Thursday, August 21, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পসরষে - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সরষে – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমি অনশন করব, আমৃত্যু অনশন।

সকালে চায়ের কাপ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে জানালার দিকে মুখ বাড়িয়ে বসলেন প্রকাশবাবু। ঘটনাস্থল কলকাতার উপকণ্ঠে মধ্যবিত্ত পাড়ার সদ্যনির্মিত একটি বাড়ির দোতলার ঘর। পশ্চিম খোলা। জানলার ওপাশে আকাশ, পরিমিত গাছপালা। দু-একটি বাড়ি। গোটাকতক পায়রা। চরিত্র দুটি প্রাণী। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত, ডাকসাইটে শিক্ষক প্রকাশ মুখোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মহামায়া মুখোপাধ্যায়। বিবাহের আগে ছিলেন চট্টোপাধ্যায়।

কাপ থেকে চা চলকে ডিশে পড়ল। আর একটু জোরে ঠেললে মহামায়ার হাতে তৈরি, নীলের ওপর সাদার কাজ করা টেবিলক্লথে পড়ত। সেই সম্ভাবনায় মহামায়ার ভুরু কুঁচকে ছিল। মনে মনে প্রস্তুতও ছিলেন, একটু পড়ুক, তারপর কী করতে হয়, আমিও দেখাব। সাতদিন হয়ে গেল বাতের ব্যথায় উঠতে পারছিনা। ডাক্তারের কথা, ওষুধের কথা বলে বলে মুখে ফেকো পড়ে গেল। একদিন নিয়ে এলেন ঢ্যাঁপা ঢ্যাঁপা একগাদা রসুন। এককোষি রসুন রোজ সকালে একটা করে জল দিয়ে কোঁত করে গিয়ে ফেলো মায়া, সাতদিনে তোমার বাত বাপ বাপ করে পালাবে। আর একদিন নিয়ে এলেন ইয়া মোটা এক স্টিলের পাঞ্জাবি বালা। এটি মায়ের নাম করে ধারণ করে ফেলো মহামায়া, বাত তো ভালোই হবে, দেখবে যৌবনও ফিরে আসছে আবার। শেষে। নিয়ে এলেন হাততিনেক ইলেকট্রিক তার। কোমরে আড়াই প্যাঁচ মেরে বসে থাকো মায়া, প্রথম বর্ষার প্রথম বিদ্যুতেই অ্যাকশান পেয়ে যাবে। শরীরে কয়েক ওয়াট কারেন্ট ঢুকলেই তোমার। হাত-পায়ের গাঁট খুলে যাবে, যৌবনকালের মতো সারা বাড়ি ধুমধুম করে আবার দাপিয়ে বেড়াবে। কেপপন অনেক দেখেছি বাবা, এই মানুষটার মতো এমন হাড়-কেপপন দেখিনি!

মহামায়া ভারিক্কি গলায় বললেন, চা-টা চলকে টেবিলক্লথে পড়ে গেলে কী হত? আকাশের দিকে ফেরানো মুখ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, যেত, যেত।

সাতসকালে বাবারে মারে করতে করতে চা করে নিয়ে এলুম, উলটে ফেলে দেওয়ার জন্যে! যত বয়েস বাড়ছে, তত তোমার রাগ বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে, বউমা এই নিয়ে হাসাহাসি করে, তোমার প্রেসটিজে লাগে না?

না, লাগে না। ওরা হাসার জন্যে, ব্যঙ্গ করার জন্যে জন্মেছে, আমি জন্মেছি সেই উপহাস আর ব্যঙ্গ কুড়োবার জন্যে। যুগটাই তো পড়েছে, বাপ-জ্যাঠার কাছা খোলার যুগ। অপমান আমার। নয়, অপমান ওইসব চপল বালক-বালিকার। যাদের জীবনটাই হল অনন্ত, অখণ্ড, অপার, অপরিমেয়, অনিয়ন্ত্রিত, অলস তামাসার। পরপর একগাদা অকারান্ত শুনে মহামায়া বললেন, বাপস। রাগের চোটে মুখ দিয়ে অমরকোষের স্রোত বইছে। নাও খুব হয়েছে, চা খেয়ে নাও। ছেলেমানুষের মতো কথায় কথায় অত ক্ষেপে যাও কেন?

প্রকাশ এবার জ্বলন্ত মুখ ঘোরালেন, নো মোর সুগার কোটেড ওয়ার্ডস ম্যাডাম, মিষ্টি কথায় আর চিঁড়ে ভিজবে না, জল চাই, জল। বোকারাও ধাক্কা খেতে খেতে একদিন বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, তখন আর তাকে বোকা বানানো যায় না। তখন নিজেকেই বোকা বনে যেতে হয়। কথা যত কম হয় ততই ভালো। তোমাদের সবকটাকে আমি চিনে নিয়েছি। সব শেয়ালের এক রা।

আমরা কী করলুম যে শেয়াল-টেয়াল বলছ?

এই সংসারে আমি এখন উপেক্ষিত। এ নেগলেক্টেড ওল্ড ফুল। আমার কোনও স্ট্যাটাস নেই। আমি গৃহপালিত দিশি কুত্তার মতো।

আঃ, কী যা-তা বলছ?

ঠিকই বলছি, ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। তোমরা যেই দেখলে, বুড়ো ব্যাটার লাস্ট ফার্দিংবাড়ি তৈরিতে খরচ হয়ে গেছে, রেস্তো চুঁচুঁ, ব্যাংক-ব্যালেন্স নিল, মরলে একজোড়া চশমা, আর ছেড়া একজোড়া চপ্পল ছাড়া আর কিছুই ব্যাটা রেখে যাবে না; তখনই তোমরা সব নিজমূর্তি ধরলে। ক্যাপসুল খুলে গেল। ঠিকই করেছ। জগতের নিয়মেই চলছ। প্রত্যাশা থেকেই মানুষের হতাশা আসে। মনের আর দেহের জোর থাকলে বানপ্রস্থে চলে যেতুম। এতকাল ধরে বোকাটাকে কুরে কুরে খেয়েছ। জ্ঞান যখন হল তখন দেখলে বোকার ছোবড়াটা পড়ে আছে। নড়বার-চড়বার ক্ষমতা নেই। চোখে চালসে, হাত-পা কাঁপছে। পড়ে পড়ে মার খাও। বাঁধা মার। সাংখ্য কী বলেছেন জানো—জীব তিন ধরনের দুঃখ পায়, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখের কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়, আর…।

তোমাদের সাংখ্যে গুলি মারো। সারাদিন ওই ছাইপাঁশ পড়ে পড়ে মাথাটি একেবারে গেছে। একদিন আগুন লাগিয়ে দেব, আপদ চুকে যাবে।

বাঃ চমৎকার মাস্তানি ভাষা শিখেছ তো। একজন অবসরপ্রাপ্ত, সম্মানিত, জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত প্রধানশিক্ষকের স্ত্রী-র ল্যাংগোয়েজ দেখো! আমাকে জুতো মারা উচিত। আমার গলায় যাঁরা পদক ঝুলিয়েছেন, তাঁদের বললো, এবার এসে জুতোর মালা ঝুলিয়ে দিয়ে যাক। যে নিজের বাড়িকে। শিক্ষিত করতে পারল না, সে সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেল দেশের শিক্ষায়। অপদার্থ পাঁঠা! আমি অত কথা শুনতে চাই না, তুমি চা খাবে কিনা?

না, খাব না। আমি খ্যাচাখ্যাচি করতে চাই না, নাকে কাঁদতে চাই না, আমি সাবেকপন্থী শান্তিপ্রিয় মানুষ, আমরণ অনশনের আমার সিদ্ধান্ত। তুমি এখন যেতে পারো। যাওয়ার সময় তোমাদের এই হতচ্ছেদ্যার পিঁপড়ে ভাসা, সর ভাসা, কেলে গামছা নিঙড়োনো গরম জলটা নিয়ে যাও।

মহামায়া চেয়ার ছেড়ে উঠে চায়ের কাপের সামনে ঝুঁকে পড়লেন, তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর! দেখাও তো! আর বর্ণ? এমন সোনার বর্ণ চা। তোমাকে গ্র্যান্ড হোটেলও দিতে পারবে না। না দেখেই ধেই ধেই নাচ। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙিয়ে…।

প্রকাশ স্ত্রীকে কথা শেষ করতে দিলেন না, নিজেই টেনে নিলেন গাধা হয়ে গেছি, গাধা। ধোপার গাধা হলে তবু পরিত্রাণের পথ ছিল, স্ত্রী-র গাধা হয়ে মরেছি। ইহকাল, পরকাল দুটোই গেল।

আমি তোমাকে গাধা বলেছি?

ওই কথার পর অবধারিত ওই কথাটাই আসে। আমার বয়স হয়েছে, ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।

দ্যাখো, সকালবেলা শুধু শুধু ঝগড়া কোরো না। কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর। তুমি দেখাও।

প্রকাশ চশমা পরে চায়ের কাপ সামনে টেনে নিয়ে প্যাথোলজিস্টের মতো চা পরীক্ষা করতে লাগলেন। মহামায়া বিজয়িনীর মতো হাসছেন, পাবে না, পাবে না, ব্যর্থ চেষ্টা।

প্রকাশ বললে, ছিল, থাকতে থাকতে গলে গেছে।

গলে গেছে? মহামায়া ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন।

হেসো না, হেসো না। ডোন্ট লাফ। আজ হয়তো নেই ভাগ্যক্রমে অথবা ছিল, অন্যদিন গোটাকতক পিঁপড়ের লাশ, বাসি দুধের সর থাকবে। বুডোর ব্রেকফাস্ট।

অন্যদিনের কথা আমি জানি না। বউমা কী করে আমি বলতে পারব না।

অ, তোমার বউমা তাহলে যা খুশি তাই করতে পারে! সাত খুন মাফ।

আঃ, কেন পরের মেয়েকে মিথ্যে মিথ্যে দোষী করছ?

অ, আমি হলুম মিথ্যেবাদী, তুমি হলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। এ সংসারে তোমরা দলে ভারী বলে দিনকে রাত করবে?

বউমা তোমার যথেষ্ট সেবা করে। শ্রদ্ধা করে। ভয়ও করে। কেন পরের মেয়ের নামে মিথ্যে বলো সব!

আমি অন্যের সেবা নেব কেন? তুমি আমার জন্যে কী করো? এই বেওয়ারিশ বুড়োর জন্যে!

আমি কিছু না করলে এতদিনে ভেসে যেতে।

তার মানে তোমার আদরের বউমা কিছু করে না!

উঃ আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেল তো। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছলেও নিবংশের ব্যাটা। তুমি কি আগুন জ্বালাতে চাচ্ছ, শুধু শুধু অকারণে?

আগুনটাগুন নয়, আমার পথ শান্তির পথ। আমরণ অনশন। ধীরে ধীরে নিবে যাওয়া। অনেকদিন এসেছি মহামায়া। পুরোনো হয়ে গেছি। গরুর দুধ চলে গেলে গোয়ালা কসাইখানায় দিয়ে আসে। তখনও তার দু-পয়সা কামাই হয়। দুর্ভাগ্য তোমার, আমি গরু নই।

হোল ফ্যামিলি তোমার জন্যে তটস্থ তবু তোমার মন পায় না।

এরপর আমাদের আর কিছু বলার নেই।

অই, অই সেই শব্দ। আমাদের, তার মানে তোমরা একটা দল, অনেকটা একালের মাস্তান পার্টির মতো। আর আমি হলুম গিয়ে একা মাইনরিটি। শাসনের নামে দুঃশাসন চলেছে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। লাশ পড়ে যাবে। মেজরিটি যা করবে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। নইলে তুমি খিটখিটে বুড়ো, একলাষেড়ে, বাহাত্তরে ধরেছে, চিরকালের স্বার্থপর। দে বেটাকে একঘরে করে। ধোপা-নাপিত সব।

মহামায়া হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, মাস্টার না হয়ে তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। নাম করতে পারতে, দুটো পয়সার মুখও দেখা সম্ভব হত। আমরা মানে, আমরা যারা তোমার সেবা করছি।

প্রকাশবাবু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, সেবা? তোমরা আমার সেবা করছ! গোপাল সেবা? সিংহাসনে একবার করে ওঠাচ্ছ আর শোয়াচ্ছ। শালগ্রামের শোয়াও যা বসাও তাই। বোঝার উপায় নেই, বসে আছি না শুয়ে আছি। যুগ যুগ জিও।

এটা কী ভাষা?

যুগের ভাষা।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বুঝলে? সব নাটবল্ট ঢিলে হয়ে গেছে। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙালে হয়।

কী হয়—গাধা?

সে কথা বলেছি?

সব কথা কি আর বলতে হয়? বলার আগেই বুঝে নিতে হয়।

এ বুড়োটা তো মহা ঝগড়াটে!

অ, আমি এখন বুড়ো, আর নিজে ভারি যুবতী? যৌবনে শরীর একেবারে মাখামাখি।

মহামায়া রাগে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন, চা খেতে হয় খাও, না খেতে হয় ফেলে দাও। সাতসকালে এই হুলো বেড়ালের মতো ঝগড়া আমার ভালো লাগে না। বয়েস বাড়ছে না কমছে?

বাতের ব্যথা ভুলে মহামায়া দুম দুম করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। নাতিটা দালানের একপাশে পুতুল নিয়ে খেলছিল। দিদাকে দেখে বললে একটু চুন-হলুদ করে দেবে দিদা, আমার এই গুন্ডা ছেলেটা পা মচকে ফেলেছে।

অন্যদিন হলে কোলে তুলে নিতেন, আজ মেজাজ ভালো নেই, বললেন, তোমার মামিকে বলো।

নাতি আপনমনেই বললে, বাবা মেজাজ একেবারে টপ।

ছেলে দাড়ি কামাচ্ছিল, মহামায়া বললেন, তোর বাবা সকাল থেকেই অনশন শুরু করলেন, আমৃত্যু।

বাবা! গান্ধী রিলিজ হতে না হতেই সত্যাগ্রহ? কীসের দাবিতে অনশন?

ওঁকে নাকি আমরা সবাই উপেক্ষা করছি। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও অধম জ্ঞান করছি।

বৃদ্ধরা একটু অভিমানী হয় মা। কী করেছিলে?

কী আবার করব?

কোনও খোঁচাখুঁচি করোনি তো?

না রে বাবা, দুর্বাসা মুনিকে খোঁচাতে হয় না, পান থেকে চুন খসলেই তেলে-বেগুনে।

ঠিক আছে। তুমি আর নাড়াচাড়া করতে যেও না, আমি যাচ্ছি। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নিয়েই হয়েছে সমস্যা।

বাড়ির যা অবস্থা, ওটাকে এখন নামিয়ে দেনা বাবা।

তোমার মায়ের তিলকে তাল করা অভ্যাস। বৃদ্ধদের হ্যান্ডেল করার আলাদা কায়দা আছে। অনেকটা ট্রানজিস্টার রেডিওর মতো, শুধু টিউনিং নব ঘোরালেই হয় না। ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে হয়।

যাও তাহলে। এখন দক্ষিণমুখো বসে আছেন, পুব কি পশ্চিমমুখো করে দ্যাখো।

বলেছ ভালো। এবারে পুজোয় পশ্চিমে নিয়ে যাব, সেই কথাটাই বলি। হয়তো চিত্ত প্রফুল্ল হবে।

প্রকাশবাবুর বড় ছেলের নাম প্রশান্ত। বড় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজিকিউটিভ। দু-এক মাসের মধ্যে রাশিয়া যাওয়ার কথা আছে। তাই চিবুকের তলায় দাড়ির চাষ করছে, সযত্ন সম্পাদনায়। দাড়ির একটা আলাদা অ্যারিস্টোক্র্যাসি আছে। সেকালের জারেদের দাড়ি ছিল, একালের পলিটিশিয়ানদের থাকে। টলস্টয়ের দেশেদাড়ি ছাড়া যাওয়া যায়! প্রশান্তর সবে বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী-র নাম ঊর্মিলা। মিষ্টি স্বভাবের সুন্দরী মেয়ে। প্রকাশবাবুরই নির্বাচন। পুত্রবধূ পাশে পাশে, কাঁধে কাঁধে থাকবে, মিহি মিহি হাসবে, বাবা বাবা করবে—প্রকাশবাবুর মনে এইরকম একটা বাসনা ছিল। তা সংসার বধূটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। সারাদিনে বারকয়েক দেখা হয়। জমবার আগেই মহামায়া নামক শত্ৰুটি ডেকে সরিয়ে নেয়। সম্প্রতি হোমিওপ্যাথির চর্চা শুরু করেছেন। রুগি তেমন আসে না। খুঁজে খুঁজে বের করেন। স্ত্রী মহামায়ার হোমিও ধরবে না। পান দোক্তা খেয়ে খেয়ে সিস্টেমটাকে চড়িয়ে ফেলেছে। হোমিওপ্যাথির জন্যে নরম, সাত্বিক জমি। চাই। যুধিষ্ঠির জীবিত থাকলে আদর্শ রুগি হতে পারতেন। এক পুরিয়া ওষুধে পাশা খেলার নেশা ছুটে যেত। অতবড় কুরুক্ষেত্র আর হত না। মহাভারত লেখা হত অন্যভাবে। ভীমকে আর একটু রোগা করে দিতেন। অর্জুনের নার্ভাস ব্রেকডাউন সেরে যেত বায়োকেমিকে। কৃষ্ণ বড় টকেটিভ ছিলেন, মনে হয় ডিপ্রেশনে ভুগতেন, তারও ওষুধ ছিল। দুর্যোধন, দুঃশাসন ছিলেন। ওভারসেক্সড। এক ডোজ মাদার টিংচার ছাড়লে দ্রৌপদী বেচারির ওই অবস্থা হত না। গান্ধারীকে দিতেন ব্যার্থ কনট্রোলের দাওয়াই। হ্যানিম্যান সায়েব যে বড় দেরিতে জন্মালেন। ভেবেছিলেন পুত্রবধূটিকে মনের মতো রুগি তৈরি করবেন, তা আর না। আজ পর্যন্ত একবারও ফ্যাঁচ করে হাঁচল না। বিয়ের জল পড়ে বরং…না থাক, ওসব কথা না ভাবাই ভালো। কন্যাসমা।

এখন একমাত্র সম্ভবনাপূর্ণ রুগি মেয়ের ছেলে ওইনাতিটি। একমাত্র রোগ পেটের গোলমাল। এন্তার খাচ্ছে আর হজমের একমাত্র রোগ পেটের গোলমালে সব এলোমেলো করে ফেলছে। এ রুগিও বেশিদিনের নয়। গরমের ছুটি শেষ হলেই মিরাটে পালাবে।

প্রকাশবাবু হাঁক মারলেন, বুড়ো।

বুড়ো এই ডাকটির অপেক্ষাতেই ছিল। ছেলে এই বয়সেই অনেক কথা শিখেছে। দু-পক্ষ জোরে জোরে কথা বলে খিচাইন হচ্ছে। দাদু আর দিদা এতক্ষণ জোরে জোরে কথা বলছিল বলে ঘরে ঢোকেনি। এখন পুতুলটিকে বুকে চেপে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল,

কী বলছ দাদা?

এদিকে এসো।

তুমি কি খুব রেগে আছ?

তা একটু আছি।

তাহলে পরে আসব।

কেন?

এখন তো তুমি কিছু দেবে না।

অ, পৃথিবীতে কেবল দাও আর দাও, তাই না বুড়ো? শুধু দাও, কেবল দিয়ে যাও। আচ্ছা, তোমাকে আর কোনওদিন আসতে হবে না। মায়া, মায়া, সব মায়া!

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশবাবু তিনবার টুসকি মারলেন। এক সময় অল্পস্বল্প সংগীতচর্চা করতেন। গুনগুন করে গান ধরলেন, ভিখারি বাসনা করি হইতে চায় লক্ষপতি, লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি। আরও দু-চার লাইন এগোতে ছেলে প্রশান্ত ঢুকে ভাব চটকে দিল। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা প্রকাশবাবুর অসহ্য লাগে। রাখতে হয় পুরো রাখো ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো, নয়তো মেরে সাফ করে দাও। এ কী ধরনের ক্ষৌরী!

যাক, মুখ নীচু করে থাকাই ভালো। সংসরের কোনও কিছুর দিকে আর তাকাবেন না। প্রতিজ্ঞা। গীতা বলছেন, উদাসীন বাচরেত। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তবাবু দাঁড়িয়ে। রইলেন। গানের পরের লাইনটা মনে ভাসছে, কোটিপতি হলেও সে ইন্দ্রত্ব লভিতে চায়।

প্রশান্ত একগাল হেসে বললে, কী, মর্নিংওয়াকে যাচ্ছেন?

কানের পাশে সাবান শুকিয়ে আছে। নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা-দুটো খুসকি উড়ে যাচ্ছে। দাড়ির যত বাড়বাড়ন্ত চুলের ততটা নয়। সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। শ্যাম্পু করে ফুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রশান্তর দেহগত ত্রুটি আজ পিতার চোখে ধরা পড়ছে। স্বার্থপরের মতো নেওয়াপাতি একটি ভুঁড়ি নামছে। আলোচাল খাওয়া বিধবাদের মতো চোখমুখ ফুলো ফুলো। ভোগীর চেহারা। এ চেহারা ত্যাগীর নয়।

প্রকাশবাবু কাটা কাটা গলায় বললেন, কেন বলো তো? বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তোমাদের সুবিধে হয়?

প্রশান্ত হকচকিয়ে গেল। স্নিগ্ধ প্রাতঃকাল। পাখি ডাকছে। দিবসের এই সময়টিতে কারওর মেজাজ এমন উত্তপ্ত হয়ে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। আমতা আমতা করে বললে:

আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন।

তোমার ধারণা বুঝি সেইরকম। নিজেকে ঠিকমতো চেনো কি? কখনও অ্যাসেস করে দেখেছ? দেখার চেষ্টা করেছ কোনওদিন! পার্সেন্টেজ অফ স্বার্থপরতা কত, উদাসীনতার পার্সেন্টেজ কত, লোভ কত, লালসা কত, ভণ্ডামি কত! সময় পেলে একবার খতিয়ে দেখো।

কথা শুনে প্রশান্তর পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। আশ্চর্য! ভদ্রলোক অকারণে খোঁচা মারছেন। খেতে একটু ভালোবাসি। সে আসক্তি তো ওঁরও ছিল। এখনও আছে লালসা? সে বস্তুটা কী? মানেটা ঠিক জানা নেই। অভিধান দেখতে হবে। স্বার্থপরতা? স্বার্থপরতার কী দেখলেন? দক্ষিণের ঘরটা তো নিজেই ছেড়ে দিলেন। পশ্চিমের ঘরে সব তুলে নিয়ে এলেন। কারওর কথা শুনলেন না। এখন সারা দুপুর রোদের তাপে কষ্ট পান। শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, লোডশেডিং অর নো লোডশেডিং আমার সেই এক অবস্থা। পাখার বাতাস যেন ব্লাস্টফার্নেসের ঝাপটা। ভণ্ডামি? ভণ্ডামি মানে? তিলক সেবা করে কীর্তনও করি না, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা বব-ববম হুঙ্কার ছাড়ি না।

প্রশান্ত রাগ রাগ গলায় বললে, আপনি অকারণে আমাকে তিরস্কার করছেন। আমাকে যতটা ঘৃণিত ভাবছেন, আমি ততটা ঘৃণিত নই।

না না, ঘৃণিত হবে কেন? তুমি যথেষ্ট সম্মানিত, বড় চাকরি করো, মোটা টাকা মাইনে পাও। তুমি আধুনিক যুগের একজন সম্মানিত, অতিসম্মানিত সফল মানুষ। আরও উঠবে, আরও ওপরে উঠবে। তোমার গাড়ি হবে, তোমার বাড়ি হবে। হয় তো পদ্মভূষণ খেতাবও পেয়ে যাবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী অহংকারে মটমট করবে। তবে একটা কথা কি জানো, কেউ কেউ তোমাকে স্বার্থপর সঙ্কীর্ণ উদাসীন ভাববে।

সে কেউয়ের মধ্যে অবশ্যই আপনি একজন।

আমার ভাবায় কী এসে-যায় প্রশান্ত? আমার সব দুধ সংসার দুয়ে নিয়েছে। শুকনো গরু গোয়ালে পড়ে আছি। দু-বেলা দুটি জাবনা পাই। চারপেয়ে গরু হলে কসাইখানায় দিয়ে আসতে। তা যখন পারলে না, তখন অবহেলা, অশ্রদ্ধা, উপেক্ষা, অবমাননা দিয়ে, এক এক দিনে একশো দিনের পথ এগিয়ে দিচ্ছ। সেই মহাকসাইখানার দিকে হু-হু করে ছুটে চলেছি।

এসব কথা আপনি বলতে পারছেন?

অবশ্যই পারছি।

উপেক্ষা? আপনাকে আমরা উপেক্ষা করি? অপমান করি?

মজাটা কী জানো প্রশান্ত, তোমরা এতই উদাসীন, কী করো তা বোঝবার মতো তোমাদের বোধশক্তিও নেই। একটা উদাহরণ দেব?

নিশ্চয়ই দেবেন

আজ থেকে সাতদিন আগে তোমাকে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আনতে বলেছিলুম। মনে পড়ছে? তুমি সে ওষুধ এনেছিলে?

প্রশান্ত করুণ মুখে বলল, আজ্ঞে সাত কাজে ভুলে গেছি।

অবশ্যই ভুলে যাবে। ভুলতে তোমাকে হবেই! তুমি যে আমার পুত্র। তোমাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি। কিন্তু তোমার বউ যদি কিছু আনতে বলত, তুমি ভুলতে না, ভুলতে পারতে না। সারাদিন জপ করতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

আপনার এই ধারণা ঠিক নয়। আমার ভুলো মন। একটা কাজ সাতদিনের চেষ্টায় করি। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।

রাইট ইউ আর। আমি জানতুম তুমি ওই ফাঁক দিয়েই গলতে চাইবে। মহাঅস্ত্র তোমার হাতেটু আর ইজ হিউম্যান টু ফরগিভ ডিভাইন। তা হলে তোমার দু-নম্বর ক্যালাসনেসটা শোনো, মনে আছে, তোমাকে একদিন বলেছিলুম, কানে আমি একটু কম শুনছি, মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে। সঙ্গে সঙ্গে তুমি খুব বোলচাল ছাড়লে। পটপট কয়েকজন স্পেশ্যালিস্টের নাম বললে। বললে কালই আমি ব্যবস্থা করছি। দু-মাস হয়ে গেল। কাল সমুদ্রে চলে গেল। প্রশান্ত সামান্য বিব্রত হয়ে বললে, আপনি একটু সুস্থ আছেন দেখে আমি একটু সময় নিচ্ছিলুম।

সুস্থ আছি! এ খবর তোমাকে কে দিলে?

মা।

ও, তুমি আজকাল ঘোড়ার মুখে ঘাস খাও বুঝি! তোমার সঙ্গে কি আমার ভাসুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক! আমাকে একবার জিগ্যেস করতে কী হয়েছিল? কে আর ঝককি-ঝামেলা নেয়, কী বলো? বুড়ো তো বেশ আছে! ঘুরছে-ফিরছে, বসে বসে জাবর কাটছে। আমি তো তোমার শ্যালিকা নই। চিংড়ির মালাইকারি খেয়ে ঠোঁট চুলকে উঠল বলে সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশটাকা ফিয়ের ডাক্তার এসে গেল।

কী বলছেন আপনি?

ট্র, ব্ল্যাটান্ট টুথ। নির্ভেজাল সত্য। স্বার্থ ছাড়া এ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। ওই ছোট ছেলেটা, যার এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হয়নি, সেও স্বার্থ বুঝেছে। স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও নড়ে না।অন্দর থেকে মহামায়ার তর্জনের গলা শোনা গেল, খোকা চলে আয়, কথায় কথা বাড়ে, টাকায় বাড়ে সুদ। চলে আয়।

প্রকাশবাবু ভুরু কুঁচকে ছেলেকে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সরে পড়ো। বার্ধক্য বড় ছোঁয়াচে ব্যাধি, স্মল পক্সের মতো। মশারি ফেলে দিন গুণতে হয়। হ্যাঁ, যাওয়ার আগে আমার অভ্যন্তর ভাগটি অবলোকন করে যাও।

প্রকাশবাবু জামা তুলে গেঞ্জিটি দেখালেন, কী বুঝলে?

আজ্ঞে একটু লালচে হয়ে আছে।

লালচে নয় কালচে। তোমার শাসনব্যবস্থায় সাবানের বড়ই অভাব ঔরঙ্গজেব। আর তোমার গর্ভধারিণী! তাঁর কথা না বলাই ভালো। আর তোমার অর্ধাঙ্গিনী! তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আধুনিক, কমরেড।

মহামায়া আবার বললেন, চলে আয় খোকা। ঘাঁটাসনি।

প্রকাশবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে যাও। বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাজ্য। যত ঢিল মারবে, তত গন্ধ বেরোবে। যাওয়ার আগে আর একটা জিনিস দেখে যাও। এইদিকে এসো।

প্রশান্ত পিতার সঙ্গে ঘরের কোণে তাকের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। প্রকাশবাবু একটা মুখ ফাঁদালো শিশি দেখিয়ে বললেন, এটা কী জানো?

আজ্ঞে না, কড়াই-টড়াই হবে।

রাইট ইউ আর। একে বলে কুলখ কড়াই। সামান্য জিনিস অথচ এর ওপর আমার জীবন অনেকখানি নির্ভর করছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আজ্ঞে হ্যাঁ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এই তো চাই, হ্যাঁ আর না, এই দিয়েই জীবনটা চালিয়ে যাও।

হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ।

আমার কিডনি দুটো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে জানো কি?

আজ্ঞে সেই রকমই শুনেছি।

তার জন্যে তোমার কোনও দুশ্চিন্তা আছে?

আজ্ঞে অবশ্যই আছে?

যাক শুনে সুখী হলুম। তোমার মায়ের কোনও দুশ্চিন্তা আছে, না বিধবা হবার জন্যে নাচছে?

ছিঃ ছিঃ, এ আপনি কী বলছেন?

তর্কশাস্ত্র কি বলছে জানো, কার্য দেখে কারণ অনুমান করা যায়।

আজ্ঞে, ও শাস্ত্রটা আমার তেমন পড়া নেই। আপনি যখন বলছেন, তখন তাই হয়তো হবে।

এইবার এদিকে এসো।

প্রকাশবাবু ছেলেকে নিয়ে দেওয়াল ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়ালেন।

এটা কী মাস?

আগস্ট।

কত তারিখ?

সাতাশ।

কটা লাল ঢ্যারা দেখছ?

আজ্ঞে পয়লা তারিখে একটা ঢ্যারা, আর পনেরোতে একটা ঢ্যারা।

মাত্র দু-দিন। তোমার মাকে খেচকে খেচকে, অনেক জল ঘোলা করে, মাত্র দু-দিনের কুলখ কড়াই ভেজানো জল পেয়েছি। প্রতিদিন খাবার কথা। বুঝলে কিছু?

আজ্ঞে হ্যাঁ, কাজের চাপে মা ভুলে গেছে।

মাই সন, কাজের চাপ নয়, শিয়ার নেগলেকট। আমার মরা-বাঁচায় তার কিছু এসে-যায় না। বুঝলে? এই হল সংসার। ছিলুম দুধেল গরু। এখন আমি গোবরে গরু। একেবারেই ওয়ার্থলেস। যাক, তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলুম। এবার তুমি যেতে পারো।

২.

মহামায়া ডাকলেন, বউমা!

দিশাহারা বউমা গুটিগুটি শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, বলুন মা।

আমার চাল নিয়েছ নাকি?

ভাত এখনও বসাইনি।

সে কী, খোকা তা হলে কী খেলে গেল?

এক গেলাস জল।

বাঃ, তোমার হাতে ছেলেটাকে তুলে দিয়ে ভালোই হয়েছে দেখছি।

আমার কী দোষ বলুন! কিছুতেই খেতে চাইলে না। বললে অশান্তির অন্নের চেয়ে উপবাসই ভালো।

ভালোই করেছে। আমিও কিছু খাব না। অনশনের প্রতিবাদে অনশন।

কী যে আপনারা করছেন মা!

বুড়োকে আমিও টাইট দিতে জানি। ভেবেছে সবাই ছাত্র।

বুড়ো বলবেন না মা। বিশ্রী শোনায়।

বুড়োকে বুড়ো বলব না তো কি ছোকরা বলব! সারাটা জীবন একা পেয়ে শুধু ধামসে গেল। আমি যেন সাঁওতালদের ধামসা রে। শরীরে দয়া, মায়া, মমতা বলে কিছুই নেই। শুধু রাগ, আর অভিমান। বাপের এক ছেলে যে, একলাফেঁড়ে তো হবেই। তোমার বয়েস হয়েছে। কচি খোকাটিও নও। কোথায় পাঁচজনকে নিয়ে হেসে-খেলে থাকবে, তা নয়, নিত্য নতুন ফ্যাঁকড়া বের করে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ধিকিয়ে ধিকিয়ে জ্বলার চেয়ে এবারে একেবারে জ্বলেপুড়ে যাক।

মা, আপনার শরীর কিন্তু ভালো নয়, লো প্রেশার। খাওয়া বন্ধ করে দিলে শরীর আরও খারাপ হবে।

সে কথাটা আমাকে না বলে তোমার দুর্বাসা শ্বশুরকে বলো।

আমার সে সাহস নেই।

তাহলে যা করছ তাই করো গে যাও। কেবল বাচ্ছাটাকে উপোস করিয়ে রেখো না।

মাগুর মাছের ঝোলভাত করে ওকে খাইয়ে দিই?

আর তুমি?

অনশন।

এই সময়টায় তোমার ভালো খাওয়াদাওয়া করা উচিত। নিজে মরো ক্ষতি নেই। পেটেরটা মেরো না। বুড়োর সঙ্গে আমার লড়াই! তোমরা এর মধ্যে জড়িয়ে পোড়োনা।

সংসারে আগুন লাগলে সকলকেই পুড়ে মরতে হবে। কী আর করা যাবে মা!

বেশ, তবে তাই হোক। ওই ওরা বলে, চলছে চলবে, আমরা বলি জ্বলছে জ্বলবে। কত্তাকে শুধু বলে দিও, আমিও আমৃত্যু অনশন চালিয়ে যাব। দেখি কার কত হিম্মত।

মহামায়া গোটাতিনেক গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার আর রুমাল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। আজ শুধু ধুয়ে যাব সারাদিন। দেখি লালকে সাদা করা যায় কি না?

প্রকাশবাবু এদিকে দাবার ছকে খুঁটি সাজিয়ে বই দেখে চাল রপ্ত করছেন। মনটাকে ঘোরাতে না পারলে মনটা ভীষণ খাই খাই করছে। মানুষের জীবনে খাওয়া বিশ্রী একটা বদভ্যাস। সারা। জীবন তো এত খেলি প্রকাশ, আর কত খাবি!

নিজেকেই নিজে শাসন করলেন। নাতিটি এসে পাশে বসেছে। আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল। খরগোশের মতো ঝকঝকে দুটি চোখ। নাতি বললে, তুমি তাহলে কী খাবে দাদু?

হরিমটর।

এই যে তুমি বললে কিছু খাবে না। মটর কী করে চিবোবে দাদু, তোমার যে দাঁত নেই!

হরিমটর চিবোতে হয় না। গিলেই খাওয়া যায়।

দিদাও হরিমটর খাবে?

দিদা কোন দুঃখে খাবে! দ্যাখো গে যাও, এতক্ষণে একগাদা চচ্চড়ি নিয়ে বসে গেছে চিবোতে।

এ রাম, তুমি কিছুই জানোনা। দিদাও তোমার মতো অনশন করেছে। আজ তো রান্নাই হয়নি।

অ্যাঁ, সে কী রে? তুই কী খেলি?

আমি ঝোল-ভাত খেয়েছি।

আর ওরা?

নাতি বুড়ো আঙুলটি দাদুর সামনে নাচাতে নাচাতে বললে, কাঁচকলা, কাঁচকলা।

অ্যাঁ, বলিস কী? বুড়ির যে আবার লো প্রেশার? শেষে বুড়ি মেরে খুনের দায়ে পড়ব নাকি?

দাদু, তুমি একটা লজেন্স খাবে?

নো-ও

বাব্বা কী রাগ!

হ্যাঁ, রাগ। রাগই হল পুরুষের ভূষণ, বুঝলি বুড়ো।

যাই, দিদাকে একটা লজেন্স খাইয়ে আসি।

তোমার দিদা এখন কোথায়?

ও-ঘরে শুয়ে আছে।

কী বলছে?

পাকা পাকা কথা বলছে। বলছে, এবার আমার যেতে পারলেই ভালো। সারাজীবন একটা লোকের অত্যাচার আর কত সহ্য করা যায়! লোকটা কে দাদা?

আমি জানি। নাতি বিজ্ঞের মতো বললে, সে লোকটা হলে তুমি।

বুড়ো ছুটে পালাল। প্রকাশবাবু দাবার ছকে খুঁটি নাড়াতে নাড়াতে অনুভব করলেন, রাগ ক্রমশ পড়ে যাচ্ছে। আর রাগ যতই কমে আসছে ততই কিছু একটা খাবার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। চারটে প্রায় বাজল। চায়ের সময়। মনটা ফসফস করছে। কিছু নেশা জীবনটাকে একেবারে নষ্ট করে। দিয়েছে। চা-সিগারেট। মহাত্মা গান্ধীর এসব নেশা ছিল না। তাই অনশন অত সাকসেসফুল হত। ফুলকো ফুলকো চিঁড়েভাজা খেতে ইচ্ছে করছে। নাঃ, রাগটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। রেগে না গেলে মানুষের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। রাগে দুর্বল মানুষও অনায়াসে জানালার শিক বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। কী নিয়ে রাগা যায়! কার ওপর রাগা যায়! কেউ যে ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইছে না। প্রকাশবাবু ঢক ঢক করে আবার খানিকটা জল খেলেন।

জল খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে উঠল। ভালোই হচ্ছে, ওয়াটার থেরাপি। জলই তো জীবন। এই সময় কেউ খাওয়ার অনুরোধ করতে এলে আবার একবার রেগে ওঠা যায়। কেউ যে আসছেই না।

ছটার সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। বেয়াইমশাই এলেন। বড় অমায়িক, আলাপী মানুষ। আজ না এলেই পারতেন। এ তো রাজনৈতিক অনশন নয় যে, নেতারা আসবেন লেবুর জল খাওয়াতে। এ হল পারিবারিক অনশন।

প্রকাশবাবু বেশ গোছগাছ করে, গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসলেন। পাশের টেবিল থেকে একটি ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। যে-সে ম্যাগাজিন নয়, বেদান্তকেশী। এক ঢোঁক জল খেয়ে শুকনো। ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মুখে একটি লবঙ্গ ফেলে রাখলেন। কুটুম মানুষ। পারিবারিক কেচ্ছা জেনে ফেললে বড় লজ্জার হবে। মহামায়াকেই ভয়। হাঁউ হাঁউ করে সব বলে না ফেলে। এমনভাবে বলবে, সব দোষ যেন আমার। যত বুড়ো হচ্ছি ততই নাকি ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছি। স্বার্থপর সংসারের বিরুদ্ধে এ আমার একক সংগ্রাম! করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। কিন্তু আমি কী করতে চাইছি, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।

সংশয়ে প্রকাশবাবুর সংগ্রামের শক্তি যেন দুর্বল হয়ে পড়ল।

বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। বেয়াইমশাই আসছেন। খুব মজলিশী মানুষ। গল্পে-গানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারেন। চতুর্দিকে ফলাও ব্যবসা। প্রচুর অর্থ। মধুপুর, শিমুলতলায় বাড়ি। খানদুয়েক গাড়ি। দক্ষিণ কলকাতায় হাল ফ্যাশানের বাড়ি।

সত্যেনবাবু দরজার বাইরে চটি ছেড়ে হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢুকলেন। দুই বেয়াই প্রায় সমবয়সি। ইনি একটু হৃষ্টপুষ্ট, উনি শীর্ণ। ইনি আনন্দপ্রধান, উনি রাগপ্রধান।

চেয়ার টেনে বসতে বসতে সত্যেনবাবু বললেন, কেমন আছেন বেয়াইমশাই?

ওই চলছে একরকম। চলে যাচ্ছে কোনওরকমে।

আপনি কি কোনওদিন ভালো বলবেন না?

যে টেকনিকে ভালো বলা যায়, সেই সিলভার টনিক আমার আয়ত্তের বাইরে। আমার পৃথিবী হল অ্যানিমিক পৃথিবী। দিনগত পাপক্ষয় করে চলে যাওয়া।

সব সময় অমন বেসুরো বাজেন কেন বেয়াইমশাই! একটু সুরে বেজে দেখুন না, বেশ ভালো। লাগবে। সব সহজ হয়ে যাবে। এখানে কাঁদতে এসেছি, না হাসতে এসেছি?

মশাই, আপনার চোখে এক রকম চশমা, আমার চোখে আর এক রকম চশমা। দুজনের দেখা কি সমান হতে পারে?

আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কথায় আমি পারব না। দয়া করে গাত্রোখান করুন। ধুতি পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে নিন।

কেন বলুন তো! আজ আর আমি আপনার কোনও অনুরোধ রাখতে পারব বলে মনে হয় না। একটু বেএক্তার হয়ে আছি।

সেই জন্যেই ঈশ্বর মনে হয় আমাকে পাঠালেন। উঠুন উঠুন। আপনার কোথায় কী আছে বলুন, হাতের কাছে এনে দিই।

না, না, সে কী কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো?

জীবনে আপনি এমন সুন্দর কীর্তন কখনও শোনেননি। মম্মমহাপ্রভু জগৎসুন্দর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে চৈতন্যআশ্রমে একটি মাত্র অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। রাত আটটায় শুরু। জন্মাষ্টমীর প্রাককালে একটি রজনী। চলুন, চলুন, মনটাকে একটু ভিজিয়ে আসি। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…

সত্যেনবাবু আপন মনে গান ধরলেন। গলা শুনলেই বোঝা যায় একসময় সংগীতচর্চা করতেন। দু-লাইন গেয়ে গান থামিয়ে সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ানের কী হল! আজ নীরব কেন কবি, ফুলের জলসায়!

উদাত্ত কণ্ঠে বেয়ান, বেয়ান করতে করতে সত্যেনবাবু অন্দরের দিকে এগোলেন। বাবার গলা শুনে শর্মিলা এগিয়ে এল, তুমি কখন এলে?

তা মিনিট পনেরো হবে। কত্তার সঙ্গে কথা বলে এলুম। আমার বেয়ান কোথায়?

মা শুয়ে আছেন।

অ্যাঁ, সে কী রে! ভর সন্ধেবেলা শুয়ে থাকার মানুষ তো তিনি নন। হ্যাঁ রে, শরীর ঠিক আছে তো!

শর্মিলা কী আর বলবে। আমতা আমতা করে বলল, এই উপোসটুপোস চলছে তো!

উপোস? অম্বুবাচি তো হয়ে গেছে?

আঃ বাবা, কী বলছ তুমি? অম্বুবাচি বিধবারা করেন।

আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম অফুলি সরি।

ওদিকে প্রকাশবাবু ঝট করে একটুকরো কাগজে লিখলেন, দয়া করে বাইরের কুটুমের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলোনা। লজ্জায় তা হলে মাথা কাটা যাবে। ফিশফিশ করে বুড়োকে বললেন, যা চুপিচুপি তোর দিদার হাতে গুঁজে দিয়ে আয়।

মহামায়া চিরকুটটা পড়ে হু: করে একটি শব্দ ছাড়লেন। শর্মিলা ঘরে ঢুকে বললে, বাবা এসেছেন।

শুনেছি।

মহামায়া মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরের বাইরে এলেন।

সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ান, ঝট করে রেডি হয়ে নিন। কত্তাকে খাড়া করেছি কোনও রকমে।

মহামায়া মৃদু গলায় বললেন, শরীরটা আজ তেমন জুতের নেই।

শরীর? সত্যেনবাবু হইহই করে হেসে উঠলেন, শরীর ঠিকই আছে বেয়ান। মনটা গোলমাল করছে। সেই মনের দাওয়াই মিলবে এখুনি। আমার সঙ্গে চলুন।

কোথায়?

উপাদেয় কীর্তন। জীবনে হয়তো আর শোনার সৌভাগ্য হবে না। নিন, নিন, গেট রেডি।

মহামায়া ধরা ধরা গলায় বললেন, বউমা, একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।

সত্যেনবাবু বেয়াইয়ের কাছে এসে বসলেন। প্রকাশবাবু জামা-কাপড় পরে ফেলেছেন। পেট জ্বলছে। গলা শুকনো। ঠোঁট খসখসে। ছাত্রজীবনে শিবরাত্রির উপবাস করেছিলেন একবার। সেই স্মৃতি মনে পড়ল। রাতের দিকে কাহিল অবস্থা। নির্জলা উপবাস। পুজোয় বসে আচমনের নামে কোষাকুষি থেকে ঢোঁকে ঢোঁকে গঙ্গাজল গিলতে লাগলেন। আজ যেন সেই শিবরাত্রির উপবাস।

সত্যেনবাবু বললেন, চলুন, এবার পুজোয় সকলে মিলে, মধুপর কি শিমুলতলা ঘুরে আসি।

মনে মনে ভাবলেন, ততদিনে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আজ ঘুরছি। কাল শয্যা নেব। পরশু খাবি খাব। পরের দিন পরপারে।

শর্মিলা বাবার জন্যে চা আর জলখাবার নিয়ে এল।

বেয়াইমশাই আপনার?

আজ্ঞে, আজ আমার উপবাস, আপনি গ্রহণ করুন।

ও, স্বামী স্ত্রী দুজনেরই উপবাস। আজ কী বার? শনিবার। ভালো, খুব ভালো। আমারও খুব ইচ্ছে করে একটা কিছু পালন করি। করি করি করে করা আর হয় না।

এটা ঠিক ধর্মীয় নয়। বলতে পারেন স্বাস্থ্যের জন্য। উপবাসে শরীর আর মন দুটোই খুব শুদ্ধ হয়। লাগাতার উপবাসে নির্বাণ লাভ হয়।

এ আপনার কার কথা, বুদ্ধদেবের?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সত্যেনবাবু ঢ্যাঁপা ঢ্যাঁপা খাস্তা কচুরি খাচ্ছেন। বড় প্রিয় জিনিস তাঁর। প্রকাশবাবুরও প্রিয়। কে যে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন? তাঁর নামে একটি মঠ দেওয়া উচিত।

সত্যেনবাবু কচুরির তারিফ করে বললেন, আপনার সামনে বসে খাচ্ছি, আর নিজেকে কেবলই মনে হচ্ছে বিধর্মী।

ও সব ভাববেন না। আহারের সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই।

কথায় কথায় আহারাদি শেষ হল। মহামায়া একটি লালপাড় শাড়ি পরেছেন। কপালে সিঁদুরের গোল টিপ। মুখটা খুব শুকনো লাগছিল বলে ছোট্ট একটা খিলি পান পুরেছেন। চুলে সামান্য পাক ধরেছে। ফরসা টকটকে রং। টিকানো নাক। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে বাগবাজারের মা জগদ্ধাত্রীর কথা মনে পড়ে।

প্রকাশবাবু স্ত্রীকে দেখে মনে মনে তারিফ করেই, মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন। স্বার্থপর! এর নাম অনশন! মুখে পানের খিলি! দুপুরে শরবত-টরবতও চলেছে বোধহয়। হেঁশেল যার হাতে, তার আর ভাবনা কী। রাগ থিতোলে অভিমান হয়। প্রকাশবাবুর ভেতরে অভিমানের বান। ডেকে গেল। দুপুরে আর একবার খোশামোদ করলেই অনশন ভঙ্গ হয়ে যেত। এতবড় অহংকারী মেয়েমানুষ গোঁ ধরে বসে রইল। অঃ, রোজগেরে ছেলের অহংকারে দেমাকে মাটিতে যেন পা পড়ছে না! বুড়ো ব্যাটা মরলেও ছেলে সিংহাসনে বসিয়ে তো দেবে।

মহামায়া সত্যেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। প্রকাশবাবু পেছন পেছনে চলেছেন। গুমরোতে গুমরোতে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, সদাহাস্যময় ভোজনবিলাসী ওই বণিকটি কার টানে প্রায়ই ছুটে আসেন! নীচ ভাবনা হলেও ভাবতে হচ্ছে।

গাঢ় নীল রঙের ঝকঝকে গাড়ি, গুমোরে যেন গুম মেরে আছে। সাদা উর্দিপরা চালক। পেছনের দরজা খুলে সত্যেনবাবু মহামায়াকে বললেন, উঠুন বেয়ান।

প্রকাশবাবুর ভেতরটা রাগে কষকষ করছে। বেয়ানের খাতির দেখো! বেয়াইটা যেন ফেউ! বানের জলে ভেসে এসেছে।

সত্যেনবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, বেয়াইমশাই আসুন, আসুন।

প্রকাশবাবু বেশ কঠিন গলায় বললেন, আমি সামনে বসব।

আপনারা দুজনে আরাম করে পেছনে বসুন।

না, না, হর-পার্বতীকে পেছনে রেখে আমি চলব সামনে। আসুন, আসুন।

প্রকাশবাবু আরও কঠিন গলায় বললেন, পেছনে বসায় আমার একটু অসুবিধে আছে। বেয়াইমশাই। আপনারা দুজনে বসুন, আমি সামনে যাচ্ছি। আর তাতেও যদি অসুবিধে হয়, আমি ফিরে যাই।

সত্যেনবাবু গাড়ির খোলা দরজায় হাত রেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহামায়া ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। এগিয়ে গেলেন বাড়ির দরজার দিকে। সিঁড়ির কাছাকাছি এসে আর পারলেন না। সিঁড়ির হাতলে মাথা রেখে কান্নায় ফুলতে লাগলেন। এই চওড়া লালপাড় শাড়ি, গহনা, জাপান, পালঙ্ক—সবই একটা মানুষের মর্জি। যখন খুশ মেজাজে তখন তুমি আমার সোহাগের স্ত্রী। মেজাজ বিগড়ালেই মানসিক নির্য্যাতন! ঠিক ওই কথাটাই মনে এল মহামায়ার— স্ত্রী হল প্রয়োজনের পিকদান।

সত্যেনবাবু তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলেন, কী হল বেয়ান! নেমে এলেন কেন? কাঁদছেন কেন?

মহামায়া কোনওক্রমে বললেন, আমি যাব না।

প্রকাশবাবু দু-পাদূরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যেনবাবু সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েদের মনে দুঃখ দেন কেন? আপনি পণ্ডিতমানুষ এইটুকু বোঝেন না, যেসংসারে মেয়েরা হাসতে পারে না, সে সংসারের কখনও উন্নতি হয় না। মরুভূমি হয়ে যায়।

মহামায়া ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলেন। পেছন পেছন এলেন সত্যেন আর প্রকাশ। প্রকাশের মনে খুব লেগেছে। বড় নীচ হয়ে গেছেন তিনি। অপমানিত মহামায়ার করুণ মুখ বড় দাগ কেটেছে মনে। সারাজীবন অনেক টর্চার করেছেন। নির্য্যাতন করে এক ধরনের আনন্দ পেয়েছেন। আমি এক ঘৃণ্য স্যাডিস্ট।

ধীরে ধীরে পা থেকে চটি খুললেন। ডান হাতে তুলে নিলেন একপাটি চটি। সত্যেনবাবু অবাক হয়ে মানুষটিকে দেখছেন। লম্বা বারান্দা ধরে মহামায়া এগিয়ে চলেছেন পায়ে পায়ে।

প্রকাশবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।

সত্যেনবাবু আতঙ্কের গলায় বললেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সে কী কথা!

জুতো, জুতোই তোমার দাওয়াই।

নিজের গালে পটাপট জুতো মারতে লাগলেন।

এ কী, এ কী করছেন আপনি? সত্যেনবাবু হাত চেপে ধরেও সামলাতে পারছেন না। শরীরে অসুরের শক্তি এসে গেছে।

জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দাও। এই নিন আর একপাটি। পটাপট মারুন।

মহামায়া দ্রুতপায়ে ঘুরে এলেন, এ কী করছ তুমি? এ কী পাগলামি!

ক্ষিপ্ত প্রকাশবাবু নেচে উঠলেন, মারো, মারো, পটাপট মারো। ডাকো প্রশান্তকে, ডাকো বউমাকে। সবাই মিলে পেটাও। এই অত্যাচারী বুড়োটাকে জুতোও, জুতোও। জুতিয়ে সিধে করো। মহামায়া স্বামীকে জাপটে ধরলেন। হু-হু করে কাঁদছেন আর বলছেন, তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেলে? মহামায়ার শীতল আলিঙ্গনে প্রকাশবাবুর শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে এল। শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠেছে। ঘোর লেগে গেছে। মহামায়াকে আর মহামায়া বলে মনে হচ্ছেনা। বহুকাল আগের এক অনুভূতি ফিরে আসছে। উনিশশো চুয়াল্লিশ সাল। টাইফয়েড হয়েছে। দাওয়ায় বসিয়ে মাথায় জল ঢেলে, মা বুকে জড়িয়ে ধরে, ধীরে ধীরে ঘরের দিকে নিয়ে চলেছেন।

মহামায়া ধীরে ধীরে স্বামীকে খাটে শুইয়ে দিলেন। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন, ইস ডান গালটার কী অবস্থা করেছে!

প্রকাশবাবু বললেন, আমি একটু জল খাব।

শর্মিলা দরজার কাছে। মহামায়া বললেন, বউমা এক গেলাস ঠান্ডা জল দাও। ফুল স্পিডে। পাখা ঘুরছে। সত্যেনবাবু একপাশে বসে স্বামী-স্ত্রী-র অপূর্ব লীলা দেখছেন। শর্মিলা ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করে ভাবতে লাগল, শুধু জলে তো অনশন ভঙ্গ হয় না। ফলের রস দিতে হয়। এক বোতল আঙুরের রস আছে। গোটা চারেক মুসুম্বি আছে। প্রশান্ত একটা ক্রাশার কাম মিক্সার কিনে এনেছে কাল। আজই তার উদ্বোধন হোক। মিক্সার চলছে ঘির ঘির করে। মুসুম্বির নরম শরীর ঘেঁতো হচ্ছে। দলা পাকাচ্ছে। রস বেরোচ্ছে। শর্মিলার হঠাৎ মনে হল—এরই নাম সংসার। যত চটকাবে তত রস বেরোবে। সব যেন ঘানির সরষে। পেষাই না হলে তেল বেরোয় না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments