Friday, April 26, 2024
Homeকিশোর গল্পপিসিমণির হারমোনিয়াম - সুব্রত সরকার

পিসিমণির হারমোনিয়াম – সুব্রত সরকার

পিসিমণির হারমোনিয়াম - সুব্রত সরকার

পিসিমণি এবছরও হিমালয়ে যাচ্ছে। গতবছরও গিয়েছিল। তার আগের বারও। মোটকথা প্রতিবছরই পিসিমণির হিমালয়ে যাওয়া চাই-ই চাই। আচ্ছা পিসি, তুমি বারবার হিমালয়ে কেন যাও বল তো? চারশো-বিশ জর্দার সঙ্গে আচ্ছা করে দোক্তাপাতা, বড় সুপুরি আর চুণ-খয়ের দিয়ে সাজানো বিগ সাইজের একজোড়া পান মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে পিসিমণি কেমন হ্যালাফ্যালা করে বলল, ওরে গুবলু, হিমালয়টা যে ওখানে! তোর ক্ষমতা থাকে তো বাইপাসের ধারে নিয়ে আয়। তখন আর আমি বছর বছর হিমালয়ে যাব না!….

যেমন আমার পিসি তেমন তার কথা। আমি নাকি হিমালয়কে বাইপাসের ধারে এনে দেব! এরপর একদিন হয়তো বলবে, ওরে গুবলু, পারলে গঙ্গাটাকে একটু উঠোনের ধারে এনে দে তো। রোজ দু’বেলা গঙ্গাস্নান করব। …

আজ সকাল থেকেই হুলুস্থুল। উপাসনা এক্সপ্রেসে পিসি এণ্ড কোং আবার যাচ্ছে হিমালয়। হ্যাঁগো পিসি, তোমাদের হিমালয় যাত্রা মোট কতবার হল? জানি, একথা জিজ্ঞাসা করলে পিসি নির্ঘাৎ বলবে, গুবলু, তুই গুনিস নি কেন? হিমালয় বারবার দেখতে বোর হও না তোমরা? একই তো জিনিস! একবার একথা বলে ফেলে খুব ধমক খেয়েছিলাম পিসিমণির, রোজ রোজ ম্যাগি চাউমিন চিকেন রোল যে খাস, বোর হোস? বন্ধুদের মুখগুলো দেখতে বোর হোস? শিবঠাকুরের সেই আপনদেশে সবই বড় সুন্দর রে গুবলু! কত নদী, পাহাড়, ঝরণা, বরফচূড়া, সবুজ সবুজ বন – একবার তুই যদি দেখিস, তোরও মনে হবে আবার যাই। বারবার যাই। অতগুণে গুণে যাবার কি আছে?

পিসিমণির হিমালয় যাত্রার সঙ্গী-সাথীরা বরাবর এক। নো চেঞ্জ। নো এক্সচেঞ্জ। পিসিমণিরা নিজেদের টিমের নাম দিয়েছে – টিম পঞ্চপাণ্ডবী। পিসিমণি ছাড়া চার পাণ্ডবী হলেন বেহালার হাসি পিসি। বেলেঘাটার বকুল পিসি। চেতলার চাঁপা পিসি। আর বৈষ্ণবঘাটার বোষ্টমী পিসি।

বেচারী নাড়ুর মা সকাল থেকে পিসিমণির বাক্সপ্যাঁটরা গোছগাছ করে দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। পিসিমণির হিমালয় যাত্রা যেন একটা কাণ্ড বটে! হৈ হৈ ব্যাপার। চিৎকার, হাঁকডাক হবেই হবে। ওরে নাড়ুর মা তুই আমার তিলক-মাটিটা গুছিয়ে ঠিক দিয়েছিস তো? মালাজপার থলিটা সেলাই করেছিস তো? কোমরে ব্যথার মলমটা দিতে ভুলিস নে যেন। আর হাঁটুতে লাগাবার নিকাপটাও দিবি। দেখ দেখ ভালো করে দেখ, হটওয়াটার ব্যাগটা দিয়েছিস কিনা। আচারের শিশির মুখটা ভালো করে আটকে দিস। ওর তেল যেন গড়িয়ে না পরে যায়। ছোট্ট গীতাটা মনে করে দিস বাপু। জর্দার কৌটোদুটো অবশ্যই ব্যাগের ওপরে রাখবি। পামসুটা পরিষ্কার করে দু’জোড়া মোজা ওতে ভরে দিস। তোর জন্য এবার হরিদ্বার থেকে সুন্দর একটা শাল আনব রে নাড়ুর মা। আমার সব যেন ঠিকঠাক যায়। কিছুই ভুললে চলবে না। আর শোন, বাক্স এবার একটা বেশী হয়েছে কিন্তু। ভুল করিস না যেন ট্যাক্সিতে তুলে দিতে।

নাড়ুর মা কিচ্ছুটি ভুল করে নি। ভুল করলে রক্ষে আছে নাড়ুর মার! পিসিমণির এক ধমকে এখনো কেঁদে ফেলে নাড়ুর মা। তাই ভুল তো করেই নি বরং একটা বাক্স বেশিই তুলে দিয়েছে ট্যাক্সিতে। পিসিমণি কুলির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে করতে জানল যে লাগেজ চারটে নয় পাঁচটা! ভাড়া তো বেশি দিতেই হবে।

পাঁচটা কোথায়? বলি, তুমি কি গুণতে জানো? পিসিমণি চোখ পাকিয়ে কুলিকে ধমক দেয়।

কুলি কাঁচুমাচু মুখে বলে, মাঈজি, আপ দেখ লিজিয়ে একঠো তো বড়িয়া আউর জাদা ওজনকা বাক্সভি হ্যায়!

ক্যায়া ফালতু বাত তুম বোলতা হ্যায়? পিসিমণি গর্জে উঠে গুণতে গিয়ে দেখে সত্যিই তো একতা বাক্স বেশি। আর সেটা কিনা হারমোনিয়ামের বাক্সটা! ওরে নাড়ুর মা, তুই একি করলি? এটা কেন তুলে দিয়েছিস ট্যাক্সিতে!

সত্যিই কি করে যে হারমোনিয়ামের বাক্সটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল, তা নাড়ুর মাই জানে!

।। দুই।।

উপাসনা এক্সপ্রেস দুরন্ত। দারুণ গতিতে ছুটছে। পিসিমণির দল কম্পার্টমেন্ট সাজিয়ে-গুছিয়ে সংসার পেতে দিব্যি বসে পরেছে। একটু আগেই এক রাউণ্ড চা হয়ে গেছে। এখন পান-সাজানো হচ্ছে। পান চিবুতে – চিবুতে এবার গল্প শুরু হল। বৈষ্ণবঘাটার বোষ্টমীপিসি হাসতে হাসতে বলল, মলি, ভালোই হল তোর হারমোনিয়ামটা পেয়ে। ট্রেনে বেশ গান-বাজনা করতে করতে যেতে পারব। লুডু খেলতে কত আর ভালো লাগে!

চেতলার চাঁপা পিসি বলল, গুরুদেবের আশ্রমের হারমোনিয়ামটা ভালো বাজে না। সা টিপলে মা বের হয়। তোমার হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে সন্ধ্যারতিটা সুন্দর করা যাবে।

বেলেঘাটার বকুল পিসি কম কথা বলে। সে বলল, একটু পরে চারটে গান শুনিও তো।

বাকি ছিল বেহালার হাসি পিসি। সে নাকি সব কথাতেই হাসে। হাসি পিসি হেসে হেসেই বলল, মনে হচ্ছে আমরা যেন প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছি। হর-কি-পৌরির ঘাটে কাল সন্ধ্যায় ফাংশান হবে। বাংলা থেকে বাংলা ভক্তিগীতির ব্যাণ্ডের দল চলেছে। ব্যাণ্ডের নাম, পঞ্চপাণ্ডবী।

একথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল। হাসির রেশ একটু মিলিয়ে যেতেই বকুল পিসি বলল, নাও, এবার একটু গান ধর তো। …

পিসিমনি গান গাইতে ভীষণ ভালোবাসে। একবার বললেই যথেষ্ট। কোনও না নেই। পিসিমনি হারমোনিয়ামটা সিটের উপর সাজিয়ে নিয়ে গান ধরল, ‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরমধন হে / চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে ….’

সবাই মন দিয়ে গান শুনছে। পিসিমনি গভীর আবেগে গান গেয়ে চলেছে। আশেপাশে যারা বসেছিলেন তাঁরাও পিসিমনির গান বেশ উপভোগ করছেন। প্রথম গান শেষ করে পিসিমনি দ্বিতীয় গান ধরল, ‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে …’

গানে গানে জমে গেল যাত্রাপথ। দ্বিতীয় গান শেষ করে পিসি নতুন গান ধরল, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে / কত প্রাণ হল বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে …..’ এ গান শুনে সবাই কেমন মেতে গেল আনন্দে। গলা মেলাল তালে তালে। নাড়ূর মা সত্যিই হারমোনিয়ামটা ভুল করে তুলে দিয়ে কোনও ভুল করে নি। পিসিমণিরা মশগুল হয়ে আছে গান-বাজনায়। উপাসনা এক্সপ্রেস ছুটছে ঝড়ের বেগে। আসানসোল, কিউল, মোকামা ছাড়িয়ে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল খেয়াল নেই। ট্রেন এসে থামল পাটনায়। ঘড়িতে রাত্রি সাড়ে নটা।

পিসিমণির দল রাতের খাওয়া শেষ করে শোয়ার আয়োজন সেরে ফেলল। হারমোনিয়ামের উঁচু, ভারী বাক্সটা সিটের নীচে কিছুতেই ঢোকানো গেল না। লোয়ার বার্থের দুটো প্যাসেজের মধ্যে বাক্সটাকে রাখতে হল। কাল সকালেই আবার লাগবে তো! ভোরের প্রভাত সংগীত একটু হবে না, ‘রাই জাগো, রাই জাগো … জাগো জাগো শচীমাতা গৌরহরি ….’

।। তিন।।

ভোরের প্রথম আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল পিসিমণির। চোখ মেলেই দেখে হারমোনিয়ামের বাক্সটা নেই! পিসিমণির বুক ছ্যাঁক করে উঠল। সিটের তলায় দেখল। এদিক-ওদিক দেখল। কোথাও নেই হারমোনিয়াম। একদম ভ্যানিশ। পিসিমণি বন্ধুদের ডেকে ডেকে তুলল, ওরে সর্বনাশ হয়ে গেছে, হারমোনিয়ামের বাক্সটা নেই!…

সবাই ধড়মড় করে উঠে বসল। হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না। বাক্সটা উধাও! সত্যিই ভ্যানিশ!

পিসিমণির মন খারাপ। পঞ্চপাণ্ডবীর মুখ গোমড়া। আশপাশের লোকজনরাও চুপ। ভোরের বাতাস জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে। কথা ছিল হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রভাতসংগীত হবে। কিন্তু সেই সখের হারমোনিয়ামটাই আর নেই! পিসিমণি মনের দুঃখে বিড় বিড় করে বলল, হ্যাঁরে চোর ব্যাটা কি জানত ওটা হারমোনিয়াম? ওটা ওর কি কাজে লাগবে বল?

ধুৎ জানলে কি আর নেয় নাকি? চাঁপা পিসি কেমন যেন বিরক্ত হয়ে বলল।

বোষ্টমী পিসি তর্ক করে বলল, কেন চোর কি গান-বাজনা ভালোবাসতে পারে না? দেখ গিয়ে ওর ঘরে হয়তো মেয়ে আছে। মেয়েকে দিয়ে বলবে, নে বেটি গান ধর। ভজন শেখ। আমি আর চুরি করব না। দুজনে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করব।

বকুল পিসি দুঃখ দুঃখ মনে বলল, গুরুদেবের আশ্রমে এবার সন্ধ্যারতিটা বেশ জমবে ভেবেছিলাম।

হাসি পিসি এই প্রথম না হেসে বলল, প্রভু, তোমার এ-কি বিচার!

পাঁচপিসিই এখন চুপচাপ। মনে কারও শান্তি নেই। আনন্দ নেই। মনে মনে সবাই খুব দুষছে নাড়ুর মাকে, ও কেন হারমোনিয়ামটা ভুল করে তুলে দিয়েছিল ট্যাক্সিতে? মনের দুঃখে পাঁচপিসিই যখন ভেবে নিয়েছে ও আর পাওয়া যাবে না, তখন হঠাৎ একটা লোক এসে খবর দিল, আপলোগকো কুছ সামান খোয়া হ্যায়?

পিসিমণি লাফিয়ে উঠে বলল, হাঁ। হাঁ। মেরা এক বাক্স খোয়া হ্যায়। উও হারমোনিয়াম থা ….

টয়লেটকা পাস এক বড়িয়া বাক্স হ্যায়। আপ দেখ লিজিয়ে।

শোনামাত্রই পিসিমণি ছুটল। সঙ্গে ছুটল আরও দুই পিসি। ছুট ছুট। লম্বা ছুট। একছুটে টয়লেট। হ্যাঁ ঠিক। টয়লেটের প্যাসেজেই পড়ে রয়েছে হারমোনিয়ামের বাক্সটা। ব্যাটা চোর বোধহয় অত ভারী বলে আর টানতে পারে নি। ফেলে রেখে দে চম্পট!

পিসিমণির দল হৈ হৈ করে বাক্স নিয়ে ফিরে এল। এখন সবাই খুব হাসছে। খুশি খুশি ভাব। কয়েকমুহূর্তের জন্য সব কেমন উধাও হয়ে গিয়ে তাল কেটে দিয়েছিল। সেই সুর-তাল সব কিছু ফিরে এল আবার। বন্ধুরা পিসিমণিকে চেপে ধরে বলল, নাও, নাও, এবার একটা গান ধর তো! প্রভাতসঙ্গীত এখন তো আর হবে না। একটা আনন্দসঙ্গীত কর।

পিসিমণিকে বললেই গায়। একবার বলাই যথেষ্ট। কোনও না নেই। হাসতে হাসতে পিসিমণি এবার প্রাণ ঢেলে গান ধরল, ‘তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায়নাকো কভু / আমরা অবোধ অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু ….’

হিমালয় যাত্রা এবারও জমে জমজমাট। পিসিমণিরা প্রফুল্ল।

উপাসনা এক্সপ্রেস আরও দুরন্ত এবার। হরিদ্বার এই এল বলে!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments