Tuesday, August 26, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পফাঁদ পাতা ভুবনে - তারাপদ রায়

ফাঁদ পাতা ভুবনে – তারাপদ রায়

‘মায়ার খেলা’র সেই আশ্চর্য গানটিকে হালকা আলোচনার সীমানায় টেনে আনার জন্যে আমি যারপর নাই লজ্জিত এবং দুঃখিত, কিন্তু প্রেমের মতো জটিল বিষয়ে আমার মতো আনাড়ি ব্যক্তির একটা অবলম্বন দরকার। তাই এই অসাধু প্রচেষ্টা, এর মধ্যে আর কোনও গূঢ় ব্যাপার নেই।

কবি হাইনেই বোধহয় বলেছিলেন, প্রথম প্রেম ঐশ্বরিক ব্যাপার, কিন্তু দ্বিতীয়বার যে প্রেমে পড়ে সে একটা গাধা।

প্রেমে পড়া ব্যাপারটাই অবশ্য অন্যের কাছে একটা চুড়ান্ত বোকামির ব্যাপার। এমন লোকের সংখ্যা কম, যাঁরা মনে করেন যে বোকা ছাড়া আর কেউ প্রেমে পড়ে না, নির্বোধ ছাড়া কেউ প্রেমে পড়তে পারে না।

কিন্তু এ জাতীয় ধারণা করার, কোনও মানে হয় না। প্রেমকলার মতো জটিল কলায় পারদর্শী হওয়া কোনও বোকা বা নির্বোধের পক্ষে বোধহয় সম্ভব নয়।

প্রথমেই দুটো প্রেমের গল্প ধরা যাক। একটি সরল প্রেমের, অন্যটা পরকীয়া প্রেমের।

সরল কাহিনীটির নায়ক একদিন তাঁর প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে প্রেমিকাকে বলল, ‘আজ সন্ধ্যাটা খুব মজায় কাটানো যাবে, এই দ্যাখো সিনেমার টিকিট কেটে এনেছি।’ মেয়েটি টিকিটগুলো হাতে নিয়ে বলল, ‘এ কী তিনটে টিকিট কেন? বোধহয় হল থেকে ভুল করে দুটো টিকিট দিতে গিয়ে তিনটে দিয়ে দিয়েছে।’

প্রেমিক যুবকটি মৃদু হেসে বলল, ‘আমি তিনটে টিকিটই কিনেছি।’ একথা শুনে প্রেমিকা কিঞ্চিত বিস্মিত হল, ‘সে কী কথা? আমাদের সঙ্গে আর কেউ যাবে নাকি?’ প্রেমিক বলল, ‘আরে না না, তা নয়। আমরা সিনেমায় যাচ্ছি না।’ প্রেমিকাটি চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করল, ‘তবে?’

প্রেমিক এবার ব্যাখ্যা করল, ‘সন্ধ্যাবেলা আমরা এখানেই থাকছি। সিনেমার টিকিট তিনটে তোমার মা, বাবা আর ভাইয়ের জন্যে।’

বলাবাহুল্য এই প্রেমিকপ্রবর নির্বোধ নয়। এর পরের পরকীয়া আখ্যানের প্রেমিকটি কিন্তু আরও বেশি চালাক।

গল্পটা উলটো দিক থেকে ঘুরিয়ে বলি। এক ডাক্তারের চেম্বারে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলাই এক যুবক ঢুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর কয়জন রোগী বাকি আছে?’ ডাক্তারবাবুর ব্যস্ত পশার, কোনওদিন দেখা যায়, তখনও দশ বারোজন রোগী অপেক্ষারত, কোনওদিন চেম্বারের কম্পাউন্ডারবাবু বলেন, ‘আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’ সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি দ্রুত বেরিয়ে যায়।

এ রকম বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। যুবকটি কোনওদিনই ডাক্তারবাবুর জন্যে অপেক্ষা করে না, চেম্বারে উঁকি দিয়ে দেখেই ব্যস্ত হয়ে চলে যায়। বৃদ্ধ কম্পাউন্ডারবাবুর ক্রমে কৌতূহল বাড়তে লাগল, ব্যাপারটা কী, এ কেমন রোগী?

বুড়ো বয়সে সব কিছু শেখার জানার জন্যে খুব ইচ্ছে হয়। অবশেষে একদিন কম্পাউন্ডারবাবু আর থাকতে না পেরে চেম্বার ফেলে রেখে সেই যুবকের পিছু নিলেন।

ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই কাজটি না করলেই নিশ্চয় ভাল করতেন। কারণ অনুসরণ করে তিনি যা দেখলেন, সে খুব মনোরম নয়। ওই যুবকটি সরাসরি গেল রাস্তার ওপাশেই খোদ ডাক্তারবাবুর বাড়িতে।

এই বাজে গল্প আর ফেনিয়ে লাভ নেই। সবাই বুঝে ফেলেছেন, শুধু যে দু’একজন বোঝেননি তাঁদের অবগতির জন্যে জানাই, এই যুবকটি ডাক্তারবাবুর স্ত্রীর বশংবদ প্রেমিক। প্রতিদিন সে চেম্বারে এসে জেনে যায় ডাক্তারবাবুর আর কতক্ষণ লাগবে, এবং সেটা জেনে তাঁর স্ত্রীর কাছে যায়।

প্রেম নিয়ে এত খারাপ গল্প লিখে মনে কেমন ধিক্কার জাগছে। প্রেম হল ফুলের মতো নিষ্পাপ, সুন্দর বিষয়, তাকে নিয়ে এতটা ইয়ারকি করা উচিত হল না।

সুতরাং অতঃপর প্রেম ও ফুল।

মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা এক পরিচিত তরুণকে একদা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তোমার এ দশা হল কী করে?’ সে বলেছিল, ‘আমার প্রেমিকা আমাকে ফুল ছুড়ে মেরেছে।’ আমি বললাম, ‘ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় শুনেছি, কিন্তু মাথা ফাটে এই প্রথম দেখলাম।’ তখন সে জানাল, ‘দাদা, ভুল বুঝবেন না। শুধু ফুল নয়, কাচের ফুলদানি সুদ্ধু ফুল ছুড়ে মেরেছিল।’

ফুলের পরের গল্পটি ম্যাটমেটে। এক প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে সপ্তাহান্তে একটি গার্লস হোস্টেলে যেত। একদিন তার হাতে কাগজের ফুল। প্রেমিকা জিজ্ঞেস করল, ‘কাগজের ফুল আনলে কেন?’ ছেলেটি করুণ কন্ঠে জানাল, ‘প্রতিদিন নীচের মেট্রনের ঘরে অপেক্ষা করতে করতে তাজা ফুলগুলো শুকিয়ে যায়, তাই কাগজের ফুল আনলাম।’

আহা!

আমরা এই অপেক্ষমান বিরহের মধ্যে যাব না। বিরহকে পূর্ণ করে তোলে প্রেমপত্র। প্রেমপত্র বিষয়ে একটি সদুপদেশ দেব, তার আগে একটা ছোট ঘটনা বলি।

ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকাকে বলল, ‘তা হলে এবার আমার চিঠিগুলো ফেরত দাও।’ প্রেমিকা বলল, ‘কী দরকার? আমি কথা দিচ্ছি চিঠিগুলি পুড়িয়ে ফেলব।’ প্রেমিক বলল, ‘না পুড়িয়ো না, ওগুলো লেখাতে আমার যথেষ্ট টাকা ব্যয় হয়েছে, আর তা ছাড়া অন্য জায়গায় চেষ্টা করতে হবে তো?’

অতঃপর একটি সদুপদেশ।

হে নবীন প্রেমিক। এ বছর বসন্ত বড় দ্রুত এসে গেছে। মলয় পবন। গাছে গাছে নতুন পাতা, গন্ধে ভরা সাদা ফুল। আমের মুকুলের ঘ্রাণে দিকদিগন্ত আমোদিত। এই তো প্রেমে পড়ার সময়।

কিন্তু একটা কথা, যতই প্রেমে পড়ো, যতই অনুরাগে বিহ্বল হও, সাবধান, প্রেমপত্র লিখতে যেয়ো না। সে বড় কঠিন কাজ। বানান-ব্যাকরণের সমস্যাই শুধু নয়, ওই প্রেমপত্র জিনিসটি একটি মারাত্মক এবং বিপজ্জনক দলিল। বহু বাঘা বাঘা লোক প্রেমপত্র লিখে ফেঁসে গেছে। সামনা সামনি যা ইচ্ছে বলো, সম্ভব হলে টেলিফোনেও বলল। যদি কাছাকাছি না যেতে পারো, তবে প্রেমিকার দৃষ্টিপথে থাকো, হাবে-ভাবে-ভঙ্গিতে প্রণয় নিবেদন করো অবশ্যই নিরাপদ দূরত্ব থেকে, যাতে প্রেমিকার বাবা কাকা কিংবা গৃহভৃত্য দৌড় দিয়ে তাড়া করে হঠাৎ ধরে ফেলতে না পারে।

কিন্তু চিঠি লিখতে যেয়ো না।

আমার এই সদুপদেশের সপক্ষে একটি বিদেশি কাহিনী বলছি। এক প্রেমিক প্রবাস থেকে নিয়মিত তার প্রেমিকাকে চিঠি লিখত। নিয়মিত মানে খুবই বেশি নিয়মিত। প্রত্যেক সপ্তাহে তিনবার, একদিন অন্তর সোমবার-বুধবার শুক্রবার সে প্রেমিকাকে নীল কাগজে আতর মাখিয়ে দীর্ঘ চিঠিতে তার মনের আকুতি জানাত।

প্রেমিকটি এতই অনুরাগে বিহ্বল ছিল যে, খেয়ালই করত না তার প্রেমিকা চিঠির উত্তর দিচ্ছে কি না। সে মনের আবেগে চিঠি লিখে যেত।

অবশেষে একদিন কালিদাসের নির্বাসিত যক্ষের মতো এই প্রেমিকটিরও প্রবাসের মেয়াদ শেষ হল সে দেশে ফিরে এল এবং পেল তার জীবনের চরম আঘাত। তার প্রেমিকা পাড়ার তরুণ ডাকপিয়নকে বিয়ে করেছে, যে ডাকপিয়ন প্রতি সপ্তাহে তিনবার প্রবাসীর সুরভিত নীল চিঠি নিয়ে প্রেমিকার কাছে পৌঁছে দিত, তারই গলায় মালা দিয়েছে প্রেমিকা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments