Friday, May 3, 2024
Homeথ্রিলার গল্পসায়েন্স ফিকশনফিহা সমীকরণ - হুমায়ূন আহমেদ

ফিহা সমীকরণ – হুমায়ূন আহমেদ

ফিহা সমীকরণ - হুমায়ূন আহমেদ

০১. ঘরের দরজা এবং জানালার রঙ গাঢ় বেগুনি

ঘরের দরজা এবং জানালার রঙ গাঢ় বেগুনি।

বেগুনি রঙ তাকে কখনো আকর্ষণ করে না। তাঁর ধারণা শুধু তাকে না এই রঙ কাউকেই আকর্ষণ করে না। তবু নিয়ম করা হয়েছে সব রেস্টুরেন্টের রঙ হবে বেগুনি। দরজা জানালা বেগুনি, পর্দা বেগুনি, এমন কি মেঝেতে যে কৃত্রিম মার্বেল বসানো থাকবে তার রঙও হবে বেগুনি। রঙের গাঢ়ত্ব থেকে বোঝা যাবে কোথায় কি খাবার পাওয়া যায়। খুব হালকা বেগুনির মানে এখানে পানীয় ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না।

তিনি যে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সে ঘরের রঙ হালকা বেগুনি। তাঁর প্রয়োজন গরম কফির। সিনথেটিক কফি নয়, আসল কফি। সব রেস্টুরেন্টে আসল কফি পাওয়া যায় না। এখানে কি পাওয়া যাবে? আসল কফি খাবার মানুষ নেই বললেই হয়। এত টাকা দিয়ে কে যাবে আসল কফি খেতে? তাছাড়া এমন না যে কৃত্ৰিম কফির স্বাদ আসলের মতো নয়। খুব কম মানুষই প্রভেদ ধরতে পারে। সব রেস্টুরেন্টে আসল কফি রাখে না এই কারণেই।

তিনি রেস্টুরেন্টে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না তা নিয়ে একটু দ্বিধার মধ্যে পড়লেন। বেশি লোকজন হয় এমন জায়গাগুলি তিনি এড়িয়ে চলেন। লোকজন তাঁকে চিনে ফেলে। তারা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে, তিনিও অস্বস্তি বোধ করেন। আজকের এই রেস্টুরেন্টে তিনি যদি ঢুকেন তাহলে কি হবে তা তিনি আন্দাজ করতে পারেন। তিনি ঢাকামাত্র লোকজনের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। শতকরা দশ ভাগ লোক এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে। শতকরা বিশ ভাগ লোক আড়চোখে তাকাবে। বাকিরা এমন এক ভঙ্গি করবে যেন তারা তাকে দেখতে পায়নি। কফির দাম দেবার সময় রেস্টুরেন্টের মালিক বিনয়ে গলে গিয়ে বলবে, আপনি যে এসেছেন এই আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের কফি কেমন লাগল তা যদি একটু লিখে দেন বড় আনন্দিত হই। কফি কুৎসিত হলেও তাঁকে লিখতে হবে-আপনাদের কফি পান করে তৃপ্তি পেয়েছি। পরেরবার যদি এই রেস্টুরেন্টে আসেন তাহলে দেখবেন, তাঁর লেখা এরা ফ্রেম করে বাঁধিয়ে রেখেছে। হাস্যকর সব ব্যাপার। দীর্ঘদিন এইসব হাস্যকর ব্যাপার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে।

রেস্টুরেন্টের মালিক নিজেই চলে এসেছে। বিনয়ে মাথা এমন নিচু করেছে। যে থুতনি লেগে গেছে বুকের সঙ্গে।

খাঁটি কফি স্যার। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের কফি।

ধন্যবাদ।

কফি কেমন লাগল যদি লিখে দেন বড়ই আনন্দিত হব। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনি…

দীর্ঘ বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। কফি কেমন লাগল আমি লিখে দেব।

আপনার একটি ছবি তুলে রাখার অনুমতি কি স্যার পাব?

না। আমি ছবি তুলতে দেই না।

তিনি কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। কারো দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছেন শতকরা দশজন লোক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ চোখের পলকও ফেলছে না। এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মনে হয়। এমন তো না যে সেকেন্ডে সেকেন্ডে তাঁর চেহারা বদলাচ্ছে। তিনি গিরগিটি নন, মানুষ। যে গিরগিটি মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ বদলায় তার দিকেও মানুষ এভাবে তাকায় না। তিনি ওভারকোটের পকেট থেকে পত্রিকা বের করলেন। নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে ফেলার একটা চেষ্টা। তাঁকে খবরের কাগজ সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয় শুধু এই কারণেই।

স্যার, আমি কি আপনার টেবিলে বসতে পারি? তিনি খবরের কাগজ চোখের সামনে থেকে নামালেন। বাইশ তেইশ বছরের একজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একগাদা বই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অথচ তাঁকে চিনতে পারছে না। আশ্চর্য! তিনি অসম্ভব বিরক্ত হলেন। এই এক মজার ব্যাপার! লোকজন তাঁকে চিনতে পারলে তিনি বিরক্ত হন। চিনতে না পারলেও বিরক্ত হন।

স্যার, আমি কি বসব?

হ্যাঁ, বসতে পার।

মেয়েটা পরবর্তীকালে বেশ কিছু কাজ করল আনাড়ির মত। চেয়ারটা। টানল শব্দ করে। ধপ করে বসল। কিশোরীর কৌতূহল নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে লাগল।

স্যার, ওয়েটার এসে কি অর্ডার নিয়ে যাবে? না আমাকে খাবার আনতে যেতে হবে? এটা কি সেলফ সার্ভিস?

তিনি খবরের কাগজ ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন। তাঁর গলার স্বর এমনিতেই রুক্ষ। সেই রুক্ষ স্বর আরো খানিকটা কর্কশ করে বললেন, কোনো রেস্টুরেন্ট সেলফ সার্ভিস কি-না, তারা কি ধরনের খাবার দেবে তা রঙ দেখেই বোঝা যায়। তুমি বুঝতে পারছ না কেন?

আমি কালার ব্লাউন্ড। বেগুনি এবং গোলাপি এই দুটি রঙ আমি দেখতে পাই না।

ও আচ্ছা। এটা সেলফ সার্ভিস রেস্টুরেন্ট। তোমাকে গিয়ে খাবার আনতে হবে।

মেয়েটি উঠে চলে গেল। টেবিলের উপর সে কয়েকটি বই রেখে গেছে। সবচে উপরে রাখা বইটার নাম পড়ে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল—অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ, লেখকের নাম আরফব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী, সে পড়ছে। অতিপ্রাকৃত গল্প, এর কোনো মানে হয়? লজিকশূন্য একটি বিষয়ে মানুষের আগ্রহ হয় কি করে কে জানে। তিনি মনে করেন যারা এ সমস্ত বই লেখে তারা যেমন অসুস্থ আবার যারা পড়ে তারাও অসুস্থ।

মেয়েটি ফিরে আসছে। মুখ শুকননা। খানিকটা ব্ৰিত। সঙ্গে কোনো খাবারের ট্রে নেই। মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, এখানে জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। সামান্য কফির দাম চাচ্ছে একুশ লী।

তোমার কাছে কি একুশ লী নেই?

আছে। কিন্তু সামান্য কফির জন্যে এতগুলি লী খরচ করব কি-না তাই ভাবছি।

তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, এই যে ভাবনাটা তুমি ভাবছ তার মানে তুমি লজিক ব্যবহার করছ। যে মেয়ে লজিক ব্যবহার করে সে কীভাবে অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ পড়ে তা আমি বুঝতে পারছি না।

এই গল্পগুলির মধ্যেও এক ধরনের লজিক আছে। আপনি যেহেতু কোনোদিন এ জাতীয় গল্প পড়েননি আপনি বুঝতে পারছেন না। স্যার, আপনি এই বইটা নিয়ে যান, পড়ে দেখুন।

এ জাতীয় বই আমি আগে পড়িনি তা কি করে বললে?

আপনি হচ্ছেন মহামতি ফিহা। এ জাতীয় বই পড়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।

তুমি আমাকে চেন?

মেয়েটি হেসে ফেলে বলল, আপনাকে কেন চিনব না? আমি কি এই পৃথিবীর মেয়ে না?

কি নাম তোমার?

আমার নাম নুহাশ।

পড়াশোনা কর।

না। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ক্যাটালগার।

পটে প্রচুর কফি আছে। তুমি ইচ্ছা করলে কফি খেতে পার।

ধন্যবাদ স্যার।

নুহাশ সাবধানে কফি ঢালল। কফির পেয়ালায় ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। ফিহার শুরুতে মনে হয়েছিল এই মেয়েটির চেহারা বিশেষত্বহীন। এখন তা মনে। হচ্ছে না। এর চেহারায় এক ধরনের মায়া আছে যা মানুষকে আকর্ষণ করে। ফিহার ভুরু কুঁচকে গেল। তাঁর চিন্তায় ভুল হচ্ছে। মায়া আবার কি? মায়া তৈরি হয় কিছু বিশেষ বিশেষ কারণে। এই মেয়েটির মধ্যে বিশেষ কারণের কি কি আছে? মেয়েটির কফি শেষ করে রুমালে ঠোট মুছতে মুছতে বলল, এত জঘন্য কফি আমি স্যার জীবনে খাইনি।

ফিহা হেসে ফেললেন। মেয়েটা সত্যি কথা বলেছে। মেয়েটির উপর মায়া তৈরি হবার একটি কারণ পাওয়া গেল, তার মধ্যে সারল্য আছে। আরেকটি জিনিস আছে—মেয়েটি লাজুক কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। লাজুক মানুষের আত্মবিশ্বাস কম থাকে।

স্যার আমি যাই? বইটা কি আপনি রাখবেন?

না। আমি আবর্জনা পড়ি না।

পড়তে হবে না স্যার। শুধু বইটা হাতে নিন। আপনি বইটা হাতে নিলে আমার ভালো লাগবে। আরব আমার খুব প্রিয় লেখক।

ফিহা কঠিন গলায় বললেন, বারবার এক ধরনের কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। তোমাকে তো একবার বলেছি এই আবর্জনা আমি হাত দিয়ে ছোব না।

নুহাশের মুখ কাল হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চোখ ভিজে গেল। দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা তাঁর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। এতটা রূঢ় তিনি না হলেও পারতেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের উপর দখল কমে আসছে। এটা ভালো কথা না। এই মেয়েটির একজন প্রিয় লেখক থাকতেই পারে। মেয়েটির প্রিয় লেখক যে তারও প্রিয় হতে হবে এমন তো কথা নেই।

স্যার আমি যাই? আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি।

মেয়েটা ঘর ছেড়ে যাচ্ছে। যে ভাবে ছুটে যাচ্ছে তাতে মনে হয় অবধারিতভাবে দরজার সঙ্গে ধাক্কা খাবে। হলও তাই। মেয়েটা দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেল।

০২. পদার্থবিদ মহামতি ফিহা

পদার্থবিদ মহামতি ফিহা কাগজে বড় বড় করে লিখলেন, কফি পান করে তৃপ্তি পেয়েছি। নিচে নাম সই করলেন। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন কমিউন অফিসের দিকে। কমিউন কৰ্মাধ্যক্ষ মারলা লির সঙ্গে তাঁর আজ দেখা করার কথা। এপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল এগারোটায়। এখন বাজছে সাড়ে এগারো। আধ ঘণ্টা দেরি। তার জন্যে মারলা লি বিরক্ত হবেন না। বরং মধুর ভঙ্গিতে হাসবেন। মারলা লি একজন মেন্টালিস্ট। মেন্টালিস্টরা কখনো বিরক্ত হয় না। আজ পর্যন্ত শুনা যায়নি কোনো মেন্টালিস্ট উঁচু গলায় কথা বলেছে বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের বিরক্ত হবার প্রয়োজন নেই।

ফিহাকে সরাসরি মারলা লির ব্যক্তিগত ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরটা অন্ধকার। জানালার ভারি পর্দা টান টান করে বন্ধ করা। দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। সে আলো যথেষ্ট নয়। ফিহা লক্ষ করেছেন সব মেন্টালিস্টদের ঘরই খানিকটা অন্ধকার। সম্ভবত এরা আলো সহ্য করতে পারে না। কিংবা এদের আলোর তেমন প্রয়োজন নেই।

ফিহা বললেন, আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেললাম।

মারলা লি হাসলেন। মেন্টালিস্টদের মধুর হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বিনয় এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন।

আপনি এসেছেন এতেই আমি ধন্য। আপনার জন্যে খাঁটি কফি তৈরি করা আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের স্বাদহীন কফি নয়, ভালো কফি।

আমি কফির প্রয়োজন বোধ করছি না।

ফির মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মেন্টালিস্টদের সামনে বসলেই এরকম হয়। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। জিভ হয়ে যায় কাগজের মতত। এটা তাঁর একার হয় না সবারই হয়, তা তিনি জানেন না। তিনি প্রচণ্ড রকম ক্ৰোধ এবং ঘৃণা নিয়ে মারলা লির দিকে তাকালেন। মানুষটা শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে অথচ এর মধ্যেই জেনে গেছে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি খেয়ে এসেছেন। মেন্টালিস্টরা তার মাথা থেকে যাবতীয় তথ্য কত সহজে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তিনি তাদের কিছুই জানতে পারছেন না। মারলা লি এই মুহূর্তে কি ভাবছে তা তিনি জানেন না। অথচ সে জানে তিনি কি ভাবছেন। এরা মেন্টালিস্ট। এদের কাছ থেকে কিছুই গোপন করা যায় না। এরা কোনো এক বিচিত্র উপায়ে অন্যের মাথার ভেতর থেকে সমস্ত তথ্য বের করে নিতে পারে। পদ্ধতিটি টেলিপ্যাথিক। তা কি করে কাজ করে ফিহা জানেন না।

মারলা লি বললেন, মহামতি ফিহা, আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?

আমি চিন্তিত কি-না তা প্রশ্ন করে জানার দরকার নেই। আপনি কি আমার মাথার ভেতরটা খোলা বই-এর মতো পড়ে ফেলতে পারছেন না?

মারলা লি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ধারণা সঠিক নয়। মহামতি ফিহা। আমরা সারাক্ষণ অন্যের মাথার ভেতর বসে থাকি না। অন্যের ভুবনে প্রবেশ করা স্বাধীনতা হরণ করার মতো। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি আপনাকে কথা দিতে পারি যে এখানে আসার

পর থেকে আমি আপনার মাথা থেকে কিছু জানার চেষ্টা করিনি।

কিছু জানার চেষ্টা করেন নি?

না।

তাহলে কেন বললেন যে আপনার কাছে ভালো কফি আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাজে কফি না। এটা বলতে হলে আপনাকে জানতে হবে যে কিছুক্ষণ আগেই আমি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাজে কফি খেয়েছি।

মহামতি ফিহা, এটা বলার জন্যে আপনার মস্তিষ্কে ঢােকার প্রয়োজন পড়ে না। রেস্টুরেন্টগুলিতে এখন ভূমধ্যসাগরীয় কফি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। কমিউন কৰ্মাধ্যক্ষ হিসেবে আমি জানি কখন কোথায় কি পাওয়া যায়। আপনার কাছে কি আমার কথা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে?

ফিহা চুপ করে রইলেন, কারণ কথাগুলি তাঁর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। মারলা লি চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, আপনাকে আরেকটা কথা বলি। আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে মেন্টালিস্টরা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনি আমার অফিসে ঢুকলেন প্রচণ্ড রাগ নিয়ে। আমি ইচ্ছা করলেই মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনার রাগ কমিয়ে দিতে পারতাম। তা কি আমি করেছি? করি নি।

ফিহা বললেন, এই প্ৰসঙ্গ থাক। কি জন্যে আমাকে তলব করা হয়েছে বলুন। আমার হাতে সময় বেশি নেই।

আপনাকে তলব করা হয়নি মহামতি ফিহা। এত স্পৰ্ধা আমার নেই। আমি নিজেই যেতাম আপনার কাছে। কিন্তু আপনি জানিয়ে দিয়েছেন আপনার বাড়ির এক হাজার গজের ভেতর যেন কোনো মেন্টালিস্ট না যায়। আমরা আপনার ইচ্ছাকে আদেশ বলে মনে করি। সে কারণেই প্রয়োজন হলেও আপনার কাছে যাই না। অতি বিনীত ভঙ্গিতে আপনাকে আসতে বলি। আশা করি আমাদের এই ধৃষ্টতা আপনি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।

ক্লান্তিকর দীর্ঘ বিনয় বাক্য আমার পছন্দ নয়। যা বলতে চান বলুন।

বলছি। তার আগে একটু কফি দিতে বলি?

বলুন।

কফি চলে এল। মারলা লি নিজের হাতে পট থেকে কফি ঢাললেন। ভালো কফি বলাই বাহুল্য। কফির গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। মারতা লি কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেন্টালিস্টরা সাধারণ মানুষের অকারণ ঘৃণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি সাধারণ মানুষ নন। আপনি হচ্ছেন মহামতি ফি। বলা হয়ে থাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ। আপনিও যদি সাধারণ মানুষের মতো ভাবেন তাহলে কি করে হয়?

এসব থাক, কাজের কথায় আসুন।

কফি শেষ হোক, তারপর আমরা কাজের কথায় আসব। যদিও এখন যেকথা বলছি তা আপনার কাছে অকাজের কথা হলেও, আমার কাছে কাজের কথা। ফিহা, আপনার কোটের পকেটে আজকের একটা খবরের কাগজ দেখা যাচ্ছে। আপনি কি কাগজটা পড়েছেন?

হ্যাঁ।

তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন একটা খবর ছাপা হয়েছে। ক্রুদ্ধ জনতার হাতে কুড়ি বছর বয়েসী একজন তরুণী এবং তার চার বছর বয়েসী কন্যার মৃত্যু। এদের অপরাধ—এরা মেন্টালিস্ট। মহামতি ফিহা, ক্ষিপ্ত মানুষের হাতে অসংখ্য মেন্টালিস্টের মৃত্যু ঘটেছে; কিন্তু আপনি একটি উদাহারণও পাবেন না যেখানে মেন্টালিস্টদের হাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

ফিহা কফির কাপ নামিয়ে রেখে শান্ত গলায় বলল, কফি শেষ হয়েছে। এখন বলুন কি বলবেন।

শুনতে পাই আপনি চতুর্মাত্রিক সময় সমীকরণের সমাধান করেছেন?

কোথায় শুনতে পান? শুনতে পাই বললে ভুল হবে, অনুমান করছি।

অনুমানের ভিত্তি কি?

এই বিষয়টি নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। পড়াশোনা করছেন। আপনার কাজের ধরন আমরা জানি। যখন কিছু শুরু করেন অন্য কোনো দিকে তাকান না। কাজটা যখন শেষ হয় তখন আনন্দিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ান। পাবলিক কফি শপে কফি খেতে যান। এই সময় আপনি রঙচঙে কাপড় পড়তে ভালবাসেন। এইসব লক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে…

মনে হচ্ছে আমি সময় সমীকরণের সমাধান করেছি।

হ্যাঁ। বড় কোনো কাজ শেষ হলে আপনি বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখেন। তাদের নির্দেশ দিয়ে দেন তারাও যেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ না করে। গত একুশ দিন ধরে বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই। এই থেকেই অনুমান করছি সমীকরণটির সমাধান আপনি করেছেন।

যদি করেই থাকি তাতে আপনার আগ্রহের কারণ কি?

আমি বিজ্ঞান তেমন জানি না। যতটুকু জানি তার থেকে বলতে পারি আপনার সমীকরণ পরীক্ষা করার জন্যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। থিওরি এক জিনিস, থিওরির ইনজিনিয়ারিং প্রয়োগ অন্য জিনিস। আমরা প্রয়োগের দিকটি দেখতে চাই। আমরা আপনাকে বলতে চাই যে অর্থ কোনো সমস্যা নয়।

শুনে সুখী হলাম। আপনি শুনে দুঃখিত হবেন যে আমি সময় সমীকরণের সমাধান বের করতে পারি নি।

পারেন নি?

না পারি নি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আমার মাথার ভেতর ঢুকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন? আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। আরেকটু কফি কি দিতে বলব?

না।

ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। মধুর ভঙ্গিতে বললেন, কষ্ট করে এসেছেন সে জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। মহামতি ফিহা, এই সামান্য উপহার কি আপনি গ্রহণ করবেন?

মারলা লি বড় একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।

ফিহা বললেন, কি আছে এখানে?

কফি বিনম্। প্রথম শ্রেণীর কফি। অনেক ঝামেলা করে আপনার জন্যে জোগাড় করেছি। গ্রহণ করলে আনন্দিত হব।

ফিহা প্যাকেটটা হাতে নিলেন। উপহার পেয়ে তিনি যে খুব আনন্দিত হয়েছেন তা মনে হল না। প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে পারলে তিনি সবচে আনন্দিত হতেন। তা সম্ভব নয়। মেন্টালিস্টরা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারবে। তার ফলাফল শুভ হবে না।

আচ্ছা কফির এই প্যাকেটটা লাইব্রেরির মেয়েটাকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? বেচারিকে তিনি কিছুটা হলেও আহত করেছেন। কফির প্যাকেট পেলে খুশি হবে। মেয়েটার কাছ থেকে অতিপ্রাকৃত গল্পের বইটাও চেয়ে নেয়া যায়। একটা গল্প পড়লে কিছু যায় আসে না।

ফিহা লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যোগাযোগ হাঁটতে হাঁটতেই করা গেল। পকেটে রাখা ক্যুনিকেটর তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ফিহাকে পরিচয় দিতে হল না। যে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির কমুনিকেটর তিনি ব্যবহার করেন তা সবারই মোটামুটি পরিচিত।

লাইব্রেরির ডিরেক্টর খানিকটা ভীত গলায় বলল, কি ব্যাপার স্যার?

কোনো ব্যাপার না। আপনাদের একজন ক্যাটালগারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তার নামটা কি বলবেন?

ফিহার ভুরু কুঞ্চিত হল। নামটা তাঁর মনে পড়ছে না। নাম মনে রাখার চেষ্টা করেন নি বলেই মনে নেই। অপ্রয়োজনীয় কিছু মনে রাখার চেষ্টা করে মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করার তিনি কোনো কারণ দেখেন না।

নাম মনে পড়ছে না। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে। অতিপ্রাকৃত গল্প পছন্দ করে। কফি খেতে ভালবাসে।

স্যার, আপনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন তার নাম কি নুহাশ?

হ্যাঁ নুহাশ।

স্যার, আমি তাকে ডেকে দিচ্ছি, একটু ধরুন স্যার। এক মিনিট।

তিনি কম্যুনিকেটরের বোতাম চেপে রাখলেন। এক মিনিট অপেক্ষা করার কথা, এক মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের মাথায় লাইব্রেরির ডিরেক্টরের গলা পাওয়া গেল–

স্যার, একটি ক্ষুদ্র সমস্যা হয়েছে। মেয়েটি বাড়ি চলে গেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছে। ক্যাটালগ সেকশনে গিয়ে জানতে পারলাম কি একটা কারণে খুব মন খারাপ করে আজ সে লাইব্রেরিতে এসেছিল। একটা বই ছিড়ে কুটিকুটি করেছে। বইটা হল অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ। তারপর বাসায় চলে গেছে। স্যার আমি কি বেশি কথা বলছি?

তা বলছেন।

ক্ষমা প্রার্থনা করছি স্যার। মেয়েটা থাকে সাধারণ আবাসিক প্রকল্পের ১১৮নং কক্ষে। তাকে আনার জন্যে লোক পাঠাচ্ছি।

তার কোনো প্রয়োজন নেই।

মেয়েটির কম্যুনিকেটরের সুবিধা নেই, থাকলে এক্ষুণি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতাম। অত্যন্ত দুঃখিত স্যার।

আপনার এত দুঃখিত হবার কিছু নেই।

তাকে কি কিছু বলতে হবে?

কিছুই বলতে হবে না। ধন্যবাদ।

ফিহা কম্যুনিকেটরের সুইচ বন্ধ করে দিলেন। তিনি অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে এগুচ্ছেন। পা ফেলছেন অতি দ্রুত। তবে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন না। বাড়ি ফিরতে কেন জানি ইচ্ছা করছে না। তার মাথায় সিনথেটিক ফারের টুপি, টুপিতে চেহারা ঢাকা পড়েছে। অন্তত তাঁর তাই ধারণা। কফির প্যাকেটটা ফেলে দিতে হবে। কোনো ডাস্টবিন পাচ্ছেন না। এই জিনিস ডাস্টবিন ছাড়া কোথাও ফেলা যাবে না। ফিহা কফির প্যাকেটটা ছুড়ে ফেললেন। তাঁর লক্ষ ভালই। প্যাকেটটা ডাস্টবিনে পড়ল।

ফিহা আকাশের দিকে তাকালেন।

সূর্য দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢাকা পড়েছে। আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে। প্রাচীন মানুষ সূর্যকে পূজা করত। চন্দ্রকে পূজা করত। গ্রহ-নক্ষত্রকেও পূজা দেয়া হত। আকাশকে করত না কেন? পূজা পাওয়ার যোগ্যতা আকাশের চেয়ে বেশি আর কার আছে? ঈশ্বরকে সীমার ভেতর কল্পনা করা অনুচিত। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র সবই সীমায় আবদ্ধ। একমাত্র আকাশই সীমাহীন।

স্যার! ফিহা চমকে তাকালেন।

দীর্ঘদেহী সবুজ পোশাক পরা যুবকটি বলল, আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?

আমাকে একমাত্র আমিই সাহায্য করি। অন্য কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারে না। আপনি কে?

আমি স্যার টহল পুলিশ।

ও আচ্ছা, টহল পুলিশ। আপনার গায়ের সবুজ পোশাক দেখেই আমার অনুমান করা উচিত ছিল।

আপনি কি কোনো ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কি কেউ ঠিকানা খোঁজে?

আপনি আকাশের দিকে তাকিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। আমি অনেকক্ষণ ধরেই আপনাকে অনুসরণ করছি। লক্ষ করছি আপনি রাস্তার নাম্বার পড়তে পড়তে এগুচ্ছেন।

অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে অনুসরণ করছেন কেন?

আমাদের উপর নির্দেশ আছে যে কেউ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটলেই তাকে অনুসরণ করতে হবে। আপনাকেও সেই কারণে অনুসরণ করছি। আপনি যে মহামতি ফিহাতা মাত্র কিছুক্ষণ আগে বুঝতে পেরেছি।

অটোগ্রাফ চাইলে অটোগ্রাফ নিতে পারেন।

স্যার, আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন?

না, বিরক্ত হইনি।

আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, আপনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব।

এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা করছে আকাশের দিকে যেতে, আপনার গাড়িতে চড়ে সেই ইচ্ছা মেটানো সম্ভব নয়। আমরা এখন আছি কোথায়?

আপনি স্যার শহরের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। আর মাত্র দশ গজ। গেলেই নিষিদ্ধ এলাকায় চলে যাবেন।

মেন্টালিস্টদের এলাকা?

জি স্যার।

মেন্টালিস্টদের এলাকা কতটুকু?

আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় স্যার। ঐ এলাকা আমার জন্যেও নিষিদ্ধ।

কতজন মেন্টালিস্ট এ শহরে আছে তা জানেন?

তাও জানি না। তাদের সংখ্যা কখনো প্রকাশ করা হয় না। তবে এ শহরে। সাধারণ মানুষ এই মুহূর্তে আছে নব্দুই হাজার সাতশ এগারো জন।

গত বছরেও জনসংখ্যা ছিল এক লাখ কুড়ি হাজারের মতো। কমে গেল কেন?

আমার জানা নেই স্যার।

আপনার সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হচ্ছে তা মেন্টালিস্টরা বুঝতে পারছে? পারছে স্যার। পুলিশের উপর এদের সরাসরি নিয়ন্ত্ৰণ আছে।

মেন্টালিস্টদের আবাসিক এলাকা কি একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ না সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে?

এরা বাস করে ভূগর্ভস্থ শহরে। সেই শহর কত বড়, কতটুকু ছড়ানো তা আমরা জানি না স্যার। আগে কেউ কেউ বাইরে থাকত, এখন নেই বললেই চলে।

আপনার নাম কি?

এরিন।

এরিন, আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আমরা মানুষ হিসেবে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছি? একদল থাকছে মাটির উপরে, একদল চলে গিয়েছে মাটির নিচে।

এইসব নিয়ে আমি ভাবি না স্যার।

কেউই ভাবে না। কেন ভাবে না বলুন তো?

জানি না স্যার।

ফিহা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাদের ভাবতে দেয়া হয় না। আমাদের ভাবনা, আমাদের কল্পনা নিয়ন্ত্রিত। আমরা কি ভাবব মেন্টালিস্টরা তা ঠিক করে দেয়। যখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের সুখী হওয়া উচিত, আমরা সুখী হই। যখন ভাবে আমাদের অসুখী হওয়া উচিত, আমরা অসুখী হই।

কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কিন্তু স্বাধীনভাবেই চিন্তা করছেন।

হ্যাঁ তা করছি এবং অবাক হচ্ছি। আপনি আপনার গাড়ি নিয়ে আসুন, আমি একটা জায়গায় যাব। সাধারণ আবাসিক প্রকল্প। ১১৮ নম্বর কক্ষ। একটি অল্পবয়স্ক মেয়ের সঙ্গে কথা বলব বলে ভাবছি, মেয়েটির নাম নুহাশ।

এরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে গাড়ি আনতে রওনা হল। ফিহা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশস্ত রাস্তার এক পাশের ফুটপাতে। পনেরো মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয় ট্রাম যাচ্ছে, এ ছাড়া রাস্তায় যানবাহন বা লোক চলাচল নেই। প্রাণহীন একটি শহর। সারাদিন হেঁটেও তিনি কোনো শিশুর দেখা পান নি। শিশুসদনগুলি শহরের বাইরে। বাবা-মার সঙ্গে শিশুদের রাখা হয় না। তারা বড় হয় শিশুসদনে। বছরে একবার অল্পকিছু সময়ের জন্যে বাবা-মারা শিশুদের দেখতে যেতে পারেন।

আচ্ছা, মেন্টালিস্টদের শিশুরা কোথায় বড় হয়। তাদের শিশু সনদগুলি কোথায়? তিনি জানেন না। ফিহা ক্লান্ত বোধ করছেন। শীত লাগছে। আজ কত তারিখ, কি বার তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ছুটি ভোগ করছেন। ছুটির সময় কিছুই মনে রাখতে চান না। ছুটি কাটান শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, অরণ্য কিছুই দেখতে ইচ্ছা করে না।

তাঁর বয়স পঞ্চাশ। অনেকখানি সময়ই তিনি পার করে দিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কেন মনে হল না বাইরে যেতে? মেটালিস্টরা সেই ইচ্ছা জাগতে দেয় নি। তিনি বিয়ে করেন নি। কখনো কোনো তরুণীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন নি। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। কেন করেছেন? মেন্টালিস্টরা কি তাকে প্রভাবিত করেছে? শুধু তিনি একা নন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিটি বিজ্ঞানীই চিরকুমার। তিনি একা হলে ব্যাখ্যা হয়তো অন্য রকম হত। তিনি তো একা নন।

মেন্টালিস্টরা বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করছে। কারণ বিজ্ঞানীদের কাজ তাদের প্রয়োজন। এই কাজ তারা আদায় করে নেবে। বিজ্ঞানীরা তাদের কাছে রোবট ছাড়া কিছুই নয়। একদল পুতুল, যে-পুতুলের সুতা মেন্টালিস্টদের হাতে।

মেন্টালিস্টরা এক সূক্ষ্মভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তা ভেবে ফিহা অতীতে অসংখ্যবার বিস্মিত হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো হবেন। কিন্তু এখন আর বিস্মিত হতে ইচ্ছা করে না।

একবার গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়লেন। বিষয়টির উপর তাঁর তেমন দখল নেই। অথচ সময় সমীকরণে গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস অসম্ভব জরুরি। নতুন করে এই জিনিস শিখতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তায় বাধা পড়বে। এই অবস্থায় হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলেন গেরিয়ান এ্যানালাইসিসের বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক শরমন তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে এখানে আসছেন। তাঁর শরীর অসুস্থ। তিনি এখানে এসে শরীর সারাবেন।

এই ব্যবস্থা কি মেন্টালিস্টরা করে দিল না?

সব কিছুই তারা করে দিচ্ছে। সব কিছু এগুচ্ছে তাদের পরিকল্পনায়। তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়া কি খুব অসম্ভব? যা তাঁর ইচ্ছা করছে না সেই কাজটি করলে কেমন হয়?

তাঁর শহর ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না, শহর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? নারীসঙ্গ তাঁর প্রিয় নয়, তিনি যদি এখন নুহাশ নামের মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলেন তাহলে কেমন হয়? অবশ্যি মেয়েটির তাতে মত থাকতে হবে। মত না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা স্বামী হিসেবে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।

ফিহা আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর হাসি পাচ্ছে। হো হো করে খানিকক্ষণ হাসা যেতে পারে। না কি মেন্টালিস্টরা তাকে হাসতেও দেবে না?

এরিন গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু দেরি হল স্যার। অনেকদূর যেতে হবে তাই নতুন সেল লাগিয়ে নিয়ে এসেছি।

অনেক দূর যেতে হবে কি? জি স্যার। শহরের অন্যপ্রান্তে। চল, রওনা হওয়া যাক।

০৩. নুহাশ দরজা খুলল

নুহাশ দরজা খুলল।

ফিহা বললেন, কেমন আছ নুহাশ?

নুহাশ তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? সে কি ঘুমুচ্ছে? মানুষটিকে সে দেখছে ঘুমের মধ্যে?

আমাকে চিনতে পারছ আশা করি।

নুহাশ জবাব দিচ্ছে না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তোমার জন্যে এক প্যাকেট কফি নিয়ে আসছিলাম। ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি বলে আনা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আনলেও হত। তুমি কি আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে, না দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে?

নুহাশ তাকিয়ে আছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। ফিহা বললেন, আমার অবশ্যি ভেতরে যাবার তেমন প্রয়োজন নেই। তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলা দরকার। বলে চলে যাব। খুব মন দিয়ে শোন। তার আগে জানা দরকার তুমি কি বিবাহিত?

নুহাশ না-সূচক মাথা নাড়ল।

ফিহা বললেন, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই নিলাম। কোনো তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। একমাত্র তোমার সঙ্গেই সামান্য পরিচয়। কাজেই আমি এসেছি তোমার কাছে। যদি আমাকে তোমার পছন্দ হয়, যদি মনে হয় আমাকে বিয়ে করা যেতে পারে তাহলে আমার কাছে চলে আসবে। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। অসময়ে আসার জন্যে লজ্জিত।

নুহাশ কঁপা গলায় বলল, একটু বসে যান।

ফিহা বললেন, না বসব না। তুমি আমার কারণে তোমার একটি প্রিয় গ্রন্থ ছিড়েছ। তা ঠিক হয়নি। যে প্রিয় সে সব সময় প্রিয়। আমি খারাপ বললেই কি প্রিয়জন অপ্রিয় হবে? তুমি অবশ্যই আরেকটি বই কিনে নেবে। মনে থাকবে?

নুহাশ হাসছে। লাজুক ভঙ্গিতে হাসছে। ফিহা তা লক্ষ করলেন না। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। নুহাশ এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখন দেখাচ্ছে রোবটের মতে, চোখের পলক ফেলছে না।

ফিহা রাস্তায় নেমে পুরো ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন। এটা নিয়ে এখন তিনি আর ভাববেন না। মেয়েটা যদি সত্যি আসে তখন দেখা যাবে। শুধু শুধু চিন্তা ভাবনা করার কোনো মানে হয় না। তাঁর অনেক কাজ।

এরিন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিহা বললেন, তুমি আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দাও। তুমি করে বলায় রাগ করনি তো?

এরিন হাসল। সুন্দর দেখাল এরিনকে। হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায়।

এরিন তুমি কেমন আছ?

জ্বি ভালো।

এই চাকরি কি তুমি পছন্দ কর।

করি।

তুমি কি বিবাহিত?

না। পুলিশদের বিয়ে করার নিয়ম নেই।

কাদের তৈরি নিয়ম এরিন?

মেন্টালিস্টদের নিয়ম।

গাড়ি ছুটে চলেছে। ফিহার ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

ফিহার বাড়িটা প্ৰকাণ্ড। অনেকটা দুর্গের মতো। উঁচু পাচিল, পাঁচিলের উপর কাঁটা তার। পাঁচিল থেকে এক হাজার গজ দূরে মূল রাস্তায় সাইনবোর্ড লাগানো।

মেন্টালিস্টদের প্রবেশ কাম্য নয়।

আমি নীরবতা পছন্দ করি।

ফিহা

এ জাতীয় লেখা ফিহার পক্ষেই লেখা সম্ভব। মেন্টালিস্টরা এই পথে যাওয়াআসা করে। সাইবোর্ড দেখে। কেউ কেউ এক মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়। তবে কখনো বলে না, এ জাতীয় সাইনবোর্ডের মানে কি? মেন্টালিস্টদের প্রধান গুণ তারা অভিযোগ করে না, বিরক্তি প্রকাশ করে না এবং কখনোই রাগ করে না। তাছাড়া ফিহার উপর রাগ করার প্রশ্ন উঠে না। উনি এসবের ঊর্ধ্বে। অন্যের রাগ ভালবাসা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।

মানুষটি জন্ম থেকেই নিঃসঙ্গ। বিশাল বাড়িটায় থাকেন একা। মাঝখানে কিছুদিন কুকুর পুষেছিলেন। দুটি শিকারী কুকুর, এদের পছন্দ করতেন। এক গভীর রাতে টাইম ডিপেনডেন্ট ইরেটা ফাংশান নিয়ে ভাবছিলেন। কুকুরের ডাকে চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত মুখে হুকুম দিলেন কুকুর দুটাকে এই মুহূর্তে বিদেয় কর। কুকুর বিদেয় হয়ে গেল। তারপর পাখি পোর শখ হল। চার পাঁচ ধরনের পাখি যোগাড় হল। এক সময় তাদের চিৎকারও অসহ্য বোধ হল। এখন আর পাখি নেই—খাঁচা পড়ে আছে।

এ বাড়িতে বর্তমানে কোনো মানুষ নেই। তিনটি রোবট আছে। তিনটিই কর্মী রোবট। দুজনের বুদ্ধিশুদ্ধি নিচের দিকে। নিজের কাজ ছাড়া অন্য কিছু প্রায় জানে না বললেই হয়। একটি রোবটের দায়িত্ব হচ্ছে ঘর গুছিয়ে রাখা এবং রান্না করা। তার নাম লীম লীম দিনরাত এইটি করে। খুব যে ভালো করে তাও না। রান্নায় লবণের পরিমাণ কখনোই ঠিক হয় না। বাকি দুটি রোবটের একটির কাজ বাড়ি পাহারা দেয়া। সে ক্রমাগত বাড়ির চারদিকে হাঁটে। তৃতীয় রোবটের কোনো কাজকর্ম নেই। এই রোবটটি PR টাইপের। বুদ্ধিবৃত্তি বাকি দুজনের মতো নিচের দিকে নয় বরং বেশ ভালো। ফিহা তাকে কিনেছিলেন নিজের কাজে সাহায্য করার জন্যে। শেষটায় মত বদলেছেন। রোবটের সাহায্য তার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। এখন রোবটটার কাজ হচ্ছে দিনরাত বারান্দায় বসে বই পড়া। ফিহা একে খানিকটা পছন্দ করেন। পাঠক নামে ডাকেন। মাঝে মধ্যে ডেকে কথাবার্তা বলেন। PR টাইপের রোবটের বড় ত্রুটি হচ্ছে এরা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। অপ্রয়োজনে দীর্ঘ বাক্য বলে। কথা বলতে এরা পছন্দ করে। ফিহা বাইরে থেকে এলে চেষ্টা করবে একগাদা কথা বলতে।

আজ ফিহা গেট দিয়ে ঢুকতেই সে এগিয়ে গেল এবং একঘেয়ে গলায় বলল, স্যার আজ আপনি দুঘণ্টা একত্রিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড বাইরে কাটিয়েছেন। ন তারিখ আপনি বাইরে ছিলেন। সেদিন আপনি ছিলেন এক ঘণ্টা চল্লিশ সেকেন্ড। আবার তিন তারিখে…

চুপ কর।

পাঠক চুপ করে গেল। তবে তাও অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ফিহার পেছনে পেছনে আসতে আসতে বলল, স্যার, আপনার কি মনে আছে কাল রাতে আপনি বাগানে এসে বললেন, আজ তো আকাশে অনেক তারা। আপনার কথা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই কোন সময় আকাশে তারা বেশি দেখা যায় তা বের করব। বের করতে গিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং কিছু মজার তথ্য…

ফিহা দ্বিতীয়বার বললেন, চুপ কর।

তিনি জানেন পাঠক চুপ করবে না। তবে অসুবিধা নেই। তিনি এখন তাঁর শোবার ঘরে ঢুকে যাবেন। পাঠক শোবার ঘরে ঢুকবে না। তাকে সে অনুমতি দেয়া হয় নি। সে খাবার ঘরে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করবে ফিহার জন্যে। ফিহার দেখা পেলে কোনো একটা আলাপ শুরুর চেষ্টা করবে। ফিহা ঠিক করলেন তাকে এই সুযোগ দেবেন না। শোবার ঘর থেকে বের হবেন না। তাঁর মন বেশ খারাপ। খেতেও ইচ্ছা করছে না। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেই তাঁর মেজাজ আকাশে চড়ে যায়।

শোবার ঘরের চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে তিনি মত বদলালেন। নিজেকে কষ্ট দেবার কোনো মানে হয় না। খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে। পাঠকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করা যায়। বেচারা গল্প করতে পছন্দ করে। গল্প করার সঙ্গী নেই।

ফিহা খাবার ঘরে ঢুকলেন।

পাঠক সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি কি কথা বলতে পারি স্যার?

না।

ফিহা খেতে বসলেন। আজও লবণ কম হয়েছে। শুধু কম না, বেশ কম। অথচ দুদিন আগে প্রতিটি খাবারে অতিরিক্ত লবণ ছিল। এই রোবটটা মনে হয় বদলানো দরকার। ফিহা বিরক্ত মুখে বললেন, লবণের জন্যে তো কিছু মুখে দিতে পারছি না। তুমি কি লবণের ব্যাপারটা কিছুতেই ঠিক করতে পারবে না?

লীম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার কিছু বলার নেই। পাঠক বলল, লবণ প্রসঙ্গে আমি কি একটা ছোট্ট কথা বলতে পারি স্যার?

না।

আপনার নিষেধ অগ্রাহ্য করেই কথাটা বলার ইচ্ছা হচ্ছে, যদিও জানি তা সম্ভব না। আপনাকে আবারো অনুরোধ করছি লবণ সম্পর্কে আমাকে কথাটা বলতে দিন।

বল।

আমাদের রোবট লীম লবণের পরিমাণে কোনো ভুল করে না। সমস্যাটা আপনার।

সমস্যা আমার মানে?

আপনার যখন মন-টন ভালো থাকে, তখন আপনি লবণ কম খান। আবার যখন মেজাজ খারাপ থাকে লবণ বেশি খান। আমি দীর্ঘ দিন পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। মনে হয় মেজাজ খারাপ থাকলে আপনার শরীর বেশি ইলেকট্রোলাইট চায়। শরীরবিদ্যার কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করা যায়। আমি চারজন বিশেষজ্ঞের ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনি কি কথা বলতে চান?

কথা বলতে চাই না। বাইরে গেলেই আপনার মেজাজ খারাপ হয় এর কারণ কি?

ফিহা জবাব দিলেন না। পাঠক বলল, মেন্টালিস্টদের নিয়ে আপনি কি খুব বেশি চিন্তা করেন?

না। তুমি কথা বলা বন্ধ কর।

এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে যদি আপনার খারাপ লাগে তাহলে অন্য বিষয়ে কথা বলি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্যরহস্য নিয়ে কি স্যার আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করব?

পাঠক!

জ্বি স্যার।

তোমার কথা বলার জন্যে কি এখন সঙ্গী দরকার?

পাঠক প্রথমবারের মতো প্রশ্নের জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। ফিহা বললেন, নুহাশ নামে একজন তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। শতকরা কুড়িভাগ সম্ভাবনা সে এ বাড়িতে আসবে। যদি আসে তুমি কথা বলার সঙ্গী পাবে।

আমি স্যার শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলাতেই আগ্রহ বোধ করি।

কেন?

আমি চিন্তা করছি আপনার একটা জীবনী লিখব। জীবনী লেখার জন্যে আপনার সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রয়োজন। তথ্য তেমন কিছু নেই। তাই সারাক্ষণ কথা বলতে চেষ্টা করি, যদি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কোনো তথ্য পেয়ে যাই।

কিছু পেয়েছ?

জ্বি স্যার।

কি পেলে?

আমি যে অল্প কয়েক পাতা লিখেছি আপনি কি পড়তে চান?

না।

আপনার জীবনী গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি যে না শব্দটা আপনার প্রিয়। যখন তখন আপনি না বলেন। মাঝে মধ্যে কিছু না ভেবেই বলেন। জীবনী গ্রন্থের শুরুটা একটু দেখে দিলে ভালো হয়। অনেক মজার মজার জিনিস সেখানে আছে। যেমন ধরুন, শুরুতেই একটা চমক আছে। পাঠক শুরুর কয়েকটি লাইন পড়েই চমকে উঠবে–

শুরুটা কি?

শুরু হচ্ছে—মহামতি ফিহা বড় হয়েছেন একটি মেন্টালিস্ট পরিবারে। এই পরিবারটি ফিকে অনাথ আশ্রম থেকে তুলে নিয়েছিলেন। পরম আদর এবং মমতায় ফিকে তাঁরা লালন পালন করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর এই বালকটির প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে মেন্টালিস্ট পরিবারের ভূমিকাকে ছোট করে। দেখার কোনো উপায় নেই। বার বছর বয়সে ফিহা ঐ মেন্টালিস্ট পরিবার ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে কোনোদিনও তিনি তাঁর পালক পিতা-মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি।

পাঠক থামল। ফিহা মূর্তির মতো বসে আছেন। পাঠক বলল, আমি কি কোনো ভুল তথ্য দিয়েছি স্যার?

না। সব ঠিকই আছে।

জীবনী গ্রন্থের ভাষাটা আপনার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?

ভাষার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

আমি জীবনী গ্রন্থটি কয়েক ধরনের ভাষা ব্যবহার করে লিখেছি। একই জিনিস খুব কাব্যিকভাবেও লিখেছি। যেমন…

ফিহা উঠে পড়লেন। পাঠকও উঠে দাঁড়াল। ফিহা বললেন, পাঠক, তুমি আমার মেন্টালিস্ট বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। বলবে, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

এটা তো স্যার সম্ভব না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের একটা ইন্টারভ্যু নেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ মেন্টালিস্টরা সবার যোগাযোগের বাইরে।

ফিহা শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। অস্থির ভাব আবার ফিরে এসেছে। শুধু ফিরে এসেছে তাই না। দ্রুত বাড়ছে। তিনি এই অস্থিরতার ধরন জানেন। এ অন্য ধরনের অস্থিরতা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি কি নিজেকে শান্ত করবেন? না, তার প্রয়োজন নেই। অস্থিরতার প্রয়োজন আছে। তিনি সময় সমীকরণের খুব কাছাকাছি আছেন। তিনি জানেন তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছে। সমীকরণের সমাধান অবচেতন মনের কাছে চলে এসেছে। চেতন মন বা তার জাগ্রত সত্তা সেই সমাধান এখনো পায় নি। তবে পেয়ে যাবে। খুব শিগগিরই পেয়ে যাবে। এখন প্রয়োজন নিজেকে শান্ত রাখা। সর্বযুগের সর্বকালের সবচে বড় আবিষ্কারটির মুখখামুখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

সময় সমীকরণের সমাধান।

এর ফলাফল কি হবে? মানবজাতি কি উপকৃত হবে? না ধ্বংস হয়ে যাবে? এই মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। কিছু ব্যাপার আছে যা আগে বলা যায় না, যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। মেন্টালিস্টদের কথাই ধরা যাক।

মেন্টালিস্ট তৈরি করা হয়েছিল যে উদ্দেশ্যে তা সফল হয় নি। মানবজাতি আজ দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতাধর মেন্টালিস্ট। অন্যদিকে মানসিক ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ। মানুষদের নিয়ন্ত্রিত করছে মেন্টালিস্টরা। সাধারণ মানুষ তাদের হাতের পুতুলের মতো। হাসতে বললে হাসতে হবে, কাঁদতে বললে কাঁদতে হবে। তারা বাধ্য করবে। সেই ক্ষমতা তাদের আছে। তারা এগুচ্ছে খুব ঠাণ্ডা মাথায়। পুরো মানবগোষ্ঠীকে মেন্টালিস্ট বানানোই তাদের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা কিছুতেই শুভ হতে পারে না। প্রকৃতি মানবগোষ্ঠী চায় নি। এটা একটা কৃত্রিম ব্যবস্থা।

ফিহা কমুনিকেটর-এ হাত রাখলেন। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। একজন মেন্টালিস্টের সঙ্গে কথা বলা দরকার। যে-কেউ হতে পারে। মারলা লির সঙ্গেই কথা বলা যায়।

মারলা লি বিস্মিত গলায় বললেন, গভীর রাতে আপনি? কি ব্যাপার মহামতি ফিহা?

রাত কি খুব বেশি হয়েছে?

মন্দও হয়নি। এগারোটা বাজে।

আমি কি আপনাকে ঘুম থেকে তুললাম?

বিছানা থেকে তুললেন। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকরাত পর্যন্ত পড়ি। আপনার মতো আমারো রাত জাগা স্বভাব। কি ব্যাপার জানতে পারি?

মেন্টালিস্টদের সম্পর্কে আমি কিছু পড়াশোনা করতে চাই।

ও আচ্ছা।

আপনি কি এই বিষয়ে বইপত্র দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারেন? বইপত্র নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে আছে।

আছে। কিন্তু মহামতি ফিহা, এইসব বইপত্র আমাদের জন্যে। যারা মেন্টালিস্ট নয় তাদের কাছে বইপত্র দেয়া নিষেধ আছে।

নিষেধ আছে বলেই আপনার কাছে চাচ্ছি।

আপনার বিষয় পদার্থবিদ্যা। পড়াশোনা সেই বিষয়ে সীমিত রাখাই কি ভালো নয়?

তার মানে কি আপনি আমাকে বই দিতে পারবেন না?

আপনি চেয়েছেন, অবশ্যই আপনাকে দেয়া হবে।

ফিহা বললেন, ধন্যবাদ। আমি কমুনিকেটর বন্ধ করে দেব। তার আগে একটি জিনিস জানতে চাই। মেন্টালিস্ট সমাজের সবচে দুর্বল দিক কি?

আমাদের কোনো দুর্বল দিক নেই।

ভুল বললেন। আপনাদের সমাজের সবচে দুর্বল দিক হচ্ছে এই সমাজে কোননা সৃষ্টিশীল মানুষ নেই। আপনাদের কোনো বিজ্ঞানী নেই, কবি নেই, গল্পকার নেই, শিল্পী নেই…আমি কি ভুল বললাম?

না ভুল বলেন নি। তবে–

তবে কি?

আজ থাক। অন্য সময় এই নিয়ে কথা বলব। শুভ রাত্রি মহামতি ফিহা। আমি মেন্টালিস্টদের নিয়ে লেখা ছোট্ট একটা বই পাঠাব। বইটা পড়ার পর আপনার আর কিছু পড়তে ইচ্ছা করবে না। বইটা কাল ভোরে পাঠালে কি হয়?

আজ রাতে পাঠাতে পারবেন?

অবশ্যই পারব।

আরেকটি কথা।

বলুন।

আমি যদি বিয়ে করতে চাই তাহলে কি আপনাদের অনুমতি প্রয়োজন আছে?

আপনার জন্য নেই। আপনি কি বিয়ের কথা ভাবছেন?

ফিহা কম্যুনিকেটর বন্ধ করে দিলেন। নিজের উপর রাগ লাগছে। শুধু শুধু এই কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।

মারলা লি বিছানা থেকে নামলেন। কাপড় পাল্টালেন। গাড়ি বের করতে বললেন। রোবট নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নয় নিজে চালাবেন এমন গাড়ি। গভীর রাতে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে, গাড়ি চালানোয় আনন্দ আছে।

আজ রাস্তাঘাট অন্যসব রাতের চেয়েও ফাঁকা। বিজ্ঞান পল্লী ধী ১১-র মানুষজন মনে হয় আতঙ্কগ্ৰস্ত। বিক্ষিপ্তভাবে নানান জায়গায় মেন্টালিস্টদের সঙ্গে

সংঘর্ষ হচ্ছে। মানুষজন রাস্তায় বেরুচ্ছে না।

মারলা লি গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে চলে এলেন। হাইওয়ের পেট্রল পুলিশের গাড়ি জায়গায় জায়গায় থেমে আছে। ট্রেল পুলিশকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

মারলা লির গাড়ির ড্যাসবোর্ডে জরুরি সংবাদজ্ঞাপক লাল বোতাম দুটি ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে। জরুরি কোনো খবর আছে। জরুরি খবর শুনতে ইচ্ছা করছে না। তবু অভ্যাসের বসে বোতাম টিপে দিলেন। আবহাওয়া দপ্তর ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সতর্ক সংকেত প্রচার করছে। ঘূর্ণিঝড়টির বিজ্ঞান পল্লী ধী-১১-র উপর দিয়ে উড়ে যাবার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মারলা লির ভুরু কুঞ্চিত হল।

লোহার ভারি গেট। কোনো কলিং বেল নেই। মারলা লি বেশ কয়েকবার গেটে ধাক্কা দিলেন। সেই শব্দ বাড়ি পর্যন্ত পৌছল কি-না তিনি বুঝতে পারছেন না। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? মারলা লি আবার গেটে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, রোবটের পায়ের শব্দ। মাটি কাঁপিয়ে রোবট আসছে। কি ধরনের রোবট? এত ভারি রোবটলতা আজকাল তৈরি হয় না।

গেট খুলল না। গেটের একটা জানালা খুলে গেল। মুখ বের করল পাঠক। তার ইরিডিয়ামের চোখ অন্ধকারে জুল জুল করছে। সে আনন্দিত স্বরে বলল, বই নিয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ।

আমার কাছে দিন। দিয়ে চলে যান।

তোমার কাছে দেয়া যাবে না। বইটি মূল্যবান, আমাকেই পৌঁছে দিতে হবে ফিহার কাছে।

আপনি বিনা দ্বিধায় আমার হাতে দিতে পারেন। আমি ফিহার একজন ব্যক্তিগত সহকারী। আমার নাম পাঠক। ফিহা আমাকে খুবই পছন্দ করেন।

ফিহা তোমাকে খুব পছন্দ করেন জেনে আনন্দিত হচ্ছি। ফিহা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না, তবু আমাকেই বইটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে।

গেটের জানালা বন্ধ হয়ে গেল। পাঠক ধুপ ধুপ শব্দে ফিরে যাচ্ছে। মারলা লি লক্ষ করলেন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। তাপমাত্রা আরো নেমে গেছে। তিনি গাড়ির ভেতর গিয়ে বসবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। পাঠক নামের এই রোবটটি কতক্ষণে ফিরবে কে জানে। পি আর ধরনের রোবট। এদের কাজকর্ম ঢিলেঢালা ধরনের, তবে এদের লজিক খুব উন্নত। তারচে বড় কথা এর আশেপাশের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করে। যতই দিন যায় ততই এদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।

গেট খুলে গেল। পাঠক বলল, ভেতরে আসুন স্যার। ফিহা লাইব্রেরি ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাকে খুব সাবধানে আসতে হবে। ভেতরে আলো নেই। ইচ্ছা করলে আপনি আমার হাত ধরতে পারেন।

মারলা লি শান্ত স্বরে বললেন, হাত ধরার প্রয়োজন নেই। তুমি আগে আগে যাও।

ফিহা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মনের বিরক্তি গোপন করার কিছুমাত্ৰ চেষ্টা করলেন না। মারতা লি বললেন, এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। আমি নিজেই বইটি নিয়ে এসেছি। যদিও জানি অনধিকার চর্চা হয়েছে। আমি একজন মেন্টালিস্ট আপনার বাড়ির এক হাজার গজের ভেতরে আমার আসার কথা না। তবু এসেছি।

একজন রোবটকে দিয়ে বইটি আপনি পাঠাতে পারতেন।

জ্বিনা, পারতাম না। এই বই অন্যের হাতে দেয়া সম্ভব না।

ফিহা হাত বাড়িয়ে বই নিলেন। মারলা লি বললেন, আপনার জন্যে এক প্যাকেট কফি এনেছি। যে কোনো কারণেই হোক আগের প্যাকেটটি আপনি ফেলে দিয়েছিলেন।

ফিহা কফির প্যাকেট হাতে নিলেন। মারতা লি বললেন, বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। লক্ষ করেছেন কিনা জানি না, বৃষ্টি পড়ছে। গরম এক কাপ কফি খেলে আমার জন্যে ভালো হত।

বসুন। কফি দিতে বলি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

মারলা লি বসলেন। ফিহা বসলেন না দাঁড়িয়ে রইলেন। বসতে ইচ্ছা করলেও অবিশ্য বসার উপায় নেই। একটিই চেয়ার। মারলা লি বললেন, আপনি বসবেন না ফিহা?

বসার প্রয়োজন কি আছে?

মুখোমুখি বসলে কিছুক্ষণ কথা বলতাম। শত্রুপক্ষের সঙ্গেও তো মানুষ। দুএকবার কথা বলে। তাছাড়া বাড়িতে ঢােকার অনুমতৃি যখন দিয়েছেন। কথা বলার অনুমতিও দেবেন।

ফিহা লাইব্রেরি ঘর থেকে বের হয়ে পাঠককে বললেন আরেকটি চেয়ার লাইব্রেরি ঘরে দিতে।

পাঠক বলল, চেয়ার টানাটানি করা আমার জন্যে সম্মান হানিকর। রাঁধুনী রোবটকে এই কাজটা করতে বলি?

বল।

আরেকটা কথা স্যার, মনে হচ্ছে এই মানুষটি আপনাকে খুব বিরক্ত করছে। দ্রতার কারণে আপনি তাকে চলে যেতে বলতে পারছেন না। আমাকে যদি অনুমতি দেন তাহলে কথার পঁাচে ফেলে লোকটাকে বিয়ে করব। আপনার দ্রতাও রক্ষা হবে।

তার প্রয়োজন দেখছি না। তুমি আড়ি পেতে কথা শুনছিলে এ ব্যাপারটিও আমার অপছন্দের। যাও গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।

পাঠক চলে গেল। তার ইরিডিয়াম চোখের উজ্জ্বলতা কিছুটা ম্লান হয়েছে।

মারলা লি বললেন, আপনার বিশাল লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার দেখে বিস্মিত হয়েছি।

ফিহা বললেন, বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি একা মানুষ।

আমিও একা মানুষ ফিহা; কিন্তু তাই বলে আমার বসার ঘরে বা আমার লাইব্রেরিতে একটি মাত্র চেয়ার থাকবে তা কল্পনাও করতে পারি না।

আপনি ফিহা নন বলে কল্পনা করতে পারেন না। আমি পারি, এবং আমার কাছে এটিই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। আমার লাইব্রেরি ঘর কফি খাবার কিংবা আড়া দেবার জায়গা নয়।

এখানে বসে কথা বলতে যদি আপনি অসুবিধা বোধ করেন তাহলে আমরা অন্য কোথাও বসতে পারি।

আপনাকে কি কথা বলতেই হবে?

বলতে পারলে ভালো হত। আপনি না চাইলে বলবেন না।

আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।

বেশ। আমি কফি শেষ করেই বিদেয় হব।

মারল লি নিঃশব্দে কফি শেষ করলেন। মাথার টুপি খুলে টেবিলে রেখেছিলেন। টুপি মাথায় দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, বিদায় নিচ্ছি। শুভরাত্রি মহামতি ফিহা।

শুভরাত্রি।

মারল লি পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালেন না, থমকে দাঁড়ালেন। আগের চেয়েও শান্ত গলায় বললেন, আমি কিন্তু ইচ্ছা করলেই আমার কথা শুনতে আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম। আমি একজন মেন্টালিস্ট। আমি চাইলে, আপনার না বলার ক্ষমতা নেই। আমি আপনাকে বাধ্য করতে পারতাম, তা কিন্তু করিনি। মেন্টালিস্টরা কখনোই কাউকে বাধ্য করে না। তারপরেও সাধারণ মানুষদের ভেতর ভয়াবহ ভুল ধারণা যে মেন্টালিস্টরা তাদের ইচ্ছা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়।

সেনাবাহিনী কি পুরোপুরি আপনারা নিয়ন্ত্রণ করেন না?

অবশ্যই করি। প্রয়োজনেই করি। নিয়ন্ত্রণ না করলে সেনাবাহিনী দুভাগ হয়ে যেত। একটি সাধারণ মানুষদের বাহিনী অন্যটি মেন্টালিস্টদের বাহিনী। তার ফলাফল নিশ্চয়ই আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না।

ফিহা বললেন, পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারে একটি বিশেষ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। আপনারা সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। গবেষণা এগুতে দিচ্ছেন না।

সঠিক তথ্য কিন্তু ভুল ব্যাখ্যা। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ ঝড় আসছে। শক্তিশালী টর্নেডো। ঝড় শেষ হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হবে। আমাদের প্রতি আপনার যত বিদ্বেষই থাকুক আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে আমরা কোনো রকম গবেষণায় বাধা দেই না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের মধ্যে কোনো বিজ্ঞানী নেই। মেন্টালিস্টরা সষ্টিশীল কাজ পারে না। যারা এই কাজটি পারে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সীমা নেই। আপনি নিজের কথা ভেবে দেখুন মহামতি ফিহা। কি পরিমাণ সম্মান আপনি ভোগ করেন?

ফিহা বললেন, এই সম্মান আপনারা আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই করেন। জ্ঞান বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তির জন্যে বিজ্ঞানীদের উপর নির্ভর করা ছাড়া আপনাদের উপায় নেই।

আরেকটি সঠিক তথ্য ভুলভাবে আপনি উপস্থিত করলেন। আপনাদের ছাড়া জ্ঞান বিজ্ঞানে আমরা অগ্রসর হতে পারছি না এটা ঠিক। কিন্তু যতটুকু অগ্রসর হয়েছি আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট। এর বেশি আমাদের প্রয়োজন নেই। মেন্টালিস্টদের প্রয়োজন সামান্য। তারা অল্পতেই সুখী। সমস্ত বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড জয়ের স্বপ্ন তারা দেখে না।

যারা দেখে তাদের বাধা দেয়।

না তাও আমরা দেই না। দীর্ঘদিন বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে আপনি জানেন যে আমরা কোনো গবেষণাতেই কখনো বাধা দেই না। আপনারা যখন টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের কৌশল উদ্ভাবনের গবেষণা করতে চাইলেন আমরা কিন্তু অর্থ বরাদ্দ করলাম। বিপুল অর্থই বরাদ্দ করা হল। সেই গবেষণা কাজে এল না। আবার আমরা যখন বিশেষ কোনো গবেষণা আপনাদের করবার জন্যে অনুরোধ করলাম আপনারা তা করতে রাজি হলেন না। মেন্টালিস্টদের কিছু শারীরিক সমস্যা ত্রিশ বছরের পর থেকে শুরু হয়। পিটুইটারি গ্র্যান্ড থেকে বিশেষ এক ধরনের এনজাইম বের হয়। তার উপর গবেষণা কোনো বিজ্ঞানী করতে রাজি হন নি।

আমি জীববিজ্ঞানী নই কাজেই এই বিষয় জানি না।

মহামতি ফিহা আপনি অনেক বিষয়ই জানেন না। আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চিকিৎসার জন্যে রোবট ডাক্তারদের উপর নির্ভর করি। মানুষ ডাক্তাররা যখন আমাদের চিকিৎসা করতে আসেন তখন প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে আসেন। আমরা মেন্টালিস্ট, আমরা তা বুঝতে পারি।

ফিহা বললেন, আপনাদের মধ্যে ডাক্তার নেই?

না। আমাদের মধ্যে ডাক্তার নেই।

আমার জানা ছিল না।

মারলা লি বললেন, আপনার অনেক সময় নিলাম। আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।

ফিহা বললেন, আপনি কি একটা সত্যি কথা আমাকে বলবেন?

অবশ্যই বলব।

এই যে এতক্ষণ আপনি কথা বললেন, আপনি কি কথা শোনাবার ক্ষেত্র সাবধানে প্রস্তুত করেন নি? আপনি কি আপনার মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করেন। নি?

মারলা লি বললেন, না করিনি। জানি না আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন কি-না। আমি সত্যি কথাই বলেছি। শুভরাত্রি।

রাত্রি খুব শুভ হল না। প্রচণ্ড ঝড় হল। বিজ্ঞান পল্লী লণ্ডভণ্ড করে টর্নেডো বয়ে গেল। যাবতীয় সাবধানতা সত্ত্বেও তেইশজন মানুষ মারা গেল, তারা সবাই পুলিশ। তাদের ডিউটি ছিল রাস্তায়। ঝড়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার অনুমতি তাদের ছিল না।

ফিহা বইটি শেষ করেছেন। বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎ সেলের সঞ্চিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাতি জ্বালাতে হল। বাইরে হাওয়া শোঁ শোঁ শব্দ করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তিনি একমনে পড়ছেন।

চল্লিশ পৃষ্ঠার বই। পুরানো ধরনের ভাষা, জটিল অলংকার ভৰ্তি বাক্য। মাঝে মাঝে অর্থহীন পদের পুনরাবৃত্তি। অনেকটা ধর্মগ্রন্থের আকারে লেখা

তিনি মানুষ নন। মানুষের ছায়া, তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না। তিনি কাহাকে জন্ম দেন না। তাঁহার আগমন আছে; নির্গমন নাই। তিনি আসিয়াছেন ভবিষ্যত হইতে। তিনি ভবিষ্যত জানেন। যে বিদ্যা তিনি ভবিষ্যত হইতে আনেন সেই বিদ্যা ভবিষ্যতে ফিরিয়া যায়। চক্র পূর্ণ হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি শুধু একটি ক্ষুদ্র চক্র সম্পন্ন করেন। ইহার অধিক তাহার কোনো কৰ্ম নাই। নতুন মানব সমাজের খবর তিনি ভবিষ্যত হইতে নিয়া আসেন। বীজ বপন করেন অতীতে। এইভাবেই চক্র সম্পন্ন হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি তাঁহার চক্ষু দিয়া নতুন মানব সমাজের বীজ বপন করেন। এইভাবেই চক্র সম্পন্ন হয়। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড একটি চক্রের অধীন। তিনি শুধু একটি ক্ষুদ্র চক্র সম্পন্ন করেন।

যতই আগানো যায় বই ততই জটিল হতে থাকে।

বইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় আছে–

প্রত্যেকের জন্যে কর্ম নির্দিষ্ট। সবাই তাহার নিজ নিজ কৰ্ম সম্পন্ন করিবে। অতঃপর তাহার প্রয়োজন নাই। অসংখ্য ক্ষুদ্র চক্র একটি বৃহৎ চক্র তৈরি করে। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড চক্রের অধীন। শূন্য ধাবিত হয় অসীমের দিকে। আবার অসীম যায় শূন্যের দিকে। এমতে চক্ৰ সম্পন্ন হয়। এই বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড চক্রের অধীন।…

ফিহা বইটি দ্বিতীয়বার পড়লেন। প্রতিটি বাক্য পড়ার পর খানিকক্ষণ ভাবলেন। যদি তাতে কোনো লাভ হয়।

তিনি মানুষ নন। মানুষের ছায়া।

এর মানে কি? মানুষের ছবি? মানুষের ছবিও তো ছায়া।

তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না। ছবি খাদ্য গ্রহণ করে না।

তিনি কাহাকে জন্মও দেন না। ছবি কাউকে জন্ম দেবে না। তবে একটি ছবি থেকে অনেক ছবি করা যায়…। মেলানো যাচ্ছে না।

পুরো জিনিসটা অঙ্কের একটি মডেলে কি দাঁড় করানো যায়?

ধরা যাক মানুষ হচ্ছে x!

তিনি মানুষের ছায়া।

অর্থাৎ তিনি মানুষের একটি ফাংশান। তিনি যদি y হন

তবে y = f (x)

তিনি কাহাকেও জন্ম দেন না। z যদি হয় জন্ম দেয়া সংক্রান্ত সংখ্যা তাহলে তিনি হবেন z এর ফাংশান তবে z এর মান হবে ঋণাত্মক, কাল্পনিক সংখ্যা।

y = f (x) f(z)

যেখানে, z = cosθ + sinθ

তিনি আসিয়াছেন ভবিষ্যত হইতে। অর্থাৎ y হচ্ছে সময়েরও ফাংশান। এমন ফাংশান যা শুধু একদিকে প্রবাহিত হবে। ভেক্টর রাশি।

y = f (x) f(z) f (t)

যে বিদ্যা তিনি ভবিষ্যত হইতে আনেন সেই বিদ্যা ভবিষ্যতে ফিরিয়া যায়। চক্র পূর্ণ হয়।

চক্র পূর্ণ হতে হলে y কে যেখানে থেকে শুরু সেখানেই ফিরে যেতে হবে। গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রাল নিয়ে আসা যায়। গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রালকে অর্থপূর্ণ করতে হলে Yকে ফাইনাইট ফাংশান হিসেবে দেখতে হবে।

ফিহা ডাকলেন, পাঠক।

পাঠক ছুটে এল।

সেন্ট্রাল কম্পিউটার চালু করার ব্যবস্থা কর।

চালু করা যাবে না স্যার।

কেন?

প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

ও আচ্ছা।

ছোটখাটো হিসেবের ব্যাপার হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি স্যার।

গ্রেগরিয়ান ইন্টিগ্রাল জানা আছে?

আছে স্যার। তবে…

তবে কি?

ভেরিয়েবল-এর সংখ্যা সাতের নিচে হতে হবে। এর উপর হলে আমি পারব না। আমার ক্ষমতা অল্প।

সাতের নিচে রাখার চেষ্টা করা হবে।

আরেকটি ক্ষুদ্র প্রশ্ন স্যার।

বল।

সমীকরণটি সময় মুক্ত?

না, সময় মুক্ত নয়।

তাহলে স্যার হেসবিয়ান নরমালাইজড ফাংশান আমাকে বের করতে হবে। সময় লাগবে।

ধীরে ধীরেই কর। তার আগে এই বইটি পড়। খুব ভালো করে পড়। বইটি মেন্টালিস্টদের উপর লেখা একটি গ্রন্থ। সম্ভবত ওদের ধর্মগ্রন্থ।

পাঠক বই হাতে নিল। ফিহা পেন্সিলে অঙ্ক সাজাতে শুরু করলেন। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল। অঙ্কের মডেল দাঁড় করানোর আলাদা আনন্দ আছে। তিনি পাঠকের দিকে তাকালেন। সে অতি দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। রোবটের গ্রন্থপাঠ দেখা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। এরা এত দ্রুত পাতা উল্টায় যে মনে হয় পাতা গুনছে, কিছু পড়ছে না।

পড়লাম স্যার।

কেমন লাগল?

কোন্ অর্থে কেমন লাগল জানতে চাচ্ছেন?

বিষয়বস্তু।

বিষয়বস্তুতে নতুনত্ব আছে। তারা চক্রকে ঈশ্বর বলছে।

চক্রকে ঈশ্বর কোথায় বলল?

রূপকের মাধ্যমে বলেছে স্যার। বিজ্ঞানের রূপক বৰ্জিত ভাষা এবং ধর্মগ্রন্থের রূপক ভাষা দুরকম।

তোমার ধারণা তুমি বিষয়বস্তু বুঝতে পেরেছ?

এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে। ধারণা কতটুক সত্যি তা বলা মুশকিল। রূপকের ভাষা পাঠ করে একেকজন একেক রকম ধারণা করবে। এমনও হতে পারে যে সবারটাই সত্যি আবার কারোরটাই সত্যি না। আপনি আপনার সমীকরণ বলুন স্যার। আমি সাজাতে শুরু করি।

সমীকরণ বলছি। তার আগে তোমার ধারণা কি শুনি।

এই গ্রন্থে মেন্টালিস্টদের জন্মের ইতিহাস বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি মেন্টালিস্ট তৈরি করলেন। সেই তিনি মানুষ নন। যেহেতু সেই তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন না সেহেতু সেই তিনি খুব সম্ভব একজন যন্ত্র। এটা আমার অনুমান। বলা হচ্ছে তিনি এসেছেন ভবিষ্যৎ থেকে। মনে হচ্ছে টাইম ট্রাবেল-এর কথা বলা হচ্ছে। একটি যন্ত্র অর্থাৎ একটি রোবট ভবিষ্যত থেকে অতীতে গেল। তৈরি করল মেন্টালিস্ট। যন্ত্রটির আগমন আছে, নির্গমন নেই। অর্থাৎ যন্ত্রটি অতীতে গিয়েছে কিন্তু ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারেনি। বলা হয়েছে—তিনি তাঁর চক্ষু হইতে নতুন মানবগোষ্ঠী তৈরি করিলেন। এই অংশটি মজার। রোবটের চোখের আলোর সংবেদনশীল অংশ তৈরি করা হয় যৌগিক অণু ইরিকার্বো ফসফিন দিয়ে। ইরিকার্বো ফসকিন হচ্ছে একটি ইরিডিয়াম, দুটি কার্বন, একটি ফসফরাস এবং দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর যৌগ;

HIrPHC2

এই অদ্ভুত যৌগ মাত্র পাঁচশ বছর আগে তৈরি হয়েছে। খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যৌগের র‍্যাডিকেল মেন্টালিস্টদের জীনে উপস্থিত।

তুমি কি করে জানলে?

মেন্টালিস্টদের প্রতি আমিও এক ধরনের আগ্রহ অনুভব করি। এই আগ্রহ থেকেই ওদের বিষয়ে পড়াশোনা করেছি।

ওদের বিষয়ে কি করে পড়াশোনা করবে? ওদের সম্পর্কে কোনো গ্ৰন্থ তো তোমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।

বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলিতে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মেন্টালিস্টদের জীনের গঠন সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। মেটালিস্টরা তাদের সম্পর্কে সব তথ্যই নিষিদ্ধ করেছে; কিন্তু তাদের জীন নিয়ে গবেষণা নিষিদ্ধ করে নি।

তুমি সেই সব লেখা পড়েছ?

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।

আর কি পড়েছ?

এ্যাংগেল হার্স্ট-এর সেই বিশেষ বক্তৃতাটা এবং বক্তৃতা প্রদানের ঘটনা পড়েছি। এটি পড়েছি ইতিহাস বই-এ।

এ্যাংগেল হার্স্ট কে?

তাকেই মেন্টালিস্টদের জনক বলা হয়। পুরো ঘটনাটা কি স্যার আপনাকে বলব?

বল। তবে অল্প কথায়।

নিউ ম্যাক্সিকো শহরে তিন হাজার পাঁচ খ্রিস্টাব্দে এমব্রায়োলজিস্টদের একটি বিশেষ অধিবেশন হয়। সেই অধিবেশনে বিশিষ্ট এমব্রায়োলজিস্ট প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট একটি বিচিত্র নিবন্ধ পাঠ করে সবার হাসি-তামাশার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। নিবন্ধের শিরোনাম—নতুন মানব সম্প্রদায়।

তিনি নিবন্ধে বলেন, মানুষের জীনে ভারি ধাতুর একটি যৌগ ইরিকার্বো ফসফিন ঢুকিয়ে দিতে পারলে মাধ্যমিক মস্তিষ্কের গঠনে সূক্ষ্ম কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটবে। থ্যালামাস ও হাইপোথ্যালামাসের সুপ্ত কর্মক্ষমতা জাগ্রত হবে। থ্যালামাসের বিশেষ নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মানুষের যাবতীয় অনুভূতির কেন্দ্র। যে কটি অনুভূতি নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে তার সঙ্গে নতুন একটি অনুভূতি যুক্ত হবে। এই মানব সম্প্রদায় হবে প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতার অধিকারী। এরা টেলিপ্যাথিক ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে কোনো রকম মাধ্যম ছাড়াই ভাবের আদান-প্রদান করতে পারবে। অন্য মানুষদের তারা সকৰ্মে, সৎ চিন্তায় প্রভাবিত করতে পারবে…

অধিবেশনে প্রবন্ধ পাঠের মাঝখানে সাধারণত বাধা দেয়া হয় না। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্টকে বাধা দেয়া হল। অধিবেশনের সভাপতি ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে থামালেন এবং বললেন, প্রফেসর এ্যাংগেল হা, আপনি কি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করছেন?

প্রফেসর বললেন, অবশ্যই বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করছি।

আপনি যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে পরীক্ষাগুলি ইতিমধ্যে করা হয়েছে। মানুষের জীনে ভারি ধাতুর যৌগ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। টেলিপ্যাথিক মানব সম্প্রদায় তৈরি হয়ে গেছে।

হয়নি কিন্তু হবে। আপনি আমাকে প্ৰবন্ধ শেষ করতে দিন তারপর আমি আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেব।

ঠিক আছে, প্রবন্ধ শেষ করুন।

প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট বিজ্ঞানীদের হাসাহাসির ভেতর প্রবন্ধ পাঠ শেষ করলেন। তাঁর প্রবন্ধের বড় অংশ জুড়ে নতুন মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হল। পৃথিবীতে এরা যে শুভ প্রভাব ফেলবে তার কথা বলা হল।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন উদ্ভট এবং অবৈজ্ঞানিক নিবন্ধ পাঠ করা হয় নি। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল।

প্রশ্ন : প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট, মনে হচ্ছে আপনি নিশ্চিত যে জীনে একটি ভারি অণু ঢুকিয়ে দিলেই আমরা সুপারম্যান পেয়ে যাব।

উত্তর : আমি সুপারম্যান বলছি না। আমি বলছি বিস্ময়কর মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ।

প্রশ্ন : আপনার ধারণা, আপনার মানসিক ক্ষমতা তেমন বিস্ময়কর নয়?

[সভাকক্ষে তুমুল হাস্যরোল শুরু হয়। সভাপতি ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে থামালেন।]

উত্তর: আপনি আমাকে হাস্যস্পদ করার চেষ্টা করছেন। তার প্রয়োজন দেখি না।

প্রশ্ন : জীনে কোন্ ভারি ধাতু ঢকাবার কথা ভাবছেন–প্লাটিনাম?

উত্তর : না ইরিডিয়াম।

প্রশ্ন : ইরিডিয়াম পরমাণু কীভাবে জীনে সংযুক্ত করবেন?

উত্তর: এটি করতে হবে ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ার সময়ে। পদ্ধতি জটিল নয়।

প্রশ্ন : জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং-এর পুরো পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল বলে আমরা সবাই জানি এবং আপনিও জানেন।

উত্তর : আমি যে পদ্ধতির কথা বলছি তা মোটেই জটিল নয়।

প্রশ্ন : আপনি নিজেই এই অসাধারণ পদ্ধতি বের করেছেন।

উত্তর : [নীরবতা]

প্রশ্ন : আপনি কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছেন না?

উত্তর : আমি নিজে এই পদ্ধতি বের করিনি। আমি একজনের কাছ থেকে পেয়েছি।

প্রশ্ন : দেবদূতের কাছ থেকে পেয়েছেন? সভাকক্ষে আবারো হাসি।

উত্তর: দেবদূতের কাছ থেকে পাইনি, যন্ত্রের কাছ থেকে পেয়েছি।

প্রশ্ন : যন্ত্র আপনাকে বলে গেছে কি করে সুপারম্যান তৈরি করা যায়?

উত্তর : অনেকটা তাই।

প্রশ্ন: আপনার ধারণা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদের সুপারম্যান তৈরি করা উচিত?

উত্তর : অবশ্যই উচিত।

প্রশ্ন : যন্ত্রটি পেয়েছেন কোথায়?

উত্তর: সে এসেছে।

প্রশ্ন : কোত্থেকে এসেছে?

উত্তর ও উত্তর দিতে চাচ্ছি না। উত্তর শুনলে আপনারা আম ভাবতে পারেন।

প্রশ্ন : আপনি কি ইদানিংকালে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে আপনার মাথা পরীক্ষা করিয়েছেন?

সভাকক্ষে তুমুল হৈ চৈ, হাসাহাসি হতে থাকল। সভাপতি বললেন, প্রশ্নোত্তর পর্বের এখানেই সমাপ্তি। এই নিবন্ধ এখানে পাঠ করার কথা ছিল না। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট অন্য একটি নিবন্ধ জমা দিয়েছিলেন। সেইটি না পড়ে তিনি এই বিচিত্র নিবন্ধ পড়লেন। এটি নিয়ে আর হৈ চৈ করার কোনো মানে নেই। আমি প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্টকে আসন গ্রহণ করবার জন্যে অনুরোধ করছি।

প্রফেসর এ্যাংগেল বললেন, আসন গ্রহণ করার আগে আমি আপনাদের একটি তথ্য দিতে চাই। ইতিমধ্যে আপনারা আমাকে হাস্যকর ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেনে গেছেন। আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেও প্রশ্ন উঠেছে। আমি জানি, যে নিবন্ধ আমি পাঠ করেছি তা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ নয়। পৃথিবীর সেরা এমব্রায়োলজিস্টদের এই সম্মেলনে আমি ঘোষণা করছি যে, নিবন্ধে উল্লেখিত প্রক্রিয়ার প্রয়োগ আমি করেছি। আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন এবং টেস্ট টিউবে ডিম্বাণু নিষিক্তকরণের মাধ্যমে আমি এ পর্যন্ত একুশটি মানব শিশুর জীনে ইরিডিয়ামের একটি করে পরমাণু সংযুক্ত করেছি। এরা এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি। ভূমিষ্ঠ হলেই জানবেন এরা সম্পূর্ণ নতুন এক মানবগোষ্ঠী। এরা মেন্টালিস্ট। এরা বড় হবে। নিজেদের মধ্যে বিয়ে করবে। এদের সন্তান-সন্ততিরাও হবে মেন্টালিস্ট।

আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।

সময় তা বিচার করবে।

আপনি যে পরীক্ষার কথা বলেছেন তা যদি করে থাকেন তাহলে আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এমব্রায়োলজিস্টের এথিক ভঙ্গ করেছেন।

প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট যেমন বলেছিলেন তেমনি হল। একুশটি শিশুর জন্ম হল। ভয়ংকর রুগণ সব শিশু। মাত্র সাতজন কোনোক্রমে বাঁচল, তাও ইনকিউবেটরে।

এ্যাংগেল হার্স্টকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। এ্যাংগেল হার্স্ট বললেন, মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন দিন, শুধু দণ্ডাদেশ চার বছরের জন্যে পিছিয়ে দিন। আমি দেখতে চাই সত্যি সত্যি মানসিক শক্তিসম্পন্ন শিশু তৈরি হয়েছে কি-না।

তাঁকে সেই সুযোগ দেয়া হল না। সুযোগ দিলে তিনি বিস্ময় এবং আনন্দ নিয়ে দেখতেন সাতজন মেন্টালিস্টকে। আজকের বিশাল মেটালিস্ট সমাজের যারা আদি পিতা ও মাতা।

ফিহা বললেন, তুমি বলতে চাচ্ছ প্রফেসর এ্যাংগেল হান্ট-এর এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছিল?

ইতিহাস তাই বলে স্যার।

যে যন্ত্রের কাছ থেকে তিনি এই বিদ্যা পেয়েছিলেন সেই যন্ত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা হয় নি?

ইতিহাস বই-এ আর কোনো তথ্য নেই স্যার।

খুব ভালো কথা। এখন অঙ্কের মডেলটা নিয়ে কাজ শুরু করা যাক।

ফিহা অতি দ্রুত সংখ্যা বলে যেতে লাগলেন। এখন শুধু ডাটা এনট্রি।

স্যার।

ফিহার চিন্তায় বাধা পড়ল। ডাটা এন্ট্রিতে শেষ সংখ্যা কি বলেছিলেন ভুলে গেলেন। তিনি ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন। লীম দাঁড়িয়ে আছে। নিচু বুদ্ধিবৃত্তির রোবটগুলির চেহারাও কি বোকার মতো করে বানানো হয়? কী অদ্ভুত বোকা বোকা লাগছে এই গাধা ধরনের রোবটটাকে।

কি চাও?

আমি কিছু চাই না স্যার।

কেন এসেছ এখানে?

একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? গেটে।

কি চায়?

জানি না কি চায়।

ফিহার শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। গাধা ধরনের এই রোবটগুলি কেন তৈরি করা হয়?

নাম কি?

আমার নাম লীম।

মেয়েটার নাম জানতে চাচ্ছি।

মেয়েটার নাম মেয়েটা জানে। আমি জানি না।

ফিহা প্ৰচণ্ড ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। হঠাৎ মনে হল নুহাশ নয়ত? সে কি আসবে? তার আসার সম্ভাবনা ছিল মাত্র দশভাগ; কিন্তু.ফি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পেছনে পেছনে লীম আসছে। এর হাঁটাচলাও বেকুবের মতো। অকারণে দরজায় ধাক্কা খেল।

ফিহা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কেন পেছনে পেছনে আসছ?

জানি না স্যার।

তোমাকে আসতে হবে না।

গেটের বাইরে নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে দুটো ব্যাগ। একটা বেশ বড়, একটা ছোট। প্যাকেট করা এক গাদা বই। একটা ফোল্ডিং ইজিচেয়ার, একটা টেবিল ল্যাম্প। নুহাশ লাজুক গলায় বলল, আপনি আসতে বলেছিলেন, আমি এসেছি।

ঠিক কোন কথাটা বললে ভালো হবে ফিহা বুঝতে পারছেন না। সব কেমন জট পাকিয়ে গেছে। মেয়েটিকে ঐদিন তেমন আকর্ষণীয় মনে হয় নি। আজ অসম্ভব রূপবতী বলে মনে হচ্ছে। কোনো সাজসজ্জা করেছে বলেতো মনে হয় না। তাহলে সুন্দর লাগার কারণ কি? সৌন্দর্য ব্যাপারটা কি? একটা জিনিসকে কেন সুন্দর লাগে, কেন অসুন্দর লাগে?

আমি কি চলে এসে আপনাকে খুব ব্ৰিতকর অবস্থায় ফেলেছি।

না।

আমি আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।

ভালো করেছ।

আমি কি বাড়ির ভেতর আসব?

অবশ্যই আসবে। অবশ্যই।

সুন্দর কিছু বলা উচিত। বলতে ইচ্ছাও করছে। কিন্তু সুন্দর কোনো কথা মনে আসছে না। তাঁর কি উচিত না মেয়েটির রূপের প্রশংসা করে কিছু বলা? কি বলা যায়?

নুহাশ বলল, আপনি গেট ছেড়ে সরে না দাঁড়ালে তো আমি ভেতরে আসতে পারছি না।

ফিহা সরে দাঁড়ালেন। তাঁর ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে, কিন্তু লজ্জা লাগছে। অসম্ভব লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগার কারণ কি?

নুহাশ বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব বিব্রত হচ্ছেন।

না না না। বিব্রত হচ্ছি না। মোটেই বিব্রত হচ্ছি না। অঙ্কের একটা মডেল তৈরি করছিলাম, মাঝখানে তুমি এলে মানে সব এলোমেলো হয়ে গেল। একটা কাজ করা যাক। তুমি ঘরে যাও। লীম তোমাকে সব দেখিয়ে দেবে। কোন ঘরে থাকবে। এইসব আর কি।

লীম কে?

লীম হচ্ছে কর্মী রোবট। বোকা ধরনের তবে ঘরের কাজে খুব পটু। তুমি সব দেখে শুনে নাও। আমি এই ফাকে আমার কাজটা শেষ করি। অবশ্যি বিয়ের লাইসেন্সের জন্যে দরখাস্ত করতে হবে। এটা যদিও তেমন জরুরি নয়। কফি?

কফি খাবে?

আমাকে নিয়ে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ব্যস্ত হচ্ছি না তো। মোটেই ব্যস্ত হচ্ছি না। নুহাশ।

জ্বি।

মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। কি বললে তারা খুশি হয় তাও জানি না। পদে পদে আমার ভুল হবে, তুমি কিছু মনে কর না। কি করলে তুমি খুশি হবে তা যদি তুমি বল তাহলে আমি তা করব। অবশ্যই করব।

নুহাশ হাসিমুখে বলল, আপনি যদি হাত ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান তাহলে আমি খুশি হব।

ফিহা নুহাশের হাত ধরে বাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। পাঠক এবং লীম দুজনই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাঠক এমন ভাব করছে যেন সে কিছু দেখছে না। কিন্তু গাধা লীম চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে এবং খুব মাথা দুলাচ্ছে যেন সে সব বুঝে ফেলেছে। এই গাধাটিকে বাড়িতে রাখাই ভুল হয়েছে। বিরাট বোকামি হয়েছে।

ফিহা লাইব্রেরি ঘরে ফিরে গেলেন। অঙ্কের মডেলটা শেষ করতে হবে। নতুন পরিস্থিতির কারণে সব কাজ কর্ম বন্ধ রাখার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া এটা খুব জরুরি, খুবই জরুরি।

০৪. লীম গভীর আগ্রহে

লীম গভীর আগ্রহে নুহাশকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। নুহাশ যা দেখছে তাতেই বিস্মিত হচ্ছে। একজন মানুষের জন্যে এত প্রকাণ্ড বাড়ি? বাড়ির পেছনে ফুলের বাগান দেখে নুহাশ হকচকিয়ে গেল। এত সুন্দর!

নুহাশ বলল, ফুলের বাগান বাড়ির পেছনে কেন?

লীম দুঃখিত গলায় বলল, স্যার পছন্দ করেন না, এই জন্যেই ফুলের বাগান বাড়ির পেছনে।

উনি ফুল পছন্দ করেন না?

না।

আর কি কি উনি পছন্দ করেন না?

গান পছন্দ করেন না।

কি বল তুমি?

লীম দুঃখিত গলায় বলল, আমি খুব ভালো গাইতে পারি। কিন্তু এই বাড়িতে গান গাওয়ার উপায় নেই। স্যার বিরক্ত হন।

কখনো গেয়ে দেখেছিলে?

একবার রান্নাঘরে বসে গুন-গুন করছিলাম। স্যার বললেন, গলায় কি হয়েছে। এরকম করছ কেন?

দেখি আমাকে একটা গান শুনাও তো।

কোন ধরনের গান শুনতে চান?

তোমার যা ইচ্ছা তুমি গাও। সব ধরনের গানই আমার ভালো লাগে।

একটি প্রেমের গান গাইব?

গাও।

ফিহা চোখ বন্ধ করে একের পর এক সংখ্যা বলেছেন, পাঠক তা মেমোরি সেলে সাজিয়ে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়া আবার ব্যাহত হল। লীমের গানের শব্দে আবার সব এলোমেলো হয়ে গেল।

ফিহা বললেন, এসব কি হচ্ছে?

পাঠক বলল, গান হচ্ছে স্যার।

ফিহা বললেন, কে গান করছে?

লীম। পিআর ধরনের রোবটদের ভয়েস সিনথেসাইজার খুব উন্নত মানের। তারা চমৎকার গাইতে পারে।

ফিহার অসম্ভব বিরক্ত হওয়া উচিত, কারণ কাজটা আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু তিনি বিরক্ত হচ্ছেন না। তাঁর ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে। তিনি কান পেতে গানের কথাগুলি শোনার চেষ্টা করছেন।

দিনের প্রথম আলোয় তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম তুমি এলে না। মধ্যাহ্নের তীব্র আলোয় তোমাকে কেমন দেখায় জানা হল না, কারণ তুমি মধ্যাহ্নে এলে না। সূর্যের শেষ রশ্মি কি তোমার রঙ বদলে দেয়? আমি জানি না, কারণ তুমি এলে রাতের অন্ধকারে। প্রিয়তম, আমি শুধু তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারে কি করে দেখব?

ফিহা মুগ্ধ গলায় বললেন, গাধাটাতে ভালো গাইছে। বেশ ভালো গাইছে।

পাঠক বলল, ডাটা এন্ট্রির কাজটা আজ বন্ধ থাকলে কি ক্ষতি হবে?

থাকুক বন্ধ থাকুক।

আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে আমি কি অভিনন্দন জানাতে পরি?

হ্যাঁ পার।

পাঠক নিচু গলায় বলল, মানুষের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। তারপরেও মনে হয় আপনার আনন্দ আমি খানিকটা বুঝতে পারছি।

ধন্যবাদ পাঠক।

সময় সমীকরণের অনেকগুলি ধাপ আপনি অতিক্রম করে এসেছেন। সীমাহীন আপনার প্রতিভা। শেষ ধাপটি অতিক্রম করতে আপনার স্ত্রী আপনাকে সাহায্য করবে। এই শুভ কামনা।

সে কি করে সাহায্য করবে? এই জটিল জগতে তার স্থান কোথায়?

সে তার মতো করে আপনাকে সাহায্য করবে। গণিত এবং পদার্থবিদ্যার সাহায্যের প্রয়োজন আপনার নেই, স্যার।

হ্যাঁ তাও বোধ হয় ঠিক। একটি ক্ষুদ্র জায়গায় আমি আটকে গেছি। আমি জট খুলতে পারছি না।

আপনি জটটা বুঝতে পারছেন। সারাক্ষণ তাকিয়ে আছেন জটটির দিকে। এই জট আপনাআপনি খুলবে।

না খুললে সমূহ বিপদ পাঠক। জট খুলতে না পারলে মেটালিস্টরা আমাদের গ্রাস করে নেবে। সামনের পৃথিবী হবে মানবশূন্য পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে থাকবে শুধু মেন্টালিস্ট আর কেউ না। মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে পাঠক। অতি দ্রুত কমে আসছে।

পাঠক বলল, যে ক্ষমতাধর সেই টিকে থাকবে। এ সত্য স্বীকার করে নেয়াই কি ভালো না স্যার?

তুমি মেন্টালিস্টদের ক্ষমতাধর বলছ?

হ্যাঁ বলছি। ওরা যে টিকে যাচ্ছে এটিই কি সবচে বড় প্রমাণ নয় যে ওরা ক্ষমতাধর।

সময় সমীকরণের আমি সমাধান বের করব। আমি নিজে যাব অতীতের পৃথিবীতে। প্রফেসর এ্যাংগেল হার্স্ট যে বিশেষ পরীক্ষাটি করে প্রথম মেন্টালিস্ট শিশু তৈরি করেছিলেন সেই পরীক্ষা আমি করতে দেব না।

তা যদি করতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে মানুষই ক্ষমতাধর। মেন্টালিস্টরা নয়।

অবশ্যই মানুষ ক্ষমতাধর। আমি তা প্রমাণ করব পাঠক। আমি তা প্রমাণ করব। শোন পাঠক, আমার সমস্যা কোন জায়গাটায় হচ্ছে আমি তোমাকে বলিখুব সাদামাটাভাবে বলা যায় সময়ের শুরু হচ্ছে বিগ বেংগে। তারপর সময় এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে…

আমাকে বলে কোনো লাভ হবে না। আমি তো স্যার এ ব্যাপারে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না–

আমি জানি, আমি জানি, তবু তুমি শোন—একজন কাউকে শুনাতে ইচ্ছা করছে—সময়কে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রের সঙ্গে তুলনা কর। খুব সহজ অর্থে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র কি বলছে? বলছে সময় যতই এগুচ্ছে। গরম জিনিস ততই শীতল হচ্ছে। ধর এক কাপ কফি টেবিলে রাখা হল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গরম কফি আরো গরম হবে না। ঠাণ্ডা হতে থাকবে।

এই তথ্য স্যার আমি জানি।

হ্যাঁ জান। অবশ্যই জান। কিন্তু এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার আছে। এটি একটি পরিসংখ্যানগত সূত্র। পরিসংখ্যান কাজ করে অসংখ্য অণুপরমাণু নিয়ে। সমষ্টিগতভাবে এই সব অণুপরমাণু গরম থেকে শীতল অবশ্যই হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান আরো বলে এর মধ্যে কিছু অণুপরমাণু গরম থেকে আরো গরম হয়ে যেতে পারে। তাতে থার্মোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র ব্যাহত হবে না। বুঝতে পারছ?

পারছি।

তাহলে বুঝতেই পারছ—এই সব অণু পরমাণু সময়ের উল্টো দিকে যাচ্ছে। আমার কাজ হচ্ছে তাদের নিয়ে। আমি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করেছি যে সময়ের উল্টোদিকে যাওয়া সম্ভব।

হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব। দেখ পাঠক বহু পুরাতন একটা সূত্র দেখা যাক।

Tau = √(1–v2 / c2)

ধরা যাক y হচ্ছে একটি বস্তুর গতি। c আলোর গতি।

অতীতে যেতে হলে তাঁর মান হতে হবে আলোর গতির চেয়ে বেশি। যখন তা হবে তখন বস্তুর ওজন, বস্তুর দৈর্ঘ্যপ্রস্থ সব হয়ে যাবে কাল্পনিক সংখ্যা। সবার আগে চলে আসবে √-12 আসবে না?

আসবে।

এই সমস্যার সমাধান আমার কাছে খুব জটিল কখনো মনে হয় নি। গণিত শাস্ত্রে আমরা কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে শুরু করি এবং এক সময় সেটাকে সত্যিকার সংখ্যায় রূপান্তরিত করি। আমি অগ্রসর হচ্ছি কোন দিকে জান?

আমার জানার কথা নয় স্যার।

হা তোমার জানার কথা নয়। অবশ্যই তোমার জানার কথা নয়— দুধরনের বস্তুর কণার কথা চিন্তা করা যাক। আলোর চেয়ে কম গতিসম্পন্ন বস্তুকণা যেমন ধর, ইলেকট্রন, প্রোটন, যাদের বলা হয় টারডিওস, আবার অন্য কণা চিন্তা কর যাদের গতি আলোর চেয়ে বেশি। এরা হচ্ছে টেকিওনস…

এরা কাল্পনিক কণা। এদের অস্তিত্ব নেই।

যার অস্তিত্ব নেই তাকে অস্তিত্ব দিতে হলে কি করতে হবে? তুমি স্পেস নিয়ে চিন্তা কর। স্পেসকে কি করলে এই কণাগুলি তৈরি হবে…

স্যার আপনি কি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছেন?

হ্যাঁ আমি গ্রেগরিয়ান এ্যানালিসিসের কথা বলছি। আমি কতটা কাছাকাছি চলে এসেছি তুমি কি তা বুঝতে পারছ?

বুঝতে পারছি না। তবে আপনার আনন্দ দেখে খানিকটা অনুমান করতে পারছি।

আমি খুব কাছাকাছি আছি। খুব কাছাকাছি। একটি মাত্র জট সেই জট খুলে যাচ্ছে।

স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। পেছনের বাগানে চেয়ার পেতে দি। আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করুন।

সে এখন আমার স্ত্রী নয় পাঠক। আমাকে মারলা লির কাছে যেতে হবে। লাইসেন্স নিয়ে আসতে হবে।

কখন যাবেন?

এখন যাব।

আমি কি স্যার আপনার সঙ্গে আসব?

তুমি আসতে চাচ্ছ কেন?

আপনাকে খুব অস্থির লাগছে। সে জন্যেই আসতে চাচ্ছি।

না আমি অস্থির না। আমি ঠিক আছি। আমি মারলা লির সঙ্গে দেখা করব। তার কাছ থেকে আমি আরো কিছু গ্রন্থও আনতে চাই। তুমি আমার টুপি এনে দাও।

আপনি কি আপনার স্ত্রীকে কিছু বলে যাবেন না?

না। ওর সামনে পড়তে কেন জানি লজ্জাও লাগছে। আচ্ছা পাঠক, মেয়েরা কি উপহার পেলে সবচে খুশি হয় বলত? আমি ফেরার পথে ওর জন্যে কিছু উপহার আনতে চাই। | পাঠক মৃদু স্বরে বলল, ভালবাসার চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে, স্যার!

ভালো বলেছ পাঠক। ভালো বলেছ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে ভালবাসা। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জান—এই উপহার আমি একমাত্র আমার পালক পিতামাতার কাছ থেকেই পেয়েছি। যারা দুজনই মেন্টালিস্ট।

স্যার, আপনি আমাদের ভালবাসাও পেয়েছেন। তবে আমরা যন্ত্র। আমাদের ভালবাসা মূল্যহীন।

পাঠক, ভালবাসা মূল্যহীন নয়। আজ সম্ভব না, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই ভালবাসাকে অঙ্কে নিয়ে আসা যাবে। অঙ্কের মডেল তৈরি করা হবে। হয়তো আমিই তা করব…

আমি কি আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেব স্যার?

দাও এগিয়ে দাও। গাধা লীম দেখি এখনো গান গাইছে। ব্যাটার গলা এত। সুন্দর তাতো জানতাম না। তাকে বার বার গাধা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।

০৫. মারলা লি বললেন

মারলা লি বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। বিয়ের লাইসেন্স এমন জরুরি কিছু নয়।

ফিহা বললেন, আরেকটা জরুরি বিষয় আমার আলোচ্যসূচিতে আছে। আপনার কি সময় হবে?

আমার সময়ের একটু টানাটানি যাচ্ছে। কিন্তু আপনার জন্যে সময় বের করা হবে।

মেন্টালিস্টদের উপর লেখা আরো কিছু বই পড়তে চাচ্ছি।

কেন? যে বইটি দিয়েছেন সেটি অস্পষ্ট।

সব বইই অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের বই এগুলি নয়।

মেন্টালিস্টদের জীবনযাপন পদ্ধতি, এদের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যদি কোনো বই থাকে।

শুনুন মহামতি ফিহা, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তার থেকে মনে হতে পারে আমরা মানুষ নই। আমরা জন্তু বিশেষ।

শুধু শুধুই আপনি রাগ করছেন।

আমি মোটেই রাগ করছি না। আপনাকে মেন্টালিস্ট সম্পর্কে আর কোনো বই দেয়া যাবে না। আপনি সমাজবিজ্ঞানী নন। আপনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবেন কেন? সবার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আপনি আপনার কাজ করবেন।

ফিহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, সবার সব কাজ তো আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। আমি জানতে চাচ্ছি আপনাদের কাজটা কি। আপনারা কি করেন? মাটির নিচে শহর বানিয়ে বাস করেন জানি। কিন্তু বেঁচে থাকা ছাড়া আর কি করেন?

আমরা ভাবি।

কি ভাবেন?

পৃথিবীর মঙ্গল নিয়ে ভাবি। মানুষকে পরিচালনা করার সর্বোত্তম পন্থা নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যত পৃথিবী কি করে সাজানো হবে তা নিয়ে ভাবি।

ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের স্থান কোথায়?

আমার জানা নেই। শুনুন মহামতি ফিহা, আজ আপনি বিয়ে করেছেন। একটি তরুণী মেয়ে ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে—আজ কেন বাজে তর্ক করে সময় নষ্ট করছেন। তার কাছে যান। যাবার পথে ফুল কিনে নিয়ে যান। ফুলের দোকান এত রাতে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি খোলাবার ব্যবস্থা। করছি।

কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

আপনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েটির প্রয়োজন আছে। আপনারা মেন্টালিস্ট নন। আপনাদের একেকজনের চিন্তা-ভাবনা একে রকম। ফুল একজনের কাছে অর্থহীন, অন্যজনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি বললেন, আমি দুঃখিত যে আপনি খানিকটা হলেও মন খারাপ করে যাচ্ছেন। আপনার মন ভালো করার জন্য কিছু কি করতে পারি?

আমি আমার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তা-কি সম্ভব হবে?

না। তা সম্ভব হবে না। তাঁরা যদি ভূগর্ভস্থ শহরে না থাকতেন তাহলে সম্ভব হত। ভূগর্ভস্থ শহর শুধু মেন্টালিস্টদের জন্যে।

সাধারণ মানুষ সেখানে গেলে শহর কি অশুচি হয়ে যাবে?

শুচি-অশুচির প্রশ্ন নয়। এটা হচ্ছে আইন।

আইনের পেছনে যুক্তি থাকে। এই আইনের পেছনের যুক্তিটি কি?

আমরা মানুষ হিসেবে আপনাদের থেকে অনেকখানিই আলাদা। সহাবস্থান আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই এই ব্যবস্থা। আপনারা আমাদের সম্পর্কে যত কম জানবেন ততই মঙ্গল।

আপনারা আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই জানবেন, আর আমরা কিছু জানব না?

আপনাদের সম্পর্কে জানা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে আপনাদের জানা প্রয়োজন নয়। আলোচনা যথেষ্ট হয়েছে ফিহা। এখন বাড়ি যান। ফুলের দোকান কি খোলাবার ব্যবস্থা করব?

ফিহা জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় তেমন আলো নেই। ঝড়ে বিদ্যুত ব্যবস্থায় যে সমস্যা হয়েছিল সে সমস্যা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায় নি। ফিহা হাঁটছেন অন্ধকারে। তীব্র হতাশাবোধ তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ফিরে এসেছে পুরোনো অস্থিরতা।

স্যার।

তিনি চমকে তাকালেন। অন্ধকারে রাস্তার পাশে বিশালদেহী একজন। যুবক।

আপনি কে?

স্যার আমি টহল পুলিশ। আপনি কোথায় যেতে চান বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।

তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যদি আপনার পেছনে পেছনে আসি আপনার কি অসুবিধা হবে?

হ্যাঁ হবে। আমি একা হাঁটতেই পছন্দ করি। ভালো কথা, এরিন নামের একজন টহল পুলিশের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাকে কি একটা খবর দিতে পারবেন? তাকে কি বলবেন যে আমি বিয়ে করেছি?

এরিনকে খবর দেয়া যাবে না স্যার।

কেন?

ঝড়ের রাতে সে মারা গেছে। রাস্তায় ডিউটি ছিল। রাস্তা ছেড়ে কোথাও আশ্রয় নেবার অনুমতি ছিল না। কাজেই সে ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।

প্রাণ বাঁচানোর জন্যেও সে কোথাও যেতে পারে নি?

না। আমরা মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত।

ও আচ্ছা।

ফিহা এগিয়ে চললেন। টহল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে দেখছে তাঁকে।

ফিহা রাতের খাবার শেষ করলেন নিঃশব্দে।

নুহাশ তার মুখোমুখি বসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। অন্যদিন খাবার টেবিলের আশেপাশে লীম এবং পাঠক দুজনই থাকে। আজ তারা নেই।

নুহাশ বলল, আপনার খাবারে লবণের সমস্যা হয় বলে শুনেছি। লবণ কি ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

আপনাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে।

চিন্তিত না। আমার মন খারাপ হয়ে আছে। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে দেখা হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

ওদের সঙ্গে দেখা না করলেই পারেন।

দেখা না করেও কি ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় আছে? এই মুহূর্তে আমরা দুজন যে কথা বলছি তা কি মেন্টালিস্টরা শুনছে না?

নুহাশ ক্ষীণ স্বরে বলল, খুব সম্ভব শুনছে।

আমার প্রায়ই ইচ্ছা করে আমরা সাধারণ মানুষরা পৃথিবীর কোনো এক নির্জন প্রান্তে চলে যাই। আমাদের নিজেদের একটি দেশ হোক। স্বাধীন দেশ।

নুহাশ কঠিন গলায় বলল, এ জাতীয় কথা আর কখনো বলবেন না। যারা এ জাতীয় কথা বলেছে বা ভেবেছে তাদের ভয়াবহ শাস্তির কথা কি আপনি জানেন না?

ফিহা চুপ করে গেলেন। হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তির কথা তিনি জানেন। শাস্তি একটিই—জেল নয়, মৃত্যুদণ্ড নয়—মানসিকতা হরণ। অপরাধীর মাথা থেকে সমস্ত স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। অপরাধী তখন পৃথিবীতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতই হয়ে যায়। সে কিছুই জানবে না। সব তাকে নতুন করে শিখতে হয়। সে হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহজ শাস্তি।

খাওয়া শেষ না করেই ফিহা উঠে পড়লেন। তাঁর আর খেতে ইচ্ছা করছে। না। নুহাশ বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করছে?

না। তুমি ঘুমুতে যাও। আমি কাজ করব।

কি কাজ করবেন?

অঙ্কের একটা মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছি। ওটা শেষ করব।

আজ না করলে হয় না?

না, হয় না নুহাশ, এই জিনিসটা আমার মাথায় ঘুরছে, এটা শেষ না করে অন্য কোনো কিছুতেই আমি মন দিতে পারব না।

আপনি যখন কাজ করবেন তখন আমি কি আপনার পাশে বসে থাকতে পারি?

না, পার না। তুমি রাগ করো না নুহাশ।

আমি রাগ করি নি। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে—

ফিহা বিস্মিত হয়ে বললেন, কি কথা?

রাতে আপনি যখন ঘুমুতে আসবেন তখন আমি আপনাকে একটা গল্প পড়ে শোনাব। অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ থেকে একটা গল্প। আপনাকে সেই গল্প শুনতে হবে।

আমি কখন ঘুমুতে আসি তার তো ঠিক নেই…

নুহাশ লজ্জিত গলায় বলল, যত রাতই হোক। আমি জেগে থাকব আপনার জন্যে।

ডাটা এন্ট্রির মাঝপথে আবারো বাধা পড়ল। কমুনিকেটরে যোগাযোগ করলেন মারলা লি।

মহামতি ফিহা।

কথা বলছি।

গভীর রাতে আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত।

কি বলবেন বলুন।

আপনি আপনার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আপনি বলেছিলেন ব্যবস্থা করা যাবে না।

এখন করা হয়েছে। এঁরা দুজনই গুরুতর অসুস্থ। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মৃত্যুপথযাত্রী মেন্টালিস্টদের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়। এঁরা দুজন আপনাকে দেখতে চাচ্ছেন। আপনি কি আসবেন?

আমি এক্ষুণি আসছি।

আপনার গেটের কাছে গাড়ি থাকবে।

ফিহা পাঠকের দিকে তাকালেন। পাঠক বলল, আমার মনে হয় আজ রাতে কাজটা করতে পারব না।

আমারো তাই মনে হচ্ছে। নুহাশের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে হবে। সে আমাকে কি এক গল্প না-কি পড়ে শোনাবে।

আপনি কখন ফিরবেন?

বুঝতে পারছি না কতক্ষণ লাগবে। তাড়াতাড়িই ফিরতে চেষ্টা করব। এখন কটা বাজে?

রাত তিনটা। ভোর হবার বেশি বাকি নেই।

ফিহা বাড়ি থেকে বের হলেন। নুহাশকে কিছু বলে গেলেন না।

চল্লিশ বছর পর ফি তার পালক পিতামাতাকে দেখলেন। ঘরে এই দুজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। প্রশস্ত একটি বাটে দুজন বসে আছেন। দুজনকেই চূড়ান্ত রকমে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে এঁরা মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মানুষ না কঙ্কাল, জ্বলজ্বলে চোখ ছাড়া এদের যেন কিছুই নেই। ঘর প্রায় অন্ধকার। অস্পষ্টভাবে সব কিছু চোখে আসে।

ফিহা বললেন, আপনারা কেমন আছেন?

দুজনই এক সঙ্গে ফিহার দিকে তাকালেন। বৃদ্ধ হাতের ইশারায় ফিহাকে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বললেন, আপনার কি কথা বলার মতত শক্তি আছে?

দুজনই একত্রে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

ফিহা বললেন, আমার শৈশব আপনারা আপনাদের ভালবাসায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাদের ছেড়ে চলে এলেও আমি সেই ভালবাসার কথা ভুলি নি। আমার সবচে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটির নামকরণ করা হয়েছে আপনার নামে। মিরান ফাংশান।

বৃদ্ধ মিরান আবার মাথা নাড়লেন, আবার হাত ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বসলেন না।

দাড়িয়ে রইলেন। দুজনকে দেখে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। এতটা কষ্ট তাঁর হবে তা কখনো কল্পনা করেননি। তাঁর চোখ ভিজে উঠল। তিনি কোমল গলায় বললেন, যতদিন পদার্থবিদ্যা বেঁচে থাকবে আপনার নাম বেঁচে থাকবে। আমি আপনাদের ছেড়ে এসেছি কিন্তু আপনাদের ভালবাসার অমর্যাদা করি নি। আমি মেন্টালিস্টদের ঘৃণা করি। তারা আমাদের রোবট বানিয়ে রেখেছে। আপনারাও মেন্টালিস্ট। আমি আপনাদেরও ঘৃণা করি কিন্তু…

কিন্তু কি?

আপনাদের দুজনের প্রতি আমার ভালবাসারও সীমা নেই।

জানি।

কি করে জানেন?

আমরা মেটালিস্ট। আমরা দূর থেকে তোমার মন পড়তে পারি। চল্লিশ বছর ধরেই পড়ছি। চল্লিশ বছর ধরে তোমার মঙ্গল কামনা করছি।

আপনাদের ধন্যবাদ।

নুহাশ মেয়েটি ভালো। তুমি সুখী হবে।

আপনাদের আবারো ধন্যবাদ।

আমরা তোমার স্ত্রীর জন্যে ফুল আনিয়ে রেখেছি। ফুলগুলি নিয়ে যেও।

অবশ্যই নিয়ে যাবে।

ফিহা লক্ষ করলেন খাটের এক পাশে প্রচুর গোলাপ। টকটকে রক্তবর্ণের গোলাপ। ফিহার চোখ আবারো ভিজে উঠছে।

তুমি ছোটবেলায় যে সব খেলনা নিয়ে খেলতে তার কোনোটাই আমরা নষ্ট করিনি। তুমি কি সেগুলি দেখতে চাও?

না।

বৃদ্ধা এবার কথা বললেন। অতি ক্ষীণ স্বরে বললেন, খুব ছোটবেলায় তুমি পিঠে ব্যথা পেয়েছিলে। ছেলেবেলায় ক্ষত চিহ্ন ছিল। এখনো কি আছে?

আছে।

তুমি ছোটবেলায় বার বার ছুটে ছুটে আসতে, আমাকে বলতে, মা আমার ব্যথায় চুমু দিয়ে দাও। তোমার কি মনে আছে?

আছে।

তুমি যদি খুব লজ্জা না পাও তাহলে আমি সেখানে আরেকবার চুমু দিতে চাই।

ফিহা গায়ের কাপড় খুললেন। তাঁর কোনো রকম লজ্জা লাগল না। বরং মনে হল এই তো স্বাভাবিক। বৃদ্ধা গভীর আবেগে চুমু খেলেন। বৃদ্ধার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। ফিহা বললেন, যাই।

আর একটু বস। আমার পাশে বস।

ফিহা বসলেন। বৃদ্ধ বললেন, আমার হাত ধরে বস। পক্ষাঘাত হয়েছে। আমি হাত নাড়াতে পারি না। পারলে আমি তোমার হাত ধরতাম। ফিহা বৃদ্ধের হাত ধরলেন।

বৃদ্ধ বললেন, তুমি সময় সমীকরণের সমাধান করতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

তুমি চাচ্ছ অতীতে ফিরে যেতে। যাতে আদি মেন্টালিস্ট তৈরির এক্সপেরিমেন্ট কেউ করতে না পারে।

আপনারা মেটালিস্ট। আমি কি ভাবছি তার সবই আপনারা জানেন।

হ্যাঁ জানি। কিন্তু তুমি জান না তোমার চিন্তায় বড় ধরনের ভুল আছে। তুমি যেই মুহূর্তে সমাধান বের করবে সেই মুহূর্তে মেন্টালিস্টরা তা জেনে যাবে। অতীতে তুমি যেতে পারবে না ফিহা, তোমাকে যেতে দেয়া হবে না। তোমার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে একটি রোবট পাঠানো হবে। তাকে মেন্টালিস্ট তৈরির বিদ্যা শিখিয়ে দেয়া হবে। এই ভাবেই চক্র সম্পন্ন হবে।

আপনি নিশ্চিত?

হ্যাঁ।

চক্ৰ ভাঙা যাবে না?

তুমি যদি সময় সমীকরণ বের না কর তাহলেই চক্র ভেঙে যাবে। অতীতে কেউ যেতে পারবে না। মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। চক্র সম্পূর্ণ করার জন্যেই তোমাকে দরকার। ধর্মগ্রন্থে তা আছে।

ধর্মগ্রন্থে কি আছে?

ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে—জ্ঞানী শত্রুদের প্রতি মমতা রাখিও কারণ জ্ঞানী শত্ৰুরা জগতের মহৎ কৰ্ম সম্পাদন করে। তোমাদের মহা শত্ৰুর কারণেই তোমরা চক্র সম্পন্ন করবে। সে মিরানের পালক পুত্র। সে জ্ঞানী।

ধর্মগ্রন্থে আমার উল্লেখ আছে বলেই কি মেন্টালিস্টরা আমাকে আলাদা করে দেখে?

হ্যাঁ। তোমার জ্ঞান তাদের প্রয়োজন। তোমার জ্ঞান ছাড়া চক্র সম্পূর্ণ হবে না।

ফিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃদ্ধা বললেন, আমরা দুজন সর্বশক্তি দিয়ে তোমার মস্তিষ্ক রক্ষা করে চলেছি। চল্লিশ বছর ধরেই করছি। যে কারণে এখননা কেউ তোমার মস্তিষ্ক থেকে কিছু জানে না। আমরা বেশিদিন বাঁচব না। তখন সবাই জানবে। আমাদের যা বলার তোমাকে বললাম, এখন তুমি তোমার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবে।

ফিহা বললেন, আমি আপনাদের ভালবাসি।

জানি। ভালবাসার কথা বলার প্রয়োজন হয় না।

বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দুজনই কাঁদতে লাগলেন।

ফিহা দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি যদি মারা যাই তাহলে চক্র ভেঙে যাবে। কারণ সময় সমীকরণ বের হবে না।

বৃদ্ধ মিরান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

ফিহা বললেন, চক্র ভেঙে গেলে মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। মেন্টালিস্টদের বিষয়ে বই লেখা হবে না। মেন্টালিস্টদের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থের সমস্ত লেখা মুছে যাবে।

বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

আমার যে হঠাৎ আপনাদের কাছে আসার ইচ্ছা হল তার কারণ কি এই যে আপনারা আমাকে ডেকেছেন?

হ্যাঁ। তুমি যেভাবে ভাঙতে চাচ্ছ সেভাবে তা সম্ভব নয়। এই কথাটি তোমাকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

আপনারা চান চক্র ভেঙে যাক?

চাই। এই চক্র অন্যায় চক্র।

আপনাদের কাছে কি কোনো বিষ আছে?

হ্যাঁ। আমরা জোগাড় করে রেখেছি। আমরা জানি তুমি চাইবে।

বৃদ্ধা বিষের শিশি বের করে আনলেন। দশ বছর ধরে তাঁরা এই শিশি আগলে রেখেছেন। এখন আর আগলে রাখার প্রয়োজন নেই।

ফিহা বললেন, বিষের ক্রিয়া কতক্ষণ পর শুরু হবে?

ঘণ্টা খানেক লাগবে। ক্রিয়া করবে খুব ধীরে ব্যথা বোধ হবে না। আমরা তোমাকে ব্যথা পেতে দেব না। তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে পৌছতে পারবে।

ফিহার হাতে একরাশ গোলাপ। বাড়ি ফিরছেন হেঁটে হেঁটে। বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন। তাঁর চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। তবু গভীর আনন্দে তাঁর মন পরিপূর্ণ। চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ংকর একটি চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ফিহা দ্রুত পা ফেলতে চেষ্টা করছেন। যে করেই হোক নুহাশের কাছে পৌছতে হবে। তার গল্পটির শুরুটা হলেও শুনতে হবে। মনে হয় ভোর হতে বেশি দেরি নেই। চারদিকে আলো হতে শুরু করেছে। ফিহার হাতের ফুলগুলি রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। তিনি দূরে ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। কোত্থেকে আসছে।

এই ঘন্টাধ্বনি?

রাস্তার মানুষ অবাক হয়ে দেখছে ফুল বিছিয়ে বিছিয়ে একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। সে পা ফেলছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। অন্ধকারে মানুষটিকে চেনা যাচ্ছে না। যারা ফুল ছড়িয়ে এগিয়ে যায় তাদের চেনারও তেমন প্রয়োজন নেই।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments