Friday, April 26, 2024
Homeকিশোর গল্পচিল মা - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

চিল মা – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

upendrakishore-roy-chowdhury-golpo-mala

এক যে ছিল বড় ঘরেব ছোট বৌ, ‘তার ছিল টুকটুকে একটি খুকী। বৌটি বসে কুটনো কুটছে, খুকীটি হামা দিয়ে ছাতে চলে গেছে। সেইখানে ছিল এক চিল বসে, সে যে খুকীটিকে দেখতে পেয়েই ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে, বৌ সব কিছু, জানে না।

খুকীটিকে নিয়ে চিল একেবাবে ঘন বনেব ভিতরে তাঁর বাসায় চলে গেল। সেইখানে খুকী থাকে, চিলের সঙ্গে খেলা করে, তার পাখায় মুখ লুকিয়ে হাসে, চিল দেশ বিদেশে ঘুরে তার জন্য খাবার নিয়ে আসে, ঝড়বাদলে তাকে ডানা দিয়ে ঢেকে নিয়ে বসে থাকে।

দিন যাচ্ছে খুকীও বড় হচ্ছে, আর দেখতে হয়েছে যেন দেবতাব মেয়ে। চিল তাকে কোথেকে একটা চরকা এনে দিয়েছে, তাই নিয়ে সে দিনবাত খেলা কবে।

এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি, সেই দেশের যে বাজা, তিনি বনে এসেছে শিকার করতে। সঙ্গে কত লোকজন এসেছে তারা ঝোপে ঝোপে উঁকি মেরে হরিণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে তারা সেই চিলের বাসার কাছে এসে বলল—ভালরে ভাল, চিলের বাসায় চরকার শব্দ হচ্ছে কিকরে হচ্ছে? বলে তারা যেই গাছে উঠে দেখতে যাবে, অমনি চিল কোথেকে উড়ে এসে নখ আর ঠোঁট দিয়ে তাদের নাক মুঁখ ছিড়ে দিতে লাগল। তখন তারা ঢিপঢাপ গাছ থেকে পড়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাজার কাছে এসে বলল— রাজামশাই, এমন ত কখন শুনিনি! চিলের বাসায় কে বসে চরকা কাটছে! আমরা দেখতে গিয়েছিলুম, তাতেই দেখুন আমাদের কি দশা হয়েছে!

একথা শুনে রাজা নিজেই সেই গাছের তলায় এলেন। তাঁকে দেখেই চিল সেই গাছ থেকে উড়ে চলে গেল। তিনি গাছে উঠে দেখলেন পরীর মত সুন্দর একটি মেয়ে চিলের বাসায় বসে আছে।

রাজামহাশয়ের শিকার করা হল না। তিনি যারপর নাই আদর করে সেই মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। তারপর পুরুত ডেকে, বাজনা বাজিয়ে, হাসি গান আর আলোর মধ্যে দিয়ে তাঁর সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। সবাই বলল—কি সুন্দর রাণী! কি সুন্দর রাণী।

রাজার আরো ছয়টি রাণী ছিল। নূতন রাণীকে দেখে তাদের ত ভারি হিংসে হয়েছে। তারা তার বাপের নাম জিজ্ঞাসা করে, বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে, বেচারা তার কিছুই বলতে পারে না। তখন তারা রাজাকে বলল—কোথাকার কোন ছোট লোকের মেয়ে বিয়ে করে এনেছ, বাপের নাম বলতে পারে না!

রাজা বললেন—কি করে বলবে? জন্মে অবধি চিলের কাছে ছিল, বাপ-মায়ের মুখ দেখতে পায় নি। ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখ দেখি, কাকে ছোটলোকের মেয়ের মতন দেখায়!

তখন রাণীরা ত হিংসায় যেন মরেই যেতে লাগল। তারা দিনরাত ভাবে, কি করে ছোটরাণীকে জব্দ করবে!

এর মধ্যে একদিন রাজা রাণীদের বললেন, তোমরা নিজের নিজের ঘর বেশ করে সাজাও ত, দেখি কার কেমন পছন্দ।

একথা শুনে বড় রাণীরা ভাবল—বেশ হয়েছে! ও ছোটলেকের মেয়ে, ভাল করে ঘর সাজাতে পারবে না। আর রাজার কাছে বোকা বনে যাবে!

তারা সবাই মিলে যুক্তি করে রাজার কাছ থেকে দামী দামী ঝাড় লণ্ঠন, পর্দা, ঝালর, গালিচা এনে নিজের নিজের ঘর সাজাল।

ছোটরাণী বেচারা কি করবে? সে মনের দুঃখে বাগানে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল—

এক গাছে টান দিতে বেত গাছ নড়ে,
চিল মা, চিলমা, আয় মা উড়ে!

বলতে বলতেই সেই চিল উঠে এসে বলল— কি হয়েছে মা? কেন ডেকেছ?

ছোটরাণী বলল— রাজা বলেছে ঘর সাজাতে, বড়রাণীরা তাদের ঘর কি চমৎকার করে সাজিয়েছে। আমি ত মা কিছু জানি না, কি করে আমাব ঘর সাজাব?

চিল বলল—এই কথা? আচ্ছা মা, তোমার কোন ভাবনা নেই। একটু বস, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে চিল কোথেকে একটা গাছের ডাল নিয়ে এসে বলল—এই ডালের পাতাগুলি ঘরের দেওয়ালে, ছাতে, দরজায়, মেঝেতে আর সব জিনিসপত্রে নিয়ে ঘসে দাও, আর কিছু করতে হবে না।

এই কথা বলে চিল চলে গেল, আর ছোটরাণী তার ঘরে এসে সকল জায়গায় আর জিনিসপত্রে সেই ডালের পাতা ঘসে দিল। দিতেই দেখে যে সেই ঘরের যা কিছু দরজা-জানলা, কড়ি, বরগা অবধি সব সোনার হয়ে গেছে। খাট সোনার, লেপ তোষক বালিস মশারি অবধি সব সোনার!

রাজা ত অন্য রাণীদের ঘর দেখে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, আর ভাবছে-ছোটরাণী হয়ত কিছুই করতে পারেনি।

ছোটরাণীর ঘরে ঢুকে কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না—এমন সুন্দর ঘর কি আর কখনো দেখেছে? বড় রাণীদের তখনি ডেকে এনে রাজা বললেন-দেখ ত কে ছোটলোকের মেয়ে! ছোটলোকের মেয়ের কাজ বুঝি এমনি হয়?

রাণীরা আর কি বলবেন? বলার কিছু থাকলে ত!

তারপর আরেকদিন রাজা বললেন—তোমরা এক একজন এক একদিন আমাদের রেঁধে খাওয়াও ত, দেখি কে কেমন রাঁধতে পারে!

বড় রাণীরা ভাবল—এই বেলা দেখা যাবে। ও আর আর যাই করুক, আমাদের মত রাঁধতে আর ওকে হবে না।

সত্যি-সত্যিই রাণীরা খুব ভাল রাঁধতে পারত। তাদের এক একজনের ঘরে রাজা সকলকে নিয়ে খেতে আসেন, খেয়ে সবাই বলে—আঃ, কি চমৎকার!

ছোটরাণী ভাবল-হায় হায়! এবারে কি হবে? সে কাঁদতে কাঁদতে বাগানে গিয়ে আবার ডাকতে লাগল—

এক গাছে টান দিতে বেত গাছ নড়ে,
চিল মা, চিল মা, আয় মা উড়ে।

বলতে বলতেই চিল এসে বলল—কি হয়েছে মা! কেন ডাকছ?

ছোটরাণী বলল—রাজা বলেছেন কাল তাঁদের সকলকে রেঁধে খাওয়াতে হবে। বড় রাণীরা সকলেই চমৎকার করে রেঁধে খাইয়েছে। আমি ত কিছু জানি না মা, কি করে রাঁধব?

চিল বলল—কোন চিন্তা নাই মা, একটু বস! বলেই সে কোথেকে গিয়ে একটা ছোট হাঁড়ি নিয়ে এসে বলল— এটাকে উনুনে বসিয়ে তুমি যে খাবার চাইবে, তাই এর ভিতর থেকে বার করতে পারবে। আর লাখ লাখ লোককে খাওয়ালেও তাতে কম পড়বে না। বলে চিল উড়ে গেল।

পরদিন ছোটরাণী সেই হাঁড়িটি উনুনে চড়িয়ে তার রান্নাঘরের দুয়ার বন্ধ করে বসে রইল। খাবার সময় হলে, চাকরদের দিয়ে জায়গা করিয়ে, রাজাকে ডেকে পাঠাল। রাজা পাত্রমিত্রদের নিয়ে এসে খেতে বসলেন। ছোটরাণী পোলাও, মাংস, লুচি, সন্দেশ, পায়েস—যখন যা খুশি, সেই হাঁড়ির ভিতর থেকে তাদের পাতে দিতে লাগল। তার যে সুন্দর গন্ধ, আর যে তা খেতে মিষ্টি— সে আর কি বলব? সেদিন তাদের যে খাওয়া হল, তেমন খাওয়া তাদের কেউ আর জন্মেও খান নি।

খেয়ে উঠেই রাজামশাই ছোটরাণীকে পাটরাণী করে দিলেন।

এরপর আর বড় রাণীরা কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারল না। তারা একদিন ছোট রাণীকে নিয়ে নদীতে স্নান করতে গিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিল। বাড়িতে এসে বলল—সে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা গেছে।

ছোটরাণী কিন্তু মরেনি। তার চিল মা এসে তাকে ভাসিয়ে একটা বনের ধারে নিয়ে গিয়ে, সেই বনের ভিতরে তাকে রেখে দিল। সেইখানে সে তাকে খাবার এনে দিত, একটুও কষ্ট হতে দেয়নি।

এমনি করে সেই বনের ভিতরে ছোটরাণী থাকে। তারপর একদিন রাজা সেই বনে শিকার করতে গেলেন। তখন ছোটরাণীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল, আর কোন কথাই তাঁর জানতে বাকি রহিল না। আহ্লাদে তখন তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তখনি তিনি ছোটরাণীকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। আর মন্ত্রীকে হুকুম দিলেন যে দুষ্টু বড়রাণী ছটার মাথা মুড়িয়ে; ঘোল ঢেলে, গলায় ঢোল বেঁধে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments