Saturday, April 27, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পদোলা - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দোলা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দোলা - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গাড়ি বদল করতে হয় মধুডিহি জংশনে।

আর যে–গাড়ি নিয়ে যাবে আপনাকে লামডিঙে তা আগাগোড়া ছবি–আঁকা। কী নরম আর চকচকে গদির আসন গাড়ির ভিতরে। আর কী মিঠে ইনজিনের ভেঁপু। কু-ঝিক–ঝিক ট্রেন মধুডিহি ছাড়িয়েই বাঁক নেবে মায়াবী জগতে। সবুজ অরণ্যের ডালপালা এসে হাত বুলোবে রেলগাড়ির গায়ে। একটু দুলে–দুলে চলবে মন্থর গাড়ি। খেয়াল করে শুনবেন গাড়ির চাকা ঠিক যেন পালকির গান গাইছে। কোথাও-কোথাও গাড়ি থামে, জল নেয়। ছোট্ট–ছোট্ট পুতুলবাড়ির মতো রঙিন স্টেশন। রাঙা মোরামে ছাওয়া প্ল্যাটফর্ম নিবিড় গাছের ছায়ায় ঝিম মেরে আছে। অনেক পাখির শিস শোনা যায় আর নেপথ্যে কুলুকুলু কোনও প্রবাহিত ছোট নদীর শব্দ। গাড়ি রেলপোল পার হয়ে মলের শব্দ তুলে। মাঝে-মাঝে ছোট উপত্যকায় দেখা যাবে শান্ত গভীর দল চরছে। দেখা যাবে মাটির ওপর নেমে এসেছে রাঙা গোধূলির মেঘ।

জ্যোৎস্নারাত্রি। আকাশভরা সোনালি চাঁদ। চারদিকে ম–ম করা ফুলের গন্ধ। নাতিশীতোষ্ণ এক বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সন্ধের একটু পরেই যখন লামডিঙের ছোট্ট স্টেশনে গাড়িটি থামবে তখন চারদিকে চেয়ে আপনি অবাক হয়ে বলে উঠবেন, আরে! ঠিক এরকম একটা জায়গাই তো আমি খুঁজছিলুম।

সবাই খোঁজে, ভাগ্যবানেরা পৌঁছে যায়।

এরকমই এক জ্যোৎস্নাময় রাতে লামডিঙের একমাত্র দুঃখী মানুষ জীবনলাল পথে–পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার দুঃখের তেমন কোনও কারণ অবশ্য নেই। কিন্তু কিছু লোক দুঃখী থাকতে ভালোবাসে। জীবনলাল চাঁদ উঠলে দুঃখ পায়, পাখি ডাকলে দুঃখ পায়, ভালো খাবার খেলে দুঃখ পায়, ভালো স্বপ্ন দেখলে দুঃখ পায়। কেবল বলে, চারদিকে এত দুঃখ! এত দুঃখ!

একদিন বুড়ো সূর্যকান্ত জীবনলালকে রাস্তায় পাকড়াও করলেন, হ্যাঁ হে জীবনলাল, তোমার দুঃখটা ঠিক কীসের তা বুঝিয়ে বলতে পারো?

জীবনলাল দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল , আমার দুঃখের কি শেষ আছে? চারদিকে যেন দুঃখেরা ওত পেতে বসে আছে। আকাশেদুঃখ, বাতাসে দুঃখ, জলে স্থলে দুঃখ।

কিন্তু কই আমরা তো কিছু টের পাই না?

এ কথায় জীবনলাল আরও কত দুঃখ পেয়ে বলল , তাহলে কি আমি ভুল বলছি?

সূর্যকান্ত তাঁর লম্বা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, লামডিঙে থাকতে–থাকতে দুঃখের ব্যাপারটা আর আমার স্মরণ হয় না। খাওয়া পরার দুঃখ নেই, ঝগড়া কাজিয়া নেই, শোক তাপও নেই, তবে দুঃখটা যে কীসের সেটা বুঝতে পারছিনা।

জীবনলাল একটা বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল , লামডিঙ তো দুঃখেরই দেশ। গাছে গাছে যে ফুল ফোটে ফল ফলে তাও আসলে দুঃখেরই প্রকাশ। আকাশে দুঃখের নীল। দুঃখের জ্যোৎস্নায় চারদিকে বান ডেকে যায়। বড় দুঃখ। বড়ই দুঃখ।

জীবনলাল চলে গেলে সূর্যকান্ত তাঁর পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে গম্ভীর মুখে আপনমনেই ‘হুঁ’ দিলেন। ব্যাপারটা তাঁর সত্যিই বোধগম্য হচ্ছে না। লামডিঙে দুঃখ! কীসের দুঃখ? কোথায় দুঃখ?

হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরে তিনি হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। সামনে দুঃখ, ওপরে দুঃখ, নীচে দুঃখ। জীবনলাল যেদিকে চায় সেদিকেই দুঃখ দেখতে পায়। সব সময় তার বুক হু-হু করে। চোখ ছলছল করে, মাথার ভিতরটা ধূসরবর্ণ হয়ে থাকে।

কে যেন বলে উঠল, এই যে জীবনভায়া, খবরটবর কী?

জীবন দেখল, বেঁটে মতো একটা লোক বগলে দাবার ছক নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। এ হল বটেশ্বর, ভারী ঝগড়ুটে লোক। প্রায় সকলের সঙ্গেই তার ঝগড়া।

জীবন শুষ্ক মুখে বলল , খবর আর ভালো কী? দুঃখের জীবন যেমন কাটবার তেমনি কাটছে।

দুঃখী জীবনলালের দুঃখের কথা সবাই জানে। বটেশ্বর তাই মাথা নেড়ে বলল , তা তো বটেই। তা আজ কী কাণ্ডটা হল তা কি জানো? সাধুচরণকে দিলুম হারিয়ে। ব্যাটার সঙ্গে অনেকদিন ধরেই একটা ঝগড়া পাকানোর তালে ছিলুম। আজ লেগে গেল। একেবারে গো হারান যাকে বলে তাই হারালুম। দুটো গজ, একটা ঘোড়া, দুটো নৌকা আর মন্ত্রী সমেত হেরে গেল।

লামডিঙের নিয়ম হল, ঝগড়াঝাঁটি চলবে না। তবে নিতান্তই কারও সঙ্গে কারও ঝগড়া লেগে গেলে দু-পক্ষই দাবা খেলতে বসবে। যে জিতবে সে-ই ঝগড়ায় জিতেছে বলে ধরা হবে। দাবা খেলাই হচ্ছে লামডিঙের ঝগড়া।

জীবনলাল গম্ভীর মুখে বলল , তাহলে তো আপনার খুব সুখের দিন আজ।

বটেশ্বর খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল , তা তো বটেই। ভারী আনন্দ হচ্ছে।

আমার হচ্ছে না।

এই বলে বিরস মুখে জীবনলাল ফের হনহন করে হাঁটতে লাগল।

উলটোদিকে বটেশ্বরও হাঁটতে লাগল, তবে হনহন করে নয়। সাধুচরণকে যে সে আজ হারিয়েছে এই সাঙ্ঘাতিক খবরটা জনে–জনে দিতে হবে তো। হেঁকে–হেঁকে সে চারদিককে শুনিয়ে বলতে লাগল, দিয়েছি হারিয়ে সিংহের বাচ্চাটাকে। খুব বাড় বেড়েছিল। আজ একেবারে লেজে গোবরে করে ছেড়েছি বাঘের বাচ্চাটাকে।

আসলে বটেশ্বর সাধুচরণকে শুয়োরের বাচ্চা বা কুকুরের বাচ্চাই বলতে চাইছে। তবে এগুলো গালাগাল বলে চিহ্নিত থাকায় লামডিঙের মাতব্বরেরা একদিন পাঁচমাথা এক হয়ে ঠিক করলেন, শুয়োর কুকুরও জন্তু, বাঘ সিংহও জন্তু। আর বাঘ সিংহ কুকুর বা শেয়ালের চেয়ে কিন্তু উঁচু দরের জন্তুও নয়। তবু কুকুরের বাচ্চা বা শুয়োরের বাচ্চা বললে মানুষ রেগে যায়, কিন্তু বাঘের বাচ্চা বা সিংহের বাচ্চা বললে ভারী গৌরব বোধ করে। তাই ঠিক করা হল, কেউ কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বলতে চাইলে সিংহের বাচ্চা আর কুকুরের বাচ্চা বলতে চাইলে বাঘের বাচ্চা বলবে। সেই নিয়মই চালু রয়েছে।

অনেকটা হেঁটে ক্লান্ত জীবনলাল একটি বনস্থলীতে ঢুকে পড়ল। লামডিঙে এরকম বড়-বড় কুঞ্জবন মেলা রয়েছে। এসব বনভূমির সৌন্দর্য দেখার মতো। চারদিকে বড়-বড় গাছের অবরোধ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে ফুলের বন্যা। মাঝখানে দীর্ঘ সরোবর। তাতেও নানা জলজ ফুল ফুটে আছে। নানা আকারের ছোটো বড় বর্ণময় নৌকো বাঁধা রয়েছে ঘাটে। যে–খুশি নৌকাবিহারে বেরিয়ে পড়তে পারে। কুঞ্জবনে অনেক পাখি ডাকছে, প্রজাপতি ও মধুকরেরা উড়ে বেড়াচ্ছে।

জীবনলাল কুঞ্জবনের নরম ঘাসের ওপর বসে জীবনের নানা দুঃখের কথা ভেবে ঘন–ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। সূর্য অস্তাচলে চলে যাচ্ছে, পাখিরা নীড়ে ফিরছে, দিন শেষ হয়ে আসছে, এসবও জীবনলালের দুঃখের কারণ।

লামডিঙের ভূতেদের খ্যাতি ও অখ্যাতি দুই-ই আছে। তারা ভালোও করে, মন্দও করে। লামডিঙের মজারু ভূত ঘেন্টু একটা কদম গাছের ডালে বসে চারদিককার শোভা দেখছিল। শশাভা দেখতে সে ভারী ভালোবাসে। শোভা দেখতে দেখতে সে হঠাৎ দেখতে পেল, জলের মধ্যে একটা ছোট্ট নীল ডোঙায় একটি ভারী সুন্দরী মেয়ে মুখখানা গোমড়া করে বসে আছে। এরকমটা হওয়ার কথা নয়। লামডিঙে একমাত্র জীবনলাল ছাড়া আর গোমড়ামুখো মানুষ কেউ নেই।

তবে ঘেন্টু ভালো করে নিরীক্ষণ করার পর বুঝল মেয়েটি হল টগর। টগরের একটা দুঃখ আছে ঠিকই। তার বিয়ের বয়স হয়েছে, কিন্তু কোনও ছেলেকেই তার পছন্দ হচ্ছে না। তার কারণ ছেলেগুলো কেমন যেন ছ্যাবলা, মোটা, অতিরিক্ত আহ্লাদী, কোনও কাজের নয়। সেইজন্য ইদানীং টগরের ভারী মন খারাপ যাচ্ছে। ডোঙায় বসে তাই সে নানা কথা ভাবছে।

ঘেন্টু ঘাসবনের মধ্যে দুঃখী জীবনলালকেও দেখতে পাচ্ছিল। বিরস মুখে বসে জীবনলাল ঘন–ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

ঘেন্টুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে গাছের ডালে বসে ঠ্যাং দোলাতে–দোলাতে হাতে হাত ঘষে মন্ত্রপূত ফুঁ দিল। সঙ্গে-সঙ্গে চারদিকে একটা ঝড়ের বাতাস উঠল। জলে বড়-বড় ঢেউ দিতে লাগল। ডোঙাটা মাঝ–দীঘিতে ভীষণ দুলতে লাগল। টগর তার বাঁশির মতো গলায় পেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও! বাঁচাও!

দুঃখী জীবনলাল চারদিকে দুঃখের ঝড় উঠতে দেখে আরও মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। সে চোখ বুজে ভাবছিল, এত দুঃখ নিয়ে, দুঃখের ওপর দুঃখ নিয়ে কী করে বেঁচে থাকা যায়?

ঠিক এই করুণ মুহূর্তে তার দুঃখিত হৃদয়কে আরও রক্তাক্ত করে দিতে টগরের আর্তস্বর কানে এসে পৌঁছোল। সে উঠল এবং জলের ধারে গিয়ে অনেক দূরে মাঝদরিয়ায় বিপন্ন ডোঙাটি দেখতে পেল। এই দুঃখময় লামডিঙে বেঁচে থাকার যদি কোনও মানেই হয় না, তবু জীবনলালের মনে হল, এই মেয়েটি হয়তো বাঁচতে চায়। এখানকার বোকা সুখী লোকেরা তো বাঁচতেই চাইবে।

জীবনলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বোকা–সুখী মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে। বড়-বড় ঢেউ কেটে এগিয়ে গিয়ে জীবনলাল ডোঙাটি ধরল এবং ডাঙায় টেনে আনল।

সঙ্গে-সঙ্গে ঝড় থেমে গিয়ে দিনশেষের সোনালি আলোয় চারদিকটা স্বপ্ন পুরীর মতো হয়ে গেল। আর সেই আলোয় জীবনলালের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল টগর, এরকম দুঃখী সুন্দর মুখশ্রী তো সে এর আগে আর কারও দেখেনি!

জীবনলালও মেয়েটির মুখে একটা বিমর্ষতা লক্ষ করছিল, যা লামডিঙের কোনও মেয়ের মুখে সে কখনও দেখেনি।

ঘেন্টু কদমগাছের ডালে বসে বড়-বড় দাঁত বের করে খুব হি–হি করে হাসছিল। মাঝে মাঝে রগড় না করলে তার পেটে বড় বায়ু হয়।

তা সোনালি আলোটা আজ রইলও অনেকক্ষণ। টগর আর জীবনলালের ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত না দেখে সূর্যদেবও পাটে বসতে পারছিলেন না। কোনও কাজ আধখ্যাঁচড়া হয়ে থেকে গেলে তাঁরও ভারী বায়ুর উৎপাত হয়। তাই তিনি সাত ঘোড়ার লাগামটা চেপে রইলেন। ওদিকে চাঁদমামা উঠে পড়েছেন আকাশে, কিন্তু সূর্যদেব বিদেয় না হলে তাঁরও বিশেষ খাতির হচ্ছে না। তাই তিনি রীতিমতো চটে উঠে বললেন, ওরে বাপু, এসব হৃদয়ের কারবারে তোমাকে কে আবার কবে ডেকেছে বলো তো! ওসব আমার কেস। চাঁদ না হলে কি হৃদয় এক হয় রে ভাই। এখন বাড়ি যাও তো, আমার কাজ আমাকেই করতে দাও।

তা চাঁদটাও উঠল আজ বড় জোর। যেন একেবারে পিচকিরি দিয়ে জ্যোৎস্না ছিটোনো হতে লাগল চারধারে। সোনার গুঁড়ো দিয়ে বৃষ্টি ঝরালে যা হয় অবিকল তাই।

তা টগর আর জীবনলাল বাক্যহারা হয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল।

এরপর ঘণ্টাখানেকের ঘটনা আমরা চেপে যাই বরং। তবে ঘণ্টাখানেক বাদে টগর ধরা–ধরা গলায় জিগ্যেস করল, তোমার দুঃখ কি ঘুচেছে?

জীবনলাল ঘাড় কাৎ করে বলল , এক্কেবারে নেই। তবে কী জানো, দুঃখ যে চলে গেল সেটাও একটা দুঃখ। আমার যেন দুঃখ হচ্ছে।

শুধু জীবনলাল আর টগরকে নিয়ে থাকলেই তো আর চাঁদমামার চলে না, তাঁর আরও পাঁচটা যজমান আছে, খদ্দের আছে, ফ্যান আছে। সবাইকেই দেখতে হয়। আজ চাঁদমামার হাতটাও বেশদরাজ। ধামা ধামা সোনার গুড়ো ঢালছেন ইচ্ছেমতো।

সূর্যকান্তের পাকা দাড়িতে সোনার গুঁড়ো মেলাই জমে গেল। তিনি একটা চিরুনি দিয়ে দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে সোনার গুঁড়ো ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগলেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে ভাবতে লাগলেন, আচ্ছা জীবনলালের দুঃখটা কীসের? দুঃখ জিনিসটাই বা কীরকম? এত বয়স হয়ে গেল, একটু দুঃখ চেখে দেখলে হত। দুঃখের স্বাদই যে বুঝলুম না। ভাবতে-ভাবতে তিনি বাগানে। বেড়াতে লাগলেন।

লামডিঙের বিখ্যাত ভূত হল ঘড়িরাম। সে কাছাকাছি থাকলেই টিকটিক শব্দ পাওয়া যায়। টিকটিক শব্দটা শুনেই সূর্যকান্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ইয়ে, ওহে ঘড়িরাম, একটা কথা।

ঘড়িরাম অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয়ে সামনে দাঁড়াল, তার রীতিমতো জোয়ান চেহারা। মাথাটা কামান। মুখখানা খুব গম্ভীর। ঘড়িরামের বউ মেরিও তার পাশে দাঁড়ানো। ভারী সুন্দর ফুটফুটে মেমসাহেব।

ঘড়িরাম গম্ভীর গলায় বলল , কী কথা?

ইয়ে দুঃখ জিনিসটা কীরকম বলতে পারো?

ঘড়িরাম খুব গম্ভীর হয়ে বলল , দুঃখ কাকে বলে তা জানতাম বটে, কিন্তু অনেককাল হয়ে গেল, এখন আর ঠিক মনে নেই। তবে জিনিসটা খুব খারাপ।

সূর্যকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, তাই হবে। কিন্তু জিনিসটা একটু চোখে না দেখলে ঠিক জুত হচ্ছে না।

ঘড়িরাম দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল , আজ্ঞে আমার কিছু করার নেই। দুঃখ জিনিসটা কেমন তা আমিই কবে ভুলে মেরে দিয়েছি।

ঘড়িরাম আর মেরি চলে যাওয়ার পর সূর্যকান্ত একা একা জ্যোৎস্নায় পায়চারি করতে লাগলেন। দুঃখ জিনিসটা ঠিক কীরকম? দুঃখ হলে কীরকম লাগবে?

ঠিক এই সময় জ্যোৎস্না ছুঁড়ে নাট্যকার বিপুলবিহারী দশাসই চেহারা নিয়ে এসে হাজির। বিপুলবিহারীর হাতে একখানা টেস্ট টিউব। তাতে খানিকটা জ্যোৎস্না ভরে নিয়ে একটু নেড়ে ছিপিটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, এই যে সূর্যদা, কী খবরটবর?

আচ্ছা বিপুলবিহারী, দুঃখ জিনিসটা কেমন বলতে পারো?

বিপুলবিহারী প্রবলভাবে অট্টহাস্য করে বললেন, আমি তার কী জানি বলো? সারাদিন নানা নাটকের মহড়া করে চলেছি আপনমনে। সুখ দুঃখ কিছুই টের পাই না। এই জ্যোৎস্নার সঙ্গে খানিকটা গ্লিসারিন মিশিয়ে তবে নায়িকার চোখের জল বানাতে হবে। দেশের এমন দুর্দশা যে নায়িকা কাঁদতে পর্যন্ত শেখেনি। আর শেখাবেই বা কে বলো? এদেশে একটা লোকও কি কাঁদতে জানে? ধরেছিলুম দুঃখী জীবনলালকে, তা সে বলল , আমার বড় দুঃখ, ওসব নাটুকে কান্না শেখানোর মতো মন আমার নেই।

সূর্যকান্ত বললেন, তাই তো হে, এ তো ভারী বিপদের কথা।

বিপুলবিহারী চলে গেল। সূর্যকান্ত একা জ্যোৎস্নায় একটা পাথরের ওপর বসে রইলেন। দুঃখ জিনিসটা না চাখলে মুখটাই যে মাটি হবে তাঁর। দুঃখ জিনিসটা কেমন তা না বুঝলে সুখটাকেই বা চেনা যাবে কী করে? বটেশ্বর আজ রাতে আর-এক পাটি দাবা না খেলে পারবে না। সাধুচরণটা বড্ড অল্পেই হেরে গেল। কিন্তু বটেশ্বর আর খেলুড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। এমনকী ঘেন্টুটা অবধি পিছিয়ে গেল দাবার নাম শুনে।

তবে ভয় নেই। লামডিঙের দক্ষিণের বনের ধারে রোজ রাতেই অন্য গ্রহের জীবেরা ঘাসপাতা খেতে তাদের মহাকাশযান করে চলে আসে। বটেশ্বর দাবার ছক বগলে চেপে, হাতে খুঁটির পুঁটুলি নিয়ে সেইদিকেই রওনা হল।

ঠিক বটে, আজও গোটা দুই বিটকেল মহাকাশযান নেমেছে। লিকলিকে চেহারার কয়েকটা জীব ঘাসপাতা খাচ্ছে আর ইতিউতি তাকাচ্ছে। ভারী ভীতু জীব।

বটেশ্বর হাঁক দিল, ওহে, ভয় নেই, এসো একটু দাবা খেলা যাক।

প্রথমটায় কেউ ভয়ে কাছে এল না। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর একটা জীব এগিয়ে এল।

বটেশ্বর মহা খুশি। দাবার ছক সাজিয়ে ফেলল ঘাসের ওপর বসে। জীবটা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না বলে চালগুলো শিখিয়ে দিল। কিন্তু খেলা শুরু হতে না হতেই বটেশ্বর বুঝতে পারল, জীবটা ভারী বুদ্ধিমান। দারুণ খেলছে। বটেশ্বরের চার চারটি জোরালো বল মেরে দিল দশ চালের মধ্যে। বাইশ চালে মাত হয়ে গেল বটেশ্বর। জীবটার গলা জড়িয়ে ধরে বটেশ্বর গদগদ স্বরে বলল , আহা, কী খেলাটাই খেললে হে, দেখার মতো।

পিছন থেকে ঘড়িরামের গম্ভীর গলা বলে উঠল, আপনার লজ্জা করছে না বটেশ্বরবাবু? অন্য গ্রহের জীবদের কাছে হেরে গেলেন! যাই বলুন, আমি ব্যাটাকে ঢিট করছি।

ঘড়িরাম একটু চাঁছাছোলা লোক। বটেশ্বর তাকে ভয়ও খায়। সে তাড়াতাড়ি সরে বসল। ঘড়িরাম বসে পড়ল খেলতে।

জ্যোৎস্নাটা বড় জোর নেমেছে আজ। ভাসিয়ে দিচ্ছে চারধার।

মৃত্যুপুরীর চারজন মুশকো পেয়াদা আজ ডিউটি দিতে লামডিঙের আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করে। খুব যে সুবিধে করতে পারে এমন নয়। লামডিঙের লোকদের আয়ু বেজায় লম্বা। আর তাদের কাছে পরোয়ানাও বড় একটা থাকে না যে কাউকে নিয়ে যাবে। তবু লামডিঙে রোজই তারা এসে ঘুরঘুর করে। এখানকার বিখ্যাত জ্যোৎস্নায় বসে একটু গা জুড়োয়। কথিত আছে লামডিঙের জ্যোৎস্নায় গেঁটে বাত, সর্দিকাশি আর বায়ু রোগে খুব উপকার হয়। লামডিঙের বাতাসে হাঁফানি, পিত্তের দোষ আর ধাতু দৌর্বল্য সেরে যায়। লামডিঙের জলের তো তুলনাই নেই, পেটের সব গণ্ডগোল সাফ করে দেয়। লোকে বলে, লামডিঙের লোকদের ইচ্ছামৃত্যু। কিন্তু সেই ইচ্ছাটাও বড় একটা কারও হয় না।

তা পেয়াদারা তবু আসে, আনাচে কানাচে ঘোরে, কারও মরার ইচ্ছে জাগে কি না তা খেয়াল রাখে।

পেয়াদাদের লামডিঙের লোকেরা ভালোই চেনে। তবে বিশেষ পাত্তা দেয় না। দেখা হলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যায়।

আজ রাতে পেয়াদারা হরগোবিন্দবাবুর দুশো বাইশ বছর বয়সি ঠাকুমার ঘরের কাছে ঘুরঘুর করল খানিক। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এ বয়সে মাঝে-মাঝে মানুষ শখ করেও তো এক আধবার বলে, আর কেন, এবার মরলেই হয়।

কারও মুখ থেকে একবার এরকম একটু ইচ্ছের কথা বেরোলেই পেয়াদারা অমনি সাপুটে ধরে আত্মাটাকে এক ঝাঁকুনিতে বের করে দেবে। পেয়াদারা হরগোবিন্দর ঠাকুমার ঘরের খোলা জানলায় ঘাপটি মেরে কান পেতে রইল। কিন্তু বুড়ি মহা ট্যাটন। আপনমনে নানা কথা বকবক করে যাচ্ছে বটে, মরবার কথাটি মুখে আনছে না।

সূর্যকান্ত বাগানে বেড়াতে–বেড়াতে ভারী চিন্তিত হাত দাড়িতে বোলাচ্ছিলেন এমন সময় পাশেই হরগোবিন্দর বাড়ির জানালায় চারটে মুশকোমতো লোককে দেখে হেঁকে বললেন, কে। ওখানে?

পেয়াদারা ভারী জড়সড়ো হয়ে কাঁচমাচু মুখে বলল , এই আজ্ঞে, আমরা।

সূর্যকান্ত পেয়াদাদের ভালোই চেনেন।

ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন। বললেন, তা সুবিধেটুবিধে কিছু করতে পারলে হে বাপু?

হেড পেয়াদা দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল , আজ্ঞে না, একেবারেই সুবিধে হচ্ছে না। কাজ কারবার লাটে উঠবার জোগাড়।

কেউ মরছে না বুঝি?

মোটেই মরছেন না। সেই বছর দশেক আগে বটেশ্বরবাবাকে জুতমতো পেয়ে গিয়েছিলুম। তারপর থেকে একেবারে জালে মাছিটি পড়ছে না।

বটেশ্বর! কোন বটেশ্বর বলল তো! বেঁটে বটেশ্বর নাকি?

আজ্ঞে তিনিই।

যে দাবা খেলে বেড়ায়।

আজ্ঞে দাবাড়ু বটেশ্বরই বটেন।

সূর্যকান্ত ভারী চটে উঠে বললেন, মরেছে যে খবরটা তো হতভাগা একবারও মুখ ফুটে আমাকে বলেনি। অথচ রোজ দেখা হচ্ছে। এই একটু আগেও তো দেখলুম তাকে।

বোধহয় চেপে যেতে চাইছেন।

সূর্যকান্ত দাড়ি নেড়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, চেপে গেলেই হল! জন্মমৃত্যুর একটা রেজিস্টার আছে তো। তা ছাড়া বাঁচা তোক আর মরা লোকে কিছু তফাতও আছে। তফাতটা না থাকলে চলবে কী করে?

হেড পেয়াদা মাথা চুলকে বলল , বটেশ্বরবাবু যে মরেছেন তা তিনি স্বীকার করতেই চান না যে!

মরতে তাকে বলেছিলই বা কে?

নিজেই বলেছিলেন। সেবার বাঘা দাবাড়ু কালীকেষ্টকে হারিয়ে ভারী খুশি হয়ে বলে ফেলেছিলেন, আহা এরকম এক চাল খেলতে পারলে মরে গেলেও দুঃখ নেই। যেই বলা অমনি আমরা ঘপাৎ করে–

বুঝেছি। তা মরাটা খুব কঠিন ব্যাপার নাকি?

আজ্ঞে মোটেই না। ব্যথাটেথা নেই, ধড়ফড়ানি নেই, একেবারে জামা ছাড়ার মতো সহজ ব্যাপার।

সূর্যকান্ত চোখ ছোট করে বললেন, আর সুবিধেটুবিধে কী দিচ্ছ? মানে, একটা লোক কিছু না পেলে খামোখা মরতেই বা যাবে কেন?

হেড পেয়াদা একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে ভারী উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল, আজ্ঞে সুবিধে মেলা। বেঁচেবর্তে যেমন আছেন প্রায় তেমনই থাকবেন। সুবিধে হল, ইচ্ছেমতো অন্তর্ধান। করা যায়। ইচ্ছে হলে গ্রহ নক্ষত্রে ঘুরে আসা যায়। স্বর্গ–মর্ত পাতাল কোথাও যাওয়া আটকায় না। তারপর ধরুন কাজকর্মও কিছু নেই, সারাদিন ফুর্তি করে বেড়ালেই হয়। হোঁচট খেয়ে যদি পড়ে যান, দরজায় যদি আঙুল চিপে যায়, ছাদ থেকে যদি পড়ে যান তাহলেও ব্যথা লাগবে না। তারপর ধরুন, রোগবালাই নেই, খিদেতেষ্টা নেই, খরচাপাতি নেই। একেবারে ঝাড়া হাত-পা। হয়ে গেলেন আর কি।

সূর্যকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বললেন, দূর। ও আর এমনকী? সুখে–সুখে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গেল, মরার পরও যদি কেবল সুখ ছাড়া আর কিছু না থাকে তাহলে ফের একঘেয়ে লাগবে। না হে বাপু, মরাটরা আমার পোষাবে না।

হেড পেয়াদা হতাশ হয়ে করুণ গলায় বলল , একবার একটু মরে দেখতে পারতেন কিন্তু। খারাপ লাগত না। শুনতে যতটা খারাপ আসলে মরা ব্যাপারটা ততটা খারাপ নয়।

সূর্যকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, অন্য জায়গায় দ্যাখো গে বাপু। আমার কাছে সুবিধে হবে না।

দুঃখী জীবনলাল আর টগর জ্যোৎস্নায় পাশাপাশি হাঁটছিল। সোনার গুঁড়োয় দুজন একদম মাখামাখি। দুজনে খুব ঘেঁষাঘেঁষি। জীবনলাল ফের তার দুঃখের কথাই বলছিল, দুঃখ ঘুচে যাওয়ার দুঃখ।

টগর শুনছিল। শুনতে তার ভারী ভালো লাগছিল।

পেয়াদারা কিছুক্ষণ তাদেরও পিছু নিল। দুঃখের কথা বলতে-বলতে যদি জীবনলালের একবারটি অন্তত মরার ইচ্ছে জাগে। তাহলে ঘপাৎ করে–

তা এইসব নিয়েই হল লামডিং। রোজ সেখানে জ্যোৎস্না ফোটে। রোজ সেখানে অন্য গ্রহের জীব আসে। রোজ ভূতুড়ে আর অদ্ভুতুড়ে নানা ঘটনার স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু লামডিঙের গল্প কখনও শেষ হয় না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments