Wednesday, August 27, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পমহেশের মহাযাত্রা - হুমায়ূন আহমেদ

মহেশের মহাযাত্রা – হুমায়ূন আহমেদ

পরশুরামের লেখা একটি ভৌতিক গল্পের নাম ‘মহেশের মহাযাত্রা’। পরশুরাম অতিপণ্ডিত এবং অতিরসিক একজন মানুষ। তাঁর রসবোধের নমুনা দিই-

রেস্টুরেন্টে এক ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে গিয়েছে। ছেলেটির বাবাও হঠাৎ করে সেখানে গেলেন। ছেলেকে রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিতে দেখে রেগে অগি্নশর্মা হয়ে প্রচুর গালাগাল করে বের হয়ে এলেন। ছেলের বন্ধুরা বলল, তোর বাবা তোকে এত গালমন্দ করল, আর তুই কিছুই বললি না?

ছেলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবার কথার কী করে জবাব দিই! একে তো তিনি বাবা, তারপর আবার বয়সেও বড়।

বাবা ছেলের চেয়ে বয়সে বড়-এই হলো পরশুরামের রসবোধ। তিনি হাসি-তামাশা, ব্যঙ্গ-রসিকতার গল্পের ভিড়ে
‘মহেশের মহাযাত্রা’ নামের অদ্ভুত এক ভূতের গল্পও লিখে ফেললেন। মহেশ নামের এক পাঁড় নাস্তিকের গল্প, যে মহেশ অঙ্ক দিয়ে প্রমাণ করেছে ঈশ্বর সমান শূন্য।

একদল নাস্তিকের ঈশ্বরকে শূন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যেমন আছে, আবার কঠিন আস্তিকদের চেষ্টা আছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার। ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নালে অঙ্কের একজন শিক্ষক ইনফিনিটি সিরিজ দিয়ে প্রমাণ করলেন ঈশ্বর আছেন। ভুবনখ্যাত অঙ্কবিদ ইউলার চার্চের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে বিদঘুটে এক অঙ্ক লিখে বললেন, এই সমীকরণ প্রমাণ করে ঈশ্বর নেই। আপনারা কেউ কি এই সমীকরণ ভুল প্রমাণ করতে পারবেন? চার্চের পাদ্রিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। কারণ, অঙ্ক-বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই।

সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কঠিন তাত্তি্বক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলেছেন, ঈশ্বর এবং আত্মা বলে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক নেই। সবই মানুষের কল্পনা। মানব-মস্তিষ্ক হলো একটা কম্পিউটার। কারেন্ট চলে গেলে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যু হলো মানব-মস্তিষ্ক নামক কম্পিউটারের কারেন্ট চলে যাওয়া।

স্টিফেন হকিং কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। মস্তিষ্ক ছাড়া তাঁর শরীরে সব কলকবজাই অচল। তিনি নিজেই মনে করছেন তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় মানুষ সাধারণত আস্তিকতার দিকে ঝুঁকে। তিনি পুরোপুরি অ্যাবাউট টার্ন করে বললেন, ঈশ্বর নেই। কোনো পবিত্র নির্দেশ ছাড়াই (Devine intervention) বিশ্বণ্ড তৈরি হতে পারে। শুরুতে এ ধরনের সরাসরি কথা তিনি বলতেন না। তাঁর কথাবার্তা ছিল সন্দেহবাদীদের মতো-ঈশ্বর থাকতেও পারেন, আবার না-ও থাকতে পারেন।

স্টিফেন হকিংয়ের এক উক্তিতে ঈশ্বর ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করার কারণ নেই। আবার অনেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে জোরালো বক্তব্যে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা হয় না। ঈশ্বর অধরাই থেকে গেছেন।

আমি সামান্য বিপদে পড়েছি, স্টিফেন হকিংয়ের মন্তব্যে আমার কী বলার আছে, তা অনেকেই জানতে চাচ্ছেন। এসব জটিল বিষয়ে আমি নিতান্তই অভাজন। তার পরও বিচিত্র কারণে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

বিজ্ঞানীদের একটি শর্ত হকিং সাহেব পালন করেননি। তাঁরা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলেন না। যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন না তখন বলেন, তিনি অনুমান করছেন বা তাঁর ধারণা। হকিং সরাসরি বলে বসলেন, ঈশ্বর নেই। তিনি নিজেও কিন্তু পদার্থবিদ্যায় তাঁর থিওরি একাধিকবার প্রত্যাহার করেছেন।

হকিং সাহেবের ধারণা-অমরত্ব বলে কিছু নেই। তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন উঘঅ অণু অমর। আমাদের এবং এ জগতের সৃষ্ট সব প্রাণী ও বৃক্ষের প্রতি নির্দেশাবলি দেওয়া আছে উঘঅ-তে। আমরা কখন যৌবনে যাব, কখন বুড়ো হব-সব নিয়ন্ত্রণ করছে উঘঅ অণু। এই অণুই সদ্য প্রসব হওয়া গো-শাবককে জানিয়ে দিচ্ছে, একটি বিশেষ জায়গায় তোমার জন্য তরল খাবার রাখা আছে। মুখ দিয়ে সেখানে ধাক্কা দেওয়ামাত্র তোমার খাবার বের হয়ে আসবে। আমরা বাস্তবে কী দেখি? বাছুর মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে ছুটে যাচ্ছে তার মায়ের ওলানের দিকে। তাকে কিছু বলে দিতে হচ্ছে না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে রহস্যময় উঘঅ.

এই রহস্যময় উঘঅ কি বলে দিচ্ছে না? ‘হে মানব জাতি, তোমরা ঈশ্বরের অনুসন্ধান করো।’ এ কারণেই কি মানুষ নিজের জন্য ঘর বানানোর আগে প্রার্থনার ঘর তৈরি করে?

হকিং বলছেন মানব-মস্তিষ্ক কম্পিউটারের মতো। সুইচ অফ করলেই কম্পিউটার বন্ধ। মৃত্যু মানব কম্পিউটারের সুইচ অফ।

সুইচ অফ করলেও কিন্তু কম্পিউটারের মেমোরি থেকে যায়। আবার পৃথিবীর সব কম্পিউটারের মেমোরি কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব।

মহা মহা শক্তিধর (আল্লাহ্, ঈশ্বর, গড) কারো পক্ষে একইভাবে প্রতিটি মানুষের মেমোরি সংরক্ষণও সম্ভব। তখনো কিন্তু আমরা অমর। সংরক্ষিত মেমোরি দিয়ে প্রাণ সৃষ্টিও সেই মহাশক্তিধরের কাছে কোনো বিষয়ই না।

মানুষ নিজেও মহা মহা শক্তিধর। সেই মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয়ে গেল। বিশ্বণ্ডে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। তাকে কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাকে পদার্থবিদ্যার প্রতিটি সূত্র মেনে চলতে হচ্ছে। এই সূত্রগুলো আপনা-আপনি হয়ে গেছে? এর পেছনে কি কোনো পবিত্র আদেশ (Devine order) নেই?

একদল বলছে, প্রাণের সৃষ্টি ‘ঈযধড়ং’ থেকে। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে জটিল যৌগ তৈরি হলো। একসময় জটিল যৌগ আরো জটিল হলো। সে নিজের মতো আরো অণু তৈরি করল। সৃষ্টি হলো প্রাণ। অণুতে অণুতে ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে তৈরি হলো ধীমান মানুষ, অন্যদিকে তৈরি হলো গোলাপ, যার সৌন্দর্য ধীমান মানুষ বুঝতে পারছে। ব্যাপারটা খুব বেশি কাকতালীয় নয় কি?

আমি ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডায় প্রায়ই ঈশ্বর-বিষয়ক একটি গল্প বলি। পাঠকদের গল্পটি জানাচ্ছি। ধরা যাক এক কঠিন নাস্তিক মঙ্গল গ্রহে গিয়েছেন। সেখানকার প্রাণহীন প্রস্তরসংকুল ভূমি দেখে তিনি বলতে পারেন-একে কেউ সৃষ্টি করেনি। অনাদিকাল থেকে এটা ছিল। তার এই বক্তব্যে কেউ তেমন বাধা দেবে না। কিন্তু তিনি যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান, তাহলে তাঁকে বলতেই হবে এই ক্যামেরা আপনা-আপনি হয়নি। এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। মনে করা যাক ক্যামেরা হাতে তিনি আরো কিছুদূর গেলেন, এমন সময় গর্ত থেকে একটা খরগোশ বের হয়ে এল। যে খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়েও হাজার গুণ জটিল। তখন কি তিনি স্বীকার করবেন যে এই খরগোশের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে?

মনে হয় স্বীকার করবেন না। কারণ, নাস্তিক আস্তিক দুই দলই জেগে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে বলে তাদের ঘুম ভাঙানো যায় না। বিপদে পড়ে সন্দেহবাদীরা। যতই দিন যায় ততই তাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাড়তেই থাকে।

পাদটিকা
রাতের অন্ধকারে এক অতিধার্মিক বাড়িঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন। তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, ঈশ্বরের সন্ধানে।

সেই লোক অবাক হয়ে বলল, সে কি! ঈশ্বর কি হারিয়ে গেছেন যে তার সন্ধানে বের হতে হচ্ছে?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments