Monday, May 6, 2024
Homeরম্য গল্পনোনামিঠা - সৈয়দ মুজতবা আলী

নোনামিঠা – সৈয়দ মুজতবা আলী

নোনামিঠা - সৈয়দ মুজতবা আলী

ব্যারোমিটার দেখে, কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, লাল-দরিয়া এমন কিছু গরম জায়গা নয়। জেক্কাবাদ পেশওয়ার দূরে থাক, যাঁরা পাটনা-গয়ার গরমটা ভোগ করেছেন তারা আবহাওয়া-দপ্তরে তৈরি লাল-দরিয়ার জন্ম-কুণ্ডলী দেখে বিচলিত তো হবেনই না, বরঞ্চ ঈষৎ মৃদু হাস্যও করবেন। আর উন্নাসিক পর্যটক হলে হয়তো প্রশ্ন করেই বসবেন, হালকা আলসটারটার দরকার হবে না তো!’

অথচ প্রতিবারেই আমার মনে হয়েছে, লাল-দরিয়া আমাকে যেন পার্ক সার্কাসের হোটেলে খোলা আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শিক-কাবাব ঝলসাচ্ছে। ভুল বললুম, মনে হয়েছে, যেন হাঁড়িতে ফেলে, ঢাকনা লেই দিয়ে সেঁটে আমাকে দম-পুখতের’ রান্না বা ‘পুটপঙ্ক’ করেছে। ফুটবলীদের যে রকম ‘বগি-টিম’ হয়, লাল-দরিয়া আমার ‘বগি-সী।’

সমস্ত দিনটা কাটাই জাহাজের বৈঠকখানায় হাঁপাতে হাঁপাতে আর বরফভর্তি গেলাসটা কপালে ঘাড়ে নাকে ঘষে ঘষে, আর রাতের তিনটে যামই কটাই রকে অর্থাৎ ডেকে তারা গুনে গুনে। আমার বিশ্বাস ভগবান লাল-দরিয়া গড়েছেন। চতুর্থ ভূতকে বাদ দিয়ে। ওর সমুদ্রে যদি কখনও হাওয়া বয় তবে নিশ্চয়ই কিম্ভুতই বলতে হবে।

তাই সে রাত্রে ব্যাপারটা আমার কিন্তুত বলেই মনে হল।

ডেকা-চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্ৰা। এমন সময় কানে এল, সেই লাল-দরিয়ায়, দেশ থেকে বহু দূরের সেই সাত সমুদ্রের এক সমুদ্রে–সিলেটের বাঙাল ভাষা। স্বপ্নই হবে। জানতুম, সে-জাহাজে আমি ছাড়া আর কোন সিলেটি ছিল না। এ-রকম মরমিয়া সুরে মাঝ রাতে, কে কাকে ‘ভাই, হি কথা যদি তলচস’—বলতে যায়? খেয়ালীপোলাও চাখতে, আকাশ-কুসুম শুকতে, স্বপ্নের গান শুনতে কোনও খরচা নেই; তই ভাবলুম চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটা আরও কিছুক্ষণ ধরে দেখি।

কিন্তু ওই তো স্বপ্নের একটিমাত্র দোষ। ঠিক যখন মনে হবে, বেশ জমে আসছে, ঠিক তখনই ঘুমটি যাবে ভেঙে। স্থলেও সে আইনের ব্যত্যয় হল না। চোখ খুলে দেখি, সামনেআমার দিকে পিছন ফিরে দুজন খালাসী চাপা গলায় কথা বলছে।

বেচারীরা। রাত বারোটার পর এদের অনুমতি আছে ডেকে আসবার। তাও দল বেঁধে নয়। বাকী দিনের অসহ্য গরম তাদের কাটাতে হয়। জাহাজের পেটের ভিতরে।

সিলেট-নোয়াখালির লোক যে পৃথিবীর সর্বত্রই জাহাজে খালাসীর কাজ করে সে-কথা আমার অজানা ছিল না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, তারা কাজ করে মাল-জাহাজেই; এ ফরাসি যাত্রী-জাহাজে রাত্রি দ্বিপ্রহরে, তাও আমার নোয়াখলি চাটগাঁয়ের নয়, একদিম খাঁটি আমার আপনি দেশ সিলেটের লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা স্বপ্নেই বেশি, বাস্তবে কম।

এরা কথা বলছিল খুবই কম। যেটুকু শুনতে পেলুম, তার থেকে কিন্তু এ-কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল, এদের একজন এই প্রথম জাহাজের কামে’ ঢুকেছে এবং দেশের ঘরবাড়ির জন্য তার মন বড্ড উতলা হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গী পুরনো লোক; নতুন বউকে যে-রকম বাপের বাড়ির দাসী সান্ত্বনা দেয় এর কথার ধরন অনেকটা সেই রকমের।

আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলুম। শেষটায় যখন দেখলুম ওরা উঠি-উঠি করছে তখন আমি কোনও প্রকারের ভূমিকা না দিয়েই হঠাৎ অতি খাঁটি সিলেটিতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমাদের বাড়ি সিলেটের কোন গ্রামে?’

সিলেটের খালাসীরা দুনিয়ায় তাবৎ দরিয়ার মাছের মত কিলবিল করে এ-সত্য সবাই জানে, কিন্তু তার চেয়ে ঢের সত্য-সিলেটের ভদ্রসন্তান পারতপক্ষে কখনও বিদেশ যায় না। তাই লাল-দরিয়ার মাঝখানে সিলেটি শুনে আমার মনে হয়েছিল, ওটা স্বপ্ন; সেইখানে সিলেটি ভদ্রসন্তান দেখে ওদের মনে হল, আজ মহাপ্ৰলয় (কিয়ামতের দিন) উপস্থিত। শাস্ত্রে আছে, ওই দিনই আমাদের সকলের দেখা হবে এক-ই জায়গায়; ভূত দেখলেও মানুষ অতখানি লাফ দেয় না। দুজন যেভাবে একই তালে-লিয়ে লাফ দিল তা দেখে মনে হল ওরা যেন এই কর্মটি বহুদিন ধরে মহড়া দিয়ে আসছে।

উভয় পক্ষ কথঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর আমি সিগারেট-কেস খুলে ওদের সামনে ধরলুম। দুজনেই একসঙ্গে কানে হাত দিয়ে জিভ কাটল। আমাকে তারা চেনে না বটেআমি দেশ ছেড়েছি ছেলেবেলায়-তবে আমার কথা তারা শুনেছে এবং আমার বাপ-ঠাকুর্দার পায়ের ধুলো তার বিস্তর নিয়েছে, খুদাতালার বেহদ্‌ মেহেরবানি আজ তারা আমার দর্শন পেল, আমার সামনে ওসব —তওবা, তওবা ইত্যাদি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দেশের চাষারা ইয়োরোপীয় চাষার চেয়ে ঢের ভদ্র।

খালাসী-জীবনের কষ্ট এবং আর পাঁচটা সুখ-দুঃখের কথাও হল। দুঃখের কথাই পনের আনা তিন পয়সা। বাকী এক পয়সা সুখ—অর্থাৎ মাইনেটা, সেই এক পয়সাই পাঁচাত্তর টাকা। ওই দিয়ে বাড়িঘর ছাড়াবে, জমি-জমা কিনবে।

শেষটায় শেষ প্রশ্ন শুধালুম, ‘আহারাদি?’ রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে।

বললে, ‘ওই তো আসল দুঃখ হুজুর। আমি তো তবু পুরোন লোক। পাউরুটি আমার গলায় গিট বাঁধে। না। কিন্তু এই ছেলেটার জান পাস্তাভাতে পোতা। পাস্তাভাত! ভাতেরই নেই খোঁজ, ও চায় পাস্তাভাত। মূলে নেই ঘর, পূব দিয়া তিন দোর। হুঁঃ।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘সে কী কথা! আমি তো শুনেছি, আর কিছু না হোক তোমাদের ডাল ভাত প্রচুর খেতে দেয়। জাহাজের কাম করে কেউ তো কখনও রোগ হয়ে দেশে ফেরেনি!’

বললে, ‘ঠিকই শুনেছেন সায়েব। কিন্তু ব্যাপার হয়েছে কী, কোনও কোনও বন্দরে চাল এখন মাগগি। সারেঙ আমাদের রুটি খাইয়ে চাল জমাচ্ছে ওই সব বন্দরে লুকিয়ে চাল বিক্রি করবে বলে। সারেঙ দেশের জাতভাই কি না, না হলে অমন মারার কৌশাল জানবে কী করে?’

আমি বললুম, ‘নালিশ ফরিয়াদ করনি?’

বললে, ‘কে বোঝে কার বুলি? এদের ভাষা কি জানি ‘ফ্রিঞ্চি’ না কী, সারেঙই একটুখানি বলতে পারে। ইংরিজি হলেও না হয় আমাদের মুরুর্কীদের কেউ কেউ ওপরওয়ালদের জানাতে পারতেন। ওই তো সারেঙের কল! ধন্যি জাহাজ; ব্যাটারা শুনেছি কোলা ব্যাঙ ধরে ধরে খায়। সেলাম সায়েব, আজ উঠি! দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনার কথা শুনে জানটা–’

আমি বললাম, ‘বাস, বাস।’

মাঝরাতের স্বপ্ন আর শেষরাতের ঘটনা মানুষ নাকি সহজেই ভুলে যায়। আমার আবার চমৎকার স্মৃতিশক্তি-সব কথাই ভুলে যাই। তাই ভাতের কেচ্ছা মনে পড়ল, দুপুরবেলা লাঞ্চের সময় রাইস-কারি দেখে।

জাহাজটা ফরাসিস, ফরাসিসে ভর্তি। আসলে এটা ইন্ডো-চীন থেকে ফরাসি সেপাই লস্কর লাদাই করে ফ্রান্স যাবার মুখে পণ্ডিচেরিতে একটা ঢু মেরে যায়। প্যাসেঞ্জার মাত্রই পল্টনের লোক, আমরা গুটিকয়েক ভারতীয়ই উটকো মাল। খানাটেবিলে আমার পাশে বসত একটি ছোকরা সূলিয়োৎনা—অর্থাৎ সাব অলটার্ন। আমার নিতান্ত নিজস্ব মৌলিক ফরাসিতে তাকে রাত্রের ঘটনাটি গল্পচ্ছলে নিবেদন করলুম।

শুনে সে তো মহা উত্তেজিত। আমি অবাক! ছুরি কাঁটা টেবিলে রেখে, মিলিটারি গলায় বাঁজ লাগিয়ে বলতে শুরু করলে, ‘এ ভারি অন্যায়, অত্যন্ত অবিচার, ইনুই-অনহার্ড-অব–ফাতাস্তিক-ফেনটাসটিক আরও কত কী!’

আমি বললুম, ‘রোস রোস। এত গরম হচ্ছে কেন? এ অবিচার তো দুনিয়ায় সর্বত্রই হচ্ছে, আকছারই হচ্ছে। এই যে তুমি ইন্দোচীন থেকে ফিরছ, সেখানে কি কোন ড্যানিয়েলগিরি করতে গিয়েছিলে, যে গার্সে (বাছ)। ওসব কথা থাক, দুটি খাও।’

ছোকরাটির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল বলেই কথাটা বলবার সাহস হয়েছিল। বরঞ্চ ইংরেজকে এ-সব কথা বলবেন, ফরাসিকে বললে হাতাহাতি বোতল-ফাটাফাটির সম্ভাবনাই বেশি।

চুপ মেরে একটু ভেবে বললে, ‘হঃ। কিন্তু এস্থলে তো দোষী তোমারই জাতভাই ইন্ডিয়ান সারেঙ!’

আমি বিষম খেয়ে বললুম, ‘ওই-যা-যা!’

পৃথিবীতে এমন কোন দেশ এখনও দেখলুম না যেখানে মানুষ সুযোগ পেলে দুপুরবেলা ঘুমোয় না। তবু কেন বাঙালির ধারণা যে, সে-ই এ ধনের একমাত্র অধিকারী, এখনও বুঝে উঠতে পারি নি। আপনি আপন ডেকচেয়ারে শুয়ে, চোখে ফেটা মেরে আর পাঁচটি ফরাসিসের সঙ্গে কোরাসে। ওই কর্মটি সবেমাত্র সমাধান করেছি, এমন সময় উর্দি-পরা এক নৌ-অফিসার আমার সামনে এসে অতিশয় সৌজন্য সহকারে অবনত মস্তকে যেন প্রকাশ্যে আত্মচিন্তা করলেন, ‘আমি কি মসিয়ো অমুকের সঙ্গে আলাপ করার আনন্দ করছি?’

আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে, আরও অবনত মস্তকে বললুম, ‘আদপেই না। এ শ্লাঘা সম্পূর্ণ আমার-ই।’

অফিসার বললেন, মসিয়ো ল্য কমাদ-জাহাজের কাপ্তান সাহেব—সিয়োকে–আমাকে–তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দাভিবাদন জানিয়ে প্রার্থনা করছেন যে, তিনি যদি মসিয়োর উপস্থিতি পান তবে উল্লসিত হবেন।’

পাপাত্মা আমি। ভয়ে আঁতকে উঠলুম। আবার কী অপকর্ম করে ফেলেছি যে, মসিয়ো ল্য কমাদাঁ আমার জন্য হুলিয়া জারি করেছেন। শুকনো মুখে টোক গিলে বললুম, ‘সেই হবে আমার এ-জীবনের সব চেয়ে বড় সম্মান। আমি আপনার পথপ্রদর্শনের জন্য ব্যাকুল।’

মসিয়ো ল্য কমাদাঁ যদিও যাত্রী-জাহাজের কাপ্তান, তবু দেখলুম তার ঠোঁটের উপর ভাসছে আর-একখানি জাহাজ এবং সেটা সবপ্রকার বিনয় এবং স্তুতিস্তোকবাক্যে টৈটম্বর লাদাই। ভদ্রতার মানওয়ারী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে মোদ্দা কথা যা বললেন, তার অর্থ আমার মত বহুভাষী পণ্ডিত ত্ৰিভুবনে আর হয় না, এমন কী প্যারিসেও হয় না।

এত বড় একটা মারাত্মক ভ্ৰমাত্মক তথ্য তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করব করব করছি, এমন সময় তার কথার তোড় থেকেই বেরিয়ে গেল, তিনি তিনশো তিরানব্বই বার পৃথিবী প্ৰদক্ষিণ করে এই প্রথম একটি মহাপণ্ডিত আবিষ্কার করেছেন, যিনি তার খালাসীদের কিচির-মিচিরের একটা অর্থ বের করতে পারেন। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তা হলে আমার মত আরও বহু লক্ষ পণ্ডিত সিলেট জেলায় আছেন। তারপর তিনি অনুরোধ করলেন, আমি যদি দয়া করে তার খালাসীদের অসন্তুষ্টির কারণটি খোলসা করে বর্ণনা করি, তবে তিনি বড় উপকৃত হন। আমি তা-ই করলুম। তখন সেই খালাসীদের আর সারেঙের ডাক পড়ল। তারা কুরবানির পাঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে উপস্থিত হল।

কাপ্তান আর জজ ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী। সাক্ষীর বয়স কত, সেই আলোচনায় জজেরা হেসে-খেলে সাতটি দিন কাটিয়ে দেন; কাপ্তানরা দেখলুম, তিন-মিনিটেই ফাঁসির হুকুম দিতে পারেন। মসিয়ো ল্য কমার্দো অতি শাস্তকণ্ঠে এবং প্রাঞ্জল ফরাসিতে সারেঙকে বুঝিয়ে দিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যদি আর কখনও এরকম কেলেঙ্কারির খবর পান, তবে তিনি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে সারেঙকে সমুদ্রের জলে ফেলে তার উপর জাহাজের প্রপেলারটি চালিয়ে দেবেন।

যাক। বাঁচা গেল। মরবে তো সারেঙটা!

পানির পীর বদর সায়েব। তাঁর কৃপায় রক্ষা পেয়ে ‘বদর বদর’বলে কেবিনে ফিরলুম।

খানিকক্ষণ পর চীনা কেবিন-বয়, তার নিজস্ব ফরাসিতে বলে গেল, খালাসীরা আমাকে অনুরোধ জানিয়েছে আজ যেন আমি মেহেরবানি করে কেবিনে বসে তাদের পাঠানো ‘ডাল-ভাত’খাই।

গোয়ালন্দী জাহাজের মামুলী রাইস-কারি খেয়েই আপনারা আ-হা-হা করেন, সেই জাহাজের বাবুর্চিরা যখন কোর্মা কালিয়া পাঠায়, তখন কী অবস্থা হয়? নাঃ, বলব না। দুএকবার ভোজনের বর্ণনা করার ফলে শহরে আমার বদনাম রটে গিয়েছে, আমি পেটুক এবং বিশ্বনিন্দুক। আমি শুধু অন্যের রন্ধনের নিন্দা করতেই জানি। আমার ভয়ঙ্কর রাগ হয়েছে। তামা-তুলসী স্পর্শ করে এই শপথ করলুম-না, থাক, আপনার আমার বাড়িতে মাবোনদের আমি একটি লাস্ট চান্স দিলুম।

কাপ্তান সাহেব আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে আছেন। খালাসীরা তাই এখন নিৰ্ভয়ে খাবার নিয়ে আমার কেবিনে আসে।

এমনি করে জাহাজের শেষ রাত্ৰি উপস্থিত হল। সে রাত্রের খালাসীদের তৈরি গ্যালা ব্যানকুয়েট খেয়ে যখন বাঙ্কে এ-পাশ ও-পাশ করছি, এমন সময় খালাসীদের মুরুঝবীটি আমার পায়ের কাছটায় পাটাতনে বসে হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, একটি নিবেদন আছে।’

মোগলাই খানা খেয়ে তখন তবিয়ত বেজায় খুশ। মোগলাই কণ্ঠেই ফরমান জারি করলুম, নিৰ্ভয়ে কও।’

বললে, ‘হুজুর ইটা পরগণার ঢেউপাশা গায়ের নাম শুনেছেন?’

আমি বললুম, আলবত! মনু গাঙ্গের পারে।’

বললে, ‘আহা, হুজুর সব জানেন।’

মনে মনে বললুম, হায়, শুধু কাপ্তান আর খালাসীরাই বুঝতে পারল আমি কত বড় বিদ্যোসাগর। যারা বুঝতে পারলে আজ আমার পাওনাদারদের ভয় ঘুচে যেত তারা বুঝল না।’

বললে, ‘সেই গ্রামের করীম মুহম্মদের কথাই আপনাকে বলতে এসেছি, হুজুর। করীম ব্যাটা মহাপাষণ্ড, চোদ্দ বছর ধরে মোর্সই (মার্সেলেস) বন্দরে পড়ে আছে। ওদিকে বুড়ি মা কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো কানা করে ফেলেছে, কত খবর পাঠিয়েছে। হা-কিছুতেই দেশে ফিরবে না। চিঠিপত্রে কিছু হল না দেখে আমরা বন্দরে নেমে তার বাড়ি গিয়েছিলাম, তাকে বোঝাবার জন্য। ব্যাটার বউ এক রেঙখোকী, এমন তাড়া লাগালে যে আমরা পাঁচজন মন্দা মানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে পালাবার পথ পাই নে। তবে শুনেছি, মেয়ে-মানুষটা প্রথম প্রথম নাকি তার ভাতারের দেশের লোককে আদর-কদর করতে। যবে থেকে বুঝেছে আমরা তাকে ভাঙচি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার তালে আছি, সেই থেকে মারমুখে খাণ্ডার হয়ে আছে।’

আমি বললুম, ‘তোমরা পাঁচজন লেঠেল যে-কর্মটি করতে পারলে না, আমি সেইটে পারব? আমাকে কি গামা পাহলওয়ান ঠাউরেছ?’

বললে, ‘না, হুজুর, আপনাকে কিছু বলবে না। আপনি সুট টাই পরে গেলে ভাববে আপনি এসেছেন। অন্য কাজে। আমাদের লুঙ্গি আর চেহারা দেখেই তো বেটি টের পেয়ে যায়, আমরা তার ভাতারের জাত-ভাই। আপনি হুজুর, মেহেরবানি করে ‘না’ বলবেন না, আপনার যে কতখানি দয়ার শরীর সে-কথা বেবাক খালাসী জানে বলেই আমাকে তারা পাঠিয়েছে। আপনার জন্যই আজ আমরা ভাত-’

আমি বললুম, ‘বাস বাস, হয়েছে হয়েছে। কাপ্তান পাকড়ে নিয়ে শুধাল বলেই তো সব কথা বলতে হল। না হলে আমার দায় পড়েছিল।’

বললে, ‘তওবা, তওবা। শুনলেও গুনা হয়। তা হুজুর, আপনি দয়া করে আর ‘না।’ বলবেন না। আমি বুড়ির হয়ে আপনার পায়ে ধরছি।’

বলে সত্য-সত্যই আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। আমি হাঁ হাঁ, কর কী, কর কী’বলে পা দুটো ছাড়ালুম।

ওরা আমাকে যা কোর্মা-পোলাও খাইয়েছে তার বদলে এ-কাজটুকু না করে দিলে অত্যস্ত নেমকহারামি হয়, ওদিকে আবার এক ফরাসিনী দজল। বঁটা কিংবা ভাঙা ছাতা নয়, পিস্তল হতে নিয়ে তাড়া লাগানোই ওদের স্বভাব।

কোন মুর্থ বেরয় দেশভ্রমণে! কত না বাহান্ন রকমের যত সব বিন্দকুট খুদার খামকা গেরো!

বন্দরে নেমে দেখি, পরদিন ভোরের আগে বার্লিন যাবার সোজা ট্রেন নেই। ফাঁকি দিয়ে গেরোটা কাটাব তারও উপায় আর রইল না। দুজন খালাসী নেমেছিল সঙ্গে–ঢেউপাশার নাগরের বাড়ি দেখিয়ে দেবে বলে। তাদের পরন লুঙ্গি, গায়ে রঙিন শার্ট, মাথায় খেজুর-পাতার টুপি, পায়ে বুট, আর গলায় লাল কৰ্ম্মফর্টার। ওই কৰ্ম্মফর্টারটি না থাকলে ওদের পোশাকী সজ্জাটি সম্পূর্ণ হয় না–বাঙালির যে-রকমী রেশমী উড়নি।

দুই হুজুরে আমাকে ‘হুজুর’ ‘হুজুর’ করতে করতে নিয়ে গেল বন্দরের এক সাবার্বে। সেখানে দূরের থেকে সন্তৰ্পণে ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই তারা হাওয়া হয়ে গেল। আমি প্রমাদ গুনতে গুনতে এগলুম। পানির পীর বদর সায়েবকে এখন আর স্মরণ করে কোনও লাভ নেই। তাই সৌন্দরবনের ডাঙার বাঘের পীর গাজী সাহেবের নাম মনে মনে জপতে লািগলুম-যাচ্ছি বাঘিনীরই সঙ্গে মেলাকাত করতে।

বেশ জোরেই বোতাম টিপলুম—চোরের মায়ের বড় গলা।

কে বলে খাণ্ডার? দরাজ খুলে একটি ত্রিশ-বত্ৰিশ বছরের অতিশয় নিরীহ চেহারার গো-বেচারী যুবতী এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ‘গো’-বেচারী বললুম তার কারণ আমাদের দেশটা গরুর। আসলে কিন্তু ওদের দেশের তুলনা দিয়ে বলতে হয়, ‘মেরি হ্যাড এ লিট্‌ল ল্যাম’–এর ভেড়াটি যেন মেরির রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে আমি তৈরি ছিলুম পিস্তল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডের জন্য। সামলে নিয়ে জাহাজে যে চোস্ত ফরাসিস আদব-কায়দার তালিম পেয়েছিলেন, তারই অনুকরণে মাথা নিচু করে বললুম, ‘আমি কি মাদম মা-ও মের (মুহম্মদের ফরাসি উচ্চারণ) সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ লাভ করেছি?’ ইচ্ছে করেই কোন দিশী লোক সেটা উল্লেখ করলুম না। ফরাসিরা চীনা ভারতীয় এবং আরবীদের মধ্যে তফাত করতে পারেন না। আমরা যে রকম চীনা, জাপানী এবং বর্মী সবাইকে একই রূপে দেখি। চেহারা দেখে বুঝলুম মাদাম গুবলেট করে ফেলেছেন। বললেন, ‘আঁদ্রে (প্রবেশ করুন), মসিয়ো।’

ভরসা পেয়ে বললুম, মসিয়ো মাওমের সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?’

‘অবশ্য!’

ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, শেখ করীম মহম্মদ উত্তম ফরাসি সুট পরে টেবিলের উপর রকমারি নকশার কাপড়ের ছোট ছোট টুকরোর দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে।

আমি ফরাসিতে বললুম, ‘আমি মাদ্রাজ থেকে এসেছি, কাল বার্লিন চলে যাব। ভাবলুম, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।’ সে যে ভারতীয় এবং তার ঠিকানা জানলুম কী করে সে-কথা ইচ্ছে করেই তুললুম না।

ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে অভ্যর্থনা জানাল।

আমি ইচ্ছে করেই মাদামের সঙ্গে কথাবার্তা জুড়ে দিলুম। মার্সেলেস যে কী সুন্দর বন্দর, কত রকম-বেরকমের রেস্তোরাঁ-হোটেল, কত জাত-বেজাতের লোক কতশত রকমের বেশভূষা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আরও কত কী!

ইতিমধ্যে একটি ছেলে আর মেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

কী সুন্দর চেহারা! আমাদের করীম মুহম্মদ কিছু নটবরটি নন, তার বউও ফরাসি দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মতো, কিন্তু বাচ্চা দুটির চেহারায় কী অপূর্ব লাবণ্য! কে বলবে এরা খাঁটি স্প্যানিশ নয়? সে দেশের চিত্রকরদের অয়েলপেন্টিঙে আমি যে রকম দেবশিশুর ছবি দেখেছি। ইচ্ছে করে, কোলে নিয়ে চুমো খাই। কিন্তু আশ্চর্য লাগল, পূর্বেই বলেছি, বাপের চেহারা তো বাংলা দেশের আর পাঁচজন হাল-চাষের শেখের যা হয় তা-ই, মায়ের চেহারাও সাধারণ ফরাসিনীর মত। তিন আর তিনে তা হলে সব সময় ছয় হয় না। দশও হতে পারে—ইনিফিনিটি অর্থাৎ পরিপূর্ণতাও হতে পারে। প্রেমের ফল তা হলে অঙ্কশাস্ত্রের আইন মানে না!

মাদাম ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি তোদের বাবার দেশের লোক। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি আদর করতেই বলে উঠল, ল্যাদ, সে ত্য প্যাই ঈ ফাতাস্তিক নেসপা?–অর্থাৎ ভারতবর্ষ ফেনটাসটিক দেশ, সে দেশের অনেক ছবি সে দেখেছে, ভারি ইচ্ছে সেখানে যায়, কিন্তু বাবা রাজী হয় না–অঁকল (কাকা), আমাকে নিয়ে চল,’ ওই ধরনের আরও কত কী!

আমি আবার প্রমাদ গুনলুম। কথাটা যে-দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে না মাদাম পিস্তল বের করে।

অনুমান করতে কষ্ট হল না, আলোচনাটা মাদামের পক্ষেও অপ্রিয়। তিনি শুধালেন, ‘মসিয়োর রুচি কিসে-চা, কফি, শোকালো (কোকো), কিংবা—

আমি বললুম, অনেক ধন্যবাদ।’

তবু শেষটায় কফি বানাতে উঠে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে করীম মুহম্মদ উঠে দাঁড়িয়ে সিলেটি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করতে গেল। বুঝলুম, ওর চোখ ঠিক ধরতে পেরেছে। আমি সিলেটিতেই বললুম, ‘থাক থাক।’

যে ভাবে তাকাল তার থেকে বুঝতে পারলুম, সে পায়ের ধুলো নিতে যাচ্ছে না, সে পায়ের ধুলো নিচ্ছে তার দেশের মুরুর্কীদের যার ভিতর রয়েছেন আমার পিতৃ-পিতামহও, সে তার মাথায় ঠেকাচ্ছে দেশের মাটির ধুলো, তার মায়ের পায়ের ধুলো। আমি তখন বারণ করবার কে? আমার কী দম্ভ! সে কি আমার পায়ের ধুলো নিচ্ছে?

শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করলে, ‘হুজুর কোন হোটেলে উঠেছেন?? আমি নাম বললুম। স্টেশনের কাছেই।

আমি বললুম, ‘বস।’সে আপত্তি জানাল না। তারপর দুজনই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম। কারও মুখে কোনও কথা নেই।

এমন সময়ে মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার গালে চুমো খেয়ে বললুম, মধু।’

বাপ হেসে বললে, ‘এবারে জন্মদিনে ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম ও কী সওগাত চায় তখন চাইলে ইন্ডিয়ান বর। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের কথা পাড়লেই ঘেমে ওঠে।’

তার গলায় ঈষৎ অনুযোগের আভাস পেয়ে আমি বললুম, মনে মনে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়। আর আসলে তো এসব বাড়ির দেশের দশের আবহাওয়ার কথা। এরা পেটের অসুখের কথা বলতে লজ্জা পায়, আমরা তো পাই নে।’

ইতিমধ্যে কফি এল। মাদাম বললেন, ‘মেয়ের নাম সারা (Sara ইংরিজিতে Sarah), ছেলেটির নাম রোমা।’ বাপ বললে, ‘আসলে রহমান।’ বুঝলুম লোকটার বুদ্ধি আছে। সারা’ নাম মুসলমান মেয়েদেরও হয়। আর রহমানের উচ্চারণ ফরাসিতে মোটামুটি রোমাই।

বেচারী মাদাম। কফির সঙ্গে দিলে দুনিয়ার যত রকমের কেক, পেসট্রি, গাতো, ব্রিয়োশ, ক্রোয়াসাঁ, বুঝলুম, পাড়ার দোকানের যাবতীয় চায়ের আনুষঙ্গিক ঝেঁটিয়ে কিনে আনিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, প্যাঁজের ফুলুরিও। মাদাম বললে, ‘ম মারি–ইল লেজ এম।’ আমার স্বামী এগুলো ভালবাসেন।

ছেলেটি চেঁচিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মামি’—আমিও মা।

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মনোকলি’–আমিও চাচা।

আমি আর সইতে পারলুম না। কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সে-সম্বন্ধে আমি সমস্তক্ষণ সচেতন ছিলুম। রোমার ভারত যাওয়ার ইচ্ছে, সারার ভারতীয় বরের কামনা এসব আমায় যথেষ্ট কাবু করে এনেছিল, কিন্তু ফ্রান্সের সেরা সেরা মিষ্টির কাছে ফুলুরির প্রশংসা—এ কোন দেশের রক্ত চেঁচিয়ে উঠে আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিলে?

আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, ‘আজ তবে আসি। বার্লিনের টিকিট আমার এখনও কাটা হয় নি। সেটা শেষ না করে মনে শাস্তি পাচ্ছিনে।’

সবাই চোঁচামেচি করতে লাগল। ছেলেটা বললে, ‘কিন্তু আপনি তো এখনও আমাদের অ্যালবাম দেখেন নি।’ বলেই কারও তোয়াক্কা না করে অ্যালবাম। এনে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে লাগল। ‘এই তো বাজান (বাবা + জান, সিলেটিতে বাজান), কী অদ্ভুত বেশে এদেশে নেমেছিলেন, এটার নাম লুঙ্গি না বাজান? কিন্তু ভারি সুন্দর, আমায় একটা দেবে, অকল-চাচা? বাবারটা আমার হয় না, (মাদাম বলেন, ‘চুপা’, ছেলেটা বললে, ‘পার্দো’ অর্থাৎ অর্থাৎ বে-আদবি মাফ কর) এটা মা, বিয়ের আগে, ক্যাল এ জনি, কী সুন্দর-’

ওঃ!

গুষ্টিসূদ্ধ আমাকে ট্রাম-টার্মিনাসে পৌঁছে দিতে এল। পৃথিবীর সর্বত্রই সর্বমহল্লা থেকে অন্তত একটা ট্রাম যায়-বিনা চেঞ্জে-স্টেশন অবধি। বিদেশীকে সেই ট্রামে বসিয়ে দিলেই হল। মাদাম কিন্তু তবু পইপই করে কন্ডাকটরকে বোঝালেন, আমাকে যেন ঠিক স্টেশনে নাবিয়ে দেওয়া হয়। মসিয়ো এ (ত্) এাত্রাজের, স্ট্রেঞ্জার, বিদেশী, (তারপর ফিশ ফিস করে)

ফরাসি বলতে পারেন না।–’

মনে মনে বড় আরাম বোধ করলুম। যাক, তবু একটি বুদ্ধিমতী পাওয়া গেল, যে আমার ফরাসি বিদ্যের চৌহদি ধরতে পেরেছে।

মাদাম, কাচ্চাব্বাচ্চারা চোঁচালে, ‘ও রভোয়ার।’ করীম মুহম্মদ বললে, ‘সেলাম সায়েব।’

আহারাদির পর হোটেলের লাউঞ্জে বসে ওপরে ঘুমুতে যাব-যাচ্ছি, যাক-যাচ্ছি করছি, এমন সময় করীম মুহম্মদ এসে উপস্থিত। পরনে লুঙ্গি কম্ফর্টার।

ইয়োরোপের কোনও হোটেলে ঢুকে আপনি যদি লাউঞ্জে জুতো খুলতে আরম্ভ করেন, তবে ম্যানেজার পুলিশ কিংবা অ্যামবুলেনস ডাকবে। ভাববে আপনি খেপে গেছেন। এতত্ত্বটি নিশ্চয়ই করীমের জানা; তাই তার সাহস দেখে অবাক মানলুম। বরঞ্চ আমিই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বারণ করলুম। কিন্তু তারপর বিপদ, সে চেয়ারে বসতে চায় না। বুঝতে পারলুম, পরিবারের বাইরে এসে সে ঢেউপাশায় ‘কেরীম্যা’ হয়ে গিয়েছে। জুতো পরবে না; চেয়ারে বসবে না, কথায় কথায় কদমবোস-পদচুম্বন-করতে চায়।

বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘এ কী আপদ!’

লজ্জা পেয়ে বললে, ‘হুজুরের বোধ হয় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সকলের সামনে আমার সঙ্গে কথা বলতে! তা হলে, দয়া করে আপনার কামরায়-’

আমি উম্মা প্রকাশ করে বললুম, ‘আদপেই না।’ এবং এ অবস্থায় শ্ৰীহট্টের প্রত্যেক সুসন্তান যা বলে থাকে, সেটাও জুড়ে দিলুম, ‘আমি কি এ ঘরে মাগনা’ বসেছি, না। এদের জমিদারির প্রজা। কিন্তু তুমি এ-রকম করছি কেন? তুমি কি আমার কেনা গোলাম নাকি? চল উপরে।’

সেখানে মেঝেতে বসে একগাল হেসে বললে, ‘কেনা গোলাম না তো কী? আমার চাচাতো ভাই আছমত ছিল আপনাদের বাসার চাকর। এখন আমি মাকে যখন টাকা পাঠাই সেটা যায় আপনার সাহেবের (পিতার) নামে। আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছি, আপনার আম্মা আমাকে চীনের বাসনে খেতে দিতেন। আমি আপনাকে চিনি হুজুর।’

আমি শুধালুম, ‘বউকে ফাঁকি দিয়ে এসেছ?’

বলল, ‘না। হুজুর। খেতে বসে রোমার মা আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললে। আপনাকে সে রাত্রে খেতে বলতে পারেনি তার জন্য দুঃখ করলে। ও সত্যি বললে যে, আপনাতে আমাতে বাড়িতে নিরিবিলি কথাবার্তা হবে না, তাই আপনাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে নি। আসবার সময় বললে, ‘উনি যা বলেন তাই হবে।’

আমি শুধালুম, ‘তবু না বললে তুমি আসতে না?’

কিছুমাত্র না ভেবে বললে, ‘নিশ্চয়ই আসতাম। তবে ওকে খামক কষ্ট দিতে চাই নে বলে না-বলে আসতুম।’ বলে। লাজুক বাচ্চাটির মত ঘাড় ফেরালে। আমার বড় ভাল লাগল।

আমি শুধালুম, ‘আমি তোমাদের বাড়িতে বলতে গিয়েছিলুম তোমরা জানলে কী করে? আমি শুনেছি, তোমার বউ দেশের লোককে তাড়া লাগায়। আমাকে লাগাল না। কেন?’

যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তা একটু-আধটু লাগায় বটে, হুজুর, ওরা যে বলে বেড়ায় আমাকে রোমার মা ভ্যাড়া বানিয়ে রেখেছে সে-খবরটা ওর কানে পৌঁছেছে। তাই গেছে সে ভীষণ চটে। আসলে ও বড় শাস্তপ্রকৃতির মেয়ে, ঝগড়া-কাজিয়া করে কয় আদপেই জানে না।’

আর মানুষকে কি কখনও ভ্যাড়া বানানো যায়? কামরূপে না, কোনখানেই না।’

‘আপনি তা হলে সব কিছু শুনে বিবেচনা করুন, হুজুর।

‘সতেরো বছর বয়সে আমি আর-পাঁচজন খালাসীর সঙ্গে নামি এই বন্দরে। কেন জানি নে, হুজুর, হঠাৎ পুলিশ লাগালে তাড়া। যে যার জান নিয়ে যেদিকে পারে দিলে ছুটি। আমি ছিটকে পড়লাম শহরের এক অজানা কোণে। জাহাজ আর খুঁজে পাই নে। শীতের রাতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় এক পোলের নীচে শুয়ে পড়লাম জিরাব বলে। যখন ইশ হল তখন দেখি, আমি এক হাসপাতালে শুয়ে। জুরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে-দেশে আমার ম্যালেরিয়া হত। তারপর ক-দিন কাটল হাঁশে আর বেষ্ট্ৰশে তার হিসেব আমি রাখতে পারি। নি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা দেখতে পেতাম ডাক্তাররা কী সব বলাবলি করছে। সেরে উঠে পরে শুনতে পাই ওদের কেউ কখনও ম্যালেরিয়ায় রোগীর কড়া জ্বর দেখে নি বলে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। আর জুরের ঘোরে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। একটি নাসকে। সে আমায় জল খাইয়ে রুমাল দিয়ে ঠোঁটের দু-দিক মুছে দিত। একদিন শেষরাতে কম্প দিয়ে এল আমার ভীষণ জুর। নার্স সব কখানা কম্বল চাপা দিয়ে যখন কম্প থামাতে পারল না। তখন নিজে আমাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইল। দেশে মা যেরকম জড়িয়ে ধরত ঠিক সেই রকম। তারপর আমি ফের বেহুঁশি।

কিন্তু এর পর যখন জুর ছাড়ল তখন আমি ভাল হতে লাগলাম। শুয়ে শুয়ে দেশের কথা, মায়ের কথা ভাবি আর ওই নার্সটিকে দেখলেই আমার জানটা খুশিতে ভরে উঠত। সে মাঝে মাঝে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিত। আর ওদের ভাষায় প্রতিবারে একই কথা বলত। আমি না বুঝেও বুঝতাম, বলছে, ভয় নেই, সেরে উঠবে।

‘তারপর একদিন ছাড়া পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম বন্দরের দিকে। সেখানে জাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা। অন্য এক জাহাজের—আমাদের জাহাজ তো কবে ছেড়ে দিয়েছে। সে সব কথা শুনে বললে-’ভাগো ভাগো, এখুনি ভাগো। তোমার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে, তুমি জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছ। ধরতে পারলেই তোমাকে পুলিশ জেলে দেবে।’

‘ক বছর? কে জানে? এক হতে পারে, চোদ্দও হতে পারে। আইন-কানুন হুজুর আমি তো কিছুই জানিনে।

‘কিন্তু যাই ই বা কোথায়? যে দিকে তাকাই সে-দিকেই দেখি পুলিশ। খানা-পিনার কথা তুলব না হুজুর, সে তখন মাথায় উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাতটা কাঁটাই কোথায়?

‘শেষটায় শেষ অগতির গতির কথা মনে পড়ল। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সেই নার্সটি আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে দিয়েছিল একখানা চিরকুট। তখনও জানতাম না, তাতে কী লেখা। যাকে দেখাই সে-ই হাত দিয়ে বোঝায়-আরও উত্তর দিকে যাও। শেষটায় একজন লোক আমাকে একটা বড় বাড়ির দেউড়ি দেখিয়ে চলে গেল।

সেখানে ঘণ্টাতিনেক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোঁদের পুলিশ আমাকে সওয়াল করতে লাগল। হাসপাতালে দু’মাস ওদের বুলি শুনে শুনে যেটুকু শিখেছিলাম তার থেকে আমেজ করতে পারলাম, ওর মনে সন্দ হয়েছে, আমি কী মতলবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছি—আর হবেই না কেন? বুঝলাম রাশিয়তে জেল আছেই। মনে মনে বললাম, কী আর করি, একটা আশ্রয় তো চাই। জেলই কবুল। চাচা মামু অনেকেই তো লাঠালাঠি করে গেছেন, আমি না হয় না করেই গেলাম।

‘এমন সময় সেই নার্সটি এসে হাজির। পুলিশকে কী একটা সামান্য কথা বলে আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেল তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে-পুলিশ যেভাবে তাকে সেলাম করে রাটি না কেড়ে চলে গেল তার থেকে আন্দেশ করলাম, পাড়ার লোক ওকে মানে।

‘আমাকে খেতে দিল গরম দুধের সঙ্গে। কাঁচা আণ্ডা ফেটে নিয়ে। বেহুঁশির ওত্তেজ্ঞ কী খেয়েছি জানি নে, হুজুর, কিন্তু হাঁশের পর দাওয়াই হিসেবেও আমি শরাব খাই নি। তাই ‘বরান্দি’টা বাদ দিল।

রাতে খেতে দিল রুটি আর মাংসের হালকা ঝোল। চারটি ভাতের জন্য আমার জন্য তখন কী আকুলি-বিকুলি করেছিল। আপনাকে কখনও সমঝাতে পারব না, হুজুর।’

জাহাজের খালাসীদের স্মরণে আমি মনে মনে বললুম, সমঝাতে হবে না।’ বাইরে বললুম, ‘তারপর?’

একটুখানি ভেবে নিয়ে বললে, ‘সব কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে সায়েব। আর কী-ই বা হবে বলে? ও আমাকে খাওয়ালে পর্যালে, আশ্রয় দিলে-বিদেশেবিভুইয়ে সেখানে আমার জেলে গিয়ে পাথর ভাঙার কথা-এ সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না বললে কি তার দাম কমে যাবে!

‘দাম কমবে না বলেই বলছি হুজুর, সুজন নার্সের কাম করে-’

আমি শুধালুম, কী নাম বললে?’

একটু লজ্জা পেয়ে বললে, ‘আমি ওকে সুজন বলে ডাকি-ওদের ভাষায় সুজান।’

বুঝলুম ওটা ফরাসি Suzzanne, এবং আরও বুঝলুম, যো-জাতের লোক আমাদের দেশে মরমিয়া ভাটিয়ালি রচেছে তাদেরই একজনের পক্ষে নামের এটুকু পরিবর্তন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কিছু কঠিন কর্ম নয়। অতখানি স্পর্শকাতরতা এবং কল্পনাশক্তি ওদের আছে।

আমি শুধালুম, ‘তার পর কী বলছিলে?’

বললে, ‘সুজন নার্সের কাম করে আমাকে যে এক বছর পুষেছিল তখন আমি তার বাড়ির কাজ করেছি। বেচারীকে নিজের রান্না নিজেই করতে হত—হাসপাতাল থেকে গতর খাটিয়ে ফিরে আসার পর। আমি পাক-রসুই করে রাখতাম। শেষ দিন পর্যন্ত সে আপত্তি করেছে, কিন্তু আমি কান দিইনি।’

আমি শুধালুম, কিন্তু তোমার পাড়ার পুলিশ কিছু গোলমাল করলে না?’

একটুখানি মাথা নিচু করে বললে, ‘অন্য দেশের কথা জানি না হুজুর, কিন্তু এখানে মহব্বতের ব্যাপারে। এরা কোন রকম বাগড়া দিতে চায় না। আর এরা জানত যে ওর বাড়িতে ওঠার এক মাস পরে ওকে আমি বিয়ে করি।

‘কিন্তু হুজুর, আমার বড় শরাম বোধ হত; এ যে ঘর-জামাই হয়ে থাকার চেয়েও খারাপ। কিন্তু করিই বা কী?

‘আল্লাই পথ দেখিয়ে দিলেন।

‘সুজন আমাকে ছুটি-ছাঁটার দিনে সিনেমায়-টিনেমায় নিয়ে যেত। একদিন নিয়ে গেল এক মস্ত বড় মেলাতে। সেখানে একটা ঘরে দেখি নানা দেশের নানা রকম তাত জড় করে লোকজনকে দেখানো হচ্ছে তাতগুলো কী করে চালানো হয়, সেগুলো থেকে কী কী নকশার কাপড় বেরয়। তারই ভিতর একটা দেখতে গেলাম, অনেকটা আমাদের দেশেরই তাঁতের মত।

‘আমার বাপ-ঠাকুরদা জেলার কাজ করেছে, ফসল ফলিয়েছে, দরকার হলে লাঠিও চালিয়েছে।

অনেক ইতি উতি কিন্তু-কিন্তু করে সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাঁতের দাম কত?” বুঝতে পারল, ওতে আমার শখ হয়েছে। ভারি খুশি হল, কারণ আমি কখনও কোন জিনিস তার কাছ থেকে চাইনি। বললে, ‘ওটা বিক্রির নয়, কিন্তু মিস্ত্রী দিয়ে আমাকে একটা গড়িয়ে দেবে।

‘ও দেশে ধূতি, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনবে কে? আমি বানালাম স্কার্য, কৰ্ম্মফর্টার। দিশী নকশায়। প্রথম নকশায় আধখানা ফুটতে না ফুটতেই সুজনের কী আনন্দ! স্কার্ফ র্তত থেকে নামাবার পূর্বেই সে পাড়ার লোক জড় করে বসেছে, আজগুবী এক নূতন জিনিস দেখাবে বলে। সবাই পাই-পই করে দেখলে, অনেক তারিফ করলে। সুজনের ডবল আনন্দ, তার স্বামী নিষ্কৰ্মা ভবঘুরে নয়। একটা হুনুরী, গুণী লোক।

‘গোড়ার দিকে পাড়াতে, পরে এখানে—সেখানে বিস্তর স্কার্ফ বিক্রি হল। বেশ দু পয়সা আসতে লাগল। তারপর এখানকার এক তাঁতীর কাছে দেখে এলাম কী করে রেশমের আর পশমের কাজ করতে হয়। শেষটায় সুজন নিয়ে এল আমার জন্য বহুত কেতাব, সেগুলাতে শুধু কাশ্মীরী নকশায় নয়, আরও বহুত দেশের বহুত রকম-বেরকমের নকশাও আছে। তখন যা পয়সা আসতে লাগল তারপর আর সুজনের চাকরি না করলেও চলে। সেই কথা বলতে সে খুশির সঙ্গে রাজী হল। শুধু বলল, যদি কখনও দরকার হয় তবে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে পারবে। রোমা তখন পেটে। সুজন সংসার সাজাবার জন্য তৈরি।

‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি কেন বুড়ির কথা পাড়ছি নে। বলছি, হুজুর, রাতও অনেক ঘনিয়ে এসেছে, আপনি আরাম করবেন।

‘আপনি বিশ্বাস করবেন না, দু পয়সা হতে সুজন বললে, ‘তোমার মাকে কিছু পাঠাবে না?’ আমি আগের থেকেই বন্দরের ইমানদার লোক খুঁজছিলাম। রোমার মাই বললে, ব্যাঙ্ক দিয়েও নাকি দেশে টাকা পাঠানো যায়।

‘মাসে মাসে বুড়িকে টাকা পাঠাই। কখনও পঞ্চাশ কখনও একশো। ঢেউপাশাতে পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা। শুনি বুড়ি টাকা দিয়ে গায়ের জন্য জুম্মা-ঘর বানিয়ে দিয়েছে। খেতে-পরতে তো পারছেই।

টাকা দিয়ে অনেক কিছুই হয়, দেশে বলে, টাকার নাম জয়রাম, টাকা হইলে সকল কাম—কিন্তু হুজুর, টাকা দিয়ে চোখের পানি বন্ধ করা যায় না। একথা আমি খুব ভাল করেই জানি। বুড়িও বলে পাঠিয়েছে, টাকার তার দরকার নেই, আমি যেন দেশে ফিরে যাই।

‘আমার মাথায় বাজ পড়ল, সায়েব; যেদিন খবর নিয়ে শুনলাম, দেশে ফিরে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়, কিন্তু ফিরে আসা অসম্ভব। আমি এখন আমার মহল্লার মুরুর্কীদের একজন। থানার পুলিশের সঙ্গেও আমার বহুত ভাব-সাব হয়েছে। আমার বাড়িতে প্রায়ই তারা দাওয়াত-ফাওয়াত খায়। তারা প্যারিস থেকে পাকা খবর আনিয়েছে, ফিরে আসা অসম্ভব। মুসাফির হয়ে কিংবা খালাসী সেজে পালিয়ে এলেও প্যারিসের পুলিশ এসে ধরে নিয়ে দেশে চালান দেবে। এমন কি তারা আমাকে বারণ করেছে। আমি যেন ওই নিয়ে বেশি। নাড়াচাড়া না করি। প্যারিসের পুলিশ যদি জেনে যায় আমি বিনা পাসপোর্টে এ দেশে আছি তা হলে তারা আমাকে মহল্লার পুলিশের কদর দেখাবে না। এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আপনি কী বলেন, হুজুর?’

ডাহা মিথ্যে বলি কী প্রকারে? আমার বিলক্ষণ জানা ছিল, ফ্রান্স চায় টুরিসটুি সে দেশে এসে আপন গাঁটের পয়সা খরচ করুক, কিন্তু তার বেকারীর বাজারে কেউ এসে পয়সা কামাক এ-অবস্থাটা সে যে করেই হোক রুখবে।

আমি চুপ করে রইলুম দেখে করীম মুহম্মদ মাথা নীচু করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বললে, ‘রোমার মা আমার মনের সব কথা জানে। দেশের লোক ভাঙচি দেয়, আমি ভেড়া বনে গিয়েছি। এ-কথা বলে-এ-সব শুনে সে তাদের পছন্দ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভোরের ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেও জেগে আছে। তখন আমার কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘তোমার দেশে যদি যেতে ইচ্ছে করে, তবে যাও। আমি একই বাচ্চা দুটোকে সামলাতে পারব।’ এ-সব আরম্ভ হল, নিজে মা হওয়ার পরের থেকে।

‘আজ আপনার কথা তুলে বললে, ‘এ ভদ্রলোকের শরীরে দয়ামায়া আছে। আমার ছেলেমেয়েকে কত আদর করলেন। আমি বললাম, ‘সুজন, তুই জানিস নে, আমাদের দেশের ভদ্রলোক আমাদের কত আপনজন। এই যে ভদ্রলোক এলেন, এর সায়েব (পিতা) আমার বাবাকে ‘পাতী।’ (ছেলে) বলে ডাকতেন। এ দেশের ভদ্রলোক তো গরিবের সঙ্গে কথা কয় না।’ আপনি-ই বলুন, হুজুর’

তার ‘আপনজন’। ওইটুকুই বাকী ছিল।

সুজনই আজ বললে, ‘ওঁর কাছে গিয়ে তুমি হুকুম নাও। উনি যা বলেন তাই হবে।’ এইবার আপনি হুকুম দিন, হুজুর’

আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’

সে আমার পায়ে ধরে বললে, ‘আপনার বাপ-দাদা আমার বাপ-দাদাকে বিপদেআপদে সলা দিয়ে হুকুম করে বাঁচিয়েছেন, আজ আপনি আমায় হুকুম দিন।’

আমি নির্লজের মত পূৰ্ব ঐতিহ্য অস্বীকার করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’

অনেক কান্নাকাটি করল। আমি নীরব।

শেষ রাত্রে আমার পায়ে চুমো খেল, আমি বাধা দিলুম না। বিদায় নিয়ে বেরবার সময় দোরের গোড়ায় তার বুক থেকে বেরল, ইয়া আল্লা!’

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments