Thursday, August 21, 2025
Homeবাণী ও কথাঘুণ পোকা - সানজিদ খান

ঘুণ পোকা – সানজিদ খান

ঘুণ পোকা – সানজিদ খান

জয়নাল সাহেবের মেজাজ এই মুহূর্তে চড়া হয়ে আছে। গত বছর নেপাল থেকে তিনি কাঠের তৈরী একটা ইয়েতির স্কাল্পচার কিনে এনেছিলেন। সেটা এখন হাত থেকে পড়ে দুই টুকরো হয়ে গেছে। কাঠের ভাস্কর্য পড়ে গিয়ে এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা নয় কিন্তু সব নষ্টের মূলে ঘুণ পোকা। ধুলো পরিস্কার করার জন্য শো-কেস থেকে বের করেছিলেন আর তখনই এই অবস্থা। ঘুণ স্কাল্পচারের ভেতরটা একদম খালি করে দিয়েছে। জয়নাল সাহেব সৌখিন মানুষ। বেচারার মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে আছে, মনে হচ্ছে ঘুণ তার বুকটাই খালি করে দিয়েছে।

দুই বছর হল সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পেনশনের টাকা দিয়ে তিনতলা বাড়ি করেছেন। স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে আছেন। তার ছেলে রেদোয়ান অসম্ভব মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স শেষ করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড মার্কস পেয়েছে। জয়নাল সাহেবের রাগ যখন সপ্তমে চড়ে আছেঠিক তখনই তার ছেলে রেদোয়ান এসে বাবাকে তার আলটিমেট সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল।

-আব্বু,আমি দেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছি না, স্কলার্শিপ নিয়ে এই মুহুর্তে কিছু ভাবছি না।

জয়নাল সাহেব কটমট করে বললেন-তা বাবা ল্যাপ্টপ, কি করবেন শুনি।
-আব্বু ,আবারও!

-জন্মের প্রথম এক বছর ঘুমানোর সময়টা বাদে সারাক্ষণ কোলের উপর(টপ অব ল্যাপ) থাকতি, এই নামই ঠিক আছে। হ্যা এখন বল, মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে,যা বলার বলে ভাগ।

-তিন তলার চিলেকোঠার ঘরটাকে আমার গবেষণার জন্য ল্যাব বানাব। যেহেতু বিভিন্ন স্পিসিস প্রিজারভ করা লাগবে তাই ঘরটার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রন মোটকথা অনুকূল এনভায়রনমেন্ট তৈরী করা লাগবে। আমার বেশ কিছু টাকা লাগবে আব্বু, না বলতে পারবা না। এই মুহুর্তে মাথায় একটা হাইপোথিসিস কাজ করছে।

-আচ্ছা, তা না হয় দিলাম, এখন কি নিয়ে হাইপোথিসিস তোর মাথা খেয়ে ফেলছে?
-ঘুণ পোকা, বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা বলি এনোবিয়াম পাঙ্কটেটাম। আমার রিসার্চ হবে এই পোকার জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তন করে একে….

জয়নাল সাহেব আর কথা শেষ করতে দিলেন না, এইবার তার রাগ আর এক স্কেল উঠে গেল।

-এক টাকাও দিব না। তোর ওই “এনে দে বয়াম” না কি যেন বললি এর পেছনে নো ইনভস্টমেন্ট।
-আব্বু, “এনে দে বয়াম” না “এনোবিয়াম”। তবে বয়াম তো এনে দিতেই হবে, না হলে ঘুণপোকা সংরক্ষণ করব কীভাবে। এই যে দেখ, মাসখানেক আগে চারটা ঘুণ পোকা অনেক কষ্টে জোগার করে নিয়ে এসেছিলাম, একটা ভাল বয়াম না থাকার কারণে হতচ্ছাড়া হাতছাড়া হয়ে গেল। এত চেষ্টা করেও ঘরের কোথাও পেলাম না।

জয়নাল সাহেব এই কথা শুনে মূর্ছা যান অবস্থা।রেদোয়ান ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
কি হল আব্বু , তুমি আমার দিকে এভাবে কটমট করে তাকিয়ে আছ কেন? আর তুমি কাঠের ভাঙ্গা টুকরা নিয়েই বা দাঁড়িয়ে আছ কেন?
পরিস্থিতি এরপরে কোথায় দাড়িয়েছিল তা বলাবাহূল্য। পরের এক সপ্তাহ রেদোয়ান তার বাবার ধারে কাছেও আর যায় নি।
তবে সে তার বাবাকে ঠিকই রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ রেদোয়ান এর গবেষণার গুরুত্ব তার বাবা হালকাভাবে নেয়নি।

রেদোয়ান দিন রাত তার হাইপোথিসিস নিয়ে পরে রইল। সে আসলে চাইছে ঘুণপোকার জিনোম সিকোয়েন্সে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন এনে একে অপকারী থেকে উপকারী পতংগে রুপান্তরিত করা। স্বাভাবিক ঘুণপোকা ডিম পাড়া থেকে শুরু করে এর লার্ভা দশা থেকে পূর্ণাংগ দশা পর্যন্ত কাঠের ভেতর থেকে শর্করা খেয়ে বেচে থাকে। আর এটা এরা এদের জেনেটিক্যাল ইন্সটিঙ্কট থেকে করে।

রেদোয়ান ঘুণপোকার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রেডিয়েশন প্রয়োগ করেমিউটেশন ঘটাবে যাতে জিনোম কোড এ একটা পরিবর্তন আসে।সে এটা এমনভাবে করবে যার ফলে ঘুণপোকার ন্যাচারাল ইন্সটিঙ্কট আর থাকবে না। মিউটেন্ট ঘুনপোকা হয়ে যাবে নিয়ন্ত্রিত। এই জেনেটিক্যালি মোডিফাইড পোকা তখন রেদোয়ানের দেওয়া নির্দেশিত ইন্সটিঙ্কট থেকে কাজ করবে।

বাবার কাছ থেকে সাড়া পেয়ে মাসখানেকের মধ্যে রেদোয়ান তার ল্যাবটাকে প্রায় গুছিয়ে ফেলল। বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি, কেমিক্যালস, পোকা মাকড় সংরক্ষণ করার কন্টেইনার প্রভৃতির সাথে স্থান পেল কয়েকশ ঘুন পোকা।এগুলো এখনও মিউটেন্ট হয়নি। তবে খুব শীঘ্রই হবে। কারণ থিউরিট্যাকিলি সে নিশ্চিত যে এটা হবেই। তার এই চিন্তা মাথায় ঢুকে অনার্স শেষ বছরে পড়ার সময়। বিভিন্ন ফিকশন মুভি দেখে দেখে তার মধ্যে অনেক আইডিয়া জেনারেশন হয়। একদিন হঠাত তার পড়ার টেবিলের পা-দানি ঘুণে খেয়ে ফেলেছে দেখে অমনি তার মাথায় আসে,আচ্ছা, যদি এই পোকাকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রন করে ইচ্ছেমত কাঠ কাটা যায়! তাহলে প্রকৃতির এই কাঠের কারিগরের থেকে নিপুন আর কে হবে?

বিভিন্ন জার্নাল ঘাটাঘাটি করে ঘুণপোকার উপর যত গবেষণা হয়েছে তা পড়া শুরু করল।এভাবে প্রায় দুই বছর এর সাথে লেগে থেকে অবশেষে সে কিছুটা সাফল্যের আলো দেখতে পেল। ততদিনে তার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে।

প্রতিবছরই রেদোয়ান তার বাবার জন্মদিনে এমন কিছু উপহার দেয় যা দেখে জয়নাল সাহেব চমকে উঠেন তবে এবারের চমকটা যেন একটু বেশি। উপহারটা হাতে পেয়ে তিনি অবাক দৃষ্টিতে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন-তুই এটা কোথায় পেলি?

-আব্বু, এটা আমার গবেষণার প্রথম সাফল্য।তাই তোমাকেই এটা ডেডিকেট করলাম।

জয়নাল সাহেবের হাতে কাঠের তৈরী একটা ইয়েতির স্কাল্পচার। হুবুহু তার বাবার নেপাল থেকে আনা স্কাল্পচার এর মত তবে এটা আগেরটার চেয়েও বেশি নিখুত। এটার কারুকাজ বিশেষ করে ইয়েতির শরীরের অংগপ্রত্যংগ, লোম এতোটাই সূক্ষ্ম যে দেখে এটাকে জীবন্ত মনে হবে। এটা যে একজন দক্ষ শিল্পীর হাতের তৈরী জয়নাল সাহেবের তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই দক্ষ কারিগর যে রেদোয়ানের মিউটেন্ট ঘুণপোকা তা জানার পর জয়নাল সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন-এটা কিভাবে সম্ভব! তুই আমাকে বলেছিলি ঘুণপোকার কাঠ কাটার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করবি। কিন্তু এটা কি করে!

-আব্বু,আমার ল্যাব এর সব ঘুনপোকা বলতে পার আমার ইচ্ছাতেই কাজ করে। বিষয়টি সহজভাবে বললেও পদ্ধতি অনেক জটিল, ও তুমি বুঝবে না। শুধু এতটুকু বলি, আমি কাঠ দিয়ে যখন যে জিনিসটা বানাতে চাই তার জন্য আলাদা মিউটেন্ট পোকা তৈরি করি। অর্থাৎ একেক প্রোডাক্ট এর জন্য একেক ধরনের মিউটেশন ঘটিয়ে বিশেষ ঘুনপোকা সৃষ্টি হয়।

-আমি তোর ওই বৈজ্ঞানিক ভাষা বুঝি না কিন্তু এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমি যদি এখন একটা কাঠের আর্মচেয়ার বানাতে চাই তাহলে তার জন্য বিশেষভাবে মোডিফাইড ঘুণপোকা তৈরি করতে হবে।

-এক্সাক্টলি আব্বু। আর এদের কাজ করার দক্ষতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোন শিল্পীকেও হার মানাবে। আমি চাইছি বিষয়টা শুধু কোন কাঠের তৈরি ক্রাফটস এর মধ্যেই রাখব না। এই বিশেষ ঘুনপোকা দিয়ে বানিজ্যিকভাবে ফার্নিচারও তৈরি করব।

জয়নাল সাহেব ঠাট্বা করে বললেন-আর প্রতিষ্ঠানের নাম হবে-জয়নাল এন্ড সন্স ফার্নিচার মার্ট।

-ওহ! ,আব্বু, ব্যাপরটা এত স্থুলভাবে দেখ না,আমি অলরেডি দেশের বাইরের একটা কোম্পানির সাথে কথা বলেছি। দে রেস্পন্ডেড মি। তারা বলেছে আমার উদ্ভাবন কমার্শিয়ালি অনেকলাভজনক হবে।

-আচ্ছা,বুঝতে পেরেছি, তোর মায়ের জন্য একটা ডাল ঘুটনি বানাতে পারস কিনা দেখ।
এই বলে জয়নাল সাহেব হাসতে হাসতে চলে গেলেন।

বছরখানেকের মধ্যে রেদোয়ান এর উদ্ভাবন চারিদিকে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে পাঁচ বছরের চূক্তিও হয়েছে। ফলে রেদোয়ানের জীবনে মোটা অঙ্কের অর্থ আসা শুরু হল। পড়াশুনায় অতিমাত্রায় সিরিয়াস থাকার কারণে তার খুব একটা বন্ধু জোটেনি। সাদমান নামে কেবল একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। যোগাযোগ খুব একটা নেই। জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীতে একটু আধটু দেখা হয় । কিছুদিন আগে সাদমানের বিবাহবার্ষিকীতে কুরিয়ার মারফত রেদোয়ান একটা উপহার পাঠায়। উপহার পেয়ে সাদমান ফোন দিয়ে বন্ধুকে বলে-দোস্ত, তোর গিফট পেয়েছি ,চমৎকার একটা উপহার পাঠিয়েছিস। সাথে কিছু পোকাও পাঠিয়েছিস।
রেদোয়ান এই কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-পোকা পাঠিয়েছি মানে?

-হ্যা, তোর দেওয়া কাঠের তৈরি ভেনাস এর মুর্তিটি যখন হাতে নিলাম দেখি কয়েকটি পোকা ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসল।

রেদোয়ানের ভ্রু কুঞ্চিত হল। উপহার পাঠানোর আগে সে ভালভাবে চেক করেছে, কোন ঘুণপোকা ছিল না। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার সে ভেনাস এর কোন মুর্তি পাঠায়নি। সে পাঠিয়েছিল একটা মারমেইড এর ভাস্কর্য।

সেই দিন রাতে রেদোয়ান তার ল্যাব এ কাজ করার সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে। তার নতুন প্রোজেক্টের জন্য ছয় ফুট-চার ফুট এর কাঠের একটা গুড়ি মেঝেতে রেখেছিল। এখনও এই প্রোজেক্টের জন্য কোন ঘুণপোকা মিউটেন্ট করা হয় নি। তারপরও গুড়ির উপর বেশ কিছু পোকা হাটাহাটি করছিল। রেদোয়ান খেয়াল করল কাঠের গুড়ির উপর কিছু একটা নকশার মত দেখা যাচ্ছে। সে এটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। সে বুঝতে পারল তার মিউটেন্ট পোকা কোন কারণে ঠিকমত কাজ করছে না। কারণ নকশা তার ইমপ্লিমেনটেশন অনুযায়ী হচ্ছে না। ঠিক একই কারণে সাদমানকে সে যে উপহার পাঠিয়েছিল তা হয়ত মিউটেন্ট পোকারা পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু সেটা নিখুতভাবে মারমেইড এর ভাস্কর্য কেন হবে?

এই ঘটনার মাস তিনেক পর রেদোয়ানকে গুরুতর ভাবে হাসপাতালে নেওয়া হয়। দুই দিন আইসিউ তে থেকে ভোরে মারা যায়। ডাক্তার এর প্রাথমিক সন্দেহে ফরেন্সিক পরীক্ষা করা হয়। ফরেন্সিক রিপোর্টে রক্তে টক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ডাক্তার বলেছেন বিষাক্ত পতঙ্গের আক্রমণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না এটা সাপ বা অন্য কোন পতঙগ এর কারণে হয়েছে। ডাক্তাররা না বুঝতে পারলেও রেদোয়ানের বাবা ঠিকই জানেন।

সে রাতেই জয়নাল সাহেব ছেলের ল্যাব এ যান। তিনি ভেজা চোখে ভাবতে থাকেন কী সুন্দরভাবে তার ছেলে এই ল্যাবটাকে সাজিয়েছে। ক্লোরফর্মে নিমজ্জিত কত প্রজাতির কীটপতংগের নমুনা। কিছু কিছু ছিদ্রুযুক্ত কাচের বাক্সে জীবন্ত কীটপতংগ আছে।ঘরের আলো জালানোর ফলে এরা এখন কিছুটা উত্তেজিত। জয়নাল সাহেব হাটতে হাটতে একটা বাক্সের সামনে এসে থামলেন যেটা তিনি খুজছিলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন বাক্সের গায়ে লেখা রেদোয়ানিয়াম পাঙ্কটেটাম। তার ছেলের দেওয়া নাম নিশ্চয়। তবে তিনি স্তম্ভিত হলেন পাশে পড়ে থাকা একটা ছয় ফুট-চার ফুটের কাঠের তৈরি মডেল দেখে। ঘরের মৃদু আলো সত্ত্বেও তিনি বুঝতে পারলেন এটা একটা মৃতদেহ বহন করার কাঠের খাট। আর খাটের উপর ক্যালিগ্রাফি করে লেখা রেদোয়ানিয়াম পাংকটেটাম। তার ছেলের উদ্ভাবিত ঘুনপোকার বৈজ্ঞানিক নাম।তবে আজ রাতে এগুলোর আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। গাঢ় নাইট্রিক এসিডে সব শেষ করে দেবেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments