Tuesday, April 30, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পলেখকদের খোশগল্প (খেরোর খাতা) - লীলা মজুমদার

লেখকদের খোশগল্প (খেরোর খাতা) – লীলা মজুমদার

লেখকদের খোশগল্প (খেরোর খাতা) - লীলা মজুমদার

১৯৩১ সালের শান্তিনিকেতনের কথা। সন্ধ্যাবেলায় উত্তরায়ণে অনেকে আসতেন আর নানারকম গল্প হত। যেদিন রবীন্দ্রনাথও সেই সব গল্পে যোগ দিতেন সেদিন সেদিন তো কথাই নেই। ওই সময় অভ্যাগতদের মধ্যে কেউ ওই ঘটনাটা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে বৈজ্ঞানিক জগদীশ বসুর খুব বন্ধুত্ব ছিল, একথা অনেকেই জানেন। তখন দুজনেরই বয়স হয়েছে, দুজনেই কিঞ্চিৎ ভুলো হয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ কয়েক দিনের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। তারই মধ্যে একদিন তাঁর বউমা প্রতিমা দেবীকে বললেন, ‘কাল দুপুরে আমার জন্য রান্না কোরো না। জগদীশের ওখানে আমার নেমন্তন্ন।’

পরদিন যথাসময়ে সেজেগুজে কাকে যেন সঙ্গে নিয়ে তিনি জগদীশ বসুর বাড়ি গেলেন। বলাবাহুল্য তাঁকে দেখেই বাড়িসুদ্ধ সবাই আহ্লাদে আটখানা। বসবার ঘরে বসে নানারকম খোশগল্প হল। কিন্তু খাবার সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও, কেউ খাবার কথা উত্থাপন করল না। তখন কবির সন্দেহ হল জগদীশ বোধহয় নেমন্তন্নর কথা ভুলে গেছেন। বাড়ির কাউকেও যে কিছু বলেননি তাও বুঝতে অসুবিধা হল না।

অগত্যা রবীন্দ্রনাথ উঠে পড়লেন। জগদীশ বসুও সস্ত্রীক সিঁড়ি অবধি বিদায় দিতে এলেন। কয়েক ধাপ নামলেনও রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় হঠাৎ জগদীশ বসুর একটা কথা মনে পড়ল। তিনি ব্যস্তভাবে রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘ও হ্যাঁ, ভাল কথা, কাল দুপুরে তুমি এখানে খাবে, মনে আছে তো? এতক্ষণ আমার মনেই ছিল না।’

রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘ওই দেখ, আমারও কী ভুলো মন! আসল কথাটাই বলা হয়নি। কাল একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, আসতে পারব না, সেই কথা বলতেই আজ আসা।’

তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সঙ্গীকে বললেন, ‘দেখলে তো কেমন কাটিয়ে দিলাম। বেচারি ভুলে গেছে।’

সঙ্গী কোনও মন্তব্য করেননি, যদিও ভুলটা যে কোন পক্ষের সে বিষয়ে তাঁর মনে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে গেছিল।

আসলে লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, এঁদের ব্যাপারই আলাদা। আর সাংবাদিকদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। একবার আমাদের প্রিয় বন্ধ পরিমল গোস্বামী ‘যুগান্তর’-এর পূজা সংখ্যার জন্য অনেক দিন আগে থাকতেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে একটা ভাল কবিতা বা গদ্য রচনা চেয়ে রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য মহালয়া যখন ভয়াবহ রকমের নিকটবর্তী, তখনও লেখাটি আদায় হল না। পরিমল গোস্বামী মরিয়া হয়ে উঠেছেন, এমন সময় এক বন্ধুর বাড়িতে প্রেমেনবাবুর সঙ্গে দেখা।

অমনি বারেন্দ্র বুদ্ধি খুলে গেল। পরিমল গোস্বামী কোত্থেকে একটা খুদে হস্তাক্ষর-সংগ্রহের খাতা বের করে বললেন, ‘ওহে প্রেমেন, এই খাতার মালিক আমার নাতনি হয়। তুমি চার-পাঁচ লাইন লিখে না দিলে তার কাছে আমার মুখ দেখানো দায় হবে। সেও নাওয়া-খাওয়া ছাড়বে।’

কোনও ছোট ছেলেমেয়ে কষ্ট পাচ্ছে এ চিন্তাও প্রেমেনবাবুর কাছে অসহ্য। সঙ্গে সঙ্গে খাতাটায় খচখচ করে যা মনে এল চার-পাঁচ লাইন লিখে দিলেন। পরিমল গোস্বামীও খাতাটি বগল-দাবাই করে বললেন, ‘তা হলে এবার আমার কথা শোনো। যদি পরশুর মধ্যে তোমার ভাল লেখাটি না পাই, তা হলে যুগান্তরের পূজা সংখ্যায় এই লেখাটাই ছেপে দেব।’

বলাবাহুল্য পরশু না হলেও, তিন-চার দিনের মধ্যেই সেই ভাল লেখাটি যথাস্থানে পৌঁছে গেল।

আরও শুনুন লেখকদের গল্প। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নিজের মুখে শুনেছি। একদিন তিনি তাঁর কালীঘাটের বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন, এমন সময় একটা ট্যাক্সি এসে বাড়ির সামনে থামল। তার মধ্যে থেকে একজন অবাঙালি ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী আর মাথায় বিশাল বান্ডিল নিয়ে চাকর-প্যাটার্নের লোক নামল।

বারান্দায় উঠেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনিই শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়?’ তার পরেই সস্ত্রীক সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। শৈলজানন্দ শশব্যস্ত হয়ে তাঁকে টেনে তুললেন।

ভদ্রলোক বললেন, ‘না, না বাধা দেবেন না। আপনারই দয়ায় আমি আমাদের রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন হয়েছি। আপনার লেখা প্রত্যেকটি বই আমি অনুবাদ করে, ভগবানের ইচ্ছায় প্রচুর টাকা আর খ্যাতি পেয়েছি। তাই আপনাকে আমার ভক্তি আর কৃতজ্ঞতা না জানালে আমার মহা পাপ হবে। তবে ইয়ে— কী— বলে সামান্য একটু ভুল হয়ে গেছে। আপনার অনুমতি নেবার কথা আমার একেবারেই মনে ছিল না। তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ এইগুলি গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করবেন।’

এই বলে সঙ্গের লোকটিকে ইঙ্গিত করতেই সে সেই বিশাল বান্ডিলটা শৈলজানন্দের পায়ের কাছে রাখল। শৈলজানন্দ একটু খুশি না হয়ে পারলেন না।

না। তাতে শাড়ি, ধুতি, চাদর, ভাল ভাল লাড্ডু বা প্যাঁড়া কিছুই ছিল না। ছিল শুধু দুর্বোধ এক ভাষায় লেখা রাশি রাশি বই, শৈলজানন্দের যাবতীয় সাহিত্যকীর্তির অনুবাদ!

আরেকটি অতি আধুনিক গল্প না বলে পারছি না। কিছুদিন আগে আমাদের বন্ধু নন্দগোপাল সেনগুপ্তের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলাম, ‘কী মুশকিল দেখুন তো, আমাদের পত্রিকাটির মহালয়ার আগেই বেরুবার কথা। গোড়ায় প্রেমেনবাবুর কবিতা যাবে। তা কাকস্য পরিবেদনা!’

নন্দগোপাল বললেন, ‘কী আর এমন মুশকিল? নিজে চার-ছয় লাইন কবিতা লিখে, ওঁর নাম দিয়ে ছেপে দিন না!’

এর ওপর কোনও মন্তব্য অবান্তর হবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments