Saturday, April 27, 2024
Homeরম্য গল্পদিলীপ - লীলা মজুমদার

দিলীপ – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

আজকাল যে শহরটাকে পুনে বলে, সেখানে একজন আশ্চর্য মানুষ থাকতেন। ৮০-র ওপর বয়স, লম্বা লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় টাক, মোটা শরীর, কানে কম শুনতেন, শরীরও বেশ অক্ষম হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনিই ছিলেন এযুগের বাণীর বরপুত্র। বছর দুই হল তিনি পরলোকে গেছেন।

তাঁর নাম দিলীপকুমার রায়। ইদানীং লোকে তাঁকে নিয়ে আর মাতামাতি করত না। কারণ তিনি ধর্মের বিষয়ে ছাড়া গদ্যও লিখতেন না, কবিতাও লিখতেন না। আর যে মহৎ গুণের জন্য তাঁকে দেশকালোত্তর বলা যায়, যে ক্ষেত্রে তিনি একক আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই সংগীতও ধর্ম বিষয়ে ছাড়া তিনি গাইতেন না।

এক হাজারের ওপর গান নিজে রচনা করেছেন। তার চেয়েও বেশি গানে সুর দিয়েছেন। কিছু কাল আগে রবীন্দ্রসদনে তাঁর ভক্তবন্ধুরা মিলে একটি গানের আসরের ব্যবস্থা করেছিলেন। বেশিরভাগ গান ও সুরই দিলীপকুমারের রচনা, কিছু তাঁর শিষ্যদের। অন্যরকম হাওয়া, অন্যরকম মেজাজ। দিলীপকুমার নিজে উপস্থিত থাকলে, তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের গুণে আর দেবদুর্লভ কণ্ঠের মাধুর্যে সেই বিশেষ সন্ধ্যাটি সে বছরের, আর শুধু সে বছরের কেন, অনেক বছরের আর সব সন্ধ্যা থেকে দশগুণ উজ্জ্বল হয়ে মনের মধ্যে ধরা থাকত।

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একমাত্র ছেলে দিলীপ যখন ছোট ছিলেন, তখন থেকেই যে তাঁকে দেখত সেই স্তম্ভিত হয়ে যেত। শেষ বয়সের দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখের রূপ বোঝা যাবে কী করে? কিন্তু ২৫ বছর আগেও, তাঁকে দেখলে চোখ ফেরানো যেত না। একটা মানুষ কী করে এত রূপ-গুণের অধিকারী হতে পারে ভাবতে গেলে, বিধাতার পক্ষপাতিত্ব সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। টাকাকড়িও যথেষ্ট পেয়েছিলেন; সেসব দিয়ে-থুয়ে দিব্যি খালি হাতে জীবনটা কাটালেন।

যখন মা মারা গেলেন, দিলীপের বয়স পাঁচ। বাপের কাছে মানুষ। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাপ হেদোর কাছে সুরধাম বলে নতুন বাড়ি করলেন। সেই বাড়িতে ছেলে-মেয়ে মানুষ হতে লাগল। বাপটিও তেমনি। তাঁর আর পুরো ম্যাজিষ্ট্রেট হওয়া ঘটে উঠল না। যে বেপরোয়া নাট্যকার ‘মেবার-পতন’ লেখে, তার চাকরি না গেলেই ঢের। নিকৃষ্টরা ম্যাজিস্ট্রেট হল; উনি নাটক লিখে অমর হলেন।

বাড়িতেই খেলার মাঠ। সেখানে আত্মীয়বন্ধুদের ছেলেদের সঙ্গে রোজ বিকেলে মহা দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলো হত। এক কুলপি-বরফওয়ালা সুযোগ বুঝে রোজ রোজ বাকিতে ওদের কুলপি খাওয়াত। এমনি করতে করতে যখন প্রায় পঁচিশ টাকার দেনা হয়ে গেল, তখন একদিন ব্যাটা সব টাকাটি চেয়ে বসল! দিলীপ আকাশ থেকে পড়ল। কুলপি খেয়েছে তো খেয়েছে, তাই বলে তার জন্যে এক্কেবারে পঁচিশ টাকা।

ইদিক-উদিক তাকিয়ে দিলীপকুমার তার জ্যাঠতুতো দাদা মেঘেন্দ্রলালকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওই যে, ও দেবে।’ মেঘেন্দ্রলালের চক্ষুস্থির! বয়সে সবচেয়ে বড় হলেও তাকে সের দরে বেচলেও ওর অর্ধেক টাকা উঠবে না। বুদ্ধিমানের মতো সে তৎক্ষণাৎ সট্‌কান দিল।

এদিকে কুলপিওয়ালা মহা ক্যাঁওমাও লাগিয়ে দিল। সবচেয়ে খারাপ হল লোকটা বারবার ভয় দেখাতে লাগল যে আর কোনওদিনও কুলপি খাওয়াবে না, বাবাকে বলে দেবে ইত্যাদি।

শেষে মরিয়া হয়ে দিলীপ বলল, ‘তুমি একটু বস, আমি টাকা নিয়ে আসছি।’ এই বলে পাই পাঁই ছুটে একেবারে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে দাদামশায়ের বাড়ি গিয়ে উঠল। সটাং দিদিমার কাছে গেল। এই দিদিমাই আমার সেই নামকরা জ্যাঠশাশুড়ি। সে যাই হোক, দিদিমাকে দিলীপ বলল, ‘তুমি না বলেছিলে তোমার কাছে রাতে শুলে, রোজ আমাকে এক টাকা দেবে?’ দিদিমা বললেন, ‘হ্যাঁ দেবই তো!’ দিলীপ বলল, তাহলে এক্ষুনি পঁচিশ টাকা দাও। আমি আজ থেকে পঁচিশ দিন তোমার পাশে শোব।’ সঙ্গে সঙ্গে দিদিমা হাতবাক্স খুলে ওকে পঁচিশটা টাকা দিলেন। টাকা নিয়ে দিলীপ আবার পাঁই পাঁই করে ছুটে বাড়ি এসে, কুলপিওলার দেনা শোধ করল।

পরে যখন এই চমৎকার ব্যাপারটি দ্বিজেন্দ্রলালের কানে পৌঁছল, তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘সব তো বুঝলুম, কিন্তু আমার কাছে চাইলে না কেন?’

এ গল্প শুনেছিলাম মেঘেন্দ্রলালের কাছ থেকে। তিনি সেই চোরধরা হেমেন্দ্রলালের দাদা, মালবিকার জ্যাঠা ছিলেন।

বাপের প্ররোচনায় ১০-১১ বছর বয়সেই দিলীপ এক অসম্ভব কাজ করে ফেলেছিল। গোটা মহাভারতের চরিত্রদের একটা বংশতালিকা তৈরি করেছিল। সে কী চাট্টিখানি কথা! বড় বড় ফুলস্কেপ কাগজের সঙ্গে কাগজ আঠা দিয়ে জুড়ে, একটা বড় গোছের ঘরের সমস্ত মেঝেটা ঢেকে গেছিল। আরও যত লেখা হতে লাগল, নতুন নতুন কাগজ জোড়া হত। মধ্যিখানের কারও পরিচয় পরে জানা গেলে, সেটিকে যথাস্থানে বসানো ছিল এক দুরূহ ব্যাপার। তলার কাগজ গুটিয়ে, হাঁটু দিয়ে হেঁটে, তবে ঠিক জায়গাটির নাগাল পাওয়া যেত।

দিলীপের সঙ্গে সঙ্গে তার সব বন্ধুবান্ধবদেরও মহাভারতের সব চরিত্রদের বংশ-পরিচয় শেখা হয়ে গেছিল। তাদের মধ্যে আমার স্বামীও ছিলেন, সম্পর্কে দিলীপের মামা, বয়সে এক মাসের বড়। তাঁর কাছেই এই গল্প শুনেছি।

মা ছাড়া মানুষ হলেও, অনাদরে মানুষ হয়নি দিলীপ। বরং মামাবাড়িতে এত বেশি আদর আহ্লাদ পেত যে বেশ আবদারে হয়ে উঠেছিল। একবার খামোখা রাগ-মাগ করে দুপুরে ভাত খেল না। সবাই অনেক সাধ্যসাধনা করল, তবু গোঁ ছাড়ল না। তখন হাল ছেড়ে দিয়ে যে-যার খাওয়া সেরে নিজেদের ঘরে গেল।

মাঝখান থেকে দিলীপের সামনে সমস্ত দীর্ঘ দুপুরটা ঢিমে তেতালা-চালে পলে পলে কাটতে লাগল। বেজায় খিদেও পেতে লাগল। দিলীপ দেখল এ তো মহা জ্বালা! রাগ কখন পড়ে গেছে, অথচ আগে যারা এত সাধাসাধি করেছিল, সেই সব মানুষরা দিব্যি সুন্দর খেয়েদেয়ে ঘর অন্ধকার করে, ঘুমুতে গেছে!

দিন আর কাটতে চায় না। বিকেলে ওর দিদিমা উঠে দেখলেন, এখানে ওখানে, দেওয়ালে, দরজার গায়ে খড়ি দিয়ে লেখা, ‘আরেকবার সাধিলেই খাইব?’ তাই দেখে দিদিমার বুক ফেটে যাবার জোগাড়! এগল্প দিলীপকুমারের কাছেই শুনেছি। তারপর কী হয়েছিল, কে তাঁকে কী খাইয়েছিল, সেকথা তিনি বলেননি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments