Sunday, August 24, 2025
Homeবাণী ও কথাবন্ধ্যা – তমাল লাহা

বন্ধ্যা – তমাল লাহা

চম্পাবতী একবার করে এসে জানলার কপাটের ফাঁক দিয়ে দেখে যাচ্ছে। তারপরে আবার রান্নাঘরে হেঁসেল গুছোতে চলে যাচ্ছে। আর প্রতিবারেই ফিরে যাবার সময় তার মুখটা বেশি বেশি করে ভার হয়ে যাচ্ছে। শেষ দুবার বিড়বিড় করে আপনমনে কাকে যেন কী বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আর নুনের বয়ান, মশলার কৌটো, চা-দুধের শিশিগুলো শুধু একটু মাত্রাতিরিক্ত ঠকা ঠকা শব্দ করে নড়ে চড়ে বসে জানান দিতে লাগল, চম্পাবতী ভিতরে গুছোন দিচ্ছে।

শেষ বেশ চম্পাবতী পাকাঁপাকিভাবে রান্নাঘর ছেড়ে হলুদমাখা আঁচলে জলে ভেজা হাত আর ঘামে ভেজা মুখ মুছতে মুছতে ঐ জানলার কপাটের ফাঁকে চোখ গলিয়ে দাঁড়াল, তখন বাইরে বিকেল প্রায় মরে এসেছে। চম্পাবতীর নাকের তেঁতুলপাতাটা আচমকা খুশিতে ঝিকমিক করে উঠল। যদিও মুখে কোন রোদ পড়ে নি তাও কেমন লালচে গোলাপি আভায় ভরে উঠল চম্পাবতীর শ্যামলা চিকন মুখ, তেলতেলে ভেজা ভেজা ঠোঁট, আর পাখির ডানার মত স্বাভাবিক ভুরু। আর আটপৌরে তাঁতের শাড়ির ঘোমটার বেড়ের ফাঁকে তার চল্লিশ পেরুনো টান টান ত্রিভুজ গ্রিবায় একটা নীলচে শিরা যেন অকারণই চঞ্চল হয়ে উঠল।

চম্পাবতীর ওটা সংস্কার। হাজার গরমে ভেপসে গেলেও বা বাড়িতে কেউ না থাকলেও সে ঘোমটা খুলবে না। সেই যে কবে কোন ছোটবেলায় তার দিদিমা তাকে শুনিয়ে দিয়েছিল—দিদিভাই, ঘোমটাটা হল হায়া। মেয়েমনিষ্যির ওটাই আসল পোষাক। হায়া না থাকলে আর রইলটা কী। বুঝলি দিদিভাই, তাহলে তো মেয়ে জম্মোটারই কোন মানে রইল না।

সেই যে মনে গেঁথে গিয়েছিল, ব্যাস। আর সেই ঘোমটার ঘেরাটোপ ছেড়ে বের হতে পারে নি। একলা স্নানের সময়ও সে বে-আব্রু হতে পারে না। নিজেকেই কেমন যেন লজ্জা লাগে তার।

–যাক বাবা, এতক্ষণে ঘাটগুলো ফাঁকা হল। কতা যেন আর শেষ হয় না। বাসন মাজতে আসা, না পাড়া-পড়শির হাঁড়ি ঘাঁটা। সেই তখন থেকে নড়ার আর নাম করে না।

মুখঝামটা দিয়ে আপন মনে বকবক করতে করতে চম্পাবতী ঝটপট তার গায়ের আঁচল খসিয়ে পেট কাপড়ের বাঁদিকের গোঁজাটায় হাত দিল। আজ তার লাজ শরমের বালাই নেই।

আসলে এ পাড়ার ঐ একটাই জল সইবার বড় পুকুর। পুকুরের চারপাশে মোট আটখানা ঘাট। একটাই শুধু বাঁধানো। আর ঐ শানবাঁধানো ঘাটটাতেই দুপুরের এঁটো বাসন নিয়ে এ পাড়ার বৌঝিরা আসে প্রতিদিন। ঠাপাও যায়। তারপর বাসন ধোয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলে গল্প। যতক্ষণ না সূর্যদেব পাটে বসেন। তারপর ধড়মড় করে সবাই ঘরে ফিরে যায়। মাঠ থেকে কত্তা বাড়ি ফিরবে, গরুটাকে জাব দেখিয়ে গোয়ালে তুলতে হবে, তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে হবে, রাতের চুলো ধরাতে হবে …..। এমনি কতরকম ঝক্কির কথা সবার মনে পড়ে যায়।

আর যেদিন ঘাটে যে অনুপস্থিত থাকে তাকে নিয়েই সেদিন যত আলোচনা। আজ চম্পাবতী যায়নি। আর আজ তাকে কেন্দ্র করেই যে ঘাটে যত আচার খাওয়া চলছিল, চম্পা সেটা নিকস জানে। তবে তার জন্যেই যে সে অতবার জানলা দিয়ে পুকুরটা দেখছিল আর রাগে গরগর করছিল তা নয়। আসলে আর তার তর সইছিল না।

পুকুরটাকে আজ তার একা চাই। একদম একা। এবং ঘাটটাও চাই বেবাক ফাঁকা। সুনসান। তা না হলে ঐ সময় কেউ দেখে ফেললেই তো সব গেল।

গঙ্গাজল সই তাকে পইপই করে বলে দিয়েছে। একটুকুও যেন পান থেকে চুন খসে। প্রতিটি নিয়মকানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারলে তবেই সিদ্ধিলাভ। একদম অব্যর্থ। আজ পর্যন্ত একজনেরও বিফলে যায় নি।

ভীষণ জাগ্রত মহাপুরুষ। ত্রিকালজ্ঞ তান্ত্রিক। চারপুরুষের সাধনা। তেমনি রাগি। কারোর দান গ্রহণ করেন না। সিদ্ধি হলে তবে একশ আটটা রক্তজবার কুঁড়ি। মায়ের প্রণামী। এমনিতে আজ পর্যন্ত তেনার মুখের কোন কথা কেউ কখনো শোনে নি। একদম মৌনী। শুধু মাঝে মাঝে যোগনিদ্রা ভেঙে গেলে রক্তক নয়ন মেলে শুধু তিনবার হুংকার দেন—ব্যোম, ব্যোম, ব্যোম। সে বড় দুর্লভ দৃশ্য। অনেক জন্মের পুণ্য থাকলে তবেই সে শব্দ নিজের কানে শোনা যায়। সেই ঐশ্বরিক দৃশ্যের চর্মচক্ষে সাক্ষী থাকা যায়।

আর সে রকমই এক অপার্থিব মুহূর্ত ছিল সেটা। তার বন্ধ চোখের মধ্যেকার গাঢ় অন্ধকার হঠাৎ যেন একটা আলোর ত্রিশূলের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আর সেই উজ্জ্বলতার দীপ্তিতে তার চোখের পাতাদুটো কেউ যেন জোর করে খুলে দিল।

একদম সোজাসুজি বিধে আছে। একজোড়া ঝকঝকে বাদামি তারা। তার থেকে দুটো অলৌকিক দৃশ্যমান আলোর রেখা যেন তার চোখ দুটোকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই পুড়ে যাওয়া। যেন সম্মোহন। চারপাশের আর সবাই যেন কোন মন্ত্রবলে উধাও।

এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

পুরো তিনমাস আগে থেকে মতলব কষেছিল দুজনে। গঙ্গাজল সই-এর ছোট জায়ের বাপের বাড়ি কর্ড লাইনে মাঝের গাঁয়ের পরে দুয়ারপাতায়। তার পাশের গ্রাম বৃন্দাবনপুর। গ্রামের সীমানায় ক্যানেলের ধারে খুব বড় একটা শ্মশান। বস্ত্রখানেক ধরে একজন সাধু হঠাৎই সেখানে এসে রয়েছে। সবাই বলে ত্রিকালদর্শী ব্রহ্মজ্ঞানী। অগুণতি বছর ধরে নাকি হিমালয়ের কোন দুর্গম গুহায় তপস্যা করে সিদ্ধি পেয়েছে। যে যা মানত করছে তাই ফলছে।

সেদিন মাঝদুপুরে সই এসে হাজির।

—ও সই, তোর কাছ থেকে পান খেতে এলুম। আমার বাটায় আজ পান বাড়ন্ত। তোর বঠাকুরও দুদিন ধরে বাড়ি নেই।

—তাতে কী হল। আমি থাকতে তোমার ভাবনা করার দরকারই বা কী। আজকাল বুঝি আমাকে পর ভাবতে শুরু করেছ?

—পর ভাবলে কি আর দৌড়ে আসতুম। পান ফুরোনোটা তো ছুতো। তোর জন্যে খবর আছে। জোর খবর।

সই বেশিক্ষণ আর আগডুম বাগডুম খেলতে পারে না।

-যে দিন থেকে তোর বটঠাকুর গেছে আমি শুধু ঘর আর বার করছি। কখন তোকে একলা পাব। হারে, পানু ঠাকুরপো আবার এক্ষুনি ফিরে আসবে না তো রে?

—সে ভয় নেই। তোমাদের ছোটঠাকুর এখন তিদিন ঘরমুখো হবে না। বর্ধমানে পালা আছে। তুমি বস তো। আমি হেঁসেল গুছিয়েই আসছি। আমার জন্যেও একটা পান সেজ। আমারটায় একটু বেশি করে খয়ের।

–বুজেছি গো বুজেছি। পুরো কৌটোটাই উপুড় করে দিচ্ছি না হয়। কিন্তু এখন পান খেয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁট করে কাকেই বা দেখাবি। ছোট্‌ঠাকুরতো ঘরেই নেই। এমনিতেই তো রূপের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। তার ওপর আবার এত বাহার কেন লা।

বলে ফেলেই সই বুঝলো বড় বেফাস ঠাট্টা হয়ে গেছে। এমনিতেই স্নেহের রঙ্গে রসে রসিকতায় তার চেয়ে বছর তিন চারেকের ছোট পাশের বাড়ির এই বউটাকে সে কীভাবে যেন আপন করে নিয়েছে। মায়ের পেটের বোনের চেয়েও যেন বেশি। তাই ওর জীবনের সব দুঃখ, আর না-পাওয়া ফাঁকগুলো ভরানোর জন্য সে সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকে। তবু ঠোঁট ফসকে বেরিয়ে গেল। এই জন্যেই বলে মেয়ে মানুষের মরণ।

চম্পা ততক্ষণে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সুন্দর মুখের ওপর বেদনার একটা আবছা ছায়া আর চোখের কোণের থমকানো জল, আটপৌরে বেশবাস—সব মিলিয়ে যেন একটা বিষাদপ্রতিমা।

সই-এর বুকটা তা দেখে দুমড়ে মুচড়ে উঠল। হাঁটু মুড়ে বসতে বসতে চম্পা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস লুকোতে চাইল। তারপর ধরা গলায় বলতে থাকল।

—আমার কি আর দেমাক দেখানোর রাস্তা আছে, সই। ভগবানই তো আমার সব দেমাক ঘুচিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জম্মের আসল দেমাকই যে কোনদিন আমি দেখাতে পারব না, সই। এই তুচ্ছ শরীর আর রূপের ঠমক আর কদ্দিন। পোকা পড়ল বলে।

—আর বলিসনে সই। কী বলতে মুখ ফসকে কী বলে ফেলেছি তার জন্যে আমাকে তুই এইসব শোনাচ্ছিস। তুই কি চাস আমি তোর পায়ে মাথা কুটে মরি। তোর জন্যে …..।

কান্না বড় ছোঁয়াচে। দুটো প্রায় সমবয়সি মেয়েমানুষের চোখে তা এখন আরো চুম্বক।

.

২.

গলা পর্যন্ত জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে চম্পা মাঝে মাঝে আপন মনেই হেসে ফেলছে। একবার মুখের মধ্যে জল নিয়ে কুলকুচি করে খেলার ছলে ফোয়ারার মত অনেকটা দূরে ছিটিয়ে দিল। আজ তার আনন্দ যেন আর ধরে না। সমস্ত শরীর আর মনে কী। একরকম খুশির ঢেউ যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে।

লোকটা একদম পাগল। তিনদিন মাত্র গেছে। তার মধ্যেই খবর পাঠিয়েছে। আজ সকালেই পাশের পাড়ার একজন বর্ধমান থেকে ফিরে এসেছে। তার হাতে পাঠানো আঠায় আটকানো একটি চিরকুট।

–আমার বেঁজি বউ। দুদিন তোমায় না দেখেই আমার মজনুর হাল। মাইরি বলছি। আজ সন্ধের ট্রেনে ফিরব। তারপর….

বাকিটা পড়তে পড়তে চম্পার মুখ চোখ একা একাই গরম আগুন হয়ে উঠেছিল। যত দিন যাচ্ছে লোকটার পাগলামি তত বাড়ছে। আদিখ্যেতা। তবে এবার থেকে কিন্তু বেঁজি বউ বললে আর সাড়া দেবে না সে।

আর একবার ফিক করে হেসে ফেলল চম্পা। তারপর দুহাত ছড়িয়ে জলের মধ্যে দু-পা ছুঁড়ে কিছুটা সামনে ভেসে যেতেই চম্পার পেছনের শাড়িটা জলের ওপর বেলুনের মত ফুলে ফেঁপে উঠল।

লোক তাকে বাঁজা বলে। আটকুঁড়ি বলে আড়ালে গাল দেয়। তার মুখ দেখে সকালে উঠলে নাকি গেরস্তের হাঁড়ি ফেটে যায়। প্রথম প্রথম তার খুব গায়ে লাগত। দুঃখ হত ভীষণ। সে একা একা কাঁদত। মনে হত যেদিকে দুচোখ যায় চলে যায়। কিংবা জীবনটাই শেষ করে দেয়। কিন্তু পারত না। শ্বশুর নেই, শাশুড়ি নেই, ননদ জা দেওর কেউ নেই। একেবারে ঝাড়া হাত পা সংসারে শুধু ঐ লোকটার কথা ভেবে সে সব সহ্য করে নিত। লোকটারও তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। যাত্রাপাগল লোকটাকে পাড়ার লোকেরা বউ-এর ভ্যাড়া বলে। শুধু চম্পা জানে, সে কত ভাগ্যবতী। ভগবান দেন নি তাই সে মা হতে পারেনি। লোকটার কি দোষ। সে তো চম্পাকে অবহেলা করেনি। রং সন্তান দিতে পারে নি বলে চম্পা নিজেই বুকের ওর পাথর চাপিয়ে সতীন ঘরে আনতে বলেছে। তা শুনে লোকটা এই মারতে যায় তো সেই মারতে যায়। তারপর দুদিন বেপাত্তা। তিদিনের দিন যখন সে ফিরল তখন তার কালির বর্ণ রূপ আর ক্ষয়াটে চেহারা দেখে চম্পা কেঁদে বাঁচে না। পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল। আর কোনদিন চম্পা সতীন আনার নাম মুখেও আনবে না।

চম্পা ব পড়শিদের উদ্দেশ্যে আপন মনে ঠোঁট বেঁকাল। এমন ভালোবাসার মর্ম তোরা কী বুঝবি, ছাই। সব হিংসুটের দল। মুখে আগুন তোদের।

সেদিন সই বলছিল—হ্যাঁরে চম্পা, তোর বটুঠাকুর বলছিল, ঠাকুরপোদের সঙ্গে একটা ঢলানি ঢঙি মেয়ে নাকি অ্যাক্টো করে। দেখিস বাপু। পুরুষমানুষের খেয়াল আর ভিজে মাটির দেয়াল। দুটোকেই বিশ্বাস নেই।

চম্পা আপন মনে আবারো খিলখিল করে হেসে ওঠে। এবার জলের ওপরতলে সেই হাসির রঙ্গ জলচাকার মত ছড়িয়ে যায়।

তার ঘরের মানুষটাকে সে আদ্যন্ত এমনভাবে চেনে যে ভাবতে চাইলেও অবিশ্বাস কখনো মনের মধ্যে দানা বাঁধতেই পারে না। লোকটার এক এক দিনের এক এক নতুন নতুন কীর্তি তার মনের ব ধুলো বালি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়।

হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে শীত করে উঠতেই চম্পা চমক ভেঙে দেখল, সে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বুক পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরপাড়ের ছায়াগুলো গাছেদের দূরত্ব পেরিয়ে জলটাকে আরো যেন কালো করে তুলেছে। কেমন ছমছমে। চারপাশে কেউ কোথাও নেই। শুধু একটা নাম না-জানা সান্ধ্যকীট অদ্ভুত স্বরে হঠাৎ ডেকে উঠল।

ঘাড় উঁচু করে চম্পাবতী একবার দেখে নিল জলছোঁয়া সিঁড়ির ধাপের ঠিক ওপরের ধাপটা। সেখানে নতুন লাল পেড়ে তারেশাড়ি আর গামছাটা। আর, গামছার ভজে রাখা আছে সেই লাল কার। আর, তার মধ্যে বন্দি একটা বিন্দুতে চম্পার সমস্ত ভবিতব্য।

চম্পার সমস্ত শরীর নিজের অবশে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

চোখের তারায় বিধে রেখে হঠাৎই আসনের পাশ থেকে ডান হাতের মুঠোয় খামচে তুলে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ঠিক চম্পার কোলের ওপর এসে পড়েছিল। আর সেই মৃদু আঘাতেই ঘোর কেটে গিয়েছিল চম্পার। কোলের শাড়ির ওপরে জ্বলজ্বল করছে একটা রক্তজবার কুঁড়ি। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় উদ্বেল চম্পা জলরা আবছা চোখ তুলে আবার তাকাতেই ভীষণ অবাক হয়ে দেখল সামনের বেদির ওপর এক উজ্জ্বল মহাপুরুষ নিমীলিত চক্ষু। ধ্যানমগ্ন। শান্ত। স্থির।

ততক্ষণে চারপাশের সবাই এই পরম ভাগ্যবতী বউটির দিকে চরম কৌতূহলে চেয়ে আছে।

বুক জলে দাঁড়িয়ে চম্পা নিজেকে উন্মোচন করতে শুরু করল। তারপর একহাতে সিক্ত বস্ত্র সম্পূর্ণ অনাবৃত চম্পাবতী জলের আড়াল থেকে আস্তে আস্তে উঠে চলল জলের ওপরের শেষ সিঁড়িটির দিকে।

লজ্জাহীন আবরণহীন চম্পাবতী নতুন গামছাটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তুলে নিল তার স্ত্রী জমের পরম প্রাপ্তির আশ্বাস। আর তখনই সে আবার দেখল সেই চোখ দুটো। রক্তকষায়। সদ্যোপিত ধ্যানভগ্ন জ্যোতির্ময় উজ্জ্বল বাদামি চোখের দুটো তারা। তার শরীরের সমস্ত যৌন রন্ধ্রে যেন অনন্তকাল বিধে থাকবে। অথচ তাতে একবিন্দু পাপ নেই। একতিল কাম নেই। কোথাও কামনার লেশমাত্র স্পর্শ পর্যন্ত নেই।

চম্পা চোখ বুজে ফেলল। কতক্ষণ এমনি ছিল সে নিজেও জানে না। হঠাৎ সে শুনতে পেল তার নিজেরই নাম। কে যেন ডাকছে। দূরে। সই-এর গলার মত।

ঘোর কাটতেই বুঝল সে একা সন্ধ্যার অন্ধকারে নির্জন ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা সেই মন্ত্রপূত রক্তজবার ফুল। একটা রুপোর মাদুলির মধ্যে ভরে লাল কারে ফাঁস দিয়ে বাঁধা। তাকে এই মুহূর্তে কোমরে ধারণ করতে হবে। তারপর নতুন কাপড় পরে আর গামছা গায়ে ঘরে ফিরে যাবে সে।

.

৩.

আজ দারুণ করে সাজতে বসেছে চম্পা। তার মনের মানুষটার ব পছন্দ আজ সে অঙ্গে ধারণ করবে।

সকাল থেকে ঘর সাজিয়েছে। এক্কেবারে মনের মত। বিছানায় নতুন চাদরে। মাথার বালিশে ফুলকাটা চাকা। মাথার কাছে ঘটিতে বাগানের সদ্য ফোঁটা এক থোকা বেলফুল আর দুটো গন্ধরাজ।

আর বিছানার পাশে একটা তিন পায়া টেবিলে একটা কাঁচের গ্লাস। জগে জল। এক বাটি চানাচুর ঢাকা দিয়ে রাখা। যদি মিইয়ে যায়। আসল জিনিসটা রেখেছে দেরাজের এক কোণে।

সই কাল সন্ধেবেলা চুপি চুপি দিয়ে গেছে।

-–শোন চম্পা, এটা রাখ। আদ্দেকটা আছে। তোর বঠাকুর মাঝে মাঝে রাতে ঘুম না এলে ওষুধের মতন খায়।

তারপরে চোখ মটকে আর হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল।

—কিন্তু সই, আমার যে ভীষণ বুক ঢিপ ঢিপ করছে। যদি বুঝে ফেলে।

–কেন, এধ্ব একদম ছোঁয় না বুঝি?

–না তা নয়। কালে ভদ্রে, পুজো পার্বণে বা যাত্রাপালা গাইতে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে…

—তবে আর ভয় কীসের। আজ বউ নিজের হাতে সোহাগ করে মুখে ধরবে। বল নেশা হবে। আর সেই ঘোরে…..

–যাও, ছি, তুমি না। এক্কেবারে যা। কথায় কোন হায়া নেই।

—আহারে হায়া রানি। ভেবেই একেবারে লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। তখন না জানি….।

—তুমি যাওতো, লজ্জা শরমের মাথা একদম খেয়ে দিয়েছ।

প্রায় জোর করে সই-কে বিদেয় করে দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরতেই আয়নায় নিজেকে দেখে শিউরে উঠল চম্পা।

—কে ও? এত রূপ তার! কই এর আগে নিজেকে তো এমন করে ভালো লাগেনি তার। আজ পনেরো বছরেরও বেশি তার বিয়ে হয়েছে। আর প্রতিটি মিলনের মুহূর্তে সে ভগবানকে ডেকেছে।

ঠাকুর, এবার ঘোচাও। এবার দয়া কর। তারপর পরের মাসটার সেই দিনটার জন্য একটা একটা দিন অপেক্ষা করেছে। আর আকুল হয়ে ভেবেছে।

—যেন পিছিয়ে যায়। দশটা মাস যেন আর না আসে সে দিনটা।

তবু নির্ভুল সময়ে শরীর ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। যেন শুধু শরীর ভেঙে নয়, প্রতি মাসে একবার করে তার মনকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেই একটা দিন। তার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নকে রজঃস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে মোচড় দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পরের আরো কয়েকটা রক্তাক্ত দিন।

.

৪.

অন্ধকারের আবরণে উন্মত্ত পৌরুষ এখন আদিম গুহামানবের মতই ধ্বনিসর্বস্ব। অস্ফুট গোঙানি আর অধৈর্য উন্মোচনের ব্যস্ততায় চম্পার শরীরের সমুদ্রে তোলপাড় করছে একটা জীবন্ত ডুবোজাহাজ। সেই গোঙানির মধ্যে মিশে যাচ্ছে অজস্র স্তুতির উপচার, তাৎক্ষণিক আবিষ্কারের অন্ধ আবেগ আর তীব্র পিপাসার গোপন শারীরিক সংকেতের টুকরো টুকরো ভাষা। চম্পার কানের লতিতে, গলায়, নীচের ঠোঁট আর স্তনের বিভাজনে ঘষটে যাচ্ছে সেইসব ধ্বনি আর সংকেত। চোখ মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘন উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের হলকা। তাতে উগ্র কোহলের ঝাঁঝ।

উন্মোচনের প্রাথমিক পর্বে চম্পাবতী আজ নিজের থেকেই অনেক বেশি সক্রিয়। উদ্দামতায় নয়, যেন পরম মমতায় সে তার অধৈর্য পুরুষকে ধীরে ধীরে বাহ্যিক খোলস থেকে মুক্ত করে নিচ্ছিল। বোধহয় এই প্রথম।

—আমার চঁপা ফুল। আমার চম্পু ….. আমার পরী বউ ….. তুই আমার সুখরানি, সোহাগমুকি, আদরখাকি ….. আজ ……

কানের ওপর গরম শাস, অস্ফুট অপ্রাকৃত আদিম শব্দের হনন চম্পাকে আজ যেন তেমন করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। সে কি বড় বেশি সাবধান আজ। নাকি ভীষণ সতর্ক। কোথাও একচুল ভুলচুক হলে চলবে না। যন্ত্রের মত তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাড়া দিয়ে যাচ্ছিল পুরুষের সেই প্রক্রিয়ায়। তবু অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে তার মনের একটা মূল অংশ যেন শরীরের এই সংবহন থেকে আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাদেরই দেহবেষ্টনীর চারপাশে। ক্ষণে ক্ষণে উপরের সারির দাঁতের আঘাতে নিচের ঠোঁটে রক্ত স্ফুটনের চিহ্ন জেগে উঠছিল। বার বার মনে পড়ছিল সন্ধের পরে স্বামীর ফিরে আসার মুহূর্তটুকু।

প্রথমে বিস্ময়। তারপরে তাকে পাঁজাকোলা করে চার চরকি পাক। ধপাস করে মেঝের ওপর নামিয়ে দিয়েই ছিটকে দুহাত পিছিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে নিরীক্ষণ।

—তব্‌বে। শালা, বার করুক তো এরকম একটা জিনিস। জানিস বউ, ছেলে পুলে না হয়ে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি হয়েছে। তোর এই বাঁধুনি কি আর এতদিন এমন থাকত। ঠকে চিত্তির। ছানা পোনার ঘ্যানঘ্যানানিতে আমাদের মধ্যের এই যে পিরিতের আঠা কবে শুককে যেত। এই শালা বেশ আছি। তুই আর মুই। কোন ঝুট ঝঞ্ঝা নেই। শালা, শহরের যাত্রারানি সরলাবালাও আজ তোকে দেখলে ভিরমি খেয়ে যাবে।

বলেই দুহাত বাড়িয়ে আবার এগিয়ে আসতে থাকা স্বামীকে চম্পা গামছা আর লুঙ্গি হাতে ধরিয়ে ঠেলে দুয়ারের বাইরে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

আর স্বামী বেরিয়ে যেতেই শির শির করে একটা অদ্ভুৎ ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেছিল। অজানা একটা আশংকা।

হঠাৎ তলপেটের কাছাকাছি একটা তীব্র অনুভূতি চম্পাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল সেই মুহূর্তের প্রক্রিয়ায়। একটা চঞ্চল ব্যস্ত হাতকে নাভির কাছ থেকে তুলে নিয়ে এসে চম্পা যেন নিতান্ত খেলাচ্ছলেই তার শরীরের অন্য সম্পদে স্থাপনা করে নিল। তারপর অনেকটা জোর করেই তার অবচেতনে শিথিল হয়ে আসা শরীরটাকে টান টান করে নেবার চেষ্টায় ব্রতী হল। ডানহাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরল তার শরীর জমিনের উপর উদভ্রান্ত হয়ে ওঠা কৃষকের চুলের মুঠি। পরিপূর্ণ আকর্ষণে।

সব বাধা পেরিয়ে যাবার মুহূর্তে চম্পা যখন প্রাণপণে সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের কাছে সৃষ্টি সুখের প্রার্থনায় একাত্ম হবার চেষ্টা করছে, আর বার বার নিশ্চিত হবার চেষ্টা করছে সই-এর সেই নির্দেশ—সেই চরম মুহূর্তে ঐ আশীর্বাদী মাদুলি একবারের জন্যে হলেও যেন স্পর্শ করে স্বামীর অঙ্গ, ঠিক তখনই তার শরীরের ওপর পাগল হয়ে ওঠা পুরুষের ক্রমশ হালকা হয়ে ওঠা শরীরটা আচমকা থেমে গেল। একদম স্থির। শক্ত। তারপর জোর করে পিঠের ওপর থেকে চম্পার দুহাত সরিয়ে হ্যাচকা টানে আলাদা হয়ে গেল।

একটা ঘামে ভেজা হাতের মুঠো অন্ধকারের মধ্যেই অব্যর্থ নিশানায় চম্পার তলপেটের নিচে থাবা বসাল।

চম্পা অস্ফুটে ককিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল।

একটা হিসহিসে গলায় গরগর করছে রাগ।

—এটা কী? এই চাপি, কোমরে এটা কী পরেছিস? কে দিয়েছে তোকে?

বোবা চম্পা ভয়ে লজ্জায় সম্পূর্ণ নিরাবরণ কুঁকড়ে শুয়ে আছে। এতক্ষণে চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকারে আর জানলা দিয়ে আসা ফিকে আলোয় মশারির মধ্যে তার পাশের মানুষটাকে তার কেমন যেন একটা আদিম হিংস্র পশুর মত ভয়ঙ্কর লাগছে। চম্পার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না।

একটা হ্যাচকা টানে চুলের মুঠি ধরে সেই অন্ধকারের শরীরটা তাকে আধশোয়া করে তুলে ধরল। তারপর, যেন একটা আদিম লোমশ মানুষ গর্জন করে উঠল।

–বল মাগি বল, এতক্ষণ ধরে সন্ধে থেকে আমার সাথে ছেনালি হচ্ছিল। এতদিন তবে পীরিত নয় অ্যাক্টো হচ্ছিল। তাই বলি, হঠাৎ রাস্তার মাগিদের মত এত নতুন নতুন ঢং। শালী, কত রকম ন্যাকামি। আমি বাঁজা, তুমি সতীন নিয়ে এস। তুই শালী ঠিক জানিস, আমার শরীরেই বীজ নেই। তাই সতীন এনে সেটা সবার সামনে পরখ করতে চেয়েছিলি। বল ঠিক কিনা, বল।

চরম আক্রোশে সেই উন্মত্ত পুরুষ যেন মশারি ছিঁড়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের মেঝের ওপর নামিয়ে নিয়ে এল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সপাটে চম্পার তলপেটে একটা লাথি এসে আছড়ে পড়ল।

দুমড়ে মুচড়ে ঘরের নর্দমার কোণে পড়ে যাওয়ার সময় তার কানে গরম সিসের মত আছড়ে পড়ল আক্রোশ।

বাঁহাতে লুঙ্গিটা খামচে, খিল তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তার স্বামী চিৎকার করে উঠল।

—অতই যদি বিয়োবার শখ তো কাউকে ঘরে ঢোকালেই তো হত। আমি তো কত রাত্তিরেই ঘরে ফিরি না।

শারীরিক যন্ত্রণার কোন বোধ মেঝেতে পড়ে থাকা চম্পাকে আর পীড়িত করছিল না। শুধু খোলা দরজার বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। অনেক রকমের মিশ্র ভাবনা। এলোমেলো। পরস্পর সম্পর্কহীন।

একসময় চম্পা ধড়মড় করে উঠে বসল। তার ভারি উন্মুক্ত বুক দ্রুত স্বাসপ্রশ্বাসে ওঠানামা করছে। মুখে চোখে গরম হলকা। রগের দুপাশের শিরা দপদপ করে মাথার মধ্যে যেন আগুনের স্রোত ছড়িয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ সে কোমরের গ্রন্থি থেকে সেই ধাতুপিণ্ডটাকে একটানে ডান হারে মুঠোয় ছিঁড়ে নিল। তারপর জানালার আবছা আলোকিত গরাদের ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে দিল সেই ধাতব আশীর্বাদ।

ঠং করে জানালার লোহার শিকে বাধা পেয়ে মাদুলিটা আবার ঘরের অন্ধকার মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল। চম্পার নাগালের বাইরে। এক দুরূহ অজানা কৌণিকে।

আস্তে আস্তে একটা তীব্র অনুভূতি তার সমস্ত সত্ত্বা আর চেতনাকে কাপিয়ে। দিয়ে গলার কাছে ফেনার মত উঠে আসতে লাগল। চম্পা অনেকক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত শরীর মন শক্ত করে নিজেকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। পারল না। সামনের অতিপ্রাকৃত গুল্ম অন্ধকারে দুহাত বাড়িয়ে যেন কোন অতল গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তারপর চম্পার সেই নগ্ন উপুড় শরীর, সেই শক্ত ঠাণ্ডা জমিনটায় দশ আঙুলের নখ বিঁধিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments