Thursday, April 25, 2024
Homeবাণী-কথাপারুলদি - তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

পারুলদি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

পারুলদি - তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

মিনিট চল্লিশ পর যখন স্টেশনে ইন করল ট্রেন, সকালের রোদ তুলতে শুরু করেছে ফণা। ফেব্রুয়ারি শেষ করে মার্চে পা দেবে পৃথিবী, শীতের লেশ নেই, কিন্তু গরমও পড়েছে তা নয়, তাই দিনের এই দ্বিতীয় প্র‌হরে খুবই মনোরম মনে হল স্টেশন চত্বর। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নিচে যেতেই একটা আকন্দফুলের ঝোপ বিল্বকে অভ্যর্থনা জানাল হাওয়ায় পাতা দুলিয়ে। শুধু পাতাই তো নয়, দিব্যি ফুলও ফুটিয়েছে থোকা-থোকা। অতি-হালকা বেগুনি-বেগুনি ফুলগুলো, কেন কে জানে বেশ আকর্ষণ করছিল বিল্বকে।

স্টেশন-চত্বর ছেড়ে বেরোতেই বড়ো রাস্তার কলকোলাহল। চত্বরের বহু সংখ্যক দোকানপাট নিয়ে রাস্তাটা গেছে পুব থেকে পশ্চিমে। বিল্ব এই পথেই পশ্চিম দিকে যায় মাঝেমধ্যে। মাইল দুই গেলে আনন্দপুরে একটা বড়ো পে-ক্লিনিক আছে যেখানে প্র‌ায় দু-ডজন ডাক্তার বসেন নিয়মিত। বিল্ব একটি নামী ওষুধ কোম্পানিতে প্র‌ায় পনেরো বছর কাজ করেছে মেডিক্যাল রিপ্রে‌জেন্টেটিভের, তারপর তার পদোন্নতি হওয়ায় এখন সুপারভাইজিং অফিসার। সেও হয়ে গেল অনেকগুলো বছর। কলকাতার উত্তরেই বেশি কেটেছে তার চাকরি জীবন, বছর দুই হল দক্ষিণের এই প্র‌ান্তদেশ তার চাকরির এলাকা। এখন তার অধীনে জনা কুড়ি রিপ্রে‌জেন্টেটিভ দক্ষিণের এই এলাকাগুলো নিয়ম করে ভিজিট করে, তাদের কাজের তত্ত্বতালাস করতেই বিল্বকে ঘুরতে হয় দক্ষিণের এই বিশাল এলাকা।

তার মধ্যে এই বসন্তপুরে আসতে হয় খুব কম, কেন না এখানে যে-যুবকটি রিপ্রে‌জেন্টেটিভ তার পারফরমেন্স এতটাই ভালো যে, বিল্বকে খুব একটা বেশি যাওয়া-আসা করতে হয় না এদিকে। হয়তো চার বা ছ-মাসে একদিন।

কিন্তু যেদিন থেকে বসন্তপুর এলাকায় তাকে আসতে হচ্ছে, অমনি বুকের মধ্যে একটি নাম এক ঝলক জুঁইয়ের মতোই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, সেই নামটি পারুলদির।

গত দু-বছরে বেশ কয়েকবার বসন্তপুর স্টেশনে নেমে বড়ো রাস্তা থেকে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেছে আনন্দপুর পে-ক্লিনিকে। বেলা দশটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে আবার বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরে ট্রেন ধরেছে বালিগঞ্জ যাওয়ার। আর রিকশায় উঠে যাওয়া-আসার পথে যখনই ‘বিবেকানন্দ ক্লাব’-এর পাশ দিয়ে গেছে, অমনি চোখে পড়েছে উত্তরমুখো রাস্তাটার দিকে।

তখনই মনে হয়েছিল, পারুলদি তো বলেছিল, তার ভাবী শ্বশুরবাড়ি হবে এই রাস্তায়।

হ্যাঁ, এই সেই রাস্তা যার কথা বহুবার শুনেছিল পারুলদির মুখে। তখনও পারুলদির বিয়ে হয়নি, কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির পথনির্দেশিকাটি ছিল এরকম— বুঝলে বিল্ব, তুমি ট্রেন থেকে নামবে বসন্তপুর স্টেশনে, একটু এগোলেই একটা রিকশা স্ট্যান্ড, সেখানে একটা রিকশায় উঠে কিছুটা পশ্চিমে সোজা গিয়ে দেখবে ‘বিবেকানন্দ ক্লাব’, তার ঠিক পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা ডানদিকে উত্তরমুখো চলে গেছে, সেদিকে অনেকটা গেলে একট কয়লার দোকান, তার পাশে একটা শীতলা মন্দির, সেখানে গিয়ে পল্লব মজুমদারের কথা বললেই—

যখন বলেছিল পারুলদির বিয়ে তখনও দূরস্থ। কিন্তু খুব প্র‌ত্যয় নিয়ে বলেছিল। সেই ক-ত্ত বছর আগে ফিসফিস করে বিল্বকে বলেছিল তার বিয়ে হবে বসন্তপুরের পল্লবদার সঙ্গে।

প্র‌ায় চল্লিশ বছর আগের সেই বলা। তখন পারুলদির বয়স ছিল ষোলো, আর বিল্বর বারো।

তারও দুই বছর পরে বিয়ে হয়েছিল পারুলদির তা জেনেছিল তার পাঠানো বিয়ের চিঠি থেকে। তখন পারুলদিরা আর জামতলায় থাকত না, তার বাবা বদলি হয়ে কদমগাছিতে।

ভাবতে ভাবতে প্র‌তিবারের মতো বসন্তপুর স্টেশনে নেমে রিকশাস্ট্যান্ডে গিয়ে ‘আনন্দপুর’ বলল না, বলল, শীতলামন্দির চেনো?

শীতলামন্দির!

হ্যাঁ, তার পাশে একটি কয়লার দোকান আছে।

‘কয়লার দোকান’ বলতে রিকশাস্ট্যান্ডের অনেকেই মুখ চাওয়া-চায়ি করে।

একজন বলল, এ রাস্তায় কোনও কয়লার দোকান নেই।

বিল্বর তৎক্ষণাৎ মনে হল ইদানীংকার শহর বা গঞ্জ এলাকাগুলিতে কয়লার দোকান আর তেমন দেখা যায় না, পরিবর্তে এখনকার জীবনযাত্রায় ঢুকে পড়েছে গ্যাসের দোকান। হয়তো কোনও এক কালে কয়লার দোকান ছিল, সেই দোকান এখন উঠে গেছে কালের নিয়মে।

নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, শীতলামন্দির নিশ্চয় আছে।

শীতলামন্দিরের নামেও কোনও হেলদোল হয় না রিকশাওলাদের মধ্যে। তাহলে কি শীতলামন্দিরও নেই এ-রাস্তায়!

আজ দু’বছর ধরে বিল্ব ভেবে এসেছে যেদিন তার কাজ একটু হালকা থাকবে, সেদিন অবশ্যই খুঁজে বার করবে পারুদিকে। কী জানি কেন, আজ চল্লিশ বছর পরেও পারুলদিকে দেখার একটা ইচ্ছে মনের গভীরে লালন করে রেখেছে সে!

তাহলে কি পারুলদির দেওয়া নির্দেশিকায় কোনও ভুল ছিল! না কি সে নিজেই বিস্মৃত হয়েছে নির্দেশিকার কোনও বিশেষ অংশ।

বিল্ব কিছুক্ষণ নিরাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রিকশাওলাদের অবাক দৃষ্টির সামনে। তারপর মনে হল পারুলদি যেরকম বলেছিল স্টেশন থেকে খুব বেশি দূর হবে তা নয়। কিছুক্ষণ ‘বিবেকানন্দ ক্লাব’-এর পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেখাই যাক না সেই নির্দেশিকার কোনও সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!

কাঁধের ব্যাগটা ঝুলিয়ে বিল্ব শুরু করল প্র‌থমে পশ্চিমদিকে: একশো গজ এগোতেই ‘বিবেকানন্দ ক্লাব’-এর ছোট্ট দোতলা বাড়ি, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে উত্তরমুখো রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা চলার পর মনে হল পারুলদি যখন পথের নির্দেশ দিয়েছিল, তখন কলকাতার অন্যান্য প্র‌ান্তিক এলাকাগুলোর মতো এই বসন্তপুরেও ছিল নিতান্তই এক গ্র‌াম্য পরিবেশ। তারপর গত চল্লিশ বছরে হু হু করে বদলে গেছে এসব এলাকা। হয়তো দুপাশে এত দোকানপাটও ছিল না। ছিল না এত-এত ফ্ল্যাটবাড়ি।

হঠাৎ চল্লিশ বছর পরে কেউ হাজির হয়ে যদি সন্ধান করতে চায় কাউকে, সে কি সত্যিই সম্ভব!

বিল্ব এগিয়ে চলেছে একটার পর একটা বাড়ি আর দোকানের সারি দুপাশে ফেলে। এই খোঁজাটাও তার কাছে এক অদ্ভুত থ্রিল।

সেই থির‌ল শুধু যে পারুলদির বাড়ি খোঁজাতেই তা নয়, সেই সঙ্গে বিল্বর কৈশোরবেলা আবিষ্কারের রোমাঞ্চও বটে।

সেই পারুলদি যার ফরসা ডাবছাঁদের মুখে সারাক্ষণ উপচে পড়ত মন-চলকানো হাসির সম্ভার।

সেই পারুলদি যে কিনা তার কৈশোরকালের মন ও শরীর পূর্ণ করে দিয়েছিল এক আশ্চর্য ভালো-লাগায়।

পারুলদির সঙ্গে তার আলাপ জামতলায় মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে। হঠাৎ পারুলদির বাবা জামতলায় বদলি হয়ে আসতে বিল্বর মামাবাড়িতে দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন এক বছরের জন্য। বিল্ব মামাবাড়িতে যেত খুব কম, গরমে বা পুজোর ছুটিতে দশ-বারো দিনের জন্য। এক বছরে পারুলদির সঙ্গে মাত্র দু-বারের সেই আলাপ, চেনাজানা ও ঘনিষ্ঠতা আজ চল্লিশ বছর পরেও আপ্লুত করে রেখেছে বিল্বকে।

এক সম্পূর্ণ অচেনা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে এক আশ্চর্য আনন্দ আছে যা বিল্ব পছন্দ করে খুব। আজও কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে চলেছে দুপাশের দোকানপাট আর বাড়িগুলোর পরিচয় পড়তে পড়তে। আর তৃষিত দু-চোখ খুঁজে চলেছে একটি কয়লার দোকানের অস্তিত্ব অথবা একটি শীতলামন্দির।

আসলে পারুলদির সঙ্গে পরিচয়ের সময়কাল খুব দীর্ঘ তা নয়। সেবার বেড়াতে গেছে মামাবাড়িতে, শুনল নীচের তলায় এক ঘর ভাড়াটে এসেছে। ভদ্রলোক থানার সাব-ইনস্পেক্টর। স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে দুটি ঘরে পেতেছেন সংসার।

সেদিন বিকেলেই আলাপ হয়ে গেল তার সঙ্গে। কী সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে! সোনার মতো গায়ের রং, প্র‌ায় গোল মুখ, একটু বুঝি উপরে-নীচে টোল-খাওয়া। বড়ো বড়ো দুটো চোখ, বাঁকানো সুন্দর ভুরু, একরাশ চুল নেমে এসেছে দু-গালের পাশে। তখন সদ্য কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হয়েছে পারুলদি। গ্র‌ামে বসবাস, অতএব সেই বয়সেই শাড়ি। বিল্বকে দেখেই বলল, তুমি বিল্ব? তোমার নাম তো দিদার কাছে শুনেছি। তোমার বয়স এখন বারো?

হঠাৎ বয়সের কথা উঠতে বিল্ব একটু হকচকিয়ে যায়, নিশ্চয় দিদার কাছে শুনেছে। পারুলদি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কিন্তু ষোলো। তোমার চেয়ে চার বছরের বড়ো। তুমি আমাকে পারুলদি বলে ডাকবে।

বিল্ব ঘাড় নাড়তেই পারুলদির পরের প্রশ্ন, তুমি নাকি ভালো আবৃত্তি করতে পারো?

বলেই একরাশ হাসি।

বিল্ব সামান্য বিব্রত। স্কুলের ফাংশনে আবৃত্তি করে প্র‌তি বছর প্র‌াইজ পায় সে কথা দিদার ঘটা করে বলার কী আছে! বলতে যাচ্ছিল, ‘সে আর এমন কী!’ কিছু বলার আগেই পারুলদি বলল, কই দেখি, কেমন আবৃত্তি করতে পারো?

বলে পারুলদির খিলখিল হাসি।

পারুলদির হাসির রকম দেখে একটু ঘাবড়ে যায় বিল্ব। হঠাৎ একটি অচেনা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরক্ষণে কবিতা আবৃত্তি করা যায় নাকি! কিন্তু এরকম পরীক্ষার মুহূর্তে আবৃত্তি না-করে পলায়নও তো যুক্তিযুক্ত হবে না! অতএব—

বিল্ব তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি দূরে প্র‌সারিত করে শুরু করল—

যেখানে রুপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর,

যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর;

সেখানে সোনালি মাছ খুঁটে খুঁটে খায়

সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়;

নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ

পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ;…

পুরো কবিতাটা এক নিশ্বাসে আবৃত্তি করে বিল্ব তাকায় পারুলদির দিকে।

পারুলদি বোধহয় রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ছাড়া আর কোনও কবির কবিতা এভাবে আবৃত্তি হতে শোনেনি। মুখেচোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলল, কী সুন্দর কবিতা! কী দারুণ তোমার গলার স্বর! কিন্তু এই কবিতা তো কখনও শুনিনি।

বিল্ব চোখেমুখে অহংকার ফুটিয়ে বলল, জীবনানন্দ দাশের কবিতা। আধুনিক কবি।

প্র‌থম দিনেই বিল্বর কবিতা শুনে পারুলদি একেবারে অভিভূত। বলল, আধুনিক কবি। নাম তো শুনিনি!

বিল্ব তখন তার জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে চার-পাঁচজন আধুনিক কবির নাম বলে প্র‌মাণ করার চেষ্টা করল সে কবিতা বিষয়ে যথেষ্ট আধুনিক।

তারপর থেকেই বিল্বর সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল পারুলদির। সারাক্ষণ শুধু বিল্ব আর বিল্ব। আর সব কথাতেই হাসে পারুলদি। উফ্‌, কিছু হাসিও হাসতে পারে মেয়েটা! বিল্ব সামান্য একটা কথা বলে তো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে পারুলদি। হয়তো হাসির কথা বলেনি, তবু হাসবে পারুলদি।

পারুলদি একটা গোটা দুপুর তাকে জানিয়ে দিল তার বাবার বদলির চাকুরিসূত্রে এই বয়সের মধ্যে কত-কত জায়গা ঘুরেছে! কতগুলো স্কুলে পড়েছে, কোথাও ছ-মাস, কোথাও দেড় বছর। এখন তো তার স্কুলের শেষ পরীক্ষার পর লম্বা ছুটি, রেজাল্ট বেরোলেই ভর্তি হবে কলেজে। এ-কথা সে-কথার পর এও জিজ্ঞাসা করল, কী রে, বিল্ব, জামতলায় নাকি কলেজ নেই! তাহলে তো ট্রেনে উঠে যেতে হবে দু-স্টেশন দূরের কলেজে! কিন্তু তাই ভালো। রোজ ট্রেনে উঠে কলেজ যাওয়ার মজাই আলাদা। কী বলো?

বিল্ব এখনও স্কুলে পড়ে, কলেজে যাওয়ার কী মজা তা অনুমান করার চেষ্টা করে, তারপর কিছুক্ষণ নতুন কলেজ, কিছুক্ষণ তার স্কুল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলল দু-জনের মধ্যে।

তারপর হঠাৎ মুখে কীরকম লজ্জা-লজ্জা ভাব মাখিয়ে বলল, কী জানি, শেষ পর্যন্ত কলেজে পড়া শেষ হবে কি না!

বিল্ব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, সে কী! কেন?

পারুলদি হঠাৎ মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলল, হয়তো আমার বিয়ে হয়ে যাবে।

বিয়ে! শব্দটার মধ্যে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ খুঁজে পেলেও বিল্বর মনে হল বিয়ের পক্ষে ষোলো বছর বয়সটা বেশ কম নয় কি!

পারুলদি তখনও হেসেই চলেছে। হাসতে হাসতেই বলে, বুঝলে বিল্ব, হাসিটা আমার রোগ! পল্লবদা তাই বলে।

কৌতূহলী হয়ে বিল্ব ভুরুতে কোঁচ ফেলে বলে, পল্লবদা কে?

মস্ত জিব কেটে পারুলদি আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে বলে, যাহ্‌, তোমার কাছে প্র‌থমদিনেই বলে দিলাম নামটা!

তারপর নিজেই আবার বলল, না-বলে আর উপায় কী! সারাক্ষণ ওই নামটা জপ করছি যে!

বিল্ব প্র‌থমদিনেই জেনে গিয়েছিল পল্লবদা পারুলদিকে ভালোবাসে। পারুলদির বাবা যখন বদলি হয়ে গিয়েছিল বসন্তপুরে, পারুলদির তখন ক্লাস নাইন, সেই স্কুলে তখন সদ্য টিচারি করতে ঢুকেছে পল্লবদা। কীভাবে যেন সুন্দরী পারুলদিকে চোখে পড়ে যায় পল্লবদার। প্র‌থমে একটু একটু কথা বলা। তারপর একদিন একটা চিঠি দিল পল্লবদা। লিখল, ‘ইচ্ছে হলে উত্তর দিও’। কী এক ঘোরের মধ্যে ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটা ক্লাসের টিচারকে একটা উত্তরও দিলে। সম্বোধন করেছিল, ‘স্যার—’

সেই চিঠি লেখার শুরু, তারপর চিঠির আয়তন বাড়তে লাগল ক্রমশ। পারুলদি তার মাকে ‘অঙ্ক কষছি’ বলে মোটা মোটা চিঠি লিখতে লাগল স্যারকে। একদিন তার স্যার লিখল, ‘স্যার লেখো কেন! পল্লবদা লিখবে।’

একটা গোটা দুপুর এভাবেই বিল্ব মামাবাড়ি বেড়াতে এসে আবিষ্কার করেছিল কিশোরী থেকে সদ্য তরুণী হয়ে ওঠা একটি মেয়েকে। যখন দোতলা থেকে তার ডাক পড়ল, বিল্ব বলল, তা হলে আজ যাই।

আবার কখন আসবে?

যেন উপরে গিয়ে ডাক শুনে আবার আসতে হবে এখনই।

বিল্ব আন্দাজ করতে না পেরে বলল, দেখি।

পারুলদির পরের প্রশ্ন, ক-দিন থাকবে মামাবাড়ি?

বিল্ব মাত্র সাতদিনের জন্য মামাবাড়ি এসেছে শুনে রাগ দেখিয়ে বলল, মোটে সাতদিন! আমি বলে এখানে এসে একজন কাউকে পাই না যার সঙ্গে দু দণ্ড কথা বলে সময় কাটাই।

স্মৃতির গভীরে হাতড়ানোর অবকাশে বিল্ব হঠাৎ ফিরে এল বর্তমানকালে, চোখ পড়ল একটা গ্যাসের ডিলারের দোকান। তৎক্ষণাৎ মনে হল কয়লার দোকানগুলো উঠে যাওয়ার পিছনে এই গ্যাসের ডিলারদের অবদানই প্র‌ধান। এখানে কি জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে কয়লার দোকানের কথা!

বিল্ব ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করে ফেলল কাউন্টারে বসা এক যুবককে। তিনি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে বললেন, এই স্টেশন রোডের এ-মুড়ো ও-মুড়ো কোথাও কোনও কয়লার দোকান নেই। আমার জন্মের আগে ছিল কি না বলতে পারব না।

বিল্ব হতোদ্যম না-হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আর শীতলামন্দির?

শীতলামন্দির বলেও কিছু নেই। তবে একটু এগিয়ে ডানদিকের বৃদ্ধাবাসে জিজ্ঞাসা করে দেখুন। বৃদ্ধাবাসের ভিতর থেকে মাঝেমধ্যে ঘণ্টাটন্টা বাজে।

বৃদ্ধাবাস শুনে বিল্বর তেমন আশা জাগে না, তবু ঘণ্টা যখন বাজে, নিশ্চয় কোথাও পুজো হয়, যদি সেখানকার কেউ বলতে পারেন। তাছাড়া সেখানে স্থানীয় বৃদ্ধ যদি কেউ থাকেন তো তাঁদের কেউ হয়তো দিতে পারেন শীতলামন্দিরের হদিশ!

বিল্ব আরও একটু এগোয়, চোখে পড়ে বৃদ্ধাবাসের টানা লম্বা বাড়িটি, সেই বাড়ির মধ্যে একটা অফিসঘর, সেখানে বসে এক বৃদ্ধ কী সব লিখছেন খাতায়। তার কাছেই গেল বিল্ব, বলল, এখানে কোথাও শীতলামন্দির আছে বা ছিল?

বৃদ্ধ কলম থামিয়ে মুখ তুললেন, বললেন, এখানে মন্দির তো দেখছিনে। তবে আমাদের ঠাকুরঘরে অনেক ক-টা মূর্তি আছে, তার মধ্যে শীতলার মূর্তিও আছে।

বিল্বর বুকের ভিতরটা চলাৎ করে ওঠে, কোনদিকে?

ওই যে, আমার চোখের দিকে তাকান।

বৃদ্ধের চোখ অনুসরণ করে বিল্ব দেখল বৃদ্ধাবাসের মধ্যে একটা ছোটো ঘর, তার মধ্যে বহু মূর্তি পাশাপাশি দণ্ডায়মান। তার মধ্যে, হ্যাঁ, একটা শীতলার মূর্তিও আছে।

তাহলে হয়তো এখানেই ছিল সেই মন্দির! সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাবাস।

তৎক্ষণাৎ সেই বৃদ্ধকেই জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বলতে পারেন এখানে কোথাও স্কুলশিক্ষক পল্লব মজুমদারের বাড়ি আছে?

বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে বললেন, আমি তো এসেছি এখানে বৃদ্ধাবাসে থাকতে। তার মধ্যে কখনও বৃদ্ধাবাসের টাকাপয়সার হিসেব করি এখানে বসে। আপনি এক কাজ করেন। এই বাড়ির পিছনে একটা কোচিং সেন্টার আছে, সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন তো।

বিল্ব কোথাও একটা খড়কুটো দেখতে পায়, তক্ষুণি সেই বৃদ্ধাবাস থেকে বেরিয়ে তার পাশের গলিতে খুঁজে পায় একটা কোচিং সেন্টার। কিন্তু এখন তো স্কুলটাইম, সেখানে জনা দুই যুবক বসে গল্প করছে। তাদের কাছেই পল্লব মজুমদারের কথা জিজ্ঞাসা করতে একজন বলল, পল্লব স্যার তো রিটায়ার করে গেছেন, ওঁরা বোধহয় বাড়ি করে রামচন্দ্রপল্লীর দিকে উঠে গেছেন।

রামচন্দ্রপল্লী! সে আবার কোন দিকে?

আপনি আর একটু এগিয়ে চলে যান, তারপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে দেখবেন একটা বড়ো স্টেশনারি দোকান। কী যেন নাম! টুকিটাকি। ওই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন।

বিল্ব আবার শুরু করল পথ হাঁটা। এ এক অদ্ভুত খোঁজা তার জীবনে। কবে চল্লিশ বছর আগে দেখা হয়েছিল এক পারুলদির সঙ্গে, বোধহয় বছরখানেক ছিল জামতলায়, তার মধ্যে বিল্বর তিনবার যাওয়া, তিনবারের মধ্যেই পারুলদির এত কাছাকাছি চলে গিয়েছিল যে, এতদিন পরেও ভুলতে পারেনি তাকে।

আর প্র‌তিবারই কী এক মোহ, কী এক সম্মোহের সৃষ্টি হয়েছিল বিল্বর মনে। যতবারই গেছে পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটিতে, সারাটা দুপুর তারা কাটাত মুখোমুখি বসে, কখনও পাশাপাশি শুয়েও গল্প করেছে জমিয়ে। আর পারুলদির গল্প মানে পল্লবদার গল্প। পল্লবদার কথা বলতে বলতে উচ্ছবসিত হয়ে উঠত পারুলদির মুখ। কখনও পল্লবদার চিঠির অংশবিশেষ পড়ে শোনাত।

আর পারুলদি কী করত! পল্লবদার কথা বলতে বলতে, তার চিঠি পড়তে পড়তে উত্তেজনার মুহূর্তে এক-এক সময় বিল্বর গালে হঠাৎ চকাস করে একটা-দুটো চুমু খেয়ে নিত, কিংবা তার মাথাটা চেপে ধরত তার বুকের উপর।

তখনও বিল্ব যৌবনের সব-সব ঠিকানা পায়নি, পারুলদির এই উত্তেজনার কারণ বুঝে উঠতে পারত না, কিন্তু কী এক আশ্চর্য ভালো-লাগা ছড়িয়ে যেত তার রক্তের ভিতর। রাতে ঘুমোনোর আগেও মনে পড়ত পারুলদির শরীরের নরম স্পর্শগুলো।

কিছুকাল পরে পারুলদিরা জামতলা থেকে চলে গিয়েছিল, সেই খবর বিল্বর কানে পৌঁছোতে কত যে দুঃখ পেয়েছিল সেই ব্যথা বোধহয় আজও খুঁজে পায় মনের কোনও কোণে। ‘বিয়ে হবে’ এই কথাটা তখনও কিছু ‘যদি’র মধ্যে আটকে ছিল কেন না পারুলদির রাশভারী বাবা কিছুতেই পল্লব মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না এরকমই জানত বিল্ব।

বছর দুই পরে পারুলদি তাকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছিল সে পালিয়ে যাচ্ছে পল্লবদার সঙ্গে।

বিল্বর কাছে পারুলদির খবরের এটুকুই মাত্র আছে, তবু এই দীর্ঘকাল তার বুকের ভিতর পারুলদির কথা জমিয়ে রেখেছে হয়তো এ-কারণেই যে, পারুলদি তার শরীরের উত্তেজনা প্র‌শমিত করতে গিয়ে বিল্বর কিশোর শরীরে চারিত করে দিয়েছিল যৌবনের প্র‌থম স্বাদ।

এতদিন হয়তো পারুলদিকে ভুলতে পারেনি সে-কারণেই।

হাঁটতে হাঁটতে বিল্ব একসময় পৌঁছে গেল সেই টুকিটাকির সামনে। এক মধ্যবয়স্ক বিক্রেতার সামনে বেশ ভিড়, সেই ভিড় অতিক্রম করে বিল্ব মুখোমুখি হল বিক্রেতার, জিজ্ঞাসা করল, এখানে টিচার পল্লব মজুমদারের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?

বিক্রেতা তাঁর ব্যস্ততার মধ্যেও বললেন, এই দোকানের পরে তিনটে বাড়ি ছেড়ে—

বিল্বর বুকের ভিতর ড্র‌াম বাজতে শুরু করে অমনি। তা হলে এই দীর্ঘ সময় পরে সে মুখোমুখি হতে চলেছে পারুলদির! অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে—

কিন্তু এই চল্লিশ বছর পরে কীরকম দেখতে হয়ে গেছে পারুলদিকে! সেই টানটান ফরসা চামড়ায় কি এখন একটু শিথিল ভাব! সেই কোঁকড়ানো কালো চুল কি এখনও লুটিয়ে পড়ে গালের দু-পাশ বেয়ে! এখনও কি তাকে দেখলে একই রকম ভাবে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়বে!

আচ্ছা, এতদিন পরে তাকে দেখে পারুলদি চিনতে পারবে তো!

সেই বাড়ি খুঁজে পেয়ে বিল্ব দেখল বেশ শৌখিন চেহারার ছোট্ট একতলা বাড়ি, তার সামনে লতিয়ে উঠেছে একটি মাধবীলতা, একপাশে একটি মুসান্ডা।

বিল্ব কিছুক্ষণ বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে সেই বাড়ির দরজায় কলিং বেল টেপে, একটু সময় নিয়ে দরজা খুলে দেয় এক যুবক, বিল্বকে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কাকে চাইছেন?

বিল্ব নিশ্বাস বন্ধ করে ভাবল সে পারুলদির খোঁজ করবে! না—

পরক্ষণে বলল, পল্লব মজুমদার আছেন বাড়িতে?

যুবকটি তাকে নিরীক্ষণ করে বলল, বাবা তো বাড়িতে নেই। বাবা-মা দুজনেই হায়দরাবাদ গেছেন এক সপ্তাহ আগে।

ও, বিল্বর মুখের দীপ্তি নিষ্প্রভ হয় এক মুহূর্তে, তা কবে ফিরবেন?

ফিরতে দেরি হবে। আসলে আমার দিদির বাচ্চা হবে। ওখানে তো দিদিকে দেখাশুনোর কেউ নেই। তাই এখন বাবা-মা তিন-চার মাস থাকবে দিদির কাছে। হয়তো আরও দেরি হতে পারে। আপনার কি দরকার আমাকে বলা যাবে?

বিল্ব কিছুক্ষণ বিব্রতকর অবস্থানয়। এই তরুণকে কি বলা যাবে কেন এসেছে সে! সেই কবেকার এক সম্পর্কের কথা কি বলা যায়! হয়তো সেটা নিতান্তই বিস্ময়ের সঞ্চার করবে তার মনে, অথবা জেগে উঠবে কৌতুক!

বিল্ব ঘাড় নাড়ে, বলে, পরে যদি কোনওদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তখনই বলব।

বিল্ব আবার তার ফেরার পথ ধরে। এই এলাকায় প্র‌ায় তিন বছর ধরে আসছে, এতদিন পরে তার মনে হয়েছিল পারুলদির সঙ্গে দেখা করবে।

যখন হল না, হয়তো আর কোনও দিনই হবে না।

বিল্ব তখন হাঁটছে শ্লথ গতিতে। কী একটা ব্যথা তখন গড়িয়ে নামছে তার অন্তরের কোথাও। তারপর মনে হল পারুলদির সঙ্গে দেখা না হয়েই ভালো হয়েছে। চল্লিশ বছর ধরে পারুলদিকে নিয়ে যে একটা আশ্চর্য ভালো লাগা তার ভিতরে লালিত হয়ে আছে, দেখা হলে সেই নরম স্পর্শটুকু হয়তো ভেঙে চুরচুর হয়ে যেত।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments