Monday, April 29, 2024
Homeবাণী-কথারাজার খেলা - সমরেশ মজুমদার

রাজার খেলা – সমরেশ মজুমদার

সমরেশ মজুমদার

হিপপকেট থেকে ছোট্ট হলদে বইটা বের করল সুজয়। ফন কোম্পানির রেসবুক। একটা ঘোড়ার মুখ মলাটে আঁকা। ছবিটাকে দেখলেই কানু মিত্তিরের মুখ মনে পড়ে যায় ওর। কানু মিত্তির বলত, রেসের আগে এটাকে দেখায় টপমোস্টের মতো আর রেস শেষ হয়ে গেলে এ শালা হয়ে যায় পাউসিকি। প্রথমটা ভারতবর্ষের সব সেরা ঘোড়ার নাম, দ্বিতীয়টা ছ্যাকড়া গাড়ি টানবার বদলে ছিটকে ঢুকছে রেস-মাঠে। কানু মিত্তির বলত, বেশি দিন ঘোড়া খেললে মানুষের মুখ, বুঝলে, ঘোড়ার শেপ নিয়ে নেয়। পাকা রেসুড়ে যে সে মুখ দেখলেই চিনবে। হেরে গেলে মুখ-চোখ কেমন হয়ে যেত কানু মিত্তিরের, বলত, আমি শালা পাউসিকি হয়ে গেছি। সেই কানু মিত্তিরকে আজকাল দেখাই যায় না মাঠে। কলকাতার সিজন যখন থাকত না তখন ব্যাঙ্গালোর বোম্বাই করত কানু মিত্তির। মাঠে না থাকলে কেমন ফাঁকা লাগে। সেই কানু মিত্তির এখন একদম ডুব। মাঠের আলাপে বাড়ির ঠিকানা দেয় না কেউ। কানু মিত্তির অবশ্য বলত, যেদিন দেখবে আমি অ্যাবসেন্ট জানবে আমি টেঁসেছি।

প্রথম পাতা খুলল সুজয়। কেমন একটা আদুরে গন্ধ। আজ নটা রেস। বাপস। নয়-নয়বার আজ তুমি চান্স পাবে টাকা বানাবার। লুটে নাও–শালা কলকাতার হাওয়ায় টাকা উড়ছে। নয় নয়বার। প্রথম রেস একটা তিরিশে, আটটা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। সুজয় নামগুলো পড়ল। অদ্ভুত সব নাম। নিজের ছেলের নামও এত যত্নে কেউ রাখে না। এক নম্বর ঘোড়ার নাম ব্ল্যাক প্রিন্স, ওজন ষাট কেজি, জকিই জেনিংস। খাস অস্ট্রেলিয়ার লোক, দারুন রাইড করে। দুনম্বর–মাই ফরচুন, ওজন সাতান্ন কেজি, জকিপি লয়েড। লয়েড সবে এসেছে বিলেত থেকে, এখনও কলকাতার মাটি চেনেনি। যে ঘোড়া যত ভালো দৌড়ায় তাকে তত বাড়তি ওজন বইতে হয়। ফলে অন্য ঘোড়াগুলো পাল্লা দিতে পারে সমানে। যদিও এটা বি-ক্লাসের বাজি, তবু সুজয়ের মনে হল ব্ল্যাক প্রিন্সই জিতবে।

মাঠে এখনও তেমন ভিড় হয়নি। ঘড়ি দেখল সুজয়, এখন পঁচিশ মিনিট বাকি রেস শুরু হতে। বুকিদের কাউন্টারের পাশ দিয়ে বারের ভিতর চলে এল ও। সুন্দর করে সাজানো টেবিলগুলো এখনও ফাঁকা। দুটো ফিরিঙ্গি মেয়ে কোকাকোলার বোতল নিয়ে চুপচাপ ভেজা কাকের মতো বসে। কোণার দিকের একটা চেয়ার টেনে সুজয় বসল। এখান থেকে বেটিং গ্রাউন্ডটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘাড় ঘোরাতেই বারের আয়নায় চোখ পড়ল। না, এখনও হর্সফেস হয়নি তার। এই নিয়ে তিনটে সিজন চলে গেল, টোটাল লস তিন হাজার। ভাবাই যায় না। একসঙ্গে টাকাটার কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে বল ড্রপ খেতে শুরু করে। প্রথম দিন ওকে যে নিয়ে এসেছিল সেই নরেন। চাকলাদার রেস ছেড়েছে কবে–কিন্তু আসব না আসব না করেও সুজয়ের তিন সিজন চলে গেল। এত লস–চোয়াল শক্ত করে আয়নার দিকে তাকাল সুজয়–আজকে জিততেই হবে।

টাকার দরকার, ভীষণ টাকার দরকার। হেসে ফেলল সুজয়, টাকার দরকার নেই এমন রামকেষ্ট কে আছে আজ! কিন্তু মুশকিলটা হল, চারদিকের পৃথিবীটায় অনেক সুখকর জিনিস আছে যা কিছু মানুষ চুটিয়ে ভোগ করছে। মোটামুটি হিসেব করেছে সে একটা লোকের হাত-পা খেলিয়ে। থাকতে হলে মাসে পাঁচ হাজার দরকার। কেউ দেবে না তাকে মুখ দেখে। ওর মাইনের দশগুণ। এক পেগ ব্ল্যাক-নাইটের দাম আট টাকা। অথচ সুজয় জানে, জানে বলেই অবাক লাগে, ওর। সহকর্মীরা কেমন ওই সামান্য টাকায় বেঁচে-বর্তে আছে। ওরা কেউ সুজয়ের মতো তিন প্যাকেট ক্যাপস্টেন ডেইলি কেনে না, আকাশে রোদ জমলে ট্যাকসি চড়ে না, মেয়েছেলের কথা ভাবতেই পারে না ওরা। রেসবুকটার দিকে তাকাল ও, এই বইটা কোনও বাঙালির ড্রইংরুমে গো-মাংসের মতো নিষিদ্ধ। ওই যে মেয়েটা তার পাশ দিয়ে চলে গেল ওর গায়ের ইন্টিমেটের গন্ধটার দাম। চল্লিশ টাকা। বেলবটমের কাপড়টা জাহাজি। এসব দেখেশুনে আপস করতে ইচ্ছে হয় কারও? অথচ কোনও রাস্তা নেই–গ্যাম্বিলিং ছাড়া। সুন্দর রাস্তা টু বি বড়লোক। কানু মিত্তির বলত।

পরপর দু-দিন দারুণ হেরে গেছে সুজয়। একদম দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাসের মাঝামাঝি অথচ পকেটে শেষ সম্বল একশো টাকার একটা নোট। বাকি কদিন চালানোই মুশকিল। প্রভিডেন্ট ফান্ড নিল, কো-অপারেটিভে ধার–শালা ভাবাই যায় না। এই রেসে মাঠে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছে সুজয়। একটার-পর-একটা রেস হেরে গিয়ে মানুষের মনে দারুণ একটা জেদ চেপে যায়। তারপর হারতে-হারতে রেস শেষ হয়ে গেলে চিনেবাদাম চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফেরার পথে নিজেকে কেমন ক্লান্ত লাগে, ফিনিশ শব্দটা আঁটো গেঞ্জির মতো বুকটাকে জড়িয়ে ধরে।

এই কদিন ও ক্যালকুলেশন করে খেলেছে, ঘোড়ার ঠিকুজি দেখেছে, একদম গোপন সূত্রে খবরে টাকা লাগিয়েছে কিন্তু কিছুই হয়নি। সুজয়ের ঘোড়াগুলো জিততে জিততে উইনিং পোস্টের কাছে মার খেয়ে যায়। রেসে বোধহয় কেউ জিততে পারে না–এরকম ধারণা ও যখন প্রায় করে ফেলেছিল ঠিক তখনই নজরে পড়ল মেয়েটাকে। ঠিক মেয়ে বললে ভুল হবে। অবশ্য মেয়ে এবং মহিলার পার্থক্য এখন লাইন টেনে করা যায় না। বিশেষ করে এইসব বিয়ার-বাটারে বেড়ে ওঠা। মেয়েদের। চল্লিশ আর চব্বিশ রুপোর টাকার এপিঠ-ওপিঠ। লক্ষ করেছিল কদিন ধরে। মেয়েটি রেস দেখতে গ্যালারির দিকে যায় না। চুপচাপ বারের চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে থাকে। বিরাট গোগো চশমার রঙিন কাঁচে মুখের অর্ধেক ঢাকা। এমন কিছু আহামরি নয় সে মুখ, কিন্তু শরীরের দিকে তাকালে বুকের ভেতরটায় কী যেন গড়িয়ে-গড়িয়ে যায়। তারপর সারাদিনে দুবার ওকে চেয়ার ছেড়ে বুকিদের কাউন্টারে উঠে যেতে দেখেছে সুজয়। একবার বললে ভুল হবে, দুবার। মেয়েটি চেয়ার ছাড়ে। দ্বিতীয়বার ও যায় টাকা আনতে। টাকার বান্ডিলটা প্রায় না গুনে সাপের চামড়ার বাহারি ব্যাগটায় পুরে কোনওদিকে না তাকিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যায় তৎক্ষণাৎ। তারপরের রেসগুলোর জন্যে বসে থাকে না। একটাই রেস খেলতে আসে ও, খেলে, জেতে এবং চলে যায়। এই গ্র্যান্ড এনক্লোজারে ওর চেয়ে সুন্দর বা অসুন্দর বিচিত্র পোশাকের অনেক মেয়ে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে যাদের সঙ্গে এক বা একাধিক সঙ্গীকে দেখা যাবেই–কিন্তু এর সঙ্গে কাউকে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না সুজয়। অতএব রেসে কেউ-কেউ জেতে। চুপচাপ জিতে চলে যায়। আজ তাই কোনওরকম প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে আসেনি সুজয়। এমনকী ঘোড়ার নামগুলো অবধি আগে থেকে আজ ও দ্যাখেনি। আজ ওকে জিততেই হবে। সতর্ক চোখে মেয়েটিকে খুঁজতে লাগল ও। টাকার দরকার, ভীষণ টাকার দরকার।

একটু-একটু করে লোক জমছে। বুকিদের কাউন্টারের সামনে ছোট-ছোট জটলা। বেশ একটা। উৎসবের মেজাজ এখন। বিকেলে এটা হয়ে যাবে শ্মশানের মতো। অজস্র বাতিল টিকিটে ছেয়ে যাবে মাঠ। মানুষের হাড়ের মতো। শুধু বুকিরা দাঁত বের করে হাসবে। তবু লোকে টাকা দিয়ে। ঢুকছে মাঠে। টাকায় টাকা আনে।

প্যাডকের দিকে তাকাল ও। সহিসরা এক-একটা নম্বর দেওয়া ঘোড়ার লাগাম ধরে প্যাডকে ঘুরছে। দৌড় শুরু হওয়ার আগে দেখিয়ে দেওয়া হয় ঘোড়াগুলোকে। জহুরি যে সে ঠিক চিনে নেবে কোন ঘোড়াটা ফিট। হুমড়ি খেয়ে দেখছে সবাই। সুজয় প্যাডকে গেল না আজ। ঘোড়া দেখে কিছু বোঝে না ও।

বারের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল সুজয়। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। এবার ঘোড়াগুলো স্টার্টিং পয়েন্টে যাবে। কেতাদুরস্ত নিয়ম-কানুন। রাজার খেলা। বুকিদের কাউন্টারে উত্তাপ বাড়ছে। টোটে এক নম্বর ফেবারিট। বোর্ডে কাঁটা প্রায় ইভন মানি ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বুকিদের কাউন্টারে দুনম্বর হট ফেবারিট। দশ টাকায় নটাকা প্লাস ট্যাক্স। মরিয়া হয়ে লোকে মারামারি। করে একশো হাজার লাগাচ্ছে। ক্রমশ বোর্ডে দু-নম্বর ফেবারিট হয়ে গেল। নিশ্চয়ই টালা টু। টালিগঞ্জ খবর হয়ে গিয়েছে ঘোড়াটার মৃত্যু নেই। জকি-ওনার-ট্রেনার অল কনসার্ন লাগাই হচ্ছে নিশ্চয়ই। একজন সিনেমা স্টারকে নিতম্ব দুলিয়ে চলে যেতে দেখল সুজয়। কিন্তু না, সেই মেয়েটি কোথাও নেই। মেইন গেট দিয়ে জনস্রোতের মতো যারা ঢুকছে তাদের মধ্যেও মেয়েটিকে পেল না ও। এখনও এল না কেন? পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালের ঘাম মুছল সুজয়। একটা কুইনেলা খেললে কেমন হয়। দশ টাকা মাত্র রিক্স। এক-দুই। এ দুটোর মধ্যেই রেস। কিন্তু না, নিজেকে সতর্ক করল ও, আজ আর হারতে আসনি তুমি। মেয়েটাকে দেখার আগে কোনও রিক্স নয়। এই রকম ভেবে নিয়ে না খেলে বেশ হালকা লাগল ওর। তিন বছরে এই প্রথম ও মাঠে। আছে এবং একটা রেস হতে যাচ্ছে অথচ ও টাকা লাগাচ্ছে না। আঃ!

সারা মাঠ জুড়ে চিৎকার, প্রথম বাজি শুরু হয়েছে। যে যার পছন্দমতো ঘোড়ার নাম ধরে চেঁচাচ্ছে। ঘোড়াগুলো এখন বাঁক নিচ্ছে। জকিরা টানটান। এখনও প্রায় দশ গজ দূরে ওরা। দু নম্বর ঘোড়ার নাম শুনতে পেল সুজয়। মাইকে রিলে হচ্ছে। একটা হেঁড়ে গলা চেঁচিয়ে উঠল, মাই ফরচুন ইন এ ও-য়া-ক। কিন্তু হঠাৎ সব স্তব্ধ হয়ে গেল কেন? ঘোড়াগুলো প্রায় এসে গিয়েছে। মাইক স্তব্ধ। গোঁড়ালি উঁচু করে সুজয় দেখল একটা ঘোড়া সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনায় জকি প্রায় শুয়ে পড়েছে ঘোড়ার ওপর। আশ্চর্য, কেউ ঘোড়াটার নাম ধরে চেঁচাচ্ছে না। উল্লাস নেই কোথাও। সমর্থন ছাড়াই ঘোড়াটা জিতে গেল। আট নম্বর ঘোড়া। বই খুলে। ঘোড়াটার নাম দেখতে গিয়ে চমকে উঠল সুজয়। পাউসিকি, থার্টি টু ওয়ান বোর্ডে। কেন যেন বলল, চুরি–এ নির্ঘাত চুরি। শালা বি ক্লাসের বাজি খেলাই মুশকিল। কানু মিত্তিরের কথা মনে পড়ে গেল ওর। পাউসিকিও বাজি জেতেরেসে কি না হয় কানুদা। তুমি দেখলে না।

এখন একটা আলস্য চারধারে। কেমন একটা থিতিয়ে যাওয়া ভাব। যে যার হেরে যাওয়া টিকিট কার্ড দুমড়ে-মুচড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে মাঠে। এক-একটা দশটাকা একশো টাকার কাগজ সব। হঠাৎ বাতিল হয়ে গেছে যেন। ঘোড়া জিতলে এর মূল্য হয়ে যেত অনেক গুণ। এক মুহূর্তেই দাম কেমন পালটে যায়।

আবার বারের কাছে ফিরে এল ও। না, এখনও সেই মেয়েটি আসেনি। পাড়ার এক বয়স্কজন। সুজয়কে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। রেসের মাঠে কেউ সহজে ধরা দিতে চায় না।

পায়চারি করতে-করতে গ্যালারির দিকে এল সুজয়। ঠাসবোনা সোয়েটারের মতো গ্যালারি। কিন্তু মেয়েটা কোথাও নেই। ও অবশ্য গ্যালারিতে আসে না–তবু। তাহলে কি আজ আসবে না? নাকি অসুখ-বিসুখ হল কিছু? ভাবাই যায় না। একটা মেয়ে, একদম চকচকে তরতাজা একটা। মেয়ের অসুখ করেছে, বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে ভাবাই যায় না। সুজয়ের ধারণা, সুন্দরী মেয়েদের অসুখ কম করে, করেই না বলা যায়। আর যদি একবার করে তবে তাকে ফিরে পাওয়া বড় মুশকিল।

একটা বুড়ো নিগ্রোর ওপর চোখ পড়ল। সাদা গ্যালারির নিচে বসে ঝকঝকে দাঁতে হাসছে। নিগ্রোটার কোল ঘেঁষে একটা ফিরিঙ্গি যুবতী যার পরনে মিনিস্কার্ট আর নাইলনের স্লিভলেশ আঁটো গেঞ্জি, ঝুঁকে পড়ে রেসবুকে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখাচ্ছে। বয়স হলেও নিগ্রোটি খুব স্মার্ট, সাদা ধবধবে কোঁকড়া চুলগুলো অলঙ্কারের মতো। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে আকাশের দিকে মুখ করে চুমু খেল। সুজয় দেখল মেয়েটা হেসে টাকাটা নিয়ে তরতর করে গ্যালারি থেকে নেমে প্যাসেজ দিয়ে বুকিদের কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দার মতো পা চালাল সুজয়। নিশ্চয় কোনও খবর পেয়েছে মেয়েটা। এইসব বিলাসিনীদের ঘরে জকিদের টাউটর যাওয়া-আসা করে। মেয়েটির পেছন-পেছন সুজয় চলে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, মেয়েটি টোট কাউন্টারের বা বুকিদের কাছে না গিয়ে একটু ঘুরে প্যাডকের পাশে বড় গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সুজয় দেখল একটা অ্যাংলো ছোঁকরা এগিয়ে এল চোরের মতো মেয়েটির কাছে।

হুইচ ওয়ান য়ু টোন্ড? নাম্বার টেন?

সুরেলা গলায় মেয়েটি জবাব দিল, ইয়েস।

গুড। প্রফুল্ল মুখে পকেট থেকে একটা বেটিং কার্ড বের করে কী লিখল ছেলেটি! নাউ শো হিম দি কার্ড। টেন টু ওয়ান প্রাইজ।

সুজয়ের মনে হল মেয়েটি দারুণ রকম নার্ভাস হয়ে পড়েছে। কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল, বাট ডার্লিং–।

কথাটা শেষ করতে না দিয়ে দাঁত বার করে বলল ছেলেটি, ওঃ বি স্টেডি, উই মাস্ট টেক দি চান্স।

একটা জাল বেটিং কার্ড নিয়ে ফিরে যেতে দেখল মেয়েটাকে ও। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সুজয়। বুড়ো নিগ্রোটার জন্যে কেমন দুঃখ হল ওর। আচ্ছা দশ নম্বর এই বাজিতে যদি জিতে যায় তাহলে মেয়েটি কী করবে। নিগ্রোটা নিশ্চয় টাকা আনতে বলবে ওকে। কিন্তু তা হল না, দ্বিতীয় বাজিতে দশনম্বরকে খুঁজেই পেল না সুজয়। জিতল হট ফেবারিট চার নম্বর।

উই মাস্ট টেক দি চান্স। সবাই চান্স নিচ্ছে। হয় হেড নয় টেল। চান্স না নিলে বেঁচে থাকাই যায় না। হয় তোমার পকেটের একশো টাকা খতম, নয় টেন টু ওয়ানে হাজার হাজার থেকে লক্ষ, তারপর অনেক লক্ষ, চেকগুলো পকেটে পুরে যখন তুমি বাইরে পা রাখবে তখন খিদিরপুর রোডে দশইঞ্চি পুরু গালচে বিছানো, লন্ডন প্যারিস কলকাতার খুশি ঘরগুলোর মালিক তোমাকে সেবা করছে–উই আর অ্যাট ইওর সার্ভিস স্যার।

বারের টেবিলে ফিরে এল সুজয়। গমগম করছে বার। তিলধারণের জায়গা নেই কোথাও। একটা চেয়ার খালি হতেই সুড়ুৎ করে সুজয় বসে পড়ল। তিনটে পাৰ্শি বুড়ি গুলতানি করছে টেবিলে। সুজয়ের ডানদিকে একটা মাদ্রাজি বুড়ো, চোখ মুখ গলায় বয়স বাচ্চা ছেলের সিকনির মতো ঝুলে আছে। চোখের পাতা সাদা হয় এই প্রথম দেখল সে। ওকে দেখে খুকখুক করে কাশল বুড়োটা। তারপর দক্ষিণী সুরে ইংরেজি বলল, লস অর গেইন?

সুজয় ঘাড় নাড়ল। কী বুঝল কে জানে, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, আই অ্যাম ফিনিশড। বেইট ফাইভ হান্ড্রেড–নো ডিভিডেন্ড। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের থুতু মুছল লোকটা, ইউ উইল নেভার উইন।

মুখ ঘুরিয়ে নিল সুজয়। শালা ঘাটের মড়া আর দিব্যজ্ঞান ছড়াবার জায়গা পেলে না।

ঠিক সেই সময় সুজয়ের বুক টইটুম্বর হয়ে গেল। বুকিদের কাউন্টারের পাশ দিয়ে একটা স্বপ্নের মতো মেয়েটি আসছে। প্রথমটায় একটু ধন্দ লেগেছিল সুজয়ের। না, বেলবটম বা স্কার্ট পরেনি ও। হালকা ঘিয়ে রঙা একটা শাড়ি লতানো গাছের মতো ওর শরীর আঁকড়ে আছে। মেয়েটি ক্রমশ সামনে এগিয়ে এল। যেন চোখ আড়াল করা সমুদ্র তার অনেক ঢেউ নিয়ে দুলছে। সুজয়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে বারের মধ্যিখানে দাঁড়াল সে। একটা মিষ্টি ঝিমঝিমে গন্ধ নাকে এল সুজয়ের। বারের সবাই দেখছে মেয়েটাকে। অনেকের চোখ চকচক করছে এখন। সুজয় হঠাৎ উঠে। দাঁড়াতেই মেয়েটি ঘুরে ওর দিকে তাকাল। সুজয়ের মনে হল ওর পায়ের পাতা সিরসির করছে, প্লিজ বি সিটেড।

মেয়েটি আলতো পায়ে এগিয়ে এল, যেন এই চেয়ারটা ওর জন্যেই ছিল এমন ভঙ্গি। টেবিলের। ওপর সুদৃশ্য সাপের চামড়ার ব্যাগটা রাখতেই মাদ্রাজি বুড়ো নাক কোঁচকাল একবার। বোধহয় ঝিমঝিমে গন্ধ সহ্য হয় না বুড়োর। চেয়ারের পাশ থেকে লাঠিটা তুলে নিয়ে উঠে পড়ল বুড়ো। যাওয়ার সময় সুজয়কে খসখসে গলায় বলে গেল, প্লিজ বি সিটেড।

পারলে একটা চুমু খেয়ে ফেলত সুজয় মাদ্রাজিটাকে, কিন্তু ও মুখ চোখ স্বাভাবিক করে বসে পড়ল। আর তখনই সেই ঠান্ডা বরফের মতো ধারালো গন্ধ ওর সমস্ত সত্তায় ছড়িয়ে পড়ল। সুজয় দেখল মেয়েটি সামান্য মুখ তুলে বারের দেওয়ালে রাখা টেলিভিশন সেট দেখছে। কয়েকটা ঘোড়াকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে।

মেয়েটি বসেছে ঈষৎ ঝুঁকে। সুজয় মেয়েটির খোলা পেটের দিকে চোখ রাখল। অনেকখানি, একটা মুখ চেপে ধরলেও অনেকখানি জায়গা পড়ে থাকবে এমনি এমনি। পালিশ করা চামড়ায় কী মোলায়েম ভাব ছড়ানো। কিন্তু একটা দুটো মৃদু ঢেউ ছাড়া সেখানে কোনও আলোড়ন নেই। বুকের দিকে তাকিয়ে একটু থতমত খেয়ে গেল সুজয়। এরকম গলাটাকা ব্লাউজ আজকাল কেউ পরে!

মেয়েটি সাপের চামড়ার মুখ খুলল। একটা ছোট্ট ডায়েরির পাতায় কী দেখল। নিশ্চয়ই ঘোড়ার নাম। সেই বিশেষ ঘোড়াটি যে হারবে না। সুজয়ের ইচ্ছে হল ডায়েরিটা কেড়ে নেয়–নামটা দ্যাখে। মেয়েটা ঘুরে সুজয়ের দিকে তাকাতেই ও হেসে ফেলল। সেই পরিষ্কার মাপা হাসি, ইউ আর লেট টুডে।

মেয়েটার ঠোঁটের কোণে একটু ভাঁজ পড়ল, বিরক্তির? তারপর খুব পরিষ্কার এবং প্রতিটি শব্দ যেন বাস্কেটবল খেলছে এমন ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করল, আপনি আমাকে চেনেন?

গলার কাছে কী একটা হয়ে গেল যেন, সুজয় কথা না বলে ঘাড় নাড়ল। মেয়েটি বাঙালি! আশ্চর্য! অথচ অ্যাংলো সিন্ধ্রী গুজরাটি যা কিছু ভাবা যায় মেয়েটিকে। তারপর বলল, আজ আপনার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি।

কারণ? আপনাকে তো আমি চিনি না। কৌতূক না কৌতূহল বোঝা গেল না।

আমিও না। তবে–কিছু খাবেন? সুজয় এখন প্রস্তুত।

না। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল মেয়েটি। তারপর বুকিদের কাউন্টারের ওপর চোখ রাখল। হঠাৎ বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার, বুকিদের ছোটাছুটি। বারের কিছু লোক দৌড়ে গ্যালারির দিকে চলে গেল। আর একটা রেস হচ্ছে। কে জিতল, উদগ্রীব হল সুজয়। কিন্তু মেয়েটি নির্লিপ্ত–যেন তেতলা বাড়ির জানলা থেকে রাস্তা দেখছে।

মাফ করবেন, রেসের মাঠে বসে আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না। মেয়েটি মুখ ঘোরাল।

জানি, সব জানি। সুজয় হাসল।

তৃতীয় রেস শেষ হয়েছে। সুজয় দেখল একটা ছেলে খুব চেঁচাচ্ছে। জিতেছে বোধহয়। জিতলেই পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়।

খুব অবাক মেয়েটি এমন ভঙ্গি, তবে?

ইচ্ছে হল। এক-একটা ইচ্ছে হয় যার কোনও মানে থাকে না। কিন্তু ইচ্ছে হলে ভালো লাগে, তাই। কথাটা বলে সুজয় ডায়েরির দিকে তাকাল।

মেয়েটি হাসল, আপনার কথা শুনে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু এখানে আমার ওপর অনেক নজর আছে, বুঝলেন?

নজর আছে? ঠিক বুঝল না সুজয়। ওর ইচ্ছে হল মেয়েটির দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলে আমাকে বাঁচান, আমি আজ হারতে চাই না।

সুজয় বলল, আজ কিছু খেলবেন না?

মেয়েটি হাসল। চোখ বন্ধ করে কী ভাবল। তারপর ডায়েরির পাতাটা সমান করে ধরল। সুজয় দেখল সেখানে তিন নম্বর লেখা। সাদামাটা তিন। প্রায় ছিটকে পড়ল সুজয়। আঃ, তিন নম্বর! চোখের সামনে অনেক টাকা উড়ে যেতে দেখল ও। কত দর থাকবে তিন নম্বরের?

মেয়েটি কী একটা বলল। সুজয় আর অপেক্ষা করতে পারছে না। প্রায় দৌড়ে নেমে এল ও বুকিদের কাউন্টারে।

তিন নম্বর ঘোড়ার সব বেশিদর সিক্স-টু-ওয়ান। আপসেটই বলা যায়। দর আরও বাড়বে। ছয় নম্বর হট ফেবারিট। খুব খাচ্ছে বুকিরা। ওপেন বোর্ডে তিন নম্বর সেভেন টু ওয়ান। ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল সুজয়। পকেটের একশোটাকা এখন ওর হাতের মুঠোয়। ঘাম জমছে হাতে। হঠাৎ চমকে উঠল ও। একটা বুকি তিন নম্বরকে ফাইফ টু ওয়ান করে দিল। প্রায় পড়িমড়ি করে সিক্স-টু-ওয়ানে পুরো টাকা লাগিয়ে দিল ও। আশি টাকা প্লাস ট্যাক্স। জিতলে পাঁচশো ষাট। ভীষণ আপসোসে মাথা ঝাঁকাল ও। আজ যদি পকেটে হাজার টাকা থাকত, ছহাজার কে। আটকায়।

বেটিং কার্ডটা হাতে নিয়ে আসতে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাঠেই আলাপ। ভালো ক্যালকুলেশন করেন। সুজয় একগাল হেসে বলল, তিন নম্বর খেলুন।

উৎসুক গলায় ভদ্রলোক বললেন, তিন নম্বর কোন ঘোড়া?

সুজয়ের এতক্ষণে মনে পড়ল তিন নম্বরের নামটাই সে জানে না। ওকে বই খুলতে দেখে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন, কি মশাই, ঘোড়ার নামই জানেন না অথচ খেলতে বলছেন, বাঃ! চলে গেলেন ভদ্রলোক। সুজয় নামটা পড়ল লাকি স্টার। ওজন সাতান্ন, জকি ইভান্স। ওর ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে ভদ্রলোককে ডাকে। ডেকে কার্ডটা দেখিয়ে বলে এই দেখুন মশাই আমি খেলেছি–আপনাকে ব্লাফ দিইনি।

গ্যালারির একটা ভালো জায়গা দেখে বসল সুজয়। এখান থেকে পুরো মাঠটা দেখা যায়। ওভাল সাইজের মাঠ। প্রচুর লোক হয়েছে আজ। জ্যাকপটের প্রথম লেগ। সারা মাঠ জুড়ে উত্তেজনা। ঘোড়াগুলো যাচ্ছে স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে। ওই যে তিন নম্বর যাচ্ছে। দুধের মতো সাদা। এটা আট ফার্লং-এর রেস। ওপেন বোর্ডের দিকে তাকাল সুজয়। তিন নম্বরের কাঁটা নেমে এসেছে। টেন-টু-ওয়ানে। বুকের মধ্যে হাঁপ ধরল সুজয়ের। নন ট্রাই নাকি ঘোড়াটা। কিন্তু অসম্ভব–এ ঘোড়া জিতবেই। মেয়েটিকে কখনও হারতে দ্যাখেনি সে। তারপর হঠাৎ মনে হল ব্যাপারটা। মেয়েটা ওকে তিন নম্বর বলেছে, সেটা তো এই রেসের নাও হতে পারে। এর পরের বাজির তিন। নম্বর যদি হয়। মেয়েটি যেন কী বলছিল ওকে। কেমন ঠান্ডা একটা স্রোত ওর সারা শরীরে ভেসে বেড়াতে লাগল। শেষ সম্বল একশো টাকা। না, হতেই পারে না। মেয়েটি এই তিন নম্বরই। বলেছে। নিজেকে বোঝাল ও। এই তিন নম্বরই।

বাঁ-দিকে যে ভদ্রলোক বসে আছে তার মুখ দেখে চমকে উঠল সে। লোকটার ছবি প্রায়ই কাগজে বের হয়। প্রচুর বড়লোক। স্যুটটা কি বিলেতের তৈরি? টাই পিনটা আলবাত হীরের। ভদ্রলোকের হাতে ধরা কার্ডটার দিকে তাকাল ও। ইভন মানিতে পাঁচ হাজার লাগিয়েছেন ছয় নম্বর ঘোড়ায়। ডাবল ফাইভ ফাইভের প্যাকেটের সঙ্গে আলতো ভঙ্গিতে ধরে রেখেছেন ভাবী দশ হাজারের প্রতিশ্রুতিপত্র। সুজয় হাসল, গেল তোমার টাকা। তিন নম্বর মাস্ট উইন।

রেস শুরু হল। মাইকে রিলে হচ্ছে। এক নম্বর লিড করছে। ছয় নম্বর খুব ভালো সেকেন্ড পজিশনে আছে। তিন নম্বরের নাম শুনতে পেল না সুজয়। উত্তেজনায় সমস্ত মাঠ দাঁড়িয়ে। কে যেন চেঁচাল নাম্বার সিক্স ইন এ ওয়াক। শালা। সুজয়ের মেরুদণ্ড টনটন করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না ও। বাঁক ঘুরল ঘোড়াগুলো। ছয় নম্বর এগিয়ে আসছে মেজাজে। পাশের ভদ্রলোক ডাবল ফাইভ ফাইভ ধরালেন। জ্যাকপটের প্রথম লেগের ফেবারিট ঘোড়ার কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। সুজয় দেখল একদম পেছন থেকে একটা কালো তীর সাঁ করে বেরিয়ে। আসছে। আউটসাইড দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সে ছয় নম্বরকে ছুঁয়ে ফেলল। সমস্ত মাঠ বোবা হয়ে গেল। পাশের ভদ্রলোক বললেন, অ্যানাদার আপসেট। সুজয়ের শরীর থরথর করে কাঁপছে, সাত নম্বর ঘোড়া জিতে গেল।

মুহূর্তেই একটা সামুদ্রিক গর্জন শুরু হয়ে গেল মাঠে। কি ভীষণ ক্লান্তিতে সুজয় বসে পড়েছিল বেঞ্চিতে, এখন দেখল সমস্ত মাঠ আহত পশুর মতো চিৎকার করছে। শালা চুরি–চুরি ছাড়া আর কিছু নয়। যে ঘোড়া আজ অবধি প্লেসে আসেনি সে জেতে কী করে। মানি না, সাত নম্বরকে জেতালে চলবে না। মেম্বার এনক্লোজারের ওপর ঢিল পড়ছে। সমস্ত মাঠ জুড়ে অস্থিরতা। সেকেন্ড আর গ্র্যান্ড এনক্লোজার এক হয়ে গেল। কেউ কোনও বাধা মানছে না। সুজয় দেখল পুলিশ এসে গেল ঢাল নিয়ে। তাড়া করছে পুলিশ। একদল লোক রেসিং ট্রাকের ওপর শুয়ে পড়ল। আর রেস হতে দেবে না। মাইকে ফায়ারিং-এর শব্দ হল–নাকি টিয়ার গ্যাস। মেয়েরা ভয়ে কাদা। হামলা হচ্ছে স্টুয়ার্টদের ওপর। ওরাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। বাতাসে চোখ জ্বালা করছে। সুজয় শুনল পাশের ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, যাক এ্যাদ্দিনে রাজার খেলা জনতার হয়ে গেল। ভীষণ বিরক্তিতে হাতের কার্ড মুচড়ে ফেলে দিয়ে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।

হুড়মুড় করে মানুষজন ছুটছে গেটের দিকে। পালাচ্ছে সবাই।

কয়েকটি উৎসাহী ছেলে বাঁশ নিয়ে তাড়া করছে বুকে ব্যাজ ঝোলানো মেম্বারদের। একজন চেঁচিয়ে বক্তৃতা করছে–আমাদের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না, চলবে না। শেষপর্যন্ত পুলিশ অ্যারেস্ট আরম্ভ করল। খেপে গেল জনতা।

নির্লিপ্তের মতো বসে-বসে দেখল সুজয়। চোখ বন্ধ করে মেয়েটার মুখটা মনে করতে চাইল। তুমি আমাকে জয়ের খবর দিলে মেয়ে–এ আমি কি জিতলাম? শেষ সম্বল একশো টাকা–সুজয়ের ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে কাঁদে।

এমন সময় মাইকে ঘোষণা হল, স্টুয়ার্টরা ভীষণ দুঃখের সঙ্গে মাঠের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে আজকের মতো রেস ক্যানসেল করে দিচ্ছেন।

কোথায় কী! চিৎকার সমানে চলেছে। কাঠের গ্যালারির এক পাশে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আগুন লাগল বুঝি। জনতা চেঁচাচ্ছে–শুধু আজকের রেস নয়, ওই হয়ে যাওয়া রেস ক্যানসেল করতে হবে। হবে হবে হবে। আবার কিছুক্ষণ কোলাহল। তারপর শেষপর্যন্ত মাইকে ঘোষণা হল, সব রকম দিক বিচার করে রেস ক্যানসেল করে দেওয়া হচ্ছে। যারা যে টিকিট ওই রেসে কেটেছেন, লাইনে দাঁড়ান টিকিট বা কার্ড দেখিয়ে দাম ফেরত নিয়ে নিন।

মুহূর্তে একটা উল্লাস-খুশির একটা ঢেউ গড়িয়ে গেল মাঠে। সুজয়ের হঠাৎ মনে হল তার একশো টাকা যায়নি–এটা সে ফেরত পাবে। ভাগ্যিস কার্ডটা সে ফেলে দেয়নি। সুজয়ের চোখে পড়ল সারা মাঠ জুড়ে মানুষ উবু হয়ে বসে ফেলে দেওয়া এই রেসের টিকিট খুঁজছে। যারা হেরে গিয়েছে ভেবে টিকিট ফেলে দিয়েছিল তারা পাগলের মতো মাঠ হাতড়াচ্ছে। সুজয়ের চোখে পড়ল পাশের ভদ্রলোকের ফেলে দেওয়া কার্ডখানা। ভিখিরির মতো ছোঁ মেরে তুলে নিল সে। হাত দিয়ে কোঁচকানো কার্ডটা সমান করল। পাঁচ হাজার। সুজয়ের মাথা ঘুরতে লাগল। কাউন্টারে একটা দেখালেই সে পাঁচ হাজার পেয়ে যাবে। আর একটা একশো টাকার টিকির পেল সুজয়। ক্রমশ সুজয় মাঠের হাজার-হাজার মানুষের মতো হাঁটু গেড়ে ধুলো ঘেঁটে বাতিল টিকিট খুঁজতে শুরু করে দিল। কলকাতার মাটিতে কত টাকা-খুঁজে নিলেই হল। ওই তো একটা দশ টাকার টিকিট। বাঃ। সুজয় দেখল তার পাশে বসা ভদ্রলোক উবু হয়ে কার্ড খুঁজতে-খুঁজতে ওপরে আসছেন। সরে এল সে। সরতেই মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল একটা ছোঁকরার সঙ্গে। সঙ্গে-সঙ্গে একটা থাপ্পড় কষালো সুজয়। রেস মাঠের নোংরা পরিষ্কার করা ছেলের দলের একটা।

হাত দিয়ে অনুভব করছিল সুজয় পকেটের ওজন বাড়ছে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে-দেখতে মাথা দোলাল। হাজার-হাজার কোট টাই ধুতি শাড়ি মাটিতে

গড়াগড়ি করে ছুটে বেড়াচ্ছে। মানুষ বলে মনে হচ্ছে না কাউকেই। হাত প্রসারিত, পিঠ আকাশের দিকে ধনুকের মতো বাঁকানো। কেমন একটা ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ হচ্ছে। মেরুদণ্ড কি সহজে গোল হয়ে গেছে সবার। শুয়োরের মতো দেখতে লাগছে আচমকা। কিন্তু তবু সুজয়ের মনে হল, মেরুদণ্ডের এমন চমৎকার খেলা আর কেউ খেলতে পারে না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments