণে ওরা বনমায়ার আস্তানার রাস্তায়। বাপী অন্যমনস্ক ছিল। এ গল্প যেমন পুরনো আবার তেমনই নতুন। ঊর্মিলার মুখখানা খুঁটিয়ে ভাবছিল। বুকের তলায় কোনো বড় ঝড় জমাট বেঁধে আছে মনে হয় নি। বরং চোখের কোণে স্বাভাবিক কৌতুক দেখেছে। ঠোটের ফাঁকে মজার ছোঁয়া লাগা হাসিও দেখেছে।
…তাহলে মা জিতেছে?
বনমায়ার ডাকে ঘুরে তাকালো। শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম তুলেই আছে আর ডাকছে। একসঙ্গে দু’জন আপনার মানুষ কতকাল বাদে দেখল, এই ভাব। লছমন ওর মুখে কচি ডাল-পাতা গুঁজে দিয়ে তোয়াজ করছিল। বনমায়া শুঁড় দিয়ে ওকে পাশে ঠেলে সরালো।
বাপীর হঠাৎ হাসি পেল। এই বনমায়ার পায়ে কতবার কত না শক্তপোক্ত বেড়ি লাগানো হয়েছে। কিন্তু সব বাধাবন্ধ ঠেলে ওর অভিসার কেউ ঠেকাতে পারে নি।
কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে বোধ হয় বনমায়া হতে পারে না।

সোনার হরিণ নেই – ১২

ঘড়ির দিকে চোখ ছিল না এমন নয়। হাত-ঘড়িটা হাতে পরাই আছে। তিনটে বাজতে দেখেছে। কাঁটা এর পর চারের দাগের কাছে এগিয়ে আসছে তাও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু বাপীর কোন তাড়া নেই। চিৎপাত শুয়ে আছে।

আবু রব্বানী ওকে জঙ্গল থেকে ছেড়েছে সাড়ে বারোটার পরে। তার আগে বারকয়েক মনে করিয়ে দিয়েছে মেমসায়েবের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট তিনটের থেকে চারটের মধ্যে। চারটের দরকার নেই, বাপী ভাই যেন অবশ্য সাড়ে তিনটের মধ্যেই চলে যায়। সময়ের ব্যাপারে মেমসায়েব খাঁটি মেমসায়েব। পরিস্থিতি অনুকূল জেনেও আবুর মনে একটু উদ্বেগ লেগেই আছে। মেমসায়েবের মেজাজ জানে, আবার বাপী ভাইয়ের মগজের খেলার যে নজির দেখেছে তাতেও তার দুর্ভাবনা। আবার কি বলে সব বানচাল করে দেয় তার কিছু ঠিক আছে। একবার কিস্তিমাত হয়েছে বটে, কিন্তু বার বার সেই রাস্তায় এগোলে ডাকসাইটে ঠাকরোন কি আর সেটা বরদাস্ত করবে? বাপীকে বলেওছে সে-কথা

জবাবে বাপী মিটি-মিটি হেসে বলেছে, না, এক রাস্তায় এগোলে কখনও হয়!

আবুর তাতে অস্বস্তি বেড়েছে বই কমেনি। তার ব্যবস্থায় বিরক্তির মিশেল। না না, আর কোনো রাস্তা-ফাস্তার কথা তুমি চিন্তাই করবে না। যা বলে শুনবে আর ভালো ছেলের মত রাজি হয়ে যাবে। মগজে বুদ্ধি কেমন ধরো সেটা ঠাকরোন ভালই বুঝেছে। আর সেই জন্যে এখন তোমার কদর। কিন্তু বেশি বুদ্ধির প্যাচ কষতে গেলে ভরা-ডুবি হবে বলে দিলাম। বুদ্ধির দাম পেয়েইছ, কিন্তু বিশ্বাসে এতটুকু আঁচড় পড়ল তো ভোকাটা। ঠাকরোনের কাছে ওটির কদর সব থেকে বেশি।

আবুর ভয়টা কোথায় বাপীর বুঝতে বাকি নেই! বুদ্ধির ফুটো দিয়ে শেষে বিশ্বাস না গলে যায়। বাপী ভাবতে বারণ করেছে, আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু বিকেলের সাক্ষাতের ফলাফল না জানা পর্যন্ত ওর স্বস্তি নেই। দোস্তের মুখ দেখে মনে হয়েছে তার যেন খুব একটা গরজ নেই, গরজ শুধু ওরই। বার দুই বলেছে, খুব আশা করেছিল মেমসায়েব ওকেই হুকুম করবে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। তা না বলার মানে, একলা দোস্তের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

আবুর সেই জন্যেই কি-হয় কি-হয় ভাবনা।

বাপীর বুকের ওপর কেউ হাত রেখে দেখছে না। রাখলে বোঝা যেত ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরছে বুকের তলার ধুপধুপুনিও ততো বাড়ছে। আবার ঘড়ি দেখল, চারটে বাজতে সতের। জামা-পাজামা বদলে এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়লেও চারটের পনের-বিশ মিনিট পরে পৌঁছুবে। বানারজুলির ওই বাড়ি এই ক্লাব হাউস থেকে আড়াই মাইল পথ। আবু এখনও ওকে শয্যায় শয়ান দেখলে ক্ষেপেই যেত বোধ হয়। ভাবত দোস্তের একটুকু তাড়া বা গরজ নেই। কিন্তু তাড়া আর গরজ দুই-ই আছে বলে আজকের সময়ের হিসেবটা অন্য রকম। কলকাতার ব্রুকলিনে মাস—কতক থেকেই গোলামীর স্বাদ বুঝেছে। ঘাড়-নিচু ঘোড়ার পিঠে চাবুক বেশি পড়ে। দু পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর পাটাতনটা শুরুতেই যতটা সম্ভব উঁচু করে নেওয়া দরকার। এই পাটাতনের বিচার টাকার অঙ্কে নয়। এই এক রমণীর দৌলতে বাড়তি টাকা তো বেশ আবুও কামাচ্ছে, আরও কতজনে কামাচ্ছে। দুপুরে আবু বলছিল, ঠাকরোনের সুনজরে আছে বলেই রেশমাও সুখের মুখ দেখেছে। কিন্তু বাপী আর সে রকম সুখের প্রত্যাশী নয়। ঠিক কি যে প্রত্যাশা বাপী নিজেও জানে না। সদ্য-সদ্য যে উঁচু পাটাতনের ওপর শুরুতেই দু’পা ভর করে দাঁড়াতে চায়—সেটা ওর নিজেরই সত্তা। টাকার নয়, সম্ভারের নয়—শুধুই সত্তা।

তাই মনে বলছে, আর একজনের মারফৎ আঙুল তুলে দু-করে ডাকা মাত্র ঘড়ির কাঁটা ধরে গোলামের মত আজ অন্তত ছুটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কেন সময়ের অত খেয়াল ছিল না, হালকা চালের সে কৈফিয়তও মগজে ছকা হয়ে গেছে।…কৈফিয়ৎ তলব করার আগেই আবুর মেমসায়েব বা ঘরে যদি থাকে তো তার মেয়েরও কিছু দেখে দু’ চোখ হয়ত কপালে উঠবে। আবুকে ছেড়ে জঙ্গল থেকে ক্লাব-ঘরে ফেরার পথে বনমায়ার নতুন মাহুত লছমনকে যা বলে এসেছিল, খুশি আর কৃতজ্ঞতায় ডগমগ লছমন মাথা ঝাঁকিয়ে তাতে রাজি হয়েছে।

চারটেই বাজল। বাপী এবার শয্যা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে বেশ করে মুখটা ধুয়ে এলো। তোরঙ্গ থেকে নতুন আর এক প্রস্থ গেঞ্জি পাজামা আর পাঞ্জাবি বার করে পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটী করে মাথা আঁচড়ে নিল। শেভিং পর্ব ঘণ্টাখানেক আগেই সেরে নিয়েছিল।

—বাঃ। তোকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে যে রে!

চমকে উঠে হাত থেকে চিরুনি ফেলে দিয়ে আয়নার কাছ থেকে সরে এলো বাপী তরফদার। শেভিংয়ের পর প্রথম যে-দিন স্নান সেরে মাথা আঁচড়ে এমনি একসেট পাজামা পাঞ্জাবি পরে সকালে চায়ের টেবিলে এসে বসেছিল, গৌরী বউদি বড় বড় চোখ করে ওর দিকে চেয়েছিল, তার পর ঠোটে হাসির ফাটল ধরিয়ে বাচ্চু আর মণিদার সামনেই ওই কথাগুলো বলেছিল।

নিজের ওপরেই তিক্ত-বিরক্ত। পিছনের যা কিছু পিছনেই পড়ে থাকে না কেন? মনে পড়ে কেন? পড়ে কেন তাও জানে। মনের ব্যামোয় বাঁক ঘুরতে বাঘ দেখে।

হনহন করে পা চালিয়ে বনমায়া আর লছমনের আস্তানায় চলে এলো। পাশেই লছমনের ঝুপড়ি ঘর। সে তৈরিই ছিল। একগাল হেসে এগিয়ে এলো। ওদিকে আগেও বনমায়া যতবার দেখত বাপীকে সেলাম বাজাতো। মাঝে পাঁচটা বছর অদর্শনের ফলে এখন তো আরও খুশির সেলাম।

এই সকালটা লছমনের কাছে খুব সুদিন। বনমায়া বন-বিভাগের হাতী আর আবু রব্বানী হল গিয়ে জঙ্গলের এই এলাকার হেড বীটম্যান। সেই সুবাদে আবু সাহেবের কৃপার পাত্র। বনমায়ার মন না পেলে আর দু’জন মাহুতের মতো ওরও জবাব হয়ে যাবে—এই হুমকি সাফসুফ দিয়েই রেখেছিল। বনমায়ার তোয়াজ তার দিনরাতের কাজ। তাতে একেবারে ফল হয় নি এমন নয়। অন্য দু’জন মাহুতের মতো বনমায়া ওকে একেবারে বরবাদ করে দেয় নি। সময়ে অনেক সয়, বনমায়ারও এই তোয়াজ পেয়ে কিছুটা সয়ে এসেছিল। তবু মন পাওয়ার ব্যাপারে এই বাঙালী বাবুর কথায় আবু রব্বানী ওকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে।

দু-দুজন ভালোবাসার মানুষকে একসঙ্গে দেখে এই বজ্জাত যখন শুঁড় দিয়ে ওকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল, বা ফোঁস ফোঁস করছিল—বাঙালী বাবুর কথায় আবু সাহেব তখন এক হাতে শুঁড় আর এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাছে রেখে বনমায়াকে ধমক-ধামক করেছে। বলেছে, ও-ই এখন তোর আসল ভালোবাসার লোক, বুঝলি? ওদের দেখে লছমনের হাতে খেতে চায় নি, আবু সাহেব তখন বকেঝকে আর রাগ করে শুঁড়ে থাপ্পড় কষিয়ে ওর হাত দিয়েই খাইয়েছে। ভালোবাসার মানুষের গুঁতো খেয়ে কতক্ষণ আর গোঁ থাকে। এর পর বাঙালীবাবু আর আবু সাহেবকে হাতির পিঠে তুলে নিয়ে লছমনই মনের আনন্দে তাদের জঙ্গলে কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

আবু সাহেবের ওপর লছমনের খুব একটা ভরসা ছিল না। কিন্তু বাঙালীবাবু এ কদিনের মধ্যে তার কথা রেখেছে। আর এই এক সকালের মধ্যে চাকরি খোয়াবার ভয়ও দূরে সরে গেছে। লছমন তাই কৃতজ্ঞ যেমন, খুশিও তেমনি।

হাওদা সাজিয়েই রেখেছিল। বাপী শুঁড় বেয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও উঠে পড়ল।

বাপী নিজের মনে হাসছে। মাথায় কি ভূত চেপেছে? সে-রকম ভাবলে এখনও নেমে পড়া চলে। চটক দেখানোর লোভে? তাও নয়। একটু বৈচিত্র্যের লোভ অবশ্যই। এর আড়ালে নিজের প্রত্যাশার চেহারাটাও চাপা পড়ার কথা।

আধা-আধি পথ ভাঙার পর বাপী সচকিত। আগে আগে পায়ে হেঁটে যে চলেছে, পিছন থেকে এক নজরেই তাকে চিনেছে। রেশমা। পরনে চকচকে ঘাগরা। পুষ্ট দুই বাহুতে রূপোর দুটো পেঁচানো গয়না। ফর্সা দুই পায়েও সেই রকম প্যাচানো রূপোর খাড়ুর মতো। এ-রকম গয়না গত সন্ধ্যায় অন্তত দেখে নি বাপী। দেখলে মনে থাকত। এখনও রোদ আছে সেই আলোয় ওগুলো চকচক করছে।

রেশমা সত্যি সুখের মুখ দেখেছে মনে হয়।…আবু বলেছিল, ও আর সাপ খেলা দেখায় না, সাপ বেচে। খপাখপ বিষাক্ত সাপের টুটি চেপে ধরে। জঙ্গলে সাপ কিলবিল করছে। ধরলেই টাকা। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে সেই টাকা মজুত। কোন জাতের কটা সাপ পেল আবু সেই হিসেব দাখিল করলেই হাতে নগদ টাকা। কিন্তু শুধু সাপ ধরে আর বেচে কত টাকা রোজগার হতে পারে আর অতটা সুখের মুখ দেখা যেতে পারে বাপীর সেটা ধারণার বাইরে। যে চালে চলেছে, যেন দুনিয়ার অনেকটা তার বশে এখন।

রেশমা কি করে সাপের টুটি মুচড়ে ধরে জানি না। কিন্তু বাপী নিজের প্রবৃত্তির টুটি চেপে ধরে আছে। রেশমা কতটা সুখে আছে বা কেমন করে আছে সে—খোঁজে তার কি কাজ? নিজের ওপর একটা আক্রোশের চাবুক হেনে অবাধ্য দুটো চোখ সামনের জঙ্গলের দিকে ফেরালো।

কিন্তু ওকে ফেরালে কি হবে। আর একটু এগোতে বনমায়ার গলার ঘণ্টির ঠুনঠুন শব্দ রেশমার কানে গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে। তারপর দাঁড়িয়েই গেছে। বাপী গম্ভীর। আবুর ডেরায় গত সন্ধ্যার মতো হাসিমস্করার সুযোগ আজ আর দেবে না। ওকে দেখে কাল অমন হাঁ হয়ে যাওয়াটা নিজের কাছেই বিরক্তিকর বিস্ময়।

—ও বাপীভাই, সত্যি অত মন দিয়ে জঙ্গল দেখছ, না এদিকে তাকাবে না বলে?

ডাকবে জানাই ছিল। সামনের দশ হাতের মধ্যে রেশমা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। দু’-হাত কোমরে। কোমরে দু’-হাত তুলে দাঁড়ানোটা অভ্যাসের দরুন, না চটক বাড়ে বলে, জানে না। বাপীর আর সে-ভাবে দেখার দরকার নেই, ভাবারও নেই। এগোতে হলে বনমায়াকেই পাশ কাটাতে হবে। মেয়েটার সরে দাঁড়ানোর দায় নেই যেন।

কি করবে না বুঝে লছমন বনমায়াকেই দাঁড় করাল। বাপী সাদামাটা হাসি-মুখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, এদিকে কোথায়?

—মেমদিদির ওখানে, ওই নেপালী মেমসায়েবের মেয়েকে আমি দিদি বলে ডাকি। ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।—আর হাঁটতে পারি না, আমাকে তুলে নেবে? তুমি তো এ রাস্তাতেই যাচ্ছ…

মুহূর্তের একটা অস্বস্তি সরোষে ঠেলে সরালো বাপী। এতেও লোভের হাতছানি। বলল, আমিও সেখানেই যাচ্ছি, তোমাদের মেমসায়েব ডেকেছেন। দরকারী কথা আছে। তার মধ্যে তোমাকে তুলে নিয়ে সেখানে হাজির হলে তিনি খুশি হবেন?

—ও…। কিছু যেন মনে পড়ল রেশমার।—তোমার তো তিনটে-চারটের মধ্যে যাওয়ার কথা ছিল শুনেছিলাম—এখন যাচ্ছ?

বাপী থমকালো একটু।—কোথায় শুনেছিলে?

সকালে ওই মেমদিদির কাছেই। দু’ চোখে কৌতূহল উপচে উঠল। কাল রাতে তুমি নাকি সব বলেটলে ওই মেমসায়েবকে ঘায়েল করে এসেছ—আর এই জন্যেই তোমার ডাক পড়েছে—সত্যি নাকি?

বাপী এবারে গম্ভীর একটু।—এও তোমার মেমদিদি বলেছে?

—হ্যাঁ, মেমদিদি কেবল আমার সঙ্গেই গল্প-সল্প করে, আর কারও সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। আত্মতুষ্টিতে উচ্ছল মুখ।—সকালে ওই মেমসায়েবই হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আর দুলারি তোমাকে চিনি কি না আর কতটা জানি। তক্ষুনি বলে দিলাম, আমরা খুব চিনি, খুব জানি—তুমি বেজায় ভালো মানুষ। কাল আবু সাহেব তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেই বুঝেছিলাম কিছু মতলব আছে, ভাবীও তাই বলছিল। তাই চোখ কান বুজে তোমার প্রশংসা করে দিলাম।

হাসির ফাঁকে সাদা দাঁত ঝিকমিক করে উঠল। দুলারি নিজের দাদার বউ ছিল, তাই বোধ হয় এখনও ভাবী বলে।

রেশমার কথা শেষ হয় নি—তা মেমসায়েব চলে যেতেই হেসে হেসে মেমদিদির ওই কথা—বাইরে ভালো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেয়ানা ছেলে, কাল রাতে এসে মা-কে পর্যন্ত কাবু করে ফেলেছে। মা আবার বিকেল তিনটে চারটের মধ্যে তোমাকে আসতে বলেছে।

মেয়ে এর বেশি কিছু বলে নি বোঝা গেল। নইলে নিজের কদর বোঝানোর জন্যেই রেশমা তাও বলে দিত। তার দু’চোখ উৎসুক।—তোমার কাজকর্মের ব্যাপারে কথা নিশ্চয়?

বাপী আর কথা বাড়াতে চায় না। মাথা নাড়ল। তাই।

রেশমা খুশি।—যাও যাও, ডেকেছে যখন ঠিক হয়ে যাবে। অত দেরি করলে কেন?…আমার এখন আর গিয়েই কাজ নেই তাহলে। তারপরেই দু’চোখ বড় বড়। তা মেমসায়েব ডেকেছে আর তুমি হাতিতে চেপে দেখা করতে চললে?

ওই খুশি আর এই বিস্ময়ের ফাঁকে মেয়েটার সরল দিকটার হদিস মিলল। এরই মধ্যে হাতের আর পায়ের রূপোর গয়নাও লক্ষ্য করছে বাপী। প্যাঁচানো একজোড়া করে সাপ মুখোমুখি। ওগুলোর জেল্লা আর রেশমার চোখের জেল্লায় খুব তফাৎ ছিল না এতক্ষণ।

বাপী সাদাসিধে জবাব দিল, হাতের কাছে পেয়ে গেলাম, হেঁটে লাভ কি। এবারে রাস্তার মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াল। হাতিতে চেপে মেমসায়েবের কাছে যাচ্ছে দেখেই হয়তো মুখে মজার ছোঁয়া।

বনমায়া আবার চলল। বাপী আর ওদিকে চোখ ফেরালো না। চোখ দুটো অবাধ্য হতে চাইছে বুঝতে পারছে। যে চাইছে তার গলা টিপে ধরলেও একেবারে শেষ হয় না কেন?

বাড়িটা আর পঞ্চাশ-ষাট গজের মধ্যে। সামনের বাঁক ঘুরলেই। বাপী লছমনকে দাঁড়িয়ে যেতে বলল। এর পরের হুকুম শুনে লছমনও অবাক। বাঙালীবাবু ওকে নামতে বলছে।

নামল।

গম্ভীর মুখে বাপী বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি ওই নেপালী মেমসায়েবের বাড়ি যাচ্ছি। সেখানে বনমায়াকে ছেড়ে দেব। এখান থেকে লক্ষ্য রেখো, ও নিজে থেকে ফিরে না এলে পাঁচ-সাত মিনিট বাদে তুমি এসে ওকে নিয়ে চলে যেও।

নেপালী মেমসায়েবকে এখানে আর কে না চেনে-জানে। কিন্তু বাঙালীবাবুর এ-রকম আদেশের কিছু মাথামুণ্ডু ভেবে পেল না লছমন। সঙের মত দাঁড়িয়ে রইল।

মেয়ে বারান্দার সামনের দিকেই মুখ করে দাঁড়িয়ে। দূরের জঙ্গল বা মেঘ বা পাহাড় কিছু দেখছিল। আজ আর পরনে শাড়ি নয়, পা পর্যন্ত ধূসর রঙের গাউন। এই বেশে আরও কচি দেখায়। পিছনের টেবিলে মা ফাইল-টাইল কিছু দেখছে।

বনমায়া এসে লতা-ছাওয়া বাঁশের বেড়ার ও-ধারে দাঁড়াতে ঊর্মিলা রাই হতবাক প্রথম। তারপরেই পিছন ফিরে অস্ফুট বিস্ময়ে মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করল বোঝা গেল। তারও দু’চোখ গোল একেবারে।

বাপী এটুকুই চেয়েছিল। ওই দু’জনকে অবাক হতে দেখে ওর মুখে সহজ সরল হাসি। হাতির পিঠে উঠে দাঁড়িয়েই দু’হাত কপালে তুলে গায়ত্রী রাইয়ের উদ্দেশে নমস্কার জানালো। তারপর শুঁড় বেয়ে তর তর করে নেমে এলো। শুঁড় ঠেলে তুলে চাপা গলায় পরিচিত ইশারা করতেই বনমায়া একেবারে কপালের ওপর উঁচিয়ে ওই মা-মেয়েকে দু’জনকেই লম্বা সেলাম জানালো।

মেয়ে অবাক যেমন খুশিও তেমনি। মা-টি অপলক চোখে দর্শনীয় কিছু দেখছে।

শব্দ করে আর শুঁড় ঘুরিয়ে বাপী বনমায়ার মুখটা এবারে ওই বাঁকের দিকে ফিরিয়ে দিল। বারান্দার দু’জনকে শুনিয়ে জোরে দুটো চাপড় মেরে বলল, যা— এবার ঘরে যা শিগগীর।

ওকে ছেড়ে লতা-ঢাকা বাঁশের গেট পেরিয়ে হাসিমুখে সোজা বারান্দায় এসে উঠল। মা-মেয়ে দু’জনে ওকেই দেখছে এখনও। মেয়ের চোখেমুখে তেমনি মজা-লাগা বিস্ময়। মা’টি অপলক গম্ভীর।

—ঘড়িতে ক’টা এখন? গায়ত্রী রাইয়ের গলার স্বর নীরস।

থতমত খাওয়াটা গোপন করার দরকার নেই আর। হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বাপী আরও একটু ঘাবড়ে গেল যেন।—পাঁচটা…আমার একটু দেরি হয়ে গেছে বোধ হয়।

—তোমাকে তিনটের থেকে চারটের মধ্যে আসতে বলা হয়েছিল। হাতি ছাড়া চলাফেরা করতে পার না?

—ইয়ে, আবু বলেছিল হয়তো…আমি ঠিক খেয়াল করি নি। মুখে সরল হাসি। পিছনে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই হাতির জন্যেই তো আরও দেরি—পাঁচ—ছ’ বছর বাদে দেখে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রাখল—কিছুতে ছাড়বে না। শেষে ওর পিঠে চেপেই চলে এলাম।

ঊর্মিলা এগিয়ে এসে মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। উৎসুক। জিজ্ঞেস করল, 3 জঙ্গল আপিসের হাতি বনমায়া নয়?

বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

ওখান থেকেই মেয়ে সকৌতুকে হাতিটাকে ভালো করে দেখে নিল একবার।—ও তো এক নম্বরের পাজী হাতি—প্রত্যেক বছর জঙ্গলের কোন্ একটা ইয়ের সঙ্গে পালায় শুনেছি। ফর্সা মুখ লাল একটু।—আপনার সঙ্গে ওর খুব খাতির বুঝি?

—হ্যাঁ, ও আমাকে খুব ভালবাসে। পাজী হাতি বলাটা বাপীর যেন একটু পছন্দ হল না। সেই ভীমবাহাদুরেরর মতো করে বলল, পালালেও বনমায়া খুব ভালো মেয়ে।

ঊর্মিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরনে শাড়ি নেই যে মুখ চাপা দেবে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা। অত হাসির কারণ বোঝার চেষ্টায় বাপীর মুখে বোকা-বোকা হাসি। কিন্তু দৃষ্টি বেশির ভাগ গায়ত্রী রাইয়ের মুখের ওপর। মা-ও যেন মেয়ের অত হাসি দেখে অখুশি নয়। হয়তো ও-রকম হাসতে কমই দেখে। কিন্তু তার নিজের মুখের গাম্ভীর্য একটু শুধু হালকা হল, তার বেশি কিছু নয়।

হাসি শেষ হলেও তার রেশ একটু লেগেই থাকে। ঊর্মিলা উৎফুল্ল মুখে বলল, আমার একদিন আপনার ভালো মেয়ের পিঠে চড়ার ইচ্ছে—ব্যবস্থা করতে পারেন?

বাপী অম্লান বদনে মাথা নাড়ল, পারে।—আবুকে বললেই তো হয়, যেদিন খুশি আপনারা দু’জনে জঙ্গলে বেড়িয়ে আসুন, হাতির পিঠে জঙ্গলে বেড়াতেই বেশি ভালো লাগে।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দু’চোখ কপালে।—মায়ের সঙ্গে হাতিতে! ভাবলেও হেসে সারা হবার মতো কিছু যেন। এবারের হাসি সামলানোর তাগিদে তাড়াতাড়ি ঘরেই ঢুকে গেল।

বাপী আবারও বোকার মতো সেদিকেই চেয়ে রইল। গায়ত্রী রাই চুপচাপ ওকেই লক্ষ্য করছে জানে।…এই মুখে নিছক সরলতা ছাড়া আর কিছু পাবে না, তাও জানে। এবারে তার দিকে চেয়ে বাপী আন্তরিক প্রশংসার সুরে বলল, আপনার মেয়েও অবিকল বাঙালীর মতোই ঝরঝরে বাংলা বলেন।

—আমার মেয়ে নিজের ভাষার থেকেও ভালো বাংলা বলে। বাচ্চা বয়েস থেকে এ-দিকে থেকে বড় হয়েছে, শুরু থেকে স্কুল কলেজে বাংলা পড়ে এসেছে, বলবে না কেন?…তা হাতির পর তুমি ভাষা নিয়ে আলোচনা করবে না কাজের কথা কিছু হবে?

—ইয়ে, না বলুন।

—চাকরি করবে?

আজ কোনো বাঁকা রাস্তায় না গিয়ে সোজা জবাব দিল, আপনি দিলে খুশি হয়ে করব।

গায়ত্রী রাই কিছু বলার আগে ভিতর থেকে মেয়ে আবার এসে হাজির। সামনের দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল, আপনার ভালো মেয়ে সত্যি নিজেই ঘরে চলে গেল নাকি?

বাপীর জবাব দেবার ইচ্ছে ছিল বুনো হাতির সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে দূরের জঙ্গল থেকে ভালো মেয়ে তার খুশিমতো নিজেই আবার ঘরে ফেরে। কিন্তু আর হালকা কথার ধার দিয়েও গেল না। ঘুরে পেছনটা দেখে নিল একবার। বনমায়াকে আর দেখা যাচ্ছে না বটে। তবু কি ভেবে আধা-সত্যি কথাই বলল।—ওর মাহুত লছমনকে আসতে বলেছিলাম, হয়তো নিয়ে গেছে…নিজেও যেতে পারে।

মেয়ে মায়ের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। সেদিকে চেয়েও গায়ত্রী রাই বলল, আমরা দরকারী কথা বলছিলাম—

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরও ভ্রুকুটি! —বিজনেস না পারসোনাল?

—বিজনেস।

এরপর তাহলে আমাকে তোমার বিজনেসে মন দেওয়ার কথা আর বোলো না। চেয়ার ঠেলে উঠতে গেল।

—সীট ডাউন! মায়ের কড়া ধমক।—আমি যেতে বলিনি, বাজে কথা বলতে বারণ করছি।

মেয়ে আবার ঝপ করে বসে পড়ল। কনুই দুটো টেবিলের ওপর, হাত দুটো দুই ফোলা গালে।..অল রাইট, গো অ্যাহেড।

মায়ের ওপর মেয়ে বিরূপ কত, এটুকু থেকে কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল। মেয়ের দিকে চেয়ে গায়ত্রী রাই বলল, ও কাজ করবে বলছে আমিও নেব ভাবছি…

ঊর্মিলা সেই রকম বসে, দুজনের মাঝখান দিয়ে সোজা সামনের দিকে চোখ। ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, নেবে যে সে তো কাল রাতেই ঠিক করে ফেলেছ, তার আর কি কথা, নিয়ে নাও।

মায়ের রুষ্ট ঝাপটা। ডলি ডোন্ট বি সো ইমপসিবল।

…মেয়ের ডাকনাম ডলি বোঝা গেল। চেহারার সঙ্গে এ নাম মন্দ মানায় না। ফুটফুটে রং, লালচে ঠোঁট, ফোলা গাল, কাঁধছোঁয়া বব-কাট চুল। কিন্তু বাইরেটা দেখে ভিতরে ডল-এর ভাগে যে এত ঘাটতি ঠাওর করা শক্ত। হাসলে বিপদ। বাপীর গোবেচারা মুখ

তা সত্ত্বেও গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখের উষ্ণ আঁচ একটু ওর ওপরেও এসে পড়ল। —নিয়ে নেবার ব্যাপারে তুমিই গোল পাকিয়ে রেখেছ। আজ সকালে চালিহার সঙ্গে কথা হল। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্য একজন লোককে ট্রেনিং দিয়ে ঠিক করে নেওয়া দরকার বুঝিয়ে তাকে তোমার কথা বলেছি। কিন্তু চালিহা অন্য লোক দেবার কথা বলছে, তোমার কালকের ব্যবহারে সে একটুও খুশি নয়!

ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়ন শুনেই বাপীর বুকের তলায় নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। যতটুকু বুঝেছে এদের কাজের বিস্তার বেশির ভাগ উত্তর বাংলায় আর তার বাইরে। এখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল বলতে খুব সম্ভব কলকাতার বাজারই আসল। কিন্তু আবার সেই কলকাতা! চিন্তাটা বাপী ছেঁটে দিল। চালিহাকে শুধু বোঝানো হয়েছিল কি-জন্যে লোক দরকার। আসলে কি-জন্যে দরকার তা এক চালিহা বাদে বাকি সকলেই জানে।

কিছু বুঝে নেবার মতো করে বাপী জিজ্ঞাসা করল, এ-কাজের জন্য আপনি যে আমাকে পছন্দ করেছেন সেটা কি মিস্টার চালিহা মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছেন?

—হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি, বাড়ির টানে ওইরকম টানা-হেঁচড়া করেছে আর যা বলার বলেছে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু চাকরির কথা উঠতে অনেক নরম হয়ে গেছে। এ-লাইনে ইন্টারভিউ করে মনে হয়েছে আমরা ভালো কাজ পাব, এ কথাও তাকে জানিয়েছি। তবু চালিহা খুব একটা সায় দেয় নি, আর একটু ভেবে দেখতে আর যাচাই করে নিতে পরামর্শ দিয়েছে। আর এক দফা ইন্টারভিউর জন্য আজ আবার তুমি আসছ তাও সে জেনে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে বাপী বলল, আপনি তাহলে এখন চান আমাকে নেবার ব্যাপারে তিনিও খুশি হয়ে সায় দিন?

গায়ত্রী রাই অল্প মাথা নাড়লেন।—সে আমার বিজনেসের চিহ্ন। শুরু থেকে তোমার এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট আপত্তির চোখে দেখলে অসুবিধে, সায় থাকলে ভালো হত—

বাপীর এবারের জবাব নির্লিপ্ত, কিন্তু দ্বিধাশূন্য।—তাই হবে!

গায়ত্রী রাই ঠিক বুঝে উঠল না।—কি তাই হবে?

—আমাকে নেবার জন্য দুই এক দিনের মধ্যে তিনিই আপনার কাছে সুপারিশ করবেন।

এবারে মেয়েরও টেবিল ছেড়ে সোজা হয়ে বসে এই লোককে আর একটু ভালো করে দেখার দরকার হল। গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি স্থির, কিন্তু মুখে বিস্ময়ের আঁচড়।—কি করে?

একই সঙ্গে মেয়েও ফস করে জিজ্ঞাসা করল, আঙ্কল চালিহাকে ঘুষ দেবেন? তার দিকে চেয়ে বাপী হাসল একটু।—ঘুষ অনেক রকমের হয়। আপনি যে ঘুষের কথা বলছেন তার টাকা আমার পকেটে থাকে না। মায়ের দিকে ফিরল।— কি করে, আমি এখনো সেটা জানি না, তবে আপনার সায় আছে এটা যখন তিনি বুঝে গেছেন, তাঁরও সায় পাবার ব্যবস্থা আমি করতে পারব—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

এই জোর কোথা থেকে পেল বাপী জানে না। কিন্তু পেল যে তাতে নিজেরও এতটুকু সংশয় নেই। ওর মুখের দিকে চেয়ে মা-মেয়েও এই জোরেরই হদিস খুঁজছে।

বাপীর ভিতরে ভিতরে হঠাৎ আবার শুরু থেকে সেই উঁচু পাটাতনে দু’ পা রেখে দাঁড়ানোর তাগিদ। কর্ত্রী-কর্মচারী সম্পর্কটাকেই গোড়ায় নাকচ করার ঝোঁক। মুখখানা একটু কাঁচুমাচু করে তার দিকে তাকালো।—এবারে আমি একটা কথা বলেই ফেলি?

তক্ষুনি মহিলার মালিকের মুখ, মালিকের চাউনি।—টাকা পয়সার কথা?

বাপী অপ্রস্তুত।—সে কি। আপনার ওপর ছেড়ে দিয়েছি যখন ও তো আপনার ভাবনা। হাসল।—আমার চাওয়াটা তার থেকে অনেক কম। বিকেলে চায়ের অভ্যেস, এখন পর্যন্ত এক পেয়ালাও জোটে নি। ভাবছিলাম, বলাটা ধৃষ্টতা হবে কিনা—

মেয়ে ছেলেমানুষ, সে হেসেই ফেলল। তার গুরুগম্ভীর মা-টিকে এমন উল্টো-পাল্টা পরিস্থিতির মধ্যে আর কখনো পড়তে দেখে নি। উঠতে যাচ্ছিল, ওই মা-ই ইশারায় নিষেধ করল। আর এক দফা সামনের ছেলের মুখখানা দেখে নিয়ে ভিতরের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জোরেই ডাকল, কোয়েলা!

পাঁচ সেকেণ্ডের মধ্যে যে রমণীটি সামনে এসে দাঁড়ালো তাকে দেখে বাপীর দু’চোখ বড় রকমের হোঁচট খেল একপ্রস্থ। কোয়েলা মানে যদি স্ত্রী-কোকিল হয় তাহলে মেয়ে-জাতের দিক থেকে আর গায়ের রঙের দিক থেকে মেলে অবশ্য। কিন্তু গায়ে-গতরে এমন জাঁদরেল মেয়েমানুষ কমই চোখে পড়ে। বাপীর মনে হল তাকেও আলতো করে তুলে ধরে বারান্দার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। পরনে খাটো গাউন। কোমর বেড়িয়ে একটা মোটা এপ্রন গোঁজা। বইয়ের পাতার গাবদা আদিবাসিনীর মূর্তি। প্রমীলা-পরিবারের প্রহরী হবার মতোই।

নাম কোয়েলা!

—তিন পেয়ালা চা। কুইক

নতুন মানুষের মুখের ওপর একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে হেলে-দুলে কোয়েলা আবার ভিতরে ঢুকে গেল। যাবার আগে সুইচটা টিপে দিয়ে গেল। দিনের আলোয় টান ধরেছে। বাপী সোজা না তাকিয়েও লক্ষ্য করছে, তিন পেয়ালা শুনেই মেয়ে যেন মায়ের মুখে না হোক চোখে একটু প্রশ্রয়ের বিরল আভাস দেখতে পাচ্ছে।

সেটুকুও গোপন করার জন্যেই হয়তো গায়ত্রী রাই ভুরু কুঁচকে তাকালো।—শুধু চা, না এরপর বলবে খিদে পেয়েছে?

লজ্জা পেয়ে বাপী হাসল।—না তা বলব না, দুপুরে ডাটাবাবু ভালো খাইয়েছে।

গায়ত্রী রাই তক্ষুনি কাজের কথায় চলে এলো—তোমার থাকার ব্যবস্থা কি হবে?

বাপী সবিনয়ে জবাব দিল, আমার সব ভার আপনি নিচ্ছেন, এটুকুও নিন…ওখানে এক রাত থেকেই আমার হাঁপ ধরে গেছে।

—কেন? ওখানকার অ্যারেঞ্জমেন্ট তো খুব ভালো শুনেছি, আর তোমার বিল তো আমিই পেমেন্ট করব বলে দিয়েছি?

—তা বলেছেন কিন্তু অত ভালো বলেই আমাদের মতো লোকের কাছে অস্বস্তি। বুদ্ধি করে আরো একটু যোগ করল।..রাতে জানলা খোলা থাকলে লিকারের গন্ধ ঘরে আসে—

এই জবাবে অখুশি নয় মনে হল বাপীর।

কোয়েলা ট্রে-তে তৈরি চায়ের পট আর পেয়ালা রেখে গেল। ঊর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে পেয়ালায় চা ঢালল। যে যার পেয়ালা টেনে নেবার পর গায়ত্রী রাই বলল, কিন্তু এখানে আবার একটা পার্টিশন দিয়ে ঘর তুলতে গেলে বিচ্ছিরি হবে—

নিজের পেয়ালাটা হাতে করে বাপী উঠে দাঁড়াল। তারপর বারান্দার এদিকে এসে পাশের খালি জমিটুকু দেখে নিল। মায়ের সামনে এই সহজতাটুকু মেয়েটার লক্ষণীয় বস্তু। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে বাপী বলল, মাঝখানে কাঠ বা ইঁটের পার্টিশন দিতে গেলে বিচ্ছিরিই হবে, মালীকে দিয়ে মেহেদীর উঁচু ঝাড় সমান করে ছেঁটে নিয়ে বসালে খারাপ দেখতে হবে না। পার্টিশনের কাজ হবে আবার দু’দিকে ফুলটুল ফুটলে দেখতেও ভালো হবে। সামনে একটা ঘর, পিছনে একটু কিচেন আর বাথ, সামান্য জায়গাই নেবে। মেহেদীর পার্টিশান করলেও দু’দিকে কিছু জায়গা ছাড় থাকবে।

এরকম পার্টিশনের কথা গায়ত্রী রাই ভাবেন নি। এ ছেলের মাথা কত দিকে খেলে তাই দেখছেন। একটু চুপ করে থেকে বলে, সে যা হয় দেখা যাবে, চালিহার সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি। ঘর তুলে দিলেও তো আর দু’দিন চারদিনে হচ্ছে না, আপাতত তোমাকে ওই ক্লাবেই থাকতে হচ্ছে।

—থাকব।

—বাট্-সাপোজ, ঘর তুলে দিয়ে ওদিকটা তোমাকে ছেড়ে দিলাম, আর এদিকটা যেমন আছে তেমনি আমি কিনে নিলাম…তাহলে আপত্তি হবে?

এবারে লুব্ধ হবার মতোই প্রস্তাব বটে। কিন্তু বাপীর হঠাৎ কেমন মনে হল এটা লোভের টোপ হতে পারে। আবু মহিলার কাছে ওকে নির্লোভের সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে। সেটা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে এই উদার প্রস্তাব কিনা বলা যায় না। তাছাড়া, ভাগ্যের ছকে বড় দান যদি কিছু পড়ে থাকে তো এই পৈতৃক ভিটের দৌলতেই পড়েছে। মন বলছে লোভে পড়লে ভুল হবে।

বাপীর মুখে বিড়ম্বনার হাসি। খুব নরম করে জবাব দিল, বিক্রী করার দরকার হলে আপনাকেই আমি সবার আগে বলব।…আমার বাবা অনেক কষ্টে এখানে মাথা গোঁজার একটু ঠাই করেছিলেন, এই বাড়িতে আমি জন্মেছি…বেচে দেব ভাবতে খারাপ লাগে। আপনি আপনার নিজের বাড়ি মনে করেই এখানে থাকুন না।

মেয়ে এবারে একটু শব্দ করেই বেতের চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ফার্স্ট ডিভিশন—!

মেয়ের হঠাৎ এই আচরণ বা মন্তব্যের জন্য প্রস্তুত ছিল না মহিলা। জিজ্ঞেস করল, কি…?

বলছি একেবারে ফার্স্ট ডিভিশন। ইউ নিডন্ট গো ফারদার, এবারে ছেড়ে দাও, হাঁপ ফেলে বাঁচুক। হাসি চাপার চেষ্টা

—আঃ ডলি! ডোন্ট বি সিলি! কিন্তু মুখখানা যতটা কড়া করে তোলার চেষ্টা ততোটা পারা গেল না যেন। আর অনুশাসনও বাপীর কানে তেমন জোরালো ঠেকল না।

.

সামনে জঙ্গল, তাই বানারজুলির এদিকটায় সন্ধে হতে না হতে ঘন অন্ধকার। ফেব্রুয়ারি মাস, ছ’টা বাজতে না বাজতে সন্ধ্যা। বাইরে পা দিয়ে বাপী তরফদার অন্ধকারের মধ্যে পড়ল, আর শীতের ঝাপটা খেল। কলকাতার তুলনায় এখনো বেশি ঠাণ্ডা এখানে।

পরনে কাল রাতেও শুধু পাজামা পাঞ্জাবি ছিল। কিন্তু কাল রাতে এতটা টের পায়নি, অথবা আবুর কড়া মেজাজের মুখে পড়ার ফলে খেয়াল করে নি। বাপীর হাসি পেল হঠাৎ। আরামের শরীরে শীত-গরম কিছুই সয় না। বাপী কি তাহলে আরামের মুখ দেখতে চলল? আসলে দিনের রোদে বেরুনোর সময় গরম জামা সঙ্গে নেবার কথা মনে থাকে না। থাকবে কি করে, মাথার তো আর বিশ্রাম নেই। জোরে পা চালিয়ে যে শরীর গরম করবে তারও উপায় নেই। অন্ধকারে ঠোক্কর খাবার ভয়। টর্চ আনতেও ভুলেছে। বাক্স থেকে টর্চটা বারই করা হয় নি। ব্যাটারি আছে না ফুরিয়েছে তাও জানে না।

বাঁক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সোজা মুখের ওপর এক ঝলক জোরালো আলো। চোখ ধাঁধিয়ে উঠল। অন্যমনস্কতার দরুন চমকেও উঠল। দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু বড় টর্চের ঝাঁঝালো আলো চোখের ওপর থেকে নড়ছে না, কাছ থেকে আরো কাছে এগিয়ে আসছে।

—আঃ! টর্চটা সরাও, চোখ দুটো গেল যে! সামনে একটা হাত আড়াল করে বাপী দেখে নিয়েছে।

আবু দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে আজ একটা মস্ত টর্চ, অন্য হাতে লাঠি। পরনে খাকী ট্রাউজার, গায়ে পুরো হাতার গলাবন্ধ মোটা গেঞ্জি। বলা সত্ত্বেও মুখের ওপর থেকে টর্চটা সরল না। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। একটু বেশি গম্ভীর।

—কি মুশকিল! ওর রকম-সকম দেখে বাপী হেসে ফেলল।—শিকারের টর্চ ফেলে আমার চোখ দুটো কানা করে লাভ কি!

আবু টর্চ নামালো। কিন্তু এমন করে ধরল যাতে মুখ আর পথ দুইই দেখা যায়। সঙ্গ নিয়ে বলল, মেমসায়েব তোমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেয় নি তাহলে?

বাপী হাসছে।—তুমি সেই রকম আশা করেছিলে?

আবু চুপ একটু। তারপর আবার প্রশ্ন।—আমি পই পই করে তোমাকে সাড়ে তিনটের মধ্যে চলে যেতে বলেছিলাম—সে জায়গায় তুমি পাঁচটায় গিয়ে হাজির হয়েছিলে?

—দেরিই হয়ে গেল। তোমাকে কে বলল?

কোনো জবাব দেবার মেজাজ নয় এখন আবু রব্বানীর। আবার প্রশ্ন।—আর, তুমি হাতির পিঠে চেপে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?

বাপী একটু জোরেই হাসল এবার। বলল, দেখে দু’জনেরই তাক লেগে গেছল, লছমনটাকে তো ওই বাঁকের খানিক আগেই নামিয়ে দিয়েছিলাম। বনমায়াকে দেখে তোমাদের বাচ্চা মেমসায়েবের ওর পিঠে চাপার ইচ্ছে একদিন। আমি বললাম, আবুই মুরুব্বি, তাকে বললেই হবে।

আবুর হাতে টর্চ আবারও মুখের ওপর উঠে এসে তারপর নামল। অর্থাৎ ভালো করে আর এক দফা দেখা দরকার হয়েছে। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল।——নাঃ, মেমসায়েবকে যা-ই বলে আসি না কেন, তোমার চরিত্তির বোঝা এই মোল্লারও কাজ নয় আর।

বাপী হেসেই জিগ্যেস করল, দেরিতে আসা আর হাতিতে চেপে আসার খবর তোমাকে কে দিলে—রেশমা?

—জানো তো সবই, আর জিগ্যেস করো কেন?

—বাঃ, তোমার রাগের কি হল?

—পাঁচটায় গিয়ে হাজির হলে, মেমসায়েব কিছু বলল না?

—রাগ করল।

—আর তুমি?

—শুনলাম। দেখলাম। তুমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে?

—কম করে এক ঘণ্টা। আসার মাঝে মাঝরাস্তায় রেশমার সঙ্গে দেখা। তুমি তার মাত্র মিনিট দশেক আগে হাতি চেপে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে গেছ শুনেই আমার মাথা খারাপ হবার দাখিল। কি হল না হল, দয়া করে বলবে এখন।

বাপী তাকে আশ্বস্ত করল, সব ঠিক আছে কিছু ভেবো না।

কি-রকম ঠিক আছে খুঁটিয়ে শুনল। এ ব্যাপারে যেমন ধৈর্য তেমনি মনোযোগ। মেমসায়েবের আচরণ আবুর কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার মেয়ের কাণ্ড শোনার ফাঁকে ফাঁকে হেসে উঠেছে। আর বাপীকে সাবধান করেছে, খবরদার খবরদার! তুমি পছন্দ করলেও মরেছ, মেয়ে পছন্দ করলেও মরেছ!

এত কথার ফাঁকে ক্লাবের কাছাকাছি এসে গেছে। বাপী থামতে আবারও দুশ্চিন্তা।—সবই তো ভালো, কিন্তু ওই ম্যানেজার তোমার জন্য সুপারিশ করবে বলে এলে তার কি হবে?

—করবে। ক্লাবে রোজই আসে তো।

—এখানে থাকলে আসে। টর্চের আলোয় আবু হাতঘড়ি দেখে নিল।—তার আসতে আটটা সাড়ে আটটা, এখনো ঢের দেরি। এখন আবার মদের গেলাস নিয়ে জুয়ায় বসে গেলে নড়ানো যাবে না। ডাকাডাকি করলে উল্টে বিরক্ত হবে। তার থেকে তার বাড়িতে যাও না, কাছেই—

কথাটা ভাবার মতো। মদ খেলে মতিগতি কেমন হয় বাপীর সেটা খুব ভালো জানা নেই। ঘোর-লাগা অবস্থায় রতন বনিককে দেখেছে। তবে সে লোকটা নির্বিষ ভালো মানুষ। কিন্তু মেজাজী বা প্যাঁচালো মানুষের কথা বলা যায় না। আবুর বাবা কালুকেই হাঁড়িয়া গিলে ছেলের ওপর হম্বিতম্বি করতে দেখেছে।

—তাই চলো।

ক্লাবের পাশ দিয়ে রাস্তা। এই এলাকায় দু’ঘরের একটা কনট্রাকটার কোয়াটার্স ভাড়া নিয়ে থাকে। বাপী বলল, কারো সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে যদি ক্লাবে এসে গিয়ে থাকে—দেখেই যাই।

দেখতে এসে আর এক মুশকিল। বারান্দায় পা দিতেই ব্যস্তসমস্ত ডাটাবাবু এগিয়ে এলো। মাথা চুলকে যে সমাচার জানালো শুনে আবুর মেজাজ খাপ্পা। চা-বাগানের এক ছোকরা অফিসারের বন্ধু হঠাৎ সস্ত্রীক ডুয়ার্স থেকে এসে গেছে। অফিসার তাদের আপাতত বাপীর পাশের ঘরে তুলেছে, আর ডাটাবাবুকে অনুরোধ করেছে, পরিবার নিয়ে থাকবে, ওই কোণের ঘরটা তাদের ছেড়ে দিলে ভালো হয়।

আবু খেঁকিয়ে উঠল, ও-ঘরে গেস্ট আছে শুনেও ছাড়তে বলে কি করে? আপনি বললেন না?

—বলেছি। মেয়েছেলে নিয়ে থাকা, তাই অনুরোধ করেছেন। রাজি না হলে বলে দেব। হুট করে মেয়েছেলে নিয়ে কেউ হাজির হবে আমিই কি ভেবেছি, সচরাচর তো এ-রকম হয় না।

বাপী বুঝল, চা-বাগানের অফিসারের গেস্ট বলেই ডাটাবাবু একটু বিপাকে পড়েছে। তাদেরই দাবী আগে। আবুকে থামিয়ে বাপী তাকে নিশ্চিত করল।— ঠিক আছে, আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছি, আপনি কাউকে দিয়ে আমার বাক্স আর বিছানা এ-ঘরে এনে দিয়ে তাদের কোণের ঘরেই যেতে বলুন।

ডাটাবাবু কৃতজ্ঞ।

চালিহা ক্লাবে আসে নি। আবুকে সঙ্গে করে বাপী কোণের ঘর খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে টেবিল থেকে কলমটা তুলে নিয়ে একটুকরো কাগজে গোটা গোটা করে লিখল, বাপী তরফদার—ফ্রম মিসেস গায়ত্রী রাই।

আবু জিজ্ঞেস করল, এ দিয়ে কি হবে?

—আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব, আগে তুমি গিয়ে এটা চালিহার হাতে দেবে। বেরিয়ে আসতেই পাশের ঘরের অতিথিটির মুখোমুখি। নিজের ঘরে ঢোকার সময় দরজা বন্ধ দেখেছিল, এখন খোলা। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাঙালী বিহারী-টিহারী হবে। মোটা কালো মুখশ্রী দেখলে দ্বিতীয় বার তাকাতে ইচ্ছে করবে না। ড্যাবডেবে চোখে লোকটা ওদের দিকেই চেয়ে আছে। তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে এসে আবু অস্ফুট কটূক্তি করে উঠল, এই চেহারা নিয়ে বউয়ের সঙ্গে রস করার জন্যে শালার কোণের ঘর চাই!

বাপীও হালকা মন্তব্য করল, বউ নিশ্চয় সুন্দরী, তাই যেটুকু সম্ভব চোখের আড়ালে রাখতে চায়।

রসের ঠাট্টায় আবুও কম যায় না। তক্ষুনি বলল, মরদের যা ছিরি, তুমি সাবধান তাহলে। তোমার সঙ্গে মেয়েছেলের একটু বেশি যোগ দেখছি। একদিকে মেমসায়েব আর তার মেয়ে ঘায়েল, এদিকে ক্লাবে পরিবার সঙ্গে করে অতিথি আসে না বড়, তুমি এলে আর ওমনি একজন এসে হাজির!

ডাটাবাবুকে চাবি দেবার জন্য বাপী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। আবুর ঠাট্টা বুকের কোথাও বেঁধার মতোই। আবুর জানার বাইরেও আরো চার-চারটে মুখ আছে। গৌরী বউদি, ব্রুকলিন বড়বাবুর মেয়ে ঊষা, কমলা বনিক….মিষ্টি। মিষ্টি…? হ্যাঁ মিষ্টির সম্পর্কেও আরো কিছু ভাবার আছে, কিন্তু ভাবনাটাকে এ পর্যন্ত সে জোর করে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে।

রাস্তায় নেমে আবু জিজ্ঞাসা করল, তোমার এখন মতলবখানা কি? ম্যানেজারের হাতে-পায়ে ধরবে?

—সেই গোছেরই কিছু করতে হবে। দেখবেই তো।

এখানেও বাইরের ঢাকা বারান্দায় বসার জায়গা। জোরালো আলো জ্বলছে। সেখানে মাঝবয়সী একজন দাঁড়িয়ে। আবু চেনে তাকে। ম্যানেজার সায়েবের কম্বাইনড হ্যান্ড। অসমীয়া। নাম অর্জুন। বারান্দার পর ভিতরে একটু প্যাসেজের মতো। প্যাসেজের দু’দিকে দুটো মুখোমুখি ঘর। বারান্দায় ওঠার পর বাপী লক্ষ্য করল, একটা ঘর থেকে প্যাসেজে সবুজ আলো এসে পড়েছে। বারান্দায় চড়া আলো, তাই লক্ষ্য না করলে চোখে পড়ে না।

আবুর ইশারায় বাপী নামের স্লিপ লোকটার হাতে দিল। কিন্তু ওটা হাতে নিয়েও তার নড়াচড়ার ইচ্ছে দেখা গেল না।

আবু জিজ্ঞেস করল, সায়েব নেই বাড়িতে?

—আছেন। পার্টির লোকের সঙ্গে কথা কইছেন। ব্যস্ত আছেন—

এবারে হুকুমের সুরে আবু বলল, এই সায়েব মালকানের কাছ থেকে আসছেন, এটা তাঁকে দিয়ে এসো।

লোকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই গেল। মিনিট খানেকের মধ্যেই রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে এলো। পরনে চকচকে লুঙ্গি আর হালকা-নীল গরম কাপড়ের ফুল হাতা শার্ট। ফর্সা মুখ বেশ লাল। আসামাত্র বাপীর মনে হল ঘরে বসেই মদ্যপান চলছিল। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁ করে গন্ধও নাকে এলো।

বাপীর বিনীত নমস্কারের জবাবে রণজিৎ চালিহা একটু চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

বাপী শুকনো গলায় জবাব দিল, মিসেস রাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন, তাই অসময়ে….

—আমার সঙ্গে দেখা করতে বললেন? কখন?

—আজই তো মনে হল, এতক্ষণ তাঁর ওখানে ছিলাম, সেখান থেকেই আসছি।

ভুরু কুঁচকে চালিহা একবার আবুকে দেখে নিল। তারপর নিজে একটা চেয়ার টেনে বসে বাপীকে বলল, সীট্ ডাউন—কি ব্যাপার?

হুকুম পেয়েও বাপী বসল না। মুখ দেখে মনে হবে, বেয়াদপীর সাহস আজ আর নেই।—বলছি…কিন্তু তার আগে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, বাড়ির চিন্তায় কি বলে ফেলেছি না ফেলেছি, ঠিক নেই, আমার অন্যায় হয়েছে—

লোকটার নেশা হয়তো এখনো তেমন জমেনি। বাঁকা চোখে খানিক চেয়ে চেয়ে দেখল ওকে। জিজ্ঞেস করল, এখন আর বাড়ির চিন্তা নেই?

—আজ্ঞে না, মিসেস রাইকে কথা দিয়ে এসেছি, আপনি যা ঠিক করে দেবেন, তাই হবে।

—আমি?

—হ্যাঁ।

ঠোটের ফাঁকে হাসির রেখা স্পষ্ট হল এবার। কলে-পড়া ইঁদুরের মুখ দেখছে যেন।—ওয়েল, আই অ্যাম বিজ্‌ই নাও, শুট!

একই রকম নিরুচ্ছ্বাস বিনয়ে বাপী বলল, একটা কাজের জন্য মিসেস রাই গতকাল আর আজ দু’দিন আমার ইনটারভিউ নিলেন, আপনারা আমার জন্য এতটা চিন্তা করবেন ভাবতেই পারি নি। মিসেস রাই আজ জানালেন, তাঁর কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এ-ব্যাপারে ফাইন্যাল ডিসিশন আপনার, আপনার অ্যাপ্রুভাল ছাড়া তিনি কিছু করেন না।

ঠোঁটের হাসি আরো প্রসারিত এখন।—তিনি এ-কথা তোমাকে বললেন, আর আমার সঙ্গে দেখা করতে বললেন?

এবারে সোজা তুমি। কাল হলে কি হত বলা যায় না, আজ বাপী একটু অনুগ্রহ হিসেবে গ্রহণ করল।—আজ্ঞে হ্যাঁ।

চালিহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।—এখানে ওবিডিয়েন্স ইজ ফার্স্ট কনডিশন—এটা এরপর মনে থাকবে তাহলে?

বাপী মাথা নাড়ল। থাকবে।

—অল রাইট, কাল মিসেস রাইয়ের সঙ্গে কথা বলব।

আর আবুর সেলাম বা বাপীর নমস্কারের জন্য অপেক্ষা না করে ভিতরে ঢুকে গেল। ওরা দু’জন বারান্দা থেকে নেমে আবার অন্ধকারে।

আবু বলল, বয়েসে যত ছোটই হও, একটা গড় করে ফেলব?

বাপী হাসছে।

—কিন্তু তুমি অত নিশ্চিন্ত ছিলে কি করে? ওই দাপটের লোকের সঙ্গে কাল তুমি যে-রকম ব্যবহার করেছ, মওকা পেয়ে আজ যদি তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করত?

বাপী ধীরেসুস্থে জবাব দিল, তা যে করতে পারে না একটু মাথা খাটালে তুমি নিজেও নিশ্চিন্ত থাকতে। চালিহা জানে তোমার মেমসায়েব আমার বাড়ির ভাড়াটে, জানে চাকরির ব্যাপারে তার সঙ্গে পর পর দু’দিন আমার কথা হল, আর অত টাকা খরচ করে আমাকে ক্লাব-হাউসে রাখা হয়েছে তাও জানে—এর পরেও সে কি এত বোকা যে গোঁয়ারতুমি করে আমাকে একেবারে ছেঁটে দেবে? বরং তোমাদের মেমসায়েব তাকে অত মর্যাদা দিল শুনে কত খুশি দেখলে না?

আবুর হাতের টর্চ বাপীর মুখের ওপর উঠে এলো।

—কি হল?

টর্চ নামিয়ে আবু হালছাড়া গলায় জবাব দিল, আর একবার তোমাকে দেখে নিলাম।

বাপী বলল, কিন্তু চালিহা ভিতরের ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে পার্টির সঙ্গে কথা কইছিল, এ আবার কেমন পার্টি?

আবুরও তক্ষুনি টনক নড়ল।—ইস্! জানতে পারলে খুব ভালো হত। ব্যাটা ক্লাবে না গিয়ে বাইরের মানুষকে অন্দরে ঢুকিয়ে মদ গিলছিল যখন, কোনো শাঁসালো মক্কেলই হবে—কত দিকে যে ফাঁক করলে মেমসায়েবকে ঠিক নেই।

অন্ধকারে বাপী মুখ টিপে হাসছে। রসের ইঙ্গিতটা আবু ধরতে পারে নি। লুঙ্গি পরে আর ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে যার সঙ্গে মদ খাচ্ছিল সেই মক্কেল কোনো মেয়েমানুষ হতে পারে কিনা সেটাই তার জিজ্ঞাস্য ছিল।

ক্লাবে কে এলো বা ক্লাব থেকে কে বেরুলো ডাটাবাবু নিজের জায়গায় বসেই দেখতে পায়। বাপীকে দেখে নিজেই নতুন ঘরের চাবি হাতে দিয়ে গেল। লম্বা বারান্দা ধরে এগোতে গিয়ে কোণের ঘরের দিকে চোখ গেল। খোলা দরজার সামনে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে একজন বেয়ারার সঙ্গে কথা কইছে ডুয়ার্সের অতিথির বউ। মুখের আধখানা দেখা যাচ্ছে। পরনে রং-চঙা সিল্কের শাড়ি, যে-হাতটা দরজার দিকে, সেই হাতে অনেকগুলো কালো চুড়ি, মাথায় কপাল-ছোঁয়া ঘোমটা, নাকে একটা ঝকঝকে পাথরের ফুল। বয়েস বেশি নয়, বেশ দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রঙ দস্তুরমতো ফর্সা, দোহারা চেহারা। মুখের সবটা দেখা না গেলেও বউটা যে বেশ সুশ্রী সন্দেহ নেই।

আবুর সঙ্গে চোখাচোখি হতে দু’জনেই হাসল। আবুর একটা চোখ আপনা থেকে ছোট হয়ে গেল। ফিসফিস করে বললে তোমার কথা মিলেছে, বউ সুন্দরী।…কাল বাপীকে জঙ্গলে আসতে বলে সে চলে গেল।

আজ জুয়ার আসর কেমন বসেছে দেখার জন্য বাপী সামনের বড় হলটায় ঢুকে গেল। গত রাতের মতো অতটা জমজমাট নয় এখনো। এক টেবিলে ডুয়ার্সের কালো-কালো অতিথিটিকে দেখে আর একটু এগিয়ে এলো। হাতে মদের গেলাস। এরই মধ্যে বেশ টইটম্বুর অবস্থা। পাশের চেয়ারের লোকটি তার এখানকার অফিসার বন্ধু হবে।

বউ নিয়ে খাসা বেড়াতে এসেছে যা-হোক! বাপী বেরিয়ে এলো। বউটা দরজার সামনে এখন একা দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে বাপী মুখ ফিরিয়ে নিল। কোণের ঘরের আগের ঘরটাই তার। কিন্তু কি রে বাবা, কাছাকাছি হবার পরেও বউটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সোজা না তাকিয়েও বাপী অনুভব করল, তার দিকে চেয়েই আছে। দরজার তালা খোলার ফাঁকে বাপী একটু ঘাড় না ফিরিয়ে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়তে হল। তাজ্জব ব্যাপার। নাকের ঝকঝকে সাদা ফুলটার মতোই বউটার বড় বড় চোখ দুটোও চকচক করছিল। আর সেই চাউনি ওর মুখের ওপর আটকে ছিল।

হতে পারে পারিবারিক জীবনে বউটা অসুখী। কিন্তু তা বলে এ কি কাণ্ড? অথচ ওই চাউনিতে অশোভন যে কিছু দেখেছে ঠিক তাও নয়।

ঘণ্টাখানেক বাদে ডিনারের জন্য আবার দরজা খুলে বেরুলো যখন, ও-ঘরের দরজা বন্ধ। ডিনার সেরে ফিরল যখন, তখনো। বড় হলঘরটা একচুপি দেখে নিল। এখন মদ আর জুয়ার আসর জমজমাট। সেই অতিথির মাথা এখন চেয়ারের কাঁধে। আর সোজা রাখতে পারছে না।

এই রাতে আর ভালো ঘুম হল না বাপীর। কাজ এবারে একটা হবে বুঝতে পারছে। গোড়াপত্তন যে রকম হল, ভালো থাকার মুখ এরপর হয়তো সেও দেখবে। গায়ত্রী রাই চালিহাকে বুঝিয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্য একজনকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হবে। মালিকের মাথায় মতলব যা-ই থাক, মাঝেসাঝে কলকাতায় তাহলে তাকে যেতে হবে। অস্তিত্বের মানচিত্র থেকে ওর একটা জায়গা মুছে ফেলার তাড়না তার

কিন্তু সত্যি কি তাই? মনের তলায় এতটুকু লোভের অস্তিত্বও কি আর নেই? বানারজুলিতে পা দিয়ে জঙ্গলের সেই সব স্মৃতি ওকে কি সেই আগের মতোই পাগল করে তোলে নি? দুর্বার আক্রোশে এক মেয়ের ওপর তার দাবীর ঘোষণা তখনো ভিতর থেকে কেউ করে নি? বলতে চায় নি আগের এই সবকিছু যদি সত্যি হয় তাহলে পরে যা ঘটেছে, তাই শেষ নয়? সেই মেয়ের সম্পর্কে যে চিন্তাটা এ পর্যন্ত ঠেলে সরিয়ে রেখেছিল সেটাই এখন এই শেষের প্রতিবাদে আঙুল তুলছে।…ওর ওপর হামলা করার জন্য পাড়ার মস্তান ছেলে কটাকে ধরে আনা হয়েছে দেখে মিষ্টির সেই রাগ, তার হাতের ক্রুদ্ধ ধাক্কায় মারমুখো একটা ছেলের দূরে ছিটকে পড়া আর তারপর সোনালি চশমার মুখের ওপর সেই আগুন ছিটানো। এর পিছনে যদি আর কোনো সত্যের অস্তিত্ব না থাকে এরকম হতে পারে কি করে?

শেষে হতাশ হয়েই হাল ছেড়েছে বাপী। এ যন্ত্রণার থেকে কি মুক্তি নেই? এত সবের পরেও আশা মরে না কেন?

সকালে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। খানিক ঘোরাঘুরির পর চায়ের টানে ক্লাবে পা দেবার মুখে আবার সেই ধাক্কা। কোণের ঘরের জানালায় সেই বউটা দাঁড়িয়ে। ওর দিকেই অপলক চেয়ে আছে। দিনের আলোয় নাকের সাদা পাথর অত আর চকচক করছে না, কিন্তু চোখে পড়ে।

মুখ ফিরিয়ে বাপী পা চালিয়ে ক্যানটিনের দিকে চলে গেল। আজও অস্বস্তি। বিরক্তিও।

তারপর সকাল প্রায় দশটা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ বাপী ক্লাবে ছিল, খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে আর ঘর-বার করার ফাঁকে অনেকবার বাপীর ওই চোখের ঘা খেতে হয়েছে। বাপী ভালো করে তাকাতেও পারে নি, দেখতেও পারে নি। ভালো করে চোখাচোখি হবার আগেই দৃষ্টি ফেরাতে হয়েছে। বউটার ঘরের লোকের সঙ্গেও অনেকবার দেখা হয়েছে। সামনেই বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে বসে ছিল। তার ঝিমুনো ভাব এখনো ভালো করে কাটে নি। বউটার আচরণ ভেবেই বিস্ময়ের অন্ত নেই বাপীর। কোনরকম ইঙ্গিত ইশারার ছিটেফোঁটাও নেই, কেবল দেখাটুকুই সব

এত বেলায় আর জঙ্গলের দিকে এগলো না। ঘুরে ঘুরে চা-বাগান দেখল। দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের আড়াই-পাতি তোলার কাজ দেখল। তারপর আধ মাইল পথ ভেঙে বনমায়ার সঙ্গে খানিক খেলা করে বেলা বারোটার মধ্যেই ফিরে এলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, এখন চান-খাওয়া সেরে আগে একটু ঘুমনোর ইচ্ছে।

জানলার কাছে সেই বউটা দাঁড়িয়ে। দূর থেকেই বাপী মুখ ফিরিয়ে নিল। আবার ঘুম সেরে বেলা তিনটে-চারটে নাগাদ বেরুনোর সময়েও তাই। ওই জানলার কাছেই দাঁড়িয়ে। বাপীর একবার ইচ্ছে হল সোজা ঘুরে তাকায়, আর নিজের দুটো চোখ দিয়েই জিগ্যেস করে, কি ব্যাপার? পারা গেল না। মাথায় ছিট কিনা কে জানে। নইলে বেড়াতে এসেও স্ত্রীকে ভদ্রলোক কাল বিকেল থেকে এ—পর্যন্ত ক্লাবের বাইরে নিয়ে গেল না কেন?

জঙ্গলে ঢুকলে বাপীর আর সময় কাটতে অসুবিধে নেই। তবে যেদিকে স্মৃতির টান বেশ, আজ আর সেদিকে পা বাড়ালো না। নতুন গাছপালা আবিষ্কারের জন্য উৎসুক। কিন্তু নতুন কিছুই চোখে পড়ছে না। সবকিছু অন্তরঙ্গ পুরনো দোসরের মতো কাছে টানছে তাকে। আবুর সঙ্গে সকালে দেখা হয় নি, কোনো খবর আছে কিনা জানার জন্যও এ-বেলা যাওয়ার কথা ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এই জগতের নিভৃতে ঢুকে পড়ার পর কিছুই আর মনে থাকল না। আগু-পিছু রঙিন প্রজাপতি উড়তে দেখল, গাছের ডালে জোড়ায় জোড়ায় কাঠবিড়ালি খেলা করছে দেখল, জোড়ায় জোড়ায় খরগোশের ছোটাছুটি দেখল, ময়ূরময়ূরী দেখল। বাপীর নিজেরই হঠাৎ মনে হল, ছেলেবেলায় ও বড় নিষ্ঠুর ছিল। কত সময় মরণপাথর ছুঁড়ে ওদের এই আনন্দ খতম করে দিয়েছে।

ঘণ্টা দুই ঘোরাঘুরির পর যেখানে এসে দাঁড়াল সে-জায়গাটা চেনা মনে হল, আর অদূরের ওই ডেরাটাও। যদিও মাটির ঘরের এখন আর সেই ভাঙা-দশা নয়, নতুন টালি বসানো হয়েছে, তবু চিনতে ভুল হল না। রেশমার মরদ মাতাল কাঁদনার ডেরা ছিল ওটা। রেশমা কি এখনো এখানেই থাকে?

আবু সঙ্গে নেই, আর এগলো না। ফিরে চলল। গেলে রেশমাই হয়তো বিশ্বাস করবে না ও বেড়াতে বেড়াতে এদিকে চলে এসেছে। কিন্তু পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে পিছনে কলকণ্ঠে—ও বাপীভাই! সামনে অত কি দেখার আছে গো, পিছনে দেখো?

রেশমা। কিন্তু রেশমার পাশে যে তাকে দেখে বাপী যথার্থ অবাক। ঊর্মিলা রাই। পরনে শাড়ি। রেশমা অবশ্য কাল বলেছিল মেমদিদি কেবল তার সঙ্গেই গপ্পসপ্প করে, আর কারো সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। তা হলে দুই সখীর জঙ্গলে বেড়ানোর মতো খাতির ভাবে নি। হাসছিল সেও। এবারে ঠেসের সুরে রেশমাকেই বলল, যেভাবে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল খাঁটি ভাবুকের মতো লাগছিল।

মুখখানা ভারিক্কি করে ঊর্মিলা বাপীর দিকে তাকালো।—মায়ের সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে?

বাপী মাথা নাড়ল, হয় নি

—আঙ্কল্ চালিহা সকালে এসেছিল, তুমি কাল রাতে তার সঙ্গে দেখা করেছ বলল, আর মায়ের কাছে তোমার বেশ প্রশংসাই করল।

এটা খুব অবাক হবার মতো খবর নয়। বিস্ময়ের ধাক্কা এই মেয়ের মুখে সরাসরি তুমি শুনে। কাল বিকেলেও আপনি করে বলেছে, আজ ওর মায়ের মতোই তুমিতে নেমে এলো।

ঊর্মিলা আবার বলল, হাঁ করে চেয়ে আছে কি—তুমি সেয়ানা কম? কিছু বুঝতে পারছ না?

বাপী সাদা মুখ করে জবাব দিল, সে-জন্য নয়, হঠাৎ অনুগ্রহ দেখে অবাক লাগছিল, কাল পর্যন্ত ‘আপনি’ ছিলাম, কাজ শুরু হওয়ার আগেই ‘তুমি’ হয়ে গেলাম।

মেয়ে বলল, আমি আপনি-টাপনির ধার ধারি না, তুমিও তাই বলতে পারো।…আংকলকে বশ করলে কি করে, ম্যাজিক-ট্যাজিক জানো?

জবাব দেবার আগেই রেশমা আলতো করে ঠেস দিল, পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে বোধ হয়। কি-যে হল বাপীর, হঠাৎ কেন যেন রেশমার মুখখানাই ভালো করে দেখে নেওয়ার ইচ্ছে। সে-চেষ্টার আগেই ঊর্মিলার ভ্রুকুটি।—এই পাজী মেয়ে, আমি বলি বলে তুইও বলবি, দু’দিন বাদে ও-ই তোর মুরুব্বি হবে সে খেয়াল আছে?

রেশমা চার আঙুল জিভ কাটল তক্ষুনি।—ও বাপীভাই, তুমি এমন করে চেয়ে আছ কেন? আমার খুব অন্যায় হয়েছে, এই নিজের কান মলছি।

সত্যি সত্যি কানে হাত দিল। তারপর হেসে ঊর্মিলাকেই বলল, আমি কি রকম পাজী মেয়ে তোমার থেকে বাপীভাই ঢের ভালো জানে মেমদিদি—রাগ করবে না। তা আমার কি আর পৌঁছে দেওয়ার দরকার আছে—লোক তো পেলে?

ঊর্মিলা সঙ্গে সঙ্গে ওকে ছুটি দিয়ে দিল, ঠিক আছে, তোকে আর আসতে হবে না। ঘরে যা, বিকেলে আর সাপ-টাপ ধরতে বেরুবি না বলে দিলাম।

জঙ্গলের পথ ধরলে এখান থেকে বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। আবার একেবারে কাছেও নয়। বাপীর অস্বস্তি লাগছে। ঊর্মিলা আগে আগে খানিকটা এগিয়েই ঘুরে দাঁড়াল।—এখনো কি জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে যাবে নাকি? পা চালিয়ে চলো, খ্যাঁক-খ্যাক করার জন্য মা বাইরে বসেই আছে দেখো’খন—

বাপী যথার্থই ঘাবড়ালো, বলল, আমাকে সঙ্গে দেখলে কি খুশি হবেন…

কথাটা আদৌ তলিয়ে ভাবল না ঊর্মিলা। জবাব দিল, তুমি না থাকলে তো রেশমাই সঙ্গে আসত, অখুশির কি আছে!

অর্থাৎ মেয়ের যাতায়াতে একজনের সঙ্গে থাকা নিয়ে কথা। আসার সময় সঙ্গে কে ছিল সে কথা না তুলে বাপী আলতো করে জিগ্যেস করল, একা চলাফেরা উনি পছন্দ করেন না বুঝি?

—নাঃ! এক শব্দের জবাবেই একপশলা বিরক্তি।—কোথাও বেরুতে হলে সঙ্গে হয় কোয়েলা, নয় রেশমা, নয় আবু, নয় তো উনি নিজে!

তারপরেই উৎফুল্ল একটু।—প্রথম দিন দেখেই তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমিই ঠিক মাকে জব্দ করেছ—ইউ উইল বি মাই ফ্রেন্ড—উইল ইউ? বিপন্ন মুখ করে বাপী বলল, সেটা কি আমার দিক থেকে একটু ভয়ের কথা হবে না?

—ভয়ের কথা হবে কেন?

—ইয়ে, আবুর মুখে শুনেছিলাম, আমার আগে চা-বাগানের একজন চৌকস লোককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছিল…সে বন্ধুত্বের জন্য এগোতে তার চাকরি গেছে।

ঊর্মিলা প্রথমে অবাক মুখ করে তাকালো তার দিকে। তারপর মনে পড়ল।—তার তো অন্য রকম মতলব ছিল, আমিই তো মাকে বলে তাকে তাড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো, তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি বুঝি সে-রকম বন্ধুত্বের কথা ভেবেছ?

বাপী তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল।—তা না…সেই একজন কি-রকম বন্ধুত্বের দিকে এগিয়েছিল আবু সেটা বলে নি।

ঊর্মিলা জোরেই হেসে উঠল। তরতাজা হাসি। বলল, আবু একটা ওয়ার্থলেস্ আর তুমি একটা সেয়ানা বোকা—ওয়েট ক্যাট্।

.

বাপী ক্লাবে ফিরল রাত প্রায় ন’টায়। মন-মেজাজ সত্যি ভালো। গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে আজ একটু হাসিও দেখেছে। দেখামাত্র বলেছে, চালিহা সকালে এসে তোমার জন্য সুপারিশ করে গেছে। তুমি তাকে কি বলেছ, তাও শুনেছি। বাট্ ডোন্ট্ এভার ট্রাই টু ওয়ার্ক দ্যাট্ স্টাফ অন্ মি…বি স্ট্রেইট অ্যান্ড বি অনেস্ট।

আজ আর মুখ ফুটে বলার দরকার হয় নি, নিজেই চা খাইয়েছে। পাশের জমিতে ওর জন্য ঘর তোলার কথাও চালিহার সঙ্গে হয়ে গেছে। সে কনট্রাক্টর লাগানোর ব্যবস্থা করবে। ঘর না ওঠা পর্যন্ত ক্লাবে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা আবুর ঘরে এসেছে। সুখবর আবু আগেই জানে। বিকেলে ওর খোঁজে ক্লাবে এসে ফিরে গেছে। এই নতুন মানুষটার সঙ্গে বাপের জড়াজড়ি কাণ্ড দেখে ওর ছেলে দুটো খুশিতে হাঁ। দুলারি আজ আবার প্রচুর জলখাবার খাইয়েছে। আর ঘরের লোকের উদ্দেশে ঠেস দিয়ে বাপীকে শুনিয়েছে, বানারজুলিতে এতদিন একজনই বুদ্ধিমান লোক ছিল, কাল থেকে সেই অহংকার একটু কমেছে।

ক্লাবে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কোণের ঘরটার দিকে আগে চোখ গেল। এতক্ষণ মনেও ছিল না। ঘর অন্ধকার, দরজা খোলা। দু’দিন থাকার কথা ছিল, আজই চলে গেছে হয়তো। বউটার আচরণ দুর্বোধ্যই থেকে গেল। নিজের দরজা খোলার ফাঁকেও আর একবার ও-ঘরটার দিকে তাকালো। কেউ আছে মনে হল না।

দরজা ভেজিয়ে গায়ের বুক খোলা সোয়েটার আর পাঞ্জাবি খুলে সটান শয্যায়। ভারী জলযোগের ফলে আরো ঘণ্টা দেড়েকের আগে খাবার তাড়া নেই। ডাটাবাবু হয়তো কালই আবার ওকে কোণের ঘরটা দিতে চাইবে। কিন্তু বাপীর আর দরকার নেই, এ-ই বেশ ভালো। আবার যে কখন পরিবার নিয়ে হাজির হয় ঠিক কি।

দরজায় টুক-টুক শব্দ। বাপী শুয়েই ঘাড় ফেরালো। ডাটাবাবু এই রাতেই ঘর বদলের কথা বলতে এসেছে, নাকি গায়ত্রী রাই আবার কিছু খবর পাঠালো? রণজিৎ চালিহা নয় তো…।

তাড়াতাড়ি সাড়া দিল, কাম ইন!

আস্তে আস্তে এক পাট দরজা খুলে যে এলো তাকে দেখামাত্র প্রচণ্ড বিস্ময়ে বাপী ধড়মড় করে উঠে বসল।

কোণের ঘরের বউটা।

চোখ দুটো চকচক করছে! ঠোঁটে হাসি। নাকের পাথরে সাদা জেল্লা। আরো দু’তিন পা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।

বাপীর গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন বিমূঢ় যে একটা শব্দও বার করতে পারছে না।

—দু’দিন আমাকে দেখে চিনতে পারলে না বাপীদা, আমি তো তোমাকে দেখেই চিনেছি!

মাথার খাটো ঘোমটা খসে গেছে। এবারে আর এক প্রস্থ ইলেকট্রিক শক্‌ খেল বাপী। তারপর স্থান-কাল ভুলে হাঁ করে দেখছে। চেনা আদলই বটে। কিন্তু কপালে সবুজ টিপ, নাকে চকচকে সাদা পাথর, দু’হাতে এক গোছা করে কালো চুড়ি…একে বাপী কবে কোথায় দেখল? মেয়েটার ভুল হয়ে থাকলে ওর নাম বলবে কি করে—বাপীদা বলবে কি করে!

—থাক, আর চেষ্টা করতে হবে না। আমি তোমাদের ড্রইং মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম। মনে পড়ছে, না তাঁকেও ভুলে গেছ?

মাথায় একটা মুগুরের ঘা খেয়ে আত্মস্থ হল বাপী তরফদার। তার পরেও বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা নেই। নিজের দুটো চোখের ওপর বিশ্বাস খোয়ানোর দাখিল। তেতাল্লিশ সালের গোড়ার দিকে হাড়ের ওপর শুধু সাদা চামড়া মোড়া বছর চৌদ্দর এই মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল। বাপের হাঁকডাকে কড়াইশুঁটি সেদ্ধ আর চিঁড়ে ভাজা খেতে দিয়েছিল। তার বেশির ভাগ রোগা পটকা দুটো ছেলে আর মাস্টারমশাইয়ের পেটে গেছল। পরের দেড় বছরের মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কমই যাওয়া-আসা ছিল, কিন্তু তখনো এই মেয়ে নিজের স্বাস্থ্যের লজ্জায় হোক ময়লা ছেঁড়াখোঁড়া জামা-কাপড়ের লজ্জায় হোক, সামনে আসতই না। ভিতরের ঘরে সেঁধিয়ে থাকত। একদিন মাত্র রাগের মুখ দেখেছিল—যেদিন জিলিপির ঠোঙা আর মুড়ি নিয়ে যেতে ও বলেছিল, মায়ের বাক্স থেকে বাবা দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠিয়েছিল বলে বাড়ির সকলের উপোস চলছে।…আর মাস্টারমশাই অ্যারেস্ট হবার দিন মেয়েটা ছেঁড়া আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। দেখা বলতে সর্বসাকুল্যে তিন-চার দিনের।

পাঁচ-ছ বছরে সেই হাড়-চামড়া-মোড়া মেয়ে এই হতে পারে কোনো কল্পনার মধ্যেও আসা সম্ভব নয়। বাপী মাথা নাড়ল বটে, মাস্টারমশাইকে ভোলে নি, কিন্তু এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না, এ সেই মেয়ে।

কুমকুম বলল, কাল সকালে চলে যাচ্ছি, আজ একবার না এসে পারলাম না। বাপী দ্রুত নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। কাল থেকে দেখছ, চিনেছ…এলে না কেন…বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না কেন?

এক জবাবে কুমকুম দু’দিক সারল।—আলাপ করানোর মতো মানুষ নয়, এখনো এ-ঘরে দেখলে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাবে।

চমকে দরজার দিকে তাকালো বাপী। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজার দু’পাটই খুলে পর্দাটাও তুলে দিল। কুমকুম হাসল একটু–তোমার ভয় নেই, আমি দেখে এসেছি, মদ আর জুয়ার নেশায় এখন আর কোনদিকে হুঁশ নেই।

হঠাৎ ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছে বাপী। কুমকুমের ঠোটের হাসি আর চকচকে চোখ কেন যেন খুব স্বাভাবিক লাগছে না।

—বোসো। বসার চেয়ার নিজেই সামনে এগিয়ে দিল। নিজে খাটে বসল।— তোমার বরের নাম কি?

—ব্রীজমোহন। কুমকুমের মুখে অদ্ভুত হাসি।

—নিজে বিয়ে করেছ?

—তা ছাড়া আর কি। কবে থেকেই তো নিজের বাঁচার ভাবনা নিজের।

তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলালো বাপী।—মাস্টারমশাইয়ের খবর কি?

খবর বলা নয়, বাপীর বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দিল কুমকুম। মাস্টারমশাইয়ের খবর ও জানে না, বা কেউ জানে না।… দিনাজপুরে এসে প্রথম দু’আড়াই বছর তারা মামা-মামীর আদরযত্ন পেয়েছিল। মামা মুহুরী কিন্তু জনাকতক পয়সা-অলা মক্কেলের সঙ্গে তার খুব খাতির ছিল। মামার তাগিদে মামী সস্তার বাজারে কুমকুমকে আম-দুধ-ঘি খাইয়ে বেশ তাজা করে তুলেছিল। তারপর বাপের থেকেও বয়সে বড় এক বউ-মরা খাতিরের মক্কেলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। এই সময় বাবা এসে যেতে এই বিয়ে নিয়েই মামার সঙ্গে তার ফাটাফাটি ঝগড়া। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওদের এক খোলার ঘরে উঠে যেতে হল, তারপর প্রায়দিনই উপোস। মাস্টারমশাই জঙ্গল থেকে একদিন কি—সব ফল আর লতাপাতা এনে হাজির—সেদ্ধ করে নুন দিয়ে খেতে নাকি চমৎকার। কুমকুম বা তার মা ফিরেও তাকালো না দেখে নিজেই সেদ্ধ করল। তারপর বাবা আর ছোট ভাই তাই খেল। বড় ভাইটাকে মামা আগেই ঢাকায় এক আত্মীয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে বেঁচে গেল। অবশ্য বেঁচে আছে কি নেই কুমকুম জানে না। সেখানকার বড় দাঙ্গার পর থেকে সেই আত্মীয়ের কারো আর খবরই পাই নি। ওই সেদ্ধ বুনো আনাজ খাওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যে বাবা আর ছোট ভাইয়ের সে কি পেট কাচিয়ে রক্ত, আর আধাকাটা পশুর মতো যন্ত্রণায় ছট্‌ফটানি। রাতের মধ্যে ভাইটা মরেই গেল। বাবা শেষ পর্যন্ত সামলে উঠল, আর তারপর থেকে একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। বেরিয়ে যেত, আর কখনো কখনো দু’দিন তিনদিন পরেও ফিরত। শেষে একবার আর ফিরলই না। পরের ক’বছরের মধ্যে কুমকুম আর তার দেখা পায় নি।

শোনার যন্ত্রণাও কম নয়। বাপীর দম আটকে আসার দাখিল।—আর তোমার মা?

—বাবা চলে যাবার দুমাসের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছে। তার আগের রাত পর্যন্তও আমাকে অজস্র অভিসম্পাত করেছে।

মাথাটা ঝিমঝিম করছে বাপীর। আর কিছু জিগ্যেস করতেও ইচ্ছে করছে না।…এবারে কুমকুমের চকচকে চোখ উৎসুক একটু।—তুমি বিয়ে করো নি বাপীদা…?

—না।

—এখানেই থাকো?

বিশদ করে বলল না। জবাব দিল, থাকব বলে এসেছি—কলকাতায় ছিলাম। শুধু চোখ নয়, কুমকুমের মুখও ব্যগ্র হঠাৎ।—কলকাতা কেমন জায়গা বাপীদা?

—আছে একরকম। অস্বস্তি বাড়ছেই বাপীর। বলল, কুমকুম এখন তুমি ঘরে যাও, ব্রীজমোহন উঠে এলে…তুমি যা…বলছ…

হ্যাঁ, খুব মুশকিল। কুমকুম তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল। ঠোটের ফাঁকে তীক্ষ্ণ হাসির ফালা।—বেইমানী ভাবলে তোমার ঘাড়েও ফেলে চলে যেতে পারে।

চলে গেল। এই রাতে বাপীর আর ডিনার খেতে বেরুনোও হল না।

সকাল। বাপী ইচ্ছে করেই প্রাতঃরাশের পর বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিল। খানিক আগে’ একটা জিপ এসে দাঁড়িয়েছে। জিপে ড্রাইভারের পাশে চা-বাগানের সেই ছোকরা অফিসার—ব্রীজমোহনের বন্ধু।

আগে স্যুটকেস হাতে বেয়ারা কোণের ঘর থেকে বেরুলো। পিছনে বিপুলবপু ব্রীজমোহন। তার পিছনে চার আঙুল ঘোমটা টানা কুমকুম। বাপীর দিকে মেয়েটা তাকালোও না একবার। বারান্দা থেকে নেমে গেল।

অফিসার বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছে। ব্রীজমোহনও দাঁত বার করে হেসে পিছন ফিরে কুমকুমকে দেখল একবার।

ওদের নিয়ে জিপটা বেরিয়ে গেল।

আর তক্ষুনি বাপীর চোখের সামনে থেকে একটা ঝাপসা পর্দা আচমকা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেল। কুমকুম আর কত ভাবে বোঝাবে ওকে ও কি? বলেছে, কবে থেকেই নিজের ভাবনা নিজের—বলেছে, মা গলায় দড়ি দিয়েছে, তার আগে পর্যন্ত অজস্র অভিসম্পাত করেছে—বলেছে, বেইমানী ভাবলে ওই লোক তাকে বাপীর ঘাড়ে ফেলেও চলে যেতে পারে। তার আগে ব্যগ্রমুখে জিগ্যেস করেছিল, কলকাতা কেমন জায়গা।

এই একজন নয়, পুরুষ প্রবৃত্তির কোন্ কাঁচা ভিতের ওপর কুমকুমের মরণ—বাঁচন নির্ভর—সেটা আর কত ভাবে ও বলে যাবে?

বাপী স্তব্ধ। বিবর্ণ।

সোনার হরিণ নেই – ১৩

আবু রব্বানী আর দুলারি ধরেই নিয়েছে গায়ত্রী রাইয়ের এত বড় ব্যবসার কর্তৃত্ব এখন আস্তে আস্তে বাপী ভায়ের হাতে চলে যাবে। রাতারাতি কিছু হবে না। চালিহাকে কোন রকম সন্দেহ করার সুযোগ মেমসায়েব দেবে না। তাছাড়া চারদিকের কাজকর্মের হদিস পেতেও বাপীভাইয়ের কম সময় লাগবে না। চোখ কান খোলা রেখে সব দেখে শুনে বুঝে নিতে হবে। তারপর বাপীভাইয়ের ওপর মেমসায়েবের বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়ে উঠলে তখন আস্তে আস্তে মেয়েছেলের বুদ্ধির খেলা দেখা যাবে। তাই গোড়া থেকে খুব সাবধান বাপীভাই, খুব সাবধান।

একই সঙ্গে ওদের আনন্দ উৎসাহ আবার উৎকণ্ঠা দেখে বাপী তরফদারের হাসি পায়। সেই সঙ্গে অস্বস্তিও একটু। মেমসাহেবের মনে কি আছে সেটা বাপীর বোকামির জন্যে এরা টের পেয়ে গেছে। প্রথম সন্ধ্যায় গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে এই বোঝাপড়ার ঝকাঝকিটা আবুর চোখের ওপর দিয়ে ঘটে না গেলে ওরা এতটা হয়তো বুঝত না। কোন্ ভবিষ্যতের দিকে চোখ রেখে মহিলা নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত লোক খুঁজছে, আর কেন ছ’মাসের জন্য ওকে ট্রায়েল দেবার আগ্রহ—বাপী সেটা তার মুখের ওপর বলেই দিয়েছিল। আবু রব্বানী সত্রাসে মেমসায়েবের প্রতিক্রিয়া দেখেছে আর বিমূঢ় বিস্ময়ে তার ফলাফলও দেখেছে। তার পরে মেমসায়েবের সঙ্গে বাপীর প্রতিটি সাক্ষাতের বৃত্তান্তও খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ছবিটা ওর স্পষ্ট আঁচ না করতে পারার কথা নয়। আর আবু জানে বলেই দুলারি সব জানে।

এখন ওরাই তাকে উপদেশ দিচ্ছে, সাবধান করছে। এর পিছনে আন্তরিকতাটুকুই সব। তবু পর পর দু’তিন দিন এ-রকম শোনার পর বাপী সেদিন বলল, তোমাদের মেমসাহেবের মতলব কি সেটা আমি গোড়া থেকেই জানি, কিন্তু তা নিয়ে তোমরা এ-রকম খোলাখুলি আলোচনায় বসলে শুরুতেই সব ভেস্তে যাবে—

দুলারি আর আবু দুজনেই অবাক।—এখানে তো ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে কথা কইছি, কে জানবে?

—এ-সব কথা ঘরের দেয়ালের জানা বা শোনাটাও ভালো নয়। খুব হাল্কা—ভাবেই জিগ্যেস করল, মেমসায়েবের মতলব আর কে বুঝছে—রেশমা?

আবু জবাব দিল, রেশমার সঙ্গে তো ক’দিনের মধ্যে দেখাই হয় নি—এক ওর মেমদিদি যদি বলে থাকে, খুব ভালবাসে ওকে…

একটু ভেবে বাপী বলল, সে রেশমাকে এ-সব কিছু বলবে মনে হয় না, তার মা-ই তাকে বারণ করবে। যা-ই হোক, তোমাদের কাছ থেকে কিছু না শোনাই ভালো।

সঙ্গে সঙ্গে আবুর মুখ বিরস একটু।—রেশমাকে তুমি অবিশ্বাস করো বাপী ভাই। তুমি জানো না, ওই চালিহার ওপর আমাদের থেকে ওর ঢের বেশি রাগ, ইচ্ছে করে ওর ওপর সব থেকে বেশি অবিচার করছে। মওকা পেলে রেশমা কোন্ দিন সাপের মতোই ওকে ছুবলে দেবে—

যত সেয়ানা হোক, আবু যে ওর তুলনায় সাদা মনের মানুষ বাপী জানে। যে সংশয়ের ছায়াটা মনের তলায় উকিঝুঁকি দিয়ে যায় সেটা ওকে বলা যাবে না। বিরক্তি চেপে জবাব দিল, বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো কথা হচ্ছে না—তুমি যা বললে সেটা সত্যি হলেও মেমসাহেবের মতলব ওর না জানা ভালো—ওই রাগের মাথাতেই বেফাঁস কিছু হয়ে বসতে পারে।

দুলারির গম্ভীর চাউনিটা মুখের ওপর আটকেছিল। বাপীর কেমন মনে হল, শুধু শুনছে না, একই সঙ্গে ভেতর দেখে নেবার চেষ্টা। চোখাচোখি হতে ও আবুর দিকে ফিরল। দাবড়ানির সুরে বলল, বাপীভাইয়ের ছটাক বুদ্ধিও ধরো না সেই জ্ঞান তোমার আছে? যা বলছে মন দিয়ে শুনে রাখো, আখেরে সকলেরই তাতে ভালো মন্দ হবে না—বুদ্ধির ঢেঁকি!

এই ধমকের মধ্যে আবুকে নিরস্ত করার কোনো ইশারা ছিল কিনা বাপী ঠিক ধরতে পারেনি। বিমূঢ় মুখে আবু তার বিবিকে দেখেছে। তারপর মোলায়েম গলায় প্রসঙ্গ বাতিল করেছে। —ঠিক আছে, ঠিক আছে, একেবারে মাটি চাপা দিলাম।

কিন্তু আবু চাপা দিলেও সে-মাটি একটু অন্যভাবে খুঁড়ে দিয়ে গেল গায়ত্ৰী রাইয়ের মেয়ে ঊর্মিলা রাই। বন্ধুত্ব হবার ফলে বাপী ওকে ডলি নামে ডাকবে কি ঊর্মিলা, তাই নিয়েও ভেবেছিল। ডলি মিষ্টি নাম, কাছের নাম। সতর্কতার তাগিদে সেই কারণেই ডলি বাতিল। এমন কি মনে মনে বন্ধুত্বও বাতিল। নিজেকে অবিশ্বাস, গায়ত্রী রাইকে আরো বেশি।

বানারজুলির চা-বাগান এলাকায় গায়ত্রী রাইয়ের ব্যবসায় আপিসও একটা আছে। ছোট বড় তিন ঘরের আপিস। বড় সাজানো গোছানো ঘরটা চিফ একজিকিউটিভ চালিহার। এখানে থাকলে সকালের দিকে এক দেড় ঘণ্টা সে এই ঘরে এসে বসে। অন্য সময় শুধু পার্টির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে তাকে ও—ঘরে দেখা যায়। এই আপিসে সাড়ে ন’টা পাঁচটা নিয়মিত হাজিরা বরাদ্দ শুধু অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্টের। একজন বেয়ারারও। কর্ত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী রাইয়ের আপিসে কখনো পদার্পণ ঘটেছে শোনে নি। কারণ আসল আপিস বাপীর দুঘরের বাড়িতে যে নতুন ঘর উঠেছে, সেটা। আর সামনের ওই বারান্দাটা দরকারী ফাইল-পত্রের বেশির ভাগ সেইখানে। সেখানে ছোট্ট একটা টাইপ রাইটারও দেখেছে বাপী। ওটা মালিকের নিজস্ব। তেমন জরুরী চিঠিপত্র টাইপ করার দরকার হলে গায়ত্রী রাই নিজেই করে নেয়, টাইপিস্টের আশায় বসে থাকে না। প্রয়োজনীয় দুটো একটা নৈমিত্তিক লেনদেন বা হিসেবের ফাইল সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে অ্যাকাউনটেন্টকে প্রায় রোজই একবার করে দুপুরের দিকে মালিকের আপিস ঘরে হাজিরা দিতে হয়।

এ দু’ সপ্তাহের মধ্যে বাড়ির আপিস ঘরে বাপীর একদিনও ডাক পড়ে নি। পড়বে জানে কিন্তু সেটা কোন ভবিষ্যতে, মহিলার মুখ দেখে আঁচ করা শক্ত। এখন পর্যন্ত কাজের কোন রকম হদিসও তার কাছ থেকে মেলে নি। শুধু বলে রেখেছে, ফাঁক পেলে মাঝে মাঝে এসো। কিন্তু কোন্ সময়টা মহিলার কাছে ঠিক ফাঁক বলে গণ্য হতে পারে বাপী এখন পর্যন্ত ঠাওর করে উঠতে পারে নি। সন্ধ্যায় রণজিৎ চালিহার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক কথাবার্তার বা গল্প করার সময়। সেই অন্তরঙ্গ পরিবেশে এসে হাজির হবার ফলে মহিলার সাদাটে ভুরুতে বিরক্তির ভাঁজ দেখেছে। বারান্দায় ওঠারও অবকাশ না দিয়ে বলেছে, দরকার নেই—

অর্থাৎ, যেতে পারো। দু’দিন বাদে এক সকালের দিকে আসার সঙ্গে সঙ্গে কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখেছে মহিলা। গলার স্বর নীরস। চান খাওয়া সেরে এসেছ।

বাপী অপ্রস্তুত।—না।

—এখন ন’টা বাজে, মিস্টার চালিহা দশটায় আপিসে হাজির থাকেন, তিনি দেরির কৈফিয়ৎ চাইলে আমি সদয় থাকব ভেবো না।

বাপীর পত্রপাঠ প্রস্থান। মেয়েটার সামনে ওই কথা শুনে অপমানিত বোধ করার কথা। কিন্তু বাপীর ধারণা খুব স্পষ্ট বলেই গায়ে মাখে নি। আরো অপ্রস্তুত পরের রবিবারের ছুটির দিনে বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ এসে। ছুটির দিন, সকাল থেকে আবুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপর দুজনে গল্প করতে করতে চলে এসেছিল। সেদিন অন্তত কোনো বিরূপ আপ্যায়ন আশা করে নি।

কিন্তু ওদের দেখামাত্র মহিলার ভ্রুকুটি। পাশে মেয়ে বসে। মালিকের মুখের দিকে চেয়েই আবু ঘাবড়েছে একটু। আর বাপী ভেবেছিল, মেয়ের কোনো কারণেই মহিলার মেজাজ ভালো নয়। আবুর বিনীত আদাবের জবাবে মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করল একটু। তারপর জিগ্যেস করল, কিছু বলবে?

এ-রকম অভ্যর্থনার জন্য আবুও প্রস্তুত ছিল না। জবাবদিহির সুরে সে বলল, দোস্ত আসছে দেখে সেও মালকানকে শুধু সেলাম জানাতেই এসেছে, আর কোনো কারণে নয়।

মেমসায়েবের মেজাজ এখন পর্যন্ত বাপীর থেকে ঢের ভালো বোঝে আবু বলল, চন্দ্রার নতুন চারা বেড়টা খাসা হয়েছে মেমসায়েব, পারেন তো একবার দেখে আসবেন। আচ্ছা, আমি চলি–আদাব।

আবু চলে যেতে গায়ত্রী রাইয়ের অপ্রসন্ন দু’চোখ বাপীর মুখের ওপর।— তোমার কি?

—এলাম…যদি কিছু বলেন।

—যদি কিছু বলি শোনার জন্যে সঙ্গে লোক নিয়ে আসতে হবে? এ বাড়ির রাস্তা তুমি চেনো না?

দোষের হদিস বাপী পেয়েছে, কিন্তু এ কথার আর জবাব কি দেবে। গায়ত্রী রাই আবার বলেছে, এখানে কাজ করতে হলে দোস্তি ভুলতে হবে।

নিরীহ মুখে বাপী জিগ্যেস করেছে, কাজের বাইরেও?

—কাজের বাইরে তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক আছে আমার?

বাপী বিনয়-বিনম্র। মাথা নেড়েছে, নেই।

—এখন আমি তোমাকে কিছুই বলব না। যা বলার মিস্টার চালিহা বলবেন। তোমার কিছু জিজ্ঞাসা থাকলে তাঁকেই বলবে।

বাপী এরপর অনায়াসে ফিরে প্রশ্ন করতে পারত, ফাঁক পেলে তাকে মাঝে মাঝে আসতে বলা হয়েছিল কেন। জিগ্যেস করল না। আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে জয়েন করার পর থেকেই মহিলার এমনি কড়া মেজাজ দেখছে। আবুর ভাষ্য অনুযায়ী এক চালিহা ছাড়া আর সব কর্মচারীর সঙ্গে এই গোছের আচরণ ঠাকরোনের। বাপীর ধারণা অন্য রকম। ওকে নেবার উদ্দেশ্যটা বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলেই শুরুতে লাগামের মুখে রাখছে। দরকার বুঝলেই ছপটি চালাতে পারে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর একই সঙ্গে চালিহার মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে যোগ্যতা যাচাইয়ের মহড়াও নিচ্ছে বোধ হয়। ক’দিন আগের সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা লোককে শুধু মুখের কিছু কথা শুনে একটু বেশি প্রশ্রয়ই দিয়ে ফেলা হয়েছে ভাবাও বিচিত্র নয়।

অতএব বাপী বুদ্ধিমাদের মতোই নরম মুখে বাংলো থেকে নেমে এসেছে। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে আর ও-মুখো হয় নি। গায়ত্রী রাইও তার অস্তিত্ব ভুলেছে যেন। একবারও ডাকে নি। এই কারণেই বাপীর আরো বদ্ধ ধারণা, সে তার লক্ষ্যের মধ্যেই আছে, আর তার প্রতিদিনের খুঁটিনাটি হিসেবও মহিলা রাখে। হিসেব কে দেয় বাপী সঠিক না জানলেও আঁচ করতে পারে। রণজিৎ চালিহা খুব সম্ভব। তাই যদি হয় তো এটা মহিলার যে সূক্ষ্ম সপটু চাল একটা, বাপী অস্বীকার করবে না।

টাইপিস্টকে তার ঘর ছেড়ে মেশিনপত্র নিয়ে অ্যাকাউনটেন্টের ঘরে চলে .. যেতে হয়েছে। তার ছোট ঘরখানা বাপীকে মোটামুটি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। রণজিৎ চালিহার তুলনায় সে-সজ্জা কিছুই নয়। তার মতো ওর ঘরের দরজায় নামের ফলকও কিছু বসানো হয় নি। কি পোস্ট বা কি চাকরি, সে সম্পর্কে এক কর্ত্রী ছাড়া আর কারোরই হয়তো ধারণা নেই। পশ্চিম বাংলার জন্য কাজকর্ম শেখানো হবে শুনেছিল, কিন্তু কাজে লাগার পর আর কিছু কানে আসে নি।

সকাল দশটার পাঁচ-দশ মিনিট আগেই হাজিরা দেয়। অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্ট আসে সাড়ে ন’টায়। চালিহা এলে বাপী তরফদার কর্তব্যবোধে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ফর্সা মুখের মিটিমিটি হাসির অর্থও খুব অস্পষ্ট নয়। গায়ত্ৰী রাই তাকেও নিশ্চয় ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে সে-ই আসল মুরুব্বি ওর।

রণজিৎ চালিহা আগে তাকে ফার্মের ফাইল পড়তে হুকুম করেছে। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, ফাইল পড়লে মোটামুটি ধারণা হবে। আর বলেছে, জঙ্গলটা ভালো করে স্টাডি করো, জঙ্গল থেকেই আমাদের যা-কিছু। জঙ্গলের প্রসঙ্গে সাপ ধরা আর কেনা-বেচার ব্যাপারটা আরো ভালো ভাবে অর্গ্যানাইজ করা দরকার সে-কথাও বলেছে।

উড়ো খই গোবিন্দের পায়ে। ওকে নিয়ে চালিহার হাবভাবও অনেকটা সেই রকমই। সকালে সামনে এসে দাঁড়ালে মুচকি হেসে জিগ্যেস করে, ফাইল দেখছ?

বাপী সবিনয়ে মাথা নাড়লে বলে, বেশ। তারপরেই নিজের কাজে ব্যস্ত ভাব।

দ্বিতীয় সপ্তাহের তৃতীয় দিনে আপিসে ঢুকতেই অ্যাকাউনটেন্ট বলল, আপনার সাইকেলটা একবার দেখে নিন—

ঈষৎ অবাক চোখে ঘরের দেয়ালের গায়ে বাপী একটা ঝকঝকে নতুন সাইকেল ঠেস দেওয়া দেখল। দামী ভালো সাইকেল। অ্যাকাউনটেন্ট জানালো মালিকের হুকুমে এটা তার জন্য কেনা হয়েছে। এগিয়ে এসে বাপী ওটা নাড়াচাড়া করে দেখল একটু। অ্যাকাউনটেন্টকে বলল, ঠিক আছে। সে তার চেয়ারে গিয়ে বসার পরেও বাপী ওটার দিকে চেয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। পুরনো স্মৃতি ব্যথার মতো ভেতর থেকে ঠেলে উঠছে।…নতুন নয়, একটা পুরনো সাইকেলের স্বপ্ন দেখেছে কত দিন। সাইকেল-সাইকেল করে পিসীকে জ্বালাতন করে মেরেছে আর গরিব বাপের গালাগাল খেয়েছে। মিষ্টিরা আসার পর সাইকেলের লোভ আরো বেড়েছিল। ও সাইকেল চালাবে…পিছনের ক্যারিয়ারে মিষ্টি থাকবে।

চালিহা আসতে সচকিত। অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্ট শশব্যস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই মাঝারি ঘরের ভিতর দিয়ে তার ঘরে ঢোকার পথ। বাপীরও। একটা নতুন সাইকেলের সামনে ওকে দেখে সেও দাঁড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ওটা কার?

অ্যাকাউনটেন্ট জানালো, মিস্টার তরফদারের জন্য কেনা হয়েছে।

কার নির্দেশে কেনা হয়েছে সেটা বুঝে নিতে চালিহার এক মুহূর্ত সময় লাগল না। সপ্রতিভ তৎপরতায় মাথা নাড়ল।—ও, হ্যাঁ…। যেন জানাই ছিল—সাইকেল একটা কেনা হবে। মুরুব্বির সুরে চালিহা বলল, ঘরে বসা কাজ নয় আমাদের, ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য তৈরি হও।

নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আর তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিজের তৎপরতা দেখালো। তার সইয়ে একটা টাইপ করা চিঠি এলো বাপীর টেবিলে। কারো নামে চিঠি নয়। ব্যবসায়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাপী তরফদারের নামে পরিচয়পত্র। এটা পাঠিয়ে রণজিৎ চালিহা যেন একপ্রস্থ রসিকতা করল ওর সঙ্গে। অর্থাৎ, সাইকেল পেয়েছ, পরোয়ানাও দিলাম, এবারে চরে খাও দেখি কেমন মুরোদ

রণজিৎ চালিহা এক পা-ও এগোতে সাহায্য করবে এ-রকম প্রত্যাশা বাপীর কোনো সময় ছিল না। কর্ত্রীরও নেই নিশ্চয়। কিন্তু তার যাচাইয়ের রীতি বিচিত্র। ওপরঅলার মতো চালিহাকে সামনে রেখে পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কাজকর্ম সম্পর্কেও কোনো আদেশ নেই, কিন্তু সাইকেল দেবার পিছনে কিছু ইঙ্গিত আছে। সেই ইঙ্গিত রণজিৎ চালিহাও বুঝেছে। তাই সাততাড়াতাড়ি পরিচয়-পত্র পাঠিয়ে দায়িত্ব সেরেছে। এখন বাপী শূন্যে ঝোলে কি হাল ছাড়ে, দু’জনার কাছেই সেই পরীক্ষা।

পায়ের নিচে মাটি চাই বাপীর। এখানে যা ফাইল আছে সব তার খুঁটিয়ে পড়া আছে। এবারে নিজস্ব ফাইলে মাইল দশেকের একটা গণ্ডী টেনে নিয়ে কাজ শুরুর ছক ঠিক করে নিল। এই এলাকার মাল বানারজুলির গোডাউন থেকে চালান যায়। ভুটানের এলাকা পর্যন্ত ধরলে আরো দুটো গোডাউন আছে। এখানকারটাই বড়। এখান থেকে উত্তর বাংলা আর তার বাইরেও অনেক জায়গায় মাল চালান যাচ্ছে। কিন্তু বাহন সাইকেল, দূরের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। খুচরো মালের কারবার নেই যখন, এই দশ মাইল পরিধির পাইকিরি খদ্দেররাই তার লক্ষ্য। তাদের নাম-ধাম বার করে কে কত মাল আর কত রকমের মাল নিয়ে থাকে তার একটা খসড়া করে নিল। যারা আগে মাল নিত, কিন্তু এখন নিচ্ছে না বা কম নিচ্ছে—তারাও এই নিজস্ব ফাইলে এলো।

সাপ চালানের ব্যবসা দেখার ব্যাপারে জোর দিয়েছিল রণজিৎ চালিহা। এর ফাইল কটাও খুঁটিয়ে দেখে নিল বাপী। কারা যোগান দিচ্ছে, কারা কিনছে, আর কত চাহিদা। চাহিদা বলতে গেলে আরো ঢের বেশি। এদিকেও নজর দেওয়া ঠিকই দরকার। এ-ব্যাপারে আবুর সঙ্গেই পরামর্শ করতে হবে। আবু বাড়িয়ে বলে নি, এখনো যে পর্যায়ের সাপ যে দামে কেনা হচ্ছে আর যে দরে বিক্রি করা হচ্ছে তার মধ্যে অনেক ফারাক। অর্থাৎ লাভ অনেক।

মদ বিক্রি আর নেশার গাছ-গাছড়া ফলমূল বিক্রি থেকেও বছরে এন্তার টাকা আসে বাপী শুনেছিল। কিন্তু এ-সবের কোনো ফাইলের চিহ্ন নেই এই দপ্তরে। এ—সব সুড়ঙ্গ পথের কারবার, থাকবে না জানা কথাই। এই কারবারে মালিকের একমাত্র দোসর সম্ভবত রণজিৎ চালিহা। আবু রব্বানীও কিছু ভাগ পায় কিনা সঠিক জানে না।

সেদিন শনিবার। টাইপিস্ট আর অ্যাকাউনটেন্ট দুটোর পরে চলে গেছে। চালিহা আপিসেই আসে নি। বেয়ারাটা এই আপিসেই থাকে বলে সে আছে। আর নিজেরই গরজে বাপী আছে।

বেলা পাঁচটা নাগাদ হাতব্যাগ দোলাতে দোলাতে যে ঘরে ঢুকল তাকে এখানে দেখে বাপীর অবাক হবারই কথা। ঊর্মিলা রাই। পরনে হাল্কা সবুজ শাড়ি। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। সুন্দরই লাগছে। কিন্তু বাপীর চোখ সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করছে না। এখানে আসার হেতু বুঝতে চেষ্টা করছে।

ঊর্মিলা এগিয়ে এসে টেবিলে ছড়ানো ফাইল কটা দেখল। তারপর বাপীর দিকে তাকালো। গম্ভীর। বলল, বাপী ইজ এ গুড বয়, শনিবারে বিকেল পাঁচটার পরেও কাজ করছে। মা জানলে খুশি হবে।

বাপী জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার?

—ব্যাপার কিছু না। বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। বেয়ারাটা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, তুমি এখনো আপিসে আছ। তাই ইন্সপেকশনে এলাম। আমিও কাগজে কলমে ব্যবসার পার্টনার একজন জানো তো?

—জাগা না ঘুমন্ত?

—তার মানে?

—স্লিপিং পার্টনার কিনা জিগ্যেস করছিলাম।

—এখন পর্যন্ত স্লিপিং। মা জাগাতে চেষ্টা করছে।

বাপী বলল, তাহলে দয়া করে বসা হোক।

টেবিলের উপরেই ধার ঘেঁষে বসল ঊর্মিলা। বসার এই অন্তরঙ্গ চিত্রটা বরদাস্ত

করার ইচ্ছে নয় বাপীর। বলল, চেয়ারগুলো কি দোষ করল?

—কেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে?

— হচ্ছে।

—কি অসুবিধে?

—দেখতে ভালো লাগছে না, এই অসুবিধে…

টেবিল থেকে নেমে ছদ্ম কোপে মেয়েটা চোখ পাকালো প্রথম। তারপর হেসে ফেলে একটা চেয়ার টেনেই বসল। বলল, এ-রকম অসুবিধে হতে দিতে আমিও রাজি নই।

বাপী জিজ্ঞেস করল, একলা বেড়াতে বেরিয়েছ?

সঙ্গে সঙ্গে রাগ।—কেন, আমি বাচ্চা মেয়ে না বাঘ-ভালুকে খাবে?

—তুমিই সেদিন বলেছিলে, মা একলা বেরুতে দেন না, সঙ্গে কেউ একজন থাকেই।

মনে পড়ল। তার পরও বিরক্তি চাপা থাকল না।—আজও ড্রাইভার আছে, মায়ের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। মা-কে আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, বেশি আগলাতে চেষ্টা করলে আবার বাড়ি ছেড়ে পালাব।

বাপীর মুখে নিরীহ বিস্ময়।—আবার বলতে?

ঊর্মিলা থমকালো। তারপর হেসেই জবাব দিল, একবার রাগ করে শিলিগুড়ি পালিয়ে গিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে দু’দিন ছিলাম। তার পরেই এ-প্রসঙ্গের ওপর যবনিকা। কাজ কি-রকম বুঝছ?

—চেষ্টা করছি।

—আঙ্কলের কাছ থেকে ক্ষমতা-টমতা কিছু আদায় করতে পেরেছ?

—এখন পর্যন্ত কিছু না।

—সে কি! কাল রাতেই তো আঙ্কল মা-কে বলছিল, তোমাকে একেবারে ফ্রি-হ্যান্ড দিয়েছে।

এটা কত নম্বরি চাল চালিহার বাপী ঠাওর করে উঠতে পারল না। সাদা মুখ করে বলল, ফাইল পড়তে বলেছেন আর জঙ্গল স্টাডি করতে বলেছেন। আর গত পরশু ফার্মের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে একটা অ্যাক্রেডিটেশন দিয়েছেন। তোমার মা না চাইলে ক্ষমতা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না—

বাধা দিয়ে ঊর্মিলা বলে উঠল, মা কিছুই বলবে না বা কিছুই করবে না। চুপচাপ বসে তোমার মুরোদ দেখবে শুধু। একটু থেমে আবার বলল, তবে তুমি যখন আমার ফ্রেন্ড, তোমাকে চুপি চুপি বলে রাখতে পারি…তোমার ওপর মায়ের অনেক আশা—

বাপীর নিরীহ মুখ। চুপচাপ চেয়ে আছে —

—সব জেনে বুঝেও হাঁ করে চেয়ে থেকে বোকা সাজছ কেন? হাসল।— সত্যিকারের বন্ধু হলে আমিও তোমাকে কিছু কিছু সাহায্য করতে পারি।

মায়ের আশা আর নির্ভরতা আছে বলেই মেয়েও বন্ধুত্ব পাতিয়ে ওকে হাত করতে চায় এটুকু স্পষ্ট। সাহায্যের কথায় বাপী ঔৎসুক্য দেখালো।— কি রকম?

—মা তো চায়ই আমি একটু-আধটু কাজকর্ম দেখি। দেখব। কিন্তু আসলে আমার দ্বারা এ-সব কিচ্ছু হবে না। আঙ্কল তো মাসের মধ্যে সতের দিন টুরে কাটায়—আজও চার দিনের টুরে বেরুলো। সে না থাকলে এখানকার কাজে কি অসুবিধে হয়, আর কত রকমের গলদ দেখা দেয় সেটা বুঝতে তোমার আর কত সময় লাগবে? তুমি আমাকে বলবে, আর আমি তোমার একান্ত প্রশংসা করে মা-কে বলব। দায়িত্ব তখন তোমার হাতে সেধে আসবে দেখে নিও।

ওই মায়ের মেয়ের বুদ্ধি নেই কে বলবে।

হাসি মুখেই ঊর্মিলা আবার বলল, আমার প্রশংসার অনেক দাম আছে বুঝলে ফ্রেন্ড! এক রেশমা ছাড়া মা আমার মুখে আর কারো প্রশংসা শোনে নি কখনো—

—রেশমার অত ভাগ্য কেন?

—ও সত্যিকারের ভালো মেয়ে বলে। ভালো কথা, ওর মজুরিটা তুমি চটপট বাড়িয়ে দাও দেখি—

—কিসের মজুরি?

—সাপ ধরার। প্রাণের মায়া ছেড়ে জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়ায়, অথচ পাওনার বেলায় ওর ওপর অনেকদিন ধরে অবিচার হচ্ছে শুনেছি।

—আমি মজুরি বাড়িয়ে দেব?

—নিশ্চয় দেবে, যার যা পাওনা তাকে তা দেবে না কেন?

—রেশমার ওপর অবিচারের কথা তোমার মা-কে বলো না কেন?

—বলতে বাকি রেখেছি! মায়ের মতো রেশমাও দু’ চক্ষে মদ খাওয়া দেখতে পারে না বলে মা ওকে পছন্দও করে, বিশ্বাসও করে—আমি বলতে ওকে রূপোর গয়নাও গড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেনা-পাওনার ব্যাপারে কখনো আঙ্কলের কাজে মাথা গলাবে না।

—আঙ্কলকে বলো না কেন?

হুঁঃ। বলা হয়েছে—তার কি মতলব কে জানে।

বাপী ভাবল একটু। বলল, সকলকে ছেড়ে প্রথমেই একটা মেয়ের জন্য আমার মাথাব্যথা দেখলে তোমার মা কি ভাববেন।

যুক্তিটা মেনে নিয়েও ঊর্মিলা হেসে উঠল।—ভাববে তুমি মজে গেছ। মরুকগে, আঙ্কলকে আমার কথা বলেই না হয় ওর মজুরিটা বাড়াতে চেষ্টা করো—অবিচার হচ্ছে বলে গত বছর থেকে মেয়েটা রাগে ফুঁসছে।

—ঠিক আছে। এবারে আলতো করে বাপী জিজ্ঞেস করল, তোমার সত্যিকারের বন্ধু হতে হলে আমাকে কি করতে হবে সেটা বললে না তো?

জবাবে ভূকুটি। সেই সঙ্গে ঠোঁটে হাসি।——ধরে বাঁদর নাচ নাচাতে চাইলেও সেটা বরদাস্ত করতে হবে।

.

সাপ চালানো আর চাহিদার হিসেব শুনে আবু রব্বানী বিড়ি দাঁতে চেপে এমন ভাবে তাকালো যার অর্থ, বাপীর বুদ্ধির দৌড় দেখে সে অবাকই হয়েছে। বলল, যত সাপ ধরা হয় আর চালান যায় তার সব হিসেব খাতায় ওঠে তুমি ভাবো নাকি! এর মধ্যে কালো ব্যাপার কিছু নেই?

বাপী এ-দিকটা ভাবে নি বটে। তবু চাহিদার ব্যাপারটা আবু অস্বীকার করল না। সাপ ধরার পার্টি আরো গোছালো ভাবে বড় করা যায় এও ঠিক। কিন্তু লাভের কড়ি আরো কিছু না খসালে তা হবে কেন? লাভের খবর এখন আর কে না রাখে? এ-ব্যবসায় তো মালিকদের শুধু মুনাফা লোটা ছাড়া আর কোনো কষ্ট করতে হয় না, তাহলে লাভের ন্যায্য ভাগ ওদের দেবে না কেন? আর এ-কাজে মেহনত বাড়ালে আবুরই বা বাড়তি লাভটা কি? মাস গেলে দুলারির নামে দিচ্ছে তো মাত্র পঞ্চাশটি টাকা।

আর কিছু অসুবিধের কথাও শুনল বাপী। গরীব বেদে-বেদেনীরা সাপ ধরলেই নগদ টাকা আশা করে। সেই ব্যবস্থাও দরকার। ম্যানেজার কত সময় থাকে না, তখন এক পাওনা পেতে ওদের কতদিন ঘুরতে হয়। অবশ্য টাকা অনেক সময় মালকান আগাম দেন, কিন্তু ম্যানেজারের সই না হলে হিসেব মেটে না। আবার অনেক সময় মেমসায়েবও পাহাড়ের বাংলোয় বা এ-ধার ও-ধার চলে যান। এই লোকগুলো তখন বিরক্ত হয়ে আবুকেই পাঁচ কথা শোনায়। বড় দল যে করবে, সম্বৎসরে কটা টাকা ওরা পায়—বছরের মধ্যে শীতের পাঁচ মাস মনসা মায়ের সন্তান-সন্ততিরা তো গর্তেই সেঁধিয়ে থাকে, আর বর্ষায় ওঁরা বাড়েন বটে কিন্তু ধরা পড়ে কম। সময়ে ভালো রসদ না পেলে দল বেঁধে ওরা জানের ধকল পোহাতে আসবে কেন?

বাপী কথা দিল, মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে যতটা সম্ভব সুব্যবস্থা করবে। কিন্তু ওর মুখ চেয়েও এ বছর সাপের চালান বাড়ানোর কথা আবুকে ভাবতে হবে। তারপর জিগ্যেস করল, রেশমার মজুরি নিয়ে অবিচার হচ্ছে শুনলাম, সেটা কি ব্যাপার?

আবুর একটা চোখ ছোট মানেই রসের খোরাক পেয়েছে।—অবিচারের কথা কে বলল?

—ঊর্মিলা রাই।

আবু হেসে মাথা নাড়ল।—অবিচার হচ্ছে আর সেটা হচ্ছে ওই ম্যানেজারের বজ্জাতির জন্য।

কি বজ্জাতি তাও শুনল। সাপ ধরতে সাধারণত দু’জন করে লোক লাগে। বেদেদের সঙ্গে অনেক সময় বেদেনীরাও থাকে, কিন্তু মজুরির হিসেব হয় পুরুষের নামে। রেশমার বেলায় হিসেব হয় ওরই নামে। সঙ্গীকে রেশমা ছ’আনা বখরা দেয়। ও-ই মুরুব্বি। চালিহার বিবেচনায় সব জায়গাতেই পুরুষের তুলনায় মেয়ের মজুরি কম। রেশমার রাগ কম কেন হবে, চালানের সময় কি সাপের গায়ে লেখা থাকে এটা মেয়েছেলে ধরেছে! এদিকে গুনলে রেশমাই সব থেকে বেশি যোগান, দেয়। ও সাপের গর্ত চেনে, শীতের সময় শুধু ও-ই খুঁজেপেতে মাস গেলে দু—পাঁচটা সাপ ধরে আনে।

—তাহলে ওর ওপর এই জুলুম কেন?

আবুর এক চোখ ছোট আবার।—একটু বাড়তি তোয়াজ তোষামোদের আশায়। এবার বুঝেছ?

হাসতে গিয়েও আবুর মনে পড়ল কি। গলা খাটো করে বলল, সেদিন তুমি চলে যেতে দুলারি আমাকে বকাঝকা করছিল। সে-ও বলেছিল তোমাকে নেবার ব্যাপারে মেমসায়েবের মতলব রেশমারও না জানাই ভালো।…মেয়েটাকে দুলারিই সব থেকে বেশি ভালবাসে, কিন্তু ওর মেজাজ-মর্জির ওপর বিশ্বাস নেই। তোমার ওপর কখনো রেগে গিয়ে ওই শালার ম্যানেজারকে তোষামোদ করার জন্য যদি কিছু লাগিয়ে দেয় তাহলে চিত্তির। আবু বড় করে তাকালো বাপীর দিকে, এই জন্যই তুমি রেশমাকেও জানাতে বারণ করেছিলে, তাই না?

বাপী অস্বীকার করতে পারে নি। কিন্তু দুলারি যে এত চতুর ধারণা ছিল না। রবিবারের এই দুপুরেই রেশমার সাপ ধরা দেখেছে বাপী। ভয়ডর ওর নিজেরও কম, কিন্তু রেশমার আর তার সঙ্গীর দুঃসাহস দেখে বার বার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়েই ওরা বেরোয় বটে।

শুনল এই মৌসুমে এর মধ্যে আর একদিন মাত্র বেরিয়েছিল ওরা। কিন্তু তখনো শীতের আমেজ ছিল বলে একটাও মেলেনি। আজ এই দ্বিতীয় দফা বেরুলো। আবুর মুখে খবরটা শুনে বাপী আগেই রেশমার ঘরে এসে হাজির হয়েছিল। খুশি মুখে রেশমা টিপ্পনী কেটেছিল, ভয় পেয়ে আবার কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাঁধাবে না তো?

কেলেঙ্কারি শব্দটা খট্ করে কানে লাগল বাপীর। সেটা বুঝেই রেশমা আবার বলল, ওই হারমা’র আগে যাকে কাজ শেখাতে গেছলাম প্রথম দিন একটা কেউটে ফণা তুলে ফোঁস করে উঠতেই ভয়ে আমাকে একেবারে জাপটে-মাপটে ধরেছিল।

দু’চোখ জোর করেই অন্যদিকে ফিরিয়েছে বাপী। এ কথার পর মেয়েটা আরো বেশি চোখ টানছিল। সাপ ধরতে বেরুনোর পোশাক বলতে পরনে একটা আঁট জাঙ্গিয়া আর গায়ে তেমনি আঁট গেঞ্জির মতো জামা একটা। পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো ব্যস। মেয়েটার এই যৌবন শাসনে রাখা ওই বেশের সাধ্যের বাইরে।

রেশমার এই সঙ্গীর নাম হারমা। এদিকেরই আদিবাসী। সমবয়সীই হবে দু’জনে। স্বাস্থ্য ভালো, হাবাগোবা মুখ। কিন্তু চাউনি সন্দিগ্ধ। প্রথম দেখেই বাপীর মনে হয়েছে রেশমার কাছে বাবুমানুষ আসাটা পছন্দ নয়। জঙ্গলের পথ ভাঙার ফাঁকে হেতুও বুঝেছে। ভক্ত মুগ্ধ হয়ে যা হয়, তাই। মুখে কথা নেই, কিন্তু চোখ দুটো নারী-অঙ্গ ছেড়ে নড়ে না। শিকারের সময়েও কি এই মুগ্ধ ভক্ত ওর দিকেই চেয়ে থাকে নাকি! তাহলে তো ছোবল খেয়ে মরার কথা।

সাপ ধরার সরঞ্জামও সাদাসিধে। হাতে এক ইঞ্চি মোটা আর দু’ হাত লম্বা একটা করে লাঠি। লাঠির এক মাথায় কম্বলের টুকরোর মতো ছোট জাল আটকানো। আর বিপাকের হাতিয়ার হিসেবে কোমরে ছোরা গোঁজা। হারমার বগলে সরু আর গোল বেতের ঝুড়ি একটা, তার মধ্যে ছোট ছোট কতগুলো দড়ির ফাঁক লাগানো থলে।

প্রথমেই অনায়াসে বড়সড় একটা নির্বিষ সাপ ধরে থলেতে পুরল ওরা। নির্বিষ সাপে পয়সা অনেক কম, কিন্তু বউনি ছাড়তে নেই। রেশমা ছুটে গিয়ে লাঠির মাথায় আটকানো কম্বলের জাল মাথায় ফেলতেই হারমা শক্ত দুহাতে ওটার গলার কাছটা চেপে ধরে ঝুড়িতে ঢুকিয়ে দিল। তারপর থেকেই গায়ে কাঁটা বাপীর। একটা সাদা-কালো শাঁখামুটের পেছনে তাড়া করেছে ওরা। এরও ফণা নেই, কিন্তু অতি বিষাক্ত। এবারে লাঠির জালের দিকটা ওদের হাতে। তরতর করে একটা গাছের দিকে এগোতে যাচ্ছিল, তার আগেই রেশমা লেজের ওপর লাঠির ছোট ঘা বসালো একটা। সাপটা ওর দিকে তেড়ে আসতেই পিছন থেকে হারমা তেমনি লেজে ঘা মারল। এই চলল মিনিট কতক। রেশমাকে তাড়া করে তো হারমা লেজে ঘা মারে। আর হারমাকে তাড়া করে তো রেশমা। বিষাক্ত সাপের বেলায় দেখা গেল শেষ কাজ রেশমার। ফাঁক বুঝেই খপ করে এক হাতে গলার কাছটা চেপে ধরে মাটি থেকে তুলে ফেলল, আর গায়ে জড়ানোর আগেই অন্য হাতের মুঠো আর আঙুল সাঁড়াশির মতো খানিকটা নিচের দিকে চেপে ধরেছে। চোখের পলকে হারমার লাঠির জালের দিকটা শাঁখামুটের মুখের ওপর। বিষদাঁত এই কম্বলের জালে আটকে গেল। তারপর ঝাঁপি থেকে থলে বার করে জাল সরিয়ে ওটার মুখে ধরলেই হল—তখন লেজ ওপরে মুখ নিচে। থলেতে না ঢুকে যাবে কোথায়?

এই দেখেই ঘাম ছুটেছিল বাপীর। তারপর দেড় ঘণ্টার মধ্যে পঁচিশ মিনিটের ফারাকে দু’দুটো গোখরো ধরা দেখে শরীরের রক্ত জল। প্রথমটা কম করে ছ’ফুট লম্বা হবে, পরেরটাও পাঁচ ফুটের কম নয়। আর তেমনি চক্কর বসানো বীভৎস ফণা। ধরার কায়দা একই, তবে ফণা আছে বলে আরো হুঁশিয়ার ওরা। ছোবল দেবার জন্য একজনের দিকে ফণা তুললেই অন্যজন লেজে বাড়ি দেয়। সেদিকে ফণা তুললেই অন্যজন তাই করে…রেশমার বুকের পাটা সম্পর্কে আবু বলেছিল, বিষাক্ত সাপগুলোর খপাখপ টুটি টিপে ধরা দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। একটুও বাড়িয়ে বলে নি। দেখেই বাপীর কালঘাম ছুটেছে। টুটি যখন চেপে ধরে তখন রক্তবর্ণ মুখ রেশমার, আর চোখ দুটোও তখন সাপের মতোই ভয়াবহ। এক হাতে এই সাপ মুঠোয় ধরে রাখা যায় না, একটু বাদেই দু’হাতে লাগাতে হয়। ততক্ষণে সাপের তলার দিকটা হারমার এক হাতের মুঠোয়। মুখে জাল লাগিয়েই অন্য হাতে ঝাঁপি থেকে থলে বার করবে।

রেশমা হাঁপাচ্ছে আর বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। আবার হাসছেও। মুখ এখনো লাল। কাজ সারা হতেই ভক্ত শুরমার মুগ্ধ দু’ চোখ আবার ওর দিকে তন্ময়।

বাপীর দিকে চেয়ে রেশমা বলল, রোসো, ওটার জোড়টাও এক্ষুনি এ-দিকে এলো বলে। সম্ভব হলে বাপী রেশমাকে টেনে নিয়ে চলে যেত। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, মিনিট পঁচিশের মধ্যে কোথা থেকে বেরিয়ে সাপটা সোজা তেড়ে এলো। কি ঘটেছে আঁচ করতে পেরেই হয়তো এই হিংস্র আক্রোশ। এটাকেও থলেতে পোরার পরে এই দিনের মতো ক্ষান্ত হল রেশমা।

খুশিতে আটখানা। তুমি আমার খুব পয়মন্ত লোক দেখি যে বাপীভাই! দু’—ঘণ্টার মধ্যে তিন-তিনটে জাতসাপ ধরে ফেললাম। তোমার পয়ে একটা শঙ্খচূড় পেলে হত—একটাতেই ডবল টাকা।

রেশমার হুকুমে ঝুড়ি মাথায় হারমা আগে আগে চলেছে—আবু সাহেবকে দেখিয়ে ওটা সাপ-ঘরে রেখে আসবে।

বাপী বলল, ভালো টাকা রোজগার হল আজ তাহলে?

—হলই তো। সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে রাগের ঝলক।—অন্য লোকে ধরলে আরো বেশি টাকা পেত, আমি বলে ওই ম্যানেজারের বজ্জাতির জন্য কম পাই। এই তিনটে বিষাক্ত সাপের জন্য অন্য লোকে কম করে তিন-পাঁচে পনের টাকা পাবে।

—আর তুমি?

—আমাকে দেবে বারো টাকা। এর থেকে হারমাকে ছ’আনা ভাগ দিলে আমার কি এমন থাকে?

অর্থাৎ একটা সাপের জন্য চার টাকা। ওর ভাগে থাকে আড়াই টাকা। বুকের তলায় মোচড় পড়ছে বাপীর। মাত্র আড়াইটে টাকার জন্য এক-একবার হাতের মুঠোয় প্রাণ!

রেশমার আবারও ঝাঁঝালো গলা—ওই ম্যানেজারকে বলে আমার পাওনাটা এবারে তুমি ঠিক করে দাও না, অন্যের থেকে আমি কম পাব কেন?

—আমি বললে বেশি দেবে?

—হাড় পাজি ওটা, এমনি বললে দেবে না, একটু তোষামোদ করে বলতে হবে।

বাপী জবাব দিল, আমার দ্বারা ওটাই তো হয় না…

—হয় না মানে, নিজের জন্যে তো বেশ তোষামোদ করতে পারো!

কি মনে পড়তে বাপীর স্নায়ুগুলো সজাগ হয়ে উঠল হঠাৎ। ভালো করে মুখখানা দেখে নিতে ইচ্ছা করল। কিন্তু খানিক আগের ভয়াল উত্তেজনা কমে আসার পর এই মেয়ের পাশাপাশি চলাটাই অস্বস্তিকর। হারমা হয়তো রাগ বা অভিমান করেই অনেকটা এগিয়ে গেছে।

সাদা মুখেই বাপী জিগ্যেস করল, তুমি পারো না তাকে তোষামোদ করতে?

—আমি? আমি ওর ঘরে কেউটে বা গোখরো ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি।

—সেই রাতে তাই ছাড়তে গেছলে?

এক ঝটকায় সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল রেশমা।—কোন্ রাতে?

—পনের-ষোল দিন আগে যে রাতে আবুকে সঙ্গে করে আমি নিজের জন্য তোষামোদ করতে গেছলাম?

কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত মুখ। তারপরেই দু’ চোখ ঝলসে উঠল।— তোমাকে কে বলল?

—কেউ না। আমার ধারণা তুমি তখন ম্যানেজারের ভিতরের ঘরে ছিলে। বাপী হাসছে অল্প অল্প। অত চোখ লাল কোরো না, সরো!

ছিটকে সরে গিয়ে রেশমা দ্রুত হেঁটে চলল। একটু বাদেই গাছগাছড়ার আড়ালে।

বাপী সেখানেই আরো খানিক দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মাস্টার মশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুমের মুখখানা মনে পড়ল। পেটের দায়ের সেই মুখের সঙ্গে রেশমার এই মুখের অনেক তফাৎ।

রেশমা বারবর্ণিনী নয়। রেশমা ফণিনী।

সোনার হরিণ নেই – ১৪

দু’তিনখানা চেয়ার পড়ে সামনে সে-রকম চিলতে বারান্দা। মাঝারি সাইজের শোবার ঘর একটা। আর পিছনে পার্টিশন করা দুটো ছোট খুপরি। কিচেন আর বাথ। যেমন কথা হয়েছিল গায়ত্রী রাই তার কিছু বেশিই করে দিয়েছে। নিজের বাংলো থেকে জলের পাইপ আর ইলেকট্রিকের লাইন টেনে দিয়েছে। কাঠের কাজ সব, নগদ টাকা ফেললে এটুকু কনস্ট্রাকশনের জন্য কন্ট্রাক্টারের কত আর সময় লাগতে পারে। রাশভারী মহিলার তাড়ায় দেড় মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ। মাঝে মেহেদির পার্টিশন বসানোও। একদিকের বারান্দা বা ঘর থেকে অন্যদিকের বাংলো শুধু দেখা যায়। মানুষ দেখা যায় না।

কর্ত্রীর নির্দেশে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে বাপী তরফদার চা-বাগানের ক্লাব ছেড়ে এই বাসস্থানে উঠে এলো। মহিলাকে এই দু’ মাস ডাটাবাবুর চড়া বিল মেটাতে হয়েছে। এ-সময়টা বাপীকে পঞ্চাশ টাকা করে পকেট খরচ দেওয়া হয়েছে। দু’বেলার চা-জলখাবার পর্যন্ত ব্যবসার অ্যাকাউন্টে গেছে যখন বাপীর পাঁচ টাকারও দরকার হয় নি। অ্যাকাউন্টেন্ট পঞ্চাশ টাকা হাতে তুলে দিতে কর্ত্রীর নির্দেশ বুঝে সে-ও নিয়ে নিয়েছে।

এর মধ্যে আর মাত্র দু’দিন বাপী তরফদার এখানে এসে কর্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিল। অ্যাকাউন্টেন্ট প্রায় রোজই আসে। প্রথমবার তার মারফৎ বাপী খবর পাঠিয়েছিল, দেখা করা দরকার। গায়ত্রী রাই সেই বিকেলেই তাকে যেতে বলেছে। আর বারান্দায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো গলায় বলেছে, খবর পাঠানোর মানে কি, দরকার পড়লে নিজে চলে আসতে পারো না?

বাপী তক্ষুনি রাগের হেতু বুঝেছে। অ্যাকাউন্টেন্ট আর টাইপিস্ট দু’জনেই রণজিৎ চালিহার বশংবদ। জানান দিয়ে দেখা করতে আসাটা গোপন না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কাজে নামার পর সেই কদিনে বাপীর মনের জোর আর বিশ্বাসও কিছু বেড়েছে। ঠাণ্ডা মুখেই জবাব দিয়েছিল, দরকার পড়লে চলে আসার ব্যাপারে আপনিই একটু অসুবিধের সৃষ্টি করেছেন। কখন এলে অখুশি হবেন না বা তাড়িয়ে দেবেন না আমার পক্ষে বোঝা মুশকিল।

মুখের ওপর কথা বরদাস্ত করার মেজাজ নয় মহিলার। কিন্তু সেই তপতপে চাউনির সবটাই খুব অকৃত্রিম মনে হয় নি বাপীর। গম্ভীর। হুকুম করেছে, বোসো।

দুপুরে রোজই সাইকেল নিয়ে বেরুচ্ছ?

বাপী মাথা নাড়তে আবার বলেছে, দুপুরের দিকে আমি ফ্রি থাকি, দরকার পড়লে তখন এসো।

বাপীর হাতে তার সেই নিজস্ব ফাইল আর সঙ্গে মাঝারি সাইজের একটা ডায়রি। দশ মাইল জুড়ে রোজ ঘোরাঘুরির ফলে ফাইল আরো পুষ্ট হয়েছে। ডায়রিতে প্রতি দিনের কাজের হিসাব। কোন্ তারিখে কোথায় কোন্ পার্টির সঙ্গে দেখা করেছে, তাদের কি অসুবিধা বা অভিযোগ ইত্যাদি।

বাপী ফাইল খুলতেই মহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে ভিতরের ঘরে গেছে। একটু বাদে খাপসুদ্ধু পড়ার চশমাটা নিয়ে এসেছে। সেই ফাঁকে বাপী দেখেছিল পাশের জমিতে তার ঘর উঠছে। আর এদিকে তিন-তিনটে মালী মেহেদির পার্টিশন বসানোর জন্য মাটি খুঁড়ছে। কিন্তু মহিলা এ-সম্বন্ধে সেদিন একটি কথাও তোলেনি। ফলে বাপীও নিরাসক্ত।

শৌখিন সোনার ফ্রেমের চশমা এঁটে ফাইলটা আদ্যোপান্ত পড়েছে। ডায়েরিটাও। মুখ দেখে খুশি অখুশি কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু বাপী জানতো অখুশি হবার কোনো কারণ নেই। অঙ্কের মাথা বরাবর সাফ। ছকে বেঁধে কাজে নেমেছে। তিন সপ্তাহ আগের আর তিন সপ্তাহ পরের লেনদেনের চার্ট পাশাপাশি রেখেছে। কি কারণে ক’জন ছোটখাটো পাইকিরি খদ্দের তাদের কাছ থেকে মাল নেওয়া বন্ধ করেছিল, আর কি শর্তে আবার তারা হাত মেলাতে রাজি—ফাইলে তাও লেখা আছে।

ফাইল দেখা আর ডায়রি পড়া শেষ করে মহিলা চশমাটা আবার খাপে পুরে শোনার জন্য প্রস্তুত—বলো।

বাপী জানিয়েছিল, কাছাকাছির এইসব ছোট পাইকিরি খদ্দেরদের বেলায় আসল গলদ সময়ে মাল পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে। মাসে একবার ঝাঁকামুটে দিয়ে বা গোরুরগাড়িতে করে তাদের কাছে মাল যায়। নয়তো লরি যখন দূরে দূরে বড় চালান নিয়ে যায় তখন পথে পড়ে বলে তারা কিছু কিছু পায়। সে-ও ক্বচিৎ কখনো। এখন থেকে পনের দিনে একদিন সে যদি মাল সহ ভ্যান নিয়ে ঘুরে আসতে পারে তাহলে এই সার্কেলের ব্যবসাই যে আরো ছ’আনা বাড়ানো সম্ভব সেই হিসেব ওই ফাইলেই আছে।

গায়ত্রী রাই জিজ্ঞেস করেছিল, মিস্টার চালিহাকে বলেছ?

—বলেছি। তাঁর মতে এত ছোট কাজে লরি দেওয়া সম্ভব নয়, আর ভ্যান আপনার হেপাজতে।

একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করেছে, কমপ্যারেটিভ চার্টে এই তিন সপ্তাহের মধ্যে তুমি যে বাড়তি বিক্রি দেখিয়েছ, সেই মাল তারা পেল কি করে?

এই প্রশ্নটার জন্যই ভিতরে ভিতরে উৎসুক ছিল বাপী। নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিয়েছে, খদ্দেরদের চাহিদা জেনে গুদাম থেকে ছালায় মাল বোঝাই করে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে নিজেই পৌঁছে দিয়েছি। বিক্রি বাড়বে বোঝার পরে আপনাকে ভ্যানের কথা বলতে এসেছি।

গায়ত্রী রাইয়ের চোখে পলকের বিস্ময় দেখেছিল বাপী। এটুকুই কাম্য ছিল। বি.এস.সি পাশ ভদ্রলোকের ছেলে এই মেহনতের কাজও করতে পারে ভাবেনি

—ভ্যান পাবে। কবে চাই?

—কাল একবার পেলে ভালো হয়, চৌদ্দ দিনের মাথায় আর একবার নেব।

—ঠিক আছে।

এই ঠিক আছের অর্থ সে বিদায় হতে পারে। তার দু’দিন বাদে ঊর্মিলা বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর আবার আপিসে হাজির। আগের দিনের পর সতের দিন বাদে এই দেখা। এই দিনেও অ্যকাউন্টেন্ট আর টাইপিস্টের থাকার মেয়াদ পার করে দিয়ে এসেছে। আগের দিন বেলা এগারটা থেকে সন্ধে পর্যন্ত ভ্যানে মাল চালানোর ধকল গেছে বাপীর। পরদিন ছুটির পর নিরিবিলিতে নিজের ফাইলে লেনদেনের হিসেব লিখে রাখছিল।

ঊর্মিলার পরনে প্রথম বিকেলে দেখা সেই রঙিন ঘাগরা, গায়ে লম্বা সাদা ব্লাউস। যা-ই পরুক, মেয়েটাকে ঝকঝকে দেখায়। কিন্তু সেইদিন মুখখানা বিরস। টেবিলের সামনে এসেই বলে উঠেছিল, মা-কে ঘায়েল করে বেশ খুশি মেজাজে আছ—কেমন?

বাপী ভিতরে উৎসুক, বাইরে অবাক।—কি করেছি? বোসো।

—ভদ্রলোকের ছেলে, সাইকেলে মাল বয়েছ, কাজ দেখিয়ে মন কেড়েছ। অসহিষ্ণু হাতে চেয়ার চেনে বসল।—প্রশংসা শুনে তোমার সম্পর্কে কড়া কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, বলার মতো চট করে কিছু পেলাম না।

বাপী হেসে ফেলেছিল।—আমার ভাগ্য। কিন্তু তোমার রাগের কারণ কি?

—তোমার সঙ্গে আমার ফ্রেন্ডশিপ হবে না—সাফ কথা। আর, আমি পিছনে লাগলে তোমার খুব সুবিধে হবে না তাও জেনে রেখে দিও।

—কি মুশকিল, দোষটা কি করলাম?

—দোষ কি তুমি জানো না? রেশমাকে কি বলেছ?

যত রাগই দেখাক, বাপীর মনে হয়েছিল ওর মায়ের খুশির খবর দিয়ে তাকেও একটু খুশি করার তাগিদ আছে। জবাব দিয়েছে, কেন কি বলেছি তা বোধ হয় জানো না…

—তাও জানি। ওটা পাজির পা-ঝাড়া, তোমাকে আগে তোষামোদের খোঁচা দিয়েছিল নিজেই স্বীকার করেছে। তা বলে তুমি ও রকম করে বলবে? আঙ্কলের কাছে অনেকরকম কাজে গিয়ে থাকতে পারে।

—তা পারে তবে ভদ্রলোক তখন ড্রিঙ্ক করছিলেন, তাঁর ভেতরের ঘরে সবুজ আলো জ্বলছিল, রেশমা সেখানে ছিল।

—তোমাকে আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না, মুখ লাল ঊর্মিলার, আমি নব জানি—আমার কোনো কাজেই যদি ও গিয়ে থাকে আর আঙ্কল যদি শয়তানি করে ওকে ভিতরে ডেকে পাঠায়—ও কি করবে?

বাপীর মজাই লাগছিল। কিন্তু গম্ভীর।…রেশমাকে পাজি বললে, আঙ্কলকে শয়তান বললে আর আমাকে তো কতবার সেয়ানা বলেছ—তোমার চোখে ভালো কে?

—কেউ না। মোট কথা তুমি যা ভেবেছ সব বাজে। খবরদার, মায়ের কাছে এ-সম্বন্ধে একটি কথাও নয়।…রেশমার সাপ ধরা তো নিজের চোখেই দেখেছ, ওই মজুরিতে পোষায় না—অন্যের থেকে ওকে কম দেবার কোনো মানে হয়?

—কোনো মজুরিতেই পোষায় না আর কম দেবারও মানে হয় না। আমার হাত থাকলে তোমাদের এ-ব্যবসা আমি বন্ধ করে দিতাম।…তোমার নাম করে রেশমার মজুরি বাড়ানোর কথাও চালিহা সাহেবকে বলেছিলাম—

—তারপর? এবারে উৎসুক।

—উনি ঠাট্টা করে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার কোনো ইন্টারেস্ট আছে কিনা। আমি বলেছি নেই।

—হাড়ে হাড়ে শয়তানি। ফিক করে হেসেও ফেলেছিল।—একেবারে নেই বলে দিলে কেন, রেশমা খারাপ কি—এবারে চটে যাবার আগে পর্যন্ত দেখেছি তোমাকে ও খুব পছন্দ করত।

ভেতর-বার এক-রকম নয় বাপীর। ভেতরে আঁচড় পড়েছে। নিজেকে চোখ রাঙিয়েছে। এই মেয়ে এমন প্রগল্ভ হতে পারে অবশ্য ভাবেনি। ফাইলটা সামনে টেনে নিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করেছে, রেশমার সম্পর্কে তোমার এত আগ্রহ কেন?

জবাব দিতে গিয়ে থমকেছিল একটু। তারপর বলেছে, বাঃ, ওই তো একমাত্র সঙ্গী আমার এখন। তারপরেই ঝাঁঝ দেখিয়েছে,—দেখো, ফ্রেন্ড বলে আমার ওপর মাতব্বরি করতে এসো না—আমার আগ্রহ তাতে তোমার কি?

কিন্তু আর না বসে চটপট চলেও গেছে।

পনের দিন আগে গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাৎ বাপীর। নির্দেশ—মতো দুপুরেই এসেছিল। সঙ্গে সেই ফাইল আর ডায়রি। সেদিনও লক্ষ্য করেছে পাশের জমিতে তার ঘরের তিন ভাগ কাজ সারা।

গায়ত্রী রাই তখন তার এখানকার আপিসঘরে। সেখানেই ডাক পড়েছে। দু’বার ভ্যান পাওয়ার ফলে বিক্রির তুলনামূলক চার্ট দাখিল করেছে বাপী। খদ্দেরের লিস্ট-এ তিনটি নতুন নামও দেখাতে পেরেছে।

ফাইল আর ডায়রির পাতায় চোখ বুলিয়ে গায়ত্রী রাই সে-দুটো আবার তার দিকে ঠেলে দিতে বাপী একটা প্রশ্ন করেছিল আর একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রশ্নটা শুনে কর্ত্রীর সতর্ক চাউনিও লক্ষ্য করেছিল।

এরই মধ্যে মোটামুটি দু’জন বড় পাইকেরি খদ্দের কিছু জিনিস চেয়েছে যা এখানকার গোডাউনে নেই বাপী জানে। কিন্তু তারা সেটা মানতে রাজি নয়, তাই বাপীর প্রশ্ন, এখানকার গোডাউনে যে-সব মাল আছে তাছাড়াও মালিকের হেপাজতে আর কোনো জিনিস আছে কিনা।

শুনেই বাঁকা ঠেকেছে।—কি জিনিস চেয়েছে তারা?

—শুখাসিদ্ধি, আফিম আর মিঠা জহর।

গায়ত্রী রাইয়ের গোল দু চোখ তার মুখের ওপর নড়েচড়ে স্থির আবার এসব আমাদের কাছে থাকতে পারে তাদের ধারণা হল কেন?

—ধারণা নয়, তারা আছেই জানে। তাদের দাবী আগে পেয়েছে এখন কেন পাবে না?

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনিতে বিস্ময়ের ছোঁয়া।—কত আগে পেয়েছে?

বাপী নির্লিপ্ত খুব।———কারো নামে কিছু বলতে রুচিতে বাধে, ওদের বক্তব্য শুনলে আপনার নালিশের মতো লাগবে।

ধৈর্য কম মহিলার, কড়া গলায় তাগিদ দিয়েছে, আমি শুনতেই চাই!

—তাঁদের অভিযোগ, ওসব জিনিস মিস্টার চালিহা আগে সেধে দিয়ে এসেছেন, আর তার জন্য তারা ভালো দামও দিয়েছে। কিন্তু চালিহা সাহেব এখন এত বড় হয়ে গেছেন তাঁর আর পাত্তাই নেই, ফলে তারা জিনিসও পাচ্ছে না।

মহিলার ঠাণ্ডা মুখভাবে রকমফের ছিল না খুব। তবু বাপীর ধারণা খবরটা তার কাছে নতুন—আর সেই সব মাল বিক্রির ভালো দামও তার হিসেবে আসে নি।

একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, এ ব্যাপারে আমি পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। মিস্টার চালিহাকে কিছু বলেছ?

—না।

—বলার দরকার নেই।

এরপর সাপ চালানের ব্যবসা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল বাপী। আবু রব্বানী আর দুলারির সঙ্গে পরামর্শ করে মোটামুটি একটা প্ল্যান ছকেই এনেছিল। সাপ ধরার দল পুষ্ট করে তুলতে হলে, অর্থাৎ প্রতি বছর যারা নিয়মিত এই কাজে আসবে এমন একটা দলকে ক্রমে বড় করে তুলতে হলে তাদের মজুরি বাড়াতে হবে, পাওনা-গণ্ডাও নগদ মিটিয়ে দিতে হবে। চালান যদি চাহিদা অনুযায়ী শতকরা পঁচিশ ভাগও বাড়ানো যায়, তাহলেও বাড়তি খরচ পুষিয়ে লাভ বেশি থাকে। তাছাড়া খরচের প্রশ্ন তুলে দালালদের সঙ্গেও দামের নতুন ফয়সলার চেষ্টা করা যেতে পারে। যে রকম চাহিদা, চাপ দিলে তাদের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।

এই প্ল্যানও খুঁটিয়ে দেখে গায়ত্রী রাই খুব যে খুশি তা নয়। সাপ পিছু আট আনা এক টাকা বা শঙ্খচূড় অথবা অতিকায় ময়াল পাইথন হলে দশ পনের টাকা বেশি মজুরির প্রস্তাব। এছাড়া দল-গড়া আর পাকা তদারকির জন্য দুলারির নামে আবুর মাইনে পঞ্চাশের জায়গায় একশ টাকা আর তার সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য আরো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একজন লোক রাখা, বাড়তি সাপ রাখার সুব্যবস্থা করার জন্য দুলারির ঘরভাড়া কুড়ি টাকা থেকে তিরিশ টাকায় তোলা— এসব তার তেমন ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হলে বাড়তি খরচ পুষিয়েও যে লাভের অঙ্ক বাড়ে, সেই হিসেব তার চোখের সামনেই। তাছাড়া এর ফলে পাহাড়ের বাংলোয় বিষ বার করার পরিমাণও বাড়বেই। তাতেও মোটা লাভ।

মুখে এতটুকু খুশি বা আশার অভিব্যক্তি নেই। উল্টে মন্তব্য করেছিল, তুমি তো দেখি দানছত্র খুলে বসতে চাও।

বাপী জবাব দিয়েছে, আমি আপাতত যা চেয়েছি সেটা মিনিমাম।

সঙ্গে সঙ্গে কড়া চাউনি মহিলার।—তার মানে এটুকু না হলে তুমি কাজে হাত দেবে না?

—না। আমার অসুবিধে হবে।…হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে কি ভয়ঙ্কর সাহসে বুক বেঁধে ওরা এই কাজ করে, জঙ্গলে ঘুরে সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। ভালো লাভ সত্ত্বেও এটুকুও এদের দিতে না পারলে আমার বিবেকে বাধবে।

নিজে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ওদের কাজ দেখার কথা শুনে মহিলার চোখে বিস্ময়ের ছোঁয়া, কি আবেগের কথা শুনে, বাপী ঠাওর করতে পারে নি। এ প্রসঙ্গও গায়ত্রী রাই সেখানেই শেষ করেছিল। প্ল্যানের খসড়া নিজের কাছে রেখে দিয়ে বলেছিল, ভেবে দেখি। তাছাড়া মিস্টার চালিহার সঙ্গেও পরামর্শ করে দেখতে হবে।

কিন্তু মেজাজের কিছু পরিবর্তন দেখাই গেছে। জিগ্যেস করেছিল, চা খাবে?

বাপী মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।

তারপরেও অনেকটা নির্লিপ্ত মুখেই গায়ত্রী রাই বলেছে, তোমার ঘর তো প্রায় শেষ…দেখেছ?

মনে মনে এইটুকুও অনুগ্রহ ধরে নিয়েছিল বাপী। কারণও আঁচ করতে পেরেছিল। অখুশি নয় বোঝা গেছে। বাপী মাথা নেড়েছে, দেখে নি।

—ইচ্ছে করলে দেখে যেতে পারো।

—দেখবই তো…তাড়া কি! থ্যাঙ্কস—

পনের দিন বাদে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের এই রবিবার সকালে চা-বাগানের ক্লাবঘর ছেড়ে নতুন বাসায় চলে আসার হুকুম হয়েছে।

বাপী এসেছে।

ভাবছিল কিছু। নিজস্ব ঘর হল বটে, এখন তড়িঘড়ি অনেক কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের মধ্যেই একটা খাট কেনা দরকার। বিছানা-পত্রের যা অবস্থা সেগুলো ব্যবহার করতে নিজেরই এখন অরুচি। শৌখিন কর্ত্রীটি বা তার মেয়ে দেখলে নাক সিঁটকোবে। সে-সবও নতুন করতে হবে। বারান্দায় পাতার মতো গোটাতিনেক চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল অন্তত চাই। যতটা সম্ভব ছিমছাম ভাবেই থাকতে হবে। পাশাপাশি ঘর তোলার কথা বলেছিল যখন, এই বিড়ম্বনার কথা ভাবেনি। এছাড়া রান্নাবান্নার সরঞ্জাম চাই, চায়ের ব্যবস্থা চাই। টুকিটাকি আরো অনেক কিছু চাই। অনেক দিনের অনভ্যাসের দরুন বাপীর হালছাড়া মনের অবস্থা।

—নিজের ঘর দেখে যে মুগ্ধ একেবারে, কোনোদিকে আর হুঁশ নেই দেখছি!

ঊর্মিলা। বাপী এদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশ্চয় পা টিপে এসেছে, নইলে পায়ে ক্যানভাসের চপ্পল হলেও কাঠের মেঝেতে টের পাবার কথা।

ঘুরে দাঁড়াতে ঊর্মিলা বলল, মা ডাকছে—জলদি!

তাড়া দিল কিন্তু নিজে ঘর ছেড়ে বেরুনোর জন্য ব্যস্ত নয় একটুও। খেদের সুরে বলল, ইউ আর ভেরি লাকি। মা রাজি হলে আমি তোমাকে তার সঙ্গে ও—বাড়ি থাকতে পাঠিয়ে আমি এটা দখল করতাম।

বাপী বলল, চলো তাহলে, তাঁকে সেই প্রস্তাব দিয়ে দেখা যাক্

ঊর্মিলা প্রথমে চোখ পাকালো। তারপর হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না!

—কি হল?

হাসি থামার পরেও লাল মুখ। বলল, যে হারে তুমি মায়ের মন কাড়ছ, তার বয়েস আরো বছর বারো কম হলে বা তোমার বেশি হলে ঠিক একটা লটঘট কাণ্ড হয়ে যেত।

বাপীও হেসেই ফেলল। মেয়েটার মুখে কিছুই আটকায় না দেখছে।

মেহেদি পার্টিশনের মাঝখানে যাতায়াতের গেট-টেট কিছু রাখা হয় নি। আসা—যাওয়ার প্রয়োজনে সামনে দিয়েই ঘুরে আসা ঘুরে যাওয়া।

গায়ত্রী রাই বারান্দার চেয়ারে বসে সোনালি চশমা এঁটে কাগজ পড়ছে। ওরা দু’জন উঠে আসতে কাগজ সরালো, চশমা খুলে খাপে ঢোকালো। গম্ভীর, তবে অপ্রসন্ন নয়। গলার স্বরও মোলায়েম। পছন্দ হয়েছে?

বাপী জবাব দিল এত ভালো আশা করি নি।

—বোসো। এত ভালো এমনি হয় নি, অনেক খরচ পড়েছে। সব হিসেব তুমি পাবে। আর—

বাপীর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েও মায়ের পাশের চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তাহলে আমি সরে পড়ি—

—বোস্। এখানেই ব্রেকফাস্ট দিতে বলেছি। তাছাড়া এই হিসেবের মধ্যে তোর থাকা দরকার। আর কত দিন আমি একলা সব দিক দেখব?

মেয়ে হালছাড়া মুখেই বসল। কিন্তু তারপর জবাবখানা যা দিল রসিয়ে শোনার মতো। বলল, বরাবর একলাই দেখতে হবে, আমাকে তো বিয়ে দিয়ে চটপট শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মতলবে আছ।

বাইরে বোঝা না গেলেও মহিলার মেজাজ এই সকালে প্রসন্নই বলতে হবে। বাপীর সামনে এই উক্তির দরুন একটুও রাগ করল না। মেয়ের উদ্দেশে হাল্কা জবাব দিল, সে চিন্তা তোকে করতে হবে না, বিয়ে যে করবে তাকেই এসে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হবে।

মেয়ে ওমনি ফোঁস করে উঠল, আই উইল নেভার এগ্রি—দ্যাট পারসন মাস্ট বি এ ভেড়া-মার্কা সামবডি।

বাপীর দিকে চেয়ে গায়ত্রী রাই বলল, সি ইজ্ ইনকরিজিবল।

মেয়েও তক্ষুনি বাপীর দিকে ফিরে চোখ পাকালো। এ ব্যাপারে মায়ের কথায় সায় দিলে ফ্রেন্ডশিপ ঘুচে যাবে মনে রেখো!

কোয়েলা মস্ত একটা ট্রে এনে টেবিলে রাখল—খোসাসুদ্ধ তিনটে বড় কলা, দুটো ডিশে দুটো করে এপোচ, একথাক টোস্ট, বাটির মাখনে বাটার-নাইফ গোঁজা। দুটো জেলি আর জ্যামের শিশি। একটা বড় কাঁচের বাটিতে কর্নফ্লেক্স, পাশে মিল্ক-পট আর সুগার-পট।

ট্রে থেকে কর্নফ্লেক্স-এর বাটিটা তুলে কোয়েলা কর্ত্রীর সামনে রাখল। বিধবা নেপালিনীদের ডিম বা আমিষ চলে কিনা বাপী জানে না। একটা কলা ছাড়িয়ে কোয়েলা ছুরি দিয়ে চাক চাক করে কেটে কর্নফ্লেক্স-এর ওপর ছড়িয়ে দিল। তারপর দুধ আর চিনির পট বাটির সামনে রেখে চলে গেল।

ঊর্মিলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনের টোস্টে মাখন মাখাচ্ছে। গায়ত্ৰী রাই কর্নফ্লেক্স-এর বাটিতে পটের দুধটা ঢেলে নিয়ে দু’ চামচ চিনি ছড়িয়ে দিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

আর ঠিক তক্ষুনি বাপীর জিভ এমনি সুড়সুড় করে উঠল যে সংবরণ করাই গেল না। কারো দিকে না চেয়ে খুব সাদামাটা সুরে বলল, ব্রেকফাস্টের ব্যাপার দেখেই মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়িতে যে আসবে সে নিজেই আর নড়তে চাইবে না।

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে এবারে চুলের তো একটু হাসির রেখা। শোনার পর মেয়ের দিকে চোখ। কিন্তু টোস্টের ওপর ঊর্মিলার বাটার-নাইফ থেমে গেছে। চকিতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে ভিতরের দরজার দিকটা দেখে নিল। তারপর ঝকঝকে দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর।—ওই কোয়েলাকে তোমার পছন্দ হয়?

বাপীর নিরীহ আক্রান্ত মূর্তি। গায়ত্রী রাই বলে উঠল, ও ডলি!

কিন্তু মায়ের অনুশাসনে মেয়ে ভ্রুক্ষেপও করল না। ঝাপটা মেরে বলে গেল, কোয়েলার জন্য মা বর খুঁজছে, পেলে সেও এই বাড়িতেই থেকে যাবে আর ভালো ভালো খেতে পাবে——চাও তো লাগিয়ে দিতে পারি।

বলতে বলতে নিজেই হেসে ফেলে ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। নিরুপায় গায়ত্রী রাইকেও এবার হাসতেই দেখল বাপী। তারপর পলকা ধমক, দিনকে দিন ছেলেমানুষি বাড়ছে তোর ডলি!

খেতে খেতে আবার কাজের কথা, অর্থাৎ সেই হিসেবের কথা। আর এসব কথার সময় স্বভাবতই মহিলা বেশ গম্ভীর।—এ বাড়ি আর তোমার ওই ঘর তোলার জন্য মোট যা খরচ হয়েছে তার সব হিসেব রেডি করে অ্যাকাউন্টেন্ট তোমাকে কপি দেবে। খরচ অনেক হলেও বাড়ি ভাড়ার একশ টাকা থেকে মাসে পঞ্চাশ টাকা করেই কাটা হবে, পঞ্চাশ টাকা হাতে পাবে—ও কে?

এ উদারতার কারণ বুঝতেও বাপীর এক মুহূর্ত সময় লাগল না। দখলের দাবী যত দীর্ঘমেয়াদী হয় ততো তার সুবিধে। বাপী ভালো মুখ করে জবাব দিল, পুরো একশ টাকাই কাটতে পারেন।

—না, পঞ্চাশ টাকাই কাটব—মাইনে তো আপাতত বেশি পাচ্ছ না। ক্লাবে থাকার খরচ চালাতে হবে বলে এতদিন পঞ্চাশ টাকা করে পকেট খরচ পেয়েছ, সেটা বড় জোর এখন দু’শ টাকা হবে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া থেকে কিছু না পেলে তোমার চলবে কি করে।

আগে দু’শ টাকা মাইনে শুনলে আনন্দে ভেতরে সাড়া জাগত। কলকাতার লোয়ার ডিভিশন চাকরির মাইনে ছিল সর্বসাকুল্যে আটাত্তর টাকা। কিন্তু এখন কিছুই খুব অপ্রত্যাশিত না। বাপী জানেই এও সবে শুরু। শেষ নয়

চুপচাপ খাওয়া শেষ করে মহিলা বাটিটা পাশে সরিয়ে রাখল। অল্প একটু জল খেল। ভাবছে কিছু। খাট বেডিং টেবিল চেয়ার সবই তো কিনতে হবে তোমাকে?

টোস্ট আর পোচে বাপীর মুখ আটকানো। মাথা নাড়ল, হবে।

—অ্যাডভান্স কত দরকার?

মুখের পদার্থ জঠরস্থ করে বাপী জবাব দিল, মোটামুটি গুছিয়ে নেবার মতো কিছু টাকা হাতে আছে।

এ পাশ থেকে ঊর্মিলা ফস করে বলে বসল, আহা মায়ের কান জুড়িয়ে গেল!

মহিলা এবারে চোখেই ধমকালো মেয়েকে। বাইরের লোকের সামনে এরকম করাটা যে বাড়াবাড়ি তাই বুঝিয়ে দিল। কিন্তু মেয়ের ভ্রুক্ষেপ নেই, অন্যদিকে চেয়ে জেলি রুটি চিবুচ্ছে। ফাঁক পেলেই মেয়ে যে তার মাকে ঠেস দিতে ছাড়ে না, এ বাপী আগেও লক্ষ্য করেছে।

গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, এখানে তোমার খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?

পরিবর্তন ভালোই দেখছে বাপী। ক’দিন আগেও মহিলা ঝাঁঝিয়ে বলেছিল, কাজের বাইরে তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক কি আমার?

জবাব দেবার আগে চায়ের ট্রে হাতে রঙ্গমঞ্চে আবার কোয়েলা। সেটা টেবিলে রেখে আগের ট্রেতে ডিশটিশ সব তুলে নিয়ে গেল। বাপীর দিকে চেয়ে ঊর্মিলা অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল। অর্থাৎ আবারও মনে করিয়ে দিল, ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা সহজেই হতে পারে।

মেয়ের প্রগল্ভতায় মহিলা এবারে যথার্থ বিরক্ত। তার দিক থেকে বাপীর দিকে চোখ ফেরালো। টেবিল থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বাপী বলল, কিছু ভাববেন না, আমি ব্যবস্থা করে নেব।

কাগজের দিকে তাকালে এখনো কলকাতার খবরই আগে চোখ টানে। মাঝের এক জায়গায় একটা হেডিংয়ের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল। কলকাতার প্লেগ। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। গায়ত্রী রাই কি বলছে, তার মেয়ে কি করছে কিছুই তার খেয়াল নেই বাপীর। খবরটুকু পড়ে ফেলল। মধ্য কলকাতার কোনো এলাকা থেকে এ পর্যন্ত এগারোজন লোককে প্লেগ রোগাক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতালে সরানো হয়েছে। তার মধ্যে তিনজন মারা গেছে। কলকাতা করপোরেশন তাই ওই এলাকাকে প্লেগ এরিয়া বলে ঘোষণা করেছে।

যুদ্ধের সময় বা কলকাতায় বোমা পড়ার সময় ওখানকার যে কোনো খবরের ফাঁক দিয়ে দুনিয়ার সকলকে ছেড়ে একটি মেয়েই তার চোখের সামনে এগিয়ে আসত। আজও তাই। প্লেগ কি, প্লেগ কেমন, বাপীর কোনো ধারণা নেই। শুধু জানে মারাত্মক কিছু, একটা শহরকে শহর উজাড় হয়ে যাবার মতোই কিছু। তবু, যে মেয়ের বাড়ি মধ্য কলকাতার ধারে-কাছেও নয়, দক্ষিণের এক রাস্তার সাতাশি নম্বর বাড়ির সেই মেয়েকেই যেন বিপন্ন দেখার অনুভূতি একটা। এ চিন্তা নিছক পাগলামি জানে। তবু বুকের তলায় কাঁপুনি কিছুক্ষণের—কোনো অঘটনের মধ্য দিয়ে ওপরঅলার হাত কি সব কিছু হঠাৎ মুছে দিয়ে যাবে? যার পর আর কিছু না—কিচ্ছু না?

আত্মস্থ হল। শুধু গায়ত্রী রাই নয়, তার মেয়েও ঈষৎ বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। এই মিনিট কতক তারা কি দেখেছে কি লক্ষ্য করেছে, জানে না।

গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, কাগজে অত মন দিয়ে কি দেখছিলে আর তারপর কি ভাবছিলে?

মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে কাগজের প্লেগের খবরটা দেখালো। গায়ত্ৰী রাই আরো অবাক।— কলকাতায় তোমার কে আছে?

বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—কেউ না। অনেক কাজ আছে, সেরে ফেলিগে।

কাজ কাজ আর কাজ। কাজের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে মুক্তি, কাজে ডুবে থাকলে স্বস্তি। ঊর্মিলা যখন তখন এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। কখনো হাসে, কখনো রাগ করে, কখনো বা অকারণ ঠেস-ঠিসারায় বিদ্ধ করতে চায়। বাপী তন্ন তন্ন করে নিজের ভেতর দেখে তখন। কোনো-পাতালে প্রবৃত্তিই সেই পশু আজও লুকিয়ে আছেই। লোভের সন্ধান পেলে এখনো ওটা থাবা চাটবে। সেই থাবা বাপীর দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেওয়ার আক্রোশ। ঊর্মিলার এই সহজ নিঃসঙ্কোচ যাতায়াত ভালো লাগে বলেই বাপী সেটা চায় না।

…রেশমা রাগ ভুলেছে। দেখা হলে মুচকি হাসে। দেখা হলে খুশি হয়ে এগিয়ে আসতে পারে। কথা বলতে পারে। সাপ চালানোর ব্যাপারে বাপীর নতুন বন্দোবস্তের প্ল্যান ওদের মেমসায়েব সবটাই মেনে নিয়েছে। এই ব্যবসায় সেই এখন মুরুব্বি ওদের। পুরুষদের সঙ্গে ওর মজুরি সমান হয়েছে। আবুর হিসেব মতো কাগজে সই করে দিলেই একদিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টেন্টের কাছ থেকে নগদ টাকা মেলে। অবশ্য চালান যে হারে বাড়ছে, অ্যাকাউন্টেন্টের হিসেবে খাতায় তার সবটা উঠছে না। এ ব্যাপারে কর্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ। এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও বাপীর নিজস্ব একটা পাকা হিসেব আছে। রেশমার রাগ ভোলার আর খুশি থাকার আরো কারণ আছে। তদারকি আর দল বাড়ানোর কাজে আবু রব্বানীর সহকারিণী হিসেবে মাসে বাড়তি পঞ্চাশ টাকা সে-ই পাচ্ছে। আবু ওকেই বাছাই করেছে। আবু দুলারির সামনেই এক চোখ ছোট করে রসিকতা করেছে, রেশমাকে অ্যাসিন্ট্যান্ট পেয়ে কাজের উৎসাহ আমার চারগুণ বেড়ে গেছে— বুঝলে বাপীভাই।

জবাবে হেসে হেসে রেশমা দুলারিকে আশ্বাস দিয়েছে, তুমি ভেবো না ভাবী, আমার সাপের টুটি চেপে ধরা আবু-সাহেব স্বচক্ষে দেখেছে। তারপর বাপীকেই জিগ্যেস করেছে, আমাদের এতবড় মুরুব্বিকে এখনো বাপীভাই বলো না সায়েব—টায়েব বলতে হবে?

বাপী জবাব দিয়েছে, আগে যা বলতে তাই বলবে।

…এই মেয়েরও চটক আছে। চোখের কালোয় আগুন আছে। হেলে দুলে চলে যখন সেই যৌবন-ঢেউয়ের আমন্ত্রণ আছে। নিজের অগোচরে হঠাৎ-হঠাৎ ভালো লাগে বলেই রেশমাকেও কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না।

আবু রব্বানী আর দুলারির খুশির সংসার বলতে গেলে রোজই ওকে আশা করে। একে ভালোবাসে, তায় বাপীর জন্যেই দু’জনারই আয় বেড়েছে। এছাড়া জঙ্গলের নানা জায়গায় মালকানের দরকারী চারা বেড় করা বা দরকারী গাছ—গাছড়া চাষের বাবদ ন্যায্য পারিশ্রমিক যে পাবে—সে সম্বন্ধেও নিশ্চিন্ত। ফলে দু’দিন দেখা না পেলে আবু মুখ ভার করে। আর দুলারি ঘরের লোককে দাবড়ানি দেবার ছলে ওকে কথা শোনায়।—বাপী ভাই এখন কত বড় মানুষ আর কত কাজের মানুষ—তোমার সঙ্গে রোজ এসে আড্ডা দেবার অত সময় কোথায়?

কিন্তু ওদের এই সুখের সংসারে দেখেও ভালো লাগে আর ভিতরে ভিতরে কিন্তু প্রত্যাশা উঁকিঝুঁকি দেয় বলেই বাপী এদেরও এড়াতে চায়। কোনো ভালো লাগার সঙ্গে তার আপোস নেই।

তাই কাজে ডুবে যাওয়া, কাজে ভেসে যাওয়া, আর কাজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। ফলে খুশি যার সব থেকে বেশি হবার কথা সে তো খুশি বটেই। গায়ত্রী রাই। তার গাম্ভীর্য অটুট এখনো। কিন্তু আচরণ বদলেছে। স্টোভে নিজে রান্না করে খায় বাপী। খাওয়ার ফিরিস্তিও মেয়ের কাছে শুনেছে। বাপীর সামনেই সেদিন বলেছিল, ভাতের সঙ্গে সমস্ত রকমের আনাজ সেদ্ধ আর তেল আর নুন আর কাঁচালঙ্কা—তোমার কাজের ছেলে খাসা খানা খেয়ে কাজে ডুবে আছে।

গায়ত্রী রাইকে তাই শুনে ভাবতে দেখেছে। শেষে প্রস্তাব দিয়েছে, মাসে যা হয় ধরে দিও—তোমার দু’বেলার খাবারটা এখান থেকেই যাবে না হয়।

হেসে উঠে ঊর্মিলা বলেছিল, কোয়েলার সম্পর্কে এখনো ভেবে দেখো ফ্রেন্ড—মাসে আর তাহলে কিছু ধরে দিতেও হবে না।

একলা পেলে আর আগের চরিত্রগত মেজাজে থাকলে বাপী জবাব দিতে ছাড়ত না। রসিকতা করে বলে বসত, কোয়েলার বদলে তার মনিবের মেয়ের সম্পর্কে ভাবতে রাজি আছি। ওই জবাব মাথায় এসেছিল বলেই বাপী নিজের ওপর অসহিষ্ণু। এক কথায় মহিলার প্রস্তাব নাকচ করেছে। বলেছে, আপনি আমাকে কাজে এগিয়ে যেতে দিন শুধু, আর কিছু দেখার দরকার নেই।

তা সত্ত্বেও প্রতি রবিবার, অন্য ছুটির দিনের সকালে ওই বাংলো থেকে চায়ের আসরে তার ডাক পড়বেই। দু’ দিন তিন দিন পরে পরে কোয়েলা রান্না-করা মাছমাংসও দিয়ে যাবে। বাপী প্রথম দিনেই বলেছিল, আর এ-রকম কষ্ট করার দরকার নেই—আমার এই খেতেই ভালো লাগে। তা সত্ত্বেও কোয়েলা এটা-ওটা নিয়ে আসে মানেই কর্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করতে পারে না।

গায়ত্রী রাই তার হিসেবমতোই ধীরেসুস্থে কাজে এগিয়ে দিচ্ছে তাকে। মাসে দু’দিন করে ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় এলাকার গণ্ডী আরো বড় হয়েছে। আর, মোটামুটি বড় এবং বিশ্বস্ত পাইকারি খদ্দেররা গোপনে যা চায়, তাও তার মারফৎ পাচ্ছে। কর্ত্রীর নির্দেশে কোয়েলা মাপা শুখা সিদ্ধি, আফিম, মিঠা জহর ইত্যাদি ঘর থেকেই বার করে দেয়। এ-সব কোথা থেকে আসে, বা কে কখন চালান দেয় বাপী এখনো সে খোঁজ রাখে না। এ-সব বিক্রীর হিসেব যে অ্যাকাউন্টের খাতায় উঠবে না, তাও বলে দিতে হয় নি। এই টাকা গায়ত্রী রাইয়ের হাতেই তুলে দেয়।

তিন মাসের মাথায় গায়ত্রী রাই নিজেই ওকে সঙ্গে করে উত্তর বাংলার নানা জায়গায় বড় বড় পার্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমাদের রিজিওন্যাল ম্যানেজার। এবার থেকে যোগাযোগ আর সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা তার মারফৎ হবে।

কোন্ রিজিয়নের ম্যানেজার তা নিয়ে বাপী নিজেও মাথা ঘামায়নি। কাজের পরিধি ঢের বেশি বাড়ল, আরো বেশি কাজে ডোবার সুযোগ মিলল, তার এটুকুই লাভ। এই দায়িত্ব পাওয়ার ফলে চিফ একজিকিউটিভ রণজিৎ চালিহাকে সন্দিগ্ধ দেখবে বা অসন্তুষ্ট দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু আদৌ তা না। ওই লোকের সঙ্গে মহিলার হৃদ্যতা আগের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। হয়তো তাকে জানিয়েই সব কিছু করা হচ্ছে।

পরে উত্তর বাংলার দু’জন বেশ বড় খদ্দেরের আচরণে বাপী ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ। আবার একটু অবাকও। বার দুই যোগাযোগের পরে আভাসে ইঙ্গিতে কিছু ব্যক্তিগত লাভের টোপ ফেলতে চেয়েছে ওই দু’জন। মাল সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে কেউ টের পাবে না এমন সামান্য কিছু কারসাজির পথে চললে বাপী তরফদারের নিজের পকেটে অনায়াসে বেশ বাড়তি টাকা আসতে পারে আর তাদেরও কিছু লাভ হয়, তোয়াজের ছলে সেই আভাস, সেই ইঙ্গিত।

বাপী বিরক্ত হয়ে সেই পথ নাকচ করতে তারা আরো অমায়িক। তক্ষুনি সৎ মানুষের সঙ্গে তাদের সৎ ভাবেই কাজ করার প্রতিশ্রুতি। মিস্টার তরফদার যেন কাউকে কিছু না বলেন বা নিজে কিছু মনে না করেন। বাপীর অবাকও লেগেছে, কারণ দীর্ঘকাল ধরে যে মহিলার সঙ্গে ব্যবসায়ে যুক্ত, তাদেরও এ-রকম মতি হয় কি করে! গায়ত্রী রাই সঙ্গে করে যখন নিয়ে এসেছিল, বাপী নিজের চোখেই এদের যত্ন-আত্তি দেখেছে, তোয়াজ তোষামোদ দেখেছে, সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা কইতে দেখেছে। যত ভেবেছে এদের এই ব্যাপারটা কেমন হেঁয়ালির মতো লেগেছে।…রণজিৎ চালিহার সঙ্গে কি এই গোছের ব্যবস্থা কিছু ছিল? নইলে মাত্র দু’বার যোগাযোগের পরেই এরা এমন কথা বলে কি করে?…চালিহা অনেক দিনের লোক। বাপী ক’দিনের? ভালো করে জানা চেনা বোঝার আগেই এত বেপরোয়া?

কি ভেবে গায়ত্রী রাইকে সত্যিই কিছু বলেনি বাপী। রণজিৎ চালিহাকে বলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু শিলিগুড়ি আর মালদহের এই দুই পাইকিরি রইস খদ্দেরের টোপ ফেলার চেষ্টাটা মনে গেঁথেই থাকল।

.

কখনো সপ্তাহে কখনো পনের দিনে একবার গায়ত্রী রাইকে মেয়েসহ ভ্যানে করে দু’তিন দিনের জন্য বাইরে যেতে দেখে বাপী। কোথায় চলল বা ক’দিনের জন্য চলল, ওকে অন্তত কিছু বলে যায় না। পরে মেয়ের মুখে শুনেছে, ভুটানে পাহাড়ের বাংলোয় যায় তারা। বাপীর ধারণা, বনজ নেশার জিনিস বা গোপন জিনিস যা আসে, ওখান থেকেই আসে। বোতলের জিনিস, অর্থাৎ মদ কিভাবে আসে সে-সম্বন্ধে এখনো সুস্পষ্ট কিছু ধারণা নেই। শুখা সিদ্ধি আফিম ইত্যাদি কোয়েলার মারফৎ এই বাংলো থেকেই বেরুতে দেখেছে বাপী। তাও কাছাকাছির ছোট চালানের সময়। বড় চালান হয়তো ওই পাহাড়ের বাংলো থেকেই সরাসরি চলে যায়। আর মদের পেটি সরাসরি চালিহার হেপাজতে গিয়ে পৌঁছয়। গত ছ’মাসে বাপীর ওপর গায়ত্রী রাইয়ের বিশ্বাস আর নির্ভরতা বেড়েছে এটুকু বুঝতে পারে। কিন্তু ওই সব মাল সম্পর্কে কোনো কথাবার্তা হয় না। এ-দিকটা এখন পর্যন্ত তার এক্তিয়ারের বাইরে। আবু রব্বানীর মুখে কিছু শোনা আছে। জিগ্যেস করলে হয়তো আরো জানা যেতে পারে, বোঝা যেতে পারে। জিগ্যেস করে না। বাপী নিজের কাজ নিয়ে আছে। আর চুপচাপ দেখেও যাচ্ছে।

ঊর্মিলা বলে, তার পাহাড়ে যেতে একটুও ভালো লাগে না। মা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়।

—কেন, ওটা তো দেশ তোমাদের।

—কে বলল? ওটা মায়ের দেশ, আমার বাবা নেপালের মানুষ ছিল।

মায়ের ওপর মেয়ের রাগ কত এই জবাব থেকেই বোঝা যায়। মায়ের কিছুই মেয়ে ভালো চোখে দেখতে রাজি নয়।

ঘরে আলো জ্বলছে দেখে সেদিনও ঊর্মিলা হাজির। গোমড়া মুখ। দিনে বাপীর টিকি দেখা মেলে না। তাই আড্ডা দেবার মেজাজ হলে আর ঘরে আলো দেখলে রাতেই আসে। ওর মা নাকি গোড়ায় গোড়ায় এটা পছন্দ করত না। কিন্তু মেয়ে তার ভ্রুকুটি বা নিষেধ উপেক্ষা করেই চলে আসত। একদিন বেশি বকা—বকি করতে ও মুখের ওপর বলে দিয়েছে, নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার কোনো হাতের মুঠোর ছেলের প্রেমে কস্মিনকালেও আমি পড়ব না—আর ওই ত্যাঁদড় ছেলেও নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার মুখ ছেড়ে আমার মুখের দিকে কখনো তাকাবে না।

সেই থেকে রাতে এখানে আসা নিয়ে মা আর কিছু বলে না। মেয়েটার আসা—যাওয়া যেমন সহজ, তেমনি অকপট। মনের মতো কথা না হলেও ঝগড়াও শুরু হয়ে যায়। তখন যা মুখে আসে তাই বলে বসে। বেশি রেগে গেলে বলে, আমার সঙ্গে লাগতে এসো না, মা-কে তেল দাওগে যাও—সুবিধে হবে।

বাপীর একটুও রাগ হয় না। কিন্তু এই মেয়ে এলে তার মায়ের কারণে হোক বা নিজেকে সংযমে বাধার তাড়নায় হোক, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। একজনের প্রেমে মজে না থাকলে এই মেয়েই হয়তো আবার তাকে কোনো বিপাকের দিকে টেনে নিয়ে যেত। মা-কে জব্দ করার আক্রোশেও কখন কি মতি হয় ঠিক নেই। মায়ের ওপর মেয়ের এত রাগ এত বিতৃষ্ণা দেখেই বাপীর বিশ্বাস, আবুর অনুমান সত্য। এই মেয়ের প্রথম প্রেমের স্রোতে একটুও ভাটা পড়ে নি।

খাটে আধ-শোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল। রাতে ঘুমের আগে পর্যন্ত এখানে বই সম্বল। পড়ার অভ্যেস আগেও ছিল। ভালো-মন্দ ধর্ম-অধর্ম, হাতের কাছে যা পায়, নির্লিপ্ত মনোযোগে পড়ে ফেলে। চা-বাগানের লাইব্রেরি থেকে বই আনে। সময় কাটানোর তাগিদে ঊর্মিলারও বইয়ের স্টক কম নয়। সে-ও দেয়।

বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল বাপী। মুখ দেখে বুঝে নিল মেজাজ সুবিধের নয়। রাতে বাইরের বেতের চেয়ার তিনটে ঘরে এনে রাখা হয়। তার একটা খাটের সামনে টেনে নিয়ে ঊর্মিলা বসল।

—কাল থেকে আমি কাজ শুরু করছি, আমার জন্য তোমাদের ওই আপিসে একটা ঘর ঠিক করবে। কালই চাই

বাপী চুপচাপ চেয়ে আছে। তাতেই অসহিষ্ণু।—এই সাদা কথাও তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?

—কি কাজ?

—ব্যবসার কাজ—আবার কি কাজ? এইভাবে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে দিন কাটবে আমার?

ফল কি হবে জেনেও খুব মোলায়েম সুরে বাপী বলল, দিন যাতে ভালো কাটে সে-চেষ্টা তোমার মা হয়তো তলায় তলায় করছেন।

গরম তেলে ফোড়ন পড়ল।—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে কে বলেছে? মা ইচ্ছে করলেই আমার নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরাতে পারবে ভেবেছ? তোমাকে যা বলছি তুমি তা করবে কি না?

—কি করে করব, আপিসে ঘর তো মাত্র তিনখানা।

ঊর্মিলার মেজাজ আরো তপ্ত।—আমি কোন কথা শুনতে চাই না! তোমার নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে ওই অ্যাকাউন্টেন্টের ঘরে বোসোগে যাও। তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে ইয়ারকি করতে এসেছি?

—তা না, বাপীর নরম মুখ, ইচ্ছে করলে তুমি তো তোমার আঙ্কলের ঘরেই বসতে পারো—তিনি তো সকালে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি থাকেন না। ওটাই সব থেকে ভালো ঘর—

অপছন্দ হল না। বলল, এখনকার মতো তাই হতে পারে। ঠাণ্ডা একটু গলার স্বরও অন্যরকম।—একটু আগে মায়ের সঙ্গে আমার একহাত হয়ে গেল। মা তোমাকে ডেকে পাঠাতে পারে।

বাপী ফাঁপরে পড়ল।—সে কি তোমাদের হাতাহাতির মধ্যে আমি কে?

—আঃ! শুনেই ভীতুর মত অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? শোনো—মা কাল সকালে দু’তিন দিনের জন্য পাহাড়ে যাচ্ছে, আমি সঙ্গে যেতে রাজি নই—তাই নিয়ে ঝগড়া। আমি মা-কে বলেছি, তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে কাল থেকে তোমাদের আপিসে আমি কাজে বসব, তাই আমার যাওয়া হবে না। মা তোমাকে ডেকে জিগ্যেস করলে তুমি বলবে কথা হয়েছে।

দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বাপী বলল, দুটো তিনটে দিনের জন্য তুমি যেতে রাজিই বা হচ্ছ না কেন?

সঙ্গে সঙ্গে রাগ। কেন যাব? কি আছে সেখানে?

—এখানে কি আছে?

—এখানে কি আছে সে কৈফিয়ৎ তোমাকে দিতে হবে?

ঠাণ্ডা মুখে বাপী জবাব দিল, আমাকে না জড়ালে কিছুই দিতে হবে না। আরো তেতে উঠতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকে দরজার দিকে তাকালো। বারান্দার পায়ের শব্দ। মুখ লাল তক্ষুণি।

ঘরে ঢুকল গায়ত্রী রাই। বাপী এখানে আসার পর এই প্রথম পদার্পণ। বরাবরকার মতোই নির্লিপ্ত গম্ভীর! একটু কঠিনও। বাপী শশব্যস্তে উঠে চেয়ার এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল, বাধা পড়ল।

—বসতে আসি নি। খরখরে চাউনি।—ডলির সঙ্গে কাজ নিয়ে তোমার কি পাকা কথা হয়েছে শুনলাম?

মেয়ে তক্ষুনি ঝাপটা মেরে উঠল, কথা ও বলেনি, আমি বলেছি!

—আমি ওকে জিগ্যেস করছি।

ঊর্মিলার গলার ঝাঁঝ আরো বাড়ল

—আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে?

কেন তুমি মাইনে-করা লোককে

মহিলার দু-চোখ মেয়ের মুখের ওপর স্থির একটু।—মাইনে-করা লোককে তুই এ-সময়ে কি বলতে এসেছিস?

—আমি আমার ঘর ঠিক করার কথা বলতে এসেছি।

—সেটা মাইনে-করা লোক ঠিক করবে না আমি ঠিক করব?

মেয়ে গুম। বাপী নির্বাক দ্রষ্টা এবং শ্রোতা। গায়ত্রী রাই তার দিকে তাকালো।—ডলির কাজ শুরু করতে দুটো-তিনটে দিন দেরি হলে খুব ক্ষতি হবে?

ঊর্মিলার চোখ এড়িয়ে কলের দিকে মুখ করে বাপী জবাব দিল, না ক্ষতি আর কি…ঘুরে এসে শুরু করলেই হল।

চেয়ারটা জোরে ঠেলে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল ঊর্মিলা। তারপর বাপীর মুখের ওপর একপশলা আগুন ছড়িয়ে দুপদাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

গায়ত্রী রাই তেমনি গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটের ফাঁকে চুল-চেরা হাসির আঁচড়। বাপীর বিপাকে পড়া মূর্তি দেখে চোখেই যেন আশ্বাস দিয়ে গেল একটু। তারপর সেও ধীরেসুস্থে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

হাতে কাজ না থাকলে এখনো নিজের মনে জঙ্গলেই ঘোরে বাপী। নিজেদের দরকারের গাছ লতাপাতা চিনতে চেষ্টা করে। ফাঁকা জায়গা দেখলে কোন্ জিনিসের চাষ হতে পারে আবুর সঙ্গে সেই পরামর্শ করার কথা ভাবে। গাছ—গাছড়া লতাপাতা চেনার প্রস্তুতির তাগিদে কর্ত্রীকে একটা প্রস্তাব দেবার কথা অনেকদিন ভেবেছে। দিন-কতকের জন্য একবার গায়ত্রী রাইয়ের পাহাড়ের বাংলোয় গিয়ে থাকার ইচ্ছে। আবুর মুখে শুনেছিল, সেখানে তার স্বর্গত স্বামী বীরেশ্বর রাইয়ের এ-সম্পর্কে অনেক বইপত্র আছে। সে-সব পড়ার ইচ্ছে তারপর সেখান থেকে ঝগড়ুকে নিয়ে পাহাড়ী জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে নিজের চোখে সেগুলো দেখা আর চেনার ইচ্ছে। বীরেশ্বর রাই তাই করত শুনেছে।

কিন্তু বলি-বলি করেও এখন পর্যন্ত বলে উঠতে পারে নি। মহিলা কি সন্দেহ করবে ভেবে দ্বিধা। এবারে পাহাড় থেকে ফিরে এলে বলবে ভাবছে। নিজের প্রয়োজনেই বাপীর ওপর বিশ্বাস তাকে রাখতে হবে।

জঙ্গলের এদিক-ওদিকে এক এক জোড়া বেদে-বেদেনীকে দেখেছে। এক মনে সাপ খুঁজছে তারা। আবার শীত এসে গেল। আর দু’ চার দিনের মধ্যে ওদের এ কাজের পাট এ বছরের মতো শেষ হবে।

আপন মনে বাপী, জঙ্গলের নিরিবিলি দিকটা ধরে এগোচ্ছিল। ওই লোকগুলোর কাছে সে এখন মস্ত মানুষ। ওদের ব্যস্ত করার ইচ্ছে নেই। একটু বাদেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল। অদূরের জারুল গাছটার নিচে পাথর মূর্তি মুখখানা খুব চেনা। রেশমার সাপ ধরার সঙ্গী হারমা। একলা দাঁড়িয়ে। সামনের দিকে চেয়ে নিবিষ্ট চিত্তে দেখছে কিছু। তার সামনে মাটিতে সাপ ধরার সরঞ্জাম।

বাপী পায়ে পায়ে সেদিকে এগলো। কিন্তু লোকটা এত তন্ময় যে একেবারে কাছে আসার আগে টেরই পেল না।

—কি ব্যাপার, একলা যে?

হকচকিয়ে গিয়ে লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। তারপরেই কপালে হাত তুলে সেলাম। রেশমার কাছেই শুনে থাকবে সে তাদের কর্তাব্যক্তি।

বাপী জিগ্যেস করল, রেশমা কোথায়?

মুখে জবাব না দিয়ে আঙুল তুলে অদূরের কটা অর্জুন আর শিশু গাছ দেখিয়ে দিল। অদূরে বলতে তিরিশ-চল্লিশ গজ দূরে। সেদিকে তাকাতে বাপীর দু’ চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। দুটো গাছের ফাঁকে সাপ ধরার পোশাকে রেশমাকে আধাআধি দেখা যাচ্ছে। আর স্পষ্ট দেখা গেল ওর সামনে যে দাঁড়িয়ে—তাকে। চকচকে কোট প্যান্ট শার্ট টাই পরা চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি সুশ্রী ছেলে। রেশমার কথা শুনছে আর হাসিমুখে মাথা নাড়ছে।

—হি রেশমা!

কর্তামানুষ খোঁজ করল বলে হোক বা ওই নিরিবিলি আলাপে বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ পেয়ে হোক, গমগমে গলায় হারমা ডেকে বসল। সঙ্গে সঙ্গে গাছের আধখানা আড়াল ছেড়ে রেশমা এদিকে ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গের চকচকে লোকটিও। রেশমা তাকে বলল কিছু, আর চট করে হাতের কিছু একটা জিনিস নিজের বুকের আঁট জামা ফাঁক করে ঢুকিয়ে দিল।

লোকটা বড় বড় পা ফেলে অন্য দিক দিয়ে চলে যাচ্ছে। ঢিমেতালে রেশমা এদিকে আসছে। তার পরনে আগের দিনের মতোই সাপ ধরার পোশাক। যে পোশাকে ওর মতো মেয়ের যৌবন কুলোয় না।

—বাপীভাই, কি হুকুম?

—কিছু না। ওকে একলা দেখে তোমার কথা জিগ্যেস করতে ও ডেকেই বসল।

রেশমার চোখেও পলকা ভ্রুকুটি। হারমাকে বলল, সেয়ানা হয়ে উঠছিস— অ্যাঁ? হাসি চেপে আর গলা খাটো করে বাপীকে বলল, কারো সঙ্গে আমাকে দু’দণ্ড কথা কইতে দেখলে ওর জ্বালাপোড়া শুরু হয়।

—ভদ্রলোক কে?

—ওই যার সঙ্গে কথা বলছিলাম?…কে জানে, গাছের ইজারাদার-টার হতে পারে, জঙ্গলের কোনো কাজ ধরার মতলবে আছে বোধ হয়—আমি আবু সাহেবকে দেখিয়ে দিলাম।

যা বলল, বিশ্বাস করার মতো নয় নিজেই বুঝল হয়তো। চোখেমুখে এক ঝলক হাসি উছলে গেল—ছুতো ধরে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দুটো কথা বলার লোভ বুঝতেই তো পারছ। হারমার দিকে ফিরে তাড়া দিল, চল্‌ চল্‌ আজ আর কিছু জুটলে হয়—

ওদের ছেড়ে বাপী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। মুখে ভাববিকার নেই। চোখে হাসির আমেজ। গাছগাছড়ার দিকে আর মন নেই। ভাবছে কিছু।

ওরা দু’জন আড়াল হতে বাপী ফিরল। এ সময়ে আবু রব্বানী চন্দ্রার চারা বেডের কাছাকাছি থাকে। জঙ্গলের হাঁটাপথে সেখানে চলে এলো। চারা বেডের পরিধি আগে যা দেখে গেছল তার থেকে অনেকটা বেড়েছে। অবসর সময়ে আবুর এখন কাজের উৎসাহ খুব। অন্যদের সঙ্গে নিজেও খুরপি হাতে মাটি নিড়োচ্ছে।

ওকে দেখে হাসি মুখে খুরপি ফেলে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে কাছে এলো।—কেমন, খাসা হবে না?

কি-রকম হবে বাপীর খুব ধারণা নেই। তবু সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।

আবু খুশি মুখেই বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। বলল, সবই হল বাপীভাই, কেবল তোমার সঙ্গে দু’দণ্ড বসে মনের কথা বলার সময় কমে গেল। সমস্ত দিন তোমার কাজ। আর সন্ধের পরেই বই নিয়ে ঘরে সেঁধিয়ে থাকো—

—তুমি গেলেই পারো।

কথার ফাঁকে ওকে সঙ্গে করে বাপী চারা বেডের কাছ থেকে খানিকটা সরে এসে দাঁড়িয়েছে।

—সন্ধের পরে তোমার ঘরে?…যেতে তো ইচ্ছে করেই। কিন্তু তুমি আমাদের মুরুব্বি এখন, নাকের ডগায় তোমার সঙ্গে মাখামাখি করতে দেখলে মেমসায়েবের পছন্দ হবে না।

এ ব্যাপারে আবুর বিবেচনা আছে। জানলে কর্ত্রীটি হয়তো বাপীকেই ঠেস দিয়ে কিছু শোনাবে। কিন্তু এই আবুর জন্যেই জীবনের আর এক বৃত্তে পা ফেলা সম্ভব হয়েছে। বাপী সেটা ভুলবে কি করে?

—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবে। যাক, ঊর্মিলা রাইয়ের সেই মিরিকের এনজিনিয়ার ছেলেটার নাম যেন কি বলেছিলে—বিজয় মেহেরা?

এই প্রসঙ্গান্তরের জন্য আবু প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে অবাক একটু, তারপর উৎসুক।—হ্যাঁ, কেন?

—দেখতে কেমন বলো দেখি?

আবু বলল।

বাপীর সংশয় খুব আগেও ছিল না। শোনার পর একেবারেই থাকল না। আবুর দু’-চোখ কৌতূহলে টুপুটুপু।—কেন, তুমি তাকে দেখেছ নাকি?

—বোধ হয়।

—কবে? কোথায়?

—এদিকেই।

এদিকে বলতে কোন্ দিকে, স্পষ্ট বোঝার কথা নয়। বুঝলও না।—সেই মেয়ে তো তার মায়ের সঙ্গে পাহাড়ে গেছল, ফিরেছে নাকি? কার সঙ্গে দেখলে?

বাপীর এখন জবাব এড়ানোর দায়। বলল, ঊর্মিলার সঙ্গে নয়, আমার দেখে মনে হল। তোমার মেমসায়েব আর মিসি সায়েব আজ সকাল পর্যন্ত ফেরেনি, এখন ফিরে থাকতে পারে। দেখিগে যাই—

ফিরে থাকলেও ওর দেখার কিছু নেই, ছুতো ধরে আবুর কাছ থেকে সরে এলো। আপিস থেকে সাইকেলটা নিয়ে ঘরের দিকেই চলল। বিকেল তখন প্রায় চারটে। কিন্তু এখন আর বাপীর ঘড়ি ধরা আপিস নয়। দু’দিন পেরিয়ে আজ তিনদিন। ওই মা-মেয়েকে আজ হয়তো বাংলোয় দেখা যাবে।

মেয়েকে নয়, মাকে দেখা গেল। কিন্তু সাইকেল না থামিয়ে বাপী সোজা নিজের আঙিনায় ফটকে এসে নামল।

দশ মিনিটের মধ্যে মালী এসে মেমসায়েবের সেলাম জানালো। আরো মিনিট পনের বাদে বাপী হাজির

মিষ্টি কথা মহিলা চেষ্টা করলেও বলতে পারে কিনা সন্দেহ। বারান্দায় উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখেও সোজা চলে গেলে কেন?

—সাইকেলটা রেখে মুখ-হাত ধুয়ে আসব ভাবছিলাম। খিদে পেয়েছিল, কিছু খেয়েও এলাম।

—বোসো। কি খেলে?

এরকম প্রশ্ন আর কি কখনো কোন কর্মচারীকে করেছে! বাপী হাসল, পাঁউরুটি মাখন। চা খেয়ে আসতে গেলে আরো দেরি হবে বলে সাহস পেলাম না।

—যা বলার সোজাসুজি বলবে। দরজার দিকে ঘুরে তাকালো।—কোয়েলা! বিপুলাকায়া দোরগোড়ায় দেখা দিতে হুকুম হল, এক পেয়ালা চা।

বাপী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদেরও ও-পাট শেষ বুঝি?

মাথা নাড়ল কি নাড়ল না।—এদিকের খবর কিছু আছে?

—সে-রকম কিছু না, ছোটখাটো কটা অর্ডার আছে।

তার সাড়া পেয়েই হয়তো ঊর্মিলা রাই একটা চকচকে নতুন বই হাতে পিছনের দরজায় এসে দাঁড়াল। ফর্সা মুখ মেজাজের মেঘে ছাওয়া। বাইরে বসে পড়ার দরকার বোধেই যেন গম্ভীর মুখে বারান্দায় এসে একটা বেতের চেয়ার হাত পাঁচেক দূরে টেনে নিয়ে বসল।

এই মুখ দেখে বাপী আরো একটু তাতিয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারল না। ভালো মুখ করে জিগ্যেস করল; পাহাড়ে বেড়ানো কেমন হল?

ঊর্মিলার হাতের বই কোলে নেমে এলো। আর ভিতরের আঁচ চোখে এসে জমতে লাগল। ঝাঁঝালো গলা।—ইয়ারকি পেয়েছ?

বাপীর ভেবাচাকা খাওয়া নিরীহ মুখ। তার মায়ের দিকে ফিরল সে, এমন গরম হাওয়ার কারণ বুঝছে না যেন।

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটের ফাঁকে খুব সূক্ষ্ম হাসির রেখা। কোয়েলা এক পেয়ালা চা এনে বাপীর সামনে রেখে গেল।

—শোনো, যে জন্যে ডেকেছিলাম। গায়ত্রী রাই একটু বেশী গম্ভীর হঠাৎ।— গত জুলাইয়ের মিডল-এ তোমার তো ছ’মাসের ট্রায়েল পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে?

এটা সেপ্টেম্বরের শেষের দিক। মুখের চা-টুকু তল করে বাপী জবাব দিল, শেষ হয়েছে কিনা আপনার বিবেচনা…

—এঃ! সঙ্গে সঙ্গে ও-পাশ থেকে মেয়ের ঠেস।—ভিজে বেড়াল একখানা!

সময়বিশেষে গায়ত্রী রাইও মেয়েকে ঘাঁটায় না হয়তো, তার দিকে তাকালোই না। বাপীর মুখের ওপর চোখ রেখে বলল, এ মাস থেকে পাকা খাতায় নাম উঠবে তোমার আর জুলাই থেকে রেট্রোসপেকটিভ এফেকট-এ তিনশ টাকা করে পাবে তুমি। মিস্টার চালিহাকে জিগ্যেস করেছিলাম, তিনি তাই সাজেস্ট করেছেন।

এখনো চালিহার দেয়াল মাঝখান থেকে সরাতে রাজি নয় মহিলা বোঝা গেল। মুখে কিছু বললে তার মেয়ে পাছে আবার ফোড়ন কাটে সেই ভয়ে বাপী চোখের ভাষাতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।

গায়ত্রী রাই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার স‍ই করে রেখেছি, দিয়ে দিচ্ছি—

ভিতরে চলে গেল। সেই ফাঁকে বাপী আস্তে আস্তে তার মেয়ের দিকে চোখ ফেরালো। ঊর্মিলা তার দিকেই চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই চাপা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, সুখবর পেয়ে মুখখানা যে আরো ওয়েট ক্যাটের মতো হয়ে গেল। এক্ষুনি ছুটে গিয়ে এক ভাঁড় তেল কিনে ঘরে মজুত রাখো!

মেয়েকে পাহাড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের কথায় সায় দিয়েছিল বলেই এই রাগ। মুখখানা খুব নির্লিপ্ত করে বাপী বলল, আমার ঘরে এলে সুখবর আমিও কিছু দিতে পারি।

গম্ভীর, কিন্তু চোখের তারা উৎসুক। বাপীর নির্বিকার মুখ আবার সামনের দিকে। একটা ফাইল হাতে গায়ত্রী রাই ফিরে এসেছে।

চেয়ারে বসল। ফাইল খুলল। বাপী তার আগেই দেখে নিয়েছে বড় হরফের টাইপে ফাইলের ওপর বাপী তরফদার নামের লেবেল। বাপীর মনে হল তার পোশাকী নাম বিপুলনারায়ণ তরফদার হারিয়েই গেল;চার মাস আগে মহিলার সঙ্গে বাড়ির যে কনট্রাকট্ হয়েছিল তাতেও বাপী তরফদারই ছিল, আর সেও বিনা আপত্তিতে তাই সই করেছিল। রাই অ্যান্ড রাই লেটার হেডে টাইপ-করা আর সই—করা একটা চিঠি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। কর্তার আমলে স্বামী-স্ত্রী নামে ব্যবসা চালু ছিল। এখনো ওই নামই আছে। অর্থাৎ মা আর মেয়ে মালিক। পকেটে রাখার উদ্দেশ্যে বাপী চিঠিটা ভাঁজ করতে যাচ্ছিল, বিরক্তির সুরে বাধা পড়ল।

—পড়ে নাও!

পড়ল। মুখে যা বলেছিল তাই। তার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করা আছে। রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার হিসেবে তাকে বহাল করা হল। কোন্ রিজিয়ন এতেও তার উল্লেখ নেই। মাসমাইনে থোক তিনশ। বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টের ব্যাপারে ফার্মের ব্যবসা আর তার কর্মপটুতা বিবেচনাসাপেক্ষ। বাইরে টুরের প্রয়োজনে যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়া হবে। এক মাসের নোটিসে অথবা একমাসের ক্ষতি-পূরণে মালিক কর্মচ্যুতি ঘটাতে পারে। কাজে ইস্তফা দেওয়ারও একই শর্ত।

চিঠিতে চারদিন আগের তারিখ। অর্থাৎ পাহাড়ের বাংলোয় যাবার আগেই ব্যবস্থা পাকা করে রেখে গেছল।

—ঠিক আছে?

বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

ফাইলসুদ্ধ ওই চিঠির কপিটা তার দিকে এগিয়ে দিল।— রিসিভড্ দি ওরিজিন্যাল লিখে সই করে দাও, আজকের তারিখ দিলেই হবে।

পাকা কাজ। পকেট থেকে কলম বার করে বাপী লিখল। সই করল। গায়ত্রী রাইয়ের দু’-চোখ সেই থেকে তার মুখের ওপর অনড়। সই করা হতে ফাইলটা টেনে নিয়ে বন্ধ করে পাশে সরিয়ে রাখল। তখনো মুখের দিকে চেয়ে নতুন করে কি দেখছে মহিলা বাপী ঠাওর করতে পারল না।

—শীত আসছে, তুমি কি এই পাজামা পাঞ্জাবি পরেই কাটিয়ে দেবে নাকি? বাপী জবাব দিল, গরম জামা আছে, গরম চাদরও আছে।

—ট্রাউজার বা কোট?

—ওসব কখনও পরিনি।

—এখন থেকে পরো। বড় বড় পার্টির সঙ্গে দেখা করতে হবে, ডিল করতে হবে—ইউ আর রিপ্রেজেনটিং এ বিগ ফার্ম। গোড়াতে কিছু আউটফিট্ অ্যালাউয়েন্স গ্র্যান্ট করে দিচ্ছি, যা করার করে নাও।

এতক্ষণে বাপী অনুভব করল মাঝের চালিহা-দেওয়াল কিছুটা সরেছে। দ্বিধাগ্রস্ত মুখে হেসে বলল, এই পোশাকটা বেশ ট্রেডমার্ক হয়ে গেছল…

অনেক দেখা, তবু এই বেশবাস আর এক দফা খুঁটিয়ে দেখে নিল মহিলা। তারপর মন্তব্য করল, ট্রেডমার্ক হয় নি এমন অনেক জায়গায় এরপর তোমাকে যেতে হবে।

—ঠিক আছে। প্রসঙ্গ বাতিল করে মনে যা আছে বলে ফেলার এটাই সময়।—আপাতত দিন কতকের জন্য আমি এখান থেকে ডুব দিচ্ছি।

শোনামাত্র তার সাদাটে দুই ভুরু কুঁচকে গেল। অন্য দিকে কথা আর শেষ হয় না দেখে তার মেয়েও হয়তো বিরক্ত হচ্ছিল। যে মুখ করে বাপী সুখবর দেবার কথা বলেছিল, ওই মেয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরে বসে থাকা সহজ নয়। ডুব দেবার কথা শুনে পড়ার ভান ছেড়ে সেও বই নামালো।

প্রস্তাব বাতিল করার মতোই রুক্ষ স্বরে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

—প্রথমে আপনার ভুটান পাহাড়ের বাংলোয়, তারপর পাহাড়ে আর জঙ্গলে। এই জবাব মা বা মেয়ে কেউ আশা করে নি। মহিলার গোল চোখ তার মুখের ওপর স্থির।

বাপী বলল, আবুর মুখে শুনেছি, আপনার পাহাড়ের বাংলোয় মিস্টার রাইয়ের পাহাড় আর জঙ্গলের দরকারি গাছগাছড়া লতাপাতা ফলমূলের ভালো ভালো বই আছে। সেগুলো আগে পড়ে নিতে চাই। তারপর ওইসব গাছগাছড়া লতাপাতা বীজদানা খুব ভালো চেনে এমন একজন লোক যদি সেখানে পাই, তাহলে নিজের চোখে সব দেখা আর বোঝার অভিজ্ঞতা হয়। যে কাজ আমরা করছি তার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত একজনের অন্তত সব চেনা আর জানা দরকার। বইপত্র ঘাঁটলে আর নিজে যাচাই-বাছাই করতে পারলে ফিল্ড বাড়ানোও সম্ভব। আর, এ অভিজ্ঞতার সব থেকে বেশি দরকার বোধ হয় কাজটাকে ভালবাসার জন্যে।

একসঙ্গে এতগুলো কথা বাপী কমই বলেছে। মহিলার অপলক চাউনি। সাদাটে মুখে লালের আভা। এই প্রথম ওই মুখে বুকের তলার কোনো অনুভূতির প্রতিক্রিয়া দেখল বাপী। তার ধারণা, স্বামীর বইপত্র পড়া, দুষ্প্রাপ্য জিনিসের খোঁজে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘোরা, সব চেনা-জানা-বোঝার তাগিদে আহার-নিদ্ৰা ভুলে বনবাদাড় চষে বেড়ানো ইত্যাদি স্মৃতির কোনো নিঃশব্দ আলোড়ন চলেছে ভিতরে। অনুমান খুব ভুল নয় সেটা একটু বাদেই বোঝা গেল।

গায়ত্রী রাই বলল, বই আছে। সব চেনে জানে এমন লোকও আছে। তুমি কবে যেতে চাও।

—কালও যেতে পারি। এখানকার কাজ মোটামুটি সেরে রেখেছি, তাছাড়া মিস্টার চালিহাও কিছুদিনের মধ্যে টুরে যাচ্ছেন না শুনেছি।

চুপচাপ ভাবল একটু।—কাল হবে না, পরশু সকালে রেডি থেকো।

ওদিক থেকে তার মেয়ে আঁতকে উঠল।—আমি এখন আর এক পা-ও এখান থেকে নড়ছি না বলে দিলাম।

ভিতরে কিছুটা নাড়াচাড়া পড়েছে বলেই হয়তো মেয়ের পলকা দিকটা বেশি চোখে পড়েছে মহিলার। তার দিকে চেয়ে রুষ্ট-গম্ভীর জবাব দিল, তোকে যেতে হবে না! ওকে রেখে আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।

কথা শেষ। বাপী চলে এলো। অনুমতি পেলে আবুকে সঙ্গে করে পাহাড়ের বাংলোয় যাবে ভেবে রেখেছিল—দিন দুই ওকে সেখানে ধরে রেখে ঝগড়ুর সঙ্গে ভাবসাব করে নেবে। কিন্তু তার থেকে এ অনেক ভালো হল। কর্ত্রী নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে।

বাপী এতটা আশা করে নি।

.

নিজের আঙিনার ফটক খুলে ভিতরে পা দিয়েই বাপী অবাক একেবারে। উঠোনে মেহেদী গাছের পার্টিশন ঘেঁষে আবু রব্বানী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখামাত্র কেন যেন বাপীর মনে হল, গাছ ফাঁক করে ও-দিকের বাংলোর দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। ওকে উঠতে দেখে ফিরেছে। নইলে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে যাবে কেন।

—কি ব্যাপার?

আবু রব্বানী একটা আঙুল মুখে তুলল। অর্থাৎ অত জোরে কথা নয়। বাপী আরো অবাক, কারণ আবুর মুখে সত্যি উৎকণ্ঠার ছাপ। আজই দুপুরে যখন খুশি ওকে বাংলোয় আসতে বলেছিল বাপী। কিন্তু সেই আমন্ত্রণে আসে নি দেখেই বুঝছে। আর দিনের আলোয় সদর দিয়ে অর্থাৎ ওদের মেমসায়েবের নাকের ডগা দিয়ে আসে নি, বলাই বাহুল্য। জংলা পথ ভেঙে পিছন দিক দিয়ে এসেছে। এত লুকোচুরি করে আসার তাগিদ কেন বা আবুর হঠাৎ এমন শুকনো মুখ কেন বাপী ভেবে পেল না।

আবু গলা খাটো করে জিগ্যেস করল, তুমি মেমসায়েবের সঙ্গে কথা কইছিলে বাপীভাই, না তার মেয়ের সঙ্গে?

—দুজনার সঙ্গেই। কেন?

এই জবাবে আবু নিশ্চিন্ত একটু। তবু আমতা আমতা করে আবার জিগ্যেস করলো, রেশমার সম্পর্কে কোন কথা হয় নি তাহলে?

ভিতরে কৌতূহলের আঁচড় পড়ল এবারে। বাইরে অবাক।— রেশমার সম্পর্কে কি কথা হবে?

—যাক, আবু হাসিমুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা, আমি তো দুলারিকে কতবার বললাম, বাপীভাই যা-ই জানুক বুঝুক ফস করে মেমসায়েবকে কিছু বলে বসে থাকার মতো কাঁচা ছেলে নয়। তবু ভয়ে ভাবনায় জোর করেই আমাকে ঠেলে পাঠালো।…তুমি একবারটি চলো না আমার ওখানে, দুলারি বার বার বলে দিয়েছিল, রেশমাও সেখানে আছে—

বাপী মাথা নাড়ল।—এখন যেতে পারছি না, তোমাদের মেমসায়েবের মেয়ে এক্ষুনি আসবে।

আবু ব্যস্ত হয়ে উঠল, তাহলে আমি চলি, তুমি পরে না-হয় এসো—

বাপী মিথ্যে বলেনি। ঊর্মিলাকে সুখবর দেবার টোপ ফেলে এসেছে। যে কোন মুহূর্তে এসে হাজির হতে পারে। আবুর সঙ্গে সে-ও বেরিয়ে এলো। তারপর বাড়ির পিছনে এসে ওকে দাঁড় করালো।—কি ব্যাপার খোলাখুলি বলো তো?

আবু হাসতেই চেষ্টা করল, কিন্তু ভিতরের উদ্বেগটুকু গোপন থাকল না।— কি আর বলব, তোমার কতদিকে কটা করে চোখ আর কান, আর মগজে কি যে আছে ভেবে তাজ্জব বনে যাই।

কথাগুলোর মধ্যে কৃত্রিমতা নেই। বাপী হাসল।—আচ্ছা, এবার বলো।

আবু যা বলবে এতক্ষণে সেটা মোটামুটি আঁচ করা গেছল। অনেকটা তাই। আজ একটা মাত্র নির্বিষ সাপ ধরে দুলারিকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল রেশমা। হয়তো ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। তাই আগে চলে এসেছে। আবুকে পেয়ে কথায় কথায় বলেছিল, বাপীভাই আজ আপিসে না বসে জঙ্গল দেখে বেড়াচ্ছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আবু জানিয়েছে দেখা তার সঙ্গেও হয়েছে। আর বাপীভাই চলে যাবার পর সারাক্ষণ যে-কথাটা মাথায় ঘুরছিল তাও বলেছে। মেমসায়েবের মেয়ের প্রেমের ব্যাপারটা তিনজনেই জানে, নিজেদের মধ্যে মাঝে—মাঝে কথা হয় তা নিয়ে। দুলারির সামনেই আবু রেশমাকে বলেছে, তোর মেমদিদিকে বলে দিস তার প্রেমিকটিকে যেন একটু সাবধান করে দেয়— বাপীভাইয়ের কাছে ধরা পড়েছে তাই রক্ষে, মেমসায়েব বা তার ম্যানেজারের কাছে ধরা পড়লে খেল খতম হয়ে যাবে।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেশমার ছাইবর্ণ মুখ একেবারে! হাঁসফাস করে জিগ্যেস করল, বাপীভাইয়ের কাছে কবে ধরা পড়ল? কি করে ধরা পড়ল?

আবু বা দুলারি তখনো কিছু বুঝতে পারে নি। আবুর সঙ্গে বাপীভাইয়ের কি কথা হয়েছে শোনার পর রেশমা বলেছে, বাপীভাই জঙ্গলে আজ ওর সঙ্গেই বিজয় মেহেরাকে কথা কইতে দেখেছে।

শুনে আবু আর দুলারির মাথায় বজ্রাঘাত। মেমসায়েব জানতে পারলে রেশমার তো হয়েই গেল, ওদেরও গিলে খাবে। সাত-পাঁচ না ভেবে বাপীভাই যদি কথায় বলে ফেলে সেই ভয়েই আবু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছে।

বাপী হাসছে।—তোমারও এত ভয়!

আঁতে লাগল।—ভয়ের নিকুচি করেছে। শুনলে মেমসায়েব আমাকেও নিমকহারাম ভাববে, বুঝলে?

—বুঝলাম। ঊর্মিলার সঙ্গে বিজয় মেহেরার যোগাযোগটা রেশমার যোগসাজসে চলেছে এ তুমি আগে বোঝোনি?

—আল্লার কসম বাপীভাই। আমার সত্যি বকরির মাথা হয়েছে আজকাল, রেশমার এত বুকের পাটা আমি ভাবতেও পারি নি, কিন্তু তোমার কি বিজয় মেহেরাকে ওর সঙ্গে দেখার আগেও সন্দেহ হয়েছিল নাকি?

বাপী হেসেই জবাব দিল, অমন ডাকসাইটে মেমসায়েবের মেয়ের সঙ্গে জঙ্গলের সাপ-ধরা মেয়ের এত গলায় গলায় ভাব খুব সাদা চোখে দেখার মতো কি? ওর মজুরি বাড়ানোর জন্য ঊর্মিলাই সব থেকে বেশি তাগিদ দিয়েছিল।.. যাক, এখন রেশমা কি বলে?

—কি আর বলবে। ঘাবড়েছে ঠিকই কিন্তু মচকাবার মেয়ে নয়। দুলারি বকাঝকা করতে ফোঁস করে উঠেছে, জানলে মেমসায়েব মাথা কাটবে নাকি— না-হয় আগের মতো কষ্ট করে দিন কাটবে—তার বেশি কি হবে? তোমার কাছে ধরা পড়েছে বলে এখন তোমার ওপরেই বেশি রাগ।

হাতঘড়িতে সময় দেখল বাপী। পাঁচটা বাজে। বলল, ঠিক আছে, তুমি চলে যাও—

—তুমি পরে আসছ?

—না। গিয়ে রেশমাকে তার ঘরে পাঠিয়ে দাও। তার মেমদিদি শিগগিরই ওর খোঁজে যাবে।

আবু ভেবাচাকা খেয়ে গেল।—কেন বাপীভাই?

—জানি না। মনে হচ্ছে। বেশি কথা বলার সময় নেই, তুমি তাড়াতাড়ি যাও। বাপী নিজেই তাড়াতাড়ি চলে এলো। ফটকের কাছে বা বারান্দায় কেউ নেই। ঊর্মিলার এত ধৈর্য আশা করে নি। ধীরেসুস্থে বারান্দাতেই চেয়ার টেনে বসল।

তার দু’ মিনিটের মধ্যে ঊর্মিলা বাঁশের ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে ওখান থেকেই দেখে নিল একদফা। তারপর গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকল। বাপীর মনে হল, না এসে পারা গেল না বলেই অমন অসহিষ্ণু হাবভাব।

বারান্দায় ওঠার আগেই তপ্ত প্রশ্ন।—ঘরদোর খোলা রেখে কোথায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলে? আনন্দ বুঝি আর ধরে না?

এরই মধ্যে এসে ফিরে গেছে তাহলে। জিগ্যেস করল, আনন্দ কেন?

মুখোমুখি বসল। তেতেই আছে। গলার স্বরে বক্রাভাস। চাকরি পাকা হল, আর আঙ্কল চালিহারও বারোটা বাজতে খুব দেরি নেই বোঝা গেল—আনন্দ হবে না?

—তোমার দুঃখ হচ্ছে?

—নাঃ, তোমার কেরামতি দেখে হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে! কি বলবে বলো—

বাপীর অবাক মুখ।—কি বলব?

—দেখো, চালাকি কোরো না। সুখবর দেবে বলে তুমি আসতে বলোনি?

—ও…! মনে পড়ল যেন। হাসছে অল্প অল্প।—তুমি কি সুখবর আশা করেছিলে?

—তোমার মতো ধড়িবাজকে বিশ্বাস কি যে আশা করতে যাব?

—তাহলে এলে কেন?

—তুমি বলবে, না চলে যাব?

—বলব। বাপী গম্ভীর।—চিঠি এসেছে। নিজের হাতে দিয়ে গেছে। রেশমার সঙ্গে দেখা হলে পাবে।

মাথার ওপর আচমকা ঘা পড়ার মতো মুখ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল খানিক। তারপর শরীরের রক্তকণাগুলো সব মুখের দিকে ধাওয়া করল। চেয়ার ছেড়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বেলা ছোট হয়ে আসছে। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে বাপীর দু’-কান সজাগ। পাশের বাংলো থেকে ভ্যানটা বেরুলো।

তারপর থেকে বাপী অপেক্ষা করছে। বড় রকমের কিছু বোঝাপড়া করার তাগিদে ঊর্মিলা রাই আজই আবার আসবে। আসবেই। বাপীর নিজের বুকের তলার একটা দিক ঝাঁঝরা। কারো প্রেম-ভীতির ব্যাপারে নাক গলানোর ইচ্ছে ছিল না—এখনো নেই। গায়ত্রী রাইকে যতটা চিনেছে, এই মেয়ে সহায় হলেই ভাগ্যের দরজা খুলে যাবে ভাবে না। কিন্তু মেয়ে এরপর সহায় না হোক শত্রুতা অন্তত করবে না। অস্ত্র হাতে নিয়ে শুধু এটুকু আপোসের দিকেই এগোনোর ইচ্ছে বাপীর।

বাপী বই নিয়ে শুয়ে ছিল। এক পাতাও পড়ছিল না! ঝড়ের জন্য প্রস্তুত। তারপর রামধনু দেখার জন্যও।

ঘণ্টা দেড়েক বাদে ঊর্মিলা রাই এলো। তপতপে লাল মুখ। চাউনিতে রাগ ভয় অবিশ্বাস।

বই হাতে বাপী হাসি মুখে উঠে বসল। জিগ্যেস করল, খুব সুখবর কি না? —খুব। খাতির পাবার জন্য রেশমাই বলেছে ভেবে আমি তার টুটি চেপে ধরতে গেছলাম। পরে বুঝলাম সে নয়। তাহলে আবু রব্বানী বোধ হয়?

বাপীর হাবাগোবা মুখ।—আবুকে নিজের গোপন কথা তুমি বলেছিলে নাকি! সামনের চেয়ারটা পা দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঊর্মিলা ঝলসে উঠল।— কে বলেছে তাও আমার বুঝতে বাকি নেই—মদের নেশায় ঝগড়ু তাকে বলেছে—দস্তি বার করছি আমি, ওদের কারো গায়ে আর ছাল-চামড়া থাকবে না তুমি জেনে রেখো!

খুব নির্লিপ্ত গলায় বাপী বলল, ঝগড়ুকে আমি এখন পর্যন্ত দেখি নি। ওদের দু’জনের কারো গায়ে আঁচড় পড়লে সেটা আমার গায়েও এসে লাগবে।

প্রকারান্তরে সতর্ক করার ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট। অর্থাৎ আঁচড় পড়ার কারণ জানলে মা ওদের ওপর অবিচার করা দূরে থাক, উল্টে আগলে রাখবে। খাঁচায় পোরা বাঘিনীর মুখ। ফাঁক পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকেই ফালা ফালা করার আক্রোশ। বাপী আবার বলল, আমারই ভুল হয়েছে, তুমি ফ্রেন্ড বলেছিলে সেটাই সত্যি ভেবেছিলাম। সত্যিকারের বন্ধু দরকার অদরকারে পাশে থাকে, তুমি তা চাও না বুঝিনি। উল্টে আশা করেছিলাম গোপনতা ফাঁস হয়ে গেছে দেখলে তোমার আমার সম্পর্কটা আরো সহজ হবে, সুবিধেরও হতে পারে…।

ওই মুখে রং বদলের সুন্দর একটু কারুকার্য দেখল বাপী। যা শুনল তার অর্থ না বোঝার মতো বোকা নয় এই মেয়ে। তবু এতটা বিশ্বাস করবে কি করবে না সেই সংশয়। দেখছে আর বিশ্বাসের দিকেই ঝুঁকছে। কাছে এসে পাশ ঘেঁষে খাটের ওপর বসে পড়ল। দু’-হাতে বাপী দু’-গাল ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠল, তুমি কক্ষনো কোনো কারণে মাকে কিছু বলছ না, কিচ্ছু জানতে দিচ্ছ না—ঠিক? ঠিক?

—তুমি বাধ্য না করলে এরকম আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।

গাল ছেড়ে খপ করে দু’-হাতে মাথার চুলের মুঠি ধরে দু’বার ঝাঁকিয়ে দিল, মুখে খুশির জেল্লা।—তুমি একটা স্কাউনড্রেল, তুমি একটা শয়তান

—কান জুড়লো।

—দরকার পড়লে তুমি আমাকে সাহায্যও করবে। করবে না?

চুলের মুঠি এখনো ওর হাতে ধরা, গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে, ওর গরম নিঃশ্বাস নাকে মুখে লাগছে। বাপী অস্বস্তি বোধ করছে।—ছাড়ো, তুমি কি চুলের ঝুঁটি ধরে কথা আদায় করবে নাকি?

—আগে বলো, সাহায্য করবে?

—নিজেকে নিরাপদ রেখে যতটা সম্ভব।

হেসে আবারও গোটা দুই ঝাঁকুনি।…সত্যিকারের বন্ধু নিজের কথা ভাবে? ইউ আর মাই ফ্রেন্ড এ জেম অফ এ ফ্রেন্ড! আনন্দের আবেগে এবারে মাথাটা টেনে বাপীর গালের সঙ্গে নিজের গাল ঘষে দিল। তারপর ছেড়ে দিয়ে হাসতে লাগল। বাপী গম্ভীর। সরে বোসো। বিজয় মেহেরা কেমন লোক আমি জানি না। কিন্তু আমি একেবারে ঢেঁাড়া জাতের নই, এতটা প্রশ্রয় সহ্য হবে না।

উঠে চট করে সামনের চেয়ারে বসল। চোখে কোপ, মুখে হাসি।—তুমি একটা হাড় পাজি আমি গোড়া থেকে জানি। নইলে মা এ-ভাবে ঘায়েল হয়— আজ তো একেবারে ট্রাম্প কার্ড ছেড়ে দিয়ে এসেছ!

প্রেমের আবেগে এই মেয়ে কতটা ডুবে আছে বাপী সেটা সহজেই আঁচ করেছে। বিজয় মেহেরার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গলায় দড়ি দিতে হলে দেবে, তবু আর কাউকে বিয়ে করবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাপীর সঙ্গে এবার তার আলাপ করিয়ে দেবে। বাপীরও ভালো না লেগে পারে না।

তেমনি রাগ আঙ্কল চালিহার ওপর। বিজয় মেহেরার সম্পর্কে মায়ের মেজাজ সে-ই আরো বিগড়ে দিয়েছে। কি তার মতলব কে জানে। বাবা মারা যাবার পর মাকে বিয়ে করে সব হাত করার আশায় ছিল। আর দায়ে পড়ে মা—

ও তখন যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল ওই লোককে, ঊর্মিলা ধরেই নিয়েছিল বউকে ডিভোর্স করে আঙ্কল সব-কিছুর ওপর দখল নিয়ে বসল বলে। তখন দু’জনের একজনকেও দেখতে পারত না ঊর্মিলা। কিন্তু মা কত ঝানু সেটা পরে বুঝেছে। এদিক থেকে মায়ের ওপর আর রাগ নেই মেয়ের, রাগ অন্য কারণে। নিজেকে ছাড়া আর সক্কলকে বোকা ভাবে মা। তার ধারণা, মেয়ে বাজে লোকের খপ্পরে পড়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে। মেয়ের মতিগতি দেখে বিজয় মেহেরা সম্পর্কে আঙ্কলকে খবর নিতে বলেছে। আঙ্কল তার সম্পর্কে যাচ্ছেতাই রিপোর্ট করেছে। মিরিকের এক পার্টিতে তাকে দেদার মদ খেতে দেখেছে বলেছে। বিজয় ঊর্মিলার কাছে সত্যি কথাই বলেছে। অল্প-স্বল্প মদ খেয়েছিল সত্যি কথাই। একলা থাকে, কিছু ভালো না লাগলে একটু-আধটু খায়ও। তাও ছেড়ে দেবে কথা দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মায়ের আবার আঙ্কলের কথাতেই ধ্রুব বিশ্বাস। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে কম ঝগড়া করে নি ঊর্মিলা। বলেছে, বাবা তো এন্তার মদ খেত—কিন্তু বাবা কি খারাপ লোক ছিল?

—বয়েস আর বারো-চৌদ্দ বছর কম হলেও ওই আঙ্কল মাকে ছেড়ে আমাকেই বিয়ে করার জন্য উঠে-পড়ে লাগত—বুঝলে? এখনো নিজের তাঁবের লোকের কাঁধে আমাকে ঝোলানোর মতলবে মা-কে ফুসলে বেড়াচ্ছে, খুব ভালো ভালো ছেলের খবর দিচ্ছে। ভালো না হাতি—এবারও মা জোর-জার করে আমাকে পাহাড়ে ধরে নিয়ে গেছল তার খবরের এক ছেলেকে দেখার জন্য। মায়েরই পছন্দ হয় নি বলে বাঁচোয়া।

এবারে আর একটা গোপন খবর ফাঁস করল ঊর্মিলা। বিজয় মেহেরার সঙ্গে তার যে যোগাযোগ আছে এটা বাপীর মতো আঙ্কলও জেনে ফেলেছে। পাহাড়ের রাস্তায় এই বানারজুলির জঙ্গল থেকেই দু’জনকে একসঙ্গে দেখে জিপ থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেছল। সে প্রায় আট মাস আগের কথা। কলে পড়ে তাকে খুশি করার জন্য ঊর্মিলা রেশমার মারফৎ তাকে এক বোতল ভালো মদ পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে-রাতে বাপী আঙ্কলের মন পাবার জন্য তার বাড়ি গেছল, সেই রাতে। বাপী টের পেয়ে ওর সম্পর্কে যা-তা ভেবেছে, কিন্তু মেমদিদিকে রেশমা দারুণ ভালবাসে—তাই গেছে। আঙ্কল যদি টের পেত এ-ব্যাপারে রেশমার সঙ্গেও যোগসাজশ আছে, মওকা পেয়ে সে তাহলে ভিতরের ঘর ছেড়ে রেশমাকে বিছানাতেই টেনে নিয়ে যেত—এমন চরিত্র তার। জেরার জবাবে রেশমা শুধু বলেছে, কাগজের বাক্সটা মেমদিদি তার কাছে পৌঁছে দিতে হুকুম করেছে তাই নিয়ে এসেছে, আর কিচ্ছু জানে না। ভালো মদের বোতল ভেট দেবার অর্থ আঙ্কল ঠিকই বুঝেছে। মাকে এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি অবশ্য, কিন্তু সেই থেকে ঊর্মিলার ওপরেও তার একটু সর্দারি বেড়েছে। ফাঁক পেলে ভালো মুখ করে বিজয় মেহেরাকে বাতিল করার উপদেশ দেয়, আর মায়ের প্রতি তার নিজের কর্তব্যের কথা বলে ওকে হাতের মুঠোয় রাখতে চায়। আবার ওদের দু’জনকে হাতেনাতে ধরার জন্যে ওত পেতে আছে। রেশমাকে ধরে জেরা করে, শাসায়। ঊর্মিলার তাই নিজের জন্যে চিন্তা, রেশমার জন্যেও চিন্তা। এ অবস্থায় ফ্রেন্ড অর্থাৎ বাপীই একমাত্র সহায় তার।

বুকের তলার চেনা যন্ত্রণাটা থেকে থেকে মোচড় দিয়ে ওঠে। এর নাম ঈর্ষা কি হতাশা বাপী জানে না। নিজের ওপরেই বিরক্ত। কেন সেধে এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে গেল। তার সামনে কাজ। কাজে শুদ্ধি। কাজে মুক্তি। এর থেকে ভ্রষ্ট হলে ওই হতাশার দেয়ালে মাথা খোঁড়াই সার হবে এ-কি ও জানে না?

.

গায়ত্রী রাই নিজে সঙ্গে করে বাপীকে তার পাহাড়ের বাংলোয় রেখে গেছে। আর ঝগড়ুকে যা বলার বলে গেছে নিশ্চয়। সমস্ত ব্যবস্থা আর কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়ে মালকান চলে যাবার পর লোকটা অনুগত ছায়ার মতোই তার সঙ্গে লেগে আছে।

ঝগড়ু বাড়িয়ে বলেনি। পাহাড়ের ওপর সত্যি ছবির মতো বাংলো। এ তল্লাটে এমন আর দুটি নেই। পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে লাল কাঁকরের রাস্তা বাংলোর মুখে এসে থেমেছে। থাকে থাকে পাহাড় কেটে প্ল্যাটফর্মের মতো করা হয়েছে। সব থেকে উঁচু প্ল্যাটফর্মে তিনটি বড় ঘর। তাকে কাঁচের দরজা জানালা। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। ঢোকার পথে দিশি ফুলের বাগান। পিছনে দরকারী এবং দামী গাছ-গাছড়ার বাগান। একদিকে কাঠের সমস্ত স্টোর হাউস। তার পরেই একসারি শিরীষ গাছ। স্টোর হাউসের পাশে সাপ-ঘর। ছোট-বড় গ্লাসকেসে নানা রকমের সাপ। ঝগড়ু এখানে সাপের বিষ বার করে। বাংলোর আর একদিকে একটু তফাতে কিচেন। তার পাশে ছোট ছোট দুটো ঘরে চাকর আর মালি থাকে। পরের ঘরটা ঝগড়ুর। কর্ত্রী বা অন্য লোকজন এলে সে ওই ঘর দখল করে, নয়তো বাংলোতেই থাকে। সবটা জুড়ে চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া—তাতে বুনো ফুল আর লতাপাতা লাগিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে।

পর পর তিনটে ঘরের একটা মেয়ের, মাঝেরটা গায়ত্রী রাইয়ের। শেষেরটা অতিথি-অভ্যাগতর জন্য। ভিতরে ডাইনিং স্পেস। সামনের বারান্দায় বসার ব্যবস্থা।

গায়ত্রী রাই চলে যাবার পর বাপীর প্রথম কাজ ঝগডুর সঙ্গে ভাব করা! ও তাকে মস্ত হোমরাচোমরা কেউ ভেবে বসে আছে। বয়েস শুনেছে সত্তরের কাছাকাছি, কিন্তু জরা এখনো দূরে সরে আছে। শক্তপোক্ত পাকানো চেহারা। লালচে চোখ। প্রথম দিনই বিকেলে পাহাড় থেকে নেমে বাপী ওর জন্য এক বোতল দামী মদ কিনেছে। ওর হাঁসফাঁস দশা দেখে বলেছে, যতদিন আমি এখানে আছি তুমি ভালো জিনিস খাবে—ফুরোলে আবার কিনে দেব। আবু রব্বানীর কাছে আমি তোমার অনেক গল্প শুনেছি, আমাকেও তার মতো কাছের একজন ভাববে।

প্রথম সন্ধে থেকেই ওই পাথুরে মুখ খুশিতে টসটসে সর্বদা। প্রথম পাঁচ ছ’দিন বাপী আর বাংলো ছেড়ে বেরোয়নি। নেশার জিনিস সব এখানেই তৈরি হয়। এর জন্য জনাকতক বাঁধা কর্মচারী আছে। মস্ত স্টোর হাউসের মধ্যেই যাবতীয় ব্যবস্থা। ঝগড়ুকে সঙ্গে নিয়ে বাপী সব খুঁটিয়ে দেখেছে, বুঝে নিয়েছে। পিছনের বাগানের প্রতিটি গাছগাছড়া চিনেছে। সাপ-ঘরে গিয়ে ঝগড়ুর সাপের বিষ বার করা দেখেছে। এও গা ছমছম করার মতো ব্যাপার। গ্রাস-কেস একটু ফাঁক করলেই বিষধর বেরিয়ে আসার জন্য গলা বাড়ায়। ঝগড়ু সেই গলা সাঁড়াশির মতো এক হাতে চেপে ধরে একটা ছোট টেবিলের সামনে নিয়ে আসে। টেবিলে রবারের ক্যাপ আঁটা কাঁচের গেলাস। সাপের মুখ সেখানে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ সাপ তার ওপরেই দাঁত বসায়—ফলে রবার ক্যাপে দাঁত আটকে যায়। ঝগড়ু তখন সাপের চোয়ালের দু’দিকে নির্মমভাবে টিপতে থাকে—গেলাসের মধ্যে তখন টস-টস করে বিষ পড়ে।

বিষ বার করা হয়ে গেলে অতি বিষাক্ত সাপের দশাও নিস্তেজ, কাহিল। মাটিতে ছেড়ে দিলেও কোনরকমে এঁকেবেঁকে পালাবার পথ খোঁজে। তেড়ে আসে না।

.

দুপুরে আর সন্ধ্যার পরে বাপী অনেক রাত পর্যন্ত তন্ময় হয়ে বই পড়ে। সত্যি অনেক রকমের বইয়ের সংগ্রহ ছিল বীরেশ্বর রাইএর। প্রথম রাতে ভালো জিনিস খেয়ে একটু নেশা জমার পর ওকে বই পড়তে দেখে ঝগড়ুর হাপুস কান্না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সায়েব ওই-রকম করে বই পড়ত। সে চলে যাবার পর ও বইয়ে আর কারো হাত পড়েনি।

এরপর ঝগড়ুকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আর জঙ্গলে ঘোরার পর্ব। এ-কাজেও ঝগড়ুর ভারী উৎসাহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে তাদের দরকারের গাছগাছড়া ফুল-ফল লতা-পাতা চিনিয়েছে। কোনটার কি কাজ আর কত কদর বুঝিয়েছে। কখনো বা বাপী এ-সব সংগ্রহের বাঁধা লোকদের সঙ্গে সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরেছে। খাওয়া-দাওয়া হয়নি বলে ঝগড়ুর সখেদ অনুযোগ, আবার একই মুখে প্রশংসাও। সায়েবও ওইরকম করত। খাওয়া-দাওয়া ভুলে যেত। ঝগড়ুর মতে সায়েবের অনেক কিছুই বাপীবাবুর মতো। কিন্তু কাজ শেষ হলে দিলদরিয়া সাহেব গেলাস নিয়ে বসত—বাপীবাবু এ-সব ছোঁয় না, এটুকুই তফাৎ।

পনের দিনের মধ্যে বাপী অনেক ঘুরেছে অনেক দেখেছে অনেক চিনেছে। এই ঘোরা দেখা আর চেনাটা নেশার মতো হয়ে উঠেছে। এরপর একলাই বেরুতে শুরু করল। সঙ্গে একটা দুটো বই। ঘোরে দেখে আর বইয়ের সঙ্গে মেলায়। এক—একদিন এত দূরে চলে গেছে, বাংলোয় আর ফেরাই হয়নি। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পথের ধারের ছাপরা ঘরের সরাইখানায় যা জোটে তাই খেয়েছে, আর অক্টোবরের পাহাড়ী শীতের রাত সেখানেই চাদর মুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। সকালে আবার পাহাড় আবার জঙ্গল।

এর মধ্যে দু’বার গায়ত্রী রাই পাহাড়ের বাংলোয় এসেছে। কিন্তু বাপীর সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি। থাকতে আসা নয়, কাজে আসা। দ্বিতীয় দফায় চালিহা সায়েবও সঙ্গে ছিল শুনেছে। আর, প্রায় বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল মালকান। ঝগড়ু তাকে কি কথা বলেছে সেটা তার উদ্ভাসিত মুখ দেখেই বোঝা গেছে। বাপীবাবুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে খুব সম্ভব ওর স্বর্গত সায়েব-এর কথাই টেনে এনেছে ও। মালকান নাকি ওকে এবার থেকে বেরুনোর সময় সঙ্গে শুকনো খাবার দিতে হুকুম করে গেছে। দ্বিতীয় দফায় অনেকক্ষণ ছিল বলে ও বাপীবাবুর সংগ্রহের গাছ-গাছড়া লতা-পাতাও মালকানকে দেখিয়ে ছেড়েছে।

মনে মনে বাপী এই ঝগড়ুর কাছেও কৃতজ্ঞ।

সেদিন চেপে শীত পড়েছিল। আগের রাতে অসময়ে বৃষ্টি হবার ফলে সকাল থেকে কনকনে ঠাণ্ডা। সেই সঙ্গে ঝড়ো বাতাস চলেছে বিকেল পর্যন্ত। জঙ্গলের মধ্যে মাথা কান আলোয়ানে মুড়ি দিয়েও বাপীর কাঁপুনি ধরেছে। তবু পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এগিয়েই চলেছে। আর খানিক এগোলে যদি আরো নতুন কিছু চোখে পড়ে। এ-দিকটা নতুন। আগে আসেনি।

হঠাৎ এক জায়গায় পা থেমে গেল। অদূরে একটা মস্ত দেবদারু গাছের নীচে কে একজন বসে। বাপী চমকেই উঠেছিল। পাহাড় থেকে বুনো আদিবাসী নেমে এসেছে কোনো? এই ঠাণ্ডায়ও সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বুক আর পিঠ পর্যন্ত ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির চট। সর্বাঙ্গে ভস্ম-প্রলেপ। কপালেও। সামনে মাটিতে একটা লম্বা ত্রিশূল পড়ে আছে। নিজেও মাটিতেই বসে আছে, কোনো আসন নেই। হয়তো জনমানবশূন্য জায়গাটা বেছে নিয়ে সাময়িক বিশ্রামে বসেছে।

ঘাড় গুঁজে লতাপাতা গাছগাছড়া দেখতে দেখতে আসছিল। মুখ তুলে হঠাৎ দেখেছে মানুষটাকে। সে বোধ হয় দূর থেকেই লক্ষ্য করছিল তাকে। চোখাচোখি হতে বাপী স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেছে।

পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে চলল। নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছে কি ওই দু’টো অপলক চোখ তাকে টানছে, জানে না। সামনে পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। ওই দু’টো চোখে হাসি ঠিকরোচ্ছে, কি আলো বাপী ঠাওর করতে পারছে না। সেই হাসি বা আলো যেন তার চুল-দাড়ির ফাঁকে ফাঁকেও লুকোচুরি খেলে গেল।

—আগে বাঢ়। মিল যায়গা।

বাপী চমকেই উঠল। কোনো সাধুসন্তের ধারে-কাছে ঘেঁষেনি কোনো দিন। ভক্তি-বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু ওই গমগমে গলার স্বর আর কথাগুলো এক রোমাঞ্চকর কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। স্নায়ুতে স্নায়ুতে এক অদ্ভুত ঝঙ্কারের মতো বেজে চলল।

ত্রিশূল হাতে মানুষটা উঠে দাঁড়াল। তারপর পলকে জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

তার পরেও ওই গলার স্বর আর ঝঙ্কারের রেশ বাপীর কানের পর্দায় ঘা দিতে থাকল।

আগে বাঢ়। মিল যায়গা!

সামনে এগোও। পেয়ে যাবে।

বাপী কী পেতে চায়? সামনে এগোলে কি পাবে? পাহাড়ের বাংলোর রাতে ঘুমের মধ্যেও ওই কথাগুলো একটা শব্দতরঙ্গের মতো কানে লেগেই থাকল। বার বার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো।

সামনে এগোও। পেয়ে যাবে।

আগে বাঢ়। মিল যায়গা!

সোনার হরিণ নেই – ১৫

পঁচিশ দিন বাদে আবার বানারজুলি। বাপী তরফদার নিজের তাগিদে ফেরেনি। অদ্ভুত ভালো কেটেছে এই কটা দিন। সম্ভব হলে আরো দিনকতক থেকে যেত। কাজে ডুবে ছিল। প্রাণের গভীরেও। যে প্রাণের স্পর্শ এখন বানারজুলিতেও তেমন আর নেই। এত দিনের মধ্যেও কর্ত্রী ডেকে পাঠায়নি, ভাগ্য। এরপর তার মেজাজ বিগড়নোর আশঙ্কা।

বাইরে সেই বাপীই। কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু ভিতরে কিছু তফাৎ হয়েছে। নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়েছে। পায়ের তলায় মাটি আরো খানিকটা নির্ভরযোগ্য শক্ত মনে হয়েছে। ভিতরে কিছু বাড়তি উৎসাহ উদ্যমের সাড়া মিলছে। জঙ্গলের ন্যাংটো সাধুর সঙ্গে যোগাযোগটা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত কিছু, ভাবছে না। আর, যে-কথা সে বলেছে তারও এমন গম্ভীর কিছু তাৎপর্য নেই যা বাপীর জানা ছিল না। কিন্তু সময় বিশেষে অনেক সাধারণ কথা বা সামান্য কথাও বড় হয়ে ওঠে। ঝঙ্কার তোলে। কলকাতার ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের ভবিষ্যৎ বচনে আস্থা কতটুকু ছিল? তবু ভালো কি লাগেনি? ন্যাংটো সাধুও কিছু না-জেনেই হয়তো বাপীর একাগ্র প্রস্তুতির মুহূর্তে সব সার্থকতার সাদা মন্ত্রটুকু কানে জপে দিয়েছে। কিছু পেতে হলে কিছু করতে হবে। আগে বাড়তে হবে। এই উদ্দীপনা কোনো দ্বিধার দোসর হতে পারে না। নিষ্ক্রিয় তো নয়ই। ভিতরের এই জোরটুকু অনুভবের বস্তু।

কিন্তু ফিরে এসেই টের পেল এখানকার সমাচার কুশল নয়।

গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোর দরজা জানালা সব বন্ধ। বারান্দাটাও খাঁ-খাঁ করছে। বেতের টেবিল বা চেয়ার কটারও চিহ্ন নেই। উঠোনের কোণের দিকে মালিটা ঘাড় গুঁজে কাজ করছে।

ঝোলা কাঁধে বাপী বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল খানিক। তারপর গেট খুলে মালির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, সব কোথায়?

মালি কোনো হদিস দিতে পারল না। চার দিন আগে বাংলো তালা-বন্ধ করে সব চলে গেছে। কোথায় গেছে বা কত দিনের জন্য গেছে সে জানে না।

বাপীর শোনা ছিল দূরপাল্লার সফরে বেরুনোর দরকার হলে গায়ত্রী রাই মেয়েকে রেখে যায় না, সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। কিন্তু গত ন’ মাসের যোগাযোগে তাকে এভাবে উবে যেতে আর দেখেনি। গোলযোগের গন্ধ পাওয়া বাপীর স্বভাব কিনা জানে না। তিন দিনের জন্য পাহাড়ের বাংলোয় যাবার নামে যে মেয়ে ফুঁসেছে আর গজরেছে, কিছু একটা না ঘটলে তাকে বগলদাবা করে বেরুনোটা ওই মায়ের পক্ষে খুব সহজ হবার কথা নয়। আরো মনে হল, ব্যবসার তাগিদে তড়িঘড়ি দূরে যাওয়ার দরকার হলে বাপীর কাছে ফেরার এত্তেলা যেত।

ঘরে ফিরে কাঁধের ঝোলা নামিয়েই সাইকেল নিয়ে বেরুলো আবার। আপিসে। পাঁচটা তখনো বাজেনি। অ্যাকাউন্টেন্টকে ডেকে নিজের ঘরে ঢুকল। কিন্তু না। কর্ত্রী কোথায় গেছে বা কত দিনের জন্যে গেছে সে-ও জানে না। চার দিন আগের বিকেলে সে-ও দুটো দরকারী চিঠি সই করাতে গিয়ে দেখে বাংলো তালাবন্ধ। ব্যবসার কাজে বেরুলে অ্যাকাউন্টেন্টের অন্তত না জানার কথা নয়। বাপী স্বস্তিবোধ করছে না।—মিস্টার চালিহা কোথায়?

—এখানেই

—উনি জানেন না মিসেস রাই কোথায় গেছেন?

অ্যাকাউন্টেন্ট তাও জানে না। মিস্টার চালিহা শুধু দরকারী কাগজপত্র সব তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নেবার হুকুম করেছেন।

পরদিন বাপী সকাল দশটার একটু আগেই আপিসে হাজির। চালিহা আসতে তার ঘরে এসে দাঁড়াল। ঘরে এলে এই লোক এখনো তাকে বসতে বলে না। ফর্সা হাসি মুখে সুতৎপর ব্যস্তভাব।—দেখাশুনো হল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কত দিন ছিলে?

—পঁচিশ দিন।

ফাইল থেকে মুখ তুলল চালিহা। ঠোটের হাসি ধারালো একটু।—পঁচিশ দিন ধরে সেখানে দেখা-শোনার এত কি ছিল?

বাপী নিরুত্তর।

—মিসেস রাইয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছিল। তোমার ফিরতে এত দেরি হবে তিনিও জানতেন না।…ঠিক আছে, এতদিন সেখানে তুমি কি করলে না করলে, কি রকম অভিজ্ঞতা হল তার একটা অফিসিয়াল রিপোর্ট দাও।

ভিতরটা উষ্ম হয়ে উঠছে বাপীর। তবু যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা এবং সংযত। একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাই কোথায় গেছেন?

হাতের লাল পেন্সিল খোলা ফাইলের ওপর ফেলে আবার মুখ তুলল। খুব মোলায়েম স্বরে জবাব দিল, শিলিগুড়ি। সেখান থেকে আর কোথাও গেছেন কিনা জানি না। কেন—খুব দরকার তোমার?

—আজ্ঞে না। আমার ওপর তাঁর কোন ইনস্ট্রাকশন আছে?

ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ছোঁয়া। ধারালো চাউনি মুখের ওপর আটকে রইল খানিক।—তোমাকে ইনস্ট্রাকশন এবার থেকে তাহলে তিনি দেবেন ভাবছ?

বাপী বিনীত অথচ স্পষ্ট জবাব দিল, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। পঁচিশ দিন আমার এখানে না থাকার জন্যে আপনি অফিসিয়াল রিপোর্ট চাইলেন বলেই কথাটা জিজ্ঞেস করার দরকার হল।

—কেন?

—আমি যা শিখতে বা জানতে বুঝতে গেছলাম তার কোনো অফিসিয়াল রিপোর্ট হয় না। আর সেজন্যে পঁচিশটা দিনও কিছুই নয়। আমার ধারণা ছিল মিসেস রাই সেটা জানতেন। নিজে সঙ্গে করে আমাকে যখন সেখানে রেখে এসেছিলেন, ফেরার কথা কিছু বলেননি। আর, ছ’দিন আগে আপনারা দু’জনে যখন সেখানে গেছলেন তখনো ফেরার সম্পর্কে কোনো নোট বা ইনস্ট্রাকশন পাইনি।

ফর্সা মুখে অল্প অল্প করে হাসি ছড়াতে লাগল। তুচ্ছ ব্যাপার ঝেড়ে ফেলার মতো গলার স্বর।

ব্যাপারটা তুমি সিরিয়াসলি আর ইমোশনালি নিয়েছ দেখছি। আই অ্যাম রাদার গ্ল্যাড। অলরাইট, ফরগেট ইট। রিপোর্ট দিতে হবে না—বোসো, তোমার সঙ্গে দরকারী কথা আছে।

বাপী বসল। লোকটার আচরণ এভাবে বদলাতে দেখে সতর্কও একটু।

চালিহা স্বভাবসুলভ ব্যস্ততায় খোলা ফাইলটার ওপর সামান্য চোখ বুলিয়ে সেটা সরিয়ে দিল। পাশের দুটো টাইপ-করা চিঠিতে খসখস করে নাম সই করে টেবিলের বোতাম টিপল। বাইরে প্যাক করে শব্দ হতে পনের সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাকাউন্টেন্ট হাজির। চিঠি আর ফাইল নিয়ে সে প্রস্থান করতে খুশি মুখে চালিহা কিছু বলার জন্য প্রস্তুত।

—ওয়েল তরফদার এবারে তাহলে তোমাকে একটা সুখবর দিতে পারি। মিসেস রাইয়ের তোমার ওপর সত্যি খুব ভালো ধারণা। আমারও তাই।…আর ইউ হ্যাপি?

বাপী সবিনয়ে মাথা নাড়ল। ঠোঁটে একটু হাসিও টেনে আনলো।

—গুড। সো লেট মি গিভ ইউ এ বিট অফ হার মাইন্ড অ্যান্ড মাইন ট্যু— এরপর বাপী কান পেতে তার বক্তব্য শুনল।…অকটোবরের শেষের দিক এটা। ডিসেম্বরের গোড়ায় চালিহা আসাম সাইডে লং টুরে চলে যাচ্ছে। বছরে দু-আড়াই মাসের জন্য এ সময় প্রতিবারই গিয়ে থাকে। সে-সময় এদিকের সবকিছু মিসেস রাই ম্যানেজ করেন। মাসের অর্ধেকটা তাঁকেও নানা জায়গায় টুরের ওপর থাকতে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে এবারে তিনি কতটা পারবেন বলা যায় না। মনে হয় বাপীর ওপর আরো অনেক দায়িত্ব আসবে। সেই সঙ্গে এখানকার কাজের ব্যবস্থা-পত্রও আস্তে আস্তে বদলাবার কথা ভাবতে হবে তাকে। বানারজুলির জঙ্গলের এ সাইডে কিছু কিছু দরকারী জিনিসের চাষ হচ্ছে। সেটা আরো অনেক বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু এ কাজ জঙ্গলের একজন উটকো লোকের সর্দারির ওপর নির্ভর করে চলবে এটা মিসেস রাই বা চালিহা কারোরই পছন্দ নয়। জঙ্গলের রেঞ্জ অফিসার চালিহার বন্ধুস্থানীয়। বাপীকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবে। লুকোচুরির মধ্যে না থেকে চাষের জমি বা লেবার পাবার ব্যবস্থা সরাসরি তার সঙ্গেই করে নিতে হবে। এর জন্য খরচ যা হয় হবে। মোট কথা নতুন লোক নিয়ে নতুন টিম-ওয়ার্কের প্ল্যান মাথায় রাখতে হবে। সাপ চালানের ব্যবসা সম্পর্কেও একই কথা। এও কোনো একজন মুরুব্বির ওপর নির্ভর করে চলবে না। ফি বছর সাপ যারা ধরতে আসে তাঁদের থেকেই লোক বাছাই করে এই টিম-ওয়ার্কের দিকে এগোতে হবে। তবে শীত তো এসেই গেল, এক্ষুনি এ-দিকটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। অন্য দিকের ব্যবস্থাও ধীরেসুস্থে অর্থাৎ খুব কোয়ায়েটলি করে নিতে হবে—কোনোরকম সোরগোল তোলার দরকার নেই।

বক্তব্য শেষ।—ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মি?

বাপী হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। যা বলতে চায় তার মধ্যে না বোঝার মতো অস্পষ্ট কিছুই নেই। একটা অসহিষ্ণু প্রতিবাদ ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে। বাইরে তাই আরো নির্লিপ্ত। মুখের দিকে চেয়ে থেকে বোঝার ভান করল। তারপর বলল, মোটামুটি টিম-ওয়ার্কের দিকে আমি এগিয়েছি। রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিলে সেটা আরো ভালোভাবে অরগ্যানাইজ করা যাবে, তবে দুটো কাজেরই মুরুব্বি বলতে আবু রব্বানী। আপনারা তাকেই বাতিল করতে চান বোধ হয়?

—এক্ষুনি কিছু করতে চাই না বা কিছু বুঝতে দিতে চাই না। কিন্তু ওই লোককে সামনে রেখে তুমি কত আর এগোতে পারো—আফটার অল হি ইজ এ গভর্মেন্ট সারভেন্ট।

কাগজে কলমে আবু রব্বানীর নাম সামনে বা পিছনে কোথাও নেই। এদিকের বাড়তি উপার্জনের সবটুকুই দুলারির নামে। আবুকে নিয়ে কোন তরফেরই বিপাকে পড়ার প্রশ্ন নেই। যে কারণেই হোক ওকে এখন এরা হেঁটেই দিতে চায় বোঝা গেল। মাত্র পঁচিশ ছাব্বিশ দিনের মধ্যে এরকম মনোভাবের কারণ কি ঘটতে পারে বাপী ভেবে পেল না।

একটু চুপ করে থেকে বাপী বলল, সে-রকম বড় প্ল্যানে যদি কাজ শুরু করি আর টাকা খরচ করতেও যদি আপত্তি না থাকে, আবু রব্বানীকে তাহলে সরকারী কাজ ছাড়িয়ে টেনে নেবার চেষ্টা করা যেতে পারে।…ওর মতো বিশ্বাসী কাজের লোক পাওয়া শক্ত, মিসেস রাইও ওকে পছন্দ করেন।

মন বোঝার জন্য বলা। নইলে আবুর সরকারী চাকরির দরুন এদের সুবিধে ছাড়া অসুবিধে কিছু নেই। কিন্তু প্রস্তাবনা শোনামাত্র বিরক্তি—সি ইজ রাদার ডিসগাসটেড নাও, টেক ইট ফ্রম মি। ওদের চালচলনে উনি এখন বিরক্ত।

বাপী সচকিত। ‘ওদের বলতে চালিহা আবু ছাড়া আর কাকে যুক্ত করল?’

এ-প্রসঙ্গ বাতিল করে চালিহা দরকারী আলোচনার উপসংহারে চলে এলো।—আমাদের মোটামুটি ডিসিশান তোমাকে জানিয়ে রাখলাম, নাও গো অ্যাহেড। টাকা ফেললে কাজের লোকের অভাব হবে না। দু’এক দিনের মধ্যে রেঞ্জ—অফিসারের সঙ্গে আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখছি। নাও ফর দি টাইমবিইং এভরিথিং ইজ ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল—মাইন্ড ইউ।

রণজিৎ চালিহা এ-দিন লাঞ্চ টাইম অর্থাৎ একটার আগে তার আপিস ঘর ছেড়ে নড়ল না। কর্ত্রী এখানে না থাকার দরুন কিছু বাড়তি দায়িত্ববোধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

নিজের ঘরে বসে বাপী মুহুর্মুহু ঘড়ি দেখছে। তার ওঠার অপেক্ষায় আছে। যে উৎসাহ আর তাজা মন নিয়ে পাহাড় থেকে ফিরেছিল সেটা আচমকা একরাশ কালীবর্ণ মেঘের তলায় চাপা পড়ে গেল। এই কটা দিনের মধ্যে সে-রকম কিছুই ঘটে গেছে। নইলে আবুর ওপর হঠাৎ এত বিরূপ কেন এরা?…শুধু আবুর ওপর নয়, আরো কারো ওপর। দুলারি কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। সে নয়।

…তাহলে রেশমা!

একটু চিন্তা করলে পাকা মাথায় সোজা অঙ্কের ফল ঝপ করে সামনে এগিয়ে আসে। বাপীর চোখের সামনেও সেই গোছের একটা নির্ভুল উত্তর দুলতে লাগল। আবু রব্বানী বা রেশমা এদের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে বটে, কিন্তু বিনিময়ে উপকার এরাও কম পাচ্ছে না। এই লেন-দেনের ফাঁকে উদারতার ঠাঁই নেই। তবু ওদের ছেঁটে দেবার মতলব। ও-দিকে বানারজুলি ছেড়ে নড়ার নামে যে মেয়ের চোখে আগুন নামে, তাকে নিয়ে কর্ত্রী উধাও। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ভিন্ন আর কিছুর যোগ কিছু থাকতে পারে না—পারেই না।

বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। ক্ষত-বিক্ষত মন নিয়ে বানারজুলিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে এই আবু রব্বানী খুশিতে আটখানা হয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। বলতে গেলে ওর জন্যেই ভাগ্যের ভিন্ন বৃত্তে পা ফেলা সম্ভব হয়েছে। আজ মুরুব্বী হয়ে সবার আগে যদি ওরই বুকে থাবা বসাতে হয় তাহলে বাপী কি করবে? বসাবে?

—কি করবে জানে না।

জঙ্গল ভেঙে বাপী সোজা আবুর ডেরায়। জঙ্গলের এই সোজা পথও লম্বা লাগছিল। এ-সময় আবু খেতে আসে। নিরিবিলিতে পাওয়ার সম্ভাবনা। বাইরের দাওয়ায় দুলারি বসে। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। হাতে চাঁদ নাগাল পাওয়ার মুখ।—তুমি এসে গেছ বাপীভাই! এদিকে যে জান্ ঠোটে নিয়ে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।

ঘরে ঢুকে একটু চেঁচিয়ে জানান দিল, বাপীভাই এসেছে! একটা চাটাই হাতে বেরিয়ে এলো।—দস্যি দুটো ঘুমোচ্ছে, এখানেই বোসো—গোসলে গেছে, বেরুলো বলে।

হালকা শীতের মিষ্টি রোদে পিঠ দিয়ে বাপী চাটাইয়ের ওপর বসল। আর তক্ষুনি প্রায় ভেজা গায়ে আবু হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো। ভালো করে একপ্রস্থ দেখে নিল, তারপর গলার স্বরে ক্ষোভ ঝরল।—আমরা ভাবলাম বিবাগী হয়ে পাহাড় থেকে আর কোথাও চলেটলে গেলে।

বাপীর সাদা-মাটা মুখ।—বিবাগী হতে যাব কোন্ দুঃখে। দুলারিকে বলল, ওকে একটা গামছা এনে দাও, গা-মাথা মুছে ফেলুক—

দুলারি ভিতরে যেতে যেতে বলল, যে রকম তেতে আছে গা-মাথার জল আপনি টেনে যাবে—

পরনের লুঙ্গি কোমরের দু’দিকে একটু গুঁজে আবু চাটাইয়ে বসে পড়ল।— একলা এলে, না ঠাকরোনও এলেন?

—ঠাকরোন কোথা থেকে আসবেন?

—কেন? তারা পাহাড়ের বাংলোয় যায়নি? আবু যথার্থ অবাক।

দুলারি গামছা, ফতুয়া আর আয়না চিরুনি হাতে বেরিয়ে এলো। কিন্তু আবুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, বাপীকেই দেখছে। সন্দিগ্ধ চাউনি।

—উনি পাহাড়ের বাংলোয় গেছেন ভেবেছিলে?

—তাছাড়া আর কোথায় যেতে পারে ভাবব! পাহাড়ে যাননি মোটে?

—না।

—তোমার সঙ্গে দেখাই হয়নি?

— না।

হাত বাড়িয়ে আবু দুলারির হাত থেকে ফতুয়াটা টেনে নিয়ে গায়ে চড়ালো। তারপর চিরুনি হাতে নিতে দুলারি একটু ঝুঁকে আয়নাটা তার মুখের সামনে ধরল। পরিপাটি করে মাথা আঁচড়ানো আবুর ছেলেবেলার বিলাস। এখনো সেই গোছের মনোযোগ। কিন্তু আড়চোখে বাপী দুলারির মুখখানা দেখছে। গম্ভীর হলেও শামলা মুখে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লেগে আছে। কে বলবে এই মেয়ে বানারজুলির পথে পথে ঘুরে সাপ খেলা দেখাতো, হাঁটু মুড়ে বসে ক্রুদ্ধ ফণা তোলা সাপের ছোবল খাবার উত্তেজনায় বারবার ভুঁয়ের ওপর হাত পেতে দিত। কেন যেন তখন রেশমার থেকেও এই দুলারিকেই বেশি ভয়াবহ মনে হত বাপীর। সেই মেয়ে এখন ঘরের লোকের মুখের সামনে আয়না ধরে আছে, আর মন দিয়ে মাথা আঁচড়ানো দেখছে।

আয়না চিরুনি গামছা নিয়ে দুলারি ঘরে চলে গেল। ওর বোধ হয় যেতে দেবার তাড়া এখন। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে আবু বলল, দুলারি এর পর একহাত নেবে আমাকে।

— কেন?

—বার বার করে ও আমাকে পাহাড়ে তোমার কাছে চলে যেতে বলেছিল।…আমি বুদ্ধুর মতো ভেবে বসে আছি মেয়ে নিয়ে মেমসায়েব ওখানে চলে গেছে, আর তোমার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছে।

—কিসের শলা-পরামর্শ?

—তুমি কিচ্ছু জানো না—না?

—কি করে জানব। কাল বিকেলে ফিরে দেখি তোমার মেমসায়েবের বাংলো তালা-বন্ধ।

—ওই ম্যানেজার তো এখানে আছে, সে কিছু বলেনি?

—তার মেজাজ গরম দেখছি।

আবুর ছোট ছোট চোখ দুটো ছুরির ফলার মতো চকচক করে উঠল।—গরম কার ওপর, শুধু রেশমার ওপর না আমার ওপরেও?

—তোমার ওপরেই বেশি!

শোনামাত্র শিরদাঁড়া সোজা।—আমার ওপরেই বেশি? ও-শালার মেজাজের গরম আমি ছুটিয়ে দেব বলে দিলাম তোমাকে—আমার পিছনে লাগতে এলে ওর টুটি ছিঁড়ে না আনি তো আমার নামে কুকুর পুষো!

দু’হাতে দুটো থালা নিয়ে দুলারি দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ধমকের সুরে বলে উঠল, থাক, গলা ফাটিয়ে আর বেশি বাহাদুরি করতে হবে না। খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় বাপীভাইকে সব বলো আগে কি হয়েছে না হয়েছে—

বড় থালাটা আবুর সামনে রাখল, ছোটটা বাপীর সামনে। আবুর থালায় এককাড়ি গরম ভাত, আর ছোট-ছোট বাটিতে ডাল-তরকারি মাছের ঝোল। বাপীর থালায় তিনখানা পরোটা, একবাটি তরকারি।

আবুকে হাল্কা মেজাজে ফেরানোর জন্য খুশিমুখে বাপী নিজের থালা কাছে টেনে নিয়ে ওর বিবির প্রশংসা করল।—এরই মধ্যে এত সব, তুমি কি ম্যাজিক জানো নাকি!

দুলারি জবাব দিল, ছেলে দুটোর জন্যে করে রাখতে হয়, উঠলেই খাই-খাই করে।…তোমার রুচলে হয়।

শেষের তিন কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে একটু। দুলারির হাতের খাবার এ-যাবৎ অনেক খেয়েছে। শেষের এই কটা মাস সে সুযোগ হয়নি।

তিরিক্ষি মেজাজে আবু ভাতের ওপর ডাল ঢেলে নিয়ে গপাগপ কয়েক গরাস খেয়ে নিল। তারপর দুলারির দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, আগে খাওয়ার গল্পটাই হোক তাহলে—

দু’হাত দূরে গালে হাত দিয়ে খাওয়া দেখতে বসেছে দুলারি। তেরছা চোখে ওর দিকে একবার তাকালো শুধু। বাপী বলল, সব শুনে আগে মাথা ঠাণ্ডা করো—

রণজিৎ চালিহার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে একটা চাপা অস্বস্তি বাপীর ভিতরেও ছেয়ে আছে। শোনার তাগিদেই ছুটে আসা। হেসেই আবুর দিকে ফিরল।—এত গরম হবার কারণটা কি…বিজয় মেহেরা?

খাওয়া ফেলে আবু সাগ্রহে আধখানা ঘুরে বসল।—তবে যে একটু আগে বললে তুমি কিচ্ছু জানো না?

—কেউ কিছু বলেনি। মেয়ে নিয়ে তোমাদের মেমসায়েবকে সরে পড়তে দেখে আর তোমার মেজাজ দেখে সেদিক থেকেই কোনো অঘটন ঘটেছে মনে হচ্ছে।

—তোমার মনের পায়ে গড় করি। ওই শালার ম্যানেজার মেমসায়েবের মেয়ের পিছনে চর লাগিয়ে রাখতে পারে এও তোমার মনে হয়েছিল?

বাপী জবাব দিল, একবার হাতে-নাতে ধরেছে যখন, রাখতে যে পারে মনে হওয়ারই কথা।

—কথা তো আমাকে তুমি একটু সাবধান করে দাওনি কেন, ওই হারামীর বাচ্চার কলে তাহলে এ-ভাবে পড়ি!

দুলারি ধমকে উঠল, ফের গাল পেড়ে কথা!

আবু খেঁকিয়ে উঠল, আমি ভদ্রলোকের ছেলে নই!

—ভদ্রলোকের ছেলের সঙ্গে কথা কইছ!

একটা হাত তুলে বাপী দুলারিকে নিরস্ত করল।—বলতে দাও, অমন ঢের শুনেছি। আবুর দিকে ফিরল।—তুমি এ ব্যাপারে জড়াবে বা তোমাকে সাবধান করার দরকার হবে জানব কি করে?

আমি জড়াইনি। আমাকে জড়ানো হয়েছে।

খাওয়ার ফাঁকে এরপর ঘটনার যে চিত্র সংগ্রহ করা গেল, তার সবটুকু নিখাদ সত্য হলে আবু পাকে-চক্রে জড়িয়ে পড়েছে সন্দেহ নেই।

…বাপী পাহাড়ে চলে যাবার পর রেশমা আবুকে দু’তিন দিন বলেছে, তার মেমদিদি বনমায়ার পিঠে চড়তে চায় লছমনকে বলে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। হাতির পিঠে চেপে একটু-আধটু বেড়ানো নয়, একদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বনমায়াকে চাই মেমদিদির। যতদূর ইচ্ছে যাবে, যতক্ষণ খুশি বেড়াবে। অনেকদিন আগে বাপী ভাইয়ের সামনেই নাকি এরকম বেড়ানোর কথা হয়েছিল। এরপর আবু একদিন কি দরকারে মেমসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে আগে-ভাগে তার মেয়ে এসে জানালো, ওমুক ছুটির দিনে বনমায়াকে চাই-ই তার।

ছুটির দিনে জঙ্গলের হাতির খোঁজ বড় একটা পড়ে না। লছমনের সঙ্গে কথা বলে আবু ব্যবস্থা পাকা করে দিল। আর সেই ছুটির দিনে বনমায়ার পিঠে রেশমা আর মেমদিদিকে তুলে নিয়ে আবুর নিষ্কৃতি।

সন্ধ্যার পর মাথায় বজ্রাঘাত। ম্যানেজার চালিহা সায়েব লোক দিয়ে আবুকে ঘর থেকে তার বাংলোয় ডেকে পাঠাতেও আবুর মনে কোনো কু-ডাক দেয়নি। ভেবেছিল ভালো বোতল-টোতলের খোঁজে ডেকেছে। কিন্তু গিয়ে চক্ষুস্থির। বাংলোর গেটে মেমসায়েবের ভ্যান। বারান্দায় ম্যানেজারের পাশে মেমসায়েব বসে। সাদা পাথরের মতো শক্ত মুখ। আর হাড়-পাঁজরে ছুরি চালানোর মতো চোখ। গিয়ে দাঁড়াতেই ওই ম্যানেজার এমন জেরা শুরু করে দিল যেন আবু খুনের আসামী। জেরায় জেরায় জান জেরবার। ফরেস্টের হাতি কার হুকুমে চলে, বাইরের কোনো পার্টির বেড়ানোর জন্য সেই হাতি বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য কাউকে ছেড়ে দেবার এখতিয়ার হেট বীটম্যান হিসেবে আবু রব্বানীর আছে কি না। না যদি থাকে তাহলে আবু এ-কাজ করল কি করে? হাতি চড়ে বেড়ানোর কথা মিসিসায়েব বলেছে না রেশমা বলেছে, কোথায় বেড়াতে যাবে বলেছে, হাতি নিয়ে কোথায় তারা যাচ্ছে আবু যে করেই হোক আগে থাকতে তা জানত কিনা, রেশমা কোন রকম আভাস তাকে দিয়েছিল কি না—এমনি জেরার পর জেরা। হকচকিয়ে গেলেও আবু মোটামুটি সত্যি জবাব দিয়েছে। আর মেমসায়েব একবারও চোখের পাতা না ফেলে সত্যি-মিথ্যে ওজন করেছে।

মেমসায়েবের মন বোঝা আবুর কম্ম নয়। ম্যানেজার সায়েব যে খুশি হয়নি বা বিশ্বাস করেনি সেটুকু স্পষ্ট বোঝা গেছে। ওকে শাসিয়েছে, সত্যি কথা না বললে ফ্যাসাদে পড়তে হবে, মেমসায়েব বেইমানি বরদাস্ত করবে না।

জবাবে আবু আল্লার কসম খেয়েছে। কিন্তু ওই চালিহার ওকে কলে ফেলে কিছু স্বীকার করিয়ে নেবার মতলব। এভাবে হাতি ব্যবহার করার জন্য ওর নামে জঙ্গলের বড় কর্তার কাছে রিপোর্ট করা হবে বলে হুমকি দিল।

যতই হাঁসফাস দশা হোক আবুর, চাকরির গায়ে কাদা ছোঁড়ার কথা শুনলে তার মেজাজ ঠিক থাকে না। তাছাড়া যা-ই থাক মেমসায়েবের মেয়েকে যে জঙ্গলসায়েবের কাছে এনে দাঁড় করানো যাবে না এটুকু বুদ্ধি আবুর আছে। মেজাজ খারাপ হতে মোলায়েম করে সে-ও তেরছা জবাব দিয়েছে। বলেছে, মিসিসায়েব জানে ও নির্দোষ, রিপোর্ট হলে উনি এসে জঙ্গলসায়েবের কাছে যদি সব স্বীকার করেন তাহলে ওর চাকরির ক্ষতি হবে বটে। তা না হলে কিছুই হবে না। আবু রেশমা বা লছমন মাহুত কিছুই স্বীকার করবে না, আর চেষ্টা করলেও বনমায়াকে দিয়ে কিছু কবুল করানো যাবে না।

মেমসায়েবের সঙ্গে কাজের সম্পর্কের বারোটা বেজে গেছে ধরে নিয়েই আবু রাগের মাথায় আর ঝোঁকের মাথায় অমন কথা বলে এসেছে। সারাক্ষণের মধ্যে মেমসায়েব টুশব্দও করেনি। নড়ে-চড়ে বসেনি পর্যন্ত। কেবল দেখেছে আর দেখেছে।

ছাড়া পেয়ে আবু প্রথমে ছুটে এসেছে লছমনের কাছে। বনমায়া জায়গা মতো বাঁধা ছিল কিন্তু লছমনের টিকির দেখা পেল না। সেখান থেকে সোজা রেশমার ডেরায়। অন্ধকারে ভূতের মতো বাইরে বসে ছিল তার সাপ ধরার সাগরেদ হারমা। সে জানিয়েছে, রেশমা ঘরে নেই। তার খোঁজে মেমসায়েব দু’-দুবার লোক পাঠিয়েছিল।

রাগে জ্বলতে জ্বলতে আবু ঘরে ফিরেছিল। দুলারির সঙ্গে রেশমা দিব্বি খোশগল্প করছে বসে। দাঁত কড়মড় করে আবু ওকে বলেছে, এখানে পালিয়ে থাকলে জান বাঁচবে?

রেশমা পাল্টা চোখ পাকিয়েছে, তুমি বেঁচে থাকতে আমার জান বাঁচবে না, কেমন মরদ!

এই মেয়ে হম্বি-তম্বির ধার ধারে না। আবুর যা জানার ঠাণ্ডা মাথায় জেনে নিল।

…বনমায়ার পিঠে চেপে এখান থেকে ছ’মাইল পথ বানারহাটে গেছল ওরা। সেখানে এক জায়গায় হাতি থামিয়ে মেমদিদি কোথায় নেমে গেছল। ঘণ্টা দুই বাদে ফিরে এসে আবার বনমায়ার পিঠে চেপে চলে এসেছে।

আবু খেঁকিয়ে উঠেছিল, হাতির পিঠ থেকে নেমে মেমদিদি দু’ঘণ্টার জন্য কোথায় গেছল তুই জানিস না?

রেশমা মুখ মুচকে জবাব দিয়েছে, মেমসায়েব জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে কিচ্ছু জানি না।

তারপর রেশমা বলেছে, ম্যানেজার চালিহা মেমদিদির পিছনে চর লাগিয়ে রেখেছে সেটা ও বানারহাটে হাতির পিঠে দু’ঘণ্টা বসে থাকার সময় টের পেয়েছে। সাইকেলে চেপে একটা লোক আশপাশে ঘুরঘুর করছিল আর ওর দিকে চেয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছিল। রেশমা প্রথমে ভেবেছিল ফষ্টিনষ্টির মতলব। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, লোকটাকে বারকয়েক বানারজুলির রাস্তায় আর জঙ্গলে দেখেছে—ওর ডেরার আশপাশ দিয়েও যাতায়াত করতে দেখেছে। তার মিনিট দশেক বাদে মেমদিদি ফিরল যখন, তখন ওই লোকটা পনের গজ দূরে সাইকেলে বসে আর একটা থামে ঠেস দিয়ে এদিকে চেয়ে সিগারেট টানছিল। রেশমা লোকটাকে দেখিয়ে সন্দেহের কথা বলতেই মেমদিদি বিষম চমকে উঠল। মনের মানুষের সঙ্গে যতক্ষণ মেমদিদি বাইরে ছিল, তার প্রায় অর্ধেক সময় ওই লোকটা নাকি তাদের সামনে পিছনে সাইকেলে ঘুরঘুর করছিল! তারা দু’জনেই ওকে দেখেছে আর রসের খোরাক পেয়ে অমন করছে ভেবে বিরক্ত হয়েছে।

বনমায়া চলতে শুরু করতেই লোকটা সাইকেলে সাঁই সাঁই করে আবার বানারজুলির পথে এগিয়ে গেছে।

….রেশমা আর সাহস করে মেমদিদির সঙ্গে বাংলো পর্যন্ত যায়নি। আগেই নেমে অপেক্ষা করছিল। লছমনের মেমদিদিকে ছেড়ে ফিরে আসতে দেরি দেখেই বুঝেছে, ফাঁস যা হবার হয়ে গেছে। লছমন ফিরতে শুনল, ম্যানেজার চালিহা চোখ রাঙিয়ে তাকে অনেক জেরা করেছে। তারপর আর নিজের ঘরমুখো না হয়ে রেশমা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। মেমদিদি ওকে সেই পরামর্শই দিয়ে রেখেছিল। আর বলেছিল, ও যেন কিছু জানে বলে কক্ষনো স্বীকার না করে। ওকে হাতির পিঠে বসে থাকতে বলা হয়েছিল, তাই বসেছিল। ও জানে মেমদিদি তার এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে—ব্যস। আর কিচ্ছু জানে না।

মেমসায়েবের জেরার মুখে রেশমাকে দাঁড়াতে হয়নি। পরদিনই মেয়ে নিয়ে উনি হাওয়া। ম্যানেজার সায়েব রেশমাকে আপিসে জেরা করেছে। তার বদ্ধ ধারণা, এই ষড়যন্ত্র অনেক দিনের আর এর মধ্যে আবু রব্বানীও আছে। কিন্তু রেশমার মুখ থেকে কোনো কথা বার করতে পারেনি। আপিস ঘরে রেশমাকে প্রায় ঘণ্টা-খানেক আটকে রেখেছিল চালিহা। চোখ দিয়েই ‘সব্ব অঙ্গ’ চেটেছে ওর। মেমসায়েব নাকি এখানকার কাজ থেকে ওকে ছাড়িয়ে দিতে হুকুম করে গেছে। এ হুকুমের আর নড়চড় হবে না। কিন্তু এতবড় ক্ষতি হোক ওর, চালিহা সেটা চায় না। রেশমার মতো সাহসী সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে ইচ্ছে করলে ব্যবসার অন্য কাজে লাগতে পারে। এরকম কিছু মেয়ে দরকার সেটা মেমসায়েবও জানে। রেশমা এ-জায়গা ছেড়ে চলে যেতে রাজী হলে তার আপত্তি হবে না। ডিসেম্বরের গোড়ায় দু’ মাসের জন্য চালিহা আসাম যাচ্ছে। সেখানে কাজের মেয়ে দরকার আপাতত। রেশমা তার সঙ্গে যেতে রাজী হলে ওর সেখানে ভালো থাকার ব্যবস্থা সে-ই করে দেবে। এখানকার থেকে ঢের ভালো থাকতে খেতে পরতে পাবে। টাকা তো বেশি পাবেই। বিলকুল হালকা কাজ। চালিহার যে লোকেরা সেখানে কাজ করছে তাদের যোগসাজশে দোকান হোটেল-রেস্তোরাঁ বা অন্য রইস খদ্দেরদের কাছে মাল পৌঁছে দেওয়া। তারপর হেসে হেসে বলেছে, মালকানের কোপে পড়ার ফলে আখেরে ওর লাভ হবে, দিন ফিরবে। ওর মতো মেয়ের জঙ্গলে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।

আবুর বলা শেষ। বাপী জিজ্ঞাসা করল, রেশমা কি বলেছে?

—কি আর বলবে। ও কম বজ্জাত? গেলে কাজ দেবে জানে, কিন্তু ও-শালার আসল মতলব কি আর জানে না? চোখের বাণে বাণে ওই দিনে দুপুরেই ওকে যতটা পারে বিঁধেছে, আর বলেছে, এত বড় ম্যানেজার সায়েবের যে এত দয়া ওর ওপর জানত না। তারপর আব্দার করেছে, শীতে ওর সাপ ধরার দিন গেল, আবু রব্বানীর সাগরেদি করে মাসে যে পঞ্চাশটি করে টাকা পায় ডিসেম্বর পর্যন্ত সে—টাকাও না পেলে খুব মুশকিলে পড়ে যাবে। দয়ার অবতার ম্যানেজারের পায়ের ওপর উপুড় হতে গেছল পর্যন্ত ওই পাজি মেযে। শালা তখন ওর দু’কাঁধ খামচে ধরে মজা করে টেনে তুলেছে আর তার দু’চোখ দিয়ে গলগল করে লোভ ঠিকরেছে—

—থামো! হাসি চেপে দুলারি ধমকে উঠল।

—থামব কেন? রেশমা নিজের মুখে তোমাকে এসব কথা বলে যায় নি?…আর ম্যানেজার লোভে গলে-গলে ওকে কথা দেয় নি, চেষ্টা করবে—তবু না যদি পারে দুটো মাস পঞ্চাশটা করে টাকা নিজের পকেট থেকেই দিয়ে দেবে?

সব বলার পর আবুর আর দুলারিরও বাপীভায়ের মন বোঝার ইচ্ছে ছিল। কিছু না বলে উঠে আসায় হয়তো একটু বেজারই হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা বা কথা না হওয়া পর্যন্ত বাপী কোন্ আশার কথা শোনাতে পারে ওদের। আবুর সম্পর্কে চালিহার মতলব শুনলে তো ওদের পিত্তি জ্বলবে আর অশান্তি বাড়বে।

সোনার হরিণ নেই – ১৬

রেশমার ডেরার বাইরে হারমা মাটিতে বসে। প্রভুভক্ত কুকুরের মতো সতর্ক চোখ। অবাঞ্ছিত কাউকে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠার ইচ্ছেটা শুধু চোখে প্রকাশ পায়। তবে বাপীকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল বটে।

ওকে একলা দেখে বাপী ধরে নিল রেশমা ঘরে নেই। কেন এলো, কি দরকার ও নিজেও জানে না। আবুর ঘর থেকে বেরিয়ে পা দুটো অনেকটা আপনা থেকেই এই পথ ধরেছে।

—কোথায়?

জবাবে ভাবলেশশূন্য হারমা ঘরের দিকে ফিরে হাঁক দিল, হি রেশমা—!

খুপরি জানলায় রেশমার মুখ দেখে বোঝা গেল ওটার গায়েই শোবার চৌকি। উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’ চোখ ঘা খেল একপ্রস্থ। গায়ে মোটা চাদর থাকা সত্ত্বেও উঠে বসার ফলে কয়েক পলকের জন্য সামনেটা অনাবৃত। গায়ে শুধু আঁট কাঁচুলি। বাপীকে দেখে শশব্যস্তে মাটিতে নেমে দু’তিন মিনিটের জন্য অদৃশ্য। বেরুলো যখন ঘাগরার ওপর চকচকে রঙিন আঁট জামা; ঠোঁটের ফাঁকে আর চোখের কোণে হাসির ছটা।—বাপীভাই যে! কি ভাগ্যি—করে এলে?

—কাল বিকেলে। এই মেয়ে কাছে এসে দাঁড়ালে খুব স্বস্তি বোধ করে না বাপী। নিজেকে সজাগ শাসনে রাখার একটু বাড়তি ধকল পোহাতে হয়।

বাসি সুর্মার দাগ লাগা রেশমার কালো চোখ তার মুখের ওপর উৎসুক।— আবু সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

—সেখান থেকেই আসছি।

কি বলতে গিয়ে হারমার দিকে চোখ গেল রেশমার। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো বিরক্তি।—তুই সেই থেকে বসে আছিস কেন—ঘরে যা না!

বাপীর মনে হল ভক্ত অথচ গোঁয়ার কুকুরের মতোই লোকটা নিঃশব্দ রাগে গরগর করতে করতে সামনে পা বাড়াল। রেশমার দিকে ফিরে বাপী হালকা সুরে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভিতরে থাকলে ওর বাইরে ডিউটি নাকি?

অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল। গতরখাটা মেয়ে ডিউটির অর্থ বোঝে। জবাব দিল, ঘরেই ডিউটি দেবার ইচ্ছে, এখন পর্যন্ত অতটা আস্কারা পায়নি।

ওকে দুষবে কি, এই চটুল প্রসঙ্গের জন্য বাপী নিজেকেই দায়ী করল আর চোখ রাঙালো।

উৎফুল্ল মুখে রেশমা বলল, এমন মান্যিগণ্যি মানুষ এলো, কোথায় বা বসাই, ঘরে আসবে?

—না। বাপী গম্ভীর। মেয়েটা তার কাজের ভাবনায় তেমন উতলা মনে হল না।—আবুর মুখে হাতির পিঠে চড়ে তোমাদের বানারহাট বেড়ানোর খবর সব শুনলাম।

—আর বলো কেন। ওই বনমায়াকে সব্বাই দিল-এর রাণী ভাবে, মানুষের ↓ বেলায় যে ওটা এত অপয়া কে জানত! মেমদিদির বরাতটাই খারাপ–

—তোমার বরাতের খবর কি?

রেশমার এবারের হাসি ধারালো মনে হল বাপীর। জবাব দিল, আমার তো বরাত ফিরে গেল! ওই জবরদস্ত ম্যানেজার সাহেব নিজে সঙ্গে করে আমাকে আসামে নিয়ে গিয়ে বেশি টাকায় নির্ঝঞ্ঝাট কাজে বসিয়ে দিচ্ছে, ভাল থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে—আবু সাহেবের মুখে শোনোনি?

—শুনেছি। তাহলে তুমি যাচ্ছ?

কেন যাব না? মুখের হাসি মিলিয়েছে, চোখের কালোয় আক্রোশ ঠিকরে পড়ছে।—এখানে উপোস করে মরব? মেমসায়েবের মেয়েই শুধু মেয়ে— আমরা কে? তবে

বাপীর মনে হল কিছু বদলার কথা বলতে গিয়ে সামলে নিল। আরো মনে হল উপোস আর অপমানের যন্ত্রণা ও ভালো জানে। তাই সাপ-ধরা মেয়ের চকিতে অমন ছোবল বসানো মূর্তি। তারপরেই আবার সেই ধার-ধার হাসি। বলল, তুমি অবশ্য ইচ্ছে করলেই ম্যানেজারের মুখে ছাই দিয়ে আমার এই বরাতও বরবাদ করে দিতে পারো—

মুখে নয় বাপীর চোখে প্রশ্ন।

—বুঝলে না? আমি তো ওদের কাছে জোর গলায় বলেছি কিচ্ছু জানি না, মেমদিদি আদর করে বেড়াতে নিয়ে গেছে তাই গেছি। হাতির পিঠে যেমন বসিয়ে রেখে গেছল তেমনি বসেছিলাম—মেমদিদিও নিশ্চয় গলা ফাটিয়ে বলেছে আমার কোনো দোষ নেই। তবু ওই ম্যানেজারের কথায় মেমসায়েব শুধু সন্দর ওপর আমাকে সরাতে চাইছে। আর তুমি তো আমাকে হাতে-নাতে ধরেছ মেমদিদির মনের মানুষের সঙ্গে কথা কইতে দেখেছ, আমার মারফৎ, মেমদিদিকে চিঠি চালান দিতে দেখেছ—এ-সব শুনলে ওই মেমসায়েব আমাকে আসামে পাঠিয়ে পয়সা দিয়ে পোষার বদলে দা দিয়ে কেটে মাটিতে পুঁতে রাখতে চাইবে।

দু’হাত কোমরে তুলে বাপীর মনের খবর আঁচ করার চেষ্টা। সুমার দাগ লাগা চোখে সত্যিকারের কৌতুক উছলে উঠল এবার। মুখ কপট-গম্ভীর।—আর মেমসায়েবকে বলে তুমিও যদি আমাকে আর কোথাও নিয়ে গিয়ে ভালো থাকা—খাওয়া-পরার মতো কাজ জুটিয়ে দেবে বলো, তাহলেও ম্যানেজারকে বাতিল করে তোমার দিকেই যেতে হবে।

হাসছে না। কিন্তু ঠোঁটে হাসি টসটস করছে। মুখের কথার সাদা অর্থ, মেমসায়েবকে বলে দেবার ভয়ে তার দিকে না গেলে নয়। কিন্তু রসের অর্থটুকু কান গরম হবার মতো। হচ্ছেও। নিজেকে সজাগ শাসনে রাখার তাড়নায় বাপী দু’চোখে বিরক্তির উষ্ণ ঝাপটা মেরে সোজা ফিরে চলল। মেয়েটা তাইতেই হকচকিয়ে গেছে একটু। দাঁড়িয়ে পিছন থেকে দেখছে আঁচ করেই বাপী আর ফিরে তাকালো না।

ঠাণ্ডা মাথায় এবারে কিছু চিন্তা করার আছে। কর্ত্রীর সম্পূর্ণ সায় ভিন্ন রণজিৎ চালিহা কোমর বেঁধে এই ফয়সলায় নামত না। আজ হোক বা দু’মাস পরে হোক, আবুকে ছেঁটে দিলে বাপীর বুকের খানিকটা খালি হয়ে যাবে তাই নয়, জোরের দিকটাও টান পড়বেই। এই বিশ্বস্ত লোকটাকে সরালে রণজিৎ চালিহার হাত আরো জোরদার হবে, গায়ত্রী রাইয়ের সেটা বোঝার মন নয় এখন।…তাঁর মেয়েই বা শেষ পর্যন্ত কি করবে! আবু বা রেশমাকে সরিয়ে দিয়ে তার মা মেয়েকে ঠেকাতে পারবে? কেউ কখনো পেরেছে? বাবার চাবুকে চাবুকে পিঠের চামড়া ফেটে চৌচির হয়েছিল, ক্ষতবিক্ষত মুখের সেই গা ঘুলনো রক্তের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে। কিন্তু এক মেয়েকে মন থেকে সরানো গেছে না এতটুকু নড়ানো গেছে?

ঊর্মিলার মতি-গতি বোঝা গেছে। তার মা-ই তাকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। বাপীর ওই পাঞ্জাবী ছেলেটাকে জানতে বুঝতে বাকি। হতে পারে প্রেমে হাবুডুবু দশা তারও। আবার রাজকন্যার থেকে রাজত্বের লোভটাও বড় হওয়া বিচিত্র নয়। যাই-ই হোক, ওদের বিয়েটা হয়ে গেলে গায়ত্রী রাই রেশমা বা আবুর মতো একমাত্র মেয়ে আর জামাইকেও ছেঁটে দেবে? তা হতে পারে না। কখনো হয় না। বরং অর্থের জোরে সামর্থ্যের জোরে আর সব থেকে বেশি নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে মহিলা তাদের আরো কাছেই টেনে নেবে।…তারপর?

সদ্য বিপাকের ধোঁয়ার কুণ্ডলি থেকে তার পরের চিত্রটাই আগে স্পষ্ট করে দেখে নেওয়া বা বুঝে নেওয়া দরকার মনে হল বাপীর।

—আগে বাঢ়। মিল যায়গা!

নাঙ্গা ফকির-টকির নয়, আশ্বাসের গমগমে স্বরটা অনিবার্য ঘোষণার মতো নিজের ভিতর থেকে তখন-তখন ঠেলে ওঠে। যা-ই হোক বা যা-ই ঘটুক বাপী আর বিচলিত নয়। বৃত্ত-বদল আবারও হতে পারে, কিন্তু তাকে আর পুরনো বৃত্তে ফিরতে হবে না। এগোতে হবে। খুঁজতে হবে। পেতে হবে। এটুকুই স্বতঃসিদ্ধ।

মিরিক খুব দূরের পথ নয়। পরদিন বাপী বেলাবেলি সেখানকার চা-বাগানের কারখানায় পৌঁছুলো। বিজয় মেহেরার হদিস পেতে সময় লাগল না। বেয়ারার হাতে স্লিপ পাঠালো। শুধু লিখল, বাপী তরফদার, ফ্রম বানারজুলি।

স্লিপটা হাতে করে লোকটা নিজেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বিস্মিত। কিছুটা সন্দিগ্ধ। জঙ্গলে খানিকটা দূর থেকে দেখেছিল। সামনা-সামনি আরো সুশ্রী মনে হল। সপ্রতিভ গাম্ভীর্যে তাকালো—ইয়েস?

অনর্থক দুটো শব্দ খরচ করল বাপী।—বিজয় মেহেরা?

মাথা নেড়ে সায় দিল।

ওর ঘরে আরো দুটো টেবিলে দু’জন অফিসার বসে আছে বাপী আগেই লক্ষ্য করেছে। স্লিপের নাম দেখেই হয়তো ভিতরে না ডেকে নিজে বাইরে চলে এসেছে। ইংরেজিতেই বলল, কিছু কথা ছিল, শোনার সময় হবে?

মুখের দিকে আর এক পলক তাকিয়ে সামনে পা বাড়ালো। বাইরে শেডের নিচে একটা নিরিবিলি বসার জায়গায় নিয়ে এলো।—সীট ডাউন প্লীজ। নিজে মুখোমুখি বসল।

বাপীর মতো অতটা লম্বা না হলেও সমবয়সীই হবে। কিন্তু বাপীর নির্লিপ্ত মুখের হাব-ভাব বয়স্ক জনের মতো। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, বাংলা বোঝো?

—থোরাসে। স্পিক ইন ইংলিশ অর হিন্দী।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে সংশয়ের আঁচড় পড়ল একটু। ঊর্মিলা পাঞ্জাবী ভাষা শিখে ফেলে নি নিশ্চয়। বাংলাই মাতৃভাষার মতো। ইংরেজি বা হিন্দী গড়গড় করে বলতে পারলেও ওতে প্রেম কতটা জমাট বাঁধতে পারে, ধারণা নেই।

হিন্দী বাপী ভালো বলে। লোকটাকে কিছুটা অন্তরঙ্গ আলোচনায় টেনে আনার মতলবে হিন্দীতেই শুরু করল, আমাকে চেনো?

সতর্ক চাউনি। মাথা নাড়ল। চেনে।

কি করে চেনো?

—ডলি বলেছে। জঙ্গলেও দেখেছি।

একটু স্বস্তি বোধ করল। এই লোকের কাছেও ঊর্মিলা তাহলে ডলি।——কি বলেছে। ঘাবড়াবার মতো কিছু?

চোখে চোখ। না বুঝে কোনো ফাঁদে পা দিতে রাজি নয়।—আমি ঘাবড়াবার ছেলে না। আমার সঙ্গে কি দরকার?

ভাবালু প্রেমিকের মতো লাগছে না বাপীর। রয়ে-সয়ে বলল, এর মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে গেছে, তুমি খবর রাখো?

—সো হোয়াট? গলার স্বরে স্পষ্ট ঝাঁঝ।

বানারহাটের দুঃসংবাদ এখানে পৌঁছে গেছে বোঝা গেল। বাপী জবাব দিল, এমন কিছু নয়, দুটো নির্দোষ লোকের কাজ চলে যাচ্ছে, একজন আবু রব্বানী আর একজন রেশমা। চেনো?

ভুরু কুঁচকে থমকে রইল একটু।—ডোন্ট গেট দি ম্যান। সে কি করেছে?

—ঊর্মিলার বানারহাটে বেড়াতে যাওয়ার হাতি ঠিক করে দিয়েছিল।

ফর্সা মুখ রাগে লাল হতে লাগল।—কিন্তু এই করে কি হবে? ডলির মা বরাবর তাকে আগলে রাখতে পারবেন না আমাকে ঠেকাতে পারবেন? ক্যান সি স্টপ ইট্‌?

—পারবেনই না বলছ…?

—সারটেনলি নট! বলে উঠেই থমকালো। ঝাঁঝালো সতর্ক চাউনি।—মিসেস রাই তোমাকে এ-কথা বলার জন্য পাঠিয়েছেন?

—আমি এখানে এসেছি মিসেস রাই জানেন না। আমি তোমাদের অ্যাফেয়ার জানি বলেও তাঁর ধারণা নেই।

এবারে ক্ষোভের মুখেই বিজয় মেহেরা উৎসুক একটু।—ডলি পাঠিয়েছে?

—তোমাদের এই বিভ্রাটের সময় আমি বানারজুলিতে ছিলাম না। এখন পর্যন্ত মা-মেয়ে কারো সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তবে ডলি জানলে খুশি হবে। এই গোলযোগে না পড়লে সে-ই তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিত মনে হয়। এতদিন মুখে সে আমাকে ফ্রেন্ড বলত, ইদানীং ফ্রেন্ড ভাবছে।

বিজয় মেহেরা অনেকটা ঠাণ্ডা। বুকপকেটে দামী সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই উঁচিয়ে ছিল। সে দুটো বার করে প্যাকেট আধখানা খুলে সামনে ধরল। বাপী মাথা নাড়তে একটা সিগারেট বার করে ধরালো। ডান হাতের তিনটে ফর্সা আঙুল সিগারেটের ধোঁয়ায় আর কষে বাদামী হয়ে গেছে। মদ ছেড়ে ওই আঙুল দেখলেও গায়ত্রী রাইয়ের মেজাজ বিগড়বে সন্দেহ নাই।

ধোঁয়া ছেড়ে বিজয় মেহেরা বলল, বানারহাটে ডলি এবারে বিশেষ করে তোমার কথা বলেছিল। বাট আই কুড্‌ বি ভেরি শিওর। ক্যান ইউ রিয়েলি হেল্প আস?

—কি রকম?

—বাইরে চলে যাওয়ার আগে আমি বিয়েটা করে যেতে চাই। ডলি রাজি হচ্ছে না। ও খুব ভালো কিন্তু এ ব্যাপারে বড় নার্ভাস।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’ কান খাড়া। এ আবার বলে কি! —বাইরে কোথায় যাচ্ছ?

—ডলি বলেনি?

—প্রায় এক মাস আমি বানারজুলিতে ছিলাম না বললাম তো।

এরপর যা শুনল, অপ্রত্যাশিত বটে। সামনের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দু—আড়াই বছরের জন্যে সে লন্ডন চলে যাচ্ছে। অনেক বড় আশা আকাঙ্ক্ষা তার। এখানে এই চা-বাগানে পড়ে থাকার ইচ্ছে কোনদিনও ছিল না। ডলির কাছে বাঁধা না পড়লে এখান থেকে অন্তত কবেই চলে যেত। এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার আগে থেকেই বাইরের ট্রেনিং আর বাইরের ডিগ্রির স্বপ্ন দেখে এসেছে। অনেক চেষ্টা আর তদ্বির-তদারকের পরে সুযোগ মিলেছে। বাইরের এক ফার্মে মোটামুটি কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। পড়ার ব্যবস্থাও। এখন সমস্যা ডলি আর তার মা! ওই মাকে জব্দ করার জন্যেই বিয়েটা চুকিয়ে ফেলে রওনা হবার ইচ্ছে তার। টের পেলে কি করবে? তাড়িয়ে দেবে? মেহেরা পরোয়া করে না? তার বাবা মা এ বিয়েতে সানন্দে রাজি। ছেলে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে তাতে আপত্তির কি থাকতে পারে? ডলির ফোটো দেখেই কত খুশি তারা। তাড়িয়ে দিলে ডলিকে বড় জোর অমৃতসরে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে হবে। তারা আদর করে রাখবে। ব্যবস্থা যা করার মেহেরা করেই যাবে। কিন্তু ডলির অত সাহস নেই। বানারহাটে এবারে সে এ নিয়ে কম বকাঝকি করেনি, দু’জনার দস্তুরমতো মনকষাকষি পর্যন্ত হয়ে গেছে! ডলির এত ভয় পাবার কি আছে মেহেরা ভেবে পায় না।

বাপী চুপচাপ শুনছিল। আর সোজা মুখের দিকে চেয়েছিল! এখন কিছুটা ছেলেমানুষের মতো লাগছে ওকে। বাপীর বুকের তলার ঝড় কেউ কখনো টের পায়নি। এ-ছেলের থেকে সে অনেক বেশি পোড়-খাওয়া মানুষ।

আবার একটা সিগারেট ধরালো বিজয় মেহেরা। কিছু অনুকূল মতামত বা মন্তব্য শোনার আশায় উন্মুখ। এরই ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে যেন।

বাপী আশার কথা শোনাতে আসেনি। আশ্বাস দিতেও না। নিজে সে কোন ভবিষ্যতের দিকে পা ফেলবে স্থির করার তাগিদে আসা। যতটুকু শুনল, আশাপ্রদ বটে। তবু এটুকুই সব নয়। কোনরকম ভনিতা না করে বলল, এত সব আমি জানতাম না, কিন্তু বড় ভালো লাগল। ডলিও ভাবছে আমি হয়তো সাহায্য করতে পারব, কিন্তু তার মাকে তার থেকে ভালো আর কে জানে। সে যাক, এ বিয়ের নামে মিসেস রাই এমন ক্ষিপ্ত কেন ভেবে না পেয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চলে এসেছিলাম।

—ক্ষিপ্ত হবেন না! বিজয় মেহেরা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তাঁর এত টাকা, এতবড় ব্যবসা, এত ক্ষমতা—তিনি শুধু মেয়ের জন্য ঘরে একটি স্বামী পুষতে চান। তাঁর মেয়ে এত ঠুনকো হলে আমার দিকে ঘেঁষত না এ তিনি বুঝতেও চান না, বরদাস্তও করতে চান না।

ছেলের মেজাজ আছে। বাপী অখুশী নয়। নিরীহ মুখে একটু অপ্রিয় উক্তিই করল এবার।—তিনি হয়তো ভাবছেন অত টাকা আর বড় ব্যবসা দেখেই তুমি তাঁর সরল মেয়েটাকে কলে ফেলেছ।

কি! সন্দেহের কথাগুলো গুঁড়িয়ে দেবার মতো করে প্রায় আস্ত সিগারেটটাকে জুতোর তলায় ফেলে পিষল।—ভাববেন না কেন? টাকা ছাড়া আর কি দেখছেন তিনি? কটা মানুষ দেখেছেন? বিলেত থেকে হায়ার ডিগ্রি আর ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার পর তাঁর এই কাঁচকলার ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকব আমি—না তাঁর টাকার পরোয়া করার দরকার হবে? এ ব্যাপারে তাঁর মেয়ের সঙ্গেই আমার সাফসুফ কথা হয়ে গেছে, তুমি জেনে নিতে পারো। মেয়ের বিয়ে দিয়ে টাকা আর ব্যবসা আগলে তিনি বসে থাকুন—

বাপী অবিশ্বাস করছে না। মেয়েকেও জিগ্যেস করার দরকার নেই। বাংলোর সেই একদিনের কথা মনে আছে। মেয়ে ঠেস দিয়ে বলেছিল মা তাকে চটপট শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মতলবে আছে, আর মা হালকা মেজাজে জবাব দিয়েছিল, সে-চিন্তা তাকে করতে হবে না, বিয়ে যে করবে তাকেই এসে শ্বশুরবাড়ি থাকতে হবে। শোনামাত্র মেয়ে ফোঁস করে উঠেছিল, আই উইল নেভার এগ্রি–দ্যাট পারসন মাস্ট বি এ ভেড়ামার্কা সামবডি!

বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাপী উঠে দাঁড়াল।—আচ্ছা মেহেরা, তোমার অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম, কিন্তু আলাপ করে খুব ভালো লাগল। কি করতে পারব জানি না, আই অ্যাম অলমোস্ট এ নো-বডি—শুধু বলতে পারি, ডলি ডিজারভস্ কংগ্র্যাচুলেশনস, তার যাচাই বাছাইয়ের চোখ আছে।

—থ্যাঙ্কস। খুশি হলেও সমস্যার দরিয়ায় ডাঙা খোঁজার মুখ।—কিন্তু তোমার কি মনে হয়, যাবার আগে বিয়েটা হতেই পারে না?

বাপীর আলতো চাউনি তার মুখের ওপর পড়ে থাকল একটু।—ডলিকে তুমি অবিশ্বাস করো?

—কক্ষনো না! বাইরে থেকে ঘুরে এলেই বিয়েটা হবে আগে ঠিক ছিল। কিন্তু ওর মায়ের এমন গোঁ দেখে আমারও গোঁ চেপেছে।

—কিন্তু বিয়েটা গোঁয়ের ব্যাপার নয়। এক্ষুনি এ চেষ্টা করতে গেলে ডলিকেই তুমি সব থেকে অসুবিধের মধ্যে ফেলবে। চুপচাপ চলে যাও, বড় হয়ে এসো—মেয়ের মন বুঝে ওই মা-ই তখন এগিয়ে আসবে হয়তো।

নীরস স্বরে বিজয় মেহেরা মন্তব্য করল, ওই মাকে তোমার এখনো চিনতে বাকি আছে।

পা বাড়িয়েও বাপী আর একটু সুড়সুড়ি দেবার লোভ সামলাতে পারল না।— বাই দি বাই, সিগারেটের ধোঁয়ায় আর কষে হাতের আঙুলগুলো তো বেশ লাল করে ফেলেছ—ড্রিঙ্কস্ কেমন চলে? ফ্র্যাঙ্কলি জিগ্যেস করলাম, কারণ জিনিসটা মিসেস রাইয়ের কাছে প্রায় ট্যাবু গোছের…

পিত্তি জ্বালার মতো বিরক্ত মুখ।—আমার নামে এ নালিশও গেছে ডলি আমাকে বলেছে। ট্যাবুর চোরাই কারবার চালাচ্ছে সে-বেলায় লজ্জা করে না? ছেলেমানুষি রাগ দেখেই যেন হাসি পাচ্ছে বাপীর।—তা বলে সব ময়রা কি আর মিষ্টি পছন্দ করে?

তাঁর পছন্দ-অপছন্দের আমি ধার ধারি না। ইট ইজ্ন্ট এনি গুড ফর হেলথ আই নো,–দ্যাটস অল। ইচ্ছে হলে খাই, ইচ্ছে না হলে খাই না। তার জন্যে কারো কাছে আমি দাসখত লিখে দিতে যাব না।

ভবিষ্যতের চিত্র অনেকটাই আঁচ করা যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটি আরো শক্তপোক্ত ঠেকছে। গায়ত্রী রাই এই ছেলেকে ঘরজামাই করে আটকে রাখতে পারবে না। যেমন চায়, টাকার গরমে তেমন বশেও রাখতে পারবে না। ছেলেটার মনের জোর আছে। পুরুষের গোঁ-ও কম নয়। বাপী এমনটা দেখবে আদৌ ভাবেনি।

তবু বুকের তলায় কোথায় একটু চিনচিনে যন্ত্রণার মতো। টের পাওয়া মাত্র নিজেকেই চাবুক কষাবার আক্রোশ। ভালবাসার নিখাদ ছবি দেখে ভিতরে কেউ যদি মাথা খোঁড়ে, তবে সেই মাথাটা বুঝি একেবারে গুঁড়িয়েই দেবে বাপী। দেউলেপনা বরদাস্ত করবে না।

.

একে একে পাঁচ-ছ’দিন কেটে গেল। নভেম্বরের শুরু এটা। শীত এসে গেল। জঙ্গলের সবুজে শুকনো টান ধরেছে। ধূসর গৈরিকের পলেস্তারা পড়ছে। ছেলেবেলায়ও শীতের এই কটা মাস বাপীর ভালো লাগত না। চেঁচিয়ে বলত, শীত বুড়ী থুথুড়ি, যা না—পালা না! শীত মানেই ঠান্ডার গহ্বরে সেঁধিয়ে থেমে যাওয়া। সেই ছেলেবেলার মতোই ভেতরটা অসহিষ্ণু বাপীর। কেউ যেন জোর করে থামিয়ে দিয়েছে তাকে। সামনে এগোনোর পথ আগলে একটা অদৃশ্য দেয়াল গজিয়ে উঠেছে। সকলকে ছেড়ে শুধু সে-ই যেন কে অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি বসে আছে।

চুপচাপ আপিসে যায়। চুপচাপ ফিরে আসে। পারলে চালিহার সামনেও পড়তে চায় না। দেখা হলেই নতুন টিম-ওয়ার্কের প্ল্যান কদ্দুর জিগ্যেস করে। কোন্ কোন্ আইটেম এ-দিকের জঙ্গলে ফলানো যায় তার একটা খসড়া করে রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে দেখা করার তাগিদ দেয়। ফলে সে আসার আগেই বাপী এখন অ্যাকাউন্টেন্টকে জানান দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কাছাকাছি পার্টিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। চালিহা বেরিয়ে পড়ার পর ফেরে।

পাশের শূন্য বাংলোর দিকে তাকালে চোখ দুটো কটকট করে। মেয়ে নিয়ে ঠিক কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছে মহিলা জানতে পারলে কপাল ঠুকে চলেই যেত। অসুবিধে তো হচ্ছেই। দূরের পার্টিদের সঙ্গে যোগাযোগর বরাদ্দ ভ্যানের চালান বন্ধ। পাহাড়ের বাংলোয় বেরুনোর আগে গোটা মাসের চালান দিয়ে গেছল মাস শেষ, ভ্যান নেই—এখন কি করবে? কিন্তু কপাল ঠুকে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার তাগিদ ভিন্ন কারণে। তার ধারণা, মুখোমুখি হলে বাধার অদৃশ্য পাঁচিলটা ভেঙে দিতে পারবে আর ওই মা-মেয়েকেও ফিরিয়ে আনতে পারবে।

কর্ত্রী এখানে নেই জেনেও আবু রব্বানী একটিবার এদিকে আসেনি। বিনা দোষে অপরাধের বোঝা কাঁধে চালানো হয়েছে, ক্ষুণ্ণ হবারই কথা। কিন্তু বাপীর কাছেও না আসার বোধ হয় ভিন্ন কারণ। ম্যানেজারের মেজাজ তার ওপরে বেশী গরম শুনেছে কিন্তু ম্যানেজারের মতলব কি বাপী বলেনি। ওদের মেমসায়েবের রাগ তো বোঝাই যাচ্ছে। আজ হোক, দু’দিন বাদে হোক হেস্তনেস্ত কিছু হবেই। চাকরির দায়ে বাপীও তখন ম্যানেজার আর মেমসায়েবের সঙ্গে হাত মেলাবে ধরে নিয়েছে। ওকেও তাই এখন আর বুকের কাছের একজন ভাবতে পারছে না।

সকাল তখন সাতটাও নয়। চা-টা খেয়ে বাপী একটা বই নিয়ে বারান্দায় বসেছিল। গায়ত্রী রাইয়ের ভ্যান তার ফটকের সামনে এসে থামল। বই ফেলে বাপী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।

ভ্যান থেকে নামল আধবয়সী পাহাড়ী ড্রাইভার বাদশা। আর কেউ নেই।

সেলাম ঠুকে ড্রাইভার জানালো, মেমসায়েব পাঠিয়েছে। যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে বাপী জেনে নিল। পাহাড়ের বাংলোয়। মেমসায়েব সেখানে আছে।

পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর নতুন কেনা বুকখোলা স্লিপওভারটা চড়িয়ে দশ মিনিটের মধ্যে বাপী বেরিয়ে পড়ল। কোটপ্যান্টের টাকা হাতে পেয়েছে কিন্তু শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং গিয়ে এখন পর্যন্ত সে সব করানোর ফুরসত হয়নি। রাতের ঠাণ্ডায় এই পোশাকে কুলোবে না। কিন্তু আন্দাজে কত আর গায়ে চড়াবে।

সকাল আটটার মধ্যেই বাংলোর পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেল। কিন্তু চড়াইয়ের রাস্তা ধরার আগেই বাদশা ভ্যান থামালো। গজ বিশ-বাইশ দূরে ঊর্মিলা রাই। পাশে ঝগড়ু। তারা পাহাড় থেকে নেমে আসছে। ঊর্মিলাই হাত তুলে ড্রাইভারকে থামতে ইশারা করেছে।

কাছে এলো। বাপীকে দেখে ঝগড়ুর একমুখ হাসি। এত শিগগীর আবার বাবুটির সঙ্গে দেখা হবে ভাবেনি। ঊর্মিলার পরনে পাহাড়ী মেয়েদের মতো চকমকে ঘাগরা, গায়ে আধাগরম আঁটা জামা। শীতের ছোঁয়ায় লালচে গাল, ছোট মেয়ের মতোই ফোলা ফোলা রাগ-রাগ মুখ। কিন্তু বাপীর মনে হল ওকে দেখে ভিতরে ভিতরে খুশিও একটু।

ড্রাইভার বাদশা ভেবেছে মিসিসায়েব আর ঝগড়ু ভ্যানে উঠবে। বাপীও সেই অপেক্ষায় বসেই আছে। তার দিকে চেয়ে ঊর্মিলা ধমকের সুরে বলে উঠল, কি হল—নামো?

বাপী বলল, আমি নামব না তুমি উঠবে?

—তুমি নামবে। ঝগড়ু উঠবে।

—এ ঊর্মি! ঝগড়ুর তখনি আপত্তি। মালকান গোঁসা হোবেন।

তার দিকে ফিরে ঊর্মিলা অসহিষ্ণু ভেঙচি কেটে উঠল।—মালকান গোঁসা হোবেন তো তুমি ওপরে গিয়ে মূর্ছো যাও! বাপীর দিকে ফিরল, নেমে এসো বলছি!

অগত্যা বাপী নেমেই এলো। চোখ পিটপিট করে ঝগড়ু বলল, মালকানের মেজাজ গরম আছে বাপীভাই, খবরদার দেরি কোরো না—

ঊর্মিলা তেড়ে যেতে সে চটপট ভ্যানে উঠে পড়ল।

পায়ে হেঁটে লাল কাঁকরের চড়াইয়ের পথ ভাঙতে কম করে পঁচিশ মিনিট লাগে। আস্তে হাঁটলে আরো বেশি। ঊর্মিলার এতটুকু তাড়া আছে মনে হল না। ঢিমেতালে পা বাড়ালো।

বাপী বলল, ভ্যানে উঠে গিয়ে আগে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখাটা করে নিলেই হত, এরপর আমাকেও হয়তো আবু আর রেশমার দলে ফেলবেন তিনি। ঊর্মিলা থমকে দাঁড়িয়ে চোখ পাকালো।—মায়ের সঙ্গে আগে দেখা করার জন্যে তোমার আসার সময় ধরে আমি নেমে এসেছি?

—ও…! বাপী হেসে ফেলল, ঠিক আছে চলো—

—যাব না, এইখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে তোমাকে আরো দেরি করাবো। বাপীর ভালো লাগছে। এই কটা দিন যেন মরু-বাসে ছিল। মা ছেড়ে মেয়েরও মেজাজ গরম, কিন্তু এই পোশাকে আগের থেকেও তরতাজা লাগছে বাপীর। হাতজোড় করে বলল, ঘাট হয়েছে দেবী, আর বিপাকে ফেলো না— চলো।

হাসতে-মানা মুখ করে ঊর্মিলা আবার সামনে পা বাড়ালো। আজ কেন যেন বন্ধুর মতোই অনায়াসে একটা হাত ওর কাঁধের ওপর রাখতে পারল বাপী। এটুকু অন্তরঙ্গ হতে ঊর্মিলার দিক থেকেও আপত্তির লেশমাত্র নেই। কিন্তু আপাতত মন পড়ে আছে অন্যদিকে।

—আবু আর রেশমার কি শাস্তির ব্যবস্থা হল?

—হয়নি এখনো। তোড়জোড় চলছে।

রাগে মুখ লাল।—ওদের কোনো দোষ নেই, আমার জন্য শুধুমুদু ওদের শাস্তি হবে কেন? আর তুমিই বা তা বরদাস্ত করবে কেন?

—আমি কারো দণ্ডমুণ্ডের মালিক নই।…তাছাড়া একেবারে দোষ নেই বলতে পারো না—চক্রান্তকারীর সঙ্গে থাকাটাই দোষের।

দেখো, রাগিও না বলছি! এই করে কেউ আমাকে রুখতে পারবে ভেবেছ! …এমনি তেতে উঠে বিজয় মেহেরাও একই কথা বলেছিল মনে আছে। তেমনি ঝাঁঝের মুখে ঊর্মিলা আবার জানান দিল, রেশমাকে আমি বলে এসেছি, শাস্তি যদি হয় তো তার খেসারত আমি দেব। কিন্তু কেন হবে শাস্তি? তোমার— বাধা দিতে এত কি ভয়? মনে পড়ল কিছু।—তোমার কিচ্ছু ভয় নেই, বুঝলে? এতদিন একলা এই পাহাড়ের বাংলোয় কাটিয়ে মায়ের মন তুমি আরো কত কেড়ে ফেলেছ জানো না–ঝগড়ু বার বার করে মাকে শুনিয়েছে, ঠিক আমার বাবার মতোই কাজের ঝোঁক আর বই পড়ে শেখার ঝোঁক তোমার—নাওয়া—খাওয়া জ্ঞান থাকে না। মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে না থাকলে শুধু এই জন্যেই তোমার আর এক দফা মাইনে বেড়ে যেত—

বিরস মুখ করে বাপী বলল, তুমি তাহলে শুধু আবু আর রেশমার ক্ষতি করোনি, আমারও করেছ—

—বাজে বোকো না! সত্যি কারো ক্ষতি হলে মাকে আরো বেশি পস্তাতে হবে জেনে রেখো!

—বুঝলাম। তোমরা কবে এসেছ এখানে?

—পরশু।

—তোমার মা আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন কেন?

—জানি না। সেই থেকে মায়ের সঙ্গে আমার কথা বন্ধ। মা বন্ধ করেনি, আমি করেছি।

বাপী মন্তব্য করল, বড় ঠাণ্ডা মেয়ে।

তেমনি ঝাঁঝের মুখে এরপর এ ক’দিনের সমাচার শোনালো ঊর্মিলা … ওকে আর কোয়েলাকে নিয়ে শিলিগুড়ির এক বড় হোটেলে গিয়ে ওঠা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে মা বড় বড় দুটো ইংরেজি কাগজের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আঙ্কল চালিহাও তখন মায়ের সঙ্গে ছিল। দু’জনে শলাপরামর্শ করে উত্তর ভারতের সেই দুটো নামী কাগজে এই এজেন্টদের মারফৎ ঊর্মিলার জন্য পাত্রের খোঁজে চটকদার বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছে। পাঁচ ছ’দিনের মধ্যে দুটো কাগজে সেই বিজ্ঞাপন ছেপে বেরিয়েছে। তিন-চারখানা করে সেই দুটো কাগজ কেনা হতে ঊর্মিলার সন্দেহ হয়েছিল, মা তাকে বলে নি। সেই দু’ কাগজের বিজ্ঞাপন নিজেই বার করে পড়েছে। ভেঙচে ভেঙচে বিজ্ঞাপনের সার জানালো ঊর্মিলা।…মস্ত বিজনেস অধীশ্বরীর একমাত্র মেয়ে। মেয়ে রূপসী বিদুষী গুণবতী কলাবতী। (ব্যঙ্গোক্তি একেবারে যেন আকাশের চাঁদ খসে নেমে এসেছে) চব্বিশ—পঁচিশের মধ্যে ভালো ঘরের সুশ্রী উচ্চশিক্ষিত সুস্বাস্থ্য পাত্র পাই। জাত-বিচার নেই তবে নেপাল বা ভুটানের ছেলে হলে ভালো হয়। ছেলের ব্যবসার অভিজ্ঞতা বা ব্যবসার দিকে ঝোঁক থাকা চাই। বিয়ের পর ছ’মাস এক বছরের জন্য বিদেশে বেড়ানোর যাবতীয় খরচ মেয়ের মায়ের। বিয়ের প্রধান শর্ত, ব্যবসায় সাহায্যের প্রয়োজন ছেলেকে বরাবর মেয়ের ঘরে এসে থাকতে হবে।…এদিকে ছেলেগুলো যে এত হ্যাংলা ঊর্মিলার ধারণা ছিল না। তিনদিন না যেতে সেই এজেন্টদের মারফৎ হোটেলে গাদা গাদা চিঠি! সবাই বিয়ে করতে চায়, সবাই ঘরজামাই হয়ে থাকতে চায়। অবশ্য তার আগে একবার চোখের দেখা হিসেবে মেয়েও সবাই দেখতে চায়। এ-রকম তিনপাঁজা চিঠি নিয়ে ওর মা আরো চিঠির প্রত্যাশায় ওই এজেন্টদের এই পাহাড়ের বাংলোর ঠিকানা দিয়ে এখানে এসে বসেছে।

ঊর্মিলা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল আসবে না। পাহাড়ের শীত তার ভালো লাগে না। বানারজুলিতে থাকবে। জবাবে মা জানিয়েছে, বেশি শীতে পাহাড় থেকে নেমে আসা হবে। এখন তার শরীর অসুস্থ স্বাস্থ্যের জন্যেই কিছুদিন পাহাড়ের নিরিবিলিতে থাকা দরকার। অসুস্থ না ছাই। ঊর্মিলার বুঝতে বাকি নেই তাকে ভোলানোর জন্যেই শিলিগুড়ির বড় হার্ট স্পেশালিস্ট ডেকে নিজেকে দেখানো হয়েছে। মায়ের যা হার্ট! স্পেশালিস্ট তা খুঁজে পেয়েছে কিনা মেয়ের সন্দেহ। এখন মায়ের শুধু কাজ নাকে চশমা এঁটে ওই হ্যাংলা হবু জামাইয়ের চিঠি যাচাই—বাছাই করা আর খাওয়া আর শুয়ে থাকা। ওকে দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছে। ওষুধ খাচ্ছে কি জল খাচ্ছে কে জানে। তবে ঊর্মিলার একটু ভরসা, অত চিঠির গাদা থেকে এখন পর্যন্ত তিনটে চিঠি মাত্র আলাদা করে রাখা হয়েছে, তাও খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না—হলেও ঊর্মিলা পরোয়া করে না। সব চিঠির গাদা উনুনে দেবার ফাঁক খুঁজছে

আগেভাগে পাহাড় থেকে নেমে আসার উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করল। বাপীর মারফৎ মায়ের সঙ্গে সোজাসুজি একটা পাকা বোঝাপড়া করার মতলব ঊর্মিলার। সামনের বছরের গোড়া থেকে ও আবার পড়াশুনা শুরু করবে। দু’বছর প্রায় কেটেই গেছে, আর দুটো বছর পড়ে বি.এ. পরীক্ষা দেবে। মায়ের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কলেজে পড়বে না, হোস্টেলেও থাকবে না—বাড়িতে মায়ের কাছেই থেকে প্রাইভেট বি.এ. পরীক্ষা দেবে। পড়াশুনা শুরু করার পর থেকে মাকে না জানিয়ে কোথাও যাবে না কারো সঙ্গে দেখাও করবে না। তার বদলে মাকে কথা দিতে হবে, বি.এ. পরীক্ষা আর তার রেজাল্ট বেরুনো পর্যন্ত, অর্থাৎ দুটো-আড়াইটে বছর তার বিয়ের নামও মুখে আনবে না। তারপর যা হয় হবে। কিন্তু এখন মায়ের যা মতলব তা যদি না ছাড়ে তাহলে আর ওকে ঘরে রাখতে পারবে না—পারবেই না।

মেয়ে চতুর বটে। মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সময় কাটিয়ে দেবার রাস্তাটা মন্দ বার করেনি। সাদা মুখ করে বাপী জিগ্যেস করল, দু’আড়াই বছর বাদে মা যেখানে বিয়ে ঠিক করবেন নির্ঝঞ্ঝাটে সেখানেই বিয়েটা করে ফেলবে সে কথাও দিচ্ছ?

ঝাপটা মেরে জবাব দিল, আমি তা বলিনি, সে যখনকার কথা তখন দেখা যাবে—আমি বলেছি এই দু’আড়াই বছর বিয়ের কোনো কথাই হবে না।

—বেশ। তোমার মা না তুললে এসব কথা আমি নিজে থেকে তুলব?

—মা বেশ ভালো করেই জানে তোমার মতো ঝানু ছেলের জানতে কিছু বাকি নেই—বিশেষ করে এবারে এ ব্যাপারটার পর। তুমি ফাঁকতালে কথাটা তুলবে, আমিই তোমাকে এই বলছি বলবে।

—দেখা যাক। হাসল, মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানোর আগেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিলে দেখছি।

কথায় কথায় অনেকটাই উঠে এসেছে। সামনের ওই উঁচু বাঁকটা ঘুরলেই রাস্তা শেষ। সামনে বাংলোর গেট। কি ভেবে বাপী জিগ্যেস করল, তোমার আঙ্কলের খবর কি?

—কেন, বানারজুলিতে নেই?

—আছেন। এখানে আসেন?

—শিলিগুড়িতে একদিন পরে-পরেই আসত। এখানে পরশু এসেছি—পরশুই এসেছিল একবার!

—ব্যবসার অভিজ্ঞতা বা ব্যবসার ঝোঁক থাকা পাত্রর জন্য বিজ্ঞাপনও কি তাঁর পরামর্শে দেওয়া হয়েছিল?

ঊর্মিলা ঠোঁট উল্টে দিল।—কাগজে দেবার আগে বিজ্ঞাপনের কথা জানতামই না। তক্ষুনি কি মনে পড়তে চলতে চলতেই ঘুরে তাকালো।—ভালো কথা মনে করেছ। স্পাই লাগিয়ে ওই আঙ্কলই বানারহাটের ব্যাপার মায়ের কাছে ফাঁস করেছে, এদিকে আমার সঙ্গে ভারী দরদী মানুষের মতো কথাবার্তা। শিলিগুড়িতে সেদিন আমাকে চুপিচুপি বলছিল, মায়ের কথা মতোই আমার ওপর চোখ রাখা হয়েছিল, কিন্তু বিজয় মেহেরাকে আমার যখন এত পছন্দ তাকে সে খারাপ লোক বলে ভাবে না। এই রাগে মুখে মা-কে এখন কিছু বলা যাবে না—কিন্তু একটু ঠাণ্ডা হলে সে তার সাধ্যমতো মাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে।…কি ব্যাপার বলো তো? ভাঁওতা দিয়ে আমাকে ভোলাবার মতলব?

—তা না-ও হতে পারে।

খবরটা শোনার পর বাপীর নিজের ভিতরেই একটা নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাপীর চিন্তার হিসেবে একটুও ভুল হয়নি। প্রথমেই আবু রব্বানীকে ছেঁটে দিতে চাওয়ার পিছনে রণজিৎ চালিহার পাকা-মাথার অঙ্কটা জল-ভাতের মতোই ধরা পড়েছে।

বাঁকটা ঘোরার আগেই ঊর্মিলার কাঁধ থেকে হাত নামালো। রাগ আর ভাবনা ভুলে ফাজিল মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল।—নামালে কেন? বেশ তো এইভাবেই মায়ের চোখের ওপর দিয়েই বাংলোয় ঢুকে যেতাম। তুমি আচ্ছা কাওয়ার্ড—

বাঁকটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর দু’চোখ বড় রকমের হোঁচট খেল একপ্রস্থ। ঊর্মিলারও মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।

বাংলোর গেটের বাইরে এসে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে গায়ত্রী রাই। পরনে পাড়-ছাড়া ধপধপে সাদা শাড়ি। গায়ে দুধ-সাদা গরম জামা। পায়ে সাদা চপ্পল।

সব মিলিয়ে সাদার ধাক্কা একখানা

হাত দশেকের মধ্যে এসে বাপী কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে দু’ হাত কপালে তুলে একটা নমস্কার সেরে ফেলল। কিন্তু সুফল কিছু হল না। জবাবে গায়ত্রী রাই সামান্য মাথাও নাড়ল না। উল্টে আলগা তোষামোদের চেষ্টা ভাবল বোধ হয়। আর দু’পা এগোতে ওই সাদা পাথুরে মুখ থেকে ঠাণ্ডা চাবুকের মতো কথা।—এক ঘণ্টা ধরে আড্ডা দেবার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে এখানে ডেকে আনা হয়েছে তোমাকে?

বাপী কি জবাব দেবে। বিপন্ন মুখে তার মেয়ের দিকে তাকালো শুধু। মায়ের সঙ্গে কথা বন্ধ বলেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে চোখেমুখে আগুন ছুটলো একপশলা।—তুমি কি আশা করেছিলে, আমি আটকাতে চাইলে তোমার তাঁবের এই বিশ্বাসী মানুষ আমাকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে তোমার কাছে ছুটে চলে আসবে?

এক ঝটকায় মায়ের পাশ কাটালো। দুহাতের ধাক্কায় লোহার গেট দুটো দু’দিকে ছিটকে খুলে গেল। পায়ের তলার লাল কাঁকরের মাটি আছড়ে আছড়ে বাংলোর দিকে চলল।

বাপীর মনে হল, পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে আসার ঝাঁঝালো উক্তিটা মহিলার মুখের ওপর ঠাস করে গিয়ে লাগল। পলকের মধ্যে আবার যে-কে সেই। ঘুরে মেয়েকেই দেখছে। কঠিন, অপলক

ভিতরে পা বাড়ালো। পাশে দু’হাত ফারাকে বাপী। বাগানের ভেতর দিয়ে বাংলো পর্যন্ত লাল কাঁকরের পথটুকু খুব কম নয়। আধা-আধি এসে সামনের দিকে চোখ রেখেই গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, আগেভাগে তোমাকে কি বলার জন্য নেমে গেছল?

গুরুত্ব না দেবার মতো করে বাপী জবাব দিল, বিশেষ কিছু না, হঠাৎ আমাকে দেখে ভ্যান থেকে টেনে নামিয়েছে মনে হল।

গায়ত্রী রাই এবারও তাকালো না তার দিকে। কিন্তু গলার স্বর আরো ঠাণ্ডা কঠিন।—হঠাৎ নয়। ও জানত তুমি আসছ। কি বলে…আমাকে গোপন করার মতো কিছু?

অধৈর্যের আঁচ পেয়েই বাপী তাড়াতাড়ি জানান দিল, তা না… রেশমা বা আবু রব্বানীর কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল, আর ওদের যে কোনো দোষ নেই সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করল।

—তুমি বুঝলে কি হবে, তোমার কাজ করছে ওরা?

এই প্রসঙ্গের ফয়সলাই বাপীর কাছে সব থেকে বড় ব্যাপার। তবু হালকা করেই জবাব দিল, আপনার মেয়েকে বলেছি যে আমি ওদের দণ্ড-মুণ্ডের মালিক নই।

চুপচাপ একটু। তারপর আবার প্রশ্ন।

—শুধু এইজন্যেই নেমে গেছল, না আরো কিছু আছে?

—ওর বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজে আপনি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, কিরকম পাত্রের খোঁজ করছেন—এইসব বলছিল।…এইজন্যেই খুব রাগ মনে হল।

—রাগ করে কি করবে। বিয়ে ঠিক হলে বিয়ে করবে না?

—আমাকে বলতে বলেছে, আপনি এই চেষ্টায় এগোলে তাকে আর ঘরে রাখতে পারবেন না।

বাপী লক্ষ্য করল, রাগে সাদাটে মুখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এবারে ওর দিকে চোখ।—তোমাকে বলতে বলেছে? কেন বলেছে তুমি তাহলে জানো?

বাপী মাথা নেড়ে স্বীকার করল জানে। ভিতরে ভিতরে শঙ্কিত। মিথ্যের মধ্যে যেতে চায় না, কিন্তু কেমন করে জানে জিজ্ঞেস করলে আবুর নাম মুখেও আনা চলবে না। জিজ্ঞেস করল না। বানারহাটের ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেছে ধরে নিল হয়তো। হয়তো বা ভাবল মেয়ে নিজেই বলেছে।

সিঁড়িতে পা রেখে থামল।—বেশ, তুমিও তাহলে ওকে জানিয়ে দিও আমি বলেছি, আমার অবাধ্য হলে বা আমার অমতে বিয়ে করলেও ওকে ঘরে রাখতে পারব না। মা নেই ধরে নিয়ে যা করতে চায় করুক।

দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে গেল। বাপী পিছনে। ভাবছে, রণজিৎ চালিহার কান বিষনোর কলা-কর্ম এমনি নিখুঁত যে অবাধ্য হলে একমাত্র মেয়েকেও মহিলা ত্যাগ করতে রাজি। খেলার মোড় হঠাৎ এভাবে ঘুরবে জানলে ভদ্রলোক নিশ্চয় কান-বিষনোর ব্যাপারে এতটা তৎপর হত না।

গায়ত্রী রাই বারান্দার চেয়ারে বসল। একটু যেন হাঁপাচ্ছে মনে হল। রাগ বা অসহিষ্ণুতার কারণেও হতে পারে। ইশারায় সামনের চেয়ারটায় বাপীকে বসতে বলল।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, আপনার শরীর তেমন সুস্থ নেই শুনলাম।

সঙ্গে সঙ্গে একটু টান হয়ে বসল গায়ত্রী রাই। গলার স্বরও চড়ল।—কে বলেছে আমার শরীর সুস্থ নেই?

বাপীর ভেবাচেকা মুখ

—আমি অসুস্থ হলে কার কি আসে যায়? আমি মরে গেলেও কারো ক্ষতি বেশি না লাভ বেশি?

সামনের দরজা দিয়ে পিছনের ঘরের কাউকে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু বাপীর নিশ্চিত ধারণা তাদের চোখের আড়ালে ও-ঘরে কারো পদার্পণ ঘটেছে। আর, মহিলাও সেটা জানে।

মিনিট খানেক বাদে গায়ত্রী রাই সংযমে বাঁধল নিজেকে।—ওদিকের কাজ—কর্মের খবর কি?

—চলছে।…তবে আমার একটু অসুবিধে হচ্ছে। আমি যেদিকটা অর্গ্যানাইজ করেছি, ভ্যান না থাকতে সেসব জায়গায় মালের চালান এখনও যায়নি।

মুখের দিকে চেয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবল একটু।—তুমি ড্রাইভিং জানো?

বাপী বুদ্ধিমানের মতোই জবাব দিল, না…আপনি বললে শিখে নিতে সময় লাগবে না।

—বাদশা ভালো ড্রাইভার। সবরকম গাড়ি চালাতে জানে। আমরা ফিরে গেলে সে শেখানোর ব্যবস্থা করে দেবে।

বাপী মাথা নাড়ল শুধু। তেমন উৎফুল্ল হবার কারণ নেই। বরাত এখনো অনিশ্চয়তার গহ্বরে। সেই ফয়সলার দিকেই এবারে এগোলো গায়ত্রী রাই। বলল, রেশমাকে এখানকার কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনেছ?

মুখ দেখলে বোঝা যাবে না…কিন্তু ভিতরে ভিতরে বাপী প্রস্তুত হয়েই এসেছে।—শুনেছি।…তবে আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা আপনি আর একবার বিবেচনা করবেন।

ঠাণ্ডা সাদাটে মুখে মেজাজের আঁচড় পড়ল।—কেন? ওর কোনো দোষ নেই ডলি বলেছে বলে? আর একবারও ওই রকম ধরা পড়েছিল বলে মিস্টার চালিহার মুখ বন্ধ করার জন্য ও মদের বোতল ভেট নিয়ে গেছল—সে-খবর রাখো?

..খুব নরম গলায় বাপী বলল, রাখি। ও যায়নি, ওকে পাঠানো হয়েছিল। …এতে ওর নিজের তো কোনো স্বার্থ নেই, আদর দিয়ে আপনার মেয়েই ওকে বাধ্য করেছে।

মুখের ওপর অসহিষ্ণু ঝাপ্টা মারার মতো করে গায়ত্রী রাই বলে উঠল, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। এত বাধ্য হবার সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। আমি ওকে তাড়িয়েই দিতে চেয়েছিলাম, চালিহা বলল আসামে কাজের মেয়ের দরকার আছে—আমি আপত্তি করিনি। সেখানে গেলে টাকাও বেশি পাবে। তোমার আপত্তি কেন?

প্রায় আবেদনের সুরে বাপী জবাব দিল, আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বুঝতে পারছি…আসামে মেয়ের অভাব নেই, তবু এত দূর থেকে রেশমার অজানা-অচেনা একটা জায়গায় উনি কেন তাকে নিয়ে যেতে চাইছেন, আপনাকে সেটা বলার দরকার হবে ভাবিনি।

রাগের মুখে ভদ্রমহিলা থতমত খেল একপ্রস্থ। একটা অনাবৃত সত্য তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। তবু ঝাঁঝালো গলায় বলল, ডলির কাছ থেকে ওকে সরিয়ে দেবার জন্যেই এই ব্যবস্থা হয়েছে।

—এভাবে সরাতে চাইলে ও সরবে কিনা জানি না, তার আপনার জনেরা ভাবছে, নিজের মেয়েকে সামলাতে না পেরে নিজের স্বার্থে মিস্টার চালিহাকে খুশি করার জন্য একটা অসহায় জঙ্গলের মেয়েকে আপনি বলি দিতে যাচ্ছেন।

গায়ত্রী রাইয়ের মুখে কথা নেই। গুম হয়ে বসে রইল। তেমনি নরম আবেদনের সুরে বাপী আবার বলল, মেয়েদের কাজ বলতে এতদিনে আমি যতটুকু বুঝেছি, এই পাহাড়ী এলাকাতেই তার স্কোপ বেশি—এদিকে রেখেই ওকে দূরে সরানো যেতে পারে।

প্রস্তাব অনুমোদন করল কিনা মুখ দেখে বোঝা গেল না। দো-টানায় একটু পড়েছে বোঝা গেল। নইলে অন্য মূর্তি দেখা যেত।

খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎ রুক্ষস্বরেই জিজ্ঞাসা করল, বানারজুলির রেঞ্জ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছ?

এইটেই ফয়সলার প্রসঙ্গ। শান্ত মুখে বাপী জবাব দিল, না। তার আগে এই ব্যাপারে আমার কিছু কথা ছিল।

শোনামাত্র আগের মতো উগ্র মুর্তি।—কোনো কথা আমার শোনার দরকার নেই—মিস্টার চালিহা তোমাকে যা বলেছেন সেটাই আমার কথা—আমার ডিসিশন। কেন দেখা করোনি?

এখনো বাপী বিনীত, কিন্তু জবাবে কোনো জড়তা বা দ্বিধা নেই।—তাহলে আমাকে আপনার ছেড়ে দিতে আপত্তি নেই বুঝতে হবে।

হঠাৎ যেন বড়রকমের একটা ধাক্কা খেল মহিলা। প্রথমে চোখ, পরে গলা দিয়ে সাদা আগুন ঠিকরলো।—তার মানে সবকিছুর কন্ট্রোল নিয়ে আবু রব্বানীকে সরাতে চাইলে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে না?

—থাকব না নয়, মিস্টার চালিহা আমাকে থাকতে দেবেন না, তাই সময় থাকতে নিজের ব্যবস্থার তাগিদে আমাকে আগেই সরে যেতে হবে। তার লক্ষ্য আবু রব্বানী নয়, তার টারগেট আমি।

অপলক গোল দু’-চোখ ওর মুখের ওপর স্থির খানিকক্ষণ।—কি বলতে চাও খোলাখুলি বলো।

চাউনি আর গলার স্বর দুইই অকরুণ।

—আপনার মন-মেজাজ ভালো থাকলে কিছু বলার দরকার হত না। মিস্টার চালিহা সেই সুযোগই নিচ্ছেন। আবু রব্বানী আমার ডান হাতের মতো কাজ করছে, গোড়াতেই তাই তাকে ছেঁটে দেওয়া দরকার তাঁর। বিজয় মেহেরা সম্পর্কে আপনাকে তিনি বিষিয়ে রেখেছেন, ওদের মেলামেশা দু’দুবার হাতে—নাতে ধরেছেন, কিন্তু এখন তিনি দেখছেন আপনার বিজ্ঞাপন অনুযায়ী কোনো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে তাঁর আরো ক্ষতি—এঞ্জিনিয়ার ছেলে আর যাই হোক এই ব্যবসা নিয়ে জঙ্গলে পড়ে থাকবে না। তাই বিজয় মেহেরাকে এখন আর তাঁর অত পছন্দ নয়। তাই আপনার মেয়েকে তিনি চুপিচুপি ভরসা দিয়েছেন, একটু ঠাণ্ডা হলে সাধ্যমতো আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করবেন। সত্যি কি মিথ্যে আপনার মেয়েকে ডেকে জিগ্যেস করুন—

মহিলার স্তব্ধ রুক্ষ মুখের দিকে চেয়ে বাপী আবার বলে গেল, মিস্টার চালিহা জানেন, মেয়ে যদি ওখানে বিয়ে করেই, ওদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলাই ভালো, আপনি তাদের শেষ পর্যন্ত ফেলে দেবেন না—আর দিলেও তাঁর লাভ ছেড়ে লোকসান কিছু নেই। তাই সবার আগে আমার জোর কাড়ার ব্যাপারে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন।…আপনার মনের এই অবস্থায় এত সব আমি বলতাম না—কিন্তু তিনি এই সুযোগটাই বেছে নিয়েছেন।…এখন আপনি বিবেচনা করুন।

গায়ত্রী রাই পাথরের মূর্তির মতো বসে। মিনিট দুই চুপচাপ। চেয়ে আছে। তারপর গলার স্বর তেমনি ঠাণ্ডা তেমনি অকরুণ। বললে, বিবেচনা করব। যা বললে, সবই আমার অভ্রান্ত বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে তোমারও এমন ভাবার কোনো দরকার নেই। তুমি বরং মনে রেখো, এক বছরও হয়নি তুমি আমার কাছে এসেছ—তার আগে পর্যন্ত তোমাকে ছাড়াই আমার চলেছে—তাই ছেড়ে যাবারও কোনো হুমকি দেবার দরকার নেই—সে-জন্যে আমার বিবেচনার হেরফের হবে না।

কথাগুলো কানের পর্দায় ঘা দিয়ে গেল, ভিতর থেকে একটা অসহিষ্ণু ক্ষোভ ঠেলে উঠল। কথা শেষ। মহিলা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠবে মনে হচ্ছে।

ফয়সলা চেয়েছিল। নিষ্পত্তি যা হবার হোক। বাপী চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে বলল, আমাকে যদি আপনাদের শুভার্থী মনে করেন তো সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপারে দুই-একটা কথা বলব।

মুখের দিকে চেয়ে থেকে তেমনি কঠিন সুরে গায়ত্রী রাই জবাব দিল, বাজে কথা ছেড়ে যা বলবার বলো।

অর্থাৎ শুভার্থী ভাবাটা বাজে কথা। এটুকুও হজম করে ঠাণ্ডা মুখে বাপী বলল, সামনের জানুয়ারির শেষ থেকে প্রায় তিন বছরের মতো মেয়ের জন্য আপনার খুব দুশ্চিন্তা করার দরকার হবে না, তার মধ্যে ঊর্মিলা আপনার কাছে ঘরেই থাকবে, তার ওপর নজর রাখতেও হবে না—হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য বিজয় মেহেরা লন্ডন চলে যাচ্ছে—সেখানকার একটা ফার্মে কাজও পেয়েছে।

এই প্রসঙ্গে কথা হবে গায়ত্রী রাই কল্পনাও করেনি। কঠিন মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে। নড়েচড়ে বসল। সত্যি হলে অনেকখানি স্বস্তি, তাই উৎসুকও একটু।—তুমি জানলে কি করে, ডলি বলেছে?

—না। আমার সঙ্গেই সামনাসামনি কথা হয়েছে।

—কোথায়?

—মিরিকে।

আরো অবাক।—তুমি সেখানে গেছলে?

—হ্যাঁ।

—কবে?

—দিন-সাতেক আগে।

—কেন গেছলে? এবারে সন্দিগ্ধ।

—যাকে নিয়ে এত ব্যাপার তাকে একটু ভালো করে জানা বা চেনা দরকার ভেবেছিলাম। তার সম্পর্কে আপনার ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা মিললে তাকে হটানোর রাস্তা বার করা যায় কিনা সে চিন্তাও মাথায় ছিল।

মহিলার আগ্রহ আরো স্পষ্ট এবার।—কি বুঝলে?

—বোঝাবুঝির কথা থাক, প্রায় তিন বছরের জন্য সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। যাওয়ার আগে ওর বিয়ে করে যাবার ইচ্ছে ছিল, আপনার মেয়ে রাজি হয়নি। বিজয় মেহেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি বলেছি সে-চেষ্টা করতে গেলে ডলিরই সব থেকে ক্ষতি করা হবে।

—স্কাউনড্রেল!

—আমি?

থতমতো খেল। কিন্তু তেমনি উষ্ণ।—তোমাকে কে বলেছে? তিন বছরের জন্য তার যাওয়া একেবারে ঠিক?

—ঠিক।

মুখের দিকে চেয়ে বাপী অনুভব করতে পারে মহিলার অনেক দিনের টান-ধরা স্নায়ুগুলো আস্তে আস্তে শিথিল হচ্ছে। মুখের সাদাটে ভাবও এরই মধ্যে একটু কম।

—বুঝলাম। তোমার কি বক্তব্য?

নিরুত্তাপ গলায় বাপী জবাব দিল, শুভার্থীও ভাবেন না যখন, বলে কি লাভ হবে জানি না। তবু নিজেকে আমি শুভার্থী ভাবি বলেই বলছি।…তিনটে বছর অনেক সময়। ছেলে-মেয়ে দু’দিকেরই মত বা মন বদলাবার পক্ষে যথেষ্ট সময়। যেখানে যাচ্ছে ছেলের পক্ষে তো বটেই। এর মধ্যে মেয়ের মনের দিকে না তাকিয়ে আর যথেষ্ট সময় হাতে পেয়েও সে সুযোগ না নিয়ে আপনি যদি এমনি ঝোঁকের মাথায় ওর বিয়ের তোড়জোড় করেন—আমার ধারণা সব থেকে বড় ভুলটা সেইখানে হবে। শুধু এই ব্যাপারই নয়, সব দিকেই যেমন চলছে চলতে দিলে আপনার খুব অশান্তির কারণ থাকবে না।

গায়ত্রী রাই বেশ মন দিয়েই শুনল কথাগুলো। আর রুক্ষ নয়, উগ্র নয়। অশান্তি অনেকটা কমেই গেছে বোঝা যায়। এখন শুধু গম্ভীর।—ঠিক আছে, ভাবব। আর দেরি না করে তুমি ভ্যান নিয়ে চলে যাও। আজ আর কালকের মধ্যে যেখানে যেখানে মাল চালান দেওয়া দরকার কালকের মধ্যে দিয়ে পরশু গাড়িটা পাঠিয়ে দিও।

বাপী উঠে দাঁড়াতে গায়ত্রী রাই ঈষৎ নীরস সুরে আবার বলল, আর একটা কথা, এক্সপ্যানসনের জন্যও ফরেস্ট রেঞ্জ-অফিসারের সঙ্গে আমাদের ডাইরেক্ট যোগাযোগ করা দরকার!

নিরুত্তাপ গলায় বাপী জবাব দিল, আপনার বিবেচনা শেষ হলে বলবেন…করব।

অদূরে ভ্যানটা দাঁড়িয়েই আছে। আর অপেক্ষা না করে সিঁড়ির দিকে এগলো।

—বাপী। হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাধা দিল ঊর্মিলা।—ওয়েট্ তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

বাপী ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল তাকে। এই মুখে খুশী যেমন রাগও তেমনি। বাপী বলল, তোমার মায়ের বিশ্বাস বা বিবেচনা বোঝা গেলে তখন কথা। এখন থাক।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা ভ্যানে।

জঙ্গলের পাশ-ঘেঁষা পাহাড়ী রাস্তা ধরে ভ্যান ছুটছে! বাপী প্রথমে গুম খানিকক্ষণ। আগে বাড়ল, কি আপাতত কিছুটা পিছে হটল জানে না। এতক্ষণের সব কথা আবার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। মন বলছে, পিছনে নয়, সামনেই পা ফেলেছে। দেখা যাক। হাসিই পেল হঠাৎ। বেলা সাড়ে ন’টা এখন। নিজে রান্না করে খায়। এরপর বাড়ি পৌঁছে সে পাটের সময় থাকবে না। কিন্তু এমনি মেজাজের হাল এখন ভদ্রমহিলার, যে মনেই পড়ল না। বাপীর ছেলেমানুষের মতো ভাবতে ভালো লাগছে নিজে যখন লাঞ্চে বসবে তখন মনে পড়বে আর খারাপ লাগবে।

সমস্ত দিন ব্যস্ত ছিল। বিকেলের দিকে আবুর খোঁজে জঙ্গলের পথ ধরল। এবারে ওর সঙ্গে কথা বলা আর পরামর্শ করার দরকার হয়েছে। গায়ত্রী রাইয়ের বিবেচনার মোড় কোন্ দিকে ফেরে বলা যায় না। রণজিৎ চালিহা অপরিহার্য ব্যাধির মতো তার স্নায়ুর ওপর চেপে আছে—থাকতে চাইবেও।

এ সময় চন্দ্রার বেডের কাছেই আবুকে পাবে ভেবেছিল। নেই। কেউ নেই। অনিশ্চয়তার দরুন উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে হয়তো। ওর ডেরার দিকে চলল। সেখানে পেল। সামনের দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছে। আশপাশ দিয়ে ছেলে দুটো ছোটাছুটি করছে।

ওকে আসতে দেখে আবু হাসল বটে, কিন্তু হাসিটা বুক ছুঁয়ে যাবার মতো নয়। ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে দুলারিকে ডাকল।

কাছে এসে বাপী আবুর পাশে দাওয়ার ওপরেই বসে পড়ল।—কি খবর?

বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে নির্লিপ্ত গলায় আবু বলল, তোমার কাছে খবর পাব বলে তো দিন গুনছি।

দুলারি এসে ছেলে দুটোকে ঘরে পাঠিয়ে পাশের থাম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আবু ওর মাথায়ও অবাঞ্ছিত কিছু ঢুকিয়েছে মনে হয়।

—চন্দ্রার বেড়ে কাজ হচ্ছে না কেন?

আর একটা বিড়ি ধরিয়ে আবু জবাব দিল, তোমাদের বিচার শেষ হোক। —ওটা যে তোমাদের মেমসায়েবের কাজেই লাগবে তোমাকে কে বলল? নষ্ট কোরো না, যেমন বাড়িয়ে যাচ্ছ বাড়িয়ে যাও।

আবু ঠিক বুঝল না। চেয়ে আছে।

বাপী বলল, মেমসায়েব এখন পাহাড়ের বাংলোয়। আজ সকালে গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেছলেন।

আবুর ছোট চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠল।—আমার ওপর হুকুম হয়েছে কিছু?

—ম্যানেজার আর মেমসায়েবের হুকুম, জঙ্গলের বড়সাহেবের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলে তোমাদের বাদ দিয়ে নতুন টিম-ওয়ার্ক করতে হবে।

—সব দোষ তাহলে আমার আর রেশমার?

মোলায়েম গাম্ভীর্যে বাপী জবাব দিল, রেশমার কথা ছাড়ো।…সত্যি কথা বলো দেখি। আগে থাকতে বলে রেখে ছুটির দিনে লম্বা সময়ের জন্য তোমার মেমসায়েবের মেয়ে বনমায়াকে নিয়ে গেল—তোমার এতটুকু সন্দেহ পর্যন্ত হয়নি?

আবুর ছোট চোখের রাগ ঠিকরে বেরুচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল, সন্দেহ হয়েছিল। আর সে-কথা রেশমাকে বলেও ছিলাম।…এবার তোমার কর্তব্য করতে সুবিধে হবে?

হাসি মুখে বাপী এবার দুলারির দিকে তাকালো। বলল, আবুর কর্তব্য-জ্ঞান সাংঘাতিক। নতুন বীম্যান হবার পর জঙ্গলের বড়সাহেবের হুকুমে আমাকে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে গেছল। ওর চোখের সামনে তারপর কি হয়েছিল ওর মুখেই শুনো।

দুলারির শোনা আছে বোধহয়। দু’জনেই হতচকিত হঠাৎ। আবুর দিকে ফিরে ঠাণ্ডামুখে এবার বাপী বলল, আমার কর্তব্যজ্ঞান-টানগুলো একটু অন্য রকমের।…মেমসায়েবকে বলে এসেছি, তোমাকে ছেড়ে দিলে আমাকেও ছেঁটে দেবার কথা ভাবতে হবে। কেন ভাবতে হবে তাও বলেছি। আমি আশা করছি অতদূর গড়াবে না, যেমন চলছে তেমনি চলবে। তা যদি না হয়, আমার বিশ্বাস আমি তুমি দুলারি আর রেশমা একত্র হয়ে ওষুধ আর সাপের ব্যবসা গোড়াতেই অত বড় করে না হোক ছোট করে অন্তত চালাতে পারব। টাকারও অভাব হবে না, বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে মিসেস রাই কিনতে বাধ্য। কিন্তু আমার ওপর তোমার বিশ্বাসের এত উন্নতি দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছি—

বিড়ি ফেলে আবু তার মুখটা বাপীর কোলে গুঁজে দিল—বাপী—বাপীভাই, তুমি আমাকে ধরে মারো—আমার মুখটা মাটিতে থেঁতলে দাও। না বাপীভাই, আমার জন্য তোমাকে কাজ ছাড়তে হবে না—আল্লার দিব্বি বলছি, মেমসায়েব আমাকে ঝাঁটা মেরে তাড়ালেও আর আমি তোমাকে অবিশ্বাস করব না।

বাপী ওকে ঠেলে তুলল। ওর চোখে সত্যি জল। দুলারি হাসছে। বাপীর সঙ্গে চোখাচোখি হতে বলল, আর অবিশ্বাস করলে আমি চ্যালা-কাঠ নিয়ে কুকুর তাড়া করব!

বেশ কপট গাম্ভীর্যে বাপী উঠে দাঁড়াল।—আমি চলে গেলে এই বুড়ো খোকাকে একটু আদর-টাদর কোরো? আবুকে বলল, আমার বিশ্বাস আর গণ্ডগোল কিছু হবে না। কিন্তু যাই হোক, আপাতত তুমি বা রেশমা ওই ম্যানেজারকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা কোরো

পরের পনেরটা দিনের মধ্যেও পাহাড় থেকে কোনরকম নির্দেশ এলো না। এলো না বলেই বাপীর ধারণা বিবেচনার ফল অনুকূল! নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ ওটা। ডিসেম্বরের শীতের কামড়ে পাহাড়ে থাকা সম্ভব হবে না। মেয়েসহ এই নভেম্বরের শেষেই মিসেস রাই নেমে আসবে আশা করছে। শুধু আশা করছে না, তাদের আসার অপেক্ষায় ভিতরে ভিতরে উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে।

এখনো বাপী রণজিৎ চালিহাকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। কাজের অছিলায় কাছাকাছির মধ্যে বাইরে বাইরে ঘুরছে দিন-কতক। এখানে থাকলে চালিহা আপিস থেকে যাবার পরে আসে। পরপর দুদিন তাকে অ্যাকাউন্টেন্ট খরচ দিল, চিফ একডিকিউটিভের মেজাজ গরম। আপিসে এসেই বাপীর খোঁজ করেছে। না পেয়ে রেগেই গেছে।

সেই দিনই সন্ধ্যার পর রণজিৎ চালিহার জিপ তার বাংলোয় হাজির। ড্রাইভার জানালো সাহেব এক্ষুনি যেতে বলেছেন।

গেল। বাংলোর ভিতরের ঘরে ডাক পড়ল। সামনের টেবিলে মদের গেলাস, মদের বোতল। লাল মুখ আর ঘোলাটে চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে জঠর ইতিমধ্যে অনেকটাই রসস্থ হয়েছে। ওকে দেখামাত্র গর্জন করে উঠল, হোয়াট্ দা হেল্ আর ইউ ডুইং অল টাইম? অ্যান্ড হাউ ডেয়ার ইউ ডিসওবে মি?

একটু দূরে চেয়ার টেনে বসল বাপী।—কি হয়েছে বলুন।

—রেঞ্জ-অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছ?

—না।

—ফ্রেশ স্কিম করার কথা বলেছিলাম—করেছ?

—না।

ফেটে পড়ল।—কেন করোনি? আমি তোমাকে স্পেয়ার করব ভেবেছ? সাবমিট ইওর রিটন এক্সপ্লানেশন টুমরো!

ধীর গম্ভীর গলায় বাপী জবাব দিল, মিসেস রাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এ-ব্যাপারে যা বলার তিনি ভেবে বলবেন জানিয়েছেন।

—হু ইজ্‌জ্ সি? আই অ্যাম ইওর বস্। ইউ ইনসাবরডিনেট লাউজি ফুল! চেয়ার ঠেলে উঠে বাপী সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। যে-রকম মত্ত অবস্থা, কিছুই এখন মাথায় ঢুকবে না।

পরের সন্ধ্যায় ফটকের সামনে আবার চালিহার জিপ। একই খবর! সাহেব ডাকছে।

বাপী ড্রাইভারকে বলল, আজ যেতে পারছি না। কাল আপিসে দেখা করব বলোগে।

কিন্তু ড্রাইভার এবারে নিজে থেকেই জানান দিল, মেমসায়েবের ভ্যান এসেছে পাহাড় থেকে, বোধ হয় জরুরি দরকারেই সাহেব ডাকছেন।

অগত্যা। জিপে উঠতে হল। ভ্যানটা সত্যি চালিহার বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে। ভিতরের ঘরে আজ সবুজ আলো জ্বলছে। ভিতরে পা দিয়েই বাপীর মনে হল আজ আরো মত্ত অবস্থা। গেলাস ভরতি। বোতল প্রায় খালি। ওকে দেখেই জড়ানো গলায় হাঁক দিল, কাম্ অন্ ইউ চিনির বলদ—একবস্তা চিনি তোমাকে এক্ষুনি পাহাড়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে! ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসতে লাগল।— নিজেকে একটি মহারানী ভেবে বসে আছেন তোমাদের লেডি, বাট আই আম নট দ্যাট ব্লাডি সোয়াইন অফ এ সারভেন্ট—আই হ্যাভ নো টাইম, আই অ্যাম ওয়েটিং ফর এ গেস্ট। গো অ্যান্ড টেল হার দ্যাট অ্যান্ড ডাম্প অল দি মানি অন হার ল্যাপ। আবার হাসি।—বুঝতে পারছ না? আজ সন্ধ্যার মধ্যেই টাকা যাবার কথা ছিল, দেরি দেখে লোক পাঠিয়েছে। এবারে হাসি আরো তির্যক, আই ওয়ান্ডার হোয়াট সি উইল ডু উইথ ইট অ্যাট দিস আওয়ার অফ দি নাইট!

গেলাসের অর্ধেক এক চুমুকে সাবাড় করে দিল। তারপর উঠে টলতে টলতে খাটের ওপর ধুপ করে বসে পড়ল। একটানে বালিশটা সরাতেই বাপীর চক্ষু স্থির।

মস্ত দুই বান্ডিল একশ টাকার নোট। নম্বর করা নতুন নোটের বান্ডিল নয়। তার থেকে ঢের বড়। গাদা করে ফিতেয় বাঁধা।

বান্ডিল দু’টো টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল।—দেখে নাও একুশ হাজার সাতশ টাকা আছে এখানে। হার হাইনেসকে দিয়ে এসো অ্যান্ড দেন গো টু হেল!

বাপী নির্বাক দাঁড়িয়ে।

এক চুমুকে গেলাসের বাকিটুকু শেষ করে রণজিৎ চালিহা গজরে উঠল, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম—হারি আপ্।

বাপী এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। নোটের বান্ডিল দুটো সামনে টেনে নিল।

রণজিৎ চালিহাও উঠল। ইংরেজি গান ধরে বোতলের বাকি মদ গেলাসে ঢেলে জল মেশালো। তারপর খোশমেজাজে দুলে দুলে ঘরের মধ্যে হাঁটতে লাগল। বাপী টাকা গুনছে তো গুনছেই। আর যত এগোচ্ছে মুখে ততো বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে।

রণজিৎ চালিহা টলতে টলতে বেরিয়ে গেছল। চাকরের সঙ্গে তার চেঁচামেচি কানে আসছে। ডিনার সার্ভ করতে দেরি হলে তার গর্দান নেবে বলে ধমকাচ্ছে। এদিকে বাপীর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। প্রথম বান্ডিলেই চৌদ্দ হাজার সাতশ’ টাকা! এখন দ্বিতীয় বান্ডিলের মাঝামাঝি এসেছে।

ফিরে এসেই রণজিৎ চালিহা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, আর বেশি দেরি করলে আমি তোমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব বলে দিলাম!

গেলাসটা তুলে নিয়ে থলথলে মুখ করে হাসছে। ঘড়ি দেখছে। বাঞ্ছিত কারো আসার প্রতীক্ষায় সময় দেখছে হয়তো

দ্বিতীয় বান্ডিল গোনা হল। এতে পনের হাজার একশ! দুটো মিলিয়ে ঊনত্রিশ হাজার আটশ। চালিহা মুখে বলেছে, একুশ হাজার সাতশ।

—ফিনিসড্?

বাপী মাথা নাড়ল।

কোণের ছোট টেবিলটার সামনে বসে প্যাড টেনে রণজিৎ চালিহা খসখস করে লিখল কি। তারপর নাম সই করে সেটা সামনে ছুঁড়ে মারল। ইংরেজিতে লেখা আছে, শরীর অসুস্থ। এই ঠাণ্ডায় যেতে পারছি না। বাপী তরফদারের হাত দিয়ে একুশ হাজার আটশ’ টাকা পাঠানো হল।

এবার নেশার ঝোঁকে দুই বান্ডিলের শেষের সাতশ’ আর একশ’ জুড়ে আটশ’ লিখেছে। বাপীর হাতে এখনো কড়কড়ে আট হাজার বেশি। এরই মধ্যে দ্রুত চিন্তা সারা তার। গড় হিসেবের এই আট হাজার টাকা হয়তো তার নিজের গায়েব করার সংকল্প ছিল। নেশার ঝোঁকে সেটা আর মনে নেই।

টলতে টলতে এগিয়ে এসে চালিহা একটা কালো থলে ছুঁড়ে দিল। অর্থাৎ টাকাগুলো ওতে ভরে নিতে হবে।

—হার হাইনেসকে বলবে, সতের জায়গায় ঘুরে যা জোটানো গেছে সব দিয়ে দিলাম—সি এক্সপেকটেড মোর। কোথা থেকে কত পাওয়া গেছে আই ডোন্ট রিমেম্বার নাও—অ্যান্ড আই ডোন্ট কেয়ার টু। পরে দেখা যাবে। এ কোনো হিসেবের টাকা নয়, স্টিল অ্যাম আই এ থিফ? একটা রাত এ-টাকা আমার কাছে থাকলে আমি মেরে দিতাম? নাও গেট আউট!

বাইরের অন্ধকার ফুঁড়ে ভ্যান ছুটেছে। ঠাণ্ডা বেশ। গায়ে গরম জামা যা আছে খুব যথেষ্ট নয়। তবু বাপীর খুব একটা শীত করছে না। স্থাণুর মতো বসে আছে। টাকার থলে কোলের ওপর শক্ত মুঠোয় ধরা। আবার নতুন করে ভাবছে কিছু।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছুল। বাংলোর জোরালো আলোগুলো দেখা যাচ্ছে নিচের থেকে সুন্দর লাগছে। পাহাড় পেঁচিয়ে ভ্যানটা উঠতে লাগল। আধাআধি ওঠার পর পাশের জানলা দিয়ে বাপী নিচের দিকে তাকালো। শুধু জমাটবাঁধা অন্ধকার। আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেন যেন ঊর্মিলার বাবা বীরেশ্বর রাইয়ের কথা মনে পড়ল বাপীর। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে নিচে পড়ে সব শেষ। ওই খোলা দিকটায় তখন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। গায়ত্রী রাই সবটা জুড়ে পরে লাগিয়েছে।

ভ্যান গেট দিয়ে ঢুকল। সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।

টাকার থলে হাতে বাপী সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। ভ্যান থামিয়ে ড্রাইভার বাদশা দু’বার হর্ন বাজিয়েছে। সেই কারণেই হয়তো বারান্দার পিছনের কাঁচের দরজা দুটো খুলে গেল। গায়ত্রী রাই দাঁড়িয়ে। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গরম চাদরে মোড়া। রাইয়ের বারান্দায় হ্যাসাক জ্বলছে। ভিতরেও জোরালো আলো। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে গায়ত্রী রাই ওকে ভালো করে দেখে নিল এক দফা। তারপর ডাকল।ভিতরে এসো।

বাপী সামনের ঘরে ঢুকল। ভিতরের অন্য দরজা দিয়ে ঊর্মিলা গলা বাড়ালো। তারপরেই খুশিতে আর বিস্ময়ে উদ্ভাসিত।—রাপী! তুমি এ সময়ে, কি ব্যাপার?

মুখ দেখে মনে হল মায়ের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া হয়েছে। বাপী জবাব দিল না। গায়ত্রী রাইয়ের মুখোমুখি একটা সোফায় বসল। অবাক মুখে ঊর্মিলা মায়ের পাশের সোফাটা দখল করল।

গায়ত্রী রাই হাতের কালো থলেটা একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওতে টাকা?

—হ্যাঁ।

—মিস্টার চালিহা কি করছেন?

—ঘরে সবুজ আলো জ্বেলে ড্রিঙ্ক করছেন। একজন গেস্ট-এর জন্য অপেক্ষাও করছেন।

বলার ধরনে সাদাটে ভুরুজোড়া একটু কোঁচকাতে দেখা গেল।—ইজ হি ড্রাঙ্ক?

—ঠিক বলতে পারব না। দেখলে তাই মনে হবে। উঠে টাকার থলে আর চিঠি তার সামনে সেন্টার টেবিলে রেখে আবার ফিরে এলো।

চিঠিটা তুলে নিয়ে নিতে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা পাঠিয়েছে? —উনি মুখে বলেছেন একুশ হাজার সাতশ’ টাকা। চিঠিতে লিখেছেন একুশ হাজার আটশ’ টাকা।

—এখানে কত আছে তুমি গুনে আনোনি?

—এনেছি। আছে ঊনত্রিশ হাজার আটশ’ টাকা।

ঊর্মিলা লাফিয়ে উঠল।—মাই গড! হি ওয়জ ডেড ড্রাঙ্ক দেন!

ওর দিকে না তাকিয়ে বাপী বলল, টাকাটা গুনে নিন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে—এরপর আরো ঠাণ্ডা পড়বে।

ঊর্মিলা উদ্বিগ্ন মুখে মায়ের দিকে তাকালো। গায়ত্রী রাইও এ-রকম শুনবে আশা করেনি। বলল, এই ঠাণ্ডায় আর তোমাকে যেতে হবে না। কাল সকালে যাবে।

সোজা মুখের দিকে চেয়ে বাপী বলল, কিন্তু আমার ফিরতে পারলে ভালো হয়…কিছু চিন্তা করার আছে।

শুধু মেয়ে নয়, মায়ের মুখেও বিস্ময়ের আঁচড় পড়েছে।—কি চিন্তা?

—আপনার কাছে আর আমার থাকা নিরাপদ হবে কিনা সেই চিন্তা।

মেয়ের ভেবাচাকা মূর্তি। মায়ের সাদাটে ভুরুতে ভাঁজ পড়ল আবার।— হোয়াট ডু ইউ মিন?

বাপীর মুখে কোন রকম আবেগের লেশমাত্র নেই। জবাব দিল, একটু পিছন থেকে বলতে হবে তাহলে।…সাত মাস আগে আপনি আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে শিলিগুড়ি আর মালদহের দু’জন বড় পাইকিরি খদ্দেরের সঙ্গে রিজিওন্যাল ম্যানেজার হিসেবে আমার পরিচয় করে দিয়েছিলেন। ওই দু’জনেই আপনার অনেক দিনের ক্লায়েন্ট, আপনাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করে দেখেছি।

গায়ত্রী রাই অসহিষ্ণু ঈষৎ—সো হোয়াট, তাঁদের কথা কেন?

—তার কারণ দ্বিতীয়বার তাঁদের কাছে যেতেই দু’জনেই তাঁরা ব্যক্তিগত লাভের টোপ ফেলে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন।…আমার ধারণা, আমার সততা পরীক্ষা করার জন্য আপনি এই টোপ ফেলতে তাঁদের বলে দিয়েছিলেন।

ঊর্মিলার দু’ চোখ বিস্ফারিত। একবার মা-কে দেখছে একবার বাপীকে। এই প্রথম বোধ হয় বিড়ম্বনার ছায়া দেখা যাচ্ছে গায়ত্রী রাইয়ের মুখে

স্পষ্ট ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলে গেল, কিন্তু মিস্টার চালিহার মতো মানুষকে দলে টেনে আবার সেই পরীক্ষার টোপ ফেলে আপনি আমাকে তার দশগুণ রিক্স—এর মধ্যে ফেলেছিলেন। আমার ধারণা, আপনি জানতেন টাকা নিয়ে মিস্টার চালিহা আসবেন না, আমি আসব। আমার ধারণা, কত টাকা আমি পাব—আপনি আর মিস্টার চালিহা দু’জনেই তা জানতেন। দেদার মাতাল হয়ে মিস্টার চালিহা আপনাকে গালাগালি পর্যন্ত করছিলেন।…আমার ধারণা, করবেন যে তাও তিনি আপনাকে বলেই রেখেছিলেন। কাউকেই বিশ্বাস করা আপনার ধাতে নেই, তাই এত বড় রিস্ক-এর মধ্যে আপনি আমাকে ঠেলে দিতে পেরেছেন।

গায়ত্রী রাইয়ের চোখে মুখে ঠোঁটে হাসি ছড়াচ্ছে। এমন একটা ব্যতিক্রম দেখে ঊর্মিলা আরো হতভম্ব।

গায়ত্রী রাই দেখছে। হাসছে। দু’ চোখে প্রশংসা উপচে পড়ছে।—রিস্ক কেন?

—অত মদ না খেলে আর আরো একটু মাথা খাটালে মিস্টার চালিহা আট হাজার টাকা কম দিয়েই আমাকে আপনার কাছে পাঠাতেন। তখন আপনি কি করতেন? কাকে বিশ্বাস করতেন? তিনি তো জোর দিয়ে বলতেন, প্ল্যান-মতো ঊনত্রিশ হাজার আটশ’ টাকাই আপনাকে পাঠিয়েছেন!

সাদা মুখ বিস্ময় আর উদ্বেগে ভরাট হতে লাগল। অস্ফুট স্বরে বলল, আমি অতটা ভাবিনি…সত্যি তো সর্বনাশ হত তাহলে!

বাপীর গলার স্বর এবারে শুধু ঠাণ্ডা নয়, কঠিনও। আপনার কিছু হত না, আমার হত। চোর নাম নিয়ে আমাকে এখান থেকে যেতে হত। মুখের ওপর দু’ চোখ বিঁধিয়ে থামল একটু। অনেক দিনের মোক্ষম গোপন অস্ত্রটা ছুঁড়ে দেবার এই বুঝি সময়। গলার স্বর আরো নির্দয়।—এবারে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি? গায়ত্রী রাই চেয়ে আছে। ভালো লাগছে। অবাক লাগছে। নিজের অগোচরে সামান্য মাথা নেড়েছে।

আঙুল তুলে ঊর্মিলাকে দেখিয়ে বাপী বলল, চার বছর আগে ওর বাবার সেই অ্যাকসিডেন্টের রাত থেকে যে লোককে আপনি সব থেকে বেশি সন্দেহ করেন আর ঘৃণা করেন—সব দিক বজায় রাখার তাগিদে আপনি তাকে আরো কত প্রশ্রয় দেবেন?

মুখের ওপর কেউ যেন আচমকা আঘাত করল। গায়ত্রী রাই নির্বাক নিস্পন্দ বিমূঢ় খানিকক্ষণ। একটা যন্ত্রণার স্মৃতি ভেতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল, অ্যাক্সিডেন্টের সেই রাত থেকে আমি সব থেকে বেশি সন্দেহ করি ঘৃণা করি…কাকে?

—আপনার চিফ একজিকিউটিভ রণজিৎ চালিহাকে।

—তোমাকে কে বলল?

—কেউ বলেনি। আমার এই রকমই ধারণা।…বড় কাজ শেষ করার আনন্দে দু’জনে প্রচুর ড্রিঙ্ক করে বৃষ্টির রাতে বন্ধুকে পাশে নিয়ে মিস্টার রাই জিপ ড্রাইভ করে ফিরছিলেন…বন্ধুরও সেই রাতে আপনার এখানেই থাকা খাওয়ার কথা… কিন্তু পাহাড়ে ওঠার আগেই কিছু কাজ সেরে আসার জন্য তিনি নেমে গেলেন আর দু’ ঘণ্টা বাদে অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনলেন। সেই অ্যাক্সিডেন্ট যে কারণেই হোক, তাঁর প্রত্যাশিত ছিল কিনা আর সেই জন্যেই কাজের অজুহাতে তিনি নেমে গেছলেন কিনা—সেই সন্দেহ আপনার মনে আসা স্বাভাবিক…আর মিস্টার চালিহা তাঁর কাজ সেরে ফিরে আসার পর সত্যি কতটা মত্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা গেছে তা-ও আপনিই সব থেকে ভালো জানেন।

ঘরের বাতাসও বুঝি স্তব্ধ হয়ে থেমে আছে। গায়ত্রী রাইয়ের মুখ কাগজের মতো সাদা। স্মৃতির নিঃশব্দ যন্ত্রণায় নিঃশ্বাস নিতে ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে মনে হয়।

ঊর্মিলা পুতুলের মতো বসে।

সোনার হরিণ নেই – ১৭

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। গায়ের পুরু কম্বল সরে গেছল। সেটা টেনে নিয়ে বাপী আবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। এত শীতে গায়ত্রী রাইয়ের সাড়ে সাতটার আগে ঘুম ভাঙে না। মেয়ে আরো দেরিতে ওঠে। কিন্তু কি মনে পড়তে গরম আরামের তলায় ঘুমের চটকা ভেঙে গেল। কম্বলটা মুখ থেকে গলা পর্যন্ত নামিয়ে চোখ মেলে তাকালো।

পাহাড়ের বাংলোয় নয়, বানারজুলিতে বাপী নিজের বাংলোয় নিজের বিছানায় শুয়ে। পাঁচ দিন বাদে গত সন্ধ্যায় সকলকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে! নভেম্বরের শেষ দিন গেছে সেটা। আজ ডিসেম্বরের পয়লা। ওই পাঁচ দিনে প্রত্যাশার বাইরে মহিলার অনেক পরিবর্তন দেখেছে বাপী।

ওই পাঁচটা দিন ছবির মতো চোখে ভাসছে।

…সেই রাতে মা ছেড়ে মেয়ের মধ্যেও এমন কিছু নাড়াচাড়া পড়েছিল যে কারো মুখে একটি কথা সরেনি। নিঃশব্দে ডিনারের পাট শেষ হয়েছে। আগের বার যে কোণের ঘরটায় থাকত সেই ঘরেই বাপীর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। বাড়ির হাওয়া দেখেই হয়তো ঝগড়ুর মুখ সেলাই। সঙ্গে করে শোবার ঘরে নিয়ে আসার পর ফিসফিস করে না. জিজ্ঞাসা করে পারেনি।—কি হয়েছে বাপীভাই? ভয়ের কিছু?

সেই রাতে আর কথা বলার মেজাজ বাপীরও ছিল না। টান-ধরা স্নায়ুগুলো সব শিথিল হয়ে গেছল। ক্লান্ত লাগছিল। মাথা নেড়েছিল শুধু, ভয়ের কিছু না। ঘরের কাঁচের জানলাগুলো সব বন্ধ। তবু বেশ শীত। বিছানায় পায়ের কাছে গায়ের কম্বল ভাঁজ করা। তবু গায়ের সোয়েটারটা খুলবে না সবসুদ্ধই কম্বলের নীচে ঢুকে পড়বে ভাবছিল।

ঝগড়ুর চকিত মুখ দেখেই বাপী ঘুরে তাকিয়েছিল। ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে গায়ত্রী রাই। সেই রকমই ফ্যাকাশে সাদা মুখ। তেমনি নির্বাক। চোখোচোখি হতে এগিয়ে এলো। ঘুরে চারদিকে চেয়ে দেখল একবার। বিছানা দেখল। কম্বলটাও। তারপর ঝগড়ুর তটস্থ মূর্তির দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওই তাকানোর অর্থ সঙ্গে আসার ইশারা বুঝে ঝগড়ুও পিছনে চলল। বাপী খোলা দরজার দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বিছানায় বসল। মিনিট পাঁচ—সাতের মধ্যেই ঝগড়ু ফিরে এলো আবার। তার হাতে ভাঁজ-করা একটা মোটা সাদাটে কম্বল। মুখে চাপা উত্তেজনা। প্রায় অসম্ভব কিছু ব্যাপার ঘটেছে যেন। হাতের কম্বল বিছানায় ফেলে আগের কম্বলটা তুলে নিল।

এই কম্বলে হাত দিয়েই বাপী বুঝল খুব দামী জিনিস। ওপরের দিকটা খড়খড়ে। নিচের দিকটা পশমের মতো নরম। আর তেমনি গরম যে বোঝাই যায়। বাপী বলেছিল, যেটা ছিল তাতেই তো হয়ে যেত…

জবাবে ঝগড়ুর চাপা বিস্ময় আর চাপা খুশি।—মালকান যে নিজে হাতে এটা বার করে তোমাকে দিয়ে যেতে হুকুম করল! এটা সাহেবের কম্বল ছিল বাপীভাই, সাহেব চলে যেতে মালকান এটা যত্ন করে তুলে রেখেছিল—এই প্রথম নামানো হল!

বাপী আজ নিজের ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে। কিন্তু গায়ে সেই কম্বল গায়ত্রী রাই এটাও সঙ্গে নিয়ে এসেছে জানত না। কাল সন্ধ্যার পরেই পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু এটাই নয়। বিগত বীরেশ্বর রাইয়ের আরো কিছু সযত্নে তোলা দামী জিনিস এখন বাপীর দখলে। ওই দেয়ালের হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। গলা থেকে পা পর্যন্ত পশনের ড্রেসিং গাউন। তাতে কাশ্মীরী কাজ করা। চোখে পড়ার মতো জিনিস। কোথায় কি-ভাবে যত্নে রাখবে ওটা বাপীর এখন সেই সমস্যা।

পাহাড়ের বাংলোয় পরদিন সকালে চায়ের পাট শেষ হতে বানারজুলি ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। গায়ত্রী রাই নিজের মনে ভাবছিল কিছু। মেয়ে ফস করে বলে উঠল, বাপীর সঙ্গে আমরাও নেমে যাই চলো না মা, এ ছাইয়ের জায়গা আর ভালো লাগে না—আর কত শীতের জন্য অপেক্ষা করবে?

গায়ত্রী রাই মেয়ের দিকে চেয়ে রইল একটু। তারপর বাপীর দিকে। বলল, তোমার এখন যাওয়ার দরকার নেই, দিন কয়েক বাদে একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। ঊর্মিলা মায়ের সুবিবেচনা দেখে খুশি। কর্ত্রী এরকম হুকুম করতে পারে বাপীর কল্পনার মধ্যে ছিল না। মেয়েকে সঙ্গ দেবার জন্য এই নির্দেশ, একবারও মনে হয়নি। দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বাপী বলেছিল, জামা-কাপড় কিছু সঙ্গে আনা হয় নি।

পাছে মা আবার ওকে যেতে বলে, ঊর্মিলা আগ বাড়িয়ে বাধা দিল, তোমার অমন রাজ-সজ্জা ভুটান শহরে পাওয়া যাবে না নাকি! সঙ্গে সঙ্গে হাসি।—আর না পাওয়া গেলেই বা, আমার আর মায়ের শাড়ি পরেই কটা দিন কাটিয়ে দিও।

মেয়ের বাচালতায় মা হালকা ভ্রুকুটি করে একবার তার দিকে তাকালো শুধু। তারপর বাপীর দিকে। সোয়েটারের ওপর আলোয়ান চড়িয়েও সকালের শীত মানছে না, বুঝল। কিছু না বলে উঠে চলে গেল। একটু বাদে ফিরল যখন হাতে ওই কাশ্মীরী কাজ করা পশমের ড্রেসিং গাউন।

—এটা পরে দেখো তো।

জিনিসটা কার আর কত যত্নে ছিল বাপী দেখেই বুঝেছে। মায়ের বদান্যতায় মেয়ে অবাক যেমন খুশিও তেমনি। বাবার এসব জিনিস মা হাতে ধরে কাউকে তুলে দিতে পারে ভাবা শক্ত। গত রাতে বাবার কম্বল বার করে দেবার কথাও ঝগড়ুর মারফৎ ওর কানে গেছে, বাপী সেটা পরে বুঝেছে। ফাঁপরে পড়ার দাখিল। বলেছিল, না, না, এর কিছু দরকার নেই—আমার কষ্ট হচ্ছে না।

কোনো কিছুতে বাধা পড়লেই বিকৃত মুখ।—আঃ! পরে দেখতে বলছি না! মেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে মায়ের হাত থেকে গাউনটা নিল। আলোয়ান খুলিয়ে নিজের হাতে ওটা পরালো তাকে। অস্বস্তির একশেষ। সামনে এসে নিজের হাতে কর্ডের বেল্টও লাগিয়ে দিল। তারপর সকৌতুকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, ফার্স্ট ক্লাস!

বড় আয়নাটার সামনে টেনে নিয়ে গেল ওকে। কিন্তু আয়নায় বাপী নিজেকে দেখবে কি। আয়নায় গায়ত্রী রাইয়ের দিকে চোখ পড়তে সে যেন অভাবনীয় কিছুই দেখল। রুক্ষমুখে কমনীয়তার অমন ঢল নামতে পারে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। দেখেই বুকের তলায় আর একখানা মুখ আঁতিপাতি করে খুঁজতে ইচ্ছে করেছিল। তার অদেখা মায়ের মুখ। ওর দিকেই চেয়ে আছে। আয়নার ভিতর দিকে চোখাচোখি হতে বাপী সরে এসেছিল।

বেড়ানোর অছিলায় ঊর্মিলা তারপর ওকে বাগানে টেনে এনেছে। ছদ্ম গাম্ভীর্যে টেনে টেনে বলেছে, কাল বাবার কম্বল পেয়েছ, আজ গরম গাউন পেলে, আরো কত কি পাবে ঠিক নেই—আমারই কপাল মন্দ।

—কেন?

—কেন আবার কি, এসব কি তোমার পাবার কথা নাকি?

—বিজয় মেহেরার পাবার কথা?

—না তো কি?

—তা হলে শেষ পর্যন্ত এসব তার কাছেই যাবে।

—আর গেছে। মা-কে তুমি যা করে ফেলেছ…

ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও খিলখিল করে হেসে উঠল তোমার বয়েস আর দশটা বছরও বেশী হলে বা মায়ের কম হলে কি যে হত বোঝাই যাচ্ছে।

ঘাড় ফিরিয়ে বাপী বাংলোর দিকে তাকিয়েছে একবার। মহিলা বারান্দায় বসে। দূর থেকে মনে হয়েছে ওদেরই দেখছে। মেজাজে থাকলে মেয়েটার জিভে লাগাম নেই। মা-কে নিয়ে এরকম রসিকতা একবার বানারজুলিতেও করেছিল, বাপী ভোলেনি।

ঊর্মিলা হাসিমুখেই আবার বলেছে, বাবাকে আমি কত ভালবাসতাম জানো না—আজ তার এসব জিনিস মা তোমাকে নামিয়ে দিল দেখে কি-যে ভালো লাগছে।

বাপীর মুখে দুটো আবেগের কথাই এসে গেছল এরপর। নিজের মা কবে চলে গেছে মনেও নেই, আজ তোমার মাকে দেখে মনে হচ্ছিল আমার মায়ের মুখখানাও বুঝি ওই রকমই ছিল। এমন আর ওঁকে আগে দেখিনি।

খুশি মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে ঊর্মিলা বলেছে, বাবার তুলনায় মা বরাবরই গম্ভীর ছিল একটু কিন্তু ভারী মিষ্টি ছিল। অনেকদিন বাদে আজ আমিও আগের মতো দেখলাম। বাবা চলে যাবার পর থেকে একেবারে যাচ্ছেতাই ভাবে বদলে গেল। কাল রাতে তোমার কথা শোনার পর বুঝলাম এতটা কেন হল। আশ্চর্য বড় হবার পরেও আমাকে কিচ্ছু বলেনি।

পাঁচটা দিন বড় ভালো কেটেছে বাপীর। তার স্বাদ এখনো ভিতরে লেগে আছে। সর্বদা মনে হয়েছে বাইরে গুরুগম্ভীর কিন্তু ভিতরে স্নেহের আধার নিজের মাকেই যেন সামনে দেখছে। মহিলার অগোচরে তাকে দেখার জন্য থেকে থেকে দু’চোখ লালায়িত হয়ে উঠেছে। আর মেয়েটারও বুদ্ধি খুব, অথচ সরল বটে। এই বন্ধুর কাছে আর যেন রেখে-ঢেকে চলার কিছু নেই। তাকে সব বলা চলে, সর্বরকমে বিশ্বাস করা চলে। মায়ের কথায় সায় দিয়ে রাগিয়ে দিলে গলা ছেড়ে ঝগড়া করেছে, মহিলার সামনেই তাকে তেল দেওয়ার খোঁটা দিয়েছে, আর বেশি রাগলে উঠে চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকাতে এসেছে। কিন্তু ফাঁক পেলেই বাপীকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে, নয়তো নিরিবিলি কোথাও গিয়ে বসেছে।

ঊর্মিলার শোনা বা বলার প্রসঙ্গ একটাই। বিজয় মেহেরা। তার চিঠি পেয়েছে। চিঠির লেনদেন এখনো কি করে চলছে ও আর সেটা প্রকাশ করতে রাজি নয়। না, একবার ধরা পড়ে ঝগড়ুকে আর এর মধ্যে টানে নি। তার থেকে ঢের পাকা ব্যবস্থা করেছে। একখানা চিঠি পেতে বিজয়ের দশ-বারো টাকা খরচ হয়ে যায় শুনেই পাকা ব্যবস্থাটা কি বাপীর আঁচ করতে অসুবিধে হয়নি। কবে কখন চিঠি পাবে জেনে ও পাহাড় থেকে নেমে আসে, বিজয় মেহেরা লোক মারফৎ মিরিক থেকে চিঠি পাঠায়। ঊর্মিলার দিক থেকে কোন অসুবিধে থাকার কথা নয়, ডাকে চিঠি দিলেই হল। বিজয়ের চিঠির জন্য কবে কখন পাহাড় থেকে নামবে সেটা নিশ্চয়ই ঊর্মিলাই জানিয়ে দেয়।

বিজয় লিখেছে; ডলির বন্ধু বাপী তরফদার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল—আলাপ হয়েছে আর ভালোই লেগেছে। ঘুরেফিরে ঊর্মিলার উদ্‌গ্রীব জিজ্ঞাসা, বিজয়কে বাপীর কেমন লেগেছে—তার সঙ্গে কথা বলে কি মনে হয়েছে। নাক-মুখ কুঁচকে বাপী প্রথমে জবাব দিয়েছিল, থার্ড ক্লাস।

সঙ্গে সঙ্গে গাঁট্টা উঁচিয়ে ঊর্মিলা চোখ পাকিয়েছে।—এই, খবরদার! তারপরেই আবেগে উন্মুখ। ওর মতো ছেলেকে ভালো না লেগে পারে—খুব ভালো লেগেছে—তাই না?

—তুমি জোর করে বলালে, তাই।

—আঃ, বলো না!

বাপী স্বীকার করেছে ভালো লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ আগ্রহ।—মাকে বলবে তাহলে?

—সর্বনাশ! আমার এ-কূল ওকূল দু-কূল যাবে।

—এখন কে বলতে বলেছে, ও বিলেত থেকে ফিরে এলে মওকা বুঝে বলবে। বেশি আনন্দ হলে ওর হাত দুটো বাপীর মাথার ওপর চড়াও হয়। চুলের ঝুঁটি ধরে মাথাটা সামনে-পিছনে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেছিল, তুমি দলে আছ যখন আমাদের বিয়ে আর কেউ ঠেকাতে পারবে না—এ আমি খুব ভালো করে বুঝে নিয়েছি—বুঝলে বন্ধু? মা-ও না—

বোকা মুখ করে বাপী বলেছিল, আমাদের বিয়ে মানে তোমার আর কার?

জবাবে মাথায় ঠাস করে একটা থাপ্পড়।

পিকনিকে গিয়ে কি করে ওদের প্রথম দেখা হল আর সেয়ানা ছেলে কি করে গুটি গুটি এতটা এগিয়ে এলো মনের আনন্দে গলগল করে মেয়ে সেই গল্পও করেছে।—গোড়ায় গোড়ায় আমি ওকে বিশ্বাস করেছি না কাছে ঘেঁষতে দিতে চেয়েছি! নিজের মাকে কি আমি চিনি না? কিন্তু এমন নাছোড়বান্দা কি বলব— লেগেই থাকল। আর কি সুন্দর চিঠি—কোনো এনজিনিয়ার ছেলে এত ভালো চিঠি লিখতে পারে তুমি ভাবতে পারবে না। অসভ্যের ধাড়ী, কিন্তু চিঠিতে একটা যদি খারাপ কথা থাকত।

বাপীর মনে হয়েছিল দেখতে চাইলে সে-সব চিঠি অনায়াসে এই মেয়ে সামনে ফেলে দিতে পারে। কারণ আরো যা বলেছে তা বোধ হয় এই বেপরোয়া মেয়ের দ্বারাই সম্ভব। গেলবারে বানারহাটে দু’জনের ঝগড়ার কথা। ও ছেলে যেমন গোঁয়ার তেমনি অবুঝ। চুপচাপ বিয়েটা করে রেখে তারপর বিলেত যাবে। তা যে হয় না ওকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। ফলে সত্যি সত্যি ঝগড়া দু’জনের।—কি পাজী আর কত অসভ্য জানো? যদিবা বোঝানো গেল, পাঁচ—পাঁচটা ভালো করে চুমু খাবার আগে কিছুতেই ঠাণ্ডা হবে না।

মুখ লাল করে মেয়ে হেসে গড়াগড়ি।

বাপীর কান গরম। বুকের তলায় মোচড়। ওকে বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে সে নিজের ভিতরে ভিখিরিটাকে চাবুকের মুখে রেখেছে। বেপরোয়া মেয়ের এমন সরল বিশ্বাসের মর্যাদা দেবার জন্য ওর মায়ের মন সত্যি ফেরাতে পারবে কিনা কে জানে। কিন্তু চেষ্টা যে করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ওই পাঁচ দিনের মধ্যে দু’দিন সকালে ভ্যান নিয়ে গায়ত্রী রাই বানারজুলি থেকে ঘুরে এসেছে। কেন বা কি দরকারে যাওয়া কিছুই বলে যায়নি। সকাল আটটায় বেরিয়ে এগারোটার মধ্যে ফিরে এসেছে। স্নেহবশত দিন কয়েক আরামে কাটিয়ে যাবার জন্য মহিলা বাপীকে এখানে বসিয়ে রেখেছে, এ একবারও মনে হয়নি। বাপীর ধারণা তার অনুপস্থিতিতে ওকে এখন চিফ—একজিকিউটিভের মুখোমুখি হতে দিতে চায় না। তার সঙ্গে কথা বলার জন্যেই নিজে দু’দুবার গেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কি কথা হতে পারে বাপী মাথা ঘামিয়ে অনুমান করতে পারেনি।

বিছানা আর ভালো লাগল না। উঠে মুখ হাত ধুয়ে এলো। বাইরে পাহাড়ের দিকটা ধূসর কুয়াশায় ছাওয়া। ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা। পশমের ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে এলো। সামনের দিকটায় কুয়াশার সঙ্গে কাঁচা রোদের বোঝাবুঝি চলেছে। কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। বাপী বাংলো থেকে নেমে এলো। ঘাসের মাথায় আর মেহেদীর পার্টিশনে শিশিরের ফোঁটাগুলো রোদের ছোঁয়া পেয়ে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। শীত পছন্দ নয় বাপীর, কিন্তু আজ অন্তত অদ্ভুত ভালো লাগছে।

গেট খুলে এগলো। পাশের গেটে এসে দাঁড়ালো। এই বাংলো নিঝুম এখনো। ঘুম ভাঙিয়ে ঊর্মিলাকে যদি হিড়হিড় করে টেনে বার করে আনা যেত, বেশ হত। কিন্তু বাপী জানে এই ভালো-লাগা-সকালে যে মুখখানা এক্ষুনি দেখার লোভ সে—মুখ ঊর্মিলার নয়। তার মায়ের। ওর ভিতরে যে আর এক কাঙাল সেঁধিয়ে আছে ক’দিন আগেও জানত না। স্নেহের কাঙাল। বাপীকে আরও সাবধান হতে হবে। মহিলা বুঝে ফেললে কোন মূর্তি ধরবে কে জানে। ভালোর কানাকড়িও ভালো। যেটুকু আপনি আসবে সেটুকুই ভালো।

গেট ছেড়ে বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে গেল। তারপর রাস্তার পাশে এসে জঙ্গল দেখতে লাগল। থেকে থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে জঙ্গলের বাতাস ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের মতো বেরিয়ে আসছে। সামনের গাছগুলোর বিবর্ণ পাতা থেকে টপটপ শিশির পড়ছে। একটা নীলকণ্ঠ-পাখি অদূরের বাবলার ডালে তপস্বীর মতো বসে। একজোড়া ফিঙে সকালের আলোয় হাবুডুবু খেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। বাপী চেয়ে চেয়ে দেখছে। ভালো-লাগার স্বাদটুকু যেন চোখের ভিতর দিয়ে আরো গভীরে ছড়াচ্ছে।

জঙ্গলেই ঢুকে পড়ত হয়তো। অদূরে পিপের শব্দ কানে আসতে ফিরে তাকালো। তারপরই সচকিত। রণজিৎ চালিহার জিপ। নিজেই চালিয়ে আসছে। বাপীকে দেখেছে। কিন্তু লোকটার হঠাৎ অমন হাঁ হয়ে যাওয়ার কারণ কি বাপী চট করে ঠাওর করে উঠতে পারল না। জিপটা সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ধাক্কা লোকটার দু’চোখে লেগে আছে এখনো।

তক্ষুনি বাপীর খেয়াল হল, কি দেখে এত অবাক। গায়ের গরম ড্রেসিং গাউনটা। খুবই চেনা নিশ্চয়। এটা শেষ পর্যন্ত এই গায়ে এসে উঠতে পারে ভাবাও শক্ত বোধ হয়। সামলে নিতে সময় লাগল না তা বলে।

—হ্যালো! গলার স্বরও অন্তরঙ্গ।—জঙ্গলের শোভা দেখছ? আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম আর ঘুম থেকে উঠেছ কিনা ভাবছিলাম।

এ বলে কি! গায়ত্রী রাই এরই মধ্যে এমন কি দাওয়াই দিয়ে গেল যে এই লোকের হাসি-হাসি মুখে এমন কথা!

—কাম অন বয়। দরাজ আহ্বান—তোমার সঙ্গে কথা শেষ করেই আবার আমাকে ছোটাছুটির মধ্যে পড়তে হবে।

চুপচাপ জিপে উঠে বাপী তার পাশে বসল, স্টার্ট দিয়ে রণজিৎ চালিহা ঘাড় ফিরিয়ে আর একবার দেখে নিল ওকে। বিশ-তিরিশ গজ এগিয়ে সামনের দিকে চোখ রেখে হালকা গলায় জিজ্ঞাসা করল, এই পোশাক তোমাকে মিসেস রাই প্রেজেন্ট করেছেন নিশ্চয়?

সকালের ভালো লাগার সুর তাল মান সব একসঙ্গে কেটে গেল। বাপী ছোট্ট জবাব দিল, হ্যাঁ।

—আই অ্যাম সো গ্ল্যাড। ইউ ডিজারভড ইট। ওটা যে পরত সে আমার কত কাছের মানুষ ছিল তুমি জানো না বোধ হয়।

ঘাড় ফিরিয়ে ভালো করে মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করছিল বাপীর। তিন চার মিনিটের মধ্যে জিপ তার গেটের সামনে। তার আগে চালিহা আর সেই সঙ্গে বাপীও আগের বাংলোর দিকে চোখ ফিরিয়েছে, সকাল তখন সাতটা বেজে মিনিট কতক। বারান্দা মুখো দরজাই খোলা হয়নি এখনো।

বাপী আগে, চালিহা পিছনে। বারান্দায় উঠে চেয়ার এগিয়ে দিতে তেমনি সপ্রতিভ অন্তরঙ্গ সুরে চালিহা বলল, দাঁড়াও তোমার কোয়ার্টারস দেখি আগে, এখন পর্যন্ত দেখাই হয়নি।

বাপীর সঙ্গে ভিতরটা দেখে বাইরে এসে বসল—ফর সিঙ্গল ইট্স ফাইন। বোসো—

—একটু চা খাবেন?

—চা খাই না। তোমার খাওয়া হয়েছে?

—পরে হবে। চেয়ারটা একটু টেনে বাপী মুখোমুখি বসল।

রণজিৎ চালিহা এবারে ঘটা করে চেয়ে রইল একটু। চোখে কৌতুক, ঠোঁটে হাসি। মজার কিছু ঘটে যাবার পর রসিয়ে দেখার মতো। বলল, মিসেস রাইয়ের সঙ্গে দু’দিন আমার অনেক কথা হয়েছে, সবটাই তোমার কথা বলতে পারো। তুমি অত্যন্ত হার্ট হয়ে কাজ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছ তাও শুনেছি, বাট নাও উই আর রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ। এরকম যাচাইয়ের কেন দরকার হয়েছিল, হাতেকলমে এবার থেকে যে কাজ তুমি করবে, তাই থেকে নিজেই বুঝে নিতে পারবে।…তাছাড়া বেই-এর সেই আট হাজার টাকা ব্যাঙ্কে তোমার অ্যাকাউন্টেই জমা পড়েছে যখন বুঝতেই পারছ যাচাইয়ের ব্যাপারে ক্রুয়েল হলেও হাউ জেনারাস্ আওয়ার লেডি ক্যান্ বি।

বাপী হতভম্ব। আট হাজার টাকা ব্যাঙ্কে তার নামে জমা পড়েছে! সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক। ও কিছুই জানে না বুঝলে এই লোক আবার অবাক হবে। দেখছে। ফর্সা মুখে মোলায়েম হাসি। ভদ্র, অন্তরঙ্গ। তবু ভিতরের মানুষটাকে বুঝতে বাপীর খুব অসুবিধে হচ্ছে না। সুন্দর আর নরম খাপের ভিতরের তীক্ষ্ণ ছোরা চোখে দেখা না গেলেই বা। অত মদ না খেয়ে আর একটু মাথা খাটাতে পারলেই যে গায়ত্রী রাইয়ের জীবনের খাতা থেকে বাপী তরফদারের নামটা বরাবরকার মতো মুছে দেওয়া যেত—সেই খেদ ভদ্রলোকের হাসিমাখা চোখের তারার ভিতর দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে

—সো? বাপী, নো হার্ড ফিলিং—ফ্রম নাও অন্ উই আর ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইকোয়ালস—আই অ্যাম্ জাস্ট সিনিয়ার–গেট্ মি?

বাপী এবার হেসে মাথা নাড়তে রণজিৎ চালিহা দরাজ হাত বাড়িয়ে ওর হাত ঝাঁকালো। তারপর চটপট কিছু কাজের কথা। আগামী পরশু সে আসাম চলে যাচ্ছে। এবারে মাস তিনেকের আগে হয়তো ফেরা সম্ভব হবে না। এবারকার এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম সব ওদিকে। শিলঙে নতুন ঘাঁটি করার ইচ্ছে আছে। মণিপুরেরও বাজারে ভালো খবর আছে, কিন্তু একলা আর কত দিক সামলানো সম্ভব? এবারে এদিকের সব দায়িত্ব কাঁধে নেবার মতো একজন তাদের সঙ্গে এসে গেছে যখন-চালিহার এবারে সমস্ত আসামের ফিল্ড দেখে শুনে বুঝে আসার ইচ্ছে। তার বিশ্বাস ওটাই একদিন এই ব্যবসায় মেইন সেন্টার হবে। এদিকের কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে মিসেস রাই সবই জানেন। তবু আজ আর কাল বাপী তার সঙ্গে ঘণ্টা দু’তিন করে বসে সব বুঝে নিতে পারে।

হাতঘড়ি দেখল। আটটা বাজে। এবারে ওঠার তাড়া। বাপী জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবেন না?

মুখের দিকে না চেয়ে শব্দ না করে হাসল। যার অর্থ, তোমার অনেক কিছু এখনো জানতে বুঝতে বাকি বাছা। কিন্তু জবাব অমায়িক।—এ দু’দিন আমাকে কম করে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে বসতে হবে তার সঙ্গে—আমার লাঞ্চ আর ডিনারও এ দু’দিন তাঁর সঙ্গেই

বাপীকে সঙ্গে আসার ফুরসৎ না দিয়ে নেমে গিয়ে জিপে উঠল। ওর উদ্দেশে হাতটা নেড়ে দিয়ে জিপ ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল।

বাপী বারান্দায় এসে বসল আবার। পাহাড়ে গিয়ে এক দুপুরে ঊর্মিলার চোখে ধুলো দিয়ে এবারেও বাপী সেই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছিল আর সেই গাছটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল…যেখানে বসে এক ন্যাঙটো সাধু তাকে আগে বাড়তে বলেছিল, আর বলেছিল পেয়ে যাবে। ফের তার দেখা পাবে আশা করেনি। পায়ওনি। তবু গেছল।

…এগিয়েই চলেছে বটে। এমন দুড়দাড় এগনোর ভুইফোঁড় বরাত নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য।

মনে মনে যা আঁচ করেছিল তাই। ড্রাইভার বাদশা এসে খবর দিল, ব্রেকফাস্ট রেডি, মেমসায়েব ডাকছেন। ঘরে এসে বাপী গায়ের গাউনটা খুলে ফেলল। তার এগনোটা বাইরে চট করে বেশি প্রকট না হওয়াই ভালো। একটা সোয়েটারের ওপর আলোয়ান চড়িয়ে নেমে এলো!

তখন পর্যন্ত বারান্দায় গায়ত্রী রাই একাই বসে। নাকে সোনালি ফ্রেমের চশমা এঁটে খবরের কাগজ পড়ছে। পাশে আরো গোটাকতক পুরনো খবরের কাগজ। এ ক’দিন কাগজের সঙ্গে যোগ ছিল না, তাই আট-দশ দিনের কাগজ একসঙ্গে নিয়ে বসেছে। টেবিলে তিনজনের তৈরি ব্রেকফাস্ট কোয়েলা সাজিয়ে দিয়ে গিয়ে থাকবে।

—বোসো। চালিহা এসেছিল? খবরের কাগজে চোখ

এমন একখানা খবর কি-ভাবে পেশ করবে ভাবছিল বাপী। প্রশ্ন শুনেই বোঝা গেল চিফ একজিকিউটিভের সাতসকালে নিজে ড্রাইভ করে আসার পিছনেও মহিলার কেরামতি কিছু আছেই। আসবে যে সেটা তার জানাই ছিল। আরো একটু ব্যতিক্রম বাপীর কান এড়ালো না। এযাবৎ ওর কাছে চিফ একজিকিউটিভের নামের সঙ্গে ‘মিস্টার’ জুড়ে তার মর্যাদা উঁচিয়ে রাখা হত সর্বদা। এই প্রথম তার মুখে শুধু চালিহা শোনা গেল।

—এসেছিলেন।…আপনি তাঁকে আসতে বলেছিলেন?

এখনো খবরের কাগজের ওপরেই চোখ।—আসতে বলিনি। যা বলেছি, বোকা না হলে আসার কথা। বোকা নয় জানোই তো। পাতলা ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস স্পষ্ট হল।—তোমার বেশ সকালে ওঠার অভ্যাস তাও তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। খবর পেয়ে কাল রাত ন’টায় এসেছিল, তখন আর তোমাকে ডাকিনি।

বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল তার দিকে। খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুললে ওই মুখের দিকে চেয়ে এমনি ঠায় বসে থাকতে পারে।…পাহাড়ে বাংলোর বাগানে বেড়াতে বেড়াতে ঊর্মিলা বলেছিল, তার মা বরাবরই গম্ভীর ছিল, কিন্তু ভারী মিষ্টি ছিল। হালকা গাম্ভীর্যের আড়ালের এই মিষ্টি দিকটাই দেখার চেষ্টা বাপীর। লোভও।

খবরের কাগজ সরিয়ে রাখল। টেবিলে কি দেওয়া হয়েছে একবার দেখে নিয়ে নিজের দুধ আর কর্নফ্লেকস-এর বাটি সামনে টেনে নিয়ে বলল, আরম্ভ করো, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

—ডলি কোথায়? খুব সহজে আজ এই নামটাই মুখে এসে গেল, বন্ধুত্বের যে ভিতের ওপর ওরা দাঁড়িয়ে তাতে কোনো দুর্বলতার ফাটল আর যেন ধরতেই পারে না।

—ঠেলে তোলা হয়েছে। মুখহাত ধুয়ে আসছে। এই মেয়ের গরম খাওয়া কপালে নেই, তুমি শুরু করো। আরো শীত চড়লে নটার আগে ঘুম ভাঙবে না দেখবে।

এখানে নয়, পাহাড়ের বাংলোতেও ঊর্মিলা ব্রেকফাস্টের মাঝখানে এসে হাজির হত। তারপর তার সকলের সঙ্গ ধরার তাড়া।

চামচে করে বাটির খাবার নাড়তে নাড়তে নিস্পৃহ মুখে গায়ত্রী রাই আবার জিজ্ঞাসা করল, চালিহা কি বলল?

—বললেন নো হার্ড ফিলিং এখন থেকে—দু’জনেই বন্ধু আমরা—আর সমান সমান, তবে তার মধ্যে উনি সিনিয়র।…আমার অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে আপনি আট হাজার টাকা জমা করে দিয়েছেন?

গায়ত্রী রাইয়ের ঠোটে আবার একটু হাসি ঝুলছিল। টাকার কথা শুনেই পিছন ঘুরে দেখলেন একবার। সস-স!—কিপ ইট, মেয়ের কানে গেলে ঠাট্টা শুরু করে দেবে—এমনিতেই খুব ইয়ারকি দিচ্ছে এখন।

—কিন্তু আমার খারাপ লাগছে খুব—

আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল। বাধা পড়ল।

গুড মর্নিং মা। ঊর্মিলার লম্বা ঘুমের দরুন ফোলা-ফোলা মুখ মুছে আসা সত্ত্বেও ভেজা-ভেজা লাগছে। শুকনো ঝাঁকড়া চুলে মুক্তোর মতো কটা জলের ফোঁটা বসে আছে। গায়ে পা পর্যন্ত ঢাকা গরম হাউস কোট। বাপীর কাছে এসে দু’ হাত কোমরে তুলে দাঁড়ালো।—ঠিক জানি তুমি এসে জুটবে। আসকারা পেয়ে একেবারে মাথায় ওঠার মতলব—কেমন?

নিরীহ মুখে বাপী ফিরে জিজ্ঞেস করল, কার মাথায়?

—কি? আমার মাথার দিকে এগোলে তোমার মাথা আস্ত থাকবে? চেয়ার টেনে নিয়ে একটা টোস্টের আধখানা কামড় দিয়ে ছোট মেয়ের মতোই চিবুতে বসল।

বাপী বলল, মায়ের তো মাথার দিকে এগনো যায় না, পায়ের দিকে ঝুঁকতে হয়।

সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে একটা আঙুল তুলে আর মায়ের দিকে তাকিয়ে জোরালো প্রতিবাদের চেষ্টা। কিন্তু রুটির সঙ্গে মুখে আধখানা ওমলেট গুঁজে দেবার ফলে কথার বদলে গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুলো শুধু। গায়ত্রী রাই ধমকে উঠল, এই মেয়ে—গলায় আটকাবে!

মুখের জিনিস গোগ্রাসে তল করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ফ্ল্যাটারি মা, স্রেফ ফ্ল্যাটারি—এই করেই তোমাকে ঘায়েল করেছে।

—মা অত সহজে ঘায়েল হয় না, তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে চা-টা ঢাল, জুড়িয়েই গেল।

কিন্তু মেয়ের কোনো তাড়া নেই। এই সকালে বাপীকে দাপটে রাখার মেজাজ যেন। আর এক দফা ডিম রুটি তল করে ঝাঁঝালো গলায় বলল।—এই ছেলে, কাল রাতে কোয়েলা তোমার ডিনার নিয়ে গেছল?

—গেছল।

—আজ আর কাল রাতেও যাবে, পরশু থেকে রাতে তুমি এখানে খেতে আসবে। তোমার সকালে আপিস বলে কোয়েলা শুধু রোজ লাঞ্চটা দিয়ে আসবে। কাল রাতেই কোয়েলার ওপর মায়ের এই হুকুম হয়ে গেছে।…আর মনে হয় তোমাকে খরচ টরচও কিছু ধরে দিতে হবে না।

এই গোছের প্রস্তাব আগেও এসেছে। বাপী নাকচ করেছে। শোনার পর এখনো বিব্রত বোধ করছে না এমন নয়। কিন্তু আর আপত্তি করাটা আরো বেশি বেমানান।

গম্ভীর টিপ্পনীর সুরে গায়ত্রী রাই বলল, আর ওর রেঁধে খাওয়া নিয়ে তুই কি বলেছিলি?

—বলবই তো। বাপী রান্নায় বসেছে দেখলে আমার মেয়েছেলের মতো লাগে। তারপরই খিলখিল হাসি। হাসির দমকে টেবিলের ডিশ ওলটানোর দাখিল।—সত্যি মা, সবই হল, একটু কেবল বাকি, বেচারী কোয়েলা…

মেয়ের দিকে চেয়ে অল্প অল্প হাসছে তার মা-ও। কাকে ছেড়ে কাকে দেখবে বাপী। গায়ত্রী রাইয়ের মুখের ওপরেই হঠাৎ দু’ চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। মেয়েকে জব্দ করার মতোই কিছু যেন বলতে পারে, কিন্তু বলছে না। কি কি কি? বাপীর মন অনেক সময় অনেক কিছু তাকে আগাম বলে দেয়। সেই মনের দিকে তাকাবে?

না। এমন প্রশ্রয় দেবে না। তাছাড়া গায়ত্রী রাইয়ের মুখের দিকে বা চোখের দিকে চেয়ে চকিতে যা মনে হয়েছে তা সত্যি হোক মিথ্যে হোক, বাপীর কাছে তার কানাকড়িও দাম নেই। যত সব আজগুবী কল্পনা।

কোয়েলা খাবারের ডিশগুলো নিতে আসতে গায়ত্রী রাই চিরাচরিত গাম্ভীর্যের খোলসে ঢুকে গেল। বাপীকে জিজ্ঞাসা করল, চালিহা আর কি বলল?

জবাব দেবার আগেই ঊর্মিলার আর এক দফা খাবি খাওয়ার দাখিল।—এর মধ্যে আঙ্কল-এর সঙ্গে কখন দেখা হল আবার?

গায়ত্রী রাইয়ের পাতলা ঠোটে হাসির দাগ পড়ল আবার। কোয়েলা চলে যেতে জবাব দিল, আজ ভোরেই বাপীর বাংলোয় এসে ওর সঙ্গে দেখা করে গেছে।

ঊর্মিলা একবার বাপীর দিকে তাকালো, তারপর বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে।—সত্যি মা, তুমি একখানা মেয়ে বটে!

বাপী জানালো, আজ আর কাল এদিকের সব কাজ বুঝিয়ে দেবেন বললেন। আর আসামের এক্সপ্যানশন প্রোগ্রামের আভাস দিলেন…তাঁর ধারণা, কালে দিনে আসামই আমাদের বিজনেসের মেইন সেন্টার হবে।

খুব ধীর ঠাণ্ডা গলায় গায়ত্রী রাই বলল, কালে দিনে আমরা আসামকে সারেন্ডার করব ধরে নিয়ে তুমি এদিকের অর্গানিজেশন কতটা মবিলাইজ করতে পারো দেখো! তাকে মুখে কিছু বলার দরকার নেই। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, মাস তিনেকের আগে সে ফিরছে না, এ সময় পর্যন্ত জিপটা তুমি ব্যবহার করতে পারো। এর মধ্যে ড্রাইভিংটাও শিখে নাও।

গায়ত্রী রাই খবরের কাগজ টেনে নিল। ঊর্মিলার মুখে চাপা আনন্দের ছটা, চোখে চকিত চপল ইশারা। বাপী জিপের দখল পেলে আর ড্রাইভিং শিখলে ওরই যেন মস্ত সুবিধে।

উঠে পড়ল।—মা তুমি তো এখন বেরুচ্ছ না, আপাতত আমি তোমার ভ্যানটা একটু ব্যবহার করছি—একটু ঘুরে আসব, বেশি দেরি করব না।

অনুমতির অপেক্ষা না রেখে ভেতরে চলে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রকের ওপর গরম জামা চাপিয়ে বেরিয়ে এলো। ভালো করে মাথা আঁচড়ানোরও সময় নেই। বাপীর উদ্দেশে একটু হাত নেড়ে দিয়ে মায়ের চোখ এড়িয়ে টক-টক করে নেমে গেল।

ভ্যানটা চোখের আড়াল হতে গায়ত্রী রাইয়ের ঠাণ্ডা দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর।—কোথায় গেল বুঝতে পারছ?

বাপীরই ফ্যাসাদ। ঢোঁক গিলে জবাব দিল, বোধ হয় রেশমার ওখানে…

রাগ না বিরক্তি না, আরো একটু গম্ভীর শুধু।—ও নেই ভালোই হল। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।…মিরিকে বিজয় মেহেরার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে বলেছিলে, তার সম্পর্কে তোমার নিজের কি ধারণা?

বিপাকে পড়লেও বাপী সত্যি জবাবই দিল।—ধারণা ভালই।

—ডলির মুখ চেয়ে কিছু বলার দরকার নেই, তুমি আমার সঙ্গে কথা কইছ এই মুখ সদয় নয় একটুও।—কতটা সময় দেখেছ তাকে যে এক কথায় সার্টিফিকেট দিয়ে দিলে?

আবারও আমতা আমতা করে বাপী জবাব দিল, আমি তো ধারণার কথা বললাম…কথাও অবশ্য বেশ খানিকক্ষণ হয়েছে।

—কি কথা?

—নিজের প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা বলছিল।

—কি প্ল্যান-প্রোগ্রাম, আরো ডিগ্রি পকেটে নিয়ে এলেও আমি চাইলে এই ব্যবসায় ভিড়বে?

—ভিড়বে না বলল।

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি স্থির, তীক্ষ্ণ। এবারে এই জবাবই আশা করেছিল। একটু চুপ করে থেকে আবার জিগ্যেস করল, দেখে কি মনে হল, ড্রিঙ্ক ট্রিঙ্ক বেশি করে?

—সিগারেট একটু বেশি খায় দেখলাম। ড্রিঙ্ক-এর কথা আমিই তুলেছিলাম। মাত্রা ছাড়িয়ে খায় না বলল।

ওই মুখের যে কঠিন রেখাগুলো খুব চেনা বাপীর সেগুলোই দাগ কেটে বসতে লাগল।— গোড়ায় কারো মাত্রা ছাড়ায় না, শেষে কেউ মাত্রার মধ্যে থাকেও না। শোনো, তোমার কথায় আপাতত আমি চুপ করে আছি—ট্রাই টু গেট হার অফ দ্যা হুক এনিহাউ, যে নেশা আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে সে নেশা যে ছোঁবে তাকে আমি আমার মেয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেব না! পাহাড়ে তুমি আমাকে বলেছিলে, সেই ছেলেকে হটানোর রাস্তা বার করা যায় কিনা তার সঙ্গে দেখা করার পিছনে সে চিন্তাও তোমার মাথায় ছিল।…তিন বছরে আপনি যদি সব মিটে যায়, ভালো—নয়তো মাথায় রেখো।

মহিলার মুখখানা আবারও খুব ভালো করে দেখে নেবে বাপী? যা বলল তার পিছনে তার কোনো ইঙ্গিত খুঁজবে?

চিন্তাটা মন থেকে ঝেঁটিয়ে সরালো বাপী।

.

ঘণ্টা দুই কাজ বোঝালো রণজিৎ চালিহা। সবই যে সুড়ঙ্গ পথের কারবার এমন নয়। অনেক রকম মাদক জিনিস লেনদেনের বৈধ পরোয়ানাও আছে। সব বড় পাইকারি খদ্দেরেরই লাইসেন্স আছে। হোলসেল ডিলার হিসাবে তাদের প্রাপ্য মাল সরবরাহের ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। আবার কারচুপির বড় ফাঁকটাও সেইখানেই। প্রাপ্যর দ্বিগুণ নিচ্ছে কেউ, কেউ তিন গুণ, কেউ পাঁচ গুণ। বাড়তি সাপ্লাইয়ের এই বিশাল ব্যাপারটা চলছে মুখের কথায়। কাগজ-কলমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে টাকা গুনে নিলে মাল দেবার পরে রাই অ্যান্ড রাই ডিলারের দায় শেষ। পাইকিরি খদ্দেররা এই বাড়তি মাল কোন পথে কিভাবে পাচার করছে তা নিয়ে রাই অ্যান্ড রাইয়ের মাথাব্যথা নেই। এই বাড়তি মাল বাঁধা দামের কিছু কমে ছেড়ে কড়কড়ে নগদ টাকা গুনে নিয়ে আসতে হবে। নেপাল, সিকিম, ভুটান, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, কুচবিহার আর বিহারের দ্বারভাঙ্গায় সমস্ত রকম মাল চালানের বড় ঘাঁটি। ব্যবসায়ের তারাই আসল পাইকিরি খদ্দের, সব দেনদেন এখন থেকে রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার বাপী তরফদারের মারফৎ হবে সকলের কাছে এই মর্মে অফিসিয়াল চিঠিও চলে গেছে।

সেই সব অফিসিয়াল চিঠির কপি দেখাবার সময় বাপীর মনে হল ক্রূর খেদে রণজিৎ চালিহার দু’ চোখ ছুরির ফলার মতো চিকচিক করছে। আশ্চর্য কিছু নয়। এই বাঁকা পথে যে পরিমাণ টাকা আমদানির আভাস পেল, বাপীরই কান-মাথা গরম হবার দাখিল।

সাড়ে বারোটার একটু আগে রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে গেল। মিসেস রাইয়ের ওখানে লাঞ্চ আর আলোচনা। বাপীও সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পকেটে চেকবই আর পাশবই। মানুষ বশ করার একটাই তুরুপের তাসের ওপর তার বিশ্বাস। চা-বাগান এলাকায় ব্যাঙ্ক। খোঁজ নিয়ে দেখল, কদিন আগে তার সেভিংস অ্যাকাউন্টে আট হাজার টাকা জমা পড়েছে। চেক কেটে নগদ এক হাজার টাকা তুলল তার থেকে।

বিকেলে আপিস-ফেরতা সোজা রব্বানীর ডেরায়। এই কটা দিন বাপীর অপেক্ষায় ওরা বোধ হয় উন্মুখ হয়ে ছিল। আবুর আর তর সয় না।—কি ফয়সলা হল—ভালো কি মন্দ?

দুলারিও শোনার আশায় উদ্‌গ্রীব। বাপী জবাব দিল, আমি তো বলেই গেছলাম, যে ফয়সলা হোক ভালো হবে। পকেট থেকে হাজার টাকার বান্ডিলটা বার করে দুলারির হাতে ধরিয়ে দিল।—এ টাকাটা সাবধানে তুলে রাখো, হাজার টাকা আছে এখানে।

টাকার ধাক্কা দেখার জিনিসই বটে। দু’জনেই ওরা হাঁ। আবুরই প্রথম বিস্ময়ের বাঁধ ভাঙল।—এ কিসের টাকা? কার টাকা?

—তোমাদের আর রেশমার। এর থেকেই বুঝতে পারছ ফয়সলাটা কেমন হল। ফয়সলার পর ম্যানেজারকে জব্দ করার জন্যেই বোধ হয় আমাকে কিছু থোক টাকা দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সকলের ওপর দিয়েই চিন্তা-ভাবনার দুর্ভোগ গেছে, তাই সব আর একলা ভোগ করি কেন, তোমাদেরও কিছু ভাগ দিলাম। এরপর মেজাজ সাফ রেখে আমরা কোমর বেঁধে কাজে না নামলে অন্যায় হবে।…এর থেকে শ’আড়াই টাকা রেশমাকে দিও আর তাকেও এই কথা বোলো। কিন্তু মেমসায়েবের মেয়েকে যেন এসব কিছু না বলে সাবধান করে দিও, সেই মেয়ে তাহলে মওকা বুঝে আবার ওকে নিয়ে কোন্ রাস্তায় হাঁটবে ঠিক নেই— কক্ষনো যেন না বলে। আমি বারণ করেছি জানিয়ে দিও।

আবু হঠাৎ কোমর বেড়িয়ে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে বাপীকে শূন্যে তুলে দু’তিনটে পাক খেয়ে নিল। আনন্দ আর খুশি ধরে না—তোমার দিল বটে একখানা বাপীভাই। বাপীভাই তুমি কি জাদু জানো, আমাকে বলো— শীগগীর বলো।

দুলারির হাসি-উপচনো মুখখানা বেশ সুন্দর দেখছে বাপী।

.

ঘরের কাছে পৌঁছুতে শীতের সন্ধ্যা পার। গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোয় সব আলো জ্বলছে। রাস্তার অন্ধকার দিকটা ঘেঁষে পাশ কাটানোর ফাঁকে বাপী একবার দেখে নিল। গায়ত্রী রাই আর রণজিৎ চালিহা খুশী মেজাজে কথা কইছে। ঊর্মিলা হয়তো ভিতরে।

নিজের বারান্দা আর ঘরের আলো জ্বেলে গায়ের গরম জামাটা খুলে বাপী সোজা কম্বলের নিচে ঢুকে গেল। রাতে রান্নার তাড়া নেই। ওবাড়ি থেকে ডিনার আসবে। পরশু চালিহা চলে যাবে, রাতে তখন ওকেই যেতে হবে।

বাপীর ধারণা এই রাতে শুধু ডিনার নয়, সেই সঙ্গে হয়তো ঊর্মিলাও আসবে। হাসিই পেল। মেয়ে ওকে একজনের কাছে এগিয়ে দেবার মানুষ ভাবছে। আর তার মা ওকে সেই একজনকে দূরে হটাবার মানুষ ভাবছে।

ডিনারের সঙ্গে নয়, বারান্দা আর ঘরের আলো দেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুপদাপ পা ফেলে ঊর্মিলা এসে হাজির।

—মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি কেমন মিষ্টি? কত মিষ্টি?

আচমকা প্রচণ্ড একটা ঘা খেয়েই যেন আস্তে আস্তে উঠে বসল বাপী। ঊর্মিলার মুখে দুষ্টুহাসি ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে।

—কি ব্যাপার?

—কি ব্যাপার? তেড়ে সামনে এগিয়ে এসো ঊর্মিলা।—সেই বাচ্চা বয়েস থেকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ, এখন ধরা পড়ে কি ব্যাপার?

বাতাস টানতেও বুকে লাগছে বাপীর।—তোমাকে কে বলল?

—রেশমা। অনেক দিন আগে আবুর মুখে জঙ্গলসাহেবের মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলেবেলার জমাটি প্রেমের কাণ্ড-মাণ্ড শুনেছিল। আবুটাকে ধরতে পারলে বেশ হত, তার নাকি ধারণা এখনো তুমি সেই মেয়ের প্রেমে মজে আছ। সেটা যে সত্যি আমিও হলপ করে বলতে পারি—নইলে তিনকূলে তোমার কেউ নেই বলো অথচ আমাদের বাংলোয় এসে কাগজে কলকাতার প্লেগের খবর পড়ে মূর্ছা যেতে বসেছিলে কার ভাবনায় মশাই? আমাকে সব বলবে কি বলবে না, জানতে চাই—না বললে মাকে দিয়ে জিগ্যেস করাবো।

আবুর দোষ নেই, ছেলেবেলার গল্প করতেই পারে। তবু মনে মনে বিষম বিরক্ত বাপী।—কি বলব যদি শোনো এ ক’বছরের ফাঁকে সেই মেয়ের কাছে আর কেউ এসে গেছে, আর আমি দূরে সরে গেছি—তাহলে?

বাপীর মুখ দেখে হোক বা কথা শুনে হোক ঊর্মিলা ভেবাচাকা খেল একটু। তারপরেই ঝলসে উঠল।—মরদ হলে সেই ছেলে বা মেয়ের একটাকে তুমি গলা টিপে মারবে!

—তুমি তাই করবে ঠিক করেছ?

থতমতো খেল।—তার মানে?

—মানে ঘরে গিয়ে ভাবোগে যাও। আমি বেজায় ক্লান্ত এখন।

আবার শুয়ে পড়ার ফাঁকে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। বারান্দার আলো জ্বলছে। বেগতিক ঊর্মিলা পায়ে পায়ে প্রস্থান করল।

সঙ্গোপনের ক্ষতটা কেউ সজোরে আঁচড়ে দিয়ে গেল। বুঝে দিক বা না বুঝে দিক, রক্ত ঝরবেই। দিনের শুরু থেকে আজ খুশির পথে পাড়ি জমিয়েছিল বাপী। শেষটুকু এমন হবে ভাবেনি।

সোনার হরিণ নেই – ১৮

জিপ থেকে নেমে বাপী বাংলোটার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিক। বানারজুলি জঙ্গলের বড় সাহেবের বাংলো। বারো বছরের এক ছেলের চোখে যেটা রূপকথার দেশের কোনো নিষেধের বাড়ির মতো।—রূপকথার সব নিষেধই শুধু ভাঙার জন্য। সেই ছেলেও ভেঙেছিল। তারপর দু’বছর ধরে ভেঙেই চলেছিল। তারপর পিঠের চামড়া ফালা ফালা। জিভে রক্তের স্বাদ।

এখন নিষেধ নেই। কোনো বড়সাহেব বা মহারানীর রক্তচক্ষু নেই। তাদের কাপুরুষ ছেলের দামাল শাসন নেই। সবার মধ্যমণি যে, এই পুরীতে সেই মেয়েও নেই।…আষ্টে-পৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরা স্মৃতির তবু লয়-ক্ষয় নেই।

একজন বেয়ারা ছুটে এলো। সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। দেবেই। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। তার ওপর জিপে এসেছে। পরনে দামী গরম প্যান্ট কোট শার্ট, গলায় ঝকঝকে টাই, পায়ে চকচকে শু। ওদের বড় সাহেবের কাছে ছোট কেউ আসেনি।

বেয়ারার হাতে কার্ড দিয়ে বাপী ড্রাইভারকে বলল, ফাইল আর সঙ্গের প্যাকেটটা পৌঁছে দিয়ে আসতে। ফাইলে কিছু প্ল্যান, জঙ্গলের নকসা, আর একটা দরখাস্ত। প্যাকেটে দুটো দামী হুইস্কির বোতল। আবুর কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল তার বড় সাহেবও রসিক মানুষ।

বড় সাহেব মধ্যপ্রদেশের মানুষ। মাঝবয়সী। কার্ড হাতে বেরিয়ে এলো। জিপ, রিজিয়ন্যাল ম্যানেজারের বেশবাস আর চেহারাপত্র দেখে হেলাফেলার লোক ভাবা গেল না। তার ওপর গায়ত্রী রাইয়ের নাম ভালোই জানে, আর রসের দোসর হিসেবে রণজিৎ চালিহাকেও খুব চেনে। উপহারের প্যাকেট দেখে মুখে বিড়ম্বনা। এ-সবের কি দরকার ছিল ইত্যাদি। দশ মিনিটের মধ্যে বাপীর কথা শেষ। সদয় বিবেচনার প্রতিশ্রুতি লাভও। রাই অ্যান্ড রাইয়ের আর্জি সামান্য। এত বড় জঙ্গলের কত জায়গা অকেজো পড়ে আছে। সেখানে কোন্ কোন্ হার্বের চাষ হতে পারে আর কত রকমের প্রয়োজনে সে-সব দরকার ইত্যাদি। ব্যবসা হলেও জনসেবারই কাজ। সুবিধে দরে লীজ পেলে আপাতত কোথায় কতটা পড়ো জংলা জমি নিজেরা সাফ করিয়ে নিয়ে টেস্ট-কেস হিসেবে কাজে নামা যেতে পারে তার ফিরিস্তি। এতে জঙ্গলও কিছুটা পরিচ্ছন্ন হবে।

দরখাস্ত রেখে বড় সাহেব আশ্বাস দিল, যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, ডি-এফ-ও.-র এতে আপত্তি হবে বলে মনে হয় না।

এই লোক তুষ্ট যখন, আপত্তি হবে না জানা কথাই। হুকুম আসার আগেই বাপীর প্ল্যানমতো আবু লোক যোগাড় করে কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেল। তার উৎসাহ এখন দেখার মতো। জঙ্গলের বহু মেহনতী মানুষ তার হাতে মজুত। বড় সাহেবের সায় আছে যখন, বাড়তি কিছু পেলে উপরি কাজ তারা সানন্দে করবে।

জঙ্গলের চার-পাঁচ জায়গায় এমন তড়িঘড়ি কাজ শুরু হয়ে যেতে দেখে গাম্ভীর্যের তলায় গায়ত্রী রাইয়ের পরিতুষ্ট মুখ। কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফ্রেন্ড-এর এমন কাজ নিয়ে ডুবে থাকা তার মেয়ের পছন্দ নয়। ফাঁক পেলেই তাড়া দেয়, মা তোমাকে ড্রাইভিং শিখে নিতে বলেছে, সেটা কবে হবে? না কি ভয় ধরেছে?

জিপ এখন বাপীর জিম্মায়। কিন্তু ড্রাইভার নিয়ে ঊর্মিলার মিরিকে যাবার সাহস নেই। মা সক্কলের থেকে কথা বার করে নিতে ওস্তাদ। বিশ্বাস কেবল ফ্রেন্ডকে।

জিপ হাতে আসার পরদিন থেকেই খুব ভোরে বাদশাকে নিয়ে ড্রাইভিং শেখা শুরু হয়ে গেছে, ঊর্মিলার তা জানার কথা নয়। কারণ ওর দিন শুরু তারও তিন ঘণ্টা বাদে। সকালের আলো পরিষ্কার হবার সঙ্গে সঙ্গে বাদশা জিপ নিয়ে আসে। ঘণ্টা দুই মহড়ার পরে চলে যায়। ফাঁকা রাস্তা, এরই মধ্যে হাত বেশ পাকা হয়েছে বাপীর। শুধু জিপ নয়, এক দিন ভ্যান নিয়েও বেরোয়। বাদশা বলেছে এই ভ্যানের গীয়ার আর মোটর গাড়ির গীয়ারে কোনো তফাৎ নেই। তাই ভ্যানে হাত পাকা হলে মোটরও চালাতে পারবে।

ঊর্মিলার ড্রাইভিং শেখার তাগিদে একটা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল বাপী।— দেখাশোনার ব্যাপার তো দিব্বি চলছে, ড্রাইভিং শেখার পর দলে টেনে মাঝখান থেকে আমাকে ফাঁসাতে চাও কেন?

জলের মাছ খপ করে ডাঙায় তোলা হয়েছে।—তুমি জানলে কি করে?

বাপী স্বীকার করেছে, জানত না, এইবার জানল।

চালাকির ফাঁদে পড়ে ঊর্মিলা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, ডিসেম্বরের এই ছাব্বিশ-সাতাশ দিনের মধ্যে দু’দিন মাত্র দেখা হয়েছে। ওর চিঠি পেয়ে বিজয় এসেছিল। সামনের সপ্তাহে আবার আসার কথা আছে।

রেশমা তার ঘর ছেড়ে দেয়?

—ধেৎ! চিঠিতে আমিই এক-একদিন এক-এক জায়গায় ওকে আসতে বলে দিই।

সামনের মাসের শেষে কত দূরে চলে যাচ্ছে, দু’জনেরই ওদের নাকি ভয়ঙ্কর মন খারাপ।

—তোমার সঙ্গে এখন তাহলে ঝগড়া করছে না?

—না। আর ঝগড়া করে কি করবে।

—ছেলেটা বোকা দেখছি। বাপীর গম্ভীর মন্তব্য।

—কেন?

—ঝগড়া করলে তো ওর বেশি লাভ হয়।

ইঙ্গিত বুঝে মুখ লাল করে ঊর্মিলা তেড়ে এসেছে।

জানুয়ারির গোড়ায় শিলিগুড়িতে ড্রাইভিং টেস্ট দিয়ে লাইসেন্স পকেটে করে বাপী নিজেই জিপ ড্রাইভ করে গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোয় এসে ঢুকেছে। মা মেয়ে অবাক যেমন, খুশিও তেমনি। বাপী ঊর্মিলাকে প্রস্তাব দিল, চলো তোমাকে ঘুরিয়ে আনি একটু। স্বচক্ষে লাইসেন্স দেখেও ঊর্মিলার ভয়। —নিয়ে গিয়ে শেষে মারবে না তো!

খানিক বাদে ডবল আনন্দ।—দিব্বি পাকা হাত হয়ে গেছে দেখি যে—অ্যাঁ?

এরপর রোজই প্রায় মিরিকে নিয়ে যাবার বায়না ওর। এই বিপাকে পড়তে হবে বাপী জানত। কাজের অজুহাতে আজ নয় কাল নয় করে ক’টা দিন কাটিয়ে দিয়েছে। ঊর্মিলা শেষে রেগেই গেল। দু’দিন বাদে কোথায় কত দূরে চলে যাচ্ছে ছেলেটা অথচ ফ্রেন্ডের এতটুকু গা নেই।

শেষে নিয়ে গেল একদিন। মেয়ে তার সঙ্গে বেরুলে গায়ত্রী রাই কিছু বলে না, কোথায় যাচ্ছে তাও খোঁজ করে না। তাইতেই তলায় তলায় বাপীর আরো অস্বস্তি। মহিলার হাবভাব স্পষ্ট, দায় তোমার, তুমি বোঝো। ওদিকে ঊর্মিলার কথাতেই বিজয় মেহেরারও ওর ওপর অগাধ বিশ্বাস, সেও তাকে সত্যিকারের ফ্রেন্ড ভাবে। তার সামনেই ওদের বোঝাপড়া শুনল। মাঝে একদিন বিজয় বানারজুলি আসবে। আর তার কলকাতায় রওনা হবার আগের দিন ঊর্মিলা আবার মিরিকে আসবে বাপীকে নিয়ে। কলকাতা থেকে লন্ডন রওনা হবার আগে এ-যাত্রায় সেটাই শেষ দেখা। বাপীর সায় না দিয়ে উপায় নেই। কথা দিল নিয়ে আসবে।

কথার খেলাপ করল না। বাপীর আপিসের সময়—ঊর্মিলাও খেয়েদেয়ে প্রস্তুত। মাকে জানিয়েছে বাপীর সঙ্গে এক জায়গায় যাচ্ছে, ফিরতে দেরি হতে পারে। গায়ত্রী রাই এবারও কিছু জিগ্যেস করেনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে দু’জনে রওনা হতে দেখেছে।

বাপী ওকে মিরিকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে। আবার কথামতো বিকেলে গিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়ের মুখ শুকনো। চোখ লাল। কান্নাকাটিও করেছে বোধ হয়। বিজয় মেহেরার বিষণ্ণ মুখ। বাপীকেই জিজ্ঞাসা করল, বিলেত থেকে চিঠি পাঠালে কোন্ ঠিকানায় পাঠাবে। বাপীর ভেতরটা সত্যি সদয়। ভেবে-চিন্তে বলেছে, লন্ডনের ঠিকানা দিয়ে প্রথম চিঠি আমার নামে পাঠাও। পিছনে তোমার নাম দেখলে ওকে দিয়ে দেব। তারপর কোন ঠিকানায় লিখবে ঠিক করে ডলিই তোমাকে জানাবে।

সেই সন্ধ্যাতেই গায়ত্রী রাই ওর বাংলোয় এলো। যেমন গম্ভীর তেমনি ঠাণ্ডা।—মিরিকে গেছলে?

সাদা মুখ করে বাপী জবাব দিল, হ্যাঁ।

এতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ওদের সঙ্গে ছিলে?

এবারেও বাপী সত্যি জবাব দিল।—না, ডলিকে ছেড়ে এসে আবার বিকেলে গিয়ে নিয়ে এসেছি।

গলার স্বর ঈষৎ কঠিন। —কাজটা ভালো করলে?

—তা না হলে অশান্তি হত। তিন বছর ধরেই আক্রোশ পুষত।

যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারল না। আবার ঠাণ্ডা।—সেই ছেলে কবে রওনা হচ্ছে?

—কাল ভোরে।

ঠিক আছে। এবার থেকে তোমার চেষ্টা তুমি করো।

চলে গেল। একরাশ অস্বস্তি যেন সঙ্গে সঙ্গে হেঁকে ধরল বাপীকে। যা বলল তার সাদা অর্থ, মেয়ের মন থেকে এবারে আস্তে আস্তে ওই ছেলেকে হটাতে চেষ্টা করো। অস্বস্তি। ভিতরে অনাগত কোনো আশঙ্কার ছায়া।

কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসৎ বাপীর সত্যি নেই। সমস্ত ফেব্রুয়ারি মাসটা জলপাইগুড়ি পশ্চিম দিনাজপুর মালদহ কুচবিহার আর দ্বারভাঙার বড় ঘাঁটিগুলিতে ঘুরেছে। আগে রণজিৎ চালিহা আসাম সফরে বেরুলে গায়ত্রী রাই দু’পাঁচ দিনের জন্য বেরিয়ে কিছুটা ঠেকা কাজ চালিয়ে দিত। কিন্তু নগদ বিনিময়ে কালো মাল অর্থাৎ বাড়তি মাল লেন-দেনের ব্যাপারে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যেত না। চালিহার অনুপস্থিতিতে মাল ঠিক-ঠিকই যেত, লেন-দেনের ফয়সলা সে ফিরে এলে হত। কাজে নামার পর বাপী এই দায়িত্ব হাতছাড়া হবার দরুন রণজিৎ চালিহার খেদের কারণ বুঝেছে। কেউ যদি মাথা খাটিয়ে এই লাভের ওপর বড়সড় থাবা বসাতে চায় এমন মওকা আর হয় না। গায়ত্রী রাইয়ের বিশেষ নির্দেশে সর্বত্র সব থেকে বড় হোটেলে থেকেছে, শাঁসালো মক্কেলদের ডিনার—লাঞ্চে ডেকেছে, মাটিতে পা ফেলেনি, ট্যাক্সি বা মক্কেলের গাড়িতে ঘুরেছে। ফার্মের সুনাম তো বটেই, কিছুটা নিরাপত্তার কারণেও এই চালে থাকার রীতি। যদিও দেশভাগের এই দু’ বছরের মধ্যে কড়াকড়ির রক্তচক্ষু কোথাও তেমন দেখা যেত না।

একটা মাস নানা ঘাঁটিতে ঘুরে দফায় দফায় সর্বসাকুল্যে তেরো হাজার হিসেবের আর চৌত্রিশ হাজার হিসেবের বাইরের টাকা গায়ত্রী রাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। মহিলা মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু বাপী অনায়াসে আঁচ করতে পেরেছে, সুড়ঙ্গপথের টাকার অঙ্কটা এবারে বেশি। এদিকের সফর শেষে সেই চৌত্রিশ হাজার টাকা থেকে গায়ত্রী রাই হিসেব করে পাঁচ হাজার একশ টাকাটা বাপীর হাতে তুলে দিল। এ নাকি তার প্রাপ্য। এ-টাকার পনের পারসেন্ট চালিহা পেত। বাপীও তাই পাচ্ছে। ঠাণ্ডা মুখে সতর্কও করে দিল, বোকার মতো এর সব টাকা আবার এখানকার ব্যাঙ্কে রাখতে যেও না।

ভাগ-বাঁটোয়ারার এদিকটা বাপীর জানা ছিল না। মাথায় হিসেব ঢুকলে তার নিষ্পত্তির দিকে ঝুঁকবেই। সব খরচ-খরচা বাদ দিলে ওই চৌত্রিশ হাজারের অর্ধেক অন্তত ছাঁকা লাভ। সতের হাজার টাকার মধ্যে পাঁচ হাজার একশ এলো বাপীর ভাগে। মহিলার ছাঁকা লাভের ভাগ তাহলে এগারো হাজার ন’শ টাকা? শুধু এই নয়, ব্যবসার আরো কত দিক আছে। এতদিন ধরে মোটামুটি এই হারে টাকা পেয়ে এসে থাকলে তার কত টাকা? ওকে সতর্ক করা হল, কিন্তু নিজে এত টাকা রাখছে কোথায়? দেশের বাইরে অর্থাৎ নেপাল ভুটান বা সিকিমে অবশ্যই তার পক্ষে মোটা টাকা সরিয়ে রাখা সম্ভব। আর এদিকেও হয়তো নানা জায়গার ব্যাঙ্কে টাকা ছড়ানো আছে। তবু আনুমানিক হিসেবের মধ্যে ঢোকার ফলে বাপীর ধারণা, ব্যাঙ্কে ঠাঁই হয়নি এমন বহু টাকাও মহিলার কাছে মজুত আছে।

পরের মাসের সফর ভুটান সিকিম নেপাল। ফাঁক পেলে এসব জায়গায় গায়ত্রী রাই, নিজেই গিয়ে থাকে। কাজকর্মের ব্যাপারে এসব এলাকায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রতিপত্তি বেশি। কাজের সুবিধের জন্য এর প্রতিটি জায়গায় একজন দু’জন করে মেয়ে এজেন্টও আছে। তাছাড়া এসব এলাকায় তেমন বড় ঘাঁটি বলতে কিছু নেই, খুচরো কারবারের টান প্রচুর। ছেলেদের থেকে এ-ব্যাপারে মেয়েরাই বেশি নির্ভরযোগ্য। গায়ত্রী রাই এবারে এলো না। শরীরটা খুব ভালো নেই বলল। বানারজুলির চা-বাগানের ডাক্তারের আনাগোনাও দেখেছে এক—আধবার। ঊর্মিলার মুখে শুনেছে মায়ের মাঝে মাঝে কেমন শ্বাসকষ্ট হয়। তবে ডাক্তার বলেছে বিশেষ কিছু না।

কিন্তু মহিলার প্ল্যান সাফ। যে কারণ দেখিয়ে রণজিৎ চালিহা রেশমাকে আসামে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেই কারণেই ওকে এবারে বাপীর সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। আবার সাপ ধরার সময় এসেছে। অনেক লোক আছে এজন্যে, দু’চার মাস ও না থাকলে সত্যি এমন আর কি অসুবিধে। রোজগার যখন ডবলের বেশি, রেশমাও নতুন কাজে ভিড়তে এক পায়ে তৈরি। বাপী আর রেশমার সঙ্গে সেখানকার এজেন্টদের যোগাযোগের ব্যবস্থা ঝগড়ু করে দেবে। পাহাড়ের বাংলো থেকে তাদের কাছে খুচরো মাল চালান রেশমার মারফৎ ভালো হবে। আর ওসব জায়গা থেকে বাছাই মদ রেশমাই বাংলোয় এনে তুলবে। ঝগডু তাকে শিখিয়ে—পড়িয়ে নেবে। জিপে হোক ভ্যানে হোক দরকার মতো রেশমাই সে-সব বানারজুলিতে নিয়ে আসবে। আবু রব্বানীর মারফৎ সেসব চা-বাগানের ক্লাবে বা অন্যত্র চালান দেওয়া হবে। বাপীর শুধু তদারকের ভার।

রেশমা সঙ্গে চলল দেখে ঊর্মিলার জিভ সুড়সুড় করে উঠেছে। কপট উদ্বেগে মুখ মচকে ছুবলোতে ছাড়েনি।—ওই পাজী মেয়ের তো তোমার ওপর এত ভক্তি এখন যে সুযোগ পেলে জিভে করে পা চাটে—মা যে কি ফ্যাসাদের দিকে ঠেলে দিল তোমাকে কে জানে। ওদিকে দুলারির মতো গম্ভীর মেয়ে পর্যন্ত মুখ টিপে হেসেছে। বলেছে, যাবার আনন্দে রেশমা হাত-পা তুলে নাচছে—আমি অবশ্য সাবধান করে দিয়েছি বেশি নাচানাচি করলে বাপীভাই ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে।

ঠাট্টা ঠাট্টাই। বাপী তবু অস্বস্তিই বোধ করেছে। নিজেকেই সব থেকে কম বিশ্বাস করে, তাই অস্বস্তি। তাছাড়া ঊর্মিলা বাড়িয়ে বলেনি খুব। সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে ভাগ্যের এই মুখ দেখার ফলে ওই সাপ-ধরা মেয়ের চোখে বাপীভাই সত্যিকারের দিলের মানুষ আর অবাক মানুষ এখন। কিন্তু তা বলে জঙ্গলের বেপরোয়া মেয়ের স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা যাবে কোথায়? আর, চালিহার মতো ভদ্রসমাজের দাপটের পুরুষেরও দুর্বলতার খবর রাখে যে মেয়ে, তার বুকের পাটাই বা কম হবে কেন? ভক্তিশ্রদ্ধা করতে পারে কিন্তু শাসনের পরোয়া করা ওর ধাতে নেই।

পাহাড়ে পৌঁছুনোর আগেই শাসন নাকচ শুরু। বাপী জিপ চালাচ্ছে। রেশমা পিছনে। হঠাৎ ডেকে বলল, বাপীভাই, গাড়িটা থামাও তো একটু—

ব্রেক কষে বাপী ঘুরে তাকালো।—কেন?

না বুঝে বাপী জীপ থামাতে চোখে পলকে নেমে সামনের দরজা খুলে পাশে বসল।—চলো। তুমি দিব্বি সব দেখতে দেখতে যাবে আর আমি খুপরির মধ্যে বসে থাকব!

বাপী সত্যি বিরক্ত।—এটা ভালো দেখাবে না, নেমে যাও।

রেশমার অবাক মুখ।—তুমি তো ওই উঁচু পাহাড়ের মতো মাথা-উঁচু মুরুব্বী আমাদেরকে কি ভাববে? তারপরেই চোখের কোণে হাসির ছুরি।—আচ্ছা পাহাড়ের কাছে এসে নেমে যাব’খন, চলো।

পাহাড়ের নিচে পৌঁছে বাপী আবার জীপ থামিয়েছে। মুখে কিছু না বলে তাকিয়েছে শুধু। গোমড়া মুখ করে রেশমা নেমে পিছনে গিয়ে বসেছে। তারপর কথা শুনিয়েছে, আবু সাহেব একবার হিসেব করেছিল বয়সে আমি তোমার থেকে প্রায় দু’ বছরের বড়, বুঝলে? কেউ কিছু ভাববে না হাতি, আসলে এত বড় মুরুব্বী হয়ে তোমার মান বেড়েছে।

নতুন কাজে উৎসাহের অন্ত নেই রেশমার। এ-বেলায় কোনরকম চপলতা ছিটেফোঁটাও নেই। মুখ বুজে উপদেশ শুনেছে, নির্দেশ মেনেছে। কোন্ মাল কোথায় কিভাবে দিয়ে আসতে হবে,আর কোন্ জিনিস ঘরে এনে তুলতে হবে— ঝগড়ু আর মেয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে তাও বুঝে নিতে সময় লাগেনি। পনের দিনের মধ্যে ঝগড়ু বা বাপীকে আর সঙ্গেও যেতে হয়নি। এজেন্টদের কাছ থেকে বাপী টাকার হিসেব আর মালের চাহিদা বুঝে নিয়েই খালাস। ভালো মদের বোতলও রেশমা সংগ্রহ করতে শিখছে।

খুশির পরব ঝড়ুর। দিলদার বাপী-ভাইয়ের কল্যাণে সাহেবসুবোদের ভোগের সেরা মাল পেটে পড়ছে। তাছাড়া ওর চোখে রেশমার মতো মেয়ে হয় না। একদিন একঘণ্টা সাপের বিষ বার করতে দেখেই, খপ করে একটা বিষাক্ত সাপের চুঁটি টিপে ধরে এনে নির্ভয়ে ওর মতো করেই গলগল করে বিষ বার করে এনেছে। সাহস দেখে ঝগড়ু যেমন তাজ্জব, তেমনি খুশি। বার বার বলেছে, তোর কথা আবুর মুখে শুনেছি, কিন্তু এমন ডাকাত মেয়ে তুই ভাবিনি। চাকর-বাকরদের আউট-হাউসে ওকে থাকতে দেয়নি, বাংলোর ভিতরেই একটা স্টোর-রুম খালি করে দিয়েছে। পাশাপাশি ওইরকম আর একটা ঘরে নিজে থাকে। বয়েস সত্তর ছাড়িয়েছে, সঙ্কোচের বালাই নেই। বেশি বয়সে পাওয়া নিজের আদরের ছোট মেয়ের সঙ্গে খুশি-উপচনো সম্পর্কের মতো

বাংলোয় অনেক রকমের লোক আসে। কাজ করে। আউটহাউসে থাকেও কেউ কেউ। এই মেয়ের দিকে চোখ পড়বে জানা কথাই। কিন্তু বাপী নিশ্চিন্ত ঝগড়ুর ভয়ে কেউ কখনো ধারে কাছে ঘেঁষবে না।

কিন্তু অস্বস্তি নিজেকে নিয়েই। অবসর সময় পাহাড়ে জঙ্গলে ঘোরাটা নেশার মতো। রেশমাও তখন সঙ্গ নেবেই। হাসবে, হৈ-চৈ করবে। জঙ্গল ওরও কম প্রিয় নয়। এদিকে বসন্তকাল। বনের সর্বত্র রূপের ঢেউ। অশোক পলাশে রঙের বাহার। শিমুল কৃষ্ণচূড়ার মাথা লালে লাল। বাপী বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। পালিয়ে আসে। নিজেকেই ভয়। মেয়েটা তাও বুঝতে পারে কি না কে জানে। রাতে ঝগড়ুর হাত ধরে বাগানে বেড়ায়। ফুলের গন্ধ আর বাতাসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। পাহাড়ের কোন্ গাছে কোকিলের গলা চড়ে। স্বর নকল করে থেকে থেকে রেশমাও ভেঙচে ওঠে। হাসে খিলখিল করে। বাপী নিঃশব্দে বারান্দা থেকেও সরে আসে।

তিন সপ্তাহ বাদে বাপী একলা ফিরতে পেরে হাঁফ ফেলে বেঁচেছে। ভ্যান পাঠিয়ে মালপত্রসহ রেশমাকে আনানো হয়েছে আরো পনের দিন পরে। প্রথম বারেই কর্ত্রীর চোখে কাজের মেয়ে হয়ে উঠতে পেরেছে এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আছেই। এখানে থাকলে সাপ ধরার কাজ, আর পাহাড়ে গেলে চারগুণ পয়সার কাজ। ভাগ্যের এমন টইটম্বুর দশায় কে না খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু আবুর ডেরায় বাপীভাইকে দেখে ত্রাসের মুখ তার। আবুকে ছেড়ে দুলারির দিকে চেয়ে বলেছে, কর্তা-মানুষ সঙ্গে থাকলে কত মুশকিল জানো না ভাবী—ভয়ে সৰ্ব্বোক্ষণ বুক ঢিপ-টিপ। পাহাড়গুলোকেও ঢের নরম মনে হয়েছে সে-সময়।

আবু মুখ টিপে হেসেছে। আর পলকা ধমকের সুরে দুলারি বলেছে, তুই যেমন পাজী, তোকে ঢিট করতে বাপীভাইই ঠিক লোক।

রেশমা ভালো মুখ করে চোখের কোণে তাকিয়েছে। এই পরিবেশেও অতটা সহজ হওয়া গেল না বলে মনে মনে বাপী নিজের ওপরেই বিরক্ত।

.

রণজিৎ চালিহা ফিরল চার মাস বাদে। দেরি হবে গায়ত্রী রাই বলেছিল। বাপীর অনুমান, এত দেরি হবার পিছনে মহিলার কারসাজি আছে। চিঠি তো হামেশাই লিখেছে। বাড়তি কাজে আটকে রাখা কঠিন কিছু নয়। সে ফেরার পরেও গায়ত্রী রাইয়ের সতর্ক পদক্ষেপ। বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাপীর। শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে চালিহার সামনেই ওকে নিজের বাংলোর আপিস ঘরটা ব্যবহার করতে হুকুম করেছে। কারণ, মিস্টার চালিহার ঘর তো এখন তাকে ছেড়ে দিতেই হবে।

চালিহা ফিরে এলে তার কাজ তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে কিনা বাপী ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু সে আসার পর দেখা গেল দায়িত্বের কাজ ভালোভাবে চালিয়ে যাবার জন্য একলাফে দেড়শ টাকা মাইনে বেড়েছে বাপীর। মালিকের ইচ্ছেয় চিফ একজিকিউটিভকে এখন আরো বড় দায়িত্ব নিতে হবে। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের বাজার দখলে আনতে হবে এবার। বাপী তরফদারের তদারকের আগের তৈরি ঘাঁটিগুলো থেকে যে টাকা আসবে তার থেকে পাঁচ পারসেন্ট কমিশন চালিহাকে দেওয়া হবে। আর মধ্যপ্রদেশ বা বিহারে যে-সব ঘাঁটি হবে তার থেকে পাবে কুড়ি পারসেন্ট। তার আসামের প্রাপ্যও পনের থেকে কুড়ি পারসেন্ট তুলে দিল গায়ত্রী রাই। এক কথায় আরো বড় দায়িত্ব, আরো বেশি স্বীকৃতি। কিন্তু লোকটা নির্বোধ নয় আদৌ। বাপী তরফদার সেভাবে সামনে এগিয়ে আসার আগেই সে সতর্ক হতে চেয়েছিল। বাপী নিঃসংশয়, এখন এই পরিস্থিতি দেখে সে আরো সন্দিগ্ধ, আরো সতর্ক। তার বাইরের আচরণ স্নেহভাজন সতীর্থের মতো। কিন্তু দেখতে জানলে মানুষের চোখের আয়নার ভেতর দেখা যায়। অমায়িক হাসির ফাঁকে ওই দুটো চোখে ক্রূর আক্রোশের ঝিলিক দেখেছে।

এরই মধ্যে দিন দশেকের জন্য আর এক দফা পাহাড়ের বাংলোয় পাঠানো হল রেশমাকে। আগের বারে বাপীর সঙ্গে গিয়ে ও কত ভালো কাজ করেছে, গায়ত্ৰী রাই চালিহার কাছে সেই গল্পও করেছে। খুশিমুখে চালিহা বলেছে, মেয়েটা যে চালাকচতুর খুব এ তো সে-ই সবার আগে বুঝেছিল। কিন্তু এই খুশীর বিপরীত কিছু আঁচ করতে বাপীর অসুবিধে হয়নি। গায়ত্রী রাইয়ের সামনেই তেমনি হাসিমুখে অন্তরঙ্গ ঠাট্টা করেছে। বাপীকে বলেছে, কিন্তু তুমি ইয়ংম্যান একটু সাবধান, সাপ-ধরা মেয়ের জালে পড়ো না যেন। নিজের রসিকতায় নিজেই বেশি হেসেছে।

গায়ত্রী রাই কিছু বলেনি বাপীকে কিন্তু রেশমা ফিরে আসার পর আবু চুপি চুপি তাকে জানিয়েছে, ম্যানেজার এর মধ্যে একদিন পাহাড়ের বাংলোয় গেছল, রাতে ছিলও। মেমসায়েবকে নাকি জানিয়েই গেছে। ভালো মদ চেনানো আর তার ঘাঁটির সন্ধান দেবার ব্যাপারে রণজিৎ চালিহা যে এক্সপার্ট একজন এ কেউ অস্বীকার করবে না। তা ছাড়া এ-সব জিনিস সরবরাহ করার মতো চেনা-জানা লোকও আছে। রেশমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রাতে নিজে মদের বোতল খুলে বসে গল্প করার জন্য রেশমার খোঁজও করেছিল নাকি। তাকে ডাকতে গিয়ে ফিরে এসে ঝগড়ুই খবর দিয়েছে, সমস্ত দিনের পরিশ্রমে মেয়েটা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে কাদা।

এই একজনের সঙ্গে চূড়ান্ত ফয়সলার দিন আসবেই। কিন্তু সেটা কোন্ ভবিষ্যতে হবে বা কেমন করে হবে, বাপী ভেবে পায় না। তার ধারণা, গায়ত্ৰী রাইও এখন পর্যন্ত অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পাচ্ছে না বলেই আপাতত যতটা সম্ভব তাকে দূরে রাখার চেষ্টা।

মহিলা হঠাৎ বেশ অসুস্থই হয়ে পড়ল। একই ব্যাপার। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে অসুবিধে। অসুবিধেটা বেড়ে গেল হঠাৎ। সাদা মুখ বেশি ফ্যাকাশে। কাউকে কিছু না বলে বাপী নিজেই ভ্যান হাঁকিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেল। তিনগুণ ফি কবুল করে সেখানকার সব থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে এলো। তার রায়, হার্টের একটা ভাল ড্যামেজ হয়েছে। তেমন সাংঘাতিক না হলেও ব্যাপারটা ভালো না। বিশ্রামের ওপর থাকতে হবে, কোনো ভারী জিনিস টানা চলবে না। নিঃসংশয় হবার জন্য এক্সরে আর ই. সি. জি. করানো হল। চা-বাগানের হাসপাতালে এসবের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাপী বিছানা ছেড়ে গায়ত্রী রাইকে নড়তে দিল না। চারগুণ খরচ করে বাড়িতে এনে সেসব করানো হল।

এত ঘটা আর টাকার শ্রাদ্ধ দেখে গায়ত্রী রাই রেগেই গেল বাপীর ওপর।— সামান্য ব্যাপারে এত হৈ-চৈ করার দরকার কি? টাকা কি খোলামকুচি নাকি?

মুখের ওপর বাপীর সাদাসাপ্টা জবাব, আপনার কিছু হলে খোলামকুচি। একটু সুস্থ হতে কত খরচ হয়েছে জিগ্যেস করতে বাপী বলেছে, খরচ আবার কি—

—আঃ! বিরক্ত।—তোমার টাকায় আমার চিকিৎসা হবে?

—তাই যদি মনে করেন তাহলে আজ থেকে আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও আমি নিজেই করে নেব, আমি কার জন্যে কি করেছি বললে ডলি এরপর তেলের ঠেস দেবে!

খুশি মুখে ঊর্মিলা বলল, কেমন সেয়ানা দেখো মা, আগে থাকতে আমার মুখ মেরে দিলে।

মহিলার মুখে আবার সেই কমনীয় শ্রী দেখল বাপী যা খুব বেশি দেখা যায় না। চেয়ে রইল খানিক। ওর দিকে। মেয়ের দিকেও। সঙ্গে সঙ্গে বাপীর বুকের তলায় সেই অজানা আশঙ্কার ছায়া।

ঊর্মিলা পড়াশুনা শুরু করেছে বটে, কিন্তু তেমন মন বসেনি। ওর বিলেতের চিঠি এখন চা-বাগানের ক্লাবের ঠিকানায় আসছে। ভেবে-চিন্তে বাপী এর থেকে ভালো ব্যবস্থা কিছু করতে পারেনি। আপিসে ওর ঠিকানায় এলে রণজিৎ চালিহার হাতে পড়তে পারেই। ডাটাবাবু বাপীর হাতের মুঠোর লোক এখন। খামের ওপর লেখা থাকে, ডলি। ডলি কে, ডাটাবাবুর জানার কথা নয়। চিঠির খবর কেউ জানবে না এও সে ডাটাবাবুকে বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে। গোপন থাকবে বলেই বিশ্বাস। কারণ ডাটাবাবু সর্বদা খাস লোকের দাস। খাস লোক যে এখন কে আবু রব্বানী ডাটাবাবুকে সেটা ভালো করেই জানিয়ে দিয়েছে।

সেই দিনই সকালে বাপী ঊর্মিলার হাতে বিজয় মেহেরার চিঠি দিয়েছিল। সন্ধের দিকে আনন্দে ডগমগ মুখে সে হাজির হতে বাপী নির্লিপ্ত মুখে জিগ্যেস করল, খুব সুখবর।

—দারুণ! তুমি শোনোনি?

—কি শুনব? বাপী অবাক একটু।

—বনমায়া পালিয়েছে। রেশমার মুখে শুনেছি একটা বুনো হাতির ডাকে ও ফি বছর একবার করে পালায়—আবার নিজেই ফিরে আসে। তুমি তো সব জানো, বলো না!

বাপী হেসে জবাব দিল, এটা কোনো খবর নয় এখন। সবাই জানে ও পালাবে। ফিরেও আসবে।

ঊর্মিলার তবু বনমায়ার গল্প শোনার লোভ। এমন দুর্বার প্রেমিকা যেন ওর কাছের কেউ। কিন্তু বাপীর ততো আগ্রহ নেই।…একজনকে ঘটা করে বনমায়ার গল্প শোনাতো মনে আছে। আট বছর বাদেও সেই একজন ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বনমায়ার খবর কি?

এর দিন দশেক বাদে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাপী সকালে ভ্যান নিয়ে শিলিগুড়ি চলে এসেছিল। ভ্যান এখন ওর হেপাজতে। আসল কারণ, আগের দিনের কাগজে খবর দেখেছে বি.এ. পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। বানারজুলিতে গেজেট পাবে কোথায়? তাই শিলিগুড়িতে বি.এ.-র ইতিহাসের রেজাল্ট দেখে গেজেটটাকেই আছড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল বাপীর। ফার্স্ট ক্লাস তিনজন পেয়েছে। তার মধ্যে মালবিকা নন্দীর নাম নেই। ও সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। মিষ্টির ওপর আর সেই সঙ্গে আর একজনের ওপরে রাগ বাপীর। সাতাশি নম্বরের উল্টো দিকের বাড়ির সেই সোনার চশমা রাঙামুখো ছেলেটার ওপর। যার নাম অসিতদা। পরীক্ষার এই রেজাল্ট হবে না তো কি, আরো প্রেম করোগে যাও!

পরে অবশ্য অত খারাপ লাগেনি। মেয়ের গুমোর কিছু কমবে।…এরই মধ্যে প্রায় দেড়টা বছর কেটে গেল। ওর সঙ্গে দেখা হবার পরের প্রতিটি খুঁটিনাটি চোখে ভাসছে। যেন সেদিনের কথা।

ফেরার সময় অন্যমনস্ক ছিল। চা-বাগানের এলাকা পেরিয়ে লছমন মাহুতের ডেরার কাছে আসতে বিষম চমকে উঠল। যে গাছের গুঁড়িতে বনমায়া বাঁধা থাকত সেখানে অনেক মেয়েপুরুষের ভিড়। সব গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছে তারা!

বিপদের গন্ধ বাতাসে ছোটে। একটা অশুভ চিন্তা বুকে হাতুড়ির ঘা বসালো। ভ্যান থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলো।

…এত লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে বনমায়াকে দেখছে কেন?

বনমায়া মাটিতে শুয়ে আছে কাত হয়ে। অত বড় শরীরের দু’তিন জায়গায় দগদগে ঘা। দুর্গন্ধ নাকে আসছে। পাহাড়ের মতো শরীরটা নিথর। যত বড় করে সম্ভব চোখ চেয়ে আছে। জল গড়াচ্ছে। মৃত্যু ওর চোখের দিকে এগিয়ে আসছে।

বাপীর বুকের ভেতরটা পাথর হঠাৎ! আবু কাঁদছে। আরো বেশি কাঁদছে লছমন। রেশমারও চোখ ছলছল। ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সক্কলের মুখ বিষাদে কালো।

কি ঘটেছে, সঠিক কেউ জানে না। কিন্তু অনুমান করা আদৌ কঠিন নয়। দলছুট বুনো পাগলা হাতি মারা নিষেধ নয়। কারণ একটা পাগলা মরদ হাতি একটা বিশাল এলাকার সর্বনাশের কারণ হতে পারে। কিন্তু অতি দামী দাঁতের লোভে পাগল না হলেও বুনো মরদ হাতি সময় সময় শয়তানের শিকার হয়ে বসে। দৈবাৎ দল-ছুট এরকম হাতি মারা হয়ে গেলে সেটাই ঢ্যাড়া অনুযায়ী পাগলা ছিল কিনা কে বলবে। তখন পাগল বললেই পাগল। এবারেও বনমায়ার সঙ্গী মরদ হাতিটাকে কেউ কেউ দেখেছে। তার অতিকায় দুটো দাঁত। লোভী শিকারীর ওটাই লক্ষ্য ছিল তাতে কারো সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে এই শিকারের সব থেকে সহজ উপায় দলে তীর-ধনুক-অলা জংলি জুটিয়ে নেওয়া। তীরের ফলায় ‘নিং-দিউদ’ আর গন্-চং নামে গাছের শিকড়ের অমোঘ মারাত্মক বিষ মেশানো থাকে। বিষক্রিয়ার ফলে যত বিশাল দেহ হোক পচন ধরতে সময় লাগে না। তীর-ধনু—অলা লোককে বুনো হাতিরাও যমের মতো ভয় করে। বনমায়ার দেহে তিনটে বিষাক্ত তীরের ক্ষত

মানুষের কাছে ছিল। দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে মানুষের কাছেই নিয়ে এসেছে।

আবুর বদ্ধ ধারণা, লোভী শিকারীর হাত থেকে দাঁতাল মরদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বনমায়ার এই হাল। ও তাকে না আগলালে নিশানার এত বড় ভুল হতে পারে না। পারেই না। বনমায়ার গায়ে আঁচড় পড়ারও কথা নয়।

বাপী আস্তে আস্তে বনমায়ার মুখের সামনে এসে দাঁড়াল। ও চোখ টান করে দেখল। চিনল। জল গড়াচ্ছে। কাত হয়ে শোয়া অবস্থাতেই শুঁড়টা মাটি ঘষটে মাথার কাছে বেঁকিয়ে নিয়ে এলো। সেলাম করল।

বাপী পালিয়ে এলো।

সন্ধ্যার মধ্যে খবর পেল সব শেষ। বনমায়া ছিল। বানারজুলির বাতাসে প্রেম ছিল। বনমায়া নেই। প্রেম শরবিদ্ধ। নিহত। আবু কেঁদেছে। লছমন কেঁদেছে। রেশমা কেঁদেছে। বনমায়াকে যারা জানে তারাই কেঁদেছে। বাপী কাঁদতে পারে না। এও এক অভিশাপ। একটা শুকনো যন্ত্রণা শুধু ভিতরটাকে কুরে খাচ্ছে।

দু’দিন বাদে কলকাতায় একটা টেলিগ্রাম পাঠালো। ওটা পারে মালবিকা নন্দী। মিষ্টি নন্দী লিখেও কেটে মালবিকা নন্দী করেছে। ওতে এক শব্দে পাশে অভিনন্দন। আর, দু’শব্দর একটা খবর।— কনগ্র্যাচুলেশনস। বনমায়া কিল্ড।’

মাঝে একদিন বাদ দিয়ে টেলিগ্রামেই তিন শব্দের জবাব এসেছে। ‘থ্যাঙ্কস। সরি।—মিষ্টি।’

জবাব আশা করেনি। আরো অপ্রত্যাশিত আর কিছু। মালবিকা বাতিল। লিখেছে, মিষ্টি। বাপীর জগতে মালবিকা নামের কোনো অস্তিত্ব নেই জেনেও লিখেছে?

ওর থেকে বাপী কি ভাববে? কি বুঝবে? প্রেম শরবিদ্ধ নয়? নিহত নয়?

সোনার হরিণ নেই – ১৯

বনমায়ার সেই দাঁতাল সঙ্গীকে মারার জন্য সরকারী ট্যাড়া পড়েছে।

প্রথম দিকে কিছুদিন ওই বুনো হাতিটা চা-বাগানের কাছাকাছি জঙ্গল থেকে তারস্বরে ডাকাডাকি করেছে। সন্ধ্যায় বা রাতে ওদিকে ঘেঁষার মতো বুকের পাটা কারো নেই। তারপর লছমন এক চাঁদনি রাতে স্বচক্ষে পাহাড়ের মতো ওই দাঁতাল হাতিটাকে সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। একবারও ডাকেনি বা এতটুকু শব্দ করেনি। বাপীকে বলেছে, ভয়ে ওর হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে গেছল। ওটা নেমে এলে ছনের ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে ওকে পিষে মারতে কতক্ষণ।

কিছুই করেনি। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি চলে গেছে। তার সঙ্গিনী আর এ-জগতে নেই তা ও ভালো করেই বুঝে গেছে। কিন্তু কিছুদিন না যেতে ওটার উপদ্রব শুরু হল। এক-এক রাতে গাছপালা মুড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাক-ঢোল টিন কানেস্তারা নিয়ে দল বেঁধে রাতে পাহারা দিতে হয়। পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যে নানা জায়গায় সাত-সাতটা জঙ্গলের কুলি মজুরকে মেরে দলা পাকিয়ে রেখে গেছে। ওটা গুণ্ডা হয়ে গেছে। মারার পরোয়ানা বার করা ছাড়া আর উপায় নেই। বনবিভাগের তরফ থেকে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। বিষমাখানো ফলার কারবারী নেপালী তীরন্দাজরা ওটার খোঁজে দল বেঁধে জঙ্গল ছুঁড়েছে। কিন্তু এই গুণ্ডা হাতিও এখন তেমনি চতুর। উল্টে ওই তীরন্দাজদের দুজন আচমকা ওর হাতে পড়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে।

শেষে বাইরের দুজন রাইফেলধারী পাকা শিকারী আসরে নামতে ওটা কিছুটা নাকাল হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছে মনে হয়। মনে হয় কারণ, রাইফেলের গুলি ওটার কান বা ঘাড়ের কোথাও লেগে থাকবে বলে শিকারীদের বিশ্বাস। নইলে মুখ থুবড়ে পড়ে ওখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু জঙ্গল কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ওটা পালিয়েছে। পরের ছ’মাসের মধ্যে জঙ্গলের এই এলাকায় আর তাকে দেখা যায়নি। অমন পাহাড়ের মতো দেহ নিয়ে কোথাও মরে পড়ে থাকলেও টের পাওয়া যেত। জঙ্গলের লোকেরাই নিঃশব্দে খোঁজাখুঁজি করেছে। ওটার দাঁতের প্রতি অনেকেরই লোভ। কোথাও মরে পড়ে থাকলে আর সকলের অগোচরে দাঁত দুটোর মালিক হয়ে বসতে পারলে এক ধাক্কায় বড়লোক। বাপী শুনেছে, ওই বুনো গুণ্ডার বিশাল দাঁত দুটো ধনুকের মতো বেঁকে শূন্যে ঠেলে ওপরের দিকে উঠেছে।

পাগল হয়ে গেছে যখন একদিন ওটা কারো হাতে মরবে জানা কথা। গুলির ক্ষত বিষিয়ে আপনিও মরতে পারে। বন্দুক ছুঁড়তে জানলে আর ওটা সামনে পড়লে বাপী নিজেও মারার চেষ্টাই করত। কিন্তু ভিতর থেকে হিংস্র হয়ে উঠতে পারত কি? উল্টে ছেলেমানুষের মতোই কাল্পনিক শত্রুনিকাশের আক্রোশ তার। বনমায়ার হাল যদি কোনো এক মেয়ের হত, ও নিজে কি করত? এমন কি কিছু না হলেও শুধু যদি সভ্য দুনিয়ার বিধি-নিষেধের অস্তিত্ব না থাকত? তাহলেও কি কলকাতার এক সোনালি-চশমা-রাঙা-মুখ এত দিনে যমের দরজা দেখত না?

আরো একটা বছর ঘুরে গেল। বাপী তরফদার সুখে নেই এ তার কোনো শত্রুও বলবে না। মর্যাদা বেড়েছে, প্রতিপত্তি বেড়েছে। মাইনে বা বাড়ি ভাড়ার টাকা এক পয়সাও খরচ হয় না। সব সোজা ব্যাঙ্কে চলে যায়। অলিখিত কমিশন হিসেবে গড়ে তার দ্বিগুণের বেশি কাঁচা টাকা হাতে আসে। তাই সামাল দিতে ভাবতে হয়। খাওয়া খরচ নেই, জলখাবারের খরচ পর্যন্ত না। শুধু লাঞ্চ ডিনার নয়, সকালে-বিকেলের জলখাবারের সময়ও এখন পাশের বাংলোয় ডাক পড়ে। আপিস তো ওখানেই, তাই সাতসকালে নাকে-মুখে গুঁজে ছোটার দরকার হয় না। দু-বেলাই গায়ত্রী রাই আর তার মেয়ের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতে হয়। তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও মহিলার নজর আছে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, যে-মুখ করে খাও, কি পছন্দ আর কি অপছন্দ কিছুই বোঝা যায় না।

বাইরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। বিরক্ত হলে আগের মতোই কথা শোনায় বা ধমকে ওঠে মহিলা। তবু বাপী স্নেহের স্বাদ পায়। ওর প্রতি মনোযোগ বাড়ছে, নির্ভরতা বাড়ছে। পরোক্ষ প্রশ্রয়ও। বাপীর সঙ্গে ঊর্মিলার কথায় কথায় ঝগড়া। ঝগড়া অবশ্য এক-তরফা ঊর্মিলাই করে থাকে। দোষ বলতে গেলে বাপীরই। ফাঁক পেলেই সাদা মুখ করে এমন কিছু মন্তব্য করবে বা ফোড়ন কাটবে যে ও—মেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেই। যা মুখে আসে তাই বলে তখন। গায়ত্রী রাই দেখে। শোনে। বিরক্ত হয়ে কখনো বা মেয়েকেই শাসন করে।—সর্বদা তুই ওর সঙ্গে এমন লাগবি কেন—আর যা-তা বলবি কেন?

বেশি রাগিয়ে দিতে পারলে মেয়ে মায়ের ওপর চড়াও হয়।—আমি ওর সঙ্গে লাগি—আমি যা-তা বলি? ও কত বড় বজ্জাত জানো?

বাপীর এমন মুখ যে মালিক না বাঁচালে এই মেয়ের অত্যাচারে তার বাঁচা দায়।

গায়ত্রী রাই কখনো ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। কখনো বা ঠোঁটের ফাঁকে চুলচেরা হাসির রেখা মিলিয়ে যায়। ঊর্মিলা জানে না, কিন্তু বাপী তাইতেই আরো বিপন্ন বোধ করে। মহিলা বলতে গেলে গোড়া থেকেই সদয় তার ওপর। অনেক ভাবে ওকে যাচাই করেছে, কিন্তু উত্তীর্ণ হোক সেটা নিজেও মনেপ্রাণে চেয়েছে। এই চাওয়াটা ভিন্ন স্বার্থের কারণে। তখন শুধু চালিহা লক্ষ্য। তেমন নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত কাউকে পেলে তাকে দূরে সরানোর সংকল্প। সেই লক্ষ্য আর সংকল্পের দিকে বাপীই তাকে এগিয়ে দিয়েছে। তার পুরস্কারও পাচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো কিছু পাচ্ছে যার ফলে আনন্দের থেকে ভয় বেশি। ভিতরে সেই অনাগত আশঙ্কার ছায়াটা ইদানীং আরো বেশি দুলছে। মহিলার স্নেহ শুধু কাম্য নয়, দুর্লভ ভাবে বাপী। এর সঙ্গে ওর ভিতরের একটা উপোসী আবেগের যোগ। কিন্তু এত স্নেহ আর প্রশ্রয়ের আড়ালে মহিলার প্রত্যাশাটুকু বাপীর কাছে দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভয় আর দুশ্চিন্তা সেই কারণে।

…মেয়ে ওর সঙ্গে যেখানে বা যত দূরে খুশি বেড়াতে গেলে গায়ত্রী রাইয়ের আপত্তি নেই। দুপুরে ব্যবসার কাজকর্ম একটু-আধটু বোঝার জন্য মেয়েকে বাংলোর আপিস ঘরে গিয়ে বসতে বলে। কিন্তু বাপীর বিশ্বাস মেয়ে এলে স্রেফ আড্ডা দেয় আর কাজ-কর্ম পণ্ড হয় জেনেও এই তাগিদ দেয়। বিশেষ কাজে কিছুদিন আগে একবেলার জন্য পাহাড়ে আসার দরকার হয়েছিল। গায়ত্রী রাই মেয়েকে হুকুম করেছে, তুইও যা, ঘরে বসে থেকে কি হবে, যেটুকু পারিস শিখেটিকে নে।

ঊর্মিলা তক্ষুনি রাজি। শিখতে দায় পড়েছে তার। বাপীর সঙ্গে বেড়ানোটুকুই লাভ। বাপীই বরং প্রস্তাব নাকচ করেছে। বলেছে, শেখার সময় ঢের পাওয়া যাবে, আপনাকে একলা রেখে দুজনের বেরুনো চলবে না।

মা সরে যেতে ঊর্মিলা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, না গেলাম তো বয়েই গেল, কিন্তু শেখার সময় ঢের পাওয়া যাবে বলার মানে কি? কাজ শেখার জন্য এখানে তোমার কাছে বসে থাকব?

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গায়ত্রী রাই তার সময়মতো শুতে চলে যায়। মেয়ের আবার সেটাই ভালো আড্ডার সময়। প্রায়ই বাপীকে ধরে রাখে। যে-দিন বিলেতের চিঠি আসে সেদিন তো ওকে সমস্ত সমাচার জানানোর জন্য এই নিরিবিলির প্রতীক্ষায় ছট্‌ফট করে। কিন্তু এরকম আড্ডা দেওয়াটাও গায়ত্রী রাইয়ের চোখে দৃষ্টিকটু ঠেকে না।

সম্প্রতি বাপীর একটা মোটর গাড়ি হয়েছে। গাড়ির তখন কি-বা দাম। চা—বাগানের সায়েবসুবোরা চলে যাবার সময় ভালো গাড়িও জলের দামে বেচে দিয়ে যায়। বাপী ডাটাবাবুকে বলে রাখতে সে-ই একটা ভালো গাড়ির সন্ধান দিয়েছিল। কিন্তু গায়ত্রী রাই বাপীকে এখানকার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাদা টাকা দিয়ে কিনতে দেয়নি। আর হিসেবের বাইরের উত্তর বাংলার দূর-দূরের ব্যাঙ্কে যে টাকা জমা আছে—তার থেকে তুলে গাড়ি কিনলে ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও আরো সতের রকমের জবাবদিহির ফ্যাসাদে পড়তে হবে। গায়ত্রী রাইয়ের হুকুমে সেই গাড়ি ফার্মের নামে কেনা হয়েছে। ফলে খরচ সব কোম্পানীর ট্যাক্সের খাতায় উঠছে গাড়ি বাপীর খাস দখলে।

মায়ের বদান্যতায় ঊর্মিলা অখুশি নয়। তবু বাপীকে ঠেস দিতে ছাড়েনি।— মা যে দেখি তোমার বেলায় মিসেস দাতাকর্ণ হয়ে বসল একেবারে, যা চাও তাই মঞ্জুর। চাইলে শেষে আমাকে সুদ্ধু না দিয়ে দেয়—

বলতে বলতে খিলখিল হাসি।

বাপী সন্তর্পণে প্রসঙ্গ এড়িয়েছে। বিজয় মেহেরা বিলেত থেকে ফেরার আগে মহিলা না চাইতেই দেবার জন্য ঝুঁকবে কিনা সেই আশঙ্কা বুকে চেপে বসেছে বাপীর। ঊর্মিলা মেয়েটা বোকা নয়। নিজেকে নিয়ে, বিভোর, তাই কোনরকম সন্দেহের আঁচড় পড়ছে না। উল্টে বাপী দলে আছে বলেই নিজের ব্যাপারে বাড়তি জোর পাচ্ছে। ও ধরে নিয়েছে, সততার সবগুলো সিঁড়ি টপকানো শুধু নয়, মায়ের সব থেকে ব্যথার জায়গাটি ছুঁয়ে যেতে পেরেছে বলেই এই ছেলের এখন এত খাতির কদর, তার প্রতি এত স্নেহ। তাছাড়া মায়ের অসুখটার জন্য বাপী যা করল তাও এই মেয়ে আর কোনদিন কাউকে করতে দেখেনি। একথা ঊর্মিলা নিজেই বাপীকে বলেছিল। ওর নিজের তো আগে ধারণা হয়েছিল মায়ের অসুখ—টসুখ সব বাজে। পরে এই জন্যেও মনে মনে লজ্জা পেয়েছে।

বাপীর এত সুখের তলায় কোন্ দুশ্চিন্তা থিতিয়ে আছে ঊর্মিলাকে তার আভাস দেওয়াও সম্ভব নয়। জানালে এই মেয়ে অবুঝের মতো ক্ষেপে যাবে। মা মেয়ের মধ্যে আবার একটা বড় রকমের অশান্তি ঘনাবে। শুধু মানসিক নয়, মহিলার তাতে স্বাস্থ্যেরও ক্ষতির সম্ভাবনা। তাছাড়া ঊর্মিলাকে বলবেই বা কি, ওর মা তো এখন পর্যন্ত সরাসরি প্রস্তাব কিছু দেয়নি। যেটুকু বোঝার বাপী আভাসে বুঝেছে, আচরণে বুঝেছে।

বাঁচোয়া শুধু এই মেয়ে শেষ পর্যন্ত যদি তার সংকল্প আঁকড়ে ধরে থাকে। যেরকম অবস্থা আর মতিগতি দেখছে, মনে হয় থাকবে। এক বছরেরও ওপরে দেরি, এখন থেকেই বিজয় মেহেরার ফেরার দিন গুনছে। প্রাণের দায়ে ইদানীং বাপী ঊর্মিলার কাছে ওই ছেলের গুণকীর্তন শুরু করেছে। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব আছে, পুরুষের গোঁ আছে, বড় হবার মতো ইচ্ছের জোর তো আছেই, গুণও আছে।

ঊর্মিলার কানে মধু। এক-এক সময় তাগিদ দেয়, মায়ের কাছে ওর সম্পর্কে তুমি একটু একটু বলতে শুরু করো না।

বাপীর তখন পিছু হটার পালা।—এখন বললে মাঝখান থেকে উত্তেজনা বাড়বে, শরীর খারাপ হবে। সময়ে তোমার জোরটাই আসল, এখন বলে কিছু লাভ হবে না।

সেদিন ঊর্মিলা এসে একটা জবর খবর দিল। বিকেলে চা-বাগান কোয়ার্টার্স—এর দিকে বেড়াতে গেছল। আংকল চালিহার সঙ্গে দেখা। ডাটাবাবুর ক্লাবে নিয়ে গিয়ে জোরজার করে অনেক কিছু খাওয়ালো। সেই ফাঁকে বিজয় মেহেরার দারুণ প্রশংসা। আংকল নিজের একটা মস্ত ভুল শুধরোবার সুযোগের অপেক্ষায় আছে বলল। মিরিকের চা-বাগানের ওপরওলার সঙ্গে দেখা করে বিজয় মেহেরার সম্পর্কে খোঁজখবরও নিয়েছে। কারণ ডলি নিজের মেয়ে বললেই হয়, তার তো একটা দায়িত্ব আছে। তা সেই ওপরওয়ালা মেহেরার খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে, যেমন সৎ তেমনি পরিশ্রমী। আর ভালো স্কলার তো বটেই। ছেলেটা যে খুব উন্নতি করবে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। বিজয় লন্ডনে এখন কোথায় আছে, কি রকম আছে, কবে পর্যন্ত ফেরার সম্ভাবনা, চিঠিপত্র লেখে কিনা, সহৃদয় আপনার জনের মতো আংকল এসব খোঁজও নিয়েছে। চিঠির প্রসঙ্গে ঊর্মিলা চুপ করে ছিল। অন্য সব কথার জবাব ঠিক ঠিক দিয়েছে। তারও ধারণা, বিজয়কে মায়ের কাছে অমন ছোট করে ফেলে আংকল এখন পস্তাচ্ছে।

কিন্তু পস্তাবার কারণটা বাপীর থেকে ভালো বোধ হয় আর কেউ আঁচ করতে পারবে না। বাপীর সঙ্গেও রণজিৎ চালিহার ব্যবহার এখন আরোও আপনার জনের মতো। মাঝে মাঝে ওকে ডিনারেও ডাকে। গেলাসে চুমুক দিয়ে অন্তরঙ্গ খোশমেজাজে জিজ্ঞাসা করে, কতকাল আর ব্যাচিলার থাকবে হে, দেখেশুনে ঝুলে পড়ো কোথাও। নয় তো বলো আমিই ঘটকালিতে লেগে যাই। তারপর গলা খাটো করে জিগ্যেস করেছিল, কাউকে মনে-টনে ধরেনি তো?

নিরীহ মুখে শুধু হেসেই বাপী এসব কথার জবাব এড়াতে পারে। ঊর্মিলার সঙ্গে সহজ মেলামেশাটাই খুব সম্ভব ভদ্রলোকের বেশি দুশ্চিন্তার কারণ। আর গায়ত্রী রাই যেভাবে এখন ওকে আগলে রাখে, সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেখে, টাকা-পয়সা দেয়—তাই দেখেও এই অতি-চতুর লোকের সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। মেয়ের বিয়ের পাত্রর জন্য দু-দুটো বড় কাগজে অত ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়েও মহিলা একটা বছরের মধ্যে সে-সম্পর্কে একেবারে চুপ মেরে গেল দেখেও এই লোকের সন্দিগ্ধ হবার কথা।

অনুমান মিথ্যে নয় দিন কতকের মধ্যেই বোঝা গেল। রণজিৎ চালিহা মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলতে দেখুক। কিন্তু মুশকিল হল, সেই একই খাঁড়া যে বাপীর দিকে উঁচিয়ে আছে! মেয়েকে নিয়ে আজকাল বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে ভ্যানে চেপে হাওয়া খেতে বেরোয় গায়ত্রী রাই। ব্যবস্থা বাপীরই। তাকে না পেয়ে রণজিৎ চালিহা সেদিন বাপীর বাংলোয় হাজির।

ব্যবসার আলোচনার ফাঁকেই তার মনের সংকট আঁচ করা গেল। মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় ঘুরে এসেছে এর মধ্যে। ভালো ব্যবসাই হবে আশা করা যায়। কিন্তু চালিহা খোঁজখবর নিয়ে দেখেছে পশ্চিম বাংলার কলকাতার মতো এমন বাজার আর হয় না। শুধু শুকনো হার্বের চাহিদাই সেখানে বছরে পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ টাকার মতো। আর নেশার জিনিসও ওখানেই সব থেকে বেশি চলতে পারে। চালিহার মতে এত বড় মার্কেট আর হাতছাড়া করে রাখার কোনো মানে হয় না। ওয়েস্ট বেঙ্গল রিজিয়নের জন্যেই বাপীকে প্রথমে নেওয়া হয়েছিল, এখন তার সেখানেই চলে যাওয়া উচিত। সেখানে একটা গোডাউন ঠিক করে এখান থেকে মাল চালানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তারপর দেখে-শুনে ঘাঁটি ঠিক করে অন্য পাঁচ রকমের মাল পাঠানো যেতে পারে।

প্রস্তাবের শুরুতেই বাপী তার মনের কথা বুঝে নিয়েছে। সাদাসিধে জবাব দিল। মিসেস রাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করুন, আমার আর অসুবিধে কি।

—বলেছিলাম। চালিহার মুখে চাপা বিরক্তি।—এই অসুখটার জন্যেই ভদ্রমহিলা মনের দিক থেকে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন মনে হয়। অত বড় একটা মার্কেট হাতছাড়া হওয়া উচিত নয় বলে যদি মনে করো তাহলে তুমিই জোর দিয়ে তাঁকে বলো। এদিকের জন্যে তো কিছু আটকে থাকবে না, মধ্যপ্রদেশের ফিল্ড হাতে নিয়েও এদিকটা আমি দেখাশুনা করতে পারব।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বাপী জিজ্ঞাসা করল, মিসেস রাই কি বলেন?

—কি বলেন তাই তো আমার মাথায় ভালো করে ঢুকছে না। তোমাকে নাকি এখন তাঁর খুব কাছে রাখা দরকার। ব্যবসায় ইন্টারেস্ট ছেড়েও তোমাকে খুব কাছে রাখা দরকার তাঁর…ব্যাপার কি বলো তো?

ব্যাপার কি তা যে এই লোক গায়ত্রী রাইয়ের ও-কথার পরে খুব ভালো করে টের পেয়ে গেছে বাপীর তাতে একটুও সন্দেহ নেই। মনে হল, অন্তরঙ্গ খোলসের আড়ালে একটা হিংস্র জানোয়ার ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওৎ পেতে আছে। চোখের গভীরেও একটা ধারালো ছুরি লুকনো আছে।

বাপী ভাবনায় তলিয়ে যাবার মতো করে জবাব দিল, অসুখটার জন্যেই হয়তো মন দুর্বল হয়ে আছে।

একটু আগে নিজেই এই কথা বলেছিল চালিহা। মুখে হঠাৎ আবার হাসির খোলস চড়ালো। বলল, তোমারও তো মন খুব সবল দেখছি না. যাক, আমার যা বলার ব্যবসার স্বার্থেই বললাম, যদি ভালো বোঝো তো মিসেস রাইয়ের সঙ্গে আলোচনা কোরো—আর কাছে থাকাটাই যদি বেশি দরকার ভাবো তা হলে আর কথা কি!

সে চলে যাবার পরেও বাপী স্থাণুর মতো বসে অনেকক্ষণ। সকলকে ছেড়ে গায়ত্রী রাই আগে এই লোকের কাছেই মনের ইচ্ছেটা প্রকারান্তরে ব্যক্ত করে ফেলল কেন মাথায় আসছে না। অসুখের জন্য বাপীর যেটুকু উদ্বেগ, মহিলার নিজের তার ছিটেফোঁটাও নেই। তার চরিত্রের এই ধাত বাপীর থেকে রণজিৎ চালিহা কম জানে না। অতএব ওকে কাছে রাখার একটাই অর্থ চালিহা বুঝেছে। আর, গায়ত্রী রাইও তাকে তা-ই বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কেন? দূরে যাকে সরাতে চায় চালিহা, ভবিষ্যতে সে কত কাছের কোন জায়গা জুড়ে বসতে পারে সেটা বলে তাকে একটু সতর্ক করে দেবার জন্যে? বুঝিয়ে দেবার জন্যে যে আর তোমার ওই ছেলের পিছনে লেগে লাভ নেই—বরং নিজে তুমি সমঝে চলো?

কিন্তু বাপী কি করবে এরপর? মহিলার সংকল্প যে ভাবে দানা বেঁধে উঠছে, ও কোন্ পথ ধরে আত্মরক্ষা করবে?

জঙ্গলের কাজ যেমন বাড়ছে, আবুর দায়িত্ব বাড়ছে তেমনি। কোথায় কোন্ চাষের বেড হচ্ছে বা হবে বাপীর কাছে তার প্ল্যান ছকা। দায়-দায়িত্ব আবুর। তার হুকুমমতো তিরিশজন লোক সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। এই গতর-খাটা লোকদের হিসেব মেটাবার জন্য আর পরামর্শ নেবার জন্য একদিন অন্তর আবুকে বাপীর কাছে আসতে হয়। হিসেব বুঝে পরচা লিখে সই করে দিলে অ্যাকাউনটেন্ট টাকা দিয়ে দেয়। মেমসায়েবের বাংলোর আপিসের দিকে ঘেঁষে না আবু। সন্ধ্যার দিকে বাপীর বাংলোয় আসে।

পর পর চার দিনের মধ্যে আবুর দেখা নেই। লোক মারফৎ অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে হিসেব পাঠিয়েছে—সে এসে বাপীর কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে গেছে। অ্যাকাউন্টেন্ট জানিয়েছে, রব্বানীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

বিকেলের দিকে বাপী সেদিন ওকে দেখার জন্যেই বেরিয়ে পড়ল। এদিক ওদিক পক্স-টক্স লেগেছে খবর পেয়েছে। শুধু-মুদু ঘরে বসে থাকার লোক নয় আবু রব্বানী।

দাওয়ার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মুখখানা বাংলার পাঁচের মতো হাঁড়ি করে হারমা বেরিয়ে আসছে। বাপীকে দেখল। অভ্যাসবশত একটা হাত কপালে উঠল বটে, কিন্তু মুখ তেমনি অপ্রসন্ন। গম্ভীর তো বরাবরই। একটি কথাও না বলে পাশ কাটিয়ে গেল।

ওর অসন্তোষের কারণ আঁচ করতে পারে বাপী। সাপ ধরার মৌসুম এটা। এর মধ্যে তিন দিন আগে রেশমাকে আবার পাহাড়ের বাংলোয় পাঠানো হয়েছে। এবারে গায়ত্রী রাইকে বলেই তাকে পাঠিয়েছে রণজিৎ চালিহা। বানারজুলি বা আশপাশের এলাকার মদ চালানোর ব্যাপারটা এখন বাপীর হাতে বটে। কিন্তু অন্যত্র চালিহার পার্টিও কম নয়। একটা বড় চালানের ব্যবস্থা করে মাল সংগ্রহের জন্য রেশমাকে আগে থাকতে সেখানে পাঠানো হয়েছে। বাপীর ধারণা দু-চার দিনের মধ্যে রণজিৎ চালিহাও পাহাড়ে যাবে। অবশ্য যাওয়াই স্বাভাবিক। হাজার টাকার মাল আসবে হয়তো, সে টাকা তো আর রেশমার হাতে দিয়ে দেওয়া যায় না। আগে গিয়ে সে শুধু সংগ্রহের ব্যবস্থা পাকা করে রাখবে।

চেষ্টা করেও ব্যাপারটা খুব সাদা চোখে দেখেনি বাপী। কিন্তু কর্ত্রীর সায় থাকলে সে আর বাধা দেয় কি করে। রেশমাকে আসামে চালান করতে চাওয়ার পিছনে চালিহার নিজস্ব মতলব কিছু আছে একথা তো গায়ত্রী রাইকে খোলাখুলিই বলে দিয়েছিল বাপী। হয়তো বা ভেবেছে, ঝগড়ু আছে সেখানে, মেয়েটা ঠিক থাকলে তার ওপর হামলার কোনো ভয় নেই। আবার এমনও হতে পারে ওই তুখোড় বুদ্ধিমতী মহিলার কাছে এও একটা টোপের মতো। আর সেই কারণেই প্রস্তাব আসামাত্র সায় দিয়েছে। হামলা যদি কিছু হয়ই, আর মেয়েটা যদি রুখে দাঁড়ায় বা ফুঁসে ওঠে, রণজিৎ চালিহার তাহলে মুখ পুড়বে। জঙ্গলের এইসব মেয়ে, বিশেষ করে রেশমা যে সহজ মেয়ে নয় গায়ত্রী রাই সেটা ভালই জানে। বড়দরের গণ্ডগোল কিছু পাকিয়ে উঠলে চালিহার সঙ্গে মহিলার কিছু ফয়সলার সুযোগ হয়তো আপনি এগিয়ে আসবে।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে বাপীর চাপা অস্বস্তি রেশমাকে নিয়েই। তার হাবভাব চাল-চলনের বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। জঙ্গলের কাজ তদারকে বেরুলে ওর সঙ্গে দেখা হয়। আবার বাংলোর দিকের রাস্তায় যখন ঊর্মিলার সঙ্গে বেড়ায়, তখনো দেখা হয়। রেশমা চোখের কোণে তাকায়, ঠোঁটে হাসি টিপ টিপ করে। সামনা-সামনি দেখা হয়ে গেলে দু-হাত কোমরে তুলে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাপী এগোলে বা থামলে দুটো কথা কইবার সাধ। কিন্তু বাপী এগোয়ও না দাঁড়ায়ও না। সোজা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাতেও মেয়েটার চোখেমুখে কৌতুক ঝরে লক্ষ্য করেছে।

বাপী তরফদার এখন ওর শুধু খোদ ওপরওলা নয়, এক কথায় দণ্ডমুণ্ডের মালিক। রেশমাও সেটা খুব ভালো জানে। দেখা হলে এই মেয়ে যদি সসম্ভ্রমে তাঁকে সেলাম ঠুকত বা পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াত—তাও অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু এর থেকে ওর সর্ব অঙ্গে ওপরওলার দাক্ষিণ্য যেটুকু আছে তার ওপরেই যেন নির্ভর বেশি। নিজের এই জোরের দিকটা সম্পর্কে সজাগ বলেই বেশি বেপরোয়া। এই মেয়ে যদি সসম্ভ্রমে সেলাম ঠোকে বা পথ ছেড়ে দাঁড়ায় সে—ও যেন কৌতুকের মতোই হবে। যাই হোক, বাপীর ধারণা মেয়েটার চাপা কৌতুক দিনকে দিন বাড়ছে।

…ক’দিন আগের এক বিকেলে ঊর্মিলা বাপীর বাংলোয় এসে হেসে অস্থির।—জঙ্গলে রেশমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?

বাপী জবাব দেয়নি। নির্লিপ্ত গম্ভীর মুখে তাকিয়েই শুধু

—তোমাকে ক’বার করে ডেকেছিল আর তুমি সাড়া না দিয়ে আর একদিকে চলে গেছ?

…জঙ্গলের সেই সাপ ধরার পোশাকে রেশমাকে দেখেছিল ঠিকই। আঁট জামা পরা এই মেয়েকে দেখলে দুটো চোখ আপনা থেকে অবাধ্য হয় বলেই ডাক শুনেও বাপী সোজা প্রস্থান করেছিল। জিগ্যেস করতে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে জবাব দিয়েছিল, রেশমাকে বলে দিও আমি ওর ইয়ার্কির পাত্র নই।

ছদ্ম বিস্ময়ে ঊর্মিলার দু’চোখ বড় বড়।—রেশমা তো তাহলে ঠিক বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি।

—কি বলেছে?

—ও একটা মস্ত শঙ্খচূড় ধরেছে আজ, সেই আনন্দে ওটা তোমাকে দেখাবার জন্যে ডেকেছিল। ও দুঃখ করছিল, এত বড় ওপরওলা হয়েও জ্যান্ত সাপের মতোই তুমি ওকে ভয় করো—এদিকে তোমার জন্যেই এখন ওর এত আয়-পয় যে ম্যানেজার চালিহা পর্যন্ত এখন ওকে খাতির করে, হেসে কথা কয়। তারপরেই চোখ পাকিয়েছে ঊর্মিলা, নিজের মনে পাপ না থাকলে ওর মতো এতদিনের একটা চেনা-জানা মেয়েকে তোমার এত ভয় কেন মশাই? ও-মেয়ে তো পারলে তোমাকে পুজো করে।

বিরক্ত হয়ে বাপী চায়ের তেষ্টার কথা বলে ওদের বাংলোয় চলে এসেছিল। মেয়েলী রাস্তা ধরে রেশমা যে শয়তানি করেই চালিহার খাতির করা বা হেসে কথা কওয়া ব্যাপারটা বাপীর কানে তুলতে চেয়েছে তাতেও কোনো সন্দেহ ছিল না।

আবু রব্বানী দাওয়ায় একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে। অদূরে দুলারি দাঁড়িয়ে। দুজনেই গম্ভীর। মুখ দেখে মনে হয় দুজনের কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। এইমাত্র হারমাকে চলে যেতে দেখেছে বাপী। কাছে আসতেই দুলারি জিগ্যেস করল, হারমাকে দেখলে?

—হ্যাঁ, কেন?

—কেন আবার কি, তোমার একটু মায়াদয়া নেই? রেশমা পাহাড়ে গেলে ওকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না? সেখানকার জঙ্গলে সাপখোপ নেই?

এমন মুখ আর এই অভিযোগ যে আবুকে আরো উত্তপ্ত করার জন্য বাপীর বুঝতে সময় লাগল না। ওর দিকে ফিরে হেসেই জিগ্যেস করল, জ্বরটর বাধিয়ে বসে আছ নাকি?

এবারে গম্ভীর চালে ঠেস দিয়ে দুলারিই আগেভাগে জবাব দিল, বসন্তের বাতাসে রাতদুপুরে ইঁদারায় ঠাণ্ডা জলে চান না করলে গা জুড়ায়? এখন গা গরম, তার থেকে মেজাজ আরো বেশি গরম। হারমার জন্য এত দরদ যে আমাকেই পাঁচ কথা শোনাচ্ছে।

বাপী দাওয়ায় বসল। কি ব্যাপার?

গোমড়া মুখ করে আবুই ব্যাপার বোঝালো তাকে। জান কয়লা করে ফেললেও রেশমার মতো মেয়ে হারমাকে পাত্তা দেবে না, দোষের মধ্যে ঠেস দিয়ে দুলারিকে এই কথা আবু বলেছিল। তাইতেই দুলারির রাগ, রেশমার নামে কেউ কিছু বললে ও আর বরদাস্ত করতে পারে না। কিন্তু হারমা যে নালিশ করে গেল, উল্টে ওই মেয়ের ওপর দুলারির রাগ হবার কথা।…ম্যানেজার চালিহার সঙ্গে রেশমার এখনকার একটু ভাবসাব আবুও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু দুলারি তা বিশ্বাসই করে না। রেশমার কানে লাগাতে ওই পাজী মেয়ে ফিরে তড়পেছে, নতুন বড় কর্তা তো সাত খুনের আসামীর মতো দেখে তাকে, পুরনো বড় কর্তা যদি হেসে-ডেকে দুটো কথা কয় তো দোষের কি, আনন্দই বা হবে না কেন? পাহাড়ে যাবার মওকা পেয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে চলে গেল, এদিকে হারমা বলল, এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় ওই চালিহা লোক পাঠিয়ে রেশমাকে তার বাংলোয় ডেকে নিয়ে গেছল। পাহাড়ে যেতে হবে বলার জন্যে সন্ধ্যার পর বাংলোয় ডেকে পাঠাবার দরকার কি, আপিসে ডেকে এনে বললেই হয়। অবশ্য হারমা তখন ওর সঙ্গে ছিল, আর আধ ঘণ্টা-টাক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল। তারপর রেশমার পাহাড়ে যাবার আগের দিন বিকেলে ম্যানেজার চালিহা নিজে ওর জঙ্গলের ডেরায় এসেছে, রেশমা নাকি তাকে আদর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে। কম করে ঘণ্টাখানেক পরে কাজের কথা বলে তারপর চলে গেছে। হারমা ততক্ষণ সামনের উঠোনে বসে। নালিশ শুনে দুলারি নাকি উল্টে হারমাকে ধমকেছে, দু’দিনই তুই কাছে ছিলি আর ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল না—তোর এভাবে এসে লাগান—ভাঙান দেবার কি হল, কাজের কথা থাকতে পারে না?

কাজ যা-ই থাক, এই ধূর্ত লোকের সঙ্গে মাখামাখি আবুর একটুও ভালো লাগেনি। হারমার পক্ষ নিয়ে সে-কথা বলতে দুলারি শুনিয়েছে, নিজের চরিত্রখানা কি ছিল তাই আগে ভালো করে দেখো, রেশমার মতো মেয়েকে বুঝতে তোমার ঢের দেরি। ফাঁদ যদি পাতেও, বুকে ছুরি বসানোর জন্যে পাতবে জেনে রেখো। সবটা শোনার পর নিরীহ মুখে বাপী জানান দিল, চালিহা সাহেবও দু’চার দিনের মধ্যে পাহাড়ে যাচ্ছেন…।

—যাচ্ছেন! রাগ আর উত্তেজনায় আবু সামনে ঝুঁকল।

—যেতে তো হবেই। রেশমা যে কাজের ভার নিয়ে গেছে তার টাকা পৌঁছে দিতে হবে না?

—শুনলে? শুনলে দোস্ত-এর কথা?

মুখ মচকে দুলারি জবাব দিল, দোস্তকেও তোমার মতো রোগে ধরাতে চাও তো এ-সব কথা বেশি করে শোনাও।

রেশমার বিরুদ্ধে কোনো কথাই দুলারির বরদাস্ত হবার নয়।

কিন্তু দুদিন না যেতে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাপারখানা অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। হাজার আড়াই টাকা নিয়ে কর্ত্রীর হুকুমে চালিহার বদলে বাপীকে ছুটতে হল পাহাড়ের বাংলোয়। জরুরী তার পেয়ে রণজিৎ চালিহা বিহারে চলে গেছে। ছ’সাত দিনের আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই।

এ-রকম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু হাসিই পেয়েছে বাপীর। বেচারার বরাত বড় মন্দ চলেছে দেখা যাচ্ছে।

.

রেশমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাংলোর ফটক দিয়ে বাপীর গাড়ি ঢুকতে দেখল। চালকের আসনে শুধু ওকেই দেখল। নিজের অগোচরে হাত দুটো কোমরে উঠল তার। একজনের বদলে অন্যজনকে দেখে অবাক কতটা ঠাওর করা গেল না। মুখে চাপা খুশির ছটা।

বাগানে মৌসুমী ফুল ছেয়ে আছে। আবার সেই বসন্তকাল। একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে রঙ-চঙা ঘাঘরা আর জামা-পরা ওই মেয়ে দাঁড়িয়ে। কোমরে দু-হাত তোলার ভঙ্গিটাও চোখ টানবেই। ভিতরে ভিতরে বাপীর আবার সেই পুরনো অস্বস্তি। ফলে ওপরওলার মুখ ভার। ঠাণ্ডা, গম্ভীর।

গাড়ি থেকে নামার ফাঁকে ঝগড়ু এসে দাঁড়ালো। ওকে দেখে একগাল হাসি। তড়বড় করে বলল, তুমি আসবে বাপীভাই, ভাবিনি—খুব ভালো হল।

বারান্দায় উঠে বাপী একটা চেয়ার টেনে বসল। রেশমা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে। ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শুধু। ঝগড়ুর দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখেই বাপী জানান দিল, মিস্টার চালিহা জরুরী তার পেয়ে বিহার চলে গেলেন, তাই আমি এলাম।

কালো মুখে আর এক প্রস্থ হাসি ছড়িয়ে ঘাড় মাথা নাড়তে নাড়তে ঝগড়ু চায়ের ব্যবস্থায় চলে গেল। ওই একজনের বদলে বাপীভাইকে দেখে সে-যে কত খুশি, মুখে আর সে-কথা বলল না।

সামান্য মাথা নেড়ে বাপী রেশমাকে কাছে ডাকল। কোমর থেকে হাত নামলো রেশমার। ঢিমেতালে এসে দাঁড়াল। বাপী তাকে বসতে বলল না। জিগ্যেস করল, কাজ-কর্মের কদ্দুর?

—হচ্ছে। কয়েকজন মাল মজুত করেছে, টাকা পেলেই দিয়ে দেবে। আর বাকিরা এখনো যোগাড় করছে, আরো পাঁচ-ছ’দিন লাগবে।

—এত সময় লাগবে কেন, তুমি তাড়া দাওনি?

—বেশি তাড়া দেবার কথা আমাকে বলা হয়নি। তোমার ফেরার তাড়া থাকলে তাড়া দিয়ে দেখতে পারি।

রেশমা সোজা চেয়ে আছে বলেই বাপীর দু-চোখ সামনের বাগানের দিকে। এবারে ওর দিকে না তাকিয়ে পারা গেল না। খুব সহজ কথাটার মধ্যেও যেন অহেতুক মজার ছোঁয়া লেগে আছে। চোখাচোখি হতেই বাপী ধাক্কা খেল একপ্রস্থ। এই হাসিমাখা চাউনি বাপীর অচেনা নয় খুব। কোথায় দেখেছিল …কোথায়? যে-চাউনি দেখলেই মনে হয় তার আড়ালে সর্বনাশ লুকিয়ে আছে কিছু। কমলা বনিক নয়, মণিদার বউ গৌরী বউদির চোখে এই রকম দেখেছিল কিছু। গৌরী বউদি সাত বছরের বড় ওর থেকে। রেশমা বছর দুইয়ের। কিন্তু দেখলে রেশমাকে বড় কেউ বলবে না। আরো তফাৎ কিছু আছে। গৌরী বউদি খুব অপ্রত্যাশিত পুরুষ দেখেছিল। রেশমার চাউনি আদৌ অপ্রত্যাশিত কাউকে দেখার মতো নয়। ও-যেন কাউকে নাগালের মধ্যে পেয়েই বসে আছে।

বাইরে বাপী আরো ঠাণ্ডা। আরো গম্ভীর। উঠল। ঘরে চলে গেল। নিজেই জানে কপাল ঘেমে উঠেছে। ওপরওলার ষড়যন্ত্রটা যে রণজিৎ চালিহাকে নিয়ে নয়—ওকে নিয়ে।

এবারে আর রেশমার সঙ্গে কোথাও বেরুলো না। ওর কাছ থেকে পার্টিদের ঠিকানা নিয়ে নিজেই বেরুলো। ওকে শুধু হুকুম করল, যোগাড়যন্ত্র তাড়াতাড়ি হয় কিনা দেখো—

একে একে চারদিন কেটে গেল। আজ পাঁচদিন। বাপী আশা করছে আজকের মধ্যে কাজ চুকিয়ে কাল সকালে বেরিয়ে পড়তে পারবে। একলাই যাবে। পরে ভ্যান এসে মালসহ রেশমাকে নিয়ে যাবে। ওর আচরণের ফলেই রেশমা ও এবারে অনেকটা সমঝে চলতে বাধ্য হয়েছে বলে বিশ্বাস। সমস্ত দিন বা রাতের মধ্যে একবারও দেখা হয়নি এমন দিনও গেছে। সকাল দুপুর বিকেল রাত্রি একলা বসে খেয়েছে। ঝগড়ুকে বলেছে খাবার ঘরে দিয়ে যেতে। বাপীভাইয়ের মেজাজ দেখে এবার ঝগড়ুও হয়তো অবাক একটু। দুদিন মাত্র রেশমাকে ডেকে কাজের কথা বলেছে বা নির্দেশ দিয়েছে। রেশমাও অনুগত বাধ্য মেয়ের মতো কথার জবাব দিয়েছে বা শুনেছে। কোনো অছিলায় কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করেনি। তবু বাপীর ভেতরটা অস্বস্তিতে বোঝাই একেবারে।

সেদিন আর দুপুরের পর বাপীর হাতে কাজ নেই কিছু। রেশমা সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তার কাজে বেরিয়েছে। বেলা থাকতে বাপী পায়ে হেঁটেই বাংলো ছেড়ে বেরুলো। আগের তুলনায় অনেক আত্মস্থ। পাহাড় থেকেই নেমে জঙ্গলে ঢুকল। তারপর পাহাড়ের ধার ধরে আপন মনে এগিয়ে চলল। পাহাড়-ঘেঁষা জঙ্গলের একান্ত নির্জন পথ ধরে মাইল দুই হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরে বসল।

বিকেল চারটে তখন। এত নিরিবিলি বলেই ভালো লাগছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। এই নির্জনতার এক ধরনের ভাষা আছে যা কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে। আগের বছর যেমন দেখে গেছল তেমনি। বনের সর্বত্র সেই রূপের ঢেউ। সেই রসের ঢেউ। অশোক পলাশের সেই রঙের বাহার। শিমূল কৃষ্ণচূড়ার মাথা তেমনি লালে লাল। বাপী তন্ময় হয়ে দেখছে।

হঠাৎ বিষম চমক। কেউ ডাকেনি, কিন্তু নিজে থেকে কি করে টের পেল জানে না। ওর বাঁ পাথরটার ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে।

রেশমা। পরনে ঘাগরা। গায়ে রঙচঙা জামা। দু-হাত কোমরে। বাপীকে যেন দেখেইনি। তার মাথার ওপর দিয়ে সামনের প্রকৃতি দেখছে সেও

—তুমি এখানে কেন? হঠাৎ কঠিন কর্কশ গলার স্বর বাপীর।

রেশমার দুচোখ যেন দূরের থেকে কাছে এলো। তার মুখের ওপর স্থির হল। রাগত মুখ রাগত চাউনি তারও।আমার সঙ্গে আজকাল তুমি এরকম ব্যাভার করছ কেন?

—তুমি যাবে এখান থেকে?

—কেন যাব? জঙ্গল তোমার?

হঠাৎ বাপী অত্যন্ত শান্ত। সংযত। গলার স্বর তেমনি কঠিন।—দেখো রেশমা, তুমি যার কাজ করছ আমিও তার কাজ করছি। এর মধ্যে তুমি যদি আমাকে ওই চালিহার মতো একজন কেউ ভেবে থাকো তো খুব ভুল হবে

কৌতুক চাপার তাড়নায় রেশমা আরো গম্ভীর। সাদাসাপটা জবাব দিল, চালিহার মতো ভাবলে তোমার ধারে-কাছে কে ঘেঁষত?

এবারে বেশ জোরেই ধমকে উঠল বাপী।—তুমি যাবে এখান থেকে?

কোমর থেকে দু-হাত খসল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকালো একবার। সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ। কিছু বোঝার আগেই দু-হাত বাড়িয়ে আচমকা প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টানে বাপীকে একেবারে নিজের গায়ের ওপর টেনে আনল। তারপরেই বলে উঠল, বনমায়ার সেই গুণ্ডা হাতি!

পলকে সামনের দিকে চোখ পড়তে বাপী বিমূঢ় হঠাৎ। রেশমা এক হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে, হুঁশ নেই। দেড়শ গজ দূরে একটা বিরাট হাতি। দুটো বিশাল দাঁত ধনুকের মতো বেঁকে শূন্যে উঠে গেছে। ডান দিকের গলার কাছে প্রকাণ্ড লালচে ক্ষতর মতো। হাতিটাও বোধ হয় সেই মুহূর্তেই দেখেছে ওদের। সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের মতো শরীরটাকে একটা ঝাঁকানি দিয়ে দ্রুত ধাওয়া করল এদিকে।

সোনার হরিণ নেই – ২০

শক্ত মুঠোয় বাপীর জামাটা ধরে আবার একটা হ্যাঁচকা টান দিল রেশমা—ছোটো শিগীর।

কিন্তু বুনো হাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটা যে সম্ভব নয় সেই মুহূর্তে অন্তত বাপীর মাথায় এলো না। দিশেহারার মতো সামনের দিকে ছুটতেই জামায় আবার জোরে টান পড়ল। জামাটা ফ্যাস করে ছিঁড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রেশমা জামা ছেড়ে তার হাত ধরল। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আঃ, পাহাড়ের দিকে ছোটো!

পঁচিশ-তিরিশ গজের মধ্যে পাহাড়। রেশমা বাপীর হাত ছাড়েনি। ওরা পাহাড়ের নাগাল পাবার ফাঁকে ওই যম পঞ্চাশ-ষাট গজের মধ্যে এসে গেছে। —ওঠো! শিগগীর ওঠো! ও-দিক দিয়ে নয়, এই ছোট পাহাড়গুলো টপকে ওঠো। রেশমা ওকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেও দু’হাতে আর দু’পায়ে তর তর করে উঠে যেতে লাগল। কিন্তু বাপী তাও পিছিয়ে পড়ছে দেখেই আবার দাঁড়িয়ে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে পাথর টপকাতে সাহায্য করল। বুনো মরদ হাতি পাহাড়ের গায়ে এসে গেছে ততক্ষণে। ওদের পাহাড়ে উঠতে দেখেছে। বিশাল মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে ওটা পাহাড়ে ওঠার জায়গা খুঁজছে। একটা পাথরের আড়ালে বাপীকে এক হাতে জাপটে ধরে বসে ওটার মতি-গতি লক্ষ্য করল রেশমা। দেখছে বাপীও। কি বলতে যেতে রেশমা মুখে হাত চাপা দিল। তারপর এক-হাতে তেমনি ধরে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে আবার অন্য উঁচু পাথরের দিকে এগিয়ে গেল। এইভাবে আরো খানিক এগিয়ে যেতে পারলে পর পর কতগুলো পাহাড়ী ঝোপের আড়াল পাবে।

আবার একটা পাথরের পিছনে এসে থামল ওরা। কানে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে রেশমা বলল, ‘খানিকটা ওঠার মতো প্লেন পাথর পেলে ও ঠিক শুঁড় দিয়ে ছোট পাথর ঠেলে ঠেলে এ দিকে উঠে আসবে। বোসো, দেখে নিই কি করছে—

সভয়ে দেখছে বাপীও। শুঁড় তুলে শিকার ঠিক কোন্ দিকে হদিস পেতে চেষ্টা করছে। দুটো অতিকায় দাঁত ধনুকের মতো বেঁকে আছে। হাঁ করে শুঁড় উঁচনোর দরুন লালা-ঝরা লাল মুখ-গহ্বর দেখেও গা শিরশির করছে। ঘাড় আর কাঁধ ঘেঁষা পেল্লায় দগদগে ক্ষতটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন।…বনমায়ার সেই বুনো মরদ হাতিটাই যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দু’পেয়ে মানুষ বনমায়ার জীবন কেড়েছে। তাই আজ মানুষই চরম শত্রু ওর।

ক্ষিপ্ত আক্রোশে হাতিটা শরীর ঝাঁকিয়ে সামনের দিকে এগোতে রেশমা আবার একটা হ্যাঁচকা টান দিল।—ওই ওপরের ঝোপের দিকে, শিগগীর।

ছোট বড় খণ্ড খণ্ড পাথর টপকে আরো ওপরের ঝোপের আড়ালে চলে এলো তারা। একটু বাদে বাপী সত্রাসে দেখলে, দূরে বারো চৌদ্দ গজের মতো পাহাড় বেয়ে উঠে শুঁড় দিয়ে পাথর ঠেলে ঠেলে হাতিটা এ-দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা যেখানে আছে শুঁড় দিয়েও নাগাল পাবে না হয়তো, কিন্তু অতটা যখন উঠেছে আরো উঠতে পারবে কিনা কে জানে। ওটাকে আসতে দেখেই বাপীর গায়ের রক্ত হিম।

বড় পাথরের দিকে ঘেঁষল না রেশমা, আবার ওকে টেনে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খণ্ড খণ্ড পাথরের আড়ালে আড়ালে আরো উঁচু উঁচু ঝোপের পিছনে চলে আসতে লাগল। এক হাতে পিঠ বেড়িয়ে বাপীকে জাপটে ধরে আছে। মহামূল্যবান একটি প্রাণ যেন ওরই হাতের মুঠোয়। ঝোপের আড়ালে বসে আবার কানের কাছে মুখ এনে ফিস-ফিস করে বলল, উল্টো দিকের হাওয়ায় ও আমাদের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে…ওর পিছনে চলে না যাওয়া পর্যন্ত ওটা নড়বে না, হয়তো বিকেল ছেড়ে সমস্ত রাত আমাদের আগলে রাখবে।

হাতিটা এখন বেশ নিচে অবশ্য। ওটার দিকে চোখ রেখে ঝোপ আর পাথরের আড়ালে আড়ালে ফাঁক বুঝে বুঝে তারা ওটার পিছনের দিকে এগোতে লাগল। এই করে অনেকটা পিছনে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু ওটা না গেলে তো আর পাহাড় থেকে নামা যাবে না।

হাতিটা যে রাস্তা ধরে ওপরে উঠেছিল সেদিকে ফিরে চলল এক সময়। ফলে ওদেরও সন্তর্পণে এগোতে হচ্ছে। নইলে গায়ের গন্ধ পাবে।

নামার আগে ওই বুনো হাতি হঠাৎ থেমে গিয়ে শরীরের সমস্ত রাগ গলা দিয়ে বার করতে লাগল। তার ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে পাহাড়টা সুদ্ধু কাঁপছে। উঁচু ঝোপের আড়ালে রেশমা বাপীকে এক হাতে বুকের আর নিজের পাঁজরের সঙ্গে জাপটে ধরে বসে আছে। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাপীর কোনো দিকে হুঁশ নেই। সব ক’টা স্নায়ু টান টান, লক্ষ্য নিচের ওই দানবটার দিকে।

হুঙ্কার থামিয়ে বুনো হাতিটা সমতল পাহাড় ধরে নামতে লাগল। নামার পর আরো খানিক দাপাদাপি করে জঙ্গলের যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলল।

একটা দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটতে লাগল বাপীর। মুখ ফেরাতেই রেশমার গালের সঙ্গে গাল ঠেকল। রেশমা তেমনি এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। নিঃশব্দে হাসছে। ঠোঁটের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের সারি চিক চিক করছে। চোখের পলকে সর্বাঙ্গে যেন আগুনের ছেঁকা লাগল বাপীর। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কোন রকম বাধা না দিয়ে রেশমাও এবারে ছেড়ে দিল। কিন্তু চাপা হাসির তরঙ্গ নিঃশব্দে ওর দেহ-তট ভেঙে উপচে উঠছে। বাপী আর তাকাতেও পারছে না। শুধু নিজের জামা নয়, রেশমারও জামার জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে-খুঁড়ে একাকার।

মাথাটা প্রচণ্ড ঝিম ঝিম করছে বাপীর। তবু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে চাপা ধমকের সুরে রেশমা বলল, এখুনি নামতে যাচ্ছ নাকি? পাগলা হাতির থেকে এখন আমাকে বেশি ভয় তোমার?

বাপী দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুর মতো। শরীরের রক্তকণাগুলো জ্বলছে। চারদিক তাকিয়ে দেখল। বিচার-বিবেচনা যতো বাড়ছে এখন, ভিতরে ততো অস্বস্তি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বেশ খানিকটা নিচে পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড ছোট পাথর। তুখোড় বুদ্ধিমতীর মতোই এই ছোট পাথরগুলোর এ-ধারে ওকে নিয়ে এসেছে রেশমা। কোনো হাতির পক্ষে এই ছোট পাথরের জঙ্গল ঠেলে উঠে আসা সম্ভবই নয়, বাপীর এতক্ষণ সেটা মনে হয়নি। কিন্তু তার পরেও রেশমা ওকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমনি জাপটে ধরে বসেছিল। সবটাই মনে পড়ছে বাপীর। নিজের প্রাণ তুচ্ছ, গোড়া থেকে ওকে বাঁচানোর আকৃতিটুকুই সব রেশমার।

বাঁচাতে পেরেছে। পাথুরে মাটি ছেড়ে রেশমাও উঠে দাঁড়াল। চোখেমুখে হাসি চিক চিক করছে তখনো। কিন্তু বাপী কি এত দুর্বল, এত অসহায়। ওর দিকে চোখ পড়তে এ কি সর্বনাশের ছায়া দেখছে। স্নায়ুগুলো এত কাঁপছে কেন ঠক ঠক করে?

রেশমা বলল, কিছুটা নেমে পাহাড় ধরেই যতটা সম্ভব এগনো যাক, একেবারে নিচে নামা ঠিক হবে না।

অর্ধেকটা নেমে পাহাড়ের পাথর ভেঙে ভেঙে পাশাপাশি চলল তারা। কিন্তু এভাবে চলা কষ্টকর। রেশমা থমকে দাঁড়াল এক জায়গায়। — হাত ধরব?

—দরকার নেই। রেশমার এই দুটো কথাও কানে গরম তাপ ছড়াচ্ছে।

—প্রাণে বাঁচালাম, এখন তো আমাকে দূরে ঠেলবেই। না তাকিয়েও বাপী বুঝতে পারছে ওর চোখেমুখে সেই সর্বনাশা হাসি ঠিকরে পড়ছে।

.

…অথচ রেশমা না থাকলে প্রাণে বাঁচা যে সম্ভব ছিল না এ এক নির্মম সত্য। বুনো পাগল হাতিটা এত নিঃশব্দে আসছিল যে বাপীর চোখেই পড়ে নি। আর এক মিনিট দেরি হলেও রক্ষা পেত না। তাছাড়া ওটাকে দেখার পরেও দিশেহারার মতো জঙ্গল ধরেই ছুটতে যাচ্ছিল। রেশমা ওকে পাহাড়ে টেনে না তুললে এই জীবনের খেলা শেষ হয়ে যেত। জঙ্গলের মধ্যে ছুটে হাতির সঙ্গে পাল্লা দেবার চেষ্টা যে হাস্যকর এ বাপীও জানে। অথচ সংকটের সময় এটুকুও মাথায় আসেনি।

দিনের আলোয় টান ধরেছে। দেখতে দেখতে এখন অন্ধকার ধেয়ে আসবে। নিচে নেমেও তারা পাহাড় ঘেঁষেই দ্রুত চলতে লাগল। আরো মিনিট বিশ-পঁচিশ বাদে সব অন্ধকার। দু’জনে পাশাপাশি চলেছে। এখন রেশমার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। তাইতেই স্বস্তি একটু।

এতটা পথ দু’জনেরই মুখ সেলাই। পাহাড়ের বাংলোয় উঠে আসতে রাত। বাইরের বারান্দায় বড় হ্যাসাক জ্বলছে। বাপীর মনে হল ওটা না থাকলে ভালো হত। দূর থেকে দেখল ঝগড়ু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত হতে দেখে ওদের অপেক্ষাতেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো

বারান্দায় উঠে আসতে দু’জনের মূর্তি দেখে ঝগড়ুর চোখ কপালে। এত আলোয় রেশমার সমস্ত মুখ লালচে দেখাচ্ছে। চাপা হাসি ঠিকরোচ্ছে। কিন্তু ঝগড়ুর কিছু তলিয়ে ভাবার ফুরসৎ নেই!—কি হয়েছে বাপীভাই? কোনো বিপদ—টিপদ নাকি?

—ওর কাছে শোনো। আমি খুব ক্লান্ত। এক পেয়ালা স্ট্রং কফি নিয়ে এসো চট করে।

দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলো। বুকের তলায় একটা ঠক ঠক শব্দ হয়েই চলেছে। মুখ হাত ধোবার ধৈর্যও নেই। গায়ের ছেঁড়া জামাটা খুলে গেঞ্জি গায়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটা চেনা যন্ত্রণার আগুন ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে।

একটু বাদে ঝগড়ু কফি রেখে গেল। ভয়ার্ত বিহ্বল মুখ তারও। বিপদের কথা শুনতে শুনতেই কফি নিয়ে চলে এসেছে বোধ হয়। পেয়ালা রেখেই আবার ছুটল।

রাত নটা নাগাদ চুপচাপ একলাই খেয়ে নিল বাপী। ভিতরে ঝগড়ুর ঘরে রেশমার খুশি-ঝরা গলা শোনা যাচ্ছে। তার ঘরের সামনেটা অন্ধকার। বাপী একটু এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে না দেখে পারল না। ঝগড়ু একটা নতুন দামী বোতল নিয়ে বসেছে। বাপী দেয়নি যখন ওটা নিশ্চয় রেশমাই দিয়েছে তাকে। পরনে তার একটা চকচকে ঘাগরা। গায়ে অন্য জামা। চান সেরে পিঠে ভিজে চুল ছড়িয়ে ঝগড়ুর মুখোমুখি মেঝেতে বসে আছে। হাঁটুর একটু ওপর থেকে ধপধপে পা দুটো দেখা যাচ্ছে। ঝগড়ুকে বিপদের গল্প বিস্তার করে শোনাচ্ছে।

বাপী সরে এলো বটে, কিন্তু স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটা অবাধ্য অবুঝ দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। সেই এক রাতের কথা মনে পড়তে বুকের ওপর আসা মুগুরের ঘা পড়েছে।…যে রাতে কমলা বনিক নিজের শোবার ঘরে বসে আধা-বুড়ো রতন বনিককে তার খুশিমত মদ খেতে দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল বাপী সেই সন্ধ্যায় সেটা তক্ষুনি আঁচ করছিল।

আজ সামনে বসে ঝগড়ুকে দামী মদ খাওয়াচ্ছে রেশমা।

নিজের ঘরে এসে বাপী দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। তারপর ছিটকিনিও লাগিয়ে দিল। শরীরটা কাঁপছে। আলো নিভিয়ে সটান বিছানায়। কিন্তু তার পরেও একটা অমোঘ সর্বনাশ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল…কলকাতায় যেমন হয়েছিল। সমস্ত দিন নিদারুণ আক্রোশে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করার পরেও রাতে একটা তিমির তৃষ্ণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছে আর তারপর একটু একটু করে ওর ওপর দখল নিয়েছে—এই রাতের অনুভূতিটাও সেই রকম। অবাধ্য তাড়নায় এখনই কেউ যেন বাপীকে ওই বদ্ধ দরজার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দরজা খুলে লোলুপ প্রতীক্ষায় বসে থাকতে বলছে। ও নড়ছে না বলেই ওই চেনা যন্ত্রণাটা ওর হাড়-পাঁজর দুমড়ে মুচড়ে ভাঙছে।

রাত বাড়ছে। যন্ত্রণাটাও।

বাপী বিছানা ছেড়ে নামল। ওই দরজা খুললে কেউ আসুক না-আসুক ওকেই যে সামনের অন্ধকার হলঘরের ভিতর দিয়ে একজনের দরজার দিকে এগোতে হবে এটা তার থেকে ভালো কেউ জানে না। কলকাতার টালি এলাকার সেই এক খুপরি ঘরে বাপী তরফদার দেউলে হয়েছিল, সর্বস্বান্ত হয়েছিল। কিন্তু তখন বাপীর কোনো হাত ছিল না।

কিন্তু আজ? এখন?

বাপী মেঝেতে বসে পড়ল। কাঠের মেঝেতে খসখসে গালচে পাতা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর সে দেউলে হবে না। জীবনে শুধু একটি মেয়েই তার লক্ষ্য। আর কেউ না—কেউ না! আবার দেউলে হলে আর কোনদিন তার মুখোমুখি হওয়া যাবে না। তাই এই যন্ত্রণার শেষ না করলেই না। এই লোভের চুঁটি টিপে না ধরলেই না।

খসখসে গালচেয় নাক মুখ কপাল ঘষে ঘষে ছাল তুলে ফেলার উপক্রম করল। চামড়া যত জ্বলছে, যন্ত্রণা তত কমছে। মুঠো করা দুটো হাতই একে একে দাঁতে তুলে চামড়া কেটে ফেলল।

…হ্যাঁ, এইবার যন্ত্রণা আরো কমছে।

গালচের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল খানিক। তার পরেই স্নায়ুগুলো সব ধনুকের ছিলে ছেঁড়ার মতো একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। বন্ধ দরজার ও-ধারে মৃদু ঘা পড়ল। কেউ দরজা ঠেলছে। খুলতে না পেরে ওই শব্দ করছে।

অন্ধকারে বাপী নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে। নিঃশ্বাসেও। উঠল। দরজার দিকে এগলো। ছিটকিনি নামালো। দরজা খুলল।

বারান্দার হ্যাসাক অনেক আগেই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি। আড় হয়ে একপশলা জ্যোৎস্না রেশমার মুখের ওপর পড়েছে। কোমরে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

দরজা খুলতেই ঘরে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত দুটো পিছনে নিয়ে নিজেই দরজা দুটো বন্ধ করল। ঘর অন্ধকার আবার।

বাপী নিঃশব্দে সুইচের দিকে এগিয়েছে। তারপরেই জোরালো আলোর ধাক্কা।

রেশমার ঠোঁটে হাসি। মুখে হাসি। চোখে হাসি। কিন্তু তার পরেই সত্যিকারের বিস্ময়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, এ কি। নাক মুখ কপালের এ-রকম হাল হল কখন? পাহাড়ে? আগে তো লক্ষ্য করিনি…ওষুধ-টষুধ লাগিয়েছ কিছু?

বাপী চেয়ে আছে। এই রাতটা যেন এই মেয়ের দখলে। মৃত্যুর থাবা থেকে যে পুরুষকে ছিনিয়ে এনেছে, এই রাতে তার ওপর দখল বরবাদ করার হিম্মতও যেন কারো নেই।…নাক মুখ কপালের এই হাল বেশ রেশমা কি তা বুঝতে পেরেছে? ঠোঁটে মুখে চোখে আবার সেই হাসি। দেখছে সে-ও।

—ও কি! অত চোখ লাল করছ কেন?

—এত রাতে তুমি এই ঘরে কেন?

জবাবে রেশমা কাছে এগিয়ে এলো। ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখল একবার। তারপর চোখের আর ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসির জালে ওর মুখটা ভালো করে আটকে নিল।—অত ধকলের পর এত রাত পর্যন্ত তুমিই বা জেগে বসে আছ কেন?

সঙ্গে সঙ্গে আরো এগিয়ে এলো। একেবারে আধ-হাতের মধ্যে। বাপীর চোখে-মুখে একঝলক তপ্ত নিঃশ্বাস এসে লাগল। হাত দুটো আবার কোমরে উঠে এলো রেশমার। গলার স্বরেও হাসি ঠিকরলো এবার।—এলাম তো এলাম, তোমার অত ঘাবড়ানোর কি আছে? তুমি কি ভেবেছ মওকা বুঝে এরপর আমি তোমার ঘর করতে চাইব?

—তুমি যাবে এখন এখান থেকে?

—যাব বলে এসেছি?

রেশমা বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে এবার। কোমরের দু’হাত ওর কাঁধের ওপর দিয়ে গলার দিকে এগোচ্ছে। বাপী জানে আর এক মুহূর্ত দেরি হলে ওই দুটো হাত এবার অব্যর্থ রসাতলের গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে তাকে।

একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে চার হাত দূরে কাঠের গালচের ওপর ছিটকে পড়ল রেশমা। পুরু গালচের ওপর দিয়েই মাথার পিছনটা জোরে ঠোক্কর খেল। প্রচণ্ড ধাক্কায় চিৎপাত হয়ে যে-ভাবে পড়ল তার আঘাতও কম নয়। কিন্তু বাপীর মাথায় খুন চেপেছে। ওর পাশ কাটিয়ে চোখের পলকে ভেজানো দরজা দুটো খুলে ফেলল। তারপর সেই অবস্থাতেই দু’হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে নারীদেহ দরজার বাইরে এনে ফেলল। আবার ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল।

হাঁপাচ্ছে। বুকের তলায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। কাঁচের জাগ থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে খেল। আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে বসল।

.

পরদিন সকাল সাড়ে আটটার পর ঝগড়ু কড়া নাড়তে বাপী দরজা খুলল। ঋগড়ু বলল, তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছ দেখে এতক্ষণ ডাকিনি। কিন্তু কি ব্যাপার বলো তো বাপীভাই, রেশমাকে কি তুমি খুব সক্কালে উঠে হেঁটেই বানারজুলিতে চলে যেতে বলেছ নাকি?

বাপী থমকালো।— কেন?

—আমি তো বেশ ভোরে উঠেছি, কিন্তু ওকে কোথাও দেখছি না। তারপর ওর ঘরে গিয়ে দেখি জামা-টামা বা তোরঙ্গটাও নেই। সকালে যাবে কাল রাতে ও তো আমাকে বলেনি!

বিড়বিড় করে বাপী বলল, না, আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।

স্নেহ-মেশানো বিরক্তি ঝগড়ুর।—দেখো তো, বলা নেই কওয়া নেই এ-ভাবে কেউ চলে যায়! যেমন বুদ্ধি তেমন সাহস মেয়েটার, কাল তুমি ওর জন্যেই বড় বাঁচা বেঁচে গেছ বাপীভাই—ভাঙা পাথর বেয়ে পাহাড়ে উঠে না গেলে আর রক্ষা ছিল না—কিন্তু এ-দিকে মর্জি দেখো মেয়ের, সকালে উঠেই হাওয়া!

…না, বাপী কিচ্ছু ভাববে না। কিচ্ছু চিন্তা করবে না। যা হবার তাই হয়েছে। এর ওপর বাপীর কোনো হাত ছিল না।

সকালে উঠে নিজেই বানারজুলি চলে যাবে ঠিক করেছিল। কিন্তু রেশমা চলে গেছে শুনে তার আর যাবার তাড়া নেই। ভালোই হয়েছে। একটু সময় দরকার। সহজ হবার মতো একটু অবকাশ দরকার। সকাল দুপুর বিকেল এক-রকম শুয়ে বসেই কাটিয়ে দিল। আয়নায় মুখ দেখে মাঝে মাঝে। নাক মুখ কপালে এখনো ছাল ওঠা লালচে দাগ। ঊর্মিলার প্রসাধনসামগ্রী এখানেও তার ঘরে মজুত। ঝগড়ুর অলক্ষ্যে ক্রিমের কৌটোটা এনে সকাল থেকে অনেকবার ঘষেছে।

….অমোঘ রসাতলের গহ্বর থেকে বাপী নিজেকে টেনে তুলেছে। সর্বক্ষণ তবু নিরানন্দে ভেতর ছেয়ে আছে। লোভের জাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে নিজেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পৌরুষের অস্তিত্ব নেই কোথাও।…এর পরেও ওই মেয়ের কোন রকম ক্ষতি করবে না বাপী। ক্ষতি করার শক্তিও নেই। কিন্তু রেশমা এরপর কি করবে? না, রাপী ভাববে না। তার ভাবনা ধরে দুনিয়ায় কিছুই ঘটছে না।

গাড়িতে সব মাল তুলে পরদিন সকালে আটটার মধ্যে বানারজুলি ফিরল। এই চালানের সবটাই রণজিৎ চালিহার অর্ডারের মাল। এগুলো কোথায় যাবে বাপী জানে না। চালিহা বাইরে থেকে ফিরেছে কিনা তাও জানা নেই। গাড়ি হাঁকিয়ে সোজা তার বাংলোতেই এলো।

গাড়ি থেকে নামার আগেই বাপীর চিন্তার জগৎ ওলট-পালট আবার।

চালিহার বাংলোর বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আছে রেশমা। একা। উস্কোখুস্কো লালচে চুল। ঢিলেঢালা বেশবাস

বাপীকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। হাত দুটো আপনা থেকেই কোমরে উঠে এলো। বাপী থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। রেশমা চেয়ে আছে। সাপ ধরা মেয়ের দুটো চোখ সাপের মতোই জ্বলছে ধক—ধক করে।

একটু বাদে ঘুরে শ্লথ পায়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রণজিৎ চালিহা বেরিয়ে এলো। চকচকে লুঙ্গির ওপর গায়ে সিল্কের হাওয়াই শার্ট। ফোলা ফোলা লালচে মুখে জলের দাগ। এইমাত্র চোখেমুখে জল দিয়ে মুছে এসেছে বোঝা যায়। রাতে মদের মাত্রা ঠিক ছিল না বলে হয়তো বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিল।

কিন্তু ঠেলে তুলল কে? অনায়াসে অন্দরে ঢুকে রেশমা চাকরটাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে? বাপী জানে না। কিন্তু বুকের ভিতরে অস্বস্তি জমা হচ্ছে আবার।

—হ্যালো—হ্যালো! গুড মর্নিং। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, উঠে এসো।

বাপী পায়ে পায়ে বাংলোয় উঠল। অন্তরঙ্গ সম্ভাষণের কোনো জবাব না দিয়ে জিগ্যেস করল, গাড়ির মাল আপনার এখানেই তোলা হবে তো?

—হ্যাঁ, বোসো। অর্জুন!

ভিতর থেকে তার অসমীয়া কমবাইন্ড হ্যান্ড বেরিয়ে আসতে তাকে গাড়ির মালের বাক্স কটা ভিতরে তুলতে হুকুম করল। তারপর হৃষ্টবদনে বাপীর দিকে ফিরল।…চা খাবে?

—না, থ্যাংকস; আমি এক্ষুনি ফিরব।

বাপীর অবাক লাগছে, রেশমা ওর সামনে বাইরে আসতে পারছে না বলে এই লোকের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে আছে?

চালিহার মুখে হাসি ছুঁয়ে পড়ছে, চাউনিও ছুরির ফলার মতো হাসিমাখা বলল, তোমার জিম্মায় মাল ফেলে চলে এলো দেখে রেশমাকে বকছিলাম— তা ব্যাপারখানা কি হে, সব ফেলে-টেলে এত পথ হেঁটেই চলে এলো—আর ওর হাবভাবও অন্যরকম দেখছি—কি হল হঠাৎ?

বাপী ঠাণ্ডা জবাব দিল, কি হয়েছে জানি না, তবে ওকে বলে দেবেন দায়িত্ব ফেলে এভাবে চলে এলে ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হবে।

রণজিৎ চালিহা হাসছে। মাথা নেড়ে সায় দিল।—ও ভিতরেই আছে, ডাকব? পাল্টা প্রশ্ন ঠোঁটের ডগায় প্রায় এসে গেছল বাপীর। বলতে যাচ্ছিল, রেশমা এই বাংলোর ভিতরে কেন? বলল না। জবাব দিল, দরকার নেই।

মালের বাক্স কটা নামানো হয়েছে। বাপী উঠে দাঁড়াল, চলি—

গাড়িতে স্টার্ট দেবার ফাঁকে চালিহার চোখে চোখ পড়ল একবার। অন্তরঙ্গ হাসি-মুখে চালিহা হাত নেড়ে বিদায় নিল। কিন্তু এই চাউনি আর ওই হাসি দেখে বাপীর কেবল মনে হল, লোকটার যেন কোনো ক্রূর অভিলাষ সফল হয়েছে বা হতে চলেছে।

গাড়ি নিয়ে বেরুনোর পনের সেকেন্ডের মধ্যে বাপীর দু চোখ আবার হোঁচট খেল। রাস্তার ধারে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রেশমার সাপ ধরার সঙ্গী হারমা। ওই বাংলোর দিকে চোখ। বাপীকেও দেখল। কলের মতো একটা হাত কপালে উঠল, বাপীর গাড়ি বেরিয়ে গেল। মুখ দেখে মনে হল, রেশমা ওই বাংলোয় সেটা ও জানে।

যার কথা ভাবছিল বাড়ির কাছাকাছি আসতে তার সঙ্গেই দেখা। আবু রব্বানী। ভেতর-জোড়া অস্বস্তি বাপীর। তাই থেকে থেকে আবুর কথা মনে হয়েছে, রেশমা ফিরে এসে ওদের কিছু বলেছে কিনা বা কতটা বলেছে জানার তাগিদ। রেশমাকে চালিহার বাংলোয় দেখার পর তাগিদটা আরো বেশি বলেই জোর করে ঘরমুখো হয়েছিল। রেশমা যদি ওদের কিছু না বলে থাকে তো বাপী কি বলবে?

উল্টো দিক থেকে আবু হনহন করে হেঁটে আসছিল। আর এত বিমনা ছিল যে বাপী মুখোমুখি ব্রেক কষতে তবে হুঁশ হল। হাসতে চেষ্টা করে বাপী বলল, ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়বে যে।… কোথায়?

—তোমার ওখানেই গেছলাম, না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম।…তুমি এই ফিরলে?

শুকনো গম্ভীর মুখ দেখে বাপীর খটকা লাগল একটু। সাত দিন বাদে দেখা, কিন্তু এই মুখে হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। বাপী জবাব দিল, একটু আগে ফিরেছি, কিছু মাল ছিল, চালিহার বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে এলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আবু উদ্‌গ্রীব।—সেখানে রেশমাকে দেখলে?

গাড়িটা রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে বাপী স্টার্ট বন্ধ করে নেমে এলো। কিছু ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কি ঘটেছে না জানা পর্যন্ত স্বস্তিও নেই। আবু কাছে এসে দাঁড়াতে বলল, দেখলাম।…রেশমা ওখানে কেন?

আরো মুখ কালো করে আবু জবাব দিল, ও কাল সন্ধ্যা থেকেই ওখানে— রাতেও ওখানেই ছিল।

শোনামাত্র বাপীর স্নায়ুগুলো সজাগ, তীক্ষ্ণ। মুখে কথা নেই।

—হঠাৎ কি হল বলো দেখি বাপীভাই, কিছু ভেবে না পেয়ে আমি তোমার কাছে ছুটেছিলাম।

—তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি?

—না। এতদিন বাদে পাহাড় থেকে ফিরে দুলারির কাছে এলো না। এমন তো কখনো হয় না। আজ সকালে হারমা এসে খবর দিল, রেশমা কাল সকালে হেঁটে পাহাড় থেকে ফিরেছে। সে নাকি ভয়ঙ্কর মূর্তি। খানিক বাদে ম্যানেজারের বাংলোয় চলে গেছে। অনেক দূর থেকে হারমা নিজের চোখে ওকে ওখানে যেতে দেখেছে। আবার সন্ধ্যার পর সেজেগুজে হারমা ওকে সেই বাংলোতেই যেতে দেখেছে। রাতে আর ঘরে ফেরেইনি।

নির্লিপ্ত মুখে বাপী জানান দিল, হারমা এখনো বাংলোর কাছাকাছি একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে।

শুনে আরো দুর্ভাবনা আবুর। বাপী শুনল, ধামন ওঝার ছেলে ও, জাতব্যবসা ছেড়ে জোয়ান ছেলে এই একটা মেয়েতে মজে আছে বলে বাপ ওকে ভিটে থেকে তাড়িয়েছে। ভাবগতিক যেমন দেখছে, এরপর ওই হারমাই না মেরে দেয় মেয়েটাকে। রাগের থেকে আবুর দুর্ভাবনা বেশি।—রেশমা হঠাৎ এরকম করছে কেন বাপীভাই?

—জানি না। দেখা হলে জিগ্যেস কোরো।…আর বোলো, আমার কোনো রাগ নেই ওর ওপর। এই জীবনটার জন্য বরাবর আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

আবু আরো হতভম্ব।—কেন বাপীভাই? কি হয়েছে?

বাপী ঠাণ্ডামুখে জানালো কি হয়েছে। বনমায়ার সেই বুনো হাতির খপ্পর থেকে রেশমা ওকে বাঁচিয়েছে।

শুনতে শুনতে আবু বার বার শিউরে উঠেছে। তারপর সোৎসাহে বলে উঠেছে, রেশমা এইরকমই বাপীভাই—ঠিক এইরকম। ঠিক অমনি করে ও দুলারির জন্যেও প্রাণ দিতে পারে। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ ও এ-রকম হয়ে গেল কেন? সব জানলে মেমসায়েব তো উল্টে ওকে আরো অনেক ইনাম দেবে।

জবাব না দিয়ে বাপী গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। বলল, পারো তো কাল সকালের দিকে একবার এসো।

আবু বিমূঢ় মুখে চেয়ে রইল তার দিকে। দেখতে দেখতে বাপীর গাড়ি অনেক দূরে।

বাংলোয় আসতে ঊর্মিলা জানালো, মায়ের শরীর আবার একটু খারাপ হয়েছে। ডাক্তার আবার দিন-কতক তাকে বিশ্রামে থাকতে বলেছে। গায়ত্রী রাই বলেছে, ও কিছুই না, ডাক্তাররা অমন বাড়িয়ে বলে। মাল চালিহার বাংলোয় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আর রেশমাও ফিরে এসেছে শুনে মহিলা নিশ্চিন্ত। মাল বা রেশমাকে আনার জন্য আর ভ্যান পাঠানোর দরকার নেই। গায়ত্রী রাইয়ের অসুস্থতার ফলে বাপী যেন একটু আড়াল পেল। দুজনেই জানে তার শরীর খারাপ শুনলে বাপী একটু বেশি উতলা আর গম্ভীর হয়ে যায়।

পরদিন সকাল সাতটার আগেই আবু এলো। ওর চকিত চাউনি দেখেই বাপীর মনে হল রেশমার এমন অদ্ভুত আচরণের কিছু হেতু ও আঁচ করতে পেরেছে। খবর জিগ্যেস করতে আবু বলল, গতকালও সমস্ত রাত রেশমা চালিহার বাংলোয় ছিল। সমস্ত দিনও ওই বাংলোতেই ছিল। চালিহা আপিসে চলে যেতে হারমা ওকে ডেকে দেখা করেছিল। বলেছিল, দুলারি ডেকেছে। ঝাঁঝ দেখিয়ে রেশমা তাকে বলে দিয়েছে, তার এখন কারো সঙ্গে দেখা করার সময় নেই।

বাপী চুপ। তার ওপর আক্রোশেই এই কাণ্ড করছে জানা কথা। আবুর পাথরের মতো মুখ। একটু থেমে মনের কথা ব্যক্ত করল।—দুলারি বলছিল রেশমা মনে মনে তোমাকে পুজো করে…বুনো হাতির কবল থেকে তোমাকে বাঁচাতে পেরে ওর বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছিল।…সত্যি?

বাপী ঈষৎ তপ্ত জবাব দিল, ওর মাথার খবর ও-ই জানে। দুলারিকে বলে দিও আমার মাথা ঠিক ছিল। আমি ওর কোনো ক্ষতি করিনি বা কোনদিন করব না।

আবু চলে যাবার পরেও সারাক্ষণ ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে থাকল বাপীর। লাঞ্চের পর আপিস ঘরে আবার কাজে বসল এসে। কিন্তু মন নেই। কিছু ভালো লাগে না। বেলা তিনটে নাগাদ সেজেগুজে ঊর্মিলা ঘরে ঢুকে ঝাঁঝালো অনুযোগ করল, কাল ফিরে এসে-তক হাঁড়ি মুখ করে কেবল কাজই দেখাচ্ছো—চলো না ঘুরে আসি একটু।

—কোথায়?

—প্রথমে রেশমার ওখানে। হতচ্ছাড়ি এসে অবধি আমার সঙ্গে একবার দেখা পর্যন্ত করল না। ফিক করে একটু হাসল ঊর্মিলা, তারপর ক্লাবে ডাটাবাবু কেমন আছে একটু খবর নেব।

বাপী বলতে যাচ্ছিল, রেশমাকে পেতে হলে তোমার আংকল চালিহার বাংলোয় যাও—দু দিন দু রাত সে তার ওখানেই আছে। কিন্তু বলল না, সামলে নিল। শুনলে মেয়েটা অবাক হবে, তারপর কৌতূহলে ওরই ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। গম্ভীর মুখে বাপী ফাইলে চোখ নামাল। যাবে কি যাবে না, ওটাই জবাব। ঊর্মিলা রাগ করে বেরিয়ে গেল।

বিকেল সাড়ে চারটে তখন। বিরক্ত হয়ে ফাইলগুলো ঠেলে সরাল। দশ মিনিটের জন্যেও কাজে মন বসেনি। উঠে পড়বে ভাবছে।

—বাপীভাই! বাপীভাই! উদ্‌ভ্রান্ত দিশেহারা মুখে ঘরে ঢুকল আবু রব্বানী। — বাপীভাই! শিগগির ওঠো—কি সর্বনাশ করল রেশমা দেখে যাও। কি প্রায়শ্চিত্তি করল নিজের চোখে এসে দেখো বাপীভাই।

বাপী চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু আবু ততক্ষণে বাইরে আবার। চেঁচামেচি শুনে গায়ত্রী রাই বারান্দায় এসেছে। সে-ও গেটের ওধারে আবুর উদ্‌ভ্রান্ত মূর্তি দেখেছে। বাপীকে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে?

—রেশমার কি হয়েছে বলছে, দেখছি।

দাঁড়াবার সময় নেই, সে-ও বেরিয়ে এলো। বুকের তলায় কাঁপুনি শুরু হয়েছে। কি হতে পারে? রেশমা কি করে বসল?

বাংলোর পিছনের পথ ধরে আবু আগে আগে হনহন করে চলছে। ওর নাগাল পেতে হলে বাপীকে ছুটতে হবে। পিছন থেকে বার দুই ডেকেও ওকে থামানো গেল না।

জঙ্গলের পথ ধরল। পিছনে বাপী।…কিন্তু আবু এ-রকম করছে কেন? দাঁড়াচ্ছে না কেন? ও কি কাঁদছে? নইলে থেকে থেকে চোখে হাত উঠছে কেন?

দুলারির সেই আগের ঘরের কাছাকাছি আসতেই বাপীর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। পর পর দুটো ঘরেই এখন সাপ মজুত করা হয়। …কিন্তু এখানে এত লোক জড় হয়েছে কেন? কি করছে ওরা? সামনের ঘরের ওই বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে কি দেখছে? বাঁশের বেড়ার ওধারে দুলারি দাঁড়িয়ে। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। কিন্তু দু চোখে আগুনের হল্কা ঠিকরোচ্ছে। তার পিছনে হারমা। ওই মুখেই কোন ভাব-বিকার নেই। আর সব কারা বাপী জানে না। জঙ্গলের সাপ ধরার লোক বা মজুর-টজুর হবে, সকলেই বিমূঢ়, হতভম্ব।

বেড়া ঠেলে ভিতরে ঢুকতে আবু ওর একটা হাত ধরল। তার আগে মাটি থেকে একটা পাকা বাঁশের লাঠি কুড়িয়ে নিয়েছে। ওর দু চোখ টকটকে লাল। জলে ঝাপসা। আবু কাঁদছে।

মুখে একটিও কথা না বলে বাপীকে বন্ধ দরজার সামনে টেনে নিলে গেল। যারা সেখানে ছিল তারা সরে গেল। কেউ বা পিছু হটল। কাছাকাছি এসে বাঁশের লাঠি দিয়ে আবু বন্ধ দরজার এক পাট ঠেলে খুলল।

সঙ্গে সঙ্গে কোমর সমান ফণা উঁচিয়ে ফোঁস করে উঠল একটা বিশাল শঙ্খচুড় সাপ। বাপী সভয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। আর তার পরেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তার গায়ের রক্ত জল। রেশমা মেঝের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে। সর্বাঙ্গ নীল। ওই বিশাল সাপ তার সর্ব অঙ্গ পাকেপাকে জড়িয়ে বুকের কাছে কুলোর মত ফণা উঁচিয়ে আছে।

দরজা দুটো বন্ধ করে আবু একজনকে ঘরের পিছনে গিয়ে ঘুলঘুলিটা টেনে খুলে দিতে বলল। বন্ধ দরজার এদিকে লাঠি-সোঁটার ঘা পড়লে সাপটা ঘুলঘুলি দিয়ে পালাবার পথ পাবে। হারমা হঠাৎ আবুর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিতে গেল। সাপটাকে পালাতে দেবে না। ঘুলঘুলির দিকে গিয়ে ওটাকে মারবে। আবু বাধা দিয়েছে।——মারবি কেন, ওটার কি দোষ, রেশমা যা চেয়েছে তাই হয়েছে। তাছাড়া কি হয়েছে মেয়েটার দেখতে হবে তো, তোর বাপ যদি কিছু করতে পারে।

যে-সাপ কাটে তাকে চট করে মারতে নেই এ-রকম একটা সংস্কার আছে। সে-রকম ওঝা নাকি ঝাড়ফুঁক করে বিষ তোলার জন্য সেই সাপকে আবার টেনে আনতে পারে। কিন্তু এ আশ্বাস যে শুধু হারমাকে আটকানোর জন্য তাও বোধ হয় সকলেই জানে।

ঘোলাটে চোখে বাপীর দিকে ফিরল আবু। বলল, ওপর-অলার খেলা দেখ বাপীভাই, পাহাড়ে যাবার দিন-কয়েক আগে এই বিরাট শঙ্খচূড়টাকে রেশমাই ধরেছিল, তারপর খুশি মুখে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, এটার ডবল টাকা দিতে হবে তোমার বাপীভাইকে বলে দিও।

বাপী ভোলেনি। সেদিন সে-ও জঙ্গলে ছিল। ওই সাপ দেখার জন্য রেশমা তাকে ডাকাডাকি করেছিল। বাপী শুনেও শোনেনি। চলে গেছল। রেশমা তারপর ঊর্মিলাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, এত বড় ওপরঅলা হয়েও বাপীভাই ওকে জ্যান্ত সাপের মতই ভয় করে।

দুটো নরম হাত একটা বাহু আঁকড়ে ধরতে বাপী ঘুরে তাকালো। ঊর্মিলা। ভয়ার্ত লালচে মুখ। খবর শুনে ছুটেই এসেছে। হাঁপাচ্ছে। সাহস করে কিছু জিগ্যেস করতে পারছে না, শুধু জানতে চায় সত্যি সব শেষ কি না। কি হল! কেন হল!

ওর হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে বাপী টের পাচ্ছে। কিন্তু বাপী কি বলবে? কি সান্ত্বনা দেবে? পাহাড়ের সেই পাগলা বুনো হাতি নাগালের মধ্যে পেলে এই দেহ ওটার পায়ের তলায় পড়ে ভেঙে-দুমড়ে তালগোল পাকিয়ে যেত। কিন্তু সে যন্ত্রণা কি এর থেকে বেশি?

বন্ধ দরজার এদিকে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাঠি ঠোকাঠুকির পর আবার দরজা ফাঁক করে দেখা হল। সাপটা পালিয়ে গেছে।

রেশমা মাটিতে শুয়ে।

চারদিক দেখে প্রথমে ঘরে ঢুকল আবু রব্বানী। তার পিছনে ঊর্মিলার সঙ্গে বাপী। ঊর্মিলা তার বাহু দু হাতে আরও শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ওদের পিছনে আরও অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

রেশমার বিবর্ণ দেহ নিষ্প্রাণ। নিস্পন্দ।

তার বুকে মুখে কপালে মাথায় কতকগুলো ছোবল মেরেছে কে গুনবে? এর যে-কোন একটাতে মৃত্যু অবধারিত। তবু ওই কাল সাপ বোধ হয় এই নারীদেহে তার সমস্ত বিষ ঢেলে আক্রোশ মিটিয়েছে।

ঊর্মিলা দু’হাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বাপীর পায়ের নিচে মাটি ভয়ানক দুলছে। সে-ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ঊর্মিলাকে ধরে নিয়ে বাইরে এলো। বাইরে এখনও বেশ আলো। মাথার ওপর বসন্তের নীল আকাশ। কিন্তু বাপী চোখে সব-কিছু ঝাপসা দেখছে। মানুষগুলোর মুখও

কেন এমন হল? কেন কেন কেন? বাপীর জন্য? বাপীর দোষে? তাই যদি হয় তো ওই নীল আকাশ বজ্র হয়ে ওর মাথায় নেমে আসতে পারে না?

বাঁশের বেড়ার সামনে দুলারি তেমনি তামাটে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। হারমা নেই। সে বোধ হয় তার বাপ ধামন ওঝাকে ধরে আনার জন্য ছুটেছে। সব যে শেষ এ বোধ হয় এখনও শুধু ও-ই বিশ্বাস করছে না। আবু রব্বানী তাকে আশার কথা শুনিয়েছে।

ঊর্মিলাকে ধরে বাপী বেরিয়ে আসছিল। এই মুহূর্তে কোনো নিঃসীম অন্ধকার গহ্বরে সে হারিয়ে যেতে চায়। মুছে যেতে চায়। কিন্তু ধমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। দুলারির ধকধকে দুই চোখ ওর মুখের ওপর

বলল, যেও না। কথা আছে।

সোনার হরিণ নেই – ২১

রাত দশটা। বানারজুলির অনেক রাত। অন্ধকার ঘরে শুয়ে বাপী এ-পাশ ও-পাশ করছে। রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। ঊর্মিলাকে বলে দিয়েছিল তাকে যেন রাতে খাওয়ার জন্য ডাকা না হয়। ঘরে গিয়েই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তাই ইচ্ছে ছিল। ঘুমের ট্যাবলেট একটা খেয়েছে। একঘুমে সকাল হলে হয়তো দেখবে এই দুঃস্বপ্নের রাতটাই মিথ্যে। ঊর্মিলা বাধা দেয়নি বা জোর করেনি। সে-শক্তিও ছিল না। তার চোখেও আতঙ্ক। ঘরে গিয়ে হয়তো মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদবে। ওরা কেঁদে হাল্কা হতে পারে। বাপী পারে না।

কিন্তু ঘুম চোখের ত্রিসীমানায় নেই। চোখ বুজলেই সামনে বিভীষিকা। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এক মেয়ের বুকের ওপরে শঙ্খচূড়ের ফণা। ওটা সরে যাবার পরে যা দেখেছে সে আরো ভয়ঙ্কর। বিষে বিষে ফর্সা অঙ্গ গাঢ় নীল কালিতে ছোপানো। চোখ বুজলেই সামনে সেই ত্রাস। অন্ধকার অসহ্য। উঠে আলো জ্বেলে দিয়েছে।

আলো দেখেই একটু আগে গায়ত্রী রাই এসেছিল। ঘরের দরজা দুটো খোলাই ছিল। মাথার ওপর বনবন পাখা ঘুরছে। কিন্তু জানলা দরজা বন্ধ করলে বাপী বুঝি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। কেউ আসছে টের পেয়েই চোখ বুজে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও আঁচ করেছে কে এলো। বাপী চোখ মেলে তাকায়নি। কেন তাকাবে? চোখে জল নেই। বুকে মুখ গোঁজার মতোও কেউ নেই।

গায়ত্রী রাই আধ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ওকে দেখেছিল হয়তো। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

মেয়ের মুখে যা শোনার শুনেছে। যা বোঝার বুঝেছে। ঊর্মিলার কাছেই বরং অনেক কিছু দুর্বোধ্য এখনো। কিন্তু তার মা সব শোনা মাত্র বুঝবে। বাপীকে রেশমা ভরাডুবি থেকে একেবারে নিরাপদ ডাঙায় তুলে দিয়ে শুধু নিজের ওপর চরম শোধ নিয়ে গেল।

….দুলারিকে নাকি রেশমা এই দুপুরেই হেসে হেসে বলেছিল, ও অনেক দোষ করেছে, ওর গুনাহর শেষ নেই। তাহলেও বাপীভাই কখনো ওর দোষ ধরবে না, ওকে মাপ করে দেবেই। কারণ সব দোষ আর সব পাপের যুগ্যি প্রায়শ্চিত্ত ও করবে। তখন আর বাপীভাইয়ের কক্ষনো ওর ওপর রাগ থাকতে পারে না। বাপীভাইয়ের মতো এমন মুরুববী আর হয় নাকি। এই মুরুব্বী মাফ করে দিলে যত দোষ আর যত পাপই করুক নরকের বদলে সরাসরি হয়তো বেহেস্তে গিয়েই হাজির হবে।

এই পাজী মেয়েকে হাড়ে হাড়ে চেনে দুলারি। ওর থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। সব শোনার পরে শেষ মুহূর্তে সুমতি হয়েছে বুঝেও হাড়পিত্তি জ্বলছে দুলারির! কিন্তু ওকে চিনতে যে এত বাকি সে কি তখনো বুঝেছিল!

….হারমা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে তার বাপ ধামন ওঝাকে ধরে নিয়ে আসতে দুলারির সেই কঠিন দু’চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর উঠে এসেছিল।—কি হবে?

বাপী মাথা নেড়েছে। কিছু হবে না। যা হবার হয়ে গেছে।

দুলারি ডেকেছিল, এসো। তুমিও এসো মেমদিদি।

জঙ্গলের পথ ধরে দুলারি আগে আগে নিজের ঘরের দিকে এগিয়েছে। পিছনে বাপী আর ঊর্মিলা। বাপীর মনে হচ্ছিল কেউ তার গলায় একটা অদৃশ্য দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছে। না গিয়ে উপায় নেই, তাই চলেছে। ঊর্মিলা তার একটা হাত চেপে ধরে ছিল। ও তখনো বিমূঢ়, ভয়ার্ত।

…দুলারি ঊর্মিলাকে সুদ্ধ ডাকল কেন? ওর সামনেই চরম কিছুর ফয়সালা করে নিতে চায়? কোনো অভিযোগের বোঝা চাপিয়ে ওকে কিছু বুঝিয়ে দিতে চায়? যে আগুন দুলারির চোখে দেখেছে, সেই আগুনে এবার বাপীর মুখ ঝলসে দিতে চায়?

ঘরে ঢুকে দুলারি ছেলে দুটোকে বাইরে বার করে দিয়েছে। তারপর ঊর্মিলাকে বলেছে, বোসো।

ওরা দাঁড়িয়েই ছিল।

আঁচলে বাঁধা একটা পুঁটলির মতো কোমর থেকে টেনে বার করল দুলারি। গিঁট খুলে মোটা সুতোয় জড়ানো কাগজের পুঁটলিটা বাড়িয়ে দিল বাপীর দিকে।— এটা তোমার কাছে রাখো এখন।

বাপীর মুখে কথা সরলো এতক্ষণে।—কি এতে?

—আমার জানার কথা নয়। ওর ডেরা থেকে ঘরে ফিরে খুলে দেখছিলাম। দু’হাজার টাকা।

বাপী আরো হতভম্ব।—এ কিসের টাকা?

—তোমাকে যমের মুখে ঠেলে দেবার জন্য এই টাকা চালিহা ওকে ঘুষ দিয়েছিল।

বিস্ময়ে হতবাক দু’জনেই। ঊর্মিলার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। সে চৌকিতে বসে পড়েছিল।

দুলারি আবার বলেছে, এটা রেশমা তোমার হাতে দিতে বলেছিল। মেমসায়েবকে সব বলে তার আপত্তি না হলে এ-টাকা তুমি হারমাকে দিয়ে দেবে। রেশমা তাই বলে গেছে।

.

বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল বাপীর। নিজের ঘরের অন্ধকার শয্যায় উঠে বসল।…একটি একটি করে দুলারি এরপর যা বলে গেছে ঊর্মিলাও শুনেছে। আংকল চালিহা একটা নোংরা ষড়যন্ত্রের জালে আটকে বাপীর বিরুদ্ধে তার মা—কে বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল—ঊর্মিলা শুধু এটুকুই বুঝেছে। এর বাইরে আর বেশি কিছু ওর কাছে স্পষ্ট নয় এখনো। কিন্তু ওর মা সব শোনামাত্র রণজিৎ চালিহার উদ্দেশ্য আরো ঢের বেশি বুঝবে বাপীর তাতে একটুও সন্দেহ নেই। গায়ত্রী রাই হয়তো এর পর ওকে আরো বেশি কাছে টেনে নেবে, আর চালিহার সঙ্গেও চূড়ান্ত বোঝাপড়া কিছু করবে। কিন্তু সব শোনার পর থেকে হাড়-পাঁজরগুলো আরো বেশি দুমড়ে মুচড়ে ভাঙছে বাপীর। ভেঙেই চলেছে।

….শেষ মুহূর্তে রণজিৎ চালিহার বদলে পাহাড়ে এবার বাপী তরফদার যাবে সেটা গায়ত্রী রাই বা ঊর্মিলা জানত না, আবু বা দুলারি জানত না, বাপী নিজেও জানত না। জানত শুধু চালিহা আর রেশমা। ম্যানেজারের হঠাৎ এমন দরাজ ভালো মানুষ হবার কারণটা রেশমা আগে বোঝেনি। তার নিজের লোভটাই আসল ভেবেছিল। কিন্তু পরে বুঝেছে। নিজের লোভ ছেড়ে এখন বাপীভাইকে লোভের ফাঁদে ফেলতে চায়। ফাঁকমতো অর্জুনকে দিয়ে কদিন সকালে ওকে ডেকে পাঠিয়েছে। ক্লাবের ডাটাবাবুর কাছে বোতলের বাক্সটা চালান দেওয়ার জন্য বা কাছাকাছির মধ্যে কোনো খদ্দেরের জিম্মায় নেশার প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য রেশমাকে পঁচিশ-তিরিশ টাকা করেও বখশিস দিয়েছে। এ-ভাবে কাঁচা টাকা হাতে পেলে রেশমা ছাড়ার মেয়ে নয়, দিব্বি নিয়েছেও। কিন্তু গোড়া থেকেই তার মতলব সম্পর্কে রেশমা হুঁশিয়ার ছিল। বাপীভাইয়ের বুকে সে কোন্ কলঙ্কের ছুরি বসাতে চায় সেটা বোঝার পর তাজ্জব বনেছে। আবার মজাও পেয়েছে।

রেশমার সঙ্গে খাতির বাড়ার পর টোপ ফেলেছে রণজিৎ চালিহা। প্রথমে কেবল বাপী তরফদারের প্রশংসা। সে আছে বলেই রাতারাতি রেশমার এত আয়পয়। নইলে ও যে এত গুণের মেয়ে সেটা আগে কে বুঝেছিল? মালকানও বোঝে নি, ম্যানেজার নিজেও না। তারপর বলেছে, শুধু এই একজনের যদি মন বুঝে চলিস আর তাকে খুশি রাখতে পারিস, তাহলে আর দেখতে হবে না। কালেদিনে এর দশগুণ বরাত ফিরে যাবে।

মতলব বোঝা গেছে। কাঁচা টাকা হাতে আসছে, রেশমা পরামর্শটা একেবারে বরবাদ করে দিতে পারে না। চালিহার সামনে খুশি যেমন দুর্ভাবনাও তেমনি।…খোদ ম্যানেজার সাহেব যখন বলছে তখন আর ভাবনা কি। তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। কিন্তু ওই তরফদার সাহেবের মেজাজের হদিসও যে পায় না কখনো, মন বুঝবে কি করে? কাছে গেলে দশ হাত দূর দিয়ে চলে যায়। আর এমন করে তাকায় যে ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করে। আগে কত সহজে মেলা-মেশা করত ওদের সঙ্গে, এত বড় মুরুব্বী হয়ে বসার পর অন্য রকম হয়ে গেছে।

চালিহা সাহস যুগিয়েছে। হেসে হেসে বলেছে, তুই একটা আস্ত বোকা। ওটা বাইরের চাল। কোথা থেকে কোথায় টেনে তুলল দেখেও মন বুঝতে অসুবিধে! যা বললাম শোন, চেষ্টা-চরিত্র করে লেগে থাক ওর সঙ্গে, হিল্লে হয়ে যাবে।

এই লেগে থাকার তাগিদটাই দিনে দিনে বেড়েছে। বখশিসের অঙ্কও। রেশমার টাকার লোভ দেখেই মুখোস খুলে শেষে মতলব ফাঁস করেছে। ওই বাপী তরফদারের মুখ লালসার আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। একটা রাতের জন্যও যদি রেশমা তা পারে, চালিহা ওকে নগদ দু’হাজার টাকা দেবে। আর তার পরেও বরাত ফেরানোর জন্য ওই বাপী তরফদারের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না কোনোদিন। ওর রানীর হালে থাকার ব্যবস্থা চালিহাই করে দেবে।

ওই শয়তানের মতলব এবার আবু সাহেব আর দুলারির কাছে ফাঁস করে দেবার কথা ভেবেছিল রেশমা। বাপীভাইয়ের মুখ কার কাছে পোড়াতে চায় রেশমা তাও জানে। মালকানের কাছে। কিন্তু যেমন বেপরোয়া তেমনি নিজের ওপর বিশ্বাস ওর। ও জানে বাপীভাইয়ের কক্ষনো কোনো ক্ষতি হবে না বা হতে পারে না। মজা কতটা গড়ায় দেখা যাক না। ফাঁকতালে নগদ আরো কিছু হাতে এলেই বা মন্দ কি, সানন্দে রাজি হয়ে দু’ হাজার টাকার বদলে দু’শ টাকা আগাম চেয়েছে। খুব দরকার। চালিহা তক্ষুনি দিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে, এটা আগাম ফাউ। বাপী তরফদার ঘায়েল হলে ফের দু’হাজারই দেবে।

খোশ মেজাজে কড়কড়ে দু’শ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরেছে। `ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত ওর কি করবে? কোন্ মতলবে দু’শ টাকা ওকে দিয়েছে সে তো আর কারো কাছে ফাঁস করতে পারবে না। বোকা বনে নিজেই জ্বলবে। তার আগে আরো কিছু টাকা ট্যাকে গোঁজার মওকা পাবে রেশমা। চালিহা যা চায় সেটা কল্পনা করতে গিয়ে অনেক সময় যে কান-মাথা গরম হয়েছে, শেষদিন হেসে হেসে দুলারির কাছে রেশমা তাও স্বীকার করেছে। ও-চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে তাড়িয়েছে।

বাপীভাইকে রসাতলে পাঠানোর প্ল্যান রেডি চালিহার। কাজ নিয়ে রেশমা পাহাড়ের বাংলোয় যাবে। দিনকতক বাদে তার বদলে বাপী তরফদার সেখানে টাকা নিয়ে যাবে। ওদের মেমসায়েবই তাকে যাতে পাঠায় সে-ব্যবস্থা চালিহাই করবে। ওকে জালে ফেলার মতো অমন মোক্ষম জায়গা আর নেই। সেখানে ঝগড়ু আছে, তাকে মদে ঠেসে রাখতে হবে। কিন্তু পরে যদি সে-ও আঁচ করতে পারে ব্যাপারটা, খুব ভালো হয়। রেশমা যেমন চালাক মেয়ে, একটু মাথা খাটালে সে-ব্যবস্থাও ও নিশ্চয় করে আসতে পারবে।

ওই আপনা-খাকী মেয়ের মাথায় তখনো কেবল মজাই নাচছে। এক কথায় রাজি। খরচার নাম করে আরো দু’শ টাকা আগাম ফাউ নিয়েছে। পাহাড়ে যখন নিজের নাগালের মধ্যেই পাবে বাপীভাইকে, তখন আর আবু সাহেব বা দুলারিকে বলা কেন—তার কাছেই ম্যানেজারের সব মতলব ফাঁস করে দেবে। বাপীভাইকে ও কি চোখে দেখে নিজে তো জানে—তার এক ফোঁটা ক্ষতিও কক্ষনো হতেই পারে না। সব বলে চালিহার দেওয়া চারশ টাকা বাপীভাইকে দেখাবে আর মালকানের সামনে এসেও সব কবুল করতে রাজি হবে।

পাহাড়ের বাংলোয় গিয়ে বাপীভাইয়ের অপেক্ষায় দিন গুনছে। রেশমা হেসে হেসে দুলারির কাছে স্বীকার করেছে, পাহাড়ে যাবার পর চালিহার মত লোকের চিন্তাটা আবারও মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, আর ভাবতে মজা লাগলেও জোর করেই সেটা ঝেঁটিয়ে দূর করেছে। কিন্তু বাপীভাই আসতেই ও যেন আর এক মজার খোরাক পেয়েছে। দোষ বাপীভাইয়েরই। আগেও টের পেয়েছে, ওকে বিশ্বাস করে না। জঙ্গলে ওকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ডাকলেও সাড়া দেয় না। এবারে ও আরো ভালো করে বুঝেছে, বাপীভাই আসলে ওকে ভয় পায়। এবারে পাহাড়ে আসতে রেশমার মনে হয়েছে, সেই ভয় যেন বাপীভাইয়ের কাঁধে ভূতের মতো চেপে বসেছে। কেবল কাজের কথা ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলে না, ওর দিকে তাকায় না, নিজের ঘরে বসে খায়। ফাঁক পেলে জঙ্গলে পালিয়ে যায়।

ক’দিন ধরে রেশমার মাথায় কেবল মজা গিসগিস করছে। বাপীভাইকে যা বলার পরে বলবে। যাবার আগে বলবে। তার আগে পর্যন্ত এইভাবেই চলুক। রেশমা নিজের মনে ছিল, আর চালিহার মতলবের কথা ফাঁস করলে বাপীভাইয়ের মুখখানা দেখতে কেমন হবে ভেবে ডবল মজা পাচ্ছিল।

ওখানকার কাজ শেষ বুঝে রেশমা সেদিন আড়াল থেকে নজর রাখছিল। পাহাড়ের ধারে জঙ্গলে এসে তাকে ধরেছে। কিন্তু পথের ওপর এমন বিমনা হয়ে বসেছিল বাপীভাই যে একটু পিছনে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে তাকে দেখে কিছুক্ষণ চোখ ফেরাতে পারেনি। শয়তান যে রেশমার দিকেই গুটি গুটি এগোচ্ছে রেশমা ভাবেইনি। ভাববে কি করে। ও তো এসেছে চালিহার মতলবের কথা ফাঁস করে দেবার জন্য!

কিন্তু ওর অজান্তে শয়তান ভর করেছে বলেই হয়তো খোদাতালাও নারাজ। নইলে বনমায়ার সেই পাগলা বুনো হাতি জঙ্গল ফুঁড়ে যমের মতো এসে হাজির হবে কেন। ওটাকে তেড়ে আসতে দেখেই রক্ত জল। ভয় পেয়ে বাপীভাই জঙ্গলের দিকে ছুটতে যাচ্ছিল। ও ধরে ফেলে পাহাড়ের দিকে টেনে নিয়ে না গেলে হয়েই গেছল। তাও প্রাণে বাঁচবে কি না কে জানে। তক্ষুনি মনে হয়েছে বাপীভাইয়ের মতো এত আপনার জন আর নেই, তাকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে—হবেই। না পারলে নিজের জীবনও রাখবে না। আর বাপীভাইয়ের সেই মুখ দেখে মনে হয়েছিল, নিজের বুকটা দু’খানা করে খুলে তাকে তার মধ্যে পুরে নিয়ে পালানো সম্ভব হলে তাই করত। তাকে আগলে নিয়ে ফাঁড়া কাটিয়েছে শেষ পর্যন্ত। ফাড়া সত্যি কেটেছে কিনা বাপীভাই তখনো জানে না। আর ঠিক তক্ষুনি বোধ হয় শয়তানের দখলে চলে গেছে রেশমা। ফাঁড়া কেটেছে, খানিকক্ষণ পর্যন্ত বাপীভাইকে সেটা বুঝতে দেয়নি। তাকে আঁকড়ে রেখে আর এক পাথর থেকে অন্য পাথরে সরেছে।

…শয়তান রেশমাকেই ফাঁদে ফেলেছে। আসমানের চাঁদের লোভ দেখিয়েছে। সেই চাঁদ যেন হঠাৎ ওর হাতের মুঠোয়। না, চালিহার মতলব হাসিলের কথা আর তার মাথায়ও ছিল না। চালিহা জানবে না। দুনিয়ার কেউ কোনদিন জানবে না।

বাংলোয় ফেরার মধ্যে রেশমার সবটাই শয়তানের দখলে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাপীভাই ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে আছে। সেই ভয়ের খোল ছিঁড়ে-খুঁড়েই দেবে রেশমা আজ। ঝগড়ুকে মদে ডুবিয়ে দিয়ে এসে দেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। ক্ষিপ্ত হয়েই সে বন্ধ দরজায় ঘা দিয়েছিল।

দরজা খুলতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আসমানের চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল রেশমা।

বাপীভাই সেই হাত দুমড়ে ভেঙে দিয়েছে।

রেশমার মাথায় দাউ দাউ আগুন জ্বলেছে তার পর থেকে। শয়তান সেই আগুন নিভতে দেয়নি। ওকে উল্টে পাগল করে তুলেছে। চরম প্রতিশোধ না নিতে পারা পর্যন্ত মাথার আগুন নিভবে না।

ভালো করে ফর্সা হবার আগে বেরিয়ে পড়েছে। ডেরায় তোরঙ্গটা রেখে সোজা চালিহার কাছে চলে গেছে। বলেছে, দু’হাজার টাকা দাও এবার।

চালিহা আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু রেশমার মুখ দেখে আবার খটকাও লেগেছে।—তোর এরকম মূর্তি কেন? বাপী তরফদার ফাঁদে পা দিয়েছে তো?

রেশমা বলেছে, না! কিন্তু না দিলেও তুমি এত বোকা কেন? এক ঝটকায় গায়ের জামা সরিয়ে পাহাড়ের সেই কাটা-ছেঁড়ার দাগ দেখিয়েছে।—এগুলো দেখেও তোমার শত্রু কিভাবে আমাকে শেষ করেছে বললে মালকান্ অবিশ্বাস করবে? তাছাড়া জিগ্যেস করলে ঝগড়ুও বলবে, ভোর হবার আগে আমি হেঁটে পালিয়ে এসেছি।

চালিহার ফর্সা মুখেও শয়তান হাসছে।—মালকানকে তুই নিজে গিয়ে বলবি?

—বলব। তার আগে তোমার কাছে নালিশ করেছি তাও বলব।

—কবে বলবি?

ও পাহাড় থেকে ফিরুক, তারপর বলব।

রেশমার মুখে সেই আগুন দেখে চালিহা বিশ্বাস করেছে। আর সেই প্রথম নিজের দুচোখেও গলগল করে লোভ ঠিকরেছে। ওর মাথাটা আদর করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছে, তোর থেকে বেশি আপনার আর আমার কেউ না। নগদ টাকা হাতে নেই এখন, রাতে আসিস দিয়ে দেব।

রাতে এসেছে। আসবে না কেন, শয়তানের হাতে চলে গেলে আর কার পরোয়া? রাতে ডাকার অর্থ জেনেও এসেছে। এরপর আর কিছুই যায় আসে না। চালিহা ওকে দারুণ খাতির করেছে। কড়কড়ে টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়েছে। রেশমা মদ ঘৃণা করে, কিন্তু চালিহা আদর করে সেই মদও ওকে খাওয়াতে পেরেছে। তারপর নরকে ডুবেছে। নিজেকে ধ্বংস করতেই চায়। নিজেকে, সেই সঙ্গে আর একজনকে।

কিন্তু পরদিন সকালে সেই বাংলোয় বাপীভাইকে দেখে রেশমার বুকের তলায় হঠাৎ প্রচণ্ড মোচড় পড়েছে। প্রাণপণে তখন সেই শয়তানকেই আঁকড়ে ধরেছে সে। নিজেকে দ্বিগুণ হিংস্র করে তুলতে চেয়েছে।

বাপীভাই চলে যাবার পর চালিহা ওকে মালকানের কাছে ঠেলে পাঠাতে চেয়েছে। কিন্তু রেশমা আবার যেন পঙ্গু হয়ে পড়েছে। শয়তান তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও বাঘিনীটাকে আর বুকের মধ্যে ধরে রাখতে পারছে না। তবু অক্লান্ত চেষ্টা করছে। চালিহাকে বলেছে, আজ না, মালকানের কাছে কাল যাবে।

চালিহার সবুর সয় না।—কাল কেন? আজ নয় কেন?

রেশমা বলেছে, আজ রাতেও তোমার কাছে থাকব। তাড়া দিও না। আমার মন মেজাজ এখনো ভালো না।

চালিহা লোভের টোপ গিলেছে, আর তাগিদ দিতেও সাহস করেনি।

পরদিন সকাল থেকে রেশমা আরো গুম। শয়তানও ওর সঙ্গে শয়তানি করেছে। ওকে ছেড়ে চলেই গেছে। ভিতরের সেই বাঘিনীও উধাও। এদিকে চালিহারও তাগিদ বেড়েছে। ওকে মালকানের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত।

ভেবেচিন্তে রেশমা একটা মতলব এঁটেছে। তাকেই ঢিট করার মতলব। চালিহাকে বলেছে, সকালে নয়, দুপুরে যাবে মালকানের কাছে। তখন তাকে নিরিবিলিতে পাবে। আর পরামর্শ দিয়েছে, তুমি সায়েব, পাহাড়ের বাংলোয় চলে যাও। আমি যা-ই বলি, ঝগড়ুকে মেমসায়েব জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। আমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার নাম করে তুমি আগেভাগে গিয়ে তার মগজে যা ঢোকাবার ঢুকিয়ে দিয়ে এসো। তারপর রাতে এসে মালকানকে যা বলার বোলো।

রেশমা জানে এই লোকের কোনো নোংরা কথা ঝগড়ু বিশ্বাস করবে না। তার নজরে বাপীভাইয়ের পাহাড়ের মতো উঁচু মাথা। রেশমার মতলব হাসিল হলে চালিহা উল্টে আরো বেশি নিজের কলে পড়বে।

দুপুরে রেশমা নিজের ডেরায় ফিরেছে। হারমা ঘরের সামনে বসে আছে দেখে বিরক্ত হতে গিয়েও ফিকফিক করে হেসেছে। কাছে এসে ওর ঝাঁকড়া চুল মুঠো করে ধরে মাথাটা ঝাঁকিয়েছে আর আদুরে গলায় বলেছে, আমার ওপর তোরা সব্বাই খুব রেগে গেছিস জানি। কিন্তু আজ থেকেই বুঝবি আমি কতো ভালো মেয়ে।

এ-কথা হারমাই পরে বলেছে দুলারিকে। দু’দিন ধরে রক্ত সত্যি টগবগ করে ফুটছিল হারমার। রেশমাকে নাগালের মধ্যে পেলে খুনই করে ফেলবে ঠিক করেছিল। কিন্তু তার কথা শুনে আর অত হাসি দেখে হারমা হকচকিয়ে গেছল। রাগও জল।

রেশমা তক্ষুনি হারমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে দুলারিকে ডেকে আনার জন্য। এক্ষুনি আসতে হবে, খুব দরকার।

দুরাত ওই শয়তানের বাংলোয় কাটিয়েছে জানার পর দুলারি আর তার মুখ দেখবে ভাবেনি। কিন্তু ডাকছে শুনে না এসে পারেনি। ওই মুখপুড়ি যে কতখানি ওর, জানে বলেই ডেকেছে। তাছাড়া অনেক জানার আছে, অনেক বোঝার আছে। না এলে জানবে কি করে, বুঝবে কি করে?

এসেছে। দুলারিকে জড়িয়ে ধরে সে কি আদরের ঘটা ওর। আর সে কি হাসি! যেন দুনিয়া জয় করে ঘরে ফিরল। খুশি ধরে না। তেমনি হাসিমুখে ওর আদ্যোপান্ত সব বলল। শুনতে শুনতে দুলারি স্তব্ধ। কিন্তু ওর ভ্রূক্ষেপ নেই। শয়তান ওকে ছেড়ে গেছে। ভিতরের বাঘিনী পালিয়েছে। আর ওর কাকে ভয়? এবারে ওই ম্যানেজারকে জব্দ করার পালা। মোক্ষম জব্দই করবে। এমন জব্দ করবে যে দুলারি আবু সায়েব এমন কি বাপীভাইয়েরও ওর ওপর আর একটুও রাগ থাকবে না।

ও কি করবে বা কি মতলব এঁটেছে বার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও বলল না। হেসেছে আর মাথা নেড়েছে। সেটি হচ্ছে না। আগে থেকে জানা-জানি হলে সর্বনাশ। সব ভেস্তে যাবে। এত কাণ্ডর পর মেয়েটার মাথাই খারাপ হয়ে গেল কিনা দুলারি ভেবে পায়নি।…ওই চালিহাকে খুন-টুন করে বসে শেষে সব কবুল করার ফন্দি আঁটছে না তো? ও না পারে কি?

মোট কথা মেয়েটার অত হাসি দুলারির ভালো লাগেনি। তার ওপর দু’হাজার টাকার পুঁটলিটা তার হাতে দিয়ে কি করতে হবে বলতে আরো খটকা লেগেছে। কিন্তু ভাবার সময় পায়নি খুব। রেশমা আবার ঠেলে তুলে দিয়েছে ওকে। বলেছে, হারমার সঙ্গে ওর দরকারি কথা আছে, পরে দেখা হবে।

দুলারির দুশ্চিন্তা বেড়েছে আরো। ওই হারমার সঙ্গে জোট বেঁধে কিছু একটা করে বসার মতলবে আছে নাকি?

দুলারি চলে যেতে রেশমা বেরিয়ে এলো। হারমাকে বলল, তুই আর বসে আছিস কেন, ঘরে যা। আমার দরকারি কাজ আছে, এক্ষুনি বেরুবো।

হারমা গোঁজ হয়ে বসে থেকে জবাব দিয়েছে, আমার আর ঘর কোথায়। এ-কথা শুনে রেশমা নাকি হাসতে লাগল আর ওকে দেখতে লাগল। তার পর কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা আজ থেকে আমার এই ঘরই তোর ঘর। আবার ঘরে ঢুকে দুটো টাকা এনে ওর হাতে দিল—সমস্ত দিন খাওয়া হয়নি মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যা খেয়ে আয়—

হারমা তাও নড়ে না।

—অবাধ্য হলে রাগ করব বলে দিচ্ছি, যা চটপট খেয়ে আয়।

হারমা চলে গেল। কিন্তু আসলে কোথাও না গিয়ে একটু ঘুরে রেশমার ডেরার পিছনে এলো আবার। নিজের এত ভাগ্য বিশ্বাস করতে পারছিল না। রেশমা কোথায় বেরুবে, কি তার দরকারি কাজ না দেখে থাকে কি করে। তাছাড়া ওর সেই হাসিমুখ দেখেই ক্ষুধাতৃষ্ণা গেছে।

একটু বাদে রেশমা বেরুলো। কিন্তু হারমা ভেবে পেল না কোথায় চলল ও। রাস্তার দিকে নয়, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যে-দিকে চলেছে সে-দিকে তো সাপ-ঘর! ভয়ে ভয়ে হারমা অনেকটা ফারাক রেখে গাছের আড়ালে আড়ালে চলছে। দেখে ফেললে কি মূর্তি ধরবে সেই ভয় আছে।

বেশ দূরে একটা গাছের ওধারেই দাঁড়িয়ে গেল হারমা। সামনে আর গাছ নেই, আর এগোলে দেখে ফেলবে। বাঁশের বেড়া সরিয়ে রেশমা দাওয়ার দিকে এগলো। তারপর সামনের বড় সাপ-ঘরটার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল।

এই ঘরে হঠাৎ কি দরকার পড়তে পারে রেশমার, হারমা ভেবেই পাচ্ছে না। পাহাড়ের বাংলো থেকে সাপের বিষ বার করা শিখে এসেছে, এ অনেকদিন আগে রেশমাই ওকে বলেছিল। সেই বিষ বার করতে গেল? বিষের নাকি অনেক দাম। কিন্তু বিষ দিয়ে রেশমা কি করবে? চুরি করে বিক্রি করবে? না কি কাউকে সাবড়ে দেবার মতলব!

ঝুপড়ির মুখ একটু একটু ফাঁক করে খুব বিষাক্ত সাপ টেনে বার করা জল—ভাত ব্যাপার। ভয়ের কিছু নেই। হারমা নিজেও পারে। অথচ কি একটা ভয় হারমার বুকের ওপর চেপে বসেছিল। রেশমা এত দেরি করছে কেন? তিন-পো ঘণ্টা পার হতে চলল—বেরিয়ে আসছে না কেন?

আর পারা গেল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। পা টিপে দাওয়ায় উঠল। আস্তে আস্তে দরজাও ঠেলল। তারপর মেঝেতে ওই দৃশ্য দেখে একটা আর্তনাদ করে বাইরে ছুটল।

.

টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখল বাপী। রাত এগারোটা বেজে দশ। ঘুম এই রাতে আর আসবে মনে হয় না।…দু’হাজার টাকার সেই পুঁটলিটা ফেরার সময় বাপী ঊর্মিলার হাতে দিয়েছে। তার মাকে দিতে বলেছে। আর যা শুনেছে সব তাকে বলতে বলেছে। রণজিৎ চালিহাকে রেশমা মোক্ষম জব্দ করে গেল বটে। পাহাড় থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অঘটনের খবর তার কানে গেছেই। তারপর সাহস করে সে আর পাশের বাংলোয় এসে গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা করেনি নিশ্চয়। কথার খেলাপ করে যে মেয়ে এ-ভাবে নিজের জীবন দিয়েছে, তার আগে হাটে হাঁড়ি কতটা ভেঙে দিয়ে গেছে কে জানে? দু’রাত পর পর ওই মেয়ে তার বাংলোয় কাটিয়েছে এও আর গোপন থাকবে না। আত্মঘাতিনী হবার ফলে ম্যানেজারের বাংলোয় রাত কাটানো নিয়েই সকলের বিকৃত জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলো থেকে নড়ার সাহস এই রাতে অন্তত চালিহার হবে না।

কিন্তু বাপী কি করবে এখন? টর্চটা হাতে করে রেশমার ডেরায় চলে যাবে? ওকে সেখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছে এখন। আবু বসে পাহারা দিচ্ছে। সংস্কারবশে হারমার বাপ ধামন ওঝা সাপেকাটা মরাকে চব্বিশ ঘণ্টার আগে মাটি চাপা দিতে নিষেধ করে গেছে। যে মুখ চোখের সামনে থেকে সরানোই যাচ্ছে না, চুপচাপ বেরিয়ে গিয়ে বাপী আবুর সঙ্গে তার কাছে গিয়েই বসে থাকবে?

—বাপী সাব! বাপী সাব! বাপী সাব!

আচমকা চিৎকারে অন্ধকার রাতের স্তব্ধতা খান-খান হয়ে গেল। সুইচটা টিপে একলাফে বিছানা থেকে নেমে বারান্দার দরজা খুলে বাপী বেরিয়ে এলো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কে। বারান্দার আলো জ্বালল।

রণজিৎ চালিহার কম্বাইন্ড হ্যান্ড অর্জুন। ভয়ার্ত মুখ। দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বেদম হাঁপাচ্ছে।

তার কথা শুনে বাপী কাঠ কয়েক মুহূর্ত। অর্জুন ঘুমোচ্ছিল। একটু আগে তার সায়েবকে সাপে কেটেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করে কয়েকজন লোক জুটিয়ে সে সাইকেল নিয়ে এখানে খবর দিতে ছুটে এসেছে। মেমসায়েব তাকে জলদি গাড়ি বার করে বাংলোর সামনে দাঁড়াতে বলেছেন। তিনিও যাবেন

দু’মিনিটের মধ্যে গাড়ি নিয়ে বাপী পাশের বাংলোয় এলো। বারান্দায় গায়ত্রী রাই আর বিবর্ণ মুখে ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে। গায়ত্রী রাই একাই নেমে এলো। ঊর্মিলার নড়াচড়ারও শক্তি নেই যেন। অর্জুন সাইকেল নিয়ে আগেই ছুটে বেরিয়ে গেছে।

রণজিৎ চালিহার শোবার ঘরে আট-দশজন লোক। প্রতিবেশী হবে। কিন্তু বাপী সব থেকে অবাক সেখানে হারমাকে দেখে। তার মুখে রক্ত। হাতে একটা ছোরা। সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। দু’মিনিটের মধ্যেই মুখ ধুয়ে ফিরে এলো।

চালিহা বিছানায় পড়ে আছে। অত ফর্সা মুখ কালচে, বিবর্ণ। সেটা ভয়ে কি বিষে বাপী ঠাওর করতে পারল না। জ্ঞান আছে কি নেই তাও বোঝা যাচ্ছে না। সম্বিৎ ফিরতে হাত তুলে বাপী নাড়ী দেখল। পালস্ অস্বাভাবিক দ্রুত। হাঁটুর নিচে পায়ের পিছনে মাংসালো জায়গায় সাপে কেটেছে। হারমা কাছাকাছিই ছিল নাকি। অর্জুনের চেঁচামেচি শুনে ভিতরে ঢুকেছে। তারপর প্রাথমিক যা করার সে-ই করেছে। হাঁটুর ঠিক নিচে শক্ত বাঁধন দিয়েছে। আর হাঁটুর ছ’আঙুল ওপরে আর একটা। তার সঙ্গে ওই ছোরাটা ছিল। সেটা দিয়ে সাপে কাটা জায়গা আরো বেশি করে কেটে দিয়ে রক্ত বার করে দিয়েছে। একবারে বিষকালা রক্ত বেরিয়েছে গলগল করে। তারপর মুখ লাগিয়ে ও অনেকটা রক্ত টেনে এনেছে—বিষ কতটা বার করতে পেরেছে জানে না।

হারমা বিড়বিড় করে বলল, সায়েব ভয়ে ভিরমি খেয়েছে—আর ভয় নেই, বেঁচে যাবে।

চা-বাগানের হাসপাতালে খবর দেওয়া হয়েছিল। তাদের গাড়ি এলো, রণজিৎ চালিহাকে তুলে নিয়ে গেল।

তখন পর্যন্ত বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি বাপীর।…সাপের জায়গা, বাংলোয় সাপ ঢোকাটা আশ্চর্য কিছু না। কিন্তু ঢুকতে পারে না বড়। কারণ সব জানলাতেই পাতলা তারের জাল লাগানো থাকে। বাপী তিনটে জানলা চেয়ে চেয়ে দেখল। পায়ের দিকের জানলার জাল বেশ খানিকটা ছেঁড়া আর দুমড়নো। মাথায় রক্ত ওঠার দাখিল বাপীর। ঘরে তখন কেবল গায়ত্রী রাই আর সে। অর্জুন তার সায়েবের সঙ্গে হাসপাতালে। কাছে ডেকে বাপী গায়ত্রী রাইকে ছেঁড়া জালটা দেখালো। চাপা গলায় বলল, জাল কেটে কেউ ঢুকিয়ে না দিলে এ-ঘরে সাপ ঢুকতে পারে না।

গায়ত্রী রাই একটি কথাও বলল না। সমস্ত মুখ অদ্ভুত সাদা। তার হার্টের কথা চিন্তা করেই বাপী হাত ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলল। সব কটা আলো জ্বালাই থাকল। বাপী বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

গায়ত্রী রাই গাড়িতেও নির্বাক।

হেড লাইটের আলোয় বাপী দেখল, পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে একটা লোক শ্লথ পায়ে হেঁটে চলেছে। হারমা। লাইট দেখে সেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তার সামনে এসে বাপী গাড়ি থামালো। হেড লাইট নেভালো। গায়ত্রী রাইকে বলল, একটু বসুন, আসছি।

নেমে এসে হারমাকে গাড়ি থেকে আট-দশ হাত দূরে গিয়ে ধরল। তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইল খানিক। হারমার ভাবলেশশূন্য মুখে শুধু রাজ্যের ক্লান্তি। চেয়ে আছে সে-ও।

—তুমি এত রাতে এদিকে এসেছিলে কেন?

হারমা নিরুত্তর।

—কি করছিলে?

নিরুত্তর।

বাপীর গলার স্বর কঠিন এবার।—আমাকে বিশ্বাস করে যা জিগ্যেস করছি জবাব দাও!

বিড়বিড় করে বলল, এদিকে এসেছিলাম।

—এত রাত্তিরে কেন এসেছিলে? তোমার সঙ্গে ওই ছোরা ছিল কেন? ঘোলাটে চোখে হারমা চেয়ে রইল খানিক।—দুশমনকে খতম করব বলে এসেছিলাম। ওই ছোরা দিয়ে খোদা তাকে বাঁচিয়ে দিল।

আর দু’চার কথায় ব্যাপারটা বুঝে নিল বাপী। রাতে সুযোগ না পেলে ভোরে বাংলোয় ডুকে সায়েবকে শেষ করার সংকল্প নিয়ে এসেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাংলোয় ঢুকে দেখে আল্লা তাকে আগেই শাস্তি দিয়েছে। তক্ষুনি আল্লার ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয়ে গেল ওর—আল্লা রেশমাকে নিয়েছে। তাই খোদা এবারে যাকে মারতে গেল হারমা তাকে বাঁচিয়ে দিল। হঠাৎ বিষম রাগে ওই কালো দেহের ছাতি ফুলে উঠল, বলল, আমি ভুল করলাম, আবার বদলা নেব।

বাপী দেখছে ওকে। এবারে ঠাণ্ডা গলায় বলল, খোদা ওই সায়েবকে শাস্তি দেয়নি, জানলার জাল কেটে কেউ তার ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে গেছে। তুমি? বিমূঢ় মুখে মাথা নাড়ল লোকটা। সে নয়। পরের মুহূর্তে কিছু মনে হতে চমকে উঠল যেন। সামলে নিয়ে আবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

—তুমি দেখেছ কাউকে?

মাথা নাড়ল, দেখেনি

—ভালো করে ভেবে দেখো। দেখেছ? কে এমন কাজ করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

হঠাৎ গলার স্বর গমগম করে উঠল ওর।—কিছু মনে হয় না। আমি জানি না। আমি কাউকে দেখিনি। হনহন করে হেঁটে চলল।

গাড়িতে ফিরে আসতে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে?

—হারমা। এক ওঝার ছেলে। রেশমাকে খুব ভালোবাসত।

—তাহলে ওরই কাজ?

বাপী জবাব দিল, না—মিস্টার চালিহাকে ও-ই বাঁচিয়ে দিল ভেবে এখন পস্তাচ্ছে।

বাকি রাতটুকু দু’চোখের পাতা আর এক করা গেল না। খুব ভোরে বাপী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গা-জুড়নো ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা বাতাস। পাশে বসন্তের রং—ছোপানো বানারজুলির জঙ্গল। বনমায়া নেই। রেশমা নেই। এই বাতাস আর এই বসন্ত বিদ্রূপে ঠাসা এখন।

সাপে কাটা রোগী হামেশাই আসে এখানকার হাসপাতালে। তাই চিকিৎসার ব্যবস্থাও ভালো। রণজিৎ চালিহাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। এত সকালে বাপী তাকে দেখতে আসেনি। খবর নিতে এসেছে। মেট্রনের কাছ থেকে খবর পেল ভালো আছে। তবে জ্বর খুব। এমনি ছোরা দিয়ে ক্ষত জায়গা কেটে দেওয়ার দরুন অ্যান্টিটিটেনাস দিতে হয়েছে। প্রাণের ভয় নেই আর, কিন্তু প্রচণ্ড রকমের নার্ভাস শকের দরুন পেশেন্ট খুবই কাহিল। যে লোকটা ক্ষত জায়গা কেটে বিষরক্ত বার করে দিয়েছে আর জায়গামতো দু-দুটো বাঁধন দিয়েছে তার খুব প্রশংসা করেছে ডাক্তাররা।

গাড়িতে ফিরে এলো। এক জায়গায় এসে জঙ্গলের ধারের রাস্তায় গাড়ি থামালো আবার। এখান থেকে জঙ্গলের পথে আবুর ঘর দূরে নয় খুব।

দুলারি দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। দূর থেকে বাপীকে দেখল। চোখে একবারও পলক পড়ল না। নিশ্চল পাথর-মূর্তি।

বাপী ওর কাছে দাওয়ার সামনে দাঁড়ালো। এ-ও সমস্ত রাত ঘুমোয়নি বোঝা যায়। এই চোখে গতকালের মতো আগুন ঠিকরোচ্ছে না এখন। পাথর-মূর্তির মতো শুধু অপলক। অনেকটা হারমার মতো ভাবলেশশূন্য।

সাদামাটা সুরে বাপী জিগ্যেস করল, আবু রাতে ঘরে ফেরেনি তো?

মাথা নাড়ল। ফেরেনি।

জানা কথাই। গতকাল বিকেল থেকে রেশমার ডেরায় আছে। মাটি না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। বাপী দুলারির কাছেই এসেছে। কিছু বলতে নয়, শুধু দেখতে। দেখছেও। অনেক কাল আগের সেই দুলারিকে মনে পড়ছে। যখন রেশমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সাপ খেলা দেখাতো, গাল ফুলিয়ে সাপের বাঁশি বাজাতো, হাঁটু মুড়ে বসে সামনের ফণা-তোলা সাপের মতোই সামনে পিছনে কোমর বুক মাথা দোলাতো আর বার বার মাটিতে হাত পেতে দিয়ে ছোবল পড়ার আগেই পলকে সে হাত টেনে নিয়ে সাপকে উত্তেজিত করত। বাপী তখন রেশমার থেকে সেই দুলারিকেই ঢের সাংঘাতিক মেয়ে ভাবত।

এতকাল বাদে আজ আবার সেই দুলারিকেই দেখছে বাপী। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে শুধু দেখাটা বিসদৃশ। বলল, এ-দিকের ব্যাপার তো শুনেছ?

দুলারি চেয়েই আছে। এখনো জিজ্ঞেস করল না কি ব্যাপার বা কি শুনবে।

—কাল রাত এগারোটা নাগাদ রণজিৎ চালিহাকে খুব বিষাক্ত সাপে কেটেছে।…ওর চাকর এসে খবর দিতে আমি আর তোমাদের মেমসায়েব তক্ষুনি গেছলাম। চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলছে বাপী। জানলার জাল কেটে কেউ ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে গেছে। খুব বরাত ভালো লোকটার…ওই হারমার জন্যেই বড় বাঁচা বেঁচে গেল।

যা দেখার এবারে নির্ভুল দেখল বাপী। ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়াল দুলারি। মুহূর্তের মধ্যে চোখে সেই আগুন নেমে এলো। এই শেষের খবরটাই যেন সর্বাঙ্গ ঝলসে দিয়ে গেল ওর—হারমার জন্য বেঁচে গেল! হারমার জন্য! ও কি করেছে?

বাপী বলল কি করেছে।

—হারমা! হারমা এই কাজ করল! হারমা ওই শয়তানকে বাঁচিয়ে দিল! বাপীর নির্লিপ্ত মুখ। গলার স্বরও ঠাণ্ডা।—তুমি তাহলে জানতে চালিহা সাহেবকে সাপে কাটবে?

সেই ছেলেবেলা হলে এই চাউনি দেখেই বাপী হয়তো ভয়ে তিন পা সরে যেত।

—হ্যাঁ, জানতাম। তুমিও বুঝেছ বলেই এত সকালে এখানে ছুটে এসেছ, তাও তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে। তোমার বন্ধুও শোনামাত্র বুঝবে। কিন্তু আমায় কে কি করবে? কে ছেড়েছে বলার জন্য ওই সাপ ফিরে আসবে, না তার গায়ে আমার হাতের দাগ থাকবে? ওই হারমাকে আমি দেখে নেব, বুঝলে? আর রেশমাকে যে শেষ করেছে, এবার প্রাণে বাঁচলেও সেই শয়তানকে আমি আর বেশিদিন এই বানারজুলির বাতাস টানতে দেব ভেবেছ?

এবারে চাপা ধমকের সুরে বাপী বলল, এখন মাথা খারাপ করবার সময় নয়—যা বলি শুনে রাখো। কটা দিন এখন মুখ সেলাই করে থাকবে। হারমাকে একটি কথাও বলবে না, আবু যা বোঝার বুঝুক, নিজে থেকে তুমি কিছু বলবে না। নিশ্চিন্ত থাকো, যাকে সরাতে চাও এবারে সে নিজেই সরবে—বানারজুলির বাতাস বেশিদিন তাকে নিতে হবে না।

.

পরের পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যে বাপী আর একবারও হাসপাতালে যায়নি। গায়ত্ৰী রাই রোজ একবার করে গেছে। কিন্তু তিন মিনিটও থাকেনি। দেখেই চলে এসেছে। সেদিন ঊর্মিলা সঙ্গে ছিল। সে এসে বাপীকে খবর দিল, আংকল তার কথা শোনার জন্য মাকে বার বার বলছিল। পরে মায়ের মুখে শুনেছে, রোজই বলে তার নাকি অনেক কথা বলার আছে। সেদিন মা তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তারও অনেক কথা শোনা হয়ে গেছে—কিন্তু আপাতত তার কারো কোনো কথা শোনার ইচ্ছে নেই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই আংকল যেন এখন আসাম চলে যায়। পরের কথা পরে।

শুনে আংকলের মুখ আমসি একেবারে।

বাপী হাসপাতালে তার কেবিনে এলো আরো দু-দিন বাদে। বিকেলে। পরের দিন সকালে সে নিজের বাংলোয় আসছে শুনেছে।

বেড-এর মাথার দিকে পিঠে ঠেস দিয়ে বসেছিল, ওকে দেখেই রণজিৎ চালিহা অন্যদিকে মুখ ফেরালো। অনেক দিন বাদে সেই ওপরওয়ালার গাম্ভীর্য আর বিরক্তি টেনে আনার চেষ্টা। কিন্তু মুখ দেখে বাপীর মনে হল এই কদিনে লোকটার দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে বাপী পাশে বসল।—কাল বাংলোয় ফিরছেন শুনলাম?

চালিহা তার দিকে ফিরল। ক্রূর সন্দিগ্ধ চাউনি।—তোমার কি ধারণা হাসপাতালেই থেকে যাব?

—না। তারপর আপনি আসাম যাচ্ছেন কবে?

পিঁজরায় পোরা হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল রণজিৎ চালিহা।—সে খোঁজে তোমার কি দরকার? আমার ঘরের জানলার জাল কেটে সাপ ঢোকানো হয়েছে…এ খবরটা জানা আছে?

—আছে।

—কে করেছে এ কাজ? এত সাহস কার?

—জানি না।

—কিন্তু আমি জানব! আমি তার টুটি টিপে ধরব—বুঝলে?

—চেষ্টা করে দেখুন। আমার আপত্তি নেই।

সন্দিগ্ধ দুই চোখ মুখের ওপর থমকে রইল একটু।—তুমি আপত্তি করার কে?

—আপনার সঙ্গে ফয়সালা এরপর আমার হবে ভেবেছিলাম। আপনি এ চেষ্টায় এগিয়ে এলে তার আর দরকার হবে না। রেশমা কেন নেই কারো জানতে বাকি নেই। আপনি যাদের খুঁজছেন তারা এখনো আপনার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় আছে। আমি বাধা না দিলে তাদের সুবিধে।

রাগে কাঁপছে লোকটা। কিন্তু বাপী জানে আসলে ত্রাসে কাঁপছে। জালে-পড়া জানোয়ারের ত্রাসে রাগের ঝাপটাই বড় হয়ে ওঠে।—তুমি তাহলে আমাকে ভয় দেখাতে এসেছ, কেমন?

—শুনুন! এবারে ঠাণ্ডা কঠিন গলায় বাপী বলে গেল, মিসেস রাইয়ের অনেক ধৈর্য…মাত্রা ছাড়িয়ে ড্রিঙ্ক করে বৃষ্টির পাহাড়ী রাস্তায় তাঁর স্বামীর জিপ—অ্যাকসিডেন্ট করাটা আর তার আগে আপনার সেই জিপ থেকে নেমে যাওয়াটা তিনি খুব সাদা চোখে দেখেননি। তবু এত ধৈর্য যে আপনাকে তিনি এ পর্যন্ত বরদাস্ত করে এসেছেন। তাঁর কাছে এতদিন থেকে আমিও কিছু ধৈর্য শিখেছি। নইলে এবারে যে ষড়যন্ত্রে আপনি নেমেছিলেন, তার জবাব আমারই দেবার কথা। কিন্তু কাল আপনার ঘরে ফেরার পর থেকে আমারও ধৈর্যের মেয়াদ আর তিন দিন। হাতে গুনে তিনটি দিন। সেই তিনদিনের জন্য আপনার জীবনের দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু তারপর আপনাকে আর এই বানারজুলিতে দেখা গেলে আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকবে না।

চালিহার সমস্ত মুখ এখন পাংশু বিবর্ণ

বাপী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

বাংলোর বারান্দায় মা-মেয়ে বসে। গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে বাপী নামল। বারান্দায় উঠে সামনের চেয়ার টেনে বসল। গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, পাঁচটার আগেই আপিস ছেড়ে হুট করে কোথায় চলে গেছলে?

—হাসপাতালে। চালিহার কাছে।

আজ আর মিস্টার বা সাহেব জুড়ল না, ওই কানে তাও ধরা পড়ল মনে হল। তার দিকে চেয়ে একটু অপেক্ষা করল।—কেন? কি কথা হল?

বাপী শান্তমুখে জানালো কেন, বা কি কথা হল। কিছুই গোপন করল না।

ঊর্মিলার চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা। কিন্তু গায়ত্রী রাই বিরক্ত হঠাৎ।—কেন তুমি আগবাড়িয়ে এ-সব বলতে গেলে? সে আসাম চলে গেলে পরে ব্যবস্থা আমিই করতাম। এখন গোঁ ধরে যদি না যায়?

বাপী তেমনি নির্লিপ্ত, নিরুদ্বিগ্ন। ঠাণ্ডা স্পষ্ট জবাব দিল, না যদি যায়, আপনি আমার নামে কুকুর পুষবেন।

গায়ত্রী রাই চেয়ে রইল। তার মেয়েও নতুন মুখ দেখছে।

সোনার হরিণ নেই – ২২

বাপীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ করে তিনরাতের মধ্যে রণজিৎ চালিহা বেত-খাওয়া কুকুরের মতো বানারজুলি থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাপী যা বলে এসেছিল তারপর আর তার গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা করারও মুখ ছিল না বা সাহস ছিল না। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবার খবরটা কানে আসতে গায়ত্রী রাই মুখে একটি কথাও বলেনি বা কোনো মন্তব্য করেনি। রাতে খাবার টেবিলে বসে কেবল টিপে-টিপে হেসেছে আর বাপীকে লক্ষ্য করেছে। দুষ্টু দামাল ছেলের কাণ্ড দেখা প্রসন্ন কমনীয় মিষ্টি-মিষ্টি হাসি।

তাই দেখে ঊর্মিলার হঠাৎ হি-হি হাসি। হাসির চোটে বিষম খেয়ে নাকের জলে চোখের জলে একাকার। গায়ত্রী রাই ওকে ধমকে থামাতে চেষ্টা করে শেষে নিজেই আবার হেসে ফেলল।—এত হাসির কি হল তোর?

জবাবে চোখেমুখে জল দেবার জন্য ঊর্মিলা বাথরুমের দিকে ছুটেছে। পরে একলা পেয়ে বাপীকে বলেছে, মা তোমাকে যেভাবে দেখছিল আর হাসছিল, তাইতে আমার সেই কথা মনে আসছিল।

—কি কথা?

চপল খুশিতে ঊর্মিলার রক্তবর্ণ মুখ তখনো।—তোমার বয়েস আর দশটা বছর বেশি হলে আর মায়ের দশ বছর কম হলে কি হত!

বাপী ওকে সতর্ক করার একটা বড় সুযোগ ফসকালো। বলতে পারত, বয়েসের ফারাক যে-দুজনের একটুও আপত্তিকর নয়, মা যদি তাদের মধ্যে কিছু ঘটাতে চায়, তাহলে কি হবে?

বলা গেল না। ওর মায়ের কোন উদ্দেশ্য পণ্ড করার জন্য এমন একটা ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে বসেছিল রণজিৎ চালিহা, এই মেয়ের মাথায় সেটা ঢোকেইনি। জানলে এই হাসিমুখ আমসি হয়ে যেত।

চালিহা উধাও হবার তিন-চার দিনের মধ্যে তার আসামের ঠিকানায় গায়ত্রী রাইয়ের সই-করা রেজিষ্ট্রি চিঠি গেছে। টাইপ করা সেই চিঠির কপি বাপী দেখেছে। অল্প কথায় ঠাণ্ডা বিদায়। রাই অ্যান্ড রাই-এর সমস্ত দায়িত্বভার থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হল। এই সংস্থার সঙ্গে আর তার কোনরকম সংস্রব থাকল না।

মহিলার পাকা কাজ। কাগজে কলমে চিফ একজিকিউটিভ এখন বাপী তরফদার—ভুটান সিকিম নেপাল বিহার মধ্যপ্রদেশ আর উত্তর বাংলার ছোট বড় সমস্ত ক্লায়েন্টের কাছে মহিলার স্বাক্ষরে রেজিষ্ট্রি ডাকে সেই ঘোষণাও তড়িঘড়ি পৌঁছে গেছে। আসামের মার্কেট হাতছাড়া হল বলে একটুও খেদ নেই তার। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে এবার ওয়েস্ট বেঙ্গলের মার্কেটও যাচাই করে আসার পরামর্শ দিয়েছে বাপীকে। সব কটা প্রভিন্স-এর জন্য তার অধীনে দেখে শুনে একজন করে রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার নেবার কথা বলেছে। ওকে সকলের ওপরে রেখে ব্যবসাটা এবার ঢেলে সাজাবার ইচ্ছে তার।

কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের মাথায় আরো কি আছে বাপীর কল্পনার মধ্যেও ছিল না। জানা গেল আরো আট-ন মাস বাদে। যে লোভে শুরু থেকে রণজিৎ চালিহার এত দিনের এত ছলা কলা কৌশল, না চাইতে বাপীর বরাতে ভাগ্যের সেই শিকেও ছিঁড়ল।

রাই অ্যান্ড রাইয়ের সমস্ত ব্যবসার চার আনার অংশীদার বাপী তরফদার।

ওকে নিয়েই মহিলা শিলিগুড়ির অ্যাটর্নি অফিসে হাজির একদিন। তখন পর্যন্ত বাপীর ধারণা নেই কি হতে যাচ্ছে। তাই বাধা দিয়ে বলেছিল, এই শরীরে এতটা পথ গাড়িতে যাওয়ার দরকার কি আপনার—কি করতে হবে আমাকে বলুন না?

অবাধ্য হলে এখনো আগের মতই মেজাজ দেখাতে চেষ্টা করে গায়ত্রী রাই। জবাব না দিয়ে গটগট করে গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। অ্যাটর্নির সঙ্গে কথাবার্তার সময় ওকে ডাকা হল না দেখে ধরে নিয়েছে ব্যক্তিগত ব্যাপার কিছু। তার দিন—কতক বাদে গায়ত্রী রাই বাংলোর আপিস ঘরে এসে চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল। সহজ সাদামাটা মুখ। হাতে অ্যাটর্নির তৈরি একটা খসড়া। বাপীর দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, পড়ে দেখো তো—

সাধারণ কিছু ধরে নিয়েই বাপী চোখ বোলাতে শুরু করেছিল। তারপর চক্ষু স্থির। হকচকিয়ে গিয়ে খসড়াটা ফেলে তার দিকে তাকালো। মহিলার সাদা মুখ কমনীয় কৌতুকে ভরাট।

এ কি কাণ্ড! এ আপনি কি করছেন!

—কেন, তোমার আপত্তি আছে? হাসি-ছোঁয়া স্নেহ ঝরছে দু’চোখে। কিন্তু খুশির বদলে শুকনো মুখ দেখে অবাক একটু।

বাপী বলল, তা না, মানে কত ভাবে কত তো দিচ্ছেন—এক্ষুনি এর দরকার কি!

মুখের দিকে চুপচাপ খানিক চেয়ে থেকে মহিলা ওর অস্বস্তিটুকু লক্ষ্য করল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার প্রাপ্য থেকে একটুও বেশি দেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না। শরীরের যা হাল, আমার দিক থেকে কোনো কাজ ফেলে রাখার ইচ্ছে নেই।

বাপীর গলা শুকিয়ে কাঠ। চুপচাপ খসড়াটা তার দিকে ঠেলে দিল শুধু।

—ওটা অ্যাপ্রুভ করে পাঠালে দলিল হবে, আমি দেখেছি—ঠিকই আছে, তবু তুমি একবার দেখে নিতে পারো।

—আমি আর কি দেখব। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, ডলি দেখেছে?

—ওর অত সময় আছে না ধৈর্য আছে? আমার মুখে শুনেছে। সব দিক সামলে যে ভাবে এখন তুমি ব্যবসার হাল ধরে আছ, ওর মতে চার-আনার থেকে বেশিই দেওয়া উচিত। ঠোটের ফাঁকে আবার একটু হাসির রেখা স্পষ্ট হতে দেখা গেল।—আমি আরও ঢের বেশি দেবার জন্য তৈরি হয়েই আছি, কিন্তু নেবার জন্য তৈরি হতে পারছ না কেন? চোখ-কান বুজে এভাবেই বা দিন কাটাচ্ছ কেন?

বাপীর কপাল ঘেমে উঠেছে। খসড়াটা হাতে করে মহিলা উঠে দাঁড়াতে প্রায় অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, দলিল করার জন্য এক্ষুনি ওটা না পাঠালে ভালো হয়। এরকম বাধা আদৌ প্রত্যাশিত নয়। গায়ত্রী রাইয়ের দু-চোখ ওর মুখের ওপর স্থির খানিক।—কেন?

বাপী চুপ। কি বলবে? কি বলতে পারে?

কমনীয় মুখে কিছু সংশয়ের আঁচড় পড়তে থাকল। গলার স্বরও নীরস একটু।—মনে যা আছে খোলাখুলি বলো। দলিল করার জন্য এক্ষুনি এটা না পাঠালে ভালো হয় কেন?

দায়ে পড়ে বাপী সত্যি জবাবই দিতে চেষ্টা করল। বলল, আপনি যা ভেবে রেখেছেন শেষ পর্যন্ত তা যদি না হয়, আপনারই খারাপ লাগবে। আপনি আমাকে অনেক দিয়েছেন, দিচ্ছেনও—পার্টনার ইচ্ছে করলে পরেও করে নিতে পারবেন।

গায়ত্রী রাই ভিতর দেখছে ওর।—আমি যা ভেবে রেখেছি তার সঙ্গে তোমাকে চার-আনার পার্টনার করার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ-কথা কেন, আমার মেয়েকে তোমার পছন্দ নয়?

বাপী আরো ফাঁপরে পড়ল। তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ডলির মতো মেয়ে আমি কমই দেখেছি। কিন্তু বলার পরই মনে হল, এবারেও ভুল বুঝল মহিলা।

অনুচ্চ গলার স্বর প্রায় কঠিন।— আমার মেয়ের যদি শেষ পর্যন্ত তোমাকে বাতিল করার মতো দুর্বুদ্ধি হয়, তাহলে তোমাকে আমার চার আনা ছেড়ে আট—আনার পার্টনার করে নেবার কথা ভাবতে হবে। ডলি আপত্তি করেছে বা তোমার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে?

সত্যি অসহায় মূর্তি বাপীর। মাথা নাড়ল। ডলি আপত্তি করেনি বা কোনো কথা হয়নি।

এত চৌকস ছেলে এ ব্যাপারে সত্যি এত ভীরু কিনা দেখছে মহিলা। এবারে গলার স্বর সদয় একটু।—আমি যতদূর বুঝেছি ডলি তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তুমি প্রায় দুটো বছর এভাবে কাটিয়ে দিলে কেন, আমি কি চাই বুঝতে তোমার বাকি ছিল?

দলিলের খসড়া হাতে চলে গেল। তার পরেও বাপী অনেকক্ষণ স্থাণুর মতো বসে।

ঊর্মিলার ইদানীংকালের বেপরোয়া মেলামেশা তার মা লক্ষ্য করেনি এমন হতে পারে না। ঝর্ণা পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে, কিন্তু নদীর দিকে গতি তার। সেই আছাড়ি-বিছাড়ির মতো বাপীর ওপর মেয়ের অমন সহজ আর নিঃসংকোচ হামলা দেখেই তার পছন্দ সম্পর্কে মায়ের এমন ধারণা। রাগ হলে বা ঝগড়া বাধলে মেয়ে তার সামনেই বাপীর কাঁধ ধরে বা দু-হাতে মাথার চুলের মুঠো ধরে ঝাঁকায়। গায়ত্রী রাই মেয়েকে বকা-ঝকা করে আর মেয়ে পাল্টা মুখঝামটা দেয়, বেশ করব, আমার সঙ্গে লাগতে আসে কেন!

ঊর্মিলা এখন গাড়ি চালানোটা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। অনায়াসে মায়ের অনুমতি আদায় করার ফলে বাপীই শিক্ষাগুরু। তার ওপর দিয়ে তখন আরো বেশি ধকল গেছে। শেখানোর সময় ঊর্মিলার হাতে স্টিয়ারিং, ব্রেক আর ক্লাচ স্বভাবতই বাপীর দখলে। ফলে স্টিয়ারিং-এর ওপর দখল আনতে হলে মেয়ের বাপীর গায়ের সঙ্গে লেপটে বসা ছাড়া উপায় কি? একটা পা, হাঁটু থেকে কোমরের একদিক, বুকের পাশের খানিকটা আর কাঁধের একদিকে বাপীর সঙ্গে এঁটে থাকবেই—কিন্তু মেয়ের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। শেখার উত্তেজনায় সমস্ত মন স্টিয়ারিংয়ের দিকে। প্রথম দিনের মহড়ার পরেই উল্টে বাপীর মাথা ঝিমঝিম করেছিল। ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছে, আমার দ্বারা হবে না—বিয়ের পরে নিজের লোককে ধরে শিখো।

অসুবিধেটা না বোঝার কথা নয় ঊর্মিলার। ওর শেখার তাড়া, কারণ বিজয় মেহেরা লিখেছে গাড়ি চালানো শিখে সে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িও কিনে ফেলেছে। অতএব ঊর্মিলাও তাকে অবাক করে দেবেই—ছেলে ফিরে এসে দেখবে ড্রাইভিং-এ ওরও পাকা হাত। বাপীর আপত্তির হেতু বুঝে হাসি চেপে চোখ পাকিয়েছে।—ধরেছি যখন না শিখে ছাড়ব না—তোমার বদলে তাহলে ওই আধবুড়ো বাদশাই মজা লুটবে।

পরদিন সকালে মায়ের সামনেই আবার হিড়হিড় করে গাড়িতে টেনে তুলেছে ওকে। তারপর তার চোখের আড়ালে গিয়ে ধমকেছে, মায়ের যখন আপত্তি হয়নি, তোমার অত সতীপনা কিসের মশাই? যার কাছে ড্রাইভিং শিখব, তার সঙ্গে জড়াজড়ি একটু হবেই মা জানে না? সঙ্গে সঙ্গে হাসি।—তুমি আমার ফ্রেন্ড আর আমি তোমার ফ্রেন্ড—ওই তকতকে নীল আকাশখানার মতো পরিষ্কার সম্পর্ক—শেখা হয়ে গেলে গুরুদক্ষিণা হিসেবে অনায়াসে একখানা চুমুও খেয়ে ফেলতে পারি।

এরপর বাপীর আর অব্যাহতি কোথায়। কিছুদিন বাদে মেয়ের হাত কিছুটা রপ্ত হতে বাপীই একটু সরে বসতে পেরে বেঁচেছে। কিন্তু এক সহজ বিশ্বাসে মেয়েটার এই বেপরোয়া মেলামেশা সত্যি যে আশ্চর্যরকম পরিষ্কার, তা অনুভব না করে পারেনি।

এভাবে আর খুব বেশি দিন কাটবে না জানত। জেনেও অসহায়। অনেক দিন থেকে মা আর মেয়ের বিপরীত প্রত্যাশা আর তাগিদ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ভাবসাব মেলামেশা দেখে গায়ত্রী রাই আশা করছে মেয়ের মনের জগৎ থেকে সেই অবাঞ্ছিত পাঞ্জাবী ছেলেটা মুছে গেছে। সে জায়গায় এই ছেলে জুড়ে বসেছে। কিন্তু আশাই করছিল শুধু, নিশ্চিত হতে পারছিল না। শরীর মোটে ভালো যাচ্ছে না। মুখ ফুটে স্বীকার না করলেও দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলে সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু দিন একে একে কেটেই যাচ্ছে, ওদের দুজনারই হাতে যেন অঢেল সময়। কারো তাড়া নেই দেখেই মহিলা মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল, বাপী তাও টের পেত। অন্যদিকে মাকে সামলাবার বা বোঝাবার সব দায় ফ্রেন্ড-এর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ঊর্মিলাও দিন গুনছে। কিন্তু মনের মানুষের ফেরার সময় এগিয়ে আসছে অথচ ফ্রেন্ড-এর তেমন মাথাব্যথা নেই। বিয়ের ব্যাপারে মায়ের দিক থেকেও স্পষ্ট কিছু তাগিদ নেই দেখেও ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি। যে ছেলে কাছে নেই, সে একেবারেই দূরে সরে গেছে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত কিনা কে জানে! তাহলে তো চিত্তির। ঘুরেফিরে তাই বাপীর ওপরেই ক্ষোভ ঊর্মিলার। এতগুলো দিন কেটে গেল, এখনো কেন মাকে বোঝাতে পারল না—মায়ের মন ফেরাতে পারল না। এত পারে আর এটুকু পারে না? এদিকে তো মায়ের চোখের মণিটি হয়ে বসে আছে একেবারে!

বাইরের দিক থেকে দেখলে প্রতিটি দিন বাপীর অনুকূলে গড়িয়ে চলেছে সেটা মিথ্যে নয়। না চাইতে গায়ত্রী রাই তার দু-হাত ভরে দিচ্ছে। সম্মান আর প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে। চিফ একজিকিউটিভ হিসাবে মাসের মাইনে দ্বিগুণ। তবু ও-টাকা টাকাই নয়। যাতে হাত দেয় তাই সোনা, তাই টাকা। টাকাই এখন বাপীর পিছনে ধাওয়া করে চলেছে। মাইনের টাকা, কমিশনের টাকা, পার্টনারশিপের ভাগের টাকা। গায়ত্রী রাইয়ের চোখের মণি হয়ে ভাগ্যের বিপুল জোয়ারেই ভাসছে বটে বাপী তরফদার।

এরই মধ্যে যে আশঙ্কা দুঃস্বপ্নের মতো বাপীর বুকে চেপে বসে আছে ঊর্মিলা তার খবর রাখে না। পরের কটা মাসের মধ্যে গায়ত্রী রাই আর একটা কথাও বলেনি। কিন্তু মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তার প্রতিটি দিন কিছু প্রতীক্ষার মধ্য দিয়ে কাটছে। ওর ওপর নির্ভর করে কখনো ঠকতে হয়নি বলেই এখনো স্থির বিশ্বাসে মহিলা সেই নির্ভরতার মর্যাদা দিয়ে চলেছে।

কিন্তু প্রতীক্ষারও শেষ আছেই।

এক সন্ধ্যায় ঊর্মিলা তার ঘরে হাজির। গনগনে মুখে সিঁদুরে মেঘ। এক ঝাপটায় বাপীর হাতের বই পাঁচহাত দূর মাটিতে ছিটকে পড়ল।

—সব তোমার জন্য বুঝলে? তুমি যতো নষ্টের গোড়া!

এরকম হামলা বা এই গোছের সম্ভাষণ নতুন কিছু নয়। শোয়া থেকে উঠে বসল।—কি ব্যাপার?

রাগের ফাটলে নাচার হাসির জেল্লা।—অমন চালাক মা বোকার মতো কি আশায় এতদিন ধরে এমন ভালোমানুষটি হয়ে ঠাণ্ডা মেরে আছে তুমি জানো?

বাপীর ভিতর নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ—তুমি কি জেনেছ তাই বলো।

জবাব না দিয়ে ঊর্মিলা আবার জিগ্যেস করল, চিকিৎসার জন্য মাকে তুমি বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছ?

—হ্যাঁ, একজন স্পেশালিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম, তাঁর মতে নিয়ে যেতে পারলে ভালই হয়।…কেন?

—একটু আগে মা সেই কথা বলতে আমি তক্ষুনি সায় দিলাম। তার উত্তরে মা কি বলল জানো? বলল, আমার বিয়ের পরে যাবে। তারপরেই জিগ্যেস করল, তোদের বিয়েটা হচ্ছে কবে আগে আমাকে সোজাসুজি বল্।

বাপীর বুক দুরুদুরু। তারপর?

—আমি হাঁ। কার সঙ্গে বিয়ে? শুনে মা রেগেই গেল। পরে বুঝলাম তার ধারণা আমার প্রেমে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ একেবারে। ধমকে বলল, এমন ভালো একটা ছেলে, সেই কবে থেকে তোর মুখ চেয়ে বসে আছে আর তুই কেবল ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছিস। ছেলেটাকে তোরও এত পছন্দ যখন মিছিমিছি দেরি করিস কেন—আমার শরীরের হাল দেখছিস না? বোঝো কাণ্ড, মা কিনা শেষে এই ভেবে বসে আছে! তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি মায়ের এ ধারণা হল কি করে?

বাপীরও ওর মতো সহজ হবার চেষ্টা। উনি যাকে এত কাছে টেনে নিয়েছেন, তাকে তুমি এমন অমানুষ ভাবো তিনি জানবেন কি করে?

—ধ্যেৎ! তুমি একটা যাচ্ছেতাই। তুমি আমার ফ্রেন্ড। সেই হিসেবে তোমাকে আমি দারুণ ভালবাসি। মা সেটাই দেখেছে কিন্তু বোঝেনি।

—তুমি আজ বুঝিয়ে দিলে না কেন?

—হুঁঃ, ধড়ফড়ানির চোটে পালিয়ে বাঁচলাম। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ চড়ল।— আমি বোঝাতে যাব কেন—দু’ বছর ধরে তুমি কি করলে? নাকি মায়ের মন বুঝে তলায় তলায় তাতেই সায় দেবার ইচ্ছে?

এবারে বাপী নির্লিপ্ত। গম্ভীরও।— নিজেকে নিয়ে বিভোর হয়ে না থাকলে মায়ের মন আমার থেকে তুমি ঢের আগেই বুঝতে পারতে।

ঊর্মিলার চোখে-মুখে সংশয়ের ছায়া।—তার মানে মা কি ভাবছে তুমি আগেই জানতে?

—তোমার মা ভাবাভাবির মধ্যে নেই। দু’ বছর ধরে তিনি নিজে যা চেয়েছেন তাই তোমাকে বলেছেন।

সোজা চেয়ে থেকে ঊর্মিলা সেই একই প্রশ্ন করল, তুমি তাহলে জানতে মা এই চায়?

—শুধু আমি কেন, অনেকে জানত। এত বড় একটা বিভ্রাটের পরেও তুমিই শুধু কিচ্ছু তলিয়ে দেখলে না বা ভাবলে না।

ঊর্মিলা এবারে বিমূঢ় খানিক। উতলাও।—কোন্ বিভ্রাটের পরেও আমি কিছু তলিয়ে দেখলাম না, ভাবলাম না? মা কি চায় সেটা তুমি ছাড়া আর কে জানত?

—রণজিৎ চালিহা জানত। রেশমা জানত। আবু রব্বানী জানত। তার বউ দুলারি জানত। তোমার মা এই চান জেনেই রণজিৎ চালিহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তোমার মায়ের কাছে তাই আমার এ-মুখ বরাবরকার মতো পুড়িয়ে দেবার জন্য টাকা ঢেলে রেশমাকে সে অমন কুৎসিত ষড়যন্ত্রের মধ্যে টেনে নামাতে চেয়েছিল। এখন বুঝতে পারছ?

ঊর্মিলা হতভম্ব। চোখে পলক পড়ছে না।—কিন্তু সকলে তো জানে আংকল ইজ্জত খেয়েছে বলে রেশমা অমন ভয়ংকর প্রায়শ্চিত্ত করে তাকে আক্কেল দিয়ে গেল!

ঠাণ্ডা মুখে বাপী জবাব দিল, অত সহজে ইজ্জত খোয়াবার মতো ঠুনকো মেয়ে নয় রেশমা। আমার ওপর আক্রোশে তার মাথার ঠিক ছিল না। সেই আক্রোশে চালিহার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমার মায়ের কাছে সেও আমার মুখ পুড়িয়েই দিতে চেয়েছিল। পরে অনুশোচনায় জ্বলেপুড়ে ঠাণ্ডা মাথায় ওই কাজ করেছে।

এক বছর পরে হলেও চোখের সামনে থেকে একটা হেঁয়ালির পর্দা সরেছে ঊর্মিলার। অস্ফুট বিস্ময়।—ওঃ! সেই জন্যেই সেই দিন নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে দুলারি তোমাকে ওই সব কথা বলেছিল!

বাপী নিরুত্তরে অন্যদিকে চেয়ে রইল।

পরের মুহূর্তে ঊর্মিলা আবার অসহিষ্ণু।—কিন্তু আমাকে তুমি কিচ্ছু বুঝতে দাওনি কেন? মায়ের মতলব জেনেও এতদিন তুমি চুপ করে ছিলে কেন?

—তাতে অশান্তি বাড়ত, মায়ের শরীর খারাপ হতো।

পায়ের নিচে থেকে নতুন করে আবার যেন মাটি সরছে ঊর্মিলার। অবুঝ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, অশান্তি কমবে? মায়ের শরীর ভালো হবে? সব জেনে-বুঝেও কেন তুমি এতদিন ধরে তাকে এমন একটা অসম্ভব ইচ্ছে আঁকড়ে ধরে থাকতে দিলে?

নিরুপায় বলেই সঙ্গে সঙ্গে বাপীও তেতেই উঠল।—তোমার কি ধারণা? কেন দিলাম?

মেয়েটা থতমত খেল একপ্রস্থ। অবিশ্বাসের এক আচমকা যন্ত্রণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছিল ঠিকই। ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা। কিছু হাল্কাও। কিন্তু গোঁ ছাড়ার মেয়ে নয়। সমান মেজাজে জবাব দিল, আমার ধারণা তুমি একটা ভীতুর ডিম—তুমি একটা ওয়ার্থলেস। বিপদ জেনেও উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছ, এদিকে তোমার ওপর নির্ভর করে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি।

নিস্পৃহ মুখে বাপী বলল, তোমার মা-ও এখন ঠিক এই কারণে আমার ওপর বিরক্ত, দু’বছর ধরে তিনিও আমার ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। এজন্য অনুযোগও করেছেন—

ফ্রেন্ডকে অবিশ্বাস করে না, করতে চায় না। কিন্তু ফের একথা শোনার পর চোখে সংশয়ের ছায়া দুলছেই একটু। মায়ের জন্যেই এ-ছেলের বেশি দরদ, বেশি দুর্ভাবনা।

—মা কি বলেছে?

—বলেছেন ব্যবসার চার-আনার অংশ ছেড়ে তিনি আরো ঢের বেশি দেবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন—আমি নেবার জন্য তৈরি হতে পারছি না কেন, সব জেনেও কেন চোখ-কান বুজে এভাবে দিন কাটাচ্ছি।

ঊর্মিলা চেয়ে আছে। এই লোকেরও ভিতর বোঝার দায় এখন। তাই নিজেকে সংযমে বাঁধাঁর চেষ্টা।—এতটা শোনার পরেও মাকে তুমি কিছু বললে না? কিছু আভাস দিলে না?

—দিয়েছিলাম। সেই জন্যেই পার্টনার হতে আপত্তি করেছিলাম। তাইতে তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁর মেয়ের যদি শেষ পর্যন্ত আমাকে বাতিল করার মতো দুর্বুদ্ধি হয়, তাহলে চার আনা ছেড়ে আট-আনার পার্টনার করে নেবার কথা ভাবতে হবে।

চেষ্টা করেও গলার স্বর খুব সংযত রাখা গেল না এবার।—আট-আনা ছেড়ে ষোলো-আনাই দিক না, কে তাকে ধরে রেখেছে?

বাপীর জবাবও এবারে প্রায় নির্মমগোছের ঠাণ্ডা।—তাও দিতে পারেন। শরীরের হাল তো ভালো নয়, তবে তাঁর ষোলো-আনাটা তোমাকে বাদ দিয়ে নয়। ঊর্মিলার ঝকঝকে দু-চোখ বাপীর মুখের ওপর নড়ে-চড়ে স্থির আবার। গলার স্বরে তপ্ত ব্যঙ্গ।—তাহলে?

—তাহলে ঘরে গিয়ে এবারে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবোগে যাও। তোমার মা আমার কাছে কতখানি সেটা তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে বলেই আমার সমস্যাটা দেখছ না—লোভের কলে পা দিলাম কিনা ভাবছ। তোমার মা হয়তো বেইমান নেমকহারাম ভাববেন আমাকে, তবু বরাবরকার মতো আমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার সুবিধে হবে? নিশ্চিন্ত হতে পারবে?

ঊর্মিলা হকচকিয়ে গেল। গালে যেন ঠাস্ করে চড় পড়ল একটা। আর একই সঙ্গে ওকে যেন একটা দম-বন্ধ করা শূন্যতার গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হল। …ও নেই, বাপী নেই—মা একা। এ-চিত্র আর ভাবাই যায় না। ফলে চিরাচরিত রাগত মুখ।—আমি তোমাকে তাই বলেছি?

—বলেছ। সব কথা মুখে বলার দরকার হয় না।—সমস্যা দুজনেরই এক এটুকু জেনে মাথা এখনই সব থেকে ঠাণ্ডা রাখা দরকার। বুঝলে?

পরের দিন-কতকের মধ্যে ঊর্মিলা মুখে আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু মাথা যে খুব ঠাণ্ডা নেই, তাও স্পষ্ট। এতটা জানা আর বোঝার পরে ঘাবড়েছে বেশ। নিজের মা-টি কত শক্ত মেয়ে বিলক্ষণ জানে। কিন্তু বাপীকে তার থেকেও জোরালো ছেলে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। এখন ভয় মা-ই না উল্টে এই ছেলেকে ঘায়েল করে। তার মতি-গতি বদলে দেয়। দিলেও ওর নাগাল কেউ পাবে না বটে, কিন্তু এমন সংকটের মধ্যে কে পড়তে চায়। এই ছেলের প্রতি মায়ের এতটুকু টান দেখলে ভিতরে ভিতরে তেতে ওঠে এখন।

ওর মনের অবস্থাটা বাপী আঁচ করতে পারে।

কিন্তু বন্ধুকে আগের মতো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেই চায় ঊর্মিলা। ভিতরে ভিতরে বিশ্বাস যে ভেঙেছে তাও নয়। তবু এরই মধ্যে সব সংশয় আর অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার মতোই কিছু চোখে পড়ল ঊর্মিলার।

নাকের ডগায় চশমা এঁটে মা কি-সব দরকারী কাগজপত্র দেখছিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাপী তখনো খবরের কাগজ পড়ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় বাপীর দু’চোখ আটকে গেল। ঊর্মিলা তারপর সেই আর একবারের মতোই স্থান-কাল ভুলে কাগজের খবরের ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখল তাকে। চোখ দিয়ে পড়ছে না, মন দিয়ে স্নায়ু দিয়ে সত্তা দিয়ে পড়ার মতো কিছু খবর যেন কাগজে আছে।

ঊর্মিলা লক্ষ্য করছে। সেই একবার কলকাতায় প্লেগের খবর পড়ে যে-রকম বিবর্ণ মুখ দেখেছিল সে-রকম নয়। কিন্তু আত্মহারা মনোযোগটুকু সেই গোছের। খবরের কাগজ খুলেই এই ছেলে প্রথমে কলকাতার খবর খোঁজে, ঊর্মিলা তাও খেয়াল করেছে। ওর এখনো বদ্ধ ধারণা, ছেলেবেলার সঙ্গিনী এক মেয়ে তার মন জুড়ে আছে যার নাম মিষ্টি। সেবারে তো বলেই বসেছিল, কলকাতার প্লেগের খবর পড়ে মূর্ছা যেতে বসেছিলে কার ভাবনায় মশাই? আজও এই মুখ আর এই একাগ্র উন্মুখ মনোযোগ দেখেই ধরে নিল, সেই এক মেয়েকে মনে পড়ার মতো কাগজে খবর আছে কিছু।

নিঃশব্দে উঠে পিছনে এসে দাঁড়াল। ঠিক কোন্ খবরটার ওপর চোখ আটকে আছে ঠাওর করা গেল না। কিন্তু কোন্ জায়গাটা পড়ছে মোটামুটি আন্দাজ করা গেল।

একটু বাদে কাগজ রেখে বাপী আপিস ঘরে চলে এলো। নিজের তখনকার চেহারা আয়নায় দেখেনি। কিন্তু ঊর্মিলা দেখেছে।

দশ মিনিটের মধ্যে নবাব-নন্দিনীর মতো দু’হাত পিছনে করে ঊর্মিলা হাজির। গম্ভীর বটে, কিন্তু মুখ থেকে মেঘের পরদা সরে গেছে।

কলকাতার মিষ্টি নামে কোনো মেয়ে দু’বছর আগে বি-এ পাশ করেছিল? হকচকিয়ে গিয়ে বাপী ওর দিকে চেয়ে রইল।

ঊর্মিলা জবাব যেন পেয়েই গেছে। আবার প্রশ্ন।—এবার তাহলে তার এম—এ পাশ করার কথা?

বাপী বোকার মতোই জিজ্ঞাসা করল, তুমি জানলে কি করে?

—তোমার মুখ দেখে। পিছনের হাত সামনে এলো। হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। ওটা সামনে ধরল। কলকাতা য়ুনিভার্সিটির এম-এ পরীক্ষার ফল বেরুনোর খবরটার চার পাশে লাল দাগ। বলল, মুখে রক্ত তুলে এমন দিশেহারা

হয়ে পড়ার মতো আর কোনো খবর এ-জায়গায় দেখলাম না। তাই মনে হল, এটাই তোমার কাছে দুনিয়ার সেরা খবর।

ঊর্মিলা হাসছে। আগের মতো তাজা হাসি।

বাপী দেখছে। এই মেয়ে এখন নিজের আর ওর সমস্যাটা এক জেনে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে।

সোনার হরিণ নেই – ২৩

গেজেটের পাতায় ছাপা নামগুলোর ওপর বাপী অনেক বার চোখ বুলিয়ে গেল। ব্যাপারখানা অপ্রত্যাশিত ধাক্কার মতোই। ইতিহাসে এম. এ-র সফল ছাত্রছাত্রীদের নামের মিছিল খুব লম্বা নয়। কিন্তু ফার্স্ট বা সেকেন্ড কোনো ক্লাসে কোনো গ্রুপে যে-নাম খুঁজছে সেটা একেবারে নেই-ই। মালা আছে, মালঞ্চ আছে, মালবী আছে—নন্দী ছেড়ে কোনো মালবিকারও অস্তিত্ব নেই।

গেজেট ফেলে বাপী হাঁ খানিকক্ষণ। এমন একটা ধাক্কা খাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বানারজুলি থেকে শিলিগুড়ি ছুটে আসেনি। আসতে আসতে বরং অন্য রকমের সম্ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।…মেয়ে বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। প্রথম তিনজনের মধ্যেও জায়গা হয়নি। এম. এ-তে না যুঝে ছাড়বে না বাপী ধরেই নিয়েছিল। গাড়ি ছুটিয়ে আসার সময় বাপীর চিন্তায় এম. এ-র ফয়সালাটা ফার্স্ট ক্লাসের দিকে ঝুঁকছিল। আর সেই কারণে কেন যেন একটু অস্বস্তিও বোধ করছিল। সেটা ঠিক ঈর্ষা বলে মানতে রাজি নয়। এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বসলে নাগালের ফারাকটা আরো বেশি লম্বা মনে হবে বাপী তা-ও স্বীকার করে না। অস্বস্তির একটা যুৎসই কারণ নিজেই হাতড়ে বার করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বসলে মিষ্টির অনেকখানি হয়তো মালবিকা হয়ে যাবে।

…ফার্স্ট ক্লাস যদি পায়ই, বাপীর এবারের টেলিগ্রামের বয়ান কি হবে তা নিয়েও মাথা ঘামিয়েছিল। তারপর ঠিক করেছে, যে-ক্লাসই হোক, ওর কাছ থেকে এক শব্দের অভিনন্দন যাবে। ফিরেও আসবে তেমনি এক শব্দের ধন্যবাদ, জানা কথাই। কিন্তু ধন্যবাদের পর এবার সেই মেয়ে মালবিকা লিখবে না মিষ্টি লিখবে?

এত সব চিন্তা-ভাবনার পরে এই! নামই নেই! কি হল? কি হতে পারে?

হতে অনেক কিছুই পারে। পরীক্ষা দিয়েও কত ফেল করে। কিন্তু মনে মনে মাথা ঝাঁকিয়েই বাপী সেই সম্ভাবনা বাতিল করে দিল। ফেল করার মেয়ে নয়। পরীক্ষার পড়া পছন্দমতো না হলেও অনেক ভালো ছেলে-মেয়ের ড্রপ করার ভূত চাপে মাথায়। সেটা বরং হতে পারে। এছাড়া আর এক সম্ভাবনার কথা মনে আসতেই ভিতরে গনগনে আগুনের ছেঁকা।

‘…বি. এ, এম. এ. পাশ করা দূরে থাক, ওই মেয়েকে ম্যাট্রিকও পাশ করতে হবে না বলে দিলাম।’

এক যুগেরও আগের সবজান্তা আবু ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল। ফকির—জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ বচনের জবাবে মিষ্টির সম্পর্কে আবু এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

তার যুক্তিও কম যুৎসই নয়।—এই বয়সেই —এই বয়সেই চেহারাখানা দেখছিস না মেয়েটার, ষোল-সতের বছরের ডবকা বয়সে এই মেয়ের চেহারাখানা কেমন হতে পারে চোখ বুজে ভেবে দেখ দিকি? তারপর আবু ব্যাখ্যা শুনিয়েছিল।— সেই বয়সে কোনো না কোনো বড় লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর। বিয়ে করে ঘরে এনে পুরবে তারপর লুটে-লুটে শেষ করবে—বি. এ. এম. এ. পাশের ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?

…তবু বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত অন্তত ফুরসৎ মিলেছিল। কিন্তু তার পরেও বাপী নিশ্চিন্ত ছিল কোন্ ভরসায়? একটানা আরো দুটো বছর ওই সম্ভাবনাটা হেঁটে দিয়ে বসে ছিল কি করে? দু বছর আগে অভিনন্দনের জবাবী টেলিগ্রামে ‘মালবিকা’র বদলে মিষ্টি লিখেছিল বলে?

…পীর ফকির ওর মা-কে অন্ন দেখে ঘি আর পাত্র দেখে ঝি দেবার শ্লোক বলেছিল। ওই মেয়ে কোন পাত্রের খপ্পরে পড়ে আছে সেটা নিজের চোখে দেখে আসেনি? দু’বছর আগে বি. এ-র রেজাল্ট দেখে ঘটা করে টেলিগ্রাম না পাঠিয়ে নিজেই কলকাতায় ছুটে গেল না কেন? যা-হোক কিছু হেস্তনেস্ত করে এলো না কেন? গায়ত্রী রাইয়ের দৌলতে দু’বছর আগেই তো ভাগ্যের চাকা বেশ জোর তালে ঘুরতে শুরু করেছিল। তারপরেও দিবাস্বপ্নে দিন কাটিয়ে দিল কেন? বাপী কি ভেবেছিল ভাগ্যের একেবারে চূড়ায় উঠে বসতে না পারা পর্যন্ত ছপ্পরফোঁড়া কোনো মন্ত্রের জোরে সেই মেয়ে তার জন্য হাঁ করে বসে থাকবে?

নিজের বয়েস এখন ছাব্বিশের প্রায় ওধারে। মিষ্টির তাহলে বাইশ তো বটেই। টানা বারো বছরের মধ্যে চার বছর আগে মাত্র দুটো দিন বাপীকে দেখেছে, চিনেছে। তা সত্ত্বেও ওই মেয়ের জগতে নিজেকে এক অমোঘ দুর্বার পুরুষ ঠাওরে বাপী একে একে দুটো বছর পার করে দিল!

এই আবেগের গালে ঠাস ঠাস করে গোটাকয়েক চড় বসালো বাপী। তাইতেই একটা সংকল্পের শর জ্যা-মুক্ত হয়ে ঠিকরে বেরুলো!

কলকাতায় যাবে।

কিন্তু যাবে ঠিক করলেই পাঁচ-সাত-দশ দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে পড়া আগের মতো অতটা সহজ হয় না এখন। এক বছর আগেও ব্যবসা বাড়ানোটাই বোধ হয় গায়ত্রী রাইয়ের জীবনের সব থেকে বড় লক্ষ্য ছিল। সেই উৎসাহে একটু একটু করে ভাটা পড়ছে বাপী সেটা অনুভব করতে পারে। দেহ নিয়ে মহিলার শান্তি নেই খুব, সেটাই হয়তো বড় কারণ। কিন্তু অশান্তির কথা মুখ ফুটে বড় একটা বলে না। বরং বেশির ভাগ সময় চাপা দিতে চেষ্টা করে। জিগ্যেস করলে বলে, ভালো আছি। আবার বেশি জিগ্যেস করলে বিরক্তি। ভালো আছি, এই জোরের ওপর থাকার চেষ্টা। কেমন ভালো আছে বা কতটা ভালো আছে বাপী তা বুঝতে পারে। ওর এই বুঝতে পারার আবেগের দিকটা খুব চাপা।

গায়ত্রী রাইয়ের প্ল্যান মতোই ব্যবসার সাজ বদল হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এমন কি উত্তর বাংলারও বিশেষ বিশেষ জায়গায় মোটা মাইনের অভিজ্ঞ ম্যানেজার বহাল করা হয়েছে। সকলের মাথার ওপর জেনারেল ম্যানেজার ও পার্টনার বাপী তরফদার। ফলে বাপীর লম্বা লম্বা টুর প্রোগ্রামের ছাঁটকাট বাড়ছে। পাঁচ-সাত দিনের জন্য কোথাও বেরুতে চাইলেও গায়ত্রী রাই ভুরু কোঁচকায়!– এত লোকজন থাকতে তোমাকে এতদিনের জন্য গিয়ে বসে থাকতে হবে কেন? ফোনে খবর নেবে, ইনস্ট্রাকশন দেবে, তারপরও ইন্সপেক্‌শনের জন্যে যেতে হয় তো একদিন-দুদিনের জন্য এয়ারে যাবে আসবে।

বাপীকে তাই করতে হয়। কর্ত্রীর হুকুম এখনও হুকুমই। কোম্পানির খরচে তেল পুড়িয়ে বাদশা ড্রাইভার তাকে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসে বা সেখান থেকে নিয়ে আসে। ট্রেনের চার-পাঁচ গুণ খরচা করে এরোপ্লেনের টিকিট কেটে রাতারাতি বা একদিন-দুদিনের মধ্যে বাপীকে কাজ সেরে ফিরে আসতে হয়। কোনো কারণে ফিরতে দেরি হলে মহিলা খুব একটা জেরা করে না কিন্তু মায়ের চোখের আড়ালে মেয়ে এসে ধমকাতে ছাড়ে না। দেরি হতে পারে বুঝলে বলে যেতে পারো না বা ফোনে জানাতে পারো না? মুখ বুজে মায়ের ছটফটানি দেখলে আমার ভয় ধরে যায় বলেছি না তোমাকে?

এই ধমক কানের ভেতর দিয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছায় তার স্বাদ আলাদা। মহিলার এই নিরুত্তাপ নির্ভরতা বাপীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই বাঁধনটুকু বড় লোভনীয়। কোনো স্বার্থের দাঁড়িপাল্লায় এর ওজন হয় না।

দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে রাতে খাবার টেবিলে বাপী সেদিন গম্ভীর মুখেই প্রস্তাব পেশ করল।—একবার কলকাতা যাওয়া দরকার।

খাওয়া ছেড়ে ঊর্মিলা বাপীর মুখখানা দ্রষ্টব্য ভাবছে। পশ্চিমবাংলা অর্থাৎ কলকাতা যে এ-ব্যবসার স্বর্গভূমি, গায়ত্রী রাই সেটা কারো থেকে কম জানে না। এক বছর আগের প্ল্যানেও কলকাতার বাজার বড় লক্ষ্য ছিল তার। তখন যাচাইয়ের তাগিদও বাপীকে দিয়েছে। কিন্তু সেই আগ্রহের ছিটেফোঁটাও নেই এখন। নিস্পৃহ মুখে জিগ্যেস করল, কেন?

—দেখেশুনে আসি…।

এক কথায় প্রস্তাব নাকচ করে দিল।—যেতে হবে না। নিজে কিছু দেখতে—শুনতে পারছি না, আর বাড়িয়ে কাজ নেই। একা কত দিক সামলাবে—

ব্যবসার স্বার্থ দেখিয়েই বাপী জোর করতে পারত। বাগডোগরা থেকে আকাশে উড়লে কলকাতা পঞ্চাশ মিনিটের তো পথ মাত্র। কিছুই বলা গেল না ঊর্মিলার জন্য। ওর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলছে। চোখে দুষ্টুমি চিকচিক করছে।

পরে হালকা ভ্রুকুটি করে বলেছে, হঠাৎ কলকাতা যাবার তাগিদ কেন আমাকে খোলা-খুলি বললে মায়ের কাছে একটু তদবির-টদবির করি—

বাপী গম্ভীর।—নিজের স্বার্থেই বলতে পারো।

অর্থাৎ, বাপীর কলকাতা যাওয়ার সঙ্গে ওরও নিষ্কৃতি লাভের যোগ। কিন্তু ওর কথা সাদা অর্থেও এমন লেগে যাবে যে সেটা কারো কল্পনার মধ্যে ছিল না। পরের তিন সপ্তাহের মাথায় ঊর্মিলার হৃদয়জগতে এমনি তোলপাড় কাণ্ড ঘটে গেল যে বাপীকে কলকাতা পাঠানোর জন্য ও নিজেই উন্মুখ।

এক সকালের দিকে নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে বাপী দূরের ধূসর পাহাড়টার দিকে চেয়ে ছিল। পাহাড়টা খুব দূরে নয়, কিন্তু সকালের হালকা কুয়াশার দরুন দেখাচ্ছে অনেক দূরে। ওই রকমই কিছু একটা স্থির লক্ষ্য বাপীর, কিন্তু ভিতরের অস্থিরতার দরুন যেন ওটাও ঝাপসা আর নাগালের বাইরে।…জঙ্গলের নাংগা ফকির বলেছিল, আগে বাড়লে পেয়ে যাবে। বাপী থেমে থাকেনি, সামনে এগিয়েছে। অনেক পেয়েছে। অনেক পাচ্ছেও। কিন্তু এই পাওয়াই শেষ লক্ষ্য হলে ভেতরটা সুস্থির থাকত, সামনেটা এত ঝাপসা দেখত না। বিত্ত বৈভব নিশ্চয় চেয়েছিল। কিন্তু সব চাওয়ার মূলে এক মেয়ে। সব থেকে বেশি চেয়েছিল সেই মেয়েকে। এই চাওয়ার সঙ্গে এখনো কোনো আপোস নেই। কিন্তু এই ব্যাপারে বাপী কতটা সামনে এগিয়েছে? কতটা আগে বেড়েছে?

ভিতরের একটা অসহিষ্ণু তাপ ঠেলে মাথার দিকে উঠতে লাগল। গায়ত্ৰী রাইকে যা-হোক কিছু বলে বা বুঝিয়ে দুই একদিনের মধ্যেই কলকাতা যাবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর না।

নিজের ভাবনায় ছেদ পড়ল। সদর রাস্তা ছেড়ে ঊর্মিলা হনহন করে এই পিছনের মাঠ ভেঙে এদিকে আসছে। হাঁপাচ্ছে বেশ। বাপীর তক্ষুনি মনে হল, নিশ্চয় ডাটাবাবুর ক্লাবে গেছল। সেখান থেকে কিছু সংগ্রহ করে বাতাস সাঁতরে ওর কাছে আসছে। পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আসার একটাই অর্থ। মায়ের চোখে পড়তে চায় না। বাপীকে জানলায় দেখে থমকে দাঁড়াল একটু। ফিক করে হেসে ফেলল। লালচে মুখ। তারপর ছোট মেয়ের মতোই ছুট্।

জানালা ছেড়ে বাপী সামনের বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। শব্দ না করে গেট ঠেলে ঊর্মিলা লঘুছন্দের দ্রুততালে বারান্দায় উঠে এলো। মেয়ের মুখের এমন গোলাপী কারুকার্য দেখলে তার মায়েরও বড় রকমের সন্দেহ কিছু হতই। চোখে মুখে গালে ঠোটে খুশির বন্যা। উত্তেজনাও।

বাপী গম্ভীর।—বিজয় মেহেরা কবে ফিরছে?

হিসেবমতো আর মাস-খানেকের মধ্যে ফেরার কথা বিজয় মেহেরার। সেই সম্পর্কে পাকা খবর কিছু এসেছে বাপী নিঃসংশয়।

ঊর্মিলা থমকে দাঁড়াল। তারপর যা করল, এই উত্তেজনার মুহূর্তে ওর কাছে সেটা সংকোচের ব্যাপার কিছুই নয়। খুব কাছে এসে দুহাতে বুকে একটা ধাক্কা মেরে আগে বাপীকে দরজার কাছ থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বাপী পড়তে পড়তে সামলে নিল। ততক্ষণে ঊর্মিলাও ঘরের মধ্যে। আনন্দ আর বিস্ময়ের ধকলে দু’চোখ কপালের দিকে।—আর কবে-টবে নয়, বাবুর ফেরা সারা।

শুনে বাপীরও হঠাৎ ফাঁপরে পড়ার দাখিল।—সে কি। কবে? কোথায় আছে?

বলতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকালো। লালচে মুখের ওপর আর এক প্রস্থ লালের ছোপ। গরম জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা বার করে ওর সামনে ধরল।— পাজী ছেলের দু’চারটে দুষ্টুমির কথাটথা আছে, কিন্তু তোমার কাছে আবার লজ্জা কি—পড়ে দেখো কি কাণ্ড!

বাপী গম্ভীর আবার। দুহাতে দুটো কাঁধে চাপ দিয়ে ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। টেবিলের ছোট আয়নাটা তুলে মুখের সামনে ধরল।

ঊর্মিলা হকচকিয়ে গেল একটু।—কি?

—গাল দুটো ফেটে এবারে খুশির রক্ত বেরুবে মনে হচ্ছে। আয়না যথাস্থানে রেখে মুখোমুখি খাটে বসল।—আমার পড়ে কাজ নেই, তুমি বলো।

যা শুনল, যে-কোনো মেয়ের মায়ের কাছে সেটা লোভনীয় হবার কথা। আরো তিন মাস আগে ওখানকার হায়ার কোর্স-এ বিজয় মেহেরা ভালো ভাবে উতরে গেছে সে-খবর আগেই এসেছিল। বুক ঠুকে সেখানকার এক মস্ত সংস্থায় ইন্টারভিউ দিয়েছিল। বম্বে আর কলকাতায় তাদের বিরাট শাখা। সেখান থেকে হোম-অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কলকাতায় উড়ে এসেছে সে। ও-ভাবে অ্যাপয়েন্ট—মেন্ট নিয়ে আসতে পারার ফলে খাস সায়েবদের গ্রেডে মাইনে, তাদের মতোই আনুষঙ্গিক সব সুযোগ-সুবিধে। এছাড়া দু’-বছরে একবার করে সপরিবারে হোমে ফেরার বা বাইরে বেড়ানোর ছুটি আর যাবতীয় খরচ-খরচা পাবে। কলকাতায় পা দিয়েই তাকে কাজে জয়েন করতে হয়েছে, আর শুরুতেই কাজের চাপ এত যে এয়ারে বাগডোগরা এসে ঊর্মিলার সঙ্গে একবার দেখা করে যাওয়ারও ফুরসৎ মিলছে না। এবারে বিয়ের তাগিদ। আর সবুর করার ধৈর্য নেই। সব ব্যবস্থা পাকা করে তাকে জানালেই সে ছুটির ব্যবস্থা করবে আর দেশে তার বাবা-মা-কেও চিঠি লিখে চলে আসতে বলবে।

ঊর্মিলা জিগ্যেস করল, এবারে?

সংকটই বটে। বাপী জবাব দিল, তাই তো ভাবছি…।

সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার সেই অবুঝ মেজাজ।—দু’বছরের ওপর তো বসে বসে শুধু ভাবলেই। এখন আর ভাবার সময় আছে?

বাপীর একটুও রাগ হল না। এই উদ্‌গ্রীব উৎকণ্ঠা দেখে বরং মায়া হচ্ছে। ভালও লাগছে। প্রেমের গাছে ফোটা একখানা সুন্দর ফুলের মতো মুখ ঊর্মিলার। সফল হবার বাসনায় অধীর, উন্মুখ। নিজের অদৃষ্টে যা-ই থাক, বাপীরও উদার হবার ইচ্ছে। চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। জবাব দিল, একেবারেই নেই মনে হচ্ছে।

ঊর্মিলা আবারও মুখ-ঝাপটা দিল বটে কিন্তু অখুশি নয়। এখনো যদি তোমার কানে জল না ঢোকে তাহলে এবারে আমি ঠিক এখান থেকে সঙ্কান দেব বলে দিলাম!

—কোথায়…কলকাতায়?

আবার কোথায়। মুখের কথা খসার আগেই মনে পড়ল কিছু। উৎসাহের ঝোঁকে বসার চেয়ারটা আরো এক হাত কাছে টেনে আনার ফলে দুজনের হাঁটুর মাঝে চার আঙুলেরও কম ফারাক। সামনে ঝুঁকল।—এই। তুমি তো কলকাতা যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলে, কালই চলে যাও না? যাবে?

—তোমার মা-কে কে রাজি করাবে, তুমি?

—আমি কেন, ব্যবসার কথা বলবে না, বলবে নিজের খুব দরকারী কাজে যাচ্ছ। তুমি চলে যাবার পর মা-কে যা বলার আমি সাফসুফ বলে দেব।

—সাফসুফ কি বলে দেবে?

—যা সত্যি তাই। মিষ্টি নামে এক মেয়ে ছেলেবেলা থেকে তোমার মন কেড়ে রেখেছে—তার সম্পর্কে কিছু খবর পেয়ে তুমি ছুটে চলে গেছ। ব্যস, এই এক চালে মা মাৎ। যাবে?

বাপী চেয়ে রইল খানিক।—ঠিক আছে। যাব।

এত সুবোধ এই ছেলে নয়।—সত্যি বলছ?

—হ্যাঁ, তবে আমি ভেবেছিলাম বিজয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে বলছ।

ঊর্মিলা কলে পড়ছে বুঝতে পারছে।–বা রে, তার সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে, তা না হলে তোমাকে যেতে বলব কেন।

বাপীর নীরস মুখ, গলার স্বরেও তপ্ত ব্যঙ্গ ঝরল।—নিজের স্বার্থ ষোল আনা বজায় রেখে আমাকে গরম তেলের কড়ায় ফেলে মা-কে তুমি মাৎ করতে চাও, এটুকু বুঝতে আমার খুব অসুবিধে হয়নি।

ঊর্মিলা অপ্রস্তুত একটু। তাই চড়া গলা।—তোমার অত ভয়টা কিসের? মায়ের ছেলে নেই, তুমি গুটিগুটি দিব্বি ছেলের জায়গাটি জুড়ে বসেছো এখন— আমাকে ছাড়া যদিও চলে, তোমাকে ছাড়া আর তার চলেই না—সাহস করে সত্যি কথাটা বলে দিলে মা তোমার কি করবে?

একটা নরম জায়গায় মোচড় পড়ল। ঊর্মিলার কথাগুলো সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করার মতো। এটুকুর প্রতি বাপীর কত যে লোভ শুধু সে-ই জানে। ঊর্মিলা জোরের কথা বলছে, কিন্তু এটুকু হারাবার ভয়ও যে কত, ওর কোনো ধারণা নেই।

শিরে সংক্রান্তি। ভয় ছেড়ে বাপী জোরের দিকটাই আঁকড়ে ধরল। রাতে খাবার টেবিলে গম্ভীর। ঊর্মিলার মুখেও কোনো কথা নেই। এমন চুপচাপ ভাবটা খুব স্বাভাবিক ঠেকল না গায়ত্রী রাইয়ের চোখে। একজনের ঝাঁঝ দেখে আর অন্যজনের টিপ্পনী শুনে অভ্যস্ত। থেকে থেকে দুজনকেই লক্ষ্য করল। কিন্তু জিগ্যেস করল না।

খাওয়ার পরে গায়ত্রী রাই আগে ব্যবসার কোনো ফাইল-টাইল খুলে বসত, নয়তো দরকারী চিঠিপত্র লিখত। এ-কাজ অনেকদিন ছেড়েছে। এখন ঘুম না আসা পর্যন্ত বই-টই পড়ে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশ থেকে বইটা টেনে নেবার আগেই বাপী ঘরে ঢুকল। হাতের বই রেখে গায়ত্রী রাই আবার সোজা হয়ে বসল। অপ্রিয় কিছু শোনার আশঙ্কা।

বাপীর তেমনি ঠাণ্ডা মুখ।—কাল আমি একবার কলকাতা যাচ্ছি।

বক্তব্য শুনে স্বস্তি একটু। বিস্ময়ও। খানিক চেয়ে থেকে জিগ্যেস করল, কি ব্যাপার?

জবাব দেবার আগে বাপী দরজার দিকে ঘুরে তাকালো একবার। কেউ নেই। ঘরে ঢোকার সময় ঊর্মিলা দেখেছে। কোথাও থেকে আড়ি পেতে শুনছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাপী সোজাসুজি বলল, বিজয় মেহেরা লন্ডন থেকে ফিরেছে। যতটা আশা করেছিল তার থেকেও বড় হয়ে ফিরেছে, কলকাতায় বড় চাকরি নিয়ে এসেছে। একবার গিয়ে দেখেশুনে বুঝে আসা দরকার।

আচমকা প্রচণ্ড একটা ঘা খেলে যেমন হয় প্রথমে সেই মুখ গায়ত্রী রাইয়ের বিবর্ণ, সাদা। সেই সাদার ওপর রাগের লালচে আভা ছড়াতে লাগল। গলার স্বর অনুচ্চ তীক্ষ্ণ।—কে বিজয় মেহেরা? সে কত বড় হয়েছে বা কত বড় চাকরি নিয়ে এসেছে তা দিয়ে আমার কি দরকার?

কোনরকম উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই বলেই বাপীর জবাবটা জোরদার শোনালো আরো। বলল, দরকার আছে। দু-তিনদিনের মধ্যে ফিরে এসে আপনাকে বলব। আপনাকে শুধু বিশ্বাস করতে হবে, আপনার বা ডলির কোনরকম ক্ষতির মধ্যে আমি যাব না—যেতে পারি না। উতলা হয়ে শরীর খারাপ করবেন না, বা আমি ফিরে আসার আগে এ নিয়ে ডলির সঙ্গে একটি কথাও বলবেন না।

গায়ত্রী রাই নির্বাক। চেয়ে আছে। এ-ছেলেকে বিশ্বাস করতে না পারলে পায়ের নিচে মাটি থাকে না। এ-কথা শোনার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিছুটা আশ্বস্ত অশান্তি যা-কিছু তার সবটাই নিজের মেয়েকে নিয়ে, এই ছেলেকে নিয়ে নয় এ—বিশ্বাসও অটুট। কলকাতায় যাতায়াতটা মেয়েকে ঠাণ্ডা করার জন্য বা অন্য কোনোরকম বোঝাপড়া করার জন্য ধরে নিয়ে আর জেরাও করল না।

বাপী বেরিয়ে এলো। সামনের বারান্দায় ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে। রাগত মুখ। বন্ধুর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কিছুটা নিষ্কৃতি পাবে ভেবেছিল, উল্টে সব দায় কিনা ওর নিজের ঘাড়ে চাপল। রাগ হবারই কথা।

কিন্তু বাপীর গাম্ভীর্যে ফাটল নেই এখনো। বলল, বিজয়ের আপিস আর বাড়ির ঠিকানা লিখে কোয়েলাকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও। ভালো যদি চাও তোমার মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে একটি কথাও বলবে না, তিনি যেন ভাবেন তুমি কিছু জানোই না। আর তাঁর শরীরের দিকে চোখ রাখবে।

বিকেল চারটের ফ্লাইট। মোটরে বানারজুলি থেকে বাগডোগরা দেড় ঘণ্টার পথ। বাদশার হাতে স্টিয়ারিং থাকলে সোয়া ঘণ্টার বেশি লাগে না। কিন্তু বাপী দেড়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত।

ঊর্মিলা ঘরের ভিতর। তার মা বারান্দায়। এই বাংলোর ফটকে বাদশা গাড়ি নিয়ে তৈরি।

গায়ত্রী রাই বলল, যাচ্ছ যখন দু’চার দিন বেশি থেকে কলকাতার বাজারটাও দেখে আসতে পারো।

এ-রকম কথা বাপী শিগগীর শোনেনি। ফিরতে দেরি হবার সম্ভাবনার কথা শুনলেই বেজার মুখ দেখেছে।

—টাকা যথেষ্ট নিয়েছ?

—হ্যাঁ, সে-জন্যে ভাববেন না।

—তবু যদি দরকার হয় হোটেলের ঠিকানা দিয়ে টেলিগ্রাম কোরো। ঘরেই অনেক টাকা মজুত আছে…তেমন দরকার বুঝলে আবু রব্বানী এরোপ্লেনে করে গিয়ে দিয়ে আসবে

দুয়ে দুয়ে চার যোগ হল এবার। কলকাতার বাজার দেখার জন্য দু’চার দিন বেশি দেরি হলে আপত্তি নেই, তার মানে, যে-ফয়সলার জন্য যাচ্ছে তাতে আরো বেশি সময় লাগলে লাগবে। আর নিষ্পত্তিটা শেষ পর্যন্ত যদি মোটা টাকার টোপ ফেলে করতে হয় তাতেও কোনো অসুবিধে নেই।

হন্তদন্ত হয়ে বাংলো থেকে নেমে বাপী গাড়ীতে উঠে বাঁচল। এই একজনকে কোন রকম ভাঁওতার মধ্যে রাখতে চায় না। অথচ নিরুপায়।

এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে একটা সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসল বাপী। প্লেন ছাড়তে ঢের দেরি এখনো। সোফায় মাথা রেখে চোখ বুজে পড়ে রইল খানিক। স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটানা ধকল যাচ্ছে। চার বছর বাদে আবার সেই কলকাতায় উড়ে চলল বটে, কিন্তু ভিতরটা তার ঢের আগে থেকে অনির্দিষ্টের মতো উড়ে চলেছে। কোথাও ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে না। ঊর্মিলার সমস্যার নিষ্পত্তি কোথায় জানে না। নিজের তো জানেই না।

মাইকে একটা ঘোষণা শুরু হতে বাপী মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। না, কলকাতার ফ্লাইট সম্পর্কে কিছু নয়। ঘাড় ফেরাতে গিয়ে বাপী বড়সড় ঝাঁকুনি খেল একপ্রস্থ। ঠিক দেখছে, না ভুল দেখছে?

পাশের দিকের পনের-বিশ হাত দূরে আর একটা সোফায় একটি মেয়ে বসে। বছর বাইশ-তেইশ হবে বয়েস। দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা। নাকে জেল্লা-ঠিকরনো সাদা পাথরের ফুল। সোজা হয়ে বসে ওকেই দেখছে, ওর দিকেই অপলক চেয়ে আছে।

নাকের এই ঝকঝকে ফুল দেখেই বাপী চিনেছে। ড্রইং-মাস্টার ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম। চার বছর আগে বানারজুলিতে ডাটাবাবুর ক্লাবে দেখেছিল। তারপর এই দেখল। চেহারা বদলায়নি তেমন। দোহারা কাঠামো একটু ভারির দিকে ঘেঁষেছে। আর একটু ফর্সা লাগছে। হাতে আগের মতো একগাদা কালো চুড়ি নেই। এক হাতে একটি শৌখিন খড়ি। অন্য হাতে সরু রুলি একগাছা তাইতে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। পরনে আকাশী রঙের সিল্কের শাড়ি।

সঙ্কোচ কাটিয়ে কুমকুমই উঠল। ঠোঁটের ফাঁকে বিব্রত হাসির রেখা। কাছে এসে বলল, এবারে চিনতে পেরেছ তাহলে বাপীদা!

বাপী মাথা নাড়ল, চিনেছে।

—আমি সেই থেকে তোমাকে দেখছিলাম…ভরসা করে সামনে আসতে পারছিলাম না।… বসব?

বাপী মাথা নাড়তে সামনের সোফাটাতে বসল। আজ বোধ হয় ভয় করার মতো সঙ্গে কেউ নেই। সহজ খুশি-খুশি মুখ। কিন্তু সামনে বসার পর এই খুশি ভাবটা অকৃত্রিম মনে হল না বাপীর। তবে মেয়েটার শ্রী এ ক’বছরে ফিরেছে। বাপী উল্টে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে কেন জানে না। জিগ্যেস করল, কেমন আছ?

হালকা জবাব দিল।—ভালো থাকতে তো চেষ্টা করছি খুব।…ভালো দেখছ? —ভালোই তো। ব্রীজমোহনের খবর কি?

ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়ল একটু।—এতদিন বাদেও ওই নাম মনে আছে তোমার! ভালোই আছে বোধ হয়, অনেককাল দেখিনি।

বাপীর কিছু জানতে বুঝতে বাকি নেই এটা ধরেই নিয়েছে। নইলে গোপনতার আশ্রয় নিত। একটা তিক্ত অনুভূতি ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে বাপীর। এ ক’বছরে আরো কত ব্রীজমোহন এই মেয়ের জীবনে এসেছে গেছে জানা কোনো কৌতূহল নেই।

একটু সামনে ঝুঁকে কুমকুম সাগ্রহে জিগ্যেস করল, তুমি কলকাতা যাচ্ছ বাপীদা?

—হ্যাঁ।…তুমি কোথায়?

জবাব দেবার আগে কুমকুম আর এক প্রস্থ দেখে নিল তাকে। ওরা প্রাচুর্যের গন্ধ পায় বোধ হয়। কার কেমন দিন চলছে মুখ দেখেই বুঝতে পারে হয়তো। কিন্তু জবাব শুনে বাপী অবাকই একটু।

—আমি আজ দু’মাস ধরে কলকাতা যেতে চেষ্টা করছি। হচ্ছে না…। বোধগম্য হল না বুঝে কুমকুম অনায়াসে বলে গেল, এখানকার অফিসারদের সপরিবারে হাওয়া-জাহাজে যাতায়াত করতে পয়সা লাগে না—একজন আমাকে কথা দিয়েছে নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতে তার সময় হচ্ছে না, আমি মাসে মাসে খবর নিতে বা তাগিদ দিতে আসি এখানে।

শোনামাত্র বাপীরই কান গরম। একজন ওকে পরিবার সাজিয়ে বিনা পয়সায় কলকাতায় নিয়ে যাবে সেই আশায় দু’মাস ধরে এখানে ধর্ণা দিচ্ছে। বিনিময়ে ওকে কি দিতে হচ্ছে বা হবে ভাবতে ভিতরটা রি-রি করে উঠল। কিন্তু সেই চার বছর আগের মতোই মেয়েটার দু’চোখ চিকচিক করছে। গলার স্বরেও অদ্ভুত অনুনয়।—আমাকে একবারটি কলকাতায় নিয়ে যাবে বাপীদা? আমার যাওয়া খুব দরকার।

বাপী কিছু ভোলে না। চার বছর আগেও ব্যগ্র মুখে এই মেয়ে জিগ্যেস করেছিল, কলকাতা কেমন জায়গা বাপীদা?

মুখে কঠিন আঁচড় পড়তে লাগল বাপীর। চাউনিটাও সদয় নয়। হাতের চকচকে ঘড়ি আর রুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার ওর দিকে তাকাতেই কুমকুম বলে উঠল, এটা খেলনা ঘড়ি বাপীদা, পাঁচ টাকাও দাম নয়, আর এই গয়নাও সোনার নয়, গিল্টি করা—সত্যি বলছি বাপীদা, নিজে যেতে পারলে আমি কারো আশায় বসে থাকতাম না—আমার যাওয়া খুব দরকার।

নীরস স্বরে বাপী জিগ্যেস করল, কেন দরকার?

ঢোঁক গিলে কুমকুম জবাব দিল, আমার ধারণা কলকাতায় গেলে বাবার সঙ্গে দেখা হবে।

বাপীর একটুও বিশ্বাস হল না। আরো রুক্ষ স্বরে বলল, কলকাতা সোনার শহর, কোনরকমে গিয়ে একবার সেখানে পা ফেলতে পারলেই আর ভাবনা নেই—কেমন?

চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে তিরস্কারটুকু মেনেই নিল যেন। কাতর সুরে বলল, ভাবনা তো ছায়ার মতো আমার সঙ্গে ফেরে বাপীদা, তার থেকে রেহাই পাব কি করে।…সকলেই আমাকে ঘৃণা করে, তুমি চেনো বলে তোমার ঘেন্না আরো বেশি বোধ হয়। কিন্তু বাপীদা, যা-ই হই, আমি তোমার সেই মাস্টারমশায়ের মেয়ে—এইজন্যেও কি তুমি আমাকে একটু দয়া করতে পারো না?

বুকের তলায় উল্টো মোচড় পড়ল। যে মুখখানা চোখে ভাসল, আশ্চর্য…সেই মুখ আজও তেমনি কাছের। বাপী ভাবল একটু, তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিগ্যেস করল, কাজ পেলে করবে?

অবাক হবার মতোই প্রশ্ন যেন।—কি কাজ?

—যে কাজ করছ তার থেকে অনেক ভালো। নিজের জোরে নিজেকে চালাবে, কারো লোভ বা দয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। করবে?

এমন প্রস্তাবও কেউ দিতে পারে মেয়েটা ভাবতে পারে না। নিজের অগোচরেই সামান্য মাথা নাড়ল। করবে।

ব্যাগ থেকে একটা ছাপানো কার্ড বার করে বাপী ওর হাতে দিল।—আট—দশদিন বাদে বানারজুলিতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

বসে আরো দশ-পনের মিনিট কথা বলার মতো সময় ছিল হাতে, কিন্তু বাপী উঠে পড়ল। আর ফিরেও তাকালো না। ঝোঁকের বশে কাজটা ভালো করল, কি মন্দ করল জানে না বলেই নিজের ওপর অসহিষ্ণু। আসে যদি রেশমার জায়গায় বসিয়ে দিতে পারবে।…রেশমার সঙ্গে এই মেয়ের কোনো তুলনাই হয় না। রেশমা দু’জন হয় না। ওর কথা মনে হলে একটা ব্যথা হাড়ে-পাঁজরে টনটন করে বাজে। বুকের ভিতরে বাতাসের অভাব মনে হয়। না, রেশমার মতো আর কেউ আসবে না, আসতে পারে না। চৌকস মেয়ে দুই একজন দরকার। কুমকুম আসে তো আসবে। এতটুকু বেচাল দেখলে বা সততার অভাব দেখলে ছেঁটে দিতে বাপী একটুও দ্বিধা করবে না।

ভিতরটা বিরক্তিতে ছেয়ে আছে তবু। একটা অনিশ্চয়তার পাহাড় নিজের বুকের ওপর চেপে বসে আছে। কলকাতায় ছুটেছে বটে, কিন্তু ওটা শেষ পর্যন্ত কতটা নড়বে কতটা সরবে জানে না। তার মধ্যে মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের এই দেহ-পসারিনী মেয়ের সঙ্গে এমন অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ মোটেই শুভ লক্ষণ ভাবতে পারছে না।

কিন্তু দমদম এয়ারপোর্টে নামার দশ মিনিটের মধ্যে সমস্ত সত্তা দিয়ে আঁকড়ে ধরার মতো কত বড় বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছিল জানে না। ঘড়ি ধরে চারটে পঞ্চাশ ওর ডাকোটা ল্যান্ড করেছে। ঠিক পাঁচটায় বাপী বাইরের বিশাল লাউঞ্জে এসে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বিজয় মেহেরার ঠিকানার সঙ্গে ঊর্মিলা তার আপিসের টেলিফোন নম্বরও লিখে দিয়েছে। একটা ফোন করতে পারলে এখনও হয়তো তাকে আপিসেই পাবে। পেলে এই রাতেই হোটেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলবে। চৌরঙ্গী এলাকায় সব থেকে নামকরা অভিজাত হোটেলে উঠবে তাও ঠিক করে রেখেছিল।

লাউঞ্জের সামনের দিকে ছোট বড় অনেকগুলি এয়ার অফিসের কাউন্টার। সবই বে-সরকারী সংস্থা তখন। টেলিফোনের খোঁজে বাপী পায়ে পায়ে সেদিকে এগলো।

তখনি সেই অভাবিত বিস্ময়। পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল। শীতের শেষের সন্ধ্যার আলোয় আলোয় বিশাল লাউঞ্জের এ-মাথা ও-মাথা দিনের মতো সাদা। সেই আলো হঠাৎ শতগুণ হয়ে বাপীর চোখের সামনে দুলে দুলে উঠতে লাগল।

অদূরে এক নামী এয়ার অফিসের ঝকঝকে কাউন্টারের ভিতরে দাঁড়িয়ে হাসি—হাসি মুখে বাইরের কোনো যাত্রীর সঙ্গে কথা কইছে যে মেয়ে তাকে দেখেই বাপীর দুচোখের ডেলা বেরিয়ে আসার দাখিল। তাকে দেখেই এমন দিশেহারা বিস্ময়! কাউন্টারের সামনের দিকে একটা বোর্ডে লেখা, ‘ইনফরমেশন’।

তার ও-ধারে দাঁড়িয়ে মিষ্টি।

বাপী ভুল দেখছে না। মিষ্টি। মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি!

পরনে ধপধপে সাদা শিফন সিল্কের শাড়ি। গায়ে জেল্লা-ঠিকরনো সাদা ব্লাউজ। শাড়ির ওপর বাঁ-দিকের কাঁধে এয়ার অফিসের কালো ব্যাজ। কপালে কুমকুমের ছোট টিপ। এই বেশে আর এই আলোয় এমন ধপধপে ফর্সা দেখাচ্ছে ওকেও। সব মিলিয়ে সাদা আলোয় গড়া রমণী অঙ্গের কপালে শুধু একফোঁটা লালের কৌতুক।

যাত্রীটি তার জ্ঞাতব্য খবর জেনে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চলে গেল। হাসি মুখে পাল্টা সৌজন্য জানিয়ে ওই মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাথা নিচু করে তার কাজে মন দিল।

সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা আনন্দের ঢেউ এসে বাপীকে যেন মাটি থেকে চার হাত ওপরে তুলে ফেলল। মাঝের সিঁথি মসৃণ সাদা। সেখানে কোনো রক্তিম আঁচড় নেই।

বাপী বুক ভরাট করে বাতাস নিল প্রথমে। তারপর খুব নিঃশব্দে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল।

—ইয়েস প্লীজ? রাঙানো ঠোঁটে অভ্যস্ত হাসি ফুটিয়ে ও-ধারের মেয়ে মুখ তুলল।

হাতে ট্রাভেল সুটকেস, কাঁধে দামী গরম কোট, বাপী সোজা দাঁড়িয়ে তার দিকে শুধু চেয়ে রইল।

প্রথমে ওই মেয়ের ভুরুর মাঝে সুচারু ভাঁজ পড়ল একটু। তারপরেই অভাবিত কাউকে দেখার ধাক্কায় সেও হকচকিয়ে গেল কেমন। তারপর একটু একটু করে বিস্ময়ের কারুকার্যে সমস্ত মুখ ভরাট হতে লাগল।

বাপী চেয়েই আছে।

মিষ্টিও।

কথা বাপীই প্রথম বলল। বলল, ঠিক দেখছি?

স্থির জলে ছোট্ট একটা ঢিল ফেললে তলিয়ে যেতে যেতে ওটা ওপরে ছোট একটা বৃত্ত-তরঙ্গ এঁকে দেয়। তারপর সেই ছোট তরঙ্গ বড় হয়ে ছড়াতে থাকে। ছোট কটা কথা সামনের চারুদর্শনার মন-সরোবরে তেমনি টুপ করে ডুবল। পাতলা দুই ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির আভাস দেখা দিল। তারপর সেটুকু সমস্ত মুখে ছড়াতে থাকল। বাপী হলপ করে বলতে পারে, এ কোন ইনফরমেশন কাউন্টারে দাঁড়ানো সুদর্শনার পেশাদারি সৌজন্যের হাসি নয়।

মিষ্টিও ঠিক তেমনি করে ফিরে জিগ্যেস করল, আমি ঠিক দেখছি?

কান আর এর থেকে বেশি কেমন জুড়োয় মানুষের বাপী জানে না। দুজনের বিস্ময় দু’রকমের। গেজেটের পাতায় নাম দেখতে না পাওয়ার ফলে যাকে নিয়ে এত ভাবনা-চিন্তা এত বিশ্লেষণ, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেই তাকে এয়ার অফিসের ইনফরমেশন কাউন্টারে দেখতে পাবে এ কোনো সুদূর কল্পনার মধ্যে ছিল না বলেই বাপীর বুকের তলায় এমন তোলপাড় কাণ্ড। নইলে চার বছর আগে যে মিষ্টিকে দেখেছিল এ-ও সেই মিষ্টি। এখানে এই বেশে আর এই পরিবেশে আগের থেকেও একটু বেশি চকচকে আর ঝকঝকে দেখাচ্ছে তফাৎ শুধু এইটুকু। কিন্তু মিষ্টির চোখে তফাৎটা যে ঢের বেশি বাপীর আঁচ করতে অসুবিধে হচ্ছে না। চার বছর আগে যাকে দেখেছিল তার পরনে সাদামাটা পাজামা পাঞ্জাবি, টালির বস্তির এক খুপরি তার বাস, ব্রুকলিন আপিসের এক বড়বাবুর মেয়েকে নাকচ করার ফলে লোয়ার ডিভিশনে কেরানীর চাকুরিটুকুও তার খোয়া গেছে। চার বছর আগের সেই ভেসে বেড়ানো ছেলে বুক ঠুকে ওকে বলেছিল, লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হওয়াটা যেমন তার অদৃষ্ট নয়, বস্তিতে থাকাটাও তেমনি আর বেশি দিনের সত্যি নয়। টনটনে আবেগে ঘোষণা করেছিল, সব বদলাবে, একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে—মিষ্টি চাইলেই হবে।

…এয়ারপোর্টে পুরুষের এই বেশে এই মূর্তিতে ওকে দেখে সেই বদলানোর ধাক্কাটাই মিষ্টির কাছে বড় বিস্ময়। দেখামাত্র আর চেনামাত্র কেমন করে বুঝেছে অনেক বড় হয়েছে, অনেক বদলেছে, অনেক অন্য রকম হয়েছে। বাপীর আরও আনন্দ, এই বিস্ময়ের সঙ্গে খুশির মিশেলও তেমনি স্পষ্ট। সকলের চোখের ওপর এভাবে চেয়ে থাকাটা যে-কোন মেয়ের কাছে অস্বস্তিকর। ওর দিকে তাকিয়ে যেতে-আসতে কাছে-দূরের কত পুরুষের জোড়া জোড়া চোখ সরস হয়ে উঠছে বাপী আর কোন দিকে না চেয়েও আঁচ করতে পারে।

মৃদু হেসে বলল, দুজনেই ঠিক দেখছি বোধ হয়।

কোন মেয়ের যদি কোন ছেলেকে দেখামাত্র সুপুরুষ মনে হয় তো সেটা সেই ছেলের চোখেই সবার আগে ধরা পড়ে। চার বছর আগে যখন কলেজে পাজামা পাঞ্জাবি পরা ছেলেবেলার দুরন্ত সঙ্গীকে প্রথম দেখেছিল বা চিনেছিল, তখনও এই মেয়ের চোখে সুপুরষ দেখার প্রসন্ন বিস্ময় উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল বাপীর মনে আছে। সেটুকুই এখন আরও স্পষ্ট।

হাসিমাখা দু’চোখ ওর মুখের ওপর রেখে মিষ্টি মুখেও বলল, আমি ঠিক দেখছি কিনা এখনো বুঝছি না। তুমি কোথাও থেকে এলে, না কোথাও যাচ্ছ?

—আমি বানারজুলি থেকে মিষ্টির কাছে এসেছি।

এতদিন বাদে দেখা হওয়ার এটুকু সময়ের মধ্যে এই লোক আবার এমন বেপরোয়া কথা বলবে ভাবেনি। বিশেষ করে লেকের ধারের সেই অপমান আর হেনস্থার পর। আজ যদি ওকে এখানে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেত তাহলে অস্বাভাবিক কিছু হত না। কিন্তু স্বাভাবিক পথে চলা যে ধাত নয় তাও মিষ্টির থেকে বেশি আর কেউ জানে না। মুখে সুচারু বিড়ম্বনা। কথাগুলো নাকচ করার সুরে বলল, আমার সঙ্গে এখানে দেখা হবে তুমি জানতে?

—এখানে দেখা হবে জানতাম না। কোথাও দেখা হবে জানতাম।…এখানে আর কতক্ষণ কাজ তোমার?

—ছটা পর্যন্ত। হেসেই সামনের কাগজগুলো দেখালো।—তার মধ্যেও সারতে পারব মনে হয় না।

বাপী হাসছে মৃদু মৃদু। ওর হাতের মুঠো আর যে ঢিলে হবার নয় সেটা এই মেয়ে কি করে জানবে। বলল, তার মানে আমাকে বিদেয় হতে বলছ?

বানারজুলির দশ বছরের ফোলা-গাল ঝাঁকড়া-চুল নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে কত সময় মুখের ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠে ওকে বিদেয় করতে চেয়েছে। এই মিষ্টি চাউনি দিয়েই বুঝিয়ে দিল, বিদেয় করতে চাইলেও বিদেয় হবে বলে মনে হয় না। মুখে বলল, না তা বলছি না—

বাপী মুখের কথাটুকুই আঁকড়ে ধরল তক্ষুনি।—হাতের কাজ তাহলে আজ না সারলেও চলবে?

চার বছর আগে ঠিক এমনি অনুরোধে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা মনে পড়ল মিষ্টির। চোখে চোখ, ঠোটে হাসি। অল্প অল্প মাথা দুলিয়ে বলল, এ কি কলেজ যে বেরিয়ে পড়লেই হল—চাকরি না?

—তাহলে কাজ সারো, দেখ কত তাড়াতাড়ি হয়। আমি বসছি।

ব্যাগ হাতে লম্বা পা ফেলে বিশ গজ দূরের লাউঞ্জে একটা সোফায় গিয়ে বসল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল মিষ্টি তার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোটের ফাঁকে হাসিটুকু এখনও ধরা আছে। পুরুষের গাম্ভীর্যে নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখল। পাঁচটা পনের।

মিনিট দশের মধ্যেই একটা লোক ঝকঝকে পেয়ালা প্লেটে চা এনে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। বাপী বুঝেও জিগ্যেস করল, চা কে পাঠাল?

লোকটা অদূরের ইনফরমেশন কাউন্টার দেখিয়ে দিল। মিষ্টি এখন এদিকেই চেয়ে। চোখোচোখি হতে মাথা নিচু করে কাজে মন দিল।

চা খেতে খেতে বাপী ঘুরে-ফিরে ওকেই দেখছে। সোজাসুজি চেয়ে থাকার লোভ সামলাতে হচ্ছে। একটু পরে-পরেই কেউ এসে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াচ্ছে। ফ্লাইট বা আর কিছুর খোঁজখবর নিয়ে চলে যাচ্ছে। মিষ্টির ঠোঁটের ফাঁকে পেশাদারী সৌজন্যের হাসিটুকু এখন অন্য রকম। বাপীর মনে হচ্ছিল এই মেয়েকে দেখেই হয়ত বেশির ভাগ লোকের কিছু না কিছুর খোঁজ নেওয়াটা দরকার হয়ে পড়ছে। নইলে সে যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল তখন তো একজনও আসে নি।

যত দেখছে, বাপীর ভেতরটা লুব্ধ হয়ে হয়ে উঠছে। শিগগীর এমন হয় নি অনেক, অনেক দিন ধরে প্রবৃত্তির এদিকটার ওপর একটা শাসনের ছড়ি উঁচিয়ে বসে ছিল। তার অস্তিত্ব কখনো ভোলে নি বলেই আষ্টে-পৃষ্ঠে তাকে শেকলে বেঁধেছিল।…ভুটানের পাহাড়ের বাংলোয় খসখসে গালচেয় নাক মুখ কপাল ঘষে ছাল তুলে লোভাতুরকে শায়েস্তা করেছিল, তারপর উদ্ভ্রান্ত যৌবনের ডালি রেশমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে প্রায় অমোঘ রসাতলের গহ্বর থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পেরেছিল। ঊর্মিলার উষ্ণ ঘন সান্নিধ্যে এসেও তার থেকে অনেক সহজে ওই অন্ধ অবুঝকে শাসনের লাগামে বেঁধে রাখতে পেরেছে। সব পেরেছে এই একজনের জন্য। এই একজনের প্রতীক্ষায়। অথচ চার বছর আগেও এই মেয়েকে যখন কাছে পেয়েছিল, আর ভেবেছিল খুব কাছে পেয়েছে—তখনও চোখে ঠিক এই লোভ চিকিয়ে ওঠে নি। রেস্তরাঁয় মুখোমুখি বসে তাকে লোভের দোসর ভাবতে চায় নি। তার থেকে ঢের বেশি কিছু ভাবতে ইচ্ছে করেছিল।

আজ নিজেকে বশে রাখার তাগিদ নেই। প্রবৃত্তির ওপর ছড়ি উঁচিয়ে বসার চেষ্টাও নেই। চার বছর আগে বড় বেশি বোকা হয়ে গেছল। আবেগের দাস হয়ে পড়েছিল। তার থেকে ঢের বেশি বাস্তবের রাস্তায় হাঁটত বানারজুলির চৌদ্দ বছরের বাপী। দখল বজায় রাখার জন্য সে হিংস্র হতে পারত। চৌদ্দ বছর বয়েসের সেই সত্তাই আজ ছাব্বিশের প্রান্তে এসে দ্বিগুণ পুষ্ট। দ্বিগুণ সংকল্পবদ্ধ। এই সংকল্পে লোভ আছে ক্ষুধা আছে বাসনা আছে কামনা আছে। বাপী এই সব নিয়েই বসে আছে। দেখছে।

ঘড়িতে ছটা বাজতে কুড়ি। সন্তর্পণে উঠল। মিষ্টির সামনে এখন দুজন মাঝবয়েসী মানুষ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে। প্রায় তিরিশ গজ সামনে এগনোর পর পাবলিক টেলিফোন পেল। রিসিভার তুলে চৌকো দো-আনি ফেলে অপারেটারের গলা পেল। কিন্তু বাপী নম্বর জানে না, তা নিয়ে মাথাও ঘামায় না। হোটেলের নাম বললে যে কোনো অপারেটর কানেকশন দিয়ে দেবে। দিল।

চৌরঙ্গী এলাকার সব থেকে অভিজাত হোটেলে একটা ভাল সুইট বুক করে ফিরে এলো। কাউন্টারের ওধারে মিষ্টি তার দিকেই চেয়ে আছে। লাউঞ্জের চেয়ারের দিকে বাপীর পা আর এগোল না। দাঁড়িয়ে গেল।

সামনের কাগজপত্র সব তুলে নিয়ে মিষ্টি ভিতরের দরজা দিয়ে অদৃশ্য প্ৰায় আট-ন মিনিটের জন্য। বাপী সেই খোলা দরজার দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টির ওভাবে লক্ষ্য করার মধ্যে গভীর অভিব্যক্তি কিছু আছে, কিন্তু দু-চার লহমায় সেটা ধরা গেল না।

—চলো।

বাপী চমকেই পাশে তাকালো। ওদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মিষ্টি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুশিমুখে বাপী ঘড়ি দেখল। ছটা বাজতে দু মিনিট বাকি—হয়ে গেল?

—হয়ে গেল না। একজনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে এলাম।

বাপী হাসল।—তোমার দায় নেবার জন্য কে আর না ঘাড় পেতে দেবে।

—এসো।

প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ফিরে তাকালো না। সামনে এগলো। ও-দিক থেকে একজোড়া সাদা চামড়ার মেয়ে-পুরুষ এদিকে আসছে। পুরুষের এক হাত সঙ্গিনীর কাঁধ বেষ্টন করে আছে। জোরালো পুরুষের মত মাঝের চারটে বছর একেবারে মুছে ফেলার তাগিদ বাপীর। তার আগের আটটা বছরও। মিষ্টি বাঁ পাশে। বাপীর হাতে সুটকেস। বাঁ কাঁধের কোটটা ডান দিকে চালান করল। তারপর দ্বিধাশূন্য বাঁ হাত মিষ্টির বাঁ কাঁধে।

চলা না থামিয়েও মিষ্টি থমকেছে একটু। মুখও ওর দিকে ঘুরেছে। বাপীর দৃষ্টি অদূরের দরজার দিকে। কিন্তু লক্ষ্য ঠিকই করেছে। বারো বছর আগের সেই দুরন্ত দস্যির হাতে পড়ার মত মুখ অনেকটা। অস্বস্তি সত্ত্বেও কিছু বলল না—অথবা বলা গেল না।

—এরোড্রোম থেকে এত পথ ভেঙে রোজ বাড়ি ফেরো কি করে?

—কোম্পানির গাড়িতে।

—নিয়ে আসে দিয়ে আসে?

— হ্যাঁ।

বাইরে এলো। সামনের আঙিনা পেরিয়ে বিশ-তিরিশ গজ দূরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। তেমনি কাঁধ বেষ্টন করেই সেদিকে চলল। অস্বস্তির কারণেই হয়ত মিষ্টি গম্ভীর। কিন্তু কিছু না বলাটা যে তারও জোরের দিকই, বাপী সেটা অস্বীকার করছে না। এই জোরের ওপর জবর দখলের স্পর্শে ভিতরটা আরও বেপরোয়া। কোন্ কবিতায় না কোথায় যেন পড়েছিল, রমণীর মন জোর করে জয় করে নেবার জিনিস।

মিষ্টি এবার বলল কিছু। আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এর মধ্যে বাইরে-টাইরে থেকে ঘুরে এসেছ নাকি?

—না তো।

—বানারজুলিতেই ছিলে?

—হ্যাঁ, কেন?

—অত সহজে কাঁধে হাত উঠে আসতে ভাবলাম বিদেশ-টিদেশ গিয়ে ব্যাপারটা রপ্ত করে এসেছ।

হুল ফুটিয়ে এত সুন্দর করে এমন কথা সকলে বলতে পারে না। ফলে লোভ আরও দুর্বার হয়ে উঠল। ছিঁচকে লোভ নয়, পুরুষের লোভ। কিন্তু ভিতরে কেউ বলছে, আর বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বিশ্বাস করে এই মেয়ে হয়তো এরপর ওর সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠতে চাইবে না। হেসেই কাঁধ থেকে হাত নামালো। কিন্তু মুখের উক্তি কম মোক্ষম নয়। বলল, না…বারো বছর আগে রপ্তটা শুধু একজনের ওপর দিয়েই হয়ে আছে।

মিষ্টি ঘুরে তাকালো একবার। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আঁচড় পড়ল কি পড়ল না। কৌতুকের স্মৃতি কিছু নয়, অবুঝপনা দেখেও সহিষ্ণু মেয়ের নিজেকে আগলে রাখতে পারার মত হাসির আভাস একটু। বলল, দু দিক থেকেই ও-সব ভোলার মতো সময় বারোটা বছর কম নয়।

বাপী এ-কথার এক বর্ণও বিশ্বাস করল না। নিজে কেমন ভুলেছে সে তো জানেই। এই মেয়েও ভোলে নি, ভুলতে পারে না। নইলে চার বছর আগে চেনার পর অনার্স ক্লাস বাতিল করে সমস্ত দিন ওর সঙ্গে কাটাত না। পরদিন লেকের ধারে যা ঘটে গেছে, তার মধ্যেও নিজেরও বিপাক বোঝাবার চেষ্টাটাই আসল ছিল। আর ভোলা এত সহজ হলে আজও আচরণ অন্য রকম হত। অন্যের ওপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে এভাবে বেরিয়ে আসত না।…কাউন্টারে দাঁড়িয়ে তখন ওর দিকে চেয়ে কি দেখছিল বাপী এখন বোধ হয় তাও আঁচ করতে পারে। অপ্রত্যাশিত যোগাযোগে আগের থেকেও ঢের সবল পুরুষ দেখছিল। পুরুষ পুরুষ হলে কোন মেয়ে তাকে সহজে ভুলতে পারে?

জবাব দেবার ফুরসৎ হল না, পাঞ্জাবী ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দিয়েছে।

মিষ্টি এবারে সোজাসুজি তাকালো তার দিকে।—তুমি যাবে কোন্ দিকে?

—তোমার দিকে। ওঠো—বেঘোরে পড়বে না।

ঠোঁটের ফাঁকে আবার সেইরকম হাসির ফাটল একটু। অর্থাৎ বেঘোরে পড়ার মেয়ে সে নয়।

ট্যাক্সিতে উঠে ওধারের কোণের দিক ঘেঁষে বসল। বাপী উঠে দরজা বন্ধ করল। ট্যাক্সিঅলার উদ্দেশে বলল, চৌরঙ্গী।

ট্যাক্সি সোজা রাস্তায় পড়ে বেগে ছুটল। এদিকের অনেকটা পথ বেশ অন্ধকার। গাড়ির ভিতরে আরো বেশি। দুজনের মাঝে এক হাতের মত ফারাক। নড়েচড়ে বসে বাপীর এই ফাঁকটুকু আর একটু কমিয়ে আনার লোভ। কিন্তু পুরুষের এ-রকম চুরির হ্যাংলামো মানায় না। ভিতরে এমনি সাড়া পড়ে আছে সেই থেকে যে এটুকু খুব বড়ও মনে হচ্ছে না। এই সান্নিধ্যেরও এক অদ্ভুত স্বাদে উপোসী স্নায়ুগুলো টইটম্বুর হয়ে উঠছে। এই নীরবতার ঘোরে বাপী আরও অনেক অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু সেটা বিসদৃশ। বলল, তোমাকে এখানে এভাবে পাব ভাবতেও পারি নি। পাব কথাটা কানে বাজল বোধ হয়। অন্ধকারে মিষ্টি ঘাড় ফেরালো।

—এখানে চাকরি করছ কত দিন?

—তা দেড় বছরের বেশি হয়ে গেল।

—এম. এ না পড়ে হঠাৎ চাকরির দিকে ঝোঁক?

—এম. এ পড়ে এর থেকে আর কি এমন ভালো চাকরি পেতাম?

অর্থাৎ পড়ার থেকে চাকরি বড়। চাকরি লক্ষ্য। অন্ধকারে এত কাছে থাকার দরুন মুখ দেখা যাচ্ছে, মুখের রেখা কিছু দেখা যাচ্ছে না।

—এম. এ পাশ করে কলেজে চাকরি করতে পারতে।

—বিচ্ছিরি। তার থেকে এ ঢের ভালো।

—নিজের চেষ্টাতেই জোটালে?

—না তো কি? গলার স্বর তরল একটু।-খবর পেয়ে দরখাস্ত করলাম, ইন্টারভিউ দিলাম, পেয়ে গেলাম। মিষ্টি-হাসির শব্দ।—এর থেকেও ভালো পোস্টে সিলেকটেড হয়েছিলাম, কেউ রাজি হল না।

—কি পোস্ট?

—এয়ার হোস্টেস।

বাপীর গলায়ও আপত্তির আভাস।সেটা এর থেকে ভালো?

—টাকার দিক থেকে তো ভালো। আর পাঁচরকম সুবিধেও আছে।

মিষ্টি টাকা চিনবে এ বাপী কোনদিন ভাবে নি। এখনও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

—কে রাজি হল না?

—রাজি না হবার লোকের অভাব!

সহজ হাল্কা জবাবটা কানে চিনচিন করে বাজল। বলতে পারত, দাদু রাজি হল না, বা মা-বাবা রাজি হল না। রাজি না হবার ব্যাপারে আর কারও গলা মেলার সম্ভাবনা বাপী ছেঁটে দিল। চার বছর আগে সেই আঠার বছরের মিষ্টির সঙ্গে এই বাইশের মিষ্টির তফাৎ বাপী ভালই অনুভব করতে পারে। মেয়েদের বিকশিত সত্তার জোরটুকুর ওপর আস্থাভরে দু পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চৌদ্দ-পনের-ষোল বা আঠার বছরের অনেক মেয়েই প্রেমের দু-চারটে পলকা বাতাসের ঝাপটা এড়াতে পারে না। মিষ্টির মতো মেয়ের এড়ানো আরও কঠিন। তা বলে উল্টো দিকের বাড়ির সেই সোনার চশমা মাখনের দলা ছেলে শেষ পর্যন্ত যে এই মেয়ের জীবনের দোসর হতে পারে না সেটা শুধু ওর চকচকে সাদা সিঁথি দেখেই বুঝছে না। ওর এখনকার এই সত্তার মধ্যেও সেই রকমই ঘোষণা স্পষ্ট। শুধু সেই লোকটাকে নয়, চার বছর আগে লেকের ধারের সেই বিকেলটাকেই ভেতর থেকে ছেঁটে দিয়েছে। আজ অপ্রত্যাশিত নাগালের মধ্যে পেয়ে শুরু থেকেই বাপীর এই আচরণ। অনুমান মিথ্যে হলে মিষ্টিই সুচারু সৌজন্যে ওকে বাতিল করে দিত। অন্যের ওপরে কাজ চাপিয়ে দিয়ে এভাবে ওর সঙ্গে চলে আসতই না

ট্যাক্সি নির্জনতা পেরিয়ে লোকালয়ে এসে পড়েছে। দু’ দিকের রাস্তা আর দোকান-পাটের আলোয় ট্যাক্সির ভিতরটাও অনেকটা পরিষ্কার। খানিক চুপ করে থেকে বাপী ওর দিকে ফিরল।—বানারজুলি থেকে বাগডোগরা এসে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে উড়ে এসেছি বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে?

মিষ্টির এবারের হাসির সঙ্গে বিড়ম্বনার মাধুর্য ছুঁয়ে আছে কিনা ঠাওর করা গেল না। মাথা নাড়ল একটু। জবাবও দিল।—হচ্ছে।

—বিশ্বাস হতে পারে এমন কিছু বলব?

চেয়ে রইল। ভরসা করে সায় দিতে পারছে না। কিন্তু শোনার কৌতূহল।

বাপীর গলার স্বরে আবেগের চিহ্ন নেই। যেন নেহাৎ সাদামাটা কিছু বলছে।—গেজেটে তোমার এম. এ পরীক্ষার ফল দেখতে বানারজুলি থেকে শিলিগুড়ি ছুটে গেছলাম। বি. এ পরীক্ষার ফল দেখতেও তাই করেছি। বি. এ’র ফল ভালো হয় নি, এম-এতে ফার্স্ট ক্লাস পাবে কি পাবে না ভাবতে ভাবতে নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলাম। কেউ তখন গাড়ি চাপা পড়লেও খুব অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু গেজেট দেখে আমি হাঁ প্ৰথম। নামই নেই।

নিজের অগোচরে মিষ্টি আরও একটু ঘুরে বসেছে। চেয়ে আছে।

বাপী তেমনি ঢিমেতালে বলে গেল, ফেল করতে পারো এ একবারও মনে হল না। প্রথমে ভাবলাম ভাল প্রিপারেশন হয় নি বলে ড্রপ করেছ। তারপর আর যে সম্ভাবনার চিন্তাটা মাথায় এলো তাইতেই আমার হয়ে গেল। তক্ষুনি ঠিক করলাম, কলকাতা যাব। আমার কপাল ভেঙেছে কিনা দেখব। তবু নানা কারণে আসতে আসতে দিন কয়েক দেরিই হয়ে গেল।

মিষ্টি অপলক চেয়েই আছে সে বোধ হয় তারও খেয়াল নেই। দু চোখ চকচক করছে। বাপী অনুভব করছে, শুধু কান দিয়ে শুনলে এমনটা হয় না। কপাল ভাঙার কোন্ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে কলকাতায় উড়ে এসেছে তাও আর ভেঙে বলার দরকার হল না। বুঝেছে

বাপীর ভিতরটা সেই ছেলেবেলার মতই একটু স্পর্শের লোভে লালায়িত। এক হাত ফারাকের এই এক মেয়েকে ঘিরে তার অন্তরাত্মা বাসনাবিদ্ধ। কামনাবিদ্ধ। কিন্তু এটা বানারজুলির জঙ্গল নয়।

তবু একটু সামনে ঝুঁকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছ?

মিষ্টি নিজের ভিতর থেকে নিজেকেই উদ্ধার করে সজাগ হল। ও-পাশের দরজার সঙ্গে আর একটু চেপে বসে সহজ হবার চেষ্টা। হেসেই বলল, তুমি একটা পাগল।

বাপীও হেসেই সায় দিল।—এত দিনে তাহলে বুঝছ।

.

হোটেলের সামনের রাস্তায় ট্যাক্সি থামতে মিষ্টি বুঝল কোথায় যাচ্ছে বা এই লোক কোথায় আস্তানা নেবে। এই বোঝাটাও বিস্ময়শূন্য নয় দেখে বাপীর মজাই লাগছে। এর থেকে নামী আর দামী হোটেল চৌরঙ্গী ছেড়ে সমস্ত কলকাতায়ও আর দুটো নেই। পয়সার হিসেবটা যাদের কাছে বড় তারা বড় একটা এমন জায়গায় আসে না। তখন পর্যন্ত সাদা চামড়া আর অবাঙালী মেয়ে-পুরুষের ভিড় বেশি এখানে।

মিষ্টি পাশে। গালচে বিছানো চওড়া করিডোর ধরে বাপী রিসেপশনে এসে দাঁড়াল। একজন আধবয়সী কেতাদুরস্ত অফিসার এগিয়ে এলো। সুটকেস রেখে বাপী ব্যাগ খুলে ছাপানো কার্ড তার হাতে দিতে লোকটি শশব্যস্তে বলল, ইয়েস সার, গট ইওর মেসেজ ওভার দি ফোন

তার ইশারায় একজন তকমা-পরা বেয়ারা ছুটে এলো। বাপীর সুটকেস আর ঘরের চাবি নিয়ে সে প্রস্তুত। অফিসারকে বাপী জানালো সে কদিন থাকবে ঠিক বলতে পারে না। খাতাপত্র যা সই করার সুইটে পাঠিয়ে দিলে সই করে দেবে, আর আপাতত পাঁচ দিনের চার্জ অ্যাডভান্স করে দেবে।

লিফটে উঠে তিনতলায় সুইট। নরম পুরু গালচে বিছানো বিশাল ঘরের মাঝে শৌখিন হাফ পার্টিশন। একদিকে বসার ব্যবস্থা, অন্যদিকে শোবার। অ্যাটাচড বাথ দু’ দিকে দুটো টেলিফোন। বাপী চারদিক দেখে নিল একবার। উত্তরবাংলা মধ্যপ্রদেশ বা বিহারে টুরে বেরুলে সব থেকে বড় হোটেলেই ওঠে। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তুলনা হয় না।

বাপী মিষ্টির দিকে তাকালো। এই লোকের এমন দিন ফেরার বিস্ময় এখনও কাটে নি। কিন্তু খুশিই মনে হল।

সুটকেস রেখে বেয়ারা চলে গেছে। বাপী বলল, বসো—

পার্টিশনের এধার থেকে কাঁধের কোটটা গদীর বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল বাপী। তারপর নিজেও বসল।—কি খাবে বলো?

মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প। কিছু খাবে না বললে শুনবে না জানে, আবার কি খাবে তাই বা বলে কি করে।

বাপী ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে রুম-সার্ভিস চাইল। তারপর একগাদা খাবারের অর্ডার দিল।

ফোন রাখতে মিষ্টি আঁতকে উঠল, অত কে খাবে!

ঠোটের ফাঁকে হাসি ছড়াচ্ছে বাপীর।—আমার এখন রাজ্যের খিদে।

জবাবটা একেবারে জল-ভাত সাদা অর্থের নয়। বিড়ম্বনা এড়াবার চেষ্টায় মিষ্টি বলল, যত খুশি খাও, আমার ওপর জুলুম কোরো না।

বাপী কি আরও বেপরোয়া হবে? জুলুম না করলে সেটা না খাওয়ারই সামিল হবে বলবে? বলল না। আরও জরুরী কিছু মনে পড়ল। ফোনের রিসিভারটা তুলে মিষ্টির দিকে বাড়িয়ে দিল।—ফিরতে দেরি হবে বাড়িতে জানিয়ে দাও।

আবারও একটু বিড়ম্বনার ধকল সামনে মিষ্টি জবাব দিল, তোমার পাল্লায় পড়েছি যখন ফিরতে দেরি হবে আগেই জানি। এয়ার অফিস থেকেই ফোন করে দিয়ে বেরিয়েছি।

বাপী রিসিভার জায়গায় রাখল আবার। দু চোখ ওর মুখের ওপর। রক্তে খুশির তাপ ছড়াচ্ছে, লোভেরও। চার বছর আগে কলেজ থেকে বেরিয়ে আশর আগে দাদুকে নিজে থেকে ফোন করে ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে এসেছিল মনে আছে।…তার পরের পরিণাম মুছেই গেছে।

এবারে মিষ্টিরই সহজ হবার তাড়না। চারদিক একবার দেখে নিয়ে বলল, ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে না এলে আমি কিছুই মুখে দিতে পারব না—মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাসল একটু, দু-তিন ঘণ্টা পর পর সমস্ত মুখে জল দেওয়াটা বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে আমার।

বাপী তক্ষুনি উঠে পার্টিশনের ওধারে গিয়ে বাথরুমের দরজা খুলল। ঝকঝকে পরিপাটি ব্যবস্থা। যাবতীয় সরঞ্জাম সাজানো।

ফিরে এসে বলল, যাও—

মিষ্টি উঠে গেল। ফিরল প্রায় সাত-আট মিনিট বাদে। সমস্ত মুখে ভালো করে সাবান ঘষে এসেছে বোঝা যায়। তোয়ালে দিয়ে মুছে আসা সত্ত্বেও ভেজা-ভেজা মুখ। ঘাড়ে মাথায়ও জল চাপড়েছে মনে হল। শুকনো চুলে মুক্তোর মতো দু—চারটে ফোঁটা আটকে আছে।

বাপী তাকালো। তারপর দুচোখ ওই মুখের ওপর অনড় খানিক। মিষ্টি আবার সামনে এসে বসার পরেও। এখানেও আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু সাবান দিয়ে সমস্ত প্রসাধন ধুয়ে মুছে আসার ফলে এখন আর অত ফর্সা লাগছে না। অকৃত্ৰিম তাজা বাদামী অনেকটা। ঠোঁটের লাল রংও ধুয়ে-মুছে গিয়ে শুধু লালচে আভা আছে একটু।

হৃষ্টমুখে বাপী মন্তব্য করল, এতক্ষণে ঠিক ঠিক তোমাকে দেখছি। শাড়িটা বদলে অন্য শাড়ি পরে আসতে পারলে আরো ঠিক দেখতাম

মিষ্টি মুখোমুখি সোফায় বসে হেসেই জিজ্ঞাসা করল, এ শাড়ি কি দোষ করল?

বাপী অম্লান বদনে জবাব দিল, বেজায় সাদা, যেন নিষেধ-নিষেধ ভাব।

দরজার বাইরে প্যাক করে শব্দ হতে মিষ্টিরই বাঁচোয়া।

—কাম ইন! বাপী সাড়া দিল।

দরজা ঠেলে দুজন বেয়ারা ট্রেতে গরম খাবার আর টুপী-আঁটা চায়ের পট ইত্যাদি নিয়ে ঘরে ঢুকল। দুজনের মাঝের চেয়ারে সেগুলো সাজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মিষ্টি আগে থাকতে আবার জানান দিল, আমার দ্বারা অত চলবে না, এ তো একেবারে রাতের খাওয়া সারার মতো এনে হাজির করেছে।

—সারলেই না-হয়। শুরু তো করো।

খেতে খেতে প্রথমেই মিষ্টির যার কথা মনে পড়ল সে বনমায়া। উৎসুকও।—টেলিগ্রামে বনমায়া কিল্ড লিখেছিলে—কি করে মরল? কে তাকে মারল?

বাপী সবিস্তারে বলল। মানুষের লোভের কথা বলল। দোসরকে বাঁচানোর চেষ্টায় বনমায়া ওভাবে নিজের জীবন খুইয়েছে সেই বিশ্বাসের কথাও বলল।

মিষ্টির খাওয়া থেমে গেছল। সব শোনার পর বিষণ্ণ।

—ও কি, খেতে খেতে শোনো। একটু থেমে বাপী আবার বলল, সেদিনও আমি শিলিগুড়ি গিয়ে তোমার বি. এ’র রেজাল্ট দেখে ফিরছিলাম বুঝলে? এসে দেখি বানারজুলির লোক ভেঙে পড়েছে বনমায়াকে দেখতে। বনমায়ার সেটা শেষ সময়, শুয়ে আছে। আমাকে দেখে চিনল, শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম করল…

—থামো, আর শুনতে পারি না।

—মিষ্টির মুখে বেদনার ছায়াতে কোনো ভেজাল নেই। বাপী অখুশি নয়। ওর স্মৃতির গভীর থেকে বানারজুলি হারিয়ে যায় নি। একটু থেমে বাপী আবার বলল, ওর মরদটার খবর শুনবে?

মন্দ কিছু শুনতে হবে কিনা মিষ্টির চোখে সেই আশঙ্কা।

—পাগলা গুণ্ডা হয়ে গেছে। সামনে কাউকে পেলে তাকে মেরে মানুষের লোভের শোধ নিচ্ছে। ওটাকে মারবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, এখনো মারা যায় নি, জখম হয়ে আরো শয়তান হয়ে গেছে। গেল বছর আমি ওই যমের মুখোমুখি পড়ে গেছলাম। কি করে যে বাঁচলাম সেটাই আশ্চর্য।

কে বললে মিষ্টির বয়েস বাইশ, হালফ্যাশানের ঝকঝকে এই মেয়ে এয়ার অফিসের চাকুরে। তার চোখে মুখে সত্যিকারের ত্রাস।—ওটার মুখোমুখি পড়লে কি করে—জঙ্গলে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলে বুঝি?

—বানারজুলির জঙ্গলে নয়, ভুটানের জঙ্গলে। আমি একটা পাথরে বসেছিলাম ওটা আসছে দেখিই নি। আর একজন সঙ্গে ছিল, সে দেখেছে, সে-ই বাঁচালো। ঘাবড়ে গিয়ে আমি সোজা ছুটতে যাচ্ছিলাম, তাহলে আর রক্ষা ছিল না। সঙ্গের সেই একজন আমাকে নিয়ে পাশের পাহাড়ে টেনে তুলল, আর বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড দেরি হলেও হয়ে যেত।

ঠোঁটের ডগায় আসা সত্ত্বেও রেশমার নামটা অনুক্তই থাকল। বুক নিঙড়নো একটা বড় নিঃশ্বাস ঠেলে বেরুলো। রেশমার নামটা করল না বলে নিজেকে অকৃতজ্ঞ ভাবছে।

দৃশ্যটা ভাবতে চেষ্টা করে মিষ্টি শিউরে উঠল। তোমার বনে-বাদাড়ে টহল দিয়ে বেড়ানোর অভ্যেস এখনো যায় নি?

রেশমার চিন্তা ঠেলে সরিয়ে বাপী হাসল। জবাব দিল না।

—সেই এক ময়াল সাপের মুখে পড়াটা আমি এখনো ভুলতে পারি নি। কখনো-সখনো স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠি।

কার জন্যে যে সেদিনের সেই মিষ্টিও প্রাণে বেঁচেছিল সেটা মুখে বলল না, চোখের ভাষায় বোঝা গেল। বাপী কিছুই ভোলে নি, কিছুই ভোলে না। মেমসায়েব অর্থাৎ ওর মায়ের সেদিনের কান-মলা পুরস্কারটাও মনে আছে। কিন্তু আজকের বাপী সেই বাপী নয়। অপ্রিয় প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেল না।

খাওয়া আর চা-পর্বও শেষ এই ফাঁকে। মিষ্টি বলল, এত খেলাম, সত্যি রাতের খাওয়া হয়ে গেল।

ওর ডিশ দুটোয় এখনো খানিকটা পড়ে আছে। বাপী তাগিদ দিল না। বেল টিপতে দরজা ঠেলে বেয়ারা এসে ট্রেসুদ্ধ নিয়ে চলে গেল।

মিষ্টি বলল, তোমার দিন অনেক বদলেছে বোঝাই যাচ্ছে—কি করছ? এ পর্যন্ত নিজের পদমর্যাদার জাহির কারো কাছে করেছে মনে পড়ে না। ঠিক জাহির না করলেও আজ লোভ সামলানো গেল না। পকেটের মোটা ব্যাগ খুলে একটা ছাপা কার্ড বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল।

মিষ্টি সাগ্রহেই কার্ডের ওপর চোখ বোলালো।—তুমি এখন মস্তলোক তাহলে—জেনারেল ম্যানেজার অ্যান্ড পার্টনার।…রাই অ্যান্ড রাই কিসের ফার্ম? অল্প কথায় বলল। কত জায়গায় ফার্মের শাখা-প্রশাখা আছে জানিয়ে সুবিধেমতো কলকাতায়ও যে জাঁকিয়ে বসার ইচ্ছে আছে তাও বলল।

—তুমি এই ফার্মের সর্বেসর্বা এখন?

—তা ঠিক না, মাথার ওপর কর্ত্রী আছে।

—কর্ত্রী?

ভিতরে বাপীর যে সাড়া জেগেছে, এই একজনকেই সব উজাড় করে বলা যায়। কে কর্ত্রী, কেমন কর্ত্রী বলল। কোথা থেকে কি ভাবে ওকে টেনে তুলেছে তাও বাদ গেল না। আর একই সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে ঊর্মিলার প্রসঙ্গও এলো। মিষ্টি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। এবারে সহজাত কৌতূহলে জিগ্যেস করল, ঊর্মিলার বয়েস কত?

—তোমারই বয়সী হবে, সামান্য ছোটও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের একেবারে রাজেশ্বরী মেজাজ।

—বিয়ে হয়েছে?

মজা করে সত্যি কথা বলতে আপত্তি কোথায় বাপীর? মাথা নেড়ে জবাব দিল, এই নিয়েই তো ফ্যাসাদ। মেয়ে এক ইঞ্জিনিয়ার-এর কাঁধে ঝোলার জন্য তৈরি, তার মা ওদিকে মেয়েকে আমার কাঁধে না ঝুলিয়ে ছাড়বে না। সঙ্কট বোঝো।

নির্লিপ্ত সুরে মিষ্টি বলল, অমন মা যখন সহায়, সঙ্কট আবার কি, ইঞ্জিনিয়ারকে হটিয়ে দাও।

কথার ফাঁকে বাপীর কার্ডটা নিজের হাত-ব্যাগ খুলে তাতে রাখল

কিন্তু পরামর্শটা বেখাপ্পা ছন্দপতনের মতো লাগল বাপীর। চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।—ইঞ্জিনিয়ারকে হটিয়ে দেব?

—তাছাড়া আর কি করবে। রাজত্ব-রাজকন্যা দুইই পাবে।

বাপীর একবার মনে হল মিষ্টি মেয়েলি ঠাট্টা করছে। কিন্তু ভিতরের অনুভূতিটা এমন যে তাও বরদাস্ত করার নয়। চাউনি ওই মুখের ওপর চড়াও হয়ে আছে। বলল, রাজত্ব বা রাজকন্যার লোভ নেই, আমার লোভ একটাই। গলার স্বরও ভারী।—বারো বছর ধরে পৃথিবীর সব বাধা আর সঙ্কটকে হটিয়ে আমি একজনের জন্যেই বসে আছি।

হাতের ব্যাগটা নাড়াচাড়া করছিল মিষ্টি। আঙুলগুলো থেমে গেল। দু-চোখ তার মুখের ওপর উঠে এলো। স্থির হল। মুখে যেন অদৃশ্য কঠিন রেখা পড়তে লাগল। হঠাৎ চাপা ঝাঁঝে বলল, তুমি মোস্ট আনপ্র্যাকটিকাল মানুষ

এটুকুতেই ভিতরে তোলপাড় কাণ্ড বাপীর।—কেন?

গলা না চড়িয়ে মিষ্টি আরো ঝাঁঝালো জবাব দিল, একটা মেয়ের দশ বছর বয়েসের সঙ্গে বারোটা বছর জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায় আর তার জগতে কত কি ঘটে যেতে পারে—ভেবেছিলে? শুধু নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়েই বারোটা বছর কাটিয়ে দিলে?

বাপী স্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত। এই মিষ্টিকে সে দেখে নি। সহজ কথা এমন কঠিন করে বলতে পারে তাও ধারণার বাইরে। তার পরেই সচকিত। বুকের তলায় কাটা-ছেঁড়ার যন্ত্রণা। বাপী কি করবে। উঠে হ্যাঁচকা টানে ওই মেয়েকে সোফা থেকে টেনে তুলে তার হাড় পাঁজর নিজের সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে? তারপর চিৎকার করে বলবে, ভুল-ভ্রান্তি জানি না, কোনো বাধা মানি না, অনেক ঝড়জলের সমুদ্র সাঁতরে ডাঙায় উঠতে সময় লেগেছে বলেই এত দেরি—ডাঙায় না উঠলে কেউ আমাকে বিশ্বাস করত না, তুমিও না। এই করবে? এই বলবে?

আত্মস্থ হল। মিষ্টির মুখের কঠিন লালচে আভা মিলিয়ে গেছে। নরম হয়েছে। চোখের কোণে সদয় কৌতুকের আভাস। ওটুকুতেই একটা দম-বন্ধ-করা জমাট অন্ধকার কিছু ফিকে হয়ে আসছে। তবু সামনে ঝুঁকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, বারো বছরে তার জগতে কত কি ঘটে গেছে জানতে পারি?

চোখের কৌতুক ঠোটে ফাটল ধরালো এবার। জবাব দিল, তেমন কিছু না— তুমি সেই বারো বছর আগের মতোই আছো দেখছি, একটুও বদলাও নি।

—কেন?

টিপ-টিপ হাসি ঠোঁট থেকে চোখে আর চোখ থেকে ঠোঁটে নামা-ওঠা করছে।— ছেলেবেলায় রেগে গেলে যেমন দেখাতো, আর আমার ওপর হামলা করার জন্য যেমন ওঁত পেতে থাকতে—ঠিক তেমনি লাগছিল তোমাকে। আমার ভয়ই করছিল—

আবার লোভ লোভ—রাজ্যের লোভ বাপীর। ভয় যে ওর থোড়াই করছিল তাও স্পষ্ট। সেই কারণেই আরো লোভ। তবু একটু আগের ঝাঁঝালো মুখ ঝাঁঝালো কথার অস্বস্তি একটু লেগেই আছে। হাসিতে যোগ না দিয়ে গম্ভীর মুখেই আবার তাগিদ দিল, কিছু যদি হয়ে থাকে আমাকে খোলাখুলি বলো।

—খোলাখুলি কি আবার বলব। বিপরীত তরল ঝাঁঝ এবার।—জেনারেল ম্যানেজার হও আর পার্টনার হও, তোমার প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধির দৌড় কত তাই বলছিলাম। ঘড়ি দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।—অনেক রাত হয়ে গেল চলি।

অনুনয়ের সুরে বাপী বলল, আর একটু বোসো।

—না, আর না–এমনিতেই এ চাকরি চক্ষুশূল।

অগত্যা বাপীও উঠল। কাল কখন আসছ?

—কাল? কাল তো আমি কলকাতাতেই থাকছি না!

সঙ্গে সঙ্গে বাপীর চাউনি সন্দিগ্ধ আবার।—আমাকে এড়াতে চাও?

হাল ছেড়ে আবারও হাসল মিষ্টি।—তোমাকে নিয়ে মুশকিল। হাত-ব্যাগ খুলে খাম থেকে খোলা একটা টাইপ করা কাগজ ওর দিকে বাড়িয়ে দিল।—এই দেখো, কাল বিকেলের মধ্যে আমি দিল্লিতে। পরশু রাতে ফিরব।

ইন্টারভিউর চিঠি পড়ল বাপী। এয়ারওয়েজের আরো পদস্থ কিছু চাকরি হবে নিশ্চয়। ইচ্ছে হল চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বলে, এর আর দরকার কি আছে? অতটা পারা গেল না। আবার হয়তো স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকার খোঁটা দেবে। শুধু বলল, না গেলে?

—পাগল নাকি! ছুটি নেওয়া হয়ে গেছে। ওখানেও তারা জানে আমি যাচ্ছি।

—তাহলে পরশু আসছ?

মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প। মাথা নাড়ল।—পরশুও না। রাত দশটার পর প্লেন ল্যান্ড করবে।

—তার পরদিন?

—তার পরদিন বিকেলে হতে পারে।

—হতে পারে? অস্ফুট আর্তনাদের মতো শোনালো।

মিষ্টি অবুঝের পাল্লায় পড়েছে।—আচ্ছা হবে।

—কথা দিচ্ছ?

হাসিমাখা দু চোখ তার মুখের ওপর থেমে রইল একটু। মাথা নাড়ল। কথা দিচ্ছে।

—ঠিক আছে। চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

মিষ্টি শশব্যস্তে বাধা দিল, না-না, পৌঁছে দিতে হবে না, একা চলা-ফেরা করা আমার অভ্যেস আছে।

কান না দিয়ে বাপী বাইরে এসে চাবি দিয়ে বন্ধ করল। বলল, আর্জ অন্তত তোমাদের বাড়ি গিয়ে হামলা করব না, ভয় নেই। দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে চলে আসব। এসো—

মিষ্টির নিরুপায় মুখ দেখে এখন বাপীরই মজা লাগছে।

সোনার হরিণ নেই – ২৪

বেশ সকালেই ঘুম ভাঙল বাপীর। চোখ মেলে তাকানোর আগে পর্যন্ত হালকা মেঘের মতো ও একটা ভেলায় চেপে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা অকারণ খুশিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছিল।

চোখ মেলে তাকানোর পরেই ভেতরটা আর ততো খুশি নয়। কলকাতার সব চেয়ে সেরা হোটেলের আরামের গদীতে শুয়ে আছে। এই কলকাতায় ও আছে মিষ্টি নেই। বাতাস ছাড়া আলো যেমন, আপাতত মিষ্টি ছাড়া কলকাতা তেমন। আজকের দিনটা যাবে। কালকের দিনটা যাবে। তার পরের দিন সেই বিকেলে মিষ্টি এখানে এই ঘরে আসবে। ভাবতে গেলে বিতিকিচ্ছিরি লম্বা সময়।

বিছানায় গা ছেড়ে চোখ পাকিয়ে বাপী কিছু মিষ্টি চিন্তায় ডুব দিল। বানারজুলির সাহেব বাংলোর দশ বছরের মিষ্টি, কলকাতার কলেজে-পড়া আঠের বছরের মিষ্টি, আর এয়ার অফিসের চাকুরে বাইশ বছরের মিষ্টি—এই তিন মিষ্টিই চোখের সামনে ঘোরা-ফেরা করে গেল। লোভাতুর তন্ময়তায় বাপী দেখছে। কারো থেকে চোখ ফেরানো সহজ নয়। যখন যাকে দেখছে, বাপী নিজের সেই বয়সের চোখ দিয়েই তাকে দেখছে।

উঠল। মুখ হাত ধুয়ে টেলিফোনে দুকাপের এক পট চা আনিয়ে নিল শুধু। এখানে গায়ত্রী রাই নেই যে শুধু চা খেতে চাইলে ঠাণ্ডা চোখে বকবে।

চা খেতে খেতে সকৌতুকে নিজের বরাতের ওপর চোখ বোলাচ্ছে বাপী। চার বছর আগে এই কলকাতা শহরে সে পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতো। বেশি খিদে, পেলে ঠোঙায় মুড়ি কিনে খেতে খেতে পথ চলত। রাস্তার কল থেকে জল খেত। ঝকঝকে এই হোটেলের দরজার সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সুন্দরী মেয়েদের আনাগোনা দেখত। আজ এই হোটেলেই সে একজন সম্ভ্রান্ত আগন্তুক। বিলাসবহুল একটা সুইট তার দখলে। টেলিফোন তুলে হুকুম করলেই যথেচ্ছ ভোগের উপকরণ নাগালের মধ্যে। কিন্তু আশ্চর্য, এই ভোগবিলাসের সঙ্গে তবু ঠিক নাড়ির যোগ নেই বাপীর।

ঝপ করে যে মুখখানা সামনে এগিয়ে এলো, তার একমাথা চুল, গালবোঝাই কাঁচা-পাকা দাড়ি, চওড়া কপালে মেপে সিঁদুর ঘষা। টালি এলাকার বাসিন্দা ব্রুকলিন পিওন রতন বণিকের মুখ। জোর গলায় বাপীর দিন-ফেরার ভবিষ্যদ্বাণী শুধু সে-ই করেছিল। বউকেও বলেছিল, হবে যখন দেখে নিস, বিপুলবাবুর ভাগ্যিখানা কালবোশেখীর ঝড়ের মতোই সব দিক তোলপাড় করে নেমে আসবে একদিন। ওই খুপরি ঘরের আশ্রয় ছেড়ে আসার দিনও বলেছিল আপনার কপালের রং অনেকটা ভালো হয়ে গেছে, আমার কথা মিলিয়ে নেবেন, দিন ফিরতে ভুলবেন না যেন।

বাপীর মনটা সবার আগে ওই রতন বণিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলিবিকুলি করে উঠল। কিন্তু যাবে কি করে। তামাম দুনিয়ায় এই একজনের কাছে নিজের বিবেক সব থেকে বেশি অপরাধী। কাল মিষ্টির দেখা পেয়েছে বলেই সেই বিবেকের চাবুক এই সকালেও অনুভব করল। কমলা বণিকের ঢলঢলে কালো মুখখানা জোর করেই স্মৃতির গভীর থেকে টেনে উপড়ে ফেলে দিতে চাইল। সম্ভব হলে রতন বণিকের সঙ্গে দেখা একবার করবে। মুখে কিছু না বলেও বুকের তলায় কৃতজ্ঞতা উজাড় করে দিয়ে আসতে পারবে। বলতে পারবে তোমাকে ভুলি নি কোনদিন, ভুলব না। কিন্তু ওর ঘরের ত্রিসীমানায় গিয়ে নয়। সময় পেলে ওর আপিসে গিয়ে দেখা করে আসবে।

খবরের কাগজ পড়ল। মিষ্টি এখানে নেই, কলকাতায় বসে কাগজে আর এমন কি খবর পড়ার আছে। ধীরেসুস্থে শেভ করল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে স্নান সারল। পিছনের সব কালো ধুয়ে-মুছে ফেলার মতো স্নান একখানা। ভুটান জঙ্গলের উদ্দাম ফকির তাকে সামনে এগোতে বলেছিল, পিছনে তাকাতে বলে নি।

ঘড়ির কাঁটা বেলা দশটার ওধারে সরতেই রিসিভার তুলে বিজয় মেহেরার আপিসের নম্বর চাইল। দু মিনিটের মধ্যে ওদিক থেকে মেহেরার ব্যস্ত গলা—মেহেরা হিয়ার!

এদিক থেকে কপট গাম্ভীর্যে বাপী বলল, বানারজুলির বাপী তরফদার।

—ফ্রেন্ড! সঙ্গে সঙ্গে ওধারে গলা উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ল।

ঊর্মিলার ফ্রেন্ড তাই তারও ফ্রেন্ড।—এই কলকাতা থেকে কথা বলছ? কবে এসেছ? কোথায় উঠেছ?

—ধীরে বন্ধু ধীরে। তোমার বুকের তলার দাপাদাপি ফোনে শোনা যাচ্ছে। কখন দেখা হবে?

ওধার থেকে দরাজ হাসির শব্দ। হোটেলের হদিস দিয়ে বাপী ওকে চলে আসতে বলল। কিন্তু সেই বিকেল ছটার আগে বিজয়ের দম ফেলার সময় নেই। একটা বড় টেন্ডারের ফয়সালা হবে আজই। ওদিক থেকে তার আরজি, কলকাতায় সে আনকোরা নতুন এখনো, বলতে গেলে এখন পর্যন্ত কিছুই চেনে না, তার থেকে ফ্রেন্ড যদি ঠিক ছ’টায় তার খিদিরপুরের ফার্মে চলে আসে তো খুব ভালো হয়—ছটার পর থেকে রাত পর্যন্ত সে তার খাতিরের গেস্ট।

বাপী রাজি হতে খুশির হাসি হেসে ফোন ছেড়ে দিল। এত ব্যস্ত বলেই হয়তো ফোনে তার প্রেমিকার সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করল না।

কিন্তু বিকেল ছ’টা দূরের পাল্লা। বাপী এতক্ষণ করে কি। তক্ষুনি বন্ধু নিশীথ সেনের কথা মনে হল। এখনো যুদ্ধের আপিসের চাকরি করছে, না হবু কবিরাজ পাকা কবিরাজ হয়ে বসেছে এতদিনে, জানে না। চার বছরের মধ্যে চিঠিপত্রেও যোগাযোগ নেই। নোট বই-এ ওর বাড়ির ফোন নম্বর লেখা আছে।

দুটো চোখের মতো কান দুটোও বাপীর জোরালো। ও-দিকের গলার আওয়াজ পেয়েই মনে হল নিশীথ ফোন ধরেছে। অর্থাৎ কবিরাজই হয়েছে, আপিস থাকলে এ-সময় তার বাড়ি থাকার কথা নয়।

গম্ভীর সুরে জিজ্ঞাসা করল, সিনিয়র কোবরেজ মশাই কথা বলছেন, না জুনিয়র?

—জুনিয়র। আপনার কাকে চাই?

—আপনাকেই। চট করে একবার না এলেই নয়।

—কোথায়?

হোটেলের নাম আর সুইট নম্বর বলল। ওদিকের বিমূঢ় মূর্তিখানা না দেখেও বাপী আঁচ করতে পারে। অমন একখানা হোটেলের কোনো রোগী ওর শরণাপন্ন ভাববে কি করে, বিশ্বাসই বা করবে কি করে।

—আমার নাম বাপী। চেনা-চেনা লাগছে?

—বা-আ-বাপী! কানের পর্দায় দ্বিতীয় দফা বিস্ময় আছড়ে পড়ল।—বাপী তুই? এতকালের মধ্যে একটা খবর নেই, কোন্ ভাগাড়ে ডুব দিয়ে বসেছিলি? ওই হোটেলের কারো সঙ্গে দেখা করতে এসেছিস?

একটি কথারও জবাব না দিয়ে বাপী বলল, আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, চলে আয়। বিকেলের আগে ছাড়া পাচ্ছিস না বাড়ীতে বলে আসিস।

ঘড়ি ধরে আধ ঘণ্টার মধ্যেই দরজার বাইরে প্যাঁক করে আওয়াজ হল। বাপী তখন হাফ পার্টিশনের এ-ধারে আরামের শয্যায় শুয়ে। কাম ইন।

ঘরে ঢুকে নিশীথ পার্টিশনের ও-ধার থেকে সন্তর্পণে গলা বাড়ালো। এ কোন্ স্বপ্নপুরীতে এসে হাজির হয়েছে ভেবে পাচ্ছে না। ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখে বাপী ডাকল, হাঁ করে দেখছিস কি? ভিতরে আয়।

বেঁটে-খাটো নিশীথের দু চোখ সত্যি ছানাবড়া। চোখে দেখেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। ভিতরে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল আর এক দফা। লোয়ার ডিভিশন চাকরি যোগাড় করে যাকে জলপাইগুড়ি থেকে টেনে এনেছিল চার বছরের মধ্যে তার এমন ভাগ্য বিশ্বাস করে কি করে?

—এ-ঘরে সত্যি তুই থাকিস নাকি?

—পাগল! বাপীর ভূত থাকে। বোস্

উঠে বসে গদীর বিছানাটা চাপড়ে দিল। এমন বিছানায় বসেও অস্বস্তি নিশীথের।—কি ব্যাপার রে? চেহারাখানা আগের থেকেও তো ঢের খোলতাই হয়েছে—গুপ্তধনের হদিস-টদিস পেয়েছিস নাকি?

বাপী হাসছে মিটি-মিটি। জবাব দিল, পুরুষের ভাগ্য।

—ভাগ্যের জোরে তো মশার দশা গিয়ে একেবারে হাতির দশা চলছে মনে হচ্ছে—খুলে বলবি কিছু, না কি?

ওপর-পড়া হয়ে সে-ই খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে বন্ধুর ভাগ্যের জোয়ারের মোটামুটি হদিস পেল। বনজ ওষুধের কাঁচা বা শুখা মাল হোলসেল দোকান থেকে ওদেরও কিনতে হয়। ওই সব বড় বড় হোলসেলাররা আবার যাদের কাছ থেকে মাল কেনে তারা কত মুনাফা লোটে নিশীথের ধারণা নেই। বাপী এই নামজাদা হোটেলে এসে ওঠা থেকে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে।

ফোঁস করে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা।—বরাত বটে একখানা তোর, পেলি কি করে?

গায়ত্রী রাইয়ের প্রসঙ্গ ধামাচাপা। এখনো তার নাম উল্লেখ করল না। এমন ভাগ্য দেখে ওর আনন্দে আটখানা হওয়া সহজ নয়। একসময় বাপী ওরও করুণার পাত্র ছিল তো বটেই।

—তুই যা বললি তাই, সবই বরাত রে ভাই। তোর খবর বল্ শুনি, বিয়ে—থা করেছিস?

নিজের প্রসঙ্গেও নিশীথ বীতশ্রদ্ধ। সরকারী আপিসের সেই টেম্পোরারি চাকরি কবেই গেছে। বাবার দাপটে আদাজল খেয়ে কোবরেজিতেই লেগে যেতে হয়েছে। বছর আড়াই আগে কিছু টাকা খরচ করে বাবা কাশীর কোথা থেকে আয়ুর্বেদের একটা চটকদার ডিপ্লোমা এনে দিয়েছে ওকে। রোগী এলে বাবা ওকেই আগে সামনে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে, আর ছেলের সম্পর্কে আয়ুর্বেদীয় জ্ঞানগম্যির গুণকীর্তন শোনায়। কিন্তু লোকে তাতে খুব একটা ভোলে না। বাবার সঙ্গে ছেলের এখন বিয়ে নিয়েই মন-কষাকষি চলছে। ছেলের জন্য বাবা এখন একটি জ্যান্ত পুঁটলি ঘরে আনতে চায়। মেয়ের গায়ের রং ময়লা আর ওর মতোই বেঁটে-খাটো। বাবার চোখে সব দিক থেকে রাজ-যোটক! মেয়ের বাপের বাজারে নিজস্ব বড় একটা মুদি দোকান। অঢেল কাঁচা পয়সা। তিনটি মাত্র মেয়ে। ছেলে নেই। মেয়ে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ে এখন ঘরে বসে বিশ্রাম করছে। এমন রূপগুণের পুঁটলিকে বিয়ে করতে আপত্তি দেখে বাবার উঠতে বসতে হুমকি। কথায় কথায় মাকে শোনায়, কুঁজোর আবার চিত হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখার সাধ!

সখেদে আবার একটা গরম নিঃশ্বাস ছাড়ল নিশীথ।—আমার অবস্থাখানা বোঝ একবার—

সহানুভূতির দায়ে বাপী তাকে একনম্বরি লাঞ্চ খাইয়ে কিছুটা তুষ্ট করল। ডাইনিং হল-এ নগদ খরচায় এ-পর্ব সমাধা করেছে। বিল মেটাবার সময় বাপীর ঢাউস ব্যাগে একশ টাকার নোটের তাড়া দেখেও নিশীথের দু-চোখ গোল!

হাতে অঢেল সময় এখনো। বেরিয়ে এসে বাপী একটা ট্যাক্সি নিল। বনজ ওষুধের পাইকিরি বাজারটা একবার ঘুরে দেখবে। চার বছরে ব্যবসার স্বার্থ ওরও রক্তে এসে গেছে।

পাইকারদের আসল ঘাঁটি বড়বাজারে। দমদম আর উল্টোডাঙার দিকে তাদের গোডাউন। নিশীথ ওকে বড়বাজারে নিয়ে এলো। মাঝারি দুজন ডিলারের সঙ্গে ওর কিছু যোগাযোগ আছে। বড় মাঝারি ডিলারদের বহু ঘাঁটিতে হানা দেবার ফলে বাপীর আগ্রহ চারগুণ বেড়ে গেল। এমন সোনার বাজার এখানে কল্পনা করে নি। বাপীর বেশভূষা চেহারাপত্র আর ছাপা কার্ড দেখে আর কথাবার্তা শুনে মালিকরা খাতিরই দেখিয়েছে। ভারতের এত জায়গায় যাদের শাখা-প্রশাখা, তার বাঙালী পার্টনার আর জেনারেল ম্যানেজারকে হেলাফেলা করবেই বা কেন।

ঘুরে ঘুরে বাপী মোটামুটি তথ্য যোগাড় করল, আগের দিন হলে গায়ত্রী রাই তক্ষুনি তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে কলকাতায় চালান করত হয়তো। দেশজোড়া নাম আছে, এখানকার এমন কটা বড় কবিরাজি কারখানাতেই কম করে তিরিশ লক্ষ টাকার বনজ উপকরণ লাগে। গ্রীষ্মকালে কবিরাজির মন্দা বাজার, শীতকালে জমজমাট। এছাড়া বড় ফার্মেসিউটিক্যাল ফার্মগুলোতেও পনের বিশ লক্ষ টাকার মাল সরবরাহ হয়ে থাকে। আর মাঝারি বা ছোট কবিরাজি বা ওষুধ তৈরির কারখানাগুলোর চাহিদা যোগ করলে তা-ও কম ব্যাপার নয়! এখানে বাসে বা ট্রেনে বেশির ভাগ মাল আসে মোকাম থেকে।

ব্যবসা সম্পর্কে বাপীর কথাবার্তা শুনে আর তৎপরতা দেখেও নিশীথ চুপ মেরে গেছে। উদ্দেশ্যও বুঝেছে। ওকে নিয়ে সেই ট্যাক্সিতেই বাপী দমদম চলে গেছে গোডাউনগুলো দেখতে। তারপর বাপীই বলেছে, ব্রোকারের মারফৎ শুধু মাল চালান দেওয়া নয়, সুযোগমতো যতো শিগগীর পারে গোডাউন ভাড়া করে এখানে রিজিয়ন্যাল সেন্টার খুলবে।

ব্যাপারখানা কত বড় নিশীথের এরপর আঁচ করতে অসুবিধে হয় নি। উত্তরবাংলা বিহার মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় ওদের রিজিয়ন্যাল সেন্টার আছে, আর সে-সব জায়গায় রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার কাজ করছে কথায় কথায় তাও জেনে নিয়েছে।

ফিরতি পথে ট্যাক্সিতে বসে নিশীথ জিজ্ঞাসা করল, এইসব রিজিয়ন্যাল ম্যানেজারদের মাইনে কত রে?

মাইনে শুনে আর তার ওপর বরাদ্দ কমিশনের অঙ্ক শুনে নিশীথ নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। তারপর আবার চুপ।

কলেজ স্ট্রীটে বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামতে নিশীথ ওকেও জোর করে নামাতে চাইল। কিন্তু ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজে। ছটায় খিদিরপুরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। শুনে অনুনয়ের সুরে নিশীথ বলল, আচ্ছা এক মিনিটের জন্য একবার নেমে আয়।

কি হল না বুঝে বাপী নেমে এলো। নিশীথের দু চোখ এমন চকচক করছে কেন হঠাৎ বাপী বুঝছে না। পরক্ষণে বোঝা গেল।

—এখানে তোদের রিজিয়ন্যাল অফিস হলে আমার ম্যানেজারের চাকরিটা পাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?

ভিতরে ভিতরে বাপী বিরক্ত। এ ব্যাপারে সে নির্মম। তক্ষুনি বলল, আমার কি হাত বল, মালিক খুব কড়া লোক

—তুই চেষ্টা করলেই হবে ভাই। আঙুল তুলে তিনখানা বাড়ির পরের একটু পুরনো বাড়ি দেখালো।—ওই বাড়ির দোতলায় একটি মেয়ে থাকে, বাবা মা নেই, কাকাদের কাছে থাকে। এবারে বি-এ পাশ করেছে। মেয়েটা ফর্সা নয়, কিন্তু ভারী সুশ্রী, আর কি মিষ্টি গান গায়। রোজ সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আমি শুনি। আজ পর্যন্ত কথা হয় নি বটে, তবু ওই মেয়েও আমাকে বেশ লক্ষ্য করেছে জানি। কিন্তু কোবরেজের ছেলে কোবরেজ হয়ে সেদিকে হাত বাড়াতে গেলে ওরা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে। একটা ভালো চাকরি পেলে আশা ছিল…।

চোখে-মুখে প্রত্যাশা উপচে পড়ছে। বাপীর মনে আছে ও-ই একদিন বলেছিল, কবিরাজের ছেলে হবু কোবরেজের সঙ্গে কোনো আধুনিক মেয়ে প্রেমে পড়েছে এমনটা নাটক-নভেলেও দেখা যায় না। বাপী দেখছে ওকে। এই আবেদন যে কত মোক্ষম নিশীথও জানে না।

—ঠিক আছে, লেগে থাক। আমি চেষ্টা করব।

বলতে পারত, এখানে রিজিয়ন্যাল ইউনিট হলে চাকরি তোর হয়েই গেছে ধরে নিতে পারিস। কিন্তু অতটা বলে কি করে, একটু আগেই বলেছে ওর হাত নেই আর মালিক কড়া লোক।

.

বিজয় মেহেরা আগেও সুপুরুষ ছিল। এখন আরো খোলতাই হয়েছে। ফর্সা মুখে লালচে আভা, মাথার পাতলা চুল এখন বাদামী গোছের। আগের থেকেও কমনীয় জোরালো পুরুষে ছাঁদ।

সহজ আনন্দে বাপীকে জাপটে ধরল। বলল, মাত্র দশ মিনিট আগে ফ্রি হলাম। তারপরেই তুমি আসছ মনে পড়তে দশটা মিনিট যেন দশ ঘণ্টা!

বাপীর ভালো লাগছে। ছেলে কাজের সময় কাজ-পাগল আর প্রেমের সময় প্রেম-পাগল। টিপ্পনী কাটল, আমি আসছি বলে, না ডলির দূত আসছে বলে?

হা-হা শব্দে হাসল। তারপর পাল্টা জবাব দিল, তুমিও আমার কাছে কম নও। লন্ডনে থাকতে ডলির যত চিঠি পেয়েছি তার সবগুলোতে ফ্রেন্ড-এর একগাদা করে প্রশংসা। মাঝে মাঝে ভয় ধরেছে, আমার কপাল না ভাঙে।

অফিস আর ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যেই একদিকে রেসিডেনসিয়াল কোয়ার্টারস। তাছাড়া মস্ত ক্লাব আছে, অঢেল খানাপিনার ব্যবস্থাও আছে সেখানে। দু’ঘরের সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে থাকে। আগে বাপীকে সেখানে নিয়ে এলো।

—ডলি কেমন আছে বলো।

—খুব ভালো। পাকা ফলটির মতো তৈরি।

এক্ষুনি ছুটে গিয়ে দেখতে পাচ্ছে না বলে গলা দিয়ে একটা হাল্কা-খেদের আওয়াজ বার করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি কলকাতায় এসেছ কেন?

নির্জলা সত্যি কথাটা বলে কি করে। জবাব দিল, ডলির তাগিদে।

খুশি। হাসছে—একেবারে গ্রীন সিগন্যাল নিয়ে এসেছ তাহলে?

বাধ্য হয়ে এবারও সত্যের অপলাশ—অতটা নয়, রেড থেকে ইয়োলো হব—হব বলতে পারো।

সঙ্গে সঙ্গে অসহিষ্ণু রাগের ঝাপটা।—এতদিন পরে ইয়েলো হব-হব। অথচ ডলি প্রত্যেক চিঠিতে আমাকে লিখেছে ফ্রেন্ড যখন ফয়সলার ভার নিয়েছে তোমার কোনো ভাবনা নেই! আমি কি ভিখিরি নাকি যে কবে তিনি দয়া করবেন সেই আশায় বসে থাকব!

এবারে বাপীও গম্ভীর একটু। প্রায় অনুযোগের সুরে বলল, আচ্ছা বিজয়, তোমার হবু শাশুড়ী কেমন আছেন একবারও জিগ্যেস করলে না তো?

অপ্রস্তুত একটু।—ডলি লিখেছিল বটে শরীর ভালো যাচ্ছে না, কেমন আছেন?

—বেশ খারাপ।

—কি হয়েছে? এবারে উদ্বিগ্ন একটু।

—হার্টের কি-সব ভাল্ব-টাল্ব ড্যামেজ। ফরেনে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা ভাবছি।…এর মধ্যে তোমার গ্রীন সিগন্যালটাই যদি বড় করে দেখো সেটা কেমন হবে?

সমস্যাটা অস্বীকার করা গেল না।—গেলে ডলিও সঙ্গে যাবে?

একমাত্র মেয়ে কাছে থাকবে না সেটা হয় কিনা তুমিই ভাবো বিজয়ের বেজার মুখ। এই থেকেই বোঝা গেল ছেলেটার মায়া দয়া আছে। তবু বলল, বিয়েটা হয়ে যেতে বাধা কি, তারপর না-হয় যাক।

—সে চেষ্টাও করতে পারি। তাছাড়া বাইরে উনি যেতে চাইবেন কিনা তাও জানি না। মোট কথা, এমন একটা অবস্থার মধ্যে তাঁর মুখ না তাকিয়ে তুমি যদি তড়িঘড়ি কিছু করে ফেলার জন্য জুলুম করো তাহলে আমাদের সকলকেই মুশকিলে ফেলবে। তোমাকে ধৈর্য ধরে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।

বিজয় চুপ খানিকক্ষণ। তারপর হালছাড়া গোছের বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।…তবে আমি আশা করেছিলাম, ডলির মায়ের মন খানিকটা তৈরি হয়ে আছে।

—ওই চাকরি ছেড়ে তুমি ব্যবসায় চলে এসো, দশ মিনিটের মধ্যে আমি তাঁর মন তৈরি করে দিচ্ছি।

—তা কখনো হয়!

—তা যখন হয় না, এমন একটা অসুখের সময় একমাত্র মেয়েকে চোখের আড়াল করা কত শক্ত সেটাও তোমাকে বুঝতে হবে। তুমি শুধু ঠাণ্ডা মাথায় একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখছি কত তাড়াতাড়ি কি করা যায়।

বিজয় ক্লাব ক্যানটিনে ডিনারে নিয়ে গেল তাকে। খাওয়ার ফাঁকে তার চাকরি—বাকরির খোঁজও নিতে ভুলল না বাপী। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে এই দু’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে, ওর কম করে গোটা পনের সিগারেট খাওয়া সারা।

খাওয়া শেষ করেই আবার সিগারেট ধরাতে বাপী বলল, তোমার সিগারেটের মাত্রা বেড়েছে মনে হচ্ছে—

—তা কি করব। সমস্ত দিন খাটাখাটুনির পর এই তো সঙ্গী।

—ড্রিংক-এর মাত্রা বাড়েনি তো?

নিঃসংকোচে হেসেই জবাব দিল, তাও বেড়েছে, আজ তোমার কম্প্যানি পেলাম বলে দরকার হল না—ভালো চাও তো তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করো।

বাপীও হেসেই সাবধান করল, এ দুয়ের কোনোটাই কিন্তু তোমার হবু শাশুড়ী ভালো চোখে দেখবেন না।

সিগারেটে আরামের টান দিয়ে বিজয় বলল, তাঁর সামনে প্লেন ওয়াটার ছেড়ে ডিসটিলড ওয়াটার খাবো।

আবার আসবে কথা দিয়ে বাপী হোটেলে ফেরার ট্যাক্সি ধরল।

ভোরের আলোয় চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলের মতো বাপীর মনে হল, আর মাত্র এই দিন আর রাতটা কাটলে তারপর যা কিছু সব মিষ্টি। এই দিন আর রাতটাকে চোখের পলকে পিছনে ঠেলে দিতে পারলে দিত। কিন্তু মিষ্টির প্রতীক্ষাটুকুও খুব মিষ্টি গোছের কিছু।

নিশীথের দুপুরে আসার কথা। বাপী ওকে সকালেই আসতে বলেছিল, কিন্তু সকালে পাশে না থাকলে বাবা এই বয়সেও কটু কথা শোনায়। চায়ের পাট শেষ করে দাড়ি কামাতে কামাতে বাপী ভাবছিল ও এলে একবার ব্রুকলিনে গিয়ে আগে রতন বণিকের সঙ্গে দেখা করবে। তারপর আজ আর কোনো কাজটাজ নয়, দুপুরের শোয়ে নিশীথকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখবে। কতকালের মধ্যেও সিনেমা-টিনেমার ধারেকাছে ঘেঁষেনি।

সকাল তখন সোয়া নটা। ঘরের টেলিফোন বাজল। বিজয় আর নিশীথ দুজনেই টেলিফোন নম্বর নিয়েছিল। ওদেরই একজন হবে ধরে নিয়ে সাড়া দিল।

ওদিক থেকে অপরিচিত গলায় প্রশ্ন এলো, বাপী তরফদার?

সায় দেবার পর যা শুনল, বাপীর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠার দাখিল।—আমি সুদীপ নন্দী…মিষ্টির দাদা, তোমাদের বানারজুলির দীপুদা…চিনতে পারছ?

সহজ হবার দায়ে বাপী চুপ একটু। তাছাড়া হঠাৎ এমন একজনের টেলিফোন, অপ্রীতিকর কিছু শোনার আশঙ্কাই বেশি। জবাব দিল, আমি চিনতে পেরেছি, তোমার মনে আছে সেটাই আশ্চর্য।

ওদিক থেকে মোলায়েম হাসির শব্দ।—আমার মনে থাকবে না কেন, আমি তো তখন অ্যাডাল্ট।…তুমি এত বড় হয়েছ জেনে মা আর আমি খুব খুশি হয়েছি। সেদিন বাড়ির দোরগোড়ায় এসেও না দেখা করে চলে গেছ শুনে মা মিষ্টির ওপরেই খুব রাগ করেছে।

রোসো বাপী তরফদার, রোসো। বুকের তলায় লাফঝাঁপে বে-সামাল হয়ো না। হেসে বলল, রাত হয়ে গেছল, মিষ্টি তো দিল্লি থেকে আজ রাতেই ফিরছে?

—হ্যাঁ। আমি কাল দিনে দুবার আর সন্ধের পর একবার তোমাকে ফোন করেছিলাম…তুমি ঘরে ছিলে না।

—তাই নাকি? বাপীর গলায় অন্তরঙ্গ খেদ।—জানি না তো, অপারেটারকে বলে রাখলে আমিই ফোন করতাম…

—তাতে আর কি হয়েছে…তুমি আজ বিকেলেই এসো না একবার, এখানেই চা-টা খাবে? মা-ও বার বার বলছেন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে…অবশ্য এসো—আসবে তো?

বুকের তলায় আবারও খুশির দামাল বাতাস। মিষ্টি দিল্লি রওনা হবার আগে এদের তাহলে যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। নইলে এদের কাছ থেকে এমন আমন্ত্রণের আর কোনো অর্থ হয় না। আপত্তি করার কোনো প্রশ্ন নেই। জিজ্ঞাসা করল, বিকেলে কখন?

—আমি পাঁচটার মধ্যে কোর্ট থেকে ফিরব…ধরো সাড়ে পাঁচটা ছটা?

—তুমি কোর্টে প্র্যাকটিস করছ?

—হ্যাঁ, হাইকোর্টে। বিলেত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি করছি, মিষ্টি বলেনি?

বাপী তাড়াতাড়ি সামাল দিল, হ্যাঁ তাই তো, চার বছর আগেই শুনেছিলাম তুমি ব্যারিস্টারি পড়তে গেছ। ঠিক আছে বিকেলে যাব, কিন্তু একটা শর্তে।

—কি?

রাতে আমার এখানে তোমার ডিনারের নেমন্তন্ন। তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে ফিরব।

—ওয়ান্ডারফুল! বানারজুলির গাঁট্টা-মারা সুদীপ নন্দীর অস্তিত্ব নেই আর।— তোমার হোটেলের ডিনার মানে তো মস্ত ব্যাপার! গলা খাটো করে জিগ্যেস করলো, বিলিতি খাওয়াবে তো?

—নিশ্চয়, যা তোমার ইচ্ছে আর যত ইচ্ছে। ডান?

—ডান।

—ঠিক আছে, ছটার মধ্যে যাচ্ছি।

রিসিভার নামিয়ে বাপী হাওয়ায় ভাসল খানিকক্ষণ।…মিষ্টি বেশি রাতে ফিরবে, কোনো অছিলায় আজই তার সঙ্গে দেখাটা হয় না? কি করে হবে, বাপী যে আবার আনন্দে কাঁসি হারিয়ে বোকার মতো দীপুদাকে হোটেলে ডিনারের নেমন্তন্ন করে বসল! তাহলেও ভালোই করেছে। ওই মা-ছেলেকে বশে আনতে পারাটাও কম ব্যাপার নয়।

নিশীথকে টেলিফোন করে আসতে বারণ করে দিল। জরুরী কাজ পড়ে গেছে। পরে কবে কখন দেখা হবে, টেলিফোনে জানাবে। এই দিন আর ওর সঙ্গ ভালো লাগবে না, সিনেমা-টিনেমাও না।

ফের বাতাসে সাঁতার কাটার ফাঁকে আবার মনে হল কিছু। ও অনেক বড় হয়েছে, মিষ্টির মা আর দাদার এত খাতির অনেকটা এই কারণে। তা না হলে উল্টে ওর ওপর অসন্তুষ্ট হত তারা। এই দুজনের কাছে বড় হওয়াটা আরো জাঁকিয়ে তোলার তাগিদ। রিসিভার তুলে সোজা ম্যানেজারকে চাইল। বক্তব্য, আজ বিকেল থেকে ওর জন্য ভালো একটা সার্ভিস-কার অ্যারেঞ্জ করা সম্ভব কিনা। শুধু আজকের জন্য নয়, পর পর কয়েকদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই গাড়ি তার হেপাজতে থাকবে। তার জন্য যত খরচ লাগুক, আপত্তি নেই।

ঘণ্টা দুই বাদে ম্যানেজার জানালো, ভালো সার্ভিস-কারই পাওয়া গেছে। গাড়ি নিচে আছে, সে ইচ্ছে করলে দেখে যেতে পারে।

বাপী তক্ষুনি নেমে এলো। তখন বিলিতি গাড়িরই ছড়াছড়ি বেশি। ঝকঝকে গাড়ি। তকমা-পরা ড্রাইভার। তাকে ঠিক পাঁচটায় আসতে বলে বাপী হৃষ্টচিত্তে ওপরে উঠে এলো।

সাতাশি নম্বরের সেই বাড়ি। মাত্র চার বছর আগে এই বাড়িরই দোরগোড়ায় পাড়ার স্তাবকের দল কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ওকে ছেঁকে ধরেছিল, ছিঁড়ে খেতে চেয়েছিল। আজ সেই বাড়িতেই বাপী তরফদার সমাদরের অতিথি। টাকা যার, মামলা তার। বাপী সেই মেজাজেই দূর থেকে দোতলার বারান্দার দিকে তাকালো। রেলিং-এর কাছে মনোরমা নন্দী দাঁড়িয়ে। পাশে দীপুদা।

এই গাড়ি দেখেও তাদের চোখ ঠিকরেছে বাপী আঁচ করতে পারে। গাড়ি থামতে ড্রাইভার আগে নেমে শশব্যস্তে দরজা খুলে দিল। বাপী নামল।

দীপুদা ছুটে নেমে এসে ওকে সাদরে জাপটে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। মনোরমা নন্দীও নেমে এসেছেন। এখন আর ব্যঙ্গ করে বাপীর তাঁকে মেমসায়েব বলতে ইচ্ছে করছে না। হাসিমুখে এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।—বাঃ, ভারী সুন্দর চেহারা হয়েছে তো তোমার, না জানলে আমি চিনতেই পারতুম না! বোসো বোসো।

অন্তরঙ্গ হেসে দীপুদা বলল, কেন, ছেলেবেলাতেই তো বেশ চেহারা ছিল ওর।

মিসেস নন্দীর মুখের হাসি খুব প্রাঞ্জল ঠেকল না বাপীর। হাসির ওধারে যাচাইয়ের চোখ। ছেলের কথার জবাবে বললেন, তা ছিল, কিন্তু কি দুষ্টু, কি দুষ্টুই না ছিল তখন!

হৃষ্টমুখে দীপুদা মন্তব্য করল, অমন দুষ্টু ছিল বলে আমি তখনই জানতাম ও কালে-দিনে বড় হবে।

বাপীর মজাই লাগছে। তার কানে এখনো মহিলার শাসনের স্পর্শ লেগে আছে। পিঠের চাবুকের দাগ আজও মেলায়নি। দীপুদার কথায় কথায় গাঁট্টা মারাও ভোলেনি। কিন্তু আজ টাকা যার, মামলা তার।

মনোরমা নন্দীর বাবা মারা গেছেন শুনল। এক মেয়ে, তাই বাড়িটা এখন তাঁর। দীপুদা বিয়ে করেছে। ছেলেও আছে। বউকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশ সুশ্রী, কিন্তু রোগা। তাদের দেড় বছরের ফুটফুটে ছেলেটাকে বাপী আদর করে কোলে তুলে নিল। চারদিক তাকিয়ে বাপীর কেন যেন মনে হল বিলেত—ফেরত দীপুদার ব্যারিস্টারির পসার তেমন জমজমাট নয়।

আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি নেই তা বলে। মনোরমা নন্দী জোর করেই অনেক কিছু খাওয়ালেন। শাঁসালো ডিনারের লোভে দীপুদা সামান্য খেল। মা-ছেলে তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওর খবর নিতে লাগল। অর্থাৎ ঠিক কত বড় হয়েছে আঁচ করার চেষ্টা। মহিলা শেষে জিজ্ঞেসই করে ফেললে, এত বড় ফার্মের তুমিই সকলের ওপরে, না তোমার ওপরে আর কেউ আছে?

—মালিক আছেন। তবে আমাকেই সব করতে হয়।

—মাইনে তো তাহলে অনেক পাও নিশ্চয়?

সত্যি যা তার চেয়ে ঢের বেশি বাড়িয়ে বলার লোভ সামলালো বাপী।— অনেক আর কি…হাজার আড়াই।…তবে আসল রোজগার পার্টনারশিপের শেয়ার আর কমিশন থেকে, সেটা মাইনের থেকে অনেক বেশি।

বাহান্ন সালে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন ভারতের আর্থিক কাঠামোর দিকে তাকালে রোজগারের এই জলুস যে কোনো মধ্যবিত্তের চোখ ঠিকরে দেবার মতো। যুদ্ধের আপিসগুলো গোটানোর ফলে যে সময় ঘরে ঘরে বেকার, সামগ্রিক ব্যবসার বাজারও মন্দা।

মা আর ছেলে দুজনের কারো মুখে কথা সরে না খানিকক্ষণ। নিজের বিত্তের ঢাক বাজানো এই প্রথম। বাপীর নিজেরই কান জুড়লো। চোখও। বানারজুলির গরিব কেরানীর ছেলে এতদিনে তার হেনস্থার জবাব দিতে পেরেছে।

বাইরেটা শুধু সহজ নয়, অন্তরঙ্গও।—আপনাদের খবর কি বলুন— মেসোমশাই এখন কোথায় পোস্টেড?

বানারজুলির সেই দাপটের বড়সাহেবকে আজ অনায়াসে মেসোমশাই বলতে পারল। মনোরমা নন্দী জবাব দিলেন, তাঁর তো সেন্টারের চাকরি এখন, উড়িষ্যায় আছেন। টান-ধরা তপতপে মুখ।—খবরের কথা আর কি বলব, কি যে মতি হল মেয়েটার, আমাদের সুখ-শান্তি সবই গেছে।

বাপী হতভম্ব হঠাৎ। এই কথা কেন! মিষ্টি এয়ার অফিসে কাজ করছে বলে? জিজ্ঞাসা করল, মিষ্টি কি করেছে?

এবারে মা আর ছেলে দুজনেই অবাক একটু। মনোরমা নন্দী ফিরে জিগ্যেস করলেন, কেন সেদিন মিষ্টি তোমাকে বলেনি কিছু?

বাপী আরো বিমূঢ়। মাথা নাড়ল। কিছু বলেনি।

সুদীপ নন্দীর ব্যারিস্টারি মাথাও যেন বিভ্রান্ত একটু।—হোটেল থেকে ফিরে মায়ের কাছে তোমার সম্পর্কে কত কথা বলল, মায়ের কাছে তোমার কার্ড নিয়ে বাড়িতে ডাকার কথাও বলে গেছে—আর নিজের সম্পর্কে ও তোমাকে কিছু জানায়নি!

অজ্ঞাত আশঙ্কায় বাপী দুজনকেই দেখে নিল একবার করে। আবারও মাথা নেড়ে জিগ্যেস করল, সুখ-শান্তি নষ্ট হবার মতো মিষ্টি কি করেছে?

কি জবাব দেবেন ভেবে না পেয়ে মনোরমা নন্দী ছেলের দিকে তাকালেন। দীপুদা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, মা আবার বেশি-বেশি ভাবছে, তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়—চলো তোমার হোটেলেই তো যাচ্ছি, শুনবে’খন।

বাপীও উঠে দাঁড়াল। দীপুদার এ কথায়ও স্বস্তি বোধ করল না। মনোরমা নন্দীর মুখখানাই আর এক দফা দেখে নিল। ওই মুখে সুখ-শান্তির অভাবের অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট এখন। নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর আবার মনোরমা নন্দীর দিকে।—মিষ্টির ফিরতে রাত হবে, তবু আমাকে একবার ফোন করতে বলবেন তো!

ফের বিপাকে পড়ার মুখ মহিলার। জবাব দিলেন না, এমন কি মাথাও নাড়লেন না।

বাপীর অপরিসীম ধৈর্য। গাড়িতে দীপুদাকে একটি কথাও জিগ্যেস করল না। হোটেলে ফিরেও আগে তার জমজমাট ডিনার ব্যবস্থা করল। আস্ত একটা খাস বিলিতি বোতল সোডা ইত্যাদি নিজের সুইটে আনিয়ে নিল। খানাপিনা শুরু করার পরেও দীপুদা খানিকক্ষণ নিজের কথাই চালিয়ে গেল। বিলেতে কতদিন ছিল, কেমন ছিল, এখানে ফিরে সব দেখেশুনে সে-তুলনায় কতটা বীতশ্রদ্ধ, সুযোগ—সুবিধে হলে সপরিবারে আবার সেইখানেই চলে যাবার বাসনা, এ-দেশে কেউ মানুষের দাম দেয় না, টাকা-পয়সার অভাব নেই যখন বাপী যেন ও-দেশটা ঘুরে দেখে আসে, ইত্যাদি। বাপীর হার্ড ড্রিংক চলে না শুনেও হতাশ একটু। নিজের গেলাস বার দুই খালি হবার পরেও নিষ্ফল অনুরোধ, দেখই না একটু টেস্ট করে, খারাপ লাগবে না।

তার গেলাস আরো এক দফা খালি হবার পর বাপী নিজের হাতে বোতলের জিনিস এবার একটু বেশিই ঢেলে দিল। সোডা মেশালো। তারপর ঠাণ্ডা মুখে জিজ্ঞেস করল, মাসিমা কি বলছিলেন, মিষ্টি কি করেছে?

এবারে সুদীপ নন্দী গলগল করে যা বলে গেল তাতে ব্যারিস্টারি বাকচাতুরি থেকে স্থূল গোছের উষ্মাই বেশি।

বি-এ পরীক্ষার আগেই মিষ্টি উল্টোদিকের বাড়ির এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে। ছেলের নাম অসিত চ্যাটার্জি, মিষ্টির থেকে কম করে আট বছরের বড়। ছেলেটা রূপে কার্তিক, গুণে মাকাল ফল। দুবারের চেষ্টায় আর-এ পাশ করেছে। সাড়ে তিনশ’ না চারশ টাকা মাইনেয় সবে একটা ফার্মে ঢুকেছিল। এখনো পাঁচশ’ টাকার বেশি মাইনে পায় কিনা সন্দেহ। মিষ্টিটা এত বোকা গাধা কে জানত, ছয় মাস না যেতে হাড় কালি। ছেলের বাপ-মা আর বাড়ির সব এমন গোঁড়া যে জানাজানি হবার পর বউ ঘরে নেওয়া দূরে থাক, তারা ছেলেকেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ

দীপুদা আগে কিছু জানত না। মিষ্টির বিয়ের এক মাস বাদে সে বিলেত থেকে ফিরেছে। এসে দেখে বাবা ছুটি নিয়ে কলকাতায় বসে আছে, আর মায়ের মুখ কালি। গুণধর জামাইয়ের এত দেমাক যে শ্বশুর-শাশুড়ী ভুরু কোঁচকালেও তার অপমান হয়। হুমকি দিয়ে কথা বলতেও ছাড়ে না। মিষ্টির বি-এ পরীক্ষা হতেই জোর করে তাকে নিয়ে গিয়ে আলাদা ঘরভাড়া করেছে। কিন্তু চলে কি করে? ওদিকে তো গুণের ঘাট নেই। মদের নেশা জুয়ার নেশা সবই আছে। এসব অবশ্য পরে জানা গেছে।

ছ’মাস না যেতে মিষ্টি মরতেই বসেছিল। ছেলেপুলে হবে, এদিকে টাকা—পয়সার জোর নেই, উঠতে বসতে অশান্তিরও শেষ নেই। অত সুন্দর মেয়েটার দিকে তাকালে তখন ভয় করে। বাছাধনের তখন টনক নড়ল, বউকে মায়ের কাছে পাঠাতে চাইল। কিন্তু মিষ্টির আবার তখন এমন গোঁ, কিছুতে আসবে না। আসবে কি করে, বাবা মা দাদা কাকে না অপমান করেছে অসিত চাটুজ্জে?

দীপুদাদের অজান্তে এরপর মিষ্টি শেষই হতে বসেছিল। পেটের ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। তার ফলেই প্রাণ-সঙ্কট। অসিত চ্যাটার্জি সস্তার একটা হাসপাতালে এনে ফেলেছিল ওকে। সেখানেও আজেবাজে ডাক্তার দিয়ে অপারেশন হয়েছে। পরে দীপুদা আর তার মা কলকাতার সব থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসতে সে আবার অপারেশন করেছে। তাইতেই রক্ষা সেই বড় ডাক্তারও বলেছে, বাজে হাতে পড়ে মেয়েটার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে প্রাণে যে বেঁচেছে এই ঢের।

এরপর টানা ছ’মাস মিষ্টি মায়ের কাছে ছিল। মেয়েটার শরীরের বাঁধুনি ভালো বলতে হবে, তিন মাস না যেতেই আগের শ্রী-স্বাস্থ্য সবই ফিরে পেয়েছে। পরের তিন মাসের মধ্যে এয়ার অফিসের চাকরিটাও নিজের চেষ্টাতেই পেয়ে গেছে। মা ওকে আর ছাড়তেই চায় নি। কতবার করে বলেছে, ভুল যা হয়েছে—হয়েছে, কাগজের বিয়ে ছিঁড়ে ফেললেই ছেঁড়ে। দীপুদাও বোনকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু মাথায় যে কি ওটার, হাঁ না কিছুই বলে না, শুধু হাসে। তাইতেই মা আর সে ভেবেছিল হয়তো রাজি হবে। কিন্তু ছ’মাস পার হতে নিজে থেকে আবার ওই অসিত চ্যাটার্জির কাছেই চলে গেল।

এখন অবশ্য লোকটা অনেকখানি ঢিট হয়েছে। তবু অমন একটা বাজে লোকের সঙ্গে বোন সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে এ দীপুদা বা তার মা বিশ্বাসই করে না। কিন্তু ও-মেয়ের মাথায় কি আছে কে জানে, মা তাগিদ দিলে হাসে, আবার বেশি বললে বিরক্ত হয়। মনোহরপুকুর রোডে মোটামুটি একটা ভালো ফ্ল্যাটেই থাকে এখন। সেদিন বাপী ওকে মায়ের বাড়ি পৌঁছে দিতে ঘণ্টাখানেক সেখানে থেকে তারপর নিজের বাড়ি চলে গেছে। আজ মিষ্টি ফিরবে বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা হবে না বা কথা হবে না। কারণ ওর বাড়িতে টেলিফোনও নেই।

.

সমস্ত রাত চোখে-পাতায় এক হয়নি বাপীর। ঘুমোতে চেষ্টাও করেনি।

তার জগৎ অন্ধকার। এ অন্ধকার দূর করার মতো আলো নেই কোথাও। আগুন আছে। সেই আগুন বুকের তলায়। এ আগুন বাইরে নিয়ে এলে ওই অন্ধকারে যে ক্রুদ্ধ হিংস্র পশুটা থাবা চাটছে, সেটাও পুড়বে। বাপী তরফদার আর ওকে ধ্বংস করতে চায় না।

পরদিনই বানারজুলি চলে যাবার চিন্তা বাতিল। সকালে নিশীথ টেলিফোন করে আসতে চেয়েছে। বাপী বলেছে, আজ না, খুব ব্যস্ত। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে। একটু বাদে আবার টেলিফোন। বিজয় মেহেরা। তাকেও বলেছে, আজ না।

সকাল পেরিয়ে দুপুরও গড়াতে চলল। বাপী নরম গদীতে শুয়ে। অপেক্ষা করছে। এই বিকেলে মিষ্টি আসবে কথা দিয়ে গেছে। বাপীর ধারণা আসবে। সমস্ত ঘটনা ওর কানে দেবার জন্যেই মাকে আর দাদাকে বলে গেছে ওকে বাড়িতে চা’য়ে ডাকতে। নিজে কেন বলেনি? ভয়ে? তাই যদি হয়, তাহলে বিকেলে আর আসবে না। কিন্তু অত ভীতু বাপী ওই মেয়েকে এখনো কেন ভাবছে না, জানে না।

…এলে কি হবে?

বাপী তাও জানে না।

এলো। একলা নয়। সঙ্গে অসিত চ্যাটার্জি। তার পরনের ট্রাউজার বা কোট তেমন দামী নয়। চোখে আগের মতোই সোনার চশমা। গায়ের রং আগের তুলনায় কিছুটা ঝলসেছে। বিব্রত হাসি-হাসি মুখ

মিষ্টির পরনে গাঢ় খয়েরি রংয়ের দামী শাড়ী। গায়ে চকচকে সাদা ব্লাউস। সিঁথিতে সরু সিঁদুরের আঁচড়। কপালে লাল টিপ। কালকের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর। হিংস্র উল্লাসে ভোগের রসাতলে টেনে নিয়ে যাবার মতোই লোভনীয়। নিজের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের ক্ষমতা কি বাপীর জানা ছিল! দু-হাত বাড়িয়ে সরগরম অভ্যর্থনা জানালো।—এসো অসিতদা এসো—চার বছর আগে লেকে তোমার সেই গলাধাক্কা খাবার পর থেকে তুমি আমারও হীরো হয়ে বসে আছ জানো না—

এরকম অভ্যর্থনার জন্য লোকটা প্রস্তুত ছিল না বোঝা যায়। খুব স্বেচ্ছায় হয়তো আসেনি এখানে। মিষ্টির বাড়ির রাস্তায় আর লেকে যাকে অত হেনস্থা করা হয়েছে, সে এখন এই হোটেলের এমন ঘরের বাসিন্দা, সে-কারণেও হয়তো সহজ হওয়া মুশকিল। মিনমিন করে জবাব দিল, ও-সব ছেলেবেলার ব্যাপার তুমি এখনো মনে করে বসে আছ…

হাত ধরে বাপী সাদরে তাকে গদীর বিছানাতেই বসিয়ে দিল। আধা পার্টিশনের ওধার থেকে একটা সোফা মিষ্টির সামনে টেনে আনল। তারপর নিজের খাটের একদিকে বসে ওই সোনার চশমার ওপর চড়াও হল আবার। —কাল দীপুদার মুখে সব শোনার পর থেকে কেবল তোমার কথাই ভাবছিলাম। তুমি একটা পুরুষের মতো পুরুষ, আমাকে তোমার শিষ্য করে নিলে বর্তে যাই।

চকচকে চশমার ওধারের চোখ দুটো স্বস্তি বোধ করছে না খুব। আবারও শুকনো হাসি টেনে বলল, কি যে বলো, কত বড় একজন মানুষ তুমি এখন…

—গুলি মেরে দাও, ধন-জন-যৌবন জোয়ারের জল—এলো তো এলো, গেল তো গেল। কিন্তু তুমি যে কেরামতি দেখিয়েছ, সন অফ কুবেরও ভেড়ার মতো তোমার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে।

মিষ্টি বাপীর দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ছুঁয়ে আছে। কিন্তু এর নাম হাসি নয়, হাসির মতো কিছু। ও মুখ দেখছে না, ভেতর দেখছে।

ও-রকম করে হাসলে আর অমন করে চেয়ে থাকলে বাপী কি করে বেশিক্ষণ এই হাসির মুখোশ ধরে রাখতে পারবে? ওর ভিতরটা কি-রকম লোলুপ হিংস্র ব্যভিচারী হয়ে উঠেছে মিষ্টি কি তা আঁচ করতে পারছে? পারলে অমন করে হাসত না। ও-ভাবে চেয়ে থাকতে পারত না।

টেবিলের ওপর বিলিতি মদের বোতলটা পড়ে আছে। দীপুদা ছ’আনা শেষ করে গেছে, বাকিটা আছে। অসিত চ্যাটার্জি ঘন ঘন ওই বোতলটার দিকে তাকাচ্ছে।

বাপী উঠে ছোট সেন্টার টেবিল তার সামনে পেতে দিল। তারপর বোতলটা এনে রেখে জিগ্যেস করল, জল চাই, না সোডা?

অসিত চ্যাটার্জির দু চোখ খুশিতে চিকচিক করছে এখন।—জলই ভালো, কিন্তু মিলু রেগে যাচ্ছে।

মিলু শুনেই কানের পর্দা দুটো ছেঁড়ার দাখিল বাপীর। মালবিকা ওর মিলু। জলের জাগ্ আর একটা গেলাস তার সামনে রেখে বাপী তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিল, শিবঠাকুরকেও পার্বতী গাঁজাখোর বলে গাল পাড়ত,—এসব দেখে মেজাজ — না চড়ালে ওদের মান থাকে না। কাল দীপুদা মাত্র অতটুকু সাবাড় করে রেখে গেছে, আজ তোমার কেরামতি দেখাও।

দীপুদার নামটা সবুজ নিশানের কাজ করল। গেলাসে বোতলের জিনিস একটু বেশিই ঢেলে নিয়ে অসিত চ্যাটার্জি মিষ্টিকে বলল, এমন জিনিস পেলে কে আর লোভ সামলাতে পারে। বাপীকে জিগ্যেস করল, তোমার গেলাস কোথায়?

—আজ তুমিই চালাও। আমি এরপর দিনক্ষণ দেখে হাতেখড়ি দেব ভাবছি। রোসো, কিছু খাবার-দাবার আনাই—

আধঘণ্টার মধ্যে অসিত চ্যাটার্জি ভিন্ন মানুষ। বাপী যে এমন রত্ন ছেলে সে ভাবতেই পারেনি। মিলুও কখনো বলেনি। মাত্র একদিনের আলাপে বাপী আপনার জন হয়ে গেছে তার, অথচ পান থেকে চুন খসলে আপনার জনেরাই দূরে সরে যায়,—যাচ্ছেও, ইত্যাদি।

মিষ্টির তাড়া খেয়ে আরো ঘণ্টাখানেক বাদে উঠল। বোতলের নিচে দু’ইঞ্চির মতো জিনিস পড়ে আছে। মিষ্টি খাবার ছোঁয়নি, শুধু এক পেয়ালা চা খেয়েছে। কিন্তু সে খাবারও প্রায় সবটাই অসিত চ্যাটার্জির উদরে গেছে। এখন ভালো মতো দাঁড়াতেও পারছে না। মিষ্টির মুখ লালচে দেখাচ্ছে এখন। কিন্তু রাগ যার ওপর হবার কথা, অর্থাৎ বাপীর দিকে সাহস করে যেন তাকাতেও পারছে না।

অন্তরঙ্গ জনের মতো লোকটাকে ধরে বাপী লিফট-এ নিচে নামল। দরজার কাছে এসে মিষ্টি অস্ফুট স্বরে বলল, আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসছি।

—ট্যাক্সির দরকার নেই, গাড়ি আছে। আঙুল নেড়ে বাপী তার সার্ভিস-কারের তকমা-পরা ড্রাইভারকে ডাকল। গাড়ি নিয়ে লোকটা সমস্ত দিন বসেই আছে।

সাহেবকে আর মেমসাহেবকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসো।

থমথমে দু চোখ মিষ্টির মুখের ওপর স্থির কয়েক পলক। এতক্ষণ দুটো চোখ দিয়ে আর হিংস্র সত্তা দিয়ে যে আদিম পশু ওই তাজা নরম দেহটা ছিন্নভিন্ন করছিল, এখনো সে মুখোশের আড়ালে।

তাকালো মিষ্টিও। এখনো অভিযোগ নেই। শুধু কিছু যেন বোঝাতে চায়। ঠোঁটের ফাঁকে আবার সেই রকমই হাসির ছোঁয়া লাগল। যার নাম ঠিক হাসি নয়। হাসির মতো কিছু।

ঘুরে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাপী তার ঘরে ফিরে চলল।

সোনার হরিণ নেই – ২৫

নিজের পৃথিবী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জীবন প্রতারণা করেছে? বাপী তরফদার কার ওপর শোধ নেবে? কাকে ক্ষমা করবে? নিজের দুটো পা কপাল পর্যন্ত ওঠে না। নইলে সবার আগে ওটাকেই থেঁতলে দিত। এই কপালের ওপর বড় বেশি আশা ছিল। আস্থা ছিল। প্রেম প্রীতি ভালবাসার কোনো দুর্জয় শক্তির উপর নির্ভর করে বসেছিল। যেন যত খুশি লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে তারা স্থান-কালের গণ্ডী টপকে কারো জন্যে কাউকে আগলে রাখতে পারে। এই বিশ্বাসে সত্তার সব কড়ি উজাড় করে ঢেলে দেয় এমন বোকাও কেউ আছে!

আজ ফিরছে গায়ত্রী রাই জানে না। বাগডোগরায় তাই গাড়িও অপেক্ষা করে নেই। লাউঞ্জে পা দিতেই একদিকের সোফার দিকে চোখ গেল। যাবার সময় যে সোফায় মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম বাপীর সামনে এসে বসেছিল। হাওয়া আপিসের এক অফিসার স্ত্রী সাজিয়ে ওকে কলকাতায় নিয়ে যাবে এ আশায় দু মাস ধরে দিন গুনছিল আর এখানে হানা দিচ্ছিল। আত্মনির্ভর জীবনে ফেরানোর আশ্বাস দিয়ে বাপী তাকে আট দশ দিন বাদে বানারজুলির ঠিকানায় দেখা করতে বলেছিল। বাপীর গলা দিয়ে নিঃশব্দ একটা কটূক্তি বেরিয়ে এলো।

এলে কি হবে? রেশমার কাজে লাগিয়ে দেবে, না দূর করে তাড়াবে? বাসনার যে আগুন শিরায় শিরায় জ্বলছে, নাগালের মধ্যে এলে আর কোনো মেয়ের তার থেকে অব্যাহতি আছে!

ইচ্ছে করেই বিকেল পার করে দিয়ে বানারজুলিতে পৌঁছুল। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে সাইকেল রিকশা চালু হয়েছে এখানে। একটায় উঠে বসল। রিকশাঅলাটাকে হুকুম করল খুব আস্তে চালাতে। বানারজুলির আকাশ বাতাস জঙ্গল সব অন্ধকারে ডুবে যাক। আরো ঘন হোক, আরো গাঢ় হোক। বুকের ভেতরটা যেমন কালি হয়ে আছে তেমনি হোক।…সেই কবে আবু রব্বানী বলেছিল, তার মুখ দেখলেই ভেতর-বার সাফ মনে হয়, মেমসায়েবের পছন্দ হবে; কিন্তু আজ অন্তত বাপীর নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। এই মুখ আজ অন্ধকারেই সেঁধিয়ে থাক!

—মিস্টার তরফদার, এক মিনিট। সাইকেল রিকশার টিমটিম আলোয়ও মুখ চিনে যে লোকটা হাত তুলে ডেকে থামালো, সে চা-বাগানের ক্লাবের ম্যানেজার ডাটাবাবু। রাস্তার উল্টো দিক থেকে হনহন করে আসছিল। ক্লাবে সন্ধ্যায় আসর বসার আগে ফেরার তাড়া সত্ত্বেও ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে রিকশা থামিয়েছে।

—কি মুশকিলে পড়েছি বলুন তো, কত দিনের মধ্যে আপনাদের কোনো চালান নেই, এদিকে ভাল মাল প্রায় শেষ—আপনি এখানে নেই খবর পেয়ে আবু রব্বানীর কাছে গেছলাম, ও বলল, আপনি কলকাতা থেকে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিছু মাল যে আমার এক্ষুনি দরকার।

বাপীর ইচ্ছে হল রিকশা থেকে নেমে ঠাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তার বদলে ঝাঁঝালো জবাব দিল, আপনার জন্যে আমি ঘরে মদের বোতল মজুত করে বসে আছি যে এক্ষুনি পাঠিয়ে দেব?

মেজাজের ঝাপটায় ডাটাবাবু বেসামাল।—না না, তা বলছি না, যত তাড়াতাড়ি হয়—

—চলো! ঝাঁঝালো বিরক্তির হুকুম রিকশাঅলাকে।

আগের বাঁকের মাথায় নেমে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ট্র্যাভেল সুটকেস হাতে বাপী বাংলোর দিকে এগলো। বারান্দায় আলো জ্বলছে। মা বা মেয়ে সেখানে বসে নেই। এগিয়ে এসে নিঃশব্দে নিজের বাংলোর গেট খুলে ভেতরে এলো।

ফেব্রুয়ারির শেষ এটা। কলকাতার তুলনায় এখনো এখানে ঠাণ্ডা বেশি। অন্ধকার ঘরের জানালা-টানলাগুলোও না খুললে চলে। তবু টর্চ জ্বেলে বাপী ঘরের ভেতরটা দেখে নিল একবার। সুটকেসটা একদিকে আছড়ে ফেলল। কাধের কোটটা দূর থেকে আলনার দিকে ছুঁড়ে দিল। তারপর বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে টর্চ নিভিয়ে দিল। পরনের ট্রাউজার বদলে পাজামা পরার ধৈর্যও নেই।

মাথাটাকে শূন্য করে দেবার চেষ্টা। কোনরকম চিন্তা মাথায় ঢুকতে দেবে না। ভালো না মন্দ না। আশা না হতাশা না। কিন্তু এমন অসম্ভব চেষ্টার সঙ্গে যুঝতে হয়। বাপী যুঝছে।…এই রাত পোহাবে। তখন আর অন্ধকারে সেঁধিয়ে থাকা যাবে না। মুখ দেখাতে হবে। দেখতে হবে। কিন্তু মাথার এই দাপাদাপি বন্ধ না হলে ভোর হবার আগেই পালাতে হবে কোথাও।

কতক্ষণ কেটেছে জানে না। আধ ঘণ্টা হতে পারে। জোরালো আলোর ঘায়ে বিষম চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।

ঘরের আলো জ্বেলে বিমূঢ় বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে আছে ঊর্মিলা। পরনে সাদা ফ্রক। তার উপর কার্ডিগান। বাপীর মুখখানা ভালো করে দেখে নিচ্ছে।

বিছানার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।—ফিরে এসে এমন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছ? তুমি ফিরেছ মা জানে?

সরল বিশ্বাসেও কেউ হিংস্র পশুর খাঁচা খুলে দিলে কি হয়? বাপী চেয়ে আছে। ওর ভিতরের কেউ চিৎকার করে বলতে চাইছে, শিগগির চলে যাও— পালাও। কারণ, আর কেউ ওকে আরো কাছে টানার জন্য লোলুপ হয়ে উঠেছে। মাথা নাড়ল কি নাড়ল না। অস্ফুট স্বরে জিগ্যেস করল, তুমি জানলে কি করে?

—আমি ক্লাবে ডাটাবাবুর জন্য বসেছিলাম। কটা দিনের মধ্যে তোমাদের কারো কোনো খবর নেই…যদি চিঠিপত্র এসে থাকে। ডাটাবাবু বলল, তুমি ফিরেছ আর তোমার মেজাজও খুব খারাপ। কি হয়েছে…তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?

—কি রকম দেখাচ্ছে?

ঊর্মিলা এতেই অসহিষ্ণু। গায়ের কার্ডিগানটা খুলে অদূরের চেয়ারে ছুঁড়ে দিয়ে আরো একটু কাছে এসে বলল, আমি জানি না, খবর কি বলো?

বাপীর চাউনিটা ওর মুখ থেকে বুকে নেমে আবার মুখে উঠে এলো। এই মেয়ের এমন মুখর যৌবনের দিক থেকে জোর করেই চোখ ফিরিয়ে ছিল এত দিন। আর তার দরকার আছে? ঠিক এই মুহূর্তে যে সংকল্পটা উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেল সেটাকে প্রশ্রয় দেবে, না ঠেলে সরাবে?

জবাব দিল, খবর ভালো না।

সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার ফর্সা মুখ ফ্যাকাশে একটু। উদ্‌গ্রীবও।—আঃ! চেপেচুপে কথা বলছো কেন? কার খবর ভালো না, আমার না তোমার?

মগজে লোভের হাতছানি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নয় কেন? প্রেম ভালবাসার কি মানে? শুধু শব্দ ছাড়া আর কি? মোহ ছড়ায়, ভোলায়। একবার দখলের আওতায় পাকাপাকি ভাবে টেনে নিয়ে আসতে পারলে এই মেয়েরই বা মোহ কাটতে আর ভুলতে কত সময় লাগবে? তবু আরো একবার ভিতরের আর কেউ বাপীকে এই লোভ থেকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করল। জোর করে ও-পাশ ফিরে বলল, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে চলে যাও, আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে—

কাল কথা হবে।

কিন্তু ঊর্মিলারও ধৈর্যের শেষ। খাটের ওপর বসে পড়ে এদিক থেকেই ঝুঁকে তার মুখ দেখতে চেষ্টা করল। তারপর চিরাচরিত অসহিষ্ণুতায় এক হাতে বাপীর চুলের মুঠি আর অন্য হাতে বুকের কাছটা ধরে জোর করেই আবার তাকে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করে বলে উঠল, তোমার মাথায় কিচ্ছু যন্ত্রণা হচ্ছে না— কি হয়েছে আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। তুমি বলবে কি বলবে না?

বাপীর মুখের ওপর ওর নিঃশ্বাসের হলকা, পাঁজরে মাথায় ওর হাঁটুর ওপরের আর হাতের উষ্ণ স্পর্শ। ঘন নাগালের মধ্যে তপ্ত দুরন্ত যৌবন। যা ঘটার মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। তারপর ঘটে যেতে লাগল। কঠিন দুটো হাতের ঝটকা টানে ওই সুঠাম নারীদেহ বাপী তরফদারের বুকের ওপর। নরম দুটো অধর নিজের দুটো ঠোঁটে বিদীর্ণ করে করে রসাতলের গহ্বরে তলিয়ে যেতে চাইল। নিজের শক্ত বুকের ওপর ওই উষ্ণ নরম বুক গুঁড়িয়ে দেবার আগে হাত দুটোও আর বুঝি ক্ষান্ত হবে না।

সমস্ত ব্যাপারটা এমন অবিশ্বাস্য যে ঊর্মিলার সম্বিৎ ফিরতেই সময় লাগল খানিকক্ষণ। তারপর প্রাণপণে ওই অমোঘ গ্রাস থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিটকে নেমে দাঁড়াল। কপালের ওপরে বিশৃঙ্খল চুলের গোছা এক হাতে পিছনে ঠেলে দিল। দেখছে। হাঁপাচ্ছে। দুই চোখ বিস্ফারিত। এই লোককে সে চেনে না, কখনো দেখেনি।

এবারে দুই চোখে ওই নরম দেহ ফালা ফালা করছে। ঠোঁটের হাসি ধারালো ছোরার মতো ঝিলিক দিচ্ছে। গলার স্বরেও কোনো দ্বিধার পরোয়া নেই আর। ঠিক আজই আমি এরকম করে বলতে চাইনি তোমার দিকের খারাপ খবরটা কি। তুমি জোর করে বলালে।

নিজের দুটো কানের ওপরেও বিশ্বাস খুইয়ে বসেছে ঊর্মিলা। হাঁপাচ্ছে এখনো। চেয়েই আছে।

—দেখছ কি? আর অত অবাক হবারই বা কি আছে? এই মূর্তি দেখেই ভেতর আরো নির্মম বাপীর।—এ তো আমার পাওনাই ছিল। ড্রাইভিং শেখানোর গুরুদক্ষিণা হিসেবে অনায়াসে চুমুও খেয়ে ফেলতে পারো, বলেছিলে না? তবে এতে হবে না, এর থেকে ঢের বেশি দক্ষিণা দেবার জন্য তৈরি হওগে যাও।

শুধু চোখে নয়, গলা দিয়েও এবারে অস্ফুট আর্তস্বর বেরুলো ঊর্মিলার।— এ তুমি কি করলে বাপী! তুমি না ফ্রেন্ড? কলকাতায় গিয়ে হঠাৎ কি হয়ে গেল তোমার? তুমি এমন কথা বলছ কেন?

বাপীর হাসিতে এতটুকু মায়ামমতার ছোঁয়া নেই। দু চোখে নরম তাজা দেহ লেহন করছে এখনো। একটু আগের উষ্ণ স্পর্শ আগুন হয়ে মাথার দিকে উঠছে। জবাব দিল, ফ্রেন্ড বলেই আমার দাবি বেশি, কলকাতায় গিয়ে এই বাস্তব বুদ্ধিটুকু নিয়ে ফিরে এসেছি। এমন কথা বলছি কারণ তোমার মা যা চান তাই হবে। আর কদিনের মধ্যে ডলি মিসেস তরফদার হবে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?

ঠোঁটে হাসি। গলার স্বর অকরুণ। চোখে আবারও ওকে দখলের মধ্যে টেনে আনার অভিলাষ। ঊর্মিলা সত্রাসে চেয়ে রইল একটু। তারপর ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। গায়ের কার্ডিগানটা চেয়ারেই পড়ে থাকল।

মিনিট দশেক বাদে বাপী খাট থেকে নামল। ঠাস ঠাস করে ঘরের জানালাগুলো খুলে ফেলল। বাথরুমে এসে চোখে-মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিল। একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে। ওটা নির্মূল করার আক্রোশেই বাপী মাথাটা কলের তলায় পেতে দিল। তোয়ালে মাথায় বুলিয়ে ঘরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল।

চেয়ারের কাঁধে হাত রেখে গায়ত্রী রাই দাঁড়িয়ে। মাত্র কটা দিনের অদেখা এই মুখ আরো সাদা, রক্তশূন্য। শরীর আরো খারাপ হয়েছে, না মেয়ে গিয়ে কিছু বলেছে বলে এমন বিবর্ণ মূর্তি বোঝা গেল না। কিন্তু প্রথম কথায় মনে হল না, মহিলা মেয়ের কাছ থেকে বড় রকমের কিছু ধাক্কা খেয়ে এসেছে। এক নজর দেখে নিয়ে বলল, এই ঠাণ্ডায় মাথা ভিজিয়ে এলে, মোছো ভালো করে, জল ঝরছে।

বাধ্য ছেলের মতো ঘরের আর একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে আবার মাথাটা মুছে নিল। একটু সময় দরকার। কিছু শোনার জন্য আর কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি দরকার। তোয়ালেটা জায়গামতো রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বাপী বলল, বসুন। খুব ভালো দেখছি না তো, কেমন ছিলেন?

—ভালো না।

বেশি অসুস্থ না হলে এরকম বলে না। চিরুনি থেমে গেল। আয়নার ভেতর দিয়ে বাপী তার দিকে তাকালো। মহিলা এখনো দাঁড়িয়ে। ওর দিকেই চেয়ে আছে।

—সেই কষ্টটা আবার বেড়েছিল?

বাজে কথায় সময় নষ্ট হচ্ছে বলেই যেন বিরক্ত।—কষ্ট লেগেই আছে, ও নিয়ে ভেবে কি করবে, তুমি কখন ফিরেছ?

—বেশিক্ষণ নয়। চিরুনি রেখে এগিয়ে এলো। আমি নিজেই তো যেতাম, আপনার কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল।

চেয়ারটা তার সামনে টেনে দিতে গিয়ে বাপীর দু চোখ হোঁচট খেল একপ্রস্থ। ঊর্মিলার কার্ডিগান এখনো চেয়ারেই পড়ে আছে। গায়ত্রী রাই দেখেছে। ঠাণ্ডা মুখে বাপী ওটা তুলে আলনায় রাখল।

গায়ত্রী রাই চেয়ারে বসল। ও খাটে এসে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর জিগ্যেস করল, ডলির কি হয়েছে?

জবাব না দিয়ে বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। ভাবলেশশূন্য এই সাদা মুখ দেখে আশা করছে কি হয়েছে বা কতটা হয়েছে মেয়ে হয়তো এখনো সেটা বলে নি। কিছু যে হয়েছে তাই শুধু বুঝে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ফিরে জিগ্যেস করল, ডলি কিছু বলেছে আপনাকে?

—না।

—কি করছে?

—ঘরে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছে। ওর বাবা মারা যেতে এভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। তারপর আর দেখিনি। রাগ হলে তেজে ফোটে, কাঁদে না। কি হয়েছে?

মিথ্যের সঙ্গে সত্তার বিরোধ বাপীর। এই একজনের চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলা আরো কঠিন। তাছাড়া একলা ঘরে পশুর মতো যেভাবে দখল নৈওয়া হয়েছিল আর হামলা করা হয়েছিল, কান্না থামলে মেয়ে মায়ের চোখে সেই নিষ্ঠুর লোলুপতার দিকটাই বড় করে তুলবে। শেষ মুহূর্তে সেই দখল না ছিঁড়তে পারলে ওই পশুর হাত থেকে আজ আর অব্যাহতি ছিল না মেয়ে তাও বলতে ছাড়বে না। বাপীর চিন্তায় এখনো কোনো বিবেকের দংশন নেই, কোনো আপোস নেই। এই মুহূর্তে তাই মাথা খুব ঠাণ্ডা।

ধীর গলায় জবাব দিল, আমাকেই বিয়ে করতে হবে, আর কারো চিন্তা আর আমার বরদাস্ত হবে না, আপনার মেয়েকে আজ সেটা আমি খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি।

গায়ত্রী রাই অপলক চেয়ে আছে। আগের মতো সেই ভেতর-দেখা চোখ। শুধু এ-জন্যেই মেয়ে রাগে না ফুঁসে বা গর্জে উঠে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এ যেন বিশ্বাস করার মতো নয়। গলার স্বর নীরস একটু।—এ বোঝানোটা আরো অনেক আগে থেকে শুরু করোনি কেন?

—অসুবিধে ছিল।

অপলক চাউনিটা মুখের ওপর বিঁধেই থাকল খানিক। বোঝার চেষ্টা। জিগ্যেস করল, কলকাতায় গিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে ফয়সালা করে এসেছ?

—না। এখানে এসে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে মন স্থির করেছি। দেখছেই। পরের প্রশ্নটাতেও তাপ-উত্তাপ নেই।—এতদিন তোমার নিজেরও মন স্থির ছিল না?

ভিতরে ভিতরে বাপী সচকিত। মায়ের কাছে এরপর নালিশ যদি করে ঊর্মিলা, পশুর মতো দখল নেবার কথাই শুধু বলবে না, মিষ্টির কথাও বলবেই। শয়তান বুদ্ধি যোগাচ্ছে বাপীকে। জবাব দিল, ছিল না। কেন ছিল না আপনার জানা দরকার। ডলিকে নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, সব শুনে আপনি যদি আমাকে বাতিল করেন, সে-বিচার মাথা পেতে নেব।

চাউনিতে ব্যতিক্রম দেখা দিল একটু। জিজ্ঞাসু।

ধীর নির্লিপ্ত সুরে বাপী বলে গেল, ছেলেবেলায় এখানকার এক মেয়েকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তখনকার রেঞ্জ অফিসার, জঙ্গলের বড়সাহেব। আমার বাবা তার আন্ডারে সামান্য কেরানী। অত বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে মিশতে চাইতাম বলে হামেশা তারা অপমান করত, তার ছেলে মারত, মা কান মলে দিত। সেই আক্রোশে ওই মেয়ের ওপর আমার পছন্দটা হামলার মতো হয়ে উঠেছিল। সেই পছন্দের শাস্তি কি পেয়েছিলাম এই দেখুন—

একটু অবকাশ না দিয়ে ঘুরে বসে একটানে ট্রাউজারের তলা থেকে শার্টটা টেনে মাথার দিকে তুলে ফেলল সে।

আধ-হাত-প্রমাণ পাঁচ-ছটা এলোপাথাড়ি সাদা দাগ পিঠের চামড়ায় স্থায়ী হয়ে আছে। জামা নামিয়ে বাপী আস্তে আস্তে ঘুরে বসল আবার। গায়ত্রী রাইয়ের সাদাটে মুখ বিমূঢ় এখন

তেমনি নিরুত্তাপ গলায় বাপী বলে গেল, বাবার তখন জ্ঞান ছিল না, চাবুকে চাবুকে বড়সাহেব আর তার মেয়ে আর তার মায়ের আর আরো অনেকের সামনে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। রক্তে জামা ভিজে গেছল। আমার বয়েস তখন চোদ্দ, সেই মেয়ের দশ। তার কিছুদিনের মধ্যে তারা এখান থেকে বদলি হয়ে চলে যায়। কিন্তু আমি তাদের কোনদিন ভুলিনি, ভুলতে চাইনি। বি-এস-সি পাশ করার পর কলকাতায় যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আবার সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আবারও অপমানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমি বানারজুলিতে ফিরে এসে আপনাকে পেয়েছি। কিন্তু এই চার বছরের মধ্যেও সেই মেয়ের সঙ্গে ফয়সালার চিন্তা আমার মাথা থেকে যায় নি। এবারে কলকাতা গিয়ে দেখলাম সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

এর পরেও হতভম্বের মতো চেয়েই আছে গায়ত্রী রাই। রাগের চিহ্নও নেই, শুধুই বিস্ময়। এরই ফাঁকে বাপী ভিতরের আশঙ্কা ব্যক্ত করে ফেলল।—

—ডলি হয়তো আপনাকে এই মেয়ের কথা বলেও আমাকে বাতিল করতে চাইবে।

একটু নড়েচড়ে আত্মস্থ হল মহিলা। এবারে সদয় মুখ নয় খুব।—এত সবও ডলিকে তোমার বলা হয়ে গেছে তাহলে?

—আমি একটি কথাও বলিনি। এতটা ও জানেও না। ছেলেবেলার ব্যাপারটা আবু রব্বানী জানত। রেশমা আর দুলারির কাছে আবু সে-গল্প করেছে। ডলি রেশমার মুখ থেকে শুনেছে।

গায়ত্রী রাই ছোট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা। ভালবাসা-টাসা নয়, যে—মেয়ের কথা শুনল তাকে ভুলতে না পারার পিছনে পুরুষের আক্রোশটাই বড় করে দেখছে। অপমান ভোলার ছেলে যে নয় তার থেকে বেশি আর কে অনুভব করতে পারে। তবু জিজ্ঞাসা করল, সেই মেয়ের যদি বিয়ে না হয়ে যেত তাহলে কি করতে?

সত্যি কি বাপীর মুখে শয়তান কথা যোগাচ্ছে? সাদামাটা এক জবাবে মহিলার সমস্ত সংশয়ের অবসান। বলল, তাহলে আমার এতদিনের রোগ ছেড়ে যেত কিনা আমি জানি না।

নীলাভ দুটো চোখের গভীর স্নেহের এমন উৎসও কি বাপী খুব বেশি দেখেছে? গায়ত্রী রাই ওকে দেখছে এখনো। পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে সেই স্নেহ হাসির আকার নিচ্ছে। বলল, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমার কাছে তোমার ছেলেবেলার কথা তুলে ডলির খুব সুবিধে হবে না।

এতক্ষণে বাপী হাসল একটু।—আপনি যেমন ভাবছেন তেমন সুবিধেও হবে না। আমার জ্বর ছাড়লেও ডলির ছাড়েনি। বেগতিক দেখলে ও এখান থেকে পালাবে, হয়তো চিঠি লিখে বিজয় মেহেরাকে এখানে আনাবে। মাথা ঠাণ্ডা হবার আগে এরকম কিছু না করতে পারে আপনার দেখা দরকার।

স্নেহ-উপচনো ধমকের সুরে গায়ত্রী রাই বলে উঠল, আমার কি দায়! তুমি আগলাবে, তুমি দেখবে। ওর মন ফেরানোর মতো সময় আর সুযোগ কম পেয়েছিলে তুমি?

বাপী চুপ।

—কলকাতায় সেই ছেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?

বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

—কি বুঝলে?

রণে বা প্রেমে নীতির বালাই রাখতে নেই। প্রেমে না হোক, রণে জেতার দুরন্ত জেদ এখন। ঠাণ্ডা জবাব দিল, বড় হয়েই ফিরেছে, ভালো মাইনে, ফ্যাক্টরির মধ্যেই কোয়ার্টারস। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খাটুনি চলছে এখন, ফুরসত নেই বলে এখানে আসতে পারছে না। এক্ষুনি বিয়েটা করে ফেলতে চায়। একটু থেমে বিরূপ প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ্য করে যোগ করল, সিগারেট খাওয়াটা আগের থেকেও অনেক বেড়েছে দেখলাম। আর সকাল-সন্ধ্যা কাজে ডুবে থাকার পর রাতে একা ভালো লাগে না বলে ড্রিংকস-এর মাত্রাও বেড়ে গেছে নিজেই বলল।

কাউকে পিছন থেকে ছুরি বসানোর মতো একটা গ্লানি বুকের ভিতরেই গুঁড়িয়ে দেবার আক্রোশ বাপীর।

কঠিন আঁচড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গায়ত্রী রাইয়ের মুখে। রাগ বেশি হলে অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হয়ই। একটু লক্ষ্য করেই বাপী তাড়াতাড়ি বলল, আপনার শরীর ভালো দেখছি না, এ-সব কথা এখন থাক

—কলকাতায় তাকে তুমি কি বলে এসেছ?

—বলেছি আপনি খুব অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার হতে পারে। বিয়ে এক্ষুণি সম্ভব নয়।

—আমি রাজি হব না একথা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে এলে না কেন?

—জানালে ছুটি নিয়ে ডলির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্যে সে ছুটে আসত। আপনার মেয়ে তখন আরো অবাধ্য হত। এখনো কারো কথা শুনবে মনে হয় না।

গায়ত্রী রাই আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।না শুনলে আমি কোনদিন ক্ষমা করব না, সেটা তার জানতে বুঝতে বাকি থাকবে না।

দরজার দিকে এগুলো। বাপীর উচিত তাকে ধরে ধরে পৌঁছে দিয়ে আসা। মন ঝুঁকলেও আজ আর এটুকু পারা গেল না। পিছনের দরজা পর্যন্ত এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সব ছেড়ে কেন যেন মহিলার স্যান্ডাল পরা ধপধপে ফর্সা দুই পায়ের দিকে চোখ গেল। মনে হল এমন দুখানা পা-ও বেশি দেখেনি।

বিবেকের গলা টিপে ধরে আছে। কিন্তু যতক্ষণ না একেবারে মরছে ওটা ততক্ষণ ছটফটানি আছেই। যন্ত্রণা আছেই। থাকুক। গুমরোক। আপনি ঢিট হবে। শয়তানের হাতে হাত মিলিয়েছে বাপী তরফদার। তার কাছে কারো জারিজুরি খাটবে না। সে নরকে টেনে নিয়ে যাবেই। বিবেকের দাস হয়ে থাকলে স্বর্গসুখ যে কত জানতে বাকি আছে? তার থেকে নরকের রাজত্ব ঢের ভালো।

ঘণ্টাখানেক বাদে কোয়েলা এসে তাকে খেতে ডেকে নিয়ে গেল। খাবার টেবিলে শুধু সে আর গায়ত্রী রাই মুখোমুখি। ঊর্মিলা নেই। থাকবে না জানা কথাই। দু চোখ তবু তার মায়ের মুখের ওপর উঠে এলো।

—ডলি খাবে না। তুমি শুরু করো।

ঠাণ্ডা মুখে মহিলা নিজেও খাওয়া শুরু করল। ইদানীং তার রাতের খাওয়া নামমাত্র। কিন্তু তাতে এতটুকু ব্যতিক্রম দেখা গেল না। মেয়ে খেল না বলে ওই মুখে কোন রকম প্রশ্রয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু বাপীর কি হল? এক মেয়ে খাবে না শুনে জঠরে খিদে সত্ত্বেও মুখে রুচি নেই। শয়তানেরও মায়ামমতা আছে?

পরদিন সকালে বারান্দার চা-পর্বেও ঊর্মিলা অনুপস্থিত। ভিতরের ঘরেও তার অস্তিত্বের আভাস মিলল না। সতর্ক করার পরেও মেয়েকে আর একলা কোথাও ছেড়ে দেবার মতো কাঁচা নয় মহিলা। তবু আশঙ্কা। জিগ্যেস করল, ডলি কোথায়?

—বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। খুব মৃদু আর নিরুত্তাপ কঠিন সুরে বলল, ওকে যতটা বোঝানো দরকার বুঝিয়ে দিয়েছি। কোয়েলা চোখ রাখবে, তুমিও একটু খেয়াল রেখো। কিছু মতলব ভাঁজছে হয়তো, নইলে ক্ষেপে উঠত।

বাপী তরফদার নয়, সংগোপনে শয়তান বড়সড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েকে কতটা বোঝানো হয়েছে এই মুখ দেখে বাপী আঁচ করতে পারে। তার পরেও মেয়ে ওর পশুর মূর্তিটা মায়ের সামনে তুলে ধরেনি। দেহ দখলের হামলার কথা বলেনি। এখনো রাগে দুঃখে অপমানে ফুঁসছে হয়তো। পরে বলতে পারে। কিন্তু বাপী আর পরোয়া করে না। বললেও এই মা-টি আরো অকরুণ সংকল্পে মেয়ের বিরুদ্ধেই পরোয়ানা জারি করবে। যতটুকু বিশ্বাস করবে তাও পুরুষের দাপট আর পুরুষের অসহিষ্ণুতা ধরে নেবে। মনে মনে মহিলা বরাবর ওকে পুরুষের সম্মান দিয়ে এসেছে বলেই আজ তার এত স্নেহ, এমন অন্ধ বিশ্বাস।

এ কদিন ছিল না, বাপী তবু আজও আপিস ঘরের দিক মাড়ালো না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। আবুকে দরকার। এক্ষুনি গেলে ঘরেই পাবে হয়তো।

আবুর দুটো ঘরেরই ভোল পাল্টে গেছে অনেক দিন। পয়সার ব্যাপারে ভাগ ভিন্ন ভোগে বিশ্বাস নেই বাপীর। ফলে কাঁচা টাকার মুখ আবুও কম দেখছে না। মাটির ঘর বাতিল করে কাঠের ঘর তুলেছে। তাতে হলদে সবুজ রংয়ের জেল্লা তুলেছে। টকটকে লাল টালির ছাদ বসিয়েছে। শুধু দোস্ত-এর কাছে কেনা, নইলে আবু রব্বানী এখন বুক চিতিয়ে নবাবী চালে চলে!

গলা পেয়েই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দোস্ত্ হুট করে কলকাতা কেন চলে গেছল জানে না। ফেরার খবরও রাখে না। বাপীর সাড়া পেলে যত কাজই থাক দুলারিও না এসে থাকতে পারে না। কিন্তু আজ আবুকে নিরিবিলিতে দরকার বাপীর।

আবু সাদর আপ্যায়ন জানালো, তুমি বাইরে থেকে হাঁক দাও কেন বাপীভাই, সোজা ভিতরে চলে আসবে। এসো—কলকাতা গেছ শুনলাম, এদিকে ডাটাবাবু তো তুমি নেই বলে চোখে অন্ধকার দেখছে।

—বাদশাকে আজ জিপ দিয়ে পাহাড়ে পাঠিয়ে দেব’খন, সে ব্যবস্থা করবে।…এখন আর বসব না, তুমি জঙ্গলের কাজে বেরুচ্ছিলে তো?…এসো।

দিন বদলালেও দুলারির ধাত বদলায়নি, মুখে কথা কম। দেখে বেশি। আজ বাপীর তাইতেই অস্বস্তিও বেশি।

জঙ্গলের পথে পা চালিয়ে বাপী সোজা প্রস্তাব করল, তোমাকে দিনকতক ছুটি নিতে হবে।

আবু হাঁ। কারো কাজে কোনো গুরুতর গাফিলতি ঘটে গেলে এ-রকম প্রস্তাব আসে জানে। দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখের দিকে তাকালো।

তেমনি ঠাণ্ডা গলায় বাপী আবার বলল, ছুটি নিয়ে আমার নিজের একটু কাজে লাগতে হবে তোমাকে।

আবুর বদ্ধ নিঃশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। কিন্তু এবারে অবাক তেমনি।—কি করতে হবে?

—সকালে দুপুরে আর বিকেলে একজনের ওপর নজর রাখতে হবে। তোমাদের মেমসায়েবের মেয়ে খুব সম্ভব আবার পালাতে চেষ্টা করবে।

—এতদিনের মধ্যেও মিসিসায়েবের সেই জ্বর ছাড়েনি?

বাপী মাথা নাড়ল। ছাড়েনি।

বেশ মজাদার উত্তেজনার রসদ পেল আবু। দোস্ত-এর এমন গম্ভীর মুখ না দেখলে কিছু চপল রসিকতা করে বসত। সোৎসাহে বলল, কিন্তু আমি একলা কত দিক আগলাবো? আমার দু’তিনজন সাগরেদকেও লাগিয়ে দিই তাহলে?

বাপীর ঠাণ্ডা মুখে বিরক্তির আভাস।—মাথাটা আর একটু সাফ করো। বিয়ের আগে আমার বউ পালাতে পারে বা পালাবার চেষ্টা করতে পারে এটা জানাজানি হয়ে গেলে আমার মান থাকবে? বানারজুলি থেকে বেরুনোর একটাই পথ, তুমি সাইকেল নিয়ে ডাটাবাবুর ক্লাবের রাস্তা আগলালেই হবে—যেমন দরকার বুঝবে করবে।…এদিকে কোয়েলার চোখে ধুলো দেওয়া সহজ হবে না, আর আমিও চোখ বুজে থাকছি না।

শেষের কথাগুলো আর কানে গেল কিনা সন্দেহ। বিস্ময়ের অকূল দরিয়ায় পড়ে হাবুডুবু দশা।—তোমার বউ! তুমি বিয়ে করবে মিসিসায়েবকে?

যে মূর্তি দেখে আর যে কথা শুনে হাসির কথা, তাই দেখে বা শুনে বাপীর রাগ হচ্ছে কেন জানে না। জবাব দিল, তোমাদের মেমসায়েবের সেই রকমই হুকুম।

বিস্ময় আর উত্তেজনার ধকল সামলে আবু জিজ্ঞাসা করল, মিসিসায়েব বেঁকে বসেছে?

—হ্যাঁ।

আবুর সামনেই যেন দিশেহারা হবার মতো সমস্যা।—তাহলে কি করে হবে…ধরে বেঁধে বিয়ে করবে?

বাপী ভিতরে ভিতরে তেতেই উঠেছে। গলার স্বরে পাল্টা শেষ।—মরদ বেঁচে থাকতেও ভিতরে ভিতরে দুলারির দিকে হাত বাড়াওনি তুমি? দুলারির মেজাজ দেখে নিজে হাল ছেড়েছিলে?

এবারে একমুখ হাসি আবুর।—তার রাগের মধ্যেও একটু আশনাইয়ের ব্যাপার ছিল যে বাপীভাই। তোমারও যদি তাই হয়ে থাকে তো কুছ পরোয়া নেই—ধরে-বেঁধে ঘরে এনে ঢোকাও, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাপী চুপ। আশনাই অর্থাৎ প্রেম থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে শুনেও ভিতরটা অসহিষ্ণু। খুশি আর উত্তেজনায় আবু টইটম্বুর।—ইস! তুমি অনেক ওপরে উঠে গেছ দোস্ত, নয়তো তোমাকে কাঁধে নিয়ে ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিতাম

ফেরার পথে সামনের গেটের কাছে বাপীর পা থেমে গেল। ঊর্মিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এদিকেই চেয়ে আছে। পিছনে তার মা চোখে চশমা এঁটে লিখছে কিছু।

ঊর্মিলা চেয়ে রইল।

এত দূর থেকেও ঝলকে ঝলকে তপ্ত আগুন ঠিকরে এসে বাপীর মুখ ঝলসে দিতে লাগল।

গেট ছেড়ে বাপী নিজের বাংলোর দিকে পা বাড়ালো। আগুনে ঝলসালে লোহা ছাই হয়, না উল্টে দগদগে লাল হয়? বাপীর মেজাজেরও সেই অবস্থা।

পর পর চার দিন দেখা হল এরপর। চোখাচোখি হল। দুবার তিনবার করে। একদিনও ঊর্মিলা খাবার টেবিল বা চায়ের টেবিলে আসেনি। গায়ত্রী রাই তাকে ডাকেনি। কোয়েলা তার খাবার বা চা ঘরে দিয়ে এসেছে। যেতে আসতে তবু দেখা হয়েছে। বেশ তফাতে দাঁড়িয়ে ঊর্মিলা দেখেছে ওকে। দুই চোখে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরেছে। বিদ্বেষ উপচে উঠেছে। কিন্তু ঘৃণার আঘাতে কাবু হবে বাপী তরফদার? বিদ্বেষ তাকে সংকল্প-ছাড়া করাবে? এই দেখে বরং ভিতরটা তার আরো ধারালো কঠিন হয়ে উঠেছে।

রাত্রি। তখনো খাবার ডাক আসেনি। এ সময়টা বাপীর বই পড়ে কাটে। কদিন হল বই পড়ার নেশাও ছেড়ে গেছে। চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে ছিল। মাথাটাকে শূন্য করে দেবার ধকল পোহাচ্ছিল।

একটা ষষ্ঠ অনুভূতির ধাক্কায় চোখ মেলে দরজার দিকে তাকালো।

ঊর্মিলা। ভিতরে এসে দু হাত কোমরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তপ্ত লাল মুখ চোখোচোখি হতে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরোতে লাগল। প্রস্তুত ছিল না বলেই হয়তো বাপী বে-সামাল একটু।

আরো পোড়ানো আরো ঝলসানোর জন্যেই যেন আরো একটু এগিয়ে এলো ঊর্মিলা।

গলায়ও হিসহিস আগুন ঝরল।—দেখছ কি? একাই এসেছি। গেটে দাঁড়িয়ে মা তোমার ঘরে ঢুকতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেছে। কি দেখছ? দরজা বন্ধ করে দেব? তাহলে সুবিধে হবে? আজ সব সাধ মেটাবে?

আত্মস্থ হবার চেষ্টায় বাপী নিজের সঙ্গে প্রাণপণে যুঝছে। নিজের অগোচরে উঠে বসেছে। গলা দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরুলো, বোসো—

বসব? তোমার কাছে এসে আনন্দে গল্প করতে এসেছি আমি? তুমি বেইমান, তুমি বিশ্বাসঘাতক, তোমার পরামর্শে বাড়িতে মা আর কোয়েলা ছায়ার মতো আমার সঙ্গে লেগে লেগে আছে, একটা চিঠি লিখতে বসলেও সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে—বাংলো থেকে নামলে কোয়েলা পিছু নেয়—কাজকর্ম ছেড়ে আড়াল থেকে তুমি চোখে আগলাচ্ছ—ক্লাবের সামনে আবু রব্বানীকে মোতায়েন রেখেছ—চারদিক থেকে আমাকে শিকলে আটকেছ—কিন্তু এই করে কি পাবে তুমি? কি পাবে আশা করো?

বাপী নির্বাক। এখনো নিজের বশে নেই। ঊর্মিলার হিসহিস গলার স্বর চড়ছেই।—যে রেশমা তোমাকে পুজো করত সেই রেশমার মরা মুখ তোমার মনে আছে? আছে? আর একখানা মরা মুখ দেখতে চাও? এত পাহারা দিয়েও সেটা ঠেকাতে পারবে? এই জ্যান্ত ডলি তোমার কোনো দিন ভোগে আসবে না সেটা জেনে রেখো আর মাকেও জানিয়ে দিও। বুঝলে? বুঝলে?

বোঝার ধকলে বাপীর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। চেয়েই আছে। ঊর্মিলাও।

বাপী অপলক।

ঊর্মিলাও।

পরের মুহূর্তে ও যা করে বসল তাও অভাবিত। এত রোষ এত ঘৃণা হঠাৎ কান্না হয়ে ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উপচে-ওঠা আবেগে এগিয়ে এসে ওই বিছানায় বসে পড়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে সমস্ত যন্ত্রণা উজাড় করে ঢেলে দিতে চাইল।—বাপী, এ হবে না—এ হতে পারে না। তুমি আমার ফ্রেন্ড—এত বিশ্বাসঘাতকতা তুমি করতে পারো না,—এমন বেইমান তুমি হতে পারো না— কলকাতায় গিয়ে তোমার সাংঘাতিক কিছু নিশ্চয় হয়েছে—তাই তুমি পাগল হয়ে গেছ। বাপী—তোমাকে আমি কত ভালবাসি তুমি জানো না—আমার ফ্রেন্ড এমন কাজ করতে পারে না—আমার এত ভুল হতে পারে না—এত বিশ্বাস না থাকলে আমি নির্ভয়ে তোমার কাছেই ছুটে আসতে পারতাম না।

কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

বাপী মূর্তির মতো বসে

সোনার হরিণ নেই – ২৬

ঊর্মিলা আবার দুপুরে আর রাতে অন্য দুজনের সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে বসছে। সকাল বিকালের চায়ের টেবিলেও আসছে। একটা বড় রকমের অশান্তির মোকাবিলার সংকল্পে কঠিন হাতে বাৎসল্যের রাশ টেনে ধরে বসেছিল গায়ত্রী রাই। কিন্তু হঠাৎ কোনো জাদুমন্ত্রে মেয়ের সুমতি ফিরে এলো কিনা ঠাওর করতে পারছে না। তার আচরণ কৃত্রিম হলে মায়ের চোখে ধরা পড়তই। স্নায়ুর সব টানা—পোড়েন একেবারে ঠাণ্ডা, ভোরের জুঁইফুলের মতো কাঁচা আর তাজা মুখ। মেয়ের রাগ-বিরাগের চিহ্ন নেই। আবার মুখে কথাও নেই। বড়সড় কিছু কৌতুকের ব্যাপার ঘটে গেছে যেন। সেটা চোখে ঝিকমিক করে, ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আঁচড় কাটে। গায়ত্রী রাই তখন ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ফেরায়। কারণ মাকে ফাঁকি দিতে পারলে ওই ছেলের মুখখানাই যে মেয়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়, সেটা বুঝতে পারে।

বাপী সবই লক্ষ্য করে। মেয়ের থেকেও উল্টে ওরই আচরণ মহিলার কাছে বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে তাও আঁচ করতে পারে। সর্বদাই গম্ভীর। সেটা কৃত্রিম নয়। একটা অসহিষ্ণুতার বাষ্প চারিদিক থেকে ওকে ছেঁকে ধরেছে। মেয়ে উঠে গেলে প্রত্যাশিত সুখবর শোনার আশায় গায়ত্রী রাই ওর দিকে ফেরে। কাজের অছিলায় বাপী তক্ষুনি উঠে চলে যায়। কদিন ধরে কাজের ভূত মাথায় চেপেছে। কেবল কাজ আর কাজ।

চায়ের টেবিলে সেদিন জানান দিল, এখনই সে একবার পাহাড়ে যাচ্ছে।

গায়ত্রী রাই সাদা মনে জিজ্ঞেস করল, কেন?

—আপনি সবেতে মাথা দেন কেন, নিজে কি করে ভালো থাকবেন সে চেষ্টা করুন না।

ছেলের ধমক খেয়ে মা যেমন হাসি চেপে বেচারি মুখ করে চেয়ে থাকে, গায়ত্রী রাইয়ের চাউনিও অনেকটা সেই রকম হয়?

গম্ভীর মুখেই বাপী বলল, ক্লাবে মাল টান পড়েছে তাই যাওয়া দরকার।

একটু চুপ করে থেকে গায়ত্রী হঠাৎ বলল, এ কাজ বন্ধ করে দিলে কি

—কোন কাজ, লিকার সাপ্লাই?

—হ্যাঁ।

বাপী গম্ভীর।কি আর হবে, মোটা লোকসান হবে। আপনি মালিক, হুকুম করলেই বন্ধ হবে।

হালকা প্রতিবাদের সুরে গায়ত্রী রাই বলল, সাপ আর সাপের বিষ চালানোর কারবার বন্ধ করার সময় তুমি মালিকের হুকুমের অপেক্ষায় ছিলে? না সেই লোকসান গায়ে লেগে আছে?

রেশমার অঘটনের পরের বছর থেকেই ব্যবসার ওদিকটা বাপী জোর করে তুলে দিয়েছিল। সাপ ধরার মৌসুমে যারা আসে তারা বেজার হয়েছিল। সব থেকে বেশি বেজার হয়েছিল পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ু। সাপের গলা টিপে বিষ বার করা বন্ধ হলে তার আর কাজের আনন্দ কি? আবুর তত্ত্বাবধানে এই ব্যবসা জাঁকিয়ে উঠছিল তাই আপত্তি তারও ছিল। বাপী কারো কথায় কান দেয়নি। গায়ত্রী রাইকে বলেছিল, আপনার সব লোকসান উশুল হয়ে যাবে, যে কাজে লেগে আছি তার এখনো ঢের স্কোপ।

কথার খেলাপ হয়নি, এদিকের ব্যবসা এত বেড়েছে যে ওদিকের লোকসান চোখেও পড়েনি। কিন্তু কোন তাড়না বা যন্ত্রণার ফলে বাপী ওই মারাত্মক কারবার একেবারে তুলে দিয়েছে তা আজও ব্যক্ত করার নয়। একটু গুম হয়ে থেকে বাপী গম্ভীর শ্লেষের সুরে বলল, তাহলে শুদু মদ কেন, নেশার আর যা কিছু নিয়ে আছি আমরা সে সবও বন্ধ করে দিন। নেশা নেশাই।

ভেবেছিল জব্দ হবে। কিন্তু জবাবে যা শুনল, মেজাজ সুস্থির থাকলে বাপীর মন নরম হবার কথা। শ্লেষ গায়ে না মেখে মহিলা হাসল একটু।—এ চিন্তাও মাঝে মাঝে মনে আসে।…যত দিন নিজের রক্তের জোর ছিল, ভয়-ভাবনা কিছু ছিল না। সব দায় নিজের ভাবতাম। এখন তোমাদের এর মধ্যে জড়াতে অস্বস্তি হয়। অনেক হয়েছে, ও সবও এখন বন্ধ করে দিলে আমার আপত্তি হবে না। গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসল।—তোমার রাগের কি হল, এক্ষুণি তোমাকে কিছু করতে বলছি না। মনে হল তাই ভেবে দেখতে বলেছি। আজ পাহাড়ে যাচ্ছ যাও—

টেবিলের এ পাশ থেকে আলতো করে ঊর্মিলা বলল, আমিও যেতে পারি— চাপা গর্জনের সুরে বাপী তক্ষুণি বলল, না!

এই মেজাজ দেখে গায়ত্রী রাই সত্যি হকচকিয়ে গেল। আরো অবাক, যে মেয়ে কারো হম্বি-তম্বির ধার ধারে না, সেও চুপ। কিছু একটা ব্যাপার চলেছে দুজনের মধ্যে তাও বোঝা যাচ্ছে। একটু সময় নিয়ে গায়ত্রী রাই মোলায়েম করেই জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ ফিরছ না?

—বিকেলে ফিরব।

—তাহলে ও যেতে চাচ্ছে যাক না, রাগের কি আছে।

তেমনি চাপা ঝাঁঝে বাপী জবাব দিল, রাগ হয় স্বার্থপরতা দেখলে বুঝলেন?

আপনি নিজে ছাড়া আপনাকে দেখার আর কেউ কোথাও নেই, এ এখন থেকেই খুব ভালো করে জেনে রাখুন।

গায়ত্রী রাই হাঁ করে কয়েক পলক চেয়ে রইল তার দিকে। রাগের হেতু বোঝা গেছে। তার জন্যেই বাড়িতে কারো থাকার দরকার। আর সে খেয়াল না থাকার মানেই স্বার্থ। চোখের দু কোণ শিরশির করে উঠল। মেয়ের দিকে ফিরল। আগে হলে মেয়ে তেল-তেল বলে চেঁচিয়ে উঠে জব্দ করতে চেষ্টা করত। পুরুষের যে রাগ আর শাসন মেয়েরা চেষ্টা করলেও অশ্রদ্ধা করতে পারে না, নিজের মেয়েরও এখন সেই মুখ।

বাপী উঠে এলো। মহিলার নীরব প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারে বলেই ভেতরটা আরো তিক্তবিরক্ত। নিজের ঘরে এসে বেশ-বাস বদলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভিতরের অসহিষ্ণুতা গাড়ীর বেগের সঙ্গে মিশছে। খানিকক্ষণের মধ্যে গাড়ি ভুটানের রাস্তায় ছুটল। আর তক্ষুনি রেশমার মুখখানা চোখে ভাসল। রেশমার হাসি-কৌতুক, ছলা-কলা…নিজের সত্তা-দগ্ধানো বন্য আক্রোশ। ও কি কোথাও থেকে বাপীকে দেখছে এখন?

রেশমার সঙ্গে সঙ্গে আর এক মেয়ের কথা মনে আসে কেন জানে না। অথচ স্বভাব-চরিত্রে দিন-রাতের তফাৎ দুজনের। মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম।…এখানে এসে দেখা করার কথা ছিল। বাপী ওকে এই ভুটান এলাকায় রেখে রেশমা যা করত সেই কাজে লাগাবে ঠিক করেছিল। আট-দশদিন ছেড়ে দু সপ্তাহ গড়াতে চলল। আর আসবে মনে হয় না। এরপর এলে সোজা বিদায় করে দিতে অসুবিধে হবে না।

সন্ধ্যার একটু আগে ডাটাবাবুকে মাল বুঝিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে বসতেই আবু রব্বানী সামনে এসে দাঁড়াল।—কি ব্যাপার বাপীভাই, মিসিসায়েব যে আজ আমাকে খুব নাকাল করে দিয়ে গেল—তোমাদের মন-বোঝাবুঝি হয়ে গেছে নাকি?

নাকাল হয়েছে বলল বটে কিন্তু মুখে খুশি উপচে পড়ছে। বাপীর স্নায়ু তেতেই আছে। তবু ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

—ক্লাবের সামনে আগেও দু-তিন দিন তাকে দেখেছি তখন একটা কথা বলা দূরে থাক, চোখে আগুন ঠিকরতো—আজ খানিক আগে আমাকে দেখে হেসে কাছে এলো, বলল, তোমার ডিউটি এখনো চলছে, আমাকে ভেবাচাকা খেয়ে যেতে দেখে আরো মজা পেয়ে বলল, আর ডিউটির দরকার আছে কিনা তোমার দোস্তকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।…তুমি তো কিছুই বলোনি আমাকে, সত্যি আর দরকার নেই?

বাপী মাথা নাড়ল, দরকার নেই। তারপর স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে গাড়ি হাঁকিয়ে দিল।

পরের সাতটা দিন বাপী বাইরের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে আপিসে বসারও ফুরসৎ নেই। কাজ-কাজ করে হঠাৎ এত ক্ষেপে গেল কেন ছেলেটা গায়ত্রী রাই বুঝছে না। দুদিনের জন্য এর মধ্যে টুরে চলে গেল একবার। কোথায় কি এমন জরুরি কাজ কিছুই বলে গেল না। ফিরে আসার পরেও কিছু জিগ্যেস করার উপায় নেই। ডাক্তার সম্পূর্ণ বিশ্রামের হুকুম জারি করেছে। ফলে ব্যবসা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে যাওয়াটাও এই ছেলের বিবেচনায় দোষের এখন। এছাড়া আরো দুদিন সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরেছে। অত ভোরে তাকে ডাকেনি। কোয়েলা বা মালিকে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে, ওর জন্য যেন অপেক্ষা করা না হয়। মাথায় কিছু চাপলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সুস্থির থাকতে পারে না এ বরাবরই লক্ষ্য করেছে। তবু এ-সময়ে কাজের ঝোঁক ভালো লাগছে না। তা বলে দুশ্চিন্তা কিছু নেই। মেয়েকে এত ঠাণ্ডা আর এমন নরম কখনো দেখেনি। সর্বদা কাজে কাজে থাকে, নিজের হাতে ওষুধপত্র দেয়। দুপুরে একটু ঘুমনো অভ্যেস হয়ে গেছে, তখনো ঘরেই বসে থাকে। ওকে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকতে বললে পলকা ঝাঁঝে জবাব দেয়, দরকার নেই বাপু, তোমার সেবায় পান থেকে চুন খসলে মাথা কাটতে আসবে।

গায়ত্রী রাইয়ের দু কান জুড়িয়ে যায়। মনের মতো ফয়সলা যে কিছু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মেয়ে কিছু বোনা বা একটা বইটই নিয়ে সামনে বসে থাকে। গায়ত্রী রাই থেকে-থেকে মুখখানা দেখে তার। ভাগ্য দেখে।

সেদিনও সকালে বেরিয়ে বাপী ফিরল প্রায় রাত আটটার পর। সামনের বাংলোর গেটের কাছে অন্ধকারে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামালো। একজন নয়, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনজন। মালি, আধবুড়ো ড্রাইভার বাদশা, আর আবু রব্বানী। জোরালো আলোয় বারান্দায় কোয়েলাকেও দেখল। কার গাড়ি বোঝামাত্র সে ভিতরে ছুটল।

গাড়ি থামিয়ে বাপী নিস্পন্দের মতো বসে রইল। চট করে নামতেও পারল না। সবার আগে আবু ছুটে এলো। চাপা উত্তেজনায় তার দু চোখ কপালে— সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেছে বাপীভাই, সকাল আটটায় চা-টা খাওয়ার পর মিসিসায়েব কখন বাংলো ছেড়ে বেরিয়েছে কেউ দেখেনি, এখন পর্যন্ত তার পাত্তা নেই!

বাপী বসেই আছে। পাথরের মতো নিষ্প্রাণ ঠাণ্ডা। উদ্বিগ্ন মুখে পরের সমাচার জানালো আবু। বেলা এগারোটা নাগাদ ওর কাছে খবর গেছে মিসিসাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে বাদশা ড্রাইভারকে নিয়ে আবু তামাম বানারজুলি চষেছে। পাহাড়ের বাংলোয়ও গেছল। সেখানেও নেই। অ্যাকাউন্টেন্টকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে দিয়ে মেমসায়েব বাপীভাইয়ের খোঁজে এদিকের প্রায় সব কটা ঘাঁটিতে ফোন করিয়েছে। বিকেল থেকে মেমসায়েব খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, দাঁড়ানো থেকে পড়ে যাচ্ছিল, কোয়েলা ধরে ফেলতে রক্ষা। এখনো খুব ছট্‌পট করছে। কোয়েলা ডাক্তার ডাকার কথা বলতে এমন ধমক খেয়েছে যে ভরসা করে আর কেউ কিছু বলতেও পারছে না। মুখ বুজে তার কষ্ট দেখতে হচ্ছে। সক্কলে সেই থেকে বাপীভাইয়ের ফেরার অপেক্ষায় দম বন্ধ করে বসে আছে।

গায়ত্রী রাইয়ের বেশি রকম অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা কানে আসতে বাপীর সম্বিৎ ফিরল। ত্রস্তে গাড়ীর দরজা খুলে বাংলোর দিকে এগলো।

ঘরে সবুজ আলো জ্বলছে। গায়ত্রী রাই বিছানার পাশে ইজিচেয়ারে শুয়ে। সবুজ আলোর জন্য কিনা বলা যায় না, রক্তশূন্য মুখ নীলবর্ণ। সমস্ত দেহেও সাড়া নেই যেন। চাউনিতে অব্যক্ত যন্ত্রণা। যন্ত্রণা প্রতিটি শ্বাসেও।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বাপী তার পাশে মেঝেতেই বসে পড়ল। পালস দেখার জন্য একটা হাত ধরতেই এক ঝটকায় হাতটা টেনে নিল গায়ত্রী রাই। মুহূর্তের মধ্যে ঋজু সোজা কঠিন। চোখে সাদা আগুনের হল্কা।—আর কি দেখবে? আর কি দেখার আছে?

বাপী নিরুত্তর। থমথমে মুখ। চোখে চোখ

সব থেকে কাছের জনকে নাগালের মধ্যে পেয়ে এতক্ষণের জমা যন্ত্রণার সমস্ত আক্রোশ তারই ওপর ভেঙে পড়ল।—সমস্ত দিন কোথায় এত কাজ দেখাচ্ছিলে? কোথায় যাও না যাও বলে যেতেও মানে লাগে তোমার আজ—কাল——কেমন? ও আমার চোখে ধুলো দিতে পেরেছে তোমার জন্য—শুধু তোমার জন্য বুঝলে? ওকে বিশ্বাস করে এত নিশ্চিন্ত মনে তুমি কাজে ডুবে ছিলে কি করে? তোমার অপদার্থতার জন্য আমারও ভুল হয়েছে—

রাগে দুঃখে উত্তেজনায় কাঁপছে। সমস্ত মুখ আরো বিবর্ণ। বাপী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগলো।

—স্টপ! গায়ত্রী রাই পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল।

বাপী ঘুরে দাঁড়াল।

—কোথায় যাচ্ছ?

—ঘরে। বাপীর অনুচ্চ গলার স্বরও কঠিন একটু।—আমাকে কাছে দেখলে নিজের এতটুকু ক্ষতি যদি আপনি করেন, তাহলে কোথায় যেতে পারি এরপর তাও ভারতে হবে।

গায়ত্রী রাইয়ের দু চোখে এখনো সাদা আগুন। আবারও ফেটে পড়ার মুখে সামলে নিল। সে শক্তিও আর নেই বোধ হয়। চেয়ারের গায়ে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।

বাইরে এসে বাপী চাপা গলায় আবুকে বলল, বাদশাকে ডেকে গাড়ি নিয়ে চলে যাও, যেখান থেকে পারো চা-বাগানের ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এসো।

ভিতরে শুধু কোয়েলা দাঁড়িয়ে। রাগে আর কান্নায় তার কালো মুখ ফেটে পড়ছে। বাপী আবার এসে ইজিচেয়ারের পাশে মেঝেতে বসল। এবারে হাত টেনে নিতে গায়ত্রী রাই বাধা দিল না। দু চোখ বোজা তেমনি।

পালস-এর গতি বাপীর ভালো ঠেকল না। বাপী এবার হাঁটুর ওপর বসে নিঃসঙ্কোচে নিজের একটা হাত তার বুকের ওপর রেখে একটু চাপ দিল। এবারে গায়ত্রী রাই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো।

বুকের ধপধপ শব্দ হাতেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে বাপী। হাত সরিয়ে নিল। মহিলা অপলক চেয়ে আছে তার দিকে। বাপীর মনে হল, হাতটা ওখানে থাকুক তাই যেন চাইছিল। একটা উদ্‌গত অনুভূতি চেপে বাপী কোয়েলার দিকে তাকালো।— দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি তো?

কোয়েলা মাথা নাড়ল। হয় নি।

—এক গেলাস গরম দুধ নিয়ে এসো।

সঙ্গে কয়েক চামচ ব্র্যান্ডি মেশালে ভালো হত বোধ হয়, কিন্তু ও জিনিসটা খাওয়ানো যাবে না জানে, তাই শুধু দুধই আনতে বলল। দুপুরের পরে একবার দুধ এনে কোয়েলা প্রচণ্ড ধমক খেয়েছে, দ্বিধান্বিত মুখে তাই কর্ত্রীর দিকে তাকালো। বাপীরও চাপা ধমক।—ওদিকে দেখছ কি, আমি তোমাকে দুধ আনতে বলেছি!

কোয়েল ত্রস্তে চলে গেল। এই ধমক খেয়ে রাগের বদলে স্বস্তি বরং।

পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে উষ্ণ দুধের গেলাস নিয়ে ফিরে এলো। হাত বাড়িয়ে বাপী ডিস থেকে গেলাসটা তুলে নিয়ে আবার দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসল। অন্য হাতটা মহিলার ঘাড়ের তলা দিয়ে গলিয়ে দিয়ে খানিকটা তুলে দুধের গেলাস মুখে ধরল।

একটুও আপত্তি না করে গায়ত্রী রাই দুধ খাচ্ছে, দু চোখ বাপীর মুখের ওপর। দুধের গেলাস কোয়েলাকে ফেরত দিয়ে বাপী জলের গেলাস নিল। দু ঢোক জল খাইয়ে সেই গেলাসও কোয়েলাকে দিয়ে বাপী পকেট থেকে রুমাল বার করে আলতো করে তার মুখ মুছিয়ে দিল।

গায়ত্রী রাইয়ের অপলক দু’চোখ তখনো বাপীর মুখের ওপর। তাই দেখে বুকের তলায় অদ্ভুত মোচড় পড়ছে বাপীর। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। দু চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে। এই দেখার তৃষ্ণা কোন যুগ ধরে বুকের ভেতরেই কোথাও লুকিয়েছিল। সহজ হবার তাড়নায় আবার তাকে শুইয়ে দিয়ে বাপী হাসতে চেষ্টা করল। বলল, অত ভাবছেন কেন, যা হবার তাই হয়, দেখছেন না আমি কোথা থেকে উড়ে এসে কোন জায়গাটা জুড়ে বসেছি।

গায়ত্রী রাই কি জীবনে কখনো কেঁদেছে? বাপী জানে না। এখনো যেভাবে চেয়ে রইল কাঁদতে পারলে হয়তো হাল্কা হত। বাপী আবার বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, মেয়ের খবর ঠিকই পাবেন…আর ভালো খবরই পাবেন

কানে যেতে আস্তে আস্তে নিজে থেকেই সোজা হয়ে বসল এবার। চাউনি বদলে গেল। সবুজ আলোয় নীলাভ তীক্ষ্ণ কঠিন মুখ। খবর পাব…! ভালো খবর পাব? তুমি এই সান্ত্বনা দিচ্ছ আমাকে? ও যা চায় তাই হতে দেবে তুমি? তাই যদি হয় নিষ্ঠুর বেইমান মেয়েকে আমি কোনদিন ক্ষমা করব ভেবেছ?

উত্তেজনা দেখে বাপী আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু করতে হল না বা বলতে হল না। আবু ডাক্তারকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকেছে। বিরক্তি চাপতে না পেরে গায়ত্রী রাই হাল ছেড়ে চেয়ারের গায়ে মাথা রাখল আবার।

আবু বুদ্ধিমান। মেয়ের সম্পর্কে ডাক্তারকে বলেই এনেছে নিশ্চয়। কারণ হঠাৎ এরকম হল কেন ডাক্তার একবারও জিজ্ঞাসা করল না। চুপচাপ পরীক্ষা শুরু করে দিল।

বাইরে এসে বাপীকে জানালো হার্টের অবস্থা আগের থেকেও বেশ খারাপ। আগামীকালের মধ্যে আর এক দফা বুকের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিল। শিলিগুড়ির বড় হার্ট-স্পেশালিস্টকে আবার নিয়ে আসার পরামর্শও দিল। এই রাতটার জন্য শুধু কড়া ঘুমের ওষুধ

টানা ঘুমে রাত কেটে গেল। খুব ভোরে চোখ তাকিয়ে গায়ত্রী রাই দেখে পাশের ইজিচেয়ারে বাপী শুয়ে। আস্তে আস্তে বসল। বাপীও সজাগ তক্ষুনি

—সমস্ত রাত তুমি এভাবেই কাটালে নাকি?

—খুব ভালো কাটালাম। এখন কেমন লাগছে?

জবাব না দিয়ে গায়ত্রী রাই চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। ব্যথাটা নিজের মেয়ের থেকে এই ছেলের জন্য বেশি কিনা জানে না। বলল, ঘরে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।

আড়মোড়া ভেঙে বাপী উঠে দাঁড়াল।—নাঃ, আমার এখন অনেক কাজ। কোয়েলা—!

সঙ্গে সঙ্গে কোয়েলা হাজির। বাপী হুকুম করল, আমার জন্য শুধু এক পেয়ালা চা আর ওঁর জন্য দুধ—খুব তাড়াতাড়ি।

কোয়েলা চলে গেলে বাপী এদিকে ফিরল।—আমি চট করে মুখ-হাত ধুয়ে আসছি, আপনিও যান। থাক, কোয়েলা আসুক।…চা খেয়ে আমি তিন-চার ঘণ্টার জন্য একবার বেরুবো, আপনাকে ততক্ষণ সব ভাবনা-চিন্তা ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে থাকতে হবে।

এই ছেলেকে খুব সহজ আর নিশ্চিন্তই দেখছে গায়ত্রী রাই। আশায় উদ্‌গ্রীব হঠাৎ।—ওর খোঁজে যাবে? পাবে?

সকালের শিথিল স্নায়ুগুলোতে টান পড়ল আবার। গম্ভীর শাসনের সুরে বলল, খোঁজে গেলে না পাবার কোনো কারণ নেই। যাব কিনা সেটা আপনি কতটা সুস্থ থাকেন তার ওপর নির্ভর করছে। এখন আমি শিলিগুড়ি থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আপনাকে আমি আবার বলছি, আমাকে বিশ্বাস করুন, করে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে চেষ্টা করুন।

বেরিয়ে এলো।

শিলিগুড়ির বড় ডাক্তারকে অনেক টাকা কবুল করে বাপী একটা রাত বানারজুলিতে ধরে রাখল। যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর ছুটি। রিপোর্ট সব হাতে পেয়ে তিনিও তেমন কিছু আশ্বাস দিয়ে যেতে পারলেন না। হার্টের আরো ভাল্ব খারাপ হয়েছে। হঠাৎ কিছু ঘটেও যেতে পারে, আবার খুব সাবধানে থাকলে কিছুকাল চলেও যেতে পারে। চিকিৎসার সমস্ত ফিরিস্তি চা-বাগানের ডাক্তারকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

গায়ত্রী রাইয়ের মনের জোরের খবর বাপীর, থেকে আর কে ভালো রাখে। কিন্তু এখন যে জোরটা দেখছে সে যেন প্রাণের দায়ে।…ও বলেছে, মেয়ের খোঁজে যাবে কিনা সেটা তার সুস্থ থাকার ওপর নির্ভর করছে। তাই সুস্থ থাকার প্রাণপণ চেষ্টা। বলেছে বিশ্বাস করতে, বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকতে। দুর্যোগের আকাশে রামধনু দেখার মতো এই বিশ্বাসটুকুই আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা। এই ছেলে কখনো তাকে মিথ্যে ভোলাবে না।

একান্ত চেষ্টার ফলে সত্যি কাজ হল। চারদিনের মধ্যে অনেকটা সুস্থ। পালস আর ব্লাডপ্রেসার স্বাভাবিক। বাপী যতক্ষণ সামনে থাকে, মহিলা ভাব দেখায় যেন কিছুই হয় নি। দিন-রাতের তিন ভাগ সময় বাপী কাছেই থাকে। কত ভালো আছে বোঝানোর তাগিদে এজন্যেও আগের মতো চোখ রাঙানোর চেষ্টা।—কাজ কর্ম শিকেয় তুলে দিন-রাত এখানে পড়ে থাকলে চলবে?

কিন্তু ধৈর্যের শেষ আছে। সেদিন কাছে ডেকে বাপীর মুখ নিজের ঠাণ্ডা দু’ চোখের আওতায় বেঁধে নিয়ে বলল, বিশ্বাস করে তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলে, আমি চেষ্টা করেছি।…আজ ছ’দিন হয়ে গেল, আর কত যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে রাখতে চাও?

বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। পাপপুণ্য মানে না—এই যন্ত্রণা দেখার নামই বোধ হয় পাপ। মুহূর্তে মন স্থির করে নিল। ভাগ্যের পাশায় একদিন যে দান পড়েছিল আজ সেটা যদি একেবারে উল্টে যায় তো যাক।

কোয়েলা!

বাপীর ডাক শুনে কোয়েলা তক্ষুণি দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। —ডলির ঘর থেকে তার বড় সুটকেসটা নিয়ে এসো।

গায়ত্রী রাই অবাক।—ওর সুটকেস কেন?

—বলছি।

কোয়েলা সুটকেস এনে দিতে বাপী সেটা বিছানায় গায়ত্রী রাইয়ের সামনে রাখল। পকেট থেকে একটা চাবি বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল খুলুন—

—এ চাবি তুমি কোথায় পেলে?

—ডলির কাছ থেকে চেয়ে এনেছি। খুলুন ওটা

মেয়ে কিছু লিখে রেখে গেছে ধরে নিয়ে স্তব্ধ মুখে গায়ত্রী সুটকেসটা খুলল। তারপর বাপীর দিকে তাকালো।

—ওপরের জামাকাপড়গুলো সরিয়ে কটা চিঠি পান দেখুন।

বিমূঢ় মুখে গায়ত্রী রাই মেয়ের জামাকাপড়গুলো বিছানায় নামিয়ে আরো হতভম্ব সুটকেসের নীচে একগাদা খাম। কম করে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা হবে; সবগুলোতে লন্ডনের ছাপ।

নিজের অগোচরে গায়ত্রী রাই সেগুলো সব হাতে তুলে নিয়েছে। প্রায় দুর্বোধ্য বিস্ময়ে খামগুলো দেখছে।—এ সব বি. ব্যাপার?

—বিলেত থেকে লেখা বিজয়ের চিঠি। ডলিও এর থেকে কম চিঠি লেখেনি। আড়াই বছর ধরে দুজনে দু’জনকে চিঠি লিখে দিন গুনছিল…

গায়ত্রী রাইয়ের ফ্যাকাশে মুখ কঠিন হয়ে উঠছে।—তুমি এটা জানতে?

—ও-চিঠি আপনার চোখে বা হাতে না পড়ে সে-ব্যবস্থা আমাকেই করে দিতে হয়েছিল।

রাগ নয়, একটা অবিশ্বাস যেন যন্ত্রণার মতো ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে!—তুমি তাহলে আমার মেয়েকে কখনো ভালবাসনি….কখনো চাওনি?

—ভালো যখন বেসেছি তখন কোনো লোভ ছিল না। শেষে কোন অক্রোশে আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওকে পেতেও চেয়েছিলাম জানলে আপনিও আমাকে ঘৃণা করতেন। আমার চরিত্রের সেই কদর্য দিকটা ডলি দেখেছে।…কিন্তু এই বন্ধুর ওপর তার এত বিশ্বাস যে শেষে ও-ই আমাকে রক্ষা করেছে। রক্ষা আপনাকেও করেছে।…আত্মহত্যার জন্য ও তৈরি হয়ে বসেছিল।

গায়ত্রী রাই নির্বাক, স্তব্ধ

খুব শান্তমুখে বাপী আবার বলল, ডলি যাকে বেছে নিয়েছে সে একটা ছেলের মতো ছেলে এও আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, ড্রিংক একটু-আধটু করে, কিন্তু নিজের আক্রোশে আপনাকে ওর ওপর আরো বিরূপ করে তোলার জন্য আমি সেই কথা তুলেছিলাম, ড্রিংক করে অমানুষ হবার ছেলে সে নয়, আমি ড্রিংক না করলেও আমার থেকে অন্তত ঢের ভালো।

গায়ত্রী রাই শুনছে, সামনে যে বসে আছে তাকে দেখছে, হিসেব জানে, এখনো কিছু হিসেব মিলতে বাকি যেন। চাউনিও সন্দিগ্ধ একটু।—ডলি কোথায় এখন…কলকাতায়?

—শিলিগুড়িতে।

—শিলিগুড়িতে কোথায়?

—একটা হোটেলে।…বিজয় মেহেরার কাছে।

গলার স্বর অভিমানে অকরুণ কিনা বলা যায় না।———তাদের বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে? না হবে বলে আগে থাকতেই একসঙ্গে আছে?

বাপী জানে নিজেরই চরম সংকটের মুহূর্ত এটা। তবু শান্ত। তবু ঠাণ্ডা — বিয়ে হয়ে গেছে। দু’দিন টুরে থাকার নাম করে কলকাতায় গিয়ে বিজয়কে এরোপ্লেনে নিয়ে এসে শিলিগুড়িতে রেখেছিলাম, টাকা খরচ করে পিছনের তারিখ দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিস দেওয়া হয়েছিল।…ছ’দিন আগের সেই সকালে ডলিকে আমিই নিজের গাড়িতে করে শিলিগুড়ি নিয়ে গেছি। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছি।

প্রথমে নিজের দুটো কানের ওপর অবিশ্বাস গায়ত্রী রাইয়ের, কিন্তু এই মুখ দেখেই বুঝছে অবিশ্বাস করারও কিছু নেই আর। সমস্ত সংযম ছিঁড়ে খুঁড়ে গলা দিয়ে আর্ত স্বর বেরিয়ে এলো। — তুমি! তুমি ওকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছ? এত…এত উপকার করেছ তুমি আমার? আবেগ সামলে নিতে বাপীরও সময় লাগল একটু। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে।—উপকার সত্যি করেছি। এত ভালো কাজ জীবনে আর করেছি কিনা জানি না। এরপর আপনি যেমন খুশি শাস্তি দেবেন, তাও আমি আশীর্বাদ ধরে নেব।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সোজা নিজের বাংলোয়। নিজের ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক দিনের টান-ধরা স্নায়ুগুলো সব একসঙ্গে শিথিল হয়েছে। অবসাদ সম্বল।

বাপী ঘুমিয়েই পড়ল।

.

কারো ডাক শুনে চোখ মেলে তাকিয়েছে। কোয়েলা। ঘরে আলো জ্বলছে। বাপী তাড়াতাড়ি উঠে বসে ঘড়ি দেখল। রাত ন’টা বাজে। কোয়েলা জানালো মালকান খেতে ডাকছে।

এই রাতেই আবার ওই একজনের সামনে বসে খাওয়ার দায় থেকে অব্যাহতি পেলে বেঁচে যেত। তার রোষ যদি মাথায় বজ্র হয়ে নেমে আসত, এর থেকে মুখ বুজে তাও সহ্য করা সহজ হত।

এত্তেলা পাবার পরেও বসে থাকতে দেখে কোয়েলা আবার জানান দিল, সে দুবার এসে ফিরে গেছে, সাহেব ঘুমুচ্ছে দেখে ডাকেনি—মালকান এবার ডেকে দিতে হুকুম করেছে।

—তুমি যাও, আসছি।

চোখে মুখে জল দিয়ে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই এলো। কোয়েলা বলল, খাবার মালকানের ঘরে দেওয়া হয়েছে।

পায়ে পায়ে বাপী শোবার ঘরে ঢুকল। গায়ত্রী রাই পিছনে উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে বিছানায় বসে। বিষম সাদা মুখ। গালের পাশে চামড়ার নিচে একটা নীল শিরা উঁচিয়ে আছে। বাপী ঘরে ঢুকতে একটুও না নড়ে তার দিকে তাকালো। বাপীও।

সামনের ছোট টেবিলে একজনের খাবার দেওয়া হয়েছে।

—অসময়ে ঘুমুচ্ছিলে…শরীর খারাপ?

বাপী মাথা নাড়ল। শরীর ঠিক আছে। তবু গত পাঁচ-ছ’দিন যাবৎ স্নায়ুর ওপর দিয়ে কতটা ধকল গেছে মহিলা নিঃশব্দে আঁচ করে নিল বোধ হয়।—খেয়ে নাও।

এই মুখ সদয়ও নয়, নির্দয়ও নয়। গলার স্বরও নরম নয় বা কঠিন নয়। বাপী টেবিলের খাবারের দিকে তাকালো একবার, তারপর দাঁড়িয়েই রইল। একলা খেতে বসার দ্বিধা স্পষ্ট।

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি আরো ঠাণ্ডা। কথাও—আমি তোমার হুকুম এখনো মেনে চলেছি, ঘড়ি ধরে সময়মতো খেয়ে নিয়েছি। বোসো!

বাপীর চোখের কোণদুটো হঠাৎ শিরশির করে উঠল কেন জানে না। শাস্তির জন্য প্রস্তুত? কিন্তু সুচনা যা দেখছে সমস্ত সংযম খুইয়ে নিজেই ভেঙে না পড়ে! ছোট টেবিলের সামনে বসল। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল।

গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখ তার মুখের ওপর স্থির সেই থেকে। এবারে জিজ্ঞাসা করল, তারা কলকাতায় চলে না গিয়ে শিলিগুড়িতে বসে আছে কেন?

বাপীর জবাবেও আর রাখা-ঢাকার চেষ্টা নেই। আপনি একবার ডাকবেন সেই আশায়।…নইলে বিজয়ের ছুটি নেই, ওর ফেরার তাড়া খুব।

গলা চড়াল না। কিন্তু কঠিন।—ডলির এত আশা করার কথা নয়।…এ-রকম আশাও তাহলে তুমিই দিয়েছ?

বাপী নিরুত্তর। এই অনুযোগের সবটাই প্রাপ্য নয়। খানিকটা হয়তো তার মেয়ের ঘাড়ে চাপানো যেত। শিলিগুড়ি থেকে বড় ডাক্তার আনার সময় ঊর্মিলা খবর জেনেছে। একবারটি এসে মা-কে দেখার জন্য তখন ঝোলাঝুলি করেছিল। সেই অবস্থায় মহিলার মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবেই বাপী রাজি হয়নি। পরে অবস্থা বুঝে দুজনকেই নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছিল।

জবাবের অপেক্ষায় গায়ত্রী রাই চুপচাপ আবার খানিক চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথাটা বালিশের ওপর রাখল। দু’ চোখ বোজা এখন। পাঁচ গজের মধ্যে বসেও বাপী শ্বাস-প্রশ্বাস ঠাওর করতে পারছে না। একটু বাদে তেমনি ঠাণ্ডা কটা কথা কানে এলো।—ঠিক আছে। কাল সকালের দিকে নিয়ে এসো। আর টাকা নিয়ে যেও। বিকেলের প্লেনে ওদের কলকাতার টিকিট বুক করে এসো।

বাপী তাই করেছে। বিকেলের প্লেনে দুটো কলকাতার টিকিটও কেটেছে। নির্দেশ অমান্য করার জোর আর নেই। টিকিটের কথা ঊর্মিলাকে বলেনি। আশা হাওয়া যদি হঠাৎ বদলায়। যাওয়া যদি ওদের না হয়। তাছাড়া, বিদায় করার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে মেয়ে-জামাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, এ বলেই বা কি করে।

মা যেতে বলেছে শুনে ঊর্মিলা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ফ্রেন্ডের মুখখানা ভালো করে দেখার পর হাওয়া মোটে সুবিধের মনে হয়নি। যে-ঝড়টা গেছে, শুকনো হাসির তলায় বাপীর সেটা চাপা দেবার চেষ্টা। খুঁটিয়ে কিছু জিগ্যেস করারও ফুরসৎ পেল না ঊর্মিলা। এসেই আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হওয়ার তাড়া লাগিয়েছে। তাছাড়া বিজয়ের সামনে খোলাখুলি জিগ্যেস করাও মুশকিল। এ-ছেলে মায়ের কতটুকু আর জানে। এমনিতেই ঘাবড়ে আছে। মা ডেকেছে শুনেও বাপীকে বলছিল, গিয়ে আবার ফ্যাসাদে পড়ব না তো, শুধু ডলিকে নিয়েই যাও না।

স্বাভাবিক ভ্রুকুটিতে তার ভয় বরবাদ করতে চেয়েছে ঊর্মিলা।—আ-হা, কি বীরপুরুষ! বলল বটে, কিন্তু নিজের ভিতরেই চাপা অস্বস্তি।

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ বাপী ওদের নিয়ে বানারজুলির বাংলোয় পৌঁছল। গায়ত্রী রাই নিজের শয্যাতেই বসে আছে। দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় ওই বিছানায় উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে কাটে। শ্বাসকষ্টের রোগীর এ ভাবে বসতে সুবিধে। কিন্তু ইদানীং শ্বাসকষ্ট বেশি কি কম মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।

মেয়ে জামাই ঘরে পা দেবার পর থেকে বাপী নির্বাক দ্রষ্টা, নীরব শ্রোতা। সামনে কয়েকটা চেয়ার পাতা। বাইরের অতিথি আসছে জেনে বাড়ির অসুস্থ কর্তা যেমন ঘরে চেয়ার পেতে রাখতে বলে, গায়ত্রী রাইয়ের অভ্যর্থনার আয়োজন ও সেই গোছের।

ঘরে পা দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েই নিঃশব্দে আঁতকে উঠল ঊর্মিলা। বিজয় মেহেরা না পারুক, ক’দিনের মধ্যে তফাৎটা মেয়ে বুঝতে পারছে। মোমের মতো সাদা মুখ মায়ের। মুখে না হোক, দুই চোখেও যদি একটু উষ্ণ তাপের স্পর্শ পেত ঊর্মিলা, হয়তো ছুটে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরত, কাঁদত।

কিন্তু ঐ বিষম সাদা মুখ তেমনি একটা নিষেধের গণ্ডীর মধ্যে আগলে রেখেছে নিজেকে। মেয়েকে একবার দেখল শুধু। তারপর জামাইয়ের দিকে তাকালো। ঊর্মিলা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।

ব্যক্তিত্বের এরকম অভিব্যক্তি হয়তো বিজয় মেহেরার কল্পনার মধ্যে ছিল না। প্রণামের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি পা ছোঁবার জন্য এগিয়ে এলো। কিন্তু দুটো পা-ই পাতলা চাদরের তলায়।

—থাক। আঙুলে তুলে গায়ত্রী রাই চেয়ার দেখালো—বোসো।

বিজয় মেহেরা বসে বাঁচল।

কিন্তু তার পরেও ওই দু’ চোখ মুখের ওপর অনড়। কথায় অনুযোগের লেশমাত্র নেই। কি আছে সেটা বাপী অনুভব করতে পারছে। ঊর্মিলাও পারছে।

—ক’দিন তোমরা আমার জন্য শিলিগুড়ির হোটেলে কাটালে শুনলাম। আমি জানতাম না, বাপী কাল রাতে বলল।…ছুটি-ছাটা না থাকায় তোমার অসুবিধের কথা ভেবে ওর খুব চিন্তা, তাই না বলে পারল না।

ফাঁপরে পড়া ভাবটা কাটিয়ে উঠে বিজয় মেহেরার সহজ হবার চেষ্টা। সায় দিয়ে বলল, নতুন জয়েন করেছি, তার ওপর কাজের এত চাপ…ছুটি বলে কিছু নেই এখন।

গায়ত্রী রাইয়ের সামান্য মাথা নাড়ার অর্থ, সমস্যাটা বুঝেছে। বলল, আর দেরি কোরো না, খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলের প্লেনেই চলে যাও। বাপীর দিকে তাকালো।—ওদের প্লেনের টিকিট কাটা হয়েছে তো?

বাপী হাঁ-না কিছুই বলল না। ঊর্মিলার মুখ আরো ফ্যাকাশে। কিন্তু মেহেরা ছেলেটা সরলই। শাশুড়ির উদারতা দেখে তারও একটু উদার হবার ইচ্ছে। বলল, আপনার শরীর খুব খারাপ শুনলাম, ডলি না হয় এখন আপনার কাছেই থাক না— ঠাণ্ডা দু চোখ আবার তার মুখের ওপর—তোমার নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধে আছে?

—না, না—আমি ভালো কোয়ার্টার্সই পেয়েছি…

—তাহলে নিয়ে যাও।…আমার চোখে ধুলো দিয়ে ডলি এখান থেকে চলে যাবার পর একে-একে ছটা দিন চলে গেছে। ওকে সাপে কেটেছে কি কোথাও কোন অঘটন ঘটেছে বা কি হয়েছে ছ-ছটা দিনের মধ্যে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তখন আমার শরীরের কথা কেউ ভাবেনি। যাক, তুমি নিশ্চিন্ত মনে ওকে নিয়ে চলে যাও। বাপী আছে…তার কর্তব্যজ্ঞান খুব

বাপী বারান্দায় চলে এলো। একটু বাদে ঊর্মিলাও এসে চুপচাপ সামনে বসল। অপরাধের একই বোঝা দুজনের বুকে চেপে আছে। নিজেদের মধ্যে ফয়সলা যখন হয়েই গেছল, সব ভয়-ভাবনা ছেঁটে দিয়ে একসঙ্গে দুজনে যদি এই একজনের কাছেই এসে ভেঙে পড়ত, কি হতে পারে না বা কি হবেই হবে খোলাখুলি সেই ঘোষণাই করত—তাহলে কি হত? রাগ করত, আঘাত পেত কিন্তু এই বিয়েই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দিতে হত। আজ মনে হচ্ছে, ওরা তার দাপটই দেখেছে শুধু ভেতরটা দেখেনি।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলেও একটা স্তব্ধতা থিতিয়ে থাকল। নতুন জামাইয়ের খাতিরেও বাপীর সহজ হবার চেষ্টা বিড়ম্বনা। গায়ত্রী রাই নিজের ঘরে। তার সময়ে খাওয়া সময়ে বিশ্রামের আজও ব্যতিক্রম ঘটল না। এদিকে তার নির্দেশেই কোয়েলার পরিপাটি ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি নেই। বিশেষ আয়োজনের ফলে লাঞ্চে বসতে অন্য দিনের তুলনায় দেরি হয়েছে।

খাওয়ার পরে বাপী বার দুই মহিলার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঊর্মিলাও।…শুয়ে আছে। সাড়া নেই। চোখ বোজা। এ বিশ্রামের অর্থ এত স্পষ্ট যে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতেও দ্বিধা।

মেয়ে জামাইয়ের যাবার সময় হবার খানিক আগে গায়ত্রী রাই উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে বসেছে আবার।

ওরা ঘরে এলো। পিছনে বাপী। সকলকে ছেড়ে গায়ত্রী রাই জামাইয়ের দিকে তাকালো।——যাচ্ছ?

বিজয় জানান দিল,—এখনো আধ ঘণ্টা মতো সময় আছে।

এয়ার অফিস পথ কম নয়…হাতে সময় নিয়ে রওনা হওয়াই ভালো। বাপীকে জিজ্ঞাসা করল, ওদের বাগডোগরা ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে, বাদশাকে বলে রেখেছ?

বাপী মাথা নাড়ল। বলা হয়েছে।

জামাইয়ের দিকেই ফিরল আবার।—তোমার সঙ্গে যেতে পারে এরকম একটু বড় ব্যাগট্যাগ কিছু নেই?

হেতু না বুঝেই সে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, এয়ার ব্যাগ আছে—

—নিয়ে এসো।

—অত কিছুই না। আরো ঢের পাবে।

এবারেও কিছু না বুঝেই বিজয় হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এলো।

গায়ত্রী রাই বালিশের তলা থেকে শক্ত সুতোয় বাঁধা বড় একটা খামে মোড়া প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে দিল।—এটা সাবধানে ওর মধ্যে রাখো, আর ব্যাগ নিজের সঙ্গে রেখো।

ঊর্মিলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিজয় ভেবে পেল না কি ব্যাপার। কি আছে এতে?

—আগে রাখো ঠিক করে।

বিমূঢ় মুখে তামিল করল। প্যাকেট ব্যাগে ঢোকালো।

গায়ত্রী রাই বলল, চল্লিশ হাজার টাকা আছে ওখানে।…যে তাড়াহুড়োর ব্যাপার করলে, কিছুই করা গেল না। তোমাদের যা পছন্দ ওই থেকে করে নিও।

বিজয় মেহেরা আঁতকেই উঠল।—অত টাকা কি হবে!

এবারে ঊর্মিলা ভেঙে পড়ল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মা, তুমি আমাদের টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছ।

এই প্রথম পরিপূর্ণ দু চোখ মেয়ের মুখের ওপর এঁটে বসতে লাগল। বাপীর মনে হল শুধু দেখবেই। জবাব দেবে না।

জবাব দিল। বলল, এখানে আমার কাছে পড়ে থাকার জন্য এমন দুড়দাড় করে বিয়েটা সেরে ফেলেছিস?

—না না। তুমি তাড়িয়েই দিচ্ছ! আমি ঠিক জানি তুমি আমাকে আর কক্ষনো ডাকবে না।

চেয়ে আছে। একটু পরে খুব স্বাভাবিক অনুশাসনের সুর। ছেলেটার সামনে কি পাগলামি করিস? চোখ মোছ! আমার শরীরের হাল দেখছিস না…আমি না পারলেও সময়মতো বাপী ঠিক ডাকবে। তখন দেরি না করে বিজয়কে নিয়ে চলে আসিস।

ঊর্মিলা তবু কাঁদছে। মা কি যে বলল, এই বিচ্ছেদের আবেগে তা মাথা পর্যন্ত পৌঁছুলো না বোধ হয়। বিজয় মেহেরারও না।

এক আর্ত ত্রাসে বাপীই শুধু নিস্পন্দ হঠাৎ।

সময় হয়েছে। বাপীর গাড়ি নিয়ে বাদশা প্রস্তুত। মায়ের পা ছুঁয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। গাড়িতে উঠল। বাপী পাশে দাঁড়িয়ে। ঊর্মিলা চেয়ে আছে তার দিকে। আশা করছে এই রওনা হবার মুহূর্তে ফ্রেন্ড কিছু বলবে। আর কিছু না হোক, মায়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবে। শিগগীরই আবার দেখা হবার কথা বলবে।

বাদশাও ঘাড় ফিরিয়ে হুকুমের প্রতীক্ষায় আছে। বাপী হুকুম করল, — চলো!

সামনের বাঁকের মুখে গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ঊর্মিলা জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে এদিকে চেয়ে রইল। বাপীও। কিন্তু সে ওকে দেখছে না। গাড়িটাও না। মাথার মধ্যে চিনচিন করে জ্বলছে কিছু। কতগুলো কথার কাটা-ছেঁড়া চলেছে। গায়ত্রী রাই শেষে মেয়েকে যা বলেছে সেই কটা কথা। মেয়েকে বলেনি, ওকে শুনিয়েছে, ওকেই কিছু বোঝাতে চেয়েছে। বুকের ভেতরটা আচমকা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যন্ত্রণাটা মগজের দিকে ধাওয়া করেছে। এখন সেটা চোখ বেয়ে নেমে আসতে চাইছে।

বাপী বাংলোয় উঠে এলো। সেখান থেকে আবার ঘরে। কোয়েলা তার মালকানের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে। কিছু বলতে হল না। এই মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দু’চোখ আরো বেশি করকর করছে বাপীর। চেয়ে আছে।

চেয়ে আছে গায়ত্রী রাইও। ভাবলেশশূন্য, নির্লিপ্ত।—বলবে কিছু?

—হ্যাঁ। আপনার মেয়ের শাস্তি দেখলাম। আমার কি শাস্তি?

জবাব দেবার তাড়া কিছু নেই যেন। একটু সময় নিয়ে ফিরে প্রশ্ন করল, মেয়ের কি শাস্তি দেখলে?

—ক্ষমার শাস্তি। আমি আপনার ক্ষমা চাই না।

মুখখানা যেন আরো একটু ভালো করে দেখে নেওয়ার কারণ ঘটল। অভিব্যক্তির রকমফের নেই, গলার স্বরে নির্লিপ্ত কৌতুকের ছোঁয়া লাগল একটু।—তুমি তো আমার গার্জেন এখন…এ-সবের অনেক ওপরে উঠে গেছ। পরের কথাগুলো ধার-ধার।—তাছাড়া এসব কথা ওঠে কেন, নিজের মুখেই তো বলেছ, যা করেছ জীবনে কারো এত উপকার খুব কম করেছ।

—হ্যাঁ, বলেছি। তাই করেছি। কিন্তু তার বদলে আপনি কি করেছেন? কি বলতে চায় গায়ত্রী রাই ঠাওর করে উঠতে পারল না। দেখছে।—আমি কি করেছি?

—আপনি মেয়েকে বলেছেন, সময়মতো বাপী ঠিক ডাকবে। সময়মতো বলতে কোন্ সময়? কিসের সময়? আর বলেছেন, তখন দেরি না করে চলে আসতে। তখন বলতে কখন?

দু’ চোখ রাগে জ্বলছে বাপীর। কিন্তু গত রাতের পর থেকে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম গায়ত্রী রাইয়ের মুখের নির্লিপ্ত কঠিন পরদাটা সরেছে একটু একটু করে। কোমল প্রলেপ পড়ছে। পাতলা সাদা ঠোঁটের ফাঁকে রং ধরেছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের হাওয়াও লঘু করে দিতে চাইল। পলকা মোলায়েম সুরে বলল, আমার ডাক আসতে আর বেশি দেরি নেই, তোমার বুঝতে খুব অসুবিধে হচ্ছে?

আগে হলে বাপী এই কমনীয় মাধুৰ্যটুকু দু চোখ ভরে দেখত। কিন্তু এখন, বিশেষ করে এই কথা শোনার পর দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত। বলে উঠল, ডাক আসুক না আসুক, আমাকে আক্কেল দেবার জন্য আপনি যে তৈরী হচ্ছেন সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু আমাকে অনেক চিনলেও আরো একটু চিনতে বাকি আপনার। নিজে সেধে ডাক শুনতে এগোলে তার আগে আমি আপনাকে নিজের মরা মুখ দেখিয়ে ছাড়ব। বানারজুলির জঙ্গলে তার সুযোগের অভাব কিছু নেই—

—বাপী!

বাতাস-চেরা তীক্ষ্ম চিৎকার শুনে ওদিক থেকে কোয়েলা ছুটে এলো। বাপীর ফুটন্ত মগজে হঠাৎ যেন বিপরীত হিমশীতল তরঙ্গ বয়ে গেল একটা। শয্যার দিকে একবার থমকে তাকিয়ে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।

.

এরপর থেকে বাপীর বাইরেটা অনেক ধীর অনেক শান্ত। নিভৃতে নিঃশব্দে এক ধরনের শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা। যে শক্তি জীবনের অমোঘ বরাদ্দও বরবাদ করে দিতে পারে। সেই অদৃশ্য শক্তিটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পেতে চায়। পাশের বাংলোর ওই রমণীর প্রাণসত্তায় সেটা আরোপ করে দিতে চায়।

পাশের বাংলোয় নয়। এখন ওই বাংলোতেই রাত কাটে তারও। পাশের ঘরে অর্থাৎ ঊর্মিলার ঘরে নিজের শোবার জায়গা করে নিয়েছে। এজন্যে কারো অনুমতির দরকার হয়নি। মাঝের দরজা খোলা। নিজের শয্যায় বসেই দেখতে বা লক্ষ্য রাখতে সুবিধে হয়। গায়ত্রী রাইয়ের ঘরে সবুজ আলো জ্বলে।

সেই ঘটনার পর থেকে তারও আচরণ বদলেছে। কোনো কিছুতে নিজের জোর খাটায় না। এক অবুঝ গোঁয়ার ছেলের হাতে নিজের সব দায় সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। যা বলে, শোনে। যা করতে বলে, করে। তবু শরীর সারার নাম নেই দেখে বেচারী-মুখ করে বাপীর দিকে চেয়ে থাকে।

ঊর্মিলার যাবার সাত-আট দিনের মধ্যে পৌঁছানোর সংবাদ এসেছে বাপীর কাছে। ঊর্মিলার তখনো মন খারাপ, তখনো অভিমান। ছোট চিঠিতে মায়ের খবর জানতে চেয়েছে। নিজেদের কথা বিশেষ লেখেনি।

আর দশ দিন পরের চিঠি অবশ্য বড়। লিখেছে, কলকাতা একটুও ভালো লাগছে না। আর একজনের কেবল কাজ তার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ফুরসৎ নেই। আর লিখছে, মা-কে যে এত ভালবাসে আগে জানত না। এখন বুঝছে। সব সময় মায়ের কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। মা রাগ করুক আর যাই করুক, আর বেশিদিন মাকে না দেখে ও এভাবে থাকতে পারবে না। বিজয়কে রেখে একলাই দিনকতকের জন্য চলে আসবে।

বাপী এ চিঠিও তার মাকে পড়ে শোনালো।

—না। স্বর না চড়লেও সুর কঠিন।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি না?

—লিখে দাও একলা আসতে হবে না। আমি ভালো আছি, আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই।

এই শুনেও বাপীর রাগ।—আমি লিখে দিচ্ছি, আপনি একটুও ভালো নেই, যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসুক।

আসলে বাপীর বুকের তলায় সেই এক ত্রাস থিতিয়েই আছে। সেটা কতটা অহেতুক জানে না। একটা হিম-ছবি থেকে থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে সময়ে তার মেয়েকে বাপীর ডাকতে হবে, সেই সময়ের ডাক শুনে দেরি না করে যখন মেয়েকে চলে আসতে হবে, সেই সময়ের। সম্ভাবনার এই ছবিটাই ছিঁড়েখুঁড়ে উপড়ে নির্মূল করে দিতে চায়। কিন্তু খুব ধীরে, প্রায় অগোচরের অমোঘ গতিতে এটা যেন এগিয়ে আসছে।

তাই আতঙ্কিত যেমন, আক্রোশও তেমনি

মফঃস্বলে বেরুনো ছেড়েই দিয়েছে। সব কাজ ফোনে বা চিঠিতে এখানকার জন্য একে একে আরো দুজন বাছাই করা সহকারী বহাল করেছে। তারা অনুগত, বাপী তরফদারকেই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জানে তারা! তাছাড়া মাইনে আরো বাড়িয়ে আবু রব্বানীর ঘাড়েও অনেক বাড়তি দায় চাপিয়েছে। বাপীর কাজ বলতে বাংলোর আপিস ঘরে। খুব দরকার পড়লে বানারজুলির গোডাউনে অথবা পাহাড়ের বাংলোয় যেতে হয়। তাও কাজ শেষ হওয়া মাত্র ঝড়ের গতিতে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে আসে।

ঘরে এসে দাঁড়ালেই গায়ত্রী রাই খুব সহজ আর স্বাভাবিক মুখ করে তাকায় তার দিকে। বোঝাতে চায় ভালো আছে। কিন্তু ভালো যে কেমন আছে এক নজর তাকিয়েই বাপী সেটা বুঝতে পারে। অন্তত বিশ্বাস করে যে বুঝতে পারে। আরো রেগে যায়। যেন লুকোচুরি খেলা হচ্ছে ওর সঙ্গে।

সেদিনও বাইরে থেকে ফিরে মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে বলল, এখানকার ডাক্তারদের বিদ্যা-বুদ্ধি বোঝা গেছে। আর না, বাইরে যাবার জন্য তৈরি হোন।

মুখের দিকে চেয়ে মেজাজ আঁচ করেও গায়ত্রী রাই বলল, পাগলামি কোরো না। —আমি পাগলামি করছি? আর মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করে আপনি খুব বুদ্ধির কাজ করছেন? তাহলে আমাকে আর কি দরকার, যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাই? গায়ত্রী রাইয়ের সাদা-সাপটা জবাব, ভয় দেখাচ্ছ কি, পারলে যাও। চেয়ে আছে, সামাল দেবার জন্যেই আবার বলল, হার্টের এই অবস্থায় আকাশে ওড়া সম্ভব কিনা ডাক্তারকে জিগ্যেস করেছ?

বাপী তক্ষুণি চলে এলো। ফোনে শিলিগুড়ির ডাক্তারকে ধরল। ইদানীং প্রতি সপ্তাহে তাকে বানারজুলি এসে রোগিণী দেখে যেতে হচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলে রিসিভার আছড়ে বাপী মুখ কালো করে ঘরে ফিরে এলো।

গায়ত্রী রাই সাদা ভাবেই জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার যেতে বলল?

চোখের ধার ওই ফ্যাকাশে সাদা মুখে বিঁধিয়ে দিতে চাইল বাপী।—না। খুশী?

শিলিগুড়ি থেকে দুজন অভিজ্ঞ নার্স নিয়ে এসেছে এরপর। পালা করে রাতদিনের ডিউটি তাদের। দরকার একেবারে ছিল না এমন নয়। বড় ডাক্তারের ব্যবস্থামতো মাঝে মাঝে অক্সিজেন চলছে এখন। অক্সিজেন দেওয়া মানেই ভয়ের কিছু নয় জানে। তবু এ জিনিসটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না বাপী। গা শিরশির করে। সেই হিমেল ছবিটা, সামনে এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু অক্সিজেন দিলে রোগীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়, আরাম হয়। অসুবিধে হচ্ছে মনে হলে গায়ত্রী রাই নিজেই ওটা চেয়ে নেয়। দরকার ফুরোলে ছেড়েও দেয়। কিন্তু দরকারের মেয়াদ যে খুব একটু একটু করে বাড়ছে তাও বাপীর হিসেব এড়ায় না। তাই কারণে অকারণে অসহিষ্ণুতা। একজন ছেড়ে দুজন নার্স আসতে দেখে গায়ত্রী রাই বলল, এক কাজ করো, জঙ্গলের একটা হাতি-বাঁধা শেকল এনে আমাকে বাঁধো, তারপর নিশ্চিন্তে একটু কাজে-কর্মে মন দাও।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হয়েছে, বনের হাতি বনমায়াকে শেকলে বেঁধে রাখা যায়নি, সে খোলস ফেলে পালিয়েছে। ফলে এই ঠাট্টাতেও রাগ।—তাহলে ছেড়ে দিই এদের?

নার্সদের সামনে গায়ত্রী রাই না পারে হাসতে, না পারে বকতে।

দিনে রাতে ঘণ্টা কতক কাজ দেখাশুনা করতেই হয় বাপীকে। মহিলা ইদানীং সেই ফাঁকে কিছু লেখা-পড়া করে চলেছে টের পেল। তার মাথার কাছের টেবিলে কিছু সাদা কাগজ আর কলম দেখে বাপীর সন্দেহ হয়েছিল। আড়ালে নার্সদের জিজ্ঞাসা করে জানল। কোয়েলাও বলল। চার-পাঁচ দিন বাদে টেবিলে আর কাগজ কলম দেখা গেল না। বাপীর থমথমে মুখ।—আপনার উইল-টুইল করা সারা তাহলে? সাক্ষী-সাবুদ ডাকতে হবে?

কোয়েলা ঘরে। সামনে একজন নার্স বসে। গায়ত্রী রাইয়ের বিপাকে-পড়া মুখ।—উইল আবার কি? ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা লিখে রাখলাম তা ছাড়া—

অসহিষ্ণু ঝাঁঝে বাপী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, আপনার ইচ্ছে—অনিচ্ছেয় দুনিয়া চলছে ভাবেন? যা লিখেছেন ছিঁড়ে ফেলতে কতক্ষণ লাগে?

গায়ত্রী রাই গম্ভীর। ধমকের সুরে বলল, এবার ডাক্তার এলে আগে নিজের মাথাটা দেখিয়ে নিও।

ছায়া আগে চলে। বাপীর চিন্তায় সেটা অনেক আগে চলে। মন আগে থাকতে কিছু বলে দেয়। তেমনি অনাগত কিছুর সঙ্গে সারাক্ষণ যুঝছে এখন। সেটা নাকচ করে দেওয়ার আক্রোশ। অথচ আর কারো উতলা মুখ দেখলে রেগে যায়। অকারণে কোয়েলা ধমক খায়, নার্সদের বেশি যত্ন-আত্তিও সব সময় পছন্দ নয়, ঘণ্টাখানেকের জন্য সেদিন কি কাজে বেরিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে আবু রব্বানী আর দুলারি এসেছে। মেমসাহেবকে দেখতে।

বাপী নীরস মন্তব্য করে বসল, ঘটা করে দেখতে আসার মতো কি হয়েছে—তোমাদের মেমসায়েবের তাতে খুব কিছু হয়েছে ভাবার সুবিধে।

আবু অপ্রস্তুত। দুলারিও। সাদামাটা গাম্ভীর্যে গায়ত্রী রাই আগের বারের মতোই মন্তব্য করল, বাপী ঠিকই বলেছে, ওকে বরং ভালো করে দেখে যাও।

একে একে কটা মাস কাটল। এই অনাগত দিনের পদক্ষেপ এখন আরো স্পষ্ট। দিনে রাতে অনেকবার করে অক্সিজেন দরকার হয়। এক এক দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে। শিলিগুড়ির বড় ডাক্তারের একজন সহকারীকে বানারজুলিতে নিজের ছোট বাংলোয় এনে বসিয়ে রেখেছে বাপী। তার ক্ষিপ্ততা আরো বেড়েছে, এক অদৃশ্য বিধানের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করছে। সাহস করে ঊর্মিলাকে আসতে বলবে কিনা জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। ও এসে ভেঙে পড়লে বাপী তার সমস্ত জোর খোয়াবে।

মাঘের গোড়া এটা। হাড়-কাঁপানো শীত। বানারজুলির জঙ্গলে শুকনো কঠিন রিক্ততার ছাপ। তার কঠোর বৈরাগ্যের তপস্বিনী মূর্তির সঙ্গে শয্যায় শয়ান ওই শান্ত রমণীর নিষ্প্রভ মুখের কোথায় যেন মিল। এতটুকু চাঞ্চল্য নেই ক্ষোভ নেই। রোগীর অবস্থা হঠাৎই সংকটের দিকে মোড় নিল। এমন হবে ডাক্তার পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। কিন্তু বাপী যেন স্পষ্ট জানত এই গোছের কিছু হবে।

রাত্রি। অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ঘন ঘন ইনজেকশন দিচ্ছে। ঘরে দুজন নার্স, কোয়েলা…। বাপীর ঘোরালো চোখ একে একে সকলের ওপর ঘুরছে।

গায়ত্রী রাই চোখ মেলে তাকালো। আশ্চর্য পরিষ্কার চাউনি

বাপী কাছে এসে দাঁড়াল। গায়ত্রী রাই কিছু বলল না। শুধু চেয়ে রইল।

বাপী বলল, টেলিগ্রাম করা হয়েছে। কাল সকালের মধ্যেই ওরা এসে পড়বে।

গায়ত্রী রাই আবার চোখ বুজল। যেন এটুকুই শুনতে চেয়েছিল।

বাপী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আপিস ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইল।

রাত বাড়ছে। দেওয়াল ঘড়ি টুং টুং শব্দে সময় জানান দিচ্ছে। ওটুকু শব্দেও বাপী বিষম চমকে উঠেছে। ঘড়িটা আছড়ে ভাঙতে চাইছে।

তিনটে বাজল।

বাপী সোজা হয়ে দরজার দিকে তাকালো। কোয়েলা ছুটে এসেছে। — সাহেব! শিগগীর—শিগগীর!

আবার ছুটে চলে গেল।

বাপী উঠল। পায়ে পায়ে এঘরে এসে দাঁড়াল। সবুজ আলোর জায়গায় জোরালো বড় আলো জ্বলছে এখন। অক্সিজেনের নল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নার্স দুজনের ছলছল চোখ। ডাক্তার নির্বাক দাঁড়িয়ে। কোয়েলা মুখে শাড়ি গুঁজে দিয়ে কাঁদছে।

বাপী শয্যা ঘেঁষে দাঁড়াল। বুকে হাত রাখল। আর কোনো সংশয় নেই। শান্ত। স্তব্ধ।

এখনো একটা চেষ্টা বাকি আছে বাপীর, যা অনেক— অনেক দিন গলা পর্যন্ত এসেও ফিরে ফিরে গেছে। এই শেষ একবার সেই চেষ্টা করবে?…এই বাতাস এই স্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে গলা ফাটিয়ে একবার মা বলে ডেকে দেখবে? তাহলে কানে যাবে? তাহলে ফিরবে? চোখ মেলে তাকাবে?

সোনার হরিণ নেই – ২৭

ছ’মাস বাদে বাপী আবার কলকাতার মাটিতে পা ফেলল।

এই আসাটা হঠাৎ কিছু ব্যাপার নয়। দু-তিন মাস যাবৎ আসার প্রস্তুতি চলছিল। গায়ত্রী রাই চোখ বোজার পর থেকে বানারজুলির সঙ্গে শিকড়ের যোগটা ঢিলে হয়ে গেছে। বানারজুলি ছেড়ে গেলে হয়তো আবার একদিন বানারজুলি ভালো লাগতে পারে। প্রথম কিছু দিন এখান থেকে একেবারে পালানোর ঝোঁক মাথায় চেপে বসেছিল। তার পিছনে আক্রোশ ছিল। অভিমান ছিল। বানারজুলি তাকে বেঁচে থাকার বিত্ত যুগিয়েছে। অকৃপণ হাতে জীবনের বোঝা টানার কড়ি ঢেলেছে। নিয়েছে তার ঢের বেশি। নিয়ে নিয়ে সেই ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত বুকের ভিতরে একটা মরুভূমি তৈরি করেছে।

কিন্তু কোথা থেকে কোথায় পালাবে? যেখানে যত দূরেই যাক, জীবনের এই বোঝাটাকে কোথাও ফেলে রাখা যাবে না। একই সঙ্গে আবার এক বিপরীত অনুভূতির তাড়না অবাক করেছে ওকে। মৃত্যুর ওধারে কি জানে না। কেউ জানে না। কিন্তু অলক্ষ্য থেকে কেউ কি দেখে? কে কি ভাবছে টের পায়? সব ছেড়েছুড়ে পালানোর চিন্তা যতবার মাথায় আসে, ততবার অদৃশ্য একখানা মুখ আর শান্ত ঠাণ্ডা দুটো চোখ যেন খুব কাছ থেকে ওকে দেখে, নিষেধ করে। আভিজাত্য গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্ব ভরা এমন একখানা মুখ আর দুটো চোখের সস্নেহ শাসন কেউ কখনো তুচ্ছ করতে পেরেছে! বাপীর ভেতরটা হাঁসফাঁস করে ওঠে। চারদিকে তাকায়। মনে হয় গায়ত্রী রাই খুব কাছে আছে। খুব কাছ থেকে দেখছে। খুব কাছ থেকে নিষেধ করছে।

পালানোর সংকল্প মাথা থেকে সরেছে। এবার তাহলে কি? খুব কাছের যাকে দেখতে পাচ্ছে না, অসহিষ্ণু সরোষ প্রশ্নটা যেন তাকেই। কি তাহলে? যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃত্তটাকে আরো বড় করতে হবে? আরো অনেক বড় ঢের বড়? জঙ্গলের উদোম সন্ন্যাসী ওকে আগে বাড়তে বলেছিল—আগে বাড়লে পেয়ে যাবে। চোখ-কান বুজে এই পথেই সামনে এগোবে এখন? কিন্তু কি পাবে? অনেক টাকা, তারপর আরো অনেক টাকা? তারপর আরো অনেক অনেক অনেক টাকা? তারও পরে?

ঠিক তক্ষুণি সেই আশ্চর্য কাণ্ডটা ঘটে গেল। বুকের তলার কালীবর্ণ আকাশটাকে এক ঝলক বিদ্যুৎ পলকের জন্য দুখানা করে চিরে দিয়ে গেল। ওই পলকের মধ্যেই বাপীর ঘেমে ওঠার দাখিল। দুর্যোগে ভরা অন্ধকারের আড়ালে এখনো কোনো সুদূর প্রত্যাশার আগুন জ্বলছে কিনা জানে না। সেটাই একপ্রস্থ ঝলসে গেল কিনা জানে না। কিন্তু আপাতত ওটা ওই অন্ধকারের ওধারেই থাকুক। পরে ভাববে। পরে বুঝতে চেষ্টা করবে। খুব কাছে যার অস্তিত্ব অনুভব করছে অথচ দেখতে পাচ্ছে না—সেও না কিছু বুঝতে পারে।

তার ইচ্ছে মেনে বৃত্ত বড় করার ঝোঁকটাকে বড় করে তুলতে গেল। আপাত পিছু টান কিছু নেই। ব্যবসার দিক থেকে ভাগ্যের পাশায় আবার নূতন যে দান পড়েছে তার দাক্ষিণ্যে বৃত্ত বিস্তারের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই কলকাতার দিকে চোখ বাপীর।

সংকল্পের কথা গোড়ায় ঊর্মিলাকে জানায় নি। ঊর্মিলা তখনো এখানে। বিজয়ও। টেলিগ্রামে মায়ের মামাবাড়ির খবর পেয়ে পরদিন সকালের প্লেনেই ওরা ছুটে এসেছিল। ঊর্মিলা মরা মায়ের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে কিছু ঠাণ্ডা হতে পেরেছে। কিছু হালকা হতে পেরেছে। বাপীর সে সম্বলও নেই কোনো দিন। খরচোখে ওর আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না দেখেছে। হিংসা করেছে।

সমস্ত ব্যবসা আর বিত্ত চুল-চেরা দু’ ভাগ করে গায়ত্রী রাই এক ভাগ বাপী আর একভাগ মেয়ে-জামাইকে দিয়ে গেছে। দিয়ে গেছে বলতে এই মর্মে নির্দেশ রেখে গেছে। ঊর্মিলা একটু ঠাণ্ডা হাত তার মায়ের শোবার ঘরের বড় সিন্দুক খোলা হয়েছিল। গায়ত্রী রাই মেয়ের সামনেও এটা বড় একটা খুলত না। ওই পেল্লায় সিন্দুকে থরে থরে সাজানো দশ আর একশ টাকার বান্ডিল দেখে বিজয় মেহেরার দু’চোখ ঠিকরে পড়ার দাখিল। কোন্ ঘরের মেয়ে নিয়েছে এ যেন নতুন করে অনুভব করেছে। এ ছাড়া ছোট-বড় সোনার বারও পঁচিশ-তিরিশটা হবে। হীরে জহরতও আছে কিছু।

সিন্দুক থেকে একটা মস্ত বড় আর একটা ছোট খাম বার করে বাপী ঊর্মিলার হাতে দিয়েছে। দুটোরই যত্ন করে মুখ আঁটা। বলেছে, কি লিখে গেছেন আমি জানি না, খুলে দেখো।

ছোট খামে মেয়ে-জামাইয়ের প্রতি গায়ত্রী রাইয়ের সংক্ষিপ্ত নির্দেশ। পড়ে ঊর্মিলা নিঃশব্দে সেটা আবার বাপীর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। পড়তে পড়তে গলার কাছে বাপীর কিছু বুঝি আবার দলা পাকিয়ে উঠেছে। ব্যবসার যাবতীয় দায়দায়িত্ব যেমন বাপীর হাতে আছে তেমনি থাকবে। জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে তার বরাদ্দ টাকা, চালু হারে কমিশন আর অন্যান্য সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে নিট লাভের আট আনা অংশ মেয়ে-জামাই পাবে। মালিকানা সম্পর্কে অন্য যে—কোনো সিদ্ধান্ত দু’তরফের বিবেচনাসাপেক্ষ। ঘরে এবং ব্যাঙ্কের সমস্ত নগদ টাকা, সোনা ইত্যাদিরও অর্ধেক বাপী তরফদার পাবে, বাকি অর্ধেক মেয়ে-জামাইয়ের। কোয়েলা ঝগড়ু, বা বাদশা ড্রাইভারকেও ভোলেনি। তাদের জন্যও কিছু থোক টাকা আলাদা সরানো আছে। ভুটান পাহাড়ের বাংলোটা একলা মেয়ে পাবে। ব্যবসায়ের জন্য যদি সে বাড়ির দরকার হয়, তার ন্যায্য ভাড়াও মেয়ের নামে জমা হবে।

বড় খামে উত্তরবাংলার আর তার বাইরে বহু ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা-কড়ির হদিস, ব্যাঙ্কের পাস-বই চেক-বই ইত্যাদি। এই টাকাও প্রায় অভাবিত পরিমাণ। প্রতিটি অ্যাকাউন্ট মেয়ে আর মায়ের নামে। তাই মেয়ের প্রতি মায়ের নির্দেশ, সে-যেন বাপীর প্রাপ্য অর্ধেক তাকে দিয়ে দেয়।

মোটামুটি হিসেব কষা হতে বিজয় মেহেরার মুখে কথা সরে না। ব্যাঙ্ক আর সিন্দুকের নগদ টাকা ভাগে চার লক্ষর ওপরে দাঁড়াচ্ছে। এর ওপর সোনা হীরে জহরতের ভাগ। কিন্তু তখনই সব কিছুর ফয়সালা করার মতো সময় নেই হাতে। নগদ টাকা আর সোনা ইত্যাদির অর্ধেক বুঝে নিয়ে সস্ত্রীক বিজয় কলকাতা চলে গেছে। বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা পরের যাত্রায়। যাবার আগে ঊর্মিলা চুপি চুপি বাপীকে বলে গেছল, ওর কাছে সব একবারে ফাঁস করে দিয়ে ভালো কাজ করলে না বোধ হয়। কলকাতায় চাকরি ভালো লাগছে না, আবার বাইরে কাজের চেষ্টায় আছে। এত হাতে পেয়ে এখন মতিগতি কি হয় দেখো।

বলেছে বটে কিন্তু বাইরে পাড়ি দেবার ব্যাপারে ঊর্মিলারও তেমন বাধা কিছু আছে মনে হয়নি। পরের দু’তিনটে চিঠিতেও এই তোড়জোড়ের আভাস দিয়েছে ঊর্মিলা। লিখেছে তার ঘরের লোক এখন বেপরোয়া হয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, আর বলছে, কাজ হাতে না পেলেও চলেই যাবে। বিদেশে ওদের জন্য উল্টে কাজই নাকি হাঁ করে আছে।

তিন মাসের মাথায় ওরা বানারজুলি এসেছে আবার। বিজয়ের খুশি ধরে না। ওর কলকাতার চাকরির মেয়াদ আর দেড়-দু মাস মাত্র। আগামী জুলাইয়ের শেষে ওরা আমেরিকা চলল। সেখান থেকে বিজয়ের বড় চাকরির প্রতিশ্রুতি মিলেছে, শুধু নিজের খরচে সেখানে গিয়ে পৌঁছুনোর দায়। এবারে বাপীকে বিজয় সরাসরি একটা প্রস্তাব দিয়েছে। এখানকার ব্যবসায়ে অর্ধেক মালিকানার ব্যাপারে তার বা ডলির কিছুমাত্র আগ্রহ অথবা লোভ নেই। ব্যাঙ্কগুলোতে যে-টাকা মজুত আছে তার অর্ধেক বাপীর পাওনা। বাপী সে টাকাটা ছেড়ে দিলে তারাও অর্ধেক মালিকানার শর্ত ছেড়ে দেবে। কতকালের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে জানে না, আধা-আধি বাখরার হিসেবনিকেশের মধ্যে থাকতে চায় না।

এর থেকে বাঞ্ছিত আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বাপীর মুখ দেখে মন বোঝা ভার। সে ঊর্মিলাকে জিগ্যেস করেছে, তোমারও এই মত তাহলে?

সে জবাব দিয়েছে, আপত্তির কিছু নেই, তবে ব্যাঙ্কগুলো থেকে ফ্রেন্ডের দুলক্ষ টাকার ওপর পাওনা—অর্ধেক মালিকানার বদলে অত দিতে হলে তার না ঠকা হয়ে যায়।

বাপী হেসেই বলেছিল, ঠকলে আখেরে তোমরাই।

এমন সম্ভাবনার কথা ভেবেই হয়তো গায়ত্রী রাই লিখে রেখে গেছল, ব্যবসায় মালিকানা সম্পর্কে অন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত দু’তরফের বিবেচনাসাপেক্ষ। অতএব বাপীর বিবেকও পরিষ্কার।

মালিকানা বদল হয়ে গেল। কিন্তু নামের বেলায় বাপী শুধু একটা রাই হেঁটে দিল। নতুন নাম রাই অ্যান্ড তরফদার। ভক্ত যেমন সর্বদা তার আরাধ্য দেবদেবীর ছবি সঙ্গে রাখে, বাপীও ঠিক সেই মন নিয়ে ওই ইষ্টদেবীর নাম গোড়ায় বসিয়ে রাখল।

বাপীর লক্ষ্য এরপর কলকাতা। আপাতদৃষ্টিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের ঝোঁকটাই বড়। কিন্তু এদিকের সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার ফাঁকে আরো দুটো মাস কেটেছে। উত্তরাঞ্চলের সব থেকে বড় হার্ব-ডিলার এবারে জাঁকের সঙ্গে কলকাতার বাজারে নামতে চলেছে এই প্রচার আগে থাকতেই শুরু করেছে। প্রচারের চমক বাড়ানোর মতো একটি চৌকস লোকও ঠিক সময়ে জুটে গেছে।

জুটিয়েছে আবু রব্বানী। লোকটার নাম জিত মালহোত্রা। ইউ-পি’র ছেলে। বাপীর বয়সী হবে। স্মার্ট, সুশ্রী। যোগাযোগই বটে। আর কেউ হলে তার পরিচয় শুনেই হয়তো ছেঁটে দিত। কিন্তু আবুর সুপারিশের ফলে বাপীর আগ্রহ বাড়ল। চা-বাগানের সেই ছেলে, বাপীর আগে গায়ত্রী রাই যাকে কাজে বহাল করেছিল। কাজে-কর্মে চতুর ছিল। কিন্তু মেয়ের অর্থাৎ ঊর্মিলার দিকে চোখ যেতে যার আবার মূষিকদশা। আবু বলেছিল, মেয়ের দিকে ছোঁকছোঁক করতে দেখে মা ওকে তাড়িয়েছিল। পরে ঊর্মিলা বাপীকে বলেছিল, তার মতলব বুঝে সে-ই মাকে বলে ওকে তাড়িয়েছে।

বাপীকে এই বানারজুলিতে কে না চেনে। সকলের চোখের ওপর দিয়েই আজ ভাগ্যের এই জায়গাটিতে পৌঁছেছে। জিত মালহোত্রা আবুকে ধরেছে। নিজের ভাগ্য সে আর একবার যাচাই করে দেখতে চায়।

বাপী তাকে নিয়ে আসতে বলেছিল। দেখে আর দুচার কথা বলে পছন্দ হয়েছে। তার এই দেখার চোখ আলাদা। সপ্রতিভ মুখে অভিবাদন জানাতে বাপী চুপচাপ মুখের দিকে খানিক চেয়ে ছিল। তারপর বলেছিল, নাম জিত, কিন্তু প্রথমেই তো হেরে পালিয়েছিলে—।

ও সবিনয়ে জবাব দিয়েছে, মহিলা মালিক, তাই একটু বেশি অ্যাম্‌বিশাস হয়ে পড়েছিলাম। ভুলের খেসারত দিয়েছি। আর এমন ভুল হবে না।

—আমার কাছে এলে অমন ভুলের সুযোগ কিছু নেই। আমার অন্য কিছু দরকার।

—বলুন।

—বিশ্বাস। এই প্রথম আর এই শেষ শর্ত!

বাপীর যা পছন্দ তাই করেছিল লোকটা। আর উৎরেও গেছল। বিনীত অথচ সপ্রতিভ আবেদন নিয়ে সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর নিরুচ্ছ্বাস গলায় বলেছিল, আমি বিয়ে করেছি, একটা বাচ্চা আছে। ওদের ভালবাসি। বিশ্বাস হারিয়ে ওদের পথে বসানোর হিম্মত আমার নেই। তাছাড়া বিশ্বাস কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে সেটা ছ’বছর ধরে আপনাকে দেখে শিখেছি। এরপর আমারও এই একমাত্র পুঁজি জানব

বাপী তাকে বহাল করেছে। খেতাব প্রাইভেট সেক্রেটারী। কাজ যোগাযোগ আর প্রচার। চা-বাগান থেকে সর্বসাকুল্যে মাইনে পেত পৌনে তিনশ’ টাকা। বাপী সেটা পাঁচশ’য় তুলেছে। বাইরে থাকাকালে এর ওপর থাকা-খাওয়ার খরচ পাবে। এ ছাড়া ভালো পোশাক-আশাকের জন্যও গোড়ায় কিছু থোক টাকা দেওয়া হবে তাকে। আর যা বোঝানোর তাও সোজাসুজি বুঝিয়ে দিয়েছে।— এ টাকা কিছু না আমি জানি। তুমি কতটা বড় হবে সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে।

এক মাস আগে রাই অ্যান্ড তরফদারের মালিক জিত মালহোত্রাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। গতবারে বড়বাজারের যে-সব মার্চেন্ট-এর সঙ্গে বাপী দেখা করে এসেছিল তাদের প্রত্যেকের নামে শুভেচ্ছাসহ চিঠি পাঠিয়েছে। বড় বড় ওষুধের কারখানার হোমরা-চোমরাদের কাছেও! সঙ্গে কোম্পানীর গাদা গাদা ঝকঝকে ক্যালেন্ডার আর ফ্যাশানের ডায়ারি। বনজ ওষুধের কারবারে প্রচারের এই গোছের চটক তখন পর্যন্ত কলকাতায়ও নতুন। কিছুদিনের মধ্যে জিত জানিয়েছে, কেউ তাদের হেলাফেলা করেনি, অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

মন সব থেকে বেশি খারাপ আবু রব্বানীর। ব্যবসার মালিকানা বদলের ফলে বরাত ওরই সব থেকে বেশি খুলেছে। এখানকার সব কিছুর তদারকের ভার বাপী ওর কাঁধে চাপিয়েছে। জঙ্গলের হেড বীটম্যানের চাকরি ওকে ছাড়তেই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। জঙ্গলের বড় সাহেব খুশি থাকার ফলে ওর ঘরসহ চারিদিকের খানিকটা জমি বাপী আবুর নামেই কিনে ফেলতে নিশ্চিন্ত। এরপর আর সরকারী জমিতে বসবাসের দায় থাকল না। এখানে সকলের মাথার ওপর ওকে বসিয়ে দেবার ব্যাপারে বাপীর মনে এতটুকু দ্বিধা ছিল না। লেখাপড়ার ঘাটতি পুষিয়ে দেবার লোক তিন-চারজন আছে।

আবুর তবু মন খারাপ, কারণ দোস্ত-এর মতিগতির ওপর তার খুব আস্থা নেই। কলকাতা কেমন জানে না। কিন্তু শুনেছে সে এক আজব শহর। সেখানে ব্যবসা ফেঁদে বসলে বানারজুলির সঙ্গে যোগটা শেষে ঢিলে হয়ে যাবে কিনা কে জানে। বাপী কথা দিয়েছে, দরকার হলে মাসের মধ্যে চারবার করেও এখানে এসে দেখাশুনা করে যাবে। আর দরকার না হলেও মাসে বার দুই আসবেই। হাওয়াই জাহাজে এক ঘণ্টার তো ব্যাপার। আর আবুরই বা যখন-তখন চলে যেতে বাধা কোথায়?

আবুর তবু খুঁতখুঁতুনির একটা কারণ দুলারি ফাঁস করেছে। ছ’মাস হতে চলল মেমসায়েব বেহেস্তে পাড়ি দিয়েছে, তার মেয়েও বিয়ে-থা করে সরে পড়েছে—এত টাকা আর এত বড় ব্যবসা নিয়েও বাপীভাই একলা পড়ে আছে—এখনো বিয়েসাদির নাম নেই। দুলারিকে নাকি বলেছে, তোমার বাপীভাইয়ের রাজার ভাগ্য রাজার মেজাজ, কিন্তু তার মধ্যে একজন ফকির মানুষও লুকিয়ে আছে। কবে না সব বিলিয়ে দিয়ে মুসাফির হয়ে চলে যায়!

শুনে বাপী হেসেছিল। কিন্তু ভিতরে কোথায় কেটে কেটে বসেছে। ওর ভিতরে লোভের মূর্তিটা ওরা দেখেনি। সেই দানবকে ওরা জানে না। জীবনে যা ঘটে গেছে তাই শেষ বলে ওই দানব আজও মেনে নিতে পারেনি। যে মনের ওপর অগাধ বিশ্বাস সেই মন আজও বলছে, আরো কিছু ঘটতে বাকি। আরো অনেক বাকি। তা না হলে সমস্ত মন এখন কলকাতার দিকে কেন? এখনো আগে বাড়ছে কেন? আরো টাকা আরো টাকা আরো টাকা? আর কিছুই না?

তাই যদি হবে, তাহলে সংগোপনের কিছু লোলুপ চিন্তা মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয় কেন? বাপী তরফদার ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছে, বিবেকের ছড়ি উঁচিয়ে হেঁটে দিতেও চেয়েছে। কিন্তু ওরা ফিরে ফিরে এসেছে। আসছে।…প্রথম দিন কলকাতার সেই নামী হোটেলে মিষ্টি বলেছিল, দু’তিন ঘণ্টা পর পর সমস্ত মুখে জল দেওয়াটা বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে। বাথরুম থেকে ফিরে আসার পর কানে মাথায় জলের ছিটে দেখেছিল বাপী। ভেতর ঠাণ্ডা থাকলে এই বাতিক কেন?

ঊর্মিলা আর বিজয় মেহেরার প্রসঙ্গে নির্লিপ্ত সুরে মিষ্টি বলেছিল, অমন মা যখন সহায়, সংকট আবার কি—ইনজিনিয়ারকে হটিয়ে দাও। তার জবাবে বাপী বলেছিল, রাজত্ব বা রাজকন্যায় লোভ নেই—বারো বছর ধরে পৃথিবীর সব বাধা আর সক্কলকে হটিয়ে একজনের জন্যেই বসে আছে।…শুনে মিষ্টির চাউনি ওর মুখের ওপর খানিক স্থির হয়েছিল, চাপা ঝাঁঝে বলেছিল, তুমি মোস্ট আপ্র্যাকটিকাল মানুষ। বলেছিল, একটা মেয়ের দশ বছরের সঙ্গে বারোটা বছর জুড়লে কি দাঁড়ায়, আর কত কি ঘটে যেতে পারে—ভেবেছিল? শুধু নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়েই বারোটা বছর কাটিয়ে দিলে?

…কি ঘটে যেতে পারে বাপী পরে জেনেছে। কিন্তু মিষ্টির সেই অসহিষ্ণুতা আর ঝাঁঝের ফাঁকে কিছু চাপা যন্ত্রণাও ঠিকরে পড়ছিল নাকি?

…ছেলেপুলে হতে গিয়ে মিষ্টির প্রাণসংকট হয়েছিল। বড় ডাক্তার বলেছে, বাজে হাতে পড়ে মেয়েটার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু বাপী যখন দেখেছে সে-রকম ক্ষতির কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি। উল্টে আগের থেকেও তাজা সুন্দর লোভনীয় মনে হয়েছে। তাহলে ক্ষতিটা কি? আর ছেলেপুলে হবে কি হবে না সেই সংশয়? তাই যদি সত্যি হয়, সেই বড় ডাক্তারের হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে আপত্তি হবে না—এমন চিন্তাও যে করেছিল বাপী অস্বীকার করতে পারবে?

—সুদীপ নন্দী বলেছিল, বউ ঘরে নেওয়া দূরে থাক, তারা ছেলেকেই দূর দূর করে তাড়িয়েছে। অসিত চ্যাটার্জির মদের নেশা বাপী স্বচক্ষেই দেখেছে। জুয়ার নেশার কথাও শুনেছে। মিষ্টির মা মনোরমা নন্দী জামাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ। কতবার করে সে নাকি মেয়েকে বলেছে, কাগজের বিয়ে ছিঁড়ে ফেললেই ছেঁড়ে। এই ছেঁড়ার ব্যাপারে দীপুদাও বোনকে অনেক বুঝিয়েছে। সব কিছুর নিষ্পত্তি যদি হয়ে গিয়ে থাকে, নিভৃতের এই চিন্তার সলতেগুলো দপ করে জ্বলে জ্বলে ওঠে কেন, হাতছানি দেয় কেন? এক-এক ফুঁয়ে বাপী তো কতবার করে সেগুলো নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। সব থেকে বেশি চোখে ভাসে শেষের দিনে মিষ্টির সেই মুখ। ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির ছোঁয়া লেগে ছিল। যার নাম ঠিক হাসি নয়, হাসির মতো কিছু। দু চোখ তুলে ওকে শুধু কিছু বোঝাতে চেয়েছিল। কোনো অভিযোগ ছিল না, দু’চোখে শুধু মিনতি ছিল।

বাপী নামে কোনো পুরুষ ওই মেয়ের জীবন থেকে একেবারে মুছে গিয়ে থাকলে এমনটা হত না। হতে পারে না।

কিন্তু বাপী তবু এইসব লোভের বুদবুদগুলো সজাগ বিশ্লেষণের আয়নায় ফেলে বড় করে দেখতে চায় না। মিষ্টি ওকে মোস্ট আনপ্র্যাকটিকাল বলেছিল। মর্মান্তিক সত্যি কথাই বলেছিল। স্বপ্নের জালে বাস্তব কিছু ছেঁকে তোলা যায় না। মনের তলায় যা আছে—থাক। তাদের কানাকানিতে কান দেবার সময় বা সুযোগ যদি আসে কখনো, আজকের বাপী তরফদারকে তখন কেউ আনপ্র্যাকটিকাল বলবে না। স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাটানোর খোঁটাও আর কেউ দেবে না। আপাতত ও শুধু সামনে এগোচ্ছে, আগে বাড়ছে। কি পাবে আগে থাকতে তার হিসেব কষে কাজ নেই।

জুনের শেষদিনে বাপী ঊর্মিলার চিঠি পেল। রাগারাগি করে লিখেছে, আসি—আসি করেও আসছে না কেন—জুলাইয়ের শেষে কলকাতা ছেড়ে ওরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, এরপর দেখা আর কবে হবে? আর লিখেছে, চটপট চলে না এলে এরপর গাড়িও ফসকে যাবে—ওটা নেবার জন্য ওখানে অনেকে হাঁ করে আছে, বিজয় ওটার গতি করার জন্যও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

প্রথম দফায় গায়ত্রী রাইয়ের সিন্দুকের মোটা টাকা হাতে পেয়েই কলকাতায় গিয়ে কোনো বিদায়ী সাহেবের কাছ থেকে প্রায় নতুন একটা ঝকঝকে বিলিতি গাড়ি কিনে ফেলার খবর ঊর্মিলা চিঠিতে লিখেছিল। সব কিছু পাকাপাকি ফয়সলার জন্য ওরা গেলবারে আসতে সেই গাড়ির প্রসঙ্গও বাপীই তুলেছিল। ঊর্মিলাকে বলে দিয়েছিল, বাইরে চলে যাবার আগে গাড়ি যেন না বেচে দেয়— তারই দরকার হবে।

এদিকের ব্যবস্থা সব পাকা করে বাপী মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। কলকাতায় মাল চালানোর জন্য শিলিগুড়ির ডিলারের মারফৎ নতুন একটা বড় ট্রাক কেনা হয়েছে। সেটা এসে পৌঁছুনোর অপেক্ষা। তাও এসে গেল।

জুলাইয়ের তৃতীয় দিন বিকেলে এরোপ্লেন থেকে নামে বাপী তরফদার আবার কলকাতার মাটিতে। এবারে আসার তফাতটুকু শুধু তার মাথার মধ্যে। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। বৃষ্টিও পড়ছে, তবে জোরে নয়। এই অভ্যর্থনাও বাপীর মেজাজের সঙ্গে মিলছে।

বাপী তরফদার সামনে এগলো। আগে বাড়ল।

সোনার হরিণ নেই – ২৮

মনিব আজ আসছে জিত্‌ মালহোত্রা জানে। কিন্তু বাপী তাকে এয়ারপোর্টে আসতে বলেনি। সন্ধ্যার পর হোটেলে দেখা করতে লিখেছে। মনের তলায় কিছু হিসেব ছিল তাই এ-রকম নির্দেশ। তা না হলে ঘড়ির কাঁটা ধরে জিত্ মালহোত্রা এরোড্রোমে হাজির থাকতই।

বিশাল লাউঞ্জের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে গেল। হিসেব গরমিল হয়েছে। এয়ার অফিসের সেই ইনফরমেশান কাউন্টারে আর একটি অবাঙালী মেয়ে দাঁড়িয়ে।

—ছ’মাস আগে বিজয় মেহেরাকে নিয়ে যাবার জন্য যখন কলকাতায় এসেছিল, এই লাউঞ্জের এদিকে আসেই নি। যে-সঙ্কল্প নিয়ে আসা, তার বাইরে মাথায় আর কিছু ছিলও না। আর পরের ভোরে বিজয়কে বগলদাবা করে আবার যখন প্লেনে উঠেছে তখন আর কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। আজ কলকাতার মাটিতে পা দেবার আগে থেকে স্নায়ুগুলো সব নির্লিপ্ত সহজতার কৃত্রিম তারে বাঁধা ছিল। কিন্তু ঝকঝকে ইনফরমেশন কাউন্টারের ওধারে একজনের বদলে আর একজনকে দেখে হিসেব বরবাদ হলে যেমন হয়, মুহূর্তের মধ্যে ভেতরটা তেমনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠল।

….দাঁড়িয়ে যে আছে তাকেই জিগ্যেস করবে? খোঁজ নেবে? দু’পা এগিয়েও থামল। দিল্লির সেই ইন্টারভিউর কথা মনে পড়ল। সেই চাকরি পেয়ে থাকলে তার এখনকার ঠিকানা কলকাতা না দিল্লি? সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক রাস্তায় সেই সাতাশি নম্বর বাড়িতে গিয়ে হাজির হবার তাড়না। বাপীর এক হাতে মস্ত সুটকেস, অন্য হাতে বড় শৌখিন ট্র্যাভেল এটাচি। লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে এসে ট্যাক্সি ধরল।

ছুটন্ত গাড়িতে বসে একটু বাদেই নিঃশব্দে এক বিপরীত কাজ করল। ছেলেবেলা থেকে চেনা নিজের ভিতরের সেই অবুঝ অসহিষ্ণু বাপী নামে ছেলেটাকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রবীণ শাসনের চোখে দেখল খানিক। তারপর ঠাস ঠাস করে দু’গালে চড় কষালো গোটাকতক। অমন নির্বোধ তাড়নার মধ্যে ফেলে দেওয়ার শাস্তি। ধৈর্যের হিমঘরে বাস এখন। অনন্তকাল ধরেই যদি সেখানে থাকতে হয়—অত ছটফটানি কিসের?

—হয়তো আজই কোনো কারণে আসেনি। দেখা হয়নি ভালো হয়েছে। মন বিক্ষিপ্ত হতই। কৃত্রিম মুখোশের আড়াল নিতে হত। ব্যবসার তাগিদে আসাটা বড় করে তুলতে হত। নিজের কানেই সেটা কৈফিয়তের মতো শোনাতো। দু’দশ দিন বা দুই এক মাসে কাজে-কর্মে কিছুটা স্থিতি হবার পরে দেখা হলে সব দিক থেকে সুবিধে। কাজের আসনে আত্মস্থ পুরুষের আর এক রূপ। সেটাই সব থেকে সহজ আর নির্ভরযোগ্য মুখোশ

—চাকরি নিয়ে দিল্লিতেই যদি চলে গিয়ে থাকে তাও অবাঞ্ছিত নয়। বাপী চাইলে দিল্লী আর কতদূর? এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা। আসল ফারাক অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে। আরো বড় ফারাকের সূচনা হতে পারে এটা। মিষ্টি তার আওতার মধ্যে বসে নেই এ আরো বেশি কাম্য। সেই রকম দাঁড়িয়েছে কিনা জানার লোভ বাপীর। দক্ষিণ কলকাতার সাতাশি নম্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেই জানা যেতে পারে। গেলে খাতির কদর আগের থেকেও বেশি হবে হয়তো। তার বর্তমান মর্যাদার খবর সুদীপ নন্দী আর তার মা-ই খুঁচিয়ে বার করবে। তাদের টাকা যথা পিরীত তথা।

নাঃ, বাপীর তাড়া নেই। সময়ে সব হবে। সব বোঝা যাবে। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সামিল। স্নায়ু নিজের বশে এখন। আপাতত সে হোটেলে যাচ্ছে। আর কোথাও না। পাশের বড় অ্যাটাচি কেসটা বোঝাই টাকা। নিজের রোজগারের টাকা ছোঁবার দরকার হয়নি। সে-সব উত্তরবাংলার নানা ব্যাঙ্কে আর লকারে যেমন ছড়ানো ছিল তেমনি আছে। এই অ্যাটাচিতে গায়ত্রী রাইয়ের সিন্দুক থেকে পাওয়া নিজের ভাগের টাকা। দু’ লক্ষর ওপরে আছে। সবটাই নিয়ে এসেছে। এত টাকা এ ভাবে আনতে বুকে কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু বাপীর এ ব্যাপারে এক ফোঁটা উদ্বেগ নেই। যেমন নির্বিকার তেমনি স্বাভাবিক। এমন কি গায়ত্রী রাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সোনা আর তার থেকেও দামী যা-কিছু হাতে এসেছে সে-সবও ওই পেল্লায় সিন্দুকের তলায় ফেলে এসেছে। অবশ্য কুডুলের ঘায়েও অমন সিন্দুক ভাঙা সহজ নয়। আর কোয়েলা আছে। তার মালকান নেই, কিন্তু তার কাছ থেকে নগদ যা পেয়েছে তাতে বাপীরও কেনা হয়ে আছে। না পেলেও বিশ্বাস খোয়ানোটা ইজ্জত খোয়ানোর সামিল ওর কাছে। ওদের এই ধাত বাপী চেনে। আর বাদশা ড্রাইভার আছে। প্রভুভক্ত সজাগ কুকুরের মতোই ওরা বাংলো পাহারা দেবে। তাছাড়া সিন্দুকে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণাও কারো নেই। সোনা তবু সোনাই। ছায়া-ভয় পিছনে ধাওয়া করে। বাপীর করে না।

তা হলেও এত কাঁচা টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি কোনো কাজের কথা নয়। তাই ঊর্মিলার ওখানে যাওয়ার ইচ্ছেও আজকের মতো বাতিল। কাল এখানকার ব্যাঙ্কের কাজ সেরে অন্য চিন্তা।

আগের সেই দামী হোটেলে মালহোত্রাকে ঘর বুক করে রাখতে বলা হয়েছিল। সে আগে থাকতে এসে বসে আছে। সপ্রতিভ অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলো।

এই লোকের একটা গুণ বাপী বানারজুলির ক’দিনের মধ্যেই লক্ষ্য করেছে। কাজের ব্যাপারে চতুর, চটপটে। গায়ত্রী রাইয়ের কাছেও ছ’মাস ছিল। কাজ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে। কিন্তু কি করল না করল প্রশংসার লোভে আগবাড়িয়ে সেটা জাহির করতে আসে না। হাল্কা চা-পর্বের পরে মালিককে বিশ্রামের অবকাশ দিয়ে পার্টিশনের ও ধারে চুপচাপ বসে আছে।

বেশভূষা বদলে বাপী গদির নরম বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকল খানিকক্ষণ। গতবারে এই হোটেলের প্রথম দিনটা বার বার মনে আসছে। শেষের দিনটাও। বাপীর ওটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা। প্রত্যাশার আতসবাজী রঙে রঙে ঝলসে উঠেছিল। ছাই হয়ে মেনেছে। ছাই ঝেঁটিয়ে দুটো দিনকেই বিদায় করল বাপী। নিশ্চল নিস্পন্দ পড়ে থেকে মাথাটাকে খানিকক্ষণের জন্য শূন্য করে দেওয়ার চেষ্টা। ভালো-মন্দ সমস্ত রকমের চিন্তা বাতিল। কোনো বই-এ পড়া এই কসরত কিছুটা রপ্ত হয়েছে। পরে বেশ ঝরঝরে লাগে।

—জিত্!

—সার! জিত্ মালহোত্রা তক্ষুনি পার্টিশনের ও-ধার থেকে এগিয়ে এলো।

—একটা চেয়ার এনে বোসো। তারপর খবর কি বলো!

খবর মোটামুটি যেমন আশা করা গেছল তাই। নিজের পোর্টফোলিও ব্যাগ থেকে জিত্ আর্ট পেপারে ছাপা একটা প্যামফ্লেট তার হাতে দিল। বাপী শুয়ে শুয়েই উল্টে-পাল্টে দেখল সেটা। তার খসড়া মতোই এখানে ছাপা হয়েছে গ্রুপে ভাগ করা ফার্মের যাবতীয় ভেষজ মালের ক্যাটালগ। সমস্ত উত্তরবাংলা নেপাল ভুটান মধ্যপ্রদেশ আর বিহারের শাখা-প্রশাখার হদিস। সে-সব এলাকায় সরবরাহের বিনীত ফিরিস্তি। ট্রেনের অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর না করে নিজেদের যানবাহনে সময়ে সর্বত্র মাল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কলকাতার এ-মাথা ও মাথা পর্যন্ত এই প্যামফ্লেট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বনজ ওষুধের পুরনো ব্যবসার প্রচার এ-যাবৎ তেমনি পুরনো ধাঁচের ছোট গণ্ডীর মধ্যে আটকে ছিল। পাঁজির পাতায় বা ক্বচিৎ কখনো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা যেত। এ-সব জায়গায়ও পাতা-জোড়া প্রচারের সংকল্প বাপীর মাথায় আছে। তার আগে এইগোছের চটকদার প্রচার এ-লাইনে কমই দেখা গেছে। ফার্মের চকচকে ক্যালেন্ডার আর ফ্যাশানের ডায়েরি তাদের নজর কেড়েছিল। আর্ট পেপারে ছাপা প্যামফ্লেট ছড়ানোর ফলে কলকাতার বাজারে রাই অ্যান্ড তরফদারের আসন্ন পদার্পণের ঘোষণা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। জিতের খবর, মালিক আসছে জেনে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন শুধু বানারজুলি থেকে মাল চালান আর স্যাম্পল্ আসার অপেক্ষা।

—সে-সব তুমি সামনের সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবে। গোডাউন ঠিক করেছ?

জিত্‌ সায় দিয়ে জানালো, দুটো গোডাউন দেখে রাখা আর ল্যান্ডলর্ডের সঙ্গে কথা বলে সময় নেওয়া হয়েছে। এখন মালিকের যেটা পছন্দ। এ-ছাড়া চৌরঙ্গীর কাছাকাছি এলাকায় আর পার্ক স্ট্রীটের দিকে কিছু ফারনিশড্ ফ্ল্যাটও দেখা হয়েছে। ‘ভাড়া অনেক। পছন্দ হলে পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।

ফ্ল্যাট খোঁজার কথাও বাপী তাকে লিখেছিল। বলল, কাল-পরশুর মধ্যে সব ঠিক করে ফেলব। ভাবল একটু। কাল সকালে—না কাল শনিবার, বারোটার মধ্যে ব্যাঙ্কের কাজ সারতে হবে। দুপুরের দিকে তাকে আসতে বলে দিল। ভবানীপুরের দিকের কোনো মেসে একটা ঘরভাড়া নিয়ে আছে ও। মনে পড়তে হঠাৎ কৌতূহল একটু।—তোমার মেস ঠিক কোন্ জায়গায় বলো তো?

জিত্‌ হদিস দিতে মনে হল টালি এলাকার কাছাকাছিই হবে।—ব্রুকলিন পিওন রতন বণিক কপাল যাচাই করে প্রথম থেকে অন্ধ বিশ্বাসে তার রাজার ভাগ্য ঘোষণা করেছিল। আর চলে আসার দিনও বলেছিল, কপালের রং আগের থেকে ভালো হয়েছে, আর বলেছিল আমার কথা মিলিয়ে নেবেন, দিন ফিরলে ভুলবেন না যেন।

দিন ফিরেছে। বাপী ভোলেনি। সেই কৃতজ্ঞতায় ওরও কপাল ফেরানো, দিন ফেরানোর ইচ্ছে। আগের বারে এসেও এমনি তাগিদ অনুভব করেছিল। এবারও হেঁটেই দিতে হল।…ভুলবে তো নাই কোনদিন। প্রবৃত্তির শেকলের দাগ এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে, ভুলবে কেমন করে। পরে দেখা যাবে। পরে যা হয় হবে।

—আচ্ছা আজ এসো।

একটু ইতস্তত করে জিত্ উঠে দাঁড়ালো। মনিবের দিকে আর একবার তাকিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

তক্ষুনি নিজের চোখ যাচাইয়ের ঝোঁক বাপীর। ডাকল, শোনো—

ফিরল।

—বোসো। কিছু বলবে? আরো কিছু যে বলতে চেয়েছিল মালিক বুঝল কি করে ভেবে পেল না। দ্বিধা কাটিয়ে জিত্ জানালো আবু সাহেব অন্য মালের ব্যাপারেও কিছু খোঁজখবর নিতে বলে দিয়েছিল। তাও নেওয়া হয়েছে—

বাপী তক্ষুনি বুঝে নিল অন্য মালটা কি। ভুটান সিকিম বা নেপালের মদ। ট্রাক যখন আসবেই, লাভ বুঝলে এ-দিকটাও চালু রাখতে অসুবিধে নেই। এই ব্যবসা এখন পুরোপুরি আবুর এখতিয়ারে। লাভের আধাআধি বখরার শর্তে বাপী শুধু পুঁজি অর্থাৎ টাকা যুগিয়ে খালাস। এ-ছাড়া আর কোনো দায়দায়িত্ব বা সংস্রব নেই।

নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, বাজার কেমন?

শুনল, বাজার খুব ভালো। বানারজুলির থেকে ঢের ভালো। যতগুলো লিকারশপের মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, দামের আঁচ পেয়ে সকলেই এক কথায় রাজি। জিনিস কেবল তাদের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।

এ-কাজেও লোকটার এমন তৎপরতা দেখে বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো একটু। জিগ্যেস করল, তুমি ড্রিংক করো?

—না, সার।

—শিওর—নো?

এবারে একটু জোরের সঙ্গে জবাব দিল, আপনি একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, মিসেস গায়ত্রী রাইয়ের কাছে আমার সম্পর্কে চালিহা সাহেবের সেটাই বড় সার্টিফিকেট ছিল।

বাপী আর জেরা করল না। এত বলার দরকার ছিল না, সত্যি না হলে মুখ দেখে বুঝতে পারত। বলল, ঠিক আছে, এ সম্পর্কে পরে ভাবব, আবুকে চিঠিপত্রে কিছু লেখার দরকার নেই।

মালহোত্রা চলে গেল। যতটা আশা করেছিল লোকটা তার থেকেও ভালো উৎরোবে মনে হল বাপীর। আকাঙ্ক্ষা বড় বলেই দ্বিতীয় দফা চাকরি ছেড়ে এই ঘাটে নৌকো বেঁধেছে। নিজের দায়েই সেটা অক্ষত রাখতে চাইবে।

আরো অনেকক্ষণ শুয়েই কাটিয়ে দিল। বাইরের অন্ধকার ঘরে সেঁধিয়েছে উঠে আলো জ্বালল। নোটবই খুলে একটা টেলিফোন নম্বর বার করে ঘরের রিসিভার তুলে কানেকশন দিতে বলল।

একটু বাদে ও-প্রান্ত থেকে চেনা গলা ভেসে এলো।

—ছোট কোবরেজ মশাই?

—বলছি—আপনি?

এধারে বাপীর গলা আরো গুরুগম্ভীর।—প্রেয়সীর খবর কি—ঘরে ডেকে গান-টান শোনাচ্ছে আজকাল, না এখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতে হচ্ছে?

কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্তের পর ও-দিক থেকে নিশীথ সেনের গলা আছড়ে পড়ল।—বাপী তুই! আচ্ছা চমকে দিয়েছিলি মাইরি। তারপরেই খাটো গলা।— ও-সব কথা আর মুখেও আনিস না ভাই, আমি ফেঁসে গেছি, এই গলায় যে ঝোলার সে ঝুলে পড়েছে—

বাপী যেন ধাক্কাই খেল একটু।—কে ঝুলল, তোর বাবার পছন্দের সেই টাকাঅলা মুদির পুঁটলি?

—আর বলিস না ভাই। লজ্জায় তোকে একটা খবরও দিতে পারিনি।—ভদ্রলোক মানে বউয়ের বাবা হঠাৎ শক্ত অসুখে পড়ে যেতে নিজের বাবাটি একেবারে মাথায় চেপে বসল। কি আর করব, দুগ্‌গা বলে ঝাঁপিয়েই পড়লাম। ভদ্রলোকের ছেলে তো নেই, তিনটেই মেয়ে—অসুস্থ শ্বশুরের সঙ্গে সকালের দিকে এখন দোকানেও বসতে হচ্ছে। যাকগে, হুট-হুট করে কখন আসিস কখন যাস জানতেই পারি না—তোর খবর কি?

—ভালো।

নিশীথের গলার স্বর উৎসুক একটু।—এখানে তোদের রিজিয়ন্যাল অফিস হচ্ছে এবার?

—ঠিক নেই। ছাড়ি, খুব ব্যস্ত এখন।

—শোন, সেই হোটেলেই উঠেছিস নাকি? কবে দেখা হবে?

—আমি তোকে ফোন করব’খন, এখন বেজায় তাড়া, ছাড়ি

রিসিভার নামিয়ে আবার বিছানায় চিৎপাত। ফোন করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এখানকার ম্যানেজারের চেয়ারে নিশীথ সেনকে বসানো স্থির ছিল। ওদের সামনের বাড়ির সেই বি. এ. পাশ করা মিষ্টি গান করা আধুনিকা সুশ্রী মেয়েই যদি নাকসিঁটকে কবিরাজের ছেলেকে বাতিল করে দিত, বাপী এমন অকরুণ হত না। ফোনে এই শোনার পর নিশীথ সেনের অস্তিত্বসুদ্ধ বাতিল।

কলকাতার বাতাস ঠিক এই সময়ে কতটা উত্তপ্ত বাপীর ধারণা ছিল না। পরদিনই টের পেল। দিন বারো আগে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হঠাৎ মৃত্যুর খবর কাগজে দেখেছিল। ছ’ সপ্তাহ যাবৎ শ্রীনগরে আটক ছিলেন। সেখানেই অঘটন। পশ্চিম বাংলার মানুষ এই মৃত্যুকে সাদা চোখে দেখেনি। অসন্তোষের আগুন তখন থেকেই ধিকি ধিকি জ্বলছে। দিল্লিতে বসে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আটক অবস্থায় এই সংগ্রামী নেতার জীবনান্তের কারণে তাঁর বেদনাবোধের কথা বলেছেন। কিন্তু এই মৃত্যু নিয়ে হাজার হাজার বাঙালীর তদন্তের দাবি সম্পর্কে তিনি নিরুত্তর। অসন্তোষ বাড়ছে। সাধারণ মানুষ ক্রোধে গজরাচ্ছে। ঠিক এই সময়, অর্থাৎ বাপী আসার পরদিনই সমস্ত কলকাতা দপ করে জ্বলে উঠল আর এক উপলক্ষে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের এক পয়সা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখানকার সরকারের তাতে অনুমোদন ছিল। ফলে ক’দিন যাবৎ একটা প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। স্নায়ু এমনি তপ্ত সকলের যে অতি নিরীহ যাত্রীও এক পয়সা বেশি দিতে নারাজ।

কলকাতায় আসার তাড়ায় আগের দু’দিনের কাগজ উল্টে দেখারও সময় হয়নি বাপীর। গতরাতে রেডিওর খবরও শোনার মেজাজ ছিল না। সকালের কাগজ খুলে দেখে, কলকাতায় সেদিন ওই এক পয়সা ট্রামভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বামপন্থীদের স্বার্থের কথা বলে পাল্টা কটাক্ষ হেনেছেন। জনসাধারণের কাছেই এই হরতাল বানচাল করার আবেদন পেশ করেছেন।

কলকাতার এই বাতাস বাপী চেনে না। ক্ষ্যাপা কলকাতার এই চেহারা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা ছিল না। শুধু একদিন নয়, পর পর আরো ক’টা দিন হোটেল-বন্দী হয়ে থাকল। চারদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে, রক্ত ঝরছে। ট্রাম পুড়ছে, সরকারী বাস পুড়ছে। নগর জীবন স্তব্ধ, অচল। হরতালের পরদিনই বিধান রায় য়ুরোপ চলে গেছেন। তাঁর সেখানে চোখের অপারেশন। এই অনুপস্থিতিতে হাল যাঁরা ধরেছেন, জনমতের দিকে না চেয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনার তাগিদে তাঁরা পুলিশের পৌরুষের ওপর নির্ভর করেছেন। এই ভুলের মাশুল বেড়েই চলল। এক পয়সার যুদ্ধের সমস্ত নেতার সঙ্গে হাজারের ওপর বিক্ষুব্ধ মানুষ জেলে। কিন্তু মানুষ ক্ষেপলে জেলই বা কত বড়? ফলে লাঠি টিয়ারগ্যাস গুলি—খুন-জখমের তাণ্ডব।

বাপী আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে আবুকে মালের ট্রাক ছাড়তে নিষেধ করেছে। এই বিপাকে গোডাউনই ঠিক করা হয়নি, মাল এনে করবে কি। ব্যাঙ্কের কাজ অবশ্য সেরে রাখতে পেরেছে। চৌরঙ্গী এলাকার কয়েকটা ব্যাঙ্কে নগদ টাকার কাঁড়ি জমা করে দিয়েছে। জিত্‌ মালহোত্রা হেঁটে হলেও একবার করে আসে। তার তৎপরতায় এর মধ্যেই ভালো একটা ফ্ল্যাটও বুক করা গেছে। চৌরঙ্গীর কাছাকাছি অভিজাত এলাকা। এখন পর্যন্ত বাঙালীর বাস কম। মস্ত ম্যানশানের রাস্তামুখো তিনতলার ফ্ল্যাট। লিফট আছে। একতলায় গ্যারাজ। সামনে প্রকাণ্ড ফারনিশড হল। ও-ধারে দুটো বড় বেডরুম। পরিপাটী ব্যবস্থার কিচেন আর ঝকঝকে বাথরুম।

মাস কয়েকের মোটা ভাড়ার আগাম দাবি মিটিয়ে বাপী চোখকান বুজে চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছে। গণ্ডগোলের দিন না হলে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে উঠে আসা যেত। বাপীর তাড়ায় ফ্ল্যাটের মালিক আশ্বাস দিয়েছে, মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে করে হোক হোয়াইটওয়াশ আর ঝাড়ামোছা সেরে ফ্ল্যাট তার বাসযোগ্য করে দেবে।

ঊর্মিলার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। বিজয়ের সঙ্গে ফোনে দু’দিন কথা হয়েছে। ওর অফিসে এসে ঊর্মিলাও গতকাল ফোনে কথা বলেছে। তাদের ওখানে চলে আসার জোর তাগিদ ওর। এই গণ্ডগোলের মধ্যে হোটেলে বসে কি করছে? তাদের ওখানে চলে আসছে না কেন? ফ্যাকটরি কোয়ার্টার্স এলাকার মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত। দু’খানা ঘরের একটা খালি পড়ে আছে জেনেও ফ্রেন্ড হোটেলেই উঠতে গেল কেন?

সম্ভব হলে বাপী আজ যাবে ঠিক করেছে। আর কিছু না হোক, ওদের গাড়িটা এখনি দরকার। নিজের দখলে একটা গাড়ি থাকতে এতটা পঙ্গু মনে হত না। ট্যাক্সি পাওয়াও দুর্ঘট এখন। বেলা থাকতে যাবে ঠিক করেছিল। বিকেলের দিকেই গণ্ডগোলটা বেশি হচ্ছে। সকালে গিয়ে লাভ নেই। বিজয় মেহেরাকে অফিস থেকে টেনে বার করা যাবে না। সব ঠাণ্ডা থাকলে চলেই আসবে। বাপীর রাতে কোথাও থাকার ইচ্ছে নেই।

আড়াইটে নাগাদ বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে সামনের ময়দান আর চৌরঙ্গী এলাকার খানিকটা দেখা যায়। এই ক’টা দিনের মধ্যে অস্থির কলকাতা সম্পর্কে বাপীর কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই জানালায় দাঁড়িয়েই দিনের হাওয়া টের পায়। ট্রাম চলাচল সেই শুরু থেকেই বন্ধ। শান্তি-শৃঙ্খলায় ঘা পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ট্যাক্সি এমন কি রিকশও রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়।

ভারী পর্দাটা ঠেলে সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাপীর গলা দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ বেরিয়ে এলো। যাওয়ার বারোটা বেজে গেল। কোথাও ঘটছে কিছু। নিচের ফুটপাতে আর সামনের ময়দান ভেঙে কাতারে কাতারে মানুষ চলছে। লোকগুলো কিছু তাড়া খেয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত। বাস চলছে এখনো, কিন্তু তার ছাদে পর্যন্ত মানুষ।

ঘরের দরজা বন্ধ করে বাপী নেমেই এলো তবু। হোটেলের বাইরের সামনের গাড়ি-বারান্দার নিচে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার মিছিল দেখতে লাগল। ঘটনা কি তাও কানে এলো। ডালহৌসি স্কোয়ারে এক পয়সার বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চালিয়েছে। কত লোককে শুইয়ে দিয়েছে ঠিক নেই। কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর মুখ দেখছে বাপী। কোথায় কোন মুহূর্তে আবার আগুন জ্বলে সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার তাড়া তাদের। কিন্তু তার মধ্যেও চোখে-মুখে জমাট-বাঁধা ক্রোধ। হয়তো বা ঘৃণাও। সামিল হবার সাহস হয়তো নেই। কিন্তু ক্ষমতার মত্ত আঘাত তাদেরও বুকে বাজছে।

ভিতরে কোথায় মোচড় পড়ছে বাপীরও। এই মানুষগুলোর থেকে, আর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে যার শাসনের আঘাতে মাটিতে মুখথুবড়ে পড়ছে তাদের থেকে ও যেন বিচ্ছিন্ন; এই বিচ্ছেদের একটা অচেনা যন্ত্রণা ওকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। একটা পয়সা—শুধু একটা পয়সার জন্য এমন ঝড় এমন তাণ্ডব? তা কক্ষনো হতে পারে না। এই একটা পয়সা হয়তো অনেক বঞ্চনা অনেক অবিচারের প্রতীক তাই যদি হয়, যত ঐশ্বর্যই থাকুক বাপীর অন্তরাত্মা এদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

—কি ব্যাপার? এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছ?

হাত ধরে একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি দিল ঊর্মিলা। ফুটপাতের ধারে ক্রিম রঙের চকচকে একটা মরিস মাইনর গাড়ির দরজা বন্ধ করে বিজয় মেহেরাও এদিকে আসছে।

ঊর্মিলা অত মানুষকে পথ চলতে দেখে সভয়ে আবার জিগ্যেস করল, গণ্ডগোলের ব্যাপার নাকি কিছু?

—হ্যাঁ, ডালহৌসিতে জোর লাঠি-চার্জ হচ্ছে শুনলাম। তোমাদের কাছে যাব বলে তৈরি হয়ে আজও আটকে গেছি…এর মধ্যে আবার তোমরা এসে হাজির হলে।

কথায় সময় নষ্ট না করে ঊর্মিলা তাকে গাড়িতে ঠেলে নিয়ে সামনের সীটে তুলল। পরে নিজেও তার পাশে বসে পড়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে বিজয়কে তাড়া দিল, হাঁ করে দেখছ কি— জলদি চালাও!

সামনে তিনজন সহজভাবে বসার মতো বড় নয় গাড়িটা। ওদের দু’জনকে সামনে বসতে দেখেই বিজয় হয়তো থমকে ছিল একটু। তাড়াতাড়ি ঘুরে এসে নিজের আসনে বসে গাড়ি ছোটাল। ঊর্মিলা বলে উঠল, আর ভালো লাগে না বাপু, রোজ এই এক কাণ্ড লেগে আছে—হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।

গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বিজয় বলল, হাড়পিত্তি আমারও জ্বলে যাচ্ছে, তুমি দুজনের মাঝখানে বসলে আধাআধি ভাগ পেতাম।

ছদ্ম কোপে ঊর্মিলা বলল, দেব ধরে গাঁট্টা।

বাপী হাসল মনে মনে। যখন যার যেমন জগৎ। বিজয়কে বলল, বেশি হাড়পিত্তি জ্বললে গাড়ি থামাও, আমি পিছনে গিয়ে বসছি।

ঊর্মিলাও এবার হেসেই সায় দিল, তাহলে দুজনেই পিছনে যাই চলো। এই যাঃ! জিব কাটল।—ভেবেছিলাম হাসব না, কম করে ঘণ্টাখানেক তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব।

বিজয় ফোড়ন কাটল, আমার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টাই করছে তাই অরুচি ধরে গেছে।

জবাবে ঊর্মিলা বাপীর পিছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিজয়ের চুলের গোছা টেনে ধরল।

পথে আর কোয়ার্টার্সে পৌঁছনোর পরেও বাপী অনেকবার ওদের ঝগড়া দেখল। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়। যেমন, ঊর্মিলা বাপীকে বলল, আমার খপ্পরে পড়েছ, এখন সাতদিনের মধ্যে তোমাকে ছাড়ছি না।

বাপী বাধা দেবার আগে বিজয় বলল, বাইরে যাবার মুখে আমি এখন অত ছুটি পাচ্ছি কোথায়?

—তোমাকে ছুটি নিতে কে বলেছে? সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার জবাব।

—দেখলে, দেখলে? বাপীকেই সালিশ মানল বিজয়। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, তোমার তেমন তাড়া থাকে তো আজই চলে যেতে পারো—আমিই না হয় পৌঁছে দিয়ে আসব।

ওদের গাড়িটা বাপীর সত্যি খুব পছন্দ হয়েছে। দেখতে যেমন, চলেও জলের মতো। বাপীর মুখে প্রশংসা শুনে ঊর্মিলা চা খেতে খেতে বিজয়কে বলল, এত যখন পছন্দ হয়েছে, গাড়িটা এমনি দিয়ে দাও না ওকে, তবু মনে থাকবে—

কথা শেষ হবার আগেই গম্ভীর ঝাঁঝের সুরে বিজয় বলল, যে দরে কিনেছি তার থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি লাগবে।

এই ঝগড়ার তলায় তলায় যা সেইটুকু আস্বাদের বস্তু। বাপীর ভাবতে ভালো লাগছে, গায়ত্রী রাইও কোথাও থেকে ওদের এই খুনসুটি দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে।

ঊর্মিলার রাগারাগিতে কান না দিয়ে পরদিন চা-পর্বের পরেই বাপী চলে এলো। বিকেলের মধ্যেই আবার ফিরবে কথা দিল। গাড়িটা তার এক্ষুনি চাই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে কিছু বোঝার আগেই বিজয়ের পকেটে গুঁজে দিয়েছে। দুজনের কারো আপত্তি কানে তোলেনি। বিজয়কে বলেছে, তুমি, কেনা বেচা সইসাবুদের ব্যাপার করো বসে বসে, আমি গাড়ি নিয়ে আজই চললাম।

ঊর্মিলা এই রাতেও ছাড়েনি ওকে। খাবার টেবিলে ঊর্মিলার মুখেই টগবগ করে বেশি কথা ফুটছিল। হঠাৎ থেমে গিয়ে আড়ে আড়ে বাপীকে দেখতে লাগল।

—কি হল?

—একটা কথা মনে পড়ল। গোটা ব্যবসাটাই এখন তোমার। যা আছে তাই নিয়ে বানারজুলিতে বসেই রাজার হালে কাটিয়ে দিতে পারতে। হঠাৎ‍ কলকাতায় জাঁকিয়ে বসার ইচ্ছে কেন?

বাপী হাল্কা সুরেই ফিরে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ধারণা?

—আমার ধারণা, এখনো তোমার মাথায় মতলব কিছু আছে।…এবারে এসে দেখা হয়েছে?

বাপী ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হঠাৎ। গেলবারে বানারজুলিতে এসে জেরার মধ্যে ফেলে ঊর্মিলা মিষ্টির বিয়ের খবর শুনেছে। তখন বেশ দুঃখও হয়েছিল ওর।

—কি বাজে বকছ!

—বাজে বকছি? তুমি শুধু আরো বেশি রোজগারের নেশায় এখানে জাঁকিয়ে বসছ?

আলতো করে বিজয় বলল, বসলেই বা। যে মতলবই থাক, আমি তো তোমাকে নিয়ে এ-মাসের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছি! তোমার নাগাল পাচ্ছে কোথায়?

রাগতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকালো। ঠোঁটের ফাঁকে দুষ্টু-দুষ্টু হাসি। ওর দিকে চেয়েই জবাব দিল, প্রেমে ঘা পড়লে কেউ কেউ কোন্ মূর্তি ধরতে পারে জানলে তুমি হার্টফেল করতে। বাপীর দিকে ফিরে চোখ পাকালো, বলে দেব?

পরক্ষণে সামলে নিল। একটা যন্ত্রণার আঁচড় পড়েছে বুঝতে সময় লাগল না। বলল, থাক বাপু ঘাট হয়েছে, এই কানে হাত দিচ্ছি, আর বলব না।…আসলে তোমাকে আমি একটু একটু ভয়ও করি, তাই তোমার জন্যে ভাবনা বুঝলে? বোঝেনি কিছুই শুধু বিজয়। তবু সে-ই চেঁচিয়ে উঠল, আমি কিন্তু এবার হার্টফেল করছি!

ওরা যাবার আগে ঘন ঘন আসবে কথা দিয়ে পরদিন বিকেলে ঝকঝকে মরিস মাইনর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সকালে বিজয়ের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক মহড়া দিয়েছে। হাত অভ্যস্ত এখন। এমন একটা গাড়ি নিজস্ব হবার ফলে মেজাজ খুশি। খানিকটা পথ এগোতে সেই খুশিতে হঠাৎই কিছু সঙ্কল্পের ফল ধরল।

দক্ষিণের পথ ধরে ফিরতে লাগল। মিনিট পঁচিশের মধ্যে সেই পরিচিত রাস্তায়। সাতাশি নম্বর বাড়িটা লক্ষ্য। ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজে। সুদীপ নন্দী অনেক আগেই কোর্ট থেকে ফিরেছে নিশ্চয়। আশা করছে তাকে বাড়িতে পাবে। তার মা-কেও পাবে। আজই যেন তাদের সঙ্গে দেখা করার ঠিক দিন। ঠিক সময়।

খানিক দূর থেকে গাড়ির স্পিড কমালো। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। তাহলেও তেমন অস্পষ্ট নয় এখন পর্যন্ত। বাপীর আশা দীপুদাকে বা তার মা—কে বা দুজনকেই দোতলার বারান্দায় দেখবে।…ও দেখবে না, তারা ওকে এই গাড়ি থেকে নামতে দেখবে।

নেই।

খানিক আগে আপনা থেকেই ব্রেকে চাপ পড়তে গাড়িটা প্রায় থেমে গেল। প্যান্ট কোর্ট পরা যে মানুষটা ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে সামনে এগিয়ে চলল, ব্রেকে চাপ পড়েছে তাকে দেখে।

….ফর্সা মুখ। সোনালী চশমা। আরো অনেক দূর থেকে দেখলেও ভুল হবার নয়। অসিত চ্যাটার্জি। যার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মিষ্টি এখন মালবিকা চ্যাটার্জি। বাপী গাড়িটা থামিয়েই দিল। লোকটা যে মুখ করে ওই সাতাশি নম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আর যে-ভাবে দু’পায়ে মাটি দাপিয়ে চলেছে তাই থেকে মেজাজ আঁচ করা যায়। জামাই-অভ্যর্থনা নিয়ে যে বেরোয়নি সেটুকু স্পষ্ট।

দু’মিনিটের মধ্যে সামনের বাঁক ধরে চোখের আড়াল হতে বাপীর গাড়িও নড়ল। কিন্তু সাতাশি নম্বর বাড়ির দোরে আর থামল না বা সেদিকে তাকালোও না। সোজা বেরিয়ে এসে সে-ও বাঁক নিল। এই হঠাৎ-দর্শনে মগজের প্ল্যানও বাঁক ঘুরেছে।

গাড়িটা যে-ভাবে একেবারে পাশ ঘেঁষে ঘ্যাঁচ করে থামল, লোকটা চমকে দাঁড়িয়ে গেল। রাগ উপচে ওঠার আগেই বিস্ময়ের ধাক্কা। বাপী হাসছে অল্প অল্প। পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, খুব অচেনা মনে না হলে উঠে পড়ো!

.

চকচকে গাড়িটা এক নজরে দেখে নিয়ে অসিত চ্যাটার্জি খোলা দরজায় এক হাত রেখে ঝুঁকল একটু। সোনালি ফ্রেমে আঁটা কাঁচের ওধারে চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল। বাপীর মুখ হাতড়ে অপ্রীতিকর কোনো ব্যাপারের হদিস পাচ্ছে যেন। গলার স্বরেও তেমনি আঁচ-লাগা বিস্ময়। তুমি এখানে তাহলে?

বাপী সত্যি অবাক।—তাহলে মানে?

চোখের তাপ মুখে ছড়াচ্ছে।—বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? কবে আসা হয়েছে?

বাপী মিথ্যে কথা সচরাচর বলে না। কিন্তু জবাব যা দেবে তা আরো কারো কানে ওঠার সম্ভাবনা। কলকাতায় এসেছে আজ হাতে গুণে ন’দিন। অম্লান বদনে বলে ফেলল, তা মাস দেড়েকের ওপর হবে। কিন্তু ব্যাপার কি…তোমরা সব আছ কেমন?

দেড় মাসের ওপর এসেছে শুনে হোক বা সাদা বিস্ময়ে খবর জিজ্ঞাসা করার দরুন হোক, লোকটা থমকালো একটু। কিন্তু চাউনি সন্দিগ্ধ তার পরেও। এতদিন এসেছ, মিলুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?

মিলু শুনে কানের পর্দা আজও চিড়চিড় করে ওঠল। কিন্তু মিলু ছেড়ে মিষ্টি শুনলে আরো অসহ্য মনে হত। ভেবাচাকা খাওয়া নিরীহ মুখ বাপীর। দেখা হলে তোমার না জানার কথা নাকি। আসার দিনে ইনফরমেশান কাউন্টারে তাকে না দেখে আমি তো ধরে নিয়েছি দিল্লির সেই চাকরি পেয়ে সেখানে চলে গেছে।

কি কারণে ওকে দেখামাত্র লোকটার এমন সন্দিগ্ধ আচরণ বাপী ঠাওর করতে পারছে না। এই জবাবের পর খানিকটা ঠাণ্ডা। তবু আরো কিছু সংশয়ের অবকাশ আছে যেন। আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে আছ, এখানকার এরাও জানে না?

—এরা কারা?

—মিলুর দাদা আর মা?

এবারের জবাবে স্পষ্ট বিরক্তি।—কি বাজে বকছ, তাদের নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর সময় হয়নি, কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়ারও ফুরসৎ মেলে না। রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তোমার অত জেরা শোনারও ধৈর্য নেই আমার, উঠবে তো ওঠো, নয়তো সরো।

দাবড়ানি খেয়ে ধাতে ফিরল। বাপীর মনে হল, সেই সঙ্গে একটা আশঙ্কাও দূরে সরল। তাড়াতাড়ি পাশের আসনে বসে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল।

বাপী এনজিন বন্ধ করেনি। সামনের দ্বিতীয় বাঁক ঘুরে বড় রাস্তায় পড়তে—গাড়ির ভিতরটা এক নজর দেখে নিয়ে অসিত চ্যাটার্জি জিগ্যেস করল, বিলিতি

গাড়ি নিজে চালাচ্ছ…কিনলে নাকি?

জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিল।

এমন ভাগ্যও ঈর্ষার বস্তু।—তুমি তাহলে কলকাতাতেই থাকছ এখন …ব্যবসার নতুন কিছু চার্জ নিয়েছ নাকি?

—চার্জ আর কার থেকে নেব…সমস্ত ব্যবসাটাই আমার এখন। এখানে নতুন সেন্টার খুলেছি। তুমি এখন আর কোথাও যাবে, না আমার ওখানে বসবে একটু?

—তোমার ওখানে মানে সেই হোটেলে?

—আপাতত তাই। ফ্ল্যাটও পেয়েছি একটা, শিগগীরই উঠে যাব।

—কোথায়?

বলল।

—এসব জায়গার ফ্ল্যাটের তো অনেক ভাড়া!

—খুব না, মাসে আটশ। সুবিধে হলে কিনে ফেলার ইচ্ছেও আছে।

বলার উদ্দেশ্য সফল। এমন পর্যায়ের মানুষকে হিংসে আর কত করবে। হৃদ্যতা বরং কাম্য। চোখে লোভ, ঠোটে হাসি।—সেবারের মতো ভালো জিনিস ঘরে আছে?

বাপী গাড়ি চালাচ্ছে তাই সামনে চোখ। হেসেই জবাব দিল, তুমি হলে গিয়ে আমার হীরো, চাইলে এসে যেতে কতক্ষণ।…আচ্ছা অসিতদা, আমাকে দেখেই তোমার মেজাজখানা অমন খিঁচড়ে গেল কেন?

লজ্জা পেল।—মন-মেজাজ সত্যি একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে আছে। তুমি কিছু মনে কোরো না ভাই, এরা দিনকে দিন মাথায় চেপে বসছে।

—এরা বলতে?

—আর কে, মিলুর দাদা আর মা।

জেনেও অবাক হওয়ার ভান করল বাপী।—তুমি এখন ওঁদের ওখান থেকে নাকি?

—হ্যাঁ। আজ এক হাত হয়ে গেল।

এক হাত হয়ে গেল বলে ওকে দেখে অমন তিরিক্ষি আর সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল কেন, বাপী ফিরে আর তা জিগ্যেস করল না। তার তাড়া নেই। হোটেলে নিয়ে গিয়ে ফেলার পর খোলস থেকে ভিতরের মানুষটাকে টেনে বার করতে সময় লাগবে না। বলল, গুলি মেরে দাও, তোমার মাথায় চেপে বসতে চাইলে আবার জন্মাতে হবে। কাজ-কর্ম কেমন চলছে বলো।

ফর্সা মুখে খুশির ঢল নামল। যত টাকাই করুক ছেলেটা সত্যিকারের সমঝদার বটে। চাকরিতেও লোককে বলার মতো মোটামুটি পদস্থ এখন। এক নামী তেল কোম্পানীর চীফ অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে বসেছে। বিলিতি কোম্পানী। মালিকানার বেশির ভাগ এখনো সাহেবদেরই হাতে। সুপারিশের জোর ছিল না, তিন-তিনটে ইন্টারভিউর বেড়া টপকে নিজের বিদ্যেবুদ্ধির জোরে কাজটা পেয়েছে। ফর্সা মুখ আত্মতুষ্টিতে অমায়িক আরো।—সাহেবদের ইন্টারভিউ বোর্ডে এই চেহারাও কিছু কাজ করেছে অবশ্য, তাহলেও ও-দেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট থেকে আমাদের রেজিস্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট যে কম কিছু নয় এটা তাদের বুঝতে হয়েছে।

বাপীর চোখেমুখে প্রশংসার বন্যা। গাড়ি চালানোর ফাঁকে দুই-একবার না তাকিয়ে পারল না। বলল, তুমি ঢের বড় হবে অসিতদা, আমি খুব ভালো করেই জানতাম। এসব ব্যাপারে আমার একটা সিক্সথ সেন্স আছে।..মাইনে এখন তাহলে অনেক পাও?

খুশিতে বিগলিত হতে গিয়েও থমকালো। হাজার টাকার মত পাচ্ছে আপাতত। চাকরির বাজার যা, সাধারণ দশজনের চোখে অনেকই বটে। কিন্তু এই লোক ফ্ল্যাট ভাড়াই দেয় মাসে আটশ টাকা। তার এই গাড়ি আর এত বড় ব্যবসার মালিক। জবাব দিল, মন্দ নয়, উন্নতিও আছে…তা হলেও তোমার কাছে আর অনেক কি!

—ছাড়ো তো। ক-অক্ষর গো-মাংস অনেক আলু-পটোলের কারবারীও ঢের টাকা রোজগার করে, তা বলে তারা অসিতদা হয় না। বাবার টাকায় বিলেতে গিয়ে পার্টিগুণে ব্যারিস্টার হয়ে আসা থেকে তো ঢের ভালো।

এমন জায়গায় সুড়সুড়ি পড়ল যে অসিতদাটি আধাআধি তার দিকে ঘুরে না বসে পারল না। শুধু কান আর বুক দিয়ে নয়, দুটো চোখ দিয়েও স্বাদ নেবার মতো কথা। ফর্সা মুখে হাসি ছুঁয়ে পড়ছে।

হোটেলে এসে বাপী এবারও আস্ত বিলিতি বোতল আনালো একটা। সঙ্গে জিভ টসটস করার মতো বাছাই খাবার! মাখন গলা আব্দারের সুরে অসিতদা বলল, আজ কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে একটু খেতে হবে।

—খাব যখন তোমার কাছেই হাতেখড়ি দেব, আজ না—মহাগুরু নিপাত দশার এক বছর না কাটলে ওসব হাত দেবার উপায় নেই।

—থাক তাহলে, থাক। অসিতদার গলায় অন্তরঙ্গ সহানুভূতি।—মহাগুরু মানে তোমার বাবা-মায়ের কেউ?

—না, আমার ভাগ্যের ইষ্টদেবী। মনে মনে বলল, মা গায়ত্রী রাই দোষ নিও না। ওই ইষ্টদেবীটিকে স্মরণ করার সময় আগে বা পরে মা জুড়ে দিতে বাপীর বেশ লাগে।

পানাহার দ্রুততালে জমে উঠলে লাগল। ঘরের সবুজ আলো জ্বেলে বাপী সাদা আলো নিভিয়ে দিল। যে সময়ের যে পরিবেশ। অসিতদা এই বিবেচনাটুকুরও তারিফ করল। দ্বিতীয় গেলাসও আধা-আধি শেষ হতে সময় লাগল না। একটু বাড়তি মর্যাদা দেবার সুরে বাপী বলল, তুমি তো তাহলে দিব্বি ভালো আছ এখন অসিতদা—

কাবাবে কামড় দিয়ে হেসেই তাকালো। চোখের তারা সবে বড় হতে শুরু করেছে।—কেন বল তো?

—নিজে এমন একখানা চাকরি করছ, মি—মা-মানে তোমার মিলুও ভালো কাজ করছে, তোমার আর ভাবনা কি!

মিষ্টি বলতে গিয়েও শুধরে মিলু বলল। ওই মুখে এই নাম হামলার মতো শোনাবে। গেলাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে তরলানন্দে অসিতদা বলল, মিলুরও একটা প্রমোশন হয়েছে জানো তো?

বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো একটু।—না তো…কি প্রমোশন?

—জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ হয়েছে। এখন এয়ারপোর্টে নেই, সেন্ট্রাল এভিনিউর আপিসে বসছে।

—গেলবারের সেই ইন্টারভিউতে ভালো করেছিল বুঝি?

—সেটা তো দিল্লির চাকরি। এখানেও চেষ্টাচরিত্র করছিল—হয়ে গেল। আবার এক চুমুক তল করে লালচে মুখে রসিকতার সুরে বলল, মেয়েদের চেহারাপত্রের জোর থাকলে সুবিধে যেচে আসে ভাই…তুমি স্বীকার করো কি করো না?

বাপী তৃতীয় দফা তার গেলাস ভরে দিতে দিতে অম্লানবদনে মাথা নেড়ে সায় দিল। ফলে ওই ফর্সা মুখের লাগাম আরো একটু ঢিলে।—আমি এ-কথা বললে মিলু আবার রেগে যায়, ওর ধারণা কাজ দেখাতে পারলেই উন্নতি হয়। আমার ভাই সাফসুফ কথা, কাজের আদ্ধেক তো যে অফিসারগুলো ছোঁকছোঁক করে ঘিরে থাকে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। কিন্তু বলতে গেলেই ফোঁস! তা হলে ও মেজাজ বিগড়োলে, আমি ছেড়ে কথা কই না।

শেষের ঝাঁঝালো অভিব্যক্তিটুকু থেকেই বোঝা গেল ওই কারণে অসিতদার মেজাজ বিলক্ষণ বিগড়োয়। এ-প্রসঙ্গ বাতিল করে খুশি গলায় বাপী বলল, যাক এমন যুগল উন্নতির খবর আমি কিছুই জানতাম না—কংগ্র্যাচুলেশনস!

রং-ধরা আবেগে অসিতদা অনুযোগ করল, তুমিই তো আমাদের ছেঁটে দিয়েছ, এতদিন হল কলকাতায় আছ একটা খবর পর্যন্ত দাওনি।

সময় বুঝে হালকা ঠাট্টার সুরে বাপী ঠেস দিয়ে বলল, আজ আমাকে দেখেই রাস্তায় তোমার যে মূর্তি দেখলাম, সেধে খবর দিতে গেলে ডাণ্ডা নিয়ে তেড়ে আসতে বোধ হয়।

—আরে না না। অন্তরঙ্গ দোসরের সংশয় মোচনের চেষ্টা। মিলুর ওই মা আর দাদার সামনে গিয়ে পড়লেই মাথায় আগুন জ্বলে আমার। সঙ্গে সঙ্গে অসিতদার বিরস বদন, ধরা গলা।—তারা আমার লাইফ হেল্ করে দেবার চেষ্টায় আছে ভাই, আর মিলুর কানে অনবরত বিষ ঢোকাচ্ছে।

বাপীর কান জুড়োচ্ছে।—খুব দুঃখের কথা। কিন্তু তা বলে রাস্তায় আমাকে দেখে তোমার অত রাগ কেন?

—তুমি আপনার জন, তোমাকে সব বলব ভাই—কিচ্ছু লুকোবো না।— ওখানে তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওরা যা চায় তুমি হাতে আছ বলেই চায়—

মেকি দাপটে কথার মাঝেই বাপী গলা চড়ালো।—আমি কোনো দিন কারো হাতে নেই—এই বান্দাকে চিনতে তাদের ঢের দেরি।

—জানি ভাই জানি। ভুলের জন্য তুমি এখন আমার গালে একটা চড় কষালেও রাগ করব না—তোমাকে সব বলব।

চতুর্থ গেলাস জঠরস্থ হতে গলগল করে অনেক দুঃখ আর অনেক রাগের কথা বলে গেল লোকটা। —মিলুর সঙ্গে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে খিটিরমিটির লেগেই আছে আজকাল। দোষের মধ্যে সে নেশা-টেশা করে আর একটু রেস বা জুয়াটুয়া খেলে। এ অভ্যেস বিয়ের আগে থেকেই ছিল, আর মিলু তা যে একেবারে জানত না তাও নয়। কিন্তু মা আর দাদা সর্ব্বোক্ষণ কান বিষোলে কাঁহাতক মাথা ঠিক থাকে? নইলে সব দোষ-গুণ মেনে নিয়েই ও কি তার কাছে আসেনি?—পাড়ার দামাল ছেলেরাও অসিতদার কথায় কেমন ওঠে-বসে, তার প্রতাপ কত মিলু সে—সব নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখত। সেই লোক যখন ফাঁক পেলে রাস্তায় লেকে বা কলেজে ওর ওপর চড়াও হত তখনো পছন্দ করত বলেই ছেঁটে দিত না। আর ওর আই-এ পড়ার সময় সেই লোকই যখন চিঠি লিখল তাকে বিয়ে

৫১৮

না করলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না, ও-মেয়ে তখন নিজে পার্কে ডেকে নিয়ে বলেছিল, আত্মহত্যা করতে হবে না, ভালো করে পড়াশুনা করো।—তারপর দুবাড়িরই অত বাধা সত্ত্বেও মিলু কি তার জীবনে আসেনি? এখন অত বিগড়ে যাচ্ছে কেন?

সব ওই মা-টির দোষ। ছেলে হবার সময় জামাই নাকি অভাবে আর অনাদরে তার মেয়েকে মেরেই ফেলার মতলবে ছিল। আরে বাবা, নিজের বউকে মেরে ফেলে তার কি লাভ? মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ী অপমান করে বাড়িতে ঠাঁই দেয়নি তাও জামাইয়ের দোষ। আর একটু নেশা-টেশা করে বলে যেন মেয়ে-খুনের আসামী সে। কিন্তু তাদের মেয়ে যে আপিসের পাঁচজন পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেয়, মাঝেমধ্যে রাত করে বাড়ি ফেরে, তা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই গোটা মহাভারতখানাই অশুদ্ধ হয়ে গেল একেবারে!

….মওকা বুঝে ব্যারিস্টার দাদাটিও সর্বদাই মায়ের কানে মন্ত্র জপছে। এমন অমানুষ জামাই আর হয় না। আসলে দাদুর কাছ থেকে পাওয়া মায়ের নামের অমন বাড়িখানা একলা গেলার মতলব তার। সর্বদাই মায়ের কানে ভাঙানি দিচ্ছে, বোনের নামে বাড়ির আদ্ধেক লিখে দিলে সেটা শেষ পর্যন্ত জামাইয়ের খপ্পরে গিয়ে পড়বে—বাড়িটাই তখন বেচে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। এমন সেয়ানা যে ঠিক জানে ডিভোর্সের ব্যাপারে বোন কান দেবে না—তাই মাকে বোঝায় এ বিয়ে ভেঙে দিয়ে বোনের নামে আদ্ধেক লিখে দিলে তার কোনো আপত্তি নেই।

—আজকের সমস্ত দিনটাই বড় খারাপ গেছে ভাই। পঞ্চম গেলাসে অসিতদার ধরা গলা।

কেন খারাপ গেছে তাও গলগল করে বলে গেল।…গত সন্ধ্যায় আপিস থেকে ফিরে মিলুকে বাড়িতে না দেখে বড় একলা লাগছিল। আর রাগও একটু হয়েছিল। তাই আড্ডায় চলে গেছল।

হাতে টাকা-কড়ি তেমন ছিল না। একেবারে শূন্য পকেটে জুয়ার আসরে গিয়ে বসে কি করে। ওদের আলমারির দুটো চাবি, একটা তার কাছে থাকে, অন্যটা মিলুর কাছে। সেই আলমারি খুলে মিলুর টাকার খাম থেকে মাত্র পঁচাত্তরটি টাকা তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেছিল। আর রাতে বাড়ি ফিরতেও দেরি হয়ে গেছিল একটু।

ব্যস তাই নিয়ে সকালে যাচ্ছেতাই করল মিলু। এমন লোকের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াই উচিত এ-কথা পর্যন্ত বলল। ফলে এই শর্মারও ভয়ানক রাগ হয়ে গেল। পাল্টা ঠেস দিয়ে সে-ও চারদিকের এই গণ্ডগোলের দিনে রাত পর্যন্ত ঘরে না ফেরার কৈফিয়ৎ চাইল। ব্যস, তারপরেই কথা বন্ধ। মিলুর এটাই এখন বড় দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝগড়ার সময় ঝগড়া করলেই ফুরিয়ে যায়। না, তার বদলে কথা বন্ধ করে বসে থাকে। স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে চায় সে অনেক সুশালীন মেয়ে, ঝগড়া করতে রুচিতে বাধে। তার ফলে অসিতদা যদি আরো বেশি রেগে যায় আর বকাঝকা করে, সেটা কি খুব দোষের? সে কি কম লেখাপড়া-জানা ভদ্রলোক?

আজ আপিসে গিয়ে অসিত চ্যাটার্জির মাথা ঠাণ্ডা হয়েছিল। খানিক আগে ছুটি নিয়ে মিলুর আপিসে চলে এসেছিল। আগেও এ-রকম আপোস করেছে। দুজনে একসঙ্গে সকাল-সকাল বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু আজ ওর আপিসে গিয়ে শুনল মিলু আসেইনি মোটে। ভাবল বাড়িতে পাবে। বাড়িতেও নেই। তাহলে আর বাপেরবাড়ি ছাড়া কোথায়? রাগ ধামাচাপা দিয়ে ওকে নিয়ে যাবার জন্য শ্বশুরবাড়িতে গেল। সেখানে তেলের কড়ার মাছ ছাড়ার মতো তপতপে গলায় শাশুড়ী জানালো, মেয়ে খানিক আগে অমানুষ জামাইয়ের ওখানেই চলে গেছে।

…শাশুড়ী আর সম্বন্ধী এমন ব্যবহার করল যেন হাড়িকাঠে গলা দিয়ে আছে সে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলটিমেটামই দিল তারা। বুঝেশুনে না চললে তাদের মেয়ে বা বোনও আর বেশিদিন বরদাস্ত করবে না। অসিতদাও তখন পাল্টা জবাবে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে, ছেলে সে-ও খুব সহজ নয়—বুঝেশুনে চলার দায় তাদের মেয়ে বা বোনেরও আছে। ব্যস, তাই শুনে শাশুড়ী আরও খাপ্পা…ওই খিঁচড়নো মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে এসেই বাপীর সঙ্গে তার দেখা। তাই তক্ষুনি সন্দেহ হল নাগালের মধ্যে একজন আছে বলেই শাশুড়ী আর শ্যালকের কথায় কথায় আজকাল এমন শাসানি—আর মিষ্টিরও তুচ্ছ কারণে এত মেজাজ।

—এ রকম সন্দেহ হতে পারে কিনা তুমিই বলো ভাই। অনুশোচনায় গলা বুজে আসার দাখিল অসিত চ্যাটার্জির। —তুমি এতদিন ধরে কলকাতায় আছ আর এদের মতো স্বার্থপর লোক তা মোটে জানেই না ভাবব কি করে? ওই মা আর দাদাটির মতো প্যাঁচালো লোক নই আমি, তোমাকে দেখামাত্র সন্দেহ আমার হয়েছিল খোলাখুলি স্বীকার করেছি—ভুল স্বীকার করারও হিম্মত চাই, এরপর তোমার মনে আর কোনো দাগ থাকতে পারে, না রাগ থাকতে পারে তুমিই বলো—পারে?

মুখখানা সীরিয়াস করে বেশ ঘটা করে মাথা নাড়ল বাপী। পারে না। তারপর মুখেও বলল, সব শোনার পর এখন বরং তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে—যে সে লোক তো নও যে এভাবে হেনস্থা করবে ওরা।

সহানুভূতির আঁচ পেয়ে আহত পুরুষকার মাথা তুলল।—তুমি হলে গিয়ে একটা সমঝদার দিলের মানুষ, তুমি বুঝবে না কেন। মদ-গেলা ফর্সা তেলতেলে মুখ রাগে লাল আরো।—ওদেরও বুঝতে হবে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই শর্মাই বুঝিয়ে ছাড়বে। আমাকে হেনস্থা করে কেউ পার পাবে ভেবেছে—সেই মেজাজ দেখলে ওদের মেয়েসুদ্ধ ভয়ে কাঁপবে—আমি কারো ধার ধারি, না, কারো পরোয়া করি?

নিরীহ মুখে বাপী বিক্রমের কথা শুনল, মাথা নেড়ে সায়ও দিল। কিন্তু আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হচ্ছে বুঝলে জঙ্গলের পশু যেমন করে, এই প্রতাপও অনেকটা সেই গোছের লাগল বাপীর।

পঞ্চম দফা গেলাস খালি হতে বাপীই বলল, আর না, আমার ড্রাইভার নেই, তোমাকে একলা যেতে হবে।

আর দরকারও নেই। আশ মিটিয়ে খাওয়া হয়েছে। দাঁড়াতে গিয়ে এখনই দু—পায়ের ওপর তেমন ভর থাকছে না। আতিথ্যে পরিতুষ্ট অসিতদা এখন যেমন অন্তরঙ্গ তেমনি দরাজ। টেনে টেনে বলল, নিজের গাড়ি আছে, কি আর এমন রাত, তুমিও চলো না আমার সঙ্গে—মিলুও খুশি হবে নিশ্চয়, হাজার হোক ছেলেবেলার বন্ধু তো তোমরা।

এবারে লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘরে থেকে বার করে দিতে ইচ্ছে করল বাপীর। মাথা নেড়ে মোলায়েম সুরেই বলল, আজ না, আর একদিন হবে— বাড়িতে টেলিফোন আছে?

—না ভাই, আপিস থেকে শিগগিরই পাবার কথা আছে। আপিসে আমার টেবিলেই ফোন, সেই নম্বরটা রাখো। দুলে দুলে টেবিলের সামনে গিয়ে পকেট থেকে কলম বার করে খসখস করে ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বলল, তোমার নম্বরটাও আমাকে দাও।

এতক্ষণ বাদে আর যেন এক মুহূর্তও বরদাস্ত করা যাচ্ছে না লোকটাকে। হাল্কা তাড়ার সুরে বলল, কাল-পরশুর মধ্যেই ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি হয়তো, এখানকার নম্বর নিয়ে কি হবে। পরে বাড়ির নম্বর নিও’খন।

লিফটে নিচে নামালো। বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল।

একটু আগে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হয়ে গেছে মনে হয়। ফুটপাথ আর রাস্তা ভেজা। ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বাপী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। হাওয়াটা ভালো লাগছে।

হাওয়াটা না আর কিছু?…জীবনের এই বাঁকে একটা অনুকূল পটভূমি তার অগোচরে আপনা থেকেই প্রস্তুতির পথে কি?

সোনার হরিণ নেই – ২৯

রাত দশটার কাছাকাছি। একটা লোভ টেলিফোনটার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সুদীপ নন্দী বা তার মা এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি নিশ্চয়। অসময়ের ডাকে তারা সাড়াও দেবে, খুশিও হবে। অনিশ্চয়তার গহ্বরে সহজে কেউ ঝাঁপ দিতে চায় না। নাগালের মধ্যে নিশ্চিত কোনো আশ্বাস পেলে তবে জোর বাড়ে। রাতের এই টেলিফোন সেই আশ্বাসের মতো হতে পারে। আর কিছু না বলে শুধু অন্তরঙ্গ কুশল খবর নিলেও হাতের কাছে তারা নাগালের মানুষ দেখতে পাবে। লোভের হাতছানি বাপী জোর করেই বাতিল করে দিল। মত্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে অসিত চ্যাটার্জি মুখ সেলাই করে বসে থাকবে না। এই রাতের ঘোরে অন্তত বাপীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেই। মিষ্টি কি ভাববে বা কি বুঝবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সেখান থেকেই তার কলকাতায় অবস্থানের খবরটা মা আর দাদার কানে পৌঁছুবে আশা করা যায়। মিষ্টির মন তার মা বা দাদার মতো এখনো খুব অস্থির মনে হয় না। কিন্তু যত স্থিরই হোক, অসিত চ্যাটার্জি ঘরে ফিরলে তাতে ঢিল একটা পড়বেই। সেই বৃত্ত আপনা থেকে কতটা ছড়ায় দেখা যাক।

এর থেকেও বড় লোভ সংবরণ করতে হল পরদিন। এক পয়সার যুদ্ধের ফয়সলা এখনো হয়নি। ছোটখাটো গণ্ডগোল রোজই চলছে। তবু লোকে কাজকর্ম একেবারে সিকেয় তুলে বসে নেই। নিজের দখলে গাড়ি থাকায় বাপীরও নড়াচড়ার সুবিধে হয়েছে। বিপাকে পড়ে কোথাও আটকে যাবার ভয় নেই। সকালে জিত্ মালহোত্রাকে সঙ্গে নিয়ে উল্টোডাঙার গুদাম ঠিক করতে গেছিল। ফেরার সময় সেন্ট্রাল এভিনিউর পথ ধরল। রাস্তার ধারে এক জায়গায় ছোট একটা চকচকে বাড়ির দোতলায় পরিচিত নামের এয়ার অফিসের সাইনবোর্ড চোখে পড়া মাত্র বাপীর ডান পা আপনা থেকেই ব্রেকের ওপর। ঘড়িতে সাড়ে বারোটা।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা রাস্তাটা পার হলে উল্টোদিকে অফিসের দরজা। ঘাড় বেঁকিয়ে বাপী দেখছে। পাশ থেকে মালহোত্রা লক্ষ্য করছে সে-খেয়ালও নেই। ওখানে একতলা বা দোতলার কোনো একটা ঘরে বসে কাজ করছে জুনিয়র অফিসার মালবিকা চ্যাটার্জি! অসিত চ্যাটার্জির মতে যে অফিসারগুলো ছোঁকছোঁক করে ওকে ঘিরে থাকে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াই কাজের অর্ধেক। জানান না দিয়ে বাপী যদি সোজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, মুখখানা দেখতে কেমন হবে? মিষ্টির সঙ্গে তখন এই মালবিকা চ্যাটার্জির একটুও যুঝতে হবে কি হবে না? এক নজর তাকিয়েই বাপী সেটুকু বুঝতে পারবে।

—কোন টিকিট কাটার দরকার থাকলে আমাকে বলে দিন সার, আমি কেটে রাখব।

জিত্‌ মালহোত্রা। একটা অদম্য লোভের তাড়না দমন করে বাপী আবার, গাড়ি চালিয়ে দিল। জবাবে সামান্য মাথা নাড়ল কি নাড়ল না।

হোটেলের মুখে জিত্ নেমে গেল। আবার সে তিনটেয় আসবে। মনিবের সঙ্গে আজ বড়বাজারে বড় কয়েকটা পার্টির সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের প্রোগ্রাম।

স্নান সেরেই বেরিয়েছিল। হুকুমমতো হোটেলের বয় ঘরে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। খাওয়া সবে শুরু করেছিল, টেলিফোন বেজে উঠল। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকালো বাপী। কে হতে পারে? নিশীথ?…অসিত চ্যাটার্জিও হতে পারে। পরেরজন হলে ততো অবাঞ্ছিত নয়। গতরাতের খবর বা আজকের সকালের খবর কিছু পাওয়া যেতে পারে। বোতলে যে অর্ধেক এখনো পড়ে আছে তার টানে আজও আসতে চাইবে হয়তো। ডাকবে না হেঁটে দেবে?

…হ্যালো?

—বাপী নাকি?

ও-ধারের গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হবার চেষ্টায় একটা উদ্‌গত অনুভূতির গলা টিপতে হল। ধৈর্যের ফল ধরেছে। সবুরে মেওয়া ফলেছে।

—হ্যাঁ, দীপুদার গলা মনে হচ্ছে?

—ঠিক ধরেছে। অন্তরঙ্গ হাসি। তারপর অন্তরঙ্গ অনুযোগ।—দেড় মাসের ওপর কলকাতায় আছ শুনলাম অথচ একটা খবর পর্যন্ত নাওনি।…শুনে মা-ও দুঃখ করছিলেন।

বাপীর গলা চিনি-গলা।—কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছিলাম না দীপুদা, তার ওপর যে গণ্ডগোল তোমাদের রাজ্যে, সব গুটিয়ে আবার না ফিরেই যেতে হয়। যখন-তখন বেরুনোর জো আছে? মাসীমাকে বোলো দেখা হলেই আমি তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব। তুমি কোত্থেকে?

—কোর্ট থেকে। তোমার সঙ্গে একটু দেখা হওয়ার দরকার ছিল। বিকেলে হোটেলে থাকবে?

—বিকেলে কখন?

—এই ধরো সাড়ে চারটে পাঁচটা?

—পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা করো, আমার ওদিকেই একটু কাজ আছে, পাঁচটা দশ-পনেরর মধ্যে কোর্ট থেকে আমি ফেরার সময় তোমাকে তুলে নেব। বিকেলের জলযোগের ব্যবস্থা ভালই হবে কথা দিচ্ছি।

ওদিক থেকে সুদীপ নন্দীর জোরালো হাসি। পরে একটু সমঝে দেবারও চেষ্টা। তোমার গতকালের দরাজ জলযোগের ব্যবস্থার জন্য মিষ্টি কিন্তু রেগে আছে।

বাপীরও হাসির কামাই নেই।—সেই ছেলেবেলায় মিষ্টির রাগও আমার খুব মিষ্টি লাগত দীপুদা। কিন্তু গতকাল আমার সত্যি কোনো দোষ ছিল না…

কথার মাঝেই বাধা পড়ল।—ঠিক আছে ঠিক আছে, এই অপদার্থটাকে আর না চেনে কে, যা বোঝার মিষ্টিও ঠিকই বুঝেছে। পাঁচটা থেকেই আমি কোর্টের ইস্ট গেটে থাকব’খন, তুমি এসো।

ফোন রেখে বাপী আবার খেতে বসল। কি খাচ্ছে, সেদিকে আর চোখ মন কিছুই নেই। হাসছে নিঃশব্দে। মিষ্টি রেগে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। বাপীর ঘর থেকে তার ঘরের লোক মাতাল হয়ে ফিরেছে সেটা বরদাস্ত করা সহজ নয়। নেশার ঘোরে এই লোক বেফাঁস কি বলেছে না বলেছে ভেবেও তার রাগ হতে পারে। ঘরের মানুষ অমানুষ হলে মেয়েদের আসল পুঁজি ঝাঁঝরা। মিষ্টি সেটা বাপীর কাছেই সব থেকে বেশি গোপন করতে চাইবে। তার রাগ হবে না তো কি? কিন্তু তার মা আর দাদার ভিন্ন লক্ষ্য, ভিন্ন চিন্তা। গেলবারেও বাপীর লক্ষ্য বা চিন্তার আভাস পেয়েছিল। ওকে দেখামাত্র অসিত চ্যাটার্জির সন্দেহ বা তিরিক্ষি মেজাজ অহেতুক নয়। মিষ্টিকে সে এখনো অত ভয় করে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার মা বা দাদা যে তাকে ছেঁটে দেবার মতলবে নির্ভরযোগ্য নাগালের মানুষ খুঁজছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মালহোত্রার সঙ্গে কথা বলে ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী বাপী পার্টি বাছাই করে নিল। হাতে যেটুকু সময়, সকলের সঙ্গে আজ দেখা করা সম্ভব নয়। ঠিক পাঁচটা দশে কোর্টের পুব গেটে গাড়িটা এসে দাঁড়াল। দীপুদা অপেক্ষা করছিল। ক্রিম—রঙের ঝকঝকে গাড়ি দেখে তারও দু’চোখ অসিত চ্যাটার্জির মতোই গোল হল।

রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে আসছে।

বাপীর পাশের আসনে জিত্‌ মালহোত্রা। তাকে বলাই ছিল, বাপীর চোখের ইশারায় সে শশব্যস্ত দরজা খুলে নামল। মানী অতিথির উদ্দেশে বিনীত তৎপর অভিবাদন জানিয়ে তাকে নিজের আসন ছেড়ে দিল। সে মালিকের পাশে বসতে দরজা খুলে ও পিছনের সীটে বসল।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাপী হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ নাকি?

—না, মিনিট পাঁচেক। গাড়ির ভেতরটাতেও চোখ বুলিয়ে নিল। জিগ্যেস করল, এ গাড়ি এখানে কিনলে, না ওখান থেকে নিয়ে এসেছ?

—আনা নেওয়ার অনেক হাঙ্গামা। তাছাড়া বানারজুলিতে থাকলে সেখানে গাড়ি ছাড়া আরো অচল। যাতায়াত তো করতেই হবে, এখানেও কিনে নিলাম আর একটা।

গাড়ি আরো একটা আছে বুঝিয়ে দেওয়া গেল। জিপও একটা আছে ফাঁক পেলে তাও জানিয়ে দিত। ব্যারিস্টার সাহেবের যাতায়াত এখনো ট্রামে বা বাসে। স্কুলে পড়তে জঙ্গল সাহেবের ছেলে জঙ্গল-আপিসের জিপে আসত যেত। বাপী পিসিমার তৈরি আমসত্ব, পাকা কামরাঙা, বন-মোরগ ঘুষ দিয়ে সেই জিপে তার সঙ্গে যাতায়াতের আরজি পেশ করতে মনে লেগেছিল। প্রথমে ধমকে উঠে পরে সদয় হয়ে বলেছিল, বাড়ি থেকে এক মাইল রাস্তা হেঁটে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে আর স্কুলের আধ-মাইল আগে নেমে যেতে। কেরানীর ছেলের সঙ্গে এক জিপে কেউ তাকে দেখে ফেললে মান খোয়া যাবে। আর আসার সময় হেঁটেই আসতে হবে কারণ উঁচু ক্লাসের ছেলেদের সামনে তাকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়। রাগে আর অপমানে বাপী এই জিপের দিকে আর ফিরেও তাকাতে চায়নি। বাপী ভোলেনি। কিন্তু দীপুদার কি মনে আছে?

সুদীপ নন্দী ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের স্মার্ট লোকটাকে দেখে নিল একবার।— ইনি?

—ইনি আমার সেক্রেটারি মিস্টার জিত্ মালহোত্রা।

মালহোত্রা আর একবার কপালে হাত তুলে সৌজন্য জানালো। দীপুদাও। বানারজুলির সেই কথায় কথায় গাঁট্টা-খাওয়া ছেলেটার আজ এই বরাত দেখে বুক একটুও চড়চড় না করে পারে কি? গাড়ি চালানোর ফাঁকে খোশ-মেজাজে বাপী আড়চোখে মুখখানা দেখার চেষ্টা করছে।

—কলকাতায় একটা বড় সেন্টার খুলে ফেললাম দীপুদা। জিত্, তুমি কি করলে না করলে দীপুদাকে একটু দেখাও না। আমাকে খুব কাজ দেখাচ্ছ, কিন্তু এঁর চোখ সহজে ফাঁকি দিতে পারবে না—নামজাদা ব্যারিস্টার।

দীপুদার বিব্রত মুখ! পিছন থেকে জিত্ সাগ্রহে আর্ট পেপারে ছাপা চকচকে প্যামফ্লেট তার হাতে দিল। সেটা ওলটাবার আগে ফার্মের একচ্ছত্র মালিকের নাম চোখে পড়বেই। ভারতের নানা জায়গায় শাখা-প্রশাখার বিস্তারও নজর এড়াবে না। জিত্ এরপর ফার্মের ক্যালেন্ডার আর ভেলভেট কভারে মোড়া ডায়েরিও তাকে উপহার দিয়ে ফেলল। ওতেও বর্তমান মালিকের নাম অনুপস্থিত নয়।

খুশিতে মুখখানা ভরাট করার চেষ্টা সুদীপ নন্দীর।—চমৎকার! আপাতত তুমি তাহলে কলকাতাতেই থাকছ?

—ইচ্ছে তাই, তবে ফাঁকে ফাঁকে বাইরে ছোটাছুটি তো আছেই। মাসে এক আধবার বানারজুলিও যেতে হবে। হাসল।—তুমি বিলেত-ফেরত সাহেব মানুষ এখন, বানারজুলির জঙ্গল বোধ হয় ভুলেই গেছ।

দীপুদা স্বীকার করল না। উল্টে রং চড়ালো।—বানারজুলির জঙ্গলের সেইসব দিনগুলি কি ভোলবার। তোমার সেই বনমোরগের স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।

বিনিময়ে বাপী কি পেয়েছে তাও মনে আছে কিনা জিগ্যেস করার লোভ সামলাতেই হল। হোটেলে পৌঁছনোর ফাঁকে ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার খবরটাও জানিয়ে দিল। শিগগীরই উঠে যাবে, মাসিমাকে এনে তখন একটু দেখেশুনে যাবার আবেদনও জানিয়ে রাখল। সুদীপ নন্দীও সানন্দে প্রতিশ্রুতি দিল।

জিত্‌ মালহোত্রাকে বিদায় করে বাপী গাড়িটা তমকা-পরা দারোয়ানের জিম্মায় ছেড়ে দিল। লোক ডেকে পিছনের গ্যারাজে গাড়ি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা সে-ই করবে। দীপুদাকে নিয়ে নিজের সুইটে এলো। ফোনে দুজনের মতো খাবারের হুকুম দিয়ে সামনে এসে নিশ্চিন্ত হয়ে বসল।—এবারে বলো কি খবর।

—না, খবর তেমন কিছু না, তুমি কলকাতায় আছ আর এতদিনের মধ্যে দেখা হল না, মা তাই বার বার বলছিল। মিষ্টির সঙ্গেও তোমার দেখা হয়নি শুনলাম।

—না। কৈফিয়ৎ দাখিল করার মুখ বাপীর।—এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন কাউন্টারে ওকে না দেখে ভাবলাম দিল্লির চাকরিটা হয়ে গেছে, ইন্টারভিউ দিতে গেছল জানতাম তো।

ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দীর ক্ষোভপ্রকাশের ধরন আলাদা। মুখ মচকে বলল, সে—চাকরিও ও-ই পেয়েছিল, আর সেটা এর থেকে ঢের ভালো চাকরিই ছিল। নিতে পারল না। দ্যাট স্কাউনড্রেল ওয়ন্—আমি আর মা বার বার করে বলেছিলাম, কি করবে ও, চলে যা। গেল না, এখন পস্তাচ্ছে।

শুনে ভেতরটা চিনচিন করছে বাপীর। এখন পস্তাচ্ছে শুনেও তেমন খুশি হতে পারল না। বড় চাকরি পেয়েও নিতে না পারার একটাই অর্থ। আর একজনের জোর খেটেছে। নিছক অত্যাচারের জোর হলে মিষ্টি পরোয়া করত কি…?

একটু চুপ করে থেকে দীপুদা বলল, এত বড় ব্যবসার তুমি একলা মালিক এখন মা তাও জানে দেখলাম। ফোনে মিষ্টি হয়তো বলেছে। আচ্ছা, এর আসল মালিক তো একজন মহিলা শুনেছি, তাঁর কি হল?

—নেই। সাত-আট মাস হল মারা গেছেন

—তাঁর ছেলেপুলে নেই?

—একটি মেয়ে।

দীপুদা নড়েচড়ে বসল।…সমস্ত ব্যবসাটাই তুমি পেয়ে গেলে, তার কি হল? বাপী থমকালো একটু। ফোনে দীপুদা বলেছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়া একটু দরকার। দরকারটা কি তার আভাস একটু একটু পাচ্ছে মনে হয়। সত্যি যদি হয় বাপী নিজেই তাহলে নিজের মগজের তারিফ করবে না তো কি? হেসেই জবাব দিল, তার বিয়ে হয়ে গেল বলেই তো আমি সব পেলাম।

ব্যারিস্টার সাহেবের সপ্রতিভ ভাবটুকু কেউ বুঝি সুইচ টিপে নিভিয়ে দিল। ঢোঁক গিলে জিগ্যেস করল, ও…তোমার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে তাহলে?

—আমার সঙ্গে! ভিতরে উৎফুল্ল, বাইরে আকাশ থেকে পড়া মুখ।—কি যে বলো ঠিক নেই। তার বিয়ে হয়েছে এক বিলেত-ফেরত পাঞ্জাবী এনজিনিয়ারের সঙ্গে—এখন কলকাতায় আছে ওরা, এ-মাসের শেষেই আমেরিকা চলে যাবে।

ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ সুদীপ নন্দীর।—তাহলে তুমি সবটা পেলে কি করে? বাপী হাসছে। দীপুদা আর তার মাকে অন্তত নিশ্চিত করার তাগিদ এখন। বলল, সেই মহিলা আমাকে খুব ভালবাসতেন, নিজের ছেলেকেও কেউ এত ভালবাসে কিনা জানি না। ব্যবসা ছাড়াও তার অগাধ টাকা আর সোনা ছিল। ব্যবসার সঙ্গে সে-সবও আমাকে আর ঊর্মিলাকে সমান দু-ভাগ করে দিয়ে গেছেন। ওর বা স্বামীর আর ব্যবসায় ইনটারেস্ট নেই—তাই ওদের অংশ আমিই কিনে নিয়েছি! কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করেছি তোমাদের এ ধারণা হল কি করে দীপুদা?

বিব্রত দেখালেও মানুষটার ভিতর থেকে একটা গুরুভার নেমে গেছে। হেসেই জবাব দিল, আর বলো কেন, রাগ হলে মেয়েদের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। অসিতকে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখেই ওর মেজাজ বিগড়ে গেছিল। তোমার কাছে ছিল আর তুমি এখন কত বড় হয়েছ তাও বোধ হয় তার মুখেই শুনেছ। আর, মা যা বলল, তোমার মালিকের মেয়ের গল্প গেলবারে তুমিই হয়তো মিষ্টির কাছে করেছিল। তাই গোটা ব্যবসাটা এখন তোমার শুনেই ও ধরে নিয়েছে মালিকের সেই মেয়েকে বিয়ে করেই সব পেয়েছ। আসলে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরে ওই অপদার্থটা আরো কি বলেছে না বলেছে ঠিক নেই। রাগের মাথায় রাত এগারোটায় মিষ্টি পাশের ওষুধের দোকান থেকে মাকে ফোন করেছে। ওর ধারণা, মালিকের সেই মেয়েকে বিয়ে করেই এখন মস্তলোক হয়েছ তুমি আর তার হ্যাজব্যান্ডকে দেদার মদ খাইয়ে মজা দেখেছ। বোনটার দোষ নেই বুঝলে, একেবারে তিক্তবিরক্ত হয়ে গেল।

শিরায় শিরায় বাপীরও উষ্ণ তাপ ছড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত কি আর হয়েছে, কতটুকু হয়েছে। তার আগে অনেক এগনোর ইচ্ছে, অনেক দেখার ইচ্ছে। ওই মেয়ে যেন সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছড়ি উঁচিয়েছে।

কিন্তু সুদীপ নন্দী নিশ্চিন্ত এখন, খুশিও। এই রাতের মধ্যে তার মা-ও নিশ্চিন্ত হবে। খুশি হবে। তাদের ভিন্ন স্বার্থ। ভিন্ন প্ল্যান। নিজের মুখ কৌতুকের মুখোশে ঢাকল বাপী। হাসতে লাগল।—তোমাদের কাছে আমিই কালপ্রিট তাহলে।

—কি যে বলো, আমরা তোমাকে চিনি না! মিষ্টিও যা বলেছে রাগের মাথায়ই বলেছে, নইলে তার চিজটিকেও সে খুব ভালোই জানে।

বয় খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। বাপী উঠে দেয়ালের দেরাজ থেকে হুইস্কির বোতল এনে টেবিলে রাখল। আধাআধি অবশিষ্ট আছে এখনো। কিন্তু ওটা দেখামাত্র খুশি হবার বদলে দীপুদা তেতেই উঠল একটু।—তুমি তো খাও না, ওই রাসকেল একলাই এতটা সাবড়ে দিয়ে গেছে নাকি?

বাপীই যেন অপরাধী—কি করব বলো, খেতে থাকলে তো আর কেড়ে রাখতে পারি না। তাও তো শেষ পর্যন্ত জোর করেই তুলে দিলাম।

—ও তোমার কাঁধে চাপল কি করে, তোমাকে পেল কোথায়?

—গাড়িতে আসছিলাম, রাস্তায় দেখা। কোন্ রাস্তা সেটা বলল না। দীপুদার মুখ চলছে। গেলাসও। প্রথম গেলাস একটু দ্রুতই শেষ। ফলে আরো একটু অন্তরঙ্গ। বাপী আবার গেলাস ভরে দিতে বলল, কিছু না মনে করো তো একটা কথা বলি, ওই ওকে তুমি অত আসকারা দিও না।

—অসিতবাবুকে? এলে তাড়িয়ে দেব?

—তা বলছি না, অন্তত বুঝিয়ে দেবে তুমি খুব সহজ লোক নও আর ওর কাছের লোক নও।

খেতে খেতে নির্লিপ্ত মুখে বাপী বলল, কিন্তু তার তো নিজের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা—রেজিস্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট— এখন বড় চাকরিও পেয়েছে…

—স-সবও গেয়ে গেল না? রাগত মুখে খাওয়া থামিয়ে গেলাসে বড় চুমুক দিল একটা। ন্যাপকিনে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কপালজোরে বড় চাকরি তো পেয়েছে, কিন্তু তার কটা পয়সা ঘরে আনে সে-কথা বলেছে? সব রেসে ঢেলে দিয়ে আসে, নয়তো জুয়ায়—বুঝলে? মিষ্টির টাকা চুরি করেও জুয়া খেলে এসেছে—উনি আবার বড় চাকরি করেন!

আলতো করে বাপী জানান দিল, কাল নিজেই সেকথা বলেছিল। তোমাদের সঙ্গে নাকি এ-নিয়ে এক হাত হয়েও গেছে।

না হয়ে উপায় কি বলো। আমরা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, রেস জুয়া মদ এসব না ছাড়লে আমাদের তাকে ছাড়তে হবে—মিষ্টিকেও।

যা জানানো হয়েছে মা আর দাদাটি তাই হবে আশা করছে বলেই যে আজ এত খাতির কদর বাপী তরফদারের তাও দিনের মতোই স্পষ্ট। অপ্রিয় প্রসঙ্গ বদলে বাপী আপনার জনের মতো মাসীমার স্বাস্থ্যের খবর নিল। মেয়ের ভাবনায় তার রাতের ঘুম গেছে শুনে বাপীর মুখেও উদ্বেগের ছায়া। বউদি অর্থাৎ দীপুদার স্ত্রী আর ছেলের খবরও নিতে ভুলল না। বউদিকে আগের বারে রোগাই দেখে গেছিল, এখন তেমনি আছে শুনল। স্বাস্থ্যটা তেমন ভালো যাচ্ছে না, অল্প-স্বল্প রোগ লেগেই আছে।

—ছেলে আর বউদিকে নিয়ে মাসখানেকের জন্য আমার বানারজুলির বাংলোয় থেকে এসো, স্বাস্থ্য চেহারা সব ফিরে যাবে। সেখানে সব ব্যবস্থা আছে, কুটোটি নাড়তে হবে না—খাবে—দাবে আর বেড়িয়ে বেড়াবে।

যাবে কি যাবে না সেটা স্বতন্ত্র কথা, এ-রকম আপ্যায়ন শুনলে সকলেই খুশি হয়। দীপুদা খুবই খুশি।

ততক্ষণে খাওয়া শেষ। দীপুদার দ্বিতীয় গেলাসও। বাপী আবার বোতল তুলে নিতে সে আধো-আধো বাধা দিল, আবার কেন…

…ওয়ান ফর দি রোড। হুইস্কি ঢেলে বাপী নিজেই সোডাও মিশিয়ে দিল। এই গেলাসও আধাআধি শেষ হতে বাপী আলতো করে আবার মোক্ষম জায়গাটিতে ঘা বসালো। বলল, অসিতবাবুরও তোমাদের ওপর বেজায় রাগ দেখলাম কাল—

ওই জিনিসটা পেটে পড়লে আর একটু জমে উঠলে গলতেও সময় লাগে না, জ্বলতেও না। দীপুদাও দপ করে ঝলসে উঠল। —হবে না! গুণের শেষ আছে ওর? যা-তা বলে গেছে বুঝি?

বলছিল, মাসিমাই তার মেয়ের কান বিষিয়ে দিচ্ছে, আর বাড়িটার লোভে তুমিও মাসিমাকে তাতিয়ে রাখছ।

—এসব কথাও বলেছে! বাড়িটা মানে আমাদের ওই বাড়িটা?

হ্যাঁ, তুমি নাকি বলেছ মেয়েকে ভাগ দিলে বাড়ি আর রক্ষা করা যাবে না, সে বেচে খাবে—এ-সব বলে মাসিমাকে বিগড়ে দিয়ে ওটা তুমি একলাই হাতড়াবার মতলবে আছ।

—স্কাউনড্রেল! মদ গিলেও মুখ এতক্ষণ এত লাল হয়নি দীপুদার।—একলা হাতাতে হলে মিষ্টিকে ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেঁটে দেওয়ার জন্য এত ঝোলাঝুলি করব কেন? ওই স্কাউনড্রেলের খপ্পরে গিয়ে পড়লে যা বলেছি তাই হবে না তো কি? জুয়ার নেশায় যে স্ত্রীর গহনা আর টাকা চুরি করতে পারে সে না পারে কি?

টাকা চুরির সঙ্গে এবারে গয়না চুরিটাও যোগ হল। কান পেতে শোনার মতোই। চার মাস আগে ভালো একটা হার খোয়া গেছে মিষ্টির। টাকা চুরি ধরা পড়ার পর মা আর তার অন্তত ধারণা ওই শয়তানই সেটা খেয়েছে। দিনে দিনে আরো অনেক গুণ ধরা পড়ছে ছেলের। মিষ্টিকে ইদানীং সন্দেহ করে। দিল্লিতে অমন ভালো চাকরিটা পাওয়ার পিছনে খারাপ কোনো খাতিরের হাত আছে ধরে নিয়ে এমন যাচ্ছেতাই ব্যাপার করল যে মিষ্টির যাওয়াই হল না শেষ পর্যন্ত। তার এই প্রমোশনটাও একই সন্দেহের চোখে দেখে। যখন তখন আপিসে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প করতে দেখলে ঘরে এসে বিচ্ছিরি রকমের খোঁচা দিয়ে কথা বলে আর যাচ্ছেতাই রসিকতা করে।

জ্বলজ্বলে চাউনি দীপুদার। ঘরের কেচ্ছার কথা কত আর বলব তোমাকে? আর বেশি শোনার তাগিদ নেই বাপীর। গতকাল আর আজকের মধ্যে তুরুপের অনেকগুলো তাস হাতে পেয়ে গেছে। ধীরেসুস্থে কি ভাবে খেলবে এখন সেই বিবেচনা সেই হিসেব।

সোনার হরিণ নেই – ৩০

পরের দিনটা আবার হরতাল। ট্রাম ভাড়ার সেই এক পয়সার যুদ্ধ। তার পরের দিন জায়গায় জায়গায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করার ধুম, জনতা পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ। গুলি টিয়ারগ্যাস লাঠি। সৈন্যদের টহলদারি।

এরই মধ্যে বাপী হোটেল ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে। ফ্ল্যাটের মালিক কথার খেলাপ করেনি। অল্প কটা দিনের মধ্যে ছিমছাম সাজিয়ে দিয়েছে। হট্টগোল থেকে সরে এসে বাপী প্রায় চব্বিশটা ঘণ্টা ঠাণ্ডা নিরিবিলির মধ্যে সেঁধিয়ে থাকল।

আরও একটা দিন গড়িয়ে গেল। দুপুরের দিকে গাড়ি হাঁকিয়ে বাপী উল্টোডাঙার সেই গুদাম ঘর দেখতে গেছল। ইতিমধ্যে সেটারও কিছু সংস্কার হবার কথা। মিস্ত্রীর কাজও অনেক। ভিতরে পার্টিশন দিয়ে গোটাকতক খুপরি করতে হবে। এদিকের কাজ সবই এগোচ্ছে। জিত্ মালহোত্রা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করাচ্ছে। কিন্তু হাঙ্গামার চেহারা যা দাঁড়াচ্ছে, আসল কাজ কবে থেকে যে শুরু হবে বাপী ভেবে পাচ্ছে না বলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে।

সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে ফিরছিল। হাতঘড়িতে বিকেল চারটে। রাস্তাটা কেমন ফাঁকা আর থমথমে মনে হল। দূরে দূরে গলির মুখে ছোট ছোট জটলা। কিছু মিলিটারি ট্রাকেরও আনাগোনা চোখে পড়ল। গলির মুখে যারা দাঁড়িয়ে, মিলিটারি গাড়ি দেখে তারা ছুটছাট সরে যাচ্ছে। একশ চুয়াল্লিশ ধারা চলছে তখনও। হাওয়াটা তেমন সুবিধের ঠেকল না বাপীর।

সেই এয়ার অফিসের কাছাকাছি এসে গাড়ি আরও জোরে ছোটাল। কোন দুর্বলতার প্রশ্রয় দেবে না। তার অগোচরে আপনা থেকে যে অনুকূল পটভূমি গড়ে উঠেছে, খুব বুঝে-শুনে পা ফেলতে হবে সেখানে। সময় আসবে। আসবেই।

কিন্তু সময় আসারও রকমফের আছে, দশ মিনিট আগেও তা ভাবে নি। সামনে থেকে একদঙ্গল লোক হুড়মুড় করে ছুটে আসছে। অদূরে টিয়ার গ্যাসের শব্দ। ধোঁয়া। ঘন ঘন গোটাকতক বোমার আওয়াজ। হতচকিত বাপী গাড়িটা ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিল। পুলিশের তাড়া-খাওয়া লোকগুলো অনেক দূরে দূরে গিয়ে থামল।

বাপী গাড়ি থেকে নেমে খবর সংগ্রহ করল। দক্ষিণ কলকাতায় সেই দুপুর থেকেই আগুন জ্বলছে। গুলি চলেছে। লোক মরেছে। দু-দুটো সরকারী বাস জ্বালানো হয়েছে। সেই উত্তাপ এদিকেও ছড়িয়েছে। খানিক আগেও লাঠিচার্জ হয়ে গেছে, এখন টিয়ারগ্যাস চলছে। অন্যদিক থেকে বোমাবাজী শুরু হয়েছে।

বাপী গাড়িতে এসে বসল। দু-দুটো বাস পোড়ানো হয়েছে, বাস আর চলবে না। এতটা পথ আসতে একটাও বাস চোখে পড়েছে মনে হল না। রাস্তায় এখন ট্যাক্সিও দেখছে না।

ইউ-টার্ন করে গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে এয়ার অফিসের ফুটপাথের গা ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করালো। কাচ তুলে দিয়ে দরজা লক করে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিতরে ঢুকল।

বোর্ডে নাম দেখল। মালবিকা চ্যাটার্জির ঘর দোতলায়। ওপরে উঠে গেল। একজন বেয়ারাকে জিগ্যেস করতে ঘরের হদিস মিলল। অপেক্ষা করতে হল একটু। ভিতরে দ্বিতীয় কেউ আছে। মিনিট তিন-চারের মধ্যে বছর চল্লিশের একজন ফিটফাট ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো।

সুইং ডোর ঠেলে বাপী ভিতরে ঢুকল।

মস্ত টেবিলের ওধারে কলম হাতে মিষ্টি টাইপ করা একটা কাগজের দিকে চোখ নামিয়েছিল। মুখ তুলল।

একটা চকিত অভিব্যক্তির ঢেউ চোখের তারায় এসে স্থির হল। তারপর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি দেখা দিল একটু। গেলবারে অসিত চ্যাটার্জিকে সঙ্গে করে হোটেলে আসার পর যে হাসি আর চাউনি দেখেছিল বাপীর মনে আছে। সেই হাসি আর চাউনিতে ওকে কিছু বোঝানোর আকুতি ছিল। এ চাউনি বা হাসি সে—রকম নয়। অনেকখানি আত্মস্থ, ব্যক্তিত্বে বাঁধা।

—বসো। সমস্ত মানুষটাকেই দেখে নিল একবার

বাপীর পুরুষের পদক্ষেপ। এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। বলল, এই রাস্তা ধরেই আমার যাতায়াত। আজই চলেই যাচ্ছিলাম, সামনে গণ্ডগোল দেখে ফিরে এলাম। বাস পোড়ানো হয়েছে, গুলিটুলি চলছে, ট্যাক্সিও চলছে না।

শুধু ঠোঁটে নয়, চোখেও একটু হাসির ছোঁয়া লেগে আছে। মিষ্টি বলল, জানি। খবর শুনেই অনেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন—

বাপী জিজ্ঞাসা করল, তোমার তাড়া নেই?

ঠোটের আর চোখের হাসি আর একটু প্রশস্ত হল। জবাব দিল, লেগেই তো আছে, কত আর আগে আগে পালানো যায়।

বাপীও চেয়ে আছে। আল্ল্গা সহজতা নেই। বাড়তি গাম্ভীর্যও না। এই মেয়েকে দেখে কেউ বলবে না ঘরের লোকের কারণে বুকের তলায় বড় রকমের যন্ত্রণা পুষছে। বাপির ভিতরেই বরং একটা চিনচিন যন্ত্রণার অনুভূতি।…গেলবারে যা দেখেছিল তার থেকেও তরতাজা লাগছে। বয়েস যেন আরো কমেছে। সহজ ব্যক্তিত্বের ছোঁয়ায় বেশ স্বাতন্ত্র্যের ছাঁদ এসেছে। পরনে ঘন ছাইরঙের সিল্কের ওপর সাদা বুটির শাড়ি, গায়ে ধপধপে সাদা ব্লাউস। ঈষৎ ঝোলানো খোঁপা। … যৌবন আপন মাধুর্যে সুস্থির। যত দিন দেখেনি, বাপী একরকম ছিল। আজ এইটুকু দেখার মধ্যেই ভিতরে একটা তোলপাড় কাণ্ড হতে থাকল। কেউ তার একেবারে নিজস্ব কাউকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে যার ওপর আর কারো অধিকার নেই। থাকতে পারে না। কিন্তু আজ বাপী শান্ত সংযত সতর্ক। স্নায়ুগুলো সব নিজের বশে টেনে ধরে আছে। মুখ দেখে ভিতরের চেহারার আভাসও কেউ পাবে না। মাথায় যে সংকল্প এঁটে বসছে এই মুখের দিকে চেয়ে কেউ তা কল্পনা করতে পারবে না।…শেষ দেখবেই। রণে-প্রণয়ে নীতির ধার কে ধারে?

মিষ্টিই স্বল্প নীরবতার ছেদ টানল।—চা খাবে?

—খেতে পারি।

—আর কিছু?

আর কি?

মিষ্টি হাসল। হোটেলে লোক ধরে নিয়ে গিয়ে যে-রকম খাওয়াচ্ছ শুনলাম, সে-রকম আর এখানে কোথায় পাব?

বাপী শুনল। দেখল। খোঁচা বটে, কিন্তু বেঁধার মতো উগ্র নয়।—শুধু চা-ই বলো।

—ভাল প্যাটিস আর পেস্ট্রি খাওয়াতে পারি।

—তুমি খাবে?

—আমার দুটোর মধ্যেই হয়ে গেছে। চা খাব’খন। বেল টিপল। —শুধু চা-ই হোক।

মিষ্টি তাকালো একবার। জোর করে আগ্রহ দেখাল না। বেয়ারা আসতে দু পেয়ালা চায়ের হুকুম করল।

বাপী নড়েচড়ে বসল একটু।—দীপুদার সঙ্গে এর মধ্যে তোমার দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে তাহলে?

প্রশ্নের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা।—তাহলে কি রকম?

—দীপুদা বলেছিল, তার আগে “যে লোককে হোটেলে ধরে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি তার জন্য তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছ আর আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছ। …কিন্তু এখন এতটা রেগে আছ বলে মনে হচ্ছে না।

মিষ্টি হাসিমুখেই স্বীকার করল, এখন আর অত রাগ নেই। বলল, রাত এগারোটায় অমন অবস্থায় বাড়ি ফিরে যা-তা বকতে থাকলে কার মেজাজ ঠিক থাকে?

চোখে চোখ রেখে বাপী ঠাণ্ডা গলায় বলল, মেজাজ ঠিক না থাকলেও মালিকের মেয়েকে বিয়ে করে আমি মস্ত লোক হয়েছি আর তোমার হাজব্যান্ডকে মদ খাইয়ে মজা দেখছি—এমন কথা তুমি বলতে পারো ভাবিনি—এর পর এলে আমার কি করা উচিত?

একটু থমকে খুব চাপা ঝাঁঝের সুরে মিষ্টি বলল, সে তোমার কাছে অত আসবেই বা কেন?

—সেটা তাহলে তুমিই তাকে বলে দিও।

বেয়ারা চায়ের ট্রে রেখে গেল। মিষ্টি দু পেয়ালা চা ঢেলে একটা তার দিকে এগিয়ে দিল। প্রায় তখনই চকচকে কোট প্যান্ট টাই পরা অল্পবয়সী একজন লোক দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ঘরে দ্বিতীয় লোক দেখে সপ্রতিভ তৎপরতায় বলল, একসকিউজ মি—ডিস্টারব্যান্স ভাল রকম শুরু হয়ে গেছে, মিসেস চ্যাটার্জি নো কনভেয়ান্স, একটা গাড়ি যোগাড় হয়েছে—অনেক খদ্দের, যেতে চান তো চটপট উঠতে হবে।

মুখ থেকে চায়ের পেয়ালা নামিয়ে বাপী মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।

ঈষৎ বিব্রত হাসিমুখে মিষ্টি লোকটার দিকে তাকালো।

—ও. কে। যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

চায়ের পেয়ালা শেষ হতেই বাপী বলল, চলো—

চোখে আর হাসি-ছোঁয়া-ঠোঁটে সামান্য বিড়ম্বনার অভিব্যক্তি।—গণ্ডগোলের মধ্যে তুমি আবার বাড়ি পৌঁছে দিতে যাবে…এঁদের সঙ্গে আপিসের গাড়িতেই চলে

যেতে পারতাম।

তার মুখের ওপর দু চোখ আরো একটু এঁটে বসল।—ভয় পাচ্ছ? সঙ্গে সঙ্গে বেশ স্পষ্ট প্রতিবাদ।—ভয় পেতে যাব কেন!

—গেলবারে তোমার ভদ্রলোককে নিয়ে যেদিন হোটেলে এসেছিলে, সেদিন একটু ভয়ই পেয়েছিলে মনে হয়েছিল….।

টেবিলে দু হাত, কৌতুক ছুঁয়ে আছে। চেয়েই রইল একটু। তারপর জবাব দিল, তোমার মধ্যে সারাক্ষণ সেদিন বানারজুলির চোদ্দ বছরের এক ক্ষ্যাপা ছেলেকেও দেখছিলাম…। মুখ লাল হঠাৎ। তাড়াতাড়ি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের কাগজপত্র একদিকে সরিয়ে রাখল।—চলো।

একরাশ হিংস্র লোভ গুঁড়িয়ে দিয়ে বাপীও উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি সিঁড়ি ধরে নামল। রাস্তায় এসে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বাপী চাবি লাগিয়ে নিজের দিকে সামনের দরজা খুলে বসল। ও-ধারের দরজার লক খুলে তাকালো।

মিষ্টি গাড়িটা লক্ষ্য করেছে। উঠে পাশে বসল। নিজেই দরজাটা বন্ধ করল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বাপী আবার পাশের দিকে তাকালো। ওদিকের দরজার কাঁচ তোলা। ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে কাঁচ নামিয়ে দিতে পারে। সম্ভাব্য স্পর্শটুকুর লোভ থেকেও নিজেকে ছিঁড়ে এনে বলল, কাঁচটা নামিয়ে দাও, নইলে গরম হবে।

মিষ্টি কাঁচ নামালো।

গাড়ি আবার টার্ন নিয়ে চৌরঙ্গীর দিকে ছুটল। দুজনের মাঝে আধ হাতটাক ফারাক। অনেক দিনের একটা ভুলে-যাওয়া স্পর্শ বাপীকে ছেঁকে ধরছে! ফাঁক পেলেই গায়ে হাত দিত আর হামলা করত বলে ন-দশ বছরের এই মেয়ের মুখঝামটা আর তাই নিয়ে তার অনেক ঝাঁঝের কথাগুলো মগজে আছড়ে পড়ছে। ফাঁকা রাস্তা। স্পিডও বাড়ছেই। পাশে যে বসে আছে তাকে নিয়ে এর সহস্রগুণ বেগে সমস্ত বাধা-বন্ধনের ওধারে উধাও হয়ে যাবার তাড়না। একই সঙ্গে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা। সবুর! রণেপ্রণয়ে নীতির ধার কেউ ধারে না। শেষ দেখবেই।

চৌরঙ্গীর খানিক বাদে গাড়িটা বাঁয়ের রাস্তায় ঢুকে যেতে মিষ্টি সামান্য ঘুরে তাকালো।—এদিকে কোথায়?

—আমার ফ্ল্যাটে।

—তুমি হোটেলে নেই?

—ছিলাম। এখন নেই। একবার দেখে যাও, তোমার খুব তাড়া নেই তো? অস্বস্তি বোধ করছে কিনা বোঝা গেল না। ছোট জবাব কানে এলো, না…। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গাড়িবারান্দার নিচে গাড়িটা দাঁড় করালো। সামনেই লিফট। দুজনে উঠল।

বাপী চাবি লাগিয়ে সামনের মস্ত দরজাটা খুলে ডাকল, এসো—

গালচে বিছানো মস্ত হল। দামী সোফা-সেটি পাতা। মিষ্টি ভিতরে ঢুকতে বাইরের দরজাটা টেনে দিল। বিকেলের আলোয় সবে টান ধরেছে। বাপী তবু সুইচ টিপে লাইট জ্বালল। এত বড় ফ্ল্যাটে এখন তৃতীয় আর কেউ নেই মিষ্টি সেটা বুঝেছে। তবু তার মুখে অস্বস্তি বা উদ্বেগের ছায়া চোখে পড়ছে না। না, বাপী শয়তানকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেবে না। ক্রূর লোভে ভিতরে কেউ আছাড়িপাছাড়ি করছে টের পাচ্ছে। তবু সবুর। এটা সময় নয়। সময় আসবে। আসতেই হবে।

—বোসো।

মিষ্টি বসল না। হলের চারদিক দেখে নিল। ফ্ল্যাটের মালিক বড় বড় দেয়ালে কিছু শৌখিন ছবি টাঙিয়েছে। শিথিল পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেগুলিও দেখল। বাপী এগিয়ে এলো। বেডরুম দুটো, ডাইনিং স্পেস কিচেন বাথও দেখালো। তারপর আবার হলের সোফায় এসে বসল। তিন হাত দূরের সোফায় মিষ্টি।

—মোটামুটি মন্দ নয়, কি বলো?

মিষ্টি হাসছে।—তোমার এখন অঢেল টাকা, তাই তোমার কাছে মোটামুটি। সোফায় আরও একটু গা ছেড়ে দিয়ে বাপী জবাব দিল, অঢেল টাকা যে হবে সে তো তোমাকে অনেক বছর আগেই বলেছিলাম…সেই যে-বারে তুমি ভাবী বরকে ডেকে লেকে আমাকে অপমান করে তাড়ালে।

মিষ্টি সোজাসুজি চেয়ে রইল খানিক। স্পষ্ট করেই বলল, অপমান করতে চাইনি, তোমাকে কিছু বোঝাতে চেয়েছিলাম। তুমি কোনদিন কিছু বোঝবার লোক নও।

বাপী আবার সোজা হয়ে বসল। দু চোখ তার মুখের ওপর। সামান্য মাথা নাড়ল।—ঠিকই বলেছ—কো-নো দিন নয়।

মিষ্টি তেমনি চেয়ে রইল। গলার ঠাণ্ডা অথচ বাড়তি জোরটুকু কান এড়াবার নয়। বাপী তক্ষুনি নিজের নাক-মুখ বেড়িয়ে কল্পিত চাবুক বসাল একটা। রণে বা প্রণয়ে কাউকে আগে থাকতে সতর্ক করাও রীতি নয়। চাবুকের ঘায়ে মুখে হাসি ছড়াল।—যাক, আমার বোঝাবুঝি নিয়ে তোমার আর কি মাথাব্যথা।

মিষ্টিও হাসল।—মাথাব্যথা একটু আছে। সেই যেবারে তোমাকে অপমান করে তাড়ালাম বললে, তখন থেকে।…গেলবারে তোমাকে দেখে সেটা আরও বেড়েছিল। আমি খুব আশা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তোমার সেই মালিকের মেয়েই ঘরে আসবে আর তোমার পাগলামিও ছাড়বে।

জমা বারুদের গায়ে আঁচ লাগছে। সেই আঁচ তফাতে রাখার চেষ্টায় বাপী নিঃশব্দে যুঝল খানিক। ভিতরের দৈন্যদশা বুঝতে বাকি নেই, মিষ্টি তা বেশ মিষ্টি করেই জানিয়ে দিল। ঠোটের ফাঁকে তির্যক হাসি ছড়িয়ে বাপী মোলায়েম সুরে জিগ্যেস করল, তা হল না বলে হতাশ হয়েছ?

মাথা নেড়ে হাল্কা জোরের সঙ্গেই জবাব দিল, হবো না! সেই ছেলেবেলা থেকে তুমিই আমার হাড় জ্বালিয়েছ—আমি কবে না তোমার ভাল চেয়েছি?

সুচারু ব্যক্তিত্বে আত্মস্থ হলেও এখন আপোসের দিক ধরেই সম্পর্কটা সহজ করে তোলার আগ্রহ স্পষ্ট। লুব্ধ দু চোখ পলকা কৌতুকে ঢেকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, ভালো দেখছ না?

—কি ভালো—মস্ত ব্যবসা অনেক টাকা বাড়ি গাড়ি?

—আর কি চাই। একটা পয়সা ট্রামভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে কলকাতা রক্তে ভাসছে। যাক গে, তোমার মতে তাহলে আমার এখন কি করা উচিত?

মিষ্টির দু চোখে হাসি ছুঁয়ে আছে, কিন্তু তরল নয় আদৌ। যা বলতে চায় তার সাদা অর্থ, যা হবার হয়েই যখন গেছে তার জের টেনে আর লাভ কি বাপু— সুস্থির হও, ভালো থাকো—আর কি চাই তা নিজেই বেশ জানো। বলল না। হাত উল্টে ঘড়ি দেখল।—এখন ওঠা উচিত।…ফ্ল্যাটে তো এখন পর্যন্ত লোকজন দেখলাম না, তোমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি?

—যখন যেখানে যা জোটে।

মিষ্টি তক্ষুনি হেসেই আমন্ত্রণ জানালো, তাহলে আমার ওখানেই চলো, এ রাতটার মতো কি জোটে দেখা যাক—

রমণী-মুখের ওই কমনীয় ব্যক্তিত্বের উপর একটা আঁচড় বসানোর সুযোগ পেল বাপী। জবাব না দিয়ে মুখের দিকে চেয়ে মিটি-মিটি হাসতে লাগল।

—কি হল?

—লোভ হচ্ছে…সাহসে কুলোবে না!

—কেন? আর একজনের মুখে তো তোমার প্রশংসা ধরে না এখন। কিছু বলার আগেই দুর্বল দিকটা আগলানোর চেষ্টা দেখে বাপীর মজা লাগছে। তার তাড়া নেই। টোপ আর একটু বসানো হোক। হৃষ্ট মন্তব্য করল, এখন আমার এই ভাগ্যটাও খুব ভালো, শুধু তোমার একজন কেন, দীপুদার সঙ্গে দেখা হলে তার মুখেও আমার খুব প্রশংসা শুনবে…কারণ দুজনের কাছেই আমি এখন একজন নিরীহ অথচ ধৈর্যশীল শ্রোতা।

মিষ্টির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগল। নিরীহ যে কত সেটা খুব ভালো জানে।…দাদার ছেলেবেলার আচরণের খোঁচা হলে দুজনকে টানত না। সতর্ক চাউনি তার মুখের ওপর স্থির কয়েক পলক। —দেখা হয়েছে, অনেক প্রশংসাও শুনেছি…কিন্তু হঠাৎ এ-কথা কেন, ড্রিংক করে এই একজন দাদার নামে যা-তা বলেছে বলে?

বাপী একটু শব্দ করেই হেসে উঠল। —বলাবলির কথা ছাড়ো, এ ব্যাপারে দুজনা দুজনার ওপর সমান টান—একেবারে কর্ণার্জুনের টান যাকে বলে।

ছাড়তে বললেও বলবলিটা যে একতরফা হয়নি সেইটুকুই বুঝিয়ে দিল। মিষ্টি বুঝল। সুন্দর মুখের এই ব্যক্তিত্ব কমনীয় হলেও একটু আগের মতো সরল নয়।—আমার ওখানে যেতে তোমার সাহসে কুলোচ্ছে না কেন…দাদা কি বলেছে?

—তোমার ভদ্রলোকের কিছু রোগের কথা।…

চাপা ঝাঁঝালো গলায় মিষ্টি জানতে চাইল, কি রোগ? জুয়া খেলে, নেশা করে?

—দিল্লির অমন ভাল চাকরিটা নিতে পারলে না বলেও তোমার দাদা খুব দুঃখ করছিল।

সব থেকে দুর্বল জায়গাটি ধরে নিঙড়ে দেওয়ার কাজ সারা। ফর্সা মুখে তপ্ত লালের আভাস ছড়িয়ে পড়েছে। অপলক দু চোখ বাপীর চোখে আটকে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে ধারালো হাসির রেখা স্পষ্ট হতে থাকল। বলল, সবই বুঝলাম।…আমার মা বা দাদা কখন কোন্ রাস্তায় চলে ছেলেবেলা থেকে জেনেও তাদের কথায় তোমার এখন এত ভক্তিশ্রদ্ধা কেন সেটুকু শুধু বুঝলাম না।… যে সহজ কথাটা তাদের বুঝতে অসুবিধে তা নিয়ে আমি খুব মাথা ঘামাই না বা তাদের কিছু বলিও না। কিন্তু তুমি এমন এক ধৈর্যশীল শ্রোতা বলেই তোমাকে বলতে পারি। তারা শুধু রোগ দেখছে, কিন্তু তার জোরের আসল পুঁজিটুকু তাদের চোখে পড়ছে না। সেটা মিথ্যে হলে আর কাউকে কিছু বলতে হত না, আমি নিজেই ছেঁটে দিতাম। জোরের এই পুঁজিটুকুতে ভেজাল নেই বলেই রোগ বরদাস্ত করতে আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে না এটুকু তুমি অন্তত জেনে রাখতে পার।

ধীরে-সুস্থে কথাগুলো শেষ করে মিষ্টি আবার ঘড়ি দেখল। মুখ তুলে সোজাই তাকালো আবার। কঠিন আঁচড়টুকু ঠোঁটের ফাঁকে লেগে আছে এখনও। —এবারে উঠতে হচ্ছে।

জবাবটা বাপীর মগজের মধ্যে কেটে কেটে বসতে লাগল। দুর্বলতায় মোচড় পড়া সত্ত্বেও যা বলল বাপীর বুঝতে একটুও সময় লাগল না। জোরের আসল পুঁজি বলতে তার ঘরের ওই একজনের ভালবাসার পুঁজি, ভালবাসার জোর। মিষ্টির ধারণা এতে কোন ভেজাল নেই। আর, এ সম্বল যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওই রোগ বরদাস্ত করতেও অসুবিধে হবে না। অর্থাৎ ভালবাসা আছে বলেই অবস্থাগতিকে সেটুকু হারাবার ভয়ে এই আঁকড়ে ধরে থাকার রোগ।…এও বুঝিয়ে দিল, দাদা বা মা যা-ই বলুক, এ-জন্যে আর কারও প্রত্যাশারও কিছু নেই।

সহজ সংযমের মুখোশ ধরে রাখার চেষ্টায় বাপীকে যুঝতে হচ্ছে এখনো। বুকের পাতালে ফুঁসছে কেউ। গজরাচ্ছে।…সামনের দরজা বন্ধ। ফ্ল্যাটে তৃতীয় কেউ নেই। ওটা শেকল ছেঁড়ার আগে বাপী উঠে পড়ল। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। ছিটকিনি টেনে দরজা দুটো খুলে দিয়ে ডাকল, এসো—

লিফটে নিচে নামল পাশাপাশি গাড়িতে উঠে বসল। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি আবার বড় রাস্তায় পড়ে বেগে ছুটল। গণ্ডগোলের দরুণ ফুটপাথে লোক চলাচল কম। ফাঁকা রাস্তা।

মিষ্টি কোন কথা বলছে না। বাপীও চুপ। গাড়ি ছুটেছে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার মগজও থেমে নেই। মিষ্টির কথাগুলো হিসেব করছে। আর ওজন করছে। হিসেব করছে আর ওজন করছে আর নাকচ করছে।

…ভালবাসার পুঁজি বাপী চেনে। তার জোর কত জানে। এই পুঁজি, এই জোরের ওপর তার চিরকালের দুর্বলতা। বনমায়ার মরদ হাতির কবলে পড়ে করতে বসেছিল, তবু ওই আহত পাগলা হাতিটার প্রতি অগাধ দরদ তার। ভালবাসার বুকে দাগ বসিয়েছিল বলে বনমায়ার এককালের মাহুত ভীম বাহাদুর চা-বাগানের লম্পট সাহেবের বুকে ছোরা বসিয়ে পালিয়েছিল—বাপী তখন মনে প্রাণে প্রার্থনা করেছে, ভীম বাহাদুর ধরা যেন না পড়ে। … ব্রুকলিন পিওন রতন বনিকের মুখে সেই ভালবাসার নির্ভরতা দেখেছিল—বাপী নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারে না।…নিজের বুকের তলায় এই পুঁজি পুষছিল বলেই প্রাণ বাঁচানো সত্ত্বেও রেশমাকে অত বড় আঘাত দিয়ে সেই চরম বিপর্যয়ের মুখ থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পেরেছিল!…ভালবাসার নিঃশব্দ অথচ বিপুল স্রোত জঙ্গলের সাপধরা মানুষ হারমার মধ্যে দেখেছে। এই পুঁজি আর এই জোরের ওপর নির্ভর করে ঊর্মিলা বেঁচে গেল।…কোবরেজের ছেলে ছোট কবিরাজ নিশীথ সেনের মুখেও এই ভালবাসার ছোঁয়াটুকু দেখেছিল বলেই অনায়াসে তাকে এখানকার ম্যানেজারের চেয়ারে বসিয়ে দেবার কথা ভাবতে পেরেছিল। সেই ছোঁয়া মুছে গেছে জানা মাত্র তাকে মন থেকেই ছেঁটে দিতে দ্বিধা করেনি।

…অসিত চ্যাটার্জির হাসিতে খুশিতে রাগে ক্ষোভে বা আচরণে এই পুঁজি। আর এই জোরের ছিটে-ফোঁটাও দেখতে পেলে বাপী সেটুকু অনুভব করত। বুঝতে পারত। নিজের বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও জানতে বা চিনতে ভুল হত না।

বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া। কিন্তু শিরায় শিরায় রক্তের তাপ বাড়ছে। মিষ্টির কথাগুলো একটা চ্যালেঞ্জের মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আর যন্ত্রণা ছড়াচ্ছে।

অপেক্ষাকৃত ঘন বসতির কাছাকাছি এসে পড়তে বাপী গাড়িটা হঠাৎ সামনের রাস্তার ডাইনের বাঁকে ঘুরিয়ে দিল। ওই রাস্তাটা ফাঁকা পাবে।…ঘোরার মুখে স্পিড এমনিতেই কমাতে হয়েছে। হঠাৎ রাস্তার ও-ধারে ল্যাম্প-পোস্টের দিকে চোখ যেতেই ব্রেকে চাপ পড়ল। বাপী বিমূঢ়, নিস্পন্দ হঠাৎ।

ল্যাম্প-পোস্টের একটু তফাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়িটা প্রায় থেমে যেতে সপ্রতিভ তৎপরতায় রাস্তায় নেমে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে এলো। তার পরেই আচমকা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো বিষম একটা ঝাঁকুনি খেয়ে মেয়েটা ছিটকে ঘুরে আবার ফুটপাথে উঠে সামনের অন্ধকারের দিকে হনহন করে হেঁটে চলল।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল পনের সেকেন্ডের মধ্যে। গাড়িটা এভাবে থামতে মিষ্টি প্রথম মুখ ঘুরিয়ে বাপীর দিকে তাকালো। তারপর তার হতচকিত দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তার দিকে। মুখ দেখা গেল না, মেয়েটির ততক্ষণে ও-দিক ফিরে পালানোর তাড়া। কিন্তু মিষ্টির পাশের লোক গাড়ি চালানো ভুলে সেদিকে চেয়েই আছে।

—কি ব্যাপার, মহিলাকে চেনো নাকি?

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। বাপী মাথা নাড়ল। চেনে।

—ওভাবে পালিয়ে গেল কেন…আমাকে দেখে?

—হয়ত আমাকে দেখেই। তোমাকে দেখলে এগোতই না।

যাকে চেনে তাকে দেখেই অমন ত্রস্তে পালিয়ে গেল শুনে মিষ্টি অবাকই একটু। বলল, কিছু না পেয়ে লিফটের আশায় দাঁড়িয়ে ছিল হয়ত, ডেকে তুলে নিলে না কেন?

বাপীর দু চোখ সামনের দিকে। জবাব দিল, লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল না।

—তাহলে কি জন্য?

—আমার জন্য…যে কোন একটি পুরুষের জন্য…।

জবাবটা দিয়ে বাপী এবারে আড়চোখে তার মুখখানা লক্ষ্য করল। মিষ্টি স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকেই দেখছে। ওদের মনোহরপুকুরের বাড়ী বাপী চেনে না। সেই রাস্তায় এসে মিষ্টি একবার বাঁয়ে যেতে বলল একবার ডাইনে। তারপর আঙুল তুলে ছোট একটা একতলা দালান দেখিয়ে দিল।

গাড়ি থামতে মিষ্টি একাই নামল। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আসবে না?

—আজ না।

বেগে গাড়ি চালিয়ে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে বাপী আবার সেই রাস্তায় চলে এলো। যেখানে তাকে দেখে এক মেয়ে ত্রস্ত হরিণীর মতো অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেছে। বাপী আশপাশের রাস্তাগুলোতে চক্কর খেল খানিক। অন্ধকার ফুঁড়ে দেখতে চেষ্টা করল।

নেই।

মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমু। কুমকুম। কলকাতায় আসার বড় সাধ ছিল। আসতে পেরেছে।

কিন্তু কলকাতায় আসার সাধ কেমন মিটেছে নিজের চোখে দেখেও বাপী তাকে খুঁজছে কেন? অস্ফুট একটা ইতর গালাগালে নিজেকে বিদ্ধ করে ফেরার রাস্তায় গাড়ি ছোটাল।

সোনার হরিণ নেই – ৩১

মাঠের ধার ঘেঁষে ফাঁকা রাস্তা ধরে আসছিল। মাইলখানেকের মধ্যে ব্রেকে আপনা থেকে চাপ পড়ল আবার। রাস্তার পাশে মাঠের আবছা অন্ধকার ধরে একজন হনহন করে হেঁটে চলেছে।…মেয়ে।

বাপী হেড লাইট জ্বালল। সেই মেয়ে।

মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে কুমকুম।

জোরালো হেড লাইটের ধাক্কায় দাঁড়িয়ে গেল। চোখে মুখে কয়েক মুহূর্তের চকিত প্রত্যাশা। তার পরেই কাঠ একেবারে।

গাড়িটা নিঃশব্দে পাশে এসে থামল। হেড লাইট নিভিয়ে বাপী নেমে এলো। মুখোমুখি দাঁড়াল। পরনে ক্যাটকেটে গোলাপী শাড়ি। গায়ে সস্তা সিল্কের সাদা ব্লাউস। পায়ে লাল স্ট্রাইপ স্যান্ডাল। ঠোঁট লাল, গাল লাল। নাকে ঝকঝকে সাদা পাথরের ফুল। বানারজুলিতে চা-বাগানের ক্লাবে জেল্লা ঠিকরনো এই সাদা ফুলটা দেখেছিল। কপালে কালো টিপ।

বাপী বেশ ধীরেসুস্থে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। রাতের কলকাতায় শিকারে বেরিয়েছিল যে মেয়ে সে নিজেই হঠাৎ এক নির্মম শিকারীর জালে আটকে গেছে। সম্ভব হলে এখনো সত্রাসে ছুটে পালানোর ইচ্ছে, কিন্তু পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। অসহায় বড় বড় দু’ চোখ মেলে সে চেয়ে আছে।

অকরুণ গাম্ভীর্যে বাপী দেখছেই। ওই চোখ-তাতানো প্রসাধন ধুয়ে মুছে ফেললে মুখখানা এখনো মন্দ সুশ্রী নয়। লম্বা আর ফর্সা বলে আগে বেশ স্মার্টই দেখাতো। ডাটাবাবুর ক্লাবে ব্রিজমোহনের সঙ্গিনী হিসেবে যেমন দেখেছিল, চার বছর বাদে বাগডোগরার এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে তার থেকেও বেশি সুন্দর দেখেছিল। সেই চেকনাইয়ে টান ধরেছে। শুকনো মুখ, চোখের কোলে কালি। তবু কলকাতার রাস্তায় এই যৌবনের পসরা নিয়ে দাঁড়ালে খদ্দের না জোটার কথা নয়। আজ চারিদিকের গণ্ডগোলের দরুন রসিক হায়নারা সব গর্তে বোধ হয়।

কিন্তু বাপী এখন কি করবে? মিষ্টিকে ছেড়ে এসে আবার এই পথে এসেছিল কেন? খুঁজছিল কেন? এখন…? ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে যে পশুটা এতক্ষণ ধরে ফুঁসছিল আর গজরাচ্ছিল তাকে ছেড়ে দেবে?…একবার ছেড়ে দিয়েছিল। এই দিনের মতোই এক সবখোয়ানো আক্রোশের মুখে রাতের অন্ধকারে কমলা বনিক সেধে তার খুপরি ঘরে এসেছিল। …

…পরপর তিন রাত এসেছিল। কিন্তু সেই অকরুণ উল্লাসের মুহূর্তে কমলা বণিকের অস্তিত্বও ছিল না। চেতনার মুগুর মাথায় এসে না পড়া পর্যন্ত আর একজন সেই জায়গায় জুড়ে ছিল। খানিক আগে তার লোলুপ গ্রাস থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যে গাড়ি থেকে নেমে গেল—সেই মেয়ে। আজও এই একজনকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারে। তারপর কামনার অন্ধকার গহ্বরে আছড়ে ফেলে তারও অস্তিত্ব মুছে দিয়ে সে জায়গায় অনায়াসে সেই মেয়েকেই বাসনার নরকে টেনে আনতে পারে। বিস্মৃতির শেষে কদর্য বাস্তবে ফেরার পরেও এবারে কোনো বিবেকের মুগুর মাথায় এসে পড়বে না।

চাপা আগুনের হলকা বেরুলো গলা দিয়ে। কেমন কলকাতা দেখছ? কুমকুম জবাব দিল না। কাতর চোখে চেয়ে রইল। মুখে ভয়ের ছায়া ঘন হয়ে উঠছে আরো। সামনে যে দাঁড়িয়ে সে বুঝি মেরেই বসবে তাকে

গলা দিয়ে আর এক প্রস্থ আগুন ঝরল বাপীর।—অত ভয় পাচ্ছ কেন…এ—রকম খদ্দের পছন্দ হচ্ছে না?

ভীত ত্রস্ত চাউনিটা এবারে মুখের ওপর স্থির হল একটু। বাপী অভিনয় দেখছে হয়তো। মুখে কিছু যন্ত্রণার রেখা টেনে আনার চেষ্টা দেখছে। গলার স্বরও ফুটল এবার।—বাপীদা বিশ্বাস করো, ওটা তোমার গাড়ি ভাবতে পারি নি, তাহলে এগোতাম না।…তোমার সঙ্গে যে ছিল তার কাছে হয়তো তুমি অপ্রস্তুত হয়েছ, কিছু রোজগারের তাগিদে মাথা এত খারাপ হয়েছিল যে তাকেও আমি লক্ষ্য করি নি। আমাকে ধরে মারো বাপীদা, তুমি আমাকে বাঁচার রাস্তায় টেনে নিতে চেয়েছিলে, বাবার জন্য পাগল হয়ে আমি তাও—

—চোপ! কথা শেষ হবার আগেই বাপীর মাথায় বিপরীত আগুন জ্বলে উঠল। দুটো হাতের থাবা তার দুই কাঁধে উঠে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কতক প্রবল ঝাঁকুনি।বাবার জন্যে? বাবার জন্য পাগল হয়ে তুমি এই নরকে চলে এসেছ? এখনো এই নাম মুখে?

মেয়েটার চোখে মুখে আর্ত বিস্ময়। তারপর মুক্তি।—তুমি বিশ্বাস করো বাপীদা—শুধু বাবার জন্য, আমি জানতাম বাবা কলকাতায় আছে, সেই এয়ার পোর্টে তোমাকে বলেছিলাম, তুমি তখনো বিশ্বাস করো নি—আমি এসে পড়তে পেরেছিলাম বলেই বাবা এখনো বেঁচে আছে—

বাপীর হাতের থাবা দুটো আপনা থেকেই শিথিল হল। নেমে এলো। কিন্তু দু’চোখের অবিশ্বাস তারপরেও ওই মুখে বিঁধে আছে।তোমার বাবা এখন কোথায়?

—আমার কাছে…ঘরে…

—কার ঘর? কোথায় ঘর?

—এন্টালির কাছাকাছি…ঘর বলতে ভাঙা টালির ঘর। ভয় গিয়ে দু’চোখে হঠাৎ বুভুক্ষু আশার আলো জ্বলে উঠল।—বাবা আর বেশি দিন বাঁচবে না বাপীদা, তুমি একবারটি এসে তাকে দেখে যাবে? গেলে দেখবে, আমি ফিরলে কিছু খেতে পাবে এই আশায় বসে আছে আর ছটফট করছে। তোমাকে দেখলে চিনতে পারবে না, কাউকে চিনতে পারে না…তবু আসবে একবারটি?

আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বাপী ওই মুখ ফালা ফালা করে দেখে নিচ্ছে। প্রাণের দায়ে এমন অভিনয়ও কারো দ্বারা সম্ভব? এ-রকম গাড়ির মালিক যাবে না বা যেতে পারে না ধরে নিয়ে করুণা উদ্রেক করে কিছু পাওয়ার চেষ্টা? কিন্তু এই দুটো চোখকে এত বড় ফাঁকিও কেউ দিতে পারে ভাবা যাচ্ছে না বলেই অস্বস্তি।

—এসো।

বাঁ-দিকের সামনের দরজাটা খুলে দিতে গিয়েও থমকালো। নিজের ভিতর থেকেই বাধা পড়ল। তার পাশে এই সীটে এতক্ষণ মিষ্টি বসে ছিল। পিছনের দরজাটা খুলে দিল।

কুমকুম তক্ষুনি উঠে বসল। বাপীর অস্বস্তি আরো বাড়ল। ওই মুখে এখনো ছলনা দেখছে না। ভয় দেখছে না। ক্ষুধার্ত আশা দেখছে। আকুতি দেখছে। বাপীর অস্বস্তি বাড়ছেই।

নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। বাপী সামনে। পিছনে কুমকুম। বাপী এখনো আশা করছে কোনো অজুহাতে কুমকুম গাড়ি থামাতে বলবে। নেমে যেতে চাইবে। ভিতরে যে কাটা-ছেঁড়া শুরু হয়েছে সেটা থামবে তাহলে। গাড়ি থামিয়ে বাপী তক্ষুনি ওকে নেমে যাওয়ার সুযোগ দেবে। এমন কি পকেটে যা আছে তাও ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। এমন নিষ্ঠুর বাস্তব থেকে ছলনা বরদাস্ত করাও সহজ।

দু’ মাইল রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি ধর্মতলায় এসে পড়ল। পিছনে কেউ আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। ঘাড় সরিয়ে রিয়ারভিউ গ্লাসে দেখতে চেষ্টা করল। তেমনি আশা ঠিকরনো অপলক দুটো চোখের ধাক্কায় বাপী মাথা সরিয়ে নিল। সামনে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, মাস্টারমশাই কলকাতায় আছেন তুমি জানলে কি করে?

পিছনে যে বসে তার গলার স্বরে এতটুকু উচ্ছ্বাস নেই। কি করে জেনেছে বাপী শুনল। শিলিগুড়িতে একটি বাঙালী ছেলের সঙ্গে খাতির হয়েছিল। সরকারী কাজে মাঝে মাঝে তাকে কলকাতা যাতায়াত করতে হত। কুমকুমকে সে চা—বাগানের এক নেশাখোর অত্যাচারী অফিসারের শিক্ষিতা বউ বলে জানত। খাতির কদর পেতে হলে এ-রকম মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হয়। কথায় কথায় কুমকুম একদিন তার আর্টিস্ট বাবার কিছু গল্প করেছিল। তার দু’দিন আগে সেই লোক কালকাতা থেকে ফিরেছে। বাবা আর্টিস্ট শুনে সে-ও কলকাতায় সদ্য দেখা ফুটপাথের এক তাজ্জব আর্টিস্টের কথা বলল। লোকটা বোধ হয় বদ্ধ পাগল। চুল-দাড়ির জঙ্গলের ভিতরে মুখের সামান্যই দেখা যায়, তবু দেখলে ভয় করে। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক-আশাকও তেমনি। খোলা ফুটপাথে বসে থাকে, আর যখন খেয়াল হয়, মস্ত একটা খড়ির ডেলা নিয়ে ফুটপাথে নানা রকমের ছবি আঁকতে থাকে। ফুটপাথের দশ-পনের হাত জুড়ে বড় বড় ছবি। সে-সব এত সুন্দর আর এত পরিষ্কার যে রাস্তার লোক ভিড় করে দেখতে দাঁড়িয়ে যায়। সেই সব তকতকে খাবারের ছবি দেখে লোকটার খিদে পেয়েছে ভেবে কেউ কেউ পয়সাও ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু লোকটা যখন মুখের দিকে তাকায় তখন ভয়ে ভয়ে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়।

শোনামাত্র কুমকুম বুঝেছিল তার বাবা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সেই থেকে তার কলকাতায় আসার তাড়না। সেই বাঙালী ছেলেকেই কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য ধরেছিল। সে কথাও দিয়েছিল পরের বারে যখন যাবে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই সে জেনে ফেলল ও চা-বাগানের কোনো অফিসারের শিক্ষিতা বউ-টউ কিছু নয়। যাদের ভোগের দাসী ছিল তাদেরই কেউ বলে দিয়ে থাকবে। তাই তার নেশা ছুটে গেল আর তাড়িয়েও দিল। তার পরেও কলকাতায় আসার জন্য পাগলের মতো হয়ে উঠেছিল। ট্রেনে চেপে একলাই কলকাতায় চলে আসতে পারত, কিন্তু সাহসে কুলোয় নি। এ-সব জায়গার মানুষই হাঙর এক—একটা, অসহায় একলা মেয়ে দেখলে কলকাতায় মানুষ ওকে জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে, তারপর রাস্তায় ফেলে দেবে সেই ভয়। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা দুই একটা মেয়ের মুখে কলকাতার মানুষদের যে গল্প শুনেছে, তাতে বুকের রক্ত আগেই হিম হয়ে ছিল। কিন্তু অনেকে আশা দেওয়া সত্ত্বেও লোক আর শেষ পর্যন্ত জুটলই না। মরীয়া হয়ে শেষে একলাই কলকাতায় চলে এলো। কলকাতায় হায়নারা যে দিনে-দুপুরে স্টেশনে রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকে জানত না। বাইরের গৃহস্থঘরের বউ অজানা অচেনা জায়গায় এসে পড়েছে বুঝে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই একজন তাকে আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়ে তুলে নিয়ে গেল—

বাপীর এই বিবরণ শোনার ইচ্ছে আর নেই। বলল, এ-সব কথা থাক, কলকাতায় এসেই তুমি মাস্টারমশায়ের দেখা পেয়ে গেলে?

—যেখানে গিয়ে পড়েছিলুম, এক মাসের মধ্যে সেখান থেকে বেরুতে পারি নি। শেষে সেখানকার সর্বেসর্বা মাসি যখন বুঝল কোথাও পালাবার মতো আশ্রয় আর নেই, তখন কড়াকড়ি গেল। সেই বাঙালী লোকটা বাবাকে কোন্ রাস্তার ফুটপাথে দেখেছিল জানতাম। সেই এলাকা ধরে খোঁজাখুঁজি করতে এক জায়গায় পেয়ে গেলাম। কি যে দেখলাম, আর দেখা না হলেই ভালো ছিল বাপীদা।

আশ্চর্য! এই মেয়ের এখনো চোখে জল আসে, কান্নায় গলা বুজে যায়। সেই পাওয়ার চিত্রটাও বাপী শুনল।…এক জায়গায় অনেক লোক ভিড় করে আছে। তাদের মুখ দেখেই বোঝা গেছে সেখানে অশুভ কিছু হয়েছে। কাছে গিয়ে কুমু যা দেখল, বুক শুকিয়ে কাঠ। ফুটপাথে সারি সারি আঁকা খাবারের ওপর মুখ থুবড়ে পাগলের মতো একটা লোক পড়ে আছে। প্রাণ আছে কি নেই বোঝা যায় না। মুখের ওপর মাছি ভন ভন করছে। রাস্তার লোকেরাই কর্পোরেশানের গাড়ি ডেকেছিল। একটু বাদে সেই গাড়ি ফুটপাথের আর্টিস্টকে তুলে নিয়ে গেল। তাদের হাতে পায়ে ধরে কুমকুমও সঙ্গে গেল। চার-পাঁচ দিন বাদে বাবাকে তারা ছেড়ে ছিল। কুমকুমকে বলল, করার কিছুই নেই, শিগগীরই মরে যাবে—যে কদিন টেঁকে ভালো-মন্দ খেতে দাও।

এই বোঝা দেখে ওদের মুরুব্বী মাসি শুধু ওকে ছেড়ে দিল না, দয়া করে মাসে চার টাকা ভাড়ায় একটা ঘরও যোগাড় করে দিল। আজ দেড় মাসের ওপর হয়ে গেল, বাবা এখনো বেঁচেই আছে। ওকেও সব সময় চিনতে পারে না—খুব যখন খিদে পায় তখন চিনতে পারে।

…বাপী এবার কি করবে। গাড়ি থামিয়ে কুমকুমকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে? তারপর পকেটে যা আছে-ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজে পালিয়ে বাঁচবে?

কুমকুমের নিশানা মতো গাড়ি বড়রাস্তা ছেড়ে দু’তিনটে আঁকা-বাঁকা গলি পেরিয়ে একেবারে একটা ঘুটঘুটি অন্ধকার সরু গলির মুখে এসে দাঁড়াল। ওখানে গাড়ি ঢুকবে না। ওই গলির মধ্যে ঘর।

গাড়ি লক করে, অন্ধকারে পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেতে খেতে কুমকুমের পিছনে একটা টালির খুপরির সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে টিমটিম হারিকেন জ্বলছে। মেঝেতে হাড় চামড়া সার একটা বুড়ী বসে। তার সামনে দড়ির খাটিয়ায় আর একটা লোক আধ-বসা। গায়ে মোটা শতেক ফুটোর কম্বল, শনের মতো চুল-দাড়ির বোঝা পিঠ আর বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। কাঠামো দেখে এখনো বোঝা যায় এককালে বেশ লম্বা চওড়া ছিল মানুষটা। হারিকেনের অল্প আলোয় ঘুরে তাকাতে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল বাপীর।

কুমকুমের অনুপস্থিতিতে বুড়ীটার হয়তো তাকে আগলানোর ভার। হাতে ভর করে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাছের মতো ঘোলাটে দুই চোখ একবার বাপীর মুখের ওপর বুলিয়ে কুমকুমের দিকে চেয়ে খনখনে চাপা গলায় বলে উঠল, একটামাত্র ঘরে আবার কাকে এনে হাজির করলি, আমি এখন আমার ঘরে একটু না শুয়ে পারব না—

বাপীর দু’কান গরম। আরো চাপা গলায় কুমকুম তাকে ধমকে উঠল, আঃ! তুমি তোমার ঘরে চলে যাও!

খাটিয়ার দিকে এগিয়ে স্বর চড়িয়ে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, বাবা—কে এসেছে তোমাকে দেখতে, চিনতে পারছ? তোমার সেই আদরের ছাত্র বাপীদা—জলপাইগুড়িতে আমাদের বাড়িতে আসত— পরে অনেক দিন তোমরা একসঙ্গে সেই বাড়িতে ছিলে—মনে আছে? চিনতে পারছ?

গর্তের ভেতর থেকে দুটো চোখ বাপীর দিকে ঘুরল। দৃষ্টি নয়, মুখের ওপর একটা অস্বাভাবিক ক্ষুধার্ত ঝাপটা এসে লাগল। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে বাপীকেই মুখ ফেরাতে হত। একটু বাদেই সেই দৃষ্টি মেয়ের দিকে ঘুরল। ক্রুদ্ধ ফ্যাসফেসে গলায় ধমকে উঠলেন, কাকে চিনব—তুই কে?

মেয়ে নির্ভয়ে আরো কাছে গিয়ে জট-বোঝাই মাথায় হাত রাখল।—এই দেখো, এর মধ্যে নিজের মেয়েকেও ভুলে গেলে? আমি কুমু! চিনেছ?

চিনলেন হয়তো। কারণ রাগে আরো বেশি গরগর করতে করতে বললেন, খিদেয় নাড়ি জ্বলছে ও এলো এখন আমাকে লোক চেনাতে—কি খেতে দিবি?

বাবার মাথার ওপর থেকে হাতটা খসে পড়ল। বিব্রত, বিবর্ণ মুখ। এই যোগাযোগের উত্তেজনায় ঘরে ফেরার আসল সমস্যা ভুলে গেছিল। হালছাড়া অসহায় চোখে বাপীর দিকে তাকালো।

চোখের কোণ দুটো অদ্ভুত দাপাদাপি করছে বাপীর। সামান্য মাথা নেড়ে ওকে কাছে ডাকল। পকেট থেকে পার্স বার করে তিনটে দশ টাকার নোট তার হাতে দিল। বিড়বিড় করে বলল, আমি এদিকের কিছু চিনি না, তুমি নিয়ে এসো…আমি অপেক্ষা করছি।

তিরিশ টাকা হাতে পেয়ে কুমকুমের দ্বিধা। অস্ফুট স্বরে বলল, এত কি হবে… এবারে বাপীরও ধমকে উঠতে ইচ্ছে করল তাকে। তাড়াতাড়ি খাটিয়ার দিকে ফিরে কুমকুম বলল, এক্ষুনি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি বাবা—তুমি ঠাণ্ডা হয়ে থাকো—

চোখের পলকে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল। ললিত ভড় গায়ের কম্বলটা ভালো করে টেনে সোজা সামনের দিকে চেয়ে আবার আধ শোয়া হলেন। হয়তো কথা বলার মেজাজ বা অভিরুচি নেই। হয়তো বা ঘরে আর কেউ আছে ভুলেই গেছেন।

ভদ্রলোক গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে আছেন, বাপী দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে। শার্টের তলায় গেঞ্জিটা সপসপে ভিজে। গুমোটে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরের এই বাতাস শ্বাস-যন্ত্রটা টানতে পারছে না। বুকের ভিতরেও একটা চাপা যন্ত্রণা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওই খাটিয়ার দিকে চেয়ে আছে। মানুষের বেঁচে থাকার ও কি দুর্জয় শক্তি—দেখছে। নিজেদের খাওয়া জোটে না, তবু এই লোক স্ত্রীর বাক্স থেকে দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল। …জেল থেকে ফিরে আসার পর বাপী তাঁর সঙ্গে তাঁরই ঘরে দেড় মাস কাটিয়েছিল। তখন নিজে হাতে ওকে রান্না শিখিয়েছে, যোগব্যায়াম শিখিয়েছে। তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছে তবু কারো বিরুদ্ধে একটা অভিযোগের কথা শোনে নি। একমাত্র অভিযোগ ছিল শাসন-যন্ত্রের বিরুদ্ধে, আর মানুষের বে-সামাল লোভের বিরুদ্ধে।

বাপীর এখনো ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। সব-কিছু দুঃস্বপ্ন ভাবার মতো অনেক দূরে কোথাও। পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে আছে তাই পারছে না। সারি সারি সেই সব স্মৃতির মিছিলে আগুন ধরিয়ে ছাই করে দিতেও পারছে না।

কুমু ফিরে এলো। হাতে বড় একটা শালপাতার ঠোঙা আর একটা মাঝারি সাইজের ভাঁড়। দরজার কাছে আবছা অন্ধকারে বাপীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো একটু। তারপর ত্রস্তে ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের কোণে ঠোঙা আর ভাঁড় রেখে বাবার খাটিয়ার পায়ের দিক থেকে বিবর্ণ তেলচিটে একটা মোড়া এনে বাপীর সামনে পেতে দিল। এ-রকম ভুলের অপরাধটুকু শুধু চোখেই ব্যক্ত করল, মুখে কিছু বলল না।

বাপী আপাতত স্থানকাল ভুলেছে। ওকেই একটু খুশি করার তাগিদে মোড়াটা দরজার কাছে টেনে নিয়ে বসল। একটা কলাই-করা বাসনে কুমু বাবার খাবার সাজালো। কচুরি তরকারি ডাল। থালাটা বাবার সামনে ধরে বলল, খেয়ে নাও।

খাওয়ার নামে শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে বসলেন মানুষটা। গায়ের কম্বল খসে পড়ল। ব্যগ্র দু’হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত থেকে থালাটা ছিনিয়ে নিলেন। ঝুঁকে দেখলেন কি দেওয়া হয়েছে। দাড়ির খানিকটা খাবারের ওপর এসে পড়ল।

সেই খাওয়া দেখেও মাথাটা ঝিকঝিম করছে বাপীর। আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে কুমকুম ইচ্ছে করেই ও-দিকে ফিরে আছে। খেতে খেতে ললিত ভড় একবার মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে বাপীর দিকে। খাওয়ার আনন্দে গর্তের দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে।

বাপী পাথরের মূর্তির মতো বসে। …শহরের হাঙ্গামার রাতেও মেয়ে এই বাপকে ফেলে চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে খদ্দের ধরতে গেছিল। কারো মত্ত ভোগের মাশুল আদায় হলে তবে বাবার খাবার আসবে। সেই খদ্দেরও আজ জোটে নি। বাপীর সঙ্গে আজ দেখা না হলে জঠরের এই খিদে নিয়ে মানুষটার রাত ভোর হত।

থালা খালি। কুমু জিজ্ঞাসা করল, আর দেব?

ব্যগ্র দু’চোখ. মেয়ের মুখের ওপর। কিন্তু একটু বাদে তাঁর গলার স্বরে হঠাৎ জলপাইগুড়ির সেই মানুষটাকেই সামনে দেখল বাপী।—তোমাদের আছে?

—অনেক আছে। কুমু আর দুটো কচুরি আর একটু তরকারী তাঁর থালায় এনে দিল। বলল, বেশি সহ্য হবে না, এর পর মিষ্টি আছে।

‘মিষ্টি’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর চোখের সামনে হঠাৎ মিষ্টির মুখ। কিন্তু ও চেয়ে আছে ললিত ভড়ের দিকে। ‘মিষ্টি’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখের ভাষাও অবর্ণনীয়। দুই-ই লোভ। কত তফাৎ অথচ কত অমোঘ।

খাওয়া হতে কুমু নিজের হাতে তাঁকে জল খাওয়ালো। দাড়ি-ভরতি মুখ মুছিয়ে দিল। একটা গুমরনো যন্ত্রণায় বাপীর শব্দ করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল। দুনিয়ার লোককে চিৎকার করে ডেকে বলতে ইচ্ছে করল, একটা ঘৃণ্য অসতী মেয়ে দেখে যাও তোমরা!

জলের গেলাস হাতে ভিতরের একটা চাপা তাগিদে কুমকুম বলে উঠল, এবারে বাপীদাকে একটু ভালো করে দেখো বাবা—চিনতে চেষ্টা করো— জলপাইগুড়ি থাকতে কত ভালবাসতে বাপীদাকে তুমি—বাপীদাই তো আজ তোমাকে খাওয়ালো!

জবাবে ঘাড় ফিরিয়ে ললিত ভড় একবার দেখলেন। কোটরগত দু’চোখের একটা ঝাপটা মেরে ঘর থেকে বিদায় করতে চাইলেন ওকে। তারপর আবার মেয়ের দিকে ফিরে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, দূর হ’, দূর হ’, এখান থেকে— আমি কাউক্কে চিনি না, কাউকে চিনতে চাই না—তুই আসিস কেন এখানে? কি চাস? আমাকে খাবি? খাবি? খাবি?

মোড়া ছেড়ে বাপী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। গাড়িতে কুমকুম বাড়িয়ে বলেনি। পেট ভরেছে। এখন তাঁর চোখে নিজের মেয়েও অচেনা।

চোখের ইশারায় ওকে ডেকে বাপী বাইরে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের টিমটিমে হারিকেনটা তুলে নিয়ে কুমু তক্ষুনি এগিয়ে এলো। ঘর এখন অন্ধকার কিন্তু সেজন্য ভিতরের মানুষের কোন রকম আপত্তির আভাস পেল না বাপী।

নিজের পকেটে হাত ঢোকালো। কিন্তু আশপাশের খুপরিগুলো থেকে কারো উকিঝুঁকি দেবার সম্ভাবনা মনে আসতে তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিল। আগে গলির বাইরে আসার তাড়া। অস্ফুট স্বরে বলল, এসো আমার সঙ্গে—

গলির মুখে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পার্স থেকে দু’টো একশ’ টাকার নোট বার করে বলল, এই টাকা এখন তোমার কাছে রাখো—

একসঙ্গে দু’শ টাকা মেয়েটার কাছে অভাবনীয় ব্যাপার কিছু। হাত বাড়ালো না। শুধু চেয়ে রইল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে অল্প অল্প।

অসহিষ্ণু বিরক্তিতে বাপী ধমকের সুরে বলল, ধরো! ওর এক হাতে হারিকেন। অন্য হাত তুলে বাপী নিজেই টাকাটা ধরিয়ে দিল। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে শাসনের সুরে হুকুম করল, বাবাকে ফেলে আর তুমি ঘর ছেড়ে বেরুবে না…আমি কাল ঠিক কখন আসতে পারব বলতে পারছি না।

গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে বেরিয়ে গেল। মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই খচখচ করছে। সে না হয় ফ্ল্যাটে গিয়েই মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দিয়ে গা জুড়বে। এখানে যাদের দেখে গেল তারা কি করবে।

পরদিন জিত্ মালহোত্রা একটু সকাল-সকাল এসে হাজির। শহরে কখন আবার হাঙ্গামা বেধে যায় ঠিক নেই। আগে এসে যতটা সম্ভব কাজ সারার তাগিদ। বাপীও তার প্রতীক্ষায় ছিল। দেরাজ খুলে একগোছা টাকা বার করে পকেটে পুরল। তারপর ওকে সঙ্গে করে নিচে নেমে গাড়িতে উঠল।

এন্টালি এলাকারই ভদ্র জায়গায় মোটামুটি পছন্দসই একটা ফ্ল্যাট ঠিক করতে ঘণ্টা আড়াই সময় লেগে গেল। একতলায় ছোট-বড় ছিমছাম দুটো ঘর। বাড়িঅলা দোতলায় থাকে। আলাদা ব্যবস্থা। মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া, ছমাসের ভাড়া আগাম। টাকা গুনে দিয়ে আর রসিদ নিয়ে বাপী বাড়িঅলাকে জানালো, আজই ঘণ্টা-কতকের মধ্যে থাকার লোক এসে যাবে, এর মধ্যে একটু ঝাড়ামোছা করিয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়।

জিতকে সেখানে রেখে এর পর কাছাকাছির একটা ফার্নিচারের দোকানে ঢুকল। ম্যাট্রেসসুদ্ধ রেডিমেড ছোট ছোট দুটো খাট কিনল। একটা ড্রেসিং টেবিল আর আলনাও। ঠিকানা লিখে কুলি দিয়ে সেগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করে সেখান থেকে সাইন বোর্ড দেখে দেখে একটা বেডিং স্টোরস-এ ঢুকল। বিছানা বালিশ তোষক চাদর ওয়াড় সব এক জায়গাতেই পেয়ে গেল। সেসবও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গায় পৌঁছুনোর নির্দেশ দিয়ে বড় রকমের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

অভ্যস্ত না হলেও পকেটে টাকার জোর থাকলে কলকাতা শহরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র যোগাড় করে দুটো ঘর বাসযোগ্য করে তোলা খুব কঠিন কিছু নয়। বাপীও পেরেছে। কিন্তু ভিতরের তৃপ্তিটুকুর স্বাদ আলাদা। জিত্‌ মালহোত্রা মুখ বুজে তাকে সাহায্য করেছে। মালিকটির মেজাজ জানে বলেই এতক্ষণ একটি কথাও জিজ্ঞাসা করে নি। এমন কে আসছে এখানে যার জন্য মনিবের এত দরদ, সে কৌতূহল ছিলই। বেলা প্রায় একটার সময় বাপী তাকে ছুটি দিয়ে চলে যেতে বলতে জিজ্ঞাসা করল, কে আসছেন এখানে…আপনারজন কেউ?

বাপী গম্ভীর। বুড়ো আঙুলটা নিজের বুকে ছুঁইয়ে জবাব দিল, একেবারে এখানকার। কাছাকাছির হোটেলে খাওয়া সারার ফাঁকে আর একটা সমস্যা মনে এলো। যে মূর্তি হয়েছে মাস্টারমশাইয়ের, দেখে সকলেই আঁতকে উঠবে। চুল—দাড়ির ওপর আপাতত হাত নেই। হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে মাঝারি সাইজের একটা সুটকেস কিনল। তারপর রেডিমেড জামা-কাপড়ের দোকান থেকে সব চেয়ে বড় সাইজের দুজোড়া টুইলের সার্ট আর দু’জোড়া পাজামা কিনে ফেলল। শরীরে কিছু নেই, কিন্তু দেহের খাঁচাটা কম নয়। জলপাইগুড়িতে টুইলের শার্টই পরতে দেখত ভদ্রলোককে।

বেলা আড়াইটে তিনটে নাগাদ গলির সেই খুপরি থেকে মাস্টারমশাই আর কুমুকে নিজের গাড়িতে তুলে নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। ললিত ভড়ের বেশবাস শুধু বদলেছে। আচরণে রকম-ফের নেই। কোটরের দু’চোখ ঘর দুটোর ওপর ঘোরাফেরা করে বাপীর মুখের ওপর এসে থেমেছে, তারপর আরো উষ্ণ হয়ে মেয়ের দিকে ফিরেছে। বিড়বিড় করে বলেছেন, খেতে দে, খিদে পেয়েছে।

পরের পাঁচ-ছ’টা দিনও বাপীর এক রকম ঝোঁকের ওপর কেটে গেল। ওপরতলার বয়স্ক বাড়িঅলা লোকটি ভদ্র। তার সঙ্গে আলাপ করে বাপী একজন বড় ডাক্তারের হদিস পেয়ে তাঁকে ধরে এনেছে। কদিনের মধ্যে যাবতীয় পরীক্ষা—নিরীক্ষার পর তিনি জানিয়েছেন রোগীর বাঁচার কোনো আশা নেই। বুক ঝাঁঝরা, পেটে ঘা, মাত্রাতিরিক্ত রক্তাল্পতা—বেঁচে আছেন কি করে সেটাই আশ্চর্য। তবু যতদিন বাঁচেন…। লম্বা ওষুধপত্রের ফিরিস্তি দিয়ে যতটা সম্ভব কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করে গেলেন তিনি। যখন তখন রাজ্যের খিদে ছাড়া আর কি যে কষ্ট মাস্টারমশায়ের বাপী ভেবে পায় না।

ওপরতলার ভদ্রলোক তাঁর চাকরকে বলে একটা বাচ্চা চাকর যোগাড় করে দিয়েছেন। কুমকুমকে সাত কথা জিজ্ঞাসা করলে সহজে একটার জবাব দেয় না। মুখের দিকে চেয়ে থাকে শুধু। পরিষ্কার আটপৌরে জামা-কাপড়ে এখন বেশ সুশ্রীই দেখায় মেয়েটাকে। প্রসাধনের প্রলেপ না থাকতে আরো ভালো লাগে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে না পেয়ে ওই রকম করে চেয়ে থাকে যখন, তখন মুশকিল হয়। মেয়েটার চোখের তারায় কতকালের কান্না জমে আছে ঠিক নেই। বাপীর ভয়, কখন না ভেঙে পড়ে। ও কাঁদতে জানে না, কান্নাকাটি দেখতেও পারে না। তাই ছোকরা চাকরটার সঙ্গেই পরামর্শ করে ওই ছোট্ট সংসারের যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হয়েছে তাকে। চাল ডাল তেল নুন চিনি কেরোসিন, ঝাঁটা মশলাপাতি স্টোভ বালতি মগ হাঁড়ি কড়া সসপ্যান চায়ের কেটলি পেয়ালা প্লেট খাবার ডিশ বাটি— দুজনের একটা সংসার চালাতে এমন আরো কত কি যে লাগে বাপীর ধারণা ছিল না। চাকরটা এসে দফায় দফায় ফিরিস্তি দেয়, অমুক অমুক জিনিস চাই। কুমকুম সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বাপী তক্ষুনি গাড়ি নিয়ে ছোটে। বাপকে ছেড়ে মেয়ে এক ঘণ্টার জন্যেও বাইরে যাক চায় না। কিন্তু নিজের ওদিকে হাঁপ ধরার দাখিল। তবু বাপীর ভিতরের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য রকমের আনন্দের উৎসও খুলে গেছে। এক খাওয়া ভিন্ন আর সব-কিছুর ওপর বীতশ্রদ্ধ এবং ক্রুদ্ধ ওই বিদায়ী মানুষটার জন্য যেটুকু করতে পারছে তাই যেন ওরই পরম ভাগ্য

বাপীর হুকুমমতো মাস্টারমশাইয়ের চুল-দাড়ির জঙ্গল পরামাণিক ডাকিয়ে কুমু কিছুটা সাফ করতে পেরেছে। সবটা পারে নি। এটুকু করতেই নাকি ক্ষেপে গেছিল। পারে তো দু-জনকেই মারে আর কুমু হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে। সব দাড়ি কামিয়ে ফেললে চামড়ার ওপর হাড় উঁচিয়ে উঠবে। একমুখ দাড়ির জঙ্গল জলপাইগুড়ি থাকতেও বাপী অনেক সময় দেখেছে। এটুকু সংস্কারের ফলে এখন সেই মানুষের কিছুটা আদল এসেছে।

ফাঁক পেলে বাপী দু’বেলাই আসছে। সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে এসে দেখে মাস্টারমশাই ঘরে একলা খাটের ওপর বসে আছেন। কুমকুম ঘরে নেই। বাড়িতেও না। সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুগুলো টান-টান বাপীর। কখন কিজন্যে দরকার হয় ভেবে আরো অনেক টাকাই ওই মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়েছে। টাকার অভাবে বাপকে ফেলে বেরুতে হয়েছে এমন হতে পারে না। ওর কড়া নিষেধ সত্ত্বেও নেই কেন? এদিক—ওদিক চেয়েও বাচ্চা চাকরটাকেও না দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।

মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করল, কুমু কোথায়? আপনি একলা কেন?

কথা জিজ্ঞাসা করলে রোজ যা করেন ভদ্রলোক আজও তাই করলেন। গর্তে—ঢোকা দুই চোখের একটা ঝাপটা মেরে অন্য দিকে চেয়ে বসে রইলেন।

বাপী তবু অসহিষ্ণু।—আপনাকে বলে কোথাও গেছে না এমনি চলে গেছে? মুখ না ফিরিয়ে রাগে গজগজ করে উঠলেন—ওষুধ আনতে গেছে, খিদে পেয়েছে খেতে দেবার নাম নেই—আমাকে ওষুধ গেলাবে!

বাপী নিজের কাছেই অপ্রস্তুত একটু। যার মনে চোর সে-ই অন্যের মধ্যে চোর দেখে। দরকারে বেরুতে পারে সেটা না ভেবে প্রথমেই সন্দেহ। একটা মোড়া টেনে কাছাকাছি বসল। ভদ্রলোক এখনো তাকে চেনে না বা পছন্দ করে না। পছন্দ অবশ্য কাউকেই করে না, খিদের তাগিদ ভিন্ন নিজের মেয়েকেও চেনে না। কাছাকাছি বসার দরুন বিরক্ত মুখে ভদ্রলোক আরো একটু ঘুরে বসলেন।

মানুষটা বেশি দিন নেই আর জানা কথাই। ঘরে তাঁকে একলা পেয়ে একটা চাপা আবেগ ভেতর থেকে ঠেলে উঠলে। বলল, আচ্ছা মাস্টারমশায়—

কানে ঢুকল না। অন্য দিকেই মুখ ফিরিয়ে আছেন।

—মাস্টারমশাই! আমি আপনাকে ডাকছি—এদিকে ফিরুন না, দেখুন না আমাকে চিনতে পারেন কি না?

এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ওর দিকে। কোটরের চোখে রাগের ঝাপটা— কে তোমার মাস্টারমশাই?

—আপনি। আমি বাপী—বানারহাট স্কুলে আপনি আমাদের ড্রইং করাতেন, জলপাইগুড়িতে আপনার বাড়িতে আপনার কাছে আমি থেকেছি—কত গল্প করেছি—আপনি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন, যোগ-ব্যায়াম শিখিয়েছেন—আপনার কিচ্ছু মনে পড়ে না?

গর্তে-ঢোকা দুটো চোখ অস্বাভাবিক চিকচিক করছে। রাগে কিনা বাপী বুঝছে না। সাগ্রহে আবার বলল, আপনি কত গল্প করতেন, যুদ্ধের গল্প দুর্ভিক্ষের গল্প— আর কত সুন্দর সুন্দর শ্লোক শোনাতেন—আপনি বলতেন, “দারিদ্র্যে দোষো গুণরাশিনাশী’—বলতেন, স্বদেশের ঠাকুর বিদেশের কুকুর—মনে আছে?

হঠাৎ বুকের তলায় একটা মোচড় পড়ল বাপীর। মনে হল মানুষটার কোটরগত ওই চকচকে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। তার দিকেই চেয়ে আছে। বাপী কি ঠিক দেখছে? ব্যগ্র মুখে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, মনে পড়ছে মাস্টারমশাই—আমাকে চিনতে পারছেন?

এবারে বিড়বিড় করে যে জবাব দিলেন, শুনে বাপীরই রোমে রোমে কাঁটা দিয়ে উঠল।—সব মনে আছে…চিনতেও সব সময়েই পারি…কিন্তু মনে পড়ে কি লাভ…চিনে কি লাভ…কুমুর অসুবিধে, আমারও অসুবিধে…আবার হয়তো আমাকে ফেলে সব পালাবে…কুমুকে বলিস না।

নিজের অগোচরে বাপী ছিটকে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁর সামনে তাঁর খাটে এসে বসেছে। ও কত বড় হয়েছে এখন এই মুহূর্তে অন্তত মনে নেই। জোরে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না মাস্টারমশাই না—আপনার কোনো ভয় নেই। আপনি যতকাল বাঁচবেন আপনার সব ভার আমার—এই আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, আমাকে বিশ্বাস করুন!

বিশ্বাস যে করলেন, অনুভব করতে একটুও সময় লাগল না। গর্তের দু’চোখ জলে ভরে গেছে। দাড়ি-ছাওয়া মুখে হাসি। দেখছেন। নির্নিমেষে চেয়ে আছেন। বললেন, জেল-ফেরত তোর সঙ্গে দেখা হতে ডিস্টিংশনে বি-এস-সি পাশের কথা বলে তুই আমাকে মিষ্টির দোকানে টেনে নিয়ে গিয়ে খুব খাইয়েছিলি, আর আমি তোকে বলেছিলাম বড় নরম মন তোর, তোর কিসু হবে না—মনে আছে?…এখনো এই মন তোর, এত হল কি করে রে!

বাপী চেষ্টা করছে হাসতে। চেষ্টা করছে কিছু বলতে। কোনোটাই পারছে না।

ওষুধের প্যাকেট হাতে কুমকুম ফিরল। এক খাটে দু’জনকে এমন ঘন হয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক।

বাপী খাট ছেড়ে উঠে পড়ল। কুমকুমকে বলল, মাস্টারমশাই আমাকে চিনতে পেরেছেন, সব মনেও পড়েছে! আর ভুল হবে না কথা দিয়েছেন—কিন্তু আমাদের যেন আর এতটুকু ভুল না হয়—বুঝলে?

অপ্রত্যাশিত খুশির ধাক্কায় কুমকুম তাড়াতাড়ি বাবার দিকে তাকালো। তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। গলার কাছে কি দলা পাকিয়ে আছে বাপীর। সেটা আনন্দের কি যন্ত্রণার জানে না। ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা পা ফেলে গাড়িতে এসে উঠল।

সোনার হরিণ নেই – ৩২

টানা চব্বিশ দিনের ট্রাম বয়কটের ফ্যসলা শেষ পর্যন্ত হল। এক পয়সার যুদ্ধ শেষ। সরকারের তরফ থেকে এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি স্থগিতের নির্দেশ ঘোষণার ফলে আপাতত গণদাবির জয়। বাপীর ধারণা পুঁজিপতিরা এ জয় খুব স্বস্তির চোখে দেখছে না। কারণ এর পিছনে নিরীহ মানুষগুলোর সঙ্ঘবদ্ধ বিপ্লবের চেহারাটা উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। চোখ চালিয়ে নিজের ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করেছে বাপী। সেও তো ছোটখাটো এক পুঁজিপতিই হয়ে বসেছে। তবু সাধারণের এই জয় ভার ভালো লাগছে। গা-ঝাড়া দিয়ে বাপী আত্মপ্রসাদ বাতিল করল।

এবারে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। আবু রব্বানীকে একপ্রেস টেলিগ্রাম করে মালের ট্রাক পাঠাতে বলেছে। ফাঁক পেলে নিজেরও একবার ঘুরে আসার ইচ্ছে। পুরো এক মাসও হয়নি কলকাতা এসেছে কিন্তু মনে হচ্ছে কত দিন হয়ে গেল শিকড় ছাড়া হয়ে আছে।

ঊর্মিলাদের যাওয়া কি কারণে এক সপ্তাহের জন্য পিছিয়েছিল। সেই যাত্রারও সময় এগিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন মাত্র ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। শিগগীরই যাবে কথা দিয়েছিল। হঠাৎ ললিত ভড়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন সময় পেয়ে ওঠেনি। সে মেয়ে হয়তো রাগে ফুঁসছে। রাতে ওর নাগালের মধ্যে টেলিফোন নেই। বিজয়ের আপিস থেকে দিনে করতে পারে। এর মধ্যে ক’বার করে তাই করেছে কে জানে। দিনের বেলায় ঘরে আর কতক্ষণ থাকে বাপী, ফোন ধরে কে।

ঊর্মিলার ওখানেই যাবে ঠিক করে প্যান্ট আর শার্ট বদলাবার জন্য সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে ফিরেছিল। একটু বাদে দরজার ওধারে কলিং বেল বেজে উঠল। বাপী অবাক একটু।…কে হতে পারে। একটু আগে জিত্ মালহোত্রাকে ছেড়ে এসেছে—সে নয়। একমাত্র মিষ্টি চেনে এই ফ্ল্যাট। সে এসেছে ভাবা যায় না। তার কাছ থেকে ঠিকানা আর ফ্ল্যাটের হদিস নিয়ে দিপুদা আসতে পারে অবশ্য।

দ্বিতীয় দফা বেল বাজল। বাপী এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।

অসিত চ্যাটার্জি। ফর্সা মুখে খুশি উপচে উঠল। সঙ্গে অন্তরঙ্গ অনুযোগ কি ব্যাপার বলো তো তোমার! কদিনের মধ্যে নো-পাত্তা! আপিস থেকে রোজ কবার করে টেলিফোন করছি কেউ ধরেই না! আপিস-ফেরতা দু-দিন এসে ফিরে গেলাম—তুমি নেই, দরজায় তালা।

লোকটাকে দেখামাত্র একটা বিজাতীয় আক্রোশ ভেতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল। তার সঙ্গে যুঝতে হলে মুখে দরাজ হাসি টেনে আনতেই হয়। এসো অসিতদা এসো। আমিও কদিন ধরে তোমার কথাই ভাবছিলাম। একদম সময় পাইনি। এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বসার জায়গায় নিয়ে এলো।—আমার ফ্ল্যাটের হদিস আর টেলিফোনের নম্বর তোমাকে কে দিল?

সোফায় আরাম করে বসে জবাব দিল, বাঃ মিলু এসেছিল না!

সাদা কথায় কদিন আগে যার স্ত্রী এসে গেছে এখানে, তার স্বামী কেন জানবে না। কিন্তু এত সাদা বাপী ভাবতে পারছে না। ঠিকানা বা ফোন নম্বর পেলে এই লোক এখানে এসে হানা দেবে অথবা যোগাযোগ করবে জানা কথাই। তবু দিয়েছে। দিয়ে মিষ্টি বোঝাতে চেয়েছে, যে যাই ভাবুক ওদের পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার কোনো অভাব নেই। ফাঁকিও নেই।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে একবার চোখ চালিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ভিতরের দিকটাও একবার দেখে নিল। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে মন্তব্য করল, নাঃ, টাকা না থাকলে সুখ নেই—চমৎকার ফ্ল্যাট তোমার। তারপরেই অন্তরঙ্গ অথচ কড়া অনুযোগ। আমি আসি আর যাই করি তোমার ওপর কিন্তু দারুণ রেগে আছি।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীরও আকাশ থেকে আছাড় খাওয়া মুখ।—কি অপরাধ করলাম?

—বাড়ির দোরে সেদিন মিলুকে নামিয়ে দিলে, একবারটি ভিতরে এলে না বা দেখা করলে না!

মগজে বক্র চিন্তার কারিকুরি চলেছে। মুখের হাসিতে খুঁত নেই।—মিস্…মানে মিলু গিয়েই তোমার কাছে নালিশ ঠুকল বুঝি?

খুশি থাকলে লোকটা প্যাচ-ট্যাচের ধার ধারে না বাপী আগেও লক্ষ্য করেছে। এখনো নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করল না, ইয়ে মেজাজটা সেদিন আমার খুব ভালো ছিল না, আর দিনটাও কেমন ছিল তোমার মনে আছে তো? হাঙ্গামা, গুলি-গোলা—অথচ রাত পর্যন্ত ওর বাড়ি ফেরার নাম নেই। তুমি বলো, চিন্তা হয় না?

বাপী ঘটা করে মাথা নাড়ল। চিন্তা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

—আমি ভাবলাম ওই মওকায় ঠিক কেউ না কেউ ওকে নিজের বাড়ি টেনে নিয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি ভাই, মিলুর আপিসের খাতিরের লোকগুলোকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না—বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাতির করার জন্য বা লিফট দেবার জন্যে সর্বদা হাঁ করে আছে। আর মিলুরও একটা গুণ স্বীকার করতেই হবে, আমি রেগে যাই জেনেও মিথ্যে বলে না—জিগ্যেস করলে কোথায় ছিল বা কোথায় গেছিল সত্যি কথাই বলে দেয়। রাত সাড়ে আটটায় বাড়ির দোরে গাড়ি থামতে ভাবলাম তাদের কেউ হবে—আমার তখনকার মেজাজ বুঝতেই পারছ। সেই মেজাজের মুখে যখন শুনলাম তুমি ওর আপিসে এসে ধরে নিয়ে গেছ আর তুমিই বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেলে তখন আমিই আবার উল্টে হাঁ। দোরগোড়ায় এসেও পালিয়ে যেতে দিল বলে তখন মিলুকেই বকলাম।

এমন বিশ্বাস আর এই হৃদ্যতার কথা শুনে ভিতরটা আরো হিংস্র হয়ে উঠছে বাপীর। এই ঘরে বসে বাপী সেদিন যে খোঁচাটা দিয়েছিল, এ তারই জবাব মিষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে লোকের রোগের খোঁচা দিয়েছিলে সে তোমাকে কত পছন্দ করে আর কত বিশ্বাস করে নিজের চোখেই দেখো।

মুখের মেকি হাসি গলায় নামল। বলল, অত রাতে তোমার খপ্পরে পড়লে সহজে ছাড়া পেতাম! হাতে সময় নিয়ে যাব’খন একদিন।…কিন্তু জানান না দিয়ে আজ প্রথম দিন এলে, ঘরে তো সেসব কিছুই মজুত নেই—

মাখন-মার্কা হৃষ্টবদনে লজ্জা-লজ্জা হাসি।—না হে, তোমার এখানে এসে আর ওসব চলবে না…কখ। দিতে হয়েছে।

—কি ব্যাপার? ভিতরে একপ্রস্থ হোঁচট খেলেও বিস্ময়টুকু নির্ভেজাল।

চোখের মিটিমিটি হাসিতে সোনালি ফ্রেমের চশমাটাও বেশি ঝিকমিক করছে এক কথায় পাঁচ কথা বলার অভ্যেস রয়েসয়ে জবাব দিল, মিলুর মাথা ইদানীং আগের থেকে ঠাণ্ডা দেখছি, কথায় কথায় আগের মতো অত রেগে ওঠে না…নিজের দাদা আর মায়ের ওপরেই বরং এখন বেশি রাগ। তারাই আমার মাথাটা বিগড়ে দিচ্ছে বুঝছে বোধ হয়। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা মাখামাখিতে আপত্তি নেই—আপত্তি শুধু ড্রিংক করার ব্যাপারে। খুব ইচ্ছে হলে বাড়িতে বসে একটু-আধটু ড্রিংক করতে পারি—কিন্তু তোমার এখানে এসে নয়।

বাপীর ঠোঁটে হাসি। মগজ তৎপর আবার। এতক্ষণের হিংস্র থাবাটার এক ঘা বসিয়ে দেবার সুযোগ আপনা থেকে উপস্থিত। মিষ্টি সেদিন কিছু জোরের সঙ্গে বড়াই করে গেছিল। এই লোকের ভালবাসার জোর। তাতে ভেজাল নেই বলেই তার একটু-আধটু বিকৃতি বরদাস্ত করতেও অসুবিধে হবে না বলেছিল। মিষ্টির সেই সব কথা একটা যন্ত্রণার মতো দাগ কেটে আছে। বাপী বিশ্বাস করেনি, কারণ এই জোরের দিকটা সে চেনে। নিজেকে দিয়ে চিনেছে, অনেক দেখে চিনেছে।

ঊর্মিলার ওখানে যাওয়ার চিন্তা আজও বাতিল। জোরের যাচাই কিছুটা এই রাতেই হতে পারে। মিষ্টিকে কথা দিয়েছে তার এখানে এসে ড্রিংক করবে না। লোকটাকে কথা রাখার মতো সবল ভাবতেও রাজি নয় বাপী। অন্তরঙ্গ সুরে বলল, চায় না যখন একেবারে ছেড়েই দাও না, ও আর এমন কি জিনিস।…কিন্তু আমার এখানে এসে ড্রিংক ছাড়া আর কিছুতেই নিষেধ নেইতো?

— আর কি? —

—কাজের চাপে হাঁসফাঁস দশা গেছে কটা দিন, সবে আজই একটু হাল্কা হতে পেরেছি তাই তোমাকে পেয়ে দারুণ ভাল লাগছে…শিগগীর ছাড়া পাচ্ছ না। কিন্তু আমার বেজায় খিদে পেয়ে গেছে, আগে কোথাও গিয়ে বেশ মেজাজে ডিনার সেরে আসা যাক চলো।

অসিত চ্যাটার্জির তক্ষুনি ঘাড় কাত. এসবে আপত্তি করার মতো বেরসিক নয়।

আধ ঘণ্টার মধ্যে বাপীর গাড়ি পার্ক স্ট্রীটের এক জমজমাট রেস্তরাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে আলোর বহর দেখে এটাই সব থেকে অভিজাত মনে হল। এত গাড়ি দাঁড়িয়ে যে পার্ক করার জায়গা মেলা ভার। রাস্তার উল্টো দিকে জায়গা খুঁজে বার করতে হল।

ঢোকার পথে পাগড়ি আঁটা তকমা-পরা দারোয়ান সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল। ভিতরে পা দিয়ে বাপীরই চোখে ঘোর লাগার দাখিল। পায়ের নিচে পুরু গালচে বিছানো। অন্ধকার-ছোঁয়া খুব মৃদু আর নরম লালচে আলোয় মানুষ দেখা যায়, দশ হাত দূরের মুখ ভালো দেখা যায় না। বাইরে থেকে এলে বা অনভ্যস্ত চোখে এ আলোয় চোখ বসতে সময় লাগে। মদিরাচ্ছন্ন বাতাস, ডিশে কাঁটা বা চামচ ঠোকার টুন-টান শব্দ, সোডার ফসফস মুখ খোলা, মেয়ে-পুরুষ বহু গলার গুনগুন রব, মিহি মোটা হাসি—ভোগবতীর আমেজ ঠাসা আসর।

এখানে ক্যাবিনের বালাই নেই। রসিক-রসিকারা আড়াল কেউ চায় না। দূরে দূরে দু’জন চারজন বা ছ’জনের তকতকে টেবিল চেয়ার। টেবিলে ধপধপে সাদা ঢাকনা। নিচে সিট নেই, দোতলার ব্যালকনিতে ঠাঁই মিলল। দোতলার পরিবেশও একই রকম জমজমাট।

বেয়ারা ফুড চার্ট আর ড্রিংক চার্ট রেখে গেল। ড্রিংক চাৰ্টটা ঠেলে সরিয়ে বাপী ফুড চার্টটা টেনে নিয়ে বলল, এখানকার ফুড খুব ভালো, সেদিন এক পার্টিকে নিয়ে এসেছিলাম—তারা অবশ্য বলে এখানকার ড্রিংকের কোনো তুলনা নেই…তা আমি তো এসবের মর্ম বুঝি না, আমার ফুডই ভালো লাগল।

চারিত্রিক নীতির প্রশ্ন যেখানে, বাপী পারতপক্ষে মিথ্যে বলে না। কিন্তু চাণক্যনীতির মুখে বাছ-বিচার নেই। তখন অম্লানবদন। গম্ভীর। ফুড বাছাই চলছে। আড়চোখে এক-একবার সামনের মুখখানাও লক্ষ্য করছে। অসিত চ্যাটার্জির দু চোখ ব্যালকনির সব কটা টেবিলে ঘুরছে। কি মেয়ে কি পুরুষ, কারো গেলাস এখানে সুরাশূন্য নয়।

একটু বাদে নোটবই আর পেন্সিল হাতে অর্ডার নেবার জন্য স্টুয়ার্ড এগিয়ে এলো। বাপী জাঁকালো ডিনারের অর্ডার দিল। লেখা শেষ করে অফিসার থমকে তাকালো। অবাকই একটু।—নো ড্রিংক?

—নো ড্রিংক।

সে চলে গেল। লালচে ঝিমুনো আলোয় অসিত চ্যাটার্জির ফর্সা মুখ নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে এখন। তবু একটু হাসি টেনে বলল, এখানে এসে ড্রিংক-এর অর্ডার না দেওয়া ওরা বোধ হয় আর দেখেনি।

—তা আর কি করা যাবে, কথা যখন দিয়েছ…।

—কথা দিয়েছি বলতে, গঙ্গাজলে গলা ডুবিয়ে তো আর প্রতিজ্ঞা কিছু করিনি।—এদের খাবার আনতে সময় লাগবে, তেষ্টাও পেয়ে গেছে।

বোকা-বোকা মুখে বাপী জলের গেলসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল।

—ধেৎ, জল কে খাবে, এখানে এসে নিরেমিষ গেলার কোনো অর্থ হয় না, তোমার অভ্যেস নেই তাই বুঝলে না—তুমি ভাই যা হোক একটা-দুটো দিতে বলো, গলা না ভেজালে কিছু নামবে না।

—একটা দুটো মানে…

ড্রিংক?

এত তেষ্টা যে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না অসিত চ্যাটার্জির। মাথা নাড়ল।

বাপী টেবিলে আঙুল ঠুকে বয়কে ডাকল। ছাপানো ড্রিংক চাৰ্টটা কাছে টেনে নিয়ে কোন জিনিসটার সব থেকে বেশি দাম দেখে নিল। তারপর সেই নামের ওপর আঙুল রেখে কার্ড সামনে ঠেলে দিল।—এ জিনিস চলবে?

ঝুঁকে নাম দেখেই অসিত চ্যাটার্জির দু-চোখ চকচক করে উঠল।—অনেক দাম যে…

এক পেগের অর্ডার নিয়ে বয় চলে গেল। বাপীর কোমল-গম্ভীর দু’চোখ সামনের লোকের মুখের ওপর স্থির একটু।—আমার কাছে তুমি এর থেকে ঢের দামী মানুষ, সকলে তোমাকে বোঝে না কেন আমি ভেবে পাই না।

সোনালি চশমা আঁটা মাখন-মূর্তি গলেই যাচ্ছে।—হিংসে, স্রেফ হিংসে ভাই, কিন্তু আমিও অসিত চাটুজ্জ্যে, কারো তোয়াক্কা রাখি না।

হুইস্কির গেলাসে সোডা ঢেলে দিয়ে বয় চলে যেতে বাপী বলল, শাশুড়ী জামাইকে আর সম্বন্ধী ভগ্নীপতিকে ভালো চোখে দেখবে না বরদাস্ত করবে না— এ কেমন কথা বুঝি না।

দুটোেক গলা দিয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে অসিত চ্যাটার্জির ভিন্ন মূর্তি। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু লোক ভাবে যে নিজেদের। বরদাস্ত করবে কি করে? তাদের মেয়ে বোনকে রেস জুয়া আর মদের নেশায় একেবারে সর্বস্বান্ত করে ফেললাম না।

তাপ বাড়ার ফলে এবারের চুমুকে গ্লাসের অর্ধেকের বেশি শেষ! নিরীহ বিস্ময়ে বাপী চেয়ে রইল একটু।—মদ তো তোমাকে খুব একটা বেশি খেতে দেখি না…রেস আর জুয়া সত্যি বেশি খেলো নাকি?

—ক্ষেপেছ! ওরা যাই ভাবুক অত টাকা কোথায় আমার! মৌসুমের সময় মাঠে এক-আধদিন যাইনে এমন নয়, আর জুয়াও একটু-আধটু খেলি সত্যি কথাই—কিন্তু সে সব তোমার কাছে নস্যি—তবু তাই বলে ওদের অত মাথা—ব্যথা কেন! ওদের কাছে কখনো হাত পাততে গেছি!

গেলাস খালি। বাপীর হুকুমে বেয়ারা দ্বিতীয় দফা গেলাস সাজিয়ে দিয়ে গেল। ডিশ থেকে একটা দুটো চিনেবাদাম তুলে বাপী দাঁতে কাটছে, আর অনেকটা আপন মনেই হাসছে। নতুন গেলাসে নতুন চুমুক বসিয়ে মাখন-মুখ উৎসুক।— হাসছ যে?

—না, ভাবছিলাম…

—কি?

—আমাদের চিন্তাটিন্তাগুলো দিনে দিনে কেমন ছোট হয়ে গেল, মানে ন্যারো হয়ে গেল সেই কথা। …নইলে এই ঘোড়দৌড় আমাদের সেই কতকালের রাজরাজড়ার খেলা, যার যত বড় দিল তার-এ খেলায় ততো বেশি টান।…জুয়াতে হেরে যুধিষ্ঠির হেন মানুষ সভার মধ্যে নিজের স্ত্রীকে বে-ইজ্জত পর্যন্ত করালেন তাতে দোষ হল না, আর আমরা দশ-বিশ টাকায় একটু আনন্দ পেতে চাইলেই মস্ত দোষ।…আর সুরা জিনিসটাই বা কি? আসল—দেব-দেবতা থেকে শুরু করে মহাযোগী ঋষি পর্যন্ত এ জিনিস ছাড়া কার চলত?

কথা নয়, সমস্ত মন ঢেলে কথকতা শুনছে অসিত চ্যাটার্জি। তারপর গলায় সবটুকু আকুতি ঢেলে বলল, বাপী আমাদের বাড়িতে একবারটি এসে মিলুকে ঠিক এমনি করে বলে বোঝাও, ওই মা আর দাদাটি সত্যি মাথাটা ওর মাঝে মাঝে বিগড়ে দিচ্ছে!

রসালো ডিনার শেষ হবার ফাঁকে মোট চারদফা গেলাস শেষ। এরপর আর একবার ওয়ান ফর দি রোড-এও বাপী আপত্তি করল না। পঞ্চম গেলাস শেষ হতে ঘড়িতে সাড়ে দশটা। বিল মিটিয়ে বাপী চটপট উঠে পড়ল। আর বাড়লে লোকটাকে হয়তো সিঁড়ি দিয়ে নামানো দায় হবে।

হাত ধরে নিচে নামালো। রাস্তায় এসে ট্যাক্সির খোঁজ। রাস্তার ওধারে দু’তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই আছে। তাকে ধরে পার হতে হতে বাপী বলল, আমাকে তুমি কিন্তু মুশকিলে ফেললে অসিতদা, মিলুকে কথা দিয়েও কথা রাখলে না—ও আমাকেই এরপর যাচ্ছেতাই বলবে—

আর তিন হাতের মধ্যে ট্যাক্সি। তার আগেই লোকটা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলায় হুমকি।—কি? তোমাকে যাচ্ছেতাই বলবে? মিলু ছেড়ে মিলুর বাপ এসে কিছু বলুক দেখি তোমাকে—মুখ একেবারে ভোঁতা করে দেব না? আমার নাম অসিত চাটুজ্জে!

…টাকা মন্দ খরচ হল না আজকে। বাপীর পরিতুষ্ট মুখ। খরচের কড়ায় গণ্ডায় সার্থক। ফ্ল্যাটে এসেও নিজের মনে হেসেছে আর অসিত চ্যাটার্জি ঘরে ফেরার পর মিষ্টির মুখখানা কেমন হতে পারে কল্পনা করতে চেষ্টা করেছে। তার জোরের মানুষের জোর বোঝা গেছে। মিষ্টি বুঝতে চায় না, কারণ এই জোরের কল্পনাটুকুই ওর কাছে শেষ সম্বল। জোর গলায় বলেছিল, এতে ভেজাল থাকলে ও নিজেই ছেঁটে দিত বা দেবে।…দেখা যাক।

পরদিনও সকাল থেকে একটা প্রচণ্ড লোভের রাশ টেনে ধরে আছে। এয়ার অফিসে গিয়ে মিষ্টির মুখখানা একবার দেখার লোভ। আজ ও গিয়ে দাঁড়ালে সেই মুখের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় দেখার বাসনা।

নিজেকে আগলাবার জন্যেই সকালের কাজের পর দুপুরের লাঞ্চ সেরেই ঊর্মিলার ওখানে চলে গেছে। আর মাত্র দুটো দিন আছে ওরা, ওই মেয়ে ক্ষেপেই আছে। বিকেলে আবার কোন ফ্যাসাদে আটকে যায় কে জানে। মাস্টারমশায়ের শরীর সকালে বেশ খারাপ দেখে এসেছে। প্রতিদিন থেকে প্রতিদিন খারাপ মনে হচ্ছে। তাঁর সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে বোঝা যায়। সকালে ভদ্রলোক ওকে বলেছে পারলে বিকেলে আবার আসিস বাবা, তোকে দেখলেই প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়। বাপী আসবে আশ্বাস দিয়ে এসেছে।

বিজয় আপিসের কার সঙ্গে দেখা করার জন্যে নিচে নেমেছে। এখন আর ওর আপিস নেই। বেশ লম্বা একপ্রস্থ বকা-ঝকা রাগারাগির পর ঊর্মিলা একটু ঠাণ্ডা মাথায় বাপীকে ভালো করে লক্ষ্য করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, দিনে না হয় তুমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত…রাতে কি নিয়ে ব্যস্ত?

—রাতে ব্যস্ত তোমাকে কে বলল?

—কাল রাত সাড়ে দশটায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিজয়কে এদিকের এক সাহেবের ফ্ল্যাট থেকে তোমাকে ফোন করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। ফোন বেজে গেছে, কেউ ধরে নি।

আগে যে প্রসঙ্গ বাপী এড়িয়ে গেছে, আজ হঠাৎ তার বিপরীত ঝোঁক কেন, জানে না। ঠোঁটের হাসিতে কৌতুক মিশল একটু। জবাব দিল, কাল রাতে হোটেলে একজনকে এনটারটেন করতে হল।

যেভাবে বলল, ঊর্মিলার চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে জানা কথাই।—একজন? মহিলা না ভদ্রলোক?

—ভদ্রলোক। তবে যা ভাবছ তার সঙ্গে তাঁর যোগ আছে।

ঊর্মিলা উৎসুক।—কি যোগ?

—মহিলার হাজব্যান্ড।

ঊর্মিলা ডবল উৎসুক।—মিষ্টির হাসব্যান্ড! রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত তাঁকে একলা এনটারটেন করলে?

বাপী হাসছে মিটিমিটি। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, আর একদিনও হোটেলে করেছিলাম—

বড় বড় চোখ করে ঊর্মিলা আগে একদফা পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর জোর দিয়ে বলল, তোমার মতিগতি একটুও ভালো দেখছি না—ভদ্রলোককে পথে বসাবার মতলব নাকি?

—ভদ্রলোকের যা চরিত্র নিজেই অনেকখানি পথে বসে আছে।

ঊর্মিলার চাউনি এখনো বিস্ফারিত তেমনি। মিষ্টির সঙ্গে তোমার দেখা হয়? বাপী নির্লিপ্ত। না হবার কি আছে।

ঊর্মিলা ব্যগ্রমুখে ঝাঁঝিয়ে উঠল, আর আমাকে একটিবার দেখালে না! আমার এত ইচ্ছে ছিল…

কথার মাঝে থমকালো। কৌতূহলের ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়তে লাগল। গলার স্বরেও চাপা আবেগ মিশল একটু।—বাপী, তোমাকে আমি বোধ হয় তোমার থেকেও ভালো চিনি…তুমি কক্ষনো কোনো ছোট কাজ করতে পারো না, করবেও না। মাঝখান থেকে আরো দুঃখু পাওয়ার রাস্তা করছ না তো?

শেষের কথায় বাপী কানও পাতল না। এতক্ষণের দাবিয়ে রাখা সেই লোভটাই আবার মাথায় চেপে বসল। মিষ্টির সামনে আজই একটিবার গিয়ে দাঁড়ানোর দুর্বার লোভ। সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যানও ঠিক। গম্ভীর।—তুমি আর দয়া করে আমার ওপর মাস্টারি করতে বোসো না—যাকে পেয়েছ তাকেই সামলে-সুমলে রাখো। দুদিন বাদে আমেরিকা দেখতে তো যাচ্ছ—ভালো করে কলকাতা দেখা হয়েছে?

তক্ষুনি রেগে ওঠার সুযোগ পেল ঊর্মিলা।—খুব দেখা হয়েছে, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একজন আপিস ঠ্যাঙাচ্ছে—আর একজনের কলকাতায় এসেও পাত্তা নেই—জিগ্যেস করতে লজ্জাও করে না!

বাপী তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল।—লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, রেডি হয়ে নাও। আমি ততক্ষণে নিচে নেমে বিজয়ের বুকে একটু দাগা দিয়ে আসি—

.

ঊর্মিলার খুশি আর ধরে না। হড়বড় করে এটা সেটা গল্প করে চলেছে। সেই খুশির ফাঁকে গাড়ির স্পিড কত চড়ানো হয়েছে খেয়াল নেই। বাপীর ঘড়ির দিকে চোখ আছে। বেড়ানোর নামে বেরুনো বেড়াতে একটু হবেই। আর বিকেল চারটের মধ্যে সেই এয়ার অফিসের দরজায় গাড়ি ভিড়ানোরও তাগিদ।

ঠিক সময় ধরেই পৌঁছুলো। নিজে গাড়ি থেকে নেমে ঊর্মিলাকে বলল, নামো—

এয়ার অফিসের সাইনবোর্ড দেখে ঊর্মিলা অবাক!—এখানে কোথায়?

—ভয় নেই, আজই টিকিট কেটে তোমাকে নিয়ে কোথাও হাওয়া হয়ে যাচ্ছি না। এসো—

ওকে নিয়ে দোতলায় উঠল। কয়েক পা এগোলেই সেই ঘর। অপেক্ষা করতে হল না, ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। দরজা ঠেলে বাপীই প্রথম ভিতরে ঢুকল, তারপর ওটা রেখে বাইরের দিকে চেয়ে ডাকল, এসো—

কলম রেখে মিষ্টি সোজা হয়ে বসেছে। এই লোককে দেখামাত্র মুখে তাপ ছড়াচ্ছিল। তারপরেই অবাক। ঊর্মিলাও ভিতরে পা দিয়ে বিমূঢ়।

বাপী গম্ভীর। এটা যে অফিস তার জন্য ভ্রূক্ষেপ নেই। ঊর্মিলাকে বলল, দেখো—

ঊর্মিলা বড় বড় চোখ করে সামনে চেয়ে দেখল খানিক। মিষ্টিও।

মিষ্টি। চাপা উচ্ছ্বাসে প্রায় নিজের অগোচরে ঊর্মিলার গলা দিয়ে নামটা বেরিয়ে এলো। তারপর টেবিলের কাছে এগিয়ে একমুখ হেসে বলল, আমাদের ফ্রে কি দুষ্টু দেখো, আমি মিষ্টি দেখতে চেয়েছিলাম বলে আগে থেকে কিচ্ছু না জানিয়ে হুট্ করে এনে হাজির করল! ঘুরে বাপীর দিকে তাকালো।—আমি তো মিষ্টি দেখলাম কিন্তু আমি কে ওঁকে বললে না?

গায়ত্রী রাইয়ের মেয়ে, তার বুদ্ধি নেই কে বলবে। জায়গা বুঝে আমার না বলে আমাদের ফ্রেন্ড বলল। বাপীর একেবারে সাদামাটা মুখ। জবাব দিল, বলার দরকার নেই, বুঝেছে। সব থেকে দূরের চেয়ারটায় বসল সে।

ঊর্মিলা আবার টেবিলের দিকে ফিরল।—কে বলো তো?

ঊর্মিলা। সৌজন্যবোধে মিষ্টির ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি। তার এই ব্যক্তিত্ব যতটা সজাগ ততোটা সহজ নয়।—বসুন।

ইচ্ছে করেই তুমি’র জবাবে ‘তুমি’ বলল না।

—বসুন! মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে পড়ে অকৃত্রিম খুশির সুরে ঊর্মিলা বলল, আমি ভাই আস্ত একখানা জংলি মেয়ে, আপনি-টাপনি শিকেয় তুলে রেখে দাও। আঙুল তুলে বাপীকে দেখালো।—ওই জবরদস্ত ফ্রেন্ড-এর ওপরেও প্রথম দিনই তুমি চালিয়ে কেমন ঘায়েল করেছিলাম জিগ্যেস করো।

স্বতোৎসারিত খুশির উষ্ণ স্পর্শ একটু আছেই। চেষ্টা করলেও এরকম মেয়েকে ঠাণ্ডা ব্যবধানে সরিয়ে রাখা সহজ নয়। মিষ্টি তবু ওদিকের লোকের দিকে একবারও না তাকিয়ে ঈষৎ তেরছা সুরে বলল, মালিকের মেয়ের কাছে ঘায়েল হতে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার।

ঊর্মিলার চোখ তক্ষুনি বড় বড় আবার।—ভাগ্য আমার? তুমি তাহলে ফ্রেন্ডকে কেমন চেনো? মেয়ে ছেড়ে উল্টে খোদ মালিকই কেমন ঘায়েল হয়ে গেল জানো না তো। ভুরু কুঁচকে ঘাড় বেঁকিয়ে বাপীর দিকে তাকালো। বলে দেব?

বাপী ছোট হাই তুলল একটা—তোমার জিভ আর কে টেনে ধরে রাখতে পারছে।

আবার একটা খুশির ঝাঁকুনি দিয়ে ঊর্মিলা সামনে তাকালো।—কটা বছরের মধ্যে মাকেই ও যেভাবে ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল, হিংসেয় আমার গা জ্বলে যেত—আমি বলতাম মায়ের বয়েস আর দশটা বছর কম হলে আর ওর দশটা বছর বেশি হলে ঠিক একটা গড়বড় হয়ে যেত!

অফিস আর ব্যক্তিত্ব ভুলে মিষ্টিও এবারে একটু হেসেই ফেলল।—চা বলি?

ঊর্মিলা বাপীর দিকে ফিরল।—খাবে?

চেয়ারের কাঁধে মাথা রেখে বাপী ঘরের ছাদ দেখছে।—আমার অনুমতি দরকার?

—ছাই দরকার। মিষ্টির মুখোমুখি। —বলো।

বেল টিপে হুকুম করতে বেয়ারা দু’ মিনিটের মধ্যে ট্রে-তে পট আর তিনটে পেয়ালা রেখে গেল। সেই ফাঁকে ঊর্মিলা টেবিলে দু-হাত রেখে আর একটু ঝুঁকে মিষ্টিকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে খুশির মন্তব্য।—সত্যি মিষ্টি। গম্ভীর থাকলে মিষ্টি, হাসলে মিষ্টি, কথা কইলে মিষ্টি—এত মিষ্টি আমি ভাবিনি!

পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে মিষ্টি একবার তার দিকে তাকিয়ে আলতো করে জিজ্ঞাসা করলো, নিজের মুখ আয়নায় দেখো-টেখো না?

—আমার সঙ্গে তোমার তুলনা! আমি হলাম গিয়ে একটা জংলি মাকাল ফল…লেখাপড়ায় কাঁচকলা—আর তুমি? এক-একবার কাগজে তোমার রেজাল্ট বেরোয় আর ওই বাবুর তখন—

কি হচ্ছে! সোজা হয়ে বসে একটা পেয়ালা টেনে নিতে নিতে বাপী বলল, পরস্ত্রীর কাছে এইসব গল্প করার জন্য তোমাকে এখানে আনা হয়েছে নাকি?

এই প্রথম মিষ্টি সোজা তাকালো তার দিকে। চেষ্টা সত্ত্বেও ভিতরের আঁচ গোপন থাকল না খুব। গলা না চড়িয়ে বলল, পরস্ত্রী যে সে-জ্ঞান ওর থেকে তোমার আর একটু বেশি থাকলে আমার সুবিধে হয়।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বাপী দেওয়ালের ক্যালেন্ডার দেখছে। নিস্পৃহ গোছের জবাবও দিল। —মনে রাখতে চেষ্টা করব।

গত রাতে একজন মাতাল হয়ে ঘরে ফেরার কারণে এই উষ্মা আর এই মুখই দেখবে আশা করেছিল। কিন্তু ঊর্মিলা একটু ঘাবড়ে দিয়ে বলল, আমি এলাম বলে…?

তার দিকে চেয়ে মিষ্টি তক্ষুনি হাসল—তুমি এলে বলে ও-কথা বলব কেন? তোমাকে সত্যি খুব ভালো লেগেছে।

ঊর্মিলা সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল। বলো কি।

—হ্যাঁ ঠোঁটের ফাঁকে তার পরেও হাসি ঝুলছে।—তোমাকে দেখার পর ভাবছি এক-একটা লোক কত বোকা হয়। খুব মন দিয়ে তারা ট্র্যাজিক হিরো হতে চেষ্টা করে।

এবারে মোলায়েম খোঁচাটা বাপীর ঠিকই লাগল। নাগালের জনকে ছেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরের দূরের জনকে নিয়ে বিভোর হয়ে থাকার খোঁচা। কিন্তু সময় বুঝে ঊর্মিলাও চোখ কপালে তুলতে জানে। একটু চেয়ে থেকে তরল গলায়ই বলে উঠল, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ অত বুঝিনে ভাই…ফ্রেন্ডের ওপর তুমি খুব রেগে আছ এটুকু শুধু বুঝছি। তুমি কেন, ও আমাকে কম জ্বালিয়েছে। তবু তো তোমাকে আমার থেকে বেশি কেয়ার করে—তুমি আর তোমার বর ওর খোঁজখবর রেখো একটু, নইলে আরো অধঃপাতে যাবে।

মিষ্টি নিজেকে ব্যক্তিত্বের সংযমে বেঁধেছে আবার। সামান্য মাথা নেড়ে স্পষ্ট অথচ মোলায়েম সুরে বলল, আমাদের অত সময় হবে না ভাই—এতকাল তোমরা খোঁজ-খবর রেখেছ, তোমরাই রেখো।

—আমরা! দুদিন বাদে আমরা তো আমেরিকায়! জানোই না বুঝি? বোকার মতো ফেঁসে গেলাম বলে, নইলে এই লোকের ভার কেউ কাউকে দেয়! তরল উচ্ছ্বাসে জিব এবারে আরো আলগা। কি অন্যায় দেখো, ছেলেদের বেলায় তিন—চারটে বউ নিয়ে ঘর করলেও দোষ নেই, আমাদের বেলায় একের বেশি হল তো মহাভারত অশুদ্ধ।

রসের কথায় ঊর্মিলা এমনিতেই ঠোঁট কাটা মেয়ে। কিন্তু এখন যেন ইচ্ছে করেই আরো বেপরোয়া। ও-পাশ থেকে বাপী আলতো করে বলল মহাভারতে তোমাদের একসঙ্গে পাঁচজনের ঘর করার নজির আছে, এত যখন টান বিজয়কে বলে দেখতে পারো…যদি রাজি হয়ে যায়। …

ঊর্মিলা ভ্রুকুটি করে তাকালো তার দিকে।—দেব ধরে থাপ্পড়। তারপরেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—আজ চলি ভাই, অনেক হামলা করে গেলাম—তোমার মনে থাকবে নিশ্চয়।

সৌজন্যবোধে মিষ্টিও উঠে দাঁড়াল। মুখের ওপর চোখ রেখে হাসছে অল্প অল্প। সামান্য মাথাও নাড়ল।

—থ্যাংক ইউ। বাপীকে ডাকল, এসো—

ঊর্মিলা আগে আগে দরজার দিকে এগলো। পিছনে বাপী। ঊর্মিলা দরজা ঠেলে বেরুতেই বাপী ঘুরে দাঁড়াল।

টেবিলের ও-ধারে মিষ্টি দাঁড়িয়ে তখনো। ঠোঁটের হাসি মিলিয়েছে। বাপী চেয়ে আছে। মিষ্টিও। এতক্ষণের উষ্ণ তাপ সেই পলকের মধ্যেই মুখের দিকে ঠেলে উঠেছে।

পলকা গাম্ভীর্যে বাপী বলল, চলি তাহলে?

মিষ্টি জবাব দিল না, চেয়েই আছে।

বাপী দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো।

.

বাপী গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের দিকে গম্ভীর মনোযোগ। পাশে ঊর্মিলা। আড়ে আড়ে দেখছে তাকে। একটু বাদে আধাআধি ঘুরেই বসল। ভুরুতে পলকা ভ্ৰূকুটি। আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হবার মতো করে বলল, তাহলে কি দাঁড়াল?

বাপী নির্লিপ্ত জবাব দিল, কি আর, তোমার দেখার ইচ্ছে ছিল, দেখা হল।

ঊর্মিলারও গম্ভীর হবার চেষ্টা। সামান্য মাথা নাড়ল।—হ্যাঁ দারুণ দেখা হল। প্রথমে মিষ্টি দেখলাম। তারপর মিষ্টির চোখ দিয়ে তোমাকে দেখলাম। শেষে তোমার চোখ দিয়ে মিষ্টিকে দেখলাম। এত দেখার ধাক্কায় এখন আমি খাবি খাচ্ছি, আর ভাবছি এ-সময়ে মায়ের বেঁচে থাকার খুব দরকার ছিল।

মায়ের কথায় বাপী একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিল তাকে।—এ সময়ে মানে?

—মানে বুঝতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে? মা ছাড়া কেঁ আর তোমাকে চুলের ঝুঁটি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে বানারজুলির মাটিতে পা দুটো পুঁতে রাখতে পারত?

বিবেকের কাঁটা ফোটাতে চায় ভেবে বাপীর ভিতরটা উষ্ণ হয়ে উঠল। তবু নিস্পৃহ সুরেই জিগ্যেস করল, তোমার খুব ভাবনা হচ্ছে?

—খুব। সম্ভব হলে বিজয়কে বলে যাওয়া ক্যানসেল করতাম।…এক্ষুনি কি ভাবছিলাম জানো?

ভিড়ের রাস্তা। বাপী মুখ ফেরালো না। কান খাড়া

—ভাবছিলাম…এই মিষ্টি-হারা হয়ে বানারজুলিতে ফিরে সেই রাতে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে যে তুমি একেবারে শেষ করে দাও নি সেটা নেহাত মায়ের পুণ্যির জোর। মিষ্টি তোমার চোখে কত মিষ্টি সেটা আজ বোঝা গেল। কিন্তু আমার মায়ের মতো অত পুণ্যির জোর তার স্বামী বেচারার আছে?

ধরা পড়ে বাপীরও মুখোশ খুলছে। ঠোটের ফাঁকে ক্রূর হাসির ঝিলিক।—নেই মনে হল?

—খুব। থাকলে মিষ্টি আরো ঢের সহজে তোমাকে বরদাস্ত করতে পারত। নয়তো ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারত। তার বদলে শ্যাম আর কুল দুই নিয়ে বেচারী কেবল জ্বলছে মনে হল।

বিশ্লেষণ শুনে কান জুড়লো। মা গায়ত্রী রাই তোমার মেয়ের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। ভিতরে পরিতুষ্ট আরো। মেয়েটা ভালবাসতে জানে বলেই ভালবাসার অনেক চেহারাও অনায়াসে মনে দাগ কাটে। তবু গায়ত্রী রাইয়ের মেয়েকে আর বাড়তে দেওয়া নিরাপদ ভাবছে না। তাই সামনে মনোযোগ। গম্ভীর। বাজে বোকো না।

—বাজে বকা হল? ঊর্মিলার গলা চড়ল একটু।—ওর বরকে তুমি একলা হোটেলে নিয়ে গিয়ে এনটারটেন করো কোন মতলবে—উদারতা দেখাও, না বুকে ছুরি বসাও?

সামনে ট্র্যাফিকের লাল আলো জ্বলে উঠেছে বাপীর সেদিকে খেয়াল নেই। একটা ক্রুদ্ধ ডাক শুনে আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামালো। অদূরের পুলিশটা চেঁচিয়ে উঠেছে আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির নম্বর নেবার জন্য নোটবইটাও হাতে উঠেছে। তাড়াতাড়ি গাড়িটা ব্যাক করে বাপী সাদা দাগের এধারে নিয়ে এলো। রুষ্ট পুলিশের দিকে চেয়ে এমন করে হাসল যেন লজ্জায় তারই মাথা কাটা যাচ্ছে। আশপাশের গাড়ি থেকেও অনেকে দেখছে।

ছদ্মরাগে ঊর্মিলার দিকে ফিরে বাপী চোখ পাকালো।—তুমি মুখ বন্ধ করবে, না এর পর লোক চাপা দেব?

কিন্তু মুখের কথা শেষ হবার আগেই চোখ দুটো হঠাৎ প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা খেল একটা। ঊর্মিলার ও-পাশ ঘেঁষে রং-চটা একটা ছোট অস্টিন গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভার চালকের বিস্ফারিত দুই চোখ এই গাড়ির দিকে। তার পাশে যে বসে সেই মহিলারও। স্থান-কাল ভুলে দু’জনেই তারা ঝুঁকে বাপীকে দেখছে, ক্রিম রঙের ঝকঝকে বিলিতি গাড়ি দেখছে, আর ঊর্মিলাকে দেখছে।

অস্টিনের চালকের আসনে বসে মণিদার পাশের বাড়ির কনট্রাকটর সন্তু চৌধুরী। তার পাশে মণিদার বউ গৌরী বউদি

…সন্তু চৌধুরীর স্টিয়ারিং-ধরা ডান হাতের পুষ্ট কব্জিতে সেই মস্ত সোনার ঘড়ি। দু’হাতের আঙুলে সেই রকম ঝকঝকে সাদা আর নীল পাথরের আংটি পরনে ট্রাউজার গায়ে সিল্কের শার্ট। শার্টে হীরের বোতাম। ফর্সা রং বটে, মুখশ্রী আগেও সুন্দর ছিল না। ছটা বছর বয়েস বাড়ার দরুন কিনা জানে না, দেখামাত্র এই সাজসজ্জায় মানুষটাকে বাপীর আগের থেকেও খারাপ লাগল।

আগে লাল আলো খেয়াল না করে পুলিশের ধমক খেয়েছে। এখন আবার সবুজ আলোয় থেমে আছে দেখে পুলিশ হাঁক দিল। পিছনের দাঁড়ানো গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে, পাশের অস্টিনও ততক্ষণে বিশ গজ এগিয়ে গেছে। রাস্তাটা পেরিয়ে বাপী গাড়ির স্পিড চড়াতে গিয়েও ব্রেকে পা রাখল। সামনের অস্টিন ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গৌরী বউদি নামছে।

নিজের গাড়ি বাপী হাত দশেক পিছনে দাঁড় করালো। সামনের অস্টিন ওর জন্যেই দাঁড়িয়ে গেছে বুঝতে অসুবিধে হল না। গৌরী বউদি শুধু নয়, সন্তু চৌধুরীও নেমেছে। স্টার্ট বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ঊর্মিলাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাপীও হাসি-হাসি মুখে নেমে এলো।

গৌরী বউদির পরনের হাল্কা নীল দামী শাড়ি। গায়ের শামলা রঙের সঙ্গে মানায় না এমন কটকটে শাড়ি বা ব্লাউস আগেও পরত না। তবে প্রসাধনের পরিপাট্য আগের থেকে কিছু বেড়েছে মনে হল। তা সত্ত্বেও বয়েসের দাগ স্পষ্ট। কাছে আসার ফাঁকে বাপী হিসেব করে নিয়েছে।…সেদিন আঠাশ ছিল, এখন চৌত্রিশ। আঠাশের ধারালো কথাবার্তা আর তার থেকেও বেশি ধারালো মেজাজের ফাঁকে যে রসের দাক্ষিণ্য উঁকিঝুঁকি দিত, এখন তাতেও টান ধরেছে মনে হয়।

বিস্ময়ের ধাক্কায় সন্তু চৌধুরীর বরং আগের থেকেও দিল-খোলা হাসি মুখ। কাছে আসতে এক হাত কাঁধের ওপর তুলে দিয়ে বলল, আমরা তাহলে ভুল দেখি নি ব্রাদার—অ্যাঁ?

বাপীও হাসিমুখে মাথা নাড়ল। ভুল দেখে নি। তোয়াজের সুরে বলল, সন্তুদা আবার কবে ভুল দেখেছে।

এই সন্তু চৌধুরীই একদিন ওর চেহারাখানা ‘ডিসেপটিভ’ বলেছিল বাপী ভোলে নি। ভদ্রলোক আবার হাসল এক দফা।—তোমার বউদি তো দেখেও বিশ্বাস করতে পারে নি, তাই গাড়ি থামিয়ে নামলাম। কথার ফাঁকে আপাদ-মস্তক চোখ বুলিয়ে নিল একবার।—বিশ্বাস করা শক্তই অবশ্য…সেই তুমি পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে এই তুমি! কি ব্যাপার বলো দেখি ভায়া, চাকরিতে তো এত বরাত ফেরে না—ব্যবসা?

বাপী তেমনি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল।

সন্তু চৌধুরী ওর ঝকঝকে বিলিতি গাড়িটা আর একবার দেখে নিল। একই সঙ্গে ঊর্মিলাকেও। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যবসা? কলকাতাতেই?

জবাবে কোটের ভিতরের পকেট থেকে মোটা ব্যাগটা বাপীর হাতে উঠে এলো। আইভরি ফিনিশড কার্ড বার করে তার হাতে দিল। ফ্ল্যাট নেবার পর এ কার্ড নতুন করা হয়েছে। ব্যবসার নাম মালিকের নাম বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর সবই এতে ফলাও করে ছাপা আছে।

কার্ডটা উল্টে-পাল্টে দেখে সন্তু চৌধুরী সেটা গৌরী বউদির দিকে এগিয়ে দিল। হাতে নিয়ে গৌরী বউদিও চোখ বোলালো। বাপীর এখন অন্তত ‘ডিসেপটিভ মুখ তাতে নিজেরও সন্দেহ নেই। বুকের তলায় খুশির ঢেউ, বাইরে, লজ্জা-লজ্জা মুখ

তরল স্বীকৃতির সুরে সন্তু চৌধুরী বলল, তোমার সঙ্গে সেই পাঞ্জায় হারার পরেই আমার মনে হয়েছিল তুমি কালেদিনে কিছু একটা হবে—নাও ইউ আর রিয়েলি সামবডি! এ গ্রান্ড সারপ্রাইজ ব্রাদার—

গৌরী বউদিকে একবার দেখে নিয়ে সন্তু চৌধুরী আবার বাপীর দিকে তাকালো। খুব মজাদার কিছু মনে পড়েছে যেন।—তোমার বউদির সঙ্গে একটাও কথা বলছ না কি ব্যাপার! চওড়া কপালের তুলনায় ছোট ছোট দুই চোখে কৌতুক উপচে উঠল। জবাবের অপেক্ষা না রেখে তরল উচ্ছ্বাসে নিজেই মুখর আবার।—আমি ভায়া সব-কিছু স্পোর্টিংলি নিয়ে থাকি, বুঝলে? সেদিক থেকে আমি এভার গ্রীন অ্যান্ড এভার ইয়ং। হুট করে তুমি ঘর-ছাড়া হতে আমি তোমার হয়েই এক হাত লড়েছিলাম কিনা জিগ্যেস করে দেখো!

বেশ গলা ছেড়ে হেসে উঠল সন্তু চৌধুরী। বাপীর হাসি-ছোঁয়া নিরীহ দু’চোখ এখন গৌরী বউদির মুখের ওপর। চকিত ধড়ফড়ানিটুকু দৃষ্টি এড়ালো না। তার ঘরছাড়া হবার ব্যাপারটাকে এই লোকের কাছে গৌরী বউদি যে নিজের কদর বাড়ানোর মতো করেই বিস্তার করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাগ দূর থাক বাপীর মজাই লাগছে।

সামলে নিয়ে বিরক্তির ভ্রুকুটি জোরালো করে তুলল গৌরী বউদি। ঝাঁঝালো গলায় বলল, মেয়েমানুষের সঙ্গে কি ইয়ারকি হচ্ছে। ছ’বছর আগের সেই মেজাজেই বাপীর দিকে ফিরল।— মস্ত মানুষ হয়েছ দেখতে পাচ্ছি, গরিব দাদার বাড়ির রাস্তা আর মনে নেই নিশ্চয়ই?

বাপী অম্লানবদনে জবাব দিল, নিশ্চয় আছে। হুকুম হলেই যেতে পারি।

গৌরী বউদি অপলক চেয়ে রইল একটু। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার হুকুম করার দিন গেছে, ইচ্ছে হলে যেও একদিন…বাচ্চু এখনো তার বাপীকাকাকে ভোলে নি।

সাদা কথা ক’টা প্রাঞ্জল ঠেকল। গৌরী বউদির রাগ বিরাগ বা ঠেসঠিসারার সঙ্গে গলার এই সুর মেলে না। কিন্তু বাচ্চুর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটা নির্দয় হয়ে উঠতে চাইল।…বছর সাতেক বয়েস ছিল তখন ছেলেটার, এখন বছর তের হবে। এই বয়সে বাপী অনেক জানত অনেক বুঝত, অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতো। আবু তখন বলত, মেয়ে-পুরুষের ভালবাসাবাসির ব্যাপারে মানুষে জানোয়ারে কোনো তফাৎ নেই। এই গৌরী বউদি আর মণিদা বানারজুলি বেড়াতে আসার ফলে বাপীর চোখের সামনে রহস্যের শেষ পর্দাটুকুও ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেছিল।…আজ নিজের ছেলে মায়ের এই অভিসার কি-চোখে দেখছে? কি ভাবছে?

গৌরী বউদির দৃষ্টি আবার পিছনের গাড়ি অর্থাৎ ঊর্মিলার দিকে। সন্তু চৌধুরীও ঘনঘন ওদিকেই তাকাচ্ছিল। চাপা আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোক এবারে বাপীর দিকে ফিরল।—মেয়েটি কে…বাঙালী মনে হচ্ছে না তো?

— বাঙালী নয়।

—তোমার বউ?

বাপী চট করে গৌরী বউদির গম্ভীর মুখখানা দেখে নিল একবার। ঠোঁটের ফাঁকে সরস হাসি, সন্তু চৌধুরীর দিকে ফিরে জবাব দিল, আমার নয়, অন্য এক ভদ্রলোকের বউ।

গৌরী বউদি তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নিরাপদ ব্যবধান বুঝে সন্তু চৌধুরী চাপা আনন্দে গলা খাটো করে বলল, কংগ্রাচুলেশনস! তোমাকে দেখে খুব আনন্দ হল ব্রাদার…ফাঁক পেলে তোমার বাড়ি যাব’খন একদিন।

ভুল বোঝার ইন্ধন নিজেই যুগিয়েছে। ওই হাসি মুখের ভোল পাল্টে দেবার জন্য হাত দুটো নিশপিশ করে উঠল এখন। ওদিক থেকে গৌরী বউদির নীরব ঝাঁঝালো তাড়া খেয়ে ব্যস্ত পায়ে সন্তু চৌধুরী তার গাড়ির দিকে এগোল।

নিজের জায়গায় ফিরে গাড়িতে স্টার্ট দিতেই ঊর্মিলা ধমকে উঠল, মেয়েছেলে দেখলেই অমন আটকে যাও কেন—বসে আছি তো বসেই আছি।

সামনের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। বাপী ধীরে সুস্থে চালাচ্ছে।

ঊর্মিলা আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে দেখে ভদ্রলোক আর মহিলা দু’জনেই খুব অবাক মনে হল…কে?

সামনে চোখ রেখে বাপী এবার গম্ভীর মুখে জবাব দিল, মহিলা আমার জ্যাঠতুতো দাদার বউ। ভদ্রলোক তাঁর প্রেমিক

ঊর্মিলার চাউনি উৎসুক। ঠিক বিশ্বাস হল না। তরল সুরেই আবার জিগ্যেস করল, তোমার আর মিষ্টির মতো?

বাপী ভিতরে ভিতরে ধাক্কা খেল একপ্রস্থ। গৌরী বউদির সঙ্গে সন্তু চৌধুরীর সম্পর্কটা কোন দিন নোঙরামির ঊর্ধ্বে মনে হয়নি বাপীর। তাই জবাবও অকরুণ।——বিজয় আর ফুটফুটে একটা ছেলেকে ফেলে তোমার অন্য কোনো লোকের ঘর করার মতো।

ঊর্মিলা বুঝল। সঙ্গে সঙ্গে নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠল, কি বিচ্ছিরি! একটু বাদেই উৎসুক আবার।—এই জন্যেই তোমার ওপর মহিলাকে একটুও খুশি মনে হল না।——কিন্তু ওঁরা আমাকে অমন ঘন ঘন দেখছিলেন কেন—আর শেষে ভদ্রলোক কি বলছিলেন তোমাকে?

বাপী শেষেরটুকুর জবাব দিল। বলল, আমিও অন্যের বউয়ের সঙ্গে আনন্দ করে বেড়াচ্ছি ধরে নিয়ে ভদ্রলোক আমাকে কংগ্রাচুলেট করছিলেন।

ঊর্মিলা বাপীর কাঁধে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নিজে সোজা হয়ে বসল।

বাপী বিমনা। মিষ্টির অফিস থেকে যে মেজাজ নিয়ে বেরিয়েছিল তার সুর কেটে গেছে। ছ’টা বছর জুড়ে মণিদার ছেলে বাচ্চুর মুখখানা ভাবতে চেষ্টা। করল। পারা গেল না। সাত বছরের সেই দুষ্টু কচি মুখখানা চোখে ভাসছে।

বুকের তলায় অবাঞ্ছিত মোচড় পড়ছে একটা।…মিষ্টির কোলেও আজ যদি একটা বাচ্চা থাকত বাপী কি করত? অসহিষ্ণু আক্রোশে চিন্তাটা মগজ থেকে ছিঁড়ে সরাতে চেষ্টা করল। পারল না। ভিতরের কেউ বরাবর যা করে তাই করছে। ওকে বিচারের মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে। জিগ্যেস করছে, সন্তু চৌধুরীর সঙ্গে তফাৎ কোথায়? তফাৎ কতটুকু?

ওই অদৃশ্য বিচারকের মুণ্ডুপাত করতে চেয়ে বাপী মনে মনেই ঝাঁঝালো জবাব দিল, তফাৎ ঢের, তফাৎ অনেক—মিলন আর ব্যভিচারে যত তফাৎ—ততো।

কিন্তু ক্ষোভে আর আক্রোশে ওই একজনকে কেন্দ্র করে নিজের ভিতরটাও সময় সময় কত ব্যভিচারী হয়ে ওঠে বাপী জানে। বিবেকের এই দ্বন্দ্ব থেকেও নিজেকে খালাস করার তাড়না। জীবনের শুরু থেকে সমস্ত সত্তা দিয়ে যার ওপর দখল নিয়ে বসে আছে তারই হাতে মার খাচ্ছে মনে হলে বাসনার আগুন শিরায় শিরায় জ্বলে ওঠে সত্যি কথাই। সর্বস্ব গ্রাস করেই তখন তাকে আবার সেই দখলের অন্তপুরে টেনে এনে বসাতে চায়। ব্যভিচার শেষ কথা নয়। এক দরজায় ঘা খেলে ব্যভিচার সতের দরজায় হানা দিয়ে বেড়ায়। মিষ্টি আর অসিত চ্যাটার্জির সম্পর্কটাকেও মিলন ভাবতে রাজি নয় বাপী তরফদার। তার চোখে এও ব্যভিচার। তাই এত দাহ, এত যন্ত্রণা। যাকে পেয়েছে, চোখ কান বুজে মিষ্টি তাকেই দোসর ভাবতে চাইছে।

…যদি সত্যি হয়, বাপীর যদি ভুল হয়ে থাকে, আর কারো বিচারের দরকার হবে না। বাপীর নিজের বিবেকই তাকে বেতের ঘায়ে দূরে সরিয়ে নেবে।

.

বিদেশে পাড়ি দেবার খানিক আগে ঊর্মিলা আবার না বুঝে এই বিবেকের ওপরেই আঁচড় কেটে বসল। বাপী এয়ারপোর্টে এসেছে ওদের তুলে দিতে। অকারণ ব্যস্ততায় বিজয় মেহেরা এদিক-ওদিক টহল দিচ্ছে। ঊর্মিলা একটা সোফায় চুপচাপ বসে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। মন খারাপ! বাপীকেও সামনে বসিয়ে রেখেছে।

মন বাপীরও ভালো না। গায়ত্রী রাইয়ের এই মেয়ে কত কাছের। আজ এত দূর চলে যাচ্ছে বলে সেটা আরো বেশি অনুভব করছে। তবু নিজে হালকা হবার আর ওকে হালকা করার জন্যে টিপ্পনীর সুরে বলল, অত মন খারাপের কি হল, গিয়ে তো দুদিন বাদেই ভুলে যাবে।

ঊর্মিলা সোজা হয়ে বসল একটু। চোখে পলক পড়ছে না। বলল, বাপী, তোমাকে ফেলে আমার সত্যি যেতে ইচ্ছে করছে না।

বাপী ঘাড় ফিরিয়ে বিজয়কে খুঁজল। অদূরে দাঁড়িয়ে সে মালের ওজন দেখছে। বাপী এদিক ফিরল আবার।—ডাকব?

—ডাকো, বয়েই গেল। আমি কেন বলছি তুমি বেশ ভালোই জানো। তার থেকে এখানকার পাট তুলে নিয়ে বানারজুলি চলে যাও না বাপু, আমি নিশ্চিন্ত হই—

বাপী হাসছে মিটি-মিটি।—গেলাম। তারপর?

—তারপর আবার কি? সেখানে আবু রব্বানী আছে, সে তোমাকে পাহাড়ের মত উঁচু-মাথা প্রাণের বন্ধু ভাবে—যতদিন না দেখাশুনার জন্য লোক ঘরে আসছে, সে দেখবে। ধমকে উঠল, হাসছ কেন?

—হাসছি না। ভাবছি।…বিজয়কে বাতিল করে তোমাকেই যদি আটকে ফেলতাম, তুমি কি করতে?

—তোমার মাথা করতাম।

—যে আসবে সে-ও তাই করবে না কি করে বুঝলে?

—কেন করবে? যে আসবে তারও যে একজন বিজয় থাকবে তার কি মানে?

—কিন্তু যার কাছে আসবে তার কেউ আছে জানলে?

রাগত সুরে ঊর্মিলা বলে উঠল, কে আছে? কোথায় আছে? সব চুকেবুকে গেছে যখন, ঘটা করে জানানোর দরকারটা কি?

বাপীও গম্ভীর এবার।—সব চুকেবুকে গেছে যখন তোমারই বা আমাকে নিয়ে এত দুর্ভাবনার কারণটা কি?…তুমি নিজেই বলো আমি কক্ষনো কোনো ছোট কাজ করতে পারি না—সে-বিশ্বাস এখন আর নেই তাহলে?

ঊর্মিলার মুখে আর কথা যোগালো না। চেয়ে আছে। চোখ দুটো বেশি চিকচিক করছে। এবারে তাকে একটু আশ্বাস দেবার মতো করে বাপী বলল, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, চুকেবুকে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে সব ফুরিয়েই গেল। গেছে কিনা তাতে আমার যেমন সন্দেহ, তোমারও তেমনি। এর মধ্যে ছোট কাজ, বড় কাজ কিছু নেই, সুযোগ পেলে এর ফয়সালা আমি করব, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এই ইচ্ছেটাকে তুমি সাদা চোখে দেখতে পারছ না বলেই অশান্তি ভোগ করছ। সব গুলি মেরে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাতাস সাঁতরে চলে যাও।

বাপী আবার হাসছে বটে, কিন্তু খুব কাছের একজন অনেক দূরে চলে যাচ্ছে এটুকু অনুভব না করে পারছে না। মাইকে যাত্রীদের সিকিউরিটির দিকে এগোতে বলা হল। ওদিক থেকে বিজয় মেহেরা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো।

আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ওদের এরোপ্লেন আকাশে উড়তে দেখা গেল। অন্ধকারে এরোপ্লেন ঠিক দেখা গেল না। সগর্জনে একটা বড় আলো দেখতে দেখতে ছোট হয়ে গেল, তারপর আর দেখা গেল না।

.

ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। ফাঁকা রাস্তায় বাপী তীব্র বেগে গাড়ি চালিয়ে আসছে। গাড়ি. সার্কুলার রোডে পড়তেই মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে হল। ঊর্মিলার ওখানে ছোটাছুটিতে আর কাজের ঝক্কিতে দু’দিনের মধ্যে একটা খবরও নেওয়া হয়নি। তার আগেও ভাল কিছু দেখেনি। ভদ্রলোক এখন নিশ্চিন্তে খুব নিশ্চিত কোন দিকে পা বাড়িয়েছেন সেটুকু আরো স্পষ্ট।

এত রাতে উনি জেগে নেই হয়তো। কুমুর জেগে থাকা সম্ভব। বাড়ির কাছের একটা লাইব্রেরিতে নাম লিখিয়েছে। ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে বই আনায়। বাবা বিছানার পাশে বসে রাত জেগে বই পড়ে। বাপী যখনই যায়, লাইব্রেরির ছাপ—মারা একটা না একটা বই চোখে পড়ে। ছোকরা চাকরটা একদিন বই বদলে এনে তার সামনেই হেসে হেসে বুড়োবাবুকে অর্থাৎ মাস্টারমশাইকে বলছিল, লাইব্রেরীর লোক নাকি ঠাট্টা করেছে, তার দিদিমণি এই রেটে পড়লে শিগগীরই লাইব্রেরি ফাঁকা হয়ে যাবে। কুমকুম লজ্জা পেয়েছে। মাস্টারমশাই মেয়ের রাত জেগে বই পড়ার কথা বলেছিলেন। বাপীর মনে হয়েছে, সময়ে ঘুমে এরই মধ্যে এই মেয়ের অভ্যস্ত হওয়ার কথা নয়।

যাবে কি যাবে না, দ্বিধা। আবার তক্ষুনি তা নাকচ করার ঝোঁক। গাড়ির স্পিড আরো চড়ল।

যা আশা করেছিল, তাই। দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। নিঃশব্দে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো। ঘরের দরজা বন্ধ। মাস্টারমশায়ের ঘরের দরজায় কয়েকটা মৃদু টোকা দিতে কুমকুম দরজা খুলে দিল।

—বাপীদা…এত রাতে?

বাপী তক্ষুনি লক্ষ্য করল। বিস্ময়ের আঁচড়ে মেকি কিছু ধরা পড়ল না। ভেতর কারো কত তাড়াতাড়ি বদলায় বাপীর ধারণা নেই। এই মেয়ের কাছে অন্তত এটুকু রাত বেশি রাত হল কি করে!

—আলো জ্বলছে দেখে নামলাম।… কেমন?

—একরকমই। ঘুমোচ্ছে। এসো…

ওর সঙ্গে নিঃশব্দে বাপী শয্যার কাছে এলো। বুক পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। দাড়ি সত্ত্বেও মাস্টারমশায়ের মুখ দুদিন আগের থেকে বেশি ফোলা মনে হল বাপীর। চাদর টেনে দেখতে গেলে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা। সে চেষ্টা না করে পাশের ঘরে এলো। ছোকরা চাকরটা মেঝেতে মাদুর পেতে শোবার তোড়জোড় করছিল। বাপীকে দেখে তাড়াতাড়ি মাদুর গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল।

কুমকুম ব্যস্ত হয়ে বলল, বোসো বাপীদা, এক পেয়ালা চা করে আনি?

—এত রাতে আর চা না। চেয়ার টেনে বসল।—এর মধ্যে ডাক্তার দেখে গেছে? মুখ তো আরো ফোলা মনে হল।

—আমারও মনে হয়েছে। বাপী লক্ষ্য করছে, দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। বলল, সকালে ডাক্তারকে ফোন করেছিলাম, শুনেও তিনি তো এই ওষুধই চালিয়ে যেতে বললেন…। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মতো দেখা গেল একটু বলল, দু’দিন আসনি, বাবা নিজেকে ছেড়ে তোমার জন্যে বেশি ব্যস্ত।…এদিকে অন্য কাজে এসেছিলে বুঝি?

—একজনকে এয়ারপোর্টে তুলে দিয়ে ফিরছিলাম, ভাবলাম দেখে যাই—

বাপী চিন্তা না করেই দু’জনের বদলে একজনকে বলেছে। তার ফলে এমন একটা প্রশ্ন শুনবে কল্পনার মধ্যে ছিল না। কুমকুমের চাউনি হঠাৎ উৎসুক একটু। বলে ফেলল, বউদি কোথাও গেলেন?

শোনামাত্র বাপীর ভিতরে নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। প্রথমেই রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়ের অন্তরঙ্গ ছলাকলা কিছু কিনা বোঝার চেষ্টা। সে-রকম আদৌ মনে হল না। তবু পাশ কাটিয়ে জবাব দিল, না, অন্য কেউ। সোজা চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ তোমার এ-কথা মনে হল?

আমতা আমতা করে কুমকুম বলল, শুনলে তুমি রাগ করবে না তো বাপীদা? বাপীর সন্দিগ্ধ চাউনি ওর মুখের ওপরে আরো স্থির একটু।—আমি রাগ করব এমন কি কথা তুমি বলতে পারো?

গলার স্বরে হঠাৎ উষ্ণ আমেজ কেন কুমকুম তাই বুঝে উঠল না। বিমর্ষ অথচ ঠাণ্ডা সুরে বলল, তা না…আমি কেমন মেয়ে জানি, তবু বাবা তোমার কাছে কতখানি, নিজের চোখে দেখছি বলে রোজই খুব আশা হয়, বউদিও হয়তো তোমার সঙ্গে এসে বাবাকে একবারটি দেখে যাবেন। এখন বুঝছি আমার জন্যেই ঘেন্নায় আসছেন না…

এই মুখ দেখে আর এই কথা শুনে বাপীই বিমূঢ় হঠাৎ। তারপরেই চকিতে মনে পড়ল কিছু। এবারে গলার স্বরও নরম।—বউদি বলে কেউ কোথাও আছে তুমি ধরে নিলে কি করে?

সঙ্গে সঙ্গে কুমকুমও হকচকিয়ে গেল।—সেদিন যে তোমার গাড়িতে তোমার পাশে…বউদি নয়?

হ্যাঁ, বাপীরও সেই সন্ধ্যার কথাটাই মনে পড়েছিল। তার পাশে সেই একজনকে দেখে কুমকুম যা ভেবে বসে আছে, তা-ও ভাবতে ভালো লাগছে। এমন কি মেয়েটার এই ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখখানাও এখন ভালো লাগছে! ঠোঁটের হাসি চোখে জমা হচ্ছে। খুব হাল্কা করে জবাব দিল, এখন পর্যন্ত নয়।

এর পরেও মেয়েটার বিমূঢ় মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে দেখল। কেন পড়ছে তা-ও আঁচ করতে পারে।…সেই সন্ধ্যায় গাড়িতে তার পাশে বসার আগেই মিষ্টি শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়েছিল। বাপীকে সজাগ রাখার আর তফাতে রাখার সংকল্প বোঝানোর জন্যেই শাড়ির আঁচল মাথার ওপর দিয়ে বুকের আর একদিকে টেনে এনেছিল।…কুমকুমের এ-রকম ভুল হতেই পারে।

বাপী উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গও বাতিল।—আর রাত করব না, তুমি যাও।…টাকা আছে তো হাতে?

মেয়েটার কমনীয় মুখে কৃতজ্ঞতা উপচে উঠল। বলল, অনেক আছে!

—ঠিক আছে।…ডাক্তারকে কাল আমিই না হয় ফোন করে দেব’খন একবার, এসে দেখে যাক। পারি তো একেবারে ধরেই নিয়ে আসব—

কুমু এমন চেয়ে রইল যে, বাপী তার পরেও থমকে দাঁড়াল। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আরো কিছু ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে।—বাপীদা আর কত করবে তুমি

আমাদের জন্য—আর কত করবে?

এই ব্যাপারটাই বাপীর চোখে বা কানে সয় না।…আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে রেশমাকে মনে পড়ল। সেই সাপধরা মেয়েটার কিছু ধারালো স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ এর মধ্যেও আশা করছে কেন, জানে না। ঝাপটা মারা গোছের গলার স্বর।—বাজে বোকো না, তোমার জন্যে কিছু করা হলে তখন ঋণ শোধের কথা ভেবো, বাপীদা কাউকে দয়া করে কিছু করে না, তখন মনে রাখতে চেষ্টা কোরো।

কুমকুম থতোমতো খেয়ে চেয়ে আছে। অবাকও।

.

নির্জন রাস্তায় গাড়ির স্পিডের কাঁটা পঞ্চাশের দাগ ছুঁয়েছে।…সব চুকেবুকে গেছে ভাবে না বলেই ঊর্মিলার দুশ্চিন্তা। ভালবাসার চেহারা ওই মেয়ে চেনে। মিষ্টির ওখান থেকে বেরিয়ে টিপ্পনী কেটেছিল, শ্যাম আর কুল দুই নিয়ে বেচারী কেবল জ্বলছে মনে হল। বাপী তাই বিশ্বাস করেছে, করে জোর পেয়েছে। আজও প্লেনে ওঠার আগে ঊর্মিলা হার মেনে ওর গোঁ বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তারপর কুমকুমের কথা শুনেও কান দুটো লোভাতুর হয়ে উঠেছিল! শিকারে বেরিয়ে সেই সন্ধ্যায় কুমকুম গাড়িতে বাপীর পাশে যাকে দেখেছিল, তাকে তার বউ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। বউদি নয় শুনে অবাক হয়েছে। আর বাপীর জবাব শুনেও মেয়েটা হকচকিয়ে গেছে। বাপী বলেছে, এখন পর্যন্ত নয়।

…মাথায় ঘোমটা তোলা কারো বউ এখন পর্যন্ত তার বউ নয় শুনলে অবাক হবারই কথা।

রণে আর প্রণয়ে নীতির বালাই রাখতে নেই। শয়তানকেও কাছে ডাকতে বাধা নেই। ও-কথার পর কুমকুমের মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎই শয়তানের কিছু ইশারা মনের পাতাল ফুঁড়ে সামনে ধেয়ে আসতে চেয়েছে। তাই কুমকুমের পরের উচ্ছ্বাসটুকু বাপী বরদাস্ত করতে চায়নি। বরং সর্বনাশের দড়ির ওপর হেসে খেলে নেচে বেড়াতে পারে এমন মেয়ে রেশমাকে মনে পড়েছে।

কেন মনে পড়েছে বাপী এখন আর সেটা তলিয়ে দেখতে রাজি নয়। ভাবতে রাজি নয়। তাহলে নিজেরই কোনো ভয়াবহ চেহারা ধরা পড়ার আশঙ্কা। ইচ্ছেটাকে বাপী চার চাকার তলায় গুঁড়িয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটিয়েছে।

সোনার হরিণ নেই – ৩৩

পরের একটা মাস বাপী কাজের মধ্যে ডুবে থাকল। মেয়েদের রূপ সাজে, পুরুষের কাজে। মনের অবস্থা যেমনই থাক, পুরুষের এই রূপটাকে বাপী কোনদিন অবহেলা করেনি। প্রাকপ্রচারের চটকে আর পার্টির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ফলে শুরু থেকেই সোনা ফলার লক্ষণ দেখা গেছে। আবু রব্বানী এর মধ্যে তিনদফা ট্রাক বোঝাই মাল চালান দিয়েছে। চিঠিতে তার একবার কলকাতায় ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছের কথাও লিখেছে। দোকে এতদিন না দেখে ওর ভালো লাগছে না।

কিন্তু বাপীর কাছে আগে কাজ পরে দোস্তি। আর এক প্রস্থ মালের অর্ডার দিয়ে ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে। তাকে এখন আসতে নিষেধ করেছে। বানারজুলিতে এখন অনেক কাজ। ওর ওপরেই সব থেকে বেশি নির্ভর। গেল মাসে সেখানকার লেনদেনের হিসেব যা পাঠিয়েছে, তা দেখে বাপী আরো নিশ্চিন্ত। তার অনুপস্থিতিতে সেখানকার লাভের অঙ্ক কোথাও মার খায়নি। ফাঁক পেলে বাপী নিজেই একবার যাবে লিখেছে। কিন্তু তেমন ফুরসৎ যে শিগগির হবে না তা-ও জানে। জিত্ মালহোত্রার কাজেকর্মে বাপী খুশি। লোকটা যেমন চৌকস তেমনি তৎপর। বাপী কি চায় বা কতটা চায় মুখ চেয়ে বুঝতে পারে। তবু একা সে কত দিক সামলাবে। তেমন বিশ্বস্ত কাউকে পেলে বাপী এক্ষুনি টেনে নেয়। কিন্তু অজানা অচেনা লোক ঢুকিয়ে এতটুকু ঝুঁকি নেবার মধ্যে সে নেই। সেরকম দরকার হলে আবুকেই বরং বানারজুলি থেকে বুঝে শুনে কাউকে পাঠাতে বলবে।

কাজের চাপের মধ্যেও মাস্টারমশাইকে একবার করে দেখতে আসতে চেষ্টা করে। রোজ হয় না। যেদিন পারে না, জিকে খবর নিতে বলে দেয়। এ ব্যাপারেও লোকটার কিছু গুণ লক্ষ্য করেছে বাপী। মনিবের মাস্টার, তাই ওরও মাস্টারজি! তার মেয়েকে বলে মিস ভড়। অসুস্থ মাস্টারের প্রতি মনিবের এত দরদের হেতু ওই মেয়ে কিনা মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এই চালাক লোকটার মুখে কৌতূহলের আভাসও দেখেনি।

বাপীর ফ্ল্যাটে এখন দুজন কাজের লোক মোতায়েন। একজন আধাবুড়ো বাবুর্চি রোশন। ইউ-পিতে ঘর। খাসা রাঁধে। এক হোটেল থেকে জিত্ ওকে খসিয়ে এনেছে। জিতের রাতের ডিনার এখন এখানে বরাদ্দ। দুটো বেডরুমের একটাকে অফিস ঘর করা হয়েছে। সকাল দুপুরের বেশির ভাগ ঘোরাঘুরির মধ্যে কাটে। বিকেলের দিকে সে অফিস খুলে বসে। রাতে খেয়েদেয়ে মেসে ফেরে। বাইরে কাজ না থাকলে সকাল দশটা থেকে লাঞ্চ লাইম পর্যন্ত বাপী অফিসে বসে।

দ্বিতীয় কাজের লোকটার নাম বলাই। মিষ্টির মা মনোরমা নন্দীর সংগ্রহ। কথায় কথায় বাপী একদিন দীপুকে বলেছিল, ঘরের কাজ জানে আবার ফোন ধরে নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে পারে এমন একজন বিশ্বাসী লোক খুঁজছে। তার দু’দিনের মধ্যে মনোরমা নন্দী একে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন। বছর উনিশ কুড়ি বয়েস। নাম ঠিকানা লিখতে পড়তে পারে কিনা জিগ্যেস করতে মুখে জবাব দিয়েছিল, ক্লাস ফাইভ ফেল, বাবা পড়ালে না বলে এই দুগ্যতি। বাপী তক্ষুনি তাকে বহাল করেছে। ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দেখে মেঝেতে ইংরেজি কাগজ বিছিয়ে বলাই গম্ভীর মুখে চোখ বোলাচ্ছে। আর কিছু না হোক, এই কাগজ পড়া দেখেই বাবুর্চি রোশন তাকে সমীহ করে। নাম-ধাম খবর প্রয়োজন ইত্যাদি শুনে নিয়ে একটা খাতায় লিখে রাখে। মনিব ফিরলেই গড়গড় করে তাকে জানায়।

দীপুদার সঙ্গে মনোরমা নন্দীও একদিন এসে ফ্ল্যাট দেখে গেছেন। দরদী মাসির মতোই যতটুকু সম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছেন। বলাই আর রোশনকে সদাব্যস্ত সাহেবের খাওয়া-দাওয়া যত্ন আত্তি সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন। দীপুদা বাপীকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর কথা তুলতে বাপীই তাড়াতাড়ি বাধা দিয়েছে। ঘরের ছেলে, যখন খুশি যাব, গল্প করব, খাব—নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন করলেই নিজেকে পর পর লাগবে মাসিমা।

মাসিমা খুশি। কিন্তু ঘরের ছেলের এ পর্যন্ত তার বাড়ি যাওয়ার ফুরসৎ হয়নি। দীপুদা এ নিয়ে টেলিফোনে অনুযোগ করেছে। বাপী বলেছে, সকাল থেকে রাত কি করে কাটছে যদি দেখতে তোমার মায়া হত দীপুদা।

অন্তরঙ্গ আপ্যায়ন অসিত চ্যাটার্জির দিক থেকেও এসেছে। বাপীর একই জবাব। যাবে, কিন্তু আপাতত দম নেবার সময় নেই। তারপর সাদা মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছে, নেমন্তন্নটা তোমার না মিলুর?

অসিত চ্যাটার্জি ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছে, আমি আর মিলু কি আলাদা? জানো আমার জন্য ও বাপের বাড়ি যাওয়াও ছেড়েছে প্রায়!

—তোমার জন্যে কেন?

লালচে দু ঠোঁট পুলকে টসটস।…পতির নিন্দা সতীর কাঁহাতক সয়। গেলেই তো আমার ঝুড়ি ঝুড়ি নিন্দে শুনতে হবে—

হেসেছে বাপীও। আর মনে মনে লোকটাকে জাহান্নমে পাঠিয়েছে।

ঊর্মিলা টেলিগ্রামে তাদের পৌঁছানো সংবাদ পাঠিয়েছিল। চার সপ্তাহ বাদে তার লম্বা চিঠি। বিজয় কাজে জয়েন করেছে। সকালে বেরোয়, রাতের আগে তার টিকির দেখা মেলে না। সপ্তাহে পাঁচদিন ওখানকার সব মানুষই কাজ-পাগল। বাকি দু’দিন ফুর্তি আর বেড়ানো। কিন্তু ঘরকন্নার কাজে ওরা এত ব্যস্ত যে বেড়ানোর ফুরসৎ মেলেনি। ঘরের সমস্ত কাজ মায় রান্না পর্যন্ত ঊর্মিলাকে নিজের হাতে করতে হয়। প্রথম প্রথম কান্নাই পেয়েছে। কিন্তু সকলেই তাই করছে দেখে সয়েও যাচ্ছে। লিখেছে, এত দূরে গিয়ে এখন সব থেকে বেশি মনে পড়ে বানারজুলির কথা। তাজ্জব দেশ অনেক আছে, কিন্তু বানারজুলি বোধ হয় আর কোথাও নেই। মা-কে শুধু মনে পড়ে না, মনে হয় মা যেন সেখানে তার অবাধ্য ছেলেটার আশায় একলা বলে দিন গুনছে। মায়ের সঙ্গে কোয়েলা, বাদশা ড্রাইভার, আর পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ুকেও খুব মনে পড়ে। মায়ের এই আশ্রিতদের ফ্রেন্ড কি ভুলে যাবে? তার পরেই খোঁচা। বানারজুলির আকাশ বাতাস পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে না পেলে ছেলেবেলার মিষ্টিকে কি আর অত মিষ্টি লাগত?

ঊর্মিলার দুষ্টুমি বাপী বুঝতে পারে। এইরকম করে মায়ের কথা আর বানারজুলির কথা লিখে ওকে কলকাতা থেকে সরাতে চায়। কিন্তু মিথ্যে লেখেনি। কাজে ডুবে থাকলেও মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে। বানারজুলি তখন বিষম টানে। ওই ঊর্মিলার থেকেও ঢের বেশি ঘরছাড়া মনে হয় নিজেকে। তার চিঠিটা পাওয়ার পর দু-তিন দিনের জন্য একবার বানারজুলি ঘুরে আসবে ঠিক করল। গিয়ে কাজ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ওখানকার পাহাড়ে জঙ্গলে আগের মতোই নিজেকে ছড়িয়ে দেবে।

হল না। মাস্টারমশাই মারা গেলেন। ললিত ভড় চলে গেলেন।

আজীবন মানুষটা একটাই মুক্তি চেয়েছিলেন। ক্ষুধার মুক্তি। শুধু নিজের নয়, সক্কলের। এমন চাওয়ার খেসারত অনেক দিয়েছেন। এবারে সত্যিই মুক্তি। তাঁর বেঁচে থাকার মধ্যে তবু কিছু সোরগোল ছিল। গেলেন বড় নিঃশব্দে। গভীর রাতে বাপীর একবার খোঁজ করেছিলেন নাকি। একটু ছটফটও করেছিলেন। এমন প্রায়ই হয়। তাই শেষ ঘনিয়েছে কুমকুম ভাবেনি, কারণ অন্যদিনের মতোই খেয়েছেন। ঘুমিয়েছেন। রাত তিনটে নাগাদ মেয়েকে ডেকেছেন। ভোর হতে দেরি কত জিজ্ঞেস করেছেন। তখনো সাংঘাতিক কিছু কষ্ট হচ্ছে বলেননি। কেবল বলেছেন, ঘরে বাতাস এত কম কেন! বাবার মুখ দেখে আর শ্বাসকষ্ট দেখে কুমকুমের অবশ্য খারাপ লেগেছে। কিন্তু অত রাতে কি আর করবে সকালের অপেক্ষায় ছিল।

সকাল পাঁচটার মধ্যে শেষ।

বাপী কুমকুমের টেলিফোন পেয়েছে সকাল ছ’টায়। বাড়িঅলার ঘর থেকে ফোন করেছে, বলাই ধরেছিল। সাহেবের নিকট-কেউ অসুস্থ খুব, এ ক’দিনের মধ্যে বলাইয়ের জানা হয়ে গেছিল। কারণ, এই মেয়ে-গলার টেলিফোন সে আরো দিন দুই ধরেছে, আর একজনের শরীরের খবর সাহেবকে জানাতে হয়েছে। যেতে না পারলে সন্ধ্যার পর টেলিফোনে খবর দেবার কথা কুমকুমকে বাপীই বলে রেখেছিল।

দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি বার করে বাপী বেরিয়ে পড়ল। উল্টো দিকে দু মাইল গাড়ি হাঁকিয়ে জিকে তার মেস থেকে তুলে নিল। আজ পর্যন্ত নিজের চোখে তিন-তিনটে মৃত্যু দেখেছে। পিসি, বাবা, গায়ত্রী রাই। না, আরো দুটো দেখেছে। বনমায়ার আর রেশমার। এই এক ব্যাপারে বাপীর নিজের ওপর এতটুকু আস্থা থাকে না। ভিতরে কিছু গোলমেলে ব্যাপার হতে থাকে।

…প্রসন্ন ঘুমে গা ছেড়ে শুয়ে আছে মানুষটা। চোখ দুটো আধ-বোজা। দুনিয়ার কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ রেখে গেছেন মনে হয় না। বাপী অপলক চোখে দেখছিল।

—শেষের ক’টা দিন বড় ভালো কাটিয়ে গেলাম রে। আর কত খেলাম! বাপী চমকে এদিক-ওদিক তাকালো।…ক’দিন আগে মাস্টারমশাই বলেছিলেন কথাগুলো। মনে হল, এখনো তাই বলছেন।

কুমকুমের মুখে রাতের বৃত্তান্ত শুনল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টনটনে জ্ঞান ছিল। কুমকুমের বিবর্ণ, বিষণ্ণ মুখ। কিন্তু কাঁদছে না। বাপী তাইতেই স্বস্তি বোধ করছে। এ-সময়ে কারো আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না শুনলে বা দেখলে আরো দম বন্ধ হয়ে আসে। ভেবেছিল, সেই রকমই দেখবে। আশ্রয় বা অবলম্বন খোয়ানোর ত্রাসে শোক অনেক সময় বেশি সরব হয়ে ওঠে। কুমকুমের বেলায় সেরকমই হবার কথা। বাপী মেয়েটার বিবেচনা আর সংযমের প্রশংসাই করল মনে মনে!

এক ঘণ্টার মধ্যে জিত্ সৎকার সমিতির গাড়ি ভাড়া করে খাট আর ফুল নিয়ে হাজির। আর যা-কিছু দরকার শ্মশানে পাওয়া যাবে।

চিতা জ্বলে উঠতে জিকে বাপী তার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিল, কাজের মৌসুমে একসঙ্গে দুজনেই আটকে থাকলে চলে না।

বিকেল তিনটের মধ্যে মর-দেহ ছাই। কুমকুমকে আগে নিজের গাড়িতে তার বাড়ি পৌঁছে দিল। ওপরতলার বাড়ি-অলা আর তার স্ত্রী সদয় হয়ে ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে ঘর দুটো ধোয়ার কাজ সেরে এসেছে। দাহ-অন্তে কুমকুম গঙ্গায় স্নান করেছে। জিতের কেনা চওড়া খয়রা-পেড়ে কোরা শাড়ি পরেছে। অত শোকের মধ্যেও মুখখানা কমনীয় লাগছিল। নিজের ফ্ল্যাটের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বাপী তার কথাই ভাবছিল। আগে মাস্টারমশাইকে নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন তিনি নেই বলে সমস্যা।

ফ্ল্যাটে পা দিতেই বলাই জানালো, পার্টির ফোন পেয়ে জিত্ সাহেব বেরিয়ে গেছেন। আর, খানিক আগে জামাইবাবু টেলিফোন করেছিলেন।

বাপী অবাক।—জামাইবাবু কে?

—আজ্ঞে…..ও বাড়ির দিদিমণির বর, নন্দী সাহেবের ভগ্নীপতি….

এবারে বুঝল। বাপীর কেন যেন মনে হল মনোরমা নন্দীর পাঠানো লোককে রাখার ব্যাপারে আর একটু চিন্তা করা উচিত ছিল। জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি আর জামাইবাবুকে তুমি চেনো?

খবর দিয়ে আবার কি ফ্যাসাদে পড়া গেল বেচারা ভেবে পেল না। জামাইবাবু বা দিদিমণি বললে নিজের কদর হবে ভেবেছিল। সাহেবের চাউনি দেখে অন্যরকম লাগছে। এবারে সত্যি জবাব দিল। পিওনের চাকরির আশায় নন্দী সাহেবের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেত, সেখানে ওঁদের দুই-একদিন দেখেছে…ও চেনে, তাঁরা ওকে চেনেন না।

ফোনে কি বলল জিজ্ঞাসা করতে বলাই আর জামাইবাবু শব্দটা মুখে আনল না। জানালো, সাহেব নেই শুনে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কোথায় গেছেন, কখন ফিরবেন। বলাই বলেছে কখন ফিরবেন ঠিক নেই, সাহেবের একজন নিকটজন মারা যেতে খুব সকালে সেখানে গেছেন, পরে সেখান থেকে শ্মশানে চলে গেছেন। কে নিকটজন ভদ্রলোক তাও জিগ্যেস করেছিলেন কিন্তু ও আর কিছু জানে না বলে এর বেশি বলতে পারে নি।

শোকের খবর নিতে অসিত চ্যাটার্জি বিকেলে এসে হাজির হতে পারে ভেবেও বিরক্তি।

অবেলায় অনেকক্ষণ ধরে চান করল। তারপর কিছু খেয়ে বিছানায় গা ছেড়ে দিল। ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। মাস্টারমশায়ের অনেক স্মৃতি চোখে ভাসছে। সে—সব ঠেলে সরিয়ে মাথাটাকে খানিকক্ষণের জন্য শূন্য করে দেওয়ার চেষ্টা।

একটু বাদে তাতেও বাধা পড়ল। হলঘরে ফোন বেজে ওঠার শব্দ কানে এলো। পাঁচটার পরে পার্টির টেলিফোন আসে না বড়। জিত্ হতে পারে। দু-হাতে ফোনটা নিয়ে বলাই ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল। সাহেব শোবার ঘরে থাকলে তাই রীতি। হল-ঘর ছাড়া অন্য দুটো ঘরেও ফোন রিসিভ করার প্লাগ পয়েন্ট করে নেওয়া হয়েছে এই জন্যেই। বলাই-এর শঙ্কিত মুখ দেখে বাপীর মনে হল অসিত চ্যাটার্জিরই ফোন আবার। শোকের খবর নেবার আগ্রহে চলেই আসে নি সেটা মন্দের ভালো। আসতে চাইলে কোনো অজুহাতে বারণ করা যাবে। প্লাগ করে দিয়ে বলাই তক্ষুনি সরে গেল।

বাপী শুয়ে শুয়েই রিসিভার কানে লাগিয়ে ক্লান্ত-গম্ভীর সাড়া দিল, হ্যালো…

—আমি মিষ্টি।

শোয়া থেকে বাপী উঠে বসল একেবারে। ঠাণ্ডা স্পষ্ট দুটো কথা কানের ভিতর দিয়ে ভিতরের কোথাও নামতে থাকল। বাপী ফের সাড়া দিতে ভুলে গেল।

নীরবতার ফলে লাইন কেটে গেল ভেবে ওদিকের গলার স্বর সামান্য চড়ল।—হ্যালো।

—হ্যাঁ, বলো।

—তোমার কে আত্মীয় মারা গেলেন শুনলাম…কে?

জেনেও বাপী জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে শুনলে?

—অফিস থেকে টেলিফোন করেছিল। বলল, তোমার কোন আত্মীয় মারা গেছেন, তুমি শ্মশানে চলে গেছ।…তোমার তেমন নিকট-আত্মীয় কে আছেন আমি ভেবে পেলাম না।

—আত্মীয় নয়। খুব কাছের একজন।

চুপ একটু।—কে?

—তুমি চিনবে না।

—ও আচ্ছা, এই জন্যেই ফোন করছিলাম।

—কোথা থেকে?

—অফিস থেকে।

—আসবে?

—কোথায়? তোমার ওখানে?

এদিক থেকে নীরবতাটুকুই জবাব।

ওদিকেও থমকালো মনে হল একটু।—আজ না, তাছাড়া শ্মশানে গেছিলে শুনলাম। তুমি ক্লান্ত নিশ্চয় খুব।

বাপীর গলায় উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। জবাব দিল, তুমি এলে ক্লান্তি বাড়বে না।

ওদিকে হাসির চেষ্টা। সুরও বিব্রত একটু।—আজ থাক্।…তোমার আপনার কেউ মারা গেলেন খবর পেয়ে অফিস থেকে টেলিফোনে বলেছিল…

বিকেলের দিকে আমাকে তুলে নিয়ে তোমার ওখানে যাবে। আমি রাজি হইনি। তাকে ফেলে একলা চলে গেছি শুনলে কি ভালো হবে?

মনে যাই থাক, বাপী তক্ষুনি ঠাণ্ডা জবাব দিল, ভালো হবে না।

ওদিকের পরের সুর আরো সহজ।— তোমারও তো আমার ওখানে আসার কথা ছিল একদিন—

—তোমার হাজব্যান্ড বলেছিলেন। সাহস হয়নি….

—কেন?

তোমার রাগ কতটা পড়েছে বুঝতে পারিনি।

গলার স্বরে কৌতুকের আভাস।—আমি রাগ কখন করলাম যে পড়বে।

—মাসখানেক আগে যেদিন ঊর্মিলাকে নিয়ে গেছিলাম। তোমার হাবভাবে মনে হয়েছিল জীবনে আর আমার মুখ দেখতে চাও না।

হাসি।—আমি তোমার মতো অত রাগ পুষে বসে থাকি না। সেদিন কেন অত রাগ হয়েছিল তুমি ভালোই জানো।

—কথার খেলাপ করে তোমার হাজব্যান্ড যদি ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে তার দায় আমার ঘাড়ে কেন?

চুপ একটু। তারপর কথা শোনা গেল।—যেতে দাও, আগেও তুমি কক্ষনো কিছু বুঝতে চাইতে না—এখনো না।

—আগে বলতে? বাপীর এখনো না বোঝার ভান।

আগে বলতে অনেক আগে। সেই বানারজুলি থাকতে। চট করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল।—ঊর্মিলা বাইরে চলে গেল?

—হ্যাঁ।

—আমার সম্পর্কে যাচ্ছেতাই ভেবেছে নিশ্চয়?

—না। আমাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বানারজুলি চলে যেতে পরামর্শ দিয়ে গেছে।

—কেন?

—কোন দিন মারধর খেতে পারি ভেবেছে হয়তো।

হাসল।—তোমাকে হয়তো তার চিনতে এখনো কিছু বাকি আছে তাহলে। আচ্ছা, আজ ছাড়ি?

—হ্যাঁ।

ওদিকে টেলিফোন নামানোর শব্দ।

হাতের রিসিভারটা বাপী বার কয়েক নিজের গালে ঘষল। কানের ভেতর দিয়ে একটা স্পর্শ এতক্ষণ ধরে তাকে লোভাতুর করে তুলেছিল। ফোন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। মিষ্টি এই তার দ্বিতীয় জীবনের গোড়া থেকেই আপস চেয়ে আসছে। এখনো চায়। কেন চায়, বাপীর কাছে তা একটুও অস্পষ্ট নয়। মন থেকে ছেঁটে দিতে পারলে তাকে নিয়ে ও-মেয়ের এতটুকু মাথাব্যথা থাকত না। পারছে না। বাপীর মন বলে দিচ্ছে পারা সম্ভব নয়।

বাপী তরফদার শেষ দেখবে। যদি আরো ছিন্ন-ভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়— হবে। তবু মিষ্টির আপোসের দোসর হতে রাজি নয়।

মাস্টারমশায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ পুরোহিতকে বলে কয়ে বাপী এক মাসের জায়গায় তেরোদিনে টেনে নিয়ে এলো। আড়ম্বরের ধার দিয়েও যায়নি। তা বলে আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি রাখেনি। কুমকুম কালীঘাটে কাজ করেছে। শেষ হতে বেলা তিনটে গড়িয়েছে। বাপী এতক্ষণ থাকতে পারবে নিজেও ভাবে নি। সাহায্যের জন্য জিত্ উপস্থিত ছিল। তাকে রেখে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু কাজ শুরু হবার পর কেন যেন আর নড়তেই পারল না। জিত্কে চলে যেতে বলল।

খুব ছেলেবেলায় বাপী পিসির কাজ করেছিল। একটু বড় হতে বাবার কাজ করেছে। মনে রাখার মতো কোন ছাপই তখন পড়েনি। এখনো অভিভূত হয়েছে এমন নয়। পড়ার নেশায় আত্মার খবর বইয়ে যা একটু-আধটু পড়েছে। তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। আজ এই কাজ দেখতে ভালো লাগার স্বাদটুকু নতুন গঙ্গায় স্নান করে চওড়া লালপেড়ে কোরা শাড়ি পরে কুমকুম কাজের আসনে বসেছে। একপিঠ ছড়ানো চুল। যজ্ঞের আগুনের আভা বার বার মুখে এসে পড়ছে। এই সময়টুকু অন্তত ওর সমস্ত অস্তিত্ব একাগ্র নিষ্ঠায় অবনত। ওর দিকে তাকিয়ে শুচিতা যে ঠিক কাকে বলে বাপী ভেবে পেল না। মৃতের আত্মা বলে কোথাও যদি কিছু থেকে থাকে, তার প্রসাদ থেকে এই কুমুকে অন্তত বঞ্চিত ভাবা যাচ্ছে না।

পরদিন থেকেই আবার বাস্তব চিন্তা। মেয়েটাকে কোন কাজে লাগানো যেতে পারে ভাবছে। একটা কাজ হাতে মজুত। বানারজুলি থেকে মদ চালান আনার প্রস্তাব দিয়েছিল জিত্ মালহোত্রা। এখনো সে-আশা একেবারে ছাড়ে নি। তার মতে ওখান থেকে এখানে এতে ঢের বেশি লাভ। আবুকে জানালেই ব্যবস্থা পাকা করতে তার সময় লাগবে না। রেশমা হলে বাপী একটুও ভাবত না। রেশমার থেকে এই মেয়ে ঢের বেশি নরকের আবর্তে ডুবেছে, বাপীর তবু দ্বিধা একটু। মাস্টারমশায়ের মেয়ে বলেই হয়তো। জীবন-যুদ্ধে এ-রকম ভাবপ্রবণতার ঠাঁই নেই ভেবেই কুমকুমের মধ্যে অনেক সময় রেশমাকে দেখতে চেয়েছে সে। তবু মন স্থির করে উঠতে পারছিল না।

পরের সন্ধ্যায় কুমকুম নিজেই তুলল কথাটা। প্রথমে বাড়ির কথা। জিজ্ঞাসা করল, মাসের বাকি কটা দিন ও এখানেই থাকতে পাবে, না তার আগেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।

বাপীর ভিতরে একটা তির্যক আঁচড় পড়ল তক্ষুনি। চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি ছাড়ার কথা উঠছে কি করে, তুমি কোথায় যাবে?

কুমকুম অবাক একটু।—বিব্রতও। বলল, বাবার জন্য যা করেছ — করেছ, এখন আমার জন্যে এত ভাড়া শুনে এ বাড়ি তুমি আটকে রেখে দেবে নাকি? ভেতরটা তেতে উঠছে বাপী নিজেই টের পাচ্ছে। জবাবও নীরস। তোমার জন্য কিছু দান খয়রাত করার কথা আমি ভাবছি না। আমি জিগ্যেস করছি, বাড়ি ছাড়লে তুমি কি করবে?

পুরুষের গলার আওয়াজ পেয়ে সামনের দরজায় একটি মাঝবয়সী রমণী মুখ বাড়ালো। পলার মা। পলা কুমকুমের ছোকরা চাকর। মাস্টারমশাই চোখ বুজতে কুমকুমের কাছে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। বাপীকে দেখে চট করে সরে গেল।

শুকনো গলায় কুমকুম বলল, পলার মা বলেছিল তাদের বস্তিতে একটা ঘর খালি আছে। অসহায় অথচ ঠাণ্ডা দু’ চোখ বাপীর মুখের ওপর থমকালো একটু। আবার বলল, নিজের ভাবনা-চিন্তা আমি অনেক দিন ছেড়েছি বাপীদা। বাবাকে নিয়ে আমার যেটুকু সাধ ছিল তার ঢের বেশি তুমি মিটিয়ে দিয়েছ। আমার মতো একটা মেয়ের জন্য তুমি ভেবো না।

বাপী চেয়ে আছে। দেখছে….এই দু’ আড়াই মাস ভালো থেকে ভালো খেয়ে ভালো পরে মেয়েটার শ্রী অনেক ফিরেছে। পুরুষের ক্ষুধার মুখে অনায়াসে নিজেকে এখন আগের থেকেও বেশি লোভনীয় করে তুলতে পারবে হয়তো। এই জোরেই বাড়ি ছাড়ার কথা বলছে কিনা বাপীর বোঝার চেষ্টা। গলা দিয়ে রাগ আর ব্যঙ্গ একসঙ্গে ঠিকরে বেরুলো। বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে যাবে আর আগের মতো রাস্তায় দাঁড়াবে ঠিক করেছ তাহলে?…নাকি পলার মা তোমাকে ভালো খদ্দের জোটানোর আশ্বাসও দিয়েছে?

কুমকুমের সমস্ত মুখ পলকে বিবর্ণ পাংশু। মাথা নীচু করে একটা চাবুকের যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করল। আস্তে আস্তে মুখ তুলল তারপর। —বাপীদা, তুমি এত বড় যে বাবা চলে যাবার পর তোমার কাছে আসতেও আমার অস্বস্তি। তাই তোমার বোঝা আর না বাড়িয়ে নিজের অদৃষ্ট নিয়েই আবার ভেসে যাওয়ার কথা বলছিলাম—

তিক্ত রূঢ় গলায় বাপী বলে উঠল, আমি একটুও বড় না। অনেক কাজ আমাকে করতে হয় যা কেউ বড় বলবে না বা ভালো বলবে না! আমি কারো মতামতের ধার ধারি না। সে-রকম কোনো কাজে আমি তোমাকে টেনে নিতে পারি—তাতে আর কিছু না হোক, বাড়ি ছাড়তে হবে না বা রাস্তায়ও গিয়ে দাঁড়াতে হবে না। রাজি আছ?

অবিশ্বাস্য আগ্রহে কুমকুম উঠে দাঁড়ালো। চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। মুখেও তাই বলল।—বাগডোগরার এয়ারপোর্টেও তুমি কাজ দেবার কথা বলেছিলে বাপীদা—এখনো যদি সে রাস্তা থাকে আমি তো বেঁচে যাই—আমি কোন্ মুখে আর তোমাকে সে-কথা বলব!

কৃত্রিমতা থাকলে বাপীর চোখে ধরা পড়ত। নেই। মেজাজ প্রসন্ন নয় তবু বলল, এ-ও জল-ভাত রাস্তা কিছু নয়, ঝুঁকি আছে বলেই এতেও কিছু বুদ্ধি—বিবেচনার দরকার আছে, সাহসের দরকার আছে।

আশায় উদ্‌গ্রীব মুখ কুমকুমের।—আমার বুদ্ধি-বিবেচনায় কুলোবে কিনা তুমিই ভালো জানো বাপীদা—আমার আর খোয়ানোর কিছু নেই, তাই ঝুঁকি নেবার মতো সাহসের অভাব অন্তত হবে না। তাছাড়া তুমি আছ, চোখ বোজার এক মাস আগেও বাবা কি বলে গেছে তুমি জান না বাপীদা—

কানে গরম কিছুর ছেঁকা লাগল। ওকে থামিয়ে বাপী চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। তেমনি নীরস গম্ভীর গলায় বলল, শোনো, যিনি চলে গেছেন, এরপর তাঁকে টানলে আমারও অসুবিধে, তোমারও। এখন থেকে তুমি শুধু তুমি—মনে থাকবে?

ধাক্কা সামলে নিয়ে কুমকুম মাথা নাড়ল। থাকবে।

—ঠিক আছে। আপাতত যেমন আছ—থাকো।

বাপী বেরিয়ে এলো। একটু বাদে গাড়ি দক্ষিণে ছুটল।…মেয়েটা দুঃখ পেল হয়তো, কিন্তু ও নিজে স্বস্তিবোধ করছে। মাস্টারমশাই মুছে গেছেন। যে আছে নতুন করে আর তার কিছু হারানোর নেই, খোয়ানোর নেই—এটুকুই সার কথা, সত্যি কথা। ও মেয়ে নিজেই এ-কথা বলেছে। বাপীও শুধু এই বাস্তবের ওপরেই নির্ভর করতে পারে। নইলে তার যেমন অসুবিধে, মেয়েটারও তেমন ক্ষতি।

এখন আর বিবেকের আঁচড় পাঁচড় কিছু নেই। হাল্কা লাগছে।

মাস্টারমশাই মারা যেতে কাজে একটু ঢিলে পড়েছিল। বাপী তাই আবার কটা দিন বেশ ব্যস্ত। একটু খুশি মেজাজেই সেদিন দক্ষিণদিক থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছিল। এক নামী ওষুধের কারখানার কর্তাব্যক্তির সঙ্গে একটা বড় কনট্রাক্টের কথাবার্তা পাকা। তাদের পারচেজ অফিসারের মারফৎ চাহিদার লিস্টও হাতে এসে গেছে। বছরে আপাতত দেড়-দু লাখ টাকার মাল তারা ওর কাছ থেকে নেবে আশা করা যায়।

আজ আর ঘোরাঘুরি না করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার ইচ্ছে। ঊর্মিলা এর মধ্যে আরো দুটো চিঠি লিখেছে। একটারও জবাব দেওয়া হয়নি। এরপর হয়তো রাগ করে টেলিগ্রাম করে বসবে। আর কিছু না হোক, মেয়ে তার মায়ের মেজাজখানা পেয়েছে। ঘরে ফিরে প্রথম কাজ ওকে চিঠি লেখা।

গাড়ি ভবানীপুরের রাস্তায় পড়তে ভিতরটা উসখুস করে উঠল।…

সামনের বাঁয়ের রাস্তায় গাড়িটা ঘুরিয়ে দিলে সেই পঁচিশ-ঘর বাসিন্দার টালি এলাকা পাঁচ মিনিটের পথ। আজ নতুন নয়, এ-পথে এলেই গাড়িটা ওদিকে ঘোরাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ব্রুকলিন রতন বণিক ওকে যতো টানে, নিজেরই অগোচরের নিষেধ ততো বড় হয়ে ওঠে।

পার্ক স্ট্রীটের মুখে পড়ার আগেই আজ আবার আর একজনের কথা মনে পড়ল। গৌরী বউদি।…সেদিন বাইরে একটা পরিবর্তন দেখে নি গৌরী বউদির, কিন্তু ভিতরে কিছু রকম-ফেরের আভাস পেয়েছিল। অথচ তফাতটা কি স্পষ্ট করে ধরতে পারে নি। ওকে বলেছিল, ইচ্ছে হলে যেও একদিন বাচ্চু এখনো তার বাপীকাকাকে ভোলে নি।

গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। ওখানে যেতে নিষেধ নেই আর।

দোরগোড়ায় গাড়ি থামিয়ে বিকেলের টান-ধরা আলোয় পাশাপাশি দুটো বাড়িই দেখে নিল একবার। দুটোই জীর্ণ, মলিন। চুন-বালি খসা। অনেকদিন সংস্কার হয়নি বোঝা যায়। বাড়ি দেখে বিচার করলে সন্তু চৌধুরীর রোজগারে কিছু ভাটা পড়েছে মনে হবে। গাড়িতে বসেই কয়েকবার হর্ন বাজালো। কিন্তু দোতলার বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়াল না। অগত্যা নেমে দোতলার কলিংবেল টিপল।

একটু বাদে যে এসে দরজা খুলল, সে বাচ্চু কোনো সন্দেহ নেই. বছর তের বয়েস। আগের থেকে অনেক লম্বা হয়েছে। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে ময়লা হাফশার্ট। শুকনো রোগাটে মূর্তি।

ঝকঝকে গাড়িটা দেখে আর ফিটফাট এক সাহেব মানুষ দেখে ছেলেটা ভেবাচাকা খেয়ে মুখের দিকে চেয়ে রইল। চেনা আদল অথচ ঠিক ধরতে পারছে না কে।

বাপী বলল, তোর বাপীকাকুকে চিনতেই পারলি না রে!

শুকনো মুখে আচমকা খুশির তরঙ্গ। বলা মাত্র চিনেছে। কিন্তু সেদিনের সেই বাপীকাকু আজ এমন গাড়ি-অলা মস্ত সাহেব হয়ে গেছে দেখে উচ্ছল হয়ে উঠতে পারছে না। তাড়াতাড়ি বলল, চিনেছি, মা বলেছিল তুমি কলকাতায় আছ, একদিন আসতেও পারো—

তার হাত ধরে বাপী হাসিমুখে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, অনেক বড় হয়ে গেছিস—কোন ক্লাস হল এখন?

—ক্লাস সেভেন।

—ফার্স্ট-টাস্ট হচ্ছিস তো?

দোতলায় উঠে হাত ছেড়ে দিতে ছেলেটা বিব্রত মুখে বলল, এবার ফেল করতে করতে পাশ করে গেছি—

—সে কি রে! কেন, দেখবার কেউ নেই বুঝি?

আসার সঙ্গে সঙ্গে বাপীকাকুকে এমন অপ্রিয় খবরটা দিতে হল বলে ছেলেটার বিমর্ষ মুখ। মাথা নাড়ল, নেই।

দোতলায় এখনো আগের মতো ডাইনিং টেবিল পাতা। কিন্তু যত্নের অভাবে টেবিল চেয়ার এমন কি ঘরের দেওয়াল পর্যন্ত শ্রীহীন। সামনের বসার ঘরের পর্দাও বিবর্ণ ছেঁড়াখোঁড়া।

বাচ্চু তাকে বসার ঘরে এনে বসালো। সোফা-সেটিগুলোরও কাল ঘনিয়েছে বোঝা যায়।

—তোর মা বাড়ি নেই?

ছেলেটা ভেবাচেকা খেয়ে গেল একটু। তারপর বলল, মা তো এ বাড়িতে থাকে না—মায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, তুমি জানো না?

একটা বড় রকমের ধাক্কা সামলে বাপীর সহজ হবার চেষ্টা। কিন্তু ছেলেটার কথার জবাবে মাথাও নাড়তে পারল না। মা কবে থেকে এ বাড়িতে থাকে না তা-ও জিজ্ঞাসা করতে পারল না।

বাচ্চু এবারে নিজেই মাথা খাটিয়ে বলল, সন্তুকাকু অনেক দূরে বাড়ি করেছে তো—মা সেইখানে থাকে।…তোমাকে এখন কি সুন্দর লাগছে দেখতে বাপী কাকু—আগের থেকে ঢের ভালো। ছেলেটা কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।—ভিখুদা আছে বাপীকাকু, তোমাকে এক পেয়ালা চা দিতে বলি?

বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। বাপী তাড়াতাড়ি সায় দিল, বল্‌–

ছুটে চলে গেল। ফিরেও এলো তক্ষুনি। অপ্রতিভ মুখ।—এই যাঃ! ভিখুদা ও তো বাড়ি নেই বাপীকাকু…আমি করে আনি?

বাপী তাড়াতাড়ি বাধা দিল, তোকে করতে হবে না, বোস—আমি চা খুব কম খাই।

ঘরটা অন্ধকার লাগছিল। বাচ্চু. সুইচটা টিপে দিয়ে মুখোমুখি বসল।

—তোর বাবার অফিস থেকে ফিরতে রাত হয় এখনো?

বাচ্চু আবার অবাক।—বাবার অফিস কি, কত বছর আগেই তো চাকরি চলে গেছে। বাবা এখন দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বেরোয় আর অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সন্ধের সময় আসে। খানিকক্ষণের মধ্যে এসে যাবে—

এবারের ধাক্কাটা ততো বড়ো না হলেও বড়ই। মণিদার চাকরি কেন চলে গেছে আঁচ করা কঠিন নয়। তার ওখানে বাপীর চাকরির প্রসঙ্গে গৌরী বউদি বাধা দিয়ে বলেছিল, তোমার ওখানে ঢুকে পরের ছেলে হাতকড়া পরুক শেষে। হাতকড়া না পরলেও মণিদা নিজের চাকরিই রাখতে পারল না। ছেলেটার এই স্বাস্থ্য বা এমন চেহারা কেন বাপী এখন বুঝতে পারছে।…ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গৌরী বউদি সেদিন বলেছিল, তার হুকুম করার দিন গেছে। সে-কথার অর্থও এখনও জলের মত স্পষ্ট।

সাগ্রহে বাচ্চু জিজ্ঞসা করল, আজ তুমি এখানে থাকবে বাপীকাকা? বলে ফেলেই অপ্রস্তুত একটু। প্রস্তাবটা কত অসম্ভব নিজেই বুঝছে যেন

ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে বাপীর শুধু মায়া হচ্ছে না। যন্ত্রণাও হচ্ছে। বাপীকাকু-অন্ত প্রাণ ছিল একদিন, একসঙ্গে খাওয়া-শোয়া পড়া হুটোপুটি করার সব স্মৃতিই হয়তো মনে আছে। বলল, থাকতে পারছি না, তবে তোর সঙ্গে এর পর থেকে মাঝে মাঝে দেখা হবে। আমি কলকাতায় আছি তোর মা বলল?

—হ্যাঁ।

—মায়ের সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল, এখানেই?

—হ্যাঁ, মা তো মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসে, আর মাসের প্রথমে আমার জন্য বাবার হাতে টাকা দিয়ে যায়…এবারে টাকা দিতে এসে বলেছিল। তার পরেই সন্ত্রস্ত।—বাবা এলে তাকে কিন্তু এসব কিছু বোলো না বাপীকাকু, শুনলেই আমাকে মারবে।

বুকের তলায় আরো একটা আঁচড়। হাত ধরে কাছে টেনে নিল।—বাবা তোকে আজকাল মারে নাকি?

—খুব। ভয়ে ভয়ে দরজার দিকটা দেখে নিল একবার। তারপর গোপন কিছু ফাঁস করার মতো করে বলল, মা যখনই আসে, বাবাকে যাচ্ছেতাই করে বকাবকি করে তো, বাবা তখন খুব রেগে থাকে—তারপর একটু কিছু হলেই আমাকে মারে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয় বলেও মার খেতে হয়—তুমি আমাকে আবার আগের মতো পড়াবে বাপীকাকু?

ঘরে যেন বাতাস কম।—দেখি, কি ব্যবস্থা করা যায়। এই বাপের কাছেই শুধু ছেলেটা কিছু আদর-যত্ন আর প্রশ্রয় পেত। দুটো চারটা বছর বাদে এই ছেলে ওই বাপকে কি চোখে দেখবে বা কতটুকু ভয় পাবে?

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। বাচ্চু সচকিত তক্ষুনি। ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা আসছে। বাপীকাকুকে দেখে বাবা খুশি হবে কিনা সেই আশঙ্কা।

মণিদা ঘরে ঢুকল। রাস্তার আলোয় দোরগোড়ায় ঝকঝকে গাড়ি দেখেছে, তখনো তার ঘরে কেউ এসেছে ভাবেনি হয়তো। এই বেশে বাপীকে দেখে হকচকিয়ে গেল।

—বাপী যে…কখন এলি?

—এই তো কিছুক্ষণ। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, এবার যাব।

—বোস্ বোস্, চা-টা দিয়েছে?

বাচ্চু বলে উঠল, ভিখুও বাড়ি নেই বাবা, কে দেবে?

মণিদার শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে গেছে। জামাকাপড়ের বিলাস সুখের দিনেও খুব ছিল না, কিন্তু এখন দুরবস্থা বোঝা যায়! গালে তিনদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলল, চায়ের দরকার নেই, বোসো।

মণিদা পরিশ্রান্ত বেশ। ঘামছে। বসে একটু সহজ হবার চেষ্টা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিড়ি বার করে ধরালো। আগে সর্বদা চুরুট মুখে থাকত। বলল, তুই কলকাতায় আছিস খবর পেয়েছি, অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছিস শুনলাম…নিচের ওই গাড়িটা তোর নাকি?

—হ্যাঁ।

—বেশ, বেশ। উৎসুক একটু।—কিসের ব্যবসা করছিস?

—অনেক রকমের। বাচ্চুকে বলল, সাতটা বাজল, তুই বই-টই নিয়ে বোসগে যা—আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি।

বাচ্চু তক্ষুনি চলে গেল। বাপী মণিদার দিকে ফিরল।—তোমার খবর তেমন ভালো নয় বোধ হয়?

—নাঃ। চাঁচাছোলা প্রশ্ন শুনে সহজ হবার চেষ্টা ছেড়ে মণিদা বলল, একটা গণ্ডগোলে পড়ে চাকরিটা চলে গেল, তোর বউদিও অবুঝের মতো বিগড়ে গেল…। হাতের বিড়িটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে এবার অসহায়ের মতো বলে ফেলল, কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস?

—পারি। বাপীর গলার স্বর চড়া নয়, কিন্তু কঠিন।—তোমার চাকরি গেল বউদি বিগড়ে গেল তার শাস্তি ছেলেটা পাচ্ছে কেন? ওর এই হাল কেন? এই চেহারা কেন? ওর গায়ে হাত তুলতে তোমার লজ্জা করে না?

মণিদা আবার ভেবাচাকা খেয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।

গায়ে হাত তোলার কথাটা বলে ফেলার দরুনও ছেলেটার দুর্ভোগ হতে পারে মনে হতে বাপী আরো তেতে উঠল।—শোনো বাচ্চুর জন্য আমি ভালো মাস্টার ঠিক করে দেব, ওর লেখা-পড়া খাওয়া-দাওয়ার সব ভার আমি নিলাম। তোমার পোষালে আলাদা রোজগারের ব্যবস্থাও আমি করে দেব। কেবল, ওই ছেলেটার ওপর তোমাদের কারো শাসন আমি বরদাস্ত করব না, এটুকু মনে রাখতে হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে সামনে ধরল।—যদি রাজি থাকো তো কাল-পরশুর মধ্যে একদিন গিয়ে দেখা কোরো—আর বাচ্চুকে নিয়ে যেও।

মণিদা কার্ড হাতে নিল। এ সেই হাবা-মুখ ভাইটাই কিনা ভেবে পাচ্ছে না।

বাপী নেমে এলো।

খিঁচড়নো মেজাজ নিয়েই ফ্ল্যাটে ফিরল। বাইরে দরজা খোলা দেখে আরো বিরক্ত। এসেছে কেউ। শুধু জিত্ হলে দরজা খোলা থাকার কথা নয়।

ঘরে পা দিয়েই দু’ চোখ কপালে। খোশ মেজাজে বসে গল্প করছে তিনটি মানুষ।

জিত্ মালহোত্রা। তার পাশে অসিত চ্যাটার্জি।

ওদের দুজনের সামনের সোফায় আবু রব্বানী

সোনার হরিণ নেই – ৩৪

যত দোস্তিই থাক, মালিকের সম্মান আবুর কাছে কম নয়। তার হুট করে এসে হাজির হওয়াটা পছন্দ হবে কিনা সেই সংশয়ও আছে। হাসি মুখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জিও।

আবুর পরনে ধবধবে সাদা চোস্ত, গায়ে জালি গেঞ্জির ওপর রঙিন ফুলকাটা সাদা পাঞ্জাবি, তার ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের চকচকে মেরজাই। হঠাৎ মনে হবে ইতিহাসের পাতা থেকে কোনো নবাবজাদা উঠে এসেছে। ওকে দেখে বাপী কত খুশি মুখ দেখে বোঝা যাবে না। বানারজুলি টানছিল। আবু রব্বানী নিজেই তার চোখে অনেকখানি বানারজুলি। তবু ওকে আরো একটু বিব্রত করার কৌতুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘটা করে দেখে নিয়ে চোখে চোখ রাখল।

আবুর ফাঁপরে-পড়া মুখ! বলে উঠল, ঘাট হয়েছে জনাব, মালের সঙ্গে চালান হয়ে এসে গেছি, কালই আবার ট্রাকে চেপে ফেরত চলে যাব।

বাপীর হাবভাব দেখে আর আবুর কথা শুনে অসিত চ্যাটার্জি আর জিও মজা পাচ্ছে। বাপীর ঠোঁটে হাসি একটু এসেই গেল। এগিয়ে এসে দু’হাত আবুর দুই কাঁধে তুলে দিল। তারপর সামান্য চাপ দিয়ে আবার তাকে সোফায় বসিয়ে দিল। সামনের সোফায় নিজেও বসল। —কখন এসেছ?

দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল। তোমার ট্রাক গুদোমে এসে দাঁড়াতেই জিত্‌ সাহেব সব ছেড়ে আগে আমাকে খালাস করে সোজা তোমার এখানে এনে তুলল। তুমি নেই দেখে গাঁটের পয়সা খরচা করে অনেক খাওয়ালে।

আবুকে জিতের একটু খাতির করারই কথা। একে মুরুব্বী মানুষ এখন, তার ওপর ওর সুপারিশের জোরেই সুদিনের মুখ দেখছে।

হাসিমুখে বাপী অসিত চ্যাটার্জির দিকে ফিরল।——অসিতদা কতক্ষণ?

—অনেকক্ষণ। সময়ে এসে গেছিলাম তাই আমিও চপ কাটলেট রসগোল্লা সন্দেশ থেকে বাদ পড়িনি—তুমি শুধু ফসকালে

বাপী মনে মনে জিতের বুদ্ধির তারিফ করল। দু একদিন দেখে এই লোককেও খাতিরের পাত্র ধরে নিয়েছে। আবুর দিকে ফিরল। ঠোঁটের হাসি চোখে ঠিকরলো। অসিতদার সঙ্গে গল্প তো করছিলে দেখলাম—কি, বুঝতে পেরেছ?

আবু খুশিতে ডগমগ।—আমি কি এত বোকা বাপীভাই, তুমি ওঁর বিবিসাহেবার ছেলেবেলার বন্ধু শুনেই ধরে ফেলেছি। এতক্ষণ তো বহিনজির ছেলেবেলার গল্পই বলছিলাম জামাই সাহেবকে—একবার তুমি যে তাকে পেল্লায় ময়াল সাপের গেরাস থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে তাও জামাইসাহেব আমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলেন। ওঁকে দেখে আমাদের সেই ফুটফুটে ছোট্ট বহিনজি এখন কেমনটি হয়েছেন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

আবু পদস্থ হয়েছে বটে। আগের দিনে পড়ে থাকলে মেমসায়েবের মেয়েকে বহিনজি না বলে মিসি সায়েবটায়েব কিছু বলত। বাপী সাদা মুখ করে সায় দিল, দেখে এসো—অসিতদাকে বলো।

হৃষ্টমুখে আবু জবাব দিল, বলতে হবে না, আমি অলরেডি ইনভাইট!

বাপী হেসে ফেলল, আবার ইংরেজি কেন!

অসিত চ্যাটার্জি আর জিও হাসছে। আবু মাথা চুলকে বলল, গড়বড় হয়ে গেল বুঝি—কি করব, তোমাদের কলকাতার বাতাসের দোষ, জিভে সুড়সুড় করে ইংরেজি বেরিয়ে আসে।

চাকরিতে বহাল হবার পর জিত্ মালহোত্রা এই প্রথম বোধ হয় মালিকের হালকা মেজাজের হদিস পেল। সকলকে ছেড়ে বাপীর পলকা গম্ভীর মনোযোগটা হঠাৎ জিতের দিকে।—মিস্টার চ্যাটার্জি মানে অসিতদার সঙ্গে তোমার কত দিনের আলাপ?

যে-রকম চেয়ে আছে আর যে ভাবে বলল, যেন গলদ কিছু ধরা পড়েছে। অপ্রতিভ জিত্ জবাব দিল, আগে কয়েকবার এখানে দেখেছি…আলাপ আজই। বাপী আরো গম্ভীর।—তুমি তো বুদ্ধির ঢেঁকি দেখি, মিস্টার চ্যাটার্জি একজন আর-এ, চার্টারড অ্যাকাউন্টেন্টের সগোত্র, আর এক মস্ত তেল কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট—এ খবর রাখো?

কি বলতে চায় কেউই বুঝছে না। আবু দোস্তকে দেখছে। অসিত চ্যাটার্জির বদনের সলজ্জ আভায় সোনালি চশমা চিকচিক করছে। ফ্যাসাদ শুধু বেচারা জিতের। খবর রাখে না যখন মাথা নাড়া ছাড়া আর উপায় কি

বাপীর পালিশ করা মুখ।—তিন মাস ধরে খাতাপত্রের হাল কি করে রেখেছ তুমিই জানো। সব ঠিকঠাক করে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করার মতো এমন আর একজন কলকাতা শহর চষে পাবে?

আবুর চোখে কৌতুক। অসিত চ্যাটার্জির ফর্সা মুখ খুশিতে টসটসে। এতক্ষণে মনিবের ইশারার হদিস পেয়ে জিতের অমায়িক বদন। পারলে এক্ষুনি গুণী মানুষটির তোয়াজ তোষামোদ শুরু করে দেয়। হালকা মেজাজে বাপী অসিত চ্যাটার্জিকে সতর্ক করল।—জিত্ এরপর তোমাকে ছেঁকে ধরবে অসিতদা, ওর তোয়াজে ভুলো না, হাত দিয়ে ওর জল গলে না—সাহায্য চাইলেই পঁচিশ পারসেন্ট চড়িয়ে ফী হাঁকবে।

বাড়তি রোজগারের লোভ আছেই। চড়িয়ে ফী হাঁকলে শেষ পর্যন্ত সেটা কার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে ভেবে না পেলেও অসিত চ্যাটার্জির চোখে জিতের কদর বেড়ে গেল। ফলে অন্তরঙ্গ হাসি মুখ তার দিকে ফিরল।—ফী-এর জন্য কি আছে, দরকার হলেই বলবেন। আপিসের দশটা-পাঁচটা ছাড়া অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস।

চতুর জিতের দুকুল বজায় রাখার চেষ্টা। সপ্রতিভ মুখে সে মাথা নাড়ল, থ্যাংক্‌স।

আবুর আসাটা বাপী একটা বড় উপলক্ষ করে তুলল। রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগে আজও অসিত চ্যাটার্জিকে ছাড়ল না। বলাই তার রোশন বাবুর্চির তৎপরতায় আয়োজনে কার্পণ্য নেই। খাওয়ার আনন্দের মধ্যে বাপী বলল, এক জিনিসের অভাবে তোমার সবটাই নিরামিষ লাগছে বোধ হয় অসিতদা, কিন্তু আজ তুমি কথার খেলাপ করলে না দেখে মিলু নিশ্চয় খুশি হবে।

অভাব কোন্ জিনিসটার বুঝতে আবু বা জিতেরও অসুবিধে হল না। লজ্জা পেয়ে অসিত চ্যাটার্জি বলল, কি যে বলো, আমি কি রোজই ওসব খাই নাকি— সঙ্গে সঙ্গে আবুর আফসোস।—জামাই সাহেবের চলে জানলে আমি তো গোটা কয়েক বাছাই মাল নিয়ে আসতে পারতাম!

সোনালি চশমার ওধারে দু’চোখ উৎসুক।—ওদিকে ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায় বুঝি?

বাপী জবাব দিল, নেপাল ভুটানের ও-সব জিনিস এদিকে তো দেখতেই পাও না তোমরা। আবুর দিকে ফিরল, হবে’খন, অসিতদা তো পালিয়ে যাচ্ছে না—। খাওয়ার পর্ব শেষ হতে জিকে বলল, দু’জনেই তো সাউথে যাবে, একটা ট্যাকসি ধরে অসিতদাকে নামিয়ে দিয়ে যাও।

তারা চলে যেতে আবু সোফায় বসে মৌজ করে একটা বিড়ি ধরাবার ফাঁকে দোস্ত-এর মুখখানা দেখে নিচ্ছে। চোখাচোখি হতে বাপীর ঠোঁটে হাসি ছড়ালো। ঊর্মিলা দূরে চলে গেছে। কাছের মানুষ বলতে এখন শুধু এই একজন।

ভণিতা ছেড়ে আবুও সোজাসুজি চড়াও হল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, শুধু জামাই-আদর নয়, বেশ একটা টোপও ফেললে মনে হল?

বাপী হাসছে।—কেন, খাতা-পত্র ঠিক রাখার দরকার নেই?

আবু মাথা নাড়ল।——আগের মতো তোমার ভেতর-বার এক লাগছে না বাপীভাই।—ভদ্রলোক সত্যি অত গুণের মানুষ নাকি?

ছদ্ম গাম্ভীর্যে বাপী সায় দিল, হ্যাঁ, তার অনেক গুণ।

আবু তবু অপেক্ষা করল একটু। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আগের দিন আর নেই, নইলে তোমাকে ধরে ধরে গোটাকয়েক ঝাঁকানি দিলে ভিতরে যা আছে গলগল করে বেরিয়ে আসত। যাক, তার বিবিসাহেবের খবর কি?

—ভালোই। এয়ার অফিসে ভালো চাকরি করছে।

—তোমার সঙ্গে দেখা-টেখা হয়?

—ক্বচিৎ কখনো। আপাতত তার হাজব্যান্ডের সঙ্গেই বেশি খাতির।

আবু টান হয়ে বসল।—আপাতত?

বাপীর মগজে সূক্ষ্ম কিছু বুনুনির কাজ চলেছে। আবু রব্বানী হঠাৎ এভাবে চলে আসাটাও সামনে পা ফেলে এগোনোর মতো লাগছে। নিরীহ মুখে মাথা নেড়ে সায় দিল।

আবুরও ধৈর্য বাড়ছে। জিগ্যেস করল, এদের বিয়ে হয়েছে কদ্দিন?

—বছর আড়াই প্রায়

কৌতূহলে একটা চোখ আগের মতোই ছোট হয়ে এলো।—বাচ্চা কাচ্চা? এই সাদাসাপটা প্রশ্নের তাৎপর্য বেআব্রু গোছের ঠেকল বাপীর কানে। মাথা নাড়ল। নেই। আবুর জিভ আরো বেসামাল হবার আগে প্রসঙ্গ বাতিল। তোমার খবর কি বলো, হুট করে চলে এলে, দুলারি ছাড়ল?

রসের ঝাঁপি বন্ধ হয়ে গেল আবুও বুঝল। দোস্ত-এর পেট থেকে আপাতত আর কোনো কথা টেনে বার করা যাবে না। জবাব দিল, তোমার কাছে আসছি শুনে পারলে নিজেও ছুটে আসে।…আর, ছাড়াছাড়ির কি আছে, যে বোঝা কাঁধে চাপিয়েছ মাসের মধ্যে আট-দশ দিন বাইরেই কাটাতে হয়। কিন্তু তুমি কথা রাখলে যা-হোক—

কি কথা?

—আসার সময় কত রকম বুঝিয়ে এসেছিলে—হাওয়াই জাহাজে এক-দেড় ঘণ্টার পথ, দরকার হলে ফি হপ্তায় একবার করে চলে যাবে—তিন মাসেও একবার তোমার ফুরসৎ হল না?

বাপী বলল, দরকার হলে যেতাম। বেশ তো সামলাচ্ছ।

জবাবে গড়গড় করে আবু অনেক কথা বলে গেল। এবার থেকে দরকার যাতে হয় ফিরে গিয়েই সেই ব্যবস্থা করছে। তিন মাসের মধ্যে একবারও আসার নাম নেই দেখে দুলারিও সাত-পাঁচ ভেবেছে। ও জানে কলকাতা হুরী-পরীর দেশ—কেউ গেলে তাকে ভুলিয়ে রাখে। দোস্ত কোনো জ্যান্ত পরীর খপ্পরে পড়েছে কিনা সেই চিন্তাও করেছে। আবার আবুর আসার ব্যাপারেও খুঁত-খুঁত করেছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ গিয়ে হাজির হলে বাপীভাই নারাজ হবে কিনা চিন্তা। আবু বলেছে, নারাজ হয় হবে, কিন্তু দোস্তকে না দেখে আর সে থাকতে পারছে না?

বাপীর ভালো লাগছে। ঠিক এ-সময় ওকেই সব থেকে বেশি দরকার ছিল। কিন্তু মনে যা আছে এক্ষুনি ফাঁস করার তাড়া নেই। দিন-কতক ওকে ধরে রাখতে হবে। ওখানকার ব্যবসার খবর শুনল! লেখাপড়ায় দিগ্‌গজ বলে এখন একটু আফসোস আবুর। সে কারণে রণজিৎ চালিহার মতো একটু হম্বি-তম্বির চালে চলতে হয়। অসুবিধে খুব হচ্ছে না। কেবল বাপীভাই পাশে না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, এই যা। বাপী পাহাড়ের বাংলোর বুড়ো ঝগড়ু, বাদশা ড্রাইভার আর কোয়েলার খবরও নিয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ের বাংলো থেকে ঝগড়ু একদিন নাচতে নাচতে নেমে এসেছিল। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার থেকে মেমসায়েবের মেয়ের চিঠি পেয়েছে। সেই চিঠি ওদের দেখাতে এসেছিল। তার ঊর্মি লিখেছে, ওদের কোনো চিন্তা নেই, নতুন মালিক সকলকে ভালো রাখবে। মালিকের পাত্তা নেই দেখে ওরা একটু ভাবনায় পড়েছিল।

কেন ওরা টাকা-কড়ি ঠিক মতো পাচ্ছে না?

—তা পাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে-সাদি করে মালিকের কলকাতাতেই থেকে যাওয়ার মতলব কিনা সে-চিন্তা তো হতেই পারে।

বানারজুলির কথাপ্রসঙ্গে আবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ধামন ওঝার ছেলে সেই হারমাকে মনে আছে তো তোমার?

—থাকবে না কেন, রেশমার হারমা…

—হারমার রেশমা বলো, বেঁচে থাকতে রেশমা ওকে পাত্তাই দেয়নি।

—হারমার কি হয়েছে?

—মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। তুমি থাকতেই তো দিন-রাত রেশমার ঘর আগলে পড়ে থাকত, কেউ মুখ দেখতে পেত না। এখন আবার দিন ছেড়ে রাতেও বাইরে টো-টো করে বেড়ায়। ওর এখন মাথায় ঢুকেছে, চালিহা সাহেবের জন্য রেশমা সাপের ছোবল খেয়ে মরেনি—ও জান দিয়েছে তোমার জন্যে। কেউ বিশ্বাস করে না, দুলারিও ওকে ডেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওর ওই এক কথা—

বাপী সচকিত একটু।—সে কি? আমার ওপর খুব রাগ নাকি ওর?

—রাগ না…দুঃখু। বলে, তোমাদের উঁচু-মাথা বাপী সাহেব কেবল দিল্‌ কাড়তেই জানে, দিলের কদর জানে না।

.

রাতটা এরপর অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কাটল বাপীর। আধ-ঘুমে মাথার মধ্যে একটা হিজিবিজি ব্যাপার চলতে থাকল। পাহাড়ী জঙ্গল…বুনো হাতি…. রেশমা পাহাড়ের বাংলো…নেশায় বুঁদ ঝগড়ু… রেশমা। বাপী… রেশমা…রণজিৎ চালিহা টাকা মদ—রেশমা। হারমা—রেশমা—হারমা—-রেশমা—

সকালে উঠে বাপী নিজের ওপরে বিরক্ত। কি দোষ করেছে? কোন দুর্বলতার প্রশ্রয় দিয়েছে? এত দিন পরেও এ-রকম টান পড়ে কেন? হারমা যা ভাবে ভাবুক। যা বলে বলুক। তাতে ওর মগজে দাগ পড়ে কেন?

সকালটা আবুর সঙ্গে গল্প-গুজবের পর কলকাতার ব্যবসার আলোচনায় কেটে গেল। সব দেখেশুনে আবু দোস্ত-এর তারিফ করল, তুমি যাতে হাত দাও তাই সোনা দেখি বাপীভাই!

প্রশস্তির জবাবে আঙুল তুলে বাপী জিকে দেখিয়ে দিল। বলল, জিত্ সঙ্গে থাকলে তার আর মার নেই, ওরও কেরামতি কম নয়। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্ম আশঙ্কা। মাইনে বাড়ানোর চাপ দিলো বলে।

আবু অখুশি নয়। জিকে জোটানোর বাহাদুরি সবটাই তার। চিঠিতে দোস্ত এই লোকের প্রশংসা আগেও করেছে। তার ভাগ্য শিগগীরই আরো কিছু ফিরবে ধরে নিয়ে ভারিক্কি স্বরে মন্তব্য করল, চাপ দিলে আমি চোখ বুজে স্যাংশন করে দেব। বলে ফেলে সভয়ে বাপীর দিকে তাকালো।—স্যাংশনই তো বলে—না কি?

জিত্‌ হাসছে আর টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছে। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে মাসকয়েকের চাকরির কালে এই আবু রব্বানী তাকেও সেলাম ঠুকত। যার অনুগ্রহে লোকটার আজ এই কপাল, তার দাক্ষিণ্য থেকে সে-ও বঞ্চিত হবে না, তিন মাসে সেই বিশ্বাস আরো বেড়েছে।

আলতো করে বাপী বলল, জিত্ তোমার। অন্য স্যাংশনের আশায় অনেক দিন ধৈর্য করে বসে আছে—

মালিকের মনে কি আছে জিত্ নিজেও ধরতে পারল না। ঠাট্টার ব্যাপার কিছু কিনা না বুঝে আরো উৎসুক। দুজনারই কৌতূহল জিইয়ে রেখে বাপী জিগ্যেস করল, ডাটাবাবুর ক্লাবের সঙ্গে তোমার লাল জলের কারবার কেমন চলছে এখন?

—ফার্স্টো কেলাস। ক্লাব তো আছেই, প্রাইভেট প্র্যাকটিসও আগের থেকে বেড়েছে—রইস খদ্দেররা এসে অর্ডার পেশ করে যায়। কেন বলো তো?

—জিকে তুমি কলকাতার বাজার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলে দিয়েছিলে? আবু মাথা চুলকে সায় দিল। বলল, আমার মনে হয়েছিল ওই জলের কারবার এখানে ভালো চলতে পারে।

—বানারজুলি থেকেও ঢের ভালো চলতে পারে। জিত্ খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে কলকাতার মতো বাজার আর হয় না। আমি গা করছি না বলে ওর মেজাজ খারাপ।

আবু জিতের মুখখানা দেখে নিল। এ ব্যাপারে তার আগ্রহ সত্যি কম মনে হল না। দোস্ত ঠাট্টা করছে না বা বাড়িয়ে বলছে, না বুঝে তাকেই জিগ্যেস করল, তুমি তাহলে গা করছ না কেন?

বাপী প্রায় নিরাসক্ত।—এসে গেছ যখন নিজেই বুঝেশুনে নাও। ভালো বুঝলে শুরু করা যাবে।

দোস্তকে কাগজপত্রে মন দিতে দেখে আবু একটু বাদে বসার হলঘরে চলে এলো। দোস্ত দিনকতক থেকে যেতে বলেছে। সে সানন্দে রাজি। তাই ঘরে একটা চিঠি পাঠাতে হবে। দুলারি লিখতে পড়তে জানে না সে-জন্য আবুর এই প্রথম আপসোস একটু। নইলে দোস্ত-এর খবরাখবর দিয়ে বেশ রসিয়ে একখানা চিঠি লেখা যেত। কিন্তু পড়াতে হবে বড় ছেলেটাকে দিয়ে। সে ব্যাটা এখনই লায়েক হয়ে উঠেছে। ছোট সাইকেলে চেপে বানারহাটের স্কুলে যায়। চিঠিতে বেচাল কথা থাকলে ফিরে গিয়ে দুলারির মুখঝামটা খেতে হবে।

মনিবের হুকুমে জিত্ ড্রাইভারসুদ্ধু একটা ভালো প্রাইভেট গাড়ির সন্ধানে বেরুলো। তিন দিন সকাল-সন্ধ্যা ভাড়া খাটবে। আবুর জন্য দরকার। টাকা যা লাগে লাগবে। মালিককে বাদ দিলে ব্যবসায় আবু রব্বানীর মর্যাদা এখন সকলের ওপরে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে এখানকার পার্টির কাছে সেই মর্যাদা বজায় থাকবে। কলকাতার ঠাট আলাদা। পার্টির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করানোর জন্য মালিক নিজে তার জেনারেল ম্যানেজারকে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় কি করে। সে কাজটা জিত্ মালহোত্রা করলে বরং কোম্পানীর চটক বাড়বে। আর, এই কাজের ফাঁকে আবুর ইচ্ছেমতো কলকাতা দেখাও হবে।

মালিকের দরাজ মনের খবর জিত্ ভালোই রাখে। আজ আরো খুশি কারণ, আবু সাহেবের জন্য গাড়ি ঠিক করতে বলে মনিব তাকেও চটপট ড্রাইভিং শিখে নিতে বলেছে। বানারজুলির মোটরগাড়ি এখন আবু সাহেবের জিম্মায়। ওর ড্রাইভিং শেখা হলে জিপটা কলকাতায় নিয়ে আসবে হয়তো

বড় হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে পছন্দসই প্রাইভেট গাড়ি জোটানো শক্ত নয়। জিত্ একেবারে গাড়িতে চেপেই ফিরল। গাড়ি কি জন্যে আর কার জন্যে শুনে আবু হাঁ। বলল, তোমার কাণ্ড দেখে আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি বাপী ভাই।

হাসি চেপে বাপী বলল, তুমি কম লোক? ঘাবড়াবার কি আছে—

.

বিকেলে ওদের ফেরার অপেক্ষায় বসেছিল। আসলে ভাবছিল কিছু। মগজে একটা ছক তৈরী হচ্ছিল। আর থেকে থেকে কুমকুমের মুখ সামনে এগিয়ে আসছিল। রেশমার মতো করে না হোক ‘ অবস্থা-বিপাকে এই কুমকুমও সর্বনাশের দড়ির ওপর কম হেসে খেলে নেচে বেড়ায়নি।

কলিং বেল বাজতে বলাই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। আবু বা জিত্‌ নয়। মণিদা। তার কথা বাপীর এর মধ্যে মনে পড়ে নি। মণিদার শুকনো ক্লান্ত মুখ। দায়ে ঠেকে আসার অস্বস্তিও অস্পষ্ট নয়।

বোসো মণিদা। বাচ্চু এলো না?

—আমি ইয়ে বাড়ি থেকে আসছি না, পরে একদিন আনব’খন।

গদী আঁটা সোফায় বসে ফ্ল্যাটের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। এই মানুষকে দেখে বাপীর আজ আর রাগ হচ্ছে না। বরং মায়া হচ্ছে। এই একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক। অসময়ে দু’হাত বাড়িয়ে আশ্রয় দিয়েছিল। শুধু খেতে ভালোবাসতো, নইলে বরাবর সাদাসিধে চাল-চলনের মানুষ ছিল। স্ত্রীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যের ফলে আজ এই হাল।

বলাইকে হুকুম করে আগে তার ভালো জলখাবারের ব্যবস্থা করল। তারপর সোজা কাজের কথা। বাচ্চুর অ্যানুয়েল পরীক্ষা কবে?

—দু’আড়াই মাসের মধ্যেই বোধ হয় …

বাপী ভাবল একটু। তারপর বলল, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সপ্তাহের মধ্যেই আমি ওর জন্যে একজন ভালো মাস্টার ঠিক করে পাঠাচ্ছি।…কিন্তু আমার মতে তারপর ছেলেটাকে এখানে আর রাখা ঠিক হবে না, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ওর মা…বিশেষ করে সন্তু চৌধুরীর কাছ থেকে ওকে তফাতে সরানো দরকার।

মণিদার অসহায় পাংশু মুখ।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, বাইরের খুব ভালো কোন ইনস্টিটিউশনে রেখে ওকে পড়ানো যায়? খরচ যা-ই লাগুক তোমাকে ভাবতে হবে না—ওর গার্জেন হিসেবে আমার নাম থাকবে।

মণিদার চোখে-মুখে সংকটের দরিয়া পার হবার আশা। নরেন্দ্রপুর আর দেওঘরের বিদ্যাপীঠের কথা বলল। সামর্থ্য থাকলে ছেলেকে নিজেই ওরকম কোনো জায়গায় পাঠাতো। ছেলেটার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে নিজেই স্বীকার করল। যন্ত্রণাও চাপা থাকল না আর। তুই যদি ছেলেটার ভার নিস আমি আর ওদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখব না। এত ঠকেছি…আর সহ্য হচ্ছে না।

বাপীর জিজ্ঞাসা করার লোভ, গৌরী বউদির যে নালিশ শুনে ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল সেটা এখন আর মণিদা বিশ্বাস করে কি না। লোভ সামলালো। বলল, এই দুটো মাস কাউকে আর কিছু বলার দরকার নেই— যা করার তুমি চুপচাপ করে যাও।

উঠে ভিতরের ঘরে গিয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। দশখানা একশ টাকার নোট মণিদার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল—এই হাজারটা টাকা তোমার কাছে রাখো এখন। তোমাকে কিন্তু-কিন্তু করতে হবে না, এও বাচ্চুর জন্যে। মুখোমুখি বসল আবার। এবারে তোমার কাজের কথা, বলো কাজ করবে তো?

দু’চোখ ছলছল মণিদার। ভিতর থেকে আরো কিছু যন্ত্রণা ঠেলে বেরুলো। বলল, কাস্টমসের পাকা চাকরি গেছে…কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না।

যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষটার ভেতর দেখতে পাচ্ছে বাপী। তবু এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথাই বলল।—কোম্পানীর লোক দরকার, তুমি কোম্পানীর কাজ করবে, সেখানে বাপী বলে কেউ নেই এটুকু মনে রাখলেই আমার দিক থেকে আর কোনো অসুবিধে হবে না।

জিতের সঙ্গে আবু ঘরে ঢুকল। বাপী ওদের সঙ্গে মণিদার পরিচয় করিয়ে দিল। তার কোম্পানীতে যোগ দেবার কথাও জানালো। মণিদাকে বলল, যতদিন না এদিকে সুবিধে মতো অফিস ঘর মেলে তাকে রোজ উল্টোডাঙার গোডাউনে হাজিরা দিতে হবে। জিত্ চেষ্টা করছে, অফিস-ঘর পেতে দেরি হবে না। কাজ আপাতত মাল চালানের খাতাপত্র ঠিক রাখা আর পার্টির কাছে চিঠি লেখা বা তাদের চিঠির জবাব দেওয়া। জিই সব দেখিয়ে শুনিয়ে আর বুঝিয়ে দেবে। বানারজুলি থেকে আবু রব্বানী তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠাবে।

একটু বাদে মণিদা আর জিত্ চলে গেল। বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবু বলল, আমাকে বাঁশ দিয়ে ঠেলে আর কত ওপরে তুলবে—একটু আগে তোমার হোমরাচোমরা পার্টিদের খাতিরের চোটে হাঁপ ধরে গেছল, এসেই আবার এই—

বাপী হাসছে—দেখাশুনা হল সব?

—এখনো সব নয় শুনছি, জিত্ শাসিয়ে রেখেছে কাল রবিবার, পরশু মাঝারি আর ছোট পার্টির সঙ্গে মোলাকাত হবে।

—জলের ব্যবসার খোঁজ নিয়েছ?

—নিশ্চয়। জিত্ ঠিকই বলেছে, টুইংকিল টুইংকিল ইস্টার—ঘাবড়ে যেও না, বাইরে বেরিয়ে একটাও ইংরেজি বলিনি।

চায়ের পর্বের পরেও দোস্ত গা ছেড়ে বসে আছে দেখে আবু উসখুস করতে লাগল। শেষে বলেই ফেলল, ইয়ে—কোথাও বেরুবে-টেরুবে না?

—কোথায়?

আবুর মুখে দুষ্টু হাসি।—কোথায় আমি তার কি জানি। ভাবলাম আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করছ—এলেই বেরুবে।

ওর ইচ্ছে বাপী খুব ভালো করেই বুঝছে। অসিত চ্যাটার্জির আপ্যায়নে সাড়া দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওর চোখে সেই দশ বছরের মেয়েই লেগে আছে। এখন চৌদ্দটা বছর জুড়বার তাগিদ।

বাপী উঠল। বলল, চলো—

ভাদ্র-শেষের ছোট বেলা। আলো-ঝলমল রাস্তা। দোস্ত্ এখন ভারী চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে দেখেও আবু মজা পাচ্ছে। জামাই সাহেবের সামনে টোপ ফেলার ব্যাপারটা মনের তলায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দোস্তের মতলব এখনো আঁচ করতে পারেনি।

সামনে চোখ রেখে বাপী জিজ্ঞাসা করল, বানারহাট স্কুলের মাস্টারমশাইদের মনে আছে তোমার?

হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন আবু ভেবে পেল না।—যারা মারধর করত তাদের মনে আছে। কেন বলো তো?

—আমাদের ড্রইং করাতো ললিত ভড়— তাকে মনে আছে?

—পেটুক ভড়! তাকে খুব মনে আছে। ব্ল্যাক বোর্ডে খড়ি দিয়ে এঁকে এঁকে কত রকমের খানা খাইয়েছে!

—এখানেও ফুটপাথে খড়ি দিয়ে এঁকে রাস্তার মানুষকে অনেক খানা খাইয়েছে—সকলে পাগল ভাবত।

—আ-হা…তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে বুঝি?

হয়েছিল। খেতে না পেয়ে আধমরা হয়ে গেছল। শেষের দু’মাস একটু শান্তি পেয়ে গেছে। কিছুদিন আগে মারা গেল।

আবু চুপ খানিকক্ষণ। তারপরে বলে উঠল, যাচ্ছি এক জায়গায় আনন্দ করতে, দিলে মনটা খারাপ করে—

বাপী শুধু হাসল একটু।

দোরগোড়ায় তার গাড়ি থামার আগেই কুমকুম ভিতর থেকে দেখেছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এলো। সঙ্গে অচেনা লোক দেখে থমকালো একটু।

বাপী হাসিমুখে বলল, কটা দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভালো আছ তো?

কুমকুম মাথা নাড়ল। বাপীদার সঙ্গে এসেছে তাই দু’হাত জুড়ে অচেনা সঙ্গের লোকটাকে নমস্কার জানিয়ে তাদের ভিতরের ঘরে বসালো। আবু হঠাৎ ঘাবড়ে গেছে কেমন। সামনে যাকে দেখছে সে বেশ সুশ্রী বটে, কিন্তু জঙ্গলের বড় সাহেবের দশ বছরের যে ফুটফুটে মেয়েটাকে মনে আছে, পরের চৌদ্দ বছরে তার চেহারা এই দাঁড়াতে পারে কল্পনায় আসে না।

নিরীহ মুখে দোস্ত তার দিকে তাকাতে আরো খটকা লাগল। জিগ্যেস করল, বহিনজি তো…?

—তুমি কোন বহিনজির কথা ভাবছ? একটু আগে যে মাস্টারমশায়ের কথা বললাম তার মেয়ে কুমকুম।

আবু হতচকিত কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু বোকা নয়, চট করে সামলে নিল। দরাজ হেসে বলল, উনিও বহিনজিই তো হলেন তাহলে। কুমুর দিকে ফিরল, মাস্টারজির হাতে আমিও বছর কতক ঠেঙানি খেয়েছি।

কুমু হাসিমুখেই নরম প্রতিবাদ করল, বাবা ভয় দেখাতেন, মারতেন না কাউকে।

বাপী সাদা মুখে কাজের কথায় চলে এলো। আবুর পরিচয় দিল। বলল, ও-ই সর্বেসর্বা এখন, তোমার যা কিছু বোঝাপড়া সব এরপর ওর সঙ্গে আর জিতের সঙ্গে—আমাকে আর বিশেষ পাচ্ছ না।…আমাকে যতটা বিশ্বাস করো একেও ততটাই বিশ্বাস করতে পারো।

কুমুর মুখে কথা নেই, চুপচাপ চেয়ে রইল।

দোস্তের মাথায় কি যে আছে আবু ভেবে পাচ্ছে না। তাই আগবাড়িয়ে সেও কিছু বলছে না।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, টাকা কেমন আছে?

—আছে…।

পার্স থেকে এক গোছা টাকা বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।—এই পাঁচশ টাকা রাখো তোমার কাছে।

কুমকুম ইতস্তত করতে আবার বলল, আবুর সামনে লজ্জা করার কিছু নেই, ও আমার থেকে কড়া মুরুব্বী, এখন থেকে যা পাবে সব তোমার পাওনা থেকে কড়াক্রান্তি কেটে নেবে। ধরো।

কুমকুম হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। সম্মান বাঁচিয়ে সাহায্য করা হল আবু এইটুকুই ধরে নিল।

দশ মিনিটের মধ্যে আবার গাড়িতে পাশাপাশি দুজনে। আবু বলল, অ্যাস্ মানে গাধা আবার ডংকি মানেও গাধা——আমি কোন্‌টা?

বাপী হাসছে।—কি হল?

প্রথম দিন তুমি আমার ঘরে রেশমার বদলে দুলারিকে দেখে হাঁ হয়ে গেছলে…তার বদলা নিলে মনে হচ্ছে।…তোমার সব ইন্টারেস্ট এখন তাহলে এই বহিনজি?

সব না, কিছুটা।

আবুর খুশি ধরে না।—এও দেখতে শুনতে তো ভালোই। ঠাণ্ডা মেয়ে হলেও বেশ বুদ্ধি ধরে মনে হল—ঠিক না?

—ঠিক। কিন্তু তুমি তো চিনতেই পারলে না।

—আমি আগে দেখলাম কোথায় যে চিনব!

—দেখেছ। ভেবে দেখো…।

আবু বিমুঢ় খানিক। এরকম ভুল তার হবার কথা নয়।—কোথায় দেখেছি?

—বানারজুলিতে। আমি তখন ডাটাবাবুর ক্লাবের সেই কোণের ঘরে থাকতাম। চা-বাগানের এক অফিসারের বন্ধু মেয়েছেলে নিয়ে এসেছিল বলে আমাকে কোণের ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল—সেজন্যে তুমি ডাটাবাবুর ওপর খেপে গেছলে, আর সেই মোটা কালো লোকটাকে দেখে বলেছিলে, এই চেহারা নিয়ে বউয়ের সঙ্গে রঙ্গরস করার জন্যে কোণের ঘর চাই—মনে পড়ছে?

মনে পড়ছে বটে। কিন্তু তার ফলে আবু চারগুণ অবাক।—এই বহিনজি সে নাকি! সেই লোকটার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

সামনে চোখ রেখে বাপী নির্লিপ্ত মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। জবাব দিল, শুধু সেই লোক কেন, তারপর অরো কত লোকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে।

আবু আধাআধি ঘুরে বসেছে দোস্তের দিকে। জল-ভাত কথাগুলোও ঠিক-ঠিক মাথায় ঢুকছে না। এখানে একে কোথায় পেলে?

—রাতের রাস্তায়! কারো জন্যে অপেক্ষা করছিল।

এও হেঁয়ালির মতো লাগল।—রাতের রাস্তায়…কার জন্যে অপেক্ষা করছিল?

—পকেটে পয়সা আছে এমন যে কোনো রসিক পুরুষের জন্য। হাতে কিছু পেলে তবে বস্তিঘরের রুগ্ন বাপের জন্য খাবার আসবে।

আবুর মুখে কথা নেই আর। স্তম্ভিতের মতো বসে রইল। তার দিকে না তাকিয়ে বাপী মোলায়েম করে বলল, তুমি যে ইন্টারেস্টের কথা ভাবছিলে ঠিক সে ইন্টারেস্ট যে নয় আমার এখন বুঝতে পারছ?

ধাক্কাখানা এমনি যে আবু তার পরেও নির্বাক। একটু বাদে একই সুরে বাপী আবার মন্তব্য করল, তবু মেয়েটাকে আমি খারাপ ভাবি না।

.

রবিবারের বিকেল পর্যন্ত বাপীর ফ্ল্যাট ছেড়ে নড়ার নাম নেই। আড্ডা দিয়ে আর গড়িমসি করে কাটিয়ে দিল। অথচ সকাল থেকেই আবু আশা করছে এই ছুটির দিনে দোস্ত ওকে প্রত্যাশার জায়গাটিতে নিয়ে যাবে। শেষে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। বলল, বেরুবে না কি সমস্ত দিনটা ঘরেই কাটিয়ে দেবে?

বাপী সাদামাটা মুখ করে চেয়ে রইল একটু। ঠোটের ফাঁকে হাসির আঁচড় পড়ল কি পড়ল না। গা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বলল, চলো—

কিন্তু এবারও আবুর অপ্রস্তুত হবার কপাল। অভ্যর্থনায় যারা এগিয়ে এলো তাদের একজন সুদীপ নন্দী আর একজন মনোরমা নন্দী। আবু দেখেই চিনেছে। তারা চিনতে পারল না। খাতিরের ছেলের সঙ্গে এসেছে তাই খাতির করেই বসালো। তার আগে আবুর আদাবের ঘটা দেখে মা-ছেলে দুজনেই অবাক একটু। হাসিমুখে বাপী বলল, মাসিমার কথা না হয় ছেড়ে দিলাম, দীপুদা তুমিও ওকে চিনতে পারলে না?

সুদীপ বলল, চেনা-চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক….

—বানারজুলির জঙ্গলের সেই অপদেবতা আবু রব্বানী। পাথর ছুঁড়ে কত বুনো মুরগি আর খরগোশ মেরে খাইয়েছে, মনে নেই?

বলা মাত্র ছেলে ছেড়ে মায়েরও মনে পড়েছে। মনোরামা দেবী বলে উঠলেন, ওকে তো জঙ্গলের বীটম্যান করা হয়েছিল….।

বাপীর সরব হাসি। সেই লোক আর নেই মাসিমা। আবু এখন আমাদের কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার, দু’গণ্ডা বি-এ, এম-এ পাশ ওর আন্ডারে চাকরি করছে—নিজের বাড়ি নিজের গাড়ি।

লজ্জা পেয়ে আবু বলল, ছাড়ো তো, মাসিমা আর দীপুদার কাছে আমিও তোমার মতো একটা ঘরের ছেলে—

বাপীর মজা লাগছে। মওকা বুঝে সেয়ানা আবুও নিজেকে ঘরের ছেলে করে ফেলল। বানারজুলির সেই দাপটের কালে মহিলাকে মেমসায়েব আর দীপুদাকে ছোট সাহেব না বললে গর্দান যাবার ভয় ছিল।

বাইরে অন্তত মা ছেলে দুজনেরই হাসি-মুখ আর খুশি-মুখ। কিন্তু আসলে ভেবে পাচ্ছে না, একটা বুনো জংলি ছেলেরও ভাগ্য এমন ছপ্পর ফুঁড়ে ফেরে কি করে। টাকার ঘরে রূপের বাসা। সেই জংলি ছেলেরও রূপ ফিরে গেছে বটে।

আদর-আপ্যায়নে কার্পণ্য নেই। বাপী মোটে আসে না বলে মনোরমা দেবী বার কয়েক অনুযোগ করলেন। শিগগীরই আবার আসবে কথা দিয়ে ঘণ্টাখানেক বাদে আবুকে নিয়ে বাপী উঠল। ছেলের পিছনে মা-ও নিচের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এক ধাপ নেমে বাপী ঘুরে দাঁড়াল।—মিষ্টির খবর কি মাসিমা, অনেক দিন দেখি না…

মহিলার অপ্রসন্ন মুখ। গলা খাটো করে জবাব দিলেন, কে জানে মাথায় কি ঢুকেছে, এখানেও বেশি আসে-টাসে না।

গাড়ি তাঁদের চোখের আড়াল হতে আবু ঝাঁঝালো চোখে দোস্তের দিকে ফিরল। বাপী বলল, আর পাঁচ-সাত মিনিট মুখ বুজে অপেক্ষা করো, নিয়ে যাচ্ছি

আবু ধৈর্য ধরে বসে রইল বটে, কিন্তু তার ভিতরে অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে এখন। বড় রাস্তা ছেড়ে কয়েকটা ছোট রাস্তা ঘুরে গাড়িটা মিনিট সাতেকের মধ্যেই থামল এক জায়গায়। আঙুল তুলে বাপী বলল, ঠিক চারটে বাড়ির পরে ওই বাড়িটা—নেমে যাও।

আবু আকাশ থেকে পড়ল।—আর তুমি?

—আমি না। একটা ট্যাক্সি ধরে ফিরে এসো, তাহলে আর রাস্তা ভুল হবে না।

—তাহলে আমারও গিয়ে কাজ নেই। ফেরো!

বাপী গম্ভীর।—দেখো তোমাকে আমি বোকা ভাবি না। তোমার একা যাওয়া দরকার, একাই যাবে। নামো।

আবছা অন্ধকারে দোস্তের মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। দরজা খুলে আবু নামল। সামনের বাঁক ঘুরে বাপী তখনি গাড়িসুদ্ধু চোখের আড়ালে।

বড় রাস্তায় পড়ে নিজের মনেই হাসছে।

.

রাত নটার পরে আবু ফিরল। গোল গোল দু’চোখ বাপীর মুখের ওপর তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

হাসি চেপে বাপী জিগ্যেস করল, হল?

আবু মাথা নাড়ল। মুখেও জবাব দিল, হল।

কিন্তু রাতের খাওয়া সারা হবার আগে দোস্তের আর কোনো কিছুতে উৎসাহ দেখা গেল না। আবু সঙ্গ দেবার জন্য বসল শুধু। পর পর দু জায়গায় খাওয়া হয়েছে, খিদে নেই। সে দোস্তের খাওয়া দেখছে অর্থাৎ ভালো করে মুখখানা দেখছে।

খাওয়ার পর রাতের আড্ডা বাপীর শোবার ঘরে বসেই হয়। আবুর গুরু-গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে এবারে বাপী হেসে ফেলল।—কেমন দেখলে?

—এত ভালো ভাবিনি, তোমার জন্যে বুকের ভেতর টনটন করছিল।

বাপী হাসছে।—আর অসিত চ্যাটার্জির জন্যে?

—খুব আদর যত্ন করেছে, তবু তাকে ধরে আছাড় মারতে ইচ্ছে করেছিল।

আলতো করে বাপী মন্তব্য করল, সে সুযোগ পাবে’খন।

আবু রব্বানী নড়েচড়ে বসল। বাপী জিগ্যেস করল, মিষ্টি তোমাকে দেখে খুশি হল?

—খুব।

—কি বলল?

—বানারজুলির পুরনো কথা, বনমায়ার কথা—আমার সে-সময়ের সাহসের কথা শোনালো জামাই সাহেবকে। পরিবার আর ছেলেপুলের কথা জিগ্যেস করল, এখানে মেমসায়েবের মেয়ে ঊর্মিলা আর তার বরের সঙ্গে আলাপের খবরও বলল—কেবল তোমাকে মোটে চেনেই না বোঝা গেল।

বাপী হেসে ফেলল।—বোঝা গেল?

—খুব। এই জন্যেই তো তোমাকে নিয়ে মিষ্টি বহিনজির ভিতরেও কিছু গড়বড় ব্যাপার আছে টের পেলাম।

বাপীর বাইরে নিরীহ মুখ। ভিতরে হাসছে। ঊর্মিলাও এই গোছের কিছু বলে গেছল। ওই মিষ্টিকে দেখে সব চুকে-বুকে গেছে বলে তারও মনে হয়নি। বাপী প্রস্তুত হচ্ছে। রণে বা প্রণয়ে নীতির বালাই থাকতে নেই।

আবুর একটা চোখ এবারে ছোট একটু। জেরায় জেরবার করার ইচ্ছে। মিষ্টি বহিনজির মেমসায়েব মা এখন তাহলে তোমার মাসিমা?

হাবা মুখ করে বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

—ওই মা আর ছেলের কাছে তোমার এখন খুব খাতির কদর?

আবারও মাথা নাড়ল।—খুব।

—আসার সময় মেমসায়েব মেয়ের সম্পর্কে অমন কথা বলল কেন— তেমন বনছে না?

—জামাইয়ের সঙ্গে বনছে না।

এটা শোবার ঘর ভুলে আবু বিড়ি ধরালো একটা।—বনছে না কেন?

—জামাই মদ খায়, রেস খেলে, জুয়ার নেশায় বউয়ের টাকা চুরি করে, ঝগড়া করে।

—সত্যি?

বাপী মাথা নাড়ল। সত্যি।

মেমসায়েবের তাহলে কি ইচ্ছে?

বাপী নির্লিপ্ত জবাব দিল, তার আর তার ছেলের ধারণা কাগজ-কলমের বিয়ে, ছিঁড়ে ফেললেই ফুরিয়ে যায়—অমন লোকের সঙ্গে ঘর করার কোন মানে হয় না।

আবু লাফিয়ে উঠল।—বিসমিল্লা। তুমি তাহলে গুলি মেরে দিচ্ছ না কেন? ঠেস দেবার মতো করে বাপী ফিরে বলল, দুলারির বেলায় তুমি অন্ধ ছট্টু মিঞাকে গুলি মেরে দিতে পেরেছিলে?

আবু লজ্জা পেল।—লোকটা মরার জন্য ধুঁকছিল তাই মায়া পড়ে গেছল। তোমারও কি এই মরদের ওপর মায়া পড়েছে?

—আমার না। তোমার বহিনজির পড়েছে। তার বিশ্বাস, জামাই সাহেব যতোই নেশা করুক জুয়া খেলুক টাকা সরাক বা ঝগড়া করুক—লোকটার ভালবাসায় কোনো ভেজাল নেই—তোমার জামাই সাহেবের এটাই নাকি আসল পুঁজি—এই পুঁজির জোর মিথ্যে হলে কাউকে কিছু বলতে হত না, তোমার বহিনজি নিজেই তাকে ছেঁটে দিত।

ব্যাপারখানা তবু মাথায় ভালো ঢুকছে না আবুর। জিজ্ঞাসা করল, তাহলে? —তাহলে ওই লোকের ভালোবাসার সবটাই যে ভেজাল আর তোমার বহিনজির বিশ্বাস সবটাই যে ভুল এটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারলেই ফুরিয়ে যায়।

—কি করে? আবু স্পষ্ট করে ধরতে ছুঁতে পারছে না বলে দ্বিগুণ উন্মুখ। সোনা মুখ করে বাপী জবাব দিল, সেটা খুব আর কঠিন কি।…তুমি জিকে একটু তালিম দিয়ে যাও, বেচারা অসিত চ্যাটার্জিকে যেন ভালো করে খাতির-যত্ন করে, রেসের নেশায় বউয়ের আলমারি থেকে টাকা সরাতে হবে এ কি কথা! আর ভদ্রলোক রংদার মানুষ, ভালো জিনিস খুব পছন্দ—মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে কুমকুমকে নিয়ে বোতলের ব্যবসা তো তোমরা শুরুই করে দিচ্ছ—ও জিনিসেরও অভাব হবার কথা নয়…

আবু লাফিয়ে উঠল। কুমকুমকে নিয়ে বোতলের ব্যবসা!

—সেদিন গিয়ে বলে এলাম কি? অমন বিশ্বস্ত আর ভালো মেয়ে কোথায় পাবে।…তাছাড়া মেয়েটার অভিজ্ঞতারও শেষ নেই।

নিরীহ মুখের দুই ঠোঁটে হাসিটুকু আরো স্পষ্ট হয়ে ঝুলছে। আবুর গোলগোল চোখ তার মুখের ওপর চড়াও হয়েই আছে। আর দুর্বোধ্য কিছু নেই। অস্পষ্ট নেই।

গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে আধখানা ঝুঁকে সেলাম ঠুকল একটা। বলল, ঠিক আছে, এর পরের সব ভার তুমি এই বান্দার ওপর ছেড়ে দিতে পারো।

পরের দুটো দিন আবু জিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার পরের দিন বানারজুলি ফেরার তাড়া। বাপীকে বলল, জিত্ সাহেব আর কুমকুম বহিনকে তিন-চার দিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছি। আমি তো খুব ঘন ঘন আসতে পারব না, ওদেরও দরকার মতো একটু ছোটাছুটি করতে হবে। নিয়ে যাই, দেখে-শুনে বুঝে আসুক। কুমকুম বহিন তোমার বাংলোয় কোয়েলার কাছে থাকবে’খন, আর জিত্ সাহেবের তো বউ ছেলে সেখানেই।…তোমার অসুবিধে হবে?

পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে! বাপী মাথা নাড়ল। অসুবিধে হবে না।

নিরাসক্ত মুখ আবুরও।—তুমি ঠিকই বলেছিলে বাপীভাই, কুমু বহিন ভারী ভালো মেয়ে। নতুন করে এখন কি ব্যবসায় নামছি শুনেও একটু ঘাবড়ালো না। বলল, বাপীদার ব্যবস্থার ওপর আর কোন কথা নেই।…ওর বাবা নাকি চোখ বোজার খানিক আগেও বলে গেছে আমাদের স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই…দরকার হলে ওই বাপীর জন্য যদি প্রাণ দিতে পারিস তাহলে সব স্বর্গ।

আবু হাসছে অল্প অল্প। বাপী নির্লিপ্ত! ভেতরটা খরখরে হয়ে উঠছে। কিন্তু বাপী তা হতে দেবে না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে।

সোনার হরিণ নেই – ৩৫

পরের টানা প্রায় দেড় বছরের নাটকে বাপী তরফদারের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। সে নেপথ্যে দাঁড়িয়ে। শান্ত, নিরাসক্ত। কাজের সময় কাজে ডুবে থাকে। অবসর সময় বই পড়ে। পড়ার অভ্যেস আগেও ছিল। এই দেড় বছরে সেটা অনেক বেড়ে গেছে। যাওয়া-আসার পথে এক-এক সময় গাড়ি থামিয়ে স্টল থেকে গাদা গাদা ইংরেজি-বাংলা বই কিনে ফেলে। এই কেনার ব্যাপারেও বাছ-বিচার নেই খুব। গল্প-উপন্যাস আর ভালো লাগে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার মতো যে-সব বইয়ে জীবনের হাজারো অদৃশ্য খুঁটিনাটির সন্ধান মেলে সে-সব বেশি পছন্দ। ভালো লাগলে পাতা উল্টে যায়, না লাগলে ফেলে দেয়।

কমলার প্রসাদ অঝোরেই ঝরছে। এক বছরের ওপর হয়ে গেল কাছাকাছির অভিজাত এলাকাতে বাড়ি কেনা হয়েছে। টাকা কোনো সমস্যা না হলে যেমন বাড়ি কেনা যায় সেই রকমই। এক তলায় অফিস, দোতলায় বাস। মণিদাকে বাপী অফিসে এনে বসায়নি। সে উল্টোডাঙার গোডাউনের অফিসেই বসছে। বাচ্চুকে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি করে দিয়ে পার্ক স্ট্রীটের বাড়ি ছেড়ে মণিদা গোড়াউনের পাশে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। ছেলে সরানোর ব্যাপারটা মণিদার মনেই ছিল। আগে বাচ্চুর কাছেও ফাঁস করেনি। কারণ, সন্তু চৌধুরী তখন পাঁচ ছ’মাসের জন্য গৌরী বউদিকে নিয়ে ইংল্যান্ড সফরের তোড়জোড় করছে। রওনা হবার আগের ক’দিন তারা বাচ্চুকে দেখতে ঘন ঘন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছিল। বাচ্চুর মাসের বরাদ্দ টাকা সন্তু চৌধুরীর কোনো বিশ্বস্ত জন প্রতি মাসের গোড়ায় মণিদাকে দিয়ে যাবার কথা। মণিদা সে টাকা সই করে রাখবে। ভরসা করে তারা একেবারে সব টাকা তার হাতে তুলে দিতে পারেনি। মণিদা ব্যবস্থার কথা শুনেছে। কোনো মন্তব্য করেনি।

পাঁচ ছ’মাস বাদে ফিরে এসে থাকলেও তারা বাচ্চু বা মণিদার হদিস পায়নি। পার্কস্ট্রীটের বাড়িতে অন্য অপরিচিত ভাড়াটে দেখেছে। আর সন্তু চৌধুরীর টাকাও মণিদা ছোঁয়নি দেখে হয়তো ধরে নিয়েছে, তাদের আক্কেল দেবার জন্যেই লোকটা বাড়ি ঘর ছেড়ে আর সব বেচে দিয়ে ছেলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। বাপীর বাড়ি কেনার খবরও তাদের জানার কারণ নেই। বাচ্চুর দু-তিন মাস অন্তর ছুটিছাটায় আসে এখানে। বাপীকাকুর কাছে থাকে। সে ক’টা দিন খুব আনন্দ ছেলেটার। বাবার কাছেও গিয়ে থাকতে চায় না। ছেলেকে দেখার জন্য মণিদাকেই আসতে হয়। বাপী আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। এখানে এসে ছেলেটা মায়ের নামও মুখে আনে না। এটা বাপের নিষেধ কিনা জানে না। হস্টেলে ফিরে যাবার সময় হলে ওর মন খারাপ হয় বুঝতে পারে। কিন্তু যেতে আপত্তি করে না। আবার কবে ছুটি ক্যালেন্ডারে দেখে রাখে। যাবার আগে জিগ্যেস করে, জিত্ কাকুকে পাঠিয়ে তখন আবার আমাকে নিয়ে আসবে তো?

ছেলেটাকে অনায়াসে নিজের কাছেই এনে রাখা যেত। কিন্তু বাপী নিজেই এখন মাসের মধ্যে টানা পনের দিন কলকাতায় থাকে না। কলকাতার ব্যবসা মোটামুটি বাঁধা ছকের দিকে গড়াতে সে আবার বাইরের ঘাঁটিগুলো তদারকে মন দিয়েছে। আবু উত্তর বাংলা নিয়ে পড়ে আছে। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের রিজিয়ন্যাল ম্যানেজারদের কাজকর্ম এখন আবার বাপী নিজে দেখছে। মাসে দেড় মাসে একবার করে বানারজুলিতেও যেতে হচ্ছে। কিন্তু দেড় বছরের এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোন রকম উত্তেজনা বা উদ্দীপনার ব্যাপার নেই। প্রাচুর্য থেকে কোনো কৃত্রিম আনন্দ ছেঁকে তোলার আগ্রহ নেই। চারদিকে খাল বিল নদী-নালা সমুদ্র, তৃষ্ণায় ছাতি-ফাটা চাতক তবু স্বাতী নক্ষত্রের ফটিক জল ছাড়া অন্য জল স্পর্শ করে না। সামাজিক যোগাযোগও কমে আসছে বাপীর। বাড়ি কেনার পর মিষ্টিকে আর অসিত চ্যাটার্জিকে একবার মাত্র নেমন্তন্ন করে আনা হয়েছিল। তাদের ঘরের শান্তিতে আবার চিড় খেয়েছে তখনই বোঝা গেছল। সেই কারণে দীপুদার যাতায়াত আগের থেকে বেড়েছে। তার মায়ের টেলিফোন আসাও। কিন্তু আগ্রহ সত্ত্বেও বাপীকে তারা তেমন নাগালের মধ্যে পায় না। তার ঘন ঘন টুর প্রোগ্রাম। ফিরলে কাজের ডবল চাপ।

অসিত চ্যাটার্জির সামনে কিছু বাড়তি রোজগারের টোপ ফেলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বাপী জিকে বলে দিয়েছিল হিসেব-পত্রের ব্যাপারে ওই লোকের কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য নেবার বা কোম্পানীর ভাউচারে এক পয়সা দেবার দরকার নেই। ফলে জিত গা করছে না দেখে অসিত চ্যাটার্জি নিজেই কাজের কথা তুলেছিল। বাপীর জবাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। বলেছে, তার ধারণা এটা মিলু বা তার মা-দাদা কেউ পছন্দ করবে না।

অপছন্দের ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে তার মা-দাদাকে জুড়ে দেবার ফলে ফর্সা মুখ রক্তবর্ণ।—আমি কাজ করে বাড়তি উপার্জন করব তাতে কার কি বলার আছে? আর মিলুই বা আপত্তি করবে কেন?

—জিগ্যেস করে দেখো। তার আপত্তি না হলেও আর কথা কি…কাজ করে কত লোকই তো কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

জিজ্ঞাসার ফল কি হয়েছে বাপী আঁচ করতে পারে। অসিত চ্যাটার্জি মেয়ে জাতটার ওপরেই বীতশ্রদ্ধ। বলেছিল, যত লেখা-পড়াই শিখুক মেয়েরা মোস্ট্ আপ্রাকটিক্যাল। সেন্টিমেন্টাল ফুল্স্ যত সব

ব্যবসার বাইরে জিত্ মালহোত্রার সঙ্গেও বাপীর অন্য কোনো কথা হয় না। এমন কি প্রত্যক্ষ যোগ নেই বলে এখানকার মদের ব্যবসা কেমন চলছে, সে খবরও নেয় না। কিন্তু জল কোন দিকে গড়াচ্ছে চোখ বুজে অনুমান করতে পারে। এই দেড় বছরের মধ্যে আবু রব্বানী পাঁচ-ছ’বার কলকাতায় এসেছে। ওদের লাল জলের ব্যবসা চালু হবার পরেই আবুকে বাপী এখানকার জন্য একটা লিকার শপের লাইসেন্স বের করার পরামর্শ দিয়েছিল। নিজেদের দোকান থাকলে শুধু সুবিধে নয়, নিরাপদও। টাকা খসালে বোবার মুখে কথা সরে। লাইসেন্স বার করতে জিতের বেশি সময় লাগেনি। লাইসেন্স কুমকুমের নামে। আবু আর জিত্ তার অংশীদার। লাভের চার আনা শুধু বাপীর নামে জমা হবে—কিন্তু কাগজে—কলমে সে কেউ নয়। এরপর মধ্যকলকাতায় যে দোকান গজিয়ে উঠেছে তাতে খুব একটা জাঁকজমকের চিহ্ন নেই। যে দুজন কর্মচারীকে বহাল করা হয়েছে তারাও বানারজুলির লোক এবং আবুর লোক।

জিত্ মালহোত্রা সময়মতো অফিসে আসে, দরকার মতো পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার পর সে নিপাত্তা। শনিবারও বেলা একটার পর তার টিকির দেখা মেলে না। এই ব্যস্ততা যে শুধু ওদের জলীয় ব্যবসার কারণে নয়, তাও বোঝা গেছে। বাড়তি রোজগারের আশায় ছাই পড়লেও অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে জিতের যে গলায় গলায় ভাব এখন তার প্রমাণ দীপুদার নালিশ। তার অবুঝ বোন আবার অশান্তির মধ্যে পড়েছে। অমানুষ ভগ্নীপতি প্রায় রাতেই বদ্ধ মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফেরে। শনিবার রেসের মাঠে যায়। দীপুদার চেনাজানা অনেকেই তাকে দেখেছে। শনিবার অন্য দিনের থেকে নেশার মাত্রা বেশি হয়, তাই মিষ্টিরও রেসের ব্যাপারটা জানতে বুঝতে বাকি নেই। ঝগড়ার মুখে ওই অপদার্থই বুক ঠুকে বলে, সে রেসে যায় নেশা করে—তাতে কার বাপের কি। রোজ মদ খাওয়া আর ফি হপ্তায় রেস খেলার অত টাকা কোথা থেকে পায় দীপুদারা ভেবে পায় না।

বাপী নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। মিষ্টির মত নেই বলে ওই লোকের তার এখান থেকে কিছু বাড়তি রোজগারের প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে, সে-খবর দীপুদা বা তার মাকে অনেক আগেই জানানো হয়ে গেছে।

কুমকুমের সঙ্গে বাপী এখন আর দেখা পর্যন্ত করে না। কিন্তু তার সমাচারও নখদর্পণে। জীবনের এই বৃত্তে সে শক্ত দুটো পা ফেলে দাঁড়িয়েছে। এখন সে নিজের সহজ মাধুর্যে আত্মস্থ। দ্বিধাদ্বন্দ্বশূন্য। কুমকুম বহিনের প্রসঙ্গে আবু রব্বানী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বুদ্ধি ধরে, কথা শোনে, একটুও হড়বড় করে না। বৃত্ত বদলের শুরুতেই কুমুর জন্য বেশি ভাড়ার ফ্ল্যাট ঠিক করা হয়েছে। মাথার ওপর বাড়িঅলা বসে থাকলে কাজের অসুবিধে। তার দেখাশুনার জন্য একজন আয়া আর একজন বুড়ো চাকর আছে। সেই তখন আবুর সঙ্গে বাপী একবার কুমুকে দেখতে গেছল। মনে মনে বাপী নিজেও তখন ওর বিবেচনার তারিফ করেছিল। বেশবাস আর প্রসাধনে রুচির শাসনও জানে মেয়েটা। আলগা চটক কিছু নেই। বাড়তির মধ্যে আগের সেই ঝকঝকে সাদা পাথরের ফুলটা আবার নাকে উঠে এসেছে। ওটার জেল্লা চোখে ঠিকরোবার জন্যেই।

এর মাস তিনেক বাদে আবু তৃতীয় দফা যখন কলকাতায় এসেছে, তার সঙ্গে বানারজুলির বাদশা ড্রাইভার। এখন বুড়োই বলা চলে। কলকাতায় মালিকের কাছে এসেছে। ভারী খুশি।

বাপী আবুকেই জিজ্ঞাসা করেছে, কি ব্যাপার?

আবু মাথা চুলকে জবাব দিয়েছে, ও কিছুদিন এখন কুমকুম বহিনের কাছে থাকবে।

বাপী আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আবু কোন্ চটকের ওপর নির্ভর করতে চায় তক্ষুনি বুঝে নিয়েছে। ওরও এখন মাথা হয়েছে বটে একখানা। দিন কয়েকের মধ্যে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড চকচকে গাড়ি কেনা হয়েছে। কিছুদিন বলতে বাদশা ড্রাইভার কুমকুমের কাছে টানা চার মাস ছিল। ও বানারজুলি ফিরে যাবার আগে মালিককে জানিয়ে গেছে, দিদিজির গাড়ি চালানোর হাত এখন খুব পাকা আর খুব সাফ। ভারী ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি চালায় দিদিজি—মালিকের চিন্তার কোন কারণ নেই।

পাকা হাত দেখাবার লোভে কুমকুম কোনো দিন গাড়ি চালিয়ে বাপীর কাছে আসেনি। জিত্ অনেক করে বলা সত্ত্বেও আসেনি। শুনেই মিস ভড়ের নাকি দারুণ লজ্জা। জিত্ আশা করেছিল এ-কথা শোনার পর মালিকই একদিন তাকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলবে।

বাপী বলেনি। কিন্তু কুমকুমের গাড়ি চালানো নিজের চোখেই দেখেছে একদিন। পার্ক স্ট্রীট ধরে আসার পথে বাপীর গাড়ি ট্রাফিক লাইটে আটকে গেছল। সামনের সোজা রাস্তা ধরে সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে আসছে। সেই চলন্ত সারিতে কুমুর গাড়ি। গাড়ি চালিয়ে কুমু দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে। ডান হাতের কনুই পাশের খোলা জানলায় রেখে স্টিয়ারিং ধরে বসায় শিথিল ভঙ্গিটুকু চোখে পড়ার মতোই। কুমকুমের ওকে দেখার কথা নয়। দেখেওনি। বাপী এর পর নিজের মনেই হেসেছে অনেকক্ষণ ধরে। রাতের আবছা আলোর নিচে এই মেয়েকে শিকারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত কে বলবে।

এর পর যা, বাপীর সামনে তার সবটাই ছকে বাঁধা ছবির মতো স্পষ্ট।

…ব্যস্ততার অজুহাতে অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে জিতের মাখামাখির ভূমিকা কমে আসছে। সে পিছনে সরছে। সামনে মিস ভড়। কুমকুম ভড়। অসিত চ্যাটার্জি তার অন্তরঙ্গ সাহচর্যের দাক্ষিণ্যে ভাসছে। রমণীর যে রূপ গুণ বুদ্ধি পুরুষের আবিষ্কারের বস্তু, অসিত চ্যাটার্জির চোখে কুমকুমের সেই রূপ সেই গুণ আর সেই বাস্তব বুদ্ধি। পয়সা আছে, তবু আর পাঁচটা মেয়ের মতো ড্রাইভারের মুখাপেক্ষী নয়। নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে। নিজের তত্ত্বাবধানে মদের দোকান চালায় এমন মেয়ে এই কলকাতা শহরেও আর আছে কিনা জানে না। সে জানে মিস ভড়ের বাবার দোকান ওটা। অসময়ে বাবা মরে যেতে লাইসেন্স নিজের নামে করে নিয়ে অনায়াসে সেই দোকান চালাচ্ছে। সামনে এসে বেচাকেনা করে না অবশ্য, পর্দার আড়ালে পিছনের চিলতে ঘরে বসে দু’তিন ঘণ্টা দেখাশোনা করে। কেউ টেরও পায় না এটা কোনো মেয়ের দোকান। আর যে—কোনো মেয়ে হলে বাপ চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে দোকান বেচে দিয়ে টাকার বাণ্ডিল বুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকত। নিজে মদ ছোঁয় না, কিন্তু পুরুষের এই নেশাটাকে সংস্কারে অন্ধ মেয়েদের মতো অশ্রদ্ধার চোখেও দেখে না। মান্যগণ্য অতিথিদের জন্য রকমারি জিনিস ঘরে মজুত। চাইতে হয় না। একটু উসখুস করলেই তেষ্টা বোঝে। উদার হাতে বার করে দেয়। আবার বেশি খেতে দেখলে আপত্তি করে। বলে, অত ভালো নয়, আনন্দের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই ভালো। কুমকুমের চিন্তা হবে না তো কি। এত রূপ আর এত বিদ্যা যে মানুষের, তার ভালো মন্দের দিকে চোখ না রেখে কোনো মেয়ে পারে?

এ-সব খুঁটিনাটি খবর বাপী বানারজুলিতে বসে শুনেছে। আবু হেসে হেসে বলেছে, আর খুব বেশি দেরি নেই দোস্ত, জামাইসাহেব ঘায়েল হল বলে।

বাপী সচকিত।—দুলারি কিছু জানে না তো?

—ক্ষেপেছো! গেল মাসেও কুমকুম বহিন এসে তিন রাত তোমার বাংলোয় থেকে গেছে—দুলারির সঙ্গে এখন খুব ভাব তার। ও বলে, মেয়েটা কত ভালো, বাপীভাই একেই বিয়ে করছে না কেন। এ-সব শুনলে আর খাতির করবে!

ফুর্তির মুখে আবু বলেছিল, কুমকুম বহিন এবারে এসে খুব মজার কথা শুনিয়ে গেছে বাপীভাই। ওই লোকটার জন্যে তার নাকি মায়া হয়। কি রকম মায়া জানো? খারাপ সময়ে একবার ও কালীঘাটের মন্দিরে গেছল—মা কালীর কাছে প্রার্থনা করতে যদি একটু দিন ফেরে। সেখানে গিয়ে দেখে এক ভদ্রমহিলার মানতের পাঁঠা বলি হচ্ছে। জীবটার জন্য মহিলার এমন মায়া যে বলির আগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। কুমকুমেরও ওমনি মায়া, কিন্তু পুজোর বলি না দিয়ে পারে কি করে।

আবুর হা হা হাসি। কিন্তু বাপী তেমন খুশি হতে পারেনি। এ-রকম শুনলে বিবেকের ওপর আঁচড় পড়ে! এই বাস্তবে নেমে বাপী সেটা চায় না।

ঘটনার ঢল এবারে পরিণতির মোহনার দিকে। সেদিন শনিবার। সন্ধ্যার ঠিক পরেই দীপুদা এলো। থমথমে মুখ। সাধারণত টেলিফোন করে বাপী আছে কি নেই জেনে নিয়ে আসে। কিছু একটা তাড়ায় এই দিনে খবর না নিয়ে বা না দিয়ে এসে গেছে। এই মুখ দেখা মাত্র বাপীর মনে হয়েছে তার প্রতীক্ষায় গাছে কিছু ফল ধরেছে।

—এসো। হঠাৎ যে?

—তোমার সঙ্গে সীরিয়াস কথা আছে…।

—বোসো। কি ব্যাপার?

হল-এর অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে বলাই কিছু একটা করছে। সেদিকে চেয়ে দীপুদা বলল, তোমার ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি চলো।

শোবার ঘরে এসেই চাপা রাগে বলে উঠল, রাসকেলটার এত অধঃপতন হয়েছে আমি শুনেও বিশ্বাস করিনি।

তিন হাতের মধ্যে মুখোমুখি বসে বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল। অর্থাৎ ব্যাপার খানা কি কিছু বুঝছে না।

বোঝানোর জন্যেই দীপুদার আসা। তপ্ত গলায় দীপুদা যা শোনালো তাতে বাপীর মনে হল, প্রতীক্ষার গাছে ফল শুধু ধরেনি, অনেকটা পেকেও গেছে।

—মেয়েছেলে নিয়ে গোলমেলে ব্যাপার বেশিদিন ধামা-চাপা থাকে না। অসিত চ্যাটার্জির আপিসের এক বন্ধু আগে ওর বাড়িতে আসত, আড্ডা দিত। মিষ্টির সঙ্গেও বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছল। ওই স্কাউনড্রেলের সেটা পছন্দ নয় বুঝেই ভদ্রলোক বছরখানেকের মধ্যে বাড়িতে আর আসেটাসে না। সপ্তাহ তিনেক আগে সে এয়ার-অফিসে এসে মিষ্টির সঙ্গে দেখা করে গেছে। কর্তব্যজ্ঞান আছে বলেই না এসে পারেনি। বলেছে, একটি সুশ্রী মেয়ে নিজে ড্রাইভ করে সপ্তাহের মধ্যে কম করে চার দিন তাদের অফিসে আসে। অফিসে ঢোকে না। ছুটির আগে আসে, গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করে। অসিত চ্যাটার্জি নেমে এলে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। প্রত্যেক শনিবার দিন একটা বাজার দু’পাঁচ মিনিট আগে তার গাড়ি আসে, হাজার কাজ থাকলেও তখন অসিত চ্যাটার্জিকে অফিসে ধরে রাখা যায় না। ঠিক নেশা না থাকলেও আগে ওই বন্ধুটি মাঝেসাঝে অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে রেসের মাঠে যেত। শনিবারে ঘড়ি ধরে এই অফিস পালানোর তাড়া দেখেও তার সন্দেহ হয়। কয়েকটা শনিবার তাই সে-ও রেসের মাঠে গেছে। সব কদিনই সেই মেয়ের সঙ্গে অসিত চ্যাটার্জিকে দেখেছে। তারা গ্র্যান্ডে বসে খেলে। ছ’সাত মাস হয়ে গেল এই এক ব্যাপার চলছে। জিগ্যেস করলে অসিত চ্যাটার্জি বলে, মেয়েটির বাবা তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন ছিলেন। উনি মারা যেতে তাঁর এই মেয়ে এখন ফার্ম দেখাশুনা করে। বিনে পয়সায় অসিত চ্যাটার্জি ফার্মের খাতাপত্র ঠিক করে দেয় বলেই এত খাতির কদর। সত্যি যদি হয় তাহলে বলার কিছু নেই। শুধু বন্ধুটির নয়, অফিসের অনেকেরই খটকা লেগেছে বলে শুভানুধ্যায়ী হিসেবে সে মিষ্টিকে খোলাখুলি জানাবার দরকার মনে করেছে।

মিষ্টি জানে, একটা বড় ফার্মে বিকেলে পার্ট টাইম কাজ জুটেছে বলে ফিরতে রাত হয় লোকটার। অনেক টাকা দেয় তারা। সেই টাকায় মদ গিলে ঘরে আসে। কিন্তু মতিগতি বদলাচ্ছে, তাও লক্ষ্য করছে। মদ খাওয়া বা রেস খেলা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হলে বেপরোয়ার মতো কথা বলে। শাসায়। তা বলে এরকম ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না। তাই শোনামাত্র সব যে বিশ্বাস করেছে তাও নয়। যে সেধে এসে এমন খবর দিয়ে গেল তার রাগ বা আক্রোশ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আজকাল বাড়িতে আসে না তার কারণ আসতে হয়তো নিষেধই করা হয়েছে।

দীপুদা জানিয়েছে, বোকা মেয়ে তার পরেও তাকে বা মাকে একটি কথাও বলেনি। ওই পাষণ্ডের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছে। সেই রাতে নেশার মুখে কিছু বলেনি। পরদিন সকালে ধরেছে। বলেছে, তুমি রোজই প্রায় অফিস থেকে একটি মেয়ের সঙ্গে বেরিয়ে যাও শুনলাম—সে নিজে ড্রাইভ করে, তুমি পাশে বসে থাকো। কি ব্যাপার?

অন্ধকারে জানোয়ারের মুখে হঠাৎ জোরালো আলোর ঘা পড়লে যেমন ধড়ফড় করে ওঠে, কয়েক পলকের জন্য সেই মুখ নাকি অসিত চ্যাটার্জির। মিষ্টি যা বোঝার সেই কটা মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে নিয়েছে। তারপর জানোয়ারের মতোই তর্জন-গর্জন লোকটার।—কোন্ সোয়াইন বলেছে? আমি কখন কোন কাজে কার গাড়িতে বেরোই তা না জেনে তোমাকে এ সব বলে কোন্ সাহসে? তোমার সেই চরিত্রবানেরা কারা আমি জানতে চাই? অফিসে তোমার চারদিকে যারা ছোঁকছোঁক করে বেড়ায়—তারা? কোন মতলবে তোমাকে তারা এ-সব বলে তুমি জানো না? না কি জেনেও ন্যাকামো করছ?

দীপুদার বোন তারপরেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সে জানতে চেয়েছে, আপিসের পর সে কোন বড় ফার্মে পার্টটাইম কাজ করে, ফার্মের নাম কি, টেলিফোন নম্বর কি।

এরপর শয়তানের মুখোশ আরো খুলেছে। চিৎকার করে বলেছে, যে স্ত্রীর এত অবিশ্বাস তার কোন কথার জবাব সে দেবে না। তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে কারো ঘাড়ে মাথা থাকবে না বলে শাসিয়েছে।

মিষ্টি এরপর টেলিফোন করে দাদাকে শনিবারের রেসের মাঠে যেতে বলেছে। শুনে দীপুদা প্রথমে আকাশ থেকে পড়েছিল। মিষ্টি শুধু বলেছে, কিছু গণ্ডগোলের ব্যাপার চোখে পড়তে পারে, কিছু বলবে না, শুধু দেখে এসো, পরে কথা হবে।

দুর্বোধ্য হলেও কাকে নিয়ে বোনের অশান্তি, জানা কথাই। দীপুদা গত শনিবারে রেসের মাঠে গেছল, এই শনিবারেও মাঠ থেকে ফিরে সোজা আগে মিষ্টির ওখানে গেছল। মাঠে যা দেখার দেখেছে। তারপর মিষ্টির মুখে সব শুনেছে। তাদের মা এখনো কিছু জানে না। সব শোনার পর মায়ের মাথাই না খারাপ হয়ে যায় দীপুদার এই চিন্তা

বাপীর মুখের রেখা নিজের প্রতি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। চুপচাপ শুনছে। চেয়ে আছে। মিষ্টির ওখান থেকে দীপুদা সরাসরি এখানে কেন, বোঝার চেষ্টা।

দুর্ভাবনায় মুখ ছাওয়া দীপুদার, একটু চুপ করে থেকে বলল, মেয়েটি সুশ্রী আর অবস্থাপন্ন তো বটেই, বেশ কালচারও মনে হল। এমন এক মেয়ের সঙ্গে স্কাউনড্রেলটা কি ভাঁওতা দিয়ে ভিড়েছে তার ঠিক কি! এরকম একটা থার্ড রেট লোক ওখানে পাত্তা পেল কি করে?

এ আলোচনা যেন অবান্তর। বাপী বলল, ওই থার্ড রেট লোক তোমার বোনের কাছেও পাত্তা পেয়েছিল…এ কথা ভেবে আর কি হবে। এখন সমস্যাটাই বড়।

দীপুদা কথাটা মেনে নিয়েই বলল, মিষ্টি তখন ছেলেমানুষ, কি আর কাণ্ডজ্ঞান। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে। উৎসুক একটু। আচ্ছা বছর সাতাশ-আটাশ বয়েস, ব্যবসা আছে, নিজে ড্রাইভ করে—এ-রকম কোনো মেয়েকে তুমি চেনো বা দেখেছ?

বাপী ভিতরে সচকিত। প্রশ্নটা ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দীর নিছক কাঁচা কৌতূহল মনে হল না। প্রশ্নটা তার না হয়ে তার বোনের হতে পারে। মাকে কিছু না বলে বা তার সঙ্গে শলাপরামর্শ না করে হন্তদন্ত হয়ে আগে এখানে এসেছে কেন? বাপীর ঠাণ্ডা দু’চোখ দীপুদার মুখের ওপর স্থির একটু। তারপর উঠে বলাইকে টেলিফোন এ-ঘরে দিয়ে যেতে হুকুম করল।

নম্বর ডায়েল করল। জিতের নম্বর। কাছাকাছির মধ্যে এখন তারও আলাদা ফ্ল্যাট হয়েছে। বউ ছেলে নিয়ে এসেছে। জিত্‌ সাড়া দিতে বাপী শুধু বলল, একবার এসো——

ঘনিষ্ঠ আলাপ না থাকলেও জিত্ মালহোত্রাকে সুদীপ নন্দীও চেনে। আরো উৎসুক। —তাকে ডাকলে কেন…এ ব্যাপারে সে কিছু জানে?

জবাবে ঠাণ্ডা মুখে বাপী তার কৌতূহল আরো চড়িয়ে দিল।—অপেক্ষা করো। এক্ষুনি এসে পড়বে।

ট্যাক্সি হাঁকিয়ে জিত্ দশ মিনিটের মধ্যে হাজির। বলাই খবর দিতে তাকেও শোবার ঘরেই ডাকা হল। সুদীপ নন্দীকে দেখে সদাসপ্রতিভ জিত্ দুহাত জুড়ে কপালে ঠেকালো। বাপী বলল, পাঁচ-ছ’মাস আগে তুমি এঁর ভগ্নীপতি অসিত চ্যাটার্জি আর তোমার চেনাজানা কোন্ ওয়াইন শপের মেয়ে মালিকের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে চেষ্টা করেছিলে…যা জানো দীপুদাকে বলো। নিজের দোষ ঢাকার জন্য কিছু গোপন করার দরকার নেই।

বাপী উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। জিকে ওটুকু না বললে চলত। ওর নিজের বুদ্ধিই যথেষ্ট। তার ওপর আবু রব্বানী অনেক রকমের তালিম দিয়েই রেখেছে। কলেপড়া মুখ করে ও কি বলবে বাপী জানে। বলবে, চ্যাটার্জি সাহেবের সঙ্গে আগে তারই গলায় গলায় ভাব হয়ে গেছল।…চ্যাটার্জি সাহেবের মতো অত না হলেও অল্পস্বল্প নেশার অভ্যেস তারও আছে। লিকারশপের সেই মেয়ে মালিকের কাছ থেকে জিনিস কিনত। সেই মেয়ে তাকে খুব খাতির করত আর সস্তায় জিনিস দিত। কারণ, ইনকাম ট্যাক্সের অনেকের সঙ্গে তার দহরম—মহরম। তার গত দু’তিন বছরের ইনকাম ট্যাক্সের জট জিত্ সাফ করে দিয়েছে, অনেক টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে। চ্যাটার্জি সাহেব ড্রিংক-এর এত বড় সমজদার, তাই জিত্‌ই সেই মেয়ে মালিকের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। সস্তায় ভালো জিনিস পাওয়া ছাড়া এর থেকে আর কোনো বিভ্রাট হতে পারে ভাবেনি। বেগতিক দেখে মাস পাঁচ ছয় আগে জিত্‌ ভয়ে ভয়ে ব্যাপারটা মালিককে জানাতে চেষ্টা করেছিল!…আর শেষে বলবে, মালিকের শোনার সময় বা আগ্রহ হয়নি দেখে সে-ও চুপ মেরে গেছে।

.

তাসের ঘর ধসে গেছে। মিষ্টি মেয়েদের কোনো হস্টেলে যাওয়ার মতলবে ছিল। তার বাবার জন্য পারেনি। বাবা রিটায়ার করে কলকাতায় চলে এসেছে। সকলে মিলে একরকম জোর করেই তাকে বাড়িতে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন ঝড়ের পরের স্তব্ধতা থিতিয়ে আছে।

মনোরমা নন্দীর ঘন ঘন টেলিফোন আসছে। গলার চাপা স্বর শুনেই বাপী বুঝতে পারে টেলিফোনের তাগিদটা মেয়ের অগোচরে। সব থেকে বেশি এখন তাকেই দরকার, আভাসে ইঙ্গিতে তাও বলতে কসুর করেননি। দুচারবার বাপী এটা-সেটা বলে এড়িয়েছে। তারপর স্পষ্ট আশ্বাস দিয়ে বলেছে, আপনি ব্যস্ত হবেন না মাসিমা, যখন সময় হবে আমি নিজেই যাব, আপনাকে বলতে হবে না।

সুদীপ নন্দীও কোর্ট ফেরত বাড়িতে হানা দিচ্ছে প্রায়ই। মায়ের বাড়িটা এরপর সম্পূর্ণ তার একার হবে এই আশাতেই হয়তো দ্রুত ফয়সলার দিকে এগনোর তাড়া তার। টাকার যার গাছপাথর নেই, আর মন যার অত দরাজ—সম্পর্ক পাকা হবার পর সে ওই বাড়ির ওপর থাবা বসাতে আসবে না এ বিশ্বাস আছে। তিক্তবিরক্ত সে আসলে নিজের বোনের ওপর। তার মাথায় কি-যে আছে ভেবে পাচ্ছে না। কারো সঙ্গে কথা নেই। চুপচাপ আপিসে যায় আসে। এত বড় এক ব্যাপারের পরেও ডিভোর্সের কথায় হাঁ না কিছুই বলে না। দীপুদার বাপীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

বাপীর একই জবাব।——আমার পরামর্শ যদি শোনো তো ব্যস্ত হয়ো না। এত বড় ব্যাপার হয়ে গেল বলেই ধৈর্য ধরে কিছুদিন সবুর করো। মাসিমাকেও তাড়াহুড়ো করতে বারণ করো।

দেড় মাসের মধ্যে অসিত চ্যাটার্জির ভরাডুবি ঘনিয়ে এলো আর এক দিক থেকে। এর পিছনে সবটাই কুমকুমের হাতযশ। বড় তেল কোম্পানীর চিফ অ্যাকাউনটেন্ট, জমা খরচের হাজার হাজার কাঁচা টাকা অসিত চ্যাটার্জির হেপাজতে। আজকের জমার টাকা কাল বা পরশু পিছনের তারিখ দিয়ে খাতায় দেখালে কে আর ওটুকু কারচুপি ধরছে। ক্যাশ ব্যালান্স ঠিক রাখাও তো তারই দায়। তারিখ অনুযায়ী সেটা ঠিক থাকলেই হল। শনিবারে রেসের মাঠের জন্য পাঁচ-সাতশ বা হাজার টাকা সরিয়ে সোমবারে আবার সে টাকাটা পুরিয়ে রাখলেই হল। দুচারবার এ-রকম করেছে। শনিবারে তাড়াতাড়ি ব্যাংক বন্ধ, কুমকুম হয়তো সময় করে টাকা তুলে রাখতে পারেনি। অসিত চ্যাটার্জিকে ফোনে জানিয়ে রেখেছে, কিছু টাকার ব্যবস্থা রেখো, সোমবার পেয়ে যাবে।

রেসে জিতলে তো কথাই নেই, ঘাটতির টাকা তক্ষুনি পকেটে এসে গেছে। না জিতলেও সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। রবিবারের সান্ধ্য বৈঠকে কুমকুম দোকান থেকেই সে-টাকা এনে তার হাতে তুলে দিয়েছে। তাই আপিসের টাকায় হাত দিতে অসিত চ্যাটার্জির তখন আর ভয়-ডর নেই।

কুমুর টেলিফোন পেয়ে শেষবারে চার হাজার টাকা সরিয়েছে। হাতে খুব ভালো ভালো টিপ আছে। কি কি উৎসব উপলক্ষে বড়দরের খেলা। কপালদোষে সেদিন সবটাই হার হয়ে গেল, রবিবারের সন্ধ্যায় এসে অসিত চ্যাটার্জি আয়ার মুখে শুনল হঠাৎ কোনো জরুরী কাজে কুমকুম বাইরে গেছে, পরদিন সকালের মধ্যেই ফিরবে বলে গেছে। অসিত চ্যাটার্জি তখনো নিশ্চিন্ত। পরস্পরের প্রতি এমনি মুগ্ধ তারা যে বাজে ভাবনাচিন্তার ঠাঁই নেই।

কিন্তু পরদিন অফিসে যাবার আগে টাকা নিতে এসে দেখে কুমকুম ফেরেনি। এবারে অসিত চ্যাটার্জির চিন্তা হয়েছে একটু। কুমকুমের জরুরি কাজে হঠাৎ যাওয়া বা দিনকতকের জন্য আটকে পড়া নতুন নয়। আগেও এরকম হয়েছে। সেরকম কোনো জরুরী কাজের জন্য যদি চলে গিয়ে থাকে, চার হাজার টাকার ব্যাপারটা হয়তো ভুলেই বসে আছে।

ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে, একদিন ছেড়ে চার-পাঁচ দিনও এই ঘাটতি ধামা-চাপা দিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার। কিন্তু লোকটার বরাত নিতান্তই খারাপ এবার। ভিতরের কারো শত্রুতার ফল কিনা জানে না। সেই বিকেলের মধ্যেই ধরা পড়ে গেল। বড় সাহেব স্বয়ং অ্যাকাউন্টস চেক করতে বসল।

অসিত চ্যাটার্জির মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। চাকরি খতম তো বটেই ‘ এখন জেল বাঁচে কি করে। কাকুতি মিনতি করে আর হাতে পায়ে ধরে দুটো দিনের সময় নিল। কুমকুমের প্রতীক্ষায় পাগলের মতো সন্ধে পর্যন্ত কাটল। আর কোনো পথ না দেখে শশুরবাড়িতে ছুটল মিষ্টির সঙ্গে দেখা করতে। অনেক করে বলে পাঠালো, ভয়ানক বিপদ—একবারটি দেখা না হলেই না। মিষ্টি নিচে নামেনি। দেখা করেনি।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ বাপীর কাছে এসে ধর্ণা দিল। উদ্ভ্রান্ত মূর্তি। এক্ষুনি চার হাজার টাকা না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

বাপী খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করল। খুঁটিয়ে শুনল সব। টাকার জন্য তার স্ত্রীর কাছে গেছল কিনা তাও জেনে নিল। তারপর উঠে নিজের ঘরে এসে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল। নম্বর ডায়েল করল।

ওদিক থেকে দীপুদা সাড়া দিল। বাপী মিষ্টিকে ডেকে দিতে বলল।

কয়েক মুহূর্তের অধীর প্রতীক্ষা। ফোন ধরবে কি ধরবে না সেই সংশয়।

—বলো।

একটা বড় নিঃশ্বাস সংগোপনে মুক্তি পেয়ে বাঁচল।—ও-ঘরে অসিত চ্যাটার্জি বসে আছে। তার এক্ষুনি চার হাজার টাকা চাই। না পেলে জেল হবে। অফিসের ক্যাশ ডিভালকেশন…। তার খুব পরিচিত কে একজন মহিলা হঠাৎ দু’তিন দিনের জন্য বাইরে চলে গেছে, সে ফিরে এলেই টাকাটা দিয়ে দেবে বলছে…

একটু বাদে ওদিকের ঠাণ্ডা গলা ভেসে এলো।—আমাকে ফোন কেন?

—দেব?

—যাকে দেবে আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলে চার হাজার টাকা আমিই দিতে পারতাম। তোমার টাকা বেশি হলে বা দয়া করার ইচ্ছে হলে দিতে পারো।

ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ। বাপীও রিসিভার নামিয়ে বেরিয়ে এলো। ঠাণ্ডা মুখে অসিত চ্যটার্জীকে বলল, মিষ্টিকে ফোন করেছিলাম, টাকা দিতে পারছি না। অসিত চ্যাটার্জি আর্তনাদ করে উঠল, চার হাজার টাকার জন্য আমার জেল হয়ে যাবে বাপী? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, মিস ভড় আজ ফিরলে আজকের মধ্যেই টাকাটা তোমাকে দিয়ে যাব!

পিছনে জিত্ এসে দাঁড়িয়েছে, অসিত চ্যাটার্জি লক্ষ্য করে নি। বাপী ওর দিকে তাকাতে সে-ও দেখল। জিতের মুখে ভাব-বিকার নেই। অসিত চ্যাটার্জির কথা কানে গেছে বলেই তাকে বলল, মিস ভড় খানিক আগে ফিরেছে, একটু আগে তার ফোন পেয়েছি।

ডুবন্ত লোকটা বাঁচার হদিস পেল। এক রকম ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

.

দু’মাসের আগেই রায় বেরিয়েছে। ডিভোর্স মঞ্জুর। বিচ্ছেদের মামলা রুজু করেছিল অসিত চ্যাটার্জি। অভিযোগ, স্ত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ তার সঙ্গে ঘর করে না। অন্য তরফ থেকে কেউ প্রতিবাদ করে নি। ফয়সলা যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায় ব্যারিস্টার সুদীপ নন্দী বরং সেই চেষ্টা করেছে। তাদের তরফ থেকে কেউ হাজিরাও দেয় নি, অসিত চ্যাটার্জির অনুকূলে এক তরফা ডিক্রি জারি হয়েছে।

সেই দিনই বিকেলে কুমকুম এলো। বাড়ীতে এসে বাপীর সামনে দাঁড়ালো এই প্রথম। খানিক আগে দীপুদা ফোনে বাপীকে রায়ের খবর জানিয়েছে।

বাপী অনেকদিন কুমুকে দেখে নি। আগের থেকেও কমনীয় লাগছে। বিনম্র, হাসিছোঁয়া মুখ। বাপীর মনে হল, কাজ হাসিল করতে পারার কৃতিত্বে আজ অনায়াসে সোজা তার সামনে এসে হাজির হতে পেরেছে। ভিতরে ভিতরে বিরক্ত তক্ষুনি। প্রশংসা বা পুরস্কার কুড়নোর জন্য বানারজুলিতে আবু রব্বানীর কাছে চলে গেলে আপত্তির কিছু ছিল না।

—কি ব্যাপার? হঠাৎ যে?

একটুও ভণিতা না করে কুমকুম বলল, আমার কিছু টাকা দরকার বাপীদা…।

পুরস্কার নিতেই এসেছে তাহলে। বাপীর মুখের রেখা কঠিন। গলার স্বরও সদয় নয়।কত টাকা?

দ্বিধা কাটিয়ে কুমকুম বলল, বেশি টাকাই দরকার…আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি, জলপাইগুড়ির সেই ভাঙা ঘরদোর ঠিক করে নেব ভাবছি… কিছুদিন চলার মতো আরো নতুন করে দুজনারই কিছু শুরু করার মতো কত হলে চলে তুমিই ভালো বুঝবে।

বাপী বিমূঢ়ের মতো চেয়ে রইল খানিক। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, চলে যাচ্ছ! আমরা মানে আর কে? অসিত চ্যাটার্জি?

লজ্জা পেলেও সপ্রতিভ মুখেই মাথা নাড়ল কুমকুম। বলল, ওই লোকের ভালো কিছু নেই সত্যি কথাই বাপীদা, কোনো ভালো মেয়ের তাকে বরদাস্ত করতে পারার কথাও নয়। তবু যেখান থেকে যেখানে টেনে এনেছি…দেখা যাক না কিছুটা ফেরাতে পারি কিনা। না পারলেও আমার তো হারাবার কিছু নেই বাপীদা।

বাপী হতভম্বের মতো চেয়েই আছে। এক ঝটকায় ঘরে চলে গেল। তক্ষুনি চেকবই আর কলম নিয়ে ফিরল। খসখস করে চেকে কুমকুমের নাম লিখল। একটু থমকে বড়সড় একটা টাকার অঙ্ক বসালো। পছন্দ হল না। পাতাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল। এবারে যে টাকার অঙ্কটা বসালো সেটা আরো বড়।

চেক হাতে নিয়ে টাকার পরিমাণ দেখে কুমকুমের দু’চোখ বিস্ফারিত।—এত টাকা কি হবে বাপীদা। না না, এত দরকার নেই—আমরা তো ভাল ভাবে কিছু রোজগার করতে চেষ্টা করব।

অন্য দিকে চেয়ে বাপী বিড়বিড় করে বলল, কিছু বেশি না, নিয়ে যাও …।

কুমকুম চুপচাপ চেয়ে রইল। আহত গলায় বলল, এর পর আমাকে তুমি আরো বেশী ঘৃণা করবে তো বাপীদা?

বাপী আস্তে আস্তে ফিরল তার দিকে। চোখের কোণ দুটো শিরশির করছে। একটা উদ্‌গত অনুভূতি জোর করেই গলা ঠেলে বেরিয়ে এলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ওরে না না—এর পর আমাকে তুই কত ঘেন্না করবি তাই বরং বলে যা!

হতচকিত কুমকুম ত্রস্তে কাছে এগিয়ে এলো। তাড়াতাড়ি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। ধরা গলায় বলল, তার আগে আমার যেন সত্যি মরণ হয় বাপীদা। বাবা আজ আমাকে আশীর্বাদ করছেন—তুমিও করো।

.

রাত প্রায় আটটা। বাপী উঠল। ঘরে এসে জামা-কাপড় বদলালো। তারপর বেরিয়ে পড়ল।

সাতাশি নম্বরের সেই বাড়ি। বাপী নিঃশব্দে গাড়ি থামালো। নিচের বৈঠকখানায় দীপুদা আর তার মা। আজকের কোর্টের ফয়সালার প্রসঙ্গেই তাদের আলোচনা হচ্ছিল মনে হয়। বাপীকে দেখে দু’জনেই খুশি, কিন্তু গলার স্বর চড়িয়ে কেউ অভ্যর্থনা জানাল না। দীপুদা বলল, এসো, মা তোমার কথাই বলছিল।

—মিষ্টি কোথায়?

—ওপরে তার ঘরে। খবর দেব? এবারের আগ্রহ মনোরমা নন্দীর

—আমি গেলে অসুবিধে হবে?

—না না অসুবিধে কিসের! মহিলার ব্যস্ত মুখ।—দীপু, বাপীকে নিয়ে যা দায়টা ছেলের ঘাড়ে চাপালেন মনোরমা নন্দী। ছেলেও খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না হয়তো। কিন্তু প্রকাশ করে বলে না।—এসো, এসো।

দোতলায় উঠে ছোট ঢাকা বারান্দা ধরে দীপুদা তাকে কোণের ঘরের সামনে নিয়ে এলো। পর্দা ঝুলছে। ভিতরে আলো জ্বলছে। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে দীপুদা বলল, মিষ্টি কি কচ্ছিস রে…বাপী এসেছে।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেয়াল-ঘেঁষা ড্রেসিং টেবিলটা চোখে পড়ল বাপীর। তার আয়নায় দেখা গেল একটা বই হাতে মিষ্টি শোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। আয়নায় তারও দরজার দিকে চোখ। বাপীকে দেখছে।

দীপুদা তাকে ভিতরে পৌঁছে দিয়ে সরে গেল। বাপীর দু’ চোখ মিষ্টির মুখের ওপর। শাড়ির আঁচলটা আরো ভালো করে টেনে দিতে দিতে সেও সোজা চেয়ে রইল। শান্ত, গম্ভীর। শোবার ঘরে এসে উপস্থিত হওয়া বরদাস্ত করতে আপত্তি, সেটা পলকে বুঝিয়ে দিল।

তক্ষুনি সেই ছেলেবেলার মতোই একটা অসহিষ্ণু তপ্ত বাসনা বাপীর শিরায় শিরায় দাপাদাপি করে গেল। তার পরেই সংযত আবার। বলল, ওঁরা নিচেই বসতে বলেছিলেন, আমি উঠে এলাম।

মিষ্টির চোখে পলক পড়ল না। বলল, দেখতে পাচ্ছি।

আবারও নিজের সঙ্গে যুঝতে হল একটু। বসতেও বলে নি। ড্রেসিং টেবিলের সামনের থেকে কুশনটা টেনে নিয়ে বাপী নিজেই বসল। স্নায়ু বশে রাখার চেষ্টা— আমার আসাটা এখনো তেমন পছন্দ হচ্ছে না মনে হচ্ছে।

অনড় দৃষ্টি তেমনি আটকে আছে।—কেন এসেছো? সব কিছুর ফয়সালা হয়ে গেল ভেবেছ?

বাপী একটু থেমে জবাব দিল, তোমার আমার দুজনেরই তাই ভাবার কথা।…যা হয়ে গেল তার ধাক্কাটা বড় করে দেখছ বলেই বোধ হয় তুমি এক্ষুনি সেটা ভাবতে পারছ না।

এবারের চাউনি তীক্ষ্ণ। মিষ্টির গলার স্বর চড়ল না। কিন্তু আরো কঠিন। যা হয়ে গেল তার পিছনে তোমার কতটা হাত ছিল?

বাপীর দু’চোখ ওই মুখের ওপরেই হোঁচট খেল একপ্রস্থ। তারপর স্থির হল, খুব ধীরে বুকের দিকে নেমে এলো একটু। আবার চোখ উঠে এলো। আশার আলো নিভলে যে জানোয়ার অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বাপী আগে তার টুটি টিপে ধরল। তার পরেও আকাশ থেকে পড়ল না। মিথ্যে বলল না। জবাব দিল, হ্যাঁ, সবটাই।

মিষ্টির মুখের তাপ চোখে জমা হচ্ছে—এর পরেও তাহলে তুমি কি আশা করো?

—আশা করেছিলাম অসিত চ্যাটার্জির জোরের পুঁজিটা তোমাকে খুব ভালো করে দেখিয়ে দিতে পেরেছি। বাপীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝলসালো, চোখের তারায় বিদ্রূপ ঠিকরলো।—তুমি বড়াই করে বলেছিলে না এই পুঁজিতে ভেজাল নেই বলে, তার জুয়া আর নেশার রোগ বরদাস্ত করতেও তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে না…তা না হলে নিজেই তাকে ছেঁটে দিতে? এখন সবটাই মিথ্যে সবটাই ভেজাল দেখিয়ে দেবার পরেও আমি কি আশা করি তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? আমাকে তোমার দয়ার পাত্র ভেবেছ?

প্রতিটি কথা নির্দয় আঘাতের মতো কানে বিধল। কিন্তু এমনি নির্মম সত্য যে কোনো জবাব মুখে এলো না। অসহিষ্ণু আরক্ত চোখে মিষ্টি চেয়ে রইল শুধু।

কুশন ছেড়ে বাপী উঠে দাঁড়ালো। সামনে এগিয়ে এলো একটু। পুরুষের উঁচু মাথা।—শোনো, আঠারো বছর ধরে আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি, তোমার কথা ভেবেছি। এতে কোনো ভেজাল নেই—মিথ্যে নেই। বারো থেকে আজ এই তিরিশ বছর বয়েস পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি—এর পর হাতে গুণে আর তিন দিন অপেক্ষা করব। আমার কি প্রাপ্য যদি স্বীকার করে নিতে পারো, এই তিন দিনের মধ্যে তুমি আসবে, নিজে এসে আমাকে ডেকে নেবে। তা যদি না পারো এখানকার পাট গুটিয়ে আমি চলে যাব—আর তোমাকে বিরক্ত করতে আসব না।

লম্বা পা ফেলে হাতের ধাক্কায় পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল।

সোনার হরিণ নেই – ৩৬

এরোপ্লেন আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাপীকে ছেলেবেলার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল। চোখে মুখে ঠোঁটে সেই রকম দুষ্টুমি। ছলে কৌশলে সেই রকম হাত—পা গা ছোঁয়ার লোভ। মিষ্টি টের পাচ্ছে। কিন্তু সহজে তার দিকে ফিরছে না বা সোজা হয়ে বসছে না। সে জানলার দিকে। বাইরের আকাশ দেখার সুবিধে, নিরাপদও।

এয়ারপোর্টে মিষ্টির মা বাবা দাদার সামনে বাপী এতক্ষণ মানানসই রকমের গম্ভীর ছিল। তার আগেও অসহ্য রকমের কতগুলো দিন গাম্ভীর্যের খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকতে হয়েছে। মিষ্টিকে বাপী তিন দিনের সময় দিয়েছিল। সেই তিনটে দিন এই মেয়ে ওকে কম যন্ত্রণা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখেনি। মনে পড়তে বাপীর হাত দুটো সেই ছেলেবেলার মতো নিশপিশ করে উঠল।

….সেই তিন দিনের বিকেল পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। তার পরেও মিষ্টি নিজে আসেনি। টেলিফোনে তার গলা ভেসে এসেছে।…ফোনে ডাকলে হবে? মুহূর্তের মধ্যে কি যে ঘটে গেল বাপীই শুধু জানে। কতকালের সত্তা—দুমড়োনো একটা জগদ্দল পাথর টুপ করে খসে পড়ে গেল। শূন্যে উঠে বাপীর মাথাটা তখন ঘরের ছাদে ঠোক্কর খেলেও অসম্ভব কিছু মনে হত না। স্নায়ুগুলোর ঝাঁপাঝাঁপি বন্ধ করতে সময় লেগেছিল। তারপর জবাব দিয়েছে, হবে। কিন্তু তোমার আসতে অসুবিধে কি?

—অসুবিধে বুঝে নাও।

—বুঝলাম তুমি না এলেও আমার যাওয়া আর ঠেকাচ্ছে কে?

জবাবে মিষ্টি টুক করে ফোনটা নামিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু সেখানে মিষ্টির মা বাবা আর দাদার সমাদরের বেড়া টপকে কতটুকু আর নিরিবিলিতে পাওয়া সম্ভব। ফলে সেখানেও বিরাট মানুষ হব, জামাইয়ের মানানসই গাম্ভীর্যের মুখোশ ধরে রাখতে হয়েছে। মুখখানা আরো গুরুগম্ভীর করে তুলতে হয়েছিল শাশুড়ীর প্রস্তাব শুনে। কাগজ কলমের বিয়েতে আর তাঁর আস্থা নেই। বিয়ে হবে হিন্দুমতে অগ্নিসাক্ষী করে। বাপীর তাতে আপত্তির কারণ ছিল না। কিন্তু সেটা ফাল্গুনের তৃতীয় সপ্তাহ। সে-মাসে আর বিয়ের তারিখ নেই। তারপর টানা চৈত্র মাসে হিন্দু বিয়ের কথাই ওঠে না। বিয়ের তারিখ আছে বৈশাখের মাঝামাঝি

বাপীর তখন মনে হয়েছিল অত দূরের বৈশাখ আর আসবে কিনা সন্দেহ। ফলে ভাবী শাশুড়ীকে ঘাবড়ে দেবার মতো ঠাণ্ডা মুখ করে আপত্তি জানাতে হয়েছে।…সব বিয়েই বিয়ে। ও সময়ে তাকে ভারতবর্ষের বাইরেও চলে যেতে হতে পারে।

মনোরমা নন্দী তার পরেও মেয়ের মারফৎ বৈশাখ পর্যন্ত বিয়েটা স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন। মিষ্টি বলেছিল, মা যখন চাইছে ক’টা দিন সবুর করোই না। বাপী আরো গম্ভীর।—ঠিক আছে। তুমি কাল পরশুর মধ্যে আমার সঙ্গে বানারজুলি চলো—বিয়ে না হয় পরেই হবে।

মিষ্টি প্রথমে থমকে তাকিয়েছিল। তারপর দ্রুত প্রস্থান। মা-কে কি বলেছে বাপী জানতেও চায়নি। মোট কথা সেই থেকে ভদ্রোচিত গাম্ভীর্যের মুখোশ সরানোর তেমন ফুরসৎ মেলেনি। টাকার জোরে রেজিস্ট্রি আপিসে পিছনের তারিখ বসিয়ে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। আজই সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে বিয়ে শেষ। দুপুরে অতিথি-অভ্যাগতদের নিয়ে নামী হোটেলে লাঞ্চ পার্টির পর শ্বশুরবাড়ি থেকে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট। এতেও শাশুড়ীর খুব আপত্তি ছিল। এ জামাই অসিত চ্যাটার্জি নয় বুঝেই হাল ছেড়েছেন। রেজিস্ট্রি বিয়ের দোষ ঢাকার জন্য মেয়ের কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরিয়েছেন, মোটা করে সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ কেটে দিয়েছেন।

জীবনে মিষ্টি এসেছে। তাই সবার আগে বানারজুলি ডেকেছে। সেখানকার আকাশ বাতাস জঙ্গল পাহাড় তারা আসবে বলে উন্মুখ হয়ে আছে। জীবনে মিষ্টি এলো এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের মত বাস্তব। এমন বাস্তবের বাসর বানারজুলি ছাড়া আর কোথায় হতে পারে। আবু রব্বানীকে খবর দিয়ে রাখা হয়েছে বিয়ের পরেই তারা যাচ্ছে। সে বোধ হয় এতক্ষণে বাগডোগরা এসে বসে আছে।

কিছুক্ষণ ধরে নিঃশব্দে খুনসুটি করার পরেও মিষ্টি সোজা হয়ে বসল না বা জানলা থেকে মুখ ফেরালো না। বাইরের দিকেই চেয়ে আছে আর হাসি চেপে আছে। সেই ছেলেবেলার দুষ্টুমি টের পাচ্ছে। বাপীও হার মানবে না। তার ঘুম পেল। মাথাটা বার বার মিষ্টির কাঁধে ঠোক্কর খেতে লাগল। শেষে ওই কাঁধের আশ্রয়ে ঘুমিয়েই পড়ল। কিন্তু হাত সজাগ। সেটা মিষ্টির বাহুর ওপর দিয়ে তার কোলের ওপর নেমে এসে বিশ্রামের জায়গা খুঁজছে।

এবারে মিষ্টি ধড়ফড় করে তাকে ঠেলে সরালো। এরোপ্লেন যাত্রী খুব বেশি না হলেও একেবারে কম নয়। চাপা তর্জনের সুরে বলল, এই! হচ্ছে কি?

—কি হচ্ছে?

গলা আরো নামিয়ে মিষ্টি বলল, শ্লীলতাহানির চেষ্টা।

মিষ্টি এবারে সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর। কিন্তু ঠোঁটে হাসি ছুঁয়ে আছে। সিঁথি আর কপালের জ্বলজ্বল সিঁদুরের আভা গাল আর মুখের দিকে নেমে আসছে।

দুর্বার লোভের এমন স্বাদও বাপীর আগে জানা ছিল না। একটু বাদে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। গলা খাটো করে বলল, আমি একটা গাধা। গোটা এরোপ্লেনটা রিজার্ভ করে আনা উচিত ছিল।

মিষ্টি সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে পলকে দেখে নিল। ঠোঁটের হাসিটুকুকেও আর প্রশ্রয় দেওয়া নিরাপদ ভাবছে না। নির্লিপ্ত চোখ আবার সামনের দিকে।

বাপীর আরো মজা লাগছে। এয়ার অফিসের জুনিয়র অফিসারের ব্যক্তিত্বের ফাঁক দিয়ে বানারজুলির মিষ্টি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

বাগডোগরা।

আবু দুটো গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে হাজির। ওর নিজের গাড়ি একটা। অন্যটা বাপীর গাড়ি। বাদশা চালিয়ে এসেছে। সেই গাড়ি আবার ফুল আর লতাপাতা দিয়ে সাজানো। কলকাতা থেকে আরো অতিথি অভ্যাগত আসতে পারে ভেবে দুটো গাড়ি আনা। শুধু দুজনকে দেখার পরে মনে হল, এ-সময় ঝামেলা বাড়াবে দোস্ত এত বোকা নয়।

দু’হাতে বাপীকে জাপটে ধরল প্রথম। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, তুমি মরদ বটে একখানা দোস্ত।

নিরীহ মুখে বাপীও খাটো গলায় জবাব দিল, চৌদ্দ বছর বয়সে বাবার সেই মারের পর তুমিই তো তাতিয়ে দিয়ে বলেছিলে মরদ হলে বদলা নিতে।

তাকে ছেড়ে আবু সভয়ে দেখে নিল বহিনজি শুনল কি না। তারপর মিষ্টিকে শুনিয়েই বলল, ভেরি ডেনজারাস আদমি ইউ! মালিক হও আর যাই হও, এখন থেকে আমি সব সময় মালকান বহিনজির দিকে।

ঘুরে মিষ্টির উদ্দেশে আধখানা নুয়ে বশম্বদ কুর্নিশ করে উঠল। অপ্রস্তুত মিষ্টি বলে উঠল, ও-কি!

—সেরে রাখলাম। আবুর ডগমগ মুখ।—এরপর সব গোস্তাফি মাফ হয়। আমি কিন্তু আর তোমাকে আপনি-টাপনি বলতে পারব না বহিনজি—দোস্ত আস্কারা দিয়ে জংলি মানুষকে কাঁধে তুললে আমার কি দোষ!

মিষ্টি হেসে জবাব দিল, কিছু দোষ নেই, বলতে হবে না।

বানারজুলি পৌঁছুতে সন্ধ্যা।

আবুর কাণ্ড দেখে বাপী হাসবে না রাগ করবে। আবুকে বেশি ঘটা করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। পাশাপাশি দুটো বাংলোই রকমারি রঙিন আলোয় ঝলমল করছে। দুই বাংলোর মাঝের মেহেদি গাছের পার্টিশনের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য আলোর ফুল। দুই বাংলোর উঠোনে আর বারান্দায় লোক গিসগিস করছে। ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত উত্তর বাংলার কেউ বাকি নেই বোধ হয়। চা-বাগানের অনেক পদস্থজনেরাও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। বাপী তরফদার আবু রব্বানীও আর উপেক্ষার পাত্র নয়। ডাটাবাবুও তার রেজিমেন্ট নিয়ে হাজির। বুফে ডিনারের সব ভার তার ওপর। বাইরের যে-সব অভ্যাগতরা স্বস্থানে ফিরতে পারবে না, রাতে তাদের ক্লাব হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আবুর আয়োজনে ত্রুটি নেই।

উপহার আর অভিনন্দন পর্বের পরে মিষ্টিকে নিয়ে বাপীর বাংলোর ঘরে উঠে আসতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। এরপর সাড়ে আটটায় ডিনার। আত্মজনেরা কেউ ভিড়ে মিশে যেতে রাজি নয়, তারা বাংলোর ভিতরে অপেক্ষা করছিল। বাপী প্রথমে দুলারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মিষ্টিকে বলল, আবুর বউ, আমার এখানকার গার্জেন।

বউ দেখে খুশিতে দুলারির চোখে পলক পড়ে না। তারপর স্বভাব-গম্ভীর গলায় বাপীর দিকে ফিরে বলল, তোমার বউ না গার্জেন দেখে ভিরমি খায় বাপীভাই—তা আমি এখন গড় করি না কি করি?

বাপী গম্ভীর একটু।—ছোট বোনকে গড় করবে কি, আশীর্বাদ করো।

এদের শিক্ষা-দীক্ষা যেমনই হোক হেলা-ফেলার যে নয় পরোক্ষে মিষ্টিকেই সেটুকু বুঝিয়ে দিল। এরপর কোয়েলা এগিয়ে এলো। সেও তার রুচিমতো সাজসজ্জা করেছে। খাটুনি নেই, খেয়ে ঘুমিয়ে বেচারী আরো খানিকটা বিপুলা হয়েছে। অতি কষ্টে উপুড় হয়ে দু’হাত মাটিতে ঠেকালো। গড়ের মধ্যে এই ওদের সেরা গড়। মিষ্টি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে সোজা হতে সাহায্য করল, এটুকুতেই কালো মুখ খুশিতে আটখানা।

খবর পেয়ে ঝগড়ুও হাজির। সকালেই পাহাড়ের বাংলো থেকে নেমে এসেছে। বয়েস এখন সাতাত্তর। মোটামুটি মজবুত এখনও। বউয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বাপী তাকেও মর্যাদা দিতে ভুলল না। বাদশা ড্রাইভারের সঙ্গে পথেই পরিচয় করানো হয়েছে।

একটু বাদে ঘর্মাক্ত কলেবরে আবু এলো। সকলকে সরিয়ে দুলারি মিষ্টিকে একটু বিশ্রাম নিতে বলছিল। আবু বাধা দিল, বিশ্রাম সেই রাত্তিরে হবে—এখন মুখ-হাত ধুয়ে সাজ-টাজ যদি কিছু করার থাকে জলদি করে নিতে হবে। আরো লোক এসে গেছে, আবার ডিনারের সময় হচ্ছে।

বাপী সত্যিকারের গম্ভীর।—আরো লোক এসে গেছে?

—বা রে, আসবে না!

—তোমাকে নিষেধ করলাম, আর তুমি এত বড় এক ব্যাপার করে বসে আছ?

আজ অন্তত আবু কারো ভ্রুকুটির তোয়াক্কা রাখে না। জবাব দিল, ছাড়ো তো! এ কি আমার বিয়ে যে তিন দিন আগেও হবু বিবি চেলা কাঠ নিয়ে তাড়া করেছে।

বিড়ম্বনা সামলে দুলারি সকোপে তাকালো তার দিকে। মিষ্টি হেসে ফেলল। বাপী বলে উঠল, আমারও তো সেই বরাত! তাহলে তুমি এত ঘটা করতে গেলে কেন?

আবু হাসছে।—বহিনজির চেলা কাঠ তো চন্দন কাঠ, কার সঙ্গে কার তুলনা। দু’হাত কোমরে তুলে সদর্পে দুলারির মুখোমুখি।—কি বলেছিলাম?

একটু কাঁচুমাচু মুখ করে দুলারি মিষ্টির দিকে তাকালো।—বলেছিলে, এই সুরৎ নিয়ে আর বহিনজির কাছে গিয়ে কাজ নেই।

আবুর উদ্দেশে মিষ্টির চোখে অনুযোগ করার আগেই আবু চেঁচিয়ে উঠল, নো নো টু বহিনজি! আমি কক্ষনো একথা বলিনি।

ইংরেজির ধাক্কায় মিষ্টি হেসে ফেলল। বাপী হাসি চেপে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে কি বলেছিলে?

এবারও দুলারিই জবাব দিল, বলেছিল, দোস্ত-এর বউয়ের নাম মিষ্টি, কত মিষ্টি দেখো’খন—এক কথাই হল না?

মিষ্টি লজ্জা পাচ্ছে। ভালোও লাগছে। এই মানুষগুলো লেখা-পড়া জানে না, শহরের আদব কায়দা জানে না এ একবারও মনে আসছে না।

সব শেষে আবু আর দুলারিকে বিদায় দিয়ে বাপী ঘরে এলো। রাত সাড়ে দশটার ও-ধারে। বাংলো নিঝুম এতক্ষণে। ঝলমলে সাজ-পোশাক বদলে মিষ্টি চওড়া লালপাড় হালকা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। সেই রঙেরই ব্লাউস। খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে বসে আছে।

বাপী দু’চোখ ভরে দেখল খানিক। ঠোটের হাসি চেপে মিষ্টিও চেয়ে রইল। গায়ের জামাটা খুলে বাপী একদিকে ছুঁড়ে দিল। দরজা দুটো বন্ধ করে কাছে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টির ঠোটে হাসি টিপটিপ করছে।

—কেমন লাগছে?

মিষ্টির চোখে মিষ্টি কৌতুক। জবাব দিল, এখনও বানারজুলির মতো লাগছে না।

বাপী থমকালো একটু। জানালার পর্দার ওপরের ফাকটুকু দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। বলল, এক্ষুনি লাগবে, দেখো।

ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিল। তারপর জানালা দুটোর পর্দা সরিয়ে দিতেই দু’দিক থেকে বাইরের জ্যোৎস্না এসে ঘরে আর বিছানায় লুটোপুটি খেল।

বাপী বলল, শুয়ে পড়ো। চোখ বুজে শোনো।

মিষ্টি তাই করল। বাপী নিঃশব্দে একটা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। দেখতে দেখতে চারদিকের নীরবতা আরো নিঝুম। না, নিঝুম বলা একেবারে ভুল। রাশি রাশি ঝিঁঝি একসঙ্গে গলা মিলিয়েছে। সামনে জঙ্গলের গাছপালার সঙ্গে চৈত্রের বসন্ত বাতাসের মিতালির সড়সড় শব্দ থেকে পুষ্ট হচ্ছে। মিষ্টি কান পেতে শুনছে।

প্রায় মিনিট দশেক বাদে সুইচ টিপে সবুজ আলোটা জ্বালল। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বানারজুলি?

মিষ্টির চোখে হাসি দুলছে। মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, বেশ তো ছিল, আলো জ্বাললে কেন?

—হুঁ? বাপীর পলকা ভ্রুকুটি।—কেন জ্বাললাম?

তার গা ঘেঁষে বসল। চেয়ে আছে। মিষ্টিও। বাপী হাসছে অল্প অল্প। মিষ্টিও। বাপীর দু’চোখ লোভে টইটম্বুর। বাসনার দাপাদাপি টের পাচ্ছে তবু হাত বাড়াচ্ছে না। এই রাত কৃপণের মতো খরচ করার রাত।

হাসি-টুপটুপ ঠোটের কোণ দাঁতে কেটে মিষ্টি বলল, কি?

বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি?

মিষ্টি বলল, এক গেলাস জল দেব?

বাপী বুঝে উঠল না। জিজ্ঞাসা করল, জল কেন?

মিষ্টি বলল, সেই কতকাল ধরে জল দিয়ে গিলে খাবার সাধ

তার পরেই প্রমাদ গুনল। লুঠতরাজের দস্যুকে সেধে অন্তঃপুরের দরজা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে সবুজ আলো। জানালার পর্দা সরানো। মিষ্টি চেষ্টা করল বাধা দিতে। পারা গেল না। দেড় যুগের বুভুক্ষু দস্যু সব বাধা ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে বিপুল বিস্মৃতির মাঝদরিয়ায় টেনে নিয়ে চলল।

পৃথিবী কি থেমে ছিল কিছুক্ষণ…বা অনেকক্ষণ! কোনো নিঃসীম নীরবতার গভীরে ডুবে গেছল। নাকি বাপী ঘুমিয়ে পড়েছিল? আস্তে মুখ তুলে তাকালো। দেখছে। কোন্ অপরিসীম শান্তির জগৎ ঘুরে এখান থেকে এখানেই ফিরে এলো।

মিষ্টিও চেয়ে আছে। তাকেই দেখছে।

.

কটা দিন প্রায় হাল ছেড়ে ভোগের এক অবুঝ দুরন্ত রূপ দেখল মিষ্টি। যৌবনের অনুবাস্তবে এই লোক প্রথম নয়। কিন্তু পুরুষ যেন এই প্রথম আগেও ভোগ দেখেছে। নিজেকে সেই ভোগের এমন একাত্ম দোসর ভাবতে পারেনি। দেহ-পথে সমস্ত সত্তার ওপর এমন দুর্বার দখল বিস্তার দেখেনি। আবার স্বার্থপরের দখলও নয়। দু’দিকেরই সমর্পণ শর্ত, সমর্পণ লক্ষ্য।

নিজের ছাব্বিশের এই মেদশূন্য সুঠাম দেহ সম্পর্কে মিষ্টি কম সচেতন নয়। সক্রিয় চেষ্টায় বয়েসটাকে বাইশের পাকাপোক্ত গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে রেখেছে। কিন্তু কটা দিনের মধ্যেই অনুভব করেছে, যা আছে খুব বাড়তি কিছু নয়। এটুকু না থাকলে ওই দামাল পুরুষের দোসর হওয়া খুব সহজ হত না। মিষ্টির অবাক লাগে, এত ক্ষুধা এত তৃষ্ণা আর এমন দুর্জয় আবেগ নিয়ে এই মানুষ এতকাল বসে ছিল কি করে।

মিষ্টি সেদিন না বলে পারল না, যে কাণ্ড করছ, দুদিনে ফুরিয়ে গেলাম বলে। বাপী নিরীহ মুখে ঘটা না করে দেখতে লাগল তাকে। এ-রকম দেখাটাই হঠাৎ জুলুমের সূচনা মিষ্টি এ ক’দিনে সেটা বুঝে নিয়েছে। চকিতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ হামলার মতলব দেখলেই সে ঘর থেকে পালাবে। অগত্যা গম্ভীর আশ্বাসের সুরে বাপী বলল, যতই করিবে দান, ততো যাবে বেড়ে।

বারান্দায় আবুর হাঁক শোনা গেল, বাপী ভাই আছ?

মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এলো। তাকে বসতে দিয়ে বলল, দিদি এলো না?

দিদি শুনে আবু গলে গেল।—তুমি ডাকছ শুনলে ছুটে আসবে—

বাপীও বারান্দায় এসে চেয়ার টেনে বসল। হাতে আগের দিনের খবরের কাগজ। ভাবখানা, এতক্ষণ এটা নিয়েই সময় কাটাচ্ছিল। এখনো ওতেই চোখ। এক-পলক দেখে নিয়ে আবু জিজ্ঞাসা করল, দোস্ত-এর তবিয়ৎ ভালো তো?

—খুব ভালো। কেন?

—চার-চারটে দিন কেটে গেল, রোজই আশা করছি বহিনজিকে নিয়ে একবার গরিব ঘরে যাবে।

ছোট হাই তুলে বাপী জবাব দিল, কি করে যাই, নিজেও যাবে না, আমাকেও ছাড়বে না। সারাক্ষণ চোখে আগলে রেখেছে, দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী, বুঝতেই পারো…

মিষ্টির মুখ লাল। চারদিনের মধ্যে দুদিন জঙ্গল দেখতে বেরোনোর কথা সে-ই বলেছে। টেনে বার করা যায় নি। রাগ করে ভিতরের দরজার দিকে পা বাড়ালো।

বাপী শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। আ-হা, সত্যি কথা বললাম বলে আবুর সামনে অত লজ্জা কিসের। বিয়ের পর বউ ওকে একমাস পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বেরুতে দেয়নি—তারও দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী—বেরুতে চাইলে দুলারি নাকি চেলা-কাঠ নিয়ে তাড়া করত। তুমি তো অতটা করো না।

আবু গলা ছেড়ে হেসে উঠল। বলল, তুমি খামোখা লজ্জা পাচ্ছ বহিনজী—সেই বাচ্চা বয়েসে তোমার জন্য বাপীভাই যে পাহাড় থেকে ঝাঁপ খায়নি আমার বাপঠাকুদ্দার ভাগ্য। এখন উল্টো বলতে না পারলে ভাত হজম হবে?

আবু উঠে পড়ল। তার কাজের অন্ত নেই। একবার খবর নিতে এসেছিল। বাপীকে বলল, ঠিক আছে, দুলারিকে বলব’খন দোস্ত এখন বেজায় ব্যস্ত—ফুরসৎ মিললে বহিনজিকে নিয়ে আসবে।

সেই দিনই দুপুরের আকাশ অন্য রকম। বাতাস অন্য রকম। চৈত্রের মেঘ কালো আস্তরণ বিছিয়ে সূর্য ঢেকেছে। পাহাড়ী এলাকায় অসময়ের মেঘ নতুন কিছু নয়। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস দিয়েছে। গাছপালার সরসর শব্দ কানে আসতে ক’দিনের মধ্যে বাপীর মনে হল, বানারজুলির জঙ্গল আজ ওদের ডাকছে।

যেমন ছিল দুজনে তেমনি বেরিয়ে পড়ল। বাপীর পরনে পাজামা, গায়ে গেঞ্জির ওপর শার্ট। ও এ-ভাবে বেরুলো দেখে মিষ্টিরও সাজ বদলের কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। আটপৌরে ভাবে পরা দামী শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরে নিল। গায়ে ফিকে লাল ব্লাউস। পিঠের ওপর খোলা চুল। যাচ্ছে জঙ্গলে। সেখানে যা সহজ তাই সুন্দর।

কিন্তু বাইরে এত ছোলাছুলি বাতাস আগে বুঝতে পারেনি। পাশাপাশি পাকা রাস্তা ধরে চলেছে। একটু বাদে মিষ্টি ফাঁপরে পড়ল। চুল সামলাতে গেলে শাড়ি যে বেসামাল হয়, আবার শাড়ির নিচের দিক ঠিক রাখতে গেলে আঁচল ওড়ে। বার কয়েক দেখে নিস্পৃহ গলায় বাপী বলল, যে যেদিকে চায় যেতে দাও না, অত ধকল পোহানোর কি দরকার।

ধমকের সুরে মিষ্টি বলল, খুব শখ যে, জঙ্গলে না নেমে হাঁটিয়ে মারছ কেন? বাপী জবাব দিল না। মুচকি হেসে এগিয়েই চলল। দুপুরের রাস্তা একেবারে নির্জন বলেই মিষ্টিও খুব একটা অস্বস্তি বোধ করছে না। চলতে চলতে মাথার চুল আঁট-খোঁপা করে নিল। আর শাড়ির আঁচলটা কাঁধের ওপর দিয়ে এনে ভালো করে কোমরে জড়িয়ে নিল। সামনে কেউ পড়লে আঁচলটা চট করে খুলে মাথায় টেনে দেওয়া যাবে।

বাপী মন্তব্য করল, এয়ার অফিসের জুনিয়র অফিসার মালবিকা এইবার ঠিক—ঠিক খসল—বানারজুলির মিষ্টির খোঁজ পাচ্ছি।

খুব মিথ্যে বলেনি। মিষ্টির নিজেরই ফেলে আসা এক দূরের অতীতের দিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু আগে যে বাংলোটার সামনে এসে দাঁড়াল, দেখা মাত্র সেই অতীত আরো কাছে এগিয়ে এলো। তাদের সেই বাংলো। সামনের কাঠের বারান্দাটা ঠিক তেমনি আছে।

পাশের লোকের দিকে চেয়ে সভয়ে বলল, কি মতলব, ভেতরে যাবে নাকি?

বাপী মাথা নাড়ল। যাবে না। বলল, ওই বারান্দাটার দিকে চেয়ে একটা দৃশ্য দেখছি। …এমনি দুপুরে চোরের মতো এসে আমি একজনের অঙ্ক বলে দিচ্ছি। সে যখন টুকছে আমি তখন চোরের মতোই গায়ের সঙ্গে লেগে দাঁড়িয়ে তার গায়ের আর মাথার ঝাঁকড়া চুলের গন্ধ নাকে টানছি। অঙ্ক টোকায় ব্যস্ত সে আমাকে কাঁধ আর কোমর দিয়ে ঠেলে দিয়ে বলছে, আঃ, সরো না।

—অসভ্য কোথাকারের। দু’গালে লালের ছোপ পড়ল।

সেখান দিয়ে জঙ্গলে নামার মুখে কি মনে পড়তে মিষ্টি বলল, যাঃ সেই গাছটা কেটে ফেলেছে।

বাংলোর সামনে রাস্তার ধারের সেই গাছটা হালে কাটা হয়েছে মনে হয়। মাস কয়েক আগেও বাপী ওটা ওখানে দেখেছে। সেই গাছের ডালে বসে বাপী নানা কৌশলে মিষ্টিকে বাংলো থেকে টেনে আনত।

জঙ্গলে ঢুকেই মিষ্টির একখানা হাত বাপীর দখলে। এই উপদ্রব মিষ্টির ভোলার কথা নয়। ভোলেনি মুখ দেখেই বোঝা গেল। ভ্রুকুটি করে বলল, ধেৎ কেউ দেখে ফেলবে—

হাতের দখল আরো ঘন করে বাপী বলল, এই জঙ্গলে শুধু নিজের জন ছাড়া আর কেউ কাউকে দেখে না।

মিষ্টি বাধা দিল না। তার অদ্ভুত ভালো লাগছে। অনেক পিছনে ফেলে আসা অতীত এমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে কে জানত! ছোট বড় গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে সেই আগের মতোই ডাকছে ওদের। সেই রঙিন প্রজাপতির দল জোড় বেঁধে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে। জোড়ায় জোড়ায় কাঠবেড়ালি গাছের ডালে লুকোচুরি খেলছে। খরগোশের জুটি একটা আর একটাকে ধাওয়া করছে। পেখম—মেলা ময়ূর তার ময়ূরির মন ভোলাচ্ছে। জঙ্গলের এ যৌবনে জরা নেই।

খুশি মনে মিষ্টি তন্ময় হয়ে দেখছে। সব ছেড়ে হাত ধরা মানুষটা যে অপলক চোখে ওকেই দেখছে খেয়াল নেই।

একটা গাছের মোটা সোটা ডালের ওপর হাত রেখে বাপী বলে উঠল, বাঃ ঠিক সেই রকমই আছে—উঠে পড়া যাক, তারপর তুমি আমার পা বেয়ে উঠে পাশে বোসো।

মিষ্টি তক্ষুনি বুঝেছে। সমস্ত মুখ টকটকে লাল। এইভাবে ওকে তুলে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে পাশে বসানো হত। পড়ে যেতে পারে বলে ধমকেই এক হাতে নিজের গায়ের সঙ্গে ওকে জড়িয়ে ধরে থাকত। বাঁদরের ভয় দেখিয়ে আরো কত রকমের দুষ্টুমি করত। নামানোর সময় আগে নিজের বুকের ওপর টেনে নামাতো। তারপরেও সহজে ছাড়তে চাইত না। পিপড়ের ডাঁইয়ের ভয় দেখিয়ে ওই রকম করে দশ-বিশ গজ এগিয়ে যেত।

—তুমি একটা অসভ্যের ধাড়ী—চলো।

আবার খানিক চলার পর বাপী আচমকা থমকে দাঁড়াল। গলা দিয়ে স্স করে ত্রাসের শব্দ বার করল একটা, সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতের আঙুল একটা শিশু গাছের গুঁড়ির দিকে তুলে বলে উঠল, সাপ!

বিষম চমকে মিষ্টি একেবারে তার বুক ঘেঁষে দাঁড়াল।—কোথায়?

আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাপী শিশুগাছের মোটা গুঁড়িটা দেখালো।— ওই যে!…এই যাঃ, ওখানেই তো ছিল।…একটু আগে দেখলাম, ওই গাছের গুঁড়িতে জড়ানো সাদা-কালোর ছোপ মারা একটা বিশাল ময়াল লম্বা চ্যাপ্টা মুখটা সামনের দিকে টান করে এগিয়ে দিয়ে একটা ছোট মেয়েকে চোখে আটকে ফেলেছে, আর তাকে ধরার জন্য গাছের গুঁড়ি থেকে শরীরের প্যাঁচ খুলছে— সেদিকে চেয়ে অবশ মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে—কোথা থেকে একটা ছেলে এসে এক ধাক্কায় মেয়েটাকে পাঁচহাত দূরে ছিটকে ফেলে দিল, তারপর তাকে তুলে নিয়ে ছুটে পালালো।

জোর করেই দু’হাতে বাপী ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, তেমনি শক্ত করে আগলে রেখে বলল, তারপর সেই মেয়ের মায়ের হাতে ওই ছেলের কানমলা পুরস্কার জুটল।

রক্তে দোলা লাগছে, মাথাটাও ঝিমঝিম করছে মিষ্টির।—ছাড়ো, কে কোন্ দিক থেকে এসে যাবে।

বাপী হাসছে।—বললাম না জঙ্গলের জগৎ আলাদা, এসে গেলেও কেউ কাউকে দেখে না। সেদিনের জন্য আমার কি পুরস্কার পাওনা ছিল?

জবাবে এদিক-ওদিক চেয়ে মিষ্টি নিজের ঠোঁটে তার ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিয়েই ধাক্কা মেরে সরালো তাকে।

বাপী হাসতে লাগল।

মিষ্টি বলল, আর বেড়িয়ে কাজ নেই, ফেরো!

বাপী বলল, আমার কি দোষ, একে একে সব মনে করিয়ে দিচ্ছি।

মিষ্টির ঠোঁটে চাপা হাসি। টিপ্পনীর সুরে বলল, জীবনে প্রথম পুরুষ চিনিয়েছ, সব মনে আছে, বেশি মনে করিয়ে দিতে হবে না!

বলল বটে, এক্ষুনি ফিরতে মোটেই চায় না। ছেলেবেলায় জঙ্গলে ঢুকলে রক্তে নেশা ধরত। এখনো তাই। তার থেকেও বেশি। সঙ্গের লোক হঠাৎ বেশ সভ্য—ভব্য হয়ে গেল লক্ষ্য করছে। জঙ্গলের গাছ চেনালো। ব্যবসার কাজে লাগে এমন কিছু গাছ দেখালো। সাপ ধরার গল্প করল। প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে ঘুরতে ঘুরতে আর এক জায়গায় দাঁড়ালো।

গাছ-গাছড়ার মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা। বাপী ভাবুকের মতো চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। তারপর আলতো করে জিগ্যেস করল, এ জায়গাটা মনে আছে?

চারদিক চেয়ে মিষ্টি ঠিক ঠাওর করতে পারল না। মাঝের আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে যাওয়ার ফলে সজাগও ছিল না তেমন। জিগ্যেস করল, এখানে কি? জবাবে বাপী হঠাৎ গায়ের শার্টটা খুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল। তারপর মিষ্টির বিমূঢ় চোখের সামনে পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো। বলল, এখানে কিছু বেপরোয়া ব্যাপার ঘটেছিল বলে পিঠে এই দাগগুলো পড়েছিল। বাংলোয় দাঁড়িয়ে তুমি নিজের চোখে দেখেছিলে—

ওই হাসি-হাসি মুখ আর চোখের দিকে তাকিয়েই ভিতরে ভিতরে বিষম অস্বস্তি মিষ্টির। মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলের কোনো আদিম ইশারা আষ্টেপৃষ্ঠে হেঁকে ধরতে চাইছে তাকে। শরীর ঝিমঝিম করছে। ছোট ছেলেকে আশ্বস্ত করার মতো করে তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক আছে, ওখানেও হাত বুলিয়ে আদর করে দেব’খন, জামা পরে নাও।

বাপী বাধ্য ছেলের মতো নিচু হয়ে জামা কুড়োতে গেল। তারপর মিষ্টি কিছু বোঝার আগে চোখের পলকে ছোঁ মেরে তাকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে ফেলল। এক হাতে ঘাড়ের নিচে, অন্য হাত দুই হাঁটুর পিছনে। একেবারে বুকের ওপর তুলে এনেছে।

মিষ্টির গলা দিয়ে একটু গোঁ গোঁ শব্দ বেরুলো শুধু। দুই ঠোঁট আর মুখও ততক্ষণে এই অকরুণ দস্যুর দখলে। বাধা দেবার সর্ব শক্তি নিঃশেষে টেনে নিচ্ছে। আর বুঝি থামবেই না।

থামল। মুখ তুলল। দু’চোখে অমোঘ অভিলাষের তরল বন্যা। চাপা ভারী গলায় বলল, পিঠের এ-দাগ ঘরের আদরে ভোলানো যাবে না।

দু’চোখ বড় করে মিষ্টি তাকালো একবার। জঙ্গলের সেই আদিম ইশারা এখন দামামা বাজিয়ে ধেয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ অবশ। অবশ অঙ্গের আধখানা মাটিতে আর আধখানা মাটির জামাটার ওপর নেমে এলো টের পেল। তারপর পৃথিবী আবার থেমে গেল। জঙ্গলের কানাকানি স্তব্ধতার গভীরে ডুবে গেল। আজ বাপী নয়, মিষ্টি তরফদার প্রায় অচেনা এক জগৎ ঘুরে এখান থেকে এখানেই ফিরে এলে।

জঙ্গল ভেঙে মিষ্টি আগে আগে চলেছে। ছেলেবেলায় জঙ্গলের সোজা পথে ও-বাড়ি গেছে। এতকাল বাদে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। ভুল হয় হবে, তবু পিছন ফিরে তাকাবে না।

বাপী তার হাত দশেক পিছনে। রাগের মর্যাদা দিচ্ছে আর হাসছে অল্প অল্প। খানিক বাদে ভুল রাস্তায় পা বাড়াতে দেখে পিছন থেকে বলল, ওদিকে গেলে এক-আধটা-বাঘ-ভালুকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।

মিষ্টির পা থেমে গেল। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। গনগনে মুখ। কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তপ্ত জবাবটা আপনা থেকে এসে গেল।—বাঘ-ভালুক ও তোমার থেকে ঢের বেশি নিরাপদ বুঝলে?

অপরাধী মুখ করে বাপী তক্ষুনি মাথা নেড়ে স্বীকার করল। তারপর কোন দিকে যেতে হবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

মিষ্টি আবার আগে আগে চলল। এত দুঃসাহস কারো হতে পারে, তার শরীরটাকে নিয়ে কেউ এমন কাণ্ড করতে পারে ভাবা যায় না। প্রচণ্ড রাগই হচ্ছে মিষ্টির। কিন্তু রাগটা পিছনের লোকের ওপর যত না, তার থেকে ঢের বেশি নিজের ওপর। কারণ ওই লোকের ওপর যত রাগ হবার কথা, চেষ্টা সত্ত্বেও ঠিক ততো রাগ হচ্ছে না।

পাছে এও টের পেয়ে যায় সেই রাগে আগে আগে চলেছে। সেই ভয়েও। জঙ্গল ছাড়িয়ে রাস্তায় উঠলো। মিনিট তিনেকের পথ। বাংলো দেখা যাচ্ছে। আগে আগে পা বাড়িয়েও মিষ্টি থমকে দাঁড়াল। গেটের সামনে বিচ্ছিরি দেখতে একটা লোক দাঁড়িয়ে। খালি গা। মিশকালো। একরাশ চুলদাড়ি। নিজের মনে বিড়বিড় করছিল। মিষ্টিকে দেখে ঘোলাটে চোখে তার দিকে চেয়ে রইল।

মিষ্টি ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকালো। বাপী হাত পনের দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে হাসি ছুঁয়ে আছে। এগিয়ে এসে বলল, কি হল, যাও?

—ওই লোকটা কে?

—ওর নাম হারমা। মাথার ঠিক নেই।

—আমাকে এভাবে দেখছে কেন?

—মনের মানুষের অভাবে ওর এই হাল। তুমি যে-মুখ করে ফিরছিলে সগোত্র ভেবে ওর বোধ হয় পছন্দ হয়েছে। চলো—

মিষ্টির হাত ধরে বাপী গেটের দিকে এগলো। এবারে মিষ্টি আর বাধা দিল না। লোকটার চাউনি দেখে অস্বস্তি লাগছে। দাঁড়িয়েই আছে। চেয়েই আছে।

—কি চাই?

বাপীর ঠাণ্ডা প্রশ্নে লোকটার সম্বিৎ ফিরল একটু। হাত তিন-চার দূরে সরে দাঁড়াল। পুরনো অভ্যেস একটা হাত তুলে কপালে ঠেকালো। কিন্তু চাউনি সদয় নয় এখনো। ঘুরে হনহন করে জঙ্গলে নেমে গেল।

সোনার হরিণ নেই – ৩৭

বানারজুলির বসন্ত এবারে শুধু আনন্দের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সেই আনন্দের ছোঁয়া বাপীর শিরায় শিরায়। অস্তিত্বের কণায় কণায়। এতকালের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা, দুঃসহ প্রতীক্ষা—সবেরই কিছু বুঝি অর্থ আছে। হাত বাড়ালে সহজে যা মেলে তার সঙ্গে এই পাওয়ার কত তফাৎ, সমস্ত সত্তা দিয়ে সেটুকু অনুভব করার জন্যেই বোধ হয় অত যন্ত্রণা আর অমন প্রতীক্ষার প্রয়োজন ছিল। নিজের সুরবিস্তারে শিল্পী অনেক সময় নিজেই ভেসে যায়, ডুবে যায়

মিষ্টিকে নিয়ে আবু রব্বানীর বাড়িতে সেদিন সকালের দিকে এসেছিল। আগের বারে সন্ধ্যায় এসেছিল। আবু অনুযোগ করেছিল, জঙ্গলের গরিবখানা বহিনজি রাতে আর কি দেখবে, সকালে এলে ভালো লাগত।

এবারে বাপী তাই সকালে নিয়ে এসেছে। আবুর এখন দস্তুরমতো বড়সড় কাঠের বাংলো। একেবারে জঙ্গলের মধ্যে এরকম বাংলো বানারজুলিতে আর দুটি নেই। মিষ্টির সত্যি ভালো লেগেছে। ইলেকট্রিক নেই তাই আগের বারে রাতে এসে গা ছমছম করেছিল। আবু বা দুলারি কারোরই ইলেকট্রিক পছন্দ নয়। জঙ্গলের মধ্যে বিজলীর আলো বেখাপ্পা। জঙ্গলে থাকার মজা মাটি। দিনের আলোয় চারদিকের সবুজের মধ্যে সবুজ বাংলোটা সত্যি সুন্দর।

প্রায় ঘণ্টা দুই আদর আপ্যায়ন আর আড্ডার পর মিষ্টির আপাদমস্তক একদফা ভালো করে দেখে নিয়ে দুলারি হঠাৎ বাপীকে বলল, তোমাদের বিয়েতে মরদেরা বউকে কত গয়না দেয় শাড়ি দেয়, তুমি বহিনজিকে কি দিলে বাপীভাই?

ভিতরে ভিতরে বাপী সত্যি অপ্রস্তুত। অন্যভাবে সামাল দিল। সাদামাটা মুখ করে বলল, এত দিয়েছি যে তোমার বহিনজি নিতে পারছে না।

শুধু দুলারি নয়, আবুও উৎসুক। আর কিছু বলছে না দেখে দুলারিই জিজ্ঞেস করল, কি দিলে?

মুখে জবাব না দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা বাপী বার দুই তিন নিজের বুকে ঠুকল। অর্থাৎ নিজেকেই দিয়ে ফেলেছে।

আবু রব্বানী আনন্দে হৈ-হৈ করে বলে উঠল, বহিনজি বুঝলেও এই দেওয়ার কদর ও বুঝবে না দোস্ত, ও বুঝবে না—নিজেকে ফতুর করে দিয়েও মন পেলাম না।

দুলারির কোপ আর আবুর চপলতায় দেওয়ার প্রসঙ্গ ধামা চাপা পড়ে গেল। কিন্তু বাংলোয় ফেরার পথে দুলারির কথাগুলো বাপীর মাথায় ঘুর-পাক খেতে লাগল। জঙ্গলের মেয়ের পর্যন্ত যে-বাস্তব চোখদুটো আছে ওর তাও নেই। মিষ্টিকে ঘরে এনে তুলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। না দুটো ভালো শাড়ি না কিছু গয়না। কলকাতা থেকে ওকে তুলে নিয়ে বানারজুলিতে ছুটে আসা ছাড়া মাথায় আর কিছু ছিলই না। নইলে দুটো ছেড়ে দু’ডজন শাড়ি কিনে ফেলতে পারত। আর গয়নাও…

আবার মনে পড়ল কি। ঠোঁটে স্বস্তির হাসি।

শোবার ঘরে ঢুকে মিষ্টি বাইরের শাড়িটাও বদলাবার ফুরসৎ পেল না। দু—মিনিট বিশ্রামের জন্য সবে শয্যায় এসে বসেছিল। আঁতকে উঠে দাঁড়াল।—ও কি!

বাপী ঘরে ঢুকে ভিতরের দরজা দুটো বন্ধ করছিল। বাইরের দরজা বন্ধই ছিল। ছিটকিনি দিয়ে বাপী ঘুরে দাঁড়াল।—কি?

—এই সাতসকালে দরজা বন্ধ করছ কেন?

নিরীহ মুখে বাপী ঘড়ি দেখল।—সকাল কোথায় এখন, বেলা সাড়ে দশটা।

—ভালো হবে না বলছি, দরজা খোলো শিগগীর!

বাপী ঘটা করে নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা।—উঃ। পাপ মন সবেতে সাপ দেখে। হাসতে হাসতে দেরাজ খুলে বড় একটা চাবির গোছা বার করল। একটা চাবি বেছে নিয়ে সামনে ধরল। কোণের পেল্লায় সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল, ওটা খোলো।

মিষ্টি থতমত খেল একটু।—ওটা কি?

আঙুল তুলে দেয়ালে টাঙানো গায়ত্রী রাইয়ের বড় ছবিটা দেখালো।—এটা ওই ঠাকরোনের, খোলোই না।

ওই মহিলার সম্পর্কে এ কদিনে অনেক শুনেছে। চাপা আবেগও লক্ষ্য করেছে। তাই দুষ্টুমির ব্যাপার কিছু ভাবল না। খুলল।

ওপরে ভাঁজ ভাঁজ করা রঙচঙা কার্পেট, রঙিন বেড-কভার, শৌখিন গায়ের চাদর। বাপীই এগিয়ে এসে একে একে সেগুলো তুলে ফেলল। তার পরেই মিষ্টির দু’চোখ ধাঁধিয়ে যাবার দাখিল। এত সোনা একসঙ্গে দেখেনি। শুধু সোনা নয়, একদিকে হীরে জহরত মণি মুক্তো। ঝুঁকে প্রথমে সোনার বারগুলো তুলে বাপী বেড-কভারে ঢাকা বিছানার ওপর রাখল। মিষ্টি হাঁ করে দেখছে। ছোট বড় মিলিয়ে পনেরটা বার। হাতে নিয়ে দেখল। সব থেকে ছোটটার ওজন দশ ভরির কম হবে না। বিশ-তিরিশ ভরি ওজনেরও আছে। বাপী হীরে জহরত মুক্তোর কাঁধ-উঁচু ট্রেটাও এনে খাটের ওপর রাখল।

মিষ্টির হঠাৎ কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। সোনার বাজার চড়া। একশ দশ পনের টাকা ভরি। কম করে আড়াইশ’ ভরি হবে এখানে। আর ট্রেতে এতসব দামী পাথর। এসব খোলা পথে সিন্দুকে এসে উঠেছে ভাবতে পারছে না। ঘরে কারো এত সোনা থাকে কি করে! কেন থাকে!

—এই সব তোমার?

বাপীর মজাই লাগছিল। জবাব দিল—এই সব তোমার। এর ডবল ছিল। ওই ঠাকরোনটি তার মেয়েকে এই কাঁধে ঝোলাতে না পেরে মনের দুঃখে অর্ধেক তাকে ভাগ করে দিয়েছে, বাকি অর্ধেক তোমার জন্যে রেখে গেছে। মিষ্টি মনে মনে মস্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল একটা।—উনি আমার কথা জানতেন?

—ও বা-বা, না জানলে। রেহাই পেলাম কি করে! পিঠের দাগ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।

এই লোকের অসাধ্য কিছু আছে ভাবে না মিষ্টি। জিগ্যেস করল, তুমি কলকাতায় ছিলে আর এ-সব এখানে পড়ে ছিল?

—না তো কি, এর থেকে ঢের দামী জিনিস ছিনিয়ে আনার তালে ছিলাম বলে এসবের কথা মনেও ছিল না। আজ দুলারি বলতে মনে পড়ল।

মিষ্টি হেসে ফেলল। তারপর বলল, বুঝলাম, কিন্তু এসব ব্যাঙ্কে না রেখে ঘরে ফেলে রেখেছ কোন সাহসে?

—ব্যাঙ্কের থেকে এখানে রাখা ঢের নিরাপদ। ধরা পড়লে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হবে।

শোনামাত্র মিষ্টির আবার সেই অস্বস্তি। কিছু সংশয় প্রকাশ পেলে দেয়ালের ওই মহিলার প্রতি অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা ভাবতে পারে।—ঠিক আছে, এখন চটপট তুলে ফেলো।

—তুলে ফেলব মানে? দুলারি দারুণ লজ্জা দিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া সেরেই তোমাকে নিয়ে আর এসব নিয়ে শিলিগুড়ি যাব। সেখানে গয়নার অর্ডার দিয়ে পরে শাড়ি কেনা হবে।

মিষ্টির আবার মজা লাগছে। চোখেমুখে কপট খেদ…এটুকু সোনার আর হীরেমুক্তোর গয়না?

কি দিয়ে হয় বা কতটা হয় বাপীর ধারণা নেই। তবু ঠাট্টা বুঝল। হেসে জবাব দিল, করে রাখতে দোষ কি, ইঁটের ডেলা আর পাথরকুঁচির মতো তো পড়েই আছে।

জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে মিষ্টিই এবার খাট থেকে সব-কিছু তুলে নিয়ে আবার সিন্দুকে রাখল। তার ওপর যা ছিল একে-একে সব তুলে চাপা দিতে লাগল।

—ও কি! সব চাপাচুপি দিচ্ছ, শিলিগুড়ি যাবে না?

—না।

—আলবৎ যাবে। বাপী বাধা দিতে এগিয়ে এলো।

—দেখো, পাগলামো করো না! তোমার এই বুদ্ধি দেখলে দশ বছরের ছেলেও হাসবে।

—কেন হাসবে?

—কলকাতা থেকে এসে শিলিগুড়ি যাব গয়না গড়াতে আর শাড়ি কিনতে? কলকাতায় গিয়ে যা-হয় হবে।

বেজার মুখ দেখে হেসে ফেলে মিষ্টি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ এখনো। এই লোককে বিশ্বাস নেই। বলতে যাচ্ছিল, এই জঙ্গলের রাজ্যে তুমিই আমার সেরা গয়না।

আরো সাত দিন বাদে মিষ্টিকে নিয়ে বাপী ভুটান পাহাড়ে বাংলোয় চলে এলো। দিন দশেক নিরিবিলিতে কাটানোর ইচ্ছে এখানে। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় গায়ত্রী রাইয়ের স্বামীর অ্যাকসিডেন্টের গল্প করেছে। ফলে এমন সুন্দর পাহাড়ী রাস্তাটাকে মিষ্টি ভয়ের চোখে দেখল। পরে ওঠা-নামার সময় গল্পের ফাঁকে ওর দিকে ঘাড় ফেরালেই ধমক লাগায়, সামনে চোখ রেখে চালাও—বর্ষায় এ-রাস্তায় তুমি মোটে আসবে না!

বাপীর দু-কান জুড়োয়। আরো বেপরোয়া হতে ইচ্ছে করে।

দুজনকে একসঙ্গে পেয়ে ঝগড়ুর কালো মুখে খুশি ধরে না। মাথায় তুলে রাখা সম্ভব হলে রাখত। পাহাড়ের এই বাংলোর সে-সব জমজমাট দিনগুলো সে ভুলতে পারে না। তাই মনমরা। দিনকতকের জন্য হলেও মরা নদীতে খুশির জোয়ার এসেছে। এই মালিক মস্ত দিলের মানুষ গোড়া থেকেই জানে। কিন্তু তার রীপনা বউও যে সেই রকমই হবে, নিজের হাতে খেতে দেবে, বসে গল্প শুনতে চাইবে, এ কি ভেবেছিল?

এখানে বসন্ত আরো উদার। আরো অকৃত্রিম। বাংলোর সামনেই ফুলের বাহার। পিছনে ব্যবসার গাছ-গাছড়ার চাষ করে পাঁচ-ছটা লোক। বাংলোর বাইরে যে-দিকে তাকায় জঙ্গল আর পাহাড়, পাহাড় আর জঙ্গল। পাহাড়গুলোও রিক্ত নয় এখন। মৌসুমি ফুলের মুকুট পরে বসে আছে। অর জঙ্গল তো ঋতুসাজে সেজেই আছে। তার বাতাস রক্তে দোলা দিয়ে যায়। তখন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

যেতে হয়ও। জীবনের এই দোসরই তাকে বসন্তের বে-হিসেবী ভোগের রকমারি স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাধা দিতে গেলে বাঁধ ভাঙে। তখন আর কৃপণ হতে ইচ্ছে করে না। হাল ছেড়ে রাগই করছিল।—তুমি এত জানো কি করে?

এ সম্পর্কেও বাপীর কিছু বইপত্র পড়া ছিল। তা ফাঁস না করে মাথা চুলকে জবাব দিয়েছে, দেখে-শুনে একজন মেয়ে মাস্টার রেখেছিলাম—সেই শিখিয়ে পড়িয়ে পাকা করে দিয়েছে।

দু-হাতের ধাক্কায় বাপী খাট থেকে উল্টে পড়তে যাচ্ছিল। সে-ই ফাঁকে মিষ্টি ঘর থেকে পালিয়েছে। ভালো মুখ করে ঝগড়ুর সঙ্গে গল্প করতে বসেছে। আর ভয়ে ভয়ে বার বার পিছন ফিরে দেখছে।

তিন দিন বাদে বাপী ওকে নিয়ে বাংলো থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। বলল, চলো আজ জঙ্গলে বেড়িয়ে আসি।

মিষ্টি উৎসুক তক্ষুনি। তার পরেই থমকালো।— কোনরকম অসভ্যতা করবে না?

৬২৬

বাপী হাসতে লাগল।—তা কি বলা যায়, সব এখানকার বাতাসের দোষ।

—যাব না, যাও।

বাপী আশ্বাস দিল, ঠিক আছে, চলো। এই জঙ্গলে পিঠে দাগ পড়ার মতো কোনো কারণ ঘটেনি।

পিঠে না হোক, মনে দাগ পড়ার মতো কিছু ঘটেছিল। মিষ্টির হাত ধরে বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় পা ফেলা মাত্র সেটা মনে পড়ে গেল। আঙুল তুলে সামনের মস্ত দেবদারু গাছটা দেখিয়ে বলল, ওখানে এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

মিষ্টির তক্ষুনি আগ্রহ।—কার সঙ্গে?

—উদোম ন্যাংটো এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। তখন হাড় কাঁপানো শীত— ওই গাছটার নিচে দিব্বি বসেছিল, সমস্ত গায়ে ভস্মমাখা, সামনে একটা ত্ৰিশূল। অমন দুটো চোখ আমি আর দেখিনি, ঝাঁকড়া চুল-দাড়িতেও তার আলো ঠিকরোচ্ছিল। আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, আগে বাঢ়। মিল জায়গা।

মিষ্টি অবাক।—কি মিল জায়গা?

—ও-ই জানে। আমার তখন সব সামনে এগোনোটা শুধু তোমাকে লক্ষ্য করে। এসবে ভক্তি বিশ্বাসের ছিটে-ফোঁটাও নেই—কিন্তু গমগমে গলার স্বর আমার কানে বসে গেল, আর তারপর থেকে মনে এক আশ্চর্য জোর পেলাম। হেসে মন্তব্য করল, এর কোনো মানে নেই, সবটাই সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার জানি, কিন্তু তখন শুধু মনে হচ্ছিল, আমার দিন ফিরবেই আর তোমারও নাগাল পাবই।

মিষ্টি বাধা দিল, মানে নেই বলছ কেন, দিনও ফিরেছে, নাগালও পেয়েছ। বাপী হেসে উঠল। জবাব দিল, সে-কি ওই সন্ন্যাসীর দয়ায় নাকি! আমার তেড়ে-ফুঁড়ে এগনোটা তো দেখোনি। তবে এগনোর জোরটা মনের সেই অবস্থায় অনেক বেড়ে গেছল সত্যি কথা।

মিষ্টি আর কথা বাড়ালো না। সাধুসন্তদের মাহাত্ম্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু অমঙ্গলের আশঙ্কায় তাদের প্রতি কোনোরকম অবিশ্বাস বা অবজ্ঞার কথাও শুনতে চায় না।

ফেরার পথে জঙ্গল ঘেঁষা সেই ছোট পাহাড়। বাপী নিজে উঠল খানিকটা হাত ধরে মিষ্টিকেও টেনে তুলল। তারপর টেনে জায়গায় বনমায়ার শোকে পাগল সেই বুনো হাতির খপ্পরে পড়েছিল, আর কোন্ পর্যন্ত ওটা তাদের ধাওয়া করে নিয়ে গেছল, দেখালো। এই অবধারিত মৃত্যু থেকে প্রাণে বাঁচার গল্প মিষ্টি কলকাতায় বাপীর প্রথমবারের সেই নামী হোটেলের সুইটে বসে শুনেছিল। তখনো শিউরে উঠেছিল। কত অল্পের জন্য বেঁচেছে চোখে দেখে এখন আরো গায়ে কাঁটা।

দুদিন বাদে সকালের দিকে আবু গাড়ি নিয়ে হাজির। একটা বড় কনট্রাকটের যোগাযোগ। মালিকের সামনে পার্টির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ইচ্ছে। বহিনজিকে আশ্বাস দিল বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবে।

বাপীর ফিরতে সন্ধ্যা গড়ালো। বাদশা পৌঁছে দিয়ে গেল। মুখ-হাত ধুয়ে চা খেতে খেতে বাপীর মনে হল, মিষ্টি একটু চুপচাপ। জিগ্যেস করল, সমস্ত দিন কি করলে?

মিষ্টি বলল, ঝগড়ুর সঙ্গে গল্প করলাম, তোমার এখানকার বাগানে কি কি চাষ হয় না হয়, ঝগড়ু বোঝালো, সাপের বিষ তোলার ঘরও দেখালো—একটা মেয়ে মরে গেল বলে অমন লাভের ব্যবসাটাই তুমি বন্ধ করে দিলে বলে ঝগড়ুর খুব দুঃখ।

বাপী চেয়ে রইল একটু। তারপর অল্প অল্প হাসতে লাগল।—তোমার আরো কিছু বলার ইচ্ছে মনে হচ্ছে?

মিষ্টিও হাসল একটু।—তুমি রাগ না করলে বলতে পারি।

—তুমি আমার রাগের পরোয়া করো এই প্রথম জানলাম। আচ্ছা, বলেই ফেলো—

মিষ্টির তবু দ্বিধা।—আজ থাকগে, সমস্ত দিনের ধকল গেছে তোমার…।

—কিছু না। তার দিকে চেয়ে বাপী একটু মজার খোরাক পাচ্ছে। বলল, যেদিন তোমাদের ডিভোর্সের রায় বেরুলো, আমার ওপর ক্ষেপে গিয়ে তুমি জিগ্যেস করেছিলে যা হয়ে গেল তার পিছনে আমার হাত ছিল, আমি বলেছিলাম সবটাই—মনে আছে?

মিষ্টি মাথা নাড়ল, মনে আছে।

—তার মানে তোমাকে চাওয়া বা পাওয়ার ব্যাপারে আমি কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিইনি। তোমার আমার মধ্যে লুকোচুরির কিছু থাকতে পারে না এটুকু ধরে নিয়ে মনে কি আছে বলে ফেলো দেখি?

এবারে মিষ্টি সোজা চেয়ে রইল একটু। মনে যা আছে ব্যক্ত না করা পর্যন্ত নিজেও স্বস্তি বোধ করছে না। বলে গেল, কলকাতার এয়ারপোর্ট থেকে প্রথম যেদিন তুমি আমাকে হোটেলে নিয়ে গেছলে সেদিনও তুমি বনমায়ার সেই বুনো হাতির হাত থেকে প্রাণে বাঁচার ব্যাপারটা আমাকে বলেছিলে।…বলেছিলে, তোমার সঙ্গে একজন ছিল, সে-ই তোমাকে বাঁচালে। সেই একজন কোনো মেয়েছেলে তখনো বলোনি…এখানে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে সেই জায়গা যখন দেখালে, তখনও না।

বাপীর ঠোঁটের হাসি মিলিয়েছে। বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। কলকাতার হোটেলে রেশমার নামটা করতে পারেনি বলে নিজেকে অকৃতজ্ঞ ভাবছিল, তাও মনে আছে।

—তোমার কাছে এ গল্প কে করল, ঝগড়ু?

সাদা মনেই করেছে। তোমাকে বাঁচানোর ব্যাপারে জঙ্গল আলো করা মেয়েটা কত সাহস আর কত বুদ্ধি ধরে তাই বলছিল।…রাত পোহাতে হঠাৎ সে এখান থেকে চলে গেল, আর কয়েকদিনের মধ্যে বানারজুলির সাপঘরে গিয়ে সাপের ছোবল খেয়ে আত্মহত্যা করল—সেই শোক আর সেই অবাক ব্যাপার ওর মনে লেগে আছে।

মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা যন্ত্রণার আভাস দেখছে মিষ্টি। একটু চুপ করে থেকে বাপী ঠাণ্ডা গলায় জিগ্যেস করল, বানারজুলির বাংলোর সামনে সেদিন যে পাগল লোকটাকে দেখেছিলে, মনে আছে?

—হারমা না কি নাম বলেছিলে।

—হ্যাঁ। রেশমা ওকে ভালবাসত না, ও দারুণ ভালবাসত। তার শোকে এই দশা। এখন ওর ধারণা রেশমা আমার জন্যেই আত্মহত্যা করেছে। বলে বেড়ায়, রেশমাকে যে বাঁচতে দিল না তার কি ভালো হবে…।

মিষ্টি সত্রাসে চেয়ে আছে।

—হারমার ধারণা খুব মিথ্যে নয়। …রেশমাকে বাঁচাতে পারতাম। তাহলে বাপী মরত। সে তোমাকে পেত না। তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারত না।

মিষ্টি নির্বাক।

ভারী অথচ নিরুত্তাপ গলায় বাপী এরপরে অব্যর্থ সেই বীভৎস মৃত্যু থেকে রেশমার তাকে বাঁচানোর চিত্রটা অকপটে তুলে ধরল। বাংলোয় ফেরার পর রাতের ঘটনাও।

মিষ্টি উৎকর্ণ। তারও চোখে মুখে বেদনার ছায়া।

বাপী বলল, এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে সে আমার কত বড় শত্রুর হাতের মুঠোয় চলে গেল আর কোন্ অনুশোচনায় সে নিজের ওপর অমন বীভৎস শোধ নিল—সে কথা তুমি দুলারির মুখে শুনে নিতে পারো—রেশমা তাকে সব বলে গেছে।

মিষ্টি সখেদে মাথা নাড়ল। দু চোখে অনুতাপ। আর কারো কাছে কিছু শোনার দরকার নেই।

তেমনি ভারী গলায় বাপী আবার বলে গেল, কিন্তু তোমার কথার জবাব এখনো দেওয়া হয়নি।…যাই করুক, রেশমা রেশমাই। নিজের ওপর ওরকম শোধ সে-ই নিতে পারে। সেই বীভৎস দৃশ্য তুমি কল্পনা করতে পারবে না। পর পর অনেকগুলো রাত আমি ঘুমুতে পারিনি। যন্ত্রণায় বুক ফেটে গেছে। কলকাতায় বা এখানে তোমার মনে এতটুকু ভুলের ছায়া পড়ুক তা আমি চাইনি। তোমাকে পাওয়ার আনন্দে স্বার্থপরের মতো অতবড় শোকের স্মৃতিও ভুলতে চেয়েছি। তাই তার নাম করিনি।

মিষ্টির বিচ্ছিরি লাগছে। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে যাকে হাড়ে হাড়ে চিনেছে, তার ভোগের দুর্বার তৃষ্ণাও দেখছে এখন। রেশমার সম্পর্কে এই গোপনতার ফলে একটা কুৎসিত সন্দেহ বার বার মনে আসছিল, নিজের কাছে অন্তত সেটা অস্বীকার করার নয়। চেয়ার ছেড়ে কাছে এসে দাঁড়াল। একটা হাত তার পিঠে রাখল।—ঘাট হয়েছে, আর কক্ষনো তোমাকে কিছু বলব না— হল?

—হাজার বার বলবে। বললে বলেই এখন হাল্কা লাগছে। তোমার আমার মধ্যে কোনো মিথ্যে থাকবে না, লুকোচুরি থাকবে না—ব্যস!

দশ দিন বাদে আবার বানারজুলি। এসে সেই বিকেলেই গেটের কাছে আবার হারমাকে দেখেছে। বাংলোর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কি বলছিল। তাকে দেখেই ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল। লোকটা নাকি বলে, রেশমাকে যে বাঁচতে দিল না তার কি ভালো হবে…।

মিষ্টির এই অস্বস্তি বাপীও লক্ষ্য করেছে। আবুকে বলেছে, হারমার এদিকে আসা আটকাও তো। তোমার বহিনজি ঘাবড়ে যায়।

তিন দিন দার্জিলিং আর দুদিন শিলিগুড়ি বেড়ানোর পর আবার বানারজুলিতে ফিরে মিষ্টি কলকাতায় ফেরার জন্য ব্যস্ত। তার এক মাসের ছুটি প্রায় শেষ।

এ ব্যাপারে বাপী নির্লিপ্ত। জিগ্যেস করল, এয়ার অফিস তোমাকে কত মাইনে দেয়?

—কেন, তুমি তার থেকে বেশী দেবে?

—দেব।

মিষ্টি হেসেই জিজ্ঞাসা করল, কত বেশি দেবে?

—বেণীর সঙ্গে মাথা।

তার চাকরির ব্যাপারে এই লোক বিগড়বে এরকম আশঙ্কা মিষ্টির ছিলই। এরপর যা দেখল তাতে দু চক্ষু স্থির। উত্তর বাংলার নানা ব্যাঙ্কের এক-গাদা পাশবই। তার কোনোটাতে বাপী তরফদার, কোনোটাতে বিপুল তরফদার, কোনোটাতে বিপুলনারায়ণ তরফদার, কোনটাতে বা শুধু নারায়ণ তরফদার। এক একটাতে টাকার অঙ্ক দেখেও মাথা ঘোরার দাখিল।

শুধু অবাক নয়, মিষ্টি অস্বস্তিও বোধ করেছে। সাদা সিধে রাস্তায় এত টাকা এলে নামের এত কারচুপি কেন? শুধুই ইনকাম ট্যাক্স এড়ানোর জন্যে বলে মনে হল না। পাহাড়ের বাংলোয় গিয়ে সে আরো কিছু দেখেছে, জেনেছে। রেশমাকে নিয়ে অমন এক আবেগের ব্যাপার ঘটে গেল বলেই মুখ ফুটে তখন কিছু জিগ্যেস করতে পারেনি। বানারজুলিতে ফেরার পর ভুলে গেছল।

ভাবনাটা এখনো চেপেই গেল মিষ্টি। বাপীর তক্ষুনি আবার দরকারী কাজ মনে পড়েছে। এসব পাশবই বাতিল করে দুজনের নামে অ্যাকাউন্ট করতে হবে। চার পাঁচ দিন অন্তত লাগবে তাতে।

তাকে কিছু না জানিয়ে মিষ্টি টেলিগ্রামে আরো এক সপ্তাহের ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে নিল।

ওই সব ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট দুজনের নামে ট্রান্সফারের সময়েও সেই নাম বদলের খেলা দেখল। এবারে একজনের নয়, দুজনেরই। কোথাও মিষ্টি তরফদার কোথাও মালবিকা তরফদার। কোথাও শুধু মিষ্টি দেবী বা মালবিকা দেবী। কোনটাতে আগে বাপীর নাম পরে ওর। কোনটাতে আগে ওর পরে বাপীর।

মিষ্টির সাদামাটা বিস্ময়—নামের ওপর এত হামলা কেন?

জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেছে। দুষ্টুমি চিকিয়ে উঠেছে।—সত্যি আমি রাম বোকা একটা, আসল লোক এত কাছে, তাকে ছেড়ে কিনা তার নামের ওপর হামলা!

নিরাপদ ব্যবধানে সরে গিয়ে মিষ্টি আবার জানতে চেয়েছে, বলো না কি ব্যাপার?

বাপীর এবারে সত্যি বলার দায়ে-পড়া মুখ —জেল-টেল যদি হয় কখনো, একলা গিয়ে মরি কেন, দুজনে জড়াজড়ি করেই যাব।

মিষ্টিও হেসে ফেলে তাড়াতাড়ি কৌতূহল চাপা দিল। ধুরন্ধর কম নয়, উদ্বেগ টের পেয়েই এই ঠাট্টা। মিষ্টি তার পরেও শুধু লক্ষ্য করেছে। মুখের আয়নায় ভেতর দেখতে চেষ্টা করেছে। বড় রকমের গলদ বা জটিলতা কিছু থাকলে কেউ এমন নিঃশঙ্ক অকপট স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে দিন কাটাতে পারে না। এখানে এসে মিষ্টি পাহাড়ী ঝরনা কম দেখল না। পাথুরে বিঘ্ন ঠেলে, কোনো আবর্জনা গায়ে না মেখে তরতর করে নেমে আসে। হাতে নিলে স্ফটিকস্বচ্ছ। এই লোকের সঙ্গে মেলে। বিঘ্ন মানে না। আবর্জনা গায়ে মাখে না। ওসব যে দেখে, দেখুক।

মিষ্টিও আর দেখতে চেষ্টা করল না। উৎকণ্ঠাও সরে গেল। সবই জানতে বুঝতে খুব সময় লাগবে মনে হয় না। পাহাড়ের বাংলোয় এই লোকের সেদিনের জোরের কথাগুলো ভোলার নয়। বলেছিল, তোমার আমার মধ্যে কোনো মিথ্যে থাকবে না, লুকোচুরি থাকবে না—ব্যস!

থাকবে না যে, তার প্রমাণ কলকাতা রওনা হবার দিনও আর এক-দফা পেল। উপলক্ষ হাতের চিঠি। এই সকালে এসেছে। আমেরিকা থেকে ঊর্মিলা একসঙ্গে ওদের দুজনকে লিখছে। রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পরেই বাপী আট-দশ লাইনের চিঠিতে বিয়ের খবর আর বানারজুলিতে লম্বা হনিমুন কাটানোর খবরটা শুধু দিয়েছিল। তার জবাব। চিঠিতে এমন কিছু প্রগলভ রসিকতার আভাস ছিল যার দরুন বউয়ের জেরার ভয়ে অনেক পুরুষ ওটা লুকিয়ে ফেলতে চাইত। চিঠিটা নিজে পড়ে বাপী নিঃসঙ্কোচে তার হাতে তুলে দিয়েছে। পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিটিমিটি হেসেছে।

‘ফ্রেন্ড ডিয়ার অ্যান্ড ডিয়ার ডিয়ার মিষ্টি। চিঠি পেলাম। চিঠি এত ছোট কেন তাও বুঝলাম।

যুগলে শোনো! দেশের মতো এখানেও সামার এখন। ছোট বড় যে কোনো উপলক্ষে এখানে এখন মেয়ে পুরুষের নাচার ধুম। ওর আপিসের অসভ্য বন্ধুগুলোর আমাকে নিয়ে নাচার জন্য টানাটানি। আমি ছুতোনাতায় পালিয়ে বেড়াই। কিন্তু সেদিন চিঠিখানা পেয়ে আর পড়েই ঘরের মধ্যে আমি এমন নাচা নাচতে লাগলাম যে তোমাদের মিস্টার মেহেরার দুই চোখ ছানাবড়া। ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে থামাতে এসে আরো বিপাকে পড়ে গেল। আমি তাকে নিয়েই ধেই ধেই নাচতে লাগলাম।

বাপী, তুমি একখানা সত্যিকারের শয়তান। যা চাও তাই পাও। তাই করো। আমি এরকম শয়তানের কত যে ভক্ত জানলে মিষ্টি না রেগে যায়। যাক এখন কি করে মিষ্টি পেলে না জানা পর্যন্ত আমার ভাত হজম হবে না। পত্রপাঠ সবিস্তারে লিখবে।

মিষ্টি, তুমি কত যে মিষ্টি একদিন স্ব-চক্ষে দেখেছি। আজ সত্যি কথা বলছি ভাই, তোমার সেদিনের অত ঠাণ্ডা হাব-ভাব দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি কোনো গৌরবের সমর্পণের অপেক্ষায় বসে আছ। নইলে সেদিন তুমি অত ঘটা করে ফ্রেন্ডের অস্তিত্ব উপেক্ষা করতে চাইতে না। কিন্তু খুব সাবধান, ওই ডেনজারাস মানুষকে কক্ষনো যেন আর মিষ্টি ছাড়া করতে চেও না। তার মিষ্টি ছাড়া হবার আক্রোশ আমি যেমন জানি তেমন আর কেউ জানে না। এই আক্রোশে সে নিজে রসাতলে ডুবতে পারে অন্যকেও টেনে নিয়ে যেতে পারে।

বাপী, মিষ্টিকে এভাবে সাবধান করার জন্য জন্য তুমি নিশ্চয় আমার মুণ্ডুপাত করছ। মানে মানে এখন সরে পড়ি।

তোমাদের হনিমুনের হনি অফুরন্ত হোক।—ঊর্মিলা’

বাপীর ঠোঁটে হাসি ঝুলছে। চিঠি পড়া শেষ করে মিষ্টি মুখ তুলল। স্বাভাবিক জেরার সুরে জিগ্যেস করল, শেষের এই কথাগুলোর মানে কি?

—মানে, অত দূরে বসেও ওই মেয়ের আমাকে ডোবানোর মতলব।

—তোমার মিষ্টি ছাড়া হবার আক্রোশ ও যেমন জানে আর কেউ তেমন জানে না লিখেছে। আক্রোশে ওকেই রসাতলের দিকে টেনেছিলে নাকি?

—প্ৰায়।

মিষ্টির কৌতূহল বাড়লো।—শুনি না কি ব্যাপার?

বাপী বিপন্ন মুখ।—শুনতেই হবে?

মিষ্টি একটু হালকা খোঁচা দেবার লোভ ছাড়ল না।—তুমিই বলেছিলে আমাদের মধ্যে লুকোচুরির কিছু থাকতে পারে না। বলতে আপত্তি থাকলে বোলো না।

বাপী বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা।—এরপর আর না বলে পারা যায় কি করে।…তোমার বিয়ে হয়ে গেছে জেনে সমস্ত মেয়ে জাতটাকে ভস্ম করার মেজাজ নিয়ে বানারজুলি ফিরেছিলাম। সেই আক্রোশে ঊর্মিলার প্রেম-কাণ্ডে আগুন ধরিয়ে ওকেই প্রায় গিলে বসেছিলাম—

মিষ্টি হাসতে গিয়েও হোঁচট খেল।—তোমার গেলার নমুনা তো জানি, প্ৰায় বলতে কতটা?

—তা অনেকটা। ওর মা তখন ষোলো আনা আমার দিকে—আমাকে ঠেকায় কে?

মিষ্টি এবারে রুদ্ধশ্বাস।—তারপর?

—তারপর ওই মেয়ের চোখের জল আমার পিঠে চাবুক হয়ে নেমে এলো। পড়িমরি করে আবার কলকাতায় ছুটে গিয়ে বিজয়কে শিলিগুড়ি ধরে নিয়ে এলাম। আর এখান থেকে মায়ের অজান্তে মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে ওদের বিয়ে দিলাম।

মিষ্টি চেয়ে আছে। তার কান-মন ভরে যাচ্ছে।

সোনার হরিণ নেই – ৩৮

চাকরির মোহ মিষ্টিরও আর নেই খুব। উপার্জনের সঙ্গে প্রয়োজনের কিছুমাত্র যোগ না থাকলে সেটা শখের চাকরি। তখন দশটা পাঁচটার কড়াকড়ি খুব সুখের মনে হয় না। মিষ্টি তবু তর্ক করতে ছাড়েনি। বলেছে, ঘরে বসে থেকে করব কি, খাবদাব ঘুমুবো আর মুটিয়ে যাব?

ওর মুটিয়ে যাবার নামে বাপীর কপট আতঙ্ক।—সর্বনাশ! সেটা বরদাস্ত হবে না। যা আছ তার থেকে এক চুল মোটা হতে দেখলে খাওয়া আর ঘুম আর্ধেক করে দেব আর হরদম ওঠ-বোস করাবো। এতদিনে আমার হাতের একটা পাকা আন্দাজ হয়ে গেছে—রোজ রাতে আর ছুটির দিনের দুপুরে খুব কড়া করে মাপ নিয়ে ছাড়ব।

মিষ্টির অবাকই লাগে। এরকম বে-আবরু রসের কথা ওই মুখেই দিবিব মানায়। হাসি চেপে বলেছে, তোমার অত কষ্ট করার দরকার কি, আমি চাকরিটা করে গেলেই তো হয়

বাপী গম্ভীর। তা হয় না। অসিত চ্যাটার্জি আমার কান বিষিয়ে রেখেছে। ওখানে নাকি গণ্ডায় গণ্ডায় লোক তোমার রূপে গুণে মজে আছে। সব ছেড়েছুড়ে আমাকে তাহলে তোমার অফিস পাহারা দিতে হয়।

সন্তর্পণে একটা মুক্তির নিশ্বাস ফেলেছে মিষ্টি। দুজনের মধ্যে দুস্তর তফাৎ কত, অনুভব করা যায়। মুখের কথা ছেড়ে আগের লোকের চাউনিতে অবিশ্বাসের ছায়া দেখলেও বরদাস্ত করতে পারত না, ঝলসে উঠত। আর এই একজনের তাই নিয়ে সাদাসাপটা ঠাট্টাও নির্ভেজাল রসের বস্তু হয়ে ওঠে।

মিষ্টির মা বাবা দাদারও এখন বাপীর সর্ব কথায় সায়। বিশেষ করে মায়ের। জামাই-গর্বে মহিলা ডগমগ। মেয়ের নিজের আলাদা নতুন গাড়ি হয়েছে, তার জন্য ড্রাইভার রাখা হয়েছে। সোনাদানার ছড়াছড়ি। ছেলের বউয়ের আর তাঁর নিজের গায়েও এক-গাদা নতুন গয়না উঠেছে। মেয়ে কোনো আপত্তিতে কান দেয়নি। মেয়ের একলার হাতখরচের জন্য এখানকার ব্যাঙ্কে যে টাকা জমা পড়েছে তা-ও চোখ ঠিকরে পড়ার মতো। জীবন-ভোর বড় চাকরি করেও মেয়ের বাপ অত টাকা জমাতে পারেনি। জামাইয়ের পরামর্শ মতো সেই টাকা মনোরমা নন্দী আর মালবিকা নন্দীর নামে রাখা হয়েছে—ঠিকানাও সেই বাড়ির। বাপীর সঙ্গে এই টাকার কেউ কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাবে না। ইনকাম ট্যাক্স এড়ানোর এই ফন্দি মিষ্টির খুব পছন্দ নয়। কিন্তু দাদা এমন কি বাবাও বলে, বেশি টাকা যাদের, এভাবে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতেই হয়।

মায়ের উদ্ভাসিত মুখ দেখে মিষ্টি তাকে আরো কিছু দেখানোর লোভ সামলাতে পারেনি। গাড়ি পাঠালেই মা চলে আসে। মেয়ের ঐশ্বর্যের আভাস পেলেও তার পরিমাণ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। মায়ের সঙ্গে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার পর আনন্দে আত্মহারা মা-কে মিষ্টি নিজের এখানে নিয়ে এলো। খাওয়া দাওয়ার পর আরো কত সোনা আর মণিমুক্তো ঘরে পড়ে আছে মা-কে দেখালো। উত্তর বাংলার নানা ব্যাঙ্কে জমা টাকার পাশবইগুলো দেখেও মায়ের দম-বন্ধ হওয়ার দাখিল। মিষ্টি আনন্দ পেয়েছে বই কি। যে জামাইয়ের আজ এত গুণকীর্তন, এই মায়ের হাতে তার ছেলেবেলার হেনস্থা মেয়ে ভোলেনি। মানুষটার পিঠের ওই দাগগুলোর ওপর মিষ্টি যখন হাত বা ঠোঁট বুলিয়ে আদর করে, তখন সেই সব নির্যাতন অবজ্ঞা আর অবহেলা সব থেকে বেশি মনে পড়ে।

কিন্তু এত ঐশ্বর্য বলেই মিষ্টি নিজেও স্বস্তি বোধ করে না খুব। একটা উৎকণ্ঠা মনের তলায় থিতিয়েই আছে। ভুটান পাহাড়ের বাংলোয় নিজের চোখে কিছু দেখে এসেছে। কিছু বুঝেও এসেছে। তারপর ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে এই জমা টাকার স্তুপ দেখে কেবলই মনে হয়েছে এত বড় ব্যবসার তলায় তলায় কিছু বে-আইনী ব্যাপারের স্রোতও বইছে। বাপীর দিকে চেয়ে কোনরকম উদ্বেগের ছিটেফোঁটাও যে দেখে না—সেটা অবাক হবার মতো কিছু নয়। তার মতো বেপরোয়া দুঃসাহসী কজন হয়।

মুখে কিছু না বলে মিষ্টি দেখে যাচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করছে। নিজের চোখ আর বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে। বাড়ির নিচের তলায় অফিস। বাপীর কথামতো খাওয়া-দাওয়ার পর দু’তিন ঘণ্টার জন্য এসে বসে। জিত্ থাকলে তার কাছ থেকে কাজকর্ম বোঝা সহজ হয়। আর শুধু এই লোক থাকলে খানিক বাদে ফষ্টিনষ্টি শুরু হয়ে যায়। এক-একদিন কাজের অছিলায় বাপী গম্ভীর মুখে জিকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। মিষ্টি মনে মনে অপ্রস্তুত হয়। জিত্ চলে গেলে রাগ দেখায়।— তোমার যে যে দিনে বাইরে কাজ থাকবে সেই সব দিনে আমি এখানকার কাজ দেখতে বা বুঝতে নামব।

বাপীর ঠোঁটে জবাব মজুত।—আমার যা হবার হয়েছে, বউ ছেলে আছে, বেচারা জিতের মাথাটা আর খাবে কেন।

—জিত্ কি বোকা নাকি, তোমার চালাকি বুঝতে পারে না ভাবো?

—না পারার কি আছে। তোমাকে কি করে ঘরে এনেছি ও সেটা খুব ভালোই জানে।

তবু এই ক-মাসে মিষ্টি যতটুকু দেখেছে বা বুঝেছে, এখানকার ব্যবসায় বেআইনী কিছু আছে মনে হয়নি। বাপীর সঙ্গে উল্টোডাঙার বিশাল গোডাউনও দেখে এসেছে। সেখানে ভাসুর অর্থাৎ মণিদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোকের দুর্ভাগ্যের কথা মিষ্টির শোনা ছিল। মাসখানেক আগের ছুটিতে বাচ্চু এসেছিল। তখন শুনেছে। শোনার পর ছেলেটার জন্য ভারী মায়া হয়েছিল। ওই ছেলেও খুব আর ছোটটি নেই এখন। সবই বোঝার কথা। যাই হোক, গোডাউন দেখেও সন্দিগ্ধ হবার মতো কিছু চোখে পড়েনি।

প্রথম ধাক্কা খেয়েছে মাস চার-পাঁচ বাদে বাপীর সঙ্গে টুরে এসে। পর পর দুবার মিষ্টি যেচে সঙ্গ নিয়েছে। তার স্পষ্ট কথা, খুব আনন্দ করে চাকরি ছাড়িয়েছ, এখন একলা বসে আমার দিন কাটে কি করে?

বাপী সানন্দে নিয়ে এসেছে। ভালো হোটেল যেখানে আছে সেখানে আর অসুবিধে কি। মিষ্টি সেই প্রথম টের পেয়েছে এ-সব দিকের ব্যবসার সবটাই সাদা রাস্তায় চলছে না। ফার্মের নামে অনেক টাকা চেকে আসতে দেখেছে। সেই সঙ্গে থোকে থোকে কাঁচা টাকাও। কাঁচা টাকার বেশির ভাগই ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে না। যা-ও পড়ছে তা-ও ফার্মের নামে নয়, দুজনের নানা নামের অ্যাকাউন্টে। ঘরের সিন্দুকে অত কাঁচা টাকার আমদানিও এই থেকেই বোঝা গেল। প্রথমবারের সন্দেহ দ্বিতীয়বারে সঙ্গে এসে আরো মাথায় গেঁথে গেল। এবারে মধ্যপ্রদেশের কয়েক জায়গায় টুরে আসা হয়েছিল। ফেরার সময় গা শিরশির করার মতো সঙ্গে পাঁজা পাঁজা নোট।

এবারে ফিরে এসে মিষ্টি আর চুপ করে থাকতে পারল না। উদ্বেগ বুঝতে না দিয়ে ঘুরিয়ে প্রসঙ্গটা তুলল। জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের সেই ভুটান পাহাড়ের বাংলোর পিছনের অত জায়গায় সবটা জুড়ে শুধু নেশারই নানারকম গাছগাছড়ার চাষ হচ্ছে দেখেছিলাম, সব ওষুধে লাগে?

বাপী হেসে জবাব দিল, ওষুধে যতটা লাগে নেশায় তার থেকে বেশি লাগে।

—তোমার লাইসেন্স আছে?

—লাইসেন্স না থাকলে এত জায়গায় ব্যবসা চালাচ্ছি।

—না, মানে নেশার জন্য ও-সব বিক্রি করার লাইসেন্সও আছে? বাপী হাসতে লাগল।

—হঠাৎ তোমার মাথায় এসব চিন্তা কেন?

—বলোই না?

—আমি হোলসেলারদের দিয়ে খালাস। যা করার তারা করে। কোটার বাইরে তারা যা নেয় তার হিসেব মুখে মুখে—আমার রেকর্ড সাফ।

মিষ্টির পছন্দ হল না। বলল, কোটার বেশি জিনিস দেওয়াও তো অন্যায়, বিশেষ করে কেন বেশি নিচ্ছে তা যখন তুমি জানো।

এই গোছের ন্যায়-নীতির আলোচনা ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু বাপীর একটুও খারাপ লাগছে না। মিষ্টির ভেতরটা এখনো ছেলেবেলার মতোই পরিষ্কার। বলল, লোকে নেশা করবেই, তাই এ অন্যায় তুমি না করলে আর একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে করবে। হেসে খোঁচাও দিল আর ন্যায়-অন্যায় যা-ই বলো সব করেছি তোমার জন্য—পিছনে টাকার জোর ছিল না বলে বানারজুলির বড়সাহেবের বাংলোয় ঢুকতে পর্যন্ত পেতাম না—লোকে নেশা আর কতটুকু করে, তোমার জন্য আমার টাকা রোজগারের নেশা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মিষ্টি মুখে আর কিছু বলল না, কিন্তু ভিতরে একটা দুশ্চিন্তা থিতিয়েই থাকল। বলতে ইচ্ছে করছিল, আমার জন্যেই যদি হয় তো এ নেশায় আর কাজ কি! আমার নাগাল তো পেয়েছ, এখন সাদা রাস্তায় চলো। বলতে পারল না। এত বছর ধরে এত জায়গায় যা ছড়িয়ে বসেছে, হুট করে তা গুটিয়ে ফেলতে বললে কান তো দেবেই না, উল্টে হেসে উড়িয়ে দেবে। বিরক্তও হতে পারে। এর পর বাপী টুরে বেরুলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মিষ্টির একটা চাপা অস্বস্তির মধ্যে কাটে। এত কাঁচা টাকা নিয়ে অনায়াসে ঘোরাফেরা করে, মিষ্টির সে-জন্যেও দুশ্চিন্তা।

ইচ্ছে থাকলেও এখন আর সঙ্গে যাওয়া হয় না। নরেন্দ্রপুর থেকে বাচ্চুকে ছাড়িয়ে এনে আবার কলকাতার স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। মুখে না বললেও বাচ্চুর এখানে থাকার ইচ্ছেটা মিষ্টি টের পেত। কলকাতায় এলে কাকীমার কাছছাড়া হতে চায় না। এই থেকেই বুঝেছে। আর এই ছেলেটার ওপর তার কাকার স্নেহ মায়া মমতাও লক্ষ্য করেছে। এত বড় বাড়িতে মিষ্টিরও একা ভালো লাগে না। সে-ই তাগিদ দিয়ে বাচ্চুকে আনিয়েছে। ছেলেটার ওপর আগেই মায়া পড়েছিল। এখন আরো বেড়েছে।

সামনের বারে স্কুল ফাইন্যাল দেবে। কিন্তু মিষ্টি মাস্টার রাখতে দেয়নি। বাপীকে বলেছে, এটুকু দায়িত্ব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।

বাপী আরো নিশ্চিন্ত।

সময় সময় তবু মিষ্টির কেমন নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিমনা দু-চোখ নিজের দেহে ওঠা-নামা করে। যেমন ছিল তেমনি আছে। আগের মতই কাঁচা, তাজা। তবু খুশি হতে পারছে না তেমন। বছর ঘুরতে চলল, দেহের নিভৃতে কোনো সাড়া নেই, ঘোষণা নেই। সব থেকে বেশি কাম্য কি এখন, মুখ ফুটে বাপীকে বলতে না পারলেও নিজে জানে। কোল-জোড়া হয়ে থাকার মতো কাউকে চাই। আগের জীবনে আর ছেলেপুলে না হওয়াটা ইচ্ছাকৃত ভাবত। একবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে সেই সম্ভাবনাও ভয়ের চোখে দেখত। সেই দোসরের ওপর ভরসা আদৌ ছিল না, তাই নিরাপদ বিধি-ব্যবস্থার দায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু এখন কি? এই এক বছর ধরে তো কোনো বাধারই বালাই নেই। ভাবতে গেলে নিজের মুখ লাল হয় মিষ্টির। দুর্বার স্রোতে ভেসে যাওয়ার এমন পরিপূর্ণ আনন্দ আগে জানা ছিল না। নিজের শরীর স্বাস্থ্য অত ভাল না হলে ধকল পোহানোও খুব সহজ হত না। এই ভোগ-বিস্মৃতির একটাই পরিণাম। কিন্তু এত দিনেও শরীরে তার কোনো লক্ষণ বা ইশারা নেই কেন?

মিষ্টির দুশ্চিন্তার ছায়াটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে। সেই অভিজ্ঞ ডাক্তারের কথা মনে পড়েছে। বলেছিল, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তখনকার সেই ভাঙা স্বাস্থ্যই সব থেকে বড় ক্ষতি ধরে নিয়েছিল মিষ্টি। সেই ক্ষতি মানে কি তাহলে এই! এত পাওয়ার বিনিময়েও তার কিছু দেবার থাকবে না?

নিজের হেপাজতে গাড়ি, হাতে অঢেল টাকা, মিষ্টি দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকল না। মা-কে শুধু বলল। তারপর সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে মায়ের মারফৎ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তার কাছে গেল। সঙ্গে কেবল মা। আর কেউ কিছু জানে না।

মা সব বলার পর কেসটা বড় ডাক্তারের কিছু কিছু মনে পড়েছে। ‘দু’ সপ্তাহে বারকয়েক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সে মা-কে জানিয়েছে, এত দিনেও হয়নি যখন, আর হবে বলে মনে হয় না। হবেই না এমন কথা ভদ্রলোক খুব জোর দিয়ে না বললেও মিষ্টি যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। মা ডাক্তারের কথা মানতে রাজি নয়। কলকাতা শহরে বড় ডাক্তার ওই একজনই নয়। মায়ের তাগিদে সমস্ত কেস সহ আরো দুজন বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়েছে। তাদেরও ঊনিশ-বিশ একই কথা। তবে আশ্বাস দিল, বিজ্ঞান থেমে নেই, এ ধরনের কেস নিয়েও বিদেশে ঢালাও গবেষণা চলছে। কোনো আশা নেই, এ-কথা জোর দিয়ে বলা চলে না।

আগের জামাইয়ের ওপর জ্বলন্ত আক্রোশে মনোরমা নন্দী দুর্ভাবনার ব্যাপারটা ছেলেকে না বলে পারেনি। ছেলে আবার কথায় কথায় সেটা বাপীকেই বলে ফেলেছে। এই ভগ্নীপতি তার সব থেকে অন্তরঙ্গজন এখন। মা-কে নিজে তাগিদ দিয়ে দাদুর সাতাশি নম্বরের বাড়ি দীপেন নন্দীর একলার নামে লেখাপড়া করিয়েছে। শুধু তার জন্যেই ভগ্নীপতি ঘরে দামী বিলিতি বোতল মজুত রাখে। নিজে এরোপ্লেনের টিকিট কেটে সপরিবারে তাকে বানারজুলিতে বেড়াতে পাঠিয়েছে—সেখানে নিজের বাংলোয় নি-খরচায় রাজার হালে রয়েছে। সেখানেও বেড়ানোর জন্য একটা গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা তার দখলে। এমন দরাজ ভগ্নীপতির কাছে গোপন করার কি আছে। তার ওপর তরল পদার্থ পেটে পড়তে মনের খেদ আপনি প্রকাশ পেয়েছে।

বলেছে, বোনটার মন খুব খারাপ। তিন-তিনজন স্পেশালিস্ট দেখানো হয়েছে, তারা এই-এই বলছে—ওই অসিত রাসকেলটাকে হাতের নাগালে পেলে দীপুদা নিজেই তার মাথাটা ছাতু করে দেয়, ইত্যাদি।

বাপী আদৌ আকাশ থেকে পড়েনি। প্রথম বারের সেই অঘটনের পর দীপুদার মুখ থেকে বড় ডাক্তারের মন্তব্য শুনে বাপীর মনে এই সংশয় ছিল। মিষ্টিকে ঘরে আনার তিন মাসের মধ্যেও কোনো লক্ষণ না দেখে ছেলেপুলে যে আর হবে না, ধরেই নিয়েছে। কিন্তু সে-জন্য তার এতটুকু মাথাব্যথা নেই বা অসিত চ্যাটার্জির মাথাও ছাতু করার ইচ্ছে নেই। সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে মিষ্টিকে চেয়েছিল। পেয়েছে. সেই অঘটন না ঘটলে বা তার পরেও একটা বা দুটো ছেলেপুলে থাকলে বাপীর চাওয়া আর পাওয়া দুই-ই বরবাদ হয়ে যেত।

বলে ফেলার পর দীপুদার অন্য সুর।—মা নিষেধ করেছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তোমার জেনে রাখাই ভালো। আমার মুখ থেকে শুনেছ মিষ্টিকে বোলো না যেন—দুদিন আগে হোক পরে হোক ও নিজে তো বলবেই তোমাকে।

বাপী বলেনি।

মিষ্টির থেকে থেকে বাপীর ওপরেই রাগ হয় এখন। এত বড় ব্যবসার কোনো কিছু চোখ এড়ায় না। বানারজুলি থেকে সময়ে আবু রব্বানীর চিঠি না এলে এখান থেকে টেলিগ্রাম যায়। সব কে-কেমন আছ জানাও। ঊর্মিলার চিঠি পেলে মিষ্টিকে তাগিদ দিয়ে জবাব লেখায়। জিতের আবার ছেলেপুলে হবে, তার বউ অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। কিন্তু জিতের থেকেও চিন্তাভাবনা বেশি তার মালিকের। থোক থোক টাকা দিচ্ছে, খবর নিচ্ছে। বাচ্চুর দিকেও কড়া দৃষ্টি, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। একমাত্র মিষ্টির সঙ্গেই যেন শুধু ভোগ-দখলের সম্পর্ক ষোল আনা ছেড়ে আঠের আনা।

খুব সুবিচার করছে না ঠাণ্ডা মাথায় মিষ্টি নিজেই বোঝে। এই সম্পর্কে ভোগদখলের থেকে সমর্পণ ঢের বেশি। আসলে রাগ হয় অন্য কারণে। নিজের দুশ্চিন্তা সম্পর্কে এই লোককে সেধে সজাগ করতেও সংকোচ। কিন্তু এত যার বুদ্ধি-বিবেচনা আর সবেতে এমন প্রখর দৃষ্টি, এতদিনে এ-ব্যাপারেও তো তার নিজে থেকেই সচেতন হওয়ার কথা। হলে মিষ্টির পক্ষেও সংকোচ ঝেড়ে সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ানো সহজ হত। ও এখনো একেবারে হাল ছেড়ে বসে নেই! এরকম কেস নিয়ে বিদেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে শুনছে। দরকার হলে তাদেরও বাইরে চলে যাওয়া তো জলভাত ব্যাপার। কিন্তু এ-ব্যাপারে ওই মানুষের এতটুকু হুঁশ নেই দেখেই মিষ্টির কখনো রাগ, কখনো অভিমান।

এই মানসিক অবস্থার মধ্যে হঠাৎ বড় রকমের ধাক্কা খেল একটা। দিন কয়েক আগে মিষ্টির কাছে ঊর্মিলার চিঠি এসেছে। তার শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না লিখেছে। খুব অস্পষ্ট একটু ইঙ্গিতও আছে চিঠিতে যা পড়ে শুধু মেয়েরাই সন্দিগ্ধ হতে পারে। মিষ্টি সেটা ধরিয়ে দিতে খুশি মুখে বাপী পারলে তক্ষুনি তাকে পাল্টা চিঠি লিখতে বসিয়ে দেয়। তাগিদ সত্ত্বেও তিন দিনের মধ্যে লেখা হয়ে ওঠেনি। বিকেলে বাইরের ঘরে বসে বাচ্চু কাকুর কাছে তাদের স্কুলের খেলার গল্প ফেঁদে বসেছে। মিষ্টিও শুনছিল। আর এক-ফাঁকে উঠে গিয়ে চট করে চিঠিটা লিখে ফেলবে কিনা ভাবছিল। ওদিকে মনে পড়লেই বকুনি খেতে হবে।

কলিং বেল বেজে উঠল।

দরজা দুটো ভেজানো ছিল। বাপী সাড়া দিল, কাম ইন!

দরজা ঠেলে ঘরে পা ফেলল সন্তু চৌধুরী। পরনে দামী ট্রাউজারের ওপর সিল্কের শার্ট, কব্জিতে সোনার ব্যান্ডের ঘড়ি, দু-হাতের আঙুলে জেল্লা ঠিকরনো আংটি। লম্বা ফর্সা বলিষ্ঠ অপরিচিত মানুষকে খবর না দিয়ে সরাসরি দোতলায় উঠে আসতে দেখে মিষ্টি বাপীর দিকে তাকালো। প্রসন্ন মনে হল না তাকে।

সন্তু চৌধুরীর পিছনে আরো কেউ আছে কিনা বাপী ঝুঁকে দেখে নিল। তারপর নীরস স্বরে বলল, সন্তুদা যে…

ঘুরে বাচ্চুকে বলল, ভিতরে যা।

ছেলেটার দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি বুঝে নিল কে হতে পারে। বাচ্চু উঠে চলে গেল। কি করবে ভেবে না পেয়ে মিষ্টিও উঠে দাঁড়াল।

বাচ্চুকে এখানে দেখেই সন্তু চৌধুরীর ফর্সামুখ রাগে লাল। ওকে ভিতরে চলে যেতে বলা হল তাও কানে গেছে। সপ্রতিভ গাম্ভীর্যে এগিয়ে এলো। মিষ্টির মুখের ওপর কপালে সিঁথিতে সিন্দুর আরো ঘরোয়া বেশবাস দেখে কে হতে পারে আঁচ করেছে। আর বাপীর মনে হল সেদিনের হা-ঘরে ছেলের এই বরাত দেখে ও লোকটার বুক চড়চড় করছে। চোখ তুলে আলতো করে একবার তাকাতে মিষ্টি বুঝে নিল, ভব্যতার দায় কিছু নেই, সে-ও ভিতরে যেতে পারে।

ঘরের দিকে পা বাড়াতে পিছন থেকে বেশ অবাক সুরের প্রশ্ন কানে এলো, সঙ্গে সঙ্গে সরস জবাবও।

—তোমার মিসেস নাকি?

—একেবারে নির্ভেজাল।

মিষ্টি আড়ালে চলে গেল বটে, কিন্তু দূরে নয়। যে এলো তার থেকে ঘরের লোকের হাবভাব দেখে ওর বেশি দুশ্চিন্তা

বাপী বলল, বোসো, হঠাৎ কি মনে করে?…

—হঠাৎ নয়, বিলেত থেকে ফিরে তোমার অনেক খোঁজ করেছিলাম। ফ্ল্যাট ছেড়ে বাড়ি করেছ কি করে জানব। ফোন গাইডেও তোমার নিজের নাম নেই। দিন কয়েক আগে খবরের কাগজে হঠাৎ হার্ব-ডিলার রাই অ্যান্ড তরফদারের বিজ্ঞাপনে টেলিফোন নম্বর দেখে তোমার বউদি অনেকটা আন্দাজেই ফোন করেছিল। তোমার অফিস থেকে খবর পেল তুমি এ-বাড়িরই দোতলায় থাকো। খুব ঠাণ্ডা গলায় বাপী জিজ্ঞাসা করল, আমাকে এত খোঁজাখুঁজির কারণ কি? চাপা ঝাঁঝে সন্তু চৌধুরী জবাব দিল, বাচ্চু তোমার ঘাড়ে পড়ে আছে সেই সন্দেহ আমাদের হয়েছিল। দু বছরের ওপর নিজের ছেলের একটা খবর পর্যন্ত না পেলে মায়ের মন কেমন হয় সেটা ওই রাসকেল বুঝতে না পারুক, তোমার বোঝার কথা।

…কার কথা বলছ, মণিদার?

সন্তু চৌধুরী জবাব দিল না। ঝাঁঝালো মুখ

বাপী আরো শান্ত।—যা বললে, দ্বিতীয়বার উচ্চারণ কোরো না, ওই ভদ্রলোক আমার দাদা।

সন্তু চৌধুরীর ছোট চোখজোড়া খাপ্পা হয়ে উঠল।

একই সুরে বাপী আবার বলল, বাচ্চুকে কেউ আমার ঘাড়ে চাপায়নি, আমিই ওকে নিয়েছি।

রূঢ় স্বরে সন্তু চৌধুরী বলল, এখন আমরা যদি ওকে নিয়ে যেতে চাই?

—আমরা বলতে তুমি আর কে?

সন্তু চৌধুরী থমকালো একপ্রস্থ। মুখ আরো লাল।—ওর মা যদি নিতে চায়?

—ওর মা বলে কেউ আছে আমি ভাবি না। আর কিছু দিন গেলে বাচ্চুও ভাববে না।

দু চোখ ধক ধক করছে সন্তু চৌধুরীর। সেদিনের সেই করুণাপ্রার্থীর মত স্পর্ধা ভাবতে পারে না। চেঁচিয়ে উঠল, ধরাকে সরা দেখছ এখন তাহলে, মস্ত একজন হয়ে গেছ, কেমন? নিতে চাইলে তুমি ঠেকাতে পারবে?

—চেষ্টা করে দেখ। গলা চড়িও না, ছেলেটা শুনতে পাবে।

—চড়ালে তুমি কি করবে?

—গলাধাক্কা খাবে।

সন্তু চৌধুরী ছিটকে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছাকাছি গিয়েও আবার ফিরল। দুচোখে গলগল করে তপ্ত বিষ ঝরছে।—অপমান মনে থাকবে, নিজের চরিত্র ভুলে এখন এতবড় সাধু হয়ে উঠেছ জানা ছিল না।

বাপী আস্তে আস্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখে একটি কথাও বলল না। আরো কিছু জানানোর জন্যে ধীরে সামনে এগলো।

মুহূর্তে বিপদ বুঝে সন্তু চৌধুরী এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ওদিক থেকে মিষ্টি ছুটে এসে বাপীকে টেনে ফেরালো। দু কাঁধ ধরে জোর করে তাকে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল, এ কি কাণ্ড—অ্যাঁ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি—বোসো বলছি। সত্যি তুমি ভদ্রলোককে মারতে যাচ্ছিলে?

—ও ভদ্রলোক নয়।

—খুব হয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে বোসো এখন

—বাচ্চু কি করছে?

—ওর ঘরে কাঠ হয়ে বসে আছে।

বাপী বলল, ঠিক আছে, তুমি ওর কাছে যাও।

সোফায় হাত রেখে মিষ্টি দাঁড়িয়ে রইল একটু। পুরুষের এত সংযত অথচ এমন ভয়-ধরানো মূর্তি আর দেখেছে? এদিক-ওদিক দেখে নিল। তারপর চট করে দু-হাতে বাপীর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়েই দ্রুত ভিতরে চলে গেল।

.

দুদিন বাদে বিকেলের দিকে মিষ্টি নিউ মার্কেট থেকে ফিরল। যখন বেরোয় বাপী বাড়ি ছিল না। মিষ্টি ফেরার আগে ফিরেছে। বাইরের ঘরে বসেছিল। বলাই তাকে বলেছে দিদিমণি গাড়ি নিয়ে মার্কেটে গেছে। কিন্তু ফিরল খালি হাতে বাপী খেয়াল করল না। ও কাছে আসতে খুশি মুখে বলল, জিতের এবারও ছেলেই হয়েছে—মেয়ের ইচ্ছে ছিল খুব।

কিছু না বলে মিষ্টি চুপচাপ ঘরে চলে যাচ্ছিল। বাপীর তখুনি আবার মনে পড়ল কি। ডাকল, শোনো! ঊর্মিলার চিঠির জবাব দেওয়া হয়েছিল তো?

মিষ্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। থমথমে মুখ। চোখে চোখ।—না।

—কেন? সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত।

—আমার সময় হয়নি, হবেও না। তুমি নিজে লেখো।

চলে গেল।

বাপী ভেবাচাকা খেয়ে গেল প্রথমে। কি হতে পারে ভেরে নিল। ওর নিজের মনে চাপা দুঃখ থাকতেই পারে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তা বলে এমন থমথমে মুখ দেখবে বা এমন কথা শুনবে ভাবা যায় না। বাপীর মনে মিষ্টির জায়গা ঈর্ষার অনেক ওপরে। অন্যের আনন্দে খুশি না হতে পারাটা ঈর্ষা ছাড়া আর কি? বাপীরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আশা করল, একটু ঠাণ্ডা হবার পর নিজেই লজ্জা পাবে। ঠাণ্ডা করার উদ্দেশ্যে উঠে সে-ও হাসিমুখেই ঘরে এলো।

মিষ্টি চুপচাপ খাটে বসে আছে। তেমনি থমথমে মুখ

—কি ব্যাপার?

জবাবে মিষ্টি অপলক চেয়ে রইল।

বাপীর খটকা লাগল একটু। মনে হল, দু চোখে তার ভেতর দেখছে।

এই মূর্তি কেন?

এবারে জবাব দিল। ফিরে জিজ্ঞাসা করল, বলব? তোমার আমার মধ্যে লুকোচুরির কিছু থাকতে পারে না, তবু বললে ঠাণ্ডা মাথায় বরদাস্ত করতে পারবে?

যে গোপনীয় ব্যাপারটা এত দিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল সেটাই কবুল করবে ধরে নিয়ে হাসি চেপে বাপীরও নিজের মুখখানা সীরিয়াস করে তোলার চেষ্টা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে বসার কুশনটা টেনে নিয়ে ওর দুই হাঁটুতে প্রায় হাঁটু ঠেকিয়ে মুখোমুখি বসল।—পারব। মিষ্টির সবই আমার কাছে মিষ্টি। বলে ফেলো।

উঠে সামনের দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে মিষ্টি আবার জায়গায় ফিরে এলো।——তোমার গৌরী বউদির সেই ভদ্রলোক একটু আগে আমার ওপর দিয়ে তার সেদিনের অপমানের শোধ নিল। সেই মহিলাও পাশে ছিল।

বাপীর সত্তাসুদ্ধ আচমকা ঝাঁকুনি খেল একপ্রস্থ। তপ্ত রক্তকণার ছোটাছুটি। জায়গায় ফিরে স্থির হতে সময় লাগল।—কি অপমান করেছে?

মিষ্টির দু চোখ তার চোখে বিঁধে আছে।—মার্কেটে মুখোমুখি দেখা হয়ে যেতে খুব খুশির বিনয়ে তোমার বউদির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সম্মান দেখিয়ে আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলল। তুমি কত বড় একজন হয়েছ দুবার করে শোনালো। তারপর আমাকে কংগ্র্যাচুলেট করে বলল, এমন মস্ত মানুষের ঘরে আমাকে আশা করেনি, অন্য একজনকে দেখবে ভেবেছিল।

—কেন? বাপীর দুই চোয়াল শক্ত।

—গাড়িতে আর একজনের অবাঙালী সুন্দরী বউকে পাশে বসিয়ে তোমাকে আনন্দে হাওয়া খেয়ে বেড়াতে দেখেছে। শুধু সে নয়, তোমার বউদিও দেখেছে। গাড়িতে সেই মেয়েকে বসিয়ে রেখে তুমি নাকি নেমে এসে তাদের সঙ্গে কথাও বলেছ। তুমি তাদের বলেছ, নিজের বউ নয়, অন্যের বউ। তাই আমার বদলে তাকে এখানে দেখবে আশা করেছিল।

বাপীর তখুনি মনে পড়ল। অল্প অল্প মাথা নেড়ে বলল, একদিন দেখেছে — ঠিকই দেখেছে।—তাহলে একথা শুনেই তোমার সব বিশ্বাস ধ্বসে গেছে?

মিষ্টি চেয়ে আছে। নিরুত্তর।

—সেই আর একজনের সুন্দরী বউকে তুমিও দেখেছ। তার নাম ঊর্মিলা। গাড়িতে পাশে সে ছিল। সেই একই দিনের কথা—তোমার অফিস থেকে তাকে নিয়ে ফেরার পথে পার্ক স্ট্রীটের রাস্তায় তাদের সঙ্গে দেখা।

মিষ্টি অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা সুরে বলল, সেদিনের কথা জানতাম না, তবে আমারও উর্মিলা বলেই মনে হয়েছিল।

—তাহলে? সে আর কি অপমান করেছে তোমাকে?

মিষ্টি চেয়ে রইল একটু।—শুনলে তোমার মাথা খুব ঠাণ্ডা থাকবে মনে হয় না।

—আমার মাথা সম্পর্কে তোমারও খুব ধারণা নেই। বলো।

—প্রথমবার কলকাতায় এসে তুমি কয়েকমাস বাচ্চুর বাবা-মায়ের আশ্রয়ে ছিলে নিজেই বলেছিলে। আজ শুনলাম বয়সে অত বড় বউদির দিকে তোমার চোখ গেছল বলেই সেখান থেকে তোমাকে তাড়ানো হয়েছিল। সত্যি কিনা তোমার বউদিকেই জিজ্ঞাসা করতে বলল। আমি জিজ্ঞেস করিনি। তোমার বউদি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

এ-ই শুনবে বাপী জানত। কুশন ঠেলে ঘরের মধ্যে একবার পায়চারি করে আবার মিষ্টির সামনে এসে দাঁড়াল।—আমার ভিতরের জানোয়ারকে তুমি ছেলেবেলায় দেখেছ। পরেও তার চোখ অনেকবার অনেক দিকে গেছে। কিন্তু বাপী তরফদার তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চায়নি বলে চাবুক খেয়ে ওটাকে চোখ ফেরাতে হয়েছে। বাচ্চুর মা কোথায় কোন্ বাড়িতে থাকে জানে কিনা ওকে জিগ্যেস করে এসো!

আগের কথায় ধাক্কা খেয়েছিল। এবারে মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি প্রমাদ গুনল।—জেনে কি হবে, তুমি সেখানে যাবে?

—না গেলে সন্তু চৌধুরী যা বলেছে তার কতটা সত্যি তুমি জানবে কি করে?

উঠে দু-হাত ধরে মিষ্টি তাকে বিছানায় বসাতে চেষ্টা করল। আর কিচ্ছু জেনে কাজ নেই—অপমানে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছল।

তখনকার মতো বাপী ঠাণ্ডা হল বটে, কিন্তু তার পর থেকে সমস্তক্ষণ গুম হয়ে থাকল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ-ঘর ও-ঘর করল। মিষ্টিকে সামনে দেখলে দাঁড়াচ্ছে। দেখছে। আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। একটু বাদে একটা বই খুলে বসল। কি বই মিষ্টি জানে। আরো দুই-একদিন এ-বইটার পাতা ওল্টাতে দেখা গেছে। নেপোলিয়ন হিল-এর থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ। রিচ অর্থাৎ বড়লোক হওয়ার রাস্তা দেখানো হয়েছে ভেবে কৌতূহলী হয়ে মিষ্টিও বইটা উল্টেপাল্টে দেখেছিল। আগাগোড়া মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার দেখে পড়ার উৎসাহ হয়নি।

রাতে চুপচাপ।

মিষ্টির এতক্ষণের চাপা অস্বস্তি এবারে বুকে চেপে বসল।—যেমন মা-ই হোক, ছেলের জন্য কাতর হওয়া স্বাভাবিক। বাচ্চুর মা-ও অনেক কষ্টে ছেলের হদিস পেয়েছে। সেই সঙ্গে ওই ছেলের এখন একমাত্র আশ্রয় কে বা কারা তাও জেনেছে। তবু ছেলের মুখ চেয়েও মহিলা ওই লোকটার অমন কুৎসিত কথাগুলোর প্রতিবাদ করল না কেন? সত্যের ছিটেফোঁটাও না থাকলে ওভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারল কি করে?

এর জবাব পরদিন পেল। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে বাচ্চু তার ঘরে গেছে, মিষ্টি ডাইনিং টেবিলে বসে। বাপী নিচের অফিস ঘরে। উঠে এলে একসঙ্গে চা খাবে।

সময় ধরেই উঠে এলো। একলা নয়, তার পিছনে আরো একজন। —মিষ্টি, গৌরী বউদি, তোমার কাছে এসেছেন।

মিষ্টি নির্বাক কয়েক মুহূর্ত। সহজাত সৌজন্যে উঠে দাঁড়ানোর কথা। পারা গেল না। অস্ফুট স্বরে বলল, বসুন।

বসল। বেশ সহজ সুরে বলল, বেশি বসার সময় নেই ভাই। বাপীর দিকে ফিরল। চোখে একটু হাসির আভাস।—বউয়ের নাম মিষ্টি তুমি রেখেছ না ও-ই \নাম?

৬৪৩

বাপীও হাল্কা জবাব দিল, আমার কোনো কেরামতি নেই।

গৌরী বউদি মুখে আর নামের সঙ্গে চেহারার মিলের প্রশংসা করল না। তাড়ার মধ্যে কিছু দরকারী কাজ সেরে যাওয়ার মতো করে বলল, তোমার কাছেই একবার এলাম ভাই…

মহিলার রীতি জানা নেই মিষ্টির। গ্লানি বা পরিতাপ-কাতর মুখ দেখছে না।—কাল যা শুনে এসেছি তা সত্যি নয় জানাতে? গলার স্বর সংযত হলেও সদয় নয় খুব।

গৌরী বউদি তক্ষুনি জবাব দিল, হ্যাঁ। সব মিথ্যে।

—কিন্তু কাল তো একটি কথাও বললেন না?

গৌরী বউদি চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। জবাব দিল, কেন বললাম না, না বুঝে থাকলে বাপীকে জিগ্যেস কোরো।

প্রায় আধ মিনিট কারো মুখে আর কথা নেই। গৌরী বউদি চেয়ার ছেড়ে উঠল। বাপীকে বলল, তোমার বউভাগ্য ভালো, এর থেকে ঢের বেশি রাগ দেখব ভেবেছিলাম। চলি—

বাপী পলকে ভেবে নিল কি। গলা চড়িয়ে ডাকল, বাচ্চু!

বাচ্চু এলো। তারপরেই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কে এসেছে জানত না গৌরী বউদি ওর আপাদমস্তক দেখে নিল একবার। সহজ সুরেই জিজ্ঞাসা করল, কি রে কেমন আছিস?

গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না ছেলেটার। সামান্য মাথা নাড়ল। ভালো আছে। গৌরী বউদি চুপচাপ দেখল আর একটু। বলল, সব সময় কাকা কাকিমার কথা শুনে চলবি।…

দরজার দিকে পা বাড়ালো। বাপী এগিয়ে এলো।

নীচে গৌরী বউদির ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। তাকে তুলে দিয়ে বাপী দু—মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। বাচ্চু ঘরে চলে গেছে। বলাই তক্ষুনি চায়ের পট আর পেয়ালা সাজানো ট্রে রেখে গেল।

বাপী চেয়ার টেনে মিষ্টির মুখোমুখি বসল। চা ঢেলে মিষ্টি একটা পেয়ালা তার দিকে এগিয়ে দিল।

বাপী বলল, গৌরী বউদিকে এক পেয়ালা চা খেয়ে যেতে বললে পারতে। নিজের পেয়ালা মুখের দিকে তুলতে গিয়ে মিষ্টি থমকে তাকালো। চেয়েই রইল একটু। বলল, কি জানি, আমি জানতাম বাচ্চুকে তুমি ওই মায়ের ছায়াও মাড়াতে দিতে চাও না, তাছাড়া সেদিন আর একটা লোককে তুমি গলাধাক্কা দিতে গেছলে দেখে আজ আরো এই ভুলটা হয়ে গেল।

প্রচ্ছন্ন শ্লেষটুকু বাপী চুপচাপ হজম করে গেল। ভিতরে একটু অসহিষ্ণুতার তাপ ছড়িয়ে আছে। কেন, নিজেও জানে না। মনের অনুভূতিগুলো সর্বদা যুক্তির পথে চলে না। তাই কেউ বুঝতেও পারে না। যেমন এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে সমস্ত অতীত মুছে দিয়ে এই গৌরী বউদিকে যদি মণিদার কাছে আর তাদের ছেলের কাছে ফিরিয়ে এনে দিতে পারত—দিত। তা হবার নয় বলেই ক্ষোভ হয়ত। কিন্তু মিষ্টি এই ক্ষোভের কি অর্থ খুঁজে পাবে?

একটু বাদে মিষ্টিই আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, অপবাদ দিয়ে তোমাকে তোমার দাদার বাড়ি থেকে তাড়ানোর কথাটাও মিথ্যে তাহলে?

পেয়ালা সামনে রেখে বাপী সোজা হয়ে বসল। সোজা তাকালো। দুজনের মধ্যে কোনো গোপনতা থাকবে না বলেছিল। এই গোপনতার সবটুকু ছিঁড়েখুঁড়ে দিলে কি হয় দেখার তাড়না। জবাব দিল, খুব সত্যি।

মিষ্টি থতমত খেল। অপবাদ সত্যি হলেও এই মুখ দেখবে ভাবেনি। আরো শোনার প্রতীক্ষায় চেয়ে রইল।

চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলল, কাল আমার ভেতরের যে জানোয়ারটার কথা তোমাকে বলেছিলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও গৌরী বউদি সেটাকে ঠিক দেখেছিল। দেখে প্রশ্রয় দিতে চেয়েছিল। তার আগে জানোয়ারের টুটি টিপে ধরে বাপী তরফদার ছিটকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই ও-বাড়িতে আর ঠাঁই হয়নি।

নিখাদ সত্যের আলোয় এসে দাঁড়ানোর ফল দেখল বাপী। মিষ্টির চোখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর সমস্ত মুখ লাল। পাহাড়ের বাংলোয় রেশমার কথা শুনে বুক ভরে গেছল, আজকের অনুভূতিটা তার বিপরীত ধাক্কার মতো। চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেল।

কিন্তু বাপীর হাল্কা লাগছে। এই সত্যের স্বাদটুকু বিচিত্র লাগছে

সোনার হরিণ নেই – ৩৯

এই সকালের একটা সামান্য ব্যাপার মনে পড়ল বাপীর। গাড়ি চালাচ্ছিল। তখন ঝমঝম বৃষ্টি। জোর বাতাস। সামনের কাঁচের ওধারে ওয়াইপারটা উঠছে নামছে। তা সত্ত্বেও কাঁচটা থেকে থেকে ঝাপসা ধূসর হয়ে যাচ্ছিল। ফলে সামনের সবও ঝাপসা। বাপী এক-একবার হাত দিয়ে হিমাভ কাঁচের খানিকটা ঘষে দিচ্ছিল। তক্ষুনি শুধু ওইটুকু জায়গার ভিতর দিয়ে সামনের যা-কিছু সব তকতকে পরিষ্কার

সেই গোছেরই কিছু হয়ে গেল। ভিতরের কোনো খুব আবছা আর্দ্র জায়গায় হঠাৎ ঘষা পড়েছে। তার ওধারে ঝকঝকে তকতকে কারো অস্তিত্বের ঝিলিক। দু’চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো ছটা তার। কয়েক পলকের জন্য বাপীর মনে হল শক্ত হাতে জীবনের সব ঝড়-জল-জঞ্জাল ঘষে-মুছে দিতে পারলে তবেই সেখানে পৌঁছনো সম্ভব।

মিষ্টি বেশ একটা ধাক্কা খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। এ-জন্যে বাপীর একটুকু উদ্বেগ নেই। মিষ্টির ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হবার কথা। তাকে রেশমার কথা বলা হয়েছে। ঊর্মিলার কথা বলা হয়েছে। গৌরী বউদির কথাও বলল। সব বলার পিছনেই গোপনতার সুড়ঙ্গ-পথ থেকে আলোয় আসার তাগিদ বাপীর। মিষ্টির সামনে কোনো মিথ্যের মুখোশ পরে থাকাটা যন্ত্রণার মতো।

ঠাণ্ডা মাথায় মিষ্টি সত্যি ভেবেছে। ভেবে হাল্কা হতে পেরেছে।…ওই লোকের প্রবৃত্তি ছকে বাঁধা হিসেবের শাসন জানে না, আবার নিজেই নিজেকে টেনে তোলে। এই জোর না থাকলে অমন বিচ্ছিরি সত্যি কথাও মুখের ওপর বলে দিত না। ও কিছু জানতেও পারত না।…আর সত্যি কথাই বা কতটা সত্যি? তার থেকে মনের তলায় জমা পরিতাপটুকুই হয়তো বেশি সত্যি। কারণ, এত দিনের মধ্যে মিষ্টি কি কোনো জানোয়ারের অস্তিত্ব টের পেয়েছে? পুরুষের দুরন্ত ভোগ হয়তো দেখেছে। ভেসে যাওয়া দেখেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়াও দেখেছে। অনুভব করেছে। জানোয়ার স্বার্থপর। একলা ভোগী। জানোয়ার তার দোসরের মন নিয়ে মাথা ঘামায় না।

মিষ্টির মেজাজ উল্টে এত ভালো হয়ে গেছে যে রাতের প্রগলভ শয্যায় এই ভাবনার আভাসটুকুই দিয়েই ফেলেছে। খুশিতে বুক বোঝাই বাপীর। কিন্তু আকাশ থেকে পড়া মুখ।—সে কি! আমার মধ্যে তুমি জানোয়ার দেখোনি?

মিষ্টি অনায়াসে মাথা নেড়েছে। দেখে নি।

—তোমার দশ বছর বয়সে বানারজুলির সেই জঙ্গলেও না? যার জন্য আজও আমার পিঠে এই দাগ

তার পিঠের তলায় একটা হাত গুঁজে দিয়ে সেই দাগে আঙুল ঘষতে ঘষতে মিষ্টি জবাব দিয়েছে, জঙ্গলের জীব-জন্তুদের ভালবাসা-বাসি দেখে দেখে তখন তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছল।

কিন্তু দিনের আলোয় মিষ্টির কাছে আসার রীতি এখন একটু অন্যরকম। এই থেকে কি ধরনের দুশ্চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বাপী আঁচ করতে পারে। সময় সময় কৌতুকও বোধ করে। দামাল ছেলের ঝড়ের মুখে বুক পেতে দেবার স্বভাব হলে তাকে আগলে রাখতেই হয়। বেপরোয়ার মতো জ্বলন্ত আগুনে হাত বাড়ানোর স্বভাব হলে সে-হাত টেনে ধরতেই হয়। মিষ্টির এখন এই গোছের দায়। নিজের সহজ অথচ অনমনীয় ব্যক্তিত্বের ওপর আস্থা খুব। সেটা বড় করে তুলে এমন দুরূহ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা।

হিসেবের বাইরে অজস্র টাকা আসাটা ও কখনো ঝড় ভাবে, কখনো জ্বলন্ত আগুন ভাবে।

পরের পাঁচ-ছমাসের মধ্যে বাপী কাজ উপলক্ষে আরো দু’বার বানারজুলি গেছে। সঙ্গে মিষ্টিও গেছে। আবু রব্বানীও বারকতক কলকাতায় এসেছে। মিষ্টির চোখ-কান খোলা। বুদ্ধিও রাখে। টের না পাবার কারণ নেই। আরো কিছু গোপন ব্যবসার খবর তার জানা হয়ে গেছে। বানারজুলিতে মদের কারবার আর কলকাতায় মদ চোরাই-চালানের খবর। আর কলকাতায়ও বনজ নেশার জিনিসের বাড়তি চালান আসছে এখন, তাও বুঝেছে। বুঝবে না কেন। গোপন টাকা আমদানির পরিমাণ তার কাছে তো আর গোপন নেই। আবু রব্বানীকে মিষ্টি জেরার মুখে ফেলেছিল। সে মাথা চুলকে পালিয়ে বেঁচেছে। দোকেও সতর্ক করেছে।

সেবারে বানারজুলি থেকে ফিরেই মিষ্টির সাফ কথা!—এসব চলবে না। বাপী অজ্ঞতার ভান করছে।—কি চলবে না?

—মদের চোরাই কারবার আর চোরাই চালান। আর ওষুধের নামে নেশা যোগানো—

গুরুদায়িত্ব পালনের মুখখানা দেখে বাপীর মজা লাগছিল। মুখে নিরীহ বিস্ময়।—মদের কারবারে আমাকে পেলে কোথায়—ওসব তো আবু আর জিতের ব্যাপার।

—কার ব্যাপার আমি খুব ভালো করে জানি। বন্ধ করতে না পারো তোমার ক্যাপিট্যাল তুমি তুলে নাও।

—ও-বাব্বা! এও জেনে ফেলেছ?

—আমি ঠাট্টা করছি না। আমার খুব খারাপ লাগছে। আর ওষুধের নামে সব জায়গায় যা চলছে তাও বন্ধ করতে হবে।

আরো একটু উসকে দেবার লোভে বাপী বলল, তুমি চাইলেও লোকে নেশা বন্ধ করবে না। আমি বন্ধ করলে তক্ষুনি আর কেউ এসে শুরু করবে।

—যে করে করবে, তুমি করবে না। তুমি নিজেই বলেছিলে, যা করেছ সব আমার জন্যে করেছ—আমি বলছি আর দরকার নেই।

বাপী হাসছে মিটিমিটি।সেই কশাইয়ের গল্প শুনেছ—যে সকাল-বিকেল মাংস কাটত অথচ তার কাছেই যোগীরা যোগের পাঠ নিতে যেত?

—শুনেছি। মাংস কাটা কশাইয়ের কাজ ছিল। তাতে চুরি ছিল না। আমি চুরি চাই না। সাদা ব্যবসা করো।

ভিতরে ভিতরে বাপীর এই প্রথম নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। এতক্ষণের মজায় বিপরীত টান ধরল। চেয়ে রইল খানিক।—আমার মধ্যে তুমি তাহলে মস্ত একটা চোর দেখছ…চোর ভালো করার জন্য ক্ষেপে উঠেছ?

মিষ্টি থমকালো।—সোজা কথাকে অমন বেঁকিয়ে দেখো না।

—আমি সব সোজা দেখি। ডান হাতের বুড়ো আঙুল বার দুই নিজের বুকে ঠেকিয়ে বলল, ভেতরে দেখার চোখ থাকলে তুমি এখানে সব সোজা দেখতে, সব সাদা দেখতে।

ক্ষুব্ধস্বরে মিষ্টি জানান দিল, ওখানকার কথা বলছি না, আমি তোমার ব্যবসার কথা বলছি!

ব্যবসাও আমিই! এবারে তুমি বলো, যে করেই হোক, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার বদলে তোমাদের সাদা রাস্তার কোনো চালাঘরের বাপীকে দেখলে তোমার বাবা মা দাদা ফিরে চাইত, না তুমি আমাকে বুঝতে আসতে?

মিষ্টিও তেতে উঠছে।—তোমার ক্ষমতা কে অস্বীকার করছে, কিন্তু আর কেন?

—আর নয় কেন? কালো রাস্তায় যা এসে গেছে তাই ঢের ভাবছ? না থামলে সব খোয়াবার ভয়?

ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকির ফলে এই লোককে একেবারে জল করে দেবার সুযোগ ফসকালো মিষ্টি। এ-কথার জবাবে তার অশান্তিটা সত্যিকারের কেন সেটা খোলাখুলি বলতে পারত। বলতে পারত, আমার সাদা কালো নিয়ে ভয় নয়, ঐশ্বর্য কমা-বাড়া নিয়েও ভয় নয়—আমার ভয় শুধু তোমার জন্য, তোমার কখন বিপদ হয় সেই জন্য। তুমি যদি বিপদ আপদ এত তুচ্ছ না করতে, তাহলে আমারও তোমাকে নিয়ে অত ভয় থাকত না।

কিন্তু তার বদলে অপমানে মুখ লাল হয়েছে।—তুমি তাহলে আমাকে এত ছোট এত নীচ ভাবো?

—আমি মোটেই তা ভাবি না। আমি শুধু বলতে চাই আমার সম্পর্কে তোমার ভাবনা বা ধারণায় কিছু ভুল হচ্ছে। আমি অসিত চ্যাটার্জি না, আমাকে তুমি তার মতো করে চালাতে চেষ্টা করলে আরো ভুল হবে, আরো অসুবিধে হবে।

বাপী ঘর ছেড়ে চলে এলো। একটা বই টেনে নিয়ে বসল। এখন বই বলতে নিজের নিভৃতে চোখ যায় এমন কিছু বই। এ-ধরনের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে কেন নিজেই জানে না। পড়তে পাঁচ মিনিটও ভালো লাগল না। ঘাড়ের পিছনটা ব্যথা-ব্যথা করছে, শক্ত লাগছে। মনে হয় বাষ্পর মতো কিছু জমাট বাঁধছে ওখানে। ইদানীং মাঝে মাঝে এ-রকম হচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজের ওপরেই সব থেকে বেশি অসহিষ্ণু। মিষ্টিকে এমন সব কথা বলে এলো কেন? বিয়ের এই আড়াই বছর পরেও মিষ্টি তো তেমনি মিষ্টি। ও যা বলেছে বা ভেবেছে শতেকে একশ জনই তো তাই বলবে, তাই ভাববে। জঙ্গলের রাজ্যে নীতির হিসেব কম। এগারো বছর ধরে বাপী না হয় তাইতেই অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু অন্য কেউ অভ্যস্ত না হলে তার এরকম আঁতে ঘা পড়ে কেন? আরো খারাপ লাগছে, ধৈর্য খুইয়ে অসিত চ্যাটার্জিকে এর মধ্যে টেনে আনল বলে। জীবনের সব থেকে বড় যে ভুলটা মিষ্টি মেনেই নিয়েছে, ইতরের মতো সেখানেই ঘা বসিয়ে এলো। একটু আগে নিজের মুখে যে সাদা মনের বড়াই করে এলো বাপী, সত্যি ওটা কতটুকু সাদা?

ছটফটানি বাড়তে থাকল। উঠে বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরনো কথা মনে পড়ল। এয়ারপোর্টের চাকরির সময় মিষ্টি বারকয়েক করে ঘাড়ে মাথায় মুখে জল চাপড়াতো। প্রথম দিনে হোটেলে বসে ওমনি জল চাপড়ে এসে নিজেই বলেছিল কথাটা। কিন্তু এখন আর জল দেবার দরকার হয় না। তার মানে তখন অশান্তি ছিল, এখন নেই। কিন্তু বাপীর কি অশান্তি? এখন সেই জল ওর নিজের মাথায় চাপড়াতে হয় কেন?

চোখ মুখ মুছে আবার মিষ্টির কাছে এলো। মিষ্টি চুপচাপ বিছানায় বসে। বাপী সামনে এসে দাঁড়াল।

মিষ্টি চোখ তুলে তাকালো। জবাব দিল না।

মাথার পিছনটা বেজায় ভারী লাগছে। শক্ত ঘাড়টা বাপী বার দুই জোরে এ—কাঁধ থেকে ও-কাঁধ পর্যন্ত ফিরিয়ে সোজা করল।—আমার আজকাল কি একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, হঠাৎ-হঠাৎ রাগ হয়ে যায়, খানিক আগেও দেখেছ খুশি মনে ছিলাম…

মিষ্টি আলতো মন্তব্য করল, রাজা-বাদশারা শুনেছি ঢালাও ফুর্তির সময়েও পান থেকে চুন খসলে হঠাৎ রেগে গিয়ে গর্দান নিয়ে ফেলত।

উপমাটা বেশ লাগল বাপীর! হেসে জবাব দিল, যা-ই বলো এখন আর রাগাতে পারবে না। রাজা-বাদশা ছেড়ে মাঝে মাঝে নিজেকে ভিখিরির মতো মনে হয়, আরো কত পাওয়ার ছিল—পাচ্ছি না। না, না, টাকা পয়সার কথা বলছি না, আমি কি রকম যেন থেমে যাচ্ছি।

কথাগুলো মিষ্টির দুর্বোধ্য লাগছে। বাপী বোঝাবে কি, যা বলল নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।

আবার ঘাড় মাথা বার দুই সামনে পিছনে করল।

মিষ্টি চেয়েই ছিল। হঠাৎ কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল।—ওরকম করছ কেন? —কি রকম যন্ত্রণা হচ্ছে…ঘাড়টাও সেই থেকে শক্ত হয়ে আছে। আজকাল মাঝে মাঝে এরকম হয়, তখন পাখার নিচে বসেও গরম লাগে। যাকগে, আমাকে তো চেনই, রাগ কোরো না।

মিষ্টি উঠে কাছে এসে দাঁড়ালো।—চোখ অত লাল কেন?

বাপী আয়নার দিকে ফিরে টান করে নিজের দু’চোখ দেখে নিল। বলল, জলের ঝাপটা দিয়ে এলাম বলে বোধ হয়—

শুধু চোখ নয়, শ্যামবর্ণ মুখও কেমন লালচে মনে হল মিষ্টির। হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, আমি একটুও রাগ করিনি, বোসো, আমি আসছি—

ঘর ছেড়ে চলে গেল। বাপীর এখন হালকা লাগছে একটু। গা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট চার-পাঁচের মধ্যে মিষ্টি ফিরল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, ফাঁক পেলে আজকাল তুমি ও-সব কি বই পড়ো বলো তো? আমি তো কিছু বুঝিই না— বাপী হাসতে লাগল। জবাব দিল, বুঝতে চেষ্টা কোরো না, আমার মতো গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে যাবে। আমিও সব বুঝি না, অথচ নিজেকে যাচাই করার নেশায় পেয়ে বসে।

—কি যাচাই করার?

—নিজের ভিতরে কত সব অজানা অচেনা ভালো মন্দ হিংসে লোভ স্বার্থপরতার ব্যাপার নাকি আছে…যত বাজে ব্যাপার সব।

মিনিট পনেরোর মধ্যে জিত্ সোজা ভিতরে চলে এলো। সঙ্গে একজন বয়স্ক ডাক্তার। জিতের হাতে তার মোটা ব্যাগ। বাপী অবাক। তক্ষুনি বুঝল, ফোনে জিকে মিষ্টি ডাক্তার নিয়ে আসতে হুকুম করেছে। ঘাড় মাথা ব্যথা আর চোখ লাল হবার কথাও নিশ্চয় বলেছে। কারণ কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করে ডাক্তার চোখের কোল টেনে ধরে দেখল, পালস্ দেখল। তারপর ব্যাগ খুলে ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র বার করল।

দেখা হতে যন্ত্র গোটাতে গোটাতে ডাক্তার জানতে চাইল বরাবরই তার হাই প্রেশার কিনা। বাপী জানালো প্রেশার এই প্রথম দেখা হচ্ছে।

মিষ্টি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, প্রেসার কত? রোগীর সামনে বলা ঠিক হবে না ভেবে ডাক্তার ইতস্তত করল একটু। মিষ্টির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, ওঁর বয়েস কত?

—বত্রিশ…–। মিষ্টিই জবাব দিল।

—তেত্রিশ। হালকা গলায় বাপী শুধরে দিল।—ছাব্বিশ সালের জানুয়ারিতে জন্ম, এটা আটান্নর আগস্ট।

আনুষঙ্গিক আরো কিছু পরীক্ষার পর ডাক্তার বাপীর পেশার খোঁজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতে জিত্ তাকে বাইরের ঘরে এনে বসালো। মিষ্টিও এলো। ডাক্তারের কথা শুনে উতলা।

প্রেসার বেশ বেশি। ওপরেরটা একশ নব্বুই, নিচেরটা একশ। ব্যবসার টেনশনের দরুন এরকম হতে পারে। কিছুদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। আজকের মধ্যেই ইসিজি করানোর নির্দেশসহ ডাক্তার প্রেসকৃপশন আর ডায়েট চার্ট লিখে দিয়ে গেল। জিত্ তক্ষুনি ব্যবস্থা করতে ছুটল।

ঘরে ফিরেই মিষ্টি ফতোয়া দিল, এখন টানা রেস্ট, আর কোনো কথা নেই। ব্যবসার কাজকর্ম সব এখন বন্ধ—নো টেনশন।

বাপী হেসে জবাব দিল, ব্যবসার আমি কি পরোয়া করি যে টেনশনের মধ্যে থাকব?

মিষ্টি চেয়ে রইল খানিক। পলকা ঠেসের সুরে মন্তব্য করল, ব্যবসা ছাড়াও সেই ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত তুমি টেনশনের মধ্যেই কাটিয়ে এসেছ।

বাপী হাসি মুখে সায় দিল, তা খানিকটা সত্যি বটে।

ইসিজি-র রিপোর্ট মোটামুটি ভালো। কিন্তু মোটামুটি শুনে মিষ্টি একটুও খুশি নয়। হাই ব্লাডপ্রেশার থেকে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে বাপীর বাবার মারা যাবার ঘটনা অনেক আগেই শোনা ছিল। ফলে বেশ কিছুদিন মিষ্টির কড়া নজর আর কড়া শাসনের মধ্যে থাকতে হল বাপীকে।

ভালো লেগেছে। জীবনের আবার একটা নূতন স্বাদ পেয়েছে।

ঊর্মিলা মা হয়েছে। মেয়ের মা।

টেলিগ্রামে খবর এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টিও বিজয় মেহেরা আর ঊর্মিলার নামে গ্রিটিং টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে হলেও বাপী হাঁকডাক করে মিষ্টিকে খবরটা দিত। আর যদি বলত, চলো, এবারে আমরা গিয়ে ওদের একবার দেখে আসি—তাহলেও মিষ্টি অস্বাভাবিক কিছু ভাবত না। একবার ঘুরে যাবার জন্য ওরা কম ডাকাডাকি করছে না। কিন্তু বাপী কিছুই না বলে মিষ্টিকে ডেকে সুখবরের টেলিগ্রামটা তার হাতে তুলে দিল।

বাপী ইজিচেয়ারে বসে তখন খবরের কাগজ পড়ছিল। হাতের কাছে সে—রকম পড়ার কিছু না থাকলে সকালের দু-তিনটে খবরের কাগজ নিয়ে দেড় দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি বা হোমরাচোমরাদের নিয়ে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। মানুষের খবর খুঁটিয়ে পড়ে। এমনি দুটো খবর মনে দাগ কেটে গেল। একটা বিদেশের ঘটনা। দুই শ্রমিক বন্ধু দশ আনা ছ’আনা ভাগে একখানা লটারির টিকিট কিনেছিল। সেই টিকিট প্রথম হয়েছে। আমাদের টাকার হিসেবে তিন লক্ষের ওপর প্রাপ্য তাদের। কিন্তু এক কপর্দকও ভোগে এলো না কারো। কারণ ছ’আনার গোঁ অর্ধেকের থেকে সে এক পয়সাও ছাড়বে না—টিকিটের গায়ে তো আর বখরার ভাগ লেখা নেই! ফলে ক্রোধে উন্মাদ দশআনার হাতে ছ’আনা খুন। দ্বিতীয় ঘটনা এই কলকাতার। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী তার দুই মেয়ে আর ছোট্ট ছেলে সাজগোজ করে বাড়ির কর্তার সঙ্গে রাতের আনন্দ উৎসবের আমন্ত্রণে যোগ দেবার জন্য তৈরি। কর্তা গেল লন্ড্রিতে তার ধোপদুরস্ত জামা-কাপড় আনতে। আর ফেরেনি। বাস চাপা পড়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ।

খবরের কাগজ কোলের ওপরে ফেলে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বাপী ভাবছিল, জীবনের তাহলে ব্যাপারখানা কি!

আধ ঘণ্টা বাদে মিষ্টি কাছে এসে বসল। বলল, একটা গ্রিটিং পাঠিয়ে দিয়ে এলাম।

মুখ না তুলে বাপী জবাব দিল, বেশ করেছ।

মিষ্টি চেয়ে রইল একটু। ব্লাডপ্রেশারের রকম-ফের হল কিনা বোঝার চেষ্টা। কিছুটা বুঝতে পারে। রক্তের চাপ সেই থেকে এখনো একটু বাড়তির দিকে, তবে স্থির, বেশি ওষুধ-টষুধ খাইয়ে ডাক্তার সেটা হুট করে টেনে নামাতে চায় না।

প্রেশার বেড়েছে মনে হল না। ফলে কৌতূহল বাড়লো। সাত মাস আগে ঊর্মিলার চিঠিতে শুধু সম্ভাবনার আভাস পেয়েই যে লোক খুশিতে আটখানা, তিন-চার দিনের মধ্যে সেই চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি বলে মিষ্টিকে বকুনি পর্যন্ত খেতে হয়েছে—আজ এমন সুখবরের পরে তার এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে মিষ্টি প্রথমে অবাক, পরে সন্দিগ্ধ। তার কথা ভেবেই উচ্ছ্বাস চেপে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা। তাও বোঝা গেল না।

—তোমার শরীর-টরীর খারাপ না তো?

বাপী সোজা হয়ে বসল।—না তো… কেন?

—এত বড় একটা খুশির খবর পেয়েও এমন চুপচাপ যে?

বাপী হাসল।—এত বড় মানে কত বড়?

—খুব বড় নয়?

—তা অবশ্য…। তবে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে যখন, ছেলেপুলে আসবে এ তো জানা কথাই।

নিজের অগোচরে মিষ্টির দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। খানিক চুপ করে থেকে সংযত মোলায়েম সুরে জিগ্যেস করল, আমাদের কত দিন বিয়ে হয়েছে?

এবারে বাপী আত্মস্থ একটু। মনে মনে হিসেব করে জবাব দিল, দু’ বছর আট মাস। …কেন?

—আমরা তাহলে এই জানা কথার বাইরে পড়ে আছি কেন?… ভেবেছ? তার দিকে চেয়ে বাপী হাসছে অল্প অল্প।—ভেবে কি হবে। আমাদের ছেলেপুলে হবে না এ তো আমি তুমি ঘরে আসার অনেক আগেই একরকম জেনে বসে আছি।

অবিশ্বাস্য কাতর সুরে মিষ্টি বলে উঠল, তুমি জানতে?

বাপী সাদাসিধে ভাবেই মাথা নাড়ল।—তোমার প্রথমবারের গণ্ডগোলের ব্যাপারটা দীপুদার মুখে শুনেছিলাম…।

—কিন্তু একেবারে হবেই না দাদা তো জানত না!

—তোমার দাদা না জানলেও সব শুনে আমার তাই মনে হয়েছিল। মিষ্টির ফর্সা মুখ তেতে উঠছে।—মনে হয়েছিল তাই তুমি নিশ্চিন্ত মনে বসে আছ? ভালো কাউকে দেখিয়ে চেষ্টাচরিত্র করার দরকার মনে করো নি?

হঠাৎ এরকম অভিযোগ কেন বাপী বুঝে উঠল না। বলল, চেষ্টা-চরিত্র যা করার তুমি নিজেই তো করেছ।…একজন ছেড়ে মায়ের সঙ্গে একে একে তিনজন এক্সপার্টের সঙ্গে কনসাল্ট করেছ—এরপর আমার আর কি করার থাকতে পারে?

—ও…! অস্ফুট স্বরে মিষ্টি বলল, তুমি এ-ও জেনে বসে আছ তাহলে। তোমার আর কিচ্ছু করার নেই? তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারতে না— বাইরের এক্সপার্ট দেখাতে পারতে না?

বাপী এই প্রথম মিষ্টির দুঃখটা অনুভব করল। জবাব দিল, যেতে চাও চলো…কিন্তু আমার ধারণা এ-সব ব্যাপারে আমাদের স্পেশালিস্টরা একটুও পিছিয়ে নেই। মাঝখান থেকে আরো কষ্ট পাবে।

—তুমি ছেলে চাও না? তুমি কষ্ট পাচ্ছ না?

বাপী নির্দ্বিধায় মাথা নাড়ল।—আমি এ নিয়ে কিছু ভাবিই নি। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি—পেয়েছি ব্যস।

—ব্যস নয়! মিষ্টির গলার স্বর কঠিন।—সব জেনে তুমি উদার হয়ে বসে আছ—চুপ করে থেকে তুমি আমাকে দয়া করছ।

বাপী অবাক। আহত।—তার মানে।

—তা না হলে ঊর্মিলার মেয়ে হয়েছে শুনে তুমি আনন্দে লাফালাফি করতে— আমার মুখ চেয়ে চুপ করে আছ।

বাপী বুঝল। হাসিই পেল এবারে। তরল সুরে বলল, কোনো এক্সপার্ট দিয়ে আগে তোমার মাথাটা দেখাব ভাবছি। পরেই গলার স্বর গভীর একটু, গম্ভীরও। বলল, আমি ঠিক আগের মতো কেন নেই জানি না…ভেতরে কি হয় নিজেই বুঝি না. তোমাকে বোঝাব কি করে। যা-ই হোক আমাকে অবিশ্বাস কোরো না, আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি, তার বেশি আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই নি।

মিষ্টির লালচে মুখ। অপলক চেয়ে রইল। একটু বাদে উঠে গেল। এই লোককে অবিশ্বাস করে না। মিথ্যে যে বলে না, তার অনেক প্রমাণ পেয়েছে। তবু ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। যা বলল, সত্যি হলে তাকে শুধু ভোগী ছাড়া আর কি বলবে? মিষ্টি শুধু সেই ভোগের দোসর। ভোগের ভোজে কদর তার। মানুষটা আগের মতো নেই তা-ও ঠিক। নিজের ভিতরেই সময় সময় কোথায় তলিয়ে যায় মিষ্টি ঠাওর করে উঠতে পারে না। কিন্তু ভেসে ওঠে যখন, আকণ্ঠ তৃষ্ণা। তখন মিষ্টিকেই সব থেকে বেশি দরকার। মিষ্টি তখন খুব মিষ্টি। মিষ্টি কোনো দিন মা হবে না সেজন্যেও এই লোকের এতটুকু খেদ নেই। মিষ্টি কেবল তার ভোগের জগতের মিষ্টি।

ক্ষোভের মুখে খুব সুবিবেচনা করছে না মিষ্টি তা-ও বোঝে। মনের তলার ক্ষীণ আশাটুকুও নির্মূল। পরিপূর্ণতার অভাব-বোধ যন্ত্রণার মতো। এ যন্ত্রণার ভাগীদার নেই। তাই ক্ষুব্ধ হয়। তাই এ-রকম ভাবে। নইলে, এই লোকের ভালবাসার গভীরতাও যে সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করতে হয় তাই বা অস্বীকার করে কি করে?

ঊর্মিলা,

টেলিগ্রামের পর মিষ্টি তোমার চিঠিও পেয়েছে। এতদিনে তুমিও মিষ্টির চিঠি পেয়ে থাকবে। তোমার মেয়ে হয়েছে শোনার পর আমার মনের কথা তোমাকে জানানো হয়নি। ছেলে শুনলে আমি নিশ্চয় এত খুশি হতাম না। কালে দিনে মেয়েটা যেন তোমার থেকে ঢের বেশি দুষ্টু হয়। আর, তুমি তোমার মা-কে যত জ্বালিয়েছ, ও যেন তার মা-কে তার থেকে অনেক বেশি জ্বালায়। আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি মেয়ে দেখতেও তোমার থেকে সুন্দর হবে।

আমার শরীরের কথা ভেবে অত ঘটা করে উতলা হয়ো না। আসলে মিষ্টি তার নিজের উদ্বেগ খানিকটা তোমার ওপর চাপিয়েছে। ওই প্রেশার-ট্রেশার হয়তো বরাবরই ছিল। আমার তেমন কিছুই অসুবিধে হচ্ছে না। আসল গণ্ডগোলটা অন্য দিকে, যা আমারও জানা ছিল না। বাচ্চা বয়েস থেকে আমার কেবল খোঁজার ধাত, খোঁজার বরাত। যেমন ধরো সেই ছেলেবেলা থেকে মিষ্টিকে খুঁজেছি। ভিখিরির খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাকে পাওয়া যাবে না, বুঝে নিয়ে টাকা খুঁজেছি, ঐশ্বর্য খুঁজেছি। সে-দিকে এগোতে গেলে যা দরকার…অর্থাৎ তোমার মায়ের মনের ভাণ্ডারে ঢুকে পড়ার চাবিটি খুঁজেছি। তারপর একটু একটু করে সব পেয়েছি, মিষ্টির কাছেও পৌঁছে গেছি। কিন্তু তারপর? এই তারপরের গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে গেছি আমি। সেই ক্ষ্যাপার খোঁজার বাতিক যাবে কোথায়? কি খুঁজব? আরো টাকা আরো টাকা আরো টাকা? মিষ্টির মধ্যে আরো মিষ্টি আরো মিষ্টি আরো মিষ্টি? জীবন খোঁজার সেটাই শেষ কথা হলে ভেতরের খ্যাপা থামে না কেন? অত মাথা খোঁড়াখুঁড়ি কিসের?

যাক আর পাগলামি বাড়াব না। বিজয় তার কাজ নিয়ে সুখে থাকুক। তুমি তোমার মেয়ে নিয়ে সুখে থাকো। তোমাদের আমার এই খাপছাড়া রোগে পেয়ে বসলে মেয়েটার সর্বনাশ। তার থেকে চোখ-কান বুজে তোমরা আপাতত ওই মেয়ের দিকে মন দাও।

— বাপী।

চিঠিটা সামনের টেবিলের ওপর। মিষ্টি স্থাণুর মতো বসে আছে।

দুপুরে রোজ দু’আড়াই ঘণ্টার জন্য নিজের অফিসে নেমে আসে। আজও তাই এসেছিল। বাপীর ব্লাডপ্রেশার চড়ে থাকার পর থেকে মিষ্টিরই এই ব্যবস্থা। বাপীর চেম্বারে বসে তার নির্দেশমতো কিছু কাজকর্ম সেরে রাখে। বাপী সকালের দিকে বসে। তেমন দরকার পড়লে বিকেলেও খানিকক্ষণের জন্য নামে।

প্যাডসুদ্ধু চিঠিটা ড্রয়ারে ছিল। ড্রয়ার খুলতেই মিষ্টির চোখে পড়েছে। নিজের হাতে চিঠি আর লেখেই না, চিঠির গোড়ায় ঊর্মিলার নাম দেখে কৌতূহল স্বাভাবিক। প্যাডটা টেনে নিয়ে পড়ল। শেষ হতে আবারও পড়ল।

মিষ্টির মনে হচ্ছিল, হঠাৎ সে বড় কিছু পুঁজি খুইয়ে বসেছে। সেই যন্ত্রণায় বুকের ভিতরটা টনটন করছে। এরই মধ্যে সে এত সুলভ হয়ে গেছে যে তার মধ্যে ওই লোকের আর খোঁজার কিছু নেই, আর পাওয়ার কিছু নেই। চোখ-কান বুজে বিজয় আর ঊর্মিলাকে তাদের মেয়ের দিকে মন দেবার উপদেশের ফাঁকে একটাই ইঙ্গিত স্পষ্ট মনে হল মিষ্টির। অর্থাৎ ওই লোকের এটুকুও অবলম্বন নেই।

প্যাড থেকে লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে পরিষ্কার করে দু’ভাঁজ করল। সেটা হাতে করে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলো। পাশের চেয়ারে জিত্ বা ওদিকের হল-এর কেরানীরা কেউ টের পেল না।

ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে বাপী মোটা বই পড়ছিল একটা। মিষ্টি চুপচাপ সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা এত তন্ময় যে দু’মিনিটের মধ্যেও টের পেল না।

—ওটা কি পড়ছ?

মুখের কাছ থেকে বইয়ের আড়াল সরল। বাপী দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো। পৌনে চারটে। অর্থাৎ এরই মধ্যে উঠে আসবে ভাবে নি। বইটা ঘুরিয়ে মিষ্টির দিকে ধরল।

মিষ্টি জানে কি বই। শ্রীঅরবিন্দর লাইফ ডিভাইন। জিগ্যেস করল, ওতে কি আছে?

হেসে জবাব দিল, কে জানে, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না।

—তাহলে পড়ছ কেন?

রঙ্গ করে বাপী জবাব দিল, আমি পড়ছি না, আমাকে ঘাড় ধরে কেউ পড়াচ্ছে।

—আমিই বোধ হয়?

মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে এবারে খটকা লাগল বাপীর।…তার মানে? —তার মানে তোমার টাকা আর টাকার মতো আমাকে নিয়েও তুমি তাহলে এখন খুব ক্লান্ত?

বাপী বিমূঢ় খানিক। মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ কি হল বোঝার চেষ্টা

হাতের ভাঁজ করা চিঠিটা খুলে মিষ্টি সামনে ধরল। —এটা লিখে ডাকে না দিয়ে প্যাডেই রেখে দিয়েছিলে কেন—আমি পড়ব বলে?

এবারে বাপী হাসছে মিটিমিটি।—বাইরের টিকিট ছিল না বলে পাঠানো হয় নি। কিন্তু ওটা পড়ে শেষে কি তুমি এই বুঝলে নাকি?

ঊর্মিলা কি বুঝবে?

বাপী থমকে চেয়ে রইল। তারপর হাত বাড়ালো—দাও ওটা।

মিষ্টি নড়ল না। চোখে চোখ।

—দেখছ কি? ছিঁড়ে ফেলব। ঊর্মিলারও যদি তোমার মতো বুদ্ধি-বিবেচনা হয় তাহলে মুস্কিলের কথাই!

মিষ্টি ভিতরে ভিতরে অবাক একটু। অপ্রস্তুত হওয়া দূরে থাক, এই উষ্ণ ঝাঁঝেও ভেজাল নেই। জিগ্যেস করল, তোমার বুদ্ধি-বিবেচনায় এই চিঠির কি অর্থ দাঁড়ায়?

বাপী আরো অসহিষ্ণু।—যা-ই দাঁড়াক, এতে তোমাকে ছোট করার বা খাটো করার কোনো ব্যাপার নেই। তোমার নাম থাকলেও আমার এই ভাবনার মধ্যে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই—বুঝলে?

মিষ্টির মুখ লাল।—নিজের দাম জেনে খুশি হলাম।

হাল ছেড়ে বাপী হাতের বইটা পাশের ছোট টেবিলে ফেলে দিল। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, মিষ্টি, অনেক লেখা-পড়া শিখেছ বলে বাতাস থেকে অশান্তি টেনে এনো না।

ইজিচেয়ারে আবার শরীর ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঝল।

চিঠি হাতে নিয়ে মিষ্টি চলে গেল। একটা দুর্বোধ্য অস্বস্তি ওকেও ছেঁকে ধরেছে এখন।

মাসখানেক বাদে ঊর্মিলার জবাব এলো। মিষ্টিকে লিখেছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার করে লিখেছে, প্রেশার ট্রেশার যা-ই থাক, সব থেকে আগে পত্রপাঠ বড় ডাক্তার ডেকে ফ্রেন্ডের মাথাখানা খুব ভাল করে দেখিয়ে নাও

মিষ্টি চুপচাপ চিঠিটা বাপীর দিকে বাড়িয়ে দিল। পড়ে বাপী হাসতে লাগল। বলল, বাঁচা গেল, ঊর্মিলা তবু রোগ কিছুটা বুঝেছে।

সোনার হরিণ নেই – ৪০

‘আগে বাঢ়। মিল যায়গা।’

ভুটান জঙ্গলের উদোম ফকিরের গমগমে গলার স্বর আর কথাগুলো বাপীর প্রায়ই মনে পড়ে। সেদিনের মানসিকতায় শব্দ চারটে রোমাঞ্চকর কাণ্ড ঘটিয়েছিল। বুকের তলায় ঝংকার তুলেছিল। বিঘ্ন ঠেলে সামনে এগনোর সাদা মন্ত্র কেউ কানে জপে দিয়ে গেছল। কিন্তু এখন কি? জপের মতো কথাগুলো এখনো কানে বাজে কেন? স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাড়া জাগে কেন?

বাপীর তন্ময় হতে সময় লাগে না। প্রকাণ্ড দেবদারু গাছের নিচে ভস্মমাখা সেই উলঙ্গ ফকির বসে। ওর দিকেই চেয়ে আছে। তার দু’চোখে হাসি ঠিকরোচ্ছে কি আলো, বাপী জানে না।

‘আগে বাঢ়। মিল যায়গা। ‘

ত্রিশূল হাতে উঠে দাঁড়াল। পলকে গভীর জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেল।

কিন্তু কোথায় গেল? সামনে এগলো? কিছু পাওয়ার আশা না থাকলে ফকিরই বা এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? দুর্নিরীক্ষ মহাশূন্যে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে এমন কোনো মহাশক্তিধরের কাছে পৌঁছনোর আশা? খুব ছেলেবেলায় বাপী ভাবত আকাশের ওপারে ঈশ্বরের রাজ্য। ও রকম কোনো অলৌকিক অস্তিত্বে বিশ্বাস এখন নিজের কাছেই হাস্যকর।

‘চলা পৃথ্বী—স্থিরভূমি’। দেড় হাজার বছর আগে ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্টের ঘোষণা বাপী বইয়ে পড়েছে। সে বলে গেছে, সূর্য নয়, স্থিরভূমি এই পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পাক খাচ্ছে। এই জ্ঞান কোনো ঈশ্বর মহাশূন্য থেকে তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল? গত দেড় বছর যাবৎ মানুষের তৈরি উপগ্রহ মহাকাশের রহস্যের আবরণ সরিয়ে চলেছে। স্পুৎনিক আর একসপ্লোরারের জয়-জয়কার। মানুষ খুব শিগগীরই ওই মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহ জয় করবে এমন বিশ্বাস বাপীরও আছে। কিন্তু সব-কিছুর আড়ালে বসে বিচ্ছিন্ন কোনো অলৌকিক পুরুষ এই শক্তির যোগানদারি করছে, বাপী ভাবে না।

অথচ শক্তিটুকু অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা শক্তির উৎস কোথাও আছেই। সেটা কোথায়, কত বড়, তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বই বা কেমন? উলঙ্গ ফকির সম্পর্কেও বাপীর সেই গোছেরই বিস্ময়। হাড়গুড়নো রক্তজমানো সেই প্রচণ্ড শীতে লোকটার গায়ে একটা সুতো নেই। শীততাপের অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান থেকে নিজেকে সে এমন অনায়াসে তফাতে সরিয়ে রাখতে পারে কোন শক্তির জোরে? লজ্জা-ভয়ই বা তার কাছে ঘেঁষে না কেন?

নিজের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে এক এক সময় দম বন্ধ হয়ে আসে বাপীর। ধড়ফড় করে ওঠে। নিজেকে টেনে তোলে। ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাস্তব ভূমির ওপর পা ফেলে চলতে চেষ্টা করে। কাজকর্মে মন দেয় কিন্তু সেই মন আর সেই উৎসাহে ভাটা পড়ছে তাও অনুভব করে।

তা হলেও ব্যবসা সেখানে দাঁড়িয়ে, টাকা আপনি আসছে। আসছেই। অনেকটা খেয়ালের বশেই বাপী, নিঃশব্দে মাঝে মাঝে এই বোঝা কিছু কিছু হালকা করে ফেলে। দেশের প্রায় সর্বত্র খরা বন্যা দুর্ভিক্ষ লেগেই আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বছর বছর পোকামাকড়ের মতো মরে যায়। তাছাড়া অন্ধ আতুর বা আর্তের সেবা প্রতিষ্ঠানই বা এ-দেশের মতো এত আর কোথায় আছে। গোটা দেশটাই যেন দাও-দাও রব তুলে হাত পেতে বসে আছে।

বাপীর নিঃশব্দে দিয়ে যাওয়ার অঙ্কটা ক্রমশ বড় হচ্ছে সেটা একমাত্র মিষ্টি লক্ষ্য করেছে। বাপী ওকেও বলে না। কিন্তু সমস্তই চেকবই পাশবই আর কাঁচা টাকা বোঝাই সিন্দুকের চাবি তার হেপাজতে। লক্ষ্য বা চোখ রাখলে তার না জানার কারণ নেই। এমন সংগোপন দানের বহর দেখেও মিষ্টি অস্বস্তি বোধ করে। ঐশ্বর্যের সবটা সাদা রাস্তায় আসছে না বলেই এভাবে বিবেক পরিষ্কার রাখার চেষ্টা কিনা বোঝে না।

ঠাট্টার সুরেই একদিন বলে ফেলল, দান করলেও লোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু প্রচার চায়—তুমি যেন খুব চুপি চুপি মস্ত মস্ত এক-একটা দানের পর্ব সেরে ফেলছ?

তার মুখের দিকে চেয়ে বাপী বেশ একটু কৌতুকের খোরাক পেল। ঠোঁটে হাসি। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি দক্ষিণেশ্বর গেছ কখনো?

প্রশ্ন শুনে মিষ্টি অবাক।——মায়ের সঙ্গে দুই-একবার গেছি। কেন? —আমি একবারও যাইনি। তোমার কথা শুনে সেখানকার জ্যান্ত ঠাকুরটির একটা কথা মনে পড়ল। বলেছিল, সেবা করতে পারিস, দান করার কে রে শালা তুই?

মিষ্টির ভালো লাগল। হেসে বলল, তুমি তাহলে সেবা করছ?

—আমি কিছুই করছি না। নিজেকে যাচাই করছি।

না বুঝে মিষ্টি চেয়ে রইল।

বাপী বলল, দিতে ইচ্ছে করে না। তখন আরো বেশি করে দিয়ে ফেলে দেখি কেমন লাগে। মানে, দেখি কতটা টাকার গোলাম হয়ে বসে আছি। ছাড়তে না পারার গোলামি বরদাস্ত করতে না চাইলেও ওটা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।

মিষ্টির দু-চোখ বড় বড়।—শেষে কি আমার ওপর দিয়েও এরকম এপেরিমেন্ট চলবে নাকি!

বাপী হাসছে।—ঘুরে ফিরে একই ব্যাপার কিন্তু।…সেই আঁকড়ে ধরে থাকার গোলামি।

মিষ্টি আর কিছু বলল না। এই জবাব আশাও করেনি, ভালও লাগেনি।

দিন গড়াতে গড়াতে ঊনষাট সালের আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বরে পা ফেলল। মাসের প্রথম দিনে বাপীর জীবনের এই গতিও আচমকা বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াল।

গত জুন মাস থেকে পশ্চিম বাংলার খাদ্য পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। চালের দর হু হু করে বাড়ছে। বাজারের চাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম—গ্রামান্তর থেকে প্রতি দিন তিন-চার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ কলকাতায় আসছে খাবার খুঁজতে। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় খাদ্যনীতির ব্যর্থতার দায় খাদ্যমন্ত্রীর ওপর না চাপিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই গড়াতে থাকল।

এই ব্যর্থতা সামনে রেখে প্রবল আক্রমণে নেমে গেছে বিরোধী দল। সরকারকে উল্টে দেবার হুমকি দিয়ে আসরে নেমেছে তারা। তাদের অসন্তোষ মুখ্যমন্ত্রীর ওপর যত না, তার থেকে ঢের বেশি খাদ্যমন্ত্রীর ওপর। পরের দু-তিন মাসে চালের দর মণ পিছু আরো পাঁচ টাকার ওপর বেড়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি আর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি কোমর বেঁধে গণ-আন্দোলনে নেমেছে। তারা চালের মজুতদারির বিরুদ্ধে যুঝবে, আইন অমান্য করবে, অবস্থান ধর্মঘট করবে, পিকেটিং করবে। অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠতে লাগল, কারণ খিদের জ্বালায় সাধারণ মানুষও ক্ষিপ্ত। জঠরে আগুন জ্বললে লোকে কান শুনতে ধান শোনে। রাজনীতি বুঝুক না বুঝুক, দুর্দিন ঘোচানোর যুদ্ধে তারাও ছুটে আসবে, হাত মেলাবে।

ধর-পাকড় শুরু হয়ে গেল। শাসনযন্ত্র গণবিক্ষোভের ষাট-পঁয়ষট্টি জন নেতাকে ছেঁকে তুলে আগে-ভাগে গ্রেপ্তার করল। কেউ কেউ আবার ধরা—ছোঁয়ার বাইরে গা ঢাকা দিল। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন তখন অনেক ছড়িয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাণ নেবার হুমকি পর্যন্ত শোনা গেল। আগস্ট-এর শেষ দিনে গতকাল সেই রক্তাক্ত গণ-বিক্ষোভের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। দুই তরফই প্রস্তুত ছিল শহরের মানুষ গ্রামের মানুষ স্ত্রীলোক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সহ পঁচিশ হাজারের এক মিছিল ময়দানের সভার পর এগিয়ে এলো রাজভবনের দিকে।

পথ আগলে সশস্ত্র পুলিশও প্রস্তুত। রাত সাড়ে সাতটায় সেখানে পুলিশ আর জনতার খণ্ডযুদ্ধ। লাঠি-চার্জ টিয়ার গ্যাস। সেখান থেকে অশান্তির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শহরে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। স্টেট বাস আর দুধের বুথ পোড়ানোর হিড়িক পড়ে গেল।

এক দিনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা তিনশ’র ওপর। আহতদের ভিড়ে হাসপাতাল বোঝাই।

বাইরে বাপী এই মানুষগুলোর থেকে অনেক দূরে অনেক বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বিপুল ঐশ্বর্য সত্ত্বেও ভিতরের মনটা আজও এদেরই দিকে। ব্যক্তিবিশেষে বিধান রায় বাপীর চোখে শুধু পুরুষ নয়, পুরুষসিংহ। চিকিৎসায় ধন্বন্তরী নাম। শক্ত দুই হাতে এই বাংলার শিল্প বাণিজ্য শিক্ষা সংস্কৃতি পথ পরিবহন স্বাস্থ্য—সব কিছুর শ্রী ফেরানোর হাল ধরে বসে আছেন। বাপীর মানসিক বিরোধ তাঁর সঙ্গে নয়। স্বাধীনতার বারো বছরের মধ্যেও যে-শাসনযন্ত্র ক্ষুধার মুখে অন্ন যোগাতে পারল না, বিরোধ তার সঙ্গে। আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির খেলাই। অজ্ঞ ক্ষুধার্ত জনেরাই বেশির ভাগ এই রাজনীতির প্রথম সারির বলি।

পরদিন অর্থাৎ আজ। পয়লা সেপ্টেম্বর। সকাল থেকে অশান্তির খবর কানে আসছে। আন্দোলনের অনেকখানি দখল চলে গেছে সমাজবিরোধীদের হাতে। বিকেলের মধ্যে পাঁচটা থানা আক্রমণ করে লুটপাট করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির এলাকায় তুমুল হামলা। বড় বড় রাস্তাগুলো ব্যারিকেড করে দেবার ফলে পুলিশ পেট্রল ব্যাহত। টিয়ার গ্যাস বা লাঠিচার্জে কুলোলো না আর। গুলি চলল। সরকারী হিসেবে পঁয়ষট্টি জন গুলিতে আহত আর চার জন নিহত। এ হিসেব কতটা সত্যি সকলেই জানে।

মিষ্টির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খবর পেয়েছিল। গতকাল বিকেলে দুজনে তাঁকে দেখতে যাবে ঠিক করেছিল। গণ্ডগোলের দরুন আর বাড়ি থেকে বেরোয় নি। আজও বিকেল পর্যন্ত বাড়ি বসে থেকে বাপীর একটুও ভালো লাগছিল না। গণ্ডগোল বেশি ঘোঁট পাকিয়েছে উত্তর কলকাতার দিকে। দক্ষিণ দিকের তেমন বড় কিছু ঘটনা বা দুর্ঘটনার খবর কানে আসেনি। বাপী মিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। বা গণ্ডগোল দেখলে এগোবেই না।

চলেছে। বাপীর গাড়িও ইদানীং ড্রাইভার চালায়। নিজে ড্রাইভ করা ছেড়েছে। রাস্তায় ট্রাম বাস ট্যাক্সি এমন কি আর প্রাইভেট গাড়িও চোখে পড়ছে না। এলগিন রোডের কাছাকাছি আসতে বোঝা গেল ব্যাপার এদিকেও সুবিধের নয়। রাস্তা জুড়ে ভাঙা কাচ ডাবের খোলা ইট পাথর জুতো আর ভাঙা কাঠের তক্তার ছড়াছড়ি। ছোট বড় গলির মুখে এক-একটা জটলা। বন্দুক উঁচনো পুলিশের পেট্রল গাড়ি দেখলেই তারা ছুটছাট হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি আর একটু ভালো করে বোঝার জন্যে বাপী গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে পাঁচ-সাত জন মারমুখী ছেলে ছুটে এসে গাড়িটা ঘিরে ফেলল।—এই দিনে আপনারা গাড়ি চেপে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন?

কেন বেরিয়েছে বাপী তাদের বোঝাতে চেষ্টা করল, কিন্তু সেই ফাঁকে একজন পিছনের একটা টায়ারের ভাল্ব খুলে দিয়েছে। সশব্দে বাতাস বেরিয়ে টায়ারটা চুপসে গেল। এই দিনে বাইরে বেরুনোর কারণ শুনে হোক বা মিষ্টিকে দেখে হোক, তাদের মাতব্বর টায়ারটা যে ফাঁসিয়েছে তাকে ধমকে উঠল। তারপর বাপীকে বলল, বাড়তি টায়ার থাকে তো এক্ষুনি লাগিয়ে ফিরে যান—সামনে এগোতে পারবেন না—আরো বিপদে পড়বেন।

দূরে পুলিশের পেট্রল গাড়ি চোখে পড়া মাত্র দলটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

মিষ্টিও গাড়ি থেকে নেমে এলো। পেট্রলগাড়িটা ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার পিছনের ক্যারিয়ার থেকে সাজসরঞ্জাম বার করে স্টেপনি লাগানোর কাজে লেগে গেল। মিষ্টি আর বাপী নির্বাক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।

—তুই আমার হাড়মাস সব খাক করে দিলি। তোকে আমি এবার থেকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখে দেব—তুই কত বড় হারামজাদা আমি এবার দেখে নেব!

তারস্বরের ক্ষিপ্ত কথাগুলো কানে আসতে বাপী ফিরে তাকালো। আর সেই মুহূর্তে মাথার ঠিক মধ্যিখানে কেউ বুঝি প্রচণ্ড মুগুরের ঘা বসিয়ে দিল একটা।

কথাগুলো কানে আসতে মিষ্টিও ফিরে তাকিয়েছিল।

…আধ হাত পাকা দাড়ি বোঝাই একটা লোক বছর এগারোর হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরা ঢ্যাঙা এক ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে রাগে ফোঁস করে এই কথা বলছে। লোকটার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে মেটে সিঁদুরের চওড়া তিলক।

মিষ্টিকে নয়, বাপীকে দেখেই লোকটা থমকে দাঁড়ালো একটু। আবার এগোতে গিয়েও পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকেই গেল বুঝি। দুই চোখ বিস্ফারিত। সামনে যাকে দেখছে, ঠিক দেখছে কিনা ভেবে পাচ্ছে না।

—বিপুলবাবু আপনি! আপনি আমাদের সেই বিপুলবাবু না?

বাপী নিস্পন্দ নির্বাক।

—আপনি আমাকে চিনতেও পারছেন না বিপুলবাবু! আমি রতন। রতন বণিক! আমাকে…আমার বউ কমলাকে মনেও পড়ছে না আপনার?

মাথার মধ্যে ঝড়। যেভাবে হোক এই ঝড় না থামালে কোথায় ভেসে যাবে বাপী জানে না। প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে টেনে তুলল। ওর শক্ত হাতে ধরা ছেলেটার দিকে না তাকাতে চেষ্টা করছে।

—চিনেছি। চিনে তোমার মতোই অবাক হয়ে গেছলাম।

রতন বণিক খুশিতে আটখানা।—আপনি না চিনে পারেন! এমন সুন্দর চেহারা হয়েছে এখন আপনার! এ আপনার গাড়ি? ইনি আপনার পরিবার? ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে বিগলিত মুখে মিষ্টির সামনে মাথা নোয়ালো।—পেন্নাম হই গো মালক্ষ্মী—এই বিপুলবাবু আমাদের কতখানি ছিলেন আপনি জানেন না। উনি আমার বস্তির খুপরি ঘরে থাকতে আমি বলে দিয়েছিলাম, এই দিন থাকবে না—উনি রাজা হবেন! হ্যাঁ বিপুলবাবু, আপনি কলকাতায়–আর আমি জানিও না!

মাথার ভিতরে যা হচ্ছে—হচ্ছে। পিঠেও চাবুক পড়ল একটা। মিষ্টি ভাবছে, একটু আগের বিভ্রাটের দরুণ মানুষটা এই লোকের আনন্দ বা কথায় তেমন সাড়া দিতে পারছে না।

রতন বণিক হঠাৎ ছেলেটার কাঁধ ধরে বাপীর দিকে ঠেলে দিল।—এই ছোঁড়া, পেন্নাম কর শিগগীর। কাকে দেখছিস জানিসও না। আজ ঘরে ফিরে তোর হাড় গুঁড়ো করে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তোর জন্যেই বিপুলবাবুর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে গেল—তাই বেঁচে গেলি।

ছেলেটা দুজনকেই প্রণাম সেরে উঠতে রতনের একমুখ হাসি। আমার ছেলে বিপুলবাবু, ওর নাম মদন। তক্ষুনি আবার রাগের মুখ।—এত বড় পাজী ছেলে আর হয় না—বুঝলেন। খেয়েদেয়ে বেলা বারোটায় আমার চোখে ধুলো দিয়ে মারামারি গোলাগুলির মধ্যে বেরিয়েছে—আমি পাঁচ ঘণ্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে এইখানে এসে ওকে ধরেছি—এইটুকু বিচ্ছু আমাকে একেবারে শেষ করে ছাড়ল।

বাপীর চোখ দুটো এবারে কেউ যেন টেনে ছেলেটার মুখের ওপর বসিয়ে দিল।

দেখছে মিষ্টিও। লম্বা গড়ন। রোগা। কালোও নয় ফর্সাও নয়। বাপ যত দুষ্টু বলছে মুখ দেখলে ততো দুষ্টু মনে হয় না। চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় দুষ্টুমিতে ছাওয়া। কিন্তু সব মিলিয়ে ছেলেটা দেখতে বেশ। এত বুড়োর এই ছেলে কেউ ভাববে না, নাতি-টাতি ভাববে।

সহজ ভাবেই মিষ্টি বলল, মায়ের কথা শোনে না বুঝি….

বলে অপ্রস্তুত। রতন বণিক ফোঁস করে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। বিড়বিড় করে বলল, মা তো নয়, শত্তুর।…ছেলে ছেলে করে পাগল হয়েছিল। আমি বলেছিলাম ছেলে হবে—হল। আর দুটো বছর না যেতে সেই ছেলে রেখে আমাকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল!

বাপী কাঠ। রতনের ছল-ছল দু’চোখ তার মুখের ওপর।—আপনি তো এ খবরও জানেন না বিপুলবাবু। এমন বউকে শত্রুর ছাড়া আর কি বলব? ভরা শীতেও দুবার করে চান করা চাই—কার নিষেধ কে শোনে। বুকে সর্দি বসিয়ে সাতদিনের জ্বরে সব শেষ। যাবার দিন সকালে আপনাকে মনে পড়েছিল… কিছু বলেও গেছল…

গাড়ি রেডি। বাপীর হঠাৎ ফেরার তাড়া। রতনকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে মিষ্টিকে তাড়া দিয়ে গাড়িতে উঠল। রতনকে বলল, গণ্ডগোলের মধ্যে আর বাইরে থেকো না—ঘরে চলে যাও।

বিকেলের আলো আর নেই-ই প্রায়। গাড়ির ভিতরটা আবছা। বাপী পিছনে মাথা রেখে নিশ্চল বসে আছে। দু চোখ বোজা।

মিষ্টির মনে পড়ছে কিছু। ফিরে তাকালো।—কলকাতায় সেই প্ৰথম দেখা হতে তুমি বলেছিলে, অফিসের চাকরি যাবার পর সেখানকার কোন্ পিওন আর তার বউ আদর করে তাদের বস্তিঘরে তোমাকে রেখেছিল…এ সেই পিওন নাকি?

জবাব না দিয়ে বাপী শুধু মাথা নাড়ল। সে-ই!

—ওদের কাছে কত দিন ছিলে?

—দুমাস।

এবারে মিষ্টিও অবাক একটু। — সামান্য লোক হলেও তোমার জন্য এত করেছে, আর এত বছরের মধ্যে তুমি তাদের একটা খবরও নাওনি?

বাপী জবাব দিল না। মাথা পিছনে তেমনি ঠেস দেওয়া। দুচোখ বোজা। মিষ্টি এবারে ভালো করে লক্ষ্য করল। উতলা একটু। শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

এবারেও বাপী সামান্য মাথা নাড়াল কি নাড়াল না।

মিষ্টি ভাবল ছেলেগুলো হঠাৎ ওভাবে হামলা করার দরুন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ধকল গেছে। এর থেকে বেশি বিপত্তিও হতে পারত।

রাত্রি। দেড় হাত ফারাকে মিষ্টি ঘুমোচ্ছে। বাপী নিঃশব্দে উঠে বসল। শরীরের রোমে রোমে আগুনের কণা। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে লাগছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বাপী জানে এই দুঃসহ যন্ত্রণার শেষ এই মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে। যদি সে মিষ্টিকে ডেকে তুলতে পারে, তুলে যদি ওকে বলতে পারে, কথা ছিল তোমার আমার মধ্যে গোপন কিছু থাকবে না—তাই এবারে শেষ কিছু শোনো— শুনে আমাকে দেখো, চেনো।

বাপীর গলায় কুলুপ আঁটা। ডাকা যাবে না। বলা যাবে না। শরীর জ্বলছে। যন্ত্রণা বাড়ছে। শব্দ না করে খাট থেকে নামল। পা দুটো পাথরের মত ভারী। ঝিনঝিন করছে। অন্ধকার ঘর-সংলগ্ন বাথরুমে এলো। কানে মাথায় জলের ঝাপটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কি-যে হতে লাগল বুঝছে না। পায়ের নিচে ভূমিকম্প। সব কিছু বিষম দুলছে, উল্টে যাচ্ছে। প্রাণপণে বেসিনটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল একটু। দেয়াল হাতড়ে ঘরে এলো। বিছানাটা কদ্দুর। বাপী কি আর নাগাল পাবে?

পেল। তারপর আর মনে নেই।

সোনার হরিণ নেই – ৪১

টানা দু মাস বাদে বাড়ির দোতলায় হাঁটা-চলার অনুমতি পেল বাপী। ডাক্তারের হুকুমে তার ওঠা বসা চলা ফেরা। তার নির্দেশ মিষ্টি একচুল এদিক ওদিক হতে দেবে না। সেই ভীষণ রাতটার কথা মনে নেই বাপীর। কারণ জ্ঞান ছিল না। পরদিন থেকে এই দুমাস যাবৎ চিকিৎসার ঘটা দেখছে। দেড় মাস পর্যন্ত দিন—রাত চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দুজন নার্স মোতায়েন ছিল। বাপীর বিরক্তি দেখে দুদিন আগে মিষ্টি রাতের নার্স ছেড়েছে। এখনে তিন দিন অন্তর ডাক্তার আসছে, প্রেশার মাপছে। সপ্তাহে একদিন করে বাড়িতে ই-সি-জি হচ্ছে। প্রেশার আরো ওপরের দিকে চড়ে থাকল বলে মিষ্টির দুশ্চিন্তা। ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছে। ওটাই মোটামুটি এখন স্বাভাবিক ধরে নিতে হবে। বেশি ওঠা-নামা করার থেকে এক জায়গায় বরং স্থির থাকা ভালো।

খবর পেয়ে বানারজুলি থেকে আবু রব্বানী ছুটে এসেছিল। একনাগাড়ে পনের দিন ছিল। তার পরেও একবার এসে ওকে দেখে গেছে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঠাট্টাও করেছে, তোমার এমন পেল্লায় হার্ট কে অ্যাটাক করতে পারে আমি ভেবে পাই না বাপীভাই। যাকগে, এখন আর নো ওয়ার্ক, নো চিন্তা—আমি আছি, জিত্ আছে, তোমার কিছু ভাবনা নেই।

ব্যবসা বা কাজকর্ম নিয়ে বাপী আর একটুও মাথা ঘামাচ্ছে না। এদিকের একটা মস্ত শেকল যেন ঢিলেঢালা হয়ে খসে খসে যাচ্ছে। একটুও খারাপ লাগছে না। বরং হালকা লাগছে। কিন্তু অস্বস্তি অন্য কারণে। সে কি পালানোর পথ খুঁজছে? দু মাসে আগের সেই ঘুম আর যদি না-ই ভাঙত।—কি হত? বেঁচে যেত?

ভিতর থেকে সায় মেলে না। এমন মৃত্যুর কথা ভাবতেও যন্ত্রণা। জীবনের এক বিরাট মুক্তির স্বাদ কোথাও লেগে আছে। কিন্তু সেটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চোরের মতো এই মৃত্যুর অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেলে সেই মুক্তির নাগাল আর কোনদিন পাবে না।

রতন বণিক নিয়মিত আসে। বিপুলবাবুর শরীরের খবর নিয়ে যায়। গোড়ায় দেখা সাক্ষাৎ নিষেধ ছিল। এখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখে। বিশেষ করে কপাল দেখে। ওর কপাল দেখার গল্প মিষ্টি এর মধ্যে বাপীর মুখে শুনেছে। তাই ও যখন কপাল দেখে মিষ্টি তখন ওর দিকে উদ্‌গ্রীব মুখে চেয়ে থাকে। রতন দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালে সহজ হবার চেষ্টায় বাপীকে সব থেকে বেশি যুঝতে হয়। এক এক সময় হেসে জিজ্ঞাসা করে, কেমন দেখছ?

রতন মাথা নেড়ে জবাব দেয়, ভালই।…ভাববেন না।

কিন্তু লোকটাকে বড় বিমর্ষ আর ক্লান্ত মনে হয় বাপীর। রতন বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ছেলের চিন্তায় সর্বদা উতলা। বিপুলবাবুর এত অসুখ, তাকে নিয়ে আসে কি করে। কিন্তু হাড়-পাজী ছেলে কোত্থেকে যে ওর ঘরে এলো ভগবান জানে!

বাপী পাশ থেকে আধ-পড়া বইটা তুলে নেয়। স্থির মনোযোগে পড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু চাপা লাইনগুলো নড়াচড়া শুরু করে দেয়।

মিষ্টি এখন আবার দেড় দুঘণ্টার জন্য নিচের অফিস ঘরে বসে কাজকর্ম দেখছে। বাপী সত্যি এখন ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না বলে দায়িত্ববোধ আরো বেশি। ব্যবসা-সংক্রান্ত সব পরামর্শ এখন জিতের সঙ্গে। বা চিঠিপত্রে রব্বানীর সঙ্গে।

সেদিন নিচে নেমে দেখে, ছেলের হাত ধরে রতন বণিক আসছে। মিষ্টি বুঝল, ছেলেকে রেখে নিশ্চিন্তে বেশিক্ষণ বসতে পারে না বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মিষ্টি আপিস ঘরে আসতে রতনও সঙ্গে এলো। ছেলেকে ভয় দেখানোর সুরে বলল, এই হল কর্তা-মা, ভয়ংকর রাগী কিন্তু। এখানে এই টুলে একেবারে চুপটি করে বসে থাকবি, নড়বি-চড়বি না। আমি বিপুলবাবুকে একটু দেখে আসি। ও এখানে বসে থাকলে কোন অসুবিধে হবে না তো মা-লক্ষ্মী?

মিষ্টি হাসিমুখে মাথা নাড়ল। অসুবিধে হবে না। ছেলেটা দুষ্টু খুব, সন্দেহ নেই। পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসির রেখা। যা শুনল, অর্থাৎ কর্তা-মা সত্যিই ভয়ংকর রকমের রাগী কিনা বোঝার চেষ্টা। মিষ্টির বেশ লাগল ছেলেটাকে। এইটুকু ছেলের মা নেই। এ-ও মনে হল। বলল, বাইরে টুলে বসতে হবে না, আমার কাছে ঘরে বসে থাক। রতনকে বলল, ও একটুও দুষ্টুমি করবে না, তুমি ওপরে যাও।

এ-সময়ে এসেছে বলে মিষ্টি অখুশি নয়। একলা থাকলেই ওই লোক বইয়ের মধ্যে ডুবে যায়। কেউ কথাবার্তা কইতে বা গল্প করতে এলে সে সুযোগ হয় না। তাছাড়া রতন বণিককে যে খুব পছন্দ করে মিষ্টি এ-ও বুঝেছে।

খুশি মুখে রতন ওপরে উঠে এলো। একগাল হেসে বাপীর সামনে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, দরাজ মন আর কাকে বলে। আমি ছেলেকে ভয় দেখালাম কর্তা-মা ভয়ংকর রাগী—চুপ করে বাইরের টুলে বসে থাক—আর উনি আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন—

রতন এলে বাপীর মানসিক প্রতিক্রিয়া একটু হয়ই। জিজ্ঞাসা করল, কার কথা বলছ?

—আমাদের মা লক্ষ্মীর কথা বলছিলাম—আমি যা দেখার দেখে নিয়েছি, বড় মন, মায়ামমতা আছে।

বাপীর মাথায় একটা শব্দ ঘুরপাক খেতে লাগল।—তোমার ছেলে কি ওকে কর্তা মা বলে ডাকবে নাকি?

—উনি হলেন গিয়ে রাজরাণী, মেমসায়েব-টায়েব ভালো লাগে না। সচকিত একটু।— উনি রাগ করবেন না তো?

অগত্যা বাপী মাথা নাড়ল, রাগ করবে না। চুপচাপ রতনকে দেখল একটু। বছর তিপ্পান্ন বয়েস হবে এখন। কিন্তু লোকটা বুড়িয়েই গেছে।

কথায় কথায় রতন বণিকের চাপা অভিমানটুকু আগে প্রকাশ পেল।—ও জোর দিয়ে বলেছিল বিপুলবাবুর ভাগ্য একদিন না একদিন ফিরবেই—বিপুলবাবু নিজেও সেদিন সে-কথা বিশ্বাস করেননি। তা রতন যতটা ভাবতে পারে, ভাগ্য তার থেকে ঢের বেশিই ফিরেছে মনে হয়। তা না হলে এমন বাড়ি, এমন দুখানা ঝকঝকে গাড়ি হতে পারে না। ভাগ্যের জোরে রাজরাণীর মতো বউ পর্যন্ত ঘরে এসেছে।—কিন্তু এত বড় হয়ে বিপুলবাবু ওদের এ-ভাবে ভুলে যাবেন ভাবেনি। এতকাল ধরে বিপুলবাবু কলকাতায় আছেন, একটা খবর পেলে রতন ছুটে আসত—কি ঝড়-জলটা না গেছে ওর ওপর দিয়ে—এখনো যাচ্ছে। সবই তার অদৃষ্ট ছাড়া আর কি।

বাপী একটুও বিরূপ হল না। কোন ওজর দেখালো না। এ-রকম বলার অধিকার ওর আছে।

একটু চুপ করে থেকে খাটো গলায় জিজ্ঞাসা করল, যাবার দিন সকালে তোমার বউয়ের কি মনে পড়েছিল বলেছিলে সেই একদিন—কি বলে গেছল?

—আপনাকে মনে পড়েছিল। বলেছিল, যদি পারো তাঁর খোঁজ কোরো। তুমি যা বলেছিলে ততো বড়টি যদি উনি হয়ে থাকেন, আমার কথা বলে মদনের ভার তাঁর হাতে ছেড়ে দিও—উনি একভাবে না একভাবে ঠিক ওকে মানুষ করে দেবেন।

বাপী স্থাণুর মতো বসে রইল। অনেকক্ষণ বাদে জিজ্ঞাসা করল, তুমি সেই ব্রুকলিনের চাকরি করছ এখনো?

বিষণ্ণ মুখে রতন মাথা নাড়ল। করছে না। পরে আস্তে আস্তে জানালো, মারা যাবার পরেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কিচ্ছু ভালো লাগত না, সর্বদা পাগল পাগল করত। তাছাড়া সে আপিসে গেলে ছেলে দেখে কে? সেই থেকে নিজের ভাগ্য পুড়িয়ে লোকের ভাগ্য দেখাই পেশা তার। ঘরে বসেই এ-কাজ করত। কিন্তু বস্তিঘরে কোন্ পদের খদ্দেরই বা আসবে। গোড়ায় গোড়ায় যা-ও চলত, এখন আর চলছেই না। ছেলেটা বিনে পয়সায় করপোরেশনের স্কুলে পড়ে—কিন্তু সেখানে পড়া যে কি হয় তাও ভালই জানে।

বাপী উঠে পায়চারি করল খানিক। রক্তশূন্য মুখ। শোবার ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে আবার ফিরে এলো। রতনের ছেঁড়া কোর্তার দু পকেটে দু তোড়া নোট গুঁজে দিল। বলল দুই হাজার টাকা আছে, এখন এই দিয়ে চালাও। ছেলের ভার আমি নেব, কিন্তু এখনো মাসখানেক মাস-দেড়েক আমি বেরুতে পারব না—তাছাড়া ডিসেম্বর মাসটা না গেলে কোনো স্কুলে নতুন করে ভর্তি হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তোমার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, ব্যস্ত হবারও দরকার নেই—সময়মতো ব্যবস্থা যা করার আমিই করব—আমিই তোমাকে খবর দেব।

বলার পরেই ভিতরে বৃশ্চিক দাহ। যে গোপনতার পর্দা ছিঁড়েখুঁড়ে ভিতরের মানুষটা বেরিয়ে আসতে চায়, তাকে আরো আড়ালে টেনে নিয়ে যাওয়া হল।

রতন বণিক হঠাৎ কেঁদে ফেলে বাপীর দু হাত ধরল।

হাত ছাড়িয়ে বাপী ভিতরে চলে গেল।

জানুয়ারির মাঝামাঝি, ব্যবস্থা যা করার নিঃশব্দেই করে ফেলল। বাপী অনেকটা নিশ্চিত।

কিন্তু আরো পনেরটা দিন না যেতে এই ব্যবস্থা যে-ভাবে পণ্ড হয়ে গেল, বাপী নিজেই হতচকিত, বিমূঢ়

মিষ্টি নিচের আপিস ঘরে ছিল। সাড়ে তিনটে না বাজতে উঠে এলো। বাপী খাটে শুয়ে বই পড়ছিল। বই সরাল। মিষ্টির অবাক মুখ।

—দিন পনের আগে তোমার সেই পিওন রতন বণিকের ছেলেকে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলে—আর তুমি গার্জেন হয়ে তাকে হস্টেলে রেখে এসেছিলে?

বই রেখে বাপী উঠে বসল। হিসেবের বাইরে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে। হঠাৎ ঠাণ্ডা একটু। সংযতও।—হ্যাঁ। কেন?

—এই শরীর নিয়ে তুমি এত-সব করেছ, আমাকে বলোনি তো?

—আমার শরীর খুব ভাল আছে।…তোমাকে কে বলল?

—রতন নিজেই। ছেলে নিয়ে ওই হলঘরে বসে কান্নাকাটি করছে— দেখগে যাও।

—কান্নাকাটি করছে কেন?

জবাব দেবার আগে শরীরটা কতটা ভাল আছে মিষ্টি তাই দেখে নিল কিনা বোঝা গেল না। বলল, ছেলে কাউকে কিছু না বলে কাল সকালে হস্টেল ছেড়ে এত পথ হেঁটে ঘরে চলে এসেছে। পথ ভুল করার জন্য আসতেও অনেক সময় লেগেছে। রতন বিকেলের মধ্যেই নরেন্দ্রপুর ছুটে গেছল, কিন্তু সেখানকার মহারাজদের হাতে-পায়ে ধরেও ফল হয় নি—তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এ—ছেলেকে আর রাখা সম্ভব নয়।

বাপী হতভম্ব। খাট থেকে নেমে এলো। হলঘরে এলো। পিছনে মিষ্টি। বিষণ্ণ পাংশু মুখে রতন মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরে ছেলেটা ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে। বাপীকে দেখে রতন উঠে দাঁড়াল। সত্যি কাঁদছে। হাতজোড় করে বলল, আমাকে আপনি শুধু মাপ করে দিন বিপুলবাবু—খুব আক্কেল হয়েছে— গরিবের ছেলে মানুষ করার সাধ মিটেছে।

বাপী সোফায় বসল। থমথমে মুখ। কিন্তু তার পরেই কেন যেন অত রাগ আর থাকল না, ছেলেটার দিকে অপলক চেয়ে রইল খানিক। তারপর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে সামনে হাত পাতল। বলল, ওর কান দুটো ছিঁড়ে এনে আমাকে দাও তো।

ছেলেটা ভয়ে ভয়ে দু পা সরে গেল। কান ছিঁড়তে যাকে বলা হল সে আসছে কিনা দেখে নিল। ঘাড় ফিরিয়ে খোলা দরজা দুটোর দিকেও তাকালো একবার সত্যি কেউ কান ছিঁড়তে এলে পালাবার পথ আছে কিনা দেখে রাখল।

বাপীর হঠাৎ হাসিই পাচ্ছে কি রকম। কিন্তু গম্ভীর তেমনি। ছেলেটা ঘাবড়েছে, কিন্তু গোঁ-ধরা মুখ। একটা আঙুল তুলে মুখোমুখি সামনের সোফাটা দেখাল।— ওখানে বোস্।

ছেলেটা মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়েই রইল। রতন মারতে এগলো।— হারামজাদা, এর পরেও কথা কানে যাচ্ছে না তোর—তোকে আমি আস্ত রাখব!

—রতন!

ছেলের পিঠে নেমে আসার আগেই রতন বণিকের হাত থেমে গেল।

বাপী বলল, আমি যেখানে ভার নিয়েছি সেখানে তোমার শাসনের আর দরকার নেই! ছেলের দিকে ফিরল।—আমি এক কথা দুবার বলি না মনে থাকে যেন। বোস্ ওখানে।

এঁকে-বেঁকে ছেলেটা সোফার সামনে গেল। বসল। কিন্তু বসার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কৌতুকের ব্যাপার ঘটল যেন। বসার জায়গা এমন হয় তার ধারণার বাইরে। নিজের অগোচরেই আধাআধি দাঁড়িয়ে আবার বসল। তারপরেই অপ্রস্তুত মুখে ভয়ে ভয়ে বাপীর দিকে তাকালো। নরম গদীর লোভে আবার ওঠা আর বসাটা ভাল কাজ হল না নিজেই বুঝছে।

মিষ্টি চেষ্টা করে হাসি চাপল। বাপী আড়চোখে একবার তাকে দেখে নিল। তেমনি গম্ভীর। রতনের দিকে ফিরে একটু গলা চড়িয়ে বলল, তুমি কিছু ভেবো না—এ-বয়সে ওর থেকে আমিই ঢের বেশি বাঁদর ছিলাম, বিশ্বাস না হয় তোমার রাজরাণীকে জিগ্যেস কর। ওকে ঢিট করার ব্যবস্থা আমি করছি—ও আর কোথাও যাবে না, এখানে থাকবে।

মিষ্টি অবাক। রতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না।

বাপীর দু চোখ রতনের মুখের ওপর।—তুমি চলে যাও এখন। আমার ওপর বিশ্বাস রেখে ছমাসের মধ্যে আর এ-মুখো হবে না। তারপর ইচ্ছে হয়, দেখে যেও—কিন্তু এখন শিগগীর না!

রতন বোকা আদৌ নয়। অকুলপাথার থেকে উঠে এলো। মিষ্টি কিছু বোঝার আগেই চট করে এগিয়ে এসে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠল। তার পর খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল।

ছেলেটা তক্ষুনি উঠে দাঁড়িয়েছে। পিছনে ছোটার ইচ্ছে। তার আগেই ধমক খেয়ে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল।

—বোস্।

বসে পড়ল।

মিষ্টি আর চুপ করে থাকতে পারল না।—–কি ব্যাপার?

—শুনলে তো। ঘাড় ফিরিয়ে হাঁক দিল, বাচ্চু!

ভিতরের ঘর থেকে বাচ্চু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। কলেজে পড়ছে। সুঠাম স্বাস্থ্য।

বাপী বলল, এখন থেকে এই ছেলেটা আমাদের এখানে থাকবে। ওর নাম মদন। কাল-পরশুর মধ্যে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দিবি। আর সব ব্যবস্থা আমি করছি। ওকে নিয়ে যা—

বাচ্চু অবাক একটু হল বটে, কিন্তু কিছুই জিগ্যেস করল না। এই কাকার বুকের খবর সে রাখে। এত শ্রদ্ধাও বোধ হয় দুনিয়ায় আর কাউকে করে না। মদনের হাত ধরে ভিতরে চলে গেল।

চোখ মুখ ভালো করে লক্ষ্য করে মিষ্টি তেমন জেরা করতে ভরসা পেল না। তার অনুমান প্রেশার একটু-আধটু বেড়েছে। শুধু মন্তব্যের সুরে বলল, ব্যবস্থাটা আর একটু-ভেবে-চিন্তে করলে হত না?

—কেন?

—পিওনের ছেলের সঙ্গে লেপটে থাকতে বাচ্চুর ভালো না-ও লাগতে পারে।

—লেপটে থাকতে হবে কেন? এ বাড়িতে ঘরের অভাব নাকি? আর ওই পিওন না থাকলে দুঃসময়ে তার কাকার অস্তিত্ব থাকত না এ কথাটা বাচ্চুকে জানিয়ে দিতেই বা তোমার অসুবিধে কি?

মিষ্টি চেয়ে রইল শুধু। এ-চাউনির অর্থ বাপীর কাছে দুর্বোধ্য নয় একটুও। যার জন্যে এত দরদ, দুঃসময়ে যারা এত করেছে—এতগুলো বছরের মধ্যে তাদের কথা একবারও মনেও পড়ে নি কেন? গাড়িতে পনের মিনিটের পথ…একটা খবর পর্যন্ত নেওয়া হয় নি কেন?

বাপী সোজা হয়ে বসল একটু। এই নীরব প্রশ্নের জবাব দেবে? গোপনতার অন্ধকার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার এমন সুযোগ আর পাবে? জবাব দেবে? দেবে দেবে দেবে?

কিন্তু অদৃশ্য কেউ গলা চেপে ধরেছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসচে।

মিষ্টি তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এলো।—ঠিক আছে, যা করেছ বেশ করেছ, এখন ওঠো তো, মাথা ঠাণ্ডা করে চুপচাপ খানিক শুয়ে থাকো।

.

এক মাসের মধ্যে মদনের বাইরের ভোল বদলে গেল। কেউ দেখলে বুঝবে না ও এ বাড়ির ছেলে নয়। এমন চকচকে জামা প্যান্ট জুতো আগে চোখেও দেখে নি। তার আলাদা ঘর, আলাদা পড়ার ব্যবস্থা। দুবেলা দু’জন মাস্টারের কাছে পড়তে হয়। স্কুলবাসে যায় আসে। এমন তোয়াজে থাকার ফলে এরই মধ্যে ছেলেটার কচি মুখের শ্রী আরও ফিরে গেছে। মিষ্টিও লাগে। কিন্তু পিওনের ছেলের জন্য যা করা হচ্ছে তা খুব স্বাভাবিক মনে হয় না তার। ঘরের লোক যা করছে ঝোঁকের বশে করছে ভাবে।

বাপীও ছেলেটাকে লক্ষ্য করে। নিজে কাছে আসে না। কাছে ডাকে না। কিন্তু কিছুই চোখ এড়ায় না। একটা দুরন্ত খাঁচায় এনে পোরা হয়েছে। ফাঁক পেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারে। তক্ষুনি নিজের সেই দুরন্ত ছেলেবেলা চোখে ভাসে। একেবারে জাহান্নামেই যাবার কথা। যায় নি কারণ মাথার ওপর বাবা ছিল, আগলে রাখার মত পিসী ছিল, আর মিষ্টি নামে এক মেয়ের কাছে পৌঁছনোর একাগ্র লক্ষ্য ছিল। এই ছেলের কি আছে? কে আছে? ভেসে গেলে স্রোতের মতো ভেসে যাবে। ভাবতে গেলেও ভিতরটা ধড়ফড় করে ওঠে বাপীর।

দিন গড়ায়। মাস গড়ায়। একে একে দুটো বছরও গড়িয়ে গেল। বাপীর বয়েস এখন সাঁইত্রিশ। কিন্তু মনে হয় এই দেহ-পিঞ্জরের অন্ধকারে সুড়ঙ্গ-গহ্বরে অনন্তকাল ধরে কেউ গুমরে মরছে, বেরিয়ে আসার জন্য মাথা খুঁড়ছে। যতদিন পর্যন্ত কিছু লক্ষ্য ছিল, খোঁজা ছিল, শুধু ততদিনই বাঁচার মত বেঁচেছিল। লক্ষ্যের শেষ, খোঁজার শেষ মানেই মৃত্যু। এই মৃত্যু জীবনের শেষ কথা হতে পারে না, এ-বিশ্বাস এখন বদ্ধমূল। কিন্তু সামনে কে এগোবে? কে খুঁজবে? যে এগোবে যে খুঁজবে সে তো এক মিথ্যেকে আশ্রয় করে গোপনতার অন্ধকার কবরের তলায় ঢুকে বসে আছে।

বাপী খুব আশা করেছিল, এখানে চোখের ওপর থেকে ছেলেটা মিষ্টির মন কাড়বে। মিষ্টির মন ওকে ঘিরে একটু একটু করে মায়ের মন হয়ে উঠবে। তখন বাপী এই গোপনতার কবর থেকে বেরিয়ে আসার কোন না কোন পথ একদিন পাবেই।

তা হল না। মিষ্টির কর্তব্যে ত্রুটি নেই। কিন্তু বাচ্চু যত কাছের, এই ছেলে তার ধারে-কাছেও না। দিন কয়েক আগে বলেছিল, স্কুল-কলেজের গরমের ছুটি চলেছে, বাচ্চু ক’দিনই দেখেছে দুপুর রোদে মদন বয়সে বড় বাজে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছে নয়তো আড্ডা দিচ্ছে—ডাকলেও ওর কথা শোনে না তুমি ডেকে একটু ধমকে দিও তো।

শোনামাত্র বাপী তেতে উঠেছিল।—কেন, তুমি কিছু বলতে পারো না? তুমি ধমকে দিতে পারো না?

মিষ্টির সাফ জবাব, পরের ছেলেকে নিয়ে তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ—যা করার তুমিই করো।

বাপীর তক্ষুনি মনে হল, মিষ্টির চোখে এই পরের ছেলের সঙ্গে বাচ্চুর মতো পরের ছেলের অনেক তফাৎ। পিওনের বস্তিঘর থেকে এসেছে বলে শাসনের মর্যাদা দিতেও আপত্তি। সেদিনের মাত্রা ছাড়া শাসনের মুখে মিষ্টিই আবার বাধা দিয়েছে। বেশি উত্তেজনার ফল জানে। মদনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাপীকে বলেছে, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। তুমি চাইলেই—

থেমে গেছে। সে চাইলেই বস্তিঘরের ছেলের স্বভাব এত সহজে বদলাবে না বলতে যাচ্ছিল বোধ হয়। তারপর দেড়-দুমাসের মধ্যে বাপী তার মুখে এই ছেলের ভালোমন্দ সম্পর্কে কোনো কথা শোনে নি।

.

…তারপর সমস্ত সত্তা দুমড়নো যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বাপীর মুক্তির দিন। গোপনতার শেষ। বাষট্টি সালের জুলাইয়ের দু’তারিখ সেটা।

আগের দিনটা, অর্থাৎ পয়লা জুলাই, দেশের—বিশেষ করে এই বাংলার বিরাট শোকের দিন। ডাক্তার বিধান রায় নেই। বেলা বারোটার পাঁচ মিনিট আগে তাঁর জীবনদীপ নিভেছে। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন। এই দিনেই চলে গেলেন। বাপীর ভিতরটা বিষাদে ছাওয়া। দোষ-গুণ নিয়ে মাটির এমন বিরাট পুরুষ আর কে থাকল?

পরদিন।…অর্থাৎ আজ সকাল। তাঁকে নিয়ে মহাযাত্রা শুরু হয়েছে। তাঁকে শেষ দেখা দেখতে কাতারে কাতারে মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাপীও ঘরে বসে থাকতে পারে নি। পায়ে হেঁটেই রাস্তার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। মহাযাত্রা এগিয়ে গেল। বাপী দেখছিল, দেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। চোখের জলে তারা শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।

বাপী ফিরে চলেছে। এ-ও মৃত্যু কি মুক্তি, ভাবছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে হঠাৎ কিছু চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। রাস্তার ও-ধারে পানের দোকানের সামনে চোদ্দ থেকে সতের আঠের বছরের চার-পাঁচটা ছোকরা জটলা করছে আর সিগারেট টানছে। তাদের মধ্যে মদন! তার মুখেও সিগারেট।

বাপী নিঃশব্দে রাস্তা পেরুলো। ডানা ধরে হিঁচড়ে ওকে রাস্তার এ-পারে নিয়ে এলো। ছেলেটা যমের মুখে পড়েছে বুঝছে। বাড়ি। জামার মুঠো ধরেই বাপী তাকে দোতলায় বড় ঘরটায় এনে ফেলল। তারপর পায়ের থেকে জুতো খুলে এলোপাতাড়ি পিটতে লাগল।

ভিতর থেকে মিষ্টি ছুটে এলো। বাচ্চুও। কিন্তু বাপীর মাথায় খুন চেপেছে। গড়াগড়ি খাচ্ছে ছেলেটা কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বার করছে না। ওকে একেবারে শেষ না করে বাপী থামবেই না। মিষ্টি কয়েক পলক বিমূঢ়। সত্রাসে এগিয়ে এসে তাকে থামাতে চেষ্টা করল, দু’হাতে আগলে রাখতে চেষ্টা সরল। চেঁচিয়ে বলে উঠল, বাচ্চু, মদনকে তুলে নিয়ে শিগগীর ঘরে চলে যা!

বাচ্চু তাই করল। বাপী হাঁপাচ্ছে। চাউনিও অস্বাভাবিক।

হাত থেকে জুতোটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মিষ্টি আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? ও কি করেছে?

জ্বলন্ত চোখে তার দিকে চেয়ে বাপী জবাব দিল, রাস্তায় ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট টানছিল…।

শোনামাত্র মিষ্টিও রেগে গেল কি রকম। বলে উঠল, ছোটলোকের ছেলে, বিড়ি সিগারেট খাবে বেশি কথা কি? তা বলে তুমি এত ক্ষেপে গিয়ে নিজের ক্ষতি করবে কেন?

—কি বললে? প্রাণপণ চেষ্টায় বাপী সংযত করতে চাইল নিজেকে। কিন্তু ভিতরে ভূমিকম্প হচ্ছে। গোপনতার কবরটা সরার আগে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।—ও ছোটলোকের ছেলে হলে সেই ছোটলোক আমি।…ও আমার ছেলে।…শুনতে পাচ্ছ? বুঝতে পারছ? সেই ছোটলোক আমি!

টলতে টলতে বাপী নিজের ঘরে চলে গেল।

মিষ্টি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। দু কানের পরদা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু মগজে কিছু ঢুকছে না। একটু বাদে পায়ে পায়ে সে-ও ঘরে এসে দাঁড়াল। বাপী খাটের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে বসে আছে। উদ্‌ভ্রান্ত চাউনি। এই মুখের দিকে চেয়ে অশুভ আশংকায় মিষ্টির ভিরতটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। নিজের অগোচরে দু’পা এগিয়ে এলো।

বাপীর ঘোরালো চাউনি।—কি শুনলে? কি বুঝলে?

মিষ্টি বিড়বিড় করে বলল, এসব কথা থাক এখন…।

—আর থাকবে না। অনেক থেকেছে। উঠে নিজেই দরজা দুটো ভেজিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল।—তোমাকে বলতে না পেরে প্রায় তিন বছর ধরে আমি মৃত্যু—যন্ত্রণা ভোগ করছি। অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। তোমার আমার মধ্যে গোপনতা থাকবে না বড়াই করে বলেছিলাম—তার শাস্তি ভোগ করছি।…শোনো, আজ আবার বলছি, আমার যা-কিছু ভালো, যা-কিছু মন্দ—সব তোমার জন্যে—শুধু তোমার জন্যে।…লোক ডেকে নিয়ে গিয়ে তুমি আমার সমস্ত স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছিলে মনে পড়ে? অসিত চ্যাটার্জি আর তার সঙ্গের জনাকতকের অপমানে আমার মাথা মুড়িয়ে দিয়েছিলে, মনে পড়ে?

মিষ্টি বিমূঢ় মুখে চেয়ে আছে। নিজের অগোচরে মাথা নেড়েছে কিনা জানে না।

—সেই রাতে আমি পাগল হয়ে গেছলাম। সমস্ত মেয়ে জাতটাকে ভস্ম করে ফেলতে চেয়েছিলাম। সেই রাতে কমলা বণিক এসেছিল। আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। অন্ধকারের জানোয়ার শুধু তোমার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মাথা খুঁড়ছিল। সেই অন্ধকারে তোমার বদলে কমলা এসেছিল। সে আমাকে চায়নি ছেলে চেয়েছে। রতন বণিক তার দিদিকে ছেলে দিতে পারে নি, তাকেও দিতে পারবে না বুঝেছিল। আরো দু’রাত আমিই শুধু নরকে ডুবেছিলাম, তারপর চাবুকে-চাবুকে নিজেই নিজেকে রক্তাক্ত করেছি—সজাগ করেছি। পালিয়ে গেছি। কিন্তু কমলাকে ঘৃণা করতে পারি নি। যাবার আগে ও বলেছিল, এরপর তুমি কেবল আমাকে ঘেন্নাই করবে জানি, কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে পুজো করেই যাব, আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমাকে ভালো রাখে।

মিষ্টি চেয়ে আছে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে এবার তারও জগৎ ভাঙছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কানে যা শুনল তা তলিয়ে ভাবার ফুরসৎ পেল না। তার আগে ভিতরে এ কিসের ঢেউ? ঘৃণা? বিদ্বেষ? সব থেকে বেশি— অবিশ্বাস?

মিষ্টি একরকম ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাপী খাটে বসল। শুয়ে পড়ল। দু’চোখ আপনা থেকে বুজে এলো। চোখের সামনে অন্ধকারের সমুদ্র। অথচ আশ্চর্য! এই সমুদ্র সে অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে আলোর তট উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সব অন্ধকারে খসে খসে দূরে সরে যাচ্ছে!

মিষ্টি বাচ্চুকে বলেছে ডাক্তার ডাকতে। ডাক্তার এসেছে। দেখে গেছে। আবার ই সি জি করা হয়েছে। তার ফল কি বাপী জানে না। কৌতূহলও নেই। ওরা কেন এত করছে ভেবে পায় না। এত ভালো কি বাপী জীবনে থেকেছে? সাতদিনের মধ্যে মিষ্টি একটা কথাও বলে নি। কিন্তু কাছে এসেছে। কর্তব্য করেছে। রাতের জন্য আবার নার্স এনেছে। বাপী না ঘুমনো পর্যন্ত নিজেও ঘরে থেকেছে। তারপর চলে গেছে। ও প্রচণ্ডভাবে নিজের সঙ্গে যুঝছে, বাপী বুঝতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য, তার জন্যও বাপীর ভিতরে এতটুকু উদ্বেগ নেই। আজ হোক বা দু’দিন বাদে হোক, মিষ্টি ওকে বুঝবেই। না বুঝে পারে না। না বোঝা মানে সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থাকা যায় না।

…সকাল থেকেই বাপীর চোখ-মুখের চেহারা সেদিন অন্যরকম। ভিতরে যেন এক অবাক-করা আনন্দের ফোয়ারার মুখ খুলে গেছে।…কিন্তু মিষ্টি জিত্ বাচ্চু তার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝছে? কি বুঝছে? বাপীর হাসি পেয়ে গেল। ওরা ঘাবড়াচ্ছে। আনন্দের ছিটেফোঁটাও টের পাচ্ছে না।

মিষ্টি সারাক্ষণ প্রায় কাছে কাছে আছে। দু-বার করে ডাক্তার এসে দেখে গেল। ডাক্তারের মতে প্রেশার বোধ হয় বেশি হাই। বাপীর হাসি পাচ্ছে। হাতের খোলা বইটা খোলা অবস্থাতেই উল্টে রেখে সকলের মুখগুলো দেখতে লাগল।

বিকেল। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য মিষ্টি ঘর ছেড়ে গেছল। ফিরে এসে মিষ্টি দেখল বিছানা খালি। খোলা বইটা তেমনি উপুড় করা। ভাবল বাথরুমে গেছে। উঠে তাও যাবার কথা নয়।

মিষ্টি বইটা তুলে নিল। সকাল থেকে মোটা কালিতে লাল দাগ মারা একটা জায়গায় বহুবার করে পড়তে দেখেছে লোকটাকে। পড়েছে। তারপর চোখ বুজেছে। আর নিজের মনেই যেন হেসেছে। হাসিটা যে কি রকম অদ্ভুত লেগেছে মিষ্টির।

এখনো সেই লাল দাগ-মারা পাতা। মিষ্টি পড়ল। ছাপা অক্ষরে ছোট ছেলেদের উপকথার মতো গল্প একটু।

—‘গরিব কাঠুরে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গেছল আর মনে মনে দুরবস্থার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত করেছিল। সাধুর রূপ ধরে ভাগ্য এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল, এগিয়ে চল, এগিয়ে চল—পেয়ে যাবি। সাহস করে কাঠুরে সেদিন অনেক দূরে চলে গেল। তারপর অবাক কাণ্ড। সামনে মস্ত একটা চন্দনের পাহাড়। আনন্দে কাঠুরের পাগল হবার অবস্থা। তার দিন ফিরেছে। চন্দন কাঠে থলে বোঝাই করল। আর ভাবল, আস্তে আস্তে সমস্ত পাহাড়টাই তুলে নিয়ে যাবে।

কিছুদিন বাদেই কাঠুরের মনে হল, সাধু তো তাকে থামতে বলে নি— এগিয়ে যেতে বলেছিল। সামনে কি তাহলে আরো বেশি লোভের কিছু আছে নাকি? এগিয়ে চলল। এবারে টাকার পাহাড়। কাঠুরে আনন্দে দিশেহারা। দিন-কতক পাগলের মতো টাকা তোলার পর আবার সেই কথাই মনে হল। সাধু সামনে এগোতে বলেছিল। সামনে আরো কি? আবার চলল। এবারে সোনার পাহাড় তারপর অবার সেই। আরো সামনে কি? হীরে মুক্তো মানিকের পাহাড়! ব্যস, চাওয়ার বা পাওয়ার আর কি থাকতে পারে।

কিছুকাল মত্ত আনন্দে কাটানোর পর বিবেকের আবার সেই তাড়না। সাধু থামতে বলে নি। এগোতে বলেছিল। কিন্তু যা পাবার সব তো পেয়ে গেছে। আর কি পাবে? কোন দিকে এগোবে? বাইরে আর এগোবার কোনো দিক নেই নিজের ভিতরের দিকে চোখ গেল তার। কাঠুরে সেই পথ ধরে এগোতে লাগল। তারপর কি আশ্চর্য? সেখানে যে ঐশ্বর্য—তার আভাতেই যে দুচোখ ঠিকরে যায়! এমন ঐশ্বর্য যে তার চারিদিকে জ্যোতির সমুদ্র।

খোলা বইটা মিষ্টি তেমনি উল্টে রেখে দিল। একটু বাদেই খেয়াল হল, বাথরুমের এদিকে ছিটকিনি টানা। অর্থাৎ সেখানে কেউ নেই। ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল। সব কটা ঘর খুঁজল নেই। নিচে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে চলল। মাস কয়েকের মধ্যে নিচে নামতে দেখে নি। ছাদে বেড়াতে দেখেছে।

তাই। লম্বা ছাদের এ-মাথা ও মাথা করছে। নড়াচড়া একেবারে বারণ! বাপী দেখতেও পেল না। আর একবার ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চলে গেল।

ফিরছে। মিষ্টি সামনে মুখোমুখি এগিয়ে গেল। বাপী থমকে দাঁড়াল। মুখে আলগা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। চোখ অস্বাভাবিক চকচক করছে। অনেক দূরের কোথাও থেকে ফিরল যেন। ভালো করে দেখতে লাগল। খুব নরম গলায় বলল, মিষ্টি অবিশ্বাস কোরো না, অবিশ্বাস করে কষ্ট পেও না

মিষ্টির বুকের তলায় মোচড় পড়ছে। একটা অজ্ঞাত ভয় তাকে ছেঁকে ধরেছে। এক হাতে বাপীর একটা হাত ধরল। অন্য হাতে শক্ত করে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছে, চলো—

মিষ্টির মনে হতে লাগল সিঁড়িগুলো বুঝি আর ফুরোবে না। একটু চেঁচিয়েই বলে উঠল, দেখে পা ফেলো—কাঁপছ কেন?

বাপী টেনে টেনে হেসে হেসে জবাব দিল, আনন্দে আনন্দে।

টের পেয়ে বাচ্চুও ছুটে এসেছে। ধরাধরি করে দুজনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মিষ্টির চোখের ইশারায় বাচ্চু ডাক্তারকে ফোন করতে ছুটল।

বাপী বেশ আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে শুলো। চোখ বুজল। ঠোঁটে হাসি।

.

কি একটা চমকের মধ্যে ঘোর কেটে গেল তার। মাঝে কতক্ষণ বা কটা দিন গেছে ঠাওর করতে পারছে না। ঘর ভরতি লোক। একটা অস্পষ্ট কোলাহলের মতো কানে আসছে। কি কাণ্ড, আবু রব্বানীর সঙ্গে এবারে দুলারিও এসেছে! কিন্তু এত আনন্দের মধ্যে ওদের চোখে জল কেন? ঘরের মধ্যে জিত্ মালহোত্ৰা… শ্বশুর শাশুড়ী দীপুদা…বাচ্চু, দরজার কাছে মদন…বিছানায় মিষ্টি। মিষ্টি চেঁচিয়ে বলছে কিছু। ও এত কাছে…কিন্তু কথাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে মনে হচ্ছে কেন? মিষ্টি বলছে আমার সব ভুল ভেঙে গেছে, আমি আর কক্ষনো তোমাকে অবিশ্বাস করবে। না, মদন আমার কাছেই থাকবে, আমাকে মা বলে ডাকবে—শুনছ?

…ভালো কথা তো! এত ভালো আর কি হতে পারে? কিন্তু মিষ্টি কাঁদছে কেন? কান্না বাপীর কোন দিন ভালো লাগে না।

…এ কি! এ যে আরো অবাক কাণ্ড! এত কাছের এই মানুষগুলো এতদিন ছিল কোথায়? তারা এত সুন্দরই বা হল কি করে?

—বাবা! আমার দিকে চেয়ে এভাবে দেখছ কি? আর আমার একটুও রাগ নেই তোমার ওপর!

—পিসী? কত দিন দেখো নি আমাকে আচ্ছা জব্দ! আর পালাবে?

—বাঃ! রেমশা! দুষ্টু মেয়ে—এমন করে? সাপের কামড়ের আর একটুও জ্বালা-যন্ত্রণা নেই তো?

—আর একজন…ঠিক এক রকমই আছে, এই মুখ বাপী কখনো ভুলতে পারে?…ঠোঁটের ফাঁকে চুল-চেরা হাসি, দাপটের চাউনি…কিন্তু মুখখানা গায়ত্রী রাইয়ের অত ফ্যাকাশে নয় আর, লালচে। গায়ত্রী মা, তোমার মেয়ে-জামাই খুব ভালো আছে, সুখে আছে—ফুটফুটে একটা নাতনি হয়েছে তোমার জানো তো?

—আমি খুব…খুব অন্যায় করেছি মাস্টারমশায়—কিন্তু আপনি তবু আমাকে বকছেন না কেন? অত হাসছেন কেন?

…সকলের সঙ্গে দেখা হল খুব ভালো হল। কিন্তু তার কি বসে থাকার জো আছে…খুঁজতে হবে না? সামনে এগোতে হবে না? পেতে হবে না? চন্দন কাঠের পাহাড়, টাকার পাহাড়, সোনার পাহাড়, হীরে-মণি-মুক্তার পাহাড়ের পর আর কি কোনো ঐশ্বর্য নেই নাকি? সেই সোনার হরিণ চাও তো ভিতরে খোঁজো। বাইরে কোথাও নেই। বাপী তার আভা দেখেছে, জ্যোতি দেখেছে। বাপী চেয়েছে অথচ পায় নি এমন কিছু আছে?

না, বাপী তরফদারের থামার সময় নেই।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments