Thursday, August 21, 2025
Homeবাণী ও কথাচিতা - চণ্ডী মণ্ডল

চিতা – চণ্ডী মণ্ডল

অসময়ে দার্জিলিং-এ এসে পড়েছে অবনী।

ফুল নেই। ফুলের মতো মরসুমী টুরিস্টের মেলা নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘারই দেখা নেই–ধূসর জমাট মেঘের আড়ালে অদৃশ্য।

অবশ্য ম্যাল আছে। আর ঘোড়া।

ঠিক প্রমোদ ভ্রমণে আসে নি অবনী। সিজিনের শেষে আসার কারণ আর্থিক। এই কারণেই সম্ভবত, নেই নেই করেও দু চারশ পর্যটক এখনো আছে। ষাট টাকার ডবল বেড রুমে তিরিশ টাকায় কে না দুদিন বেশী থাকতে চায়! এরই মধ্যে যেদিন আবহাওয়া একটু ভালো থাকে, সকাল হওয়ায় আগেই সেদিন সকলে হৈ হৈ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে।

সকাল থেকে দুপুর—বিকেলের আগে পর্যন্ত কে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সকলেই ম্যালে এসে হাজির হয়। যেন দার্জিলিং এ থাকার হাজিরা খাতাটা থাকে ম্যালে।

দুপুরেই বা তার আগেই ম্যালে চলে আসে দু-একজন। দুপুরের স্নান খাওয়া সকাল সকাল সেরে হোটেল থেকে সোজা চলে আসে। একটা বেঞ্চ দখল করে বসে সারাদিনের জন্যে।

যেমন শিপ্রা।

দার্জিলিং-এ বেড়াবার জায়গায় গাড়িতে চড়ে বা হেঁটে যেভাবেই যেখানেই যাওয়া যাক, চড়াই-এর ধকল সহ্য করতেই হবে একটু-আধটু। সেটুকুই সহ্য করবার সামর্থ নেই। শিপ্রার। অনেক দিন ধরে শিপ্রা খুব অসুস্থ।

অসুখটা কি বড় বড় ডাক্তাররা কেউ ধরতে পারছে না। কেউ কিডনির চিকিৎসা করেছে। কেউ হার্টের। কেউ ফিমেল ডিজিজের। কেউ মানসিক চিকিৎসার কথা ভেবেছে। সব অসুখই কিছু কিছু থাকতে পারে পারে, কিন্তু শিপ্রার আসল অসুখটা কি সঠিক ডায়গনোসিস করা যাচ্ছে না। সবাই বলে সেরে যাবে—সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। দু বছরে ঠিক কিছুই হয়নি। শিপ্রা আরো রোগা আরো বেশী রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ঘুমোতে পারে না। মন খুলে কথা বলতে পারে না। প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। সব সময় চোখে মুখে আতঙ্ক আর অস্থির ভাব।—একটা চেঞ্জ দরকার, সব ডাক্তার এক মত হয়ে বলেছে—জল হাওয়ার চেঞ্জ চাই।

শিপ্রাকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছিল অবনী গত বছর। পনের দিনের মতো ছিল সেখানে। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি—শিপ্রার মধ্যে চেঞ্জের কোন লক্ষণই দেখা যায়নি! সমুদ্রের উত্তাল উচ্ছ্বাস, আবেগের এক কণা পায়নি শিপ্রার শরীর, মন। মাঝখান থেকে অবনীর পনের দিন ছুটি আর পাঁচশর বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। টাকাটা কিছু নয়, শিপ্রার সেরে ওঠাটাই জরুরী। ছমাস পরেই তাই আবার শিপ্রাকে নিয়ে এসেছে চেঞ্জে। মনোরম এই শৈলশহরে।

কিন্তু সাতদিন ধরে শুধু ম্যালেই বসে আছে শিপ্রা।

সন্ধের পর ধীরে ধীরে হেঁটে হোটেলে ফিরে যায়। রাতটুকুর জন্যে। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙ্গে, তখন থেকেই ম্যাল-এ আসবার জন্যে তৈরী হতে থাকে—দুপুরের আগেই চলে আসে।

ভোরে সবাই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে টাইগার হিলে ভীড় করে দাঁড়িয়ে। এক অলৌকিক সূর্যোদয় হবে—সারা পুবের আকাশ, সারা আকাশ সারা পৃথিবী আশ্চর্য আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। প্রত্যাশায় উত্তেজনায় আনন্দে আবেগে রোমাঞ্চে মানুষগুলোর মুখের আদলই বদলে যায়—সাধারণ একজন মানুষ অসাধারণ মহিমাময়। হয়ে যায়। সেই সময়টায় রোজই অবনী স্ত্রীর রোগ শয্যার পাশে আলাদা খাটে শুয়ে থাকে। হয়তো জেগেই থাকে। ঘুমিয়ে থাকলে স্বপ্ন দেখে হয়তো। হয়তো কোন দুঃস্বপ্ন।

অবনীর দেখা হয় না দার্জিলিং-এর কিছুই। বিখ্যাত সিনচর লেক, ঘুম মন্যাট্টি, বাতাসিয়া লুপ, ভিকটোরিয়া ফলস-বোটানিক্যাল গার্ডেনও কিছুই না। শিপ্রা অবশ্য বলে, তুমি কেন আমার জন্যে সারাদিন এক জায়গায় বসে থাকবে, তোমার কি ভালো লাগে—যাও না কোথাও বেড়িয়ে এসো।

অবনী হ্যাঁ না কিছু বলে না। অবনী জানে শিপ্রা মনে মনে চায় না অবনী দূরে দূরে একা একা ঘুরে বেড়াক। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে, তার আগে থেকেই শিপ্রার এই অদ্ভুত দুর্বলতা। কিছুতেই অবনীকে চোখের আড়ালে যেতে দেবে না।

ম্যালের চারদিকটা অবশ্য দেখে নিয়েছে অবনী। শিপ্রা বেঞ্চে বসে থাকে। অবনী মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করে। বেশী দূরে যায় না। দু একবার তবু চলে গেছে শিপ্রার চোখের আড়ালে।

ম্যালের উত্তর দিকে যে বাগানটা, বাগান নয়, বন-গহন জঙ্গল। জঙ্গলটা ঘিরে একটা রাস্তা আছে। ম্যাল থেকেই রাস্তাটা বেরিয়ে জঙ্গলটাকে পাক দিয়ে আবার ম্যালে ফিরে এসেছে। রাস্তাটা নির্জন খুব। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের জন্যেই যেন রাস্তাটা। ম্যাল থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তা ধরে মিনিট পনের হেঁটে গেলে দেখা যায় দূরে হ্যাপিভ্যালি। কুয়াশা না থাকলে দেখা যায় হ্যাপিভ্যালির সবুজ গভীর বিস্তার। অনেক দুরে ধূ ধূ করছে ভূটান সীমান্ত। সবুজ পাহাড়-এর ঢেউ। পিছনে কয়েকটা ধূসর গিরিশৃঙ্গ। তারপরেই সেই অলৌকিক হিমগিরি, আলোক সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা।

অবনী কুয়াশার দিকে চেয়ে কল্পনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছে! দু একদিন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে। একটা বাঁক পেরিয়ে পুবের দিকে ফিরতেই আবার একটা ভ্যালি। তারপর আর একটা। একটা বিশাল উপত্যকা। ঘন সবুজের ওপর সুতোর মতো রাস্তা আঁকাবাঁকা, অসংখ্য। ওইখানে দার্জিলিং-এর ভুটানী বস্তি। খাদ নেমে গেছে আরো নীচে। উপত্যকার ওপারে অনেক দূরে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের ওপর আকাশ। খাদের গভীর থেকে মেঘ উঠে পাহাড়ের গা বেয়ে আকাশে জমে—সেই মেঘ তারপর একসময় সবেগে নেমে আসে। দেখতে দেখতে ভুটানী বস্তি ঢেকে ফেলে, তারপর ধেয়ে আসতে থাকে ম্যালের দিকে।

অবনী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে আসে ম্যালে শিপ্রার কাছে। এসে দেখে শিপ্রার চোখে-মুখে দারুণ উৎকণ্ঠা। স্পষ্ট বোঝা যায় শিপ্রা দারুণ ভয় পেয়েছে।

—কি হয়েছে?

শিপ্রা ক্ষীণ স্বরে বলে, আমার ভয় করছে।

কেন, ভয় কিসের?

জানি না তুমি অতদূরে যেও না।

দূরে তো যাই নি।

আর যেও না কখনো। আমাকে একা রেখে তুমি কোথাও যাবে না। বল যাবে না!

পরের দিন থেকে অনী ম্যাল ছাড়িয়ে কোথাও যায় না। শিপ্রার পাশে, বেঞ্চে বসে থাকে। দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেল হয়। সন্ধে হয়ে আসে।

সকালেই ঘোড়াগুলো চলে আসে ম্যালে। লম্বায়, চওড়ায় খুব বড় নয় মোটেই ঘোড়াগুলো। পাহাড়ী মানুষজনের মতো আকারে ছোট। শক্ত হাড়ের ওপর মেদ মাংস চামড়ার শক্ত বাঁধুনিতে পাহাড়ী সুষমা সুস্পষ্ট। পিঠে জিন লাগানো, মুখে লাগাম। ঘোড়াগুলো ঘিরে কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতীদের উৎসাহই বেশী, তাদেরই বেশী ভীড়। প্রত্যেক ঘোড়ার সঙ্গে আছে একজন করে ঘোড়াওআলা—যাদের বয়স বারো থেকে বাইশের মধ্যে। মলিন পোশাক আর ময়লা চামড়া দেখলেই বোঝা যায় ভুটানী বস্তির ছেলেমেয়ে, এরা ঘোড়ার মালিক নয়।

ঘোড়ার মালিক কেউ ঘোড়া নিয়ে ম্যালে আসে না সওয়ার ধরতে এমন নয়। নোংরা পোষাক, রুক্ষ চুল, অপরিচ্ছন্ন চামড়ার মাঝখানে দু একজনকে দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায় ঘোড়ার মালিক। কালো রঙের জিনের ভুটানী কামিজ, গোড়ালি থেকে গলা পর্যন্ত, বুক আর গলার কাছে কাপড়ের রং সাদা। লাল ফিতে দিয়ে বিশেষ ঢঙে বাঁধা চুল বিনুনী করে কোমরে নীচ পর্যন্ত নামানো। একটু ভারী নিটোল নিতম্ব। চওড়া কঠিন কাঁধ যেন ছুরি দিয়ে গাঁথা। নাকটা একটু চাপা, চোখদুটো ছোট, মণিদুটো নীল, নীলার মতো। দুটো গাল লাল রক্তাভ। বুকে সাদা জিনের তলায় দুটো তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা লুকোনো।

একটা সাদা রঙের সুন্দর ঘোড়া নিয়ে রোজ দুপুরে সে অবনীর সামনে এসে দাঁড়ায়। রোজই তার এক কথা-ঘোড়াকে পর চডেঙ্গা বাবু?

অবনী কোন উত্তর দেয় না।

কিন্তু উত্তর না নিয়ে সে নড়বে না। দাঁড়িয়ে থাকবে আর লাল ঠোঁটে মোহিনী হাসি ফুটিয়ে প্রলুব্ধ করতে থাকবে।

শিপ্রা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয় সেই ভেবেই অবনী বিরক্ত হয়ে বলে—ম্যায় ঘঘাড়েকে উপর নেই চড়না চাতা।

ঝকঝকে সাদা করাত্রে মতো দাঁত্রে সারি মেলে হাসতে হাসতে বলে—এ বাবু, ডরো মত-মেরা ঘোড়া বহুৎ বেইরিন হ্যায়।

আপ দুসরা আদমী কে পাস যাইয়ে। একটু বেশী রুক্ষভাবেই কথাটা বলা হয়ে যায়। অবনীর নিজের কানেই খারাপ লাগে। লাগুক শিপ্রা নিশ্চয়ই খুব খুশী হয়।

শিপ্রার কিন্তু অন্য সুর। বলে—আহা। বেচারা রোজ তোমার কাছে আসে, একদিন চড়লেই পার ওর ঘোড়ায়।

পাগল হয়েছ।

কেন, কি হয় চড়লে।

ভেবেছ একবার চড়লে তারপর ও ছেড়ে দেবে–।

তোমার যদি ইচ্ছা হয় রোজ একবার করে না নয় চড়বে!

অবনী বলে, আমার ইচ্ছা করে নাকে দেখে ফেলবে কি ভাববে।

শিপ্রা বলে—কে তোমাকে দেখছে!

অবনী বলল—তুমি তো দেখবে।

শিপ্রা বলল—দেখতে ভালোই লাগবে আমার।

মোটেই ভালো লাগবে না।

ভালো লাগবে বলছি—তুমি চড়েই দেখ না।

না–।

না কেন, কোনদিন কি চড়োনি, ছেলেবেলায় কোনদিন—।

অবনী বলল—এখন তো আর ছেলেমানুষ নই।

শিপ্রা বলল বুড়োও ত হয়ে যাওনি।

অবনী আর কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।

শিপ্রা কিছুক্ষণ পরে বলল কি ভাবছ, কথা বলছ না।

অবনী শিপ্রার চোখের দিকে তাকায়। তার কেমন সন্দেহ হয়। শিপ্রার চোখ দুটো এত নিরীহ, এত নিপ্রাণ, কোন অনুভূতিই যেন নেই। যেন পাথরের চোখ।

অবনীর বুকের মধ্যে, কোথায় কোন শুষ্ক ধূসর উপত্যকায় একটা পুরোনো আক্ষেপ আবার কুণ্ডলি পাকাতে থাকে।

এই সময় মেঘ উঠে আসে ম্যালে। নিমেষে বিকেলের সবটুকু আলো শুষে নেয়। হিমেল কুজঝটিকায় চারদিক ঢেকে যায়। শীতের কামড় চামড়া কেটে হাড়ে পৌঁছতে থাকে।

অবনী তাড়াতাড়ি শিপ্রাকে হোটেলে ফিরিয়ে আনে।

হোটেলের ঘর তখন যেন হিমঘর।

কার্ডিগানের ওপর প্রম শাল, তার ওপর দুটো পাহাড়ী কম্বল, তাতেও শিপ্রা হাত পা গরম হয় না, কাঁপুনি থামে না। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে হয়।

দেবদারুর শুকনো ডাল জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে। অবনী ফায়ার প্লেসের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে দু একটা করে কাঠের টুকরো আগুনে ফেলে। অবনীর বিশাল ছায়া শিপ্রার বিছানা ছাড়িয়ে পিছনের দেয়ালের ওপর। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে শিপ্রা। শরীরে তাপ ফিরে এসেছে। অবনীর অনুমান, শিপ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে।

হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে খাঁটি ভুটানী ব্রাণ্ডি আনিয়েছে অবনী, শিপ্রা জানে না। শিপ্রা ঘুমিয়েছে, আরো কিছুক্ষণ পরে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে, অবনী উঠে গিয়ে সন্তর্পণে গোপন জায়গাটা থেকে সেটা বের করে। তারপর আগুনের সামনে এসে আবার বসে।

ম্যালের সেই ভুটানী যুবতী তার সাদা রঙের পাহাড়ী ঘোড়া নিয়ে হেসে সামনে এসে দাঁড়ায়।

পরের দিন ভোর থেকেই আবহাওয়া আবার খুব খারাপ। দূরের গাছপালা কারে মানুষ কিছুই দেখা যায় না এত কুয়াশা। শীত চামড়া কেটে সরাসরি হাড়ে বিধছে। হাড় কন কন করছে। অবনী আগে ঘরে কিছু কাঠ আনিয়ে রাখল।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কিছুটা কমল, কিন্তু আকাশ আরো থমথমে হয়ে এল। শিলাবৃষ্টি হতে পারে আজ।

অবনী বলল, আজ আর ম্যালে গিয়ে কাজ নেই।

শিপ্রা বলল, তুমি একবার ঘুরে এসো।

অবনী কি ভাবল, বলল—তাহলে তুমিও চল।

দুপুরের আগেই শিপ্রার সঙ্গে অবনীও শীতে কাঁপতে কাঁপতে ম্যালে এসে পৌঁছল। তাদের নির্দিষ্ট বেঞ্চে দুজনে পাশাপাশি বসল।

দুপুর হয়ে গেল।

একটু পরেই ভুটানী তার ঘোড় নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। সেই পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা কালো জিনের কামিজ, বুক আর গলা সাদা। গাল দুটো আজ যেন একটু বেশী লাল। দুটো ঠোঁট এত বেশী লাল, মনে হয় যেন রক্ত চুইয়ে পড়ছে।—ঘঘাড়েকে পর চড়েঙ্গে বাবু।

শিপ্রা কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল—আজ ম্যাল খুব নির্জন—এমন সুযোগ আর পাবে না—যাও!

অবনীর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। শিপ্রার মুখের দিতে তাকাতে পারছে না।

পাহাড়ী সেই যুবতী যেন জেনে গেছে অবনী আজ সওয়ার হবেই। তার চোখের মণিদুটো চকচক করছে। সাদা দাঁতের সারি মেলে হাসতে হাসতে বলছে, চড়েঙ্গে বাবুঘোড়া বহুৎ বেইরিন হ্যায়।-আইয়ে—আইয়ে না!

কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল অবনী। সম্মোহিতের মতো ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেল। দুহাতে ঘোড়ার কাঁধটা আঁকড়ে ধরে লাফিয়ে উঠে পড়ল পিঠে।

তারপর শিপ্রার দিকে আর ফিরে তাকাবার সময় পেল না। কোনমতে লাগামটা শুধু ধরতে পেরেছিল। পা দুটোও ঠিকমতো রেকাবে রাখতে পারেনি, তার আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল ভুটানী।

একটু অভ্যস্ত হওয়ার পরেই অবনী একবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল শিপ্রাকে দেখবার জন্যে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে শিপ্রা। সেই ভুটানী যুবতী ঘোড়ার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে ছুটে চলেছে। তাকে পিছনে ফিরতে দেখে যুবতী তীক্ষ্ণস্বরে সতর্ক করে দিল—পিছে মত দেখিয়ে বাবু-সামনে দেখিয়ে!

অবনীর আর একটুও শীত করছে না। বুঝতে পারছে ঘামে ভিজে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ভেতরটা কাঁপছে ভীষণ। রাস্তার বাঁদিকে গভীর খাদ। ডানদিকে ঘন জঙ্গলি জঙ্গলের মধ্যে জমাট কুয়াশা। সামনে কিছুই দেখা যায় না, শুধু কুয়াশা!

শুধু ঘোড়ার খুঝের শব্দ। না সেই শব্দ অবনীর বুকের হৃদপিণ্ডের। ভীষণ জোরে, সশব্দে আর অসম্ভব দ্রুত ওঠানামা করছে অবনীর বুক। উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে, আতঙ্কে এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে অবনীর সারা শরীর অদ্ভুত কাঁপছে। সেই অনুভূতি সহ্য করতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে, মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো ছিঁড়ে যাবে, হৃদপিণ্ড বিদীর্ণ হয়ে যাবে। একবার মনে হয় চীৎকার করে বলে, ভুটানী ঘোড়া থামাও, ঘোড়া থামাও, আমি নেমে যাব—ঘোড়া থামাও—আমাকে নামিয়ে দাও। লাগাম তার নিজেরই হাতে, অবনীর একবারও তা মনে পড়ল না।

এক যুগ পরে যেন অবনী ম্যালে এসে পৌঁছল। মাটিতে পা দিয়েই ছুটে গেল দেখতে শিপ্রা কোথায়, কেমন আছে. দেখে শিপ্রা সেই বেঞ্চেই বসে আছে। শুধু আরো বেশী কুয়াশা শিপ্রাকে ঘিরে।

শিপ্রার মুখ আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো আরো সাদা চোখদুটো আরো ঘোলাটে। অবনীকে দেখছে, যেন অন্য কাউকে দেখছে। কথা বলছে না। কথা বলতে পারছে না।

অবনী কি করবে বুঝতে পারে না। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে…ডাকে শিপ্রা আমি এসে গেছি। তোমরা কি কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল। শিপ্রা, তোমার কি হয়েছে?

ঠোঁটদুটো একটু নড়ে। খুব ক্ষীণ স্বরে, যেন অনেক দূর থেকে শিপ্রা বলে শরীর খারাপ লাগছে—ঘরে চল।

অবনী তাড়াতাড়ি শিপ্রার হাত ধরে।—ওঠ। হেঁটে যেতে পারবে?

শিপ্রা তার শীর্ণ ঘাড়টা নাড়ে।—পারব।

হোটেলে পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি নয়, গায়ে বিধতে লাগল বরফের তীক্ষ্ণ কুচি। পথেই একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। অবনী কোন মতে শিপ্রার শরীরটাকে হোটেলে নিয়ে তুলল।

বরফের মত শরীরটাকে বিছানায় তুলে দিয়েই অবনী ফায়ার প্লেসের দিকে ছুটে গেল।

দু মিনিটের মধ্যেই আগুন জ্বলে উঠল।

দেখতে দেখতে শিপ্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। ঠোঁটদুটো সাদাই রইল, কিন্তু গলায় অর ফিরে এল।

শিপ্রা প্রথমেই বলল—আমি আর বাঁচব না।

অবনী কাছেই একটা চেয়ারে বসে ছিল আগুনের দিকে চেয়ে, চমকে ফিরে তাকাল।

শিপ্রা বলল—আমি এবার ঠিক মরে যাব।

অবনীর নিজের শরীরটাও ভালো ছিল না, কেমন অসুস্থ লাগছে। নিজের শরীরটাকে মনে হচ্ছে যেন অন্য কারো শরীর। তবু খুব আন্তরিকভাবে, গলার স্বরে মমতা। মিশিয়ে বলল—এসব কেন ভাবছ শিপ্রা, তোমার এমন কি অসুখ—।

শিপ্রা বলে উঠল—অসুখের কথা নয়।

তাহলে?

কেন বাঁচব আমি!

এসব কি বলছ শিপ্রা!

সত্যি কথাই বলছি। বল, আছে–ভালোবাসা—বিশ্বাস–?

কেন একথা বলছ?

তুমিই বল কেন।

—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

তুমি ঘোড়ায় কিন্তু শেষপর্যন্ত চড়লে।

শিপ্রা!

না চড়ে পারলে না।

শিপ্রা তুমি—তুমিই তো আমাকে বাধ্য করলে। তুমি না বললে–।

আমি না বললেও তুমি–। তোমার চোখে সেই লোভ দেখেছিলাম। আমি না বললেও, একদিন খুব নগ্নভাবে লোভটা তুমি প্রকাশ করতে। বল, তাই করতে কি না। বল!বলতে বলতে উত্তেজনায় শিপ্রা বিছানায় উঠে বসে। তার শুকনো সাদা মুখ অদ্ভুত লাল হয়ে উঠেছে যেন তার ভেতরে আগুন জ্বলছে।

অবনীর বুকের মধ্যেও আগুন ধরে যায়। দারুণ আক্রোশে কয়েকটা শুকনো কাঠ সে জ্বলন্ত চুল্লিতে ছুঁড়ে দেয়।

দ্বিগুণ বেগে আগুন জ্বলে ওঠে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments