Friday, May 3, 2024
Homeবাণী-কথাকেদার রাজা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কেদার রাজা – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কেদার রাজা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

০১. নীলমণি চাটুজ্জে বাড়ি ফেরবার পথে

দুপুর বেলায় নীলমণি চাটুজ্জে বাড়ি ফেরবার পথে গ্রামের মুদির দোকানে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ গো ছিবাস, কেদার রাজাকে দেখেছিলে আজ সারাদিন?

ছিবাস আলকাতরার পিপে থেকে আলকাতরা বার করতে করতে জিজ্ঞেস করলে, কেন চাটুজ্জে মশায়, তেনার খবরে কি দরকার?

নীলমণি বললেন, আরে, খাজনার অংশ নিয়ে গোলমাল বেধেছে বড্ড৷ বাঁটুল নাপিতের দরুন আমার অংশে আমি চার আনা করে বছরশাল খাজনা পাই, তা গাঁয়ের শুদ্দুর ভদ্দর কে না জানে? এ বছরের খাজনা কেদার রাজা দিব্যি আদায় করে নিয়ে বসে আছে৷ দ্যাখো তো কি উৎপাত৷

ছিবাস মুদির মন তখন ছিল আলকাতরার পিপের মুখের ফাঁদলের দিকে৷ সে আপনমনে কি বললে, ভাল বোঝা গেল না৷ নীলমণি ছিবাসের সহানুভূতি না পেয়ে বোকার মত মুখখানা করে বাঁড়ুজ্জে পাড়ার দিকে অগ্রসর হলেন—উদ্দেশ্য, বৃদ্ধ বিশ্বেশ্বর বাঁড়ুজ্জের বাড়ির সান্ধ্য পাশার আড্ডায় গিয়ে একবার খোঁজ নেওয়া৷

পথেই একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে দেখা৷

নীলমণি চাটুজ্জে বললেন, আরে এই যে কেদার খুড়ো, তোমাকেই খুঁজছি৷

লোকটি বললে, কেন বলো তো হে?

নীলমণি যতটা জোরের সঙ্গে ছিবাসের দোকানে কথা বলেছিলেন, এখানে কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে অত জোরের সুর বের হল না৷

—সেই বাঁটুল নাপিতের ভিটের খাজনা বাবদ কয়েক আনা পয়সা—

—সে পয়সা তুমি কোত্থেকে পাবে খুড়ো?

নীলমণি ভ্রু কুঁচকে বললেন, নেই বললে সাপের বিষ থাকে না তো জানি কোন ছার! তবে সেটেলমেন্টের কাগজপত্রে তাই বলে বটে৷

—ভুল বলে নীলমণি খুড়ো!

—সেটেলমেন্টের পড়চা ভুল বলে?

নীলমণির বড় ছেলে হাজুকে এই সময় সাইকেলে চড়ে সতেজে যেতে দেখা গেল৷

নীলমণি হেঁকে বললেন, ও অজিত—ও অজিত—

ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে বললে, বাবা, তুমি এখানে?

—দরকার আছে, তুই একবার তোর দাদুর সঙ্গে যা দিকি ওর বাড়ি৷ খুড়ো, আমাদের অংশের খাজনা ক’আনা পয়সা অজিতের সঙ্গে দিয়ে দাও গিয়ে—

—কোথা থেকে দেবো এখন? আজ পাঠিও না, যদি কাগজ-পত্র দেখে মনে হয় তোমার জমি ওর মধ্যে আছে—

নীলমণি বাধা দিয়ে বললেন, আলবাত আছে, হাজার বার আছে, ওর বাবা আছে—

লোকটা বললে, চটো কেন নীলু খুড়ো, থাকে পাবে৷ তবে এখন হাতে টানাটানি—

—টানাটানি তা আমার কি? আমার তো না হলে চলে না৷ ওসব শুনলে আমার কাছারির খাজনা মাপ করবে কি জমিদার?

গ্রামের পথ৷ চেঁচামেচি শুনে দু-চারজন লোক জড়ো হয়ে পড়ল৷

—কি, কি, খুড়ো কি?

—এই দ্যাখো না ক্যাদার খুড়োর কাণ্ডটা—নিজের অংশ আমার অংশ গিলে খেয়ে বসে আছে, এখন উপুড়হাত করবার নামটি নেই৷

লোকে কিন্তু এ ঝগড়ায় উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিলে না, দু-একবার ঘাড় নেড়ে সরে পড়ল অনেকে৷ যারা দাঁড়িয়ে রইল, তারাও নীলমণি চাটুজ্জের পক্ষে কথা না বলে বরং এমন সব মতামত প্রকাশ করলে, যা কি না তাঁর বিরুদ্ধেই যায়৷

নীলমণি অগত্যা অন্য দিকে চলে গেলেন৷ দু-একজন লোকে বললে, পথের মধ্যে এ রকম চেঁচামেচি কি ভালো? ছিঃ—সামান্য কয়েক আনা পয়সার জন্যে—আর ওঁর সঙ্গে? কেউ সহানুভূতির সঙ্গে বলেন, ক্যাদার জ্যাঠা আপনি বাড়ি যান চলে—

তিনিও চলে গেলেন৷

নবাগত দু-একজন লোক জিজ্ঞেস করলে জনতাকে—কি হয়েছে, কি?

—ওই নীলু খুড়ো ক্যাদার রাজাকে পথের মধ্যে ধরেছে, আমার খাজনা শোধ করো ভারি তো খাজনা, ক’অনা পয়সা—হুঁঃ—

—ক্যাদার রাজা কি বললে?

—বলবে আর কি, সবাই জানে ওর অবস্থা কি৷ দিতে পারে যে দেবে এখুনি? পয়সা ট্যাঁকে করে এনেছে নাকি?

—কেদার রাজা এসব গোলমালের ভেতর থাকতে চান না, কখনও পছন্দ করেন না৷ নির্বিবাদী লোক৷ নীলু খুড়োর যা লোভ!

জনতা ক্রমে ভেঙে গেল৷

.

যাঁর নাম কেদার রাজা, তিনি নিজের বাড়ি ঢুকলেন যখন, তখন বেলা প্রায় একটা৷ কেদারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, ইদানীং তাঁর সে চোখ-ধাঁধানো রূপের সামান্য কিছু অবশেষ যা ছিল তাতেও অপরিচিত চোখ তাঁর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত৷ তাঁর মৃত্যু হয়েছে আজ এই বছর দুই৷

বাড়িতে আছে শুধু মেয়ে শরৎসুন্দরী৷ মেয়ে মায়ের অতটা রূপ পায় নি বটে, তবুও এ গ্রামের মধ্যে তার মতো সুন্দরী মেয়ে আর নেই৷

—এত বেলা অবধি কোথা ছিলে?…তোমায় নিয়ে আর পারিনে—তেল মাখো, নেয়ে এসো৷ কেদার রাজা একটু অপ্রতিভ মুখে ঘরে ঢুকলেন৷ মেয়ে ভাত রেঁধে বসে আছে, তিনি আগে খেয়ে না নিলে সে-ও খেতে পারে না—হয়তো তার কষ্টই হচ্ছে৷ মুখ ফুটে তো কিছু বলতে পারে না৷ না, বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে৷

শরৎ বাবাকে তেল দিয়ে গেল৷ বললে, এত বেলায় আর নদীতে যেয়ো না৷ জল তুলে দিচ্ছি, বাড়িতেই নাও৷

এই কষ্টের ওপর আবার শরৎকে জল তুলতে হবে কুয়ো থেকে? কেদার প্রতিবাদ করে বললেন, না, আমি নদীতেই যাই৷ ডুব দিয়ে না নাইলে কি আর নাওয়া হল; চললাম, দে গামছাখানা—

শরৎ পাথরের খোরায় বাবার ভাত বাড়তে গেল৷ কাঁসার জিনিসপত্র ছিল বড় সিন্দুক বোঝাই—সব গিয়েছে একে একে—অভাবের তাড়নায় বিক্রি হয়ে, নয়তো বাঁধা দিয়ে৷ আর উদ্ধার করা যায় নি৷

শরৎ বাবার খাবার জায়গা করে অপেক্ষা করতে লাগল৷ কেউ নেই কেদার রাজার সংসারে—এই বিধবা মেয়ে শরৎ ছাড়া৷ মানে, এখন এই গ্রামের বাড়িতে নেই৷ কেদার রাজার একমাত্র পুত্র বহুদিন যাবৎ নিরুদ্দেশ৷ কোনো সন্ধানই তার পাওয়া যায় নি গত দশ বৎসরের মধ্যে৷

কেদার স্নান সেরে এসে খেতে বসলেন৷ পাথরের খোরায় বুকড়ি কালো আউশ চালের ভাত ও ডাঁটাচচ্চড়ি৷ খোরার পাশে একটা ছোট কাঁসার বাটিতে কাঁচা কলাইয়ের ডাল৷ কেদার নাক সিঁটকে বললেন, কি ছাই-রাই-ই রাঁধিস রোজ, তোর রান্না নিত্যি খাওয়া এক ঝকমারি৷

শরৎ চুপ করে রইল৷

নীরবে কয়েক গ্রাস উদরস্থ করে ক্ষুধার প্রথম দিকের জ্বালার খানিকটা মিটিয়ে কেদার মেয়ের দিকে তিরস্কারসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, আহা, কি ডাল রাঁধবার ছববা! আর এই একঘেয়ে ডাঁটাচচ্চড়ি, এ রোজ রোজ তুই পাস কোথায় বাপু!

—আমার কি দোষ আমি কি বাজারে যাই নাকি? যা পাই হাতের কাছে তাই রাঁধি৷ কে এনে দিচ্ছে বল না—

কেদার মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, তার মানে?

তার মানে কি শরৎ বাবাকে-ভালো ভাবেই বুঝিয়ে বলতে পারত, ঝগড়ায় সে-ও কম যায় না—কিন্তু বাবার মেজাজ সে উত্তমরূপে জানে, এখুনি রাগ করে ভাতের থালা ফেলে উঠে যাবেন এখন৷ সুতরাং চুপ করেই গেল সে৷

কেদার পাতের চারিদিকে ডাল-মাখা ভাত ফেলে ছড়িয়ে ছেলেমানুষের মতো অগোছালো ভাবে আহার সম্পন্ন করে অপ্রসন্ন মুখে উঠে যাবার উদ্যোগ করতে শরৎ বললে—বসো বাবা, উঠো না, কিছু তো খেলে না, একটু তেঁতুল দিয়ে খেয়ে নাও—

কেদার রেগে বললেন, তোর মুণ্ডু দিয়ে খাব অকর্মার ঢেঁকি কোথাকার—অমন ছাই না রাঁধলেই না—

শরৎও প্রত্যুত্তরে বললে, তাই খাও, আমার মুণ্ডু খাও না—আমার হাড় জুড়ুক, আর সহ্যি হয় না—

মাঝে মাঝে পিতাপুত্রীতে এমন দ্বন্দ্ব বাধা এদের সংসারে সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ কেদার খারাপ জিনিস খেতে পারেন না, অথচ এদিকে সংসারের সচ্ছলতার যে রূপ, তাতে আউশ চালের ভাত জোটানোই দুষ্কর৷ এক পোয়া সর্ষের তেল কলুবাড়ি থেকে আসে, মাথায় মাখা সমেত সেই তেলে তিন দিন চালাতে হয়—সুতরাং তরকারিতে জল-আছড়া দিয়ে রান্না ছাড়া অন্য উপায় নেই৷ তরকারি মুখরোচক হয় কোথা থেকে?

অথচ শরৎ বাবাকে সে কথা বলতে পারে না৷ বড়ই রূঢ় শোনায় সেটা৷ বাবার অর্থ উপার্জনের অক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয় তাতে৷ এক যদি তিনি বুঝতেন, তবে সব মিটেই যেত৷ কিন্তু বাবা ছেলেমানুষের মতো অবুঝ, তিনি দেখেও কিছু দেখেন না, বুঝেও বোঝেন না—প্রৌঢ় পিতার এই বালস্বভাবের প্রতি স্নেহ ও করুণাবশতঃই শরৎ কিছু বলতে পারে না তাঁকে৷

তার পর সে বাবার পাতেই খেতে বসে গেল৷

.

দিবানিদ্রায় কেদার রাজার অভ্যাস নেই, দুপুরে খাওয়ার পর তিনি আটদশগাছা ছিপ নানা আকারের, পুঁটি মাছ থেকে রুই কাৎলা ধরা পর্যন্ত, সুতো—বঁড়শি বাঁধা, মাছধরা ভাঁড়, চারকাঠি, মশলা প্রভৃতি মাছ ধরবার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ নিষ্কর্মার কর্ম৷

ওপাড়ার গণেশ মুচি একাজে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু৷ গণেশ এসে বললে, বাবাঠাকুর, তৈরি?

—সব ঠিক আছে, কোথায় যাবি, গড়ের পুকুরে না নদীতে?

—চারকাঠি বেঁধেছ কোথায়?

কেদার রাজা চোখে-মুখে স্বীয় কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার আত্মপ্রসাদসূচক একখানি হাস্য বিস্তার করে বললেন, ওরে বেটা, আজ ত্রিশ বছর বর্শেলগিরি করছি এটুকু আর বুঝিনে? ঘোলার শেষের গাঙ, সেখানে চারকাঠি না বেঁধে বাঁধব কিনা পুকুরে?…হ্যা-হ্যা হ্যা—

গণেশ কেদার রাজার ছিপ ও সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে চলল নিজের ছিপগুলোর সঙ্গে৷

গড়ের পুকুরের ধারে বেতস ও কণ্টকগুল্মের দুর্ভেদ্য জঙ্গল৷ গত বর্ষার জলে সে জঙ্গল বেড়ে মধ্যেকার অন্ধকার সুঁড়িপথটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে—তার মধ্যে দিয়ে দুজনে সন্তর্পণে চলল, পায়ের পাতায় কাঁটা না মাড়িয়ে ফেলে৷

পাড়ের ওপারে যেখানে জঙ্গলটা একটু পাতলা হয়ে এসেচে, সেখানে পৌঁছে গণেশ বললে, আমার কিন্তু বাবাঠাকুর জোড়া দেউলির নীচে চারকাঠি পোঁতা, দেখে যাব না একবারটি?

কেদার বললেন, উঃ ব্যাটা বড় চালাক তো! ওখানে পুঁতেছিস তা আমাকে বলিস নি মোটেই? চল দেখি—

গড়ের দিঘির বাঁ পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে থেকে সেকালের ভাঙা প্রকাণ্ড দেউলের চূড়া যেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, তারই নীচে দিঘির জলে গণেশ গিয়ে নামল৷

দিঘিটা এত বড় যে এপার থেকে ওপারের গাছপালা যেন মনে হয় ছোট৷ অনেকগুলো দেউল এখানে আছে গড়ের দিঘির গভীর জঙ্গলের মধ্যে—কোনো কোনো মন্দিরের গায়ে কালো স্লেট পাথরের ওপর মন্দির-নির্মাতার নাম ও সন তারিখ লেখা৷ একটার ওপর সন লেখা আছে ১০২৪৷ এ থেকে দেউলগুলির প্রাচীনত্ব অনুমান করা কঠিন হবে না৷

গণেশ বললে, ভালো মাছ লেগেছে বাবাঠাকুর, এখানেই বসবা এসো—

—আরে না না, চল গাঙে—এখানে আবার মাছ—

—আপনি নেমে দ্যাখোই না—আমি কি মস্করা করছি তোমার সঙ্গে?

দুজনে পুকুরের ধারেই মাছ ধরতে বসে গেল৷ কেদার রাজা যা হুকুম করেন, গণেশ মুচি তখনই তা তামিল করে, যদিও কার্যত সে কেদার রাজার ইয়ার৷

—তামাক সাজ গণশা, আর পাতা ভেঙে নিয়ে বসবার জায়গা করে দে দিকি!

গণেশ পাড়ের ওপরকার জঙ্গল থেকে বন-ডুমুরের বড় বড় কচি পাতা ভেঙে এনে বিছিয়ে দিলে৷ গণেশ নিজে কিন্তু সেখানে বসল না—বললে, আমি এই বাঁধাঘাটের সানে গিয়ে বসি বাবাঠাকুর—

একটু দূরে প্রাচীন দিনের প্রকাণ্ড বাঁধাঘাট যেখানে ছিল, এখন সেখানে পুকুরপাড়ে সোপানশ্রেণীর চিহ্ন দেখা যায় মাত্র৷ ঘট ব্যবহার করা চলে না, তবে ভাঙা চাতালে বসে মাছ ধরা চলতে পারে এই পর্যন্ত৷

দিঘির চারধারে বড় বড় বট, শিমুল, ছাতিম গাছের বহুকালের বন৷ ঘাটের ওপরকার বৃদ্ধ বট গাছটা দিঘির ঘাটের বাঁধা সোপানশ্রেণীর ফাটলে শিকড় চালিয়ে যদি তার কয়েকটা ধাপকে না ধরে রাখত, তবে প্রাচীন দিনের ঘাটের একখানা ইটও আজ খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ৷ এর প্রধান কারণ এই সব ধ্বংসস্তূপের পোড়ো ইট দিয়ে এ গ্রামের বহু গৃহস্থের বাড়ি তৈরি হয়ে আসছে আজ একশো বছর ধরে৷

ঘণ্টা-দুই পরে নিবিড় ছায়া নামল দিঘিটার চার পাশ ঘিরে৷ চারধারেই বন, বেলা তিনটে বাজতে না বাজতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে এ বিচিত্র কথা কিছু নয়৷ কেদার হেঁকে বললেন, ওরে গণশা শীত শীত করছে, একটু ভালো করে তামাক সাজ, ইদিকে আয় তো—

গণেশের ছিপের ফাৎনা বড় মাছে দু-দুবার নিতলি করে নিয়ে গেছে সবেমাত্র, তার এখন ছিপ ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও কেদারের আদেশ সে অমান্য করতে পারল না৷ বিরক্ত মুখে উঠে এসে বললে—কিছু হচ্ছে-টচ্ছে বাবাঠাকুর?

—তোর কি হল?

—অই অমনি—তেমন কিছু নয়৷

বড় মাছের ঘাই মারার কথা গণেশ বললে না, কোনো বর্শেলই বলে না, যদি বাবাঠাকুর এখান থেকে উঠে গিয়ে ওখানে বসে!

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে কেদারের ছিপে দৈবক্রমে একটা বড় রুই মাছ টোপ গিলে ফাৎনা ডুবিয়ে একেবারে নিতলি হয়ে গেল৷ বহু ধস্তাধস্তি করে সুতো লম্বা করে ছেড়ে মাছটাকে অনেক খেলিয়ে কেদার সেটা ডাঙায় তুললেন৷

গণেশ ছুটে এসেছিল তাঁকে সাহায্য করতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণেশের সাহায্য তাঁর দরকার হল না৷ কেদার হাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাছটার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে, তিনি বললেন— তোল রে গণশা, ক’সের বলে মনে হয় দ্যাখ তো?

গণেশ কানকো ধরে মাছটাকে তুলে বার-দুই ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, তা তিনসের চোদ্দপোয়া হবে বাবাঠাকুর, আপনাদের বরাত—আমার ছিপে ঘাই মেরেই পুকুরের মাছ নিউদ্দিশ হয়ে গেল—

নিরুদ্দেশ হওয়ার তুলনাটি কেদারের ভালো লাগল না, হঠাৎ মনে পড়ে গেল তাঁর পুত্রের কথা৷ আজ দশ বৎসর…হাঁ, প্রায় দশ বৎসর যাবৎ সে-ও নিরুদ্দেশ৷…কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না, কে বলবে? সচ্ছল অবস্থার লোক যারা, তারা এ অবস্থায় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, কত খোঁজখবর করে৷ দরিদ্র কেদারের সে সব করবার সঙ্গতি কই? —নীরবে ও নিশ্চেষ্ট ভাবে সব সয়ে থাকতে হয়েছে৷

কি করবেন উপায় নেই৷

কেদার নিজের অলক্ষিতে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, নিয়ে চল রে গণেশ, পৌঁছে দে মাছটা বাড়িতে৷ একেবারে কেটে দিয়ে তুইও কিছু নিয়ে যা—চল৷

সন্ধ্যার অন্ধকার গড়ের পুকুরের বনে দিব্যি ঘনিয়েছে—হেমন্তের প্রথম, ছাতিম ফুলের উগ্র গন্ধে ভরা অন্ধকার বনপথ বেয়ে দুজনে বাড়ির দিকে ফিরলে৷

.

শরৎ বাবার সন্ধ্যা-আহ্নিকের জায়গা করে বসে ছিল, কিন্তু কেদার এখনও ফেরেন নি৷ বাইরের দোরের কাছে খুটখাট শব্দ শুনে শরৎ ডেকে বললে, কে? বাবা নাকি?

শব্দ বন্ধ হয়ে গেল৷ শরৎ চেঁচিয়ে বললে, দেখে আসি আবার কে, বাবার এখনও দেখা নেই—কোথায় গিয়ে বসে আছে তার ঠিক কি? হাড় ভাজাভাজা হয়ে গেল আমার—

দরজার কাছে কেউ কোথাও নেই৷ শরৎ মুখ বাড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির রোয়াকে এসে বসল৷

খানিকটা পরে আবার বাইরের দরজায় খুটখুট শব্দ৷ এবার যেন বেশ একটু জোরে জোরে৷ শরৎ এবার পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে বাইরের দরজার খিলটা খুলে ফেলল৷ বাইরে বেশ অন্ধকার, কিন্তু কোথায় কে?

শরতের ভয়-ভয় করতে লাগল৷ তবুও সে খুব সাহসী মেয়ে—এই জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়ির ধ্বংসস্তূপ চারিদিকে, কত কাণ্ড সেখানে ঘটে—একা শরৎ কত রাত্রি পর্যন্ত বাবার ভাত নিয়ে বসে থাকে৷ ভয় করলে চলে না তার৷ মাঝে মাঝে দু-একটা ঘটনাও ঘটে৷

ঘটনা অন্য বেশি কিছু নয়, খুটখাট শব্দ, একা রান্নাঘরে যখন শরৎ রাঁধছে—বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলা, তখন কে কোথায় ফিসফিস করে কি যেন বলে ওঠে—বেশ কি একটা কথা বললে সেটা বোঝা যায়, কিন্তু কথাটা কি, তা বোঝা যায় না৷

এ-সব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে শরতের৷

শরৎ বাপের বাড়িতেই আছে আজীবন, মধ্যে বিয়ের পর বছর-তিনেক শ্বশুরবাড়ি ছিল৷ শিবনিবাসে ওর শ্বশুরবাড়ি, রানাঘাটের কাছে৷ স্বামী মারা যাওয়ার পর আর সেখানে যায় নি, তার কারণ মায়ের মৃত্যুর পর পিতার সংসারে লোক নেই, কে এই বয়সে তাঁকে দুটি রেঁধে দেয়, কে একটু জল দেয়—এই ভাবনা শরতের সব চেয়ে বড় ভাবনা৷ শরতের শ্বশুরবাড়ির অবস্থা নিতান্ত খারাপ নয়, অন্তত এখানকার চেয়ে অনেক ভালো—কিন্তু দরিদ্র পিতাকে একা ফেলে রেখে সে সেখানে গিয়ে থাকতে পারে কি করে?

তার শ্বশুর বলে পাঠিয়েছিলেন, এখানে যদি না আস বৌমা, তা হলে ভবিষ্যতে তোমার প্রাপ্য অংশ সম্বন্ধে আমি দায়ী থাকব না৷

শরৎ তার উত্তরে বলে দেয়—আপনার সম্পত্তি আপনি যা খুশি করবেন, আমার কি বলার আছে সে সম্বন্ধে? বাবাকে ফেলে আমার স্বর্গে গিয়েও সুখ হবে না৷

আজ বছর দুই আগে মা মারা যান, এই দু-বছরের মধ্যে শ্বশুর সাতবার লোক পাঠিয়েছিলেন৷

শরৎ জানে, বাবার অবর্তমানে এ-গাঁয়ে তার চলা-চলতির মহা অসুবিধে৷ বাবা সামান্য কিছু খাজনা আদায় করেন, দু-তিন বিঘে ধান করেন,—কষ্টেসৃষ্টে একরকম চলে৷ কিন্তু সে একা থাকলে এ দুটি আয়ের পথও বন্ধ৷ গ্রামে লোক নেই, থাকলেও সবাই নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত, শরতের মুখের দিকে চেয়ে কেউ নিজের কাজের ক্ষতি করে শরতের কাজ করে দেবে—তেমন প্রকৃতির লোক এ গাঁয়ে নেই৷

সব জেনেশুনেও শরৎ এখানেই রয়ে গিয়েছে৷ তার অদৃষ্টে যা ঘটে ঘটুক৷

সন্ধ্যার পর দেড় ঘণ্টা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে৷

কেদারের সঙ্কোচমিশ্রিত কাশির আওয়াজ এই সময় বাইরের উঠানে পাওয়া গেল৷ শরৎ বললে, কে? বাবা?

—হ্যাঁ—ইয়ে—এই যে আমি—

শরৎ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল—হ্যাঁ, তুমি যে তা তো বেশ বুঝলাম৷ এত রাত পর্যন্ত এই জঙ্গলের মধ্যে একা মেয়েমানুষ বসে আছি, তা তোমার কি একটু কাণ্ডজ্ঞান নেই—জিজ্ঞেস করি?

কেদার কৈফিয়তের সুরে বলতে গেলেন, তাঁর নিজের কোনো দোষ নেই—তিনি এক ঘণ্টা আগেই আসতেন৷ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেণ্ট পঞ্চানন বিশ্বাস তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল একটা গুরুতর বিষয়ের পরামর্শের জন্যে—সেখানেই দেরি হয়ে গেল৷

শরৎ বললে—তোমার সঙ্গে কিসের পরামর্শ? ভারি পরামর্শদাতা তুমি কিনা? তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করলে তাদের কাজ আটকে গিয়েছে ভারি—

কেদার নীরবে হাত পা ধুয়ে ঘরে উঠলেন, মেয়ের সঙ্গে বেশি তর্কাতর্কি করে ঝগড়া বাধাতে তিনি এখন ইচ্ছুক নন—নির্বিরোধী লোক কেদার৷

মেয়ে আহ্নিকের জায়গা করে বসে আছে দেখে কেদার একটু বিপদে পড়লেন—সেদিকে চেয়ে বললেন—সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে এখন আবার—

—তোমার যত সব ছুতো—সন্ধ্যে উৎরে গেলে বুঝি আহ্নিক করে না? তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, পরকালের কাজটা এখন থেকে করো একটু—

কেদার অপ্রসন্ন মুখে আহ্নিক করতে বসলেন৷

বাইরে থেকে কে ডাকল—ও শরৎদি—আলো ধরো, উঠোনে যে জঙ্গল করে রেখেছ—

হাসতে হাসতে একটি ষোল-সতেরো বছরের শ্যামবর্ণ মেয়ে ঘরে ঢুকল৷ কেদারকে দেখে সঙ্কোচের সঙ্গে গলার সুর নীচু করে শরৎকেই বললে, জ্যাঠামশায় ফিরেছেন কখন? আমি ভাবলাম বুঝি একা—

—বাবার কথা আর বলিস নে ভাই—তিনটের সময় বেরিয়েছিলেন, আর এই এখন এসে আহ্নিক করতে বসলেন—

নবাগত মেয়েটি হাসিহাসি মুখে চুপ করে রইল৷

কেদার দায়সারাগোছের অবস্থায় সন্ধ্যাহ্নিক সাঙ্গ করে বললেন, আছে নাকি কিছু?

—হ্যাঁ, বোসো৷ বাতাবি লেবু খাবে? মিষ্টি লেবু, ফকিরচাঁদের মা দিয়ে গেল আজ ওবেলা৷ আর এই নারকোলের নাড়ু দুটোও দিয়ে গেল, জল খেয়ে নাও—

জলযোগান্তে কেদার একটু ইতস্তত করে বললেন, তা হলে রাজলক্ষ্মী তো আছিস মা, আমি ততক্ষণ একটুখানি—বরং—ওই হরি বাঁড়ুজ্জের ওখান থেকে—

—না, যেতে হবে না বাবা৷ বোসো৷ রাজলক্ষ্মী দুপুর রাত পর্যন্ত আমায় আগলে বসে থাকবার জন্যে এসেছে নাকি? ও এখুনি চলে যাবে—

—আমি যাব আর আসব মা—এই আধ ঘণ্টার মধ্যে—

—না, তোমার আধ ঘণ্টা আমি খুব ভালো জানি—যেতে হবে না, বোসো তুমি৷ তার চেয়ে বসে একটা গল্প করো—

রাজলক্ষ্মীও আবদারের সুরে বললে, হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, বলুন না একটা গল্প! আপনার মুখে কতকাল গল্প শুনি নি৷ সেই আগে আগে বলতেন—

অগত্যা কেদারকে বসতে হল৷ খাপছাড়া ভাবে একটা গল্পের খানিকটা বলে তিনি কেমন উসখুস করতে লাগলেন৷ মন ঠিক গল্পে নেই তাঁর, এটা বেশ বোঝা যায়৷ শরৎ বললে—কোথায় যাবে বাবা? বিশ্বেসকাকার ওখানে কি বড্ড বেশি দরকার তোমার?

কেদার উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, বিশেষ জরুরি, দুবার লোক পাঠিয়েছে—জমিজমা নিয়ে একটা গোলমাল বেধেছে, তাই আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চায় কিনা, তাই—

শরৎ মুখে কিছু বললে না৷ পঞ্চানন বিশ্বাস ঘুণ বিষয়ী ব্যক্তি, সে লোক তার বাবার মতো ঘোর অবৈষয়িক লোকের সঙ্গে পরামর্শ করবার আগ্রহে দু-দুবার লোক পাঠিয়েছিল, একথা বিশ্বাস করা শক্ত৷ তা নয়, আসলে বাবা বারুইপাড়ার কৃষ্ণযাত্রার দলের আখড়ায় গিয়ে এখন বেহালা বাজাবেন, এই তাঁর বৈষয়িক কাজ৷ যদি কেউ লোক পাঠিয়ে থাকে, সেখান থেকেই পাঠানো সম্ভব৷

রাজলক্ষ্মী বললে, দিদি, উনি যান তো একটু ঘুরে আসুন—

শরৎ বললে, হ্যাঁ, উনি গেলে রাত এগারোটার কম ফিরবেন না, আমি একা কি করে এখানে বসে থাকি বল তো? থাকবি তুই আমার সঙ্গে—বাবা না আসা পর্যন্ত? বলছিস তো খুব যেতে—কেদার বিব্রত ভাবে বলে উঠলেন, আরে না না, ওর থাকার দরকার হবে না, আমি যাব আর আসব, এই ধর গিয়ে ঘণ্টাখানেক, দেরি কিসের? যাই তা হলে—

শরৎ বললে, ন’টার মধ্যে যদি না ফিরে আস, তবে আমি কি রকম রাগ করি দেখো এখন আজ—রাজলক্ষ্মী এখন রইল, তুমি এলে তবে যাবে—

রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে বললে, বেশ ভালোই তো জ্যাঠামশাই, যান আপনি—আমি ততক্ষণ দিদির কাছে থাকি৷ আসবেন তো শীগগিরই—

কেদার আর দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে গেলেন৷ শরৎ ঠিক বুঝতে পারে নি, কৃষ্ণযাত্রার দলে বেহালা বাজাতে তিনি যাচ্ছিলেন না৷

কেদারের বাড়িটার ধারে ধারে অনেক দূর পর্যন্ত ভাঙা ও পুরনো বাড়ি, সবগুলো ভাঙা নয়, তবে পরিত্যক্ত এবং সাপখোপের বাস হয়ে আছে বর্তমানে৷ চার-পাঁচ রশি কি তা ছাড়িয়েও একটা পুরনো আমলের উঁচু সদর দেউড়ির ভগ্নাবশেষ আজও বর্তমান৷ এটা পার হয়ে দুধারে সেকালের আমলের নিচু লম্বা কুঠুরির সারি, কোনো কালে এর নাম ছিল কাছারিবাড়ি, এখনও সেই নাম চলে আসছে৷ এই অর্ধেকখানি এখন মাটির ভেতর বসে গিয়েছে, দেওয়াল সেকালে হয়তো চুনকাম করা ছিল, এখন শেওলা ছাতা ধরে সবুজ রং দাঁড়িয়েছে৷ কোনো একটা ঘরেও ছাদ নেই—মেঝেতে বনজঙ্গল, শালকাঠের বড় বড় কড়ি আর ভাঙা ইঁটের স্তূপের ওপর বড় গাছ—এমন কি দেউড়ির ঠিক পাশেই এক কাছারিবাড়ির একটা অংশে প্রকাণ্ড এক তিন-পুরুষের বটগাছ—যার বয়স কোনোক্রমেই একশ বছরের কম হবে না, বেশিও হতে পারে৷

কাছারিবাড়ি পার হয়ে আর একটা দেউড়ি—এর নাম নহবৎখানা—বর্তমানে কিছুই অবশিষ্ট নেই—দুটি মাত্র উঁচু থাম ও তাদের মাথায় একটা ফাটা খিলান ছাড়া৷ থামের এক-পাশে এক সারি সিঁড়ির খানিকটা ভেঙে পড়ে গিয়েছে—বিচুটি গাছের জঙ্গলে থাম আর সিঁড়ির ধাপগুলো ঢেকে রেখেছে৷ হঠাৎ কোনো নবাগত লোক এসব জায়গায় সন্ধ্যার পর এলে দস্তুরমতো ভয় হওয়ার কথা, কিন্তু কেদার নির্বিকার ভাবে এসব পার হয়ে গিয়ে বড় খালের মধ্যে নামলেন৷

এই খালটাকে এখানে গড়ের খাল বলে, কিন্তু এতে জল নেই, খানিকটা খুব নাবাল জমি মাত্র, পশ্চিম কোণের এক জায়গায়—সদর দেউড়ি থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে—এই খালের খানিকটায় জল আছে—কচুরি পানায় ভর্তি৷

পূর্বদিকের বাহু ধরে এলে গড়ের খালের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত বিরাট ধ্বংসস্তূপ সম্পূর্ণরূপে জঙ্গলাবৃত, দিনমানে বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে৷ এমন ঘন কাঁটা আর বেত বন, বন্যশূকরের ভয়ে সেদিকে বড় কেউ একটা যায় না৷

গড়ের এই দিকটায় বিস্তর বড় বড় ছাতিম গাছ—মানুষের হাতে পোঁতা গাছ নয়, বন্যবৃক্ষের বীজের বিস্তারে উৎপন্ন৷

যেখানে এখনও একটু জল আছে, সেখানকার উঁচু পাড়ে বসে দেখলে এই অংশের দৃশ্য মনে কেমন এক ধরনের ভয়-মিশ্রিত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে৷ কেদার অবিশ্যি এসবের দিকে নজর না দিয়েই খালের নাবাল জমি পেরিয়ে ওধারে গিয়ে উঠলেন এবং আরও খানিকটা হেঁটে ছিবাস মুদির দোকানে উপস্থিত হলেন৷

ছিবাস মুদির চালাঘরে ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে, কারণ এমন গাঁয়ে এই রাতে খরিদ্দার কেউ আসবে না—কিন্তু ঘরের ভেতরে চার-পাঁচজন লোক বসে৷ ছিবাস বললে, আসুন বাবাঠাকুর, আপনার জন্য সব বসে—বলি বলে গেলেন আসচেন, তা দেরি হচ্চে কেন—আসুন বসুন—

এখানে এখন গান-বাজনা হবে—শরৎসুন্দরী ঠিকই আন্দাজ করেছিল, তবে বারুইপাড়ার কৃষ্ণযাত্রার দলে নয়, এই যা তফাৎ৷ সবাই সরে বসে কেদারকে বসবার জায়গা করে দিলে৷ কেদার মহানন্দে বেহালা ধরলেন, তাঁর বেহালা বাজানোর নাম আছে এ গ্রামে৷ অনেকক্ষণ ধরে গান-বাজনা চলল, আরও দু-তিনজন লোক এসে গান-বাজনায় যোগ দিলে—তবে গ্রামের ভদ্রলোক কেউ আসে নি৷

কেদার বেহালায় কসরৎ দেখালেন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে, তার পর আবার গান শুরু হল৷ রাত আন্দাজ এগারটার সময় কি তারও বেশি যখন, গানের আড্ডা তখন ভাঙল৷

একজন বললে, বাবাঠাকুর, আলো এনেছেন কি, না হয় চলুন আলো ধরে দিয়ে আসি খাল পার করে—

কেদারের হুঁশ হল এতক্ষণ পরে, বাইরে এসে বললেন, তাই তো, চাঁদ অস্ত গেল কখন? বড্ড অন্ধকার দেখছি যে—

পঞ্চমীর চাঁদের অবিশ্যি যতক্ষণ থাকা সাধ্য ততক্ষণ সে বেচারি আকাশে ছিল, তার কোনো কসুর নেই৷ কেদার রাজার জন্যে দুপুররাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা তার সাধ্যাতীত৷

দাসু কুমোর বললে—আমার সঙ্গে যদি কেউ আসে আমি বাবাঠাকুরকে খাল পার করে দিয়ে আসি—

দু-তিনজন যেতে রাজি হল—একা রাত্রে কেউ ওদিকে যেতে রাজি হয় না, গড়ের মধ্যে আছে অনেক রকম গোলমাল৷ এ অঞ্চলে সবাই তা জানে৷ কেদার কিন্তু নির্ভীক লোক, তিনি কোনো লোক সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজি নন—দরকার নেই কিছু, তিনি এমনিই বেশ যাবেন৷

তবুও জনচারেক লোক পাঁকাটির মশাল জ্বালিয়ে তাঁকে গড়ের খাল পার করে দিয়ে এল৷ এত রাত হয়েছে কেদার সেটা পূর্বে বুঝতে পারেন নি, তা হলে এত দেরি করতেন না, ছিঃ কাজ বড় খারাপ হয়ে গিয়েছে৷

কেদার বাড়ি ঢুকে দেখলেন মেয়ে খিল বন্ধ করে ঘরের মধ্যে শুয়ে৷ মেয়েকে একা এত রাত পর্যন্ত এই বনে ঘেরা নির্জন বাড়িতে ফেলে বাইরে ছিলেন বলে মনে মনে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন, তবে কিনা এ অনুতাপ তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ আর মজা এই যে, প্রতিরাত্রে ফিরবার সময়েই এই অনুতাপ মনের মধ্যে হঠাৎ আবির্ভূত হয়, এর আসা আর যাওয়া দুই-ই অদ্ভুত ধরনের আকস্মিক, ন্যায়শাস্ত্রের ‘বেগবেগা’ জাতীয় পদার্থ, আসবার সময় যত বেগে আসে, ঠিক তত বেগেই নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়—মনে এতটুকু চিহ্নও রেখে যায় না৷

শরৎ উঠে বাবাকে দোর খুলে দিলে, ভাত বেড়ে খেতে দিলে৷ তার মনে রাগ অভিমান কিছুই নেই—সে জানে এতে কোনো ফলও নেই—বাবা যা করবেন তা ঠিকই করবেন৷ ওঁর ঘাড়ে ভূত আছে, সে-ই ওঁকে চরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, উনি কি করবেন?

কিন্তু কেদারের ঘাড়ে সত্যিই ভূত চেপে আছে বটে৷ খাওয়াদাওয়ার পরে অত গভীর রাত্রেও বাবাকে বেহালার লাল খেরোর খোল খুলতে দেখে সে আর কথা না বলে থাকতে পারলে না৷ বাবা এখন আবার বেহালা বাজাতে বসলেই হয়েছে!

কেদার ব্যাপারটাকে সহজ করবার চেষ্টা করলেন৷ বেহালা যে তিনি ঠিক বাজাতে চাইছেন এখন তা নয়, তবে একটা সুর মাথার মধ্যে বড় ঘুরছে—সেইটে একবারটি সামান্য একটু ভেঁজে নিতে চান৷

শরৎ বললে, না বাবা, তোমার ঘুম না আসতে পারে, তোমার খিদে নেই, তেষ্টা নেই, শরীরের ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই—সব জয় করে বসে না হয় আছ, কিন্তু আমি এই সারাদিন খাটছি, তুমি এখন রাতদুপুরে বেহালা নিয়ে কোঁকর কোঁকর জুড়ে দিলে কানের কাছে আমার চোখে ঘুম আসবে?

কেদার বললেন, আমি—তা—না হয় দেউড়িতে গিয়ে বসি মা—তুই ঘুমো—

—না, তা হবে না৷ আমি মাথা কুটে মরব, এই এত রাত্রে অন্ধকারে সাপখোপের মধ্যে তুমি এখন জঙ্গলের মধ্যে দেউড়িতে বসে বেহালা বাজাবে? রাখ ওসব—

কেদার অগত্যা বেহালা রেখে দিলেন৷ মেয়েমানুষদের নিয়ে মহা মুশকিল৷ এরা না বোঝে সঙ্গীতের কদর, না বোঝে কিছু৷ তাঁর মাথায় সত্যিই একটা চমৎকার সুর খেলছিল, এই নিস্তব্ধ নির্জন দুপুর রাত্রি, সুরটা বেহাগ—রক্তমাংসের শরীরে এ সময় তারের ওপর ছড় চালানোর প্রবল লোভ সামলানো যায়?

মেয়েমানুষ কি বুঝবে?

.

কেদার বিকেলবেলা গেঁয়োখালির হাটে যাবার পথে সাধু সেকরার দোকানে একবারটি ঢুকলেন, উদ্দেশ্য তামাক খাওয়াও বটে, অন্য একটি উদ্দেশ্যও ছিল না যে এমন নয়৷ সাধু সেকরার বয়েস হয়েছে, নিজে সে একটি হরিনামের ঝুলি নিয়ে একটা জলচৌকিতে বসে মালাজপ করে, তার বড় ছেলে নন্দ দোকান চালায়৷ ব্রাহ্মণসজ্জনে সাধুর বড় ভক্তি—কেদারকে দেখে সে হাত জোড় করে বললে—আসুন ঠাকুরমশায়, প্রণাম হই—ওরে টুলটা বার করে দে—ব্রাহ্মণের হুঁকোতে জল ফেরা—

কেদার বললেন—তার পর, ভালো আছ সাধু? তোমার কাছে এসেছিলাম একটা কাজে—আমার কিছু টাকার দরকার—তোমার এ বছরের খাজনাটা এই সময়—

সাধুর অবস্থা ভালোই, কিন্তু মুখে মিষ্ট হলেও পয়সাকড়ি সম্বন্ধে সে বেজায় হুঁশিয়ার৷ কেদারকে যা হয় কিছু বুঝিয়ে দেওয়া কঠিন নয় তা সে বিলক্ষণ জানে—সে বিনীত ভাবে হাত জোড় করে বললে, বড্ড কষ্ট যাচ্ছে ঠাকুরমশায়, ব্যবসার অবস্থা যে কি যাচ্ছে, সোনার দর এই উঠচে এই নামচে, সোনার দর না জোয়ারের জল! আর চলে না ঠাকুরমশাই—এই সময়টা একটু রয়ে বসে নিতে হচ্ছে—আপনি রাজা লোক, আপনার খেয়েই মানুষ—

কেদার চক্ষুলজ্জায় পড়ে আর খাজনা চাইতে পারলেন না৷ হাটে ঢুকে আরও দু-একজনের কাছে প্রাপ্য খাজনা চাইলেন—সকলেই তাদের দুঃখের এমন বিস্তারিত ফর্দ দাখিল করলে যে কেদার তাদের কাছেও জোর করে কিছু বলতেই পারলেন না৷

হাটের জিনিসপত্রও সুতরাং বেশি কিছু কেনা হল না—হাতে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই৷

সতীশ কলুর দোকানে ধারে তেল নিয়েছিলেন ওমাসে—এখনও একটি পয়সা শোধ দিতে পারেন নি, অথচ সর্ষের তেল না নিয়ে গেলে রান্না হবার উপায় নেই, মেয়ে বলে দিয়েছে৷

সতীশ বললে, আসুন দাদাঠাকুর, তেল দেব নাকি?

সতীশের দোকানে কোণের দিকে যে ঘাপটি মেরে বৃদ্ধ জগন্নাথ চাটুজ্জে বসেছিলেন, তা প্রথমটা কেদার দেখতে পান নি, এখন মুশকিল বাধল—অথচ না বললেও নয়! জগন্নাথ উঠলে না হয় বলবেন এখন৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে হেঁকে বললেন, ওহে কেদার রাজা, এস এস, এদিকে এস ভায়া—তামাক খাও—

কেদার বললেন, জগন্নাথ দাদা যে! ভালো সব?

—ভালো আর কই, আবার শুনেছ তো ওপাড়ার নীলমণি গোসাঁইয়ের বাড়ির ব্যাপার? শোন নি? তা শুনবে আর কোথা থেকে—শুধু মাছ ধরা নিয়ে আছ বই তো নয়— সরে এস ইদিকে বলি—ঘোর কলি হে ভায়া ঘোর কলি, জাতপাত আর রইল না গাঁয়ের বামুনের—

জগন্নাথ চাটুজ্জের কথা শোনবার কোনো আগ্রহ ছিল না কেদারের—পরের বাড়ির কুৎসা ছাড়া তিনি থাকেন না৷ কিন্তু এঁকে এখান থেকে সরাবার উপায় না দেখলে তো তেল নেওয়া হয় না৷ কেদার অগত্যা জগন্নাথের কাছে গেলেন৷ জগন্নাথ গলার সুর নিচু করে বললেন, কাল রাত্তিরে নীলু গোসাঁইয়ের মেয়েটা আফিম খেয়েছিল, জানো না?

কথাটা প্রথম থেকেই কেদারের ভালো লাগল না৷ তবুও তিনি বললেন, আফিম? কেন?

জগন্নাথ চোখ মুখ ঘুরিয়ে হাসি-হাসি মুখে বললেন, আরে, এর আবার কেন কি কেদার রাজা! বিধবা মেয়ে, সোমত্ত মেয়ে, বাপেরবাড়ি পড়ে থাকে—কোনো ঘটনা-টটনা ঘটে থাকবে! কথায় বলে—

কেদারের নিজের বাড়িতেও ওই বয়সের বিধবা মেয়ে, গল্প শুনবেন কি, জগন্নাথ চাটুজ্জের কথার গূঢ় ইঙ্গিত, শ্লেষ ও ব্যঞ্জনা শুনে কেদার ভেতরে ভেতরে ভয়ে ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করলেন৷ তেল কিনতে এসে এমন বিপদে পড়বেন জানলে তিনি না হয় আজ তৈলবিহীন রান্নাই খেতেন!

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললেন, আমি শুনলাম কি করে বলি শোনো তবে৷ কাল আমি ক্ষেত্র ডাক্তারের বাড়িতে ডাক্তারের স্ত্রীর ব্রত উদযাপনে নেমন্তন্ন খেতে যাই, তাদের পরিবেশনের লোক হয় না, আমি আমার খাওয়ার পরে নিজে পরিবেশন করতে লাগলুম৷ রাত প্রায় বারোটা হয়ে গেল৷ তখন ক্ষেত্র ডাক্তার বললে, এখানেই আমার বাইরের ঘরে বিছানা পেতে দিক, এখানেই শুয়ে থাকুন—এত রাত্তিরে আর বাড়ি যায় না—

শুয়ে আছি, রাত প্রায় তিনটের সময় নীলু গোসাঁইয়ের বড় ছেলে ধীরেন এসে ডাক্তারকে ডাকলে৷ আমি জেগে আছি, সব শুনছি শুয়ে শুয়ে৷ ধীরেন কাঁদকাঁদ হয়ে বললে, শীগগির যেতে হবে ক্ষেত্রবাবু, মীনা আফিম খেয়েছে—

ডাক্তার বললে, কতক্ষণ খেয়েছে?

ধীরেন বললে, কখন যে খেয়েছিল তা তো জানা যায় না৷ নিজের ঘরে খিল দিয়ে শুয়েছিল, এখন গোঙানি ও কাতরানির শব্দ শুনে সবাই গিয়ে দেখে, এই ব্যাপার৷

সেই রাত্রে ক্ষেত্র ডাক্তার ছুটে যায়৷ কত করে তখন বাঁচায়৷ তা ওরা ভাবে যে কাক-পক্ষীতে বুঝি টের পেলে না, কিন্তু আমি যে ক্ষেত্র ডাক্তারের বাইরের ঘরে শুয়ে তা তো কেউ জানে না৷ সোমত্ত বিধবা মেয়ে মীনা, কি জানি ভেতরের ব্যাপারটা কি—কাল পড়েছে খারাপ কিনা—বলে আগুন আর ঘি—আরে উঠলে যে, বোসো!

বারে বারে বিধবা মেয়ের উল্লেখ কেদারের ভালো লাগছিল না—তা ছাড়া জগন্নাথ চাটুজ্জে কি ভেবে কি কথা বলছে তা কেউ বলতে পারে না৷ লোক সুবিধের নয় আদৌ৷ সর্ষের তেলের মায়া ছেড়ে দিয়েই কেদার উঠে পড়লেন, জগন্নাথ চাটুজ্জের সামনে তিনি ধারের কথা বলতে পারবেন না সতীশকে৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললেন, তা হ’লে নিতান্তই উঠলে কেদার রাজা, বাড়ি থাকো কখন হে—একবার তোমাদের বাড়িতে যাব যে—ভাবি যাব, কিন্তু গড়ের খাল পার হতে ভয় হয়, আর যে বনজঙ্গল গড়ের দিকটাতে! তা ছাড়া আবার সেই তিনি আছেন—

জগন্নাথ চাটুজ্জে হাত জোড় করে কার উদ্দেশে দু-তিনবার প্রণাম করলেন৷

কেদার বলে উঠলেন, আরে ও কখনো কেউ দেখে নি, এই তো শরৎ রোজ সন্ধের সময় উত্তর দেউলে পিদ্দিম দিতে যায়—একাই তো যায়—কিছু তো কখনো কই—

ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে ফেলেই কেদার বুঝলেন কথাটা বলা তাঁর উচিত হয় নি৷ জগন্নাথ চাটুজ্জের পেটে কোনো কথা থাকে না—এর কথা ওর কাছে বলে বেড়ানোই তাঁর স্বভাব—এ অবস্থায় মেয়ের কথা তোলাই এখানে ভুল হয়েছে—

কিন্তু জগন্নাথ অন্য দিক দিয়ে গেলেন পাশ কাটিয়ে৷ বললেন, তুমি বলছ কেদার রাজা কিছু নেই, আমরা বাপ-দাদাদের মুখ থেকে শুনে আসছি চিরকাল—নেই বলে উড়িয়ে দিলেই—অবিশ্যি তোমার মেয়ে ওই নিবান্দা পুরীর মধ্যে একা থাকে, সাহস বলিহারি যাই—আমাদের বাড়ির এরা এলে দিনমানেই থাকতে পারত না—

এদের কথাবার্তার এই অংশটা সতীশ কলুর কানে গিয়েছিল, সে খদ্দেরকে তেল মেপে দিতে দিতে বললে, এখন অবেলায় ও কথাডা বন্ধ করুন বাবাঠাকুর, দরকার কি ওসব কথায়? চেরকাল শুনে আসছি, বাপ-পিতেমো পজ্জন্ত বলে গিয়েছে—গড়ের বাড়িই পড়ে আছে কতকাল অমনি হয়ে তার ঠিক-ঠিকানা নেই—আমার বয়েস এই তিন কুড়ি চার যাচ্ছে, আমি তো ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি ঠিক অমনি ধারা—কেদার দাদাঠাকুরের বয়েস আমার চেয়ে কত কম—আমি ওনাকে একটুখানি দেখেছি—

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললেন, আরে তোমার তো মোটে চৌষট্টি সতীশ, আমার ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন আমার ছেলেবেলায়, তিনি বলতেন তাঁর ছেলেবেলায় তিনিও গড়বাড়ি অমনিধারা জঙ্গল আর ইটের ঢিবি দেখে আসছেন, তাঁর মুখেও আমি উত্তর দেউলের ওকথা শুনেছি—কেদার রাজা কি জানে? ও কত ছোট আমাদের চেয়ে!

কেদার বলে উঠলেন, ছোট বড় নই দাদা, এই তিপ্পান্ন যাচ্ছে—

জগন্নাথ বললেন,—আর আমার এই খাঁটি ষাট কি একষাট্টি—তা হলে হিসেব করে দেখো কতদিন হল, আমার যখন পনেরো তখন ঠাকুরদা মারা যান, তখন তাঁর বয়েস নব্বুইয়ের কাছাকাছি—এখন হিসেব করে দেখ ঠাকুরদাদার ছেলেবেলা, সে কত দিনের কথা—কত দিনের হিসেব পেলে দেখো—

কেদার তেলের আশা ত্যাগ করে উঠে পড়লেন—কোনো উপায় নেই, কারো সামনে তিনি ধারের কথা বলতে পারবেন না—বিশেষ করে জগন্নাথ চাটুজ্জের সামনে৷

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়েছে৷ গেঁয়োখালির হাট থেকে ফিরবার পথে গড়ের সদর দেউড়ির দিকে গেলে ঘুর হয় বলে পূর্বদিক দিয়েই ঢুকলেন কেদার—যে দিকটাতে খালে এখনও জল আছে৷ এদিকটাতেই বড় বড় ছাতিম গাছ আর ঘন বন৷ এক জায়গায় মাত্র হাঁটুজল খালে, কার্তিক মাসে কচুরিপানার নীলাভ ফুল ফুটে সমস্ত খালটা ছেয়ে ফেলেছে—এতটুকু ফাঁক নেই কোথাও—অন্ধকার সন্ধ্যাতেও শোভা যেন আরো খুলেছে৷

খাল পেরিয়ে উঠে গড়ের মধ্যে ঢুকেই ছাতিম বনের ওপারে ডান দিকে এক জায়গায় ধ্বংসস্তূপের থেকে একটু দূরে গোলাকৃতি গম্বুজের মতো ছাদওয়ালা ছোটগোছের মন্দির—এরই নাম এ গাঁয়ে উত্তর দেউল৷ কেন এ নাম তা কেউ জানে না, সবাই শুনে আসছে চিরকাল, তাই বলে৷

উত্তর দেউলের পাশ দিয়ে ছোট্ট পায়ে-চলার পথ বাদুড়নখী কাঁটার ঝোপের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে৷ ছাতিম ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশেছে বাঁদুড়নখী ও জংলী বনমরচে ফুলের ঘন সুবাস৷ বন বাঁ-ধারে বেশ ঘন আর অন্ধকার৷ গড়ের এখানকার দৃশ্যটি সত্যিই ভারি সুন্দর৷

কেদার একবার গম্বুজাকৃতি মন্দিরটার দিকে চাইলেন৷ আজ কেন যেন তাঁর গা ছমছম করতে লাগল৷ অন্ধকার ঘরটার মধ্যে সামান্য মৃদু প্রদীপের আলো—শরৎ এই সন্ধ্যার সময় প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যাদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে—এটা কেদার রাজার বংশের নিয়ম, আজন্ম দেখে আসছেন তিনি, উত্তর দেউলে বাতি দিয়ে এসেছেন চিরকাল কেদারের মা, ঠাকুরমা এবং সম্ভবত প্রপিতামহী৷ কেদারের আমলেও দেওয়া হয়৷

০২. খাজনা আদায় করতে

শরৎ বাবাকে বললে, তুমি আজও তো কোথাও খাজনা আদায় করতে বেরুলে না—কি করে কি হবে আমি জানি নে৷ ঘরে কাল থেকে চাল বাড়ন্ত, কোনো কাজের কথা বললে, সে তোমার কানে যায় না, আমি বলে-বলে হার মেনে গিয়েছি—

কেদার বললেন, তা যাব তো ভাবছি৷ তুই না বললেও কি আর আমি বাড়ি বসে থাকতাম? একটু বেলা হোক—

শরৎ গৃহকর্মে মন দিলে৷ কেদার মোটা চাদরখানা গায়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে বেরুবার উদ্যোগ করতেই শরৎ বললে, না খেয়ে বেরিও না বাবা—আহ্নিক করে একটু জল মুখে দিয়ে যাও—

কিছু খেতে অবিশ্যি কেদারের অনিচ্ছা ছিল না, কিন্তু তৎপূর্বে যে আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানটির কথা শরৎ উল্লেখ করলে, তাঁর যত আপত্তি সেখানে৷ এত সকালে তিনি আর ও হাঙ্গামার মধ্যে যেতে রাজি নন৷ সুতরাং তিনি বললেন, আমি এখন আর খাব না, এসে বরং—সবাই বেরিয়ে যাবে কিনা এর পরে—

তাঁদের গ্রামের পাশে রাজীবপুর চাষাদের গাঁ৷ এখানে কেদারের তিন-চারটি প্রজা আছে৷ আজ কয়েক মাস যাবৎ কেদার তাদের কাছে খাজনার তাগাদা করে আসছেন, কিন্তু জোর করে কাউকে কিছু বলতে পারেন না বলে একটি পয়সাও আদায় হয়নি৷

প্রথমেই কেদার গেলেন একঘর মুসলমান প্রজার বাড়ি৷ আরও দিন পনেরো পরে মাঠ থেকে ধান আসবে৷ মুরগি চরছে ধানের মরাইয়ের তলায়৷

বছর দুই আগে এই বাড়ির মালিকের মৃত্যু হয়েছিল৷ ছেলে আর ছেলের বৌ ছিল—গত চৈত্র মাসে ছেলেটির সর্পাঘাতে মৃত্যু ঘটে—এখন শুধু আছে বিধবা পুত্রবধূ আর একটি মাত্র শিশু পৌত্র৷ সামান্য জমার জমির ধান আর রবিশস্য থেকে কোনো রকমে সংসার চলে এদের৷

কেদার উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হেঁকে বললেন, বলি ও আবদুলের মা, কোথায় গেলে? বাড়িতে কেউ ছিল না সম্ভবত৷ দু-একবার ডেকে কারো সাড়া না পেয়ে কেদার ধানের মরাইয়ের ছায়ায় একখানা কাঠ পেতে বসে পড়লেন৷ একটু পরে একটি অল্পবয়সী বৌ কলসিকক্ষে উঠোনে পা দিতেই কেদারকে দেখে জিব কেটে একহাতে ঘোমটা টেনে ক্ষিপ্রপদে উঠোন পার হয়ে ঘরে উঠল৷

একটু পরে বৌটি একখানা পিঁড়ি নিয়ে এসে কেদারের বসবার জায়গা থেকে হাত দশেক দূরে মাটির ওপর রেখে চলে গেল৷ কেদার সেখানা টেনে এনে তাতে বসলেন৷

মেয়েটি আরও প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ঘোমটা দিয়ে ঘরের বার হয়ে ছাঁচতলায় নেমে দাঁড়াল৷ কোনো কথা বললে না৷

কেদার বললেন, আর বছরের দরুণ এক টাকা পাঁচ আনা আর এ বছরের সমস্ত খাজনা— মোট সাড়ে চার টাকা তোমার কাছে বাকি, টাকাটা আজ দিয়ে দাও—বুঝলে?

মেয়েটি নম্রসুরে বললে, বাপজী—

কেদার চমকে উঠলেন৷ কখনো বৌটি তাঁর সঙ্গে কথা বলে নি—তা ছাড়া ওর মুখের ডাকটি তাঁর বড় ভালো লাগল৷ শরতের চেয়েও বৌটির বয়স কম৷

কেদার বললেন—কি?

—টাকা তো যোগাড় করতে পারি নি আজও, কলাই বিক্রি না করে টাকা দিতে পারব না৷

কেদার দ্বিরুক্তি না করে সেখান থেকে উঠলেন৷ ওর মুখের ‘বাপজী’ ডাকের পর আর কখনো তাকে কড়া তাগাদা করা চলে?

আর এক বাড়ি গিয়ে দেখলেন, তাদের বাড়িসুদ্ধ সব ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়ে৷ শুধু রোগের সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সেখান থেকে তিনি বিদায় নিলেন৷

পথে বেলা বেশি হয়েছে৷ এক দিনের পক্ষে যথেষ্ট বিষয়কর্ম করা হল—বেশি খাটতে তিনি রাজি নন—বাড়ির দিকে ফিরবার জন্যে সড়কে উঠেছেন, এমন সময় একজন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হল৷

বৃদ্ধ লোকটির পরনে আধময়লা থান, গায়ে চাদর, হাতে একটা বড় ক্যাম্বিসের ব্যাগ৷ তাঁকে দেখে লোকটি জিজ্ঞেস করলে, হ্যাঁ মশাই গড়শিবপুর যাব কি এই পথে?

—গড়শিবপুরে কোথায় যাবেন?

—ওখানকার রাজবাড়ির অতিথিশালা আছে—শুনলাম, সকলে বললে৷ অনেক দূর থেকে আসছি, অতিথিশালায় গিয়ে আজ আর কাল থাকব৷

—গড়শিবপুরের রাজবাড়ি? কে বলে দিয়েছে? আচ্ছা চলুন নিয়ে যাই, আমার সঙ্গে চলুন— কেদারের বাড়ির অতিথিশালা পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই আছে—সেই নামডাকেই এখনও গ্রামে অপরিচিত বিদেশী লোক এলে কেদারের বাড়ি অতিথি হতে আসে৷ নিজে খেতে না পেলেও পূর্ব-আভিজাত্যের গৌরব স্মরণ করে কেদার তাদের থাকবার খাবার বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসছেন বরাবর৷ কখনও তাদের ফিরিয়ে দেন নি এ-পর্যন্ত৷ থাকবার জায়গার অসুবিধা বলে কেদার কাছারিবাড়ির উঠানে অতিথির জন্যে একখানা ছোট্ট দো-চালা খড়ের ঘর তৈরি করে দিয়েছেন অনেক দিন থেকে৷ খড় পুরনো হয়ে জল পড়তে শুরু করলে কেদার নিজেই চালে উঠে নতুন খড়ের খুঁচি দেন৷ এই ঘরখানার নামই অতিথিশালা৷ কেদারকে বিপন্ন হয়ে পড়তে হয় যখন হঠাৎ অতিথি এসে জোটে অতিথিশালায়, হয়তো নিজের ঘরেই সেদিন চাল বাড়ন্ত—কিন্তু অতিথিকে যোগান দিতেই হবে৷ অনেক সময় গ্রামের লোক দুষ্টুমি করে কেদারের অতিথিশালায় অতিথি পাঠিয়ে দেয়, সকলেই জানে কেদারের অবস্থা—মজা দেখবার লোভ সামলানো যায় না সব সময়৷

সাধারণ অতিথিকে দিতে হয় এক বোঝা কাঠ ও এক সের চাল, সামান্য কিছু নুন আর তেল৷ তরকারি হিসাবে দু-একটা বেগুন৷ এর বেশি কিছু দেবার নিয়ম নেই পূর্বকাল থেকেই—কেদারও তাই দিয়ে আসছেন৷

তবে ভদ্র-অতিথি এলে অন্যরকম ব্যবস্থা৷ নিয়ম আছে দুধ, ঘি, সৈন্ধব লবণ, মিছরিভোগ, আতপ চাল, মুগের ডাল ইত্যাদি তাকে যোগাতে হবে৷ কেদারের বর্তমান অবস্থায় সে-সব কোথায় পাওয়া যাবে—কাজেই নিজের ঘরে রেঁধে তাদের খাওয়াতে হয়—যতই অসুবিধা হোক, উপায় নেই৷ মাসের ভিতর পাঁচদিন শরৎকে অতিথিসেবা করতেই হয়৷ আজ কেদার একটু অসুবিধায় পড়লেন৷

ঘরে এমন কিছু নেই যা অতিথিশালায় পাঠাতে পারেন৷ লোকটি কি শ্রেণীর তা এখনও তিনি বুঝতে পারেন না, সাধারণ শ্রেণীর বলেই মনে হচ্ছে৷ অন্তত আধসের চালও তো দিতে হয়, কি করা যাবে সে-সম্বন্ধে পথ হাঁটতে হাঁটতে কেদার সেই কথাই ভাবতে লাগলেন৷

বৃদ্ধ বললে, কতদূর মশাই গড়শিবপুর?

—এই বেশি নয়, ক্রোশখানেক হবে৷ আপনাদের বাড়ি কোথায়?

—বাড়ি অনেকদূর, মেহেরপুরের কাছে, নদে জেলায়৷

—কোথায় যাবেন?

—দেশ বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি৷ যেদিকে যখন ইচ্ছে, তখন সেদিকেই যাব—

—আপনারা?

—ব্রাহ্মণ, কাশ্যপ গোত্র, অভিনন্দ ঠাকুরের সন্তান, খড়দ মেল—আমার নাম শ্রীগোপেশ্বর চট্টোপাধ্যায়৷

কেদারের বয়স হয়েছে, সুতরাং তিনি জানেন ব্রাহ্মণদের পরিচয় দেবার এই প্রথাই ছিল আগের কালে৷ তাঁর ছেলেবেলায় তিনি দেখে এসেছেন বটে৷ এমন লোককে অতিথিশালায় পাঠিয়ে দেওয়া যায় না, নিজের ঘরে রেঁধে খাওয়াতে হয়৷

গ্রামের মধ্যে ঢুকে ব্রাহ্মণ বললে, রাজবাড়ি দেখিয়ে দিয়ে আপনি চলে যান, আমার সঙ্গে অনেকদূর তো এলেন—আর কষ্ট করতে হবে না আপনার—

—চলুন, আমিও সেই বাড়ি যাব, সেই বাড়ির লোক—

—আপনি রাজবাড়ির লোক বুঝি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ—আমি—ইয়ে—

গড়ের খাল পেরিয়ে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বিস্ময়ের চোখে দু-ধারের জঙ্গলে ভরা ধ্বংসস্তূপগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে বললে—রাজবাড়ি কতদূর?

কেদার কৌতুকের সঙ্গে বললেন, দেখতেই পাবেন, চলুন না—

দেউড়ির ধ্বংসস্তূপ পার হয়ে নিজের চালাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কেদার বললেন, এই রাজবাড়ি—আসুন—

বৃদ্ধ কেদারের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইলে৷

কেদার হাসিমুখে বললেন, আমিই রাজবাড়ির রাজা—আমারই নাম কেদার রাজা—

ইতিমধ্যে শরৎ বার হয়ে বাবাকে কি বলতে এল, সকালে উঠে সে স্নান সেরে নিয়েছে, ভিজে চুলের রাশি পিঠময় ছড়ানো, গায়ের রঙের সুগৌর দীপ্তি রোদে দশগুণ বেড়েছে, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে এই সুন্দরী মেয়েটির দিকে চেয়ে রইল৷

কেদার বললেন, আমার মেয়ে, ওর নাম শরৎসুন্দরী৷ প্রণাম করো মা, ব্রাহ্মণ অতিথি—

শরৎসুন্দরী বাবাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলে, তার পর, নিয়ে তো এলে, এখন উপায়? ঘরে তো এক দানা চাল নেই৷ বেলাও হয়েছে, কি করি বলো?

কেদার বললেন, যা হয় করো মা তুমি৷ আমি কিছু জানি নে—ওবেলা বরং—

শরৎসুন্দরী রাগ করে নিজের গালে চড় মারতে লাগল৷ ফর্সা গাল রাঙা হয়ে গেল৷ মেয়ে এরকম প্রায়ই করে থাকে বেশি রাগ হলে—কেদার অপ্রতিভ মুখে বললেন, ও কি করো মা ছেলেমানুষি! না—ছি—অমন করতে নেই৷

শরৎ জলভরা চোখে রাগের ও ক্ষোভের সুরে বললে, আমার ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দিয়ে কি মাথায় ইট ভেঙে মরি, আমার এ যন্ত্রণা আর সহ্যি হয় না বাবা৷ বেলা দুপুরের সময় তুমি এখন নিয়ে এলে ভদ্রলোক অতিথি, নিজেদের নেই খাবার যোগাড়—কি করব—বলো বুঝিয়ে আমায়৷ নিত্যি তোমার এই কাণ্ড—কত বার না তোমায় বলেছি—

কেদার চুপ করে রইলেন, বোবার শক্র নেই৷ শরৎ তাঁর সামনে থেকে চলে গেলে তিনি অতিথির সঙ্গে এসে বসে গল্প করতে লাগলেন, কারণ শরৎ যে একটা যা হয় কিছু ব্যবস্থা করে ফেলবেই এ বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না৷ শরৎ রাগী তেজি মেয়ে বটে, কিন্তু সব কাজে ওর ওপর বড় নির্ভর করা চলে অনায়াসে৷ খুব স্থিরবুদ্ধি মেয়ে৷

.

শরৎ কোথা থেকে কি করলে তিনি জানেন না, আহারের সময় অতিথির সঙ্গে খেতে বসে দেখলেন, ব্যবস্থা নিতান্ত মন্দ হয় নি৷ এত বেলায় মাছও যোগাড় করে ফেলেছে মেয়ে৷

আহারাদির পর কেদার বললেন, আচ্ছা গোপেশ্বরবাবু, চলুন একটু বিশ্রাম করবেন—

তারপর তিনি অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে অতিথিশালার দো-চালা ঘরখানাতে এলেন৷ এখানে একখানা কাঁঠাল কাঠের সেকেলে ভারি তক্তপোশ পাতা আছে অতিথির জন্যে৷ পাতার জন্যে একখানা পুরনো মাদুর ছাড়া অন্য কিছু নেই চৌকিখানার ওপর—দেবার সঙ্গতিও নেই তাঁর৷

বৃদ্ধ বললেন, বসুন আপনিও৷ একটু গল্পগুজব করি আপনার সঙ্গে৷

—আপনার গান-বাজনা আসে?

—সামান্য এক-আধটু৷ সে কিছুই নয়—

কেদার উৎসাহে উঠে পড়লেন চৌকি ছেড়ে৷ গানবাজনা জানে এ ধরণের লোকের সঙ্গ তাঁর অত্যন্ত প্রিয়৷ এরকম লোকের সঙ্গে দেখা হওয়া ভাগ্যের কথা৷

বললেন, কি বাজনা আসে আপনার?

—কিছু না, তবলা বাজাতে পারি এক-আধটু—

—তা হলে আজ ওবেলা আপনাকে যেতে দেব না গোপেশ্বরবাবু—আমাদের আড্ডায় আজ সন্ধ্যাবেলা আপনাকে নিয়ে একটু আমোদ করা যাবে—

—তা আপনি যখন বলছেন, আমায় থাকতে হবে রাজামশায়৷ আপনার অবস্থা এখন যাই হোক, আপনি গড়শিবপুরের রাজবংশের বড় ছেলে, এখানকার রাজা৷ আমি সব শুনেছি আসবার পথে৷ আপনার অনুরোধ না রেখে উপায় কি বলুন! আর আমার কোনো তাড়া নেই, দেশ দেখতেই তো বেরিয়েছি—

—পায়ে হেঁটে?

—পয়সাকড়ি কোথায় পাব বলুন! পায়ে হেঁটে যত দূর হয় দেখছি৷ কখনো দূর দেশে যাই নি, কিছু দেখি নি ছেলেবেলা থেকে, অথচ বেড়াবার শখ ছিল৷ ভাবলুম বয়েস ভাঁটিয়ে গেল, এইবার বেরুনো যাক, হেঁটেই দেশ দেখব৷ পয়সা কোনো দিনই হবে না আমাদের হাতে৷ তা ধরুন ইতিমধ্যে নদীয়া জেলা সেরে ফেলেছি, এবার আপনাদের জেলায়—

—আপনার বয়েস হয়েছে, এরকম হেঁটে পারেন এখনও?

—বয়েস হলেও মনটা তো এখনও কাঁচা৷ কখনও কিছু দেখি নি বলেই যা দেখছি তাই ভালো লাগে৷ ভালো লাগলে হাঁটতে কষ্ট বোধ হয় না৷ কিন্তু আপনাকে দেখে আজ এত অবাক হয়ে গিয়েছি আমি, আর আপনাকে এত ভালো লেগেছে যে কি বলব! সত্যিকার রাজদর্শন ভাগ্যি ছাড়া হয় না, আমার তাই হল আজ৷ আমিও আমুদে লোক রাজামশায়, আমোদ ভালোবাসি বলেই বেরিয়েছি এই বয়সে৷

—বেশ তো, এখানে দু’চারদিন থেকে যান৷ আমোদ করা যাবে এখন৷ আপনার মতো লোক পেলে—

—কি জানেন, অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে নেনজার হয়ে পড়তুম রাজামশাই৷ দেশ ভ্রমণের শখ ছিল এস্তক লাগাৎ৷ কিন্তু যেতে পারিনে কোথাও—মনটা মাঝে মাঝে এমন হাঁপাতো! এই আমার বাষট্টি-তেষট্টি বছর বয়েস হয়েছে—আর বছর মেয়ে দুটিকে পাত্রস্থ করার পরে সংসারের ঝঞ্ঝাট অনেকটা মিটল৷ তাই বলি কখনও কোথাও যাই নি—বেরিয়ে আসি একবার৷ এক বছর পথে পথে থাকব—

—লাগছে ভালো এরকম হেঁটে বেড়ানো?

—আহা, বড্ড ভালো লাগছে রাজামশায়৷ নদীর ধার, বটগাছের তলা, মাঠে যবের ক্ষেত, মেয়েদের ক্ষার-কাচা পিঁড়ির ওপরে, হয়তো কোনো পুকুরের পাড়—যা দেখি তাতেই অবাক হয়ে থাকি৷ বড় ভালো লেগেছে আমার৷ যেখানে নদে জেলা শেষ হল সেখানে একটা বড় শিমুল গাছ আছে রাস্তার ধারে৷ জেলার শেষ কখনো দেখি নি—হাঁ করে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম কতক্ষণ৷ বেশ রোদ্দুর তখন মাঠে, আকাশে বড় বড় চিল উড়ছে, কেউ কোনোদিকে নেই৷ আমার এক বন্ধু ছিল, মারা গিয়েছে অনেক কাল, নাম ছিল কেশব—সেও দেশ দেখতে ভালোবাসত বড়৷ তার কথা মনে পড়ল—

কেদার বিস্ময়ে ও কৌতূহলের সঙ্গে বৃদ্ধের গল্প শুনছিলেন৷ তিনিও বেশিদূর কোথাও যান নি, অবস্থার জন্যেও বটে—তাছাড়া সংসার ফেলে নড়তে পারেন না৷ তাঁর বড় ইচ্ছে হল মনে, নদে জেলা যেখানে শেষ হয়েছে, সেই শিমুল গাছের তলাটাতে গিয়ে একবার দাঁড়ান৷ কখনও তিনি দেখেন নি৷ জেলা কি করে শেষ হয়৷ বৃদ্ধের বর্ণনা শুনে মনে মনে অনেক দূরে সেই অদেখা শিমুল গাছের তলায় চলে গিয়েছে তাঁর মন৷

জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা গোপেশ্বরবাবু, সেই যেখানে শিমুল গাছ, তার এপারে ওপারে তো দুই জেলা? একহাত তফাতেই নদীয়া, এধারে আবার যশোর৷ ধরুন আমার যদি একখানা বেগুনের ক্ষেত থাকে সেখানে, একটা বেগুন গাছ থাকবে নদে জেলায়, আর দু হাত তফাতের বেগুন গাছটা হবে যশোর জেলায়! ভারি মজা তো! সেখানে এমন জমি আছে?

বৃদ্ধ হেসে বললে, কেন থাকবে না? ওদিকের জমি হবে কেষ্টনগর সদরের তৌজিভুক্ত, আর এদিকের জমি হবে যশোর বনগাঁ মহকুমায়—

—বাঃ বাঃ চমৎকার!

কেদারের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিস্ময়ে ও কৌতূহলে৷ তাঁর ইচ্ছে হল জায়গাটা এখান থেকে কতদূর হবে জিজ্ঞেস করে নেন৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ল বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবার যো নেই তাঁর, শরৎকে একা এই বনের মধ্যে রেখে একদিনও তাঁর নড়বার উপায় আছে কোথাও? ছেলেমানুষ শরৎ…

জেলার সীমা দেখা তাঁর ভাগ্যে নেই৷…

সন্ধ্যার সময় বৃদ্ধকে নিয়ে কেদার ছিবাস মুদির দোকানে গিয়ে হাজির হলেন৷ রাত দশটা পর্যন্ত সেখানে পুরোদমে গান-বাজনা চলল৷ সকলেই বৃদ্ধের হাতে তবলা বাজানোর প্রশংসা করলে৷ খুব দ্রুত এবং খুব মিঠে হাত৷ সেই আড্ডাতেই আবার এসে জুটলো জগন্নাথ চাটুজ্জে৷ কোনো দিন আসে না, আজ কি ভেবে এসে পড়েছে কে জানে!

জগন্নাথ চাটুজ্জে মন দিয়ে খানিকক্ষণ গোপেশ্বরের বাজনা শুনে কেদারের কানে কানে বললে, ওহে কেদার রাজা, এ ভদ্রলোকটি বেশ গুণী দেখছি৷ এঁকে জোটালে কোথা থেকে হে?

কেদার পরিচয় দিলেন৷ জগন্নাথ শুনে খুব খুশি৷ তাঁর ইচ্ছে কেদারের বাড়িতে এসে লোকটির সঙ্গে কাল সকালে আরও আলাপ জমান৷ কেদার বললেন, তা বেশ তো দাদা, আসুন না সকালে—

বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা হয়ে গেল৷ রাত্রের আহারের ব্যবস্থা শরৎ ভালোই করেছে৷ মেয়ের ওপর ভার দিয়ে কেদার নিশ্চিন্ত থাকেন কি সাধে? কোথা থেকে সে কি করে, কেদার কোনোদিন খবর রাখেন নি৷ সে রাগ করুক, সংসারের কাজকর্ম সব ঠিকমতো করে যাবে, সে বিষয়ে তার ত্রুটি ধরবার উপায় নেই৷ ঠিক ওর মায়ের মতো৷

কেদার বোধ হয় একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন কি ভেবে৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে কেদারের সঙ্গে বাড়ির চারদিক বেড়িয়ে বেড়িয়ে দেখলেন৷ গড়ের এপারে ওপারে যে সব প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ বনের আড়ালে আত্মগোপন করে রয়েছে, তার সবগুলির ইতিহাস কেদারেরও জানা নেই৷

একটা পাথরের হাত-পা-ভাঙা মূর্তির চারিদিকে নিবিড় বেতবন৷

গোপেশ্বর বললেন, এ কি মূর্তি?

কেদার বলতে পারলেন না৷ বিভিন্ন মূর্তি চিনবার বিদ্যা নেই তাঁর৷ বাপ-পিতামহের আমল থেকে শুনে আসছেন এখানে যে মূর্তি আছে, অনেক দিন আগে মুসলমানদের আক্রমণে তার হাত পা নষ্ট হয়—কেউ বলে কালাপাহাড়ের আক্রমণে;—এ কিছু নয়, আসল কথা কেউ কিছু জানে না৷ বিস্মৃত অতীত কোনো ইতিহাস লিখে রেখে যায় নি গ্রামের মাটির বুকে—সময় যে কি সুদূরপ্রসারী অতীত ও ভবিষ্যৎ রচনা করে মানুষের স্মৃতিতে, সে গহন রহস্য এসব গ্রামের লোকের কল্পনাহীন মনে কখনও তার উদার ছায়াপাত করে নি, পঞ্চাশ বছর আগে কি ঘটেছিল গ্রামে, তাও তারা যখন জানে না—তখন ঐতিহাসিক অতীতের কাহিনী তাদের কাছে শুনবার আশা করা যায় কি করে?

গড়ের বাইরে এসে কেদার একটা প্রাচীন বটগাছ দেখালেন৷ কেদারের বাড়ি থেকে জায়গাটা অনেক দূর৷ গাছটার তলায় প্রাচীন আমলের বড় বড় শিবলিঙ্গ, গৌরীপট্ট, মকরমুখ পয়োনালা ইত্যাদি এখানে ওখানে পড়ে আছে স্মরণাতীত কাল থেকে—গ্রামের কেউ বলতে পারে না সে-সব কোথা থেকে এল৷ বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে এসব দেখে সেই ধরণের আনন্দ পেল, অধিকতর সচ্ছল অবস্থার ভ্রমণকারী দিল্লি আগ্রার মুঘলের কীর্তি দেখে যে আনন্দ পায়৷

কেদারকে বললে, রাজা মশায়, যা দেখলাম আপনার এখানে, জীবনে কখনও দেখি নি৷ দেখবার আশাও করি নি—এসব জিনিস কতকালের, যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুনের সময়কার বোধ হয়৷ পাণ্ডবদের রাজ্য ছিল এখানে—না?

.

সেই রাত্রে বৃদ্ধের জ্বর হল৷ পরদিন সকালে কেদার অতিথিশালায় এসে দেখলেন বিছানা থেকে উঠবার ক্ষমতা নেই বৃদ্ধের৷ সারাদিন জ্বর ছাড়ল না—সন্ধ্যার পরে তার ওপর আবার ভীষণ কম্প দিয়ে জ্বর এল৷ কেদার পড়ে গেলেন মুশকিলে৷ তাঁর বাইরে যাওয়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল৷ সর্বদা রোগীর কাছে থাকতে হয়, কখনও তিনি কখনও শরৎ৷

সাতদিন এভাবে কাটল৷ কেদার পাশের গ্রাম থেকে সাতকড়ি ডাক্তারকে এনে দেখালেন, বৃদ্ধের জ্ঞান নেই—তার বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিয়ে একখানা চিঠি দেবেন তার আত্মীয়স্বজনকে, তার সুযোগ পেলেন না কেদার৷ শরৎ যথেষ্ট সেবা করলে এই বিদেশী অতিথির৷ ঠিক সময়ে দুটি বেলা বৃদ্ধের পথ্য প্রস্তুত করে নিজের হাতে তাকে খাইয়ে আসা, বাপের স্নানাহারের সুযোগ দেবার জন্যে নিজে রোগীর পাশে বসে থাকা, নিজের বাবার অসুখ হলেও শরৎ বোধ হয় এর চেয়ে বেশি করতে পারত না৷

ন’দিনের পর বৃদ্ধের জ্বর ছেড়ে গেল৷ পথ্য পেয়ে আরও এক সপ্তাহ বৃদ্ধ রয়ে গেল অতিথিশালায়—কেদার কিছুতেই ছাড়লেন না, এ অবস্থায় তিনি অতিথিকে পথে নামতে দিতে পারেন না৷ বাড়িতে চিঠি দিতে চাইলে বৃদ্ধ ঘোর আপত্তি তুললে৷ বললে, কেন মিছে ব্যস্ত করা তাদের? স্ত্রী নেই, মেয়ে নেই—থাকবার মধ্যে আছে ছেলে দুটি আর ছেলের বৌয়েরা—তাদের অবস্থা ভালোও নয়, তাদের বিব্রত করতে চাই নে৷

পরের সপ্তাহে বৃদ্ধ বিদায় নিয়ে চলে গেল৷ শরৎ পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করতে বৃদ্ধের চোখে জল দেখা দিল৷ শরতের মাথায় হাত দিয়ে বললে, এমন সেবা আমার আপনার লোক কখনো করে নি৷ আমার পয়সা নেই, পয়সা থাকলে হয়তো তারা করত৷ তুমি যে বড় বংশের মেয়ে তা তোমার অন্তর দেখেই বোঝা যায়৷ তুমি আমার যা করলে, কখনো তা পাই নি কারো কাছ থেকে৷ তোমায় আর কি বলে আশীর্বাদ করব মা, ভগবান যেন তোমায় দেখেন৷

কেদার বললেন, আপনি কি এখন বাড়ি যাবেন?

—না রাজামশায়—বেরিয়ে পড়েছি যখন, তখন ভালো করে সব দেখে নিই৷ অনেক কিছু দেখলাম, আরও অনেক কিছু দেখব৷ আপনাকে আর মাকে যা দেখলাম এই তো আমার কাছে একেবারে নতুন৷ বাড়ি থেকে না বেরুলে কি আপনাদের মতো মানুষের দর্শন পেতাম? ফেরবার পথে আপনাদের সঙ্গে দেখা না করে যাব না৷

অনেক দিন পরে বাড়ি থেকে বেরুবার অবকাশ পেলেন৷ বৃদ্ধের অসুখ সেরে গেলেও রুগ্ন অতিথিকে একা ফেলে কেদার কোথাও যেতে পারতেন না বড় একটা৷ সর্বদা কাছে বসে কথাবার্তা বলতেন৷ আজ একটা বড় দায়িত্বের বোঝা যেন ঘাড় থেকে নেমে গেল৷

ছিবাস মুদির দোকানের আড্ডায় জগন্নাথ চাটুজ্জে বললে—আরে এই যে কেদার রাজা, এসো এসো—কি হল, অতিথি চলে গেল? যাক, বাঁচা গিয়েছে—আচ্ছা অতিথি জুটিয়েছিলে বটে! বাপরে, একেবারে একটি মাসের মতো জুড়ে বসলো—যাবার নামটি করে না!

কেদার হেসে বললেন, কি করে যায় বলো—বেচারি এসেই পড়ে গেল অসুখে৷ লোক বড় ভালো, তার কোনো ক্রটি নেই৷ তার পর জগন্নাথ-খুড়ো—এখানে কি মনে করে? তোমাকে তো দেখিনে এখানে আসতে?

জগন্নাথ বললে, মাঝে মাঝে আসি আজকাল৷ একা বাড়ি বসে থাকি আর ওই একটু সতীশের দোকান নয় তো পঞ্চানন বিশ্বেসের বাড়ি—কোথায় যাই বলো আর? একটু বেহালা ধরো দিকি হে বাবাজী—তোমার বাজনা শুনি নি অনেক দিন৷…

.

শরৎ সন্ধ্যাবেলায় উত্তর দেউলে প্রতিদিনের মতো প্রদীপ দিতে গেল৷ দিঘির পশ্চিম পাড় ঘুরে সেই বড় ছাতিম গাছতলা দিয়ে প্রায় তিন রশি পথ যেতে হয়—বড্ড বন এখানটাতে৷ বাদুড়নখীর জঙ্গলে শুকনো বাদুরনখী ফল আঁকড়ে ধরে রোজ শরতের পরনের কাপড়৷ রোজ ছাড়াতে হয়৷

যে গম্বুজাকৃতি মন্দিরটার নাম ‘উত্তর দেউল’, সেটা একেবারে এই পায়ে চলা সরু পথের পাশেই, গড়ের খালের ধারের ধ্বংসস্তূপ থেকে একটু দূরে, স্বতন্ত্র ভাবে দণ্ডায়মান৷ বাদুড়নখীর কাঁটাজাল ভেঙে পথটা এসে একেবারে মন্দিরের ভাঙা পৈঠায় উঠেছে৷ মাটি থেকে উঁচু রোয়াক, তার ওপর গোল গম্বুজাকৃতি মন্দির—দুটি কুঠুরি পাশাপাশি৷ কি উঁচু ছাদ—শরতের মনে হয় মন্দিরের মধ্যে ঢুকতেই৷ চামচিকের বাসা—দোর খুলতেই খোলা দরজা দিয়ে একপাল চামচিকে উড়ে পালালো৷ ভেতরের কুঠুরিতে বেশ অন্ধকার৷ গা ছমছম করে সাহসিকার, তবুও তো ওর হাতে মাটির প্রদীপ মিটমিট জ্বলছে, আঁচল দিয়ে আড়াল করে আনতে হয়েছে পাছে বাতাসে নেবে৷ আলো হাতে ভয় কিসের?

হঠাৎ যেন পাশের কুঠুরিতে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল অন্ধকারে৷ শরতের বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে উঠল—তবুও সে সাহসে ভর করে কড়া-সুরে হেঁকে বললে—কে ওখানে?

ওর হাত কাঁপছে৷…

কোনো সাড়া না পেয়ে শরৎ সাহসে ভর করে আর একবার ডেকে বলল—কে পাশের ঘরে? সামনে এসো না দেখি?

ওর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পাশের কুঠুরির ওদিকের কবাটবিহীন দোর দিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল—বাইরের চাতালে তার পায়ের শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা গেল৷

শরৎ মন্দিরের মেঝেতে মাটির পিলসুজে বসানো প্রদীপটা জ্বালাতে জ্বালাতে আপনমনে বকতে লাগল—দোগেছের শ্মাশান তোমাদের ভুলে রয়েছে? মুখপোড়া বাঁদরের দল—বাড়িতে মা-বোন নেই?

ওর আগের ভয়টা একেবারে সম্পূর্ণ কেটেছে৷ ব্যাপারটা অপ্রাকৃতের শ্রেণী থেকে সম্পূর্ণ বাস্তবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁচেছে৷ দু-পাঁচ মাস অন্তর, কখনো বা উপরি উপরি দু-তিন মাস ধরে—এক-একদিন এরকম কাণ্ড উত্তর দেউলে সন্ধ্যাবেলা আলো দিতে এসে ঘটেই থাকে৷ গ্রামের বদমাইশ কোনো ছেলে-ছোকরার কাণ্ড৷ এমন কি কার কাণ্ড শরৎ খানিকটা মনে মনে সন্দেহও করতে পারে—তবে সেটা অবিশ্যি সন্দেহ মাত্রই৷

শরৎ এসবে ভয় খায় না, ভয় খেতে গেলে তার চলেও না৷ দরিদ্রের ঘরে সুন্দরী হয়ে যখন জন্মেছে, তখন এ রকম অনেক উপদ্রব সহ্য করতে হবে, সে জানে৷ বাবার তো সে-সব জ্ঞান নেই, সেই যে বেরিয়েছেন কখন তিনি ফিরবেন তার ঠিকানা আছে? একাই এই নিবান্দা পুরীর মধ্যে যখন থাকা, তখন ভয় করে কি হবে? আসুক কার কত সাহস, বঁটি নেই ঘরে? বঁটি দিয়ে নাক যদি কেটে দুখানা না করে দিই তবে আমি গড়শিবপুরের রাজবংশের মেয়ে নই! পাজি, বদমাইশ সব কোথাকার!

প্রদীপ দেখিয়ে যখন সে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়াল—তখন সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ ভালো করে নেমেছে৷ ওই দিঘির পাড়ের ছাতিমবনটা বড্ড অন্ধকার হয়ে পড়ে এ সময়—ওখানটাতে ভয় যে না করে এমন নয়৷ শরৎ যে-প্রদীপটা হাতে করে এনেছিল, সেই প্রদীপটা প্রাণপণে আঁচল দিয়ে বাঁচিয়ে বাদুড়নখীর কাঁটাজঙ্গলের পথ বেয়ে চলে গেল—শুকনো ফলের থোলো নাড়া পেয়ে ঝমঝম করছে—দু-একবার ওর কাপড় পেছন থেকে টেনেও ধরলে বাদুড়নখী ফলের বাঁকা ঠোঁট—দু-একবার ও ছাড়িয়েও নিলে৷

বাড়ি পৌঁছে যদি রাজলক্ষ্মীকে দেখতে পেতো, খুব খুশি হত সে, কিন্তু সে পোড়ারমুখী আসে নি৷ শরৎ রান্নাঘরে ঢুকে উনুন জ্বেলে রান্না চড়িয়ে দিলে৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে ছিল এতদিন, শরতের বেশ লাগত৷ বাপের বয়সী বৃদ্ধকে সেবা করে আনন্দ পেত সে—কেদার সে-রকম নন, তিনি সেবা তেমন কখনও চান না৷ তা ছাড়া নির্জন পুরীতে দু-একজন মানুষের মুখ যদি দেখা যায়, সে ভালোই৷

শরৎ সেবা করতে ভালোবাসে, পছন্দ করে৷ জীবনে যেটা সে চেয়েছিল, তাই তার হল না৷ স্বামীর কথা তার ভালো মনে হয় না, সেদিক থেকে তার মন শূন্য—সে মন্দিরের সোপান- বেদীতে কোনো দেবতা নেই—তাদের গড়ের উত্তর দেউলের মতোই৷

সেজন্যে শরৎ স্বাধীন আছে এখনও—সম্পূর্ণ স্বাধীন৷ মনের দিগন্তে এতটুকু মেঘ নেই কোনোদিকে৷

বেশি রাত এখনও হয় নি, শরৎ ডাল সবে নামিয়েছে—এমন সময় কেদার বাড়ি এলেন৷

শরৎ হাসিমুখে বললে, এত সকালে যে বাড়ি ফিরলে! আবার যাবে বুঝি?

কেদার শান্তভাবে বললেন, না, আর যাব না—তবে—

—না বাবা, আজ আর যেয়ো না—

কেদার একটু অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে চাইলেন৷ ওর গলার সুরের মধ্যে বোধ হয় কি পেলেন৷

—কেন বলো তো মা?

—এমনি বলছি—থাকো না বাড়িতে৷ সকাল সকাল খেয়ে নাও—রান্না হয়ে গেল, একটু চা করে দেব নাকি?

কেদার চা খেতে তেমন অভ্যস্ত নন, মেয়েও এত আদর করে তাঁকে চা খেতে বলে না কোনোদিন৷ ইতস্তত করে বললেন, তা কর না হয়—খাওয়া যাক৷ তুইও খা একটু—

—আজ একটা গল্প করো না বসে আমার কাছে? করবে? ভালো কথা, সন্ধে-আহ্নিকটা সেরে নাও দিকি? জায়গা করে দিই?

মেয়ে মুশকিলে ফেললে দেখা যাচ্ছে৷ কেদার একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন৷ তিনি আসলে এসেছিলেন খানিকটা রজন সংগ্রহ করতে বেহালার ছড়ে দেবার জন্যে৷ ছিবাস মুদির আড্ডায় রজন ছিল, ফুরিয়ে গিয়েছে কিংবা হারিয়ে গিয়েছে৷ এত রাত্রে এ গ্রামের আর কোথাও ও জিনিস পাওয়া গেলে কেদার কখনই বিপদের মুখে পা দিতেন না৷ করাই বা যায় কি? অগত্যা কেদার সন্ধ্যা-আহ্নিকে বসলেন৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাঙ্গও করে ফেললেন৷ তার পর তিনি ভাবছেন এখন কি ভাবে বাইরে যাওয়া যায়, শরৎ আবার আবদারের সুরে বললে—বাবা, বল একটা গল্প—আজ তোমাকে যেতে দেব না—

কেদারের বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল৷ আজ শরৎ যেন ছেলেমানুষের মতো হয়েছে৷ কতদিন শরতের গলায় এমন আবদারের সুর তিনি শোনেন নি৷ এমনি অন্ধকার রাত্রে তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণি বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিল গরুর গাড়ি করে৷ শরৎ তখন ছ-মাসের শিশু৷ কেদার চিরদিনই এক রকম বাইরে বাইরে ফেরেন—বাড়িতে কেদারের আপন বৃদ্ধা জ্যাঠাইমা ছিলেন—তিনি কানে অত্যন্ত কম শুনতেন৷ লক্ষ্মীমণি ও তার বাপের বাড়ির গাড়োয়ান অনেক ডাকাডাকি করেও বৃদ্ধার ঘুম ভাঙাতে পারে নি৷ অগত্যা তাঁর ঘরের দাওয়াতেই বসে ছিল কেদারের আগমনের অপেক্ষায়৷…

রাত এগারটার সময় কেদার গানবাজনার আড্ডা থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন এই কাণ্ড৷ কেদারের মনে আছে, লক্ষ্মীমণি অন্ধকারের মধ্যে তাঁর কোলে ছ-মাসের মেয়েকে তুলে দিয়েই কৌতুকে আমোদে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল৷

—কেমন, বড্ড যে মেয়েকে ঘেন্না করতে!…মেয়ে যেন হয় না, হলে গড়ের পুকুরে ডুবিয়ে মারব!…ইস, মার না দেখি ডুবিয়ে!

সেই নবযৌবনা রূপবতী স্ত্রীর মুখের হাসি আজও মাঝে মাঝে যেন কানে বাজে…তখন পৃথিবী ছিল তরুণ, তিনি ছিলেন তরুণ, লক্ষ্মীমণি ছিল তরুণী৷ আর একজন এসেছিল তারপর…কিন্তু থাক, তার কথা কেদার এখন ভাববেন না৷

সেই মেয়ে শরৎ—সেই ছোট্ট শিশু৷ কি সুখে তাকে রেখেছেন কেদার?

শরৎ চা করে এনে দিলে৷

—শুধু চা খেও না, দাঁড়াও কি আছে দেখি৷

—দুটো বড়ি ভেজে কেন দ্যাও না, সে বেশ লাগে আমার—

শরৎ একটু আচারনিষ্ঠ মেয়ে, ভাতের শকড়ি কড়াতে সে বড়ি ভেজে এখন চায়ের সঙ্গে দিতে রাজি নয় বাবাকে৷ বাবা নিতান্ত নাস্তিক, তাঁর না আছে ধর্ম—না আছে কর্ম—বাবার ওসব ম্লেচ্ছাচার শরৎ পছন্দ করে না আদৌ৷

—বড়ি আবার এখন কি খাবে, হেঁসেলের জিনিস—দুটি মুড়ি মেখে দিই তার চেয়ে৷

কেদার অগত্যা মুড়ির বাটি নিয়ে বসলেন৷

না, আজ আর আড্ডায় যাওয়া গেল না৷ শরৎ তাঁর মনকে বড় অন্যমনস্ক করে দিয়েছে৷ ভালো রজন নিতে এসেছিলেন তিনি!

—আচ্ছা বাবা, উত্তর দেউলের কথা যে লোকে বলে—তুমি কিছু জানো?

—বলে, শুনে আসছি এই পর্যন্ত, নিজে কিছু দেখিও নি, কিছু শুনিও নি৷ তবে বাবার মুখেও শুনেছি, ঠাকুরদাদাও বলতেন—আমাদের বংশেও প্রবাদ চলে আসছে চিরদিন থেকে—

—বল না বাবা, কি কথা—

—তুমি তো জানো, সবই তো শুনে আসছ আজন্ম৷ থাক ও কথা এখন এই রাত্তির বেলা৷ কেন বল তো মা, উত্তর দেউলের কথা উঠল কেন মনে হঠাৎ?

—কিছু না, এমনি বলছি—

—আজ পিদিম দিয়ে এসেছ তো?

—ওমা, তা আবার দেব না! কবে না দিই? এমনি মনে হল তাই বলছি—

আজকার সন্ধ্যার ব্যাপারটা বাবার কাছে বলা উচিত কি না শরৎ অনেকবার ভেবেছে৷ শেষ পর্যন্ত সে ঠিক করে ফেলেছে বাবাকে কিছু বলবে না৷ বাবা ওই এক ধরনের লোক, বালকের মতো আমোদপ্রিয়, সরল লোক—সংসারের কোনো কিছু গায়ে মাখেন না—মাখা অভ্যেসও নেই৷ তিনি শুনবেন, শুনে ভয় পাবেন, উদ্বিগ্ন হবেন—কিন্তু কোনো প্রতিকার করতে পারবেন না৷ দুদিন পরে আবার সব ভুলে যাবেন৷ তাঁকে বলে কোনো লাভ নেই৷

তা ছাড়া একথা প্রকাশ হলেও এ-সব পাড়াগাঁয়ে অনেক ক্ষতি আছে৷ কে কি ভাবে নেবে তার ঠিক কি? এ থেকে কত কথা হয়তো ওঠাবে লোকে৷ বাবা পেটে কথা রাখতে পারেন না, এখুনি গিয়ে ছিবাস কাকার দোকানে গল্প করবেন এখন৷ দরকার কি সে-সব গোলমালে?

কেদার অবশেষে একটা গল্প বললেন—মেয়ের আবদার রাখার জন্যেই৷ এ গল্প এদেশে অনেকে জানে৷ তাঁর নিজের বংশের ইতিহাসেরই হয়তো—কেদার কিছু খোঁজ রাখেন না৷ কোনো পাঁজি-পুঁথিতে কিছু লেখা নেই৷

গড়ের বড় দিঘিটার নাম কালো পায়রার দিঘি৷ এ বাদে আরও দুটো দিঘি আছে ছাতিমবনের ওপারে—একটার নাম রানীদিঘি—একটার নাম চালধোয়া পুকুর৷ ও দুটো পুকুরেই অনেক পদ্মবন আছে—কালো পায়রার দিঘি অর্থাৎ যেটাতে কেদার প্রায়ই গণেশ মুচির সঙ্গে মাছ ধরে থাকেন—সেটাতে কোনো ফুল নেই পাটা-শেওলার দাম ছাড়া৷

বহুকাল আগে—কতকাল আগে কেদারের কোনো ধারণাই নেই—তাঁর কোনো পূর্বপুরুষের সঙ্গে মুসলমান ফৌজদারের দ্বন্দ্ব বাধে৷ চাকদহের নিকট যশড়া ও হাট জগদলের যে যুদ্ধের প্রবাদ আজও ছড়ার আকারে এই সব গ্রাম-অঞ্চলে প্রচলিত, কেদার শুনেছেন সে ছড়ার মধ্যে উল্লিখিত রাজা দেব রায় ও ভূমিপাল রায় তাঁরই বংশের পূর্বপুরুষ৷

হাট জগদলে পানি প্যালাম না

তীর খেয়ে ভিরমি নেগেচে—

দেবরায়ের সেপাই যে ভাই যমদূতের চ্যালা

ভুঁইপালের তীরন্দাজে দেয় বড় ঠ্যালা—

(ও ভাই) হাট জগদলে পানি প্যালাম না৷

তীর খেয়ে ভিরমি নেগেছে—

বিপদে পড়ে রাজা দেব রায় গৌড়ে যান দরবার করতে, বাড়িতে বলে গিয়েছিলেন যদি মঙ্গলের সংবাদ থাকে তবে সঙ্গের শ্বেত পারাবত উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু যদি অশুভ কিছু ঘটে, তবে কৃষ্ণ পারাবত উড়ে আসবে৷ সংবাদ শুভ হলেও কার ভুলক্রমে কৃষ্ণ পারাবত উড়িয়ে দেওয়া হয়৷ মহারানী অন্তঃপুরিকাদের নিয়ে গড়ের মধ্যের বড় দিঘির জলে আত্মবিসর্জন করে বংশের সম্মান রক্ষা করেন৷

রাজা জয়ী হয়ে ফিরে এসে যখন দেখলেন তাঁর অসতর্কতার পরিণাম—তিনি আর রাজকর্ম পরিচালনা করেন নি, ভাইয়ের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে উত্তর দেউলে বারাহী দেবীর বেদীমূলে বসে প্রায়োপবেশনে দেহত্যাগ করেন৷

এ অঞ্চলে প্রবাদ, উত্তর দেউলে এক বিশালকান্তি পুরুষকে কখনো কখনো নাকি দেখা গিয়েছে—হাতে তাঁর বেত্রদণ্ড, মুখে তর্জনী স্থাপন করে তিনি চিত্রার্পিতের মতো উত্তর দেউলের দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে৷

কিন্তু এসব শোনা-কথা মাত্র৷ কেউ এমন কথা বলতে পারে না যে, সে নিজের চোখে কিছু দেখেছে৷

অথচ গ্রাম্য লোক ভয় পায়, সন্ধ্যার পর উত্তর দেউলের এদিকে কেউ বড় একটা যাতায়াত করে না৷

কেদারও কিছু জানেন না, অপর পাঁচজনে যা জানে, তিনি তার বেশি কিছু জানেন না, জানবার কোনো চেষ্টাও করেন নি৷ আর কে-ই বা বলবে?

শরৎ বললে, বাবা, এসব কত দিনের কথা?

—তা কি করে বলব রে পাগলি? আমি কি দেখেছি?

রানীর নাম কি ছিল বাবা?

—কি করে বলব মা?… ইয়ে তা হলে আমি এখন—

—আচ্ছা বাবা, তিনি আমার সম্পর্কে কেউ নিশ্চয় হতেন—আমাদেরই বংশের তো—

কেদার একটু ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন—এখনও যদি ছিবাস মুদির দোকানে গিয়ে পৌঁছুতে পারেন—রাত বেশি হয় নি এখনও৷

তিনি অধীর ভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই হবেন বৈকি—তোমার ঠাকুরমা-টাকুরমা হতেন আর কি—

শরৎ হেসে বললে, ঠাকুরমা কি বাবা, সে হল কোন যুগের কথা—তোমার মা-ই তো আমার ঠাকুরমা হতেন৷

কেদারের মন এখন অত কুলজী-নির্ণয়ের দিকে নেই৷ তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন—আচ্ছা, তুমি ততক্ষণ রান্নাটা নামিয়ে রাখো—আমি আসছি চট করে—

—এত রাত্তিরে তোমায় বাবা আর যেতে হবে না৷ না, থাকো আজ—

—কেন, তোর ভয় করছে নাকি মা?

—হ্যাঁ তাই৷ থাকো আজকে—

কেদার একটু আশ্চর্য হলেন, শরৎ কোনোদিন এমন করে বাধা দেয় না৷ গল্প-টল্প শুনে ভয় পেয়েছে ছেলেমানুষ৷ থাক, আজ আর তিনি যাবেন না৷ রজন আনতে বাড়ি এসে যে ভুল তিনি করে ফেলেছেন, তার আর চারা নেই৷

শরৎ বললে, বাবা, সেই কলসিটার কথা মনে আছে?

—হ্যাঁ খুব আছে৷ কলসিটা কোথায় রে?

—রাজলক্ষ্মীদের বাড়িতে চেয়ে নিয়েছিল দেখবার জন্যে৷ সেখানেই আছে৷

—নিয়ে এসে রেখে দিয়ো, নিজের জিনিস বাড়িতে রাখাই ভালো৷

আজ বছর ছ’সাত আগে মাটির কলসি গড়ের খাতের মধ্যে এক জায়গায় পাওয়া যায়—কলসিটার ওপরে নানারকম ছক কাটা, নক্সা আঁকা—কেদারই কলসিটা প্রথমে দেখতে পান,

টাকাকড়ি পোঁতা আছে হয়তো পূর্বপুরুষের—প্রথমটা ভেবেছিলেন৷ কিন্তু শেষে কলসিটা খুঁড়ে বের করে আধ খুঁচিটাক কড়ি পান তার মধ্যে৷

গ্রামের হীরু ও সাধন কুমোর দেখে বলেছিল—এ পোড়ের কলসি আজকাল আর হয় না, এমন ধরনের আঁকাজোকা কলসির গায়ে—এসব বাবাঠাকুর অনেক কাল আগের জিনিস৷ এ পোড়ই আলাদা—খুব ওস্তাদ কুমোর না হলে এমন পোড় হবে না বাবাঠাকুর৷

গড়ের খালের খুব নিচের দিকে, যেখানে জল প্রায় মজে এসেছে, সেখানে একদিন মাছ ধরতে বসে কেদার কলসিটা পেয়েছিলেন৷ ওঃ, টাকার কলসি পেয়ে গিয়েছেন বলে কি খুশি কেদারের! শরতের মা লক্ষ্মীমণি তখনও বেঁচে৷

লক্ষ্মী ছুটে এল—কি গা কলসিটাতে?

এর আগে কেদার বলে গিয়েছিলেন যে একটা কলসির কানা বেরিয়েছে গড়ের খালের পাড়ে৷ অনেক নিচের দিকে পাড়ের৷

কেদার হাসতে হাসতে বললেন, এক হাঁড়ি মোহর—নেবে এসো—

লক্ষ্মীর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম, কিন্তু দেখাতো পঁচিশ বছরের যুবতীর মতো৷ গায়ের রঙের জলুস এই দু-বছর আগেও মরণের দিনটি পর্যন্ত ছিল অম্লান৷ এই মেয়ে হয়েছে ওর মায়ের মতো অবিকল—কিন্তু লক্ষ্মীর মতো অত জলুস নেই গায়ের রঙের—তার কারণ কেদার নিজে তত ফর্সা নন—শ্যামবর্ণ৷

লক্ষ্মী এসে হাসিমুখে কড়িগুলো নিয়ে গেল৷ বললে, জানো না, লক্ষ্মীর কড়ি, পয়মন্ত কড়ি—আমাদের বংশের কেউ হয়তো পুঁতে রেখে থাকবে কতকাল আগে—যত্ন করে তুলে রেখে দিই—

কেদার জিজ্ঞেস করলেন মেয়েকে—ভালো কথা, কলসির সেই কড়িগুলো কোথায় আছে?

—লক্ষ্মীর হাঁড়ির মধ্যে মা-ই তো রেখে গিয়েছিল, সেখানেই আছে৷

কেদারের মনটা আজ হঠাৎ কেমন আর্দ্র হয়ে উঠেছে, আশ্চর্যের ব্যাপার বটে! তিনি একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন, দেখে এসো না মা, আছে তো ঠিক—যাও না—

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শরৎ মুখের হাসি গোপন করলে, আহা, হাসিও পায়, দুঃখও হয় বাবার জন্যে৷ মা মারা যাবার পরে বাবা মায়ের কোনো জিনিস ফেলতে পারেন না, মায়ের ভাঙা চিরুনিখানা পর্যন্ত৷ তবে সব সময় তো খেয়াল থাকে না, ভোলা মহেশ্বরের মতো বাইরে বাইরে ঘোরে কিন্তু মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়ে যায়৷ শরতের বয়স হল পঁচিশ-ছাব্বিশ—সে সব বোঝে৷

বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেই বিশেষ করে শরৎ উঠে গেল লক্ষ্মীর হাঁড়ি দেখতে—সে ভালোরকমই জানে—কড়িগুলো আছে ওর মধ্যে৷ কিন্তু বাবার ছেলেমানুষের মতো স্বভাব, যখন যা ধরবেন তাই৷

সে দেখে ফিরে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে কেদার জিজ্ঞেস করলেন, রয়েছে দেখলি?

শরৎ আশ্বাস দেওয়ার সুরে বললে, হ্যাঁ বাবা, রয়েছে৷

—আর সেই কলসিটা কালই নিয়ে আয় ওদের বাড়ি থেকে৷ সেখানে এত দিন ফেলে রাখে? তোর জিনিসপত্রের যত্ন নেই৷

—তুমি ভেবো না বাবা, কালই আনব৷

আজ বাবার হঠাৎ খেয়াল চেপেছে তাই, নইলে আজ পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে কোনো দিন কলসিটার কথা বাবা তো এক দিনও বলেন নি! আজও তো সে-ই আগে তুলেছিল ওকথা, তাই এখন বাবার বড্ড দরদ কলসির ওপর, কড়ির ওপর৷ কেদার নিশ্চিন্ত হয়ে এক ছিলিম তামাক ধরালেন৷ কলসির কথা ওঠাতে তাঁর মনে পড়ল, বনে-জঙ্গলে ঘোরেন তিনি এই বিশাল গড়ের হাতার মধ্যে, খালের এপারে বা ওপারে জলের মধ্যে আরও দু-একটা জিনিস দেখেছেন, যার অর্থ তিনি করতে পারেন নি৷

যেমন একবার, আজ দশ-পনেরো বছর আগে, গড়ের বাইরে যে বড় মজা দিঘির নাম চালধোয়া পুকুর, তার ধারে কি করতে গিয়ে কেদার একটা বাঁধা-ঘাটের চিহ্ন দেখতে পান৷ কত কাল আগের বাঁধাঘাট কে বলবে? কয়েকটা মাত্র ধাপ তার অবশিষ্ট আছে—বাকিটা হয়তো মাটির মধ্যে পোঁতা৷

একবার তিনি কিছু পুরনো ইট বিক্রি করেন, গড়ের খালের এপারের একটা বড় পাঁচিলের ইট৷ বহুকাল থেকে স্তূপাকার হয়ে পড়ে ছিল—তার ওপরে গজিয়েছিল বনগাছের জঙ্গল৷ ইটের ঢিবি খুঁড়তে খুঁড়তে যখন সব ইটের স্তূপ শেষ হয়ে গেল—তখন সমতল মাটির আরও হাত-তিনেক নিচে আর কতকগুলো ইটের সন্ধান পাওয়া গেল৷ সে জায়গাটা খুঁড়ে দেখা গেল মাটির নিচে একটা মন্দিরের খানিকটা অংশ যেন চাপা পড়ে আছে৷

তখন সে ইটগুলোও খুঁড়ে তোলবার জন্যে বন্দোবস্ত করা হল৷ আরও হাত-দুই খুঁড়ে খুব বড় একটা পাথরের মাথা বেরিয়ে পড়ল৷ আর খোঁড়া হয় নি—এখন সে-সব আবার বনে ঢেকে গিয়েছে৷ কেদারের মনে হয়েছিল, ওখানে একটা মন্দির ছিল বহুকাল আগে—কতকাল আগে তা অবিশ্যি তিনি আন্দাজ করতে পারেন নি৷ অনেকগুলো নক্সাকাটা ইট বেরিয়েছিল ওখান থেকে৷ কিসের মন্দির তাও কেউ জানে না৷

ওই বাড়ির চারিপাশে তাঁদের পূর্বপুরুষদের কত দিঘি, দেউল, ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে আত্মগোপন করে আছে আজ কত কাল কত যুগ ধরে, দুর্ভেদ্য বেতবনের আড়ালে, জগডুম্বুর গাছের আঁকাবাঁকা শেকড়ের নীচে; দুশো বছরের সঞ্চিত চামচিকের নাদির মধ্যে থেকে বিরাট শিবলিঙ্গ কোথাও মাথাটি মাত্র জাগিয়ে আছেন—হস্তপদভগ্ন বারাহী দেবীর পাষাণ মূর্তি ছাতিমবনের নিবিড় ছায়ায় অনাদৃত অবস্থায় পড়ে আছে কতকাল৷

শরৎ এসব জানে৷ নিজের চোখেও দেখে আসছে আবাল্য, রাজলক্ষ্মীর ঠাকুরদাদা বৃদ্ধ শ্রীনাথ চাটুজ্জের মুখে সে অনেক কথা শুনেছে, যা তার বাবাও কোনদিন বলেন নি৷ শ্রীনাথ চাটুজ্জে অনেক খবর রাখতেন৷

—ভাত দিই বাবা, রাত হয়ে গিয়েছে অনেক—

—কেমন গল্প শুনলি, হল তো?

—উত্তর দেউলের কথা ভুলে গিয়েছ দিব্যি!

—ভুলব কেন, ওই যে বললাম—

—দেবীমূর্তির কথা বললে না যে—

—সেও তো শোনা কথা৷ কালাপাহাড় না কে…দেবীর মূর্তি ভেঙেচুরে মন্দির থেকে ফেলে দেয় টান মেরে—৷

—ভাদ্র মাসের অমাবস্যেতে দেবীমূর্তি নাকি—

—কে দেখতে গিয়েছে মা? চোখে কেউ দেখেছে? ওসব গুজব৷ পাষাণের অতবড় মূর্তিটা অমনি জাগ্রত হয়ে ঠেলে উঠে চলতে শুরু করে—হ্যাঁঃ—

শরৎ সাহসিকা মেয়ে, তবুও বাবার কথায় যে ছবি তার মনে জাগল—তাতে সে শিউরে উঠল, কারণ সে শুনে এসেছে সে-সময় যে সঞ্চরণশীল জগ্রত পাষাণ মূর্তির সামনে পড়ে, তার সেদিন বড়ই দুর্দিন৷

না, ওসব কথায় তার ভয় হয়; তাড়াতাড়ি সে বাবাকে বললে, থাক থাক বাবা, ওসব কথায় আর দরকার নেই৷ তোমার কি, রাতদুপুর পর্যন্ত ফেলে রেখে যাবে, মরতে আমিই মরি আর কি!

মশা বিনবিন করছে জঙ্গলের মধ্যে৷ খালিগায়ে ঘরের মধ্যে বসা কষ্ট৷ কলাবাদুড় ঝুলছে তালকাঠের আড়া থেকে৷ বাইরের বাতাসে কি বনফুলের সুগন্ধ!

কেদার আহারে বসে অভ্যাসমতো এ-তরকারি ও-তরকারির দোষ খুঁত বার করতে করতে খেতে লাগলেন৷ কাঁচকলা রান্না বড় শক্ত কথা, বেগুনের তরকারিতে অত ঝাল সে কোথা থেকে শিখেছে ইত্যাদি৷ খেয়ে উঠে তামাক সাজতে গিয়ে কেদার দেখলেন তামাক একদম ফুরিয়ে গিয়েছে৷ মেয়ে আজকাল অত্যন্ত অমনোযোগী, কাজকর্মে আর অগের মতো মন নেই—যদি থাকত তবে তামাক ফুরিয়ে যাওয়ার একদিন আগে লক্ষ করে নি কেন? এখন তিনি তামাক কোথায় পান এত রাত্রে?

শরৎ বললে, আচ্ছা বাবা, তোমার তামাক খেতে পেলেই তো হল! কলকেটা দাও—

—কোথায় পাবি তামাক?

—তোমার সে খোঁজে দরকার কি? দেখি কলকেটা—

অসময়ের জন্যে সে প্রতিদিনের তামাক থেকে একটু একটু নিয়ে একটা ঘুলঘুলির মধ্যে লুকিয়ে রাখে৷ বাবার কাণ্ড তার জানতে বাকি নেই, এই রকম রাতদুপুরে তামাক ফুরিয়ে যাবে হঠাৎ৷ বকুনি খেতে হবে সে-সময় তাকেই৷ বকুনির চেয়েও তার দুঃখ হয় যখন বাবার কোনো জিনিসের অভাব ঘটে—কোনো কিছুর জন্যে তিনি কষ্ট পান৷

শরৎ তামাক সেজে এনে দিলে৷ কেদার তামাক পেয়েই সন্তুষ্ট, মেয়েকে আর বিশেষ জেরা করলেন না এ নিয়ে৷ রাত অনেক হয়েছে—আর এখন শয্যা আশ্রয় করলেই তিনি বাঁচেন৷ শরৎ সারাদিন খাটে, রাত্রে বিছানায় একবার শুয়ে পড়লে তার জ্ঞান থাকে না৷ আর এক ছিলিম তামাক চেয়ে রাখলে হত ওর কাছ থেকে, কিন্তু কেদার ভরসা পেলেন না৷

গভীর রাত্রে ঘুমের ঘোরে শরতের মনে হয়, আর সে ভাঙাচোরা গড় নেই, কি সুন্দর রাজবাড়ি, পদ্মদিঘির শ্বেতপদ্ম ফুটে জল আলো করেছে—দেউড়িতে দেউড়িতে পাহারা পড়েছে, ছাদে লাল সাদা নিশান উড়ছে—গড়ের এপারে ওপারে কত বাড়ি, কত অতিথিশালা, কত হাতি-ঘোড়ার আস্তাবল, উত্তর দেউলে প্রকাণ্ড বারাহী মূর্তির পুজো হচ্ছে, ধূপ-ধুনো-গুগগুলের সুবাসে চারিদিক আমোদ করছে, কাড়া-নাকাড়ার বাদ্যিতে কান পাতা যায় না৷

যেন এক রানী এসে তার শিয়রে দাঁড়িয়েছেন, ওঁর সুন্দর মুখে প্রসন্ন হাসি, কপালে চওড়া করে সিঁদুর পরা, রূপের দীপ্তিতে ঘর আলো হয়ে উঠেছে…তিনি সস্নেহ সুরে যেন বলছেন—খুকি, আমার বংশের মেয়ে তুই, বংশের মান বাঁচাবার জন্যে আমি দিঘির জলে ডুবে মরেছিলাম, তুইও বংশের মর্যাদা বজায় রাখিস, পবিত্র রাখিস নিজেকে৷

ঘুমের মধ্যেও শরতের সর্বাঙ্গ যেন শিউরে ওঠে৷

.

কেদার পাশের গ্রাম থেকে খাজনা আদায় করে ফিরছেন, এমন সময় ছিবাস মুদি রাস্তায় তাঁকে ডাকলে—চলুন আমার দোকানে দাদাঠাকুর, একটু তামাক খেয়ে যাবেন—

রাস্তার ধুলোতে কিসের দাগ দেখে কেদার বললে, এ কিসের দাগ হে ছিবাস?

—এ মোটর গাড়ির চাকার দাগ—প্রভাস বাড়ি এসেছে যে মোটরে চড়ে—

—বেশ, বেশ৷ তা গাড়ি তো দেখতে হয় ছিবাস—

—কখনো দেখেন নি বুঝি দাদাঠাকুর? আমি সেবার যোগে গঙ্গাচানে গিয়ে নবদ্বীপে দেখে এইচি—

—দূর, মোটর গাড়ি দেখবো না কেন, সেদিনও তো কেষ্টনগরে সদর খাজনা দাখিল করতে গিয়ে চার-পাঁচখানা দেখে এলাম৷ বড়লোকেরা কেনে, কেষ্টনগরে বড়লোকের অভাব আছে নাকি? তবে আমাদের গাঁয়ে মোটর গাড়ি নতুন কথা কিনা—

—তা হবে না কেন দাদাঠাকুর! আজকাল প্রভাসের বাবার অবস্থা কি! কলকাতায় দুখানা বাড়ি, কারবার চলছে তোড়ে—রমারম টাকা আসছে৷ বলে লক্ষ্মী যখন যারে দ্যান, ছপ্পড় ফুঁড়ে টাকা আসে—ওদেরই তো এখন দিন—এ কি আর আপনি আমি?

—তা ভালোই তো৷ গাঁয়ে সবাই গরিব, দু-একজন যদি বড়লোক হয়, অন্ততঃ গাঁয়ের রাস্তাঘাটগুলো তো ভালো হবে৷ দুদিন মোটরে করে এলেই তখন রাস্তার দিকে নজর পড়বে—

—হ্যাঁ, দুদিন মোটরে এসেই তোমার গাঁয়ের রাস্তা অমনি পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে গ্যাংট্যাং রোড করে ফেলছে! তুমিও যেমন পাগল দাদাঠাকুর! ছাড়ান দ্যাও ওসব কথা৷

প্রভাস যে মোটরখানা এনেছে, সাতকড়ি চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে সেখানা কাঁঠালতলার ছায়ায় দাঁড় করানো৷ চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপে আট-দশজন লোকের ভিড়৷

কেদার সামনের রাস্তায় কালো চকচকে গাড়িখানার পাশে দাঁড়িয়ে ভালো করে জিনিসটা দেখতে লাগলেন৷ কেমন একটা গরম গন্ধ, কিসের গন্ধ কেদার ঠিক বুঝতে পারেন না৷ ঝকঝক করছে পেতলের না কিসের ডাণ্ডা, হ্যান্ডেল—আরও কি সব যন্ত্রপাতি৷

বেশ জিনিস৷

এত কাছে দাঁড়িয়ে কেদার কখনও মোটর গাড়ি দেখেন নি৷ রাস্তায় যেতে যেতে গাড়িখানার ওধারে আরও দু-একজন পথচলতি চাষাভুষো লোক দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি দেখতে৷

কেদার তাদের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন, কালে কালে কত কাণ্ডই দেখা গেল—য়্যাঁ—কি বলো মোড়লের পো? তাই না কি, বলো ঠিক করে? দশ বছর আগে দেখেছিলে কেউ?

একজন চাষীলোক স্টিয়ারিংয়ের চাকা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, এখানডাতে চাকা একটা আবার কেন, হ্যাদে ও দা’ঠাউর?

কেদার বিজ্ঞভাবে বললেন, ও হল হ্যাণ্ডেলের চাকা৷ ওটা ঘোরায়৷

লোকটির নিকট সব ব্যাপারটা এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে গেল৷ সে হাসিমুখে বললে, দেখুন দিখি দা’ঠাউর, বললেন আপনি, তবে আমি বোঝলাম৷ না বলে দিলে কি আমরা বুঝতি পারি?

সে কি বুঝলে তা অবিশ্যি সে-ই জানে৷

এই সময় কেদারকে দেখতে পেয়ে কে চণ্ডীমণ্ডপ থেকে ডেকে উঠল—ও কেদার রাজা, ওহে ও কেদার রাজা—শোন শোন, এদিকে এস না একবার—

প্রভাসকে ঘিরে গ্রামের অনেকগুলি ভদ্রলোক বসে৷ জগন্নাথ চাটুজ্জেও আছে ওদের মধ্যে, কেদারকে ডাক দিয়েছে সে-ই৷

চণ্ডীমণ্ডপের মালিক সাতকড়ি চৌধুরী বললেন, কেদার-দা যে! আরে এস এস—বসতে দাও হে—কেদার-দা’কে বসাও—

জগন্নাথ বললে, আরে ভায়া কেদার রাজা, এসে পড়েছ ঠিক সময়ে—তোমার কথাই হচ্ছিল৷

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন—আমার কথা!

তাঁর কথা কোথাও মজলিসে আলোচিত হবার মতো গুণ তাঁর কি আছে? কেদার ভেবে পেলেন না৷ কখনও আলোচিত হয়ও নি৷

জগন্নাথ বললে, তোমার কথা কেন, সকলেরই কথা৷ প্রভাস, চিনতে পেরেছ কেদার ভায়াকে? রাজবাড়ির কেদার-রাজা৷ এ হল প্রভাস—আমাদের গাঁয়ের রাসু বিশ্বেসের নাতি—

কেদার বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি৷ তবে সেই ছেলেবেলায় হয়তো দু-একবার দেখে থাকব, বাবাজি তো আসে না গাঁয়ে বড় একটা—কাজেই এদানীং দেখি নি আর৷

প্রভাসের বয়স ত্রিশ-বত্রিশ, মাথায় কোঁকড়া চুলে টেরি কাটা, গায়ে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি, জরিপাড় ধুতি পরনে৷ সকলেই জানে প্রভাস চরিত্রহীন ও বওয়াটে, কিন্তু বড়লোকের ছেলের কাছে স্বার্থ অনেকের অনেক রকম, মুখে কিছু বলতে সাহস করে না৷

সাতকড়ি চৌধুরী বললেন—প্রভাসকে আমরা ধরেছি, অমাদের পুবপাড়ার ইস্কুলটার সম্বন্ধে কিছু বিবেচনা করুক৷ ওদের হাত ঝাড়লে পব্বোত৷

কেদার এক পাশে গিয়ে বসলেন৷ ব্যাপারটা কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন, এ গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের বাড়িটা পাকা করে দেবার জন্যে সবাই প্রভাসকে ধরেছে, শ-চার-পাঁচ টাকা ব্যয় করলে আপাতত বাড়িটা এক রকম দাঁড়িয়ে যায়৷

প্রভাস বলছিল—তা যখন আপনারা বলছেন, তখন দিয়ে দেব, তবে টাকা আপাতত এখন আনি নি, আপনারা যদি কেউ আমার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে—

—আহা সে-জন্যে ভাবনা কি? তুমি যখন হয় পাঠিয়ে দিয়ো৷ তুমি বললেই আমরা কাজ আরম্ভ করে দিই৷ তোমার ভরসা পেলে আমরা করতে পারিনে এমন কি কাজ আছে? কি বল হে জগন্নাথ খুড়ো?

জগন্নাথ চাটুজ্জে সাতকড়ির কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে কেদারের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার কথা কি হচ্ছিল বলি, ইস্কুলটার জন্যে তোমার গড়বাড়ির পুরনো ইট কিছু দিতে হবে৷

কেদার দ্বিরুক্তি না করে বললেন—নিয়ো৷

—ঠিক তো?

—নিশ্চয়৷

—তা হলে সব কথা তো মিটে গেল হে সাতু, কেদার রাজার ইট আর প্রভাসের টাকা, ইস্কুল বাড়ি তো পাকা হয়ে রয়েছে৷ এক ছিলিম তামাক খাও—বসো কেদার রাজা৷

প্রভাস উঠতে চাইলে—কিন্তু সাতকড়ি চৌধুরী বাধা দিলেন৷ চা হচ্ছে বাড়ির মধ্যে তার জন্যে, না খেয়ে যাবার যো নেই৷

কেদারের একটু চা খাবার ইচ্ছে ছিল না এমন নয়, সুতরাং তিনিও চেপে বসলেন৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে তাঁর সঙ্গে তার নিজের সংসারের ঝঞ্ঝাটের গল্প শুরু করলে৷ মেজ ছেলেটার জ্বর হচ্ছে আজ এক মাস, রোজ বিকেলে জ্বর আসে, কত রকম কি করলেন, কিছুতেই জ্বর যাচ্ছে না৷ ও-পাড়ার যতীশ চক্কত্তির সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদ চলেছে গেঁয়োহাটিতে৷ জগন্নাথ বলে জমি আমার, যতীশ বলে আমার৷ প্রজারা ফলে খাজনা বন্ধ করেছে, দু-পক্ষের কাউকেই খাজনা দেয় না৷

কেদার বললেন, কেন, জমির পড়চা দেখলেই তো মিটে যায়—কার জমি লেখাই তো আছে—

—আরে তা কি দেখা হয় নি ভাবছ কেদার রাজা? পড়চা-দৃষ্টে জমি সনাক্ত করতে হবে না!

—পড়চা দেখে যদি জমি সনাক্ত করতে না পারো, তা হলে আমীন ডেকে মীমাংসা করে নাও৷ সেটেলমেণ্টের ম্যাপ আছে, তাই দেখে আগে মেপে নেবার চেষ্টা কর না কেন?

—তুমি একদিন এসো না ভায়া৷ তুমি ম্যাপ দেখে একটা মীমাংসা দাও না করে? জমিজমার কাজ তুমি তো খুব ভালো বোঝ৷

—কেদার-দা সত্যিই ভালো জানে জমিজমা-সংক্রান্ত কাজ—কিন্তু মন এদিকে দিতে চায় না একেবারেই৷ নিজের অনেক জমি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে বেহাতি হয়ে গেল, দেখেও দেখে না, ওই হয়েছে ওর দোষ৷

একথা বললেন সাতকড়ি চৌধুরী৷ অনেক দিন আগে তাঁর নিজের জমিজমার দলিলসংক্রান্ত কি একটা জটিল ব্যাপারের ভালো মীমাংসা করে দেন কেদার, সেই থেকে কেদারের বৈষয়িক কাজকর্মের প্রতি সাতকড়ি চৌধুরীর যথেষ্ট শ্রদ্ধা৷

এই সময়ে চা এল৷ এখানে আর কেউ চা খায় না বলে বোধ হয় চা এসেছে শুধু প্রভাসের জন্যেই৷ শুধু চা নয়, খানকতক গরম পরোটা আর একটু আলু-চচ্চড়িও এসেছে৷ সকলেই নানা অনুযোগ অনুরোধ করে প্রভাসকে খাওয়াতে লাগল৷ কেদার চা খাবেন কি না এ কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে না, সুতরাং চা-পানের ইচ্ছে আপাতত কেদারকে দমন করতে হল৷

প্রভাস চা-পান শেষ করে উঠে পড়ল৷ সকলে গিয়ে তাকে তার মোটরে উঠিয়ে দিলে৷

সাতকড়ি বললেন, এখন যাবে কোথায় প্রভাস?

—এখন একবার রানীনগর যাব কাকা, হারাণ কাপালীর কাছে একখানা তিনশো টাকার হ্যাণ্ডনোট আছে, তামাদির মুখে দাঁড়িয়েছে, বাবা বলে দিয়েছেন একবার গিয়ে তাগাদা দিতে৷

—ওবেলা একবার এসো৷ গড়ের ইট কেদার-দা দিতে চেয়েছেন, তোমায় দেখিয়ে আনব৷ কি বলো জগন্নাথ খুড়ো? তুমি টাকা দেবে, ইটগুলো তুমি দেখে নাও৷ এই, সব সরে যা গাড়ির কাছ থেকে, তোদের এত ভিড় কেন?

প্রভাসের গাড়ির চারিধারে বহু ছেলেমেয়ে এসে জড়ো হয়েছিল৷ সকলকে সরিয়ে সাবধান করে দু-চারবার হর্ন দিয়ে প্রভাস গাড়ি ছেড়ে দিলে৷…

জগন্নাথ চাটুজ্জে পথের বাঁকে দ্রুতবিলীয়মান গাড়িখানার দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন—সব টাকা রে বাপু, টাকা! ওর ঠাকুর-দা এই গাঁয়ের পুবপাড়ার কামারের দোকান করতো, হেঁই-ও হেঁই-ও করে হাতুড়ি পেটাতো, আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি৷ সাতু বাবাজি, রাসু বিশ্বেসকে মনে আছে নিশ্চয়ই!

সাতকড়ি চৌধুরীর বয়স আসলে চল্লিশের বেশি নয়৷ তার চেয়ে অন্তত পঁচিশ বছর বেশি বয়সের লোক জগন্নাথ চাটুজ্জে তাঁকে নিজের দলে টানবার চেষ্টা করছে দেখে তিনি ক্ষুণ্ণমুখে বললেন—আমার কি করে মনে থাকবে জগন্নাথ খুড়ো, আমি দেখিই নি…

কেদার বললেন, তোমার যে কাণ্ড জগন্নাথ-দাদা! ও দেখবে কোথা থেকে? আমারই ভালো মনে হয় না৷

জগন্নাথ বললেন—তা সে যাই হোক, মোটের ওপর পয়সা করেছে বটে৷ ব্যবসা না করলে কি আর বড়লোক হওয়া যায়? ওই রাসু কামারের ছেলে—আমরা রাসু কামার বলেই জানতাম ছেলেবেলায়—সেই রাসুর ছেলে হারাণ কলকাতায় গিয়ে ঘোড়ার গাড়ি সারানোর ছোট্ট দোকান খুললে বৌবাজারে৷ ক্রমে দোকানের উন্নতি হতে লাগল—মাথা খুলে গেল, তখন পুরনো গাড়ি কিনে তাই সারিয়ে বেচতে লাগল৷ তার পর দ্যাখো আজকাল ওদের অবস্থা৷ কলকাতায় চারখানা বাড়ি৷

সাতকড়ি চৌধুরী বললেন, আজকাল প্রভাসই কর্তা৷ ও-ই বলছিল ওর বাবা বাতে পঙ্গু, উঠে হেঁটে বেড়াতে পারে না৷ প্রভাসই দেখাশুনো করে৷

একজন কে বললে—তবে প্রভাস নাকি বাপের পয়সা বিস্তর উড়িয়েছে৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললেন—তা ওড়াবে না কেন? হারাণ বিশ্বেস কম টাকা করে নি তো? ছেলে যদি না ওড়াবে তবে ওড়াবে কে বলো না? ঘোর বওয়াটে আর মাতাল—

সাতকড়ি চারিদিকে চেয়ে বললেন, থাক থাক, ওকথা থাক খুড়ো৷ সে-সব কথায় দরকার কি তোমার আমার? যার ছাগল তার লেজের দিকে সে কাটুক না—বাদ দাও৷ ওরা হল আজকাল বড়লোক, এদিগরে সাত-আটখানা গাঁয়ের মহাজন হল ওরা৷ ওদেরই খাতির৷ টাকার দরকার হলে হারাণ বিশ্বেসের কাছে—কলকাতায় গিয়ে হ্যাণ্ডনোট লিখে কর্জ না করলে যখন উপায় নেই, তখন তার ছেলে কি করে না করে সে-সব কথার আলোচনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে না করাই ভালো৷

বেলা বেড়েছে৷ কেদার বাড়ির দিকে রওনা হলেন৷ পথে প্রভাসের গাড়ির সঙ্গে আবার দেখা—বেজায় ধুলো উড়িয়ে আসছে, কেদার এক পাশে দাঁড়ালেন৷ ধুলোর পাহাড় সৃষ্টি করে হর্ন বাজিয়ে মোটরখানা সবেগে পাস কাটিয়ে চলে গেল, পেট্রল ও গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে৷ কেদার ধুলোর মধ্যে চোখ মিট মিট করতে করতে প্রশংসমান দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলেন৷

.

সকালে উঠেই সেদিন কেদার খাজনা আদায় করতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন, এমন সময় জগন্নাথ চাটুজ্জে এসে ডাকলে, ওহে কেদার রাজা, বাড়ি আছ নাকি ভায়া?

কেদার বললেন, এসো জগন্নাথ দাদা, এসো৷ কি মনে করে?

—ওরা সব আসছে, ইট কোথা থেকে নেবে দেখিয়ে দেবে চলো৷

কেদার বললে, ও আর দেখিয়ে দেওয়া কি, তুমি তো জানো—যেখান থেকে হোক—

জগন্নাথ জিভ কেটে বললে, তা কি হয় ভায়া? তোমার জিনিস না বলে দিলে কি আমরা নিতে পারি? চলো তুমি৷ প্রভাস নিজে আসবে এখুনি—আরও সব আসছে৷

—ততক্ষণ বসবে এসো দাদা৷ ওরে শরৎ, তোর জ্যাঠামশায়ের জন্যে বসবার কিছু দে৷

শরৎ একখানা পিঁড়ি পেতে দিয়ে বললে, জ্যাঠামশায় তো এদিকে আসা ছেড়েই দিয়েছেন আজকাল৷ বসুন ভালো হয়ে৷ চা খাবেন?

জগন্নাথ চাটুজ্জে একগাল হেসে বললে, তা মা, দে না হয় করে৷

নিজের বাড়িতে জগন্নাথের চা খাওয়ার পাট নেই কোনো কালে, তবে পরের বাড়িতে হলে কোনো কিছু খাওয়াতেই আপত্তি নেই জগন্নাথের৷

কেদার বললেন, তারপর, তোমাদের ইস্কুলের বাড়ি আরম্ভ হবে কবে?

—জিনিসপত্র যোগাড় হলেই হবে৷ প্রভাস টাকা দিলেই আমরা কাজ আরম্ভ করে দিই৷ একটু তামাক সাজো ভালো করে ভায়া৷ চা-টা তোমার এখানেই খাওয়া যাক৷

কিছুক্ষণ পরে শরৎ এসে দু-পেয়ালা চা সামনে রাখল৷ সে সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে, পরনে সরুপাড় ফর্সা ধুতি, একরাশ ভিজে এলো চুল পিঠে ফেলা—গায়ের রং ফুটেছে স্নান করে—লম্বা পাতলা দেহ, সুন্দর ভুরু, বড় বড় চোখ—প্রতিমার মতো সুশ্রী৷

চা নামিয়ে বললে, জ্যাঠামশায়, বসুন, একটা জিনিস খাওয়াব৷ খাবেন তো?

—কি মা?

—সে এখন বলছি নে৷ আনি আগে, তখন দেখবেন!

শরৎ একটা পাথরের খোড়া ভর্তি বাসি পায়েস এনে জগন্নাথের সামনে রাখলে৷ হাসিমুখে বললে, খান৷ বাবা বড় ভালোবাসেন বলে কাল রাত্রে করেছিলুম—তা আজ সকালে অনেকখানি রয়েছে দেখলাম৷ বাবা চেয়েছিলেন খেতে কিন্তু ওঁকে এখন আর দেব না, দুপুরে ভাতের সঙ্গে দেব বলে রাখলাম খানিকটা৷

এমন সময় গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে প্রভাসকে দূরে আসতে দেখে কেদার বললেন, ও শরৎ আরও সবাই আসছে৷ চা আর হবে নাকি?

শরৎ বললে, ক’ পেয়ালা?

—চার-পাঁচ পেয়ালার মতো হোক না হয়৷

—তা হবে না, দুধ নেই৷ কাল রাত্রে একটু দুধ রেখেছিলাম, তাই দিয়ে তোমাদের করে দিলাম৷ এক পেয়ালার মতো একটুখানি পড়ে আছে৷

—তবে প্রভাসের জন্যে শুধু এক পেয়ালা করে দে৷ ও গাঁয়ে কখনো আসে না, ওকে দেওয়া উচিত আগে৷ আর সব তো ঘরের লোক৷

ওরা কিন্তু কেউই বাড়ির কাছে এল না৷ অতিথিশালার কাছে এসে সাতকড়ি চৌধুরী ডাক দিয়ে বললেন,—ও কেদার দাদা, এসো এদিকে, প্রভাস এসেছেন—আর কে বসে ওখানে—জগন্নাথ খুড়ো?

কেদার বললেন, তুমি বসে পায়েস খাও দাদা, আমি যাই দেখি৷

সাতকড়ি বললেন, কোথা থেকে ইট দেবে হে? চলো নিয়ে৷

—চলো, কালো পায়রার দিঘির পাড়ে জঙ্গলে অনেক ইট আছে৷ দুটো মন্দিরের ভাঙা ইটের রাশি৷ তাই নিয়ো—কি বলো?

প্রভাস চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে৷ সে এ-গ্রামে ইতিপূর্বে কয়েকবার এলেও কেদারের বাড়ি কখনো আসে নি বা গড়ের মধ্যেও কখনো ঢোকে নি৷ এত বড় বড় ভাঙা ঘরদোর ও মন্দির যে এখানে আছে সে তা জানত না৷ আগে জানলে সে ক্যামেরাটা নিয়ে আসত কলকাতা থেকে৷

কেদার তাকে বললেন, চলো প্রভাস, ওখানে জগন্নাথদা বসে আছেন, তুমিও একটু চা খাবে এসো৷ এসো সাতু ভায়া, তুমিও এসো৷

উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্যে চা-পান করতে অভ্যস্ত নয় কেউই, সাতকড়িও না৷ সুতরাং প্রভাস ছাড়া আর কেউ চা খেতে গেল না৷

সাতকড়ি বললেন, ঘুরে এসো প্রভাস, দেরি না হয়—আমরা এখানেই আছি৷

প্রভাসকে ঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসিয়ে কেদার মেয়েকে চা দিতে বললেন৷ শরৎ এসে চা দিয়ে যাবে, কিন্তু অপরিচিত প্রভাসের সামনে হঠাৎ আসতে সঙ্কোচ বোধ করে পেয়ালা হাতে দোরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কেদার বললেন, ওকে দেখে লজ্জা করতে হবে না, বুঝলি মা৷ ও আমাদের গাঁয়ের ছেলে—এখনই না হয় থাকে কলকাতায়৷ ও পর নয়৷ দিয়ে যাও চা৷

শরৎ এসে প্রভাসের সামনে চা রাখলে৷ প্রভাস শরৎকে কখনো দেখে নি বলা বাহুল্য—চা দেবার সময় সে মৃদু কৌতূহলের সঙ্গে প্রথমটা একবার শরতের দিকে চাইলে…কিন্তু শরৎকে দেখবার পরক্ষণেই প্রভাসের চোখমুখ যেন অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ মুখের চেহারা যে বদলে গেল অতি অল্পক্ষণের জন্যে, এ যে-কেউ দেখলেই বলতে পারত৷

প্রভাস আশা করে নি এত সুন্দরী মেয়েকে আজ সকালে এই ভাঙা-ইটের-স্তূপে-ঘেরা জঙ্গলাবৃত ক্ষুদ্র বাড়িতে এ ভাবে দেখতে পাবে৷ এত রূপ আছে, এই সব পাড়াগাঁয়ে!

প্রভাস থতমত খেয়ে চায়ের পেয়ালাটা হাতে তুলে নিলে৷

কেদার বললেন, তোমাদের কলকাতায় কোথায় থাকা হয় বাবাজি?

প্রভাস অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল, কেদারের প্রশ্নে যেন চমকে উঠে বললে, আমায় বলছেন? আপার সারকুলার রোড—

—তোমার বাবার শরীর কেমন?

—আছে ভালো, তবে উঠতে হাঁটতে পারেন না৷ বয়েস তো হল কম নয়৷ সাহেব ডাক্তার দেখছে—তবে এ বয়েসের রোগ—

—তোমার একটি ছোট ভাই আছে শুনছিলাম, সে কি করে?

—সেও দোকানে বেরোয়৷ খুব ছোট নয়, তার বয়েস এই সাতাশ বছর হল৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললে, বাবাজি বিয়ে করেছ কোথায়?

—কই, আমি বিয়ে তো করি নি এখনও৷

কেদার জানতেন না যে প্রভাস অবিবাহিত৷ প্রভাসের সম্বন্ধে এ কথা তিনি কারো মুখে শোনেন নি৷

তিনি বিস্ময়ের সুরে বললেন, বিয়ে করো নি! তা তো জানতাম না৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললেন, আমিও জানতাম না৷ বাবাজির বয়েস অবিশ্যি এখনও—বয়েসটা কত হল বাবাজি?

—আজ্ঞে একত্রিশ যাচ্ছে৷

—ওঃ, একত্রিশ! যথেষ্ট সময় আছে৷ তোমাদের এখনো যথেষ্ট—

—সে জন্যে নয় কাকাবাবু, বিয়ে আমার করবার ইচ্ছে নেই৷

—বলো কি বাবাজি! তোমাদের রাজার মতো সম্পত্তি, বাড়িঘর, বিয়ে করবে না কি রকম?

প্রভাস হাসি-হাসি মুখে চুপ করে রইল৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে বললে, রাসু-দাদা কিছু বলেন না এ নিয়ে?

—অনেক বড় বড় সম্বন্ধ এনেছেন৷ হুগলী বালিতে একবার পঁচিশ হাজার টাকা দেবে আর হীরে জহরতের জড়োয়া—বাবা কিছুতেই ছাড়বেন না৷ বাবাকে বললাম, অমন সম্বন্ধ এর পরে জোটবার অভাব হবে না, যদি আমি বিয়েই করি৷ বাবা তাদের জানিয়ে দিলেন, কিন্তু তবুও তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগল এমন যে আমি ওয়ালটেয়ার পালিয়ে গেলাম—সেখানে আমাদের বাড়ি আছে কিনা! বছর পাঁচ-ছয় হল বাবা হাইকোর্টের সেলে কিনেছিলেন৷

কেদার বললেন, কি জায়গাটা বললে বাবাজি—কোথায় সেটা?

—ওয়ালটেয়ার৷ সমুদ্রের ধারে৷

সমুদ্র কোন দিকে কত দূরে, কেদারের সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব ছিল, কিন্তু জগন্নাথ চাটুজ্জের জামাই রেলে কাজ করে, সে গত পুজোর সময় সস্ত্রীক পাশ নিয়ে পুরী গিয়েছিল৷ জগন্নাথ চাটুজ্জের জানা আছে মাত্র এইটুকু যে, পুরী নামক প্রসিদ্ধ তীর্থস্থানটি সমুদ্রের ধারে—সে সমুদ্র যত দূরেই হোক বা যে দিকেই হোক৷ সুতরাং সে জিজ্ঞেস করলে—পুরীর কাছে বাবাজি?

—না, পুরী থেকে অনেক নীচে৷

বলা বাহুল্য, পুরীর নীচে বা ওপরে কি ভাবে আর একটা জায়গা থাকতে পারে এ কথা জগন্নাথ বা কেদার কারো কাছেই তেমন পরিস্ফুট হল না৷ সে দিক থেকে বরং সমস্যা জটিলতর হয়ে দাঁড়াতো এদের কাছে, কিন্তু শরৎ দোরের কাছে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল, সে তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে বললে—পুরীর আরও দক্ষিণে হল তা হলে—না বাবা?

কেদার বিপণ্ণমুখে বললেন, হাঁ—দক্ষিণে!—তাই—ইয়ে দক্ষিণেই তো তা হলে গিয়ে—

প্রভাস হঠাৎ শরতের মুখের দিকে একটু বিস্ময়-মিশ্রিত প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়েই তখনই আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জগন্নাথের দিকে চেয়ে বললে, ঠিক বলেছেন উনি৷ দক্ষিণেই হল৷

এবার সকলে পুকুরের পাড়ের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল ইট দেখবার জন্যে৷ ছাতিম-বনের তলায় এদিক ওদিক ছড়ানো ভাঙা ঘরবাড়ি ও প্রাচীন দেউলগুলির ধ্বংসস্তূপ সকলকেই বিস্ময়াবিষ্ট করে তুলল৷ বেতের দুর্ভেদ্য ঝোপের আড়ালে কতদূর পর্যন্ত ছড়ানো বড় বড় ইটের স্তূপ, পাথরের কড়ি, পাথরের চৌকাঠ, নক্সা করা প্রাচীন ইট, ভাঙা থামের মাথা, সকলেরই মনে বর্তমানের বহুদূর পিছনকার এক লুপ্ত বিস্মৃত অতীতের রহস্যময় বার্তা ক্ষণকালের জন্যে বহন করে নিয়ে এল—যাতে জগন্নাথ চাটুজ্জের মতো কল্পনাশূন্য নিরেট ব্যক্তিকেও বলতে শোনা গেল—বাস্তবিক৷ এসব দেখলে মন কেমন করে—কি বলো সতু বাবাজি?

সাতকড়ি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, তা আর করে না?

কিন্তু সকলের চেয়ে বিস্ময়ান্বিত হয়েছে প্রভাস—তা তার মুখ দেখেই বেশ বোঝা গেল৷

প্রভাস এ-সব কোনোদিন দেখে নি—বা তাদের গ্রামে যে এরকম আছে তা শুনলেও সেটা যে এই ধরনের ব্যাপার তা জানত না৷

সে বিস্ময়ের সুরে বললে, ওঃ, এ তো অনেক কাল আগেকার! এ-সব কীর্তি ছিল কাদের?

সাতকড়ি বললেন, এই আমার কেদার দাদার পূর্বপুরুষের—আবার কার? এঁরাই গড়শিবপুরের রাজবংশ৷ কেন, তুমি জানতে না বাবাজি? যাক দেখে নাও দিকি, ক’গাড়ি ইট হবে বা কোন দিক থেকে খুঁড়বে?

প্রভাস চুপ করে রইল৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে বললে, যেখান থেকে হয় হাজার দশেক ইট আপাতত নাও না৷ কেদার ভায়ার কোনো আপত্তি নেই তো?

কেদার নির্বিকার মানুষ—কোনো প্রকার ভাব বা অনুভূতির বালাই নেই তাঁর৷ তিনি বললেন, না আমার আপত্তি কি? ইট তো পড়েই রয়েছে!

সাতকড়ি বললেন, কিন্তু এ ইটের দাম কিছু দিতে পারব না কেদার দাদা, তা আগে থেকেই বলে রাখছি৷

কেদার ক্ষুদ্র মনের পরিচয় কোনোদিন দেন নি—তিনি দিলদরিয়া মেজাজের মানুষ সবাই জানে৷ বললেন, কিছু বলবার দরকার নেই সে-সব৷ নিয়ে যাও না ভায়া—আমি কি তোমায় বলেছি দামদস্তুরের কথা?

ইতিপূর্বেও কেদারের অবৈষয়িকতা ও ঔদার্যের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বহু লোক গড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে বিনামূল্যে গাড়ি গাড়ি ইট নিয়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি তৈরি বা মেরামতের জন্যে—অর্থকষ্ট যথেষ্ট থাকা সত্বেও কেদার কারো কাছে মূল্য চাইতে পারেন নি বা কাউকে বিমুখও করেন নি কোনোদিন, অথচ যেখানে পুরনো ইটের হাজার-করা দর পাঁচ টাকা করে ধরলেও কেদার ইট বিক্রি করেই অন্তত দেড় হাজার টাকা নিট দাম আদায় করতে পারতেন৷

কিন্তু তা কখনো করবেন না কেদার৷ রাজবংশের ছেলে হয়ে পূর্বপুরুষের ভিটের ইট বিক্রি করে টাকা রোজগার? ছিঃ!…এমনি দেবেন৷ লোকের উপকার হয়, হোক না৷

সাতকড়ি বললেন, তা হলে প্রভাস বাবাজি, কাল থেকে লোক লাগিয়ে দিই—কি বল?

প্রভাস বললে, বেশ, নিয়ে যান—আমি তো বলেছি কাজ আরম্ভ করুন৷

ক্ষণকালের সে ভাবান্তর কেটে গিয়েছে সকলের মন থেকেই৷ এরা অন্য ধাতের মানুষ, প্রত্যক্ষ দৃষ্ট বাস্তব ছাড়া অন্য কোনো জগতের সঙ্গে এদের বিশেষ পরিচয় নেই৷

কেদার দেখিয়ে দিলেন কোন পথে ইটের গাড়ি আসতে পারে, কারণ তিনি ভিন্ন গড়ের জঙ্গলের অন্ধি-সন্ধি বড় কেউ একটা জানে না৷

কাজ মিটে গেল৷ সাতকড়ি বললেন, চলো সবাই জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে যাই—মশার কামড়ে মলাম৷

বনের মধ্যে একটু যেন ভিজে ভিজে এখনও গাছপালা—বেলা বেশি হয়েছে বটে, কিন্তু ঘন ছাতিম-বনের আবরণ ভেদ করে সূর্যকিরণ এখনও বনের তলায় পড়ে নি৷ কি একটা বনফুলের সুমিষ্ট গন্ধ ঠাণ্ডা বাতাসে৷

প্রভাস সমস্ত পথ ঘোর অন্যমনস্ক ভাবে চলে এল৷ সে আজ যেন কেমন হয়ে গিয়েছে৷

গড়বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামে ঢুকবার মুখে সে কেদারকে বললে, আপনি বাড়ি থাকেন, না কোথাও চাকরি করেন?

কেদার বললেন, না বাবাজি, চাকরি-টাকরি কখনো আমাদের বংশে করে নি কেউ৷ বাড়িই থাকি৷

—আসুন না একবার কলকাতায়৷ আমাদের বাড়ি রয়েছে—দয়া করে সেখানে গিয়ে—

—আমার কখনো কোথাও যাওয়া হয় না বাড়ি ফেলে—তা ছাড়া মেয়েটা একলা বাড়িতে—ইয়ে হ্যাঁ, এই সব কারণে যেতে পারি নে কোথাও৷ আর ধরো গিয়ে আমার বাড়ি একেবারে গাঁয়ের বাইরে, মানুষজন নেই—ফেলে যাই কি করে?

এ কথার প্রভাস বিশেষ কোনো জবাব দিলে না৷

কেদার আবার বললেন, তুমি এখন ক-দিন থাকবে?

প্রভাস বললে, না, আমি কালই যাব বোধ হয়৷ কলকাতায় অনেক কাজ রয়েছে পড়ে৷ পরশু তারিখের একটা পোস্ট-ডেটেড চেক রয়েছে মোটা টাকার—আমি না গেলে সেখানা ব্যাঙ্কে প্রেজেন্ট করা হবে না৷

কেদার আদৌ বুঝলেন না জিনিসটা কি৷ ব্যাঙ্ক জিনিসটা তিনি জানেন, শুনেছেন বটে—কিন্তু পোস্ট-ডেটেড চেক কথার অর্থ কি, বা সে কি ব্যাপার—এ সব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই তাঁর৷ তিনি শুধু বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বললেন, ও! ঠিক ঠিক!

ওরা চলে গেল সবাই৷ কেদার এত বেলায় অন্য কোথাও যাওয়া উচিত না বিবেচনা করে বাড়ির দিকেই ফিরছেন এমন সময় গেঁয়োহাটির ক্ষেত্র কাপালির সঙ্গে দেখা৷ সে গড়ের খাল পার হয়ে তাঁর বাড়ির দিক থেকেই আসছে৷ কেদার বললেন, কি হে ক্ষেত্র, আমার ওখানে গিয়েছিলে নাকি?

—প্রাতপেন্নাম দা-ঠাকুর৷ মোদের গাঁয়ে ওবেলা যাতি হবে, একেবারে ভুলে গিয়ে বসে আছো! দা-ঠাকুর আমাদের একেবারে বোম ভোলানাথ৷ মনে নেই আজ আমাদের যাত্তারার দলের আখড়াই? আপনি গিয়ে বেয়ালা না ধরলি আসর জমবে, না আসরে ঢোলক বাজবে? চলো দা-ঠাকুর—তোমার বাড়ি গিয়েছিলাম, তা মা-ঠাকরুণ বললেন তিনি কোথায় গিয়েছেন বেরিয়ে৷

—ভালোই তো—তা ক্ষেত্র, তুমিও দুটো খেয়ে যাও আমার বাড়ি, চলো না? বেলা হয়ে গিয়েছে, চলো৷

ক্ষেত্র কাপালি রাজি হল না সে চলে গেল, যাবার সময় কেদারকে তাদের গ্রামে যেতে বলে গেল বার বার করে৷

কেদার বাড়ি ফিরে দেখলেন শরৎ রান্না সেরে বসে আছে৷ বললে, বাবা নেয়ে নাও, ভাত হয়ে গিয়েছে কতক্ষণ৷ ওরা সব চলে গেল, ইট নিয়েছে?

—হ্যাঁ, ইট কাল গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবে৷

—গেঁয়োহাটির ক্ষেত্র এসেছিল তোমার খোঁজে৷ দেখা হয়েছে?

—এই তো গেল৷ ওবেলা ওদের আখড়াই বসবে তাই ডাকতে এসেছিল কিনা? খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেব—তার পর যাব ওদের গাঁয়ে৷ তেল দাও৷

.

ঘুমিয়ে উঠে বেলা তিনটের সময় কেদার গেঁয়োহাটি রওনা হবার উদ্যোগ করছেন, এমন সময় ভাঙা দেউড়ির রাস্তায় প্রভাসকে আসতে দেখে হঠাৎ বড় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন৷

—আরে এসো এসো বাবাজি এসো! কি মনে করে?…

প্রভাস একা এসেছে৷ ওবেলার সাজ আর এবেলা নেই গায়ে—সাদা সিল্কের একটা শার্ট পরেছে, হাতে ও গলায় সোনার বোতাম, পরনে জরিপাড় ধুতি, পায়ে নতুন ফ্যাশনের খাঁজকাটা জুতো৷ হাতের পাঁচ আঙুলের মধ্যে তিন আঙুলে পাথর-বসানো আংটি রোদ পড়ে চিকচিক করছে৷

—ও শরৎ মা, এদিকে এসো—প্রভাসকে একটা বসার জায়গা দাও৷ চা খাবে তো প্রভাস? হ্যাঁ, খাবে বৈকি, বোসো বোসো৷

প্রভাস বললে, আপনাদের এখানে মোটর আসবার রাস্তা নেই৷ গাড়িখানা গড়ের খালের ওপারে দাঁড় করিয়ে রেখেছি৷

শরৎ একটা আসন বার করে প্রভাসকে বসতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে সম্ভবত চা করতে গেল৷ প্রভাস বসে চারিদিকে তাকিয়ে বললে, আমি এর আগে কখনো গড়বাড়িতে আসি নি, খুব কাণ্ড ছিল তো এক সময়! দেখেশুনে সত্যিই অবাক হয়ে যাবার কথা বটে৷ কি ছিল, তাই ভাবি! মন কেমন যেন হয়ে যায়, না কাকা?

কেদার এ ধরণের কথা অনেক লোকের মুখ থেকে অনেক বার শুনেছেন, শুনে আসছেন তাঁর বাল্যকাল থেকে৷ এই সব ইট-পাথরের টিবি আর জলের মধ্যে লোকে কি যে দেখতে পায়, তিনি ভেবেই পান না৷ পয়সা থাকলেই বোধ হয় মানুষের মনে এ-সব অদ্ভুত ও আজগুবি মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়—কে জানে? কেদারের কৌতুক হয় এ ধরণের কথা শুনলে৷ থাকে সব কলকাতায় বড় বড় বাড়িতে, ইলেকটিরি আলো আর পাখার তলায়, এই সব পাড়াগাঁয়ে এসে যা দেখে তাই ভালো লাগে—আসল কথাটা হল এই৷ একবার অনেক দিন আগে মহকুমার হাকিম এসেছিলেন এই গ্রামে কি একটা মোকদ্দমার তদারক করতে৷ যেমন সকলেই আসে, তিনি এলেন গড়শিবপুরের রাজবাড়ি দেখতে৷ কেদারের ডাক পড়ল৷ কেদার তো সঙ্কোচে জড়সড় হয়ে হাকিমের সামনে হাজির হলেন৷ হাকিম-হুকুমকে বিশ্বাস নেই, কাঁচা-খেকো দেবতা সব!

হাকিম জিজ্ঞেস করলেন, আপনি গড়শিবপুরের রাজবংশের লোক?

—আজ্ঞে, হুজুর৷

—আপনাকে দেখে আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে, জানেন? আপনি কে আর আমি কে! আপনি এ পরগনার রাজা—আর আমি—আপনার একজন কর্মচারীর সমান৷

কেদার সম্ভ্রম দেখিয়ে নীরব রইলেন৷ বড়লোক খেয়াল-খুশিতে অনেক কিছু বলে—সব কথার জবাব দিতে নেই৷

শরৎ তখন মাত্র পনেরো বছরের মেয়ে, উদ্ভিন্ন-যৌবনা, অপূর্ব সুন্দরী৷ হাকিম তাকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, মাকে আমি নিয়ে যেতাম, যদি আজ রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ হতাম, আমার সে সৌভাগ্য নেই৷ আমার ছেলেটি এবার বি-এ পাশ করেছে৷ কিন্তু বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণের সঙ্গে তো আপনি কাজ করবেন না৷ মা আমার রাজবংশের মেয়ে বটে! ওর সেবা পাব, সে ভাগ্য কি আর করেছি?

শরৎ মুখ নিচু করে রইল লজ্জায় ও সঙ্কোচে৷

দশ-এগারো বছর আগেকার কথা৷

শরৎ প্রভাসের সামনে চা এনে দিলে৷ সে খুব সরুপাড় একখানা ধুতি পরেছে, হাতে দু-গাছা সোনার চুড়ি—মায়ের হাতের বালা ভেঙে ক-গাছা চুড়ি হয়েছিল, এই দু-গাছা তার মধ্যে অবশিষ্ট আছে৷ জড়িয়ে এলো-খোঁপা বাঁধা, দেখলে ওকে উনিশ-কুড়ি বছরের বেশি বলে কিছুতেই মনে হয় না, এমনি লাবণ্যভরা মুখশ্রী৷

প্রভাসের দিকে চেয়ে বললে, দেখুন তো, আর চিনি দেব কিনা—

প্রভাস চায়ে চুমুক দিয়ে একটু সঙ্কোচের সুরে বললে, আজ্ঞে না৷ আমি চিনি কম খাই—

কেদার বললেন, তার পর, কি মনে করে বাবাজি?

প্রভাস যেন আমতা আমতা করে উত্তর দিলে—ইয়ে—এই কিছু না—এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম কি না৷…তাই—

—বেশ বেশ৷ বোসো বাবাজি—

প্রভাস চা-পান করে বসে রইল বটে, তবে একটু উশখুশ করতে লাগল৷ বসে থাকাটা তার পক্ষে যেন বড়ই অস্বাচ্ছন্দ্যকর হয়ে উঠছে৷ অথচ মুখেও কোনো কথা যোগায় না৷ এমন অবস্থায় সে কখনো পড়ে নি৷

কেদার বললেন, তুমি কালই তো কলকাতায় যাবে—না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, কাল দুপুরে রওনা হব খেয়ে-দেয়ে৷

আবার সে একটু উশখুশ করতে লাগল৷

তার এ ভাবটা বুদ্ধিমতী শরতের চোখ এড়ালো না৷ তার মনে হল, প্রভাস কিছু বলবার জন্যে এসেছে—কিন্তু তা বলতে পারছে না৷ সে একটু বিস্ময়মিশ্রিত কৌতূহলের দৃষ্টিতে প্রভাসের দিকে চেয়ে রইল৷

পরক্ষণেই প্রভাস পকেট থেকে একটা ছোট মখমলের বাক্স সসঙ্কোচে বার করে বললে, এইটে এনেছিলাম দিদির জন্যে—

কেদার বিস্ময়ের স্বরে বললেন, কি ওটা?

—এই গিয়ে—একটা আংটি—

—শরতের জন্যে এনেছ?

—হ্যাঁ—ভাবলাম, কখনো আসিনে—যখন আলাপ হয়েই গেল আপনাদের সঙ্গে, তাই—

কেদার হাত বাড়িয়ে মখমলের বাক্স হাতে নিয়ে বললেন, দেখি? বাঃ, বাক্সটি বেশ! আংটিটা—এ যে দেখছি বেশ দামি জিনিস! এ তুমি আনলে কোথা থেকে?

—ওবেলা মোটরে চলে গিয়েছিলাম রানাঘাট৷ সেখান থেকে কিনে এনেছি—আমার জানাশুনা দোকান, এ জিনিস বাইরে শো-কেসে সাজিয়ে রাখে না৷ আমাকে চেনে বলে বার করে দিলে৷

—কত দাম নিয়েছে?

প্রভাস সলজ্জভাবে বললে, সে কথা আর কেন জিজ্ঞেস করছেন কাকাবাবু! দাম আর কি, অতি সামান্য—আপনাদের দেওয়ার মতো কিছু না—

কেদার আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, আমার মনে হচ্ছে তুমি বেশ পয়সা খরচ করেছ৷ এ পাথরখানা তো বেশ দামি, হীরে বোধ হয়—না?

প্রভাস একটু উৎসাহের সুরে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ৷ দেড় রতি ওজন, আসল পাথর৷ তবে দামদস্তুরের কথা এখনও সেকরার সঙ্গে কিছু হয় নি—

কেদার বাক্সটা প্রভাসের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, কেন এত খরচপত্র করতে গেলে অনর্থক? এ তুমি নিয়ে যাও বাবাজি৷ এ দরকার নেই৷

প্রভাসের মুখে যেন কে কালি লেপে দিল৷ সে ভয়ে ভয়ে বললে—এনেছিলাম দিদিকে দেব বলে—খুব আশা করেছিলাম—যদি অপরাধ না নেন—

—না বাবাজি—শরৎ বিধবা মানুষ, ও আংটি-টাংটি পরে না তো! ও বড় গোঁড়া ধরণের মেয়ে৷ এতদিন চুল কেটে ফেলত, শুধু আমার ভয়ে পারে না৷

প্রভাস কিছু কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল৷ কেদারের মনে কেমন একটু সহানুভূতি জাগল প্রভাসের প্রতি—বেচারি যেন বড়ই লজ্জিত ও অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে আংটির বাক্স ফেরত দেওয়ায়৷ নাঃ, এদের সব ছেলেমানুষি কাণ্ড!

মেয়ের দিকে চাইতে গিয়ে কেদার দেখলেন শরৎ কখন সেখান থেকে সরে গিয়েছে৷ ডাকলেন—ও শরৎ, শোনো মা—

শরৎ ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিলে—কি বাবা?

—হ্যাঁরে, প্রভাস একটা আংটি দিতে চাচ্ছে তোকে—কি করবি? রাখবি?

শরৎ আড়াল থেকেই বললে—আমি কি জানি? তুমি যা ভালো বোঝো৷…আংটি আমি তো পরি নে—তবে উনি যখন হাতে করে এনেছেন থাক জিনিসটা৷

কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শরৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বললে—দেখি?

প্রভাস জিনিসটা কেদারের হাতে দিলে—তিনি মেয়ের হাতে তুলে দিলেন সেটা৷ প্রভাস শরতের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল—কিন্তু শরৎ তখন বাক্সটি খুলে আংটি নেড়েচেড়ে দেখছে—তার চোখ অন্যদিকে ছিল না৷

কেদার হাসিমুখে বললেন—পছন্দ হয়েছে তোর? তা পছন্দ হবার জিনিস বটে৷ আমি শুধু বলছি প্রভাসকে যে এত খরচ করবার কি দরকার ছিল? এখান থেকে সাত ক্রোশ তফাৎ রানাঘাটের বাজার৷ মোটর গাড়ি আছে তাই যেতে পেরেছিলে বাবাজি৷

প্রভাসের মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, সে বললে, দিদিকে একটা সামান্য জিনিস দিলাম—এতে খরচপত্রের কি আর—কিছুই না৷ অতি সামান্য জিনিস—

শরৎ বললে, বসুন আপনি৷ আমি খাবার করছি, খেয়ে যাবেন৷ ততক্ষণ বাবা একটু গল্প করো না প্রভাসবাবুর সঙ্গে৷

কেদার আসলে খুব সন্তুষ্ট নন, তিনি একটু বিরক্তই হয়েছেন প্রভাস আসাতে৷ বেলা পড়ে আসছে, এখন তাঁর বেরুবার সময়—গেঁয়োহাটির আখড়াইয়ের আসরে বেহালা না বাজালে আখড়াই জমবে না, ক্ষেত্র কাপালি বলে গিয়েছে ওবেলা৷

আর ঠিক এই সময়ে এসে কিনা জুটলো প্রভাস!

একে তো মেয়ে বাড়ি থেকে বেরুতে দেয় না, তার ওপর যদি প্রতিবেশীরা পর্যন্ত বাদ সাধে, তবে তিনি বাঁচেন কি করে?

শরৎ ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছে খাবার করতে—কেদার আর কিছুক্ষণ বসে প্রভাসের সঙ্গে অন্যমনস্কভাবে একথা ওকথা বললেন৷ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল তাঁর মন নেই কথাবার্তার দিকে—গেঁয়োহাটিতে একটা ছিটের বেড়ার দেওয়াল দেওয়া চালাঘরে এতক্ষণে কত লোক জুটেছে—সবাই তাঁর আগমন-পথের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে—তিনি না গেলে আখড়াইয়ের আসর একেবারে মাটি৷

বেলা বেশ পড়ে এসেছে৷ এখান থেকে দেড় ক্রোশ রাস্তা গেঁয়োহাটি—অনেক দূর৷

হঠাৎ তিনি উঠে পড়ে বললেন, মা, প্রভাস বাবাজি রইলেন বসে৷ তুমি খাবার করে খাইয়ে দিয়ো৷ আমার বিশেষ দরকার আছে—গেঁয়োহাটিতে খাজনার তাগাদা আছে৷ প্রভাসের দিকে চেয়ে বললেন—বোস তুমি বাবাজি, কিছু মনে কোরো না—

মেয়েকে কোনো রকম প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়েই তিনি দাওয়া থেকে নেমে উঠোন পার হয়ে ভাঙা দেউড়ির দিকে হন হন করেই হাঁটতে শুরু করলেন৷ অনেক সময় এ-রকম ক্ষেত্রে মেয়ে ছুটে এসে পথ আটকায়—পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে কেদার এ জানেন কিনা৷

শরৎ রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললে, যেয়ো না বাবা—শোনো বাবা—খেয়ে যাও খাবার—শোনো ও বাবা—

সঙ্গে সঙ্গে সে খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বার হয়ে এসে নিচু চালের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে চেয়ে দেখলে, কেদার ভাঙা দেউড়ির পথে অদৃশ্য হয়েছেন৷

তার লজ্জা করতে লাগল, প্রায় অপরিচিত প্রভাস যে বসে সামনে—নইলে সে এতক্ষণ দেখিয়ে দিতো বাবা জোরে হেঁটে কতদূর পালান! গড়ের খালে নামবার আগেই সে ছুটে গিয়ে ধরে ফেলত বাবার হাত৷

ছিঃ, কি অন্যায় বাবার!

প্রভাসের দিকে চেয়ে বললে, একটু বসুন, কেমন তো? আমি মোহনভোগ চড়িয়ে এসেছি কড়ায়—আসছি নামিয়ে—

প্রভাস খানিকক্ষণ একা বসে থাকবার পরে শরৎ কাঁসার কানা-উঁচু রেকাবিতে মোহনভোগ এনে ওর সামনে রাখলে, আর এক গেলাস জল৷

—কেমন হয়েছে বলুন তো প্রভাসদা?

শরতের স্বর সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচ—আত্মীয়তার সহজ হৃদ্যতায় মধুর ও কোমল৷

প্রভাস একটু অবাক হয়ে গেল ওর ‘দাদা’ ডাকে৷

শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, আপনি কি করে জানলেন আমি আপনার চেয়ে বড়?

শরৎ মৃদু হাসিমুখে জবাব দিলে—আমি জানি৷

—কি করে জানলেন?

—বারে, ভুলে গেলেন? ওবেলা তো জগন্নাথ জেঠাকে বললেন এখানে বসে আপনার বয়সের কথা৷

এইবার প্রভাসের মনে পড়ল৷ ওবেলা এ-কথা উঠেছিল বটে৷ সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, বেশ হল, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল—

শরৎ সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে, কেমন হয়েছে মোহনভোগ বললেন না যে?

—খু-ব ভালো হয়েছে৷ সত্যি বলছি চমৎকার হয়েছে—

—মা খুব ভালো করতে পারতেন, তেমনটি আমার হাতে হয় না৷

—আমার একটা অনুরোধ রাখুন৷ আংটিটা পরুন আমার সামনে—

শরৎ বাক্সটা খুলে আংটিটা হাতে নিয়ে আঙুলে পরে বললে, বেশ হয়েছে৷ এই দেখুন—

প্রভাস আনন্দে গলে গিয়ে বললে, কি চমৎকার মানিয়েছে আপনার আঙুলে!

শরৎ ছেলেমানুষের মতো খুশিতে নিজের আঙুলের দিকে বার বার চেয়ে দেখতে লাগল৷

প্রভাস বললে, আচ্ছা আপনি একা থাকেন, কাকা বেরিয়ে গেলে ভয় করে না আপনার?

—ভয় করলেই বা করছি কি বলুন—উপায় তো নেই৷ বাবা লুকিয়ে পর্যন্ত পালিয়ে যান, পাছে আমি আটকে রাখি৷ ওঁর ছেলেমানুষি স্বভাব—দেখে আসছি এতটুকু বেলা থেকে৷ মা বেঁচে থাকতেও ঠিক অমনি করতেন—

—আচ্ছা, আপনি কখনো কলকাতা দেখেছেন?

শরৎ ঠোঁট উল্টে হেসে বললে, কলকাতা! উঃ—তা আর জানি নে! কখনো জীবনে গোয়াড়ি কেষ্টনগর কি নবদ্বীপ দেখলাম না, তার কলকাতা! আমি এই গড়ের খালের জঙ্গলে কাটালাম সারা জীবনটা প্রভাসদা—সত্যি বলছি ভালো লাগে না৷

প্রভাস যেন বড় উৎফুল্ল হয়ে উঠল—পরক্ষণেই আবার সে ভাবটা চেপে সহজ তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, এ আর কি কঠিন আপনার কলকাতা দেখা! যেদিন মনে করবেন, সেদিনই হতে পারে৷

শরৎ হর্ষদীপ্ত স্বরে বললে, আপনি নিয়ে যাবেন প্রভাসদা?

প্রভাস সোৎসাহে বললে, কেন নিয়ে যাব না? বলুন না আপনি কবে যাবেন? মোটর তো রয়েছে—টানা মোটরে বেড়িয়ে আসবেন কলকাতা৷

—খুব ভালো কথা প্রভাসদা৷ যাব এর মধ্যে একদিন৷ একঘেয়েমি বরদাস্ত হয় না আর৷

প্রভাস একহাত জমি শরতের দিকে এগিয়ে বসল উৎসাহের ঝোঁকে৷ বললে—আপনাকে আজ নতুন দেখছি বটে, কিন্তু মনে হয় যেন আপনার সঙ্গে আমার আলাপ আজকের নয়, অনেক পুরনো৷

কি জানি কেন, এ কথা শরতের কানে ভালো শোনাল না—সে নিজেকে কিছু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল৷ প্রভাসের কথার কোনো উত্তর সে দিলে না৷

প্রভাস বোধ হয় শরতের এ ভাব লক্ষ করলে৷ সে সুর বদলে বললে—আপনার বাবা বড় ভালো লোক, ওঁকে আমার নিজের বাবার মতো ভাবি৷

বাবার প্রশংসা শুনে শরতের মন আহ্লাদে পূর্ণ হয়ে গেল৷ তার বাবাকে গ্রামের কেউ প্রশংসা করে না, অন্তত সে তো বড়-একটা শোনে নি কখনো কারো মুখে, এক রাজলক্ষ্মী ছাড়া৷ কিন্তু রাজলক্ষ্মী বালিকা মাত্র, তার মতামতের মূল্য কি?

শরৎ বললে, বাবার মতো মানুষ একালে হয় না৷ একেবারে সাদাসিদে, কিছুই বোঝেন না ঘোরপ্যাঁচ, গাঁয়ের লোক কত রকম কি বলে, মজা দেখবার জন্যে ওঁকে নাচিয়ে দিয়ে কত রকম কি করে—সেসব দিকে খেয়াল নেই৷ দেখুন প্রভাসদা, আমাদের অতিথিশালা আছে বলে গাঁয়ের লোক ইচ্ছে করে বাইরের লোক এনে বাবার ঘাড়ে চাপাবে৷ আমাদের অবস্থা অথচ সবাই জানে—কিন্তু বাবাকে জব্দ করা তো চাই৷ আমার এত দুঃখু হয় সময়ে সময়ে!

—আপনি বলেন না কেন কাকাকে বুঝিয়ে?

—আমার কথা উনি শোনেন, না কখনো শুনেছেন? মাকেই বড় গেরাহ্যি করতেন, আর আমি! যা খেয়াল ধরবেন, তাই করবেন৷

—আচ্ছা, আজ উঠি তা হলে৷ আর এক দিন আসব এখন৷ কলকাতা যাওয়ার কথা মনে আছে তো? একদিন নিয়ে যেতে আসব কিন্তু৷

প্রভাস চলে গেলে শরৎ গৃহকর্ম শেষ করে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালল৷ চারিদিকে বন-বাদাড়ে-ঘেরা উঠোন, বেশ একটু শীত পড়েছে—হেমন্তকাল শেষ হতে চলেছে৷

শরৎ উত্তর দেউলে প্রদীপ দিয়ে এসে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকল৷ বাবা কত রাত্রে ফিরবেন ঠিক নেই—সে রান্না শেষ করে বসে থাকবে৷ একলা থেকে থেকে ভালো লাগে না সত্যই এই নিবান্দা পুরীতে, এই বন-বাদাড়ের মধ্যে৷

তার মন চায় একটু মানুষজনের সঙ্গ, কারো সঙ্গে একটু কথাবার্তা কওয়া যায়, কেউ একটা মজার গল্প বলে৷ তবুও কলকাতা থেকে প্রভাসদা এসেছিল, খানিকটা সময় কাটল৷

এই সময় যদি একবার রাজলক্ষ্মী আসত!

রান্না করতে করতে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে গল্প করা যেত তা হলে৷ মুখটি বুজে কি করে মানুষ থাকতে পারে সারাদিন?

রান্না চড়িয়ে শরৎ আপনমনে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল—

দাদা, কে বা কার পর কে কার আপন!

কালশয্যাপ’রে

মোহনিদ্রা ঘোরে

দেখি পরস্পরে অসার আশার স্বপন—

এই গ্রামেই বারোয়ারির যাত্রায় শোনা গান৷ শরতের গলার সুর এক সময়ে খুব ভালো ছিল—এখন আর কিশোরীর বীণানিন্দিত সুকণ্ঠ নেই—তবুও সে বেশ ভালোই গায়৷ তবে রাজলক্ষ্মী ছাড়া তার গান আর কেউ শোনে নি কখনও, এই যা দুঃখ! এমন কি কেদারও শোনেন নি৷

একবার সে বাইরে বেরুলো—বেশ জ্যোৎস্না আজ৷ শীতের আমেজ দিয়েছে বাতাসে—বাইরে এলে গা সির-সির করে৷ ছাতিম-বনে আর ছাতিম-ফুলের সুগন্ধ নেই—উত্তর দেউলে প্রদীপ দিতে গিয়ে সে দেখেছে৷

মনে কত সব অস্পষ্ট ইচ্ছা জাগে, কত কি করবার ইচ্ছে হয়, কত কি দেখবার ইচ্ছে হয়, এই বনের মধ্যে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই অবস্থায় থেকে মন হাঁপিয়ে ওঠে৷ অথচ এও সে জানে, অন্য কোথাও গিয়ে সে বেশি দিন থাকতে পারবে না৷

তাদের গড়ের খালের দু-পাশে বনে ভরা, ঘরবাড়ি ভাঙা ইটের আর কাঠের স্তূপ৷ কিন্তু শরতের সমস্ত অস্তিত্ব এই ভিটেটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ উত্তর দেউলে যখন সে প্রদীপ দেখাতে যায়—তখন বাদুড়নখীর জঙ্গল, ছাতিমগাছের সারি, অন্ধকারে কালো পায়রার দিঘি, ভাঙা মন্দির—এরা যেন তার জীবনে একটা স্থায়ী শান্ত অস্তিত্বের বাণী বহন করে আনে, যে অস্তিত্বটা শরতের কাছে একমাত্র সত্য ও বাস্তব৷

নীল আকাশের তলায় দুপুরের ঝমঝম রোদে কালো পায়রার দিঘিতে সে কতদিন নেমেছে ক্ষার কাচতে, কিংবা কুলের থলে মেলে দিয়েছে উঠানের মাচানের ওপর—বাবা হয়তো ঘরে ঘুমিয়ে, কিংবা হয়তো বাড়ি নেই—সেই সময় কতবার তার মনে হয়েছে নানা অদ্ভুত কথা—বহুদূরের কোনো নাম-না-জানা দেশ থেকে সে জন্মেছে এসে এই গড়বাড়ির রাজবংশে—যে রাজবংশে সে আর তার বাবা চলে গেলে বাতি দিতে আর কেউ থাকবে না৷ সে রাজবংশের মেয়ে—রূপকথার রাজকন্যা, রুক্ষ চুলে তেলের অভাব তখন তার মনে থাকে না, ভাঁড়ারের চালডালের দৈন্য, ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলি বাঁশের আড়ার ওপর—এসব সে ভুলে যায়৷

সে রাজার মেয়ে—রাজকন্যা৷

ওই নীল আকাশ, ওই ছাতিম-বনের সারি, ঘুঘু-কোকিলের দল, সারা দেশ, সারা পৃথিবী তার অস্তিত্বের দিকে সসম্ভ্রমে চেয়ে আছে কিসের অপেক্ষায়—গভীর রহস্যভরা তার মহিমান্বিত অস্তিত্বের দিকে৷

আবার এক এক সময় ভুল ভেঙে যায়৷

সে তখন বড় ছোট হয়ে পড়ে৷

যখন রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি চুপি চুপি কাঠা হাতে চাল ধার করতে যেতে হয়, কলুর তাগাদাকে হজম করতে হয়, পয়সার অভাবে ঘর্মাক্ত মুখে হেঁইও হেঁইও করে সাবানদেওয়া ময়লা কাপড়ের রাশি কাচতে হয় নির্জন দিঘির ঘাটে—তখন সে হয় নিতান্ত গরিবের ঘরের মেয়ে, হয়তো বাগদি কিংবা দুলে—তার কোনো লজ্জা নেই, সঙ্কোচ নেই, অপমান নেই—নিজের জন্যে নয়, নিজের কষ্ট সে কোনোদিন গ্রাহ্য করেও নি, কিন্তু বাবার জন্যে সে করতে পারে না এমন কাজই নেই…বাবার এতটুকু কষ্ট সে দেখতে পারবে না কোনোদিন…

তার নিঃসন্তান মাতৃত্বের সবটুকু স্নেহ গিয়ে পড়েছে বাবার ওপরে৷ বাবা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, সব জিনিস হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারেন না—তাঁকে আগলে বেড়ানো উচিত সব সময়৷

মা যখন নেই, তখন তাকেই করতে হবে বাবার সব কাজ৷ তাঁর সব সুখ-সুবিধে তাকেই দেখতে হবে৷ বাবাকে ফেলে তার মরেও সুখ নেই৷

এ অভাবের সংসারে সে যে কত জায়গা থেকে জিনিসপত্র জুটিয়ে আনে, বাবা কি তার কোনো খবর রাখেন?

তিনি দুবেলা ঠিক খাবার সময় এসে বলেন—শরৎ ভাত হয়েছে? ভাত দে মা৷ চাল যে কতদিন বাড়ন্ত থাকে, তেল-নুনের অভাবে রান্না হয় না—বাবা কখনো রেখেছেন সে সন্ধান?

রাজকন্যার গর্ব তখন খসে পড়ে, রাজকন্যা তখন এক গরিব গৃহস্থের ছেঁড়াশাড়ি-পরা মেয়ে হয়ে কাঠা হাতে তেলের বাটি হাতে ছোটে ধর্মদাস কাকাদের বাড়ি, রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি…সাজিয়ে বানিয়ে কত মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যে কথা সেখানে বলে, মানকে জলে ভাসিয়ে দেয়, চক্ষুলজ্জাকে আমল দিতে চায় না৷

যখন আরও বয়স কম ছিল, মাঝে মাঝে কিন্তু সত্যিকার রাজকন্যা হতে তার ইচ্ছে জাগত মনে৷ গড়বাড়ির পুকুরপাড়, বন, জংলী লতায় ঢাকা ইটের স্তূপ চাঁদের আলোয় ফুটফুট করছে, তার স্বাস্থ্যভরা দেহের প্রতি পদক্ষেপে গর্ব ও আনন্দ, প্রাণে অফুরন্ত গানের ঝঙ্কার, মুকুলিত প্রথম যৌবনের অপরিসীম স্বপ্ন তার চোখের চাউনিতে—তখন একদিন এক দেশের রাজপুত্র এলেন ঘোড়ায় চেপে, তার রূপের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে যে—না এসে কে থাকতে পারবে?

—বিয়ে তোমায় আমি করব না রাজপুত্তুর—

—ওমা, সে কি সর্বনাশ! তুমি বলো কি রাজকন্যে, আমার ঘোড়ার দিকে চেয়ে দেখ, ঘেমে উঠেছে৷ কদ্দূর থেকে ছুটে আসছি যে তোমার জন্যে—আর তুমি বলো কি না—

—বাজে কথা বলে লাভ কি রাজপুত্তুর! ফিরে যাও—

—কেন বলো না? কি হয়েছে?

—আমরা মস্ত বড় বংশ, তার ওপরে ব্রাহ্মণ—তোমার কোন দেশে ঘর, কি বংশ তার নেই ঠিকানা—আমায় কত হীরেমোতির গহনা দিতে হবে জানো? আমার বাবাকে একগাদা টাকা দিতে হবে জানো?…বাবা দোকান করবেন—

—এই কথা! কত টাকা দিতে হবে তোমার বাবাকে? কিসের দোকান করবেন তিনি?

—দাও দু হাজার পাঁচ হাজার৷ চাল-ডাল-ঘি-তেলের প্রকাণ্ড মুদিখানার দোকান—ছিবাস কাকার দোকানের চেয়ে অনেক, অনেক বড়—বাবার কষ্ট যে দূর করবে, সে আমায় নিয়ে যাবে—

কেদার এসে ডাক দিলেন—ও মা, ওঠ—ও শরৎ—উঠে পড়ো—

আঁচল বিছিয়ে কখন শরৎ উনুনের সামনে রান্নার পিঁড়ির পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বাবার ডাকে সে ধড়মড় করে উঠে পড়ল৷

—নাঃ, তুই কোন দিন পুড়ে মরবি দেখছি! আচ্ছা, রাঁধতে রাঁধতে অমন করে উনুনের সামনে শোয়? যদি আঁচলখানা উড়ে পড়ত আগুনে? ঘুম ধরলে তোর আর জ্ঞানকাণ্ড থাকে না—

শরৎ একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল, ঘুমজড়িত কণ্ঠে বললে, কি হয়েছে?…আঁচল উড়ে পড়ত তো বেশ ভালোই হত৷ তোমার হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে স্বগগে চলে যেতাম—বাবাঃ—রাত্তিরে একটু ঘুমুবারও যো নেই—বেশ যাও—কথা শেষ করেই শরৎ আবার তখুনি মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল৷

কেদার জানেন, মেয়ের ঘুমের ঘোর এখনও কাটে নি—এই রকমই হয় প্রায় প্রতিদিন, তিনি দেখে এসেছেন৷ ভারী ঘুমকাতুরে মেয়ে৷

তিনি আবার ডাক দিলেন—ও শরৎ—মা আমার ওঠো—এই যে আমি বাড়ি এইচি—ও মা—ওঠো, লক্ষ্মী-মা আমার—বুঝলি, উঠে চোখে জল দে দিকি? ঘুম কেটে যাবে এখন—

শরৎ এবার সত্যিই উঠল৷

কেদার বললেন, যা চোখে জল দিয়ে আয়—তোর যা ঘুম৷ রাত আর এমন কি হয়েছে? এই তো সবে রাত দশটার গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল, যখন গড়ের খাল পার হই৷

শরৎ বাবাকে খাবার ঠাঁই করে দিয়ে ভাত বাড়তে বসল৷

খানিকটা পরে খাওয়াদাওয়া সেরে কেদার তামাক খেতে খেতে বললেন—ভালো কথা, প্রভাস কখন গেল রে? বেশ ছেলেটি৷ ওকে এবার একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে হবে৷ তোরও একটা কিছু দেওয়া উচিত৷

—কি দেব বাবা? আমিও তা ভেবেছি৷

—একটা কিছু বুনে-টুনে দে না৷ আসন-টাসন গোছের৷ শুধু হাতে কারো কাছে কিছু নিতে নেই তো? দিস একটা কিছু করে৷ আংটিটা কই দেখি?

শরৎ মৃদু হাসিমুখে বললে, সে নেই বাবা৷

কেদার অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, নেই! কি হল?

শরৎ মুখ নিচু করে হাসি-হাসি মুখেই বললে, সে বাবা আমি দিঘির জলে ফেলে দিয়ে এসেছি৷ রাগ করো নি বাবা?

—সে কি রে? কখন?

—উত্তর দেউলে পিদিম দিতে যাওয়ার সময়৷ কি হবে বাবা বিধবা মানুষের হীরের আংটি পরে?

কেদার মেয়ের সঙ্গে তর্ক করলেন না৷ মেয়েকে চিনতে তাঁর বাকি নেই৷ সুতরাং তিনি চুপ করে রইলেন৷ কেবল তাঁর মনে দুঃখ হচ্ছিল অমন দামি আংটিটা যদি রাখবিই নে বাপু, তবে সে বেচারির কাছ থেকে নেওয়া কেন?

এমন খামখেয়ালি মেয়ে!

.

দুপুরে রাজলক্ষ্মী এল শরতের কাছে৷ কেদার খেয়ে হাট করতে বেরিয়ে গিয়েছেন—আজ গেঁয়োহাটির হাটবার৷

রাজলক্ষ্মী দেখতে বেশ মেয়েটি৷ নিতান্ত পাড়াগেঁয়ে, কখনো শহরের মুখ দেখে নি, তবে শহরের কথা অনেক জানে৷ তার দুই মামাতো ভগ্নীপতি এখানে মাঝে মাঝে আসে৷ কলকাতায় কাজ করে তারা—শহরের অনেক গল্প সে শুনেছে ওদের মুখে৷

রাজলক্ষ্মী বললে, হাঁ শরৎদি, প্রভাসবাবু বুঝি কাল বিকেলে তোমাদের বাড়ি এসেছিল? কি বললে?

—বলবে আর কি, বৈকেলে এসেছিল, সন্দের আগে চলে গেল৷ গল্পগুজব করলে বসে—চা করে দিলাম৷ বেশ লোক প্রভাসদা৷ আমাদের বলেছে এক দিন কলকাতায় নিয়ে যাবে—বাবাকে আর আমাকে৷

—কবে শরৎ দিদি?

—তার কিছু ঠিক আছে? তবে প্রভাসদা বলেছে যেদিন আমি মনে করব সেদিনই নিয়ে যাবে৷

—রেলে?

—না, মোটর গাড়িতে৷ এখান থেকে সমস্ত পথ মোটরে যাবে—কেমন মজা হবে, কি বলিস? তুই চড়েছিস কখনো মোটর গাড়িতে?

রাজলক্ষ্মী উদাস নয়নে অন্য দিকে চেয়েছিল৷ শরৎদিদির কথায় তার মনে কত অদ্ভুত ছবি জেগে উঠেছে৷ আজ বছর দুই আগে পিসেমশাই একটি বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন তার জন্য—ছেলেটি কলকাতায় চাকরি করত৷ চল্লিশ টাকা মাইনে৷ বেড়ে নাকি হতে পারে একশো টাকা৷ তাদের পৈতৃক বাড়ি কোন্নগর, চাকরি উপলক্ষে কলকাতায় আছে অনেক দিন৷

সম্বন্ধটা রাজলক্ষ্মীর মনে ধরেছিল৷ ছেলেটিও দেখতে নাকি ভালোই ছিল৷ কি দেনা-পাওনার গণ্ডগোলে সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছে৷

মাস দুই ধরে কথাবার্তা চলবার ফলে রাজলক্ষ্মীর মন অনেকবার নানা রঙিন স্বপ্ন বুনেছিল সেটাকে ঘিরে৷ কখনো যে কলকাতা সে দেখে নি এবং হয়তো দেখবেও না কখনো ভবিষ্যতে—সেই কলকাতা শহরের একটা বাড়ির দোতলার ঘরে খাট টেবিল চেয়ার সাজানো তাদের ঘরকন্না, দালানের এক কোণে ছোট্ট একটি খাঁচায় টিয়া কি ময়না পাখি, মাটি-দেওয়া-টিনের টবে তুলসী গাছ, একটা ঘেরাটোপ-মোড়া সেলাইয়ের কল টেবিলের এক পাশে—নিস্তব্ধ দুপুরে বসে সে হয়তো কিছু একটা বুনছে কি সেলাই করছে—উনি গিয়েছেন আপিসে—বাসায় শ্বশুর-শাশুড়ি বা ও ধরনের কোনো ঝামেলা নেই—সে আছে একাই—নিজেকে কত মনে মনে সেই কল্পনীয় ঘরকন্নাটিতে ডুবিয়ে দিয়েছে সে, সে ঘরের খুঁটিনাটি কত কি পরিচিত হয়ে উঠেছিল তার মনের মধ্যে—দেখলেই যেন চিনে নিতে পারত ঘরটা—কিন্তু কোথায় কি হয়ে গেল, সে ঘরে গিয়ে ওঠা তার আর ঘটে উঠল না৷

শরৎ দিদির কথায় সে অল্পক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, শেষের দিকের প্রশ্নের মানে সে ভালো করে না বুঝে শূন্যদৃষ্টিতে শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে—কি বললে শরৎদি? মজা?…ও, মজা হবে না আবার? খুব হবে৷ সত্যি কথা বলতে কি, এখান থেকে যেখানে বেরুবে সেখানেই ভালো লাগবে৷ একঘেয়ে দিন যেন আর কাটতে চায় না৷ অসহ্য হয়ে উঠছে দিন দিন৷ দুপুরে যে তোমার এখেনে নিশ্চিন্দি হয়ে বসব তার উপায় নেই৷ এতক্ষণ কাকিমা ঘুম থেকে উঠলেন, যদি দেখেন এখনও এঁটো বাসন মাজা হয় নি, রান্নাঘর ধোয়া হয় নি, তবে সন্ধে পর্যন্ত বকুনি চলবে৷

শরৎ হাসিমুখে বললে, তা হলে তুই ঝগড়া করে এসেছিস বাড়ি থেকে, ঠিক বললাম৷ হ্যাঁ কি না বল?

রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷

শরৎ বললে, তাই বুঝলাম এতক্ষণ পরে৷ নইলে ঠিক দুপুরবেলা তুমি আসবার মেয়েই আর কি! ভাত খেয়ে এসেছিস না আসিস নি, সত্যি কথা বল—আমার মাথার দিব্যি—আমার মরা মুখ দেখবি—

—না, তা নয়৷ তেমন ঝগড়া নয়৷ ভাত খেয়েছি বৈকি—

—সত্যি বলছিস?

—মিথ্যে কথা বলব না শরৎদি, তুমি যখন অমন দিব্যি দিলে৷ না, সে খাওয়ার কথা নিয়ে নয়—ঝগড়া নিয়েও নয়, সত্যিই এত একঘেয়ে হয়ে উঠেছে এখানে—ইচ্ছে হয় যেদিকে দু-চোখ যায় ছুটে যাই—

—সত্যি, যা বলিস ভাই, আমারও বড় একঘেয়ে লাগে৷ সেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একই হাঁড়ি-হেঁসেল নিয়ে নাড়ছি, আর একই দিঘির ঘাটে সতেরো বার দৌড়ুচ্ছি, তার পর কেবল নেই আর নেই—

কিন্তু তরুণী রাজলক্ষ্মীর মন যা চায়, যে জন্যে ব্যাকুল—শরৎ তা ঠিক বুঝতে পারে নি৷ রাজলক্ষ্মীও ঠিকমতো বোঝাতে পারে না, তাই নিয়েই তো আজ বাড়িতে কাকিমার বকুনি খেতে হল৷ সে সর্বদা নাকি থাকে অন্যমনস্ক, কি তাকে বলা হয় নাকি তার কানে যায় না—ইত্যাদি, তার বিরুদ্ধে বাড়ির লোকের অভিযোগ৷ শরৎ বুঝতে পারে না ওর দুঃখ৷ ঘরকন্না করে করে শরতের মন বসে গিয়েছে এই সংসারেই, যেমন তাদের বংশের পুরনো আমলের পাথরের থাম আর ভাঙা মূর্তিগুলো ক্রমশ মাটির ওপর চেপে বসতে বসতে ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে!

উঠোনের রোদ এইসময় একটু পড়ল৷ রাজলক্ষ্মী বললে—চলো শরৎ-দি, একটু গিয়ে দিঘির ঘাটে বসি, বেশ ছায়া আছে গাছের—বেশ লাগে৷

শরৎ বললে, আমায় তো যেতেই হবে এঁটো বাসন মাজতে৷ চল ওখানে বসে গল্প করিস—আমার কি হয়েছে জানিস—মুখ বুজে থেকে থেকে আরও মারা গেলুম৷ আচ্ছা তুই বল রাজলক্ষ্মী, ভালো লাগে সকাল থেকে রাত দশটা অবধি? কার সঙ্গে দুটো কথা কই যে!—বাবা তো সব সময়েই বাইরে—

—তুমি তো আবার এমন জায়গায় থাকো যে গাঁয়ের কেউ আসতে পারে না৷—এত দূর আর এই বনের মধ্যিখানে৷ জানো শরৎ-দি, গাঁয়ের বৌ-ঝি এদিকে আসতে ভয় পায়, সাধনের বৌ সেদিন বলছিল গড়বাড়িতে নাকি ভূত আছে—

—সাধনের বৌয়ের মুণ্ডু—দূর!

—তোমার নাকি সয়ে গিয়েছে৷ তা ছাড়া সে ভূতে তোমায় কিছু বলবে না৷ তুমি তো এই বংশের মেয়ে—রাজার মেয়ে৷ আমাদের মতো গরিব-গুরবো লোকদেরই বিপদ—হি—হি—

—মরবি কিন্তু মার খেয়ে আমার কাছে—

কালোপায়রা দিঘির সান-বাঁধানো ভাঙা ঘাটের নিচু ধাপে বড় বড় গাছের ছায়া এসে পড়েছে পুকুরের জলে আর ঘাটের রানাতে৷ ঘাটে ছাতিম আর অন্য অন্য গাছের ছায়া৷ বাঁ-দিকে দূরে উত্তর দেউল, যদিও এখান থেকে দেখা যায় না—সামনে সেই ইটের টিবিটা৷ প্রভাস যেখান থেকে ইট নিয়ে গিয়েছে গ্রামের স্কুলের জন্যে৷ সামনে প্রকাণ্ড দিঘিটার নিথর কালো জল—জলের ওপর এখানে-ওখানে পানকলস আর কলমির দাম, কোণের দিকে রাঙা নাললতার পাতা ভাসছে, যদিও এখন ওর ফুল নেই৷

শরৎ এ সময় রোজ বসে একাই বাসন মাজে৷ আজ রাজলক্ষ্মীকে পেয়ে ভারি খুশি হয়েছে সে৷

এই ঘাটে বসে শরৎ কত স্বপ্ন দেখেছে—রোজ এই বাসন মাজবার সময়টি একা বসে বসে৷ নীল আকাশের তলায় ঠিক দুপুরের অলস স্তব্ধতাভরা ছাতিম-বন, ভাঙা ইটের রাশ আর কালো পায়রা দিঘির নিথর কালো জল—হয়তো কখনো কাক ডাকে কা-কা—কিংবা যেমন আজকাল ঘুঘু সারাদুপুর ধরে ডাকের বিরাম বিশ্রাম দেয় না৷ কি ভালোই যে লাগে!

জীবনের যে একঘেয়েমির কথা রাজলক্ষ্মী বললে, শরৎ তা কখনো হয়তো সে ভাবে বোঝে নি৷ এই গ্রামে এই গড়বাড়ির ইটের ভগ্নস্তূপের মধ্যে সে জন্মেছে—এরই বাইরের অন্য কোনো জীবনের সে কল্পনা করতে পারে না৷ অন্তত করতে পারত না এতদিন৷

কিন্তু কি জানি, সম্প্রতি তার মনে কোথা থেকে বাইরের হাওয়া এসে লেগেছে—কালো দিঘির নিস্তরঙ্গ শান্ত বক্ষ চঞ্চল হয়ে উঠেছে৷

প্রথমে এল তাদের অতিথিশালায় সেই বুড়ো বামুন, তার বাবার কাছে যে জেলার সীমানা দেখবার অপূর্ব গল্প করেছিল৷ যা ছিল স্থাণুবৎ অচল, অনড়—সেই নির্বিকার অতি শান্ত অস্তিত্বের মূলে কোথায় যেন সে কি নাড়া দিয়ে গেল৷ তার এবং তার বাবার৷

বামুনজ্যাঠা কত গল্প করতো তার রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে বসে৷ বাইরের ঘরকন্না, কত সংসারের কথা, কত ধরণের সুখ-দুঃখের কাহিনী৷ বড় বড় আম কাঁঠালের বাগান, যা তাদের গড়ের বাগানের চেয়েও অনেক বড়, পঞ্চাশ বিঘের কলমের আমবাগান; কত বড় বাড়ি, তাদের মেয়েদের বৌদের কথা, দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের মধ্যে বাবলা গাছের সারি, শেওড়াবন, শিরীষের ফল পেকে ফেটে কালো বীচির রাশি ছড়িয়ে আছে; উইয়ের ঢিবির পাশে বনধুতুরার ঝোপ৷ শরৎ তন্ময় হয়ে শুনত৷…

অন্য এক জীবন, অন্য এক অস্তিত্বের বার্তা বহন করে আনতো এ সব গল্প৷ আজ সে মেয়ে হয়ে জন্মেছে—তার হাত-পা বাঁধা, কোথাও যাবার উপায় নেই, কিছু দেখবার উপায় নেই—তার ওপর রয়েছেন বাবা, বৃদ্ধ, সদানন্দ বালকের মতো সরল, নির্বিকার৷

তার পরে এল প্রভাসদা৷

প্রভাসদা এল আর এক জীবনের বার্তা নিয়ে৷ শহরের সহস্র বৈচিত্র্য ও জাঁকজমক আছে সে কাহিনীর মধ্যে৷ মানুষ যেখানে থাকে অত অদ্ভুত আমোদ-প্রমোদের মধ্যে ডুবে—নিত্য নতুন আনন্দের মধ্যে যেখানে দিন কাটে, দেখতে ইচ্ছে হয় শরতের সে দেশ কেমন৷ খুব বড় একটা আশা ও আকাঙ্ক্ষা শরতের মনে জেগেছে প্রভাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে৷

তার পরে এই রাজলক্ষ্মী, ষোল বছরের কিশোরী মেয়ে তো মোটে—এরও নাকি একঘেয়ে লাগছে আজকাল গড়শিবপুরের জীবন৷ ওর বয়সে শরৎ শুধু শিবপুজো করেছে বসে বসে দিঘির ঘাটে বোধনের বেলতলায়, অত সে বুঝতও না, জানতও না৷

কিন্তু আজকালের মেয়েদের মন আলাদা৷ শরৎ যে কালের মেয়ে, সে কাল কি আছে?

রাজলক্ষ্মী শরতের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল—সত্যি শরৎদি—

শরৎ মুখ নিচু করে বাসন মাজছিল, মুখ তুলে ওর দিকে চেয়ে বিস্ময়ের সুরে বললে, কি রে?

—আচ্ছা, তোমার চেহারা দেখলে কে বলবে তোমার বয়স হয়েছে! তোমাকে দেখে, আমি মেয়েমানুষ, আমারই চোখের পলক পড়ে না শরৎদি—সত্যি-সত্যি বলছি৷ রাজকন্যে মানায় বটে৷

শরৎ সলজ্জ হাসি হেসে বললে, দূর বাঁদরী!

—মিথ্যে বলি নি শরৎদি—এতটুকু বাড়িয়ে বলছি নে—

—কেন নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝি কথা বলিস নে?

—আর লজ্জা দিয়ো না দিদি, তোমার পায়ে পড়ি৷ অনেক তাকিয়ে দেখেছি, কাজেই ওকথা মনে সর্বদাই জেগে থাকে৷ ওকথা তুলে আর কেন মন খারাপ করিয়ে দ্যাও?

শরৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ইতস্তত করে বললে—একটা কথা বলব রাজলক্ষ্মী?

—কি শরৎদি?

—আমায় অমন কথা আর বলিস নে৷ কে কোথায় থেকে শুনবে আর কি ভাববে৷ এ গাঁ বড় খারাপ হয়ে উঠেছে ভাই৷

—কেন শরৎদি এ কথা বললে?

—তোকে এতদিন বলি নি, কাউকে বলি নি বুঝলি? কিন্তু যখন কথাটা উঠলই, তখন তোর কাছে বলি৷

—কি কথা বলে ফেল না ঝাঁ করে৷ হাঁ করে তোমার মুখের দিকে কতক্ষণ চেয়ে থাকব—

—এ গাঁয়ের কতকগুলো পোড়ারমুখো ড্যাকরা জুটেছে, তাদের মা বোন জ্ঞান নেই—সেগুলোর জ্বালায় আমার সন্দের সময় উত্তর দেউলে পিদিম দিতে যাবার যদি জো থাকে—সেগুলো কবে ষাঁড়াতলার ঘাটসই হবে তাই ভাবি—

রাজলক্ষ্মী অবাক হয়ে শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, বলো কি শরৎদি! এ কথা তো কোনো দিন শুনি নি তোমার মুখে! কবে দেখেছ? কি করে তারা?

—কি করে আবার—উত্তর দেউলে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে, ছাতিমবনের মধ্যে ফিসফিস করে৷ রোজ নয়, মাঝে মাঝে প্রায়ই করে৷ এই কালও তো করেছিল৷

—কাল?

—কালই৷ প্রভাসদা উঠে চলে গেল, তখন প্রায় বেলা গড়িয়ে গিয়েছে৷ আমি উত্তর দেউলে গেলাম সন্দে দেখাতে, আর অমনি শুনি মন্দিরের পশ্চিম গায়ে দেওয়ালের ওপাশে কার পায়ের শব্দ অন্ধকারে—

—বলো কি শরৎদি! আমার শুনে যে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ তোমার ভয় করল না?

—আমার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে ভাই৷ আর বছর সারা বর্ষাকাল অমনি করে মরেছে পোড়ারমুখোরা—তাদের যমে ভুলে আছে—আবার শুরু করেছে এই ক’দিন—

—তার পর, কি হল?

—কি আর হবে, সাহস নেই এক কড়ার৷ হেই করলে কুকুরের মতো পালিয়ে যায়৷ একবার যদি দেখতে পাই—তবে দেখিয়ে দিই কার সঙ্গে তারা লাগতে এসেছে৷ বঁটি দিয়ে নাক কেটে ছাড়ি—

—জ্যাঠামশায়কে বলো না কেন?

—বাবাকে? পাগল! উনি কিছু করতে পারবেন না, মাঝে পড়ে গাঁয়ে ঢাক বাজিয়ে বেড়াবেন৷ মন্দ লোকে পাঁচ কথা বলবে৷

—বাবাকে কি ধর্মদাসকে বলব তবে?

—না ভাই, কাউকে বলবি নে৷ পাঁচ জনে পাঁচ রকম কথা ওঠাবে৷ গাঁয়ের লোক বড় খারাপ, জানো তো সবই৷ কাকারা করতে যাবেন ভালো ভেবে, হয়ে যাবে উল্টো৷ তা ছাড়া তাঁরা করবেনই বা কি? চোখে তো কাউকে দেখি নি!

—আচ্ছা সন্দেহ হয় কারো ওপরে শরৎদি?

শরৎ চুপ করে নিচু মুখে বাসন মাজতে লাগল৷

রাজলক্ষ্মী বললে, বলো না শরৎদি, কাউকে সন্দেহ কর?

—কার ভাই নাম করব—যখন চোখে দেখি নি৷ তবে সন্দেহ আমার হয় কার ওপর তা বলতে পারি, তুই কিন্তু কারো কাছে কিছু বলতে পারবি নে৷ কীর্তি মুখুজের ভাগ্নে অনাদি ছোঁড়াটার চালচলন অনেক দিন থেকে খারাপ দেখছি৷ রাস্তাঘাটে যখন দেখা হয়—তখন কেমন হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, শিস দেয়—আর ওই বটুক মুখপোড়াটাকেও আমার সন্দেহ হয়৷

—বটুক-মামা? তার তো বয়েস হয়েছে অনেক—তবে—

—বয়েস হয়েছে তাই কি? আমিও তো দাদা বলে ডাকি৷ ও লোক কিন্তু ভালো না৷

—সে আমিও একটু একটু না জানি এমন নয় শরৎ দিদি—একদিন হয়েছে কি শোনো তবে বলি৷ আমি আসছি হারান চক্কত্তিদের বাড়ি থেকে—ঠিক দপুর বেলা, ঘোষেদের কাঁটালবাগানে এসে বটুক মামার সঙ্গে দেখা—

শরৎ বাধা দিয়ে বললে, থাকগে—ওসব কথা আর শুনে কি করব? ওসব শুনলে রাগে আমার সর্বশরীর রি-রি করে জ্বলে৷ তবে ওরা এখনও আমায় চিনতে পারে নি৷ কাউকে কিছু বলবার দরকার নেই আমার৷ শাস্তি যেদিন দেব, সেদিন নিজের হাতে দেব৷ মুখপোড়াদের শিক্ষে সেদিন ভালো করেই হবে৷ তবে একটা কথা বলি—যাদের নাম করলাম, তাদের সন্দেহ করি এই পর্যন্ত৷ ওরা কিনা আমি ঠিক জানি নে—চোখে তো দেখতে পাই নি কাউকে৷ অন্যায় দোষ দিলে ধম্মে সইবে না৷

রাজলক্ষ্মী প্রশংসমান দৃষ্টিতে শরতের সুগঠিত সুন্দর দেহের দিকে চেয়ে চেয়ে বললে—সে যদি কেউ পারে, তবে তুমিই পারবে শরৎদি, তা আমি জানি৷ তোমায় দেখলে আমাদের মনে সাহস আসে৷

শরৎ দুষ্টুমির হাসি হেসে রাজলক্ষ্মীর মুখের দিকে সুন্দর ভঙ্গিতে চেয়ে বলল—ইস! বলিস কি রে! সত্যি? সত্যি নাকি?

রাজলক্ষ্মীও উৎসাহের সুরে হাসিমুখে বললে, বাঃ, কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায় শরৎ দিদি? কি চমৎকার ভাবে চাইলে? আমারই মন কেমন করে ওঠে, তবুও আমি মেয়েমানুষ৷

শরৎ কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বললে, আবার! বারণ করে দিলাম না? ওসব কথা বলবি নে৷ মেয়ের এদিকে নেই ওদিকে আছে! চল বাসনগুলো কিছু নে দিকি হাতে করে—বেলা আর নেই৷ এখন ছিষ্টির কাজ বাকি!

.

বাড়ি ফিরে রাজলক্ষ্মী বললে, চলে যাই শরৎ দিদি—সন্দে হলে যেতে ভয় করবে৷

শরৎ তাকে যেতে দিলে না৷ বললে—ও কি রে! তোকে কিছু খেতে দিলাম না যে? তা হবে না৷ এইবার চা করি, আর কিছু খাবার করি৷

—না শরৎদি, পায়ে পড়ি ছেড়ে দাও আজ৷ আর একদিন এসে খাব এখন৷

শরৎ কিছুতেই শুনলে না—কখনো সে রাজলক্ষ্মীকে কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দেয় না, নিজে সে গরিব ঘরের মেয়ে, রাজলক্ষ্মীর দুঃখ ভালো করেই বোঝে৷ বাড়িতে হয়তো বিকেলে খাবার কিছুই জোটে না—আসে এখানে, গল্প করে—ওকে খাওয়াতে পারলে শরতের মনে তৃপ্তি হয় বড়৷ শরৎ চা করে দিলে ওকে, নিজের জন্যে একটা কাঁসার গ্লাসে ঢেলে নিলে৷ হালুয়া করে ওকে কিছু দিয়ে বাকিটা বাবার জন্য রেখে দিলে৷

রাজলক্ষ্মী বললে, ওকি শরৎদি, তুমি নিলে না?

—আমি একবোরে সন্দের পরই তো খাব৷ এখন খেলে আর খিদে পায় না, তুই খা৷

রাজলক্ষ্মী চা ও খাবার পেয়ে একটু খুশিই হল৷ বললে, কি সুন্দর হালুয়া তুমি করো শরৎদি—

—যাঃ, আমার সবই তো তোর ভালো!

—তা ভালো লাগলে বলব না? বা রে—তোমার সবই আমার যদি ভালো লাগে, তবে কি করি বলো না?

—আমারও ভালো লাগে তুই এলে, বুঝলি? এই নিবান্দা পুরীর মধ্যে একা মুখটি বুজে সদাসর্বদা থাকি, কেউ এলে গেলে বড় ভালো লাগে৷ বাবা তো সব সময় বাড়ি থাকেন না—তোর সঙ্গে বেশ একটু গল্পগুজব করে বড় আমোদ পাই৷

—আমারও শরৎদি! গাঁয়ের আর কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশে তেমন আমোদ পাই নে, তাই তো তোমার কাছে আসি৷

রাজলক্ষ্মীর বিবাহের বয়স পার হয়েছে—কিন্তু বাপ-মায়ের পয়সার জোর না থাকায় এখনও কিছু ঠিকঠাক হয়নি৷ শরতের মনে এটা সর্বদাই ওঠে, যেন তার নিজেরই কন্যাদায় উপস্থিত৷

কেদারকে দিয়ে শরৎ দু-এক জায়গায় কথাবার্তা তুলেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পয়সাকড়ির জন্যে সে-সব সম্বন্ধ ভেঙে যায়৷ আজ দিন দশ-বারো হল, কেদার আর একটা সম্বন্ধ এনেছিলেন—শরতের শুনে মনে হয়েছে সেখানে হলে ভালোই হয়৷ পূর্বে এ নিয়ে একবার দুই সখীর মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে৷

আজও শরৎ বললে—ভালো কথা, রাজলক্ষ্মী—আসল ব্যাপারের কি করবি বল—

রাজলক্ষ্মী না বুঝতে পারার ভান করে বললে—কি ব্যাপার আসল?

—তোকে যে-কথা সেদিন বললাম৷ সাঁতরা পাড়ার সেই সম্বন্ধটা—

রাজলক্ষ্মী মনে মনে খুশি হয়ে উঠল৷ মুখে বললে—যাঃ, আর ও-সবে দরকার নেই৷ বেশ আছি৷ কেন তাড়িয়ে দেবে শরৎদি?

—না, ও-সব চালাকি রাখ দিকি৷ এখন আমায় বল, বাবাকে কি বলব?

যার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব উঠেছে তার সম্বন্ধে সব কথা রাজলক্ষ্মী ইতিপূর্বে দুবার শুনেছে শরতেরই মুখে—তবুও তার ইচ্ছে হল আর একবার সেকথা শোনে৷

শুনতে লাগে ভালোই৷ তবুও কিছু নূতনত্ব৷

সে তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, ভারি তো সম্বন্ধ! ছেলে কি করে বলেছিলে?

শরৎ বললে, নৈহাটিতে পাটের কলে চাকরি করে, শুনেছি মাকে নিয়ে নৈহাটিতেই বাসা করে থাকে৷

রাজলক্ষ্মী ঠোঁট উলটে বললে, পাটের কলে আবার চাকরি৷ তুমিও যেমন!…

রাজলক্ষ্মী কথাটা বললে বটে, কিন্তু তার মনে হল এ সম্বন্ধ খারাপ নয়৷ ছেলেটির বিষয়ে আরও কিছু জানবার তার খুব কৌতূহল হল, কেমন দেখতে, কত টাকা মাইনে পায়, বাড়িতে আর কেউ আছে কিনা৷

শরৎ কিন্তু সে দিক দিয়েও গেল না৷ বললে, তা তো বুঝলাম, তোর খুব উঁচু নজর৷ কিন্তু জজ মেজেস্টার পাত্র এখন পাওয়া যাচ্ছে কোথায় বল? অবস্থা বুঝে তো ব্যবস্থা? কি মত তোর?

রাজলক্ষ্মী চুপ করে থেকে বললে, ভেবে বলব শরৎদি—আচ্ছা কি পাশ বলেছিলে যেন সেদিন?

খানিকক্ষণ এ-সম্বন্ধে কথা চলে যদি, বেশ লাগে৷

শরৎ বলে, ম্যাট্রিক পাশ৷

—মোটে!

—অমন কথা বলিস নে৷ দু-তিনটে পাশ পাত্র কি পাওয়া সহজ? এতগুলো টাকা চাইবে৷

—আচ্ছা, পাটের কল কি রকম শরৎদি?

শরৎ হেসে বললে, আমি তো আর দেখি নি কখনো৷ তোরও পরের মুখে ঝাল খাওয়ার দরকার কি, একেবারে নিজের চোখেই তো দেখবি৷

—যাঃ, শরৎদি যেন কি!

শরৎ হাসতে হাসতে বললে, আচ্ছা শোন, তুই যে বলছিস ম্যাট্রিক পাশ কিছুই না—দু-তিনটে পাশ ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দিলে তুই কথা বলতে পারবি তার সঙ্গে?

—কেন পারব না, দেখে নিও—

গল্পে দুজনে উন্মত্ত, কখন ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, বাইরে বেশ অন্ধকার নেমেছে, ওরা খেয়ালই করে নি৷ ছাতিমবনে শেয়াল ডেকে উঠলে ওদের চমক ভাঙল৷

রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ও শরৎদি, একেবারে অন্ধকার ছেয়ে গেল যে! আমি কি করে যাব?

—বোস না৷ বাবা এলে তোকে বাড়ি দিয়ে আসবেন এখন৷

—না শরৎদি আমি যাই, তুমি গড়ের খাল পার করে দিয়ে এসো আমায়—বাকি পথ ঠিক যাব৷ আমার যত ভয় এই গড়ের মধ্যে৷

—আর আমি একলাটি এখন কতক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকব তার ঠিক আছে? বাবা যে কখন ফিরবেন! তুই থাকলে বড্ড ভালো হত৷ থাক না লক্ষ্মীটি—আর একটু চা খাবি?

কিন্তু রাজলক্ষ্মী আর থাকতে চাইল না৷ বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকলে মা ভারি বকবে৷ একলাটি অন্ধকারে যেতে ভয়ও করে৷ কেদার-জ্যাঠার আসবার ভরসায় থাকতে গেলে দুপুররাত হয়ে যাবে, বাপ রে!

কেরোসিনের টেমি ধরে শরৎ গড়ের খাল পর্যন্ত রাজলক্ষ্মীকে এগিয়ে দিল৷ রাজলক্ষ্মী খাল পার হয়ে ওপারের রাস্তায় উঠে বলে, তুমি যাও শরৎদি, গোয়ালাদের বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে—আর ভয় নেই৷

যেতে যেতে সে ভাবছিল, নৈহাটি কেমন জায়গা না জানি!

সংসারে বেশি ঝামেলা না থাকাই ভালো৷

ম্যাট্রিক পাশ ছেলে মন্দ নয়৷

ছেলের রংটা কালো না ফর্সা?

০৩. শীত কমে গিয়েছে

শীত কমে গিয়েছে—বসন্তের হাওয়া দিতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সজনে গাছে থোকা থোকা ফুল দেখা দিয়েছে৷

কেদার নিজের গ্রামেই একটি কৃষ্ণযাত্রার দল খুলেছেন৷ সম্প্রতি এ অঞ্চলে কৃষ্ণযাত্রার একটা হিড়িক এসে পড়েছে—গত পুজোর সময় থেকে এর সূত্রপাত ঘটে, বর্তমানে মহামারীর মতো গ্রামে গ্রামে হুজুক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কেদার হটবার পাত্র নন, তাঁর গ্রামকে ছোট হয়ে থাকতে দেবেন কেন—জেলেপাড়া, কামারপাড়া এবং কুমোরপাড়ার লোকজন জুটিয়ে তিনিও এক দল খুলে মহা উৎসাহে মহলা আরম্ভ করেছেন৷ স্নানাহারের সময় নেই তাঁর, ভারি ব্যস্ত৷ সম্প্রতি তাঁর দলের গাওনা হবে চৈত্রমাসে অন্নপূর্ণা পূজার দিন, গ্রামের বারোয়ারি তলায়৷ বেশি দেরি নেই, দেড় মাস মাত্র৷

সীতানাথ জেলের বাড়ির বাইরে বড় ছ-চালা ঘর৷ যাত্রার দলের মহলা এখানেই রোজ বসে৷ অন্য সকলের আসতে একটু রাত হয়, কারণ সবাই কাজের লোক—কাজকর্ম সেরে আসতে একটু দেরিই হয়ে পড়ে৷ কেদারের কিন্তু সন্ধ্যা হতে দেরি সয় না, তিনি সকলের আগে এসে বসে থাকেন৷

সীতানাথ বাড়ি নেই—শীতকালের মাঝামাঝি নৌকো করে এখান থেকে পাঁচ দিনের পথ চূর্ণী নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছে—এখনও দেশে ফেরে নি৷

সীতানাথের বড় ছেলে মানিক বাড়িতে থাকে ও গ্রামের নদীতেই মাছ ধরে স্থানীয় হাটে বিক্রি করে সংসার চালায়৷ আজ পুরো মহলা হবে বলে সে সকাল সকাল নদী থেকে ফিরে এসে বাইরের ঘরে বড় বড় খানকতক মাদুর ও চট পেতে আসর করে রেখেছে৷

কেদারকে বললে, বাবাঠাকুর, তামাক কি আর এক বার ইচ্ছে করবেন?

—তা সাজ না হয় একবার৷ হ্যাঁরে মানকে, এরা এখনো সব এল না কেন?

—আসছে বাবাঠাকুর, সবাই কাজ সেরে আসছে তো, একটু দেরি হবে৷

—তুই তামাক সেজে একবার দেখে আয় দিকি বিশু কুমোরের বাড়ি৷ ওর ছেলেটাকে না হয় ডেকে আন৷ সে রাধিকা সাজবে, তার গানগুলো ততক্ষণ বেহালায় রপ্ত করে দিই—

কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে জন দুই অভিনেতা ঘরে ঢুকল—একজন ছিবাস মুদি আর একজন হৃষিকেশ কর্মকার৷

কেদার খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে ছিবাস যে! এই যে রিষিকেশ, এসো এসো—তোমরা না এলে তো রিয়্যাশাল আরম্ভ হয় না৷ বেশ ভালো করেছ—বসো৷

মানিক ততক্ষণ তামাক সেজে কেদারের হাতে দিয়ে বললে, তামাক ইচ্ছে করুন!

কেদারের মনে অকস্মাৎ তুমুল আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল৷ বাইরের ঝিরঝিরে মিঠে ফাল্গুনের হাওয়ায় আমের বউলের সুঘ্রাণ, একটা আঁকোড় ফুলের গাছে সাদা ফুল ধরেছে—সামনে এখন অর্ধেক রাত পর্যন্ত গানবাজনার গমগমে আসর, কত লোকজন, ছেলে-ছোকরা আসবে, মানুষের জীবনে এত আনন্দও আছে!

তামাক খেতে খেতে কেদার খুশির আতিশয্যে বলে উঠলেন, ওহে রিষিকেশ, এদিক এসো—ততক্ষণ তোমার আয়ান ঘোষের পার্টটা একবার মুখস্ত বলে যাও শুনি—

কেদারের হুকুম অমান্য করবার সাধ্য নেই কারো এ আসরে৷ হৃষিকেশ কর্মকার দু-একবার ঢোঁক গিলে, দু-একবার ঘরের আড়ার দিকে তাকিয়ে বিপন্ন মুখে বলতে শুরু করলে—‘অদ্য পৌর্ণমাসি রজনী, যমুনা পুলিনের কি অদ্ভুত শোভা! কিন্তু অহো! আমার হৃদয়ে সহস্র বৃশ্চিকদংশনের মতো এরূপ মর্মঘাতী জ্বালা অনুভব করিতেছি কেন?—কোকিলের কুহু-ধ্বনি আমার কর্ণকুহরে—’

—আঃ দাঁড়াও দাঁড়াও, অমন নামতা মুখস্ত বলে গেলে হবে না৷ থেমে দমক দিয়ে দিয়ে বলো—কাঠের পুতুলের মতো অমন আড়ষ্ট হয়ে থাকার মানে কি? হাত-পা নড়ে না?

এই সময় কয়েকজন লোক এসে ঢুকল৷ কেদারের ঝোঁক গানবাজনার দিকে, শুধু বক্তৃতার তালিম তাঁর মনে পুরো আনন্দ দিতে পারে নি এতক্ষণ, নবাগতদের মধ্যে বিশ্বেশ্বর পালের ছেলে নন্দকে দেখে তিনি হঠাৎ অতিমাত্রায় খুশি হয়ে উঠলেন৷

—আরে ও নন্দ, এত দেরি করে এলি বাবা, তবেই তুই রাধিকা সেজেছিস! বারোখানা গান তোমার পার্টে, আজই সব তালিম দেওয়া চাই, নইলে আর কবে কি হবে শুনি? বোস, বেয়ালা বেঁধে নি—গানগুলো আগে হয়ে যাক৷

দু-একজন ক্ষীণ আপত্তি তুলবার চেষ্টা করলে৷ ছিবাস মুদির নন্দ ঘোষের পার্ট, সে বললে, এ্যাকটোর সঙ্গে সঙ্গে গান চললে একানে গানগুলো ভালো রপ্ত হয়ে যেত বাবাঠাকুর—নইলে এ্যাকটো আড়ষ্ট মেরে যাবে যে!

কেদার মুখ খিঁচিয়ে বললে, থামো না ছিবাস৷ বোঝ তো সব বাপু—কিসে কি হয় সে আমি খুব ভালো জানি৷ একানে গান আগে না তালিম দিয়ে নিয়ে নিলে শেষকালে এ্যাকটোর সময় গান গাইতে গেলে ভয়েই গলা শুকিয়ে যাবে৷ তুমি তোমার নিজের পাট দ্যাখো গিয়ে বাইরে বসে—

ছিবাস ধমক খেয়ে অপ্রতিভ হয়ে গেল৷ এর পরে আর কেউ কোনো প্রকার প্রতিবাদ করতে সাহস করলে না, কেদারের মুখের ওপর প্রতিবাদ কখনো বড় একটা করেও না কেউ৷

সুতরাং গান-বাজনা চলল পুরোদমে৷

ক্রমে সব লোক এসে জড় হয়ে গেল—ঘরে বসবার জায়গা দিতে পারা যায় না৷ বাইরের দাওয়ায় গিয়ে অনেকে বসলো৷ বাইরে যাবার আরও একটা কারণ এই, এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেছোকরা ও বাইশ-তেইশ থেকে ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক, এরা কেদারের সামনে বিড়ি বা তামাক খায় না—অথচ বেশিক্ষণ ধূমপান না করে তারা থাকতেও পারে না, বাইরের দাওয়া আশ্রয় করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই৷

গানে বাজনায় বক্তৃতায় গল্পে এবং সঙ্গে সঙ্গে তামাক ও বিড়ির ধোঁয়ায় মহলাঘরের বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে, এমন সময় দূরে কিসের চিৎকার শোনা গেল৷

কে একজন বললে, ও ছিবাস জ্যাঠা—চৌকিদার হাঁকছে যে বামুনপাড়ায়, অনেক রাত হয়েছে তবে!

দু-একজন উৎকর্ণ হয়ে শুনে বললে, তাই তো, রাতটা বেশি হয়ে গিয়েছে৷ বাবাঠাকুর, আজ বন্ধ করে দিলে হত না? আপনি আবার এতটা পথ যাবেন—

বিশু কুমোরের ছেলে এ পর্যন্ত গোটা আষ্টেক গানের তালিম দিয়ে এবং কেদারের কাছে বিস্তর ধমক খেয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল—সে করুণ দৃষ্টিতে কেদারের দিকে চাইলে৷

কেদার বললেন, ঘুম আসছে, না? তোর কিছু হবে না বাবা৷ কুমোরের ছেলে, চাক ঘোরাবি, ভাঁড় আর তিজেল হাঁড়ি গড়বি, তোর এ বিড়ম্বনা কেন বল দিকি বাপু? সেই সন্দে থেকে তোকে পাখিপড়া করছি, এখনও একটা গানও নিখুঁত করে গলায় আনতে পারলি নে—তোর গলায় নেই সুর তার কোত্থেকে কি হবে? বেসুরো গলা নিয়ে গান গাওয়া চলে?

আসলে তো একথা ঠিক নয়৷ বিশু ছেলেটি বেশ সুকণ্ঠ গায়ক, সবাই জানে, কেদারও তা ভালোই জানেন—কিন্তু তিনি বড় কড়া মাস্টার এবং তাঁর কথা বলবার ধরনই এই৷ ছেলেটির এ রকম তিরস্কার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, সুতরাং সে কেদারের কথায় দুঃখিত না হয়ে বললে—দাদাঠাকুর, বাড়িতে মার অসুখ—বাবা সকাল সকাল যেতি বলে দিয়েল—

—তা যা যা৷ আজ তবে থাক এই পর্যন্ত, কাল সবাই সকালে সকালে আসা হয় যেন৷ চল হে ছিবাস, চল হে রিষিকেশ—

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও কেদার উঠে পড়লেন, হুঁশ না করিয়ে দিলে তিনি আরও কতক্ষণ এখানে থাকতেন কে জানে!

কিন্তু মহলা-ঘরের বাইরে পা দিয়ে তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন, একি, হ্যাঁ ছিবাস, জ্যোৎস্না উঠে গিয়েছে যে!

—আজ্ঞে হ্যাঁ বাবাঠাকুর, তাই তো দেখছি—

—তাই তো হে, আজ নবমী না? কৃষ্ণপক্ষের নবমী, ওঃ অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তা হলে!

পথে কিছুদূর পর্যন্ত একসঙ্গে এসে বিভিন্ন পাড়ার দিকে একে একে সবাই বেরিয়ে গেল কেদারকে ফেলে৷ দু-তিনজন কেদারকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাইলে—কিন্তু কেদার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একাই বাড়ির দিকে চললেন৷ গড়ের খাল পার হবার সময় নিশীথ রাত্রির জ্যোৎস্নালোকিত বন-ঝোপের দিকে চেয়ে চেয়ে কেদারের বেশ লাগল৷ কেদারের পিতামহ রাজা বিষ্ণুরামের স্বহস্তে রোপিত বোম্বাই আমের গাছে প্রচুর বউল এসেছে এবার—তার ঘন সুগন্ধে মাঝরাত্রির জ্যোৎস্নাভরা বাতাস যেন নেশায় ভরপুর, ভারি আনন্দে জীবনের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে মোটের উপর তাঁর৷ সকাল থেকে এত রাত পর্যন্ত সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় তা তিনি বুঝতে পারেন না৷

কি চমৎকার দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায় এই গড়বাড়ির জঙ্গল, ভাঙা ইট-পাথরের ঢিবিগুলো! সবাই বলে নাকি অপদেবতা আছে, তিনি বিশ্বাস করেন না৷ সব বাজে কথা!

কই এত রাত পর্যন্ত তো তিনি বাইরে থাকেন, একাই আসেন বাড়ি, কখনো কিছু তো দেখেন নি! বাল্যকাল থেকে এই বনে-ঘেরা ভাঙা বাড়িতে মানুষ হয়েছেন, এর প্রত্যেক ইটখানা, প্রত্যেক গাছটি, বনের লতাটি তাঁর প্রিয় ও পরিচিত৷ তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে এরা জড়ানো, তিনি যে চোখে এদের দেখেন, অন্য লোকে সে চোখ পাবে কোথায়?

কষ্ট হয় শরতের জন্যে৷

ওকে তিনি কোনো সুখে সুখী করতে পারলেন না৷ ছেলেমানুষ, ওর জীবনের কোনো সাধ পুরলো না৷ সারাদিনের কাজকর্ম ও আমোদ-প্রমোদের ফাঁকে ফাঁকে শরতের মুখখানা যখন তাঁর মনে পড়ে হঠাৎ, তখন বড় অন্যমনস্ক হয়ে যান কেদার৷ যেখানেই থাকুন, মনে হয় এখনি ছুটে একবার তার কাছে চলে যান৷

আহা, এত রাত পর্যন্ত মেয়েটা একা জঙ্গলে-ঘেরা বাড়ির মধ্যে থাকে, কাজটা ভালো হচ্ছে না—ঠিক নয় কেদারের এতক্ষণ বাইরে থাকা!

দোরে ঘা দিয়ে কেদার ডাকলেন, ও শরৎ, মা ওঠো, দোর খোলো—

দু-তিনবার ডাকের পর শরতের ঘুমজড়িত কণ্ঠের ক্ষীণ সাড়া পাওয়া গেল৷

—উঠে দোর খুলে দে—ও শরৎ—

শরৎ বিরক্তিভরা মুখে দোর খুলতে খুলতে বললে, আমি মরব মাথা কুটে কুটে তোমার সামনে বাবা৷ পারি নে আর—সন্দে হয়েছে কি এ যুগে! রাত কাবার হয়ে গেল—এখন তুমি বাড়ি এলে! পুবে ফর্সা হবার আর বাকি আছে?

—না না, আরে এই তো বামুনপাড়ার চৌকিদার হেঁকে গেল—রাত এখনও অনেক আছে৷ আর বকিস নে, এখন ভাত দে দিকি৷ খিদে পেয়েছে যা—

কেদার খেতে বসলে শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

—কোথায় আর থাকব? আমাদের দলের মহলা হচ্ছে, সেখানে আমি না থাকলেই সব মাটি৷ যেদিকে আমি না যাব সেদিকেই কোনো কাজ হবে না৷

শরৎ একটু নরম সুরে বললে, যাত্রা কোথায় হবে? আমি কিন্তু যাব তোমার সঙ্গে৷

—তা ভালোই তো৷ বাড়ির মেয়েদের জন্যে চিক দিয়ে দেবে, যাবি তো ভালোই৷

শরৎ একটু চুপ করে থেকে বললে, বাবা, আজ প্রভাসদা এসেছিল৷

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, কোথায়? কখন?

—তুমি বেরিয়ে চলে গেলে, তার একটু পরেই৷ এখানে এসে বসলো৷ তার সঙ্গে আর একজন ওর বন্ধু৷ দু-জনকে চা করে দিলাম—খাবার কিছু নেই, কি করি—একটুখানি ময়দা পড়েছিল, তাই দিয়ে খানকতক পরোটা ভেজে দিলাম৷

—বেশ বেশ৷ কতক্ষণ ছিল?

—তা অনেকক্ষণ—প্রায় ঘণ্টাতিনেক৷ সন্ধ্যা হবার পরও খানিকক্ষণ ছিল৷

—কি বলে গেল?

—বেড়াতে এসেছিল৷ প্রভাসদা’র বন্ধু কলকাতার কোনো বড়লোকের ছেলে, বেশ চেহারা৷ নাম অরুণ মুখুজ্জে৷ আমাদের গড়বাড়ির গল্প শুনে সে এসেছিল প্রভাসদা’র সঙ্গে দেখতে৷ অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলে৷

—বড়লোকের কাণ্ড, তুইও যেমন! ঘরে পয়সা থাকলেই মাথায় নানা রকম খেয়াল গজায়৷ তার পর, দেখে কি বললে?

—খুব খুশি৷ আমাদের এখানে এসে কত রকম কথা বলতে লাগল, অরুণবাবু আবার আসবে, ফটোগ্রাফ নিয়ে যাবে! কি লিখবে নাকি আমাদের গড়বাড়ি নিয়ে৷ আমায় তো একেবারে মাথায় তুললে৷

—ওই তো বললাম, বড়লোকের যখন যেটি খেয়াল চাপবে! কলকাতায় মানুষের অভাব নেই—আমাদের মতো দুঃখ-ধান্দা করে যদি খেতে হত—

শরতের হাসি পেল বাবার দুঃখ-ধান্দা করে খাবার কথায়৷ জীবনে তিনি তা কখনো করেন নি৷ কাকে বলে তা এখনও জানেন না৷ কিসে কি হয় তা শরৎ ভালো করেই জানে৷

যেমন আজকের দিনের কথা৷ শরৎ হুবহু সত্য কথা বলে নি৷ ঘরে কিছুই ছিল না৷ ওরা গেল৷ ভাঙা ইট কাঠ দেখতে, গড়বাড়ি ঘুরতে—সেই ফাঁকে শরৎকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হল রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি ময়দা ও ঘি ধার করতে৷ সেখানে পাওয়া গেল তাই মান রক্ষে৷ সব দিন আবার সেখানেও পাওয়া যায় না৷

রাজলক্ষ্মী ওদের কথা শুনে দেখতে এসেছিল৷ সে-ই চা ও খাবার পরিবেশন করেছিল প্রভাস ও তার বন্ধুকে৷

আর একটা কথা শরৎ বলে নি বাবাকে৷ প্রভাস ওকে একটা মখমলের বাক্স দিয়ে গিয়েছে৷ কেমন চমৎকার বাক্সটা৷ তার মধ্যে গন্ধতেল, এসেন্স পাউডার আরও সব কি কি! না নিলে প্রভাসদা কি মনে করবে, সে বাক্সটা হাত পেতে নিয়েছিল—কলকাতার ছেলে, ওরা হয়তো বোঝে না যে বিধবা মানুষের ওসব ব্যবহার করতে নেই৷ তার যে কোনো বিষয়ে কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই, সব বিষয়ে সে নিস্পৃহ, উদাসী—কেমন এক ধরনের! এ বয়সেই মেয়ের সন্ন্যাসিনী মূর্তি—তার বাবার ভালো লাগে না৷ শরৎ তা জানে৷ বাবাকে বলে কি হবে বাক্সটার কথা, যখন সেটা সে রাখবে না৷

কেদার আহারান্তে তামাক খেতে বসলেন বাইরের দাওয়ায়৷

শরৎ বলল, বাইরে কেন বাবা, ঘরে বসে খাও না তামাক, আজকাল রাত্তিরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে৷ দিনে গরম রাতে ঠাণ্ডা যত অসুখের কুটি৷

গভীর রাত্রি৷

বিছানায় শুয়ে একটা কথা তার মনে হল বার বার৷ এর আগেও অনেক বার মনে হয়েছে৷ প্রভাস-দার বন্ধু অরুণবাবুর চেহারা বেশ সুন্দর, অবস্থাও ভালো৷ রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়া যেত!

.

রাজলক্ষ্মী এল তিনদিন পরে৷

সে গড়ের বনে সজনে ফুল কুড়ুতে এসেছিল, কোঁচড় ভর্তি করে ফুল কুড়িয়ে বাড়ি ফিরবার পথে শরতের রান্নাঘরে উঁকি মেরে বললে, ও শরৎদি, সজনে ফুল রাখবে নাকি? কত ফুল কুড়িয়েছি দ্যাখো—তোমাদের ওই পুকুরের কোণের গাছে!

শরৎ রান্না চড়িয়েছিল, ব্যস্তভাবে খুশির সুরে বললে, ও রাজলক্ষ্মী আয় আয়, দেখি কেমন ফুল? আয় তোকে আমি খুঁজছি ক’দিন৷ কথা আছে তোর সঙ্গে৷

একটা ছোট চুবড়ি এনে বললে, দে এতে চাট্টি ফুল৷ বেশ কুঁড়ি কুঁড়ি ফুলগুলো, ভাজব এখন৷ বাবা বড্ড খেতে ভালোবাসেন৷

—শরৎদি, আমাদের ওদিকে তুমিও তো যাও না ক’দিন?

—না ভাই, বাবার পায়ে বাত মতো হয়ে ক’দিন কষ্ট পেলেন৷ তাঁর তাপসেঁক—আবার এদিকে সংসারের ছিষ্টি কাজ, এর পরে সময় পাই কখন যে যাব বল! চা খাবি?

—না শরৎদি, বেলা হয়ে গেল—আর বেশিক্ষণ থাকলে এবেলা ফুলগুলো ভাজা হবে কখন? এ বেলা যাই—ও বেলা বরং আসব৷

—দাঁড়া, তোর জন্যে একটা জিনিস রেখে দিয়েছি, নিয়ে যা—

শরৎ মখমলের বাক্সটা এনে ওর হাতে দিয়ে বললে, দ্যাখ তো কেমন? খুলে দ্যাখ—

অপ্রত্যাশিত আনন্দে ও বিস্ময়ে রাজলক্ষ্মীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক মুহূর্তে৷ বাক্সটা খুলতে খুলতে বললে, কোথায় পেলে শরৎদি?

—প্রভাসদা দিয়ে গিয়েছিল সেদিন৷

রাজলক্ষ্মী শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, তা তুমি রাখলে না?

শরৎ মৃদু হেসে বললে, ওর মধ্যে দ্যাখ না কত কি—পাউডার, মুখে মাখবার ক্রিম—আমি কি করব ও সব! তুই নিয়ে গিয়ে রাখলে আমার আনন্দ হবে৷

রাজলক্ষ্মী কিছু ভেবে বললে, যদি মা জিজ্ঞেস করে কোথায় পেলি?

—বলিস আমি দিয়েছি!

—এ নিয়ে কেউ কিছু বলবে না তো? জানো তো নিমু ঠাকরুণকে, গাঁয়ের গেজেট৷ প্রভাসবাবুর কথা বলব না—কি বলো?

—সত্যি কথা বলছি, এতে আর ভয় কি? নিমু ঠানদি এতে বলবে কি? বলিস প্রভাসবাবু দিয়েছিল শরৎদিকে৷

—ভারি খারাপ মানুষ সব শরৎদি৷ তুমি যত সহজ আর ভালো ভাবো সবাইকে, অত ভালো কেউ নয়৷ আমার আর জানতে বাকি নেই৷ সেবার যে এখানে প্রভাসবাবু এসেছিল, এ কথা গাঁয়ে রটনা হয়ে গিয়েছে৷ কাল যে এসেছিল আবার—তা নিয়েও কাল কথা হয়েছে৷

শরৎ বিস্ময়ের সুরে বললে, বলিস কি রে? কি কথা হয়েছে?

—অন্য কথা কিছু নয় শরৎ দিদি৷ শুধু এই কথা যে প্রভাসদা তোমাদের বাড়ি আসা-যাওয়া করছে আজকাল৷ তুমি না হয়ে অন্য মেয়ে যদি হত, তা হলে অনেকে অন্য রকম কথাও ওঠাতো—নিমু ঠাকরুণ, আমার জ্যাঠাইমা, হীরেন কাকার মা, জগন্নাথ দাদু—এরা৷ কিন্তু তুমি বলেই কেউ কিছু বলতে সাহস করে না৷

শরৎ যাত্রার দলের সুর নকল করে টেনে টেনে হাত নেড়ে বললে, দেশের রাজকন্যার নামে অপকলঙ্ক রটাবে, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সব তা হলে গর্দান নেব না দুরাচারদের?

রাজলক্ষ্মী হি হি করে হেসে লুটিয়ে পড়ে আর কি! মুখে কাপড় গুঁজে হাসতে হাসতে বললে, উঃ, এত মজাও তুমি করতে জানো শরৎদি! হাসিয়ে মারলে—মাগোঃ—

শরৎ হাসিমুখে বললে, তবে একটু বসে যা লক্ষ্মী দিদি আমার৷ দুটো মুড়ি খেয়ে যা—

রাজলক্ষ্মী দুর্বল সুরের প্রতিবাদ জানিয়ে বললে, না শরৎদি—ফুল ভাজা হবে কখন তা হলে এবেলা? আমায় আটকো না—

—বোস৷ আমিও খাচ্ছি দুটো মুড়ি—নারকেল-কোরা দিয়ে৷ তুইও খাবি৷ যেতে দিলে তো? সজনে ফুলের দুর্ভিক্ষ লাগে নি গড়শিবপুরে—

খানিক পরে শরৎ মুড়ি খেতে খেতে বললে, শোন রে, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে৷ অরুণবাবু এসেছিল প্রভাসদা’র সঙ্গে, দেখেছিস তো? ওর সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পাড়ব প্রভাসদা’র কাছে? অরুণবাবুরা বেশ অবস্থাপন্ন৷ বেশ ভালো হবে৷

রাজলক্ষ্মী সলজ্জ দৃষ্টিতে শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, কি যে তুমি বলো শরৎদি! এক-এক সময় এমন ছেলেমানুষ হয়ে যাও!

—ছেলেমানুষ হওয়া কি দেখলি?

—ওরা আমায় নেবে কেন? আমার কি রূপগুণ আছে বলো! তুমি যে চোখে আমায় দ্যাখো—সকলে কি সে চোখে দেখবে?

—সে ভাবনায় তোর দরকার নেই৷ তুই শুধু আমায় বল, প্রভাসদা’র কাছে কথা আমি পাড়ব কিনা৷ অরুণবাবুকে পছন্দ হয়?

—দূর—কি যে বলো! শরৎদি একটা পাগল—

—সোজা কথাটা কি বল না?

—ধরো যদি বলি হয়—তুমি কি করবে?

—তাই বল৷ আমি প্রভাসদা’র কাছে তা হলে কথাটা পেড়ে ফেলি৷

রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷ শরৎ বললে, বাড়িতে বা অন্য কারো কাছে বলিস নে কোনো কথা এখন৷

রাজলক্ষ্মী হাত নেড়ে বললে, হ্যাঁ, আমি বলে বেড়াতে যাই, ওগো আমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে সবাই শোনো গো৷ একটা কথা, জ্যাঠামশাইকে যেন বোলো না শরৎদি৷

—বাবাকে? ও বাপ রে! এখুনি সারা গাঁ পরগণা রটে যাবে তা হলে৷ পাগল তুই, তা কখনো বলি?

রাজলক্ষ্মী বিদায় নিয়ে বাড়ি যাবার পথে গড়ের খাল পার হয়ে দেখলে, কেদার একটা চুপড়িতে আধ-চুপড়ি বেগুন নিয়ে হন হন করে আসছেন৷

ওকে দেখে বললেন, ও বুড়ি, ওঃ কত সজনে ফুল রে!—কোত্থেকে? তা বেশ৷ শরতের সঙ্গে দেখা করে এলি তো?

—হ্যাঁ জ্যাঠামশায়, শরৎদির সঙ্গে দেখা না করে আসবার জো আছে? আর না খাইয়ে কখনো ছাড়বে না!

—হ্যাঁঃ, ভারি তো খাওয়া! কি খেতে দিলে?

—মুড়ি মাখলে, ও খেলে, আমি খেলাম৷

—তা যা মা—বেলা হয়ে গেল আবার—

রাজলক্ষ্মী দূর থেকে কেদারকে আসতে দেখে মখমলের বাক্সটা কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল—সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল৷ কথা শেষ করে কেদারের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো সে৷

কিন্তু কিছু দূর যেতেই সে শুনলে কেদার তাকে পেছন থেকে ডাকছেন—ও বুড়ি, শুনে যা৷ একটু দাঁড়িয়ে যা—

—কি জ্যাঠামশায়?

—এই বেগুন ক’টা আনলাম গেঁয়োহাটির তারক কাপালির বাড়ি থেকে৷ তুই নিয়ে যা দুটো৷ সজনে ফুলের সঙ্গে বেশ হবে এখন—

রাজলক্ষ্মী বিব্রত হয়ে পড়ল৷ এক হাতে সে বাক্সটা ধরে আছে, অন্য হাতে ফুলে ভর্তি আঁচল৷ বেগুন নেয় কোনো হাতে? কিন্তু কেদার সদাই অন্যমনস্ক, কোনোদিকে ভালো করে লক্ষ করে দেখবার সময় নেই৷ কোন রকমে গোটাচারেক বেগুন রাজলক্ষ্মীর সামনে নামিয়ে রেখে তিনি চলে যেতে পারলে যেন বাঁচেন, এমন ভাবে দেখালেন৷

রাজলক্ষ্মী ভাবলে—জ্যাঠামশায় বড় ভালো৷ এ গাঁয়ে ওঁদের মতো মানুষ নেই৷ শরৎদি কি ভালোই বাসে আমায়৷ এ গাঁ থেকে যদি বিয়ে হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাই, শরৎদিকে না দেখে কি করে থাকব তাই ভাবি৷ পাছে বাড়িতে জ্যাঠাইমা টের পায়, এজন্যে রাজলক্ষ্মী বাক্সটা সন্তপর্ণে লুকিয়ে বাড়ি ঢুকল৷ মাকে ডেকে বললে, এই দ্যাখো মা—

রাজলক্ষ্মীর মা বাক্সটা হাতে নিয়ে বললে, বাঃ দেখি দেখি—কোথায় পেলি রে? শরৎ দিলে? চমৎকার জিনিসটা৷ আমরা বাপু সেকেলে লোক, কখনো চক্ষেও দেখি নে এসব৷ শরৎ কোথায় পেলে রে?

রাজলক্ষ্মী বললে, ওকে প্রভাসদা কাল দিয়েছিল৷ তা ও তো এসব মাখবে না—জানো তো ওকে৷ তাই আমায় বললে, তুই নিয়ে যা৷ এ কথা কাউকে বোলো না কিন্তু মা৷

.

দু-দিন পরে কেদার একদিন সকালে বললে, শরৎ মা, আমি আজকে একবার তালপুকুর যাব খাজনা আদায় করতে, আমার আসতে একদিন দেরি হতে পারে, একটু সাবধানে থেকো৷

শরৎ বলল, বেশি দেরি কোরো না বাবা, তুমি যেখানে যাও আসবার নামটি করতে চাও না তো! আমি একলা থাকব মনে করো৷

কেদার একবার বাড়ির বার হলে ফিরবার কথা ভুলে যান, একথা শরৎ ভালোভাবেই জানে৷ মুখে বললেও শরৎ জানে বাবা এখন দিন দু-তিনের মতো গা-ঢাকা দিলেন৷ সেদিন সে রাজলক্ষ্মীকে বলে পাঠালো একবার দেখা করতে৷

দুপুরের পর রাজলক্ষ্মী এসে বললে, কি শরৎ দিদি, ডেকেছিলে কি জন্যে?

—বাবা গিয়েছেন তালপুকুরে খাজনা আদায় করতে, আমাদের বাড়ি দু-দিন রাত্রে শুবি?

রাজলক্ষ্মী বললে, মা থাকতে না দিলে তো থাকা হবে না৷ আচ্ছা, বলে দেখব এখন৷

—এইখানেই খাবি কিন্তু এবেলা—

—ওই তো তোমার দোষ শরৎদি, কেন, বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারি নে?

—পারবি নে কেন, তবে দুজনে মিলে খেলে বেশ একটু আনন্দ পাওয়া যায়৷ খাবি ঠিক বললাম কিন্তু৷

দুপুরের অনেক পরে রাজলক্ষ্মী এসেছে৷ বেলা প্রায় গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল৷ পুকুরঘাটে ছাতিমবনের দীর্ঘ ছায়া পড়ে গিয়েছে, যখন ওরা দুজনে পুকুরঘাটে এসে বসলো৷

মুখে বিদেশে যাবার যত ইচ্ছেই ওরা প্রকাশ করুক, এই গ্রাম ওদের অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে এর ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস নিয়ে, ঘুঘু ও ছাতারে পাখির ডাক নিয়ে, প্রথম হেমন্তে গাছের ডালে ডালে আলকুশী ফলের দুলুনি নিয়ে—এর সমস্ত রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে৷ শরৎ যখনই এই দিঘির বাঁধা ঘাটের পাড়ে বসে ছাতিমবনের দিকে তাকায়, তখন মনে হয় ওর, সে কত যুগ থেকে এই গ্রামের মেয়ে, তার সমস্ত দেহমন-চেতনাকে আশ্রয় করে আছে এই ভাঙা গড়বাড়ি, এই কালো পায়রার দিঘি, এই পুরনো আমলের মন্দিরগুলো, এই ছাতিমবন, ইটের স্তূপ৷

ঋতুতে ঋতুতে ওদের পরিবর্তনশীল রূপ ওর মন ভুলিয়েছে৷ শরৎ অত ভালো করে বোঝে না, ঋতুর পরিবর্তন সম্বন্ধে তার মন তত সজাগ নয়, তবুও ভালো লাগে৷ বুদ্ধি দিয়ে না বুঝলেও অন্য একটা অনুভূতি দিয়ে তার মন এর সৌন্দর্যকে নিতে পারে৷

শরৎ পুকুরপাড়ে বাসন নামিয়েই বললে, রাজলক্ষ্মী, পাতাল-কোঁড় তুলে আনবি? ওই উত্তর দেউলের ওদিকের জঙ্গলে সেদিন অনেক ফুটেছিল—চল দেখে আসি৷

—এখন বর্ষাকাল নয়, এখন বুঝি পাতাল-কোঁড় ফোটে?

—ফুটে বনের তলা আলো করে আছে, বলে ফোটে না! চল না দেখবি—

—আমার বড্ড ভয় করে শরৎদি ও বনে যেতে, তুমি চলো আগে আগে—

বাসন সেখানেই পড়ে রইল৷ গড়শিবপুরে এ পর্যন্ত কোনো জিনিস ফেলে রাখলে চুরি যায় নি৷ কতদিন এমন দিঘির ঘাটে এঁটো বাসন জলে ডুবিয়ে রেখে চলে যায়, সারারাত হয়তো পড়ে থাকে—তার পরদিন সকালে সে-সব বাসন মাজা হয়—একটা ছোট তেলমাখা বাটিও চুরি যায় নি৷ শরৎদি’র ঘরে বেশি জায়গা নেই বলে কত জিনিসপত্র বাইরেই পড়ে থাকে দিনরাত৷ শুধু গড়ের মধ্যে বলে যে এমন তা নয়, এ-সব পল্লীঅঞ্চলে চোরের উপদ্রব আদৌ নেই৷

ঘন নিবিড় বনের মধ্যে রাজলক্ষ্মীর গা ছমছম করতে লাগল৷ শরৎদি শক্ত মেয়েমানুষ, ওর সাহস বলিহারি—ও সব পারে৷ বাবাঃ, এই বনে মানুষ ঢোকে পাতালকোঁড়ের লোভে?

—ও শরৎ দিদি, সাপে খাবে না তো? তোমাদের গড়ের ইটের ফাটলে ফাটলে সাপ বাবা—

শরৎ কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বললে, অমন করে আমার বাপের বাড়ির নিন্দে করতে দেব না তোকে—আমাদের এখানে যদি সাপ থাকত তবে আমায় এতদিন আস্ত থাকতে হত না৷ আমার মতো বনে-জঙ্গলে তো তুমি ঘোরো না! কি বর্ষা, কি গরমকাল, ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, অন্ধকার নেই—একলাটি বনের মধ্যে দিয়ে যাব উত্তর দেউলে সন্দে পিদিম দিতে—তা ছাড়া এই বনে কাঠ কুড়িয়ে বেড়াই, বাবা কি যোগাড় করে দেন?

এক জায়গায় রাজলক্ষ্মী থমকে দাঁড়িয়ে বললে, দ্যাখো দ্যাখো শরৎ দিদি, কত পাতাল কোঁড়—বেশ বড় বড়—

শরৎ তাড়াতাড়ি এসে বললে, কই দেখি?

পরে হেসে বলে উঠল—দূর! ছাই পাতাল কোঁড়—ও সব ব্যাঙের ছাতা, অত বড় হয় না পাতাল-কোঁড়—ও খেলে মরে যায় জানিস? বিষ—

—সত্যি শরৎদি?

—মিথ্যে বলছি? ব্যাঙের ছাতা বিষ—

—আমি খেলে মরে যাব—

—বালাই ষাট—কি দুঃখে?

—বেঁচে বা কি সুখ শরৎদি? সত্যি বলছি—

—কেন, জীবনের উপর এত বিতেষ্টা হল যে হঠাৎ?

—অনেকদিন থেকেই আছে৷ এক এক সময় ভাবি আমাদের মতো মেয়ের বেঁচে কি হবে শরৎদি? না আছে রূপ, না আছে গুণ—এমনি করে কষ্টস্রেষ্ট করে ঘুঁটে কুড়িয়ে আর বাসন মেজেই তো সারাজীবন কাটবে?

—সুখ যদি জুটিয়ে দিই? তা হলে কিন্তু—

—তোমার সেই সেদিনের কথা তো? তুমি পাগল শরৎদি—

—তুই রাজি হয়ে যা না!

—সেই জন্যে আটকে রয়েছে৷ তোমার যেমন কথা—

—এবার প্রভাসদাকে বলব, দেখিস হয় কি না—

হঠাৎ রাজলক্ষ্মী উৎকর্ণ হয়ে বললে, চুপ শরৎদি, বনের মধ্যে কারা আসছে—

শরতের তাই মনে হল৷ কাছের পায়ের শব্দ বনের ওপাশে৷ শরৎ ও রাজলক্ষ্মী একটা গাছের আড়ালে লুকুলো৷ দুজন লোক বনের মধ্যে কি করছে৷ কিসের শব্দ হচ্ছে যেন৷ শরৎ চুপি চুপি বললে, কারা দেখতে পাচ্ছিস?

—না শরৎদি, চলো পালাই—

—পালাবো কেন? বাঘভাল্লুক তো না—তুই দাঁড়া না—

একটু সরে শরৎ আবার বললে, দেখেছিস মজা? রামলাল কাকার ছেলে সিদু আর ওপাড়ার জীবন শুঁড়ির ভাই হরে শুঁড়ি৷

হঠাৎ শরৎ কড়া গলায় সুর চড়িয়ে বললে, কে ওখানে?

দুপ দুপ দ্রুত পদশব্দ৷ তারপর সব চুপচাপ৷

শরৎ বললে, আয় তো গিয়ে দেখি—কি করছিল মুখপোড়ারা—

রাজলক্ষ্মী চেয়ে দেখলে শরতের যেন রণরঙ্গিণী মূর্তি৷ ভয় ও সঙ্কোচ এক মুহূর্তে চলে গিয়েছে তার চোখমুখ থেকে৷ রাজলক্ষ্মী ভয় পেয়ে বললে, ও শরৎদি, ওদিকে যেয়ো না—পরে শরৎ নিতান্তই গেল দেখে সে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে চলল৷ খানিকদূর দিয়ে দুজনেই দেখলে, যেখানে উত্তর দেউলের পুব কোণে একটা ভাঙা পাথরের মূর্তি পড়ে আছে ঘন লতাপাতার ঝোপের মধ্যে—সেখানে একটা লোহার শাবল পড়ে আছে, কারা খানিকটা গর্ত খুঁড়েছে আর কতকগুলো মাটিতে পোঁতা ইট সরিয়েছে৷

শরৎ খিল খিল করে হেসে বললে, মুখপোড়াদের বিশ্বাস গড়ের জঙ্গলে সর্বত্র ওদের জন্যে টাকার হাঁড়ি পোঁতা রয়েছে৷ গুপ্তধন তুলতে এসেছিল হতচ্ছাড়া ড্যাকরারা, এরকম দেখে আসছি ছেলেবেলা থেকে কেউ এখানে খুঁড়েছে, কেউ ওখানে খুঁড়েছে—আর সব খুঁড়বে কিন্তু লুকিয়ে৷ পাছে ভাগ দিতে হয়! যাক—শাবলখানা লাভ হয়ে গেল৷ চল নিয়ে চল—

রাজলক্ষ্মীও হেসে কুটিপাটি৷ বললে, ভারি শাবলখানা নিয়ে পালাতে পারলে না! তোমার গলা শুনেই পালিয়েছে—তোমাকে সবাই ভয় করে শরৎদি—

বনের পথ দিয়ে ওরা আবার যখন দিঘির ঘাটে এসে পৌঁছলো, তখন বেলা বেশ পড়ে এসেছে৷ আর রোদ নেই ঘাটের সিঁড়িতে, তেঁতুল গাছের ডালে দু-একটা বাদুড় এসে ঝুলতে শুরু করেছে৷ ওরা তাড়াতাড়ি বাসন মেজে নিয়ে বাড়ির দিকে চলল৷

শরৎ বললে, এবার কিছু খা—তার পর বাড়ি গিয়ে বলে আয় খুড়িমাকে এখানে থাকবার কথা রাতে৷

রাজলক্ষ্মী ব্যস্তভাবে বললে, না শরৎদি, সন্দের আর দেরি নেই৷ আমি আগে বাড়ি যাই৷ অনেকক্ষণ বেরিয়েছি বাড়ি থেকে, মা হয়তো ভাবছে—

—বোস আর একটু—একটু চা করি, খেয়ে যা—

শাবল ফেলে ওদের পালানো ব্যাপারটাতে শরৎ ও রাজলক্ষ্মী খুব মজা পেয়েছে৷ তাই নিয়ে হাসিখুশি ওদের যেন আর ফুরোতে চায় না৷

রাজলক্ষ্মী বললে, তোমার সাহস আছে শরৎ দিদি, আমি হলে পালিয়ে আসতাম—

—এই রকম না করলে হয় না, বুঝলি? সব সময় ভীতু হয়ে থাকলে সবাই পেয়ে বসে—আর কখনো ওরা আসবে না দেখিস৷

—যদি আমার না আসা হয়, একলা থাকতে পারবে শরৎদি?

শরৎ হেসে বললে, কতবার তো থেকেছি৷ এমনিতেই বাবা এত রাত করে বাড়ি ফেরেন, এক একদিন আমার একঘুম হয়ে যায়৷ বাবার কি কোনো খেয়াল আছে নাকি?

তার পর সে ঈষৎ লাজুক মুখে মুখ নিচু করে বললে, বাবার জন্যে মন কেমন করছে—

—ওমা, সে কি শরৎ দিদি! আজ তো জ্যাঠামশাই সবে গেলেন—

—সেজন্যে না৷ বিদেশে কোথায় খাবেন কোথায় শোবেন, উনি বাড়ি থেকে বেরুলেই আমার কেবল সেই ভাবনা৷

—জলে তো আর পড়ে নেই? লোকের বাড়ি গিয়েই উঠেছেন তো—

—তুই জানিস নে ভাই—ওঁর নানান বাচবিচার৷ এটা খাবে না ওটা খাবে না—দুনিয়ার আদ্ধেক জিনিস তাঁর মুখে রোচে না৷ আমায় যে কত সাবধানে থাকতে হয়, তা যদি জানতিস! পান থেকে চুণ খসলেই ভাতের থালা ফেলে উঠে গেলেন৷ আমার হয়েছে ওঁকে নিয়ে সব চেয়ে বড় ভাবনা৷ একেবারে ছেলেমানুষের মতো!

রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে বললে, তোমার বুড়ো ছেলেটি শরৎ দিদি—আহা কোথায় গেল, মায়ের প্রাণ, ভাবনা হবে না?

শরতের চোখ ছলছল করে উঠল৷ আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললে, তাই এক এক সময় ভাবি, ভগবান আমায় যেন এর মধ্যে টেনে নিয়ো না৷ বুড়ো বয়সে বাবা বড় কষ্ট পাবেন৷ ওঁকে ফেলে আমার স্বর্গে গিয়েও সুখ হবে না—উনি মারা যান আগে, তার পর আমি কষ্ট পাই দুঃখ পাই, যা থাকে আমার ভাগ্যে৷

—আমি এবার যাই শরৎদি—সন্দের আর দেরি কি?

—তুই কিন্তু আসবি ঠিক—খুব চেষ্টা করবি, কেমন তো? একলা আমি থাকতে পারি, সেজন্যে না৷ দুজনে থাকলে বেশ একটু গল্পগুজব করা যেত—মুখ বুজে এই নিবান্দা পুরীর মধ্যে থাকতে বড় কষ্ট হয়৷

রাজলক্ষ্মী চলে গেলে শরৎ সলতে পাকাতে বসলো—তার পর শাঁখ বাজিয়ে চৌকাঠে জলের ধারা দিয়ে তার অভ্যাসমতো ছোট্ট একটি প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে উত্তর দেউলে সন্ধ্যাদীপ দিতে চলল৷ সঙ্গে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেউলে বসে প্রদীপ জ্বালানোও চলে বটে, কিন্তু এদের বংশের নিয়ম ঘরের সন্ধ্যাদীপ থেকে জ্বালিয়ে নিয়ে যেতে হয় মন্দিরের প্রদীপ৷ তবে যদি ঝড়েবৃষ্টিতে পথে সেটা নিবে যায়, অগত্যা সেখানে বসেই জ্বালাতে হয়—উপায় কি?

উত্তর দেউলের পথে শরতের কেবলই মনে হচ্ছিল, আবার হয়তো সেইখানে খুঁড়তে আরম্ভ করেছে৷ সে একবার গিয়ে দেখবে নাকি? তা হলে বেশ মজা হয়—

কথাটা মনে আসতেই শরৎ আপনমনেই হি-হি করে হেসে উঠল৷

—উঃ শাবল ফেলেই ছুট দিলে! এ গুপ্তধন না তুললে নয় মুখপোড়াদের! ওদের জন্যে আমার ঠাকুরদাদা কলসি কলসি মোহর পুঁতে রেখে গিয়েছে! যদি থাকে তো আমরা নেব আমাদের জিনিস—তোরা মরতে আসিস কেন হতভাগারা?

শরৎ হঠাৎ থমকে দাঁড়াল এবং একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে একটা নতুন সিগারেটের বাক্স পড়ে আছে উত্তর দেউলের পৈঠার ওপরেই৷ এ বনের মধ্যে সন্ধ্যাবেলা সিগারেট খেয়েছে কে? এখানকার লোকে সিগারেট খাবে না, তাদের তামাক জোটে না সিগারেট তো দূরের কথা! বাক্সটা হেলাগোছা ভাবে ফেলা নয়, কে যেন তা যাবার পথে ইচ্ছে করে রেখেছে!

প্রদীপ দেখিয়ে এসে ও সিগারেটের বাক্সটা হাতে তুলে নিলে, খালি বাক্স অবিশ্যি৷

রাংতাটা আছে ভেতরে৷ বেশ পাওয়া গিয়েছে৷ সিগারেটের রাংতা বেশ জিনিস৷ তবে এ গাঁয়ে মেলে না, কে আর সিগারেট খাচ্ছে!

শরতের হাত থেকে সিগারেটের বাক্সটা পড়ে গেল৷ তার মধ্যে একটানা চিঠি৷ শরৎ বিস্ময়ে ও কৌতূহলে পড়ে দেখলে, লেখা আছে—

‘‘আমি তোমার জন্যে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা মন্দিরের পেছনে কতক্ষণ

বসেছিলাম৷ তুমি এলে না৷ তোমাকে কত ভালোবাসি, তা তুমি জানো না৷

যদি সাহস দাও, লক্ষ্মীটি, তবে কালও এই সময় এইখানেই থাকব৷’’

শরৎ খানিকটা অবাক হয়ে থেকে চারিদিকে চেয়ে চেঁচিয়েই বললে, আ মরণ চুলোমুখো আপদগুলো! আচ্ছা, আবার চিঠি লেখা পর্যন্ত শুরু করেছে—হ্যাঁ? এ-সব কি কম খ্যাংরার কাজ? কাল এসো, থেকো না জঙ্গলের মধ্যে, থেকো! বঁটি দিয়ে একটা নাক যদি কেটে না নিই, তবে আমার নাম নেই—যমে ভুলে আছে কেন তোমাদের, ও মুখপোড়ারা?

রাগে গরগর করতে করতে শরৎ বাড়ি এসে দেখলে রাজলক্ষ্মী বসে আছে৷ বাড়ি থেকে সে একটা লণ্ঠন নিয়ে এসেছে৷ শরৎ খুশি হয়ে বললে, এসেছিস ভাই!

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, না, একেবারে আসি নি শরৎ দিদি৷ মা বললে, বলে আয়, রাত্তিরে থাকা হবে না৷

—সত্যি?

—সত্যি শরৎদি৷ আমি কি বাজে কথা বলছি?

—তবে তুই আর কষ্ট করে এলি কেন?

—কথাটা বলতে এলাম শরৎ দিদি৷ তুমি আবার হয়তো কি মনে করবে, তাই৷ রাজকন্যে তুমি৷

রাজলক্ষ্মীর কথা বলার ধরনে শরতের সন্দেহ হল৷ সে হেসে বললে, যাঃ, আর চালাকি করতে হবে না! আমি আর অত বোকা নই—বুঝলি?

রাজলক্ষ্মী খিল খিল করে হেসে উঠে বললে, কিন্তু তোমায় প্রথমটা কেমন ভাবিয়েছিলাম বলো না?

শরৎ বললে, যাঃ, আমি গোড়া থেকেই জানি৷ খুড়িমা এখানে রাত্তিরে থাকতে না দিলে তোকে আলো নিয়ে আসতে দিতেন না৷ ও রাজলক্ষ্মী…একটা মজা দেখবি ভাই?

বলেই শরৎ চিঠিখানা রাজলক্ষ্মীর হাতে দিয়ে বললে, পড়ে দ্যাখ—

রাজলক্ষ্মী পড়ে বললে, এ কোথায় পেলে?

—উত্তর দেউলের সিঁড়ির ওপর একটা সিগারেটের খোলের মধ্যে ছিল৷

—আশ্চর্য, আচ্ছা কে লিখলে বলো তো শরৎদি?

—তাই যদি জানব, তা হলে তো একেবারে শ্রাদ্ধের চাল চড়িয়ে দিই তাদের—

—তুমি আগে যাদের কথা বলেছিলে—

—তারাও হবে হয়তো৷ নাও হতে পারে৷ সিগারেট খাবে কে এ গাঁয়ে?

—কাউকে দেখলে, কি পায়ের শব্দ শুনলে?

শরৎ সুর বদলে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, বাদ দে ও-সব কথা! বাবা নেই কিনা বাড়িতে, বাবা না থাকলেই ওদের বিদ্ধি বাড়ে আমি জানি৷ যদি দেখতে পেতাম তবে না কথা ছিল৷

রাজলক্ষ্মী বললে, আচ্ছা যদি আমি না আসতাম, তবে তুমি ভয় পেতে না শরৎদি, এই সব চিঠি পেয়ে—জ্যাঠামশায় নেই বাড়ি—?

—দূর, কি আর ভয়! আমার ও-সব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে—

—একলাটি তো থাকতে হত?

—থাকিই তো৷ ভয় করে কি করব? চিরদিনই যখন একা—

—তোমার বলিহারি সাহস শরৎদি! এই অরুণ্যি বনের মধ্যে—

—ঘরে বঁটি আছে, দা আছে—এগুক দিকি কে এগুবে শরৎ বামনীর সামনে—ঠাণ্ডা করে ছেড়ে দেব না? কি খাবি বল রাত্রে—ও কথা যাক৷ ভাত না রুটি?

—যা হয় করো৷ তুমি তো ভাত খাবে না, তবে রুটিই করো—দুজনে মিলে তাই খাব৷

—বাইরে বসে আটাটা মেখে ফেলি—

—তুমি যাও শরৎদি, আমি মাখছি আটা—

দু’জনে গল্পগুজবে রাঁধতে খেতে অনেক রাত করে ফেললে৷ তার পর দোর বন্ধ করে দু’জনে যখন শুয়ে পড়ল৷ তখন খুব সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে৷ বেশি রাত্রে শরৎ ঘুম ভেঙে উঠে রাজলক্ষ্মীর গা ঠেলে চুপি চুপি বললে, ও রাজলক্ষ্মী, ওঠ—বাইরে কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে যেন—

রাজলক্ষ্মী ঘুমে জড়িত কণ্ঠে ভয়ের সুরে বললে, কোথায় শরৎদি?

—চুপ, চুপ, ওই শোন না—

রাজলক্ষ্মী বিছানায় উঠে বসে উৎকর্ণ হয়ে শোনবার চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পেলে না৷

শরৎ উঠে আলো জ্বাললে৷ তার ভয়-ভয় করছিল৷ তবু সে সাহস করে আলো হাতে দোর খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করাতে রাজলক্ষ্মী ছুটে এসে ওর হাত ধরে বললে, খবরদার বাইরে যেয়ো না৷ শরৎদি, কার মনে কি আছে বলা যায় না৷ তোমার দুটি পায়ে পড়ি—

শরৎ কিন্তু ওর কথা না শুনেই দোর খুলে দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়াল৷ ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না, কেউ কোথাও নেই! তবুও তার স্পষ্ট মনে হল খানিক আগে কেউ এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার কোনো ভুল নেই৷

হঠাৎ তার মনে পড়ল, আজ ত্রয়োদশী তিথি৷

তাদের এখানে প্রবাদ আছে, বারাহী দেবীর পাষাণ-মূর্তি ত্রয়োদশী থেকে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত তিন দিন, গভীর রাত্রিকালে নিজের জায়গা থেকে নড়েচড়ে বেড়ায় গড়বাড়ির নির্জন বনজঙ্গলের মধ্যে৷ সেই সময় যে সামনে পড়ে, তার বড় অশুভ দিন৷

শরতের সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল৷

যদি সত্যিই তাই হয়?

যদি সত্যিই বারাহী দেবীর বুভুক্ষু ভগ্ন পাষাণ-বিগ্রহ রক্তের পিপাসায় তাদেরই ঘরের আনাচে-কানাচে শিকার খুঁজে বেড়াতে বার হয়ে থাকে?

শরৎ ভয় পেলেও মুখে কিছু বললে না৷ ধীরভাবে ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে দিলে৷

রাজলক্ষ্মী কলসি থেকে জল গড়িয়ে খাচ্ছিল, বললে, কিছু দেখলে শরৎদি?

—না কিছু না৷ তুই শুয়ে পড়৷

.

পরদিন বৈকালের দিকে প্রভাস ও আর একটি তরুণ সুদর্শন যুবক হঠাৎ এসে হাজির৷

রাজলক্ষ্মী তখন সবে কি একটা ঘরের কাজ সেরে দিঘির ঘাটে শরতের কাছে যাবার যোগাড় করছে—এমন সময় ওদের দেখে জড়সড় হয়ে উঠল৷

প্রভাস বললে, খুকি, তুমি কি এ বাড়ির মেয়ে? না, তোমাকে তো কখনো দেখি নি? বাড়ির মানুষ সব গেল কোথায়?

রাজলক্ষ্মী সলজ্জমুখে বললে, শরৎদি দিঘির পাড়ে৷ ডেকে আনছি৷

—হ্যাঁ, গিয়ে বলো প্রভাস আর অরুণবাবু এসেছে৷

শেষের নামটা উচ্চারিত হতে শুনে রাজলক্ষ্মীর মুখ তার নিজের অজ্ঞাতসারে রাঙা হয়ে উঠল৷ সে জড়িত পদে কোনো রকমে ওদের সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে আড়ালে এনে এক ছুটে ঘাটের পাড়ে গিয়ে খবরটা দিল শরৎকে৷

শরৎ অবাক হয়ে বললে, তুই দেখে এলি?

—ও মা, দেখে এলাম না তো কি! এসো না—

শরৎ ব্যস্তভাবে দিঘির ঘাট থেকে উঠে এল৷ প্রভাস ততক্ষণ নিজেই মাদুর পেতে বসে পড়েছে ওদের দাওয়ায়৷ হাসিমুখে বললে, আবার এসে পড়লাম৷ এখন একটু চা খাওয়াও তো দিদি—

—বসুন প্রভাসদা৷ এক্ষুনি চা করে দিচ্ছি—

প্রভাস পকেট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বার করে বললে, ভালো চা এনেছি৷ আর এতে আছে চিনি—

—আবার ও-সব কেন প্রভাসদা? আমরা গরিব বলে কী একটু চা দিতে পারি নে আপনাদের?

—ছিঃ অমন কথা বলতে নেই৷ সে ভেবে আনি নি, এখানে সব সময় ভালো চা তো পাওয়া যায় না পয়সা দিলেও৷ আর এ চিনি সে চিনি নয়, এ চায়ে খাওয়ার আলাদা চিনি৷ দ্যাখো না—এ পাড়াগাঁয়ে কোথায় পাবে এ চিনি?

শরৎ হাতে করে দেখলে চৌকো লেবেঞ্চুসের মতো জিনিসটা৷ এ আবার কি ধরণের চিনি! কখনো সে দেখেই নি৷ শহর বাজারে কত নতুন জিনিস আছে!

প্রভাস বললে, কাকাবাবু কোথায় গেলেন?

—বাবা গিয়েছেন খাজনার তাগাদায়৷ দু-তিন দিন দেরি হবে ফিরতে৷

প্রভাস হতাশমুখে বললে, তিনি বাড়ি নেই! এঃ, তবে তো সব দিকেই গোলমাল হয়ে গেল!

—কেন, কি গোলমাল?

—আমি এসেছিলাম তোমাদের কলকাতা ঘুরিয়ে আনতে৷ মোটর ছিল সঙ্গে৷ সেই ভেবেই অরুণকে সঙ্গে নিয়ে এলাম৷

—তাই তো, সে এখন কি করে হয়?

—নিতান্তই আমার অদৃষ্ট৷

—সে কি, আপনার অদৃষ্ট কেন প্রভাসদা, আমাদের অদৃষ্ট৷

—তা নয় দিদি, মুখে যাই বলো, প্রাচীন রাজবংশের মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে বেড়ানোর মধ্যে যে আনন্দ আছে—তা কি সকলের ভাগ্যে ঘটে শরৎদি? বিশেষ করে তুমি আর কাকাবাবু যখন কখনো কলকাতাতে যাও নি!

—কোথাও যাই নি—তার কলকাতায়!

অরুণ এবার কথা বললে৷ সে অনেকক্ষণ থেকে একদৃষ্টে শরতের দিকে চেয়ে ছিল৷ শরতের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরুণ জিভ ও তালুর সাহায্যে একপ্রকার খেদসূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললে, ও ভাবলে একদিকে কষ্ট হয়, একদিকে আনন্দ হয়৷ আপনার এই সরলতার তুলনা নেই৷ অভিজ্ঞতা সব জায়গাতেই যে পুজো পাবে তা পাবে না৷ অনভিজ্ঞতার মূল্য অনেক সময় অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেক—অনেক বেশি৷

প্রভাস বললে, তাই তো, বড় ভাবনায় পড়া গেল দেখছি!

—ভাবনা আর কি, অন্য এক সময় নিয়ে যাবেন প্রভাসদা৷

প্রভাস কিছুক্ষণ বসে ভেবে বললে, আচ্ছা, কোনো রকমেই এখন যাওয়া হয় না? ধরো তুমি আর কাউকে নিয়ে না হয় আমাদেরই সঙ্গে গেলে—

—আমি একাও আপনার সঙ্গে যেতে পারি প্রভাসদা৷ আমার মন তেমন নীচ নয়৷ কিন্তু সেজন্যে নয়—বাবার বিনা অনুমতিতে কোথাও যেতে চাই নে৷ যদিও আমার মনে হয় আপনি নিয়ে গেলে বাবা তাতে অমত করবেন না৷

অরুণ এবার বললে, তবে চলুন না কেন, গাড়ি রয়েছে—কাল সকালে বেরুলে বেলা বারোটার মধ্যে কলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে৷ ইচ্ছে করেন, কাল রাতেই আবার আপনাকে এখানে পৌঁছে দেব, কি বলেন প্রভাসবাবু?

প্রভাস ঘাড় নেড়ে বললে, তা তো বটেই৷ তাই চলো যাওয়া যাক—অবিশ্যি যদি তোমার মনের সঙ্গে খাপ খায়৷ কাল সকালে আমরা আসব এখন আবার—

এরা উঠে গেলে রাজলক্ষ্মী দেখলে শরৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে৷ কি যেন ভাবছে আপন মনে৷ কিছুক্ষণ পরে শরৎ নিজেই বললে, তুই তো সব শুনলি, তোর কি মনে হয়—যাব ওদের সঙ্গে? খুব ইচ্ছে করছে৷ কক্ষনো দেখিনি কলকাতা শহর—

—তোমার ইচ্ছে শরৎদি৷ তুমি আমার চেয়ে বুদ্ধিমতী৷

—তুই যাবি?

—আমার যেতে খুব ইচ্ছে—কিন্তু আমার যাওয়া হবে না শরৎদি৷ বাবা মা যেতে দেবে না৷

—আমার সঙ্গে যাবি, এতে আর দোষ কি?

—তুমি যদি যাও, লোকে কোনো কথা ওঠাতে সাহস করবে না শরৎদি৷ কিন্তু আমায় কেউ ছেড়ে কথা বলবে না৷ শেষকালে বাপ-মা মুশকিলে পড়ে যাবে বিয়ে দেবার সময়৷

—বাবাঃ, এর মধ্যে এত কথা আছে? ধন্যি সব মন বটে!

—তুমি থাকো গাঁয়ের বাইরে৷ তা ছাড়া তুমি যে বংশের মেয়ে, তোমার নামে এ অঞ্চলের লোকে কিছু রটাতে সাহস করবে না৷ আমার বেলায় তা তো হবে না!

আরও কিছুক্ষণ পরে রান্না শেষ হয়ে গেল৷ শরৎ রাজলক্ষ্মীকে খেতে দিয়ে একটা বাটিতে চিঁড়েভাজা তেল-নুন দিয়ে মেখে নিয়ে খেতে বসলো৷

রাজলক্ষ্মী খেতে খেতে বললে, ও সাত-বাসি চিঁড়ে-ভাজা কেন খাচ্ছ শরৎদি? আমার জন্যে তো সেই কষ্ট করলেই, রান্না করলে, এখন নিজের জন্যে না হয় খানকতক পরোটা কি রুটি করে নিলেই পারতে?

শরৎ সলজ্জ হেসে বললে, ময়দা আর ছিল না৷ প্রভাসদা আর অরুণবাবুকে তখন দুখানা করে পরোটা করে দিলাম—যা ছিল সব ফুরিয়ে গেল৷

—আমায় বললে না কেন শরৎদি? ওই তোমার বড় দোষ৷ আমায় বললে আমি বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম৷

—থাক গে, খাওয়ার জন্যে কি? এখন কলকাতায় যাওয়ার কি করা যায় বল! আর শোন, ওই অরুণবাবু, দেখলি তো? পছন্দ হয়? এবার তবে কথাটা পাড়ি প্রভাসদা’র কাছে?

রাজলক্ষ্মী জবাব দিতে একটু ইতস্তত করে সঙ্কোচের সঙ্গে বললে, তা তোমার ইচ্ছে৷ কিন্তু ও আমাদের কখনো হয়? বলে বামন হয়ে চাঁদে হাত—

—যদি ঘটিয়ে দিতে পারি?

রাজলক্ষ্মী মনে মনে ভাবলে, শরৎদি’র বয়সই হয়েছে আমার চেয়ে বেশি, কিন্তু এদিকে সরলা৷ অনেক জিনিসই আমি যা বুঝি, ও তাও বোঝে না৷ চিরকাল গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে বাস করে এলো কিনা৷

সে মুখে বললে, দিতে পারো ভালোই তো৷ বেশ কথা৷

—ঘটকালির বখশিশ দিবি কি?

—যা চাইবে শরৎদি৷

—দেখিস তখন যেন আবার ভুলে যাস নে—

রাজলক্ষ্মীর খাওয়ার প্রবৃত্তি চলে গিয়েছিল শরৎকে বাসি চিঁড়েভাজা খেতে দেখে৷ তার ওপর যখন আবার শরৎ গরম দুধের বাটি এনে তার পাতের কাছে নামাতে গেল, সে একেবারে পিঁড়ির ওপর থেকে উঠে পড়ল৷ দুধটুকু থাকলে তবুও শরৎদি খেতে পাবে৷

—ও কি, উঠলি যে?

রাজলক্ষ্মী ভালো করেই চেনে শরৎকে৷ সে যদি এখন আসল কথা বলে, তবে শরৎ ও দুধ ফেলে দেবে, তবু নিজে খাবে না৷ সুতরাং সে বললে, আর আমার খাওয়ার উপায় নেই শরৎদি, পেট খুব ভরে গিয়েছে৷ মরব নাকি শেষে একরাশ খেয়ে?

—দুধ যে তোর জন্যে জ্বাল দিয়ে নিয়ে এলাম? কি হবে তবে?

রাজলক্ষ্মী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, কি হবে তা কি জানি৷ না হয় তুমি খেয়ে ফেল ওটুকু৷ আমার আর খাওয়ার উপায় দেখছি নে৷ জানোই তো আমার শরীর খারাপ, বেশি খেতে পারি নে৷

অগত্যা শরৎকেই দুধটুকু খেয়ে ফেলতে হল৷

.

পরদিন সকালেই প্রভাস ও অরুণ আবার এসে হাজির৷

প্রভাস বললে, কি ঠিক করলে দিদি?

—ও এখন হয়ে উঠবে না প্রভাসদা৷ আপনারা যাবেন না, বসুন৷ চা আর খাবার করে দি, বসে গল্প করুন৷

শরৎ কাল রাত্রে ভেবে ঠিক করেছে, রাজলক্ষ্মীর বিবাহের প্রস্তাবটাও আজই প্রভাসের কাছে উত্থাপিত করে দেখবে কি দাঁড়ায়৷ রাজলক্ষ্মীকে এজন্যে সে সরিয়ে দেবার জন্যে বললে, ভাই, তোদের বাড়ি থেকে এত ক’টা আটা কি ময়দা দৌড়ে নিয়ে আয় তো? কাল রাত্রে আমাদের ময়দা ফুরিয়েছে৷ প্রভাসদা ও অরুণবাবুকে চায়ের সঙ্গে দুখানা পরোটা ভেজে দিই৷

প্রভাস যেন একটু হতাশার সুরে বললে, তা হলে যাওয়া হল না তোমার? এবার গেলেই বেশ হত৷

শরৎ বললে, না, এবার হবে না৷

—তোমার বন্ধুটিকে নিয়ে চলো না কেন?

—কে? রাজলক্ষ্মীর কথা বলছেন?…আচ্ছা, একটা কথা বলব? রাজলক্ষ্মীকে কেমন লাগল আপনাদের?

প্রভাস একটু বিস্ময়ের সুরে বললে, কেন বলো তো? ভালোই লেগেছে৷

—গরিব বাপ-মা, বিয়ে দিতে পারছে না৷ ওর জন্যে একটা পাত্র দেখে দিন না কেন প্রভাসদা৷ বড্ড উপকার করা হবে৷ একটা কথা শুনুন প্রভাসদা—

প্রভাস শরতের পিছু পিছু বাড়ির পিছনদিকে গেল৷

শরৎ বললে, আচ্ছা প্রভাসদা, অরুণবাবুর সঙ্গে রাজলক্ষ্মীর বিয়ে দিন না কেন জুটিয়ে? পালটি ঘর৷ চমৎকার হবে—

প্রভাস যেন ঠিক এ ধরণের কথা আশা করে নি শরতের মুখ থেকে৷ সে আশাহতের সুরে বললে, তা—তা দেখলেও হয়৷

শরতের যদি কিছুমাত্র সাংসারিক ও সামাজিক জ্ঞান থাকত তবে প্রভাসকে চিনে নিতে সে পারত এই এক মুহূর্তেই৷ কিন্তু শরৎ যদিও বয়সে যুবতী, সারল্যে ও ব্যবহারিক অনভিজ্ঞতায় সে বালিকা৷ সুতরাং সে প্রভাসের স্বরূপ ধরতে পারলে না৷

সে আরও আগ্রহের সঙ্গে বললে—তাই দেখুন না প্রভাসদা? আপনি করলে অনেক সহজ হয়ে যায় কাজটা—

প্রভাস অন্যমনস্কভাবে কি একটা কথা ভাবছিল৷ দু-একবার যেন কোনো একটা কথা বলবার জন্যে শরতের মুখের দিকে চাইলেও—কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললে না৷

দুজনকে চা করে দিয়ে শরৎ পথের দিকে চেয়ে আছে—এমন সময় দেখা গেল রাজলক্ষ্মী ফিরে আসছে৷ সে দাওয়া থেকে নেমে রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়ে বললে—এনেছিস ময়দা? দে আমার কাছে৷

—আমি যাই শরৎদি, মা বলে দিয়েছে বাড়ি ফিরতে—

—কেন বল তো? প্রভাসদারা এখানে বসে আছে বলে?

রাজলক্ষ্মী অপ্রতিভ মুখে বললে—তাই শরৎদি, জানোই তো, আমরা গরিব, এখানে ওদের সঙ্গে বসে থাকলে হয়তো কথা উঠবে৷ মা বড় ভয় করে ওসব৷

—তাহলে তুই যা—গিয়ে মান বজায় রাখ—

রাজলক্ষ্মী হাসতে হাসতে চলে গেল৷

.

প্রভাসদের খাবার করে দিতে বেলা প্রায় আটটা বেজে গেল৷ ওরা উঠতে যাবে এমন সময় শরৎ গড়ের খালের দিকে চেয়ে আহ্লাদের সঙ্গে বলে উঠল—বাবা আসছেন৷ প্রভাস ও অরুণ দুজনেই যেন চমকে উঠে সেদিকে চেয়ে দেখলে৷ ওদের মুখ দেখে মনে হবার কথা নয় যে কেদারের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনে তারা খুব খুশি৷

তবুও প্রভাস এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কেদারের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে৷ কেদার আনন্দের সঙ্গে বলে উঠলেন—এই যে প্রভাস, কখন এলে, ভালো সব?..আমি—হ্যাঁ—তাই বেরিয়েছিলাম বটে৷ সাংকিনী ও মাকড়ার বিলে বাচ হচ্ছে খবর পেলাম পথেই৷ খাজনা আদায় করতে যখন যাওয়া—আর সবাই জেলে প্রজা—বাচ শেষ না হলে কাউকে বাড়ি পাওয়া যাবে না তাও বটে—আর মস্ত কথা হচ্ছে বাচ না মিটে গেলে ওদের হাতে পয়সা আসবে না৷ তাই ফিরে এলাম৷

প্রভাস বললে, ভালোই হল৷ শরৎ তো ছোটবোনের মতো—আপনাদের কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে আসব বলে মোটর এনেছি এবার৷ আপনি ছিলেন না বলে একটু মুশকিল ছিল৷ শরৎদি বলেছিল যাবে৷ আমার সঙ্গে যাবে এ আর বেশি কথা কি? নিজের দাদার মতো—তবুও আপনি এলেন—বড় ভালোই হল৷ কাল সকালে চলুন কাকাবাবু কলকাতায়৷

শরৎ প্রভাসের কথা শুনে একটু অবাক হয়ে ভাবল—কই, সে কখন প্রভাসদা’র সঙ্গে কলকাতায় যাবে বললে? প্রভাসদা’র ভুল হয়েছে শুনতে—কিন্তু সে তো দুবার তিনবার বলেছে তার যাওয়া হবে না৷

কেদার বললেন, তা বেশ কথা৷ চলো না, ভালোই তো৷ অনেককাল থেকে কলকাতায় যাব যাব ভাবি, তা হয়ে ওঠে না৷ মন্দ কি?

প্রভাস ও অরুণ একসঙ্গে খুশির সঙ্গে বলে উঠল—কাল সকালেই চলুন তবে! সে কথা তো আমরাও বলছি৷

—কখন গিয়ে পৌঁছবে?

—বেলা বারোটার মধ্যে৷ কোনো কষ্ট হবে না আপনাদের, যাতে সব রকম সুবিধে হয়—

—এখানে কাল সকালে তোমরা খাবে—খেয়ে গাড়িতে ওঠা যাবে৷

শরৎ বাবার অনুরোধে যোগ দিয়ে বললে, হ্যাঁ প্রভাসদা, অরুণবাবুকে নিয়ে কাল সকালে এখানেই খাবেন৷ না, কোনো কথা শুনব না৷ এখানে খেতেই হবে—

প্রভাস বললে, রাজলক্ষ্মী বলে সেই মেয়েটি যাবে নাকি? তারও জায়গা হয়ে যাবে৷ বড় গাড়ি৷

শরৎ বললে, না, তার যাবার সুবিধে হবে না৷ আমায় সে বলে গেল এই মাত্র৷

প্রভাস বললে, তা হলে কাকাবাবু কাল সকালেই আসব তো?

—হ্যাঁ, এখানে তোমরা খাবে যে সকালে৷ তারপর রওনা হওয়া যাবে৷ অরুণকেও নিয়ে এসো—

.

দুপুরের পরে রাজলক্ষ্মী এল৷ শরৎ দাওয়ায় বসে পুরনো টিনের তোরঙ্গটা থেকে তার ও বাবার কাপড় বার করতে ব্যস্ত৷ রাজলক্ষ্মীকে দেখে বললে, এই যে আয় রাজলক্ষ্মী, সব কাপড়ই ছেঁড়া, যেটাতে হাত দিই৷ আমার তবু দুখানা বেরিয়েছে, বাবার দেখছি আস্ত কাপড় বাক্সে একখানাও নেই৷ কি নিয়ে যে যাবেন কলকাতায়—

—তা হলে যাচ্ছ সত্যিই শরৎদি? কাকাবাবু কোথায়?

—যাই, একবার বেড়িয়েই আসি৷ বসে বসে বাবার কাপড়গুলো এখন সেলাই করব— কেনবার পয়সা নেই যে নতুন একজোড়া ধুতি কিনে নেব—বেশি ছেঁড়া নয়, একটু-আধটু সেলাই করলে কেউ টেরও পাবে না৷ বাবা নেই বাড়ি, এইমাত্র পাড়ার দিকে গেলেন৷

শরতের মনে খুব আনন্দ বাইরে বেড়াতে যাবার এই সুযোগ পেয়ে৷ সে বসে বসে কেবল সেই গল্পই করতে লাগল রাজলক্ষ্মীর কাছে৷ কতকাল আগে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল—ভালো মনেও পড়ে না—সে-ও বেশি নয়, টুঙি-মাজদে গ্রামের কাছে বল্লভপুরের ভাদুড়ীদের বাড়ি৷ মাজদিয়া স্টেশনে নেমে তিন ক্রোশ গরুর গাড়িতে গিয়ে কি একটা ছোট্ট নদীর ধারে৷ তাদেরও অবস্থা খারাপ, আগে একসময় ও অঞ্চলের ভাদুড়ীদের নামডাক ছিল, সে নাকি অনেককাল আগে৷ এখন সতেরো সরিকে ভাগ হয়ে আর সবাই মিলে খেয়ে বেজায় গরিব হয়ে পড়েছে৷

রাজলক্ষ্মী বললে, সেখানে তোমায় নিয়ে যায় না শরৎদি?

—কে নিয়ে যাবে ভাই?

—তোমার দেওর ভাশুর নেই?

—আপন ভাশুরই তো রয়েছেন৷ হলে হবে কি, তাঁর বেজায় পুরী পাল্লা—সাত মেয়ে, পাঁচ ছেলে—নিজেরগুলো সামলাতে পারেন না—খেতে দিতে পারেন না—আমাকে নিয়ে যাবেন! আজ তেরো বছর কপাল পুড়েছে, কখনও একখানা থানকাপড় দিয়ে খোঁজ করেন নি৷ আর খোঁজ করলেও কি হত, আমি কি বাবাকে ফেলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি? সে গাঁয়ে আমার মনও টেঁকে না৷

—যদি এখন তারা নিতে আসে শরৎদি?

—আমি ইচ্ছে-সুখে যাইনে—তবে ভাশুর যদি পেড়াপীড়ি করেন—না গিয়ে আর উপায় কি?

—কতদিন থাকতে পারো? বলো না শরৎদি?

—কেন বল তো, আজ আবার তুই আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে পড়লি কেন?

রাজলক্ষ্মী মুখে আঁচল দিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে উঠল৷ তার পর বললে, দাও গুছিয়ে দিই কি জিনিসপত্তর আছে—মা বলছিল—

—কি বলছিলেন খুড়িমা?

—ভাগ্যিস কাকাবাবু এসে গিয়েছেন তাই৷ নইলে তোমার একা যাওয়া উচিত হত না প্রভাসবাবুর সঙ্গে—

শরতের চোখ দুটি যেন ক্ষণকালের জন্যে জ্বলে উঠল৷ মুখের রং গেল বদলে—রাজলক্ষ্মী জানে শরৎ দিদি রাগলে ওর মুখ রাঙা হয়ে ওঠে আগে৷ রাজলক্ষ্মী ভয় পেল মনে মনে, হয়তো তার এ কথা বলা উচিত হয় নি, কিন্তু বলতে তাকে হবেই শরৎদির ভালোর জন্যে৷ না বলে সে পারে না৷ কতবার তার মনে হয়েছে—শরৎ দিদি তার ছোট বোন, সে-ই এই সংসারানভিজ্ঞা বালিকাপ্রকৃতির দিদিকে সব বিপদ থেকে, কলঙ্ক থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে বেড়াবে৷

শরৎ কড়া সুরে বললে, কেন উচিত হত না, একশো বার হত৷ খুড়িমাকে গিয়ে বোলো রাজলক্ষ্মী, শরৎ যেখানে ভালো ভাবে, সেখানে আপনার লোকের মতোই ব্যবহার করে—পর ভাবে না৷ তার মন যেখানে সায় দেয় সেখানে যেতে তার এতটুকু ভয় নেই—আমি কারো কথা—

রাজলক্ষ্মী সভয়ে বললে, ওকি শরৎদি, তোমার পায়ে পড়ি শরৎদি, অমন চলে যেয়ো না, ছিঃ—

—তবে তুই এমন কথা বলিস কেন, খুড়িমাই বা কেন বলেন? তিনি কি ভাবেন—

—শোনো আমার কথা৷ মা সে কথা বলে নি৷ কিন্তু একা মেয়েমানুষ যদি বিপদে পড় তখন তোমায় দেখবে কে? সেই কথাই মা বলছিল৷ তুমি যত ভালো ভাব লোককে, সকলেই অত ভালো নয়৷ তুমি সংসারের কি বোঝ? মার বয়েস তোমার চেয়ে তো কত বেশি— সেদিক থেকে মা যা বলেছে মিথ্যে বলে নি৷ লক্ষ্মী দিদি, অমন রাগে না, রাগলে সংসারে কাজ চলে? আমি তোমায় কত ভালোবাসি, মা কত ভালোবাসে—তা তুমি বুঝি জানো না? মা আমায় গাঁয়ে কারোর বাড়ি যেতে দেয় না—কিন্তু তোমাদের বাড়ি আসতে চাইলে কখনো কোনো আপত্তি করে নি৷

শরতের রাগ ততক্ষণ চলে গিয়েছে৷ সে রাজলক্ষ্মীর হাত ধরে বললে, কিছু মনে করিস নে রাজী—

—না, মনে তো করি নে, আমি জানি শরৎদি ছেলেমানুষের মতো, এই রেগে উঠল, এই জল হয়ে গেল৷ রাগ তোমার বেশিক্ষণ শরীরে থাকে না—গঙ্গাজলে ধোয়া মন যে৷ সাধে কি বড়বংশের মেয়ে বলে তোমাকে শরৎদি?

শরৎ সলজ্জ-মুখে বললে, যা যা বকিস নে—থাম তুই৷

এই সময় দূর থেকে কেদারকে আসতে দেখে রাজলক্ষ্মী বললে, কাকাবাবু আসছেন, শরৎদি—ও-সব কথা থাক, কি কি কাজ করতে হবে, কি গুছিয়ে দিতে হবে বলে দাও৷

—কি আর গুছিয়ে দিবি৷ দু-পাঁচ দিনের জন্যে তো যাওয়া৷ হ্যাঁ রে, উত্তর দেউলে সন্দে-পিদিম দেওয়ার জন্যে বামী বাগ্দীকে ঠিক দিতে পারবি? আমি এসে তাকে চার আনা পয়সা দেব৷

রাজলক্ষ্মী বললে, বলে দেখব—কিন্তু সে রাজি হবে না৷ সন্দেবেলা সে ঘেঁষবে উত্তর দেউলের অরুণ্যি বিজেবনে? বাপরে! তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না কেন? আমি তোমার সন্দে দেব রোজ রোজ—

শরৎ বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে, তুই দিবি সন্দে-পিদিম—উত্তর দেউলে?

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কেন হবে না? পানুকে সঙ্গে নিয়ে আসব—আর সন্দের এক ঘণ্টা আগে আলো জ্বেলে রেখে চলে যাব৷ তোমাদের ঘরবাড়িও তো দেখাশুনো করতে হবে আমায়? অমনি দিয়ে যাব পিদিম জ্বেলে৷

—তা হলে তো বেঁচে যাই রাজলক্ষ্মী৷ ওই একটা মস্ত ভাবনা আমার, তা জানিস? মনে মনে ভাবি, আমি বেঁচে থাকতে পূর্বপুরুষের দেউলে আলো জ্বলবে না—তা কখনই হতে দেব না প্রাণ ধরে৷ আর একটা কথা শিখিয়ে দি, যখন পিদিম হাতে নিয়ে দেউলে যাবি তখন বেতবনের জঙ্গলে বারাহী দেবীর যে ভাঙা মূর্তি আছে সেখানটাতে একবার পিদিমটা তুলে দেখাবি৷

রাজলক্ষ্মীর মুখে কেমন ভয়ের ছায়া নামলো—সে বললে, ওই ভাঙা কালীর মূর্তি! ওখানে যেতে ভয় করে৷

—কালী নয়—ও বারাহী বলে এক পুরনো আমলের দেবীমূর্তি৷ বহুকাল পুজোও হয় নি৷ কেমন চড়কের সময় সন্নিসিরা একবার ওখানে এসে নেচে যায় দেখিস নি?

—তা যাক নেচে৷ আমি ওখানে যেতে পারব না শরৎদি৷ মাপ করো৷

—তুই যদি না পারিস—তবে আমার যাওয়া হবে না৷ আমি বারাহী দেবীকে ফেলে রেখে যেতে পারব না৷

রাজলক্ষ্মী বললে, না দিদি, সত্যি কিছু ভালো লাগছে না৷ তুমি চলে যাবে, আমার মন কাঁদবে সত্যিই৷ তাই বলছিলাম পারব না, যদি তোমার যাওয়ায় বাধা দিতে পারি৷ কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, এ কাজ ভালো না৷ শরৎ দিদি কখনো কোনো জায়গায় যায় না, কিছু দেখে নি—ও-ই যাক৷ ঘুরে আসুক৷

কেদার গামছা পরে পুকুর থেকে স্নান করে এসে বললেন, ওমা শরৎ , একটা ডাব খাওয়াতে পারবি?

—না বাবা, একটা ছোট্ট ডাব ওবেলা ঠাকুরদের দিয়েছি—এবেলা আর কিছু নেই৷ পুণ্য বাগদিকে ডেকে নিয়ে আসব?

—না থাক মা, সব গুছিয়ে নিয়ে রাখো—রাজলক্ষ্মী মা এলি কখন? তা তুই একটু সাহায্য কর না!

—ও তো করছেই বাবা৷ ও উত্তর দেউলে পিদিম দেবে পর্যন্ত বলছে৷ ও গাঁয়ের মধ্যে আর কেউ এতদূর আসেও না, খোঁজখবরও নেয় না৷ ও আছে তাই, তবু মানুষের মুখ দেখতে পাই৷

.

পরদিন প্রভাসের মোটর সামনের বারুইদ’র বিল পার হয়ে যাওয়ার পরে কেদারের মুখে প্রথম কথা ফুটলো৷ পেছনের সিটে তিনি মেয়েকে নিয়ে বসেছেন—সামনের সিটে বসেছে অরুণ ও প্রভাস—অরুণ গাড়ি চালাচ্ছে৷

কেদার মাঝে মাঝে বিস্ময়সূচক দু-একটা রব করছিলেন এতক্ষণ, এইবার মেয়েকে সম্বোধন করে প্রথম কথা বললেন৷

—ও শরৎ, কি জোরে যায় বটে মোটর গাড়ি, বারুইদ’র বিল গড়শিবপুর থেকে পাক্কা চার ক্রোশ রাস্তা৷ হেঁটে আসলে দু-ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার কম পৌঁছুনো যায় না—আর এই দ্যাখো, চোখের পাতা পাল্টাতে না পাল্টাতে এসে হাজির বারুইদ’র বিলে—

—হাজির কি বাবা, বিল পেরিয়েও তো গেল!

—ও, মানুষ না পাখি? কি জোরেই যায় তাই ভাবছি৷

—হ্যাঁ বাবা, কলকাতা কতদূর বললে প্রভাসদা?

—বেলা বারোটা কি একটার মধ্যে যাব বলছে৷ ত্রিশ ক্রোশ হবে এখান থেকে কলকাতা৷

প্রভাস সামনের সিটে বসে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বললে, কাকাবাবু কখনো কলকাতায় এসেছিলেন?

কেদার বললেন, তা দু-বার এর আগে কলকাতা ঘুরে এসেছি৷ তবে সে অনেকদিন আগের কথা৷ প্রায় দু-যুগ হল৷

অরুণ বললে, সে কলকাতা আর নেই, গিয়ে দেখবেন৷ শরৎদি, আপনি কখনো যান নি কলকাতায় এর আগে?

—নাঃ, আমি কোথাও যাই নি৷

—কলকাতাতেও না?

কলকাতা তো কলকাতা! বলে এখনো রানাঘাট কি রকম শহর তাই দেখি নি! রাজি হয়ে গেল বাবা তাই, নইলে আমার আসা হত না৷ পিদিম দেখানোর জন্যেই তো যত গোলমাল৷

আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য৷ ধর্মদাসপুরে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে ছায়ায়৷ এখনি এল ধর্মদাসপুরে! কেদার খাজনা আদায় করতে বেরিয়েছেন সকালে—বেলা এগারোটার কমে ধর্মদাসপুরে পৌঁছুতে পারেন নি৷ আর সেই ধর্মদাসপুর পার হয়ে গেল বড় জোর চল্লিশ মিনিটে—কি তারও কমে!

শরৎকে বললেন, মা, এই দ্যাখো ধর্মদাসপুর গেল, সেই যে একবার ওল এনেছিলাম মনে আছে? সে এখানে থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ কি জোরে যাচ্ছে একবার ভেবে দ্যাখো দিকিন?…হ্যাঁ, গাড়ি বের করেছে বটে সায়েবরা!

শরৎ ক্রমাগত ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করতে লাগল, বাবা—আর কত দেরি আছে কলকাতা? কতক্ষণে আমরা কলকাতা পৌঁছবো?

প্রায় ঘণ্টাচারেক একটানা ছোটার পরে একটা শহরে বাজারের মতো জায়গায় গাড়ি ঢুকল৷ কেদার বললেন, এটা কি জায়গা?

প্রভাস বললে, এটা বারাসাত৷ আর বেশি দূর নেই কলকাতা৷ এখান থেকে একটু চা খেয়ে নেবেন কাকাবাবু?

কেদার বললেন, কেন, এখানে কি তোমার কোনো জানাশুনো লোকের বাড়ি আছে নাকি? চা খাবে কোথায়?

—না, জানাশুনো কেউ নেই৷ দোকানে খাব৷ চায়ের দোকান আছে অনেক—

—না বাপু৷ তোমরা খাও, আমি দোকানের চা কখনও খাই নি, ও আমার ঘেন্না করে৷ আমি বরং একটু তামাক ধরিয়ে খাই, অনেকক্ষণ তামাক খাওয়া হয় নি৷

দোকানের চা শরৎও খেলে না৷ অরুণ ও প্রভাস নিজেরা গাড়ির গাছে চা আনিয়ে খেলে৷ কেদার আরাম করে হুঁকো টানতে টানতে বললেন, চা ভালো?

প্রভাস ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে, কেন, মন্দ না! খাবেন, আনব?

—না, আমি সেজন্যে বলছি নে৷ আমি দোকানের চা কখনো খাই নি, ও খাবও না কখনো৷ তোমরা খাও৷ আমরা সেকেলে মানুষ, আমাদের কত বাছবিচার৷

গাড়ি ছেড়ে যশোর রোড দিয়ে অনেকখানি এসে একটা বড়লোকের বাগানবাড়ির মধ্যে ঢুকল৷ ফটক থেকে লাল সুরকির রাস্তা সামনের সুদৃশ্য অট্টালিকাটির গাড়িবারান্দাতে গিয়ে শেষ হয়েছে৷ পথের দু-ধারে এরিকা পামের বড় বড় চারা গাছ, ক্রোটন, শেফালি, চাঁপা, আম, গোলাপজাম প্রভৃতি নানারকম গাছ৷

প্রভাস বললে, আপনারা নামুন—এবেলা এখানে থাকবেন আপনারা৷ এটা অরুণদের বাগানবাড়ি, ওর দাদামশায়ের তৈরি বাড়ি এটা৷

কেদার ও শরৎ দুজনেই বাড়ি দেখে আনন্দে ও বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন৷ এমন বাড়িতে বাস করবার কল্পনাও কখনো তাঁরা করেন নি৷ মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেজে, ছোট বড় আট-দশটা ঘর৷ বড় বড় আয়না, ইলেকট্রিক পাখা, আলো, কৌচ, কেদারা৷ তবে দেখে মনে হয় এখানে যেন কেউ বাস করে নি কোনো দিন, সব জিনিসই খুব পুরনো—দু-একটা ঘর ছাড়া অন্য ঘরগুলোতে ধুলো, মাকড়সার জাল বোঝাই৷

কেদার কথাটা বললেন প্রভাসকে৷

প্রভাস বললে, ওর দাদাবাবু শৌখিন লোক ছিলেন, তিনি মারা গিয়েছেন আজ বছর কয়েক৷ এখন মাঝে মাঝে অরুণরা আসে—সব সময় কেউ থাকে না৷

শরৎ বললে, এটাই কলকাতা প্রভাসদা?

—না, এটাকে বলে দমদম৷ এর পরেই কলকাতা শুরু হল৷ তোমরা বিশ্রাম করো—ওবেলা কলকাতা বেড়িয়ে নিয়ে আসব৷ এখুনি ঝি আসবে, যা দরকার হয় বলে দিয়ো ঝিকে—সব গুছিয়ে এনে দেবে৷ ঠাকুর আসবে এখন—

শরৎ বললে, কি ঠাকুর?

—রান্না করতে আসবে ঠাকুর৷

—বাবা ঠাকুরের হাতে রান্না খেতে পারবেন না প্রভাসদা, ঠাকুর আসবার দরকার নেই৷ আমি আছি তবে কি জন্যে?

—কলকাতায় এলে, একটু বেড়াবে না, বসে বসে রান্না করবে গড়শিবপুরের মতো? বাঃ—

—তা হোক গে৷ আমার রান্না করতে কতক্ষণ যাবে বলুন তো? কজন লোকের রান্না করতে হবে?

প্রভাস ও অরুণ শরতের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললে৷ প্রভাস বললে—কজন লোকের রান্না আবার৷ তোমাদের দুজনের, আবার কে আসবে তোমার এখানে খেতে? তুমি তো আর রাঁধুনী বামনী নও যে দেশসুদ্ধ লোকের রেঁধে বেড়াবে? আচ্ছা, আমরা এখন আসি কাকাবাবু, বিকেলে ছ’টার সময় আবার আসব৷ মলঙ্গা লেনে আমাদের যে বাড়ি আছে সেখানে নিয়ে যাব ওবেলা৷

ওরা গাড়ি নিয়ে চলে গেলে কেদার আর একবার তামাক সাজতে বসলেন৷

শরৎ চারিদিকে বেড়িয়ে এসে বললে, বাঃ চমৎকার জায়গা! ওদিকে একটা বাঁধা ঘাটওয়ালা পুকুর, দেখবে এসো না বাবা! তোমার কেবল তামাক খাওয়া আর তামাক খাওয়া! এই তো একবার খেলে বারাসাত না কি জায়গায়!

কেদার অগত্যা উঠে মেয়ের পিছু পিছু গিয়ে পুকুর দেখে এলেন৷ বাঁধা ঘাট অনেক দিনের পুরনো—কতকাল এ ঘাট যেন কেউ ব্যবহার করে নি৷ পুকুরের ওপারেও বাগান, কিন্তু ওদিকটাতে আগাছার জঙ্গল বড় বেশি৷

শরৎ বললে, বাবা, খিদে পেয়েছে?

—নাঃ—

—ঠিক পেয়েছে বাবা৷ উড়িয়ে দিলে শুনব না৷ ভাঁড়ার জিনিসপত্র সব আছে দেখে এসেছি—হালুয়া আর লুচি করে আনি?

কেদার চুপ করে তামাক টানতে লাগলেন, মেয়ের কাজে বাধা দেবার বিশেষ কোনো লক্ষণ প্রকাশ করলেন না অবিশ্যি৷ শরৎ কিন্তু অল্প একটু পরে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বললে—বাবা, মুশকিল বেধেছে—

—কি রে?

—এখানে তো দেখছি পাথুরে কয়লা জ্বালানো উনুন৷ কাঠের উনুন নেই৷ কয়লা কি করে জ্বালতে হয় জানি নে যে বাবা! ঝি না এলে হবেই না দেখছি৷

শরৎ ছেলেমানুষের মতো আনন্দে বাগানের সব জায়গায় বেড়িয়ে ফুল তুলে ডাল ভেঙে এ গাছতলায় লোহার বেঞ্চিতে বসে ও গাছতলায় লোহার বেঞ্চিতে বসে বসে উৎপাত করে বেড়াতে লাগল৷ বেশ সুন্দর ছায়াভরা বাগান৷ কত রকমের ফুল—অধিকাংশই সে চেনে না, নামও জানে না৷ কেদার মেয়ের পীড়াপীড়িতে এক জায়গায় গিয়ে লোহার বেঞ্চিতে খানিকটা বসে কলের পুতুলের মতো দু-একবার মাথা দুলিয়ে বলতে লাগলেন—বাঃ, বেশ—বাঃ—

বেলা যখন বেশ পড়ে এসেছে, তখন প্রভাস মোটর নিয়ে এসে বললে—আসুন কাকাবাবু, চলো শরৎ—কাকাবাবুকে কিছু খাইয়েছ?

শরৎ হেসে বললে, তা হয় নি৷ ঝি তো মোটেই আসে নি৷

—তুমি তো বললে তুমিই করবে? জিনিসপত্র তো আছে—

—কয়লার উনুনে জ্বাল দিতে জানি নে, কয়লা ধরাতে জানি নে! তাতেই তো হল না৷

প্রভাস চিন্তিতমুখে বলল, তাই তো! এ তো বড় মুশকিল হল!

কেদার বললেন, কিছু মুশকিল নয় হে প্রভাস৷ চলো তুমি, ফিরে এসে বরং জলযোগ করা যাবে—

প্রভাস বললে, যদি নিকটের ভালো দোকান থেকে কিছু মিষ্টি কিনে আনি, তা আপনার চলবে না কাকাবাবু?

শরৎ হেসে বললে, বাবা ও-সব খাবেন না প্রভাসদা, তা ছাড়া আমি তা খেতেও দেব না৷ কলকাতা শহরে শুনেছি বড় অসুখ-বিসুখ, যেখান সেখান থেকে খাবার খাওয়া ওঁর সইবে না৷

অগত্যা সকলে মোটরে উঠে বসলেন, গাড়ি ছাড়লো৷

প্রথমে যশোর রোডের দু-ধারে বাগানবাড়ি ও কচুরিপানা-বোঝাই ছোট বড় জলা ছাড়িয়ে বেলগেছের মোড়ের আলোকোজ্জ্বল দৃশ্য দেখে পিতাপুত্রী বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়ল৷ ওদের দুজনের মুখে আর কোনো কথা নেই৷ গাড়ি ওখান থেকে এসে পড়ল কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে—এবং দু-ধারে দোকানপসার, থিয়েটার সিনেমা, ইলেকট্রিক আলোর বিজ্ঞাপন, দোকানের বাইরে শো-কেসে বহুবিচিত্র কাপড়, পোশাক, পুতুল, আয়না, সেণ্ট, সাবান, স্নো প্রভৃতির সুদৃশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে গাড়ি এসে পড়ল হ্যারিসন রোডের মোড়ে এবং এখান থেকে গাড়ি ঘুরে গেল হাওড়ার পুলের ওপর, ওপার হয়ে হাওড়া স্টেশনের গাড়িবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল৷

পুল পার হবার সময় প্রভাস বললে, এই দেখুন হাওড়ার পুল, নিচে গঙ্গা—আমরা যাচ্ছি হাওড়া স্টেশনে৷

এবারও কেদার বা শরৎ কারো মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলো না৷

প্রভাস গাড়ি থামিয়ে বললে, কাকাবাবু, চলুন স্টেশনের রেস্টোরেণ্ট থেকে আপনাকে চা খাইয়ে আনি—খাবেন কি?

কেদারের কোনো আপত্তি ছিল না—কিন্তু মেয়ে বাপের পরকালের দিকে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে—বাবা নাস্তিক মানুষ—ওঁর এ বয়সে কোনো অশাস্ত্রীয় অনাচারের সংস্পর্শে কখনো সে আসতে দেবে না কেদার তা ভালো জানতেন৷ তিনি মেয়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইলেন বটে, কিন্তু শরৎ তাঁর মুখের দিকে ভালো করে না চেয়েই বললে, চলুন প্রভাসদা, উনি ওখানে খাবেন না—

অগত্যা প্রভাস আবার গাড়ি ছেড়ে হাওড়ার পুলের ওপর এল এবং আস্তে আস্তে চলতে লাগল৷ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ওই দেখুন সব জাহাজ, শরৎদি দ্যাখো সমুদ্রে যে সমস্ত জাহাজ যায়, ওই দাঁড়িয়ে আছে৷

স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে গাড়ি এল আউট্রাম ঘাটে৷ ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে প্রভাস আউট্রাম ঘাটের জেটিতে গিয়ে একখানা বেঞ্চিতে বসলো৷ সামনের গঙ্গাবক্ষে ছোট বড় স্টীমার বাঁশি বাজিয়ে চলেছে, বড় বড় ভড় ও বজরা ডাঙার দিকে নোঙর করে রেখেছে, সার্চলাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাল একখানা বড় স্টীমার আস্তে আস্তে যাচ্ছে নদীর মাঝখান বেয়ে, সুবেশা নরনারীরা জেটির ওপর বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে—চারিদিকে একটা যেন আনন্দ ও উৎসাহের কোলাহল৷

একটা বড় বয়া ঢেউয়ের স্রোতে দুলছে দেখে শরৎ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ওটা কি?

প্রভাস বললে, জাহাজ বাঁধে ওই আংটাতে, বয়া বলে ওকে৷ আরও অনেক আছে নদীতে—

এতক্ষণে ওদের দু-জনের কথা যেন ফুটলো৷ কেদার নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাপ রে, এ কি কাণ্ড! হ্যাঁ শহর তো শহর, বলিহারি শহর বটে বাবা!

শরৎ বললে, সত্যি বাবা, এমন কখনো ভাবি নি৷ এ যেন জাদুকরের কাণ্ড! আচ্ছা, এখানে জলের ওপর ঘর কেন?

প্রভাস বুঝিয়ে দিয়ে বললে, শরৎদি, কাকাবাবুকে এবার চা খাওয়ানো চলবে এখানে? খুব ভালো বন্দোবস্ত৷

শরৎ রাজি হল না৷ বাবাকে পরকালে যমের বাড়ি সে কখনো পাঠাতে পারবে না৷ যা নাস্তিক উনি, এমনি কি গতি হয় ওঁর কে জানে! তার ওপর রাশ আলগা দিলে কি আর রক্ষা আছে? বাবা ধেই ধেই করে নৃত্য করে বেড়াবেন এই কলকাতা শহরে!

প্রভাসের নির্বন্ধাতিশয্যে শরৎ একটু বিরক্তই হল৷ সে যখন বলছে বাবা যেখানে সেখানে খাবেন না, তখন তাঁকে অত প্রলোভন দেখাবার মানে কি?

বললে, আচ্ছা প্রভাসদা, ওঁকে খাইয়ে কেন বাবার জাতটা মারবেন এ কদিনের জন্যে? ও কথাই ছেড়ে দিন৷

এবার কিন্তু কেদার বিদ্রোহ ঘোষণা করে বললেন, হ্যাঁঃ, যত সব! একদিন কোথাও চা খেলেই একেবারে নরকে যেতে হবে! নরক অত সোজা নয়, পরকালও অমন ঠুনকো জিনিস নয়৷ চলো সবাই মিলে চা খেয়ে আসা যাক হে—

শরৎ দৃঢ়স্বরে বললে, না, তা কখনো হবে না৷ যাও দিকি—সন্দে-আহ্নিক তো করো না কোনোকালে, আবার ছত্যিশ জাতের জল না খেলে চলবে না তোমার বাবা?

কেদারের সাহসের ভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে গেল৷ প্রভাসও আর অনুরোধ করলে না, তিনিও আর যেতে চাইলেন না৷ ওখান থেকে সবাই এল ইডেন গার্ডেনে৷ রাত প্রায় সাড়ে আটটা, বহু সুসজ্জিত সাহেব-মেমকে বেড়াতে দেখে শরৎ তো একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত৷ এত সাহেব-মেম একসঙ্গে কখনো দেখা দূরে যাক, কল্পনাও করে নি কোনো দিন! শরৎ হাঁ করে একদৃষ্টে এরিকা পামের কুঞ্জের মধ্যে বেঞ্চিতে উপবেশন-রত দুটি সুবেশ, সুদর্শন সাহেব ও মেমের দিকে চেয়ে রইল৷ হঠাৎ কি ভেবে তার চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়তেই আঁচল দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে সে মুছে ফেললে৷ শরতের মনে পড়ল, গ্রামের লোকের দুঃখদারিদ্র্য, কত ভাগ্যহত, দীনহীন ব্যক্তি সেখানে, কখনো জীবনে আনন্দের মুখ দেখলে না৷ ব্যান্ডস্ট্র্যান্ডে ব্যান্ড বাজছিল অনেকক্ষণ থেকে৷ শরৎ অনেকক্ষণ বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনলে৷ কিন্তু ওর ভালো লাগল না, সবই যেন বেসুরো, তার অনভ্যস্ত কানে পদে পদে সুরের খুঁৎ ধরা পড়ছিল৷

প্রভাস বললে, সিনেমা দেখবে তো বলো নিয়ে যাই!

শরৎ কখনো না দেখলেও সিনেমা সম্বন্ধে গড়শিবপুরে থাকতেই শহর-প্রত্যাগত নববিবাহিতা বালিকা কিংবা বধূদের মুখে অনেক গল্প শুনেছে৷ বাবাকে এমন জিনিস দেখাতেই হবে, সে নিজে দেখুক না দেখুক, কিন্তু আজ আর নয়—বাবার কিছু খাওয়া হয় নি বিকেল থেকে৷ একবার তার মনে হল বাবা চা খেতে চাইছেন, খান বরং কোনো ভালো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকানে বসে! কি আর হবে! বাবা না নাস্তিক, এত বয়েস হল, একবার পৈতেগাছটা হাতে করে গায়ত্রী জপটাও করেন না কোনোদিন, পরকালে ওঁর অধোগতি ঠেকাবার সাধ্যি হবে না শরতের—সুতরাং ইহকালে যে ক’দিন বাঁচেন, অন্ততঃ সুখ করে যান৷ ইহকালে পরকালে দু-কালেই কষ্ট করে আর কি হবে?

শরৎ বললে, বাবাকে চা খাইয়ে নিই কোনো দোকানে বসে৷ ভালো দোকান দেখে—ব্রাহ্মণের দোকান নেই?

কেদার অবাক হয়ে মুখের দিকে চাইলেন৷ প্রভাস বিপন্ন মুখে বললে, ব্রাহ্মণের দোকান—তাই তো—ব্রাহ্মণের দোকান তো এদিকে দেখছি নে—আচ্ছা হয়েছে—এক উড়ে বামুন ঘড়া করে চা বেচে ওই মোড়টাতে, ভাঁড়ে করে দেয়—সেই সবচেয়ে ভালো৷ চলুন নিয়ে যাই৷

চা-পান শেষ করে ওরা আবার মোটরে চৌরঙ্গী পার হয়ে পার্ক স্ট্রীটের মোড় পর্যন্ত গেল৷ এক জায়গায় এসে কেদার বললেন, এখানটাতে একটু নেমে হেঁটে দেখলে হত না প্রভাস? বেশ দেখাচ্ছে—

গাড়ি এক জায়গায় রেখে ওরা পায়ে হেঁটে চৌরঙ্গীর চওড়া ফুটপাথ দিয়ে আবার ধর্মতলার মোড়ের দিকে আসতে লাগল৷ দোকান-হোটেলগুলির আলোকোজ্জ্বল অভ্যন্তর ও শো-কেসগুলির পণ্যসজ্জা ওদের একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে—শরৎ তো একেবারে বিস্ময়বিমুগ্ধ৷

কতকাল মেয়েমানুষ হয়েও সে জিনিসপত্রের লোভ করে নি৷ জিনিসপত্র অধিকার করে রাখবার মেয়েদের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি চেপে চেপে রাখে মনের মধ্যে, শরতের সে-সব বহুদিন চলে গিয়েছিল মন থেকে মুছে—কিন্তু আজ যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তারা৷

একটা দোকানে ক্রিস্ট্যালের চমৎকার ফুলদানি দেখে শরৎ ভাবলে—আহা, একটা ওইরকম ফুলদানি কেনা যেত!—বুনোফুল কত ফোটে এই সময় কালো পায়রা দিঘির পাড়ের জঙ্গলে, সাজিয়ে রাখত সে রোজ রোজ৷ একটা চমৎকার পুতুল সাদা পাথরের, একটা কি অদ্ভুত কাঁচের বল, তার মধ্যে বিজলির আলো জ্বলছে…কি চমৎকার শাড়ি একটা বাঙালির দোকানে, রাজলক্ষ্মীর জন্যে ওইরকম শাড়ি একখানা যদি নিয়ে যাওয়া যেত! জন্মে সে এরকম পাড়ের শাড়ি কখনো দেখে নি৷

প্রভাস বললে, এটাকে বলে নিউমার্কেট৷ চৌরঙ্গী ছাড়িয়ে এলাম—চলুন শরৎদির জন্যে কিছু ফল কিনি৷

শরৎ বললে, না, আমার জন্যে আবার কেন খরচ করবেন প্রভাসদা? ফল কিনতে হবে না আপনার৷

প্রভাস ওদের কথা না শুনে ফলের দোকানের দিকে সকলকে নিয়ে গেল৷ এর নাম ফলের দোকান! শরৎ ভেবেছিল, বুঝি ঝুড়িতে করে তাদের দেশের হাটের মতো কলা, পেঁপে, বাতাবিনেবু বিক্রি হচ্ছে রাস্তার ধারে—এরই নাম ফলের দোকান! কিন্তু কি এ ব্যাপার? এত স্তূপীকৃত বেদানা, কমলালেবু, কিশমিশ, আনারস, আঙুর যে এক-জায়গায় থাকতে পারে, এ কথা সে জানত এখানে আসবার আগে? তবুও তো এগুলো তার পরিচিত ফল, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে—অন্য কতশত প্রকারের ফল রয়েছে যা সে কখনো চক্ষেও দেখে নি—নামও শোনে নি!

শরৎ জিজ্ঞেস করলে, কাগজে জড়ানো জড়ানো ওগুলো কি ফল প্রভাসদা?

—ও আপেল, কালিফোর্নিয়া বলে একটা দেশ আছে আমেরিকায়, সেখান থেকে এসেছে৷ তোমার জন্যে নেব শরৎদি? আর কিছু আঙুর নিই, কাকাবাবু আনারস ভালোবাসেন?

একটা বড় ঠোঙায় ফল কিনে ওরা নিউমার্কেটের বিভিন্ন দিকে বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় এল—সেখানে একটা আস্ত বাঘের হাঁ-করা মুণ্ডু মেঝের ওপর দেখে শরৎ চমকে উঠে বাবাকে দেখিয়ে বললে, বাবা, একটা বাঘের মাথা!

কেদারও অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সেদিকে৷

প্রভাস বললে, এরা জন্তুর চামড়া আর মাথা এরকম সাজিয়ে বিক্রি করে৷ এদের বলে ট্যাক্সিডারমিস্ট৷ এরকম অনেক দোকান আছে৷

এইবার সত্যি সত্যি একটা জিনিস পছন্দ হয়েছে বটে শরতের৷ ওই বাঘের মুণ্ডুসুদ্ধ ছালখানা৷ তার নিজের শাড়ির দরকার নেই, গহনার দরকার নেই—সে-সব দিন হয়ে গিয়েছে তার জীবনে৷ কিন্তু এই একটা পছন্দসই জিনিস যদি সে নিজের দখলে নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখতে পারত, তবে সুখ ছিল পাঁচজনকে দেখাবার মতো জিনিস বটে৷

মুখ ফুটে সে প্রভাসকে দামটা জিজ্ঞেস করলে৷ প্রভাস দোকানে ঢুকে বললে, ওটা বিক্রির জন্যে নয়৷—দোকান সাজাবার জন্যে৷ তবে এরকম ওদের আছে,—আড়াইশো টাকা দাম৷

অরুণ বললে, এখন কোথায় যাওয়া হবে?

প্রভাস বললে, কেন, সিনেমায়? কি বলেন কাকাবাবু—

শরতের যদিও সিনেমা দেখবার আগ্রহ খুবই প্রবল, তবুও সে যেতে রাজি হল না৷ বাবা সেই কোন সকালে দুটো খেয়ে বেরিয়েছেন, এখন গিয়ে রান্না না চড়িয়ে দিলে আবার তিনি কখন খাবেন?

অগত্যা সকলে মোটরে আলোকোজ্জ্বল কলিকাতা নগরীর বিরাট সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে এল আবার সেই বেলগেছের পুলের মুখে৷

শরৎ এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এইবার বললে, বাবাঃ, কত বড় শহর৷ কূলও নেই, কিনারাও নেই!

প্রভাস হেসে বললে, শরৎদি, একি আর তুমি ধর্মদাসপুর পেয়েছ? গড়শিবপুর থেকে ধর্মদাসপুর যত বড়—ততখানি লম্বা হবে কলকাতা৷ আজ চলো, কাল আবার ভালো করে দেখো৷ আমাদের মলঙ্গা লেনের বাড়িতেও নিয়ে যাব৷

বেলগেছের পুল ছেড়ে দু-ধারের দৃশ্য যেন অনেকটা পাড়াগাঁয়ের মতো৷ বড় বড় বাগানবাড়ির ঘন বৃক্ষশ্রেণীর অন্তরালে দু-চারটি বিজলি বাতি, কোনো কোনো বাগানবাড়ি একদম অন্ধকার৷ এখানে এক পশলা বৃষ্টি আসতে গাড়ির জানলার কাঁচ উঠিয়ে দেওয়া হল হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে—খাড়া সোজা পথ তীব্র হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চোখের সামনে—দ্রুতগামী মোটর লম্ভে লম্ভে যেন সে সুদীর্ঘ পথটার খানিকটা করে অংশ এক এক কামড়ে গিলে খাচ্ছে৷ শরৎ হাঁ করে চেয়ে রইল৷

ওদের বাগানবাড়িটার ফটক দিয়ে গাড়ি ঢুকল ভেতরে৷

এ বাগানটা যেন আরও অন্ধকার৷ তবে সব ঘরেই বিজলি বাতির বন্দোবস্ত৷

প্রভাস কি টিপলে—পুটুস—পুটুস—এ ঘরে আলো জ্বলে উঠল সবুজ কাঁচের বড় চিমনির মধ্যে দিয়ে—বারান্দায় পুটুস পুটুস—দীর্ঘ বারান্দায় এদিক থেকে ওদিকে তিনটে আলো জ্বলে উঠল৷

শরৎ বললে, আমায় দেখিয়ে দিন প্রভাসদা কি করে জ্বালাতে হয়—

পুটুস—বাতি নিবে গেল—একদম অন্ধকার৷

—এইটে হাত দিয়ে টেপো শরৎদি—এই দেখো—এই জ্বললো—আবার উঠিয়ে দাও—এই নিবে গেল—

শরৎ বালিকার মতো খুশিতে বার বার সুইচ টিপে আলো একবার জ্বালিয়ে একবার নিবিয়ে দেখতে লাগল৷

—বাবা, দ্যাখো কি রকম, তুমি এরকম দ্যাখো নি—

কেদার তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ওসব তুমি দ্যাখো মা৷ আমি এর আগেও এসেছি, ওসব দেখে গিয়েছি—

শরৎ বললে, সে কবে বাবা? তুমি আবার কবে কলকাতায় এসেছিলে শুনি?

—তুই তখন জন্মাস নি৷ কলকাতায় তখন ঘোড়ার ট্রাম চলত৷ তোর মার জন্যে বড়বাজার থেকে ভালো তাঁতের ডুরে-শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই দেখে তোর মার কি আহ্লাদ!…তখন ইলেকটিরি আলো সব রাস্তায় ছিল না, দু-একটা বড় রাস্তায় দেখেছিলাম৷ লোকের বাড়িতে তখন গ্যাস জ্বলত—

প্রভাস বিস্ময়ের সুরে বললে, সত্যি কাকাবাবু, আপনি যা বলছেন ঠিক তো! আমি বাবার মুখেও শুনেছি প্রথম হ্যারিসন রোডে ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে, তখন—

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই যে রাস্তা বললে, ওখানেই আমি দেখেছি—অনেক দিনের কথা৷

ইতিমধ্যে ঝি এসে জানাল, উনুনে আঁচ দেওয়া হয়েছে৷ শরৎ তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে গেল—যাবার সময় বলে গেল, বোসো বাবা, ভালো করে চা করে আনি—প্রভাসদা, অরুণবাবু যাবেন না চা না খেয়ে৷

রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে ক্ষিপ্তহস্তে রান্না-বাড়া সাঙ্গ করে শরৎ বাবাকে খাওয়ার ঠাঁই করে দিলে৷ প্রভাস ও অরুণ তার অনেক আগে চা-পান করে বিদায় নিয়েছে৷

শরৎ মাথা দুলিয়ে বললে, ভাত কিন্তু নয় বাবা—লুচি—

—যা হয় দাও মা৷ লুচি কেন?

—লুচির বন্দোবস্ত দেখি করে রেখেছে৷ ঘি, আটা—চাল আনে নি—

—বেশ ভালোই হল—তুই খেতে পাবি এখন—

—বোসো, গরম গরম আনি—

পরম তৃপ্তির সহিত প্রায় বিশ-বাইশখানা লুচি অনর্গল খেয়ে যাওয়ার পরে কেদারের মনে পড়ল, আর বেশি খাওয়া ঠিক হবে না—মেয়ের লুচিতে টান পড়বে৷

শরৎ আবার যখন দিতে এল, বললে, নাঃ আর না, থাক৷

—কেন দিই না এই দুখানা গরম গরম—

—তোমার জন্যে আছে তো?

—ওমা, সে কি! প্রায় আধসেরের ওপর আটা—একপোয়া আটার লুচি আমি খেতে পারি না, তুমি পারো?

—খুব পারি, ওকথা বলো না মা—এক সময়ে…

—তোমার তো বাবা কেবল এক সময়ে আর এক সময়ে৷ এখন পারো না তো আর?

—খুব পারি—

—পারলেও আর দেব না৷ খেয়ে ওঠো—বিদেশবিভুঁই জায়গা—দাঁড়াও দইটা নিয়ে এসে দিই—দই আছে, মিষ্টি আছে—

আহারাদি সেরে পরিতৃপ্তির সহিত তামাক টানতে টানতে কেদার মেয়েকে বললেন, প্রভাস ছোকরা ভালো৷ বেশ যোগাড় আয়োজন করেছে খাওয়ার—কি বলিস মা?

—চমৎকার, আবার কি করবে?

—ফলগুলো কেটেছিস নাকি?

—না বাবা, কাল সকালে কাটব, তোমায় দেব৷ আজ তো লুচি ছিল, তাই খেলাম৷

—বড্ড নির্জন বাগানটা—না?

—গড়ের জঙ্গলের চেয়ে নির্জন নয় তা বলে৷ ওই তো রাস্তা দিয়ে মোটরগাড়ি যাচ্ছে, আর গড়ের জঙ্গলে যে-সময়ে শেয়াল ডাকে, বাঘ বের হয়!

—তা যা বলিস বাপু, সেখানে যতই জঙ্গল হোক, জন্মভূমি তো বটে৷ সেখানে ভয় হয়—তুই সত্যি করে বল তো?

—ভয় হলে কি থাকতে পারতাম বাবা? ছেলেবেলা থেকে কাটালাম কি করে তবে?

—কিন্তু এখানে কেমন যেন ভয় করে মা৷ কলকাতা শহর যেমন, তেমন গুণ্ডা-বদমাইশের জায়গা৷

.

সারাদিন মোটর ভ্রমণের ক্লান্তির ফলে রাত যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল৷

পরদিন সকালে শরৎ বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিয়ে বাবার জন্যে চা আর খাবার করতে বসল৷ অনেকদিন পরে সে বাবাকে ভালো করে খাওয়ানোর সচ্ছল উপকরণ হাতের কাছে পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷

কেদার বললেন, প্রভাস আর অরুণের জন্যে খাবার করে রাখো মা, যদি ওরা সকালে এসে পড়ে?

কিন্তু তারা সকালের দিকে এল না৷

দুপুরের পর কেদার একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ তাঁর দিবানিদ্রা অভ্যাস নেই—অথচ রাস্তাঘাট না চেনার দরুন কোথাও যেতেও পারেন না৷ এই বাগানবাড়ির চতুঃসীমায় বন্দী-জীবন যাপন করার মতো লোক নন তিনি৷

শরৎকে ডেকে বললেন, হ্যাঁ মা, গঙ্গা কোনদিকে ঝিকে জিজ্ঞেস করো তো?

শরৎ ঘুরে এসে বললে, গঙ্গা নাকি এখান থেকে দুক্রোশ পথ বাবা৷ কেন, গঙ্গা কি হবে?

—না, একটু বেড়িয়ে আসতাম গঙ্গার ধারে৷

বেলা তিনটের পর প্রভাস একা মোটর হাঁকিয়ে এল৷

বললে, ওবেলা কাজ ছিল জরুরী—আসতে পারলাম না৷ কোনো অসুবিধে হয় নি তো কাকাবাবু?

—নাঃ, অসুবিধে কি হবে? অরুণ এল না?

—তার সঙ্গে দেখাই হয় নি আজ সারাদিন৷ তবে সেও কাজে ব্যস্ত আছে মনে হচ্ছে৷ নইলে নিশ্চয় আসত৷

—তুমি চা খেয়ে নাও শরৎ মা, তোমার প্রভাসদাকে—

আধ ঘণ্টার মধ্যে কেদার চা-পান শেষ করে মেয়েকে নিয়ে মোটরে উঠলেন৷ বললেন, কলকাতার দিকে না গিয়ে এবার চলো না বেশ গঙ্গার ধারে নির্জন জায়গায়—

—পেনেটিতে দ্বাদশ শিবের মন্দিরে যাবেন?

শরৎ আগ্রহের সুরে বললে তাই চলো প্রভাসদা, দেখি নি কখনো৷

কেদার শিবমন্দির দেখবার কোনো আগ্রহ দেখালেন না—তীর্থদর্শনে পুণ্যঅর্জন করবার ওপর লোভ জীবনে তাঁর কোনো দিনই দেখা যায় নি৷

বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে পড়ে মোটর তীরবেগে পেনিটির দিকে ছুটল৷ রাস্তার দুধারে কত বিচিত্র উদ্যানরাজি, কত সুন্দর বাড়ি—কলকাতার বড়লোকদের ব্যাপার৷ পেনিটির দ্বাদশ শিবের মন্দির দেখে শরৎ খুব খুশি৷ সামনে গঙ্গা, ওপারে কত কলকারখানা, মন্দির, ঘরবাড়ি৷ এপারে সারি সারি বাগানবাড়ি—বিকেলের নীল আকাশ গঙ্গার বিশালবক্ষে ঝুঁকে পড়েছে— নৌকো স্টীমারের ভিড়৷

শরৎ অবাক হয়ে গঙ্গার বাঁধাঘাটে রানার ওপর দাঁড়িয়ে দেখে দেখে বললে—এমন কখনো দেখি নি বাবা, ওপারের দিকটা কি চমৎকার!

প্রভাস বললে, ভালো লাগছে, শরৎদি?

—উঃ, ইচ্ছে করে এখানেই সব সময় থাকি আর গঙ্গাস্নান করি—ভালো কথা প্রভাসদা, কাল গঙ্গা নাওয়াও না কেন?

—বেশ ভালোই তো৷ কোন সময়ে আসব বলো—কোথায় নাইবে?

—এখানেই এসো৷ এ জায়গা আমার ভারি ভালো লেগেছে—

—এখানেই আসবে? না কালীঘাটে? কাকাবাবু কি বলেন?

—তুমি যেখানে ভালো বোঝো৷ বাবার কথা ছেড়ে দাও—উনি ওসব পছন্দ করেন না৷

সন্ধ্যার আগে অস্ত-দিগন্তের চিত্রবিচিত্র রঙিন আকাশের ছায়া গঙ্গার জলে পড়ে যে মায়ালোক সৃষ্টি করল, শরৎ সে-রকম দৃশ্য জীবনে কোনোদিন দেখে নি৷ গড়শিবপুর জলের দেশ নয়—এত বড় নদী, জলের বুকে এমন রঙিন মেঘের প্রতিচ্ছায়া সে এই প্রথম দেখল৷ রাজলক্ষ্মীর জন্যে মনটা কেমন করে উঠল শরতের—সে বেচারি কিছু দেখতে পেলে না জীবনে, আজ সে সঙ্গে থাকলে আনন্দ অনেক বেশি হত৷

বাড়ি ফিরে শরৎ রান্নাঘরে ঢুকল—প্রভাস কিছুক্ষণ বসে কেদারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল৷

কথায় কথায় কেদার বললে, হ্যাঁ হে, এখানে কোথাও গান-টান হয় না?

আসলে কেদারের এসব খুব ভালো লাগছিল না—শহর, দেবমন্দির, গঙ্গা, দোকান, ট্রাম—এসব খুব ভালো জিনিস৷ কিন্তু তিনি একটু গান-বাজনা চান, চিরকাল যা করে এসেছেন৷ শরৎ ছেলেমানুষ, তার ওপর মেয়েমানুষ—ও শহর বাজার, ঠাকুর দেবতা দেখে খুশি থাকতে পারে—কেদারের এখন সে বয়েস নেই৷ মেয়েমানুষও নন যে পুণ্যের লোভ থাকবে৷

প্রভাস বললে, কি রকম গান-বাজনা বলুন?

—এই ধরো কোনো গান-বাজনার আড্ডা—শুনেছি তো কলকাতায় অনেক বড় বড় গানের মজলিশ বসে বড়লোকের বাড়ি৷ একদিন সে-রকম কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারো?

প্রভাস একটু ভেবে বললে, তা বোধ হয় পারব—দেখি সন্ধান নিয়ে৷ কাল বলব আপনাকে—

—অনেক শুনেছি বড় বড় ওস্তাদ আছে কলকাতায়, কোথায় থাকে জানো? তাদের গান শোনবার সুবিধে হয়?

—আমি দেখব কাকাবাবু৷ অরুণকে জিগগেস করি কাল—ও অনেক খোঁজ রাখে—

প্রভাস মোটর নিয়ে চলে যাচ্ছে, এমন সময় শরৎ এসে বললে—ও প্রভাসদা, যাবেন না—

—কেন শরৎদি?

—আপনার জন্যে একটা জিনিস তৈরি করছি—

—কি বলো না?

—এখন বলছি নে—আসুন, খাবার সময় দেব—

—খুব দেরি হয়ে যাবে শরৎদি—

—কিছু দেরি হবে না, হয়ে গেল—গরম গরম ভেজে দেব—

কিছুক্ষণ পরে শরৎ একখানা রেকাবিতে খানকতক মাছের কচুরি এনে বললে—খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে৷ এবেলা ঝি ভালো পোনামাছ এনেছে প্রায় আধসের৷ অত মাছ রান্না করে কে খাবে? তাই ভাবলাম বাবার জন্যে খান-কতক কচুরি ভাজি—

প্রভাস বললে, কাকাবাবুকে দিলে না?

—তাঁকে এখন না৷ এখন খেলে রাত্রে আর খেতে পারবেন না৷ তখন একেবারে দেব—

প্রভাস খাওয়া শেষ করে বিদায় নেওয়ার আগে বললে—কাল শরৎদি গঙ্গা নাওয়াবো তোমায়৷ ভেবে রেখো কালীঘাট না পেনিটি কোথায় যাবে?

কেদার বললেন, আমার কথাটা যেন মনে থাকে, প্রভাস৷ ভালো গান-বাজনার সন্ধান পেলেই খবর দেবে—

—সে আমার মনে আছে কাকাবাবু৷

.

পরদিন সকালে উঠে কেদার দেখলেন মেয়ে তাঁর আগেই উঠে বাগানে ফুল তুলে বেড়াচ্ছে৷ বাবাকে দেখে বললে—ওঠো বাবা, আমি আজ পুজো করব ভেবে ফুল তুলছি৷ কি চমৎকার চমৎকার ফুল ফুটে আছে পুকুরের ওপাড়ে! তুমি চেনো এসব ফুল? বিলিতি না কি ফুল—দেখিই নি কখনো—

কেদার বললেন, বেশ বাগানবাড়িটা, না মা শরৎ? কিন্তু—

—কিন্তু কি বাবা?

—এখানে বেশিদিন মন টেঁকে না৷ আমাদের গড়শিবপুরের সেই জঙ্গলা ভালো—না মা?

—যা বলেছ বাবা৷ বাগানের পুকুরটা দেখে আমার এইমাত্র কালো পায়রার দিঘির কথা মনে পড়ছিল—

—আর কতদিন থাকবে এখানে? প্রভাস কিছু বলেছে?

—তুমি যে ক’দিন বলো বাবা৷ এখনও কালীঘাট দেখি নি, বায়স্কোপ দেখি নি—দেখি সেগুলো? আর কি কি আছে দেখবার বাবা?

—চিড়িয়াখানাটা আমার সেবারও দেখা হয় নি—এবার দেখব৷

—সেবার মানে কি বাবা? হয়তো ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগেকার কথা৷ আমার জন্মাবার অনেক আগে—না?

—হ্যাঁ—তা হবে৷ তোমার মায়ের জন্যে একখানা শাড়ি, বেশ ভালো ডুরে শাড়ি কিনে নিয়ে যাই, মনে আছে৷

—তুমি হাত ধুয়ে নাও বাবা, আমি চা করে আনি—খাবার কি খাবে?

এমন সময় গেটের পথে মোটরের শব্দ শোনা গেল—সঙ্গে সঙ্গে প্রভাসের মোটর এসে বারান্দার সামনের লাল কাঁকরের পথের ওপর এরিকা-পাম কুঞ্জের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল৷ প্রভাস নেমে এসে বললে, চলুন কাকাবাবু, কালীঘাটে নিয়ে যাই—শরৎদি তৈরি হয়ে নাও৷

শরৎ খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললে, সে বেশ হবে প্রভাসদা, চলো বাবা, চা করে নিয়ে এলাম বলে, বসো সব৷

সত্যিই এ ক’দিন অদ্ভুত উত্তেজনা ও আনন্দের মধ্যে শরতের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে৷ কেদার বৃদ্ধ হয়েছেন, নতুন জায়গা এখন আর তাঁর তেমন ধাক্কা দেয় না, জীবনের সমস্ত আকাশটা জুড়ে গড়শিবপুরের ভাঙা রাজ-দেউড়ি ও বনজঙ্গলে ঘেরা গড়খাই সেখানে পূর্ণ অধিকারের আসন পেতেছে, আর আছে ছিবাস মুদির দোকান, ওপাড়ার কৃষ্ণযাত্রার আখড়াইয়ের আসর—তার সঙ্গে হয়তো সতীশ কলুর দোকান—তাদের ছোট্ট খড়ের বাড়িখানা৷ এ বয়সে নতুন কোনো জিনিস জীবনে স্থান দখল করতে পারে না৷ জীবনের বৃত্ত পরিধিকে শেষ করে ওদিকের বিন্দুতে মিলবার চেষ্টায় রয়েছে—নব অনুভূতিরাজির সঞ্চার এ বয়সে সম্ভব কবি ও বৈজ্ঞানিকের পক্ষে, প্রতিভাবান শিল্পীর পক্ষে, কেদার সে দলে পড়ে না৷

প্রভাসের মোটর এবার স্ট্র্যান্ড রোড ধরে চলল হ্যারিসন রোড দিয়ে৷ প্রভাস বললে, ইডেন গার্ডেনটা একবার দেখিয়ে নিয়ে যাই আপনাদের?

কেদার বললেন, সেটা কি বাবাজি?

—আজ্ঞে একটা বাগান, বেশ ভালো, সবাই বেড়াতে আসে৷

—ও বাগান-টাগান আমরা আর কি দেখব, বন-বাগান তো দেখেই আসছি, তুমি বরং আমাদের কালীঘাটটা নিয়ে চল৷

কালীঘাটে কালীমন্দিরের সামনের চত্বরে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পেয়ে শরৎ খুশির সুরে বললে—বাবা, ওই অরুণবাবু, ডাকুন না প্রভাসদা?

প্রভাস বললে, এখানে আমাদের সঙ্গে মিশবার কথা ছিল ওর৷ ও অরুণ—এই যে!

শরৎ কালী-গঙ্গায় স্নান সেরে মন্দিরে দেবী দর্শন করে এল৷ সঙ্গে রইল প্রভাস৷ কেদার মোটরে বসে চারিপাশের ভিড় দেখতে লাগলেন৷ অরুণ একটা ছোট ঘর ভাড়ার চেষ্টায় গেল, কারণ প্রভাস ও অরুণ দুজনে শরৎকে বিশেষ করে ধরেছে, এখানে চড়ুইভাতি করতে হবে৷

শরৎ বড় অস্বস্তি বোধ করে একটা ব্যাপারে৷ এখানকার লোকে এমনভাবে তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে কেন? শহরের লোকের এমন খারাপ অভ্যাস কেন? আজ ক’দিন থেকেই সে লক্ষ করছে৷ অপরিচিতা মেয়েদের দিকে অমনভাবে চেয়ে থাকা বুঝি ভদ্রতা? শরতের জানা ছিল কলকাতার লোকে শিক্ষিত, তাদের ধরনধারণ খুব ভদ্র হবে, তাদের দেখে গড়শিবপুরের মতো পাড়াগাঁয়ের লোকেরা শিখবে৷ এখন দেখা যাচ্ছে তার উল্টো৷

অরুণ বাড়ি ঠিক করে এসে কেদারকে বললে, এরা কই? চলুন এবার, সব ঠিক করে এলাম৷

একটু পরে প্রভাসের সঙ্গে শরৎ মন্দির থেকে ফিরল৷ ওরা সবাই মিলে ভাড়াটে ঘরে গিয়ে শতরঞ্জি পেতে বসল৷ হোগলার ছাওয়া, দরমার বেড়া দেওয়া সারি সারি অনেকগুলো খুপরির মতো ঘর৷ ছোট্ট একটুখানি নিচু দাওয়ায় মাটির উনুন৷ প্রভাস মোটরের ক্লিনারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে প্রচুর বাজার করে নিয়ে এল, এমন কি প্রসাদী মাংস পর্যন্ত৷ কেদার খুব খুশি৷ মেয়েকে বললেন—ভালো করে মাংসটা রাঁধিস মা, একটু ঝাল দিস৷

—সে কি বাবা, ঝাল যে তুমি মোটে খেতে পারো না?

—তা হোক, কচি পাঁটার মাংস ঝাল না দিলে ভালো লাগে না৷

রান্না-খাওয়া মিটতে বেলা তিনটে বাজল৷ অরুণদের আবার কে একজন বন্ধু এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলে৷ লোকটি এসেই বলে উঠল—এই যে প্রভাস, আরে অরুণ এনেছিস তো জুত করে! ভালো চিজ বাবা, তোদের সাহস আছে বলতে হবে!

প্রভাস তাড়াতাড়ি তাকে চোখ টিপে দিলে, শরৎ দেখতে পেল৷ সে কিছু বুঝতে পারলে না, লোকটা অমন কেন, এসেই চিৎকার করে কতগুলো কথা বলে উঠল—যার কোনো মানে হয় না! কলকাতা শহরে কত রকম মানুষই না থাকে!

কি জানি কেন, লোকটাকে শরতের মোটেই ভালো লাগল না৷ মোটা মতো লোকটা, নাম গিরীন, বয়সে প্রভাসের চেয়েও বড়, কারণ কানের পাশের চুলে বেশ পাক ধরেছে৷

তিনটের পরে ওখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে গিয়ে প্রভাস একটা বাগানের সামনে গাড়ি রেখে বললে—এই চিড়িয়াখানা কাকাবাবু, নেমে দেখুন এবার—

শরৎ সব দেখেশুনে সমস্ত দিনের কষ্ট ও শ্রম ভুলে গেল৷ কেদারও এমন, একটা জিনিস দেখলেন, যা তাঁর মনে হল না দেখলে জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেত৷ পৃথিবীতে যে এত অদ্ভুত ধরণের জীবজন্তু থাকতে পারে, তার কল্পনা কে করেছিল? কেদার তো ভাবতেই পারেন না৷ পিতাপুত্রীতে মিলে সমবয়সী বালক-বালিকার মতো আমোদে পশুপক্ষী দেখে বেড়াল৷ এ ওকে দেখায়, ও একে দেখায়৷ কী ভীষণ ডাক সিংহের? জলহস্তী—এর নাম জলহস্তী? ছেলেবেলায় ‘প্রাণী-বৃত্তান্ত’ বলে বইয়ে কেদার এর কথা পড়েছিলেন বটে৷ ওই দ্যাখো শরৎ মা, ওকে বলে উঠপাখি৷

—কতবড় ডিম বাবা উঠপাখির! আচ্ছা ও খায়, প্রভাসদা? বিক্রি হয়?

ফেরবার সময় গেটের কাছে এসে গিরীন প্রভাস ও অরুণের সঙ্গে কি সব কথা বললে৷ প্রভাস এসে বললে, কাকাবাবু, এবার চলুন সিনেমা দেখে আসি, মানে বায়োস্কোপ৷ কাছেই আছে—

কেদার বললেন, তা চলো, যা ভালো হয়৷

বাইরে এসে ওরা একটা ফাঁকা মাঠের ধারে মোটর থামিয়ে রেখে কেদার ও শরৎকে নেমে হাওয়া খেতে বললে৷ এরই নাম গড়ের মাঠ৷ সেদিনও নেমেছিল শরৎ৷ তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে—রাস্তার ধারে গ্যাসের আলো এক-একটা করে জ্বেলে দিচ্ছে৷ শরৎ জিজ্ঞাসা করলে—সে বায়োস্কোপ কতক্ষণ দেখতে হবে? প্রভাস বললে, এই সাড়ে ন’টা পর্যন্ত৷

শরৎ ভেবে দেখলে, অত রাত্রে গিয়ে রান্না চড়ালে বাবা খাবেন কখন? তা ছাড়া বাবা আজ সারাদিন এখানে ওখানে বেড়িয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন—বুড়ো বয়সে অত অনিয়ম করলে যদি শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে বিদেশে—তখন ভুগতে হবে তাকেই৷ সে বললে, আজ থাক প্রভাসদা, আজ আর বায়োস্কোপ দেখে দরকার নেই৷ বাবার খেতে দেরি হয়ে যাবে৷

গিরীন তবুও নাছোড়বান্দা৷ সে বললে, কিছু ক্ষতি হবে না—মোটরে যেতে আর কতটুকু লাগবে?

আজই দেখা যাক৷

শরৎকে অত সহজে ভোলানো যাবে তেমন প্রকৃতির মেয়ে নয় সে৷ নিজের বুদ্ধিতে সে যা ঠিক করে, ভালো হোক, মন্দ হোক, তার সে সঙ্কল্প থেকে নড়ানো গিরীনের কর্ম নয়—গিরীন শীঘ্রই তার পরিচয় পেলে৷ প্রভাসকে সে ইংরেজিতে কি একটা কথা বললে, প্রভাস ও অরুণ দুজনে অনুচ্চস্বরে কি বলাবলি করল৷

প্রভাস বললে, কাকাবাবু কি বলেন?

কেদার নিজের মত অনুসারে চলবার সাহস পান গড়শিবপুরে, এখানে মেয়ের মতের বিরুদ্ধে যেতে তাঁর সাহসে কুলোয় না৷ সুতরাং তিনি বললেন, ও যখন বলছে, তখন আজ না হয় ওটা থাকগে প্রভাস, কাল যা হয় হবে৷

অগত্যা প্রভাস ওদের নিয়ে মোটরে উঠল—কিন্তু বেশ বোঝা গেল ওদের দল তাতে বিরক্ত হয়েছে৷

০৪. কেউই বাগানবাড়িতে এল না

পরদিন প্রভাসের দলের কেউই বাগানবাড়িতে এল না৷ শরৎ সন্ধ্যার দিকে বাগানে আপনমনে খানিকটা বেড়িয়ে বাবাকে ডেকে বললে, বাবা খাবে নাকি?

কেদার বললেন, আজ এরা কেউ এল না কেন রে শরৎ?

—তা কি জানি বাবা! বোধ হয় কোনো কাজ পড়েছে—

—তা তো বুঝলাম, কিন্তু যা দেখবার দেখে নিতে পারলে হত ভালো৷ আবার বাড়ি ফিরতে হবে সংক্রান্তির আগেই—

কেদারের আর তেমন ভালো লাগছিল না বটে, কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন মেয়ের এত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবার ইচ্ছে নেই—তার এখন দেখবার বয়স, কখনো কিছু দেখে নি, আছে আজীবন গড়শিবপুরের জঙ্গলে পড়ে৷ দেখতে চায় দেখুক—তিনি বাধা দিতে চান না৷

শরৎ বললে, পেঁপে খাবে বাবা? বাগানের গাছ থেকে পেড়েছি, চমৎকার গাছ-পাকা! নিয়ে আসি দাঁড়াও—

কেদার বললেন, আশপাশের বাগানবাড়িতে লোক থাকে কিনা জানিস কিছু মা?

—চলো না, তুমি পেঁপে খেয়ে নাও—দেখে আসি৷

মিনিট পনেরো পরে দুজনে পাশের একটা অন্ধকার বাগানবাড়ির ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন খোট্টা দারোয়ান ফটকের পাশের ছোট্ট একটা গুমটি ঘর থেকে বার হয়ে বললে, কেয়া মাংতা বাবুজি?

কেদার হিন্দী বলতে পারেন না৷ উত্তর দিলেন, এ বাগানে কি আছে দারোয়ানজি?

—বাবুলোক হ্যায়—মাইজি ভি হ্যায়—যাইয়ে গা?

—হ্যাঁ, আমার এই মেয়েটি একবার বাগান দেখতে এসেছে—

—যাইয়ে—

বেশ বাগান৷ প্রভাসদের বাগানের চেয়ে বড় না হলেও নিতান্ত ছোট নয়৷ অনেক রকম ফুলের গাছ, ফুল ফুটেও আছে অনেক গাছে—সানবাঁধানো পুকুরের ঘাট, খানিকটা জায়গা তার দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে হাঁস এবং মুরগি আটকানো৷ খুব খানিকটা এদিক-ওদিক লিচুতলা ও আমতলায় অন্ধকারে বেড়ানোর পরে ওরা একেবারে বাগানবাড়ির সামনের সুরকি বিছানো পথে গিয়ে উঠল৷ বাড়ির বারান্দা থেকে কে একজন প্রৌঢ়কণ্ঠে হাঁক দিয়ে বললেন, কে ওখানে?

কেদার বললেন, এই আমরা৷ বাগান দেখতে এসেছিলাম—

একটি পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ ভদ্রলোক ধপধপে সাদা কোঁচানো কাপড় পরে খালিগায়ে রোয়াকে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আসুন—সঙ্গে মা রয়েছেন, তা উনি বাড়ির মধ্যে যান না? আমার স্ত্রী আছেন—

শরৎ পাশের পাঁচিলের সরু দরজা দিয়ে অন্দরে ঢুকল৷ কেদার রোয়াকে উঠতেই ভদ্রলোক তাঁকে নিয়ে উপরে চেয়ারে বসালেন৷ বললেন, কোন বাগানে আছেন আপনারা?

—এই দুখানা বাগানের পাশে৷ প্রভাসকে চেনেন কি বাবু?

—না, আমি নতুন এ বাগান কিনেছি, কারুর সঙ্গে চেনা হয় নি এখনও৷ তামাক খান কি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা খাই—তবে আমার আবার হ্যাঙ্গামা আছে—ব্রাহ্মণের হুঁকো না থাকলে—

—আপনি ব্রাহ্মণ বুঝি? ও, বেশ বেশ৷ আমিও তাই, আমার নাম শশিভূষণ চাটুজ্জে—‘এঁড়েদার’ চাটুজ্জে আমরা৷ ওরে ও নন্দে, তামাক নিয়ে আয়—

দুজনে কিছুক্ষণ তামাক খাওয়ার পরে চাটুজ্জে মশাই বললেন, আচ্ছা মশাই—এখানে টেক্স এত বেশি কেন বলতে পারেন—আমার এই বাগানে কোয়ার্টারে আট টাকা টেক্স৷ আপনি কত দেন বলুন তো? না হয় আমি একবার লেখালেখি করে দেখি—কলকাতায় আপনারা থাকেন কোথায়?

কেদার অপ্রতিভ মুখে বললেন, আমার বাগান নয়—আমাদের বাড়ি তো কলকাতায় নয়৷ বেড়াতে এসেছি দু-দিনের জন্যে—কলকাতায় থাকি নে—

—ও, আপনাদের দেশ কোথায়? গড়শিবপুর? সে কোন জেলা? ও, বেশ বেশ৷

—বাবু কি এখানেই বাস করেন?

—না, আমার স্ত্রীর শরীর ভালো না, ডাক্তারে বলেছে কলকাতার বাইরে কিছুদিন থাকতে৷ তাই এলাম—যদি ভালো লাগে আর যদি শরীর সারে, তবে থাকব দু-তিন মাস! বেশ হল মশায়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে৷ আপনার গানটান আসে?

কেদার সলজ্জ বিনয়ের সুরে বললেন, ওই অল্প অল্প৷

—তবে ভালোই হল—দুজনে মিলে বেশ একটু গান-বাজনা করা যাবে৷ কাল এখানে এসে বিকেলে চা খাবেন৷ বলা রইল কিন্তু…বাজাতে পারেন?

—আজ্ঞে, সামান্য৷

—সামান্য-টামান্য না৷ গুণী লোক আপনি দেখেই বুঝেছি৷ এখন খালিগলায় একখানা শুনিয়ে দিন না দয়া করে? তার পর কাল থেকে আমি সব যোগাড়যন্ত্র করে রাখব এখন৷

কেদার একখানা শ্যামা বিষয় গান ধরলেন, কিন্তু অপরিচিত জায়গায় তেমন সুবিধে করতে পারলেন না, কেমন যেন বাধ-বাধ ঠেকতে লাগল—সতীশ কলুর দোকানে বসে গাইলে যেমনটি হয় তেমনটি কোনোখানেই হয় না৷ চাটুজ্জে মশাই কিন্তু তাই শুনেই খুব খুশি হয়ে উঠে বললেন, বাঃ বাঃ, বেশ চমৎকার গলাটি আপনার! এসব গান আজকাল বড় একটা শোনাই যায় না৷—সব থিয়েটারি গান শুনে শুনে কান পচে গেল মশাই৷ বসুন, একটু চায়ের ব্যবস্থা করে আসি—

কেদার ভদ্রলোককে নিরস্ত করে বললেন, চা খেয়ে বেরিয়েছি, আমি দুবার চা খাইনে সন্দের পর, রাতে ঘুম হয় না, বয়েস হয়েছে তো—এবার আপনি বরং একটা—

চাটুজ্জে মশায়ও দেখা গেল বিনয়ের অবতার৷ তিনি গান গাইলেন না, কারণ তিনি বললেন, একে তিনি গান গান না, কারণ গানের গলা নেই তাঁর—যাও বা একটু-আধটু হুঁ হুঁ করতেন, কেদারের মতো গুণী লোকের সামনে তাঁর গলা দিয়ে কিছুই বেরুবে না৷ অবশেষে অনেক অনুরোধের পর চাটুজ্জে মশায় একটা রামপ্রসাদী গেয়ে শোনালেন—কেদারের মনে হল তাঁদের গ্রামের যাত্রাদলের তিনকড়ি কামার এর চেয়ে অনেক ভালো গায়৷

এ সময় শরৎ বাড়ির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে বললে, চলো বাবা, রাত হয়ে গেল৷

চাটুজ্জে মশায় বললেন, এটি কে? মেয়ে বুঝি? তা মা যে আমার জগদ্ধাত্রীর মতো, ঘর আলো করা মা দেখছি৷ বিয়ে দেন নি এখনও?

—বিয়ে দিয়েছিলাম চাটুজ্জে মশাই—কিন্তু বরাত ভালো নয়, বিয়ের দু-বছর পরেই হাতের শাঁখা ঘুচে গেল৷ চলো মা, উঠি আজ চাটুজ্জে মশাই, নমস্কার৷ বড় আনন্দ হল—মাঝে মাঝে আসব কিন্তু৷

—আসবেন বৈকি, রোজ আসবেন আর এখানে চা খাবেন৷ মাকেও নিয়ে আসবেন৷ মায়ের কথা শুনে মনে বড় দুঃখ হল—উনি আমার এখানে একটু মিষ্টিমুখ করবেন একদিন৷ নমস্কার৷

পথে আসতে আসতে শরৎ বললে, গিন্নি বেশ লোক বাবা৷ আমায় কত আদর করলে, জল খাওয়ানোর জন্যে কত পীড়াপীড়ি—আমি খেলাম না, পরের বাড়ি খেতে লজ্জা করে—চিনি নে শুনি নে৷ আমায় আবার যেতে বলেছে৷

—আমারও ভালো হল, কর্তা গান-বাজনা ভালোবাসে, শখ আছে—এখানে সন্দেটা কাটানো যাবে—

ওরা নিজেদের বাগানবাড়িতে ঢুকেই দেখলে বাড়ির সামনে প্রভাসের মোটর দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তার পর বাড়ি পৌঁছেই প্রভাসের সঙ্গে দেখা হল৷ সে বাড়ির সামনে গোল বারান্দায় বসে ছিল, বোধ হয় এদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়৷ কাছে এসে বললে, কোথায় গিয়েছিলেন কাকাবাবু? আমি অনেকক্ষণ এসে বসে আছি৷ কিন্তু আজ যে বড্ড দেরি করে ফেললেন—সিনেমা যাবার সময় চলে গেল৷ সাড়ে ন’টার সময় যাবেন? প্রায় বারোটায় ভাঙবে৷

শরৎ বললে, না প্রভাসদা, অত রাত্রে ফিরলে বাবার শরীর খারাপ হবে৷ থাক না আজ, আর একদিন হবে এখন—

কেদার বললেন, তাই হবে এখন প্রভাস, আজ বড্ড দেরি হয়ে যাবে৷ তুমি তো আজ ও-বেলা এলে না—এ-বেলাও আমরা সন্দে পর্যন্ত দেখে তবে বেরিয়েছি৷ কাল বরং যাওয়া যাবে এখন৷ বসো চা খাও৷

—না কাকাবাবু, আজ আর বসব না৷ কাল তৈরি থাকবেন, আসব বেলা পাঁচটার মধ্যে৷ কোনো অসুবিধে হচ্ছে না?

—না না, অসুবিধে কিসের? তুমি সেজন্য কিছু ভেব না৷

.

পরদিন একেবারে দুপুরের পরই প্রভাস মোটর নিয়ে এল৷ শরৎ চা করে খাওয়ালে প্রভাসকে—তারপর সবাই মিলে মোটরে গিয়ে উঠল৷ অনেক বড় বড় রাস্তা ও গাড়ি মোটরের ভিড় পেরিয়ে ওদের গাড়ি এসে একটা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়াল৷ প্রভাস বললে, এই হল সিনেমা ঘর—আপনারা গাড়িতে বসুন, আমি টিকিট করে আনি—

শরৎ বাড়িটার মধ্যে ঢুকে চারিদিকে চেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল৷ কত উঁচু ছাদ, ছাদের গায়ে বড় বড় আলোর ডুম, গদি-আঁটা চেয়ার বেঞ্চি ঝকঝক তকতক করছে, কত সাহেব মেম বাঙালির ভিড়!

কেদার বললে, এ জায়গাটার নাম কি হে প্রভাস?

—আজ্ঞে এ হল এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস—একটা পার্শি কোম্পানির৷

—বেশ বেশ৷ চমৎকার বাড়িটা—না মা শরৎ? থাকি জঙ্গলে পড়ে, এমন ধারাটি কখনো দেখি নি—আর দেখবই বা কোথায়? ইচ্ছে হয় সতীশ কলু, ছিবাস এদের নিয়ে এসে দেখাই৷ কিছুই দেখলে না ওরা, শুধু তেল মেপে আর দাঁড়ি-পাল্লা ধরেই জীবনটা কাটালে৷

সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল৷ কেদার বলে উঠলেন—ও প্রভাস, এ কি হল? ওদের আলো খারাপ হয়ে গেল বুঝি?

প্রভাস নিম্নসুরে বললে, চুপ করুন কাকাবাবু, এবার ছবি আরম্ভ হবে৷

সামনে সাদা কাপড়ের পর্দাটার ওপরে যেন জাদুকরের মন্ত্রবলে মায়াপুরীর সৃষ্টি হয়ে গেল, দিব্যি বাড়িঘর, লোকজন কথা বলছে, রেলগাড়ি ছুটছে, সাহেব-মেমের ছেলেমেয়েরা হাসি-খেলা করছে, কাপড়ের পর্দার ওপরে যেন আর একটা কলকাতা শহর৷

কিন্তু ছবিতে কি করে কথা বলে? কেদার অনেকবার ঠাউরে দেখবার চেষ্টা করেও কিছু মীমাংসা করতে পারলেন না৷ অবিশ্যি এর মধ্যে ফাঁকি আছে নিশ্চয়ই, মানুষে পেছন থেকে কথা বলছে কৌশল করে, মনে হচ্ছে যেন ছবির মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে—কিন্তু কেদার সেটা ধরে ফেলবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারলেন না৷ একবার একটা মোটরগাড়ির আওয়াজ শুনে কেদার দস্তুরমতো অবাক হয়ে গেলেন৷ মানুষে কি মোটরগাড়ির আওয়াজ বের করে মুখ দিয়ে? বোধ হয় কোনো কলের সাহায্যে ওই আওয়াজ করা হচ্ছে৷ কলে কি না হয়?

হঠাৎ সব আলো একসঙ্গে আবার জ্বলে উঠল৷ কেদার বললেন, শেষ হয়ে গেল বুঝি?

প্রভাস বললে, না কাকাবাবু, এখন কিছুক্ষণ বন্ধ থাকবে—তারপর আবার আরম্ভ হবে৷ চা খাবেন কি? বাইরে আসুন তবে?

শরৎ বললে, প্রভাসদা, দোকানের চা আর ওঁকে খাওয়ানোর দরকার নেই—সত্যিক জাতের এঁটো পেয়ালায় চুমুক দিতে হবে—থাকগে৷ ওমা, ওই যে অরুণবাবু—উনি এলেন কোথা থেকে?

অরুণ কেদারকে প্রণাম করে বললে, কেমন লাগছে আপনার, ওঁর লাগছে কেমন? চলুন আজ সিনেমা ভাঙলে দমদমা পর্যন্ত আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব—

কেদার বললেন, বেশ, তা হলে আমাদের ওখানেই আজ খেয়ে আসবে দুজনে—

—না, আজ আর না, আর একদিন হবে এখন বরং৷

এই সময় গিরীন বলে সেই লোকটিও ওদের কাছে এসে দাঁড়াল৷ প্রভাসকে সে কি একটা কথা বললে ইংরিজিতে৷

প্রভাস বললে, কাকাবাবু, শরৎ দিদিকে আমার এই বন্ধু ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে বলছেন৷

কেদার বললেন, বেশ তো৷ আজই?

—হ্যাঁ আজ, বায়োস্কোপের পরে৷

ছবি ভাঙবার পরে সবাই মোটরে উঠল৷ গিরীন ও প্রভাস বসেছে সামনে, কেদার, অরুণ আর শরৎ পেছনের সিটে৷ একটা গলির মধ্যে ঢুকে একটা ছোট বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ গিরীন নেমে ডাক দিলে—ও রবি, রবি?

একটি ছেলে এসে দোর খুলে দিলে৷ গিরীন বললে, তোমার এই পিসিমাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাও—আসুন কেদারবাবু, বাইরের ঘরে আলো দিয়ে গিয়েছে৷

সে বাড়িতে বেশিক্ষণ দেরি হল না৷ বাড়ির মধ্যে থেকে সেই ছেলেটাই সকলকে চা ও খাবার দিয়ে গেল বাইরের ঘরে৷ একটু পরে শরৎ এসে বললে, চলো বাবা৷

.

আবার দমদমার বাগানবাড়ি৷ রাত তখন খুব বেশি হয় নি—সুতরাং কেদার ওদের সকলকেই থেকে খেয়ে যেতে বললেন৷ হাজার হোক, রাজবংশের ছেলে তিনি৷ নজরটা তাঁর কোনো কালেই ছোট নয়৷ কিন্তু ওরা কেউ থাকতে রাজি হল না৷—তবে এক পেয়ালা করে চা খেয়ে যেতে কেউ বিশেষ আপত্তি করলে না৷

কেদার জিজ্ঞেস করলেন রাত্রে খেতে বসে—ওই ছেলেটির বাড়িতে তোকে কিছু খেতে দেয় নি?

—দিয়েছিল, আমি খাই নি৷ তুমি?

—আমায় দিয়েছিল, আমি খেয়েওছিলাম৷

—তা আর খাবে না কেন? তোমার কি জাতজম্মো কিছু আছে? বাচবিচের বলে জিনিস নেই তোমার শরীরে৷

—কেন?

—কেন? ওরা জাতে কি তার ঠিক নেই৷ বামুন নয়, কায়েতও নয়—আমি পরের বাড়ি গিয়ে কি করে তোমাকে বারণ করে পাঠাই?

—কি করে জানলে?

—ও মা, সে যেন কেমন৷ দু-তিনটি বৌ বাড়িতে৷ সবাই সেজেগুজে পান মুখে দিয়ে বসে আছে৷ যে ছেলেটা দোর খুলে দিলে, তাকে ও-বাড়ির চাকর বলে মনে হল৷ কেমন যেন—ভালো জাত নয় বাবা৷ একটি বৌ আমায় বেশ আদর-যত্ন করেছে৷ বেশ মিষ্টি কথা বলে৷ আবার যেতে বললে৷ আমার ইচ্ছে হয় মাথা খুঁড়ে মরি বাবা, তুমি কেন ওদের বাড়ি জল খেলে? আমায় পান সেজে দিতে এসেছিল, আমি বললাম, পান খাই নে৷

—তাতে আর কি হয়েছে?

—তোমার তো কিছু হয় না—কিন্তু আমার যে গা-কেমন করে৷ আচ্ছা গিরীনবাবুর বাড়ি নাকি ওটা?

—হ্যাঁ, তাই তো বললে৷

—অনেক জিনিসপত্র আছে বাড়িতে৷ ওরা বড়লোক বলে মনে হল৷ হারমোনিয়ম, কলের গান, বাজনার জিনিস—বেশ বিছানা-পাতা চৌকি, বালিশ, তাকিয়া—দেওয়ালে সব ছবি৷ সেদিক থেকে খুব সাজানো-গোজানো৷

—তা হবে না কেন মা, কলকাতার বড়লোক সব৷ এ কি আর আমাদের গাঁয়ের জঙ্গল পেয়েছ?

—তুমি আমাদের গাঁয়ের নিন্দে করো না অমন করে৷

কেদার বললেন, তোদের গাঁ বুঝি আমাদের গাঁ নয় পাগলি? আচ্ছা, বল তো তোর এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে, না গ্রামে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে?

—এখন দুদিন এখানে থেকে দেখতে ইচ্ছে হয় বৈকি বাবা৷ আমার কথা যদি বলো—আমার ইচ্ছে এখানে এখন কিছুদিন থেকে সব দেখি শুনি—গাঁ তো আছেই, সে আর কে নিচ্ছে বলো৷

.

পরদিন সকালে চাটুজ্জে মশায় কেদারকে ডেকে পাঠালেন৷ সেখানে গানের মজলিশ হবে সন্ধ্যায়৷ কেদারকে আসবার জন্যে যথেষ্ট অনুরোধ করলেন তিনি৷ মজলিশে শুধু শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থাকলে চলবে না, কেদারকে গান গাইতে হবে৷

কেদার বললেন, আজ্ঞে, আমি বাজাতে পারি কিছু কিছু বটে—কিন্তু মজলিশে গাইতে সাহস করি নে৷

—খুব ভালো কথা৷ কি বাজান বলুন?

—বেহালা যোগাড় করতে পারেন বাবু?

—বেহালা ওবেলা পাবেন৷ আনিয়ে রাখব৷ সেদিন তো বলেন নি আপনি বেহালা বাজাতে পারেন! আপনি দেখছি সত্যিই গুণী লোক৷ ওবেলা এখানে আহার করতে হবে কিন্তু৷ বাড়িতে মাকে বলে আসবেন৷

—আমার মেয়ে যেখানে সেখানে আমায় খেতে দেয় না, তবে আপনার বাড়িতে সে নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি করবে না৷ তাই হবে৷

—আপত্তি ওঠালেও শুনব না তো কেদারবাবু? মার সঙ্গে নিজে গিয়ে ঝগড়া করে আসব৷ আচ্ছা তাঁকে—

—সে কোথাও খায় না৷ তাকে আর বলার দরকার নেই৷

—বিকেলে চাও এখানে খাবেন—

বৈকালে কেদার সবে চাটুজ্জে মশায়ের বাগানবাড়িতে যাবার জন্যে বার হয়েছেন, এমন সময় প্রভাসের গাড়ি এসে ঢুকল ফটকে৷ প্রভাস গাড়ি থেকে নেমে বললে, কাকাবাবু কোথায় যাচ্ছেন?

কেদারের উত্তর শুনে প্রভাস হতাশার সুরে বললে, তাই তো, তা হলে আর দেখছি হল না—

—কি হল না হে?

—শরৎ দিদিকে আজ একবার অরুণের বাড়ি আর আমার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিলাম, ওখান থেকে একেবারে নিউমার্কেট দেখিয়ে—

—চলো একটু কিছু মুখে দিয়ে যাবে—এসো—

শরৎ ছুটে বাইরে এসে বললে, প্রভাসদা! আসুন, আসুন—অরুণবাবু এসেছেন নাকি? বসুন প্রভাসদা, চা খাবেন৷

কেদার বললেন, বড় মুশকিল হয়েছে মা, প্রভাস নিতে এসেছিল, এদিকে আমি যাচ্ছি চাটুজ্জেবাবুদের গানের আসরে৷ না গেলে ভদ্রতা থাকে না—ওবেলা বার বার বলে দিয়েছেন—

প্রভাসও দুঃখ প্রকাশ করলে৷ শরৎ দিদিকে সে নিজের বাড়ি ও অরুণের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিল—কিন্তু কাকাবাবু বেরিয়ে যাচ্ছেন—

শরৎ বললে, বাবা আমি যাই নে কেন প্রভাসদার সঙ্গে? যাব বাবা?

কেদার খুশির স্বরে বললে, তা বরং ভালো বাবা৷ তাই যাও প্রভাস—তুমি শরৎকে নিয়ে যাও—তবে একটু সকাল সকাল পৌঁছে দিয়ে যেয়ো—

প্রভাস বললে, আজ্ঞে, তবে তাই৷ আমি খুব শীগগির দিয়ে যাব৷ সে বিষয়ে ভাববেন না৷

প্রভাসের গাড়ি একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ প্রভাস নেমে দোর খুলে বললে, আসুন শরৎদি, ভেতরে আসুন৷

শরৎ বললে, এটা কাদের বাড়ি প্রভাসদা?

—এটা? এটা অরুণদেরই বাড়ি ধরুন—তবে অরুণ এখন বোধ হয় বাড়ি নেই—এল বলে৷ শরৎকে নিয়ে গিয়ে প্রভাস একটা সুসজ্জিত ঘরে বসিয়ে ডাক দিলে—ও বৌদি, বৌদি, কে এসেছে দ্যাখো—

শরৎ চেয়ে দেখলে ঘরটার মেজেতে ফরাস বিছানা পাতা, দেওয়ালে বেশির ভাগ বিলিতি মেম-সাহেবের ছবি, একদিকে একটা ছোট তক্তপোশের ওপর একটা গদিপাতা বিছানা—তাতে বালিশ নেই, গোটা দুই ডুগি-তবলা এবং একটা বেলো-খোলা বড় হারমোনিয়াম বিছানার ওপর বসানো৷ একটা খোল-মোড়া তানপুরা, দেয়ালের কোণের খাঁজে হেলান দেওয়ানো৷ খুব বড় একটা কাঁসার পিকদানি তক্তপোশের পায়াটার কাছে৷ একদিকে বড় একটা কাঁচের আলমারি—তার মধ্যে টুকিটাকি শৌখিন কাঁচের ও মাটির জিনিস, গোটাকতক ছোট মতো বোতল, আরও কি কি৷ একটা বড় দেওয়াল-ঘড়ি৷

শরৎ ভাবলে—এদের বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা খুব আছে দেখছি৷ বাবাকে এখানে এনে ছেড়ে দিলে বাবার পোয়া বারো—

একটি সুবেশা মেয়ে এই সময় ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললে, এই যে এসো ভাই—তোমার কথা কত শুনেছি প্রভাসবাবু ও অরুণবাবুর কাছে৷ এসো এই খাটের ওপর ভালো হয়ে বোসো ভাই—

মেয়েটিকে দেখে বয়স আন্দাজ করা কিছু কঠিন হল শরতের৷ ত্রিশও হতে পারে, পঁয়ত্রিশও হতে পারে—কম হবে না, বরং বেশিই হবে৷ কিন্তু কি সাজগোজ! মাগো, এই বয়সে অত সাজগোজ কি গিন্নিবান্নি মেয়েমানুষের মানায়? আর অত পান খাওয়ার ঘটা!

পেটো-পাড়া চুলে ফিরিঙ্গি খোঁপা, গায়ে গহনাও মন্দ নেই—বাড়িতে রয়েছে বসে, এদিকে পায়ে আবার চটিজুতো—মখমলের উপর জরির কাজ করা৷ কলকাতার লোকের কাণ্ডকারখানাই আলাদা৷

শরৎ গিয়ে খাটের ওপর বসল বটে ভদ্রতা রক্ষার জন্যে—কিন্তু তার কেমন গা ঘিনঘিন করছিল৷ পরের বিছানায় সে পারতপক্ষে কখনো বসে না—বিছানার কাপড় না ছাড়লে সংসারের কোনো জিনিসে সে হাত দিতে পারবে না—জলটুকু পর্যন্ত মুখে দিতে পারবে না৷ কথায় কথায় বিছানায় বসা আবার কি, কলকাতার লোকের আচার-বিচার বলে কিছু নেই৷

বৌটি তেমনি হাসিমুখে বললে, পান সাজব ভাই? পানে দোক্তা খাও নাকি?

শরৎ মৃদু হেসে জানালে যে সে পান খায় না৷

—পান খাও না—ওমা তাই তো—আচ্ছা দাঁড়াও, ভাজা মশলা আনি—

—না, আপনি ব্যস্ত হবেন না৷ আমার ওসব কিছু লাগবে না৷

প্রভাস বললে, শরৎদি, বৌদি খুব ভালো গান করেন, শুনবেন একখানা?

শরৎ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললে, শুনব বৈকি, ভালো গান শোনাই তো হয় না—উনি যদি গান দয়া করে—

বাবার গান ও বাজনা শরৎ শুনছে বাল্যকাল থেকেই, কিন্তু লণ্ঠনের তলাতেই অন্ধকার, বাবার গান-বাজনা তার তেমন ভালো লাগে না৷ এমন কি বাবা ভালো গাইতে পারেন বলেও মনে হয় না শরতের৷ অপরে শুনে বাবার গানের বা বাজনার কেন অত প্রশংসা করে শরৎ তা বুঝতে পারে না৷

মাঝে মাঝে কেদার বলতেন গড়শিবপুরের বাড়িতে—শরৎ শোনো মা এই মালকোষখানা— বেহালার সুরের মূর্ছনায় রাগিণী পর্দায় পর্দায় মূর্তি পরিগ্রহ করত—বাবার ছড় ঘুরানোর কত কায়দা, ঘাড় দুলুনির কত তন্ময় ভঙ্গি—কিন্তু শরৎ মনে মনে ভাবত বাবার এসব কিছুই হয় না৷ এ ভালোই লাগে না, বাবা হয়তো বোঝেন না, লোকে শুনে হাসে…

প্রভাস ওর বৌদিদির দিকে চেয়ে হেসে বললে, শুনিয়ে দাও একটা—

মেয়েটি মৃদু হেসে হারমোনিয়মের কাছে গিয়ে বসল—তার পরে নিজে বাজিয়ে সুকণ্ঠে গান ধরল—

‘‘পাখি এই যে গাহিলি গাছে,

চুপ দিলি কেন ঝোপে ডুবে গেলি যেমন এসেছি কাছে৷’’

শরৎ মুগ্ধ হয়ে শুনলে, এমন কণ্ঠ এমন সুর জীবনে সে কখনও শোনে নি৷ গড়শিবপুরের জঙ্গলে এমন গান কে কবে গেয়েছে? আহা, রাজলক্ষ্মীটি যদি আজ এখানে থাকত৷ রাজলক্ষ্মী কত দুঃখদিনের সঙ্গিনী, তাকে না শোনাতে পারলে যেন শরতের অর্ধেক আমোদ বৃথা হয়ে যায়৷ সুখের দিনে তার কথা এত করে মনে পড়ে৷

গান থেমে গেলে শরতের মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে গেল—কি চমৎকার!

মেয়েটি ওর দিকে চেয়ে হেসে হেসে কি একটা বলতে যাবে—এমন সময় একটি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে দোরের কাছে এসে বললে, আজ এত গানের আসর বসল এত সকালে, কে এসেছে গো তোমাদের বাড়ি? আমি বলি তুমি—

শরতের দিকে চোখ পড়াতে মেয়েটি হঠাৎ থেমে গেল৷ তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল৷ ঘরে না ঢুকে সে দোরের কাছে রইল দাঁড়িয়ে৷

মেয়েটির পরনে লালরঙের জরিপাড় শাড়ি, খোঁপায় জরির ফিতে জড়ানো, নিঁখুত সাজগোজ, মুখে পাউডার৷ শরৎ ভাবলে, মেয়েটি হয়তো কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে যাবে কুটুমবাড়ি, তাই এমন সাজগোজ করেছে৷

প্রভাসের বৌদি বললে, এই যে গানের আসল লোক এসে গিয়েছে৷ কমলা, এঁকে তোমার গান শুনিয়ে দাও তো ভালো—

কমলা বিষণ্ণমুখে বললে, তাই তো, আমার ঘরে যে এদিকে হরিবাবু এসে বসে আছে—আজ আবার দিন বুঝে সকাল সকাল—

প্রভাস ওকে চোখ টিপলে মেয়েটি চুপ করে গেল৷

প্রভাসও বললে, না, তোমার একখানা গান না শুনে আমরা ছাড়ছি নে—এদিকে এসো কমলা—

কমলাও হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান ধরলে৷ থিয়েটারি গান ও হালকা সুর—কলকাতার লোক বোধ হয় এইসব গান পছন্দ করে৷ অন্য ধরনের গান তারা তেমন জানে না, কিন্তু গড়শিবপুরে ঠাকুরদেবতা, ইহকাল পরকাল, ভবনদী পার হওয়া, গৌরাঙ্গ ও নদীয়া ইত্যাদি সংক্রান্ত গানের প্রাদুর্ভাব বেশি৷ বাল্যকাল থেকে শরৎ বাবার মুখে, কৃষ্ণযাত্রার আসরে, ফকির-বোষ্টমের মুখে এই সব গান এত শুনে আসছে যে কলকাতায় প্রচলিত এই সব নূতন সুরের নূতন ধরনের গান তার ভারি সুন্দর লাগল৷ জীবনটা যে শুধু শ্মশান নয়, সেখানে আশা আছে, প্রাণ আছে, আনন্দ আছে—এদের গান যেন সেই বাণী বহন করে আনে মনে৷ শুধুই হতাশার সুর বাজে না তাদের মধ্যে৷

শরৎ বললে, বড় চমৎকার গলা আপনার, আর একটা গাইবেন?

বিনা প্রতিবাদে মেয়েটি আর একটা গান ধরলে, গান ধরবার সময় ঘরের মেজেতে বসানো এক জোড়া বাঁয়াতবলার দিকে চেয়ে প্রভাসকে কি বলতে যাচ্ছিল, প্রভাস আবার চোখ টিপে বারণ করলে৷ আগের চেয়েও এবার চড়া সুর, দু-একটা ছোটখাটো তান ওঠালে গলায় মেয়েটি, দ্রুত তালের গান, শিরায় শিরায় যেন রক্ত নেচে ওঠে সুর ও তালের মিলিত আবেদনে৷

গান শেষ হলে প্রভাস বললে, কেমন লাগল শরৎদি?

—ভারি চমৎকার প্রভাসদা, এমন কখনও শুনি নি—

কমলা এতক্ষণ পরে প্রভাসের বৌদিদির দিকে চেয়ে বললে, ইনি কে গা?

প্রভাসের বৌদিদি বললে, ইনি? প্রভাসবাবুদের দেশের—

শরৎ এ কথায় একটু আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, প্রভাসদার বৌদিদি তাকে ‘প্রভাসবাবু’ বলছেন কেন, বা যেখানে ‘আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের’ বলা উচিত সেখানে ‘প্রভাসবাবুদের দেশের’ই বা বলছেন কেন? বোধ হয় আপন বৌদিদি নন উনি!

কমলা বললে, বেশ, আপনার নাম কি ভাই?

শরৎ সলজ্জ সুরে বললে, শরৎসুন্দরী—

—বেশ নামটি তো৷

প্রভাস বললে, উনি এসেছেন কলকাতা শহর দেখতে৷ এর আগে কখনও আসেন নি—

কমলা আশ্চর্য হয়ে বললে, সত্যি? এর আগে আসেন নি কখনও?

শরৎ হেসে বললে, না৷

—আপনাদের দেশ কেমন?

—বেশ চমৎকার৷ চলুন না একবার আমাদের দেশে—

—যেতে খুব ইচ্ছে করে—নিয়ে চলুন না—

—বেশ তো, আপনি আসুন, উনি আসুন—

মেয়েটি আর একটি গান ধরলে৷ এই মেয়েটির গলার সুরে শরৎ সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল—সে এমন সুকণ্ঠী গায়িকার গান জীবনে কখনও শোনে নি—প্রভাসের বৌদিদির বয়স হয়েছে, যদিয়ো তাঁর গলা ভালো তবুও এই অল্পবয়সী মেয়েটির নবীন, সুকুমার, কণ্ঠস্বরের তুলনায় অনেক খারাপ৷ শরতের ইচ্ছে হল, কমলার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে৷

গান শেষ করে কমলা বললে, আসুন না ভাই, আমাদের ঘরে যাবেন?

—চলুন না দেখে আসি—

প্রভাস তাড়াতাড়ি বলে উঠল—না, উনি এখনই চলে যাবেন, বেশিক্ষণ থাকবেন না—এখন থাকগে—

কিন্তু শরৎ তবুও বললে, আসি না দেখে প্রভাসদা? এখুনি আসছি—

প্রভাস বিব্রত হয়ে পড়ল যেন৷ সে জোর করে কিছু বলতেও পারে না অথচ কমলার সঙ্গে শরৎ যায় এ যেন তার ইচ্ছে নয়৷ এই সময় হঠাৎ একটা লোক ঘরে ঢুকে অস্পষ্ট ও জড়িত স্বরে বলে উঠল—আরে এই যে, কমল বিবি এখানে বসে, আমি সব ঘর ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছি বাবা—বলি প্রভাসবাবুও যে আজ এত সকালে—

প্রভাস হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে উঠে তাকে কি একটা বলে তাড়াতাড়ি বাইরে নিয়ে গেল৷ লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে শরৎ আশ্চর্য হয়ে ভাবলে—লোকটা পাগল নাকি? অমন কেন?

সে প্রভাসের বৌদিদিকে বললে, উনি কে?

—উনি—এই হল গে—আমাদের বাড়ির—বাইরের ঘরে থাকেন—

—কমলার সম্পর্কে কে?

—সম্পর্কে—এই ঠাকুরপো—

কমলার ঠাকুরপো কি রকম শরৎ ভালো বুঝল না৷ লোকটির বয়স চল্লিশের কম নয়—তা হলে কমলার দোজবরে কি তেজবরে স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নাকি? না হলে অত বড় ঠাকুরপো হয় কি করে? কমলার ওপর কেমন একটু করুণা হল শরতের৷ আহা, এমন মেয়েটি! কমলাও একটু অবাক হয়ে প্রভাসের বৌদিদির দিকে চাইলে৷ সে যেন অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না৷

শরৎ জিজ্ঞেস করলে, আপনি প্রভাসদার কে হন?

কমলা কিছু বলবার আগে প্রভাসের বৌদিদি উত্তর দিলে, ও আমার পিসতুতো বোন হয়৷ এখানে থেকে পড়ে৷

হঠাৎ শরৎ কমলার সিঁথির দিকে চাইলে৷ সত্যই তো, ওর এখনও বিয়ে হয় নি৷ এতক্ষণ সে লক্ষ করে নি৷ তবে আবার ওর ঠাকুরপো কি রকম হল! শরতের বড় ইচ্ছে হচ্ছিল এসব গোলমেলে সম্পর্কের একটা মীমাংসা সে করে ফেলে—এদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে৷ কিন্তু দরকার কি পরের বাড়ির খুঁটিনাটি কথা জিজ্ঞেস করে?

একটু পরে প্রভাস বাইরে থেকে ডাকলে, কমলা, তোমায় ডাকছেন—শুনে যাও—

কমলা চলে যাবার আগে হাত তুলে ছোট্ট একটা নমস্কার করে শরৎকে বললে, আচ্ছা, আসি ভাই—

—কেন, আপনি আর আসবেন না?

—কি জানি, যদি কোনো কাজ পড়ে—

—কাজ সেরে আসবেন—যাবার আগে দেখা করেই যাবেন—

—আপনি কতক্ষণ আছেন আর?

প্রভাসের বৌদি বললেন, উনি এখনও ঘণ্টাখানেক থাকবেন—

কমলা বললে, যদি পারি আসব তার মধ্যে—

ও চলে গেলে শরৎ প্রভাসের বৌদিদির দিকে চেয়ে বললে, বেশ মেয়েটি—

—কমলা তো? হ্যাঁ, ওকে সবাই পছন্দ করে—

—বড় চমৎকার গলা—

—গানের মাস্টার এসে গান শিখিয়ে যায় যে! এখন বোধ হয় সেই জন্যেই উঠে গেল৷ আপনি বসুন চায়ের দেখি কি হল—

শরৎ ব্যস্ত হয়ে বললে, না না, আপনি যাবেন না৷ আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি—

—বেরুলেন বা! তা কখনও হয়? একটু মিষ্টিমুখ—

—না না—আমি এসময় কিছুই খাই নে—

—বসুন, আমি আসছি৷

—বসছি কিন্তু খাওয়ার যোগাড় কিছু করবেন না যেন৷ আমি সত্যিই কিছু খাব না৷

প্রভাস বললে, থাক বরং বৌদি, উনি এসময় কিছু খান না৷ ব্যস্ত হতে হবে না৷

এই সময় অরুণ ও গিরীন বলে সেই লোকটা ঘরে ঢুকল৷ শরৎ হাসিমুখে বললে, এই যে অরুণবাবু আসুন—

—দেখুন মাথায় টনক আছে আমার৷ কি করে জানলুম বলুন আপনি এখানে এসেছেন—

গিরীন প্রভাসকে বাইরে ডেকে নিয়ে বললে, কি ব্যাপার?

প্রভাস বিরক্ত মুখে বললে, আরে, ওই হরি সা না কি ওর নাম, সব মাটি করে দিয়েছিল আর একটু হলে—এমন বেফাঁস কথা হঠাৎ বলে ফেললে—আমি বাইরে নিয়ে গিয়ে ধমকে দিলাম আচ্ছা করে৷ ভাগ্যিস পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, কিছু বোঝে না তাই বাঁচোয়া৷ কমলা বিবি আবার ঘর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিল ওর, কত কষ্টে থামাই৷ দেখলেই সব বুঝে না ফেলুক, সন্দেহ করত৷

—তার পর?

—তার পর তোমরা তো এসেছ, এখন পথ বাৎলাও—

—লেমনেড খাওয়াতে পারবে না?

—চা পর্যন্ত খেতে চাইছে না—তা লেমনেড!

—ও এখানে থাকুক—চলো আমরা সব এখান থেকে সরে পড়ি৷

—মতলবটা বুঝলাম না৷

—এখানে দু-দিন লুকিয়ে রাখ৷ তার পর ওর বাবা ওকে আর নেবে না—ওর গ্রামে রটিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দাও যে কোথায় ওকে পাওয়া গিয়েছে৷ পাড়াগাঁয়ের লোক, সমাজের ভয়ে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না৷

—তাই করো—কিন্তু মেয়েটিকে তুমি জানো না৷ যত পাড়াগেঁয়ে ভীতু মেয়ে ভাবছ, অতটা নয় ও৷ বেশ তেজি আর একগুঁয়ে মেয়ে৷ তোমার যা মতলব, ও কতদূর গড়াবে আমি বুঝতে পারছি নে৷ চেষ্টা করে দেখতে পার৷

—তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও, দেখ আমি কি করি—টাকা কম খরচ করা হয় নি এজন্যে—মনে নেই?

—হেনাকে ডাকো একবার বাইরে৷ হেনার সঙ্গে পরামর্শ করো৷ তাকে সব বলা আছে, সে একটা পথ খুঁজে বার করবেই৷ কমলাকেও বোলো৷

ওর বৌদিদি শরৎকে পাশের ঘরের সাজসজ্জা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে৷ একটা খুব বড় ড্রেসিং টেবিল দেখে শরৎ খুশি হয়ে বললে, বেশ জিনিসটা তো? আয়নাখানা বড় চমৎকার, এর দাম কত ভাই?

—একশো পঁচিশ টাকা—

—আর এই খাটখানা?

—ও বোধ হয় পড়েছিল সত্তর টাকা—আমার ধীরেনবাবু—মানে আমার গিয়ে বাপের বাড়ির সম্পর্কে ভাই—সেই দিয়েছিল৷

—বিয়ের সময় দিয়েছিলেন বুঝি? এ সবই তা হলে আপনার বিয়ের সময় বরের যৌতুক হিসেবে—

—হ্যাঁ তাই তো৷

—আপনার স্বামী এখনো বাড়ি আসেন নি, আফিসে কাজ করেন বুঝি?

—হ্যাঁ৷

—আপনার শাশুড়ি বা আর সব—ওঁদের সঙ্গে আলাপ হল না৷

—এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন না৷ এ শুধু মানে আমাদের—উনি আর আমি—

—আলাদা বাসা করেছেন বুঝি? তা বেশ৷

—হ্যাঁ, আলাদা বাসা৷ আফিস কাছে হয় কিনা৷ এ অনেক সুবিধে৷

—তা তো বটেই৷

—আপনি এইবার কিছু মুখে না দিলেই সত্যিই ভয়ানক দুঃখিত হব ভাই৷

বারবার খাওয়ার কথা বলাতে শরৎ মনে মনে বিরক্ত হল৷ সে যখন বলছে খাবে না, তখন তাকে পীড়াপীড়ি করার দরকার কি এদের? সে যে বিধবা মানুষ, তা এরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, বিধবা মানুষ সব জায়গায় সব সময় খায় না—বিশেষ করে সে পল্লীগ্রামের ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা, তার অনেক কিছু বাছবিচার থাকতে পারে, সে জ্ঞান দেখা যাচ্ছে কলকাতার লোকের একেবারেই নেই৷

শরৎ এবার একটু দৃঢ়স্বরে বললে, না, আমি এখন কিছু খাব না, কিছু মনে করবেন না আপনি৷

প্রভাসের বৌদিদি আর কিছু বললে না এ বিষয়ে৷ শরৎ ভাবলে, এদের সঙ্গে ব্যবহারে হয়তো সে ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে পারবে না, কিন্তু কি করবে সে, কেন এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করা? খাবে না বলেছে, ব্যস মিটে গেল—ওদের বোঝা উচিত ছিল৷

—আরও দু-পাঁচ মিনিট শরৎকে এ ছবি, ও আলমারি দেখানোর পরে প্রভাসের বৌদিদি ওর দিকে চেয়ে বললে, ভালো, একটা অনুরোধ রাখো না কেন—আজ এখানে থেকে যাও রাতটা৷

শরৎ আশ্চর্য হয়ে বললে, এখানে? কি করে থাকব?

—কেন, এই আলাদা ঘর রয়েছে৷ উনি বোধ হয় আজ আর আসবেন না৷ এক-একদিন রাত্রে কাজ পড়ে কিনা৷ সারারাত আসতে পারেন না৷ একলা থাকতে হবে, তার চেয়ে তুমি থাকো ভাই, দুজনে বেশ গল্পে-গুজবে রাত কাটিয়ে দেব, তোমাকে আমার বড় ভালো লেগেছে৷

কথা শেষ করে প্রভাসের বৌদিদি শরতের হাত ধরে আবদারের সুরে বললে, কথা রাখো ভাই, কেমন তো? তা হলে প্রভাসবাবুকে—ইয়ে ঠাকুরপোকে বলে দিই আজ গাড়ি নিয়ে চলে যাক—তাই করি, বলি ঠাকুরপোকে?

শরৎ বিষণ্ণ মনে বলে উঠল—না না, তা কি করে হবে? আমি থাকতে পারব না৷ বাবার পাশের বাড়িতে চাটুজ্জে মহাশয়ের ওখানে আজ রাত্রে নেমন্তন্ন আছে, তাই রান্না নেই, এতক্ষণ আছি সেই জন্যে৷ নইলে কি এখনও থাকতে পারতাম! বাবা একলাটি থাকবেন, তা কখনো হয়? তা ছাড়া তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠবেন যে! আমি তো আর বলে আসি নি যে কারো বাড়ি থাকব, ফিরব না৷ আর সে এমনিই হয় না৷ আপনার স্বামী যদি এসেই পড়েন হঠাৎ—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, এসে পড়লে কিছুই নয়৷ তিনটে ঘর রয়েছে এখানে, তোমাকে ভাই এই ঘরে আলাদা বিছানা করে দেব, কোনো অসুবিধে হবে না—থাকো ভাই, প্রভাসকে বলি গাড়ি নিয়ে চলে যাবার জন্যে৷ বোসো তুমি এখানে—

—না, সে হয় না! বাবাকে কিছু বলা হয় নি, তিনি ভীষণ ভাববেন—

—প্রভাস কেন গাড়িতে করে গিয়ে বাবার কাছে খবর দিয়ে আসুক না যে তুমি আমাদের এখানে থাকবে—তা হলেই তো সব চেয়ে ভালো হয়—তাই বলি—এই বেশ সব দিক দিয়ে সুবিধা হল—তোমার পায়ে পড়ি ভাই, এতে অমত করো না৷

শরৎ পড়ে গেল বিপদে৷ একদিকে তার অনুপস্থিতিতে তার বাবার সুবিধে অসুবিধের ব্যাপার, অন্যদিকে প্রভাসের বৌদিদির এই সনির্বন্ধ অনুরোধ—কোন দিকে সে যায়? অবিশ্যি একটা রাত এখানে কাটানো আর তেমন কি, সম্ভবতঃ ওর স্বামী আজ আফিসের কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে পারবেন না বলেই ওকে সঙ্গে রাখবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছে—শোয়ারও অসুবিধে কিছু নেই, থাকলেই হল—কিন্তু একটা বড় কথা এই যে, সে বাড়ি না ফিরলে বাবা কি ভাবনাতেই পড়ে যাবেন! তবে বাবাকে যদি প্রভাসদা এখুনি খবর দিয়ে দেন—সে আলাদা কথা৷

সে সাতপাঁচ ভেবে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে কমলা এসে ঘরে ঢুকে বললে, বা রে, এখানে সব যে, আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি—

প্রভাসের বৌদিদি উৎফুল্ল হয়ে উঠে বললে, বেশ সময়ে এসে পড়েছ কমলা—আমি ওকে বোঝাচ্ছি ভাই যে আজ রাতটা এখানে থেকে যেতে৷ উনি আজ আফিস থেকে আসবেন না, জানোই তো—দুজনে বেশ একসঙ্গে গল্পগুজবে—কি বলো?

প্রভাস এবং তার দলবল একটু আগে বাইরে কমলার সঙ্গে কি কথা বলেছে৷ এই জন্যই তার এখানে আসা, যতদূর মনে হয়৷

সে বললে, আমিও তাই বলি ভাই, বেশ সবাই মিলেমিশে একটা রাত আপনাকে নিয়ে আমোদ করা গেল—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আর বড্ড ভালো লেগেছে তোমাকে তাই বলছি৷ কি বলো কমলা?

—তা আর বলতে! আমি তো ভাবছি একটা কিছু সম্বন্ধ পাতাব—

এই মেয়েটিকে সত্যিই শরতের খুব ভালো লেগেছিল—বয়সে এ তার সঙ্গিনী রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কিছু বড় হবে, দেখতে শুনতে রূপসী মেয়ে বটে৷ সকলের ওপরে ওর গান গাইবার গলা…অনেক জায়গায় গান শুনেছে শরৎ—কিন্তু এমন গলার স্বর—

শরৎ আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল, বেশ, সম্বন্ধ পাতাও না ভাই—আমি ভারি সুখী হব—

—কি সম্বন্ধ পাতাবেন বলুন?

—আপনি বলুন—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, গঙ্গাজল! পছন্দ হয়?

কমলা উৎসাহের সুরে ঘাড় নেড়ে বললে, বেশ পছন্দ হয়৷ আপনারও হয়েছে তো?…তবে তাই—কিন্তু আজ রাত্রে—

শরৎ আপনমনেই বলে গেল—তোমাকে ভাই আমাদের দেশে নিয়ে যাব, যাবে তো? তোমার বয়সী একটি মেয়ে আছে রাজলক্ষ্মী, বেশ মেয়ে৷ আলাপ করিয়ে দেব৷ আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবে৷ তবে হয়তো অত অজ-পাড়াগাঁ তোমার ভালো লাগবে না—

—কেন লাগবে না, খুব লাগবে—আপনাদের বাড়ি থাকব—

—জানো না তাই বলছ৷ আমাদের বাড়ি তো গাঁয়ের মধ্যে নয়—গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে—

কমলা আগ্রহের সুরে বললে, কেন, জঙ্গলের মধ্যে কেন?

—আগে বড় বাড়ি ছিল, এখন ভেঙে-চুরে জঙ্গল হয়ে পড়েছে, যেমনটি হয়—

—বাঘ আছে সেখানে?

শরৎ হেসে বললে, সব আছে, বাঘ আছে, সাপ আছে, ভূতও আছে—

কমলা ও প্রভাসের বৌদিদি একসঙ্গে বলে উঠল—ভূত! আপনি দেখেছেন?

—না, কখনো দেখি নি, ওসব মিথ্যে কথা৷ কিংবা চলো তোমরা একদিন, ভূত দেখতে পাবে৷

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আচ্ছা, সে জঙ্গলে না থেকে কলকাতায় এসে থাকো না কেন ভাই! এখানে কত আমোদ-আহ্লাদ—তুমি এখানে থাকলে কত মজা করব আমরা—তোমাকে নিয়ে মাসে মাসে আমরা থিয়েটারে যাব, বায়োস্কোপে যাব—খাব দাব—কত আমোদ ফুর্তি করা যাবে! গঙ্গার ইস্টিমারে বেড়াতে যাব, যাও নি কখনো বোধ হয়? চমৎকার বাগান আছে ওই শিবপুরের দিকে, সেখানে কত গাছপালা—

শরতের হাসি পেল৷ গাছপালা দেখতে ইস্টিমারে চেপে গঙ্গা বেয়ে কোথায় যেন যেতে হবে কতদূর কলকাতায় এসে—তবে সে গাছপালা দেখতে পাবে! হায় রে গড়শিবপুরের জঙ্গল—এরা তোমাকে দেখে নি কখনো তাই এমন বলছে৷ সেখানে গাছ দেখতে রেলেও যেতে হয় না, ইস্টিমারেও যেতে হয় না—ঘুম ভেঙে উঠে চোখ মুছে জানালা দিয়ে চাইলেই দেখতে পাবে জঙ্গলের ঠ্যালা৷

কমলাও বললে, তাই করুন—কলকাতায় চলে আসুন, কেমন থাকা যাবে—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, এই আমাদের বাড়িতেই থাকবে ভাই! মানে—আমাদের বাড়ির কাছেও বাসা করে দেওয়া যাবে এখন৷ এমনি সাজিয়েগুছিয়ে বেশ চমৎকার করে দেওয়া যাবে৷ কি ভাই সেখানে পড়ে আছ জঙ্গলে, কলকাতায় এসে বাস করে দেখো ভাই, আমোদ ফুর্তি কাকে বলে বুঝতে পারবে৷ আমাদের সঙ্গে থাকবে, একসঙ্গে বেড়াব, দেখব শুনব, সে কি রকম মজা হবে বলো দিকি ভাই? তোমার মতো মানুষ পেলে তো—

কমলাও উৎসাহের সুরে বললে, আপনাকে পেয়ে আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না বলেই তো—

শরতের খুব ভালো লাগছিল ওদের সঙ্গ৷ এমন মন-খোলা, আমুদে, তরুণী মেয়েদের সঙ্গ পাড়াগাঁয়ে মেলে না, এক আছে রাজলক্ষ্মী, কিন্তু সেও এদের মতো নয়—এদের যেমন সুশ্রী চেহারা, তেমনি গলার সুর, এদের সঙ্গে একত্রে বাস করা একটা ভাগ্যের কথা৷ কিন্তু ওরা যে বলছে, তা সম্ভব হবে কি করে? এরা আসল ব্যাপারটা বোঝে না কেন?

সে বললে, ভালো তো আমারও লেগেছে আপনাদের৷ কিন্তু বুঝছেন না, কলকাতায় বাবা থাকবেন কি করে? তেমন অবস্থা নয় তো তাঁর? এই হল আসল কথা৷

প্রভাসের বৌদিদি হেসে বললে, এই! এজন্যে কোনো ভাবনা নেই তোমার ভাই৷ এখন দিনকতক আমাদের বাসাতে থাকো না—তার পর বাসা একটা দেখেশুনে নিলেই হবে এখন৷ আর তোমার বাবা? উনি যে অফিসে কাজ করেন, সেখানে একটা কাজটাজ—

—সে কাজ বাবা করতে পারেন না৷ ইংরিজি জানেন না—উনি জানেন গান-বাজনা৷ বেশ ভালো বেহালা বাজাতে পারেন—

প্রভাসের বৌদিদি কথাটা যেন লুফে নিয়ে বলল, বেশ, বেশ—তবে তো আরও ভালো৷ নরেশবাবু থিয়েটারেই তো কাজ করেন—তিনি ইচ্ছে করলে—’

শরৎ বললে, নরেশবাবু কে?

—নরেশবাবু!—এই গিয়ে—ওঁর একজন বন্ধু, আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন-টাসেন কিনা৷

শরৎ একটুখানি কি ভেবে বললে, কিন্তু বাবা কি গাঁ ছেড়ে থাকতে পারবেন? আমার শহর দেখা শেষ হয় নি বলে তিনি এখনও বাড়ি যাবার পেড়াপীড়ি করছেন না—নইলে এতদিন উদ্ব্যস্ত করে তুলতেন না আমাকে! নিতান্ত চক্ষুলজ্জায় পড়ে কিছু বলতে পারছেন না, তিনি টিকবেন শহরে, তবেই হয়েছে!

প্রভাসের বৌদিদি বললে, আচ্ছা, এক কাজ করো না কেন?

—কি?

—তুমিই কেন থাকো না এখন দিনকতক? এই আমাদের সঙ্গেই থাকো৷ তোমার বাবা ফিরে যান দেশে, এর পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন৷ আমাদের বাড়িতে আমাদের বন্ধু হয়ে থাকবে, টাকাকড়ির কোনো ব্যাপার নেই এর মধ্যে—তোমায় মাথায় করে রেখে দেব ভাই৷ বড্ড ভালো লেগেছে তোমাকে, তাই বলছি৷ কি বলিস কমলা? তুই কথা বলছিস নে যে—বল না তোর গঙ্গাজলকে!

কমলা বললে, হ্যাঁ, সে তো বলছিই—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, সে-সব গেল ভবিষ্যতের কথা৷ আপাততঃ আজ রাত্রে তুমি এখানে থাকো৷ প্রভাস গিয়ে খবর দিয়ে আসুক তোমার বাবাকে৷ রাজি?

শরৎ দ্বিধার সঙ্গে বললে, আজ?—তা—না ভাই আজ বরং আমায় ছেড়ে দাও—কাল বাবাকে বলে—

—তাতে কি ভাই! প্রভাস ঠাকুরপো গিয়ে এখুনি বলে আসছে৷ যাবে আর আসবে—ডাকি প্রভাসবাবুকে—তুমি আর অমত কোরো না৷ বসো আমি আসছি—তুমি থাকলে কমলাকে দিয়ে সারারাত গান গাওয়াব৷

শরৎ এমন বিপদে কখনো পড়ে নি৷

কি সে করে এখন? এদের অনুরোধ এড়িয়ে চলে যাওয়াও অভদ্রতা—যখন এতটাই পীড়াপীড়ি করছে তার থাকার জন্যে, থাকলে মজাও হয় বেশ—কমলার গান শুনতে পাওয়া যায়৷

কিন্তু অন্যদিকে বাবাকে বলে আসা হয় নি, বাবা কি মনে করতে পারেন৷ তবে প্রভাসদা যদি মোটরে করে গিয়ে বলে আসে, তবে অবিশ্যি বাবার ভাববার কারণ ঘটবে না৷ তবুও কি তার নিজের মন তাতে শান্তি পাবে? কোথায় বাগানের মধ্যে নির্জন বাড়ি, সেখানে একলাটি পড়ে থাকবেন বাবা, রাত্রে যদি কিছু দরকার পড়ে তখন কাকে ডাকবেন, কে তাঁকে দেখে?

সে ইতস্তত করে বললে, না ভাই, আমার থাকবার জো নেই—আজ ছেড়ে দাও, বাবাকে বলে কাল আসব৷

হঠাৎ প্রভাসের বৌদিদি উঠে হাত বাড়িয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বললে, যাও দিকি কেমন করে যাবে ভাই! কক্ষণও যেতে দেব না—কই, যাও তো কেমন করে যাবে? এমন আমোদটা আমাদের মাটি করে দিয়ে গেলেই হল!

শরৎ তার কাণ্ড দেখে হেসে ফেললে৷

এমন সময় বাইরে থেকে প্রভাসের গলা শুনতে পাওয়া গেল—ও বৌদিদি—

প্রভাসের বৌদিদি বললে, দাঁড়াও ভাই আসছি—ঠাকুরপো ডাকছে—বোধ হয় চা চান, বন্ধু-বান্ধব এসেছে কিনা? ঘন ঘন চা—

সে বাইরে যেতেই প্রভাস তাকে বারান্দার ও-প্রান্তে নিয়ে গিয়ে বললে, কি হল?

তার সঙ্গে অরুণ ও গিরীনও ছিল৷ গিরীন ব্যস্তভাবে বললে, কতদূর কি করলে হেনা?

—বাবাঃ—সোজা একগুঁয়ে মেয়ে! কেবল বাবা আর বাবা! এত বোঝাচ্ছি, এত কাণ্ড করছি এখনও মাথা হেলায় নি—কমলা আবার ঢোঁক মেরে চুপ করে রয়েছে৷ আমি একা বকে বকে মুখে বোধ হয় ফেনা তুলে ফেললাম৷ ধন্যি মেয়ে যা হোক৷ যদি পারি, আমায় একশো কিন্তু পুরিয়ে দিতে হবে! কমলা কিছুই করছে না—ওর টাকা—

গিরীন বিরক্তির সুরে বললে, আরে দূর, টাকা আর টাকা! কাজ উদ্ধার করো আগে—একটা পাড়াগেঁয়ে মেয়েকে সন্দে থেকে ভুলোতে পারলে না—তোমরা আবার বুদ্ধিমান, তোমরা আবার শহুরে—

প্রভাসের বৌদিদি মুখনাড়া দিয়ে বলে উঠল—বেশ, তুমি তো বুদ্ধিমান, যাও না, ভজাও গে না, কত মুরোদ! তেমন মেয়ে নয় ও—আমি ওকে চিনেছি৷ মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি, আমরা চিনি মেয়েমানুষ কে কি রকম! ও একেবারে বনবিছুটি—তবে পাড়াগাঁ থেকে এসেছে, আর কখনো কিছু দেখে নি—তাই এখনও কিছু সন্দেহ করে নি, নইলে ওকে কি যেমন তেমন মেয়ে পেয়েছ?

প্রভাস বিরক্ত হয়ে বললে, যাক, আর এক কথা বার বার বলে কি হবে? সোজা কাজ হলে তোমাকেই বা আমরা টাকা দিতে যাব কেন হেনা বিবি, সেটাও তো ভাবতে হয়—

হেনা বললে, এবার যেন একটু নিমরাজি গোছের হয়েছে—দেখি—

হেনা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরেই হাসিমুখে বার হয়ে এসে বললে, কই ফেল তো দেখি টাকা!

ওরা সবাই ব্যস্ত ও উৎসুক ভাবে বলে উঠল—কি হল? রাজি হয়েছে?

হেনা হাসিমুখে ঘাড় দুলিয়ে বাহাদুরির সুরে বললে, এ কি যার-তার কাজ? এই হেনা বিবি ছিল তাই হল৷ দেখি টাকা? আমি যাকে বলে—সেই যাই পাতায় পাতায় বেড়াই—তাই—

গিরীন বিরক্তির সুরে বললে, আঃ, কি হল তাই বলো না? গেলে আর এলে তো?

—আমি গিয়েই বললাম, ভাই, প্রভাস ঠাকুরপোকে বলে এলাম তোমার বাবাকে খবর দিতে৷ সে গাড়ি নিয়ে এখুনি যাচ্ছে বললে৷ আমি জোর করে কথাটা বলতেই আর কোনো কথা বলতে পারলে না৷ কেবল বললে, প্রভাসদা যাবার আগে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়—বাবাকে কি বলতে হবে বলে দেব—কমলা কিন্তু কিছু করছে না, মুখ বুজে গিন্নি-শকুনির মতো বসে আছে!

গিরীন বললে, না প্রভাস, তুমি এখান থেকে সরে পড়ো, হেনা গিয়ে বলুক তুমি চলে গিয়েছ—তুমি এসময় সামনে গেলে একথাও বলতে পারে যে আমিও ওই গাড়িতে বাবার কাছে গিয়ে নিজেই বলে আসি৷ তা ছাড়া তোমার চোখমুখ দেখে সন্দেহ করতে পারে—হেনার মতো তুমি পারবে না—ও হল অ্যাকট্রেস, ও যা পারবে, তা তুমি আমি পারতে—

হেনা বললে, বঙ্গরস থিয়াটারে আজ পাঁচটি বছর কেটে গেল কি মিথ্যে মিথ্যে? ম্যানেজার সেদিন বলেছে, হেনা বিবি, তোমাকে এবার ভাবছি সীতার পার্ট দেব—সেদিন আমার রানীর পার্ট দেখে—ও কি ওই কমলির কাজ? অনেক তোড়জোড় চাই—

গিরীন বললে, যাক ও সব কথা, কে কোথা দিয়ে শুনে ফেলবে! এত পরিশ্রম সব মাটি হবে! খসে পড়ো প্রভাস—তোমাকে আর না দেখতে পায়—মন আবার ঘুরে যেতে কতক্ষণ, যদি বলে বসে—না, আমি প্রভাসদার মোটরে বাবার কাছে যাব! আর কে যাচ্ছে এখন এত রাত্রে সেই পাগলা বুড়োটার কাছে?

প্রভাস ইতস্তত করে বললে, তবে আমি যাই?

—যাও—তোমায় আর না দেখতে পায়—পায়ের বেশি শব্দ করো না৷

—তোমরা? তোমাদেরও এখানে থাকা উচিত হবে না, তা বুঝছ?

—আমরা যাচ্ছি৷ তুমি আগে যাও—কারণ তুমি চলে গেলে ওর হাতের তীর ছাড়া হয়ে যাবে, আর তো ও মত বদলাতে পারবে না?

হেনা বললে, আজ রাত্তিরটা কোনো রকম বেতাল না দেখে ও৷ তোমরা ওই হরি সা লোকটাকে আগলে রাখো—

অরুণ বললে, কোথায় সে?

প্রভাস বললে, আমি তাকে কমলির ঘরে বসিয়ে রেখে এসেছি৷ কিন্তু এখন যা আছে, আর দু-ঘণ্টা পরে তো থাকবে না৷ ওকে চেনো তো? চীনেবাজারের অত বড় দোকানটা ফেল করেছে এই করে৷ বোকা তাই রক্ষে! ওকে সরিয়ে দাও বাবা, আজ রাত্তিরের মতো—

গিরীন বললে, যাও না তুমি? কেন দাঁড়িয়ে বকবক করছ?

প্রভাস চলে যেতে উদ্যত হলে গিরীন তাকে বললে, কোথায় থাকবে?

—আজ বাড়ি চলে যাই—বাবা সন্দেহ করবেন, বেশি রাত্তিরে বাড়ি ফিরলে—

—ভালো কথা, তোমার বাবার সঙ্গে তো ওর বাবার খুব আলাপ, সেখানে গিয়ে সন্ধান নেবে না তো বুড়ো?

প্রভাস হেসে বুড়ো আঙুল নেড়ে বললে—হুঁ হুঁ বাবা—সে গুড়ে বালি! অত কাঁচা ছেলে আমি নই৷ বাবা তো বাবা, বাড়ির কেউই ঘুণাক্ষরেও কিছু জানে না৷ বাবাও কেদারকে ভুলে গিয়েছেন, দুজনের দেখাশুনো নেই কতকাল৷ দেখলে কেউ হঠাৎ হয়তো চিনতে পারবে না৷ তার ওপর আমাদের বাড়ি কেদার বুড়ো জানবে কি করে? ঠিকানা জানে না, নম্বর জানে না—কোনোদিন শোনেও নি৷ আর এ কলকাতা শহর, বুড়ো না চেনে বাড়ি না চেনে রাস্তাঘাট৷ সেদিকে ঠিক আছে৷

প্রভাস সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে গেল৷

অরুণ একটু দ্বিধার সুরে বললে, কাজটা তো এক রকম যা হয় এগুলো—শেষে পুলিসের কোনো হাঙ্গামায় পড়বো না তো?

—কিসের পুলিসের হাঙ্গামা? নাবালিকা তো নয়, ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের ধাড়ি—আমরা প্রমাণ করব ও নিজের ইচ্ছেয় এসেছে৷ ওকে এ জায়গায় কেন পাওয়া গেল—এ কথার কি জবাব দেবে ও? আমি বুঝি নি বললে কেউ বিশ্বাস করবে? নেকু!

—তা ধরো ও পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, সত্যিই ওর বয়েস হয়েছে বটে, কিন্তু এসব কিছু জানে না, বোঝে না৷ দেখতেই তো পেলে—একটু সন্দেহ জাগলে ওকে রাখতে পারত হেনা? তা জাগে নি৷ এমন জায়গাও কখনো দেখে নি, জানে না৷ যদি এই সব কথা প্রমাণ হয় আদালতে?

গিরীন আত্মম্ভরিতার সুরে বললে, শুধু দেখে যাও আমি কি করি! কুণ্ডুকে তোমরা সোজা লোক ঠাউরো না—

অরুণ বললে, আর একটা কথা, সে না হয় বুঝলাম—কিন্তু ওসব ঘরের মেয়ে, যখন সব বুঝে ফেলবে, তখন আত্মহত্যা করে বসে যদি? ওরা তা পারে৷

গিরীন তাচ্ছিল্যের সুরে বললে, হ্যাঁ—রেখে দাও ওসব! মরে সবাই—দেখা যাবে পরে—

—আজ চলো আমরা এখান থেকে যাই—

—এখন?

—আমার মনে হয় তাই উচিত৷ কোনো সন্দেহ না জাগে মনে—এটা যেন মনে থাকে৷

হেনাকে সন্তর্পণে বাইরে আনিয়ে গিরীন বললে, আমরা চলে যাচ্ছি হেনা বিবি৷ রেখে গেলাম কিন্তু—

হেনা বললে, আমি বাবু পুলিসের হ্যাঙ্গামে যেতে পারব না, তা বলে দিচ্ছি৷ কাল দুপুর পর্যন্ত ওকে এখানে রাখা চলবে৷ তারপর তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে যেয়ো—আমার টাকা চুকিয়ে দিয়ে৷

গিরীন বললে, কেন, আবার নতুন কথা বলছ কেন? কি শিখিয়ে দিয়েছিলাম?

—সে বাপু হবে না৷ ও বেজায় একগুঁয়ে মেয়ে৷ আগে যা ভেবেছিলাম তা নয়—ও শুধু বুঝতে পারে নি তাই এখানে রয়ে গেল৷ নইলে রসাতল বাধাত এতক্ষণ৷ আর একটা কথা কি, কিছুতেই খাচ্ছে না, এত করে বলছি, নানারকম ছুঁতো করছে, পাড়াগাঁয়ের বিধবা মানুষ, ছুঁচিবাই গো, ছুঁচিবাই৷ কেন খাচ্ছে না আমি আর ওসব বুঝি নে? আমি মানুষ চরিয়ে খাই—

অরুণ বললে, মানুষ চরাও নি কখনো হেনা বিবি, ভেড়া চরিয়েছ৷ এবার মানুষ পেয়েছ, চরাও না দেখি৷ বুঝলে?

ওরা দুজনে নীচে নেমে গেল৷

.

চাটুজ্জে মশায়ের বাড়ির গানের আসর ভাঙল রাত এগারোটায়৷ তার পরে খাওয়ার জায়গা হল, প্রায় ত্রিশজন লোক নিমন্ত্রিত, আহারের ব্যবস্থাও চমৎকার৷ যেমন আয়োজন, তেমনি রান্না৷ কেদার একসময়ে খেতে পারতেন ভালোই, আজকাল বয়স হয়ে আসছে, তেমন আর পারেন না—তবুও এখনও যা খান, তা একজন ওই বয়সের কলকাতার ভদ্রলোকের বিস্ময় ও ঈর্ষার বিষয়৷

বাড়ির কর্তা চাটুজ্জে মশায় কেদারের পাতের কাছে দাঁড়িয়ে তদারক করে তাঁকে খাওয়ালেন৷ আহারাদির পরে বিদায় চাইলে বললেন, অবার আসবেন কেদারবাবু, পাশেই আছি—আমরা তো প্রতিবেশী৷ আপনার বাজনার হাত ভারি মিঠে, আমার স্ত্রী বলছিলেন উনি কে? আমি বললাম, আমাদের পাশের বাগানেই থাকেন—এসেছেন বেড়াতে৷ আহা, আজ যদি আপনার মেয়েটিকে আনতেন—বড় ভালো হত, আমার স্ত্রী বলছিলেন—

—আজ্ঞে হ্যাঁ—তা তো বটেই৷ তার এক দাদা এসে তাকে নিয়ে গেল বেড়াতে কিনা? মানে গ্রাম-সম্পর্কের দাদা হলেও খুব আপনা-আপনি মতো৷ কলকাতায় তাদের বাড়ি আছে—সেখানেই নিয়ে গেল৷ মোটর গাড়ি নিয়ে এসেছিল, তা আর একদিন নিয়ে আসব—

—আনবেন বৈকি, মাকে আনবেন বৈকি,—বলা রইল, নিশ্চয় আনবেন—আচ্ছা নমস্কার কেদারবাবু—

কেদারের সঙ্গে চাটুজ্জে মশায় একজন লোক দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেদার তা নিতে চান নি৷ তিনি গানের আসরের শেষ দিকে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, মেয়ে এসে একা থাকবে বাগানবাড়িতে৷ গাঁয়ে গড়বাড়ির বনের মধ্যে মেয়েকে ফেলে রেখে যেতেন প্রায় প্রতি রাত্রেই, সে কথা ভেবে এখন তাঁর কষ্ট হল৷ তবুও সে নিজের গ্রাম, পূর্বপুরুষের ভিটে, সেখানকার কথা স্বতন্ত্র৷

গেট দিয়ে ঢোকবার সময় কেদার দেখলেন, কোনো ঘরে আলো জ্বলছে না৷ শরৎ তা হলে হয়তো সারাদিন ঘুরেফিরে এসে ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে! আহা, কত আর ওর বয়স, কাল তো এতটুকু দেখলেন ওকে—দেখুক শুনুক, আমোদ করুক না৷

বাড়ির রোয়াকে উঠে ডাকলেন, ও শরৎ—মা শরৎ উঠে দোরটা খোলো, আলোটা জ্বালো—

সাড়া পাওয়া গেল না৷

কেদার ভাবলেন—বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে দেখছি—বড্ড ঘুম-কাতুরে, গড়শিবপুরে এক-একদিন এমন ঘুমিয়ে পড়তো—ছেলেমানুষ তো হাজার হোক—হুঁ—

পুনরায় ডাক দিলেন—ও মা শরৎ, ওঠো, আলো জ্বালো—

ডাকাডাকিতে ঝি উঠে আলো জ্বেলে রান্নাঘরের বারান্দা থেকে এসে বললে, কে—বাবু? কই দিদিমণি তো আসেন নি এখনও—

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, আসে নি? বাড়ি আসে নি? তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি, জানিস নে হয়তো—দ্যাখ—সে হয়তো আর ডাকে নি—চল ঘরে, আলো জ্বাল—

ঝি বললে, চাবি দেওয়া রয়েছে যে বাবু, এই আমার কাছে চাবি৷ দোর খুলবে, আমার কাছ থেকে চাবি নেবে, তবে তো ঢুকবে ঘরে! কি যে বলো বাবু!

তাই তো, কেদার সে কথাটা ভেবে দেখেন নি৷ চাবি রয়েছে যখন ঝিয়ের কাছে, তখন শরৎ দোর খুলবে কি করে!

ঝি বললে, আমি সন্দে থেকে বসে ছিনু এই রোয়াকে, এই আসে এই আসে—বলি মেয়েমানুষ একা থাকবে? এসব জায়গা আবার ভালো না৷ বাগানবাড়ি, লোকজনের গতাগম্যি নেই—রাত্তির কাল! আমি শুয়ে থাকবখন দিদিমণির ঘরে—রান্নাঘরে আটা এনে রেখেছি, ঘি এনে রেখেছি, যদি এসে খাবার করে খায়—

কেদার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন—ঝিয়ের দীর্ঘ উক্তির খুব সামান্য অংশই তাঁর কর্ণগোচর হল৷ ঝিয়ের কথার শেষের দিকে প্রশ্ন করলেন—কে খাবার করে খেয়েছে বললে?

—খায় নি গো খায় নি, যদি খায় তাই এনে রাখনু সব গুছিয়ে৷ আটা ঘি—

কেদার বললেন, তাই তো ঝি, এখনও এল না কেন বল দেখি? বারোটা বাজে—কি তার বেশিও হয়েছে—

—তা কি করে বলি বাবু!

—হ্যাঁ ঝি, থিয়েটার দেখতে যায় নি তো? তা হলে কিন্তু অনেক রাত হবে৷ না?

—তা জানি নে বাবু৷

রাত একটা বেজে গেল—দুটো৷ কেদারের ঘুম নেই, বিছানায় শুয়ে উৎকর্ণ হয়ে আছেন৷ বাগানবাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে অত রাতেও দু-একখানা মোটর বা মাল-লরীর যাতায়াতের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে; কেদার অমনি বিছানার ওপর উঠে বসেন৷ এই এতক্ষণে এল প্রভাসের গাড়ি! কিছুই না!

আবার শুয়ে পড়েন৷

নয়তো উঠে তামাক সাজেন বসে বসে, তবুও একটু সময় কাটে৷

হলের ঘড়িটায় টং টং করে তিনটে বাজল৷

কত রাত্রে কলকাতার থিয়েটার ভাঙে! কারণ এতক্ষণে তিনি ঠিক করেই নিয়েছেন যে প্রভাস ওকে থিয়েটার দেখাতে নিয়ে গিয়েছে, প্রভাস এবং অরুণের বাড়ির সবাই গিয়েছে, মানে মেয়েরা৷ তাদের সঙ্গেই—তা তো সব বুঝলেন তিনি, কিন্তু থিয়েটার ভাঙে কত রাত্রে? কাকে জিজ্ঞেস করেন এত রাত্রে কথাটা! আবার শুয়ে পড়লেন৷ একবার ভাবলেন, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কি দেখবেন? শেষ রাত্রে কখন ঘুম এসে গিয়েছিল চোখে তাঁর অজ্ঞাতসারে, যখন কেদার ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন, উঃ, এ যে দেখছি রোদ উঠে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে!

ডাকলেন—ও ঝি—ঝি—

ঝি এসে বললে, আমি বাজারে চননু বাবু, এর পর মাছ মিলবে না, ওই মুখপোড়া ইটের কলের বাবুগুণো হন্নে শেয়ালের মতো—

—হ্যাঁরে, শরৎ আসে নি?

—না বাবু, কই? এলে তো তখুনি উঠে দরজা খুলে দিতাম বাবু৷ আমার ঘুম বড্ড সজাগ ঘুম৷

ঝি বাজারে চলে গেল৷ কেদারের মনে এখন আর ততটা উদ্বেগ নেই৷ তিনি এইবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন৷ অনেক রাত্রে থিয়েটার ভেঙে গেলে প্রভাসের বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে শরৎ তাদের বাড়িতে গিয়ে শুয়েছে—এ তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার৷ রাত্রের অন্ধকার মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ আনে, দিনের আলোয় তাঁর মনের দুশ্চিন্তা কেটে গিয়েছে৷ মিছিমিছি ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই এর মধ্যে৷ কলকাতার জীবনযাত্রা-প্রণালী গড়শিবপুরের সঙ্গে এক নয়—এ তাঁর আগেই বোঝা উচিত ছিল৷

কেদার নিজেই জল ফুটিয়ে চা করে খেলেন, ঝি দোকান থেকে খাবার নিয়ে এল—আটটা ন’টা দশটা বাজল, কেদার ঝিকে বলে দিয়েছিলেন কি কি আনতে হবে, মেয়ে এসে মাছ রাঁধবে বলে ভালো মাছও আনতে দিয়েছেন—ঝি বাজার থেকে ফিরে এল, অথচ এখনও শরতের সঙ্গে দেখা নেই৷ বাজার পড়ে রইল, ঝি জিজ্ঞেস করল—দিদিমণি তো এখনও এলো না, মাছ কি কুটে রাখবো?

—রেখে দে৷ হয়তো গঙ্গাচ্চান করে আসবে৷

যখন বারোটা বেজে গেল, তখন ঝি এসে বললে, বাবু, রান্নাটা আপনিই চড়িয়ে দিন না কেন? আমার বোধ হয় দিদিমণি এবেলা আর এলেন না৷ না খেয়ে কতক্ষণ বসে থাকবেন৷

কিন্তু কেদার বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন৷

আজ একটা ব্যাপার তাঁর কাছে আশ্চর্য ঠেকেছিল, সেটা এই, শরৎ যত আমোদের মধ্যেই থাকুক কেন না, বাবাকে ভুলে—তাঁর জন্যে রান্নার কথা ভুলে—সে কোথাও থাকবে না৷ জীবনে সে কখনও তা করে নি৷ যতই কালীঘাটেই যাক আর গঙ্গাস্নানই করুক, বাবার খাওয়া হবে না দুপুরে, এ চিন্তা তাকে বৈকুণ্ঠের দোর থেকেও ফিরিয়ে আনবে৷

অথচ এ কি রকম হল!

মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন কেদার৷

প্রভাসের বাড়ির ঠিকানা জানেন না তিনি যে খোঁজ নেবেন৷ এমন তো হতে পারে কোনো অসুখ করেছে শরতের! কিন্তু প্রভাসও খবর দিতে এল না একবার, এই বা কেমন কথা!

ঝি এসে দাঁড়াল, আবার ভাত চড়াবার কথাটা বলতে৷

একটু ইতস্তত করে বলল, বাবু, একটা কথা বলব কিছু মনে কোরো নি, দিদিমণি যেনার সঙ্গে গিয়েছেন, তিনি কি রকম দাদা!

ঝিয়ের কথার সুর ও বলবার ধরণ কেদারের মনের মধ্যে হঠাৎ যেন একটা ধারালো অস্ত্রের বিষম ও নিষ্ঠুর খোঁচা দিয়ে তাঁর সরল মনকে জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করলে৷

তিনি পাংশুমুখে ঝিয়ের দিকে চেয়ে বললেন, কেন মেয়ে? কেন বলো তো?

—না বাবু, তাই বলছি৷ বলি, যেনার সঙ্গে তিনি গিয়েছেন, তিনি নোক ভালো তো? শহর-বাজার জায়গা, এখানে মানুষ সব বদমাইশ কিনা, দিদিমণি সোমত্ত মেয়ে, তাই বলছি, তবে আপনি বলছিলে দাদার সঙ্গে গিয়েছে, তবে আর ভয় কি! তা বাবু, ভাতটা চড়িয়ে—

কেদার রান্না চড়াবেন কি, ঝির কথা শুনে তাঁর কেমন একটা ভয়ে সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল, হাতে পায়ে যেন বল নেই৷ এসব কথা তাঁর মনেও আসে নি৷ ঝি নিতান্ত অন্যায় কথা তো বলে নি৷ প্রভাসকে তিনি কতটুকু জানেন? তাঁর সঙ্গে মেয়েকে যেতে দেওয়া হয়তো তাঁর উচিত হয় নি৷

হঠাৎ মনে পড়ল, পাশের বাগানে গিয়ে চাটুজ্জে মশাইকে সব জানিয়ে এ বিপদে তাঁর পরামর্শ নেওয়া দরকার—বিশাল কলকাতা শহরের মধ্যে তিনি আর কাউকে জানেন না, চেনেন না৷ ঝিকে বসিয়ে রেখে বাড়িতে তিনি চাটুজ্জে মশায়ের বাগানবাড়িতে গেলেন৷ চাটুজ্জে মশায়কে সামনের চাতালেই চাকরে তেল মাখাচ্ছিল, কেদারকে এমন অসময়ে আসতে দেখে তিনি একটু বিস্মিত হয়ে কাপড় গুছিয়ে পরে উঠে বসলেন৷ হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, আসুন কেদারবাবু, ওরে বাবুকে টুলটা এগিয়ে দে—

কেদার বললেন, বড় বিপদে পড়ে এসেছি চাটুজ্জে মশায়—আপনি ছাড়া আমি তো আর কাউকে জানি নে চিনিও নে—কার কাছেই বা যাব—

চাটুজ্জে মশায় সোজা হয়ে বসে বিস্ময়ের সুরে বললেন, কি বলুন দিকি? কি হয়েছে?

কেদার ব্যাপার সব খুলে বললেন৷

চাটুজ্জে মশাই শুনে একটু চুপ করে ভাবলেন৷ তার পর বললেন, আপনি ঠিকানা জানেন না?

—আজ্ঞে না—

—প্রভাস কি?

—দাস—ওরা কর্মকার৷

—আহা দাঁড়ান, টেলিফোন গাইডটা দেখি৷ কিন্তু আপনি তো বলছেন ঠিকানা জানেন না, তবে তাতে কি হবে? ওই নামে পঞ্চাশ জন মানুষ বেরুবে—আচ্ছা, আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন, আমি স্নানটা সেরে নি চট করে, বেলা হয়েছে৷ আপনাকে নিয়ে একবার থানায় যাব কি না ভেবে দেখি৷ পুলিসের সঙ্গে একবার পরামর্শ করা দরকার৷

পুলিসের নাম শুনে নির্বিরোধী কেদার ভয় পেয়ে গেলেন৷ পুলিসে যেতে হবে, ব্যাপারটা গুরুতর দাঁড়াবে কি? নাঃ, হয়তো মন্দির-টন্দির দেখতে বেরিয়েছে মেয়ে, ফিরে আসতে একটু বেলা হচ্ছে৷ একেবারে পুলিসে যাওয়াটা ঠিক হবে না৷

কেদার বললেন, আচ্ছা, আপনি স্নানাহার সেরে নিন—আমি ততক্ষণ একবার দেখে আসি এল কিনা৷ আপনি খেয়ে একটু বিশ্রাম করুন৷ আমি আসছি—

বাগানবাড়িতে ফিরে কেদার এঘর ওঘর খুঁজলেন, ঝিকে ডাকলেন, শরৎ আসে নি৷ ঘড়িতে বেলা দুটো৷ কিছুক্ষণ চুপ করে বিছানায় শুয়ে মন শান্ত করার চেষ্টা করলেন—পুলিসে খবর দেবার আগে বরং একটু দেরি করা ভালো৷ ঘড়িতে আড়াইটে বাজল৷

এমন সময়ে ফটকের কাছে মোটরের হর্ন শোনা গেল৷ কেদার উৎকর্ণ হয়ে রইলেন—সকাল থেকে একশো মোটর গাড়ির বাঁশি শুনেছেন তিনি৷ কিন্তু মনে হল—না, এই তো, গাড়ির শব্দ একেবারে বাগানের লাল কাঁকরের পথে৷ বাবাঃ, বাঁচা গেল৷ সমস্ত শরীর দিয়ে যেন ঝাল বেরিয়ে গেল কেদারের৷

ঝি ছুটে এসে বললে, বাবু মোটর ঢুকছে ফটক দিয়ে—দিদিমণি এসেছে—

কেদার প্রায় ছুটেই বাইরে গেলেন৷ মোটর সামনে এসে দাঁড়াল—তা থেকে নামল প্রভাস ও গিরীন৷ শরৎ তো গাড়িতে নেই!

ওরা এগিয়ে এল৷

কেদার ব্যস্ত ভাবে বললে, এসো বাবা প্রভাস—শরৎ আসে নি? এত দেরি করলে, তাকে কি বাড়িতে—

প্রভাস ও গিরীনের মুখ গম্ভীর৷ পাশেই ঝিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গিরীন বললে, শুনুন, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে৷ ওদিকে চলুন—

ঝি হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁগা বাবু, দিদিমণি ভালো আছে তো?

গিরীন নামতা মুখস্ত বলার মতো বললে, হ্যাঁ, আছে আছে—আসুন, চলুন ওই ওদিকে৷ তুই যা না কেন, হাঁ ক’রে এখানে দাঁড়িয়ে কি—

ওদের রকম-সকম দেখে কেদার উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলেন, কি—কি হয়েছে? শরৎ ভালো আছে তো?

প্রভাস বললে, হ্যাঁ, ভালো আছে৷ সেজন্য কিছু নয়, তবে একটা ব্যাপার হয়েছে, তাই আপনার কাছে—

কেদার জিনিসটা ভালো বুঝতে না পেরে বললেন, তা শরৎকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হত বাবাজি—তাকে আর কেন বাড়িতে রেখে এলে?

গিরীন বললে, আজ্ঞে না, তাঁকে নিয়েই তো ব্যাপার—সেই বলতেই তো—

কেদারের প্রাণ উড়ে গেল—শরতের নিশ্চয় অসুখ-বিসুখ হয়েছে, এরা গোপন করছে—তা ছাড়া আর কি হওয়া সম্ভব? তিনি অধীর ভাবে কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, গিরীন এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে বললে, আপনাকে বলতেই তো আমাদের আসা৷ কিন্তু কি করে যে বলি, তাই বুঝতে পারছি নে৷ আসল কথাটা কি জানেন, আপনার মেয়েকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না—মানে এখন পাওয়া গিয়েছে তবে—

এদের কথাবার্তার গতি কেদার বুঝতে পারলেন না, একবার বলে মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না, আবার বলে পাওয়া গিয়েছে—গিয়ে যদি থাকে, তবে কি তাকে সাংঘাতিক আহত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে? নইলে এরা তার পরে আবার ‘কিন্তু’ বলে কেন? মুহূর্তের মধ্যে কেদারের মনে এই কথাগুলো খেলে গেল—কিন্তু তাঁর হতবুদ্ধি ওষ্ঠাধর বাক্যে এর রূপ দেওয়ার পূর্বেই গিরীন আবার বললে—হয়েছিল কি জানেন, আপনার মেয়ে—বল না হে প্রভাস!

প্রভাস বললে, বলব কি, আমারও হাত-পা আসছে না আপনার সামনে একথা বলতে, অরুণের সঙ্গে কাল শরৎ-দি কোথায় চলে গিয়েছিল—কাল রাত্রে তারা সারারাত আসে নি৷ আজ সকালে—মানে—

গিরীন ওর কাছ থেকে কথা লুফে নিয়ে বললে, মানে আমরা কাল সারারাত খোঁজাখুঁজি করেছি—পাই নি৷ আপনার কাছেই বা কি বলি, কার কাছেই বা কি বলি—তার পর আজ সকালে একটা কুশ্রেণীর মেয়ের বাড়িতে এদের দুজনকে পাওয়া গিয়েছে৷ এসব কথা বলতে আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে লজ্জায়৷ প্রভাস তো বলছিল, আমি কাকাবাবুর কাছে গিয়ে এসব বলতে পারব না৷ আমি বললাম—না চলো, বলতেই যখন হবে আমিই বলব এখন৷ তিনিও তো ভাববেন৷ তাই ও এল, নইলে ও আসতে চাইছিল না৷

কেদার নির্বোধের মতো ওদের মুখের দিকে চেয়ে সব কথা শুনছিলেন—কিন্তু কথাগুলোর অর্থ তাঁর তেমন বোধগম্য হয় নি বোধ হয়—কারণ কিছুমাত্র না ভেবেই তিনি প্রশ্ন করলেন, তাকে তোমরা আনলে না কেন? তার অসুখ-বিসুখ হয় নি তো?

গিরীন হাত নেড়ে একটা হতাশাসূচক ভঙ্গি করে বললে, সে চেষ্টা করতে কি আর আমরা বাকি রেখেছিলাম? আসতে চাইলেন না৷

কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, আসতে চাইলে না?

—তবে আর বলছি কি ছাই আপনাকে! আমি আর প্রভাস গিয়ে আজ সকাল থেকে কত খোশামোদ, তা বললেন, আমি যাব না৷ এখানে বেশ আছি৷ কুশ্রেণীর দুটো মেয়ে আছে সে বাড়িতে, দিব্যি দেখলুম সাজিয়েছে৷ আমায় বললেন, দেশে আর সে জঙ্গলে ফেরবার আমার ইচ্ছে নেই৷ এই বেশ আছি৷ অরুণ তাঁকে সুখে রাখবে বলেছে৷ কলকাতা শহর ফেলে তিনি আর জঙ্গলে ফিরতে চান না, এই গেল আসল কথা৷ বললেন, আমি সাবালিকা, আমার বয়স হয়েছে, আমি এখন যা খুশি করতে পারি৷ আমি যাব না৷ এখন যেমন ব্যাপার বুঝিছি অরুণের সঙ্গে ওর—মানে মনের মিল হয়ে গিয়েছে—বয়েসও তো এখনও—বুঝলাম যতদূর তাতে—

কেদার অধীর ভাবে বললেন, আমার কথা বলেছিলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, এই জিজ্ঞেস করুন না প্রভাসকে৷ সকাল থেকে ঝুলোঝুলি করেছি আমরা৷ কিছু কি আর বাদ রেখেছি—কাল থেকে কলকাতা শহর তোলপাড় করে বেড়িয়েছি৷ ওদিকে অরুণের সঙ্গে ওখানে গিয়ে উঠেছেন তা কি করে জানব? তা আপনার কথা বলতে বললেন, বাবাকে দেশে ফিরে যেতে বলুন৷ আমার এখন সেখানে যাবার ইচ্ছে নেই—এই জিজ্ঞেস করুন না প্রভাসকে?

প্রভাস বিষণ্ণ মুখে বললে, সে-সব কথা আর কি বলি? কত রকম করে বোঝালুম, তা ওই এক বুলি মুখে! আমি আর ফিরব না দেশে, বাবাকে গিয়ে বলো গে যাও৷ আমি এখানে বেশ আছি৷ এসব কথা কি আপনার কাছে বলবার কথা, লজ্জায় মাথা কাটা যায়—কি করি বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে৷ আমি কি চেষ্টার ত্রুটি করেছি কাকাবাবু? এখন এক উপায় আছে পুলিসে খবর দেওয়া৷ আপনার সঙ্গে সেই পরামর্শ করতেই আসা৷ আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, জোড়াসাঁকো থানায় গিয়ে পুলিসের কাছে এজাহার করে দেওয়া যাক—

গিরীন চিন্তিত মুখে বললে, তাতেই বা কি হবে, সেই ভাবছি৷ ছেলেমানুষ নয়, বয়েস হয়েছে ছাব্বিশ-সাতাশ, বিধবা—সে মেয়ে যা খুশি করতে পারে৷ পুলিস হস্তক্ষেপ করতে চাইবে না৷ তার ওপরে ওঁদের মানী বংশ, পুলিসে কেস করতে গেলেই এ নিয়ে খবরের কাগজে একটা লেখালেখি হবে, ওঁদের ছবি বেরুবে, একটা কেলেঙ্কারির কথা—ভালো কথা তো নয়? চারিদিকে ছি ছি পড়ে যাবে৷ এ সবই ভাবছি কিনা! তা উনি যে-রকম বলেন সে-রকম করতে হবে৷ চলুন না হয় এখুনি তবে পুলিসে যাই—পুলিসে খবর দিলেই এখুনি প্রথম তো ওঁর মেয়েকে বেঁধে চালান দেবে—যদি অবিশ্যি পুলিসে এ কেস নেয়৷ তাঁকেই আসামী করবে—

গিরীন ধীরে ধীরে যে চিত্রপট কেদারের সামনে খুলে ধরলে, নিরীহ কেদার তাতে শিউরে উঠলেন৷ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না—পুলিসে যাওয়ার দরকার নেই৷

গিরীন বললে, না কেন? আমার মনে হয় পুলিসে একবার যাওয়া উচিত৷ আমাদের মোটরে আসুন জোড়াসাঁকো থানায়৷ আপনি গিয়ে এজাহার করুন৷ আদালতে আপনাকে সব খুলে বলতে হবে এর পর৷ হয় কেস হোক৷ আপনার মেয়ে যখন এ পথে গিয়ে পড়েছেন, তখন তাঁরও একটু শিক্ষা হয়ে যাক না! তিনটি বছর জেল ঠুকে দেবে এখন৷ ও অরুণকেও ছাড়বে না—আপনার মেয়েকেও ছাড়বে না৷ যা হয় হবে, আপনি আসুন আমাদের সঙ্গে জোড়াসাঁকো থানায়৷ চলুন—কি বলো প্রভাস?

প্রভাস বললে, হ্যাঁ, তা যেতে হবে বৈকি৷ যা থাকে কপালে৷ শরৎ-দিকে আসামী হয়ে ডকে দাঁড়াতে হবে বলে আর কি করা, চলুন আপনি৷ আমার গ্রামের লোক আপনি৷ আমি এর একটা বিহিত না করে—

গিরীন বললে, না, বিহিত করাই উচিত৷ খারাপ পথে যখন পা দিয়েছে, তখন ওদের শাস্তি হয়ে যাওয়াই উচিত৷ জেল হলেই বা আপনি করবেন কি? আসুন, উঠুন গাড়িতে, আপনার আহারাদি হয়েছে?

কেদার যেন অকূলে কূল পেয়ে বললেন, না, এখনও হয় নি৷ ভাত চড়াতে যাচ্ছিলাম—

—কি সর্বনাশ! খাওয়া হয় নি এখনও? আপনি রান্নাখাওয়া করে নিন—আমরা ততক্ষণ একটু অন্য কাজ সেরে আসি৷

কেদার ব্যস্তভাবে বললেন, তোমরা যেন আমায় না বলে থানায় যেয়ো না বাবাজি৷

গিরীন বললে, আপনি না থাকলে তো পুলিসে এজাহার করাই হবে না৷ আমরা কে—আপনিই তো ফরিয়াদি—আপনার মেয়ে, আমরা বাইরের লোক—আমাদের কথা নেবেই না পুলিস৷ আপনাকে না নিয়ে গেলে তো কাজই হবে না৷ আপনি খাওয়া-দাওয়া করুন, আমরা বেলা চারটের মধ্যে আসব৷

প্রভাস ও গিরীন মোটর নিয়ে চলে গেলে কেদার খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবলেন৷ ঠিকমতো ভাববার শক্তিও তখন তাঁর নেই—মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে৷ জীবনে কখনো এ-ধরনের ভাবনা ভাবেন নি তিনি—নির্বিরোধী নিরীহ মানুষ কেদার—শখের যাত্রাদলে গানের তালিম দিয়ে আর গ্রাম্য মুদির দোকানে বসে হাসিগল্প করেই চিরদিন কাটিয়ে এসেছেন৷ এমন জটিল ঘটনাজালের মধ্যে কখনো পড়েন নি, এমন ধরনের চিন্তায় তাঁর মস্তিষ্ক অভ্যস্ত নয়৷

একটা কথাই শুধু বার বার তাঁর মাথায় খেলতে লাগল—পুলিসে গেলে তাঁকে মেয়ের বিরুদ্ধে এজাহার করতে হবে, তাতে তাঁর মেয়ের জেল হয়ে যেতে পারে!

শরতের জেল হয়ে যেতে পারে!

আর এ মোকদ্দমার তিনিই হবেন ফরিয়াদি! আদালতে দাঁড়িয়ে মেয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে তাঁকে৷

ঝি এসে বললে, বাবু ওনারা চলে গেল৷ দিদিমণির কথা কি বলে গেল বাবু? কখন আসবেন তিনি?

কেদারের চমক ভাঙলো ঝিয়ের কথায়৷ বললেন, হ্যাঁ—এই—কি বললে? ও, শরৎ—না, তার এখন আসবার দেরি আছে৷

—তা আপনি আজ ভাত চড়াবেন না বাবু? দিদিমণির খবর তো পাওয়া গেল—এখন দুটো ভাতে ভাত যা হয় চড়িয়ে—

—না, মেয়ে, এখন অবেলায় আর ভাত—দুটো চিঁড়ে এনে দেবে?

—ওমা, চিঁড়ে খেয়ে থাকবেন আপনি? তা দেন, পয়সা দেন—নিয়ে আসি৷

.

বাগানের পথে দিব্যি বাতাবিলেবু গাছের ছায়া পড়েছে, প্রায় বিকেল হতে চলল৷

ঘণ্টা দুই পরে প্রভাস ও গিরীন মোটর নিয়ে ফিরে এসে দেখলে ঝি গাড়িবারান্দার সামনের রোয়াকে বসে৷ তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল কেদার কোথায় চলে গিয়েছেন, বাজার থেকে চিঁড়ে কিনে নিয়ে এসে সে আর তাঁকে দেখতে পায় নি৷ কেদারের কাপড় চোপড়ের পুঁটুলিটাও সেই সঙ্গে দেখা গেল নেই৷

গিরীন বাগানের বাইরে এসে হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি!

—কেমন বাবাঃ, বললাম যে সব আমার হাতে ছেড়ে দাও—গিরীন কুণ্ডুর মাথার দাম লাখ টাকা বাবা! ও পাড়াগেঁয়ে বুড়োর কানে এমন মন্তর ঝেড়েছি যে, এ-পথে আর কোনো দিন হাঁটবে না, বলি নি তোমায়?

—আচ্ছা বুড়োটা গেল কোথায়?

—কোথায় আর যাবে? গিয়ে দেখ গে যাও তোমাদের সেই কি পুর বলে, তার জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে কাল সকাল নাগাদ ঠেলে উঠেছে৷ লজ্জায় এ-কথা কারো কাছে এমনিই বলতে পারত না—তার ওপর যে পুলিসের ভয় দিইছি ঢুকিয়ে বুড়োর মাথায়—দেখবে যে রা কাটবে না কারো কাছে৷ এক ঢিলে দুই পাখি সাবাড়৷

.

দমদমার বাগানবাড়ি থেকে বার হয়ে কেদার পুঁটুলি হাতে হনহন করে পথে চলতে লাগলেন৷ হাতে পয়সার সচ্ছলতা নেই—খরচের দরুন যা কিছু ছিল, তা নিতান্তই সামান্য৷ তা ছাড়া কেদার এখনও কোথায় যাবেন না যাবেন ঠিক করে উঠতে পারেন নি—এখন তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য, তাঁর ও কলকাতা শহরের মধ্যে অতি দ্রুত ও অতি বিস্তৃত একটি ব্যবধান সৃষ্টি করা৷ এই ব্যবধান যত বড় হবে, যত দূরে গিয়ে তিনি পড়তে পারবেন—তাঁর মেয়ে তত নিরাপদ৷

সুতরাং পিছন ফিরে না চেয়ে এখন শুধু হেঁটেই যেতে হবে…হেঁটেই যেতে হবে৷ মেয়ের বিপদ না ঘটে…শুধু হাঁটতেই হবে৷ কিসের বিপদ মেয়ের, তা কেদারের ভাবার সময় বা অবসর নেই৷ মেয়ে যে খুব নিরাপদ আছে কি নেই—সে-সব ভাবনারও সময় নেই এখন৷ শুধু হাঁটতে হবে, কলকাতা থেকে দূরে গিয়ে পড়তে হবে৷ প্রভাস ও গিরীন যেমন রেগে গিয়েছে, ওরা শোধ তুলে হয়তো ছাড়বে অরুণের ওপর৷ মোটরে করে এসে তাঁকে রাস্তা থেকে জোর করে নিয়ে না যায়!

ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, ক্লান্তি নেই, পরিশ্রম নেই, শুধু পথ বেয়ে চলা—যতদূর যাওয়া যায়৷

সন্ধ্যার সময় দমদমা থেকে সাত মাইল দূর যশোর রোডের ধারে গাছতলায় বসে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে দু-চারজন পথিকের ভিড় জমে গেল৷

একজন বললে, কি হয়েছে মশায়?

আর একজন বললে, বাড়ি কোথায় আপনার? কি হয়েছে?

লোকজনের মধ্যে বেশির ভাগ চাষী লোক, দুজন দমদমায় এইচ-এম-ভি গ্রামোফোন কোম্পানির কারখানায় কাজ করে, ছুটির পর সাইকেলে গ্রামে ফিরছিল৷ তাদের একজন এগিয়ে এসে বললে—কি হয়েছে মশাই? আমিও ব্রাহ্মণ, আসুন আমার বাড়ি—এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়ে গরানহাটি কেশবপুরে আমার বাড়ি—

কেদার বললেন, না, ও কিছু না—আমি এখন হেঁটে যাব—

—কাঁদছেন কেন, কি হয়েছে আপনার বলতেই হবে—আসুন আপনি দয়া করে৷ এ অন্ধকার রাত্রে একা যাবেন কোথায়?

কেদার কাকুতি মিনতির সুরে বললেন, না বাবু, আমি যাব না৷ আমার কিছুই হয় নি—এই গিয়ে মাঝে মাঝে পেটে ফিকব্যথা ধরে কিনা৷ ও কিছু নয়, এক্ষুনি সেরে যাবে—সেরে গিয়েছে অনেকটা৷

কেদার পুঁটুলি নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে উঠে বারাসাতের দিকে রওনা দিলেন পথ ধরে৷

সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে৷

ওদের মধ্যে একজন মুচকি হেসে বললে, পাগল—পাগল ও, দেখেই চেনা যায়৷ পাগল—

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে পথে রাত এল৷ অন্ধকার রাত৷ কেদারের দৃকপাত নেই—কোথায় যাচ্ছেন তা তিনি এখনও জানেন না৷ মাঝে মাঝে মোটরের হর্ন বাজে পেছন থেকে, মালবোঝাই লরি যশোর রোড বেয়ে বারাসাত কি বনগাঁয়ে মাল নিয়ে চলেছে—কেদার হর্ন শুনলেই পথের ধারের গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়েন, প্রভাসদের মোটর তাঁর সন্ধানে পুলিস নিয়ে বেরিয়েছে কিনা কে জানে! সারাদিন পেটে কিছু যায় নি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কেদার এখন আহারের কোনো প্রয়োজন পর্যন্ত অনুভব করছেন না৷ শরীর এবং মন যেন তাদের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে একটিমাত্র অনুভূতিতে পর্যবসিত হয়েছে, সেটা সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তীক্ষ্ণ ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ অন্য কিছু নয়—কন্যার উপর তাঁর গভীর স্নেহ ও একটি অদ্ভুত করুণা৷ শরৎ যেন ছাব্বিশ বছরের যুবতী নেই, তাঁর মনোরাজ্যে সে কখন শিশু মেয়েটি হয়ে ফিরে এসেছে, যে গড়শিবপুরের বাড়িতে জঙ্গলের ধারে কুচফল তুলে খেলা করত—তার খেলাঘরে ধুলোর ভাত ও পাথরকুচি পাতা মাছ খেতে হয়েছে বসে বসে৷ তার এখনও কি বুদ্ধিই বা হয়েছিল, চিরকাল পাড়াগাঁয়ে কাটানোর ফলে শহরের ব্যাপারে কি বা সে বোঝে!

একবার ভাবলেন, কলকাতায় ফিরে গিয়ে পাশের বাগানের চাটুজ্জে মশায়ের কাছে সব কথা ভেঙে বলে তাঁর সাহায্য চাইলে কেমন হয়? কিন্তু পুলিসের আইন বড় কড়া৷ সেখানে চাটুজ্জে মশায় কতটুকু সাহায্য করতে পারবেন? বিশেষ করে এমন একটা কথা তিনি চাটুজ্জে মশায়কে খুলে বলতে পারবেন? তবে কথা গোপন থাকবে না৷ ওই ঝিটা এতক্ষণ কথাটা পাড়াময় রাষ্ট্র করেছে—ঝি কি আর এতক্ষণ এ কথা না জেনেছে! ওই প্রভাস ও গিরীনই তাকে সব কথা প্রকাশ করে বলেছে এতক্ষণ৷ না, সেখানে আর ফিরবার উপায় নেই—এখন তো নয়ই, এর পর—কত পরে তা তিনি এখনও জানেন না—যা হয় একটা কিছু করবেন তিনি৷

বারাসাতের বাজারে পৌঁছে কেদারের ইচ্ছে হল এখানে চা কিনে খান দোকান বেছে—রাস্তার ধারেই অনেকগুলো চায়ের দোকান৷ আজ শরৎ নেই সঙ্গে যে তাঁকে দোকানের চা খেতে বাধা দেবে, যে তাঁকে ইহকালের অনাচার থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রেখে তাঁর পরকালের মুক্তির পথ খোলসা করবার জন্যে সচেষ্ট ছিল চিরদিন—আজ সে নির্মমভাবে সমস্ত অনাচারের স্বাধীনতা দিয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে—সুতরাং অনাচার তিনি করবেনই৷ যা হয় হবে, পরকাল তিনি মানেন না৷ আরও জোর করে, ইচ্ছে করে তিনি যা খুশি অনাচার করবেন কে দেখবার আছে তাঁর?

রাস্তার ধারের দোকান থেকে এক পেয়ালা চা খেয়ে কেদার আবার হনহন করে রাস্তা হাঁটতে লাগলেন—সারারাত ধরে পথ চলে সকালের দিকে দত্তপুকুর থেকে কিছু দূরে একটা গ্রামে এসে পথের ধারেই বসে পড়লেন৷ আর তিনি ক্ষুধা ও পথশ্রম-ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না৷

জনৈক গ্রাম্য লোক সকালে গাড়ু হাতে মাঠ থেকে ফিরে আসছিল, তাঁকে এ অবস্থায় দেখে বললে—কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

—আজ্ঞে বারাসাত থেকে৷

কেদার একটু মিথ্যে কথার আমদানি করলেন, লোককে সন্ধান দেওয়ার দরকার কি, তিনি কোথা থেকে আসছেন?

লোকটি আবার বললে, তা এখানে বসে এমন ভাবে?

—একটু বসে আছি, এইবার উঠি৷

—আপনারা?

—ব্রাহ্মণ৷

—আজ্ঞে প্রাতঃপ্রণাম৷ আমার নাম হরিহর ঘোষ, কায়স্থ—আপনি যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা বলি! আমার বাড়ি এবেলা দয়া করে পায়ের ধুলো দিয়ে দুটি সেবা করে যান৷ আমরাও প্রসাদ পাব এখন৷ চলুন উঠুন৷

কেদার কিছুতেই প্রথমটা রাজি হন নি—কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে লোকটার কেমন দয়া ও সহানুভূতির উদ্রেক হয়েছিল, সে পীড়াপীড়ি করে তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল৷ কেদার দেখলেন লোকটি সম্পন্ন অবস্থার গ্রাম্য গৃহস্থ, বাইরে বড় চণ্ডীমণ্ডপ, অনেকগুলো ধানের মরাই, বাড়ির সামনে একটা পানাভরা ডোবা৷ সেই ছোট পানাভরা ডোবার আবার একটা ঘাট বাঁধানো দেখে দুঃখের মধ্যেও কেদার ভাবলেন—এদের দেশে এর নাম পুকুর, এর আবার বাঁধা ঘাট! এদের নিয়ে গিয়ে গড়ের কালো পায়রার দিঘিটা একবার দেখিয়ে দিতে হয়—

ভালো লাগল জায়গাটা তবুও৷ কেদার সারাদিন রইলেন, সন্ধ্যার সময় বিদায় নিতে চাইলে গৃহস্বামী আপত্তি করে বললে—তা হবে না ঠাকুরমশায়৷ সামনে অন্ধকার রাত, আপনাকে কি ছেড়ে দিতে পারি এখন? থাকুন না এখানে দুদিন৷

ইতিমধ্যে কেদার নিজের একটা মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন৷ তিনি গরিব ব্রাহ্মণ৷ গোবরডাঙার জমিদারবাড়িতে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করতে চলেছেন৷

লোকটা তাই বললে, দুদিন থাকুন, দেখি যদি আমাদের এখান থেকে আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারি৷ আমি দুপুরবেলা দু-একজনকে আপনার কথা বলেছি—সকলেই কিছু কিছু দিতে রাজি হয়েছে৷

কেদার বিপদে পড়লেন৷ তিনি গড়শিবপুরের রাজবংশের লোক, কারো কাছে হাত পেতে কখনো কিছু নিতে পারবেন না ওভাবে—যতই অভাব থাকুক৷ নিজেকে গরিব ব্রাহ্মণ বলে তিনি যে মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন৷

রাত্রিটা অগত্যা থেকে যেতে হল৷ পরদিন সকালে তিনি যখন আবার বিদায় চাইলেন, গৃহস্বামী তিনটি টাকা তাঁর হাতে দিতে গেল৷ বললে—এই উঠেছে ঠাকুরমশায়, মিত্তির মশায় দিয়েছেন এক টাকা আর আমি সামান্য কিছু—এই নিয়ে যান—

কেদার বিনীত ভাবে বললেন, আমি ও নিতে পারব না—

ঘোষ মশায় আশ্চর্য হয়ে বললে, নেবেন না? কেন?

—আজ্ঞে—ইয়ে—ও আমার দরকার নেই৷

ঘোষ মশায় তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বললে, এর চেয়ে বেশি উঠল না যে ঠাকুরমশায়! না হয় আমি আর একটা টাকা—

কেদার বললেন, না—না—আপনি অতি মহৎ লোক, যা করেছেন তা কেউ করে না৷ কিন্তু আমি—আমি নিতে পারব না৷ আমি আপনাকে এমনিই আশীর্বাদ করছি—আপনি ধনেপুত্রে লক্ষ্মীশ্বর হোন—ভগবান আপনাদের সুখে রাখুন—

কেদারের চোখে জল দেখে গৃহস্বামী বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইল, তার পরে উঠে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললে—আচ্ছা, আপনি ঠিকমতো পরিচয় দেন নি বোধ হয়৷ এ বাজারে চার টাকা ছেড়ে দেয় এমন লোক আমি দেখি নি—বলুন আপনি কে—কি হয়েছে আপনার—

কেদার উদগত অশ্রু কোনোমতে চেপে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় উঠতে উঠতে বললেন—কিছু হয় নি, কিছু হয় নি৷ আমি আসি, আমার বিশেষ দরকার আছে—কিছু মনে করবেন না—

গৃহস্বামী টাকাটা হাতে করে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

সেদিন সারাদিন অনবরত পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার পর কেদার গড়শিবপুর থেকে ছয় ক্রোশ দূরে হলুদপুরের বাজারে পৌঁছলেন৷ এখানে কেউ তাঁকে চিনতো না—চার ক্রোশ দূরের এ বাজারে তাঁর যাতায়াত বিশেষ ছিল না৷ না চেনে সে খুব ভালো৷ একটা পুকুরের বাঁধা ঘাটের চাতালে এসে বসলেন, এতদূর পর্যন্ত চলে এসেছেন কিসের ঝোঁকে, কিছু বিবেচনা না করেই, এইবার তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—কোথায় যাবেন তিনি? গাঁয়ে ফেরা কি উচিত হবে? মেয়ের কথা লোকে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবেন তিনি? কেদারের উদভ্রান্ত মন এ দু-দিন এসব কথা ভাববার অবকাশ পায় নি৷

০৫. শরতের ভালো ঘুম হল না

রাত্রে শরতের ভালো ঘুম হল না, অচেনা জায়গা, ভালো ঘুম হবার কথা নয়, দেশের বাড়ি ছেড়ে এসে পর্যন্তই তার ঘুম তেমন হয় না৷ কিন্তু কাল রাত্রে কি জানি কেমন হল, বাবার কথা মনে হয়েই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক—শরৎ প্রথম দিকে তো চোখের পাতা একটুও বোজাতে পারে নি৷

প্রভাসের বৌদিদি তার পাশে শুয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল৷ এত শব্দ এত আওয়াজের মধ্যে মানুষ পারে ঘুমুতে? মোটরগাড়ি যাচ্ছে, লোকজনের কথাবার্তা চলেছে—ভালো রকম অন্ধকার হয় না, জানলা দিয়ে কোথা থেকে আলো এসে পড়েছে দেওয়ালের গায়ে—আর সারারাতই কি লোক-চলাচল করবে আর গান-বাজনা চলবে? এখানে এতও গানবাজনা হয়! ডুগি-তবলার শব্দ, হারমোনিয়মের আওয়াজ, মেয়ে-গলার গান চলেছে আশেপাশের সব বাড়ি থেকে৷ দমদমার বাগানবাড়িতে থাকতে সে বুঝতে পারে নি আসল কলকাতা শহর কি৷ এখন দেখা যাচ্ছে এখানকার তুলনায় দমদমার বাগানবাড়ি তাদের গড়শিবপুরের জঙ্গলের সমান৷

ভোরে উঠে সে গঙ্গাস্নান করে আসবে—এখান থেকে গঙ্গা কতদূর কে জানে? প্রভাসদাকে বললে মোটরে নিয়ে যাবে এখন৷ সকালে প্রভাসের বৌদিদির ডাকে তার ঘুম ভাঙল৷ জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে বিছানায়৷ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে নাকি তবে? ওর মুখে কেমন ধরনের ভয় ও উৎকণ্ঠার চিহ্ন প্রভাসের বৌদিদির চোখ এড়ালো না৷

সে বললে, ভাবনা কি দিদি, দেরিতে উঠেছ, তাই কি—তোমার উঠে আপিস করতে হচ্ছে না তো আর৷ মুখ ধুয়ে নাও, চা হয়ে গিয়েছে—

শরৎ লজ্জিত মুখে জানালে এত সকালে সে চা খায় না৷ তার চা খাওয়ায় কতকগুলো বাধা আছে—স্নান করতে হবে, কাপড় ছাড়তে হবে—সে-সব হাঙ্গামায় এখন কোনো দরকার নেই, থাকগে৷ গঙ্গা এখান থেকে কতদূর? একবার গঙ্গায় নাইতে যাবার বড় ইচ্ছে তার৷ প্রভাসদা কখন আসবে?

প্রভাসের বৌদি বললে, গঙ্গা নাইবে? চল না আমাদের—আচ্ছা, দেখি বোসো৷ ওরা আসুক সব—

—কখন আসবে? আসতে বেশি দেরি করবে না তো প্রভাসদা?

—কি জানি ভাই! তবে দেরি হওয়ার কথা নয় তো, এখুনি আসবে—

—গঙ্গা নেয়ে এসে আমি বাবার কাছে যাব—আমায় রেখে আসুক—

—সে কি ভাই? এ-বেলাটা থাকবে না এখানে? থেকে খাওয়াদাওয়া করে ওবেলা—

শরৎ চিন্তিত মুখে বললে, কাল রাতে গেলাম না, বাবা কত ভেবেছেন৷ আমার কি থাকবার জো আছে যে থাকব?

প্রভাসের বৌদিদি বললে, ওবেলা চলো ভাই সিনেমা দেখে দুজনে—

—কি দেখে?

—সিনেমা—মানে বায়োস্কোপ টকি—

—ও—

—দেখে চলো আমরা যশোর রোড দিয়ে মোটরে বেড়িয়ে আসব৷ চাঁদের আলো আছে—

শরৎ হেসে বললে, মোটে একাদশী গেল বুধবারে, এরই মধ্যে চাঁদের আলো কোথায় পাবেন? আপনারা কলকাতার লোক, আপনাদের সে খবরে কোনো দরকার নেই—ওখানে সারারাতই গ্যাসের আলো—ইলেকট্রিক আলো—

ঈষৎ অপ্রতিভের সুরে প্রভাসের বৌদিদি বললে, তা বটে ভাই, যা বলেছ৷ ওসব খেয়াল থাকে না৷

এমন সময় পাশে কমলাদের ঘর থেকে জড়িত স্বরে কে বলে উঠল—আরে ও হেনা বিবি, এদিকে এসো না চাঁদ, আলোর সুইচটা যে খুঁজে পাচ্ছি নে—ও হেনা বিবি—

প্রভাসের বৌদিদি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, আ মরণ, বেলা সাড়ে সাতটা বাজে—উনি আলোর সুইচ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখন—

শরৎ বললে, কি হয়েছে, কে উনি?

—কে জানে কে? মাতালের মরণ যত—পাশের বাড়ির এক বুড়ো৷ রোজ ভাই অমনি করে—

শরৎও হেসে ফেললে মাতাল বুড়োটার কথা ভেবে৷ বললে, ডাকছে কাকে? ও যেন পাশের ঘর থেকে কথা বললে বলে মনে হল—না?

—ওই পাশের বাড়ি, দোতলার জানলাটা খোলা রয়েছে দেখছ তো, ওই ঘর৷ দাঁড়াও আসছি—

শরৎ শুনলে বুড়ো মাতালটা হঠাৎ ‘এই যে হেনা বিবি, বলিহারি যাই! বলি সার্সি জানলা বন্ধ করে’—এই পর্যন্ত চেঁচিয়ে বলে উঠেই চুপ করে গেল৷ কে যেন তার মুখে থাবা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলে৷ কিছুক্ষণ পরে কমলাও ঘরে ঢুকল৷ শরৎ হাসিমুখে বলে উঠল—এসো ভাই গঙ্গাজল এসো—তোমাকেই খুঁজছি—গঙ্গা নাইতে চলো না কেন যাই সবাই মিলে?

কমলা সত্যিই সুন্দরী মেয়ে৷ ঘুম ভেঙে সদ্য উঠে এসেছে, আলুথালু চুলের রাশ খোঁপার বাঁধন ভেঙে ঘাড়ে পিঠে এলিয়ে পড়েছে, বড় বড় চোখে অলস দৃষ্টি, মুখের ভাবেও জড়তা কাটে নি—বেশ ফর্সা নিটোল হাত দুটি কেমন চমৎকার ভঙ্গিতে ঘাড়ের পেছনে তুলে ধরে এলোচুল বাঁধবার চেষ্টা করছে৷ আসলে বাঁধার ছলে একটা কায়দা মাত্র, চুল বাঁধবার চেয়ে ওই ভঙ্গিটা দেখাবার আগ্রহটাই ওখানে বেশি৷ শরতের হাসি পায়—ছেলেমানুষ কমলা!

শরৎ এসব বোঝে৷ সেও এক সময়ে সুন্দরী কিশোরী ছিল, ওই কমলার মতো বয়সে, সে জানে নিজেকে ভালো দেখানো কত খুঁটিনাটি আগ্রহ অকারণে মেয়েদের মনে জাগে৷ তারও জাগত৷ এসব শিখিয়ে দিতে হয় না, বলে দিতে হয় না মেয়েদের৷ আপনিই জাগে৷ শরতের কেমন স্নেহ হয় কমলার ওপর৷ স্নেহের সুরেই বলে—ভাই, চমৎকার দেখাচ্ছে তোমায় গঙ্গাজল—

—সত্যি?

—সত্যি বলছি৷

কমলার মুখে লজ্জার আভাস নেই, সে যে পথে পা দিয়েছে, সে পথের পথচারিণীরা লজ্জাবতী লতা নয়, বনচাঁড়ালের পাতা—টুসি দিলে নাচে৷ কমলা হেসে বললে, আপনার ভালো লাগে?

—খুব ভাই—খুব—

—তবে তো আমার ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো—এদিকে আবার গঙ্গাজল পাতিয়েছি—

কমলার কথার নির্লজ্জ সুর শরতের কানে বাজল৷ সে মনে মনে ভাবলে, মেয়েটি ভালো, কিন্তু অল্পবয়সে একটু বেশি ফাজিল হয়ে পড়েছে৷ আমি ওর চেয়ে কত বড়, মা না হলেও কাকি-খুড়ির বয়িসী—আমার সঙ্গে কেমন ধরনের কথা বলছে দ্যাখো—

কমলা বললে, আপনি চা খেয়েছেন?

শরৎ হেসে বললে, না ভাই, আমি বিধবা মানুষ, নাই নি, ধুই নি—এখুনি চা খাব কি করে? চা খাওয়ার কোনো তাড়াতাড়ি নেই আমার৷ এখন গঙ্গা নাইবার কি ব্যবস্থা হয় বলো তো?

—চলুন না হেঁটে গিয়ে নেয়ে আসি৷ এই তো আহিরীটোলা দিয়ে গেলে সামনেই গঙ্গা—

প্রভাসের বৌদিদি ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে পেছন থেকে গিরীন ডাকলে—ও হেনা বিবি—

হেনা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বললে, কখন এলে? কি ব্যাপার? ওদিকে—

গিরীন চোখ টিপে বললে, আস্তে৷

হেনা এবার গলার সুর নিচু করে বললে, কি হল?

—এখনো হয় নি কিছু৷ আমরা এখনো বুড়োর কাছে যাই নি৷ বেশি বেলা হলে যাব৷ এদিকের খবর কি?

হেনা রাগের সুরে বললে, তোমরা আমায় মজাবে দেখছি৷ এখনও সে কিছু খায় নি, এ বাড়ি এসে পর্যন্ত দাঁতে কুটো কাটে নি৷ না খেয়ে ও কতক্ষণ থাকবে, ও আপদ যেখানে পারো বাপু তোমরা নিয়ে যাও৷ আমার টাকা আমায় চুকিয়ে দাও, মিটে গেল গোলমাল৷ না খেয়ে মরবে নাকি শেষটা—তার পর এদিকে হরি সা যা কাণ্ড বাধিয়েছিল! হেনা বিবি বলে ডাকাডাকি! সারারাত কমলির ঘরে বসে মদ খেয়েছে—এই একটু আগে কি চেঁচামেচি৷ মেয়েটা যাই একটু সরল গোছের, কোনোরকমে তাকে বুঝিয়ে দিলাম, পাশের বাড়িতে একটা মাতাল আছে তারই কাণ্ড, বিশ্বাস করেছে কিনা কে জানে—

গিরীন হাসিমুখে বললে, ভয় কি তোমার হেনা বিবি, রাত যখন এখানে কাটিয়েছে তখন ওর পরকাল ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে৷ ওর সমাজ গিয়েছে, ধর্ম গিয়েছে৷ ওর বাবার কাছে সেই কথাই বলতে যাচ্ছি—

—কি বলবে?

—সে-সব বুদ্ধি কি তোমাদের আছে? গিরীনের কাছ থেকে বুদ্ধি ধার করে চলতে হয় সব ব্যাটাকে৷

—গালাগাল দিয়ো না বলছি—

—গালাগাল তোমাকে তো দিই নি হেনা বিবি, চটো কেন? তার পর শোনো৷ সন্দে অবধি রেখে দাও৷ সন্দের আগে আবার আমরা আসব৷

—টাকা নিয়ে এসো যেন৷

—অত অবিশ্বাস কিসের হেনা বিবি? নতুন খদ্দেরের কাছে তাগাদা করো, আমাদের কাছে নয়৷

—আচ্ছা, কথায় দরকার নেই—যাও এখন৷ আমি দেখি গে, কমলিটা ছেলেমানুষ—কি বলতে কি বলে বসে—ওকে সামলে নিয়ে চলতে হচ্ছে আবার—

হেনা ঘরে ঢুকে দেখলে শরৎ ও কমলা চুল খুলে তেল মাখতে বসেছে৷ বললে—ও কি? নাইতে যাবে নাকি ভাই?

কমলা বললে, গঙ্গাজলকে নিয়ে নেয়ে আসি—

হেনা প্রশংসার দৃষ্টিতে শরতের সুদীর্ঘ কালো কেশপাশের দিকে চেয়ে বললে, কি সুন্দর চুল ভাই তোমার মাথায়! এমন চুল যদি আমাদের মাথায় থাকত—

কমলা বললে, আমিও তাই বলছিলাম গঙ্গাজলকে—

শরৎ সলজ্জ স্বরে বললে, যান, কি যে সব বলেন! গঙ্গাজলের মাথায় চুল কি কম সুন্দর? দেখুন দিকি তাকিয়ে? তা ছাড়া আমার লম্বা চুলের কি দরকার আছে ভাই? বাবা কিছু পাছে মনে করেন তাই—নইলে ও চুল আমি এতদিন বঁটি দিয়ে কেটে ফেলতাম৷ শুধু বাবার মুখের দিকে চেয়ে পারি নে৷ তাঁর চোখ দিয়ে যাতে জল পড়ে, তাতে আমার ধর্ম নেই৷

হেনা এ পথের পুরাতন পথিক, তার মন কোমল হৃদয়-বৃত্তির ধার ধারে না অনেক দিন থেকে—যা কিছু ছিল তাও পাষাণ হয়ে গিয়েচে চর্চার অভাবে, শরতের কথায় তার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত হল না—কিন্তু কমলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷

হেনা বললে, কমলা, এঁকে গঙ্গায় নিয়ে যাবি? কেন, বাড়িতে চান করে না? বেলা হয়ে যাবে!

শরতের দিকে চেয়ে বললে, সে তুমি যেয়ো না ভাই, ও ছেলেমানুষ, পথ চেনে না—কোথায় যেতে কোথায় নিয়ে যাবে!

কমলা বললে, বা রে, আমি বুঝি আর—সেবার তো আমি—

হেনা কমলাকে চোখ টিপে বললে, থাম বাপু তুই৷ তুই ভারি জানিস রাস্তা-ঘাট৷ তার পর দিদিকে নিয়ে যেতে একটা বিপদ হোক রাস্তায়! যে গুণ্ডা আর বদমাইশের ভিড়—

শরৎ বললে, সত্যি নাকি ভাই, বলুন না?

—আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি—ও ছেলেমানুষ, কি জানে?

এইবার কমলা বললে, না—তা—হ্যাঁ আছে বটে৷

—কি আছে ভাই গঙ্গাজল?

কমলাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বললে, কি নেই কলকাতা শহরে বলতে পারো? সব আছে৷ আজকাল আবার সোলজারগুলো ঘুরে বেড়ায় সর্ব জায়গায়৷

—সে আবার কি?

—সোলজার মানে গোরা সৈন্য৷ এরা যে অঞ্চলে আছে, তার ত্রিসীমানায় মেয়েমানুষের যাওয়া উচিত নয়৷ না, তুমি যেয়ো না ভাই৷ আমি তোমায় যেতে দিতে পারি নে৷ তোমার ভালো-মন্দর জন্যে আমি দায়ী যখন৷ প্রভাস-ঠাকুরপো আমার হাতে তোমায় যখন সঁপে দিয়ে গিয়েছে৷

কমলা বললে, আমরা তেল মাখলাম যে!

—তেল মেখে বাড়ির বাথরুমে ওঁকে নিয়ে চান করো৷ মিছিমিছি কেন ওঁকে বিপদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া?

আড়ালে নিয়ে গিয়ে কমলাকে হেনা খুব বকলে৷ প্রভাসের কাছ থেকে সেও টাকা নেবে যখন, তখন এতটুকু বুদ্ধি নিয়ে কাজ করলে কি চলে না? বাড়ির মধ্যেই ওকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, একবার বাইরের রাস্তায় পা দিলে আর সামলানো যাবে না ওকে৷ এত কম বুদ্ধি কেন কমলার! হরি সা লোকটাকে কাল রাত্রে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে কি কোম্পানির রাজ্য অচল হত? সামলে না নিলে সব কথা ফাঁস হয়ে যেত যে আর একটু হলে! ঘটে বুদ্ধি হবে কবে তার?…ইত্যাদি৷

কমলা গুরুজন-কর্তৃক-তিরস্কৃতা-বালিকার ন্যায় চুপ করে রইল৷

হেনা বললে, তুমি আর ওঘরে যেয়ো না৷ আমি করছি যা করবার—তুমি যাও৷ হরি সা যেন এখন আর না ঢোকে—

হেনা ঘরে ঢুকে শরৎকে বললে, গঙ্গায় যাওয়া হবে না ভাই৷ পথে আজকাল বড় গোলমাল, তুমি বাথরুমে নেয়ে নাও, আমি সব যোগাড় করে রেখে এলাম—

স্নান করে আসবার কিছু পরে হেনা শরৎকে বললে, তোমার খাওয়ার কি করব ভাই? আমাদের রান্না চলবে না তো?

—আমার খাওয়ার জন্যে কি ভাই! দুটো আলোচাল আনুন, ফুটিয়ে নেব৷

—মাছমাংস চলে না—না? গাঁ থেকে এসেছ, এখন চলুক না, কে আর দেখতে আসছে ভাই?

প্রভাসের বৌদিদির এ কথায় শরৎ বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ে নয় বটে, কিন্তু হিন্দু তো—সে একজন ব্রাহ্মণের বিধবাকে একথা বলতে পারলে কি করে? অন্য জায়গায় এ ধরনের কথা বললে শরৎ নিজেকে অপমানিতা বিবেচনা করত, তবে এরা কলকাতার লোক, এদের কথা স্বতন্ত্র৷

হেনা মনে মনে বললে, বাপ রে, দেমাক দ্যাখো আবার! কথা বলেছি তো ওঁর গায়ে ফোস্কা পড়েছে! তোমার দেমাক আমি ভাঙব, যদি দিন পাই—কত দেখলাম ওরকম, শেষ পর্যন্ত টিকল না কোনোটা!

শরৎ বিকেল থেকে কেবল দমদমায় ফেরবার জন্যে তাগাদা করতে লাগল৷ হেনা ক্রমাগত বুঝিয়ে রাখে, ওরা এখনো আসছে না, এলেই পাঠিয়ে দেবে৷ শরৎ তো জলে পড়ে নেই—এর জন্যে ব্যস্ত কি?

কমলার দেখা নেই অনেকক্ষণ ধরে৷ শরৎ বললে, গঙ্গাজল কই, তাকে দেখছি নে—

হেনা কমলাকে সরিয়ে দিয়েছিল, কাঁচা লোক, কখন কি বলে বসবে, করে বসবে,—সব মাটি হবে৷ তা ছাড়া কমলার ঘরে এমন সব জিনিসপত্র আছে, যা দেখলে শরতের মনে সন্দেহ হতে পারে৷ হরি সা’র একটা বিছানা, আলমারিতে তার দাড়ি কামানোর আসবাব, বড় নল লাগানো গড়্গড়া ইত্যাদি৷ মদের বোতলগুলো না হয় পাড়াগাঁয়ের মেয়ে না বুঝতে পারলে—কিন্তু পুরুষের বাসের এসব চিহ্নের জবাবদিহি দিয়ে মরতে হবে হেনাকে!

বিকেলের দিকে হেনা বললে, চলো ভাই, টকি দেখে আসি—

—সে কোথায়?

—চৌরঙ্গীতে চলো, শ্যামবাজারে চলো—

—বাবার কাছে কখন যাবে? ওরা কখন আসবে?

—চলো, টকি দেখে দমদমায় তোমায় রেখে আসব—

শরৎ তখুনি রাজি হয়ে গেল৷ টকি দেখবার লোভ যে তার না হয়েছিল তা নয়৷ বিশেষ করে টকি দেখেই যখন বাবার কাছে যাওয়া হচ্ছে তখন আর গোলমাল নেই এর ভেতর৷

কিন্তু হেনার আসল উদ্দেশ্য কোনো রকমে ওকে ভুলিয়ে রাখা৷ টকি দেখবার জন্যে গাড়ি ডাকতে গিয়েছে বলে দেরি করিয়ে সে প্রায় সন্ধ্যা করে ফেললে৷ শরৎ ব্যস্ত হয়ে কেবলই তাগাদা দিতে লাগল—কখন গাড়ি আসবে, কখন যাওয়া হবে৷ হেনাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, এদের কারো দেখা নেই—পোড়ারমুখো গিরীনটা লম্বা লম্বা কথা বলে, তারও তো চুলের টিকি দেখা যাচ্ছে না, গিয়েছে সেই সকাল বেলা! যা করবি করগে বাপু, টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে এ আপদ তোরা যেখানে পারিস নিয়ে যা, তার এত ঝঞ্ঝাটে দরকার কি? এদিকে একে আর বুঝিয়ে রাখা যায় না৷

.

সন্ধ্যার পরে গিরীন এসে নীচের তলায় হেনাকে ডেকে পাঠালে৷

হেনা তাড়াতাড়ি নেমে এসে বললে, কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করি তোমাদের? আমার ঘাড়ে যে চাপিয়ে দিয়ে গেলে এখন আমি করি কি? ও যে থাকতে চাইছে না মোটে৷ কোথায় নেবে নিয়ে যাও না, আমি কতকাল ভুলিয়ে রাখব? আমার থিয়েটার আছে কাল৷ কাল ওকে কার কাছে রাখব? ওদিকে কদ্দূর করলে?

গিরীন তুড়ি দিয়ে গর্বের সুরে বললে, সব ঠিক৷

—কি হল?

—বুড়োকে ভাগিয়েছি৷ সে বলব এখন পরে৷ সে পুঁটুলি নিয়ে বুঝলে—হি-হি-হি—

—কি বলো না?

—পুঁটুলি নিয়ে ভেগেছে, হি-হি—ঝি চিঁড়ে আনতে গিয়েছে আর সেই ফাঁকে হি-হি—পুলিসের এ্যায়সা ভয় দেখিয়ে দিইছি, বুড়োটা আর এমুখো হবে না!

—বেশ, এখন নিয়ে যাও—

—দ্যাখো, ওকে একটু ভুলোও-টুলোও৷ পাড়াগাঁয়ে গরিব ঘরে থাকত, সুখ আমোদ-আহ্লাদের মুখ দেখে নি৷ গয়নাগাঁটি কাপড়-চোপড়ের লোভ দেখাবে—

—ওরে বাপ রে, বলেছি তো ও মেয়ে তেমন না৷ একটুখানি মাছমাংস খাওয়ার কথা বলেছিলাম তো অমনি ফোঁস করে উঠল—আর কেবল হা বাবা যো বাবা—

—তবে আর তোমার কাছে দিয়েছি কেন হেনা বিবি? পাকা লোকের কাছে রেখেছি, আজ রাতটা রেখে দাও, রেখে যা পারো করো৷ আজ আর নিয়ে যাই কোথায়? এখনো কিছু ঠিক করি নি৷ প্রভাসের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, প্রভাস বাড়ি থেকে বেরুতে পারছে না৷ অরুণ আজ নাইট-ডিউটি করবে আপিসে৷ আমি একা—

—কেন, তুমি একাই একশো বলে যে বড্ড গোমর করো! লম্বা লম্বা কথা বলবার সময় হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা—এখন কাজের সময়ে হেনা বিবি তুমি করো৷ আরও টাকা চাই তা বলে দিচ্ছি—

—যাহোক, যা বললাম আজকার রাতটা তো রাখো—

—ও টকি দেখতে যাবে বলছিল, নিয়ে যাব?

—দরকার নেই৷ বাড়ির বার করবার হ্যাঙ্গামা অনেক৷ ভুলিয়ে রাখো৷

—কাল সকালে এসো বাপু৷ কাল আমার থিয়েটার, আমার দ্বারা কাল কোনো কাজ হবে না বলে দিচ্ছি—

হেনা মুখ চুন করে শরতের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে, বড় মুশকিল! প্রভাস-ঠাকুরপোর বাবার বড় অসুখ, এখন যান তখন যান! হঠাৎ অসুখ হয়ে পড়েছে—এই মাত্তর খবর দিয়ে পাঠিয়েছে৷

শরৎ উদ্বেগের সুরে বললে, অসুখ! তা বয়সও তো হয়েছে—বাবা বলেন তাঁর চেয়ে দশ-বারো বছরের বড়!

—তা তো বুঝলুম৷ এদিকে এখন উপায়!

—আজ কি দমদমা যাওয়া হবে না?

—কি করে আর যাওয়া হচ্ছে বলো ভাই৷ প্রভাস-ঠাকুরপোর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না তো—

—কেন ভাড়াটে গাড়ি?

—কে নিয়ে যাবে? তুমি আমি দুই মেয়েমানুষ, ভাড়াটে গাড়িতে ভরসা করে যাওয়া চলবে না৷ কাল সকালেই যা হয় ব্যবস্থা হবে৷

শরৎ অগত্যা রাজি হল৷ না হয়ে উপায় যখন নেই৷

.

সন্ধ্যার পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে হেনা গিয়ে ছাদে উঠল৷ চারদিকে আলোর কুরকুট্টি, নিচের রাস্তা দিয়ে সারবন্দী গাড়ি ঘোড়া, মোটর, কর্মব্যস্ত জনস্রোত, ফিরিওয়ালারা কত কি হেঁকে যাচ্ছে, বেলফুলের মালাওয়ালা ‘চাই বেলফুলের গোড়ে’ বলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকছে, শরৎ মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷

বললে, সত্যি শহর বটে কোলকাতা! জায়গার মতো জায়গা একথা ঠিক! কি লোকজন, কি আলোর বাহার! আমাদের গাঁ এতক্ষণ অন্ধকার হয়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে জঙ্গলে৷

হেনা অবসর বুঝে অমনি বললে, আমিও তো তাই বলি, এখানেই কেন থেকে যাও না? সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, সুখে থাকবে, খাও-দাও, আমোদ-আহ্লাদ করে বেড়াও—

শরৎ হেসে বললে, তা তো বুঝলাম৷ আমার ইচ্ছে করে না যে তা নয়, কিন্তু চলবে কি করে? বাবা গরিব মানুষ—

হেনা উৎসাহের সুরে বললে, সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে এখন৷ তুমি রাজি হয়ে যাও ভাই—

—কি বন্দোবস্ত হবে? বাবার চাকরি করে দিতে পারা যায় যদি, তবে সব হয়৷ গড়শিবপুরের জঙ্গলে থেকে আমার প্রাণও হাঁপিয়ে উঠেছে—দুদিন এখানে থেকে বাঁচি—

—বেশ কথা তো! কলকাতার মতো জায়গা আছে ভাই—এখানে নিত্য আমোদ, লোকজন—ইচ্ছে হল আজ শিবপুরে কোম্পানির বাগানে বেড়াতে গেলাম—ইচ্ছে হল আজ জু’তে গেলাম—

—সে আবার কি?

—মানে চিড়িয়াখানা৷ যখন যেখানে যেতে চাও গেলে, যা খাবার ইচ্ছে হয় খেলে, এই তোমার বয়েস, হেসে খেলে যদি এখন না বেড়ালে তবে কবে আর কি করবে? মানব-জীবনে এই সবই তো আসল৷ জঙ্গলে থাকলাম আর আলোচাল খেলাম—এজন্যে কি আসা জগতে?

—কি করব বলুন! অল্প বয়সে কপাল পুড়েছে যখন, তখন কি আর উপায় আছে—ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ের? বাবাও টাকার মানুষ নন যে কলকাতায় বাসা করে রাখবেন৷

—তুমি ইচ্ছে করলেই সব হয়৷ কলকাতায় থাকতে চাও, বাসা কেন—খুব ভালো ভাবে থাকতে পারবে এখন—স্টাইলে থাকবে৷ রেডিয়ো রাখবে এখন বাড়িতে—

—সে কি?

—বেতার৷ ওই শোনো বাজছে—ওই যে দোকানের সামনে লোক জমেছে? গান গাইছে না? তার পর গ্রামোফোন মানে কলের গান—

—জানি৷

—সে কলের গান রাখো—মোটর পর্যন্ত হয়ে যাবে৷ আজ এখানে বেড়াও, কাল ওখানে বেড়াও ইচ্ছে হল আজ কাশী বেড়াতে যাবে, কাল এলাহাবাদ কি দার্জিলিং বেড়াতে যাবে—

শরৎ হি-হি করে হেসে উঠে বললে, আপনি যে রূপকথার গল্প আরম্ভ করে দিলেন দেখছি! আমি মুখে বললেই সব হবে—এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের—যাক গে, সত্যি হোক না হোক—ভেবে তো নিলাম—বেশ লোক কিন্তু আপনি!

—আমি মোটেই গল্পকথা বলি নি ভাই৷ আপনি ইচ্ছে করলেই হয়—

—আমি কি আর ইচ্ছে করলে বাবার চাকরি করে দিতে পারি? অবিশ্যি আমিও বুঝতে পারি, বাবার যদি থিয়েটারে চাকরি হয় তবে সব হয়৷ বাবা যে কি চমৎকার বেহালা বাজান, সে আপনি শোনেন নি—কলকাতার থিয়েটারে সে-রকম পেলে লুফে নেয়৷ যেমনি বাজান, তেমনি গাইতে পারেন৷

হেনার হাসি পাচ্ছিল৷ পাড়াগেঁয়ে একটা বুড়ো এমন বেহালা বাজায় যে তাকে কলকাতার বড় থিয়েটারে লুফে নিয়ে এত টাকা মাইনে দেবে যে তাতে ওদের বাড়ি, গাড়ি, জুড়ি, ঢাক, ঢোল সব হয়ে যাবে! শোনো কথা! বাঙাল কি আর গাছে ফলে?

হেনা চুপ করে ভাবলে৷ আর বেশি বলা কি উচিত হবে একদিনে? অনেকদূর সে এগিয়েছে—অনেক কথা বলে ফেলেছে৷ মাগী কি সত্যিই বোঝে না—না ঢং করছে? কিন্তু যদি সত্যি ও বুঝতে পেরে থাকে তার কথার মর্ম—তবে আর না বলাই ভালো৷ ভয় করে বাবা, এখনি ফোস করে উঠে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলতে পারে! বাঙালনীকে বিশ্বাস নেই৷

শরৎ বললে, কই বললেন না, আমি ইচ্ছে করলে কি করতে পারি?

এ কথার জবাবে হেনা খপ করে বলে ফেললে, তুমি বুঝতে পারছ না ভাই, সত্যিই আমি কি বলছি?

এই পর্যন্ত বলেই হেনার হঠাৎ বড় ভয় হল৷ চোখ বুঝে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার দরকার নেই—আপাতত সাহসও নেই তার৷ কথা সামলে নেবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে একই নিশ্বাসে সে কণ্ঠস্বরকে লঘু ও হাস্য-তরল করে এনে বললে, বুঝলে এবার? একটু ঠাট্টা করছি তোমায়৷ তাই কি কখনো হয়? তুমি আমি বললে কি হবে বলো—এমনি বলছিলাম৷ চলো নীচে যাই—রাত্রে কি খাবে?

—কিছু না৷ আমি কিছু খাইনে রাত্রে৷

—বেশ, একটু দুধ একটু মিষ্টি খেতে আপত্তি আছে?

—আমি কিছুই খাব না, আপনি ব্যস্ত হবেন না৷

হেনা মনে মনে বললে, তুমি না খেয়ে মরো না, আমার কি? এমন একগুঁয়ে বালাই যদি আর কখনো দেখে থাকি! যা বলবে তাই, ‘না’ বললে ‘হাঁ’ করাবার জো নেই!

এই সময় নীচের তলায় খুব একটা চেঁচামেচি শোনা গেল৷ কে জড়িত স্বরে চিৎকার করছে, কে গালাগালি করছে৷

শরৎ ভীতমুখে বললে, ওকি ভাই? কে চেঁচাচ্ছে? আমাদের বাড়িতে না?

হেনা পাংশুমুখে বললে, না, ও আমাদের বাড়ি নয়৷

হরি সা মদ খেয়ে কমলার ঘরে ঢুকে নিত্যকার মতো উপদ্রব শুরু করেছে৷ সর্বনাশ!

এই সময় নীচে মারধরের শব্দ শোনা গেল৷ এও নতুন নয়, হরি সা মদ খেয়ে এসে কমলাকে ঠেঙায় মাঝে মাঝে—পয়সার খাতিরে গায়ের কালশিরে ঢেকে আবার হাসতে হয় কমলাকে৷ কিন্তু—

শরৎ ব্যস্ত হয়ে বললে, না, দেখুন, আমাদের বাড়িতে নীচের ঘরেই৷ কমলার ঘরের দিকে মনে হচ্ছে৷ যান যান, আপনি শীগগির যান—দেখুন—চলুন যাই আমরা৷ কে হয়তো বদমাইশ ঘরে ঢুকেছে—

চেঁচামেচি বাড়ল৷ আর রক্ষা হল না৷ হরি সা গর্দভের মতো চেঁচানি জুড়েছে৷ হরি সা যে একদিন মাটি করে দেবে সব, হেনা তা জানত৷ সেই লম্বা কথাওয়ালা গিরীন এই সময় আসুক না দেখা যাক৷

কমলার গলার কান্না মেশানো আর্ত সুর শোনা গেল—ও দিদি, তোমরা এসো, আজ আমায় মেরে ফেললে মুখপোড়া—আর পারি নে দিদি—উঃ, আর রক্ষা হয় না৷

তবুও অ্যাকট্রেস হেনা মরীয়া হয়ে শেষ চাল চাললে৷ মুখে দিব্যি শান্ত হাসি এনে বললে, ও আমাদের বাড়ি না, পাশের বাড়ির সেই বুড়ো মাতালটা৷ ছাদ থেকে মনে হয় যেন আমাদের বাড়ি৷ রোজই শুনছি৷ যাবেন না নীচে—জানলা দিয়ে ওদের ঘরটা দেখা যায় কিনা, আমাদের দেখলে আবার গালাগালি করবে৷ আমি তো এ সময় সিঁড়ি দিয়ে নামি নে—

.

ওদিকে কমলার চিৎকার তখনও শোনা যাচ্ছে৷

শরৎ বললে, ও তো পষ্ট গঙ্গাজলের গলা—আপনি কি বলছেন?

তার পরে সে নিজে এগিয়ে গিয়ে কমলার ঘরে ঢুকল৷ গিয়ে যা দেখলে তাতে সে অবাক হয়ে গেল৷ কমলা মেঝেতে পড়ে কাঁদছে, একটা কালো মোটা-মতো লোক তক্তপোশের ওপর বসে, তার হাতে একখানা পাখা৷ পাখার বাঁটের দিকটা উঁচিয়ে বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে সে কমলাকে মেরেছে, কারণ পাখাখানা উল্টো করে ধরা রয়েছে লোকটার হাতে৷

শরৎকে দেখে কমলা দিশাহারা ভাবে বললে, আমায় মারছে গঙ্গাজল—আমায় বাঁচাও—

শরৎ কমলার হাত ধরে বললে, তুমি চলে এসো আমার সঙ্গে—

মোটামতো লোকটা গর্জন করে বলে উঠল, ও কোথায় যাবে?

পরক্ষণেই সে শরতের দিকে ভালো করে চেয়ে, সুর নরম করে ইতরের মতো রসিকতার সুরে বললে, তুমি আবার কে চাঁদ?

শরৎ সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কমলার হাত ধরে তাকে ঘরের বাইরে আনতে গেল৷

বুড়ো লোকটা বললে, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ চাঁদ? ওকে আমার দরকার আছে—তুমিও এখানে বসো না একটু—কোন ঘরে থাকো?

পরে কমলার দিকে চেয়ে কড়া সুরে বললে, এই, যাবি নে৷ বোস বলছি৷

শরৎ বললে, আপনি একে মারছেন কেন?

—আমার ইচ্ছে—তুমি কে হে আমার কাজের কৈফিয়ৎ নিতে এসো? আমার নাম হরি সা৷ বৌবাজারে আমার দোকানে ছাপ্পান্ন হাজার টাকার জল বিক্রি হয় মাসে—শুধু জল, বুঝলে চাঁদ! বোতলভরা জল—

শরৎ ততক্ষণে কমলার হাত ধরে ঘরের বাইরে এনেছে৷ কমলার পিঠের কাপড় তুলে দেখলে, পিঠেও অনেক জায়গায় লম্বা লম্বা মারের দাগ৷ হেনা কখন এসে নিঃশব্দে ওদের পেছনে দাঁড়িয়েছে৷ শরৎ তার দিকে চেয়ে বললে, দেখুন ওই কে একজন লোক কি রকম মার মেরেছে—কে ভাই উনি তোমার?

কমলা চুপ করে রইল, তখন সে নিঃশব্দে কাঁদছে৷

এ কথার উত্তর দিলে স্বয়ং হরি সা৷ কমলার পিছনে পিছনেই সে ঘরের বাইরে এসে বললে—আমি কে ওর? শুধু ওকে জিজ্ঞেস করো ওর পেছনে কত টাকা খরচ করেছি আমি! হাড়কাটা গলির দোকানখানাই উড়িয়ে দিয়েছি ওর পেছনে—আমার—আচ্ছা আমি বসছি গিয়ে ঘরের মধ্যে৷ ও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘরে আসুক—

শরৎ এতক্ষণও খুব খারাপ কোনো সন্দেহ করে নি৷ কমলার কোনো গুরুজন হবে এতক্ষণ ভেবেছিল—যদিয়ো লোকটার কথাবার্তার ধরনে সে রাগ করেছিল খুব৷ কিন্তু এবার তার বুকের মধ্যেটা হঠাৎ ধক করে উঠল, এ কোন সমাজে সে এসে পড়েছে যেখানে দাদামশায়ের বয়সী বৃদ্ধ নাতনীর বয়সী মেয়ের সম্বন্ধে এ ধরনের কথাবার্তা বলে! সে কোথায় এসে পড়েছে? বুড়ো লোকটার সঙ্গে কমলার সম্পর্ক কি?

প্রভাসের বৌদিদিই বা তাকে এত মিথ্যে বলতে গেল কেন?

সে হেনার দিকে তীব্রদৃষ্টিতে চেয়ে বললে, আপনি জেনেশুনে আমায় কি সব কথা বলছিলেন এতক্ষণ? আমায় আপনারা কোথায় এনেছেন? এ সব কি কাণ্ড!

হেনা ঠোঁট উল্টে বললে, ন্যাও ন্যাও গো রাইমণি! অমন সতীপনা অনেককে করতে দেখেছি—প্রথম প্রথম যারা আসে, সবাই অমনি সতী থাকে! কত দেখলুম, কত হল আমাদের এ চক্ষের সামনে—

শরৎ রাগের সুরে বললে, তার মানে? কি বলছেন আপনি?

—যা বলছি তা বলছি, ভেবে দ্যাখো৷ আর ঢং দেখাতে হবে না তোমাকে৷ বেরিয়ে এসেছ তো প্রভাসের আর গিরীনের সঙ্গে—কোথায় এসে পড়েছ বুঝতে পারছ না? তোমার একূল ওকূল দুকূল গিয়েছে৷ এখন যেখানে এসে উঠেছ সেখানেই থাকো—সুখে থাকবে৷ তোমার বাবা এখানে নেই—চলে গিয়েছে কাল৷ তুমি এখানে ওদের সঙ্গে পালিয়ে এসে উঠেছ শুনে—

শরতের মুখ থেকে হঠাৎ সব রক্ত চলে গিয়ে সমস্ত মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ সে হাঁ করে হেনার মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হল না, শুধু তার ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল৷

ওর অবস্থা দেখে হেনার ভয় হল৷

বাঙালনীর ঢং দ্যাখো আবার! ফিট-টিট হবে নাকি রে বাবা! আঃ, কি ঝঞ্ঝাটেই তাকে ফেলে গেল ওই কথার ঝুড়ি গিরীনটা! এসে সামলাক এখন তাল!

সে কাছে এসে বললে, তা ভাই তুমি তো আর জলে নেই? ভয় কিসের? আমি তো বলছিলাম তোমার সব হবে৷ থাকো না এখানে আমাদের এই বাড়িতে৷ তোমায় মাথায় করে রেখে দেবে এখন ওরা৷ মোটর বলো, কালই মোটর হবে৷ রেডিও হবে, কলের গান হবে—যা আমি বলেছি৷ আপাদমস্তক জড়োয়া দিয়ে মুড়ে দেবে—ভয় কিসের তোমার? চাকর-চাকরানীর মাথায় পা দিয়ে বেড়াও, মুখের কথা খসাও, কাল থেকে সব ঠিক করে দেব—কি হবে সেই ধাবধাড়া গোবিন্দপুরের জঙ্গলে—

শরৎ এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল৷ বললে, এমন লোক আপনারা—তা আমি ভাবি নি৷ মাথার ওপর ভগবান আছেন, আমি জানতাম না, সরল বিশ্বাস করেছিলাম প্রভাস দাদার ওপর৷ ভাইয়ের মতো দেখতাম৷ আপনাদের ভেবেছিলাম ভদ্রঘরের মেয়ে৷ আমার বোকামির শাস্তি যথেষ্ট হয়েছে—

কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল৷

হেনার মন যে পথকে আশ্রয় করে পোক্ত হয়েছে, সেই পথেরই সংকীর্ণ দৃষ্টি ওর মনুষ্যত্বকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে৷ পাপের পথে যে মনে মনে ঝানু হয়ে পড়ে, পুণ্যের আলো প্রবেশ করবার বাতায়ন-পথ তার নিজের অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে যায়৷

হেনার মন গলবার নয়৷

সে বললে, কেন কান্নাকাটি করছ ভাই? প্রথম প্রথম অবিশ্যি একটু কষ্ট হয়—কিন্তু জগতে এসে সুখের মুখ যদি না দেখলে তবে করলে কি? এখানে দিব্যি সুখে থাকো—পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খাও—সব সয়ে যাবে৷

শরৎ বললে, আপনি দয়া করে আর কিছু বলবেন না৷ আমি গরিব লোকের মেয়ে, বাসন মেজে ভাত রেঁধে কাঠ চ্যালা করে সংসার করে এসেছি এতকাল, এক দিনের জন্যেও ভাবি নি যে কষ্টে আছি৷ আপনাদের সুখ নিয়ে থাকুন আপনারা—

এই সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে দুপ দুপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল গিরীন৷

তাকে দেখে হেনা যেন অকূলে কূল পেয়ে গেল৷ তার দিকে ফিরে বললে, এই যে! বাপরে বাপ! এত ঝক্কি পোয়াবার জন্যে আমি রাজি হই নি, তা বলে দিচ্ছি৷ ওই নাও, সব খুলে বলেছি—যা বোঝো করো৷

গিরীন বললে, কি, ও বলে কি?

—জিজ্ঞেস করো, তোমার সামনেই তো বিরাজ করছে সশরীরে—

গিরীন শরতের দিকে ফিরে বললে, কি? বলছ কি তুমি? তোমার বাবা তোমার কথা সব শুনে পালিয়েছে৷ এখানে থাকো, পরম সুখে থাকবে—

শরৎ বললে, আপনি আমায় কোনো কথা বলবেন না৷ আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে—আমি গাঁয়ে চলে যাব বাবার কাছে—

গিরীন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললে, সে গুড়ে বালি! এতক্ষণ গাঁয়ে রটে গিয়েছে সব৷ কোথায় দু-দিন দু-রাত কাটিয়েছ গাঁয়ের সবাই জেনে গিয়েছে৷ আর ঘরে জায়গা নেই তোমার—এখন যা বলছি তাতে রাজি হও চাঁদ—

শরৎ হঠাৎ তীব্র পরুষকণ্ঠে বলে উঠল, খবরদার, আমাকে যা তা বলবার কোনো এক্তার নেই আপনার জানবেন—সাবধানে কথা বলুন—

গিরীন কৃত্রিম ভয়ের ভান করে হেনার পেছনে লুকোবার অভিনয় করলে৷ বললে—ও বাবা, শূলে দেবার না ফাঁসিতে লটকাবার হুকুম হয়ে গেল বুঝি! তাল সামলাও হেনা বিবি—

শরৎ বললে, সে দিন নেই, আজ আমার বাবা গরিব, আমরা গরিব—নইলে আপনাদের মতো ছোটলোককে শূলে ফাঁসে দেওয়া খুব বেশি কথা ছিল না গড়শিবপুরে—যাক, আমায় যেতে দিন, আমি চলে যাব—

গিরীন বললে, কোথায় যাবে চাঁদ? সে পথ বন্ধ—আমি তো—

শরৎ বলে উঠল, আবার ওই ইতরের মতো কথা! আমি কোনো কথা শুনবার আগে আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান—ভদ্রলোক বলে ভুল করে ঠকেছি—

শরতের কথাবার্তার ভঙ্গির মধ্যে ও কণ্ঠস্বরে এমন কি একটা জিনিস ছিল যাতে গিরীন কুণ্ডু যেন সাময়িক ভাবে ভয় পেয়ে চুপ করল৷

হেনা ওকে আড়ালে চুপি চুপি বললে, কেন ও বাঙালনীকে রাগাচ্ছ৷ রাগিয়ে কাজ পাবে না ওর কাছে!

—বাপরে, কেবলই যে ফোঁস ফোঁস করে! আজ ওকে এখানে রাখো—

—আমি পারব না, আমার থিয়েটার আজ—

—তুমি নিয়ে যাও কমলাকে৷ হরি সা কে আমি নিয়ে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে যাচ্ছি৷ থাকুক এখানে চাবি দেওয়া আটকানো—

হেনা ফিরে গিয়ে বললে, তোমার কথা হল৷ বাড়ি যাবে কোথায়? সেখানে সব রটে গিয়েছে—গাঁয়ে যাবে কোন মুখে? এখানে সুখে থাকবে৷

—সে ভাবনা আপনি ভাববেন না৷ আমার যে দিকে দু-চক্ষু যায় চলে যাব৷ মা-গঙ্গা তো আছেন শেষ পর্যন্ত৷ এমন কি করেছি আমি যাতে মা আমায় কোলে স্থান দেবেন না?

শরতের গলা আবার কান্নার বেগে আটকে গেল৷ বললে—লোককে বিশ্বাস করে আজ আমার এই দশা—কি করে জানব যে মানুষের পেটে এত থাকে!

হেনা বললে, আচ্ছা, তাই হবে৷ না হয় মোটরে করে তোমাকে ইস্টিশানে রেখে আসুক—দেখে আসি নীচে—

—সে চলে গেল৷ কমলাকে গিরীন কি বলতে নিয়ে গেল পাশে৷ শরৎ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেনার ওপরে উঠে আসবার অপেক্ষা করলে৷ তার পর তার দেরি হচ্ছে দেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখলে বাইরের দরজা বন্ধ৷ বাইরে থেকে ওরা তালা দিয়েছে৷

শরৎ এসে চুপ করে ওপরে অনেকক্ষণ বসে রইল৷

বাড়ি নির্জন, নিস্তব্ধ৷ জলতেষ্টা পেয়েছে বড়, জল আছেও কিন্তু এ বাড়িতে সে জলস্পর্শ করবে না, জলতেষ্টায় মরে গেলেও না৷ প্রভাসদার বাবার কি সত্যিই অসুখ? হয়তো সব মিথ্যে কথা ওদের৷ কথাতে কথাতে বিশ্বাস করেই আজ তার এই দশা৷ প্রভাসও লোক ভালো নয় নিশ্চয়ই৷

অনেকক্ষণ কেটে গেল৷ কেউ আসে না৷ শরৎ জানলা দিয়ে পাশের বাড়িতে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে৷ কোনো লোক দেখা গেল না৷ দু ঘণ্টা তিন ঘণ্টা কেটে গেল, শরৎ বসে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল৷ সম্পূর্ণ অসহায়, কেউ তাকে জানে না, কেউ চেনে না৷ কি সে এখন করে?

শেষ পর্যন্ত সে ভাবলে, এও ভালো, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালও ভালো৷ ওরা না আসুক, সে এখানে না খেয়ে মরবে—মরতে তার ভয় নেই৷ একবার আশা ছিল বাবার সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বলে—কিন্তু বাবার দর্শনলাভ অদৃষ্টে বোধ হয় নেই৷

বিকেল হয়ে আসছে৷ পাশের বাড়ির গায়ে লম্বা ছায়া পড়েছে৷ শরৎ বসে বসে একটা উপায় ঠিক করলে৷ সে যেই দেখবে পাশের বাড়ির জানলায় লোক, তাকে সে নিজের অবস্থার কথা জানাবে৷ তার কথা শুনে দয়া হবে না কি ওদের? বাড়ির চাবিটা খুলিয়ে দেবে না তারা?

হঠাৎ সে দেখলে পাশের বাড়ির জানলায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে৷

সে চেঁচিয়ে বললে, শুনুন, এই যে এদিকে—

মেয়েটি ওর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, আমায় বলছ—কি ভাই?

—আমায় এ বাড়িতে আটকে রেখেছে৷ আমি পাড়াগাঁ থেকে এসেছি—আমায় দোরটা খুলে দিন—দয়া করুন আমার ওপর৷

—এ তো হেনা দিদির বাড়ি, হেনা নেই?

—হেনা কে জানি নে৷ তবে কেউ এখন এ-বাড়িতে নেই৷ আমায় তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখে চলে গিয়েছে—

—তোমার বাড়ি কোথায়?

—অনেক দূরে৷ গড়শিবপুর বলে একটা গাঁ—যশোর জেলা—

—এখানে কার সঙ্গে এসেছ?

—প্রভাস আর অরুণ বলে দুজন লোক—আমাদের গাঁয়ের—

মেয়েটি মুচকি হেসে বললে, তার পর ঝগড়া হয়েছে বুঝি? থাকো ভাই, থাকো৷ এসেছ যখন, তখন যাবে কোথায়?

শরৎ ব্যগ্রস্বরে বললে, না না—আপনি বুঝতে পারছেন না৷ ওরা আমায় ঠকিয়ে এনেছে, আমি ভদ্রলোকের মেয়ে৷ আমায় দোর খুলে দিন কাউকে বলে দয়া করে—আমায় বাঁচান—আমার সব কথা শুনুন—

মেয়েটি ঠোঁট উল্টে বললে, সবাই বলে ঠকিয়ে এনেছে৷ তবে এসেছিলে কেন? ওসব আমি কিছু করতে পারব না—কে হ্যাঙ্গামা পোয়াতে যাবে বাপু তোমার জন্যে? যারা এনেছে, তাদের কাছে বোঝাপড়া করো গে—

কথা শেষ করে মেয়েটি জানলা থেকে সরে গেল৷ শরৎ জানত না যে এ পাড়ায় আশপাশের বাড়িতে যেসব স্ত্রীলোক বাস করে, তারা কেউ ভদ্রঘরের নয়, মানে, চরিত্রে, পেশায় তারা হেনারই সগোত্র৷ এদের কাছ থেকে সাহায্য ভিক্ষা নিষ্ফল৷

কিছুক্ষণ কেটে গেল৷ বিকেল বেশ ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে শরৎ তাড়াতাড়ি ছুটে বাইরের বারান্দায় এসে দেখতে গেল৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে একা কমলা৷ ওর পেছনে কেউ নেই৷ ওকে দেখে কমলা হাসিমুখে বললে—কি ভাই গঙ্গাজল?

তার পর তাড়াতাড়ি দু-তিনটে সিঁড়ি একলাফে ডিঙিয়ে এসে শরতের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, গঙ্গাজল—কি কষ্ট ওরা তোমাকে দিলে! কোনো ভয় নেই ভাই, আমি যখন এসে গিয়েছি৷ তুমি পালাও—আমি লুকিয়ে দেখতে এসেছিলাম তোমার কি দশা হচ্ছে—হয়তো এতক্ষণে একটা উপায় হয়েছে ভেবেছিলাম৷ তুমি চলে যাও—আমার কাছে এ বাড়ির একটা চাবি থাকে তাই রক্ষে৷

এতক্ষণ শরৎ কথা বলবার অবকাশ পায় নি, এত তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা ঘটল!

সে এইবার বললে, ভগবান আছেন গঙ্গাজল, তাই তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছেন ভাই—

—আমার তো আর কেউ ছিল না—

কমলা বললে, তুমি ভাই তাড়াতাড়ি নেমে চলো, জিনিসপত্র কিছু এনেছিলে—সুটকেস কি পুঁটুলি নেই? এসো নেমে গিরীনরা এসে পড়তে পারে৷ আমায় দেখলে গোলমাল করবে৷ হেনাদি থিয়েটারে গিয়েছে—সে আজ এখুনি আসবে না৷

শরৎ ওর সঙ্গে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল৷

কমলা বললে, ভাই, তুমি এখন কোথায় যাবে?

—যেদিকে দু চোখ যায়—ভগবান আমার হাত ধরে যে পথে নিয়ে যাবেন৷ আমাদের গড়ের ভাঙা দেউলে সন্দে পিদিম দিয়েছি জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত—তিনি পথ দেখিয়ে দেবেন আমায়৷ পথ না হয়, মা-গঙ্গা আর কোল থেকে ঠেলে ফেলবে না৷

কমলার চোখ জলে ভরে উঠল৷ সে বললে, আমরা নরকের কীট ভাই, তোমার মতো মেয়ের পায়ের ধুলো পড়ে আমাদের পাপের বাসা পবিত্র হয়ে গেল৷ একটু সাবধানে থেকো, তোমার রূপ যে কি তুমি নিজে জানো না৷ আমাদের মাথা ঘুরে যায়—পুরুষের দোষ কি দেব? তার পর সে আঁচল খুলে পাঁচটা টাকা নিয়ে শরতের হাতে দিয়ে বললে—এই টাকা কটা সঙ্গে রাখো দিদি৷ দরকার হবে, ছোট বোনের কাছ থেকে নিতে লজ্জা নেই৷ সুসময় আসে, অনেক রকমে শোধ দিতে পারবে৷

শরৎ বললে, তুমিও কেন চলো না আমার সঙ্গে? এই কষ্ট সহ্য করে মার খেয়ে কেন এখানে পড়ে থাকো? চলো দুই বোনে পথে বেরুই ভগবানের নাম করে৷ তিনি নিরুপায়ের উপায়, একটা কিছু করে দেবেনই তিনি—

কমলা বিষণ্ণ মুখে বলল—না দিদি, আমার তা হবার নয়৷ আমার মা এখানে—মার বয়েস হয়েছে—তাঁকে ফেলে যেতে পারব না৷ তা ছাড়া আরও অনেক কাল এই পথের পথিক—এক পুরুষে নয়, অনেক পুরুষে৷ আমাদের উদ্ধার নেই—আমি যাব বললেই যাওয়া হবে না৷ বাঁচি মরি এখানে থাকতে হবে৷ গোবরের গাদাতে জন্মেছি, গোবরের গাদাতেই মরতে হবে৷

শরৎ কমলার চিবুক ধরে আদর করে বললে, না ভাই, গোবরের গাদায় তুমি পদ্মফুল—

কমলা অশ্রুসজল চোখে মাথা নিচু করে বললে, একটু পায়ের ধুলো দাও দিদি৷ ছোট বোন বলে মনে রেখো যেখানে থাকো—আমার আর দেরি করবার জো নেই—

কমলা বিদায় নিয়ে দ্রুতপদে চলে গেল৷

.

কমলা চলে গেলে শরৎ বড় একা মনে করল নিজেকে৷ এতক্ষণ তবুও একটা অবলম্বন ছিল, তাও গেল৷ এখন থেকে সে সম্পূর্ণ একা, নিঃসহায়৷ কখনো এমন অবস্থায় পড়ে নি জীবনে৷ কোথায় সে এখন যায়? বেলা পড়ে এসেছে—এই বিশাল অপরিচিত শহর সামনে৷ সুনির্দিষ্ট পথে চিন্তাধারাকে চালিত করবার শিক্ষা ওর নেই—যারা এ বিষয়ে আনাড়ি, তাদের চিন্তা যেমন খাপছাড়া ধরনের, ওর বেলাতে তার ব্যতিক্রম হল না৷ শরৎ ভাবলে—কালীঘাট গিয়ে গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হই—যা কিছু পাপ, যদি ঘটে থাকে কিছু, গঙ্গায় ডুব দিয়ে কেটে যাবে এখন—

একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছিল পাশ দিয়ে৷ গাড়োয়ান এ পাড়াতেই থাকে, এ পাড়ার স্ত্রীলোকদের সে চেনে—সওয়াড়ি খুঁজবার চেষ্টায় বললে, গাড়ি চাই?

শরৎ যেন অকূলে কূল পেলে৷ গাড়ি ডেকে নিজে চড়তে পারতো না—কি করে গাড়ি ডাকতে হয়, কি বলতে হয়, এসবে সে অনভ্যস্ত৷ সে বললে, আমায় কালীঘাটে নিয়ে যাবে?

—কেন যাব না বিবিজান? চলো—

—কত ভাড়া দিতে হবে?

—তিন টাকা দিয়ো, তোমাদের এ পাড়ার ভাড়া তো বাঁধাই আছে৷ ওই খেঁদি বিবি যায়, বড় পারুল বিবি সেদিন গেল—তিন টাকা দিলে৷ আমি যাস্তি লেবো না৷

শরৎ দরদস্তুর করতে জানে না৷ দু টাকার জায়গায় তিন টাকা ভাড়ায় সওয়ারি পেয়ে গাড়োয়ান মনের আনন্দে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে৷ গড়ের মাঠ দিয়ে যখন গাড়ি চলেছে, তখন শরতের মনে হল একটা বিশাল জনস্রোতের মধ্যে সেও একজন৷ প্রকাণ্ড মাঠটার মধ্যে দিয়ে কত রাস্তা, কত গাড়ি ঘোড়া, ট্রাম গাড়ি, লোকজন ছুটেছে, চলেছে—দূরে গঙ্গাবক্ষে বড় বড় জাহাজের মাস্তুল দেখা যাচ্ছে৷ সকলের ওপর উপুড় হওয়া নীল আকাশের কতটা দেখা যাচ্ছে, মুচুকুন্দ চাঁপাগাছের সারির নিচে সাহেবদের ছেলেমেয়েদের ঠেলে নিয়ে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ঠ্যালাগাড়িতে—জীবনটা ছোট নয়, সংকীর্ণ নয়—এত বড় জগতে যদি সবাই বেঁচে থাকে নিজের নিজের পথে—সেও থাকবে৷ ভগবান তাকে পথ দেখিয়ে দেবেন৷

গাড়িতে বসে গতির বেগে মন যখন পুলকিত, তখন অনেক কথা এমন অল্প সময়ের জন্যে মাথায় আসে, শরীরের জড়তার সুদীর্ঘ অবসরে নিষ্প্রভ ও অলস মন যা কখনো কল্পনা করতে পারে না৷

এই অল্প সময়টুকুর মধ্যেই শরৎ অনেক কথা ভেবে ঠিক করলে৷ সে আর গড়শিবপুরে ফিরবে না৷

বাবা সেখানে গিয়ে আছেন, হয়তো তিনি গিয়ে বলেছেন মেয়ে তাঁর মারা গিয়েছে৷ সে গেলেই গ্রামে কলঙ্ক রটবে৷ সে কলঙ্কের হাত থেকে বাবাকে সে রক্ষা করবে৷

কোথায় সে যাবে? তা সে জানে না আজ, যদি কখনো কারো অনিষ্ট চিন্তা না করে থাকে জীবনে, কখনো অন্যায় না করে থাকে—তবে সে-সবের জোর নেই জীবনে?

কালীঘাটে পৌঁছে সে গঙ্গায় ডুব দিলে, তার পর আর কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে সে কালী-মন্দিরের সামনে চুপ করে বসে রইল৷

সন্ধ্যার আরতি আরম্ভ হল৷ কত মেয়ে সাজগোজ করে আরতি দেখতে এল৷ তার মধ্যে ও চুপ করে বসে বসে সকলের দিকে চেয়ে দেখলে৷ কত বৃদ্ধা এসে দোরের কাছে ওর পাশে বসল৷ রাত্রি বেশি হল৷ ও ভাবলে কোথায় যাবে এখন৷ কোনো জায়গা নেই যাবার৷ এত বড় বিশাল শহরে অসহায় তরুণী নারীর পক্ষে নিরাপদ স্থান কোথায় এই দেবমন্দির ছাড়া৷ সুতরাং সে বসেই রইল৷ বসে বসে মনে পড়ল বাবার কথা৷ গড়শিবপুরের জঙ্গল-ঘেরা বাড়িতে বাবাকে একা হয়তো এতক্ষণ হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হচ্ছে৷ আনাড়ি মানুষ, কোনো দিন জীবনে কুটোটা ভেঙে দুখানা করার অভ্যেস নেই, বেহালা বাজিয়ে আর গান গেয়েই নিশ্চিন্তে দিনগুলো কাটিয়ে এসেছেন বাবা—শরৎ তাঁর গায়ে আঁচটুকুও লাগতে দেয় নি৷ আজ সে থেকেও নেই৷ বাবার কি কষ্টই হচ্ছে! তার কথা মনে ভেবে বাবার কি শান্তি আছে?

শরতের চোখে জল এল৷ বাবার কথা মনে পড়লে মন হু-হু করে৷ সে কিছুতেই চুপ করতে পারে না, ইচ্ছে হয় সে এখুনি ছুটে চলে যায় সেই গড়শিবপুরের ভাঙা বাড়িতে, বড় কাঁঠালকাঠের পিঁড়িখানা বাবাকে পেতে দেয় রান্নাঘরের কোণে—একটা চটা-ওঠা কলাইকরা পেয়ালায় বাবাকে চা করে দিয়ে ছোট্ট খুকির মতো বাবার মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে গল্প শোনে৷

মন্দিরের সামনে নাটমন্দিরে একজন সন্ন্যাসিনী ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে—ওর নজরে পড়ল৷ তার চারিপাশ ঘিরে অনেক মেয়েছেলে জড়ো হয়ে কেউ হাত দেখাচ্ছে, কেউ ওষুধ নিচ্ছে, কেউ শুধু বা কথা শুনছে৷ শরৎ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে এই দেবমন্দিরের পবিত্রতা অনুভব করতে চাইছিল—যে ঘরে সে আজ দুদিন কাটিয়ে এসেছে তার সমস্ত গ্লানি, অপবিত্রতা, পাপ—এই দেবায়তনের ধূপধুনার সৌরভে, শঙ্খঘন্টার ধ্বনিতে, সমবেত ভক্তমণ্ডলীর প্রাণের নিবিড় আগ্রহে যেন ধুয়ে যায়, মুছে যায়, শুভ্র হয়ে ওঠে, নির্মল হয়ে ওঠে৷ কালীঘাটের মন্দিরের সেবকদের লোভ যেখানে উগ্র, পূজার্থীদের অর্থ শোষণ করবার হীন আকাঙ্ক্ষা সব ছাপিয়ে যেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে—পূজার মধ্যে ব্যবসা এসে ঢুকেছে, বৈষয়িকতা এসে ঢুকেছে—সে সব দিক পল্লীবাসিনী শরতের জানা নেই৷ তার মুগ্ধ মনের ভক্তি ওর চোখে যে অঞ্জন মাখিয়েছে, তার সাহায্যে প্রাচীন ভারতের সংস্কারপূত বাহান্ন পীঠের এক মহাপীঠস্থান জাগ্রত হয়ে উঠেছে ওর মনে, বুদ্ধদেবের সেই অমর বাণী ‘মনই জগৎকে সৃষ্টি করে’—শরতের মনে মহারুদ্রের চক্রছিন্ন দক্ষকন্যা সতীর দেহাংশ সতী নারীর তেজ ও পাতিব্রত্যের প্রতীক স্বরূপ এখানকার মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এই মাটি তার মনে তেজ ও বল দিক৷ সন্ন্যাসিনীর সামনে বসে সারারাত কাটিয়ে দিলে সে৷ কিছু কিছু কথাও হল সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে৷ সামান্য কিছু ফলমূল কিনে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলে৷

সন্ন্যাসিনী বললে, বাড়ি কোথায় তোমার?

—গড়শিবপুরে৷

—এখানে কোথায় থাকো?

—কোথাও না মা৷ মন্দিরেই আছি এখন৷ আশ্রয় নেই কোথাও৷

—তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি বড়ঘরের মেয়ে৷ কে আছে তোমার? কি করে এখানে এলে মা? একটা কথা জিজ্ঞেস করি কিছু মনে কোরো না—মানে কেউ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিল?

কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গেই শরতের সরল, তেজোদৃপ্ত মুখের সুকুমার রেখার দিকে, তার ডাগর, কালো নিষ্পাপ চোখ দুটির দিকে চেয়ে সন্ন্যাসিনী এ প্রশ্ন করার জন্যে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ল৷

শরৎ মুখ নিচু করে বললে, না মা, ও সব নয়৷ তবে সব তো বোঝেন, মেয়েমানুষের অনেক শক্র—বিশেষ করে মা, যে সকলকে বিশ্বাস করে তার শত্রু এখন দেখছি চারিদিকেই৷ ভুলিয়েই এনেছিল বটে মা—তবে আমি ভুলে আসি নি, বুঝলেন মা?

—তোমার বয়েস কত মা?

—সাতাশ বছর৷

—কিন্তু তোমার রূপ এই বয়েসে যা আছে, তা কুড়ি বছরের যুবতীরও থাকে না— তোমার বড় বিপদ এই কলকাতা শহরে৷ আমার এখানে থাকো—কোথাও গেলে তোমার বিপদ ঘটতে দেরি হবে না মা৷

শরতের চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল৷ এই তো মা সতীরানী তাকে আশ্রয় দিয়েছেন৷ ঠাকুর-দেবতার মাহাত্ম্য কলিকালে তবে নাকি নেই? বাবা তো নাস্তিক, সন্দে-আহ্নিকটা পর্যন্ত করবেন না৷ সে কত বকুনির পর জোর করে আসন পেতে বাবাকে আহ্নিকে বসাত৷ বাবার কথা মনে পড়তে শরতের চোখের জল আর থামে না৷ বাবা কি আর সন্দে-আহ্নিক করছেন? উত্তর দেউলে এই সন্ধ্যায় বাদুড়নখীর জঙ্গল ঠেলে কে সন্দে-পিদিম দিচ্ছে আজকাল? কেউ না৷

বহুদূর থেকে সে দেখতে পায়, দেবীমূর্তির পায়ের চিহ্ন বনে-জঙ্গলে নির্দেশহীন কালো নিশীথ রাত্রে এখনও অমনি পড়ে যাচ্ছে, ভয়ে শিউরে উঠে কুটিরের ঘরে অর্গলবদ্ধ করবার জন্যে সে আর সেখানে নেই৷ রাজলক্ষ্মী? সে কি আছে—সে আর এখানে আসে না৷ কেনই বা আসবে?

শরৎ সেখানেই রইল সেদিনটা৷ সন্ধ্যার পরে অনেকগুলি মেয়ে আসে—রোজ শাস্ত্রকথা হয়৷ শরৎ বড় ভালোবাসে শাস্ত্রকথা শুনতে, একদিন নকুলেশ্বরের মন্দিরে কথকতা হল৷ আরও কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে সেখানে শরৎ গেল৷ কথকতার পর প্রসাদ বিতরণের পালা৷ সকলের সঙ্গে শরৎও শালপাতা পেতে বাতাসা, শসা, ছোলা ভিজে, ফলমূল নিয়ে এল৷ সন্ন্যাসিনী ব্রাহ্মণের মেয়ে—তিনি স্বপাক ভিন্ন খান না, নিজে রান্না করেন, শরৎকে শালপাতে ভাত বেড়ে দেন৷ সারাদিন খাওয়া হয় না—সন্ধ্যার পর রান্না চড়ে৷

তিন-চার দিন পরে একটি বড়লোকের গৃহিণী এলেন সন্ন্যাসিনীর কাছে৷ স্নানের ঘাটে যেতে শরৎকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দুপুরে৷ বোধ হয় সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে তাঁর কিছু কথা হয়ে থাকবে শরতের সম্বন্ধে৷ বললেন—তোমাকে দেখে আমার বড় ভালো লেগেছে৷ তোমার নাম কি?

—শরৎসুন্দরী৷

—কতদিন সন্ন্যাসিনীর কাছে আছ?

—বেশি দিন না৷

—আমাদের সঙ্গে যাবে?

—কোথায় মা?

—আমরা বেরিয়েছি কাশী, গয়া করব বলে৷ মুখে বলতে নেই—এখন হবে কিনা তা জানি নে৷ ইচ্ছে তো আছে আমার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে লক্ষ্ণৌ৷ সেখানে গিয়ে একবার মেয়ের সঙ্গে দেখা করব৷ আমি যাচ্ছি আর আমার দুই মেয়ে, ছোট ছেলে আর কর্তা৷ একটা লোক আমাদের দরকার৷ বয়েস হয়েছে—একা ভরসা করি নে সব ঝক্কি নিতে বিদেশে৷ তুমি চলো না কেন আমার সঙ্গে? মাইনে-টাইনে সব ঠিক করে দেব এখন—কোনো অসুবিধে হবে না৷ গৌরী-মা বলেছিলেন তোমার কথা৷ কথা কি জানো, যে সে মেয়ে নিতে ভরসা হয় না৷ স্বভাব-চরিত্তির কার কি রকম না জেনে বাপু নেওয়া তো যায় না৷ গৌরী-মা তোমার সম্বন্ধে বললেন—তখন আমার নিতে কোনো আপত্তি নেই৷

মহিলাটির প্রস্তাব ভালোই—তবুও শরৎ বলল, ভেবে দেখি মা—আপনাকে আমি বলব এখন সন্দেবেলা৷ গৌরী-মার কথকতা আপনি আসবেন তো শুনতে সন্দেবেলা?

তার পর মন্দিরে ফিরে এল ওরা স্নান সেরে৷

গিন্নি বললেন, আমি এখন যাচ্ছি মনোহরপুকুর রোডে আমার মেজ জামাইয়ের বাড়ি৷ নাতির অসুখ, তাকে গৌরী-মার কাছে নিয়ে এসে মাদুলি ধারণ করাবো৷ জামাই খ্রীষ্টান মানুষ, ওসব মানে না৷ মেয়েকে বলে রেখেছি জামাই আপিসে বেরুলে নাতিকে মোটরে নিয়ে আসব৷ যাবে আমার সঙ্গে?

শরতের যাবার কৌতূহল হল৷ ভাড়াটে গাড়ি করে ওরা অনেক রাস্তা গলি পার হয়ে একটা ছোট দোতলা বাড়ির সামনে এসে নামলে৷ শরৎ আশ্চর্য হয়ে ভাবলে, কলকাতার বড় লোক, দেখি ওদের বাড়ি-ঘর কি রকম—

প্রথমে এগারো বারো বছরের একটি মেয়ে নেমে এসে দোর খুলেই চেঁচিয়ে বলে উঠল—ও মা, কে এসেছে দ্যাখো—

একটি সুন্দরী মেয়ে ওপর থেকে নেমে এসে গিন্নির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, মা কবে এলে? কখন এলে? চিঠি তো লিখলে না আজ আসছো? এ কে মা?

ওকে নিয়ে এলাম৷ আমাদের সঙ্গে যাবে৷ গৌরী-মার কাছে এসেছে—সেখানে থাকে৷ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি—কোন জায়গায় গো?

শরৎ বলল—যশোর জেলায় গড়শিবপুরে৷

মেয়েটি বলল, এসো ওপরে এসো৷

ওপরের ঘর বেশ চমৎকার সাজানো৷ শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে৷ বড় বড় গদি-আঁটা চেয়ার, মেঝের উপর বড় বড় শতরঞ্জির মতো আসন পাতা৷ তার ওপর দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সবাই, তবে আসন পাতা কেন? এক কোণে একটি ছোট পাথরের মূর্তি, মেয়েটি বলল, তার শ্বশুরের চেহারা৷ বড় ডাক্তার ছিলেন, আজ ছ-বছর মারা গিয়েছেন৷ ফুলদানিতে বড় বড় রজনীগন্ধার ঝাড়৷ রান্নাঘরের মধ্যে কল, রান্না করতে করতে টিপলেই জল, ভারি সুবিধে৷ ছ-সাতটা বড় কাঠের আলমারি-ভর্তি মোটা বই৷ সেগুলো দেখিয়ে মেয়েটি বলল, শ্বশুর ডাক্তার ছিলেন বড়, নাম করতে পারি নে৷ তাঁর ডাক্তারি বই এগুলো—আরও সাত আলমারি বোঝাই বই আছে, নীচের ঘরে—শ্বশুরের শোবার ঘরে৷

মেয়েটি শরৎকে কিছু মিষ্টি ও ফল খেতে দিলে৷

তার পর গিন্নি মেয়ে ও নাতির সঙ্গে তাদের বড় মোটরে আবার এলেন কালীমন্দিরে৷ বেলা প্রায় তিনটে৷ শরৎ বলল, মা, আমি গঙ্গায় একটা ডুব দিয়ে আসি, বড্ড গরম—

আসল কথা গরম নয়৷ গঙ্গাহীন দেশের মেয়ে শরৎ, গঙ্গাকে কাছে পেয়ে সর্বদা ডুব দিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের লোভ দমন করতে পারে না৷ কিন্তু স্নান করে উঠে আসবার সময় শরৎ মহা বিপদের সামনে পড়ে গেল৷ স্নান করে উঠে কৃষ্ণকালী লেনের মুখে এসেছে, বাঁ দিকেই মনসাতলা ও কৃষ্ণকালীর মন্দিরে একবার দর্শন করে আসবে—হঠাৎ দেখলে তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে গিরীন, প্রভাস ও আরও দুটো অজানা লোক৷ তারা চারিদিকে কি যেন খুঁজছে৷

ওর সঙ্গে গিরীনের একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল৷ গিরীন আঙুল দিয়ে তার সঙ্গীদের ওর দিকে দেখিয়ে বলল—এই যে! তার পর সবাই মিলে এসে ওকে ঘিরে ধরল৷ গিরীন বলল, তার পর? রাগ করে ঝগড়া করে পালিয়ে এসে এখানে আছ? চলো বাড়ি চলো—

সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বলল, কেমন বলেছি কি না যে ঠিক কালীঘাটে খুঁজলেই পাওয়া যাবে৷ আজীর গাড়োয়ান দেখ ঠিক সন্ধান দিয়েছিল৷ বাবা, এ সব ডিটেকটিভগিরি কি তোমাদের কম্মো?

প্রভাস বলল, চলো শরৎ দিদি, ফিরে চলো—রাগ কেন? আর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়?

ওদের কথাবার্তার সুরে এমন একটা সহজ ভাব নিয়ে এসে ফেলেছে যেন শরৎ ওদের বহুদিনের ন্যায্য অভিভাবকত্ব থেকে বঞ্চিত করে নিজের একগুঁয়েমি এবং বদমেজাজের দরুন নিজে চলে এসেছে৷ ওরা যথেষ্ট উদারতা দেখিয়ে আবার ফিরিয়ে নিতে এসেছে৷ গিরীন বলল, নাও হয়েছে, কোথায় বাসা নিয়েছ চল দেখি—জিনিষপত্র কিছু আছে-টাছে? প্রভাস একখানা গাড়ি ডেকে আনো—এসো—

শরৎ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, আপনি আবার এসেছেন এখান পর্যন্ত? কেন এসেছেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যাবই বা কেন? আপনাদের সাহস তো খুব৷

প্রভাসের দিকে চেয়ে বলল, আর প্রভাসদা, আপনাকে মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো জ্ঞান করতাম—তার সাজা খুব দিয়েছেন! এত খাবাপ হয় লোকে তা আমি বুঝি নি! বাবা কোথায়? বাবার খবর কিছু আছে?

গিরীন ওদের দিকে সাট করে চোখ টিপে বলল—আরে আছেই তো৷ তিনি তো কাল থেকে এসে আমাদের ওখানে প্রভাসদের বাড়ি বসে৷ সেই জন্যেই নিতে আসা—চলো৷

শরৎ বলল, মিথ্যে কথা৷ বাবা কখনো আসেন নি৷ হ্যাঁ প্রভাসদা সত্যি? বাবা এসেছেন সত্যি বলুন—

প্রভাস বলল, মিথ্যে বলে লাভ? এসো দেখবে চলো৷ গাড়ি আনি৷

—গাড়ি আনতে হবে না প্রভাসদা৷ বাবা কখনো আসেন নি৷ এলে আপনাদের সঙ্গে এখানে আসতেন৷

—আমাদের কথা বিশ্বাস হল না? যাবে কিনা তাই বলো?

কলকাতা শহরের রাস্তা—একটি তরুণী মেয়েকে ঘিরে তিন-চারজন লোককে কথা-কাটাকাটি করতে দেখে দু-একজন লোক জমতে শুরু করল৷ একজন ছোকরা এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে মশাই?

গিরীন কুণ্ডু ঈষৎ সলজ্জ সুরে বলল, ও আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার মশাই৷ আপনারা যান৷

আর একজন বলল, ইনি কে? কি বলছেন? আপনারা নিয়ে যেতে চাইছেন কোথায়?

প্রভাস বলল, উনি আমাদের লোক—

গিরীন বলল, মশাই আপনারা ভদ্দরলোক, চলে যান৷ আমাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে—সে-সব কথা শুনে আপনাদের লাভ কি? আমাদের মেয়েমানুষ ঝগড়া হয়ে রাগ করে চলে এসেছে, তাই নিয়ে যেতে এসেছি৷

কে একজন বাইরে থেকে বলে উঠল—ওহে চলে এসো না—ওসবের মধ্যে থাকবার দরকার নেই, ও বুঝতে পেরেছি৷ এসব জায়গায় ওরকম কত কাণ্ড নিত্যি ঘটছে—

শরৎ অবাক, স্তম্ভিত৷ এমন সহজ ভাবে এমন নির্লজ্জ মিথ্যে কথা কেউ যে বলতে পারে তা তার ধারণার বাইরে৷ সে এর প্রতিবাদ করতেও পারলে না৷ প্রকাশ্য রাজপথে অপরিচিত পুরুষ-বেষ্টিতা অবস্থায় কথা-কাটাকাটি করা, চিৎকার করে ঝগড়া করা তার ঘটে লেখা নেই, তার স্বভাবজ শোভনতা-বোধ মুখে যেন হাত চাপা দেয়৷ সে মরে যাবে তবুও পথে দাঁড়িয়ে ইতরের মতো ঝগড়া করতে পারবে না৷

লোকজন চলে যেতে শুরু করলে৷ শরৎ এগিয়ে যেতে চাইল, গিরীন কুণ্ডু এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, নাও চলো—খুব ঢলান ঢলালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, এতগুলো ভদ্দরলোক জুটিয়ে ফেললে চারিদিকে—এখন ফিরে চলো আমাদের সঙ্গে—রাগ অভিমান করে কি পালিয়ে এলে চলে চাঁদ?

গিরীন যেন রাস্তার লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে এ কথাগুলো চেঁচিয়েই বলল৷

শরতের হঠাৎ বড় রাগ হল, গিরীনের মিথ্যা কথায়, ধূর্তামি ও শেষের কথার ইতর সম্বোধনে৷

সে বলল, আবার ওই কথা মুখে? আপনার সাধ্য নেই এখান থেকে আমায় নিয়ে যান! আমি এখানে চলে এলাম—এখানেও আপনারা এলেন? পথ ছেড়ে দিন বলছি—

শরৎ তখনই মনে ভেবে দেখলে ওই দল যদি তার সঙ্গে যায় বা যে মহিলাটির আশ্রয় সে পেয়েছে তারা যদি এখন এখানে এসে পড়ে, তবে এদের সাজানো মিথ্যে কথায় তাদের মনে সন্দেহ জাগবে এবং তারা তাকে কুচরিত্রা ভেবে তখনই পরিত্যাগ করে চলে যাবে৷ তা হলে সে একেবারে অসহায়—এই সব শুনলে গৌরী-মা কি তাকে জায়গা দেবেন আর?

যাক, যদি কেউ আশ্রয় না দেয়, গঙ্গা তো কেউ কেড়ে নেবে না?

গিরীন আবার বলল, দাঁড়াও এখানে গাড়ি ডাকি—মিছে রাগ করে কি হবে বলো!

সুর নীচু ও নরম করে বলল, চলো—কেন মিথ্যে পথে পথে ঘুরে কষ্ট পাও! এখানে আছ কোথায় বলো তো? খুব সুখে থাকবে৷ আমাদের সব ঠিক হয়ে গিয়েছে৷ প্রভাস মাসে পঞ্চাশ টাকা দেবে—আমি আর অরুণ পঞ্চাশ৷ আলাদা বাড়িভাড়া করে থাকতে চাও পাবে, হেনার বাড়িতেও থাকতে পার৷ নেকলেস আর চুড়ি সামনের হপ্তাতেই পাবে৷ ঘর সাজিয়ে দেব দুশো টাকা খরচ করে৷ কলের গান কিনে দেব৷ পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকবে, যা যখন হুকুম করো ইচ্ছামত—

শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, আবার ওই সব কথা? চলে যান আপনারা! আপনাদের দেখলেও পাপ হয়৷ আমি এই পথে বসে থাকব, মা কালী আমায় আশ্রয় দেবেন—

গিরীন জানত রাস্তার ওপর কোনো জোর করতে গেলেই লোক ছুটে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেবে, পুলিস আসবে—সব পণ্ড হবে৷ মিষ্টি কথায় কাজ হাসিল হল না দেখে সে ভয় দেখাতে আরম্ভ করল৷ চোখ রাঙিয়ে বললে, সহজে না যাও—জানো আমি কি করতে পারি? আমার নাম গিরীন কুণ্ডু—থানায় এজাহার করব তুমি হেনা বিবির হার চুরি করে এনেছ! এক্ষুনি চালান দিয়ে দেব, জানো? হেনা সাক্ষী দেবে—আজ রাতেই হাজতে বাস করতে হবে৷ ও বাঙালির বাঙালগিরি কি করে ঘোচাতে হয়, সে আমি জানি—তুমি এখানে আছ কোথায় শুনি?

শরৎ বলল, বেশ তাই করুন৷ ভগবান জানেন আমি কোনো অপরাধ করি নি৷ এখনও চন্দ্র সূর্যি উঠছে—আমি জীবনে পরের কুটোগাছটাতে কখনো হাত দিই নি৷ তিনি কখনো আমায় মিছিমিছি শাস্তি—

হঠাৎ নিজের অসহায় অবস্থা কল্পনা করে এবং ভগবানের উপর নির্ভরতার অনুভূতিতে শরতের চোখে জল এসে পড়ল—সে কেঁদে ফেললো৷

ক্রন্দনরতা মেয়ে পথের ওপর, তখনই কৌতূহলী জনতা জমতে আরম্ভ করল আবার৷

একজন ষণ্ডা গোছের তোয়ালে-কাঁধে লোক এগিয়ে এসে বললে, কি হয়েছে? কে আপনি? উনি কাঁদছেন কেন মশাই?

ভিড়েরই একজন বলল, তা কি জানি? আপনার সঙ্গে কে আছেন মা, হয়েছে কি?

আর একজন বলল, আপনি কোথায় যাবেন? কি হয়েছে আপনার বলুন তো মা?

এরা গিরীনের দলকে ঠাওর করতে পারে নি—সুতরাং তাদের সঙ্গে জনতার কথা বিনিময় হল না৷ জনতার সুর ক্রমশ উত্তেজিত ও কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখে গিরীন বুঝলে এখানে কথা বলতে যাওয়া মানেই বিপদ টেনে আনা৷ এরা কোনো কথা শুনবে না, সকলেরই সহানুভূতি ক্রন্দনরতা নারীর দিকে৷ মার খেতে হবে বেশি কথা বললে৷ বাতাসের মোড় হঠাৎ এমন ভাবে ঘুরে যাবে, তা ওরা ভাবে নি৷

গিরীন কুণ্ডু আর যাই হোক, নির্বোধ নয়৷ বেগতিক বুঝে সে দলবল নিয়ে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল৷

শরৎ যখন নাটমন্দিরে ফিরে এল, তখন বেলা পাঁচটা৷

গৌরী-মা বললেন, এত দেরি হল যে মা? এসে একটু প্রসাদ খেয়ে নাও৷ ওরাই পুজো দিয়ে গেল৷ কাল যাবে তো ওদের সঙ্গে?

শরৎ ইতিমধ্যে পথে আসতেই ঠিক করে ফেলেছে সে ওদের সঙ্গে যাবে৷ এখানে থাকলে তার সমূহ বিপদ৷ আজ উদ্ধার পেয়েছে, কিন্তু যদি গিরীন তোড়জোড় করে আর একদিন আসে—আসবেই সে, তখন হয়তো জোর করেই নিয়ে যাবে৷ সন্ধ্যাবেলা গৌরী-মার কথকতা শুনতে গিন্নি এলেন, সব ঠিক হয়ে গেল—কাল বেলা তিনটার সময় শরৎ তৈরি থাকবে৷ কালই রওনা হতে হবে ওদের সঙ্গে৷

রাত্রিটা নিতান্ত ভয়ে ভয়ে কেটে গেল৷ সকালে উঠে শরৎ গৌরী-মার সঙ্গে গঙ্গাস্নান করে এল৷ তাও তার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল, কোনো দিক থেকে ওরা এসে পড়ে নাকি! ভগবান কাল বড় বাঁচিয়ে দিয়েছেন! মানুষ এত খল হতে পারে, এমন নয়-কে-ছয় করতে পারে, হাসিমুখে নির্জলা মিথ্যে বলতে পারে—গ্রাম্য মেয়ে শরতের তা জানা ছিল না৷ বিশেষ করে সে যে বাপের মেয়ে! কেদারের মেয়ে তাঁরই মতো সরল৷

গৌরী-মা বললেন, নকুলেশ্বর তলায় গিয়ে একটু প্রসাদী বেলপাতা নিয়ে এসো৷ তোমার যাত্রার দিন, ওদের যাত্রার দিন৷ মায়ের ফুল বেলপাতা আমি মন্দির থেকে এনে দেব৷

যাবার সময় গৌরী-মার চোখে জল এল, বললেন—তিনদিনের মায়া, তাতেই তোমায় ছেড়ে দিতে মন কেমন করছে৷ আবার এসো, দেশে ফেরবার সময় এখান দিয়েই হয়ে যাবে সরলারা৷

শরৎ চোখের জলে ভেসে গৌরী-মার পায়ের ধুলো নিলে, বলল—অনেকদিন মাকে হারিয়েছি, আবার সেই মায়ের কথা আপনাকে দিয়ে মনে পড়ল৷ আশীর্বাদ করুন মা৷

.

হাওড়া স্টেশন৷ মস্তবড় জায়গা৷ লোকজন গমগম করছে৷ লম্বা লম্বা রেলগাড়ি ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছে৷ আলোয় আলো চারিদিক৷ ঘরের মধ্যে এসে রেলগাড়ি দাঁড়ায় কেমন করে!

সে সত্যিই চলল তবে? কোথায় চলল?

বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না৷ কোথায় পড়ে রইল তার আবাল্য-পরিচিত গড়শিবপুর! যেখানকার গড়ের জঙ্গলে, তাদের কালো পায়রার দিঘির জলে, চৈত্র মাসে তুলোওড়া বড় শিমুল গাছটার ছায়ায়, উত্তর দেউলের নির্জন পথে বাদুড়নখীর শুকনো খোলের ঝুমঝুমির শব্দে তার যে জীবনের শুরু সেই মাটিতেই—সেখানকার জ্যোৎস্নার মধ্যে, বর্ষার দিনের মেঘের ছায়ায় যে জীবন সুখে দুঃখে আপন পথ ধরে চলে এসেছিল এতদিন— সে জীবনের সঙ্গে আজ চিরদিনের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল৷

শরৎ জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দিল৷ চোখের জলে দ্রুত পলায়নপর টেলিগ্রাফের তারের খুঁটি, গাছপালা, ঘরবাড়ি সব ঝাপসা৷ কামরার মধ্যে শরৎ চেয়ে দেখলে অবাক হয়ে৷ কাদের সঙ্গে সে আজ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে? কারা এরা? ওই মাটিতে ফর্সা রঙের গিন্নি, এই চৌদ্দ বছরের মেয়ে ওই তিন-চারটি ছোট বড় খুকি, কর্তা আছেন পুরুষগাড়িতে—এদের তো সে চেনে না!

বাবা গান গাইতেন—‘দিয়ে মায়াবেড়ি পথে ফেলেচ বিপদে৷’

কত যে তার সাধ ছিল দেশবিদেশে বেড়াতে৷ গড়শিবপুরের জঙ্গল ভালো লাগে না৷ রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সে কত গল্প! আজ তো সে-সব সফল হতেই চলল—কিন্তু এ ভাবে সর্বস্ব ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে গড়শিবপুর জন্মের মতো ছেড়ে যেতে হবে, জন্মজন্মান্তরের গভীর চেতনা দিয়ে যে গড়শিবপুর তার মন আঁকড়ে ধরে ছিল, তা সে কি কোনোদিন ভাবত?

আর সে ফিরবে না৷ বাবাকে সে কলঙ্কের হাত থেকে—লোকের টিটকিরি থেকে মুক্ত রাখবে৷ তার ভাগ্যে পরের বাড়ির দাসী হয়ে চিরকাল বিদেশে নির্বাসন—যা ঘটে ঘটুক—বুড়ো বয়সে বাবার মুখ হাসাতে পারবে না৷ বাবা হয়তো দেশে গিয়ে বলেছেন, মেয়ে মরে গিয়েছে৷ খুব ভালো৷ আর সে দেখা দেবে না৷ দেশের কাছে মৃত হয়েই থাকবে যতদিন বাঁচবে সে৷ রাতের অন্ধকারে বাংলা মুছে গেল৷ কামরাটা ছোট—ধামা, লণ্ঠন, পেঁটরা, বিছানা, জলের কুঁজোতে একটা দিক ঠাসা, অন্য দিকে শরৎ গৃহিণীর জন্য বিছানা পেতে দিলে বেঞ্চিতে৷ তার স্বাভাবিক সেবা-প্রবৃত্তি এখানেও সজাগ আছে৷

গিন্নি বললেন, কোন ইস্টিশান রে মিনু?

তেরো-চোদ্দ বছরের মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে বললে, ব্যান্ডেল জংশন—

—সব শুয়ে পড় তোরা৷ শরৎ ওদের বিছানা করে দাও—

মিনু তাড়াতাড়ি বলল, আমি বিছানা পেতে নিচ্ছি মা—আমার পাতাই আছে৷

শরৎ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে চাইল৷ বাঃ, বেশ মেয়েটি৷ এতক্ষণ চুপ করে লাজুকের মতো আপনমনে বসে ছিল৷

পথে তার পর মেয়েটির সঙ্গে ওর বড় ভাব হয়ে গেল৷ ওর ভালো নাম মৃণাল, মৃদু স্বভাব, হৃদয়বতী৷ ও শরৎকে কি চোখে দেখে ফেলেছে, দিদি বলে ডাকে, লুকিয়ে হাতের কাজ কেড়ে নেয়৷

জামালপুরে বদল করে ওরা গেল প্রথমে মুঙ্গেরে৷ সেখানে গিন্নির ছোট ঠাকুরপো চাকরি করে৷ গঙ্গার ধারে বেশ ভালো বাসা৷ তিন দিন ধরে কাটাল সেখানে, শরৎ মিনুকে সঙ্গে নিয়ে কষ্টহারিণীর ঘাটে রোজ স্নান করে আসে৷ গৃহিণীর বাতের ধাত, তিনি বাথরুমে স্নান করেন৷

কষ্টহারিণীর ঘাটে প্রথমে যে দিন গিয়ে দাঁড়াল, শরতের মন অভিভূত হয়ে পড়ল—গঙ্গার রূপ দেখে৷ একদিকে জামালপুরের মাবক পাহাড়ের লম্বা টানা সুনীল রেখা, সামনে প্রশস্ত পুণ্যতোয়া জাহ্নবী, দু-একখানা পালতোলা নৌকা নদীবক্ষে, কত স্নানার্থীর যাতায়াত৷

পৃথিবীতে এমন সুন্দর জায়গাও আছে?

আবার চোখে জল আসে, শরৎ দেখে নি কখনো এসব৷

মিনু বললে, দিদি চেয়ে দ্যাখো—এই যে ভাঙা পাঁচিল না—এখানে মীরকাসিমের দুর্গ ছিল৷ ওই যে ফটক দিয়ে এলাম—দেখলে তো?

—তোর দিদি মুখ্যু মেয়ে, তোরা এ কালের ইস্কুলে পড়া মেয়ে—দিদিকে একটু শিখিয়ে নে৷ মীরকাসিমের দুর্গ বললে তো—কে ছিল সে?

—আহা দিদি, তুমি কিচ্ছু জান না৷ শোনো বলি—

তার পর মিনু বিজ্ঞভাবে স্কুলে সদ্য-অধীত ইতিহাসের বিদ্যা সবিস্তারে জাহির করে৷

শরৎ চোখ বড় বড় করে বলল—ও!

.

দিন বেশ কেটে যায়৷ একদিন সবাই মিলে চণ্ডীর মন্দিরে পুজো দিতে গেল, আর একদিন গেল সীতাকুণ্ড৷ মুঙ্গের থেকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে গমের ক্ষেত, ছোলার ক্ষেতের পাশের পথ দিয়ে গিয়ে, কত ছোট বড় বস্তি ছাড়িয়ে কতখানি বেড়িয়ে এল সবাই মিলে৷

পাহাড় জিনিসটা শরতের কাছে একটা বিস্ময়ের বস্তু৷

প্রথম যেদিন মিনু ওকে দেখালে ওই দ্যাখো দিদি জামালপুরের পাহাড়—শরৎ অপলক চোখে চেয়ে রইল সেদিকে৷ তারপর ভালো করে দেখলে যেদিন মুঙ্গের থেকে ওরা বখতিয়ারপুর রওনা হল৷ কাজরা স্টেশনের কাছে এবং স্টেশন ছাড়িয়ে বাঁদিকে সে কি লম্বা উঁচু পাথরের পাহাড়, এত বড় বড় পাথর যে আবার হয়, তার এত বড় স্তূপ হয়—এ কথা কে আবার কবে ভেবেছিল?

কিউলের কাছাকাছি এসে দূরে কত নীল পাহাড়—শরৎ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে৷ দেখে মনে আনন্দ হয়, দুঃখও হয়—কেবলই মনে হয় বাবাকে এসব সে যদি আজ দেখাতে পারত৷

রেলে যেতে যেতে একটা চমৎকার জায়গা দেখেছে, মনের মধ্যে গেঁথে গেল জায়গাটা৷ কাজরা পাহাড়ের একটা কি সুবৃহৎ গাছের ছায়ায় অনেকটা যেন পাথরের সানবাঁধানো রোয়াক, চারিধারে শুধু পাহাড়, নিকটেই একটা ঝর্ণা ঝিরঝির করে পাহাড় থেকে বয়ে নেমে এসেছে৷ কি শান্তি পাহাড়ের ওপর সান-বাঁধানো রোয়াকের মতো পাথরটাতে! কি ছায়া!

ট্রেনের এককোণে সে বসে বসে ভাবে বাবাকে নিয়ে সে ওইখানে একটা ছোট ঘর বাঁধবে৷ মাঝে মাঝে গড়শিবপুর থেকে বাবা আর সে ওখানে এসে বাস করবে দু-মাস, তিনমাস৷ জ্যোৎস্নারাতে এদিকের সেই যে পাথরখানা, বাবা ওটার ওপর বসে বেহালা বাজাবেন, তাঁর সেই প্রিয় গান গাইবেন—

‘‘তারা কোন অপরাধে, এ দীর্ঘ মেয়াদে, সংসার গারদে থাকিব বল’’—

ভাবতে বেশ লাগে৷ যদিও সে জানে, এসব ভাবনা আকাশকুসুম, কোথায় বা বাবা, কোথায় কে? এত দূর দূর সব জায়গা আছে তা হলে? গড়শিবপুর থেকে, কলকাতা থেকে? সত্যি পৃথিবীটা কত বড়—না মিনু?

মিনু হেসে খিল খিল করে গড়িয়ে পড়ে বলল—দিদি, তুমি বড় ছেলেমানুষ! কিচ্ছু জানো না৷

—মুখ্যু যে তোর দিদি—তোরা আজকাল কত পড়িস বোন কত জানিস—

—দিদি, তোমাদের বাড়ির যে বড় গড়টা আর সেই ভাঙা কি কি পাথরের মূর্তি সেই বলেছিলে?

—বারাহী দেবীর মূর্তি৷

—সেই অন্ধকারে চলে বেড়ায় জঙ্গলের মধ্যে—না?

—হ্যাঁ ভাই মিনু৷

—সামনে যে পড়ে তাকে মেরে ফেলেন বুঝি?

—এই রকম সবাই বলে৷ গড়ের জঙ্গলে সেই তিথিতে কেউ যায় না প্রাণের ভয়ে৷

—সব দিন বুঝি নয়?

—তিথির দিনে৷

—আচ্ছা দিদি—কখনো এরকম হতে দেখেছ তুমি? তোমাদেরই তো গড়—

শরৎ গড়শিবপুরের জঙ্গল থেকে বহুদূরে থেকেও যেন ভয়ে শিউরে উঠে বললে—না দিদি, আমি কিছু দেখি নি চোখে৷ তবে পায়ের দাগ দেখেছে অনেকে—আমিও দেখেছি ছোটবেলায়—

—কিসের পায়ের দাগ?

—বারাহী দেবীর পাথরের পায়ের ছাপ—

—সত্যি?

—সত্যি ভাই মিনু? তোর গা ছুঁয়ে বলছি—

শরৎ যুবতী হলে কি হবে, ছেলেপুলে হয় নি, একা নির্জন গ্রাম্য সংসারে চিরদিন কাটিয়েছে, বালিকা-স্বভাব তার যায় নি৷ যায় নি বলেই সে বালিকাদের সঙ্গে নিজেকে যত মিশ খাওয়াতে পারে, বড়দের দলে তেমন পারে না৷ মিনুর সঙ্গে তাই মিলছিল ভালোই—যেমন গাঁয়ে থাকতে মিলেছিল রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে৷

বখতিয়ারপুর থেকে ওরা গেল রাজগীর৷ কর্তার শরীর ভালো নয়, গিন্নির বাতের ধাত—রাজগীরের উষ্ণ-কুণ্ডে স্নান করে বাত ভালো করতে চান৷ মিনু ও শরৎ বাসা থেকে বেরিয়ে রাজগীরের বৌদ্ধমঠ পার হয়ে বাজার ও উষ্ণ-কুণ্ডকে ডাইনে রেখে বেণুবন ও বৈভার পর্বতের ছায়ায় ছায়ায় সোন ভাণ্ডার গুহা পর্যন্ত বেরিয়ে আসে সরস্বতী নদীর ধারের পথ বেয়ে৷ ওদের ডাইনেই থাকে সেই গৃধ্রকূট পর্বত ও সেই সুপবিত্র বেণুবন, বুদ্ধদেব যেখানে শিষ্য আনন্দকে উপদেশ দিয়েছিলেন! হাজার বছর ধরে পার্বত্য সরস্বতী নদীর বাতাসে বুদ্ধদেবের পদচিহ্নপূত করণ্ড ও বেণুবন ধ্বনিত হয়, হাজার হাজার বছরের জ্যোৎস্নালোকে বৈভার পর্বতের শিখরদেশ উদ্ভাসিত হয়—ছেলেমানুষ মিনু ও অশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে শরৎ, লোকে তার কিছুই খবর রাখে না৷ তবুও মিনু তার স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের জ্ঞানকে আশ্রয় করে বলল—এই যে রাজগীর দেখছ দিদি, এর নাম রাজগৃহ৷ মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ—জরাসন্ধের নাম জানো তো দিদি? এখানে জরাসন্ধের রাজধানী ছিল—

মগধের খবর রাখে না শরৎ, কিন্তু কাশীরাম দাসের মহাভারত ও গ্রাম্য যাত্রার কল্যাণে জরাসন্ধের নাম তার অপরিচিত নয়৷

শরতের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়৷ জরাসন্ধের রাজ্যে এসে গিয়েছে তারা—পুরাণের সেই জরাসন্ধ? কতদূরে এসে পড়েছে আজ…কত দূর বিদেশে?

এখানে প্রতিদিন ওরা উষ্ণ-কুণ্ডে স্নান করে, গিন্নিকে ধরে এনে রোজ স্নান করাতে হয়, শরৎ অত্যন্ত যত্নে নিয়ে আসে, অত্যন্ত যত্নে নিয়ে যায়৷ গিন্নি শরতের ওপর খুব সন্তুষ্ট—সেবাপরায়ণা শরৎ প্রাণ দিয়ে আশ্রয়দাত্রীর সেবা করে৷ সে সেবার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই৷

রাজগীর থাকতেই গিন্নির এক জা কোন জায়গা থেকে ছেলেপুলে নিয়ে ওদের ওখানে হাওয়া বদলাতে এলেন৷ ইনি নাকি বেশ বড়লোকের মেয়ে, স্বামী পশ্চিমের কোন শহরে ইনজিনিয়ার, মোটা পয়সা রোজগার করে৷ সঙ্গে দুটি ছেলেমেয়ে, একজন আয়া এসেছে৷ সর্বাঙ্গে সোনার গহনা—গুমোরে মাটিতে পা পড়ে না৷ দোহারা গড়ন, রং খুব ফর্সাও নয়, খুব কালো নয়৷ দাম্ভিক মুখশ্রী৷

প্রথম দিন থেকেই মিনুর কাকিমা শরতের ওপর ভালো ব্যবহার করত না৷ যেদিন গাড়ি থেকে নামল—সেই দিনই বিকেলে মিনু ও শরৎ রাজগীরের বাজার ছাড়িয়ে সরস্বতী নদীর ধারে বেড়িয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে ফিরল৷ মিনুর কাকি অমনি শরৎকে বলে উঠল, ছেলে দুটোকে একটু কোথায় ধরবে, না কোথা থেকে এখন বেড়িয়ে ফিরল—বামনী, ও বামনী খোকাদের কাপড় ছাড়িয়ে গা-হাত ধুইয়ে দাও—

তার পর থেকে প্রত্যেক সময় সে শরৎকে ডাকে ‘বামনী’ বলে৷ শরৎ নিজের হাতেই দুবেলার রান্নার ভার নিয়েছিল৷ বাড়ির পাচিকাকে যে চোখে দেখা উচিত, মিনুর কাকি সেই চোখেই দেখত ওকে৷

একদিন মিনুকে ডেকে বলল, হ্যাঁরে, বামনীকে নিয়ে রোজ রোজ যাস কোথায়?

—কে? দিদি? দিদির সঙ্গে বেড়াতে যাই—

—দ্যাখ, তোকে বলে দিই মিনু! চাকর-বাকরের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করা ভালো নয়৷ সেবার তো দেখি নি, ওকে কোথা থেকে আনলি?

—মা কলকাতা থেকে এনেছে এবার৷

—ক’টাকা মাইনে ঠিক হয়েছে জানিস?

—আমি জানি নে কাকিমা৷ তবে আমার মার যিনি গুরু-মা, কালীঘাটে থাকেন, তিনিই দিয়েছেন৷

যাকগে, ওদের সঙ্গে এত মেশামেশি ভালো নয় বাপু৷ ওদের নাই দিলেই মাথায় চড়ে বসবে, চাকর-বাকরকে কখনো নাই দিতে নেই৷ অমনি একদিন বলে বসবে দু-টাকা মাইনে বাড়িয়ে দাও—ওসব করিস নে৷

—উনি কিন্তু তেমন নয় কাকিমা—বড় ভালো, কি কথাবার্তা, ওঁদের দেশে মস্ত বড় বাড়ি ছিল, এখন পড়ে গিয়েছে—গড় ছিল বাড়িতে—কেমন দেখতে দেখছ তো? বড় বংশের মেয়ে—

মিনুর কাকিমা হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি! একটু সামলে নিয়ে বললে, তোকে এইসব গল্প করে বুঝি? কলকাতা থেকে এসেছে, ওই বয়েস—যাই হোক ওরা লোক ভালো হয় না৷ সে-সব তোর শোনার দরকারও নেই—মোট কথা তুই ছেলেমানুষ, ওর সঙ্গে অত মেলামেশা করো না—বারণ করলুম৷

তার পর থেকে মিনুর সত্যিই শরতের সঙ্গে বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেল, কাকিমার হুকুমে৷

একদিন মিনুর কাকিমা শরৎকে ডেকে বললে, ওগো বামনী শোনো এদিকে৷ আগে কোথায় কাজ করতে?

শরৎ এই বৌটির পাশ কাটিয়ে চলত—এ পর্যন্ত সামনেই এসেছে কম, উত্তর দিলে—কাজ বলছেন? কাজ—কলকাতাতেই—

—কোথায় বলো তো? আমরা কলকাতার লোক৷ সব চিনি৷ কোথায় ছিলে?

—কালীঘাটে গৌরী-মার কাছে৷

—না না, আমি বলছি কাজ করতে কোথায়?

—কাজ করি নি কোথাও৷

—তবে যে খানিক আগে বললে কাজ করতে! বাড়ি কোথায় তোমার?

—যশোর জেলার গড়শিবপুর—

—আচ্ছা, তোমার নাম কি বলো৷ কি পোস্টাফিস তোমার গাঁয়ের, আমরা চিঠি লিখব৷ তোমাকে সেখানে কেউ চেনে কিনা দেখা দরকার৷ অজানা লোককে রাখা ঠিক নয় কিনা৷ তোমার কেউ আছে, সেই কি নাম বললে, সেই গাঁয়ের?

শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ সে সত্য কথা বলে বিপদে পড়ে যাবে এমন তো ভাবে নি৷ কথা বানিয়ে বলা তার অভ্যাস নেই—তার বাবাও যেমন চিরকাল সোজা সরল কথা বলে এসেছেন, সেও তাই শিখেছে৷ এখন কি করা যায়, দেশে চিঠি লিখলে তো সব ফাঁস হয়ে যাবে৷

কিন্তু এর মধ্যে একটা সত্য বলবার ছিল৷ ডাকঘরের নাম তার জানা নেই৷ আগে ডাকঘর ছিল কুলবেড়ে৷ সে ডাকঘর উঠে গিয়েছে, বাবার কাছে সে শুনেছিল—তাদের কস্মিনকালে চিঠিপত্র আসে না, কেই-বা দেবে, ডাকঘর যে কোথায় হয়েছে৷

সে বললে—ডাকঘর কোথায় জানি নে—

—ওমা, সে কি কথা—ডাকঘর জানো না কোথায়—কে আছে তোমার?

—কেউ নেই মা—

কথাটা বলবার সময়ে শরতের গলা ধরে গেল, মিনুর কাকিমা সেটা লক্ষ্য করলে৷ গিন্নিকে গিয়ে বললে—দিদি লোক দেখে রাখতে হয়৷ বামনীর বাড়িঘর আজ জিজ্ঞেস করলুম, তা বলতে চায় না৷ আমি তো ভালো বুঝছি নে, ওকে তাড়াও—

গিন্নি বললেন, গৌরী-মা ওকে দিয়েছেন, তাঁর কাছে থাকত৷ ভালো মেয়ে বড্ড—কোনো বদচাল তো দেখি নি৷ ওর আর কেউ নেই, তখনি জানি৷ ওকে তাড়াতে পারব না৷

মিনুর কাকিমার এ খুঁটিনাটি জেরার পরদিন থেকে শরৎ ভয়ে আর সামনে বেরুতে চায় না সহজে৷ সে জানত না, গিন্নির কাছে তার সম্বন্ধে লাগানোর কথা৷ কিন্তু আবার কোনোদিন বাপের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে হয়তো বসবে বৌটি—হয়তো যে আশ্রয়টুকু আছে, তাও যাবে৷ তার চেয়ে সামনে না যাওয়া নিরাপদ৷

কিন্তু শরৎ এড়িয়ে যেতে চাইলেও মিনুর কাকিমা অত সহজে শরৎকে রেহাই দিতে রাজি নয় দেখা গেল৷ শরৎকে সে পছন্দও করে না—অথচ পছন্দ না করার মধ্যেই শরৎ সম্বন্ধে ওর কেমন এক ধরনের উগ্র কৌতূহল৷

একদিন শরৎকে ডেকে বললে, ও বামনী—শোনো—

শরৎ কাছে গিয়ে বললে, কি বলছেন?

—তোমার হাতের রান্না বেশ ভালো৷ কোন জেলায় বাপের বাড়ি বললে সেদিন যেন—

শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ এই বুঝি আবার—

সে বললে—যশোর জেলা৷

—যশোর জেলা৷ বাঙাল দেশের নিরিমিষ্যি রান্না বাপু তোমাদের ভালোই৷ তোমার বয়েস কত?

—সাতাশ বছর৷

—না, তার চেয়ে বয়েস বেশি৷ বত্রিশ-তেত্রিশের কম না৷ তোমাদের হিসেব থাকে না৷

শরৎ চুপ করে রইল৷ এর কোনো উত্তর নেই৷

—তোমার বিয়ে হয়েছিল কোথায়?

—আমাদের গাঁয়ের কাছেই৷

—কতদিন বিধবা হয়েছ?

এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে শরতের মনে বড় কষ্ট হয়৷ যা ভুলে গিয়েছে, যা চুকেবুকে গিয়েছে কতদিন আগে, সে-সব দিনের কথা, সে-সব পুরনো কাসুন্দি—এখন আর ঘেঁটে লাভ কি?

—তবু সে বললে, অনেকদিন আগে৷ আমার তখন আঠার বছর বয়েস৷

—সেই থেকে বুঝি কলকাতায়—মানে, চাকরি করছ?

—না, দেশেই ছিলাম৷

শরৎ খুব সতর্ক ও সাবধান হল৷ তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল৷

—কলকাতায় কতদিন আগে এসেছিলে?

—বেশিদিন না৷

—গাঁ থেকে কার সঙ্গে—মানে কলকাতায় আনলে কে?

শরতের জিব ক্রমশ শুকিয়ে আসছে৷ তার মুখে কথা আর যোগাচ্ছে না৷ কাঁহাতক বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে সে?

—কালীঘাট এসেছিলাম মা—গৌরী-মার কাছে সেই থেকে ছিলাম৷

সেদিন মিনু এসে পড়াতে তার কাকিমার জেরা বন্ধ হল৷ শরৎ মুক্তি পেয়ে সামনে থেকে সরে গেল৷

পরদিন বাসার সকলে মিলে উষ্ণকুণ্ডে স্নান করতে গেল৷ শরৎ ছেলেমেয়েদের সামলে নিয়ে পেছনে পেছনে চলল৷ মিনুর মা সেদিন যান নি৷ মিনুর কাকিমার সঙ্গে যে আয়া এসেছিল, সে যেন এখানে এসে ছুটি পেয়েছে—খাটুনি যত কিছু শরতের ঘাড়ে৷ কাকিমার দুটি ছেলেমেয়ে যেমন দুষ্ট তেমনি চঞ্চল—তাদের সামলাতে সামলাতে শরৎ হয়রান হয়ে পড়ে৷

মিনুর কাকিমা বলে, ও বামনী, ওই মিন্টুকে চার পয়সার গরম জিলিপি কিনে এনে দাও তো বাজার থেকে—

বাজারে সকলের সামনে দোকান থেকে জিনিস কেনা শরতের অভ্যেস নেই৷ চুপি চুপি মিনুকে বললে, মিনু দিদি, যাবি আমার সঙ্গে?

মিনু সব সময়েই তার দিদিকে সাহায্য করতে রাজি৷

বললে, চলো দিদি—

জিলিপি কিনে ফিরে আসতেই মিনুর কাকিমা বললে, চলো কুণ্ডীতে কাপড়গুলো নিয়ে—সাবানের বাক্স নেও৷ নেয়ে আসি—

মিনু পেছন থেকে এসে সাবানের বাক্স নিজেই নিয়ে চলল৷

স্নান শেষ হয়ে গেল৷ সিক্ত বসনে সবাই উঠে এসে মেয়েদের কাপড় ছাড়বার ঘেরা জায়গার মধ্যে ঢুকল৷ শরৎও স্নান করে এল৷ সে লক্ষ করল, মিনুর কাকিমা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে৷ পশ্চিমের জলহাওয়ার গুণে হয়তো শরতের স্বাস্থ্য আরও কিছু ভালো হয়ে থাকবে, তার গৌর তনুর জলুস আরও খুলে থাকবে, সিক্তবসনা দীর্ঘদেহা সে তরুণীর মূর্তি এমন মহিমময়ী দেখাচ্ছিল যে রাস্তার কত লোক তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল৷

মিনু অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে ভাবলে—দিদি যে বলে তাদের রাজার বংশ, মিথ্যে নয় কথাটা৷ ওই তো কাকিমা অত সেজেগুজে এসেছেন, দিদির পাশে দাঁড়াতে পারেন না—

মিনুর কাকিমাও বোধ হয় শরতের অদ্ভুত রূপে কিছুক্ষণের জন্যে মুগ্ধ না হয়ে পারলে না—কারণ সেও খানিকটা শরতের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷

সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন এক ধরনের ভাব হল মনে—সেই পুরাতন মনোভাব, সুন্দরী নারীর প্রতি সাধারণ নারীর ঈর্ষা৷

সে ধমকের সুরে বললে, একটু হাত চালিয়ে কাপড়টাপড়গুলো কেচে-টেচে নাও না বাপু, তোমার সব কাজেই ন্যাড়া-ব্যাড়া—

যেন শরতকে খাটো করে অপমান করে ওর নিজের মর্যাদা আভিজাত্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করলে৷

ফিরবার পথে মিনুর কাকিমা বললে, তুমি একটু আগে হেঁটে যাও বাপু, আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছি—তোমাকে আবার গিয়ে দিদির গরমজল চড়াতে হবে—কাপড়গুলো নিয়ে গিয়ে রোদে দাও গে—

বড় এক বোঝা ভিজে কাপড় শরতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাকিমা মিনুকে ও নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে পিছিয়ে পড়ল৷ মিনু বলল, দিদিকে আজ চমৎকার দেখাচ্ছিল নেয়ে উঠে, না কাকিমা?

কেন মিনু হঠাৎ একথা বললে? মিনুর কাকিমাও বোধ হয় ওই ধরনের কোনো কথাই ভাবছিল৷ হঠাৎ যেন চমকে উঠে মিনুর দিকে চেয়ে রইল অল্প একটু সময়ের জন্যে৷ পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, পরের ঘি-দুধ খেলে এমন সবারই হয় বাপু—তুই চল, নে—

বিকেলে আবার বৌটি ডাকলে শরতকে৷ বৌ নিজে স্টোভ ধরিয়ে চা করে এক পেয়ালা মুখে তুলে চুমুক দিচ্ছে, আর একটা ধূমায়মান পেয়ালা সামনে বসানো মেঝের ওপর৷ শরতকে বললে, ও বামনী, দিদিকে চা-টা দিয়ে এসো তো?

তার পরের কথাতে শরৎ বড় চমৎকৃত হয়ে গেল কিন্তু৷

বৌটি বললে, তোমার জন্যেও এক পেয়ালা আছে, ওটা দিদিকে দিয়ে এসো—এসে তুমি খাও—

শরৎ অগত্যা ফিরে এসে কলাই করা পেয়ালাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে, বৌটি বললে, এখানে বসে খাও না গো, তাড়াতাড়ির কি আছে?

শরৎ বসে চা খেতে লাগল কিন্তু কোনো কথা বললে না৷

মিনুর কাকিমা আবার বললে, তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি৷ দিদির কাছ থেকে তোমায় যদি আমি নিয়ে যাই, তুমি মাইনে নেবে কত?

শরৎ আরও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে—আমাকে?

—হ্যাঁ গো—তোমাকে৷ বলো না মাইনে কত নেবে?

—গিন্নিমা যেতে দেবেন না আমায়৷

মিনুর কাকিমা মুখ নেড়ে বললে, সে ভাবনা তোমার না আমার? আমি যদি বলেকয়ে নিতে পারি! মানে আর কিছু না, যেখানে থাকি খোট্টা বামুনে রাঁধে, বাঙালীর মুখে সে রান্না একেবারে অখাদ্য৷ আমার নিজের ওসব অভ্যেস নেই—হাঁড়িহেঁসেল কখনো করি নি, বাপের বাড়িতেও না, শ্বশুরবাড়িতে এসে তো নয়ই৷ তোমাদের বাঙাল দেশের রান্না ভালো—তাই বলছিলাম—বুঝলে?

শরতের মুখ চুন হয়ে গেল৷

এমন একটা আশ্রয় পেয়ে সে যে কোথাও যেতে রাজি নয়, এদের ছেড়ে মিনুকে ছেড়ে৷ কিন্তু সে এখনও পরের দয়ার পাত্রী, তার কোনো ইচ্ছে বা দয়া এসব স্থলে খাটবে না, সে ভালোই বোঝে৷

সে চুপ করে রইল৷

মিনুর কাকিমা ভুল বুঝে বললে, আচ্ছা তাই তবে ঠিক রইল৷ মাইনের কথা একটা কিন্তু ঠিক করে ফেলা ভালো—তা বলছি৷ তখন যে বলবে—

শরৎ মিনুকে নিরিবিলি পেয়ে বললে, মিনু বেড়াতে যাবি?

—চলো দিদি—কোন দিকে যাবে?

—সোন ভাণ্ডারের গুহার দিকে চল—

নদীর ধারে ধারে বনাবৃত পথ গৃধ্রকূট শৈলের ছায়ায় ছায়ায় সোন ভাণ্ডার ছাড়িয়ে রাজগীরের প্রাচীনতর অঞ্চলে জরাসন্ধের মল্লভূমির দিকে বিস্তৃত৷ ওরা সেই পথে চলল৷ কত পাথরের নুড়ি পড়ে আছে পাহাড়ের তলায়, নদীর পাড়ে৷ সমতলবাসিনী শরৎ এখনও এই সব রঙচঙে নুড়ির মোহ কাটিয়ে ওঠে নি, দেখতে পেলেই কুড়িয়ে আঁচলে সঞ্চয় করে৷

মিনু বললে, তুমি একটা পাগল দিদি! কি হবে ওসব?

—বেশ না এগুলো? দ্যাখ এটা কেমন—

—কি করবে?

—ইচ্ছে কি করে জানিস! ওসব দিয়ে ঘর সাজাই—কিন্তু ঘর কোথায়?

—জড়ো করেছ তো একরাশ৷—তাতেই সাজিও—

—জানিস মিনু, তোর কাকিমা কি বলেছে?

—কি দিদি?

—আমায় নিয়ে যেতে চায় ওদের বাড়ি৷

—তোমার যাওয়া হবে না, আমি মাকে টিপে দেব!

—আমি তোদের ফেলে কোথাও যেতে চাই নে মিনু৷ যখন আশ্রয় পেয়েছি, যতদিন বাঁচি এখানেই থাকব৷

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হল মিনুর কাকিমার সঙ্গে৷ মিনুর মা বললেন—যাও মা, ওরা কাশীতে যাচ্ছে, তোমার তীর্থ করা হবে এখন৷ আমি এর পরে তোমায় কাছে নিয়ে আসব৷

মিনুর কাকিমা সগর্বে অন্যান্য বোঁচকা, ট্রাঙ্ক, আয়া ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শরৎকেও নিয়ে গিয়ে কাশী নামল দিন-দশেক পরে৷ মাঝারি গোছের তেতলা বাড়ি, ছোট্ট সংসার, স্বামী-স্ত্রী আর এক দেওর৷ দেওর লাহোর মেডিকেল ইস্কুলে পড়ে, এবার পাশ দেবে৷ নীচে একঘর গরিব লোক থাকে ওদের ভাড়াটে৷

শরৎ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি, কিন্তু নতুন জায়গায় এসে তার এত খারাপ লাগছিল! একটা কথা বলবার লোকও নেই৷ মিনুর কাকিমা চাকর-বাকরকে আমল দেয় না, ছেলেমেয়েদেরও তার ভালো লাগে না৷ যেমন দুষ্ট, তেমনি একগুঁয়ে এগুলো৷ যা ধরবে তাই৷

একদিন মিনুর কাকিমা বললে—ও বামনী, এই ডালটুকু ওই নীচের তলার পটলের মাকে দিয়ে এসো—চেয়েছিল আমার কাছে, গরিব লোক—

শরৎ ডাল দিতে গিয়ে দেখল একটি বৌ রান্নাঘরে বসে ওর দিকে পিছন ফিরে রান্না করছে৷ ওর কথায় বৌটি ওর দিকে ফিরতেই শরৎ বললে, উনি ডাল পাঠিয়ে দিয়েছেন—রাখুন—

তার পরেই বৌয়ের চোখ দুটোর দিকে চেয়ে শরতের মনে কেমন খটকা লাগল৷

বৌটি হেসে বললে, তোমার গলা নতুন শুনছি৷ তুমি বুঝি ওদের এখানে নতুন ভর্তি হয়েছ? বলছিলেন কাল দিদি৷ বসো ভাই৷ আমি চোখে দেখতে পাইনে—বাটিটা রাখ এই সিঁড়ির কাছে৷

ও, তাই অমন চোখের চাউনি!

শরতের বুকের মধ্যে যেন কোথায় ধাক্কা লাগল৷

বৌটি আবার বললে, তোমার নাম কি ভাই? তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে বয়েস বেশি নয়৷

—আমার নাম শরৎ৷ বয়েস আপনার চেয়ে বেশিই হবে বোধ হয়—

—না ভাই, আমার বয়েস কম নয়৷ তা আমাকে তুমি আপনি আজ্ঞে কোরো না৷ আমি একা থাকি এই ঘরে—উনি তো বাইরের কাজেই ঘোরেন৷ তুমি এসো, দুজনে গল্প করব৷

—বেশ ভাই৷ তাহলে তো বেঁচে যাই—

শরতের মনের মধ্যে কাশী আসবার কথা শুনে একটু আগ্রহ না হয়েছিল এমন নয়৷ মিনুর মার কাছে এজন্যে সে না আসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি৷ কাশী গয়া কজন বেড়াতে পারে? তাদের গাঁয়ের নীলমণি চাটুজ্জের মা শরতের ছেলেবেলায় কাশীতে এসে তীর্থ করে যান—সে গল্প বুড়ির এখনো ফুরলো না৷ আর বছরও সে গল্প বুড়ির মুখে শরৎ শুনেছে৷ সেই কাশীতে যদি এখন যাওয়া হয়—হোক!

কাশী এসে কিন্তু মিনুর কাকিমার ফরমাশ আর হুকুমের চোটে এতটুকু সময় পায় না শরৎ৷ সকালে উঠে হেঁসেলের কাজ শুরু৷ একদফা ছোটদের দুধবার্লি, একদফা বড়দের চা খাবার, বাজল বেলা আটটা৷ তার পরে রান্নার পালা শুরু হল এবং খাওয়ানো-দাওয়ানোর কাজ মিটতে বেলা দেড়টা৷ ওবেলা তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে আবার চা-খাবারের পালা৷ সন্ধ্যার সময় বাবুর বন্ধুরা বৈঠকখানায় এসে বসে, রাত নটা পর্যন্ত বিশ পেয়ালা চা-ই হবে৷

দুপুরবেলায় কাজকর্ম চুকিয়ে ফাঁক পেলে শরৎ এসে বসে একতলায় অন্ধ বৌটির কাছে৷ শরৎ তার পরিচয় নিয়েছে—ওর নাম রেণুকা, ওর বাবা কাশীতেই স্কুল-মাস্টারি করতেন৷ মা নেই, ভাই নেই, আজ কয়েক বছর আগে ওর বিয়ে দিয়েই বাবা মারা যান৷ ওরা ব্রাহ্মণ, স্বামী সামান্য মাইনেতে কি একটা চাকরি করে৷ সন্ধ্যার সময় ভিন্ন বাড়ি আসতে পারে না—সারাদিন রেণুকাকে একা থাকতে হয় বাসাতে৷

শরৎ বলে, তুমি বাংলা দেশে যাও নি কখনো?

—না ভাই, এখানেই জন্ম, বিশ্বনাথের চরণ ছেড়ে আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই৷

—দেশ ছিল কোথায় বাবার মুখে শোনো নি?

—হালিশহর বলদেঘাটা৷ এখনো আমার কাকারা সেখানে আছেন শুনেছি৷

দুজনে বসে সুখদুঃখের কথা বলে৷ রেণুকার অনেক কাজ শরৎ করে দেয়৷ বড় ভালো লাগে এই অন্ধ মেয়েটিকে৷ মন বড় সরল, অল্পেই সস্তুষ্ট, জীবন ওকে বেশি কিছু দেয় নি, যা দিয়েছে তাই নিয়েই খুশি আছে৷

রেণুকা বলে, একদিন আমার বাড়ি কিছু খাও ভাই—

—বেশ, আমি কি খাব না বলছি?

—রান্না তো খেতে পারবে না৷ নিরিমিষের হাঁড়ি নেই—সব একাকার৷ রান্না করে খাবে আলাদা?

—না ভাই, সে হাঙ্গামাতে দরকার নেই—তুমি ফল খাইও বরং—

রেণুকার স্বামী ছানা ফলমূল মিষ্টি কিনে রেখে গিয়েছিল৷ একদিন বিকেলে রেকাবি সাজিয়ে রেণুকা ওকে খেতে দিলে৷ চোখে দেখতে পায় না বটে—কিন্তু কাজকর্ম সবই করে হাতড়ে হাতড়ে৷

শরৎ একদিন মিনুর কাকিমাকে বলেকয়ে বিশ্বনাথ দর্শনের ছুটি নিলে৷ ওদের আয়া সঙ্গে গেল মন্দিরের পথ দেখানোর জন্য৷ শরৎ রেণুকাকে হাত ধরে নিয়ে গেল৷

বিশ্বনাথের গলির মধ্যে কি লোকের ভিড়! কত বৌ-ঝি, কত লোকজন! শরৎ অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে, তার কাছে সব কিছু নতুন, সবই আশ্চর্য৷ মন্দির থেকে বার হয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলো বিকেলবেলা৷ নিত্য উৎসব লেগেই আছে সেখানে৷ নৌকো আর বজরাতে কত লোক সাজগোজ করে বেড়াতে বেরিয়েছে৷

রেণুকা বললে, আমি এসব জায়গা দেখেছি ছেলেবেলায়৷ চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে অসুখে চোখ হারিয়েছি৷ এখনো সেইরকম আছে, কানে শুনে বুঝতে পারি৷

—ভারি ভালো জায়গা ভাই৷ কলকাতা শহর দেখে ভালো লেগেছিল বটে—কিন্তু সেখানে শান্তি পাই নি এমন৷ এখানে মন জুড়িয়ে গেল৷

—একদিন গঙ্গায় নাইতে এসো—

—সময় পাই নে, আসি কখন? কাল একবার বলব—

শরৎ আর রেণুকা একটু তফাৎ হয়ে বসে৷ চারিদিকের জন-কোলাহল ও সম্মুখে পুণ্যতোয়া জাহ্নবীর দিকে চেয়ে শরতের নতুন চোখ ফোটে৷ সত্যই সে বড় শান্তি পেয়েছে মনে৷

আয়া বললে, একদিন তোমাকে কেদার ঘাটে নিয়ে যাব—

শরৎ চমকে উঠে বললে, কি ঘাট?

—কেদার ঘাট৷ ওই দিকে—আমার সঙ্গে যেয়ো—

শরতের মন স্বপ্নঘোরে একমুহূর্তে কোন পথে চলে গেল পাহাড় পর্বত বনবনানীর ব্যবধান ঘুচিয়ে৷ গরিব বাবা কত কষ্টে চাল যোগাড় করে, নুন তেল যোগাড় করে এনে বলতেন ভালো করে রাঁধো, বাবা যে ছেলেমানুষের মতো, ঘরে কিছু নেই, তা বুঝবেন না—ভালো খাওয়াটি হওয়া চাই—নইলে অবুঝের মতো রাগ করবেন, অভিমান করবেন৷ এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারেন না বাবা৷ কোথায় গেলেন বাবা! জানবার জন্যে বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে, তিনি এখন কোথায় কি ভাবে আছেন! এমন জায়গা কাশী, সেই কতকাল আগের গল্প শোনা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট সব দেখা হল—কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় একথা আসে কেন, বাবা যে এসব কিছু দেখলেন না, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর এখন তীর্থধর্ম করবার সময়, অথচ বাবার অদৃষ্টে জুটল না কিছু! তিনি গোয়ালপাড়া বাগদিপাড়ায় বেহালা বাজিয়ে, গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন, ফিরে এসে অবেলায় হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছেন কিম্বা তাও খাচ্ছেন না, কে তাঁকে দেখছে, কে মুখের দিকে চাইবার আছে তাঁর!

কাশী গয়া সব তুচ্ছ—কিছু ভালো লাগে না৷

শরৎ বলে, আচ্ছা রেণুকা, কাশীতে দুজন লোকের কত হলে চলে?

রেণুকা ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে, তা কুড়ি টাকার কম তো কোনো মাস যেতে দেখলাম না৷ আমরা তো দুটো মানুষ থাকি৷ কেন ভাই?

শরৎ কি ভেবে কি কথা বলছে সে নিজেই জানে না৷ রেণুকা ভাবে, শরৎ হঠাৎ কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেল, না কি—আর ভালো করে কথা বলছে না কেন?

বাড়ি ফিরে মিনুর কাকিমার ফাইফরমাশ ও হুকুমের মধ্যে রান্নাঘরে রাঁধতে বসে সে ভাবে তার কোন জীবনটা সত্যি, গড়শিবপুরের ভাঙা গড়বাড়ির বনের সেই জীবন, না পরের বাড়ির হাঁড়ি-হেঁসেলের এ জীবন?

০৬. মিছরিপোখরায় বন্ধুর বাড়ি

মিনুর কাকিমা শরৎকে প্রায়ই বেরুতে দেন না৷ আজ তিনি যাবেন মিছরিপোখরায় তাঁর বন্ধুর বাড়ি, শরৎকে বাড়ি আগলে বসে থাকতে হবে, কাল তিনি লকসাতে মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, শরৎ ছেলেমেয়ে সামলে বাড়ি বসে থাকবে৷

একদিন মিনুর কাকিমা বললে, পটলের বউয়ের ওখানে অত ঘন ঘন যাও কেন?

—কেন?

—আমি পছন্দ করি নে৷ ওরা গরিব লোক, আমাদের ভাড়াটে, অত মাখামাখি করা ভালো না৷

—আমি মিশি, আমিও তো গরিব লোক৷ এতে আর দোষ কি বলুন?

—তুমি বড় মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করেছ দেখছি৷ পটলের বউ মেয়ে ভালো নয়—তুমি জানো কিছু?

শরৎ এতদিন মিনুর কাকিমার কোনো কথার প্রতিবাদ না করে নীরবে সব কাজ করে এসেছে, কিন্তু অন্ধ রেণুকার নামে কটু কথা সে সহ্য করতে পারলে না৷ বললে—আমি যতদূর দেখেছি কোনো বেচাল তো দেখি নি৷ আমি যদি যাই, আপনাকে তাতে কেউ কিছু বলবে না তো!

—না, আমি চাই আমার বাড়ির চাকরবাকর আমার কথা শুনবে—যাও, রান্নাঘরের দিকে দ্যাখো গে—

শরৎ মাথা নামিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল৷ সেখানে গিয়েই সে ক্ষুণ্ণ অভিমানে কেঁদে ফেললে৷ আজ সে এ কথার জবাব দিত মিনুর কাকিমার, একবার ভেবেছিল দিয়েই দেবে উত্তর, যা থাকে ভাগ্যে৷

তবে মুখে জবাব না দিলেও কাজে সে দেখালে, মিনুর কাকিমার অসঙ্গত হুকুম সে মানতে রাজি নয়৷ রেণুকার বাড়ি সেই দিনই বিকেলের দিকে সে আবার গেল৷

রেণুকা ওকে পেয়ে সত্যিই বড় খুশি হয়৷ বললে—ভাই, আজ চলো আমরা নতুন কোনো জায়গায় যাই৷

—কোথায় যাবে?

—আমি রাস্তাঘাট চিনি নে, তুমি বাঙালীটোলায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে?

—কেন পারব না, চলো৷

—ছ’ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি—জিজ্ঞেস করে চলো যাওয়া যাক৷

একে ওকে জিজ্ঞেস করে ওরা ধ্রুবেশ্বরের গলিতে নির্দিষ্ট বাসায় পৌঁছলো৷ তারাও খুব বড়লোক নয়, ছোট দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রী, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে৷ বাড়ি অনেক দিন আগে ছিল ঢাকা জেলায় কি এক পাড়াগাঁয়ে, বাড়ির কর্তা বেনারস মিউনিসিপ্যালিটির কেরানি, সেই উপলক্ষে এখানে বাস৷

বাড়ির গিন্নির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ তিনি ওদের যত্ন করে বসালেন, চা করে খেতে দিলেন৷

তাদের বাড়িতে একটি চার-পাঁচ বছরের খোকা আছে, নাম কালো৷ দেখতে কি চমৎকার, যেমন গায়ের রং, তেমনি মুখশ্রী, সোনালি চুল, চাঁচাছোলা গড়ন৷

শরৎ বললে, এমন সুন্দর ছেলের নাম কালো রাখলেন কেন?

গিন্নি হেসে বললেন, আমার শ্বশুরের দেওয়া নাম৷ তাঁর প্রথম ছেলে মারা যায়, নাম ছিল ওই৷ তিনিই জোর করে কালো নাম রেখেছেন৷

প্রথম দর্শনেই খোকাকে শরৎ ভালোবেসে ফেললে৷

বললে, এসো খোকা, আসবে?

খোকা অমনি বিনা দ্বিধায় শরতের কাছে এসে বসলো৷

শরৎ বললে, আমি কে হই বলো তো খোকন?

খোকা হেসে শরতের মুখের দিকে চোখ তুলে চুপ করে রইল৷

খোকার মা বললেন, মাসিমা হন, মাসিমা বলে ডাকবে—

খোকা বললে, ও মাসিমা—

—এই যে বাবা, উঠে এসে কোলে বসো—

খোকার মা বললেন, সেই ছড়াটা শুনিয়ে দাও তোমার মাসিমাকে খোকন!

খোকা অমনি দাঁড়িয়ে উঠে বলতে আরম্ভ করলে—

এই যে গঙ্গা পুণ্য ঢারা

বিমল মুরটি পাগলপারা

বিশ্বনাটের চরণটলে বইছে কুটুহলে—

খোকা ‘ত’ এর জায়গায় ‘ট’ বলে, ‘ধ’ এর জায়গায় ‘ঢ’ বলে—শরতের মনে হল খোকার মুখে অমৃত বর্ষণ হচ্ছে যেন৷ অভাগিনী শরৎ সন্তানস্নেহ কখনো জানে নি, কিন্তু এই খোকাকে দেখে তার সুপ্ত মাতৃহৃদয় যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল৷ কত ছেলে তো দেখলে এ পর্যন্ত, মিনুর কাকিমারই তো এ বয়সের ছেলে রয়েছে, তাদের প্রতি স্নেহ তো দূরের কথা—শরৎ নিতান্তই বিরক্ত৷ এ ছেলেটির ওপর এমন ভাবের কারণ কি সে খুঁজে পায় না৷ কিন্তু মনে হল এ খোকা তার কত দিনের আপনার, একে দেখে, একে কোলে করে বসে ওর নারীজীবন যেন সার্থক হল৷

শরৎ সেদিন সেখান থেকে চলে এল বটে, কিন্তু মন রেখে এল খোকার কাছে৷ কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার মন হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়৷

গড়বাড়ির জঙ্গলে তাদের পুরনো কোঠা৷

বাবা বাড়ি নেই৷

—ও খোকন, ও কালো—

—কি মা?

—বেরিও না এই রোদ্দুরে হটর হটর করে—ঘরে শোবে এসো—

খিল খিল করে দুষ্টুমির হাসি হেসে খোকা ছুটে পালায়৷

হাঁড়ি-হেঁসেলের অবসরে নতুন আলাপী খোকনকে ঘিরে তার মাতৃহৃদয়ের সে কত অলস স্বপ্ন৷ যে সাধ আশা কোনোকালে পূর্ণ হবার নয়, ইহজীবনে নয়, মন তাকেই হঠাৎ যেন সবলে আঁকড়ে ধরে৷

দিন দুই পরে সে রেণুকাকে বলে—চল ভাই, কালোকে দেখে আসি গে—

কিন্তু সেদিন রেণুকার যাবার সময় হয় না৷ স্বামী দুজন বন্ধুকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছেন, রান্নাবান্নার হাঙ্গামা আছে৷

আরও দিনকয়েক পরে আবার শরতের অবসর মিলল—এবার রেণুকাকে বলেকয়ে নিয়ে গেল ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ দূর থেকে বাড়িটা দেখে ওর বুকের মধ্যে যেন সমুদ্রের ঢেউ উথলে উঠল—বড় বড় পর্বতপ্রমাণ ঢেউ যেন উদ্দাম গতিতে দূর থেকে ছুটে এসে কঠিন পাষাণময় বেলাভূমির গায়ে আছড়ে পড়ছে৷

খোকা দেখতে পেয়েছে, সে তাদের বাড়ির দোরে খেলা করছিল৷ সঙ্গে আরও পাড়ার কয়েকটি খোকাখুকি৷

শরতের বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল—খোকা যদি ওকে না চিনতে পারে!

কিন্তু খোকা তাকে দেখেই খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুধে-দাঁত বার করে একগাল হেসে ফেললে৷

শরতের অদৃষ্টাকাশের কোন সূর্য যেন রাশিচক্রের মধ্যে দিয়ে পিছু হঠতে হঠতে মীনরাশিতে প্রবিষ্ট হলেন, যার অধিপতি সর্বপ্রকার স্নেহপ্রেমের দেবতা শুক্র!

—চিনতে পারিস খোকা? আয়—

শরৎ হাত বাড়িয়ে দিলে ওকে কোলে নেবার জন্য৷ খোকা বিনা দ্বিধায় ওর কোলে এসে উঠল, বললে—মাছিমা—

—তাহলে তুই দেখছি ভুলিস নি খোকা—

খোকার মা ছুটে এসে বললেন, যাক, এসেছ ভাই? ও কেবল মাসিমা মাসিমা করে, একদিন ভেবেছিলাম রেণুকাদের বাড়ি নিয়েই যাই—দাঁড়াও ভাই, পাশের বকসীদের বাড়ির বড় বউ তোমাকে দেখতে চেয়েছে, ডেকে আনি—

বকসীদের বাড়ির দুই বউ একটু পরে হাজির৷ দুজনেই বেশ সুন্দরী, গায়ে গহনাও মন্দ নেই দুজনের৷ বড় বউ প্রণাম করে বললে—ভাই, আপনার কথা সেদিন দিদি বলছিলেন, তাই দেখতে এলুম—

—আমার কথা কি বলবার আছে বলুন?

—দেখে মনে হচ্ছে, বলবার সত্যিই আছে৷ যা নয় তা কখনো রটে ভাই? রটেছে আপনার নামে—

শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ কি রটেছে তার নামে? এরা কি কেউ গিরীন প্রভাসের কথা জানে নাকি? সে বললে, আমার নামে কি শুনেছেন?

বড় বউ হেসে বললে, না, তা আর বলব না৷

শরতের আরও ভয় হল৷ বললে, বলুনই না?

—আপনার চেহারার বড় প্রশংসা করছিলেন দিদি৷ আমায় বললেন, ভাই রেণুকাদের বাড়িও’লাদের বাড়িতে তিনি এসেছেন রান্না করতে, কিন্তু অনেক বড় ঘরে অমন রূপ নেই৷ সে যে সামান্য বংশের মেয়ে নয়, তা দেখলে আর বুঝতে বাকি থাকে না৷ তাই তো ছুটে এলাম, বলি দেখে আসি তো—

শরৎ বড় লজ্জা পায় রূপের প্রশংসা শুনলে৷ এ পর্যন্ত তা সে অনেক শুনেছে—রূপের প্রশংসাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল জীবনে, আজ এই দশা কেন হবে নইলে? কিন্তু সে-সব কথা বলা যায় না কারো কাছে, সুতরাং সে চুপ করেই রইল৷

কালোর মা বললেন, খোকা তো মাসিমা বলতে অজ্ঞান! তবু একদিনের দেখা! কি গুণ তোমার মধ্যে আছে ভাই, তুমিই জানো—

বকসীদের বড় বউ বললে, একটু আমাদের বাড়ি পায়ের ধুলো দিতে হবে ভাই—

—এখন কি করে যাব বলুন, ছুটি যে ফুরিয়ে এল—

—তা শুনব না, নিয়ে যাব বলেই এসেছি—দিদিও চলুন, রেণুকা ভাই তুমিও এসো—খোকাকে কোলে নিয়ে শরৎ ওদের বাড়ি চলল সকলের সঙ্গে৷

বড় বউ বললে, ভাই তোমার কোলে কালোকে মানিয়েছে বড় চমৎকার৷ ও যেমন সুন্দর, তুমিও তেমন৷ মা আর ছেলে দেখতে মানানসই একেই বলে—

ওদের বাড়ি যে জলযোগের জন্যেই নিয়ে যাওয়া একথা সবাই বুঝেছিল৷ হলও তাই, শরতের জন্যে ফলমূল ও সন্দেশ—বাকি দুজনের জন্যে সিঙাড়া-কচুরির আমদানিও ছিল৷ বউ দুটির অমায়িক ব্যবহারে শরৎ মুগ্ধ হয়ে গেল৷ খানিকক্ষণ বসে গল্পগুজবের পর শরৎ বিদায় চাইলে৷

বড় বউ বললে, আবার কিন্তু আসবেন ভাই, এখন যখন খোকার মাসিমা হয়ে গেলেন, তখন খোকাকে দেখতে আসতেই হবে মাঝে মাঝে—

—নিশ্চয়ই আসব ভাই—

খোকা কিন্তু অত সহজে তার মাসিমাকে যেতে দিতে রাজি হল না৷ সে শরতের আঁচল ধরে টেনে বসে রইল, বললে—এখন টুমি যেয়ো না মাছিমা—

—যেতে দিবি নে?

—না৷

—আবার কাল আসব৷ তোর জন্যে একটা ঘোড়া আনব—

—না, টুমি যেয়ো না৷

শরৎ মুগ্ধ হয় শিশু কত সহজে তাকে আপন বলে গ্রহণ করেছে তাই দেখে৷ যেন ওর কতদিনের জোর, কতদিনের ন্যায্য অধিকার৷ সব শিশু যে এমন হয় না, তা শরতের জানতে বাকি নেই৷

খোকা ওর ছোট্ট মুঠি দিয়ে শরতের আঁচলে কয়েক পাক জড়িয়েছে৷ সে পাক খুলবার সাধ্য নেই শরতের, জোর করে তা সে খুলতে পারবে না, চাকরি থাকে চাই যায়৷ শরতের হৃদয়ে অসীম শক্তি এসেছে কোথা থেকে, সে ত্রিভুবনকে যেন তুচ্ছ করতে পারে এই নবার্জিত শক্তির বলে, জীবনের নতুন অর্থ যে তার চোখের সামনে খুলে গিয়েছে৷ যখন অবশেষে সে বাড়ি চলে এল, তখন সন্ধ্যার বেশি দেরি নেই৷ মিনুর কাকিমা মুখ ভার করে বললেন, রোজ রোজ তোমার বেড়াতে যাওয়া আর এই রাত্তিরে ফেরা! উনুনে আঁচ পড়ল না এখনও, ছেলেমেয়েদের আজ আর খাওয়া হবে না দেখছি৷ আটটার মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়বে—

—কিছু হবে না, আমি ওদের খাইয়ে দিলেই তো হল—

—তোমার কেবল মুখে মুখে জবাব! এ বাড়িতে তোমার সুবিধে দেখে কাজ হবে না—আমার সুবিধে দেখে কাজ হবে, তা বলে দিচ্ছি৷ কাল থেকে কোথাও বেরুতে পারবে না৷

মুখোমুখি তর্ক করা শরতের অভ্যেস নেই৷ সে এমন একটা অদ্ভুত ধরনের নির্বিকার, স্বাধীন ভঙ্গীতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, একটা কথাও না বলে—যাতে মিনুর কাকিমা নিজে যেন হঠাৎ ছোট হয়ে গেল এই অদ্ভুত মেয়েটির ধীর, গম্ভীর, দর্পিত ব্যক্তিত্বের নিকট৷

মিনুর কাকিমা কিন্তু দমবার মেয়ে নয়, শরতের সঙ্গে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে ঝাঁজালো এবং অপমানজনক সুরে বললে, কথার উত্তর দিলে না যে বড়? আমার কথা কানে যায় না নাকি?

শরৎ রান্নাঘরের কাজ করতে করতে শান্তভাবে বললে, শুনলাম তো যা বললেন—

—শুনলে তো বুঝলাম৷ সেই রকম কাজ করতে হবে৷ আর একটা কথা বলি, তোমার বেয়াদবি এখানে চলবে না জেনে রেখো৷ আমি কথা বললাম আর তুমি এমনি নাক ঘুরিয়ে চলে গেলে, ও-সব মেজাজ দেখিও অন্য জায়গায়৷ এখানে থাকতে হলে—ও কি, কোথায় চললে?

—আসছি, পাথরের বাটিটা নিয়ে আসি ওঘর থেকে—

মিনুর কাকিমার মুখে কে যেন এক চড় বসিয়ে দিলে৷ সে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল৷ এ কি অদ্ভুত মেয়ে, কথা বলে না৷ প্রতিবাদ করে না৷ রাগঝালও দেখায় না—অথচ কেমন শান্ত, নির্বিকার, আত্মস্থ ভাবে তুচ্ছ করে দিতে পারে মানুষকে! মিনুর কাকিমা জীবনে কখনো এমন অপমানিতা বোধ করে নি নিজেকে৷

শরৎ ফিরে এলে তাই সে ঝাল ঝাড়বার জন্যে বললে, কাল থেকে দুপুরের পর বসে বসে ডালগুলো বেছে হাঁড়িতে তুলবে৷ কোথাও বেরুবে না৷

মিনুর কাকা তাঁর স্ত্রীর চিৎকার শুনে ডেকে বললেন, আঃ কি দুবেলা চেঁচামেচি করো রাঁধুনীর সঙ্গে? অমন করলে বাড়িতে চাকরবাকর টিকতে পারে?

—কেন গো, রাঁধুনীর উপর যে বড্ড দরদ দেখতে পাই—

—আঃ, কি সব বাজে কথা বল! শুনতে পাবে—

—শুনতে পেলে তো পেলে—তাতে ওর মান যাবে না৷ ওরা কি ধরনের মানুষ তা জানতে বাকি নেই—আজ এসেছে এখানে সাধু সেজে তীর্থ করতে৷

—লোককে অপ্রিয় কথাগুলো তুমি বড্ড কটকট করে বলো৷ ও ভালো না—

মিনুর কাকিমা ঝাঁজের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললে, আমায় তোমার পাদ্রি সাহেবের মতো মর্মজ্ঞান শিখিয়ে দিতে হবে না—থাক—

মিনুর কাকাটিকে শরৎ দূর থেকে দেখেছে৷ সামনে এ পর্যন্ত একদিনও বার হয় নি৷ লোকটি বেশ নাদুস-নুদুস চেহারার লোক, মাথায় ঈষৎ টাক দেখা দিয়েছে, সাহেবের মতো পোশাক পরে আপিসে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে কখনো চেঁচামেচি হাঁকডাক করে না, চাকর-বাকরদের বলাবলি করতে শুনেছে যে লোকটা মদ খায়৷ মাতালকে শরৎ বড় ভয় করে, কাজেই ইচ্ছে করেই কখনো সে লোকটির ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না৷

সেদিন আবার তার মন উতলা হয়ে উঠল খোকাকে দেখবার জন্যে৷ খোকাকে একটা ঘোড়া দেবে বলে এসেছিল, হাতে পয়সা নেই, এদের কাছে মুখ ফুটে চাইতে সে পারবে না, অথচ কি করা যায়?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোকাকে খেলনা দেবার টানই বড় হল৷ সে মিনুর কাকিমাকে বললে—আমায় কিছু পয়সা দেবেন আজ?

মিনুর কাকিমা একটু আশ্চর্য হল৷ শরৎ এ পর্যন্ত কখনো কিছু চায় নি৷

বললে—কত?

—এই—পাঁচ আনা—

মিনুর কাকিমা মনে মনে হিসেব করে দেখলে শরৎ পাঁচ মাস হল এখানে রাঁধুনীর কাজ করছে, এ পর্যন্ত তাকে মাইনে বলে কিছু দেওয়া হয় নি, সেও চায় নি৷ আজ এতদিন পরে মোটে পাঁচ আনা চাওয়াতে সে সত্যিই আশ্চর্য হল৷

আঁচল থেকে চাবি নিয়ে বাক্স খুলে বললে, ভাঙানো তো নেই দেখছি, টাকা রয়েছে৷ ও বেলা নিয়ো—

শরৎ ঠিক করেছিল আজ দুপুরের পরে কাজকর্ম সেরে সে খোকার কাছে যাবে৷ মুখ ফুটে সে বললে, টাকা ভাঙিয়ে আনলে হয় না? আমার বিকেলে দরকার ছিল৷

—কি দরকার?

—ও আছে একটা দরকার—

—বলোই না—

—একজনের জন্যে একটা জিনিস কিনব৷

—কে?

শরৎ ইতস্তত করে বললে রেণুকা জানে—পটলের বউ—

মিনুর কাকিমা মুখ টিপে হেসে বললে, আপত্তি থাকে বলবার দরকার নেই, থাক গে৷ নিও এখন—

.

শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে ঘোড়া কিনতে গেল৷ এক জায়গায় লোকের ভিড় ও কান্নার শব্দ শুনে ও রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেখতে গেল৷ একটি আঠারো-উনিশ বছরের বাঙালির মেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে, আর তাকে ঘিরে কতকগুলো হিন্দুস্থানী মেয়েপুরুষ খেপাচ্ছে ও হাসাহাসি করছে৷

মেয়েটি বলছে, আমার গামছা ফেরত দে—ও মুখপোড়া, যম তোমাদের নেয় না, মণিকর্ণিকা ভুলে আছে তোদের? শালারা, পাজি ছুঁচোরা—গামছা দে—

শরৎকে দেখে ভিড় সসম্ভ্রমে একটু ফাঁক হয়ে গেল৷ কে একজন হেসে বললে, পাগলি, মাইজী—আপলোক হঠ যাইয়ে—

মেয়েটি বললে, তোর বাবা মা গিয়ে পাগল হোক হারামজাদারা—মণিকর্ণিকায় নিয়ে যা ঠ্যাং-এ দড়ি বেঁধে, পুড়ুতে কাঠ না জুটুক—দে আমার গামছা—দে—

যে ওকে পাগলি বলেছিল সে তার পুণ্যশ্লোক পিতামাতার উদ্দেশে গালাগালি সহ্য করতে না পেরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এইয়ো—মু সামহালকে বাত বোলো—নেই তো মু মে ইটা ঘুষা দেগা—

মেয়েটির পরনে চমৎকার ফুলনপাড় মিলের শাড়ি, বর্তমানে অতি মলিন—খুব একমাথা চুল তেল ও সংস্কার অভাবে রুক্ষ ও অগোছালো অবস্থায় মুখের সামনে, চোখের সামনে, কানের পাশে পড়েছে, হাতে কাঁচের চুড়ি, গায়ের রং ফর্সা, মুখশ্রী একসময়ে ভালো ছিল, বর্তমানে রাগে, হিংসায়, গালাগালির নেশায় সর্বপ্রকার কোমলতা-বর্জিত, চোখের চাউনি কঠিন, কিন্তু তার মধ্যেই যেন ঈষৎ দিশাহারা ও অসহায়৷

শরতের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল৷ রাজলক্ষ্মী? গড়শিবপুরের সেই রাজলক্ষ্মী? এর চেয়ে সে হয়তো দু-তিন বছরের ছোট—কিন্তু সেই পল্লীবালা রাজলক্ষ্মীই যেন৷ বাঙালীর মেয়ে হিন্দুস্থানীদের হাতে এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে এই বিশ্বনাথের মন্দিরের পবিত্র প্রবেশপথে?

শরৎ সোজাসুজি গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে বললে, তুমি বেরিয়ে এসো ভাই—আমার সঙ্গে—

মেয়েটি আগের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমার গামছা নিয়েছে ওরা কেড়ে—আমি রাস্তায় বেরুলেই ওরা এমনি করে রোজ রোজ—তার পরেই ভিড়ের দিকে রুখে দাঁড়িয়ে বললে, দে আমার গামছা, ওঃ মুখপোড়ারা, তোদের মড়া বাঁধা ওতে হবে না—দে আমার গামছা—

ভিড় তখন শরতের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে কিছু অবাক হয়ে ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম হয়েছে৷ দু একজন হি হি করে মজা দেখবার তৃপ্তিতে হেসে উঠল৷ শরৎ মেয়েটির হাত ধরে গলির বাইরে যত টেনে আনতে যায়, মেয়েটি ততই বার বার পিছনে ফিরে ভিড়ের উদ্দেশে রুদ্রমূর্তিতে নানা অশ্লীল ও ইতর গালাগালি বর্ষণ করে৷

অবশেষে শরৎ তাকে টানতে টানতে গলির মুখে বড় রাস্তার ধারে নিয়ে এল, যেখানে মনোহারী দোকানের সামনে সে রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল৷

রেণুকা চোখে না দেখতে পেলেও গোলমাল ও গালাগালি শুনেছে; এখনও শুনছে মেয়েটির মুখে—সে ভয়ের সুরে বললে, কি, কি ভাই? কি হয়েছে? ও সঙ্গে কে?

—সে কথা পরে হবে৷ এখন চলো ভাই ওদিকে—

মেয়েটি গালাগালি বর্ষণের পরে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যেন৷ সে কাঁদো কাঁদো সুরে বলতে লাগল—আমার গামছাখানা নিয়ে গেল মুখপোড়ারা—এমন গামছাখানা—

শরৎ বললে, ভাই রেণুকা, দোকান থেকে গামছা একখানা কিনে দিই ওকে—চল তো—

মেয়েটি গালাগালি ভুলে ওর মুখের দিকে চাইলে৷ রেণুকা জিজ্ঞেস করলে, তোমার নাম কি? থাকো কোথায়?

মেয়েটি কোনো জবাব দিলে না৷

গামছা কিনতে গিয়ে দোকানি বললে, একে পেলেন কোথায় মা?

শরৎ বললে, একে চেন?

—প্রায়ই দেখি মা৷ গণেশমহল্লার পাগলি, গণেশমহল্লায় থাকে—ও লোককে বড় গালাগালি দেয় খামকা—

পাগলি রেগে বললে, দেয়? তোর পিণ্ডি চটকায়, তোকে মণিকর্ণিকার ঘাটে শুইয়ে মুখে নুড়ো জ্বেলে দেয় হারামজাদা—

দোকানি চোখ রাঙিয়ে বললে, এই চুপ! খবরদার—ওই দেখুন মা—

শরৎ ছেলেমানুষকে যেমন ভুলোয় তেমনি সুরে বললে, ওকি, অমন করে না ছিঃ—লোককে গালাগালি দিতে নেই৷

পাগলি ধমক খেয়ে চুপ করে রইল৷

—গামছা কত?

—চোদ্দ পয়সা মা—আমার দোকানে জিনিসপত্তর নেবেন৷ এই রাস্তায় বাঙালি বলতে এই আমিই আছি৷ দশ বছরের দোকান আমার৷ হুগলী জেলায় বাড়ি, ম্যালেরিয়ার ভয়ে দেশে যাই নে, এই দোকানটুকু করে বাবা বিশ্বনাথের ছিচরণে পড়ে আছি—আমার নাম রামগতি নাথ৷ এক দামে জিনিস পাবেন মা আমার দোকানে—দরদস্তুর নেই৷ মেড়োদের দোকানে যাবেন না, ওরা ছুরি শানিয়ে বসে আছে বাঙালি দেখলেই গলায় বসিয়ে দেবে৷ এই গামছাখানা মোড়ের দোকানে কিনতে যান—চার আনার কম নেবে না৷

দোকানির দীর্ঘ বক্তৃতা শরৎ গামছা হাতে দাঁড়িয়ে একমনে শুনলে, যেন না শুনলে দোকানির প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অসৌজন্য দেখানো হবে৷ তার পর আবার রাস্তায় উঠে পাগলকে বললে, এই নেও বাছা গামছা—পছন্দ হয়েছে?

পাগলি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললে, খিদে পেয়েছে—

শরৎ বললে, কি করি রেণু, ছ’টা পয়সা সম্বল, তাতেই যা হয় কিনে খাক গে—

রেণুকা বললে, আমার হাঁড়িতে বোধ হয় ভাত আছে৷

—তাই দেখি গে চলো,—

পাগলিকে ভাত দেওয়া হল, কতক ভাত সে ছড়ালে, কতক ভাত ইচ্ছে করে ধুলোতে মাটিতে ফেলে তাই আবার তুলে খেতে লাগল, অর্ধেক খেলে ভাত, অর্ধেক খেলে ধুলোমাটি৷

শরতের চোখে জল এসে পড়ে৷ মনে ভাবলে—আহা অল্প বয়েস, কি পোড়া কপাল দেখো একবার! মুখের ভাত দুটো খেলেও না—

বললে, ভাত ফেলছিস কেন? থালায় তুলে নে মা—অমন করে না—

ঠিক সেই সময় রাজপথে সম্ভবত কোনো বিবাহের শোভাযাত্রা বাজনা বাজিয়ে ও কলরব করতে করতে চলেছে শোনা গেল৷ শরৎ তাড়াতাড়ি সদর দরজার কাছে ছুটে এসে দেখতে গেল, এসব বিষয়ে তার কৌতূহল এখনও পল্লীবালিকার মতোই সজীব৷

সঙ্গে সঙ্গে পাগলিও ভাতের থালা ফেলে উঠে ছুটে গেল শরৎকে ঠেলে একেবারে সদর রাস্তায়—শরৎ ফিরে এসে বললে, ওমা, একি কাণ্ড, ভাত তো খেলেই না, গামছাখানা পর্যন্ত ফেলে গেল! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পাগলির আর দেখা পাওয়া গেল না৷

পরদিন শরৎ আবার খোকাদের বাড়ি ধ্রুবেশ্বরের গলিতে গিয়ে হাজির, সঙ্গে পটলের বউ৷

খোকার মা বললেন, দু-দিন আস নি ভাই, খোকা ‘মাসিমা মাসিমা’ বলে গেল৷

খোকার জন্যে আজ সে এসেছে শুধু হাতে, কারণ পাগলিকে পয়সা দেবার পরে ওর হাতে আর পয়সা নেই৷ মিনুর কাকিমার কাছে বার বার চাইতে লজ্জা করে৷

খোকা শরতের কোল ছাড়তে চায় না৷

শরৎ যখন এদের বাড়ি আসে, যেন কোনো নূতন জীবনের আলো, আনন্দের আলোর মধ্যে ডুবে যায়৷ আবার যখন মিনুর কাকিমাদের বাড়ি যায়, তখন জীবনের কোন আলো-আনন্দহীন অন্ধকার রন্ধ্রপথে ঢুকে যায়, দূর দিকচক্রবালে উদার আলোকোজ্জ্বল প্রসার সেখান থেকে চোখে পড়ে না৷

খোকা বলে, এসো মাছিমা—খেলা করি—

খোকার আছে দুটো রবাবের বল, একটা কাঠের ভাঙা বাক্স, তার মধ্যে ‘মেকানো’ খেলার সাজ-সরঞ্জাম৷ শেষোক্ত জিনিসটা ছিল খোকার দাদার, এখন সে বড় হয়ে তার ত্যক্ত সম্পত্তি ছোট ভাইকে দিয়ে দিয়েছে৷

খোকা বলে, সাজিয়ে দাও মাছিমা৷

শরৎ জীবনে ‘মেকানো’র বাক্স দেখে নি, কল্পনাও করে নি৷ সে সাজাতে পারে না৷ খোকাও কিছু জানে না, দুজনে মিলে হেলাগোছা করে একটা অদ্ভুত কিছু তৈরি করলে৷

খোকার মা শরতের জন্যে খাবার করে খেতে ডাকলেন৷

শরৎ বললে, আমি কিছু খাব না দিদি—

—তা বললে হয় না ভাই, খোকার মাসিমা যখন হয়েছ, কিছু মুখে না দিয়ে—

—রোজ রোজ এলে যদি খাওয়ান তা হলে আসি কি করে?

—খোকনকে তুমি বড় হলে খাইও ভাই৷ শোধ দিয়ো তখন না হয়—

বকসীদের বড় বউ খবর পেয়ে এসে শরতের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলে৷

সে বললে, কি ভালো লেগেছে ভাই তোমাকে, তুমি এসেছ শুনে ছুটে এলাম—একটা কথা বলবে?

—কি, বলুন?

—তোমার বাপের বাড়ি কোথায় ভাই?

—গড়শিবপুর, যশোর জেলায়৷

—শ্বশুরবাড়ি?

—বাপের বাড়ির কাছেই—

—বাবা-মা আছেন?

শরৎ চুপ করে রইল৷ দু চোখ বেয়ে টস-টস করে জল গড়িয়ে পড়ল বাবার কথা মনে পড়াতে৷ সে তাড়াতাড়ি চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললে, ওসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না দিদি—

বকসীদের বউ বুদ্ধিমতী, এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না তখন৷ কিছুক্ষণ অন্য কথার পরে শরৎ যখন ওদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসছে, তখন ওকে আড়ালে ডেকে বললে, আমি তোমাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে চাই নে ভাই—কিন্তু আমার দ্বারা যদি তোমার কোনো উপকার হয়, জানিও—তা যে করে হয় করব৷ তোমাকে যে কি চোখে দেখেছি!

শরৎ অশ্রুভারনত চোখে বললে, আমার ভালো কেউ করতে পারবে না দিদি৷ যদি এখন বাবা বিশ্বনাথ তাঁর চরণে স্থান দেন, তবে সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়৷

—তুমি সাধারণ ঘরের মেয়ে নও কিন্তু—

—খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে দিদি৷ ভালোবাসেন তাই অন্যরকম ভাবেন৷ আচ্ছা এখন আসি৷

—আবার এসো খুব শীগগির—

শরৎ ও পটলের বৌ পথ দিয়ে চলে আসতে আসতে সেদিনকার সেই পাগলির সঙ্গে দেখা৷ সে রাস্তার ধারে একখানা ছেঁড়া কাপড় পেতে বসেছে জাঁকিয়ে—আর যে পথ দিয়ে যাচ্ছে তাকেই বলছে—একটা পয়সা দিয়ে যাও না?

শরৎ বললে, আহা, সেদিন ওর কিছু খাওয়া হয় নি, পয়সা আছে কাছে ভাই?

পটলের বউ বললে, পাঁচটা পয়সা আছে—

—ওকে কিছু খাবার কিনে দিই—এসো৷

নিকটবর্তী একটা দোকান থেকে ওরা কিছু খাবার কিনে নিয়ে ঠোঙাটা পাগলির সামনে রেখে দিয়ে বললে, এই নাও খাও—

পাগলি ওদের মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা না বলে খাবারগুলো গোগ্রাসে খেয়ে বললে—আরও দাও—

শরৎ বললে, আজ আর নেই—কাল এখানে বসে থেকো বিকেলে এমনি সময়, কাল দেব৷

পটলের বৌ বললে, ভাই, আমাদের বাড়ি থেকে দুটো রেঁধে নিয়ে এসে দেব কাল?

—বেশ এনো৷ আমি একটু তরকারি এনে দেব৷ আমার যে ভাই কোনো কিছু করবার যো নেই—তা হলে আমার ইচ্ছে করে ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভালো করে পেটভরে খাওয়াই৷ দুঃখ-কষ্টের মর্ম নিজে না বুঝলে অপরের দুঃখ বোঝা যায় না৷ বাঙালির মেয়ে কত দুঃখে পড়ে আজ ওর এ দশা—তা এক ভগবান ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না৷ আমিও কোনোদিন ওই রকম না হই ভাই—

—বালাই ষাট, তুমি কেন অমন হতে যাবে ভাই?…. ধরো, আমার হাত ধরো, ভাই, বড্ড উঁচু-নীচু—

এই অন্ধ পটলের বউ—এর ওপরও এমন মায়া হয় শরতের! কে আছে এর জগতে, কেউ নেই পটল ছাড়া৷ আজ যদি, ভগবান না করুন, পটলের কোনো ভালোমন্দ হয়, তবে কাল এই নিঃসহায় অন্ধ মেয়েটি দাঁড়ায় কোথায়?

আবার ওই রাস্তার ধারের পাগলির কথা মনে পড়ে৷

জগতে যে এত দুঃখ, ব্যথা কষ্ট আছে, শরৎ সেসবের কিছু খবর রাখত না৷ গড়শিবপুরের নিভৃত বনবিতান শ্যামল আবরণের সংকীর্ণ গণ্ডী টেনে ওকে স্নেহে যত্নে মানুষ করেছিল—বহির্জগতের সংবাদ সেখানে গিয়ে কোনোদিনও পৌঁছায় নি৷

শরৎ জগৎটাকে যে রকম ভাবত, আসলে এটা সে রকম নয়৷ এখন তার চোখ ফুটেছে, জীবনে এত মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে দিয়েই তবে যে উদার দৃষ্টি লাভ হয়েছে তার—এক একদিন গঙ্গার ঘাটে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে শরতের মনে ওঠে এসব কথা৷

আগেকার গড়শিবপুরের সে শরৎ আর সে নেই— সেটা খুব ভালো করেই বোঝে৷ সে শরৎ ছিল মনেপ্রাণে বালিকা মাত্র৷ বয়স হয়েছিল যদিও তার ছাব্বিশ—দৃষ্টি ছিল রাজলক্ষ্মীর মতোই, সংসারের কিছু বুঝত না, জানত না৷ সব লোককে ভাবত ভালো, সব লোককে ভাবত তাদের হিতৈষী৷

সেই বালিকা শরতের কথা ভাবলে এ শরতের এখন হাসি পায়৷

শরৎ মনে এখন যথেষ্ট বল পেয়েছে৷ কলকাতা থেকে আজ এসেছে প্রায় দেড় বছর, যে ধরনের উদভ্রান্ত ভীরু মন নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পালিয়ে এসেছিল কলকাতা থেকে—এখন সে মন যথেষ্ট বল সঞ্চয় করেছে৷ দুনিয়াটা যে এত বড়, বিস্তৃত—সেখানে যে এত ধরনের লোক বাস করে, তার চেয়েও কত বেশি দুঃখী অসহায়, নিরাবলম্ব লোক যে তার মধ্যে রয়েছে, এই সব জ্ঞানই তাকে বল দিয়েছে৷

সে আর কি বিপদে পড়েছে, তার চেয়েও শতগুণে দুঃখিনী ওই গণেশ-মহল্লার পাগলি, এই অন্ধ পটলের বউ৷ এই কাশীতে সেদিন সে এক বুড়িকে দেখেছে দশাশ্বমেধ ঘাটে, বয়স তার প্রায় সত্তর-বাহাত্তর, মাজা ভেঙে গিয়েছে, বাংলা দেশে বাড়ি ছিল, হাওড়া জেলার কোনো এক পাড়াগাঁয়ে৷ কেউ নেই বুড়ির, অনেকদিন থেকে কাশীতে আছে, ছত্রে ছত্রে খেয়ে বেড়ায়৷

সেদিন শরৎকে বললে, মা, তুমি থাকো কোথায় গো?

—কাছেই৷ কেন বলুন তো?

—তোমরা?

—ব্রাহ্মণ৷

—আমায় দুটো ভাত দেবে একদিন?

—আমার সে সুবিধে নেই মা৷ আমি পরের বাড়ি থাকি৷ আপনার মতো অবস্থা৷ কেন, আপনি খান কোথায়?

—পুঁটের ছত্তরে খেতাম, সে অনেকদূর৷ অত দূর আর হাঁটতে পারি নে—আজকাল আবার নিয়ম করেছে একদিন অন্তর মাদ্রাজীদের ছত্তরে ডালভাত দেয়৷ তা সে-সব তরকারি নারকোল তেলে রান্না মা, আমাদের মুখে ভালো লাগে না৷ আজ এক জায়গায় ভোজ দেবে, সেখানে যাব—ওই পাঁড়েদের ধর্মশালায়—চলো না, যাবে মা?

—কতদূর?

—বেশি দূর নয়৷ এক হিন্দুস্থানী বড়লোক কাশীতে তীর্থধর্ম করতে এসেছে মা৷ লোকজন খাওয়াবে—আমাদের সব নেমন্তন্ন করেছে৷ চলো না?

—না মা, আমি যাব না৷

—এতে কোনো লজ্জা নেই, অবস্থা খারাপ হলে মা সব রকম করতে হয়৷ আমারও দেশে গোলাপালা ছেল, দুই ছেলে হাতির মতো৷ তারা থাকলে আজ আমার বের্দ্ধ বয়েসে কি এ দশা হয়?

বুড়ির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷

শরৎ ভাবলে, দেখেই আসি, খাব না তো—যা জিনিস দেবে, নিয়ে এসে পাগলিকে কি পটলের বউকে দিয়ে দেব৷

তাই সেদিন সে মনোমোহন পাঁড়ের ধর্মশালায় গেল বুড়ীর সঙ্গে৷ ধর্মশালার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অনেক বৃদ্ধ বাঙালি ও হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ জড়ো হয়েছে—মেয়েমানুষও সেখানে এসেছে, তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়৷

যাঁরা ভোজ দিচ্ছে তারা বাংলা জানে না—হিন্দীতে কথাবার্তা কি বলে, শরৎ ভালো বুঝতে পারে না৷ তারা খুব বড়লোক, দেখেই মনে হল৷ শরৎকে দেখে আলাদা ডেকে তাদের একটি বউ বললে, তুমি কি আলাদা বসে খাবে, মাইজি?

—না মা—আমি নিয়ে যাব৷

—বাড়িতে লেড়কালেড়কি আছে বুঝি?

শরৎ মৃদু হেসে বললে, না৷

—আচ্ছা বেশ নিয়ে যাও—এখানে থাকো কোথায়?

—একজনদের বাড়ি৷ রান্না করি৷

—বাঙালি রান্না করো?

—হ্যাঁ মা৷

একটু পরে ভোজের বন্দোবস্ত হল৷ অন্য কিছু নয়, শুধু হালুয়া, তিল তেলে রান্না৷ প্রকাণ্ড চাদরের কড়াইয়ে প্রায় দশ সের সুজি, দশ সের চিনি—আর ছোট টিনের একটিন তিল তেল ঢেলে হালুয়া তৈরি হচ্ছে, শরৎকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হিন্দুস্থানী বৌটি সব দেখালে৷ অভ্যাগত দরিদ্র নরনারীদের বসিয়ে পেটভরে সেই হালুয়া খাওয়ানো হল—যাবার সময় দু-আনা করে মাথাপিছু ভোজনদক্ষিণাও দেওয়া হল৷ শরৎকে কিন্তু একটা পুঁটুলিতে হালুয়া ছাড়া পুরী ও লাড্ডু অনেক করে দিলে ওরা৷

খাবারগুলো পুঁটলি বেঁধে নিয়ে এসে শরৎ পটলের বউকে দিয়ে দিলে৷ বললে, আজ আর পাগলির দেখা নেই! আজ খেতে পেত, আজই নিরুদ্দেশ!

পটলের বউ বললে, পাগলির জন্যে রেখে দেব দিদি?

—কেন মিথ্যে বাসি করে খাবে? কাল যে আসবে তারই বা মানে কি আছে? খাও তোমরা৷

—তুমি খাবে না?

—আমি খাব না, সে তুমি জানো৷ ওরা কি জাত তার ঠিক নেই, ওদের হাতে রান্না—

—কাশীতে আবার জাতের বিচার—

—কেন, কাশী তো জগন্নাথ ক্ষেত্তর না, সেখানে নাকি জাতের বিচার নেই—

এমন সময় ওপর থেকে ঝি এসে বললে—ওগো বামুনঠাকরুণ, মা ডাকছেন—ওপরে যেতেই মিনুর কাকিমা এক তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে দিল৷ মোগলসরাই থেকে তার ভাইপোরা এসেছে, রাত আটটার গাড়িতে চলে যাবে, অথচ বামনীর দেখা নেই, মাইনে যাকে দিতে হচ্ছে সে সব সময় বাড়ি থাকবে! বিধবা মানুষের আবার এত শখের বেড়ানো কিসের, এতদিন কোনো কৈফিয়ৎ চাওয়া হয় নি শরতের গতিবিধির, কিন্তু ব্যাপার ক্রমশ যে-রকম দাঁড়াচ্ছে, তাতে কৈফিয়ৎ না নিলে চলে না!

শরৎ বললে, আমি তো জানতাম না ওঁরা আসবেন৷ আমি আটটার অনেক আগে খাইয়ে দিচ্ছি—

—তুমি রোজ রোজ যাও কোথায়?

—পটলের বউয়ের সঙ্গে তো যাই—

—কোথায় যাও?

—৬ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ হরিবাবু বলে এক ভদ্রলোকের বাড়ি—

—সেখানে কেন?

—পটলের বউ বেড়াতে নিয়ে যায়৷ ওদের জানাশুনো৷

—আজ কোথায় গিয়েছিলে?

—একটা ধর্মশালা দেখতে৷

—ওসব চলবে না বলে দিচ্ছি—কোথাও বেরুতে পারবে না কাল থেকে৷ ডুবে ডুবে জল খাও, আমি সব টের পাই৷ একশো বার করে কর্তাকে বললাম পটলদের তাড়াও নীচের ঘর থেকে—এগারো টাকার জায়গায় এখুনি পনেরো টাকা ভাড়া পাওয়া যায়! তা কর্তার কোনো কথা কানে যাবে না—পটলের বউয়ের স্বভাবচরিত্র আমার ভালো ঠেকে না—

বেচারি অন্ধ পটলের বউ, তার নামে মিথ্যে অপবাদ শরতের সহ্য হল না৷ সে বললে, আমার নামে যা হয় বলুন, সে বেচারি অন্ধ, তাকে কেন বলেন? আমায় না রাখেন, কাল সকালেই আমি চলে যাব—

—বেশ যাও৷ কাল সকালেই চলে যাবে—

শরৎ নির্বিকার-চিত্তে রান্নাবান্না করে গেল৷ লোকজনকে খাইয়ে দিলে৷ রাত ন’টার পরে মিনুর কাকিমা বললে, তোমার কি থাকবার ইচ্ছে নেই নাকি?

—আপনিই তো থাকতে দিচ্ছেন না৷ পটলের বউয়ের নামে অমন বললেন কেন? আমি মিশি বলে সে বেচারিও খারাপ হয়ে গেল?

—তোমার বড্ড তেজ—কাশী শহরে কেউ জায়গা দেবে না৷ সে কথা ভুলে যাও—

—আমার কারো আশ্রয়ে যাওয়ার দরকার নেই৷ বিশ্বেশ্বর স্থান দেবেন৷ আমি আপনাদের বাড়ি থাকতে পারব না, সকালে উঠেই চলে যাব, যদি বলেন তো রেঁধে দিয়ে যাব, নয়তো খোকাদের খাওয়ার কষ্ট হবে৷

রাত্রে বাড়ি ফিরে মিনুর কাকা সব শুনলেন৷ সেই রাত্রেই তিনি শরৎকে ডেকে বললেন, তুমি কোথাও যেতে পারবে না বামুন-ঠাকরুন৷ ও যা বলেছে, কিছু মনে করো না৷

শরৎ মিনুর কাকার সামনে বেরোয় না, কথাও বলে না৷ ঝিকে দিয়ে বলালে, তিনি যদি যেতে বারণ করেন, তবে সে কোথাও যাবে না৷ কারণ গৌরী-মা তাকে তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছিলেন—তাঁর অর্থাৎ মিনুর মা’র বিনা অনুমতিতে সে এ সংসার ছেড়ে যেতে পারবে না৷

.

আরও দিন পনের কেটে গেল৷ একদিন বিশ্বেশ্বরের গলির মুখে সেই বুড়ির সঙ্গে আবার দেখা৷ বুড়ি বললে, কি গা, যাচ্ছ কোথায়? কোন ছত্তরে?

শরৎ অবাক হয়ে বললে, আমি ছত্তরে খাই নে তো? আমি লোকের বাড়ি থাকি যে৷

—চলো, আজ কুচবিহারে কালীবাড়িতে খুব কাণ্ড, সেখানে যাই৷ নাটকোটার ছত্তর চেন?

—না মা, আমি কোথাও যাই নি—

—চলো আজ সব দেখিয়ে আনি—

সারা বিকেল তিন-চারটি বড় বড় ছত্রে শরৎ কাঙালিভোজন, ব্রাহ্মণভোজন দেখে বেড়াল৷ বাঙালীটোলা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট কালীবাড়ি ও ছত্র কুচবিহার মহারাজের৷ কালীমন্দিরের দেওয়ালে কত রকমের অস্ত্রশস্ত্র, কি চমৎকার বন্দোবস্ত অনাহূত রবাহূত গরিব, নিরন্ন সেবার! মেয়েদের জন্যে খাওয়ানোর আলাদা জায়গা, পুরুষদের আলাদা, ব্রাহ্মণদের আলাদা৷ এত অকুণ্ঠ অন্নদান সে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি৷

শরৎ বললে, হ্যাঁ মা, এখানে যে আসে তাকেই খেতে দেয়?

—কুচবিহারের কালীবাড়িতে তা দেয় গো৷ তবুও আজকাল কড়াকড়ি করেছে৷ হবে না কেন, বাঙাল দেশ থেকে লোক এসে সব নষ্ট করে দিয়েছে৷

—আমি নিজে যে বাঙাল—হ্যাঁ মা—

শরৎ কথা বলেই হেসে ফেললে৷ বুড়ি কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বললে, হ্যাঁগো, বাঙাল না ছাই, তোমার কথায় বুঝি বোঝা যায় কিছু, চলো চলো—নাটকোটার ছত্তর দেখিয়ে আনি—

নাটকোটার ছত্রে যখন ওরা গেল, তখন সেখানকার খাওয়া-দাওয়া শেষ৷ বাইরের গরিব লোকেরা ভাত নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ৷

শরৎ বললে, এ কাদের ছত্র মা?

—তৈলিঙ্গিদের ছত্তর৷ এখানে খেতে এসেছিলুম একদিন, ডালে যত বা টক, তত বা লঙ্কা৷ সে মা আমাদের পোষায় না৷ তুণ্ডুমুণ্ডুদের পোষায়, ওদের মুখে কি সোয়াদ আছে মা?

শরৎ হেসে কুটি কুটি৷ বললে, তুণ্ডুমুণ্ডু কারা মা?

—আরে ওই তৈলিঙ্গিদের কথাবার্তা শোনো নি? তুণ্ডুমুণ্ডু না কি সব বলে না?

—আমি কখনো শুনি নি৷ আমায় একদিন শোনাবেন তো!

—একদিন খাওয়া-দাওয়ার সময় নাটকোটার ছত্তরে নিয়ে আসব—দেখতে পাবে—

—আর কি ছত্তর আছে?

—এখানে রাজরাজেশ্বরী ছত্তর, পুঁটের ছত্তর, আমবেড়ে—আহিল্যেবাই—

—সব দেখব মা, আজ সব দেখে আসব—

সমস্ত ঘুরে শেষ করতে ওদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বুড়ি বললে, কাশীতে ভাতের ভাবনা নেই, অন্নপুণ্ণো মা দু-হাতে অন্ন বিলিয়ে যাচ্ছেন—

শরৎ বাসায় ফিরে এসে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইল৷ তার সকলের চেয়ে ভালো লেগেছে কাশীর এই অন্নদান৷ এমন একটা ব্যাপারের কথা সত্যিই সে জানত না৷ ডাল-ভাত উনুনে চাপিয়ে দিয়ে সে শুধু ভাবে ওই কথাটা৷ তার আর কিছু ভালো লাগে না৷ কাল সকাল সকাল এদের খাইয়ে-দাইয়ে দিয়ে সে আবার বেরুবে ছত্র দেখতে৷ ছত্রে খাওয়ানোর দৃশ্য সে মাত্র দেখলে কুচবিহারের কালীবাড়িতে৷ অন্য ছত্রে যখন গিয়েছিল তখন সেখানকার খাওয়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ সে দেখতে চায় দুচোখ ভরে এই বিরাট অন্নব্যয়, অকুণ্ঠ সদাব্রত—যেখানে গণেশমহল্লার পাগলির মতো, ওই অন্ধ রেণুকার মতো, তার নিজের মতো, ওই সত্তর বছরের মাজা-ভাঙা বুড়ির মতো—নিরন্ন, নিঃসহায় মানুষকে দুবেলা খেতে দিচ্ছে৷ ওই দেখতে তার খুব ভালো লাগে—খুব—খুব ভালো লাগে—ওই সব ছত্রেই বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা প্রত্যক্ষ বিরাজ করেন বুভুক্ষু অভাজনদের ভোজনের সময়—মন্দিরে তাঁদের দেখার চেয়েও সে দেখা ভালো৷ অনেক—অনেক ভালো৷

ঝি এসে বলে, ও বামুন-ঠাকরুণ, মাছের ঝোল দিয়ে বাবুকে আগে ভাত দিতে হবে৷ খেয়ে এখুনি বেরিয়ে যাবেন—

—ও ঝি, শোনো—পাঁচফোড়ন মোটে নেই, বাজার থেকে আগে এনে দাও—

ঝি চলে যায়৷ মাছের ঝোল ফোটে৷ নিভৃত রান্নাঘরের কোণে গোলমাল নেই—বসে শরৎ স্বপ্ন দেখে, সে প্রকাণ্ড ছত্র খুলেছে কেদার ছত্র, বাবার নামে৷ কত লোক এসে খাচ্ছে—অবারিত দ্বার৷ বাবার ছত্র থেকে কোনো লোক ফিরবে না, অনাহারে কেউ ফিরে যাবে না৷ সে নিজে দেখবে শুনবে—সকলকে খাওয়াবে৷ সে দু-হাতে অন্নদান করবে৷ সকলকেই—ব্রাহ্মণ-শূদ্র নেই, তুণ্ডুমুণ্ডু নেই, বাঙাল-ঘটি নেই—সকলেই হবে তার পরম সম্মানিত অতিথি৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াবে সে৷

শরতের মাথার মধ্যে কি যেন নেশা জমেছে৷….

রান্নাবান্না সেরে সে মিনুর কাকিমাকে বলল, আজ একবারটি বাইরে যাব?

—কোথায়?

শরৎ হঠাৎ সলজ্জ হেসে বললে—সে বলব এখন এসে৷

শরতের হাসি দেখে মিনুর কাকিমার মনে সন্দেহ হল৷ সে বললে, কোথায় যাচ্ছ না বললে চলে? সব জায়গায় যেতে দিতে পারি কি? রাগ করলে তো চলে না—বুঝে দেখতে হয়৷

—ছত্তর দেখতে৷ রাজরাজেশ্বরী ছত্তরে অনেক বেলায় খাওয়া-দাওয়া হয়, পুঁটের ছত্তরেও হয়—দেখে আসি একটিবার—

মিনুর কাকিমা শরতের মনের উত্তাল উদ্বেল সমুদ্রের কোনো খবর রাখে না—সেবা ও অন্নদানের যে বিরাট আকৃতি ও আগ্রহ, তার কোনো খবর রাখে না—বললে, কেন, ছত্তর দেখতে কেন? সে আবার কি?

—দেখি নি কখনো৷ যেতে দিন আজ আমায়—

শরতের কণ্ঠে সাগ্রহ মিনতির সুরে মিনুর কাকিমা ছুটি দিতে বাধ্য হল, তবে হয়তো শরতের কথা সে আদৌ বিশ্বাস করলে না৷

শরৎ এসে বললে, ও রেণু পোড়ারমুখী—কি হচ্ছে?

—ও, আজ যেন খুব ফুর্তি, তোমার কি হয়েছে শুনি?

—কি আবার হবে, তোর মুণ্ডু হবে! চল ছত্তরে যাই, খাওয়া দেখে আসি৷

রেণু অবাক হয়ে বললে, কেন?

—কেন, তোর মাথা! আমি যে কাশীতে ছত্তর খুলছি, জানিস নে?

—বেশ তো ভাই৷ আমাদের মতো গরিব লোকে তাহলে বেঁচে যায়৷ দু-বেলা ছত্তরে পেট ভরে দুটো খেয়ে আসি৷ হাঁড়ি-হেঁসেলের পাট উঠিয়ে দিই৷ কি নাম হবে, শরৎসুন্দরী ছত্র?

—না ভাই, বাবার নামে—কেদার ছত্তর৷ কেমন নাম হবে বল তো?

—যাই বলো ভাই, শরৎসুন্দরী ছত্র শুনতে যেমন, তেমনটি কিন্তু হল না৷

রাজরাজেশ্বরী ছত্রে ওরা যেতেই ছত্রের লোকে জিজ্ঞেস করলে—আপনারা আসুন, মেয়েদের জন্যে আলাদা বন্দোবস্ত আছে—

শরৎ বললে, চল ভাই রেণু, দেখি গে—

—যদি খেতে বলে?

—জোর করে খাওয়াবে না কেউ, তুমি চলো৷

মেয়েদের মধ্যে সবাই বুড়ো-হাবড়া, এক আধ জন অল্পবয়সী মেয়েও আছে—কিন্তু তারা এসেছে বুড়িদের সঙ্গে কেউ নাতনী, কেউ মেয়ে সেজে৷ বুড়িরা বড় ঝগড়াটে, পাতা আর জলের ঘটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে৷ শরৎ বললে, মা বসুন, আমি জল দিচ্ছি আপনাদের—

একজন জিজ্ঞেস করলে—তুমি কি জেতের মেয়ে গা?

—বামুনের মেয়ে, মা৷

—কাশীতে এলে সবাই বামুন হয়৷ কোথায় থাকো তুমি?

—বাঙালিটোলায় থাকি মা—কিছু ভাববেন না আপনি৷

ছত্রের পরিবেশনকারিণী একটি মধ্যবয়স্কা মেয়ে শরতকে বললে, তোমরা বসছ না বাছা?

—আমি খাব না মা৷

সে অবাক হয়ে বললে, তবে এখানে কেন এসেছ?

—দেখতে৷

রেণুকা বললে, উনি বড়লোকের মেয়ে, ছত্তর খুলবেন কাশীতে—তাই দেখতে এসেছেন কি রকম খাওয়া-দাওয়া হয়৷

এক মুহূর্তে যে-সব বুড়ি খেতে বসেছে এবং যারা পরিবেশন ও দেখাশুনো করছে, সকলেরই ধরন বদলে গেল৷ যে বুড়ি শরতের জাতি-বর্ণের প্রশ্ন তুলেছিল, সে-ই সকলের আগে একগাল হেসে বললে, সে চেহারা দেখেই আমি ধরেছি মা, চেহারা দেখেই ধরেছি৷ আগুন কি ছাইচাপা থাকে? তা দ্যাখো রানীমা, একটা দরখাস্ত দিয়ে রাখি৷ আমার এই নাতনী, অল্পবয়সে কপাল পুড়েছে, কেউ নেই আমাদের৷ আপনার ছত্তর খুললে এর দুটো বন্দোবস্ত যেন সেখানে হয়৷ ভগবান আপনার ভালো করবেন৷ কুচবেহার কালীবাড়িতেও আমাদের নাম লেখানো আছে মাসে পনেরো দিন৷ বাকি পনেরো দিন আমবেড়েয় আর এই ছত্তরে—

আর চার-পাঁচজন নিজেদের দুরবস্থা সবিস্তারে এবং নানা অলঙ্কার দিয়ে বর্ণনা করেছে, এমন সময় পায়েস এসে হাজির হল৷ একটা ছোট পিতলের গামলার এক গামলা পায়েস, খেতে বসেছে প্রায় জন ত্রিশ-বত্রিশ, বেশি করে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়—অথচ প্রত্যেকেই নির্লজ্জভাবে অনুযোগ করতে লাগল তার পাতে পায়েস কেন অতটুকু দেওয়া হল, রোজই তো পায়েস কম পায়, তাকে আজ একটু বেশি করে দেওয়া হোক৷ কেউ কেউ ঝগড়াও আরম্ভ করলে পরিবেশনকারিণীর সঙ্গে৷

শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বাইরে চলে এল৷ বললে, কেন ওরকম বললি? ছিঃ—ওরা সবাই গরিব, ওদের লোভ দেখাতে নেই৷

তারপর অন্যমনস্কভাবে বললে, ইচ্ছে করে ওদের খুব করে পায়েস খাওয়াই৷ আহা, খেতে পায় না, ওদের দোষ নেই—ছত্তরে বন্দোবস্ত ঠিকই আছে, একটু পায়েস দেয়, একটু ঘি দেয়—তবে ছিটেফোঁটা৷

রেণুকা বললে, বাবা, বুড়িগুলো একটু পায়েসের জন্যে কি রকম আরম্ভ করে দিয়েছে বল তো? খাচ্ছিস পরের দয়ায়—আবার ঝগড়া! ভিক্ষের চাল কাঁড়া-আঁকাড়া!

—আহা ভাই—কত দুঃখে যে ওরা এমন হয়েছে তা তুমি আমি কি জানি? মানুষে কি সহজে লজ্জাশরম খোয়ায়? ওদের বড় দুঃখ৷ সত্যি ভাই, আমার ইচ্ছে করছে, আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকত, বাবার নামে ছত্তর দিতাম৷ আর তাতে নিজের হাতে বড় কড়ায় পায়েস রেঁধে ওদের খাওয়াতাম৷ সেদিন যেমন কড়ায় হালুয়া রেঁধে দিল সেই ছত্তরটা—তুই দেখিস নি—চাদরের মস্ত বড় কড়া৷

—নে চল আমার হাত ধর—

—ওই পাগলিকে নিজের হাতে রেঁধে একদিন পেটভরে খাওয়াব৷ তোর বাড়িতে—

—বেশ তো৷

—আমি মাইনে বলে কিছু চাইলে ওরা দেবে না?

—দেওয়া তো উচিত৷ তবে গিন্নিটি যে রকম ঝানু—তুমি তো ভাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না—

—মরে গেলেও না৷ তবে একবার বলে দেখতে হবে৷ বেশি লোককে না পারি, একজনকেও তো পারি৷

ওরা খানিক দূর এসেছে, ছত্রের উত্তর দিকের উঁচু রোয়াক থেকে পুরুষের দল খেয়ে নেমে আসছে, হঠাৎ তাদের মধ্যে কাকে দেখে শরৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বার হল—পরক্ষণেই সে রেণুকার হাত ছেড়ে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে চলল৷

বিস্মিতা রেণুকা বললে, কোথায় চললে ভাই? কি হল?

পুরুষের ভিড়ের মধ্যে এঁটোহাতে নেমে আসছেন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, তিন বৎসর আগে যিনি পদব্রজে দেশভ্রমণে বেরিয়ে গড়শিবপুরে শরৎদের বাড়ির অতিথিশালায় কয়েকদিন ছিলেন৷

শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে৷ কোনো ভুল নেই—তিনিই৷ সেই গোপেশ্বর চট্টোপাধ্যায়৷

সে প্রথমটা একটু ইতস্তত করছিল—কিন্তু তখনি দ্বিধা ও সঙ্কোচ ছেড়ে কাছে গিয়ে বললে, ও জ্যাঠামশাই? চিনতে পারেন?

সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণই বটে৷ শরতের দিকে অল্পক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তিনি আগ্রহ ও বিস্ময়ের সুরে বললেন—মা, তুমি এখানে?

—হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, আমি এখানেই আছি—

—কতদিন এসেছ? রাজামশায় কোথায়? তোমার বাবা?

—তিনি—তিনি দেশে৷ সব কথা বলছি, আসুন আমার সঙ্গে৷ আমার সঙ্গে একটি মেয়ে আছে—ওকে ডেকে নিই৷ আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন জ্যাঠামশায়৷

পথে বেরিয়েই গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন—তারপর মা, তুমি এখানে কবে এসেছ? আছ কোথায়?

—সব বলব৷ আপনি আগে বসুন, আপনি কবে এসেছেন?

—আমি সেই তোমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে আরও দু-এক জায়গায় বেড়িয়ে বাড়ি যাই৷ বাড়িতে বলেছি তো ছেলের বউ আর ছেলেরা—তাদের অবস্থা ভালো না৷ কিছুদিন বেশ রইলাম—তার পর এই মাঘ মাসে আবার বেরিয়ে পড়লাম—একেবারে কাশী৷

—হেঁটে?

—না মা, বুড়ো বয়সে তা কি পারি? ভিক্ষে-সিক্ষে করে কোনোমতে রেলে চেপেই এসেছি৷ ছত্তরে ছত্তরে খেয়ে বেড়াচ্ছি৷ মা অন্নপুণ্ণোর কৃপায় আমার মতো গরিব ব্রাহ্মণের দুটো ভাতের ভাবনা নেই এখানে৷ চলে যাচ্ছে এক রকমে৷ আর দেশে ফিরব না ভেবেছি মা৷

রেণুকাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শরৎ বললে, চলুন জ্যাঠামশায়, দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসি৷ দুজনে গিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় বসলো৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, তারপর মা, তোমার কথা বলো৷ কার সঙ্গে এসেছ কাশীতে? ও মেয়েটি বুঝি চোখে দেখতে পায় না? ও কেউ হয় তোমাদের?

শরতের কোনো দ্বিধা হল না৷ এই পিতৃসম স্নেহশীল বৃদ্ধের কাছে সব কথা খুলে বলতে৷ অনেক দিন পরে সে এমন একজন মানুষ পেয়েছে, যার কাছে বুকের বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া যায়৷ কথা শেষ করে সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল৷

বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে সব শুনে কাঠের মতো বসে রইলেন৷

এসব কি শুনছেন তিনি? এও কি সম্ভব?

শেষে আপন মনেই যেন বললেন, তোমার বাবা রাজামশায় তা হলে দেশেই—না?

—তা জানি নে জ্যাঠামশায়, বাবা কোথায় তা ভেবেছিও কতবার—তবে মনে হয় দেশেই আছেন তিনি—যদি এতদিন বেঁচে থাকেন—

কান্নার বেগে আবার ওর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল৷

—আচ্ছা, থাক মা, কেঁদো না৷ আমিও বলছি শোনো—গোপেশ্বর চাটুজ্জে যদি অভিনন্দ ঠাকুরের বংশধর হয়, তবে এই কাশীর গঙ্গাতীরে বসে দিব্যি করছি তোমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবই৷ তুমি তৈরি হও মা—কালই রওনা হয়ে যাব বাপে-ঝিয়ে—তুমি কোন বাড়ি থাকো—চল দেখে যাই৷ তুমি কি মেয়ে, আমার তা জানতে বাকি নেই৷ নরাধম পাষণ্ড ছাড়া তোমার চরিত্রে কেউ সন্দেহ করতে পারে না৷ আমার রোগ থেকে সেবা করে তুমি বাঁচিয়ে তুলেছিলে—তা আমি ভুলি নি—আমার আর জন্মের মা-জননী তুমি৷ তোমায় এ অবস্থায় এখানে ফেলে গেলে আমার নরকেও স্থান হবে না যে৷

এগারো
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে সঙ্গে নিয়ে শরৎ ফিরল নিজের বাসায়৷

বৃদ্ধ বললেন, এই বাড়ি? বেশ৷ কাল তুমি তৈরি হয়ে থেকো৷ তোমার এই বুড়ো ছেলের সঙ্গে কাল যেতে হবে তোমায়৷ পয়সাকড়ি না থাকে, সেজন্যে কিছু ভেবো না—ছেলের সে ক্ষমতা আছে মা-জননী৷

রেণুকা এতক্ষণ কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে গিয়েছিল, শরৎকে চুপি চুপি বললে, উনি কে ভাই?

—আমার জ্যাঠামশাই—

—তোমাকে দেশে নিয়ে যাবেন?

—তাই তো বলছেন৷

—হঠাৎ কালই চলে যাবে কেন, এ মাসটা থেকে যাও না কাশীতে৷ বলো তোমার জ্যাঠামশাইকে৷ খোকার সঙ্গে একবার দেখাও করতে হবে তো? আমাকে এত শীগগির ফেলে দিয়েই বা যাবে কোথায়?

শরৎ বৃদ্ধকে জানাল৷ কালই যাওয়া মুশকিল হবে তার৷ যেখানে কাজ করছে, যারা এতদিন আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল তারা একটা লোক দেখে নিলে সে যাবার জন্যে তৈরি হবে৷

বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে তাতে রাজি হলেন৷ পাঁচ দিনের সময় নিয়ে শরৎ রোজ রান্নাবান্নার পরে রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে খোকনদের বাড়ি যায়৷ কাশী থেকে কোন অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের পথে সে যাত্রা শুরু করবে তা সে জানে না—কিন্তু খোকনকে ফেলে যেতে তার সব চেয়ে কষ্ট হবে তা সে এ ক’দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝছে৷ খোকনের মা ওর যাবার কথা শুনে খুবই দুঃখিত৷

শরৎ বলে, ও খোকন বাবা, গরিব মাসিমাকে মনে রাখবি তো বাবা?

খোকন না বুঝেই ঘাড় নেড়ে বলে—হুঁ, তোমাকে একটা বল কিনে দেব মাসিমা—

—সত্যি?

—হ্যাঁ মাসিমা, ঠিক দেব৷

—আমায় কখনো ভুলে যাবি নে? বড় হলে মাসিমার বাড়ি যাবি, মুড়কি নাড়ু দেব ধামি করে, পা ছড়িয়ে বসে খাবি৷

খোকা ঘাড় নেড়ে বলে— হুঁ৷

বকসীদের বড় বউ ওর নামঠিকানা সব লিখে নিলে, খোকনের মার কাছে ওর নামঠিকানা রইল৷

ফেরবার পথে শরৎ গণেশমহল্লার পাগলির সন্ধানে ইতস্তত চাইতে লাগল, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না৷ রেণুকাকে বললে, ওই একটা মনে বড় সাধ ছিল, পাগলিকে একদিন ভালো করে রেঁধে খাওয়াব—তা কিন্তু হল না৷ আমি মাইনে বলে কিছু চেয়ে নেব মিনুর কাকির কাছ থেকে, যদি কিছু দেয় তবে তোর কাছে রেখে যাব৷ আমার হয়ে তুই তাকে একদিন খাইয়ে দিস—

রেণুকা ধরা গলায় বলে—আর আমার উপায় কি হবে বললে না যে বড়? তোমার ছত্র কবে এসে খুলছ কাশীতে—শরৎসুন্দরী ছত্র? গরিব লোক দুটো খেয়ে বাঁচি৷

শরৎ হেসে ভঙ্গি করে ঘাড় দুলিয়ে বললে, আ তোমার মরণ! এর মধ্যে ভুলে গেলি মুখপুড়ি? শরৎসুন্দরী নয়, কেদার ছত্তর—

—ও ঠিক, ঠিক৷ জ্যাঠামশায়ের নামে ছত্র হবে যে! ভুলে যাই ছাই—

—না হলেও তুই যাবি আমাদের দেশে৷ মস্ত বড় অতিথিশালা আছে৷ রাজারাজড়ার কাণ্ড! সেখানে বারো মাস খাবি, রাজকন্যের সখী হয়ে—কি বলিস?

—উঃ, তা হলে তো বর্তে যাই দিদিভাই৷ কবে যেন যাচ্ছি তাই বলো, জোড়ে না বিজোড়ে?

—তা কি কখনো হয় রে পোড়ারমুখি? জোড়ের পায়রা জোড় ছাড়া করতে গিয়ে পাপের ভাগী হবে কে?

মিনুর কাকিমাকে শরৎ বিদায়ের কথা বলতেই সে চমকে উঠল প্রায় আর কি৷ কেন যাবে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে—নানা প্রশ্নে শরৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল৷ তার কোনো কথাই অবিশ্যি মিনুর কাকিমার বিশ্বাস হল না৷ ওসব চরিত্রের লোকের কথার মধ্যে বারো আনাই মিথ্যে৷

শরৎ বললে, আমায় কিছু দেবেন? যাবার সময় খরচপত্র আছে—

—যখন তখন হুকুম করলেই কি গেরস্তর ঘরে টাকাকড়ি থাকে? আমি এখন যদি বলি আমি দিতে পারব না?

—দেবেন না৷ আপনারা এতদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ঢের৷ পয়সাকড়ির জন্যে তো ছিলাম না, গৌরী-মা বলে দিয়েছিলেন, সব ঠিক করে দিয়েছিলেন—তাই এখানে ছিলাম৷ আপনাদের উপকার জীবনে ভুলব না৷

মিনুর কাকিমা শরতের কথা শুনে একটু নরমও হল৷ বললে, তা—তা তো বটেই৷ তা আচ্ছা দেখি যা পারি দেব এখন৷

বিদায়ের দিন শরৎ মিনুর কাকিমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু-না-কিছু খেলনা ও খাবার জিনিস কিনে নিয়ে এল৷ রেণুকাকে তার ঘরে একখানা লালপাড় শাড়ি দিতে গিয়ে চোখের জলের মধ্যে পরস্পরের ছাড়াছাড়ি হল৷

রেণুকা বললে, এ শাড়ি আমার পরা হবে না ভাই, মাথায় করে রেখে দেব—

—তাই করিস মুখপুড়ি৷

—কেন আমার জন্যে খরচ করলে? ক’টাকা দাম নিয়েছে?

—তোর সে খোঁজে দরকার কি? দিলাম, নে—মিটে গেল৷ জানিস আমি রাজকন্যে, আমাদের হাত ঝাড়লে পর্বত?

রেণুকা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললে—তুমি আমায় ভুলে গেলে আমি মরে যাব ভাই৷

শরৎ মুখে ভেংচি কেটে বললে, মরে ভূত হবি পোড়ারমুখি! ভূত না তো, পেত্নী হবি! রাত্রে আমায় যেন ভয় দেখাতে যেয়ো না!

শরতের মুখে হাসি অথচ চোখে জল৷

.

আবার কলকাতা শহর৷….

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, এখানে বৃন্দাবন মল্লিকের লেনে আমাদের গাঁয়ের একজন লোক বাস করে, আপিসে চাকরি করে৷ চলো সেখানে গিয়ে উঠি দুজনে৷

খুঁজতে খুঁজতে বাসা মিলল৷ বাড়ির কর্তা জাতিতে মোদক, স্বগ্রামের প্রবীণ ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে সে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল৷ মাথায় রাখে কি কোথায় রাখে, ভেবে যেন পায় না৷ বললে—মা-ঠাকরুণ কে?

—আমার ভাইঝি, গড়শিবপুরে বাড়ি ওদের৷ তুমি চেন না—মস্ত লোক ওর বাবা৷

—তা চাটুজ্জে মশাই, সব যোগাড় আছে ঘরে৷ দিদি ঠাকরুণ রান্নাবান্না করুন, ওরা সব যুগিয়ে দেবে এখন৷ আমার আবার আপিসের বেলা হয়ে গেল—দশটায় হাজির হতেই হবে৷ আমি তেল মাখি—কিছু মনে করবেন না৷

বাড়ির গৃহিণী শরৎকে যথেষ্ট যত্ন করলেন৷ তাকে কিছুই করতে দিলেন না৷ বাটনা বাটা, কুটনো কোটা সবই তিনি আর তাঁর বড় মেয়ে দুজনে মিলে করে শরৎকে রান্না চড়িয়ে দিতে ডাক দিলেন৷

শরতের জন্যে মিছরি ভিজের শরবৎ, দই, সন্দেশ আনিয়ে তার স্নানের পর তাকে জল খেতে দিলেন৷

আহারাদির পর শরতের বড় ইচ্ছে হল একবার কালীঘাটে গিয়ে সে গৌরী-মার সঙ্গে দেখা করে৷ বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে শুনে বললেন, চলো না মা, আমারও ওই সঙ্গে দেবদর্শনটা হয়ে যাক৷

বিকেলের দিকে ওরা কালীঘাটে গেল৷ বাড়ির গৃহিণী তাঁর বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ওদের সঙ্গিনী হলেন৷ মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিস্তৃত নাটমন্দিরে দু-তিনটি নূতন সন্ন্যাসী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন৷ গৌরী-মা তাঁর পুরনো জায়গাটিতেই ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন৷ শরৎকে দেখে তিনি প্রায় চমকে উঠলেন৷ বললেন, সরোজিনীরা কি কলকাতায় এসেছে?

শরৎ তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে সব খুলে বললে৷

গৌরী-মা বললেন, তোমার জ্যাঠামশাই? কই দেখি—

বৃদ্ধা চাটুজ্জে মহাশয় এসে গৌরী-মার কাছে বসলেন, কিন্তু প্রণাম করলেন না, বোধ হয় সন্ন্যাসিনী তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট বলে৷ বললেন—মা, আমি আপনার কথা শরতের মুখে সব শুনেছি৷ আপনি আশীর্বাদ করুন আমি ওকে যেন ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারি৷ আপনার আশীর্বাদ ছিল বলে বোধ হয় আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কাশীতে৷

গৌরী-মা বললেন, তাঁর কৃপায় সব হয় বাবা, তিনিই সব করছেন—আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র৷

বাসায় ফিরে আসবার পথে শরতের কেবলই মনে হচ্ছিল, যদি কমলার সঙ্গে একবারটি পথেঘাটে কোথাও দেখা হয়ে যেত, কি মজাই হত তা হলে! কলকাতার মধ্যে যদি কারো সঙ্গে দেখা করবার জন্য প্রাণ কেমন করে—তবে সে সেই হতভাগিনী বালিকার সঙ্গেই আবার সাক্ষাতের আশায়৷

কাশীতে গিয়ে এই দেড় বৎসরে সে অনেক শিখেছে, অনেক বুঝেছে৷ এখন সে হেনাদের বাড়ি আবার যেতে পারে, কমলাকে সেখান থেকে টেনে আনতে পারে, সে সাহস তার মধ্যে এসে গিয়েছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় সে হেনাদের বাড়ির ঠিকানা জানে না, শহর বাজারে ঘরবাড়ির ঠিকানা বা রাস্তা না জানলে বের করতে পারা যায় না, আজকাল সে বুঝেছে৷

কলকাতায় এসে আবার তার বড় ভালো লাগছে৷ কাশী তো পুণ্যস্থান, কত দেউল-দেবমন্দির ঘাট, যত ইচ্ছে স্নান কর, দান কর, পুণ্য কর—স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের সেখানে অধিষ্ঠান৷ কিন্তু কলকাতা যেন ওকে টানে, এখানে এত জিনিস আছে যার সে কিছুই বোঝে না—সেজন্যেই হয়তো কলকাতা তার কাছে বেশি রহস্যময়৷ এত লোকজন, গাড়িঘোড়া, এত বড় জায়গা কাশী নয়৷

শরৎ বলে, জ্যাঠামশায় আপনি কোন কোন দেশে বেড়ালেন?

—বাংলা দেশের কত জায়গা পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি মা, বর্ধমানে গিয়েছি, বৈঁচি, শক্তিগড়, নারাণপুর গিয়েছি৷ রাঢ় দেশের কত বড় বড় মাঠ বেয়ে সন্দেবেলা সুমুখ আঁধার রাত্তিরে একা গিয়েছি৷ বড় তালগাছ ঘেরা দিঘি, জনমানব নেই কোথাও, লোকে বলে ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতের ভয়—এমন সব দিঘের ধারে সারাদিন পথ হাঁটবার পরে বসে চাট্টি জলপান খেয়েছি৷ একদিন সে কথা গল্প করব তোমাদের বাড়ি বসে৷

—বেশ জ্যাঠামশায়৷

—বেড়াতে বড় ভালো লাগে আমার৷ আগে বাংলাদেশের মধ্যেই ঘুরতাম, এবার গয়া কাশীও দেখা হল—

—আমারও খুব ভালো লাগে৷ বাবা কোনো দেশ দেখেন নি৷ বাবাকে নিয়ে চলুন আবার আমরা বেরুবো—

—খুব ভালো কথা মা৷ চলো এবার হরিদ্বারে যাব—

—সে কতদূর? কাশীর ওদিকে?

—সে আরও অনেক দূর শুনেছি৷ তা হোক, চলো সবাই মিলে যাওয়া যাক—বৃন্দাবন হয়ে যাব—তোমার বাবাও চলুন৷

—জ্যাঠামশায়?

—কি মা?

—বাবার দেখা পাব তো?

—আমি যখন কথা দিয়েছি মা, তুমি ভেব না৷ সে বিষয়ে নিশ্চিন্দি থাকো৷

.

পরদিন গোপেশ্বর চাটুজ্জে শরৎকে কলকাতায় তাঁর স্বগ্রামবাসী কৃষ্ণচন্দ্র মোদকের বাসায় রেখে দুদিনের জন্যে গড়শিবপুরে গেলেন৷ শরৎকে আগে হঠাৎ গ্রামে না নিয়ে গিয়ে ফেলে সেখানকার ব্যাপার কি জানা দরকার৷ গড়শিবপুরে গিয়ে সন্ধান নিয়ে কিন্তু তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল, যা শুনলেন সেখানে গ্রামের লোকে বললে, কেদার রাজা বা তাঁর মেয়ে আজ প্রায় দেড়-বৎসর দু-বৎসর আগে গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে যান৷ সেখান থেকে তাঁরা কোথায় চলে গিয়েছেন তা কেউ জানে না৷ কলকাতায় তাঁরা নেই একথাও ঠিক৷ যাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তারাই ফিরে এসে বলেছে৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে গ্রামের অনেককেই জিজ্ঞেস করলেন, সকলেই ওই এক কথা বলে৷ সেবার যে সেই মুদির দোকানে কেদারের সঙ্গে বসে বসে গান-বাজনা করেছিলেন সেখানেও গেলেন৷ কেদার গাঁয়ে না থাকায় গানবাজনার চর্চা আর হয় না, মুদি খুব দুঃখ করলে৷ গোপেশ্বরকে তামাক সেজে খাওয়ালে৷ অনেকদিন কেদার বা তাঁর মেয়ের কোনো সন্ধান নেই, আর আসবেন কিনা কে জানে!

বৃদ্ধ তামাক খেয়ে উঠলেন৷

গ্রামের বাইরের পথ ধরে চিন্তিত মনে চলেছেন, শরতের বাপের যদি সন্ধান না-ই পাওয়া যায়, তবে উপস্থিত শরতের গতি কি করা যাবে? কাশী থেকে এনে ভুল করলেন না তো?

এমন সময় পেছন থেকে একজন চাষা লোক তাঁকে ডাক দিলে—বাবাঠাকুর—

গোপেশ্বর চাটুজ্জে ফিরে চেয়ে দেখে বললেন—কি বাপু?

—আপনি ক্যাদার খুড়ো ঠাকুরের খোঁজ করছিলেন ছিবাস মুদির দোকানে? আমিও সেখানে ছেলাম৷ আপনি কি তাঁর কেউ হন?

—হ্যাঁ বাপু, আমি তাঁর আত্মীয়৷ কেন, তুমি কিছু জান নাকি?

—আপনি কারো কাছে বলবেন না তো?

—না, বলতে যাব কেন? কি ব্যাপার বলো তো শুনি? আমি তাঁর বিশেষ আত্মীয়, আর আমার দরকারও খুব৷

লোকটা সুর নিচু করে বললে—তিনি হিংনাড়ার ঘোষেদের আড়তে কাজ করছেন যে! হিংনাড়া চেনেন? হলুদপুকুর থেকে তিন ক্রোশ৷ আমি পটল বেচতে যাই সেবার মাঘ মাসে, আমার সঙ্গে দেখা৷ আমায় দিব্যি দিয়ে দিয়েলেন, গ্রামের কাউকে বলতে নিষেধ করে দিলেন, তাই কাউকে বলি নি৷ আপনি সেখানে যাও, পুকুরের উত্তর পাড়ে যে ধান-সর্ষের আড়ত, সেখানেই তিনি থাকেন৷ আমার নাম করে বলবে, গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর সন্ধান দিয়েছে৷ আমাদের গাঁয়ের শখের যাত্রার দলে কতবার উনি গিয়ে বেয়ালা বাজিয়েছেন৷ আমায় বড্ড স্নেহ করতেন৷ মনে থাকবে— গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর কাপালি!

গোপেশ্বর চাটুজ্জে আশা করেন নি এভাবে কেদারের সন্ধান মিলবে৷ বললেন, বড্ড উপকার করলে বাপু৷ কি নাম বললে—ক্ষেত্র? আমি বলব এখন তাঁর কাছে—বড় ভালো লোক তুমি৷

সেই দিনই সন্ধ্যার আগে গোপেশ্বর চাটুজ্জে হিংনাড়ার বাজারে গিয়ে ঘোষেদের আড়ত খুঁজে বার করলেন৷ আড়তের লোকে জিজ্ঞেস করলে, কাকে চান মশাই? কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

—গড়শিবপুরের কেদারবাবু এখানে থাকেন?

—হ্যাঁ আছেন, কিন্তু তিনি মালঞ্চার বাজারে আড়তের কাজে গিয়েছিলেন—এখনও আসেন নি৷ বসুন৷

রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় কে তাঁকে বললে—মুহুরি মশায় ওই যে ফিরছেন—

গোপেশ্বর চাটুজ্জে সামনে গিয়ে বললেন, রাজামশায়, নমস্কার৷ আমায় চিনতে পারেন?

গোপেশ্বরের দেখে মনে হল কেদারের বয়স যেন খানিকটা বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু হাবভাবে সেই পুরনো আমলের কেদার রাজাই রয়ে গিয়েছেন পুরোপুরিই৷

কেদার চোখ মিটমিট করে বললেন, হ্যাঁ, চিনেছি৷ চাটুজ্জে মশায় না?

—ভালো আছেন?

—তা একরকম আছি৷

—এখানে কি চাকরি করছেন? আপনার মেয়ে কোথায়?

—আমার মেয়ে? ইয়ে—

কেদার যেন একবার ঢোঁক গিলে, তারপর অকারণে হঠাৎ উৎসাহিত সুরে বললেন, মেয়ে কলকাতায়—তার মাসিমার—

গোপেশ্বর চাটুজ্জে সুর নিচু করে বললেন, শরৎ-মাকে আমার সঙ্গে এনেছি৷ সে আমার কাছেই আছে—কোনো ভয় নেই৷

এই কথা বলার পরে কেদারের মুখের ভাবের অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল৷ নিতান্ত নিরীহ ও নির্বোধ লোক ধমক খেলে যেমন হয়, তাঁর মুখ যেন তেমনি হয়ে গেল৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জের মনে হল এখুনি তিনি যেন হাতজোড় করে কেঁদে ফেলবেন৷

বললেন, আমার মেয়েকে—আপনি এনেছেন? কোথায় সে?

—কলকাতায় রেখে এসেছি৷ কালই আনব৷ বসুন একটু নিরিবিলি জায়গায়—সব বলছি৷ ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, কোনো ভয় নেই রাজামশায়৷ চলুন ওদিকে—বলি সব খুলে৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আপনার মেয়ে আগুনের মতো পবিত্র—

কেদার হা-হা করে হেসে বললেন, ও কথা আমায় বলার দরকার হবে না হে গোপেশ্বর৷ আমার মেয়ে, আমাদের বংশের মেয়ে—ও আমি জানি৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, রাজামশায় শেষটাতে কি এখানে চাকরি স্বীকার করলেন?

কেদার অপ্রতিভের হাসি হেসে বললেন, ভুলে থাকবার জন্যে, স্রেফ ভুলে থাকবার জন্যে দাদা৷ এরা আমার বাড়ি যে গড়শিবপুরে তা জানে না৷ বেহালা বাজাই নি আজ এই দেড় বছর— বেহালার বাজনা যদি কোথাও শুনি, মন কেমন করে ওঠে৷

—চলুন, আজই কলকাতায় যাই—

—আমার বড় ভয় করে৷ ভয়ানক জায়গা—আমি আর সেখানে যাব না হে, তুমি গিয়ে নিয়ে এস মেয়েটাকে৷ আজ রাতে এখানে থাকো—কাল রওনা হয়ে যাও সকালে৷ আমার কাছে টাকা আছে, খরচপত্র নিয়ে যাও৷ প্রায় সওয়া-শো টাকা এদের গদিতে মাইনের দরুন এই দেড় বছরে আমার পাওনা দাঁড়িয়েছে৷ আজ ঘোষ মশায়ের কাছে চেয়ে নেব৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে পরদিন সকালে কলকাতায় গেলেন এবং দুদিন পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে স্বরূপপুর স্টেশনে নেমে নৌকাযোগে বৈকালে হিংনাড়া থেকে আধক্রোশ দূরবর্তী ছুতোরঘাটায় পৌঁছে কেদারকে খবর দিতে গেলেন৷ শরৎ নৌকাতেই রইল বসে৷

সন্ধ্যার কিছু আগে কেদার এসে বাইরে থেকে ডাক দিলেন—ও শরৎ—

শরৎ কেঁদে ছইয়ের মধ্যে থেকে বার হয়ে এল৷ সে যেন ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল বাপের কাছে৷ অকারণে বাপের ওপর তাঁর এক দুর্জয় অভিমান৷

কেদার বড় শক্ত পুরুষমানুষ—এমন সুরে মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, যেন আজ ওবেলাই মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, যেন রোজই দেখাসাক্ষাৎ হয়৷

—কাঁদিস নে মা, কাঁদতে নেই, ছিঃ! কেঁদো না—ভালো আছিস?

শরৎ কাঁদতে কাঁদতেই বললে, তুমি তো আর আমার সন্ধান নিলে না? বাবা তুমি এত নিষ্ঠুর! আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তুমি এমনি করে ভুলে থাকতে পারতে?

দুজনেই জানে কারো কোনো দোষ নেই, যা হয়ে গিয়েছে তার ওপর হাত ছিল না বাবা বা মেয়ের কারো—রাগ বা অভিমান—সম্পূর্ণ অকারণ!

কেদার অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, তা কিছু মনে করিস নে তুই মা৷ আমার কেমন ভয় হয়ে গেল—আমায় ভয় দেখালে পুলিস ডেকে দেবে, তোমায় ধরিয়ে দেবে, সে আরও কত কিছু৷ আমার সব মনেও নেই মা৷ যাক যা হয়ে গিয়েছে, তুমি কিছু মনে করো না৷ চলো চলো আজই গড়শিবপুরে রওনা হই—দেড় বছর বাড়ি যাই নি!

.

গড়শিবপুরের রাজবাড়ি এই দেড় বছরে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে৷

চালের খড় গত বর্ষায় অনেক জায়গায় ধ্বসে পড়েছে৷ বাঁশের আড়া ও বাতা উইয়ে খেয়ে ফেলেছে৷ বাড়ির উঠোনে একহাঁটু বনজঙ্গল—আজ গোপেশ্বর চাটুজ্জে ও কেদার অনবরত কেটে পরিষ্কার করেও এখনও সাবেক উঠোন বের করতে পারেন নি৷

নিড়ানি ধরে সামনের উঠোনের লম্বা লম্বা মুথো ঘাস উপড়ে তুলতে তুলতে কেদার বললেন, ও মা শরৎ, আমাদের একটু তামাক দিতে পার?

গোপেশ্বর চাটুজ্জে উঠোনের ওপাশে কুকশিমা গাছের জঙ্গল দা দিয়ে কেটে জড়ো করতে করতে বলে উঠলেন—ও কি রাজামশাই, না না, মেয়েমানুষদের দিয়ে তামাক সাজানো—ওরা ঘরের লক্ষ্মী—না, ছিঃ—তামাক আমি সেজে আনছি গিয়ে—

ততক্ষণে শরৎ তামাক ধরিয়ে কলকেতে ফুঁ পাড়ছে৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া ঈষৎ দীর্ঘতর হয়েছে৷ বাতাসে সদ্য কাটা বনজঙ্গলের কটুতিক্ত গন্ধ৷ ভাঙা গড়বাড়ির দেউড়ির কার্নিসে বন্য পাখির কাকলি৷

কাশীতে যখন ছিল তখন ভাবে নি আবার সে দেশে ফিরতে পারবে কখনো, আবার সে এমনিতর বৈকালে বাবাকে নিড়ান হাতে উঠোনের ঘাস পরিষ্কার করতে দেখবে, বাবার তামাক আবার সাজবার সুযোগ পাবে সে৷

তামাক দিয়ে শরৎ বললে, বাবা, হিম হয়ে বসে থেকো না—এবেলা একটা তরকারি নেই যে কুটি, ব্যবস্থা আগে করো৷

কেদার কিছুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে বললেন, কেন, পুকুরপাড়ে ঝিঙে দেখে এলাম তো তখন!

কালোপায়রা দিঘির পাড়ে বাঁধানো ঘাটের পাশের ঝোপের মাথায় বন্য ঝিঙে ও ধুঁধুলের লতা বেড়ে উঠেছে, কেদারের কথার লক্ষ্যস্থল সেই বুনো ধুঁধুলের গাছ৷

—শুধু ঝিঙে বাবা?

—তাই নিয়ে এসে ভাতে দে—কি বল হে দাদা? হবে না?

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বনজঙ্গল কাটতে কাটতে একটা ঝালের চারা দায়ের মুখে উপড়ে ফেলেছিলেন, সেটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে কিছুক্ষণ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন—খুব, খুব৷ রাজভোগ ভেসে যাবে৷

কেদার বললেন—তবে তাই করো মা শরৎ৷ তাই নিয়ে এসো৷

শরৎ কালোপায়রা দিঘির ধারে জঙ্গলে এল ঝিঙে খুঁজতে৷

আজই দুপুরবেলা ওরা গরুর গাড়ি করে এসে পৌঁছেছে এখানে৷ বাপ ও জ্যাঠামশায় সেই থেকে বনজঙ্গল পরিষ্কার নিয়েই ব্যস্ত আছেন৷ সে নিজে ঘরদোর পরিষ্কার করছিল—এইমাত্র একটু অবসর মিলেছে চোখ মেলে চারিদিকে চাইবার৷ কালোপায়রা দিঘির টলটলে জলে রাঙা কুমুদ ফুল ফুটেছে গড়বাড়ির ভগ্নস্তূপের দিকটাতে৷ এই তো বাঁধাঘাট৷ ঘাটের ধাপে শেওলা জমেছে, কুকশিমার জঙ্গল বেড়েছে খুব—কতকাল বাসন মাজে নি ঘাটটাতে বসে৷ কাল সকালে আসতে হবে আবার৷

ছাতিম বনের ছায়ার দিকে চেয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ছাতিম বনের ওপরে ওই দেউলের গম্বুজাকৃতি চূড়োটা বনের আড়াল থেকে মাথা বার করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছায়া ওপার থেকে এপারে এসে পৌঁছেছে৷ চাতালের যে কোণে বসে শরৎ বাসন মাজত, এপারের বটগাছটার ডাল তার ওপরে ঝুঁকে পড়েছে৷ শরৎ যেন কতকাল পরে এসব দেখছে, জন্মান্তরের তোরণদ্বার অতিক্রম করে এ যেন নতুন বার পৃথিবীতে এসে চোখ মেলে চাওয়া বহু কালের পুরনো পরিচয়ের পৃথিবীতে৷ কালোপায়রা দিঘির ধারের এমনি একটি সুপরিচিত বৈকালের স্বপ্ন দেখে কতবার চোখের জল ফেলেছে কাশীতে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে করতে, দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় সন্ধ্যাবেলা রেণুকার সঙ্গে বসে, রাজগিরিতে গৃধ্রকূট পাহাড়ের ছায়াবৃত পথে মিনুর সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে৷

সে শরৎ নেই আর৷ শরৎ নিজের অনুভূতিতে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল৷ নতুন দৃষ্টি, নতুন মন নিয়ে ফিরেছে শরৎ৷ পল্লীগ্রামের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা যে শরৎসুন্দরীর দৃষ্টি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিল, আজ বহির্জগতের আলো ও ছায়া, পাপ ও পুণ্যের সংস্পর্শে এসে যেন শরতের মন উদারতর, দৃষ্টি নবতর দর্শনের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে৷

ঝিঙে তুলে রেখে শরৎ বার বার দিঘির ঘাটের ভাঙা চাতালে প্রাচীন বটতলায় নানা কারণে অকারণে ছুটে ছুটে আসতে লাগল শুধু এই নতুন ভাবানুভূতিকে বার বার আস্বাদ করবার জন্যে৷ একবার উপরে গিয়ে দেখলে গ্রামের জগন্নাথ চাটুজ্জে কার মুখে খবর পেয়ে এসে পৌঁছে গিয়েছেন৷ বাবা ও জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন৷

ওকে দেখে জগন্নাথ বললেন, এই যে মা শরৎ তা কাশী গয়া অনেক জায়গা বেড়িয়ে এলে বাবার সঙ্গে আর গোপেশ্বর ভায়ার সঙ্গে? ভালো—প্রায় দেড় বছর বেড়ালে৷

বুদ্ধিমতী শরৎ বুঝল এ গল্প জ্যাঠামশায়ই রচনা করেছেন তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ নির্দেশ করার জন্যে৷ শরৎ জগন্নাথ চাটুজ্জের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে৷

—এসো, এসো মা, থাক৷ চিরজীবী হও—তা কোন কোন দেশ দেখলে?

কেদার বললেন, দেড় বছর ধরে তো বেড়ানো হয় নি৷ আমি মধ্যে চাকরি করেছিলাম হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তে৷ এই গোপেশ্বর দাদা সপরিবারে পশ্চিমে গেলেন, শরৎকে নিয়ে গিয়েছিলেন—

শরৎ বললে, চা খাবেন জ্যাঠামশায়, যাবেন না—বসুন৷ আমি বাসনগুলো ধুয়ে আনি পুকুরঘাট থেকে৷

আবার সে ছুটে এল কালোপায়রা দিঘির পাড়ে ছাতিমবনের দীর্ঘ, ঘন শীতল ছায়ায়৷ পুরনো দিনের মতো আবার রোদ রাঙা হয়ে উঠে গিয়েছে ছাতিম গাছের মাথায়৷ বেলা পড়ে এসেছে৷ এমন সময়ে দূর থেকে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে সে হঠাৎ লুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

রাজলক্ষ্মীর হাতে একটি প্রদীপ, তেলসলতে দেওয়া৷

দুজনেই দুজনকে দেখে উচ্ছ্বসিত আনন্দে আত্মহারা৷

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, মানুষ না ভূত, দিদি?

—ভূত, তোর ঘাড় মটকাব!

তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলে৷

—শুনিস নি আমরা এসেছি?

—কারো কাছে না৷ কে বলবে? আমি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠে এই আসছি—

—কোথায় চলেছিস রে এদিকে?

—তোমাদের উত্তর দেউলে পিদিম দিচ্ছি আজ এই দেড় বছর৷ বলে গিয়েছিলে, মনে নেই?

—সত্যি ভাই?

—না মিথ্যে!

—আর জন্মের বোন ছিলি তুই, এই বংশের মেয়ে ছিলি কোনো জন্মে৷

—এতদিন কোথায় ছিলে তোমরা দিদি?

—কাশীতে৷ সব বলব গল্প তোকে৷ চল—

—আজ পিদিম তুমি দেবে দিদি?

—নিশ্চয়! ভিটেয় যখন এসেছি, তখন তোকে আর পিদিম দিতে হবে না৷ তবে আমার সঙ্গে চল—

০৭. ছাতিমবন নিবিড় হয়েছে

কালোপায়রা দিঘির ওপারের ছাতিমবন নিবিড় হয়েছে, তার ছায়ায় ছায়ায় উত্তর দেউলের যাবার পথে বাদুরনখী গাছের জঙ্গল তেমনি ঘন, যেমন শরৎ চিরকাল দেখে এসেছে, তবে এখনো গাছ শুকিয়ে যায় নি— সবে বেগুন রঙের ফুল ধরেছে বড় বড় সবুজ পাতার আড়ালে৷ শরৎ আগে আগে প্রদীপ হাতে রাজলক্ষ্মী পেছনে৷ কত পরিচিত পুরনো পথ, সারা জীবনই যেন অতীব শান্ত ও নিরুপদ্রব আরামে ওই বাদুড়নখী গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে সে, তার পিতৃগৃহের পুণ্য আবেষ্টনী তার জীবনের পাথেয় যুগিয়ে এসেছে— যে জীবনের না আছে রাত্রি, না আছে অরুণোদয়—শুধু এমনি চাপা গোধূলি, হৈচৈহীন কর্মকোলাহলহীন!

প্রদীপ দিয়ে ওরা আবার ফিরল৷ পথের দুপাশে পুষ্পশ্রীর লীলায়িত চেতনা ওর আগমনে যেন আনন্দিত৷ কতকাল পরে রাজকন্যা বাড়ি ফিরেছে!

রাজলক্ষ্মী বলে, এঃ দিদি, এ ঘরে বসে রাঁধবে কি করে? জল পড়ে মেজে যে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে!

—পিঁড়ি পেতে নেব এখন৷ তুই আমার বাপের ভিটের নিন্দে করিস নি বলে দিচ্ছি—

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, সেই ছেলেমানুষি স্বভাব এখনও যায় নি শরৎদি—

—চা খাবি?

—তা খাচ্ছি—এখন বলো এতকাল কোথায় ছিলে তোমরা?

—রাজারাজড়ার কাণ্ড, একটু হিল্লিদিল্লি বেড়িয়ে আসা গেল!

—সে তো বুঝতেই পারছি৷

—আজ রাত্তিরে এখানে খাবি রাজলক্ষ্মী৷ কিন্তু কিছু নেই বলছি, শুধু ধুঁধুলভাতে, ধুঁধুলভাজা৷ ভাঙা ঘরে এই দুই তরুণীতে বসে বহুকাল পরে আবার আসর জমালে—ওদিকে দুই বৃদ্ধ উঠোনে দুই কাঁঠালকাঠের পিঁড়ি পেতে বসে অনেক রকম রাজা-উজির বধের গল্প করছিলেন৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে ইতিমধ্যে চলে গিয়েছেন৷

—ভাই, জ্যাঠামশায় আর বাবাকে চাটুকু দিয়ে আয় তো—

রাজলক্ষ্মী চা দিতে গেলে কেদার বললেন, আরে আমার মা-লক্ষ্মী যে! আয় আয়—কতকাল পরে দেখলাম, ভালো ছিলি?

গোপেশ্বর চাটুজ্জেও বললেন, হ্যাঁ, এ খুকিকে তো দেখেছি বটে এখানে—কি নাম যেন তোমার মা?

রাজলক্ষ্মী দুজনের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে রান্নাঘরে চলে গেল৷

কেদার বললেন, দাদা, এবার এখানে কিছুদিন থেকে যাও৷ একসঙ্গে দিনকতক কাটানো যাক—

—শরৎ-মা বলছিল—তীর্থভ্রমণে একবার চলুন, বেরুনো যাক রাজামশাই—

কেদার নিশ্চিন্ত আরামে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বললেন, আর কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করে না দাদা৷ বিদেশে বড় গোলমাল—শুনলে তো সবই! আমাদের এই জায়গাটাই ভালো—বাইরে নানারকম ভয়৷ কেন এখানে ওখানে বেরুনো—আমার হাতে এখনো যা টাকা আছে, এ বছরটা হেসে খেলে চলে যাবে৷ খাজনাপত্তর কেউ দেয় নি দুটি বছর—কাল থেকে আবার তাগাদা শুরু করি৷

শরৎ নিজে তামাক সেজে আনতেই গোপেশ্বর চাটুজ্জে হাঁ হাঁ করে উঠলেন৷ —তুমি কেন মা—তুমি কেন? আমাকে বললেই তো হত—এসব আমি পছন্দ করি নে, মেয়েদের দিয়ে তামাক সাজানো! রাজামশায়ের তামাক আমি সাজব৷

কেদার বললেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় দাদা৷ আর যে উপকার তুমি করেছ, তার ঋণ আমি বা আমার মেয়ে কেউ শুধতে পারব না৷ আমার এ বাড়িতে যতদিন ইচ্ছে থাকো, তোমার বাড়ি তোমার ঘর-দোর৷ আমার মেয়ে তোমার আমার তামাক সাজবে এ আর বেশি কথা কি দাদা?

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আচ্ছা রাজামশাই, এই কালোপায়রা দিঘি৷ ওপারের বন কেটে বেশ আলু হয়—কিছু বীজ এনে—

—না দাদা, ওসব আমাদের বংশে নেই৷ চাষকাজ করে চাষা লোকেরা৷ আমার দরকার হয় গড়ের জঙ্গল থেকে মেটে আলু তুলে আনব৷ সোজা মেটে আলুটা হয় গড়ের জঙ্গলে৷ সে বছর উত্তর দেউলের গায়ের বন থেকে আলু তুলেছিলাম এক একটা আধমণ ত্রিশ সের৷ আলুর অভাব কি আমার?

হঠাৎ জগন্নাথ চাটুজ্জেকে পুনরায় আসতে দেখে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ও শরৎ, জগন্নাথ খুড়ো আসছেন—আর একটু চা পাঠিয়ে—

জগন্নাথ চাটুজ্জে আসতে আসতে বললেন, তুমি বাড়ি এসেছ শুনে অনেকে দেখা করতে আসছে কেদার রাজা৷ আমি গিয়ে সাতকড়ির চণ্ডীমণ্ডপে খবরটা দিয়ে এলাম—সেই জন্যেই গিয়েছিলাম৷ ওঃ, একটু তেল আনতে বলো তো শরৎকে! বিছুটি যা লেগেছে গায়ে—বড্ড বিছুটির জঙ্গল বেড়েছে গড়ের খালের পথটাতে৷ ছিলে না অনেকদিন, চারিধারে বনজঙ্গল হয়ে—

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, কাল আমি সব কেটে সাফ করে দেব—দেবেন তো দেখিয়ে জায়গাটা!

জগন্নাথ চাটুজ্জে এসেছেন এদের সব খবর সংগ্রহ করতে৷ একটু পরেই তিনি বড় বেশি আগ্রহ দেখাতে লাগলেন, একা এতদিন কোথায় ছিলেন, কি ভাবে কাটল সে-সব খবর জানতে৷ জগন্নাথ বললেন, তুমি কি বরাবর হিংনাড়ায় ছিলে এই দেড় বছর—না আর কোথাও—

—না, আমি—গিয়ে হিংনাড়াতেই—

—কাদের আড়তে বললে—

—ঘোষেদের আড়তে৷ বিপিন ঘোষ বিনোদ ঘোষ দুই ভাই—ওদেরই—

—মাটসের বিনোদ ঘোষ?

—মাটসে তো ওদের বাড়ি নয়, শত্রুঘ্নপুর—

—সে আবার কোন দিকে? নাম তো শুনি নি—

—শত্রুঘ্নপুর বাজিতপুর—রামনগর থানা৷

কেদার ক্রমশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন জগন্নাথ চাটুজ্জের জেরায়৷ এত খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করবার কি দরকার তিনি বুঝতে পারলেন না৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে পরের ছিদ্র অনুসন্ধান করে জীবন কাটিয়ে দিলেন কিনা, তাই ভয় হয়৷

গোপেশ্বরকে দেখিয়ে জগন্নাথ বললেন, ইনি সেই একবার তোমার এখানে এসেছিলেন না? চমৎকার হাত তবলার৷ একদিন শুনতে হবে আবার৷

—হ্যাঁ৷

—শরৎ বুঝি এঁর পরিবারের সঙ্গে তীর্থ করে এল?

—হ্যাঁ৷

—বেশ বেশ৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে হঠাৎ বললেন, ভালো কথা কেদার ভায়া, শুনেছ বোধ হয়, প্রভাসের বাবা হারান বিশ্বেস মারা গিয়েছে আজ বছরখানেক হল৷ প্রভাসদের কলকাতার বাড়িতে তোমরা তো প্রথম যাও—না?

কেদারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে কতটা জানে বা না জানে আন্দাজ করা শক্ত৷ কি ভেবে ও কি কথা বলছে, তাই বা কে জানে? হঠাৎ প্রভাসের কথা তোলার মানে কি?

তবুও সত্য কথার মার নেই ভেবে তিনি বললেন, প্রভাসদের বাড়িতে তো ছিলাম না আমরা৷ একটা বাগানবাড়িতে আমাদের থাকবার জায়গা করে দিয়েছিল৷

—কতদিন সেখানে ছিলে তোমরা?

—বেশি দিন নয়—দিন পনেরো৷

—তার পর কোথায় গেলে?

এইবার জবাব দিলেন গোপেশ্বর চাটুজ্জে৷ বললেন, তার পর একদিন আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা৷ আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করলাম বাগানবাড়িতে গিয়ে তার পরদিন সকালে৷ আমার বাড়ির সকলে তীর্থ করতে বেরিয়েছিল—সেই সঙ্গে শরৎকে নিয়ে গেলাম৷ রাজামশাই দেশে চলে আসছেন, হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তের একজন কর্মচারীর সঙ্গে ওঁর চেনা ছিল—সে নিয়ে গিয়ে চাকরি জুটিয়ে দিলে৷ এই হল মোট ব্যাপার৷ কেমন, এই তো রাজামশাই?

—হ্যাঁ, ওই বৈকি৷

.

দুপুরবেলা৷ কেউ কোথায় নেই৷ গোপেশ্বর কালোপায়রার দিঘিতে মাছের চার করতে গিয়েছেন, আহারাদির পর কেদারকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবেন৷

শরৎ বাবাকে একা পেয়ে বললে, আচ্ছা বাবা, আমার খোঁজ করলে না কেন?

কেদার এ কথার কি উত্তর দেবেন? এ সব ব্যাপারকে তিনি এড়িয়ে চলতে চান—জীবনের সব চেয়ে বড় ধাক্কাকে তিনি ভুলে যেতে চেষ্টা করে আসছেন—তাঁর সব চেয়ে ভয় মেয়ে পাছে আবার ওইসব কথা তোলে৷

আমতা আমতা করে বললেন, তা—খোঁজ করি কোথায়? আমার—

—তোমাকে ওরা বলেছিল আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে দেখা করি নি—না? বলো বাবা, তা যদি বিশ্বাস করে থাকো আমি তোমার সামনেই দিঘির জলে ডুবে মরব৷

এবার কেদার যেন একটু বিচলিত হলেন, তাঁর অনড় আত্মস্বাচ্ছন্দ্য-বোধ এইবার একটু ধাক্কা খেলে৷ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন, তাই তুই বিশ্বাস করিস যে আমি ওসব ভাবতে পারি? দে—একটু তেল দে মাখবার— দেখি আবার গোপেশ্বর ভায়া মাছের চারের কতদূর কি করলে! তোর রান্না হল?

—বেশ বাবা, কি নিশ্চিন্দিই থাকতে পার তুমি, তাই শুধু আমি ভাবি৷ ঘরে আগুন লাগলেও বোধ হয় তোমার সাড়া জাগে না—মানুষে যে কি করে তোমার মতো—আচ্ছা আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি—উত্তর দেবে?

কেদার বিষণ্ণ মুখে বললেন, কি?

—প্রভাসের নামে তোমাকে কেউ কিছু বলেছিল তো? সেই মুখপোড়া গিরীনই বলে থাকবে৷ তুমি পুলিসে খবর দিলে না কেন?

—তারাই বললে পুলিসে খবর দেবে তোর নামে৷ তাতেই তো আমি পালিয়ে এলাম৷

পুলিসের কাছে নালিশে কে আসামী কে ফরিয়াদি হয় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই শরতের—ওসব বড় গোলমেলে ব্যাপার৷ সে চুপ করে রইল৷

কেদার বললেন, কষ্ট পেয়েছিস না মা?

—যাও, তোমাকে আর—

—না মা, ছিঃ, রাগ করতে নেই৷ কি রাঁধছিস? বেগুন এনে দেব এখন ওবেলা৷ গেঁয়োহাটি যাব তাগাদা করতে, ব্যাটারা আজ দু-বছর খাজনার নামটি করে নি৷

—করবে কি? তুমি ছিলে এ চুলোয়? মেয়েকে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও ভেসে পড়েছিলে৷ কি নির্বিকার পুরুষমানুষ তুমি তাই শুধু ভাবি বাবা৷

শরতের এ মেজাজকে কেদারের চিনতে বাকি নেই৷ এ সময় ওর সামনে থাকতে যাওয়া মানে বিপদ টেনে আনা৷ কেদার তেল মেখে সরে পড়লেন৷ বাবাকে যতক্ষণ দেখা গেল শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে, তারপর তিনি কালোপায়রা দিঘির পাড়ের বন-ধুঁধুলের লতাজালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে শরৎ দুই হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল৷ তার বাবা, তাদের বনজঙ্গলে ঘেরা এত বড় গড়বাড়ি, কত পুরনো ভাঙা মন্দির, উত্তর দেউল, বারাহী দেবীর ভগ্ন পাষাণমূর্তি, ওই ছায়ানিবিড় ছাতিমবন—এসব ফেলে তাকে কোথায় চলে যেতে হয়েছিল ভাগ্যের বিপাকে! আর যদি সে না ফিরত, আর যদি বাবাকে না দেখতো, গড়বাড়ির মাটির পুণ্যস্পর্শলাভের সৌভাগ্য যদি আর না ঘটত তার?

কার পায়ের শব্দে সে মুখ তুলে দেখলে রাজলক্ষ্মী একটা বাটি হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠছে৷ এই আর একটি মানুষ—যাকে দেখে শরৎ এত আনন্দ পায়! দেড় বছরের মধ্যে কত জায়গা সে বেড়াল, কত নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল—কিন্তু এমন কি একটা দিনও গিয়েছে যেদিন সে এই গরিব ঘরের মেয়েটার কথা ভাবে নি৷

—কি রে ওতে?

—তোমাদের জন্যে একটু সুত্তু�নি—মা বললেন জ্যাঠামশায়কে দিয়ে আয়—

—খাওয়া হয়েছে?

—পাগল! এখুনি খাওয়া হবে? তোমাদের এখান থেকে গিয়ে নাইব—তার পর—

—আর বাড়ি যায় না, এখানেই খা—

—না, না শরৎদি—

—খেতেই হবে৷ আচ্ছা, কেন অমন করিস বল তো? কতকাল দুই বোনে বসে একসঙ্গে খাই নি তা তোর মনে পড়ে? মোটে কাল আর আজ যদি হয়—সত্যি ভাই, বিশ্বাস এখনও যেন হচ্ছে না যে, আমি আবার গড়শিবপুরের ভিটেতে বসে আছি৷ একযুগ পরে আবার এ মাটিতে—

রাজলক্ষ্মীকে শরৎ এখনও সব কথা খুলে বলে নি৷ রাজলক্ষ্মীও ওকে খুঁটিনাটি কিছুই জিজ্ঞেস করে নি প্রথম আনন্দের উত্তেজনায়৷ শরৎ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রাজলক্ষ্মীকে সে অবসর সময়ে সব খুলে বলবে৷ বন্ধুত্বের মধ্যে দেওয়াল তুলে রাখা তার পছন্দ হয় না৷

শরৎ বললে, এই দেড় বছরের গাঁয়ের খবর বল—কিছুই তো জানি নে৷

—চিন্তে বুড়ি মরে গিয়েছে, জানো?

—আহা, তাই নাকি? কবে মোলো?

—ফাল্গুন মাসে৷ গুরুপদ জেলের সেই হাবা ছেলেটা মরে গিয়েছে আষাঢ় মাসে৷ ম্যালেরিয়া জ্বরে৷

—আহা!

—পাঁচী গয়লানীর বাড়ি চোর ঢুকে সব বাসন নিয়ে গিয়েছিল৷ থানার দারোগা এল, এর নাম লিখলে, ওর নাম লিখলে—কিছুই হল না শেষটা৷

—ভালো কথা, ওপাড়ার সেজখুড়িমার ছেলেপিলে হবে দেখে গিয়েছিলাম—

—একটা ছেলে হয়েছে—বেশ ছেলেটি৷ দেখতে যাবে কাল?

—বেশ তো, চল না৷ সাতকড়ি চৌধুরীর মেয়ের বিয়ে হয়েছে?

—কেন হবে না? হাতে পয়সা আছে—মেয়ের বিয়ে বাকি থাকে?

শরৎ হেসে বললে, কেন রে, তোর বুঝি বড় দুঃখু বিয়ে না হওয়ায়?

—কার না হয় শরৎদি, যদি সত্যি কথা বলা যায়! যেমনি মা হিম হয়ে বসে আছে, তেমনি মেজখুড়িমা হিম হয়ে বসে আছে—আমার এদিকে আঠারো পেরুলো, লোকের কাছে বলে বেড়ান পনেরোতে নাকি পা দিইছি৷ এমন রাগ ধরে!

শরৎ হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি৷

—ওমা, তুই হাসালি রাজলক্ষ্মী৷ আজকালকার মেয়ে সব হল কি? সত্যি রে, তোর মনে কষ্ট হয়?

—ওই যে বললাম দিদি, সত্যি কথা বললে হাসবে সবাই৷ তুমি বললে, তাই বললাম৷

—আমি দেখব রে তোর সম্বন্ধ?

—না, হাসি না শরৎদি৷ এতদিন তুমি ছিলে না—আমার মন পাগল-পাগল হয়ে উঠত৷ এই গাঁয়ে একঘেয়ে থাকলে মানুষ পাগল হয়ে যায় না তুমিই বলো? তার চেয়ে মনে হয়—যা হয় একটা দেখে-শুনে দে, একঘেয়েমির হাত থেকে নিস্তার পাই৷ জন্মালাম গড়শিবপুর, তো রয়েই গেলাম সেই গড়শিবপুরে৷ এই যে তুমি কত দেশ বেড়িয়ে এলে শরৎদি, কেন বেড়িয়ে এলে? নতুন জিনিস দেখবার জন্যে তো?

শরৎ গম্ভীর সুরে বললে, আমার কপাল দেখে হিংসে করিস নে ভাই৷ তোকে সব খুলে বলব সময় পেলে৷

রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বলল, কেন শরৎদি?

—সে কথা এখন না ভাই—বাবা আসছেন, সরে আয়—

কেদার গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বললেন, কে ও? রাজলক্ষ্মী? বেশ মা বেশ৷ হ্যাঁ ভালো কথা শরৎ—মনে পড়ল নাইতে নাইতে—তোর মায়ের সেই কড়িগুলো কোথায় আছে মা?

শরৎ হেসে বললে, কোনো ভয় নেই বাবা, লক্ষ্মীর হাঁড়িতেই আছে৷ প্রথম দিন এসেই আমি আগে দেখে নিয়েছি৷ ঠিক আছে৷

—ও, তা বেশ৷ আর—ইয়ে—তোর মার সেই ভাঙা চিরুনিখানা?

—ওই গোল তোরঙ্গের মধ্যে রেখে গিয়েছিলাম, সেইখানেই আছে, সেও দেখে নিয়েছি সেদিন৷

—ইয়ে, ডাকি তবে গোপেশ্বর দাদাকে? রান্না হয়েছে তো?

কেদার আবার গেলেন পুকুরপাড়ে গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে ডাকতে৷ শরৎ মৃদু হেসে রাজলক্ষ্মীকে বললে, দুটি নিষ্কর্মা আর নিশ্চিন্দি লোক এক জায়গায় জুটেছে, জ্যাঠামশায় আর বাবা—দুই-ই সমান৷ দুটিতে জুড়ি মিলেছে ভালো৷

কেদার বলতে বলতে আসছিলেন, বেহালা বাজাই নি আজ দেড় বছর দাদা৷ তারগুলো সব ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ আজ ওবেলা ছিবাসের ওখানে আসর করা যাক গিয়ে৷ তোমার তবলাও অনেক দিন শোনা হয় নি৷

দিন দশ-পনেরো কেটে গেল৷

এ দিনগুলো কেদার ও গোপেশ্বরের কাটলো খুব ভালোই৷ ছিবাস মুদির দোকানে প্রায়ই সন্ধ্যার পর ছেঁড়া মাদুর আর চট পেতে আসর জমে, কেদার এসেছেন শুনে তাঁর পুরনো কৃষ্ণযাত্রা দলের দোহার, জুড়ি, এখানে গায়কেরা কেউ জাল রেখে, কেউ লাঙল ফেলে ছুটে আসে৷

—রাজামশাই! ভালো ছেলেন তো? এট্টু পায়ের ধুলো দ্যান—

—বাবাঠাকুর, এ্যাদ্দিন ছেলেন কনে? মোদের দল যে একেবারে কানা পড়ে গেল আপনার জন্যি!

গেঁয়োহাটি কাপালি পাড়ার মধু কাপালি, নেত্য কাপালি এসে পীড়াপীড়ি—গেঁয়োহাটিতে একবার না গেলে চলবে না৷ সবাই রাজামশাইকে একবার দেখতে চায়৷ এদের ওপর কেদারের যথেষ্ট আধিপত্য, অন্য সময় যে কেদার নিতান্ত নিরীহ—এদের দলের দলপতি হিসাবে তিনি রীতিমতো কড়া ও উগ্র মেজাজের শাসক৷

মধুকে ডেকে বললেন, তোর যে সেই ভাইপো দোয়ার দিত সে কোথায়?

—আজ্ঞে সে পাট কাটছে মাঠে—

কেদার মুখ খিঁচিয়ে বলেন, পাট তো কাটছে বুঝতে পারছি, চাষার ছেলে পাট কাটবে না তো কি বড় গাইয়ে হবে? কাল একবার ছিবাসের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ো তো, বুঝলে?

—যে আজ্ঞে রাজামশাই—

—আর শশীকে খবর দিয়ো, দু-বছরের খাজনা বাকি৷ খাজনা দিতে হবে না? নিষ্কর জমি ভোগ করতে লাগল যে একেবারে—

নেত্য কাপালি এগিয়ে এসে বললে, বাবাঠাকুর, আপনি যদি বাড়ি থাকতেন, তবে, সবই হত৷ তারা খাজনা নিয়ে এসে ফিরে গিয়েল—

কেদার ধমক দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর—তোকে ফোপর-দালালি করতে বলেছে কে?

কেদারের নামে বহু লোক জড়ো হয় ছিবাসের দোকানে—কেদারের বেহালার সঙ্গে মিশেছে ওস্তাদ গোপেশ্বরের তবলা৷ পাড়াগাঁয়ে নিঃসঙ্গ দিনেরাত্রে সময় কাটাবার এতটুকু সূত্রও যারা নিতান্ত আগ্রহে আঁকড়ে ধরে—তাদের কাছে এ ধরনের গুণী-সম্মেলনের মূল্য অনেক বেশি৷ দু-তিনখানা গ্রাম থেকে লোকে লণ্ঠন হাতে লাঠি হাতে জুতো বগলে করে এসে জোটে৷ সেই পুরনো দিনের মতো অনেক রাত্রে দুজনেই অপরাধীর মতো বাড়ি ফেরেন৷

শরৎ বলে, এলে? ভাত জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছে—

গোপেশ্বর আমতা আমতা করে বলেন—আমি গিয়ে বললাম মা রাজামশায়কে—যে শরৎ বসে থাকবে হাঁড়ি নিয়ে—তা হয়েছে কি, উনি সত্যিকার গুণী লোক, ছড়ে ঘা পড়লে আর স্থির থাকতে পারেন না৷ জ্ঞান থাকে না মা—

কেদার গোপেশ্বরের পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে কৈফিয়ৎ তৈরি করেন৷

শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, আপনি জানেন না জ্যাঠামশায়, বাবার চিরকাল একরকম গেল আর যাবেও৷ আজ বলে না, কোন কালে ওঁর ছিল জ্ঞান, ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না?

গোপেশ্বর মিটমাটের সুরে বলেন, না না, কাল থেকে রাজামশাই আর দেরি করা হবে না৷ শরতের বড্ড কষ্ট হয়, কাল থেকে আমি সকাল সকাল নিয়ে আসব মা, রাত করতে দেব না—

এই দুই বৃদ্ধের ওপর শাসনদণ্ড পরিচালনা করে শরৎ মনে মনে খুব আমোদ পায় এবং এঁদের সঙ্কোচজড়িত কৈফিয়তের সুরে যথেষ্ট কৌতুক অনুভব করে—কিন্তু কোনো তর্জনগর্জনেই বিশেষ ফল হয় না, প্রতি রাত্রেই যা তাই—সেই রাত একটা৷ নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকার গভীর আওয়াজের সঙ্গে মিশে শরতের শাসনবাক্য বৃথাই প্রতি রাত্রে নিশীথের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে৷

শরৎ বলে—আজ কিছু নেই বাবা, কি দিয়ে ভাত দেব তোমাদের পাতে? হাট না, বাজার না, একটা তরকারি নেই ঘরে, আমি মেয়েমানুষ যাব তরকারি যোগাড় করতে? ওল তুলেছিলাম কালোপায়রার পাড় থেকে একগলা জঙ্গলের মধ্যে—তাই ভাতে আর ভাত খাও—এত রাত্তিরে কি করব আমি?

কেদার সঙ্কুচিত ভাবে বললেন, ওতেই হবে—ওতেই হবে—

—তুমি না হয় বললে ওতেই হবে, জ্যাঠামশায় বাড়িতে রয়েছেন, ওঁর পাতে শুধু ওল ভাতে দিয়ে কি করে—

গোপেশ্বর তাড়াতাড়ি বলেন, যথেষ্ট, মা যথেষ্ট৷ তুমি দাও দিকি৷ ভেসে যাবে—কাঁচালঙ্কা দিয়ে ওল ভাতে মেখে এক পাথর ভাত খাওয়া যায় মা—

—তবে খান৷ আমার আপত্তি কি?

—কাল গেঁয়োহাটির হাট থেকে আমি ঝিঙে পটল আনব দুটো—মনে করে দিয়ো তো?

শরতের কি আমোদই লাগে! কতদিন পরে আবার পুরাতন জীবনের পুনরাবৃত্তি চলছে—আবার যে প্রতি নিশীথে গড়বাড়ির জঙ্গলের মধ্যে তাদের ভাঙা বাড়িতে সে একা শুয়ে থাকবে, বাবা এসে অপ্রতিভ কণ্ঠে বলবেন—ও মা শরৎ, দোর খুলে দাও মা,—এসব কখনো হবে বলে তার বিশ্বাস ছিল?

সেই সব পুরনো দিন আবার ঠিক সেই ভাবেই ফিরে এসেছে….

—জ্যাঠামশাইয়ের জন্যে একটু দুধ রেখেছি—ভাত কটা ফেলবেন না জ্যাঠামশায়—

গোপেশ্বর ব্যস্তভাবে বললেন, কেন, আমি কেন—রাজামশায়ের দুধ কই?

—বাবার হবে না৷ দু-হাতা দুধ মোটে—

—না না, সে কি হয় মা? রাজামশায়ের দুধ ও থেকেই—

কেদার ধীরভাবে বললেন, আমার দুধের দরকার নেই৷ আমরা রাজারাজড়া লোক, খাই তো আড়াইসের মেরে একসের করে খাব৷ ও দু-এক হাতা দুধে আমাদের—

কথা শেষ না করেই হা-হা করে প্রাণখোলা উচ্চ হাসির রবে কেদার রান্নাঘর ফাটিয়ে তুললেন৷

এইরকম রাত্রে একদিন গোপেশ্বর ভয় পেলেন কালোপায়রা দিঘির পাড়ের জঙ্গলে৷ বেশি রাত্রে তিনি কি জন্যে দিঘির পাড়ের দিকে গিয়েছিলেন—সেদিন আকাশে একটু মেঘ ছিল, ঘুম ভেঙে তিনি রাত কত তা ঠিক আন্দাজ করতে পারলেন না৷ দিঘির জঙ্গলের দিকে একাই গেলেন৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কোথায় যেন পদক্ষেপের শব্দ তাঁর কানে গেল—গুরুগম্ভীর পদক্ষেপের শব্দ৷ উৎকর্ণ হয়ে কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে পা ফেলে চলেছে—তাঁর দিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে নাকি? চোর-টোর হবে কি তা হলে? না কোনো ছাড়া গরু বা ষাঁড়—

কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হল এ পায়ের শব্দ মানুষের নয়—গরু বা ষাঁড়েরও নয়৷ পদশব্দের সঙ্গে কোনো কঠিন জিনিসের যোগ আছে—খুব ভারি ও কঠিন কোনো জিনিস৷

এক-একবার শব্দটি থেকে যায়—হয়তো এক মিনিট….তার পরেই আবার….

হঠাৎ গোপেশ্বরের মনে হল শব্দটি যেন—তাঁকেই লক্ষ্য করে হোক বা নাই হোক—মোটের ওপর খুব কাছে এসে গিয়েছে৷ তিনি আর কালবিলম্ব না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকতেই পাশের বিছানা থেকে কেদার জেগে উঠে বললেন কি, কি—অমন করছ কেন দাদা?

—ইয়ে, একবার বাইরে গিয়েছিলাম—কিসের শব্দ—তাই ছুটে চলে এলাম—কেমন যেন গা ছম-ছম—

—শব্দ? ও শেয়াল-টেয়াল হবে—

—না দাদা, মানুষের পায়ের শব্দের মতো, ভারি পায়ের শব্দ—যেন ইট পড়ার মতো—

কেদার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হুঁ, আজ কি তিথি?

—তা কি জানি, তিথি-টিথির কোনো খোঁজ রাখি নে তো—

—হুঁ৷ নাও শুয়ে পড় দাদা…একটা কথা বলি অমন একা রাত্তির বেলা যেখানে-সেখানে যেয়ো না—দরকার হয় ডাক দিয়ো!

.

রাজলক্ষ্মী দুপুরবেলা হাসিমুখে একখানা চিঠি হাতে করে এসে বললে, ও শরৎদি, তোমার নামে কে চিঠি দিয়েছে দ্যাখো—

শরৎ সবিস্ময়ে বললে, আমার নামে! কে আনলে?

—দাদার সঙ্গে পিওনের দেখা হয়েছিল বাজারে—তাই দিয়েছে—

—দেখি দে—

—কোথাকার ভাবের মানুষ চিঠি দিয়েছে দ্যাখো খুলে—

বলে রাজলক্ষ্মী দুষ্টুমির হাসি হাসলে!

শরৎ ভ্রূকুটি করে বললে, মারব খ্যাংরা মুখে যদি ওরকম বলবি—তোর ভাবের মানুষেরা তোকে চিঠি দিক গিয়ে—জন্মজন্ম দিক গিয়ে—

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক শরৎদি, তাই বলো—তাই যেন হয়৷

—ওমা, অবাক করলি যে রে রাজি! সত্যি তাই তোর ইচ্ছে নাকি?

—যদি বলি তাই?

—ওমা, আমার কি হবে!

—অমন বোলো না শরৎদি৷ তুমি এক ধরনের মানুষ, তোমার কথা বাদ দিই—কিন্তু মেয়েমানুষ তো, ভেবে দ্যাখো৷ আমার বয়েস কত হয়েছে হিসেব রাখো?

শরৎ সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললে, কেউ আটকে রাখতে পারবে না যেদিন ফুল ফুটবে, বুঝলি রাজি? কাকাবাবুর হাতে পয়সা থাকলে কি আর এতদিন—ফুল যেদিন ফুটবে—

—ফুল ফুটবে ছাতিমতলার শ্বশান-সই হলে—নাও, তুমি যেমন! খোলো চিঠিখানা দেখি—শরৎ চিঠি খুলে পড়ে বললে, কাশী থেকে রেণুকা চিঠি দিয়েছে—বাঃ—

—সে কে শরৎদি?

—সে একটা অন্ধ মেয়ে৷ বিয়ে হয়েছে অবিশ্যি৷ গরিব গেরস্ত, এ চিঠি তার বরের হাতে লেখা, সে তো আর লিখতে—

—কাশীতে থাকে? কি করে ওর বর?

—চাকরি করে কোথায় যেন—

—দেখতে কেমন?

—কে দেখতে কেমন? মেয়েটা না তার বর?

—দুই-ই৷

— রেণুকা দেখতে মন্দ নয়, বর তার চেয়েও ভালো—ছোকরা বয়েস, লোক ভালোই ওরা৷ দ্যাখ না চিঠি পড়ে!

—অন্ধ মেয়েরও বিয়ে আটকে থাকে না, যদি কপাল ভালো হয়—

—হ্যাঁ রে হ্যাঁ৷ তোর আর বকামি করতে হবে না—পড় চিঠি—

রেণুকা অনেক দুঃখ করে চিঠি লিখেছে৷ শরৎ চলে গিয়ে পর্যন্ত সে একা পড়েচে, আর কে তার ওপর দয়া করবে, কে তার হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যাবে? ওঁর মোটে সময় হয় না৷ তার মন আকুল হয়েচে শরৎকে দেখবার জন্য, রাজকন্যা কবে এসে কাশীতে ‘কেদার ছত্র’ খুলছে? এলে যে রেণুকা বাঁচে—ইত্যাদি৷

চিঠি পড়ে শরৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল৷ অসহায়া অভাগী রেণুকা! ছোট বোনটির মতো কত যত্নে শরৎ তাকে নিয়ে বেড়াত—কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাট, জলে ভাসমান নৌকো ও বজরার ভিড়, বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে সান্ধ্য-আরতির ঘণ্টা ও নানা বাদ্যধ্বনি৷…রেণুকার করুণ মুখখানি৷ এখানে বসে সব স্বপ্নের মতো মনে হয়৷ খোকা—খোকনমণি! রেণুকা খোকনের কথা কিছু লেখে নি কেন? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল রেণুকাকে কে বকসীদের বাড়ি নিয়ে যাবে হাত ধরে অত দূরে? তাই লিখতে পারে নি৷

রাজলক্ষ্মী কৌতূহলের সঙ্গে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কাশী ও সেখানকার মানুষ-জন সম্বন্ধে, বহির্জগৎ সম্বন্ধে৷ শরৎ বিরাট অন্নসত্রগুলোর গল্প করল, রাজরাজেশ্বরী, আমবেড়ে, কুচবিহারের কালীবাড়ি৷

হেসে বললে, জানিস এক বুড়ি তৈলঙ্গিদের ছত্তরদের বলত তুণ্ডুমুণ্ডুদের ছত্তর!

—তৈলঙ্গি কারা?

—সে আমিও জানি নে—তবে তাদের দেখেছি বটে৷

রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে৷ বাইরের জগৎ মস্ত একটা স্বপ্ন৷ জীবনে কিছুই দেখা হল না, একেবারে বৃথা গেল জীবনটা৷ শরৎদির ওপর হিংসে না হয়ে পারে?

কেদার ও গোপেশ্বর দুজনে মিলে খেটে বাড়ির উঠানটা অনেকটা পরিষ্কার করে তুলেছেন৷ কেদার তত নন, বলতে গেলে গোপেশ্বরই খেটেছেন বেশি৷ শরৎকাল পড়েছে, পূজার দেরি নেই, গোপেশ্বর একদিন উঠানের এক ধার খুঁড়ে কতকগুলো কচুর চারা পুঁতছেন, কেদার মহাব্যস্ত হয়ে এসে বললেন, দাদা, এসো—ওসব ফেলে রাখো—

—কি রাজামশায়?

—আরে একটা নতুন রাগিণীর সন্ধান পেয়েছি একজনের কাছে৷ মুখুজ্জে-বাড়িতে জামাই এসেছে—ভালো গায়ক৷ দেওগান্ধার ওর কাছে আদায় করতে হবে৷ থাকবে এখন কিছুদিন এখানে, চলো দুজনে যাই—

—দেবে কি রাজামশাই? ওসব লোক বড় কষ্ট দেয়৷ আমি কাশীতে এক ওস্তাদের কাছে বড় আশা করে যাই৷ একখানা ভীমপলশ্রীর আস্তাই দিলে অতি কষ্টে তো মাসাবধি অন্তরা আর দেয় না৷ কত খোশামোদ, কেবল অন্তরা এক মিনিটে নাকি হয়ে যাবে! হায়রান হয়ে গেলাম হাঁটাহাঁটি করে৷

—পেলে?

—কোথায় পেলাম? আদায় করা গেল না শেষ পর্যন্ত৷ সেই থেকে নাকে-কানে খৎ—ওস্তাদের কাছে আর যাব না৷

—যা হোক চলো দাদা৷ এ আমাদের গাঁয়ের জামাই—ওকে নিয়ে একদিন মজলিশ করা যাক—অনেকদিন থেকে দেওগান্ধারের খোঁজ করছি৷ ধরা যাক চলো—ওখানে কি হচ্ছে?

—মানকচুর চারা লাগিয়ে রাখলাম গোটাকতক৷ সামনের বছরে এক একটা কচু হবে দেখবেন কত বড় বড়! আপনার ভিটের এ জমিতে একটা মানকচু—

—জানি দাদা৷ ও এখন রাখো, হবে পরে৷ ও শরৎ—

শরৎ রান্নাঘর থেকে বার হয়ে এসে বললে, কি বাবা?

—আমাদের দুজনকে একটু তেল দ্যাও মা৷ রান্নার কতদূর?

—ওলের ডালনা চড়েছে—নামিয়ে ভাত চড়াব৷ তা হলেই হয়ে গেল—

—হ্যাঁ মা, রাজলক্ষ্মী এসেছে?

—না, আজ আসে নি এখনো৷ কেন?

—না বলছিলাম, মুখুজ্জে-বাড়ি জামাই এসেছে, ভদ্রেশ্বরে বাড়ি, কেমন লোক তাই তাকে জিজ্ঞেস করতাম৷

—সে খোঁজে তোমার কি দরকার? সে ভালো হোক মন্দ হোক—

—তুই তা বুঝবি নে বুঝবি নে৷ অন্য কাজ আছে তার কাছে৷ যদি এর মধ্যে রাজলক্ষ্মী আসে—

—মুখুজ্জে-বাড়ির কোন জামাই বাবা? আশাদিদির বর? আশাদিদির শ্বশুরবাড়ি তো ভদ্রেশ্বর—

—তাই হবে৷

—সে তো বুড়ো মানুষ৷ আশাদিদিকে বিয়ে করেছে দোজপক্ষে—

—তোর সে-সব কথায় দরকার কি বাপু? বুড়ো হয়, আরও ভালো!

—বলো না, কেন বাবা—

—নাঃ, সে শুনে কি করবি?

—না আমি শুনব—

—শুনবি? রাগিনী ভূপালী, বাদী গান্ধার বিবাদী মধ্যম আর নিখাদ—সম্বাদী ধৈবত—আরও শুনবি? রাগিনী আশারবী—বাদী—

—থাক, আর শুনে দরকার নেই—নেয়ে এসে ভাত খেয়ে আমায় খোলসা করে দিয়ে যত ইচ্ছে রাগিনী শেখো—

.

বেলা পড়ে গেল৷ ঘরের তালকাঠের আড়াতে কলাবাদুড় ঝুলছে, যেমন শরৎ আবাল্য দেখে এসেছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর আহারাদি সেরে অন্তর্হিত হয়েছেন, মধ্যরাত্রে যদি ফেরেন তবে শরতের সৌভাগ্য৷ রাজলক্ষ্মীর জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকে সে৷ তবুও দুজনে গল্প করে সময় কাটে৷ রোজ রোজ বাবার এই কাণ্ড! ভালো লাগে!

এমন সময় কে বাইরে থেকে ডাকল—ও শরৎ, শরৎ—

শরৎ বাড়ির দাওয়ায় উঁকি মেরে দেখে বললে—কে? ও বটুক-দা, ভালো আছেন? আসুন৷

বটুককে শরৎ কোনো কালেই ভালো চোখে দেখত না৷ সেই বটুক, যে এক সময় শরতের প্রতি অনেক অসম্মানজনক ব্যবহার করেছিল, রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে যে বটুকের সম্বন্ধে সেযুগে কলকাতায় যাবার পূর্বে শরৎ আলোচনা করেছিল একবার৷

বটুক একটু ইতস্তত করে বললে, শুনলাম তোমরা এসেছ—কাকা এসেছেন, তাই একবার দেখা করতে—

শরৎ আগেকার মতো নেই—জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক সাহসী ও সহিষ্ণু করে দিয়েছে৷ আগেকার দিন হলে শরৎ বটুকের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথাও বলত না, এ নিশ্চয়ই৷ আজ শরৎ দাওয়ায় একখানা পিঁড়ি পেতে বটুককে বসতে বললে৷

বটুক একটু আশ্চর্য হয়ে গেল৷ শরতের কাছ থেকে এ আদর সে আশা করে নি এখানে৷ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বসলো৷ শরৎ তাকে চা করে খাওয়ালে৷ বললে, দুটি মুড়ি খাবে বটুকদা? আর তো কিছু নেই ঘরে৷ তুমি এলে এতদিন পরে—

—থাক, থাক, সে জন্যে কিছু নয়! আমি দেখতে এলাম, বলি দেখা হয় নি কত দিন৷ আচ্ছা শুনলাম নাকি কত দেশ-বিদেশে বেড়িয়ে এলে?

—তা বেড়ালাম বৈকি৷ রাজগীর, কাশী৷

—কাকা নিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?

—জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম—ওই যিনি আমাদের এখানে আছেন—

—তা বেশ বেশ৷

এই সময় দূরে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে বটুক তাড়াতাড়ি উঠে বিদায় নিলে৷ শরৎ বললে—আর একদিন এসো, বাবার সঙ্গে তো দেখা হল না! বাবা থাকতে এসো একদিন—

রাজলক্ষ্মী চেয়ে বললে—ও এখানে কি জন্যে এসেছিল? বটুকদা তো লোক ভালো না—

—কি মতলব নিয়ে এসেছিল কি করে বলব বল? এলো—বসতে দিলাম, চা করে দিলাম—

—না না শরৎদি, জানো তো—ওসব লোকের সঙ্গে কোনো মেলামেশা না করাই ভালো৷ তুমি কানে আঙুল দেবে৷ অতি বদ লোক৷ কি মতলব নিয়ে এসেছিল কে জানে?

—তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার বাড়ি এলো, আমি কি বলে না বসাই! তা তো হয় না, আমায় আমার কাজ করতেই হবে৷

—সেই যে প্রভাস কামার তোমাদের মোটরে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল, সে লোকটাও ভালো না, পরে শুনলাম৷ বটুকদা প্রভাসের খুব বন্ধু ছিল আগে—তবে এখন অনেকদিন আর তাকে এ গাঁয়ে দেখি নি৷ তোমরা চলে গেলে একবার এসেছিল যেন—

শরতের মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল, সে তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়লে একথা চাপা দিয়ে৷ বললে—চল৷ দিঘির পাড় থেকে গোটাকতক ধুঁধুল পেড়ে আনি—কিছু তরকারি নেই, বাবাকে বলা না বলা দুই সমান—

রাজলক্ষ্মী বললে, আর কোথাও যেয়ো না শরৎদি, দুটি বোন এই গাঁয়ে কাটিয়ে দিই জীবনটা৷ আমারও যা হবে, সে বেশ দেখতেই পাচ্ছি৷ তুমি থাকলে বেশ লাগে৷

—খারাপ কি বল না! আমি কত জায়গায় গেলাম, কিন্তু তোকে ছেড়ে—কালোপায়রার দিঘি ছেড়ে—

—যা বলেছ শরৎদি৷ তুমি এসেছ আমি আর কোথাও যেতে চাই নে, স্বর্গেও না৷ দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করি—

—আর চাল-ছোলা ভাজা খাই—না রে? ভাজি দুটো চাল-ছোলা?

—না না, শরৎদি৷ ওই তোমার পাগলামি—

—পাগলামি নিয়েই জীবন৷ আয় আমার সঙ্গে রান্নাঘরে, তার পর আবার দুজনে এসে বসব৷

রাজলক্ষ্মী আজকাল সর্বদা শরতের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে৷ সন্ধ্যার আগে একাই বাড়ি চলে যায়, শরৎ দিদির মুখে বাইরের জগতের কথা শুনতে ওর বড় আগ্রহ৷ যে একঘেয়ে জীবন আবাল্য সে কাটাচ্ছে গড়শিবপুরে, যার জন্যে তার মনে হয় এ একঘেয়েমির চেয়ে যে কোনো জীবন বাঞ্ছনীয়, যে কোনো ধরনের—শরৎ দিদি আজ কিছু দিন হল বিদেশ থেকে ফিরে সেই একঘেয়ে আবেষ্টনীর মধ্যে যেন আগ্রহ ও নতুনত্বের সঞ্চার করেছে৷ তা ছাড়া জীবনে শরৎ দিদিই তার একমাত্র ভালোবাসার লোক, ও দূরে চলে যাওয়াতে রাজলক্ষ্মীর জীবন শূন্য হয়ে পড়েছিল, এখন আবার গড়বাড়িতে এসে, ওর সঙ্গে বসে গল্প করে, ওর সামান্য কাজকর্মে সাহায্য করে রাজলক্ষ্মীর অবসর-ক্ষণ ভরে ওঠে৷

শরৎ বললে, রেণুকার চিঠির জবাব দিলাম অনেকদিন, উত্তর তো এল না?

—আসবে৷ অত ব্যস্ত কেন? দিন দশেক হল মোটে জবাব গিয়েছে৷ ঠিকানা লেখা ঠিক হয়েছিল তো?

—ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন জ্যাঠামশায়৷ উনি কি আর ভুল করবেন? আমার বড় মন কেমন করে খোকনমণির জন্যে৷ সে যদি চিঠি লিখতে পারত আমায় নিজের হাতে—

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, একেই বলে মায়া! কোথাকার কে তার ঠিক নেই—

শরৎ ব্যথা-কাতর কণ্ঠে বললে, অমন বলিস নে রাজি৷ তুই জানিস নে, সে আমার কি! কেন তাকে ভুলতে পারি নে তাই ভাবি৷ কখনো অমন হয় নি আমার, কাশীতে থাকবার শেষ একটা মাস যা হয়েছিল৷ খোকাকে না দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেতাম বুঝলি? কষ্টও যা গিয়েছে! আচ্ছা বল তো, সত্যিই সে আমার কে? অথচ মনে হত কত জন্মের আপনার লোক সে, তার মুখ দিনান্তে একবার না দেখলে—ভালোই হয়েছে রাজি, সেখানে বেশিদিন থাকলে মায়ায় বড্ড জড়িয়ে পড়তাম৷ আর তেমনি ছিল মিনুর মা!

—সে কে শরৎদি?

—যাদের বাড়ি ছিলাম সে বাড়ির গিন্নি৷ বলব তোকে সব কথা একদিন৷ এখন না—

—কাশীর কথা শুনতে বড্ড ভালো লাগে তোমার মুখে—কখনো কিছু দেখি নি—যেন মনে হয় এখানে বসে দেখছি সব৷ আজ একটু ঠাণ্ডা পড়েছে, না শরৎদি?

—তা হেমন্তকাল এসে পড়েছে, একটু শীত পড়বার কথা৷ একটা নারকোল কুরতে হবে—দা খানা খুঁজে দ্যাখ ততক্ষণ—আমি ছোলাগুলো ততক্ষণ ভেজে ফেলি—

—কেন এত হাঙ্গামা করছ শরৎদি? দাঁড়াও আমি নারকোল কুরে দিই—

শরৎ বললে, দুজনে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করব আর চালভাজা—কি বলিস?

ছেলেমানুষের মতো উৎসাহ ও আগ্রহভরা কণ্ঠস্বর তার৷ এই জন্যই শরৎ দিদিকে রাজলক্ষ্মীর এত ভালো লাগে৷ এই পাড়াগাঁয়ে সব লোক যেন ঘুমুচ্ছে, তাদের না আছে কোনো বিষয়ে আগ্রহ, না শোনা যায় তাদের মুখে একটা ভালো কথা৷ অল্প বয়সে বুড়িয়ে যেতে হয় ওদের মধ্যে থাকলে৷ শরৎ দিদি এসে বাঁচিয়েছে৷

রাজলক্ষ্মী হঠাৎ মনে পড়বার সুরে বললে, ভালো কথা, বলতে মনে নেই শরৎদি, টুঙিমাজদে থেকে তোমার নামে একখানা চিঠি এসেছিল একবার—

শরৎ চমকে উঠে বললে—টুঙি-মাজদে! কই সে চিঠি?

—আছে বোধ হয় বাড়িতে, খুঁজে দেখব৷ তোমরা তখন এখানে ছিলে না—আমি রেখে দিয়েছিলাম—

—কতদিন আগে?

—তা ছ-সাত মাস কি তার বেশিও হবে৷ গত বোশেখ মাসে বোধ হয়৷ আচ্ছা শরৎদি ওখানে তোমার শ্বশুরবাড়ি—নয়?

শরৎ অন্যমনস্কভাবে বললে, হাঁ৷

একটুখানি চুপ করে কি ভেবে বললে, কে দিয়েছিল, জানিস?

—খামের চিঠি৷ আমি খুলে দেখি নি—কে আছে তোমার সেখানে?

শরৎ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে, নিয়ে আসিস চিঠিখানা, দেখব৷

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ৷ তারপর রাজলক্ষ্মী বললে, খাও শরৎদি, সন্দে হয়ে আসছে—

—হুঁ—

—নারকোল কেটে দেব আর একটু?

—না, তুই খেয়ে নে৷ উত্তর দেউলে সন্দে দেখিয়ে আসতে হবে—

—এখন রোদ রয়েছে গাছের ডগায়, অনেক দেরি এখনো, খেয়ে নাও না—

—আমি আর খাব না এখন৷

—তুমি না খেলে আমার এই রইল—

—না, না, আচ্ছা খাচ্ছি আমি—নে তুই৷ কাঁচালঙ্কা একটা নিয়ে আসি—

উত্তর দেউল থেকে সন্ধ্যা-প্রদীপ দিয়ে কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরছিল, কালোপায়রা দিঘির ওপাড়ের ঘন জঙ্গলে যেখানে ছাতিম ফুল ফুটে হেমন্তসন্ধ্যার বাতাস সুবাসিত করে তুলেছে৷ শ্যামলতার লম্বা কালো ডাঁটায় কুচো কুচো সুগন্ধ ফুল প্রত্যেক বর্ষাপুষ্ট ঝোপের মাথায়৷ পায়ে চলার পথ গত বর্ষায় ঘাসে ঢেকে আছে, ভাঙা ইটের স্তূপে শেওলা জমেছে, গড়ের জঙ্গল ঘন কালো দেখাচ্ছে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে৷ রাজলক্ষ্মীকে বাড়ি ফিরতে হবে বলে ওরা সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখানোর কাজ বেলা থাকতে সেরে এল৷

শরৎ বললে, অনেক মেটে আলু হয়ে আছে বনে, আজ দু-বছর এদিকে আসি নি—

—তুলবে একদিন শরৎদি? আমিও আসব—

বাড়ি গিয়ে শরৎ বললে, চল তোকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি—গড়ের খাল পর্যন্ত যাই৷ জল নেই তো খালে?

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কোথায়! বর্ষায় সামান্য জল হয়েছিল, শুকিয়ে গেছে৷

—থাক না আজ রাতটা! একা থাকব?

—বাড়িতে বলে আসি নি যে শরৎদি—নইলে আর কি৷ আচ্ছা কাল রাত্রে বরং থাকব৷ বাড়িতে বলে আসতে হবে কিনা!

রাজলক্ষ্মীকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসবার পথে শরৎ একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসলো৷ হেমন্তের সান্ধ্য-বাতাস কত কি বন্য পুষ্প, বিশেষত বনমরচে ও শ্যামলতার পুষ্পের সুবাসে ভারাক্রান্ত৷ দেউড়ির ভাঙা ইটের ঢিবির সর্বত্র-এ সময় বনমরচে লতায় ছেয়ে গিয়েছে, পুরনো রাজবাড়ি, লক্ষ্মীছাড়া দৈন্য তাদের শ্যামশোভায় আবৃত করে রেখেছে৷ রাজকন্যার সম্মান রেখেছে ওরা সেভাবে৷

কি হবে এখুনি ঘরে ফিরে৷ বেশ লাগে বাইরের বাতাস৷ ভয় নেই ওর মনে, যা ছিল তাও চলে গিয়েছে৷ তা ছাড়া ভয় কিসের? সবাই বলে ভূত আছে, অপদেবতা আছে—তার পূর্বপুরুষের অভ্যুদয়ের দিনের শত পুণ্য অনুষ্ঠানে এ বাড়ির মাটি পবিত্র, এ বাড়ির সে মেয়ে, আবাল্য সে এ-সব এইখানেই দেখে এসেছে—তার ভয় কিসের?

উত্তর দেউলের দেবী বারাহী তাদের মঙ্গল করবেন৷

সে ঘরে ফিরে ডুমুরের চচ্চড়ি রান্না করবে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের জন্যে৷ জ্যাঠামশায় অনেক ডুমুর পেড়ে এনেছেন আজ কোথা থেকে৷ জ্যাঠামশায় বেশ লোক৷ ওঁকে সে আর কোথাও যেতে দেবে না৷ উনি না থাকলে কে তাকে আনতো কাশী থেকে? বাবার সঙ্গে কে আবার দেখা করিয়ে দিত? যতদিন উনি বাঁচেন, সে ওঁর সেবা-যত্ন করবে মেয়ের মতো৷

শরতের হঠাৎ মনে পড়ল, রাজলক্ষ্মীকে তার শ্বশুরবাড়ির সে পুরনো চিঠিখানা আনবার জন্যে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নি আর একবার৷ টুঙি-মাজদিয়া! কত দিন সেখানে যাওয়া হয় নি! কে-ই বা আছে আর সেখানে? চিঠি লিখেছেন বোধ হয় খুড়শাশুড়ি৷ তাই হবে—তা ছাড়া আর কে? সেখানকার সব কিছু যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন ভালো জ্ঞানই হয় নি শরতের৷ এক উৎসব-রজনীর চাঁপাফুলের সুগন্ধ আজও যেন নাকে লেগে আছে৷ কতকাল আগে বিস্মৃত মুহূর্তগুলির আবেদন—আজও তাদের ক্ষীণ বাণী অস্পষ্ট হয়ে যায় নি তো! বিস্মৃতির উপলেপন দিয়ে রেখেছে চলমান কাল, সেই মুহূর্তগুলির ওপর৷ তবে সে ভালোবাসে নি, ভালোবাসলে কেউ ভোলে না৷ তখনও বোঝবার, জানবার বয়স হয় নি তার৷

টুঙি-মাজদে তার শ্বশুরবাড়ি৷ ওখানকার ভাদুড়ীরা তার শ্বশুরবংশ—একসময়ে নাকি ভাদুড়ীদের অবস্থা খুব ভালো ছিল৷ এখন তাদেরই মতো৷

টুঙি-মাজদে! নামটা সে ভুলেই গিয়েছিল, রাজলক্ষ্মী আবার মনে করিয়ে দিলে৷

বনের মধ্যে কোথায় গম্ভীর স্বরে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে, শুনলে ভয় করে—যেন রাত্রিচর কোনো অপদেবতার কুস্বর! শরৎ অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে ঘরে গিয়ে রান্নাঘরে খিল দিয়ে রান্না চড়িয়ে দিলে৷

অনেক রাত্রে কেদার এসে ডাকাডাকি করেন—ও মা শরৎ, দোর খোলো—ওঠো—

.

দিন দশেক পরে একদিন রাজলক্ষ্মী এসে বললে, চললাম শরৎদি—

শরৎ বিস্ময়ের সুরে বললে, কি রে? কোথায় চললি?

—সব ঠিক৷ আমার বিয়ে হচ্ছে সতেরোই অঘ্রাণ—জানো না?

—তোর? সত্যি?

—সত্যি না তো মিথ্যে?

—বল শুনি—সত্যি? কোথায়?

রাজলক্ষ্মী বেশি কিছু জানে না বোঝা গেল৷ এখান থেকে মাইল দশেক দূরে দশঘরা বলে অজ এক পাড়াগাঁয়ে যার সঙ্গে সম্বন্ধ হয়েছে, তার বয়েস নাকি তত বেশি নয়, বিশেষ কিছু করে না, বাড়িতেই থাকে৷

শরৎ বললে, তোর পছন্দ হয়েছে?

—পছন্দ হলেও হয়েছে, না হলেও হয়েছে—

—তার মানে?

—তার মানে বাবার যখন পয়সা নেই, আমি যদি বলি আমার বর হাকিম হোক, হুকুম হোক, দারোগা হোক, তা হলে তো হবে না! যা জোটে তাই সই!

—এখন যা হয় হলে বাঁচি, না কি?

—তোমার মুণ্ডু৷

তার পর ওরা বনের মধ্যে মেটে আলু তুলতে গিয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত রইল৷ বনের মধ্যে এক জায়গায় একটা পাথরের থামের ভাঙা মুণ্ডুটা মাটিতে অর্ধেক পুঁতে আছে৷ রাজলক্ষ্মী সেটার ওপরে গিয়ে বসল৷ পাথরের গায়ে সামুদ্রিক কড়ির মতো বিট কাটা, মাঝে মাঝে পদ্মফুল এবং একটা দাঁড়ি৷ আবার কড়ি, পদ্ম ও দাঁড়ি—মালার আকারে সারা থামটা ঘুরে এসেছে৷ নীচের দিকে একরাশ কেঁচোর মাটি বাকি অংশটুকু ঢেকে রেখেছে৷

রাজলক্ষ্মী চেয়ে চেয়ে বললে, এই নক্সাটা কেমন চমৎকার শরৎদি! বুনলে ভালো হয়—দেখে নাও—

শরৎ বললে, এর চেয়েও ভালো নক্সা আছে ওই অশ্বত্থ গাছটার তলায়—একটা খিলেন ভেঙে পড়ে আছে, তার ইঁটের গায়ে৷ কিন্তু বড্ড বন ওখানে আর কাঁটা গাছ—

—তোমাদেরই সব তো—একদিন শুনেছি গড়বাড়ির চেহারা অন্যরকম ছিল, না?

—কি জানি ভাই, ও-সবের খবর আমি রাখি নে৷ আজকাল যা দেখছি, তাই দেখছি৷ তেল জোটে তো নুন জোটে না, নুন জোটে তো চাল জোটে না৷

তার পর শরৎ কি ভেবে আনন্দপূর্ণ কণ্ঠে বললে, সত্যি রাজি, খুব খুশি হয়েছি তোর বিয়ের কথা শুনে৷ কত যে ভেবেছি, কাশীতে থাকতে কতবার ভাবতাম, ভালো সম্বন্ধ পাই তো রাজির জন্যে দেখি৷ একবার দশাশ্বমেধ ঘাটে একটা চমৎকার ছেলে দেখে ভাবলাম, এর সঙ্গে যদি রাজির বিয়ে দিতে পারতাম, তবে—

রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷ সে যেন কি ভাবছে৷

শরৎ বললে, প্রভাসদার দেওয়া সেই মখমলের বাক্সটা আছে রে?

—হুঁ৷ স্নোটা সব খরচ হয়ে গেছে—আর সব আছে৷ দ্যাখো শরৎদি, সত্যি সত্যি একটা কথা বলি, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না তোমায় ছেড়ে—আমি একবার বলেছি, আবার বলছি, মনের কথা আমার—

তার পর রাজলক্ষ্মী উঠে ধীরে ধীরে শরতের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, শরৎদি, তুমি আমায় ভালোবাস?

শরৎ তাকে ঠেলে দিয়ে হেসে বললে, যাঃ—

রাজলক্ষ্মীর চোখ দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে জল পড়ল৷ সে অশ্রুসিক্ত স্বরে বললে, তুমি ভালোবাস বলেই বেঁচে আছি শরৎদি৷ তুমি গরিব হতে পারো, আমার কাছে তুমি গড়বাড়ির রাজার মেয়ে, এই দেউল, মন্দির, দিঘি, গড়, ঠাকুর-দেবতার মূর্তি সব তোমাদের, আমি তোমাদের প্রজার মেয়ে, একপাশে পড়ে থাকি—তুমি সুনজরে দ্যাখো বলে বার বার আসি—

শরৎ কৌতুকের সুরে বললে, খেপলি নাকি, রাজি? কী হয়েছে আজ তোর?

.

রাজলক্ষ্মী চলে যাবার কিছু পরে বটুক এসে ডাকলে, ও শরৎ—বাড়ি আছ?

শরৎ তখন স্নান করতে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে, বটুককে দেখে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল৷

মুখে বললে, এসো বটুকদা—

—হ্যাঁ, এলাম, তুমি বুঝি—

—নাইতে বেরিয়েছি বটুকদা৷ রাজির সঙ্গে বন থেকে মেটে আলু তুলতে গিয়েছিলাম কিনা! না ডুব দিয়ে ঘরে-দোরে ঢুকব না—

—ও, তা আমি না হয় অন্য সময়—

—কোনো কথা ছিল?

—হ্যাঁ, না—কথা—তা একটু ছিল—তা—

বটুকের অবস্থা দেখে শরতের হাসি পেল৷ মনে মনে বললে, কি বলবি বল না—বলে চলে যা—কাণ্ড দ্যাখো একবার!

মুখে বললে, কি বটুকদা? কি কথা?

বটুক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে তার পর মরীয়ার সুরে বললে, প্রভাস এসেছিল কাল কলকাতা থেকে—

বলে সে শরতের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল৷

শরতের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এক মুহূর্তে৷ তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিম-ঝিম করে উঠল৷ কিন্তু তখনি সামলে নিয়ে বললে, তা আমায় এ কথা কেন? আমি কি করব?

বটুক মাথা চুলকে বললে, না—তা—এমন কিছু নয়, এমন কিছু নয়৷ প্রভাসের সঙ্গে গিরীনবাবু বলে এক ভদ্রলোক ছিল৷ এই গিয়ে তারা বলছিল—

এই পর্যন্ত বলে বটুক একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলে৷

শরৎ দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন টলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে বললে, কি বলছিল?

—বলছিল যে—

—বলো না কি বলছিল?

—মানে, ওরা—তোমার সঙ্গে একবার লুকিয়ে দেখা করতে চায়৷ নইলে গাঁয়ে সব কথা নাকি প্রকাশ করে দেবে!

—হুঁ—তোমাকে তারা চর করে পাঠিয়েছে বুঝি?

শরতের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বটুক ভয় খেয়ে গেল৷ সুর নরম করে বললে—আমার ওপরে অনর্থক রাগ করছ তুমি৷ আমায় তারা বললে, তোমাকে কথাটা বলতে—কেউ টের পাবে না, গড়ের জঙ্গলের ওদিকে হোক কি রানীদিঘির পাড়ে হোক—কি তারা বলবে তোমায়৷ আমায় বললে, বলে এসো৷ তারা কলকাতায় চলে গিয়েছে, আবার আসবে৷ নয়তো কলকাতায় কি হয়েছিল না হয়েছিল, সব গাঁয়ে প্রকাশ করে দিয়ে যাবে—

শরৎ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ৷ কোনো কথা নেই তার মুখে৷ তার মূর্তি দেখে বটুকের ভয় হল৷ সে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় শরৎ স্থিরগলায় বললে, বটুকদা, তোমার বন্ধুদের বোলো আমি লুকিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা কোনোদিন করব না৷ তাদের সাহস থাকে বাবা আর জ্যাঠামশায়ের সামনে এসে যেন দেখা করে৷ আমরা গরিব আছি, তাই কি—আমাদেরও মান আছে৷ না হয় তারা বড়লোকই আছে৷

বটুক বললে, না—এর মধ্যে আর গরিব বড়লোকের কথা কি?

—আর একটা কথা বটুকদা! তুমি না গাঁয়ের ছেলে? তোমার উচিত কলকাতায় সেই সব বখাটে বদমাইশদের তরফ থেকে আমায় এ-সব কথা বলা? আমি না তোমার ছোট বোনের মতো? তোমায় না দাদা বলে ডাকি? তুমি এসেছ চর সেজে?

বটুক আমতা আমতা করে বললে, আমি কি করব, আমি কি করব—তোমার ভালোর জন্যেই—

শরৎ পূর্ববৎ স্থিরকণ্ঠেই বললে, আমার বাড়ি তুমি এসেছ—আমার বলতে বাধে, তবুও আমি বলছি—আমার এখানে তুমি এসো না—আমার ভালো তোমায় করতে হবে না৷

বটুক ততক্ষণে ভগ্ন দেউড়ির পথে অদৃশ্য হয়েছে৷

পনেরো
শরৎ কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কতক্ষণ৷ এখন সে কি করবে? গড়শিবপুরের রাজবংশে সে কি অভিশাপ বহন করে এনেছে, তার বংশের নাম বাবার নাম ডুবতে বসেছে আজ তার জন্যে!

মানুষ এত খারাপও হয়!

এই পল্লীগ্রামের বনে বনে হেমন্তকালের কত বনকুসুম, লম্বা লতার মাথায় থোবা থোবা মুকুল ধরেছে বন্য মাখম-সিম ফুলের শিউলির তলায় খই-ছড়ানো শুভ্র পুষ্পের সমারোহ, সুমুখ জ্যোৎস্নারাতের প্রথম প্রহরে ছাতিমবনের নিবিড়তায় চাঁদের আলোর জাল-বুনুনি, ছাতিম ফুলের সুবাস—এ সবের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রভাসের মতো, বটুকের মতো ভয়ানক প্রকৃতির লোক, যাদের অসাধ্য কাজ নেই, যাদের ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই! এত কষ্ট দিয়েও ওদের মনোবাঞ্ছা মিটল না? এতদিন পরে আবার এখানেও এসে জুটল তার জীবনে আগুন জ্বালাতে?

আচ্ছা সে কি করেছে যার জন্যে তার এত শাস্তি?

সে কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কিছু করেছে? সে কি স্বেচ্ছায় কমলাদের পাপপুরীর মধ্যে ঢুকেছিল? হতে পারে সে নির্বোধ, কিছু বুঝতে পারে নি, অত খারাপ কাউকে ভাবতে পারে নি বলেই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগে নি৷ সন্দেহ সত্যই জাগলো, তখন ওরা তো তাকে বেরুতে দিল না৷ অথচ সে যদি সব কথা খুলে বলে গ্রামে, কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না৷

প্রভাসের ও গিরীনের বদমাইশির কথা শুনে ওদের কেউ শাস্তি দেবে না? ভগবান সত্যের দিকে দাঁড়াবেন না?

না হয় সে কালোপায়রা দিঘির জলে ডুবে মরে বাবার ও বংশের মুখ রক্ষা করবে৷ তা সে এখুনি করতে পারে—এই দণ্ডে!

শুধু পারে না বাবার মুখের দিকে চেয়ে৷

আচ্ছা সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে দু’দিনের জন্যে? টুঙি-মাজদে গ্রামে খুড়শাশুড়ির আশ্রয়ে এখন থাকবে গিয়ে কিছুদিন? কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়? জ্যাঠামশায় বা বাবাকে এসব কথা বলতে বাধে৷

তার চেয়ে জলে ডুবে মরা সহজ৷

সকলে মিলে অমনভাবে তাকে যদি জ্বালাতন করে, বনের মেটে আলু, বুনো সিম-ভাতে-ভাত এক বেলা খেয়েও যদি শান্তিতে থাকতে না দেয়, তবে মায়ের মুখে শোনা তারই বংশের কোন পুরনো আমলের রানীর মতো—তারই কোন অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহীর মতো নিজের মান বাঁচাবার জন্যে কালোপায়রা দিঘির শীতল জলের তলায় আশ্রয় নিয়ে সব জ্বালা জুড়ুতে হবে, যদি তাতে হতভাগারা শান্তিতে থাকতে দেয়৷….চোখের জলে শরতের গালের দু-পাশ ভেসে গেল৷

কতক্ষণ পরে তার যেন হুঁশ হল—কত বেলা হয়েছে! রান্না চড়ানো হয় নি—বাবা জ্যাঠামশায় এসে ভাত চাইবেন এখুনি!

উঠে সে স্নান করে এল—তেল আগেই মেখে বসে ছিল, বটুক আসবার আগেই৷

রান্না চড়িয়ে দিয়ে আবার সে ভাবতে বসল৷ সব সময়েই ভাবছে, বটুক চলে যাবার পর থেকে৷ কতবার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে, কতবার অঁচল দিয়ে মুছেছে—কি সে করে এখন?

তার কি কেউ নেই সংসারে?

কেউ তার দিকে দাঁড়িয়ে, তার হয়ে দুটো কথা বলবে না? প্রভাস ও গিরীন যদি তার নামে কুৎসা রটিয়ে দেয় গ্রামে, তবে তাদের কথাই সবাই সত্য বলে মেনে নেবে? তার কথা কেউ শুনবে না?

এমন সময় কেদার ও গোপেশ্বর এসে পৌঁছে গেলেন৷

তাঁরা মুখুজ্জে-বাড়ির জামাই সোমেশ্বরের কাছে নতুন রাগিণীর সন্ধানে গিয়েছিলেন, বোধ হয় খানিকটা কৃতকার্যও হয়েছেন, তাঁদের মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়৷

গোপেশ্বর খেতে খেতে বললেন—গলাটা ভালো লোকটার৷

—বেশ৷ ভৈরবীখানা গাইলে বড় চমৎকার—অবরোহীতে একবার যেন ধৈবৎ ছুঁয়ে নামল—

—না না, আমার কানে তো শুনলাম না৷ কোমল ধৈবৎ তো লাগবেই অবরোহীতে—

—সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে—শুনবে? এই শোন না—আচ্ছা খেয়ে উঠি৷ অবরোহীতে কোমল নিখাদ, তার পরেই কোমল ধৈবৎ আসছে৷ যেমন—

শরৎ বললে, বাবা খেয়ে নাও দিকি! এর পর ওর অনেক সময় পাবে—

—এটা কিসের চচ্চড়ি মা?

—মেটে আলু৷ রাজলক্ষ্মী আর আমি তুলে এনেছিলাম আজ ওই বনের দিক থেকে—

—রাজলক্ষ্মী এসেছিল নাকি?

—কতক্ষণ ছিল৷ এই তো খানিকটা আগে গেল—

—ওর বিয়ের কথা শুনে এলাম কিনা—তাই বলছি—

—আমার সঙ্গে অত ভাব, ও চলে গেলে গাঁয়ের আর কেউ এদিকে মাড়াবে না৷ ওকে একটা কিছু দিতে হবে বাবা—

—কি দিবি?

—তুমি বলো বাবা—

—আমি ওসব বুঝি নে৷ যা বলবি, কিনে এনে দেব—ওসব মেয়েলি কাণ্ডকারখানার আমি কোনো খবর রাখি নে—

.

আহারান্তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে দুজনে হাটে চলে গেলেন, আজ পাশের গ্রামে হাট৷ পূর্বে হাট ছিল না, দুই জমিদারে বাদাবাদির ফলে আজ বছরখানেক নতুন হাট বসেছে৷ হাটের খাজনা লাগে না বলে কাপালিরা তরিতরকারি নিয়ে জমা হয়—সস্তায় বিক্রি করে৷

অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহ পড়েছে, অথচ এবার শীত এখনও তেমন পড়ে নি৷ বাবা ও জ্যাঠামশায় চলে গেলে শরৎ রোদে পিঠ দিয়ে বসে আবার সেই একই কথা ভাবতে লাগল৷

গড়ের খাল পার হয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী আসছে৷ ওর জীবনে যদি কেউ সত্যিকার বন্ধু থাকে তবে সে রাজলক্ষ্মী, ও এলে যেন বাঁচা যায়, দিন কাটে ভালো৷

রাজলক্ষ্মী আসতে আসতে বললে, আজ একটু শীত পড়েছে শরৎদি—না?

—আয় আয়, তোর কথাই ভাবছি—

—কেন—

—তুই চলে গেলে যেন ফাঁকা হয়ে যায়, আয় বোস—

শরৎ ভাবছিল বটুকের কথাটা বলা উচিত হবে কিনা৷ কিন্তু তা হলে অনেক কথাই ওকে এখন বলতে হয়—রাজলক্ষ্মী তাতে কিছু যদি মনে করে সব শুনে? শরৎ তাহলে মরে যাবে—জীবনের মধ্যে দুটিমাত্র বন্ধু সে পেয়েছে—অন্ধ রেণুকা আর এই রাজলক্ষ্মী৷ এদের কাউকে সে হারাতে প্রস্তুত নয়৷

আর একটি মেয়ের কথা মনে হয়—হতভাগিনী কমলার কথা—কে জানে সেই পাপপুরীর মধ্যে কি ভাবে সে দিন কাটাচ্ছে?

সরলা শরৎ জানত না—পাপে যারা পাকা হয়ে গিয়েছে, তারা পাপপুণ্য বলে জ্ঞান অল্প দিনেই হারিয়ে ফেলে, পাপে ও বিলাসে মত্ত হয়ে বিবেক বিসর্জন দেয়৷ কোনো অসুবিধাতে আছে বলে নিজেকে মনে করে না৷ পুণ্যের পথই কণ্টকসঙ্কুল, মহাদুঃখময়—পাপের পথে গ্যাসের আলো জ্বলে, বেলফুলের গড়েমালা বিক্রি হয়, গোলাপজলের ও এসেন্সের সুগন্ধ মন মাতিয়ে তোলে৷ এতটুকু ধুলোকাদা থাকে না পথে৷ ফুলের পাপড়ির মতো কোঁচা পকেটে গুঁজে দিব্যি চলে যাও৷

রাজলক্ষ্মী বললে, দিন ঘনিয়ে এল, তাই তো তোমায় ছাড়তে পারি নে—

—হুঁ—

—কি ভাবছ শরৎদি?

শরৎ চমক ভেঙে উঠে বললে—কই না—কিছু না৷ হ্যাঁরে, তুই আশাদিদির বরের গান শুনেছিস? খুব নাকি ভালো গায়? বাবা আর জ্যাঠামশায় সেখানে ধন্না দিয়ে পড়ে আছেন আজ ক’দিন থেকে৷ দিন দশেক থেকে দেখছি—

—ও, তাই শরৎদি—মুখুজ্জে-বাড়ির দিকে যেতে দেখেছি বটে ওঁদের আজ সকালে—

—রোজ সেখানে পড়ে আছেন দুজনে—কি সকাল, কি বিকেল—কেমন গান গায় রে লোকটা?

—হিন্দী-মিন্দি গায়—কি হা-হা করে, হাত-পা নাড়ে, আমার ও ভালো লাগে না৷

দুজনে সন্ধার পূর্ব পর্যন্ত গল্প করলে, সন্ধার আগে প্রতিদিনের মতো রাজলক্ষ্মী চলে গেল, শরৎ এগিয়ে দিতে গেল৷ অল্প অল্প অন্ধকার হয়েছে, ভারি নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গল৷ শরৎ ভয় পায় না একটুও, বরং এতকাল পরে তার বড় ভালো লাগে৷ এসব জিনিস তার হারিয়ে গিয়েছিল, আবার সে ফিরে পেয়েছে৷ চিরদিনের গড়বাড়ির জঙ্গল তার পল্লব-প্রচ্ছায় বীথিপথে কত কি বনপুষ্পের সুবাস ও বনবিহঙ্গের কলকাকলি নিয়ে বসে আছে, পিতৃপিতামহের পায়ের দাগ আজও যেন আঁকা আছে সে পথের ধুলোয়, মায়ের স্নিগ্ধ স্নেহদৃষ্টি কোন কোণে সেখানে যেন লুকিয়ে আছে আজও—তাই তো মনে হয় তার যদি কোনো পাপ হয়ে থাকে নিজের অজ্ঞাতে—সব কেটে গিয়েছে এখানে এসে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে৷

.

রাজলক্ষ্মীর বিবাহে বেশি ধুমধাম হবে না, গ্রামের সকলকে ওরা বিবাহ-রাত্রে নিমন্ত্রণ করতে পারবে না বলে বেছে বেছে নিমন্ত্রণ করছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর দুজনেই অবিশ্যি নিমন্ত্রিত—এসব খবর কেদারই আনলেন৷

শরৎ বললে, বাবা, ওর বিয়েতে কি একটা দেওয়া যায় বলো না—

—তুই যা বলবি, এনে দেব৷

—তুমি যা ভালো ভাব, এনো৷

—আমি তো তোকে বললাম, ওসব মেয়েলি ব্যাপারে আমি নেই—

—টাকা আছে?

—আড়তে চাকরি করার দরুন টাকা তো খরচ হয় নি৷ সেগুলো আছে একজনের কাছে জমা৷ কত চাই বলে দে—

—আইবুড়ো ভাতের একখানা ভালো শাড়ি দাও আর একজোড়া দুল—ও আমায় বড় ভালোবাসে, আমার ছোট বোনের মতো৷ আমার বড় সাধ—

—তা দেব মা৷ কখনো তোর কাউকে কিছু হাতে করে দেওয়া হয় না—তুই হাতে করে দিয়ে আসিস—হরি সেকরাকে আজই দুলের কথা বলে দিই—

বিবাহের দু-তিন দিন আগে কেদার শাড়ি ও দুল এনে দিলেন৷ শরৎ কাপড়ের পাড় পছন্দ না করাতে দুবার তাঁকে ও গোপেশ্বরকে ভাজনঘাটের বাজারে ছুটোছুটি করতে হল৷ শরৎ নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে রাজলক্ষ্মীকে আইবুড়ো ভাতের নিমন্ত্রণ করে এল৷ সকাল থেকে শাক, সুত্তুনি, ডালনা ঘণ্ট অনেক কিছু রান্না করলে৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জে এসব ব্যাপারে শরৎকে কুটনো কোটা, ফাইফরমাশ—নানা রকম সাহায্য করলেন৷

শরৎ বললে, জ্যাঠামশায়কে বড় খাটিয়ে নিচ্ছি—

—তা নেও মা৷ আমি ইচ্ছে করে খাটি৷ আমার বড় ভালো লাগে—এ বাড়ি হয়ে গিয়েছে নিজের বাড়ির মতো৷ নিজে যা খুশি করি—

ইতিমধ্যে দুবার গোপেশ্বর চাটুজ্জে চলে যাবার ঝোঁক ধরেছিলেন, দুবার শরৎ মহা আপত্তি তুলে সে প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে৷

শরৎ বললে, সেই জন্যেই তো বলি জ্যাঠামশায়, যতদিন বাঁচবেন, থাকুন এখানে৷ এখান থেকে যেতে দেব না৷

—সেই মায়াতেই তো যেতে পারি নে—সত্যি কথা বলতে গেলে যেতে ভালোও লাগে না৷ সেখানে বৌমারা আছেন বটে, কিন্তু আমার দিকে তাকাবার লোক নেই মা—তার চেয়ে আমার পর ভালো—তুমি আমার কে মা, কিন্তু তুমি আমার যে সেবা যে যত্ন করো তা কখনো নিজের লোকের কাছ থেকে পাই নি—বা রাজামশায় আমায় যে চোখে দেখেন—

শরৎ ধমকের সুরে বললে, ওসব কথা কেন জ্যাঠামশায়? ওতে পর করে দেওয়া হয়—সত্যিই তো আপনি পর নন?

রাজলক্ষ্মী খেতে এল৷

শরৎ বললে, দাঁড়া, কাপড় ছাড়তে হবে—

রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বললে, কেন শরৎদি?

—কারণ আছে৷ ঘরের মধ্যে চল—

পরে কাগজের ভাঁজ খুলে শাড়ি দেখিয়ে বললে—পর এখানা—পছন্দ হয়েছে? তোর কান মলে দেব—কান নিয়ে আয় এদিকে—দেখি—

—দুল? এসব কি করেছ শরৎদি?

—কি করলাম! ছোট বোনকে দেব না? সাধ হয় না?

রাজলক্ষ্মী গরিবের মেয়ে, তাকে এমন জিনিস কেউ কোনো দিন দেয় নি৷ সে অবাক হয়ে বললে, এই সব জিনিস আমায় দিলে শরৎদি! সোনার দুল—

শরৎ ধমক দিয়ে বললে, চুপ৷ বলিনি আমাদের রাজারাজড়ার কাণ্ড, হাত ঝাড়লে পর্বত—

রাজলক্ষ্মীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল৷ নীরবে সে শরতের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিলে৷ বললে, তা আজ দিলে কেন? বুঝেছি শরৎদি—তুমি যাবে না বিয়ের রাতে!

—যাব না কেন—তা যাব—তবে পাড়াগাঁ জায়গা, বুঝিস তো—

—তোমার মতো মানুষ আমার বিয়েতে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অকল্যাণ হবে না শরৎদি৷ এ তোমায় ভালো করেই জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি না গেলে আমার মনে বড্ড কষ্ট হবে৷ আর তুমি গেলে যদি অকল্যাণ হয়, তবে অকল্যাণই সই—

—ছিঃ ছিঃ—ওসব কথা বলতে নেই মুখে—আয়, চল রান্নাঘরে—কেমন গোটা দিয়ে সুত্তুনি রেঁধেছি খেয়ে বলবি চল—

.

বিকেলের দিকে শরৎ পুকুর থেকে গা ধুয়ে বাড়ি গিয়ে দেখলে রান্নাঘরের দাওয়ায় ইটচাপা একখানা কাগজের কোণ বেরিয়ে রয়েছে৷ একটু অবাক হয়ে কাগজটা টেনে নিয়ে দেখলে, তাতে লেখা আছে—

‘‘আজ সন্ধ্যার পরে রানীদিঘির পাড়ে ডুমুরতলায় আমাদের সঙ্গে দেখা করিবা৷ নতুবা কলিকাতায় কি হইয়াছিল প্রকাশ করিয়া দিব৷ হেনা বিবি আমাদের সঙ্গে আছে ভাজনঘাটের কুঠির বাংলায়৷ সেই তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চায়৷ দেখা করিলে তোমার ভালো হইবে৷ এ চিঠির কথা কাহাকেও বলিও না৷ বলিলে যাহা হইবে দেখিতেই পাইবে৷ সাবধান৷’’

শরৎ টলে পড়ে যেতে যেতে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলে৷ মাথাটা যেন ঘুরে উঠল৷ আবার সেই হেনা বিবি, সেই পাপপুরীর কথা—যা মনে করলে শরতের গা ঘিনঘিন করে! এ চিঠিখানা ছুঁয়েছে, তাতেই তাকে নাইতে হবে এই অবেলায়৷

এরা তাকে রেহাই দেবে না? তাদের গড়বাড়িতে কলকাতার লোকের জোর কিসের?

সব সমস্যার সে সমাধান করে দিতে পারে এখুনি, এই মুহূর্তেই কালোপায়রা দিঘির অতল জলতলে—

কিন্তু বাবার মুখের অসহায় ভাব মনে এসে তাকে দুর্বল করে দেয়৷ নইলে সে প্রভাসেরও ধার ধারত না, গিরীনেরও না৷ নিজের পথ করে নিত নিজেই৷ তাদেরই বংশের কোন রানী ওই দিঘির জলে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন মান বাঁচাতে৷ সেও ওই বংশেরই মেয়ে৷ তার ঠাকুরমারা যা করেছিলেন সে তা পারে৷

বাবাকে এ চিঠি দেখাবে না৷ বাবার ওপর মায়া হয়, দিব্যি গানবাজনা নিয়ে আছেন, ব্যস্ত হয়ে উঠবেন এখুনি৷ গোপেশ্বর জ্যাঠামশায়কে দেখাতে লজ্জা করে৷ থাক গে, আজ সে এখুনি রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসবে অনেক রাত পর্যন্ত৷ উত্তর দেউলে পিদিম আজ সকাল সকাল দেখাবে৷

রাজলক্ষ্মীর মা ওকে দেখে বললেন, এসো এসো মা শরৎ, আচ্ছা পাগলি, মেয়ে, অত পয়সাকড়ি খরচ করে রাজিকে দুল আর শাড়ি না দিলে চলত না?

রাজলক্ষ্মীর কাকিমা বললেন, গরিবের ওপর ওদের চিরকাল দয়া অমনি—কত বড় বংশ দেখতে হবে তো? বংশের নজর যাবে কোথায় দিদি?

শরৎ সলজ্জ সুরে বললে, ওসব কথা কেন খুড়িমা? কি এমন জিনিস দিয়েছি—কিছু না—ভারি তো জিনিস—রাজি কোথায়?

রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, এই এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল, তোমার দেওয়া কাপড় আর দুল দেখতে চেয়েছেন গাঙ্গুলীদের বড় বউ, তাই নিয়ে গিয়েছে দেখাতে৷ শরৎদি বলতে মেয়ে অজ্ঞান, তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ বলে, মা—শরৎদিকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে সুখ পাব না৷ বসো, এল বলে—

একটু পরে গাঙ্গুলী-বউকে সঙ্গে নিয়ে রাজলক্ষ্মী ফিরল, সঙ্গে জগন্নাথ চাটুজ্জের পুত্রবধূ নীরদা৷ নীরদা শরতের চেয়ে ছোট, শ্যামবর্ণ, একহারা গড়নের মেয়ে, খুব শান্তপ্রকৃতির বউ বলে গাঁয়ে তার সুখ্যাতি আছে৷

গাঙ্গুলী বউ বললেন, এই যে মা শরৎ, তোমার কথাই হচ্ছিল৷ তুমি যে শাড়ি দিয়েছ, দেখতে নিয়েছিলাম—ক’টাকা নিলে? ভাজনঘাটের বাজার থেকে আনানো? বটঠাকুর কিনেছেন বুঝি?

শরৎ বললে, দাম জানি নে খুড়ীমা, বাবা ভাজনঘাট থেকেই এনেছেন৷ দুবার ফিরিয়ে দিয়ে তবে ওই পাড় পছন্দ—

নীরদা বললে, দিদির পছন্দ আছে৷ চলুন দিদি, ও ঘরে একটু তাস খেলি আপনি আমি রাজলক্ষ্মী আর ছোট খুড়িমা—

রাজলক্ষ্মীর মা শরৎকে পাশের ঘরে নিয়ে বললেন, মা, কাল তুমি আসতে পারো আর না পারো, আজ সন্দের পর এখান থেকে দুখানা লুচি খেয়ে যেয়ো—রাজলক্ষ্মী আমায় বার বার করে বলেছে—

সবাই মিলে আমোদ-স্ফূর্তিতে অনেকক্ষণ কাটাল—বেলা পড়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বিয়েবাড়ির ভিড়, গ্রামের অনেক ঝি-বউ সেজেগুজে বিকেলের দিকে বেড়িয়ে দেখতে এল৷ মুখুজ্জে বাড়ির মেজ বউ পেতলের রেকাবে ছিরি গড়িয়ে নিয়ে এলেন৷ রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, বরণ-পিঁড়ির আলপনাখানা তুমি দিয়ে দ্যাও দিদি—তুমি ভিন্ন এসব কাজ হবে না—এক হৈমদিদি আর তুমি—তারকের মা তো স্বর্গে গেছেন—আলপনা দেবার মানুষ আর নেই পাড়ায়—তারকের মা কি আলপনাই দিতেন!

শরৎ বললে, বাবাকে একটু খবর দিন খুড়িমা, কালীকান্ত কাকার চণ্ডীমণ্ডপে গানের আড্ডায় আছেন৷ যাবার সময় আমাকে যেন সঙ্গে নিয়ে যান এখান থেকে৷ অন্ধকার রাত, ভয় করে একা থাকতে৷

.

পরদিন সকাল আটটার সময় শরৎকে আবার রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি থেকে ডাকতে এল৷ নিরামিষ দিকের রান্না তাকে রাঁধতে হবে৷ গাঙ্গুলীদের বড় বউয়ের জ্বর কাল রাত্রি থেকে৷ তিনিই রান্না করে থাকেন পাড়ার ক্রিয়াকর্মে৷

রাজলক্ষ্মী প্রায়ই রান্নাঘরে এসে শরতের কাছে বসে রইল৷

শরৎ ধমক দিয়ে বলে—যা রাজি, দধিমঙ্গলের পরে হটর হটর ক’রে বেড়ায় না৷ এখানে ধোঁয়া লাগবে চোখেমুখে—অন্য ঘরে বসগে যা—

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কারো ধমকে আর ভয় খাই নে৷ এই বসলাম পিঁড়ি পেতে—দেখি তুমি কি করো?

নীরদা এসে বললে, শরৎদি একটা অর্থ বলে দাও তো?

আকাশ গম গম পাথর ঘাটা

সাতশো ডালে দুটি পাতা—

শরৎ তাকে খুন্তি উঁচিয়ে মারতে গিয়ে বললে, ননদের কাছে চালাকি—না? দশ বছরের খুকিদের ওসব জিজ্ঞেস করগে যা ছুঁড়ি—

গরিবের বিয়ে বাড়ি, ধুমধাম নেই, হাঙ্গামা আছে৷ সব পাড়ার বউ-ঝি ভেঙে পড়ল সেজেগুজে৷ প্রথম প্রহরের প্রথম লগ্নে বিবাহ৷ শরৎ সারাদিন খাটুনির পরে বিকেলের দিকে নীরদাকে বললে, গা হাত পা ধুয়ে আসব এখন৷ বাড়ি যাই—কাউকে বলিস নে—

বাড়ি ফিরে সে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখাতে গেল৷ শীতের বেলা অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছে, রাঙা রোদ উঠে গিয়েছে ছাতিমবনের মাথায়, ঈষৎ নীলাভ সাদা রঙের পুঞ্জ পুঞ্জ ছোট এড়াঞ্চির ফুল শীতের দিনে এই সব বনঝোপকে এক নির্জন, ছন্নছাড়া মূর্তি দান করেছে৷ শুকনো বাদুড়নখী ফল তাদের বাঁকানো নখ দিয়ে কাপড় টেনে ধরে৷ থমথমে কৃষ্ণা চতুর্দশীর অন্ধকার রাত্রি৷

এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ সে ভয়ে ও বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ একটি লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে উত্তর দেউলের পথ থেকে সামান্য দূরে বাদুড়নখী জঙ্গলের মধ্যে৷ শরৎ কাছে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল—কলকাতার সেই গিরীনবাবু!

মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ৷ ওর ঘাড়টা যেন শক্ত হাতে কে মুচড়ে দিয়েছে পিঠের দিকে, সেই মুণ্ডুটা ধড়ের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেছে৷ গিরীনের দেহটা যেখানে পড়ে, তার পাশেই মাটিতে ভারী ভারী গোল গোল কিসের দাগ, হাতির পায়ের দাগের মতো৷….শরতের মাথা ঘুরে উঠল, সে চিৎকার করে মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেল৷ হাত থেকে সন্ধ্যাপ্রদীপ ছিটকে পড়ল বাদুড়নখীর জঙ্গলে৷

.

এই অবস্থায় অনেক রাত্রে কেদার ও গোপেশ্বর তাকে বিয়েবাড়ি থেকে ডাকতে এসে দেখতে পেলেন৷ ধরাধরি করে তাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া হল৷

লোকজনের হৈ-হৈ হল পরদিন৷ পুলিশ এল, রানীদিঘির জঙ্গলে এক চালকবিহীন মোটরগাড়ি পাওয়া গেল৷ কি ব্যাপার কেউ বুঝতে পারলে না৷ সবাই বললে গড়বাড়ির সবাই সারারাত বিয়েবাড়িতে ছিল৷ মৃতদেহের ঘাড়ে শক্ত, কঠিন পাঁচটা আঙুলের দাগ যেন লোহার আঙুলের দাগের মতো, ঘাড়ের মাংস কেটে বসে গিয়েছে৷ গোল গোল হাতির পায়ের মতো দাগগুলোই বা কিসের কেউ বুঝতে পারলে না!

.

গড়ের জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে৷ সন্ধ্যাবেলা৷ কেদার ঘোর নাস্তিক, কি মনে করে তিনি হস্তপদভগ্ন বারাহী দেবীর পাষাণ মূর্তির কাছে মাথা নিচু করে দণ্ডবৎ করে বললেন, গড়ের রাজবাড়ি যখন সত্যিকার রাজবাড়ি ছিল, তখন শুনেছি তুমি আমাদের বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলে৷ আমাদের অবস্থা পড়ে গিয়েছে, অনেক অপরাধ করেছি তোমার কাছে, কিন্তু তুমি আমাদের ভোলো নি৷ এমনি পায়ে রেখো চিরকাল মা—অনেক পুজো আগে খেয়েছ সে কথা ভুলে যেয়ো না যেন৷

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments