Monday, August 25, 2025
Homeবাণী ও কথারানু ও স্যর বিজয়শঙ্কর - সোমেন চন্দ

রানু ও স্যর বিজয়শঙ্কর – সোমেন চন্দ

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু সান্ধ্যভ্রমণ শেষ হয়নি। পার্কের যেদিকটা জনবিরল সেখানে কখনো লাল কাঁকরের পথে, কখনো নরম ঘাসের উপরে স্যর বিজয়শঙ্কর নীরবে পায়চারি করছিলেন। অদূরে মানুষের ভীড় থেকে, যানবাহন পীড়িত পথের চলায়মান জনতা থেকে, একটানা কোলাহল শোনা যায়। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল আলো এসে পার্কের দেহাবরণ খুলে সমস্ত প্রকাশ করে দিয়েছে।

স্যর বিজয়শঙ্কর নিজের মন এদিক-সেদিক হাঁটছিলেন।

-বাবা, ও বাবা!

কান্নায় বিকৃত একটি ছোট্ট মেয়েলি স্বর যেন কাছে কোথাও শোনা গেল! স্যর বিজয় থমকে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হলেন।

-আপনি আমার বাবাকে দেখেছেন?

মেয়েটি তাঁর কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে—ফ্রকপরা, স্যর বিজয়শঙ্কর চশমা-চোখে সেই স্বল্পালোকেই তাকে দেখলেন। ঘাড় পর্যন্ত চুল, দু-হাত আর পা নিরাভরণ, মুখ চোখের জলে ভেজা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদছে।

-বলুন না, আমার বাবাকে দেখেছেন?

স্যর বিজয় তার ছোটো একটি সরু হাত ধরে বললেন, তোমার বাবা বুঝি হারিয়ে গেছেন?

মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললে,—বাবা আমায় খুব ভালবাসে কি না, আমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে এমনি বেড়াতে আসি, আজও এলাম, কিন্তু বাবাটা কি দুষ্টু, আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেল, আমায় একবার ডাকলও না, আমি কত খুঁজলাম, এমন দুষ্টুমিতো বাবা কখনো করে না। আমি তো আর সব পথ চিনি না, কেমন করে বাবাকে খুঁজে বের করি! আপনি দেখেছেন আমার বাবাকে?

স্যর বিজয়শঙ্কর তার মাথায় হাত রেখে বললেন, দেখিনি, কিন্তু খুঁজে বার করে দেব, তুমি কেঁদো না খুকি। আচ্ছা, তোমার বাবার কেমন চেহারা বলো তো?

–আপনি যেমন লম্বা না, ঠিক এমনি লম্বা। কিন্তু আপনার মতো দাড়ি-গোঁফ নেই, আর থাকবেই বা কেন, আপনার মতো বুড়ো তো নয়—কিন্তু আমি একদিন দুপুরবেলা দেখেছি, মাথায় ছোটো একটা টাক, চুল পেকেছে খুব, আমি কত ফেলে দিই তবু পাকে!

কথার বেগে মেয়েটির কান্না কমে আসছিল। স্যর বিজয় পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে সস্নেহে মেয়েটির চোখের জল মুছে দিলেন। বললেন, খুকি, তুমি কেঁদো না। কোনো ভয় নেই, আমি তো আছি, তুমি কেঁদো না। আমি তোমার বাবাকে খুঁজে বার করে দেব।

মেয়েটি তাঁর মিষ্টি কথা শুনে, আর চেহারার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য দেখে কতকটা আশ্বস্ত হয়েছিল। ঘাড় কাত করে বললে, কলকাতার সব রাস্তা আপনি চেনেন?

কী একটু ভেবে স্যর বিজয় হেসে বললেন, তা নাহলে আর এত বুড়ো হলাম। কেমন করে বল? সব রাস্তা চিনি।

মেয়েটি মনে মনে তাঁর যুক্তি স্বীকার করল।

—রূপসিং?

–হুজুর?

স্যর বিজয়শঙ্কর মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, এসো।

প্রকান্ড গাড়ি। আর কেমন চকচক করে! মেয়েটি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। মাডগার্ডের ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, এটা আপনার গাড়ি! আমিও উঠব না?

—হ্যাঁ! স্যর বিজয় হাসলেন।

—কত দাম? তেমনি হাত বুলোতে বুলোতে সে জিজ্ঞাসা করলে।

স্যর বিজয় আবার হেসে বললেন, কুড়ি হাজার।

মেয়েটি আশ্চর্য হল না; কারণ কুড়ি হাজার কাকে বলে তা সে জানে না। কেবল চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগল।

–এসো। স্যার বিজয় ভিতরে গিয়ে বসে তাকে পাশে বসালেন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে বললেন, রূপসিং?

—হুজুর?

টাকা বার করে তিনি বললেন, কুছ টফি ঔর লজেন্স—

একটু পরে রূপসিং কতগুলো টফি আর লজেন্স এনে হাজির করল। সেগুলো সীটের একপাশে রেখে স্যর বিজয়শঙ্কর বললেন, তোমার ক্ষিদে পেয়েছে, না? খাও!

কিন্তু সেগুলো কয়েকটা হাতে নিয়ে মেয়েটি বসে রইল, আর তাঁর দিকে। তাকাতে লাগল—কেমন করে খাব?

স্যর বিজয় ওপরের কাগজ ছিড়ে তার মুখের কাছে ধরে হেসে বললেন, আচ্ছা, তোমার নাম তো বললে না?

—রাণু। মেয়েটি চিবুতে চিবুতে বললে।

রাজপ্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কক্ষসারির প্রতি জানালায় দেখা যায়। উজ্জ্বল আলো। কোলাহল নেই, স্তব্ধ পাষাণপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দু ধারে প্রকান্ড বাগান, চারিদিকে ঘিরে নীচু মেহেদির বেড়া, মধ্যে লাল পথ। বাতাসে নানা ফুলের সৌরভ। বিস্ময়ে অভিভূত রাণু প্রাণভরে সেই সৌরভ শুকতে লাগল। সে কী বলবে?

স্যর বিজয়শঙ্কর তার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। পায়ের নীচে রঙিন পুরু কার্পেট। রাণু নীচের দিকে চেয়ে-চেয়ে উঠতে হোঁচট খেল। আর, চারদিকে, কী আলো! মুক্তার মতো ঝরে পড়ে। জায়গায়-জায়গায় মানানসইভাবে ভাস্কর মূর্তি সাজানো। আর ঘরগুলো, যেন একেকটি মাঠ; কৌচ, আলমারি, নানা দামি আসবাবপত্রে ভরা, কেবল কার্পেটে মোড়া–কোথায় মেঝে? রাণু অবাক হয়ে ভাবে।

—এইখানটায় বসো। স্যর বিজয় একটা কৌচ দেখিয়ে দিলেন।

না ডাকতেই বয় এসে হাজির। স্যর বিজয়ের সিল্কের চাদর, জামা, লাঠি, জুতো ইত্যাদি খুলে রাখল।

দেখবার জিনিষের ভিড়ে রাণুর মনে সব জিজ্ঞাসা এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর দিকে গভীর দৃষ্টিতে কতোক্ষণ চেয়ে তারপর বললে, আচ্ছা আপনার দাড়ি এখান দিয়ে অমনি ছুঁচোলো হয়ে এসেছে কেন? রাণু নিজের ছোট্ট চিবুকটিতে হাত দিলে।

এরও আবার কারোর কাছে জবাবদিবি করতে হয়। স্যর বিজয়শঙ্কর হেসে বললেন, অমনি আমি ইচ্ছে করেই করি রাণু। একে ফ্রেঞ্চ-কাট বলে। তোমার ভালো লাগে না?

-না, একটুও না, কাউকে তো অমনি দেখিনি-রাণু হঠাৎ কিছুক্ষণ তাঁর মুখ আর মাথায় দিকে চেয়ে বললে, আচ্ছা আপনি তো বুড়ো ঠাকুদ্দা, আপনার চুল এত কালো কেন?

স্যর বিজয়শঙ্কর হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, আমি বুড়ো ঠাকুদ্দা নাকি? কিন্তু আমার যে ইচ্ছা করে না বুড়ো হতে, একটুও ইচ্ছা করে না। একটা ওষুধ বলে দিতে পার রাণু—যাতে বুড়ো না হয়ে এমনি জোয়ান হওয়া যায়? তিনি হাতদুটো পাশে ছড়িয়ে জোয়ানের ভঙ্গি করে দেখালেন। বয় এসে ডাকল, হুজুর?

-কীরে?

—ডাগদারবাবু।

—পাঠিয়ে দে।

ডাক্তার এলেন; পিছনে ইঞ্জেকশনের সরঞ্জাম হাতে একটি পরিচারক।

-হ্যাল্লো ডক্টর, আজ একটু দেরি বলে মনে হচ্ছে?

–না, স্যর বিজয়শঙ্কর, আমি ঠিক সময়েই এসেছি। ডাক্তার হাসলেন।

—ঠিক সময়? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্যর বিজয় বললেন, তাই বটে।

ডাক্তার মর্ফিয়া ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে গেলেন। রাণু সমস্ত ইন্দ্রিয় উন্মুখ করে এতক্ষণ দেখছিল, ডাক্তার চলে যাবার পর বললে, লোকটা অমনি ছুঁচ ফুড়ে দিলে, আপনি ব্যথা পেলেন না?

-না, রোজই দেয় কিনা, অভ্যাস হয়ে গেছে, আমি ব্যথা পাইনে।

-ওরে বাবারে, আমি হলে খুব ব্যথা পেতাম-রাণু যেন ভয় পেয়ে বললে, আচ্ছা, চামড়ার ভেতরে ভরে দিলে কী ওগুলো?

—মর্ফিয়া! স্যর বিজয়শঙ্কর হেসে বললেন, তুমি ওসব বুঝবে না রাণু। এখন তোমায় সব দেখাই এসো, ওদিকে বেড়াই গিয়ে চলো।

রাণু তার ছোটো সরু হাত দিয়ে তাঁর লম্বা ভারী হাতটি ধরল।

—এই দ্যাখো, এই যে আলমারি, টেবিল, চেয়ার, এই যে বড়ো আয়না, ছবি —সব আমার। আর এই যে আমার ছবিটা, অনেক খরচ করে তৈরি করিয়েছি, দ্যাখো আমার চেয়ে কতো বড়ো? এই ঘর-বাড়ি-দোর, সব আমার। আমার বড়ো ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ভিন্ন থাকে, কী আশ্চর্য দ্যাখো, আমার চেয়ে বড়োলোক হয়ে উঠেছে। এতে আমার হিংসা হয় না, বলো? আর তিন ছেলের একজন থাকে নরওয়েতে, আর একজন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে, আর একটি শ্রীনগর কাশ্মীরে। আর এই হলটার মেঝেটা দ্যাখো, এখানে কার্পেট নেই, সাহেবদের নাচের ঘর এমনি থাকে, তার চেয়ে ভালো করতে শখ হল একটা করেছি, কী চকচেকে দ্যাখো, চেহারা পর্যন্ত দেখা যায়। থাক, ওখানে গিয়ে কাজ নেই পিছলে যাবে এদিকে এসো।

-আপনি তাহলে মস্ত বড়লোক! আপনি একটা রাজা! বাবা কী বলে। জানেন? বলে, বড়লোকেরা দস্যি, ডাকাত, পরের লুঠ করে নেয়–

স্যর বিজয়শঙ্কর থমকে দাঁড়ালেন, রাণুর মুখের কাছে নীচু হয়ে অনাবশ্যক। উচ্চস্বরেই বললেন, তোমার বাবা আর কী বলেন?

-বলে, আমাদেরটা চুরি করে নিয়ে তারা বড়োলোক। তাই বুঝি আমরা খুব গরিব, না? বলে, আমাদের বড়োলোকরা মদ খাইয়েছে—আচ্ছা, মদ খেলে কী হয়? বাবাও মদ খেয়েছে নাকি? বাবা আরও কত সব বলে। সবাই বলে, আমার ভুলো মন, সব ভুলে গিয়েছি।

-তোমার বাবা। স্যর বিজয়শঙ্করের গলায় স্বর আরও উঁচু হয়ে উঠল, কাছেই একটা কোচে বসে পড়ে বললেন, মিথ্যে কথা। তোমার বাবা মিথ্যুক!

—আমার বাবা মিথুক? সব বাবাকে বলে দেব কিন্তু। আপনি নিজে মিথুক! চোপ! স্যর বিজয় ভয়ানক চিৎকার করে উঠলেন, তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল, তারপর মুখ নীচু করে কপালে হাত রেখে বসে রইলেন।

-আপনি মিথুক। আমার বাবাকে খুঁজে বার করে দিলেন কই? আমি সব বলে দেব, সব বাবাকে বলে দেব। বাবা, ও বাবা, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গেলে? আমি তো কোনো দুষ্টুমি করিনি, তুমি তো জানো না, কী কান্না পাচ্ছে! বাবা, ও বাবা, বাবা—রাণু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাড়াতাড়ি বারান্দা ধরে নামবার সিঁড়ি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে স্যর বিজয়শঙ্কর মুখ তুলে দেখলেন, রাণু সেখানে নেই। তিনি তাড়াতাড়ি উপরের সকলকে জিজ্ঞেস করে নীচে গেলেন। সেখানে একজন কেবল বললে, কে একটি ছোট্ট মেয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে।

বেরিয়ে গেছে। এখনও তো তেমন রাত হয়নি, রাস্তায় লোকজন মোটর ইত্যাদিতে ভরা! অতটুকু মেয়ে, রাস্তাও চেনে না।

রূপসিং? রূপসিং?

কণ্ঠস্বরে গুরুত্ব বুঝে রূপসিং এস্তে এল।–হুজুর?

—সেই মেয়েটা এইমাত্র রাস্তায় বের হয়ে গেছে, কখন কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে বসে কে জানে—তুমি শিগগির গাড়ি নিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি খুঁজে দেখো, রাস্তায় পেলে উঠিয়ে নেবে, হয়তো কাঁদবে আর জেদ করবে, তবু উঠিয়ে নেবে। নইলে এমনি বেঘোরে মারা যাবে নাকি? যাও শিগগির–

হুশ–রূপসিং গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়াল।

–পেলে না?

–নেহি, হুজুর।

স্যর বিজয়শঙ্করের আর ভালো লাগলো নাঃ হয়তো মেয়েটা এতক্ষণে কোনো প্রকান্ড মোটর গাড়ি বা বাসের নীচে—উঃ, সে তো তাঁরই জন্যে, তাঁর দোষেই যে সে চলে গেছে!

বহুমূল্য খাট আর তার ওপর পুষ্পকোমল শয্যায় স্যর বিজয়শঙ্কর না খেয়েই শুয়ে পড়লেন। পরিচারকরা ডাকতে এসে তিরস্কার শুনে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখলেন: রাজপথ—তিনি মিটিং-এ যাচ্ছেন, হঠাৎ একটি ছোটো মেয়েও চীৎকার জনতার গোলমালে মিশে গেল; তিনি নেমে দেখলেন তারই বিপুল মোটরের তলায় রাণু চাপা পড়েছে—তার ছোটো ফর্সা মুখ কেমন চ্যাপ্টা, আর কী রক্ত! কিন্তু কী আশ্চর্য, এই অবস্থাতেও রাণু কথা বলছে-বাবা, ও বাবা, তুমি কোথায় গেলে? রাজার মতো বড়োলোক, আর ছুঁচোলো দাড়িওলা একটা বুড়ো তোমাকে গাল দিলে, মিথুক বললে! বাবা, ও বাবা, আমায় একা ফেলে তুমি কোথায় গেলে?

স্যর বিজয়শঙ্করের বিলাসী ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। বাকি রাতটুকুও আর ভালো ঘুম হল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments