Tuesday, August 26, 2025
Homeবাণী ও কথামাসি - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

মাসি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দু-হাতের দুটো বুড়ো আঙুল নেই বলে ফটকের আটকায় কীসে? কিছুতেই না। কেবল মাঝে মাঝে মাসি দুঃখ করে বলে–আহা, আমার ফটকের যদি দুটো বুড়ো আঙুল থাকত।

মাসি হচ্ছে কড়ে রাঁড়ি। ফটকেই তার ধ্যান জ্ঞান। বর্ধমানে ফটকের অপদার্থ বাপ এক ভুসিওলার আড়তে দাঁড়িপাল্লা সামলায়, বাদবাকি সময়টা হয় দিশি মাল গেলে, নয়তো বোকা মুখে সুখসুখ ভাব ফুটিয়ে পায়ের একজিমা চুলকোয়। ছেলেপুলেগুলো রাস্তার ধুলোকাদা মেখে ভূত সেজে বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায়। ওই ভূতের দল থেকে মাসি বেছেছে ফটিককেই তুলে এনেছিল একদিন। দুটো বুড়ো আঙুল না থাকায় সে ছিল মা-বাপের কমতি ছেলে। পুরো ছেলে নয় বলে বাপ তাকে পুষ্যিপুত্ত্বর দিতে আপত্তি করেনি, মা কিছু কান্নাকাটি করেছিল, তা সে হচ্ছে মায়েদের ধাত, মনোমাসির বিষয়সম্পত্তি একদিন যে ফটিকই পাবে তা বুঝতে না পেরে। এক ভাগীদার ভাগনে মাঝে-মাঝে এসে হামলা করে। নইলে মাসির খোলার চালের বাড়ির আর তিন বিঘে ধানী জমি, কিছু সোনাদানা-এসব ফটকেই পাবে। মাসি ধর্মভীরু লোক, স্বামীর ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সার সুদ থেকে সংসার চালায়। ইচ্ছে করলে মাসি টাকাটা বাইরে চড়া সুদে খাটাতে পারত। খাটায় না। সন্ধেবেলা ভাগবত পড়ে বারান্দায় বসে। সেই ভাগবত শুনতে মাঝে-মাঝে দু-চারজন বুড়ি বিধবা এসে বসে। তাদের কাছেই দুঃখ করে মাসি-আহা আমার ফটকের যদি দুটো বুড়ো আঙুল থাকত।

বুড়িরা সায় দিয়ে বলে–আঙুল থাকলে ও ছেলের আর দেখতে হত না। বুড়ো আঙুল ছাড়াই বা ওর আটকায় কীসে?

ঠিক কথা। ফটিকের আটকায় না। মাসি তাকে বসে থাকতে দেয় না। সাইকেল চালানো। শিখতে পাঠায়। তবলা বাজানো শিখতে পাঠায়। গাড়ি চালানো শিখতে পাঠায়। তার ধারণা, ফটিককে দিয়ে সব হবে। দিব্যি সাইকেল চালায় ফটিক, চাটুজ্জেদের ড্রাইভার মদনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে গাড়ি চালাতেও শিখে গেল প্রায়। ভরসা আছে, মাসি একটা লরি কিনে দেবে ওকে। লম্বা লম্বা ট্রিপ মেরে দেদার কামাবে ফটিক। বুড়ো আঙুল ছাড়াই ও সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখাবে একদিন।

পাড়ার ফাংশানে সেদিন রেডিয়ো আর্টিস্ট অনিলবরণ গাইতে এসে ফটিককে দেখে চোখ কোঁচকাল, বলল –তুই পারবি?

ফটকে তবলায় পাউডার মাখাতে–মাখাতে বলল –তুমি গান ধরো না।

অনিলবরণের চাকরি ভালো নয়। হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির জমাদারদের কাজ দেখে বেড়ায়। কিন্তু তার চুল ফাঁপানো, পোশাক হালফিলের প্যান্ট–শার্ট, পায়ে চোখা জুতো, কণ্ঠে সর্বদা গুনগুনানি। একবার রেডিয়োতে চান্স পেয়েছে। গায়ক অনিলবরণের ডাঁটই আলাদা। এ অঞ্চলের সব ফাংশানে সে বাঁধা আর্টিস্ট। ফটকেকে তাই নীচু নজরে দেখে। অবহেলায় ফাংশানমারা একখানা সাপটা মেরে মৃদু স্বরে ফুলপ্রজাপতি–তুমি–আমি–মার্কা আধুনিক ধরে ফেলল। টপাটপ টুম টপাটপ টুম আওয়াজে তবলায় বোল তুলে ফেলে ফটিক। শ্রোতারা অনিলবরণকে ছেড়ে ফটিকের আট আঙুলের কাজ দেখে, আর বাহবা দেয়। সামনে বাচ্চারা চেঁচাচ্ছে–ফটিকদা, চালিয়ে যাও।

অনিলবরণ হারমোনিয়ামে সুর ধরে রেখে নীচু স্বরে বলল –ফটকে, ঘিঁষে মার।

তা ফটিক ঘিঁষে মারল। বাঁয়াতে দিব্যি পরিপাটি কাজ দেখায় সে। মুখে হাসি। অনিলবরণ গেয়ে উঠে তার পিঠ চাপড়ে দিল–বেশ বাজিয়েছিস।

তা ফটিকের আটকায় না। মাসির ছানি কাটার পর আজকাল সে-ই জামাকাপড়ের ফাটাফুটো উঁচ সুতোয় সেলাই করে, ছেঁড়া বোতাম বসিয়ে নেয়। বুড়ো আঙুল ছাড়াই সে দিব্যি উলও বুনতে পারে। তর্জনী আর মাঝের আঙুলে কলম চেপে ধরে সে গোটা–গোটা অক্ষরে লেখালেখি যা চালায়, কে বলবে সেই হাতের লেখা বুড়ো আঙুল ছাড়াই লেখা হয়েছে। পাড়ায় সে হচ্ছে একটা উদাহরণ। দু-আঙুল কমতি ফটকে যা পারে তা বাড়তি দু-আঙুলের লোকেরা পারে না।

উদাহরণ আরও আছে। পঞ্চাননতলার হারাধন। কোমরের নীচের অংশটুকু শুকিয়ে কুঁকড়ে এইটুকু। হারাধন হাঁটে হামাগুড়ি দিয়ে। হাঁটুতে দড়ি দিয়ে বাঁধা চামড়ার একটু গদি, দুহাতে একজোড়া কাঠের খড়ম, ভিড়ের রাস্তায় এঁকেবেঁকে অনায়াসে চলে যায় সে। আটকায় না। কুকুর বেড়াল যদি চার পায়ে বিশ্বসংসার চষতে পারে তবে হারাধনই বা পারবে না কেন? হারাধন। বাজার করে, দোকানে সওদা করে, দোতলার সিঁড়িও দরকার মতো ভাঙতে পারে। বেঁচে থাকা মানেই হচ্ছে কম্পিটিশন।

নানা ধান্ধায় ঘুরেটুরে অবশেষে হারাধন গত বারো বছর যাবৎ তার বাড়িতে এক কালীমন্দির দিয়েছে। ভারী জাগ্রত কালী। হাফ প্যান্টপরা হারাধন গায়ে একটা পাটের চাদর জড়িয়ে পুজো করতে বসে। বেলা দশটায় শুরু হয় তার জনসংযোগ। একটা একসারসাইজ বুক খুলে পেনসিল হাতে বসে থাকে। খাতায় কয়েকটা খোপ কাটা। সেইসব খোপে বিচিত্র অঙ্ক লেখা আছে। তার রোগা–টোগা বুড়োমানুষ বিধবা মা ছেলের পিছনে এসে হাতজোড় করে বসে থাকে তখন।

লোকজন এলে তাদের সমস্যার কথা শুনে টুনে হারাধন গম্ভীরভাবে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়, এক সময়ে হঠাৎ আস্তে-আস্তে ডাকতে থাকে–মা, মাগো, ও মা। সে ডাক তার আসল মাকে নয়, কালীকে। হাতের পেন্সিল যেন স্বপ্নের ঘোরে সরতে–সরতে একটা ঘরে গিয়ে স্থির হয়। এসেছে, মা এসেছে। হারাধন তখন এমনভাবে কথাবার্তা শুরু করে যেন টেলিফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে। বলে–তা হ্যাঁ মা, এই জয়চরণদার বড় বিপদ, একবার এদিকে বেড়াতে–বেড়াতে আসবেন নাকি? সময় কি হবে মা? ওপার থেকে কালী কী বলেন, তা এ পাশের সাধারণ শুনতে পায় না, কিন্তু হারাধন শোনে ঠিকই। বলে–এই ধরুন কাল রাত দশটা–এগারোটা নাগাদ মিনিট পনেরোর জন্য কি সময় হবে মা! হবে আচ্ছা মা, তবে ওই কথাই রইল। এবং তখন চোখ খুলে আসল মার দিকে চেয়ে হারাধন গম্ভীর হয়ে বলে–শুনলে তো? কাল রাত দশটা এগারোটার মধ্যে মা আসবেন। তার মা তখন ভারী আতঙ্কিত হয়ে বলে–তাহলি তো পুজোর জোগাড় করতি হয়। হারাধন অবজ্ঞাভরে জয়চরণের দিকে চেয়ে বলে–তাহলে, খরচাপাতি ইত্যাদি।

আট-আঙুলের ফটকের সঙ্গে হারাধনের ভারী ভাব। যাতায়াতের পথে ফটকে হারাধনের জাগ্রত কালীর স্থানে একবার মাথা ঠুকে যায়। সময় থাকলে বসেও পড়ে। হারাধন তার দুটো কমতি আঙুলের হাতদুখানার দিকে চেয়ে বলে–জন্মের দোষ বুঝলি?

ফটকে মাথা নাড়ে–আর তোমারটা?

–এ হচ্ছে ক্ষণের দোষ। টাইফয়েড না হলে–একটা শ্বাস ফেলে বলে–সবই মায়ের ইচ্ছে। তিনিই পা ভেঙে আটকে রেখেছেন তাঁর কাছে, নইলে হয়তো পিছলে যেতুম।

তবু কারও কিছু আটকে থাকে না। হারাধনেরও দিন চলে। ফটিকেরও। হারাধন মাঝে-মাঝে ডেকে বলে–মন্তর নিবি নাকি, ও ফটিক?

ফটিক রাজি। কিন্তু মাসি রাজি নয়। অল্পবয়স থেকে ব্রহ্মচর্য করে-করে মাসি ভারী জেদি আর তেজি হয়ে গেছে। বলে–পঞ্চাননতলার হারু দেবে মন্তর! ওম্মাগো! ঠাকুরদেবতার নামে। কিছু বলতে নেই, হারাধনের কালীমায়ের পায়ে গড়। কিন্তু ও কি মন্তর দেবে খ্যাপা? ন্যালাহাবলা, কুচুটে। খবরদার, ও কথা মনেও ঠাঁই দিবি না। সব নিংড়ে নেবে।

ফটিক তাই রাজি হয় না। হারাধন দুঃখ করে বলে–শেষতক লরি চালাবি ছোট লোকদের মতো! আমারই হয়েছে বিপদ! আমার সব মন্তরতন্তর, তত্বের সব গুহ্যকথা, মন্ত্রগুপ্তি–এগুলো কাকে দিয়ে যাই!

–তোমার তো অনেক শিষ্য!

কথাটা মিথ্যে। বস্তির কিছু হাঘরে, কয়েকটা রেলকুলি, আর দু-চারজন ছাতুওয়ালাকে ধরে মন্তর দিয়েছে বটে হারাধন, কিন্তু সংখ্যায় তারা বড়জোর পঁচিশ–ত্রিশ হবে কুড়িয়ে বাড়িয়ে। তবু হারাধন কথাটা শুনে খুশি হয়। বলে–তা অনেক শিষ্য বটে, কিন্তু মানুষ কটা? এই তো সেদিন লালুবাবু মন্তর নিতে এল, পয়সাওয়ালোক, বড়বাজারে পাইকারি রুমালের কারবার–কিন্তু হলে কী হয়! পলকা গেলাসে কড়া মদ ঢাললে যেমন ফেটে যায় চড়াক করে, এও হচ্ছে তাই। আধার দেখে বুঝলুম চলবে না। মন্তর কানে ঢুকতে–না-ঢুকতেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আর উঠবে না। একটা কমজোরি মন্তর জপ করতে দিলুম, আসল মন্তর নেওয়ার লোক কই রে? তোকে দেখেই বুঝেছি, এই হচ্ছে আসল আধার। আমার সব সাধনটাধন ধরে রাখতে পারবে।

ফটিককে ভালোবাসে সবাই। মদনাও। চাটুজ্জেদের গাড়িটায় মদনাই তাকে সুযোগ বুঝে তুলে নেয়, এটা ওটা শেখায়। বলে–আট আঙুলে তোর যা এলেম। বুঝলি, আমার ইচ্ছে একটা গাড়ি সারাইয়ের কারখানা করি। কাঁচা পয়সা। তোর মাসি যদি কিছু ছাড়ত, কদমতলায় রাস্তায় মোড়ে একটা ভালো স্পট দেখে রেখেছি। দুজনে মিলে কারখানা চালাতাম। চাকরি করে আর কটা পহা?

সে ফাঁদে পা দেয় না ফটিক। পিছলে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আশ্বাস দিয়ে রাখে। ফাঁকতালে মোটরের ইঞ্জিনটা মদনার কাছ থেকে ভালোমতো চিনে নিতে থাকে।

ফটিকের আসল জায়গা হচ্ছে তার মাসি। সারাদিন শুদ্ধাচার আর শুচিবাই। ঘরে গুরুর ছবি আছে–দিনের বেশিরভাগ সেখানে বসে থাকে। ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত এ সব হচ্ছে। মাসির সারাদিনের সঙ্গী। তবু ফটিক হচ্ছে মাসির বুকের পাঁজর। সারাদিন ফটিকের কথা ভেবে ভেবে সারা। ফটিক তাই নিশ্চিন্ত আছে।

কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকতে দেয় না মাসির ভাগনে শ্রীপতি। কালো মতো ক্ষয়া চেহারা, বয়স চল্লিশ–টল্লিশ হবে, একসময়ে ঠিকাদারি করত, এখন কী করে কে জানে। অভাবী লোক, বড়। বদমেজাজি, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদা আত্মহত্যা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে-হাঁটতে সেই রামরাজাতলা পর্যন্ত চলে যায়। তারপর একটা নির্জন জায়গা দেখে রেল লাইনে গলা দিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু কপাল খারাপ। আগে থেকে শুয়ে থাকার ফলে একটু ঘুমভাব এসে গিয়েছিল বুঝি। হঠাৎ ট্রেনের হুইশিলের শব্দে আঁতকে উঠে আঁ–আঁ করতে-করতে কেমন। হয়ে গেল, লাইন থেকে আর গলা তুলতে পারে না। বিশ গজ দূরে গাড়িটা থামিয়ে বদরাগি ড্রাইভারটা তেলকালি মাখা ভূতের মতো নেমে এসে ঘেঁটি ধরে যখন তুলল তাকে তখন সে বিড়বিড় করে বলছে, হ্যাঁ মরে গেছি। হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়ই মরে গেছি! ড্রাইভার সাহেব মুগুরের মতো হাতে দু-চারটে থাপ্পড় বসাতেই শ্রীপতি সজ্ঞানে আসে। তারপর সে কী দৌড়! তাই শ্রীপতির আর মরা হয়নি। জ্যান্ত শ্রীপতি তাই এসে মাঝে-মাঝে ফটিককে শাসায় কবে কাটছ বলো দেখি ফটিকচাঁদ? আমাকে জানো তো, সালকের এক নম্বর মস্তান হচ্ছে এই শ্রীপতি সমাদ্দার। ঘাড়ে ধরে বের করব যদি নিজে থেকে না-যাও। মাসির ওপরেও টং করে যায় সে-মামি, আমি কিন্তু উকিল মোক্তার করব না। ওই ফটকের যদি ভালো চাও তো ওকে পাঠিয়ে দাও দেশে। আমার মামার ভিটেয় কাউকে চেপে বসতে দেব না।

ফটিক এসব অবস্থায় ভারী অসহায় বোধ করে। ভাবে, এমন সুখের জায়গা ছেড়ে আবার বুঝি সত্যিই তাকে বর্ধমানের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু মাসির মুখের রেখায় নড়চড় হয় না। শ্রীপতি যেন সামনে নেই, এমনভাবে মাসি তাকে অগ্রাহ্য করে, ঘরের কাজ সারে। শ্রীপতি পাড়া মাত করে ফিরে যায়। ওই রোগা, ফরসা ছোট্ট, বুড়ি মাসির কোথায় যেন একটা ভারী জোর আছে। সেই জোরটা যেন সব সময়ে ঘিরে রাখে ফটিককে। তাই একদিন শ্রীপতি এলে ফটিক তাকে উলটে শুনিয়ে দেয়–ভারী তো মাস্তান, ইঞ্জিনের ড্রাইভার চড়িয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছিল। আবার মাস্তান!

–তবে রে আট আঙুলে, অলক্ষুণে। বলে তেড়ে আসে বটে শ্রীপতি, কিন্তু সহসা উদ্যত হাত থামিয়ে কেবল তড়পাতে থাকে। মারে না। ঠিক সাহস পায় না বোধ হয়।

মাসির কী বা আছে! অল্প কিছু জমি, সামান্য টাকা, কিছু সোনাদানা। তার ওপরেই সকলের চোখ। মাসিই কেবলমাত্র উদাসীন। এ তত্বটা বুঝতে পারে ফটিক। নিজের ওপর ঘেন্না হয় মাঝে মাঝে। সেও তো ওই ভরসায় আছে।

হারাধনের কালীর স্থানে সেদিন প্রণাম সেরে বেরিয়েই যদু মোক্তারের সঙ্গে দেখা। বুড়ো হাড়ে হারামজাদা, রোগা খিটখিটে চেহারা, চোখে বুদ্ধির চিকিমিকি। ফটিককে দেখে বলে কী বাবা ফটিক, শুনেছ?

–কী?

–তোমার বাড়া ভাতে ছাই। মাসি যে সম্পত্তি সব দেবোত্তর করে দিল। কথাটা বিশ্বাস হয় না ফটিকের। চেয়ে থাকে। বুড়ো তার মুখের দিকে ভারী খুশি–খুশি ভাবে চেয়ে থাকে। কারও কোনও গর্দিশ হলে যদু মোক্তারের ভারী আনন্দ। বলে–তোদের বাড়ি থেকেই আসছি উইলে সাক্ষী দিয়ে। তোর মাসির ভিটেয় গুরুর মঠ হবে। এবার নিজের রাস্তা দ্যাখ।

কথাটা মাসিকে মুখোমুখি জিগ্যেস করতে লজ্জা পায় ফটিক। মাসিও যেচে কিছু বলে না। মনটা ভারী দমে যায় তার। চার বছর বয়স থেকে মাসির কাছে সে এত বড়টি হল। সবাই জানে, সে মাসির ছেলের চেয়েও বেশি। আট আঙুলের ফটিককে মাসি কত স্নেহে ভালোবাসায় দশ আঙুলের মানুষের মতে সবকিছু শিখিয়েছে। তবে মাসির এটা কীরকম ব্যবহার?

হারাধনের কাছে দুঃখ করে ফটিক–এমনটা হবে জানলে কোনও শালা এসে এতকাল পড়ে থাকত!

–দুঃখ করিস না ফটিক। মঠ যদি হয় তো, মাসিকে বল আমায় যেন সেবাইত করে। তোরটা পুষিয়ে দেব।

মদনা ফটিককে ধরে বলে–তখনই বলেছিলুম, কদমতলার জায়গাটা দুজনে নিই আয়, কাঁচা পয়সা লুটে নিতাম।

খবর পেয়ে শ্রীপতিও আসে। ফটিকের সঙ্গে দেখা হয় চৌরাস্তায়। নরম গলায় বলে–বুড়ির মাথাটাই গেছে বিগড়ে। দেবোত্তর আবার কীরে! না হয় তোর নামেই থাকত সম্পত্তি, আমরা দু ভাইয়ে ভোগ করতুম? হাজার পঞ্চাশেক নগদ, সোনাদানা মিলে আরও ধর হাজার ত্রিশ-চল্লিশ ইস ভাবা যায় না!

ভাবতে-ভাবতে নিজের আট আঙুলের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলে ফটকে। দিনরাত লোকজন তার কানমন্তর দিচ্ছে। মাথা ক্রমে গরম হয়ে যায়। বুঝতে পারে, মাসি তাকে সবচেয়ে বড় ধাপ্পাটা দিয়েছে। ফটিক তাই রাগে–রাগে বাসাতেই থাকে না বড় একটা। সকালে বেরোয়, রাত করে ফেরে। মনের মধ্যে একটা পাখি কেবল কু-ডাক ডাকে।

.

বারান্দায় একা বসে ভাগবত পড়ছে মাসি। সামনে পিদিম। ননীচোরা কৃষ্ণের মুখ ফাঁক করে মা যশোদা দেখছেন সত্যিই খেয়েছে কি না কৃষ্ণ। ওমা কোথায় ননী! মা যশোদা দেখেন, কৃষ্ণে মুখের মধ্যে বিশ্বরূপ। রাত হয়েছে। ফটিক এইবার ফিরবে। মাসি টের পায়, চরাচর নিঝুম। ভাগবত পাঠের শব্দ যতদূর যায় ততদূর বড় পবিত্র। কত পোকামাকড় কাছে আসে, কত সাপখোপ। ওই শব্দ সবাইকে টেনে আনে কাছে। আজও এসেছে। চোখ না তুলেও টের পায় মাসি। সিঁড়ির মুখে উঠে এসেছে দুটি দীর্ঘ দেহ। নিস্পন্দ পড়ে আছে। শুনছে। কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু গায়ে পা পড়লে? ফটিক এ সময়েই ফেরে। পিদিমের আলোয় যদি দেখতে না পায় সাপ দুটোকে? আজ কৃষ্ণপক্ষ, বাইরেটা বেজায় অন্ধকার।

মাসি শোনে, আগল ঠেলে ফটিক ঢুকল উঠোনে। সোজা সিঁড়ির দিকে হেঁটে আসছে। অধ্যায় শেষ না হলে পাঠ শেষ করা চলবে না। মাসি ঝুঁকে থাকে বইখানার ওপর। ঠাকুর! চোখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ে। ফটিক আসছে।

ঠিকাদারদের লরি একটু আগেই মাটি ফেলছিল সাঁইদের মজা পুকুরে। তারই একটা হেডলাইট জ্বালল। সমস্ত বাড়ি, উঠোন ধাঁধিয়ে একটা আলো এসে পড়ে। ফটিক থেমে যায়। মাসি ঝুঁকে পড়ে বইয়ের ওপর। ঠাকুর।

ফটিক চিৎকার করে ওঠে–মাসি পালাও।

মাসি একখানা হাত তুলে করতলখানা তাকে দেখাল। উঠল না, নড়ল না। শুধু হাতখানা তুলে ফটিককে অভয় দিল। অনেক ভেবে–ভেবে ফটিকের আজকাল মনে হয়না, মাসি তাকে বঞ্চিত করেনি। কী যেন একটা দিয়েছে, যার হিসেবনিকেশ করতে ফটিকের এ জন্মটা চলে যাবে বোধহয়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments