
খিদিরপুর বন্দর। কোল জেটি। শেষ বার্থে রয়েছে ‘বিশ্ব সমুদ্র’। মালবাহী জাহাজ। এপাশে কাছাকাছি অন্য কোনো জাহাজ নেই এখন। শুধু রয়েছে হাইড্রোলিক ব্রিজের দুপাশে দুটো জাহাজ। এম ভি হর্ষবর্ধন আর জলতরঙ্গ। প্রথমটি নিয়মিত আন্দামান যায় এবং অন্যটি মালবাহী।
এ সমস্ত দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে রতনের। এরই মধ্যে বন্দরের রক্ষি বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা দাঁড়িয়েছে দুবছর। একটা রেলইঞ্জিন ঝকঝক করতে কারতে এসে জলের ট্যাঙ্কের কাছে দাঁড়াল। জল ভরবে নিশ্চয়ই। এধারে গেটের পাশে বটগাছের ছায়ায় রতন পাহারায় দাঁড়ানো। হঠাৎ গেটের পাশে এসে দাঁড়াল একজন বৃদ্ধ। একমাথা পাকা চুল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, পরনে প্যান্ট, গায়ে একটা চেক চেক শার্ট, চোখমুখ দেখে মোটেও স্বাভাবিক ঠেকছে। গেট থেকে আর একটু ভেতরে হঠাৎ ঢুকে এল।
: আপ কৌন? কোথায় যাবেন?
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ বিশ্ব-সমুদ্রজাহাজের দিকে তারপর রতনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পরে বলে : ই জাহাজ কব ছোড়েগি?
: এ আর কোনোদিনই ছাড়বে না।
: কেন? কেন? বৃদ্ধ বিমর্ষ, হতবাক।
: ‘বিশ্ব-সমুদ্র’ এখন স্ক্র্যাপ জাহাজ । ভেঙে ফেলা হবে। বিক্রি হয়ে গেছে।
: বিশ্ব-সমুদ্র আর জলে ভাসবে না কখনো? পাগলের মতো শব্দগুলো আওড়াতে থাকে বৃদ্ধ। হঠাৎ হেসে হেসে বলে : এই জানো তো, এটা আমারই জাহাজ ছিল।
একথায় রতন আর কোনো উত্তর করে না। বুঝতে পারে বৃদ্ধের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ। মিনিট দশ-পনেরো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বৃদ্ধ, তারপর গেটের পাশ থেকে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। এবার রতনকে বলে : আমাকে একবার ভেতরে যেতে দেবে?
: ভেতরে যাওয়া বারণ।
: শুধু একবার। আমার কেবিনটা দেখে ফিরে আসব। অনুরোধ জানায় বৃদ্ধ : ঐ কেবিনে আমার বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।
: আপনি সত্যি সত্যি পাগল দেখছি! ঐ ভাঙা জাহাজে উঠবেন? রতন পাশ থেকে বৃদ্ধকে জোর করে সরিয়ে দিল।
পরের দিন। রতনের ডিউটি সেই একই জায়গায়। শুধু সময়ের হেরফের হয়ে বিকেলে হয়েছে। গেটের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই অবাক। হইচই, মানুষে মানুষে ছড়াছড়ি। ‘বিশ্ব-সমুদ্র’ জাহাজের পাশে ভিড়ে ভিড়াক্কার। লোকপরম্পরায় খবর এসে পৌছল। বিশ্ব-
সমুদ্রজাহাজের কেবিনে একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাজ্জব ব্যাপার। স্ক্র্যাপ জাহাজ। সেখানেও মৃতদেহ। পুলিশ এসেছে। এসেছে ফায়ার ব্রিগেডের লোক। জাহাজের মালিকপক্ষকে খবর দিয়ে আনানো হয়েছে। মৃত ব্যক্তি ওঁদের নাকি পরিচিত। দীর্ঘদিন এ.. কম্পানিতে কাজ করেছেন। নাম ডি সুজা। গোয়ার মানুষ। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন।
মৃত ব্যক্তির সঙ্গে একটা ডায়রি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা রয়েছে : আমি গত সপ্তাহের শিপিং নিউজ কাগজে দেখলাম বিশ্ব সমুদ্রকে স্ক্র্যাপ করা হবে। কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। তাই ছুটে আসি কলকাতা বন্দরে। এখানে এসে দেখি, কথাটা সত্যি। গেটের একজন সান্ত্রিও তা-ই জানাল। আমি তাকালাম আমার প্রিয় বিশ্ব-সমুদ্রের দিকে। আমার মনে হল ও যেন আমাকে দেখে অঝোরে কেঁদে চলেছে। আমারই কি কম কান্না পাচ্ছিল তখন। আমি সবার চোখে ধুলো দিয়ে আমার কেবিনে উঠে এসেছি। আমার সেই প্রিয় কেবিন। উঃ কতদিন এখানে আসিনি! দারুণ ভাল লাগছে আমার। আমার পরম… এরপর আর কিছু লেখা নেই। কালির একটা দুটো আঁকিবুকি রয়েছে।
ডাক্তারের অভিমত : হার্টফেল – পরম আনন্দের অন্য এক প্রকাশ।
গেটে দাঁড়িয়ে রতন কিরকম যেন একটা উত্তেজনা অনুভব করছে। বিভিন্ন বন্দর কর্মীরা আসছে, চলে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত ঘটনা। কারো কারো অভিমত : এমন জাহাজ প্রেমিক কখনো দেখিনি। রতন সবকিছুই লক্ষ করছিল। প্রায় বিকেল চারটের সময় মৃতদেহটি জাহাজ থেকে নিচে নামিয়ে আনা হল। ডেড বডি শোয়ানো রয়েছে বিশ্ব-সমুদ্রের পাশে। আরো কিছুক্ষণ এখানেই শোয়ানো থাকবে। তারপর যাবে মর্গে। … রতন একজনকে ওর জায়গায় দাঁড়াতে বলে এক ছুটে এসে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মাথা গলাল। হ্যা, কালকের সেই বৃদ্ধ।
খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছেন। এখন ওঁর মুখেচোখে সেই অস্বাভাবিক ভাব নেই। অবিন্যস্ত একমাথা পাকা চুল ও মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ। মুখে প্রশান্তির প্রতিচ্ছায়া।