Monday, August 18, 2025
Homeবাণী ও কথাযুধিষ্ঠিরের স্বর্গ - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

দশ বৎসর আগে আমি যখন কটকে বাস করিতাম তখন যুধিষ্ঠির দাস আমার ভৃত্য ছিল। কুড়ি বছরের নিকষকান্তি যুবক, পান ও গুণ্ডির রসে মুখের অভ্যন্তর ঘোর রক্তবর্ণ; মাড়ির প্রান্তে ক্ষুদ্র দাঁতগুলি তণ্ডুলকণার মতো লাগিয়া আছে; মোটের উপর যুধিষ্ঠিরকে সুপুরুষ বলা চলে না। সে মাঝে মাঝে আমার জামার পকেট হইতে টাকা-পয়সা চুরি করিত; বোধ করি নবপরিণীতা বধূ রম্ভা দাসীর শখের জিনিস কিনিয়া দিবার জন্যই এই দুষ্কর্ম করিত। একদিন হাতে হাতে ধরা পড়িয়া গেল। প্রেমপীড়ির যুবকের অপরাধ কঠিন দণ্ডের যোগ্য নয়, বিশেষ যদি প্রেমের পাত্রীটি সুশ্রী সুচটুলা এবং চকিতনয়না হয়। মনে আছে যুধিষ্ঠিরকে সামান্য দু এক ঘা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিলাম।

তারপর দশ বৎসরে আমার জীবনে নানা ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে। বোম্বাই শহরে আসিয়া বাসা বাঁধিয়াছি এবং সিনেমা সমুদ্রের তীরে চোরাবালির উপর অতি সন্তর্পণে পা টিপিয়া টিপিয়া চলিয়াছি। সমুদ্রে নরভু হাঙ্গর কুমির আছে; তীরও নিরাপদ নয়, পদে পদে অতলে তলাইয়া যাইবার ভয়। সিনেমার মরীচিকা-মোহে যে হতভাগ্য মজিয়াছে তাহার চিত্তে সুখ নাই।

যাহোক, কোনও রকমে এখনও টিকিয়া আছি ইহাই ভাগ্য বলিতে হইবে। কাহাকেও এ পথে আসিতে উৎসাহ দিই না। অনেক অপবুদ্ধি যুবক সিনেমা রাজ্যে প্রবেশ করিবার আশায় আমার কাছে দরবার করিতে আসে; তাহাদের দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিই। তাহারা বুঝিতে পারে না আমি তাহাদের কত বড় সুহৃৎ।

একদিন সায়ংকালে বাড়ির বারান্দায় একাকী বসিয়াছিলাম, একটি অপরিচিত লোক আসিয়া জোড়হস্তে প্রণাম করিল। অনুমান করিলাম, ইনিও একজন ভাবী চিত্রাভিনেতা, হিরোর ভূমিকা না হোক, অন্তত ভিলেনের ভূমিকা না লইয়া ছাড়িবে না।

ভ্রূকুটি করিয়া বলিলাম, কি দরকার বাপু?

কর্ণচুম্বী হাস্যে অধরোষ্ঠ প্রসারিত করিয়া লোকটি বলিল, আজ্ঞে বাবু, আমি যুধিষ্ঠির দাস।

ভাল করিয়া দেখিলাম, যুধিষ্ঠির বটে। তাহার গায়ে সাটিনের ঝকমকে কোট, গলায় পাকানো চাদর, পায়ে কিড়-লেদারের পালিশ করা জুতা। বেশ একটু মোটা হইয়াছে। যুধিষ্ঠির আমার টাকা চুরি করিয়াছিল বটে কিন্তু অনেকদিন পরে তাহাকে দেখিয়া আনন্দ হইল। বলিলাম, আরে তাই তো—এ যে যুধিষ্ঠির। আয় আয়! এখানে কোত্থেকে এসে জুটলি

যুধিষ্ঠির এবার গড় করিয়া পদধূলি লইল। বলিল, আজ্ঞে বাবু, বোম্বাই আসা হল—তা এখানে আপনি আছেন তাই পেন্নাম করতে এলাম।

বলিলাম, তা বেশ করেছিস। উঠেছিস কোথায়?

সে একটি হোটেলের নাম করিল যাহার দৈনিক ভাড়া পঁচিশ টাকা! বুঝিলাম যুধিষ্ঠির বড়মানুষ মালিক পাইয়াছে, তাহারই সহিত বড় হোটেলে উঠিয়াছে।

তাহাকে আদর করিয়া বেঞ্চিতে বসিতে বলিলাম; সে একটু সঙ্কোচের সহিত বসিল। এদিক ওদিক দুচার কথার পর প্রশ্ন করিলাম, তারপর তোর বৌ রম্ভা কেমন আছে? ছেলেপুলে কটি?

রম্ভার নামে যুধিষ্ঠিরের মুখ বিবর্ণ হইল, সে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, রম্ভা নেই, সে চলে গেছে বাবু।

চলে গেছে? কোথায় চলে গেল?

ছিনেমা করতে চলে গেছে। একটা ছিনেমা কোম্পানী এসেছিল, তাদেরই সঙ্গে পালিয়েছে।

কিছুই বিচিত্র নয়। রম্ভার চেহারার চটক ছিল; হয়তো কোনও চিত্র প্রযোজকের নজরে পড়িয়া থাকিবে। জিজ্ঞাসা করিলাম, কতদিন হল পালিয়েছে?

সাত বছর হল। যুদ্ধের আগেই পালিয়েছে। প্রথমে মাদ্রাজে ছিল, অনেকগুলো তামিল ছবিতে হেরোইন সেজেছিল। খুব নাম করেছিল বাবু। এখন শুনেছি বোম্বাই এসেছে।

তামিল ছবির খবর রাখি না; কিন্তু বোম্বাই আসিয়া কোনও স্ত্রীলোক হিরোইন সাজিলে আমি খবর পাইতাম। প্রশ্ন করিলাম, বোম্বাই এসে হিরোইনের পার্ট করছে রম্ভা?

যুধিষ্ঠির বলিল, আজকাল আর হেরোইনের পার্ট পায় না। বয়স গেছে, চেহারাও ভেঙেছে—আজকাল হেরোইনের মার পার্ট করে।

হিরোইনদের অবশ্য ইহাই পরিণাম। তবে যাহারা বুদ্ধিমতী তাহারা সময় থাকিতে কিছু সঞ্চয় করিয়া লইয়া বিদায় গ্রহণ করে। সিনেমা যৌবনের ক্ষেত্র, বিগত যৌবনার স্থান এখানে অতি অল্প।

জিজ্ঞাসা করিলাম, আবার বিয়ে করেছিস তো?

যুধিষ্ঠির বিতৃষ্ণাসূচক মুখভঙ্গি করিয়া বলিল, না বাবু, ন্যাড়া আর কবার বেলতলায় যায়? মেয়েলোকের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

বুঝিলাম, সে বড় রকম দাগা পাইয়াছে। অন্য কথা পাড়িবার উদ্দেশ্যে বলিলাম, যাক্, তুই এখন কি কাজকর্ম করছিস বল্।

যুধিষ্ঠির বলিল, কাজ আর এখন কিছু করি না। যুদ্ধের সময় খুব কাজ করেছিলাম বাবু। এখন ইচ্ছে হয়েছে ছিনেমার ছবি করব। তাই আপনার কাছে বলিয়া সলজ্জে ঘাড় বাঁকাইল।

হরি হরি! ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই সিনেমা। যুধিষ্ঠিরও সিনেমা করিতে চায়। হাসিও পাইল দুঃখও হইল। রম্ভা হিরোইন সাজিয়াছে তাই যুধিষ্ঠিরও হিরো সাজিয়া তাহার পাল্টা জবাব দিতে চায়। হায় মানুষের অভিমান!

গম্ভীর হইয়া বলিলাম, তা হয় না যুধিষ্ঠির। সিনেমার কাজ করতে গেলে চেহারাটা ওরই মধ্যে একটু ইয়ে হওয়া দরকার। তুই দুঃখ করিস নি—

যুধিষ্ঠির বলিল, আজ্ঞে বাবু, আমি ছিনেমায় পার্ট করব না, টাকা দিয়ে ছবি তৈরি করতে চাই।

বলে কি যুধিষ্ঠির! সে অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীর লোক বটে কিন্তু এত নির্বোধ তাহা ভাবি নাই। বিরক্ত হইয়া বলিলাম, টাকা দিয়ে ছবি তৈরি করাবি! তুই পাগল না ছন্ন? একটা ছবি করতে কত টাকা লাগে জানিস?

আজ্ঞে না বাবু!

একটা ছবি তৈরি করতে খুব কম করেও দেড় লাখ টাকা লাগে। পারবি দিতে?

যুধিষ্ঠির ঘাড় চুলকাইয়া বলিল, আজ্ঞে বাবু, তা পারব। যুদ্ধের সময় ঠিকেদারী করেছিলাম, মিলিটারিকে কুলি আর বাঁশ দিতাম—ভারি লাভের কাজ। তা কুড়িয়ে বাড়িয়ে দেড় লাখ দিতে পারব বাবু।

অভিভূত হইয়া বসিয়া রহিলাম। আমার ভূতপূর্ব ভৃত্য যুধিষ্ঠির দেড় লাখ টাকার মালিক। আর আমি—! সে যাক্। কিন্তু ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। মিলিটারিকে বাঁশ দিয়া যুদ্ধের বাজারে অনেকেই লাল হইয়াছে, যুধিষ্ঠির হইবে না কেন? বিশেষত পরের পকেটে হস্ত প্রবিষ্ট করাইবার। অভ্যাস তাহার পূর্ব হইতেই আছে। সে তত বড়মানুষ হইবেই। তাহার সাটিনের কোট ও কিড়-লেদার জুতার তাৎপর্য এতক্ষণ আমার কাছে একটু ঘোলাটে হইয়াছিল এখন তাহা ফটিক-জলের। মতো পরিষ্কার হইয়া গেল। দৈনিক পঁচিশ টাকা ভাড়ার হোটেলের রহস্যেরও সমাধান হইল। কিন্তু আশ্চর্য, দেড় লাখ টাকার মালিক হইয়াও তাহার মাথা গরম হয় নাই; নহিলে সে আমার বাড়িতে আসিয়া এমন কাঁচুমাচুভাবে বেঞ্চিতে বসিয়া আছে কেন?

যুধিষ্ঠির বলিয়া চলিল,—ছিনেমার কাউকে তো চিনি না—শুনেছি চোর বাটপাড় অনেক আছে, ভালমানুষের টাকা ঠকিয়ে নেয়। তাই আপনার কাছেই এলাম বাবু—আপনি আমায় একটা ছবি করে দেন।

ভাবিলাম, যে দুর্লভ সম্ভাবনার গোলাপী স্বপ্ন দেখিয়া সিনেমা জগতের অর্ধেক মানুষ জীবন কাটাইয়া দেয়, তাহা যখন পায়ে হাঁটিয়া আমার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তখন তাহাকে অবহেলা করিব না। বরাত যদি খুলিয়াই থাকে, তাহাকে রোধ করিবে কে? যুধিষ্ঠির নিমিত্ত মাত্র।

বলিলাম, তোমার ছবি আমি করে দেব। কিন্তু তুমি যে অর্ধেক টাকা দিয়ে হাত গুটোবে তা হবে।

যুধিষ্ঠির বলিল, বাবু, আমি হাত গুটোব না। আপনি আমার দেড় লাখ টাকা নেন আর আপনার গল্প থেকে আমায় একটা ছবি করে দেন। আর আমি কিছু চাই না।

বলিলাম, বেশ। তুমি আমার নামে দেড় লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা করে দেবে, সেই টাকায় ছমাসের মধ্যে আমি তোমাকে ছবি তৈরি করে দেব—এই শর্তে কন্ট্রাক্ট হবে। ছবি আমার যেমন ইচ্ছে তেমনি করব, তুমি হাত দিতে পাবে না। কেমন রাজী?

যুধিষ্ঠির কৃতার্থ হইয়া বলিল, আজ্ঞে বাবু, আপনি যা বলবেন তাতেই রাজী। কেবল—ছবিতে আমার নামটাও একটু জুড়ে দেবেন, যাতে রম্ভা—মানে সবাই জানতে পারে—

তোমার নাম নিশ্চয় থাকবে বড় বড় অক্ষরে থাকবে। তাহলে কালই অ্যাটনীর অফিসে গিয়ে দলিলপত্র তৈরি করে ফেলতে হবে। আর দেরি নয়।

আজ্ঞে যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভাল। বলিয়া যুধিষ্ঠির আবার এক খাচা পায়ের ধূলা লইল।

হপ্তাখানেকের মধ্যে লেখাপড়া হইয়া গেল। যুধিষ্ঠির গুল মারে নাই, সত্যই দেড় লাখ টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে জমা করিয়া দিল। মহা উৎসাহে কাজে লাগিয়া গেলাম।

স্টুডিও ভাড়া লইয়া নট-নটী নির্বাচনের পালা আরম্ভ হইল। তাছাড়া আরও হাজার রকমের কাজ। আমি স্টুডিওর অফিসে বসিয়া সারাদিন কাজ করিতাম, আর যুধিষ্ঠির ঘরের এক কোণে। চুপটি করিয়া বসিয়া থাকিত। কত রকমের লোকের যাতায়াত, নট-নটী পরিদর্শন—যুধিষ্ঠির কোণে বসিয়া পরম আগ্রহভরে দেখিত, কিন্তু কখনও আপনা হইতে কথা কহিত না বা কোনও কাজে। হস্তক্ষেপ করিত না। তাহার টাকায় এত ব্যাপার হইতেছে ইহা দেখিয়াই তাহার আনন্দ।

এইভাবে দিন পনেরো কাটিবার পর একদিন যুধিষ্ঠির অফিসে আসিল না। সেদিন তাহার অনুপস্থিতি গ্রাহ্য করিলাম না, কিন্তু তাহার পর আরও দুদিন আসিল না দেখিয়া ভাবনা হইল হয়তো অসুখে পড়িয়াছে। তাহার হোটেলের ঠিকানা জানা ছিল, অফিসের কাজকর্ম সারিয়া তাহাকে দেখিতে গেলাম।

অভিজাত শ্রেণীর হোটেল; তাহার পাঁচতলায় যুধিষ্ঠিরের স্যুট। লিফটে চড়িয়া তাহার দ্বারে উপস্থিত হইলাম। এমন মানুষের মন, এত ব্যাপারের পরও যুধিষ্ঠিরের সহিত তাহার ঐশ্বর্যের সহিত সঙ্গতি স্থাপন করিতে পারি নাই, সে যে এককালে আমার আজ্ঞাবহ ভৃত্য ছিল সেই কথাটাই মনের মধ্যে বড় হইয়া আছে। কিংবা হয়তো যুধিষ্ঠিরের তৃণাদপি সুনীচ অন্তরটি সত্য, তাহার ঐশ্বর্য অলীক, তাই উভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করিতে পারিতেছি না।

যুধিষ্ঠিরের ঘরের দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। টোকা দিতেই যুধিষ্ঠির দ্বার একটু ফাঁক করিয়া আমাকে দেখিয়াই সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। আমি বিস্মিত হইয়া ভাবিলাম—এ কি ব্যাপার!

ঘরের ভিতর হইতে ফিস্ ফিস্ কথার আওয়াজ আসিতেছে

ঘরে নিশ্চয় দ্বিতীয় ব্যক্তি আছে। চলিয়া যাইব কিনা ভাবিতেছি এমন সময় দ্বার আবার খুলিয়া গেল। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত সঙ্কুচিতভাবে আমাকে অভ্যর্থনা করিল

আসুন বাবু, আমার ঘরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল, এ আমার সাত পুরুষের ভাগ্যি।

ঘরে প্রবেশ করিয়া বুঝিলাম, সেখানে খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল। চা কে প্রভৃতি রহিয়াছে, কিন্তু যে ব্যক্তিটি এই আমন্ত্রণের অতিথি তাহাকে দেখিলাম না। আমার আকস্মিক আবির্ভাবে সে বোধ করি বাথরুমে লুকাইয়াছে।

বেশীক্ষণ থাকিলাম না। যুধিষ্ঠিরের স্বাস্থ্য যে ভালই আছে তাহাতে সন্দেহ নাই; উপরন্তু সে যদি এমনি কোনও কাজে লিপ্ত থাকে যাহা সে আমার কাছে লুকাইতে চায়, তবে সে বিষয়ে আমার কৌতূহল থাকা উচিত নয়। তবু মনে খটকা লাগিল। টাকা সর্বনেশে জিনিস; উপসর্গ জুটিতে বিলম্ব হয় না। যাহোক, ভরসার কথা, যুধিষ্ঠিরের অধিকাংশ টাকা এখন আমার হাতে, সে যে অসৎ-সঙ্গে পড়িয়া সব কিছু উড়াইয়া দিবে সে সম্ভাবনা নাই।

পরদিন হইতে যুধিষ্ঠির আবার স্টুডিওতে আসিতে লাগিল। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম, সে যেন সর্বদাই অন্যমনস্ক হইয়া থাকে স্টুডিওর কার্যকলাপে তাহার তেমন মন নাই।

ক্রমে মহরতের শুভ-মুহূর্ত আসিয়া পড়িল। নট-নটী যন্ত্র-যন্ত্ৰী সব ঠিক হইয়া গিয়াছে।

মহরতের আগের দিন সকালবেলা যুধিষ্ঠির আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত। হাত কলাইয়া বলিল, বাবু, একটা কথা বলব।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কি কথা?

আরও খানিকক্ষণ হাত কচলাইয়া যুধিষ্ঠির বলিল, রম্ভাকে ছবির হেরোইন করতে হবে।

রম্ভা! তাকে কোথায় পেলে?

আজ্ঞে–তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে বড় কষ্টে আছে বাবু—কেউ তাকে ছবিতে নেয় না—

বলিলাম, এখন আর হতে পারে না, আমি অন্য হিরোইন নিয়েছি।

না বাবু, তাকে নিতেই হবে।

অত্যন্ত বিরক্ত হইলাম, তোমার মাথা খারাপ। নিজেই বচ, তাকে কেউ ছবিতে নেয় না, আমি নিলে আমার ছবির কি দশা হবে বুঝতে পারছ না? বুড়ো-হাড়া দিয়ে হিরোইনের কাজ চলবে না। রম্ভা আবার তোমার ঘাড়ে চেপেছে দেখছি—সেদিন হোটেলে তাকেই চা কে খাওয়াচ্ছিলে। তা খাওয়াও, আপত্তি নেই। কিন্তু তার জন্যে আমার ছবি নষ্ট করতে পারব না।

তবু যুধিষ্ঠির ছাড়ে না, করুণ কণ্ঠে মিনতি করিতে লাগিল। আমি কিন্তু অটল রহিলাম। শেষে যুধিষ্ঠির হঠাৎ রাগিয়া উঠিল, বলিল, তবে আমার টাকা ফেরত দেন, আমি ছবি করব না।

বলিলাম, আদালত থেকে টাকা আদায় কর গে যাও। তোমার এই দুর্মতি হবে জানতাম বলেই আগে থাকতে ব্যবস্থা করে রেখেছি।

যুধিষ্ঠির তখন কাঁদিতে আরম্ভ করিল, হাউ হাউ করিয়া বালকের মতো কাঁদিতে লাগিল। তাহার অবিগলিত গদগদ কাতরোক্তিতে পাষাণও দ্রব হইয়া যায়। রম্ভা অবলা মেয়েমানুষ… নাচিতে গাহিতে জানে বলিয়াই না তার পতন হইয়াছিল! কিন্তু সেজন্য ভগবান তাহাকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়াছেন—এখন পৃথিবীতে তাহার কেহ নাই, এখন যুধিষ্ঠির যদি তাহাকে সাহায্য না করে তো কে করিবে? বাবু, আপনি দয়া করুন—

অবশেষে আর সহ্য করিতে না পারিয়া আমি বলিলাম, কেঁদো না, শোনো। তাকে যে নেবই এমন কথা দিতে পারি না। কিন্তু তুমি তাকে স্টুডিওতে নিয়ে এস, যদি দেখে আমার পছন্দ হয় পার্ট দিতে চেষ্টা করব।

যুধিষ্ঠির এই আশ্বাসে সম্মত হইয়া চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল।

সেদিন স্টুডিওতে গিয়া রম্ভাকে দশ বৎসর পরে আবার দেখিলাম। আমার সম্মুখে আসিতে লজ্জায় ও কুণ্ঠায় সে যেন ভাঙিয়া পড়িল। যে-মেয়ে দীর্ঘকাল সিনেমায় অভিনেত্রীর কাজ করিয়াছে তাহার পক্ষে এতখানি লজ্জা প্রশংসার কথা বটে। কিন্তু শুধু লজ্জায় তো কাজ চলে না। রম্ভার সে রূপ-যৌবন সে চমক-ঠমক কিছুই নাই। সাত বৎসরের অবিরাম নিষ্পেষণ তাহার দেহটাকে নিড়াইয়া ভাঙিয়া ছিঁড়িয়া একেবারে তচনচ করিয়া দিয়াছে। বয়স বোধ করি এখনও ত্রিশ পার হয় নাই। কিন্তু চেহারা দেখিলে মনে হয়, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধির কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

যুধিষ্ঠির নিকটে দাঁড়াইয়া দীনভাবে হাত কচলাইতেছিল, তাহাকে বাহিরে যাইতে ইশারা করিলাম। তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা বৃথা। দেখি যদি রম্ভাকে বুঝাইতে পারি।

যুধিষ্ঠির ঘরের বাহিরে গেলে আমি রম্ভাকে বলিলাম, একবার যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ করে তোমার মন ওঠেনি, আবার তার সর্বনাশ করতে চাও?

রম্ভা আমার পানে ভয়-চকিত একটা দৃষ্টি হানিয়া ঘাড় নীচু করিয়া ফেলিল। আমি নিষ্ঠুরভাবে। বলিয়া চলিলাম, তুমি ছবির হিরোইন হলে ছবি একদিনও চলবে না, ওর দেড় লাখ টাকা ড়ুবে যাবে। ওকে আবার পথের ভিখিরি করতে চাও? ওর যখন টাকা ছিল না তখন ওকে ছেড়ে পালিয়েছিলে, আজ ওর টাকা হয়েছে তাই আবার ওকে ধরেছ? তোমার শরীরে কি লজ্জা নেই? কি রকম রক্তচোষা মেয়েমানুষ তুমি?

রম্ভা ব্যাকুলভাবে মুখ তুলিল; দেখিলাম, তাহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইতেছে। সে ভাঙা ভাঙা গলায় বলিল, বাবু, আমি হিরোইন হতে চাইনি—ও-ই জোর করে আমাকে… বলিয়া মুখে আঁচল চাপিয়া কাঁদিতে লাগিল।

নরম হইয়া বলিলাম, বেশ। যুধিষ্ঠির বড় ভালমানুষ, তোমাকে ক্ষমা করেছে। তোমার গায়ে। যদি মানুষের চামড়া থাকে তাহলে তোমারও উচিত ওর স্বার্থের দিকে নজর রাখা। যাও, যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে বলবে। আর যেন এসব হাঙ্গামা না হয়।

প্রায় বুজিয়া যাওয়া গলায় রম্ভা বলিল, আচ্ছা বাবু।

রম্ভা চলিয়া গেল। মনুষ্য হৃদয়ের বিচিত্র কুটিল গতি অনুধাবন করিয়া বিস্ময় অনুভব করিবার অবসর ছিল না, আশু একটা বড় রকম ফাঁড়া কাটিয়াছে বুঝিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলাম।

মহরতের দিন যুধিষ্ঠির আসিল না।

শুটিং আরম্ভ হইল। সাতদিন কাটিয়া গেল তবু যুধিষ্ঠিরের দেখা নাই। অভিমান করিয়া আছে ভাবিয়া তাহার হোটেলে আবার দেখা করিতে গেলাম।

যুধিষ্ঠির নাই। ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিতে পারিলাম, শেষের দিকে একটি স্ত্রীলোক আসিয়া যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বাস করিতেছিল, তারপর তাহারা একসঙ্গে চলিয়া গিয়াছে।

অতঃপর দীর্ঘকাল যুধিষ্ঠিরের দেখা নাই। ভাবিয়াছিলাম টাকার গরজে শেষ পর্যন্ত নিজেই আসিবে, কিন্তু সে আসে নাই। ছবি তৈয়ার হইয়াছে, ছবিতে যুধিষ্ঠিরের নাম ছাপা হইয়াছে। বেশ, ভাল দামে ছবি বিক্রয় করিয়াছি। ভারতবর্ষের সর্বত্র ছবি দেখানো হইতেছে। আমি টাকা ও খ্যাতির দিক দিয়া বিশেষ লাভবান হইয়াছি। যুধিষ্ঠিরের ভাগেও আসলের উপর পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ হইয়াছে। কিন্তু লাভের টাকা লইতে সে আসিল না। হতভাগ্য মূর্খ ঐ পতিতা স্ত্রীকে লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

চলচ্চিত্র নির্মাণ সহজ কাজ নয়, শরীরে বেশ ধকল লাগে। তাই দ্বিতীয় ছবি আরম্ভ করিবার আগে ভাবিলাম, কিছুদিনের জন্য কোনও নির্জন স্থানে গিয়া বিশ্রাম করিয়া আসি। একজন ধনী বন্ধু সমুদ্র তীরে তাঁহার একটি প্রমোদভবনে আমাকে থাকিবার অনুমতি দিলেন।

বোম্বাই হইতে চারিশত মাইল দক্ষিণে সাগরকূলে একটি নগর, তাহারই উপকণ্ঠে বন্ধুর নিভৃত নির্জন প্রমোদভবন। বছরের অধিকাংশ সময়েই বন্ধ থাকে, মাঝে মাঝে গৃহস্বামী আসিয়া আমোদ-প্রমোদ করিয়া যান।

বাড়িতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বাড়ির রক্ষক-ভৃত্যরূপে বিরাজ করিতেছে—যুধিষ্ঠির!

বলিলাম, তুই এখানে!

যুধিষ্ঠির আমাকে দেখিয়া প্রথমটা বোধ হয় সুখী হয় নাই, কিন্তু ক্রমশ সামলাইয়া লইল। তাহার পলায়নের কৈফিয়ত সে যাহা দিল তাহা এইরূপ : শহর বাজারের গণ্ডগোল আর তাহার ভাল লাগে না। রম্ভাও চেনা লোকের মধ্যে থাকিতে লজ্জা পায়। তাই তাহারা জনারণ্যের বাহিরে এই একান্তে। আশ্রয় লইয়াছে। এখানে সে ত্রিশ টাকা মাহিনা পায়, তাহার উপর খোরাক পোশাক। বড় সুখে আছে তাহারা। তাহাদের কোনও আক্ষেপ নাই।

আমি বলিলাম, কিন্তু তোর অত টাকা

যুধিষ্ঠির হাত-জোড় করিয়া বলিল, বাবু, ও টাকা আর আমাকে নিতে বলবেন না। আমরা বেশ আছি।

কি জানি, হয়তো তাহার ভয় হইয়াছে টাকা এবং রম্ভা একসঙ্গে তাহার ভাগ্যে সহ্য হইবে না। আমি পীড়াপীড়ি করিলাম না; ভাবিলাম যদি কোনও দিন তাহার মতিগতির পরিবর্তন হয় তখন তাহার টাকা ফেরত দিব, ততদিন আমার কাছে গচ্ছিত থাক।

ভারি আনন্দে এক মাস কাটিয়া গেল। যুধিষ্ঠির ভৃত্যের মতোই আমার সেবা করিল। রম্ভা বোধ হয় লজ্জায় আমার সম্মুখে আসিত না; একবার চকিতের জন্য তাহাকে দেখিয়াছিলাম। রম্ভার চেহারার অনেক উন্নতি হইয়াছে। যৌবন আর ফিরিয়া আসে না, কিন্তু মনে হইল রম্ভা তাহার হারানো নারীত্ব ফিরিয়া পাইয়াছে।

চলিয়া আসিবার সময় যুধিষ্ঠির মিনতি করিয়া বলিল, বাবু, আমরা যে এখানে আছি তা কাউকে বলবেন না।

টিকিট কিনিবার জন্য দশটাকার দশখানা নোট বাহির করিয়া পকেটে রাখিয়াছিলাম। স্টেশনে আসিয়া টিকিট কিনিতে গিয়া দেখি, একটি নোট কম—নয়খানা আছে!

হঠাৎ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলাম। যুধিষ্ঠিরের পুরানো অভ্যাস এখনও যায় নাই।

২৩ শ্রাবণ ১৩৫৫

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments