Friday, April 26, 2024
Homeরম্য গল্পহুদিনি ইত্যাদি - লীলা মজুমদার

হুদিনি ইত্যাদি – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

ভোজবাজি, ইন্দ্রজাল, ভেলকি। সবই এক; অর্থাৎ নয়কে হয় করা। অন্তত অভিধানে তাই বলে। আসলে তফাত আছে। একটি হল চোখকে ফাঁকি দেওয়া; হাতসাফাইয়ের কারচুপি দিয়ে দর্শককে বোকা বানানো। খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিদ্যুতের মতো হাত চাই, দর্শকের মনকে মুঠোর মধ্যে রাখতে পারা চাই।

যেমন অনেক বছর আগে নিউ এম্পায়ারের মঞ্চে দেখেছিলাম, সওয়ারসুদ্ধ একটা মরিস গাড়ি তোলা হল। পিছনে একটা পরদা ঝুলছিল; যদ্দূর মনে পড়ে, তাতে একটা পেট্রল স্টেশনের দৃশ্য আঁকা ছিল।

ফট করে জাদুকর পি সি সরকার ফঁকা পিস্তলের আওয়াজ করলেন, সবাই চমকে উঠলাম। তারপরেই চেয়ে দেখলাম মঞ্চের ওপর পেট্রল স্টেশনের দৃশ্য আঁকা পরদাটা রয়েছে, কিন্তু সওয়ারসুদ্ধ গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেছিলাম।

পরে ভেবে দেখেছি হাতসাফাই দিয়ে এটা সম্ভব হতে পারে। ধরুন যদি গাড়ির ঠিক সামনে, মাথার ওপর অদৃশ্যভাবে অবিকল ওইরকম আরেকটা পরদা গুটিয়ে রাখা হয় আর পিস্তলের শব্দে চমকে-ওঠা দর্শকদের এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে, ঝুপ্‌ করে গুটনো পরদাটিকে গাড়ির সামনে নামিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে পিস্তলের ধোঁয়া পরিষ্কার হবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে পরদা আছে, গাড়ি নেই। তাই করা হয়েছিল কি না জানি না, তবে ব্যাখ্যানা হতেও পারে।

আরেক রকম দেখেছি তাকে হাতসাফাই বলা যায় না। তার কোনও ব্যাখ্যানই হয় না। ৫০ বছর আগে সুরুল গ্রামের মাঠে সার্কাসের তাবু পড়েছিল। শান্তিনিকেতন থেকে আমরা দল বেঁধে গিয়ে, চার আনা করে টিকিট কিনে, ছেঁড়া তাঁবুর তলায়, রিং-এর ধারে কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম।

তখন বিজলিবাতি ছিল না এদিকে। ছাদ থেকে মস্ত একটা হ্যাজাক ঝোলানো ছিল। মালিক দু’জন; আর্টিস্ট জনাদশেক; কয়েকটা ঘেয়ো কুকুর, রোগা ঘোড়া আর একটা বেয়াদব চাকর। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে, গোড়াতেই বড় মালিক বলল, ‘এই লোকটা বেজায় বদ, পারলে খেলা নষ্ট করে দেবে। তার চেয়ে এটাকে পুঁতে রাখা যাক! অ্যাই, গর্ত খোঁড়!’

ছোট মালিক বলল, ‘দাঁড়াও, আগে ও হ্যাজাকটা ঝোলাক, তারপর পোঁতা যাবে। নইলে তুমি আমাকে বাতি ঝোলাতে বলবে?’

বাতিটা ঠিকমতো ঝোলানো হল, চাকরটার সাহায্যে গর্তও খোঁড়া হল। দর্শকরা অনেকে উঠে গিয়ে ভাল করে দেখে এল গর্তে কেউ বা কিছু নেই। তারপর চাকরটাকে গর্তে পুরে, মাটি-চাপা দিয়ে, পা দিয়ে বেশ করে চেপেচুপে মাটি শক্ত করে, তার ওপর দেড় ঘণ্টা খেলা দেখানো হল।

প্রায় সবই অতি মামুলি খেলা, তার জন্যে একটা লোককে জ্যান্ত পোঁতার কোনও দরকার ছিল মনে হল না। বিরক্ত হয়ে উঠে যাবার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় শেষ খেলার ঘোষণা শুনতে পেলাম।

বড় মালিক বলল, ‘জিন্দা পুতুলের নাচ দেখাব। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, তাঁবুতে তালি দেবার পয়সা পর্যন্ত জোটাতে পারি না। জিন্দা পুতুল কিনব কী করে? তাই নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি।’

এই বলে দু’জনে নিজেদের পকেট থেকে দুটি ময়লা রুমাল বের করে, ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাল। দর্শকরা কেউ কেউ হাতে নিয়ে দেখল কোনও কারচুপি নেই, কিন্তু জঘন্য নোংরা।

রুমাল দুটি হাতে ফিরে আসতে, বড় মালিক একেকটাতে ছয়টি গিঁট দিয়ে মুন্ডু, কোমর, দুই হাত, দুই পা বানিয়ে, আবার রুমাল-পুতুল সবাইকে দেখাল। তারপর হাতের তেলোয় তাদের পাশাপাশি শুইয়ে বলল, ‘মরা পুতুল তো আর নাচতে পারে না, তাই জ্যান্ত করে নিচ্ছি।’ এই বলে দুটো ফুঁ দিতেই, পুতুল দুটো লাফিয়ে উঠে হাত তুলে সেলাম করে, এ-ওর কোমর জড়িয়ে মালিকের হাতের তেলোয় নাচতে লাগল। নাচতে নাচতে একসময় তিড়িং-বিড়িং করে লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল। নেমে হাত তুলে ঠ্যাং ছুড়ে কতরকম নাচ যে দেখাল, তার ঠিক নেই। আমরা একেবারে থ! কোথাও কোনও সুতোটুতো বাঁধা দেখা গেল না। মালিকরা হাতও নাড়ছিল না।

তবে ছোট মালিক ভুলে একটাকে মাড়িয়ে দেওয়াতে তার রাগ দেখে কে! ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে গিয়ে, ধাঁই ধাঁই করে বেশ ক’টা লাথি কষে দিল। অন্যটা সেই সুযোগে বেচারা ছোট মালিকের পা বেয়ে উঠতে লাগল।

তখন বড় মালিক চটে গেল। ‘ঢের হয়েছে, আর না! তোদের দেখছি বড্ড বাড় বেড়েছে!’ এই বলে দুটোকে আবার হাতে তুলে নিল। তখনও তাদের তেজ কমেনি। সমানে লাফাচ্ছে আর ঘুঁষি দেখাচ্ছে। মালিক জোরে একটা ফুঁ দিতেই কিন্তু তারা নেতিয়ে শুয়ে পড়ল। মালিক আমাদের কাছে এসে পুতুল দেখাল। হাতে তুলে দেখলাম রুমালে গিঁট বেঁধে তৈরি দুটি পুতুল। কলকবজা কিছু নেই!

আমাদের চোখের সামনে তাদের গিঁট খুলে, ঝেড়ে, পকেটে পোরা হল। খেলাশেষের ঘণ্টি পড়ল। সবাই উঠে যাচ্ছিল, এমন সময় বড় মালিক বলল, ‘চাকরটা তো মাটির নীচে! আরে, সে না থাকলে, এত সরঞ্জাম তুলে রাখবে কে?’ এই বলে দুই মালিক কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে, তাকে আবার বের করল।

লোকটা ঢুলু-ঢুলু চোখে চারদিকে তাকিয়ে, গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, গর্তটা আবার বুজিয়ে দিল। তারপর হ্যাজাকের দড়ি খুলতে লেগে গেল! আমাদের মুখে কথা নেই। আজ পর্যন্ত এর কোনও ব্যাখ্যানা খুঁজে পাইনি।

আমেরিকায় আমার স্বামী বিখ্যাত ভেলকিবাজ হুদিনির খেলা দেখেছিলেন। সে বড় আশ্চর্য ব্যাপার। সেদিন হুদিনি বলেছিলেন তিনি নাকি ভারতে এসে এক সাধুর কাছে যোগ শিখেছিলেন। তাঁর সব আশ্চর্য খেলার কিছুটা হাতসাফাই হলেও, ভাল রহস্যগুলিতে তিনি যোগবল প্রয়োগ করেন। সে ব্যাপারই আলাদা।

এর পর তিনি তাঁর বিখ্যাত বাক্স রহস্য দেখিয়েছিলেন। মঞ্চের মধ্যিখানে বারোটা উজ্জ্বল আলোর নীচে, বস্টন শহরের নামকরা কারিগররা, দর্শকদের সামনে বসে, বড় বড় তক্তা আর ছয় ইঞ্চি আট ইঞ্চি লোহার স্ক্রু দিয়ে মস্ত বড় এক বাক্স তৈরি করল। তার সব উপকরণ এক নামকরা কোম্পানি সরবরাহ করেছিল।

বাক্সের যে দিকটি দর্শকদের দিকে ফেরানো ছিল, তাতে দুটো ছ্যাঁদা করা হল। বোধহয় বাতাস যাবার জন্য। তারপর পুরোদস্তুর ডিনার স্যুট পরে হুদিনি ওই বাক্সে ঢুকলেন। বাক্সের ঢাকনি বন্ধ করে লম্বা লম্বা স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেওয়া হল।

বাক্স চাদর দিয়ে ঢাকা হল না। উজ্জ্বল আলোর নীচে, মঞ্চের ওপর এমনি পড়ে রইল। গোড়ার দিকে সেই দুটো ছ্যাঁদা দিয়ে হুদিনি আঙুল বের করে দেখাচ্ছিলেন, যে তিনি ভিতরেই আছেন। তারপর তাও বন্ধ হল। ঘরভরতি শত শত দর্শক নিশ্বাস বন্ধ করে, বাক্সের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রইল।

হয়তো আধ ঘণ্টা সময় কেটেছিল। মনে হচ্ছিল এক যুগ। অনেকে ভাবছিল বাহাদুরি করতে গিয়ে শেষটায় লোকটা মরে-টরে গেল না তো! হঠাৎ দেখা গেল বাক্সের পাশে হুদিনি দাড়িয়ে!! ঘর্মাক্ত কলেবর, উসকোখুসকো চুল। যেন বড় বেশি পরিশ্রম করে এসেছেন। বাক্স যেমন-কে-তেমন।

সেটাকে যন্ত্রপাতির সাহায্যে খুলতেই মিনিট পনেরো লেগেছিল। দেখা গেল ভিতরে শুধু হুদিনির রুমালটা পড়ে আছে! বাক্স হুদিনির লোকরা করেনি। তার চারপাশ, তলা বা ওপর, কিছুই খোলা যেত না। তা হলে লোকটা বেরুল কী করে? যোগবলে কি?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments