Saturday, April 27, 2024
Homeকিশোর গল্পগুপ্তধন - আহমেদ খান

গুপ্তধন – আহমেদ খান

গুপ্তধন - আহমেদ খান

খবরটা শুনেই বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করে উঠল। ডেকে পাঠিয়েছেন, তা-ও আবার বড় মামা? এবার নিশ্চয় খবর আছে আমাদের। আমি আর আমার ছোট বোন তুলতুল, একসঙ্গেই বোধ হয় ঢোঁক গিললাম। ছোট মামা বললেন, ‘কী হলো তোদের, যা! বড় ভাই কারও জন্য অপেক্ষা করতে পারে না জানিস না?’

তা আর জানি না? আমরা যারা ছোট, এই নানুবাড়িতে বেড়াতে এসেও তিনতলার ছাদে যে খেলতে উঠি না, সে তো একমাত্র বড় মামার কারণেই। কে না জানে আর যারই হোক, বড় মামার চোখ এড়ানো যায় না। তার ওপর নানুবাড়ির তিনতলার ওপরেই বড় মামার বাস। বিয়েটিয়ে করেননি। অনেক অনেক বই আর মোটা এক জোড়া গোঁফ নিয়ে বড় মামা তাঁর ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকেন। কেউ কখনো তাঁকে হাসতে দেখেনি আবার কেউ কখনো তাঁকে রাগতেও দেখেনি। কিন্তু রাগলে কী যে হবে এই ভেবে ভেবে আমরা কেউ তাঁর সামনে গলা উঁচিয়ে কথা পর্যন্ত বলি না। সেই বড় মামা কিনা আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন? গ্রীষ্মের ছুটিটা হঠাৎই কেমন হিম হিম হয়ে উঠল। তুলতুলের কী অবস্থা জানি না, আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে।

কিন্তু হাঁটু কাঁপুক আর পেট গুড়মুড় করুক, বড় মামা যখন ডেকে পাঠিয়েছেন, তখন তো যেতেই হবে। পলেস্তারা ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমি একবার তুলতুলের দিকে তাকালাম। তুলতুল বলল, ‘আমরা কি চিত্কার করে কথা বলেছি ভাইয়া?’

‘না।’

‘ধুপধাপ আওয়াজ তুলেছি ছাদে?’

‘না।’

‘তাহলে বড় মামা ডাকছে কেন?’

সিঁড়ি শেষে কেবলই দাঁড়িয়েছি তিনতলায়, বড় মামার কণ্ঠ শোনা গেল। বললেন, ‘ভেতরে এসো!’

আমরা এসেছি কীভাবে বুঝলেন কে জানে! পায়ে পায়ে বড় মামার ঘরে ঢুকলাম। বাপ রে! কত বড় ঘর। আর ঘরের চার দেয়ালজুড়ে শুধু বইয়ের আলমারি। বড় মামা বসে আছেন ঘরের মাঝখানে। এই গরমেও গায়ে একটা চাদর। হাতে বই। বললেন, ‘সামনে এসো।’

কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব যেকোনো সময়।

‘তুমি তীব্র আর তুমি তুলতুল, তাই তো?’

‘জি।’

‘কোন ক্লাসে পড়ো?’

‘জি আমি ক্লাস নাইনে আর তুলতুল এবার ফাইভে।’

‘হুম। তোমরা নাকি গোয়েন্দা দল খুলেছ?’

এই যা! এ খবর বড় মামার কান পর্যন্ত কীভাবে এল? আমাদের গোয়েন্দা দল তো এমনি এমনি একটা খেলা। মানে আমি আর তুলতুল ও রকম দল দল খেলি। কিন্তু এসব কি বড় মামাকে বলা ঠিক হবে?

‘কী, কথা বলছ না কেন? খুলেছ গোয়েন্দা দল?’

আমি চুপ করে থাকলেও তুলতুল বলে উঠল, ‘হ্যাঁ মামা। আমাদের দলটার নাম তুতীগো! বলেন তো তুতীগো মানে কী?’

বড় মামা অত্যন্ত নিরস গলায় বললেন, ‘তুলতুল, তীব্র গোয়েন্দা—এটা আর এমন কী!’

তুলতুলের আগ্রহ কমল না অবশ্য। ঝটপট বলল, ‘আমি আর ভাইয়া সব গোয়েন্দা বই পড়ে ফেলেছি। ভাইয়া পড়ে আর আমি শুনি।’

আমি তুলতুলকে চুপ করতে বলতেও পারছি না, কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছি বড় মামা বিরক্ত হচ্ছেন। তুলতুল বলে চলেছে, ‘আমাদের সবচেয়ে ফেবারিট হলো শার্লক হোমস। কী বুদ্ধি তার—’

‘তো তোমাদের মধ্যে কে শার্লক আর কে ওয়াটসন?’

‘আমরা দুজনেই শার্লক। তাই না ভাইয়া?’

আমি না পেরে বললাম, ‘চুপ কর তুলতুল।’

বড় মামা চোখ উঠিয়ে আমার দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, ‘সিঁড়িঘাটে গেছ কখনো?’

‘গেছি মামা। ওই যে অনেক পুরোনো মন্দিরটার সঙ্গে সিঁড়ি। এক শ সাতাশটা। তারপর নদী।’

‘হুম। এখান থেকে দূরেও না অবশ্য। ওই সিঁড়িঘাট পেরিয়ে নদীটাকে ডানে রেখে ছোট্ট আরও একটা মন্দির আছে, দেখেছ?’

‘না মামা।’

‘তাহলে? গোয়েন্দাদের চোখ হতে হবে শার্প। কেমন গোয়েন্দা তুমি?’

বড় মামা উঠে আলমারির দিকে গেলেন। বললেন, ‘ওটা শিবমন্দির। অনেক বছরের পুরোনো। এখন আর কেউ যায়-আসে না। কিন্তু আগে অনেকে গিয়েছিল, কেন জানো?’

কিছু না বলে চুপ থাকলাম। জানি না বললেই তো ধমকাবেন!

‘লোকে বলে ওই মন্দিরে নাকি গুপ্তধন আছে!’

তুলতুল খলবলিয়ে ওঠে, ‘গুপ্তধন?’

‘হুম। কতজন গেল, মন্দিরের দশ দিক খুঁড়ে খুঁড়ে পরিষ্কার করে ফেলল, কিন্তু কোনো গুপ্তধন পেল না। তোমরা একবার দেখবে নাকি? তোমরা তো গোয়েন্দা!’

আমি বলতে গেলাম, কেউ যখন পায়নি তখন আর আমরা কীভাবে পাব? কিন্তু তুলতুলের বুদ্ধি কম তো, সে ফট করে বলল, ‘গুপ্তধন মামা? আমরা গুপ্তধনের কথা কত পড়েছি…আমরা যাব গুপ্তধন খুঁজতে, তাই না ভাইয়া?’

মামা বললেন, ‘কিন্তু সাবধান! জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না। খানাখন্দ তো আছেই, গরমের সময় এখন তো, সাপটাপও থাকতে পারে।’

আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। ছাদের ওপর রান্নাবাড়ির মতো গোয়েন্দা গোয়েন্দা খেলা এক জিনিস আর সাপের মুখে গুপ্তধন খুঁজতে যাওয়া একেবারেই আলাদা জিনিস। আমি তো মরে গেলেও যাব না! তুলতুলকে নিয়ে তাই আলগোছে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই বড় মামা আবার ডাক দিলেন, ‘শোনো—’

আমরা ফিরে তাকালাম। দেখলাম বড় মামা ইয়া মোটা আর বহু পুরোনো এক বইয়ের মলাটের ভেতর থেকে পাতলা ফিনফিনে একটা কাগজ বের করলেন। আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুপ্তধন পাওয়ার গুপ্তসংকেত! এটা দেখেও অনেকে চেষ্টা করেছে, পারেনি অবশ্য! দেখো, তোমাদের যদি কোনো কাজে লাগে!’

২.

আথালি-পাথালি বৃথা
নিমবাবু বড় তিতা
পাথরে ঘুমায় কে রে
রেগে কয় লাল চিতা

এ কয়টা লাইন লেখা বড় মামার দেওয়া গুপ্তসংকেতে। এর যে কোনো অর্থ নেই বোঝাই যাচ্ছে। অর্থ থাকলে অনেক আগেই গুপ্তধন বেরিয়ে আসত। কিন্তু এর অর্থ যে নেই, এটা তুলতুলকে কে বোঝাবে! সে ওই মন্দিরে যাবেই যাবে! এক শ সাতাশ সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমরা নামছি নিচে। নামতে নামতেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, এ সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠতে হবে ভাবতেই গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে!

তুলতুল অবশ্য নির্বিকার। নামতে নামতে বলল, ‘আমরা যদি গুপ্তধনটা পেয়ে যাই ভাইয়া তাহলে এবার স্কুলে গিয়ে খুব গল্প করা যাবে, তাই না? বলব নানুর বাড়িতে বেড়াতে এসে কেমন করে পেয়ে গেলাম আস্ত এক হাঁড়ি মোহর!’

‘ধুর, এখন কি আর মোহরটোহর পাওয়া যায় নাকি?’

‘যদি ভালোমতো খুঁজি তাহলে নিশ্চয় পাব।’

‘পেছনে তাকিয়ে সিঁড়ি নামিস না, পড়ে যাবি।’

‘উফ্ ভাইয়া, সত্যি যদি গুপ্তধন পেয়ে যাই—’

তুলতুলকে নিয়ে গোয়েন্দা দল করাটা আসলে ঠিক হয়নি। সবকিছুতে এত বেশি বুঝলে কী করে হবে? আমি বড়, আমি তো বলছিই গুপ্তধনটন এখন পাওয়া যায় না! কিন্তু তার লাফালাফি বন্ধই হয় না।

সিঁড়ি ফুরাল অবশেষে। বিকেলটা এই নদীর পাড়ে না এসে রিটুদের মাঠে খেলতে গেলেই পারতাম। কালকে রিটু ছক্কা মেরেছে আমার বলে—ওর বলে একটা ছক্কা না মারা পর্যন্ত শান্তি নেই। নদীটা সামনে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। বাঁয়ে রেখে গেছে ছোট্ট একটা খাল। ছোট্ট মানে এই এত্তটুকু। তুলতুলের থেকেও ছোট। তুলতুল বলল, চলো লাফ দিই ভাইয়া! বলেই তুলতুলটা তিড়িং করে একটা লাফ দিয়ে সেটা পার হয়ে গেল। তার দেখাদেখি আমি যেই না লাফ দিতে গেলাম, অমনি এঁটেল মাটিতে পিছলে গেল আমার পা।

একেবারে ঝপাং! খালের পানিতে। তুলতুল বদমাশটা খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি কোনোমতে হাঁচড়েপ্যাঁচড়ে উঠলাম। কিন্তু এপারে এসেই বা কী লাভ হলো? কোনো তো মন্দির নেই। তুলতুল বলল, ‘বড় মামা তো ভুল বলবেন না ভাইয়া! নিশ্চয় আছে। আমরাই দেখতে পাচ্ছি না। বড় মামা কী বলেছে মনে নেই? গোয়েন্দা হতে গেলে সবকিছু ভালোমতো দেখতে হবে।’

আমি যখন আমার শরীরের কাদামাটি দেখতে ব্যস্ত, তখন তুলতুল চিত্কার করে উঠল। বলল, ‘ওই যে ভাইয়া, দেখেছি, ওই যে, ওই গাছগুলোর ভেতরে। ভালো করে দেখ।’

ঠিক। চারটা কি পাঁচটা আম-বট-শজনেগাছের আড়ালে এমনভাবে মন্দিরটা আছে যে প্রথমে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালেই মন্দিরটার আবছা দেয়াল চোখে পড়ে।

মন্দিরটা খুবই ছোট। ঢুকতেই যেন শেষ হয়ে যায়। চারপাশে খোলা দরজা। বড় বড় দুটো জানালা। কিন্তু এত দরজা-জানালা থাকলে কী হবে? বাইরে এমন গাছ যে মন্দিরের ভেতর আলো ঢুকতেই পারে না। এই বিকেলেই কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। তা ছাড়া মন্দিরের দেয়ালজুড়ে শেওলা। তাতেও কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। একটা কেমন গন্ধও। ইচ্ছা করে না, কিন্তু নিজে থেকেই গলার স্বর কেমন খাদে নেমে এল। ফিসফিস করে বললাম, ‘এখানে এভাবে কী খুঁজবি বল, তার চেয়ে চল ফিরে যাই!’

‘ফিরে যাব কেন! গুপ্তসংকেতে বলেছে না আথালি-পাথালি বৃথা।’

‘হুম। তাতে কি বোকা?’

‘তার মানে আথালি-পাথালি খোঁজা যাবে না।’

‘অ্যাই তোর বয়স কত? আথালি-পাথালি বুঝিস তুই, অ্যা? শুধু পাকামো!’

‘পাকামো না ভাইয়া। আমার তো মনে হচ্ছে গুপ্তসংকেতে বলছে এলোমেলো না খুঁজে একটা জায়গায় খুঁজতে হবে!’

‘খুউব না! তা কোন জায়গা সেটা?’

‘পরের লাইনেই বলেছে নিমবাবু বড় তিতা!’

‘তো? এখন নিমবাবুকে কোথায় পাবি?’

‘নিমবাবু এখানেই কোথাও আছে।’

তুলতুল মন্দিরের ভেতর ঢুকে কোনো এক নিমবাবুকে খুঁজতে শুরু করল। আমার নজর অবশ্য মন্দিরের শুকনো পাতায়। সাপটাপ যদি থাকে পাতার মধ্যে! তুলতুল বলল, ‘ভাইয়া—’

‘কী হয়েছে?’

‘এটা কী গাছ?’

একটা মোটা গাছের গুঁড়ি মন্দিরের ভেতর ঢুকে আছে, আর ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে এর শরীরটা। গাছের পাতা দেখেই আমি গাছ চিনতে পারি না, গুঁড়ি দেখে কি চিনব? তুলতুল তার নখ দিয়ে গাছটার গুঁড়ি খুঁটতে শুরু করল।

‘কী করছিস কী তুই?’

‘দাঁড়াও না ভাইয়া।’

গুঁড়ি খুঁটে বাকল উঠিয়ে মুখে পুরে দিল তুলতুল। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা কেমন চিমসে গেল, আর পরক্ষণেই হেসে বলল, ‘নিমগাছ ভাইয়া এটা। গুপ্তসংকেতের নিমবাবু!’

আমার চোখ ছানাবড়া। সত্যি যদি এটাই নিমবাবু হয়, তাহলে? তাহলে কি সত্যিই আশপাশে গুপ্তধন আছে? এতক্ষণ বিশ্বাস হয়নি আমার। কিন্তু এই প্রথম কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো মনে। বললাম, ‘তুলতুল, দেখ তো গুপ্তসংকেতে পরে আর কী লেখা আছে!’

তুলতুলের দেখি মুখস্থ। বলল, ‘পাথরে ঘুমায় কে রে’

‘মানে?’

‘মানে তো বুঝছি না ভাইয়া।’

আমরা নিমগাছের গুঁড়ি ধরে মন্দিরের পুরো অংশটা দেখলাম। কিন্তু না পাথর দেখলাম, না দেখলাম পাথরে ঘুমানো কেউ। নাহ্, কোথাও একটা ভুল করছি। হয়তো মন্দিরের ভেতর না, বাইরে! তুলতুল বলল, ‘ভেতরেই ভাইয়া ভেতরেই। আথালি-পাথালি খুঁজতে তো মানা করেছে!’

‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো!’

এ সময় একটা সড়সড় শব্দ। সাপ নাকি? আমি তুলতুলকে নিয়ে দিলাম একটা লাফ। পায়ের নিচ দিয়ে কী যাচ্ছে কে জানে—তুলতুল চিত্কার করে উঠল, ‘ভাইয়া, ভাইয়া—’

আমি তার চেয়েও বেশি চিত্কার করে উঠলাম, ‘কোথায়, সাপ কোথায়?’

‘সাপ না ভাইয়া, মেঝেতে পাতাগুলো সরাও।’

‘অ্যা?’

প্রথমে বুঝতে পারলাম না। পরক্ষণেই দেখলাম তুলতুল মেঝে থেকে পাতা সরাচ্ছে আর মেঝেতে ধীর ধীরে একটা একটা ছবি ফুটে উঠছে। ছবিতে একটা নীল মানুষ শুয়ে আছে। রং উঠে গেছে অনেক—আমিও পাতা সরাতে শুরু করলাম। সরাতে সরাতে বুঝলাম পুরো মেঝেটাই আসলে একটা পাথর। আর তার ওপর নীল রঙের একটা মানুষের ছবি আঁকা। শুধু চোখ দুটো টুকটুকে লাল। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। আমার ধারণা, অন্যরাও বোঝেনি। আর বোঝেনি বলেই কেউ গুপ্তধন পায়নি। ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার ফিরতে হবে। নাহলে নানুর অনেক বকাঝকা শুনতে হবে। বললাম, ‘তুলতুল চল, দেখছিস না এখানে কোনো চিতাটিতা নেই।’

‘আরেকটু দেখি না ভাইয়া!’

‘না, চল!’

গুপ্তধন
অলংকরণ: জুনায়েদ আজীম চৌধুরী
বুঝতে পারছি গুপ্তধনের এত কাছে এসে তুলতুলের ফিরতে খুবই খারাপ লাগছে। কেঁদেই ফেলবে হয়তো। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। আর এটা ভাবতেই তুলতুলকে নিয়ে আবার ছুটলাম মন্দিরের মেঝেতে। এই নীল মানুষটার চোখ লাল। লাল চিতা নাকি? লাল ওই চোখ দুটোতে হাত দিতেই বুঝলাম ওগুলো শুধু চোখ না, বোতামও। আর বোতাম দুটোতে চাপ দিতেই লম্বা পাথরের মাঝামাঝি জায়গাটা থেকে সরে গেল কাঠের তক্তা। বেরিয়ে এল ভেতরটা। ভেতরটা অন্ধকার। তুলতুলের মুখে বিস্ময়, ‘ভাইয়া, গুপ্তধন! গুপ্তধন!’

কিন্তু ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা উপুড় হয়ে আরেকটু ভালো করে তাকাতেই ধীরে ধীরে একটা চৌকো জিনিস দেখতে পেলাম। বাক্স! একটা বাক্স! টিনের বাক্স! গুপ্তধনের বাক্স!

ঠিক এ সময় পেছন থেকে একটা ঝলসানো আলো এসে পড়ল। সঙ্গে বাজখাঁই কণ্ঠ, গুপ্তধন!

ছায়া হা হা হা করে হয়তো হেসে উঠবে এক্ষুনি—হয়তো আমাদের ধরে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে দেবে গুপ্তধনের সুড়ঙ্গে, তারপর বোতামে চাপ দিয়ে আমাদের চিরকালের মতো বন্দী করে রাখবে গুপ্তধনের সঙ্গে…এসব ভাবতে ভাবতেই আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এল। মাথা ঘুরে ধাপ করে আমি পড়ে গেলাম। তুলতুল ডাকতে থাকল, ‘ভাইয়া! ভাইয়া!’ কিন্তু সে ডাকও যেন অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল!

৩.

তীব্র আলোর মধ্যে চোখ যখন খুললাম, তখন দেখলাম, আমি শুয়ে আছি নানুর কোলে। নানু আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন আর সমানতালে বকছেন কাউকে। বলছেন, তোদের কোনো হুঁশ-আক্কেল কি নেই? ছোট ছোট বাচ্চাদের ভয় দেখাস?

একটু দূরে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বড় মামা। বলছেন, আরে কী মুশকিল, আমি তো ভয় দেখাতে যাইনি। আমি পিছু পিছু গিয়েছিলাম যেন ওদের কোনো বিপদ না হয়! গুপ্তসংকেতটা যেই ওরা মেলাতে পেরেছে, সেই গিয়েছিলাম কংগ্রাচুলেশন জানাতে! অন্ধকার ছিল তাই টর্চটা—

নানু খুবই বিরক্ত, ‘রাখ তোর কংগ্রাচুলেশন!’

আমি তুলতুলের দিকে দেখলাম। তুলতুল হেসে একপাশ দেখিয়ে দিল। দেখলাম, গুপ্তধনের ওই টিনের বাক্সটা রাখা। বললাম, ‘তাহলে আমরা সত্যি সত্যি গুপ্তধন পেয়েছি?’

বড় মামা বললেন, ‘হুম। দেখ, বাক্সটা খুলে দেখ!’

আমি আর তুলতুল হুটোপুটি করে বাক্সটা খুললাম। একি! বাক্সটার ভেতরটা তো দারুণ দারুণ মজার মজার সব চকলেটে ঠাসা! আর চকলেটগুলো সরাতেই দেখলাম বই। অনেক অনেক অনেক বই! গোয়েন্দা গল্পের নানা রঙের নানা ঢঙের বই!

নানু বললেন, ‘তোদের বড় মামার উপহার। তোরা গোয়েন্দা হয়েছিস শুনেই গুপ্তধনের এই নাটক সাজিয়েছিল সে! বলেছিল,“ওরা যদি সত্যি গোয়েন্দা হয়ে থাকে তাহলে এই উপহার পাবে, নাহলে পাবে না!”’

আমরা বড় মামার দিকে তাকালাম। বড় মামাকে এখন আর তেমন গম্ভীর মানুষ মনে হচ্ছে না। এখন একটু যেন হাসছেনও তিনি। বললেন, ‘তোমরা যে জায়গাটা খুঁজে বের করেছ, অনেক বছর আগে সেখানে সত্যি সত্যি গুপ্তধন পাওয়া গিয়েছিল! সত্যি সত্যি ওই পাথরের মেঝে চিড়ে গুপ্তধনের সুড়ঙ্গটার খোঁজ পেয়েছিল একজন। কেউ বলে পাঁচ হাঁড়ি মোহর, কেউ বলে দশ হাঁড়ি মোহর ওখানে ছিল! তোমরা গুপ্তসংকেত মেনে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছ ঠিকই, কিন্তু পাঁচ হাঁড়ি-দশ হাঁড়ি মোহর তোমরা পেলে না!’

আমরা ততক্ষণে চকলেট খেতে শুরু করেছি আর এক বাক্স গোয়েন্দা বই নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি কোনটা আগে পড়া যায়—বড় মামা মোহরটোহর নিয়ে কী বলছেন, তা ঠিকমতো কানেও ঢুকল না আমাদের। আমরা আমাদের গুপ্তধন পেয়ে গেছি!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments