ফুলমতি – মাসুম আওয়াল

ফুলমতি - মাসুম আওয়াল

‘স্যার গোলাপগুলা কিনবেন? একদম তাজা। বিশ ট্যাকা দিলেই চলবো।’ গাড়ির জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরেই ঘ্যানর ঘ্যানর করছে মেয়েটা। আফজাল সাহেব বিরক্তি নিয়ে কয়েকবার তাকিয়ে দেখেছেন মেয়েটাকে।

মেয়েটার মায়াভরা মুখ। চোখ দুটো টানা টানা। গায়ে ছেঁড়া লাল রঙের জামা। ঠিক লাল বললেও ভুল হবে। নতুন অবস্থায় জামাটার রঙ লাল ছিলো। এত নোংরা হয়েছে যে বিশেষ একটা রঙ হয়ে গেছে। যা, আ স হ বে নী ক লা অর্থাৎ আকাশি, সবুজ, হলুদ, বেগুনি, নীল, কমলা, লাল কোনো রঙের মধ্যেই পড়ে না। বরং এই রঙটার কোনো নতুন নাম দেওয়া যেতে পারে। কী নাম দেওয়া যেতে পারে রঙটার? এই মুহূর্তে কিছুই মাথায় আসছে না।

আসলে আফজালের মন মেজাজ খুব খারাপ। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এদিকে কয়েকদিন হলো তার গাড়ির এসি নষ্ট। বাধ্য হয়েই গাড়ির জানালা খুলে রাখতে হচ্ছে। জানালা খোলা রাখায় পথের ধুলো, শব্দ সব সরাসরি গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করছে। তার মধ্যে আবার শাহবাগ মোড়ে অনেকক্ষণ থেকে জ্যামে আটকে আছে তার গাড়ি। অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে আজ।

গাড়ির এসি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আফজালের মন মেজাজ খারাপ হলেও সুবিধা হয়েছে পথশিশুটির। এসি ভালো থাকলে গাড়ির জানালাও খোলা থাকতো না। আর এত সহজে ফুল নিয়েও ঘ্যানঘ্যান করতে পারতো না ও।

মায়ে আমারে ‘ফুলমতি’ কইয়া ডাকে। তয় অন্য হগলেই ফুলওয়ালি ডাকে। এই নামডাও আমার পছন্দ। ফুল বেচি। ফুলওয়ালি কইয়ায় তো ডাকবো তাই না!

ও আবার হাঁক দিলো, স্যার ফুলগুলা কেনেন না! আফনার বান্ধবীরে দিলে খুশি হইবো…।

আধখোলা জানালার ফাঁক গলিয়ে কথাগুলো তীরের মতো কানে প্রবেশ করলো আফজালের। ও স্যার ফুলগুলা কেনেন না, মাত্র বিশ ট্যাকা! পাঁচটা টাটকা গোলাপ বিশ ট্যাকায় আর কেউ দিবো না। লন না স্যার! দ্যাহেন কি সুন্দর! পাঁপড়ির রঙ দ্যাখলেই মন ভালা হইয়া যায়।

খুব রাগ করে মেয়েটার দিকে তাকাতে গিয়ে মায়া লাগলো আফজালের। গায়ের জামার রঙটা নষ্ট হয়েছে তাতে কী? ওর মুখটার মধ্যেই একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে। ভালো করে চেয়ে দেখলে যে কারও মায়া লাগবে।

আফজাল জানালার কাচটা আরেকটু নিচে নামিয়ে বললো, এই তোর নাম কী?

ফুলওয়ালি।

আর কোনো নাম নাই?

আছে স্যার। মায়ে আমারে ফুলমতি কইয়া ডাকে। তয় অন্য হগলেই ফুলওয়ালি ডাকে। এই নামডাও আমার পছন্দ। ফুল বেচি। ফুলওয়ালি কইয়ায় তো ডাকবো তাই না! ও স্যার ফুলগুলা নেন, জ্যাম ছুইটা যাইবো!

আফজাল ফুল কিনবে কিনা কিছুই বলছে না। ফুলমতিকে একের পর এক প্রশ্ন করছে। কিছুক্ষণ একে একে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো ফুলমতি। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিরক্ত হয়ে যায় সে। বলে ওঠে- ধ্যাত স্যার, আফনের আর কিছু কওনের কাম নাই। ফুল কিনলে কন। ম্যালাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করছি। না নিলে যামুগা।

আফজালের পেছনের সিটে বসে আছে এক নারী। চোখে কালো কাচের সানগ্লাস। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ডানে বামে কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না। আফজাল ফুলমতির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। তার কোনো ভাবান্তর নেই। একবারও ফুলমতির দিকে চেয়েও দেখলো না সানগ্লাস পরা মেয়েটি। ফুলমতিরও সেদিকে খেয়াল নেই। সে আফজালকেই ফুলগুলো কেনার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছে।

হঠাৎ ট্রাফিকের বাঁশি বেজে উঠলো। জ্যাম ছুটে গেছে। সারি সারি গাড়ি সামনে যাওয়ার জন্য হুটোপুটি করছে। প্রায় প্রতিটি গাড়ি থেকেই বিকট হর্নের শব্দ ভেসে আসছে। শাহবাগ মোড়ের পাশেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বারডেম হাসপাতাল। কতশত রুগি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে সেখানে। রাস্তার পাশেই সাইনবোর্ডে লেখা ‘এখানে হর্ন বাজানো নিষেধ’। কারও এসব খেয়াল করার সময় নেই। সবার আগে যাবার তাড়া।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিউলী আর বকুল ফুলের গাছগুলো ওদের বন্ধু। এই গাছগুলো আছে বলে ওদের খাবার জোটে। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে শিশির ভেজা শিউলী, বকুল কুড়ায় ফুলমতি আর ওর বন্ধুরা।

ও স্যার ফুল কিনবেন না। যাই গা। জ্যাম ছুটেছে। আফজালের উদ্দেশ্যে আরও একবার বললো ফুলমতি। এ যেনো শেষবারের মতো প্রচেষ্টা তার। ফুলগুলো বিক্রি হলে মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলতে যাবে সে। ওখানে ওর মতো আরও অনেক শিশু আছে। ওরা ওর খেলার সাথি ও ফুল কুড়ানোর সঙ্গী।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিউলী আর বকুল ফুলের গাছগুলো ওদের বন্ধু। এই গাছগুলো আছে বলে ওদের খাবার জোটে। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে শিশির ভেজা শিউলী, বকুল কুড়ায় ফুলমতি আর ওর বন্ধুরা। তারপর সুঁই-সুতো হাতে নিয়ে বসে পড়ে মালা গাঁথতে। সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই মালা গাঁথা শেষ করে ফুলমতি। তারপর বেরিয়ে পড়ে ফুলমালা নিয়ে। বেশিরভাগ সময় এ ফুলের মালা বিক্রি করেই খাবারের টাকা জোগাড় করে।

কোনো দিন খুব কপাল ভালো হলে বিক্রি করার জন্য জুটে যায় গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা। ফুলমতির রোজ ফুল কুড়াতে ইচ্ছে করে না। ওর যেদিন ফুল কুড়াতে ইচ্ছে করে না সেইদিন ভোরবেলা ঘুম থেমে উঠেই চলে আসে শাহবাগ মোড়ে। সারি সারি বড় বড় ফুলের দোকান এখানে। গ্রাম থেকে ফুলচাষীরা গাড়ি গাড়ি ফুল নিয়ে আসে এখানে। শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা সেই ফুল কিনে নেয়।

গাড়ি থেকে ফুল নামানোর সময় একটা দুটো তাজা গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গে সেসব কুড়িয়ে নেয় ফুলমতি। সব ফুলের দোকানীরাই ফুলমতিকে চেনে, তাই রাস্তায় পড়ে যাওয়া একটা দুটো ফুল কুড়োনোর জন্য কেউ ফুলমতিকে বকা দেয় না। ওকে সবাই পছন্দ করার আরও একটা কারণ আছে। কারণটা হলো অন্যসময় দোকানীদের ফুট ফরমায়েস খেটে দেয় ফুলম‌তি। যেমন কারও দোকানে পানি এনে দেওয়া, দোকানের সামনে ঝাড়ু দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

তার বিনিময়ে ও এসব ফুল কুড়িয়ে পথে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতে পারে। আজ সকালে কপালটা বেশ ভালো ছিলো বলতে হবে। বেশ কয়েকটা গোলাপ কুড়িয়েছিলো ফুলমতি। কয়েকটা বিক্রিও করেছে। বাকি আছে এই পাঁচটা। ফুলগুলো বিক্রি করতে পারলেই ওর ছুটি।

গাড়ির লুকিং গ্লাসে আফজাল দেখে ফুলমতি টাকা হাতে দৌড়াচ্ছে। ও মনে মনে হাসে। দুখী মেয়েটাকে আশি টাকা বেশি দিতে পেরে ভালো লাগছে।

আফজালকে দেখে ওর কেন যেন মনে হয়েছিলো ফুলগুলো কিনবে সে। কিন্তু না, ফুলমতির ফুলগুলো বুঝি এ যাত্রায় বিক্রি হলো না। আফজালের মন গলেনি। আফজাল গাড়ি টান দিলো। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে আবার গাড়ি থামাতে হলো তাকে। পুরো জ্যাম ছাড়েনি। আরও কিছুক্ষণ জ্যামে আটকে থাকতে হলো।

ফুলমতি নাছোড়বান্দা। আবারও গাড়ির জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আফজাল এবার পকেটে হাত দেয়। মানিব্যাগ বের করে। ফুলগুলো কিনবে। খেয়াল করে তার কাছে কোনো খুচরো টাকা নেই। ফুলমতির দিকে একশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় সে। আর ফুলগুলো নিয়ে নেয়।

আবারও ট্রাফিকের বাঁশি বাজে। বেজে ওঠে পেছনে গাড়ির হর্ন। টাকা ফেরত না নিয়েই গাড়ি টান দেয় আফজাল। গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে থাকে ফুলমতি। আশি টাকা ফেরত দিতে হবে।

গাড়ির লুকিং গ্লাসে আফজাল দেখে ফুলমতি টাকা হাতে দৌড়াচ্ছে। ও মনে মনে হাসে। দুখী মেয়েটাকে আশি টাকা বেশি দিতে পেরে ভালো লাগছে। যে কোনো ভালো কাজ করার মধ্যেই একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। আফজাল খেয়াল করে তার মেজাজ খারাপ ভাব কেটে গেছে। ফুলগুলো পেছনের সিটে তার স্ত্রী আফরিনার হাতে তুলে দেয় সে। আফরিনা হাসছে। আফজালের মেজাজ খারাপ ছিলো বলে এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন তিনি। একই অফিসে চাকরি করেন তারা।

গাড়ি দ্রুত গতিতেই এগুচ্ছে, ধানমণ্ডি যেতে আর বেশি সময় লাগবে না। গল্প করতে করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে আফজাল ও আফরিনা। এলিফ্যান্ট রোডে এসে সিগন্যাল পড়লো আবার। এই সময় এক পেপার বিক্রেতা এসে দাঁড়ালো গাড়ির কাছে। স্যার পেপার লন। টাটকা খবর আছে। পেপার পেপার…

আফরিনা পেপার কেনে। সামনে সিটে রেখে দেয় পেপারটা। পেপারের শেষ পাতার নিচের দিকে ছবিসহ একটা খবরে গিয়ে চোখ আটকে যায় আফজালের। খবরের শিরোনাম , ‘জাতীয় শহীদ মিনারের পেছন থেকে পথশিশুর লাশ উদ্ধার’। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে আফজাল। ফুলমতির সঙ্গে চেহারার হুবহু মিল। নিউজটা পড়তে থাকে সে। কয়েকদিন আগে কে বা কারা এক কিশোরীকে নির্যাতন করে তার মরদেহটি ফেলে রেখে গেছে শহীদ মিনারের পেছনে। গতকাল কিশোরীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

আফজাল আরও চিন্তার মধ্যে পড়ে যায়, নিউজের এ মেয়েটিই যদি ফুলমতি হয় তাহলে সে ফুল কিনলো কার কাছ থেকে? আবার ভাবে ফুলমতিকে নিয়ে, ভাবতে ভাবতে মৃত শিশুটির সঙ্গে ফুলমতিকে গুলিয়ে ফেলেছে সে। এই দিনের পর থেকে শাহবাগ মোড়ে আসলেই ফুলমতিকে খোঁজে আফজাল। শাহবাগে ফুল হাতে কোনো কিশোরী ফুল বি‌ক্রেতা‌কে দেখলেই ওর ফুলমতি মনে হয়।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.