Monday, August 25, 2025
Homeকিশোর গল্পসাকিবের সাইকেল - সুমন্ত আসলাম

সাকিবের সাইকেল – সুমন্ত আসলাম

সাকিবের সাইকেল – সুমন্ত আসলাম

লম্বা আর কালো ছায়াটা প্রথম দেখল ফাহাদ। হাত টেনে ধরল ও আমার। একটু কাছ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখতে পেয়েছিস জিনিসটা?’

ছায়াটা আমি দেখেছি এবং ওটা যে কোনো মানুষের ছায়া না, বুঝতে পেরেছি এটাও। কিন্তু কোনোভাবেই এটা বুঝতে দেওয়া যাবে না ওকে। ক্লাস সিক্সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভিতুর ডিম হচ্ছে ওই ফাহাদ। স্কুলের বাথরুমে একদিন একটা গিরগিটি দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল ও মেঝেতে, জ্ঞান ফিরতে অনেকক্ষণ।

রাত ১টা বেজে ৪০ মিনিট এখন। আমরা চারজন একটা মিশন নিয়ে বের হয়েছি আজ। রাশা আর পাভেল কিছু দূর এগিয়ে গেছে, সামনে। ওদের হাতে একটা সাইকেল। দুজন ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে ওটা। ছায়াটা সম্ভবত চোখে পড়েনি ওদের। পড়লে থমকে দাঁড়াত ওরা।

ফাহাদ এখনো হাত ধরে আছে আমার। আস্তে আস্তে খামচির রূপ নিচ্ছে ওর হাত ধরাটা। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ছাড় তো!’

‘আমার ভয় করছে তো!’ কান্নার মতো শোনাল ফাহাদের গলাটা।

‘কিসের ভয়?’

‘ওই যে একটু আগে—।’ কথা শেষ করল না ফাহাদ।

‘এ রকম লম্বা ছায়া কাদের হয়, জানিস?’

মাথা এদিক ওদিক করল ফাহাদ। আমি ওর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘না, আপাতত এসব শোনার দরকার নেই। শুনে আরও ভয় পাবি তুই।’

পায়ের কাছে হঠাৎ কিচকিচ করে উঠল আমাদের। কিছুটা শূন্যে লাফ দিল ফাহাদ। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে। আমার বুকের সঙ্গে বুক চেপে কাঁপতে লাগল বেচারা। থুতনিটা ঠেকিয়ে দিয়েছে আমার কাঁধে। আমি ওর পিঠে একটা হাত রেখে বললাম, ‘পেছনে তাকাবি না!’

‘কেন!’ গলাও কাঁপছে ফাহাদের।

‘লম্বা ছায়াটা দেখা যাচ্ছে আবার। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সম্ভবত।’

‘বলিস কী!’ ফাহাদ আরও জাপটে ধরল আমাকে।

পিঠের হাতটায় আরও একটু চাপ দিলাম আমি। মুখটা একটু ঘুরিয়ে ফাহাদের কানের কাছে আনলাম। ফিসফিস করে বললাম, ‘আমেরিকা থেকে তোর ছোট মামা একটা ভিডিও গেম পাঠিয়েছে না তোর জন্য?’

‘ওটা তোকে এক দিনের জন্য—।’ ফাহাদ দ্রুত গলার স্বর পাল্টিয়ে বলল, ‘না না, এক দিনের জন্য না, তিন দিনের জন্য খেলতে দেব তোকে।’

‘পরশু তোর স্কুল ব্যাগে লম্বা লম্বা কতগুলো চকলেট দেখেছি। চুপি চুপি একা একা খেয়েছিসও।’

‘আমার কাছে আরও দুটো আছে।’ প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢোকাল ফাহাদ। চকলেট দুটো বের করে বলল, ‘এই নে।’

দুটো চকলেটই খুলে মুখে পুরলাম আমি। জিব আর মুখটা ভরে গেল রসে। চুস করে একটা টান দিলাম গলার ভেতর। স্বাদ আর আরামে চোখ বুজে আসছে আমার। এ রকম মজার চকলেট খাইনি কখনো।

‘খবরদার—।’ ফাহাদকে আরও একটু চেপে ধরি আমি। গলা নিচু করে বলি, ‘একদম নড়বি না। ছায়াটা একেবারে কাছে এসে গেছে। ওই তো মোটা গাছটার আড়ালে এসে থামল।’

‘চল, দৌড়ে পালাই।’

‘দৌড়ে পারব ওই ছায়ার সঙ্গে!’

‘তাহলে কী করব?’ এবার সত্যি সত্যি যেন কেঁদে ফেলবে ফাহাদ।

‘তোর কাছে সম্ভবত আরও দুটো চকলেট আছে।’

‘তুই কী করে জানলি?’

‘আছে কি না তাই বল?’

‘আছে।’ বিড়ালের মতো মিউমিউ করে বলল ফাহাদ।

‘ও দুটোও দে।’ গলাটা রহস্যময় করে আমি বলি, ‘ছায়াটা যদি সত্যি সত্যি কাছে আসে আমাদের, কিছু করার আগেই চকলেট দুটো দিয়ে দেব তাকে। দেখি, চকলেটের লোভে ছেড়ে দেয় কি না আমাদের।’

কিছুটা কষ্ট নিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল আবার ফাহাদ। চকলেট দুটো বের করে হাতে দিল আমার। আমি টুক করে পকেটে ঢুকিয়ে বললাম, ‘ছায়াটা একবারে কাছে এসে গেছে!’

সামনে তাকিয়ে দেখি, সত্যি সত্যি ছায়াটা কাছে এসে গেছে আমাদের। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে। ঠিক তখনই রাশা কিছুটা শব্দ করে বলল, ‘মাসুক, কোথায় তুই?’

রাশার শব্দেই কি না, ছায়াটা দ্রুত সরে গেল অন্যদিকে। কী রকম একটা শব্দও হলো। এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম! ফাহাদ আমাকে জাপটে ধরে আছে, আমিও জাপটে ধরলাম ওকে।

বুকের ভেতর ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল দ্রুত।

মূল রাস্তা থেকে একটা মাটির রাস্তা নেমে গেছে ডান দিকে। এই রাস্তাটা পেরিয়ে বাঁয়ে মোড়, সেখান থেকে আরও একটু সামনেই সাকিবদের বাসা।

কিছু দূর এগিয়েও গেলাম আমরা। চারপাশে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধে৵ কী একটা পোকা ডেকে উঠছে চিকচিক করে। ফাহাদ এখনো আমার হাত ধরে আছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করছি, পারছি না। এরই মধে৵ একবার বলে ফেলেছে, ‘চকলেট দুটো তো দেওয়া হয়নি ওই ছায়াকে—।’ কথাটা শেষ করতে দিইনি ওকে। কিছুটা রাগী গলায় উত্তর দিয়েছি, ‘যদি আবার ছায়াটা আসে, তখন কিন্তু তুই ওকে সামলাবি। আমাকে যেন জড়িয়ে ধরিস না আর।’

‘আচ্ছা, চকলেট দুটো তোর কাছেই থাক।’ বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে বলল আবার ফাহাদ।

রাশা আর পাভেল যথারীতি সামনে সামনে যাচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘সাইকেলটা এবার আমাদের হতে দে। তোরা তো অনেকক্ষণ বয়ে আনলি। আমি আর ফাহাদ নিয়ে যাই কিছুক্ষণ।’

‘আমরা পারছি তো। কষ্ট হচ্ছে না তেমন।’ রাশা বলল।

পাভেলের কাছ থেকে জোর করে সাইকেলটা হাতে নিই আমি, পেছনের পাশটা ধরতে বলি ফাহাদকে।

দুই হাত এক করে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে রাশা বলল, ‘সাইকেলটা মাটিতে নামানো যাবে না কিন্তু! আর দেখিস, পড়ে গিয়ে আবার ব্যথাট্যাথা পাস না যেন, যে এবড়োখেবড়ো রাস্তা!’

সাইকেলটা বেশ ভারী। অথচ এতক্ষণ বয়ে এনেছে রাশা আর পাভেল। ওদের অবশ্যই কষ্ট হয়েছে, কিন্তু কিছুই বলেনি এতক্ষণ। রাশা এ রকমই—সবার কষ্ট একা নিতে চায়, সবার উপকারে প্রথম এগিয়ে যায়। আমরা মাঝেমধে৵ খাবার কিনে এনে একসঙ্গে খাই। সবাইকে খাবার দেওয়ার পর, ও সবচেয়ে পরে নেয়। কোনো কোনো দিন ওর ভাগে কোনো খাবার থাকে না। কিন্তু মুখটা ঠিকই হাসি হাসি করে রাখে ও। আমাদের ভীষণ আপত্তি আর সাধাসাধিতে সবার কাছ থেকে এক টুকরো করে মুখে দেয় ও সবশেষে।

স্কুলের সব স্যারও রাশা বলতে পাগল। পিকনিক, স্পোর্টস, স্কুল ম্যাগাজিন, শিক্ষাভ্রমণ, যা-ই হোক না কেন, সবার আগে রাশা। ওর মধ্যে কী যেন একটা আছে, সবাই পছন্দ করে ওকে, ওর কথা শোনে। আবার এটাও তো ঠিক, ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি, সবার চেয়ে ও অনেক কিছু দ্রুত বোঝে। আমরা যেটা কল্পনা করতে পারি না, ভাবতে পারি না, ও সেটা ঝট করে শুরু করে ফেলে অবলীলায়।

রাশা এখনো আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে, পাশে পাভেলও। ওর এই সামনে সামনে হেঁটে যাওয়ার কারণটা আমি জানি। যদি কোনো বিপদ বা সমস্যা আসে সামনে থেকে, তাহলে ওকে দিয়েই যেন শুরু হয়, ও যেন প্রথম মোকাবিলা করতে পারে বুদ্ধি আর শক্তি দিয়ে।

হাত উঁচু করল রাশা। থেমে গেল পাভেল, থামলাম আমরাও।

বাঁ পাশের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে রাশা। ওর দেখাদেখি আমরাও তাকালাম। চাঁদ আছে আকাশে, তবে আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ওই মিটমিটে আলোতেই আমরা দেখতে পেলাম কে যেন দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মাঝখানে, সটান হয়ে।

ফাহাদ এক হাতে সাইকেল ধরে আছে, আরেক হাতে চেপে ধরল আমার হাত। পাভেল শঙ্কিত গলায় বলল, ‘এত রাতে এমন ফাঁকা জায়গায় আবার কে দাঁড়িয়ে আছে! দেখতে তো মানুষের মতো মনে হচ্ছে।’

‘ওটা কি মানুষ?’ কাঁপা কাঁপা গলা ফাহাদের।

রাশা পাশ ফিরল, ফাহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর দু পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘দেখতে তো মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু—।’

কথা শেষ করল না রাশা। ফাহাদ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কিন্তু কী? কথা শেষ করো না!’

‘দাঁড়া, ভালো করে দেখে নিই।’

রাস্তার কিনারা থেকে একটি ইটের টুকরো হাতে নিল পাভেল। রাশা হাত চেপে ধরল পাভেলের, ‘ঢিল মারবি না। আগে বুঝতে দে ব্যাপারটা।’

‘একটা ঢিল মারলে কী হয়!’ উৎকণ্ঠা নিয়ে ফাহাদ বলল।

‘কে না কে দাঁড়িয়ে আছেন, হঠাৎ ঢিল মারা কি ঠিক হবে?’ রাশা আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ঢিলটা মানুষটার গায়ে লাগলে ব্যথা পাবেন, কেটেও যেতে পারে শরীরের যেকোনো জায়গায়।’

‘একটা মানুষ তো এতক্ষণ এভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না।’ রাশার পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমি, ‘সম্ভবত ওটা মানুষ না, অন্য কিছু।’

‘অন্য কিছুটা কী?’ ফাহাদ আগের চেয়ে অস্থির হয়ে গেল।

রাশা হাত বাড়াল পাভেলের দিকে, ‘ইটের টুকরোটা আমার হাতে দে। দেখি, ওটা আসলে কী?’

পাভেল ইটের টুকরোটা রাশার হাতে দিল। আমাদের স্কুলের ক্রিকেট টিমের তিনজন সেরা বোলারের মধ্যে রাশা একজন, কিন্তু ব্যাট করতে পারে না তেমন। ইটের টুকরোটা ছুড়ে দিল ও ওই মানুষটার দিকে। পাশ দিয়ে চলে গেল ইটটা, লাগল না। রাস্তা থেকে আরও একটা ইটের টুকরো নিল রাশা। ঢিল ছুড়ল আগের মতোই, এবারও লাগল না, তবে মানুষটার খুব কাছে গিয়ে পড়ল, শব্দও হলো বেশ। কিন্তু মানুষটা আগের মতোই স্থির। এত বড় একটা ইটের টুকরো পড়ল পায়ের কাছে, শব্দও হলো অনেক, মানুষটার কোনো চমকে ওঠা নেই।

নিচু হয়ে আরেকটা ইটের টুকরো খুঁজতে লাগল রাশা। এমন সময় মেঘের আড়াল থেকে পুরো চাঁদটা বের হয়ে এলো। ঝকঝক করতে লাগল চারপাশ। পাভেল শব্দ করে বলল, ‘আরে, ওটা তো মানুষ না!’

সোজা হয়ে দাঁড়াল রাশা। সামনের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘কাকতাড়ুয়া! কিন্তু হুবহু মানুষের মতো দেখাচ্ছে!’

‘আমি আগে থেকেই চিনতে পেরেছিলাম ওটা একটা কাকতাড়ুয়া।’ ফাহাদের গলায়ও আনন্দ।

‘তুই আগেই চিনতে পেরেছিলি ওটাকে?’ ফাহাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলি আমি।

ঘন ঘন মাথা উঁচু–নিচু করতে থাকে ফাহাদ, গদগদ দেখায় ওকে।

ফাহাদের দিকে তাকালাম আমরা তিনজন, ফাহাদ আমাদের দিকে। পাভেল কিছু একটা করতে যাচ্ছিল ওর মাথায়। কিন্তু সাইকেল ধরে আছে বলে ফিরিয়ে নিল হাতটা। পেছনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে উঠল, ‘কই, ওটা তো আর দেখা যাচ্ছে না ওখানে!’

ঝট করে আমরাও তাকালাম পেছনে। এতক্ষণ যেখানে মানুষের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল, সেখানটা এখন ফাঁকা। কেউ নেই—না কাকতাড়ুয়া, না কোনো মানুষ।

‘কোথায় গেল ওটা?’ পাল্টে গেল ফাহাদের গলা, কান্নার মতো শোনাচ্ছে এখন আবার।

‘সম্ভবত তোর কাছে আসছে।’ আমি উত্তর দিলাম।

‘আমার কাছে আসবে কেন!’

‘তুই যেহেতু আগেই চিনতে পেরেছিলি ওই জিনিসটা, তাই ধন্যবাদ দিতে আসছে তোকে।’

ফাহাদ কিছু বলল না, চিঁচিঁ করতে লাগল ছুঁচোর মতো। রাশা আবার ঘুরে তাকাল আমাদের দিকে। পাভেলের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘ব্যাপারটা অন্য রকম মনে হচ্ছে আমার।’

‘ওটা মানুষই ছিল।’ পাভেল বলল।

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে, ওটা মানুষই ছিল।’ রাশা পেছনের দিকে তাকাল আবার, খেয়াল করতে লাগল চারপাশ।

‘কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ওটা মানুষ না।’ কথাটা বলে হাতের সাইকেলটা মাটিতে রাখল ফাহাদ। হাত লেগে গেছে সম্ভবত ওর। যদিও সাইকেলটা মাটিতে রাখতে নিষেধ করেছিল রাশা।

‘মানুষ না হলে ওটা কী?’ রাশা জিজ্ঞেস করল।

‘কিছুক্ষণ আগে লম্বা একটা ছায়া দেখলাম, একটু আগে আবার কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সামনের মাঠে। আবার দেখি নাই।’ ফাহাদ বিমর্ষ হয়ে বলল, ‘এসব তো কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না।’

রাশা মুখোমুখি দাঁড়াল ফাহাদের। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘মানুষ যা করতে পারে, তা অন্য কেউ করতে পারে না। না বাঘ, না সিংহ, না কোনো অজগর।’

সনতুদের পুকুরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম আমরা। দুজন মানুষকে দেখা গেল, পুকুরে নেমে কী যেন করছে তারা। রাশা হাত উঁচু করে হাঁটা থামিয়ে দিল আমাদের। পুকুরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মাঝরাতে মানুষ দুজন কী করছে পুকুরে?’

‘সম্ভবত গোসল করছে।’ ফাহাদ দ্রুত বলতে লাগল, ‘সারা দিন কাজকর্ম করে শরীর পরিষ্কার করছে সম্ভবত।’

‘আমার তা মনে হচ্ছে না।’ সামনের দিকে আরও একটু এগিয়ে গেল রাশা, ‘আমরা বরং মানুষ দুটোর কাছাকাছি গিয়ে দেখি।’

‘কাছে যাওয়ার দরকার কী?’ প্রচণ্ড আপত্তি জানাল ফাহাদ।

‘আমাদের জানতে হবে মানুষ দুজন কে, কী করছেন ওখানে, তা–ও এই মাঝরাতে!’ রাশা ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে, ‘কোনোরকম শব্দ না করে আমরা মানুষ দুজনের কাছে গিয়ে পৌঁছাব। দুজন করে দুপাশ দিয়ে যাব।’

‘এসব ঝামেলা করে লাভ কী? লোক দুজনের মনে হয়েছে পুকুরের ঝাঁপাঝাঁপি করবে, করুক। আমাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’ ফাহাদ ফোস ফোস করে বলল, ‘আমরা যে জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি, সেই কাজটা শেষ করি আগে।’

‘এত রাতে দুজন মানুষ পুকুরে নিজেরা ইচ্ছে করে নেমেছে, না কেউ তাদের নামিয়ে দিয়েছে, সেটা জানতে হবে আমাদের।’

‘এত রাতে কে পুকুরে নামাবে তাদের!’

‘মেছো ভূত।’

‘মেছো ভূত মানে?’

‘মেছো ভূত মানে যেসব ভূত মাছ খায়।’ রাশা গলাটা রহস্য করে বলল, ‘তোরা তো জানিস ভূতরা একা একা কিছু করতে পারে না। তারা কিছু করতে চাইলে মানুষের রূপ নেয় প্রথমে, তারপর যা করতে চায়, তা করে ফেলে। ওই যে রনটুর মাকে একবার ঘর থেকে বের করে মাঠে নিয়ে গিয়েছিল না ভূতরা! রাতে ঘুমিয়েছিলেন রনটুর মা। ওর বাবা ওর এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন, ফেরেননি সেদিন। রাতে ঠকঠক শব্দ হয় দরজায়। রনটুর মা বলেন, কে? রনটুর বাবার মতো গলা করে কেউ একজন বলেন, আমি। রনটুর বাবা মনে করে দরজা খুলে দেন রনটুর মা। বাইরে বের হয়ে দেখেন, সত্যি সত্যি রনটুর বাবা দাঁড়িয়ে। রনটুর মাকে বলেন, সামনের মাঠে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, চলো তো দেখি। রনটুর বাবার পেছন পেছন মাঠে যান রনটুর মা। কিন্তু মাঠে গিয়েই দেখেন, কেউ দাঁড়িয়ে নেই সেখানে, রনটুর বাবাও নেই। চিৎকার করে ওঠেন তিনি। আশপাশের বাড়ির লোকজন দৌড়ে এসে দেখেন, জ্ঞান হারিয়ে মাঠের ভেতর পড়ে আছেন রনটুর মা।’

‘যদি ওই দুজন সত্যি সত্যি ভূত হয়?’

‘তাহলেই তো মজা।’ রাশা হাসতে হাসতে বলল, ‘কখনো একেবারে সামনাসামনি ভূত দেখেছিস তুই?’

‘না।’

‘আমিও দেখিনি। পাভেল দেখেনি, মাসুক দেখেনি। আজ আমরা একসঙ্গে ভূত দেখব। তারা দুজন, আমরা চারজন। ভয় পেলে তারা পাবে, আমরা পাব না। কাছে গিয়ে প্রথমেই বলব, পুকুর থেকে উঠে আসেন। পাড়ে বসে গল্প করি।’

‘যদি আক্রমণ করে বসে?’

‘দুই ভূত আমাদের দুজনকে আক্রমণ করবে। বাকি দুজন কি তখন বসে থাকব? পেছন থেকে গলা চেপে ধরব ভূতের।’

ফাহাদ আলতো করে ঢোঁক গিলল। পাভেল ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের কেউ কখনো ভূত দেখেনি, মারামারি করা তো দূরের কথা। আমরা আজ ভূতও দেখব, মারামারিও করব। এটা একটা অপূর্ব সুযোগ! চল চল।’

পুকুরের এক পাশ দিয়ে রাশা আর পাভেল, আরেক পাশ দিয়ে আমি আর ফাহাদ যেতে লাগলাম। ফাহাদ হাত চেপে ধরল আমার। যথারীতি ও কাঁপছে। আমি ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘ভূত কারা হয় জানিস? মৃত যারা, তারা ভূত হয়। এবার বল তো, মৃত মানুষ শক্তিশালী, না জীবিত মানুষ?

চিঁচিঁ করে কিছু একটা বলল ফাহাদ, বোঝা গেল ওর কথাটা। পুকুরপাড়ের জঙ্গলের পাশ দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছি আমরা। ‘গোওওত’ করে কী যেন ডেকে উঠল ডান পাশের বড় গাছটায়। ফাহাদ কিছু বলার আগেই বললাম, ‘কে ডাকল, জানিস?’

‘ক্কে?’

‘সাধারণত যে গাছে ভূত থাকে, তার পাশ দিয়ে কেউ গেলে ওভাবে ডেকে ওঠে ওরা।’

ফাহাদ হঠাৎ ওর পেট চেপে ধরে বলল, ‘আমার না প্রচণ্ড হিসু পেয়েছে।’

‘এখানে হিসু করা যাবে না! ভূতদের থাকার আশপাশে হিসু করলে ভীষণ রাগ করে ওরা।’

পেট চেপে ধরেই হাঁটতে লাগল ফাহাদ। পুকুরের পশ্চিম পাশে এসে থমকে গেলাম আমরা। আমাদের বয়সী দুটো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে হাত জোড় করে, ওদের সামনে রাশা আর পাভেল। আমাদের দেখে রাশা এগিয়ে এসে বলল, ‘চিনতে পেরেছিস এদের?’

দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। বেশ অন্ধকার। চোখ মেলে তাকালাম ওদের মুখের দিকে। চিনতে পারলাম সঙ্গে সঙ্গে—মিজান আর সবুজ। চাচাতো ভাই ওরা। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে আমাদের স্কুলে। সিক্সে আমরা নতুন ক্লাসে ভর্তি হলাম সবাই, ওরা হয়নি।

পুরো শরীর ভেজা ওদের। আমি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখি ওদের। অবাক হয়ে বলি, ‘মিজান আর সবুজ! তোরা এখানে! এত রাতে এই পুকুরে!’

মাথা নিচু করে ফেলল মিজান। মাথা নিচু করে ফেলল সবুজও। আমি ওদের কাঁধটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘কিরে, কথা বল।’

‘আমরা মাছ চুরি করতে এসেছি।’ সবুজ বলল। মাথা নিচু করেই আছে ও।

‘মাছ চুরি করতে এসেছিস! এই পুকুরটা তো তোদেরই!’

‘ছিল, এখন নেই। আমাদের অবস্থা ভালো না। এলাকার কাউন্সিলর জোর করে পুকুরটা কিনে নিয়েছেন বাবা আর কাকার কাছ থেকে। এই পুকুরের মাছ বিক্রি করে কোনো রকম সংসার চলত আমাদের। পুকুরটা হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই আমরা আরও গরিব হয়ে যাই। স্কুলেও যাওয়া বন্ধ হয় আমাদের। এখানে–ওখানে কাজ করে টাকা রোজগার করতে হয়। করোনার পর কাজ তেমন পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে না খেয়ে থাকতে হয় তখন। তাই এই রাতে…।’ কথা শেষ করে না সবুজ। মাথা আরও নিচু করে ফেলে ও।

রাশা পাশে এসে দাঁড়ায় ওদের। আমি জানি, রাশা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারবে না এখন। চোখ ছল ছল করে উঠবে ওর। নাক টানতে থাকবে শব্দ করে। মানুষ যে এত নরম হয়! এত আবেগ ধরে রাখে বুকে! মাঝেমধ্যে উল্টোটাও দেখা যায় ওর মধ্যে। কোনো খারাপ কাজ বা অন্যায় দেখলে রেগে আগুন হয়ে যায়। ক্লাস নাইনের এক ভাইয়া ক্লাস সেভেনের এক ভাইয়াকে কী কারণে মেরেছিল একদিন। রাশা ওই ভাইয়ার সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলেছিল, আপনি বড় হয়ে কেন হাত তুললেন ছোট একজন মানুষের গায়ে? রাশার চিৎকার শুনে হেডস্যারসহ বেশ কয়েকজন স্যার দৌড়ে এসেছিলেন লাইব্রেরির বারান্দায়।

রাশা বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর মিজান আর সবুজকে বলল, ‘মাছ ধরতে পেরেছিস তোরা?’

মাথা উঁচু-নিচু করল সবুজ।

‘কয়টা ধরেছিস?’

‘পাঁচটা।’

‘কী মাছ?’

‘পাঙাশ আর কাতলা।’

‘বড় বড়?’

‘মাঝারি।’

মিজান আর সবুজের দুটো হাত রাশা নিজের দুহাতে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘এরপর যখন আবার মাছ চুরি করতে আসবি, আমাদের জানাবি। আমরাও তোদের সঙ্গে মাছ ধরব। তারপর সব মাছ নিয়ে বাড়িতে যাবি তোরা।’

দ্রুত পেছনের দিক থেকে সামনে এল ফাহাদ। মিজান আর সবুজের গা ছুঁয়ে বলল, ‘এই পুকুরের সব মাছ মেরে শেষ করে ফেলব আমরা।’

‘আর একটা কথা—।’ পাভেল আর আমার দিকে তাকাল রাশা। তারপর মিজান আর সবুজের দিকে ফিরে বলল, ‘তিন-চার দিন পর স্কুলে যাবি তোরা। স্কুলে ভর্তি হবি তোরা। এতে যা করার আমরা করব।’

সবুজ আর মিজান মাথা নিচু করে ফেলল আবার। পরিবেশটা কেমন যেন হয়ে উঠল হঠাৎ। চারপাশ নীরব। নীরব হয়ে গেলাম আমরাও। কেবল বুকের ভেতরটা লাফাতে লাগল অন্য রকম এক কষ্টে।

সাকিবদের বাসার কাছাকাছি আসতেই কুকুর ডেকে উঠল একটা। কান্নার মতো শোনাল ওই ডাকটা। ফাহাদ আবার হাত চেপে ধরল আমার। এবার আরও ভীত গলায় বলল, ‘কুকুর কান্না করছে তো!’

‘আমি কী করব?’ রেগে যাই আমি।

‘রাতে কুকুর কান্না করে কেন, জানিস?’

‘জানি। শীতের দিনে কান্না করে ওদের কম্বল নাই বলে। গরমে কান্না করে এসি নাই বলে।’

‘তোকে বলেছে!’ রাগে গজগজ করতে থাকে ফাহাদ।

‘তাহলে কান্না করে কেন কুকুর?’ এবার আমি জিজ্ঞেস করি।

‘আমি জানি, কিন্তু বলব না।’ ফাহাদ আমার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল, ‘বলতে পারব না এখন। ভীষণ ভয় করছে আমার।’

‘থাক, বলার দরকার নেই। আবার হিসু আসতে পারে তোর। তবে ভয়ই যেহেতু করছে তোর, তাহলে তুইও কুকুরের মতো কান্না শুরু কর। ভূত কিংবা কেউ যদি আশপাশে থেকেই থাকে, মানুষ আর কুকুরের কান্না শুনে কনফিউজড হয়ে যাবে সে। একসময় ভয় পেয়ে নিজেই পালিয়ে যাবে সে।’

ফাহাদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল সে। কারণ, রাশা হাঁটা বন্ধ করেছে। বাঁ পাশে যে বড় বটগাছটা আছে, তাকিয়ে আছে সেদিকে। পাভেলও তাকাল ওদিকে। রাশাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছিস তুই?’

‘কিছু না।’ রাশা হাঁটতে লাগল আবার। আমার মনে হচ্ছে, রাশা নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখেছে, কিন্তু আমাদের বলছে না। বললে হয়তো ভয় পাব আমরা, তাই বলছে না।

ফাহাদ ফিসফিস করে বলল, ‘রাশা কী দেখেছে বল তো?’

‘দুটো বানর দেখেছে, তারা বিটিএসের গান গাচ্ছিল!’

‘বানর বিটিএসের গান জানবে কীভাবে!’

‘সেটা তো আমি জানি না। তবে বানর দুটোর সঙ্গে দেখা হলে হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করব, ভাইজান, বিটিএসের গান কোথায় শিখলেন?’

সাকিবদের বাড়ির কাছাকাছি এসে রাশা আবার হাঁটা বন্ধ করল। দেয়ালের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এতক্ষণ যা হয়েছে, সব ভুলে যাব আমরা। যে কাজটি করার জন্য আমরা এই মাঝরাতে বাসা থেকে বের হয়েছি, এখন সেই কাজটি করব। তবে খুব সাবধানে। একটু ভুল হলেই আমাদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যাবে কিন্তু!’

পুরো দেয়ালটা একপলক দেখে পাভেল বলল, ‘দেয়ালে উঠবে কে?’

‘আমাদের মধ্যে মাসুক সবচেয়ে দ্রুত ও চমৎকারভাবে গাছে উঠতে পারে। দেয়ালে ওই উঠুক।’ রাশা আমার দিকে তাকাল, ‘মাসুক, তোর কি কোনো আপত্তি আছে?’

রাশাকে কোনো জবাব দিলাম না আমি। ছোট্ট করে একটা লাফ দিলাম, দেয়ালের ওপরটা ধরে ফেললাম দুই হাতে। চাপ দিয়ে উঠে বসলাম সেটার ওপর। তারপর হাত বাড়ালাম নিচে।

রাশা হেসে উঠল আমাকে দেখে। সারা রাস্তায় ওকে একটুও হাসতে দেখিনি আমরা। হাসলে সব মানুষকেই সুন্দর দেখায়, রাশাকে আরও বেশি দেখায়।

সাইকেলটা উঁচু করে ধরল পাভেল, রাশাও হাত লাগাল সঙ্গে। হ্যান্ডেলটা ধরে আমি দেয়ালে তুলে ফেললাম একটানে। ফাহাদ শঙ্কিত গলায় বলল, ‘দেখিস, আবার ফেলে দিস না কিন্তু।’

রাগে গা জ্বলে গেল আমার। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘ফেলে যদি দিই-ই, তাহলে মাটিতে ফেলব না, তোর মাথায় ফেলব।’

‘ইশ্‌!’ বলেই নিজের মাথার ওপর দুহাত তুলে তালু দিয়ে চাপা দিল ফাহাদ, যেন আমি সত্যি সত্যি ওর মাথায় ফেলে দেব সাইকেলটা।

সাইকেলটা বেশ ভারী। এক হাত দিয়ে দেয়াল ধরে আছি, আরেক হাতে সাইকেল। কষ্ট হচ্ছে আমার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রাশা উঠে এল দেয়ালে, ওর দেখাদেখি পাভেলও। ফাহাদ আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘আমি একা একা নিচে কী করব?’

‘একটু পর শিয়াল আসবে, হুস হুস করে সেই শিয়াল তাড়াবি তুই।’ উত্তর দিলাম আমি ফাহাদকে।

ঝট করে পেছনে তাকাল ফাহাদ। ও বিশ্বাস করে ফেলেছে—সত্যি সত্যি শিয়াল আসবে। ভয়ে সে–ও উঠে এল দেয়ালে।

সাইকেলটা পাভেল আর রাশার হাতে দিয়ে সাকিবদের বাড়ির ভেতর নেমে এলাম আমি। হাত উঁচু করতেই সাইকেলটা নামিয়ে দিল ওরা আমার হাতে। আমি ওটা নিয়ে মাটিতে রাখতেই চমকে উঠলাম। সাকিবদের বড় ঘরের দরজাটা খুলে গেল। বারান্দার টিমটিমে আলোয় স্পষ্ট দেখলাম আমি। আতঙ্কে স্থির হয়ে গেলাম, আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, পাভেল আর রাশা নো নড়চড়, বসে আছে মূর্তির মতো। কেবল ফাহাদ টুপ করে নেমে গেল ওদিকে। হঠাৎ এমন রাগ হলো, মনে হলো দেয়ালের ওপাশে গিয়ে কান কামড়ে ধরি ফাহাদের, ছিঁড়ে ফেলি দাঁত দিয়ে। তারপর সবাই ওকে ডাকবে, কানকাটা ফাহাদ!

সাকিবের বাবা বের হলেন দরজা দিয়ে। বারান্দায় এসে সামনের দিকটা দেখে নিলেন একবার। ভাগ্যিস, আমরা যেখানে আছি, এদিকটা অন্ধকার।

ঘরের কোনায় সাকিবদের বাথরুম। সেখানে গেলেন সাকিবের বাবা, একটু পর বের হলেন। ঘরে ঢুকলেন আবার, বন্ধ করে দিলেন দরজা।

রাশা চাপা গলায় বলল, ‘যা, কাজটা করে ফেল।’

‘তাড়াহুড়ো করবি না। শব্দ হতে পারে তাতে।’ পাভেল আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘সাকিবের বাবাকে দেখলি তো, ঘুমিয়ে পড়েননি সম্ভবত এখনো।’

সাইকেলটা নিয়ে দুপা এগিয়েছি, হঠাৎ একটা ছুঁচো চেঁচিয়ে উঠল পায়ের নিচে। ছোট্ট করে একটা লাফ দিলাম আমি। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হতে যাচ্ছিল, কোনোরকমে ঠেকালাম তা। রাশা আর পাভেলের দিকে তাকালাম, বুড়ো আঙুল উঁচু করে থাম্বস আপ দেখাল ওরা আমাকে।

পা টিপে টিপে সাকিবদের কোনার ঘরটার কাছে গেলাম আমি। ওই ঘরে সাকিব ঘুমায়। সাইকেলটা ওই ঘরের বারান্দায় রেখে ফিরে আসছিলাম দ্রুত। হঠাৎ থেমে পেছনে তাকালাম। সাইকেলটা একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দেয়ালে। কেমন একটা মায়া হলো! একা রেখে যাচ্ছি সাইকেলটাকে!

দেয়ালের কাছে এসে উঠে পড়লাম আবার দেয়ালে। নেমে এলাম এপাশে।

রাশা আর পাভেলও নামল। জড়িয়ে ধরল ওরা আমাকে। আমি মন খারাপ করে বললাম, ‘তোরা কাঁদছিস?’

হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রাশা বলল, ‘কী যে শান্তি লাগছে! কী যে সুখী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে!’

স্কুল বন্ধ আজ আমাদের। ছুটির দিনে খুব সকালে আমরা চারজন সাইকেল নিয়ে বের হই। স্কুলের মাঠে ঘণ্টাখানেক চালিয়ে বাসায় ফিরি তারপর। আজও সাইকেল চালাচ্ছিলাম, আর স্কুলের গেটের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার। হঠাৎ সাকিবকে দেখতে পাই আমরা। সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে আসছে ও আমাদের দিকে। সাইকেল চালানো বন্ধ করলাম আমরা। ও কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘চার-পাঁচ মাস আগে অঙ্ক স্যার একটা কথা বলেছিলেন। মনে আছে তোদের?’

‘কোন কথাটা?’ রাশা জিজ্ঞেস করল।

‘ওই যে, স্যার বলেছিলেন না, মনপ্রাণ দিয়ে স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন নাকি পূরণ হয় একদিন, অল্পদিনেই পূরণ হয়।’

‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে কথাটা।’

‘আমার তো তিন মাসেই পূরণ হলো!’

‘তাই নাকি!’ চোখ বড় বড় করে ফেলেছে রাশা।

‘হ্যাঁঅ্যা…।’ সাইকেল থেকে নেমে সাকিব সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখমুখ চকচক করছে ওর, ‘আমার একটা স্বপ্ন ছিল। তিন-চার মাস আগে বলেওছিলাম তোদের।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কোনো একদিন ঘুম থেকে উঠে সকালে দেখবি, আমরা যে রকম সাইকেল চালাই, সে রকম একটা সাইকেল রাখা আছে তোদের ঘরের বারান্দায়।’ রাশা খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘এই স্বপ্নটা না?’

‘হ্যাঁ, এই স্বপ্নটা। তোদের সাইকেল দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। বাবাকে বলেছিলাম কথাটা। বাবা মন খারাপ করে বলেছিল, সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি, সাইকেল কিনে দেব কোথা থেকে! জানিস…।’ সাকিব মাথাটা নিচু করে ফেলল, ‘বাবার কথা শুনে সারা রাত কেঁদেছিলাম সেদিন।’

‘হ্যাঁ, এই কান্নার কথাটাও তুই বলেছিলি আমাদের।’ সাকিবের সাইকেলটা ছুঁয়ে পাভেল বলল, ‘তোর সাইকেলটা দেখতে কিন্তু হুবহু আমাদেরগুলোর মতো!’

‘আমি এটাও অবাক হয়েছি। স্বপ্নও পূরণ হলো, সাইকেলটাও পেলাম ঠিক তোদের মতো!’ সাকিব হাসতে থাকে শব্দ করে।

‘কিন্তু তোর সাইকেলে তো হর্ন নেই, কিন্তু আমাদের সাইকেলে আছে। হর্নটা যদিও আলাদাভাবে কিনতে হয়। আমরা চারজন তোকে একটা হর্ন গিফট করব।’ রাশা বলল।

‘হর্নের তো অনেক দাম!’ চোখ বড় করে ফেলল সাকিব।

‘কত আর দাম হবে? টিফিনের জন্য বাসা থেকে আমরা যে টাকা পাই প্রতিদিন, চার-পাঁচ দিন টিফিন না খেলেই হবে।’ সবার দিকে একপলক তাকিয়ে পাভেল বলল।

‘আমার জন্য টিফিন খাবি না তোরা চার-পাঁচ দিন!’ মনটা খারাপ করে ফেলল সাকিব।

‘চার-পাঁচ দিন কেন, আমরা তো গত তিন মাস এগারো দিন…।’ ফাহাদের মুখটা চেপে ধরে থামিয়ে দিল রাশা। কৃত্রিম রাগে বলল, ‘এই উল্লুক, তোর না গলায় ব্যথা! ডাক্তার না তোকে কথা বলতে মানা করেছেন। চল চল, সাইকেল চালানো শুরু করি আমরা আবার।’

সাইকেলে চড়ে বসি আমরা চারজন। কিন্তু তার আগেই সাইকেল চালানো শুরু করে দিল সাকিব। দুহাতে হ্যান্ডেল চেপে এমনভাবে চালাতে থাকে, যেন সাইকেল রেসে নেমেছে ও, যে করেই হোক, ফার্স্ট হতে হবে ওকে এই রেসে।

রাশার দিকে তাকাই আমি। চোখ দুটো আড়াল করতে অন্যদিকে তাকায় ও। আমাদের চারজনের কারোরই আর সাইকেল চালানো হয় না, আমরা কেবল সাকিবকে দেখি, স্বপ্নপূরণের আনন্দ নিয়ে সাইকেল চালানো দেখি ওর।

রাশার পাশে গিয়ে একটা হাত রাখি আমি ওর পিঠে, পাভেলও রাখে, ফাহাদও। হঠাৎ পেছন ফেরে সাকিব। সাইকেল চালানো থামিয়ে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকায়। তারপর কী মনে করে কাছাকাছি চলে আসে দ্রুত। চোখ দুটো আরও বড় করে বলে, ‘এই, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে…।’ সাকিব একটু থামল। গভীর চোখে আমাদের দিকে তাকাল, ‘আমার এই সাইকেলটা তোরা…?’

ফাহাদ চিৎকার করে উঠল, ‘এই গাধা, বেশি কথা বলবি না। বেশি কথা বললে গলাব্যথা হয়। অযথা গলাব্যথা করবি না। চল চল, সাইকেল চালাই আমরা।’

সাকিব আর সাইকেল চালায় না। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে ও আমাদের দিকে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, চোখ দুটো টসটসে হয়ে যাচ্ছে ওর, পানিতে ভারী হয়ে গেল একটু পর, ফোঁটা গড়িয়ে থমকে দাঁড়াল দুগালেই।

আপাতত আর কিছু দেখতে পাই না আমরা, সাকিবকে এখন ঝাপসা দেখাচ্ছে, ঝাপসা দেখাচ্ছে ওর সাইকেলটাকেও।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments