Thursday, May 2, 2024
Homeবাণী-কথাওষুধ - লীলা মজুমদার

ওষুধ – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

বছর চল্লিশেক আগে আমার একবার চিংড়িমাছের কাটলেট খেয়ে বেজায় পেটের অসুখ করেছিল। প্রায় নাড়ি ছেড়ে যাবার জোগাড়, চোখে অন্ধকার দেখছি। এমন সময় আমার বড় ভাসুর বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ জিতেন্দ্রনাথ মজুমদার, আমাকে এক ডোজ কী যেন ওষুধ খাইয়ে, হাসি হাসি মুখ করে, আমার খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে রইলেন। ব্যস, ওই এক ডোজেই আমি এক্কেবারে ভাল হয়ে গেলাম। তখন দু’দিন জল-পথ্য, তৃতীয় দিনে পোরে ভাতের ব্যবস্থা দিয়ে, দাদামণি বিদায় নিলেন।

অমনি তাঁর বোনেরা আমাকে ঘিরে বসলেন। পটোদিদি— পটোদিদির কথা তো আগেও বলেছি— বললেন, ‘কী ওষুধ দিল, তোকে বলেনি নিশ্চয়? তোকে ভাল মানুষ পেয়ে ভারী চালাকি করে গেল দেখছি! আমরা বাপু প্রতাপ মজুমদারের মেয়ে, আমাদের সঙ্গে বুজরুকি চলবে না—’

এই অবধি শুনে আমি বললাম, ‘না, না, পটোদিদি, ওষুধের নাম বলে গেছেন।’ বললাম ও ওষুধের নামটা, এখন ভুলে গেছি। নাম শুনে দুই বোন গালে হাত দিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘দেখলে কাণ্ড! বোকা পেয়ে কেমন চাল দিল! আমরা থাকলে কখনও তোকে ও ওষুধ গিলতে দিতাম না। নেহাৎ ভগবান তোকে বাঁচিয়েছেন!’

পটোদিদি বললেন, ‘স্পষ্টই বুঝতে পারছি ওটা এক্কেবারে ভুল ওষুধ। সাধারণ নক্স ভমিকা থাট্টি দিলেই কাজ হত!’ আমি বললাম, ‘কী মুশকিল! ওঁর দেওয়া এক ডোজেই আমি এক্কেবারে সেরে গেছি, তবে আবার ভুল ওষুধ কীসের?’

খুনুদিদি কাষ্ঠ হেসে বললেন, ‘যদি প্রেতপুজো করে তোর অসুখ সারত, তা হলে কি বলতিস প্রেতপুজোই ঠিক ওষুধ? অবিশ্যি পটোদিদি যাই বলুক, নক্স ভমিকাও ঠিক ওষুধ নয়। এ তো পরিষ্কার পালসেটিলার ব্যাপার!’

পটোদিদি চটে গেলেন, ‘তোর স্বামী বাঘ শিকার করে, তুই আবার এসবের কী জানিস?’

খুনুদিদি বললেন, ‘তা তো বটেই! বাবা বলতেন আমি জাত চিকিৎসক। রুগির বুকে কান দিয়ে আমি তার শরীরের নাড়িনক্ষত্র বুঝতে পারি। স্টেথোস্কোপের সাহায্য লাগে না।’ সে যাই হোক, গুরুতর কিছু পাকিয়ে উঠবার আগেই ওঁদের ভাই এসে বললেন, ‘রুগির ঘরে এত হট্টগোল ভাল নয়। তা ছাড়া এদিকের ঘরে গরম কফি তৈরি হচ্ছে।’ বলাবাহুল্য, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা উঠে গেলেন।

আমার নিজের ভালমানুষ ননদটির জ্যাঠতুতো দিদিদের মতো নিজের ওপর অতখানি আস্থা না থাকলেও, তিনি তাঁর গুরুদেবের কাছ থেকে অব্যর্থ বীরেশ্বরের মাদুলি পেয়েছিলেন। ওই মাদুলির জোরে তিনি যে কত বন্ধ্যা মেয়ের দুঃখ ঘুচিয়ে ছিলেন তার ঠিক নেই।

একবার আমার স্বামীর এক রুগি এসে ধরে পড়লেন, ‘বউমার ছেলেপুলে হয়নি বলে বড় দুঃখ। এত টাকাকড়ি কে ভোগ করবে? ডাক্তার-কবরেজ করেও কিছু হল না, এখন দৈবযোগ ছাড়া গতি নেই দেখছি।’ কথাচ্ছলে আমার স্বামী তাঁর দিদির বীরেশ্বরের মাদুলির কথা বললেন।

শেষ পর্যন্ত ঠাকুরঝি বউমাকে দিলেন সেই মাদুলি। মাদুলির মধ্যে কী পুরে দিলেন সেটা বলতে গুরুদেবের বারণ ছিল। তবে নিয়মগুলো শিখিয়ে দিতে হল। মাদুলি বউমার মাথার চুলে বাঁধা থাকবে। শনি মঙ্গলবার শুধু ফল দুধ মিষ্টি খেয়ে থাকতে হবে। মুরগিটুরগি কোনও দিনই চলবে না। ব্যস! আর কিছু নয়। বছর না ঘুরতে বউমার দুঃখ দূর হবে। শ্বশুর-শাশুড়ি কৃতজ্ঞচিত্তে বিদায় নিলেন।

তাঁরা চলে গেলেন, দেখি ঠাকুরঝির মুখ গম্ভীর। কী ব্যাপার? না, ওঁদের একটা কথা বলা হয়নি। ওঁরা হয়তো ছেলে চান। কিন্তু আজ পর্যন্ত যাকেই ঠাকুরঝি মাদুলি দিয়েছেন, তারই মেয়ে হয়েছে। তাও একটা মেয়ে নয়, পর পর গোটা তিন চার!

আমি বললাম, ‘তাতে কী হয়েছে? আজকাল তো মেয়েরাও সম্পত্তি পায়।’

শেষ অবধি কী হয়েছিল বলতে পারছি না। আমরা মোটে চারটি মেয়ের হিসাব রেখেছিলাম। ওঁরা কিন্তু খুব খুশি।

১৯৩১ সালে শান্তিনিকেতনে কারও ছোটখাটো অসুখ করলে, রবীন্দ্রনাথ বেজায় খুশি হতেন। তাঁকে ডাকার জন্য অপেক্ষা করতেন না। অমনি বায়োকেমিস্ট্রির বাক্সটি নিয়ে, তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। দস্তুরমতো বই পড়ে, লক্ষণ মিলিয়ে ওষুধ দিতেন। তারপর রোজ গিয়ে রুগির অবস্থা দেখে আসতেন। দু’-চার দিনেই সে সেরে উঠত।

মনের পেছনে এইসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে, আমিও কিছুদিন বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে রুগির চিকিৎসা করেছিলাম। ব্যাপার হল যে আমার বড় ভাসুর একটা চটি হোমিওপ্যাথির বই আর-একটা মস্ত কাঠের বাক্সের গোলগোল খোপে চল্লিশটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি ভরে আমাকে দিলেন।

দাদামণি বলেছিলেন, বাড়িতে কারও ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ হলেই ডাক্তার না ডেকে, বইটি পড়ে, একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ওষুধ দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথি ওষুধে বিষ থাকে না, সেরকম বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই।

তাই দিতে আরম্ভ করে দিলাম, ছেলেমেয়ের, কিংবা বাড়ির কাজের লোকদের অসুখবিসুখ হলে। সব্বাই সেরে যেত। চাকরমহলে ক্রমে আমার বেজায় পসার জমল। বাড়ির চাকরদের থেকে আরম্ভ করে ধোপা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, শিল-কুটানোওয়ালা, পিওন, ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান, জমাদার, অন্য ভাড়াটেদের যাবতীয় পরিচারকদের মধ্যে আমি ফলাও করে চিকিৎসা করতে লাগলাম। বিশ্বাস করুন সব্বাই সেরে যেত। যেহেতু আমার স্বামী সমস্ত ব্যাপারটাকে কুনজরে দেখতেন, তাই অধিকাংশই সম্পন্ন হত তিনি যখন নিজের কাজে ব্যস্ত।

যে কোনও সকালে পেছনের কাঠের সিঁড়ি থেকে পেয়ালা হাতে, মগ হাতে, লাইন শুরু হত। এমনিভাবে দরাজ হাতে ওষুধ বিতরণের অবশ্যম্ভাবী ফল হল যে একদিন আমার মামুলি ওষুধ সব ফুরিয়ে গেল। কিন্তু রুগিরা নাছোড়বান্দা। তখন নিরুপায় হয়ে কাছাকাছি নামওয়ালা ওষুধ দিতে লাগলাম। এবং সমান ফল পেতে লাগলাম।

বৈজ্ঞানিকরা যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু অন্য ওষুধ দিলেও কাজ দিত। হতে পারে আমার রুগিরা আমাকে গুরুমার মতো ভক্তি করত বলে। বাড়ির লোকে এই অস্বাভাবিক সাফল্যে উদ্বেগ প্রকাশ করলে বলতাম, ‘সেরে যখন যাচ্ছে তখন ভুল ওষুধ বলছ কী করে? ওদের সব সর্দি কাশি জ্বর পেটব্যথা দূর হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি খারাপ হচ্ছে?” দেখতে দেখতে ওষুধের বাক্স চাঁচাপোঁছা!

সুখের বিষয়, এই সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ গরম হয়ে উঠল, আমরাও সে বছরের মতো পাট গুটিয়ে দার্জিলিং গেলাম। শীতের আগে ফিরে বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে পড়লাম। অসুখ-বিসুখের সময় কারও রইল না। পরে ওষুধের বাক্সটাকে অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাইনি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments