Tuesday, August 26, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্প১৩ তলা - অনীশ দাস অপু

১৩ তলা – অনীশ দাস অপু

১৩ তলা – অনীশ দাস অপু

তেরো বছরের তারিকুল ইসলাম ওরফে তারিক আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে। ঢোলা সুট পরনে তার, এ নিয়ে অস্বস্তিও কম নয়। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে ট্যাক্সির পেছনের আসনে মুখ শুকনো করে বসে আছে সে। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে অসংখ্য গাড়ির মাঝখান দিয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসেছেন ওর বাবা।

‘এবারের ছুটিটা বেশ মজার কাটবে,’ ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন বাবা। তারিক কোনো মন্তব্য করল না। সে জানে, বাবা ভুল বলেছেন। তার ধারণা, ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আজ মাসের ১৩ তারিখ। ক্যাব ছুটছে ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন শহরের ১৩ নম্বর রাস্তা দিয়ে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ নম্বর রাজ্য। ঘড়ি দেখল তারিক। প্রায় একটা বাজে। মিলিটারি সময় ১৩০০ ঘণ্টা।

১৩! তারিকের মস্তিষ্কে যেন গরম লোহার ছ্যাঁকা লাগল সংখ্যাটা মনে করে। পকেট থেকে খরগোশের পা বের করে হাতের তালুতে ঘষতে লাগল সে।

‘ভাইয়া, আবার সেই জঘন্য জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ!’ বলল ছোট বোন মালা। ‘তোমার যে কী কুসংস্কার!’ ‘কিসের কুসংস্কার!’ ধমক দিল তারিক। ‘তোরা কেউ বুঝতে পারছিস না কী ঘটতে চলেছে? আমাদের সামনে ভয়ানক কোনো বিপদ ওত পেতে আছে, পৈশাচিক কিছু। সোজা ওটার ফাঁদে গিয়ে পড়ব।’

ওর বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে, ‘তারিক, ফাজলামো অনেক হয়েছে। আর না। ফালতু কুসংস্কার ছাড় তো। ১৩ সংখ্যাটা নিয়ে এত লাফালাফি করিস কেন? আমরা মজা করতে যাচ্ছি। এসব কুসংস্কার বাদ দে। নইলে নিজের মজা মাটি তো করবিই, আমাদেরটাও। বোঝা গেছে?’

চুপচাপ বসে রইল তারিক। কোনো মন্তব্য করল না। তর্ক করে লাভ কী? গম্ভীর মুখে ভাবছে সে। এরা আমার কথা শুনতেই চাইবে না। বুঝবেও না।

‘হোটেল আর কদ্দূর?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভারকে।

‘এই তো সামনে, স্যার,’ জবাব দিল ড্রাইভার।
নীরবতা নেমে এল গাড়িতে, আরও তেরোটি ব্লক পার হচ্ছে যান্ত্রিক বাহন। এক, দুই করে গুনছে তারিক।

অবশেষে উইলমন্ট রিজেন্সি হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল ড্রাইভার, সঙ্গে সঙ্গে কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তারিকের। লবি ধরে হাঁটছে ওরা, অনুভূতিটা জোরালো হয়ে উঠল তার ভেতর।

‘আমি আগেও এখানে এসেছি,’ বলল সে।

‘কী বকবক করছিস, তারিক,’ বাবা মৃদু ধমক দিলেন, ‘তুই এর আগে জীবনেও বোস্টনে পা দিসনি।’

তারিক তাকাল চারপাশে, ‘কিন্তু সবকিছু এত পরিচিত লাগছে!’

মালা চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি সত্যি একটা অদ্ভুত ভাইয়া!’

‘প্লিজ, তারিক,’ অনুনয় মায়ের গলায়, ‘আবার শুরু করিস না।’

‘তোর ফালতু প্যাঁচাল শুনে শুনে আমি ক্লান্ত,’ থমথমে গলায় বললেন বাবা। ‘এখন একটু ক্ষ্যামা দে, নাকি?’ স্পষ্ট বিরক্তি তাঁর চেহারায়, এগিয়ে গেলেন রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে। ওখানে তালগাছের মতো লম্বা এক মহিলা, বড় বড় কুচকুচে কালো চোখ, ওদের অভ্যর্থনা জানাল।

মনের মধ্যে রাগ পুষে, কালো মুখ নিয়ে লবিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল তারিক। ওর মা আর বোন বাবার সঙ্গে রিসিপশন ডেস্কে। তারিক নিশ্চিত, এ হোটেলে সে আগেও এসেছে। ফুল আঁকা গোলাপি সবুজ কার্পেট, নতুন দেখতে গোলাপরঙা সোফা, সুসজ্জিত স্ফটিকের ঝাড়বাতি, এ সবই ও আগে দেখেছে…কিন্তু কবে বা কখন?

হঠাৎ অদ্ভুত, ঘ..র..র..র একটা শব্দ শুনতে পেল তারিক। পাঁই করে ঘুরল, হোটেল এলিভেটর থেকে আওয়াজটা আসছে।

আগেকার মডেলের রেপ্লিকা বা নকল। এই এলিভেটর অবশ্যই আগে কখনো দেখেছে তারিক।

পুরোনো যন্ত্রটার দিকে হেঁটে গেল সে। খাঁচার মতো গরাদ দেওয়া জিনিসটার মাঝখান দিয়ে এলিভেটরের দিকে তাকাল। অন্ধকার, আয়তাকার একটা গর্ত, তাতে মোটা মোটা বিদ্যুতের তার ঝুলছে। এক লোকের মাথা দেখতে পেল তারিক, তারপর পুরো শরীরটা। এলিভেটর নিয়ে উঠে এল সে। খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওপরে যাবে?’

এ লোক নিশ্চয়ই এলিভেটরের অপারেটর। গেটের মতো দেখতে চকচকে দরজা খুলল সে। এলিভেটরের মেঝেতে সবুজ কার্পেট, দেয়ালে আয়না।

‘না,’ পিছিয়ে এল তারিক। অপারেটরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লোকটা বেঁটেখাটো, মাথাভর্তি লাল চুল, থুতনিতে মস্ত আঁচিল।

‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা।

লোকটার ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না তারিক। একে কোথাও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়?

‘আ, আমি বোতামে চাপ দিইনি,’ বিব্রত গলায় বলল তারিক। ‘এলিভেটরে ওঠার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই।’

বেঁটে লোকটা কাঁধ ঝাঁকাল শুধু, কিছু বলল না। তারিক দ্রুত ফিরে এল মা–বাবা আর বোনের কাছে। এক বেল বয় একটি কার্টে ওদের মাল তুলছে। বেল বয়টিকে প্রথমে বাচ্চা ছেলে ভেবেছিল তারিক। লক্ষ করতে বুঝল, এ বামন। মস্ত বড় মাথাটা ক্ষুদ্র শরীরের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

‘মা,’ মাকে একপাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করল তারিক, ‘আমি এখানে থাকতে চাই না। আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে।’

‘কেন! হোটেলটা তো খুবই সুন্দর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মা, দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন চারপাশে।

ওর বাবা পেছন পেছন চলে এসেছেন, ‘আবার কী হলো?’

‘ঠিক বোঝাতে পারব না,’ শুরু করল তারিক, ‘তবে কোথাও একটা ভজঘট আছে।’

‘কী?’ অধৈর্য গলা বাবার।

‘জানি না। তবে কিছু একটা ঘটবে মনে হচ্ছে। অদ্ভুত কিছু।’

হেসে উঠল মালা, ‘তুমি নিজেই তো অদ্ভুত।’

‘কোনো অদ্ভুত ঘটনাই ঘটবে না,’ বললেন বাবা, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে তোকে মানা করলাম না!’

তারিক উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে। ‘শান্ত হ, বাবা,’ বললেন তিনি। ‘মাথা থেকে আজেবাজে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে দে। অন্তত আমার জন্যে এটুকু করবি না?’ কথাটা শেষ করেই বেল বয়ের পেছনে হাঁটা দিলেন মা। সে ওদের ঘর দেখিয়ে দেবে।

‘কেউ আমার কথা শুনতে চায় না,’ বিড়বিড় করল তারিক। এলিভেটরের দিকে পা বাড়াল সে পরিবারের পেছন পেছন।

‘কোন ফ্লোর?’ নিরাসক্ত গলায় জানতে চাইল অপারেটর।

‘রুম নম্বর ১৩০২,’ হাতের চাবি দেখে বললেন বাবা।

‘ওহ্, দারুণ!’ লাফিয়ে উঠল মালা, চোখ টিপল ভাইকে, ‘তেরো নম্বর ফ্লোর!’

‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল তারিক, ঝট করে নেমে পড়ল এলিভেটর থেকে, ‘আমি এ হোটেলে থাকব না। তেরো নম্বর ফ্লোরে তো নয়ই!’

‘ফিরে আয় বলছি!’ শাসালেন মা।

‘প্রশ্নই ওঠে না,’ খেঁকিয়ে উঠল তারিক। নিতম্বে হাত, চেহারায় বেপরোয়া ভাব।

অপারেটরকে অপেক্ষা করতে বলে এলিভেটর থেকে নেমে এলেন বাবা, ছেলের সামনে এসে বললেন, ‘অনেক হয়েছে, তারিক। ফাজলামো রাখ।’

‘আমি ফাজলামো করছি না,’ দৃঢ় গলা তারিকের।

প্রচণ্ড রাগে মুহূর্তের জন্য কথার খেই হারিয়ে ফেললেন বাবা। নিজেকে সামলে নিয়ে গোলাপরঙা সোফার দিকে আঙুল তুলে হিমগলায় বললেন, ‘আমরা আমাদের ঘরে যাচ্ছি। আর তুই এসব ফাজলামো বাদ না দেওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবি।’

তারিক চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি যে যা বলবে তা-ই শুনতে হবে?’

‘তুই বাচ্চা ছেলেরও অধম,’ বললেন বাবা, ‘দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো আচরণ করছিস।’

‘না, করছি না। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। তুমি আমাকে বাচ্চা ভাবলেও আমার কিছু আসে যায় না।’

ঝাড়া কয়েক সেকেন্ড আগুনচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাবা। কষে চড় মারার ইচ্ছাটা দমন করলেন বহু কষ্টে। এলিভেটরে ফিরে গেলেন তিনি। ‘ওপরে চলুন,’ বললেন অপারেটরকে। কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। ‘তোকে কয়েক মিনিটের মধ্যে ওপরে দেখতে চাই।’

‘কিন্তু আমি তোমার চেহারা আর কখনো দেখতে চাই না,’ তারস্বরে চেঁচাল তারিক। ‘তোমাদের কাউকে না!’

‘যা বলবে ভেবেচিন্তে বোলো, খোকা,’ একটা লিভার ধরে টান দিল অপারেটর, ‘অনেক সময় বেমক্কা কথাও ফলে যায়।’

‘ফলে গেলেই ভালো!’ জোরে চেঁচাল তারিক। রাগে জ্বলছে শরীর।

চকচকে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর একটা গুঞ্জন উঠল, তারিক দেখল তার পরিবারকে নিয়ে ওপরে রওনা দিয়েছে এলিভেটর। একমুহূর্ত পর অদৃশ্য হয়ে গেল।

দুই

অনেকক্ষণ লবিতে দাঁড়িয়ে রইল তারিক, প্রতি মিনিটে বাড়ছে ক্রোধ। শেষে রাগ সামলাতে না পেরে ঝড়ের বেগে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল সে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে। অচেনা শহরে ঘুরতে লাগল একা একা। মূর্তিবোঝাই একটি পার্কের বেঞ্চিতে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হাঁটা দিল বাইক চলা একটি পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একটা কবরস্থানের সামনে চলে এল। নিজেকে ভীষণ একা, রদ্দি আর বাতিল মাল মনে হচ্ছে, যেন বাবা ওকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছেন।

কবরস্থানের পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারিক ভাবতে লাগল, কিছুক্ষণ আগে কী রকম ব্যবহার করে এসেছে সে তার পরিবারের সঙ্গে। ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে লাগল মাথা। সবার সঙ্গে সে যাচ্ছেতাই আচরণ করেছে! দোষ সম্পূর্ণ ওরই। সাধে কি আর ওর বন্ধুরা ওকে ‘রগচটা’, ‘অদ্ভুত ভাবুক’ বলে ডাকে! বন্ধুরাও জানে, কুসংস্কারে সাংঘাতিক বিশ্বাস তার। কিন্তু কী করবে তারিক? কীভাবে সে তার মা–বাবাকে বোঝাবে এক অদ্ভুত, অশুভ শক্তি ক্রমেই ওকে গ্রাস করে ফেলছে?

আগে কখনো কুসংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাত না তারিক। এখন সে কালো বিড়াল ভয় পায়, মইয়ের নিচ দিয়ে কখনো হাঁটে না, বিশেষ করে ১৩ সংখ্যাটির প্রতি তার ভয়ানক ভয়। এই যে সে ফুটপাত ধরে হাঁটছে, সতর্ক নজর রয়েছে যাতে কোনো ফাটল বা গর্তে পা না পড়ে। এটাও একধরনের কুসংস্কার।

তারিক জানে, অবশেষে তাকে হোটেলেই ফিরতে হবে, সে ওদিকে পা বাড়াল। তবে এখনই হোটেলে ঢোকার ইচ্ছা তার নেই। জায়গাটাকে সে শুধু ভয় পায় বলে নয়, এখনো রাগটা পড়েনি যে! মাত্র আড়াইটা বাজে। এত তাড়াতাড়ি হোটেলে গেলে ব্যাপারটা ওর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে।

কিন্তু কী করবে তারিক? সময় কাটাবে কীভাবে? রাস্তার ওপারে একটা সিনেমা হলে আটকে গেল চোখ। সিনেমা দেখে সময় কাটানো যায়। পা চালিয়ে রাস্তা পার হলো তারিক। টিকিট কিনে ঢুকে পড়ল অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে।

ছবির টাইটেল দেখানো শুরু হয়ে গেছে। ছবির নাম ‘কলিশন কোর্স’। নাম দেখে মনে হলো, প্রচুর অ্যাকশন আছে। কিন্তু একটা খামারবাড়ির দখল কে নেবে, তা নিয়ে এক লোক আর এক মহিলার বিরক্তিকর দ্বন্দ্ব নিয়ে ছবি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ছবি চলার সময় তারিকের মনে হতে লাগল, এ ছবি আগেও দেখেছে সে অনেক আগে, তবে কবে, কোথায় মনে করতে পারল না। রদ্দি মার্কা সিনেমা আর ভ্রমণের ক্লান্তি ঘুম এনে দিল তারিকের চোখে। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে তারিক দেখে, রাত নেমেছে। মা–বাবা ওকে এত দেরিতে ফিরতে দেখলে নিশ্চয়ই রেগে যাবেন, ভাবল তারিক। দ্রুত পা চালাল হোটেল অভিমুখে। চোখে ঝাপসা দেখছে সে, হাড় আর জয়েন্টগুলো আড়ষ্ট, ব্যথাও করছে, একঝলক শীতল বাতাস ঝাপটা মেরে ঢুকে পড়ল ওর বিশ্রী স্যুটের মধ্যে। এ জিনিস মা–বাবা ওকে বানিয়ে দিয়েছেন প্লেনে পরে আসার জন্য। তবে ঢোলা স্যুটটা কোনো কারণে এখন টাইট লাগছে, কলারটাও।

আশ্চর্য! ভাবল তারিক। এ পোশাক তো আমার গায়ে ঢিলে হতো।

হিম বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ঢুকে পড়ল সে। দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করেনি তারিক, কিন্তু লবিতে ঢুকেই পার্থক্যটা চোখে পড়ল। অবাক হয়ে দেখল, জায়গাটা বদলে গেছে। সবকিছুর যেন বয়স বেড়ে গেছে, কবরস্থানের বাসি একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

একমুহূর্তের জন্য ভাবল তারিক, ভুল কোনো হোটেলে চলে এসেছে ও, পরক্ষণে চোখে পড়ল রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের ওপর, দেয়ালে ঝোলানো ম্লান সোনালি-বাদামি অক্ষরের প্ল্যাকার্ড: উইলমন্ট রিজেন্সি।

চারপাশে চোখ বোলাল তারিক। গোলাপি-সবুজ রঙের ফুল আঁকা কার্পেট ঠিকই আছে, তবে আগের চেয়ে বিবর্ণ লাগছে দু–এক জায়গায়, ছিঁড়ে সুতা বেরিয়ে গেছে। গোলাপ রঙের সোফা, আগে যা মনে হয়েছে ঝাঁ–চকচকে, দেখাচ্ছে জীর্ণ, ডেলার মতো, লবির মাঝখানের বড় ক্রিস্টালের ঝাড়বাতিটি জ্বললেও গায়ে ধুলা জমে থাকার কারণে আলো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না।

হঠাৎ তারিক গোঙানির মতো ঘ..র..র..র একটা আওয়াজ শুনল। ঘুরল। হোটেল এলিভেটর থেকে শব্দটা আসছে। ওদিকে ছুটল সে, ওপরে গিয়ে মিলিত হবে পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু ছোটার গতি মন্থর হয়ে গেল প্যান্টের জন্য। বিচিত্র কোনো কারণে তার প্যান্ট এত ছোট হয়ে গেছে, জোরে দৌড়ালে ফট্ করে ছিঁড়ে যেতে পারে।

এলিভেটর এসে পৌঁছুল। তারিক বিকটদর্শন, বয়সের ভারে ক্ষয়ে যাওয়া গরাদের গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকল।

‘ওপরে যাবেন?’ নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল অপারেটর।

তারিকের ইচ্ছা করল গলা ফাটিয়ে চিত্কার দেয়। এ সেই আগের অপারেটর, তবে এ মুহূর্তে অনেক বুড়োটে লাগছে, গালে আর কপালে ভাঁজটাজ পড়ে গেছে, মাথার চুলও পাতলা দেখাচ্ছে, থুতনির আঁচিলটা যেন আকারে আরও বড় হয়েছে। লোকটা লম্বা, হলুদ দাঁত বের করে হাসল, ‘কী হয়েছে?’

তারিক ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে, মুখে রা নেই।

‘কোন ফ্লোর?’ জানতে চাইল লোকটা।

‘তে-তেরো,’ অবশেষে বিড়বিড় করে বলল তারিক।

লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাল তারিকের দিকে, ‘এখানে তেরো নম্বর ফ্লোর নেই।’

‘অ্যাঁ?’ হতভম্ব দেখাল তারিককে, ‘কী বললেন?’

‘বললাম, এখানে তেরো নম্বর ফ্লোর নেই,’ পুনরাবৃত্তি করল লোকটা হিমগলায়।

ঢোক গিলল তারিক। ‘এসব ঘটছে কী এখানে?’ জিজ্ঞেস করল সে, টের পেল শিরদাঁড়া বেয়ে বরফশীতল জল নামছে, ‘আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে?’

‘ওপরে যাবেন কি যাবেন না?’ প্রশ্ন করল বুড়ো, ভাবলেশহীন চেহারা।

পিছিয়ে এল তারিক, পা চালিয়ে চলে এল রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে। ধাতব হ্যান্ডবেল ক্রমাগত বাজানোর পর তালগাছের মতো লম্বা এক মহিলা বেরিয়ে এল ব্যাকরুম থেকে।

এ সেই মহিলা, বড় বড় কালো চোখ। তবে এরও বয়স বেড়ে গেছে, নুয়ে পড়েছে কাঁধ।

‘কোনো সাহায্য করতে পারি?’ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

তারিক জানাল, অপারেটর তাকে বলেছে, এ হোটেলে নাকি তেরো নম্বর ফ্লোর বলে কিছু নেই।

মাথা ঝাঁকাল মহিলা। ‘ঠিকই বলেছে সে। উইলমন্ট রিজেন্সিতে তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল, তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর লোকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তেরো নম্বর ফ্লোর তারপর বাদ দেওয়া হয়েছে।’

‘কি-কিসের অগ্নিকাণ্ড?’ কথা জড়িয়ে গেল তারিকের।

‘বেশ কয়েক বছর আগে তেরো নম্বর ফ্লোরে আগুন লেগে যায়। সে এক ভয়াবহ কাণ্ড! মেরামতের পর নম্বর পাল্টে ফেলা হয়।’ কাঁধ ঝাঁকাল মহিলা। ‘এ স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়, তবে নম্বরগুলো এখন ১১…১২…১৩ বদলে ১১…১২…১৪। কাজেই, স্যার, আমার ধারণা, আপনি আসলে চৌদ্দ নম্বর ফ্লোর খুঁজছেন, যা আগে তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল।’

‘আগুনে,’ জিজ্ঞেস করল তারিক, মনে মনে ভাবছে, মহিলা তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করল কেন, ‘কেউ হতাহত হয়েছিল?’ মহিলার চেহারা বিষণ্ন দেখাল। ‘জি, তিনজন মানুষ মারা যায়।’ একমুহূর্ত বিরতি দিল। ‘কিন্তু সে তো অনেক আগের কথা।’

‘মারা যায়!’ চেঁচিয়ে উঠল তারিক। ‘আমার মা–বাবা ছিলেন ওই ফ্লোরে!’

‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না, স্যার,’ বলল মহিলা, ‘আমি দুঃখিত যদি—’

কিন্তু মহিলার কথা কানে ঢোকেনি তার। আতঙ্কিত ও হতভম্ব হয়ে সে রওনা দিয়েছে এলিভেটরের উদ্দেশেও।

‘আমার পরিবার কোথায়?’ বুড়ো অপারেটরকে ধমকের সুরে প্রশ্ন করল সে।

খাঁচার ভেতর লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল।

‘তুমি সব জানো, না?’ খেঁকিয়ে উঠল তারিক।

মাথা দোলাল লোকটা।

‘আমার পরিবারের কী করেছ তুমি?’

‘আমি কিছু করিনি,’ ঠান্ডা গলা লোকটার, ‘আপনি করেছেন।’

‘আমি করেছি মানে?’ গলা কেঁপে গেল তারিকের।

‘আপনাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম,’ বলল বুড়ো, ‘কোনো কিছু চাওয়ার আগে ভেবেচিন্তে তা কামনা করতে হয়।’

‘ঠিক আছে, আমি এখন ১৩০২ নম্বর রুমে যেতে চাইছি!’

‘মানে ১৪০২, স্যার,’ অপারেটর শুধরে দিল তাকে।

‘আমাকে স্রেফ ওপরে নিয়ে চলো!’ হুকুম দিল তারিক।

‘আপনি যা বলেন, স্যার।’

‘আর স্যার স্যার করবে না,’ ঘেউ করে উঠল তারিক। ঢুকে পড়ল এলিভেটরে। আর তখন দেয়ালের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল।

মাঝবয়সী হয়ে গেছে সে!

ঝনঝন শব্দে গেট টেনে বন্ধ করল অপারেটর, টান দিল একটি লিভার ধরে, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে ওপরে রওনা হয়ে গেল এলিভেটর। ঘেমেনেয়ে গেছে তারিক, দাগ পড়া, ফাটা আয়নায় নিজের ভাঙাচোরা প্রতিবিম্ব থেকে চোখ সরাতে পারছে না। তারপর বহু কষ্টে ফ্লোর ইন্ডিকেটরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। বিস্ফারিত চোখে দেখল এক এক করে জ্বলে উঠছে সংখ্যাগুলো: ৯…১০…১১…১২…১৪!
মৃদু ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল এলিভেটর। ‘আপনার ফ্লোর, স্যার,’ বলল অপারেটর, মুখে অশুভ হাসি।

পুরোনো হোটেলটার বিবর্ণ হলওয়েতে পা রাখল তারিক। চারদিকে অযত্নের ছাপ, বোঝা যায়, অনেক আগে এখানে মেরামতের কাজ হয়েছে। সে দ্রুত ১৪০২ লেখা রুমের সামনে চলে এল। দমাদম ঘুষি মারতে লাগল দরজায়।

ক্যাঁঅ্যাচ শব্দে খুলে গেল দরজা, বদমেজাজি চেহারার এক বুড়ি উঁকি দিল। ‘কে? কী চাই?’ খ্যাঁক করে উঠল সে।

‘আমি আমার মা–বাবাকে খুঁজছি,’ ব্যাকুল গলায় বলল তারিক। ‘আমার বোন মালাকেও। ওরা সবাই এ ঘরে থাকত, তবে তা অনেক আগে। আমি ওদের এখন কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘কেটে পড়ুন তো। যত্তসব যন্ত্রণা,’ ঘোঁত ঘোঁত করল মহিলা, তারিকের মুখের ওপর ঠাস করে বন্ধ করে দিল দরজা।

তারিক ছুটে এল এলিভেটরে। ‘আমার পরিবারের কী হয়েছে?’ কাঁদো কাঁদো গলা।

‘আগুনে পুড়ে মারা গেছে,’ জবাব দিল অপারেটর, শয়তানি হাসি মুখে।

‘আর আমি, আমার এ রকম দশা হলো কী করে? আমি তো বাচ্চা একটা ছেলে ছিলাম, আর এখন—’

‘এখন আপনি বড় হয়ে গেছেন,’ মুখ বাঁকাল বুড়ো। ‘অন্তত এখন আর কেউ আপনাকে বাচ্চা ছেলে বলে অবহেলা করবে না।’

‘কিন্তু আমি তো বাচ্চা ছেলেই,’ বলল তারিক। ‘অন্তত ছিলাম।’

কাঁধ ঝাঁকাল বুড়ো। ‘আপনি যা কামনা করেছিলেন পেয়ে গেছেন!’ ভয়ংকর খনখনে গলায় হেসে উঠল সে, একটা লিভার ধরে টান দিল।

ভীত তারিক দেখল এলিভেটর নিচে নামতে শুরু করেছে। ভেতরে, ময়দার তালের মতো তেলতেলে বুড়োর মুখটা ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল, এলিভেটর নামছে, ভৌতিক, খনখনে হাসি হেসেই চলেছে লোকটা, তারপর নেই হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।

টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে এল তারিক। ‘মা! বাবা!’ বারবার চিত্কার করল ও একা হলওয়েতে দাঁড়িয়ে যা একসময় উইলমন্ট রিজেন্সির তেরো নম্বর ফ্লোর ছিল। ওর চিত্কারে হলঘরের দুপাশের কয়েকটি ঘরের দরজা খুলে গেল, উঁকি দিল বাসিন্দারা। বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে দেখল, হলওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়স্ক লোক তার মা–বাবাকে ডাকছে আর হাপুস নয়নে কাঁদছে…বাচ্চা ছেলেদের মতো।

(বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments