কী হল! – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ছাত থেকে নদীটা দেখা যায়। দূরে সূর্য ওদিকেই অস্ত যায়। নদীর ওপারে জঙ্গল আর পাহাড়। আমরা কয়েকদিনের জন্যে এখানে বেড়াতে এসেছি। বড়রা আশেপাশে বেড়াতে যান। এখনও স্টেশানে যান। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাগানে ঘুরে বেড়ান। বৈঠকখানায় হাসি-গল্প করেন আর রকম রকম খাবার খান।

রুকু একদিন আমাকে বলল, ‘শোন পলাশ, তোর ভালো লাগে এই খুচখাচ ঘোরা আর সারাদিন বড়দের বড় বড় কথা শোনা?’

‘কী আর করা যাবে বল, বড়দের কথা ছোটদের শুনতেই হবে।’

‘আমরা অত ছোট নই, আর কয়েকবছর পরে আমরাও বড় হয়ে যাব।’

‘কী করতে চাস?’

‘কাল খুব ভোরে আমরা ওই নদীটার কাছে যাব। দুপুরে চান করব। চাল, ডাল, আলু সব নিয়ে যাব। খিচুড়ি বেঁধে খাব।’

শুনে খুব আনন্দ হল। ভয়ও হল। বললুম, ‘ওপারের জঙ্গলে বাঘ থাকে।’

থাকে থাক। বাঘ বাঘের জায়গায় থাকবে। আমাদের কী?’

‘এপারে যদি চলে আসে।’

‘আসুক। গরম গরম খিচুড়ি খাইয়ে দেব।’

‘মানুষ খায়?’

‘আমাকে খাইয়ে দেব। তুই বাড়ি চলে আসবি।’

পরের দিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। পথ একসময় ফুরিয়ে গেল। তারপর মাঠ ময়দান। এর আগে একটা চালা দোকানে আমরা গরম জিলিপি আর কচুরি খেয়েছি। দোকানদারকে জিগ্যেস করায় বললেন, ‘নদী! সে তো বেশদূরে। অনেকটা পথ। কেউ থাকে না সেখানে। এক শিকারি সাহেবের ভাঙা একটা বাংলো আছে। সাপের আড্ডা। সেখানে গিয়ে কী করবে তোমরা!’

রুকু বললে, ‘নদী দেখব।’

‘নদীর আবার দেখার কী আছে? কলকল করে জল যাচ্ছে। সাদা সাদা পাথর।’ রুকু বললে, ‘সেইটাই তো দেখব।’

দোকানদার আর কথা বললেন না। বিরক্ত মুখে কড়ায় জিলিপি ঘোরাতে লাগলেন।

রুকু জিগ্যেস করলে, ‘কোন দিক দিয়ে যাব?’

‘পশ্চিমে ঘুরে যাও। শেষ এক মাইল স্রেফ জঙ্গল।‘

‘বাঘ আছে?’

‘না, বাঘ ওপারে। মাঝেসাঝে দেখা যায়।’

‘তাহলে আবার কী?’

‘আনন্দের কিছু নেই। প্রচুর কটাস আছে।’

‘কটাস আবার কী?’

‘বড় বড় কালো কালো বনবেড়াল। ধরলে শেষ।’

রুকুর খুব আনন্দ বিপদের নাম শুনলে। নাচতে থাকে।

শীতকাল। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। ফনফনে উত্তরে বাতাস। আমাদের দুজনের হাতেই ভাঙা গাছের ডাল। বনবেড়াল এলে পেটাতে হবে। দেহাতি গ্রামের এলাকা শেষ হয়ে গেল। প্রথমে পাতলা জঙ্গল। ঘন জঙ্গল এইবার শুরু হবে। দূরে দেখতে পাচ্ছি।

গাছের আড়াল থেকে ভোজবাজির মতো একটা বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এল। ভারী সুন্দর দেখতে।

কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক, বড় বড় চোখ। ছেলেটি জিগ্যেস করলে, ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

‘নদীর কাছে। তুমি কে?’

‘আমি এই বনে থাকি। আগে আমার জায়গায় চলো। বিশ্রাম করে নদীতে যাবে।’

ছেলেটি আগে আগে চলেছে। আমরা পেছনে। যেন টেনে নিয়ে চলেছে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে। গভীর জঙ্গলে হঠাৎ একটা জায়গা খুব পরিষ্কার। সেখানে একটা ভাঙা মন্দির। অপূর্ব কারুকাজ সব ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ছেলেটি চট করে সেই মন্দিরে ঢুকে গেল। ভেতরের থেকে ডাক এল ‘এসো’।

কেউ কোথাও নেই শ্বেতপাথরের বেদীর ওপর শ্বেতপাথরে তৈরি শ্রীরামচন্দ্রের অপূর্ব মূর্তি। যেন হাসছেন। কী সুগন্ধ!

ভাঙা মন্দিরের পাশে একটা কুঠিয়া। সেখানে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ সাধু। জ্বরে অচৈতন্য। রুকু। সঙ্গে সঙ্গে সেবা শুরু করল। জলপটি কপালে দিয়ে আমাকে বললে, ‘পা ঘষতে থাক। বরফ হয়ে গেছে।’

অনেকক্ষণ পরে সাধু চোখ মেলে বললেন, ‘রুকু! তুমি আর পলাশ এসেছ, আমি দেখেছি। আজ রঘুবীর তিন দিন উপবাসী।’

‘নাম জানলেন কী করে?’

‘ও জানা যায়, রঘুবীরের কৃপায়। আমার পাত্রে পঞ্চকেদারের জল আছে, আমার মুখে দাও। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর তোমরা ভোগ বসাও। পেছনেই নদী। আগে স্নান করে এসো।’

নদীতে স্নান করতে করতে রুকু বললে, ‘আমি আর ফিরব না। আমার বিশ্বাস সাধু আর কেউ নয়, বিশ্বামিত্র মুনি!’

স্নান করে ওঠার পর যা হল, তা আরও অদ্ভুত। সেই জায়গাটা আমরা আর খুঁজে পেলুম না! সেই মন্দির, বিগ্রহ নেই, সারা জায়গা জঙ্গল আর জঙ্গল! যেদিকে যাই জঙ্গল।

Facebook Comment

You May Also Like