Monday, August 25, 2025
Homeবাণী ও কথাশেষ চুরি - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

শেষ চুরি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আংটিটা খুব সুন্দর! বেশ ভারী। এক ভরির বেশি সোনা। টালি ডিজাইন। চার চৌকো জায়গাটায় আমার নামের আদ্যক্ষর মিনে করা। মা বললে, ‘জিনিসপত্রে তোর যা যত্ন, হারাতে বেশিদিন লাগবে না।’ আংটিটা বড়মামা দিয়েছেন। যথেষ্ট বড়লোক। গাড়ি আছে। ব্যাবসা আছে। অহংকার নেই। আমাকে পছন্দ করেন। মামার বাড়িতে কখনও গেলে ভালো-মন্দ খুব খাওয়ান। নিজে খুব ভালো রান্না করতে পারেন। একটাই গান জানেন—’জনগণমন’। মাঝে-মাঝে বেশ কিছুদিনের জন্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান। কোনও পাহাড়ের গুহায়—ভগবানের সঙ্গে গল্প করতে যান। আমাকে বলেছেন—ভালো করে লেখাপড়া করলে, ঠিক সময়ে একটা হিরের আংটি দেবেন। দেখা যাক, আমার কপালে কী আছে। মা মাঝে-মাঝে রেগে গিয়ে বলে, ‘তুই বাঁদর নাচওয়ালা হবি। ওইটাই তোর ভবিষ্যৎ।’ আমি বলি, ‘নট ব্যাড। পয়সা জমিয়ে তোমাকে আমি কাশীতে নিয়ে যাব। নিজের চোখে দেখে আসবে, বাঁদর কত ভগবান।’

শীতকালে পৈতে হল। ন্যাড়া মাথায় কচি-কচি খড়খড়ে চুল। দিদি দাড়ি চুলকোয়। কান দুটো ফুটো করা হয়েছিল। দুপুরবেলা দুল পরিয়ে বলে, ‘আয় তোকে কেষ্ট ঠাকুর সাজাই।’ দিদি। আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। আমিও। যে-জগতে দিদি নেই, সে-জগতে মানুষ বাঁচে কী করে! কে জানে! মা যখন আমাকে বকে দিদি কাঁদতে শুরু করে। মা বলে, ‘এ এক আচ্ছা জ্বালা হয়েছে।’

আগাপাশতলা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। শীত পড়েছে খুব। রানাঘাটের শীত। আমার লেপের খোলে ছোট্ট একটা ফুটো আছে। মাঝেমধ্যে তুলো বেরিয়ে আসে। তখন আঙুল দিয়ে ঢুকিয়ে দি। যতটা পারা যায় ভেতরে। আজও সেই কেরামতিটা করছিলুম। হঠাৎ মনে হল—আংটিটাকে লুকিয়ে রাখার নিরাপদ একটা জায়গা পেয়েছি। বেশ আরামেই থাকবে। সেই ফুটোর মধ্যে আংটিটাকে চালান করে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম। পাশেই দিদি শুয়ে আছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে। রোজ যা করি—কর্তব্যকর্ম—এইবার সেইটা করি। দিদির ঘুম ভাঙাই। সামান্য ব্যাপার নাকটা টিপে ধরলুম। তেড়েফুঁড়ে উঠে গুমগুম করে গোটাকতক কিল মেরে হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মস্ত বিনুনিটা সাপের মতো আমার লেপের ওপর। দিদি ঘুমোচ্ছ, তার বিনুনিও ঘুমোচ্ছে। কাঁথার বাইরে চলে এসেছে। শীত করছে না তো! লেপের তলায় গুঁজে রাখি। টান পড়েছে। ওপাশের মুখ ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠল, ‘আবার মার খাবি।’

আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ছাঁত করে ঘুমটা এক সময় ভেঙে গেল। রাত ক’টা কে জানে! রানাঘাটের শীত। দিদির গা থেকে কাঁথাটা সরে গেছে। টুকটুকে পা দুটো বেরিয়ে গেছে। ঠিকঠাক করে দিলুম। বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। আমাকেই বকছে, ‘পড়ে যাবি যে, মাথা মোটা।’

এখন দেখা যাক, আংটিটা কোথায় আছে, কেমন আছে। লেপের মধ্যে, তুলোর ভেতর। বাইরে থেকে টিপেটিপে দেখছি। কই শক্ত মতো কিছু ঠেকছেনা তো আঙুলে। কোথায় গেল? না, এখানে হবে না। লেপটাকে টেনে মেঝেতে ফেলি। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে টিপে দেখি। এ কী রে বাবা।

‘মাঝরাতে কী করছিস, পাগলা দাশু!’

খাটের পাশে দিদির মুখ আর বিনুনি ঝুলছে। সেই মুখের প্রশ্ন।

পাশের ঘরে বাবার নাক নানা সুরে ডাকছে। ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে রে দিদি। আমার আংটিটা লেপের ভেতর ঢুকে গেছে।’

‘ঢুকে গেছে, না ঢুকিয়েছিস? বাঁদর ছেলে।

‘বাঁদর, উল্লুক, ভাল্লুক, তোর যা খুশি তুই আমাকে বল। শুধু আংটিটা উদ্ধার করে দে ভাই। তোকে পান্তুয়া খাওয়াব। মা জানতে পারলে আমার পিঠের ছাল ছাড়াবে।’

দিদি ধুপ করে নেমে এল। ‘আলো জ্বাল।’

‘আলো জ্বাললে মা আসবে।’

‘অন্ধকারে হয় না কি?’

‘তুই এদিক থেকে ওদিক থেকে টিপেটিপে দেখ না।’

‘কোনখান দিয়ে ঢুকিয়েছিস?’

‘এই ফুটোটা দিয়ে।‘

‘উঃ, এই পৃথিবীতে কত রকমের হনুমান যে আছে। এ আর বেরোবে না। যেমন আছে থাক। মার গয়নার বাক্সে না থেকে এখানেই থাক। একই ব্যাপার। এখনও ভোর হতে দেরি আছে, চল, আর একটু ঘুমোনো যাক! বেশ ঠান্ডা!’

‘দিদি, তোর পায়ে পড়ি।’

‘আলো ফুটুক, তার পর দেখা যাবে। সমস্ত তুলো বের করে আংটিটাকে উদ্ধার করে তুলল ঢুকিয়ে সেলাই করে দেব। মা চোখ দেখাতে যাবে বাবার সঙ্গে, সেই সময় অপারেশন কমপ্লিট।’

‘দিদিরে, তোর কোনও তুলনা নেই।’

ভোরের ঘুম কি সহজে ভাঙে! দিদি আমাকে ঝাঁকাচ্ছে, ‘ওঠ, ওঠ। এ কী রে, রোদ উঠে গেছে।’

‘উঠুক গে।’

‘থাক তা হলে, আংটির কথা আমায় আর বলবি না।’

বেলা আটটার সময় রহিম চাচা এসে হাজির। ধুনুরি। ধনুকে টঙ্কার—থুং থুং শব্দ। সঙ্গে সহকারী। তুলোর বস্তা। নানারকমের কাপড়। টকটকে লাল সালু।

দিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে—’এ কী রে? রহিম চাচা কেন এল?

বাবার হুকুম সব লেপ তোশক রি-মেক করা হবে। অনেকদিন করা হয়নি। তুলো ড্যালা পাকিয়ে গেছে।

দিদি মাকে জিগ্যেস করল, ‘চোখ দেখাতে যাবে না।’

‘কার চোখ, কীসের চোখ?’

হয়ে গেল। সব লেপ ছাতে উঠল। এখনি তুলো ধোনা শুরু হবে। সেই পরিচিত শব্দ–ঠ্যাং ঠ্যাং ফ্যাত ফ্যাত।

‘এই দিদি। কী হবে?’

‘ঘাবড়াস না। ব্যবস্থা হচ্ছে।’

চাচার কানে-কানে কী বলে এল। ডাইনে বামে মাথা দুলল। প্রথমেই ধরল আমার সেই মূল্যবান লেপটা। ছাতের মাঝখানে তুলোর পাহাড়। তুলোর বিচির গড়াগড়ি। লাঠি দিয়ে, হাত দিয়ে তুল্লাস চলল। অতই সহজ!

দিদি বললে, ‘আংটিটা মনে হয় তুলো হয়ে গেছে।’

চাচা ভারি ভালো লোক। হাহা করে হেসে বললে, ‘হাঁ হাঁ, তুলো হোয়ে গেছে।’ এইবার যন্ত্র দিয়ে ধোনা শুরু হল—ত্যাং ত্যাং ফ্যাত ফ্যাত। আমরা দুজনে দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। কী হয়, কী হয়! ফ্যাটাস-ফ্যাটাস শব্দ। হঠাৎ ঝিলিক মেরে কী একটা উড়ে পাশের বাড়ির গ্যারেজের টিনের চাল গিয়ে পড়ল। ঠ্যাং করে শব্দ হল। ওই তো সেই আংটি।

বাড়িটা দুবছর তালা বন্ধ পড়ে আছে। মামলা চলছে। পাঁচিল টপকে ঢুকতে হবে। এসব কাজ চোরেরাই পারে। দিদি বললে, ‘তুই একটা চোর জোগাড় কর।’

‘কোথায় পাব?’

‘জেলখানায় চলে যা। কয়েকঘণ্টার জন্যে একটা চোর ভাড়া করে আন।’ আংটিটা টিনের চালে কাত হয়ে পড়ে আছে। এক জোড়া কাক বদ মতলবে ঘোরাঘুরি করছে। কী যে হবে ভগবানই জানেন।

দিদি বললে, ‘চল, লক্ষ্মীদাকে ধরি।’

লক্ষ্মীদা একসময় এ-তল্লাটের বিখ্যাত চোর ছিল। এমন কায়দায় চুরি করত পুলিশ প্রমাণের অভাবে দু-চার ঘা মেরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হত। তারপরে মানুষটা একবারে বদলে গেল। সাইকেল ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। খুব কষ্ট, কিন্তু আনন্দ। চোর হয়ে গেল সাধু।

লক্ষ্মীদা সব শুনে বললে, ‘ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুই নয়। ওই বাড়িতেও এক সময়ে আমি কাজ করেছি। সমস্যা একটাই, কোর্টে কেস। বাড়ির মালিক এখন সরকার। অনুমতি ছাড়া ঢুকলেই জেল। যদি ধরতে পারে। তবে তোমাদের আমি ভালোবাসি, চেষ্টা আমাকে করতেই হবে। আজ অমাবস্যা, রাত দুটোর সময় পেছন দিক দিয়ে ঢুকব।‘

রাত দুটো। দিদি আর আমি জেগে আছি। জানলার নীচে বসে মাথা উঁচু করে কাচের ভেতর দিয়ে দেখছি। টিনের চালে একটা লোক। টর্চলাইটের মুখে সাদা রুমাল বেঁধে চাপা আলোয় খুঁজছে। এত খোঁজার কী আছে। পায়ের কাছেই তো পড়ে থাকার কথা।

মানুষটা এক সময় অদৃশ্য হল।

দিদি বললে, ‘মনে হচ্ছে পায়নি। যাক গে। দামি আংটিটা তোর ভুলেই গেল। চল, শুয়ে পড়ি। ঘুমোলে দুঃখ ভোলা যায়।’ ভোর হতে না হতেই আমরা লক্ষ্মীদার চালায় গিয়ে হাজির।

‘কী গো পেয়েছ?’

‘অনেক কষ্টে। আংটিটা চালের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে গ্যারেজে পড়ে গেল। অন্ধকারে আমারই পায়ে লেগে। ওদের সেই বোকা-বোকা গোব্দা চেহারার মোটর গাড়িটা এখনও রয়েছে।’

‘তুমি ঢুকলে কী করে?’

‘অনেক দিন পরে আমার প্রতিভা বের করলুম। সিঁদ কেটে ভেতরে। গাড়ির চালে আংটিটা পড়েছিল। এই নাও। এর অনেক দাম। বেশ কয়েক ভরি সোনা আছে।’

‘তোমাকে কি দেব লক্ষ্মীদা? বলতে লজ্জা করছে।’

‘কিচ্ছু দেবে না। শুধু ভগবানকে বলো—আমার বউটা যেন বেঁচে যায়।’

‘কী হয়েছে?’

‘গরিবের যা হয়, টিবি। ভালো করে খেতে দিতে পারিনি কোনও দিনই। না খেয়ে আমার জন্যে খেটে মরেছে। কারখানা বন্ধ হল। চোর হলুম। বললে, চোরের ভাত খাব না। নিজেই কাজে বেরোল। একদিন আয়নায় নিজের মুখ দেখছি। আয়নার মুখটা বলে উঠল, কী রে! কী দেখছিস? চোরের মুখ। সেদিন ছিল অক্ষয় তৃতীয়া। বউটাকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে গেলুম মন্দিরে নয় গির্জায়। সেখানে কেউ বলবে না—ওই দেখ চোরের বউ কেমন সেজেছে। ক্রুশে ঝুলছেন যিশু।

তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বউয়ের পা ছুঁয়ে বললুম, ওগো শোনো, আজ থেকে চোর হল সাধু। এখন ও যদি চলে যায়, এই দুনিয়ায় আমার যে আর কেউ থাকবে না। তোমরা সেই ডাকাত ভগবানটাকে বোলো ভাই চোরের বউটাকে ছেড়ে দিতে। প্রায় তো মেরে এনেছি, আর তো ক’টা দিন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments