Wednesday, August 20, 2025
Homeবাণী ও কথাঅশ্বমেধের ঘোড়া - দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়

অশ্বমেধের ঘোড়া – দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়

অশ্বমেধের ঘোড়া – দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়

‘শুনছ? সানাই।’

রেখা থমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ঠিক সেই মুহূর্তে আলোটা ওর মাথার চুলে ভেঙে পড়ে চিবুক আর গলার পাশে একটা হালকা ছায়া সৃষ্টি করল। কাঞ্চন সানাইয়ের সুর বিস্মৃত হয়ে আশ্চর্য চোখে রেখার সেই ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ রেখাকে অপরিচিতা মনে হল। স্বপ্নের অস্পষ্ট স্মৃতির মতো।

‘কি সুর?’

কাঞ্চন চমকে বলল, ‘দাঁড়াও।’ তারপর ভুরু কুঁচকে অন্যমনস্কের মতো খানিক শুনে উত্তর দিল, ‘চন্দ্রকোশা’ হাসল, ‘আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসলে কি হয়, আজ শুক্লপক্ষ তো বটে।’

রেখা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। আলোটা মাথার চুল ছাপিয়ে সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঞ্চনের একটা আশ্চর্য উপমা মনে এল। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাহ। বেশ একটু মোগলাই মেজাজ হচ্ছে।’

রেখা চকিতে হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মোস্ট কর্টেবল জার্নি! ‘ধুৎ!’ কাঞ্চন ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে উত্তর দিল, ‘ও তোমাদের কেরানী ইন্টেলেকচুয়ালদের মানায় উঠে বসতে না বসতেই পৌঁছে যাওয়া। তার ওপর বেবী ট্যাকসিগুলো তো নেহাতই ভালগারা যেন বালিগঞ্জে বান্ধবীর বিয়ের চায়ের নেমন্তন্ন। বড় ট্যাকসিতে তা-ও বনেদী বাড়ির পাত পেতে বসার আভিজাত্য আছে। তোমাদের এই কলকাতা দিন দিন আধুনিক হচ্ছে, বর্বর হচ্ছে, সূক্ষ্মতার নামে দরকচা মেরে যাচ্ছে।’

রেখা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘এত বাণী দিও না মাস্টারমশাই। লোকে ধরে বেঁধে মন্ত্রী বানিয়ে দেবো।’

কাঞ্চন হা-হা করে হেসে উঠল। আশেপাশের লোক চমকে বিরক্ত চোখে তাকাল। লজ্জায় দুজনেই মাথা হেঁট করেছে। একটি প্রৌঢ় পসারী ‘ফুল চাই’ বলে তখনই সামনে এসে দাঁড়াল। কাঞ্চন কখনও পয়সা দিয়ে ফুল কেনে নি। একবার চকিতে রেখার সিঁথির দিকে তাকাল। তার বড় ইচ্ছে হতে লাগল এক ছড়া মালা কিনে বিনুনিতে জড়িয়ে দেয়। কিন্তু রাস্তায় ফুল কিনতে যথারীতি লজ্জা করল। বলল, ‘না।’

রেখা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে দিয়েছে। কাঞ্চন রেখার সাহস দেখে স্তম্ভিত। রেখা কি আজ, রেখা কি, প্রকাশ্যে মালা কিনতে ওর ভয় করল না? ফুলের মালা হাতে একটি মেয়ের সঙ্গে সে এখন বাসে উঠবে?

‘চলো, হাঁটি।’

‘চলো।’

হাঁটার শেষ নেই। এক পথে পা ফেলা। রাস্তাটা চোখের সামনে পালটাতে দেখি কলকাতা রোজ পালটায়। আমরা শুধু রাস্তাটুকুর খবর রাখি হাঁটতে হাঁটতে বড়জোর ময়দান অব্দি যাব। বড়জোর চা খাবো এক পেয়ালা আলো আর অন্ধকারের সমারোহ দেখব। তারপর বাস ধরব। রেখার পাশে খালি জায়গা থাকলেও আমাকে আলাদা বসতে হবে, বা দাঁড়াতো ভিড় ঠেলে নেমে যাবার সময় রেখা হাতে একটা টিকিট গুঁজে দিয়ে যাবো সুযোগ পেলে কিছু একটা বলবো নয়তো অপরিচিতার মতো রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হবে। কন্ডাক্টর কি কোনো কৌতূহলী যাত্রী অকারণে একবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাবো তারপর আমি নামব। তারপর বাড়ি যাবা। তারপর রাত্রি। তারপর দিন আর দিনে হাঁটতে হাঁটতে দেখব রাস্তাটা পালটাচ্ছে। কলকাতা কত তাড়াতাড়ি পালটায়।

‘ইস, দেখেছ?

কাঞ্চন যদিও জানত, তবু সেনেট হলের সিঁড়ি আর ছাদের দিকে তাকিয়ে নতুন করে চমকে না। উঠে পারল না। কাঞ্চন সত্যিই আত্মীয়বিয়োগের বেদনা অনুভব করলা সিঁড়ি নেই, খিলান নেই, দরজা নেই। অন্ধকারে কতগুলো পায়রা উড়ছে। ছাদ জুড়ে আকাশ শুধু পিছনের দেয়ালটা এখনও ভাঙে নি। রাঙাদিকে আত্মহত্যা করতে দেখেছিলাম। সমস্ত শরীরটা পুড়ে গেলেও মাথার খোঁপা ঠিক ছিল।

কাঞ্চন ফুটপাতে পা ঠুকে মন থেকে স্মৃতিটা তাড়াল। তারপর গলা ঝেড়ে বলল, ‘জানো, বাংলাদেশে নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির মৃত্যু অনেক দিন হয়েছিল। এবার তার কবরটাও ভেঙে গেল।’ রেখা হঠাৎ অদ্ভুত প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, সে পাগলটা এবার কোথায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করবে?

কাঞ্চন চমকে রেখার দিকে তাকাল। সত্যি, পাগলটা এখন, সত্যি, সেনেট, দাঁড়াও পথিকবর, বন্দী আমার প্রাণেশ্বর, মরি হায় হায় রে।

গমগম করে যেন অজস্র গলা একসঙ্গে হাজার কথা বলে উঠল। কাঞ্চন প্রশ্ন করল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

রেখা হাসল, ‘তোমায় চান্স দিচ্ছি।’

হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘কিসের?’

মালাটা খোঁপায় বেঁধে দেওয়ার।’

রেখা কি মরিয়া? আজকের দিনটাই কি ওকে, আজকের দিনটা, আহ দিনটা দিন গেল, রাত্রি। রাত্রি যায় না যায় না কাঞ্চন স্পষ্ট শুনল সানাই বাজছে। চন্দ্রকোশা সেই আমরা রেস্তোরাঁয়–সুকুমার দুটো মালা—আর প্রফুল্ল সকলকে হতবাক করে এক প্যাকেট সিঁদুর, দুটো লোহার নোয়া—আর সেই মুহূর্তে প্রথম রেখাকে অপরিচিত মনে হয়েছিল। আশ্চর্য লোভে, ভয়ে সিঁদুরের প্যাকেটের দিকে তাকিয়েছিল। অথচ শপথ উচ্চারণের সময়ও তাকে এতটুকু বিচলিত দেখি নি। সকলের তাড়া খেয়ে আমি রেখার ঠাণ্ডা কপালে মুখের দিকে তাকাতে সাহস—কেন আঙুল দিয়ে সিঁদুর লাগাতে হয়–প্রফুল্ল বকেছিল আর রেখা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল। রেখাকে আমার সেই মুহূর্তে বউ-বউ মনে হচ্ছিল কিন্তু মালাবদল কিছুতেই করতে পারি নি রেখাও কিছুতে মাথায় ঘোমটা—আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম মাসের শেষ হলেও। প্রত্যেকে কিছু কিছু টাকা এনেছিল। তারপর সন্ধ্যে হল। সুকুমারের টিউশনি আছে, প্রফুল্ল বা চন্দন পালাতে চায়। রেখা রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে কপালের সিঁদুর মুছে ফেলল। রেখার এই মুখটাই আমার পরিচিত। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মাত্র কিছুক্ষণে রেখার কপালের সিঁদুর আমার মনে একটা স্থায়ী স্মৃতি রেখেছে। রেখাকে হঠাৎ বিধবার মতো শূন্য, করুণ মনে হল। দেখলাম বাচাল প্রফুল্লও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। রেখার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা নীল শিরা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

‘দ্যাখো, সেই পেয়ারটা’। কাঞ্চন অন্যমনস্কের মতো তাকিয়ে যুগলটিকে দেখল। কিন্তু তার চোখের সামনে স্পষ্ট করে ভেসে উঠল সুকুমার, প্রফুল্ল আর চন্দন। ওরা প্রায় পালিয়ে গেল। মালা দুটো আমার হাতে ছিল। ফুল নিয়ে আমি হাঁটতে পারি না। রেখার কপাল শূন্যা চাইলেও রেখা মালা হাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না আমার পকেটে বিয়ের দলিল রেখার হাতটা ছুঁতে ইচ্ছে করছে। রেখাকে একবার বউ বলে ডাকতে—আহ, কি আশ্চর্য ইচ্ছে! আমরা পাশাপাশি হাঁটছি অথচ নীরবতা। বিয়ের পর একান্তে প্রথম কথা কি হবে, কি হতে পারে? আমি অস্ফুটে বলেছিলাম, গঙ্গায় বসলে হয়। রেখা অস্ফুটে বলেছিল, হুঁ। তারপর আমরা চৌরঙ্গীর বাস ধরেছিলাম আর উঠেই দেখেছিলাম রেখার বাবা! তারপর আমি দোতলায় গিয়ে বসলাম। রেখা একতলায়। তারপর অন্যমনস্কের মতো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাসের যাত্রীদের লক্ষ্য করলাম আর বাসের বিজ্ঞাপন। জনৈক বিজ্ঞাপন দেখে যথার্থ মুগ্ধ হয়েছিলাম সুন্দর করে লেখা ছিল —’ডোন্ট কে ইন দি বাস, নট ইভন নাম্বার টেন’ তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চৌরঙ্গী দেখতে খুব ভালো লেগেছিল। হঠাৎ কুয়াশা, মেঘ ও স্তিমিত আলোকমালা শোভিত তীরভূমি আর অন্ধকার, আর মাস্তুলের কথা মনে পড়ায় আমার খুব হাসি পেয়েছিল। অকস্মাৎ লক্ষ্য করেছিলাম আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। তারপর রেখা নেমে গেল। একটিবার ব্যাকুল গ্রীবা তুলে হয়তো সে আমাকে খুঁজেছিল। রেখার জন্যে সেই মুহূর্তে আমার খুব মমতা হয়েছিল। হয়তো আমি একটু বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ পৌঁছে গেছি লক্ষ্য করে হুড়মুড় করে নামছিলাম। দরজার কাছে কন্ডাক্টর বলল, টিকিট? অভ্যেসে বললাম, হয়ে গেছে। কন্ডাক্টর। বলল, দেখি? মুখ লাল করে পয়সা দিয়ে নেমে শুনলাম কন্ডাক্টর বলছে, হাতে আবার মালা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! রাস্তায় অসহায় দাঁড়িয়ে আমার কান্না পেয়েছিল। দু-পা হেঁটে মালা জোড়া ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই লক্ষ্য করেছিলাম একটা স্থবির বলদ সেটি চিবুচ্ছে। কি একটা ভয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম কি একটা ভয় আমাকে তাড়া করলা রেজিস্ট্রারের চেম্বারটা মনে পড়ল–ছোট, ঠাসা। রেস্তোরাঁর কেবিনটা মনে পড়ল—ছোট, ঠাসা। বাসের সিঁড়িটা মনে পড়ল ছোট, ঠাসা। শোবার ঘরটা মনে পড়ল—ছোট, ঠাসা। আমার দম বন্ধ হয়ে এলা। স্পষ্ট দেখলাম রেখার কপালে নীল শিরা। মনে হল আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছি। চমকে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বুঝলাম, চন্দ্রকোশা পায়ে পায়ে পানের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম দিন রেখার সঙ্গে দেখা হতে বলেছিলাম, ‘জানো, আমাদের বিয়েয় স্বয়ং বিসমিল্লা সানাই বাজিয়েছে।’

‘এই কাঞ্চনবাবু?’

কাঞ্চন চমকে তাকিয়ে দেখল সুবিমলা বেহায়ার মতো একবার রেখার দিকে তাকিয়ে সুবিমল বলল, তারপর, কি খবর?’

কাঞ্চন কোন রকমে হেসে বলল, ‘বিকেল পাঁচটার পর থেকে এ পর্যন্ত নতুন কিছু ঘটেনি।’ না, তাই বলছি। একটা সিগারেট হবে? রেখা একটু সরে দাঁড়ালা। কাঞ্চন পকেট থেকে চারমিনার বের করে সুবিমলকে দিল, নিজে ধরাল। সুবিমল রেখার দিকে আর একবার তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আপনার বোন?

‘না’

‘ছাত্রী?’

‘না।’

‘ও, বুঝেছি।‘ সুবিমল মুখটা উজ্জ্বল করে বলল, ‘দেখেও আনন্দ। আপনাদের আর কি ভাবনা মশাই জীবন সামনে পড়ে আছে। এই আমি কলেজ সেরে, টিউশনি সেরে এখন বাড়ি ফিরে শুনব মা-র সঙ্গে ঝগড়া করে বৌদি রান্না চাপায় নি, ইত্যাদি আচ্ছা চলি যা বিষ্টি আসছে!’ দু-পা এগিয়ে সুবিমল আবার থমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খবর শুনেছেন? ইউ.জি.সি-র টাকাটা নাকি আরও পেছিয়ে গেল। প্রিন্সিপালও হয়েছে তেমনি।’

‘লোকটি কে, মাস্টারমশাই?’

‘আমাদের কলেজের, ম্যাথমেটিকস।’

‘কি বলল?’

‘এই, তুমি আমার কে হও, ইত্যাদি।’ শেষ শব্দটা উচ্চারণ করেই কাঞ্চন সচেতন হল যে সুবিমল তার আগাগোড়া মধ্যবিত্ত সংলাপের মধ্যে এই একটি শব্দপ্রয়োগে আভিজাত্যের পরিচয় দিয়ে গেছে।

‘জানো, সেদিন আমাদের নমিতা, নমিতাকে মনে নেই তোমার—সেই যে ইসলামিক হিস্ট্রির…’

‘হুঁ, দেখা হয়েছিল?

‘হ্যাঁ তো। কথায় কথায় তোমার খবর জিজ্ঞেস করল। বলল, ‘কবে বিয়ে করছিস?’

‘কি বললে?’

‘বললুম, এই ভালো, বিয়ে করলেই তো সব ফুরিয়ে যায়। তার ওপর ছেলেপিলের ঝঞ্চাট, শাশুড়ী-ননদের ঝামেলা।’

তারপর দুজনেই স্তব্ধ হয়ে খানিক পথ হাঁটল। রাস্তায় ব্যস্ততা বাড়ছিল, কারণ বৃষ্টি আসছে। অথচ পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ওরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল।

‘রেখা।’

‘রেখা?’

‘কি?’

‘রেখা?’

এবার জবাব না দিয়ে রেখা হাসিমুখে কাঞ্চনের দিকে তাকাল। কাঞ্চন বলল, ‘জানো, ছেলেবেলায় মাকে এমনি অকারণে ডেকে জ্বালাতাম।’

রেখার হাসিমুখ মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। মা-র নামে ওর বাড়ির কথা মনে পড়েছে। আমারও পড়ে। রেখা সম্পর্কে মা-র একটা চাপা স্নেহ লক্ষ্য করেছি। অনেক আগে রেখাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, মাত্র একবার। রেখার মা-র চেহারা মনেই পড়ে না। বাবাকেও না। রেখার ভাই বোনেরা এই চার-পাঁচ বছরে নিশ্চয়ই কত বদলে গেছে।

‘আচ্ছা, আমি যদি চিৎকার করে লোক জানিয়ে বলি, এই যে দেখছেন ভদ্রমহিলা—ইনি আমার ধর্মপত্নী, তাহলে?

‘পাগল বলে ধরে নিয়ে যাবে, এই আর কি।’

‘তাহলে তো বেঁচে যাই।’

কাঞ্চন হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারল না। রেখা ঠোঁটে ফুল ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আহা, অ্যাজমাটা আবার মাথাচাড়া দিল?’

কাঞ্চন বলল, ‘জানো, এই কথার খেলা সত্যি আর ভালো লাগে না।’ রেখা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল।

ভালো লাগে না। ভালো লাগে না। চুরি করে একটু সময় নেওয়া, দুটো কথা, এক পেয়ালা কফি, লম্পট নদীতীরে নির্জনতার ব্যর্থ অন্বেষণ, তারপর অক্ষম ক্লান্তি ও ক্ষোভে অপরিচিতের মতো ঘরে ফিরে যাওয়া। একদিন, কোনো এক নিকট অথচ বিস্মৃত অতীতে, সবই ছিল স্বপ্না আর আজ, আর এখন, ঘেন্না করে। একই অভ্যাসবোধ, একই পরিবেশ, একই চায়ের দোকান আর রাস্তা আর গঙ্গার ধারের গাছতলা। এক ধরনের কথা বা কথা খুঁজে না পাওয়া বদল নেই, হায়! অথচ কলকাতা প্রতিমুহূর্তে বদলায়। পৃথিবী বদলায়। জীবন বদলায়। আমাদের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, মনে মনে আমরা আরও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ সেই মৌলিক ছকের ওপর খুঁটির মতো এগোচ্ছি, পেছোচ্ছি। এ-যুগের নিয়তিই হল বাল্য এবং প্রৌঢ়তা—মধ্যিখানে বিশাল চড়ায় ইচ্ছা ও অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, আর কর্তব্যের বিরোধে পোকার মতো গর্ত খুঁড়ে নিচে নামছি— অথচ সামনে সমুদ্র ছিল। হায় রে সমুদ্র! নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি কথায়, রেখাকে ফাঁকি দিচ্ছি কথায় আর পুঁথি থেকে তার সমর্থন খুঁজছি। কি যেন সেই কি যেন…ফুলগুলি কথা আর পাতাগুলি চারিদিকে পুঞ্জিত নীরবতা। সমুদ্রের মৌন, বক্ষের কাছে পূর্ণিমা লুকানো আছে। দিনে দিনে অর্ঘ্য মম। দিনে দিনে রূপবতী হবে পৃথিবী দিনের পর রাত্রি। কিন্তু রাত্রির পর? রাত্রির পর?

‘এই, এ-ভাবে হাঁটলে পথেই বৃষ্টি নামবে।’

উত্তরে অন্যমনস্কর মতো কাঞ্চন চিৎকার করে উঠল, ‘গাড়োয়ান, রেককে।’ বলেই সে নাকে মালতীফুলের গন্ধ পেল। কারণ শ্রীকান্তর গহর-ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল।

রেখা বলল, ‘ক্ষেপেছ?’

কাঞ্চন শুনল, নতুন গোঁসাই, ওঠো! অথচ সে সচেতন ছিল এসপ্ল্যানেডের সামনে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে রেখা।

‘খিদিরপুর কেতনা?’

লুঙ্গির খুঁট দিয়ে গলাটা মুছে গাড়োয়ান বলল, ‘সওয়ারী কিধার?’

‘দেখতে পাচ্ছ না?’ কাঞ্চন বিরক্ত কারণ গাড়োয়ানের রক্তাভ চোখের হাসি তার কারণ ও অশ্লীল মনে হল। অথচ বিদেশী উপন্যাস এবং মধুসূদন দত্তের কলকাতার ইতিহাস পড়ে ঘোড়ার গাড়ি সম্পর্কে মনে যে স্মৃতির পরিমণ্ডল জন্ম নিয়েছে, তার চেহারা অন্য।

‘পোলের ওপারভি যাবেন?

‘না।’

‘গঙ্গার কিনারা দিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

‘চার টাকা লাগবে স্যার।’

চমকে উঠে বিরক্ত কাঞ্চন বলল, ‘ঠিক আছে।’

চলে যেতে দেখে গাড়োয়ান গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কত দিবেন?’

রেখা হঠাৎ উত্তর দিল, ‘দু-টাকা।’

কাঞ্চন গম্ভীর হয়ে রেখার দিকে তাকাল। রেখা দর কষছে? রেখা এই অশ্লীল, ধূর্ত গাড়োয়ানটার সঙ্গে যেচে কথা বলল, রেখা কি আজ প্রতিপদে প্রমাণ করবে আমি কাপুরুষ, আমি

জীবন থেকে পালাচ্ছি? রেখা কি আজ, রেখা কি, এই সব ছুটকো স্মার্টনেস, অথচ রেখার পক্ষে–

‘তিনটে টাকা দিন মা।’

রেখা হেসে কেটে কেটে বলল, ‘ট্যাকসিতে দু-টাকাও লাগে না।’

গাড়োয়ানটা আহত ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে একটা ঘোড়ার রোগা পিঠে চাপড় মেরে নিজের জিভে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলল, ‘আরে হায়, মিসিন আর জানবার এক হল দিদি? আচ্ছা, আট আনা বখশিস দিয়ে দেবেন। আচ্ছাসে ঘুমিয়ে দিব।’

লাফিয়ে নেমে যখন দরজাটা খুলে ধরল তখন আবার রেখাকে অপরিচিত মনে হল বিব্রত, ভীত চোখে সে কাঞ্চনের দিকে তাকাল, তারপর গাড়িটার ভেতরো ব্রুদ্ধ কাঞ্চন কোনো কথা না বলে ত্বরিতে উঠে পড়ল।

আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে রেখা এক কোণে কুঁকড়ে বসেছিল। উল্টোদিকের গদিতে নিজেকে ছড়িয়ে প্রায় আধশোয়ার ভঙ্গিতে বসে কাঞ্চন চারমিনার বের করল। ভেবেছিল রেখা এত তাড়াতাড়ি আবার সিগারেট ধরাতে নিষেধ করবে। কিন্তু রেখা নির্বাক লাল আলোের সংকেতে গাড়ি তখনও ট্রাম লাইনের ওপারে যেতে পারে নি কাঞ্চন অদ্ভুত আনন্দ বোধ করল। রেখা এই আলো, এই অরণ্য, এই পরিপার্শ্বকে ভয় পাচ্ছে। ঘোড়ার গাড়িতে আমার সঙ্গে উঠেছে তাই ভয় পাচ্ছে। আমার সঙ্গে উঠে ভয় পাচ্ছে। ফিটনের দু-পাশ খোলা। সত্যিই চারদিকে অমতের অজস্র সন্তান কে না কে দেখছে জানি না। রেখার পরিবার আছে, সমাজ আছে, আমি একটা পুরুষ। ওহো, আমি পুরুষ। বেড়ে।

‘আলোর দিকে মুখ রাখুন হলদের পর সবুজ আলো জ্বললে দুই দাগের মধ্য দিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হন। মনে রাখবেন, জীবন অমূল্য সামান্য ভুলের মাশুল ভয়ানক। আলোর দিকে মুখ রাখুন

কাঞ্চন হা হা করে হেসে উঠল।

‘কি?’

‘সাবধানে পথ চলুন সপ্তাহ। ফলে আরও ট্রাফিক জামা বেশ বলেছে, আলোর দিকে মুখ রাখুন। তোমার যাবতীয় জেসচার আর ঘোষণাটা মিলে পুরো শরৎ চাটুজ্জে টাইপ।’

‘কি আর করি বলো? প্রবোধ সান্যালের নায়কের সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের নায়িকা হলে গুরুচণ্ডালীর দোষ সামলাবে কে?

কাঞ্চন সিগারেটে টান দিল। রেখার স্মার্ট উত্তর তাকে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। অথচ আমি জানি না ঠিক কি চাই। কি হলে খুশি হতামা রেখার অস্বস্তি মিথ্যে নয়, তুচ্ছ নয়। আমি একটা কলেজের শিক্ষক। রেখাকে এনে সংসারে স্ত্রীর মর্যাদা দেবার সাধ্য আমারই নেই। বাড়ির ক্রমাগত বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে, যাবতীয় লুকোচুরির নিষিদ্ধ পথে সে তার ভালোবাসা—রেখাই উদ্যোগ নিয়ে রেজিস্ট্রেশন—তার ভয় শেষ পর্যন্ত বাবা নিষ্ঠুর—শেষ পর্যন্ত বাবা কিছুতেই জাতের অভিমান—তখন তাঁকে ঠেকাবে বিয়ের দলিল—কারণ সে জানে আমাদের হতকুৎসিত সংসারে হঠাৎ চলে আসা সম্ভব নয়া সে জানে যতদিন না অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে ততদিন তার পক্ষেও বাবাকে আঘাত দেওয়া— আহ, এইভাবে ঠিক এইভাবে আমরা স্বার্থপর হতে পারি না। অথচ যাদের জন্য ত্যাগ, তাদের প্রতিও মনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করি। আর দুঃখ পাই। নিজের কাছে ক্রমাগত ছোট হতে থাকি। অথচ জানি না ঠিক কি চাই।

তারপর গাড়ি চলতে শুরু করল। পর পর কতগুলো বাস বাতাসের ঝাপটা দিয়ে চলে গেল। জানলার পাশে দু’একজন যাত্রী একটু ঝুঁকে কাঞ্চনদের দেখল। নানা ধরনের শব্দের ভেতর। ঘোড়র ক্ষুরের অলস অথচ একটানা আওয়াজ কাঞ্চনের মনে কিসের যেন অনুষঙ্গ আনতে চাইছে। গাড়িটা দক্ষিণে ঘুরল। কাৰ্জন পার্কের পাশ দিয়ে স্বল্প আলো আর নির্জনতার দিকে ধীরে এগোতে লাগল। এসপ্ল্যানেডের মোড়ের সেই আশ্চর্য শব্দপ্রবাহ স্তিমিত হয়ে পেছনে পড়ে রইল, যেন এক চিত্রিত শব। এখন কৃচিৎ রিকশার গুঞ্জন, দু-একটা গাড়ির দ্রুত অন্তর্ধান, পথচারীর আকস্মিক কণ্ঠস্বর। কাঞ্চন এতক্ষণে অনুভব করল চৌরাস্তার ভিড়ে ঘোড়ার গাড়িতে বসে থাকতে সে অত্যন্ত কমপ্লেক্স বোধ করছিল।

আর বৃষ্টি নামল। রেখা বাইরে হাত পেতে ধরলা ফোঁটা ফোঁটা জলে হাতটা অপরূপ হয়ে উঠল রেখার আঙুলগুলিতে একটি মুদ্রার ভঙ্গি। ঘোড়ার ক্ষুরের অলস অথচ অবিচ্ছিন্ন শব্দপ্রবাহে কাঞ্চনের মনে হঠাৎ নূপুরের মৃদু, অস্ফুট শব্দতরঙ্গের অনুষঙ্গ এলা। সারেঙ্গিতে গাঢ় পুরুষালি ছড়ের টানে চন্দ্রকোশ বেজে উঠল। রাধার চোখ, রাধার আঙুলে মিনতি! সঈ, কেনা বাশী বা কালিনী নঈ কূলে। কড়ি মধ্যম সমুদ্র স্তম্ভের মতো কোমল ধৈবতে ভেঙে পড়ে কোমল গান্ধার ছুঁয়ে ষড়জে ফিরে এল। আর বৃষ্টি দ্রুত হল। চাকার শব্দ, ক্ষুরের শব্দ। বৃষ্টির মাঝে মাঝে সহিসের চাবুক বাতাসে একটা সূক্ষ্ম মীড় টেনে দিচ্ছে। অজস্র জলবিন্দু ওদের মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল।

‘বাবু?’

‘কেন?’

‘পর্দাটা ফেলে দিব?’

কাঞ্চন জানত না এ জাতীয় ফিটনে পরদা থাকে। অবাক হয়ে বলল, ‘দাও।’ মুহূর্তে যেটাকে ভেবেছিল গাড়ির ছাউনি, তার ওপর থেকে দুপাশে দুটো চামড়ার পরদা ঝুলে পড়লা আর হঠাৎ তারা সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

স্তব্ধ দুজনে বসে রইল। কেউ কারোর দিকে তাকাতে পারছে না। এ কি আশ্চর্য ঘটনা! আমরা নির্জনতা খুঁজতাম, যেখানে ঘনিষ্ঠ বসা যায়। কলকাতা শহরে নির্জনতা নেই। আমরা অবসর খুঁজতাম, যেখানে নিবিড় হওয়া যায়। আমাদের জীবনে অবসর পাই না। আমরা একটা পরিমণ্ডল খুঁজতাম, যেখানে আমরাই অধীশ্বর। আমাদের সময় সে পরিমণ্ডল দেয় না। অথচ আজ, অথচ একি, অথচ এভাবে বন্ধ গাড়ি চলছে, বাইরে বৃষ্টি আজ আমাদের বিবাহের প্রথম বার্ষিকী। আমার স্ত্রী রেখা—পরমেশ্বরকে সাক্ষী করে—ধর্মপত্নী…

‘এই, কি ভাবছ?’

কাঞ্চন দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, ‘কিছু না।’ বলেই হেসে ফেলল। কারণ এর পরেই সে জানে রেখা বলবেকথা নয়, ভাবনা নয়, তাহলে এখন তোমার মনে ‘সিচুয়েশন ভেকেন্ট’ নোটিশখানা আবার ঝুলিয়েছ? কিন্তু রেখা কাঞ্চনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে শুধু বলল, ‘কিছু বলো।

হাতের তেলোর ওপর মাথা রেখে ঘাড়টা পেছন দিকে ঈষৎ ঝুলিয়ে জানুর ওপর আড়াআড়ি পা ফেলে রেখা শিথিল ভঙ্গিতে বসেছিলা একগোছা ভেজা চুল কপালের ওপর টিকলির মতো কুঁকড়ে ঝুলে আছে। গর্বে আনন্দে রেখা যেন রাজেন্দ্রাণী।

প্রায়ই আজকাল রেখাকে অপরিচিত মনে হয়। কি এক ঔদাসীন্যে হঠাৎ সে অনেক দূর চলে যায়। আসলে গত একবছরে, বিয়ের পর, আহ আমাদের বিয়ে একটা কৌতুক। কিন্তু সত্যিই তো তারপর রেখাকে নতুন করে কিছুই জানিনি। রেখার শরীর না, মন না, অভ্যাস না। আসলে আমরা দুজনেই আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা পরস্পরের কাছে গোপন করে যাচ্ছি, নিজের কাছে মহৎ থাকার তাড়নায় পরস্পর ছদ্মবেশ পরেছি।

‘কিছু বলল না গো?’

রেখার মুখে গো শব্দটা কাঞ্চনকে চমকাল। বাস্তবিক, অবস্থায় পরিবেশে শব্দের ওজন কি আশ্চর্য বদলে যায়। অন্য সময় হলে গ্রাম্য বলে পরিহাস করার সুযোগ নিশ্চয়ই ছাড়তাম না। আসলে আমি তো আমি, আমার তাবৎ অস্তিত্ব এমনই কিছু সম্বোধনের জন্য কাঙাল হয়ে থাকে।

‘বউ?’

রেখা উদ্ভাসিত মুখে কাঞ্চনের দিকে তাকাল।

‘বউ?’

‘উঁ?’

‘আমাকে একবার স্বামীন বলে ডাকবে?’

‘যাহ।’

‘ডাকোনা?’

‘যাহ।‘

‘প্লীজ একবার ডাকো।

‘না গো, ভীষণ লজ্জা করে।’

‘আচ্ছা, ফিসফিস করে বলো। একবারটি শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে বুঝলে—‘

রেখা কাঞ্চনের কথার মধ্যে হঠাৎ স্পষ্ট করে বলল, ‘স্বামীন।’ বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ঝির ঝির করে হেসে উঠল। হাসিটা হঠাৎ ক্ষুরের শব্দের সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেল। কাঞ্চন নাকে ভেজা মাটির গন্ধ পেল।

ছুঁতে ইচ্ছে করছে। খোঁপাটা খুলে একমুঠো ফুলের মতো চুলগুলো যদি রেখার মুখে-বুকে। ছড়িয়ে দিই! হাতটা ধরব? কান পেতে রেখার হৃৎপিণ্ডের শব্দ যদি শুনতে পেতাম? আমার রক্ত, আমার মন বৃষ্টি হতে চায়। একটা কথা ধ্রুব বুঝেছি। বৈষ্ণব কবিরা যৌবন সম্পর্কে যে উল্লাস প্রকাশ করেছেন, তা মিথ্যো আসলে যৌবন আমাদের লজ্জা, আমাদের যন্ত্রণা। আমি পারি না, আমি পারি না এখানে রেখাকে অপমান করতে।

আঁচল সরে গিয়েছিল একটা সেফটিপিনা কাঞ্চনের খুব ইচ্ছে হল বলে, জামায় বোতাম লাগিয়ে নিতে পারো না?বলল, ‘কি দেখছ এমন করে?

রেখা হাসল। বলল, ‘জানো, আজ প্রথম লক্ষ্য করলাম তোমার গলায় একটা তিল আছে।’

‘এই অন্ধকারে?’

‘হুঁ। যখন সিগারেট ধরালে, হঠাৎ তোমার—‘

‘যাহ।‘

‘ভালো লাগছে তোমার?

‘খুউব।’

ভালো লাগছে রেখার। কি অমোঘ এই ভালো লাগা। আমি জানি রেখা কি চায়। আমি জানি আমি কি চাইছি। অশ্বক্ষুরের ধ্বনি চেতনা অবশ করেছে। এই আমার শরীর গীর্জার উজ্জ্বল মোমবাতি, বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়ছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের গর্বিত ঘোড়াটি ঘাড় বেঁকিয়ে আগুনের নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল আর দ্রাবিড়-কন্যা আর্য-ঘোড়সওয়ারের পায়ের তলায় হা হা করে। কেঁদে উঠল। তারপর চেঙ্গিজ খাঁর অশ্বারোহী দল শেকল বেঁধে দাসদের টেনে নিলা তারপর লরেন্স ফস্টর ধুলো উড়িয়ে দিল্লীতে পতাকা ওড়াল। আর পতাকার রঙ পালটায়। স্বর্গের উচ্চৈঃশ্রবা এখন ধর্মনিরপেক্ষ কলকাতার মাঠে পাটোয়ারী বুদ্ধিতে বাজি দৌড়য়। আর যে যজ্ঞের অশ্বকে ফিরিয়ে আনতে ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গা এনেছিল, মাত্র আড়াই টাকার বিনিময়ে সে আমাদের খিদিরপুর পৌঁছে দেবো কাঞ্চন চোখ বন্ধ করে ক্ষুর এবং হ্রেষাধ্বনি শুনতে লাগল। সত্য যে, দিগ্বিজয়ী অশ্বের শোণিতে যজ্ঞের আহুতি পূর্ণ হয়।

‘কি গো, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

কাঞ্চন চোখ বুজে জবাব দিল, ‘হুঁ। তাকাব না, আমার নিজেকে ভয় করছে। আমার নিজেকে বড় দীন, বড় অসহায় মনে হল।‘

‘শোনো?’

‘কি?’ হঠাৎ রেখা দু-হাতে কাঞ্চনের ডান হাতটা ধরে বলল, ‘শোনো!’

কাঞ্চন অস্ফুটে বলল, ‘কি?’

‘এই মালাটা আমায় পরিয়ে দেবে?’

গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়োয়ান ডাকল, ‘বাবু?’

‘কি?’

‘খিদিরপুর।’

রেখা প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘দাও, পরিয়ে দাও।’

কঞ্চন বিমূঢ়ের মতো রেখাকে মালা পরিয়ে দিচ্ছিল, সেই সময় পরদাটা উঠেই আবার নেমে গেল। ঘাড় হেঁট করে দুজনে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। কাছেই ট্রাম-স্টপ। চৌরাস্তায় একটা পুলিশ। তাছাড়া জায়গাটা নির্জন।

রেখা ব্যাগ খুলে দুটো টাকা দিল। কাঞ্চন পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে টাকাটা গাড়োয়ানের হাতে দিতেই সে চটে উঠে বলল, ‘সে কি? পাঁচ টাকার কম হবে না।’

কাঞ্চন ব্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘কেন? তুমিই তো বলেছিলে।‘

গাড়োয়ান বলল, ‘ফুর্তি করবেন, হোটেল ভাড়াভি দিবেন না?’

প্রায় ফিসফিস করে কাঞ্চন বলল, ‘কি বললে?’ জিভে তার কথা জড়িয়ে গেল। আর রেখা চমকে দুহাতে নিজের কান চেপে ধরতে যাওয়ায় মালাটা হাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেল।

তারপর সম্পূর্ণ অপরিচিতের মতো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দ্রুত পায়ে তারা খানিকটা হেঁটেছিল। কিন্তু কাঁদে নি। কারণ একান্তে কাঁদবার মতো কোনো আশ্রয় তাদের জানা ছিল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments