Tuesday, August 26, 2025
Homeরম্য গল্পমজার গল্পকলকাতার রাস্তায় - লীলা মজুমদার

কলকাতার রাস্তায় – লীলা মজুমদার

কলকাতার রাস্তায় কেন ভিড় জমে তা বুঝে ওঠা দায়। একদিন সিনেমার তিনটের শো ভাঙলে পর আমার ভাই অমি বাইরে এসে দেখে বেজায় ভিড়। সঙ্গে তার বন্ধু মিহির। মিহিরের গাড়ির খোঁজে দুজনে ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে, এমন সময় পেছনে শোরগোল ধর— ধর— ধর— পালাল— পালাল! সঙ্গে সঙ্গে পর পর দশ বারোটা লোক প্রায় ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে দৌড়— দৌড়!

কে যে চোর আর কে যে তাকে ধরছে কিছুই মালুম দিল না। কী ব্যাপার? কার জানি গলা থেকে সত্যিকার সোনার বিছে হার ছিনতাই করে, চোর পালিয়েছে! যে গিন্নির হার গেছে, তিনি ডুকরে কেঁদে আকাশ ফাটাচ্ছেন!

সবাই তাঁকে বকছে, ‘আজকালকার দিনে কেউ সত্যি সোনার হার গলায় দিয়ে বেরোয়? নকল সোনা তো অবিকল একরকম দেখতে। বরং ঢের ভাল, আরও ঝকমকে!’ গিন্নি কেঁদে বলছেন, ‘এও তো অবিকল নকল সোনার মতো দেখতে! তেমনি ঝকমকে, তেমনি ভাল!’

একজন রোগা ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘মেয়েদের কাণ্ড তো, বুঝুন ব্যাপার!’

এদিকে এইসব ব্যাপার দেখে হাসতে হাসতে অমি আর মিহির তাদের গাড়ির কাছে এসে পড়েছে। ততক্ষণে চোর এবং তার অনুসরণকারীরা হয়তো পৌনে এক কিলোমিটার এগিয়ে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে অমি ভেতরে পা দিতে যাবে, এমনি সময় সেই রোগা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বললেন, ‘মাপ করবেন! একটা বড় ভুল হয়ে গেছে।’

এই বলে অমির কোটের পকেটে হাত সেঁদিয়ে লম্বা এক ছড়া সোনার বিছে হার টেনে বের করে নিয়ে, স্যাঁ—ৎ করে নিমেষের মধ্যে সেই পাতলা-হয়ে-আসা ভিড়ের মধ্যেই বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেলেন!

অমি আর মিহির এমনি হতভম্ব হয়ে গেল যে তার পরেই যখন পেছন থেকে রব উঠল, ‘কাঁমড়াঁবে! কাঁমড়াঁবে!’ এবং তার পরেই, ‘কাঁমড়েঁছে! কাঁমড়েঁছে!’ ওরা ফিরেও তাকাল না।

আরেকবার ওই মিহিরের গাড়ি করেই দুজনে রাসবিহারী এভেনিউ দিয়ে গড়িয়াহাটের দিকে এগোচ্ছে। সন্ধ্যাবেলায় ওই পথে এমনি ভিড় যে, কি গাড়ি, কি মানুষ, এগোয় কার সাধ্যি! মিহিরের গাড়ির ঠিক সামনেই এক বুড়ি আবার ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটা ধরল।

মিহির যতই হর্ন বাজায়, যতই চ্যাঁচায়, ‘ও বুড়িমা, ও বুড়িমা, ফুটপাথে উঠুন!’ তা কে কার কথা শোনে! এদিকে পেছনের গাড়ির চালকরা বুড়িকে দেখতে পাচ্ছে না, তারা মহা রেগে হর্ন দিচ্ছে, চ্যাঁচাচ্ছে, যাচ্ছেতাই করে গাল দিচ্ছে!

অগত্যা নাচার হয়ে মিহির গাড়িটাকে বুড়ির ছয় ইঞ্চির মধ্যে এনে খুব জোরে হর্ন দিল। আর যায় কোথায়! বুড়ি শূন্যে হাত-পা ছুড়ে, ‘ওরে বাবারে! গেলাম রে! মেরে ফেললে রে!’ বলে এমনি চেল্লাতে লাগল যে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে যাকে বলে ট্রাফিক জ্যামের অতিবৃদ্ধ ঠাকুরদাদা!

শুধু তাই নয়। কোত্থেকে দলে দলে মাস্তানরা বেরিয়ে এসে, ‘কী পেয়েছেন, মশাই! গাড়ি হাঁকাচ্ছেন বলে অকাতরে মানুষ মেরে চলে যাবেন! এ কী মগের মুল্লুক!’ ইত্যাদি বলতে বলতে গাড়িটাকে ঘেরাও করে ফেলে, নেচে-কুঁদে একাকার কাণ্ড বাধিয়ে দিল।

ওরা যতই বলে, ‘চেয়ে দেখ, বুড়িকে আমরা ছুঁইনি! ওর কিচ্ছু হয়নি!’ তা কে শোনে!

শোনা দূরে থাকুক, একজন পাণ্ডা গোছের মাস্তান একটা লোহার ডান্ডা ঘোরাতে ঘোরাতে, টপ করে গাড়ির বনেটের ওপর চড়ে শাসাতে লাগল, ‘চালাকি চলবে না, মশাই! বেরিয়ে আসুন! আজ আপনাদের দেখে নেব!’ সঙ্গে সঙ্গে তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও ‘দেখে নেব! দেখে নেব!’ বলে নাচতে লাগল। বুড়ি কিন্তু ততক্ষণে সটকান দিয়েছে!

Read here : Leela Majumdar Bangla Mojar Golpo

এতক্ষণ উভয় পক্ষের কেউ কারও মুখ দেখেনি। হঠাৎ পাণ্ডার কী খেয়াল হল, মাথা নিচু করে, সামনের কাচের ভেতর দিয়ে গাড়ির আরোহীদের মুখের দিকে তাকাল।

তাকিয়েই যেন ভূত দেখেছে, এমন করে আঁতকে উঠে, ডান্ডা ফেলে, বনেট থেকে নেমে পড়ে, হাত জোড় করে অমিকে বলতে লাগল, ‘স্যার! আপনি, স্যার! দেখতে পাইনি! আপনার পায়ে পড়ি স্যার, অপরাধ নেবেন না!’

এই বলেই স্যাঙাত-শাকরেদদের প্রচণ্ড ধমক, ‘কাকে কী করিস তোরা, একটা আক্কেল নেই!! দেখছিস না, গাড়িতে স্যার নিজে রয়েছেন!’ মুহূর্তের মধ্যে কোথায় কে! চারদিক ভোঁ— ভোঁ! যেখান থেকে এসেছিল, মাস্তানসুদ্ধ সব্বাই সেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল!

ভাবিত মুখে গড়িয়াহাটে ঢুকে, নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি থামিয়ে, মিহির বলল, ‘এবার রহস্য খুলে বল। সেই যে কিছুদিন মাস্টারি করেছিলি, তখনকার ছাত্র নাকি? এত ভক্তি! কী আশ্চর্য!’

অমি কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘আরে ধুৎ! আমি রেস খেলার মাঠে গেলেই ওরা আমার পিছু নেয়। ‘বলে দিন স্যার, কোন ঘোড়া জিতবে!’ আমি যে আন্দাজে যে ঘোড়ার নাম বলি, সে-ই নাকি সর্বদা জেতে!”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments