Sunday, April 28, 2024
Homeবাণী-কথাপরী - আলাউদ্দিন আল আজাদ

পরী – আলাউদ্দিন আল আজাদ

একেবারে পিছনে ঘনঘোর রাক ঝাড়ের কাছাকাছি ছনের তৈরি মোল্লাবাড়ির রান্নাঘর। একটু বাতাস বইলে চালের ওপর যে ন্সর আওয়াজ হয়, তা যেন বাঁশপাতার নয়, ভূতপ্রেতের ফিসফিসানি, কানাকানি; নিশুতি রাত্রে সেই একটানা করুণ সুর শুনলে দেহের রক্ত ঠাণ্ডা হিম হয়ে যেত কতক্ষণ। বেড়াগুলোও প্রজার, বেশি মজবুত নয়, ঘরে ঢোকবার জন্য খুব কায়দা করার প্রয়োজন নেই, ভোতা একটা দা দিয়ে কয়েক মিনিট কোপালেই যথেষ্ট। উপরন্তু, বড়ঘর থেকে অন্তত দশহাত দূরে, যদিও দুই ঘরের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধের জন্য বারান্দার ওপর দিয়ে আছে কেরোসিন-টিনের চাল, এসব কারণে এখানে কোনো অঘটন ঘটলে বাড়ির ভেতরের লোকের চট করে জানবার কথা নয়।

কিন্তু জীবনে এমন মুহূর্তও তো আসে যখন দুনিয়ার সমস্ত রকম ভয়-র নেহাত তুচ্ছ মনে হয়?

আজ পরীর অবস্থাও তাই, নইলে সোয়ামির ঘর থাকতে এমন অন্ধকার রাত্রে এই রান্নাঘরে এসে শোবে কেন?

সারাদিন মোন্নাবাড়ির হাঁড়ি ঠেলবার পর এক থালা ভাত রকারি নিয়ে গিয়েও রেহাই পায়নি। পেট ভরে খেয়ে উঠেও কিনা লোকটা গায়ে হাত তুলল। তাও যে সে মার নয়! কিল চাপড় দেখা যায় না, কিন্তু রোজ রোজ কাঁচা শরীরে কত সয়? শেষমেষ যে একটা লাথি মেরেছিল তা কোঁকে লাগলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যেত হয়তে। বিয়ের সময় দুই কুড়ি পাঁচ টাকা খরচ করেছিল বলে এমনভাবে মেরে ফেলবার অধিকার তার নেই! নসিব, সব নসিব! নইলে এমন জামাইয়ের হাতে পড়বে কেন রী। চোরের চেয়ে চাষাভুষা অনেক ভালো। বয়েস আছে, এখন তালাক দিয়ে দিলেই সে বাঁচে; কিন্তু মাঝে মাঝে মিষ্টি মিষ্টি রঙ্গরসের কথাও যে বলে। চুরিধারি করে হলেও শাড়িটা-চুড়িটা এনে দেয়। সেদিন এনেছে সুবাসী তেল, আর এক ডিবে সোননা। বোঝা যায়, মিনসে সহজে ছাড়বে না। যদি না ছাড়ে, সে পালিয়ে যাবে শহরে বন্দরে কোথাও।

তবু, দোষ পেয়ে মারলে তা সওয়া যেত; কিন্তু এ যে অকারণ অত্যাচার। নিজে চুরি করে বলে তাকেও চুরি করতে বললে নারাজ হবে না?

এতবড় মোগ্লাবাড়িতে কোথায় কোন্ জিনিসটা থাকে তার স্বই জানে পরী এবং ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই সরাতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি সে ঘরে আগুন দেবে? এ কাজ সে করবে কিসের জন্য? জানে খেটে খেয়ে না খেয়ে এমনিতেই দিন কেটে যাচ্ছে। জানে মতিগতি সুবিধে নয়, সারাদিন পড়ে ঘুমোয় আর রাত্রে বেরিয়ে পড়ে। এও না হয় সহ্য করা গেল, কিন্তু তার অন্য নজরও আছে: প্রথম বৌকে ছেড়ে ওকে বিয়ে করেছে, এবং গোটা চল্লিশেক টাকা জমাতে পারলে আরেকটা বিয়ে করতে পিছপা হবে না। আর সতীনের ঘর করার চেয়ে পরের বাড়িতে বাদি হয়ে থাকায় বরং বেশি সুখ।

কুঃ! কুঃ! ঘরের চালের কাছে বাঁশঝাড়ে পাচা ডাকছে পরী এতক্ষণ শুনতে পায়নি, হঠাৎ খেয়াল করলে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। প্যাচার এই একটানা বীভৎস ডাক নাকি মৃত্যুর সংকেত। কা’র মরণ ঘনিয়ে এসেছে।

বাঁশের ঝাঁপটা টেনে দেওয়া ছিল, সেটা একসময় মম শব্দে ফাঁক হয়ে গেল। প্রথমে একটা কালো হাত, তারপর গোটা কালো লোকটাই দরজার কাছে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ কি ভেবে নিয়ে ঝাঁপটা আরেকটু ঠেলে ভেতরে চলে আসে। পরীক্ষা এতক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি, কিন্তু জেগে থাকলে কি হবে হঠাৎ যেন তাকে বোবায় পেয়েছে। চিৎকার করার বদলে সে ভয়ে জমে গেল।

কাঁথার ধারে বসে গায়ে হাত দিলে বুঝতে বাকি রইল না কিছু। কিন্তু বুড়ো লোকটাও এরাত জেগে থাকতে পারলো? ঘুমের ভান করে পরী নিপ পড়ে থাকে।

.

প্রথম যেদিন এবাড়িতে কাজ করতে আসে সেদিনই দুপুরে ধনু মোল্লার মেজাজ দেখে অনেকে অবাক হয়েছিল। নাম নিলে হাঁড়ি ফাটে এমন কিপটে। বাপের কিছুই ছিল না, কেবল এই গুণটি থাকাতে এখন সেরা গেরস্ত, গ্রামের প্রধান। যুবা বয়েসেও নেংটি মত গামছা পরে থেকেছে, সে অভ্যেস ভুলতে পারেনি বলেই হয়তো এখনো একটা কম-উসারী লুঙিই শীত-গ্রীষ্মের সম্বল। মার্কিন কাপড়ের একটা ফতুয়া আছে বাজারে গেলে আর জুম্মার দিনে সেটা পরে। এমন লোক, নিজেরা যাই খাক, মুনি মজুরদের জন্য শেওড়া গোটার মতো মোটা চালের ভাত আর লম্বা ডালের ব্যবস্থা করলে তাতে আর বিচিত্র কি? কিন্তু সেদিন রীকে ভাজা রুইমা টুকরো না দেওয়াতে বউঝিদের অনেকক্ষণ গালাগাল করেছিল।

মেজো বলল, আমার নতুন মা অইব পরী, হের লাইগা বাজানের অমুন গোব্য। ননদের কথা শুনে বৌরা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বড় বৌ বলল, মেসাহেব একটা নিহা করাইলে ভালোই অয়।

মোল্লাকে কেন পরী নানা ডাকল সে নিজেই জানে না, হয়তো থুৎনিতে পাকা দাড়ি আর মাথায় গোলটুপি দেখে এর বেশি ভাবতে পারেনি। নানা ডেকেছে বলেই ওদের কথাগুলো কাছে থেকেই হজম করল। নইলে ফড়িং-এর মতো মেয়েটি হলে কি হবে, ও কম মুখরা নয়, বৌদের বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিত।

দুতিনটা নাতিনাতনি নিয়ে বড় ঘরে থাকে মোল্লা। পঞ্চাশ সালের রায়টের সময় বুড়ি এন্তেকাল করেছেন। ছেলেরা উপযুক্ত, বেশ জোয়ান জোয়ান, এবং তারাই চাষবাস থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় ব্যাপার দেখতে পারে। কিন্তু বাপকে মানিয়ে রাখতে পারে না এখনো সারাদিন কাজ করে ঠিক আগের মতে বাড়ির সকলে যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন উঠে একটা হাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাঠের উদ্দেশ্যে। নয় যায় জমি দেখতে। ক্ষেত্রে কাজ না থাকলে বেতেরকাজ। তার হাতের তৈরি বুচুন বিখ্যাত; একেকটা দশটাকা পর্যন্ত বিক্রি যায় কিনা কথায়। জোরের কাজেও যে কজি শক্ত আছে সে একদিন বুঝেছিল তখন দেখে এবড় লোহার সিন্দুকের ডালাটা বাঁ হাতে কেমন অনায়াসে তুলে ফেলল। কলকের মধ্যে নিটে টিকে ধরিয়ে রেখে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিতে দিয়ে গিয়েছিল পরী, কাছে থেকেই মোল্লা মুখ তুলে চাইল, চোখ শিকার করে বসল, দ্যাখ, পরী দেইখা যা।

মোল্লা সিন্দুকের ওপরে ঝুঁকে ছিল, পরী ইতস্তত করলে অতর্কিতে হাত বাড়িয়ে ওর বাঁ হাত ধরে ফেলল। টেনে কাছে এনে আবার বলল, দ্যাখ কত জেওর।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেনে দেখে সত্যি সিন্দুকের ভিতরে এক প্রস্থ কাপড়ের ওপর অনেকগুলো সোনারূপার অলঙ্কার। চুড়ি বালা লটকন নাকফুল গোলখাউরা, সবই আছে। ধনু মোল্লা ডান হাত বাড়িয়ে একটা মাদুলি ছড়া তুলে আনল, ওকে দিতে গিয়ে বলল, গলাৎ পিনছান দেহি। র নানির জেওর।

পরী হাত ছাড়িয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল, না। মাইষে দেখলে কি কইবো।

আ লো মাইন্ যে দেখবো না। মোল্লা কাছ গিয়ে ফিসফিস করে বলল, তরে আমার খুব ভাল লাগে পরী, তুই যদি রাজি অস—

পরী কথাটা শুনল না, একদৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণেই ছোট বৌ ঘরে ঢুকলে মোল্লা তেতো-স্বরে বলল, যহন তহন আমার ঘরে আও ক্যারে বৌ? যাও যাও।

তারপর তাড়াতাড়ি সিন্দুকের ডালাটা নামিয়ে চাবি লাগিয়ে দেয়। দুষ্ট বৌ ঠোঁটের তলে মিটিমিটি হাসে। রান্নাঘরে গিয়ে কি বললে মেয়েদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল।

মণ্ডা মিঠাইয়ের দিকে পরীর লোভ একেবারে ছোটবেলার, যেখানেই দেখুক জিভে পানি এসে পড়ে। তেলের পিঠা বানাবার জন্য বেলায় বাজার থেকে এক চাক্কা। আখের গুড় আনা হয়েছিলো, ওপরে বেতের ঢাকনা দিয়ে বড়ঘরেই একটা খাদার মধ্যে রেখেছে। আনার পর বারান্দায় রেখেছিল, তখনই ও দেখেছে, কি সুন্দর রং! মিহি দানা! অন্য কাজ করলেও তাকে তাকে রইল, এবং এক সময় সকলে যখন অন্যদিকে ব্যস্ত তখন ঘরে ঢুকে খামছা দিয়ে ভেঙে এক খাবলা তুলে নেয়, এরপর সিন্দুকের ওধারে এক রক্তি হয়ে বসে ফুলে ওঠা মুখটা নাড়তে থাকে। চোখের মণিদুটো ছোট্ট পাখির মতো চঞ্চল। কেউ এসে দেখে ফেললে রক্ষে নেই।

সামনের দরজাটা ভেজানো ছিল, খানিকক্ষণ পরে আসবি তো আস একেবারে ধনু মোল্লা স্বয়ং। কোমর থেকে চাবি খুলতে খুলতে সিন্দুকের কাছে গেল।

পরী দ্বিতীয়বার গুড় নিয়েছিল, তাড়াতাড়ি গেলবার চেষ্টা করতেই খুকখুক করে কেশে ওঠে এবং কিছু ছিটকে পড়ে কাছাকাছি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আঁচ করতে মোশ্লার দেরি হল না। হেসে বলল, আরো খাইবি, দিমু নাকি?

পরী জবাব দেবে কি লজ্জায় ওর কানের পাতা দুটো লাল হয়ে গেল। মাথার চুলে খস খসে হাতে আদর করে তাকে ছেড়ে দেয় ধনু মোল্লা।

সেদিনই সন্ধ্যার পরে পরী যখন রান্নাঘরে তরকারিতে জ্বাল দিচ্ছিল, হঠাৎ কাশতে কাশতে মোল্লা গিয়ে হাজির। তার হাতে নারকেলের ডাবা, মাথায় গোল টুপি। ঝাপের কাছে চৌকিতে বসে কলকেটা খুলল, তারপর সেটাতে আগুন নিতে যাওয়ার অছিলায় ফতুয়ার জেবের ভেতর থেকে একটা পোঁটলা বার করে পরীর কোলে গুঁজে দিল, কাঁপাস্বরে বলল, তর লইগা আনছি, মিডাই!

পরী মাথা ঝাঁকানির সঙ্গে সেটা ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। এদিকে কে আসছে টের পেয়ে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলে।

সেদিন পানি তুলতে গিয়ে অন্ধকারে কুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা রসগোল্লা খেতে কি মজাই না লেগেছিল। কিন্তু আস্কারা পেয়ে তার ফল যে এতটা গড়াবে ওর ছোট্ট মাথায় তখন তা মোটেই ঢোকেনি।

ধনু মোল্লা প্রথম দুই আঙুলে নাক টিপে ধরে আন্দাজ করল ওর ঘুমের পরিমাণটা কত, খানিকক্ষণ শাসরোধ হওয়ার একটু নড়ে উঠতেই কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপাস্বরে ডাকল, ‘পরী! ও পরী পরী গো।

স্পষ্ট জেগে থাকলেও সে সাড়া দেয় না। এরপর কাঁধে খসখসে হাতের অবিরত ঢাকুনি খেয়ে একবার উচ্চারণ করল, ‘উঃ।

পরী! পরী। আবার কানের কাছে গড়গড় গলার স্বর, পরী! পরী! ধনুমোল্লা হালকা নরম পুতুলটির মতো ওকে ধরে তার বিশাল কোলের ওপর তুলে নিল। এবার পরী চুপ থাকতে পারে না, ঘুম জড়িত গলায় সে বলল, ক্যাডা? নানা?

আ লো অহন নানা কইনা। আমি ধনা গাজি! মোগ্লা আদর করে বলল, রইম্যা হালা তরে খুব মারছে আমি তেল আনিছি মালিশ করবার লাইগ্যা। পরীর গায়ে জামা নেই, মোল্লা কাছেই রাখা বাটি থেকে সরষের তেলে আঙুলসহ ডান হারে পাতাটা ভিজিয়ে নিয়ে ওর খালি পিঠে বোলাতে থাকে। চিচি করে বলল, আপনে এতা কি করতাছে! কেউ টের পাইলে আপনার মান থাকব না!

রাইখ্যা দে মানসম্মান। তোরে কোলে নিয়া আমার জীবন ধন্য অইছে ইজ্জত যায় যাকগা!

পরী জিজ্ঞেস করলো, নানীরে পছন্দ করতেন না?

করতাম খুইব, ভালো বাইতাম। ধনু মোল্লা ওর কোমরের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে মালিশ করতে করতে বলল, কিন্তুক হেইতে মইরা গেছে গা।

খুলে গিয়েছিল, পরী কাপড়টা নাভি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেরো দিয়ে পরতে থাকে। হঠাৎ খেয়াল করে বেশ একটা সুগন্ধ। জিগগেশ করলো, কিয়ের খুশবু নানা?

মোল্লা অন্ধকারে খলখল করে হাসে। বলল, তুই একদিন কইছিলি না আমার গতরে বঁই করে? হের লাইগ্যা আর মাখছি।

তেলের হাতটা লুঙিতে ভালো করে পুছলে বোঝা গেল মালিশ করা শেষ হয়েছে। মোল্লা জেকের ভিতর থেকে একটা পোঁটলা বার করে। খুললে টিনটিন শব্দ হল। সেই মাদুলি ছড়াটা। পাঁচভরি পাকা সোনার তৈরি ছয়টা মাদুলি আর নয়টা দুগদুগি। বৌয়ের জেওর, রশুনটা তামাকটা বিক্রি করে নিজেই বানিয়ে দিয়েছিল। গলা হাতড়ে সেটা ওকে পরাতে গেলে হাতে বাধা দিয়ে বলল, না নানা। আপনের পায়ে পড়ি, আমারে ছাইড়া দ্যা। আমি যাইগা বাড়ি।

ইমুন কথা কইসনা পরী, আমার বুক ভাইঙা যাইব গা। গলায় বেষ্টন করার পর ওর ঘাড়ের কাছে কাইতনের প্রান্ত দুটোতে গেরো দিয়ে বলল, কয়দিন আর আছি, শেষমেষ আমারে একটু শান্তি দিয়া যা তুই পরী।

লোমশ বুকটাতে মুখ লুকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ক্যামনে আপনেরে শান্তি দিয়াম আমি? আমার তো কিছুই করার নাই। আমার সোয়ামি আছে যে!

পরিচিত কায়দায় তৈরি হতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মোল্লা বলল, নাই নাই হে আর নাই। তরে মারছে, হেরে আমি গলা টিইপ্যা মাইরা আছি। কেউটে সাপের ছোবল খাওয়ার মতো পরী আর্তনাদ করে উঠতে চাইলে ওর মুখটা চেপে ধরে মোগ্লা। ও আঙুলের ফাঁকে চ্যাপটা হয়ে থাকা মুখে জিগগেশ করল, সইত্য কইছেন?

সইত্য না মিথ্যা? রইম্যারে খতম কইরা আইছি, দুনিয়া উলিডা যাউগ গা আমি তরে শাদি করুম পরী।

পরীর বুকের ভেত্রটা লোমে-ঢাকা মুর্গির সিনার মতো দুরুদুরু করে কাঁপছিল, বলছে কি লোকটা? মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওর মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতবড় তাগড়া জোয়ান লোকটাকে বুড়ো শেষ করে দিতে পেরেছে? সে তার হাতটা টেনে নেয়, কাঁধের গোড়া থেকে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে আনে, চামড়া আলগা ধরনের বটে কিন্তু হাতটা সত্যিই বেশ কঠিন, হাড্ডি বেজায় মোটা। এরপর রে ছোট্ট হাতটা দিয়ে তার হাতের পাঁচ আঙুল, কজি ও তালু ধরে ধরে দেখে, সেগুলোও বেশ শক্ত আর চওড়া। হঠাৎ সে ফুঁপিয়ে উঠে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল, নানা!

তুই কান্দিস না পরী আমি তরে নিহা করুম, আমার অনেক ট্যাহাপয়সা জমি জমা আছে র কোনো কষ্ট অইব না। কেডা কি কইব, আমিই তো গ্রামের মাতব্বর। এই নে ধর।

মোল্লা আরেকটা পুটলি ওর হাতে গুঁজে দিল। বেশ বড় আর ভারী। কাঁচা টাকা আর রেজগিতে ভরা। পরী সেটা ধরল না। তখন মোল্লা পোটলাটা ওর কাপড়ের খুঁটে বেঁধে তাকে শুইয়ে দিল কাঁথার ওপর। অনেকক্ষণ কেটে গেল। দ্রুত ধুকধুক করতে করতে ধনু মোন্নার হৃৎপিণ্ডটা বিকল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে, মুখের দুই কষে ফেনা দেখা দিয়েছে। পরী উঠে পড়তে চাইলে ওকে ঠেলা দিয়ে ফেলে বলল, আরেকটু থাক্ পরী, আরেকটু!

কিন্তু সব বৃথা। চরম বিরক্তির সঙ্গে ঝামটা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে ও ঠিকঠাক হতে থাকে। নিঝঝুমি রাত্রি; কিন্তু অকস্মাৎ চারিদিকটা যেন অট্টহাস্যে মুখরিত হয়ে গেল। দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটি লেপটে বসে পড়ে ধনু মোল্লা। বিফল, বিফল সব উদ্যম ধ্ব আয়োজন বিফল। এখন নিজের বিরুদ্ধেই যত আক্রোশ পারলে নিজেকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, ন্যাকড়ার মতো ঝুলে পড়া দেহটাকে করে ছিন্নভিন্ন।

তাকে ছাড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়ার সময় কাপড়ের বাড়ি লাগল গায়ে, মোন্না আঁতকে উঠল, পরী, পরী, তুই যাইস না পরী! আরেকবার দ্যাখ আমি পারুম্।

গলার স্বরটা কান্নার মতো; কিন্তু তবুও ফিরেও চাইলো না, দুধুপ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় একান্ত অস্পষ্টস্বরে বলল, বুইড়া।

অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে ধনু মোল্লা। পথের ধারে ধূলিবালির মধ্যে বসে-থাকা ভিখিরির চেয়েও দীন-হীন রিক্ত নিঃস্ব যেন। হঠাৎ মনে পড়ল, টাকার পোঁটলাটা নিয়ে থাকে নিক, কিন্তু মাদুলি ছড়াটা তো দিয়ে যায়নি? রাত আছে, এখনি সময়। পরে আদায় করা মুশকিল হতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। আসমানে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। বাঁশঝাড়ের পাতায় ঝিরঝিরে বাতাসের মৃদু নড়াচড়া। বিহান হয়ে এল নাকি? বাঁশের তৈরি আওতার মধ্যে দরজার মতো ফাঁকটা দিয়ে ওধারে গেলেই একটু দূরে রমুর ছনের ডেরাটা, খরের বেড়া, অনেক জায়গায় ফাঁক-ফোকর। পায়ের শুকনো পাতা মচমচ্ করলে চমকে ওঠে। হকচকিয়ে ফিরে তাকায় এদিক-ওদিক। রমু নাম করা চোর, ওর কাজই রাত্রে বেলায়। হঠাৎ এসে পড়াটা বিচিত্র নয়। পরীকে ভয় পাইয়ে বশ করবার জন্য খুনের বানানো গল্পটায় কাজ হয়েছিল বেশ।

সাবধানে বেড়ার কাছে যাওয়ার পর একটু ঝুঁকে কান পেতে থাকে। অবস্থাটা আঁচ না করে পরীকে ডাকা ঠিক হবে না। এ-সময়ে চোর ব্যাটা তো ঘরেও থাকতে পারে। ভিতরে নড়াচড়ার আওয়াজ হচ্ছে।

হঠাৎ খচখচ করে দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠলে বেড়ার একটা ফাঁকে চোখ রাখে ধনু মোল্লা, সব দেখা যাচ্ছে; তেল-চিটচিটে বালিসে মাথা রেখে হোগলার ওপরলম্বা হয়ে শুয়ে আছে রমু, শিয়রে মাটির বার ওপরে রাখা কুপির মুখে আগুন দিল পরী। সে এখন ধীর, স্থির। আলোর দিকে চাইতে ওর গলায় মাদুলি ছড়াটা ঝিকমিকি করে উঠলো। নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে লোকটা, কোনো তাড়া নেই। ডান হাত পিছনে নিয়ে আঙুলে ধরে ঘুরিয়ে আনে কাইতনের গোড়াটা, তারপর দুইহাতে খুঁটে খুলতে থাকে। ছড়াটা খুলে ডানহাতের তালুতে নিল, অসম্ভব বস্তু, এমন জিনিস পাবে, কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। বিয়ের সময় পেয়েছিল শুধু কয়গাছি রূপোর চুড়ি, আর একটি রূপোর চেইন। সেগুলোও কবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন গলা খালি, আর হাতে পরে বাঙড়ি; কিন্তু সেও সবসময় নয়, ধান ভানতে গিয়ে বা এটা সেটার বাড়ি লেগে ভেঙে যায়, অনেকদিন কিনতে পারে না। কাঁচের জিনিস, কদিনই বা টেকে। আর টিকলেই বা কি এই সোনার ছড়া তো পরতে পারবে না, একটা আয়নাও নেই যে এখন পরে দেখে গলায় কেমন মানায়!

এমনিতে কেমন আলাঝোলা, কিন্তু বুড়োটার পেটেও এত বুদ্ধি! বলে কিনা, গলা টিপে মেরে গিয়েছিল।

একবার স্বামীর ঘুমন্ত মুখটা, আরেকবার মাদুলি ছড়াটার দিকে চেয়ে ওর পাতলা ঠোঁটে একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুঠে ওঠে। এরপর হঠাৎ সক্রিয় হল। স্বামীর গা ঘেঁষে ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে মাথার চুলে আদর করে, এরপর একটা নাড়া দিয়ে বলল, এই!

অল্পেতেই ঘুম ভেঙে যায় রমুর। সে পিটপিট চোখে দেখে ঘরে আলো এবং পরী বসে আছে কাছে। বলল, আইছিস?

হ! অভিমানের ইচ্ছাটাকেও পরী ভুলে গেছে, সে বলল, খোয়াবে দেহি তুমারে ক্যাডা মারতে আইতাছে, আর থাকতে পারলাম না।

হু খুব পিরিত। শুয়ে থেকেই বালিশের ধারে হাত দিয়ে একটা বিড়ি বার করল রমু।

মাদুলি ছড়াটা ধরে পরী বলল, দ্যাহ তুম যে কইতা, আমি আজগা চুরি করছি।

লম্বা কথা শোনার অবসর ছিল না রমুর, অলঙ্কারটা দেখবা মাত্র সে ঝট করে উঠে বসলো। চাপা উত্তেজিত স্বরে জিগগেস করলো, কইখে?

ছড়াটা ছোঁ মেরে নিয়ে সে বাতির ধারে মেলে ধরল।

এই দ্যাহ, আরো। কোমরে গুঁজে রাখা আঁচল খুলে পোঁটলাটা বার করল পরী, সঙ্গে সঙ্গে সেটাও রমু টান দিয়ে নেয়। আস্তে খোলবার অবস্থা নেই, দুই হাতে টান দিয়ে ছিঁড়ে মাটিতে ঢেলে দিলে অনেক টাকা, আধুলি, সিকি ঝঝন্ করে উঠল। বৌয়ের মুখের দিকে তেমনি দ্রুত চেয়ে বলল, এই তো! এই তো কামের মত কাম করছস!

বাতিটা নিভাইয়া ফালাও! পরী ফিসফিস্ করে বলল, কেউ দেখবো।

কথাটা ঠিক রমুও উপলব্ধি করল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আলো নেভাল না। আচমকা প্রবলভাবে টেনে ওকে তুলে নিল বুকের ওপর। পরী কোনমতে বলল, আহ্ আস্তে!

পরদিন সকালে অভ্যেসমত হাল নিয়ে মাঠে গেল না ধনু মোশ্লা, ফজরের নামাজের পরেও অনেকক্ষণ বসে ওজিফা করলো জায়নামাজের ওপর। চেহারায় অটল গাম্ভীর্য। সারাটা দিনও তেমনি ভাব। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলেপেলেরা বসলে বৌ-ঝিদেরও ডেকে বলল, রা হগতেই, আমি এবার হজে যাইয়াম। গতরাত্রে রার মারে দেখলাম, হেই পরীর বেশে আইয়া আমারে তাই করতে কইছে। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। এবং দুদিনের মধ্যে কথাটা সারা গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেলেও কেউ তা বিশ্বাস করল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments