Monday, April 29, 2024
Homeবাণী-কথাঅন্নপ্রাশন - সমরেশ মজুমদার

অন্নপ্রাশন – সমরেশ মজুমদার

অন্তর আত্মা - সমরেশ মজুমদার

ফুলের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে উমাপদ, এমন ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল। না, একটা কুটো কোথাও পড়ে নেই। শালারা চেটেপুটে নিয়ে গেছে। এখন এই এত বড় উঠোনটা হাতের তালুর চেয়ে পরিষ্কার। উঠোনের একপাশে ওর বাবার তৈরি ছোট ইটের লুডোর ছক্কার মতো বাড়ি, বাকি তিনটে দিকে দু-মানুষ লম্বা কাঁটাতারের বেড়া লোহার বিম কুঁড়ে চলে গেছে টানটান। বাড়ির ঠিক মধ্যিখানে যে ছোট্ট একটা যার ওপর শুয়ে উমাপদের বাবা খুঁড়িতে তেল মাখাতেন, তার সরাসরি সামনে চা-বাগানের এক সাহেবের কাছ থেকে কিনে আনা বিলিতি লোহার গেট কাটাতারের দেওয়ালের ফাঁকে বসানো। গেটটা এখন বন্ধ। তৈরি, জল দাঁড়ায় না। উমাপদ উঠোনের মধ্যিখানে গম্বুজগুলোর চারপাশে একটা পাক দিয়ে নিল।

এক হঁট ভিতের ওপর সমানভাবে সিমেন্ট বুলিয়ে উঠোনটা প্রত্যেকটা গম্বুজের গা বেয়ে লোহার সিঁড়ি ওপরে চলে গেছে। লম্বায় হাত বারো, গম্বুজগুলোর মাথায় হাওয়া ঢুকতে পারে এরকম ছাউনি, বৃষ্টির জল ঢোকার কোনও সুযোগ নেই। লোহার সিঁড়ির মুখটা ছাউনির তলায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এ তল্লাটে এরকম গম্বুজ আর কারও নেই। উমাপদর বাবা যত নতুনরকম ফন্দি করতে ভালোবাসতেন। চোর-ডাকাতের উৎপাত হয়নি কখনও। একবার তিস্তা নদীর বুকে এক গুলিতে জলপাইগুলির এক দাগি গুণ্ডাকে মেরে ফেলেছিলেন উনি। বাড়িতে সেই বন্দুকটা ছিল। সেটাও চা-বাগানের সাহেবের কাছ থেকে কেনা। বিলিতি।

উমাপদকে অবশ্য কখনও বন্দুক চালাতে কেউ দেখেনি। তার কোনও দরকারও হয়নি। ওই লোহার গেট পেরিয়ে সন্ধের পর যে এই উঠোনে ঢুকবে সে কোনও মাতৃগর্ভে বাস করেনি। মাথা তুলে উমাপদ আকাশ দেখল। পাঁকের মতো লাগছে মেঘগুলোকে। থম ধরে আছে চারধার, যদিও এ-বাড়িতে কোনও গাছপালা নেই, তবু বোঝা যায়, বুঝতে পারে উমাপদ। নবকেষ্ট বলেছিল তিস্তার শরীরটাও সুবিধের নয়। আর এই সময়ে হিম বাতাসের স্পর্শ পেল ও। কাছাকাছি কোথাও নিশ্চয়ই বৃষ্টি নেমেছে। –অসময়ের বৃষ্টি।

উঠোন জুড়ে মরা আমপাতার মতো যে আলোটা ছিল এতক্ষণ, তিরতিরিয়ে সেটাও টুক করে সরে গেল। উমাপদ বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতেই চাপা গলা শুনতে পেল। হঠাৎ শুনলে মনে হয় বুঝি কয়েকটা রাগি অজগর ফুসছে। বাড়ির গায়ে দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা লোহার খাঁচার কাছে এসে। দাঁড়াতেই যেন ভিতরে ঝড় বয়ে গেল। জন্তু দুটো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একসা। উমাপদ ছাড়া আর। কেউ এই খাঁচার সামনে আসে না। খাঁচার দরজায় হাত দেওয়ার সাধ্য নেই কারও। লম্বায় দুটোয় প্রায় সাড়ে চার ফুট, দাঁড়ালে উমাপদর থাই-এর কাছে চলে আসে। লেজ দুটো প্রায় মুড়িয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে ছেলেবেলায়। একফোঁটা চর্বি লেগে নেই গায়ে, বরং মাংসের অভাবই মনে হয়। মুখটা থ্যাবড়া, একটা জামবাটির মতো। শুকনো জিভ সড়াৎ-সড়াৎ করে টানে লোক দেখলেই। চোখের দিকে তাকালেই বুক হিম হয়ে যাওয়া যথেষ্ট। এই দুটো জীব যেমন হিংস্র তেমনি এদের শক্তি। এ দুটোকেও চা-বাগানের সাহেবের কাছ থেকে কেনা। এদের মা-বাবা নাকি একটা নেকড়ে বাঘের পেছনে দু-মাইল দৌড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল। উমাপদ মাথা দুলিয়ে ওদের তারিফ করল। ওরা আর ফুসছে না এখন, মেঘ ডাকার মতো আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ওপরের বালতিতে রাখা কাঁচা মাংসের একটা টুকরো হাতে নিয়ে নাচাল উমাপদ। কুকুর দুটো সঙ্গে-সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখ উমাপদর হাতের ওপর, শরীর টানটান। সারাদিন ওদের খেতে দেওয়া হয় না। সন্ধের সময় একতাল মাংস ছুঁড়ে ওদের বের করে দেয় খাঁচা থেকে। মুহূর্তেই সেটা শেষ করে দেয় ওরা। সেই সুযোগে ভিতরে ঢুকে যায় উমাপদ। তারপর সারারাত রাক্ষসের মতো কুকুর দুটো ঘুরতে থাকে উঠোনে। তখন তাদের সামনে যে পড়বে সেই টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। এমনকী উমাপদরও সাহস হয় না যেতে। খিদের চোটে হিংস্র হয়ে থাকে কুকুর দুটো। ভোর হলে আধ বালতি মাংস নিয়ে আর লম্বা কাঁটাওয়ালা চাবুক হাতে উমাপদ খাঁচার সামনে। এসে দাঁড়ায়। আশ্চর্য, এই সময় ওরা কিছু করে না! মাংসগুলো খাঁচার ভেতরে ঢেলে দেওয়া মাত্র। চুপচাপ ঢুকে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সরে আসে উমাপদ।

এক হাতে মাংস উঠোনের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া, অন্য হাতে দরজার মুখ খুলে দেওয়া একই সঙ্গে সারল উমাপদ। তীরের মতো জন্তু দুটো বেরিয়ে যেতেই ও সরে এল ওখান থেকে। এই সময় কয়েক ফোঁটা জল ওর গায়ে এসে পড়ল, বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। উঠোন জুড়ে তখন বীভৎস আওয়াজ শুরু হয়েছে। ছাড়া পাওয়ার আনন্দের সঙ্গে মাংস কবজা করার প্রতিযোগিতা মিলে মিশে ওদের গলার শব্দ অন্যরকম শোনাচ্ছে।

দরজা বন্ধ করে ভেতরে এল উমাপদ। এখন স্নান করে এক গ্লাস লেবুর জল খাবে প্রথমে। বড় বড় হ্যারিকেনগুলো জ্বেলে দেওয়া হয়ে গেছে এরইমধ্যে। বেশি তেল পুড়োবার একটা বাতিক আছে শিবানীর, একটুও অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। বললেও শোনে না। বাঁজা মেয়েছেলেকে নিয়ে এই বিপদ। ভীষণ একরোখা হয়।

এই রকম ম্লেচ্ছপনা কদিন চলবে? উমাপদ জামা খুলতে গিয়ে দেখল শিবানীদরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিকেলে গা ধুয়ে চুল বাঁধলে ওকে এখনও বেশ টাটকা দেখায়। যদিও গায়ে-গতরে খুব ভারী হয়ে গেছে ইদানীং। পাছা কোমর পেছন থেকে দেখলে চোখ হোঁচট খায়, বাচ্চাকাচ্চা না হলে শরীরের ক্ষয়টা হবে কোত্থেকে। আজকাল আর ওদের মধ্যে শারীরিক যোগাযোগ তেমন। হয়টয় না। খুব যদি এক-আধদিন দুম করে ইচ্ছে হল তো হল। বারো-তেরো বছর ঘর করার পর এখন এসব মাথায় আসেও না। তা ছাড়া যে জিনিসে রহস্য নেই, যদি কিছু হয়ে যায় মার্কা। উদ্দীপনা নেই, সেই ব্যাপারগুলো মানুষকে দীর্ঘদিন টেনে রাখতে পারে না। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্যে ইসবগুলের ভুষি খায় উমাপদ, তাতেও যখন মাঝে-মাঝে কাজ হয় না তখন দোমহনী থেকে সন্তোষ ডাক্তারের ট্যাবলেট আনিয়ে নেয়। সেই রকম ব্যাপার এটা।

কী ব্যাপার? উমাপদ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।

মাংস ছুঁড়ে-ছুঁড়ে উঠোনময় সকড়ি করছ, তোমার একটু খেয়াল হয় না? ও দুটোকে বিদায় করে দিলেই বাঁচি। শিবানী গজগজ করল।

হাসল উমাপদ, ওরা আমার হাতের বাহু। বাম বাহু আর ডান বাহু।

মরণ! চলে যেতে-যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল শিবানী, দু-মুঠো চাল দিয়ে দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত?

প্রথমটা বুঝতে পারেনি উমাপদ, জ-কুঁচকে তাকিয়ে ছিল কথাটা শুনে। তারপর খিঁচিয়ে উঠল, এতই যখন দরদ তখন তাড়ালে কেন? তা কাল নিয়ে আসতে বলি, পারবে তো পালতে?

চুপচাপ খানিক তাকিয়ে থাকল শিবানী। এই উমাপদকে ও চেনে। বিয়ের পর এতদিন ঘর করে এইসব ভঙ্গিগুলো রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সরে এল ও, ব্যাপারটা ভাবলেই গা গুলিয়ে যায়।

স্নানটান করে লেবুর জলটা খেল উমাপদ। দু-মুঠো চাল দিয়ে দিলেই হত, ইল্লি আর কি! যেন লঙ্গরখানা খুলে বসে আছে ও! যে আসবে তাকেই গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে দিতে হবে। জানলা দিয়ে দেখতে পেয়ে বিবিসাহেবের দুঃখ উথলে উঠল। শিবানীর এই জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকাটা। ইদানিং ওর একদম পছন্দ হচ্ছে না। উঠোন জুড়ে লোকগুলো কাজকর্ম করে। রোদ্দুরে হাঁটুর ওপর কাপড় গুটিয়ে বসে কেউ-কেউ। সেদিকে নজর যেতে কতক্ষণ! আর উমাপদর যে একটা। বাঁজা বউ আছে সেটা জানতে কারই বা বাকি আছে। জানলাটা বন্ধ করে দিতে হবে। বেলা। তিনটে নাগাদ উঠোনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তদারকি করছিল উমাপদ। কেঁকিতে ধান ভেঙে চালগুলো ঝাড়াই করছিল ওরা। কালানোনিয়া ধান–ফার্স্ট ক্লাস গন্ধ ছড়ায়। আরও কয়েক মণ হয়ে গেলে গয়েরকাটার বা ধূপগুঁড়ির হাটে পাঠিয়ে দেবে। দুটো গম্বুজ ভরতি রয়েছে ধান, আর একটায় চাল বোঝাই করা হচ্ছে একে একে। সরকারকে ন্যায্যটুকু দিয়ে-থুয়ে মন্দ থাকে না।

তবে আজকাল খরচ পোষাচ্ছে না। জমির পেছনে ব্যয়টা বেড়ে গেছে হঠাৎই। এখনও বিঘে আটেক জমিতে ধান পাকব-পাকব হয়ে আছে। টিপটিপ বৃষ্টি হলে ক্ষতি নেই, তেজি হাওয়া। উঠলেই জলের ধার ছুরির মতো হয়ে যায়। ভয় সেখানেই। তা এবছর আকাশ বিট্রে করেনি এখনও। উমাপদ নিশ্চিন্ত। আর সাতটা দিন কেটে গেলেই হয়। জোত ল্যাংটো করে দেওয়া যাবে।

তিন-চারটে লোক সমানে কাজ করে চলেছে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। চালের অবস্থা দেখার জন্যে গম্বুজের গায়ে লাগানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে হাঁক দিল সে, হাত চালা রে–আকাশ ফুটো হলেই চিত্তির আর কি! আর এই সময়েই ও দেখতে পেল। লোহার গেটটা খুলে সে আসছে। ময়লা চিরকুটে খাকি শার্টটা যেন কাঁধের দুই হ্যাঙারে ঝোলানো। লোকটা কেমন। চোরের মতো তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। বুকের ওপর ডান হাতে জড়িয়ে রেখেছে খ্যাঙরা কাঠি হয়ে আসা বাচ্চাকে। লোকটা একটু ইতস্তত করে সামনের দিকে এগিয়ে এল। উমাপদর বাপের আমলের মানুষ হরিহর ফোঁকলা মুখে বিড়বিড় করে উঠল চাল বাছা থামিয়ে, আজ মর, ইটারে আবার নিয়ে এল কেন, ঝাঁটা মার ঝাঁটা মার!

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিল উমাপদ। লোকটাকে ও অনেকদিন বাদে দেখল। আচ্ছা সাহস তো। উমাপদর ভীষণ রেগে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একটা চোরা ভয় এবং সেই সঙ্গে খানিক কৌতূহলের মিশেলে ও টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটা উঠোনের ঠিক মধ্যিখানে এসে হরিহরের দিকে মিটমিটে চাইল, তারপর পেতল বাঁধানো একটা দাঁত বের করে হাসবার চেষ্টা করল, বাবু হ্যায়? হরিহরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে এবার উমাপদকে দেখতে পেল। দেখে। ছেলেটাকে ফুলের তোড়ার মতো বুকে ধরে কয়েক পা এগোল।

কী চাই? লোকটা কিছু বলার আগে উমাপদ হুঙ্কার দিল। ওর মুখ দেখে উমাপদর এককালে হাসি পেত। কুলের বিচির সাইজের একটা আঁচিল নাকের বাঁদিকে হরদম নাচছে। মুখচোখ পাথরের মতো–মনের ভাব ঠাউর করা মুশকিল। কিন্তু ওর বউও তো নেপালি–মুখচোখে। বুকের কথাটা চকচক করত। আর এখন এই যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কী ভাবছে ব্যাটা?

চাউল! ঘসঘসে একটা স্বর বেরুল গলা দিয়ে।

চাল? চাল কোথায় পাব? হকচকিয়ে গিয়ে গম্বুজে হাত রাখল উমাপদ। এ আবার ন্যাকড়াবাজি!

দো দিন ভুখা হ্যাঁয় বাবুজি, কুছ খানেকো নেহি মিলা–এ বাচ্চা মর যায়গা। লোকটা প্রায় ককিয়ে উঠল। এবার বাচ্চাটাকে দেখল উমাপদ। দিব্যি ছটফট করছে–মরবার কোনও লক্ষণ নেই। বাচ্চার মুখ চোখ দেখতে-দেখতে উমাপদর মনে হল লোকটা ইচ্ছে করেই ওকে খোঁচাতে এসেছে। এই তো সেদিন, ঠিক বছরখানেক আগে হরিহরের হাত দিয়ে ওর বউকে দুশো টাকা ধার দিয়েছিল শিবানী। মদ খেয়ে বউকে টানতে-টানতে নিয়ে এসেছিল সেদিন। বউকে চাকরি ছাড়িয়ে দিলে খাবে কী–চিৎকার করে বলেছিল। হাতে খোলা ভোজালি। যদিও বউটা সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে কুকুরের খাঁচার দিকে নজর রাখছিল। মেয়েমানুষটার পেট দখেলে বোঝা যেত না বাচ্চা আছে কিনা। টাকাটা দেওয়ার সময় যদিও শিবানী ধার শব্দটা বলেছিল, তবু বলার মধ্যে তেমন জোর ছিল না।

উমাপদ চিৎকার করল, ওসব চালফাল এখানে হবে না। এটা কি লঙ্গরখানা, হ্যাঁ! বেরোও–নিকালো।

লোকটা যেন মরিয়া হয়ে গেল, ই বাচ্চা মর যায়েগা বাবুজি।

কেন, এটা দুধ খায় না? বেফাঁস কথাটা জিজ্ঞাসা করে ফেলে জিভ কাটল উমাপদ। কী দরকার খায় কি না খায় জিজ্ঞাসা করার।

কাঁহা মিলেগা! যেন উত্তরটা দেওয়ার দায়িত্ব উমাপদর। ইল্লি আর কি! মায়ের বুকে দুধ নেই, অমন পাকা বেলে বাজ পড়েছে নাকি! শালা!

ওসব হবেটবে না। তুমি বেরোও বাড়ি থেকে। নিকালো! তরতর করে নেমে এল উমাপদ। আর এই সময় খাঁচার মধ্যে বসে দুটো কুকুর চাপা গর্জন করে উঠল। লোকটার গায়ের গন্ধ বোধহয় ওরা ঠিক ঠিক চিনতে পারছে না।

মুখোমুখি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক ঝটকায় বাচ্চাটাকে কাঁধ বদলি করে লোকটা আবার গেটের দিকে হাঁটতে লাগল গম্বুজ তিনটেকে চোখ দিয়ে চাটতে-চাটতে। শালার হাঁটার ভঙ্গি কি! যেন চ্যাম্পিয়নশিপের কাপ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরেই ও সতর্ক হয়ে গেল। কাজ থামিয়ে। সবাই ব্যাপারটা দেখছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠল উমাপদ, কী হল, অ্যাঁ! হাতে পোকা ধরেছে নাকি? আমার গুষ্টির পিণ্ডি হবে বৃষ্টি নামলে? নে-নে বাবা হাত চালা।

পার্শেমাছের ঝোল আর কালানোনিয়া চালের ভাত খেতে-খেতে বৃষ্টি নামল। বেশ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কুকুর দুটো দুবার চিৎকার করে ডেকে উঠে চুপ মেরে গেল। গম্বুজের গায়ে দাঁড়ালে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না–ব্যাটারা জানে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই গুমগুম শব্দ শুনতে পেল উমাপদ। প্রথমটা অন্যমনস্ক ছিল, তারপর কথাটা মনে হতেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। সকড়ি তুলছিল শিবানী, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও! বলে উমাপদ দ্রুতপায়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে এল। শব্দটা খারাপ, খুব খারাপ, বুড়ি তিস্তার বুকে যখন এই রকম শব্দ ওঠে তখনই বান হয়। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে কথাটা–ওর বাপও বলত। তা বছর দশেক এরকম শব্দ শোনেনি ও। এখন ওই মণ্ডলঘাট থেকে জলপাইগুড়ির মুখ অবধি এতো উঁচু বাঁধ বেঁধে দিয়েছে সরকার, শালার নদীর সাধ্যি নেই ট্যাঁ-ফ্যাঁ করে। কিন্তু শব্দটা হল কেন? চিলেকোঠার ঘরটা ছাদের খানিকটা আড়াল করে রেখেছে। অন্ধকারে ওপরে উঠে এল। ওঃ, জোর হাওয়া বইছে! মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পাথরের মতো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মারছে। একবার বিদ্যুৎ চমকাতেই ও দেখল আকাশটা শালা মড়াখেকো কাকের মতো কালো। চাপা একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পেল উমাপদ। দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ। তিস্তার বুক থেকে আসছে। ওর লোহার গেট ছাড়িয়ে দুশো গজ গেলেই তিন মানুষ উঁচু পাথরের বাঁধ। শাসানিটা যেন বাঁধে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে ছিটকে ওপরে। উঠে আসছে। মনের মধ্যে কু গাইতে লাগল ওর, না, ভালো ঠেকছেনা লক্ষণটা। শালার জোতভরতি ধান-রাতভোর এই হাওয়া চললেই যে বেগুনটুলির গলির মেয়েছেলেদের মতো হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকবে। বুকের মধ্যে হি-হি করে উঠল ওর। নিচে নেমে দেখল খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে শিবানী খাটের ওপর বসে সেলাই করছে লাল নীল সুতোয়–পতি পরম গুরু। এই রকম ভয়-ভয় মনখারাপ হলেই উমাপদ বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। সাহস বাড়ে তাতে।

দোল দোল দোল। অদ্ভুত মজাদার একটা স্বপ্ন দেখছিল উমাপদ। শিবানীর হাতের ঠেলায় ধড়মড় করে উঠে বসল। বসেই মনে হল খাটটা যেন দুলছে। ব্যাপারটা কী হল!

বুড়ি বেড়ালের মতো ফাঁসফেসে গলায় কেঁদে উঠল শিবানী, হ্যাঁগা, জল সেঁদিয়েছে ঘরে।

তাই তো! উমাপদ দেখল কাঠের জলচৌকির ওপর রাখা হ্যারিকেন চাঁদের মতো এপাশ-ওপাশ ভাসাভাসি করছে। পাকা ঘরে সাপের মতো খলবলে ঢেউগুলো ছলাৎছলাৎ শব্দ তুলছে। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থেকে উমাপদ চমকে উঠল হঠাৎ। জল–জল এল কোত্থেকে? তাহলে কি তিস্তার বাঁধ ভেঙেছে! ওপাশে জলপাইগুড়ি এদিকে দোহমনী বাঁধটা তো দু-দিকেই মজবুত–ভাঙবে বলে মনে হয় না। কিন্তু না ভাঙলে জল আসবে কেন? কয়েক মুহূর্তের অসহায় অবস্থায় ও দেখল শিবানী প্রায় জড়িয়ে ধরেছে ওকে, হ্যাঁগাজল যে বাড়ছে!

তড়াক করে জলে নেমে পড়ল উমাপদ। উঃ, কী ঠান্ডা। পায়ের পাতায় বরফ ঘষে যায় যেন! প্রায় হাঁটু অবধি ডুবে গেল ওর। না, আর এ-ঘরে থাকা যায় না। ঘরভরতি সংসারে নানা জিনিসের দিকে তাকাল ও। এগুলো কী হবে? কোনওরকমে আলমারি খুলে লোহার হাতসিন্দুকটা বের করল, করে শিবানীর হাত ধরল, চলে এসো–চলে এসো।

কোথায়? ফ্যালফ্যাল করে তাকাল শিবানী।

ছাদে! জল যদি বাড়ে তাহলে এখানে থাকলে দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে!

অধৈর্য হয়ে উমাপদ ওর হাত ধরে টানল। চট করে শিবানী বুঝে ফেলল ব্যাপারটা। সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আমার শাড়ি–আমার গয়না–আমার ঠাকুর–ওগুলো নেবে না?

নেব নেব! আগে জান বাঁচাও। তারপর ওসব নেব। আর সোনার গয়না জলে নষ্ট হয় না।

প্রায় হিঁচড়ে ওকে জলে নামল উমাপদ। পায়ে জল লাগতেই শিবানী চেঁচিয়ে উঠল, মা গো!

দরজা ভিতর থেকে আগল-বন্ধ করে শুয়েছিল ওরা। উমাপদ দেখল লোহার মতো ভারী হয়ে। গেছে পাল্লা দুটো। অনেক চেষ্টা করে এক হাতে টেনে খুলতেই ঘরের জল হাঁটু ছাড়িয়ে গেল। আই বাপ! অন্ধকারে চোখ যায় না বেশিদূর–শুধু জলের শব্দ আর জলের শব্দ। মাথায় নামছে জল, পায়ে খেলছে জল। বারান্দা দিয়ে জল ভেঙে উমাপদ শিবানীকে নিয়ে চিলেকোঠার দরজায় এসে দাঁড়াল। আর এখানে এসে ওর মনে পড়ল দরজায় ও তালা দিয়ে রেখেছিল। ছাদের ওঠার সিঁড়িতে তিন বস্তা সিমেন্ট রাখা আছে, লোহা-লক্কড় আছে, বলা যায় না কিছু কুলিকামিনদের মতিভ্রম হতে পারে। এখন চাবি আনতে যাবে কে? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শিবানী নাকে কেঁদে উঠল, মরণ আমার, সবতাতে সন্দেহ, তালা দিয়ে রাখি, বেড়া দিয়ে রাখি, মর এখন এখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে!

মাথায় রক্ত চড়ে গেল উমাপদর, বউ-এর দিকে একবার তাকিয়ে পিছিয়ে গিয়ে ছুটে এসে কাঁধের ধাক্কা দিল দরজার গায়ে। নড়ে উঠল সেটা, এই পর্যন্ত। জলের স্রোতে টান বাড়ছে। এখন প্রায় ওদের থাই ছাড়িয়ে যায় আর কি। শিবানীর শরীরের সঙ্গে শাড়ি ন্যাতার মতো লেপ্টে আছে। এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল উমাপদ, এত মাংস হয় কী করে মেয়েছেলের গায়ে!

দড়াম করে আবার ধাক্কা দিল উমাপদ। শেষপর্যন্ত বারবার। জল এখন প্রায় কোমরের কাছে। শরীরের তেজ কমে আসছে। শিবানীর মনে হল নাভির তলায় হিমজল কেমন শিরশিরানি। তুলছে। কোনওদিন পেটে বাচ্চা আসেনি ওর, আট-নয় মাস হয়ে গেলে নাকি তারা লাথি মারে পেটে শুয়ে।

শেষপর্যন্ত কড়া দুটো খুলে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গে জলের টানে ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। এতক্ষণ এক হাতে লোহার হাতবাক্স আঁকড়ে ধরেছিল উমাপদ। একবারও শিবানীকে ওটা দেওয়ার কথা মনে হয়নি। পড়তে পড়তে টাল সামলে দেখল শিবানীও জলের মধ্যে পড়ে গিয়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এমনিতেই বৃষ্টির জলে সারা শরীর ভেজা। এখন শীত-শীত বোধ হচ্ছে।

কয়েক পা হেঁটেই শুকনো সিঁড়ি। আঃ, কি আরাম! ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। মাথার ওপর চিলেকোঠার ছাদে বৃষ্টির জলের শব্দ হচ্ছে। ছাদের ওপর দরজার সামনে টিনের ছাউনি আছে এক চিলতে। ওরা ওখানে এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে আসা শব্দটাকে মানুষের আর্তনাদ বলে ঠিক চেনা যাচ্ছে। প্রাণপণে চিৎকার করছে কারা, হয়তো সাহায্যের জন্যে ডাকছে। হঠাৎ আকাশ জুড়ে একটা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠতেই বুক। হিম হয়ে গেল। তিস্তা নদীটা যেন ওর বাড়ির গায়ে উঠে এসেছে। মুহূর্তের আলোয় যা দেখা গেল তা শুধু ঢেউ আর ঢেউ। দুরে মোষের পিঠের মতো বাঁধটা জলের ওপর জেগে আছে কি না আছে!

দরজার কাছে থপ করে বসে পড়ল শিবানী। বসার শব্দে বোঝা গেল ও ভেঙে পড়েছে। একটা হ্যারিকেন সঙ্গে আনলে হত। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে কী করে উঠে এল ওরা! উমাপদ ঘাড় নাড়ল।

আমার সব গেল, জামাকাপড়, গয়না, টাকা–সংসার সব গেল–বিড়বিড় করছিল শিবানী।

আঃ চুপ করো। খেঁকিয়ে উঠল উমাপদ, প্রাণে বেঁচে আছ এই ঢের। আর কার কোঠাবাড়ির ছাদ আছে এই তল্লাটে–হ্যাঁ?

একটু উষ্ণ আরাম বোধ করল উমাপদ। এই তল্লাটে একমাত্র তার বাড়িতেই পাকা ঢালাইয়ের ছাদ আছে আর তাই ওরা নিরাপদ। জল যেরকম বাড়ছে, সব তো ধুয়েমুছে যাবে। এরকম জল বাপের জন্মে দ্যাখেনি ও। আর সঙ্গে-সঙ্গে ওর মাঠের কথা মনে পড়ে গেল। মাঠভরতি পেকে আসা ধানগুলো মুখিয়ে আছে গোলায় ওঠার জন্যে। আর আছে! এই জল কি আর সেগুলোকে জ্যান্ত রাখবে। হু-হুঁ করে উঠল বুকের ভিতরটা। হঠাৎ নিজের অজান্তে ডুকরে কেঁদে উঠল। উমাপদ। চারপাশে খোলা আকাশ আর হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে ও ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগল।

শিবানী বলল, সব গেল, সব গেল–এত পাপ–।

কাঁদতে-কাঁদতে কথাটা শুনল উমাপদ। পাপ! কার পাপ? কি বলে মেয়েছেলেটা? ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা চড় মারলে কেমন হয়। অন্ধকারে ওর মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। উমাপদ শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে দেখল বৃষ্টিটা কমে আসছে।

আস্তে-আস্তে ছাদের মধ্যিখানে চলে এল ও। এক হাতে লোহার হাতবাক্স এখন মাদুলির মতো ভারহীন হয়ে গেছে। তিস্তার দিকটা অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। কার্নিশের ধারে এসে চমকে উঠল ও। ওটা কী? কি যেন ভেসে যাচ্ছে! ভাসছে কী করে? জল এখন এতটা ওপরে উঠে এসেছে নাকি! মেরুদণ্ড কনকন করে উঠল ওর। ছাদের কার্নিশের নিচে জল প্রচণ্ড স্রোতে বেরিয়ে যাচ্ছে। বড়জোর এক হাত নিচে।

উঠোনের দিকে তাকিয়ে ও প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না। জলের টানে কার্নিশের গায়ে যেটা ঠোকর খেয়ে বেরিয়ে গেল সেটা গরু বা মোষ হবে। আর হঠাৎ ওর মনে হল কুকুর দুটো তো ডাকছেনা! কোথায় গেল ওগুলো? বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। ও দুটো না থাকলে এই বাড়িটায় থাকার কথা ভাবা যায় না। ভেসে গেল–সব ভেসে গেল–উমাপদর মনে হল ওর দুটো হাত শরীরের সঙ্গে লেগে নেই। এত বড় উঠোনটায় জায়গা নেবে কুকুর দুটো এমন কোনও উপায় নেই। আর এরকম স্রোতের টানে হাতি অবধি ভেসে যাবে তো কুকুর! আর এক ঝলক। বিদ্যুতের আলোয় গম্বুজ তিনটের মাথা চট করে দেখতে পেল ও। ওপরের সিঁড়ির মুখে কী যেন ছটফট করছে। কুকুরটা নাকি। সিঁড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বোধহয়। কিন্তু জল যে গম্বুজ ছুঁল। সঙ্গে-সঙ্গে উমাপদর মনে হল বত্রিশফলা ছুরি দিয়ে কে যেন ওর পেটের নাড়িভুঁড়ি টেনে-টেনে বের করছে। জল যে গম্বুজ তিনটেকে গিলে ফেলল বলে। উত্তেজিত হলে পেটে ব্যথা হয়–উমাপদ এক হাতে পেট ধরে চিৎকার করে উঠল।

পাথরের মতো বসেছিল শিবানী, মুখ না তুলে বলল, পাগল!

কথাটা শুনে দৌড়ে এল উমাপদ, অ্যাই চোপ! আমি পাগল, না? ওই ধানচালগুলো ডুবে গেলে খাবে কী? গয়নাশাড়ি আসবে কোত্থেকে, অ্যাঁ? ।

কিন্তু পাগলের মতোই ছাদময় দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল উমাপদ। এখন বৃষ্টি প্রায় নেই। আকাশের রঙটা ফিকে মেরে এসেছে। কিন্তু এত জল কোত্থেকে আসে? গেরুয়া রঙের জলের। স্রোত গাছপালা গরুবাছুর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওর বাড়িটাকে মধ্যিখানে রেখে। এরই নাম কি প্রলয়? ছাদের উলটোদিকে চলে এল ও। ওপারে ফরেস্ট কোয়ার্টার আর নেপালি বস্তি। না, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল ওর। একটা ডাঁসা বেঁটেখাটো শরীর আর তার হাজাররকম রহস্যের কথা–পাকা বেলের মতো বুক, শিবানীকে লুকিয়ে-চুরিয়ে একটু জুত করে নেওয়া–এইসব ব্যাপার মনে পড়ে যায় কেন? কিন্তু জলের তোড়ে বোধহয় সব ভেসে। গেল। ওখানে ওই বস্তিতে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। হঠাৎ মনে হল, ভালোই হল। কেমন একটা তৃপ্তি লাগছে মুক্তির।

এক সময় উমাপদর মনে হল বেঁচে থেকে অনেক সুখ ছিল। অথচ সে সুখগুলোকে ও পুরোপুরি জানল না। চিলেকোঠার দরজার গায়ে শিবানী ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল। শিবানীর গায়ে জলপাইগুড়ি থেকে আনা পাউডারটার গন্ধ কি করে যে মিশে থাকে এই জলে ভিজে! অদ্ভুত উদাস চোখে ও ফিকে অন্ধকারে চারধারে তাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে না, মেঘ ডাকছেনা, আকাশের নীল হঠাৎ-হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু নড়ার উপায় নেই আর, পৃথিবীটার কোনও জায়গা আর বাকি নেই বোধহয়। রে-রে করে ডাকাতের মতো ঢেউগুলো ছাদের ওপর উঠে এসেছে। খানিক আগে। জল এখন হাঁটুর গায়ে। চারধার থইথই। এভাবে জল বেড়ে গেলে মরে যেতে। হবে। আর মরে গেলে কিছুই করার থাকবে না। মরে গেলে জোতের ধানগুলো কে বিক্রি করবে? গম্বুজের চালগুলোলা? এই বাড়ি–এইসব। ও গেলে শিবানীও যাবে। আসবে কেউ না কেউ নিশ্চয়। ওর এক খুড়তুতো ভাই আছে মালবাজারে–সে ছুটে আসবে দখল নিতে। অদ্ভুত ঠান্ডা এই জলস্রোতে দাঁড়িয়ে থেকেও একটু পরে শিবানীকে জড়িয়ে ধরল। জলে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শিবানীর শরীর কাহিল হয়েছিল–উমাপদর এই উষ্ণতা ওকে খানিকটা আরাম দিল।

জল যদি আরও বাড়ে, যদি গলা পর্যন্ত এসে যায় তবে যাওয়ার জায়গা যে একদম নেই তা নয়–মাথার ওপর টিনের ছাদ আছে চিলেকোঠার। কোনওরকমে কসরত করে উঠে যেতে পারে হয়তো। কিন্তু শিবানীকে নিয়ে ওঠা অসম্ভব। যদি তাই হয়, তাহলে ও কী করবে? শিবানী যদি ভেসে যায়–ভাসতে দিতে হয় তাহলে ও কী করবে? এমন যদি হত, ওর একটা বাচ্চা ছেলে থাকত, তবে তাকে অনায়াসে ওপরে তুলে দিতে পারত ও, নিজেরা ভেসে গেলেও বাচ্চাটা হয়ত থেকে যেত ওপরে বেঁচেবর্তে, অনেক বছর ধরে বলত আমার বাবার নাম উমাপদ। আর একটা ঢেউ এসে ওদের দুলিয়ে যেতেই উমাপদ শিবানীকে জোরে জড়িয়ে ধরল। আর এই সময় এই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এই প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ওর মনে হল, ওর আলিঙ্গনের মধ্যে। শিবানীর মোটা শরীরটায় কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। এতদিন অনায়াসে সবকিছু পেয়ে-পেয়ে উমাপদর মনে হল, মূল্য দিয়ে কিছু পাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

এতক্ষণ যেটা ছিল না, জল কমার পর সেটা শুরু হয়ে গেল। ভোরের দিকে চমৎকার টাটকা সূর্য উঠল। তিন-তিনটে মদ পার করে দিয়ে বেগুনটুলির গলরি মেয়ে যেমন ঘোমটা টেনে বলে আমি ভদ্দরঘরের মেয়ে–এরকম রোদ্দুর ছিল। আর এক সময় পুরু পলিমাটি ছাদে ঢেলে দিয়ে জল টুপুস করে নেমে গেল নিচে। উমাপদ পায়ে-পায়ে কয়েক পা হাঁটল। এই সারারাত মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আর কোনও শক্তি শিবানীর ছিল না, কাদা জমা ছাদেই পাছা লেপটে বসে পড়েছে ও। এখন চারধারে অদ্ভুত একটা দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। দুরের বাড়ি-ঘরগুলো ভাঙা-ভাঙা, কোত্থেকে গাছপালা বয়ে নিয়ে এসেছে জলস্রোত–এখানে-ওখানে আটকে আছে। তিস্তাকে দেখা যাচ্ছে বাঁধের ওপাশে, বাঁধটা শিখণ্ডীর মতো দাঁড়িয়ে, অথচ এপাশেও তিস্তা।

উঠোনের গম্বুজগুলো অনেকটা উঠে এসেছে জল থেকে। বুকের মধ্যে আঁকুপাঁকু শুরু হয়ে গেল। উমাপদর। জলের দাগ প্রায় গম্বুজের ওপর-দরজার কানায়-কানায়। জল যদি ঢুকে থাকে তো মন কেমন করা গন্ধের কালাননানিয়া চাল-ভাত বয়ে কেলিয়ে আছে। আর তাহলেই মাথা গরম হয়ে গেল ওর। এখন ভাবা যায় না আর। কাল রাত্রে মরে গেলে কোনও কথা ছিল না। আজ বেঁচে থেকে এগুলোকে চোখের সামনে নষ্ট হতে দেওয়া মানে নিজের শরীরের মাংসগুলো কেটে কেটে কাউকে খেতে দেওয়া–একই ব্যাপার। অথচ চারপাশের মানুষজনের কোনও পাত্তাই নেই। কোথাও কে নড়ছে না। এমনকী কাকগুলো অবধি।

জল যখন কোমরের নিচে এল তখন আর পারল না উমাপদ। প্রায় উদোম হয়ে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। বসে-বসে শিবানী বলল, কেন যাও?

উমাপদ বলল, ফুর্তি মারতে?

বারান্দায় জল এখন হাঁটুতে। কিন্তু পায়ের তলায় হড়হড়ে। পিছলে-পিছলে যাচ্ছে। উঠোনে নামল ও সাবধানে। জল চলে এল কোমরে। কুকুর দুটোর কোনও অস্তিত্ব নেই আর। খুব সাবধানে পা টিপেটিপে এগোচ্ছিল উমাপদ। চারপাশে তাকিয়ে দেখল একবার। কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে অজস্র ডালপালা জড়িয়ে গিয়ে আর একটা দেওয়াল হয়ে গিয়েছে। ওটা কী? জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ও দেখতে পেল একটা পেটফোলা গরু ভাসাভাসি করছে।

কোনওরকমে চালের গম্বুজের কাছে এল উমাপদ। আর সেই সময় আকাশ থেকে শিবানীর চিনচিনে গলা কানে এল, যক্ষ, যক্ষ, মরে গিয়েও লোভ যাবে না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শিবানী কার্নিশের গায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে উমাপদর লোহার বাক্সটা নামবার সময় যেটা ও রেখে এসেছিল যত্নে। কথার জবাব দিল না আর, চালগুলো যদি ভিজে ঢোল হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? শুকতে দেওয়ার জায়গা কোথায়–আর লোকজনই বা কোথায় পাবে এসময়? কিন্তু জল তো নাও ঢুকতে পারে গম্বুজে। আশায়-আশায় পা টেনে ও সিঁড়ির কাছে চলে এল।

লোহার সিঁড়িতে হাত রেখে ওপরে মুখ তুলতেই চমকে উঠল উমাপদ। সিঁড়ির ফাঁকে লটকে থেকে দুটো দেহ ঝুলছে। একটা কুকুরের, অন্যটি মানুষের। মানুষটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না ও। জলের মধ্যে তার অনেকটাই ডোবা, কুকুরটার দাঁত ওর থাই-এর হাড়ে আটকে গেছে। হলের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরেছে সেটা। এখন কামড়ে থাকা অবস্থায় ওর চোখ দুটো খোলা। লোকটা কে? চোরটোর নয় তো? জলের সুযোগে এসেছিল। মরা কুকুরটার গায়ে হাত বোলাতে ইচ্ছে হল ওর। সাবাস!

সিঁড়িতে উঠে পা দিয়ে জোরে ঠেলতেই দুটো শরীর ঝপাস করে জলে পড়ে গেল। উমাপদ আস্তে-আস্তে ওপরে উঠতে লাগল। একপা-একপা করে যত ওপরে চলে আসে বুকের মধ্যে তত বাতাস বন্ধ হয়। শেষপর্যন্ত ছাঁউনির তলায় চলে এল ও।

বেশ ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে। কেমন পুজো-পুজো রোদ্দুর। আস্তে-আস্তে মাথা ঢোকাল ও। ঢোকাতেই ওর মনে হল ভগবান আছেন। না হলে কাল ও বেঁচে যেত না, না হলে এই চালগুলো জল ছুঁই-ছুঁই করেও জল মাখল না। আনন্দে ও হাততালি দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ওটা কী? ভেতরে ঢুকে চালের ওপর বাবু হয়ে বসে উমাপদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। সেই খ্যাংড়াকাঠি হয়ে আসা বাচ্চাটা!

বাচ্চাটা কি নড়ছে? কী করে এল এটা এখানে? মাথা ঘুরিয়ে নিচে জলে ভেসে থাকা দেহটাকে ও দেখল একবার। মুহূর্তেই সমস্ত কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

দুটো হাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে দোলাতে লাগল উমাপদ। বেঁচে আছে কিনা বুঝতে পারছে না। চোখ মেলছে না, কেমন নেতিয়ে আছে। ছাদের দিকে তাকাল ও। শিবানী বোধহয় দেখতে পেয়েছে। হাত নেড়ে কিছু বলছে যেন।

হঠাৎ নজরে এল চালগুলো এক জায়গায় ভেজা-ভেজা। নির্ঘাত এটা পেচ্ছাপ করেছিল খানিক আগে। মাথায় রক্ত উঠতে-উঠতে সামলে নিল উমাপদ। তারপর নিজের কড়ে আঙুল বাচ্চাটার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে আলতো করে নাড়তে লাগল। মাড়ি বেশ শক্ত হয়ে গেছে এর মধ্যে, দাঁত বেরোবার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কুটুস করে একটা কামড়ের অপেক্ষায় বসে থাকল উমাপদ।

হঠাৎ কি মনে হতে ভিজে চালগুলো থেকে দুই আঙুলে দুটো নরম দানা তুলে নিল ও এক সময়। কেমন গলে-গলে এসেছে এর মধ্যে। আঙুলের চাপে চটকে-চটকে মাড়ির ভেতর খুঁজে দিল ও। উমাপদর মনে হল, জিভটা এবার নড়ে উঠবে, যে-কোনও মুহূর্তেই।

খিদে পেলেই তো মানুষ বেঁচে থাকে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments