Sunday, April 28, 2024
Homeকিশোর গল্পএকটি দিনের অতিথি - নির্মল ভার্মা

একটি দিনের অতিথি – নির্মল ভার্মা

একটি দিনের অতিথি - নির্মল ভার্মা

সে সুটকেসটা দরজার কাছে নামিয়ে রেখে ঘণ্টির বোতামটা টিপে অপেক্ষা করতে লাগলো। বাড়িটা চুপচাপ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ওর মনে হলো হয়তো বাড়িতে কেউ নেই আর সে একটা খালি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। রুমাল বার করে ঘাম মুছে হাতের এয়রব্যাগটা সুটকেসের উপর নামিয়ে আবার ঘণ্টি বাজিয়ে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। শুধু বারান্দার পিছনে জানলার খোলা কপাটটা হাওয়ায় খটখট করছে।

সে দুপা পিছিয়ে উপরদিকে তাকালো। দুতলা বাড়ি। গলির অন্য বাড়িগুলির মতোই কালো ছাদ, ইংরেজি V-র মতো দুদিকে ঢালু, আর মাঝখানে সাদা পাথরের দেয়ালের উপর বাড়ির নম্বরটা কালো টিপের মতো দেখাচ্ছে। উপরের জানলাগুলো বন্ধ, পরদা ফেলা। কোথায় যেতে পারে সে এই সময়?

সে বাড়ির পিছন দিকে গেল। ওদিকে লন, বেড়া আর ঝোপঝাড় যেমন দুবছর আগেও দেখেছিলো। মাঝখানে উইলো গাছটা একটা বুড়ো ভালুকের মতো ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু গ্যারাজটা খোলা আর খালি। ও গাড়ি নিয়ে কোথাও গেছে, হয়তো সারা সকাল অপেক্ষা করে এইমাত্র কোনো কাজে বেরিয়েছে। কিন্তু তার জন্য একটা নোট তো লিখে যেতে পারতো।

ও আবার সদর দরজায় ফিরে এল। আগস্ট মাসের গনগনে রোদে সারা শরীর জ্বলছে। বারান্দায় ওর সুটকেসের উপরেই বসে পড়লো। হঠাৎ মনে হলো রাস্তার ওপারে বাড়ির জানলা দিয়ে কেউ ওর দিকে তাকাচ্ছে। ইংরেজরা নাকি অন্যের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না! কিন্তু বাড়ির বাইরে বারান্দায় বসে থাকলে হয়তো প্রাইভেসির প্রশ্নটা ওঠে না, তাই খোলাখুলি উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে। তবে, তাদের কৌতূহলের অন্য কারণও থাকতে পারে। এইরকম ছোটোখাটো শহরতলিতে সবাই পাড়াপড়শিদের জানে। তার বিদেশী চেহারা আর ঢিলেঢালা হিন্দুস্তানি সুট নিশ্চয়ই বেশ অদ্ভুত ধরনের। ওর দোমড়ানো ঘামে-ভেজা পোশাক দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না যে দু’দিন আগেই সে ফ্রাঙ্কফুর্টের কনফারেন্সে রিসার্চ পেপার পড়েছে। ‘আমাকে নিশ্চয়ই এক গরীব এশিয়ান ইমিগ্রান্ট-এর মতো দেখাচ্ছে।’… ভেবে উঠে দাঁড়ালো, যেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাটা বেশি সহজ। এইবার কিছু না ভেবে সে দরজাটায় জোরে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ। পরক্ষণেই সে দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়ালো।

সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরার আগের মুহূর্তে মেয়েটি প্রশ্ন করলো, ‘তুমি বাইরে দাঁড়িয়েছিলে বুঝি?’

‘আর তুমি এতক্ষণ ভিতরেই ছিলে?’ উত্তর দিয়েই আগন্তুক তার ধুলোমাখা হাতে মেয়েটির পলকা কাঁধদুটো জড়িয়ে, মাথা নামিয়ে মেয়েটির চুলের উপর ঠোঁট ছোঁয়াল।

পড়শিদের জানলাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল।

মেয়েটি আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাইরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে?’

‘গত দুই বছর!’

মেয়েটি হেসে ফেলল। ওর বাবা ভারি মজার কথা বলে।

‘আমি দু-দুবার বেল বাজালাম, তুমি ছিলে কোথায়?’

‘বেলটা খারাপ হয়ে আছে, তাই দরজা খুলেই রেখেছিলাম।’

‘তা তুমি আমায় ফোনে বললেই পারতে। আমি এক ঘণ্টা ধরে বাড়ির সামনে পিছনে দৌড়োদৌড়ি করছিলাম।’

‘আমি বলতে যাচ্ছিলাম তো, কিন্তু লাইনটাই কেটে গেল। তুমি আরও পয়সা দিলে না কেন?’

‘আমার কাছে শুধু দশ পয়সা ছিলো। আর ওই মেয়েটাও ভীষণ পাজি।’

‘কোন মেয়েটা?’

‘ওই, যে আমাদের লাইনটা কেটে দিলো।’

লোকটি সুটকেসটা ড্রয়িং রুমে টেনে নিয়ে এল। মেয়েটি কৌতূহলী চোখে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো–সিগারেটের প্যাকেট, স্কচের লম্বা বোতল, চকোলেটের বাক্স, তাড়াহুড়ো করে সব ফ্রাঙ্কফুর্টের ডিউটি-ফ্রি দোকানে কেনা।

‘তুমি চুল কেটেছো দেখছি।’

‘হ্যাঁ, ছুটির জন্য। কেমন লাগছে?’

‘আমার মেয়ে নাহলে ভাবতাম কোনো রাস্তার ছোকরা ঘরে ঢুকে পড়েছে।’

‘ওফ, পাপা!’ মেয়েটি হাসতে হাসতে একটা চকোলেটের মোড়ক খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল। ‘সুইস চকোলেট,’ হাত দুলিয়ে বললো।

‘আমায় এক গ্লাস জল দিতে পারো?’

‘দাঁড়াও, আমি চা বানাচ্ছি।’

‘চা পরে–,’ সে কোটের ভিতরের পকেটগুলোয় কিছু খুঁজছিলো–নোটবুক, ওয়ালেট, পাসপোর্ট, সব বেরুলো, শেষে পেল ট্যাবলেটের ছোট্ট ডিব্বাটা।

‘কীসের ওষুধ?’ মেয়েটির হাতে জলে গেলাস।

‘জার্মান। খুব কাজ দেয়।’ ওষুধটা গিলে আবার সোফায় গিয়ে বসল। সবকিছু ঠিক একইরকম। যেমনটি সে ভেবেছিলো। সেই ঘর, কাচ-লাগানো দরজা, খোলা পর্দার ফাঁকে সবুজ রুমালের মতো লন। টিভির পর্দায় উড়ন্ত পাখি, বাইরে উড়ছে কিন্তু মনে হয় যেন ভিতরে।

ও উঠে কিচেনের দোরগোড়ায় এল। গ্যাসের উনুনের সামনে মেয়েটির পিঠ দেখা যাচ্ছে। কর্ডুরয়ের কালো জিনস আর সাদা কামিজ। হাতা কনুই অব্দি গোটানো। ওকে খুব হালকা-পলকা দেখাচ্ছে।

‘মা কোথায়?’

হয়তো ওর নিচু গলা মেয়েটির কানে গেল না। কিন্তু ওর ঘাড়টা একটু যেন শক্ত হয়ে উঠলো।

‘মা উপরে বুঝি?’ যখন মেয়েটি আগের মতোই নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল, ও বুঝতে পারলো প্রথম প্রশ্নটিও সে ঠিকই শুনেছে।

‘বাইরে গেছে?’ এবারে মেয়েটি একরকম মাথা দোলাল যার মানে হ্যাঁ বা না দুই-ই হতে পারে।

‘পাপা, আমায় একটু সাহায্য করবে?’

এক লাফে ও মেয়ের পাশে এসে গেল। ‘বলো কী করতে হবে?’

‘তুমি চায়ের কেটলিটা ওঘরে নিয়ে যাও। আমি এখুনি আসছি।’

‘ব্যস?’ ওর গলায় নিরাশা।

‘আচ্ছা, কাপ আর প্লেট দুটোও নিয়ে যাও।’

ও সবকিছু ভিতরের ঘরে নিয়ে এল। ও আবার রান্নাঘরে যেতে চাইছিলো কিন্তু মেয়ের ভয়ে সোফাতেই বসে রইলো। রান্নাঘর থেকে কিছু একটা ভাজার সুগন্ধ আসছে। মেয়েটি হয়তো ওর জন্য কিছু তৈরি করছে। আর সে তাকে কোনো সাহায্য করতে পারছে না। একবার মনে হলো বারণ করে কিছু না বানাতে, পরক্ষণেই খিদেটা চাড়া দিয়ে উঠলো। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। হিউস্টন স্টেশনে ক্যাফেটেরিয়ার লাইন অত লম্বা দেখে ও না দাঁড়িয়ে সোজা ট্রেনে ঢুকে পড়েছিলো। ভেবেছিলো ডাইনিং কারে কিছু খেয়ে নেবে; কিন্তু তাও লাঞ্চের আগে খুললো না। সত্যি বলতে ও লাস্ট খাবার কাল বিকেলে ফ্রাংকফুর্টেই খেয়েছিলো। তারপর লন্ডন পৌঁছে হোটেলের বারে ড্রিঙ্ক। তিনটে গেলাসের পর নোটবুক দেখে মনে করে টেলিফোন বুথ থেকে মেয়েকে ফোন করেছিলো। প্রথমবার ঠিক বুঝতে পারলো না ওর মেয়ে ধরেছে, না বউ। কিছুক্ষণ ফোনটা নিঃশব্দ। তারপর শুনল উপর থেকে মেয়েকে ডাকছে। ঘড়ি দেখে হঠাৎ খেয়াল হলো ও নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে এখন। ও ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু মেয়ের গলা শুনতে পেল। বেচারা আধোঘুমে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলো না সে ইন্ডিয়া থেকে বলছে, না ফ্রাঙ্কফুর্ট, নাকি লন্ডন। বুঝতে না বুঝতে তিন মিনিট সময় শেষ। কাছে খুচরো পয়সাও নেই যে আরেকটু সময় নেয়। তবু যাহোক নেশাটেশার মধ্যেও এটুকু জানাতে পেরেছিলো যে ও কাল সকালে বাড়ি আসছে। কাল মানে আজ।

দিনটা ভালোই মনে হচ্ছে। বাইরে ইংল্যান্ডের গরম রোদ। কিন্তু ঘরের ভিতরে বেশ আরাম। এয়ারপোর্টের দৌড়ঝাঁপ, হোটেলের ঝামেলা, ট্রেন-ট্যাক্সির হাঁকডাক–সবকিছু ছাড়িয়ে এখন সে ঘরের মধ্যে। যদিও ওর নিজের ঘর নয়, তবু একটা ঘর তো–চেয়ার, পর্দা, সোফা, টিভি। সে গোড়া থেকেই এসব দেখে আসছে, প্রত্যেকটি জিনিসের ইতিহাস ওর জানা। দু’তিন বছর অন্তর যখনই আসে, ভাবে মেয়েটা কত বড় হল, আর স্ত্রী? ভাবে নিশ্চয়ই কত বদলে গেছে। কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র ঠিক একরকমই রয়ে গেছে, যেদিন সে এই ঘর ছেড়েছিলো।

‘পাপা তুমি চা ঢালোনি?’ সে কিচেন থেকে দুটো প্লেট নিয়ে এল; একটায় টোস্ট আর মাখন, অন্যটায় সসেজ।

‘আমি তোমার জন্যই বসেছিলাম।’

‘চা ঢালো, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

দুজনে সোফায় এসে বসলো। ‘টিভি খুলি? দেখবে?’

‘এখন না…শোনো, তুমি আমার পাঠানো স্ট্যাম্পগুলো পেয়েছিলে?

‘হ্যাঁ পাপা, থ্যাংকস।’ টোস্টের উপর মাখন লাগাতে লাগাতে জানালো।

‘কিন্তু তুমি একটাও চিঠি লেখোনি।’

‘আমি লিখেছিলাম, কিন্তু তারপর তোমার টেলিগ্রাম আসতে আমি ভাবলাম তুমি যখন আসছই তো আর চিঠি লেখার কী দরকার।’

‘তুমি সত্যি একেবারে গাগা।’

মেয়ে বাপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। এটা ওর খ্যাপানো নাম। বাবার দেওয়া। যখন তারা একসঙ্গে থাকতো। ও খুব ছোটো ছিলো, ইন্ডিয়ার নামও জানতো না তখন।

মেয়ের হাসির সুযোগে ও সাবধানে কাছে ঝুঁকলো, যেন একটা চঞ্চল পাখিকে আস্তে করে হাতে ধরা। ‘মা কখন আসবে রে?’

প্রশ্নটা এত আচমকা যে মেয়ে সাবধান হবার সুযোগ পেল না, ‘মা তো ওপরের ঘরে।’

‘ওপরে? তবে তুমি বললে যে…?’

ক্র্যাচ, ক্র্যাচ, ক্র্যাচ–মেয়ে ছুরি দিয়ে টোস্টের পোড়া অংশটা ছাড়িয়ে দিচ্ছে, সেই সঙ্গে তার প্রশ্নটাকেও। হাসিটা তখনো মুখে, কিন্তু বরফের টুকরোর মতো ঠান্ডা।

‘মা জানে আমি এখানে?’

মেয়ে টোস্টের উপর মাখন তার উপর জ্যাম লাগিয়ে প্লেটটা এগিয়ে দিলো। ‘হ্যাঁ, জানে।’

‘ও নিচে এসে চা খাবে না আমাদের সঙ্গে?’

মেয়ে দ্বিতীয় প্লেটে সসেজ সাজাতে থাকলো, তারপর কিছু মনে পড়তেই কিচেন থেকে নিয়ে এল কেচাপ আর মাস্টার্ডের বোতল।

‘আমি উপরে গিয়ে জানিয়ে আসি,’ বলে সে মেয়ের দিকে সমর্থনের আশায় তাকালো। মেয়েকে চুপ দেখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।

‘প্লীজ পাপা!’

ওর পা থমকে গেল।

‘তোমরা আবার ঝগড়া করতে চাও?’ মেয়ের গলায় রাগ।

‘ঝগড়া?’ সে একটু লজ্জিত হাসি মেখে বললো, ‘আমি এই দু’হাজার মাইল উড়ে এসেছি ঝগড়া করতে?’

‘তাহলে তুমি আমার কাছে বসো,’ মেয়ের গলা ভারি। ও থাকে মার সঙ্গে কিন্তু বাপের উপর নির্দয় হতে পারে না। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বললো, ‘আমিও তো তোমার কাছে, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?’

সে খেতে শুরু করলো। টোস্ট, সসেজ, টিনের কড়াইশুঁটি। ওর আর খিদে ছিলো না। কিন্তু মেয়ের চোখ তার উপর। সে তাকে দেখছে, কিছু একটা ভাবছে, আর টোস্টের এক-একটা টুকরো মুখে ফেলে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আবার চুপ করে হাসিমুখে তাকাচ্ছিলো; যেন আশ্বাস দিচ্ছে, ‘সবকিছু ঠিক, আমি আছি তোমার পাশেই। ভয়ের কিছু নেই।’

ভয় ছিলো না। তবে ট্যাবলেট-এর প্রভাব বা জার্নির ধকল–সে কিছুক্ষণের জন্য মেয়ের চোখের আড়াল হতে চাইছিলো। নিজের থেকেও।

‘আমি আসছি একটু।’

মেয়ে উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে বললো, ‘বাথরুমে যাবে?’ বলে ওর পিছন পিছন বাথরুম পর্যন্ত চলে এল, দরজা বন্ধ করার পরেও ওর মনে হলো মেয়েটা দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে…।

বেসিনের উপর ঝুঁকে কলটা খুলে দিলো। মুখের উপর জলের ধারা, গলা ককিয়ে উঠছে, অস্পষ্ট শব্দগুলো ওর বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বমি আসছে, কিছুক্ষণ আগে গেলা ট্যাবলেটটা এখন সাদা মার্বেলের বেসিনে। কল বন্ধ করে ও রুমালে মুখটা মুছে নিলো। দেয়ালে হ্যাঙ্গার থেকে স্ত্রীর জামাকাপড় ঝুলছে। কোণে একটা বালতিতে সাবান জলে আন্ডারওয়ার আর ব্রা চুবিয়ে রাখা। খোলা জানলা দিয়ে এক টুকরো রোদ পড়েছে। কোথাও দূরে মেশিনে ঘাস কাটার বোঁ-বোঁ আওয়াজ …

সে তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজা খুলে ঘরের ভিতর চলে এল। ঘরটা খালি, কেউ নেই। কিচেনে গিয়ে দেখে মেয়ে সেখানেও নেই। ওর মনে হলো হয়তো সে উপরে মার কাছে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত আতঙ্ক ঝিকিয়ে উঠলো ওর মনে। ঘরটা যতই নিশ্চুপ ততই যেন সংকটময় মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি কোণে রাখা সুটকেসটা খুলে জিনিসপত্র বের করতে লাগলো। প্রথমেই কনফারেন্সএর নোটগুলি আলাদা করে রাখল। তারপর একে একে দিল্লি থেকে কেনা উপহারগুলো বের করলো–এম্পরিয়াম থেকে কেনা রাজস্থানী ঘাগরা (মেয়ের জন্য), তামা আর পেতলের গয়না যা সে জনপথের তিব্বতি লামা হিপিদের কাছ থেকে কিনেছিলো, পশমিনা কাশ্মীরি শাল (মেয়ের মায়ের জন্য), একজোড়া লাল জরিদার গুজরাটি চটিজুতো যা মা বা মেয়ে দুজনেই পরতে পারে, হ্যান্ডলুম বেডকভার, হিন্দুস্তানি স্ট্যাম্প অ্যালবাম– আর একটি বিরাটকায় ছবিওয়ালা বই–বেনারসঃ দা ইটারনাল সিটি। সোফার উপর একটা ছোটোখাটো হিন্দুস্তান জমে উঠলো, যেরকম সে প্রত্যেক বার ইউরোপে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে।

হঠাৎ সে হাত থামিয়ে কিছুক্ষণ উপহারের স্তূপের দিকে তাকিয়ে রইলো। সোফার উপর জিনিসগুলো কীরকম অনাথ আর করুণ মনে হচ্ছে। একটা পাগলামি খেয়াল মাথায় এল যে এই মুহূর্তে সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেউ জানবে না সে কোথায় গেল। মেয়েটা হয়তো একটু হয়রান হবে, কিন্তু তারা তো অনেকদিন থেকেই এরকম আচমকা দেখা আর বিনা কারণে বিদায়ে অভ্যস্ত। ওকে বলতো, ‘ইউ আর এ কামিং ম্যান অ্যান্ড এ গোয়িং ম্যান।’ প্রথম প্রথম বিষাদের সঙ্গে বলতো, পরে হাসতে হাসতে। ওকে ঘরে না দেখে মেয়ের খুব একটা চিন্তা হবে না। হয়তো উপরে গিয়ে মাকে বলবে, ‘তুমি এখন নিচে আসতে পারো। ও চলে গেছে।’ ওরা দুজনে নিচে এসে বসবে, ওদের ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই ভেবে আশ্বস্ত হবে।

‘পাপা!’

সে চমকে উঠলো যেন হাতেনাতে ধরা পড়েছে। অপ্রস্তুতভাবে হেসে মেয়ের দিকে তাকালো, সে দেখছিলো উপহার-ভরা সুটকেসটা, যেন কোনো ম্যাজিক বাক্স, যার ভিতর থেকে রংবেরঙের জিনিস বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তার চোখে হাসির বদলে ছিলো অপ্রতিভ ভাব, যখন ছোটোরা বড়োদের ম্যাজিক করতে দেখে, কিন্তু আগে থেকেই তারা কৌশলটা জানে, শুধু সঙ্কোচটা ঢাকার জন্য একটু বেশি বেশি উৎসাহ দেখায়।

‘এতসব জিনিস?’ ও চেয়ারে বসে পড়লো। ‘কী করে অ্যালাউ করলো? আজকাল তো শুনি কাস্টম-এর লোকগুলো ভীষণ বিরক্ত করে।’

‘না, এবার আমায় কিচ্ছু বললো না,’ সে উৎসাহিত, ‘হয়তো আমি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে আসছিলাম বলেই। শুধু একটা জিনিসের উপর নজর দিয়েছিলো।’ সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

‘কী জিনিস?’ মেয়ে এবার সত্যি উৎসুক।

সে ব্যাগ থেকে ডালমুটের একটা ডাব্বা বের করে টেবিলে রাখল। মেয়েটি ইতস্তত হাতে দু’চার দানা তুলে শুঁকলো, ‘কী এটা?’

‘ওরাও এইরকমভাবে শুঁকছিলো।’ সে হেসে বললো, ‘ওদের ভয় এতে চরস-গাঁজা নেই তো।’

‘হ্যাশ?’ মেয়ের চোখ বড়ো বড়ো। ‘সত্যি আছে নাকি?’

‘খেয়েই দ্যাখ না।’

মেয়েটি একমুঠো মুখে দিতেই ঝালের চোটে আহা-উহু করতে লাগলো।

সে ঘাবড়ে গিয়ে বললো, ‘লঙ্কার ঝাল। ফেলে দাও, ফেলে দাও।’

কিন্তু মেয়েটা ছলছলে চোখেও সবটা গিলে ফেলল।

‘পাগল দ্যাখো! খেয়ে নিলে সবটা?” সে তাড়াতাড়ি জলের গেলাসটা এগিয়ে দিলো।

‘বেশ ভালো!’ মেয়ে তাড়াতাড়ি জল খেয়ে জামার হাতায় মুখটা মুছে হাসিমুখে বাপকে বললো, ‘আই লাভ ইট!’ সে বাপের মন রাখতে অনেক সময়েই এরকম বলে। ওদের মধ্যে সময় কম বলেই সে বাপের কাছে পৌঁছোতে এইরকম শর্টকাট নেয় যা অন্য ছেলেমেয়েদের পার করতে অন্তত দু’মাস লাগবে।

‘ওরাও খেয়ে দেখেছিলো নাকি?’ মেয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে।

‘না রে, ওদের এত হিম্মত আছে নাকি? ওরা শুধু আমার ব্যাগের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখে যেই বুঝলো আমি কনফারেন্স থেকে আসছি, আমায় বললো, “মিস্টার, ইউ মে গো।”’

‘কী বললো?’ মেয়েটা আরও হাসছিলো।

‘বললো, “মিস্টার, ইউ মে গো, লাইক অ্যান ইন্ডিয়ান ক্রো!”’ বাপ মেয়েকে লক্ষ করছিলো, ‘কি বলে একে?’

মেয়ে তখনো হাসছে। ও যখন ছোটো ছিলো, বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়াবার সময় এই ছেলেমানুষি খেলাটা খেলতো। বাপ একটা গাছের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ‘ও ডিয়ার, ইজ দেয়ার এনিথিং টু সি?’ আর মেয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলতো, ‘ইয়েস ডিয়ার, দেয়ার ইজ এ ক্রো ওভার দ্য ট্রি।’ বাপ অবাক হয়ে বলতো, ‘কী বলে একে?’ আর মেয়ে বিজয়োল্লাসে লাফিয়ে বলতো, “পোয়েম!”

এ পোয়েম! বড়ো বয়সের উপর ছোটোবেলার ছায়া। পার্কের হাওয়া, গাছপালা, হাসি। বাপের আঙুল ধরে সে এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে যা সে অনেকদিন আগে ছেড়ে এসেছে, এখন শুধু কখনোসখনো ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেই সেখানে যাওয়া যায়…

‘আমি তোমার জন্য কয়েকটা ইন্ডিয়ান সিকিও এনেছি…তুমি গতবার বলেছিলে।’

‘দেখাও, কোথায়?’ মেয়ে প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।

সে চুমকি-বসানো জরির কাজ-করা লাল রঙের একটা থলি বার করলো– যেরকম হিপিরা পাসপোর্ট রাখার জন্য ব্যাবহার করে। মেয়েটি ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতেই ভিতরে সিকি, আধুলিগুলো ঝনঝন করে উঠলো। ও থলির মুখ খুলে সব পয়সা টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলো।

‘ইন্ডিয়ায় সবার কাছেই এইরকম পয়সা থাকে বুঝি?’

বাপ হেসে ফেললো, ‘নয়তো কি? সবার কাছে আলাদা আলাদা থাকবে নাকি?’

‘কিন্তু গরিবরা? আমি একবার টিভিতে দেখেছিলাম তাদের…’ পয়সা ভুলে সে অন্যমনস্কভাবে সোফার উপর সাজানো জিনিসগুলো দেখছিলো। হঠাৎ তার মনে হলো যেন সামনে বসা মেয়েটি অন্য কেউ। ফ্রেমটা আগের মতোই, যেমন দুবছর আগে দেখেছিলো, কিন্তু ভিতরের ছবিটা বদলে গেছে। কিংবা ঠিক বদলায়নি, শুধু অন্য কোথাও চলে গেছে। দূরে থাকা মা-বাবারা সে জায়গার খোঁজ জানে না। জানে না কেমন করে একাকী ছেলেমেয়েরা একের পর এক ঘর বানায়। এই মেয়ে ছোটোবেলায় বেসমেনটে বাবার সঙ্গে খেলতো…কিন্তু কখনো কখনো তাকে ছেড়ে চলে যেত অন্য কোনো ঘরে যার হদিশ তার জানা ছিলো না।

‘পাপা! আমি এগুলো তুলে রাখি?’

‘কেন? তাড়াহুড়োর কী আছে?’

‘না, তাড়াহুড়ো নয়, তবে মা যদি এসে দেখে–‘ ওর গলায় একটু ভয়ের আভাস, যেন হাওয়ায় সে কোনো অদৃশ্য বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।

‘দেখলো তো কী?’ বাপ অবাক।

‘পাপা, আস্তে…’ মেয়ে উপরে ঘরের দিকে তাকালো। সেখানে সব চুপচাপ। যেন বাড়ির দেহটা দুই অংশে কাটা। এক দিকে সব নিঃশব্দ, নিঃস্পন্দ, অন্য দিকে ওরা দুজন। মাঝখানে তার মেয়ে একটা পুতুলনাচের পুতুলের মতো নাটক করে যাচ্ছে। উপরে সুতো টেনে কেউ ওকে নাচাচ্ছে। সে সুতোগুলো দেখতে পাচ্ছে না, যে নাচাচ্ছে তাকেও না।

সে উঠে দাঁড়ালো। মেয়ে সন্ত্রস্তভাবে তাকালো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘ও নীচে আসবে না?’

‘ও জানে তুমি এখানে।’ মেয়ে একটু বিরক্ত যেন।

‘তাই আসতে চাইছে না?’

‘না… তাই সে যেকোনো সময়ে এসে পড়তে পারে।’

বাপটা যেন কেমন। এই সহজ কথাটাও বুঝতে পারে না। ‘তুমি বসো, আমি সব গুছিয়ে রাখছি।’

মেয়ে হাঁটু গেড়ে কার্পেটের উপর বসে যত্ন করে সব জিনিস এক কোণে তুলছে। মখমলের জুতো, পশমিনা শাল, গুজরাট এম্পরিয়াম-এর বেডকভার। ও পিছন থেকে মেয়ের হাতদুটো দেখতে পাচ্ছিলো–রোগা কিন্তু কমনীয়, ঠিক মার মতোই, ওইরকমই একাকী ও শীতল, যা তার জন্য আনা জিনিসগুলো ভালো করে দেখছে না, শুধু অন্যমনস্কভাবে সরিয়ে রাখছে। এ সেই হাত যা শুধু মার সীমিত, সুরক্ষিত স্নেহটাই ছুঁতে শিখেছে, পুরুষের উত্তেজিত উদ্দীপনাকে নয় যা তার বাপের অন্তরের গহ্বর থেকে ফেটে বেরুতে চাইছে।

হঠাৎ তার হাত থেমে গেল। প্রথমে মনে হলো দরজায় কেউ বেল বাজাচ্ছে, পরক্ষণেই টের পেল ফোনের শব্দ। সিঁড়ির নীচে একটা তাকে-রাখা ফোনটা শিকল-বাঁধা পশুর মতো আর্তনাদ করছে। জিনিসপত্র ফেলে মেয়েটি এক লাফে গিয়ে ফোন তুলল। কিছুক্ষণ চুপ। তারপর সে চেঁচালো–

‘মা, তোমার ফোন!’

মেয়ে সিঁড়ির রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে ফোন ঝুলছে। উপরের দরজাটা খুললো। কেউ নামছে। সিঁড়ির উপর একটি ঝোঁকানো মাথা, আলগা খোঁপা আর একটি মুখ দেখা গেল।

‘কার ফোন?’ মহিলা খোঁপা পিছনে সরিয়ে মেয়ের হাত থেকে ফোনটা নিলো। বাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো… মেয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে। ‘হ্যালো?’ মহিলার গলা, তারপর আরও উঁচু পর্দায়–‘হ্যালো, হ্যালো’। তখন ওর মনে পড়লো ওর স্ত্রীর গলা যা সে এত বছর পরেও হাজার গলার মধ্যে ধরতে পারে, উঁচু স্বরের হালকা কাঁপুনি, সব সময়ে যেন কঠিন, আহত, ক্লান্ত, এমন যে দূরের মানুষের বুকেও রক্ত চিরে দিতে পারে। সে যেমন উঠেছিলো তেমনি বসে পড়লো।

মেয়েটা তখন হাসছে।

সে দেয়ালে লাগানো আয়নায় বাপের চেহারাটা দেখছিলো–একটু আলুথালু, কিছুটা বয়সের ছায়া, মায়ের গলার স্বরের প্রতিক্রিয়ায় একটু বাঁকাচোরা, পাজল-এর মতো রহস্যময়। ওরা তিনজনে কী করে যেন চার ভাগ হয়ে গেছে। সে, তার মেয়ে, তার স্ত্রী ও মেয়ের মা…পরিবার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারাও বেড়ে গেছে।

‘তুমি জেনির সঙ্গে কথা বলো,’ মা মেয়েকে বললো। মেয়েও যেন তারই প্রতীক্ষায় ছিলো। লাফ দিয়ে সিঁড়ি টপকে মায়ের হাতের টেলিফোনটা ছিনিয়ে নিলো। ‘হ্যালো জেনি, ইট ইজ মি!’

তার স্ত্রী দু’ধাপ নীচে নামলো। এখন সে তাকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে।

‘বসো’… সে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার গলায় অনুরোধ আর একটু ভয়ও, যেন সে তাকে দেখামাত্র পিছন ফিরে পালাবে।

সে একটুক্ষণ অনিশ্চিত দাঁড়িয়ে। এখন ফিরে যাওয়াটা নিরর্থক, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকারও মানে হয় না। সে একটা টুল টেনে টিভির সামনে বসে পড়লো।

‘কবে এলে?’ তার গলা এত নিচু যে মনে হয় টেলিফোনে কেউ কথা বলছে।

‘অনেকক্ষণ। আমি টেরই পাইনি যে তুমি উপরে…’

স্ত্রী চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে।

সে পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘামটা মুছে নিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো, ‘আমি অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানতাম না ডোরবেলটা খারাপ। গ্যারাজও খোলা, ভাবলাম তোমরা কোথাও বেরিয়েছো…তোমার গাড়ি?’ সে জানতো তবু জিজ্ঞেস করলো।

‘সারভিসিং-এর জন্য পাঠিয়েছি।’ সে গোড়া থেকেই এরকম খুচরো, নিরর্থক কথা বলতে পছন্দ করে না। আর তার স্বামী এইরকম কথাগুলোকেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চায়, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও বাঁচার আশায়।

‘তুমি আমার টেলিগ্রাম পেয়েছিলে? আমি ফ্রাঙ্কফুর্টে এসেছিলাম, সেই টিকিটেই এখানে। কয়েক পাউন্ড বেশি ধরে দিতে হল, এই যা। আমি তোমাকে ফোনও করেছিলাম, কিন্তু তোমরা বোধহয় বাড়ি ছিলে না।’

‘কখন?’ হালকা জিজ্ঞাসা, ‘আমরা তো ঘরেই ছিলাম।’

‘রিং হয়ে গেল কিন্তু কেউ ধরলো না। হয়তো অপারেটর ভুল নাম্বার দিয়েছিলো, আমার ইংরেজি বুঝতে পারেনি। তারপর শোনো’–সে হাসছে, ‘হিথরোয় এক মহিলাকে দেখলাম, পিছন থেকে ঠিক তোমার মতো দেখতে। ভাগ্যিস তাকে ডাকিনি। দেশের বাইরে সব দেশী মহিলা আমার একরকম মনে হয়।’ সে বলেই যাচ্ছিলো। যেন চোখে রুমাল বেঁধে সে উঁচুতে দড়ির উপর দাঁড়িয়ে। তার স্ত্রী অনেক নীচে কোনো স্বপ্নের মধ্যে। সে তাকে অনেকদিন আগে জেনেছিলো কিন্তু এখন মনে পড়ছে না কেন তারা এখানে বসে আছে।

হঠাৎ সে চুপ করে গেল। এতক্ষণ শুধু নিজের গলাই শুনছিলো। সামনে তার স্ত্রী একেবারে নিস্তব্ধ, আশাহীন ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে।

‘কী হলো?’ সে একটু ঘাবড়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘আমি তোমায় বারণ করেছিলাম, তুমি বোঝো না কেন?’

‘কী জন্য? কীসের বারণ?’

‘আমি তোমার কাছে কিছু চাই না। আমার বাড়িতে কেন এসব জিনিস নিয়ে আসো? কী লাভ এতে?’

এক মুহূর্ত সে বুঝতে পারলো না কী জিনিস। তারপর উপহারগুলোর দিকে নজর গেল…শান্তিনিকেতনের পার্স, স্ট্যাম্পের অ্যালবাম, ডালমুটের ডাব্বা…সব এলোমেলোভাবে ডাঁই করা। ‘এ আর বেশি কী এমন?’ একটু হেসে বললো, ‘এ না আনলে সুটকেস অর্ধেক খালিই থেকে যেত।’

‘কিন্তু আমি যে তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না। এটুকুও বুঝতে পারো না?” তার গলাটা কেঁপে গিয়ে উঁচু হয়ে যাচ্ছিলো। এই ভর্ৎসনার পিছনে কতই না ব্যর্থ কথা কাটাকাটি, কত নরকের জল আটকে রাখা, তা এখন হঠাৎ বাঁধ ভেঙে এগিয়ে আসতে চাইছে। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘামে ভেজা মুখটা মুছবার চেষ্টা করলো।

‘এতদিন পরে এলাম তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না?’

‘না!’ তার চোখে আবার ক্লান্তি ও হতাশা। ‘আমি তোমায় দেখতে চাই না। ব্যাস।’

এতই সহজ? সে জেদী ছেলের মতো তাকালো। অঙ্ক বোঝার পরেও যে বায়না করে যে কিছুই বোঝেনি।

‘বুক্কু, প্লীজ!’ সে আস্তে বললো।

‘আমায় ক্ষমা করো।’ স্ত্রীর ধরা গলায় উত্তর।

‘তুমি কী চাও?’

‘লিভ মি অ্যালোন। এর থেকে বেশি আর কিছু চাই না।’

‘আমি মেয়েটাকেও দেখতে আসতে পারি না?’

‘এ বাড়িতে নয়। বাইরে কোথাও দেখা করতে পারো।’

‘বাইরে?’ সে চমকে তাকালো। ‘বাইরে কোথায়?’

সে ভুলে গেল বাইরের ছড়ানো পৃথিবী, পার্ক, রাস্তাঘাট, হোটেলের ঘর, ওর নিজের সংসার– বাচ্চা মেয়েটাকে কোথায় কোথায় টেনে বেড়াবে?

মেয়েটা তখনো ফোনে হাসছে। কিছু বলছিলো। ‘নারে, আজ আসতে পারবো না। পাপা বাড়ি এসেছে। এই মাত্র এল…না, জানি না। জিজ্ঞেস করিনি…’ কী জানে না সে? হয়তো ওর বন্ধু জানতে চেয়েছিলো সে কতদিন থাকবে? সামনে বসা তার স্ত্রীও সেটা জানতে চায়, আরও কত ঘণ্টা, কত মিনিট, কত যন্ত্রণা তাকে ওর সঙ্গে ভুগতে হবে?

ঘরের ভিতরে বিকেলের শেষ রোদ লম্বা ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। বন্ধ টিভির খালি খালি স্ক্রিনে ওর স্ত্রীর ছায়াটা দেখা যাচ্ছে, খবর শুরু হবার আগে নিউজ-রীলে অ্যানাউন্সার-এর ছবির মতো, প্রথমে ঝাপসা, পরে ধীরে ধীরে যা উজ্জ্বল হতে থাকে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলো যে স্ত্রী কিছু বলবে। কিন্তু সে জানতো যে গত কয়েক বছর তাদের মধ্যে একই নিউজ-রীল ঘুরছে যাতে শুধু পুরোনো ব্যথা আর পুরোনো নালিশ। সে সব যেন অন্য জন্মের কাহিনী…মানুষ আর জিনিস কত আলাদা! বছরের পরেও বাড়ি, ঘর, বই, আসবাব সব একইরকম থাকে– যেমন তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে; কিন্তু মানুষ? মানুষ তো যেদিন আলাদা হয়ে যায় সেদিন থেকেই মরতে শুরু করে…না, মরতে নয়, অন্য একটা জীবন শুরু করে যা আস্তে আস্তে আগের জীবনটার গলা টিপে দেয়–যে জীবনটা আমি তোমার সঙ্গে কাটিয়েছিলাম…

‘শুধু মেয়ের সঙ্গেই নয়,’ সে থতমতভাবে বললো, ‘আমি তোমার সঙ্গেও দেখা করতে এসেছিলাম।’

‘আমার সঙ্গে?’ স্ত্রীর গলায় হাসি, ক্লান্তি, ধিক্কার সব মিশে একাকার, ‘তোমার মিথ্যা বলার অভ্যেসটা এখনও গেল না।’

‘তোমায় মিথ্যা বলে আমি কী পাবো?’

‘কে জানে কী পাবে–আমি যা পেয়েছি তাতে তো আমিই ভুগছি।’ সে ঠান্ডা গলায় বললো, ‘যদি আগে থেকে জানতাম তো কিছু করতে পারতাম।

‘কী করতে?’ সে একটা ঠান্ডা শিহরন অনুভব করলো।

‘কিছু একটা। আমি তোমার মতো একলা থাকতে পারি না; কিন্তু এই বয়সে…এখন তো কেউ আমাকে দেখেই না।’

‘বুক্কু…’ সে তার হাতটা ধরল।

‘ও নামে ডাকবে না। ওসব শেষ হয়ে গেছে।’

ও কাঁদছে; একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে, যার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে তার আগামী প্রত্যাশার কোনো যোগাযোগ নেই। চোখের জল, শুধু একটা কারণেই নয়, পুরো পাথরটা সরে যাবার পর যা হয়, ঢালু জীবন বেয়ে স্রোতের মতো বয়ে আসে; সে হাত দিয়ে বারবার মুছে ফেলছিলো…

মেয়েটি অনেকক্ষণ ফোন কোলে সিঁড়ির নীচের ধাপে চুপ করে বসে শুকনো চোখে মার কান্না দেখছিলো। তার সব চেষ্টা নিষ্ফল কিন্তু তাতে তার কোনো নিরাশা নেই। প্রত্যেক পরিবারেরই নিজস্ব দুঃস্বপ্ন থাকে যা অনবরত চাকার মতো ঘুরপাক খায়, তাতে সে হাত দেয় না। এতটুকু বয়সেও তার এই জ্ঞানটা হয়েছে যে মানুষের ভিতরের মন আর বাইরের সৃষ্টির সঙ্গে একটা অদ্ভুত সমতা আছে– আবর্তন শেষ না হওয়ার আগে তাকে বাধা দিতে নেই।

সে বাপকে এক নজর দেখে মার কাছে গেল। কিছু একটা বললো যা বাপের জন্য নয়। মা তাকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসাল। সোফায় বসা দুজনকে দুই বোনের মতো লাগছে। তারা ওর উপস্থিতি ভুলেই গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ আগেও যে জোয়ারটা সারা ঘর ডুবিয়ে দিচ্ছিলো এখন তা ভাঁটার মুখে। আর সে যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে– এক কোণে। ঈশ্বরের বরে যেন দেখতে পেল সে বসে আছে ওদের দুজনের মধ্যে–অদৃশ্য! ওর অনেকদিনের ইচ্ছা মা আর মেয়ের মধ্যে এমন অদৃশ্য হয়ে বসে থাকে। শুধু ঈশ্বরই অদৃশ্য থাকেন, তা সে জানে। কিন্তু যে মানুষ জলের একেবারে তলায়, সেও একরকম অদৃশ্যই। মা আর মেয়ে তাকে আলাদা করে দিয়েছে কিন্তু সেটা উপেক্ষা বলে নয়। তার থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা ওকে ঠিক সেখানেই ছেড়ে গেছে যেখানে সে-ই অনেকদিন আগে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো।

‘আমাদের বাগানটা দেখবে?’ মেয়েটি মাকে ছেড়ে ওর পাশে এসে বসল।

‘এখন?’ ও একটু অবাক। মেয়েকে অধীর, ছটফটে মনে হচ্ছে, যেন তাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু ঘরের মধ্যে বলতে পারছে না।

‘চলো,’ ও উঠে দাঁড়াল, ‘কিন্তু আগে এসবগুলো উপরে নিয়ে যাও।’

‘ওসব পরে গুছিয়ে নেব।’

‘পরে আবার কখন?’ ও একটু শঙ্কিত।

‘তুমি চলো তো।’ মেয়ে অধৈর্য হাতে টানছে ওকে।

‘ওকে বলো, নিজের জিনিসপত্র সুটকেসে রেখে দিতে।’ স্ত্রীর গলা শুনতে পেল।

ওর মনে হলো কে যেন পিছন থেকে ওকে ধাক্কা মারল। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

‘আমার কোনো দরকার নেই।’

ওর বুকের ভিতর একটা ঝড় উঠছিলো। ‘আমি কিচ্ছু নেব না। তুমি চাও তো ফেলে দাও বাইরে।’

‘বাইরে?’ স্ত্রীর গলা কাঁপছিলো। ‘এগুলোর সঙ্গে তোমাকেও বাইরে ফেলে দিতে পারি।’ কান্নার পর তার চোখদুটো চিকচিক করছে, গালে শুকনো জলের দাগ, যা তখনও মোছেনি।

‘বাগানে চলো না!’ মেয়ে আবার তার হাত টানল। সে বেরিয়ে এল মেয়ের সঙ্গে। সে কিছুই দেখছিলো না, ঘাস, কেয়ারি করা ঝোপ, গাছ সব নিঃশব্দ ছবির মতো চোখের সামনে সরে যাচ্ছিলো। শুধু স্ত্রীর গলা ভুতুড়ে আওয়াজের মতো কানে বাজছে–বাইরে, বাইরে!

‘কেন তুমি মার সঙ্গে ঝগড়া করো?’

‘আমি কোথায় ঝগড়া করলাম?’ সে মেয়ের দিকে তাকালো, সে-ও কি তার বিরুদ্ধে?

‘তুমি করো,’ মেয়ের স্বর রুদ্ধ। সে ইংরেজিতে যখন ‘ইউ’ বলে সেটার মানে ভালবেসে ‘তুমি’ হতে পারে কিংবা রুষ্ট হলে ‘আপনি’। ইংরেজি সর্বনামের এই মুশকিল যে বাপ-মেয়ের সম্বন্ধটা শূন্যে দোলে, কখনো কাছে, কখনো দূরে। এর সঠিক আন্দাজটা একমাত্র মেয়ের গলার স্বরের ইঙ্গিতেই পাওয়া যায়। তার ভয় হল, একসঙ্গে মা আর মেয়ে দুজনকেই না খুইয়ে বসে।

‘ভারি সুন্দর বাগান,’ সে মেয়ের মন ভোলাতে বললো, ‘মালী আসে বুঝি?’

‘না, মালী না।’ মেয়ে উৎসাহের সঙ্গে বললো, ‘আমি বিকেলে জল দিই আর ছুটির দিন মা ঘাসটা কাটে।’

ও মেয়ের পিছন পিছন চলল। লনটা ছোট। সবুজ, হলুদ, নরম। পিছনে গ্যারেজ আর দুপাশে ঝোপের বেড়া। মাঝখানে একটা বুড়ো উইলো গাছ। মেয়ে গাছের পিছনে অদৃশ্য হলো। শুধু তার গলা শোনা গেল, ‘কোথায় তুমি?’

সে পা টিপে টিপে গাছের পিছনে গিয়ে অবাক। উইলো আর বেড়ার মাঝখানে একটা কাঠের খাঁচা। তার ভিতর থেকে একটা খরগোশ উঁকি মারছে, আরেকটা খরগোশ মেয়েটার কোলে, একটা উলের বলের মতো, যেন এক্ষুনি হাত থেকে পড়ে ঝোপের মধ্যে গড়িয়ে যাবে।

‘আমি এটা পুষেছি। প্রথমে দুটো ছিলো, এখন চারটে।’

‘বাকিরা কোথায়?’

‘খাঁচার ভিতর। এখনও খুব ছোটো।’

ওর হাতটা খরগোশটাকে ছুঁতে গিয়ে আপনা থেকেই মেয়েটির মাথায় চলে গেল। আস্তে আস্তে ওর ছোটো চুলগুলোর মধ্যে বিলি কাটতে লাগলো। মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আর খরগোশটা নাক কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

‘পাপা!’ মেয়ে মাথা না উঠিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি ডে-রিটার্ন টিকিট কেটে নিয়েছ?’

‘না তো, কেন?’

‘এমনি। এখানে রিটার্ন টিকিট বেশ সস্তায় পাওয়া যায়।’

ও কি এইটা জিজ্ঞেস করতেই ওকে বাইরে ডেকেছিলো? সে আস্তে আস্তে মেয়ের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল।

‘তুমি আজ রাতে কোথায় থাকবে?’ মেয়ের গলা ভাবলেশশূন্য।

‘যদি এখানেই থাকি?’

মেয়ে খরগোশটাকে খাঁচায় ঢুকিয়ে চট করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

‘আমি ঠাট্টা করছিলাম রে।’ সে হেসে ফেলল। ‘আমি লাস্ট ট্রেনেই চলে যাবো।’

মেয়ে তার দিকে তাকালো, ‘এখানে দু-তিনটে ভালো হোটেল আছে… আমি ফোন করে জেনে নিতে পারি।’ সে নরমভাবে বললো। সে জানতো বাবা বাড়িতে রাত কাটাবে না। সে এখন মার থাকে সরে এসে বাপের দিকে ঝুঁকেছে। তার হাতে হাত বুলোতে লাগলো, যেমন একটু আগে খরগোশটাকে করছিলো। কিন্তু বাপের হাতটা ঘামছিলো।

”শোনো, আমি আগামী ছুটিতে ইন্ডিয়া যাব। এবার পাক্কা।’ ও একটু অবাক হলো যে বাবা কিছু বলছে না; শুধু খাঁচায় খরগোশগুলোর খটর-পটর শোনা যাচ্ছে।

‘পাপা…তুমি কিছু বলছ না?’

‘তুমি তো প্রত্যেক বছরই এ কথা বলো।’

‘বলি, কিন্তু এবার ঠিক যাবোই। ডোন্ট ইউ বিলিভ মি?… চলো, ভিতরে যাই? মা নিশ্চয়ই ভাবছে আমরা কোথায় চলে গেছি।’

আগস্টের সন্ধ্যা নিঃশব্দে এসে গেছে। হাওয়ায় উইলো পাতার সরসর শব্দ। জানলার পর্দাগুলো টানা কিন্তু রান্নাঘরের দরজাটা খোলা ছিলো।

মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে সিঙ্কে হাত ধুলো। সে মেয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সিঙ্কের আয়নাতে নিজের মুখটা দেখছিলো। শুকনো মুখ, না-কামানো দাড়ি, লালচে চোখ ওর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো–না, তোমার কোনো আশাই নেই!’

‘পাপা, তুমি এখনও একা একা বিড়বিড় করো?’ মেয়ে ভিজে মুখ তুলে আয়নায় ওকে দেখছিলো।

‘হ্যাঁ, কিন্তু এখন আর কেউ আমায় শোনে না।’ সে আস্তে মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘ফ্রিজে সোডা আছে?’

‘ভিতরে চলো, আমি নিয়ে আসছি।’

ঘরে কেউ নেই। তার জিনিসগুলো ভাগ করা, সুটকেসটা এককোণে দাঁড়িয়ে। তারা যখন বাইরে ছিলো তার স্ত্রী হয়তো এইসব জিনিস দেখেছিলো, ছুঁয়েছিলো। যতই রাগ হোক না কেন, উপহারের কথাই আলাদা। সে ওগুলো উপরে নিয়ে যায়নি কিন্তু সুটকেসে তুলে রাখবারও সাহস হয়নি। ভাগ্যের উপর ছেড়ে গিয়েছে।

একটু পরে সোডা আর গেলাস নিয়ে এসে মেয়েটা হঠাৎ ঠিক ঠাহর করতে পারলো না সে কোথায় বসে আছে। ঘরটা আধো-অন্ধকার, তাকেও জিনিসপত্রের মধ্যে আরেকটা জিনিস বলেই মনে হচ্ছিলো।

‘পাপা…তুমি লাইট জ্বালাওনি?’

‘এই যে, জ্বালাচ্ছি।’

ও উঠে ঘরের সুইচটা খুঁজতে লাগলো। মেয়ে সোডা আর গেলাস টেবিলে নামিয়ে টেবিল-ল্যাম্পটা অন করে দিলো।

‘মা কোথায়?’

‘চান করছে। এখুনি আসবে।’

সে ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতলটা বার করলো। এইটা সে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে কিনেছিলো। গেলাসে ঢালতে গিয়ে তার হাত থেমে গেল। ‘তোমার জিঞ্জার-এল কোথায়?’

‘আমি এখন আসল বিয়ার খাই।’ মেয়ে হাসলো। ‘তোমার বরফ চাই?’

‘না…তুমি কোথায় চললে?’

‘খাঁচায় খাবার দিতে। নইলে ওরা নিজেদেরই খেয়ে ফেলবে।’

ও বাইরে যেতে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখা গেল। আকাশে কয়েকটা তারার ঝিকিমিকি। হাওয়া নেই। বাইরের নিস্তব্ধতা ভিতরের আওয়াজের মধ্যে ঢুকে পড়ছে যেন। ওর মনে হচ্ছে ও নিজের ঘরেই বসে, আর যা অনেক বছর আগে হওয়ার কথা ছিলো সেটাই এখন হয়ে যাচ্ছে। সে শাওয়ারের নিচে গুনগুন করত আর যখন মাথায় তোয়ালে বেঁধে বার হত জলের ফোঁটাগুলো বাথরুম থেকে ওর ঘর পর্যন্ত একটা হার বানিয়ে দিত। কে জানে কী করে সেই জলের হারটা শুকিয়ে গেল; কোথায়, কোন্‌ রাস্তার মোড়ে সেটা হাত থেকে পড়ে গেল, আর কখনওই কি সে হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতে পারবে?

সে গেলাসে আরও একটু হুইস্কি ঢালল, যদিও গেলাস তখনো খালি হয়নি। অবাক হলো ভেবে যে গত রাতেও ঠিক এই সময় সে হুইস্কি খাচ্ছিলো কিন্তু তখন সে শূন্যে উড়ছে। এয়ার হোস্টেসের ঘোষণায় জানা গেল যে তারা চ্যানেল পার হচ্ছে, কিন্তু জানলা দিয়ে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। না সমুদ্র, না লাইটহাউস, শুধু অন্ধকার, অন্ধকারের ভিতর বহমান অন্ধকার। জানলা দিয়ে ঝোঁকার সময় খেয়াল হলো যে সেই অদৃশ্য চ্যানেলটা আসলে ওর ভিতরে, ওর এক জীবন থেকে আরেক জীবন পর্যন্ত টানা। ও সেটা সর্বক্ষণ পার হচ্ছে, কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে, কখনই কোনো এক জায়গায় স্থিত নয়, কোথা থেকে আসছেও না, আর কোথাও পৌঁছচ্ছেও না…।

‘বিন্দু কোথায়?’

ও চমকে উঠে তাকালো। সে কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো কে জানে। ‘বাইরে, বাগানে,’ ও বললো, ‘খরগোশদের খাবার দিচ্ছে।’

সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, ব্যানিসটারের নিচে। চান করে একটা লম্বা ম্যাক্সি পরেছিলো…। চুল খোলা। বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে। টেবিলের উপর গেলাসটা দেখল। ওকে এখন শান্ত মনে হচ্ছে, যেন স্নানের সঙ্গে শুধু শরীরই নয়, মনের সন্তাপটাও ধুয়ে ফেলেছে।

‘বরফও আছে।’ সে বললো।

‘থাক, আমি সোডা নিয়েছি। তোমাকেও একটা করে দিই?’

সে মাথা নাড়ল, যার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে। ও জানতো গরম জলে চান করার পর তার ঠান্ডা পানীয়টা পছন্দ। এতদিন পরেও তার অভ্যাসটা ভোলেনি। এইসব পুরোনো অভ্যাসের মধ্যে দিয়েই তো পুরোনো পরিচয়টা ফিরে ফিরে আসে। সে রান্নাঘর থেকে আরেকটা গেলাসে কয়েকটা বরফ দিল। হুইস্কি ঢালবার সময় শুনল, ‘ব্যস, এই যথেষ্ট।’

কথাটা ধোয়ামোছা, কোনো রং ছিলো না। না স্নেহের, না অসন্তোষের। একটি শান্ত, স্থির স্বর। সিঁড়ি থেকে সরে সে চেয়ারের দিকে এগিয়ে এল।

‘তুমিও বসো না।’ ও একটু চিন্তিত সুরে বললো।

স্ত্রী গ্লাসটা নিয়ে স্টুলের উপর বসলো। দুপুরে ঠিক যেখানে বসেছিলো। টিভির কাছে কিন্তু টেবিল-ল্যাম্প থেকে দূরে–যেখানে আলোটা আবছা হয়ে ওর উপর পড়ে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর স্ত্রীর আওয়াজ শোনা গেল, ‘বাড়িতে সবাই কেমন?’

‘ঠিকঠাক। এসব জিনিস তারাই পাঠিয়েছে।’

‘জানি।’ ক্লান্ত স্বর। ‘কেন ওদের মিছিমিছি ব্যস্ত করো? তুমি টেনে টেনে এই সব নিয়ে আসো আর এখানে পড়ে থেকে নষ্ট হয়।’

‘ওরা শুধু এইটুকুই করতে পারে। তুমি তো অনেক বছর যাওনি। ওরা তোমায় মনে করে।’

‘এখন আর গিয়ে কী হবে।’ গেলাসে লম্বা চুমুক দিলো। ‘এখন তো আর কোনো সম্বন্ধই নেই।’

‘তুমি মেয়েটাকে নিয়ে আসতে পারো। ও তো ইন্ডিয়া দেখেইনি কখনো।’

ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর শান্ত স্বরে বললো, ‘আসছে বছরে ও চোদ্দোয় পড়বে… আইন অনুসারে তখন যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে।’

‘আমি আইনের কথা বলছি না। তোমায় ছাড়া ও কোথাও যাবেই না।’

স্ত্রী গ্লাসের ভিতর দিয়ে স্বামীকে দেখল। ‘আমার ক্ষমতা থাকলে ওকে কখনই যেতে দিতাম না।’

‘কেন?’ সে তাকালো।

‘কেন?’ ম্লান হাসির সঙ্গে বললো, ‘আমরা দুই ভারতীয় যথেষ্ট নই?’

একটু পরে কিচেনের দরজা খুলে মেয়েটি ভিতরে এল। চুপ করে মা-বাবাকে দেখে সিঁড়ির দিকে সরে গেল, টেলিফোনের কাছে।

‘কাকে ফোন করছ?’ মা জিজ্ঞেস করলো।

মেয়ে চুপ করে ডায়াল ঘোরাচ্ছিলো।

স্বামী উঠে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আরেকটু নেবে?’

‘না,’ সে মাথা নাড়ল। স্বামী নিজের গেলাসটা ভরে নিল।

‘একটু বেশিই খাচ্ছ আজকাল?’ স্ত্রী মন্তব্য করলো।

‘না…’ সে মাথা নাড়ল। ‘জার্নির সময় একটু বেশি হয়ে যায় আর কি।’

‘আমি ভেবেছিলাম এতদিনে তুমি থিতু হয়ে বসবে।’

‘কী করে এমন ভুল ভাবলে?’ সে তাকালো বউয়ের দিকে।

স্ত্রী কিছুক্ষণ নীরব চোখে তাকিয়ে রইল, ‘কেন? সেই মেয়েটি? তোমার সঙ্গে থাকে না?’ তার গলায় কোনো উত্তেজনা ছিলো না, না কোনো কষ্টের ছায়া। যেন তারা অনেকদিন পর কোনো ঘটনার আলোচনা করছে যা একদিন তাদের দুজনকে দুদিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলো।

‘আমি একলা থাকি…মা’র সঙ্গে।’

‘কেন, কী হয়েছিলো?’ স্ত্রী অবাক।

‘কিছু না। হয়তো আমিই কারুর সঙ্গে থাকার যোগ্য নই।’ খুব নিচু স্বরে বললো যেন কোনো গুপ্তরোগের বিষয়ে বলছে, ‘তুমি অবাক কেন? এরকম তো অনেকেই থাকে…’ হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলো, প্রেমের বিষয়ে, আনুগত্যের বিষয়ে, বিশ্বাস বা প্রতারণার বিষয়ে, বড়ো কোনো সত্য যা অনেক মিথ্যা মিলিয়ে তৈরি, হুইস্কির ঝাঁঝে বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠে যা পরমুহূর্তেই অন্ধকারে মিলিয়ে যায় চিরদিনের জন্য…

মেয়েটি এই মুহূর্তের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলো। ফোন নামিয়ে রেখে বাপের পাশে এসে বসলো। একবার মাকে দেখে নিলো, সে টেবিল-ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোয় লুকিয়ে, আর লোকটি? তাকে গেলাসের পিছনে একটা জ্বলজ্বলে দাগের মতো দেখাচ্ছিলো।

‘পাপা?’ তার হাতে একটা কাগজের টুকরো, ‘এই নাও হোটেলের নাম। ট্যাক্সি দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেবে।’

সে কাগজটা পকেটে রেখে মেয়েকে কোলে টেনে নিলো। কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে বসে, যেমন তারা অনেকদিন আগে, কোথাও বেরুবার সময়, একটুক্ষণ সবাই মিলে চুপ করে বসতো। বাইরে অনেক তারা, তার মধ্যে উইলো গাছ, ঝোপঝাড় আর খরগোশের খাঁচাটা অস্পষ্ট আলোয় একসঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিলো।

সে গেলাসটা টেবিলে রেখে মেয়ের কপালে একটা চুমু খেল। সুটকেসটা তুলে নিয়ে দরজায় পা বাড়িয়েই এক মুহূর্ত থামলো। ‘আমি আসি।’ কথাটা কাকে বললো ঠিক বোঝা গেল না। যেখানে স্ত্রী বসেছিলো সেখান থেকে কোনো উত্তর এল না। ভিতরের নীরবতা বাইরের অন্ধকারের মতোই গভীর।

সেই অন্ধকারে সে পা বাড়ালো।

মূল গল্প ‘এক দিন কা মেহমান’ সংগৃহীত হয়েছে: ‘হিন্দী কাহিনী সংগ্রহ’—নির্মল ভার্মা; সম্পাদক-ভীষ্ম সাহানি; প্রকাশনা-সাহিত্য একাডেমী ১৯৫৯

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments