Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাবন্ধুর অসুখ - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বন্ধুর অসুখ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

অনিন্দ্যর অসুখ করেছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।

এই প্রথম ওর বাড়িতে যাওয়া। কোনও নিমন্ত্রণ ছিল না। আমরা কেবল খবর পেয়েছিলাম যে, ওর অসুখ। অনিন্দ্য রোগা টিঙটিঙে, এক মাথা চুল, খুব সিগারেট খায়, আর খলবল করে কথা বলে। অফিসের আমরা সবাই অনিন্দ্যকে মোটামুটি পছন্দ করি, কারণ অনিন্দ্য ঝগড়া করেই ভাব করতে পারে, সকলের সঙ্গেই তার ভাব আর ঝগড়া লেগেই থাকে। রাজনীতিতে সে উগ্র, ভগবানকে সে কাছায় বাঁধে, তবু তার মন নরম, অল্পেই সে এলিয়ে পড়ে। তাকে নিজের দুঃখের কথা শুনিয়ে বড় আরাম।

তার অসুখের খবর পেয়ে আমরা চার সহকর্মী তার বাসায় যাব ঠিক করেছিলাম। আমি, সুভাষ, সমীর আর আশুতোষ। বড় দূরে অনিন্দ্যর বাসা। শিয়ালদহ থেকে রেলগাড়িতে এক ঘণ্টা তার পরেও মাইল খানেক হাঁটা পথ। রিকশাও যায়, তবে রাস্তা খারাপ বলে ঝাঁকুনি লাগে। তাই হেঁটেই আরাম। এসব আমাদের শোনা ছিল।

এর অসুখের দশ দিনের দিন এক শনিবার পড়ল। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল পাঁচজন যাব। কিন্তু শনিবার মানু এল না বলে হলাম চারজন। হাঁটা পথে বউবাজার থেকে চাঁদা করে আপেল কিনলাম, কয়েকটা দামি কমলা, আশুতোষ কিছু ফল কিনল নিজের পয়সায়, তারপর ঘামতে–ঘামতে দুর্জয় গরমে চারজন গিয়ে রেলগাড়িতে উঠলাম। ভিড়, গরম, ধাক্কাধাক্কি। তার মধ্যেও চারজন দলা পাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে অসুখটা ভালোই পাকিয়েছে অনিন্দ্য। নইলে দশ দিনে তার হাঁপিয়ে ওঠার কথা। জ্বর–জারি তার লেগেই থাকে, গলায় সাত-আট মাস গলাবন্ধ জড়ানো আর ফ্যরিনজাইটিসের জন্য, তবু সে বাধা মানে না। অফিসে আসে, বলে–দূর, ওই অজ পাড়াগাঁয়ে কথা বলার লোক পাই না। আমি তো রবিবারেও এসে কফি হাউসে আড্ডা মেরে যাই।

কতবার তার বাড়িতে যেতে বলেছে অনিন্দ্য। যাওয়া হয়নি। শহরে আছি বারো মাস, মাঝে মাঝে বাইরে কোথাও একটু যেতে ইচ্ছে করে। জলজঙ্গল গাঁ–গ্রামের টান। অনিন্দ্যর অসুখ হল বলেই যাওয়াটা ঘটে গেল। নইলে যাব–চ্ছি করে আরও সময় কেটে যেত।

তখন প্রায় পৌনে চারটে। ঘামে ভেজা জামা কাপড় নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামতেই শরীর জুড়িয়ে বাতাস দিল। প্ল্যাটফর্ম থেকে মনে হচ্ছিল জায়গাটার ভাবসাব শহুরে। সেটা কিন্তু বেশিক্ষণ রইল না। স্টেশনের যে দিকটায় শহরের ভাব, আমাদের যেতে হল তার উলটোদিকে, রেল লাইন পেরিয়ে। ইটের এবড়ো–খেবড়ো রাস্তা, গাছপালার ছায়ায় আচ্ছন্ন, গরুর গাড়ি আর মন্থর রিকশা একটা দুটো চলছে। রিকশার ওপর ঝুড়ির পাহাড়, তার ওপর ঠ্যাং মেলে চিৎ হয়ে আছে গ্রামীণ চাষাভুসো লোক, বিড়ি টানছে। রিকশাওয়ালারা পায়ে হেঁটে গাড়ি টেনে নিচ্ছে। বোঝা যায়, স্টেশনের এপাশে শৌখিন সওয়ারি নেই, রিকশাও মাল পরিবহণে কাজ লাগে।

যেন অসুখ উপলক্ষ্যে নয়, বেড়াতেই এসেছি আমরা। চেঁচামেচি করে চারজন হাঁটছিলাম, হোহো হাসি আর কলকাতার গল্প। কলকাতার বাইরে ঠিক কলকাতার মতো কিছু নেই, তাই বাইরে এলে কলকাতার লোক কেবল কলকাতার গল্প করে। গাছের নীচু ডাল থেকে লাফিয়ে পাতা ছিঁড়ে, এটা–ওটা দেখার জন্য মাঝে-মাঝে থেমে, পথের হদিস জিগ্যেস করে আমরা হাঁটছিলাম। ফেরার খুব তাড়া ছিল না। শুনেছি দশটায় শেষ ট্রেন যায় কলকাতায়। ইচ্ছে করলে সেটাও ধরা যাবে। বাগড়া দিচ্ছিল সুভাষ, ওর একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ, আর নিম–অরাজি ছিল সমীর। আমাদের মধ্যে একমাত্র সমীরই প্রেম করে। ত্রিশ বছরে প্রেমে পড়েছিল, এখন একত্রিশ চলছে। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো টগরের জন্যই ফেরার তাড়া। সমীর বলল যে তা নয়, ওর ভাইয়ের অসুখ। এক অসুখ রেখে আর এক অসুখ দেখতে এসেছে।

গ্রামের আবহাওয়ায় এলেই আমাদের ছেলেবেলায় কথা মনে পড়ে। বিশেষত আমার। ছেলেবেলার কথা আমিই প্রথম শুরু করলাম। তারপর আর কারও কথাই থামছিল না। মা-বাবার গল্প, দাদু ঠাকুরমার গল্প, আদর শাসন, সস্তার দিন আর দাঙ্গা যুদ্ধ দেশভাগের আগেকার সব কথা এসে পড়ল, দূর পথ টের পেলাম না। চারদিকে কচুবন, মাঝখানে পায়ে হাঁটা পথ, আর অদূরে বাঁশের হেঁচা–বেড়ার ঘের–দেওয়া একটা টিনের চালওলা বাড়ির সামনে একটা লোক দেখিয়ে দিল… এই বাড়ি।

উঠোনে এসে দাঁড়াতেই গ্রাম্য চেহারার দু একজন লোক আর বউ–ঝি নানাদিক থেকে উঁকি দিল। খালি গায়ে কালো মতো একজন আধবুড়ো লোক এসে বলল –আসুন, কলকাতা থেকে আসছেন তো?

সম্মতি জানাতেই বলল –অনু ওই ঘরে আছে।

উঠোনের চারদিকে আলাদা আলাদা ঘর, যেন শরিকানার বাড়ি। সব ঘরেরই এক-ইটের দেওয়াল, দাওয়া, আর টিনের চাল। অদূরে খড়ের গাদা, গোয়াল পেঁকি ঘর একটা। টিউব ওয়েলের হাতলের ওপর শরীরের সমস্ত চাপ দিয়ে পাম্প করতে গিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে শূন্যে উঠে হাত পা ছড়িয়ে নেমে আসছে। দেখতে-দেখতে আমরা দাওয়ায় উঠলাম। ঘরের দরজা থেকেই দেখা গেল অনিন্দ্যর রোগা মুখে শেষবেলার লাল আলো এসে পড়েছে। চোখ বুজে ছিল সে। লোকটা গিয়ে তাকে ডাকল। আমরা খবর দিয়ে আসিনি, তাই আমাদের দেখে ধড়মড় করে উঠে পড়ল অনিন্দ্য, মুখে অবিশ্বাসের হাসি, চোখ উজ্জ্বল। উঠে বসে বলল –আয় রে।

বিছানায় দুজন, আর টিনের চেয়ারে দুজন বসলাম। একথা ঠিক যে এরকম পরিবেশে অনিন্দ্যকে মানায় না। অনিন্দ্য পুরোপুরি শহুরে মেজাজের, যে টেরিলিন পরে, অল্পেই ধৈর্য হারায়, চালাক, সপ্রতিভভাবে চলাফেরা করে। তাকে দেখে আন্দাজ করা শক্ত যে তাদের বাড়িতে টেকি–ঘর আছে, কিংবা খড়ের গাদা। যে লোকটা আমাদের ওর কাছে নিয়ে এল তার মুখের আর চেহারার আদলের সঙ্গে অনিন্দ্যর মিল আছে। সম্ভবত ওর বাবা। সত্যি বলতে কি ওরকম বাবাও অনিন্দ্যকে মানায় না।

ঘরের আসবাবপত্র ভালো নয়। যে খাটে অনিন্দ্য শুয়ে আছে একমাত্র সেই খাটটার গায়েই কিছু সেকেলে কারুকার্য, আর যা আছে তার কোনওটাকেই লোক দেখানো বলা চলে না। সস্তা একটা আলমারিতে ঠাসা বই, একটা টেবিলের ওপর পাতা খবরের কাগজের ঢাকনা, ঘরের ওধারে আর একটা চৌকিতে বিছানা গুটিয়ে রাখা, মাদুর পাতা রয়েছে, ঘরের কোণে মেটে হাঁড়ি কলসি চাল থেকে দড়িতে ঝুলছে শীতে ব্যবহার্য লেপ কাঁথার পুঁটলি। ইঁদুরের ভয়ে ঝুলন্ত দড়িতে উপুড় করা মালসা লাগানো হয়েছে। ঢুকতে–না-ঢুকতেই এত সব লক্ষ্য করা গেল।

অনিন্দ্য ফুল আর ফলের বাহার দেখে বলল –তোরা যে আমাকে রোমান্টিক হিরো বানিয়ে দিলি। আহা, গাড়ির ভিড়ে ফুলগুলো ডলা খেয়ে গেছে রে!

জিগ্যেস করলাম–তোর কী হয়েছে?

–সে অনেক কথা। শুনবি। আগে একটু মা বাবাকে ডাকি, আলাপ পরিচয় কর, তারপর।

অনিন্দ্যর বাবা সে লোকটা নয়। তার চেহারার ধরনটা একই। আরও বুড়ো, লম্বা, রোগা, ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ আছে একটু। প্রণাম করতে গিয়ে দেখি ঘোর গ্রীষ্মেও তাঁর পায়ে মোজা। সম্ভবত পায়েও শ্বেতী আছে। খুব কুণ্ঠিতভাবে বিড়বিড় করে কী একটু বললেন। সামান্যক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, বললেন–গাড়িতে কষ্ট হয় নাই তো!…আইচ্ছা তোমরা বসো, অনুর লগে গল্প কর…আইচ্ছা বেশ… বলতে-বলতে ভ ভদ্রলোক পালিয়ে বাঁচলেন। অনিন্দ্য হেসে বলল –একদম গাঁইয়া রে বাবাটা।

অনুর মা উলটোরকম। গিন্নিবান্নির মতোই মোটাসোটা চেহারা; অল্প ঘোমটা দিয়ে এসে দাঁড়িয়েই হাসলেন, পরিষ্কার কলকাতার টানে বললেন–তোমাদের তো অনেকদিন আগেই আসার কথা ছিল। আসোনি কেন?

প্রায় সমস্বরে বললাম–আসা হয় না। কত কাজ বাকি থাকে আমাদের। অফিস আমাদের যে কীভাবে গ্রাস করে বসে আছে।

–রাত্রে তোমরা খেয়ে যেও। আমি রান্না করছি।

সমস্বরে বললাম–তা হয় না। বাসায় আমাদের জন্য রান্না করা থাকবে, খাবার নষ্ট হবে।

হেসে বললেন–কলকাতার লোক তো রাত্রে রুটি খায়। আমরা ভাত খাওয়াব। যত ইচ্ছে। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে বললেন–দ্যাখো তো, এই দুর্দিনে কী একটা রোগ বাঁধিয়ে বসে আছে। হবে না কেন! এই কটা মাত্র খায়, মরে গেলেও এক মুঠো বেশি খাবে না। জোয়ান বয়েস, এখন তেমন খোরাক না হলে কি শরীর টেকে! বড্ড পিটপিটে, কালো মাছ খাবে না, দুধ খেলে বমি আসে, শাকপাতা নাকি জঞ্জাল, চিঁড়ে–মুড়ি ছোঁবে না, খালি পেটে কেবল অমৃত আছে ওর চা। যত দাও খাবে। একে আমি কী করে বাঁচাব বলো তো? মাঝখানে ধুয়ো তুলেছিল যে কলকাতায় গিয়ে মেসে থাকবে। বলো তো তাহলে ও আর বাঁচাত? যাতায়াতের অসুবিধে হয় তা বুঝি, কিন্তু লোকে তো যাচ্ছে। তা ছাড়া এখানকার স্কুলে ওর জন্য একটা মাস্টারিও জুটিয়েছিল ওর বাবা। অনেক বলেকয়ে। ঘরের খেয়ে চাকরি, কিন্তু ওতে ওর পোষাল না। এখানে নাকি লাইফ নেই, কেবল নাকি ঘোঁট পাকায় লোকেরা।

অনিন্দ্য ভ্রূ কুঁচকে বলল –মা, তুমি এবার কেটে পড়ো।

উনি হাসলেন–তা তো বলবিই। বন্ধুদের কাছে সব ফাঁস হয়ে যাচ্ছে কিনা। তারপর একটু শ্বাস ফেলে বললেন–যেদিন সত্যিই কেটে পড়ব সেদিন আর কুল পাবি না…বলতে-বলতে সামলে গেলেন, আমাদের দিকে চেয়ে হেসে বললেন, তোমরা বোসো, আমি চা পাঠিয়ে দিই গে।

আর কী খাবে?

–কিছু না…কিছু না…

–আচ্ছা সে আমি বুঝব। কলকাতার তোক না খেয়ে-খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। এখানে ‘কিছুনা’ চলে না।

স্পষ্টই বোঝা যায় অনিন্দ্য তার বাবার চেয়ে মায়েরই বেশি ভক্ত। অনিন্দ্য যখন তার মায়ের দিকে তাকায় তখন তার নিজের মুখ শিশুর মতো হয়ে যায়। ওর মা চলে গেলে ঘরে একটু নিস্তব্ধতা রইল। তখন শোনা যাচ্ছিল অজস্র পাখির কিচমিচ, খড়মের শব্দ, হুঁকো টানার শব্দ, গরুর হাম্বা। কলকাতায় ঠিক ওইরকম শব্দ হামেশা শোনা যায় না। আশুতোষ সিগারেট ধরাতে খস করে দেশলাই জ্বালল, জ্বেলেই বলল –অনিন্দ্য, সিনিয়াররা কেউ এসে পড়বে না তো রে! দরজাটা ভেজিয়ে দেব।

দূর! খা না। আমিও তো মার সামনেই খাই। বাবা বড় একটা আমার ঘরে আসে না। বলে হাসল বুড়ো আমাকে খুব সমীহ করে চলে। বোধহয় ছেলেকে খুব লায়েক ভাবে।

সমীর বলল –মাসিমাকে বলে দে যে আমরা রাতে সত্যিই খাব না। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।

অনিন্দ্য চোখ ছোট করে বলল –টগর রানীর হুকুম নয় তো!

–নারে। ছোট ভাইটার টাইফয়েড।

অনিন্দ্য কনুইয়ে ভর দিয়ে টপ করে সোজা হয়ে বসল, বলল আর, আমার যে টি বি!

আমরা সত্যিই জানতাম না। শুনে ভয়ঙ্কর চমকে গেলাম। টি বি! পর মুহূর্তে মনে পড়ল আজকাল ওষুধ আছে। টি বি এখন আর তেমন কিছু অসুখ নয়। তবু কোথাও একটু সংস্কার রয়ে গেছে। চমকে উঠি! ওর বিছানাতেই আমি বসেছিলাম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে লাগল। আশ্চর্য! ও কিংবা ওর বাবা মা কেউই ওর বিছানায় বসতে আমাদের নিষেধ করেনি। অথচ করা উচিত ছিল। এখন স্বেচ্ছায় ওর বিছানা ছেড়ে অন্যত্র বসাটাও কেমন খারাপ দেখায়। তাই অস্বস্তি নিয়েই বসে রইলাম।

অনিন্দ্য হাসল–দুর! দুম করে বলে দিলাম। ইচ্ছে ছিল অনেকক্ষণ তা দিয়ে দিয়ে জমজমাটি একটা নাটুকে সিচুয়েশন তৈরি করে তারপর রক্তাক্ত সংলাপের মতো করে কথাটা বলব। হল না। দুর!

সবাই হাসলাম। আশুতোষ বলল –এটা কবে ধরা পড়ল?

অনিন্দ্য বলল –দিন দশেক আগে, যেদিন রিপোর্ট পেলাম সেদিন থেকেই আর অফিসে যাই না।

সুভাষ বলল –চিকিৎসা কেমন চলছে?

–ওই যেমন চলে। ঘড়ি বেঁধে খাওয়া। সকাল বিকেল হাঁটা। গুচ্ছের ফলমূল গিলতে হচ্ছে। ঠাকুর দেবতা প্রণাম করতে হচ্ছে। সকালে এসে পুরুত ঠাকুর কপালে মঙ্গল টিপনা ঘোড়ার ডিম কী পরিয়ে যান। মাইরি অসুখ–বিসুখ হলে আর ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না।

সুভাষ বলল –এ রোগ তো আজকাল জলভাত। আমার বোনের দেওর ভুগে উঠল কিছুদিন। আগে তোর মতোই রোগা পটকা ছিল, বিয়ে হত না চেহারার জন্য। এখন তাগড়া চেহারা হয়েছে…মন–মেজাজ ভালো হয়েছে, শিগগিরই বিয়ে হয়ে যাবে।

আশুতোষ বলল –দেখিস, দু-দশ বছরের মধ্যে ক্যানসারেরও ওষুধ বেরিয়ে যাবে। সায়েন্স সব পারে। তুই তো অনেকটা সেরেই গেছিস অনিন্দ্য, তোর চোখে–মুখে রোগের খুব একটা ছাপ নেই।

দূর শালা! অনিন্দ্য হাসে-আমি সুস্থ থাকলেও লোকে রোগের ছাপ দেখে আমার মুখে, আর এখন তো সত্যিকারের রোগ আমার। গ্যাস দিস না। আমি খুব রোগা হয়ে গেছি, না রে রমেন?

মাথা নাড়লাম–খুব না। তারপর তো একটু খুঁতখুঁতে আছিস, একে রোগা তার চেয়ে বেশিই রোগা ভাবিস নিজেকে। কাজেই তোকে বলে লাভ নেই।

অনিন্দ্য হাসে-ঠিক। আমি শালা নিজেকে নিয়ে খুব ভাবি। সারাদিনই ভাবি। নারসিসাস যাকে বলে। বোধহয় সেইজন্যই ভোগানি আমাকে ছাড়ে না। সারা বছর বারোমাস কোলের পোষা বেড়ালের মতো আমার অসুখ লেগে আছে। একটু গলা ব্যথা করলেই ভাবি ক্যানসার, পেট ব্যথা করলেই মনে ভাবি আলসার, খুক খুক কেশেই ভয় হয় টি বি হল না তো! দ্যাখ শেষকালে সেই টি বি তো হলই। নিজেকে নিয়ে ভাবতে নেই, কী বলিস।

হাসলাম–নিজেকে নিয়ে আমরা সবাই ভাবি।

–কেন ভাবিস?

বোধহয় নিজেকে ভালোবাসি বলে।

অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করে ভ্রূ কুঁচকে বলে নিজেকে ভালোবেসে কী হয়! দ্যাখ আমিও অনিন্দ্য চাটুজ্জেকে ভালোবাসি। কিন্তু ভেবে দেখলে সে শালা ভালোবাসার উপযুক্তই নয়। স্বার্থপর, রগচটা, দাম্ভিক, অস্থিরচিত্ত–দূর, এ শালাকে ভালোবেসে হবে কী! ঠিক আমার মতোই যদি আর একটা লোকের সঙ্গে আমার দেখা হত, তবে দু-কথাতেই ঝগড়া লাগত, মারামারি হয়ে। যেত, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিতুম। তবে কেন নিজেকে ভালোবাসি!

–নিজেকে ভালোবেসে তোর এ অসুখ হয়নি। ভালো না বেসে হয়েছে। মাসিমা যে বলে গেল তুই খেতে চাস না। খালি পেটে চা খাস, অনিয়ম করিস–এগুলো নিজেকে ভালোবাসার লক্ষণ নয়।

–নীতিকথা বলছিস! বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অনিন্দ্য–আসলে কীভাবে যে ভালো থাকি তো জানিই না।

অনিন্দ্যর মা এসে বললেন–রুগির ঘরে খেতে নেই। বারান্দায় তোমাদের জলখাবার দেওয়া হয়েছে। এসো।

গিয়ে দেখি বারান্দায় পিঁড়ি পাতা, জামবাটিতে দুধ, বেতের ধামায় মুড়ি, প্লেটে কাটা আম, কলা আর কাঁঠালের কোয়া। অনিন্দ্য ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল –আমাকে একটা চেয়ার দাও। আমি ওদের খাওয়া দেখব।

সমীর আর একবার বলতে চেষ্টা করল–আমাকে কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে মাসিমা। আমার ভাইয়ের অসুখ, ওরা বরং একটু থাকুক, আমি ফিরে যাই।

–কী অসুখ?

–টাইফয়েড?

–আ হা! তবে ওতো আজকাল তাড়াতাড়িতেই সেরে যায়। কত ওষুধ বেরিয়েছে। আমাদের আমলের সান্নিপাতিক সারতই না। ঠিক আছে, আমি তোমাকে সাতটার মধ্যে খাইয়ে দেব। সাতটা পঞ্চাশে একটা গাড়ি আছে না রে অনু? সেই গাড়িতে ফিরে যেও।

বাচ্চা একটা মেয়ে আমাদের হাত পাখায় বাতাস করছিল। অনিন্দ্য তাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল –এই আমার ছোট বোন পুটলি। দিন–রাত বেড়ালছানা ছেনে বেড়ায়। কী বলে রে তোকে সবাই পুটলি।

–ষষ্ঠী ঠাকরুণ। বলেই জিভ কাটল।

উঠোনে অনেক কাচ্চা বাচ্চা বউ, দু-একজন মুনিশ। গৃহস্থের সংসার।

অনিন্দ্যর মা বলল –শান্তি পাই না বাবা। এই দুর্দিনে ছেলেটা রোগ বাঁধাল।

অনিন্দ্য হাসে-ধানের দাম পড়ে গেলে তোমাদের দুর্দিন, কিন্তু ওদের তো দুর্দিন নয়। ওসব বোলোনা, ওরা বুঝবে না।

–কী যে বলিস। বলেই অনিন্দ্যর মা হেসে প্রসঙ্গ পালটে নিলেন–তোমরা সবাই মাংস খাবে তো!

সুভাষ আমিষ খায় না। ছেলেবেলাতে বাবা মারা গিয়েছিল, তারপর থেকে বিধবা মায়ের আওতায় ও মানুষ। মাছ মাংসর স্বাদই জানে না। সেকথা জানাতে মাসিমা বললেন–তোমাকে ছানার ডালনা খাওয়াব।

ঠিক হল রাত সাতটা পঞ্চাশের গাড়িতেই সবাই একসঙ্গে ফিরে যাব। হাতে সময় ছিল। আমরা পাঁচজন কাছেপিঠে একটু ঘুরে এলাম। পুরোনো মন্দির, দিঘি, বটগাছ, কিংবদন্তির কবর –এইরকম কিছু-না-কিছু সব গ্রামেই থাকে। সেসব দেখা হল। ওদের বাড়ির পিছনেই পুকুর। তার বাঁধানো চাতালে বসলাম পাঁচজনে। অনিন্দ্য বলল –একটা সিগারেট খাওয়া। অসুখ হওয়ার পর খুব রেস্ট্রিকশন যাচ্ছে। খেতে দেয় না। সিগারেট ধরিয়েই বলল –বোধহয় জ্বর আসছে রে! গা–টা দেখ দেখি।

দেখে বললাম–একটু আছে। চল ঘরে যাই।

অনিন্দ্য মাথা নাড়ল, না থাক। একটু বসি।

গ্রীষ্মের সূর্য তখনও আকাশের প্রান্তে একটুখানি লেগে আছে। দীর্ঘ বেলা। অনিন্দ্যর রোগা মুখে আলো এসে পড়েছে। আমরা চেয়ে আছি। ও বলল –সায়েন্সের কথা কী যেন বলছিলি আশু? খুব এগিয়ে গেছে না কী যেন।

আশু হাসল–কেন শালা তুমি জান না?

–জানি, জানি আমার অসুখ সেরে যাবে, সায়েন্স আমার জন্য ওষুধ বের করেছে, সব অসুখের জন্যই করবে। তারপর হাসল অনিন্দ্য কিন্তু আমি শালা কোনও ওষুধ বের করিনি, কারও রোগ শোক দূর করবার কোনও যন্তর–মন্তর বের করিনি। এক নম্বরের স্বার্থপর, দাম্ভিক ঝগড়াটে এই আমাকে দ্যাখ আমি কিছুই করিনি এ-পর্যন্ত। আমার বাবা খেত খামার করে, জমি বাড়ায়, ধানের দাম কমলে হায়–হায় করে। আমি চাকরি করি, টাকা আনি, নিজের জন্য ভাবি। আমার বাবা বা আমি যে বংশ রেখে যাব তারাও অবিকল এরকমই কিছু করবে। সায়েন্স এগিয়ে গেল বলে আমার শালা গর্ব করার কিছু নেই। তাই না? পরের জন্য না ভাবলে সায়েন্স এগোয় না। আর আমি কেবল শালা নিজের কথা ভাবি। তোকে বলছিলাম না রমেন, নিজেকে ভালোবেসে কী হয়। দূর, নিজেকে ভালো করে দেখলে ভালোবাসাই যায় না। মাইরি, এ-রোগটা যখন আমার সত্যিই সেরে যাবে তখন বড় লজ্জা করবে আমার।

–কী বলছিস যা তা?

–বিশ্বাস কর সত্যিই লজ্জা করবে। যার জন্য কিছু করিনি সে যদি হঠাৎ এসে আমার মস্ত উপকার করে তাহলে যেরকম লজ্জা করে ঠিক সেরকম। বুঝলি রমেন, শোধ দেওয়া না গেলে খুব লজ্জার কথা। আমি সারাদিন শুয়ে-শুয়ে ভাবি আর লজ্জায় মরে যাই। মনে-মনে লোকজনের কাছে ক্ষমা চাই বলি–দ্যাখো আমার ভিতরে বিজ্ঞান নেই, পরোপকার নেই, সেবা নেই, ভালোবাসা নেই, তবু এই আমাকে আমি সারাদিন ভেবে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করো।

আস্তে-আস্তে বললাম–আমরা সবাই ওরকম।

–হবে। বলে চুপ করে গেল অনিন্দ্য।

আমরা উঠলাম যখন তখন অনিন্দ্যর জ্বর বেড়েছে। একটু কাশছে ও।

রাত সাতটা নাগাদ আমরা গাড়ি ধরার জন্য বেরোলাম। তখন অনিন্দ্য শুয়ে আছে ঘরের মধ্যে। দরজা থেকেই ডেকে বললাম–চলি রে, অনিন্দ্য।

–আচ্ছা, ঘোলাটে চোখে চেয়ে ও হাসল–আবার বড় দল নিয়ে আসিস। মুরগি খাওয়াব। সবাইকে বলিস যে আমার ভালো হওয়ার ইচ্ছে নেই, তবু সকলের জোর জবরদস্তিতে লজ্জার সঙ্গে আমি ঠিক ভালো হয়ে যাব।

হাসলাম।

ওর কাকা লণ্ঠন ধরে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে গেল। ফেরার পথে ফাঁকা রেলগাড়ির কামরায় আমরা চার সহকর্মী বন্ধু খুব বেশি কথাবার্তা বলছিলাম না। হয়তো বেশি খাওয়ার জন্য আমাদের ঝিমুনি আসছিল। হয়তো আমরা অনিন্দ্যর কথা ভেবে বিষণ্ণ ছিলাম। কিংবা কে জানে হয়তো নিজেদের কথা ভেবেই আমরা কেন যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments