Wednesday, August 27, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পনীল আতঙ্ক - সত্যজিৎ রায়

নীল আতঙ্ক – সত্যজিৎ রায়

আমার নাম অনিরুদ্ধ বোস। আমার বয়স উনত্রিশ। এখনও বিয়ে করিনি। আজ আট বছর হল আমি কলকাতার একটা সদাগরি আপিসে চাকরি করছি। মাইনে যা পাই তাতে একা মানুষের দিব্যি চলে যায়। সর্দার শঙ্কর রোডে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছি, দোতলায় দুখানা ঘর, দক্ষিণ খোলা। দুবছরই হল একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি কিনেছি–সেটা আমি নিজেই চালাই। আপিসের কাজের বাইরে একটু-আধটু সাহিত্য করার শখ আছে। আমার তিনখানা গল্প বাংলা মাসিক পত্রিকায় বেরিয়েছে, চেনা মহলে প্রশংসাও পেয়েছে। তবে এটা আমি জানি যে, কেবলমাত্র লিখে রোজগার করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। গত কয়েক মাসে লেখা একদম হয়নি, তবে বই পড়েছি অনেক। আর তার সবই বাংলাদেশে নীলের চাষ সম্পর্কে। এ বিষয়ে এখন আমাকে একজন অথরিটি বলা চলে। কবে সাহেবরা এসে আমাদের দেশে প্রথম নীলের চাষ শুরু করল, আমাদের গ্রামের লোকদের উপর তারা কীরকম অত্যাচার করত, কীভাবে নীল বিদ্রোহ হল, আর সব শেষে কীভাবে জার্মানি কৃত্রিম উপায়ে নীল তৈরি করার ফলে এদেশ থেকে নীলের পাট উঠে গেল–এ সবই এখন আমার নখদর্পণে। যে সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার ফলে আমার মনে নীল সম্পর্কে এই কৌতূহল জাগল, সেটা বলার জন্যই আজ লিখতে বসেছি।

এখানে আগে আমার ছেলেবেলার কথা একটু বলা দরকার।

আমার বাবা মুঙ্গেরে নামকরা ডাক্তার ছিলেন। ওখানেই আমার জন্ম আর ওখানের এক মিশনারি স্কুলে আমার ছেলেবেলার পড়াশুনা। আমার এক দাদা আছেন, আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। তিনি বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পাশ করে লন্ডনের কাছেই গোল্ডার্স গ্রিন বলে একটা জায়গায় হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন; দেশে ফেরার বিশেষ ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। আমার যখন ষোলো বছর বয়স তখন বাবা মারা যান। তার কয়েকমাস পরেই আমি মা-কে নিয়ে কলকাতায় এসে আমার বড়মামার বাড়িতে উঠি। মামাবাড়িতে থেকেই আমি সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বি. এ. পাশ করি। তারপর একটা সাময়িক ইচ্ছে হয়েছিল সাহিত্যিক হবার, কিন্তু মার ধমকানিতে চাকরির চেষ্টা দেখতে হল। বড়মামার সুপারিশেই চাকরিটা হল, তবে আমারও যে কিছুটা কৃতিত্ব ছিল না তা নয়। ছাত্র হিসেবে আমার রেকর্ডটা ভালই, ইংরিজিটাও বেশ গড়গড় করে বলতে পারি, আর তা ছাড়া আমার মধ্যে একটা আত্মনির্ভরতা ও স্মার্টনেস আছে যেটা ইন্টারভিউ-এর সময় আমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিল।

মুঙ্গেরে ছেলেবেলার কথাটা বললে হয়তো আমার চরিত্রের একটা দিক বুঝতে সাহায্য করবে। কলকাতায় একনাগাড়ে বেশিদিন থাকতে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এত লোকের ভিড়, ট্রামবাসের ঘরঘরানি, এত হইহল্লা, জীবনধারণের এত সমস্যা মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এইসবের থেকে ছুটে বেরিয়ে চলে যাই। আমার গাড়িটা কেনার পর কয়েকবার এটা করেওছি। ছুটির দিনে একবার ডায়মন্ড হারবারে, একবার পোর্টক্যানিং, আর একবার দমদমের রাস্তা দিয়ে সেই একেবারে হাসনাবাদ পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। একাই গিয়েছি প্রতিবার, কারণ এ ধরনের আউটিং-এ উৎসাহ প্রকাশ করার মতো কাউকে খুঁজে পাইনি।

এ থেকে বোঝাই যাবে যে, কলকাতা শহরে সত্যি করে বন্ধু বলতে আমার তেমন কেউ নেই। তাই প্রমোদের চিঠিটা পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। প্রমোদ ছিল আমার মুঙ্গেরের সহপাঠী। আমি কলকাতায় চলে আসার পর বছর চারেক আমাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখি চলেছিল, তারপর বোধহয় আমার দিক থেকেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন আপিস থেকে ফিরতেই চাকর গুরুদাস বলল মামাবাড়ি থেকে লোক এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। খামের উপর লেখা দেখেই বুঝলাম প্রমোদ। দুমকা থেকে লিখছে–জংলি আপিসে চাকরি করছি…কোয়ার্টার্স আছে…দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে চলে আয়…।

ছুটি পাওনা ছিল বেশ কিছুদিনের, তাই যত শীঘ্র সম্ভব আপিসের কাজ গুছিয়ে নিয়ে, গত ২৭শে এপ্রিল–তারিখটা আজীবন মনে থাকবে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, কলকাতার জঞ্জাল ও ঝাট পিছনে ফেলে রওনা দিলাম দুমকার উদ্দেশে।

প্রমোদ অবিশ্যি মোটরযোগে দুমকা যাবার কথা একবারও বলেনি। ওটা আমারই আইডিয়া। দুশো মাইল রাস্তা, বড়জোর পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ধাক্কা। দশটার মধ্যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ব, দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছে যাব, এই ছিল মতলব।

কাজের বেলা গোড়াতেই একটা হোঁচট খেতে হল। রান্ন তৈরি ছিল ঠিক সময়, কিন্তু ভাত খেয়ে সবে মুখে পানটা পুরেছি, এমন সময় বাবার পুরনো বন্ধু মোহিতকাকা এসে হাজির। একে ভারভার্তিক লোক, তার উপর প্রায় দশ বছর পরে দেখা; মুখ ফুটে কিছুতেই বলতে পারলাম না আমার তাড়া আছে। ভদ্রলোককে চা খাওয়াতে হল, তারপর ঝাড়া একঘণ্টা ধরে তাঁর সুখদুঃখের কাহিনী শুনতে হল।

মোহিতকাকাকে বিদায় দিয়ে গাড়িতে মাল তুলে যখন নিজে উঠতে যাচ্ছি, তখন দেখি আমার একতলার ভাড়াটে ভোলাবাবু তাঁর চার বছরের ছেলে পিন্টুর হাত ধরে কোত্থেকে যেন বাড়ি ফিরছেন। আমায় দেখে বললেন, একা একা কোথায় পাড়ি দিচ্ছেন?

আমার উত্তর শুনে ভদ্রলোক একটু উদ্বিগ্নভাবেই বললেন, এতটা পথ মোটরে একা যাবেন? অন্তত এই ট্রিপটার জন্য একটা ড্রাইভার-ট্রাইভারের বন্দোবস্ত করলে হত না?

আমি বললাম, চালক হিসেবে আমি খুব হুঁশিয়ার, আর আমার যত্নের ফলে গাড়িটাও প্রায় নতুনই রয়েছে, তাই ভাবনার কিছু নেই। ভদ্রলোক বেস্ট অফ লাক বলে ছেলের হাত ধরে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লেন।

গাড়িতে স্টার্ট দেবার আগে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি–পৌনে এগারোটা।

হাওড়া দিয়ে না গিয়ে বালি ব্রিজের রাস্তা নেওয়া সত্ত্বেও, চন্দননগর পৌঁছতেই লাগল দেড় ঘণ্টা। এই তিরিশটা মাইল পেরোতে এত ঝক্কি, রাস্তা এত বাজে ও আরোমান্টিক যে, মোটরযাত্রার প্রায় ষোলো আনা উৎসাহ উবে যায়। কিন্তু তার ঠিক পরেই শহর পিছনে ফেলে গাড়ি যখন ছোটে মাঠের মধ্যে দিয়ে, তখন সেটা কাজ করে একেবারে ম্যাজিকের মতো। মন তখন বলে–এর জন্যই তো আসা! কোথায় ছিল অ্যাদ্দিন এই চিমনির ধোঁয়া বর্জিত মসৃণ আকাশ, এই মাটির গন্ধ মেশানো মনমাতানো বিশুদ্ধ মেঠো বাতাস?

দেড়টা নাগাদ যখন বর্ধমানের কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখন পেটে একটা খিদের ভাব অনুভব করলাম। সঙ্গে কমলালেবু আছে, ফ্লাস্কে গরম চা আছে, কিন্তু মন চাইছে অন্য কিছু। রাস্তার পাশেই স্টেশন; গাড়ি থামিয়ে রেস্টোর্যান্টে গিয়ে দুটো টোস্ট, একটা অমলেট ও এক পেয়ালা কফি খেয়ে আবার রওনা দিলাম। পথ বাকি এখনও একশো তিরিশ মাইল।

বর্ধমান থেকে পঁচিশ মাইল গিয়ে পানাগড় পড়ে। সেখান থেকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে ইলামবাজারের রাস্তা নিতে হবে। ইলামবাজার থেকে সিউড়ি হয়ে ম্যাসানজোর পেরিয়ে দুমকা।

পানাগড়ের মিলিটারি ক্যাম্পগুলো সবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এমন সময় আমার গাড়ির পিছনের দিক থেকে একটা বেলুন ফাটার মতো শব্দ হল, আর সেইসঙ্গে গাড়িটা একপাশে একটু কেদরে গেল। কারণ অবিশ্যি সহজেই বোধগম্য।

গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম শহর এখনও কয়েক মাইল দূরে। কাছাকাছির মধ্যে মেরামতির দোকানের আশাটা মন থেকে মুছে ফেলতে হল। সঙ্গে যে স্টেপনি ছিল না তা নয়, আর জ্যাক দিয়ে গাড়ি তুলে ফাটা টায়ার খুলে ফেলে তার জায়গায় নতুন টায়ার পরানো আমার অসাধ্য কিছু নয়। তবু, এক্ষেত্রে পরিশ্রম এড়ানোর ইচ্ছেটা অস্বাভাবিক নয়। আর গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়িতে টায়ার পরাব–পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে অন্য কত গাড়ি বেরিয়ে যাবে, আর আমার শোচনীয় হাস্যকর অবস্থাটা তারা দেখে ফেলবে–এটা ভাবতে মোটেই ভাল লাগছিল না। কিন্তু কী আর করা? দশ মিনিট এদিক ওদিক চেয়ে ঘোরাফেরা করে গঙ্গা বলে কাজে লেগে পড়লাম।

নতুন টায়ার লাগিয়ে ফাটা টায়ার ক্যারিয়ারে ভরে ডালা বন্ধ করে যখন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, তখন শার্টটা ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ঘড়িতে দেখি আড়াইটা বেজে গেছে। আবহাওয়াতে একটা গুমোট ভাব। ঘণ্টাখানেক আগেও সুন্দর হাওয়া বইছিল; গাড়ি থেকে দেখছিলাম বাঁশঝাড়ের মাথাগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। এখন চারিদিক থমথমে। গাড়িতে ওঠার সময় পশ্চিমের আকাশে নীচের দিকে দূরের গাছপালার মাথায় একটা কালচে নীলের আভাস লক্ষ করলাম। মেঘ। ঝড়ের মেঘ কি? কালবৈশাখী? ভেবে লাভ নেই। স্পিডোমিটারের কাঁটা আরও চড়াতে হবে। ফ্লাস্কটা খুলে খানিকটা গরম চা মুখে ঢেলে আবার রওনা দিলাম।

.

ইলামবাজার পেরোতে না পেরোতেই ঝড়টা এসে পড়ল। ঘরে বসে যে জিনিস চিরকাল সানন্দে উপভোগ করেছি যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছি, গান করেছি–সেই জিনিসই খোলা মাঠের মধ্যে পিচের রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে যে কী বিভীষিকার সৃষ্টি করতে পারে তা কল্পনা করতে পারি না। ওটাকে প্রকৃতির একটা শয়তানি বলে মনে হয়। অসহায় মানুষকে এক নির্মম রসিকতায় নাজেহাল করার ভাব নিয়ে যেন এই বাজের খেলা। এদিকে ওদিকে আচমকা বৈদ্যুতিক শরনিক্ষেপ, আর পরমুহূর্তেই কর্ণপটাহ বিদীর্ণ করা দামামা গর্জন–গুড় গুড় গুড় গুড় কড়কড় কড়াৎ! এক এক সময় মনে হচ্ছে যে, আমার এই নিরীহ অ্যাম্বাসাড়ার গাড়িকেই তাগ করে বিদ্যুত্বণ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, এবং আরেকটু মনোযোগ দিয়ে কাজটা করলেই লক্ষ্যভেদ হয়ে যাবে।

এই দুর্যোগের মধ্যেই কোনওমতে যখন সিউড়ি ছাড়িয়ে ম্যাসানজোরের পথে পড়েছি, তখন হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল যেটাকে কোনওমতেই বজ্রপাত বলে ভুল করা চলে না। বুঝলাম আমার গাড়ির আরেকটি টায়ার কাজে ইস্তফা দিলেন।

হাল ছেড়ে দিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। গত বিশ মাইল স্পিডোমিটারের কাঁটাকে পনেরো থেকে পঁচিশের মধ্যে রাখতে হয়েছে। না হলে এতক্ষণ ম্যাসানজোর ছাড়িয়ে যাবার কথা। কোথায় এসে পৌঁছলাম? সামনের দিকে চেয়ে কিছু বোঝার উপায় নেই। কাঁচের উপর জলপ্রপাত। ওয়াইপারটা সপাৎ সপাৎ শব্দ করে চলেছে, কিন্তু সেটাকে কাজ না বলে খেলা বলাই ভাল। নিয়মমতো এপ্রিল মাসে এখনও সুর্যের আলো থাকার কথা, কিন্তু ভাব দেখে মনে হয় রাত হল বলে!

আমার ডানপাশের দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরের দিকে চাইলাম। যা দেখলাম তাতে মনে হল কাছাকাছির মধ্যে ঘন বসতি না থাকলেও, দু-একটা পাকাবাড়ি যেন গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে যে একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখব তার উপায় নেই। তবে সেটা না দেখেও যে জিনিসটা বলা যায় সেটা হল এই যে, মাইলখানেকের মধ্যে বাজার বা দোকান বলে কোনও পদার্থ নেই।

আর আমার সঙ্গে বাড়তি টায়ারও আর নেই।

মিনিট পনেরো গাড়িতে বসে থাকার পর একটা প্রশ্ন মনে জাগল; এতখানি সময়ের মধ্যে একটি গাড়ি বা একটি মানুষও আমার গাড়ির পাশ দিয়ে গেল না। তবে কি ভুল পথে এসে পড়েছি? সঙ্গে রোড ম্যাপ আছে। সিউড়ি পর্যন্ত ঠিকই এসেছি জানি, কিন্তু তারপরে যদি কোনও ভুল রাস্তায় মোড় ঘুরে থাকি? এই চোখধাঁধানো বৃষ্টিতে সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু যদি ভুল হয়ে থাকে–এটা তো আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল নয় যে, দিশেহারা হয়ে পড়তে হবে! যেখানেই এসে থাকি না কেন, এটা বীরভূমেরই মধ্যে, শান্তিনিকেতন থেকে মাইল পঞ্চাশের বেশি দূর নয়, বৃষ্টি থামলেই সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে, এমনকী হয়তো মাইলখানেকের মধ্যে একটা গাড়ি মেরামতের দোকানও পেয়ে যাব।

পকেট থেকে উইল্স-এর প্যাকেট আর দেশলাই বার করে একটা সিগারেট ধরালাম। ভোলাবাবুর কথা মনে পড়ল। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ভুক্তভোগীনইলে এমন খাঁটি উপদেশ দেন কী করে? ভবিষ্যতে—

প্যাঁ—ক্‌ প্যাঁ—ক্‌ প্যাঁ—ক্‌!

একটা তন্দ্রার ভাব এসে গিয়েছিল, হর্নের শব্দে সজাগ হয়ে উঠে বসলাম। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। তবে অন্ধকারে গাঢ়তর।

প্যাঁ—ক্‌ প্যাঁ—ক্‌ প্যাঁ—ক্‌!

পিছন ফিরে দেখি একটা লরি এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ন দিচ্ছে কেন? আমি কি রাস্তার পুরোটা দখল করে আছি নাকি?

দরজা খুলে নেমে দেখি লরির দোষ নেই। টায়ার ফাটার সময় গাড়িটা খানিকটা ঘুরে গিয়ে রাস্তার পুরোটা না হলেও প্রায় আধখানা আটকে রেখেছেলরি যাবার জায়গা নেই।

গাড়ি সাইড কিজিয়ে–সাইড কিজিয়ে।

আমার অসহায় ভাব দেখেই বোধ হয় পাঞ্জাবি ড্রাইভারটি নেমে এলেন।

কেয়া হুয়া? পাংচার?

আমি ফরাসি কায়দায় কাঁধ দুটোকে একটু উঁচিয়ে আমার শোচনীয় অবস্থা বুঝিয়ে দিলাম। বললাম, আপনি যদি একটু হাত লাগান তা হলে এটাকে একপাশে সরিয়ে আপনার যাবার জায়গা করে দিতে পারি।

এবার লরি থেকে পাঁইজির সহকারী নেমে এলেন। তিনজনে ঠেলে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে একপাশে করে দিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, এটা দুমকার রাস্তা নয়। আমি ভুল পথে এসে গেছি, তবে সেটা মাইল তিনেকের বেশি নয়। কাছাকাছির মধ্যে সারানোর কোনও দোকান নেই।

লরি চলে গেল। তার ঘরঘর শব্দ মিলিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশাল নৈঃশব্দ্যের সৃষ্টি হল, আর আমি বুঝলাম যে, আমি অকূল পাথারে পড়েছি।

আজ রাত্রের মধ্যে দুমকা পৌঁছনোর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, এবং রাতটা কীভাবে কাটবে তার কোনও ইঙ্গিত নেই।

আশেপাশের ডোবা থেকে ব্যাঙের কোরাস আরম্ভ হয়েছে। বৃষ্টিটা কমের দিকে। অন্য সময় হলে মাটির সোঁদা গন্ধে মনটা মেতে উঠত, কিন্তু এ অবস্থায় নয়!

আবার গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু তাতেই বা কী লাভ? হাত পা ছড়িয়ে আরাম করার পক্ষে অ্যাম্বাসাডার গাড়ির মতো অনুপযুক্ত আর কিছু আছে কি? বোধ হয়, না।

আরেকটা সিগারেট ধরাতে যাব, এমন সময় হঠাৎ পাশের জানলা দিয়ে একটা ক্ষীণ আলো এসে স্টিয়ারিং হুইলটার উপর পড়ল। আবার দরজা খুলে গলা বাড়িয়ে দেখি গাছের ফাঁক দিয়ে একটা আলোর চতুষ্কোণ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় জানলা। ধোঁয়ার কারণ আগুন, কেরোসিনের আলোর কারণ মানুষ। কাছাকাছি বাড়ি আছে, এবং তাতে মানুষ আছে।

টর্চটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আলোর দূরত্ব বেশি নয়। আমার উচিত এগিয়ে গিয়ে অনুসন্ধান করা। একটা রাস্তাও রয়েছে, অপরিসর পথ, সেটা বোধহয় আলোরই দিক থেকে, আমি যে রাস্তায় আছি সেটায় এসে পড়েছে। পথের দুপাশে গাছপালার বন, তলার দিকে আগাছার জঙ্গল।

কুছ পরোয়া নেহি। গাড়ির দরজা লক করে রওনা দিলাম।

যতদূর সম্ভব খানাখন্দ বাঁচিয়ে জলকাদার মধ্যে দিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে খানিকদূর হেঁটে একটা তেঁতুলগাছ পেরোতেই বাড়িটা চোখে পড়ল। বাড়ি বলা ভুল হবে–একখানা কি দেড়খানা ইটের ঘরের উপর একটা টিনের চালা। ফাঁক করা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর একটা জ্বালানো লণ্ঠন, একটা ধোঁয়াটে ভাব, আর একটা খাটিয়ার কোণ লক্ষ করলাম।

কোই যায়?

একটা মাঝবয়সি বেঁটে গোঁফওয়ালা লোক বেরিয়ে এসে আমার টর্চের আলোর দিকে ভুরু কুঁচকে চাইল। আমি আলোটা নামিয়ে নিলাম।

কাঁহাসে আয়া বাবু?

আমার দুর্ঘটনার কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করে বললাম, এখানে কাছাকাছির মধ্যে রাত কাটানোর কোনও বন্দোবস্ত হতে পারে? যা পয়সা লাগে আমি দেব।

ডাকবাংলামে?

ডাকবাংলো? সে আবার কোথায়?

প্রশ্নটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বোকামোটা বুঝতে পারলাম। এতক্ষণ কেবল লণ্ঠন আর টর্চের আলোর দিকে দৃষ্টি থাকার ফলে আশেপাশে কী আছে দেখিইনি। এবার টর্চটাকে ঘুরিয়ে আমার বাঁ দিকে ফেলতেই একটা বেশ বড় একতলা পুরনো বাড়ি চোখে পড়ল। সেটা দেখিয়ে বললাম, এটাই ডাকবাংলো?

হাঁ বাবু। লেকিন বিস্তারা উস্তারা কুছ নেহি হ্যায়, খানা ভি নেহি মিলেগা।

বিছানা আমার সঙ্গে আছে। খাট হবে তো?

খাটিয়া হোগা।

আর তোমার ঘরে তো উনুন ধরিয়েছ দেখছি। তুমি নিজে খাবে নিশ্চয়ই।

লোকটা হেসে ফেলল। তার হাতের সেঁকা মোটা রুটি, আর তার বউয়ের রান্না উরুৎ কা ডাল কি আমার চলবে? বললাম, খুব চলবে। সবরকম রুটিই আমার চলে, আর উরুৎ কা ডাল তো আমার অতি প্রিয় খাদ্য।

এককালে কী ছিল জানি না, এখন নামেই ডাকবাংলো। তবে পুরনো সাহেবি আমলের বাড়ি, তাই ঘরের সাইজ বড় আর সিলিংটা পেল্লায় উঁচু। আসবাব বলতে একটি পুরনো নেয়ারের খাট, একপাশে একটা টেবিল, আর তার সামনে হাতল ভাঙা একটা চেয়ার।

চৌকিদার আমার জন্য একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে এনে টেবিলের উপর রাখল। বললাম, তোমার নাম কী হে?

সুখনরাম, বাবুজি।

এ বাংলোয় লোকজন কোনওকালে এসেছে, না আমিই প্রথম?

সুখনরামের রসবোধ আছে। সে হেসে ফেলল। বললাম, ভূতটুত নেই তো?

আরে রাম, রাম! কত লোকই তো এসে থেকে গেছে।কই, এমন অপবাদ তো কেউ দেয়নি।

একথায় একটু যে আশ্বস্ত হইনি তা বলতে পারি না। ভূতে বিশ্বাস করি বা না করি, এটুকু অন্তত জানি যে, যদি ভূত থাকেই এ বাংলোতে, তা হলে সে সবসময়ই থাকবে, আর না থাকলে কোনও সময়ই থাকবে না। বললাম, এটা কদ্দিনের পুরনো বাড়ি?

সুখন আমার বেডিং খুলে দিতে দিতে বলল, পহিলে ইয়ে নীল কোঠি থা। এক নীলকা ফেক্টরি ভি থা নজদিগমে। উস্কা এক চিমনি আভি তক খাড়া হ্যায়; আউর সব টুট গিয়া।

এ অঞ্চলে যে এককালে নীলের চাষ হত সেটা জানতাম। মুঙ্গেরের আশেপাশেও ছেলেবেলায় পুরনো ভাঙা নীলকুঠি দেখেছি।

সুখনের তৈরি রুটি আর কলাইয়ের ডাল খেয়ে নেয়ারের খাটে বিছানা পেতে যখন শুলাম তখন রাত সাড়ে দশটা। প্রমোদকে আজ বিকেলে পৌঁছব বলে টেলিগ্রাম করেছিলাম, ও একটু চিন্তিত হবে অবশ্যই। কিন্তু সে নিয়ে ভেবে লাভ নেই। একটা আস্তানা যে পেয়েছি, এবং বেশ সহজেই পেয়েছি, সেটা কম ভাগ্যের কথা নয়! ভবিষ্যতে ভোলাবাবুর উপদেশ মেনে চলব। উচিত শিক্ষা হয়েছে আমার। তবে এটাও ঠিক যে, এমনি শেখার চেয়ে ঠেকে শেখার দাম অনেক বেশি।

লণ্ঠনটা পাশের বাথরুমে রেখে এসেছি। দরজার ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো এসেছে তাই যথেষ্ট। ঘরে বেশি আলো থাকলে আমার ঘুম আসে না, অথচ এখন যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা হল ঘুম। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র সব বার করে নিয়ে সেটা লক করে এসেছি, বলাই বাহুল্য। এটুকু জোর গলায় বলতে পারি যে, আজকালকার দিনে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি ফেলে রাখা যতটা বিপজ্জনক, গ্রামের রাস্তায় তার চেয়ে হয়তো কিছুটা কমই।

বাইরে বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে। ব্যাঙ আর ঝিঁঝির সমবেত কণ্ঠস্বরে রাত মুখর হয়ে উঠেছে। শহরের জীবনটা এত দূরে আর এত পিছনে সরে গেছে যে, সেটাকে একটা প্রাগৈতিহাসিক পর্ব বলে মনে হচ্ছে। নীলকুঠি!…দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের কথা মনে পড়ল। কলেজে থাকতে অভিনয় দেখেছিলাম…কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের কোনও এক পেশাদারি থিয়েটারে…

ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। কতক্ষণ পরে তা জানি না। দরজায় একটা খচমচ শব্দ হচ্ছে। ভেতরে হুড়কো দেওয়া; বুঝলাম বাইরে থেকে কুকুর বা শেয়াল জাতীয় একটা কিছু নখ দিয়ে সেটাকে আঁচড়াচ্ছে। মিনিটখানেক পরে আওয়াজটা থেমে গেল। আবার। সব চুপচাপ।

চোখ বুজলাম, কিন্তু সে অল্পক্ষণের জন্য। একটা কুকুরের ডাকে ঘুমটা একেবারে গেল।

বাংলার গ্রাম্য নেড়িকুত্তার ডাক এটা নয়। এ হল বিলিতি হাউন্ডের হুঙ্কার। এ ডাক আমার অচেনা নয়। মুঙ্গেরে আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই মার্টিন সাহেবের বাড়ি থেকে রাত্রে এ ডাক শুনতে পেতাম। এ তল্লাটে এমন কুকুর কে পুষবে? একবার মনে হল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি কারণ কুকুরটা ডাকবাংলোর খুব কাছেই রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তারপর মনে হল, সামান্য একটা কুকুরের ডাক নিয়ে এতটা মাথা ঘামানোর কোনও মানেই হয় না। তার চেয়ে আবার ঘুমনোর চেষ্টা দেখা যাক। রাত কটা হল?

জানলা দিয়ে অল্প চাঁদের আলো আসছে। শোয়া অবস্থাতেই বাঁ হাতটা তুলে মুখের সামনে আনতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। হাতে ঘড়ি নেই।

অথচ অটোম্যাটিক ঘড়ি যত পরে থাকা যায় ততই ভাল বলে ওটা শোয়ার সময় কখনও খুলে শুই। ঘড়ি কোথায় গেল? শেষটায় কি ডাকাতের আস্তানায় এসে পড়লাম নাকি? তা হলে আমার গাড়ির কী হবে?

বালিশের পাশে হাতড়িয়ে টর্চটা খুঁজতে গিয়ে দেখি সেটাও নেই।

একলাফে বিছানা থেকে উঠে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে খাটের নীচে তাকিয়ে দেখি সুটকেসটাও উধাও।

মাথা গরম হয়ে এল। এর একটা বিহিত করতেই হবে। হাঁক দিলাম–চৌকিদার!

কোনও উত্তর নেই।

বারান্দায় যাব বলে দরজার দিকে এগিয়ে খেয়াল হল যে হুড়কোটাকে যেমনভাবে লাগিয়ে শুয়েছিলাম, ঠিক তেমনই আছে। জানলাতেও গরাদ–তবে চোর এল কোথা দিয়ে?

দরজার হুড়কোটা খুলতে আমার নিজের হাতের উপর চোখ পড়ে কেমন জানি খটকা লাগল।

হাতে কি দেয়াল থেকে চুন লেগেছে না পাউডার জাতীয় কিছু? এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন?

আর আমি তো গেঞ্জি পরে শুয়েছিলাম তা হলে আমার গায়ে লম্বাহাতা সিল্কের শার্ট কেন?

মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। দরজা খুলে বাইরে এলাম।

ছাউখিডা-র।

নিজের গলার স্বর চিনতে পারলাম না। উচ্চারণও না। যতই মিশনারি ইস্কুলে পড়ি না কেন বাংলা উচ্চারণে উগ্র সাহেবিয়ানা আমার কোনওদিন ছিল না।

আর চৌকিদারই বা কোথায়, আর কোথায়ই বা তার ঘর! বাংলোর সামনে ধুধু করছে মাঠ। দূরে আবছা একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, তার পাশে একটা চিমনির মতন স্তম্ভ। চারিদিকে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।

আমার পরিবেশ বদলে গেছে।

আমি নিজেও বদলে গেছি।

ঘর্মাক্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে এলাম। চোখটা অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঘরের সব কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছি। খাট আছে–তাতে মশারি নেই–অথচ আমি মশারি টাঙিয়ে শুয়েছিলাম। বালিশ যেটা রয়েছে সেটাও আমার নয়। আমারটা ছিল সাধারণ, এটার পাশে বাহারের কুঁচি দেওয়া বর্ডার। খাটের ডান দিকের দেয়ালের সামনে সেই টেবিল, সেই চেয়ার–কিন্তু তাতে প্রাচীনত্বের কোনও চিহ্ন নেই। আবছা আলোতেও তার বার্নিশ করা কাঠটা চকচক করছে। টেবিলের উপর রাখা রয়েছে–লণ্ঠন নয়–বাহারের শেডওয়ালা কাজ করা কেরোসিন ল্যাম্প।

আরও জিনিসপত্র রয়েছে ঘরে–সেগুলো ক্রমে দৃষ্টিগোচর হল। এক কোনায় দুটো ট্রাঙ্ক। দেয়ালে একটা আলনা, তা থেকে ঝুলছে একটা কোট, একটা অদ্ভুত অচেনা ধরনের টুপি, আর একটা হান্টার চাবুক। আলনার নীচে একজোড়া হাঁটু অবধি উঁচু জুতোযাকে বলে goloshes।

জিনিসপত্র ছেড়ে আরেকবার আমার নিজের দিকে দৃষ্টি দিলাম। এর আগে শুধু সিল্কের শার্টটা লক্ষ করেছিলাম। এখন দেখলাম তার নীচে রয়েছে সরু চাপা প্যান্ট। আরও নীচে মোজা। পায়ে জুতো নেই, তবে খাটের পাশেই দেখলাম একজোড়া কালো চামড়ার বুট রাখা রয়েছে।

আমার ডান হাতটা এবার আমার মুখের উপর বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, শুধু গায়ের রঙ ছাড়াও আমার চেহারার আরও পরিবর্তন হয়েছে। এত চোখা নাক, এত পাতলা ঠোঁট আর সরু চোয়াল আমার নয়। মাথায় হাত দিয়ে দেখি ঢেউখেলানো চুল পিছনে কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। কানের পাশে ঝুলপি নেমে এসেছে প্রায় চোয়াল পর্যন্ত।

বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে একটা উগ্র কৌতূহল হল আমার নিজের চেহারাটা দেখার জন্য। কিন্তু আয়না? আয়না কোথায়?

রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে এক ধাক্কায় বাথরুমের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

আগে দেখেছিলাম একটিমাত্র বালতি ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। এখন দেখি মেঝের এককোণে একটা টিনের বাথটব, তার পাশে চৌকি আর এনামেলের মগ। যে জিনিসটা খুঁজছিলাম সেটা রয়েছে। আমার ঠিক সামনেই–একটা কাঠের ড্রেসিং টেবিলের উপর লাগানো একটা ওভাল শেপের আয়না। আমি জানি আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু যে চেহারাটা তাতে প্রতিফলিত হয়েছে সেটা আমার নয়। কোনও এক বীভৎস ভৌতিক ভেলকির ফলে আমি হয়ে গেছি ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন সাহেব–তার গায়ের রঙ ফ্যাকাশে ফরসা, চুল সোনালি, চোখ কটা এবং সে চোখের চাহনিতে ক্লেশের সঙ্গে কাঠিন্যের ভাব অদ্ভুত ভাবে মিশেছে। কত বয়স এ সাহেবের? ত্রিশের বেশি নয়, তবে দেখে মনে হয় অসুস্থতা কিংবা অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য অকালেই বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে।

কাছে গিয়ে আরও ভাল করে আমার মুখটা দেখলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বুকের ভিতর থেকে উঠে এল।

ওঃ!

এ কণ্ঠস্বর আমার নয়। এই দীর্ঘশ্বাসও সাহেবেরই মনের ভাব ব্যক্ত করছে–আমার নয়।

এর পরে যা ঘটল, তাতে বুঝলাম যে, শুধু গলার স্বর নয়, আমার হাত পা সবই অন্য কারুর অধীনে কাজ করছে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আমি–অনিরুদ্ধ বোস–যে বদলে গেছি–সে জ্ঞানটা আমার আছে। অথচ এই পরিবর্তনটা ক্ষণস্থায়ী না চিরস্থায়ী, এ থেকে নিজের অবস্থায় ফিরে আসার কোনও উপায় আছে কিনা, তা আমার জানা নেই।

বাথরুম থেকে শোয়ার ঘরে ফিরে এলাম।

আবার রাইটিং টেবিলের দিকে চোখ পড়ল। ল্যাম্পটা এখন জ্বলছে। ল্যাম্পের নীচে খোলা অবস্থায় একটা চামড়া দিয়ে বাঁধানো খাতা। তার পাশে একটা দোয়াতে ডোবানো রয়েছে একটা খাগের কলম।

টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। খাতার খোলা পাতায় কিছু লেখা হয়নি। কোনও এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দোয়াত থেকে কলমটা আমার ডান হাত দিয়ে তুলিয়ে দিল। সে হাত এবার বাঁ দিকে সাদা পাতার দিকে অগ্রসর হল। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে খসখস করে শব্দ করে খাগের কলম লিখে চলল:

২৭শে এপ্রিল, ১৮৬৮

কানের কাছে আবার সেই রাক্ষুসে মশার বিনবুনুনি আরম্ভ হয়েছে। শেষটায় এই সামান্য একটা পোকার হাতে আমার মতো একটা জাঁদরেল ব্রিটিশারকে পরাহত হতে হল? ভগবানের এ কেমন বিধি? এরিক পালিয়েছে। পার্সি আর টোনিও আগেই ভেগেছে। আমার বোধহয় এদের চেয়েও বেশি টাকার লোভ, তাই বারবার ম্যালেরিয়ার আক্রমণ সত্ত্বেও নীলের মোহ কাটাতে পারিনি। না–শুধু তাই নয়। ডায়রিতে মিথ্যে কথা বলা পাপ। আরেকটা কারণ আছে। আমার দেশের লোক আমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। সেখানে থাকতেও তো কম কুকীর্তি করিনি–আর তারা সেকথা ভোলেওনি। তাই ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার সাহস নেই। বুঝতে পারছি এখানেই থাকতে হবে। আর এখানেই মরতে হবে। মেরি আর আমার তিন বছরের শিশুসন্তান টোবির কবরের পাশেই আমার স্থান হবে। এত অত্যাচার করেছি এখানকার স্থানীয় নেটিভদের উপর যে, আমার মৃত্যুতে চোখের জল ফেলার মতো একটি লোকও নেই এখানে। এক যদি মীরজান কাঁদে। আমার বিশ্বস্ত অনুগত বেয়ারা মীরজান!

আর রেক্স–আসল ভাবনা তত রেক্সকে নিয়েই। হায় প্রভুভক্ত কুকুর! আমি মরে গেলে তোকে এরা আস্ত রাখবে না রে! হয় ঢিল মেরে, না হয় লাঠির বাড়ি মেরে তোর প্রাণ শেষ করবে এরা। তোর যদি একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারতাম!…

.

আর লিখতে পারলাম না। হাত কাঁপছে। আমার হাত নয়–ডায়রি-লেখকের।

কলম রেখে দিলাম।

এবার আমার ডান হাতটা টেবিলের উপর থেকে নেমে কোলের কাছে এসে ডান দিকে গেল।

একটা দেরাজের হাতল।

হাতের টানে দেরাজ খুলে গেল।

ভিতরে একটা পিনকুশন, একটা পিতলের পেপার ওয়েট, একটা পাইপ, কিছু কাগজপত্র।

আরও খানিকটা খুলে গেল দেরাজ। একটা লোহার জিনিস চকচক করে উঠল। পিস্তল! তার হাতলে হাতির দাঁতের কাজ।

আমার হাত পিস্তলটা বার করে নিল। হাতের কাঁপুনি থেমে গেল।

বাইরে শেয়াল ডাকছে। সেই শেয়ালের ডাকের প্রত্যুত্তরেই যেন গর্জিয়ে উঠল হাউন্ডের কণ্ঠস্বর–ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে গেলাম। দরজা খুলে বাইরে।

সামনের মাঠে চাঁদের আলো।

বাংলোর বারান্দা থেকে হাত বিশেক দূরে ছাই রঙের একটা প্রকাণ্ড গ্রে হাউন্ড ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি বাইরে আসামাত্র আমার দিকে ফিরে লেজ নাড়তে লাগল।

রেক্স।

সেই গম্ভীর ইংরেজ কণ্ঠস্বর। দূরে বাঁশবন ও নীলের ফ্যাক্টরির দিক থেকে ডাকটা প্রতিধ্বনিত হয়ে এল-রেক্স!…রেক্স…

রেক্স এগিয়ে এল–তার লেজ নড়ছে।

ঘাস থেকে বারান্দায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান হাত কোমরের কাছে উঠে এল–পিস্তলের মুখ কুকুরের দিকে। রেক্স যেন থমকে গেল। তার জ্বলন্ত চোখে একটা অবাক ভাব।

আমার ডান তর্জনী পিস্তলের ঘোড়া টিপে দিল।

বিস্ফোরণের সঙ্গে একটা চোখ ঝলসানো আলো, একটা ধোঁয়া আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া বারুদের গন্ধ।

রেক্সের দেহের সামনের অংশ বারান্দার উপর ও পিছনটা ঘাসের উপর এলিয়ে পড়েছে।

পিস্তলের শব্দ শুনে কাক ডেকে উঠেছে দূরের গাছপালা থেকে। ফ্যাক্টরির দিক থেকে কিছু লোক যেন ছুটে আসছে বাংলোর দিকে।

ঘরে ফিরে এসে দরজায় হুড়কো লাগিয়ে খাটের উপর এসে বসলাম। বাইরে লোকের গোলমাল এগিয়ে আসছে।

পিস্তলের নলটা আমার কানের পাশে ঠেকাতে বুঝলাম সেটা বেশ গরম।

তারপর আর কিছু জানি না।

.

দরজা ধাক্কানিতে ঘুম ভেঙে গেল।

চা লিয়ায়া বাবুজি।

ঘরে দিনের আলো। চিরকালের অভ্যাসমতো দৃষ্টি আপনা থেকেই বাঁ হাতের কবজির দিকে চলে গেল।

ছটা বেজে তেরো মিনিট। ঘড়ি চোখের আরও কাছে আনলাম–কারণ তারিখটাও দেখা যায় এতে।

আটাশে এপ্রিল।

বাইরে থেকে সুখনরাম বলছে, আপকা গাড়ি ঠিক হো গিয়া বাবুজি।

বীরভূমের নীলকর সাহেবের মৃত্যুশত বার্ষিকীতে আমার অভিজ্ঞতার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?

সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৭৫

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments