Monday, September 15, 2025
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পফোবিয়া – অনীশ দাস অপু

ফোবিয়া – অনীশ দাস অপু

একেকজন মানুষের একেক রকম ফোবিয়া থাকে-এ এমন এক অস্বাভাবিক ভয় যার ওপর লোকের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ মাকড়সা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায় ভয়ে, কারও রয়েছে তেলাপোকা ভীতি। তবে ইলেন ইঁদুর দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। আর ইঁদুর নিয়ে সে রাতে ওর জীবনে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল…।

.

ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার খেয়ে বেরুতে বেরুতে রাত আটটা বেজে গেল। রেস্টুরেন্টটি বড় পার্কটির এক কোণে। গরমের রাত। ইলেন সিদ্ধান্ত নিল হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। ওর বাসা বেশি দূরে নয়, পার্ক থেকে মাত্র কয়েকশো গজ।

ইলেন ঢুকে পড়ল পার্কে। মাথার ওপর ডালপালা নিয়ে ঝুঁকে আছে গাছ। রাস্তাটা নির্জন এবং একটু যেন বেশিই অন্ধকার। গা কেমন ছমছম করে ওঠে ইলেনের। কদম দ্রুত হলো ওর। এ পার্ক নিয়ে নানা অদ্ভুতুড়ে গল্প শুনেছে ইলেন। যদিও বিশ্বাস করেনি সেসব কাহিনি।

অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভোলা একটা জায়গায় চলে এল ইলেন। আধখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে। এদিকটাতে অল্প জোছনা। চলার গতি কমিয়ে দিল সে, যদিও মন থেকে অস্বস্তি ভাবটা দূর হচ্ছে না।

পার্কের মাঝখানে বড়সড় একটি লেক। যে রাস্তা ধরে হাঁটছে ইলেন, ওটা সোজা লেকের দিকে চলে গেছে। এ রাস্তার মাথায় আরেকটা পথ দেখতে পেল ইলেন। ওখানে কেউ নেই। পেছন ফিরে তাকাল ও, ভাবছে ফিরতি পথ ধরবে কিনা। কিন্তু ও পার্কের মাঝামাঝিতে চলে এসেছে। এখন আবার ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

রাস্তায় পাতার খসখস ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বাতাসে দুলছে ডাল, খসখস শব্দ তুলছে পাতায়। ব্যস্ত শহরের দূরের কোলাহল পার্কের নীরবতা ভঙ্গ করতে পারেনি। ইলেন হাঁটছে, রাতের বাতাসে পাতার ফিসফিসানি। মনে হচ্ছে ও যেন সভ্যতা থেকে হাজার মাইল দূরে। হঠাৎ আরেকটা শব্দে খাড়া হয়ে গেল। কান। পাতা বা অন্য কিছুর শব্দ নয়, ভিন্ন একটা আওয়াজ। পায়ের শব্দ। আমারই পায়ের শব্দ, নিজেকে বোঝাতে চাইল ইলেন।

না, সিমেন্টের রাস্তায় যে শব্দটা উঠেছে ওটা ইলেনের পায়ের আওয়াজ নয়। অন্য কারও পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে। ভয় ঢুকে গেল ইলেনের মনে। ধড়াশ ধড়াশ লাফাতে লাগল কলজে। চলার গতি বেড়ে গেল।

ইলেনের ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ পেছনের পায়ের শব্দটা হচ্ছে ওর পা ফেলার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ইলেন জোরে হাঁটলে পেছনের জনও জোরে হাঁটছে।

ঝেড়ে দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা বহু কষ্টে দমন করল ইলেন। ওর পেছনে যে-ই থাকুক, তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না ও ভয় পেয়েছে। ইচ্ছে করে হাঁটার গতি মন্থর করল ইলেন। কিন্তু অনুসরণকারী মোটেই গতি কমাল না। দ্রুত হয়ে উঠল তার পদশব্দ।

নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রইল না ইলেনের। দৌড় দিল ও। ছুটতে লাগল রাস্তা ধরে। কয়েক সেকেণ্ড পেছনে কোনও শব্দ পেল না ইলেন। তারপর, ওর হৃৎপিণ্ডের দিড়িম দিড়িম ঢাকের শব্দ ছাড়িয়ে পেভমেন্টে ভেসে এল দ্রুত এবং ছন্দবদ্ধ ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ।

লেক সোজা যে রাস্তাটি চলে গেছে, ওটাতে উঠে এল ইলেন। অনেকেই পার্কে হাওয়া খেতে এসে লেকের ধারে বসে থাকে। ইলেন আশা করল এমন কাউকে দেখতে পাবে। ছোট একটি টিলা বেয়ে নেমে লেক অভিমুখে ছুটল ও। মোড় ঘুরল। দপ করে নিভে গেল আশার আলো। লেকের রাস্তায় জন-মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। ইলেন টের পেল টিলা বেয়ে নেমে আসছে তার অনুসরণকারী পায়ের শব্দ : হচ্ছে। থপ থপ থপ থপ। ওকে এই ধরল বলে!

উন্মাদের মত চারপাশে চোখ বুলাল ইলেন। বামে বেশ ঘন ঝোঁপ আর কতগুলো গাছ দেখতে পেল। ছুটে গেল ওদিকে, চট করে লুকিয়ে পড়ল ঝোঁপের আড়ালে।

এদিকে গাছপালার সারি। ঘন বলে চাঁদের আলোর অবাধ প্রবেশের সুযোগ নেই। ডাল আর পাতার আবরণী ভেদ করে যেটুকু আলো প্রকৃতির বুকে পৌঁছেছে। তাতে অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই। ইলেন প্রথমে পায়ের শব্দ শুনতে পেল তারপর দেখতে পেল পায়ের মালিককে।

লোকটা ইলেনের লুকানো জায়গা থেকে কুড়ি ফুট দুরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলেনের দিকে পেছন ফেরা। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর পা বাড়াল লেকের ধারের বেঞ্চিতে। বসল।

ঝোঁপের আড়ালে বসে ঘেমে ভিজে একাকার ইলেন। ওর এখানে লুকিয়ে পড়া মোটেই উচিত হয়নি। লোকটা নিশ্চয় টের পেয়েছে ও কোথায় লুকিয়েছে। লোকটা কি অপেক্ষা করছে কখন ইলেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে এবং আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে? অবশ্য ইলেনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে পার্কের ভ্রমণকারীরা হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসতে পারে। ও তখন লাফ মেরে বেরিয়ে আসবে ঝোঁপের আড়াল থেকে, লোকের ভিড়ে মিশে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে পার্ক থেকে।

বেঞ্চিতে বসা লোকটার দিকে আবার তাকাল ইলেন। সে চুপচাপ বসেই আছে, স্থির দৃষ্টি লেকে। হঠাৎ কী যেন একটা নজর কাড়ল ইলেনের। পানির ধারে কীসের একটা ছায়া, এগিয়ে আসছে। বিরতি দিল। এবারে ওটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ইলেন। বড় একটা ইঁদুর। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লাফ মেরে উঠতে গেল ইলেন নিজেকে দমন করল বেঞ্চির লোকটার কথা ভেবে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটাকেও একই সঙ্গে গলা টিপে মারল।

যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে ইলেন, বড়টার সঙ্গে আরও তিনটে ইঁদুর যোগ দিল। চাঁদের আলোয় ওদের বিকট ছায়া এবং কুৎসিত মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে ইলেন। সিমেন্টের রাস্তায় প্রাণীগুলোর থাবার আওয়াজ উঠল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল ইলেনের, মন চাইল ছুট দেয়। কিন্তু বেঞ্চিতে বসা লোটার ভয়ে কিছুই করতে পারল না।

লোকটা পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে বেঞ্চে, ইঁদুরগুলো তার কাছ থেকে তিন হাত দূরেও নেই। ওগুলোকে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে সে, ভাবল ইলেন। কিন্তু তার। মাঝে কোনও ভাবান্তর নেই। কেমন লোক এ?

ইঁদুরের দিকে চোখ ফেরাল ইলেন। ওরা যেন সম্মোহন করেছে ওকে। ঝোপে, দুই ফুট দূরে খস খস একটা শব্দ হলো। চিৎকার বন্ধ করার জন্য মুখে সোয়েটার চেপে ধরল ইলেন। যদি ওর দিকে ছুটে আসে কোনও ইঁদুর? ধারাল নখ বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে?

এমন সময় তীব্র আতংক নিয়ে ইলেন দেখল লেকের ধারের চারটে ইঁদুর ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের ধারাল মুখগুলো যেন উঁচিয়ে আছে ইলেনের দিকেই। লম্বা লেজ নড়ছে ডানে-বামে।

চিৎকার দিল ইলেন। উঠে দাঁড়াল বেঞ্চির লোকটা। ঝোঁপের দিকে আসছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে সিধে হলো ইলেন। পিছিয়েছে এক কদম, একটা পা গিয়ে পড়ল গভীর একটা গর্তে। এটা ইঁদুরের গর্ত। ডজন খানেক ইঁদুরের বাচ্চা ব্যথা এবং ভয়ে কিকি করে উঠল। পিলপিল করে বেরিয়ে এল গর্ত ছেড়ে। ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। এক ঝটকায় গর্ত থেকে পা বের করে আনল ইলেন। আবার পিছিয়েছে, ওর পা চাপা পড়ে ভর্তা হয়ে গেল একটি বাচ্চা ইঁদুরের নরম শরীর। মরণ যন্ত্রণায় কিইইচ করে উঠল ওটা। ইলেন গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল।

লোকটা ক্রমে কাছিয়ে আসছে। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল ইলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে জমে যাওয়া দুর্বল হাঁটু যেন সাড়া দিতে চাইছে না। কোনও মতে ঘন ঝোঁপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এল ও, পা রাখল রাস্তায়।

লোকটা দেখে ফেলেছে ইলেনকে। আরও কাছে চলে এসেছে সে। চাঁদের স্নান আলোয় তার মুখ দেখতে পেল ইলেন। ভয়ে শরীরের সব কটা রোম দাঁড়িয়ে গেল। ওটা মোটেই মানুষের মুখ নয়! ওটা একটা ইঁদুরের মস্ত মুখ, মুখটা নড়ছে, সেইসঙ্গে নড়ছে মুখের দুপাশের গোঁফ।

ঘুরেই ছুট দিল ইলেন। প্রচণ্ড ভয়ে দিশাহারা হয়ে দৌড়াতে লাগল ও। পেছনে ভেসে এল অসংখ্য ইঁদুরের ভয়ঙ্কর কিকি নিনাদ।

ছুটতে ছুটতে পার্কের এক্সিট লেখা গেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেল ইলেন। আর মাত্র দশ গজ। তারপরই ওর মুক্তি। আশ্চর্য! গেটের কাছে কেউ নেই। একজন ভ্রমণকারীও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী? ইলেন তো এখনই বেরিয়ে পড়বে। হঠাৎ ওর কলজে হিম হয়ে গেল ঠিক ওর পেছনে তীব্র কিইইচ শব্দ হতে। আঁতকে উঠে পাই করে ঘুরল ও। ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইঁদুর-মানব। জ্বলজ্বল করছে চোখ। দৃষ্টিতে বিকট উল্লাস। কই, দানবটার ছুটে আসার শব্দ তো পায়নি ও। ইলেনের মুখ হাঁ হয়ে গেল, চিৎকার দেবে। লম্বা, ধারাল থাবা আছড়ে পড়ল মুখে। চিৎকারটা আর মুখ ফুটে বেরুতে পারল না। তার আগেই আঁধার হয়ে এল ইলেনের দুনিয়া।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments