Friday, March 29, 2024
Homeলেখক-রচনালেখক পরিচিতিউপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী | Upendrakishore Ray Chowdhury Biography

শিশুসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, বাংলা ছাপাখানার অগ্রপথিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় তার ছেলে ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার নাতি। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন তার অমর সৃষ্টি। গুপি গাইন বাঘা বাইন অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা তার অন্যতম কীর্তি। তার লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টুনটুনির বই, ছোটদের মহাভারত, সাতমার পালোয়ান, গল্পমালা, ছেলেদের মহাভারত, ছেলেদের রামায়ন, কুঁজো আর ভূত, বাঘ খেকো শিয়ালের ছানা, লাল পরি নীল পরি প্রভৃতি। এ ছাড়া তার রচিত ছোট ছোট অসংখ্য গল্প নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র করা হয়েছে। তার বইগুলো তখনকার দিনের মতো আজও সমান জনপ্রিয়। ভারতের জনপ্রিয় সন্দেশ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তাঁর পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ১৮৬৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে জম্মগ্রহণ করেন যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। উপেন্দ্রকিশোরের পৈত্রিক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। তিনি ছিলেন তার পিতা মাতার আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে নিসন্তান আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোরের বাবা কালীনাথ রায় চৌধুরী। কালীনাথ রায় চৌধুরী ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ ও পণ্ডিত। তিনি আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। তরুণ বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি ঘটে এবং তৎকালীন শিশুকিশোর পত্রিকা সখা, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বালক, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, রূপকথা, উপকথা, পৌরাণিক কাহিনী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনাসহ শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে একুশ বছর বয়সে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় তার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। তাঁর প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়। এ বইটি বেশ সমাদৃত হয়। কিন্তু এর মুদ্রণ নিয়ে সন্তুষ্ঠ হতে পারেননি। তাই ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্র আমদানি করেন। ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে ছাপাখানা খোলেন। সেখানে একটি কক্ষে ছবি আঁকার স্টুডিও করেন এবং হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ফটোগ্রাফী ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য ১৯১১ সালে বড় ছেলে সুকুমারকে ইংল্যান্ডে পাঠান। ১৯১৩ সালের এপ্রিলে শিশুসাহিত্যের কিংবদন্তীতুল্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এর যাত্রা শুরু হয়। এর সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রক, লেখক ও চিত্রকর ছিলেন স্বয়ং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী যা পরে তাঁর পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন।

বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন। তবে বেহালাই ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেহালার বাজনা ছিল একটি বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বেহালা শিক্ষা এবং হার্মোনিয়াম শিক্ষা নামে তাঁর দুটি বই রয়েছে। উপেন্দ্রকিশোরের মধ্যে এভাবে নানামুখী যোগ্যতার সমাবেশ ঘটলেও তিনি প্রধানত নির্মল আনন্দরসিক শিশুসাহিত্যিক রূপেই অধিক পরিচিত। এ শিশুসাহিত্য পরবর্তীসময়ে তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন। ১৮৮৬ সালে তার সঙ্গে সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বিধুমুখীর বিয়ে হয়। এ দম্পতির তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। জোড়াসাকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের মতো উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীরও এক অবাক-করা জমজমাট গুণী লেখক পরিবার! যার ধারা বাংলা শিশুসাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়কে আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে। তার বড় ছেলে সুকুমার রায়তো সবার সেরা। এ ছাড়াও তার ছোটভাই কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জনও গুণী লেখক। উপেন্দ্রকিশোরের জীবনকাল খুব বেশিদিনের ছিল না। ১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments