Monday, September 15, 2025
Homeবাণী ও কথাআততায়ী - অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

আততায়ী – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

আজও টাকাটা নিয়ে ফেরত আসতে হল। এক টাকার একটা নোট তার মাথার মধ্যে এভাবে আগুন ধরিয়ে দেবে দু-দিন আগেও টের পায় নি। যেন নোটটা যতক্ষণ মানিব্যাগে থাকবে ততক্ষণই তাকে বিচলিত করবে। উত্তপ্ত রাখবে এবং অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে হবে। সামান্য একটা এক টাকার নোট এভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে সে ভাবতেই পারে নি। আজকাল এক টাকার দামই বা কী! কিচ্ছু না। কিন্তু টাকার নোটটা যেন তার সঙ্গে বাজি লড়ছে। নোটটা এবং সে।

আসলে জীবনে একজন সব সময় প্রতিপক্ষ এসে তার সামনে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষটি প্রথমে খাটো থাকে—ক্রমে সে হাত পা বিস্তার করতে থাকে এবং একদিন এই প্রতিপক্ষই জীবনে চরম শক্র হয়ে দাঁড়ায়। দু-দিন ধরে এই নোটটা তার প্রতিপক্ষ, এটাকে বাজারে চালাতেই হবে।

সকালে বাজার করতে গিয়ে হাফ পাউণ্ড পাঁউরুটি কেনার সময় ব্যাগ থেকে খুঁজে নোটটা বের করে দিয়েছিল। আর তক্ষুণি দোকানির কাতর গলা, না স্যার চলবে না। কিছু নেই।

নেই মানে!

মাঝখানটা একেবারে সাদা। ন্যাতা হয়ে গেছে। কে দিল?

কে দেবে। বাসের কনডাক্টর। এক টাকার নোট পাওয়াই যায় না! নেবে না কেন? এক টাকার নোট অচল হয় না। আমি তো ঘরে বসে ছাপিনি! নেবে না কেন?

না বাবু, বদলে দিন।

দেব না। নিতে হবে। এক টাকার নোট অচল হয় না।

আপনি পাঁউরুটি ফেরত দিন। অচল কি না জানি না। আমি নিতে পারব না।

মাথা তার গরম হয়ে যাচ্ছিল। সেও দোকানির মতোই বলেছিল, ভাই কনডাক্টর নোটটা পাল্টে দাও। ছেঁড়া।

কিছু নেই।

কী হাসি!

কী বলছেন দাদা, কিছু নেই! না থাকলেও চলে। ছাপ থাকলেই চলে। বাজারে এক টাকার নোট পাওয়াই যায় না, আপনার লাক ভাল।

লাক ভাল বলছ!

হ্যাঁ, তাই বলছি। নিতে হয় নিন, না হয় চেঞ্জ দিন। কোথাকার লোক আপনি, বাসে ট্রামে চড়েন না।

বাসে ট্রামে চড়ি কি না তোমাকে কৈফিয়ত দেব না। চলবে না। পাল্টে দাও। আমার কাছে চেঞ্জ নেই।

ধূস নিতে হয় নিন, না হয় নেমে যান।

এক কথায় দু-কথায় বচসা শুরু হতেই বাসের লোকজন মজা পেয়ে গেছিল। একজন বলল, কী হল দাদা! এক টাকার নোট আজকাল অচল হয় না জানেন। দু পয়সা, পাঁচ পয়সা উঠেই গেল। আপনি দেখছি আজব লোক মশাই।

বাস বাদুড় ঝোলা হয়ে ছুটছে। তার সামনে দুজন যুবতী ফিক ফিক করে হাসছে। তার মনে হয়েছিল, সে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সামান্য এক টাকার একটা নোট নিয়ে। এত কথা বলা উচিত হয় নি। অনেকে সিট থেকে উঁকি দিয়ে তাকে দেখেছে। এমন বিপাকে যেন সে জীবনেও পড়ে নি। সত্যি তো এক টাকার নোটের বড় ক্রাইসিস। কীই বা দাম! নোটটা নিয়ে আর সে কোনো কথা বলে নি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আজকাল মানুষ সামান্য বিষয়ে কত মজা পায়! সে সব বাস-যাত্রীদের মজার খোরাক হয়ে গেল। তাকে নিয়ে দু-একজন বেশ ঠাট্টা রসিকতাও চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সে বুঝতে পারছে, কনডাক্টরের পক্ষ নিয়েছে সবাই!

তার এ-ভাবে মাথা গরম হবার কারণ বাড়ি গেলে আবার এক ধকল যাবে। ছবি বলবে, কে আবার অচল টাকা গছিয়ে দিল তোমাকে! যেমন মানুষ তুমি—ঘরে দুটো পাঁচ টাকার নোট, একটা দশ টাকার নোট, গোটা তিনেক দু টাকার নোট অচল হয়ে পড়ে আছে। ছবির এক কথা—দেখে নেবে না! তুমি কী! যে যা দেয় নিয়ে নাও! লোক ঠিক চিনেছে।

বাড়ি ফিরে নোটটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। বরং বলা যায়, নোটটা ছবির চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে রেখেছে। দু-দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যদি চলে যায়। কিন্তু চলে যাচ্ছে না। সে তবে ঠিকই ধরেছিল, চলবে না। নোট অচল।

কিন্তু বাসের সবাই বলেছে, এক টাকার নোট অচল কবে হল আবার! চেনা গেলেই হল—হ্যাঁ এক টাকার নোট। এই তো সরকারের টিপ ছাপ আছে বোঝা যায়। বোঝা গেলেই হল।

এই যে বাবু।

হ্যাঁ, আমাকে ডাকছ?

চলে যাচ্ছে যে।

কী করব! দাঁড়িয়ে থাকব।

নোটটা চলবে না। বদলে দিন।

দুটো মর্তমান কলা কিনে নোটটা দিয়েই হাঁটা দিয়েছিল সে।

আর টাকা নেই। আমি তো বানাই নি।

না থাকে কাল দেবেন। এটা নিয়ে যান।

রেখে দাও। পরে পাল্টে দেব।

না বাবু। কালই দেবেন। নিয়ে যান।

রাখলে দোষের কী। ছোঁয়াচে নাকি।

তা বাবু বলতে পারেন।

সে অগত্যা নোট ফিরিয়ে নিয়েছে। কাছে টাকা থাকতেও দেয় নি। দিলে যেন প্রমাণ হবে ঠগ, জোচ্চোর। অচল টাকা চালিয়ে বেড়াবার স্বভাব।

তারও মাথা গরম হয়ে যায়। যেন পারলে সেই বাস কনডাক্টরের মাথার চুল ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, বেটা তুমি সাধু। আর আমি শালা চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।

ঘরে বাইরে সব জায়গায়।

বাজার থেকে ফিরেই সে গুম হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। ছেলেরা স্কুলে যাবে। বাস এসে গেছে। ছবি রান্নাঘরে ওদের টিফিন হাতে নিয়ে ছেলে দু-জনকে বাসে তুলে দিতে যাচ্ছে। সে দেখেও দেখল না। মাথার মধ্যে বুড়বুড়ি উঠছে, লোকটাকে ধরতে হবে। টাকাটা নিয়ে সে এত হেনস্থা হবে অনুমানই করতে পারেনি। একটা এক টাকার নোট যেন পকেটে থেকে মজা লুটছে। তোমার মজা বের করছি, দাঁড়াও।

ছবি ফিরে এসে বলল, কী ব্যাপার? এত সকালে কোথায় বের হবে!

কাজ আছে।

কী কাজ বলবে তো। কিছুই রান্না হয় নি।

যা হয়েছে দাও।

সে বেশি কথা বলতে পারছে না। যেন সবাইকে তার চেনা হয়ে গেছে। বাজার করতে গেলে সে ঠকে, বাসে মিনিবাসে সে ঠকে, অফিসে পদোন্নতি নেই, স্বভাব দোষে—সর্বত্র সে অচল। ঘরেও। বাজার করে দিয়ে রেজকি ফেরত দিলেই ছবির এক কথা, এটা নিলে! চলবে!

আরে এখন সব চলে। রাখ তো, ভ্যাজর ভ্যাজর করবে না।

তার অফিস বিকেল বেলায়। কাগজের অফিসে কাজ করলে যা হয়! এত সকালে বের হবে শুনে ছবি চমকে গেছে। রান্নাঘরে তার মেজাজ চড়া!—এ কী লোকরে বাবা, আগে থেকে কিছু বলবে না। এখন কী দিই!

বলছি না যা হয়েছে তাই দাও।

শুধু ভাত হয়েছে।

ওতেই হবে। ফ্রিজে কিছু নেই!

না।

ডিম ভেজে দাও। একটু মাখন দাও। ওতেই হয়ে যাবে।

কোথায় যাচ্ছ বলবে তো!

বলছি না কাজ আছে।

সেটা কী রাজসূয় যজ্ঞ!

তাই বলতে পার।

কথা বাড়ালে খাণ্ডবদাহন শুরু হয়ে যাবে। সে আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খেয়ে বের হয়ে গেল।

রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই পাশ থেকে একজন চেনা লোক বলল, দাদা এত সকালে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?

একটু কাজ আছে।

কত নম্বর বাস? দুশ এগার?

দরজায় দেখল, না সে লোকটা নেই।

আবার দু’শ এগার।

এটাতেও নেই।

বেলা বাড়ে সেই লোকটাকে সে কিছুতেই সনাক্ত করতে পারে না।

লোকটা কী উধাও হয়ে গেল!

ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ফিরে এসে সে শুয়ে পড়ল। সেদিন আর অফিস বের হল না। মাথায় পেরেক ফুটিয়ে লোকটি উধাও হয়েছে। শুয়োরের বাচ্চা তুমি কত বড় ঠগ আমি দেখব। চেঞ্জ দিতে পারে দিন, না হলে নেমে যান!

পরদিন সকালে ফের এক কথা।

বের হচ্ছি।

এত সকালে!

কাজ আছে বলছি না।

কী কাজ!

রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়েছে। বুঝলে!

ছবি বলল, সারা জীবনই তো রাজসূয় যজ্ঞ করলে, এ আবার কী নতুন যজ্ঞি শুরু হল তোমার!

ছবি খোঁটা দিয়ে কথা না বলতে পারলে আরাম পায় না। এতদিনে ছবি বুঝে গেছে, সত্যি অচল মাল নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। দুনিয়ার লোক মুখিয়ে আছে, লোকটাকে ঠকাবার জন্য। বাজারে, কাজের জায়গায়, বন্ধু-বান্ধব সবাই যেন জেনে ফেলেছে , তার কাছে এলে ফিরে যাবে না। সে ধার দিয়ে ঠকেছে, সে বিশ্বাস করে ঠকেছে, জমি কেনার সময় দালালি বাবদ অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে, বাড়ি করার সময় ঠিকাদার মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ ভাল রকমের টুপি পরিয়ে দিয়ে গেছে। দরজা সেগুনের দেবার কথা, দিয়েছে গাম্বার কাঠের। একটু বাতাস উঠলেই খড়খড় করে নড়ে ওঠে। কোনো দরজা বৃষ্টি হলে ফুলে ফেঁপে যায়, লাগাতে গেলে হাতি জুতে টানাটানি নাকি করতে হয়। সব অভিযোগই ছবির। রান্নাঘরের দেয়ালের দুটো টাইলস খসে পড়েছে। তা পড়বে না, যেমন মানুষ! কথায় যে চিঁড়ে ভেজে তাকে দেখে নাকি ছবি সেটা সত্যি টের পেয়েছে।

এবারে আর ভিজতে দেবে না।

কী দাদা দাঁড়িয়ে আছেন! এত সকালে।

দাঁড়িয়ে আছি তো তোর কীরে ব্যাটা! সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকব। আমার খুশি। সে এমন ভাবল।

কী পেলেন?

কাকে?

সেই লোকটাকে!

তুমি জান কী করে?

না যে-ভাবে ক’দিন থেকে রোজ দাঁড়িয়ে থাকছেন!

সে কী পাগল হয়ে যাচ্ছে! তাকে দেখেই কী টের পায়, একজন ঠগ জোচ্চোরকে সে খুঁজতে বের হয়েছে। চোখে মুখে কী তার কোনো আততায়ীর মুখ ভেসে উঠছে।

সে বলল, এমনি দাঁড়িয়ে আছি।

বাস স্টপে এসে এমনি সারা সকাল কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না! মাথায় কোনো গণ্ডগোল সত্যিই কী দেখা দিয়েছে! আমি দাঁড়িয়ে থাকি, খুশি! তোর কীরে শুয়োরের বাচ্চা! অবশ্য সে প্রকাশ করল না। মাথা তেতে আছে। সবার সঙ্গে সে দুর্ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। লোকটাকে সনাক্ত করতে না পারলে সে কী সত্যি পাগল হয়ে যাবে!

আবার দু’শ এগার।

না নেই।

তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

দুটো দরজায় যারা ঘন্টি বাজায় দেখে। তাদের কারো মুখ মেলে না।

এবারে ভাবল না, এ-ভাবে হবে না। সে উঠেই পড়ল। বাস স্ট্যাণ্ডে গিয়ে খোঁজ করল। নেই। সে আবার একটা বাসে উঠে পড়ল। কিছু দূরে গিয়ে নেমে পড়ল। না নেই।

আসলে সে যেন সবার মুখেই সেই একজনের মুখ দেখতে পায়। কে যে আসল ধুরন্ধর তা টের পায় না। ধরতে পারলেই মুখে ঘুঁসি মেরে বলত, নে শুয়োরের বাচ্চা, তোর টাকা রাখ। আমার টাকা ফেরত দে।

একদিন এ-ভাবে সারাদিন এই করে সে যখন বুঝল, আসল আততায়ীকে ধরা যাবে না, যায় না, তখন একটা গাছের নিচে এসে বসে পড়ল। পার্স থেকে নোটটা বের করে দেখল! হাজার অপমানের কথা মনে পড়তে থাকল। টাকাটা আবার দেখল। উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে কী ভাবল কে জানে, সে নোটটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। সঠিক আততায়ীকে খুঁজে বের করা জীবনে কঠিন। বাতাসে নোটের কুচি উড়ে যেতেই সে একেবারে হাল্কা হয়ে গেল! কী আরাম। বাড়ি ফিরে সে আবার অনেকদিন পর ঘুমাল। সকালে উঠে দেখল, গাছপালা পাখি, ঘরবাড়ি মানুষজন সব আবার তার কাছে সুন্দর হয়ে গেছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments