Monday, September 15, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পবনের ভেতরে নতুন ভয় - হেমেন্দ্রকুমার রায়

বনের ভেতরে নতুন ভয় – হেমেন্দ্রকুমার রায়

।। এক ।।

কুচবিহার থেকে মোটর ছুটেছে—আলিপুর গেল, কুমারগ্রাম পিছনে পড়ে রইল, এখন জয়ন্তীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বিমল ও কুমার শিকারে বেরিয়েছে। কুমারের মেলোমহাশয় কুচবিহারে বড়ো চাকরি করেন, তাঁরই নিমন্ত্রণে কুমার ও তাঁর বন্ধু বিমল কুচবিহারে এসে আজ কিছুদিন ধরে বাস করছে। তাদের শিকারের তোড়জোড় করে দিয়েছেন তিনিই।

জয়ন্তীতে কুচবিহারের মহারাজার শিকারের একটি ঘাঁটি বা আস্তানা আছে। স্থির হয়েছে, বিমল ও কুমার দিন দুই-তিন সেখানে থাকবে এবং শিকারের সন্ধান করবে। জয়ন্তীর অবস্থান হচ্ছে কুচবিহার ও ভুটানের সীমান্তে। এখানকার নিবিড় বনে বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র জন্তুর অভাব নেই।

শীতের বিকাল। রোদের আঁচ কমে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই পাহাড়ে শীতের আমেজ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। ধুলোয় ধূসরিত আঁকা-বাঁকা পথের দুই পাশে চাঁদের গ্রামগুলো গাছপালার ছায়ায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এপাশে-ওপাশে বুনো কুলগাছের ঝোপের পর ঝোপ। মাঠে মাঠে যে গোরুগুলো চরছে, তাদের কোনও-কোনওটা মোটর দেখে নতুন কোনও দুষ্ট জন্তু ভেবে ল্যাজ তুলে তেড়ে আসছে এবং দেশি কুকুরগুলোও গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে খাপ্পা হয়ে ঘেউ ঘেউ করে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে।

এইসব দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে সন্ধ্যার ছায়া ঘন হয়ে উঠল এবং গাড়িও জয়ন্তীর ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছল।

একতলা সমান উঁচু শালকাঠের খুঁটির ওপরে শিকারের এই ঘাঁটি বা কাঠের বাংলো। একজন কুচবিহারী রক্ষী এখানে থাকে। আগেই তাকে খবর দেওয়া হয়েছিল, সে এসে গাড়ি থেকে মোটমাট নামিয়ে নিতে লাগল।

একটি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বিমল ও কুমার বাংলোর ওপরে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে চারদিকের দৃশ্য টার্নারের আঁকা একখানি ছবির মতো।

একদিকে ভুটানের পাহাড় আকাশের দিকে মটুক পরা মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তার নীচের দিকটা গভীর জঙ্গলে ড়ুব দিয়ে অদৃশ্য। অস্তগত সূর্যের ফেলে যাওয়া। খানিকটা রাঙা রং তখনও আকাশকে উজ্জ্বল করে রাখার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। পাতলা অন্ধকারে চারদিক ঝাপসা হয়ে গেছে। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ ক্রমেই যেন ঝিমিয়ে পড়ছে এবং বহুদূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে দুই-একটা গোরুর হাম্বা রব।

বিমল পাহাড় ও অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললে, কুমার, ও জঙ্গলে কেবল বাঘ নয়, হাতিও থাকতে পারে।

কুমার বললে, ভালোই তো, কলকাতায় অনেকদিন ধরে লক্ষ্মীছেলের মতো হাত গুটিয়ে বসে আছি, একটুখানি নতুন উত্তেজনা আমাদের দরকার হয়েছে।

।। দুই ।।

কিন্তু সে-বারে উত্তেজনা এল সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধরে, অপ্রত্যাশিতভাবে।

কুচবিহারি শীত ভুটানের সীমান্তে দার্জিলিঙের প্রায় কাছাকাছি যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার সঙ্গে করে যে শীত নিয়ে এল, তিনটে পুরু গরম জামার ওপরে মোটা আলোয়ান চাপিয়েও তার আক্রমণ ঠেকানো যায় না।

রক্ষী ঘরের ভেতরে এসে জিনিসপত্তর গুছোচ্ছে, বিমল তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ওহে, তোমার নামটি কী শুনি?

আজ্ঞে, শ্রীনিধিরাম দাস।

আচ্ছা নিধিরাম, তুমি এখানে কতদিন আছ?

আজ্ঞে, অনেকদিন!

কাল ভোরে আমরা যদি বেরুই, কাছাকাছি কোথাও কোনও শিকার পাওয়া যাবে?

আজ্ঞে, ওই জঙ্গলে বরা (বরাহ) তো পাওয়া যাবেই, বাঘও আছে। কাল রাতেই আমি বাঘের ডাক শুনেছি। আজ সকালে উঠে দেখেছি, কাছেই একটা ঝোপে বাঘে গোরু মেরে আধখানা খেয়ে ফেলে রেখে গেছে।

তাহলে গোরুর বাকি আধখানা খাওয়ার লোভে বাঘটা হয়তো বেশি দূরে যায়নি। নিধিরাম, জঙ্গল ঠেঙাবার জন্যে কাল আমার সঙ্গে জনকয়েক লোক দিতে পারো?

নিধিরাম একটু ভেবে বললে, হুজুর, লোক পাওয়া শক্ত হবে!

কেন, আমরা তাদের ভালো করেই বকশিশ দেব!

সে তো জানি হুজুর। হপ্তাখানেক আগে হলে যত লোক চাইতেন দিতে পারতুম, কিন্তু এখন ডবল বকশিশ দিলেও বোধহয় তোক পাওয়া যাবে না!

বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, কেন নিধিরাম, হপ্তাখানেকের মধ্যেই এখানে কি বাঘের উপদ্রব বড়ো বেড়েছে?

নিধিরাম মাথা নেড়ে বললে, না হুজুর, বাঘের সঙ্গে থেকে এখানকার লোকের কাছে বাঘ গা-সওয়া হয়ে গেছে! বাঘকে আমরা খুব বেশি ভয় করি না, কারণ সব বাঘ মানুষ খায় না।

কুমার এগিয়ে এসে বিমলের হাতে এক পেয়ালা কফি দিয়ে বললে, নিধিরাম, তোমার কথার মানে বোঝা যাচ্ছে না! বাঘের ভয় নেই, তবু লোক পাওয়া যাবে না কেন?

নিধিরাম শুস্বরে বললে, হুজুর, বনে এক নতুন ভয় এসেছে!

বিমল বললে, নতুন ভয়!

কুমার বললে, নিধিরাম বোধহয় পাগলা হাতির কথা বলছে!

নিধিরাম প্রবল মাথা-নাড়া দিয়ে বলল, না হুজুর, বাঘও নয়—পাগলা হাতি-টাতিও নয়! এ এক নতুন ভয়! এ ভয় যে কী, এর চেহারা যে কীরকম, কেউ তা জানে না! কিন্তু সকলেই বলেছে, এই নতুন ভয় ওই পাহাড় থেকে নেমে বনে এসে ঢুকেছে!

বিমল ও কুমারের বিস্ময়ের সীমা রইল না, তারা পরস্পরের সঙ্গে কৌতূহলী দৃষ্টি বিনিময় করলে।

নিধিরাম বললে, জানেন হুজুর, এই নতুন ভয় এসে এক হপ্তার ভেতরে তিনজন মানুষকে প্রাণে মেরেছে?

বলো কী?

আজ্ঞে হ্যাঁ ছিদাম একদিন বনের ভেতরে গিয়েছিল। হঠাৎ সে চিৎকার করতে করতে বন থেকে বেরিয়ে এল। তারপর ধড়াস করে মাটিতে পড়ে মরে গেল! সকলে ছুটে গিয়ে দেখলেতার ডান পায়ের ডিমে একটা বাণ বিঁধে আছে?

বাণ?

হ্যাঁ, ছোটো একটি বাণ। এক বিঘতের চেয়ে বড়ো হবে না! কোনও মানুষ ধনুক থেকে সে-রকম বাণ ছছাড়ে না!

কুমার প্রায় রুদ্ধশ্বাসে বললে, তারপর?

দিনচারেক আগে এক কাঠুরেও দুপুরবেলায় বনের ভেতর থেকে তেমনি চাঁচাতে চাচাতে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে করতে মারা পড়ল! তারও গোড়ালির ওপরে তেমনি একটা ছোটো বাণ বেঁধা ছিল!

তারপর, তারপর?

কাল বনের ভেতরে আমাদের গায়ের অছিমুদ্দির লাশ পাওয়া গেছে। তার পায়ের ওপরেও বেঁধা ছিল সেইরকম একটা ছোটো বাণ! বলুন হুজুর, এর পরেও কেউ কি আর ওই ভেতরে যেতে ভরসা করে?

বিমল ও কুমার স্তব্ধভাবে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে লাগল।

শূন্য পেয়ালাটা রেখে দিয়ে বিমল ধীরে ধীরে বললে, নিধিরাম, তুমি যা বললে তা ভয়ের কথাই বটে! তিন তিনটি মানুষের প্রাণ যাওয়া কি যে সে কথা? কিন্তু যারা এই খুন করেছে তাদের কোনও সন্ধানই কি পাওয়া যায়নি?

কিছু না হুজুর! লোকে বলে, এ মানুষের কাজ নয়, এত ছোটো বাণ কোনও মানুষ কখনও ছুড়েছে বলে শোনা যায়নি!

প্রত্যেক বাণই এসে বিঁধেছে পায়ের ওপরে, এও একটা ব্যাপার!

আজ্ঞে হ্যাঁ, কোনও বাণই পায়ের ডিম ছাড়িয়ে ওপরে ওঠেনি!

আর পায়ে কেবল অতটুকু বাণ বিধলে মানুষ মারা পড়ে না, কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বাণের মুখে বোধহয় বিষ মাখানো ছিল।

কবরেজমশাই ও লাশগুলো দেখে ওই কথাই বলেছেন।

বিমল বললে, একটা বাণ দেখতে পেলে ভালো হত!

দেখবেন হুজুর? আমি এখনই একটা বাণ নিয়ে আসছি—এই বলে নিধিরাম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল!

বিমল জানলা দিয়ে কুয়াশামাখা স্লান চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললে, কুমার, অ্যাডভেঞ্চার বোধহয় আমাদের অনুসরণ করে—কাল আমরাও ওই বনের ভেতরে প্রবেশ করব! কে জানে, শিকার করতে গিয়ে আমরাই কারও শিকার হব কি না!

কুমার বললে, কিন্তু এমন অকারণে নরহত্যা করার তো কোনও অর্থ হয় না।

বিমল বললে, হয়তো বনের ভেতরে কোনও পাগল আড্ডা গেড়ে বসেছে! নইলে এত জায়গা থাকতে পায়েই বা বাণ মারে কেন?

এমন সময় নিধিরামের পুনঃপ্রবেশ। তার হাতে একটা কাগজের মোড়ক, সে খুব ভয়ে ভয়ে সেটাকে বিমলের হাতে সমর্পণ করলে।

বিমল মোড়কটা খুলে টর্চের তীব্র আলোকে জিনিসটা সাম্পিল ধরে পরীক্ষা করলে, কুমারও তার পাশে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল।

মুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট আভাস জাগিয়ে বিমল বললে, কুমার, দেখছ?

কী?

এ তো বাণের মতো দেখতে নয়! এ যে ঠিক ছোট্ট একটি খেলাঘরের বর্শার মতন দেখতে!

সত্যই তাই! এক বিঘত লম্বা পুঁচকে একটি কাঠি, তার ডগায় খুব ছোট্ট এক ইস্পাতের চকচকে ফলা! অবিকল বর্শার মতো দেখতে!

কুমার বললে, মানুষ যদি দূর থেকে এই একরত্তি হালকা বর্শা ছেড়ে, তাহলে নিশ্চয়ই তার লক্ষ স্থির থাকবে না!

বিমল ভাবতে ভাবতে বললে, তাই তো, এ যে মনে বড়ো ধাঁধা লাগিয়ে দিলে! হ্যা নিধিরাম, বনের ভেতরে অছিমুদ্দির লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, অন্তত সেই জায়গাটা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে আসতে পারবে তো?

নিধিরাম বললে, তা যেন পারব, কিন্তু হুজুর, এর পরেও কি আপনারা ভূতুড়ে বনে যেতে চান?

বিমল হেসে বললে, ভয় নেই নিধিরাম, এত সহজে মরবার জন্যে ভগবান আমাদের পৃথিবীতে পাঠাননি, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো! আমরা কাল সকালেই ওই বনের ভেতরে ঢুকতে চাই! কুমার, আমাদের শিকারি-বুট পরতে হবে, কারণ এই অদ্ভুত শত্রুর দৃষ্টি হাঁটুর নীচে পায়ের ওপরেই।

।। তিন ।।

ওইটুকু পলকা কাঠির তির বা বর্শা যে শিকারি-বুট ভেদ করতে পারবে না, বিমল এটা বেশ বুঝতে পেরেছিল। শরীরের অন্যান্য স্থানেও তারা ডবল করে জামা প্রভৃতি চড়িয়ে, দুটো পা পর্যন্ত ঝোলা ওভারকোট পরে নিল।

বিমল বললে, সাবধানের মার নেই, কী জানি, বলা তো যায় না!

উপরি উপরি দুই দুই পেয়ালা কফি পান করে হাড়ভাঙা শীতের ঠকঠকানি যতটা সম্ভব কমিয়ে বিমল ও কুমার বাংলো থেকে নীচে নেমে এল। সামনের বনের মাথায় দূরে তখনও কুয়াশার পাতলা মেঘ জমে আছে। কাঁচা রোদ চারদিকে সোনার জলছড়া দিচ্ছে, ভোরের পাখিদের মনের খুশি আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে গানে গানে।

বিমল ও কুমারের মাঝখানে থেকে নিধিরাম ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছিল। তার ভাব দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, সামান্য বিপদের আভাস পেলেই সে সর্বাগ্রে অদৃশ্য হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছে! একটা পায়ে চলা পথ ধরে তারা যখন একেবারে বনের কাছে এসে পড়ল, নিধিরামের সাহসে আর কুলাল না, হঠাৎ হেট হয়ে সেলাম ঠুকে সে বললে, হুজুর, ঘরে আমার বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে, আমি গোয়ারের মতো প্রাণ দিতে পারব না!

কুমার হেসে বললে, তোমাকে বলি দেওয়ার জন্যে আমরা ধরে আনিনি, নিধিরাম! খালি দেখিয়ে দিয়ে যাও, অছিমুদ্দির লাশ কোথায় পাওয়া গিয়েছিল!

ওইখানে হুজুর, ওইখানে! বনের ভেতরে ঢুকেই এই পথটা যেখানে ডানদিকে মোড় ফিরে গেছে, ঠিক সেইখানে!—বলেই নিধিরাম সেলাম ঠুকুতে ঠুকতে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল!

বিমল ও কুমার আর কিছু না বলে নিজেদের বন্দুক ও রিভলভার ঠিক আছে কি না। পরীক্ষা করে দেখলে। তারপর সাবধানে বনের ভেতরে প্রবেশ করলে।

সব বন যেমন হয়, এও তেমনি! বড়ো বড়ো গাছ আঁকড়া ডালপাতাভরা মাথাগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঠেকিয়ে যেন সূর্যের আলো যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে, সেই চেষ্টাই করছে! গাছের ডালে ডালে ঝুলছে অজানা বন্য লতা এবং গাছের তলার দিক অদৃশ্য হয়ে গেছে ঝোপে-ঝাপে-আগাছায়।

কিন্তু সব বন যেমন হয় এও তেমনি বন বটে, তবু এখানকার প্রত্যেক দৃশ্যের ও প্রত্যেক শব্দের মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত রহস্য মাখানো আছে, এই বনকে যা সম্পূর্ণ নতুন ও অপূর্ব করে তুলেছে!

পথ যেখানে ডানদিক মোড় ফিরেছে সেখানে রয়েছে একটা মস্ত বড়ো ঝোপ।

সেইখানে দাঁড়িয়ে পড়ে বিমল বললে, এইখানেই অছিমুদ্দি পৃথিবীর খাতা থেকে নাম কাটিয়েছে! কুমার, এ ঝোপে অনায়াসেই প্রকাণ্ড বাঘ থাকতে পারে! লুকিয়ে আক্রমণ। করবার পক্ষে এ একটা চমৎকার জায়গা!

কুমার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে একবার ঝোপটার দিকে তাকালে, তারপর হঠাৎ একটানে বিমলকে সরিয়ে এনে উত্তেজিত কিন্তু মৃদু কণ্ঠে বললে, ও ঝোপে সত্যিই বাঘ রয়েছে!

চোখের নিমেষে দুজনে বন্দুক তুলে তৈরি হয়ে দাঁড়াল।

বিমল বললে, কই বাঘ?

ঝোপের বাঁ-পাশে তলার দিকে চেয়ে দ্যাখো!

ঝোপের তলায় বড়ো বড়ো ঘাসের ফঁক দিয়ে আবছা আলোতে মস্ত একটা বাঘের মুখ দেখা গেল! মাটির ওপরে মুখখানা স্থির হয়ে পড়ে আছে, এমন উজ্জ্বল ভোরের আলোতেও ব্যাঘ্রমহাশয়ের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয়নি।

তারা দুজনেই সেই মুখখানা লক্ষ করে একসঙ্গে বন্দুক ছুড়লে, কিন্তু বাঘের মুখখানা একটুও নড়ল না!

দুটো বন্দুকের ভীষণ গর্জনে যখন সারা বন কেঁপে উঠল, গাছের উপরকার পাখিগুলো সভয়ে কলরব করতে করতে চারদিকে উড়ে পালাল, তখন বিমল ও কুমার বাঘের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বলে আর একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পেলে না!

বন্দুকের শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের ঝোপের তলাকার দীর্ঘ ঘাস বনগুলো হঠাৎ যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল যেন তাদের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো ছোটো ছোটো জীব চমকে এদিকে-ওদিকে ছুটে পালাচ্ছে! সেগুলো খরগোশও হতে পারে, সাপও হতে পারে!

বিমল আশ্চর্য হয়ে বলল, ঘুমন্ত বাঘ গুলি খেয়েও একটু নড়ল না! তবে কি ওটা মরা বাঘ?

দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। তারপর বন্দুক দিয়ে ঝোপটা দু-ফাক করে উঁকি মেরে দেখলে, বাঘটা সত্যি-সত্যিই মরে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আছে, তার সর্বাঙ্গ ভরে ভনভন করছে মাছির পাল।

কুমার হেট হয়ে হাত বাড়িয়ে বাঘটার তলপেট থেকে কী একটা জিনিস টেনে বার করলে। তারপর সেটাকে বিমলের চোখের সামনে উঁচু করে তুলে ধরলে।

বিমল অবাক হয়ে দেখলে, সেই ছোট্ট কাঠির ডগায় এতটুকু একটা বর্শার ফলা চকচক করছে!

।। চার ।।

বিমল বললে, সেই খুদে বর্শা আর সেই মারাত্মক বিষ! এ বনে বাঘেরও নিস্তার নেই!

কুমার বললে, বর্শাটা ছিল বাঘের তলপেটে। অমন জায়গায় বর্শা মারলে কেমন করে?

বিমল খানিকক্ষণ ভেবে বললে, দ্যাখো কুমার, ব্যাপারটা বড়োই রহস্যময়। এতটুকু হালকা বর্শা দূর থেকে নিশ্চয়ই কেউ ছুড়তে পারে না। তিনজন মানুষ মরেছে প্রত্যেকেই চোট খেয়েছে হাঁটুর নীচে। বাঘটাও তলপেটে চোট খেয়েছে। সুতরাং বলতে হয়, যে এই বর্শা ছুড়েছে নিশ্চয়ই সে ছিল বাঘের পেটের নীচে। হয়তো বনের এই অজানা বিপদ থাকে নীচের দিকেই, ঝোপঝাপে লুকিয়ে।

কুমার বললে, কিংবা বাঘটা যখন চিত হয়ে শুয়েছিল, বর্শা মারা হয়েছে তখনই।

আচম্বিতে বিমলের চোখ পড়ে গেল কুমারের শিকারি-বুটের ওপরে। সচকিত স্বরে সে বলে উঠল, কুমার, কুমার! তোমার জুতোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!

কুমার হেট হয়ে সভয়ে দেখলে, তার শিকারি-বুটের ওপরে বিধে রয়েছে একটা ছোটো বর্শা! আঁতকে উঠে তখনই সেটাকে টেনে সে ছুড়ে ফেলে দিলে!

বিমল বললে, ও বর্শা নিশ্চয়ই তোমার বুটের চামড়া ভেদ করতে পারেনি। কারণ, তোমার পায়ের মাংস ভেদ করলে তুমি নিশ্চয়ই টের পেতে!

ওঃ, ভাগ্যে শিকারি-বুট পরেছিলুম। কিন্তু কী আশ্চর্য বিমল, এই অদৃশ্য শত্রু কোথায় লুকিয়ে আছে?

বিমল ও কুমার সাবধানে ওপরে নীচে আশেপাশে চতুর্দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল, কিন্তু উঁচু গাছের ডালে একটা ময়ূর, একটা হিমালয়ের পায়রা, গোটাকয়েক শকুনি ছাড়া আর কোনও জীবকে সেখানে আবিষ্কার করতে পারলে না। বনের তলায় আলোআঁধারির মধ্যেও জীবনের কোনও লক্ষণ নেই—যদিও কেমন একটা অস্বাভাবিক রহস্যের ভাব সেখানকার প্রত্যেক আনাচ-কানাচ থেকে যেন অপার্থিব ও অদৃশ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এবং সুযোগ পেলেই যে-কোনও মুহূর্তেই সে যেন ধারণাতীত মূর্তি ধারণ করে বাইরে আত্মপ্রকাশ করতে পারে!

হঠাৎ সামনের লম্বা লম্বা ঘাসগুলো সরসর করে কাঁপতে লাগল, তার ভেতর দিয়ে কী যেন ছুটে যাচ্ছে ঠিক যেন দ্রুত গতির একটা দীর্ঘ রেখা কেটে!

মাটি থেকে টপ করে একটা নুড়ি তুলে নিয়ে কুমার সেই দিকে ছুড়লে, সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেল!

ওটা কী জন্তু দেখতে হবে বলে কুমার যেখানে নুড়ি ছুড়েছিল সেইদিকে দৌড়ে গেল! তারপর পা দিয়ে ঘাস সরিয়ে হেঁট হয়ে দেখেই সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল।

কী কুমার, কী, কী?

কিন্তু কুমার আর কোনও জবাব দিতে পারলে না—সে যেন একেবারেই থ হয়ে গেছে।

বিমল তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু নীচের দিকে তাকিয়ে সে-ও যেন শিউরে উঠে বললে, কুমার, কুমার, এও কি সম্ভব?

।। পাঁচ ।।

মাটির ওপরে শুয়ে আছে, অসম্ভব এক নকল মানুষ-মূর্তি!

লম্বায় সে বড়োজোর এক বিঘত! কুমারের নুড়ির ঘায়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে!

এক বিঘত লম্বা বটে, কিন্তু তার ছোট্ট দেহের সবটাই অবিকল মানুষের মতো—মাথার চুল, মুখ, চোখ, ভুরু, নাক, চিবুক, কান, হাত, পা—মানুষের যা-যা থাকে তার সে-সবই আছে।…তার পাশে হাতের খুদে মুঠো খুলে পড়ে রয়েছে সেই রকম এক কাঠির বর্শা!

বিমল ও কুমার নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে রাজি হল না! বিমল সেই এক বিঘতি মানুষটিকে দুই আঙুলে তুলে একবার নিজের চোখের কাছে ধরলে সেই একফোট্টা মানুষের এতটুকু বুক নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে বারবার উঠছে আর নামছে! বিমল তুলে ধরতেই তার মাথাটা কাঁধের ওপরে লুটিয়ে পড়ল! শিউরে উঠে আবার সে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলে!

কুমার হতভম্বের মতো বললে, বিমল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

বিমল বললে, এও যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে আমরাও স্বপ্ন!

পাহাড় থেকে নেমে এসে তাহলে এই ভয়ই বনবাসী হয়েছে?

তা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এদের চেহারাই খালি আমাদের মতো নয়, এই পকেট সংস্করণের মানুষ আমাদেরই মতো বর্শা তৈরি করে, ইস্পাতের ফলা ব্যবহার করতে জানে, আবার বিষ তৈরি করে বর্শার ফলায় মাখিয়ে বড়ো বড়ো শত্রু মারতেও পারে! সুতরাং এর বুদ্ধিও হয়তো মানুষের মতো! জানি না, এর দলের আরও কত লোক এখানে লুকিয়ে আছে!..ওই যাঃ, কুমার-কুমার–

ইতিমধ্যে কখন যে এক বিঘতি মানুষের জ্ঞান হয়েছে, তারা কেউ তো টের পায়নি! যখন তাদের হুঁশ হল তখন সেই পুতুল-মানুষ তিরবেগে ঘাস জমির ওপর দিয়ে দৌড় দিয়েছে!

ব্যর্থ আক্রোশে বিমল নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়ে কেন যে গুলি ছুঁড়লে তা সে নিজেই জানে না, তবে এটা ঠিক যে, সেই পুতুল-মানুষকে হত্যা করবার জন্যে নয়!

কিন্তু যেমনি গুড়ুম করে বন্দুকের শব্দ হল, অমনি তাদের এপাশে-ওপাশে, সামনে পিছনে লম্বা লম্বা ঘাসের বন যেন সচমকে জ্যান্ত হয়ে উঠল—ঘাসে ঘাসে এলোমেলো দ্রুত গতির রেখার পর রেখা, যেন শত শত জীব লুকিয়ে লুকিয়ে চারদিক দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে।

বিমল ও কুমারও পাগলের মতো চতুর্দিকে ছুটাছুটি করতে লাগল, অন্তত আর-একটা পুতুল-মানুষকে গ্রেপ্তার করবার জন্যে!

—কিন্তু মিথ্যা চেষ্টা!

তারপরেও বিমল ও কুমার বহুবার বনের ভেতরে খুঁজতে গিয়েছিল। কিন্তু আর-কোনও পুতুল-মানুষ সে অঞ্চলে আর দেখা দেয়নি বা বিষাক্ত বর্শা ছুড়ে আমাদের মতো বড় বড় মানুষকে হত্যা করেনি। বোধহয় বন ছেড়ে তারা আবার পালিয়ে গিয়েছিল ভুটানের পাহাড় জগতে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments