চোর – ফয়সল সৈয়দ

চোর - ফয়সল সৈয়দ

সকাল থেকে ইউসুফ শিকদারের বউয়ের মেজাজ বিগড়ে আছে । কয়েকদিন ধরে সর্দি-কাশিতে ভুগছে, তার উপর দশ ভরি স্বর্ণ উধাও। কে নিয়েছে? কেউ স্বীকার করছে না। যদিও এই ধরণের ঘটনায় চোর কখনো স্বীকার করে না যে ,আমি চোর। আমাকে ধরেন, শাস্তি দেন, জনমের মত শিক্ষা দিয়ে দেন। ইতোমধ্যে কাজের মেয়ে মুনাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে চুরি করে নাই, আর এতগুলি স্বর্ণ চুরি করে সে কি এখানে থাকত। সাত আসমান, আল্লাহ রাসুলের নামে, মৃত বাবার নামে শপথ খেয়ে বার বার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। শিকদারের বউ হিংস্র বাঘের মত এ-দিক ও-দিক ছুটছে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। আলমারির কাপড় নামিয়ে খুঁজতে থাকে, বিছানার তোষক উলটিয়ে মুনার শোয়ার ঘর তছনছ করে খুঁজতে থাকে। কাপড়ের ব্যাগ, মুনার সারা শরীর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। এমনকি মুনার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতেও হাত দিতে দ্বিধা করছে না। এক সময় রান্না ঘর থেকে বটি নিয়ে এসে মুনার চুল টেনে ধরে বলে— বল হারামজাদি বল, আমার স্বর্ণ কোথায় রেখেছিস ? বিশ্বাস করেন খালাম্মা আঁই চুরি করি’ন।

দু’হাত জোড় করে ভয়ে সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে।
— কী শুরু করে দিয়েছ তুমি। পাগল হয়ে নাকি। শিকদার আরক্ত চোখে বউয়ের দিকে তাকালেন।
— হুঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি নিশ্চিত এই হারামজাদিই আমার স্বর্ণ চুরি করেছে। হারামজাদিকে আজকেই আমি ঘর থেকে বের করে দিব।
কাঁপা গলায় শিকদারের বউ চেঁচিয়ে উঠে বলে ।

খবর শুনে মুনার মা ছুটে এসেছে। আড়ালে-আবডালে মুনাকে জিজ্ঞেস করে তিনি এক প্রকার নিশ্চিত হন যে, তার মেয়ে চুরি করেনি, কিন্তু কে শুনে কার কথা। শিকদারের বউয়ের এক কথা ঘরে স্বামী, শাশুড়ী, কাজের মেয়ে মুনা ছাড়া আর তো কেউ থাকে না। স্বামী চুরি করবে? কার স্বর্ণ। শ্বাশুড়ী চুরি করবে? কার জন্য? তার কি আর সে-ই বয়স আছে! আমি কেন আমার স্বর্ণ চুরি করব? শিকদারের মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। প্রতিবেশী কয়েকজন বউ, শ্বাশুড়ীকে স্বাক্ষী রেখে তিনিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা যতই বুঝাতে চেষ্টা করছেন আপনার বউ আপনাকে সন্দেহ করছে না। তিনি ততই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বুঝাতে চেষ্টা করছেন। আকার ইঙ্গিতে তার ছেলের বউ তাকে সন্দেহ করছে। শুধু মুখ ফোটে খই ফোটার অপেক্ষা। — আম্মা, আমার স্বর্ণ আপনি-ই চুরি করেছেন। গ্রামের মুরব্বি কয়েকজন পুলিশের কথা বলতে-ই ইউসুফ শিকদার না করে দেন। পুলিশী ঝামেলা বড় ঝামেলা। তার চৌদ্দপুরুষ কখনো পুলিশী ঝামেলায় যায়নি। আজ সামান্য চুরির ঘটনা নিয়ে পুলিশ…। না। তার চেয়ে ভাল নিজের সমস্যা নিজেরা সমাধান করার চেষ্টা করি। কিভাবে সমস্যা সমাধান করবে তা কারো কাছে স্পষ্ট নয়। শিকদারের বউয়ের চোখে মুখে রাজ্যের হতাশার চিহ্ন। কি করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। এই দিকে শ্বাশুড়ীও বেঁকে বসে আছে। পরক্ষণে শিকদারের বউ মনে মনে ভাবে শ্বাশুড়ী চুরি করে নাইতো। (স্বামী) ইউসুফ ছাড়া তার আরও দুই মেয়ে আছে। বড় মেয়ে সংসারের অবস্থা ভাল হলেও ছোট মেয়ের সংসারের অবস্থা করুণ। নুন আনতে পান্তা পুরার দশা। আর শ্বাশুড়ী এই ছোট্ট মেয়েকে সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন। পুকুরে মাছ ধরলে, মৌসুমী ফল পাকলে, যে কোন উৎসবে তিনি নিজ হাতে ছোট মেয়ের জন্য আলাদা করে রাখেন। তবে কি . . . । শিকদারের বউ আর ভাবতে পারছে না।

এখন বাজারে স্বর্ণের চড়া দাম। ভরি আশি হাজার। এতগুলো স্বর্ণ চুরি । কত কষ্ট করে স্বর্ণগুলো জোগাড় করেছেন। বাপের বাড়ি থেকে
যতটুকু সম্পত্তি পেয়েছেন তার অধের্ক এ স্বর্ণে খাটিয়েছেন। এই সব চিন্তা করতে করতে টপ টপ করে শিকদারের বউয়ের দু’চোখে পানি গড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশী সবুজের মা, নীলুর দাদি প্রবোধ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করে স্বর্ণ কোথাও যায়নি। স্বর্ণ ঘরে-ই আছে। দেখবেন ভাল করে খোঁজ করলে পাবেন।

— না-রে ভাবী, এক ভরি, দুই ভরি না দশ দশ ভরি স্বর্ণ উধাও। সোজা কথা! বলতে বলতে শিকদারের বউয়ের গলা শুকিয়ে যায়। গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে পানি পান করলেন। গ্রামের মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিল চাল পড়া দিয়ে চোর ধরবে। চালপড়া সবাই চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। কড় কড় শব্দ করে খাবে। উপস্থিত সবাইকে খেতে হবে। যে চোর সে চালপড়া খেতে পারবে না, খেতে চাইলে বরং সে রক্ত বমি করবে। মারাও যেতে পারে।

বিকেলের রৌদ্র মরে আস্তে-আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুল্লাহ চালপড়া নিয়ে এসেছে। — মা, এহনো সময় আছে, হাছা কথা বল। তুই চুরি করছিস কিনা। মুনার মা’র মনে ভয়, শংকা দোলা খাচ্ছে।

— মুয়াজ্জিন হুজুর, আমারে দেন, চালপড়া আমারে দেন। এই বলে এক প্রকার জোর করে আধা মুষ্ঠি চালপড়া নিয়ে মুনা কড় কড় শব্দ করে খেতে লাগল। যেন একমাত্র চালপড়াই তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। মুনার দেখাদেখি আস্তে-আস্তে উপস্থিত সবাই খেতে লাগল।

শিকদারের মা চাল চিবাতে চিবাতে আল্লাহকে সাত আসমান থেকে নামিয়ে ফেলছে। — হায় আল্লাহ! এই দৃশ্য দেখার আগে তুই আমারে তুলি নিলি না ক্যান? ছেলের সংসারের নিজেকে গলগ্রহ ভেবে অশ্রু বির্সজন দিতে থাকে।

উপস্থিত সবার চক্ষু জোড়া চড়কগাছ।
— একি! ইউসুফ শিকদারের বউ চাল চিবাতে পারছে না। তাঁর দু’দাতের মাড়ি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ইতস্তত ভঙ্গিমায় বলে ওঠে— আমার গলা ধরে আছে, আমার কেমন জানি করছে।

ততক্ষণে মুনার দু’চোখ কৌতুকে ঝিকঝিক করছে।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.