আমাদের বাড়ি – জিনাতুন নেসা

আমাদের বাড়ি - জিনাতুন নেসা

ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে ১৫ মিনিট। কবরস্থানে বসে আছি আমি। উঠে দাঁড়ানোর জোরটুকুও নেই শরীরে। আশপাশে অনেক চিৎকার, কান্নাকাটি। তার মধ্যেও আমাকে নিয়ে টানাটানি করছে অনেকে, এখান থেকে ওঠার জন্য। বারবার বাড়ি যাওয়ার জন্য বলছে সবাই। কেন তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি তো আমার বাবার পাশেই বসে আছি। নতুন একটা বাসা পেয়েছে বাবা। ওই যে বাবার নাম লেখা। শুধু নামের আগে বসানো হয়েছে ‘মরহুম’ শব্দটা। বাসাটা অনেক ছোট। তারপরও নিজের বাসা বলে কথা। বাবা তো কিছুক্ষণ পরই দরজা খুলবে। সবাই এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? এই তো কাল সকালবেলা বাবা বলছিল—

—নাহিন, বাবা ওঠ!

—বাবা আর একটু! প্লিজ!

—আরও ঘুমুতে চাইছিস? তুই দুপুরের খাবার খাবি, নাকি সকালের নাশতা?

—আচ্ছা উঠছি।

ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা ঠেলে বের হওয়ামাত্রই অনেকগুলো বেলুন ফাটল, স্নো স্প্রে, তার সঙ্গে কেক মাখামাখি। ব্যাপার কী?

—হ্যাপি বার্থডে!

—ও আচ্ছা, আমার বার্থডে। ভুলেই গিয়েছিলাম।

—কই বাত নেহি বেটি (বাবা খুশি হলে হিন্দি বলে)।

খুশিতে আমি যখন প্রায়ই কেঁদে ফেলছিলাম, তখনই বাবা বলে উঠল, আজ পুরো ঢাকা ঘুরে বেড়াবে।

দুপুর নাগাদ খাওয়াদাওয়া সেরে আমি, মা, বাবা আর ছোট ভাই রিংকু বেরিয়ে পড়লাম। চিড়িয়াখানায় ঘুরলাম, একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটলাম চারজন। ভালোই কাটছিল সময়টা। কিন্তু হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা ওঠে বাবার। বাবা হার্টের রোগী। সময়ের ওষুধ সময়ে নেওয়া প্রয়োজন তার। কিন্তু তাড়াহুড়ার জন্য ওষুধ আনার কথা মনেই ছিল না।

—বাবা, তোমার ওষুধ তো আনা হলো না।

—থাক, ওতে কিছু হবে না।

—না, চলো পাশের কোনো ফার্মেসি থেকে কিনে নিই।

—আহা, লাগবে না তো বললাম।

—কিন্তু তোমার ব্যথা…

তোরা আছিস, তোদের মা আছে। আমাকে কি কেউ বাগে পাবে? হা হা হা…

বাবার হাসিই বলে দিচ্ছিল বাবার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের দিকে আসতে না-আসতেই বাবার সেই হূদয়বিদারক ব্যথা। বাবার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। কেমন যেন করছিল বাবা। আমরা হতভম্ব। বাবাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল আশপাশের মানুষ। তারপর আর কিছু জানি না। আমি কী করেছিলাম, সেটাও মনে নেই। শুধু মনে আছে, পরদিন সকালবেলা, মানে আজ সকালে একটা সাদা কাপড়ের মধ্যে করে আসে বাবা। ছোটবেলায় বাবা প্রায়ই আমার সঙ্গে মায়ের ওড়না নিয়ে লুকোচুরি খেলত।

খুব বকাঝকা করত মা। বাবা আর আমি হাসতাম। কিন্তু এখন বাবা কেন এভাবে আসবে? জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলছে না। মা জ্ঞান হারিয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত ধরলাম। বরফের চেয়েও ঠান্ডা বাবার হাত। বাবার হাত তো কখনো এত ঠান্ডা থাকে না। এখন কেন এত ঠান্ডা? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাবা যে গাড়িতে শুয়ে ছিল, সেই গাড়িতে ধড়মড় করে উঠলাম আমি। আমাকে নামাতে চেয়েছিল, নামিনি। আমার বাবা এখানে, আমি নামব কেন? আর তারপর? তারপরও কিছু মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে, বাবাকে এই ছোট্ট ঘরটায় শুইয়ে দেওয়া হলো। তারপর মাটি দিয়ে দরজা দেওয়া হলো বাবার। আশ্চর্য! বাবা বের হবে কীভাবে?

এ জন্যই আমি বসে আছি। বাবা ডাকলেই আমি মাটি খুঁড়ব। ওরা কী বোকা! এত সহজ জিনিসটা বোঝে না। কিন্তু বাবা এখনো ডাকছে না কেন? আমার আর ভাল্লাগছে না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। ইশ্! আমার অসুখ একেবারে সহ্য করতে পারে না বাবা। দৌড়ে চলে আসে। এখন কেন আসছে না? বাবার কী হলো? ঘুমে তো চোখ বন্ধ হয়ে এল। না, জেগে থাকতে হবে। কিন্তু আমার অনেক বেশি ঘুম পাচ্ছে।

অনেক অনেক বেশি।

—বাবা, বাবা?

—এই তো মা, এইখানে!

—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

—এই তো আমাদের বাড়িতে।

—এইটা আমাদের বাড়ি?

—হ্যাঁ।

—মা কোথায়? রিংকু কোথায়?

—ওরা আসবে ওদের সময় হলে।

—আমি আর তুমি কি এখন থেকে একসাথে থাকব?

—হ্যাঁ।

—কী মজা বাবা!

—হুম, অনেক মজা।

—বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

—আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি।

Facebook Comment

You May Also Like