Sunday, September 14, 2025
Homeরম্য গল্পমেয়ে-চাকরে - লীলা মজুমদার

মেয়ে-চাকরে – লীলা মজুমদার

চাকরেদের কথা বলি। বিশেষ করে মেয়ে-চাকরেদের। রোজ চার-পাঁচটা ট্রামগাড়ির আধখানা বোঝাই করে যাওয়া-আসা করে। অনেক দূর থেকে একটা গুনগুন শব্দ শোনা যায়, যেমন কোনও পুরুষ-ভরা গাড়ি থেকে যায় না। বড্ড ভাল লাগে। পুরুষদের গানের গলা ভাল হতে পারে, কিন্তু ভিড়ের গলা!!— সে যাক গে। বছর কুড়ি আগে, আমিও সাত বছরের জন্য মেয়ে-চাকরে ছিলাম। তখন অবিশ্যি গুঞ্জনমুখরিত মেয়ে-গাড়ি ছিল না, সাধারণ গাড়িতে গোটা চারেক মেয়েদের সিট থাকত। সেখান থেকে বড় জোর পুরুষকণ্ঠের খ্যাঁকখ্যাঁক শব্দ কানে আসত।

মেয়ে-চাকরেদের হালচাল রপ্ত হতে আমার পুরো সাতটা বছরই লেগেছিল। তারপরেই কাজে ইস্তফা দিয়েছিলাম; কিন্তু সেই ইস্তক আমার মনে মেয়ে-চাকরেদের জন্য একটা নরম গরম জায়গা আছে। ভারী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফিটফাট চেহারা, তাদের সঙ্গে বড় বড় ব্যাগ থাকে, তাতে ঘামের গন্ধ দূর করবার সুগন্ধী জিনিস থাকে। ওদের পাশে পুরুষদের দেখলে মনে হয় প্রজাপতির পাশে গুবরে-পোকা। সত্যি কথাই বলব, তাতে কেউ রাগ করলে কী আর করা! ঢের বেশি যত্ন নিয়ে কাজ করত মেয়েরা, ওপরওয়ালারা খুব খুশি হতেন। পুরুষ সহকর্মীরা হিংসে করে বলত, ‘মেয়েদের বুদ্ধি কম কিনা, না খাটলে ওদের চলবে কেন! আমরা কেমন ম্যানেজ করে নিই দেখেননি?’

তখন ম্যানেজ কথাটার নতুন মানে শিখলাম। ম্যানেজ মানে হল কাজ না করে ধরা না পড়া। ওদের সরল বিশ্বাস দেখে মায়া হত। যে কোনও বিবাহিত মেয়েই সারা জীবন ধরে যেসব জিনিস কাছে নেই, থাকবার নয়, তাদের বাদ দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়। কোনও বাড়িতে এমন পুরুষ দেখলাম না যে তাদের ধরবার সাধ্যি রাখে। ডিম বাদ দিলে যা কখনওই হবার নয়, মেয়েরা হামেশাই ডিম বাদ দিয়ে তাই করে নেয়—একথা পুরুষ ছাড়া সবাই মানে। আবার বলে কিনা মেয়েদের বুদ্ধি কম। সত্যি কথা বলতে কী, এই যে পুরুষানুক্রমে মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার প্রবাদ চলে আসছে, এতে মেয়েদের কম সুবিধে হচ্ছে না। তা ছাড়া বেজায় বুদ্ধি না থাকলে মান্ধাতার আমল থেকে কেউ বোকা সেজে থাকতে পারত না। যাকগে, এখন চাকরে মেয়েদের কথাই হোক।

আপিসে দেখেছিলাম ভাল কাজ করত বলে মেয়েদের নাম হত, উন্নতি হত। তার ফলে তাদের আত্মসম্মান বাড়ত। বাড়ত মানে বেজায় বেড়ে যেত। সে এক ব্যাপার। চিরকাল যে জাত একা হাতে হেঁসেল ঠেলে এসেছে, আপিসে তারা নিজের হাতে পাখার সুইচ টিপত না, বন্ধ করত না; কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেত না। টেবিলে রাখা একটা ঘণ্টি টিপত। বাইরে ছ্যাং-ছ্যাং করে ঘণ্টি বাজত, অমনি দেখতাম অনিমেষ বলে একজন রোগা ছোকরা ছুটে এসে পাখা চালানো, বন্ধ করা, জল গড়ানো সারত। অনিমেষ আমাদের ঘরের পিওন। ওসব হল পিওনদের কাজ, কর্মচারিণীদের নয়। সব বেয়ারাই কিন্তু পিওন নয়। ফরাশ বলে আরেক রকম বেয়ারা ছিল। টেবিলের ওপর জলের গেলাস কিংবা কালির শিশি উলটে গেলে তাদের ডাকা হত। খুব তাড়াতাড়ি ডাকতে হত। অনেক সময় উঠে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে হত। নইলে জল-কালি চুঁইয়ে, টেবিলের টানায় ঢুকে, নামসই তারিখ ইত্যাদি মূল্যবান কীর্তি ধেবড়ে দিয়ে অভাবনীয় ক্ষতি করত। আমি অবিশ্যি সে-রকম হলে সেগুলো নিজেই আবার মন থেকে কী আন্দাজে লিখেটিখে রাখতাম।

একদিন একজনের টেবিল থেকে কাচের কাগজ-চাপা সরে যাওয়ায় খুব জরুরি কাগজপত্র পাখার হাওয়ায় ছোটখাটো একটা ঘূর্ণি তুলে, ঘরময় চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। বোঝা গেল যে কোনও সময়ে তারা আকিয়াব যাত্রা করবে।

কর্মচারিণীরা ঘণ্টি বাজালেন, অনিমেষকে হাঁকডাক করলেন। দুঃখের বিষয় অনিমেষ অনুপস্থিত এবং জরুরি কাগজ সামলানো ফরাশের কাজ নয়, কাজেই তারা চুপ করে বসে রইল। শেষটা আর টিকতে না পেরে, আমিই উঠে কাগজগুলো কুড়িয়ে আবার চাপা দিয়ে রাখলাম।

কর্মচারিণীরা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন, ‘ও কী করছেন দিদি, ও তো পিওনের কাজ।’ আমি বললাম, ‘শুধু কি এই? আমাদের বাড়ির গোছলখানার নালা বন্ধ হলে, অনেক সময় তা-ও সাফ করি!’

বলতে বলতে আরেকটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। নিউ মার্কেটের সামনে একটা ব্যাংক ছিল। সেখানে দেখি একজন মহিলা কর্মচারী। সে এক সময় আমাদের কলেজে পড়ত। মনে হল খুব দক্ষ কর্মচারী, ভাল মাইনে-টাইনে পায়। আমার চেয়ে অনেক ভাল কাপড়চোপড় পরা। একদিন সে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, তোমাদের রান্নার লোকের অসুখ করলে তুমি কী কর?’

আমি বললাম, ‘অন্য চাকরদের দিয়ে রাঁধাবার চেষ্টা করি।’

কর্মচারিণী বলল, ‘আর তারা যদি রাজি না হয়, বা না থাকে?’

‘তা হলে নিজে রাঁধি, আবার কী করব? তুমি কী করো?’ সে বলল, ‘মায়ের বাড়িতে খেতে যাই। আমার স্বামী তাই নিয়ে অশান্তি করেন। ভারী ইয়ে। শেষটা বাঁদির মতো হেঁসেল ঠেলি আর কী!’

বাঁদি বলতে মনে হল একজন পুরুষ অফিসার টাকার লোভে বড়লোকের কালো মুখ্যু মেয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর তাকে পছন্দ হয় না। আরেকটা বিয়ে করল। সেকালে তাতে কোনও দোষ হত না। এদিকে বড়লোক শ্বশুরটি তাঁর কালো মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে, বিলেত পাঠিয়ে, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে পাশ করিয়ে এনে, ভাল চাকরি পাইয়ে দিলেন। দিনে দিনে তার উন্নতি হতে লাগল। খুব ভাল কাজ করত। কয়েক বছর পরে সে বড় সায়েব হয়ে গেল। তারপর দিল্লির হেড অফিসে গিয়ে দেখে, তার সেই স্বামীটি সেই অফিসের একজন খুব ছোট সায়েব হয়ে বিরাজ করছেন।

তখন বড় সায়েব তাকে শক্ত শক্ত কাজ আর কড়া কড়া নোট দিতে লাগলেন। এবং শেষ পর্যন্ত তাকে জম্মু না কোথাকার যেন খুব অসুবিধার কোনও জায়গায় বদলি করিয়ে, নারীজাতির সম্মান বজায় রাখলেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments