Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পঅশুভ জন্মদিন - ডিউক জন

অশুভ জন্মদিন – ডিউক জন

অশুভ জন্মদিন - ডিউক জন

‘যাক বাবা, সময়মতো পৌঁছানো গেছে!’ হাঁপ ছাড়ল আয়মান ইকরামুল্লাহ, ‘সারাটা রাস্তায় মনে হচ্ছিল, পার্টিতে হাজির হয়ে দেখব, কেক কাটা হয়ে গেছে!’

‘অযথা টেনশন করিস তুই,’ মন্তব্য করল ওর বড় ভাই।

গেস্টদের গাড়িগুলো যেখানে পার্ক করে রাখা হয়েছে, সেদিকে এগোচ্ছে ওরা সাইকেল ঠেলে নিয়ে। দ্বিচক্রযান দুটো স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলল আয়ান আর আয়মান।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা।

ওদের মায়ের বান্ধবী তানিয়া পার্কারের একমাত্র মেয়ে সোনিয়ার জন্মদিন আজ। মেয়েটার বাবা নেই। বান্ধবীকে সাহায্য করতে আগেভাগেই চলে এসেছেন মিসেস ইকরামুল্লাহ।

বাড়ির সামনের লনে চেয়ার-টেবিল পেতে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। সাতটায় কেক কাটা হবে। তারপর নাচ-গান করবে সোনিয়ার বন্ধুদের কয়েকজন। সবশেষে নয়টার দিকে ডিনারের আয়োজন।

মাকে দেখতে পেয়ে হনহন করে সেদিকে চলল দুই ছেলে।

‘এতক্ষণে আসার সময় হলো তোদের!’ ঘাড় ফিরিয়ে ছেলেদের দেখেই বলে উঠলেন নাদিয়া ইকরামুল্লাহ, ‘তানিয়া আর সোনিয়া মেয়েটা কতবার করে খোঁজ নিয়েছে, জানিস? আমি তো ভাবছিলাম, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আর আসবিই না তোরা! তেমনটা হলে অবশ্য কান ছিঁড়ে নিতাম!’

‘সরি আম্মি!’ কাঁচুমাচু চেহারা করল আয়মান, ‘তৈরি হতে হতে একটু দেরি হয়ে গেল!’

‘হয়েছে হয়েছে, আর সাফাই গাইতে হবে না! এখন মেহমানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় কর, যা। আরও অনেকেই জিজ্ঞাসা করছিল তোদের কথা।’

মায়ের আদেশ শিরোধার্য জ্ঞান করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সমবয়সী অতিথিদের জটলাটার দিকে রওনা হলো দুই ভাই। কাছাকাছি হতেই জটলার মধ্যমণি হিসেবে দেখতে পেল সোনিয়া পার্কারকে।

‘হাই আয়ান! হাই আয়মান!’ দুজনের ওপর চোখ পড়তেই হাত নাড়ল মেয়েটা। এগিয়ে গিয়ে অনুযোগ করল, ‘এলে অবশেষে! এত দেরি করলে কেন?’

‘হ্যাঁ, দেরি হয়ে গেল একটু!’ ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল আয়ান।

‘যাক…পরিচয় করিয়ে দিই…ও হচ্ছে সিন্ডি…ও ক্যাটরিনা…ও ইয়াং মি…হেনরি…পিটার।’ নিজের বন্ধুদের নাম বলে গেল সোনিয়া, ‘আর উনি হচ্ছেন লিলি আপু, আমার কাজিন। আর ইনি বিড ওয়াকার, লিলি আপুর কলিগ কাম বন্ধু।’ সবার ওপর দৃষ্টি বোলাল মেয়েটা, ‘এদের কথাই বলছিলাম। আয়ান-আয়মান নাম দুটোর সঙ্গে তো কমবেশি পরিচিত সবাই।’

‘নাইস টু মিট ইউ,’ বলে প্রত্যেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল দুই সহোদর।

‘তোমাদের ব্যাপারে পত্রিকায় অনেক পড়েছি।’ মুগ্ধতা ঝরল বিড ওয়াকারের কণ্ঠে, ‘এই বয়সেই তুখোড় গোয়েন্দা!’

‘লজ্জা দিচ্ছেন!’ বিনয় করল আয়ান।

‘এক্সকিউজ মি!’ হঠাৎ বলে উঠল লিলি, ‘একটু আসছি আমি!’ কথাটা বলেই পা বাড়াল সে পার্কিং লটের দিকে।

সোনিয়ার কাজিনকে এভাবে চলে যেতে দেখে সবাই কিছুটা অবাক।

‘লিলি আপুর আবার কী হলো?’ বিস্ময় প্রকাশ করল সোনিয়া।

‘গাড়ি থেকে কিছু আনতে গেছেন বোধ হয়,’ চীনা মেয়ে ইয়াং মির অনুমান।

‘দেখছি আমি…’ বলেই বিডও পা চালাল কলিগের পেছন পেছন।

‘চলো, কেকটা দেখাই তোমাদের,’ দুই গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বলল সোনিয়া।

এক লেয়ার করে কেক আর এক লেয়ার করে ক্রিম। সব মিলিয়ে ছয়টা লেয়ার। দেখেই জিবে জল আয়মানের। খেতে দারুণ হবে নিশ্চয়ই!

ভেবে সারতে পারল না, নারীকণ্ঠের চিৎকার ভেসে এল পার্কিং এরিয়া থেকে।

কী ব্যাপার! কী হলো?

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি রাখার জায়গাটার দিকে ছুট লাগাল সবাই।

দুই

কার পার্কিংয়ের মেঝেতে পড়ে আছে লিলি, রক্ত ঝরছে পেট থেকে!

সবার আগে তার কাছে পৌঁছে গেল আয়ান। মেঝেতে বসে পড়ে হাঁটুর ওপর তুলে নিল লিলির মাথাটা।

নিজের শার্ট খুলে মেয়েটার পেটের ক্ষতে চেপে ধরল আয়মান। রক্ত বন্ধ করা দরকার। শার্টের নিচে টি-শার্ট থাকায় উদোম হলো না গা।

‘আপনার এ অবস্থা কীভাবে হলো?’ জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল আয়ানের। ভড়কে গেছে ও এত রক্ত দেখে।

জবাব দিতে পারল না সোনিয়ার বড় বোন। থরথর করে কেঁপে উঠল তার ঠোঁট জোড়া।

‘ভাইয়া, জলদি হাসপাতালে নেওয়া দরকার আপুকে!’ বলল আয়মান জরুরি কণ্ঠে, ‘অবস্থা ভালো ঠেকছে না!’ বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ওর কপালে। জন্মদিনের পার্টিতে এসে এ রকম একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে, কল্পনাও করেনি কেউ।

‘হ্যাঁ! ইমার্জেন্সি নম্বরে কল করে অ্যাম্বুলেন্স আনাতে আনাতে দেরি হয়ে যাবে অনেক! এই মুহূর্তে গাড়ি দরকার একটা!’

ওর কথার জবাবেই যেন শোনা গেল গাড়ির হর্ন।

একহারা গড়নের এক তরুণ নেমে এল কনভার্টিবলটার ড্রাইভিং সিট থেকে, ‘আমি বোধ হয় সাহায্য করতে পারব!’

ধরাধরি করে গাড়ির পেছনে শুইয়ে দেওয়া হলো সোনিয়া পার্কারের কাজিনকে। আহত তরুণীর মাথাটা কোলের ওপর তুলে নিয়ে পেছনের সিটে বসলেন আয়ান-আয়মানের আম্মু। ক্ষতস্থানে চেপে ধরে রেখেছেন চেক শার্টটা।

‘আমরাও আসছি!’ রোল উঠল ভিড়ের মধ্য থেকে।

‘না!’ সাফ মানা করে দিলেন মিসেস পার্কার। ড্রাইভারের পাশে উঠে বসেছেন তিনি, ‘হাসপাতালে ভিড় করার দরকার নেই। অন্তত এখনই নয়। সোনি! দেখিস, কেউ যেন খালি মুখে না ফেরে!’

অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল তরুণ। হাসপাতাল অভিমুখে রওনা হয়ে গেল হলদে কনভার্টিবল।

তিন

বরবাদ হয়ে গেছে পার্টি। ভীষণ নাড়া খেয়েছে সবাই সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটায়। জল্পনা-কল্পনা চলছে এটা নিয়ে।

‘…আমি আর লিলি আপু যখন কয়েকটা গোলাপ তোলার জন্য বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে যাচ্ছি, এ সময় একটা পুরুষ আর একটা মেয়েকণ্ঠের কথার আওয়াজ কানে আসে আমাদের।’ চমকপ্রদ তথ্য দিচ্ছে সোনিয়া, ‘পুরুষকণ্ঠটা বিডের। তবে চিনতে পারিনি অন্য কণ্ঠটা। আড়ি পাতা উচিত হবে না ভেবে ফুল না নিয়েই ফিরতি পথ ধরি আমি। থেকে যান লিলি আপু। হাঁটতে হাঁটতেই কানে আসে আমার, ওদের কথার মধ্যে নাক গলিয়েছেন তিনি।’

‘আপুকে পরে জিজ্ঞাসা করোনি, কে ছিল মেয়েটা?’ প্রশ্ন করল আয়ান।

‘নাহ্।’

‘আচ্ছা, ওয়াকার সাহেব কোথায় হাওয়া হলেন, বলো তো!’

আয়মানের প্রশ্নটা সবারই। গোলমালের মধ্যে খেয়াল হয়নি কারও, বিড ওয়াকার নেই ওদের মধ্যে। সন্দেহের আঙুলগুলো এখন নির্দেশ করছে ভিকটিমের এই অপরিচিত বন্ধুটির দিকে।

খাওয়াদাওয়ার রুচি ছিল না কারও। তা-ও চারটে মুখে গুঁজে একে একে বিদায় নিতে শুরু করল আমন্ত্রিতরা।

‘হাসপাতালে যাওয়া দরকার না, ভাইয়া?’ অগ্রজকে জিজ্ঞাসা করল আয়মান।

‘হ্যাঁ, যাব।’

সোনিয়াও ওদের সঙ্গী হতে চাইল।

‘সাইকেল আছে তোমার?’ জানতে চাইল আয়মান।

‘না নেই। তবে এর চেয়ে ভালো উপায় রয়েছে।’

‘কী উপায়?’

‘গাড়ি। আপাতত এখানেই রেখে যাও তোমাদের সাইকেলগুলো।’

‘ও, ড্রাইভার আছে?’

‘আমাদের নয়, গুন আঙ্কেলের গাড়ি। উনিই নিয়ে যাবেন বলেছেন।’

‘গুন আঙ্কেল কে?’ আয়ানের প্রশ্ন।

‘হেইফার গুন। লিলি আপুর সহকর্মী তিনিও। তা ছাড়া আম্মুর পরিচিত। আন্টিরা হাসপাতালে রওনা দেওয়ার পর দাওয়াতে এসেছেন তিনি।’

‘আচ্ছা।’

‘খবরটা শোনার পর আম্মুকে ফোন করেছিলেন আঙ্কেল। ক্যানজাস মেডিকেল সেন্টারে গেছেন ওরা লিলি আপুকে নিয়ে।’

চার

রাত ১০টা।

‘এগোও তোমরা।’ মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বললেন মিস্টার গুন, ‘গাড়িটা পার্ক করেই আসছি আমি।’

মিতসুবিশি মিরেজ থেকে নেমে পড়ল তিনজন।

রিসেপশনে গিয়ে কাজিনের নাম বলে কেবিন নম্বর জানতে চাইল সোনিয়া।

১১৫ নম্বর রুমে রাখা হয়েছে লিলি জর্ডানকে।

‘এই রাতের বেলায় আবার আসতে গেলি কেন তোরা?’ তিন কিশোর-কিশোরীকে প্যাসেজে দেখেই প্রশ্ন ছুড়লেন নাদিয়া। বান্ধবীর সঙ্গে বসে ছিলেন তিনি কামরার বাইরে।

‘ না এসে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।’ নিচু গলায় জবাব দিল আয়ান, ‘কী অবস্থা, আম্মি? কী বললেন ডাক্তার?’

‘বিপদ কেটে গেছে,’ জানালেন তানিয়া আন্টি।

‘কী দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, জানা গেছে সেটা?’ আয়মানের জিজ্ঞাসা।

‘না।’ বললেন ওর মা, ‘তবে জিনিসটা ধারালো কিছু।’

‘ছুরি হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা করল বড় ছেলে।

‘উঁহু। আমিও এই সম্ভাবনার কথা তুলেছিলাম ডাক্তারদের কাছে। তারা বললেন, ছুরি দিয়ে অ্যাটাক করা হলে আড়াআড়ি কিংবা লম্বালম্বি হতো ক্ষতটা। কিন্তু ক্ষতচিহ্নটা গোলাকার।’

‘লিলি আপুর কাছ থেকে জানা যায়নি কিছু?’ মুখ খুলল সোনিয়া।

প্রত্যুত্তরে না-সূচক মাথা নাড়লেন ওর আম্মু, ‘কথা বলার অবস্থায় ছিল না মেয়েটা। এখনো নেই। অপারেশনের পর ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ওকে ইনজেকশন দিয়ে। আগামীকাল সকালের আগে জ্ঞান ফিরবে না।’

‘রকি ভাই কই?’ করিডরের এমাথা-ওমাথা তাকিয়ে দেখল সোনিয়া।

‘খাবার আনতে গেছে আমাদের জন্য। তোরা খেয়েছিস তো?’

‘খেয়েছি, আম্মু।’

রাত জাগতে হবে। কফির সন্ধানে চলল বাঙালি ছেলেরা। সোনিয়া রয়ে গেল দুই ভদ্রমহিলার সঙ্গে।

‘আঙ্কেল গুনের কী হলো, বল তো!’ চলার ওপর জিজ্ঞাসা করল আয়মান, ‘এখনো দেখা নেই কেন?’

‘আমিও তা-ই ভাবছিলাম। গাড়ি পার্ক করতে তো এতক্ষণ লাগার কথা নয়!’

‘বিড ওয়াকারের মতো উধাও না হলেই হয়! আচ্ছা ভাইয়া, পুলিশকে না জানিয়ে ভুল করলাম না তো? বিড যদি কালপ্রিট হয়?’

‘মনে হয় না…।’

‘পালিয়ে গেল যে?’

‘পালিয়েছে ভাবছিস কেন? ধর, যদি কিডন্যাপ হয়?’

‘তা-ও বটে।’ মাথা চুলকাল আয়মান, ‘একটা কথা বলা হয়নি তোকে!’

‘কী কথা?’

‘আমি যখন লিলি আপুর ক্ষতস্থান শার্ট দিয়ে চেপে ধরেছিলাম, শার্ট ভিজে গিয়ে রক্ত লাগে হাতে। রক্তটা ঠান্ডা বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। যদিও তাজা রক্ত গরম হওয়ার কথা।’

‘কী বলিস! শিওর তুই?’

‘তবে আর বলছি কী!’

চলার পথে হেইফার গুনের খোঁজে ইতিউতি চোখ রাখল ইকরামুল্লাহ ভাইয়েরা। কোথাও দেখা গেল না লোকটাকে। রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওরা যাওয়ার খানিক পরই নাকি এক ভদ্রলোক মেসেজ রেখে গেছেন ওদের জন্য।

চিরকুটটা দিল ওদের রিসেপশনিস্ট। ওতে লেখা:

দুঃখিত। ভুলেই গিয়েছিলাম, হাসপাতালের গন্ধ সহ্য হয় না আমার। সে জন্য আর থাকতে পারলাম না। ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।

—হেইফার গুন

‘ঝামেলা হয়ে গেল!’ ভাইকে বলল আয়ান, ‘এই গুনের বাসায় এখন যেতে হবে আমাদের।’

‘কেন, ব্রাদার?’

‘কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে ভদ্রলোককে। ব্লু জ্যামাইকা অ্যাপারেলসে চাকরি করে, বলেছিল না বিড?’

‘ওখানে যাওয়ার কথা ভাবছিস নাকি?’

‘হ্যাঁ, ওদের ঠিকানা পাওয়ার আশা করছি ওখান থেকে।’

‘কিন্তু এত রাতে কি খোলা থাকবে অফিস?’

‘দেখা যাক। কফির জোগাড় দেখি আগে।’

‘সকালে গেলে সমস্যা কী?’

‘না। এক্ষুনি যেতে হবে আমাদের। রাত যেহেতু জাগতেই হচ্ছে, তদন্ত ফেলে রাখার মানে হয় না কোনো।’

‘কিন্তু যাবি কীভাবে? সাইকেল, গাড়ি—কোনোটাই তো নেই!’

‘লাগবে না। চিনি অফিসটা। খুব একটা দূরে নয় এখান থেকে।’

পাঁচ

অফিস বিল্ডিংটা তেতলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ নেই ভেতরে। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগে।

ছেলেদের গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে অভ্যস্ত বলে আসতে দিতে নিমরাজি হয়েছেন ওদের আম্মু। সোনিয়াও বায়না ধরেছিল আসার জন্য। নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে বাদ সেধেছেন মিসেস পার্কার।

দুজন নাইটগার্ড পাহারায় রয়েছে মেইন গেটে। একজন মোটা, আরেকজন শুকনা। সিনেমার লরেল অ্যান্ড হার্ডি যেন। গল্পগুজব করছে বসে বসে।

‘কারা তোমরা?’ দুই কিশোরকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেছে গার্ডদের, ‘এখানে কী এত রাতে?’

‘কেউ নেই অফিসে?’ আলাপ চালানোর দায়িত্ব নিল আয়ান।

‘নাহ্, পাঁচটার সময় ছুটি হয়ে গেছে।’ বিরক্তির ছাপ শুকনা গার্ডের কণ্ঠে, ‘কোনো কাজ থাকলে সকালে এসো। নয়টায় খোলে অফিস।’

‘কিন্তু আমাদের যে জরুরি দরকার!’ ভালো অভিনেতা আয়ান। কণ্ঠ আর চেহারায় চমত্কার ফুটিয়ে তুলেছে বিপন্ন ভাবভঙ্গি, ‘মিস্টার হেইফার গুন তো এখানেই চাকরি করেন, তাই নয়? ওনার ঠিকানাটা প্রয়োজন। আজ এক বার্থডে পার্টিতে দেখা হয়েছে আমাদের। পার্টি শেষে লিফট দিয়েছিলেন গাড়িতে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাজাব বলে কে-পপের একটা সিডি নিয়েছিলাম সঙ্গে। গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারে চালিয়ে দিই সেটা। পরে নামার সময় ওটা নেওয়ার কথা মনে ছিল না। এখন যদি দয়া করে মিস্টার গুনের ঠিকানাটা দেন, তবে খুব উপকার হয়। সিডিটা আমাদের বড় ভাইয়ের। ওটা না নিয়ে গেলে আচ্ছামতো ধোলাই দেবে আমাকে!’

‘আচ্ছা আচ্ছা!’ বলল মহাবিরক্ত প্রহরী, ‘ভেতরে এসো একজন। রেজিস্টার বই থেকে টুকে নেবে ঠিকানা।’

অফিস থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিটের হাঁটাপথ মিস্টার গুনের বাসা।

এগিয়ে চলেছে ওরা, হঠাৎ চমকে উঠল আয়মান, ‘আরে! বিড ওয়াকার না?’

আয়ানও লক্ষ করেছে। হ্যাঁ, বিডই! ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

ব্যাপার কী! কোথায় চলেছে লোকটা? ক্যানজাস ছেড়ে পালাচ্ছে না তো? যদিও কোনো ব্যাগট্যাগ দেখা যাচ্ছে না সঙ্গে। পার্টির পোশাকই পরে রয়েছে এখনো।

কাছাকাছি এসে প্রথম মুখ খুলল তরুণই, ‘কী ব্যাপার, এত রাতে এদিকে?’

‘তার আগে বলুন, পার্টি ছেড়ে পালিয়ে এলেন কেন?’ জবাব দাবি করল আয়মান।

‘আ…আসলে…ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি!’ আমতা আমতা করছে লোকটা, ‘ক্-কোনো দোষ নেই আমার! বিশ্বাস করো, কিচ্ছু করিনি আমি লিলিকে!’

‘কিছুই যদি না করে থাকেন, চলে আসার পক্ষে যুক্তি কী তাহলে?’ আয়ানও চেপে ধরল যুবককে।

‘বললাম তো, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম!’ কী যেন ভাবল বিড ওয়াকার, ‘খুলে বললেই বুঝতে পারবে।’

‘সেটাই করছেন না কেন তাহলে?’ ধমকের সুরে বলল আয়মান।

‘ইয়ে…মানে…লিলির সঙ্গে আজ একটা বিষয়ে কথা–কাটাকাটি হয়েছে আমার। একপর্যায়ে চড় মেরে বসে ও আমাকে! সে জন্যই ওর পিছু পিছু পার্কিং লটে গিয়েছিলাম চড়ের শোধ তুলতে। কিন্তু…,’ বাক্যটা শেষ করল না বিড, ‘বুঝতেই পারছ, ওখানে থাকলে আমাকেই সন্দেহ করত সবাই!’

‘ভেগেছেন বলে আরও বেশি করে সন্দেহ করছে!’

‘ঝগড়াটা কী নিয়ে?’ প্রশ্ন আয়ানের।

‘বলা যাবে না, ব্যক্তিগত বিষয়।’

‘তবে তো পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না! শুধু তো আক্রমণ নয়, অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডার!’

‘দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ ভয় দেখা দিয়েছে বিডের চেহারায়, ‘বলছি সব কথা।’ এক সেকেন্ড বিরতি নিল তরুণ, ‘ভালো বন্ধু ছিলাম আমি আর লিলি। এদিকে বেশ কিছুদিন হলো ফারিহা নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। আজ সন্ধ্যায় সোনিয়াদের বাগানে ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লিলির চোখে পড়ে যাই আমরা। নিজের জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারেনি মেয়েটা। ফলাফল তো আগেই বলেছি। আসলে, আজই বুঝেছি, অন্য চোখে দেখে ও আমাকে।’

‘বোঝা গেল এবার।’ মাথা দোলাল আয়ান, ‘আচ্ছা, মিস্টার গুনের সঙ্গে লিলি আপুর সম্পর্ক কেমন?’

‘ভালোই তো!’ অবাক মনে হলো বিডকে, ‘কেন জিজ্ঞাসা করছ এ কথা?’

‘দরকার আছে।’

‘একই সঙ্গে জয়েন করেছি আমি আর হেইফার। যদিও বয়সের দিক থেকে সিনিয়র লোকটা। দুজন দুজনকে পছন্দ করে বলেই জানি।’

‘যাচ্ছিলেন কোথায় আপনি?’ জিজ্ঞাসা আয়মানের।

‘হাসপাতালে খোঁজ করতে।’

‘লিলি আপুকে কে আঘাত করেছে, দেখেছেন?’

‘না। পেছন থেকে যে–ই ওকে ডাক দিতে যাব, এমন সময় একটা চিৎকার ছেড়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে লিলি। কাছে গিয়ে দেখি, রক্ত বেরোচ্ছে। ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে এলাম ওখান থেকে।’

‘গুলি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে…।’ চিন্তিত স্বরে মন্তব্য করল আয়ান।

‘গুলির আওয়াজ পেয়েছিলেন আপনি?’ বিডের দিকে তাকাল আয়মান।

‘না, পাইনি।’

‘আওয়াজ না করেও কিন্তু গুলি করা যায়!’ আয়ান বলল, ‘সাইলেন্সারের কথা শুনেছিস নিশ্চয়ই?’

ছয়

‘ঘরে আলো জ্বলছে।’ স্বগতোক্তি আয়মানের, ‘এখনো জেগে আছেন ভদ্রলোক?’

‘টিভি দেখছেন হয়তো।’ বড় ভাইয়ের মন্তব্য, ‘টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলো তো অনেক রাত পর্যন্ত চলে।’

‘হুম। ভালোই হলো, ঘুম ভাঙাতে হলো না মানুষটার।’

‘তুই যা, নক দে গিয়ে। আমি না আসা পর্যন্ত চালিয়ে যাবি কথা।’

‘আর তুই?’

‘আসছি একটু পরে।’

সুইচ টিপতেই জলতরঙ্গের আওয়াজে বেজে উঠল কলবেল।

কয়েক সেকেন্ড পর খুলে গেল দরজা।

মিস্টার গুনের পরনে নাইট ড্রেস। হাতে টিভির রিমোট। সামনে দাঁড়ানো কিশোরটিকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত তিনি।

‘ইয়ে…একটা দরকারে আসতে হলো, আঙ্কেল!’ অস্বস্তি লাগছে আয়মানের, ‘ডিসটার্ব করলাম বোধ হয়!’

‘এসো, ভেতরে এসো।’ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন গুন।

ড্রয়িংরুমে বেসবল ম্যাচের হাইলাইটস দেখাচ্ছে টিভিতে।

‘হ্যাঁ…এবার বলো, কী জন্য এসেছ।’ কিশোর গোয়েন্দা সোফায় বসার পর জবাব চাইলেন মিস্টার গুন।

‘লিলি আপুর ব্যাপারে। হাসপাতালে দেখতে গেলেন না ওনাকে…।’

‘কেন, মেসেজ পাওনি তোমরা?’

‘তা পেয়েছি। আসলে, কয়েকটা ইনফরমেশন জানার ছিল আপনার কাছে। ভেবেছিলাম, হাসপাতালেই জেনে নেব ওগুলো। চলে এলেন বলে বাসায় আসতে হলো আপনার।’

‘কী ইনফরমেশন?’ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন গুন।

‘একই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন আপনারা…।’

‘হ্যাঁ, তো?’

‘কেমন তিনি কলিগ হিসেবে?’

‘চমৎকার।’

‘আর মিস্টার ওয়াকার?’

‘কে, বিড? কোনো অভিযোগ নেই।’

‘শুনলাম একসঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিলেন আপনারা…।’

‘কার কাছে শুনলে?’

‘উনিই বললেন…।’

‘হ্যাঁ। একই সঙ্গে, একই পোস্টে যোগ দিই দুজন…।’

‘আর লিলি আপু?’

‘ও আরও আগে ঢুকেছে। পদমর্যাদায়ও এগিয়ে।…আর কিছু?’

আয়মান জবাব দেওয়ার আগেই আবার বাজল দরজার ঘণ্টি।

‘আপনার খেল খতম, মিস্টার গুন!’ দরজা খুলতেই বোমা ফাটাল আয়ান ইকরামুল্লাহ।

‘কীহ্!’ হাঁ হয়ে গেছেন ভদ্রলোক। চোখ জোড়া যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে।

‘লিলি আপুকে গুলি করলেন কেন?’

‘কী বলছ এসব?’

‘অভিনয় করে লাভ নেই আর! আপনার গাড়ির পেছনের বুটে এয়ার রাইফেল দেখে এলাম। পার্টিতে এয়ার রাইফেল নেওয়ার ব্যাখ্যা দেবেন, প্লিজ?’

সহসা হাত দুটো মরা সাপের মতো ঝুলে পড়ল লোকটার। বুঝে গেছেন, ধরা পড়ে গেছেন তিনি। ক্লান্ত, পরাজিত দৃষ্টি ফুটল চোখে।

‘কিন্তু, ভাইয়া…ডাক্তাররা তো…!’ আয়মানও চলে এসেছে দরজায়।

‘গুলির ইঙ্গিত দেয়নি, তা-ই তো?’ গুনের দিকে চাইল আয়ান, ‘বিশেষ একধরনের কম্প্রেসড রাইফেল ব্যবহার করেছেন তিনি। ফায়ারের সময় এক্সপ্লোশনজনিত তাপ উৎপন্ন হয় না বললেই চলে এ-জাতীয় অস্ত্রে। এক আর্মস ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম ওটার ব্যাপারে। সাধারণ বুলেট নয়, বরফের বুলেট ব্যবহার করা হয় এ ধরনের রাইফেলে!’

‘বরফের বুলেট!’ হতভম্ব হয়ে গেছে আয়মান, ‘এ-ও কি সম্ভব?’

‘সম্ভব। বিশেষ ধরনের ছাঁচে ডিপ ফ্রিজে পানি রেখে দিয়ে সহজেই তৈরি করা যায় আইস বুলেট। এটার সবচেয়ে বড় সুবিধা, টার্গেটে আঘাত হানার পর গলে যায় গুলি। সে জন্যই বুলেট পায়নি ডাক্তাররা। লিলি আপুর রক্ত ঠান্ডা মনে হওয়ার রহস্যটা বুঝলি তো এবার?’

‘কেন?’ ঝট করে আয়মান ঘাড় ঘোরাল অপরাধী লোকটার দিকে।

‘আমিই বলছি।’ আবার বলল আয়ান, ‘পেশাগত ঈর্ষা, আর কিছু নয়! রেজিস্টার বুকে মিস্টার ওয়াকার আর ওনার ডেজিগনেশন খেয়াল করেছিলাম আমি। পদের দিক থেকে সিনিয়র ওয়াকার। পরে যখন শুনলাম, একসঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিলেন দুজন, তখন মনে হলো—মিস্টার ওয়াকারের প্রমোশন হলো, ওনার হলো না কেন? তার কারণ, ওয়াকারের হয়ে সুপারিশ করেছিলেন লিলি আপু, এই তো? স্রেফ এ কারণেই…!’

‘ভুল!’ দপ করে জ্বলে উঠল হেইফার গুনের চোখের তারা, ‘হ্যাঁ, আমিই গুলি করেছি লিলিকে! প্রতিনিয়ত অবিচার করছিল ও আমার ওপর। সহ্য করেছি মুখ বুজে। কিন্তু কয়েকদিন আগে যখন চাকরি খেয়ে দেওয়ার হুমকি দিল…।’

‘কী কারণে?’

‘আমার অপরাধ: বিডের আসল চেহারা তুলে ধরতে চেয়েছি লিলির সামনে। অনেক করেছে মেয়েটা ওর জন্য। চাকরি পাইয়ে দিয়েছে, সময়ে-অসময়ে টাকাপয়সা ধার দিয়েছে, ব্যবস্থা করেছে প্রমোশনের…অথচ ছোঁড়াটা একদমই অকৃতজ্ঞ! আমার কথা তো বিশ্বাস করলই না, উল্টো চাকরি খাওয়ার ভয় দেখাল লিলি…!’

‘তার মানে…লিলি আপুকে হাসপাতালে নেওয়ার পর নয়, আগেই এসে ঘাপটি মেরে ছিলেন আপনি?’

মাথা নিচু করে ফেললেন গুন।

চট করে আবার বৈঠকখানায় ঢুকে পড়ল আয়মান। এবার ফোন করতে হবে পুলিশকে।

(বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments